2 of 3

২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে

কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে!
কি অস্থির সংক্রমণ!
কি গভীর আলোড়ন!
বিস্মিত-স্তম্ভিত আমি দাঁড়াইয়া তটে।

রাত কোথা দিয়ে কেটে গেল জানি না। সুরের নেশা, দেহের নেশা। ইন্দ্রিয়ের কিলিবিলি। গাঁজার ধোঁয়া। নাচিয়ে মহিলার নাম জিরাবাই। শ’খানেক মানুষকে একেবারে লুটিয়ে দিলে। আমরা খাওয়াদাওয়ার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলুম। হঠাৎ লতা এসে পরেশদার পিঠে এক চাপড় মেরে বললে, পেঁয়াজি বাইয়ের শরীরের পেঁয়াজি দেখতে হয় তো, আমাকে উদ্ধার করে এসে দেখো। ঘনিষ্ঠতা দেখে মনে হল, পরেশদাও লতার প্রেমমুগ্ধ। ছিপছিপে দীর্ঘাঙ্গী এই মহিলাও কম যান না। সবেতেই বেশ মাদকতা। শরীরের বাঁধুনি বোতলের নেশাকেও হার মানায়। পরেশদা গাঁজায় চুর হয়ে ছিলেন। গোপাল বালকটির মতো পিছু পিছু চলতে লাগলেন। পশ্চিমের গঙ্গাগর্ভ থেকে জোলো বাতাস বয়ে আসছে। বেশ ভারী। ভিজে আঁচলের মতো। লতার আঁচল উড়ে উড়ে ঝাঁপটা মেরে যাচ্ছে মুখে। মহুয়ার গন্ধ। গুনগুন করে গান ধরেছে তোমার আমার গোপন কথা শোনে শুনুক লোকে। মেয়েটা যে নেশা করেছে বেশ বোঝাই যায়। কপাল চকচক করছে। চোখদুটো ধকধক করছে। টুসকি মারছে। মাথায় অনেক চুল। থেকে থেকে খোঁপা ভাঙছে খোঁপা বাঁধছে। কখনও সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলছে।

পরেশদা সাবধান করছেন, এই কী হচ্ছে! লোকে মাতাল বলবে।

লতা বললে, এই নাবালক, মালটাকে জোটালে কোথা থেকে! বাঁদরছানার মতো সেই থেকে আমার দিকে জুলজুল করে তাকাচ্ছে। আমার শরীরে সুড়সুড়ি লাগছে মাইরি।

পরেশদা বললেন, অ্যায় লতু, হচ্ছেটা কী? কাকে কী বলছ! ভদ্দরলোকের ছেলে।

লতা খিলখিলিয়ে বললে, মাঝরাতে দুধের বাছা আর বুড়োহাবড়া ছাড়া কোন শালা ভদ্দরলোক!

পরেশদা ধমক মেরে বললেন, লতু, হি ইজ মাই ফ্রেন্ড।

আমার বেশ মজা লাগছিল। ভাগ্য আমাকে কী সুন্দর জায়গায় টেনে এনেছে। বলা যায় না, এইটাই হয়তো আমার বাকি জীবনের পরিবেশ। অন্য সময়ে আমি কি আসতুম এখানে? সাতদিন আগেও এখানে আসার কথা আমি ভাবতে পারতুম না। একেই বলে যোগাযোগ। তা সবই যদি ভগবানের ইচ্ছায় হয়, তা হলে এই খালপাড়ে আসাটাও তার ইচ্ছা। কেন? বলছি। ঠনঠনে গিয়েছিলুম মাকে প্রণাম করতে। হৃদয়ের ব্যথা জানাতে। মা সেখানে আমার জন্যে খাড়া করে রেখেছিলেন পকেটমার জামাইকে। জামাই সব আবর্জনা সাফা করে দিলে। দেখা হল এই পরেশদার সঙ্গে। তিনি টেনে নিয়ে এলেন এই বিচিত্র জায়গায়। এমনই বরাত, শুরু হল গান। সঙ্গে আবার নাচ। ভগবান জানতেন, ছেলেটার মনে গেঁদা হয়েছে। তালি মারতে হবে।

তালি মেরে পা ঠুকে জিরাবাই গান ধরলে, সেঁইয়া না মারো লাথ। তেরি গোড় পড়ি সজনীয়া। শুনো মেরি বাত ॥ ঈশ্বর এতেও সন্তুষ্ট হলেন না। পাতে দিলেন চাটনি। মাতাল লতা। যা ভেবেছিলুম। খেলা কোয়ার্টার সেমি নয় একেবারে ফাঁইনালে গিয়ে শেষ হল। খাদ্য যা জুটল সে আর বলার নয়। মাতাল রমণীর পোশাকআশাকের ঠিক থাকছে না। আঁচল খুলে পড়ে যাচ্ছে। চুল। এলিয়ে যাচ্ছে। শোচনীয় অবস্থা। তার নয়, আমাদের। সেই অবস্থায় কাজ কিন্তু হয়ে চলেছে। এনামেলের থালায় ভাত, ডাল, আস্ত একটা পেঁয়াজ আর চাটনি। এই হল খাদ্য। মেয়েটির হাতের রান্নার পরিচয় পাওয়া গেল ডালে। অমৃতের স্বাদ। কী দিয়েছিল কে জানে!

যে-লোকটিকে কিছু আগে দেখেছিলুম নির্বাক পশুর মতো বউয়ের পায়ে পায়ে ঘুরছে, মধ্যরাতে তার কী বিক্রম! সে-ও মনে হয় দু’পাত্র চড়িয়েছিল। রাজার মতো বসে বসে হুকুম করছে, অ্যায় ডাল দে। চাইবার মত একটা জিনিসই তো হয়েছে, সেটা ডাল। মদের একটা অদ্ভুত গুণ। পৃথিবীর সব প্রাণীকেই সম্বন্ধী মনে করায়। শালা ছাড়া সম্বোধন নেই। আর পরস্পরকে খুব নিকট করে। তুই ছাড়া মুখ দিয়ে আর কিছু বেরোয় না।

ডাল দে, বললেই তো আর ডাল দেওয়া যায় না। সব শেষ। লতা হাতের চুড়ি দিয়ে অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিটা একবার বাজিয়ে দিলে। মাথার ওপর দু’হাত তুলে শরীরের ওপরটা নাচিয়ে বললে, ডাল নেই, মাল আছে।

লোকটি অদ্ভুত কায়দায় বসে বসেই ডান পা-টা ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো এমন ছুড়ল, ধাঁই করে লতার বুকে। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। স্থলে জলে আকাশে। প্রথমে গোলা যুদ্ধ। গেলাস ছোঁড়াছুড়ি, ডালের বাটি, আধখাওয়া পেঁয়াজ। রাম রাবণ তো নয়, রাম-সীতায় লড়াই।

পরেশদা বললেন, আর না। চলো সরে পড়ি। প্রেম জাগছে।

এর নাম প্রেম?

আজ্ঞে হ্যাঁ। প্রেমের তুমি কী বোঝো হে ছোকরা? আলোড়ন, আলিঙ্গন, আক্রমণ, আন্দোলন, নিষ্পেষণ, নিপীড়ন।

একটা গেলাস পরেশদার মাথা ঘেঁষে ঠিকরে চলে গেল বাইরে। দুটো নেড়ি কুকুর বসে ছিল প্রসাদের আশায়। দুটোতেই তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। লতা ছুটে বাইরে চলে যেতে চাইছিল। লতার স্বামী চুলের মুঠি ধরে মেঝেতে পেড়ে ফেলল। পরেশদা বললেন, হয়ে গেল। ফ্লোর করে দিয়েছে। আর না। এইবার পালাই।

রাস্তায় নেমে বললুম, পরেশদা, আবার ওই গানের আসর! শরীরের সমস্ত রক্ত খালের মশা শুষে নিল। আর যে পারছি না।

ওইজন্যেই বলেছিলুম ছিলিমে মারো টান। মশা কেন, কাকড়াবিছে কামড়ালেও টের পেতে না। এত রাতে তুমি ফিরবে কী করে? হেঁটে! দিনকাল ভাল নয়। রাত আর বেশি বাকি নেই, কোনওরকমে কাটিয়ে দাও।

গানের আসরের কাছাকাছি এসে পরেশদার মত বদলে গেল, আমরা একটা কাজ অবশ্য করতে পারি। তবে… তবে…

বারকতক তবে শুনে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলুম, তবে কী?

তোমার হয়তো খারাপ লাগবে। ভাববে, তোমাকে আমি খারাপ করে দিচ্ছি। তবে, সবরকম। অভিজ্ঞতাই হওয়া ভাল। একবারই তো জন্মেছি। পরেশ নামে আর তো দ্বিতীয় বার আসা হবে না। জীবনের সব দিক দেখে যাব। আমার ভাই এই মত। তোমার মত অবশ্য অন্যরকম হতে পারে। আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলবে?

মরার ভয় না থাকলে নিশ্চয় বলব।

পরেশদা আমার কাছে সরে এলেন আরও। হাতটা চেপে ধরে বললেন, শরীরটা একটু কেমন কেমন লাগছে না?

তা তো লাগছেই। সারাদিন টোটো করে ঘুরছি।

আরে ধুর। সে তো আমিও ঘুরছি। শ্যামবাজার ধর্মতলা, ধর্মতলা শ্যামবাজার। সে নয়। জিরাবাই যা দেখালে তাতে একটু ইচ্ছে ইচ্ছে করছে না? তারপরে তোমার ওই লতা। ভেতরটা একটু টাল খেয়েছে না? সত্যি বলবে। ভণ্ডামি করবে না মাইরি।

বেশ বেকায়দা হয়ে গেলুম। এর উত্তরে সত্যি কথা বলা যায় না। ঝট করে বলে ফেললুম, আমার কিছুই হয়নি।

তোমার তা হলে অসুখ আছে। তুমি পুরুষ নও। তুমি সেই।

খপ করে আমার দুটো হাত চেপে ধরে বললেন, চরিত্র দেখাচ্ছ। চরিত্র! ওই শরীরের ঝটকা দেখে তোমার চটকা ভাঙেনি! মিথ্যে বলার জায়গা পাওনি? চলো আমার সঙ্গে।

কোথায় আমাকে নিয়ে যাবে পরেশদা?

তুমি আমাকে কতটা খারাপ ভাবছ?

একটুও না।

তোমার কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে কি না?

হয়েছে।

এই এতটা সময় আমরা দুঃখকষ্ট ভুলে ছিলুম কি না?

ছিলুম।

কে ভোলালে?

গান।

গানের সঙ্গে?

নাচ।

ওকে নাচ বলে? এইবার আমি খিস্তি করব। চলো। বেশি দূরে যেতে হবে না। কাছেই।

আপনি আমাকে খুলে বলুন আগে।

ওই কালীমন্দিরের পাশের গলি দিয়ে ঢুকে গেলেই অন্য এক জগৎ। বিশাল এক বস্তি। সেই বস্তিতে জেগে আছে রাত-রূপসিরা। সাংঘাতিক এক মজার জায়গা। তোমাকে বলতে লজ্জা নেই আমি মাঝে মাঝে যাই ভাই। একটু আদরটাদর করে, একটু আদর খেয়ে, ফ্রেশ হয়ে চলে আসি। এতে তো কারও কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। কারও কোনও ক্ষতিও আমি করছি না। তোমারও কেউ নেই, আমারও কেউ নেই। আমাদের এইসব নিয়েই থাকতে হবে। একা তো আর থাকা যায় না। আমার যুক্তিটা তুমি মানো কি না!

পরেশদা, ওখানে আমি যেতে পারব না। আর এই এত রাতে আমাকে আপনি একা ফেলে পালাবেন না। একটা রাত আমার জন্যে একটু কষ্ট করুন। তা ছাড়া, আমার পকেটে আপনারই। দেওয়া একটা মাত্র টাকা পড়ে আছে। একটাকায় তো আর ফুর্তি হয় না!

পরেশদার প্রবল উৎসাহে একটু ভাঁটা পড়ল। বুঝলেন, যেখানে যাচ্ছেন সেখানে বিনা পয়সায় কেউ আদর করবেনা। ফেলো কড়ি মাখো তেল। একপাক পায়চারি করে নিলেন। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ব্যাড লাক। আমার কাছে আমার মতন আছে। অন্যদিন থাকে। ভেরি ব্যাড লাক। আজকের রাতটা বেশ নরম ছিল। জমত ভাল। আমি যার কাছে যাই একেবারে ঘরের বউয়ের মতো ব্যবহার করে। যাক গে, আর একদিন হবে। চলো তা হলে ওই মশার ডিপোতে গিয়েই বসি।

জিরাবাইয়ের নাচ শেষ হয়ে গেছে। তিনি সাহাবাবুর গদিতে গিয়ে ঢুকেছেন। ওস্তাদজি একটা কাওয়ালির মুখ নিয়ে কসরত করছেন। আমার ভেতরে বেশ একটা ছটফটানি অনুভব করছি। পকেটে আজ টাকা থাকলে সময়টা কী সুন্দর কাটত! অনেকদিনের একটা ব্যাকুল ইচ্ছা, প্রবল কৌতূহল পূর্ণ হত। ওরা কেমন? কী করে? কী বলে? কেমন হাসে! কত কী শুনেছি! দূর থেকে দেখেছি। আজ চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন হত। এ তো পাপ নয়। একটা অনুসন্ধিৎসা। ভেতরটা তোলপাড় করছে। সবই তো তার ইচ্ছাতেই হচ্ছে। তিনি এটারও মালিক, ওটারও মালিক। তা হলে পাপ ভেবে কুঁকড়ে যাচ্ছি কেন? এটা তো ঠিক, ওই একটা জিনিস কিছুক্ষণের জন্যে মানুষের সবকিছু ভুলিয়ে দিতে পারে! হরিশঙ্করের নিষ্ঠুরতা, মুকুর অনিশ্চয়তা, কেউ-না থাকার নিঃসঙ্গতা। বলাও তো যায় না, প্রকৃত প্রেম হয়তো ওই জায়গা থেকেই পাশ ফিরে জেগে উঠবে। কার বরাতে কী লেখা আছে, কেউ কি বলতে পারে? সেদিন এক ভদ্রপাগল দু’চরণ কবিতা হাঁকছিল, হয়তো তারই লেখা: চলতে চলতে মাঝপথে গেলে তার দেখা পাওয়া যায়। সেই পথে জোনাকিরা দেয়। আলো। পাগল পরের চরণটা আর শেষ করলেন না। তড়বড় তড়বড় করে বলে উঠলেন, যে-জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি তার শালা কিস্যু হয় না। আমার ওইটা ভাল লেগেছিল, চলতে চলতে চলতে চলতে তার দেখা পাব। ওই যে বারোদির ব্রহ্মচারী, বিখ্যাত সাধক, তার এক শিষ্যকে বলেছিলেন, যদি মনে হয় আর পারছ না, তা হলে নিজের সঙ্গে অকারণে লড়াই না করে বেশ্যাগমন করো। তার এই যুক্তি শুনে সারা বৃন্দাবনে হইচই পড়ে গেল। বৈষ্ণবসমাজ অতিশয় অসন্তুষ্ট হলেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজি, কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীজি তখন বৃন্দাবনে প্রবল সাধনায়। তারা। হায় হায় করে উঠলেন। তাদের দাওয়াই ছিল অন্য, দৌড়োও, কোদাল পাড়ো, গায়ে জল ঢালল। কষ্ট দিয়ে, না খেতে দিয়ে মেরে ফেলল। সনাতন পথ। বিদেশিরা বললেন, মরে না। বিকৃত হয়ে বেরিয়ে আসে। মারতে নেই। খাইয়ে খাইয়ে খিদে মেরে দিতে হয়। অরুচি করে দিতে হয়। বাঘের মোটা নেজও নড়বে, রোগা নেজও নড়বে। টিকিটিকিও ছুটবে, কুমিরও ছুটবে। করবেটা কী? ভগবানের যেমন কাণ্ড! এ কি তোমার ইচ্ছে? এ যে তার ইচ্ছে। মনে পড়ছে সেই গান। বাউল গাইছেন:

বিবাদী তোর দেহে সকল
অহর্নিশি করছে রে গোল,
যথা যাবি, তথায় পাগল করবে তোরে ॥
নারী ছেড়ে জঙ্গলে যায়,
স্বপ্নদোষ কি হয় না তথায়,
সাথের বাঘে সবারে খায়,
তখন আর কে ঠেকায় রে ॥
সঙ্গে আছে রিপু ছয়জন,
তারা সদাই করে জ্বালাতন,
কোন দেশে যাবি মনা চল দেখি যাই।
আমি দেখব, কোথায় পির হও তুমি রে,
তীর্থে যাবে সেখানে কি পাপী নাই রে ॥

হঠাৎ কানে সুর লেগে গেল। খারাপ ভাবটা শীতের পাতার মতো খুস করে ঝরে পড়ল। মনে হল আমিও একটু গান গাই। কিন্তু আমাকে কি গাইতে দেবে? পরেশদার কানে কানে বললুম, আমাকে গান গাইতে দেবে? পরেশদা বললেন, সেকী, তুমি গান জানো?

অল্প অল্প।

দাঁড়াও, ব্যবস্থা করে আসি।

পরেশদা উঠে গিয়ে ওস্তাদজির কানে কী বললেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গান থামিয়ে বললেন, আইয়ে আইয়ে। উঠে গেলুম। তিনি হারমোনিয়মটা ঠেলে দিলেন আমার দিকে। প্রথমে একটু ভয়ভয় করছিল। গুরুকে স্মরণ করে নিলুম চোখ বুজিয়ে। ওস্তাদজিকে নমস্কার করলুম। তিনি খুব খুশি হলেন। রাত ভোর হয়ে আসছে। ভৈরবীটা আমার গলায় আসে ভাল। ভৈরবীর পরদা লাগালুম। সুর ঝলমল করে উঠল। মনে মনেই বললুম, আহা! ওস্তাদজি আমার মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে দিলেন একবার। ধরে ফেললুম সেই বিখ্যাত গান, দয়ানী ভবানী। তিন সপ্তকে গলা বলছে। নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। ছেলের মাথায় আপেল বসিয়ে বাবা তিরবিদ্ধ করেছিলেন। আমার অনেকটা সেই অবস্থা। গলির ভেতর বস্তি, সেই বস্তির আধময়লা বিছানায় একটা মেয়ে, সেই মেয়েটিকে ভৈরবী দিয়ে মন থেকে ফেঁড়ে ফেলে দিতে হবে। ভবানী, তুমি দয়া করো। যাক, ভোর হয়ে আসছে। অন্ধকার ফিকে হয়েছে। বেশ ভাল লাগছে এই ভেবে, যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। ওস্তাদজি দয়া করে হারমোনিয়ম ছেড়ে না দিলে, আংটিটা শেষপর্যন্ত টেনে নিয়ে যেত পাপের পথে। খোঁচা মেরেছিল। চল চল করেছিল, আরে আমি তো আছি আঙুলে!

রাজা রীক্ষিতের কথা মনে পড়ে গেল। তারই কীর্তি। আমার তো কিছু করার নেই। পরীক্ষিতের সঙ্গে দেখা হল। প্রথমে চিনতে পারেননি। কে এই বিকট দর্শন পুরুষ! হাতে দণ্ড, চোখ ক্রোধে রক্তবর্ণ। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। একটি বৃষ ও একটি ধেনুকে নির্দয় প্রহার করছে। বৃষ ও ধেনুটিকে দেখে রাজা আরও অবাক হলেন। এ কেমন বৃষ! সুন্দর ধবল বর্ণ, কিন্তু তার একটি মাত্র পা। প্রহারে জর্জরিত ধেনুটির চোখে জলের ধারা। রাজা প্রশ্ন করলেন, বর্বর, তুমি কে?

আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি কলি। আমি এসে গেছি।

রাজা স্তম্ভিত হলেন। আমার রাজ্যসীমায় কলি! কী স্পর্ধা! রাজা তখন প্রশ্ন করলেন বৃষকে, তুমি কে?

বৃষ বললেন, আমি ধর্ম।

আপনার এই অবস্থা কেন ধর্মরাজ?

মহারাজ, কলিতে ধর্মের এই অবস্থাই হবে। কলিযুগ অধর্মের যুগ। ধর্মের তিন ভাগ চলে গিয়ে থাকবে মাত্র এক ভাগ। তাই আমার একটি মাত্র পা।

রাজা ধেনুকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কে?

ধেনু বললেন, আমাকে চিনতে পারলে না পরীক্ষিত! আমি মাতা ধরিত্রী। আজ আমি ভাগ্যহীনা। আমারই বুকে সংঘটিত হবে যত অনাচার। দুবৃত্তরা নৃত্য করবে। সাধুসজ্জন নিপীড়িত হবে। রাজা পরীক্ষিত গর্জন করে উঠলেন, তুমি কলি! তোমার সংহার হবে আমার হাতে। রাজা অস্ত্র ধারণ করলেন। মহাতেজা পরীক্ষিত। কলি ভীষণ ভয় পেলেন। রাজা পরীক্ষিতের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি তার নেই। তিনি করজোড়ে আশ্রয় চাইলেন, মহারাজা, কালের নিয়মে আমাকে আসতেই হবে। না এসে উপায় নেই। আমাকে শুধু একটু থাকার স্থান নির্দেশ করুন।

বিচক্ষণ রাজা বুঝলেন, কালকে হনন করা যায় না। রাজা তখন কলির স্থান নির্দেশ করলেন। কোথায় থাকবেন কলি! পাশাক্রীড়ায় অর্থাৎ দূতসভায়, মদ্যপানে, পরস্ত্রী অনুগমনে আর প্রাণীহিংসায়। কলি সবিনয়ে বললেন, রাজন, দয়া করে আরও একটি আশ্রয় দিন। আপনি যা দিলেন, তা যথেষ্ট হল না।

মহারাজ পরীক্ষিত সামান্য চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, সুবর্ণেও আপনার স্থান হোক। কলি সন্তুষ্ট হলেন। আমার আঙুলের আংটিটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, এই সেই সুবর্ণ। ঘোর কলি। আমাকে আর একটু হলেই দুই ম-এ মজিয়ে মারত।

এক লাফে সূর্য উঠল টালার দিকের আকাশে। আমি বসে আছি বাগবাজারের ঘাটে। পরেশদা আর বেগ ধারণ করতে পারেননি। আমার গান শেষ হবার আগেই চলে গেছেন সেইখানে, যেখানে যাবার জন্যে প্রাণ ছটফট করছিল। ওস্তাদজি আর জিরাবাই সাহাবাবুদের গাড়িতে চেপে চলে গেছেন। ওস্তাদজি যাবার আগে ঠিকানা দিয়ে গেছেন। বলেছেন যদি যাই, তা হলে ঠিক ঘরানায় ফেলে দেবেন। জিরাবাই চাঁপাফুল রঙের কোমর বের করে পেছনের আসনে এলিয়ে ছিলেন। শরীর খুবই বে-এক্তার। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

ঘাটের কিনারায় জল ছলাত ছলাত করছে। পশ্চিম আকাশের ঘুম ভেঙে গেছে। মরকত নীল আকাশ। বড় বড় বিচিলির নৌকো মৃদুমন্দ দুলছে। ভোরের আনার্থীরা কেউ জলে, কেউ ঘাটে। কেউ বলছেন হরি, কেউ রাম, কেউ তারা। সারারাত বিশ্রীভাবে জেগে থাকার ফলে, চোখদুটো ফুলুরির মতো হয়ে আছে। এইখানে বসে থাকার ফলে, নিজের জীবনের সুরটা ধরতে পারছি। একদিকে মন্দির। মাঝে মাঝে টিং করে ঘণ্টা বাজিয়ে চলে যাচ্ছেন ভক্ত। শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢেলে চিৎকার করছেন কেউ, জয় বাবা বিশ্বনাথ। ঘাটের ধাপ কাপড়ের আর পায়ের জলে ক্রমশই ভিজে উঠছে। দু’হাত দিয়ে জল ঠেলার শব্দ। ঢেউয়ের ওপর প্রথম সূর্যের আলো চিকমিক করছে। গাঁজা নেই, গান নেই, শরীর দোলানো নাচ নেই। কোনও কুপ্রস্তাব নেই। লতার শাড়ি খোলা আধময়লা সাদা ব্লাউজ ফাটা বুক নেই। এই পবিত্রতাই আমার জীবনের সুর। আমি ধরে ফেলেছি। এই জীবনের সুর চিরকালের জন্যে বেঁধে দিয়ে গেছেন আমার পিতা, খ্যাপা হরিশঙ্কর। নিজেকেই নিজে টাইট করে বাঁধো,নইলে ফসকে যাবে। জীবন বড় গোল, পৃথিবীর চেটো বড় সমতল। বেশি নড়াচড়া কোরো না, গড়িয়ে পড়ে যাবে।

বসে থাকতে থাকতে মনে হল বারাণসী যাব। সেই দশাশ্বমেধ ঘাট। সেই বাড়িটা খুঁজে বের করব, যে বাড়িতে যৌবনে আমার পিতা, পিতামহের সঙ্গে কিছুকাল বাস করেছিলেন। যে বাড়িতে বাঁদরের তাড়ায় ছাদের খাড়া সিঁড়ি বেয়ে পড়ে গিয়ে, নাকের ওপরে, কপালে অর্ধচন্দ্রাকৃতি একটি ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয়েছিল। যেন মহাদেবের কপালের শশাঙ্ক তিলক। প্রতিজ্ঞাটা তা হলে এই হল, রাত যাকে প্রলোভন দেখায় তাকে দিনের সুরে বাঁধতে হবে। সন্ন্যাসই তার আদর্শ। কাটাপেরেকের মতো ভেতরে গজগজ করছে কদিচ্ছা। রাতে কতরকম যুক্তি খাড়া করি! সকালে শঙ্কর, রাতে খৈয়াম। এমন ছেলেই বংশের মুখে চুনকালি মাখায়।

হঠাৎ পেছন দিক থেকে মাথার ওপর আলতো একটা হাত এসে পড়ল। চমকে ফিরে তাকালুম। গেরুয়া বসনের প্রান্ত। মুখ তুলে তাকালুম। স্বামীজি। স্বামী নির্মলানন্দ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। অতিশয় অপবিত্র হয়ে আছে আমার এই দেহ। স্পর্শমাত্রই তিনি অনুভব করবেন। পড়ে ফেলবেন আমার চিন্তা। এঁদের সামনে মানুষ কাঁচ হয়ে যায়। আমি দাঁড়িয়ে উঠে প্রণাম করলুম নিচু হয়ে।

তিনি বললেন, কী ব্যাপার, এই সময়ে তুমি এইখানে বসে?

প্রসন্ন স্নিগ্ধ গম্ভীর মুখ। পরিষ্কার টকটকে গেরুয়া। একটু ইতস্তত করে বললুম, কাল সারাটা রাত আমি পথেই কাটিয়েছি।

সেকী? কেন? অ্যাডভেঞ্চার?

আজ্ঞে না, সে অনেক কথা।

চলো চলো, আশ্রমে চলল।

মহারাজ তরতর করে হাঁটতে লাগলেন। ভীষণ দ্রুত হাঁটেন। তাল রাখা শক্ত। কাছেই আশ্রম। সকালে প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলেন নিমতলা। শুনেছি রোজই তিনি এই পথপরিক্রমা করেন। বাগবাজারের ঘাটে অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে ফিরে যান আশ্রমে। তিনতলার ঘরে। সেখানে সারাদিন জ্ঞান-তপস্যা। পত্রিকার সম্পাদনা।

কোনও দিকে তাকাবার অবকাশ নেই। পেছনে পেছনে চলেছি। সিঁড়ি। মহারাজ তরতর করে উঠছেন। ফরসা পায়ের ওপর টকটকে গেরুয়া,কী সুন্দর শোভা! টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসে আমাকে বললেন, বোসো।

ভয়ভয় করছে। স্বামীজির বিশাল ব্যক্তিত্বকে আমি ভীষণ ভয় পাই। আবার ভীষণ আকর্ষণও বোধ করি। মনে হচ্ছে পাহাড়ের সামনে থম মেরে বসে আছি। স্বামীজি হাড়ের ছুরি দিয়ে একটা খামের মুখ কাটতে কাটতে বললেন, আমার যতদূর মনে হচ্ছে, তোমার মুখ ধোয়া, প্রাতঃকৃত্য সবই বাকি আছে।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

স্বামীজি স্প্রিং-এর মতো চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। এমন এনার্জি আমি একমাত্র হরিশঙ্করের ভেতরেই দেখেছি। কিছু একটা করার সময় একেবারে ছিলে-ছেঁড়া ধনুক। স্বামীজি আলমারি খুলে একটা ভোয়ালে বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, আগে প্রাকৃতিক কর্ম সারো। তারপর সব কথা শোনা যাবে। ইতস্তত ভাব এল, আপনার বাথরুম, আপনার তোয়ালে! হাসেন যখন একেবারে ছেলেমানুষ! সে হাসি আবার কড়া সুরে বাঁধা। বললেন, কর্মটা একই। আশা করি পশ্চিমি পরিচ্ছন্নতাটা জানো? সেইভাবেই ব্যবহার কোরো। আর তোয়ালে? ওটা তোমার। নারীসুলভ লজ্জা ছেড়ে পুরুষমানুষের মতো চলে যাও। একেবারে স্নান সেরে বেরিয়ে এসো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *