২.০৭ মেহেদি নেসার সাহেব

মেহেদি নেসার সাহেব প্রথম দিকে জানতে পারেনি। নবাব মির্জা মহম্মদ পূর্ণিয়ায় যাবে লড়াই করতে শওকত জঙের সঙ্গে। খবরটা ইয়ারবকশিদের কাছে সুখবর। সেপাইরা যখন লড়াই করবে তখন নবাবের সঙ্গে থাকবে কে? নবাবের সঙ্গে খোঁজা যায়, বাঁদি যায়, বেগম যায়। বাইজি, তয়ফাওয়ালি, বাজনদার, কেউই বাদ পড়ে না। নবাবের বেগমদের জন্যে খানা যায়, খানা পাকাবার বাবুর্চি যায়। লোক-লশকর-পাইকবরকন্দাজ সবাই যায়। আর যায় ইয়ারবকশিরা। যখন শিবিরের ভেতরে নবাবের জন্যে নাচ হয় তখন ইয়াররা শাবাশ’ দেয়। গানের সময় যখন সম পড়ে তখন সোহান আল্লা’ চেঁচায়। অর্থাৎ যেন যুদ্ধের ভাবনা ভুলে থাকতে পারে নবাব, যেন নাচ দেখে গান শুনে চাঙ্গা হয়ে ওঠে নবাব।

ওদিকে মোহনলাল তখন কামান ছুড়ছে নবাবগঞ্জ লক্ষ্য করে। নবাবগঞ্জ আর মনিহারির মধ্যে শওকত জঙ শিবির বসিয়েছে। আর এদিকে নবাবের শিবিরের মধ্যে তখন নতুন তয়ফাওয়ালি গান গাইছে–ইয়ে দিল দিওয়ানা হো চুকা…

বোধহয় রাতটা নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে কাটত। কিন্তু তা হল না। মেহেদি নেসার সাহেবের অত শখের তয়ফাওয়ালির গান শোনা হল না। অনেক দাম দিয়ে ফয়জাবাদ থেকে আনা বাইজি একেবারে বরবাদ হয়ে গেল হঠাৎ।

ওমরাহসাহেব!

মেহেদি নেসার সাহেব মুখ ঘুরিয়ে লোকটাকে দেখেই বললে–কী রে ইবলিশ!

সফিউল্লাসাহাব খুন হো গয়া সাহাব!

তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে মেহেদি নেসার সাহেব। অত দামি নাচ-গান-তয়ফাওয়ালি, সবকিছু ছেড়ে উঠে পড়েছে এক নিমেষে। ইয়ারজান সাহেবও একমনে দিল খুশ করে গান শুনছিল। তাকেও ডেকে বাইরে নিয়ে এল মেহেদি নেসার, বাইরে তখন অন্ধকার। এক-একটা কামান ছুড়ছে আর আগুনের পিণ্ডটা গিয়ে পড়ছে নবাবগঞ্জের বিলের দিকে।

কে খুন করলে?

 মরিয়ম বেগমসাহেবা।

মেহেদি নেসার সাহেবের মুখ দিয়ে একটা অশ্রাব্য গালাগালি বেরিয়ে এল।

 ইবলিশ বললে–কোতোয়াল সাহাবকে খবর ভেজিয়ে দিয়েছি, এখন মতিঝিলের ফাটকে আটকা আছে।

ফাটক কে পাহারা দিচ্ছে?

কোতোয়ালের লোক আর নেয়ামত খাঁ খিদমদগার!

ঘোড়া তৈয়ার?  

ইয়ারজান সাহেব কী করবে বুঝতে পারছিল না। মেহেদি নেসার সাহেবের তখন যেন ভূত দেখার মতো অবস্থা। বললে–জলদি করে ইয়ার, সফিউল্লা খা’র কাছে করিম খাঁ’র খত্ আছে, সে খত্ বেহাত হয়ে যেতে পারে–জলদি করো

ইয়ারজান সাহেবেরও যেন নেশা ছুটে গেল করিম খাঁ’র নামটা শুনে। এখন যদি সব ফাঁস হয়ে যায় তো মুশকিল। সে-চিঠি যদি মরিয়ম বেগমের হাতে পড়ে গিয়ে থাকে! কিংবা নানিবেগমের হাতে। তা হলে যে সবাই ধরা পড়বে, সবাই গর্দান হারাবে।

নবাবের তখন বোধহয় তার মতো এসেছে। নিঃশব্দে দু’জনে বেরিয়ে এল রাস্তায়। রাস্তার ওপর সেপাইরা তখন মোহনলালের হুকুম তামিল করবার জন্যে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিক থেকে শওকত জঙের মিরবকশি কারুগুজার খাঁ’র সেপাইরা বিলের ওপর দিয়ে যাতে এদিকে ঝাঁপিয়ে না পড়ে তারই বন্দোবস্ত করে রেখেছে মিরজাফর সাহেব।

কৌন?

 লম্বা-চওড়া হাঁক দিলে সিপাহি-সর্দার।

মেহেদি নেসার আর ইয়ারজান আর ইবলিশ তিনজনেই তিনটে ঘোড়ায় করে পাঞ্জা দেখিয়ে সেপাইদের বেড়া পেরিয়ে এল। মুর্শিদাবাদ থেকে সোজা ঘোড়া নিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে এসেছিল। ইবলিশ। অনেক পথ পেরিয়ে জান দিয়ে সে ছুটে এসেছে শুধু মেহেদি নেসার সাহেবের নিমকের মর্যাদা রাখতে। মাঝে মাঝে ইবলিশ যে মেহেদি নেসার সাহেবের কাছে মাসোহারা পায় সে তো এইসব কাজের জন্যেই। কে কোথায় যাচ্ছে, কে কাকে কী বললে, কোথায় কী কানাঘুষো হচ্ছে, তা ইবলিশকেই মেহেদি নেসার সাহেবের কানে তুলে দিতে হয়। তারপর যা কিছু করবার তা মেহেদি নেসার সাহেব। নিজেই করে। তখন ইবলিশের ছুটি। চেহেল্-সুতুনের ভেতরে যা-কিছু হয়, জগৎশেঠ-মিরজাফর-মনসুর আলি মেহের সাহেবের দফতরেও যে-ঘটনা ঘটে, তার খবর মেহেদি নেসারের কানে তুলে দেওয়া তার কাজ।

কিন্তু সফিউল্লা খাঁ যে এমন কঁচা কাম করবে তা মেহেদি নেসার সাহেব ভাবতে পারেনি। কথা ছিল করিম খাঁ কী কী বন্দোবস্ত করেছে তা লিখে সফিউল্লা সাহেবের হাতে দেবে। নবাব যখন পূর্ণিয়াতে থাকবে তখনই সব বন্দোবস্ত করতে হবে। বেল্লিক, বেত্তমিজ, বেওকুফ, হারামজাদা! যখন সঙ্গে অত জরুরি খত্ রয়েছে তখন কি কেউ মেয়েমানুষের দিকে নজর দেয়? মেয়েমানুষের দিকে নজর দেওয়ার। সময় তো অটেল রয়েছে হাতে; চিঠিটা আর কারও হাতে পড়ে গেলে সব মতলব যে খোলসা হয়ে যাবে।

ভোর হয়ে এসেছিল রাজমহলের পথেই। তার পরেই তির বেগে তিনটে ঘোড়া ছুটে চলল দক্ষিণের রাস্তাটা ধরে।

যখন মুর্শিদাবাদ পৌঁছল তখন আর একটা দিন, আর একটা রাতও কাবার হয়ে গেছে। পরের দিনের ভোরবেলা যখন কাজিসাহেবের হাবেলিতে পৌঁছুল তখন বেশ সকাল।

কাজিসাহেব নিজামতি মহকুমে কাজার সদরস সুদুর। নামাজ পড়া তার শুরু হয় ভোরবেলা, শেষ হয় ঘণ্টা দু-এক পরে। মেহেদি নেসার সাহেবকে দেখে দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে সেলাম আলেকুম করলেন।

সব শুনে বললেন–দিনকাল বড় খারাপ পড়েছে নেসারসাহেব, সব চিজ মাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে, নিজামতি নোকরিতে আর মজা নেই তেমন–

নেসার সাহেব বললে–কিন্তু এ তকলিফ আপনাকে করতেই হবে কাজিসাহেব–

ওই তো বললুম জনাব, সব চিজ মাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে, দুনিয়ার জিন্দগি ভি মাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে ঔর মুর্দা ভি মাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে

আপনি কত নেবেন বলুন কাজিসাহেব, অত বাহানা করবেন না।

কাজিসাহেব আবার দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন। বললেন–মরিয়ম বেগমসাহেবা এখন কোথায় আছে?

মতিঝিলে!

কাজিসাহেব বললেন–সে-চিঠি যদি দুসরা কারও হাতে চলে গিয়ে থাকে?

ইবলিশ বললে–না হুজুর, আমি নেয়ামতকে বলে রেখেছি কাউকে যেন মুলাকাত করতে না দেয় মরিয়ম বিবির সঙ্গে

কাজিসাহেব বললেন–তা হলে তাড়াতাড়ি কোতোয়ালিতে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখতে হবে, নইলে মরিয়ম বিবি সব ফাঁস করে দেবে। আর নবাব কোথায়?

পূর্ণিয়ায়। শওকত জঙের সঙ্গে জোর লড়াই চলছে দেখে এসেছি।

 নবাব কবে নাগাদ লেটবে?

মেহেদি নেসার সাহেব বললে–সে কাজিসাহেব এখন দেরি হবে অনেক, শওকত জঙের তাগদ কম নয়, তার মিরবকশি কারগুজার খাঁ জঁদরেল লড়নেওয়ালা–আপনি বে-ফিকির থাকুন! ওই মরিয়ম বিবির হাতে যদি চিঠি পড়ে থাকে তো আমাদের সব মতলব বরবাদ হয়ে যাবে। তখন জান নিয়ে টানাটানি হবে আমাদের।

সফিউল্লা সাহেবের কাছে সে-চিঠি নেই ঠিক জানেন জনাব?

ইবলিশ বললে–সফিউল্লা খাঁর কাছে কোনও চিঠি নেই জনাব, কোতোয়াল সাহেব মুর্দা ঘেঁটে পায়নি!

আর করিম খাঁ? চিঠি ঠিক দিয়েছিল তো করিম খাঁ?

 ইবলিশ বললে–করিম খাঁ’র সঙ্গে আগেই তো মোলাকাত করেছি কাজিসাহেব, সে বলছে। সফিউল্লা সাহেবের হাতে চিঠি দিয়ে দিয়েছে নেসার সাহেবের জন্যে! সে-চিঠি যখন সফিউল্লা সাহেবের বরাবর পাওয়া গেল না, তখন কে নেবে আর? হরগিজ মরিয়ম বিবি নিয়েছে

কাজিসাহেব আবার দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন। বললেন–সব চিজ মাঙ্গা হচ্ছে জনাব, এটা তো আপনাদের খেয়াল রাথতে হয়!

মেহেদি নেসার সাহেব রেগে গেল। বললে–তাই তো বলছি, কত নেবেন তাই বলুন, বেশি বাহানা করবেন না–পাঁচশো আসরফি?

কী যে বলেন, পাঁচশো আসরফি তো আমার মুফতি খুদ নেবে, তারপর আছে আমার কাজি-উল-দোজাত–তারপর আছে দারোগা-ই-আদালত–সব চিজ যে মাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে আজকাল জনাব

আচ্ছা, তা হলে এক হাজার আসরফি!

কাজিসাহেব দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে হো হো করে হেসে উঠলেন। যেন ছেলেখেলা করছে এরা তার সঙ্গে।

শেষপর্যন্ত রফা হল দশ হাজারে। দশ হাজার আসরফিতে সফিউল্লা খাঁ সাহেবের খুনের প্রতিশোধ কেনা হয়ে গেল। মেহেদি নেসার, ইয়ারজান, করিম খাঁ সকলের জিন্দগি কিনে ফেলাও হল, এ তো খুব সস্তা দরই পড়ল বলতে গেলে।

কিন্তু কাজিসাহেব ধারে বিশ্বাস করেন না, নগদ চাই!

মেহেদি নেসার বললে–আমিও ধারে বিশ্বাস করি না কাজিসাহেব, নগদই দেব–কিন্তু মরিয়ম বেগমকে ফাঁসিতে লটকাতেই হবে ।

নগদই দেওয়া হল আসরফি। মোহরগুলো যে কোথা থেকে মেহেদি নেসার বার করল রাতারাতি কে জানে! অনেক ডিহিদার, অনেক ফৌজদার, অনেক তালুকদার জমিদারের পরমায়ু নিংড়ে উপায় করা মোহর আবার সদর সুদুরের হাতে উপুড় করে দিতে হল।

কাজিসাহেব বললেন–যদি ভাল চান জনাব তো মরিয়ম বিবিকে কোতোয়ালিতে এনে রাখুন, নইলে আমার হাতের বাইরে চলে যাবে। তখন আপনাদের মোহর ভি চলে যাবে, আপনাদের জান ভি চলে যাবে–

আলেকুম সেলাম জনাব!

মেহেদি নেসার চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ইয়ারজান, ইবলিশ তারাও সেলাম করে চলে গেল। কাজিসাহেব মোহরগুলো নিয়ে ঘরের ভেতরে লোহার সিন্দুকে রাখতে গেলেন। কিন্তু বাইরে তখনই আবার যেন কে ডাকলে সদর-সুদুরকে।

কৌন?

মোহরগুলো রেখেই কাজিসাহেব ফিরে এসে দেখেন নজর মহম্মদ দাঁড়িয়ে আছে।

কী রে, তুই? তবিয়ত আচ্ছা তো?

তবিয়ত তো আচ্ছা, লে কাম পেস গিয়া সাহাব। একজন গরিব আদমিকে আপনার পাশ নিয়ে এসেছি দোয়ার জন্যে!

গরিব আদমি, দোয়া, এইসব কথা শুনেই কাজিসাহেবের খুশ মেজাজটা বিগড়ে গেল আবার। গরিব আদমিরা আবার তার কাছে কী করতে আসে!

আমার কি সময় আছে রে এখন! কাছারিতে যেতে হবে। আর দিনকাল যা পড়েছে, সব চিজ মাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে, দেখছিস তো

নজর মহম্মদ বললে–তা তো হাড়ে হাড়ে বুঝছি হুজুর, লে এ বড়া গরিব আদমি!

 কোথায় সে?

হুজুর, বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি, ভরসা দেন তো ভেতরে ডেকে নিয়ে আসি।

কী কাম আমার কাছে?

হুজুর, সে খুদ নিজেই হুজুরের বরাবর তার আর্জি পেশ করবে।

ভরসা পেয়েই নজর মহম্মদ বাইরে গেল। আর সঙ্গে করে নিয়ে এল একজন লোককে। সদর সুদুর সাহেব গোঁফ-দাড়ির ফাঁক দিয়ে ভাল করে লোকটার দিকে চেয়ে দেখলেন। জওয়ানি ছোকরা, কিন্তু গরিব আদমিদের দেখতে পারেন না সদরস্ সুদুর সাহেব। গরিব আদমিরা সদর সুদুর সাহেবের চক্ষুশূল। তাদের না আছে রেস্ত না আছে দিল-দিমাগ!

নজর মহম্মদ বললে–হুজুর, এর নাম কান্ত সরকার, সারাফত আলির খুশবু তেলের দুকানের পেছনে থাকে, বড় গরিব।

কী চায় এ? কাজিসাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

 নজর মহম্মদ বললে–হুজুর, মরিয়ম বেগম সফিউল্লা সাহেবকে খুনের দায়ে গ্রেফতার হয়েছে, এখনও মতিঝিলের ফাটকে আটকে আছে তাকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিতে হবে

কেন?

হুজুর, মরিয়ম বেগমসাহেবা এর ভারী পেয়ারের মেয়েমানুষ। বড় পেয়ার করে এ মরিয়ম বেগমকে, মরিয়ম বিবির ফাঁসি হয়ে গেলে এর কলিজা একেবারে ফেটে যাবে হুজুর! আপনি যদি মরিয়ম বিবিকে ছেড়ে দেন তো এর খুব আনন্দ হয়! তার জন্যে আপনাকে এ খুশি করে দেবে–

সব শুনে কাজিসাহেব দাড়িতে হাত বুলোতে লাগলেন।

বললেন–দুনিয়া বড় খতরা হয়ে গেছে রে নজর, আজকাল সবকিছু মাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে, দেখছিস তো; বড় খতরা হয়ে যাচ্ছে দুনিয়া

নজর বলতে লাগল–বড় গরিব মানুষ এই কান্তবাবু হুজুর, ছ’টাকা তলব পায়, উপরি ভি নেই, কোত্থেকে দেবে আপনাকে বেশি।

কাজিসাহেব তখনও দাড়িতে হাত বোলাচ্ছেন। বলতে লাগলেন–সব চিজ মাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে এটা তো তোদের খেয়াল রাখতে হয় নজর!

নজর বললে–তাই তো বলছি কত নেবেন তাই বলুন, বেশি বাহানা করবেন না, পাঁচশো আসরফি!

কী যে বলিস, পাঁচশো আসরফি তো আমার মুফতি খুদ নেবে, তারপর আছে আমার কাজি-উল-দোজাত, তারপর আছে দারোগা-ই-আদালত–সব চিজ যে মাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে আজকাল নজর–

আচ্ছা, তা হলে এক হাজার? তার বেশি ও দিতে পারবে না হুজুর, ও মারা যাবে, জানে মারা যাবে

গরিব আদমি! বেশি আর টানাটানি করলেন না কাজিসাহেব।

বললেন–ঠিক আছে, গরিব আদমি, তা হলে তাই-ই দে—

নজর উঠে দাঁড়াল। বললে–বহুত মেহেরবানি হুজুর, আসরফি নিয়ে এসে কালই ও দিয়ে যাবে আপনার বরাবর–মেহেরবানি রাখবেন গরিবের ওপর হুজুর

নজর মহম্মদের সঙ্গে কান্তও বাইরে বেরিয়ে এল।

ওদিকে মতিঝিলে তখন মেহেদি নেসার সাহেব, ইয়ারজান সাহেব, ইবলিশ মিঞা সবাই গিয়ে হাজির হয়েছে। সঙ্গে কোতোয়াল সাহেবও গিয়েছে।

ফাটকের সামনে গিয়ে নানিবেগমকে সবাই মাথা নিচু করে কুর্নিশ করলে।

 মরিয়ম বেগমসাহেবাকে কোতোয়ালিতে নিয়ে যেতে এসেছি বেগমসাহেবা।

কাজিসাহেবের পরোয়ানা আছে?

জি বেগমসাহেবা!

নানিবেগম কী যেন ভাবলে। তারপর বললে–মির্জা মুর্শিদাবাদে আসবার আগে এর বিচার হবে, না পরে হবে?

তা তো মালুম নেই বেগমসাহেবা! কাজিসাহেব জানে!

 তারপর নানিবেগম মেহেদি সাহেবের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল–পূর্ণিয়ার লড়াইয়ের খবর কী নেসার? মির্জা ভাল আছে?

হা বেগমসাহেবা!

তারপর কোতোয়াল সাহেব মরিয়ম বেগমকে নিয়ে ফাটকের বাইরে এল। মরালীও যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। যেতে যেতে বললে–আসি নানিজি!

কোতোয়াল সাহেব মরিয়ম বিবিকে পালকিতে তুলে নিয়ে রাস্তার দিকে চলতে লাগল। পেছনে পেছনে ঘোড়ায় চড়ে চলতে লাগল কোতোয়াল সাহেব, মেহেদি নেসার সাহেব, ইয়ারজান সাহেব, আর । আরও অনেকে।

কাজি সাহেবের হাবেলির বাইরে এসে দাঁড়াতেই কান্ত হতাশ হয়ে পড়ল। হাজার আসরফি। হাজার আসরফি দিলে মরালীকে কাজিসাহেব ছেড়ে দেবে। কিন্তু এই এক দিনের মধ্যে হাজার আসরফি কী রকম করে জোগাড় করবে!

হঠাৎ সামনে দিয়ে একটা পালকি আসছিল–হট যাও–হট যাও

তফাতে সরে দাঁড়াল কান্ত। নজর মহম্মদ বললে–ওই তো কোতোয়াল সাহেব মরিয়ম বিবিকে কোতোয়ালিতে নিয়ে যাচ্ছে

আর ওরা কারা?

আরে ওই তো কোতোয়াল সাহেব, মেহেদি সাহেব, ইয়ারজান সাহেব, আর পাহারাদারের দল

*

সেদিন সরখেলমশাই আবার এসে উঠল হাতিয়াগড়ের অতিথিশালায়। কেষ্টনগর থেকে এসেছে। খাজাঞ্চিবাবুকে ডেকে বললে–ছোটমশাই আছেন নাকি খাজাঞ্চিবাবু?

খাজাঞ্চিবাবু চেহারা দেখেই চিনে ফেলেছে। চুপি চুপি বললে–কেষ্টনগর থেকে এসেছ নাকি তুমি?

আজ্ঞে হ্যাঁ কর্তা!

তা হলে এসো আমার সঙ্গে

বলে সোজা অন্দর বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে একেবারে ছোটমশাইয়ের ঘরে নিয়ে গেল। তাকে সেখানে পৌঁছিয়ে দিয়ে খাজাঞ্চিবাবু নীচেয় নেমে এসেছে।

ছোটমশাইয়ের হাতে চিঠিটা দিতেই ছোটমশাই বললেন তুমি নীচেয় যাও, আমি তোমায় খবর পাঠাব।

সরখেল চলে যেতেই ছোটমশাই লেফাফাখানা ছিঁড়ে চিঠিখানা পড়তে লাগলেন।

চিঠিটা লিখছেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মন্ত্রী কালীকৃষ্ণ সিংহ মহাশয়

শ্ৰীযুক্ত রাজা হিরণ্যনারায়ণ রায় বাহাদুর অসংখ্য দীন প্রতিপালকেষু—

রাজাধিরাজ মহারাজ নবদ্বীপাধিপতি শ্রীল শ্রীযুক্ত কৃষ্ণচন্দ্র রায় আজ্ঞা মতো অত্র পত্রে নিবেদন কুরু, মহাশয়, মহাশয়ের ধর্মপত্নীকে অম্মাদাঞ্চলে মহারাজ-ভবনে পাঠাইবার ব্যবস্থাদি করিয়াছিলেন। সেইমতো মহারাজ কতিপয় দিবস অপেক্ষা করোন্তর হতাশ-পূর্ব জ্ঞাত করাইতেছেন যে অদ্যাবধি হাতিয়াগড়ের রানিমহাশয়ার আগমনের কোনও লক্ষণাদি নাই। বহু দিবস গত হওন পর কোনও বিপদাপদ আবির্ভাবের সন্দেহ উদ্রেক হওয়ায় অত্র পত্র পত্রবাহক মারফত প্রেরিত হইল। মহাশয় পত্রান্তরে সন্দেহভঞ্জন করতঃ শুভম্বিশেষ সংবাদ দানে চিত্তবিক্ষোভ রহিত করিবেন বাঞ্ছা করিয়া পত্র সমাপ্ত করিলাম। ইতি… চিরবশংবদ–

বড় বউরানি ঘরে এসেছিল। বললে–কার চিঠি?

 এই দেখো–বলে ছোটমশাই চিঠিটা এগিয়ে দিলেন।

তারপর অনেকক্ষণ দু’জনেই চুপ করে রইলেন। একদিন ছটফট করছিলেন ছোটমশাই। তারও ঘুম আসেনি রাত্রে। দিনেরবেলাতেও কাছারিতে আসেননি। জগা খাজাঞ্চিবাবু সেরেস্তার কাগজপত্র নিয়ে। এসে দরকার মতো দেখিয়ে গেছে। হুকুমনামা নিয়ে গেছে। প্রজা-পাঠকরা যারা দেখা করতে এসেছে। তারা জেনে গেছে ছোটমশাইয়ের শরীর খারাপ। নীচেয় নামবেন না।

সরখেলমশাই আছে না চলে গেছে?

ছোটমশাই বললেন–আছে, অতিথিশালায় থাকতে বলেছি—

বড় বউরানি বললে–এ-চিঠির কী উত্তর দেবে, কিছু ভেবেছ?

না, এখনও কিছু ভেবে পাইনি।

 বড় বউরানি বললে–তুমি ভেবে পাওনি, কিন্তু আমি ভেবে ফেলেছি

কী ভেবেছ?

বড় বউরানি বললে–তুমি মহারাজকে লিখে দাও, আমি নিজে যাব মহাতাপচাঁদ জগৎশেঠের কাছে, যদি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র পারেন তো তিনি একবার যেন সেখানে আসেন।

তুমি যাবে? তুমি নিজে?

 কেন, দোষ কী?

না, সে কথা বলছি না, জগৎশেঠজির কাছে গিয়ে তোমার লাভ কী হবে? ছোটবউকে কি জগৎশেঠ লুকিয়ে রেখে দিয়েছে?

না, তা রাখেনি। লুকিয়ে রেখেছে নবাবের লোক।

 কী করে জানলে?

 কেন, নবাবের লোক লুকিয়ে রাখতে পারে না? নবাবের কোন কাজটা করতে বাধে শুনি? পরের বউয়ের ওপর নজর যে দিতে পারে, সে সব পারে! আমি নিশ্চয় করে বলছি, এ আর কারও কাজ নয়; নবাবের ডিহিদার-ফৌজদার আর তার চরেরা মিলে একাজ করেছে। ওই যে লোকটা এসেছিল, নিজের নাম বলেছিল কার্তিক পাল–ওই বশির মিঞা এই কাণ্ড করেছে।

ছোটমশাই বললেন–বশির মিঞা কী করে জানবে? তার আগেই তো মাঝরাত্তিরে বজরা করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে

তা তুমি কি ভেবেছ ওদের এক জোড়া চোখ? তা হলে এখানে ডিহিদার রেজা আলি রয়েছে কী করতে? ঘাস কাটতে?

ছোটমশাই বললেন–সেই জন্যেই তো আমি ওদের অমন করে একা একা পাঠাতে চাইনি, তুমি জোর করলে তাই তো পাঠালাম, তখনই জানতুম একটা না একটা বিপদ বাধবে। শেষে যা ভেবেছিলুম তাই হল তো? এখন মহারাজাই বা কী করবেন, জগৎশেঠজিই বা কী করবেন? কোথায় যে তারা আছে, কী করছে, কী খাচ্ছে, কারও বোঝবার উপায় নেই।

বড় বউরানি বললে–দোষ তুমি তো আমারই দেখলে। আর যখন ছোটকে নিয়ে মুর্শিদাবাদে গিয়েছিলে তখন তো আমার পরামর্শ নাওনি? তখন তো আমার কথা একবারও শোনোনি? তখন আমার কথা শুনলে কি আর এই দুর্দশা হয়। তখনই তো তোমার ভাবা উচিত ছিল এসব কথা।

তারপর একটু ভেবে বললে–তা সে যা-হবার তা হয়ে গেছে, এখন ভাবলে কোনও লাভ নেই, এখন আমি মুর্শিদাবাদে যাচ্ছি, তার জোগাড়যন্ত্র করে দাও।

তুমি যাবে মুর্শিদাবাদে? সেখানে কোথায় গিয়ে উঠবে? কার কাছে যাবে?

তা বাংলাদেশে কি মানুষ নেই? সব মানুষ কি বাংলাদেশের মরে গেছে? জগৎশেঠজিরও তো বউ-ঝি আছে, তার তো একটা বাড়ি আছে, সে-বাড়িতে তো থাকবার জায়গাও আছে। সেখানেই গিয়ে উঠব। গিয়ে জগৎশেঠজিকে বলব যে আপনারা থাকতে বাংলাদেশের মেয়েরা কি সব আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরবে? রাজপুতদের মেয়েদের মতো জহরব্রত করবে?

ছোটমশাই বললেন–তুমি একটু মাথা ঠান্ডা করো, যা করবে মাথা ঠান্ডা করে করো। অমন হুটপাট করে কিছু কোরো না। তাতে তোমারও ভাল হবে না, আমারও ভাল হবে না

বউ বউরানি বললে–আর ভাল হয়ে কাজ নেই, যথেষ্ট ভাল হয়েছে

কিন্তু শেষকালে যে সব জানাজানি হয়ে যাবে! একবার ডিহিদারের কানে গেলে তখন মেহেদি নেসারের কানেও উঠে যাবে, তখন আর সামলাতে পারব না, তাও বলে রাখছি–

আর সামলাবার রইলটা কী শুনি? বউ গেল, ইজ্জত গেল, মান-সম্ভ্রম সব গেল, এখনও তুমি সামলাবেটা কী? সামলাবার আছে কী যে সামলাবার কথা বলছ?

ছোটমশাই বললেন অত চেঁচিয়ো না তুমি, কেউ শুনতে পাবে–

তা তুমি কি ভাবো এইরকম করে বরাবর খবরটা চাপা রাখতে পারবে তুমি? একদিন ছোটবউটা গেছে, এরপর কবে তোমার তালুকও যাবে, তখন কেঁদেও কূল পাবে না!

ছোটমশাই কিছুক্ষণ ভেবে বললেন–তা তুমি কী করতে বলল আমাকে। আমি না-হয় তাই-ই করব।

তোমাকে আর কিছু করতে হবে না, যা করবার আমিই করব।

তা কী করবে তুমি সেটা আমাকে বলবে তো?

 তোমাকে বলেই বা কী লাভ হবে বলে তোতুমি তো কোনও সুরাহা করতে পারবে না!

 বলল আমাকে, বলে দাও, কী করলে সুরাহা হয়!

তা তোমরা এতগুলো মানুষ এক দলে রয়েছ, তোমরা সবাই মিলে পরামর্শ করে একটা সুরাহা করতে পারলে না, আর আমি মেয়েমানুষ হয়ে তোমাদের সুরাহার পথ বাতলে দেব? তুমি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে যাও, গিয়ে জগৎশেঠজির সঙ্গে দু’জনে মিলে দেখা করো! তাকে গিয়ে বলো যে বাংলাদেশের মানুষগুলো মরে-হেজে যাক এইটেই কি আপনি চান? আপনার টাকা আছে, আপনার লোকবল আছে, দিল্লির বাদশার ওপর আপনার এত জোর আছে, তবু আপনি এর একটা বিহিত করবেন না?

তা নবাবের সঙ্গে কি লড়াই করতে বলো আমাদের?

কেন, লড়াই করতে তোমাদের এত ভয়?

ভয় কে বললে? কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যেই যে কারও সঙ্গে কারও মতের মিল নেই। কে যে নবাবের দলে আর কে যে নয়, তারই যে ঠিক নেই। আমাদের সামনে তো সবাই নবাবকে গালাগালি দেয়, কিন্তু নবাবের সামনে গিয়ে আবার যে সবাই মাথা নিচু করে কুর্নিশ করে! নবাব একটু হেসে কথা বললে–যে সবাই কৃতার্থ হয়ে যায়। যে-ই একটু মুখ বেঁকায় অমনি তাকে চাকরি দিয়ে নবাব দলে টেনে নেয়।

কিন্তু আজ না-হয় হাতিয়াগড়ের বউকে নিয়ে গেছে, কাল যদি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বউকে নিয়ে যায় তো তখন কি মহারাজ চুপ করে বসে থাকবেন তোমার মতো?

তা আমি কি চুপ করে বসে আছি? আমি কি ভাবছি না মনে করছ?

বড় বউরানি রেগে গেল। বললে–বসে বসে তুমি তা হলে ভাবো, তাতেই বউ উদ্ধার হয়ে যাবে, আর কী! 

তা তুমি অমন রাগ করছ কেন? দুটো পরামর্শের কথা বলো, তা হলে তো তবু আমি শান্তি পাই।

সবাই যখন মরোমরো, তুমি তখন শান্তি চাইছ! বেশ তো!

ছোটমশাই বললেন–তা হলে তুমি যা বলছ তাই-ই করি! আজকেই রওনা দিই কেষ্টনগরে, গিয়ে মহারাজকে নিয়ে জগৎশেঠজির কাছে যাই। গিয়ে বলি এইসব ব্যাপার।

হ্যাঁ, বলবে। তারপর ফিরিঙ্গিরা রয়েছে, ফরাসি-ফিরিঙ্গিরাও রয়েছে, তারাও তো খেপে আছে নবাবের ওপর, তাদেরও তো তোমরা দলে টানতে পারো! ইচ্ছে থাকলে কী না পারে লোকে। আর তা যদি না বলতে পারো তো আমি নিজেও গিয়ে বলতে পারি।

না না, তুমি মেয়েমানুষ, তুমি যাবে, সেটা ভাল দেখাবে না!

কেন, রানিভবানীও তো তোমাদের দলে, তিনিও তো মেয়েমানুষ। তিনি যদি আসেন, আমিও যেতে পারি!

রানিভবানী আর তুমি? ওঁরা কী ভাববেন বলল তো?

কী আর ভাববেন, ভাববেন হাতিয়াগড়ের জমিদারের কোনও সাহস নেই তাই তার বউকে পাঠিয়েছে। তুমি কি নিজেকে পুরুষমানুষ বলতে চাও? পুরুষমানুষ হলে কি এর পরেও কেউ চুপ করে। বাড়িতে বসে থাকতে পারে? আজ তোমার চক্ষুলজ্জাটাই বড় হল, আর নিজের বউয়ের ধর্মটা কিছু। নয়?

ছোটমশাই গম্ভীর হয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন–তা হলে আজই যাবার ব্যবস্থা করি, যদি কেউ জিজ্ঞেস করে তো বলে দিয়ে আমি তালুক দেখতে বেরিয়েছি, বুঝলে?

সরখেলমশাই তখনও অতিথিশালায় ছিল। তার হাতে চিঠি দিলেন ছোটমশাই। লিখলেন–আমি আপনার চিঠি পাইয়া অতিশয় চিন্তান্বিত হইয়া পড়িয়াছি। অবিলম্বে আপনার বরাবর হাজির হইয়া সমুদয় নিবেদন করিবার মানস করিয়াছি। সাক্ষাতে সমস্ত জ্ঞাত করাইব।

সেদিন গভীর রাতে ছোটমশাই আবার নদীর ঘাটে একটা বজরাতে উঠলেন। গোকুলও সঙ্গে সঙ্গে বজরায় উঠল। কাকপক্ষীতেও যাতে টের না পায় তাই সরখেলমশাইকে আগেই যাত্রা করতে বলে দিয়েছিলেন। ছাতিমতলার ঢিবির কাছে যেন কালো মতন একটি কী নড়ে উঠল।

ছোটমশাইয়ের কী যেন সন্দেহ হল। গোকুলকে জিজ্ঞেস করলেন–ওখানে কে রে গোকুল?

গোকুলও দেখতে পেয়েছিল। জোরে গলা ছেড়ে জিজ্ঞেস করলে ওখানে কে গা, কে ওখানে দাঁড়িয়ে?

কেউ উত্তর দিলে না। শুধু মনে হল ছায়ামূর্তিটা যেন নড়ে উঠে সরে গেল। কিন্তু কিছু উত্তর দিলে না।

গোকুল আবার চেঁচিয়ে উঠল–কে ওখানে? ওখানে কে সরে গেলে?

তবু কারও উত্তর নেই।

 তবে হয়তো গোরুটোরু হবে। কেরষাণটা গাইটাকে গোয়ালে পুরতে ভুলে গেছে।

গোকুল বললে–ও ওই ভূতেশ্বরের কাণ্ড, শ্যামলা গাইটাকে বাইরে রেখেই খোঁয়াড় বন্ধ করে দিয়েছে হুজুর, ওভেনে ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে–যদি

ছোটমশাই বললেন–থাক গে, এবার বজরা ছাড়তে বল

কিন্তু বজরা ছাড়বার আগেই ছাতিমতলার ঢিবির ওপার থেকে চিৎকার এল সরখেল মশাইয়ের। সরখেলমশাই চিৎকার করতে করতে দৌড়ে আসছে–ওগো, কাদের নৌকো গো, বাঁধো, আমি যাব

গোকুল বজরা বাঁধতে বললে। কিন্তু ছোটমশাই সরখেলমশাইকে দেখে অবাক হয়ে গেছেন।

 সরখেলমশাইও ছোটশাইকে দেখে হতবাক।

 একী? তুমি? তুমি যাওনি এখনও? তোমাকে যে দু’প্রহরের সময় যেতে বললাম!

 সরখেল তখনও হাঁফাচ্ছে। নদীর ঘাটে বইঠার ঝপঝাঁপ শব্দ পেয়েই দৌড়ে এসেছিল ঊর্ধ্বশ্বাসে।

বললে–হুজুর, সব্বনাশ হয়ে গেছে–

কী হল?

আজ্ঞে, ডিহিদারের লোক ধরে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে।

কেন?

তা জানিনে হুজুর, অতিথিশালা থেকে আমি বেরোচ্ছি, হঠাৎ কে একজন এসে আমাকে ডিহিদারের দফতরে যেতে বললে।

ছোটমশাই বললেন সর্বনাশ! তারপর?

তারপর আজ্ঞে, ডিহিদার আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি কোত্থেকে এসেছি, কী কাজে এসেছি, কেন এসেছি, হ্যাঁনত্যান কত কী! শেষে আমাকে বললে–চিঠিখানা দেখি?

তুমি চিঠি দিলে নাকি?

আমি কি দিতুম হুজুর? তারা যে কেড়ে নিলে!

কেড়ে নিলে আর তুমিও দিয়ে দিলে? চিঠিখানা পড়লে নাকি ডিহিদার?

আজ্ঞে হাঁ, পড়লেন। সবটা পড়লেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন আমি কী চিঠি নিয়ে এসেছি, সেখানাতে কী লেখা ছিল? আমি বললাম, আমি তা দেখিনি হুজুর, আমি লেখাপড়া জানি না, দেখলেও পড়তে পারতাম না।

ছোটমশাই চিন্তিত হয়ে উঠলেন। বললেন–কী সর্বনাশ করলে এখন বলল দিকিনি সরখেল। আমি তোমায় কতবার সাবধানে যেতে বলেছি না, আর তুমি কিনা এই কাজ করলে?

আমি তো কতবার এমনি চিঠি নিয়ে গিয়েছি হুজুর, কখনও তো এমন হয়নি!

আর কী হবে! যা হবার তা হয়ে গেছে। ছোটমশাই বজরা ছাড়তে বলে দিলেন। কাছি খুলে দিলে মাঝিরা। ছোটমশাই সরখেলমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন–যে-লোকটা তোমায় ডেকে নিয়ে গেল তার কী রকম চেহারাটা বলো তো? মনে আছে?

সরখেলমশাই বললে–খুব মনে আছে হুজুর, পাতলা ক্ষয়া চেহারা, শ্যামলা রং গায়ের, মাথায় বড় বড় চুল, মুখে নুর!

ঠিক হয়েছে! ছোটমশাই শিউরে উঠলেন চেহারার বর্ণনা শুনে। বশির মিঞা! বশির মিঞা তা হলে আবার এসেছে হাতিয়াগড়ে। সেবার কার্তিক পাল সেজে এসে উঠেছিল অতিথিশালায়, এবার এসে উঠেছে ডিহিদার রেজা আলির দফতরে! কিন্তু এবার কীসের মতলব!

ছোটমশাইয়ের বজরা তখন সোঁ সোঁ করে তিরের বেগে উজানে বয়ে চলেছে।

*

বরানগরের ছাউনির ভেতর তখন ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের মানচিত্র আঁকা হতে চলেছে পাকাপাকিভাবে। সে ভারতবর্ষ আর-এক ভারতবর্ষ। সে ভারতবর্ষ থেকে র-মেটিরিয়াল চালান যাবে ইউরোপে, আর ফিনিশড-প্রোডাক্ট হয়ে আমদানি হবে এই ইন্ডিয়ায়। এরা কাপড় পরতে পায় না, এখানে চালান করবে সেই কাপড় ইংলন্ড। সেই মানচিত্রে ইন্ডিয়ার রং হবে রেড। সেই রেড রং দিয়েই এম্পায়ারের ভিত তৈরি হবে এখানে। এই যেখানে হাতিয়াগড়ের ছোটরানি আর তার ঝি দুর্গা এসে উঠেছে। শুধু যে লাল রং হবে তাই-ই নয়, ইংলন্ডের ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিভলিউশনের সঙ্গে সঙ্গে যাতে রেডি মার্কেট পাওয়া যায়, তার জন্যেও তো জমি তৈরি করা দরকার; ইন্ডিয়ার মতো এমন উর্বর জমি কোথায় পাওয়া যাবে? এখানে বাদশার অস্তিত্ব তখন লোপাট হবার জোগাড়। এখানে-ওখানে যেসব স্টেট আছে তারা বাদশাকে খাজনা দেবার কথাও ভুলে গেছে ইচ্ছে করে। তারপর মানুষ যারা তখনও কোনওরকমে টিকে আছে, তারাও মনে মনে বলছে–আমাদের ভোমরা বাঁচাও সাহেব, আমরা মরে যাচ্ছি

ওয়াটসন সেই চিঠিখানা দেখালে, সেই চিঠির উত্তরটাও দেখালে।

কর্নেল ক্লাইভ পড়তে লাগল।

মান্যবর নবাব বাহাদুর বরাবরেষু–

ইংরেজ-কোম্পানির বাণিজ্য রক্ষাৰ্থ ইংলভাধিপ আমাকে এই দেশে প্রেরণ করিয়াছেন। আপনি বলপ্রয়োগে ইংরেজদিগকে কলিকাতা হইতে বিতাড়িত করিয়াছে। তাহাদের বহু পল্টন ও বহু অর্থ লুণ্ঠিত হইয়াছে। ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্যের জন্য মোগল-এম্পায়ারের প্রভূত মুনাফা আসিতেছে। আপনার আমির-ওমরাহরা এবং আপনার বেগমরা পর্যন্ত আমাদের কোম্পানির সহিত বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করিয়া উপকৃত হইতেছেন। অতএব ভরসা করি, ইংরাজ পক্ষের বাণিজ্যাধিকার পুনঃপ্রদান ও ন্যায়সঙ্গত ক্ষতিপূরণ করিয়া বাধিত করিবেন..’

এর উত্তরে নবাব কী লিখেছে?

ওয়াটসন বললেন–এই দেখো নবাবের চিঠি। নবাব লিখেছে–আপনার পত্র পাইবামাত্রই উত্তর প্রদত্ত হইয়াছে। কিন্তু বোধ হইতেছে সে উত্তর আপনারা পান নাই। সুতরাং পুনরায় লিখিতেছি ইংরেজ অধ্যক্ষ ড্রেক আমার আদেশনামানিয়া পলায়িত প্রজা কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দিয়াছিলেন, তজ্জন্য তাহাকে শাস্তি দিয়াছি। তাহার বদলে অন্য কাহাকে অধ্যক্ষ মনোনীত করিলে ইংরেজদিগের বাণিজ্যাধিকার পুনস্থাপনায় আমার কোনও আপত্তি নাই।

তারপর দেখো, আমি সেই চিঠির উত্তরে এই চিঠি লিখেছিলাম–’রাজারা স্বকর্ণে শুনিয়া বা স্বচক্ষে দেখিয়া কার্য করেন না, এজন্য কুটিল কর্মচারীবর্গের দ্বারা তাহারা অনেকসময় প্রতারিত হন। আপনার নিজের আমির-ওমরাহরাই যত নষ্টের জড়। আপনি সেই কুপরামর্শদাতাদের শাস্তি দিন, ইংরেজপক্ষের। লোকসানের ক্ষতিপূরণ করুন। ড্রেক সাহেব কোম্পানির ভৃত্য। তাঁহাকে শাস্তি দিবার অধিকার আপনার নাই। কোম্পানির নিকট জানাইলে কোম্পানিই তাহার বিচার করিবেন।

ওয়াটসন বললেন–এর পর কী করতে চাও তুমি, বলো–এ-চিঠির উত্তর এখনও কিছু আসেনি–

কর্নেল ক্লাইভ বললে–আমি বলি নবাবের সঙ্গে ঝগড়া করে আমরা পারব না—

তুমিও শেষকালে ভয় পেয়ে গেলে?

ক্লাইভ হাসল। বললে–ভয় পেলে আর এখানে আসতুম না এমন করে। ভয় পেলে ইংলন্ডেই থেকে যেতুম, কিন্তু ভয় আমার জন্যে নয়, ভয় তোমার জন্যে, ভয় তোমাদের কোম্পানির জন্যে। মোটা টাকা প্রফিট বন্ধ হবার ভয়। ফ্রান্সের সঙ্গে এখন লড়াই বেধেছে আমাদের, সে-চিঠি তো তুমি পেয়েছ। এইসময় নবাব যদি এখানকার চন্দননগরের ফ্রেঞ্চ কম্যান্ডারের সঙ্গে হাত মেলায় তখন আমাদের দশা কী হবে ভাবো তো

হঠাৎ হরিচরণ ঘরে ঢুকল। বললে–আপনাকে একবার ভেতরে ডাকছেন—

কে?

দুগ্যাদিদি!

 ক্লাইভ বললে–বলো যাচ্ছি

ওয়াটসন জিজ্ঞেস করলে সেই ফিমেল দুটোকে এখনও রেখেছ নাকি?

 ক্লাইভ রেগে উঠল ফিমেল বোলো না, বলো লেডি! একটু রেসপেক্ট নিয়ে কথা বলা উচিত। মেয়েদের সম্বন্ধে।

ও, তুমি এখনও সেইরকম আছ দেখছি। যদি লড়াইতে জিততে চাও তো ওসব ছেড়ে দাও রবার্ট, মেয়েদের উইকনেস সর্বনাশ করে দেবে তোমার। ভুলো না আমরা এখানে ফুর্তি করতে আসিনি

আবার সেদিনকার মতো ক্লাইভের মাথায় রক্ত চড়ে উঠছিল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলে। বললে–তুমি এখন যাও ওয়াটসন, আমি এখন টায়ার্ড

ওয়াটসন গজগজ করতে করতে চলে গেল। ক্লাইভ ভেতরের দিকে আসতেই দেখলে, দাওয়ার ওপর কে বসে রয়েছে।

তুমি কে? হু আর ইউ?

লোকটা উঠে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে প্রণাম করলে। বললে–অধীনের নাম উদ্ধব দাস হুজুর

তার মানে বেগার! ভিক্ষে চাও? না, এখানে কোনও ভিক্ষেটিক্ষে হবে না।

ক্লাইভ সাহেব রেগেই ছিল সেই থেকে। ওয়াটসনের কথায় মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। তারপর এই ভিখিরিটা এখানে এসেছে। হয়তো ভিখিরি নয়, নবাবের মিলিটারি ইনফরমার। স্পাই। নবাবের গুপ্তচরেরা এইরকম করেই ইংলিশ আর্মির খবর নিয়ে যায়। কী রকম একটা কৌতূহল হল।

জিজ্ঞেস করলে এখানে কী করতে এসেছ তুমি? আমার সেন্ট্রি তোমায় ঢুকতে দিলে?

আমাকে সবাই সব জায়গায় ঢুকতে দেয় সাহেব, আমাকে সবাই ভালবাসে কিনা, শুধু আমার বউই ভালবাসে না, তাই পালিয়ে গেছে আমায় ছেড়ে

তোমার ওয়াইফ? তোমায় ছেড়ে পালিয়ে গেছে? হোয়াই?

সেই জন্যেই তো আমি গান বেঁধেছি সাহেব আমি রব না ভব-ভবনে! যে-নারী করে নাথ পতিবক্ষে পদাঘাত, তুমি তারই বশীভূত, আমি তা সব কেমনে।

সাহেব কথাগুলোর মানে ভাল করে বুঝতে পারলে না। বললে–তার মানে কী?

 উদ্ধব দাস বললে–তার মানে হল, আমার নিজের বউই যখন আমায় তাড়িয়ে দিলে তখন আর আমি এ-সংসারে থেকে কী করব? আমি তাই ঘুরে ঘুরে বেড়াই সাহেব, সারা পৃথিবীই আমার সংসার, আমি যখন যেখানে থাকি সেইটেই আমার ঘর।

হোল ওয়ার্ড তোমার ঘর?

কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ যেন নতুন একটা কথা শুনল, নতুন একটা কথা শিখল। এতদিন ইন্ডিয়ায় এসেছে, এমন কথা তো কেউ আগে বলেনি। হোল ওয়াডই একটা ফ্যামিলি, একই ফ্যামিলিরই লোক। আমরা সবাই। তবু কেন ওরা ঝগড়া করে? তবু কেন ওরা লড়াই করতে পাঠিয়েছে তাকে?

তোমার ওয়াইফ পালিয়ে গেছে বলে সত্যিই তোমার কষ্ট হয় না?

উদ্ধব দাস হাসল হোহো করে। বললে–কষ্ট না হলে কি কবি হতে পারতুম গো সাহেব? কষ্ট হয় বলেই তো ওই গান বাঁধতে পেরেছি! কষ্ট হওয়া ভাল গো, সাহেব, একটু কষ্ট হওয়া ভাল। তোমার একটু কষ্ট হোক আমার মতন, দেখবে তুমিও কত কাজ করতে পারবে। আর যদি একটু অহংকার হয় তোমার তো তুমি গেলে! দর্পহারী মধুসূদন

দর্পহারী মধুসূদন? সে কে? হু ইজ হি?

 হুজুর, তিনিই তো এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন, দর্প দেখলেই তিনি তাকে বিনাশ করেন! দেখছ না সাহেব, নবাবের কত দৰ্প আমাদের! মাথার ওপর বসে সেই দর্পহারী তো সমস্ত দেখছেন!

সাহেব এবার উদ্ধব দাসের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।

 বললে–তুমি তো বেশ নতুননতুন কথা বলছ পোয়েট! ইন্ডিয়াতে এতদিন এসেছি, এসব কথা তো আগে আমাকে কেউ বলেনি হে!

উদ্ধব দাস বললে–তুমি আমার একটা ছড়া শুনবে সাহেব? নতুন একটা ছড়া বেঁধেছি, শোনো

 বলে উদ্ধব দাস গান আরম্ভ করলে

এসেছিলাম ভবে আমি
ভজব বলে হরির চরণ।
পড়ে ভূমে মাটি খেয়ে
ভুলে গেল আমার এ মন ।
ঘোর জননীর মায়া,
নিত্য বাড়ে মম কায়া
এ-সংসার ভোজবাজির ছায়া,
বিফলে গেল এ-জীবন ৷
 দারা-সুত-পরিবার,
দেখো রে মন কে বা কার।
আঁখি মুদলে অন্ধকার,
বেঁধে লবে তোরে শমন ॥
দিনান্তরে একবার,
ডাক কৃষ্ণ সারাৎসার।
অন্তিমে পাবে নিস্তার,
তিনি ব্ৰহ্ম সনাতন ॥

হঠাৎ গানের মাঝখানেই হরিচরণ এসে হাজির। বললেনা গো, তুমি ওদের জামাই নও গো

আমি ওদের জামাই নই? কিন্তু আমার সঙ্গে যে ওনার বিবাহ হয়েছে প্রভু! সম্প্রদান হয়েছে, কুশণ্ডিকা হয়েছে, মালাবদল হয়েছে। ওনার নাম তো মরালীবালা দাসী?

কর্নেল ক্লাইভ সাহেব এতক্ষণ সব শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিছুই বুঝতে পারছিল না।

বললে–হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই লেডির নামও মরালীবালা ডাসি! তুমিই ওর হাজব্যান্ড?

 উদ্ধব দাস সবিনয়ে বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ প্রভু! আমারই স্ত্রী উনি।

 হরিচরণ বললে–না না স্যার, এ অন্য লোক, এ ওর হাজব্যান্ড নয়

 কিন্তু পোয়েট যে বলছে ওর ওয়াইফ?

তা বলুক, ও পাগল! পাগলের কথায় কান দেবেন না আপনি! তুমি এখন যাও বাছা, আমি ভুল করে তোমায় ডেকেছিলাম গো! তুমি যাও

সাহেব কিন্তু ছাড়বার লোক নয়। বললে–ব্যাপারটা কী বলল তো? তোমার ওয়াইফের নামটা কী বলো তো?

মরালীবালা দাসী, প্রভু।

কোথায় তোমার শ্বশুরবাড়ি?

আজ্ঞে হাতিয়াগড়ে।

সাহেব হরিচরণের দিকে ফিরে বললে–তা হলে তো সবই মিলে যাচ্ছে। পোয়েটের বউও তো পালিয়েছে। নিশ্চয়ই কোথায় গোলমাল আছে হরিচরণ!

উদ্ধব দাস বললে–ঠিক ধরেছেন আপনি প্রভু! গোলমাল আছে সে তো আমি আগেই আপনাকে বলেছি আজ্ঞে।

কীসের গোলমাল!

উদ্ধব দাস বললে–আজ্ঞে, আমার বউ যে আমাকে পছন্দ করে না।

 কেন? লাইক করে না কেন?

 আপনিই বলুন প্রভু, আমাকে কী করে পছন্দ করবে? আমার তো চেহারা ভাল নয়, আমাকে কি পছন্দ হয় কারও?

কিন্তু তুমি তো পোয়েট, তোমার পোয়েট্রি তো আমার খুব ভাল লাগছে! কেন তোমাকে লাইক করবে না?

তারপর বললে–চলো তো, তুমি আমার সঙ্গে ভেতরে চলো তো, তোমার ওয়াইফকে তুমি চিনতে পারবে তো?

হরিচরণ বাধা দিয়ে বললে–না স্যার, দিদি জামাইকে ভেতরে নিয়ে যেতে বারণ করেছে কিন্তু হাজব্যান্ড-ওয়াইফে মিল হবে না, এটা তো ভাল কথা নয়, দিস ইজ ভেরি ব্যাড–চলো পোয়েট ভেতরে চলো, আমি তোমার বউয়ের সঙ্গে মিল করিয়ে দেব

কিন্তু ভেতরে আর যেতে হল না। ভেতর থেকে দুর্গাই বেরিয়ে এসে বললে–না সাহেব, ও আমার জামাই নয়

তারপর উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে বললে–তুমি আবার কেন এখেনে মরতে এসেছ শুনি? আর মরবার জায়গা পেলে না? আমরা মরছি নিজের জ্বালায় আর তুমি কিনা আবার জ্বালাতে এসেছ? একজনকে জ্বালিয়েও তোমার আশ মেটেনি? আর একজনের জীবনটাও নষ্ট করতে চাও?

উদ্ধব দাস হঠাৎ দুর্গাকে এখানে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল।

 বললে–আমার কী অপরাধটা হল মা-জননী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না

আর বুঝে দরকার নেই তোমার, তুমি এখান থেকে যাও–

ক্লাইভ সাহেব, হরিচরণ দু’জনেই যেন হতবাক হয়ে গিয়েছিল কাণ্ডকারখানা দেখে।

উদ্ধব দাস নিজের পুঁটলিটা আবার মাথায় করে নিলে। তারপর সাহেবের দিকে ফিরে বললে–তা হলে আসি প্রভু।

এতক্ষণে ক্লাইভ সাহেবের মুখে যেন কথা বেরোল। দুর্গার দিকে ফিরে বললে–তা হলে এ তোমার জামাই নয় দিদি?

দুর্গা ঘেঁকিয়ে উঠল–ওই অকালকুষ্মণ্ডটা আমার জামাই হতে যাবে কোন দুঃখে শুনি সাহেব? অমন জামাইয়ের হাতে মেয়েকে তুলে দেওয়ার চাইতে গলায় দড়ি দেওয়া যে ভাল সাহেব

সাহেবের যেন তবু কেমন সন্দেহ হল। বললে–তোমার মেয়েকে একবার জিজ্ঞেস করো না দিদি, তোমার মেয়ে হয়তো জামাইয়ের সঙ্গে একবার কথা বললে–দু’জনের মিটমাট হয়ে যেত!

না সাহেব, আমার মেয়ে কথা বলবে না ওর সঙ্গে। তুমি যাও বাছা এখেন থেকে

 হঠাৎ অ্যাডমিরাল ওয়াটসন এসে হাজির।

 কর্নেল!

ক্লাইভ মুখ ফেরাতেই ওয়াটসন বললে–তোমার এখনও সেই নেটিভ মেয়েদের ওপরে লোভ গেল না শোনো, এদিকে নবাবের লেটার এসেছে, এই যে

নবাব লিখেছেন–

তোমরা হুগলি লুণ্ঠন করিয়া আমার প্রজাগণের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করিয়াছ। ইহা ব্যবসায়ী বণিকের উপযুক্ত কার্য নহে। আমি ইহার জন্য রাজধানী হইতে হুগলি পর্যন্ত আসিয়াছি। যাহা হউক, ইংরাজেরা যদি আমার আদেশ মান্য করিয়া বণিকের ন্যায় কার্য করেন তবে আমি যথোচিত ক্ষতিপূরণ করিয়া তোমাদের সন্তোষসাধন করিতে প্রস্তুত আছি। তোমরা খ্রিস্টান, বিবাদ বাধানো অপেক্ষা মোলযোগের মীমাংসা যে শ্ৰেয় তাহা অবশ্যই জ্ঞাত আছ। তবে যদি তোমরা কোম্পানির ক্ষতি করিয়া যুদ্ধ করিতেই সংকল্প করিয়া থাকো, তাহা হইলে পরে আমাকে দোষ দিয়ো না

ঘরের ভেতরে যেতেই ছোট বউরানি বললে–লোকটা কোথায় গেল রে দুগ্যা?

দুর্গা বললে–পাগলটাকে এক ধমক দিলুম। বেটা যেতে কি চায়, কেবল বউয়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়,

ছোট বউরানি বললে–আহা গো, আমার বড় কষ্ট হয় রে দুগ্যা ওর জন্যে আমার জন্যে যেমন ছোটমশাইয়ের কষ্ট হচ্ছে, ওরও তেমনি ওর বউয়ের জন্যে কষ্ট হচ্ছে! ছোটমশাই যেমন জানতে পারছে না আমি কোথায় আছি, ও-ও তেমনি জানে না যে ওর বউ মুর্শিদাবাদের চেহেল্‌-সুতুনে আটকা পড়ে আছে

হঠাৎ দূর থেকে উদ্ধব দাসের গানের আওয়াজ আসতে লাগল।

 দুর্গা বললে–ওই দেখো কেমন গান ধরেছে পাগলটা, কষ্ট হলে কারও গলা দিয়ে অমন গান বেরোয়?

উদ্ধব দাস তখন গলা ছেড়ে গাইছে–

আমি রব না ভব-ভবনে।
শুন হে শিব শ্রবণে ॥
যে নারী করে নাথ পতি বক্ষে পদাঘাত,
তুমি তারই বশীভূত, আমি তা সব কেমন ॥

ক্লাইভও শুনছিল গানটা। বললে–পোয়েটের গান শুনছ ওয়াটসন? পোয়েটটা আমায় একটা নতুন কথা শোনালে আজ। বললে–কী জানো, বললে–হোল ওয়ার্লডটাই ওর সংসার, ও যেখানে থাকে, সেইটেই ওর ঘর! বড় ওয়ান্ডারফুল লাগল ওর কথাটা! তখন থেকেই কেবল সেই কথাটাই ভাবছি। হোল ওয়ার্লডটাই আমার সংসার, এখন ইন্ডিয়ায় আছি, ইন্ডিয়াই যেন আমার ঘর!

এ্যাডমিরাল ওয়াটসন ক্লাইভের মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ! কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ, সেন্ট ফোর্ট ডেভিডের কম্যান্ডারও কি শেষকালে ওই পোয়েটটার মতো পাগল হয়ে গেল নাকি!

*

মহিমাপুরের মহাতাপ জগৎশেঠজির হাবেলির ফটকে ভিখু শেখ তখন পাহারা দিচ্ছে। বড় কড়া। পাহারাদার ভিখু শেখ। একটি মাছি পর্যন্ত জগৎশেঠজির হাবেলির ভেতর ঢুকতে পারে না ভিখু শেখের নজর এড়িয়ে।

এই কুত্তা, ভাগ, ভাগ ইহাসে।

রাস্তা দিয়ে কেউ গেলেই ভিখু শেখের সন্দেহ হয়। সবাই যেন চর। সবাই যেন শেঠজির বাড়ির ভেতরের খবর জানতে চায়। ভেতরে কী ষড়যন্ত্র হচ্ছে তাই-ই যেন সবার লক্ষ!

ভাগ শালা কুত্তা। ভাগ ইধারসে।

হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই তখন দরবার-ঘরের ভেতরে চুপি চুপি কথা বলছেন।

 বললেন–আপনি সত্যিই জানেন? ভাল লোকের মুখে শুনেছেন?

জগৎশেঠজি বললেন–হ্যাঁ, আমার খবর ভুল হবার নয় ছোটমশাই। প্রথমে শুনেছিলাম চেহেল-সুতুনের হারেমের মরিয়ম বেগম সফিউল্লা খা-কে খুন করেছে। কিন্তু পরে শুনলাম, আপনার স্ত্রী!

আপনি ভাল রকম জানেন আমার স্ত্রী?

জগৎশেঠজি বললেন–আমি তো বললাম আমার খবর ভুল হয় না। এতদিন আপনার স্ত্রীকে ওরা মতিঝিলের ফাটকে আটক রেখে দিয়েছিল, আজ ভোরে কোতোয়ালিতে এনে পুরেছে। মেহেদি নেসার আর ইয়ারজান ওরা দু’জন কাজিসাহেবের কাছে গিয়েছিল। কাজিসাহেবের কাছে দরবার করে দশ হাজার আসরফি ঘুষ দিয়েছে

কেন?

জগৎশেঠজি বললেন–সফিউল্লা সাহেবের কাছে একটা চিঠি ছিল, সেটা তার শরীর তল্লাসি করেও পাওয়া যায়নি। ওরা বলছে, সেটা নাকি আপনার স্ত্রীর কাছেই আছে।

কীসের চিঠি?

সেই চিঠিখানাতে নবাবকে খুন করবার মতলবের কথা লেখা ছিল। করিম খাঁ পাঠিয়েছিল মেহেদি নেসারের কাছে। সে-চিঠি যদি আপনার স্ত্রী নবাবকে দেখিয়ে দেয় তো মেহেদি নেসার, ইয়ারজান সকলের ফাঁসি হয়ে যাবে। তাই আপনার স্ত্রীকে ফাঁসি দেবার জন্যে ওরা কাজিসাহেবকে ঘুষ দিয়েছে।

ছোটমশাই যেন বজ্রাহতের মতো অচৈতন্য হয়ে গেলেন। এই কদিনের মধ্যে এত কাণ্ড হয়ে গেছে!

 তা হলে তাকে বাঁচাবার কী উপায় হবে শেঠজি?

 জগৎশেঠজি বললেন–আপনি এখনই গিয়ে কাজিসাহেবের সঙ্গে দেখা করুন। ওরা দশ হাজার আসরফি দিয়েছে, আপনি পনেরো হাজার আসরফি ঘুষ দিন। সব ফয়সালা হয়ে যাবে।

কিন্তু পনেরো হাজার আসরফি আমি এখন এত শিগগির কোথায় পাব?

জগৎশেঠজি বললেন আপনার কিছু ভয় নেই, আমি দেব, আপনি হুন্ডি কেটে দিন, পরে শোধ করে দেবেন।

ছোটমশাই বললেন–তা হলে তাই দিন শেঠজি, আমি আর ভাবতে পারছি না, যেমন করে পারুন। আমায় এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন!

কোতোয়ালির ফাটকের মধ্যেও মরালীর শান্তি ছিল না। একবার কে একজন আসে, উঁকি মেরে দেখে যায়, আবার তার পরেই আসে আর একজন। চারদিকে পাকা ইটের দেয়াল। শুধু সামনে একটা লোহার গরাদ দেওয়া দরজা। আবরু নেই কোথাও। সেই সকালবেলাতেও ভেতরটা ঝাপসা অন্ধকার। যেন রাত। চেহেল্‌-সুতুনের হারেমের মতোই কোনও দিকে পালাবার উপায় নেই।

মেহেদি নেসার প্রথমেই কোতোয়াল সাহেবকে পাঠিয়েছিল। বেশ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে খুশি করতে চেয়েছিল মরালীকে। কোনও তকলিফ থাকলে যেন মুখ ফুটে বলেন বেগমসাহেবা। বেগমসাহেবার কী কী অসুবিধে হচ্ছে বললে–তখনই তার প্রতিকার করবেন তিনি।

মরালী শুধু বলেছিল–আমার কোনও তকলিফ নেই

বেগমসাহেবা নাস্তা করবেন?

 মরালী বলেছিল-না

খানা? কী খানা খাবেন বেগমসাহেবা?

মরালী বলেছিল–যা খুশি, যা আপনারা দেবেন!

প্রথমবার এইটুকু মাত্র। তারপর অনেকবার এসেছে, খোঁজ নিয়েছে, তবিয়ত কেমন আছে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করেছে। কোনও কথারই স্পষ্ট ব্বাব দেয়নি মরালী!

শেষকালে শুরু হল কড়া কড়া কথা। বেগমসাহেবা কোথা থেকে ছুরি পেলেন?

ওর হাতেই ছুরি ছিল, আমি কেড়ে নিয়েছিলুম।

আর কী কেড়ে নিয়েছিলেন?

আর কিছু কেড়ে নিইনি।

কোনও চিঠি?

না।

এমনি করেই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অনেকবার জেরা চলল। শেষকালে বোধহয় কোতোয়াল বুঝতে পারলে, এ বেগমসাহেবা সাধারণ বেগমসাহেবা নয়। সাধারণত এরকম ব্যাপারে ভয় দেখিয়ে কড়া কথা বললেই কাজ হয়ে যায়। অন্য বেগমসাহেবারা কেঁদে ফেলে। কেঁদে সব কথা বলে দেয়। তারপর হাত জোড় করে মাফি চায়। এমন অনেকবার হয়েছে। তারপর কাজিসাহেবের কাছারিতে বিচার হয়ে তাদের ফাঁসি হয়ে গেছে। চেহেলসতুনের ভেতরে হলে সে বিচার খোজারাই করে। পিরালি খাঁ নিজেই মহড়া নেয়। নবাব থাকেন তার হুকুমদার। কিন্তু এ খুন হয়েছে মতিঝিলে। মুর্শিদাবাদের কোতোয়ালের এক্তিয়ারের ভেতরে। এর বিচার করবে কাজিসাহেব। এ বিচারে মেহেদি নেসারের হাত আছে। সে ইচ্ছে করলে ফাঁসিও দিতে পারে, ফাঁসির হাত থেকে ছাড়িয়ে আনতেও পারে। এ ব্যাপারে আসরফির খেলা চলে দু’পক্ষ থেকে। যে যত বড়লোক আসামি, তার বিচারে তত বেশি আসরফি খরচা হয়ে যায়। একবার যদি কাজিসাহেব জানতে পারে আসামি বড়লোক, ততই ঝুলিয়ে রাখে বিচারটা। দু’পক্ষ থেকেই লোক আসে, দর কষাকষি হয়, দর ওঠে আর কাজিসাহেব তত ভারিক্কি চালে কথা বলে।

মুর্শিদকুলি খাঁ’র আমল থেকেই এমনি চলে আসছে। এর জন্যে দিল্লির বাদশার হুকুমের দরকার হয় না। নিজামতি ফারমানে অনেক অধিকার নবাব বহুদিন থেকেই ভোগ করে আসছে। বিশেষ করে শাহনশা আওরঙ্গজেবের বেহেস্তে যাবার পর থেকে। নবাবজাদা মির্জা যখন মুর্শিদাবাদের রাস্তায় হোসেনকুলি খা-কে খুন করে, তখনও তার কাছে কেউ জবাবদিহি চায়নি। চাইবার সাহসই পায়নি। ফৈজি বেগমকে যখন গুমখুন করে নবাবজাদা মির্জা মহম্মদ হাতের রক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলেছিল, সেদিনও কেউ তার কৈফিয়ত চায়নি। শুধু কি নবাবজাদা মির্জা মহম্মদ? নবাব আলিবর্দি খাঁ-ই কি কিছু কম অপরাধ করেছেন। পাটনার সুন্দর সিংকে নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে এনে যেদিন খুন করেছিলেন সেদিনও কেউ তাঁকে দোষ দেয়নি। আবদুল করিম খাঁ-কে নিজের তিনজন লোক দিয়ে দরবারের মধ্যে খুন করেও আল্লার দরবারে বেকসুর খালাস পেয়ে গিয়েছিলেন আলিবর্দি খাঁ। এইটেই ছিল নবাবি রীতি। এই নিয়মই নিজামতের কাজিসাহেবের কাছারিতে চলে আসছিল বরাবর। এরই বা হঠাৎ ব্যতিক্রম হবে কেন?

মেহেদি নেসার আর বেশি দেরি করেনি। সন্ধে হতেই এসে হাজির হয়েছিল কোতোয়ালিতে।

ফাটকের দরজাটা খুলতেই তন্দ্রা ভেঙে গিয়েছিল মরালীর। আগের রাত্রে ঘুম হয়নি, খাওয়া হয়নি, পরের দিনও সারাদিন তাকে নিয়ে জেরা চলেছে। ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল সমস্ত শরীর।

কে?

নিজের ছায়া দেখেই যেন নিজে চমকে উঠেছিল মরালী। মরালী নিজেই যেন নিজেকে খুন করতে এসেছে কোতোয়ালির ফাটকের ভেতরে।

আমি, বেগমসাহেবা, আমি মেহেদি নেসার!

কী চাই আপনার?

আমি বেগমসাহেবার বরাবরে কুর্নিশ দিতে এসেছি।

মরালী বুঝতে পারলে মতলবটা। বললে–আমি এখন আর বেগমসাহেবা নই, আমি খুনের আসামি।

তা হোক, তবু বেগমসাহেবা বেগমসাহেবাই!

আপনি কী চান?

বেগমসাহেবা কি সফিউল্লার কাছ থেকে কোনও চিঠি নিয়ে লুকিয়ে রেখেছেন?

 যদি লুকিয়েই রাখি, তা আপনাকে বলতে যাব কেন? আপনি কে?

মেহেদি নেসার সাহেব হেসে উঠল শব্দ করে। বললে–আমি? আমি বেগমসাহেবার বান্দা!

বান্দা তো বান্দার মতো করে কথা বলুন!

এবার মেহেদি নেসারের শক্ত হবার পালা। বললে–আমি বেগমসাহেবার শরীর তালাশ করতে এসেছি, কুর্নিশ করতে আসিনি। সেই চিঠি আমার চাই!

খবরদার, আমাকে ছুঁয়ো না।

মেহেদি নেসার হাত বাড়িয়ে ছুঁতে এল মরালীকে।

 খবরদার! আর কাছে এলে বিপদ আছে তোমার বলে রাখছি!

মেহেদি নেসার বিপদ কাকে বলে তা জানেনা বেগমসাহেবা। কী বিপদ সেটা একবার জানিয়ে দিলে ভাল হয়।

মরালী দাঁত দিয়ে নিজের হাতটা কামড়াল।

 তা হলে বলে রাখছি, সফিউল্লা খাঁ যেখানে গেছে তোমাকে সেখানেই পাঠাব!

মেহেদি নেসার আর দেরি করলে না। একেবারে মরালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত দুটো চেপে ধরলে।

*

ইতিহাসের পাতায় যত অনাচার-অত্যাচারের কাহিনী লেখা আছে এ তাদেরই মধ্যে আর একটা নয়। তবু এ এমন নতুন কিছুও নয়। কোতোয়াল সাহেবের এ-সব দেখা আছে। শহরের বাইরে যখন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আপাতভাবে অব্যাহত গতিতে চলেছে, তখন তার আড়ালে-আবডালে তার অলিতে-গলিতে যা ঘটে তার প্রমাণ কোথাও থাকে না। আবদুল করিমের খুনের উপাখ্যান লিখে গেছে গোলাম হোসেন। নাজির আহম্মদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে সরকারে বাজেয়াপ্ত হওয়ার উপাখ্যানও লিখে গেছে তারিখ-ই-বাংলার অজ্ঞাতনামা লেখক। নাজির আহম্মদের ফাঁসি হবার পর তার মসজিদ বাগানবাড়ি কেমন করে সুজাউদ্দিনের ফাবাগে রূপান্তরিত হয়েছিল, তার উপাখ্যানও লেখা আছে তারিখ-ই-বাংলার পাতায় পাতায়। কিন্তু কত মরালী, কত কান্ত, কত সারাফত আলি, কত রানিবিবি ইতিহাসের অন্দরমহলে দীর্ঘশ্বাসের তাপে শুকিয়ে ক্ষয় হয়ে গেছে, তার নজির মুতাক্ষরিন, তারিখ-ই-বাংলা, রিয়াজুস-সালাতিনেও নেই। এমনকী নিজামতি সেরেস্তার রেকর্ডেও তার হদিস মেলবার কোনও ভরসা নেই। নেই বলেই হয়তো উদ্ধব দাস এই বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্য লিখেছিল। কে জানে!

পুরনো পাণ্ডুলিপি নিয়ে যাঁরা ঘাঁটাঘাঁটি করেন তারা জানেন, গল্প যেখানটায় খুব জমে ওঠে, পোকাগুলো ঠিক জায়গা বুঝে বুঝে সেই জায়গাগুলোতেই দাঁত বসায়। এর পরেই উদ্ধব দাস লিখেছে

মরাও নয় জীয়ন্তও নয়, যেমন চিররোগী
হিন্দুও নয় যবনও নয়, তার সাক্ষী যুগি।
এখন রাম ভজি কি রহিম ভজি
দিশে পাইনে কীসে মজি।
নিশে কে করে শেষে আমার পক্ষে।
এখন ব্ৰত করি কি বোজা করি
সন্ধে করি কি নামাজ পড়ি
করতে চাই তো পরকালটা রক্ষে।
হল কথা কওয়ার ভারী জ্বালা।
কলা বলি কি বলি কেলা
একী জ্বালা কাকে হেলা করিব?
 দিদি বলি কি বলি নানি।
জল বলি কি বলি পানি।
কোরান মানি কি শাস্ত্রের মত ধরিব?
 হল মরণকালে বিপদ ঘোর।
গঙ্গা নিই কি নিই পোর।
কার কাছে বা শরণ লয়ে থাকিব!
কিবা করেন গোকুলের চাঁদ।
যা করেন পির গোরাচাঁদ,
কিছু কিছু দুইয়ের মতেই চলিব ॥

মোল্লাহাটির মধুসূদন কর্মকারের সঙ্গে দেখা। বললে–কী গো দালমশাই, নতুন গান বেঁধেছ নাকি?

উদ্ধব দাস বললে–রাস্তায় হাঁটছি আর এই গান বাঁধছি

কী গান শুনি?

উদ্ধব দাস গানটা আবার গাইতে লাগল। বললে–আমার কাছে সবই সমান গো মধুসুদন, ওই কোরান-গীতা, জল-পানি, দিদিনানি, পির সাধু, মন্দির-মসজিদ সবই সমান আমার কাছে। তবু ভাবছিলুম আমরা ওই নিয়েই সবাই মাথা ঘামাচ্ছি, খোসা নিয়েই খেয়োখেয়ি করছি। আসল শাঁস ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে

তা হঠাৎ একথা এল কেন তোমার দাসমশাই?

উদ্ধব দাস তখন দাওয়ায় উঠে বসেছে। বললে–এই বরানগরে গিয়েছিলুম, সেখানে আমার বউয়ের সঙ্গে দেখা হল, জানো!

তোমার বউ? যেবউ পালিয়ে গিয়েছিল?

হ্যাঁ কর্মকারমশাই।

বউ কী বললে? কেন পালিয়েছিল?

বলবে আবার কী? হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির একটা ঝি ছিল, সে কি আমাকে বউয়ের সঙ্গে দেখা করতে দিলে? দেখা হলে তো বলতুম বউকে। বলতুম, আমার বাইরের চেহারাটা দেখেই তুমি আমার বিচার করলে গো। আমার ভেতরটা তো দেখলে না। এই তোমরা সবাই যেমন করছ?

মধুসূদন বললে–আমরা আবার তোমার কী করছি?

তোমরা তো সবাই আমার বউয়ের মতন।

আমরা তোমার বউয়ের মতন? বলছ কী তুমি?

তা নয়? ওই কোরান-গীতা, জল-পানি, দিদিনানি, পির সাধ, মন্দির-মসজিদ সবই কি এক বলে মানো তোমরা? সেই সচ্চরিত্র পুরকায়স্থকে চেনো তো? সেই যে ঘটকমশাই? সেদিন কেষ্টনগরের পথে দেখা। আমাকে দেখেই হাউহাউ করে কান্না। বলে কী, মোছলমানরা নাকি তাকে ম্লেচ্ছ মাংস খাইয়ে দিয়েছে। তার নাকি জাত গিয়েছে, তাকে নাকি তার গাঁয়ের লোক একঘরে করেছে, তার মাগ-ছেলেমেয়ে তাকে ত্যাগ করেছে। আমি তো হেসে খুন। আমি বললুম–পুরোকায়েতমশাই, তোমার গা কি তুলসীগাছ যে কুকুরে পেচ্ছাব করলেই পাতাগুলো সব পচে গেল? তা শুনে কী বললে–জানো?

মধুসূদন কর্মকার ওসব বাজে কথা শুনতে চায় না। বললে–ওসব কথা থাক দাসমশাই, তোমার বউয়ের কথা বলল। বউ তোমার সঙ্গে দেখা করলে না?

উদ্ধব দাস বললে–না গো, সেবউ এখন আরাম করে সাহেবের বাড়িতে আছে, আয়েশ করে ভাল-মন্দ খাচ্ছোচ্ছে, নফর শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়ে, এত ভাল খাওয়াদাওয়া তো পায়নি। কখনও আগে!

মধুসূদন বললে–সাহেব? সাহেব মানে? ম্লেচ্ছ সাহেব?

হ্যাঁ গো, ফিরিঙ্গি কোম্পানির সাহেব। কলিকালে সবাই ম্লেচ্ছ, কলির দেবতাই বলে ম্লেচ্ছ হয়ে গেছে হে, কেউ ম্লেচ্ছ হতে বাকি নেই আর। তুমিও ম্লেচ্ছ মধুসূদন, আমিও ম্লেচ্ছ।

বলছ কী দাসমশাই, পাগলের মতো কী বলছ সব তুমি?

উদ্ধব দাস বললে–ঠিক বলছি মধুসূদন, আর কিছুদিন সবুর করো তখন দেখবে আল্লা-হরি সব একাকার হয়ে অনারকম চেহারা হয়ে গেছে–

কী রকম চেহারা?

ওই ফিরিঙ্গিদের মতো চেহারা! তখন দেখবে আল্লা আর হরি কোট-প্যান্টলুন পরে গ্যাটম্যাট করে ঘোড়ায় চড়ে বন্দুক ছুড়ছে। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই বন্দুক ছুঁড়ে মারছে। মারতে মারতে যখন কেউ আর থাকবে না, তখন কলিযুগ শেষ হয়ে যাবে!

কলিযুগ শেষ হয়ে যাবে? বলো কী গো?

তা হবে না? শেষ হলেই তো ভাল গো। তখন আবার সত্যযুগ শুরু হয়ে যাবে। আবার আরাম করে কেষ্টনগরের রাজবাড়িতে গিয়ে মুগের ডাল খাব। হাতিয়াগড়ের অতিথশালায় গিয়ে রসের গান গাইব। জানো মধুসূদন, হাতিয়াগড়ের ছোটরানি রসের গান শুনতে খুব ভালবাসে। নতুন নতুন রসের গান বাঁধব আর গাইব। সত্যযুগে একটা ভাল জিনিস হবে হে মধুসূদন, বিয়ের রাত্তিরে আর বউ পালাবে না কারও।

কেন?

কী করে পালাবে শুনি? তখন তো আর বাইরের চেহারা দিয়ে মানুষের বিচার হবে না গো, বিচার হবে যে গুণ দিয়ে! তোমার জাত দিয়েও বিচার হবে না, ধর্ম দিয়েও বিচার হবে না, বিচার হবে তোমার কর্ম দিয়ে। তুমি আমি যেমন কর্ম করব, তেমনই ফলভোগ করব। তখন কী আরামে দিন কাটাব বলো তো মধুসূদন ভায়া?

মধুসূদন বললে–তোমার মাথাটি এবার সত্যিই খারাপ হয়েছে দাসমশাই বউ পালিয়ে যাবার। পর থেকেই দেখছি মাথাটা গোলমাল হয়ে গেছে

না মধুসূদন, কত গান কত ছড়া বেঁধেছি জানো! শুনবে আমার নতুন ছড়া?

বলো।

 উদ্ধব দাস বললে–তবে শোনো–

পিতা-পুত্রে এক নারী করে আলিঙ্গন।
উভয় ঔরসে জন্ম উভয় নন্দন ।
অগ্রেতে তাদের নাহি পরিচয় ছিল।
অবশেষে মৃত্যুমুখে শুনিতে পাইল ॥
কী নাম তাদের ভাই বলো দেখি শুনি।
অনুমানে বুঝি আমি না পারিবে তুমি ।

হঠাৎ ছড়াটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই মোল্লাহাটির শাহি রাস্তাটার দিকে নজর পড়ে গেছে।

আরে, বশির মিঞা না?

 দূরে দেখা গেল ডিহিদার রেজা আলি তার ফিরিঙ্গি’র ওপর চড়ে আসছে, আর বশির মিঞা ঘোড়া ছুটিয়ে কাছে এল।

কী গো, দাসমশাই, তুমি এখেনে?

বহুদিন উদ্ধব দাসকে দেখেছে বশির মিঞা। দু’জনেই রাস্তার লোক। রাস্তায়, গাছতলায়, ধর্মশালায়, অতিথিশালায় একসঙ্গে রাত কাটিয়েছে।

উদ্ধব দাস বললে–একটা ছড়া বেঁধেছি নতুন, শুনবে মিঞাসায়েব? এই মধুসূদনকে শোনাচ্ছিলাম

বশির মিঞা বাধা দিলে। বললে–এখন ছড়া থাক দাসমশাই, ডিহিদারসাহেব সঙ্গে রয়েছে–তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে, বলি তোমার বউয়ের কিছু হদিস পেলে? জানতে পারলে কিছু?

পেইছি!

 কথাটা শুনেই ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল বশির মিঞা।

 সত্যি পেয়েছ? না দেয়ালা করছ?

উদ্ধব দাস বললে–নিজের মাগ নিয়ে কেউ দেয়ালা করে?

বশির মিঞার আর তর সইছে না। বললে–পাগলামি কোরো না এখন, ডিহিদার সাহেব দাঁড়িয়ে আছে, সময় নেই, এখন বলো শিগগির কোথায় আছে তোমার বউ?

উদ্ধব দাস যে উদ্ধব দাস, সে-ও অবাক হয়ে গেল। বললে–তা আমার বউয়ের ওপর তোমার এত নজর কেন গো মিঞাসায়েব? আমার বউয়ের খোঁজ পাওয়া গেল কি গেল না, তা জেনে তোমার লাভ কী?

লাভ আছে! ওদিকে হাতিয়াগড়ে সব ফাঁস হয়ে গেছে।

ফাঁস হয়ে গেছে মানে? ফাঁস হয়ে গেছে মানেটা কী?

তা তোমাকে সব খুলে বলতে হবে নাকি?

তুমি খুলে না বললে–তা হলে আমিও খুলে বলব না।

বশির মিঞা বললে–তা তুমি এত গোসা করছ কেন দাসমশাই? নিজামতি কাছারির সব কথা খুলে বলা যায় কখনও? চারদিকে আমাদের কত দুশমন তা জানো না? আমরাও যে খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমার বউকে?

আমার বউকে খুঁজছ? তোমরা? কেন?

বশির মিঞা গলাটা নিচু করে বললে–সে-সব অনেক কাণ্ড। এখন সব কথা বলবার ওয়াকত নেই, নবাব পূর্ণিয়ায় গেছে নিজের ভাইজানের সঙ্গে লড়াই করতে

তাই নাকি? আবার লড়াই?

হ্যাঁ, এদিকে মুর্শিদাবাদেও আবার খুনোখুনি ব্যাপার ঘটে গেছে। সফিউল্লা সাহেবকে খুন করে ফেলেছে মরিয়ম বেগমসাহেবা!

মরিয়ম বেগমসাহেবা? সে আবার কোন বেগম?

তুমি কি সব বেগমসাহেবার নাম শুনেছ নাকি। সে লস্করপুরের তালুকদার কাশিম আলি সাহেবের মেয়ে। তুমি তো চিনতে তাকে?

খুব চিনতুম!

বশির মিঞা বললে–সেইসব নিয়ে বড় হল্লা হচ্ছে দাসমশাই, আমার ফুপা মনসুর আলি মেহরার সাহেব বলেছে হাতিয়াগড়ে গিয়ে সব তালাশ করে আসতে। তাই তো হাতিয়াগড়ে গিয়েছিলুম, তাই তো ডিহিদার সাহেবকে নিয়ে যাচ্ছি।

কোথায়? কোথায় যাচ্ছ?

সব কথা শুনতে চেয়ো না দাসমশাই। যাচ্ছি কেষ্টনগরে। হাতিয়াগড়ের রাজাবাবু গেছে সেখানে। তার হাতের লেখা চিঠি পেয়ে গেছি আমরা। তার মধ্যে তোমার বউয়েরও নাম লেখা আছে!

সেই চিঠিতে? আমার বউয়ের নাম? তা কী করে হয় মিঞাসায়েব? আমার বউ কোথায় আছে সে তো আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।

বশির মিঞা গলা নিচু করে বললে–আমি কাউকে বলব না। বলল তোমার বউ কোথায় আছে?

হ্যাঁ, বলি, শেষকালে আমার বউকেও তোমরা ধরে ফেলল আর কী!

না, মাইরি দাসমশাই, তোমার বউকে আমরা ধরব না, বলো তুমি কোথায় আছে!

সত্যি বলছ? আমার বউকে ধরবে না?

আরে, বউ তো তোমার নামেমাত্তর বউ, সেবউয়ের জন্যে অত মায়া কেন তোমার? তোমার মুখে। তো লাথি মেরে পালিয়ে গেছে সে।

তবু তো বউ মিঞাসায়েব! অগ্নিসাক্ষী রেখে বিয়ে তো হয়েছে। আমার সঙ্গে না-ই রইল, কিন্তু আমি তো নিজের হাতে তার সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দিয়েছি, আর মন্তর পড়ে তাকে গ্রহণ করেছি।

ওদিকে ডিহিদার তখন ফিরিঙ্গি’র ওপর বসে ছটফট করছে।

 বশির মিঞা সেদিকে চেয়ে বললে–ওই দেখো, রেজা আলি দাঁড়িয়ে আছে। জানতে পারলে তোমায় কিন্তু কোতল করবে!

উদ্ধব দাস হেসে উঠল। বললে–আমাকে ভয় দেখাচ্ছ নাকি বশির মিঞা? তা হলে কিন্তু কিছু বলব না–

বশির মিঞা চিনত উদ্ধব দাসকে।

বললে–না না, ভয় দেখাচ্ছি না দাসমশাই, তুমি নিজের ইচ্ছেতেই বলল, আমি জোর করব না। কোথায় আছে বলো দিকিনি?

পথে এসো মিঞাসায়েব! পথে এসো। তা হলে বলো তার কোনও অনিষ্ট করবে না। কথা দাও আগে!

হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি। তোমার বউয়ের কোনও ক্ষতি করব না।

কথা দাও তার ধর্ম রাখবে?

রাখব, কথা দিলাম তোমাকে।

উদ্ধব দাস বললে–তা হলে শোনো, সে আছে কলকাতায়। কলকাতার উত্তরে বরানগরে ফিরিঙ্গিদের ছাউনিতে!

ফিরিঙ্গিদের ছাউনিতে? সেকী?

উদ্ধব দাস বললে–হ্যাঁ, ফিরিঙ্গিদের কর্তা ক্লাইভ সাহেরের ছাউনিতে! সেখানে গেলেই দেখা পাবে তার।

*

সারাফত আলি তখনও মৌতাত করছে খুশবু তেলের দোকানে। দুনিয়াটা বেশ খুশবু হয়ে উঠেছে। তার চোখের সামনে। একটা তো মরল তবু। একটা ইয়ার তো খুন হয়ে গেল! এমনি করে একদিন মেহেদি নেসার যাবে, ইয়ারজান যাবে। তারপর যাবে নানিবেগম, লুৎফা বেগম, আমিনা বেগম, ঘসেটি বেগম, পেশমন বেগম, বব্বু বেগম, তক্কি বেগম, মরিয়ম বেগম। তারপর যাবে চেহেল্‌-সুতুন। তারপর যাবে মুর্শিদাবাদ, চকবাজার। তারপর যাবে নবাব মির্জা মহম্মদ হেবাৎ জঙ বাহাদুর আলমগির! ইয়া আল্লাহ রসুল আল্লা!

হঠাৎ পেছন দিকে খুট করে একটা কীসের শব্দ হল!

 বোধহয় চুহা! কোঠির ভেতর চুহা ঢুকেছে। আবার গড়গড়ায় টান দিলে সারাফত আলি। আগরবাতির ধোঁয়ার গন্ধের সঙ্গে তাম্বাকুর গন্ধ মিশে মৌতাত বেশ আরও জমজমাট হয়ে উঠল। সারাফত আলি চোখ বুজে হাজি-আহম্মদের বংশের ধ্বংস দেখতে দেখতে বেসামাল হয়ে বললে–ইয়া আল্লাহ

কান্ত তখন নিঃশব্দে সারাফত আলির শোবার ঘরের ভেতর ঢুকেছে। কেউ তাকে দেখতে পায়নি। সকাল থেকেই সুযোগ খুঁজছিল সে। এই সন্ধেবেলাটাই হল আসল সুযোগ। এই সময়েই সারাফত আলির মেজাজ খুশ থাকে। এই সময়েই বাদশা নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

কান্ত সিন্দুকের ডালাটা খুলতে গিয়ে একটু শব্দ করে ফেলেছিল। মোটা লোহার তালা ভাঙতে একটু শব্দ হবারই কথা। কিন্তু শব্দটা হতেই কান্ত নিজের নিশ্বাস বন্ধ করে ফেলেছে। এক হাজার আরফি চাই। এক হাজার, কাজিসাহেব এক হাজারের কমে মরালীকে ছাড়বে না। একবার মরালীকে ছাড়িয়ে নিতে পারলে তখন আর চেহেলসূতুনে চলে যেতে দেবে না মরালীকে। তখন এই কবাজার ছাড়িয়ে একেবারে অন্য কোথাও চলে যাবে। যেখানে যেতে চায়। যদি উদ্ধব দাসমশাইকে একবার দেখতে পায় তো তার হাতেই তুলে দিয়ে বলবে-এই নাও দাসমশাই, তোমার বউকে তুমিনাও, এখন আমার ছুটি।

হঠাৎ বাইরে চকবাজারের রাস্তায় যেন হুড়মুড় করে শব্দ হল একটা। কীসের শব্দ ওটা?

 একটুখানি কান পেতে শুনতে লাগল কান্ত।

প্রথমে মনে হল যেন বান আসছে। ঠিক গঙ্গায় ষাড়াষাড়ি বান আসবার সময় যেমন শব্দ হয় তেমনই। তারপর গোলাগুলি ছোঁড়ার দুমদাম শব্দ! লড়াই শুরু হল নাকি চকবাজারে।

অন্ধকারের মধ্যেই কান্ত হাত দিয়ে দিয়ে মুঠো মুঠো আসরফি তুলে নিজের কোচড়ে রাখতে লাগল। গোনবার সময় নেই। বেশি নেওয়াই ভাল। না হয় বেশিই হবে! এক হাজারের বেশি। এক হাজারের বেশি নিলে তো দোষ নেই। কম হলেই মুশকিল। একটা আসরফি কম হলে আর কাজিসাহেব তার কথা রাখবে না।

বাইরের শব্দটা বাড়তে লাগল।

নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা হেবাৎ জঙ বাহাদুর শাকুলি খান আলমগির কি ফতেহ্

 আর সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল ফতেহ

নবাব বোধহয় পূর্ণিয়া থেকে লড়াই ফতেহ্ করে ফিরল। সঙ্গে হাতি, ঘোড়া, সেপাই, সবাই ফিরছে। তাই এত শব্দ!

এবার আর শব্দ হলেও ক্ষতি নেই। বাইরের আওয়াজে ভেতরের আওয়াজ ঢাকা পড়ে যাবে।

কান্ত তাড়াতাড়ি মুঠো মুঠো আসরফি কোঁচড়ে ভরতে লাগল।

কৌন!

কান্তর মাথার ওপর যেন সঙ্গে সঙ্গে বাজ পড়ল শব্দ করে। কান্ত পেছন ফিরে চেয়ে দেখলে, বুড়ো সারাফত আলি দরজার ওপর দাঁড়িয়ে তার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে।

ভয় পেয়ে হাতটা ফসকে গেল। ফসকে যেতেই সিন্দুকের লোহার ডালাটা ঝপাং করে পড়ে গেল হাতের ওপর। হাতটা চেপটে থেঁতলে গেল। কিন্তু তবুকান্তর মুখ দিয়ে একটু টু শব্দও বেরোল না।

সারাফত আলি নেশার ঝেকে তখন সামনে এগিয়ে এসে খপ করে তার গলাটা টিপে ধরেছে।

আর টিপে ধরতেই কান্তর ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুমটা ভেঙে যেতেই কান্ত চারদিকে চেয়ে দেখলে ভাল করে। অন্ধকার ঘরে সে একা শুয়ে আছে। কেউ কোথাও নেই। ঠান্ডা শীতের মধ্যেও তার সমস্ত শরীর ঘেমে একেবারে ভিজে গেছে। সব নিস্তব্ধ। শুধু চকবাজারের রাস্তায় কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ আওয়াজ করছে।

ঘুম থেকে উঠে বাইরে আসতেই সারাফত আলি সাহেব ধরেছে। কাল কোথায় ছিলি? সন্ধেবেলা চেহেল্-সুতুনে গেলি না কেন? ক্যা হুয়া তুমারা?

হাজারো প্রশ্ন করে তোলপাড় করে তুলল মিঞাসাহেব! তোকে খাওয়াচ্ছি, তোকে মুফত থাকতে দিচ্ছি, তোকে শহর দিচ্ছি মিনিমাগনা? কিছু কাম করবার নাম নেই, শুধু বে-ফিকির সময় চলে যাচ্ছে। আর ক’দিনই বা বাঁচব? আর ক’দিনই বা আমার মোহর থাকবে! মোহর ফুরিয়ে গেলে তখন চেহেলসূতুনের ভেতর নিয়ে যাবে কোন হারামজাদ?

সারাফত আলির মেজাজ এরকম বিগড়ে যায় মাঝে মাঝে। সে সকালবেলার দিকে। তখন মনে পড়ে যায় তার বয়েস বাড়ছে, মনে পড়ে যায় নবাব ফিরিঙ্গি কোম্পানিকে লড়াইতে হারিয়ে দিয়েছে। তখন মনে পড়ে যায় জগৎশেঠজি নবাবের হাতে থাপ্পড় খেয়েছে। সব মনে পড়ে আর মনে পড়লেই মেজাজ বিগড়ে যায় তার।

ডাকে–বাদশা

বাদশা এলেই তখন তার সঙ্গে টাকার হিসেবের গোলমাল নিয়ে কথা কাটাকাটি করে। তখন একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যায় সারাফত আলি। তখন দেখে সিন্দুকের তালাটা ঠিক লাগানো আছে। কিনা। ভেতরে ঢুকে আরক বানানো তদারক করে। গুলিগুলো ঠিক বানানো হচ্ছে কিনা নজর দিয়ে পরখ করে নেয়। কী রান্না হবে, কী খেতে ভাল লাগে বুড়োর, সব খোলসা করে বলে তখন।

কান্ত একবার ভাবলে আসরফির কথাটা বলবে। কিন্তু যদি রেগে যায়! যদি রেগে গিয়ে কাউকে বলে দেয়। যদি জানাজানি হয়ে যায়। বুড়ো নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে কেন এত টাকা লাগবে? কীসের জন্যে? কার দরকার?

কী উত্তর দেবে তখন সে?

 হঠাৎ বশির মিঞার সঙ্গে দেখা। চকবাজারের রাস্তায় হনহন করে চলেছে বশির।

কান্ত দৌড়িয়ে গিয়ে ধরল তাকে!

কী রে? কোথায় গিয়েছিলি এ্যাদ্দিন?

 বশির বললে–বড় জরুরি কামে ঠেকে গিয়েছিলুম ইয়ার, বড় মুশকিলকা কাম। সব গোলমাল হয়ে গেছে। হাতিয়াগড় থেকে এখন আসছি, নিজামতকাছারিতে গিয়ে খবর দিতে হবে–

কী খবর?

 বশির গলা নিচু করলে। বললে–আরে সব বিলকুল গোলমাল হয়ে গেছে। হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই তোর বউকে কলকাতায় ভেজিয়ে দিয়েছে–

আমার বউ?

তোর বউ নয় ঠিক। যার সঙ্গে তোর বিয়ে হবার কথা ছিল। শোভারাম বিশ্বাসের মেয়ের সঙ্গেই তো তোর বিয়ে হবার বাত ছিল?

হ্যাঁ।

এ-এক অদ্ভুত সংবাদ দিলে বশির মিঞা। সমস্ত ঘটনাটা চুপ করে শুনে গেল কান্ত। এত গণ্ডগোল হয়ে গেল এই ক’দিনে। কিছুই জানত না সে। কতদিন আগে থেকে সে মরালীকে এখানে এনে রেখে দিয়েছে, কতদিন রাত্রে চেহেল্‌-সুতুনে গিয়ে সেই মরালীর সঙ্গে দেখা করেছে। বোঝা গেল সেসব কিছুই জানতে পারেনি বশির। না পেরেছে ভালই হয়েছে। শুধু জানে,হাতিয়াগড়ের রানিবিবি সফিউল্লা। খাঁ সাহেবকে খুন করার দায়ে কোতোয়ালিতে আটক আছে। তার কাছে যে-চিঠিটা আছে সেই চিঠিটা যাতে না-পায় কেউ, সেই চেষ্টা করছে মেহেদি নেসার; আর হাতিয়াগড়ের রাজা এখানে এসেছে। রানিবিবিকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে।

তারপর?

 তারপর মোল্লাহাটিতে দেখা হল উদ্ধব দাসের সঙ্গে, সেই পাগলটা। তার কাছেই তো শুনলুম সব!

উদ্ধব দাসের কথাটা শুনে কান্ত যেন কেমন বিহ্বল হয়ে গেল।

জিজ্ঞেস করলে সে জানে এইসব! এই এত কাণ্ড হচ্ছে?

আরে সে তো পাগলা-ছাগলা মানুষ। কী সব গান বেঁধেছে, সেইসব শোনাতে লাগল। তখন কি আর সেসব শোনবার সময় ছিল আমার। আমার সঙ্গে ডিহিদার রেজা-আলি সাহেবও ছিল যে! সে-বেটাও তাড়া দিচ্ছে তখন!

কান্ত জিজ্ঞেস করলে সে তার বউয়ের কথা কিছু জিজ্ঞেস করলে না?

বউয়ের কথাও বললে। ফিরিঙ্গি কোম্পানির সিপাহশালার ক্লাইভ সাহেবের হেফাজতে রয়েছে তার বউ। তার সঙ্গে দেখা করেনি!

কান্ত চুপ করে রইল। তবে কি রানিবিবি কলকাতায় আছে?

বশির বললে–আমার তাড়া আছে ইয়ার, আমি খবরটা আমার ফুপাকে দিয়ে আসি যে হাতিয়াগড়ের রাজাসাহেব মুর্শিদাবাদে এসেছে।

কান্ত বললে–তোর সঙ্গে একটু জরুরি কথা ছিল ভাই

কী কথা, জলদি বল!

আমাকে এক হাজার আসরফি পাইয়ে দিবি ইয়ার? খুব দরকার ছিল আমার।

 এক হাজার আসরফি? তুই বলছিস কী? এক হাজার আসরফি আমি নিজে কখনও চোখে দেখেছি?

কান্ত বললে–কিন্তু আমার যে দরকার!

কীসের দরকার তোর? এত আসরফি নিয়ে তুই কী করবি? বিবি পুষবি?

না!

তা হলে কীসের কাম তোর? খুলে বল!

কান্ত বললে–খুলে বলতে পারব না ভাই। আমার জীবন দিয়েও যদি হাজার আসরফি পাওয়া যেত তো তাও দিতুম! কিন্তু আমার জীবনের আর দাম কী বল! কানাকড়ি!

কিন্তু কী করবি তুই অত টাকা নিয়ে, বল না!

কান্ত বললে–সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস করিসনি। আমাকে কেটে ফেললেও আমি তা বলতে পারব না ভাই, আমি নাচার–শুধু টাকাটা পাইয়ে দে

চকবাজারে তখন বেশি ভিড় নেই। মুর্শিদাবাদের রাস্তায় ভিড় শুরু হয় বেলা করে। দোকান-পসারিরা বেলা করে সওদা কেনা-বেচা করে। আগের রাত্রে অনেকক্ষণ ফুলওয়ালারা ফুল বেচেছে। গণতকারেরা রেড়ির তেলের আলো জ্বালিয়ে ভাগ্য গুনেছে, তাই পরের দিন ঘুম থেকে উঠতে তাদের দেরি হয়। তারপর দেরি করে কাছারি খোলে। শুধু দুপুরবেলা কয়েক ঘণ্টার জন্যে কাছারি বন্ধ থাকে। তারপর বেলা তিন প্রহর থেকে আবার কাছারি খুলবে। তখন যারা বাইরে থেকে মুর্শিদাবাদে আসে তারা সওদা করতে বেরোয়।

কিছুতেই দিতে পারবি না তুই?

বশির মিঞার বোধহয় বাজে কথা শোনবার সময় ছিল না। সে হনহন করে এগিয়ে গেল। আর ফিরে তাকাল না।

কান্ত চুপ করে সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আবার পেছন ফিরল। তারপর আবার ফিরে আসতে লাগল সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের দিকে। রাস্তার ধারে তখন সবে একজন গণতকার আসন পেতে বসতে শুরু করছে। লোকটাকে অনেক দিন ধরে দেখে আসছে কান্ত। বুড়ো লোক। অনেক লোক ভিড় করে তার সামনে।

লোকটাও কান্তর দিকে চাইলে একবার। চেয়েই বললে–মশাই, অত ভাববেন না!

কান্ত চমকে উঠল। সে যে আকাশ-পাতাল ভেবে বেড়াচ্ছে তা লোকটা কেমন করে জানতে পারলে! তা হলে তার মুখে-চোখে কি দুর্ভাবনার ছাপ পড়েছে!

মঙ্গল আপনার কুপিত হয়েছেন। আপনি অশেষ ভাগ্যবান মশাই, আপনি অমূল্য রত্ন হারিয়েছেন, কিন্তু আবার অমূল্য রত্ন পেয়েছেন।

কেমন যেন অভিভূত হয়ে গেল কান্ত লোকটার কথা শুনে। লোকটার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর লোকটা বললে–বসুন না–বসুন-মশাই খুব ভাগ্যবান ব্যক্তি।

তখনও কেউ খদ্দের জোটেনি। কান্তর কৌতূহল হল। বললে–আমার কাছে তো এখন কিছু নেই

লোকটা বললে–না-ই বা থাকল, পরে দেবেন—

কান্ত বললে–আমি কিন্তু গরিব লোক, ছটাকা মাইনে পাই, বেশি কিছু দিতে পারব না—

লোকটা বললে–আপনাকে কিছু বলতে হবে না মশাই, আমি সব দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি–

বলে কী যে অঙ্ক কষতে লাগল একটা পাথরের ওপর। বললে–অত ভাবেন কেন বলুন তো আপনি? আপনার তো ভাবার কিছু নেই। মঙ্গলের লোক কখনও ভাবে? এগিয়ে যান ঘুষি পাকিয়ে। কাউকে ভয় করবেন না। লগ্নের ওপর মঙ্গল রয়েছে, বৃহস্পতি সহায়। আপনার স্ত্রী নিয়ে একটু বিপদ আছে, সাবধানে থাকবেন!

স্ত্রী! স্ত্রী তো আমার নেই!

 লোকটা মাথা নাড়তে লাগল।

নেই বলছেন কী! নিশ্চয় আছে। আপনি বিবাহ করেছেন আর বলছেন নেই?

কান্ত বললে–দেখুন, আমি মিথ্যে কথা বলতে যাব কেন, আমার বিয়ের সময় গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল, তারপর আর বিয়ে হয়নি!

যার সঙ্গে বিয়ের গণ্ডগোল হয়েছিল, তাকেই আবার বিয়ে করেছে তো?

কান্ত বললে–না

তার সঙ্গেই বিয়ে হবে আপনার, যান!

কান্ত আরও অবাক হয়ে গেল। বললে–তার সঙ্গে আবার কী করে বিয়ে হবে? তার তো একবার বিয়ে হয়ে গেছে!

গণতকারটা বললে–তা জানিনে মশাই, তবে এটুকু জেনে রাখুন, কেউ আপনাকে হারাতে পারবে! সেই বিবাহিতা কন্যার সঙ্গেই মশাইয়ের বিবাহ হবে।

সেকী?

 যা বলছি ধ্রুব সত্য!

কিন্তু সে যে অসম্ভব! তারও ধর্ম নষ্ট হবে, আমারও ধর্ম নষ্ট হবে যে। আমাদের দুজনেরই যে জাতিপাত হবে!

জাতিপাত হবে না। জাতিপাতের আশঙ্কা আপনার নেই। আপনার আশঙ্কা শুধু জলে।

জল মানে?

জল থেকে দূরে থাকবেন আর কী। জলই আপনার শত্রু।

কান্তর মনে পড়ল ছোটবেলায় একবার জলে ডুবে যাচ্ছিল। বর্গিদের হাঙ্গামার সময় কোনও উপায়–পেয়ে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আর তারপরেই এসে বেভারিজ সাহেবের কাছে সোরার গদিতে চাকরি পেয়েছিল।

কান্ত উঠে আসছিল। হঠাৎ একটা লোক এসে ডাকলে। রাস্তার একধারে নিয়ে গিয়ে বললে–আপনার নাম কান্ত সরকার?

কান্ত বললে–হ্যাঁ,

আপনাকে ডাকছেন একজন কোতোয়ালিতে।

কে?

মরিয়ম বেগমসাহেবা! আজ ভোররাত্তিরেই আমাকে খবর দিয়েছেন ডাকতে, আপনাকে পাইনি। দোকান বন্ধ ছিল। সারাফত আলির চাকরটা নানান কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল। বড় হুজ্জৎ করছিল বলে আমি চলে গিয়েছিলাম। এখন আপনাকে দেখতে পেলুম!

তুমি কে?

লোকটা বললে–আমি কোতোয়ালির নোকর, তদারকি করি, বেগমসাহেবার বড় তকলিফ যাচ্ছে

কান্ত বললে–তা হলে চলো

লোকটা আগে আগে চলতে লাগল। সকালবেলার শহর তত জমজমাট নয়, তবু কান্তর মনে হল অন্যদিনের চেয়ে যেন শহরটা আরও নিঝুম হয়ে গেছে। যেন সবাই বুঝতে পেরেছে। একজন মানুষকে এরা এখানে বন্দি করে রেখেছে, এখানে তাকে ফাঁসি দেবে, এখানে তার শ্বাসরোধ করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে, তা যেন জানতে পেরেছে সবাই। অথচ কেউ তাকে বাঁচাবার নেই। কারও কিছু করবার নেই। সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছে। রোজ যেমন করে ভোর হয় তেমনি করেই ভোর হয়েছে, তেমনি করেই লোক-জন-পসারি এসে জুটছে বাজারে। বাঁকে করে ভারীরা নদী থেকে জল তুলে আনছে মাটির কলসিতে। রাস্তার ধুলোর ওপর জল পড়ছে টপ টপ করে। অন্য দিন এসব দৃশ্য দেখেছে কান্ত, কিন্তু এমন করে কখনও চোখ ভরে দেখেনি। মরালীর ফাঁসি হবার পর কান্তও যেন এসব এমন করে আর দেখতে পাবে না। মরালীর সঙ্গে সঙ্গে সেও যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এ-পৃথিবী থেকে। কোতোয়ালির সামনে বেশ নিরিবিলি তখন। লোকটা বললে–আপনি পেছনের দরজা দিয়ে আসুন হুজুর, আমি ওদিকে গিয়ে খিড়কি খুলে দিচ্ছি–

কিন্তু কান্ত ভেবে অবাক হল, হঠাৎ মরালী তাকে ডাকতে গেলই বা কেন?

আসুন!

লোকটা পেছনের দরজা দিয়ে আস্তে আস্তে ভেতরে নিয়ে গেল। তারপর সুড়ঙ্গ রাস্তা। সেখানে যেতেই মরালীর গলা শুনতে পেলে। মেহেদি নেসারের গলাও শুনতে পাওয়া গেল। যেন দুজনে খুব ঝগড়া হচ্ছে।

ও কে?

লোকটাও বোধহয় অবাক হয়ে গেছে। সেও বোধহয় অবাক হয়ে গেছে মেহেদি নেসার সাহেবের গলা শুনে। সে আর এগোল না। কিন্তু কান্ত সেই গলার আওয়াজ অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। তারপর এঁকেবেঁকে যেতে যেতে একেবারে সোজা ফটকের সামনে এসে হাজির। সেখানে তখন কোতোয়াল সাহেব বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আর মেহেদি নেসার সাহেব মরালীর হাত ধরে টানাটানি করছে।

কান্ত আর থাকতে পারলে না। সেও সামনে গিয়ে মেহেদি নেসারের ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল।

*

নানিবেগম চেহেল্-সুতুনে এসে সেই ভোরবেলাই পিরালি খাঁ-কে ডাকলে।

পিরালি খাঁ’র মেজাজ বলে একটা জিনিস আছে। পিরালি খাঁ আলিবর্দি খাঁর আমলের সর্দার খোঁজা। নবাবি আমলের খানদানি খিদমদগার। অনেক আসরফি জমিয়েছে নিজের খাশ সিন্দুকে। এখনই যদি খোঁজাগিরি চলে যায় তো কারও পরোয়া করবার দরকার নেই। সোজা নিজের দেশে চলে যাবে। তালুক কিনবে, সেখানে নিজেই আবার আর একটা চেহেল্‌-সুতুন বানাবে। সেখানকার চেহেল্‌-সুতুনে আবার নবাব হয়ে বসবে। আর তা ছাড়া জগৎশেঠজির কারবারেও পিরালি খাঁর অনেক টাকা খাটছে, সেখান থেকেও অনেক আমদানি হয় তার।

কিন্তু এবার বোধহয় সত্যি সত্যিই পিরালির নোকরিটা চলে যাবে। নইলে জুবেদার ব্যাপারে অনেকখানি অপমান মাথা পেতে হজম করতে হয়েছে। এরকম অপমান এই-ই প্রথম। কোথাকার কোন হাতিয়াগড়ের রানিবিবি এসে তার সমস্ত ইজ্জত একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিলে। আগে সমস্ত বেগমসাহেবরা এসে সবাই তাকে খাতির করেছে। কিন্তু মরিয়ম বেগমসাহেবা আসার পর থেকেই যেন সব উলটেপালটে গেল। চেহেল্-সুতুনের ভিত পর্যন্ত নড়িয়ে দিলে একেবারে মরিয়ম বেগম।

নজর মহম্মদ যা রোজগার করে তারও ভাগ দেয় পিরালি খাঁ-কে।

বলে-মামুলি! মামুলি নাও সর্দার!

তা যত বাইরের ছোকরা আমদানি হয়, তার ভাগ দিয়েও নজর মহম্মদের নিজের ভাগে অনেক থাকে। তারও সিন্দুক আছে। সেখানে সে মোহর জমায়।

কিন্তু এসব টাকা আবার অনেক খোয়াও যায়। খোজাদের টাকার ওয়ারিশন কে-ই বা থাকে। একদিন যখন কবরে যায় তারা, তখনই সে টাকার ভাগাভাগি হয়ে যায় রাতারাতি। এমনি করে যে পুরুষানুক্রমে কত মোহর জমেছে পিরালির কাছে, তার আর গোনাগুনতি নেই।

এমনি যখন অবস্থা তখন হঠাৎ কোথাকার কোন মরিয়ম বেগম এসে তার ইজ্জত ধরে নাড়া দিলে। সর্দারের আঁতে সেদিন বড় ঘা লেগেছিল। কিন্তু নবাবজাদা মির্জার ইজ্জতের দিকে চেয়ে মুখ বুজে ছিল–কিছু বলেনি পিরালি খাঁ!

এবার আর কোনও রাগ নেই পিরালি খাঁ’র মনে।

এবার পিরালি খাঁ রাত্রে বিছানায় শুয়ে দম ভোর সিদ্ধি খায়। ওই একটাই নেশা পিরালি খাঁ’র। চেহেল্‌-সুতুনে যখন সবাই নেশায় ঢুলুঢুলু করে, তখন পিরালি খাঁ একটা বাটিতে সিদ্ধির শরবত চুমুক দিতে দিতে স্বপ্ন দেখে তালুকদারির। নজর মহম্মদ, বরকত আলির ওর চেহেল্‌-সুতুন ছেড়ে দিয়ে তখন একটু সামান্য মৌজ করে। চোখ দুটো বুজিয়ে নেয়।

কিন্তু সব দিন তা হয় না। ভোরের দিকের একটুখানি নেশা তাও এক-একদিন জমে না। তার আগেই পেশমন বিবির ঘর থেকে হল্লা ওঠে। কিংবা তক্কি বেগমসাহেবার ঘর থেকে গালাগালির চিৎকার কানে আসে। তখন আবার গিয়ে সব ঠান্ডা করতে হয়। নইলে নানিবেগম আবার চটে যাবে। নানিবেগম আবার ডেকে পাঠিয়ে দুটো কথা শোনাবে। কারও কথা শুনতে পিরালি খাঁ রাজি নয় জীবনে।

নইলে সব তো জানে পিরালি খাঁ।

কোন বেগমসাহেবার ঘরে কী ঘটছে তা তো জানতে তার বাকি নেই। নতুন যে ছোকরা আসত মরিয়ম বেগমের ঘরে, তাকেও চিনে রেখে দিয়েছিল পিরালি খাঁ। ছোকরাটা ঠান্ডা মেজাজের। সারাফত আলি সাহেবের খুশবু তেলের দোকানে থাকত আর নিজামত কাছারিতে কাজ করত। মরিয়ম বিবির সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করতে গিয়েই সব গণ্ডগোল করে ফেললে।

দোষটা বরকত আলির।

তুই কেন নিয়ে গেলি মরিয়ম বেগমসাহেবাকে? তাকে চেহেল সুতুনের বাইরে নিয়ে গিয়ে তোর কী কাম?

বরকত আলি বলেছিল–সর্দার, বেগমসাহেবা যে মুহব্বত করছে ওই ছোরার সঙ্গে

তা মুহব্বত করছে তো করুক না, চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে মুহব্বত হয় না?

ও ছোকরাবাবু যে আসছিল না। দিমাগ বিগড়ে গিয়েছিল মরিয়ম বিবির! আর পেশমন বেগমসাহেবা আমাকে মোহর দিলে, আমি কী কসুর করলুম সর্দার!

তা, নিয়ে গেলি তো সফিউল্লা খাঁ সাহেবের নাম করলি কেন? অন্য দুসরা নাম দিতে পারলি না?

হঠাৎ ওই নামটা মনে পড়ল যে সর্দার। নইলে এত নাম থাকতে ওনাম ইয়াদ আসবে কেন? ওই-ই তো নসিব! ওকেই তো নসিব বলে সর্দার, সফিউল্লা খাঁ সাহেব ভি ওই বখত ওখানে আসবে কেন?

পিরালি খাঁ কিন্তু মনে মনে খুশি।

বলে ঠিক করেছিস, আচ্ছা করেছিস, বহুতখুব কাম করেছিস

বলে আর এক-একবার চুকচুক করে সিদ্ধির শরবতে চুমুক দেয়। তখন ভোর হয়-হয়। তখন একটু তন্দ্রা আসে পিরালি খাঁ’র। তন্দ্রা মানে একই স্বপ্ন। নবাবিআনার স্বপ্ন।

সেই স্বপ্নের মধ্যেই হঠাৎ নজর মহম্মদ এসে ডাকল–সর্দারজি, সর্দারজি

পিরালি খাঁ তন্দ্রা ভেঙে লাফিয়ে উঠল–ক্যা হুয়া?

একটানা-একটা দুর্ঘটনা না ঘটলে এমন করে কেউ পিরালি খাঁ-কে ডাকে না।

ক্যা হুয়া?

ময়মানা বেগমসাইেবা আয়ি।

 ময়মানা বেগমসাহেবা!

 হ্যাঁ, নানিবেগমসাহেবা এত্তেলা দিয়েছে!

 তাড়াতাড়ি মাথায় পাগড়িটা পরে নিলে পিরালি খাঁ। পূর্ণিয়ার শওকত জঙ বাহাদুরের মা, বউ, সবাই এসে গেছে।

পিরালি খাঁ সোজা গিয়ে ফটকের সামনে দাঁড়াল। হাতির পিঠ থেকে নেমে আলিবর্দি খাঁ সাহেবের বিধবা মেয়ে তখন তাঞ্জামে উঠছে। তাঞ্জামে করে চেহেসূতুনের ভেতরে আসবে! অস্পষ্ট কান্নার শব্দে গুনগুন করে উঠছে আবহাওয়া। সেই ভোররাত্রেই যেন বড় করুণ হয়ে উঠল চেহেল্‌-সুতুন। আলিবর্দি খাঁ’র তিন মেয়ের মধ্যে, দু’মেয়ে চেহেল-সুতুনেই ছিল এতদিন। এবার আরও এক মেয়ে এল। একেবারে অনাথ হয়ে এল। শুধু মেয়ে নয়, পূর্ণিয়ার হারেমের অন্য বেগমসাহেবারাও এল। একেবারে হারেম জমজমাট হয়ে উঠল। নানিবেগমের মনটাও হুহু করে উঠল ময়মানাকে দেখে। তবু প্রাণ ভরে কাঁদবারও উপায় নেই যেন।

সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল আমিনা বেগম।

তাকে যেন দেখেও দেখল না ময়মানা। এরই ছেলে তাকে অনাথ করেছে। মির্জা মহম্মদ! যেন সমস্ত দোষটাই আমিনার। যেন আমিনাই শিখিয়ে দিয়েছে নিজের ছেলেকে।

আর সেই সময়ে নহবতখানায় ইনসাফ মিঞা নহবতে সুর ধরলে–মিঞা-কি-মলহার।

আর সঙ্গে সঙ্গে সারা মুর্শিদাবাদে সাড়া পড়ে গেল। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা হেবাৎ জঙ বাহাদুর মির্জা মহম্মদ আলমগির কি ফতে–এ-এ-এ-এ

আর সামনে-পেছনের সবাই চিৎকার করে উঠল একসঙ্গে ফতে—

হাতির মিছিলের মাথায় বসে ছিল নবাব। হাতির মিছিল মতিঝিলের দিকেই যাচ্ছিল। হাতিরা কলকাতাতেই যাক আর পূর্ণিয়াতেই যাক, ফিরে এসে এই মতিঝিলের দিকেই তাদের গতি। তাদের সে-পথ মুখস্থ হয়ে গেছে। আলিবর্দি খাঁর আমলেও সেই নিয়ম ছিল, নবাব মির্জা মহম্মদের আমলেও সেই একই নিয়ম আছে।

কিন্তু কোতোয়ালির সামনে আসতেই নবাব হুকুম দিলে এখানে থামো

সবাই অবাক হয়ে গেল। রাজা মোহনলাল, মিরজাফর, দুর্লভরাম সবাই অবাক। এ আবার মির্জার কী খেয়াল! কোতোয়ালিতে ঢুকবে নাকি নবাব।

লম্বা কাঠের সিঁড়িটা এনে লাগানো হল হাতির পিঠে।

নবাব সেই অবস্থাতেই সেই কাঠের সিঁড়ি দিয়ে কোতোয়ালির চবুতরে নামতে লাগল।

.

মুর্শিদাবাদ তো শুধু একা নবাবের নয়। মুর্শিদাবাদ কারও একলার ইচ্ছেয় চলে না। একলার ইচ্ছেয় চললেও একলার চালনায় চলে না। তার জন্যে বিভিন্ন আমির-ওমরাহ আছে। ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ আছে। এ অনেকটা এই দেহযন্ত্রের মতো। তার বিভিন্ন বিভাগের চালনার জন্যে বিভিন্ন ছোট ছোট যন্ত্র আছে। আবার সেগুলোকে চালনার জন্যে আরও বড় বড় যন্ত্র আছে। সেই বড় বড় যন্ত্রগুলোর মাথার ওপরে সবচেয়ে যে বড় যন্ত্রটা কাজ করে তারই নাম হল নবাব।

মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা হেবাৎ জঙ বাহাদুর আলমগির অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাসে সেইরকম সবচেয়ে একটা বড় যন্ত্র!

সে-যন্ত্রকে শ্রদ্ধা যেমন করতে হয়, সম্মান যেমন করতে হয়, তেমনই আবার ভয়ও করতে হয়। কারণ ভয় না করলে তার হুকুম পালন করতে যে আমাদের দ্বিধা হবে। আর দ্বিধা হলেই আর মুর্শিদাবাদ চলবে না। এখানে ভয়টা রাষ্ট্র-চালনার পক্ষে অপরিহার্য অঙ্গ।

এবার কিন্তু সেই ভয়ের ওপরেই হস্তক্ষেপ হয়েছে।

একদিন দাক্ষিণাত্য-নিবাসী এক অখ্যাত ব্রাহ্মণ-সন্তান যে মসনদের পত্তন করেছিলেন এই মুর্শিদাবাদে, সেই নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ’র মাথাতেই যেন কেউ থুথু ফেলেছে। যেন সেই পরলোকগত আত্মা বেহেস্ত থেকে নেমে এখানে জবাবদিহি চাইতে এসেছে।

কোতোয়াল সাহেব একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে খানিকক্ষণের জন্যে। তার পরেই খাড়া হয়ে কুর্নিশ করেছে।

অন্ধকার ফটকের ভেতরে মরালী তখন একসঙ্গে দু’জনের সঙ্গে যুঝছে। মেহেদি নেসার থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল খবর পেয়েই। কিন্তু কান্ত ছাড়েনি। কান্ত নেসারের হাত দুটো তখনও জাপটে ধরে আছে।

ইয়ে কৌন?

কান্ত নবাবকে বোধহয় চিনতে পারলে।

কোতোয়াল সাহেব সামনে এগিয়ে এসে বললে–খোদাবন্দ, এ বাহারকা ফালতু আদমি, কোতোয়ালির ভেতরে ঘুষে গেছে

আউর তুম?

মেহেদি নেসার বললেনবাব, এ বেগমসাহেবা সফিউল্লাকে খুন করেছে, একে আমি জেরা করছি

জেরা? জেরা তো আদালতে করবে উকিল। তুমি কোতোয়ালিতে এসে জেরা করছ কেন?

কাজিসাহেবের অনুমতি নিয়ে এসেছি আমি, নবাব।

 নবাব কান পেতে শুনল কথাটা। তারপর মরালীর দিকে ফিরে বললে–ওর তুম?

মরালী মাথা নিচু করে ছিল। সকলের মনে হল সারা কোতোয়ালিটাই যেন তখন নবাবকে দেখে লজ্জায় হতাশায় মাথা নিচু করে ফেলেছে।

জবাব দিচ্ছ না কেন? জবাব দাও?

কোতোয়াল মাথা বাড়িয়ে নবাবের হয়ে যেন ধমক দিয়ে উঠল।

নবাব বললে–তুমি থামো। আমি হুকুম দিচ্ছি, জবাব দাও, কে তুমি? কৌন তুম?

মরালী তবু মাথা নিচু করে রইল।

এবার মরালী মুখ তুলল। বলল–জবাব আমি কাকে দেব?

কেন, আমি জিজ্ঞেস করছি, আমার কাছে জবাব দেবে!

মরালী ঘাড় বেঁকিয়ে বললে–আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না।

কী করে জানলে আমি তোমার কথা বিশ্বাস করব না?

আপনি যে সংসারে কাউকেই বিশ্বাস করেন না!

 তুমি তা কী করে জানলে?

মরালী বললে–আমি সব জানি। আপনার সম্বন্ধে আপনি নিজেও যা জানেন না, আমি তাও জানি!

 তুমি তো চেহেল-সুতুনে থাকো, তুমি কী করে এত জানলে?

 আপনার চেহেল-সুতুনের সবাই সবকিছু জানে।

তারপর একটু থেমে বললে–আর তা ছাড়া আমি যা জানি, এখানে এত লোকের সামনে তা বলতে পারব না, আমায় বলতে বলবেন না আপনি দয়া করে।

নবাবের হুকুম, তোমায় বলতে হবে।

আমায় বলতে বলবেন না আপনি!

আবার বলছি আমি নবাব, নবাবের হুকুম, তোমাকে বলতেই হবে।

মরালী এবার হঠাৎ বলে উঠল–আপনি নবাব নামের কলঙ্ক!

আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল কোতোয়ালির ছাদটা যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ল মেঝের ওপর। যে-যেখানে ছিল সবাই চমকে উঠেছে। এত বড় কথা দিল্লির বাদশাও বুঝি বলবার সাহস করত না কখনও। এত বড় কথা বুঝি নবাব আলিবর্দি খাঁ-ও কখনও বলতে সাহস করেনি নবাবজাদাকে! তুমি আমি আর পাঁচজন যখন সবাই নবাবকে খোশামোদ করে আরও প্রতিষ্ঠা আরও প্রতিপত্তির লালসায় মিথ্যেকে সত্যি বলে প্রিয়ভাজন হবার চেষ্টা করছি, তখন এ-মেয়েটার এত বড় সাহস হল কেমন করে? তবে এ কি আরও বেশি প্রতিষ্ঠা চায়? আরও বেশি প্রতিপত্তি? আমাদের সকলকে ছাপিয়ে ও কি অপ্রিয় কথা বলে নবাবের নজরে পড়তে চায়?

ওকে মতিঝিলে পাঠিয়ে দাও

বলে নবাব আবার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু কী যেন মনে পড়ে যেতেই বললে–আর ওকেও—

বলে কোতোয়ালির বাইরে চলে গেল নবাব। আবার হাতির পিঠে গিয়ে উঠল।

*

এতদিন বাইরে ছিল নবাব, কিন্তু মুর্শিদাবাদের ভেতরে এই ক’দিনের মধ্যেই যেন সমস্ত কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। ফিরিঙ্গি কোম্পানির কাছ থেকে চিঠি এসেছে। ক্লাইভ বরানগরে এসে বসে আছে। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন কলকাতার কেল্লায় ঢুকে পড়েছে। কেল্লার ভেতরে যে মসজিদ তৈরি হতে শুরু হয়েছিল তাও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। চারদিকে সব ছারখার হয়ে গেছে। তুমি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব, তুমি কোথায় এখন? তুমি যা-যা বলেছিলে আমি তো বর্ণে বর্ণে তা পালন করে আসছি জাঁহাপনা। ওরা ফিরিঙ্গি, ওদের তো আমি হিন্দুস্থান থেকে তাড়াতে চাইনি। শুধু চেয়েছিলাম ওরা আমাকে নবাব বলে মানুক। ওরা জানুক যে হিন্দুস্থানের মালিক ওরা নয়, হিন্দুস্থানের মালিক আমি। আমি আরও চেয়েছিলাম যে ওরা বুঝুক এখানে নবাব বলে একজন আছে, তার ফার্মান নিয়ে তবে কারবার করতে হয়, কেল্লা বানাতে হয়, তাকে অগ্রাহ্য করলে এখানে টেকা যায় না; এখানো সোরা, রেশম, নুন, গলার ব্যাবসা উঠিয়ে দিয়ে নিজের দেশে ফিরে যেতে হয়। আমি তো আর কিছু চাইনি। ওরা যে আমার মসনদ নিতে চায় নবাব! ওরা যে আমায় উৎখাত করতে চায়! তবু আমি কিছু বলতে পারব না? আমি তোমার কাছেই যুদ্ধ করতে শিখেছি। তুমিই আমায় শিখিয়ে গেছ যে রাজনীতিতে ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই। রাজনীতি হল কূটনীতি। কূটনীতির গতি বড় কুটিল, বড় জটিল। আমি তো তাই কুটিল হয়েই কোম্পানির সঙ্গে লড়াই শুরু করেছি। বলল, এখন আমি কী অন্যায় করলাম, আমি কোন অপরাধ করলাম?

মির্জা।

সমস্ত দিনটা বড় অশান্তিতে কেটেছে। রাজা মানিকচাঁদ এসে সমস্ত খবর জানিয়ে গেছে। মতিঝিলের দরবার-ঘরে তখন সবে একটু বিশ্রামের স্বপ্ন নেমে এসেছে। ঠিক হয়েছে শেষপর্যন্ত যুদ্ধই করতে হবে আবার। তবে এবার আর দুদিকে নয়, একদিকে। পূর্ণিয়ার দিক থেকে আর কোনও ভয় নেই। এবার মোহনলালের সঙ্গে থাকবে চল্লিশ হাজার ঘোড়সওয়ার, ষাট হাজার পায়দল ফৌজ, গোটা পঞ্চাশেক হাতি আর তিরিশটা কামান। এবার শেষ করে দিতে হবে কোম্পানিকে। সেবার যেমন দয়া-মায়া দেখিয়েছিল, এবার আর তা নয়।

মির্জা!

 নানিবেগম ঘরে ঢুকল।

 তুই যে চেহেল্‌-সুতুনে গেলি না?

 নানিবেগমকে দেখে আর থাকতে পারলে না মির্জা। দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

নানিবেগমের চোখ দুটো কিন্তু শুকনো, খটখটে। বুকের মধ্যে তখনও মির্জা মুখ গুঁজে কাঁদছে। শুধু মির্জার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে নানিবেগম বলে-ময়মানা এসেছে রে মির্জা, চেহেল্‌-সুতুনে এসেছে। কিন্তু সে কথা বলতে আসিনি

মির্জা মুখ তুলল–আর কী বলবে বলো নানিজি!

আমার খত পেয়েছিলি?

হা নানিজি, তোমার খত্ পেয়েই তো মুর্শিদাবাদে এসে সোজা কোতোয়ালিতে গিয়েছিলুম। মরিয়ম বেগমকে নিয়ে এসেছি মতিঝিলে!

তার কাছে যে-চিঠি আছে সেটা দেখেছিস?

না, এখনও সময় পাইনি নানিজি! রাজা মানিকচাঁদ এসেছিল, তার সঙ্গে পরামর্শ করতেই অনেক সময় কেটে গেল। তারপর একটু তন্দ্রা এসেছিল আমার, এবার ডাকব মরিয়ম বেগমকে।

মরিয়ম বেগমের সঙ্গে আর কাকে ধরে এনেছিস?

আর একটা ছোকরা নানিজি! যার কথা তুমি লিখেছিলে। ওকে নানিজি?

নানিবেগম বললে–বোধহয় ওর দেশের লোক। ওর সঙ্গে ওর খুব পেয়ার আছে, ওর কাছেই তো গিয়েছিল মেয়ে

কিন্তু ও কোয়োয়ালিতে কী করছিল? সেখানে মেহেদি নেসারের সঙ্গে হাতাহাতি করছিল কেন?

নানিবেগম বললে–তা জানি না ।

তোমার চিঠি পেয়ে আমি আর কোতোয়ালিতে ওকে রাখতে সাহস করলাম না। সবাই মিলে আমাকে বিপদে ফেলবার চেষ্টা করছে। আমি কতদিক সামলাই বলো তো? একলা সব দিকে তো দেখা যায় না।

নানিবেগম বললে–ভাল ভাল লোকের হাতে কাজের ভার দিয়ে দে

কার হাতে ভার দেব? কাকে বিশ্বাস করব বলো তো নানিজি? যাকে বিশ্বাস করব সে-ই আমার। বিরুদ্ধে লোক খেপাবে। শওকতকে যে আজ মেরে ফেলতে হল, এ কি আমি করতুম? সবাই তাকে খোশামোদ করে করে আমার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছিল। শওকত মুখে মুখে বলে বেড়াত বাংলাদেশ জয় করে অযযাধ্যার সুজাউদ্দৌলা আর উজির গাজিউদ্দিনকে হারিয়ে নিজের পছন্দমতো লোককে অযোধ্যার বাদশা বানাব, তারপর লাহোর কাবুল জয় করে খোরাসানে গিয়ে রাজধানী। বসাব বাংলাদেশের জলহাওয়া খারাপ! লোকেরাই তো তাকে এত আহাম্মক করে তুলেছিল, নইলে ও তো ছোটবেলায় এত বোকা ছিল না–

নানিবেগম সেকথায় কান না দিয়ে হঠাৎ বললে–আমি মরিয়ম মেয়েকে তোর কাছে আনছি—

এখন?

 কেন, এখন তোর সময় নেই?

আমি যে কাল কলকাতায় যাচ্ছি, কোম্পানির ফৌজের সঙ্গে মোকাবেলা করতে।

কিন্তু তার আগে তোর নিজের মোকাবেলা কে করবে?

আমার মোকাবেলা? সে মোকাবেলা তো তোমার খোদাতালা করবে নানিজি! তার আগে। মোকাবেলা করবে এমন ক্ষমতা কার আছে?

নানিবেগম বললে–কে মোকাবেলা করবে তার নিশানই তো আছে সেই চিঠিতে। সেই চিঠি কেড়ে নেবার জন্যেই তো দুদিন ধরে মুর্শিদাবাদে এত ষড়যন্ত্র চলছে। সেই জন্যই তো তোকে চিঠি লিখে তাড়াতাড়ি চলে আসতে বলেছিলাম আমি তাকে আনছি তোর কাছে বোস একটু

বলে নানিবেগম ঘরের বাইরে চলে গেল। মির্জা বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে। বহুদিন যেন এমন করে একলা থাকার আরাম ঘটেনি মির্জার জীবনে। সারাদিনসারারাত সবাই তাকে চোখে-চোখে রাখে। সবাই তাকে ভুলিয়ে রাখতে চায়, হয় আরাম দিয়ে নয়তো মেয়েমানুষ দিয়ে। আশ্চর্য, কোরান ছুঁয়ে যে একবার মদ ছেড়ে দেবার প্রতিজ্ঞা করেছে, আবার কেমন করে সে মদ ছোবে। তবু ওরা লোভ দেখায়। আর জেনানা! ও বড় পুরনো চিজ! মেয়েমানুষের নতুন করে দেখবার কিছু নেই। মেয়েমানুষের শরীরের রাস্তা-ঘাট-অলি-গলি-খুঁজি সব দেখা হয়ে গেছে মির্জার। অচেনা নেই কিছুই। শুধু মনটা। কিন্তু সেটাও যে কানাগলি। সেখানে যে ঢোকাই যায় শুধু, সেখানে যে সবই ভুলভুলাইয়া, সব যেন গোলকধাঁধার মতো ঘুলিয়ে যায়। সে ভুলভুলাইয়ার থেকে বেরোবার পথ কে বলে দিতে পারে! কে তার হদিস দেবে!

সামনে চেয়ে দেখলে মরিয়ম বেগম আসছে। পেছনে নানিবেগম!

নানিবেগম মরালীকে সামনে এগিয়ে দিয়ে বললে–কুর্নিশ কর মেয়ে

 মাথাটা নিচু করে আনাড়ির মতো কুর্নিশ করল মরালী।

তোর কাছে কী চিঠি আছে দেখা!

মরালী চুপ করে রইল।

 তারপর বললে–তার আগে ওকে ছেড়ে দিতে হবে!

নানিবেগম বুঝতে পারলে না। জিজ্ঞেস করলে কাকে?

ওই আমার জন্যে যাকে ধরে আনা হয়েছে, তাকে

তা, ও তোর কে?

 মরালী বললে–ও আমার নিজের লোক—

নিজের লোক মানে কী? তোর রিস্তেদার?

মরালী বললে–রিস্তেদারের চেয়েও বড়–এর বেশি আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না, এর বেশি আমি কিছু বলবও না–

বুঝেছি। তা এতদিন এ কথা বলিসনি কেন? তা হলে কবে তোকে আমি ছেড়ে দিতুম—

মরালী বললেন, আমি ছাড়া পেতে চাই না, আমি এখানেই থাকব।

এখানে থেকে কী করবি? চেহেল্‌-সুতুনের বেগমরা যেমন করে থাকে, যেমন করে চুলোচুলি করে বাঁচে, তেমনই করতে পারবি?

পারব! এখানে আমার থাকতে কোনও কষ্ট নেই।

তা হলে দেখা তোর কাছে কী চিঠি আছে–দেখা

মরালী ওডনির ভেতর থেকে হাত গলিয়ে বার করলে একখানা কাগজ। ভাঁজ করা এক টুকরো চিঠি। চিঠিখানা হাত বাড়িয়ে দিলে নবাবকে। নবাব সেখানা খুলে পড়তে লাগল।

নবাব মির্জা মহম্মদ অনেকক্ষণ ধরে কাগজখানা পড়তে লাগল। নানিবেগমও নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল।

মরালী বললে–সবাই এখানা কেড়ে নিতে চেয়েছে, আমি অনেক কষ্টে এটাকে সামলে রেখেছি

পড়তে পড়তে মির্জা মহম্মদ উঠে বসল। তার কপালে ঘাম জমে উঠল বিন্দু বিন্দু। নানিবেগমও একমনে পড়ছিল।

কিন্তু এ করিম খাঁ কে?

 নবাব নানিবেগমের দিকে চেয়ে বললে–একরিম খাঁ কোথাকার লোক? আমি তো একে চিনি না

নানিবেগম বললে–তা হলে মেহেদি নেসারকে জিজ্ঞেস কর করিম খাঁ কে?

 তা হলে তুমি যাও নানিজি, মরিয়ম বেগমকে নিয়ে পাশের কামরায় যাও, আমি ডেকে পাঠাচ্ছি—

বলে নেয়ামত খাঁ-কে ডাকলে। বললে–মেহেদি নেসার, ইয়ারজান, সকলকে এত্তেলা দে

*

উমিচাঁদ সাহেব শুধু সাহেব নয়, খানদানি সাহেব। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে দিশি পাড়ার সব মার্চেন্টদের মাথার ওপর তার জায়গা। ফিরিঙ্গিরাও তার প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখে অবাক হয়ে যেত। বলত–রাজা উমিচাঁদ। রাজাই বটে। রাজার মতোই তার চালচলন। বিরাট বাড়িটার সামনে সকালে-বিকেলে ভিস্তিরা গোলাপজল ছিটিয়ে ছিটিয়ে রাস্তার ধুলো ওড়া বন্ধ করত।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উমিচাঁদের হাত দিয়ে প্রথম-প্রথম কেনা-বেচা করত। তখন ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে উমিচাঁদ সাহেবের মহা দোস্তি। রোজ একসঙ্গে ওঠাবসা, একসঙ্গে খানা-পিনা চলছে। বেভারিজ সাহেব সোরা কিনত উমিচাঁদ সাহেবের গদি থেকে। লাভের কড়ি বেশির ভাগ উঠত গিয়ে উমিচাঁদের সিন্দুকে। উমিচাঁদের সিন্দুক ফুলে-ফেঁপে একেবারে ঢোল হয়ে উঠল। কান্তকে অনেক দিন নিজে গিয়ে উমিচাঁদের গদিতে গোমস্তার সঙ্গে লেন-দেন চালাতে হয়েছে। বাড়ির বাগানে বিরাট বিরাট সব মেহগনি গাছ ছিল। কোত্থেকে সব গাছ এনে বসিয়েছিল উমিচাঁদ সাহেব। টাকাও অঢেল, মানুষটাও শৌখিন। দাড়ি-গোঁফের আড়ালে শৌখিন লোকটার আসল চেহারাটা ঠিক বোঝা যেত না। কেউ বলত ভাল, কেউ বলত শয়তান।

 ১৭৫৩ সাল থেকেই কোম্পানির দাদনের ব্যবস্থা উঠে গেল। তার বদলে কোম্পানির গোমস্তারা গ্রামে-গ্রামে গিয়ে আড়ঙের মাল নিজেরা দেখা-শোনা করে কেনাকাটা আরম্ভ করলে। তাতে মুনাফা বাড়ল কোম্পানির। কিন্তু লোকসান হতে লাগল উমিচাঁদের।

তখন থেকেই ঝগড়াটা শুরু হল। শেষ হল কেল্লার মধ্যে উমিচাঁদকে বন্দি করে।

কিন্তু সে অনেক আগের কথা। তারপর উমিচাঁদের সেবাড়ি আবার সেজেগুজে প্রাসাদ হয়ে উঠেছে। জগমন্ত সিং নেই, কিন্তু অন্য দারোয়ান আছে। আবার উমিচাঁদ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আবার খোরাসান কাবুল কান্দাহার থেকে শুরু করে সুতানুটির গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত তার নৌকো মাল নিয়ে আমদানি রপ্তানির কাজ করছে। আবার ফিরিঙ্গি কোম্পানির সাহেবরা যাতায়াত শুরু করেছে তার বাড়িতে।

সেদিন সন্ধের সময় উমিচাঁদের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল এক ফকির।

ফকিরই বটে। একেবারে ঠিক ফকিরের মতো চেহারা। গায়ে তালি-মারা আলখাল্লা, গলায় স্ফটিকের মালা। হাতে আঁকানো-কোনো লাঠি। গুনগুন করে আল্লার নাম করে ভিক্ষে চাইতে এল। তারপর ভিক্ষে নিলেও। কিন্তু চলে গেল না।

গোমস্তা খুব খাতির যত্ন করে ভেতরে নিয়ে গেল। তারপর ভেতরে কোথায় গিয়ে যে ঢুকল তা বাইরের কেউ আর দেখতে পেলে না।

কিন্তু উমিচাঁদ সাহেবের কাজ হাসিল হয়ে গেল সেইদিনই। একেবারে সাহেবের খাসকামরার ভেতরে দরজা বন্ধ কুঠুরিতে বড় চুপিসারে কথা হতে লাগল দুজনে।

কেউ দেখতে পায়নি তো তোমাকে?

না হুজুর, দেখতে পেলেও চিনতে পারেনি কেউ, আমি মোল্লাহাটি হয়ে ঘুরে এসেছি। মেহেদি নেসার সাহেব আমাকে তাড়াতাড়ি সব জানাতে বলেছে। সব জানাজানি হয়ে গেছে হুজুর।

কী জেনেছে?

 নবাবকে নানিবেগম সব জানিয়ে দিয়েছিল চিঠি লিখে। সেই চিঠি পেয়েই একেবারে কোতোয়ালিতে এসে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে মেহেদি নেসার সাহেবকে। সে-চিঠি এখন নবাবের হাতে চলে গেছে।

সেখানে তো করিম খাঁ’র নাম আছে। আমি তো আমার নাম দিইনি সে-চিঠিতে।

তা জানি না হুজুর। সেই খবরটা আপনাকে বলতে এলাম! মেহেদি নেসার সাহেব আমাকে পাঠালেন হুজুরের কাছে, সেখানে আপনার নিজের নাম লিখেছেন কিনা জানতে

উমিচাঁদ সাহেব বললে–আমার নিজের নামওয়ালা চিঠি আছে, কিন্তু সেটা ও-চিঠির সঙ্গে নেই

সে চিঠিতে কী লেখা ছিল?

আমাদের মতলব লেখা ছিল তাতে। নবাবকে কোনওরকমে কলকাতায় এনে তারপর যেমন করে হোসেনকুলি খাঁ-কে মারা হয়েছে, তেমনি করে মারা হবে। লোক তৈয়ার আছে–

এসব কথা চিঠিতে লেখা আছে?

আছে, কিন্তু সফিউল্লা সাহেবের কাছে যে চিঠি আছে তাতে নেই। এ চিঠিখানা সফিউল্লা সাহেবকে রাস্তাতেই খাজা হাদিকে দিতে বলে দিয়েছি। খাজা হাদি তো আমাদের লোক, সেই সব ব্যবস্থা করবে যে

খাজা হাদিকে সে-চিঠি দেওয়া হয়েছিল আপনি ঠিক জানেন হুজুর?

নিশ্চয় দিয়েছে। সে-চিঠি সফিউল্লাসাহেব মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাবে কেন?

তা হলে আমি চলি হুজুর। এইটে জানতেই আমাকে পাঠিয়েছিল নেসার সাহেব।

কথা শেষ হবার আগেই খিদমদগার এসে খবর দিলে, ওয়াটসন সাহেবের লোক এসেছে।

তুমি পাশের কামরায় যাও, ফিরিঙ্গি কোম্পানির বড়সাহেব এসেছে, তোমাকে দেখতে পাবে মেহেদি নেসার সাহেবকে বলবে, কী হল যেন আমাকে জানান তিনি। আমি ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি

বিরাট প্রাসাদ উমিচাঁদ সাহেবের। পাঞ্জাবি আড়তদার। তামাম হিন্দুস্থান ছড়িয়ে আছে তার কারবার। একদিন এই বাড়িই পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু উমিচাঁদ আবার তা সারিয়ে নিয়ে সাজিয়ে ফেলেছে। এই ক’দিনের মধ্যেই আবার সামনের বাগানে ফুলগাছে ফুল ফুটিয়েছে মালি। সমস্ত সম্পত্তি গুরুগোবিন্দ নানকের নামে চালালেও দেয়ালের গায়ে মধ্যিখানে বড় বড় অক্ষরে গণেশায় নমঃ’ লেখা। বাংলার অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাসে এ এক অদ্ভুত পুরুষ।

অ্যাডমিরাল ওয়াটসন অত্যন্ত সন্তর্পণে ভেতরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলে–কী হল উমিচাঁদ সাহেব? এ-ঘরে কেউ এসেছিল নাকি?

কই, না!

মনে হল যেন কেউ এতক্ষণ এ-ঘরে ছিল!

ভুল অ্যাডমিরাল, ভুল। আপনি বড় ভয় পেয়ে গেছেন তাই এই ধারণা। আমি তো আপনার জন্যেই। অপেক্ষা করে বসে আছি।

অ্যাডমিরাল ওয়াটসন যেন এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হল। তারপর ভাল করে আয়েশ করে বসল।

উমিচাঁদ সাহেব বললে–আমার এখানে আসতে আপনার কোনও ভয় করবার দরকার নেই। নবাব আর কাউকে বিশ্বাস করুক আর না করুক, আমাকে নিজের লোকের মতো বিশ্বাস করে, এ সম্বন্ধে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন

শুনলাম মুর্শিদাবাদে নাকি কী সব ট্রাবল হয়েছে।

কোত্থেকে শুনলেন?

আমাদের স্পাইয়ের মুখের খবর। শুনলাম কোন একটা বেগম নাকি মার্ডার করেছে সফিউল্লা খাঁ সাহেবকে। তার কাছে নাকি ভ্যালুয়েবল ডকুমেন্ট ছিল, সেটাও ধরা পড়েছে। তাতে নাকি মেহেদি নেসার, ইয়ারজান, আপনি সবাই জড়িয়ে পড়েছেন।

ফুঃ

 গুরুগোবিন্দ নানকের ভক্ত এক ফুয়ে ওয়াটসনের সব সন্দেহ হাওয়ায় উড়িয়ে দিলে।

বললে–এটা জেনে রাখবেন, আমার বিরুদ্ধে যে যা-কিছু বলুক, নবাব আমাকে কখনও অবিশ্বাস করবে না

কেন?

সে চালাকি শেখা চাই অ্যাডমিরাল। সেটা আমি কাউকে শেখাই না। নইলে কোটি কোটি টাকা এই একটা জীবনে আয় করতে পারি? কারবার করে খাই, লোকচরিত্র জানব না?

তা হলে কী হবে?

 কীসের কী হবে?

সে ডকুমেন্ট ধরা পড়লে কী হবে?

কিছুই হবে না। আপনারা অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন? আপনারা যদি নবাবকেনা-হটাতে পারেন তা হলে কেন আবার ফিরে এলেন? ফলতায় থাকলেই পারতেন? আমরা নিজেরাই সরাব।

ওয়াটসন অবাক হয়ে গেল আপনারা নিজেরাই সরাবেন?

আমরা সরাতে পারি না ভাবছেন? নবাব যাকে-তাকে যখন-তখন অপমান করবে, যার-তার বউকে ধরে হারেমে পুরবে, যা-খুশি তাই করবে, তা হলে আমরা আছি কী করতে?

অ্যাডমিরাল কী যেন ভাবলে আমাদের যে মুশকিল হয়েছে

আপনাদের আবার মুশকিল কী? আমরা সবাই তো আপনাদের পেছনে আছি

ওয়াটসন বললে–ফ্রেঞ্চরা যে চন্দননগরে রয়েছে, মঁসিয়ে লা যে নবাবের ফ্রেন্ড

দেখুন

উমিচাঁদ অভয় দিয়ে বললে–দেখুন, টাকার জোর বড় জোর, আমার টাকা আছে, মুর্শিদাবাদের জগৎশেঠজির টাকা আছে। যতক্ষণ আমাদের টাকা আছে ততক্ষণ আমরা যা খুশি তাই করব। যদি আমাদের খুশি হয় তো নবাবকে মসনদে বসাব, আবার খুশি হলে নবাবকে মসনদ থেকে নামা তাতে আপনারা আমাদের দলে থাকুন আর না-ই থাকুন।

অ্যাডমিরাল ওয়াটসন যেন কিছুক্ষণ কী ভাবলে।

 তারপর বললে–তা হলে বলছেন কিছু ভয় নেই?

না, যতক্ষণ উমিচাঁদ আছে ততক্ষণ কিছু ভয় নেই, আপনারা তোড়জোড় শুরু করে দিন, আমি থাকতে ভয় কী?

মিরজাফর সাহেব

আরে, মিরজাফর সাহেব তো আমার হাতের পুতুল। আমি যা বলব সে তাই করবে। বলুন তো এখানে আমার বাড়িতে তাকে ডেকে নিয়ে আসি-তা আনার ফ্রেন্ড কোথায় গেল? সে এল না?

কে ফ্রেন্ড?

 কর্নেল ক্লাইভ।

অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের মুখে একটা তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল।

তার দ্বারা কিছু হবে না উমিচাঁদ সাহেব, তার আর কোনও পদার্থ নেই।

কেন?

সে এক নেটিভ ওম্যানের সঙ্গে লাভে পড়েছে—

দিশি মেয়ে? কোথাকার মেয়ে?

কোথাকার কোন কান্ট্রি গার্ল, আবার ম্যারেড। বিয়ে হয়ে গেছে ওম্যানটার। তাকে নিয়ে নিজের ঘরে তুলেছে। আমি তাকে নেটিভ গার্ল বলেছিলুম বলে আমার সঙ্গে মারামারি করেছে আর কোনও ভরসা নেই–

ছি ছি ছি শেষকালে লড়াই করতে এসে মেয়েমানুষের খপ্পরে পড়ল।

কথাটা শেষ হবার আগেই খবর এসে গেল। উমিচাঁদ সাহেবের খোদ খিদমদগার এসে কুর্নিশ করলে হুজুর, কর্নেল ক্লাইভসাহাব হাজির

ওই দেখো, এসে গেছে।

ইন্ডিয়ার মানুষদের এতদিনে চিনে ফেলেছিল ক্লাইভ সাহেব। ক্লাইভ জানত যারা কন্সপিরেটর তাদের কাছে নিজেকে ছোট করতে নেই। মাথা নিচু অলেই ষড়যন্ত্রকারীরা পেয়ে বসে। এরা কাউকেই ভালবাসে না। এরা নিজেরা ছোট বলেই পরকেও ছোট মনে করে। এরা নবাবের এনিমিই শুধুনয়, এরা ক্লাইভেরও এনিমি।

কিন্তু ঘরে ঢুকেই মুখময় হাসি ভরিয়ে তুলল।

হ্যালো উমিচাঁদ দি গ্রেট।

*

ততক্ষণে মেহেদি নেসারকে ডেকে পাঠিয়েছিল নবাব। মির্জার হাতে তখনও চিঠিটা ধরা আছে। শুধু মেহেদি নেসারই নয়, ইয়ারজানকেও ডেকে পাঠিয়েছে।

এটা কীসের চিঠি ইয়ার?

বড় হাসিমুখে এগিয়ে এল মেহেদি নেসার। নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা তাদের সন্দেহ করেছে। এতদিনের ইয়ারগিরির আজ বুঝি পরীক্ষা হয়ে যাবে। তবু মির্জাকে চিনতে তাদের বাকি নেই।

মির্জাকে ভোলাতে তারা জানে। মির্জার গুণও তারা জানে, মির্জার দোষও জানে। বাচপান থেকে একসঙ্গে উঠেছে বসেছে তারা, একসঙ্গে ফুর্তি করেছে, আবার কখনও ঝগড়াও করেছে। কিন্তু মির্জা কখনও সন্দেহ করেনি তাদের, বরং সন্দেহ করলেও অবিশ্বাসে উড়িয়ে দিয়েছে। যখন চারদিকে আরও শত্রু ছিল মির্জার, যখন নবাবি টলমল করত, তখনও পাশে দাঁড়িয়ে যারা উৎসাহ দিয়েছে, আশা জুগিয়েছে, দুশমনদের দূর করেছে, তারা মেহেদি নেসার, ইয়ারজান আর সফিউল্লা। কত রাত ভোর করে দিয়েছে একসঙ্গে, কত দিন খতম করে দিয়েছে একসঙ্গে। সেই সব কথা মনে রেখেই একদিন মেহেদি নেসার, ইয়ারজান আর সফিউল্লা মুর্শিদাবাদে নবাবের মতো কলিজা ফুলিয়ে বেড়িয়েছে। কারও পরোয়া করবার দরকার হয়নি। সেই তাদেরই আজ ভয়ে-সংকোচে-দ্বিধায় এসৌঁড়াতে হয়েছে। মির্জার সামনে আসামি হয়ে।

সেসব দিনের কথা কি মির্জা সব ভুলে গেল?

সেই যেদিন হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে দেখেছিল বজরার ভেতরে। ভারী খুবসুরত লেগেছিল চোখের চাউনিটা। শুধু কি হাতিয়াগড়ের রানিবিবি! কত লেড়কি, কত আওরাত, কত জেনানা, কত মহফিল! সব তো মির্জার জন্যে।

অথচ যেদিন থেকে হাতিয়াগড়ের রানিবিবি চেহেলসূতুনে এসেছে, সেইদিন থেকেই যেন সব ওলটপালট হয়ে গেছে নিজামতিতে। নানিবেগমও তাদের সন্দেহ করতে শুরু করেছে। মির্জাও তাদের সন্দেহ করতে শুরু করেছে। সেইদিন থেকেই সুখের দিন, সোয়াস্তির দিন চলে গেছে তাদের।

এটা কীসের চিঠি ইয়ার? এ করিম খাঁ কে?

সমস্ত মতিঝিলের মধ্যে যেন একটা অস্ফুট জিজ্ঞাসার চিহ্ন সবকিছু তোলপাড় করে ফেললে।

মেহেদি নেসার সেকথার সোজা উত্তর দিলে না।

 আজ আমাদের তুই অবিশ্বাস করলি মির্জা?

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা নয় ইয়ার। আমার সব বিশ্বাস-অবিশ্বাস আজ আমাকে পাগল করে তুলেছে। আমার মসনদের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে। কাকে বিশ্বাস করব আর কাকে অবিশ্বাস করব, আমি বুঝতে পারছি না। জানিস ইয়ার, শেষকালে কোনদিন শুনব নানিবেগম আমাকে খুন করবার জন্যে জহ্লাদ লাগিয়েছে তা শুনলেও হয়তো আজ আর তাজ্জব হব না

মেহেদি নেসার বললে–কিন্তু কেন এরকম হল ইয়ার?

কেন হল? হয়তো মসনদের খাতিরে হল। হয়তো মসনদ না পেলে কেউ আমার পেছু লাগত না, আমিও কারও পেছনে লাগতুম না। আমিই কি কম খুন করেছি, তোরাই বল?

মেহেদি নেসার বললে–তোর সঙ্গে আমার কথা বলতেও শরম লাগছে ইয়ার! ভাবছি আমি যা-কিছু বলব তুই তা-ই সন্দেহ করবি

তা করব! মিরজাফর এ-চিঠি লিখলে আমি অবাক হতুম না, এমনকী জগৎশেঠজি লিখলেও অবাক হতুম না। হিন্দুস্থানের কেউ লিখলেও অবাক হতুম না। বোধহয় নানিবেগম লিখলেও অবাক হতুম না! কিন্তু তা বলে তোরা?

মেহেদি, নেসার বললে–তা হলে এক কাম কর, আমি মাথা পেতে দিচ্ছি তোর সামনে, দুই আমাদের কোতল কর

বলে মেহেদি নেসার নবাবের সামনে নিজের মাথাটা নিচু করলে।

ঠিক যেমন ভাবে হোসেনকুলিকে কোতল করেছিলি তেমনি করেই কোতল কর। আমি হাসতে হাসতে বেহেস্তে চলে যাব

তা হলে এ করিম খাঁ কে, বল?

মেহেদি নেসার বললে–তার দরকার নেই। একবার যখন তোর মনে সন্দেহ হয়েছে তখন তার উত্তর পেলেও তোর সন্দেহ ঘুচবে না। তার চেয়ে তুই আমাদের খতম করে দে সফিউল্লা যেখানে গেছে আমরাও সেখানে চলে যাই

বলে মির্জার সামনে তেমনি করেই মাথা নিচু করে রইল।

ওঠ

মির্জা হাত ধরে টেনে ওঠালে। বললে–দ্যাখ ইয়ার, যখন নবাব হইনি তখন বেশ ছিলাম রে, এখন কেবল সকলকে সন্দেহ হয়। রাগের ঝেকে সেদিন জগৎশেঠকেই চড় মেরে বসেছিলুম! এখন নবাব হয়ে আমার এ কী হল বল তো!

বলতে বলতে কেমন করুণ হয়ে উঠল মির্জার গলাটা।

এখন কবে যে প্রাণভরে ঘুমিয়েছি তাও মনে পড়ে না। এখন একটু ঘুমোব ভেবেছিলুম, তাও হল না। কোথা থেকে কী একটা চিঠি এসে সব গোলমাল বাধিয়ে তুলল–

বলে চিঠিটা নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিলে।

বললে–যা যা ভাগ তোরা, ভাগ এখান থেকে ভাগ, আমি ঘুমোব এখন

মেহেদি নেসার, ইয়ারজান দু’জনেই চলে গেল দরবার ছেড়ে চলে যেতেই নানিবেগম ভেতরে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে মরিয়ম বেগম।

নানিবেগম বললে–কী হল, চিঠি ছিঁড়ে ফেললি?

 মির্জা বললো নানিজি, ওদের ছেড়ে দিলুম

তোকে খুন করবার জন্য ওরা সড় করছে আর তুই ওদের ছেড়ে দিলি মির্জা! এই চিঠির জন্যে ওরা এত টানা-াচড়া করছে, আর তুই কিছু বললিনে?

মির্জা বললে–আমার দেমাগটা বড় খারাপ হয়ে আসছে নানিজি।

তা দেমাগ খারাপ বলে খুনিদের মাফ করে দিবি তুই?

মির্জা বললে–খুন তো আমিও আগে অনেক করেছি নানিজি! তাতে কি আমার দুশমন কমেছে? এই তো শওকতকে খুন করে এলুম, তুমি কি ভাবছ তাতে আমার দুশমন কমবে? এখন আমার বড় ঘুম পেয়েছে নানিজি, আমি একটু ঘুমোব এখন

তা হলে নবাবি নিলি কেন?

আমি ভুল করেছি নানিজি!

তা হলে নবাবি ছেড়ে দে, দুশমনের মোকাবিলা না করতে পারলে নবাবি ছেড়ে দিয়ে ফকিরি নে—

মির্জা বললে–না নানিজি, ওদের কিছু কসুর নেই, ওদের তুমি দোষ দিয়ো না, ওরা আমার পুরনো ইয়ার

নবাবের ইয়ারের কি অভাব হয় রে মির্জা! দুশমনরাই তো ইয়ার সেজে আসে!

মির্জা এবার সোজা হয়ে বসল। বললে–কিন্তু বলতে পারো নানিজি, কাকে আমি বিশ্বাস করব? ওদেরও যদি আমি ছেড়ে দিই তো কাদের নিয়ে আমি থাকব? ঠগ বাছতে গিয়ে যে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে!

এতক্ষণ মরালী চুপ করে ছিল। জিজ্ঞেস করলে–জাঁহাপনা কি আমার দেওয়া চিঠি ছিঁড়ে ফেলেছেন?

হ্যাঁ, ওই যে পড়ে আছে।

তা হলে চিঠিতে যা লেখা ছিল সব ভুল?

হ্যাঁ বিবিজি, সব ভুল। ওরা কখনও ও-চিঠি লেখাতে পারে না।

 তা কীসে বুঝলেন জাঁহাপনা?

নবাব বললে–করিম খাঁ বলে কেউ নেই। মেহেদি নেসারের কোনও দুশমন আছে, ওটা তারই কাজ। ওরা আমার ইয়ার, ওদের আমি ভালবাসি, এটা অনেকের সহ্য হয় না

তা যদি হয় তা হলে এ-চিঠি কার লেখা?

বলে মরালী আর একটা চিঠি তার ওড়নির আড়াল থেকে বার করলে। করে নবাবের দিকে নিচু হয়ে এগিয়ে দিলে।

এ-চিঠি আবার কোথায় ছিল?

মরালি বললে–সফিউল্লা খাঁ সাহেবের জামার ভেতরে। এটা আলাদা করে রেখেছিলাম।

মির্জা মহম্মদ তাড়াতাড়ি চিঠি নিয়ে পড়ে বললে–একী! উমিচাঁদ সাহেব? উমিচাঁদও এদের দলে?

নানিবেগমসাহেবা চিঠিটার ওপর ঝুঁকে পড়ল উদগ্রীব হয়ে।

*

অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাস আজকের বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস নয়। ইতিহাস বদলায় কিন্তু ইতিহাসের বাইরের বোরখার চেহারাটা হয়তো একই থাকে। আজকের প্রাইম মিনিস্টার সেদিনের নবাব। আজকের মিনিস্টার সেদিনের মেহেদি নেসার। তবুনবাবদের কিন্তু পরিবর্তন নেই, মেহেদি নেসাররাও অজর-অমর। তারা আসে, নবাবি করে, বক্তৃতা দেয়, লড়াই করে, ষড়যন্ত্র করে, খোশামোদ করে, ঘুষ খায়, তারপর আবার একদিন ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে কোথায় হারিয়ে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, কেউ তাদের মনে রাখে না। দু-একটা রাস্তার নাম, বাড়ির নাম, কি প্রতিষ্ঠানের নামে শুধু তারা বেঁচে থাকে। তারপর আবার শুরু হয় আর একজনের পালা। তখন আবার সেই একই নিয়মে ইতিহাস এগিয়ে চলে। যে-নিয়মে সেই মহারাজ অশোক এসেছে গেছে, সেই নিয়মেইনবাব সিরাজউদ্দৌলা এসেছে গেছে, মেহেদি নেসাররাও এসেছে গেছে, সেই নিয়মেই আবার আপনি আমি সবাই এসেছি আবার একদিন যাবও।

তবু বলছি ইতিহাস বদলায়।

আপনি আমি চাইলেও বদলায়, না-চাইলেও বদলায়।

বদলায় বলেই যুগে যুগে ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে আসে উদ্ধব দাসরা। উদ্ধব দাস লিখে গেছে

বিধির বিধান রবে, কেবা আর রবে ভবে।
 চলে যেতে হবে সবে না-হইতে শেষ ॥
বিপুল পৃথিবী তার, রবে মাত্র সারাৎসার,
কে বোঝে রহস্য কার এবম্বিশেষ ॥
কাব্য রচি কাটে দিন, আমি অতি দীন হীন,
তব পদে চিরদিন ভক্তি মম আশ।
ওহে প্রভু কল্পতরু, হে গোবিন্দ কৃপাঙ্কুর।
লিখিতং কাৰ্যঞ্চাগে শ্রীউদ্ধব দাস ॥

কাব্য লিখবে যে তুমি দাসমশাই, তা হলে এত ঘুরে বেড়াও কেন তুমি!

মোল্লাহাটির মধুসূদন কর্মকার কথাটা জিজ্ঞেস করেছিল একদিন। যে-লোকটাকে তার বউ পর্যন্ত নিলে না, দেখা হওয়ার পর তাড়িয়ে দিলে, তার তুল্য দুঃখী কেউ আছে এটা যেন কেউ কল্পনাই করতে পারত না।

মধুসূদন বলত–রায় গুণাকর তো রাজার সভায় ছাদের তলায় বসে অন্নদামঙ্গল লিখেছিল, তাই অত ভাল লেখা হয়েছিল কিন্তু তোমার কাব্য অত ভাল হবে না, তুমি যে কেবল ঘুরে বেড়াও–

উদ্ধব দাস বলত–আমার তো আর রাজাকে খুশি করবার জন্যে লেখা নয় গো

তবে কাকে খুশি করবার জন্যে?

রাজার রাজাকে খুশি করতে পারলেই হল।

রাজার রাজা? সে আবার কে গো? বাদশা?

 দুর বোকা।

 মধুসূদন বুঝতে পারেনি। বলেছিল–ও বুঝেছি–ভগবান—

দুর বোকা! ভগবান আছে না ছাই আছে! কচু আছে, ঘেঁচু আছে–

তা হলে রাজার রাজা কে?

উদ্ধব দাস বলেছিল–আরে বুঝলিনে বোকাঁচাঁদ, আমার রাজার রাজা হচ্ছে মানুষ মানুষ ভগবান। সেই মানুষ-ভগবানকে দেখবার জন্যেই তো কাহা কাহা ঘুরে বেড়াই কর্মকারমশাই। ছাদের তলায় বসে থাকলে কি আর মানুষ ভগবানকে দেখা যায়? মানুষ-ভগবান গঙ্গায় নৌকে ঠেলে, মাঠে লাঙল চষে, পথে মোট বয়।

মানুষ-ভগবান কথাটা কেউ শোনেনি। হিন্দু, মুসলমান, বোস্টম, কর্তাভজা, সহজে, সাহেবধনী, বাউল, বলরামভজা, কত রকম ভগবান-ভজার দল কত রকম কথা বলে বেড়ায়, কিন্তু উদ্ধব দাসের কথার সঙ্গে কারও কথা মেলে না।

তা তোমার মানুষ ভগবানকে পুজো করো তুমি?

করিনে? ওরে বাবা, না করলে বেগম মেরী বিশ্বাস’কাব্য লিখব কী করে? এ তো মানুষ ভগবানকে নিয়েই লেখা।

কখন তার পুজো করো?

সব সময়েই করি।

উদ্ধব দাস বলত–কী রকম করে পুজো করি শুনবে? শয়নে-স্বপনে-নিদ্রে সব সময়েই পুজো করি। তবে শোনন, আমার পুজো কী রকম মন দিয়ে করি

(যেমন) বারিগত মীন দাতাগত দীন।
নদীগত তরী ভক্তিগত হরি।
কনগত পশু মাতৃগত শিশু।
স্বামীগত সতী ক্রিয়াগত গতি।
জলগত মকর চন্দ্রগত চকোর।
বৃক্ষগত লতা জিহ্বাগত কথা।
আহারগত কায়া ধর্মগত দয়া।
অর্থগত নর পিত্তগত জ্বর।
অর্জনগত ধন আশাগত মন
ধনগত মান
তেমনি আমার কাব্যগত প্রাণ ॥

বলেই হাঃ হাঃ করে হেসে কুটোকুটি হয়ে পড়ে উদ্ধব দাস! তারপর উদ্ধব দাস চলে গেলে হরিচরণ সোজা এসে ঢুকল। বললে–দিদি গো, পাগলাটা চলে গেছে

দুর্গা জিজ্ঞেস করলে তোমার সাহেব কোথায়?

কর্নেল ক্লাইভ বরানগরে এসে যেন একটু শান্তি পেয়েছিল। এতদিন মাদ্রাজে ছিল। সেখানে কেল্লার মধ্যে বসে বসে শুধু বই পড়েছে আর লড়াই করেছে। কিন্তু ফলতায় আসার পর থেকেই দেশটাকে যেন আরও ভাল লাগছে। অনেকদিন দূর থেকে দেখেছে রানিবিবিকে। মনে হয়েছে, বড় অদ্ভুত মেয়েটা। মাথায় যাদের সিঁদুর থাকে তারা ম্যারেড লেডি সেটা জেনে নিয়েছে। কিন্তু ম্যারেড হলেও কেন হ্যাঁজব্যান্ডের কাছে গেল না। অথচ অত ভাল হাজব্যান্ড! সারা ওয়ার্লডই লোকটার সংসার। এ ওয়ার্লড-সিটিজেন। মনে হল এই পোয়েটটা তার নিজের মনের কথাটাই বলে গেল। ইন্ডিয়ায় এসে যদি কোনও লাভ হয়ে থাকে তো তা ওই।

ক্লাইভ সাহেবও গিয়ে ডাকলে–দিদি

দুর্গা এল। বললে–কী সাহেব?

ওই পোয়েটটা কিন্তু ভাল লোক দিদি। আই লাইকড দ্যাট পোয়েট। কিন্তু ওকে তোমরা ঘরে ঢুকতে দিলে না কেন? ও কী করেছে?

দুর্গা আর কী বলবে। সাহেবকে কী করে বোঝাবে যে ও-লোকটা তার জামাইও নয়, কেউই নয়। ও লোকটা একটা বাউন্ডুলে পাগল।

দুর্গা বললে–ওর কথা থাক বাবা, তুমি আমাদের কোথাও পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দাও, আমরা আর এখেনে থাকতে পারছিনে–

কেন? এনি ট্রাবল? কোনও কষ্ট হচ্ছে?

তা কষ্ট হবে না? বাড়ি-ঘর ছেড়ে এসে এখেনে পড়ে থাকতে কারও ভাল লাগে? আমাদের কি ঘর-সংসার নেই?

সাহেব বললে–আমার তো এখানে বেশ ভাল লাগছে দিদি, তোমাদের সঙ্গে থাকতে আমার খুব ভাল লাগছে। দেশে আমার তো বাবাও নেই, মাও নেই

মা বাবা কেউ নেই? মারা গেছেন বুঝি, আহা—

সাহেব হাসল। বললে–না দিদি, মা বাবা থেকেও নেই আমার।

কেন?

 আমার বাবা যে মাতাল, আমার মা তাই বাবার সঙ্গে থাকে না। আমার মা মাসির কাছে থাকত, আমিও সেখানে থাকতুম–

অত বড় দুর্ধর্ষ সাহেব দুর্গার সঙ্গে যখন গল্প করত তখন যেন অন্য মানুষ হয়ে যেত। দুর্গার মনে হত যেন সে ঘরের ছেলে। কোথাকার কোন সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে এখেনে যুদ্ধ করতে এসেছিল, নবাবকে খুন করে ফেলতে এসেছিল; কিন্তু মানুষটাকে দেখে তা যেন বোঝা যেত না। তিন বছর বয়েস পর্যন্ত মা’র সঙ্গে মাসির সঙ্গে কাটিয়েছে, তারপর আর দেখা হয়নি। মা তাকে দূরে পড়তে পাঠিয়েছে। ইস্কুলে।

তারপর থেকে আর বাড়ি কাকে বলে তা জানি না দিদি। কাকে বলে ভাই, কাকে বলে বোন তাও জানি না। তাই এই যে কদিন তোমরা আছ এখেনে, মনে হচ্ছে যেন নিজের দেশেই আছি, নিজের বাড়িতেই আছি। আমার তাই খুব ভাল লাগছে দিদি, তোমরা চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে

দুর্গা বললে–আমাদেরও তো তেমন খারাপ লাগত না বাবা—কিন্তু

 কিন্তু কী?

কিন্তু তোমরা যে বাবা ম্লেচ্ছ, তোমরা যে বাবা মোছলমানদের মতো গোরু খাও, গোরু খৈলে আর কেমন করে থাকি বাবা তোমাদের এখেনে–

বিফ? তোমরা বিফ খাও না?

দুর্গা বললেও নাম কোরো না বাবা, শুনলে আমার মেয়ে বমি করে ফেলবে।

তা বিফ আমি খাব না। তোমরা যদি চাও আমি গোরুর মাংস খাওয়াও ছেড়ে দিতে পারি, আমার কোনও অসুবিধে হবে না দিদি। আমি ফিশ খাব, আমি এগস খাব, ফাউলকারি, চিকেনকারি…

মুরগি? না বাবা, ও সব মোছলমানেরা খায়, আমরা ওসব খাইনে–

সাহেব বললে–তোমরা ফাউল-চিকেন কিছুই খাও না? তা হলে মাটন? মাটন খাও তো? আমি তাই-ই খাব–

না বাবা, তা কেন খাবে না। আমাদের জন্যে তুমি কেন অত কষ্ট করতে যাবে? আমরা দু’দিন আছি, দুদিন পরেই চলে যাব আমাদের সঙ্গে তোমার কীসের সম্পর্ক বাবা?

সাহেবের মুখটা যেন কেমন ম্লান হয়ে গেল।

বললে–ঠিক আছে, আমি তো তোমাদের ওপর জোর করতে পারি না

দুর্গা বললে–আমি তো সে কথা বলিনি বাবা। আমাদের কপালে যেকদিন কষ্ট আছে সে ক’দিন তো এখেনে থাকতেই হবে। আমাদের জন্যে তোমারও তো কষ্ট হচ্ছে, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

না দিদি, আমার কোনও কষ্ট নেই, তোমাদের যদি কষ্ট না হয় তো আমার কিছু কষ্ট নেই। একদিন তোমরা থাকাতে তবু হোম-লাইফ এনজয় করতে পাচ্ছি

দুর্গা বললে–তা যদি বললো তা হলে ওই ছাইপাঁশগুলো আর কেন খাও?

 কীসের কথা বলছ?

ওই যে মদ! কী বিটকেল গন্ধ বেরোয় রোজ

কেন? মদ তো আমরা সবাই খাই। আমার বাবা তো পিপে-পিপে মদ খেত

তা খাক, আমার মেয়ের বাপু বমি আসে ওই গন্ধ নাকে গেলে!

সাহেব বললে–তাই নাকি? তা এতদিন বলোনি কেন? আগে জানলে আমি খেতাম না দিদি

না বাছা, খেয়ো না তুমি। ও কি ভদ্দরলোকে কেউ খায়? আমাদের গাঁয়ের ছোটলোকেরা খায় ওসব, খেয়ে বাড়িতে এসে বউদের গালাগাল দেয় আর মারধর করে

সাহেব বললে–তা বেশ তো খাব না, তোমাদের যদি খারাপ লাগে তো তাও খাব না, প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে, কিন্তু হোক কষ্ট, না-খেলে তোমরা থাকবে তো?

ওমা, দুর্গা বললে–তা কি কথা দিতে পারি বাছা! আমরা আমাদের ঘর-সংসার ছেড়ে তোমার বাড়িতে পড়ে থাকব সেকথা কেমন করে দেব?

না না, তা আমি বলছি না। তোমাদের বাড়ি যাবার বন্দোবস্ত তো আমিই করে দেব, তোমাদের বাড়িতে না-পাঠিয়ে কি চিরকাল তোমাদের আটকে রাখব? সেকথা তো আমি বলিনি।

সত্যিই কর্নেল ক্লাইভের সেক’দিন কেমন মনে হয়েছিল ওরা তার বাড়িতে থাকলেই যেন ভাল হয়। নবাবের সঙ্গে ওয়ার-ফেয়ার করতে এসে এ কী হল তার। তবে কি সে ছোটবেলা থেকে যে ফ্যামিলি লাইফের আস্বাদ পায়নি, এ সেই ফ্যামিলি-লাইফের লোভ?

কথা বলতে বলতে কখন যে দেরি হয়ে গিয়েছিল তার খেয়াল ছিল না। উমিচাঁদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের সঙ্গে, সেকথাটাও বেবাক ভুলে গিয়েছিল। খেয়াল হতেই উঠে পড়ল। বললে–উঠি দিদি, একটা কাজের কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম

কিন্তু কলকাতার কেল্লায় গিয়ে শুনলে, ওয়াটসন তার জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে করে শেষকালে নাকি একলাই বেরিয়ে গিয়েছে। রবার্ট আর নামল না ঘোড়া থেকে। সোজা চলল হালসিবাগানের দিকে। বন-জঙ্গল ঢাকা রাস্তা, উমিচাঁদের বাড়িটাও এমন জায়গায় করেছে যে সহজে যাওয়া-আসার উপায় নেই। ফিরিঙ্গিদের ছোঁয়াচ এড়িয়ে আছে। অনেকদিন ওয়াটসন বলেছে লোকটাকে বিশ্বাস করা উচিত নয়।

ক্লাইভ বলেছিল–উমিচাঁদ যদি আমাদের কাজে লাগে তো বিশ্বাস করতে আপত্তি কী?

না রবার্ট, ইন্ডিয়ানদের বিশ্বাস কোরো না, ডোন্ট বিলিভ দেম, দে আর লায়ার্স!

এইসব কথা শুনলেই ক্লাইভের রাগ হয়ে যেত। ইন্ডিয়ানরা সবাই লায়ার, এটা হতে পারে না। মিথ্যেবাদী সত্যবাদী সব দেশেই আছে। সমস্ত জগতটাকেই একেবারে লায়ার বলে দোষ দিচ্ছ কোন অপরাধে?

এই যে নবাব সকলকে বারণ করে দিয়েছে ইংরেজদের যেন কেউ জিনিসপত্র না বেচে, কিন্তু সবাই তো এসে লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের চাল-ডাল-মাছ-মাংস বিক্রি করে যায়! লন্ডনে কোম্পানির হেড অফিস থেকে কেবল চিঠি আসছিল–তোমরা বেঙ্গল ছেড়ে চলে এসো। ওখানে তোমাদের আর থেকে কোনও লাভ নেই। আমাদের অকারণে অনেক টাকাকড়ি নষ্ট হচ্ছে, আর নষ্ট কোরো না।

উমিচাঁদের বাড়ির সামনে আসতেই গেটের দারোয়ানটা সেলাম করলে।

ওয়াটসন সাব আয়া হ্যায়?

জি হাঁ।

দরোয়ানটা ফিরিঙ্গি কোম্পানির সাহেব দেখলে একটু বেশি খাতির করে। একেবারে সোজা টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। বিরাট গদি-পাতা আসর উমিচাঁদের। লোকটা মালটি-মিলিওনেয়ার। আগে কখনও আসেনি ক্লাইভ এ বাড়িতে। কিন্তু শুনেছিল সব। চারদিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। এত বড় বাড়ি, এত ট্রেজার উমিচাঁদের!

কী দেখছ সাহেব?

ক্লাইভ বসল গদিতে। বললে–তুমি খুব রিচ লোক আমি জানতুম, কিন্তু এত রিচ জানতুম না–

উমিচাঁদ সেকথার ধার দিয়ে গেল না। বলল-ইচ্ছে করলে তোমরাও আমার মতো বড়ুলোক হতে। পারো

কী করে?

আমি যেমন করে হয়েছি।

কী করে বড়লোক হয়েছ তুমি?

উমিচাঁদ দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললে–সেই কথাই তো এতক্ষণ বলছিলুম তোমার ফ্রেন্ডকে। কিন্তু একটা কথা কর্নেল ক্লাইভ, তুমি কি সত্যিই বড়লোক হতে চাও? মালটি-মিলিওনেয়ার হতে চাও?

অ্যাডমিরাল চুপ করে বসে ছিল একপাশে। রবার্ট তার দিকে চাইলে।

তা হলে এ-দেশের মেয়েমানুষের দিকে নজর দিয়ো না। আগে ঠিক করে নাও, টাকা চাও, না মেয়েমানুষ চাও–এ-দেশে টাকা দিলে অনেক মেয়েমানুষ পাবে। যেমন নবাববাদশারা টাকা দিয়ে হারেমের মধ্যে মেয়েমানুষ কিনে রেখেছে। কিন্তু টাকা উপায় করতে গেলে আমার মতো হতে হবে

ক্লাইভের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল হঠাৎ। বললে–হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট? তুমি কী বলতে চাও বুঝিয়ে বলল।

তুমি তোমার ক্যাম্পে মেয়েমানুষ পুষেছ শুনলুম! কে বললে? ওয়াটসন? অ্যাডমিরাল ওয়াটসন তখনও চুপ করে বসে ছিল একপাশে। ক্লাইভ তার দিকে চাইলে। মিস্টার উমিচাঁদ, অন্য কেউ একথা বললে–আমি তাকে আমার বন্দুক দিয়ে গুলি করে মারতুম। কিন্তু তুমি ইংরেজ কোম্পানির ফ্রেন্ড, বেঙ্গলের নবাবেরও ফ্রেন্ড, তাই কিছু বললুম না, অন্য কথা বলো, লেট আস কাম টু আওয়ার ওয়র্ক

বলে রাগে গোঁ গোঁ করে ফুলতে লাগল ক্লাইভ। মনে হল যেন জীবনে কখনও এত রেগে ওঠেনি সে। ইন্ডিয়ায় আসার পর থেকেই বরাবর দেখে আসছে, এখানকার ইংলিংশম্যানেরা যেন অন্য রকম। এখানে তারা নিজের দেশকে যেন সবাই ছোট করে।

বললে–তোমরা সবাই লেডিদের যে-চোখে দেখো আমি সে-চোখে দেখি না। উমিচাঁদ বললে–আমরা কী চোখে দেখি?

ক্লাইভ বললে–শুধু তুমি কেন? এই ওয়াটসন, এও একজন ক্রিশ্চান, জেসাস ক্রাইটের ফলোয়ার, সানডেতে চার্চে যায়, এও লেডিদের অনার করে কথা বলতে জানে না। আমার ক্যাম্পের পাশে দু’জন লেডিকে আমি শেলটার দিয়েছি, দে আর হেলপলেস, তাদের রিলেটিভদের কাছে তারা যেতে পারছে না। দে আর ইন্ডিয়ান, কিন্তু ইন্ডিয়ান তো তাদের আশ্রয় দেয়নি। আমি কি তাদের আটকে রেখেছি বলতে চাও? অ্যাম আই সো মিন? যেদিন তারা নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় পাবে, সেইদিনই আমি তাদের সেখানে পাঠিয়ে দেব

উমিচাঁদ এবার কৌতূহলী হয়ে উঠল।

কে তারা?

ক্লাইভ বললে–আই ডোন্ট নো৷ আমি জানি না। আমি তাদের জিজ্ঞেসও করিনি—

তোমার কাছে তারা এল কী করে?

দে ওয়্যার স্ট্র্যান্ডেড। আমি আমার সেপাই হরিচরণকে তাদের দেখাশোনা করবার জন্যে রেখে দিয়েছি। ওরা কেষ্টনগরে যেতে চেয়েছিল, সেখানেও যেতে পারেনি ফ্রেঞ্চদের ভয়ে, তারা হাতিয়াগড় যেতে চেয়েছিল, সেখানেও

হাতিয়াগড়?

উমিচাঁদ যেন হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে উঠল।

ক্লাইভ বললে–হ্যাঁ, হাতিয়াগড়।

হাতিয়াগড়ে যেতে চেয়েছিল কেন?

আই ডোন্ট নো। শুনেছি সেখানে তাদের রিলেটিভস আছে। কিন্তু আই ডোন্ট বদার আইদার। আমি শুধু ওদের সেফটির জন্যে আমার কাছে রেখে দিয়েছি। আমি জানি তোমাদের নবাব একজন লেডিকিলার, যদি একবার কোনওরকমে তোমাদের বিস্টলি নবাবের হাতে এরা পড়ে তো–দি ইয়ং লেডি উইল বি রেপড হি উইল মেক এ বেগম অব হার–ওকে বেগম বানিয়ে ছাড়বে।

তারপর একটু থেমে বললে–তুমি কি মনে করো ওদের আমি মিছিমিছি আমার কাছে রেখেছি?

এতক্ষণ অ্যাডমিরাল ওয়াটসন চুপ করে বসে ছিল। বললে–রবার্ট, ওসব কথা থাক, লেট আস কাম টু আওয়ার ওয়র্ক। উমিচাঁদসাহেব বলছে নবাবের সঙ্গে আমাদের মিটমাট করিয়ে দেবে।

মিটমাট করে কী হবে?

অ্যাডমিরাল ওয়াটসন বললে–কিন্তু কতদিন এভাবে আমরা থাকতে পারব এখানে? কেউ আমাদের সঙ্গে কারবার করছে না। আমাদের মার্কেট কোথায়? শুধু ফোর্ট দখল করলেই চলবে? আমাদের এখানে থাকা-খাওয়া আমি মেনটেন করার খরচ নেই? আমাদের কোম্পানির হেড অফিস। থেকে চিঠি লিখছে বেঙ্গল ছেড়ে চলে আসবার জন্যে। শেষকালে কোথায় টাকা পাব?শ্যাল উই স্টার্ভ?

ক্লাইভ বললে–কিন্তু আমি তো এখানে হারবার জন্যে আসিনি—

কে বলছে আমরা হেরেছি? আমরা তো জিতেছি।

ক্লাইভ বললে–একে জেতা বলে না। আমি একেই বলি হার। ওরা আমাদের বিজনেস বয়কট করলে আমাদের হারই হল–

কিন্তু মিটমাট করতে তোমার আপত্তিটা কী?

ক্লাইভ বললে–এখন মিটমাট করতে গেলে নবাব আমাদের টার্মস ডিক্টেট করবে। যেসব শর্ত দেবে তাতে সই করা আর লড়াইতে হেরে যাওয়া একই কথা।

অ্যাডমিরাল ওয়াটসন মিস্টার উমিচাঁদের দিকে চাইলে।

 বললে–আপনার কী মত মিস্টার উমিচাঁদ?

উমিচাঁদ বললে–নবাব আমাকে বিশ্বাস করে। আপনারা যদি চান মিটমাট হোক, তাও করিয়ে দিতে পারি, আবার আপনারা যদি চান নবাবকে লড়াইতে নামিয়ে দিতে, তাও করিয়ে দিতে পারি। আমি সব করিয়ে দিতে পারি–কোনটা চান আপনারা বলুন।

ওয়াটসন বললে–আমি মিটমাট চাই–

উমিচাঁদ বললে–মিটমাট করে আপনাদের আগেকার কারবার চালাতে চান?

হ্যাঁ! নইলে আমাদের অনেক লস হচ্ছে!

উমিচাঁদ বললেও মিটমাট করিয়ে দিতে পারলে আমি কী পাব? আমায় কত টাকা দেবেন বলুন?

ওয়াটসন রবার্টের মুখের দিকে চাইলে।

ক্লাইভ বললে–আমি চাই ওয়ার, আমি নবাবের সঙ্গে ফাইট করতে চাই

উমিচাঁদ বললে–আমি তাও করিয়ে দিতে পারি। করালে আমায় কত টাকা দেবেন বলুন? আমি কারবারি লোক, কারবার করে খাই, নাফা ছাড়া আমি কিছু বুঝি না

ক্লাইভ চুপ করে শুধু কথাটা শুনল। কিছু কথা বললে–না।

ওয়াটসন উমিচাঁদকে জিজ্ঞেস করলে টেল মি হোয়াট ইজ ইয়োর ডিম্যান্ড–আপনার কত দাবি সেটা বলুন আগে

উমিচাঁদ হঠাৎ উঠল। বললে–বলছি, তার আগে আমি একটু পাশের ঘর থেকে আসছি বলে পাশের ঘরে উঠে গেল উমিচাঁদ সাহেব।

ক্লাইভ দাতে দাঁত চেপে বললে–নাম্বার ওয়ান স্কাউলে–

অত চেঁচিয়ে বোলো না রবার্ট! লোকটাকে এখন আমাদের কাজে লাগাতে হবে! একবার ওকে আমরা প্রিজনার করেছিলাম, দরকার হলে না-হয় আবার ওকে জেলে পুরব। কিন্তু ওকে চটিয়ে লাভ কী। এখন ওকে আমরা হাতের মুঠোয় রাখতে চাই। হি ইজ এ মালটিমিলিওনেয়ার

পাশের ঘরে ফকিরটা তখনও লুকিয়ে ছিল। উমিচাঁদ সাহেব কাছে যেতেই বললে–ওরা ভেগে গেছে নাকি সাহেব?

না, ওদের বসিয়ে রেখে দিয়ে এসেছি। তোকে একটা কাজ করতে হবে।

কী কাজ?

ওরা এখানে থাকতে থাকতে তোকে দেখে আসতে হবে বরানগরে গিয়ে যে, ক্লাইভ সাহেবের ছাউনিতে আওরাত দু’জন কে?

আওরাত?

হ্যাঁ রে, হ্যাঁ, জেনানা! কাদের লুকিয়ে রেখেছে ফিরিঙ্গিটা, সেটা খোঁজ নিয়ে এসে আমাকে বলবি। তারপরে মেহেদি নেসার সাহেবের কাছে যাস!

কিন্তু তা হলে যে আমার দেরি হয়ে যাবে!

দেরি হলে মেহেদি নেসার সাহেবের কাছে আমার নাম করিস। তুই ওই দিকের দরজাটা দিয়ে সোজা বরানগরে চলে যা!

ফকিরটা সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছিল। উমিচাঁদ সাহেব থামিয়ে দিলে। বললেদূর বেত্তমিজ, ফকির সেজে যাসনি। হিন্দুদের মতো সাধুসগ্নেসি সেজে যা!

এখন সাধু কী করে সাজব! গেরুয়া কোথায় পাব? কমণ্ডলু কোথায় পাব? ওদের হরিনামের মালা কোথায় পাব?

উমিচাঁদ চুপি চুপি ধমকে উঠল। বললে–একেবারে বেল্লিক একটা তুই, মেহেদি নেসার বাজে লোককে চরের নোকরি দিয়েছে। আমি তো হিন্দু রে! আমার বাড়িতে তো সব আছে। গেরুয়া,কমণ্ডলু, হরিনামের মালা-বলে বোধহয় ওইসব আনতেই ঘরের বাইরে চলে গেল উমিচাঁদ সাহেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *