পেরিন সাহেবের বাগানে তখন আর-এক নাটক জটিল হয়ে উঠেছে। সকাল থেকেই ক্লাইভের মনটা অস্থির ছিল। হুগলি থেকে ফেরবার সময়ই ক্লাইভ খবর পেয়েছিল, রাজা দুর্লভরাম আর্মি সরিয়ে নিয়ে গেছে লঙ্কাবাগ থেকে। তারপর এখানে এসে দিদির সঙ্গে কথা বলবার সময়েই কেষ্টনগরের মহারাজা এসে হাজির হয়েছিল। সঙ্গে ছিল হাতিয়াগড়ের জমিদার।
এতদিন ধরে যে-ধারণাটা মনে মনে গড়ে উঠেছিল সেইটেই আরও শক্ত হয়ে শেকড় গজাল সাহেবের মনে। এরাই ইন্ডিয়ান। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন আগেই ভাল করে চিনেছিল এদের, এবার ক্লাইভও চিনতে পারলে। া, এরাই ইন্ডিয়ান। সামান্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে একদিন ছ’টাকা মাইনের রাইটার হয়ে এসেছিল সে। না আছে তার ফ্যামিলি পরিচয়, না আছে বিদ্যে, না আছে টাকা। বলতে গেলে কিছুই নেই তার। গড শুধু দিয়েছে দুটো চোখ, একখানা বুক আর দুর্জয় সাহস। ক্যাপিট্যাল বলতে আর কিছুই নেই তার। একজন জগৎশেঠ কি একজন উমিচাঁদ তাকে কিনে নিতে পারে। তবু তার কাছেই এই ইন্ডিয়ানরা আসছে। সবাই চাইছে ক্লাইভ তাদের কিং করে দেবে। ক্লাইভই তাদের সেভিয়ার, ক্লাইভই তাদের অলমাইটি গড। এদের কি লজ্জাও হয় না! এদের কি নিজেদের ওপর একটু আস্থাও নেই? তোমরা তোমাদের কান্ট্রির কথা ভাবছ না, শুধু ভাবছ নিজের লাভ-লোকসানের কথা। কিন্তু আমিও তো মানুষ। আমারও তো লোভ থাকতে পারে। আমিও তো তোমাদের প্রপার্টি কেড়ে নিতে পারি।
ওয়াটসন বলেছিল–এই-ই আমাদের অপরচুনিটি রবার্ট, এমন সুযোগ আর আসবে না। ফ্রেঞ্চরা নেই, ডাচরা নেই, পর্তুগিজরা নেই, এখন আমরাই লর্ড অব দি ল্যান্ড
মহারাজার কথা শুনতে শুনতে ওয়াটসনের কথাগুলোই মনে পড়ছিল বারবার। নবাবের ফেবারে কেউই নেই। নবাবের নিজের মাদার পর্যন্ত নবাবের বিরুদ্ধে। এর চেয়ে বড় হতভাগা আর কে আছে দুনিয়ায়। এনবাব তো যেতে বাধ্য। তবু ইতিহাসের এমন ভাগ্য যে আমিই এই সেঞ্চুরির ডেনিয়্যাল হয়ে উঠব।
হঠাৎ ক্লাইভ বললে–আমি যদি মুর্শিদাবাদ অ্যাটাক করি তো আপনারা আমাকে হেলপ করবেন কথা দিচ্ছেন?
ছোটমশাই সমস্ত কথাই মন দিয়ে শুনছিল। বললে–আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে সব রকম সাহায্য করব। আমি টাকা দিয়ে সাহায্য করব, মানুষ দিয়ে সাহায্য করব, আমার হাতি আছে, আপনি যদি চান তো তাও দিতে পারি–
কিন্তু ক্লাইভ উত্তর দেবার আগেই বাইরে কার যেন পায়ের শব্দ হল।
অর্ডারলি!
অর্ডারলি ভেতরে এসে কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। মিলিটারি সিক্রেট বাইরের লোকের কাছে প্রকাশ করার কথা নয়। রবার্ট ক্লাইভ মুখ দেখে বুঝতে পারলে। মহারাজকে বসতে বলে পাশের ঘরে গেল। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন বসে ছিল সেখানে। জিজ্ঞেস করলেও-ঘরে কারা?
ক্লাইভ বললে–কৃষ্ণনগরের মহারাজ আর হাতিয়াগড়ের জমিনদার—
কী বলছে ওরা? কী করতে এসেছে?
দি সেম প্রপোজাল। ওরাও নবাবের এগেনস্টে। আমরাই ওদের সেভিয়ার। আমাদের হেলপ করতে রেডি ওরা।
কিন্তু এই দেখো, ওয়াটসের কাছ থেকে চিঠি এসেছে। দোহাজারি মনসবদার ইয়ার লুৎফ খা আর মিরজাফর তাদের টার্মস দিয়েছে। এই হচ্ছে মিরজাফরের টার্মস
এক দুই তিন করে বারো দফা শর্ত মিরজাফরের।
এক এক করে সবগুলি শর্ত পড়তে লাগল ওয়াটসন। সাত নম্বর শর্তে লেখা আছে
(৭) আরমানিগণের ক্ষতিপূরণের জন্য সাত লক্ষ টাকা দিব। ইংরেজ, দেশীয় প্রভৃতির মধ্যে কাহাকে কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে তাহা ওয়াটসন, ক্লাইভ, ড্রেক, ওয়াটস, কিলপ্যাট্রিক ও বিচার সাহেব ঠিক করিয়া দিবেন।
(৮) কলিকাতা যে-খাত দ্বারা বেষ্টিত আছে তাহার মধ্যে অনেক জমিদারের জমি রহিয়াছে। এই জমি এবং খাতের বাহিরে ছয় শত গজ ইংরেজ কোম্পানিকে দান করিব।
(9) কলিকাতার দক্ষিণে কুলপি পর্যন্ত স্থান ইংরেজ কোম্পানির জমিদারি হইবে। তথাকার সমস্ত কর্মচারী কোম্পানির অধীন হইবে এবং কোম্পানি অন্যান্য জমিদারের মতো রাজকর দিবেন।
(১০) যখন আমি ইংরাজ-সৈন্যের সাহায্য চাহিব তখন তাহার ব্যয়ভার আমার। (১১) হুগলির দক্ষিণে কোনও স্থানে দুর্গ প্রস্তুত করিব না।
(১২) আমি বাংলা বিহার উড়িষ্যা এই তিন প্রদেশের রাজ্যে অধিষ্ঠিত হইলেই উল্লিখিত সমস্ত টাকা দিব।
ঈশ্বর এবং পয়গম্বরের নামে শপথ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি, যতদিন জীবিত থাকিব ততদিন এই সন্ধিপত্রের নিয়ম পালন করিব।
তারিখ ১৫ই রমজান। ৪ জুলুস। ইতি– মিরজাফর খাঁ
তারই নীচে সকলের সই রয়েছে। ওয়াটসন, ড্রেক, ওয়াট, কিলপ্যাট্রিক, বিচার।
ওয়াটসন জিজ্ঞেস করলে তুমি যেমন ড্রাফট করে দিয়েছিলে ঠিক তেমনই লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন তুমি একটা সই করে দাও
ক্লাইভ বারবার পড়তে লাগল টামর্শগুলো। কোথাও কোনও ফাঁক না থাকে।
ওয়াটসন বললে–ফ্লেচার এই টার্মস নিয়ে চলে এসেছে কাশিমবাজার থেকে এখনই আবার এক কপি নিয়ে মিরজাফরকে দিতে যাবে।
আর ওয়াটস?
সে জগৎশেঠের বাড়িতে গিয়েছিল।
কিন্তু উমিচাঁদ যায়নি?
গিয়েছিল। উমিচাঁদ সঙ্গেই ছিল। কিন্তু ফ্লেচার বললে–যে, মুর্শিদাবাদে সমস্ত জানাজানি হয়ে গেছে।
ফ্লেচার কোথায়?
ওয়াটসন বললে–বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি। তুমি আগে ওদের বিদেয় করে দাও, ওরা চলে গেলে তোমাকে আরও অনেক কথা বলব অনেক জরুরি কথা আছে
ক্লাইভ উঠল।
পাশের ঘরে তখনও মহারাজ আর ছোটমশাই চুপ করে অপেক্ষা করছিলেন। ক্লাইভ গিয়ে বললে–মহারাজ, আজকে একটা জরুরি কাজে আটকে পড়েছি, আপনি আর একদিন বরং আসবেন
মহারাজ উঠলেন। ছোটমশাইও উঠল।
ক্লাইভ বললে–কিছু মনে করবেন না ছোটমশাই, আপনারা যদি আমাকে হেলপ করেন তা হলে আমিও আপনাদের হেলপ করব–গড উইল হেলপ আস
অনেক আশা নিয়ে এসেছিল ছোটমশাই। মনটা বড় ভেঙে গেল। আজ কতদিন ধরে কেবল এই ক্লাইভ সাহেবের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই একটানা-একটা বাধা এসে পড়ছে। সেবারও সেই বাউন্ডুলে কবিটাকে মুরুব্বি ধরে এসেছিল। সেবারও বাধা পড়েছিল।
মহারাজ বাইরে বেরিয়ে বললেন–এতদিন ধৈর্য ধরলেন, আর একটু ধৈর্য ধরুন! যদি ধৈর্যই ধারণ করতে না-পারবেন তো পুরুষমানুষ হয়েছিলেন কেন?
কিন্তু আমি বড়গিন্নির কাছে মুখ দেখাব কেমন করে?
তা আপনার তো কিছু দোষ নয়, আপনিই বা কী করবেন?
ছোটমশাই বললে–আমারই তো দোষ, আমি যদি আমার স্ত্রীর রূপ দেখাবার জন্যে বাহাদুরি করে মুর্শিদাবাদে নবাবজাদার বিয়ের সময় না নিয়ে যাই তা হলে এসব আর কিছুই হয় না। কেউ জানতেই পারত না যে আমার স্ত্রী সুন্দরী
ততক্ষণে বাইরে বেরিয়েছে দু’জনে। মহারাজ বললেন–আপনার বজরা কোথায়?
আমি তো কালিঘাটে বজরা রেখে এসেছি।
তা হলে আমার সঙ্গেই চলুন। একসঙ্গে কালীঘাট পর্যন্ত যাই, ওখান থেকে সকলকে নিয়ে আমি কেষ্টনগরে চলে যাব, আপনি হাতিয়াগড়ে চলে যাবেন
কিন্তু আমি বড়গিন্নিকে গিয়ে কী বলব?
মহারাজ বললেন–বলবেন আমি তার ভার নিয়েছি। দেখলেন না ক্লাইভসাহেবের মুখের চেহারাখানা! ভেতরে ভেতরে ওদের ষড়যন্ত্র চলছে। আপনি ভাল করে দেখেননি। আমি দেখেছি, সাহেবের আরদালি যেই ঘরে ঢুকল আর সাহেবের মুখখানা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল।
আমি তো বললাম সাহেবকে আমি টাকা দিয়ে পয়সা দিয়ে লোকবল দিয়ে হাতি দিয়ে সবকিছু দিয়ে সাহায্য করব।
ভালই করেছেন বলে। আমি ভেতরে ভেতরে সাহায্য করব, কিন্তু আমি তো মহারাজা হয়ে প্রকাশ্যে সাহায্য করার কথা বলতে পারিনে আপনার মতো। জানাজানি হয়ে গেলে আমাদের সকলের ক্ষতি হয়ে যাবে। রাজনীতিতে অত তাড়াতাড়ি কিছু করতে নেই। সইয়ে সইয়ে ঠিক সময় ঘা দিতে হয় তা জানেন তো! সেই জন্যেই নবাব এখনও আমার ওপর সন্দেহ করেনি। সকলের ওপর সন্দেহ হলে সব বন্দোবস্ত গোলমাল হয়ে যাবে
ছোটমশাই বললে–তা হলে আমি এখন কী করব?
মহারাজ বললেন আমি কৃষ্ণনগরে গিয়েই আপনাকে খবর দেব
কিন্তু কী খবরই বা দেবেন, আমি তো কোনও আশা দেখতে পাচ্ছি না।
মহারাজ বললেন–আশা কারও মেটবার কথা নয় ছোটমশাই, নইলে বাদশা আওরঙ্গজেবের মতো লোক বিরেনব্বই বছরে মরবার সময় কখনও ওইরকম কথা বলে যায়? আপনি আমি তো তুচ্ছ। আমরা যদি তিনশো বছর বাঁচি তবু আমাদের আশা মিটবে না।
.
ঘরের মধ্যে ওয়াটসন বললে–ওরা গেছে এখন?
হ্যাঁ, ওদের বিদেয় করে দিয়ে এলাম।
তা হলে এখনই ফোর্টে চলো।
কেন?
কাশিমবাজার থেকে ওয়াটসন ফ্লেচারকে চিঠি দিয়েছে যে, মিরজাফরের সঙ্গে যে আমাদের কথাবার্তা চলছে তা মুর্শিদাবাদে সব জানাজানি হয়ে গেছে। জগৎশেঠজির বাড়িতে যখন ওয়াটস আর উমিচাঁদ গিয়েছিল তখন হঠাৎ সেখানে মরিয়ম বেগম গিয়ে হাজির
সেকী! মরিয়ম বেগম কী করে জানতে পারলে?
ভগবান জানে! শুনলাম মরিয়ম বেগম নাকি জগৎশেঠের বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটি করেছে, বলেছে। তার হাজব্যান্ডের কাছে ফিরে যেতে চায়
ক্লাইভ বললে–অল ব্লাফ। সমস্ত মিথ্যে কথা
কিন্তু সত্যি হোক মিথ্যে হোক, উই মাস্ট বি কেয়ারফুল। চলো, আমি সমস্ত প্ল্যান করে ফেলেছি। কালকে ওয়াটস আর উমিচাঁদ আসছে। ক্যালকাটায়। আমার মনে হয় এখনই আর্মি নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত
ক্লাইভ বললে–আচ্ছা, চলো তা হলে–
দু’জনেই বাইরে বেরোল। আর সময় নেই। একবার ইচ্ছে হল হরিচরণকে বলে যায়। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও তাকে দেখা গেল না।
ওয়াটস জিজ্ঞেস করলে কী খুঁজছ? ক্লা
ইভ বললে–আমার এখানে যে লেডিরা রয়েছে তাদের খবর দিয়ে যাচ্ছি
তোমার এখানে এখনও তারা আছে? ওরা তো রইলই, ওদের জন্যে ভাবছ কেন, এখন চলো পরে এসে দেখা কোরো
একদিকে মিরজাফরের টার্মস, আর অন্য দিকে এরা। ঠিক আছে, একটুখানি ফোর্টে যাবে আর আসবে, কত আর দেরি হবে। অ্যাডমিরাল ওয়াটসনও তখন টানাটানি করছে। তখন আর সময়ও নেই। কাউকে না বলে বাইরে চলে এল। তারপর সেই পেরিন সাহেবের বাগানের ছাউনি পেরিয়ে কর্নেল আর অ্যাডমিরালকে নিয়ে কোম্পানির পালকিটা সোজা ফোর্টের দিকে চলতে লাগল। হেঁইও হেঁই, হেঁইও হেঁই হেঁইও–
*
ইতিহাসের এও বুঝি এক পরিহাস। কে জানত বেগম মেরী বিশ্বাস সেই রাত্রে জগৎশেঠজির বাড়ি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন করে সারা পৃথিবীর মানচিত্রের রং বদলে যাবে। সামান্য এক গ্রামের মেয়ে মরালী! মরালীবালা দাসী, শোভারাম বিশ্বাসের মেয়ে। সে-ই হবে সেই রং বদলের উপলক্ষ। আর বেগম মেরী বিশ্বাস নিজেই কি জানত? না
যতক্ষণ জগৎশেঠজির সঙ্গে ওয়াটস্ আর উমিচাঁদের কথা হয়েছে, সব কান পেতে শুনেছে মরালী। পাশের ঘর থেকে স্পষ্ট সব কথা কানে এসেছে।
তারপর আবার যখন জগৎশেঠজি ঘরে ঢুকল তখন মরালী দূরে সরে এসে নিজের জায়গায় বসল।
জগৎশেঠজি বললেন–এত রাত্রে আপনি এখানে এসেছেন, আপনার চেহেল্-সুতুনে কেউ টের পায়নি।
মরালী বললে–টের তো পেয়েছেই–আমার তাঞ্জামের বেহারারা আমার সঙ্গেই এসেছে, তারা বাইরে রয়েছে–
তা হলে?
কিন্তু আমার তো এখন ওসব কিছু ভাববার সময় নেই।
কিন্তু আপনাকে এখন আমার বাড়িতে থাকতে দিলে আপনারও ক্ষতি হবে, আমারও ক্ষতি হবে
মরালী বললে–আপনার মতো লোকও যদি একথা বলেন তা আমি কোথায় যাব? কার কাছে গিয়ে আশ্রয় চাইব? কে আমার মতো মেয়েদের বাঁচাবে? আমাদের ইজ্জত কে রাখবে?
জগৎশেঠজির বোধহয় দয়া হল। কিংবা হয়তো নিজেকে বাঁচাবার জন্যেই বললেন–আপনি এখন চেহেল্-সুতুনে যান বেগমসাহেবা, পরে আমি হাতিয়াগড়ে আপনার স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে আপনাকে খবর দেব
কিন্তু আমাকে আপনি খবর দেবেন কী করে?
আপনি বলুন আপনাকে কী করে খবর দেওয়া যায়?
মরালী বললে–একজন লোক আছে আমার তার কাছে আমার খবর নিতে পারেন
কে সে?
চকবাজারে সারাফত আলি নামে এক খুশবু তেলওয়ালা আছে, সেখানে সে থাকে। তার নাম কান্ত। কান্ত সরকার। তাকে খবর দিলেই আমি খবর পাব–
সে কে? জগৎশেঠজি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
মরালী বললে–সে আমার দেশের লোক।
পাশের ঘরে তখন ওয়াটস আর উমিচাঁদ অন্য মতলব করছে। যখন মরিয়ম বেগম এসে গেছে। জগৎশেঠজির বাড়িতে তখন আর দেরি করা চলে না। চলুন, চলুন। উমিচাঁদের রক্তের মধ্যে তখন সন্দেহের ফণা ফোঁস ফোঁস করে উঠছে। একবার ফিরিঙ্গি কোম্পানির হাতে ধরা পড়েছে আগে, আর একবার এই মরিয়ম বেগমের হাতেও ধরা পড়েছিল। এবার ধরা পড়লে আর ছাড়া পাওয়া যাবে না। চলুন! চলন!
ভিখু শেখ তখনও কড়া নজর রেখে ফটকের সামনে পায়চারি করছে। হঠাৎ পেছন থেকে দুজন শরিফ আদমিকে আসতে দেখে পা খাড়া করে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল।
সেলাম হুজুর!
কিন্তু তখন আর সেলামের প্রতিদান দেবার সময় নেই কারও। ওয়াটস্ সাহেব বোরখাটা পরে নিয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছে। তারপর সোজা পালকিতে উঠে চড়ে বসল দুজনেই। রাত শেষ হয়ে আসছে। মহিমাপুরের আকাশের পুবদিকে তখন একটা তারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে শুধু। সমস্ত পৃথিবী নিস্তব্ধ। সমস্ত হিন্দুস্থান ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘুম নেই ইতিহাসের। সে নিঃশব্দে নিজের খাতায় সালতামামি করে চলেছে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের। সামনের সাদা পাতায় তখন আরও কী কী লিখবে, ভাবছে। মৃত্যু না জীবন, পতন না উত্থান, ধ্বংস না সৃষ্টি। মোতোমন উল মুলক আলাউদ্দোলা জাফর খাঁ নসিরি নাসির জঙ মুর্শিদকুলি খাঁ যে মসনদ পয়দা করে গিয়েছে, তার যদি অসম্মান কেউ করে তো তার শাস্তির বিধান লেখা হচ্ছে তখন সেই সাদা পাতায়। ইতিহাস-পুরুষ লিখছে আর ভাবছে।–১৭০৭ সালে, হিজরি ১১১৮, ২৮ জেকদ, ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে যেবাদশা আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে নশ্বর দেহ রেখে বেহেস্তে চলে গিয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল তোমাদের মসনদ। হে ক্ষণভঙ্গুর মনুষ্যসমাজ, কিছুই চিরস্থায়ী নয়। ইহা স্থির জানিবে যে তোমাদের নিয়মের চেয়ে আমার নিয়ম আরও কঠোর আরও নিষ্ঠুর। আমি নিয়ম স্থির করে দিয়েছি যে, যেখানে অত্যাচার সেখানেই পতন, যেখানে অন্যায় সেখানেই ধ্বংস, যেখানে অপব্যয় সেখানেই বিলোপ। এ-নিয়ম তোমরা জানো বা না-জানো, শোনো বা না-শোনো, অনাদি কাল ধরে এ-নিয়ম লঙ্ঘন করে কেউ অবিনশ্বর হতে পারেনি। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহাপ্রাণ আকবর বাদশা যে মহতী শাসনীতির প্রবর্তন করে প্রকৃতিপুঞ্জের হৃদয়াসনে দেশীয় ভূপালের সিংহাসন রচনার প্রকৃষ্ট উপায় উদ্ভাবন করেছিলেন, তার অদূরদর্শী উত্তরাধিকারী ভ্রান্তনীতির অনুসরণ করে মোগল রাজশক্তিকে ঘৃণাস্পদ করে তুলেছিল বলেই আমি তার পতন ঘটিয়েছি। সামনে পতনের সংকেত দিলাম, তোমরা যদি সেসংকেত চিনতে পারো তো বাঁচবে,নয়তো ভাগীরথীর স্রোতে তোমাদের ভাগ্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে, দু-তিন শো বছরের মতো। আজ ১১ জুন তারিখের শেষ রাত্রে ইহা লিখিতং। শুভমস্তু।
*
ফ্লেচারকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিল ওয়াট।
ফ্লেচার বলেছিল–এ-চিঠি কর্নেল সাহেবকে দেব, না অ্যাডমিরাল সাহেবকে?
ওয়াটস বললে–প্রথমে ক্যালকাটার ফোর্টে যাবে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের কাছে, তারপর ওয়াটসনকে নিয়ে যাবে পেরিনসাহেবের বাগানে কর্নেল ক্লাইভের কাছে। ভেরি ইমপর্ট্যান্ট ডকুমেন্ট। রাত্রে ঝাপসা অন্ধকারেই ফ্লেচার চলে গিয়েছিল। কিন্তু খানিক পরে আবার এসেছে–স্যার–
কী? কী হল? গেলে না?
ফ্লেচার বললে–স্যার, মরিয়ম বেগমসাহেবা আজ ক্যালকাটায় যাচ্ছে
চমকে উঠেছে উমিচাঁদ। বললে–কে বললে?
স্যার বশির মিঞা, নিজামতের স্পাই
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও—
আর দাঁড়াল না ফ্লেচার। কিন্তু কাশিমবাজারের কুঠিতে বসেও মনটা খচখচ করতে লাগল। তা হলে তো তাদের সব ষড়যন্ত্র জেনে ফেলেছে মরিয়ম বেগম।
উমিচাঁদ বললে–আমিও যাই—
ওয়াটস বললে–তুমি একলা গেলে কেউ জেনে ফেলবে–তার চেয়ে…
তারপর একটু ভেবে বললে–আমিও তোমার সঙ্গে যাব
কোথায়?
ক্যালকাটায়। মরিয়ম বেগম যখন সব জেনে ফেলেছে তখন এখানে থাকা আর সেফ নয়, সেবারের মতো তা হলে নবাব আবার আমাকে অ্যারেস্ট করবে
উমিচাঁদ বললে–তা হলে কুঠি কে দেখবে?
কেউ জানবেনা আমি চলে যাচ্ছি। এখানে কাউকে জানাবনা। তোমার সঙ্গে যেন আমি মর্নিং-ওয়াক করতে বেরোচ্ছি, এইভাবে দুটো ঘোড়া নিয়ে দুজন চলে যাব
তারপর?
ওয়াটস্ বললে–পরের কথা পরে ভেবে দেখব। এখানে সব জানাজানি হয়ে গেছে, এখনই নবাবের লোক এসে যাবে।
উমিচাঁদ বললে–কিন্তু মরিয়ম বেগম কলকাতায় কী করতে যাবে? সেখানে তার কী কাজ? আবার ক্লাইভসাহেবের কাছে যাবে নাকি! আবার কী মতলব?
ওয়াটস্ বললে–কী জানি কী মতলব, কর্নেলসাহেবের তো আবার মেয়েমানুষের ওপর দুর্বলতা আছে। তাকে মিসগাইড করতে পারে
আর দেরি নয়। যেখানকার জিনিস সেখানেই পড়ে রইল। কাশিমবাজার কুঠি থেকে দু’জন। ভোরবেলা বেরোল ঘোড়ায় চড়ে। সবাই দেখলে সাহেবরা বেড়াতে বেরোচ্ছে। ফিরিঙ্গি কুঠির সাহেবরা এমন করেই রোজ বেড়ায়। চাষারা লাঙল নিয়ে খেতের দিকে চলেছে। বর্ষার আগেই খেত খুঁড়ে তৈরি রাখতে হবে। তারপর যখন আরও সকাল হল তখন সামনে ধুধু করছে ফাঁকা পোডো জমি। সেখানে তখন কেউ লোকজন আসেনি। দুটো ঘোড়া জোর কদমে ছুটতে লাগল। যখন আর কোনও কেউ দেখবার ভয় নেই, তখন অগ্রদ্বীপের কাছে এসে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল ওয়াট। ঘোড়া দুটোকে ছেড়ে দিলে, যা চরে চরে ঘাস খেয়ে বেড়া। কাদের একটা নৌকো ছিল ঘাটে। সেই নৌকোটা নিয়েই উমিচাঁদ আর ওয়াট পঁাড় বাইতে লাগল। বললে–কাম অন উমিচাঁদ-কুইক-কুইক–
সাহেবের গায়ে ক্ষমতা আছে বটে। নবদ্বীপে পৌঁছেই ভাল বজরা পাওয়া গেল। খবর পেয়ে কোম্পানির সাহেব পাঠিয়ে দিয়েছে।
ওয়াটস্ জিজ্ঞেস করলে–ফ্লেচারসাহেব এত শিগগির পৌঁছোল কী করে?
হুজুর, গহনার নৌকোকে টাকা দিয়ে জলদি জলদি চলে গেছেন। কোম্পানির ফৌজও কালনার দিকে রওনা দিয়েছে
তোমাকে কে পাঠাল?
অ্যাডমিরাল সাহেব।
বেশ মজবুত বজরা। নবদ্বীপের ঘাট থেকে উঠলে কালনায় পৌঁছোতে দেরি হবার কথা নয়। দাড়িরা ঝপঝপ করে দাঁড় টেনে চলতে লাগল। বদর, বদর
.
হরিচরণের তখন ভয় লেগে গেছে। সত্যি সত্যিই নিজামতের নৌকো নাকি! হরিচরণও তাগাদা দিতে লাগল দাড়িদের। একটু জোরে জোরে পঁাড় বাও মিঞা, জোরে জোরে
কিন্তু আর বোধহয় ঠেকানো গেল না। পেছনের নৌকোটা যেন তিরের বেগে ছুটে আসছে। অন্ধকার চারদিকে। বজরার আলোটা নিবিয়ে দিয়েছে হরিচরণ, তবু যেন তাদের লক্ষ করেই জোরে জোরে বজরাটা ছুটে আসছে।
দুটো বজরাই জোরে চলেছে। কিন্তু আর পারা গেল না। পেছনের বজরাটা কাছে আসতেই হরিচরণ চিৎকার করে উঠেছে সামাল-সামাল
কিন্তু কারা যেন হরিচরণকে ধরে তার গলা টিপে ধরেছে। নৌকোর ওপর ধস্তাধস্তির শব্দ হল খানিকক্ষণ। দুর্গা বাইরে উঁকি মেরে দেখলে অন্ধকারে কালো কালো কটা ছায়ামূর্তি তাদের নৌকোয় উঠে পড়েছে।
কে? কারা তোমরা?
বউরানি ভয়ে দুর্গার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফেলেছে। দুর্গা আবার চেঁচিয়ে উঠল–কে? কারা তোমরা?
ওয়াটস্ তখনও নিজের বজরার মধ্যে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলে ভেতরে লেডি কেউ আছে? জেনানা? মেয়েমানুষ?
হ্যাঁ, হুজুর। একজন নয়, দু’জন।
ওয়াটস্ উমিচাঁদের দিকে চাইলে। বললে–দেখলে তো, আমি বলেছিলাম, মরিয়ম বেগম লুকিয়ে পালাচ্ছিল, তাই আমাদের দেখে বজরার বাতি নিবিয়ে দিয়েছিল–
তারপর পঁড়িয়ে উঠে বললে–চলো, ও-নৌকোয় গিয়ে দেখে আসি
উমিচাঁদ বললে–কিন্তু দু’জন কেন? সঙ্গে কি নানিবেগমসাহেবা আছে?
তা হবে, কিংবা কোনও বাঁদি–
ওয়াটস আর উমিচাঁদ দুজনই এ-নৌকো থেকে ও-নৌকোয় গিয়ে উঠল। মরিয়ম বেগমের নৌকোর দাড়ি-মাঝি-মাল্লাদের হাত-পা-মুখ সব তখন বাঁধা হয়ে গেছে। তারা পাটাতনের ওপর পড়ে রয়েছে, কথা বলতে পারছে না।
উমিচাঁদ বললে–খুব সাবধান ওয়াটস্, মরিয়ম বেগমসাহেবার পেট কাপড়ে ছোরা থাকে-
-ওয়াটস্ বললে–তা থাক, আমার কাছেও পিস্তল আছে—
*
ওদিকে যখন রাত আরও গম্ভীর হল, মতিঝিলের ভেতরে নবাবের হঠাৎ কেমন মনে হল, ঠিক যেমন করে রোজ রাত আসছিল, তেমনি করে আর রাত এল না। প্রতিদিন মরিয়ম বেগমসাহেবা আসে, প্রতিদিন এসে পাশে বসে। রামপ্রসাদের কথা বলে, উদ্ধব দাসের কথা বলে, আর ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে কখন পালিয়ে যায় টের পাওয়া যায় না।
বড় আরামে কাটছিল ক’দিন। অনেকদিন পরে একটু শান্তির মুখ দেখেছিল নবাব।
নানিবেগম যেদিন আসত মির্জা জিজ্ঞেস করত–কেমন আছ নানিজি?
নানিবেগম বলত–তুই কেমন আছিস মির্জা?
আমি খুব ভাল আছি নানিজি!
নানিবেগম বলত–তুই ভাল থাকলেই আমি ভাল থাকি মির্জা। আমার নিজের বলতে আর তো কিছু নেই–তুই-ই আমার সব
আচ্ছা নানিজি—
মির্জা যেন হঠাৎ কী বলতে চায়। তারপর বলে–আচ্ছা নানিজি, ছোটবেলায় তুমি আমাকে অনেকবার ভাল হবার কথা বলতে, না?
হ্যাঁ বলতাম। কিন্তু কেন রে? ওকথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
মির্জা বলে কিন্তু তখন কেন তোমার কথা শুনিনি নানিজি? তোমার কথা না শুনলে আমাকে তুমি বকোনি কেন? কেন আমাকে বলোনি যে, এ-জীবনেই পাপের ফল ভোগ করতে হয় মানুষকে? কেন তুমি শেখাওনি আমাকে যে, মসনদের চেয়ে মানুষের ভালবাসা আরও বড় মসনদ!
নানিবেগম বলত–কিন্তু হঠাৎ তোর একথা কেন মনে এল রে?
না নানিজি, আমি কোরান শুনছিলুম। কোরান শোনার পর আমার ঘুম এল আবার। আজকাল রাত্রে ভাল করে ঘুমোই, তা জানো নানিজি?
নানিবেগম বলত–সে তত ভাল কথা রে। সেই জন্যেই তো আমি কোরান রোজ পড়ি
কিন্তু তা হলে তুমি আমার নানাকে এসব শেখালে না কেন?
নানিবেগমের মুখের জবাব বন্ধ হয়ে আসত কথাগুলো শুনে। নানিবেগমই কি সেদিন কম কষ্ট পেয়েছিল? এই মসনদ কি কারও কাছে আরামের মসনদ ছিল কোনওদিন? নবাব আলিবর্দি কি বিশ্বাসঘাতকতা করেনি নবাব সুজাউদ্দিনের সঙ্গে। একদিন যে-আলিবর্দিকে, যে-হাজি আহম্মদকে সুজাউদ্দিন আশ্রয় দিয়েছিল, তার বিশ্বাসঘাতকতা করতে কেন নবাব আলিবর্দি খাঁ’র বাধল না? সরফরাজ তো কোনও অন্যায় করেনি, তবে কেন আলিবর্দি খাঁ তাকে খুন করতে গেলেন? এ কথা কি সত্যি যে, হাজি আহম্মদ বিষ খাইয়ে সুজাউদ্দিনকে খুন করেছিল? বলল, একথা কি সত্যি?
এসব কথা এতদিন পরে কেন মনে এল মির্জা?
না, তুমি বলো, তোমাকে বলতেই হবে। তোমাকে এর জবাব দিতেই হবে।
এর পর নানিজির আর কোনও জবাব দেবার থাকত না।
তা হলে আজ যদি আমাকে কেউ বিষ দিয়ে নবাব সুজাউদ্দিনের মতো খুন করে ফেলে, তখন তুমি কাঁদতে পারবে? যেমন করে নবাব সরফরাজকে আমার নানাজি খুন করেছিল, তেমনি করে আমাকেও যদি কেউ খুন করে তো তুমি তাকে দোষ দিতে পারবে? বলল, পারবে?
নানিজি কথাগুলো শুনে শুধু কাঁদে। এর জবাব দিতে পারে না।
বলো নানিজি, তোমাকে বলতেই হবে। বলো?
কী বলব, বল?
মির্জা বলে–সত্যি বলল না নানিজি, আমি আমার নিজের পাপের ফলও ভোগ করব আবার নবাব আলিবর্দির পাপের ফলও ভোগ করব? দিল্লির বাদশা যদি কোনও অন্যায় করে থাকে তো তার ফলও ভোগ করব আমি?
নানিজি এসব কথা বেশিক্ষণ শুনতে পারত না। ঘর ছেড়ে চলে যাবার চেষ্টা করত। কিন্তু মির্জা ছাড়ত না। বলত–বলল না নানিজি, আমি কী করব?
নানিজি একটু শক্ত হবার চেষ্টা করত মির্জার সামনে। বলত–কেন রে, এখন তো তোর সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন তো আর কোনও অশান্তি নেই। তুই যা চেয়েছিলি, সব তো পেয়েছিস!
মির্জা বলত–আমি কী পেয়েছি নানিজি?
কেন, কী পাসনি তুই? তুই এই মসনদ চেয়েছিলি, তা তো পেয়েছিস।
মির্জা বলত–একে মসনদ পাওয়া বলে নানিজি? চারদিকের এই ষড়যন্ত্র, চারদিকের এই দুশমনি, এই-ই কি আমি চেয়েছিলুম?
তা হলে বল, কী চাস তুই?
মির্জা বলত–আমি একটু ভালবাসা চাই নানিজি, এখন আর কিছু চাই না!
কেন, আমি কি তোকে ভালবাসি না?
তুমি ভালবাসলে কী হবে নানিজি, আমি তো তোমাকে ভালবাসি না। মরিয়ম বেগমসাহেবা। আমাকে বলেছে যে, ভালবাসা পেলেই শুধু হয় না, ভালবাসার প্রতিদানও দিতে হয়!
তা তুই কি আমাকে ভালবাসিস না মির্জা?
মির্জা বলত–আমি তোমাকে কী করে ভালবাসব নানিজি? পাপ করে করে কি আমার বুকের মধ্যে আর কিছু ভালবাসা আছে যে ভালবাসব?
নানিজি বলত–তুই আর ওসব কথা ভাবিসনি মির্জা, ওসব কথা ভাবলে মসনদ রাখা চলে না, মসনদে বসলে ওসব কথা ভাবতে নেই। কে কী ভাববে, কার কী ক্ষতি হবে, কে আমাকে ভালবাসল না বাসল, ওসব নবাববাদশার ভাবনা নয়। ও ভাবলে তোর মাথা খারাপ হয়ে যাবে
আমার মাথা খারাপই হয়ে গেছে নানিজি!
কিন্তু এই বয়েসেই মাথা খারাপ হলে তো তোর চলবে না মির্জা! তোর ভাল-মন্দের ওপর যে আমাদের সকলের ভাল-মন্দ নির্ভর করছে রে। তোর একটা কিছু হলে তখন আমরা কী করব, আমরা কোথায় যাব? আমাদের কথাও একবার ভাববি তো তুই?
চেহেল-সুতুনে এসে নানিবেগম মরালীকে জিজ্ঞেস করত–কী রে মেয়ে, মির্জা আজকাল অমন করে কথা বলে কেন রে? তুই ওকে কী শিখিয়েছিস? কী বলেছিস ওকে? তুই কি আমার সর্বনাশ করতে চাস?
কেন নানিজি?
কেন, তুই জানিসনে যে, নবাববাদশাদের ওসব কথা শোনাতে নেই!
মরালী বলত–কেন নানিজি, নবাববাদশারা কি আলাদা?
আলাদা না হলে খোদাতালাহ তো সকলকেই নবাব করতে পারত। সকলকে নবাব করেনি কেন? নবাববাদশারা যদি আলাদা না হত তো তাদের কেউ ভয় করত, ভক্তি করত?
কিন্তু তোমার মির্জা যে তাতে শান্তি পায় না নানিজি। শান্তির জন্যেই তো আমি কলকাতা থেকে আসবার সময় তোমার নাতিকে রামপ্রসাদের গান শুনিয়ে দিলুম। শান্তির জন্যেই তো তোমার নাতি আজকাল মৌলভিসাহেবকে ডাকিয়ে কোরান পড়ছে। মসনদের চেয়ে তো শান্তি বড় জিনিস নানিজি!
নানিজি বলত–যা ভাল বুঝিস কর বাপ, আমার কিন্তু ভয় করছে
মরালী বলত–না নানিজি, দেখো, তোমার কোনও ভয় নেই, তোমার মির্জা এবার ভাল হয়ে যাবে
কিন্তু আমার মির্জার জন্যে তোর এত ভাবনা কেন রে? আরও তো কত বেগম রয়েছে চেহেল-সুতুনে, তারা তো কেউ এমন করে ভাবে না?
মরালী বলত–তারা তো আমার মত কেউ এত হতভাগি নয় নানিজি!
সেই তোর এক কথা! তোর কী হয়েছে বল তো? কীসের দুঃখু তোর! বললুম তোকে না হয় তোর সোয়ামির কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি, না হয় যা তুই চাইবি, তাই করে দেব। তা কিছুই তো তুই চাস না–
মরালী বলত–ভগবান যে আমার চাওয়ার মুখে ঝাটা মেরে দিয়েছে নানিজি! লোকে সোয়ামি চায়, সংসার চায়, ছেলেমেয়ে চায়, কিন্তু আমি যে সে-সব কিছুই চাইতে পারিনে নানিজি!
কেন, তোর কী হয়েছে খুলে বল না। চেষ্টা করেই না হয় দেখি, কিছু করতে পারি কিনা তোর জন্যে।
মরালী বলত–তোমার নাতিও আমাকে সেই কথা বলে নানিজি।
তা, সে তো ঠিক কথাই বলে বাছা। মির্জা তোকে ভালবাসে বলেই ওই কথা বলে।
মরালী বলে আমি সেকথা জানি নানিজি। কিন্তু ওই যে বললুম, ভগবান আমার সব চাওয়ার মুখে ঝাটা মেরে দিয়েছে! চাইতে কি আমার অসাধ? কিন্তু কেমন করে চাই? আমি বউ হয়েও কারও বউ হতে পারলাম না, আমার সোয়ামি থেকেও কেউ আমার সোয়ামি হতে পারল না।
নানিজি বলত-কী জানি বাপু, আমি তোর হেঁয়ালি কথা বুঝতে পারি না
কথা বলে আর দাঁড়াত না মরালী, সোজা তার নিজের ঘরে গিয়ে খিল দিয়ে দিত। এ যে কী যন্ত্রণা, তা কাউকেই বোঝানো যেত না,কাউকে বোঝাতে চাইলেও বুঝত না। কান্ত চেষ্টা করেও কখনও বুঝতে পারেনি। কান্তকে অনেকবার মরালী বলেছে–তুমি কেন আমার পেছন পেছন ঘুরছ? তুমি যাও না এখান থেকে। আমাকে না খুন করে কি তুমি শান্তি পাবে না?
কান্ত বলত–কেন, আমি তোমার কী করলুম?
কেন তুমি আমার সামনে সামনে থাকো? কেন তুমি আসো আমার কাছে? তোমার কি আর কোনও চুলোয় যাবার জায়গা নেই? নিজামত ছাড়া কি আর কোথাও চাকরি জোটে না তোমার?
কান্ত বলত–কিন্তু তুমিই তো আমাকে ডাকো মরালী। আমি একদিন না এলে তুমিই তো আমাকে ভাকতে পাঠাও
যাও, এবার থেকে আমি ডাকতে পাঠালেও আর এসো না। খবরদার, আর আসবে না।
মাঝে মাঝে মরালীকে দেখে অবাক হয়ে যেত কান্ত! যেন পাগলের মতো আবোলতাবোল বকত। কান্তকে দেখলে যা ইচ্ছে তাই বলে গালাগালি দিত। আবার কিছুদিন দেখা না হলে ডেকে পাঠাত।
তখন কাছে গেলে মরালী বলত–কী হল, কদিন আসোনি যে?
কান্ত বলত–তুমিই তো আসতে বারণ করলে!
বা রে, আমিও বারণ করলাম, আর তুমিও তাই আসা বন্ধ করলে?
কান্ত বলত–আমি আসিনি বটে, কিন্তু তোমার খবর নিয়েছি। কিন্তু কেন আমার খবর নাও বলল তো তুমি? আমি তোমার কে? তোমার সঙ্গে আমার কীসের সম্পর্ক?
এইরকম আবোলতাবোল কত বকত মরালী। জীবনে কান্ত কখনও মরালীকে বুঝতে পারেনি। একবার মনে হত মরালী তাকে পছন্দ করে। কান্ত যে তার কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে যায়, সেটা তার ভাল লাগে। আবার এক একদিন কী যে হয়, তখন আর তাকে চেনা যায় না।
সেদিন ভোরবেলা মরালীর তাঞ্জামটা যাচ্ছিল মতিঝিলের দিকে। কান্তও পেছন পেছন গেল। তাঞ্জামটা মতিঝিলের ভেতরে গিয়ে ঢুকল। চবুতরায় নেমে ভেতরে যাবার মুখে কান্তকে দেখেই থমকে দাঁড়াল। বললে–কী হল, তুমি আবার এখানে কেন?
তুমি যে আমায় আসতে বলেছিলে?
আমি? আমি আবার কখন তোমায় ডাকলুম?
সেই যে উদ্ধব দাসকে নিয়ে আসতে বলেছিলে। তাকে এনেছি মুর্শিদাবাদে। অনেক কষ্টে তাকে মোল্লাহাটি থেকে ধরে এনেছি।
কিন্তু এখন তো আমার শোনবার সময় নেই। নবাবেরও গান শোনবার সময় হবে না এখন।
কান্ত বললে–তা হলে তাকে চলে যেতে বলব?
মরালী কী যেন ভাবলে। তারপর বললে–এখন যে ভীষণ কাণ্ড বেধে গেছে এর মধ্যে। তুমি জানো না কিছু? বোধহয় আমিও আর বাঁচব না
সেকী?
কান্ত অবাক হয়ে গেল মরালীর কথা শুনে। মরালী বলছে কী? অনেক দিন কান্তই মরালীকে সাবধান করে দিয়েছে। আর মরালীই আজ কান্তকে ভয় পাইয়ে দিলে? কান্ত আরও কী বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ওদিকে চবুতরার মধ্যে যেন কারা এল। অনেক লোকজনের ভিড় হতে লাগল।
তবু কান্ত এগিয়ে গিয়ে বললে–কী হয়েছে বলো না মরালী!
মরালী বললে–ওয়াট সাহেব কাশিমবাজার কুঠি ছেড়ে পালিয়েছে
কান্তর মনে আছে, সেদিন সেই ওয়াটসাহেবের পালিয়ে যাওয়া উপলক্ষ করেই সমস্ত মুর্শিদাবাদে যেন ঝড় বয়ে গিয়েছিল। সেদিন আর ভাল করে ঘুমই হয়নি কান্তর। শুধু কান্তর কেন, মুর্শিদাবাদে কি কারওই ঘুম হয়েছিল? চকবাজারের রাস্তায় রাস্তায় আবার সবাই গুজগুজ ফিসফিস আরম্ভ করেছিল মনে আছে। সবাই সে সময় কান পেতে থাকত। মিরজাফর সাহেব নাকি ফিরিঙ্গি ফৌজের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আপনি কিছু শুনেছেন জনাব? কিছু শোনেননি? এ ওকে জিজ্ঞেস করে, ও একে। চকবাজারের রাস্তায় রাস্তায় আবার ঘোট ঘোট জটলা হয়। সকলের মুখ শুকিয়ে যায় খবর শুনে। তবে কী হবে? আবার লড়াই শুরু হবে নাকি? তা হলে মরিয়ম বেগম এতদিন কী করছে? যে গনতকারটা রোজ মানুষের ভাগ্য গণনা করত চকবাজারের রাস্তায় বসে, সেও যেন তখন অন্যমনস্ক হয়ে অন্য আলোচনা করছে। কান্ত সব কথা কান পেতে শুনতে লাগল সমস্ত দিন ধরে। এ কী হল! বুড়ো সারাফত আলি আবার রোজকার মতো সন্ধেবেলা খুশবু তেলের দোকান খুলে বসল। আবার রোজকার মতো আগরবাতির ধোঁয়ার সঙ্গে তাম্বাকুর গন্ধ মিশে রাস্তা মাতোয়ারা করে তুলল। কথাটা বোধহয় সেও শুনেছে। ইয়া আল্লা, জিন্দগির আশা তা হলে পূরণ হবে তার। নেশা তার আরও চড়ে যায়। সন্ধেবেলা বাড়িতে ফিরতেই উদ্ধব দাস জিজ্ঞেস করে–কী গো বাবুসাহেব, তোমার নবাব আমার গান শুনবে না?
*
বহুদিন পরে ছোটমশাই আবার হাতিয়াগড়ে ফিরে এসেছে। কোথায় মুর্শিদাবাদ, কোথায় কেষ্টনগর, কোথায় কালিঘাট আর কলকাতা। সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে বড় কান্ত হয়ে পড়েছিল। জগা খাজাঞ্চিমশাই একলা কত দিক সামলাবে! ডিহিদার রেজা আলিও বসে থাকবার লোক নয়। একটা-না-একটা ছুতো করে খাজাঞ্চিখানায় আসে, মুনশি পাঠায়। খোদ মুর্শিদাবাদ থেকে আরও ভেট চেয়ে পাঠিয়েছে নিজামত, তারই তাগাদা করে। ঘি, নয়তো গুড় নয়তো তামাক। আবওয়াব দিয়েও রেহাই নেই। নিজামতের খাতায় যা লেখা আছে তা তো আদায় করবেই, তারপর যা লেখা নেই তারও বরাত আসে।
কিন্তু আসবার সঙ্গে সঙ্গে মহিমাপুর থেকে জগৎশেঠজির চিঠি নিয়ে নোক এসেছে।
বড়গিন্নির মেজাজ আরও বিগড়ে গেল সব শুনে। বললে–তা হলে চুপ করে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বাড়িতেই বসে থাকো। আর কিছু করতে হবে না–
ছোটমশাইয়ের বলবার মুখও ছিল না।
একদিন ছোটমশাইয়ের পূর্বপুরুষরা যে বংশের প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিল ত্যাগ-ভোগ–সংযম-সংগ্রাম দিয়ে, এই এতদিন পরে যেন তারই পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে তার ওপর দিয়ে। এতদিন পরে যেন তারই পূর্বপুরুষ আবার বিদেহী আত্মা নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এতদিন পরে এসে যেন আবার বলছে–তোমার ধর্ম, তোমার বংশ, তোমার নিষ্ঠা, তোমার দেশ, তোমার কাছে আজ সাহস চাইছে, তোমার কাছে তোমার বীর্য চাইছে। আজ তোমার পরীক্ষার দিন। আজ তোমার আত্মবিশ্লেষণের দিন। হয় তুমি ত্যাগ করে দরিদ্র হও, নয়তো আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করো। একক সংগ্রাম যদি সম্ভব না হয়, তা হলে যৌথ সংগ্রাম করো। এ তোমার নিজের অধিকারের প্রশ্ন নয়, এ তোমার নিজের বংশের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নও নয়, এ তোমার রাজ্য, তোমার প্রজা-সাধারণ সকলের অস্তিত্বের প্রশ্ন। সকলের অস্তিত্বের প্রশ্ন নিয়ে আজ ইতিহাস তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এর জবাব তোমাকে দিতে হবে।
রাত্রে ঘুমোত ঘুমোতেও ছোটমশাই জেগে ওঠে। প্রতিদিনকার পৃথিবী তার চাহিদা নিয়ে সামনে এসে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে–কই, তোমার জবাব দাও
বড়গিন্নি ভোরবেলা বুড়োশিবের মন্দির থেকে পুজো দিয়ে ফিরে এসে বলে–কী ভাবছ?
ছোটমশাই বলে–না, কই, কিছু ভাবছি না তো!
বড়গিন্নি আর থাকতে পারে না। বলে–দোহাই, আর বসে থেকো না, একটা কিছু করো, তোমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলে আমার ভাল লাগে না
কিন্তু কী করব তুমি বলে দাও?
আমিই যদি বলব তো আমি পুরুষমানুষ হলেই পারতাম।
কিন্তু একটা কিছু পরামর্শ দেবে তো?
তোমাদের এত বড় বড় মাথা রয়েছে, তারা থাকতে আমি দেব পরামর্শ?
ছোটমশাই বলে-মহারাজ তো বললেন আরও কিছুদিন সবুর করতে
কেন, কীসের জন্যে সবুর করব? মহারাজের নিজের বউকে যদি নবাব চুরি করে নিয়ে যেত তো মহারাজই কি সবুর করতেন?
না, সে ব্যাপার নয়। ক্লাইভসাহেব চেষ্টা করছে খুব। আমাকে বলে কিনা আমার বউ নবাবের হারেমের ভেতরে মদ খায়–আমি বললুম তা কক্ষনও হতে পারে না।
বড়গিন্নি বললে–তা বললে–না কেন, সে মদই খাক আর জাহান্নামেই যাক, সে আমরা বুঝব?
তা তো বললাম।
তা শুনে কী বললে?
ছোটমশাই বললে–এত ব্যস্ত মানুষ যে কথা বলবার সময়ই নেই সাহেবের। কথা বলতে বলতে নোক এসে গেল। আর আমরা চলে এলুম। আমি বলে এলুম দরকার হলে আমি ফিরিঙ্গিদের টাকাকড়ি দেব, হাতি দেব, নবাবের সর্বনাশ না হলে আমার ঘুম হচ্ছে না
তুমি বলে এলে ওই কথা?
তা বলব না? মহারাজের সামনেই ওকথা বলেছি। মহারাজও তার সাক্ষী আছেন! মহারাজকেই কি কম বলেছি? কাকে বলতে বাকি রেখেছি? জগৎশেঠজির সঙ্গে দেখা করেও সব বলে এসেছি। তুমি কি ভাবছ আমি সেখানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকি শুধু? শুনলাম এখন নাকি নবাব ছোটবউয়ের হাতের মুঠোর মধ্যে। ছোটবউ যা বলে নবাব তাই-ই করে। মুর্শিদাবাদের সব নোক সেই কথা বলছে।
আর দুগ্যা? সে-মাগি কী করছে সেখানে বসে বসে? ছোটবউয়ের না-হয় আক্কেল গেছে, কিন্তু সে তো সেয়ানা, তার তো বুদ্ধি-বিবেচনা আছে? সে কী বলে তাল দিচ্ছে?
ছোটমশাই বললে–তাকে সঙ্গে পাঠালাম সবকিছু সামলাবার জন্যে, আর সে পর্যন্ত একটা খবর দিচ্ছে না
বড়গিন্নি বললে–তার কথা ছেড়ে দাও, সে ছোটলোক। ছোটলোকের আর কত বুদ্ধি হবে। কিন্তু তুই যে পোড়ারমুখি নিজের মুখ পোড়ালি, আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মুখও পোড়াচ্ছিস, তোর একটা আক্কেল-বিবেচনা নেই?
ছোটমশাই বললে–তুমি সব না-জেনে না-শুনে তাকে গালাগালি দিচ্ছই বা কেন?
দেব না? আমি তাকে নিজে ঘরে আনলুম, আমিই তাকে এ বাড়ির বউ করে আনলুম, আর আমারই এমন করে সর্বনাশ করলে? আমি তার এই সংসার নিয়ে কী করে দিন কাটাচ্ছি, তা সে বুঝতে পারছে না? এ কি আমার সংসার না তার সংসার, না ভূতের সংসার?
জগা খাজাঞ্চি ভয়ে ভয়ে কাছে আসে। কাজকর্ম বুঝিয়ে সইসাবুদ আদায় করে নিয়ে যায়। সেদিন তার ওপরেও রেগে খাপ্পা হয়ে গেল ছোটমশাই। বললে–সব কাজ আমাকেই যদি করতে হয় তো তুমি আছ কী করতে খাজাঞ্চিবাবু?
মাথা চুলকোতে চুলকোতে চলে যায় জগা খাজাঞ্চিবাবু। অথচ এই জগা খাজাঞ্চিবাবু আছে বলেই তবু টিকে আছে হাতিয়াগড়, তা-ও জানে ছোটমশাই।
আবার সেদিন জগা খাজাঞ্চিবাবু সামনে আসতেই রেগে উঠল ছোটমশাই।–আবার? আবার কী করতে এসেছ শুনি? আমাকে না মেরে তুমি ছাড়বে না?
কিন্তু জগা খাজাঞ্চিবাবু একটা চিঠি দিতেই ছোটমশাই অবাক হয়ে গেল।
কার চিঠি?
চিঠিখানার চেহারা দেখেই ছোটমশাই একেবারে লাফিয়ে উঠেছে। জগৎশেঠজির নিজের নামের সিলমোহর করা লেফাফা। চিঠিখানার একটা ধার ছিঁড়ে ফেলেই ভেতরের লেখা পড়তে লাগল ছোটমশাই: এই পত্রবাহক মারফত জানাইতেছি যে আপনার সহধর্মিণী শ্রীমতী মরিয়ম বেগমসাহেবা কাল রাত্রে আমার হাবেলিতে আসিয়া আমার সহিত দেখা করিয়াছিলেন। তিনি আপনার কাছে ফিরিয়া যাইতে ইচ্ছুক। আমার নিকট তিনি নিজের দুঃখ-দুর্দশার কথা সবিস্তারপূর্বক নিবেদন করিলেন। আমি তাহাকে আশ্বাস দিয়াছি যে, আমি আমার যথাসাধ্য তাহার জন্য করিব। এই পত্রপাঠমাত্র আপনি আমার এখানে চলিয়া আসিবেন। অন্যথা করিবেন না। এখানে নিজামতের ব্যাপারে নিরতিশয় গণ্ডগোল চলিতেছে। কখন কী হয় কিছুই বলিতে পারা যায় না। এই সময়ে আপনার সহধর্মিণীকে সরাইয়া লওয়া যাইতে পারে। পরে এ-সুযোগ আর কখনও না-আসিতে পারে। ইতি–
ছোটমশাই চোখ তুলে দেখলে জগা খাজাঞ্চিমশাই তখনও সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
জিজ্ঞেস করলে–এ-লোক কোথায়?
আজ্ঞে, অতিথিশালায় বসিয়ে রেখে এসেছি।
ছোটমশাই বললে–ঠিক আছে, তাকে যেতে বলে দাও
জগা খাজাঞ্চিমশাই চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে আবার ডাকলে ছোটমশাই–শোনো
জগা খাজাঞ্চিমশাই ফিরল।
ছোটমশাই কী বলতে গিয়েও থেমে গেল।
বললে–না থাক, তুমি যাও
জগা খাজাঞ্চিমশাই চলে যেতেই ছোটমশাই চিঠিখানা হাতে নিয়ে বড়গিন্নির মহলের দিকে চলতে লাগল।
*
আপনি ফেব্রুয়ারির সন্ধির অনুরূপ কার্য না করিয়া নানাপ্রকার ছল করিয়া আসিতেছেন। চার মাসে অঙ্গীকৃত অর্থের মাত্র পঞ্চমাংশ শোধ করিয়াছেন। সন্ধিবন্ধনের সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজগণকে বাংলা হইতে তাড়াইবার জন্য ফরাসি সেনাপতি বুশিকে আহ্বান করিয়াছেন। ফরাসি সেনানি ল’কে এখনও রাজধানী হইতে পঞ্চাশ ক্রোশ দুরে নিজ অর্থে পোষণ করিতেছেন। অকারণে ইংরেজগণকে অপমান করিয়াছেন। ফৌজ পাঠাইয়া কাশিমবাজার কুঠি অনুসন্ধান করিয়াছেন, একবার ইংরেজ উকিলকে দরবার হইতে দূর করিয়া দিয়াছেন। অঙ্গীকৃত স্বর্ণমুদ্রা দেন নাই, এবং উমিচাঁদই ইংরেজগণকে ওইরূপ অঙ্গীকারের কথা বলিয়াছে বলিয়া তাহাকে নগর হইতে বহিস্কৃত করিয়াছেন। পক্ষান্তরে ইংরেজগণ সহিষ্ণুতার সহিত সমস্ত সহ্য করিয়াছেন। পাঠান আক্রমণসংবাদে ভীত হইলে তাহারা সাহায্য করিতে প্রস্তুত ছিলেন। এক্ষণে উপায়ান্তর না দেখিয়া ইংরেজ সৈন্য মুর্শিদাবাদ যাত্রা করিল। সেখানে গিয়া আপনার দরবারের প্রধান পাত্র-মিত্র মিরজাফর, দুর্লভরাম, জগৎশেঠজি, মিরমদন ও মোহনলালের উপর ভার দিব। তাহারা যাহা মীমাংসা করিবেন, রক্তপাত পরিহারের জন্য আপনি তাহা স্বীকার করিয়া লইবেন, ভরসা। করি।
ইংরেজ ফৌজ আগেই কলকাতা ছেড়ে চলে গেছে। ক্লাইভ সাহেব চিঠিটার নীচেয় সই করে ফ্লেচারের হাতে দিলে।
তারপর নিজেও নৌকোয় চড়ে বসল। দু’শ নৌকোর ব্যবস্থা হয়েছে। পেরিন সাহেবের বাগানে কেউ নেই বলতে গেলে। সব ফাঁকা। শুধু পাহারা দেবার জন্যে কয়েকজন সেপাই রইল। ক্লাইভ সাহেব আরও কয়েকজনকে নিয়ে বজরায় উঠে বসল। কলকাতা থেকে নবদ্বীপ। নবদ্বীপ থেকে ছ’ক্রোশ দূরে পাটুলি, পাটুলি থেকে ছ’ক্রোশ দূরে কাটোয়া। সেখান থেকে আরও, উত্তরে সাঁকাই। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন আগেই চলে গেছে।
হঠাৎ মনে হল আর একটা নৌকো দূর থেকে সাদা কাপড় ওড়াচ্ছে।
হু ইজ দ্যাট? ও কে! ও কারা?
ক্লাইভ নৌকো থামাতে বললে। বললে–স্টপ হিয়ার
পেছনের নৌকোটা ছুটতে ছুটতে আসছে সোঁসোঁ করে। তারপর একটু কাছাকাছি আসতেই ওয়াটস চিৎকার করে উঠল-কর্নেল
ক্লাইভ অবাক হয়ে গেছে। বললে–কাশিমবাজার কুঠি ছেড়ে চলে এসেছ?
ইয়েস। কিন্তু আর একটা নিউজ আছে কর্নেল। আমরা মরিয়ম বেগমকে অ্যারেস্ট করেছি
কোথায়?
ভেতরে আছে।
*
তারপর? তারপর কী হল?
উদ্ধব দাস সেই গল্প এসে শুনত মরালীর সামনে বসে। আর বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্য লিখত।
সে বলত—তারপর? তারপর কী হল?
ক্লাইভ সাহেব উদ্ধব দাসকে বড় খাতির করত। বড় ভালবাসত তাকে। বলত–পোয়েট, তুমি নবাবকে গান শোনাতে পারলে না, কিন্তু আমি তোমার গান শুনেছি। তুমি তো মেরীর জীবন কাহিনী লিখছ, কিন্তু আমার জীবন কাহিনী কে লিখবে?
আশ্চর্য না আশ্চর্য, ইতিহাসে কে কার কাহিনী লেখে! সেই ক্লাইভ সাহেবই কি জানত, একদিন তারও কাহিনী লিখবে উদ্ধব দাস। উদ্ধব দাসকে একদিন সাহেব জিজ্ঞেস করেছিল লাইফের মানে কী, পোয়েট?
তার মানে? উদ্ধব দাস বুঝতে পারেনি প্রশ্নটা।
সাহেব বলেছিল–আমি এত যুদ্ধ করলাম, এত কাণ্ড করলাম, অথচ মনে হয় এ যেন আমার ঠিক হল না, আমি ন্যায় করলাম কি অন্যায় করলাম বুঝতে পারছি না। আমি ছিলুম গরিব, হয়েছি বড়লোক, কিন্তু তবু মনে হয় ঠিক যেন এই জীবন আমি চাইনি! বলতে পারো পোয়েট, কেন এমন হয়?
উদ্ধব দাস বলত–দেখুন প্রভু, মানুষ যখন জন্মায় তখন সে কাঁদে, আর সবাই হাসে—
ক্লাইভ বলত–তা তো বটেই মানুষ জন্ম হলেই কান্না দিয়ে শুরু হয় তার জীবন
কিন্তু যখন সে চলে যায় তখন আর সবাই কাঁদে, সেই কেবল হাসতে হাসতে চলে যায়। যে তেমন করে হাসতে হাসতে যেতে পারে, সেই মানুষের জীবনই তো সার্থক প্রভু
কথাটা ক্লাইভ সাহেবের ভাল লেগেছিল। সেইদিন থেকেই মরালী দেখেছিল ক্লাইভ সাহেব যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার শেষ জীবনটা দেখেনি সে। শুধু কানে শুনেছিল। সে বড় মর্মান্তিক শেষ। সমস্ত মুর্শিদাবাদ সেদিন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। সেদিন কোথায় ছিল এই উদ্ধব দাস আর কোথায় ছিল বা সে নিজে।
আরও মনে পড়ে সেই রাত্রের কথা। সে রাত্রে তার মান-সম্ভ্রম সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে সে ছুটে গিয়েছিল জগৎশেঠজির বাড়িতে। কে যেন তার কানে কানে বলে দিয়েছিল, সেই রাত্রেই তার চরম সর্বনাশ হবে। জগৎশেঠজি বলেছিলেন–আপনি যান বেগমসাহেবা, আমি আপনার স্বামীর কাছে খবর পাঠাব
কিন্তু কে তার স্বামী? কোথায় তার স্বামী? যে-মেয়ে স্বামীর হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল তাকে কেমন করে অন্য লোকে উদ্ধার করবে? তাই তাঞ্জামটা আবার মহিমাপুর থেকে তাকে নিয়ে ফিরে এসেছিল। মহিমাপুর দিয়ে ফিরে আসবার সময়ই দেখেছিল, সেই ভোরবেলা কাশিমাজার কুঠি থেকে সাহেবরা ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে বেরোচ্ছে।
মুখ বাড়িয়ে মরালী বেহারাদের জিজ্ঞেস করেছিল–ওরা কারা রে? ওরা কারা?
বেহারারা তাঞ্জাম থামিয়ে খবর এনে দিয়েছিল। ও হল ওয়াটস্ সাহেব আর উমিচাঁদ সাহেব। বেতে বেরিয়েছে।
কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল মরালীর। এমন তো হবার কথা নয়।
আর তারপর পঁড়ায়নি সেখানে। সেখান থেকে চলে গিয়েছিল সোজা একেবারে মতিঝিলে। মতিঝিলে তখন সব শান্ত, সব নিঝুম। সেখানে গিয়ে তাঞ্জাম ছেড়ে দিয়েছিল।
বেহারাদের বলে দিয়েছিল সোজা গঙ্গার ঘাটের দিকে যেতে। ঝালর দেওয়া তাঞ্জাম। ঝালর ঢাকা থাকলে কারও জানবার কথা নয় ভেতরে কে আছে।
মরালী বলে দিয়েছিল কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তো বেহারারা যেন বলে দেয়, মরিয়ম বেগমসাহেবা কলকাতার দিকে চলে গেছে।
গঙ্গার ঘাটে নিজামতের নবাবি বজরা সাজানো থাকে সার সার। নবাব যখন খুশি গিয়ে হাজির হতে পারে সেখানে। হঠাৎ যদি নবাবের ইচ্ছে হয় বিহার করবার তো বজরা ছেড়ে দিতে হবে। তখন আর দেরি করা চলবে না।
খালি তাঞ্জামটা সেখানে গিয়ে থামল। তখন বেশ অন্ধকার। গমগম করছে অন্ধকার। তখন চেহেল্-সুতুনের নহবতখানার ইনসাফ মিঞা সুর ধরেনি। তাঞ্জামটা গিয়ে থামতেই বজরার মাঝিমাল্লা টের পেয়েছে।
কে? কে রে?
মাঝিমাল্লারা তাড়াতাড়ি দাঁড় নিয়ে তৈরি হয়ে পড়ছে। হয় নবাব এসেছে, নয়তো নবাবের বেগমসাহেবা।
তাঞ্জাম নামল। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ নামে না।
বেহারারা মাঝির কাছে গিয়ে কানে কানে যেন কী বললে। আর মাঝিমাল্লারাও তৈরি হয়ে বজরা ছেড়ে দিলে। সেই ভোররাত্রে মুর্শিদাবাদের গঙ্গার ঘাট থেকে খালি বজরাটা বদর’ বদর’ বলে পাল তুলে কাছি খুলে দিলে।
কথাটা যেন কেউ জানতে না পারে মিঞাসাহেব, মরিয়ম বেগমসাহেবার হুকুম, দেখো
মাঝি বললেন ভাইসাহেব, কেউ জানবে না
তারপর তাঞ্জামটা আবার মুখ ঘোরাল। আবার ফিরতে লাগল চেহেল্-সুতুনের দিকে। কিন্তু ফেরবার মুখেই বশির মিঞার নজরে পড়ে গেছে।
বশির মিঞা ফিরছিল মোহরার সাহেবের হাবেলি থেকে। কেমন যেন সন্দেহ হল তাঞ্জামটা দেখে। এই তাঞ্জামটাকেই দেখেছে সে জগৎশেঠজির বাড়ির চবুতরে। আবার এখন দেখছে গঙ্গার ঘাটের কাছে।
কী ভাইসাহেব, কার তাঞ্জাম যাচ্ছে?
বেগমসাহেবার মিঞাসাহেব, বেগমসাহেবার।
কোন বেগমসাহেবার?
মরিয়ম বেগমসাহেবার! মরিয়ম বেগমসাহেবা শ্যায়র করতে গেল কলকাতায়
তাজ্জব হয়ে গেল বশির মিম। মরিয়ম বেগমসাহেবা। মরিয়ম বেগমসাহেবা শ্যায়র করতে গেল কলকাতায়। তবে তো মতলব ধরা গেছে। এতক্ষণ জগৎশেঠজির বাড়িতে ছিল। এতক্ষণ ওয়াটস সাহেব আর উমিচাঁদ সাহেবও ছিল সেখানে। তা হলে কি সব তালাস পেয়ে গেল নাকি বেগমসাহেবা? তালাস পেয়ে কলকাতায় খবর দিতে গেল?
সঙ্গে আর কে গেল ভাইসায়েব?
সঙ্গে গেল বাঁদি, আর কে যাবে?
তোবা, তোবা! বশির মিঞা আর দাঁড়াল না সেখানে। দূর থেকে দেখা গেল নিজামতের বজরাটা তখন অন্ধকার মাঝ-গঙ্গাতে পাল তুলে দিয়ে সোঁ সোঁ করে এগিয়ে চলেছে। সোজা সেখান থেকে বশির মিঞা একেবারে মোহরার সাহেবের বাড়ির দিকে ছুটল।
কিন্তু পথেই দেখা ফিরিঙ্গি কোম্পানির হরকরার সঙ্গে। সে ফ্লেচার সাহেব।
বশির মিঞা বললে–কী সাহেব, এত রাত্তিরে কোথায় চলেছ?
ক্যালকাটায়।
বশির মিঞা বললে–আরে, আমাদের মরিয়ম বেগমসাহেবাও যে তোমাদের ক্যালকাটায় গেল।
কেন? হোয়াই?
তা জানিনে। শায়েদ মতলব উতলব কিছু আছে!
ফ্লেচার সাহেব কী যেন ভাবলে। তারপর ঘোড়াটার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললে–যাই, ওয়াটস সাহেবকে খবরটা দিয়ে আসি গিয়ে–
বলে ফ্লেচার সাহেব চলে গেল। কিন্তু বশির মিঞাও আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে না। মোহরার সাহেবকে খবরটা দিলে খুশি হবে। অনেক গালাগালি দিয়েছে ফুপা সাহেব। এ-খবরটা দিলে এবার খুশ করা যাবে তাকে।
*
ভোররাত্রেই খবরটা এল। জগৎশেঠজির বাড়িতে যা কিছু সলাপরামর্শ হয় সবই রাত্রে। বেশি রাত্রেই তার কাজ কারবার। মোগল আমলে যখন নবাব বাদশারা রাত্রের আসরে নাচের আর গানের তালে বিভোর হয়ে থাকে, তখনই শুরু হয় আমির-ওমরাওদের কাজের পালা। দিনেরবেলায় যে কাজ সেকাজ প্রকাশ্য কাজ। সেখানে শুধু আইন কানুনের বাঁধা-পথে চলা-ফেরা। ঠিক জায়গায় ঠিক লোককে তসলিম জানানো, ঠিক-ঠিক সহবত, ঠিক-ঠিক নজরানা। তখন আদবকায়দায় কোনও ভুল নেই। তখন যার যা তকমা নিয়ে চাপরাস নিয়ে ঠিক-ঠিক ব্যবহার। কিন্তু রাত্রের বেলাতেই আসল রূপ তাদের। তখন কাকে ওঠাতে হবে, কাকে নামাতে হবে, কাকে বধ করতে হবে, কাকে খেতাব দিতে হবে, এইসব মতলব।
শেষরাত্রের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন জগৎশেঠজি! অনেক সম্পত্তির মালিক হলে ঘুম থাকার কথা নয়। সম্পত্তি যত ভারী হয়, ঘুম তত পাতলা হয়ে আসে। পেট ভরে ঘুমোয় জগৎশেঠজির ঝি-চাকর-নোকর-চোপদারবরদার-বেহারারসুইকর সবাই। তারা খেতেও যেমন ঘুমোতেও তেমনি। কিন্তু সেদিন ডাকাডাকিতে তাদেরও ঘুম ভাঙল। ভিখু শেখ খবর পাঠালে সদরে। সদরের লোক খবর পাঠালে অন্দরে। অন্দরের লোক খবর পাঠালে অন্তঃপুরে।
কী খবর?
খবর শুনে জগৎশেঠজির আর শুয়ে থাকা হল না। গোসলখানায় ঢুকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন। তখনও ভাল করে ভোর হয়নি।
অত্যন্ত চুপিচুপি কথা। অত্যন্ত আস্তে আস্তে।
কী খবর?
মেহেদি নেসার সাহেব একেবারে নিজেই সরাসরি চলে এসেছে। মনসুর আলি মেহের মোহর সাহেব নিজে ঘুম থেকে উঠে মেহেরবানি করে তাকে খবরটা দিয়ে গেছে। এ সময় আর কারও ওপর নির্ভর করা যায় না। নবাব সব টের পেয়ে গেছে।
মরিয়ম বেগমসাহেবাকে নবাব ভোররাত্রেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
সেকী? বেগমসাহেবা যে আমার বাড়িতেই রাত্রে এসেছিল। আমার সামনে অনেক কান্নাকাটি করলে। আমি তাই শুনে তখনই হাতিয়াগড়ে লোক পাঠিয়ে দিলুম।
সে-লোক চলে গেছে নাকি?
হ্যাঁ, তাকে হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েই তো আমি ঘুমোতে গেলুম। বলে দিলুম যত তাড়াতাড়ি পারো ছোটমশাইকে গিয়ে খবরটা দেবে।
মেহেদি নেসার সাহেব বললে–আপনি এত সহজে শয়তানির ধাপ্পাবাজিতে ভুললেন জগৎশেঠজি! ওদিকে উমিচাঁদ আর ওয়াটস্ সাহেবও কাশিমবাজার কুঠি ছেড়ে পালিয়েছে। সে-খবর নবাবের কানে উঠে গেছে।
কী করে কানে গেল? তোমাদের চর বেইমানি করেনি তো?
না শেঠজি, আমার লোক বেইমানি করবে না।
তা হলে নবাব টের পেলে কী করে? নবাবকে কে খবর দিলে?
মেহেদি নেসার বললে–আবার কে? মরিয়ম বেগমসাহেবা!
তা হলে কি ক্লাইভসাহেব এখনও কলকাতায় আছে? ক্লাইভসাহেবের তত ১২ জুন তারিখে মুর্শিদাবাদে রওনা দেবার কথা!
মেহেদি নেসার সাহেব বললে–কী জানি, আর তো কোনও খবর পাবার উপায়ই নেই, কাশিমবাজার কুঠিতে যে-লোক খবরাখবর আনত সে তো আর এখানে আসবে না!
তা হলে মিরজাফরসাহেব কোথায়?
তার হাবেলিতে!
মিরজাফরসাহেব কি জানে যে, মরিয়ম বেগমসাহেবা কলকাতায় পালিয়ে গেছে?
মেহেদি নেসার বললে–তা জানি না। বোধহয় খবর পাননি!
তা হলে তুমি এখনই গিয়ে তাকে খবরটা দিয়ে দাও। ক্লাইভসাহেবের সঙ্গে মিরজাফরসাহেবের যে-চিঠি চলছে তা যদি বেগমসাহেবার হাতে পড়ে তা হলে যে সব ফাঁস হয়ে যাবে! তা হলে যে একসঙ্গে সকলের কোতল হয়ে যাবে! ইয়ার লুৎফ খাঁ-কেও খবরটা দিয়ে এসো–সকলের সাবধান হওয়া দরকার
বড় সন্দেহের, বড় সাবধানের, বড় সতর্কতার সেই দিনগুলো। আর সেই রাতগুলো। মেহেদি নেসার সাহেবের চলে যাওয়ার পরও জগৎশেঠজি কিছুক্ষণের জন্যে চুপ করে বসে রইলেন। শুথু তো মসনদের পরিবর্তন নয়, মসনদের সঙ্গে সঙ্গে যে সমস্ত মুর্শিদাবাদে ওলোটপালোট হয়ে যাবে। সরফরাজ খা’র মৃত্যুর পর যেমন করেছিল আলিবর্দি খাঁ, তেমনি করে কড়া হাতে সমস্ত কিছুর দখল নিতে হবে। ফৌজের লোকেরা এখনও কিছু জানে না। তারা জানবার আগেই সব হাসিল করতে হবে। সেখানে মিরবকশি হয়ে মোহনলাল এখনও নবাবের দলে রয়েছে। কিন্তু আর কতদিন! একদিন-না-একদিন খবর আসবেই। খবর ঠিক এসে পৌঁছোবে যে ক্লাইভ আর অ্যাডমিরাল ওয়াটসন সাহেব মুর্শিদাবাদের দিকে সেপাই কামান-জাহাজ নিয়ে এগোচ্ছে, তখন নবাবের ঘুম ভাঙবে! তখন নবাব জগৎশেঠজিকে ডেকে পাঠাবে।
আস্তে আস্তে দিন হল। জগৎশেঠজি সকাল থেকেই অপেক্ষা করতে লাগলেন। কোনও খবর এল না। সারাটা দিন বড় অস্বস্তিতে কাটল। জগৎশেঠজির দফতরে কানুনগো আর সেরেস্তা আর গোমস্তার দল আবার যথারীতি কাজ করতে এল। জগৎশেঠজিও সকালবেলা দফতরে গেলেন। চোখের সামনে হিসেবের খাতা। খাতার পাতায় অঙ্কের অক্ষরগুলো অনেকগুলো শূন্য বুকে করে তার দিকে হা করে চেয়ে রইল। অঙ্ক নয় যেন, অঙ্কের পাহাড়। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি শূন্যের অঙ্ক যেন হঠাৎ চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। একদিন নবাব বাদশার প্রয়োজনেই জগৎশেঠের সৃষ্টি হয়েছিল, এখন যেন আবার নবাববাদশার সৃষ্টি হল জগৎশেঠের জন্যে! সুদের অঙ্ক যেন নিয়ম করে বাড়ছেনা। সুদ কমে গিয়ে যেন আসলে গিয়ে ঠেকতে চাইছে। তবে আর কীসের জন্যে জগৎশেঠগিরি! তিনিই যদি জগৎশেঠ তো নবাব কেন তাকে হুকুম করে। হঠাৎ পাতার ওপর অঙ্কের শূন্যগুলো যেন তাঁকে চড় কষাতে লাগল। যেন অঙ্ক নয়, নবাব। নবাব যেন খাতার পাতায় কামানের গুলি ছুঁড়ে দিয়েছে। অথচ এই অঙ্কগুলো যদি না থাকত তো কোথা থেকে নবাবিনা আসত। কোথা থেকে চেহেল-সুতুন আসত। কোথা থেকে মতিঝিল-বেগম-মসনদ-তাঞ্জাম-হাতি কামান-গোলাগুলি আসত!
সমস্ত রাস্তাটা তিনি কান পেতে রইলেন। কই, কেউ তো কিছু বলছে না। কেউ কি জানে না যে, ক্লাইভ সাহেব ফৌজ নিয়ে মুর্শিদাবাদে আসছে! কেউ কি জানে না যে, এবার থেকে মিরজাফর খাঁই নিজের বিছানা পাতবে চেহেল্-সুতুনে, নিজের দরবার বসাবে মতিঝিলে।
প্রতিদিন এমনি করেই এই রাস্তা দিয়েই জগৎশেঠজি দফতরে যান। জগৎশেঠজির পালকি দেখলেই মুর্শিদাবাদের লোক তাকে উদ্দেশ করে মাথা নিচু করে হাত জোড় করে প্রণাম করে। রাস্তার লোক সসম্ভ্রমে দু’পাশে সরে দাঁড়ায়। অঙ্কের শূন্যগুলো তার বাড়ির লোহার সিন্দুকের ভেতরে থাকে, শুধ তিনি যান দফতরে। দফতরের হিসেবের খাতার পাতায় নিজের চোখে সেই শূন্যগুলোকে দেখেন আর নিশ্চিন্ত মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। সব ঠিক আছে। টাকা-পয়সা কড়া-ক্রান্তির কূট ভগ্নাংশটা পর্যন্ত তাঁর খাতায় ঠিক লেখা থাকে। নবাব যাই বলুক, ওই হিসেবের খাতার শূন্যগুলোর জন্যে নবাব মুর্শিদাবাদের নবাব আর বাদশা দিল্লির বাদশা। একটা শূন্যও যদি খাতা থেকে কম পড়ে তো নবাবের মতিঝিলের একটা মশাল সঙ্গে সঙ্গে নিবে যাবে, চেহেল সুতুনের খাবার থালায় সঙ্গে সঙ্গে একটা পদ কমে যাবে। যতক্ষণ জগৎশেঠজি আছেন ততক্ষণ নবাবও আছে। শুধু আছে নয়, সগৌরবে সবিক্রমে আছে।
হঠাৎ বাজারের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে একটা গুঞ্জন কানে এল। ওটা কীসের গুঞ্জন? ওটা কীসের কোলাহল?
গুঞ্জনটা ক্রমেই যেন কোলাহলে পরিণত হল। জগৎশেঠজি বাইরে মুখ বাড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। এরা? এরা কারা? এ কি কোম্পানির সেপাই? সেপাইরা বন্দুক নিয়ে ঢুকে পড়েছে। নাকি? মুর্শিদাবাদে কখন এল? আজ তো ১২ জুন। এত শিগগির ওরা এসে গেল এখানে?
চোখের সামনে যেন চকচক ঝকমক করে উঠল সেপাইদের তলোয়ারগুলো। তলোয়ার উচিয়ে তারা ছুটে আসছে ভেতরের দিকে। মতিঝিলের দিকে। চেহেল্-সুতুনের দিকে।
জগৎশেঠজি চিৎকার করে তাড়া দিলে বেহারাদের–চল চল, জলদি চল–জলদি
কিন্তু ইতিহাসের চেয়ে জলদি আর কে চলতে পারে! ইতিহাসের পালকি লক্ষ লক্ষ সূর্যের বেহারারা চালায়। তারা ভোরবেলা পুব দিক থেকে ওঠে আর রুদ্ধ নিশ্বাসে আকাশ পরিক্রমা করে, তাদের গতির সঙ্গে কে পাল্লা দেবে? কোন জগৎশেঠের এত ক্ষমতা? তুমি জগৎশেঠ হতে পারো কিন্তু আমি ব্ৰহ্মাণ্ডশেঠ। এই বিশাল বিরাট ব্রহ্মাণ্ডে তুমি কতটুকু? তোমার কত টাকা আছে যে তুমি আমার সঙ্গে পাল্লা দেবে? তুমি আজ নবাবকে হটিয়ে দিচ্ছ, কিন্তু একথা কি তুমি জানো যে, তোমাকেও একদিন আর একজন হটিয়ে দেবে! সেদিন তোমার টাকা তোমাকে বাঁচাতে পারবে না, তোমার খ্যাতি তোমাকে বাঁচাতে পারবে না, তোমার বিত্ত-সম্পত্তি-আত্মীয়রাও তোমাকে পরিত্যাগ করবে। সেদিন কোনও রবার্ট ক্লাইভ কোনও কোম্পানির ফৌজ নিয়েই আর রক্ষে করতে পারবে না তোমাকে। সেদিন রবার্ট ক্লাইভের মতোই তুমিও মুছে নিঃশেষ হয়ে যাবে চিরকালের মতো!
জগৎশেঠজি!
একেবারে চমকে উঠেছেন নিজের নামটা শুনে! কে? কে ডাকলে আমাকে?
সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন–না না, আমি কেউ নই, আমি কিছু নই, আমি কারও দলে নেই, আমার সঙ্গে মিরজাফর উমিচাঁদ, ক্লাইভ, ওয়াটসন কারও কোনও সম্পর্ক নেই আমাকে ছেড়ে দাও, আমায় মুক্তি দাও আমার গলায় বড় লাগছে
আমি মেহেদি নেসার, আমায় চিনতে পারছেন না?
এতক্ষণে যেন হুশ হল। চারদিকে চেয়ে দেখলেন জগৎশেঠজি। এ কোথায় তিনি! এ তো রাস্তা নয়। এ তো তার নিজের ঘর। এ তো তিনি তার নিজের ঘরেই বসে আছেন আর তার সামনে দাঁড়িয়ে মেহেদি নেসার সাহেব।
মেহেদি নেসার বললে–মিরজাফরসাহেবকে নবাব বন্দি করেছে, সেই কথাই আপনাকে বলতে এসেছি
মিরজাফর খাঁ-কে ধরেছে?
হ্যাঁ।
জগৎশেঠজি বললেন–তা হলে তো আমাদের সকলকেই ধরবে, আমাদেরও বন্দি করবে!
মেহেদি নেসার বললে–আপনার কথা শুনে আমি সকালেই গিয়েছিলাম মিরজাফরসাহেবের বাড়ি, সেখানে গিয়েই দেখি নিজামতের সেপাইরা বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে। তখন আর এখানে আসতে পারিনি–এখন এলাম।
জগৎশেঠজি কী বলবেন ভেবে ঠিক করতে পারলেন না।
মেহেদি নেসার বললে–অত ভাবনার কিছু দরকার নেই, ওদিকে মরিয়ম বেগমসাহেবাকেও ধরে ফেলেছে ক্লাইভসাহেব
সেকী?
হ্যাঁ! মরিয়ম বেগমসাহেবা কলকাতায় গিয়েছিল চালাকি করতে, যাতে ক্লাইভের ফৌজ মুর্শিদাবাদে না আসে, কিন্তু রাস্তাতেই ওয়াটস্ সাহেব আর উমিচাঁদের নজরে পড়ে যায়, তারাই বেগমসাহেবাকে ক্লাইভসাহেবের হাতে তুলে দিয়েছে–
হঠাৎ বাইরের সদর-ফটকে মতিঝিলের পেয়াদা এসে দাঁড়াল।
ভিখু শেখ জিজ্ঞেস করলে-ক্যা হুয়া!
নবাবের পেয়াদার সঙ্গে ভিখু শেখ একটু নরম করেই কথা বলে।
জগৎশেঠজির নামে পরওয়ানা আছে।
ভেতরের দরবারে জগৎশেঠজির হাতে পরওয়ানা পৌঁছোতেই তিনি চমকে উঠলেন। যা ভেবেছেন তাই। পরওয়ানা তারও এসেছে। যখন তারও পরওয়ানা এসেছে তখন সকলেরই এসেছে। ওই মিরজাফর খাঁ’র এসেছে, ইয়ার লুৎফ খাঁ’র এসেছে, উমিচাঁদ সাহেবের এসেছে, মেহেদি নেসারের এসেছে, ইয়ারজান সাহেবেরও এসেছে
মেহেদি নেসারও দেখলে। দেখে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। সব ফঁস হয়ে গেল নাকি! এতদিনের সব ষড়যন্ত্র, সব আয়োজন সব মতলব বিলকুল ফাঁস হয়ে গেল!
জগৎশেঠজি মেহেদি নেসারকে জিজ্ঞেস করলে–কে ফাস করে দিলে?
মেহেদি নেসার সাহেবও বুঝতে পারছিল না। বললে–মরিয়ম বেগমসাহেবা ফাস করে দিতে পারে। কিন্তু তাই-ই বা কী করে হয়, মরিয়ম বেগমসাহেবাকে তো ধরে ফেলেছে ক্লাইভ সাহেব।
ধরে কোথায় রেখেছে?
তা জানি না।
নবাবের মতিঝিলের পেয়াদা পরওয়ানা দিয়ে তখনই চলে গিয়েছিল। জগৎশেঠজি বললেন–তা হলে আমি তৈরি হয়ে নিই–তুমি এসো–
বলে জগৎশেঠজি অন্দরমহলের দিকে চলে গেলেন। নবাবের পরওয়ানা বিধাতার পরওয়ানার চেয়ে কি কিছু কম জরুরি?
*
ছোটমশাই চিঠি পেয়েই রওনা দিয়ে দিলেন হাতিয়াগড় থেকে। এতদিন পরে আবার ছোট বউরানিকে পাওয়া গেছে, এ কি কম কথা নাকি? ধর্ম হয়তো গেছে, কিন্তু ধর্মের চেয়েও যা বড়, ধর্মের চেয়েও যা মহৎ তার আকর্ষণ কি কিছু কম?
হয়তো পুরুতমশাই বিধান দেবেন। বলবেন, প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। মুসলমানের সঙ্গে ছোওয়া-লেপা করেছে, মুসলমানের রান্না খেয়েছে, সেটা কম অপরাধ নয়। হোক বড় অপরাধ, কিন্তু তবু তো একবার দেখতে পাবেন তাকে।
বড়গিন্নি আসবার সময় বলে দিয়েছিল–খবরটা পেলে আমাকে জানিও, আমিও যাব মুর্শিদাবাদে
তা তুমি আবার কেন যাবে?
বড়গিন্নি বলেছিল–আমি গিয়ে তাকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞেস করব—
কী কথা বলল না, সেগুলো না-হয় আমিই জিজ্ঞেস করব!
তুমি জিজ্ঞেস করলে হবে না। আমি তাকে শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করব। পোড়ারমুখি জাত যদি দিয়েই থাকে তো ধম্ম দিয়েছে কিনা তাই জিজ্ঞেস করব।
তার মানে? জাত আর ধর্ম আলাদা জিনিস নাকি?
বড়গিন্নি বলেছিল–সে তুমি বুঝবে না–সে তোমার বোঝবার দরকারও নেই, তুমি যাও শিগগির, যা হয় আমাকে জানিও, তারপর যাকরবার আমি করব
এরপর আর কিছু বোঝবার চেষ্টা করেনি ছোটমশাই। সোজা তাড়াতাড়ি দাঁড় বেয়ে চলে এসেছিল মুর্শিদাবাদে। কিন্তু মুর্শিদাবাদে এসে মহিমাপুরের ঘাটে নেমেই কেমন যেন মনে হল চারদিকে থমথমে ভাব। ঘাটের ওপর মাঝিমাল্লারা যেন কেমন অন্যমনস্ক। কী হল ওদের? এমন তো হয় না। অন্যবার ওরা রাঁধা বাড়া করে, গান গায়, নমাজ পড়ে, কেউ বা কৌতূহলি হয়ে তার দিকে চায়। এবার কী হল? মুর্শিদাবাদে কিছু হয়েছে নাকি? কিছুই বুঝতে পারলে না ছোটমশাই।
বুঝতে পারলে মহিমাপুরে জগৎশেঠজির হাবেলিতে এসে।
জগৎশেঠজির দেওয়ান সামনেই ছিল। বললে–শেঠজি বাড়িতে তো নেই এখন
কোথায় গেলেন তিনি? আমি তো তার চিঠি পেয়েই এসেছি
দেওয়ানজি বললে–তা জানি আমি, তিনি গেছেন মতিঝিলে, নবাবের পরওয়ানা এসেছিল
পরওয়ানা? পরওয়ানা কেন?
দেওয়ানজি বললে–মিরজাফর খাঁ সাহেব ধরা পড়ে গেছেন, তা জানেন না আপনি?
কবে? কখন? তা হলে সব ফাস হয়ে গেছে নাকি?
হয়তো ফাঁস হয়েছে, সকলের নামেই পরওয়ানা বেরিয়েছে। ইয়ার লুৎফ খাঁ, মেহেদি নেসার সাহেব, ইয়ারজান সাহেব, জগৎশেঠজি, কেউ বাদ নেই।
ছোটমশাই জিজ্ঞেস করলে–তা হলে কী হবে?
দেওয়ানজি বললে–কী হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। জগৎশেঠজি না ফিরলে কিছুই বলতে পারছি না-আপনি বসুন, বিশ্রাম করুন, তারপর দেখা যাক কী হয়। নিজামতের অবস্থা বড় খারাপ
কেন, খারাপ কেন?
খারাপ তো বটেই। কাশিমবাজার কুঠির ফিরিঙ্গিরা তো সব কুঠি ছেড়ে পালিয়েছে!
পালাল কেন?
দেওয়ানজি বললে–নিশ্চয়ই কোম্পানির হেড-অফিস থেকে নোটিশ এসেছিল সেই রকম,নইলে কি এমন করে সবকিছু ছেড়ে কেউ পালায়?
তা হলে কি ফিরিঙ্গিরা যুদ্ধটুদ্ধ বাধাবে নাকি?
দেওয়ানজি বললে–আপনি বিশ্রাম করুন, জগৎশেঠজি যদি আসেন তো তার মুখ থেকেই সব শুনতে পাবেন–
বলে, দেওয়ানজি ঘর ছেড়ে ভেতরের দিকে চলে গেল।
*
মতিঝিলের মধ্যে তখন দরবার বসেছে পুরোদমে। মুর্শিদকুলি খাঁর যা-কিছু সম্পত্তি ছিল সুজাউদ্দিন খাঁর আমলেই তার সবটুকু নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন বিলাসী মানুষ। অল্প টাকায় তার চলত না। তার কাছে টাকা ছিল হাতের ময়লা। বেগমদের নিয়ে দোল খেলেই লক্ষ লক্ষ টাকা উড়িয়ে দিনে এক রাত্রে। পরের জমানো টাকা। নিজের গতর নিজের মাথা ঘামিয়ে সে টাকা রোজগার করতে হয়নি। তাই টাকার ওপর মায়া ছিল তার কম।
কিন্তু আলিবর্দি খাঁ যখন নবাব হলেন তখন বাদশাহি পেশকস দিতেই ফতুর হয়ে গেলেন। তারপর আছে ঘুষ। দিল্লির বাদশার কাছে বাদশাহি সনদ আনা কি অত সহজ! ঘুষ না দিলে কি বাদশার মিনিস্টারদের কাছে পাত্তা পাওয়া যায়? আমির-ওমরাওরা হাঁ করেই বসে আছে। আগে আমাদের প্রণামী দাও তবে বাদশার কাছে তুমি পৌঁছোতে পারবে। চিরকাল এই নিয়মই চলে আসছে, সুতরাং তোমাকেও সেই নিয়ম মানতে হবে।
তারপর গেছে বর্গিদের হাঙ্গামা।
টাকা না জল! বাংলাদেশের রক্ত নিংড়ে যা টাকা পাওয়া গেছে সব গেছে বর্গি তাড়াতে। বর্গিরা যাবার পর মাত্র তিনটি বছর রাজত্ব করেছিলেন আলিবর্দি খাঁ। তিন বছর পরেই ওপার থেকে ডাক এসেছিল তার। সিরাজ-উ-দ্দৌলা যখন নবাব হল তখন নিজামতের ভাঁড়ারে মাত্র সেই ক’টা বছরের জমানো টাকা। সেই জমানো টাকা নিয়েই মির্জা মহম্মদের মসনদ আরম্ভ হয়েছিল।
কিন্তু মিরজাফর আলির ধারণা ছিল অন্যরকম।
মিরজাফর খাঁ বলেছিল-আমিনবাব হলে টাকার অভাব হবে না আপনাদের আপনাদের আমি লক্ষ লক্ষ দিয়ে ক্ষতিপূরণ করব
কিন্তু ঠিক যখন সব তৈরি তখন এমন করে যে ধরা পড়ে যাবে তা ভাবতে পারেনি কেউই।
ভোর থাকতেই নিজামতের ফৌজ গিয়ে মিরজাফর খাঁ’র বাড়িতে হামলা করলে। আশেপাশের বাড়ি থেকে যারা ঘটনাটা দেখতে পেয়েছিল, তারা যে যার বাড়ির ভেতরে গিয়ে আবার ঢুকল। নবাবি রাগ কখন কার ওপর গিয়ে পড়ে তার ঠিক নেই। এর কান থেকে ওর কানে গিয়ে পৌঁছোল কথাটা।
চকবাজারের রাস্তায় তখন কানাকানি শুরু হয়ে গেছে।
একজন বললে–নবাব মিরজাফরকে কোতল করে ফেলেছে বড়ে ভাইয়া
যারা শুনল তারা অবাক হয়ে গেল। একজন ওরই মধ্যে আবার প্রতিবাদ করে উঠল–দুর, মিরজাফরসাহেবকে খুন করবে বাংলা মুলুকে এমন কেউ নেই
আর একজন বললে–তা হলে মিরনসাহেব আছে কী করতে রে! মিরনসাহেব তো গুন্ডা! গুন্ডা কি ছেড়ে কথা বলবে?
অন্য একজন বললে–আরে রেখে দে তোর মিরন গুন্ডার কথা। মিরনসাহেব আমাদের মতো ঘোট আদমির সঙ্গে গুন্ডামি করবে, নবাবের ফৌজের সঙ্গে গুন্ডামি করতে হিম্মত চাই
আরে হিম্মত দেখাতে যাসনে মিরনসাহেবের কাছে! গুম-খুন করে ছাড়বে তোকে।
শেষকালে মিরনের সাহস আছে না সাহস নেই, এই নিয়ে দুই দলে তর্ক বেধে গেল। তর্ক বাধলেই ভিড় জমে। আরে, নবাব কি কম গুন্ডা নাকি? নবাবের ছোটবেলাকার গুন্ডামি যারা একদিন দেখেছে তাদের কাছ থেকে সেসব দিনের ইতিহাস অনেকে শুনেছে। নবাব মির্জা মহম্মদ কি গুন্ডামি কম জানে ভেবেছিস? নবাব নিজেই গুন্ডামি শেখাতে পারে তোদের। আমার চাচার কাছে শুনেছি, নবাব বাচপানমে আওরতদের ধরে ধরে বজরায় পুরে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। সেসব জমানা আমার চাচা দেখেছে। তুই কী জানিস? তুই তো সেদিনকার ছোকরা!
ছোকরা কথাটা উচ্চারণ করতেই একজন রেগে উঠল। –ছোকরা বললি কেন আমাকে? আমি কি তোর নওকর? আমার বাপ তোর বাপের চেয়ে বেশি মাইনে পায় নিজামতে, তা জানিস?
তারপর শুরু হয়ে গেল হাতাহাতি।
ঘটনাটা ঘটছিল সারাফত আলির দোকানের সামনে।
এই, ভাগ ইহাসে, ভাগ যা–
একজন বললে–হুজুর, শালা বলছে নবাব মিরনকে ভয় করে!নবাব ডরপোক আদমি! শরিফ আদমিকে গালাগালি দিচ্ছে বেওকুফ
কে শরিফ আদমি? কৌন হারামি বলছে নবাব শরিফ আদমি?
সারাফত আলির গলা চড়ে উঠল–নি যা ইধারসে! হাজি আহম্মদ কা পোতা কভি শরিফ হো সকতা হ্যায়? ভাগ ইহাসে, ভাগ যা তু লোগ–
সারা মুর্শিদাবাদে এই রকমই চলে। কাজকর্ম না থাকলে যা হয় তাই। নতুন জমানার বাচ্চারা কেবল দিনভর চৌকের রাস্তায় বেত্তমিজি আর বেলেল্লাগিরি করে কাটায়। তারা জন্ম হওয়ার পর থেকে দেখে আসছে খোশামোদ আর ঘুষ দিলে যে কাজ হয়, সত্যি কথা আর সততায় সেকাজ হয় না। নিজামতে নোকরি পেতে গেলে কারও জামাই হওয়া চাই, কারও ছেলে হওয়া চাই, কিংবা কারও পোতা হওয়া চাই। আর তা যদি না হতে পারো তো ঘুষ দাও। ঘুষের কড়ি যদি তোমার না থাকে তো
আমির-ওমরাওদের মেয়েমানুষ জোগাও। যে কাজ টাকা দিলে হাসিল হবে না, সেকাজ মেয়েমানুষ দিলে জলের মতো সোজা হয়ে যাবে। শুধু মুর্শিদাবাদ কেন, দিল্লির বাদশাকে কাত করতেও ওর চেয়ে বড় হাতিয়ার আর দুসরা কিছু নেই। যাদের বয়েস পনেরো-ষোলো তারা দেখেছে গুণের কদর নেই। নিজামতে, সবচেয়ে বেশি কদর ঘুষের। ঘুষের আর আওরতের। আরে ইয়ার, আলিবর্দি নবাব কখনও খাজনা পাঠিয়েছে বাদশার দরবারে? নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা কখনও পাঠিয়েছে? দুনিয়াদারি আলখ জিনিস! যা কোরানে লেখা আছে সবকিছু বেত্তমিজ, যা গীতা-রামায়ণ-মহাভারতে লেখা আছে সব ঝুটা বাত। ওগুলো আমাদের মাদ্রাসা আর পাঠশালায় ওরা পড়ায় ওদের সুবিধের জন্যে। ওরা চুরি করবে, বেত্তমিজি করবে, আর আমাদের বলবে কোরান পড়তে, গীতা পড়তে! দুনিয়াদারির কানুন বদলে গেছে। ইয়ার। ওই কোরান-গীতা ভি বদলাতে হবে। নইলে তোমাদের কথা আর শুনব না।
ওদিকে যখন কোম্পানির সিলেক্ট কমিটির দফতরে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে নতুন যুগের মানুষরা সারা পৃথিবীতে নতুন বাজার খুঁজতে বেরিয়েছে, জেসাস ক্রাইস্টের ক্রস বুকে ঝুলিয়ে পৃথিবীর মানুষকে স্লেভ করে রাখতে এসেছে, তখন হিন্দুস্থানে বাদশার দরবারে ঘুষ না দিলে সনদ পাওয়া যায়, মেয়েমানুষ না দিলে খেলাত পাওয়া যায় না। তখন পণ্ডিত, মৌলবি, সাধু, ফকির, কোরান, গীতার কোনও কদর নেই। কদর আছে শুধু সেলামের আর খোশামোদের। আজ যে নবাবের ভাল চায় নবাব তার ভাল চায় না। যে নবাবের নজরে পড়তে পারবে, নবাব তারই ভাল চাইবে। সেই নজরে পড়বার জন্যেই আমির-ওমরাওদের প্রিয় হতে হবে। আমির-ওমরাওদের খুশি করতে হবে। আমির-ওমরাওদের খোশামোদ করতে হবে। কিন্তু খোশামোদ করবার লোকেরও তো সংখ্যা কম নয়। তাদের সকলের ভিড় ঠেলে সামনে যাব কেমন করে! আমার কী আছে যে আমাকে তুমি খাতির করবে? আমার টাকা নেই, আমার মেয়েমানুষ নেই, আমার খোশামোদ করবার ক্ষমতাও নেই। তোমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছোতে পারব এমন ক্ষমতাও আমার নেই। আমি থাকি মুলুকের এক প্রান্তে, সেখানকার . ডিহিদার তালুকদার আমার কথা শুনবে কেন? অনেক কায়দা করে যদি তাদের হাত করতে পারি তো. তবে বড় জোর তোমার মিরবকশির কাছ পর্যন্ত পৌঁছোতে পারব। কিন্তু তারপর? তারপর কি তোমারই এমন সময় আছে যে আমি আমার আর্জি তোমার কাছে পেশ করতে পারব। তোমার সময় কোথায়, আমার অভাব-অভিযোগের কথা তুমি শুনবে! তোমার নিজের আরাম আছে, মর্জি আছে, অবসর আছে, আছে খেয়াল-খুশি, খেদমত। খোদাহতালারও হয়তো সময় আছে মানুষের আর্জি শোনবার, কিন্তু নবাববাদশার তো সময় নেই প্রজার কথা শোনবার জন্যে। সে ভুগে ভুগে মরুক, সে জাহান্নমে যাক, সে গোল্লায় যাক। তার কথা আমার কানে তুলো না। কানে তুললে আমার মেহফিলের মজা নষ্ট হয়ে যাবে। আমার মসনদের মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। আমাকে তোমরা শান্তিতে থাকতে দাও।
এমনি করেই পাঠান আমল পার হয়েছে। এমনি করেই মোগল আমলও পার হতে চলেছে। কিন্তু আর বুঝি চলল না। ওদিকে শিখরা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, মারাঠারাও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তারা তো নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া করে করে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এবার সাগর পার থেকে তোমরা এসেছ, তোমরাই আমাদের ভরসা, তোমরা আমাদের বাঁচাও সরকার। এবার থেকে তোমাদেরই সেলাম। করব। সেলাম সরকার, সেলাম!
.
নবাব মির্জা মহম্মদের সামনেও সেদিন সবাই যথারীতি সেলাম করেই দাঁড়িয়েছিল এসে। চিরকাল যারা সেলাম করার দলে তারা দরকার হলে তোমাকে সেলাম করবে, কিন্তু আবার দরকার ফুরিয়ে গেলে অন্য লোককে সেলাম করতেও তাদের বাধবে না।
অন্য সময় হলে মির্জা মহম্মদ বুঝত না। কিন্তু সেদিন বুঝল। একেবারে না-বোঝার চেয়ে দেরি করে। বোঝাও বোধহয় ভাল। সকালবেলাই ফৌজ পাঠিয়েছিল মিরজাফর আলির হাবেলিতে। কোতোয়ালিতে হুকুম হয়েছিল মিরজাফর সাহেবকে হাতকড়া পরিয়ে দরবারে ধরে এনে হাজির করতে। কিন্তু খানিক পরে কী যে হল, নবাব কোতোয়াল সাহেবকে ফিরে আসতে বললে।
বললে–না, আমি নিজেই যাব মিরজাফরসাহেবের কাছে
যা কখনও হয়নি, সেদিন তাই হল। একদিন সেই রাস্তা দিয়েই মির্জা মহম্মদ কতবার খেলা করতে গেছে ওই হাবেলিতে। ছোটবেলায় খেলার জায়গা ছিল ওই হাবেলিটা। ওবাড়ির প্রত্যেকটা ইটের সঙ্গে নবাবের পরিচয় ছিল একদিন। আলিবর্দি খাঁ’র বোনের খসম মিরজাফর আলি।
নানিবেগম বলে দিয়েছিল ওর কাছে ছোট হতেও তোর লজ্জা নেই মির্জা। ওতে তোর ইজ্জত যাবে না। বরং ইজ্জত বাড়বে
মির্জা বলেছিল–কিন্তু তামাম মুর্শিদাবাদের লোক কী বলবেনানিজি? তারা বলবে আজ বিপদে পড়েছে বলেইনবাব মিরজাফরসাহেবকে আবার খোশামোদ করতে এসেছে
তা বলুক মির্জা। লোকের কথায় আর কান দিসনে!
কিন্তু লোকের কথায় কান দিয়েই তো আমার এই দশা হয়েছে নানিজি!
কী এমন দশা হয়েছে তোর যে এমন করে কথা বলছিস?
মির্জা বলেছিল–না নানিজি, মানুষের সম্মানে আর কখনও আঘাত দেব না ঠিক করেছি। এবার থেকে মানুষের মেজাজকেও সম্মান দেব আমি
তা হলে তাই যা, মিরজাফরসাহেবকে গিয়ে নিজে এখেনে ডেকে নিয়ে আয়
প্রথমে মিরজাফর সাহেব অবাকই হয়ে গিয়েছিল মির্জাকে দেখে। হাসতে গিয়েও হাসি বেরোয়নি মুখ দিয়ে। অনেকদিনের অপমানের প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছে হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু মির্জার কথায় বুঝল যে বিপদে পড়লে মানুষ এমনি করেই মাথা নিচু করে।
কিন্তু আমি দরবারে যদি না যাই হলে কি আমাকে তুমি গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে? যদি তাই করতে চাও তো গ্রেফতারই করো!
মির্জা বলেছিল–গ্রেফতার করবার ইচ্ছে থাকলে কি আমি আজ নিজে আসতুম আলিসাহেব? আমি কোতোয়াল পাঠাতুম!
কিন্তু কোতোয়ালকেই তো পাঠিয়েছিলে আমার কাছে। কোতোয়ালকে ফিরে যেতে বললে–কেন?
তা বলে মানুষের কি ভুল হয় না? ভুল করেছি বলেই ভুলের খেসারত দিতে আমি নিজেই এসেছি আপনার কাছে।
কিন্তু আমার কাছে কেন?
মির্জা বললে–আমার আর কেউ নেই বলেই আপনার কাছে এসেছি!
কিন্তু যারা তোমার নিজের লোক তারা কোথায় গেল?
আমার নিজের লোক বলতে কার কথা বলছেন?
কেন? যেদিন আমাকে দরবার থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে সেদিন তো তাদের ওপরেই ভরসা করেছিলে! সেদিন তো তারাই তোমার নিজের লোক ছিল।
কাদের কথা বলছেন? তারা কারা?
কেন, তোমার নিজের শ্বশুর ইরাজ খাঁ, মোহনলাল, মিরমদন, আবার কারা?
আমি নিজে আপনার বাড়িতে এসেছি, মুর্শিদাবাদের নবাব হয়ে আমি আপনার কাছে নিজের ভুলের জন্যে ক্ষমা চাইছি, তবু আপনার রাগ যাবে না?
মিরজাফর আলি বললে–আমার রাগ করাটাই দেখলে, আর তোমার অপমান করাটা বুঝি কিছুই নয়? দরবারে গিয়ে মোহনলালকে কুর্নিশ করার হুকুমটাও বুঝি রাগ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়?
আমি তো বলছি আমি ভুল করেছি। নবাব বলে কি আমি মানুষ নই? আপনি আমাকে আগে যা দেখেছেন, আজ আমি আর তা নই! বিশ্বাস করুন, বাংলা মুলুকের ইতিহাস আমাকে একেবারে বদলে দিয়েছে। আমি আজ অন্য মানুষ।
তার মানে?
মিরজাফর আলি সাহেব মির্জার মুখের দিকে মুখ ফেরাল। ঘরের চারদিকের জানালা-দরজা সব বন্ধ। এখনই বাংলার মসনদের মালিকের মুখখানা চিরকালের মতো বন্ধ করে দেওয়া যায়। তা হলে আর কোনও বাধাই থাকে না মসনদ দখল করার পথে। কিন্তু আলি সাহেবের মনে হল রাজনীতি কূটনীতি বটে, কিন্তু কূটনীতিরও একটা নীতি থাকা উচিত। সে-নীতি বলে যে, তোমার খাদ্যদ্রব্য সামনে এলেও তাকে খেতে নেই। তার সামনে নির্লোভ নিরহংকার সাজতে হয়। নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক সাজতে হয়। তাতে সুবিধে বই অসুবিধে নেই। আজ যখ সমস্ত প্রকাশ হয়ে পড়েছে তখন নবাব তার কাছে এসেছে। অনুশোচনা নিয়ে। খোদাহতালার মর্জি একেই বলে! খোদাহতালার দোয়া একেই বলে!
হ্যাঁ, সত্যিই আমি অন্য মানুষ আলি সাহেব। যে-মানুষ হোসেনকুলি খাঁ-কে খুন করেছিল, যে-মানুষ নিজের মাসিকে গ্রেফতার করে বন্দি করে রেখেছিল, যে-মানুষকে মুর্শিদাবাদের লোক ভয় করত, এখন আর আমি সে-মানুষ নই। বিশ্বাস করুন আলিসাহেব, আমার কথা একবর্ণও মিথ্যে নয়।
তারপর একটু থেমে নবাব আবার বলতে লাগল লোকে বলছে, আমার বদনামের সুযোগ নিয়ে, আমার দুর্বলতার সুবিধে নিয়ে আপনি নাকি কোম্পানির ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে দুশমনি করছেন, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন
লোকে যা বলে বলুক, তুমিও কি তাই বলো?
মির্জা বলতে লাগল লোকের কথা থাক, কিন্তু হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, কাশিমবাজার কুঠি ছেড়ে ওয়াটসই বা চলে গেল কেন? তারপর এই চিঠি
বলে একখানা চিঠি দেখালে বার করে।
এর মানে কী?
মিরজাফর আলি সাহেব চিঠিখানা হাতে নিয়ে পড়লে। তারপর পড়া হয়ে যাবার পর ফেরত দিলে।
এর মানে, এই মুর্শিদাবাদেই আমার মসনদের জন্যে আমাকে লড়াই করতে হবে। আর আপনারা মানে আপনি, জগৎশেঠ, ইয়ার লুৎফ, রাজা দুর্লভরাম, আপনারা সবাই আমাকে ত্যাগ করবেন।
মিরজাফর সাহেব তবু চুপ করে রইল।
এই আমার জীবনের প্রথম লড়াই নয়, আলিসাহেব। আপনি সবই জানেন। লড়াই করতে আমি ভয় পাই না। তামাম দুনিয়ার সকলের সঙ্গে আমি একলা লড়াই করতে রাজি। কিন্তু ওই যে আমি বললাম, এই মির্জা মহম্মদ আর সে মির্জা মহম্মদ নেই। আমি আজ অন্য মানুষ। আপনি জানে না হয়তো আলিসাহেব–আমি আজকাল রোজ কোরান পড়ছি। আমি আজ সকলের ভালবাসা চাই, মুহব্বত চাই। তবে শুননে, কেন এমন হল? আমি কলকাতা থেকে ফিরছিলাম। গঙ্গার ওপর তখন অনেক রাত। বজরার মধ্যে বিছানায় শুয়ে আছি, কিন্তু ঘুম আসছে না। মনের মধ্যে নানারকম ভাবনা ভাবছি। ভাবছি, মসনদ পেয়ে আমার কী লাভ হল, মসনদ পেয়ে আমার কী সুবিধে হল? অথচ ছোটবেলায় জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে এই মনদ নিয়েই তো আমার যত শক্রতা। মসনদের জন্যেই তো আমার রিস্তাদারদের সঙ্গে এত ঝগড়া। জীবনে খুনখারাপি যা-কিছু করেছি সব তো এই মনদের জন্যে। কিন্তু এই কি সেই মসনদ যার জন্যে আমি এত কিছু করেছি? এ-মসনদ আমাকে কী দিলে? এই মসনদ পেয়ে আমি কী পেলুম? ভাবতে ভাবতে ভাবনা আরও বেড়ে গেল। হঠাৎ কোথা থেকে একটা গানের সুর কানে ভেসে এল, আলিসাহেব। মনে হল, এত রাত্তিরে কে গান গাইছে। বাইরে চেয়ে দেখলুম, আর একটা বজরা যাচ্ছে উলটো দিকে। গানটা আসছে সেই বজরার ভেতর থেকে।
মিরজাফর আলিসাহেবের মুখে তখনও কোনও কথা নেই। ভাবলে, নবাব আজ কুটনীতির অন্য ঘোরালো পথ ধরে কথা বলছে। তা হোক, আজ কূটনীতির লড়াই-ই হয়ে যাক এখানে।
তারপর আলিসাহেব, আমি সেই বজরাটা থামাতে বললাম। শুনলাম নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেই বজরায় আছে। আর গান গাইছে রামপ্রসাদ! আপনি রামপ্রসাদের গান নিশ্চয় শুনেছেন আলিসাহেব। আমি বাংলা বিহার উড়িষ্যার সুবাদার, কিন্তু ঘাটে মাঠে নদীতে নৌকোয় যারা দিনরাত একজনের নাম করে সে তো আমিনয় আলিসাহেব, সে তো রামপ্রসাদ। তার তো মসনদ নেই, জায়গির নেই, খেলাত নেই, সনদ নেই, ফার্মান নেই। ভাবলাম, দেখে আসি সেই আর এক সুবাদারকে, যাকে বড়লোক-গরিব সব লোকই মানে। তারপর গেলুম। আমাকে দেখে সেই রামপ্রসাদ উর্দু গজল গান ধরলে। সেঁইয়া গেও পরদেশ, সখিরি ক্যা করু ম্যায়।’আমি বললুম-না, তোমার ওই মায়ের গান গাও
মির্জা মহম্মদ বলতে লাগল–তারপর আলিসাহেব, সে গাইতে লাগল–মা গো আমার এই ভাবনা। আমি কোথায় ছিলাম…
হঠাৎ ফটকের বাইরে কার যেন টোকা পড়ল।
মির্জা মহম্মদ বললে–কে?
মিরজাফর আলি বললে–আমি দেখে আসছি—
মির্জা বললেন আলিসাহেব, এখন যাকে-তাকে ঢুকতে দেবেন না, আজকে আমি অনেক কথা বলতে এসেছি, আমার সব কথা আমি আপনাকে শোনাব।
মিরজাফর আলি সাহেব বললে–ঠিক আছে, আমি আর কাউকে এখানে ঢুকতে দেব না। তোমার কথাই শুনব। তবু দেখে আসি কে। কী জন্যে ডাকছে
বলে মিরজাফর আলি সাহেব ফটক খুলতে গেল।
*
এও ইতিহাসের এক আশ্চর্য ঘটনা। একদিন যেনবাব মতিঝিলের দরবারে সবাইকে ডেকে এনে কুর্নিশ করতে বাধ্য করেছে, সেই নবাবকেই আবার নিজের গরজে একদিন যেতে হয়েছে নিজের ওমরাহের বাড়িতে তোষামোদ করে খুশি করতে। কথায় বলে গরজ বড় বালাই। কিন্তু নবাবের গরজ আরও বড় বালাই।
কিন্তু পৃথিবীর যত বাদশা, যত নবাব অতীতে পাপ করে গিয়েছে, সব যেন একলা নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলারই দায়িত্ব। সকলের সব অপরাধের দায় যেন নবাবের ঘাড়েই এসে পড়েছে। চোখের সামনে যেন নতুন যুগের নতুন মানুষরা এসে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সামনে জবাবদিহি চাইছে। বলছে–জবাব দাও। তোমার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, বৃদ্ধ প্রপিতামহ, অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ, এমনকী প্রাগৈতিহাসিক সব মানুষের সব গুনাহর প্রায়শ্চিত্ত করো।
কে? কারা?
মিরজাফর সাহেব দরজা খুলতে গিয়েছিল। এবার ফিরে এল।
মির্জা মহম্মদ আবার জিজ্ঞেস করলে কে? কে এসেছিল এখন?
মিরজাফর সাহেব বললে–কেউ না, এমনি
এমনি মানে? এমনি কখনও দরজায় শব্দ হয়?
মিরজাফর সাহেব বললে–হয়, হয় মির্জা হয়! এমন শব্দ আমি প্রায়ই শুনি। দিনে রাত্রে দুপুরে, প্রায়ই মনে হয় কে যেন আমার দরজায় ঘা দিলে।
সত্যিই হয় আলিসাহেব? সত্যিই আপনার মনে হয় কেউ যেন দরজায় ঘা দিলে?
হ্যাঁ মির্জাসাহেব, সত্যিই হয়।
কিন্তু আমি ভেবেছিলাম শুধু আমি একলাই শুনি, আমি একলাই শুনতে পাই, আর কারও হয় না। কিন্তু কেন এমন হয় আলিসাহেব? কে অমন ধাক্কা দেয় আলিসাহেব? কারা?
মিরজাফর সাহেব বললেও কিছু নয়, ও মনের ভুল
সত্যিই বলছেন মনের ভুল? সত্যিই বলছেন ও কিছুনয়? কিন্তু আমি ভাবতুম ও শুধু আমারই হয়। আমি ভাবতুম সামনে হয়তো আমার খুব বিপদ আসছে, ও তারই ইঙ্গিত।
মিরজাফর বললে–ও নিয়ে তুমি আর ভেবো না–ওতে আরও শরীর খারাপ হবে—
কিন্তু শরীরের আমার কী দোষ আলিসাহেব। ওদিকে যখন কাশিমবাজার কুঠি থেকে সবাই পালিয়েছে, ওদিকে ক্লাইভসাহেব যখন মুর্শিদাবাদে আসবে বসে শাসাচ্ছে, তখন শরীর খারাপ হবে না? আমার শরীর খারাপ হবে না তো কার হবে? কিন্তু আমি কী করেছি বলতে পারেন? আমি আপনাদের কী ক্ষতি করেছি যে, আপনারা এমন করে মুর্শিদাবাদের সর্বনাশ করছেন? মুর্শিদাবাদ আপনাদের কাছে।
কী দোষ করল? আজ যদি ফিরিঙ্গিরা এসে এখানে হামলা করে তখন কে মুর্শিদাবাদের মানুষদের রক্ষে করবে?
মিরজাফর সাহেব বললে–কিন্তু আমাকে এসব কথা বলছ কেন তুমি? আমি কে? আমাকে তো তুমি নিজামত থেকে তাড়িয়ে দিয়েছ।
আমি আপনাকে তাড়িয়ে দিয়েছি?
তুমি তোমার মিরকশি মোহনলালকে সেলাম করে তবে দরবারে ঢুকতে বলে দিয়েছ সকলকে। আমি যদি সে নিয়ম না মেনে থাকি তো সে কার দোষ? আমার, না তোমার? আমার যদি আত্মসম্মান বলে কোনও জিনিস থাকে তো সে কি আমার দোষ না গুণ। তুমি বাংলার নবাব, তোমার যেমন আত্মসম্মান আছে, তেমনই তোমার প্রজাদেরও তো আত্মসম্মান থাকতে পারে।
কিন্তু সেই অপরাধের জন্যে আপনি আমাকে এত বড় শাস্তি দেবেন?
কে বললে–আমি তোমাকে শাস্তি দিয়েছি?
আপনি ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাননি? আপনি আমাকে মসনদ থেকে উৎখাত করবার জন্যে ফিরিঙ্গি সাহেবদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছেন না বলতে চান? আপনি বলতে চান, আমি যা কিছু শুনেছি সব মিথ্যে? তা হলে কেন আমি দরবার ছেড়ে আপনার এই জাফরগঞ্জের বাড়িতে এলুম? বিপদে না পড়লে কি কোনও নবাব এমন করে তার ওমরাহর বাড়িতে একলা একলা আসে?
তুমি তো আমাকে ধরে নিয়ে যাবার জন্যে ফৌজ পাঠিয়েছিলে। আমি যাব না জেনেই তুমি ফৌজ ফেরত পাঠাবার হুকুম দিয়ে নিজে এসেছ। এ তো তোমার নিজেরই গরজ! নিজের গরজেই তুমি এসেছ। আমার কাছে!
মির্জা মহম্মদ বললে–তা না হয় নিজের গরজেই হল, তবু তো আমি নবাব। আপনিও তো একদিন এই নিজামতের নিমক খেয়েছেন। না হয় সেই নিমকের দোহাই দিয়েই আমি আপনার কাছে আমার আর্জি পেশ করছি
মিরজাফর সাহেব বললে–অমন করে তুমি বোলো না। সোজা করে বলল কী চাও!
দোষ আমার কি আপনার, আপনি ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছেন কি না করছেন সে তর্ক না হয় এখন থাক, সে না হয় পরেও কোনওদিন ফয়সালা হতে পারে। কিন্তু আমি চাই আপনি আমার সঙ্গে থাকুন।
কী হিসেবে থাকব?
আপনার যা ইচ্ছে। আমি কিছু বলব না। ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে এখন আমার যে ফয়সালা চলছে তাতে–আপনি আমার দলে থাকুন এই আমার ইচ্ছে। আপনিও বাংলা মুলুকের একজন মানুষ। বাংলা মুলুকের যাতে ভাল হয়, আপনি তাই করুন। আমি আর কিছু চাই না। যাদের সঙ্গে আমার শত্রুতা তারা আমারও কেউ নয়, আপনারও কেউ নয়। তারা বিদেশ থেকে এসেছে। এসে এখানে আমাদের ঝগড়ার সুযোগ নিয়ে আমাকে চোখ রাঙাবে এ অপমান কি আমার একলার? আপনার অপমান নয়? আমার কোনও ক্ষতি হলে কি আপনার ক্ষতি হবে না?
এত কথা বলছ কেন আমাকে? আমি কি কিছু বুঝি না?
সবই বোঝেন আপনি, মানছি। কিন্তু মানুষের মনে একবার যখন অভিমান হয় তখন কি আর কিছু তার মনে থাকে? আপনি আমার ওপর অভিমান করে ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন আমার সর্বনাশ করবার জন্যে। কিন্তু আমার সর্বনাশ তো আপনারও সর্বনাশ। আমার সর্বনাশ হলে আপনি কি ভেবেছেন আপনিই বাঁচবেন? বলুন, বাঁচবেন?
মিরজাফর সাহেব বললে–আমার কথা এখন কিছু বলব না, বললে–তোমার যা মনের অবস্থা তুমি তা বিশ্বাসও করবে না।
আলিসাহেব, এখন আর কথা বলবার সময়ও নেই। কথা যা বলবার তা পরে হবে। তখন আপনি যত কথা বলবেন আমি শুনব। আমার দিককার কথাও আপনি তখন শুনবেন। এখন আমি আপনাকে শুধু একটা অনুরোধ করব, বলুন আপনি রাখবেন?
বলো!
আপনি আমার সামনে কোরান ছুঁয়ে বলুন যে, এই লড়াইতে আপনি ফিরিঙ্গিদের সাহায্য করবেন না। এই লড়াইতে আপনি মুর্শিদাবাদের স্বার্থ দেখবেন, বাংলা মুলুকের স্বার্থ দেখবেন, বাংলার মসনদের স্বার্থ দেখবেন, আর আমার স্বার্থ দেখবেন?
মিরজাফর সাহেব চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল।
আপনি চুপ করে থাকবেন না আলিসাহেব। কোরান নিয়ে আসুন। কোরান ছুঁয়ে আপনি দিব্যি করুন। কোরান ছুঁয়ে দিব্যি করলে আমি সব ভুলে যাব আলিসাহেব। আপনার বিরুদ্ধে আমি যা কিছু শুনেছি সব ভুলে যাব। একবার ফিরিঙ্গিদের কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দিলে তখন আপনি যা চাইবেন আলিসাহেব, সব দেব। আপনি যদি মুর্শিদাবাদ ছেড়ে নিজের পরিবার নিয়ে দিল্লি গিয়ে বাস করতে চান তাও দেব। আমি সমস্ত বন্দোবস্ত করে দেব আপনার। আপনার যাতে সারাজীবন ভরণপোষণের কোনও কষ্ট না হয় তার ব্যবস্থাও আমি করব কথা দিচ্ছি-আনুন, আপনি কোরান আনুন
মিরজাফর সাহেব বললে–আমার মুখের কথা তুমি বিশ্বাস করবে না?
আপনার মুখের কথাই আমি বিশ্বাস করছি আলিসাহেব। সেই মুখের কথাটাই না হয় কোরানের সামনে হোক। আমি যে আজকাল কোরান পড়ি আলিসাহেব।
কিন্তু কোরান ছুঁয়ে তো আগেও দিব্যি করেছি কতবার, তবু তো তুমি আমাকে অবিশ্বাস করেছ! এ তো প্রথম নয়!
তবু আপনি কোরান আনুন আলিসাহেব। অন্যবারের সঙ্গে এবারের তুলনা করবেন না, এবার আরও খারাপ অবস্থা মুর্শিদাবাদের। এবার হয় হিন্দুস্থান বাঁচবে, নয়তো যাবে। আমি বাঁচলেই তবে হিন্দুস্থান বাঁচবে আলিসাহেব, হিন্দুস্থান বাঁচলে আপনি আমি উমিচাঁদ জগৎশেঠ সবাই বাঁচবে। ভাববেন না আমি মারা গেলে আপনারা বেঁচে যাবেন। এ-বিপদ আমার আপনার সকলের আনুন আপনি, কোরান আনুন।
মিরজাফর কোরান আনতে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল।
আর জাফরগঞ্জের দেবতা, মতিঝিলের দেবতা, মহিমাপুরের দেবতা, হাতিয়াগড়, কলকাতা, হিন্দুস্থান, ইংলন্ড–সকলের দেবতা সবার অলক্ষে মিটিমিটি হাসলেন।
*
হাতিয়াগড় থেকে এসে ছোটমশাই হাঁফিয়ে উঠেছিল। হাতিয়াগড় থেকে মহিমাপুর কম দূর নয়। মহিমাপুরের এই হাবেলিতেই এই নিয়ে কতবার আসতে হল। তবু এবার যেন অনেকটা আশা হচ্ছে। ছোট বউরানির মুখখানা মনে করতে বড় ভাল লাগল। এই ঘরেই, এই এখানেই পালিয়ে এসে আশ্রয় চেয়েছিল। আর কার কাছেই বা যাবে! চেহেল্-সুতুনের ভেতর থেকে পালিয়ে আসা কি অত সহজ। সেখানে খোজাদের চোখ এড়িয়ে বাইরে আসা সহজ নয়। মুর্শিদকুলি খাঁর আমল থেকে সেখানে পাহারাদারি চলছে। আকাশের চন্দ্র সূর্য যারা দেখতে পায় না, তাদের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে ছোট বউরানি। বিয়ের পর থেকে যে-বউ বরাবর ছোটমশাইয়ের পাশে না শুলে ঘুমোতে পারেনি, তাকে আজ মুসলমান হারেমের মধ্যে বন্দি হয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে। ওগো, তুমি তো জানো, তোমাকে ছাড়া আমিও থাকতে পারি না। আজ কতদিন হল আমি কাছারির কাজকর্ম কিছুই দেখতে পারিনি। জগা খাজাঞ্চিবাবু। জমা-খরচের খাতা নিয়ে এসে আবার ফিরে গেছে। সমস্ত হাতিয়াগড়ই অন্ধকার মরুভূমি হয়ে গেছে। আমার কাছে। তোমার কষ্টটাও কি আমি বুঝি না ভেবেছ? মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কেবল ধৈর্য ধরতে বলেন। মহারাজ কী করে বুঝবেন! মহারাজের বয়েস হয়েছে। ছেলে-মেয়ে হয়েছে। কিন্তু আমি তোমাকে কী দিতে পেরেছি?
দেওয়ান মশাইকে আবার ডাকলে ছোটমশাই।
কই, এখনও তো আসছেন না শেঠজি! এত দেরি হচ্ছে কেন?
দেওয়ান মশাই বললে–মিরজাফরসাহেবের সঙ্গে আজ একটা ফয়সালা হচ্ছে কিনা, তাই দেরি হচ্ছে
কীসের ফয়সালা?
দেওয়ান মশাই বললে–আপনি শোনেননি কিছু? কাশিমবাজার কুঠি থেকে ফিরিঙ্গিরা সবাই পালিয়েছে যে
সে তো শুনেছি, কিন্তু পালালে কী হয়েছে? পালানো ভালই তো
দেওয়ান মশাই বললে–কিন্তু না বলেকয়ে পালানো মানেই তো নবাবকে অগ্রাহ্য করা। তা ছাড়া ইংরেজদের সঙ্গে এত ষড়যন্ত্র, এত মাখামাখি সব যে জানাজানি হয়ে গেছে!
কিন্তু জানাজানি হলটা কী করে?
দেওয়ান মশাই বললে–মরিয়ম বেগমসাহেবা সেদিন রাত্রে এখানে এসেছিল, সে তো সব শুনে গেছে
সেকী?
দেওয়ান মশাই বললে–শেঠজি এলেই সব টের পাবেন। মোট কথা, নিজামতের অবস্থা এখন খুব টলোমলো। নবাবের খুব ভয় লেগে গেছে। ক্লাইভসাহেব নবাবকে যে-চিঠি লিখেছে তারপর ভয় হবারই কথা
কী রকম? কী চিঠি লিখেছে?
লিখেছে সেপাই নিয়ে কাশিমবাজারের দিকে আসছে
কেন? আসছে কেন ক্লাইভসাহেব? যুদ্ধ হবে নাকি?
লিখেছে, ফরাসিদের তাড়াবার জন্যে আসছে। লিখেছে–আমরা শিগগির কাশিমবাজারে যাচ্ছি। সেখানে গিয়ে নবাবকে এক দস্তক দিতে হবে যে, ফরাসিদের পাটনা থেকে ধরে আনবার জন্যে দু’হাজার সৈন্যকে আজিমাবাদের দিকে যেতে দিতে হবে।
ছোটমশাই বড় ভাবনায় পড়ল। ঠিক এই সময়েই কিনা গণ্ডগোল শুরু হল। আগে যুদ্ধ হয়েছিল কলকাতার জঙ্গলে। কিন্তু এবার একেবারে রাজধানীতে! রাজধানীর বুকের ওপর! ছোটমশাইয়ের বুকটা দুরদুর করে উঠল।
বললে–জগৎশেঠজি কী বলছেন?
দেওয়ানজি জগৎশেঠজির দফতরের বহু দিনের পুরনো লোক। যা কিছু সলাপরামর্শ করবার সমস্তই দেওয়ানজির সঙ্গে করে তবে কাজে হাত দেন। দেওয়ানজি সব খবর জানে। নবাবের নাকি এখন। একেবারে চরম অবস্থা। ফরাসিদের তাড়িয়ে দিলেও ভেতরে ভেতরে তাদের মাইনে ঠিক দিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছে, বুশিকে আবার গোপনে ডেকে পাঠানো হয়েছে। একদিন একটা হুকুমত বার করে তার পরদিন আবার সেটা ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এখন মতিস্থির করতে পারছে না নবাব! ওদিক থেকে নবাবের গুপ্তচর খবর পাঠিয়েছে ইংরেজদের অর্ধেক সেপাই নাকি কাশিমবাজারের দিকে আগেই রওনা দিয়েছে।
এত খবর হাতিয়াগড় বসে ছোটমশাই পায়নি। যুদ্ধ যদি বাধে তো শেষপর্যন্ত হাতিয়াগড়ও বাদ পড়বে না। সেখানে ডিহিদার রেজা আলি আছে। সে এসে টাকা চাইবে, লোক চাইবে। আগাম আবওয়াব চাইবে। ভাবতে ভাবতে ছোটমশাইয়ের মাথাটা সেখানে বসেই গোলমাল হয়ে গিয়েছিল।
মনে আছে, সেদিন যখন রাত অনেক হয়েছে তখন জগৎশেঠজি মতিঝিলের দরবার থেকে ফিরেছিলেন। এমন উদ্বিগ্ন দেখা যায়নি কখনও জগৎশেঠজিকে।
বলেছিলেন–অবস্থা খুব খারাপ ছোটমশাই
সে তো সব বুঝতে পারছি।
আপনাকে যখন চিঠি লিখেছিলাম তখন বিশেষ জানাজানি হয়ে যায়নি। এখন এই দু’দিনের মধ্যে একেবারে সমস্ত গরম হয়ে উঠেছে। নবাব নিজে গিয়েছিল মিরজাফরসাহেবের জাফরগঞ্জের বাড়িতে। এখন অবস্থা বুঝে অন্যরকম ব্যবহার করছে। এখন আর কাউকে চটাতে চাইছে না। সেবারে আমার গালে চড় মেরেছিল সকলের সামনে। এবার আবার খুব ভদ্র ব্যবহার করলে।
ছোটমশাই বললে–এই সুযোগে আমার স্ত্রীকে বের করে নিয়ে আসা যায় না?
জগৎশেঠজি বললেন–কিন্তু শুনছি আপনার স্ত্রী নাকি এখন আর চেহেল্-সুতুনে নেই। আমার সঙ্গে কথা ছিল আমি ডেকে পাঠাব। চকবাজারে সারাফত আলির দোকানে কে নাকি কান্ত বলে একজন আছে, তাকে খবর দিলেই আপনার স্ত্রী আমার এখানে চলে আসতে পারবেন।
কান্ত! সে আবার কে?
জগৎশেঠজি বললেন–কী জানি সে কে!
ছোটমশাই বললে–তার কাছে কেন যেতে বলেছে?
তা জানি না। বলেছেন, তার কাছে গেলে আপনার স্ত্রীর কাছে সে খবর পাঠিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু এখন তো আর তার কাছে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। শুনছি নাকি আপনার স্ত্রী আমার কাছ থেকে কোনও খবর না পেয়ে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন।
কলকাতায়? কলকাতায় কেন?
বোধহয় ক্লাইভসাহেবের কাছে কোনও সাহায্য পাবার আশায়।
ছোটমশাই সোজা হয়ে উঠে বসল এবার। বললে–কিন্তু আমি তো ক্লাইভসাহেবের কাছে গিয়েছিলুম। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে আমার স্ত্রীর কথাও বলেছিলুম। ক্লাইভসাহেব তো জানে, মরিয়ম বেগম আসলে কে!
জগৎশেঠজি বললেন–যখন ক্লাইভসাহেব সব জানে তখন আপনার কাছে নিশ্চয়ই আপনার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দেবে! কিন্তু এখন কি তার অত ভাববার সময় আছে? এখন এখানে নবাবের যেমন মনের অবস্থা, ক্লাইভসাহেবেরও তেমনি। সবই তো নির্ভর করছে মিরজাফরসাহেবের ওপর।
কেন? মিরজাফরসাহেব কী করবে?
জগৎশেঠজি বললেন–মিরজাফরসাহেব এখন যার দিকে ঢলবে, আসলে তারাই জিতবে। মিরজাফরের সঙ্গে তো লেখাপড়া-দস্তক সব চুকে গেছে ফিরিঙ্গিদের! কিন্তু বিশ্বাস তো কিছু করতে পারছেনা। এদিকে নবাব মিরজাফরসাহেবকে দিয়ে কোরান চুঁইয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলে। তাতে কথাটা যখন ক্লাইভসাহেবের কানে যাবে তখন কি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারবে মিরজাফরসাহেবকে?
তা হলে আমি কী করব? আমাকে কী করতে বলেন আপনি?
জগৎশেঠজি বললেন–আমিও তো সেই কথাই ভাবছি! ভেবে কিছু ঠিক করতে পারছি না।
চকবাজারে সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানে একবার যাব? কান্ত না কী নাম বললেন, তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করব? সে যদি কিছু হদিশ দিতে পারে!
জগৎশেঠজি বললেন–তা যেতে পারেন, কিন্তু সেখানে তার কাছে কোনও হদিশ পাবেন কিনা সন্দেহ–কারণ, মরিয়ম বেগম তো আর চেহেল্-সুতুনে নেই, কলকাতায় ক্লাইভসাহেবের তাঁবে।
তা হলে সেখানেই যাই! ক্লাইভসাহেবকে গিয়ে সব বলি গে—
জগৎশেঠজি বললেন–আপনি একলা যাবেন?
কেন? একলা গেলে দোষ কী?
না, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে যদি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন ভাল হত। আর তা ছাড়া এখন ক্লাইভসাহেবকে পাবেনই বা কোথায়? সাহেব তো শুনছি সেপাই-লশকর নিয়ে কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছে।
ছোটমশাই বললে–তা আমি কী করব বলুন জগৎশেঠজি! আমি আর কিছু ভেবে উঠতে পারছি না। আপনি আমায় একটা কিছু পরামর্শ দিন।
তা হলে আপনি আজ সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানেই না হয় যান একবার। তারপর না হয় ক্লাইভসাহেবের কাছে যাবেন!
ছোটমশাই উঠল। বললে–তা হলে যাই এখন?
এক্ষুনি যাবেন কী? এখন রাস্তায় রাস্তায় চর ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন আপনি এখানে এসেছেন একথা চরেরা জেনে ফেলতে পারে। আর একটু রাত হোক তখন যাবেন।
তারপর একটু থেমে বললেন–আর একটা কথা, আপনাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আপনি কে, কোত্থেকে আসছেন, আপনি যেন বলবেন না! এখন এই ডামাডোলের সময় কখন কাকে ধরে কোতোয়ালিতে পুরে রাখে, কিছু বলা যায় না। ধরলে আপনিও বিপদে পড়বেন, আমিও বিপদে পড়ব
ছোটমশাই হতাশ হয়ে আবার বসে পড়ল। আর যেন তার দেরি সইছে না।
জগৎশেঠজি বললেন–হ্যাঁ, আপনি এখানে থাকুন, একটু রাত হলে তারপর একজন লোক দেব আপনার সঙ্গে, সে আপনাকে সরাফত আলির দোকানটা দেখিয়ে দেবে। এখন আপনি একটু বিশ্রাম করুন। আমি আপনার খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে দিচ্ছি
বলে জগৎশেঠজি খিদমদগারকে ডাকলেন।
*
মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে সত্যিই তখন ডামাডোেল চলেছে। এ মুর্শিদাবাদে নতুন কিছু নয়। যখনই একটা যুদ্ধ হয়েছে তখনই রাজধানীতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে সরফরাজ খাঁ, আলিবর্দি পর্যন্ত কখনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা যখন ছোট ছিল তখন সারা মুর্শিদাবাদ তোলপাড় করে তুলেছে। কিন্তু সে আর এক রকম। সে ভাইতে-ভাইতে লড়াই, সে বর্গিদের সঙ্গে হামলা, সে হিন্দুস্থানের লোকের সঙ্গে মোকাবিলা, কিন্তু এবার তা নয়। এবার গোরা পল্টনদের সঙ্গে, এবার ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে। এবার রাজধানীর টনক নড়ে-ওঠা ডামাডোেল। এবার রাস্তায়ঘাটে চুপিচুপি কথা, কানাঘুষো আলোচনা। এবার সন্ধে হলেই লোকের বাজারহাট থেকে বাড়ি চলে যাওয়া। যে গনকারটা চকবাজারের রাস্তায় বসে থাকত অনেক বেলা পর্যন্ত, সেও বেলাবেলি পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যায়। বলে রাহু রন্ধ্রে ঢুকেছে, এবার আকাল আসবেই
বুড়ো সারাফত আলির কোনও পরিবর্তন নেই। সে রোজ সন্ধেবেলা নিয়ম করে আগরবাতি জ্বেলে দিয়ে গড়গড়ার নলে অম্বুরি তামাকের ধোঁয়া টানে আর আফিমের নেশায় মশগুল হয়ে মনে মনে গজরায়। আর অভিশাপ দেয় হাজি আহম্মদের বংশধরদের।
অনেকদিন পরে সেদিন নজর মহম্মদ এল। সারাফত আলির সামনে দিয়ে এল না। পেছনের দরজা দিয়ে এসে চুপি চুপি কান্তকে ডাকলে।
কী রে নজর মহম্মদ?
হুজুর, আপনাকে তলব দিয়েছে মরিয়ম বেগমসাহেবা।
এতদিন পরে মরালী তাকে ডেকে পাঠাবে তা ভাবতে পারেনি কান্ত।
বললে–মরিয়ম বেগমসাহেবা কি চেহেল্-সুতুনে আছে?
জি হুজুর। ছুপিয়ে ছুপিয়ে আছে, কেউ পাত্তা জানে না।
কান্তর সমস্ত শরীরে আবার রোমাঞ্চ জেগে উঠল। এতদিন লোকের কানাঘুষো থেকে শুনে আসছিল, মরিয়ম বেগম চেহেল্-সুতুনে নেই। কত কী বাজে কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কেউ বলত-মরিয়ম বেগমসাহেবা একদিন নাকি শেষরাত্রে মুর্শিদাবাদের গঙ্গার ঘাট থেকে বজরায় করে একলা চলে গিয়েছে। একজন নাকি আবার নিজের চোখে তা দেখেছে। আবার একটা গুজব উঠেছিল, কলকাতায় ক্লাইভ সাহেব নাকি মরিয়ম বেগমসাহেবাকে গ্রেফতার করে রেখেছে। কতরকম গুজব শুনতে শুনতে কান্তর মনটা খারাপ হয়ে যেত। কতদিন ভেবেছে কাউকে জিজ্ঞেস করবে। সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাইকে জিজ্ঞেস করলে হত। কিন্তু মতিঝিলেও আর যখন-তখন যাকে-তাকে আগের মতন ঢুকতে দেওয়া হয় না। বশির মিঞাকেও জিজ্ঞেস করতে ভয় হয়েছে। বিশ্বাস নেই কাউকেই। শুধু মনসুর আলি মেহের মোহরার সাহেবের দফতরে গিয়ে হাজরেটা দিয়ে এসেছে, আর ঠিক দিনে মাইনে নিয়ে এসেছে।
একটা ফরসা ধুতি পরে নিয়ে কান্ত বেরোল। নজর মহম্মদ বাইরেই অপেক্ষা করছিল। বাদশাকে ডেকে বললে–দেখো বাদশা, আমি একটু বেরোচ্ছি
বাদশা বললে–কোথায়? কত দেরি হবে?
কান্ত বললে–তা বলতে পারি না। নিজামতের জরুরি তলব এসেছে। কোথায় যেতে হবে, কী কাজ তা তো আগে থেকে বলার নিয়ম নেই ওদের!
যেতে গিয়েও থামল কান্ত। বললে–দেখো, আর একটা কথা। কেউ যদি আমার খোঁজ করে এখানে আসে তো তাকে যেন কিছু বোলো না। বোলো না যেন আমি কোথায় গেছি, কী কাজ করি, কোনও বৃত্তান্ত বলবার দরকার নেই। আমি এখানে থাকি কিনা তাও বলবার দরকার নেই। নিজামতের কাছারিতে আজকাল বড্ড কড়াকড়ি করে দিয়েছে
বাদশা বললে–ঠিক আছে–
মুর্শিদাবাদ চকবাজারে তখন অন্ধকার বেশ জমে উঠেছে। নজর মহম্মদ এবার কোথা দিয়ে যে কোথায় নিয়ে চলল কিছু বোঝা গেল না।
এদিকে কেন নজর মহম্মদ? সেই সোজা ফটক দিয়ে যাবে না?
নজর মহম্মদ বললে–মরিয়ম বেগমসাহেবা অন্য মহলে আছে
শেষপর্যন্ত যেখানে নিয়ে গিয়ে তুলল, সে এক আজব জায়গা, ঠান্ডা, নিরিবিলি। চেহেল্-সুতুনের কোনও শব্দ সেখানে পৌঁছোয় না। ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নজর মহম্মদ বাইরে চলে গেল। মরালী সামনে দাঁড়িয়ে। চেহারাটা যেন বদলে গিয়েছে তার। সেই জৌলুস নেই।
মরালী বললে–কী দেখছ অমন করে? বসো।
কান্ত বসল। বললে–আমি তোমার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনছি। সবাই বলছে, তোমাকে নাকি ক্লাইভসাহেব গ্রেফতার করেছে, তাই নবাব রেগে গিয়ে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে–
মরালী বললে–সবাই তাই-ই জানে—
কিন্তু নবাব? নবাবও কি তাই জানে?
হ্যাঁ।
কিন্তু হঠাৎ এ-গুজব রটল কেন? আর তুমিই বা সকলকে লুকিয়ে এখানে এমন করে আছ কেন?
মরালী বললে–নবাবের বিপদের জন্যেই আমি এই পথ নিয়েছি। সবাই আমার জন্যে নবাবের সঙ্গে শত্রুতা করছিল। সবাই ভাবছিল নবাব বুঝি আমার কথায় উঠছে বসছে। সবাই ভাবছিল আমিই বুঝি নবাবের চর। তাই নবাবের ভালর জন্যেই আমি এখানে লুকিয়ে আছি। এখানকার কোনও বেগমরাও জানে না। নানিবেগমসাহেবাও না। কেবল একজন জানে।
কে? কে সে?
তুমি চিনতে পারবে। যে তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ করেছিল, সেই ঘটক। সেই সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ। সে এখন ইব্রাহিম খাঁ হয়ে গেছে মুসলমান হয়ে। মতিঝিলে মদের খেদমদ করে। সে একলাই কেবল আমার খবর জানে। আর জানে ওই নজর মহম্মদ
কান্ত কিছু উত্তর দেবার আগেই মরালী বললে–যাক গে, যে জন্যে তোমায় ডেকেছি সেই কথাটা বলি–
কান্ত বললে–বলো
ওদিকে সর্বনাশ হয়েছে কলকাতায়।
বলে নিজের ওড়নির ভেতর থেকে হাত গলিয়ে একটা চিঠি বার করলে।
তারপর বললে–এই চিঠিটা আমাকে লিখেছে ছোট বউরানি।
ছোট বউরানি?
মরালী বললো, সেই হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের দ্বিতীয় পক্ষের বউ। যার জন্যে আমি এত কাণ্ড করেছি, সে। তার জন্যেই আমি নাম ভাড়িয়ে এই চেহেল্-সুতুনে এসেছিলাম, তাকে বাঁচাবার জন্যেই আমি কলমা পড়ে মুসলমান হয়েছি, তাকে রক্ষে করবার জন্যেই আমি মরিয়ম বেগম হয়েছি। অথচ তাকেই শেষপর্যন্ত বাঁচাতে পারলুম না।
কিন্তু এ-চিঠি তোমার কাছে তিনি কী করে পাঠালেন?
ওইইব্রাহিম খাঁ’র হাত দিয়ে। ও হাতিদের রোজ নিয়ে যায় গঙ্গার ঘাটে। নৌকো থেকে মদের পিপে নামিয়ে হাতির পিঠে করে ও মতিঝিলে নিয়ে আসে। তার হাতেই একজন দিয়ে গেছে আমাকে দেবার জন্যে
কান্ত বললে–লোকটা সত্যিই ভাল
মরালী বললে–ও তো জানে যে, ওর গণ্ডগোলের জন্যেই অন্য একজন বুড়োর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তাই মনে মনে খুব দুঃখ করে। বলে–আমার দোষেই তোমার এমন কপাল হল মা। তা সে যা হোক, এখন হোট বউরানিকে যেমন করে তোক বাঁচাতেই হবে
ছোট বউরানির কী হয়েছে?
মরালী বললে–আগে শুনেছিলাম যে, ছোট বউরানি ফিরিঙ্গিদের বাগানবাড়িতে আছে। তখন বিশ্বাস হয়নি। সেই দেখবার জন্যেই একবার ক্লাইভসাহেবের পেরিন সাহেবের বাগানেও গিয়েছিলাম। কিন্তু সেবার তো সেই উমিচাঁদের হাতের লেখা চিঠিটা পেয়ে কেলেঙ্কারি কাও হয়ে গিয়েছিল–এবার আর এক কাণ্ড!
কী?
এবার ভুল করে ফিরিঙ্গিরা ওকে ভেবেছে মরিয়ম বেগম। নৌকো করে দুগ্যা আর ছোট বউরানি কেষ্টনগরের দিকে যাচ্ছিল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে। পথে ফিরিঙ্গি সাহেবরা ওকে মরিয়ম বেগম মনে করে গ্রেফতার করে রেখেছে। কোনও উপায় না পেয়ে আমার কাছে দরবার করেছে। আমি যেমন করে হোক ওদের যেন নবাবকে বলে বাঁচাই
নবাবকে বলেছ?
নবাবকে এই অবস্থায় কী করে বলব? এখন তো ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে নবাবের যুদ্ধ লাগে লাগে!
তা হলে কী করবে?
মরালী বললে–সেই কথা বলতেই তো তোমাকে ডেকেছি। ঠিক করেছি আমিই ফিরিঙ্গি কোম্পানির সাহেবদের কাছে যাব। গিয়ে বলব, ওদের ছেড়ে দাও, ও মরিয়ম বেগম নয়, আমিই মরিয়ম বেগম–
কিন্তু তখন যদি তোমাকে আবার ধরে রাখে?
মরালী বললে–তা তো ধরে রাখবেই–এমন সুযোগ পেয়ে কি আর ছাড়বে! আমি ওদের কত ফন্দি ফাস করে দিয়েছি। আমাকে পেলে তো টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবে!
কান্ত কী বলবে বুঝতে পারলে না। মরালীর মুখখানার দিকে চেয়ে দেখতে লাগল। মুখখানা অনেকদিন পরে দেখছে কান্ত। শুকিয়ে গেছে চেহারাটা একেবারে। তাই প্রতিবাদ করবার কথাও তার মনে এল না। আর যখন কখনও মরালীর কথার প্রতিবাদ করেনি তখন এই কথাতেই বা প্রতিবাদ করবে কেন এখন?
মরালী বললে–তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে। এই জন্যেই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। চলো—
*
ওদিকে তখন সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের সামনে একজন ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞেস করলে এটা সারাফত আলি সাহেবের খুশবু তেলের দোকান?
সারাফত আলি নিজে তখন নেশায় মশগুল। কিছু উত্তর দিলে না।
বাদশা পাশ থেকে উত্তর দিলে হ্যাঁ-কী চাই আপনার?
এখানে কান্ত নামে কোনও বাবু থাকে?
সারাফত আলির নেশা এতক্ষণে বুঝি হঠাৎ ভেঙে গেল। জিজ্ঞেস করলে কৌন? হাজি আহম্মদ?
কোথাকার কোন হাজি আহম্মদ, তারই বুঝি ধ্যান হচ্ছে তখন মনে মনে। হাজি আহম্মদ কবে মরে গিয়ে জাহান্নমে চলে গিয়েছে, হাজি আহম্মদের ভাই আলিবর্দি খাঁ-ও কবে মরে গিয়েছে। তবু মরে গিয়েও তারা যেন সারাফত আলিকে যন্ত্রণা দিচ্ছে দিনরাত। এখনও বুঝি সারাফত আলি সেকথা ভুলতে পারেনি। সারা দোকানঘর আগরবাতি আর তামাকের ধোঁয়ায় ঢেকে আফিমের মৌতাতে সেই দুশমনদের কবর থেকে তুলে এনে যেন নতুন করে খুন না করলে বুড়োর তৃপ্তি হবে না। কান্তকে একদিন যে সারাফত আলি নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েছে, সেও তো সেই মতলবেই। নিজে বুড়ো হয়ে গিয়েছে। চোখের তেজ নেই, হাতের পেশিতে সে জোর নেই। শুধু আছে বদলা নেবার অন্ধ জিদ। কান্তকে বুড়ো বলত আর কত দেরি রে? ঔর কিতনা দের হ্যায় তেরা?
শুধু কান্ত কেন, কান্তর মতন আরও অনেক ছোকরাকে বাড়িতে রেখেছে, খাইয়েছে দাইয়েছে আর নিজের মতলব সিদ্ধির স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু এক এক সময় বুড়ো হতাশ হয়ে পড়ে। আর বোধহয় দেখে যেতে পারলে না। হাজি আহম্মদের বংশের পতন দেখা আর বুঝি তার কপালে নেই।
কান্ত বলত–চেষ্টা করছি তো সাহেব, চেষ্টার কসুর নেই
লেকন ওই মরিয়ম বেগমকা সাথ তেরা জান-পছান থা? ও বেগম শালী নবাবকে মদত দেয় কেন?
কান্ত প্রতিবাদ করত–কে বললে–মদত দেয়, সাহেব?
সব্বাই বলে! সবাই তো বলে হাজি আহম্মদের পোতা মরিয়ম বেগমের কথায় নড়ে বসে।
কান্ত বলে–আপনি ভুল শুনেছেন জনাব!
আমি ভুল শুনেছি?
নিজের বার্ধক্যের কথা শুনলেই খেপে যায় সারাফত আলি। নিজে জানে বুড়ো হয়ে গেছে সে, কিন্তু লোকে সেকথা বললেই দোষ। বলে–আমি ভুল শুনেছি? আমার কান কালা হয়ে গেছে? আমি কি বুড়ো হয়ে বেছি বেত্তমিজ? আমি বেওকুফ?
তারপর সেই নেশার ঘোরেই বুড়ো খাস আফগানি ভাষায় গালাগালির বন্যা বইয়ে দেয়। সে-ভাষা কান্ত বুঝতে পারে না। বুঝতে না পারলেও কান্তর রাগ হয় না। বুড়োমানুষের কথায় রাগ করতে নেই। কবে একদু’জন কোন জি আহম্মদ সারাফত আলির চরম সর্বনাশ করে গিয়েছে, সে ঘা তখনও শুকোয়নি। সেই ঘায়ের যন্ত্রণায় তখনও সারাফত আলি ছটফট করে, আর যত ছটফট করে তত আফিম খায়, তত আগরবাতি জ্বালায়, তত তামাক টানে। টানতে টানতে যখন ধোঁয়ার সমস্ত দোকান, সমস্ত স্মৃতি আচ্ছন্ন হয়, তখন আর কাউকে চিনতে পারে না। অন্য লোককেও চিনতে পারে না, নিজেকেও চিনতে পারে না। তখন শুধু ঝাপসা ঝাপসা একটা নাম মনে থাকে। সে হাজি আহম্মদ। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে ভাবে, বুঝি হাজি আহম্মদের কথাই জিজ্ঞেস করছে।
ছোটমশাই বড় মুশকিলে পড়ল। বললে—
এখানে কান্ত বলে কেউ থাকে না?
বাদশা সামনে এগিয়ে এসে বললেনা জনাব, ওনামে কেউ থাকে না এখানে। এ সারাফত আলি সাহেবের খুশবু তেলের দোকান। ইহা খুশবু তেল মিলতি হ্যায়–আপ কৌন?
ছোটমশাই কী করবে বুঝতে পারলে না। এত আশা করে এসেছিল। তবে কি ভুল ঠিকানা শুনেছে। জগৎশেঠজি? আরও অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল পাশের দোকানেও কোনও হিন্দু ছেলে থাকে কিনা ওই নামে। কিন্তু যেরকম হালচাল তা দেখে আর ভরসা হল না।কয রাত তখন অনেক হয়েছে। ছোটমশাই আস্তে আস্তে সেখান থেকে পা বাড়াল।
*
অবস্থা যত সঙ্গীন হয় ক্লাইভ সাহেবের মাথা তত খোলে। সংসারে এক-একজন লোক থাকে যারা বিপদ ঝঞ্জাট ঝামেলার মধ্যেই নিজের ক্ষমতার প্রকাশ দেখাতে পারে। যত ঝঞ্জাট আসে ততই যেন তারা ঝঞ্ঝাটের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে আনন্দ পায়। মিরজাফর খাঁ-কে একটার পর একটা চিঠি দিয়ে আসছে। কিন্তু অনেক দিন পরে একখানা চিঠি মাত্র এল।
মিরজাফর খাঁ লিখেছে–আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি যদিও নবাবকে কোরান ছুঁয়ে কথা দিয়েছি যে, আমি ইংরেজদের কোনওরকম সাহায্য করব না, কিন্তু আপনি জেনে রাখুন, আপনাদের সঙ্গে যে-সন্ধিপত্রে সই দিয়েছি, এখনও তা স্বীকার করছি। সেইটিই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে উমিচাঁদ এসে হাজির হল।
উমিচাঁদের মুখের চেহারা দেখে ক্লাইভ সাহেবের কেমন যেন সন্দেহ হল। তবু মুখে হাসি এনে বললে–কী খবর, উমিচাঁদসাহেব?
পাশেই ওয়াটস্ সাহেব দাঁড়িয়ে ছিল।
উমিচাঁদ বললে–আপনাদের জন্যে যা করে এলুম, তার জন্যে চিরকাল কোম্পানির সিলেক্ট কমিটি আমাকে মনে করে রাখবে
কী করেছেন?
উমিচাঁদ বললে–এই ওয়াটস্ সাহেবকেই জিজ্ঞেস করুন। আমার নিজের মুখে বললে–সেটা অহংকারের মতো শোনাবে!
ক্লাইভ বললে–তবু আপনি বলুন, আপনাকে আমি এতদিন বিশ্বাস করে সব কথা বলে এসেছি, এখনও বিশ্বাস করছি
উমিচাঁদ সাহেব হেসে উঠল। বড় সর্বনেশে সে হাসি। ক্লাইভ সাহেবের মনে পড়ল, ঠিক এইরকম হাসিই শুনেছিল উমিচাঁদের মুখে যেদিন প্রথম ক্লাইভ সাহেব উমিচাঁদের বাড়িতে গিয়েছিল দরবার করতে।
উমিচাঁদ বললে–আমরা কারবারি মানুষ সাহেব, আমরা বিশ্বাসটিশ্বাস বুঝি না।
তার মানে?
উমিচাঁদ বললে–এখানে এই বজরায় বসে তা বলা যায় না। একটু নিরিবিলি দরকার, আমার হালসিবাগানের বাড়িতে চলুন, একেবারে পাকা বন্দোবস্ত করে ফেলি।
কীসের পাকা বন্দোবস্ত?
বিশ্বাসের।
তবু ক্লাইভ সাহেব কিছু বুঝতে পারলে না।
উমিচাঁদ বললে–যেখানে তোক চলুন, হয় আমার বাড়িতে নয় আপনার পেরিন সাহেবের বাগানবাড়ির দফতরে।
এতক্ষণে কথার মানেটা ক্লাইভ সাহেবের মাথায় ঢুকল। দি স্কাউড্রেল! এইমাত্র বাগানবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। সবাইকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে শুধু একলা চলেছে। ঠিক এই সময়েই আবার ফিরে যেতে হবে! তবু মুখে কিছু বললে–না ক্লাইভ। হাসতে হাসতে শুধু বললে–অল রাইট
ওয়াটস বললে–কিন্তু মরিয়ম বেগমসাহেবার কী হবে কর্নেল?
মরিয়ম বেগম! একটার পর একটা প্রবলেম যেন ক্লাইভকে উন্মাদ করে দেবে। জুন মাসের রাত। একটু পরেই বোধহয় ঝড় বৃষ্টি আসবে। ওদিককার সমস্ত আকাশটা ডার্ক হয়ে গেছে। ক্লাইভ সেই দিকে একবার দেখে নিয়ে বললে–মরিয়ম বেগমের সঙ্গে কে আছে?
একজন বাঁদি! পাছে ধরা পড়ে যায় বলে হিন্দু লেডির ছদ্মবেশে রয়েছে।
বজরার মাঝিমাল্লারা? তারা কোথায়?
তারা ফাইট করতে আসছিল, কিন্তু আমরা তাদের মুখ বন্ধ করে বেঁধে জলে ডুবিয়ে দিয়েছি। দে আর অল ডেড! কাউকে কথা বলতে দিইনি!
ক্লাইভ সাহেব অবাক হল–সেকী?
উমিচাঁদ বললে–ঠিকই করেছি সাহেব। তাদের না মেরে ফেললে নবাবের কানে পৌঁছে যেত কথাটা! এতে ভালই হল, কেউ আর জানতে পারবে না।
কিন্তু মরিয়ম বেগমকে এখন ধরে রাখা কি ঠিক হবে? বেগম নিয়ে আমাদের কী কনসার্ন?
ওয়াটস বললে–এই মরিয়ম বেগমই তো আমাদের সব কথা জেনে ফেলেছে স্যার; রাত্রে জগৎশেঠজির বাড়িতে এই বেগমসাহেবাই তো গিয়েছিল। এই-ই সব কথা জানিয়ে দিয়েছে। নইলে তো কারও জানবার কথা নয়!
ওকে নিয়ে এখন কী করব? কোথায় রাখব?
উমিচাঁদ বললে–কেন, আপনার বাগানে তো আরও একজন হিন্দু লেডি আছে, তার সঙ্গে একেও রেখে দিন। একটা ঘরে হিন্দু লেডি থাকবে, আর একটা ঘরে মুসলমান লেডি থাকবে।
ক্লাইভ বললে–না, তারা নেই, সেই হিন্দু লেডি চলে গেছে
সেকী? তাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের? ভালই করেছেন। মেয়েমানুষ যদি রাখতেই হয় সাহেব, তা বেশ ভাল মেয়েমানুষ রাখবেন। যে ফুর্তি করতে জানে, ফুর্তি দিতে জানে, সেই তো মেয়েমানুষ।
ক্লাইভ উমিচাঁদের কথা শুনে রেগে গেল। বললে–উমিচাঁদ, তোমার কাছে মেয়েমানুষ সম্বন্ধে আমি আইডিয়া নিতে চাই না। আমি অনেক দিন ইন্ডিয়াতে আছি, ইন্ডিয়ান ওম্যান আমি চিনি
এই দেখুন, আপনি রেগে যাচ্ছে। আপনার ওই তো দোষ!
স্টপ দ্যাট টপিক-ও সম্বন্ধে আর কোনও কথা শুনতে চাই না আমি, অন্য কথা বলো—
তারপর মাঝিদের দিকে ফিরে বললে–পেরিন সাহেবের বাগানের দিকে বজরা ঘোরাও।
*
ইতিহাসের সে এক কুটিল সন্ধিক্ষণ! হিন্দুস্থানের মানুষ যখন সবাই নিজের নিজের স্বার্থচিন্তার আফিম খেয়ে নেশায় আচ্ছন্ন তখন ভূগোলের এক কোণে এক জলাভূমির রঙ্গমঞ্চে বিদেশ থেকে আসা আর-একদল মানুষ নিঃশব্দে আর-এক ইতিহাস, আর-এক ভূগোেল রচনা করবার আগ্রহে আর-এক মতলব আঁটছে। তাদের কাছে কষ্ট কোনও কষ্টই নয়, বিশ্রাম ঘুম স্বাস্থ্য তাদের কাছে শুধু অভিধানের শব্দাবলী! ও কথাগুলো শুধু অভিধানে লেখাই থাক। যে-দিন এমপায়ার হবে সে-দিনকার জন্যে ওগুলো মুলতুবি রইল। এই মশা মাছি, এই সাপ-জোক, এই বিছে-মাকড়শা, এই শীত-গ্রীষ্ম সেদিন সুদে-আসলে মিলে সোনা-হিরে-জহরত হয়ে উসুল হয়ে যাবে। তখন সবাই বলবে–দি সান নেভার সেটস ইন ব্রিটিশ এম্পায়ার। সূর্য কখনও অস্ত যায় না ব্রিটিশ এম্পায়ারে। এরপর আছে আরব, আফ্রিকা, বর্মা, সিলোন, ইজিপ্ট, মেসোপটেমিয়া। আমেরিকা হাতছাড়া হয়ে গিয়ে যা লোকসান হয়েছে তা পূরণ হয়ে যাবে ইন্ডিয়ান এম্পায়ার করে।
আবার সেই পেরিন সাহেবের বাগান। যেখানে যত সেপাই-সোলজার-ফৌজ ছিল চলে গেছে। ফাঁকা হয়ে গেছে কলকাতার ফোর্ট, ফাঁকা হয়ে গেছে পেরিন সাহেবের বাগান। শুধু ওয়ান হানড্রেড সোলজার রাখা হয়েছে চন্দননগরের ফোর্ট গার্ড দেবার জন্যে। তবু দু’-একজন যারা ছিল পেরিন সাহেবের বাগান তদারক করবার জন্য, তাদের আবার ডাক পড়ল। তারা এসে আবার গেট খুলে দিলে। দফতরের দরজা খুলে দিলে।
মরিয়ম বেগমকে কোথায় রাখলে?
হুজুর, যেখানে আগে জেনানারা ছিল, সেখানেই রেখে দিয়েছি।
ওয়াটস্ নিজে তদারক করে এসেছিল। বললে–দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসেছি কর্নেল, খুব কাঁদছিল
খুব কাঁদছিল?
ওয়াটস্ বললো কর্নেল, বলছিল আমি মরিয়ম বেগম নই, আমি মরিয়ম বেগম নই–
উমিচাঁদ বললে–তখন থেকেই কেবল বলছে আমি মরিয়ম বেগম নই। ভাবতে পারেনি এমন করে ধরা পড়ে যাবে, তাই ওই বলে ছাড়া পেতে চাইছে ।
ক্লাইভ উমিচাঁদের দিকে চেয়ে বললে–তোমাকে চিনতে পেরেছে নাকি?
উমিচাঁদ বললে–আমাকে কে না চেনে সাহেব। কিন্তু আমি তাতে পরোয়া করি না। আপনি ভয় করতে পারেন, ওয়াটসন ভয় করতে পারেন। আমি হলাম কারবারি লোক, আমি জানি প্রাণের চেয়ে কারবার বড়! আপনাদের সঙ্গে যখন কারবার করতে বসেছি তখন সবকিছু জেনেশুনেই করেছি
ক্লাইভের তবু ভাবনা গেল না। বললে–কিন্তু ওদের খাবার বন্দোবস্ত করেছ?
ওয়াটস্ বললে–ইয়েস কর্নেল, ল্যাসিংটন ছিল, ওকে বলেছি
ডাকো একবার ল্যাসিংটনকে এখানে।
ওয়াটস্ ল্যাসিংটনকে ডেকে আনলে ঘরের ভেতরে। ল্যাসিংটন ভেতরে আসতেই ক্লাইভ জিজ্ঞেস করলে–কী অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছ ওদের খাওয়ার?
ওরা খেতে চাইছে না স্যার, দে আর ক্রাইং। ওরা বলছে ক্লাইভসাহেবকে ডেকে দাও।
উমিচাঁদ বললে–আপনি যানে না সাহেব। একবার ওরা আপনাকে ঠকিয়ে চিঠি চুরি করে নিয়েছিল, এবারও আবার সেই মতলব করেছে
ল্যাসিংটন আবার বললে–ওরা বলছে আপনি নাকি ওদের চেনেন
উমিচাঁদ বললে–নিশ্চয়ই চেনেন সাহেব। খুব ভাল করে চেনেন!
তারপর ক্লাইভের দিকে ফিরে বললেও নিয়ে আর সময় নষ্ট করা উচিত নয় সাহেব, আমাকেও যেতে হবে, আমাকেও যেতে হবে। আমিও সোজা মুর্শিদাবাদ থেকে আসছি, আমাকেও বাড়ি যেতে হবে, অনেক কাজ পড়ে আছে সেখানে
ক্লাইভ ল্যাসিংটনের দিকে চেয়ে বললে–ঠিক আছে, তুমি যাও, ওদের কোনও কথায় কান দিয়ো তুমি, দরজা বন্ধ করে রাখবে সবসময়, দিনরাত পাহারার বন্দোবস্ত করবে
ল্যাসিংটন চলে গেল।
ক্লাইভ উমিচাঁদের দিকে ফিরে বললে–বলল, তুমি কী বলছিলে?
উমিচাঁদ বললে–যা বলবার আমি তাড়াতাড়ি বলব সাহেব। আমি বলেইছি তো আপনাকে যে আমি কারবারি লোক, কাজ ছাড়া আমি আর কিছু বুঝি না। আমি আপনাদের জন্য কী কী কাজ এতদিন করেছি তা আপনারা জানেন। নবাবও জানে, নবাবের জন্য আমি কী কী করেছি। আজ যে চন্দননগর আপনারা দখল করে বসে আছেন, তা আমার জন্যে, একথা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। আজ যে মিরজাফর সাহেবের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া হয়েছে তাও এই উমিচাঁদের জন্যে। এও জানেন যে, এই উমিচাঁদ আপনাদের সহায় না হলে আপনারা এই কলকাতায় কলকে পেতেন না। পাততাড়ি গুটিয়ে আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতে হত আর এও জানেন যে, এতদিন যে নবাব রেগে গিয়ে আপনাদের ভিটে-ছাড়া করেনি এও আমার জন্যে!
ক্লাইভ বললে–অত কথা শোনবার সময় নেই। কী করতে হবে তাই বলো–
উমিচাঁদ বললে–সেই কথা বলবার জন্যই তো আপনাকে এখানে ডেকে আনলুম। আপনার মতন আমারও তো সময়ের দাম আছে! আমাকে তো কারবার করেই পেট চালাতে হয়।
বলো আমাকে কী করতে হবে?
উমিচাঁদ বললে–দেখুন, যদি ইয়ার লুৎফ খাঁ’র সঙ্গে আপনারা বোঝাঁপড়া করতেন তো আমি কিছু বলতুম না। আপনারা মরজাফরকেই পছন্দ করলেন। যা হোক, সে যা করে ফেলেছেন, ফেলেছেন, আমার কিছু বলবার নেই। এখন নবাব হবার পর মিরজাফরসাহেব আপনাদের যে টাকা দেবে বলেছে, তার থেকে আমার কিছু ভাগ চাই–
তোমার ভাগ চাই!
উমিচাঁদ বললে–বেশি নয়, যা টাকা পাবেন তার শতকরা পাঁচ টাকা।
ক্লাইভ কথাটা শুনে গুম হয়ে বসে রইল। উমিচাঁদের কথায় এতদূর এগিয়ে শেষকালে কি পেছিয়ে যেতে হবে নাকি। নবাবকে চিঠি লেখা হয়ে গেছে। ইংরেজ ফৌজ মুর্শিদাবাদের দিকে যাচ্ছে; ফৌজকামান-সেপাই-সৈন্যসামন্ত সবকিছু চলে গেছে। শুধু ক্লাইভের নিজের যেতে কিছু বাকি। এতদিন উমিচাঁদই তো বুঝিয়েছে যে, সে ইংরেজের দলে। এতদিন উমিচাঁদই তো তাদের খুঁচিয়ে তুলেছে। বলেছে সমস্ত আমির-ওমরাহ সবাই নবাবের ধ্বংস চায়। জগৎশেঠকে তাদের দলে এনেছে এই উমিচাঁদই তো। এই উমিচাঁদের ঘরেই গুরু নানকের ছবিকে ধূপ ধুনো দিয়ে পুজো করা হয়। এই উমিচাঁদই ফলায় তাদের চাল-ডাল-ঘি বিক্রি করে মোটা প্রফিট করেছে। এরা ঠিক শেষ মুহূর্তে আসে। এই উমিচাঁদ, এই নন্দকুমার, এই নবকৃষ্ণের দল। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন ক্লাইভ অবাক হয়ে যাচ্ছে এই ইন্ডিয়ানদের দেখে। সাধারণ রাস্তার মানুষ, গ্রামের চাষাভুষোরা তো এমন নয়। তারা কতবার তামাক খাইয়েছে ক্লাইভকে। তাদের বাড়ির দাওয়ার ওপর বসিয়ে সুখদুঃখের গল্প বলেছে। তারা জানে না–কে উমিচাঁদ, কে জগৎশেঠ, কে মিরজাফর। তারা তো খবরও রাখে না, কে তাদের নবাব আর কে তাদের বাদশা। তারা রামপ্রসাদের গান শুনেছে, হরির নাম শুনেছে, কৃষ্ণের নাম শুনেছে, রাধার নাম শুনেছে। ঘেঁটু, লক্ষ্মী, সরস্বতী, মনসা, শীতলার নামও শুনেছে। আর এই উমিচাঁদের দল, এরাই তাদের লোভ দেখিয়ে ভয় দেখিয়ে উমিচাঁদ জগৎশেঠ হয়ে বসেছে।
পাঁচ পার্সেন্ট শুনেই চমকে উঠলেন নাকি সাহেব?
এতক্ষণে যেন ক্লাইভ সাহেবের জ্ঞান ফিরে এল। কিন্তু উমিচাঁদ জানে না যে, ক্লাইভ যদি উমিচাঁদের চালাকি ধরতে না পারবে তো সেন্ট ফোর্ট ডেভিডের কম্যান্ডার সে মিছিমিছি হয়েছিল। হাজার হাজার লাখ লাখ উমিচাঁদদের জব্দ করবার ক্ষমতা নিয়েই সে ইন্ডিয়ায় এসেছে, একথাও উমিচাঁদ হয়তো ঠাহর করতে পারেনি।
পাঁচ পার্সেন্ট হলে আমার পাওনা হয় তিরিশ লাখ টাকা মাত্র! তিরিশ লাখ টাকা এমন কিছু বেশি না।
রাত গম্ভীর হয়ে আসছে। সমস্ত প্রোগ্রাম নষ্ট করে দিয়েছে উমিচাঁদ। তবুক্লাইভ সাহেব মুখে হাসি ফুটিয়ে উমিচাঁদের দিকে চেয়ে রয়েছে।
বললে–আর?
উমিচাঁদ বললে–আর নবাবের সিন্দুকে যা গয়নাগাঁটি পাওয়া যাবে তার চার ভাগের এক ভাগ আমায় দিতে হবে। বাকি তিন ভাগ আপনারা যে-কেউ নিতে পারেন, আমি কিছু বলতে যাব না–
আর?
উমিচাঁদ বললে–আর মানে?
আর কী চাও তাই জিজ্ঞেস করছি। কারণ সব জিনিসটা আগে থেকে বোঝাঁপড়া হয়ে থাকা ভাল। আমি চাই না, শেষে কিছু মিস-আন্ডাস্ট্যান্ডিং হোক–
উমিচাঁদ বললে–আমিও তাই চাই না সাহেব। সেই জন্যেই তো সব খোলাখুলি বললুম। আপনি শেষকালে বলবেন যে উমিচাঁদ বেটা আমাকে ঠকিয়ে নিলে
কিন্তু আমি তিরিশ লাখ টাকা দিতে পারব না।
কত দেবেন?
ক্লাইভ বললে–বলব?
উমিচাঁদ বললে–বলুন, মন খুলে বলুন। আপনার সঙ্গে আমার লুকোচুরি নেই। আমি কারবারি মানুষ, সোজা কথার ভক্ত, ঘোরপাঁচ বুঝি না
ক্লাইভ বললে–আমি তিরিশ লাখ টাকা দিতে পারব না—
কিন্তু দেবেন কত তাই বলুন!
ক্লাইভ বললে–লেখাপড়া যখন হচ্ছে তখন পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে যাওয়াই ভাল। আমি বিশ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে পারি–রাজি?
উমিচাঁদ ভাবতে লাগল। ক্লাইভও মনে মনে তখন হিসেব করছে। পঞ্চাশ লাখ দিতে হবে ইংরেজ ব্যাবসাদারদের। সেবারের লড়াইতে যাদের লোকসান হয়েছে। আরম্যানিয়ানদের দিতে হবে দশ লাখ টাকা। তারপর আমি আর নেভির জন্যে পঁচিশ পঁচিশ করে পঞ্চাশ লাখ টাকা। যারা নেটিভ কারবারি তাদেরও ক্ষতি হয়েছিল। আগুন লেগে ঘরবাড়ি সব পুড়ে গিয়েছিল। তাদের অন্তত কুড়ি-তিরিশ লাখ টাকা দিতে হবে। আর কোম্পানির জন্যে এক কোটি টাকা তো বরাদ্দ আছেই। এর থেকে তিরিশ লাখ টাকা দিতে হবে উমিচাঁদকে। টাকা দিতে আপত্তি নেই, কিন্তু তিরিশ লাখ টাকা চাইলেই সে-টাকা দিতে রাজি হলে সন্দেহ হতে পারে তাই একটু দর কষাকষি করা ভাল।
বললে–বলুন বিশ লাখ টাকা হলে রাজি কি না?
উমিচাঁদ অনেক ভেবে অনিচ্ছের সঙ্গে বললে–ঠিক আছে, বিশ লাখেই রাজি–সেই কথাই রইল। কিন্তু লেখাপড়া? জানেন তো সাহেব, আমি কারবারি লোক, লেখাপড়া সইসাবুদ করা দলিল চাই, তাতে আপনাদেরও সই থাকবে আর আমিও সই করব। নইলে যখন কাজ খতম হয়ে যাবে তখন বলবেন, টাকা দেবার কথা ছিল না
ক্লাইভ বললে–না না, সেরকম কথা বলব না, তুমি আমাদের গোড়া থেকে সাহায্য করে আসছ, আমরা অত আনগ্রেটফুল নই। তবু তুমি যখন বলছ তখন দলিলই তৈরি হবে
বেশ, তাই ভাল।
কিন্তু আজকে এখন তো হবে না। কাল হতে পারে। আজ আমি এখনই যাচ্ছি, সব বন্দোবস্ত ঠিক করে ভোরবেলা তোমার বাড়িতে সব পেপার নিয়ে যাব।
উমিচাঁদ বললে–আপনাদের সকলের সই চাই কিন্তু আপনি, ওয়াটসন, ড্রেক, ওয়াটস, মেজর কিলপ্যাট্রিক, বিচার–সকলের। মিরজাফরের সঙ্গে ঠিক যেমন যেমন দলিল হয়েছে, যারা যারা সই করেছে, তাতে তাদের সকলের সই থাকা চাই
ঠিক আছে, ওই কথাই রইল।
উমিচাঁদ খুশি হয়ে চলে গেল। ওয়াটস্ এতক্ষণ চুপ করে ছিল।
বললে–কর্নেল, ভালই করেছেন রাজি হয়ে। টাকা না দিলে উমিচাঁদসাহেব সব বলে দিত নবাবকে–তাতে মিরজাফর সাহেবেরও বিপদ হত, মিরজাফরসাহেব হয়তো ভয়ে শেষ পর্যন্ত পেছিয়ে যেত
ক্লাইভ বললে–না–আমি টাকা দেব না
তার মানে? আপনি কথা দিলেন টাকা দেবেন, কুড়ি লাখ টাকা দেবেন, কনট্র্যাক্ট সই করে দেবেন!
তা হোক, আমি কথা রাখবনা। স্কাউড্রেলটাকে আমি ভাল শিক্ষা দেব-আইশ্যাল টিচ হিম এ লেসন।
বলে উঠে দাঁড়াল ক্লাইভ। শেষ মুহূর্তে প্যাঁচ কষে কিছু টাকা আদায় করে নিতে চায় স্কাউড্রেলটা। সুতরাং ক্লাইভও প্যাঁচ কষবে।
ওয়াটসকে বললে–চলো, লেট আস গো
কোথায়?
ক্লাইভ বললে–এখনও বোধহয় ওরা আছে, এর পরে হয়তো সবাই চলে যাবে আর দেরি করলে চলবে না।
পেরিন সাহেবের বাগানে তখন অন্ধকার ঝিমঝিম করছে। ক্লাইভ আর ওয়াটস বাগানের গেট পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। বড় বড় গাছগুলোর মাথায় কয়েকটা বাদুড় পাখা-ঝাপটানি দিচ্ছে। অনেক ভাবনার বোঝা নিয়ে ইতিহাস আপনার হাতে লিখে চলেছে একটা পরিচ্ছেদের পর আর একটা নতুন পরিচ্ছেদ। সৎ-অসৎ, ন্যায়-অন্যায়, উত্থান-পতনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বারবার। এবার ইন্ডিয়ার পালা। তোমরা অনেকদিন আমাকে অস্বীকার করেছ, আমাকে অবহেলা করেছ, আমি তোমাদের কিছু বলিনি। তোমরা একবার বলেছ ভগবান আছে, একবার বলেছ ভগবান নেই। তোমরা একবার পরকালে বিশ্বাস করেছ, একবার ইহকালে। আলেকজান্ডার যে সমরকন্দের সিংহাসনে বসে একদিন সেকেন্দার বাদশা নামে বিখ্যাত হয়েছিল, সেই সিংহাসনে একদিন তৈমুর আর তার বংশধর বাবর বসেছিল। সিংহাসন তো চিরকাল কারও একচেটিয়া থাকে না। একশো দশ বছরের এক বুড়ির মুখে হিন্দুস্থানের কথা প্রথম শুনেছিল বাবর। শুনেছিল, ১৩৯৮ সালে কেমন করে তৈমুর হিন্দুস্থান দখল করেছিল। তখন থেকেই এ-দেশে আসবার আগ্রহ হয়েছিল সেই ছেলেটার। একদিন যখন বাবর দিল্লির সিংহাসনে বসল, ওদিকে বাংলাদেশে তখন আর-একজন আর-এক সিংহাসন দখল করে বসেছে। সে শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু। হিন্দুস্থানের ইতিহাস এই সিংহাসন বদলের ইতিহাস। সিংহাসন যখন বদলেছে তখন উমিচাঁদের দল এমনি করেই দলিল সইসাবুদ করে পাকা বন্দোবস্ত করে নিতে চেয়েছে। কিন্তু ভারত ভাগ্য বিধাতার বিধানে একদিন সব দলিল, সব সই, সব বন্দোবস্ত আবার বানচাল হয়ে গিয়েছে।
স্যার!
পেছন থেকে হঠাৎ ল্যাসিংটনের গলা পেয়ে ক্লাইভ ফিরে দাঁড়াল।
কী?
ল্যাসিংটন বাগান পেরিয়ে গেটের বাইরে এসে বললে–আপনি চলে যাচ্ছেন?
কেন? কিছু বলবে?
ল্যাসিংটন বললে–মরিয়ম বেগম আর তার বাঁদিটা আপনাকে ডাকছে। বলছে আপনার সঙ্গে একবার কথা বলবে।
কী কথা?
তা বলছে না।
ক্লাইভ বললে–বলল,এখন আমার সময় নেই কথা বলবার। আমি কাল ভোরেই মুর্শিদাবাদ যাচ্ছি, সেখান থেকে ফিরে এসে কথা বলব
কিন্তু ওরা কিছু খাচ্ছে না, না খেয়ে থাকলে যে মারা যাবে।
ক্লাইভ বললে–মারা যায় যাক। মরিয়ম বেগম মারা গেলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোনও লোকসান হবে না
বলে সোজা অন্ধকারের মধ্যেই পা বাড়িয়ে দিলে।
.
উমিচাঁদ নিজের বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই হিসেবের খাতা বার করে বসল। মোহর টাকা জমি সম্পত্তি কারবার সব সেই খাতায় লেখা থাকে। নিখুঁত হিসেব। গুরু নানকের শিষ্য মাথার ওপর গুরুর পট টাঙিয়ে রেখে হিসেব লেখে। হিসেবের মজা বড় মজা। একের পরে একটা শূন্য বসালেই দশ হয়ে যায়। তারপর আর একটা শূন্য বসালেই একশো। আর তারপর আর একটা শূন্য বসালেই এক হাজার। আর তারও পরে একটা শূন্য বসালেই একেবারে দশ হাজার। এমনি একটা করে শূন্য বসিয়েই উমিচাঁদ লাখ লাখ টাকার মালিক হয়েছে আজ। আজ আবার আরও কুড়ি লাখ যোগ হল। কিছু করতে হল না। পরিশ্রম নয়, কেনাবেচা নয়, শুধু একটু বুদ্ধি খরচ। এই বুদ্ধিটারই দাম বিশ লাখ টাকা। হিসেবের খাতার পাতায় শেষ সংখ্যাটার সঙ্গে আরও বিশ লাখ যোগ করলে মোট কত হবে তারই হিসেব করতে উমিচাঁদ একবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গুরু নানকের কথা মনে পড়ল। মাথা উঁচু করে দেয়ালে টাঙানো পটটার দিকে চেয়ে একমনে প্রণাম করে নিলে।