2 of 3

১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ

পাগলা মনটারে তুই বাঁধ।
কেন রে তুই যেথা সেথা
পরিস প্রাণে ফাঁদ?

যত জোরেই হাঁটি না কেন, কী যেন এক আকর্ষণ পেছন থেকে টানছে। হাঁটার বেগ যতটা হওয়া উচিত কিছুতেই যেন তা হচ্ছে না। স্বপ্নে একবার বাঘ দেখে দৌড়াবার চেষ্টা করেছিলুম। কী ভীষণ চেষ্টা! মাটিতে পা খচমচ করছে অথচ শরীর ছুটছে না। এদিকে বাঘ এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে, মুখে তার কথামালার বাঘের মতো এক ধরনের মিচকি হাসি। পালাতে না পেরে ভ্যা করে কেঁদে ফেলেছিলুম। বাঘ সামনে এসে দু’পায়ে খাড়া দাঁড়িয়ে পড়ল। অবাক হয়ে দেখলুম বাঘ নয়, মানুষ। আমার সংস্কৃতের পণ্ডিতমশাই। চোখে নিকেল ডাটির তলতলে গোল চশমা। খপ করে ডান হাতটা আমার কাঁধে ফেলে বললেন, শাখামৃগ, ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে পার পাবি ভেবেছিস! বল লতা শব্দের প্রথমার একবচনে বিসর্গ আছে, না নেই? আমি আরও জোরে কেঁদে উঠে বললুম, বিশ্বাস করুন আমি জানি না।

তবু আমি হাতিবাগানে এসে গেলুম। বাজার এখন জমজমাট। গাছের বাজার, পাখির বাজার, জীবজন্তুর বাজার। পা থেমে পড়ল। অপর্ণা এখন অনেক দূরে। ছাদের আলসেতে ঝুঁকে আছে। মাথার ওপর সূর্যের অগ্নিগোলক জ্বলজ্বল করছে। গহনগভীর চুলের অরণ্যে ভেসে আছে একটি গোলাপের মুখ। মানুষ আবার গোলাপ হয় কী করে! গোলাপ দেখতে চাও সামনে তাকাও।

সারি সারি টবে তাজা তাজা গোলাপ ফুটে আছে। ছোট ছোট গাছে একটি করে নমুনা ফুল। সাদা, টকটকে লাল, ফিকে গোলাপি, হলদে। এর মধ্যে কোনও এক জাতির গোলাপের নাম মিস মারসেল। মানুষ পাগলের মতো কিনছে। দরদাম করছে। কঁধ দিয়ে এ ওকে ধাক্কা মারছে, ও একে। খাঁচার চন্দনা কর্কশ গলায় চিৎকার করে ক্রোধ প্রকাশ করছে। বাচ্চা দুটো বিলিতি কুকুর তিড়িং লাফাচ্ছে, আর শিশুর গলায় ডাকছে। চুলে পমেড মাখা, কাটগ্লাস চেহারার, গিলে করা হাফহাতা পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক নীল সিল্কের শাড়ি পরা এক ভদ্রমহিলাকে বলছেন, টেরিয়ারের জাতই আলাদা। তেজ দেখেছ, তেজ!

মহিলার বয়স অনেক কম, সম্পর্ক দেখে মনে হচ্ছে মেয়ে নয়, স্ত্রীও নয়। অন্য কোনও ব্যাপার। বড়লোকদের সব থাকে, জীবনদায়িনী ব্যাধি। মহিলা কুকুর ছেড়ে সোনালি রঙের একটা খরগোশের দিকে এগিয়ে গেলেন। দেকেচো, দেকেচো, কী সুন্দর!

ভদ্রলোকের ওপর-হাত খামচে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন খরগোশের কাছে। অমন খরগোশ আমিও দেখিনি জীবনে। খরগোশ সাদা হয়। এ আবার কোন জাতের জীব! ভদ্রমহিলার আকর্ষণে ভদ্রলোক টাল সামলাতে না পেরে উলটে পড়ে যাচ্ছিলেন। পায়ে বার্নিশ করা জুতো। মহিলার কোমর আঁকড়ে ধরে টাল সামলাতে সামলাতে বললেন, কী যে তুমি করো সুকু!

রাগের সঙ্গে স্নেহ, দেহবোধ মিলেমিশে মানুষের গলাটাকে কেমন করে দেয়। মহিলা চোখের অদ্ভুত ভঙ্গি করে বললেন, কোনও কম্মের নয়, একেবারে ঢ্যাঁড়োস।

আমি যেন সিনেমা দেখছি। ভীষণ মজা লাগছে। একজায়গায় কতরকমের মানুষ! একটু চিন্তা করলেই সৃষ্টিকর্তার অপরিসীম রসবোধে মুগ্ধ হতে হয়। মহিলা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলেন। আমাকেই বললেন, গায়ে এক ফোঁটা শক্তি নেই। একটানেই উলটে পড়ে যাচ্ছে।

ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে নিজের মাথার চারপাশে গোল করে হাত ঘুরিয়ে বললেন, নাটবলটু ঢিলে আছে।

ভদ্রমহিলার কানে গেল না। সোনালি খরগোশ মন কেড়ে নিয়েছে। সামনে ঝুঁকে পড়ে বলছেন, কী সুন্দর দেখো, কী সুন্দর দেখো।

সীতা যেন সোনার হরিণ দেখেছেন। মানুষ কেমন মেতে ওঠে। মন যেন ছটফটে মাছির মতো। একবার এখানে বসছে, একবার ওখানে বসহে। সোনার খরগোশের দিক থেকে সরে এলুম। ডলপুতুলের মতো ফুটফুটে একটি মেয়েকে তার বাবা নোমওয়ালা সাদা একটা কুকুরছানা কিনে দিয়েছেন। মেয়েটির কোলে সেই কুকুর। কাকে দেখি, মেয়েটিকে না কুকুরটিকে? পৃথিবীর এই প্রান্তে হাটের একটি বৃত্তে যেন স্বর্গ নেমে এসেছে।

সরতে সরতে পায়রা-পাড়ার কাছে চলে এসেছি। গাট্টাগোট্টা চেহারার এক ভদ্রলোক, ছুঁচোলো গোঁফ ঠোঁটের ওপরে কথা বলার তালে তালে নাচছে, পায়রা দর করছেন। পায়রা যে কত রাজকীয় পাখি এই প্রথম কাছ থেকে দেখে চিনলুম। দুধের মতো সাদা। আদুরে আদুরে মুখ। দৈত্যের মতো মানুষটির হাতে পায়রা যেন ঠিক মানাচ্ছে না। এ হাতে থাকবে বাজপাখি।

রংমহলের রং দেখতে দেখতে সময় যে কীভাবে হুহু করে কেটে গেল। মানুষের বরাত! রাজভোগের বদলে হরিমটর। এতখানি বেলা হল, পেটে এখনও দানাপানি পড়ল না। অনেক আগেই খিদেয় পেট জ্বলছিল, এখন পিত্তি পড়ে মুখ তেতো লাগছে। বাড়িতেও মনে হয় আহারের ব্যবস্থা থাকবে না। কিছু খেতে পারলে মন্দ হত না। সিনেমা আর বাজার পাড়ায় চপকাটলেট ছাড়া কিছু পাওয়া যাবে না।

ঝোঁকের মাথায় তেড়ে বেরিয়ে এসে কেমন যেন লাগছে এখন। খুব ছেলেমানুষি হয়ে গেল। কী ভাবলেন ওঁরা কে জানে! কী করব! পালিয়ে না এসে আমার উপায় ছিল না। যেখানে গেলে মন কুঁকড়ে যায়, সেখানে এক মুহূর্তও থাকা চলে না। ও বাড়ি আমার বাড়ি নয়। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। ছোট মাপের মন। রাজাউজির মারতে শেখেনি। আমার জগৎ আলাদা।

আমার জগৎ আলাদা, এই ভাবনা আসামাত্রই মনে বেশ একটা বল পেয়ে গেলুম। ঘিনঘিনে সেই পাপবোধটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। পতন আর উত্থান এই তো মানুষের জীবন। একবার পড়েছি। বলে পড়েই থাকব, তা কেন? আবার উঠব ঠেলে। তবে এ কথাও ঠিক, মনে এক ধরনের স্বাদ লেগেছে। জীবনে যেদিন প্রথম মাংস খেয়েছিলুম সেদিন কেমন লেগেছিল! সবকিছুরই একটা প্রথম আছে। অক্ষর পরিচয়। অ লিখতে শেখা, আ লিখতে শেখা; প্রথম একা একা পথে বেরোনো। প্রথম ইস্কুল, প্রথম কলেজ। প্রথম চুম্বন। মায়া যেদিন প্রথম আমাকে চুমু খেয়েছিল। ঘুঘু-ডাকা এক দ্বিপ্রহরে, সবুজ গাছপালা চারপাশে। কচুরিপানা ভরা পুকুর। ফড়িং উড়ছে নেচে নেচে। কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতাই ছিল না। তবু ভেতরটা ঠিক সুরেই বেজে উঠেছিল। সে ঝংকার যে কী ঝংকার, যে জানে সে জানে।

পাঁচমাথার মোড়ে এসে ঘঘাষেদের একদা-বিখ্যাত মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ঢুকে পড়লুম। সামান্য কিছু খাওয়া দরকার। নিজেকে জেল-ভাঙা আসামির মতো মনে হচ্ছে। পেছন থেকে কেউ না এসে চেপে ধরে! কী করা যায়! বড় দোটানায় পড়ে গেছি। দুটো জগৎ দু’পাশ থেকে কান ধরে টানছে। ভোগ আর ত্যাগ। কোথায় গেল আমার সেই রোম্যান্টিক মন! দেহ ঢুকেছে মনে। অপর্ণার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে দৃষ্টি আমার কোথায় ঘুরছিল! ছিঃ ছিঃ মন।

কে যেন খুব চড়া গলায় বললেন, কী খাবেন বলুন? আমাদের অন্য কাস্টমার আছে।

ও হ্যাঁ, হিং-এর কচুরি খাব।

ক’খানা?

চারখানা।

মিষ্টি?

দুটো বালুসাই।

দোকানে খুব একটা ভিড় নেই। লোকটি খুব কাস্টমার দেখিয়ে গেল। ভাবজগতে থাকলে মানুষ সহজে কিছু শুনতে পায়! আমার বলে এখন জীবনমরণ সমস্যা। মচকাব তবু দোমড়াব না। কিন্তু কীসের এ লড়াই! বিয়ে যদি করতেই হয় তা হলে করে ফেলতে দোষ কী! এমন তো কিছু গর্হিত কর্ম নয়! সকলেই করে। সংসারে থাকতে হলে সংসারীই হতে হয়। সন্ন্যাসী হতে হলে সংসার ছাড়তে হয়। ন্যাজে খেলার কোনও মানে হয় না। আর বিয়ের আগে একটু এদিক-সেদিক! বিলেতে অমন অভিজ্ঞতা সকলেরই হয়। এ দেশের বিলেত হতে বাকি কী আছে! সাজে পোশাকে, আহারে বিহারে সবেতেই সায়েবি ঢং এসে গেছে। প্রাচীনের যুগ প্রায় শেষ হয়ে এল। দোকান হলে লিখে দিত। রেন্টস ফর সেল। প্রাচীন বিশ্বাসের ঝড়তিপড়তি কিছু পড়ে আছে। জলের দামে বিকিয়ে যাবে।

তিনটে বেজে পনেরো মিনিট হল। বাড়ির সামনে দূর থেকে সেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে গেলুম। পঙ্কজবাবু ঠিক ধাওয়া করে এসেছেন। কতক্ষণ এসেছেন কে জানে। পা থেমে পড়তে চাইছে। মনে হচ্ছে, যেদিক থেকে এসেছি আবার সেই দিকেই পালাই। ভাবলে কী হবে! ঘটনা যেন অজগরের নিশ্বাস। নিশ্বাসের টানে ছাগলছানা পায়ে পায়ে এগিয়েই চলল। এই প্রথম নিজেকে মনে হল শিকার। ঘটনার শিকার, পরিস্থিতির শিকার, দুটো মনের লড়াইয়ের শিকার।

সদর দরজার পাশেই কাকিমা দাঁড়িয়ে আছেন। দরজার একটা পাল্লা ভেজানো। আর একটা ঈষৎ ফাঁক, সেই ফাঁকে চোখ রেখে কাকিমা স্থির। দৃষ্টি এতই সুদূরে, মন এমনই তন্ময়, আমি একেবারে সামনে না গিয়ে দাঁড়ানো পর্যন্ত তিনি আমার আগমন টেরই পেলেন না। চমকে উঠে বললেন, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে আমাকে ঢুকতে দিলেন, তারপর দরজা আবার ভেজিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ছিলে কোথায়? তুমি নাকি কিছু না বলে ওঁদের বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ?

পালিয়ে এসেছ শব্দটা কানে বড় কর্কশ লাগল। মনে হল বলি, বেশ করেছি। আমি কি কারুর বন্দি পাখি? বলতে পারলুম না। সামনে যে-মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছেন। মুখে বলার সাহস নেই, মন বলছে, আমি তোমার জন্য বড় বিচলিত। একে ভালবাসা বলা যায় কিনা জানি না। হয়তো যায় না। শীতের সকালে উষ্ণ জল অথবা নরম আঁচের রোদ যেমন। মনের ভেতর একটা আমেজ তৈরি করে দেয়, তুমি সামনে এলে আমার সেইরকমের একটা সুখসুখ অনুভূতি হয়। খুব বিশাল একটা ঘরে সার সার ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে। লম্বা খাবার টেবিলে সুদৃশ্য চিনামাটির প্লেটে অদ্ভুত সব ভোজ্য সামগ্রী। বাদামি রঙের রোস্ট করা মুরগির ঠ্যাং, ফিকে হলুদ পুডিং, তার ওপর কাঠি গোঁজা লাল একটি চেরি ফল। পালতোলা গেলাসে স্বচ্ছ লাল পানীয়, রুপোর পাত্রে সরু চালের হালকা হলুদ বিরিয়ানি। জাফরানের রং, জায়ফল আর আতরের সুবাস। দু’খণ্ড করা লাল বেদানার দানা, খোলো থোলো আঙুর, পালিশ করা আপেল, দূরে কোথাও কোনও ঝরনার ফিনিক ফিনিক শব্দ। তোমাকে দেখলে আমার কেন জানি না এইসবই মনে পড়ে। বড় ভোগের ইচ্ছে হয়। কৃশকায় এক সন্ন্যাসীকে চোখে হাত চাপা দিয়ে চলে যেতে দেখি। তাকে আর ফেরাতে ইচ্ছে করে না। বিশাল আকাশের চেয়ে কূপকেই সুখের মনে হয়। আগুন জ্বলে। সে আগুন হোমের নয়। যে-আঁচে মশলা-মাখা মুরগি ধীরে ধীরে বাদামি হতে থাকে, সেইরকম কোনও কাবাবের আঁচ।

মহিলা আমার দুধে হাত রেখে শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন, কী হয়েছে তোমার?

চমকে উঠে বললুম, না কিছু হয়নি। আমার কি ওপরে যাওয়া উচিত, না সরে পড়ব?

সরে পড়বে কেন? ওঁরা দুজনেই ভীষণ চিন্তায় আচ্ছন্ন। তুমি এখুনি ওপরে যাও।

ফাঁসির আসামি যেভাবে বধ্যভূমির দিকে এগোয় আমি সেইভাবে ওপরে উঠে গেলুম। ভাবতে লাগলুম, কীভাবে আমার কাহিনিকে সাজাব। বিশ্বাসযোগ্য একটা কিছু বলতে হবে। মিথ্যেকে করে তুলতে হবে সত্যি।

সকালের সেই পোশাকে পঙ্কজবাবু বসে আছেন সোফায়। আমি পেছন থেকে দেখছি। বাতাসে চুল এলোমেলো। ঘরে পিতৃদেব নেই। দেয়ালে প্রায় নিঃশব্দে ঘড়ির দীর্ঘ পেন্ডুলাম সময়ের রেখা টেনে চলেছে।

আমি অবাক হয়ে দেখছি। এমন সময় ভেতরের ঘর থেকে পিতা বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন, চলো তা হলে, আর দেরি করে লাভ নেই। নিশ্চয় কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।

কোঁচার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন। মুখ তুলেই আমাকে দেখতে পেলেন। মুখের চেহারা একবারে পালটে গেল। মনেই হল না কঠোর একটি পুরুষের মুখ। স্নেহের নরম ছায়া নেমেছে। মা যেন যুদ্ধ-ফেরত সন্তানকে দেখছেন। অদ্ভুত গলায় বললেন, তুমি এসেছ!

পঙ্কজবাবু ধড়মড় করে ঘাড় ফেরালেন। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

পিতা বললেন, ওকে আগে ভেতরে আসতে দাও। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে খুব বিপদে পড়েছিল।

পঙ্কজবাবু এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলেন, কী হয়েছিল বাবা?

সত্যি কথাই মুখে আসছিল। চাপা অভিমানে আমি পলাতক হয়েছিলুম। স্টেটাসে মিলবে না বলে সরে যেতে চেয়েছি। বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা মানায় না। বলা গেল না, কিছুতেই বলা গেল না। পরিবারের বাইরে এই মানুষটি একেবারে আমাদের মতো, যেন আর এক পিতা। মৃদু গলায় বললুম, আমার ভীষণ বড়বাইরে পেয়েছিল।

অ্যাঁ, সেকী? তা তুমি কী করলে?

আমি তিরবেগে বেরিয়ে এলুম। প্রাণপণে চেষ্টা করলুম বাড়ি আসার। হল না। শেষে কলেজে চলে গেলুম। সেখানে কোনওরকমে, এই আর কী?

আমাদের বাড়িতে সাত-সাতটা বাথরুম, তুমি তিরবেগে ছুটলে, একবার বললে না?

আমার বলতে ভীষণ লজ্জা করল।

পিতা বললেন, হি ইজ এ ফুল। পঙ্কজ, এই হল বাঙালি। বাইরের জগতে নিজেকে এমনভাবে প্রোজেক্ট করতে চায়, যেন দেবতা। মানুষও যে অ্যানিম্যাল, তারও যে আহার, নিদ্রা, মৈথুন আই অ্যাম সরি, রিয়েলি আই অ্যাম সরি, এক্সকিউজ মাই ল্যাঙ্গোয়েজ।

পঙ্কজবাবু বললেন, তুমি একবার বললে না কেন বাবা? ইস কত কষ্ট পেলে।

ও প্রশ্ন আর নাই বা করলে পঙ্কজ। লজ্জা, লজ্জা। লজ্জা নারীর ভূষণ কিন্তু পুরুষের? পুরুষের ইডিওসিনক্রেসি। একবার ঠিক এই কাণ্ড করেছিল আমাদের অফিস-রিক্রিয়েশন ক্লাবের ফাংশনে গিয়ে। আমি ডায়াসে অরকেস্ট্রার সঙ্গে এসরাজ বাজাচ্ছি। মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছি, বেশ বসে আছে সামনের সারিতে। হঠাৎ দেখি নেই। ভাবলুম ছোটবাইরে করতে গেছে। অনুষ্ঠান শেষ। তবু বাবুর পাত্তা নেই। খোঁজ খোঁজ। কাকস্য পরিবেদনা। পরের দিন পনেরো টাকা ফাইন দিয়ে বাবুকে ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে খালাস করে আনলেন আমার শ্বশুরমশাই। পুলিশ পাঁচ লাইনে চালান করে দিয়েছিল। লজ্জা!

পঙ্কজবাবু বললেন, কীসের লজ্জা! আমাদের বাড়িতে তোমার কীসের লজ্জা! তুমি তো ব্যাটাছেলে! আজকাল মেয়েরাই উদোম হয়ে ফিরিঙ্গি নাচ, আই অ্যাম সরি। এক্সকিউজ মাই ল্যাঙ্গোয়েজ।

পিতা বললেন, কীসের লজ্জা, শুনবে? সব খুলে গামছা পরে…।

গামছা পরবে কেন? তোয়ালে, তোয়ালে পরবে।

আরে তার চেয়েও বড় কথা, যে-মানুষ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়, ওর ব্যাখ্যায় সে মানুষ মানুষই নয়, জন্তু। যাক কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ওকে ছেড়ে দাও। একটু সাফা হয়ে আসুক। অশুদ্ধ হয়ে আছে।

হ্যাঁ বাবা যাও, চট করে সেরে এসো। ওরা সব না খেয়ে তোমার জন্যে হা করে বসে আছে। পঙ্কজবাবুর কথা শুনে মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। আবার যেতে হবে! মিউমিউ করে বললুম, আবার যেতে হবে!

বাঃ যেতে হবে না! তুমিই তো সব। তোমার জন্যেই তো সব আয়োজন!

পঙ্কজবাবু বললেন ভাল। তবে বিশ্বাসযোগ্য নয়। আয়োজন আমার জন্যে নয়। উপলক্ষ ভায়রাভাই। এক ঢিলে দু’পাখি মারা হচ্ছে। তবু বলেছেন, এই যথেষ্ট। এসে বসে আছেন কতক্ষণ! সেও তো কম কথা নয়! নিজের বোকামির জন্যে সকাল গেল, দুপুর গেল, এইবার রাতটাও যেতে বসেছে। পেটে হিং-এর কচুরি ঠেলেঠেলে উঠছে। এই অসময়ে আর কি কিছু ভালমন্দ খাওয়া যাবে!

পঙ্কজবাবুর খুরথুরে গাড়ি আবার কলকাতামুখো। আবার সেই মনস্তত্ত্ব। দু’হাতে স্টিয়ারিং। দু’চোখ রাস্তায়। মুখে ক্লান্তির ছায়া। আমাকে বললেন, বুঝলে, তোমার মন আমি বুঝে ফেলেছি। তুমি সত্যি কথা বললে না। আসলে তোমার অভিমান হয়েছে। বলল, ঠিক ধরেছি কি না! এইবার তুমি সত্যি বলো!

পঙ্কজবাবুর কথা শুনে গলা শুকিয়ে এল। মিথ্যে কীভাবে ধরা পড়ে যায়! পাপ অনেকটা পক্সের মতো। গায়ে গুটি বেরোয়। অভিজ্ঞ মানুষ দেখেই ধরে ফেলেন। পঙ্কজবাবু তন্ময় হয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসিটি লেগে আছে। ইনি এক অন্য জাতের মানুষ। পাকা পিচফলের মতন নরম। ভেলভেটের মতো মন। এঁর সঙ্গে খোলাখুলি কথা হয়ে গেলে ক্ষতি কী! আবার একটা জটিল অবস্থার মধ্যে পড়ার চেয়ে, মনে যা হয়েছে তা বলে ফেলাই ভাল।

বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি ধরেছেন ঠিক, আমি সত্যি কথা বলিনি। বলার সাহস হয়নি।

তুমি ওভাবে তা হলে পালিয়ে এলে কেন?

আমার মনে হল—

মনে হল, বলে থেমে পড়তে হল। ভাষায় কুলোচ্ছে না। এমন কিছু শব্দ চাই যা বেশ ভদ্র, নরম অথচ স্পষ্ট।

বলো, কী তোমার মনে হল? আমরা খারাপ লোক?

আজ্ঞে না। ছি ছি, খারাপ লোক কেন হবেন! আপনারা অসাধারণ। সেই তুলনায় আমি ভীষণ সাধারণ। আমার মনে হল, আপনাদের পরিবারে আমি একেবারেই মিসফিট।

মিসফিট? এমন মনে হবার কারণ!

আপনারা ধনী। আপনাদের আত্মীয়স্বজন সব বড় বড় ব্যক্তি, জীবনে কত সুপ্রতিষ্ঠিত! সেই তুলনায় আমি একটা বোগাস। জীবনে খুব বেশি দূর ওঠার যোগ্যতাও আমার নেই। এইরকম একটা মিডিয়োকার ছেলে ও পরিবারে অচল।

এই তোমার ধারণা?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমরা তা হলে তোমাকে আপন করে পেতে চাইছি কেন?

ঠিক জানি না। ধরতে পারছি না বলেই আশ্চর্য হচ্ছি।

তুমি খুব মেটিরিয়ালিস্ট!

একেবারেই না।

তা হলে তুমি ও রাস্তায় ব্যাখ্যা খুঁজতে যাচ্ছ কেন?

আজ্ঞে ওইটাই তো পৃথিবীর রাস্তা। জীবনের রাজপথ।

রাজপথের পাশে পায়ে-চলা পথও থাকে যে-পথে তীর্থযাত্রীরা যাওয়া-আসা করে।

পঙ্কজবাবু গাড়িটাকে হেদোর ডান পাশে নির্জন একটা রাস্তার ধারে দাঁড় করালেন। ইঞ্জিন বন্ধ। হয়ে গেল। একপাশে সার সার বাড়ি, বাগান। আর একপাশে বড় বড় গাছ। দেবদারু, কৃষ্ণচূড়া। বিকেলের আলো মরে আসছে। ঝক ঝক পাখি কিচিরমিচির করছে। ডাইভিং বোর্ড থেকে মাঝে মাঝে এক-একজন জলে ঝাঁপ মারছে। শব্দ হচ্ছে ঝপাং।

স্টার্ট বন্ধ করে পঙ্কজবাবু আমার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। কাল রাতে সদ্য-পাওয়া মুখের কাটা দাগ আমার ভেতরটাকে কেবলই সামনে ঠেলে দিতে চাইছে আর আমি ক্রমশই কুঁকড়ে যাচ্ছি। পঙ্কজবাবু হঠাৎ খপ করে আমার হাতদুটো চেপে ধরলেন। হাত কাঁপছে। ভদ্রলোক যে-কোনও কারণেই তোক উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।

চাপা গলায় বললেন, তোমাকে আমি ধরে ফেলেছি।

ধরে ফেলেছি বলায় ভীষণ ভয় পেয়ে গেলুম। কী ধরে ফেলেছেন! আমার মন, আমার চিন্তা! বলা যায় না। কোনও কোনও মানুষের ভীষণ শক্তি বাড়ছে। পঙ্কজবাবুর পরের কথায় ভয় কেটে গেল।

তুমি গ্রহণ করেছ।

কাকে?

আমার মেয়ে অপর্ণাকে। তার ওপর তোমার একটা অধিকারবোধ জন্মেছে। বলো ঠিক কি না?

আজ্ঞে তা কী করে হয়?

হয়, খুব হয়, তা না হলে তোমার অভিমান হত না। আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। শোনো, অর্থ, কেরিয়ার এসবের প্রয়োজন আছে, তবে সব নয়, সবার ওপরে হল বংশ, কৌলীন্য, চরিত্র। প্রাচীনকালে গৌরীদানের প্রথা ছিল। যুগ পালটেছে। পালটালেও, যোলো থেকে আঠারোর মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া উচিত। জানো তো, প্রবাদ আছে মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি হয়ে যায়। ছেলেদেরও পঁচিশের মধ্যে বিয়ে দেওয়া উচিত। এই তো সেই বয়েস। স্বপ্ন দেখার বয়েস, রোমান্সের বয়েস, ঘর বাঁধার বয়েস, আনন্দ করার বয়েস, দুঃখ সহ্য করার বয়েস। তোমার ঠাকুর বলতেন, হাঁড়ি যতক্ষণ কঁচা, তলতলে, ততক্ষণই তার গায়ে আঁকিবুকি চলে। পেকে গেলে পুড়ে গেলে আর কিছু চলে না। তুমি ওই বিলিতি বস্তু দেখে ভয় পেয়ো না। ওরা আমাদের ঘন্টাকয়েকের অতিথি। আমরা ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের আদর্শ আলাদা। তুমি একটু হাসো। তোমার সেই হাসিহাসি মুখ ফিরিয়ে আনন।

আমাকে হাসতেই হল। পঙ্কজবাবু সত্যিই আমাকে ধরে ফেলেছেন। গাড়ি স্টার্ট নিয়ে আবার রাস্তায় ভেসে পড়ল। উনি গুনগুন করে গান ধরেছেন, পাগলা মনটারে তুই বাঁধ। সেই বিশাল বিশাল থামওলা শ্বেতপাথরের মতো শুভ্র বাড়িটি ক্রমশই এগিয়ে আসছে। গাড়ি এগিয়ে গিয়ে গাড়িবারান্দার তলায় দাঁড়াল। সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছে অপর্ণা, বাবা, খুঁজে পেয়েছ, খুঁজে…একটি মুখ ঝুঁকে এল জানলার কাছে। সুন্দর এক সুবাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *