2 of 3

২.২৩ If your only tool is a hammer

If your only tool is a hammer, then all your problems look like nails.

অসহায় শিশুটির মতো সদরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম মুকুর চলে যাওয়া। বিলিতি সুটকেস হাতে সোজা হেঁটে চলেছে রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে। মনে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে জাপটে ধরি পেছন দিক থেকে। শিশু যেভাবে জড়িয়ে ধরে মায়ের কোমর। জীবনের অক্ষমতা কাঁদিয়া করিব নিবেদন,/মাগিব অনন্ত ক্ষমা। হয়তো ঘুচিবে দুঃখনিশা,/তৃপ্ত হবে এক প্রেমে জীবনের সর্বপ্রেমতৃষা। অভিমান এক দুর্ভেদ্য পাঁচিল। মুকু রিকশায় উঠে বসল, পায়ের কাছে সুটকেস, দু’হাতে হাতলটা ধরে রেখেছে সামনে সামান্য ঝুঁকে। চওড়া পিঠ। আকাশি রঙের ব্লাউজ। এলো খোঁপা। তাকানো মাত্রই ভেতরের নিবে-আসা আগুন আবার জ্বলে উঠল। অসম্ভব! মুকুকে ছাড়া আমার জীবন শূন্য, অর্থহীন। সিঁড়ি-ছাড়া বহুতল বাড়ির মতো। রিকশা চলতে শুরু করামাত্রই আমি ছুটতে শুরু করলুম। একটা সাইকেল পেছন দিক থেকে আমাকে প্রায় ধাক্কা মেরেই চলে গেল। রিকশাটাকে থামালুম।

মুকুর হাতটা চেপে ধরলুম। গায়ে হাত রেখেই বুঝলুম, মুকুর বেশ ভালই জ্বর হয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নাকের ডগায় মতিচুরের মতো ঘামের বিন্দু। মধ্যদিনের দীপ্ত সূর্য ঝলসে দিচ্ছে চারপাশ।

মুকু দাতে দাঁত চেপে বললে, রাস্তায় নাটক কোরো না। ইচ্ছে থাকলে অনেক আগেই আমাকে আটকাতে পারতে!

ভেতর থেকে একটা হাহাকার বেরিয়ে এল, আমার কেউ নেই মুকু। তুমি ছাড়া।

রিকশার চালক সিটে বসে আছে একটু তেরছা হয়ে। প্রবীণ মানুষ। আমার চেনা। নাম, জগাদা। জগাদা আড়চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। হঠাৎ বললে, কাজটা ভাল হচ্ছে না।

কোন কাজ! প্রশ্ন করার সময় নেই। মুকু বললে, হাত ছাড়ো। বেরিয়ে যখন পড়েছি আর ফেরাতে পারবে না।

ওই ভদ্রলোকের ব্যবস্থা আমি করছি।

কিছুই করতে পারবে না, কারণ লাঠি ছাড়া তুমি চলতে পারবে না। মনের দিক থেকে তুমি পঙ্গু।

জগাদা বললে, তা হলে আমি চালাই!

মুকু বললে, হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন। এখুনি লোক জড়ো হয়ে যাবে।

রিকশার চাকাটা আমার পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল। মুকু একবার ফিরে তাকাল না! এই হয়। এরই নাম জগৎ। এরই নাম দুনিয়াদারি! সামান্য পান থেকে চুন খসলেই সব সম্পর্ক ফরদাফাঁই। মুকুর যত রাগ আমার ওপর। এই কি রাগ করার সময়! বেশ রাগই না হয় করলে, তা বলে ছেড়ে চলে যাবে? সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। রাজপথ নির্জন। খাঁখা রোদ। বন্ধ দোকানের রকে ছায়ায় শুয়ে হাহা করছে একটা কুকুর। অসহায় অনাথ বালকের মতো দাঁড়িয়ে আছি আমি। পায়ের পাতার ওপর দিয়ে রিকশা চলে গেছে। জ্বালা করছে ভীষণ। আশ্চর্যই বটে। হায় মন, পিতা হরিশঙ্কর চলে যাওয়ায় এতটা অসহায়বোধ করিনি। হঠাৎ শূন্য মনে ভেসে উঠল একটা কবিতা :

বাসনার লক্ষ্যে তুমি যাত্রী? তবে থেমো না নিখিলে,
স্বয়ং লাইলি যদি সঙ্গী হয় বোসো না মহফিলে।
তুমি ঝরনা বয়ে চলো, তূর্ণগতি নদী হও তুমি,
তীর যদি পাও, তবু ছুঁয়ো নাকো সেই তীরভূমি।
হারিয়ে যেয়ো না, তুমি এ বিশ্ব-মন্দির মাঝে কোথা,
চিরমুক্ত তুমি বন্ধু, আসরেতে বোসো না অযথা।

কুকুরটা হঠাৎ ঝাড়াঝুড়ি দিয়ে রক থেকে নেমে এসে, আমার সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল পুটুসপুটুস করে। এই তো আমার ব্যথার ব্যথী। চিনতে পেরেছে। একজন ফেরিঅলা ধুঁকতে ধুঁকতে চলে গেল আমার পাশ দিয়ে। কোনওরকমে হাঁকছে, পানি ফলঅ, পানি ফলঅ।

ধীরে ধীরে ফিরে এলুম বাড়িতে। দোতলায় উঠতেই অক্ষয় কাকাবাবু বললেন, অতটা নরম হোয়ো না। পেছন পেছন ছোটার প্রয়োজন ছিল কি?

একজন না খেয়ে এই ভরদুপুরে চলে যাচ্ছে!

তাতে কী? ডোন্ট মেক ইয়োরসেলফ সো চিপ।

পিতা হরিশঙ্করও ঠিক এই কথাই বলতেন; কিন্তু তার একটা বিশাল হৃদয় ছিল। মানুষের দুঃখ বুঝতেন। অসহায়কে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। কারওকে অপদস্থ করতেন না। রাজসিক অহংকার ছিল। তামসিক নয়। আমার সামনে শ্মশ্রুমণ্ডিত ছ’ফুট যে দৈত্যটি পঁড়িয়ে আছেন, তাঁকে চেনা খুব কঠিন।

আমি নীরবে সরে এলুম। হুড়হুড় করে অক্ষয় কাকাবাবুর চান শুরু হল। সঙ্গে সংস্কৃত স্তোত্র। ভারী গলার আওয়াজে বাড়ি কাঁপতে লাগল। প্রবল একটা শক্তি। সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল আহার-পর্ব। সে এক বিশাল ব্যাপার। ভদ্রলোক একাহারী। সেই কারণে– সবই বেশিবেশি। ডাল-ভাতের তাল দেখে মাথা ঘুরে গেল। যেন ছোট মাপের একটা বল। এই সেই মানুষ, যিনি আগে নিমন্ত্রণ বাড়িতে এক বালতি পোলাও অক্লেশে মেরে দিতেন। তারপর সারারাত ছাদে চিত হয়ে শুয়ে মুখে ড্রপারে করে ফোঁটা ফোঁটা জল ঢালতেন। জলের মাত্রা বেশি হলে পেট ফেটে যাবে। পিতা হরিশঙ্কর বলতেন, এইভাবেই একদিন অকালে মরবে, বেশি খেতে চাও তো কম খাও, আর কম খেতে চাও তত বেশিই খাও! খাওয়াটাই অক্ষয় কাকাবাবুর বীরত্ব।

আমিও বসেছি, কিন্তু মুখে কিছু তুলতে পারছি না। দিদির কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে মুকুর কথা। মেয়েটা কেমন একা একা চলে গেল! সকাল থেকে একফোঁটা জলও তার মুখে পড়েনি। কোথায় গেল? আবার কি সেই হস্টেলে? না কোনও বন্ধুর বাড়িতে? কে এক সত্যেনের নাম কয়েকবার তার মুখে শুনেছি। সহপাঠী। জমিদারের ছেলে। আলিপুরে বাগানবাড়ি। তার ঠাকুরদা ছিলেন বিখ্যাত শিকারি। সত্যেনের বাবা একালের একজন বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। মুকু কি সেই সত্যেনের বাড়িতে গেল! একটু যেন প্রেম-প্রেম ভাব আমার মনে হয়েছিল। তা না হলে সত্যেনের অত প্রশংসা করবে কেন? যিশুর মতো রূপ। শিশুর মতো মন। ভাল না বাসলে মানুষ মানুষের নির্ভেজাল প্রশংসা করতে পারে না। মুকু ইদানীং আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল।

কেবল তিরস্কার আর তিরস্কার। আমার সবই খারাপ। কাকাবাবু বিশাল একটা উদগার তুলে বললেন, দেহ আর মন। দুটোকে আলাদা আলাদা রাখার চেষ্টা করবে। দেহের এক ধর্ম, মনের এক ধর্ম। এখন দেহের ধর্ম পালন করো। রাতে কোনও খাবার জুটবে না। শ্মশানেই কাটবে। এখন একটু চেষ্টা করে খেয়ে নাও। মেয়েরা এক মোহ। শরীর নষ্ট করার শ্রেষ্ঠ কল। তোমাকে পেতনিতে ধরেছিল।

আর আমার বসতে ইচ্ছে করল না মানুষটির সামনে। এখনই হয়তো কঠিন কোনও কথা বলে ফেলব। বয়সের সম্মান রাখতে পারব না। থালা নিয়ে ঝ করে উঠে পড়লুম। ধ্যাততেরিকা খাওয়া! এই ভদ্রলোকই আমাকে গৃহছাড়া করবেন। উঠে দাঁড়ালুম। হাঁটুতে খট করে একটা শব্দ হল।

অক্ষয় কাকাবাবু সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য করলেন, শনি। তোমার কোষ্ঠীটা একবার ভাল করে দেখতে হবে। মনে হয় শনির দশা চলেছে। নীচস্থ শনি। জয়েন্টের শব্দ। মানে দারিদ্র্য আসছে। সব যাবে এইবার। ধন-জন-গৃহসুখ। ঘোর অমানিশা আসছে এইবার।

এ তো অভিশাপ! আমার হাত থেকে থালাটা পড়ে গেল। ভাত তরকারি সব ছিটকে গেল। কিছু পড়ল কাকাবাবুর পাতে। ভদ্রলোক চমকে উঠেছেন, একী? ইচ্ছে করে ফেললে? আমার খাওয়াটা নষ্ট করে দিলে।

কোনও উত্তর না দিয়ে আমি সোজা ঘরের বাইরে। মুকুর নীল শাড়িটা তারে ঝুলছে। শাড়িটা সে ফেলে গেছে। কাকাবাবু ঘর থেকে হেঁকে বললেন, জায়গাটা তো পরিষ্কার করা দরকার।

একটু রাগের গলাতেই বললুম, যথাসময়ে হবে।

কাঁধে একটা গেরুয়া রঙের ভিজে গামছা ফেলে তিনি বেরিয়ে এসে বললেন, এখন বুঝতে পারছি হরিদা কেন পালিয়ে গেলেন! কারণটা তুমি। তোমার তমোগুণই তাকে গৃহছাড়া করেছে।

নিজের সংযমে নিজেই অবাক। কোনওরকম মন্তব্যই আমার মুখ দিয়ে বেরোল না। শুধু বললুম, বসুন, আমি আপনার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

কোনও প্রয়োজন নেই। ভদ্রলোক বেশ রাগতভাবেই চলে গেলেন। মনে মনে বললুম, যা, যেখানে খুশি যা, আর জ্বালাসনি। বলেই মনে হল, অন্যায় করেছি। পিতার বন্ধুকে অসম্মান করার অধিকার নেই আমার। যা হচ্ছে সবই হচ্ছে তার ইচ্ছায়। এই খেলায় আমি এক দর্শক মাত্র। এদিক-ওদিক তাকিয়ে মুকুর শাড়ির আঁচলটা হাতের মুঠোয় ধরেই ভয়ে ভয়ে ছেড়ে দিলুম। দূরের তামাটে আকাশে তিনটে চিল উড়ছে। আকাশের আঁচলের আড়ালে যে-ঈশ্বর লুকিয়ে আছেন, তাঁকে বললুম, আমার মুকুকে ফিরিয়ে দিন, সে যে আমার মায়ের মতো। কে আমাকে শাসন করবে প্রতি মুহূর্তে! হেসে ফেললুম মনে মনে, হরিশঙ্কর নয়, ফিরে আসুক মুকু! মুকুর জন্যে প্রাণ যত কাঁদছে, পিতার জন্যে কই কাঁদছে না তো! মুকুর হাত ধরে পিতাকে খুঁজে পেতে চাই।

এমন যদি হত, পিতা হরিশঙ্কর হঠাৎ ফিরে এলেন, সন্ন্যাসীর সাজে। দেহ বীরের মতো, মুখ প্রেমিকের মতো। আমি আর মুকু দু’জনে এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি হাসিমুখে দু’হাত বাড়িয়ে বলছেন, এসো এসো। আমি তো এই ভবিষ্যৎই চেয়েছিলুম। তোমরা সুখী হও। তোমাদের সুখই আমার সুখ।

নীচে গভীর গম্ভীর গলায় কে যেন বললেন, হরি নারায়ণ।

কী ব্যাপার! স্বপ্ন বাস্তব হতে চলেছে বুঝি! দুদ্দাড় করে নেমে গেলুম। এক এক লাফে ডবল সিঁড়ি। সদর দরজা মনে হয় খোলাই ছিল। টকটকে গেরুয়াধারী এক সন্ন্যাসী। চাঁপাফুলের মতো গায়ের রং। অবাক হয়ে গেলুম। সেই হরিদ্বারের সন্ন্যাসী। যার শরীর থেকে পবিত্র হোমের গন্ধ বেরোয়। বহুক্ষণের সাধ্যসাধনায় যাঁর কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হয় একটিমাত্র কথা, হরি নারায়ণ। সেই কতকাল আগে এসেছিলেন, মাতামহের মৃত্যুকালে। চেহারা সেই একই রকম আছে। বয়স যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রণাম করামাত্রই মাথায় হাত রাখলেন আমার। সারাশরীর যেন অবসন্ন হয়ে গেল। আলসার-এর পেটে শীতল দুধ পড়লে যেমন স্নিগ্ধ একটা অনুভূতি হয় সেইরকম হল। তাপিত প্রাণে করুণাধারার মতো নীরব আশীর্বাদ। মনে হচ্ছিল, পায়ে মাথা ঠেকিয়ে পড়ে থাকি যতক্ষণ পারি। আর উঠব না। হিমালয়ের কোলে এইভাবেই শুয়ে থাকি। ভব-রোগ-বৈদ্য এসেছেন কৃপা করে।

সাদরে তাকে নিয়ে এলুম ওপরে। পায়ে সেই পরিচিত গেরুয়া রঙের ন্যাকড়ার জুতো। জুতোজোড়া একপাশে খুলে রেখে ঘরে ঢুকলেন। তাড়াতাড়ি একটা কম্বলের আসন বিছিয়ে দিলুম চেয়ারে। তিনি বসলেন। এদিক-ওদিক তাকালেন জ্যোতির্ময় মুখে। গেরুয়া কুর্তার পকেট থেকে একটা প্যাড আর পেনসিল বের করে লিখলেন কী সব। বুঝলুম মৌনী হয়েছেন। লেখাটা আমার হাতে দিলেন। পরিষ্কার ইংরেজি ইউ আর গোয়িং থু এ ক্রাইসিস।

ইয়েস। লেখাটা এগিয়ে দিলুম তাঁর দিকে।

লিখে লিখেই আলাপ চলল। প্রশ্ন করলুম, হিমালয়ের কোনও তীর্থে আমার পিতাকে কি দেখেছেন?

ওভাবে তো দেখা হয় না। বিশাল জায়গা। বেশিরভাগ সময় আমি আমার ডেরাতেই থাকি।

আমার পিতা কি ফিরে আসবেন? তিনি কি জীবিত আছেন?

সংসার যে ছেড়ে যায়, মুক্তজীবনের স্বাদ যে একবার পায়, সে কি আর বদ্ধজীবনে ফিরতে চায়!

সাধুজি, আমি তা হলে কী করব?

তুমি তার আদর্শের প্রদীপটি ধরে রাখো। দেখো যেন নিবে না যায়!

সন্ন্যাসী লিখলেন : Observe what a man has in mind to do when his father is living, and then observe what he does when his father is dead. If for three years, he makes no changes to his fathers ways, he can be said to be a good son–Confucious.

অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলুম তার লেখাটির দিকে। পিতা যতদিন জীবিত, লক্ষ রাখো তার সন্তানের দিকে। তার মনের গতির দিকে। এইবার দেখো, তার পিতার মৃত্যুর পর সে কী করছে! যদি দেখা যায় টানা তিনটি বছর সে তার পিতার ধারা থেকে একটুও সরে আসেনি, তখনই বলা যাবে সে সুসন্তান।

কে এই সন্ন্যাসী! এঁর কোনও পরিচয়ই আমার জানা নেই। সামান্য সন্ন্যাসী নন। প্রভূত জ্ঞানী। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন। আমি একটু থমকে গেছি। পিতা জীবিত। আমি কী করতে চেয়েছি? ভোগ। দেহভোগ। যৌবনের নীচ আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি খুঁজেছি। দেহের বন্ধ কাঁচের জানলায় ডুমো মাছির মতো অবিরত ধাক্কা খেয়েছি। আর তিনি চলে যেতে-না-যেতেই তার ধারা, তার আদর্শ লোপাট করে দিয়েছি। এর নাম সুসন্তান! এ তো একটা রাসকেলের জীবন বৃত্তান্ত!

সন্ন্যাসী হাতের আঙুল তুললেন। চিন্তার আবর্ত স্থির হয়ে গেল। বোধহয় অভয় দিতে চাইলেন। বলতে চাইলেন হতাশ হয়ো না। তিনি হাত বাড়িয়ে প্যাডটা আবার টেনে নিয়ে স্থির হাতে লিখেছেন, When you make a mistake, do not be afraid of mending your ways.

ঠিক ধরে ফেলেছেন আমার চিন্তা কোন পথে ছুটছে। অদ্ভুত তন্দ্রালু চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আপনমনে আমার দিকে। পাঞ্জাবির পকেটে আবার হাত ঢোকালেন। বেরিয়ে এল শুকনো একটা ফল। ফলটা আমার হাতে দিয়ে ইশারায় বললেন, খেয়ে ফেলো।

আমি প্রথমটায় একটু ইতস্তত বোধ করেছিলুম। খাব? সন্ন্যাসী-প্রদত্ত ফল! যদি কিছু হয়ে যায়। বলা তো যায় না। যা থাকে বরাতে! মুখে ফেলে দিলুম। অপূর্ব স্বাদ। ক্ষীরের মতো গলে গেল। সুন্দর গন্ধ। প্রশ্ন করার আগেই সন্ন্যাসী লিখলেন, এর নাম অমৃত ফল। হিমালয়ের একটি মাত্র অঞ্চলে হয়। একমাত্র সাধু-সন্ন্যাসীরাই যেতে পারেন সেখানে। অনেক প্রতীক্ষায় পাওয়া যায়। এই ফল মানুষের মনে একটা সাইকোলজিক্যাল পরিবর্তন আনে। বিষণ্ণতা দূর করে। কুভাব আসতে দেয় না। ঈশ্বরের চিন্তা করো। কথাটা বলা সহজ, শোনা সহজ, করা শক্ত। একমাত্র অ্যামবিশন হওয়া উচিত, আমি হব, কী হব, কেমন হব?

Like bone cut, like horn, polished,
Like jade carved, like stone ground.

কাগজের লেখা ক্রমশই বাড়ছে। ক্রমশই দুর্লভ হয়ে উঠছে আমার সংগ্রহ। আকাঙ্ক্ষা তো আছেই আমার। সংস্কার যাবে কোথায়! আসলে সঙ্গদোষ। ঘেরাটোপে মানুষ। মাতামহ ঠাট্টা করে কতদিন বলেছেন, তুলোয়-রাখা আঙুর। মাকে পাইনি। ছেলেবেলা থেকেই যেসব মহিলার সংস্পর্শে এসেছি, তারা প্রায় সকলেই ছিলেন দেহল। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তারা আমার মধ্যে বিকৃত রুচি তৈরি করে দিয়ে গেছেন। তাঁদের আলাপ-আলোচনা, দেহ-প্রদর্শন উঠতি বয়সের একটা ছেলের পক্ষে ক্ষতিকারকই ছিল। নিজের দুর্বলতা আমি জানি। শত্রু আমার অচেনা নয়। পরাভূত করতে পারি, কিন্তু শত্রুকে আমি ভালবেসে ফেলেছি গোলাপি নেশার মতো। মদ ক্ষতিকারক জেনেও লোকে মদ খায়।

সন্ন্যাসী আবার প্যাড টেনে নিয়ে লিখলেন। লেখাটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে,

A blemish on the white jade
Can still be polished away.

আমি তার দিকে তাকালুম। করুণা ঝরেছে চোখে। প্রশ্ন করলুম, আমার কিছু হবে?

তিনি সঙ্গে সঙ্গে লিখলেন, Heaven is author of the virtue that is in you.

কী অপূর্ব কথা! আমি হা করে তাকিয়ে রইলুম লেখাটার দিকে। যে-গুণ আমার মধ্যে রয়েছে তার লেখক হলেন ঈশ্বর। অথবা ঈশ্বরই আমার মধ্যে লিখবেন আমার গুণাবলি। অথবা যে-গুণ আমার মধ্যে আছে তার বিকাশ ঘটাবেন তিনি। তাকে ধরতে হবে। কেমন করে মন যাবে তার দিকে?

উত্তরে সন্ন্যাসী লিখলেন, সাইলেন্ট প্রেয়ার। কৃপা করো, কৃপা করো। জপই একমাত্র পথ। নাম জপ। ঈশ্বর আর নিয়তি দুটোকেই বোঝার চেষ্টা করো। ঈশ্বরের মর্জি বুঝতে হলে বুঝতে হবে, কেন তার এমন ইচ্ছে হল! কেন তিনি করলেন এমন? আর নিয়তিকে বুঝতে হলে জানতে হবে, আমাদের জীবনের অনেক কিছুই নিয়তির এক্তিয়ারে। নিয়তির হাতে যা, তার পেছনে না-ছোটাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। জন্ম আর মৃত্যু নিয়তির হাতে, ধন, মান, মর্যাদা, মোক্ষ ঈশ্বরের হাতে।

এতক্ষণ খুব আন্তরিক একটা নাসিকা-গর্জনের শব্দ আবহসংগীতের মতো আমাদের ঘিরে ছিল, হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। পাশের ঘরে নাক ডাকিয়ে দিবানিদ্রায় যোগস্থ ছিলেন কাকাবাবু। তিনি এইবার ঘরে এলেন। এলেন বললে ভুল হবে। আবির্ভাব হল। আসনে সন্ন্যাসীকে দেখে প্রথমটায় হকচকিয়ে। গেলেন। শেষে বুদ্ধিমানের মতো বললেন, আরে আপনি? হঠাৎ কী মনে করে? এবার কোন শিষ্যের বাড়িতে উঠলেন?

কাকাবাবুর কথা বলার ধরনটাই কেমন যেন। সন্ন্যাসী মৃদু মৃদু হাসছেন।

কাকাবাবু বলেই চলেছেন, বছরে একবার করে আপনাদের তো বেরোতেই হয় সংগ্রহে। আপনার শিষ্য-সামন্তের সংখ্যা কত হবে সাধুজি? লাখ না হাজার?

উত্তরটা আমাকেই দিতে হল, উনি মৌনী আছেন।

কাকাবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সাধুদের অনেক লোকদেখানো কায়দা আছে। অবশ্য তা না হলে শিষ্যরা ভিড়ব কেন?

সন্ন্যাসী প্যাড টেনে নিয়ে লিখলেন, ভদ্রলোককে বলো, উনি কত জ্ঞানী। আরও বলো, আমার কোনও শিষ্য নেই। আমিই শিষ্য। শিষ্য হবার চেষ্টা করছি; কারণ গুরু মিলে লাখ, তো শিষ্য মিলে এক। সময় পেলে কলকাতায় আসি পার্শ্বনাথজিকে দর্শনের জন্যে। জিজ্ঞেস করো, ওঁর ঘড়ি ঠিক চলছে তো!

লেখাটা কাকাবাবুকে দিলুম। তিনি পড়লেন। পড়ে অহংকারীর মতো বললেন, আমার ঘড়ি সুইস-মেক। অলওয়েজ গিভস কারেক্ট টাইম।

সন্ন্যাসী আবার স্মিত হাসলেন। প্যাডে লিখলেন, আই কেম ফর ইউ। কলকাতায় সাত দিন আছি। পারলে, পার্শ্বনাথজির মন্দিরে সকালের দিকে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। তোমার জীবনে ভাল সময় আসছে। ইউ আর স্ট্যান্ডিং অন দি গ্লেসহোল্ড। অ্যাভয়েড দিস ম্যান। হি ইজ বেসিক্যালি কুড। আমার হাত থেকে এক গেলাস জল নিলেন। আলগোছে খেয়ে গেলাসটাকে টেবিলের ওপর না রেখে ঘরের এককোণে রেখে, ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন। দেখছি রাস্তার একপাশ দিয়ে হেঁটে চলেছেন আত্মস্থ হয়ে। যেন একটি জ্যোতির্বলয় চলে গেল।

ওপরে উঠে আসতেই কাকাবাবু বললেন, প্যারাসাইটস। কত টাকা দিলে প্রণামী?

প্রণামী? অমৃতফলের প্রভাব কি না জানি না, ভীষণ হাসি পেল। আমি হাহা করে হাসতে। লাগলুম। নিজের হাসি দেখে নিজেই অবাক। এত জোরে আমি কখনও হাসিনি।

কাকাবাবু বললেন, অমন ইডিয়টের মতো হাসছ কেন?

এতেও আমার রাগ হল না। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, তামসিক একটা মানুষের অবয়ব খসে পড়েছে। ধসে পড়ছে অহংকারের ইমারত। সেই তূপের ওপর কুচকুচে কালো একটা ডিম।

কাকাবাবু বললেন, এইভাবে হাসাটা একটা মহা অসভ্যতা। হরিদার ছেলেকে এটা মানায় না। যাও চা করে আনো। আমাদের এইবার প্রস্তুত হতে হবে। খাওয়াটা তো মাটি করেই দিয়েছ, এইবার মনটাও খিঁচড়ে দিলে। চা-টা একটু কড়া করে কোরো। যেন সিস্টেমে অনেকক্ষণ থাকে।

ঘরের একপাশে টুলের ওপর ছোট্ট একটা কুঁজো ছিল। গলাটা ধরে নিজের মুখে জল ঢালতে লাগলেন। এমন হিপোপটেমাসের মতো হাঁ আমি খুব কমই দেখেছি। মানুষ যে সমস্ত পশুর সমাহার, কথাটা মিথ্যে নয়।

.

সন্ধে নেমে গেছে। আকাশ এখন লাল-কালো। মাঠ পেরিয়ে আমরা চলেছি থানার দিকে। দিদি এইবার আসবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *