2 of 3

১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী

ফলপাকা বেলী ততী ছিটকায়া সুখ যাহিঁ।
সাঙ্গঁ আপনা করি লিয়া সো ফিরি ঊগৈ নাহিঁ।।

মায়া আমার সামনে দাওয়ায় এসে বাঁশের বাতা ধরে সামনে ঝুঁকে দোলখাওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়াল। আমি এক ধাপ নীচে মেটে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখের সামনে মায়ার বুক শরীরের আন্দোলনে থরথর করছে। বিকেলে চুলে তেল দিয়ে বড় খোঁপা বেঁধেছে। কপালে কাঁচপোকার টিপ। পাশ থেকে লণ্ঠনের আলো ছিটকে এসে মুখের একপাশে পড়ে চিকচিক করছে।

মায়ার পিসিমা বললেন, এসো বাবা এসো। এতদিনে আমাদের মনে পড়ল? ঘর থেকে একটা আসন এনে দে মায়া।

আমি এখন বসতে পারব না। দুটো বেলপাতা নিতে এসেছি।

মায়া হিহি করে হেসে মাথার চুল খামচে দিয়ে বললে, পার্বতীর কাছে যাও, মহাদেবের মাথায় রাত বারোটার সময় একমাত্র তিনিই বেলপাতা ফেলতে পারেন, আর নয়তো দস্যু রত্নাকর।

এরা কেউই জানে না আমি আজ কী মন নিয়ে এখানে এসেছি। মায়ার দেহতত্ত্ব, পিসিমার ধর্মতত্ত্ব, সবকিছুই আজ স্বাদহীন। আমি খুব মৃদুস্বরে বলতে বাধ্য হলুম, মায়া, এইমাত্র আমার দাদু মারা গেলেন।

মায়া সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে গুছিয়ে দাঁড়াল। আর সামান্যতমও চপলতা নেই। পিসিমা মহাভারত মুড়ে রেখে বললেন, অ্যাঁ, সেকী! অমন স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ মানুষ! এই তো কালও দেখলুম বেশ সুস্থ মানুষ!

ঘণ্টাখানেক আগেও সুস্থ ছিলেন। গান গাইতে গাইতে সমাধি।

সমাধি?

হ্যাঁ বসে বসেই মৃত্যু। ব্রহ্মতালু খুলে গেছে।

বলো কী, সাধকের মৃত্যু? শুনেছি, খুব সাধন-ভজন করতেন।

মায়া বললে, বেলপাতা যে গাছে। রাতে বেলগাছে হাত দিতে আছে গো পিসি!

ঘরে চৌকির তলায় দেখ না। চুবড়িতে আছে কি না!

মায়া লণ্ঠন নিয়ে ঘরে ঢুকল। পিসি বললেন, হ্যাঁ বাবা, আমি একবার দেখতে যেতে পারি?

কী উত্তর দেব ভেবে পেলুম না। পিতৃদেব নিষেধ করেছিলেন, মৃত্যুর কথা রাষ্ট্র কোরো না। কেন তা জানি না। বেলপাতা নোব অথচ কিছু বলব না, তা কী করে হয়? আমতা আমতা করে বললুম, হা হ্যাঁ, কেন আসতে পারবেন না! নিশ্চয় পারবেন।

অনেকে এসেছেন?

না না। আপনাকেই আমি প্রথম বললুম। মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরেই আশ্চর্যজনক ভাবে হরিদ্বার থেকে এক সন্ন্যাসী এলেন। দাদুর গুরুদেব।

সাধকের মৃত্যুসংবাদ এইভাবে বাতাসে ছড়ায়।

মায়া গোটাকতক শুকনো বেলপাতা হাতে সামনে এসে দাঁড়াল। মায়াটাকে আমি আর কিছুতেই মানুষ করতে পারলুম না। এত কাছাকাছি গায়ে গা লাগিয়ে এসে দাঁড়ায়, নিজেরই লজ্জা করে। এইভাবে কোনদিন আমার একটা দাবি জন্মে যাবে, তখন আমার জায়গায় অন্য কাউকে দেখলে হয়তো খুনই করে ফেলব!

মায়া বললে, দেখো, এতে হবে?

একেবারে শুকিয়ে গেছে!

জানি এতে হবে না। পিসি, গাছে হাত দোব?

তুই হাত দিসনি। ব্রাহ্মণ মানুষকেই বল। বেলগাছে ব্ৰহ্মদৈত্য থাকে। আর একটা লণ্ঠন জ্বেলে নে।

অন্ধকার ঝুপসি বাগান। অসংখ্য ঝিঁঝি ডাকছে। মজা পুকুরে একটা ব্যাং কটর কটর করে অন্ধকার চিবোচ্ছে। ঝোঁপের মধ্যে খসখস করে কী সব চলে বেড়াচ্ছে। মনে হয় সাপ। গরমকাল, সাপেদের এই তো নিশাভ্রমণের সময়। আঙুলে একটু ঠুকরে দিয়ে গেলেই হল। মৃত্যুশোকে এত কাতর হলে কী হবে, নিজের জীবনের চিন্তা কত প্রবল!

মায়া আমার পাশে। মাঝে মাঝে আমার পায়ে তার শাড়ির তলার অংশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। কাঁধে কাঁধে ঠোকাঠুকি হচ্ছে। সরু পথ। লম্বা লম্বা ঘাস। পুকুরে হাঁচি পানা। জোলো গন্ধ ছাড়ছে। পুরনো পাঁচিলের গা ঘেঁষে বেলগাছ। বেশ ডালপালা মেলেছে। কোনও এক সময় তলায় একটা বেদি ছিল। ভেঙে উলটেপালটে পড়ে আছে। বেলগাছের কম তেজ!

মায়া লণ্ঠনটা নীচে রাখল। ঝোপে আলো পড়েছে। রাতের বেলা ঝোঁপঝাঁপ কেমন যেন রহস্যময় হয়ে ওঠে। অসংখ্য চোখ সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে যেন বলাবলি করছে- এরা কারা! বেলগাছের সবকটা ডালই আমার হাতের নাগালের বাইরে। ডিঙি মেরে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করা গেলেও টেনে নামানো সম্ভব নয়। মায়া বললে, দাঁড়াও, ওভাবে হবে না। হয় তুমি আমাকে কোলে তুলে ধরো, না হয় আমি তোমাকে তুলে ধরি।

লণ্ঠনের আলোয় মায়ার দিকে একবার তাকালুম। ভরাট স্বাস্থ্য। নিটোল নিতম্ব। আমি জড়িয়ে ধরতে পারি। তুলতে পারব না। মায়া আমার মুখ দেখে বললে, বুঝেছি। তুমি ব্রাহ্মণ, আমার ছোঁয়া পাতা তুমি নেবে না।

কী বলছ তুমি? আমাদের পরিবারে জাতের বিচার নেই।

খুব আছে। ব্রাহ্মণ শূদ্র না থাক বড়লোক গরিবলোক আছে।

সেকী?

তা হলে তুমি আসো না কেন? কেন আসো না?

কথা বলতে বলতে মায়া কোমরে আঁচল জড়াচ্ছে। মায়ার ঠোঁটদুটো ভারী পাতলা। মুখটা পানের মতো। চোখদুটো অদ্ভুত সজীব। আমি কিছু বোঝার আগে খপ করে দু’হাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে তুলে ফেলল, নাও এবার ব্রহ্মদত্যি হয়ে পাতা ঘেঁড়ো। ধেড়ে ধেড়ে কাটা আছে, খোঁচা খেয়ে মোয়রা না যেন।

সেই কোন কালে শিশু ভোলানাথ মায়ের কোলে উঠত। আজ মায়ার কোলে। টাটকা কচি কচি পাতা এখন আমার হাতের নাগালে। শরীরের নিম্নাংশ এদিকে বড়ই অসহায়। ভাঙা বেদির ঢকঢকে ইটে মায়া তেমন অবলম্বন পাচ্ছে না। অল্প অল্প টলছে। দুজনে একসঙ্গে হুড়মুড় করে পড়ে না যাই!

মায়া বললে, হয়েছে? আর তোমাকে রাখতে পারছি না। আগের চেয়ে একটু মুটিয়েছ।

আমি বললুম, হয়েছে, এইবার নামাও।

ধীরে ধীরে পা দুটো মাটিতে নেমে এল। মায়া তখনও জড়িয়ে ধরে আছে।

কী হল ছাড়ো!

যদি না ছাড়ি?

মায়া, প্লিজ, আমার দাদু মারা গেছেন। তুমি জানো না, এর চেয়ে শোকের আমার কাছে আর কিছুই নেই।

মায়া অনায়াসে বললে, দাদুরা মরবেই। এ আবার এমন শোকের কী? বুড়ো হলেই মানুষকে মরতে হয়।

তুমি ছাড়ো মায়া, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ছাড়তে পারি, যদি কথা দাও আজকালের মধ্যে তুমি অবশ্যই আসবে।

হ্যাঁ আসব।

মনে থাকে যেন হাতে বেলপাতা।

মনে থাকবে।

আচ্ছা তুমি না বলছিলে, জাত মানো না!

না মানি না, ওসব সেকেলে বিচার।

তুমি আমার ঠোঁটে চুমু খেতে পারবে?

মায়ার প্রস্তাবে স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। এ আবার কী অদ্ভুত আবদার! হঠাৎ মনে হল স্বামীজি যদি জাত যায় কি না দেখার জন্যে ব্রাহ্মণেতর জাতির হুঁকো খেয়ে থাকতে পারেন, আমি পারব না কেন, তার মন্ত্রশিষ্য হয়ে?

মায়া চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে বললে, কী? পারবে?

হ্যাঁ, পারব।

তবে দাঁড়াও, ঠোঁটদুটো জিভ দিয়ে বেশ করে ভিজিয়ে নিই। নাও এসো।

মায়া দু’হাত দু’পাশে মেলে এমনভাবে এসো বললে, সারাশরীর কেমন যেন করে উঠল। ঈশ্বর আমার চলার পথেই কি যত গর্ত খুঁড়ে রেখেছেন! এক কদম এগোই কী একটা করে গর্তে গিয়ে পড়ি। এই অন্ধকারে বেলতলায় এ কী কাণ্ড! পিসি অবিলম্বে মায়ার কেন বিয়ে দিচ্ছেন না! মায়ার সময় হয়েছে।

রক্ত দিয়ে মানুষ ঋণ শোধ করে। আমি আমার ঠোঁট ক্ষতবিক্ষত করে বেলপাতা নিয়ে নিজেকে ধিক্কার জানাতে জানাতে রাস্তা হাঁটছি। নিজেও এক শয়তান। অছিলার অভাব নেই। পাপের পথে যেতে চাস তো যা, আধ্যাত্মিক নজির খাড়া করিস কেন! ক্ষুদ্র কীট পর্বতের সঙ্গে তুলনা!

বিষ্টুদা সামনের কল থেকে জল নিয়ে দোকানে ঢুকছিলেন। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, কী ব্যাপার পিন্টু, তুমি এত রাতে ডালপালা নিয়ে বাজারের দিকে চললে কোথায়?

এমন একজন মানুষকে সব কথাই বলা যায়। বললুম, বিষ্টুদা, একটু আগে দাদু মারা গেলেন। গান গাইতে গাইতে সমাধি।

সেকী?

আজ্ঞে হ্যাঁ। বাজারে যাচ্ছি ফুল কিনতে। এই যে বেলপাতা জোগাড় করেছি অতি কষ্টে।

একটু দাঁড়াও, আমি তোমার সঙ্গে যাই। একা পারবে না। আরও তো অনেক কিছু কিনতে হবে। এত রাতে দোকানপাট কি ভোলা পাবে!

ফুলের দোকান কি খোলা থাকবে না?

না থাকলেও জগন্নাথের বাড়ি আমার চেনা। সেখান থেকে তুলে নোব। রাত বারোটার আগে বিষ্টুদার দোকান বন্ধ হয় না। আজ আমাদের জন্যে সাড়ে ন’টার মধ্যেই ঝাঁপ ফেলে দিলেন। বিষ্টুদা হনহন করে হাঁটেন। আজ হাঁটার বেগ আরও বেশি। হাঁটতে হাঁটতে বারেবারে বলছেন, আহা, বড় পুণ্যাত্মা মানুষ, আহা, বড় পুণ্যাত্মা মানুষ। আমরা কি আর এভাবে যেতে পারব! ভুগে, ভুগিয়ে তবে যাব।

ফুলের দোকান খোলাই ছিল। এরকম সাধারণত হয় না। সবে ফুলের চালান এসেছে। এক ঝাঁকা টাটকা ফুল, আর মালা। গোলাপ আছে, পদ্ম আছে, রজনীগন্ধা আছে। বিষ্টুদা বললেন, বাঃ, অনেক ফুল।

জগন্নাথ বললে, ফুল যে সব বিক্রি হয়ে গেছে।

বিক্রি হয়ে গেছে মানে?

রাজাবাবু সব নিয়ে নিয়েছেন। বলে গেলেন, আমার নাতি এসে দাম দিয়ে নিয়ে যাবে।

রাজাবাবু কে?

ওই যে রাজনারায়ণবাবু, যাঁর ছেলে জয়নারায়ণবাবু, বিরাট বড় গাইয়ে।

আমি অবাক হয়ে বললুম, সেকী? আমিই তো তার নাতি। তিনি কখন এসেছিলেন?

তা হবে। দেড়ঘণ্টা কি দু’ঘণ্টা হয়ে গেল। ওঁর যত ফুল তো ব আমার দোকান থেকেই যায়। আমার বাবা সাপ্লাই করতেন, এখন আমি করি। পুজোপার্বণের তো শেষ ছিল না! ছেলের বিয়েতে হাজার টাকার ফুল কিনেছিলেন।

আমি বলতে যাচ্ছিলুম, সেকী, দু’ঘণ্টা আগে তো তিনি জগৎ ছেড়ে চলে গেছেন।

বিষ্টুদা একটা খোঁচা মারলেন। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। বিষ্টুদা জগন্নাথকে বললেন, কত দাম?

ওঁর জিনিস বেশি আর কী নোব! শ’খানেক দিয়ে দিন।

বিষ্টুদা আমাকে বললেন, টাকা আছে? না, আমি দোব!

না না, আমার কাছে অনেক আছে।

জগন্নাথ বললে, টাকার চিন্তা করছেন কেন? না থাকে পরে দিয়ে যাবেন।

না, টাকা আছে। কিন্তু এত ফুল বইবে কে?

জগন্নাথ হাসতে হাসতে বললে, সব ব্যবস্থা আছে।

দোকান ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসে হাঁকতে লাগলে, দুখিয়া দুখিয়া!

গায়ে গোলাপি রঙের সিল্কের গেঞ্জি। গলায় সোনার হার। চওড়া পাড় দিশি ধুতি। বড় বড় চুল। কেষ্টঠাকুরের মতো মুখ। ফুল বেচার মতোই চেহারা। একেবারে ফুলবাবু। জগন্নাথ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছে, রাজাবাবু এখন কেমন আছেন?মাঝে বলেছিলেন, শরীরটা তেমন ভাল যাচ্ছে না। আজ দেখলুম একেবারে ফিট। বয়েস যেন পঞ্চাশ বছর কমে গেছে। একেবারে রাজবেশ। তাকালে চোখ আর ফেরাতে ইচ্ছে করে না। সাধমানুষের ধরনই আলাদা।

দুখিয়া এসে গেছে। জগন্নাথ নিচু হয়ে আঁকার দু’পাশ ধরে বললে, নে তোল। বাবুরা এসে গেছেন। যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছি, জগন্নাথ বললে, আপনার বিয়ে কবে লাগছে?

আমার বিয়ে?

হ্যাঁ, রাজাবাবু এর আগে যেদিন এসেছিলেন, আমাকে বললেন, জগন্নাথ, আমার শেষ কাজ নাতির বিয়ে। ছেলের বিয়েতে কী দেখেছ! ধুমঘটা করব। বেনারস থেকে সানাই আনাব, বাজি পুড়বে। দু’হাজার টাকার ফুল দিয়ে বাড়ি সাজাব। আমি বললুম, বাবু শীতে করুন। ফুল দিয়ে কীভাবে সাজাতে হয় আমিও দেখে নোব। কৃষ্ণনগর থেকে মালাকার আনাব। আচ্ছা নমস্কার!

দু’পা এগোতেনা-এগোতেই জগন্নাথ আবার জিজ্ঞেস করলে, কাল কী আছে? এত ফুল যাচ্ছে! আশীর্বাদ।

আর তো চেপে রাখা যায় না। এবার তো সত্যি কথা বলতেই হয়। বিষ্টুদার দিকে তাকালুম। জবাব তিনিই দিলেন, রাজাবাবু মারা গেছেন।

অ্যাঁ, সেকী? কখন মারা গেলেন?

ঠিক যে সময়ে তোমার দোকানে এসে ফুলের অর্ডার দিলেন ঠিক সেই সময়ে।

জগন্নাথ অবাক হয়ে বললে, তা হলে কি…

হ্যাঁ, তুমি ধরেছ ঠিক, যাবার পথেই বলে গেছেন।

অসম্ভব, অসম্ভব বলে জগন্নাথ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইল। হাতের মুঠোয় আমার দেওয়া একশো টাকার নোটটি ধরা ছিল। নোটটা আমার দিকে এগিয়ে ধরে বললে, এই নিন, এ ফুলের দাম আমি নিতে পারব না।

ফুলের দাম নেবেন না কেন? এত টাকার ফুল!

যাবার আগে আমাকে শেষ দর্শন দিয়ে গেলেন। আমাকে কী ভীষণ ভালবাসতেন আপনারা জানেন না। আমার একমাত্র ছেলেটা গতবছর ন্যায় মরেই যেত। কতরকম ওষুধ জানতেন! কী এক দাগ খাইয়ে দিলেন, ছেলেটা ভাল হয়ে গেল। বললেন, যাঃ ব্যাটা, এবারের মতো বেটি ছেড়ে দিলে। জীবনে পাপ কাজ করিসনি, তা হলে কোনওদিন আর দুঃখ পেতে হবে না।

কথা বলতে বলতে বাঁ হাতে কেঁচার খুঁট তুলে জগন্নাথ চোখ মুছল। গলা ধরে এসেছে। ধরাধরা গলায় বললে, বউটাকে ধরে রোজ খুব পিটতুম। রাজাবাবু ছিলেন অন্তর্যামী। আমাকে বললেন, যে-বাড়িতে মেয়েছেলে কাঁদে সে বাড়ি পাপের বাড়ি। কাঁদতে হয় তুই কাদ ব্যাটা, তাড়াতাড়ি উদ্ধার পেয়ে যাবি। আমি তাকে গুরুর মতো মানতুম। সেই দিন থেকে আমি আর গায়ে হাত তুলিনি। আর সেই দিন থেকে আমার ভাগ্য ফিরে গেছে। আমি আজ অনাথ হয়ে গেলুম। ব্যাটা ফুলঅলা বলে কে আর আমাকে ভালবাসবে!

বিষ্টুদা বললেন, নাও, টাকাটা ফিরিয়ে নাও।

টাকাটা নিতেই হল। জগন্নাথ বললে, আপনারা এগিয়ে যান। আমিও আসছি। কিছু ভাল ধূপ নিয়ে যাই। বিষ্টুদা যেতে যেতে বললেন, একজন মানুষ কী ছিলেন বোঝা যায় মৃত্যুর পর। বেঁচে থেকে অনেকেই লম্বাচওড়া মারতে পারে, মরলে কেউ আর ফিরেও তাকায় না। কত ছোট মানুষে বড় মানুষ থাকে দেখেছ? সামান্য ফুলঅলা জগন্নাথ আগে নেশাভাঙ করত, বউকে ধরে পেটাত, একজন মানুষের কথায় কীরকম পালটে গেছে! স্বভাবচরিত্র, স্বাস্থ্য। ভাবতে পারো। ব্যাবসাদাররা একটা পয়সার জন্যে মরে বাঁচে, সেই ব্যাবসাদার একশো টাকার ফুল ভালবেসে দিয়ে দিলে! ঠাকুর বলতেন না! হাজার বছরের অন্ধকার ঘর যেই একদিন একটা দেশলাই কাঠি জ্বালালে সব অন্ধকার অমনি নিমেষে চলে গেল।

যত আমাদের বাড়ির কাছাকাছি আসছি ততই একটা সুর ভেসে আসছে। অনেকটা স্তোত্রপাঠের মতো।

মায়ার পিসিমা সিঁড়ির একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। ওপরে ওঠার সাহস নেই। আমাদের দেখে ভয়ে ভয়ে বললেন, আমি যেতে পারি?

অনুমতি নিয়ে আমাদের পেছন পেছন উঠতে লাগলেন। মহিলা কবে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন জানি না। যবে থেকে দেখছি, গেরুয়াই পরেন। মাথায় জটা ধরেছে। হলঘরের সবকটা আলো জ্বলছে। বাড়ির মিয়োনো ভাবটা হঠাৎ কেমন কেটে গেছে! মৃত্যুর মতো মৃত্যু যেন জন্মের সমান! এই কি সেই সত্য, তোমার জন্মও নেই মৃত্যুও নেই। তুমি মনে করলেই তুমি আছ। তুমি নেই মনে করলে তুমি নেই। বুদ্ধের বাণী স্মরণে আসছে, যে জানে এ জীবন তরঙ্গশীর্ষে ভাসমান ফেনার মতো, মরীচিৎকার ছায়ার মতো, সে কামনার শতদলে লুক্কায়িত মৃত্যুর তীক্ষ্ণ শরসন্ধান ব্যর্থ করেছে। যমরাজের অলক্ষ্যে তার চলার পথ সামনে, আরও সামনে।

হরিদ্বারের সেই জ্যোতির্ময় সন্ন্যাসী মুদিত নেত্রে স্তোত্রপাঠ করে চলেছেন। শুধুমাত্র তানপুরাটি বেজে চলেছে। নাদগম্ভীর কণ্ঠ। গোবিন্দং গোকুলানন্দং গোপালং গোপীবল্লভম। গোবর্দ্ধনং ধরং ধীরং তং বন্দে গোমতীপ্রিয়ম ॥ নারায়ণং নিরাকারং নবীরং নরোত্তম। নৃসিংহং নাগনাথঞ্চ তং বন্দে নরকান্তম্ ॥

ঘামতেল মাখা দেবীদুর্গার মুখ যেমন সন্ধিপুজোর সময় চকচক করে মাতামহের মুখ সেইরকম চকচক করছে। কেমন করে এইভাবে মৃত একটি শরীর বসে আছে। জীবন যে কত বড় তামাশা, মাতামহের প্রাণহীন দেহের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মৃত্যুর পথরেখায় মাতামহের প্রায় আশি বছরের ভোগ করা খোলসটি পড়ে আছে। আমি কি প্রকৃতই শোকার্ত! শোক নয়, কেমন যেন একটা শূন্যতার বোধে মন আচ্ছন্ন। আমাকে যিনি সবচেয়ে ভালবাসতেন তিনি আর সেই আদরের নাম, পাতুরানি বলে ডাকবেন না। ঠোঙা থেকে একটি গরম আলুর চপ বের করে ফিসফিস করে বলবেন না, খেয়ে নে চট করে। দুর্বাসা মুনি দেখলে আর রক্ষে থাকবে না। সাধুসন্ত কোথায় কে এলেন, আর সে খবর এনে বলবেন না, চল জীবনটা সার্থক করে আসি। সবচেয়ে বড় পথপ্রদর্শক, সবচেয়ে বড় বন্ধু, থাক তুই পড়ে, বলে আপন মনে চলে গেলেন। নিষ্ঠুর আপনি, স্বার্থপর আপনি।

এইবার বুকের মাঝখানটা কেমন করে উঠল। এখন নির্জনে বসে একটু কাঁদতে পারলে বেশ হত! ফোঁটা ফোঁটা জল জীবনের চিড়-খাওয়া জমিতে পড়ে প্রথম বর্ষার গন্ধের মতো আকুল করে তুলত। সে অবসর এখন আমার নেই। জগন্নাথ কঁদতে পারে, বিষ্টুদা পারেন, মায়ার পিসিমা আঁচলে চোখ মুছতে পারেন। তুলসীর মালা ঘুরিয়ে জপ করতে পারেন। আমার এখন সে সময় নেই।

সন্ন্যাসী স্তোত্র শেষ করে চোখ মেললেন। সারাঘর দেখে নিলেন। তারপর মায়ার পিসির দিকে তাকিয়ে বললেন, মাইজি ইধার আইয়ে।

একপাশে ফুলের ঝুড়ি। গোলাপ, রজনীগন্ধা, পদ্ম সব মিলিয়ে লিলি অফ দি ভ্যালির মতো অদ্ভুত এক গন্ধ তৈরি করে বাতাসে ছুড়ছে। মায়ার পিসিমা ধীর নম্রতায় সামনে এসে প্রণাম করে বসলেন।

মাতামহের অঙ্গরাগ শুরু হল। পিসিমা ভাগ্যবতী মহিলা। সন্ন্যাসীকে সাহায্যের তিনিই অধিকারী হলেন। চোখের সামনে কত কী যে ঘটতে লাগল! কর্পূরের আগুনে সোনার তবক পুড়িয়ে মস্তকের মধ্যদেশে স্থাপন করা হল। তার ওপর চন্দন চর্চিত বিল্বপত্র স্থাপিত হল। মন্ত্রোচ্চারণের গুনগুন শব্দে ঘর মুখরিত। সর্বঅঙ্গে চন্দনের তিলক। প্রশান্ত কপালে সুবৃহৎ একটি রক্তচন্দনের ফোঁটা। মুদিত নয়নে রাখা হল চন্দন-লেপিত তুলসীপত্র। গলায় গোড়ের মালা। রেশমের উত্তরীয় দুই স্কন্ধের ওপর দিয়ে নেমে এল বুকের কাছে। রাজযোগীর রাজবেশ। চলেছেন রাজাধিরাজের দরবারে। অন্তহীন কালপ্রবাহে মহাকালের সিংহদুয়ার খোলা। মহারাজের সিংহাসন ঘিরে অনন্ত দরবার চলেছে। যার যখন আমন্ত্রণ আসে, সেজেগুঁজে চলে যায়।

সব আয়োজন শেষ হল। এইবার মনে হয় যাত্রা শুরু হবে। মাতুল কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন। আর একটু পরেই রাত ভোর হবে। রেডিয়োর ঘোষক বলতে থাকবেন, নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে গ্রামাফোন রেকর্ডে গান বাজিয়ে শোনানো হচ্ছে। চিন্তা ছিঁড়ে গেল। পিতা বললেন, মহারাজ, আমার খুব ইচ্ছে, এই বাড়ির বাগানে এঁকে সমাহিত করি। এখানে আপনার একটা আসন হোক।

নেহি বেটা।

পিতা বললেন, তা হলে চন্দন কাঠে দাহ করার ব্যবস্থা হোক। আহা এইসময় আমার অক্ষয়টা যদি থাকত!

ঘরের দূর কোণ থেকে কে যেন বললেন, থাকত কী, আমি তো রয়েইছি।

সেকী তুমি কখন এলে? লক্ষ করিনি তো!

অনেকক্ষণ এসেছি হরিদা। আজ হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছিলুম, হঠাৎ কে যেন বললে, একবার ঘুরে যা। চন্দন কাঠ তো! তা একবার হীরালালের কাছে চলে যাই?

তাকে ভোরের আগে পাচ্ছ কোথায়?

সাধুজি বললেন, নেহি বেটা, চন্দন কাঠ জরুরৎ নেহি। অ্যায়সাই হো যায়গা।

শেষ ক’টা দিন মাতামহ যে-ঘরটিতে কাটিয়ে গেলেন, দোর ঠেলে সেই অন্ধকার ঘরে একবার গেলুম। নিভাঁজ শয্যা। শেষ চাঁদের আলোর গলিত একটু অংশ বিছানায় শুয়ে ছিল। পাশের টেবিলে কীটদষ্ট সেই সাধনসংগীতের বইটি। নিখুঁত ভাঁজ করা সাদা একটি গামছা। মানুষের প্রয়োজন কত সামান্য! বাদামি রঙের ন্যাকড়ার সেই জুতোটি বাইরে কোথাও আছে। খড়ম পরতে ভালবাসতেন। খাটের পাশে খড়ম জোড়াটি হয়তো অপেক্ষা করে আছে। ভোর হয়ে আসছে, এইবার সেই পা দুটি এসে জাগিয়ে তুলবে। জানে না, হাঁটার ছুটি হয়ে গেছে! আধো আলো আধো অন্ধকার ঘরে সব আছে নেই কেবল একজন। টেবিলে ঝকঝকে বাটি চাপা এক ড্যালা ছানা, গোটা দশ বারো ভেজানো কিসমিস, দুটি খেজুর। কাঁসার গেলাসে চাপা জল। কাকিমা সব আয়োজন সম্পূর্ণ করে রেখে গিয়েছিলেন। আসর ভেঙে গেলেই রাতের সামান্য আহার শেষ করে শয্যা নেবেন। কেউ নেই, তবু মনে হল শূন্য ঘরে সেই লঘু তরল কণ্ঠস্বরটি বেজে উঠল, কী করে বেড়াচ্ছিস? আয় এখানে বোস। তোর মায়ের ছেলেবেলার গল্প শোন। কেন তুলসী নাম রেখেছিলুম জানিস? আমি ঘোর শাক্ত। তোর দিদিমা ছিল ঘোর বৈষ্ণব। শাক্তের ঘরে তুলসী এল। যিনিই শ্যাম তিনিই শ্যামা।

চলে এসো।

পিতৃদেবের গম্ভীর গলা। এইবার আমরা বেরোব। সিলি সেন্টিমেন্টের আর সময় নেই।

যে সময় রাত চলে যায়, সেই সময়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল। মাতামহের অসাধারণ এই দেহত্যাগের সংবাদ ঠিকই ছড়িয়েছে। ভোরের সেই স্নানার্থী সন্ন্যাসী, যিনি গঙ্গায় চিত হয়ে ভেসে ভেসে ঘাট থেকে ঘাটে চলে যান, তিনি যে মাতামহকে চিনতেন আমার জানা ছিল না। খাটের পাশে পঁড়িয়ে পড়ে বললেন, চললে রাজা রাজনারায়ণ! দু’পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, আচ্ছা চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। ইচ্ছে যখন হয়েছে। আবার ফিরে এসে হাত দিয়ে খাট স্পর্শ করে দাঁড়ালেন। নাম সংকীর্তনের দল রোজকার মতোই নগর পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন, তারাও স্বেচ্ছায় আমাদের শবযাত্রার অনুগামী হলেন।

হরিদ্বারের সন্ন্যাসীর ঝুলিতে জগন্নাথের ফুল। তিনি মুঠো মুঠো ফুল ছড়াচ্ছেন। সংকীর্তনে প্রভাতী সুর। আমার মাতামহ চললেন চিরযাত্রায়। যে-পথ চলে গেছে আগুনের শিখায় উধ্বমুখে। এরপর আজ যাঁরা গঙ্গার স্নানে যাবেন, তারা দেখবেন সারাপথে ছড়িয়ে আছে পদ্ম আর গোলাপের পাপড়ি, রজনীগন্ধা। তারা ভাববেন কেউ হয়তো অভিসারে গেছে। হ্যাঁ এও তো অভিসার!

মর্গ দেখেছি। শ্মশান এই প্রথম। পাশ দিয়ে বহুবার গেছি, ভেতরে কোনওদিন ঢুকিনি। স্থানটি বড় মনোরম। সামনেই একটি গেট। মাধবীলতা ঝুলছে। বড় বড় হরফে লেখা মহাশ্মশান। সেই শ্মশানই মহাশ্মশান যেখানে অতীতে কোনও মহাপুরুষ অগ্নিশয্যা পেতে গেছেন। শ্মশানের চোখে নিদ্রা নেই। দেখেই মনে হচ্ছে, সারারাত জেগেই ছিল। আলো এখনও জ্বলছে। ভিজে কাপড়ে একটি দল আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেলেন। দু-এক ছিটে জল গায়ে লাগল। এঁদের সারা হয়ে গেল। আমাদের এইবার শুরু হবে। কীর্তন যখনই থামছে কানে আসছে পাখির ডাক।

ভেতরে দুটি চিতা তখনও জ্বলছে। বাঁধা বটতলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আপনজনেরা বসে আছেন। ভালবাসার, ভালবাসবার নশ্বর দেহখাঁচা চোখের সামনে চড়চড় করে পুড়ে যাচ্ছে। হাড়ফাটার অট্টহাসি মানুষের সমস্ত অহংকারের ওপর ফোয়ারার মতো ঝরে পড়ছে। জীবনের সব চিৎকার মৃত্যুর মুঠোয়। খাঁটিয়ার বাঁশ খুলে নিয়ে সাহসী একজন চিতার সামনে, আর একজন বলছেন, দাও দাও এইবার মাথাটা ভেঙে দাও। ফটাস করে একটা শব্দ হল। কিছু আগুনের ফুলকি পড়পড় করে আকাশের দিকে

লাফিয়ে উঠল। আমার ভেতরটা যেন ছিটকে উঠল। মৃতের আসরে জীবিতেরা বড় অসহায়।

মাতামহ ধীরে ধীরে সাজানো কাঠের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চিতায় অগ্নি প্রজ্বলিত হল। শিখা উঠছে, ক্রমশই ওপরে উঠছে। শোক নয়, কেমন যেন স্তম্ভিত অবস্থা আমার। দিগ্বিদিক আলোকিত করে ফসফরাসের মতো রুপোলি একটা দ্যুতি মাতামহের অবয়ব নিয়ে সোনালি আগুনের মধ্যে দুলতে লাগল। অলৌকিক দৃশ্য। সকলে একসঙ্গে গম্ভীর গলায় উচ্চারণ করলেন হরি ওম্। হরি ওম্।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *