2 of 3

১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া

আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
যো কুছ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।

নিখুঁত পরিপাটি বিছানায় মাতামহ বসে আছেন। চাঁদরের ওপর ধূসর একটি কম্বল বিছানো। হাতে একটি বহুকালের পুরনো কীটদষ্ট বই। বইটি সামনে খুলে ধরে মাতামহ একেবারে তন্ময় হয়ে গেছেন। পোকায় ফুটো ফুটো করে দিয়েছে। সমস্ত পাতা পাঁপড়ভাজার মতো মচমচে। দূর থেকে দেখছি, যেন ধ্যানস্থ মহাদেব।

আমার পদশব্দে ধীরে মুখ তুলে তাকালেন। চোখদুটি আরক্ত। জলে ছলছল করছে। মৃদু একটি হাসি ঠোঁটের কোণে নেমে এল। আমি জানি। আমি আজ এসেছি সব হাসি শুষে নেবার ব্লটিং পেপার হয়ে। যে-সংবাদ বুকে চেপে রেখেছি, সে সংবাদ যেই লাফ মেরে নেমে আসবে, বজ্রপতনের মতো আতঙ্ক ছড়াবে।

মাতামহ বললেন, এসো লর্ড, তোমাকে আজ যেন একটু কমজোর মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল বুঝি?

তাড়াতাড়ি চলে আসতে হল। বাবার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।

অ্যাঁ, কী বললে? হরিশঙ্করের…!

মাতামহের হাত থেকে বইটি বিছানার ওপর খসে পড়ে গেল।

আজ্ঞে হ্যাঁ, পুড়ে গেছেন।

পুড়ে গেছে? ও তো পুড়েই আছে। আবার নতুন করে কী পুড়বে? এখনও কি ব্রহ্মময়ী হয়নি তোর মনের মতো? আরও পোড়াবে!

অ্যাসিডে বুক আর মুখের একটু পুড়ে গেছে।

তাকে কোথায় রেখে এলে?

হাসপাতালে। মেডিকেল কলেজে।

আমি যাব। আমি এখুনি যাব। সে এখন কেমন আছে? কথা বলছে? হাসছে?

হ্যাঁ, কথা বলছেন।

তা হলে? ফিরে আসবে তো? না, সবাই যেভাবে চলে গেল, সেইভাবে চলে যাবে? অ্যাসিড নিয়ে সে কী করছিল? জানে না অ্যাসিডে মানুষ পুড়ে যায়? এত জানে, এই সামান্য জিনিসটুকু জানে না!

মাতামহ উঠে দাঁড়ালেন। পা দুটো বেশ তপতপে ফুলে আছে। মুখটা আজ বড় বেশি ফরসা দেখাচ্ছে। শরীরের রক্তস্রোতে ক্রমশই মনে হয় ভাটা পড়ে আসছে।

বউমা! মাতামহ গর্জন করে উঠলেন।

নীচের কলতলা থেকে কাকিমার গলা ভেসে এল, যাই বাবা।

আমার জামাকাপড় দাও।

আঁচলে হাত মুছতে মুছতে কাকিমা দরজার বাইরে থেকে উঁকি মারলেন।

আমার জামাকাপড় দাও। জানো না কী হয়েছে? হরিশঙ্কর পুড়ে গেছে।

কী বললেন? কী হয়েছে বটঠাকুরের?

কাকিমা জলপায়ে ঘরে এলেন।

অ্যাসিডে পুড়ে গেছে। হাসপাতালে আছে। যে-জাহাজে চেপে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছিলুম সেই জাহাজ বুঝি এবার ডুবে যায় বউমা! সবই এই বুড়োর ভাগ্য। সুখ সইবে কেন? গাছতলায় যার আস্তানা, রাজপ্রাসাদে সে কি থাকতে পারে! আগুন লাগবেই।

আপনি এত উতলা হচ্ছেন কেন দাদু? সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি যে ঘরপোড়া গোরু।

কাকিমা বললেন, একটু দাঁড়ান, আমিও যাব।

আজ আর আপনাদের কাউকেই যেতে হবে না। আমি যাই। দু-একটা প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে আসি।

তুমি কি ভাবছ আমি মরে গেছি? অথর্ব হয়ে গেছি! তুমি জানো না, আমি সকলকে মেরে তবে যাব। আমার পালা আসবে সব শেষে। আমি এক লোভী, ভোগী পুরুষ। জীবনে অনেক অপরাধ করেছি। তার প্রায়শ্চিত্ত করে আমাকে যেতে হবে সব শেষে। বেটি, তুই হরিশঙ্করের দিকে হাত বাড়ালি কেন? অবিচার তোর আগাগোড়া। ভবে এসে খেলব পাশা, বড়ই আশা মনে ছিল। মিছে আশ ভাঙা দশা, প্রথমে পঞ্জুড়ি পালা ॥ পো-বারো আঠারো ষোলো, যুগে যুগে এলেম ভাল। শেষে কচে-বারো পেয়ে মাগো, পাঞ্জা ছক্কায় বদ্ধ হল ॥

কাকিমা অবাক হয়ে মাতামহকে দেখছেন। আমিও এমন মূর্তি কখনও দেখিনি। দু’গাল বেয়ে। জলের ধারা নামছে। সংসার-সমরাঙ্গনে পরাজিত নৃপতি আধ্যাত্মিক শক্তিতে ভর করে উঠে। দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন।

কাকিমা এগিয়ে গিয়ে মাতামহের হাতদুটো ধরে ফেললেন। শুধুমাত্র একটি শাড়ি একটু উঁচু করে পাক দিয়ে পরে আছেন। গায়ে জামা নেই। গা ধুতে ধুতে উঠে এসেছেন। উপায় ছিল না এর চেয়ে পরিপাটি হয়ে আসার। ইনি যেন আমার মাতামহের আর এক কন্যা।

হাত ধরে বিছানার দিকে নিয়ে যেতে যেতে কাকিমা বলছেন, বাবা, শান্ত হন। শান্ত হন, আপনার শরীর ভাল নেই। টলছেন। পড়ে যাবেন।

দু’জনে ধরাধরি করে বৃদ্ধ মানুষটিকে বিছানায় বসিয়ে দিলুম। কাকিমা প্রায় জড়িয়ে ধরে আছেন। নিয়তি নামক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে অভিমানের তরোয়াল খুলে বারেবারে যুদ্ধে নামার চেষ্টা। অপরাজেয়কে যে পরাজিত করা যায় না! কে বোঝাবে সে কথা এই অভিমানী মানুষটিকে! মানুষ যদি বোকার মতো কষ্ট পায় কিছু করার আছে? সংসার থেকে শুধুমাত্র আনন্দের অংশটি তুলে নেবার মতো হাঁস কোথায় পাওয়া যাবে। তা হলে তো সকলকেই পরমহংস হতে হয়। এ কি সদলবলে মধুপুরে বায়ু পরিবর্তনে আসা! এলুম একসঙ্গে, ফিরে গেলুম একসঙ্গে। অদৃশ্য মৃত্যুপুরুষ আমাদের প্রত্যেকের কাঁধে হাত রেখে বন্ধুর মতো পাশে পাশে হেঁটে চলেছে। কখন কোন সময় সে হঠাৎ গতি থামিয়ে দিয়ে বলবে, চলো, এবার তোমার ফেরার সময় হয়েছে, কেউ জানে না। সেই মহা অভিভাবকের অবাধ্য হবার ক্ষমতা কারুর নেই। মানুষের বৃথা এই আস্ফালন। আসলে মৃত্যুই। আমাদের মধ্যে জীবিত হয়ে ঘুরছে। আচ্ছা চলি, বলে চলে গেলেই হয়ে গেল।

অতি কষ্টে মাতামহকে শান্ত করা গেল। গুম হয়ে রইলেন বিছানায়। একবার শুধু জিজ্ঞেস করলেন, আজ আর তা হলে সে ফিরছে না! এই শুন্য বাড়ি। তুমি আর আমি আর বউমা!

যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমি আবার হাসপাতালে ফিরে গেলুম। দিনের চোখে নিদ্রা নামছে। দু’-একটা আলো জ্বলেছে, তেমন জলুস নেই। পৃথিবী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ছোট্ট একটি কেবিনে শুয়ে আছেন পিতৃদেব। যে-মানুষ সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকেন তাঁর কাছে এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে! আমার সঙ্গে খানকয়েক বইও আছে। এইবার সময়টা হয়তো সহজে কাটবে। আমার নিজের একবার অ্যাসিডে হাত পুড়েছিল। সেই সামান্য পোড়ার যন্ত্রণায় আমি এক রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। বুকের অনেকখানি জায়গা পুড়েছে। যন্ত্রণার তীব্রতা অনুমান করতে পারছি। যন্ত্রণার অংশীদার হওয়া যায় না। আনন্দ হয়তো ভাগ করে নেওয়া যায়। কষ্ট মানুষকে একাই ভোগ করতে হয়।

ঘরে আমিও ঢুকলুম, একজন সিস্টারও ঢুকলেন। খুবই কম বয়েস। ধড়াচূড়া খুলে ফেললে মনে হতে পারে আমার বোন। মুখে একটা কৃত্রিম গাম্ভীর্যের আবরণ। আমার হাত থেকে জিনিসপত্র একে একে বুঝে নিলেন। তোয়ালে, সাবান, কাপড়, ঢোলা জামা। চা আনতে বলেছিলেন, এক প্যাকেট ভাল চা। চিনির কিউব। কাপ ডিশ, চামচে, গেলাস, কেটলি, ছাকনি। ঝোলা থেকে একের পর এক জিনিস বেরুচ্ছে। যতটা সম্ভব বাড়ির পরিবেশে রাখার চেষ্টা। সে কি আর সম্ভব হবে? হাসপাতালও এক কারাগার, অসুখের কারাগার।

কেবিনের বাইরে উঁকি মেরে সিস্টার কাকে যেন ডাকলেন, সুখী, সুখী।

সাধারণ শাড়ি পরা এক মহিলা টুল থেকে উঠে এলেন। সিস্টার বললেন, প্রায় সবকিছুই এসে গেছে। বুঝে নাও। এঁর যখন যা দরকার হয়, কান খাড়া রাখবে, উঠে এসে দেবে। বসে বসে ঘুমিয়ে পোড়ো না যেন।

সিস্টার নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন। হাইহিল জুতোর খুটখুট শব্দ চওড়া করিডরে দূর থেকে দূরে হারিয়ে গেল। মিষ্টি চেহারার শ্যামবর্ণা সুখী আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে টুলে গিয়ে বসল। সাদা ডোমে ঢাকা একটা ভুতুড়ে আলো দরজার সামনে কুয়াশার আঁচল পেতেছে।

পিতা ডাকলেন, এদিকে এসো।

কণ্ঠস্বর একেবারে পালটে গেছে। পুরনো টিন দিয়ে রেকর্ড বাজালে যেরকম হয়, সেইরকম খসখসে।

আপনার গলাটা এইরকম হয়ে গেল কেন?

ভোকাল কর্ড বেশ খানিকটা অ্যাসিড সোক করে ফেলেছে। ভেতরের মিউকাস মেমব্রেন অ্যাফেক্টেড। কথা বলতে গেলে বেশ লাগছে।

খুব কষ্ট হচ্ছে?

তা তো একটু হবেই। সহ্য করতে হবে। উপায় নেই। একে কী বলে জানো, পিউরিফিকেশন অফ সোল। সুখে থাকলে মানুষ দেহযন্ত্রকে ভুলে যায়। এই যন্ত্রণায় আমি সব অনুভব করতে পারছি, হার্ট, লাংস, ফ্যারিংস, ল্যারিংস, স্ক্রিন, কিউটিস। চামড়ার আচ্ছাদনে একগাদা সেনসিটিভ যন্ত্রপাতি। হোয়্যার ইজ দি সোল? কোথায় সেই আত্মপুরুষ!

আমারও খুব জানার ইচ্ছে। হয়তো তিনি জানতে পেরেছেন। অসীম আগ্রহে বললুম, কোথায়?

নীচের দিকে নেই। হি মাস্ট বি সামহোয়্যার অ্যাট দি টপ। হি স্পিকস। আমারই কণ্ঠস্বর ধার করে তার প্রশ্ন, তার উত্তর। দেহবিদ খুঁজে পাবে না। খাঁচা খুললেই পাখি ঠিক উড়ে যায়। না, আর কথা বলব না। বেশ কষ্ট হচ্ছে। লেট মি সাফার অ্যালোন ইন সাইলেন্স।

হঠাৎ এমন দুর্ঘটনা ঘটল কেন? আপনি বলেছিলেন, অন্যায় আর পাপের পাথরে ধাক্কা না খেলে,

জীবন তরতর করে স্রোতের টানে এগিয়ে যায়।

হ্যাঁ তা ঠিক। পাপের সূক্ষ্ম কাঁটা বড় সেনসিটিভ, চিন্তাতেও নড়ে ওঠে। আমি তো দেবতা নই, আমিও মানুষ। আমার লোভ আছে, লালসা আছে, হিংসা আছে, অন্যের অনিষ্ট চিন্তা আছে, কত কী আছে! মাছের আঁশটে গন্ধ আতরে ধুলেও কি যায় রে বাবা! অরক্ষিত মন পথের পাশে দরজা খোলা ঘরের মতো। কখন কে ঢুকছে, কে বেরোচ্ছে। অবারিত ব্যাপার। কতবার ধাক্কা খেতে খেতে, সাজা পেতে পেতে তবে মানুষ একটু মানুষ হয়।

আজ আমি এখানেই থাকি।

না না, তার কোনও প্রয়োজন নেই। শুধু শুধু তুমি কেন কষ্ট করবে? আমি এখন প্রোফেশনালদের হাতে। তারাই হ্যাঁন্ডেল করবেন। তা ছাড়া যন্ত্রণা নির্জনে সাফার করতেই ভাল। লাগে। তোমার ওপর একজন বৃদ্ধ মানুষের দায়িত্ব রয়েছে। তার ব্যাপার আরও সিরিয়াস।

আপনাকে একা ছেড়ে যেতে ভীষণ খারাপ লাগছে। বাড়ি একেবারে খাঁখাঁ করছে। একা আমি থাকব কী করে? আপনার বিছানা শূন্য পড়ে থাকবে। ঘরে রাতের টেবিল ল্যাম্প জ্বলবে না। খাবার আসন পড়বে না।

উপায় নেই, বাবা। পৃথিবীটাই এইরকম। কেউ হাসপাতালে যায়, কেউ বাড়ি যায়, কেউ মারা যায়, কেউ সেজেগুঁজে বিবাহ করতে যায়। কেউ জেলে যায়, কেউ বিদেশে যায়। কেউ মন্দিরে যায়, কেউ যায় নাচঘরে। সবই যাওয়া। যার তেমন গতি। রাত হচ্ছে। তুমি এবার এসো। বাড়িতে তোমার ভূমিকা এখন আমার ভূমিকা। আমার অনুপস্থিতি তুমি একটু ফিল করো। আজ যা সাময়িক কাল তা চিরকালের। মন খারাপের কিছু নেই। পুরুষ হও। পৌরুষ আনো। আবার কাল। যে-জায়গাটা পুড়েছে, সে জায়গাটা বড় ভাল হে। হৃৎপদ্মে আগুন জ্বলছে। আচ্ছা, গুড নাইট।

হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে কলুটোলা পেরিয়ে প্রায় নেশাগ্রস্তের মতো চিৎপুরে চলে এলুম। মানুষ যে-সময় কাছে স্ত্রীকে পেতে চান, সে সময় সন্তান কিছু করতে পারে না। পিতার পাশে এখন আমার মাতার থাকা উচিত ছিল। সন্তান রক্তের অংশ হতে পারে, স্ত্রী হলেন মনের অংশ। আরও কাছের। দুঃখের, সুখের, দেহের। কী জানি, কী হয়!

থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম। নাখোদা মসজিদের মিনেকরা মিনার সোজা উঠে গেছে আকাশের দিকে। সামনেই বিশাল প্রবেশপথ। হঠাৎ মনে হল আমি এক জাতিস্মর। বহুকাল আগে আমি এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রায়ই যাতায়াত করতৃম। হয়তো রাজা নবকৃষ্ণের আমলে, ভোলা ময়রার কালে। আমার একটা জুড়িগাড়ি ছিল। শ’খানেক বছর আগের আমিকে আমি দেখতে পাচ্ছি। চিকনের পাঞ্জাবি, জরির নাগরা, কানে আতর। অনেক রাত। পিরু মিঞার দোকানে ফিনফিনে রুমালি রুটি উড়ছে। কাবারের গন্ধ ছুটছে। নিকি বাই ঘুরে ঘুরে ঘুঙুর পায়ে নাচছে।

অন্ধ একটি মানুষ সামনে হাত পেতে, লাঠি ঠুকঠুক করে চলেছে। মুখে হাঁকছে, আল্লা দেনেঅলা, আল্লা দেনেঅলা। হঠাৎ ভীষণ দাতা হবার ইচ্ছে হল। পুরো একটি টাকা হাতে ফেলে দিলুম। আর সঙ্গে সঙ্গে ঢক করে একটা শব্দ হল। পেছনেই জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটের বিখ্যাত মাংসর দোকান। বৃহৎ একটি খাসির পেছনের ঠ্যাংটি অস্ত্রের আঘাতে নেমে এল। ত্রিপদ মৃত পশু ঘিনঘিনে চর্বির আস্তরণ নিয়ে পেন্ডুলামের মতো দুলতে লাগল। বলছে, লোভ, লালসা, লালসা, লোভ। উলটো দিকের একটা দোকানে আজও শিককাবাব হচ্ছে, যেমন হত একশো বছর আগে। কেন যে পা আমাকে আজ এদিকে চালিয়ে নিয়ে এল!

আরে কে রে, পিন্টু না?

প্রশ্ন এবং মানুষ দুটোই যেন মাটি খুঁড়ে উঠল। সামনে দাঁড়িয়ে সুখেন আর জবা। সুখেনের হাতে নতুন একটা চামড়ার সুটকেস। চেহারা ভালই ছিল। আরও ভাল হয়েছে। জবার চেহারাতেও চেকনাই এসেছে। দেখলেই বোঝা যায় মা হতে চলেছে।

জবা বললে, আপনি এখানে কী করছেন? কারুর জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন?

দু’জনকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ আনন্দ হল। কী সুন্দর মানিয়েছে! জবা ফিকে লাল রঙের একটা সিল্কের শাড়ি পরেছে। আগেকার সেই চঞ্চল স্বভাব আর নেই। বললুম, না, কারুর জন্যেই দাঁড়িয়ে নেই। বাড়ি ফিরছি।

সুখেন বললে, এ পথে কেন?

এসেছিলুম মেডিকেল কলেজে। কী মনে হল, হাঁটতে হাঁটতে এলুম এদিকে।

হাসপাতালে আবার কী হল?

সুখেনকে সংক্ষেপে সব বললুম। জবা বললে, আপনার তা হলে খুব বিপদ যাচ্ছে।

সুখেন বললে, তোর খুব তাড়া আছে?

তাড়া মানে, যত তাড়াতাড়ি ফেরা যায় ততই ভাল। তোরা কবে এলি, কোথায় আছিস?

তিন দিনের জন্যে এসেছি। উঠেছি বালিগঞ্জে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। চল না, ওই রয়ালে গিয়ে একটু বসি। জবার ভীষণ চাপ খাবার ইচ্ছে। জানিস তো এইসময় মেয়েদের নানারকম খাবার ইচ্ছে হয়।

জবা সুখেনের সুটকেস ধরা ডান হাতটা আদর করে খামচে দিল। রাস্তার দিকে মুখ নিচু করে বললে, অসভ্য!

আমার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে, বিশাল সুটকেস হাতে নিয়ে সুখেন এগিয়ে চলল রয়ালের দিকে। বউকে আজ চাপ খাওয়াবেই রুমালি রুটি দিয়ে। জবা আমার পাশে পাশে ধীরে ধীরে হাঁটছে। শরীরের আয়তন বেড়েছে। আইবুড়ো বেলায় জবার একটা রিপু খুব প্রবল ছিল। সুখেনের হাতে পড়ে ভালই হয়েছে। মা হলে মনটা ঘুরে যাবে। ট্রামলাইন পার হবার সময় আমার একটা হাত জড়িয়ে ধরল। চারপাশে লোকজন, যানবাহন, বেচারার ভয় করছে। হাতের তালু বেশ গরম। রক্ত এখনও শীতল হয়নি।

রয়ালের বাইরে বিশাল একটা উনুন। কাঠকয়লার আগুনের ওপর বিশাল এক কানা-উঁচু পাত্রে ঘি আর মশলায় জরোজরো নিখুঁত সব মাংসের টুকরো। মৃদু আঁচে পুটপুট করে ফুটছে মানুষের রসনার সুখখণ্ড। আতরের ভুরভুরে গন্ধ। সুখেনের পেছন পেছন সিঁড়ির ধাপ ভাঙছে জবা। সিল্কের আবরণে শরীর টানটান। জবার দেহ সবসময়েই যেন গলা ছেড়ে চিৎকার করছে, আমাকে দেখো, আমাকে দেখো। অপর্ণার সঙ্গে কনকের সঙ্গে এই তফাত। মুকুর সঙ্গে কিছুটা মেলে। আমার মনে হয় মনের আকারের সঙ্গে মানুষের দেহের মিল থেকে যায়। মন অনুসারে দেহ সূক্ষ্ম হয়, স্থূল হয়।

ধপ করে টেবিলে একটা মেনু ফেলে দিয়ে গেল। এপাশে ওপাশে যাঁরা আহারে বসেছেন, সকলেরই চেহারা যেন কেমন কেমন। পাশবিক মানুষ দেখলেই যেন চেনা যায়। মাংস, মদ, মেয়েছেলে, সব নিয়ে একটা হাঁসফাস অবস্থা। দাঁতে মাংস ছিঁড়ছে। গজর গজর বকছে। হ্যাঁ হ্যাঁ। করে হাসছে। গলগল ঘামছে। ঢুকে পড়ে বিপদ করেছি। ভেতরটা পালাই পালাই করছে।

জবা মেনু থেকে চোখ তুলে বললে, সবকিছুর বড্ড দাম যে গো! কী করবে?

সুখেন আর আমি পাশাপাশি। জবা আমাদের উলটো দিকে। টেবিলে দু’কনুইয়ের ভর রেখে সামনে ঝুঁকে আছে। এতক্ষণ লক্ষ করিনি, হাতে লাল সুতো দিয়ে একটা মাদুলি পরেছে। ব্লাউজের হাতা কুঁড়ে লাল সুতোর ছোট্ট একটি অংশ বেরিয়ে এসে দোল খাচ্ছে। তেল চুকচুকে কপালে দিগন্তে লাল সূর্যের মতো গোল একটা সিঁদুরের টিপ।

সুখেন অসহায়ের মতো বললে, কী করবে তা হলে, অন্য কোথাও যাবে?

সুখেন বউয়ের হাতে নিজেকে একেবারে সমর্পণ করে দিয়ে বসে আছে। উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে। আমি বললুম, আপনি দামের জন্যে ভাবছেন কেন? যা প্রাণ চায় খেয়ে যান। আজ আমি আপনাদের খাওয়াব।

সুখেন বললে, তুই আপনি বলছিস কী রে?

তাতে কী হয়েছে! আমি চট করে কাউকে তুমি বলতে পারি না। নিন খাবার সিলেক্ট করে অর্ডার দিন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তুই খাওয়াবি? চাকরি পেয়েছিস?

হ্যাঁ রে।

সুখেন বললে, তবে আর কী? চালাও চাপ, চালাও তন্দুর।

পরের পয়সায় খেতে তোমার লজ্জা করবে না।

না, বন্ধুর পয়সায় আবার লজ্জা কীসের! তুমি জানো, আমার সব প্রেমপত্তর পিন্টু লিখে দিত? কী ল্যাঙ্গোয়েজ! তুমি অমনি কৃষ্ণের বাঁশি-শোনা রাধিকার মতো নেচে নেচে চলে এলে।

ও যে তোমার ভাষা নয়, তোমার লেখা নয় আমি জানতুম।

অর্ডার নিয়ে দোকানের কর্মচারী গম্ভীর মুখে চলে গেল। আমরা সামান্য পাতি খদ্দের। টেবিলে টেবিলে খাবার ব্যভিচার চলেছে। ঝক ঝক পায়রার মতো ফড়ফড় করে নোট উড়ছে।

জবা বললে, এবার তা হলে একটা বিয়ে করে ফেলুন। না, করে ফেলেছেন?

না, করিনি।

সেই মেয়েটি এখনও আছে? খুব সুন্দরী।

না, তারা চলে গেছে।

সেই শাড়িটার খোঁজ করেনি?

শাড়ি! কোন শাড়ি?

পাঁচিল টপকে এসে, আপনার হাত থেকে যে শাড়িটা নিয়ে পরে আমি চম্পট দিয়েছিলুম। মনে পড়ছে?

ও হ্যাঁ, না সেটার খোঁজ পড়েনি।

শাড়িটা আর নেই জানেন! চুরি হয়ে গেছে। আমাদের ওখানে যে কী চুরি হয়!

আমাদের নাকের পাশ দিয়ে খাবার এসে টেবিলে নামল। দারুণ মোগলাই গন্ধ বেরোল। জিবে আধপোয়া জল। খাবারের প্লেট টানতে গিয়ে হাত যেন অবশ হয়ে এল। এ আমি কী করছি! পিতা হাসপাতালে, মাতামহ অসুস্থ। আমার সামনে মোগলাই খানা। তার সামনে পরস্ত্রী। মাঝে মাঝে। আড়চোখে তাকাচ্ছি। এর চেয়ে স্বার্থপরতা আর কী হতে পারে? এখন আর উপায় নেই। নাচতে এসে ঘোমটা টানা চলে না।

আপনি আমার থেকে একটু মাংস আর ঝোল নিন।

বাটি-ধরা হাত জবার দিকে এগিয়ে গেল। সে না না, এ কী করছেন, এ কী করছেন, বলে দু’হাত দিয়ে আমার হাত চেপে ধরল। শূন্যে চারটি হাত আর পোর্সিলিনের বাটি ঝুলে রইল।

হাত ছাড়ুন, আপনার শাড়িতে পড়ে যাবে। আমি এতটা খেতে পারব না।

সুখেন বললে, দিচ্ছে যখন নিয়ে নাও। অনেকক্ষণ থেকে বলছিলে খিদে পেয়েছে।

তা বলে মরব নাকি!

মরবে কেন? তুমি তো এখন দু’জন।

জবা হাত ছেড়ে লজ্জায় মুখ নিচু করল। একটা তন্দুর, একটা ঝোল, এই আমার পক্ষে যথেষ্ট। নিঃশব্দে আহার পর্ব চলেছে। জবা মাঝে মাঝে হুসহাস করছে একটু-আধটু। গর্ভবতী রমণীর আহারের একটা বৈশিষ্ট্য থাকে। রয়াল বেঁধেছেও খাসা। যে-দেহে নতুন একটি প্রাণ আসছে, সেই দেহের জিভ এমন জিনিসই পছন্দ করবে। সামান্য ঝাল লেগেছে। চোখমুখ কেমন যেন বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। মৃদু মৃদু হাসছে। অন্যকে খাওয়ানোর এত যে তৃপ্তি, আগে কখনও বুঝিনি। তৃপ্তি মানুষের মুখকে দেবীর মুখের মতো করে তোলে। কী থেকে মানুষের মনে কী ভাব এসে যায়! হঠাৎ মনে হল, আমি যখন গর্ভে ছিলুম আমার মা-ও হয়তো এইভাবে সাধ খেয়েছিলেন। এমনি আগ্রহ নিয়ে, লাল একটি শাড়ি পরে। আজ আর আমার সে দৃষ্টি নেই, যে-দৃষ্টিতে ছাদের ফুলগাছের টবের আড়ালে থেকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখতুম। অনেকদিন আগে। গা তখন শিরশির করে উঠত। মনে কুভাব আসত। মনটা বড় উৎফুল্ল হয়ে উঠল, এতদিনে, এতদিনে তা হলে মহিলাকে মা ভাবতে পেরেছি।

বিলের টাকা দেবার জন্যে সুখেন লাফিয়ে উঠল। খবরদার! আমি দোব বলেছি। সত্যভঙ্গ হবে।

খামচাখামচি করে সুখেনকে নিরস্ত করলুম। ঠাকুর বলে গেছেন, বিষয়ীর পয়সার খাবার মুখে তুলতে নেই। অন্তরপুরুষ সংকীর্ণ হয়ে যাবে। জবা বললে, আঃ, এরপর একটা পান খেতে পারলে যেন যোলোকলা পূর্ণ হত।

পান? পান খাবে, বলে সুখেন ঢাউস সুটকেস হাতে পানের দোকানের দিকে ছুটল। চারপাশে ভীষণ ভীষণ চেহারার মানুষের আনাগোনা। জবা আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ছোট্ট লেডিজ রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুচছে। সেন্টের গন্ধ উড়ছে।

জবা বললে, ভাল মেয়ে আছে, বিয়ে করবেন? আমাদের ওখানে। দেখতে শুনতে ভাল। গান জানে, নাচ জানে। বাপের একমাত্র মেয়ে। ভাল দেবেথোবে। আপনার সঙ্গে বেশ মানাবে। ছিপছিপে চেহারা।

আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

তাই নাকি! খবরটা এতক্ষণ চেপে রাখা হয়েছিল! আমাদের নেমন্তন্ন করবেন তো?

যদি হয় নিশ্চয় করব।

আবার যদি কেন? সামনের মাঘেই লাগিয়ে দিন। ও তখন তো আবার…।

জবা চোখ নামাল, নাঃ আমার আসা হবে না।

সুখেন এসে গেল, তুই পান খাবি?

আমি খাই না।

এঃ একটা তা হলে বেশি হয়ে গেল।

জবা বললে, আমাকে দাও। রুমালে মুড়ে রাখি। কাল খাওয়া যাবে। কী দাম নিলে গো?

কুড়ি পয়সা এক খিলি।

বলো কী? তোমায় নতুন লোক দেখে ঠকিয়েছে।

না না, ঠকাবে কেন? মঘাই পান।

রাখো তোমার মঘাই। যা হয় একটা বললেই হল। এই বেড়ালই বনে গেলে বনবেড়াল।

না গো, দেখছ না কেমন সাদা সাদা। বরফে শোয়ানো ছিল।

তোমার কলকাতা এক গলাকাটার জায়গা।

সুখেন ট্যাক্সি ধরতে ছুটছিল। জবা হাঁ হাঁ করে উঠল, ট্রামে চলো, ট্রামে। অত বড়লোকি চাল ভাল নয়। ঢাউস সুটকেস আর একটা লাল বউ নিয়ে সুখেন ট্রামে উঠে পড়ল। যাবার সময় বলে গেল, একবার আমাদের ওখানে আয় না।

সুখেনের কী অদ্ভুত পরিবর্তন! ভেড়ার মতো হয়ে গেছে। ঠাকুরের কথা মনে পড়ছে, সংসারী লোকগুলো তিনজনের দাস, তাদের কি পদার্থ থাকে? মেগের দাস, টাকার দাস, মনিবের দাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *