২.০৮ হালসিবাগানের উমিচাঁদ

সেদিন হালসিবাগানের উমিচাঁদ সাহেবের বাড়িতে যে-ঘটনা তখন ঘটেছিল মুর্শিদাবাদের মতিঝিলের মধ্যেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। সেই আত্মপ্রতিষ্ঠা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইন্ডিয়াতে এসে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল কারবার করে। মুর্শিদাবাদের নবাবও আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল নতুন পাওয়া মসনদের ওপর নিজের অধিকার পাকা করে। উমিচাঁদ সাহেবও আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। তার ফিরে পাওয়া ঐশ্বর্যের ওপর অধিষ্ঠিত হয়ে।

পৃথিবীর ইতিহাস এই আত্মপ্রতিষ্ঠারই ইতিহাস। একজন আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে, আর আশপাশের দশজন তাকে হয় সাহায্য করে নয়তো বাধা দেয়। কোনও সাহায্য উপকারে লাগে, আবার কোনও বাধা দুর্লঙঘ হয়ে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

নবাব মির্জা মহম্মদের যেন নতুন করে চোখের দৃষ্টি খুলে গেল। তা হলে কি কাউকেই বিশ্বাস করবার উপায় নেই সংসারে? একজনকে ধ্বংস করে মুক্ত হতে-না-হতে আর একজন শত্রু ওদিক থেকে গজিয়ে ওঠে।

নানিবেগম লক্ষ করছিল সমস্ত। মির্জার কথায় কিন্তু আশ্চর্য হল না। মির্জার সামনে নিচু হয়ে বসল।

বললে–ভেবে আর কী করবি মির্জা, চল আজকে চেহেল্‌-সুতুনে থাকবি চল

চেহেল্‌-সুতুনে আগে থেকেই সাড়া পড়ে গিয়েছিল। নবাব চেহেল্‌-সুতুনে আসবে শুনলেই সব আবহাওয়াটাই যেন বদলে যায়।

পেশমন বেগম খবরটা শুনেই সাজগোজ আরম্ভ করে দিয়েছিল। ময়মানা বেগম নতুন এসেছে। তার ঘর, তার আসবাব সবকিছুর ব্যবস্থা করতে হয়েছে পিরালি খাঁ-কে। সমস্ত দিন তাই নিয়েই কেটে গেছে, তারপর হঠাৎ খবর এল নবাব আসবে চেহেল্‌-সুতুনে।

রাত তখন হয়নি ভাল করে। চকবাজারে দোকানে দোকানে আলো জ্বলে উঠেছে। পিলখানা থেকে হাতির দল চরতে বেরিয়েছিল গঙ্গার ধারে। তারা সব দলে দলে ফিরে আসছে। সারাফত আলি দোকান খুলে আগরবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গড়গড়ায় তামাকুর ধোঁয়া টানতে শুরু করেছে। হঠাৎ বাইরে নবাবের তাঞ্জাম দেখে যেন নেশা কেটে গেল।

বাদশা!

বাদশা আসতেই সারাফত আলি জিজ্ঞেস করলে–ও কার তাঞ্জাম রে? নবাবের না?

বাদশা বললে–জি হাঁ জনাব!

গড়গড়ার নল থেকে আরও লম্বা লম্বা ধোয়া টেনে সারাফত আলি নিজের রাগ চেপে রাখবার চেষ্টা করলে।

জিজ্ঞেস করলেও বাঙালিবাচ্চা কাহা—

বাদশা বললে–অন্দরে আছে

ডাক ওকে ডাক—

এসময় সাধারণত ডাকে না সারাফত আলি। তাই কান্ত একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। কান্ত আসতেই মিঞাসাহেব জিজ্ঞেস করলে–কী করছিলি কান্তবাবু?

এমনি শুয়ে ছিলুম!

তোর কাজ কাম কিছু নেই? কেবল শুয়ে থাকবি দিনরাত? কী হয়েছে তোর?

কান্ত বললে–আমার কিছু ভাল লাগছে না মিঞাসাহেব।

তবিয়ত খারাপ?

কান্ত বললো হ্যাঁ

কেন? আরক খাবি?

কান্ত ভয় পেয়ে গেল। বললে–না মিঞাসাহেব, না–কদিন বিশ্রাম নিলেই ভাল হয়ে যাবে। আরক খাবার দরকার নেই

ততক্ষণ রাস্তার ওপর দিয়ে আগে আগে হাতির দল সার সার চলেছে। তার পেছনে দুটো তাঞ্জাম। পেছনে আবার হাতির সার। সমস্ত চকবাজারের রাস্তার ভিড় সরাতে সরাতে চলেছে হুকুমবরদার।

পেছনে কার তাঞ্জাম রে বাদশা?

নানিবেগমসাহেবার!

হুম! সারাফত আলি সাহেব নিজের মনের ভেতরেই যেন নিঃশব্দে গুমরে উঠল। হাজি আহম্মদের ঘরানা এখনও মিঞাসাহেবের কলিজা মাড়িয়ে মাড়িয়ে চলেছে। বহু দিনের মনের রাগ যেন বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। দিনের পর দিন এই খুশবু তেলের দোকানের সামনে দিয়েই নবাব এসেছে-গেছে। কখনও গেছে কলকাতায় ফিরিঙ্গি কোম্পানির সঙ্গে লড়াই করতে, কখনও গেছে পূর্ণিয়ায় শওকত জঙের সঙ্গে লড়াই করতে। প্রত্যেক বারই লড়াই ফতেহ করে নবাবি ফৌজ বুক ফুলিয়ে মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছে। আর সারাফত আলির বুকখানা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। আর কতদিন ইস্তিজারি করবে সে!

কান্তও দেখছিল জলুসটা। নবাব তো মতিঝিলেই থাকত বরাবর। হঠাৎ আবার চেহেল্‌-সুতুনে চলেছে কেন? তা হলে মরালী কোথায় গেল? মরালীকে কি ছেড়ে দিয়েছে নবাব? কদিন থেকেই চকবাজারে বড় গোলমাল চলছিল। বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিল কান্ত, যদি সত্যি সত্যিই মরালীর ফাঁসি হয়ে যেত! ভাগ্যিস মরালী ডেকে পাঠিয়েছিল তাকে। ভাগ্যিস কান্ত ঠিক সময়ে গিয়ে পড়েছিল। নইলে মেহেদি নেসার কী করত কিছু বলা যায় না!

সকালবেলা যখন হঠাৎ তাকে কোতোয়াল ছেড়ে দিলে তখনও বুঝতে পারেনি। নবাব নিজে তাকে দেখে ফেলেছে। অথচ নিজের জীবন দিয়েই সে বাঁচাতে গিয়েছিল মরালীকে। মরালীকে বাঁচাতে গিয়ে সে হয়তো মেহেদি নেসারের হাতেই খুন হয়ে যেত। খুন যে হয়নি সে তার কপাল।

তারপর মতিঝিলে যাবার সময় পুরকায়স্থ মশাইও তাকে দেখতে পেয়েছিল। হাতে হাতকড়া বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। নেয়ামত যখন তাকে চলে যেতে বললে–তখন যেন বিশ্বাসই হয়নি।

কেন? আমাকে ছেড়ে দিলে কেন নবাব?

নেয়ামত বলেছিল–মরিয়ম বেগমসাহেবা নবাবকে বলে আপনাকে ছাড় করিয়ে নিয়েছে।

 মরিয়ম বেগমসাহেবা?

যেন কথাটা বিশ্বাস করবার মতো নয়। প্রথমটা তাই একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিল কান্ত। কিন্তু তারপর আর ভাববার সময় পায়নি। কোতোয়ালের পাহারাদাররা হাতের বাঁধন খুলে দিতেই সিঁড়ি দিয়ে নীচেয় নেমে এসে একেবারে পুরকায়স্থ মশাইয়ের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাইও হঠাৎ এই ব্যাপারে বোধহয় আকাশ থেকে পড়েছিল।

কী বাবাজি, তুমি কি শেষকালে এই কাজ করলে?

কান্তর মনটা ভাল ছিল না। তবু জিজ্ঞেস করলে–কী কাজ?

ওরা না হয় ম্লেচ্ছ, শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়ে না-হয় চরিত্রটি খারাপ করে বসেছে, তা বলে তুমি কেন বাবাজি এসব শ্লেচ্ছ কাণ্ডের মধ্যে এলে? তুমি তো ভদ্রসন্তান বলে জানতুম।

ওদিক থেকে কার যেন পায়ের শব্দ এল। আর কথা বলবার সাহস হল না। নবাব মতিঝিলে এসেছে। বলে মুর্শিদাবাদের আমির-ওমরাও সবাই তটস্থ হয়ে উঠেছে। লোকজন, সেপাই-সাত্ত্বি, খিদমদগার, হুকুমবরদার, সবাই এদিক-ওদিক করছে। তার মধ্যে কখন কে দেখে ফেলবে তখন আরও মুশকিলে পড়বে। তাই বেশিক্ষণ আর দাঁড়ায়নি সেখানে। সোজা ফটক পেরিয়ে রাস্তায় চলে এসেছিল। তারপর সেখান থেকে সেই যে সে নিজের ঘরে এসে ঢুকেছে আর বেরোয়নি।

সত্যিই তো, কেন সে এখানে এখনও পড়ে আছে। এর চেয়ে তো নিজের দেশে চলে গেলেই পারত। সেখানে হয়তো কলকাতার মতো জাঁকজমক নেই, মুর্শিদাবাদের মতোনবিআনা নেই, কিন্তু শান্তি তো আছে।

হঠাৎ বশির মিঞা এসে হাজির হল।

এই ইয়ার, এদিকে আয়।

কান্ত দোকান থেকে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। তখনও জলুসটা চলেছে চেহেল্‌-সুতুনের দিকে।

 কাছে যেতেই বশির বললে–আয় আমার সঙ্গে, একটা বাত আছে—

বলে রাস্তার এক কোণে নিয়ে গেল। সমস্ত লোকজন তখন হাঁ করে জলুস দেখছে। বশির এক ধারে টেনে নিয়ে গিয়ে বললে–তোর নামে সব কী শুনলুম? তুই কী করেছিস?

কান্ত বললে–রানিবিবি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল কোতোয়ালিতে, তাই গিয়েছিলুম।

কে ডেকেছিল তোকে?

 রানিবিবি। সফিউল্লা খাঁ সাহেবকে যে খুন করেছিল।

কাকে দিয়ে ডেকেছিল? তাকে চিনিস?

না।

তাকে চিনিয়ে দিতে পারবি?

না, ভাল করে চিনে রাখিনি।

বশির মিঞা যেন খুব চিন্তিত হয়ে উঠেছে। বললে–শালার সব গোলমাল হয়ে গেল। হইচই পড়ে গেছে চারদিকে। তোর নোকরি হয়তো আর রাখতে পারব না। তবে কোশিস করব। তুই কিছু। ঘাবড়াসনি।

কথাটা শুনে কান্ত মুখ ফেরাল।

আমার চাকরি চলে যাবে? কেন?

তুই কী সব লটঘট করেছিস মেহেদি নেসার সাহেবের সঙ্গে। আমার ফুপা মনসুর আলিকে মেহের সাহেব বলছিল। আমি হাতিয়াগড়ে গিয়েছিলুম ডিহিদারের সঙ্গে দেখা করতে, এর মধ্যে তামাম সব কুছ বদলে গেছে!

কান্ত বললে–আমিও আর চাকরি করব না ভাই। এ চাকরি করার ইচ্ছেও আমার নেই

কেন, চাকরি করবি না তো খাবি কী?

খাবার ভাবনা নেই আমার। বুড়ো মিঞাসায়েব যতদিন আছে ততদিন আমাকে সেই খাওয়াবে। আর তা ছাড়া মুর্শিদাবাদ আমার আর ভালও লাগছে না, আমি দেশে চলে যাব, বড়চাতরায় সেখানে আমাদের বাবুদের সেরেস্তায় একটা যা-হোক কাজ জুটিয়ে নেব।

তারপর একটু থেমে বললে–শুধু একটা কারণের জন্যে যেতে পারছি না–

কী?

ওই রানিবিবির জন্যে।

মরিয়ম বেগম?

হ্যাঁ।

 মরিয়ম বেগমসাহেবার জন্যে তোর কী পরোয়া?

মরিয়ম বেগমসাহেবার যদি ফাঁসি হয়ে যায়? শুনছি ফাঁসি হবে নাকি?

 বশির জিজ্ঞেস করলে-ফাঁসি হলে তোর কী? মরিয়ম বেগম তোর কে? তোর বিবি না তোর জরু?

ওকথা বলিসনি! তুই তো জানিস, আমিই মরিয়ম বেগমকে চেহেল্‌-সুতুনে এনে দিয়েছি! আমিই তো তার জবাবদার। মরিয়ম বেগমসাহেবার যদি ফাঁসি হয় তো তার জবাবদারি তো আমারই।

কে তোর জবাব চাইবে? কাজিসাহেব, না কোতোয়াল, না নিজামত!

ওদের কথা ছেড়ে দে! আমার বিবেক বলে কিছু নেই, মাথার ওপর ভগবান বলে কেউ নেই বলতে চাস? স্বর্গে গেলে আমার কাছে জবাবদহি চাইবে না ভগবান?

বশির মিঞা হেসে উঠল।

রেখে দে তোর ইমানদারি! ইমানদারি নিয়ে ধুয়ে খাবি? ইমানদারি নিয়ে দুনিয়া কখনও চলে? কখনও চলেছে? ইমানদারিতে দিল্লির বাদশাগিরি চলছে? ইমানদারিতে নিজামত চলছে?

কান্ত বললে–ইমানদারি না থাকলে কিছুই চলবে না জেনে রাখিস। এই তোর নিজামতিও চলবে । ইমানদারিই হচ্ছে আসল জিনিস। ইমানদারি আছে বলে এখনও আকাশে চন্দ্র সূর্য উঠছে, ইমানদারি আছে বলেই এখনও তুই-আমি সবাই বেঁচে আছি।

দুর গাধা কোথাকার! তুই কিচ্ছু জানিস না।

কান্ত বললেও নিয়ে তোর সঙ্গে তর্ক করতে চাই না ভাই। তুই কী বলতে এসেছিলি, বল

বশির বললেনা রে, তোর ভয় নেই, তোর পেয়ারের রানিবিবির ফাঁসি হবে না।

হবে না? কেন?

নবাব খুদ নিজে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল, দেখলি না? ওই যে জলুস গেল? সামনের তাঞ্জামে নবাব আর পেছনের তাঞ্জামে নানিবেগম আর মরিয়ম বেগমসাহেবা। রানিবিবির মুসিব্বতটা ভাল রে ইয়ার, এক ঝটকায় নবাবের নেকনজরে পড়ে গেছে।

তা হলে ফাঁসি হবে না আর?

ফাঁসি হবে কী রে! হলে কোতোয়াল সাহেবের ফাঁসি হবে, মেহেদি নেসার সাহেবের ফাঁসি হবে, ইয়ারজান সাহেবের ফাঁসি হবে, তামাম মুর্শিদাবাদের সকলের ফাঁসি হতে পারে। লে মরিয়ম বেগমসাহেবার কৌন ফাঁসি দেবে?

তারপর একটু গলাটা নিচু করে বললে–তোর কাছে যে-জন্যে এসেছি তাই বলি–উমিচাঁদ সাহেবের কাছে যেতে পারবি? কলকাতায়, হালসিবাগানে?

কেন?

মেহেদি নেসার সাহেব উমিচাঁদ সাহেবের কাছে আদমি পাঠিয়েছিল, সে এখনও ফিরে আসছে না। খবর মিলছে না কিছু। তুই যেতে পারবি?

কে সে? কোন লোক? কাকে পাঠিয়েছিল?

দরবার খাঁ, ফকির সেজে গিয়েছিল উমিচাঁদ সাহেবের কাছে।

কেন গিয়েছিল?

সে তোর জানবার দরকার কী? তুই শুধু জেনে আসবি দরবার খাঁ বলে কোনও লোক ফকিরের পোশাকে উমিচাঁদ সাহেবের হাবেলিতে ঢুকেছে কি না।

কান্ত বললে–সে আমাকে বলবে কেন?

তুই মেহেদি নেসার সাহেবের পাঞ্জা নিয়ে যাবি। তোর ডর কী? তুই উমিচাঁদ সাহেবকে মেহেদি নেসার সাহেবের পাঞ্জা দেখাবি, তা হলেই বলবে সব।

চলতে চলতে অনেক দূর চলে এসেছিল দু’জনে। নবাবের তাঞ্জামের জলুস তখন চেহেল্-সুতুনে ঢুকে পড়েছে। হাতির দল চেহেল্‌-সুতুন থেকে বেরিয়ে আবার মতিঝিলে চলে গেছে। রাস্তার ধারে সেই গণতকারটা একমনে কার হাত দেখছিল আর পাথরের ওপর কী ব লিখছিল।

কান্ত বললে–ওই দেখ, ওকে কাল আমার হাত দেখিয়েছিলুম রে—

বশির মিঞাও দেখলে। বললে–ওর কাছে গিয়েছিলি কেন?

মনটা খারাপ ছিল খুব। ভাবছিলাম জীবনে তো কিছুই হল না। কলকাতার সেই বেভারিজ সাহেবের গদিতে জীবন শুরু হয়েছিল, কত আশা ছিল জীবনে তখন। তারপর এখানে চলে এলাম। বিয়ে করতে গিয়ে গণ্ডগোল হয়ে গেল। তাই ভাবলাম হাতটা দেখাই। দেখি না ভাগ্যে কী লেখা আছে। গিয়ে দেখালাম

কী বললে?

বললে, যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবার কথা ছিল, তার সঙ্গেই আমার নাকি আবার বিয়ে হবে ভাই।

আর কী বললে? আর কিছু বলেছে?

আর বললে, জলই আমার শত্রু। কখনও যেন জলের কাছে আমি না যাই।

 বশির মিঞা বললে–একবার তো জলে ডুবে গিয়েছিলি তুই?

ডুবে যাইনি ঠিক। বর্গিদের হামলার সময় আমি বুড়িগঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিলুম। প্রায় ডুবে যেতুম। অনেক কষ্টে সুতোনুটির ঘাটে উঠেছিলুম, তাই বেঁচে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে না-হয় হল। না-হয় নৌকোয় কখনও যাব না। কিন্তু একবার যার অন্য লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে, তার সঙ্গে আবার বিয়ে হবে কী করে? তোদের মতো আমাদের হিন্দুদের তো নিকে হয় না। তালাকও হয়

দুর, ওসব বুজরুকি। ও-লোকটা বুজরুক। ওসব নিয়ে কিছু ভাবিসনি।

 কান্ত বললে–ভাবব না তো ভাবি, কিন্তু ভাবনাটা কিছুতেই যে মন থেকে দূর করতে পারি না!

কেন, তুই কি এখনও তার কথা ভাবিস?

কান্ত বললো, ভাবি, কেবল ভাবি

তা হলে এক কাজ কর না। যে-লোকটার সঙ্গে তার সাদি হয়েছে সে তো পাগলা। তাকে তো তার বউ তাড়িয়ে দিয়েছে। সেদিন মোল্লাহাটিতে আমার সঙ্গে উদ্ধব দাসটার দেখা হল তো। সে নিজেই তো বললে–তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে তার বউ, তার সঙ্গে দেখাই করেনি। তা তুই কলমা পড়ে মোছলমান হয়ে যা না! হবি?

মুসলমান হব?

 হনা। হতে দোষ কী! হলে তো তোর নোকরিরও সুবিধে হবে, সাদিরও সুবিধে হবে। উদ্ধব দাসের বউও মুসলমান হবে, তুইও মুসলমান হবি, হয়ে আবার সাদি করবি তোরা। তুই তো কলকাতায় যাচ্ছিস উমিচাঁদ সাহেবের হাবেলিতে। ওখান থেকে কামটা সেরে সোজা বরানগরে যাবি, গিয়ে বলবি তোর বউকে মোছলমান হতে! আর আমি এদিকে মওলভি সাহেবকে ভি সব বলে ঠিক করে রাখব। কিছু ভাবিসনি, যা। মন খারাপ করিসনি। যা, আমার কাজ আছে আমি চললুম।

কান্ত তখনও কিছু কথা বলছিল না।

বশির মিঞা বললে–কী রে, সব বন্দোবস্ত তো করে দিলুম, আবার কী ভাবছিস?

কান্ত হঠাৎ বললে–আচ্ছা, মরিয়ম বেগমসাহেবাকে যে আজকে নবাব চেহেসতুনে নিয়ে গেল, এর মতলবটা কী? কী করবে নবাব?

বশির মিঞা হাসল, বললে–কী আবার করবে? যে-জন্যে রানিবিবিকে চেহেল্‌-সুতুনে নিয়ে এসেছিল তাই করবে?

কী জন্যে নিয়ে এসেছিল?

বশির মিঞা বললে–ফুর্তি করবার জন্যে! সেই ফুর্তি করবে!

 ফুর্তি করবে মানে?

বশির মিঞা বললে–তোকে আমি আর বোঝাতে পারব না–ফুর্তি করবে মানে মহফিল করবে, মজলিস করবে!

আর কী করবে?

বশির মিঞা বিরক্ত হয়ে গেল। আর একথার উত্তর দিলে না। চলে যেতে যেতে বললে–তোর মাথায় বিলকুল গোবর পোরা, তোর কিচ্ছু হবে না। আমি চলি, আমার কাম আছে। কাল ভোরবেলা তৈয়ার থাকবি–যা–

বলে বশির মিঞা চলে গেল। কিন্তু কান্তর পা দুটো তখন কে যেন শেকল দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। সেই চকবাজারের রাস্তার ওপর। তার যেন নড়বার ক্ষমতাটাও হারিয়ে ফেলেছে সে।

*

চেহেলসূতুনে সেদিন আর কারও বিশ্রাম নেই। বহুদিন পরে নবাব মির্জা মহম্মদ চেহেল সূতুনে এসেছে। এসে রাত কাটাবে বেগমমহলে। বাবুর্চিখানায় শোরগোল পড়ে গেছে। জাফরান দিয়ে মোরগ-মুশল্লাম, বিরিয়ানি আর কাবাব বানানো হয়েছে। নবাবের বড় পেয়ারের খানা সব। নানিবেগমসাহেবা জানে মির্জা কী খেতে ভালবাসে। ছোটবেলা থেকে নানিবেগমের সঙ্গে সঙ্গে কাটিয়েছে মির্জা। মির্জা হাঁ করলে নানিবেগম বুঝতে পারে নাতি কী চায়।

পিরালি খাঁ পোশাক বদলিয়েছে। নজর মহম্মদ, বরকত আলি সবাই আজ তটস্থ। বব্বু বেগম, তক্কি বেগম, পেশমন বেগম অনেক দিন পরে আবার সাজতে বসেছে ঘরে ঘরে। অনেক দিন পরে আবার ইনসাফ মিঞা অসময়ে নহবত শুরু করেছে। শাগরেদ তবলাটা বেঁধে নিয়ে চাটি দিয়ে পরখ করে নিয়েছে সুরটা। গোসলখানায় গরম পানির ফোয়ারা খুলে দিয়েছে ভিস্তিওয়ালা। সমস্ত চেহেল্-সুতুনটা যেন আবার সরগরম হয়ে উঠেছে নবাবের পায়ের ধুলো পেয়ে।

নানিবেগম একবার ময়মানা বেগমের ঘরে গিয়েছিল। ময়মানা তখনও চুপ করে বসে ছিল। তার মহলে কোনও ঘটা নেই, কোনও জাঁকজমক নেই। ছেলে শওকত জঙের সঙ্গে সঙ্গে যেন ময়মানার সব সাধ সব আকাঙ্ক্ষা খতম হয়ে গেছে।

কী রে ময়মানা? তোর মহলে আঁধিয়ার কেন রে? রোশনি জ্বালাবি না?

সেই যে ময়মানা এসেছে চেহেল্‌-সুতুনে, তারপর থেকে তার মুখে আর হাসি দেখেনি কেউ। সে চেহেল্‌-সুতুনের এক কোণে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে।

সেখান থেকে নানিবেগম গেল লুৎফুন্নিসার মহলে।

কী রে, তুই এখনও সাজিসনি?

সাজব কেন নানিজি?

 যদি মির্জা তোকে ডাকে আজ! সাজ সাজ, আর ওয়াকত নেই

বলে নানিবেগম তাড়াতাড়ি মরিয়ম বেগমের মহলে গিয়ে ঢুকল।

মরালী তখন তৈরি হয়েই ছিল। নানিবেগম ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল। নবাব মির্জা মহম্মদের কাছে মেয়ে যাবে এমনি করে? এই পোশাকে?

মরালী বললে–তা হোক নানিজি, তোমার নাতি আমার সঙ্গে শুধু তো কথাই বলবে, আর কিছু তো করবে না, গান গাইতেও বলবে না, নাচতেও বলবে না আর আমি তো ওসব জানিও না

কিন্তু আমার নাতি হলে কী হবে, সে তো মুর্শিদাবাদের নবাব।

মরালী বললে–না নানিজি, আমাকে তুমি আজকে সাজতে বোলোনা। অন্য সব বেগমরা সাজুক। তোমার নাতি তো কখনও চেহেল্‌-সুতুনে আসে না, এতদিন পরে এসেছে, তার জন্যে তো বাবুর্চিখানাতে অনেক এলাহি রান্না হচ্ছে, সে-গন্ধও পাচ্ছি। কিন্তু এখন কি মজলিস করবার সময়?

নানিবেগম হাসল।

ওরে,নবাবদের জীবনে কখনও ফুরসত হয় না। তোর নানাজির কি কখনও মজলিসকরবার ফুরসত হয়েছিল? তবু আমি সাজতুম। যখন লড়াই করতে যেত তোর নানাজি, তখন আমি কেন সঙ্গে যেতাম? ওই জন্যেই তো যেতাম। সব বেগমদেরও বেছে বেছে নিয়ে যেতাম। যারা গান গাইতে জানত, নাচতে জানত, তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতাম তো ওই জন্যেই। তবু যদি নবাব একটুখানির জন্যে শান্তি পায়, তবু যদি মুখে একটু হাসি ফোটে নবাবের

কথাটা যেন পছন্দ হল মরালীর।

বললে–আচ্ছা, নানিজি, এখন কি নবাবের কাছে কেউ আছে?

তা জানি না, মির্জা তোকে ডেকে পাঠাবে এখুনি, সেই জন্যেই তো তোকে তৈরি হয়ে থাকতে বলছি। মির্জার মেজাজ তো কারও বোঝবার সাধ্যি নেই। কখন যে কী মেজাজ থাকে ওর, কে বলতে পারে?

তারপর একটু থেমে বললে–তোকে একটা কথা বলছি মা, তুই মির্জাকে বলবি

কী বলব?

বলবি, ইয়ারবকশিদের কথা যেন কানে না শোনে মির্জা, ওরাই হয়েছে ওর কাল। জানিস, মির্জার সব ভাল, শুধু এই ইয়ারবকশিদের কথায় যদি না উঠতবসত তো ওরও ভাল হত, বাংলা মুলুকেরও ভাল হত

তা আমার কথা কেন শুনবে তোমার মির্জা, নানিজি! আমি কে?

নানিবেগম বললে–শুনবে রে শুনবে; ও আমার কথা শোনে না, ও ওর মার কথা শোনে না, ও ওর নিজের বউয়ের কথা পর্যন্ত শোনে না, কিন্তু তোর কথা শুনবে।

তুমি বলছ কী নানিজি! আমার কথা শুনবে?

হ্যাঁ, তুই যে ওর জান বাঁচিয়েছিস রে! তুই যদি আজ ওই খতনা দেখাতিস, তা হলে কি ও তোকে খালাস করত? দেখলি না তোকে নিয়ে মতিঝিলে গেল, তোর কথায় তোর পেয়ারের লোকটাকে বেমালুম খালাস করে দিলে। তোর কথায় মেহেদি নেসার, ইয়ারজানদের ডেকে পাঠালে? তুই ওই খত্ না দেখালে ও কি বিশ্বাস করত তোর কথা?

মরালী জিজ্ঞেস করলে–তা হলে কী বলব আমি নানিজি?

বলবি, নবাব, আপনি আপনার ওই ইয়ার বকশিদের কথায় আর উঠবেন বসবেন না। ওরাই আপনার শত্রু! আপনি বুটমুট মোহনলালকে মিরবকশি করে দিলেন বলে মিরজাফরজি আপনার শত্রু হয়ে গেল। বলবি, আপনি নানিজির পুরনো আমলের আমির-ওমরাওদের কেন অপমান করতে গেলেন? তাই তো তারা আপনার দুশমন হয়ে গেল। এসব বলতে পারবি না?

মরালী বললে–কিন্তু এসব কথা তো তুমিও বলতে পারো নানিজি!

নানিবেগম বললে–না রে না, আমি বললে–শোনে না, তোর কথা শুনবে।

আমার কথা শুনবে, আর তোমার কথা শুনবে না? নবারে কাছে তোমার চেয়ে আমিই বড় হলুম আজ?

নানিবেগম বললো রে মেয়ে, হ্যাঁ। এতদিন চেহেল্‌-সুতুনে আছি, আমি বুঝতে পারি কে কার কথা শোনে। আমি চোখ দেখলে যে বলে দিতে পারি!

মরালী কেমন অবাক হয়ে গেল।

বললে–তুমি ঠিক বলছ নানিজি, আমার কথা নবাব শুনবে?

হ্যাঁ রে মেয়ে, হ্যাঁ। তোকে মির্জার নজরে লেগেছে। যে তোকে একবার দেখবে তারই নজরে লাগবে! সাধে কি আব তোর গুণ গাইছি মা!

মরালী নানিজির হাত দুটো ধরে ফেললে। বললে–কেন নানিজি? কেন আমার ওপর লোকের নজর লাগে? কী জন্যে? আমার মধ্যে কী আছে?

নানিবেগম বললে–ছাড়, ছাড় আমাকে আমি আসছি, তুই তৈরি হয়ে নে

না, ছাড়ব না তোমাকে, তুমি আমাকে বলে যাও

কী বলব?

কেন আমাকে সকলের ভাল লাগে? আর, যদি আমাকে লোকের এত ভালই লাগে তা হলে আমার কপালে এত কষ্ট কেন? কেন আমি সুখী হতে পারলাম না জীবনে? আমি কী অপরাধ করেছিলুম?

নানিবেগম মরালীর মুখটা নিজের বুকের মধ্যে জাপটে ধরল।

ওমা, কাঁদছিস তুই? একেবারে কেঁদে ফেললি?

মরালী মুখটা তুলল। চোখ দুটো তার জলে ভরে গেছে। বললে–তুমি তো জানো নানিজি, এখানে আসা পর্যন্ত তুমি তো আমাকে দেখছ? আমি কারও কোনও ক্ষতি করেছি? কেন তোমরা জুবেদাকে অমন করে শাস্তি দিলে?ও কীকরেছিল? আর আমিই বাকী পাপকরেছি যে ভগবান আমাকে এই শাস্তি দিলে?

নানিবেগম মরালীকে সাত্বনা দিতে লাগল।

বললে–চুপ কর মা, চুপ কর। কাদিসনে। তোর কীসের কষ্ট? আমি তো আছি, তোর যখন যা কষ্ট হবে আমাকে বলবি তুই, আমি তার বিহিত করব! তোর খাবার কিছু কষ্ট হচ্ছে? তোর পরার কষ্ট হচ্ছে? তোর খেদমতের কষ্ট হচ্ছে?

মরালী নানিবেগমের দিকে চেয়ে বললে–তুমি নিজে মেয়েমানুষ হয়ে আমাকে এই কথা জিজ্ঞেস করছ নানিজি? তুমি জানো না.মেয়েমানুষ কী চায়? তুমি জানো না মেয়েমানুষ কীসে খুশি হয়? তুমি নিজে মেয়েমানুষ হয়ে আমাকে এই কথা বলছ?

মরালীর কথা শুনে নানিবেগম কেমন হয়ে গেল যেন। আর যাওয়া হল না। বললে–না, তুই দেখছি ঠিক আমার লুৎফা মেয়ের মতো, কথায় কথায় কেঁদে ভাসিয়ে দিলে সংসার চলে? এ কি তোর। বাড়ি পেয়েছিস? এ কি তোর বাপের বাড়ি না শ্বশুরবাড়ি? তোদের মতন কাঁদতে পারলে আমি বেঁচে যেতুম তা জানিস? তোরা আমার দুঃখটা তো কখনও বুঝতে চেষ্টা করিস না। তোদের মতো আমারও। কি কান্না পায় না ভেবেছিস? আমার বুকটা হা-হা করে না মনে করেছিস? এই যে আজ চেহেল্‌-সুতুনে এতদিন আছি, আমার চোখে কেউ কান্না দেখেছে? কিন্তু কই, আমার তো কান্নার উপায় নেই। আমার নিজের পেটের মেয়েরা একটার পর একটা বিধবা হয়েছে, ঘসেটির মুখ পর্যন্ত আমার দেখবার হুকুম নেই, আর আজই ময়মানা আমার এখানে এসে উঠল! কই, আমার চোখ দিয়ে তো এক ফোঁটাও জল বেরোল না। তবে কি আমার চোখের ব জল শুকিয়ে গেছে?

মরালী তখন একদৃষ্টে নানিবেগমের দিকে চেয়ে আছে।

নানিবেগম বলতে লাগল–এই চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে যা ঘটতে দেখেছি, সব যদি ভাবতে বসি তো আত্মঘাতী হতে ইচ্ছে হবে, তাই তো কিছু আর ভাবি না মা। তাই তো কেবল কোরান নিয়ে দিনরাত থাকি, তাই তো সেইসব মনে পড়লেই খোদার নাম জপ করি আর নমাজ পড়ি। ওরে, এতদিন পাগল হয়ে যাইনি কেন, তা তো তোরা কেউ জিজ্ঞেস করিস না আমাকে? তুই তোর দুঃখের কথা বলছিস, কিন্তু আমারও তো দুঃখ থাকতে পারে, আমারও তো কষ্ট থাকতে পারে। তা তো কেউ জিজ্ঞেস করে না। সকলের নানিজি বলে কি আমি মানুষ নই বলতে চাস?

মরালী এবার নানিবেগমকে ছেড়ে দিলে।

 বললে–তুমি যাও নানিজি, তোমাকে আমি আর আটকাব না, আমি সাজছি

নানিবেগম মরালীর চিবুকটা ধরে বললে–কিছু মনে করিসনে মা এত কথা বললুম বলে! এত কথা আমি বড় একটা বলি না। তুই কথা তুললি বলেই বলে ফেললুম! জীবনে আমি কিছুই পাইনি রে, তার তুলনায় তোরা অনেক কিছু পেইছিস আমার যখন বিয়ে হল আমিও অনেক জ্বালা সয়েছি, তখন একটা লোক পাইনি যার সঙ্গে দুটো কথা বলি, যার কাছ থেকে একটু আদর পাই। তোরা বাইরে থেকে এসেছিস, আমার দুঃখটা তোরা বুঝবিনে

মরালী বললে–না নানিজি, আমি আর তোমাকে এসব কথা বলব না–তুমি যাও, তোমাকে আর আটকে রাখব না–

তা হলে যা বললুম সেইসব কথা বলবি তো মির্জাকে?

 সব বলব নানিজি!

কী বলবি?

বলব, ইয়ার বকশিদের কথায় জনাব যেন না ওঠেন বসেন। বলব, যার যা মান-মর্যাদা তাকে যেন তা দেন।

আরও বলবি, লোকে তাকে যে অত্যাচারী বলে সেটা মিথ্যে বলে না। তার মানে সারা মুর্শিদাবাদে তার যা কিছু কলঙ্ক সব তার ইয়ার বকশিদের জন্যে। আরও বলবি, এখন মির্জা বড় হয়েছে, এখন দেশের কথা তাকে ভাবতে হবে। ইয়ারবকশিদের কথা দেশের লোকের কথা নয়। এইসব কথা বলতে পারবি তো? বলতে পারবি তো যে, দেশের লোকেরা নবাবের নামে ছি ছি করে বেড়াচ্ছে, নবাবের নামে দোষ দিয়ে বেড়াচ্ছে, এটা মির্জার বোঝা উচিত! বলবি, নবাব আলিবর্দির নামে যেন মির্জা কলঙ্ক না লাগায়। নবাব আলিবর্দি খাঁ অনেক কষ্ট করে অনেক লড়াই করে অনেক তকলিফ করে এই মসনদ মজবুত করে রেখে দিয়ে গিয়েছিল। তার নাতি হয়ে মির্জা মসনদ যেন পরের হাতে তুলে না দেয়। বলতে পারবি তো মা এসব কথা? তোর বলতে সাহসে কুলোবে তো মা?

মরালী বললে–সাহস না থাকলে কি আমি সফিউল্লা খাঁ-কে খুন করতে পারি নানিজি?

তুই যদি বলতে পারিস মেয়ে তো তোকে আমি কী বলে যে আশীর্বাদ করব তা বলতে পারছি না। আমার এ অনেক সাধের চেহেল্ সুতুন রে। নবাব সুজাউদ্দিনের সময়কার এই সংসার, আমি কত কষ্টে একে বাগে এনেছি কী বলব! এককালে এই হারেমের মধ্যে মেয়েরা এসেছে আর শুকিয়ে মরে গেছে। এখন তো তোরা তবু লুকিয়েচুরিয়ে বাইরে যাস। আর আগে কত খোঁজার গর্দান গেছে সেই জন্যে! কত বেগম গলায় দড়ি দিয়েছে এর মধ্যে তার কি ইয়ত্তা আছে রে!

তারপর হঠাৎ যেন সচেতন হয়ে নানিবেগম বললে–তা হলে আমি আসছি, এতদিন পরে মির্জা এসেছে, আমার অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে, পিরালি খাঁ-কে বলে আসি বাবুর্চিখানায় কী বন্দোবস্ত হল! চলি মা তা হলে, আবার আসব পরে

বলে নানিবেগম চলে গেল।

মরালী আয়নাটা নিয়ে নিজের মুখখানা দেখলে একবার। তারপরেই কার পায়ের শব্দ হতেই পেছন ফিরে দেখে অবাক হয়ে গেছে মরালী।

একী, তুমি?

তাড়াতাড়িতে ভেতরে ঢুকে তখনও হাঁফাচ্ছে কান্ত। সে ভেতরে ঢুকেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

তুমি কেন আবার এলে এখানে? তুমি কি আবার বিপদে পড়তে চাও?

কান্ত বললে–নজর মহম্মদ আমাকে নিয়ে এসেছে,

কিন্তু আমি তো বলেছি, এখানে আসা ঠিক নয়। কেন এলে?

কান্ত বললে–শুনলুম আজকে নবাব চেহেল্‌-সুতুনে নিয়ে এসেছে তোমাকে, চকবাজারের রাস্তা দিয়ে তোমাদের তাঞ্জাম আসতে দেখলুম, তাই খুব ভয় হয়ে গেল

নবাব চেহেলসুতুনে এলে তোমার ভয়টা কীসের?

বলছ কী তুমি? ভয় হবে না? ভয় তো তোমার জন্যে!

মরালী বললে–আমার জন্যে শেষকালে তোমার নিজের জীবনটাও খোয়াবে নাকি?

কান্ত বললে–আমার কথা থাক এখন

কেন, তোমার কথা থাক কেন? তুমি কেন এই নরকের মধ্যে এলে?

কান্ত বললে–তোমার সঙ্গে অনেক কথা ছিল। কথাগুলো না বলতে পারলে আমার স্বস্তি হচ্ছিল না

কিন্তু আজ যে নবাব চেহেল্‌-সুতুনে রয়েছে। এখন কি আসতে আছে?

কান্ত বললে–নবাব তো চলে গেছে চেহেল সুতুন থেকে চলে গেছে

 চলে গেছে মানে?

নবাব থাকলে কি আসতুম?

কী যা-তা বলছ? আমার চেয়ে তুমি বেশি জানো?

কান্ত বললে–আমাকে নজর মহম্মদ যে বললে। নজর মহম্মদ আজ সারাফত আলির দোকানে আরক কিনতে গিয়েছিল। তখন আমি আসতে চেয়েছিলুম চেহেল্‌-সুতুনে। কিন্তু ও বললে, নবাব আছে, আজ হবে না। আমি তো তাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলুম। কিন্তু এক্ষুনি দৌড়োত দৌড়োত গিয়ে আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে এল। বললে, নবাব নাকি হঠাৎ চেহে সুতুন ছেড়ে মতিঝিলে চলে গেছে

কেন?

কলকাতা থেকে রাজা মানিকচাঁদ এসেছে নবাবের সঙ্গে সলাপরামর্শ করতে, কলকাতায় ফিরিঙ্গি কোম্পানিরা লড়াই শুরু করে দিয়েছে!

মরালীর মাথায় যেন চেহেল্-সুতুনের ছাদটা ভেঙে পড়ল।

বললে–তুমি ঠিক বলছ?

আমাকে নজর মহম্মদ যা বললে–তাই-ই বলছি, আমি কী করে এত সব জানব বলো। আমার তো আবার বাইরে যাবার কথা ছিল কিনা নিজামতির কাজে

মুর্শিদাবাদের বাইরে? কী কাজে?

কত রকমের কাজ আছে, তার কি ঠিক আছে? তোমাকে যেমন হাতিয়াগড় থেকে পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছিলুম, এ-ও সেই রকম কাজ!

আবার কাউকে চেহেল্‌-সুতুনে নিয়ে আসবে নাকি?

না, তা নয়, এ অন্য রকমের কাজ। এসব কাজ সকলকে বলা নিয়ম নয়। আমাকে নিজামত থেকে কলকাতার উমিচাঁদের বাড়িতে গিয়ে একটা খবর আনতে যাবার হুকুম হয়েছে

মরালী কৌতূহলী হয়ে উঠল। বললে–কী খবর?

কান্ত বললে–সে-খবর তোমাকে বলা যাবে না। এসব ব্যাপার খুব গোপনীয়। আজকাল এমন সব কাণ্ড চলছে মুর্শিদাবাদে, যা কাওকে বলা যায় না। নবাবের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র চলছে, আমরা খুব সাবধান হয়ে চারদিকে দেখাশোনা করছি

কীসের ষড়যন্ত্র?

কান্ত বললে–সে তোমার না-শোনাই ভাল। আর সে তোমাকে আমি বলবও না

মরালী কান্তর হাতখানা হঠাৎ ধরে ফেললে। বললে–না, তোমাকে বলতেই হবে। কে ষড়যন্ত্র করছে? কারা? খাজা হাদির নাম তুমি শুনেছ?

না।

করিম খাঁ?

কান্ত বললে–না। কিন্তু ওসব জেনে তোমার লাভ কী?নবাবকে কে মারল না-মারল, তা জেনে তোমার লাভ কী? তুমি চেহেল সুতুন থেকে বেরিয়ে চলো, তোমাকে আমি চেহেল সুতুন থেকে বার করে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে এসেছি। আমি নজর মহম্মদের সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি যত টাকা লাগে, সব দেবে সারাফত আলি সাহেব

সারাফত আলি? যার আরকের দোকান আছে চকবাজারে? যার দোকানে আমি সেদিন তোমাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম? সে কেন টাকা দেবে?

কান্ত বললে–সে বুড়ো আমাকে খুব ভালবাসে

তোমাকে ভালবাসে বলে আমাকে ছাড়াবার জন্যে টাকা দেবে কেন?

আমি যে তোমার কথা সূব বলেছি মরালী।

আমার কথা? আমার কথা কী বলেছ?

তোমার সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক, সব কথা বলেছি।

 মরালী আরও কৌতূহলী হয়ে উঠল–তোমার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?

 কান্ত হঠাৎ যেন বোবা হয়ে গেল।

বলো, কী সম্পর্ক তোমার সঙ্গে আমার থাকতে পারে, বলো?

কান্ত বললে–কেন, তোমার সঙ্গে কি আমার কোনও সম্পর্ক নেই?

সম্পর্কটা কীসের?

কান্ত বললে–আমার নিজের মুখ দিয়ে সেটা না-ই বা বলালে! তোমার কি কিছুই মনে নেই? একদিন তো তোমার সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক হত, যদি না

যদি না?

কান্ত বললে–সেকথা মনে পড়লেই আমার কষ্ট হয় মরালী! সে কথা আমি বারবার ভুলে থাকতেই তো চাই। কিন্তু ভুলতে পারি না যে মোটে! যখনই একলা থাকি তখনই মনে পড়ে যায়। সারাফত আলির দোকানের পেছনের অন্ধকার ঘুপচি ঘরের মধ্যে শুয়ে কেবল তোমার কথাই ভাবি! জানি, তোমার কথা ভাবা পাপ, তোমার কথা ভাবা অন্যায়; বুঝি, আজকে তোমার এই অবস্থার জন্যে আমিই দায়ী, কিন্তু কী করব বলো? একবার যে-দোষ করে ফেলেছি তার যে আর চারা নেই!

ওকী? অত কাছে সরে আসছ কেন?

আমাকে কি তুমি সত্যিই ক্ষমা করবে না?

মরালী বললে–ওকথা মুখে এনো না তুমি আর

তা হলে আমি কী নিয়ে থাকব? কী করে বাঁচব?

আমার কথা আর ভেবো না। জানো না আমি ম্লেচ্ছ হয়ে গেছি!

কান্ত আর থাকতে পারলে না। বললে–তা হোক, তবু তুমি আমার

ছিঃ। বলে মরালী কান্তর মুখখানা নিজের হাত দিয়ে চাপা দিয়ে দিলে। ওকথা যদি আর কখনও বলো তো তোমার সঙ্গে আর আমি দেখা করব না, আর কখনও আমি তোমাকে চেহেল্‌-সুতুনে আসতে দেব না নজর মহম্মদকে আমি বারণ করে দেব; শেষপর্যন্ত তাতেও যদি আসো তো আমি নানিবেগমকে বলে দেব–তুমি যাও এখন, যাও

হঠাৎ বাইরে দরজায় ধাক্কা পড়ল

ও মেয়ে, দরজা বন্ধ করলি কেন? কী হল?

মরালীর মুখখানা শুকিয়ে গেল।

ওই নানিবেগমসাহেবা এসেছে।

কে এসেছে?

মরালী বললে–চুপ। অত জোরে কথা বোলো না, নানিবেগমসাহেবা এসেছে। যাও, ওই সিন্দুকটার পেছনে লুকিয়ে পড়ো, শিগগির, দেরি কোরো না যাও যাও দাঁড়িয়ে দেখছ কী হাঁ করে? যাও, লুকিয়ে পড়ো

কান্ত বললে–দরকার নেই লুকিয়ে, দেখুক নানিবেগম।

কিন্তু দেখে ফেললে যে তোমার সর্বনাশ হবে, তোমাকে যে কোতল করবে।

কান্ত তবু ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। বললে–আমাকে কোতল করলে আমাকেই কোতল করবে, তোমাকে তো করবে না–আমার যা-হয় হয়ে যাক আজ, আমি আর পারছি না

মরালী বড় ব্যস্ত হয়ে উঠল–এ গোঁয়ার লোককে নিয়ে তো খুব মুশকিলেই পড়লুম; বলছি যে তোমার সর্বনাশ হবে, কথা শোনো, শিগগির লুকিয়ে পড়ো

কান্ত বললে—না

 ওরে ও মেয়ে, দরজা খোল, মির্জা চেহেল্‌-সুতুন থেকে চলে গেছে, আমি যাচ্ছি মতিঝিলে–

মরালী আর পারলে না। কান্তকে ধরে সোজা সিন্দুকের পেছনে নিয়ে গেল। তারপর সেখানে তাকে তার ঘাড় গুঁজিয়ে বসিয়ে দিয়ে বললে–লক্ষ্মীটি, এখানে চুপ করে বসে থাকো, নানিবেগম চলে গেলে তারপর উঠে এসো; তোমার পায়ে ধরছি, উঠো না এখান থেকে। তোমাকে দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে আমার

তারপর দরজাটা খুলে দিয়ে বললে–কী নানিজি?

নানিবেগমের মুখখানা কাঁদোকাঁদো হয়ে গেছে। বললে–ওরে, আমার মির্জা মতিঝিলে চলে গেছে রে, আমি ওদিকে বাবুর্চিখানায় খানার বন্দোবস্ত দেখতে গেছি, আর এদিকে মির্জা কখন মতিঝিলে চলে গেছে টেরই পাইনি, পিরালি খাঁ হঠাৎ এসে এখন আমায় খবর দিলে?

তা হলে কী হবে নানিজি?

আমি তো তাই মতিঝিলে যাচ্ছি। শুনলাম নাকি রাজা মানিকষ্টাদ এসেছে জরুরি খবর নিয়ে! ফিরিঙ্গি কোম্পানি নাকি লড়াই শুরু করেছে কলকাতায়। এই কাল সবে লড়াই থেকে মির্জা ফিরে এল। সোজা তো পূর্ণিয়া থেকে কলকাতায় চলেই যাচ্ছিল, আমিই বলে কয়ে মুর্শিদাবাদে আনিয়েছিলাম। কখন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছি আর সঙ্গে সঙ্গে কখন মতিঝিলে চলে গেছে।

আমিও তোমার সঙ্গে মতিঝিলে যাব নানিজি?

 যাবি তুই? তা হলে তো ভালই হয়, তা হলে তো আমি বেঁচেই যাই! আমি একলাই যাচ্ছিলুম, আমার সঙ্গে কেউ যেতে চাইলে না, তাই তোর কাছে এলুম। এখন যাবি তো চল

মরালী বললে–তুমি চলো, আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি

নানিবেগমসাহেব আর দাঁড়াল না। তাড়াতাড়ি বাইরে চলে গেল। মরালী সিন্দুকটার কাছে গিয়ে বললে–এসো, বেরিয়ে এসো

কান্ত আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে এল।

মরালী বললে–এবার বাইরে চলে যাও

কান্ত বললেন, আমি যাব না কিন্তু নানিবেগম যদি এসে তোমায় দেখে ফেলে তা হলে কিন্তু তোমায় আমি বাঁচাতে পারব না—

কান্ত বললে–আমি বাঁচতে চাইও না

বাঁচতে চাও না বলে কি এইরকম করে খোঁজার হাতে কোতল হবে?

কান্ত বললে–আমি তোমাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে চাই–তুমি না গেলে আমি যাব না।

মরালী বললে–কিন্তু এখন তো আর আমার যাওয়া চলে না

কেন?

আমার অনেক কাজ আছে, এখানে নবাবের বিরুদ্ধে অনেকে ষড়যন্ত্র করছে, আমি তাদের সকলের কথা টের পেয়েছি, তাদের ধরিয়ে দিতে হবে। সেকাজ শেষ না-হলে আমার যাওয়া হবে না।

তা হলে নবাবের স্বার্থই তোমার কাছে বড় হল? যেনবাব তোমার ওপর অত্যাচার করে তারই ভাল করতে চাও তুমি? যে-নবাবের ধ্বংস চায় সবাই তারই জন্যে তুমি এখানে থাকতে চাও? তুমি কি মনে করো সত্যিই তুমি নবাবকে বাঁচাতে পারবে?

মরালী রেগে উঠল।

বললে–তুমি যেনবাবের নামে এত কথা বলছ, তুমি নবাবকে চেনো? তুমি নবাবের সঙ্গে কথা বলেছ কখনও?

হঠাৎ দরজা খুলে যেতেই নানিবেগম ঘরে ঢুকে পড়েছে। কী যেন বলতে চেয়েছিল নানিবেগম। কিন্তু কান্তকে দেখেই থমকে দাঁড়াল।

বললে–এ কে?

নানিবেগম কান্তর দিকে তাকাল। কান্ত মরালীর দিকে তাকাল। মরালী নানিবেগমের দিকে চেয়ে কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল।

নানিবেগম মরালীর দিকে চেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলে–এ কে?

মরালী এগিয়ে এসে বললে–নানিজি, এ আমার চেনা লোক, আমাদের দেশের

এখানে এর ভেতরে কে নিয়ে এল?

মরালী বললে–তুমি ওকে কিছু বলতে পারবেনা নানিজি, তোমার পায়ে পড়ি নানিজি, ওকে কিছু বোলো না তুমি। আমিই ওকে ডেকে নিয়ে এসেছি এখানে, আমারই কাজে ও এসেছে

কান্ত তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।

মরালী বললে–আমি অনেকদিন আমার বাবার খবর পাইনি, তাই এর কাছেচকবাজারে খবর আনতে গিয়েছিলুম, এ আমার দেশ থেকে খবর এনে দেবে বলেছিল। তুমি ওকে কিছু বোলোনা নানিজি।

কিন্তু ওকে কে নিয়ে এল এখেনে?

তাও তুমি জানতে চেয়ো না।

নানিবেগম বললে–না, তুই বল আমাকে, কে নিয়ে এল ওকে এখনো কী করে নিয়ে এল? এত খোঁজা রয়েছে, এত পাহারাদার, খিদমদগার রয়েছে, তারা মোটা মোটা তলব নিচ্ছে কী জন্যে? আমি তাদের একজনকে এখনই ডাকছি…

বলে বাইরেই চলে যাচ্ছিল নানিবেগম, কিন্তু মরালী নানিবেগমের হাতটা ধরে ফেললে। বললে—না নানিজি, তুমি যেতে পারবে না–

তা হলে বল আর কখনও ভেতরে নিয়ে আসবি না বাইরের লোককে?

মরালী বললে–নিয়ে আসব না

তা হলে এখুনি ওকে বাইরে পাঠিয়ে দে! এখুনি বাইরে পাঠিয়ে দে–আমি ডাকছি পিরালিকে

মরালী বললে–না নানিজি, পিরালিকে ডাকতে হবে না তোমাকে, আমিই সব ব্যবস্থা করব। যে নিয়ে এসেছিল ওকে, সে-ই ওকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে আসবে

নানিবেগম এবার কান্তর দিকে ফিরে বললে–মরিয়ম বেগমসাহেবার বাবা কেমন আছে, তুমি জানো কিছু?

কান্ত বললে–এখন তবিয়তটা কিছু খারাপ আছে বিবিজির বাবার

 কী হয়েছে?

মাথাটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। বিবিজিকে দেখবার জন্যে ছটফট করছে দিনরাত। রানিবিবি চেহেল্-সুতুনে আসবার পর থেকেই ওইরকম হয়েছে, মেয়েকে কেবল দেখতে চাইছে ।

মরালী বললে–এ না থাকলে আমাকে কোতোয়ালির মধ্যে মেহেদি নেসার সাহেব খুন করেই ফেলত নানিজি,এ না থাকলে সেইদিনই মারা যেতুম। সেই জন্যেই তো নবাব একে সেদিন খালাস করে দেবার হুকুম দিলেন নানিজি!

তুমিই সেই?

এতক্ষণে মনে পড়ল যেন নানিবেগমের। বললে–ঠিক আছে, আমি ওকে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু খবরদার বলছি মেয়ে, ওকে তুই আর কখনও চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে আনতে পারবিনে। আমি যা দেখতে পারিনে তাই হয়েছে–আমি গিয়ে বোরখা পাঠিয়ে দিচ্ছি, সেইটে পরে পালকি করে বাইরে চলে যাক ও

বলে নানিবেগম বাইরে বেরিয়ে গেল।

কান্তর মুখে এবার কথা ফুটল। বললে–আমি যাব না

না, তুমি যাও

 তা হলে এই পালকিতে তুমিও চলো আমার সঙ্গে। কেউ জানতে পারবে না। তোমার পোশাকটা আমাকে দাও

মরালী বললে–আমার জন্যে তুমি কেন এত ভাবছ?

না, সত্যি বলছি, এক্ষুনি হয়তো কোনও খোঁজা বোরখা নিয়ে আসবে। তার আগেই তোমার ঘাগরা ওড়নি আমি পরে ফেলি, আর আমার পোশাকটা তুমি পরে নাও। তুমি বোরখা পরে চলে যাও আমার বদলে–

আর তুমি?

কান্ত বললে–আমার কথা ভেবো না তুমি। নজর মহম্মদ আমার চেনা লোক, আমাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবে, মোহর পেলে সে সব করবে। তারপর আমি বাইরে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করব

বাইরে গিয়ে কোথায় যাব? কোথায় থাকব? হাতিয়াগড়ে তো যেতে পারব না।

কান্ত বললে–তুমি যেখানে বলবে সেখানে নিয়ে যাব তোমাকে। তোমাকে কোনও নিরাপদ জায়গায় রেখে দিয়ে আমি চলে যাব আমার কথা শোনো মরালী, আমাকে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও, বেশি দেরি কোরো না, এখনই কেউ এসে পড়বে, শিগগির করো!

মরালী বললে–পাগলামি কোরো না, সমস্ত বাংলাদেশে আগুন জ্বলে উঠবে, কোথাও নিয়ে গিয়ে তুমি আমাকে বাঁচাতে পারবে না, আর দুদিন পরেই দেখতে পাবে!

আগুন জ্বলবে? তার মানে?

 মরালী বললে–সে তুমি এখন বুঝবে না।

আমি বাইরে থাকি, এত জায়গায় ঘুরি, আমি জানব না, আর তুমি চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে থেকে এত জানলে কী করে?

মরালী বললে–সব কথা বলবার সময় নেই এখন। এখানকার চেহেলসূতুনের অন্য বেগমরা কেউ সেসব জানে না, নানিবেগমও কিছু জানে না। শুধু আমি জানি। সফিউল্লা খাঁ সাহেবের কাছে যে-চিঠি পাওয়া গিয়েছে তা থেকে আমি সব জেনেছি। আমি যদি এ সময়ে চেহেসূতুনে না থাকি তো সমস্ত ছারখার হয়ে যাবে। মুর্শিদাবাদ ছারখার হবে, কেষ্টনগর ছারখার হবে, হাতিয়াগড়ও ছারখার হয়ে যাবে। আমি তো দূরের কথা, কেউই বাঁচব না, তুমিও বাঁচবে না সেই বিপদ থেকে।

কান্ত বললে–কী বলছ তুমি? আমি যে কিছু বুঝতে পারছি না

মরালী বললে–তোমাকে সব কথা এখন খুলে বলা যাবে না। নিজামতের এখন ভীষণ বিপদ চলছে। বাইরে থেকে কেউ কিছু বুঝতে পারছে না, কিন্তু আমি উমিচাঁদের চিঠি থেকে সব টের পেয়ে গিয়েছি–এই সময় যদি আমি এখান থেকে চলে যাই তো সব তছনছ হয়ে যাবে

কী হবে?

 বলেছি তো, সব তোমাকে বলা যাবে না। হয়তো উমিচাঁদই মুর্শিদাবাদের নবাব হয়ে বসবে।

তাই নাকি?

মরালী বললে–শুধু উমিচাঁদ নয়, জগৎশেঠজিও নবাব হতে পারে। মহারাজ কেষ্টচন্দ্রও হতে পারে, সবাই ষড়যন্ত্রের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। মেহেদি নেসারও নবাব হবার চেষ্টা করছে। কর্নেল ক্লাইভ বলে কে একটা ফিরিঙ্গি আছে, সেও নবাব হতে পারে। হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইও এই দলের মধ্যে আছে

কান্ত শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছিল।

মরালী আবার বলতে লাগল-মুর্শিদাবাদে এমন একজনও নেই, যে এর মধ্যে নেই। তারা সবাই লুঠপাট করে বড়লোক হতে চাইছে। যেমন করে হোক, নবাবকে হটিয়ে দিয়ে সব টাকা-কড়ি-মোহর লুটেপুটে নিতে চাইছে

তারপর একটু থেমে বললে–তা এসব কথা তোমাকে বলছিই বা কেন? তুমিই বা কী করতে পারবে? যদি পারতে তো তোমাকে একটা কাজ করতে বলতুম–

কী কাজ বলো না, তুমি বললে–আমি সবকিছু করতে পারব।

তা হলে তুমি বাইরে যেখানে যা কিছু শুনবে, আমাকে বলে দিয়ো এসে, আমিনবাবকে বলে দেব।

কান্ত বললে–আমি এখেনে কী করে আসব?

সে আমি নজর মহম্মদের সঙ্গে ব্যবস্থা করব। কেউ জানতে পারবে না। জানো, নবাবকে এই অবস্থায় ছেড়ে চলে যেতে আমার কেমন লাগছে।

কান্ত জিজ্ঞেস করলে সত্যিই নবাব ভাল লোক বলে তুমি মনে করো?

মরালী বললে–নবাব ভাল হোক মন্দ হোক, নবাবের জায়গায় যে-ই আসুক, সে-ই এইরকম করবে। উমিচাঁদ নবাব হলে কি আর ভাবছ পরের বউকে ধরে টানাটানি করবেনা? রাতারাতি সাধু হয়ে যাবে?

দেখো মরালী, একটা কথা–কান্ত বললে–আমাদের সারাফত আলি আছে, যার বাড়িতে আমি থাকি, সেই বুড়ো মিঞাসাহেব আমাকে এত টাকা দেয়, আমার জন্যে এত খরচ করে শুধু চেহেল্‌-সুতুন ধ্বংস করবার জন্যে।

মরালী বললে–আমি জানি। আমি এখানে এসে পর্যন্ত দেখছি, কেউ নিজামতের ভাল চায় না। নবাবের মা পর্যন্ত নবাবকে গালাগালি দেয় তার নিজের সোরার কারবার বন্ধ হয়ে গেছে বলে। টাকার জন্যে নিজের ছেলের পর্যন্ত শত্রু হয়ে গেছে, ভাবতে পারো?

কিন্তু তুমি যে নবাবকে এত ভালবাসো, নবাব তোমার জন্যে কী করবে?

মরালী বললে–আমার আবার কী করবে? আমি এখন আর আমার নিজের জন্যে কিছুই চাই না

তোমার নিজের সুখ, তোমার নিজের শান্তি, তোমার নিজের সংসার

মরালী বললে–সংসারের কথা, সুখের কথা, শান্তির কথা আমাকে আর বোলো না। যেদিন থেকে মরিয়ম বেগম হয়ে গেছি সেইদিন থেকেই আমার সব সুখ, সব শান্তি ঘুচে গেছে–

কান্ত বললে–না, ওকথা তুমি বোলো না! আমি তোমাকে শাস্তি দেব!

 তোমার সাধ্যি কী আমাকে শাস্তি দাও, আকাশের ভগবানেরও আমাকে শাস্তি দেবার ক্ষমতা নেই।

কিন্তু তা হলে আমি থাকব কী নিয়ে?

আগে বেঁচে থাকো কিনা তাই দেখো, তারপর সুখশান্তি, সংসারের কথা ভেবো। আমি কদিন ধরে একদণ্ডের জন্যে ঘুমোতে পারিনি, তা জানো? আমি শুধু একটা সফিউল্লা খা-কে খুন করেছি। পারলে ওই সবক’টাকে খুন করতুম! ওই উমিচাঁদ, মেহেদি নেসার, মিরজাফর খাঁ, সকলকে খুন করতুম। শুধু তো নবাবকে খুন করতে চায় না ওরা, ওরা সমস্ত বাঙালি জাতকে খুন করে ফেলতে চায়।

তারপর বললে–এসব তুমি বুঝবেনা, তুমি এবার যাও, এখুনি হয়তো কেউ তোমাকে বাইরে নিয়ে যাবার জন্যে আসবে–আমি নানিবেগমের সঙ্গে মতিঝিলে যাব নবাবের সঙ্গে দেখা করতে

কেন?

সেখানে রাজা মানিকচাঁদ এসে আবার কী মতলব দিচ্ছে কে জানে। আমি পাশে থাকলে নবাবকে সাবধান করে দিতে পারব। আজকে অনেক কষ্টে নানিবেগমের হাত থেকে তোমাকে বাঁচিয়েছি, এর পর হয়তো আর তোমাকে লুকিয়ে আসতে হবে না, তখন সোজা পাঞ্জা দেখিয়ে চলে আসতে পারবে

কী করে?

তা হলে আমি তোমাকে যা বলব তাই করতে হবে। দরকার হলে যাকে খুন করতে বলব তাকে খুনও করতে হবে, পারবে তা করতে?

তারপর হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল।

বেগমসাহেবা।

বরকত আলি একটা বোরখা নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। বললে–পালকি তৈরি।

মরালী কান্তকে বললে–বোরখাটা পরে নাও, ওর সঙ্গে বাইরে চলে যাও, আমি না ডাকলে আর কখনও এসো না

কবে ডাকবে তুমি?

যখন ডাকব তখন জানতে পারবে, এখন যাও, দেরি কোরো না

কান্ত বরকত আলির হাত থেকে বোরখাটা নিয়ে পরে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এ আবার কোন ষড়যন্ত্রের মধ্যে জড়িয়ে পড়ল সে। কান্তর মনে হল যেন আরও জটিল জালে সে আটকে গেল মরালীর জীবনের সঙ্গে। হয়তো ভালই হল। তবু তো এই সূত্র ধরে সে মরালীর সঙ্গে দেখা করতে পারবে! মরালীর কাছে আসতে পারবে।

পালকিটা চেহেল্‌-সুতুনের সুড়ঙ্গ পেরিয়ে যখন ফটকের কাছে এসেছে, তখন বরকত আলির গলা শোনা গেল। ফটক খোলার হুকুম। ফটকটা খুলতেই পালকিটা বেরিয়ে এল। আর সঙ্গে সঙ্গে ফটক বন্ধ করার শব্দ হল।

আর ওদিকে মরিয়ম বেগমের ঘরের ভেতর নানিবেগমসাহেবা এসে বললে–চল মেয়ে, চল তৈরি?

হ্যাঁ নানিজি।

 বাছাকে একদিনের জন্যে আমি চেহেল্‌-সুতুনে আনতে পারলুম না। চল, তুই একটু বুঝিয়ে বলুবি, চল মা। তোর কথা শোনার পর থেকে আমার বড় ভয় করছে মা

মরালী বললে–ভয় কীসের নানিজি,আমি তো রয়েছি।

নানিবেগম বললে–কিন্তু যদি আবার ওরা মির্জাকে লড়াই করতে টেনে নিয়ে যায়?

মরালী বললে–তুমি কিছু ভেবো না নানিজি, যদি যান তো আমি সঙ্গে থাকব বলতে বলতে চবুতরের তাঞ্জামে গিয়ে উঠতেই তাঞ্জাম ছেড়ে দিল।

*

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তখন নদীয়ার একছত্ৰাধিপতি। নদীয়ার রাজস্ব আদায় তখন ন’লক্ষ টাকার মতন। কিন্তু তার মধ্যে ৮,৩৫,৯৫২ টাকা রাজস্ব দিতে হত নবাব সরকারের খাজাঞ্চিখানায়। কদিন থেকে মহারাজ বড় ব্যস্ত ছিলেন। এতগুলো টাকা জলে চলে যায়, অথচ খরচ অনেক। সারা বাংলাদেশ থেকে পণ্ডিতেরা আসে, নৈয়ায়িকা আসে, জমিদাররা আসে। তাদের দেখাশোনা করার একটা খরচ আছে। বাড়িতে বাঁধা পণ্ডিত আছেন কালিদাস সিদ্ধান্তমশাই। তিনি মহারাজকে সংস্কৃত শাস্ত্র শেখান। বিশ্রাম খাঁ কালোয়াতের কাছে গানবাজনা শেখেন। মুজাফার হুসেনের কাছে অস্ত্রশস্ত্র চালাতে শেখেন। এদের সকলের খাওয়া-পরা-থাকার ব্যবস্থা করতে হয়েছে, জমির ইজারা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া আছে। পণ্ডিত-বিদায়।

পণ্ডিতই কি একজন! রাজা বিক্রমাদিত্যের সভায় যেমন ছিলেন ক্ষপণক, ধন্বন্তরী, অমরসিংহ, শম্বুক, বেতালভট্ট, ঘটকৰ্পর, কালিদাস, বরাহমিহির আর বররুচি, তেমনই মহারাজার সভাতেও ছিল হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত, রামচন্দ্র বিদ্যানিধি, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, বীরেশ্বর ন্যায়পঞ্চানন, ষড়দর্শনবেত্তা শিরাম বাচস্পতি, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, গুপ্তিপাড়ার বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, হালিশহরের রামপ্রসাদ সেন।

দেওয়ানজির খাতায় সকলের নাম-ধাম কুলজি লেখা থাকত। মাসে মাসে সবাই মহারাজার দরবারে এসে শাস্ত্র আলোচনা করতেন আর মাসিক বৃত্তি নিয়ে যেতেন। কিন্তু যারা সবসময় কাছে থাকতেন তারা হলেন ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, গোপাল ভাড়, মুক্তিরাম মুখোপাধ্যায় আর রামরুদ্র বিদ্যানিধি।

সেদিনও সকলকে নিয়ে বসেছিলেন।

দরবারি এসে জানাল-হাতিয়াগড় থেকে রাজা হিরণ্যনারায়ণ রায় এসেছেন—

কথাটা শুনেই মহারাজা উঠলেন। বললেন আপনারা বসুন, আমি আসছি–

যখন ভারতচন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে আসেন তখন আলিবর্দির আমল। ফরাসি গভর্নমেন্টের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণই তাঁর আলাপ করিয়ে দেন মহারাজার সঙ্গে। চারদিকে তখন অরাজক অবস্থা। ভারতচন্দ্র মন দিয়ে কেবল সংস্কৃত পড়নে। ভারতচন্দ্রের বাবা রাজেন্দ্রনারায়ণ বড় রাগ করতেন। বলতেন-সংস্কৃত পড়ে কী হবে শুনি? দিনকাল যা পড়েছে তাতে ও ভাষা শিখলে কে তোমায় খেতে দেবে? জমিদারি সেরেস্তায় যদি কাজকর্ম পেতে চাও তো ফরাসি পড়ো বাপ। তা ভাগ্যিস ফারসিটা পড়েছিলেন ভারতচন্দ্র। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্রের মা যখন বাবার জমিদারি বাজেয়াপ্ত করলেন, তখন গাজিপুরে গিয়ে ফারসি পড়ে ফারসির পণ্ডিত হয়ে গেলেন। সেখানেই ইন্দ্রনারায়ণের বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে গেলেন। আর সেই সূত্রেই একেবারে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায়। এমন একজন সংস্কৃত-ফারসি জানা পণ্ডিত পেয়ে মহারাজা যেন হাতে চাঁদ পেলেন।

জিজ্ঞেস করলেন–চাকরি আমি তোমায় দিতে পারি, কিন্তু তোমার মতো লোককে কী কাজ দেব বলো তো?

আজ্ঞে, যে কাজ দেবেন সেই কাজই করব! জমিদারি সেরেস্তার কাজকর্মও করতে পারি।

গোপাল ভাঁড় মশাই বসে ছিলেন সেখানে। বলেছিলেন–আমি যে-গল্পগুলো বলি সেগুলো লেখার কাজ তো এঁকে দিতে পারেন মহারাজ। তা হলে আমি অমর হয়ে থাকতুম!

মহারাজ বলেছিলেন–তোমার ভাঁড়ামি যদি লোকের মুখে মুখে ফেরে তা হলেই তুমি অমর হয়ে যাবে গোপাল, কিন্তু লিখলে আমার বদনাম হবে–

কেন মহারাজ?

লোকে ভাববে, দেশের যখন দুর্দিন তখন রাজসভায় বসে বসে মহারাজ কেবল ফষ্টিনষ্টিই করে গেছেন! আমি যে দেশের কথা ভাবি, সেকথা কেউই বুঝবে না।

গোপাল ভাড় মশাই বলেছিল–না, তা ভাববে না মহারাজ; ভাববে, মহারাজ রাজকার্যে এতই। বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন যে, দুশ্চিন্তা ভোলবার জন্যে গোপাল ভাঁড়কে বাড়িতে পুষে রেখেছিলেন!

মহারাজ খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন–তুমি তো বেশ বলেছ গোপাল, খাসা বলেছ। কিন্তু বিদ্বানকে বিদ্যাচর্চার সুযোগ না দিয়ে বসিয়ে রাখলে লোকেও যে আমাকে নিন্দে করবে।

তারপর ভারতচন্দ্রের দিকে চেয়ে বলেছিলেন–তুমি নিজেই বলল, তুমি কী করতে চাও

ভারতচন্দ্র উত্তর দিয়েছিলেন আজ্ঞে আমি মহারাজের অনুচর, আপনি যা আদেশ করবেন তাই-ই করব

সেই তখনই শুরু হয়েছিল অন্নদামঙ্গলকাব্য রচনার সূত্রপাত।

তারপর থেকে অনেক বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে নবাব সরকার থেকে খাজনা আদায়ের হুমকি এসেছে। অনেকবার দেওয়ান কালীকৃষ্ণ সিংহকে যেতে হয়েছে নবাব নিজামতে। বারবার দরবার করতে হয়েছে নবাবের আমদরবারে। কোনও ফল হয়নি। মহারাজকে নিজেকে গিয়েও জগৎশেঠ মহতাপজির সঙ্গে সলা-পরামর্শ করতে হয়েছে। তাতেও ফল হয়নি। অনেক রকম ষড়যন্ত্র হয়েছে নবাবকে নিয়ে। কতবার ভেবেছেন একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দেখেছেন আস্তে আস্তে নিজামতের জলুস বেড়েই চলেছে। সন-পিছু ৮,৩৫,৯৫২ টাকা রাজস্ব দিলে রাজ্য চলবে কেমন করে সেটা কেউ দেখে না। দেখেছেন মিরজাফর আলি সাহেবও খুশি নয়, জগৎশেঠজিও খুশি নয়, মেহেদি নেসার, ইয়ারজান, সফিউল্লা খাঁ, কেউই খুশি নয়। নিজামতের প্রত্যেকটা আমিন কর্মচারী থেকে শুরু করে আমির-ওমরাওরা পর্যন্ত সবাই যেন নিজামতের সর্বনাশ চায়। এমন অবস্থা আগে কখনও ছিল না। আগে কখনও এমন করে নবাবকে অভিশাপ দিত না সবাই। নবাবের অবশ্য টাকার দরকার। বর্গিদের হাঙ্গামার পর থেকেই টাকার টানাটানিটা যেন দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর তারপর ফিরিঙ্গি কোম্পানির সঙ্গে যখন ঝগড়া বাধতে শুরু হল তখন থেকে নিজামতের খাই যেন আরও বেড়ে যেতে লাগল। শেষকালে যখন আরও অসহ্য হয়ে উঠল তখন মহারাজ দেখলেন, তাঁর দলে আরও অনেকে আছেন। শুধু তিনিই নন, শুধু জগৎশেঠই নন, কিংবা শুধু মিরজাফর, মেহেদি নেসার, ইয়ারজান, সফিউল্লা খাই নন, ফিরিঙ্গি কোম্পানিও আছে, আর আছে হাতিয়াগড়ের রাজা হিরণ্যনারায়ণ রায়। বেচারির অনেক বয়েস কম। কোনওদিন কোনওরকমে কোনওভাবেই হাতিয়াগড়ের রাজা নিজের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে অন্যায় পস্থা গ্রহণ করেননি। নিজের কোনও সন্তান নেই, কিন্তু দুটি সতীসাধ্বী স্ত্রী নিয়ে সুখে ঘরকরনাই করতে চেয়েছেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রেরও যেমন দুটি স্ত্রী, হিরণ্যনারায়ণেরও তেমনি দুটি। তবুনবাবের দৃষ্টির শনি সেখানেও পড়েছে। নিজের গোমস্তা সরখেলমশাইকে অনেকবার পাঠিয়েছেন হাতিয়াগড়ে খবর আদানপ্রদানের জন্যে। অন্তত কিছুটাও যদি সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত বোধহয় তা-ও পারা গেল না। দ্বিতীয়পক্ষের পত্নীকে মহারাজ নিজের প্রাসাদে আশ্রয় দেবেন কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও হয়তো শনির দৃষ্টি পড়ল।

পাশের ঘরেই হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইকে বসানো হয়েছিল। মহারাজকে খবর দিয়ে দেওয়ান কালীকৃষ্ণ সিংহ মশাই এসে হাজির হলেন। বললেন–কী সংবাদ ছোটমশাই? মুর্শিদাবাদের কিছু সংবাদ পেলেন?

ছোটমশাই বললেন–পেলাম। কিন্তু মহারাজা কোথায়?

তিনি আসছেন, খবর পাঠিয়েছি। আমাদের এদিকেও খুব গণ্ডগোল চলছে, মহারাজার মন ভাল নেই–

কেন?

নিজামতের খাই বাড়ছে দিন দিন। নবাবের পাওনা বেড়েই চলেছে সন-সন। এবার চিঠি এসেছে ৮,৩৫,৯৫২ টাকা দিতে হবে। এত টাকা কোত্থেকে আসে?

আমারও তো তাই হয়েছে। আমাকেও ১,১৭,০০০ দিতে হুকুম হয়েছে। কিন্তু এত টাকার দরকারই বা হচ্ছে কেন নিজামতের?

আমি তো সেই কথা জানতে গিয়েছিলুম নিজামতকাছারিতে। তহশিলদার বললে–দিল্লির বাদশার কাছ থেকে হুকুমত এসেছে।

ছোটমশাই বললেন–সব বাজে কথা।

বাজে কথাই তো। আমি কিছু জানি না ভেবেছে ওরা? দিল্লির বাদশার কাছারিতে আমিও তো যাতায়াত করি। তারা বলে, বাংলাদেশ থেকে আলিবর্দি খাঁ শুধু একবার খাজনা পাঠিয়েছিলেন, তার পর আর কেউই পাঠায়নি। মুর্শিদকুলি খাঁ’র সময় থেকে কেউই খাজনা পাঠায়নি। যে যখন প্রথম নবাব হয় তখনই মাত্র একবার খাজনা পাঠায় বাদশার কাছে, তারপর আর পাঠায় না

হঠাৎ মহারাজ ঘরে ঢুকলেন। ছোটমশাই উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করলেন তাকে। কালীকৃষ্ণ সিংহ মশাই ভেতরে চলে গেলেন।

আপনার গৃহিণীর কোনও সংবাদ পেলেন ছোটমশাই?

 পেলাম মহারাজ, কিন্তু না পেলেই হয়তো ভাল হত।

 কী রকম?

আপনি শুনেছেন বোধহয় সব! আমার স্ত্রীকে নবাবের লোক চুরি করে চেহেল সুতুনে রেখেছে।

 কিন্তু আপনি তো আপনার পত্নীর বদলে অন্য একটি মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন চেহেল্‌-সুতুনে।

সে তো পাঠিয়েছিলুম, কিন্তু এবার আপনার কাছে পাঠাবার সময় যে সব গোলমাল হয়ে গেল। কী করে জানব বলুন যে, ফিরিঙ্গিরা ঠিক এই সময়েই আবার ফিরে আসবে, আর কলকাতা দখল করে নেবে; নবাবের ফৌজের সঙ্গে পল্টনদের লড়াই হবে। যারা বজরার সঙ্গে ছিল তারা এসে বললে, বোম্বেটে ডাকাতরা বজরা নিয়ে পালিয়ে গেছে–তারা কোনওরকমে হাতিয়াগড়ে ফিরে এসেছে

মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন আর আপনার শ্রীনাথ, মাঝির সর্দার?

সে কি আর বেঁচে আছে? তাকে বোধহয় নবাবের লোকরা ঠেঙিয়ে নদীর জলে ডুবিয়ে দিয়েছে।

তারপর?

ছোটমশাই বললেন–তারপর আপনার চিঠি পেয়েই আমি মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠজির হাবেলিতে গেলাম। গিয়ে শুনি সব অদ্ভুত কাণ্ড। আমার গৃহিণীকে কলমা পড়িয়ে মুসলমান করে নাম বদলিয়ে দিয়ে চেহেল সুতুনে রেখে দিয়েছে। এখন নাম হয়েছে মরিয়ম বেগম। সেই আমার গৃহিণীর ওপর নাকি নবাবের ওমরাও সফিউল্লা খা অত্যাচার করতে গিয়েছিল। তাতে তাকে খুন করে ফেলেছে সে।

সে তো সব শুনেছি আমি। মরিয়ম বেগম কি আপনারই গৃহিণী?

ছোটমশাই বললেন–এসব কি আমিই জানতুম? আমাকে জগৎশেঠজি সব বললেন যে। সেই খুনের অপরাধে তো আমার গৃহিণীর ফাঁসি হয়ে যাবার কথা। আমি জগৎশেঠজির কাছ থেকে পনেরো হাজার আসরফি হাওলাত নিয়ে তবে কাজিসাহেবকে ঘুষ দিয়ে তাকে ছাড়াই

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কথাগুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বললেন–এ তো আমি জানতুম না তারপর? তারপর এখন কী অবস্থা?

এখন নবাব তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে চেহেলসূতুনে তুলেছেন। তারপর ভগবান যা করেন। আমি এইটুকু দেখে আপনার কাছে ছুটে এসেছি, আপনি পরামর্শ দিন এখন কী করব?

মহারাজ খানিকক্ষণ ভাবলেন।

তারপর বললেন–আপনি জগৎশেঠজির কাছে আর যাননি?

গিয়েছিলুম। তিনি নিজেও এখন অপমানের ভয়ে চুপ করে আছেন। একবার নবাবের হাতে চড় খেয়েছেন সকলের সামনে। সে-অপমান এখনও ভুলতে পারেননি। আমি তো সেই জমায়েতের সময় ছিলাম, যখন জগৎশেঠজির বাড়িতে মিরজাফর আলি সাহেব এসেছিলেন, ওয়াটসন সাহেব এসেছিলেন, মেহেদি নেসার সাহেব ছিলেন, তখন থেকেই তো চেষ্টা চলছে আমার; কিন্তু দেখছি আপনি ছাড়া কিছু হবে না। আপনি নিজে একটু চেষ্টাচরিত্র করুন, নইলে কিছুই হবে না।

মহারাজ বললেন–আমি তো আমার দেওয়ানকে পাঠিয়েছিলাম। বলে পাঠিয়েছিলাম যে, নবাবের মিরবকশিকে যদি দলে টানা যায় তবেই আমাদের সব চেষ্টা সার্থক হবে। মিরবকশি যদি নবাবের দলে থাকে, তা হলে কিছুই হবে না

ছোটমশাই বললেন–শুনছি তো মিরজাফর সাহেবও নবাবের ওপর খাপ্পা হয়ে উঠেছে নাকি!

তা তো উঠেছে। সে আমিও জানি। কিন্তু কেন হয়েছে তা ঠিক জানি না।

ওই যে মিরজাফর আলি সাহেব কলকাতার উমিচাঁদ সাহেবের সঙ্গে জোট বেঁধে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে–এইরকম খবর নবাবকে কে নাকি দিয়েছে।

মহারাজ বললেন–সে-খবর আমার কানেও গেছে!

না, শুধু খবর নয়, নবাবের হাতে উমিচাঁদের লেখা চিঠিও নাকি পৌঁছে গেছে। এর পর কী হবে তা বুঝতে পারছি না। ওসব খবর নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমার নেই, এখন আমি নিজের ব্যাপারে কী করব তাই ভাবছি, সেই জন্যেই আপনার কাছে পরামর্শ করতে এলুম

মহারাজ বললেন–এখন একমাত্র উপায় ইংরেজরা

তাদের সঙ্গে তো আর দেখা হচ্ছে না। আর তাদের কাউকে আমি চিনিও না। তারাও আমাকে চেনে । একবার তারা নবাবের সঙ্গে লড়াইতে হেরে গেছে, তারা তো ভয়ে নবাবকে চটাতেই চাইবে না। কলকাতায় তারা উপোস করছে এখন, কেউ তাদের চাল-ডাল-তেল-নুন বেচছে না। এ সময়ে কি তারা লড়াই করতে সাহস করবে?

মহারাজ বললেন–লড়াই না করেও তো নবাবকে জব্দ করা যায়।

 কী রকম?

মহারাজ বললেন–সে-সব কথা আপনার জানবার দরকার নেই আপনি এক কাজ করুন—

কী কাজ?

আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি ফিরিঙ্গি কর্নেলের কাছে, আপনি সেখানা নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করুন। গিয়ে।

কে সে?

তার নাম কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ।

সে আবার কোন সাহেব?

মহারাজ বললেন–সে এক নতুন কম্যান্ডার এসেছে মাদ্রাজ থেকে। লোকটা ভাল। এরই মধ্যে বেশ মেলামেশা করে নিয়েছে বাঙালিদের সঙ্গে, চাষাভুষোদের সঙ্গে মিশে তাদের অনেক ভাষা শিখে নিয়েছে। আমি এবার যখন কালিঘাটে গিয়েছিলুম, ঠাকুর দেখার নাম করে তার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। উমিচাঁদ সাহেবের সঙ্গে খুব ভাব তার। খুব আঁদরেল লোক, নবাবকে উচ্ছেদ করবেই। আমি যা বলবার তা বলেছি, দেশের গরিব বড়লোক কেউ নবাবকে চায় না। এখন আপনিও গিয়ে দেখা করে বলে আসুন। বলনে, দরকার হলে আমরা টাকা দিয়ে, লোকজন দিয়ে, সবকিছু দিয়ে তাদের পেছনে আছি

ছোটমশাই বললেন কলকাতার কোথায় থাকে তারা?

আপনি কখনও যাননি কলকাতায়?

ছোটমশাই বললেন– না।

দলবল নিয়ে পল্টনরা থাকে কেল্লায়, আর ক্লাইভ থাকে বরানগরে।

 ছোটমশাই বললেন–তা আমি তো উমিচাঁদ সাহেবের বাড়িতে গিয়ে উঠতে পারি!

খবরদার, খবরদার! মহারাজ সাবধান করে দিলেন–খবরদার, ও-লোকটা একটা কাঁকড়াবিছে ও নবাবের দলেও আছে, আমাদের দলেও আছে। আপনি ওর ছায়া মাড়াবেন না

তা হলে আমি বরানগরেই যাব?

হ্যাঁ, ওখানে ক্লাইভ সাহেবের ছাউনি আছে, সেখানে গেলেই খবর পাবেন।

ছোটমশাই বললেন–তা হলে উঠি আমি মহারাজ

মহারাজ বললেন কিন্তু বিশ্রাম না করেই যাবেন? এক দিন এখেনে আরাম করে গেলে হত!

ছোটমশাই বললেন–বহুদিন থেকেই আমার বিশ্রাম ঘুঁটে গেছে মহারাজ। মাথার ওপর যতদিন বাবামশাই ছিলেন, ভাবনা ছিল না। তখন দিনকালও ছিল অন্যরকম। এখন কী যে হয়েছে, সব দিক থেকেই অশান্তি–

তারপর একটু থেমে বললেন–কিছু মনে করবেন না, আমি উঠি

তা হলে পালকিটা নিয়ে যান।

হ্যাঁ, ওরা তো ওখানে বসে রয়েছে, আমি লোকজনদের বসিয়ে রেখে দিয়ে এসেছি। বলে প্রণাম করে চলে গেলেন।

খানিক পরেই দেওয়ান কালীকৃষ্ণ ঘরে ঢুকেছেন। ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেছেন। মহারাজ, মহারাজ কোথায় গেলেন! পাশের ঘরে গেলেন, সেখানে গোপাল ভাঁড় মশাই একধারে বসে ছিলেন। আর কেউ নেই।

কোথায়? মহারাজ কোথায় গেলেন?

পাশের ঘরেই তো আছেন, দেখুন!

ভেতরে খবর পাঠালেন। জরুরি খবর এসেছে, মহারাজকে জানাতে হবে। খবর পেয়ে মহারাজ ভেতর থেকে এলেন-কী হল? কীসের জরুরি খবর দেওয়ানমশাই?

দেওয়ানমশাই বললেন–এখুনি মুর্শিদাবাদ থেকে খবর পাঠিয়েছিলেন আমাদের উকিলবাবু, নবাব কলকাতায় যাচ্ছেন লড়াই করতে।

নবাব যাচ্ছেন লড়াই করতে? কেন, ফিরিঙ্গিরা কি কিছু বাড়াবাড়ি করেছে?

তা জানি না। এই খবরটা পেয়েই আমাদের জানিয়েছেন। আর কিছু জানাননি।

মহারাজ বললেন–এখুনি যে ছোটমশাই কলকাতায় রওনা হয়ে গেলেন, দেখুন তো বজরা ছেড়ে দিয়েছে কিনা! ঘাটে গিয়ে একবার খবর নিতে বলুন তো শিগগির, শিগগির করুন।

সিংহমশাই আর দাঁড়ালেন না। সোজা কাছারির দিকে লোকের উদ্দেশে বেরিয়ে গেলেন।

কিন্তু ঘাটে গিয়ে যখন লোক পৌঁছুল তখন ছোটমশাইয়ের বজরা ছেড়ে দিয়েছে। নদীর এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো পর্যন্ত লক্ষ করেও তাঁর বজরার কোনও নিশানা পাওয়া গেল না।

*

বরানগরের ক্লাইভ সাহেবের ছাউনির সামনে গিয়ে দরবার খাঁ মিষ্টি গলায় সুর করে বলে উঠল–জয় রাধে কৃষ্ণ শ্রীরাধে

বাড়ির চালে একটা লাউগাছের ডগা লকলক করে লতিয়ে উঠেছে। বেলা পড়ো-পড়ো।

দরবার খাঁ-কে আর চেনবার উপায় নেই। ডান হাতে হরিনামের মালা, গলায় কঞ্চি, পরনে গেরুয়া কাপড়।

হালসিবাগান থেকে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে বরানগরে এসে ঠিক আস্তানা খুঁজে বার করেছে।

জয় রাধে কৃষ্ণ, শ্রীরাধে। দুটি সেবা পাই মা!

 ভেতর থেকে দুর্গা কথাটা শুনতে পেয়েছিল। ছোট বউরানির কানেও কথাটা গিয়েছিল। দুর্গা বললে–আবার কোন আবাগির বেটা জ্বালাতে এল।

ছোট বউরানি বললে–বোষ্টমবাউল কেউ হবে বোধহয়, দেখব?

না গো, তোমায় দেখতে হবে না। আমি দেখছি!

বাইরে তখন দরবার খাঁ আবার একবার মিহি সুরে বলে–জয় রাধে কৃষ্ণ, দুটো সেবা পাই মা

আর থাকতে পারলে না দুর্গা। হরিচরণটাও কোথায় এই সময়ে কাজে গেছে। দুর্গা নিজেই বাইরে বেরিয়ে এল। এক মুখ দাড়িগোঁফ বোস্টমটার। কোন দলের কে জানে! কর্তাভজা, না বলরামভজা, না সাহেবধনি কে জানে।

বললে–এখানে কিছু হবে না বাছা, এ গেরস্তবাড়ি নয়

বলে ভেতরেই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ বোস্টমটা বলে উঠল–তোর সামনে খুব বিপদ আসছে মা, ভারী বিপদ। একটু সাবধানে থাকিস!

বিপদের কথা শুনেই দুর্গা থমকে দাঁড়াল। ভাল করে চেয়ে দেখলে বোস্টমবাবাজির দিকে। এও কি বুজরুক নাকি!

কীসের বিপদ?

দরবার খাঁ বললে–একটু দাঁড়া না মা, দেখি তোর কপালটা ভাল করে দেখি! আমার দিকে চা, ভাল করে চা

দুর্গার কেমন সন্দেহ হল। বোস্টমরা তো এমন করে কথা বলে না। আবার ভাল করে চেয়ে দেখলে।

বললে–তুমি কোন দলের বোস্টম বাছা? সাহেবধনি, না কর্তাভজা?

দরবার খাঁ বললে–রাগ কোরো না মা, আমি গরিব বোস্টম, আমার আবার দল কী? আমি

শ্রীরাধার সেবা করে দিন কাটাই।

বলে সেইখানেই বসে পড়ল। বললে–একটু তেষ্টার জল দেবে মা?

 দুর্গা বললে–এ তো গেরস্তবাড়ি নয় বাছা, এখানে কিছু সেবা হবে না

দরবার খাঁ বললে–শ্রীরাধার নাম করে যখন চাইছি মা, তখন আর ফিরে যেতে বোলোনা। তোমার ভাল হবে, তোমার মেয়েরও ভাল হবে!

মেয়ে!

হ্যাঁ মা, তোমার মেয়েরও ভাল হবে। তোমার মেয়ের সব দুঃখু ঘুচে যাবে। তোমার মেয়ের কপালে এবার থেকে সুখ আসছে!

দুর্গার কেমন সন্দেহ হতে লাগল। এ-ও আর-এক বুজরুক নাকি!

বলি তুমি বাটি চালতে পারো? আমার জামাই কোথায় আছে বলতে পারো?

দরবার খাঁ বললে–পারব না কেন মা? কিন্তু তোমার মেয়ের কপালটা একবার দেখতে হবে। কপাল দেখব, হাতের পাতা দেখব। ভূত-ভবিষ্যৎ কি অত সহজে বলা যায় মা! তোমার মেয়েকে একবার ডাকো না দেখি!

দুর্গা কী করবে বুঝতে পারলে না। হরিচরণটাও নেই, ফিরিঙ্গি সাহেবটাও নেই। কাকেই বা জিজ্ঞেস করে। আশেপাশে তো সবই জঙ্গল। জঙ্গলের ওপাশে গোরা পল্টনদের ছাউনি। ডাকলে তারা এখনই এসে পড়বে হুড়মুড় করে। কোম্পানির রাজত্বের মধ্যে বসে কেমন যেন ভয়-ভয় করতে লাগল দুর্গার। হাতিয়াগড় হলে এখুনি হাঁকডাক করলে পাইক-পেয়াদারা হইহই করে এসে পড়ত।

ভেতর থেকে ছোট বউরানি হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছে।

 দুর্গা দেখতে পেয়েই বললে–তুমি আবার কেন বাইরে এসেছ বউরানি?

ভেতর থেকে আমি সব শুনিচি যে

দরবার খাঁ বললে–খুব ভাগ্যবতী মা, খুব ভাগ্যবতী তোমার মেয়ে দেখি মা, তোমার কপালটা ভাল করে দেখি।

দুর্গার ভয়-ভয় করতে লাগল।

 কিন্তু ছোট বউরানি সোজা এগিয়ে এল দরবার খাঁ’র দিকে।

এবার বাঁ হাতের পাতাটা দেখি মা তোমার?

বলে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলে ছোট বউরানির দিকে। ছোট বউরানিও নিজের বাঁ হাতটা দিলে দরবার খাঁ’র দিকে। খুব মন দিয়ে কী যেন দেখতে লাগল দরবার খাঁ।

বললে–সামনে বড় বাধা আছে মা তোমার জীবনে, খুব সাবধানে থাকবে।

কীসের বাধা? আমার নিজের ঘরে ফিরে যেতে পারব তো? আমাদের বড় কষ্ট হচ্ছে বাবা। অনেক দিন ধরে ঘরে ফেরবার চেষ্টা করছি, কিছুতেই পারছিনে।

তোমাদের ঘর কোথায় মা?

হাতিয়াগড়ে!

হাতিয়াগড়ে? হাতিয়াগড়ে তোমাদের যদি ঘর তো এখানে কেমন করে এলে? এখানে কে নিয়ে এল?

দুর্গা বললে–ওই ফিরিঙ্গি সাহেব আমাদের।

 ফিরিঙ্গি সাহেব? ওই গোরা পল্টনদের সাহেব? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছি। ফ্লেচ্ছসংস্পর্শ করাচ্ছে রাহু। রাহু সরলে তো মুক্তি নেই মা তোমার!

রাহু? কিন্তু আমরা তো সাহেবের ছোঁয়া খাইনে। আমি নিজেই তো রান্নাবাড়া করি।

 দরবার খাঁ বললে–এখনও সংসর্গ পুরোপুরি হয়নি, কিন্তু এবার আর এড়াতে পারবে না মা।

তা হলে কি জাত যাবে আমাদের?

জাত যাবে কেন? বৃহস্পতি আছে কী করতে? রাহুর পরেই বৃহস্পতি আসছে। তিনিই বাঁচিয়ে দেনে। কিন্তু রাহু তার ঝাট যা-দেবার তা তো দেবেই, তা তো এড়াতে পারবে না মা!

ছোট বউরানির মুখখানা কালো হয়ে উঠল।

বললে–তা হলে কী উপায়?

উপায় আছে বই কী মা! একটা উপায় আছে।

বলে দরবার খাঁ নিজের কমণ্ডলুর ভেতর থেকে একটা হরতুকি বার করলে।

বললে–তোমার সোয়ামির নাম কী মা?

ছোট বউরানি’একটু বিব্রত হয়ে পড়ল।

 দুর্গা রেগে গেল। বললে–তোমার তো আক্কেল খুব বাবা! সোয়ামির নাম কী করে করবে মেয়ে। ইস্ত্রি হয়ে কী সোয়ামির নাম কেউ করে? তুমি কী রকম বোস্টম শুনি?

দরবার খাঁ প্রায় বেসামাল হয়ে পড়েছিল। বললে–আমাদের ধর্মে কিছু আটকায় না মা, আমারও তো বোষ্টুমি আছে, সে তো আমার নাম ধরে ডাকে।

তা আমরা তো বোস্টম নই!

তবে তোমরা কী মা?

কিন্তু তার উত্তর দেওয়া আর হল না। ওদিক থেকে ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে দু’জন পল্টন আসছিল, তাদের দেখেই দুর্গা আর ছোট বউরানি ভেতরে চলে গেল।

এই ভাগো ভাগো ইধার সে, ভাগ যাও

দরবার খাঁ ভয় পেয়ে গেল। বললে–কেন বাবা, আমি তোমাদের কী ক্ষতি করেছি?

নেহি, হুকুম নেহি ইধার ঘুসনে কা। ই কোম্পানিকো পল্টনকা ক্যাম্প হ্যায়।

 আমি তো গরিব বোস্টম বাবা, আমি তো লড়াই করতে আসিনি। দুটো সেবা নিতে এসেছিলুম।

হঠাৎ তখন ওদিক থেকে হরিচরণ এসে পড়েছে। হরিচরণ পল্টনের লোক। কিন্তু সাহেব তাকে দুর্গাদের সেবার কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। সে তখন ছাউনি থেকে বরাদ্দ চাল-ডাল আনতে গিয়েছিল। বাড়ির সামনে এসে এই হইচই কাণ্ড দেখে অবাক। একটুখানি বাইরে গিয়েছে, আর তার মধ্যে এত কাণ্ড ঘটে গিয়েছে!

এ কে? কী হয়েছে?

গোরা পল্টন দু’জন ততক্ষণে দরবার খাঁ-কে ধরে ফেলেছে। দরবার খাঁ বললে–আমাকে ছেড়ে দাও বাবা, আমি জানতুম না এ কোম্পানির পল্টনদের ছাউনি। আমি সেবা নিতে এসেছি।

দাঁড়াও, তোমার সেবা নেওয়া দেখাচ্ছি।

আর একজন পল্টন বললে–এ শালা স্পাই আছে, বি কেয়ারফুল কাপড়ের ভেতরে আর্মস থাকতে পারে ।

সঙ্গে সঙ্গে গায়ের গেরুয়া আলখাল্লাটা টান দিতেই কোমরের ভেতর থেকে চকচকে ছোরা একখানা খসে পড়েছে মাটিতে। ছোরাখানা দেখেই হরিচরণ কুড়িয়ে নিলে। কী সর্বনেশে কাণ্ড! এরই মধ্যে এত!

গোরা পল্টন দুটো দরবার খাঁ’র হাত দুখানা পিছোঁড়া করে বেঁধে ফেললে। তারপর হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল নিজেদের ছাউনির দিকে। কলকাতার কেল্লার মতো বরানগরেও ছোটখাটো পল্টন ছাউনি।

হরিচরণ দৌড়াতে দৌড়োতে ভেতরে ঢুকল।

 ও দিদি, দিদি

দুর্গ, ছোট বউরানি–দু’জনেই এতক্ষণ সব শুনছিল ভেতর থেকে। হরিচরণ যেতেই দুর্গা বললেও কে হরিচরণ? কী করতে এসেছিল?

হরিচরণ বললেনবাবের চর গো দিদি কোম্পানির ছাউনির হাঁড়ির খবর নিতে এইছিল—

নবাবের চর কথাটা শুনে ছোট বউরানি ভয়ে চমকে উঠল।

তোমাদের কী জিজ্ঞেস করছিল?

দুর্গা বললে–জিজ্ঞেস করছিল এর সোয়ামির নাম কী, কোথায় বিয়ে হয়েছে, এইসব

বলোনি তো কিছু তোমরা?

না হরিচরণ, আমরা আর একটু হলেই বলতে যাচ্ছিলুম! শুধু বলেছি হাতিয়াগড়ে এর শ্বশুরবাড়ি, আর কিছু বলিনি। কিছু বলবার আগেই গোরা পল্টন দু’জন যে এসে গেল, তা রক্ষে

ভাগ্যিস বলোনি, নইলে সব্বনাশ হত। আমি একটুখানি গিয়েছি ছাউনি থেকে তোমাদের চালডাল আনতে, আর এরই মধ্যে শয়তানটা এসে ঢুকে পড়েছে এখানে-সাহেব এসে সব জানতে পারলে খুব বকবে আমাকে দিদি।

হঠাৎ বাইরে ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ হতেই হরিচরণ অন্যমনস্ক হয়ে উঠল।

ওই আমার সাহেব আসছে দিদি। সাহেবের ঘোড়ার আওয়াজ আমি শুনলেই বুঝতে পারি। বলে দৌড়ে বাইরে গেল।

.

হরিচরণ সাহেবের মুখখানার দিকে চেয়ে দেখলে। সাহেবের মুখের চেহারা দেখেই হরিচরণ বুঝতে পারে সাহেবের মেজাজ। কেমন যেন রুক্ষ-রুক্ষ ভাব। সত্যিই ক্লাইভ সাহেবের রাগ হয়ে গিয়েছিল উমিচাঁদের কথা শুনে। উমিচাঁদ বলতে চেয়েছিল, টাকা দিলে নবাবের সঙ্গে লড়াই বাধিয়েও দিতে পারে, আবার মিটমাট করিয়ে দিতে পারে। লোকটা ট্রেটর! এই ট্রেটরদেরই ক্লাইভ টলারেট করতে পারে না। এরাই চিরকাল রবার্ট ক্লাইভদের এনিমি, আবার নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাদেরও এনিমি। এরাই তাকে ইংলন্ড থেকে তাড়িয়ে ইন্ডিয়াতে পাঠিয়েছে। এরাই আবার কোম্পানিকেনবাবের সঙ্গে লড়াইতে নামিয়েছে। অথচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তো লড়াই করতে এখানে আসেনি।

পাশের ঘর থেকে ফিরে এসেই উমিচাঁদ সাহেব বলেছিল–তা হলে কী হল, বলো?

 অ্যাডমিরাল ওয়াটসন বললে–বলুন, আপনি কত নেবেন?

আমি তোমাদের সঙ্গে নবাবের লড়াই বাধিয়ে দেব!

ওয়াটসন বললে–শুধু লড়াই বাধিয়ে দিলে চলবে না, লড়াইতে জিতিয়েও দিতে হবে?

তা হলে অনেক টাকা চাই।

 কত টাকা?

নবাবের খাজাঞ্জিখানায় যত টাকা তোমরা পাবে, তার চার ভাগের এক ভাগ।

ক্লাইভ বললে–তাই-ই দেব!

উমিচাঁদ সাহেব বললে–আমরা কারবারি লোক, তোমরাও নতুন, তোমাদের সঙ্গে কারবারে তোমরা আমার কথা রাখোনি আগে, এবার লেখাপড়া করে নেব!

তা লেখাপড়াই করে নেবেন।

বেশ, সেই কথাই রইল। এখন কী করতে হবে আমাদের?

উমিচাঁদ বললে–একটা খবর তোমাদের মুফত বলে দিই, এর জন্যে তোমাদের টাকাকড়ি কিছু দিতে হবে না। আমার কাছে মুর্শিদাবাদ থেকে এখুনি একটা চর এসে একটা খবর দিয়ে গেছে।

কী খবর?

উমিচাঁদ দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললে–নবাব মির্জা মহম্মদ মুর্শিদাবাদ থেকে রওনা হয়েছে তোমাদের সঙ্গে লড়াই করবার জন্যে!

সেকী? আমরা তো কিছু খবর পাইনি? 

উমিচাঁদ বললে–তোমরাই যদি খবর পাবে সাহেব, তা হলে আমি কী করতে হালসিবাগানে বসে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছি।

নবাব বেরিয়ে পড়েছে?

হ্যাঁ সাহেব, হ্যাঁ।

আপনি ঠিক বলছেন? আপনি ঠিক জানেন?

এ তো ছোট তুচ্ছ খবর সাহেব। এ-খবর তোমাদের মুফত দিয়ে দিলুম। এর জন্যে একটা দামড়িও নেবে না উমিচাঁদ। উমিচাঁদ মাছি মেরে হাত নষ্ট করে না সাহেব!

একটু থেমে আবার বললে–তবে আরও শোনো,নবাবের সঙ্গে আছে চল্লিশ হাজার ঘোড়সওয়ার, ষাট হাজার পায়দল ফৌজ, পঞ্চাশটা হাতি আর তিরিশটা কামান–ভয় হচ্ছে?

অ্যাডমিরাল ওয়াটসন রবার্টের দিকে চাইলে।

আর তোমাদের?

অ্যাডমিরাল বললে–আমাদের আছে গোরা পল্টন সাতশো এগারোজন, গোলন্দাজ একসোজন, নেটিভ সেপাই প্রায় তেরোশো

উমিচাঁদ জিজ্ঞেস করলে আর কামান? কামান ক’টা আছে?

অ্যাডমিরাল বললে–তিন সেরি গোলা ছোড়বার মতো কামান আছে চোদ্দোটা।

উমিচাঁদ হেসে উঠল। বললে–তোমাদের তো সাহস কম নয় হে! মোটে এইকটা মাল নিয়ে তোমরা নবাবের সঙ্গে লড়বার জন্যে পাঁয়তাড়া কষছ?

ক্লাইভ বললে–পারি না-পারি সে আপনার দেখবার দরকার নেই, কিন্তু আপনি বলুন আমাদের কতটা হেলপ করতে পারবেন!

আমি?

উমিচাঁদ সাহেব সেই একই রকম রহস্যময় হাসি হাসতে লাগল।

 বললে–হেলপ আমি করব, কিন্তু তার আগে তোমাদের একটা কাজ করতে হবে।

কী কাজ?

তোমাদের একটা ফারসি-জানা মুনশি রাখতে হবে।

মুনশি তো আমাদের আছে।

উমিচাঁদ বললে–তাকে দিয়ে চলবে না। অন্য মুনশি রাখতে হবে। সে আমাদের লোক। মুর্শিদাবাদ থেকে যে-সব চিঠি আসবে সে-সব চিঠি যাকে-তাকে দিয়ে পড়ালে চলবে না। বাইরের লোক জেনে ফেলবে। আমাদের নিজেদের জানাশোনা মুনশিকে দিয়ে পড়াতে হবে।

তা তাই করব। সে-মুনশিকে কোথায় পাব?

আমি তাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দেব।

কে সে?

সে একজন গরিব ছোকরা। বেচারি চাকরি খুঁজছে অনেক দিন ধরে। আমার কাছেও এসেছিল চাকরির খোঁজে। আমি কিছু করতে পারিনি। কিন্তু ছেলেটা বিশ্বাসী। প্রাণ গেলেও ছেলেটা ভেতরের কথা কাউকে ফাস করবে না।

তা বেশ তো৷ তাকেই রাখব। কত মাইনে নেবে?

তিন টাকা, চার টাকা, পাঁচ টাকা যা দেবে তাতেই সে খুশি থাকবে।

কী নাম তার?

 নবকৃষ্ণ।

 নামটা শুনে রেখেছিল ক্লাইভ! কোথাকার কোন নবকৃষ্ণ, ছেলেটা কেমন কাজ করবে কে জানে। তবু কথাটা মনে লেগেছিল। মন্দ বলেনি উমিচাঁদ। ইন্ডিয়াতে এসে ব্যাবসা করতে গেলে ইন্ডিয়ানদের হেলপ নিতেই হবে। ইন্ডিয়ানদেরই এজেন্ট বানাতে হবে। সেই এজেন্টদের দিয়েই ইন্ডিয়াকে হাত করতে হবে।

হঠাৎ নিজের ক্যাম্পের সামনে আসতেই হরিচরণকে দেখে ঘোড়া থামিয়ে দিলে ক্লাইভ সাহেব।

কী হরিচরণ? হোয়াট নিউজ? কী খবর?

হরিচরণ যা-কিছু ঘটেছিল সব বলতেই মাথায় রক্ত উঠে গেল ক্লাইভের। বললে–কোথায় গেল স্পাইটা?

তাকে পল্টনরা ছাউনিতে ধরে নিয়ে গেছে হুজুর

ক্লাইভ ঘোড়া থেকে আর নামল না। সোজা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ছাউনির দিকে ছুটে চলল। লড়াই যদি শেষপর্যন্ত করতেই হয় তো ধীরে-সুস্থে করলে চলবে না। নবাব মুর্শিদাবাদ থেকে আর্মি নিয়ে কলকাতার দিকে আসছে, এখন তো আর সময় নষ্ট করলে চলে না। অ্যাডমিরাল চলে গেছে কেল্লার দিকে তোড়জোড় করতে। এদিকে বরানগরের ক্যাম্পেও তোড়জোড় শুরু করতে হবে।

হরিচরণ পেছন থেকে বললে–রান্না হয়ে গেছে হুজুর খেয়ে যান

দুর, খাওয়ার কথা এখন ভাবলে চলে! আগে খাওয়া না আগে লাইফ। লাইফ আর ডেথের প্রশ্ন এখন। এখন কি খাওয়ার কথা ভাবলে চলে!

*

মতিঝিলের আম-দরবার তখন জমজমাট হয়ে উঠেছে। নানিবেগমের সঙ্গে মরিয়ম বেগমসাহেবা গিয়ে সেইখানেই হাজির হল।

চবুতরার ওপর তাঞ্জামটা গিয়ে থামতেই নেয়ামত খবর পেয়েছে।

সামনে এসে সেলাম করে দাঁড়াল নেয়ামত। বললে–বন্দেগি বেগমসাহেবা

 নবাব কী করছে নেয়ামত?

 নেয়ামত বললে–দরবার খতম করে কলকাতায় লড়াই করবার হুকুম জারি করে দিয়েছে জাঁহাপনা

এখন কে কে আছে মতিঝিলে?

কেউ নেই বেগমসাহেবা। জগৎশেঠজি ছিলেন, তিনিও ভি চলে গেছেন। মানিকচাঁদজি, মিরজাফরজি, মোহনলালজি, মিরমদনজি, মেহেদি নেসার সাহেব, ইয়ারজান সাহেব, সবাই চলে গেছেন বেগমসাহেবা। জাঁহাপনা ভি মুস্তায়েদ হচ্ছেন

সত্যিই বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা মতিঝিলের মধ্যে আর একবার একটা বিরাট আয়নার সামনে নিজের চেহারাটা দেখছিলেন। জগৎশেঠজি একটু আগেই ফিরিঙ্গি কোম্পানির সঙ্গে লড়াই করতে বারণ করে গেছে। কিন্তু মানিকচাঁদ বলেছে লড়াই চালিয়ে যেতে! একেবারে উলটো কথা!

মানিকচাঁদ বলেছিল–লড়াই না করলে ওরা ভাববে জাঁহাপনা ভয় পেয়েছেন!

জগৎশেঠজি বিজ্ঞ মানুষ। বলেছিলেন কিন্তু একবার তো লড়াই করে জাঁহাপনা দেখিয়ে দিয়েছেন ভয় পাবার লোক জাঁহাপনা নন

মানিকচাঁদ বলেছিল কিন্তু এবার তো ড্রেকসাহেব নয় জাঁহাপনা, এবার যে তৈলঙ্গ দেশ থেকে নতুন দল এসেছে। এদের সঙ্গে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন আছে, রবার্ট ক্লাইভ বলে আর একজন আঁদরেল কর্নেল আছে

নবাব বললে–এ লোকটা কেমন, মানিকচাঁদ? ওই ক্লাইভ?

 জাঁহাপনা, লোকটা কাটখোট্টা আদমি কাকে বলে মেহেরবানি, কাকে বলে তোয়াজু কিছু জানে না। দিল বলে কোনও পদার্থ নেই লোকটার–এককথায় মতলববাজ!

মির্জা মহম্মদ সব শুনলে।

তারপর বললে–এতদিন যে ফিরিঙ্গিরা ফলতায় গিয়ে ছিল, কী খেয়ে থাকত? আমি তো হুকুম দিয়ে দিয়েছিলাম কেউ ওদের খুরাকি বেচবে না! কে ওদের খুরাকি জোগান দিলে?

হঠাৎ মানিকচাঁদের মুখটা খানিকক্ষণের জন্যে যেন কালো হয়ে গেল। কথা বলতে গিয়ে জিভটা আটকে গেল।

তুমি খুরাকি জুগিয়েছ?

 নবাবের গলার শব্দে যেন আসমানের বাজ ভেঙে পড়ল আমদরবারে।

না জাঁহাপনা।

 তা হলে কে জোগান দিল? খিলাফত-ই-খুদা?

সবাই চুপ। মাসের পর মাস ফিরিঙ্গিরা ফৌজ-পল্টন নিয়ে হিন্দুস্থানের নবাবের হুকুম অমান্য করে হিন্দুস্থানের দরিয়াতে ভেসে রইল তবে কি সির্ফ হাওয়া খেয়ে? নিশ্চয় হিন্দুস্থানের নিমকহারামরা তাদের খুরাক জুগিয়েছে। কে সে নিমকহারাম? কে সে বেত্তমিজ! কে সে হারিফ? কে সে দুশমন? কে সে শয়তান?

সমস্ত আম-দরবারটা যেন গমগম করতে লাগল নবাবের রাগের চিৎকারে।

তা আমি জানি না জাঁহাপনা।

কিন্তু আমি জানি!

এবার আর রাগ নয়। এবার নবাবের গলায় যেন আর্তনাদের বিভীষিকা ভয়াল মূর্তিতে ফুটে উঠল।

তা হলে নবাব কি সব জেনে গেছে! মিরজাফর আলির বুকটা দুলে উঠল শিরশির করে। জগৎশেঠজি স্থির নিশ্চল নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নবাবের তো কিছু জানবার কথা নয়। তবে কি এও একটা কৌশল। ভেতরের খবর আদায় করবার কারসাজি?

তুমি কেমন করে নিমকহারামি করতে পারলে মানিকচাঁদ? তোমাকে না আমি কলকাতার সুবাদার করে দিয়েছিলাম! তোমার ওপর কলকাতার ভার তুলে দিয়ে আমি না নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিলাম। তোমাকে না আমি বিশ্বাস করেছি, তোমাকে না আমি ইয়াকিন করেছি! বলল, সত্যি কি মিথ্যে?

মানিকচাঁদ মাথা উঁচু করল।

না জাঁহাপনা, আমি নিমকহারামি করিনি!

তুমি ফিরিঙ্গিদের খুরাক জোগাওনি?

না।

তুমি উমিচাঁদের সঙ্গে হাত মেলাওনি? সত্যি বলো, কত টাকা কামিয়েছ তোমরা দু’জনে আমার দুশমনদের খুরাক হাজত-রফাই করে?

মানিকচাঁদের মাথাটা আস্তে আস্তে হেঁট হয়ে এল।

এত টাকা কামিয়ে তোমরা কার নিমকহারামি করলে মানিকচাঁদ? আমার, না হিন্দুস্থানের, না খুদাতালার? বলো বলো।

সমস্ত মতিঝিল, সমস্ত আম-দরবার হতবাকের মতো স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল নবাব মির্জা মহম্মদের করুণ মুখখানার দিকে।

এ হিন্দুস্থান কি আমার একলার মানিকচাঁদ? না আলিবর্দি খাঁ’র, না দিল্লির শাহেন শা বাদশাজাদার? এ তো কারও একলার তালুকদারি নয়! এ তোমার আমার খিলাফত-ই-খুদার! তোমরা কার সর্বনাশ করলে? আমার, না তোমার? না তামাম হিন্দু-মুসলমানের? যাদের আমি কলকাতা থেকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছি, তাদের তুমি আবার ডেকে আনলে টাকার লোভে? এত তোমার টাকার লোভ? কলকাতার সুবাদারি পেয়েও তোমার টাকার লোভ মিটল না?

এতক্ষণে মানিকচাঁদ সাহস করে আবার মুখ তুলল।

 বললে–জাঁহাপনা আমার ওপর অবিচার করছেন, জাঁহাপনা হয়তো ভুল খবর পেয়েছেন।

 ভুল খবর?

 মানিকচাঁদ বললে–নিজামতের চররা লোকের মুখের ভুল খবর জাঁহাপনাকে জানিয়েছে।

নিজামতের চর নয় মানিকচাঁদ।

তবে কে জানিয়েছে, জিজ্ঞেস করতে পারি কি জাঁহাপনা?

নবাব বললে–সে-খত আমার কাছে রয়েছে এই চিঠিতেই সব লেখা আছে

ও কার চিঠি জাঁহাপনা?

 উমিচাঁদের!

আবার থমথম করে উঠল আম-দরবার! আবার খানিকক্ষণের জন্যে যেন বিহ্বল হয়ে রইল মতিঝিল। কী বলবে ভেবে পেলে না কেউ।

ও চিঠি তো জালও হতে পারে জাঁহাপনা!

না, জাল নয়। সফিউল্লা খাঁ’র জেব থেকে পাওয়া গেছে এই রাজদার খত!

কে পেয়েছে?

পেয়েছে আমার বেগম। চেহেল্‌-সুতুনের বেগম।

 তিনি কী করে পেলেন এ চিঠি?

সেই বেগমই খুন করেছে সফিউল্লাকে! সেই বেগমসাহেবার নাম মরিয়ম বেগম।

তারপর যেন বড় ঘৃণা হয়েছিল মির্জা মহম্মদের। এই আমির-ওমরাও সকলকে জুতো মেরে আম-দরবার থেকে বার করে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। হায় রে! এরাই তার আমির। এদের পরামর্শ নিয়েই তিনি চালাচ্ছেন বাংলা বিহার উড়িষ্যার মসনদ! এদেরই খেতাব দিয়ে, খেলাত দিয়ে তিনি তোয়াজ। করছেন। এরা নিমকও খাবে আবার হারামিও করবে। অথচ কাকে বিশ্বাস করবেন? মরবার সময় আলিবর্দি খার চোখমুখ বড় করুণ হয়ে উঠেছিল মির্জার কথা ভেবে। কাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছেন তিনি তার নাতিকে। দিল্লির বাদশার দিন ফুরিয়ে গেছে। মসনদের চারপাশে শেয়াল কুকুর-শকুনির ভিড়, আর ওদিকে ওত পেতে বসে আছে ফিরিঙ্গিরা। তামাম হিন্দুস্থান হয়তো শ্মশান করে দিয়ে তবে ছাড়বে!

যাও, ভোরবেলা কলকাতা রওনা হব!

সবাই মির্জা মহম্মদের সামনে থেকে আড়ালে সরে গিয়ে যেন মুক্তি পেলে।

হঠাৎ নেয়ামতের গলার শব্দে চমক ভাঙল।

জাঁহাপনা, নানিবেগমসাহেবা আয়ি!

নানিবেগমসাহেবা?

জি জাঁহাপনা!

একলা?

না জাঁহাপনা, মরিয়ম বেগমসাহেবা ভি সঙ্গে আছে

মির্জা মহম্মদ আয়নার সামনে থেকে সরে এসে আম-দরবারের মাঝখানে দাঁড়াল। বললে–দাও, এত্তেলা দাও—

*

মতিঝিল, মুরাদবাগ, মনসুরগঞ্জ–আজকে এসব শুধু স্বপ্নের নাম। স্বপ্নের সমষ্টি হয়ে ঔপন্যাসিকের কল্পনার আশ্রয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেদিন সেই বিপ্লবের সন্ধিযুগে কে ভাবতে পেরেছিল দিল্লির মোগল বাদশার অধীনে বাংলার নগণ্য সুবাদারের একটা মসনদ নিয়ে সারা হিন্দুস্থানের ভাগ্যে এতবড় একটা বিপর্যয় ঘটে যাবে! কোথাকার কোন সাত সাগর তেরো নদীর পারের একটা তিরিশ বছরের বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো ছেলে এমনি করে হাজি আহম্মদের একমাত্র চোখের মণির চোখ থেকে ঘুম কেড়ে নেবে!

সমস্ত হিন্দুস্থানটাই যেন সেদিন বারুদখানা হয়ে উঠেছিল। বারুদের স্থূপ।

রাত্রে ঘুমোতে ঘুমোতে শুধু কি মির্জা মহম্মদই শিউরে উঠত? চেহেল্‌-সুতুনের অন্দরে বেগমদের যখন সারাফত আলির আরক খেয়ে দামি ঘুম নিতে হত, তখন মিরবকশি, মির মহম্মদ জাফর খাঁ-ও তো ছটফট করত এক ফোঁটা ঘুমের জন্যে। আর মিরমহম্মদ জাফর খাঁই বা একলা কেন? কে ঘুমোতে পারত নিশ্চিন্ত মনে? হাতিয়াগড়ের ডিহিদার রেজা আলির ঘোড়া সেই ফিরিঙ্গিটা পর্যন্ত নিজের আস্তাবলে দাঁড়িয়ে পা ঠুকত খটখট শব্দ করে। হাতিয়াগড়ে রাজবাড়ির অতিথিশালায় অতিথিরা পর্যন্ত ছটফট করত নিজের মনে। বর্গিরা নেই, ভাস্কর পণ্ডিতরা আর আসে না পশ্চিমদিক থেকে। তবু ভয় কীসের জন্যে কে জানে। রাস্তায় একা একা চলতে ভয়, অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে ভয়। নদীতে নৌকো বাইতে ভয়।

তা ভয় করবে না?

কেউ বুঝতে পারে না, কেউ বোঝাতে পারে না। তবু মনে হয় সকলের পায়ের তলার মাটিতে কোথাও যেন ফাটল ধরেছে। নিজামতের কাছারিতে গেলে টাকা না দিলে কেউ কথা বলে না। ঘরে বউ-ছেলেমেয়ে রেখে কোথাও যেতে ভরসা হয় না। প্রাণটাও যেন বেওয়ারিশ হয়ে গেছে গোরু-ছাগল-মুরগির মতো। ওপরওয়ালা বলে একমাত্র যদি কেউ থাকে তো সে আছে। কিন্তু তাকে তো দেখা যায় না। তা হলে কোথায় যাই? কার কাছে গিয়ে নালিশ পেশ করি?

বুঝতে পেরেছিল শুধু ওই মেয়েটা। হাতিয়াগড়ে থাকতে অতটা বোঝা যায়নি, কিংবা তখন বয়েস কম ছিল বলে হয়তো বুঝতে পারেনি। কিন্তু মুর্শিদাবাদে আসার পর থেকেই দেখলে এ এক অরাজক দেশ। গায়ে যতদিন ছিল মরালী ততদিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখেছে। সেখানেও বুঝি এর চেয়ে বেশি নিয়ম শৃঙ্খলা আছে। নিয়ম করে সূর্য ওঠে সেসব সংসারে, আবার নিয়ম করে সূর্য ডোবে। কিন্তু মুর্শিদাবাদে নিয়মকানুনের বালাই নেই। নিয়ম যা আছে তা সেরেস্তা কাছারির নথিপত্রে। অথচ এই মুর্শিদাবাদে আসবার আগে কত ভয় করেছিল। কিন্তু এসে দেখলে এর বাইরেই শুধু বজ্রআঁটুনি। ভেতরে ভেতরে ফসকা গেরো। এখানে বসে যা-কিছু বেনিয়ম করা যায়, কেউ কিছু বলবার নেই। ইচ্ছে করলেই তো একদিন চেহেল সুতুন থেকে পালিয়ে যেতে পারত সে। ওই কান্ত রয়েছে। ওকে একটু বললেই নিয়ে যায় এখান থেকে। কিন্তু চোখের সামনে যখন খাঁচার ফটকটা খোলা দেখলে তখন আর পালাবার উপায় রইল না। মনে হল পালিয়ে। কোথায় যাবে? যেখানেই যাবে সেখানেই তো আবার তার জন্যে নতুন খাঁচা তৈরি হয়ে থাকবে। ওই মেহেদি নেসার, ওই ইয়ারজান, ওই সফিউল্লারা তো সারা দেশটাতেই ছড়িয়ে রয়েছে। ওই উমিচাঁদ, ওই মিরজাফর, ওই জগৎশেঠ, ওরা থাকতে পালিয়েই বা যাবে কী করে?

কান্ত বলেছিল–ওদের সঙ্গে কি তুমি পারবে মনে করেছ?

কান্তর মুখের দিকে চেয়ে একটু মায়া হয়েছিল মরালীর। ছেলেটার কিছু হবে না। কেন যে পড়ে আছে মুর্শিদাবাদে! চলে গেলেই পারে! আবার বিয়েথা করে ঘর-সংসার করবার চেষ্টা করলেই ল্যাঠা চুকে যায়।

কান্ত বলেছিল–তা আর হয় না!

কেন? হয় না কেন?

 কান্ত প্রথমে বলতে চায়নি। বলেছিল–তুমি তো ওসব বিশ্বাস করবে না।

কী সব?

হাত দেখা!

হাত দেখা! হাত দেখার কথা শুনে মরালী একটু কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল।

হাত দেখা মানে? তুমি কাউকে হাত দেখিয়েছ নাকি? কী বলেছে সে?

কান্ত কিছুতেই বলতে চায় না। মরালী পীড়াপীড়ি করলে বলল না, কী বলেছে, বলো না

 কান্ত বলল তুমি যদি রাগ না করো তো বলি!

না, রাগ করব না, বলো।

কান্ত বললে–বলেছে, যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবার কথা ছিল তার সঙ্গেই নাকি আমার আবার বিয়ে হবে!

তার মানে?

কান্ত চুপ করে রইল।

মরালী বললে–তার মানে আমার সঙ্গে? তুমি বুঝি সেই আশাতেই আমার পেছনে ঘুরঘুর করছ? এই তোমার মতলব? ওসব মতলব থাকলে কিন্তু তোমাকে আর আমার কাছে আসতে দেব না, তা বলে রাখছি।

কান্ত বলেছিল–না না, সত্যি বলছি মরালী, আমার সে-মতলব নেই। বিশ্বাস করো আমাকে, আমি সেকথা বিশ্বাস করিনি

মরালী বলেছিল–আচ্ছা, তুমি এখন যাও তো, তুমি এখন আমার সামনে থেকে যাও

বলে কান্তকে জোর করে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল মরালী। যেতে কি চায়! জোর না করলে হয়তো যেতই না। তাঞ্জামে করে চকবাজার দিয়ে আসতে আসতে কান্তর কথাই বেশি করে মনে পড়েছিল তার।

নানিবেগম জিজ্ঞেস করেছিল–কী ভাবছিস মেয়ে?

মরালী বলেছিল কিছু না

নানিবেগম কিছুই বোঝে না। এতদিন নবাব আলিবর্দি খাঁ’র সঙ্গে সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছে আর চেহেলসুতুনের ভেতরে নিজের বেগমগিরি ফলিয়েছে। বাইরের পৃথিবীতে যে কী ষড়যন্ত্র চলছে তার নাতির বিরুদ্ধে, তার খবরও রাখে না। জানে না যে, এমনি করে চললে তার চেহেল্‌-সুতুনও একদিন চলে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে তার বেগমগিরিও চলে যাবে।

নেয়ামত ডাকতেই মরালী এগিয়ে গেল। পেছনে নানিবেগম। আজ আর কোনও ভয় করল না মরালীর নবাবের সামনে যেতে। আজ আর কোনও সংকোচও হল না।

নানিবেগমই প্রথম কথা বললে–তুই নাকি আবার লড়াই করতে যাচ্ছিস মির্জা?

হ্যাঁ নানিজি!

তা তুইও কি তোর নানার মতো কেবল লড়াই করেই জিন্দগি কাটাবি?

 নবাবি রাখতে গেলে তাই-ই হয়তো করতে হয় নানিজি!

মরালী এবার মুখ তুলল। বললে–জাঁহাপনা আমার কসুর মাফ করবেন। নানাজি তো লড়াই করেছিল ডাকাতদের সঙ্গে, মারাঠা ডাকাত। জাঁহাপনা কার সঙ্গে লড়াই করতে যাচ্ছেন?

নবাব বললে–এরা মারাঠা ডাকাতদের চেয়েও বদমাস, তার চেয়েও শয়তান এরা–

কে জাঁহাপনাকে বললে–সে কথা? জাঁহাপনা কি তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন?

নবাব মরালীর কথায় যেন ক্ষুণ্ণ হল। বললে–তোমার তো খুব সাহস বেগমসাহেবা! তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ তা জানো?

মরালী মাথা নিচু করে একবার কুর্নিশ করে নিলে। তারপর বললে–আমি গাঁয়ের মেয়ে, গেরস্ত ঘরের বউ, আমার যদি কিছু বেয়াদপি হয়ে থাকে, জাঁহাপনা আমাকে ক্ষমা করবেন।

কী বলছিলে বলল, আমার বেশি কথা বলবার সময় নেই।

নানিবেগম বললে–কোনও দিনই তো তোর সময় হবে না মির্জা। তোর জন্যে সবাই চেহেল সুতুনে আমরা বসে ছিলুম। আমি নিজে বাবুর্চিখানায় গিয়ে তোর মুরগি-মসল্লাম খানার বন্দোবস্ত করেছিলুম, হঠাৎ শুনলুম মানিকচাঁদের ডাকে তুই চলে এসেছিস

মরালী বললে–আপনি সেই চিঠি পড়বার পরও মানিকচাঁদকে বিশ্বাস করছেন?

বিশ্বাস!

হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে নবাব যেন ছেলেমানুষে পরিণত হয়ে গেল। সেই হাসিটার কথা মরালী জীবনে কখনও ভুলবে না। নবাব হেসে নানিবেগমের দিকে চেয়ে বললে–তোমার এই নতুন বেগমকে বুঝিয়ে বললো না নানিজি যে, মির্জা মহম্মদ কাউকেই বিশ্বাস করে না। বুঝিয়ে বলল না যে, মির্জা তার নিজের মাসিকে পর্যন্ত বিশ্বাস না করে তাকে ফাটকে পুরে রেখে দিয়েছে। শুধু মাসি কেন, বলে দাও তোমার মির্জা তার নিজের মা, নিজের বউ, নিজের ভাইকে পর্যন্ত কখনও বিশ্বাস করেনি। নিজের ভাইকে সে এই সেদিন খুন করে এসেছে। এখনও তার হাতের রক্ত শুকোয়নি। বলো না নানিজি, ভাল করে বুঝিয়ে বলল না বেগমসাহেবাকে। বেগমসাহেবা তো নতুন এসেছে, তাই এখনও জানে না তোমার মির্জাকে–

মরালী বললে–আমি জানি জাঁহাপনা, সব জানি। জানি বলেই তো জাঁহাপনার হুকুম ছাড়াই এখানে এসেছি!

তা আমি লড়াইতে যাই এটা তুমি চাও না, না?

 মরালী বললো—হ্যাঁ

নানিবেগম বললে–আমিও তো সেই কথাই তোকে বলতে এসেছি মির্জা

 কিন্তু কই, আমার মা, আমার মাসি তারা তো কেউ বারণ করতে এল না। তারা কি কেউ আমাকে ভালবাসে না? তোমরাই শুধু আমাকে ভালবাসো?

মরালী বললে–জাঁহাপনা, এ সংসারে কেউ কাউকেই ভালবাসে না।

সেকী? কী বলছ তুমি?

আমি ঠিক কথাই বলছি জাঁহাপনা। ওটা কথার কথা। আমরা সবাই নিজেকেই ভালবাসি। জাঁহাপনাই কি কাউকে কোনওদিন ভালবেসেছেন? আমরা জাঁহাপনার বেগম। আমাদের সকলের মুখ কি কোনওদিন জাঁহাপনা ভাল করে দেখেছেন? আমাদের কথা ছেড়েই দিন, জাঁহাপনা কি লুৎফুন্নিসা বেগমকেই কোনওদিন চিনতে চেষ্টা করেছেন?

মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা এই যেন প্রথম ভাল করে চেয়ে দেখলে মরিয়ম বেগমের দিকে। এতদিন যেন আমলই দেয়নি এই মেয়েটাকে। এ-মেয়েটা এত কথা শিখল কেমন করে!

এই যে আমি, এই যে নানিবেগমসাহেবা, এই আমরাই কি জাঁহাপনাকে ভালবাসি বলে এত কথা বলতে এসেছি?

মির্জা বললে–তা হলে এত রাতে কীজন্যে এসেছ তোমরা?

এসেছি আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। আমরা আমাদের ভালর জন্যই এসেছি। আমাদের যাতে কোনও ক্ষতি না হয় তাই আমরা জাঁহাপনাকে লড়াই করতে যেতে বারণ করতে এসেছি।

তা আমি লড়াই করতে গেলে তোমাদের কীসের লোকসান? আমি যদি হেরে যাই, সেই ভয়? আমি হেরে গেলে তোমাদের দেখবার কেউ থাকবে না, সেই লোকসান?

না, তা নয়!

মরালী একটু থেমে আবার বললেনবাব কি আপনিই প্রথম হয়েছেন? তা তো নয়। আমি তো শুনেছি আপনার আগে আরও অনেক নবাব এসেছেন গেছেন। সবাই লড়াই করেছেন। কেউ হেরেছেন, আবার কেউ বা জিতেছেন। জীবনেরই যখন কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই, তখন লড়াইতে হার-জিত তো ছোট কথা। আমি তা বলছিনা। আমি বলছি, জাঁহাপনার মতো এমন করে শত্রু নিয়ে কেউ লড়াই করতে যায়নি আগে। আপনি কাদের ওপর ভরসা করে লড়াই করতে যাচ্ছেন? কে আপনার দলে? কারা জাঁহাপনার লোক? আপনার কে আছে? জাঁহাপনার আমির-ওমরার মধ্যে কেউই তো নেই যে আপনার ভাল চায়।

মির্জা মহম্মদ চুপ করে রইল।

মরালী আবার বলতে লাগল–যে মানিকচাঁদকে আপনি কলকাতার সুবাদার করেছিলেন, সেই মানিকচাঁদই ফিরিঙ্গিদের চাল-ডাল-আটা বিক্রি করে হাজার হাজার মোহর কামালে। আপনি চেয়েছিলেন ফিরিঙ্গিদের দেশছাড়া করতে, আপনার ওমরাওরা তাদেরই আবার দেশের ভেতরে ডেকে আনলে। আপনি যাকে সবচেয়ে বিশ্বাস করেন, সেই উমিচাঁদও আপনার সর্বনাশ করবার জন্যে কাঁদ পাতছে। আমার বেআদপি মাফ করবেন জাঁহাপনা, আমি সফিউল্লা খাঁ-কে খুন না করলে এত কথা জানতেও পারতাম না, এত কথা বলতেও আসতাম না ।

মির্জা মহম্মদ নানিবেগমের দিকে চেয়ে বললে–নানিজি, তুমি বেগমসাহেবাকে বুঝিয়ে বললো না। যে, নবাবের কাছে এসব কথা নতুন নয়। নবাব সব জানে। একে বুঝিয়ে দাও যে, নবাবের মা, যে নবাবকে পেটে ধরেছে, সেও নবাবের ভাল চায় না! বলে দাও যে, বাংলার নবাব শত্রু নিয়েই সংসারে জন্মেছে।

নানিবেগম বললে–সে-সব আমি মরিয়মকে বলেছি, এ সব শুনেছে, তবু তোর কাছে এসেছে, তুই আর কারও কথা না শুনিস এর কথা শোনো বাবা

মির্জা যেন উত্তেজিত হয়ে উঠল। বললে–এসব পুরনো কথা শুনে কী করব? তবে কি বলতে চাও ওর কথা শুনে আমি সরফরাজ খাঁ’র মতন চেহেসতুনে গিয়ে বেগমদের সঙ্গে ফুর্তি করতে বসব? বেগমদের ঠুংরি গান শুনে আর তয়ফাওয়ালির নাচ দেখে দিন কাটাব? চারদিকে শত্রু আছে বলে কপাল চাপড়ে কাঁদতে বসব?

তারপর একটু থেমে আবার বলতে লাগল আর ভালবাসার কথা বলছ? মহব্বতের কথা বলছ? সে যে পায় সে পায়! আমি মহব্বত পাইনি বলে খুদাতালাকে গালাগালি দেব? খুদাতালার সঙ্গে কাজিয়া করব? আজ যদি আমি হিন্দুস্থানের খাতিরে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে মুকাবিলা করতে না যাই তো হিকায়াৎ আমাকে মাফ করবে? তারিখ-দান আমাকে ক্ষমা করবে?

মরালী খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে–জাঁহাপনা কথা দিন, জাঁহাপনার সঙ্গে আমাকে যেতে দেবেন ।

তুমি আমার সঙ্গে যাবে?

 কেন, জাঁহাপনার সঙ্গে কি তয়ফাওয়ালিরা যায় না?

তুমি কি তয়ফাওয়ালি?

ধরে নিন জাঁহাপনা, আমি আপনার তয়ফাওয়ালি!

কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে গিয়ে কী করবে?

মরালী বললে–আমি জাঁহাপনার পাশে পাশে থাকব–জাঁহাপনার যখন ভাবনায় ঘুম আসবে না, জাঁহাপনা যখন অশান্তিতে ছটফট করবেন, আমি তখন জাঁহাপনাকে একটু সান্ত্বনা দেব, কিংবা জাঁহাপনা যখন দুশমনদের হারিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন, আমি তখন জাঁহাপনার মুখের সামনে শরবতের গাগরা তুলে ধরব।

মির্জা মহম্মদ বললে–তার জন্যে তো আমার বাঁদিই থাকবে!

মনে করবেন না হয় আমি জাঁহাপনার বাঁদিই!

মির্জা মহম্মদ আরও কৌতূহলী হয়ে উঠল। আরও ভাল করে দেখতে লাগল মরিয়ম বেগমের মুখের দিকে।

বললে–কেন বলো তো? তুমি আমার জন্যে এতখানি করতে চাও কেন? তুমি কী চাও?

 মরালী তেমনি মুখ তুলেই বললে–আমি কিছুই চাই না জাঁহাপনা।

 কিন্তু বাংলার নবাবের জন্যে এতখানি দরদ তো ভাল কথা নয়? তুমি কি শোনোনি লোকে আমাকে আড়ালে কী বলে? লোকের কথা বুঝি তোমার কানে যায়নি? যদি কানে না গিয়ে থাকে তো যাকে জিজ্ঞেস করবে সে-ই তোমাকে বলে দেবে যে আমি লম্পট, আমি চরিত্রহীন, আমি বদমাইস, আমি মেয়েমানুষবাজ! এর পরেও তুমি আমার সঙ্গে যাবে?

মরালী হাসল নবাবের দিকে চেয়ে। বললে–আমি চেহেল্-সুতুনে এতদিন কাটালুম, লম্পট দেখলে আমার আর ভয় করে না জাঁহাপনা–আমি পাপের আড়তের মধ্যে বসে আছি, আমি জাঁহাপনার চরিত্রকে ভয় করি না! সঁহাপনার ভালর জন্যে আমি জাহান্নমে পর্যন্ত যেতে রাজি আছি

মির্জা মহম্মদ এবার একটু চুপ করে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করলে আসলে তুমি কে? তুমি কোত্থেকে এসেছ? আগে কী ছিলে? কোথায় ছিলে? দিল্লির তোষাখানায়?

নানিবেগম বললে–না রে মির্জা, ও হল হাতিয়াগড়ের ছোট রানিবিবি! ও হিন্দু! ওকে মেহেদি নেসার পরোয়ানা পাঠিয়ে চেহেল্‌-সুতুনে এনে তুলেছে।

মরালী নানিজির কথা শেষ না হতেই বললে–সেকথা আমি এখন ভুলে গিয়েছি জাঁহাপনা। আমি এখন মরিয়ম বেগম। আমার আর অন্য কোনও নাম নেই–

তুমি কি নিজের বাড়ি ফিরে যেতে চাও?

আমি ফিরে গেলেও আমার বাড়ি আমাকে আর ফিরিয়ে নেবে না। আমি চেহেল্‌-সুতুনে এসে পতিত হয়ে গিয়েছি।

তা হলে তুমি আর কী চাও বলো? কোথায় যেতে চাও? কার কাছে যেতে চাও? দেশে তোমার আর কে আছে বলো? কে তোমায় ফিরিয়ে নেবে?

কেউ নেবে না। জাঁহাপনা যাকে একবার নিয়েছে, চিরকালের মতো তার ভবিষ্যৎ চলে গেছে। দুনিয়ার কোথাও তার ঠাই নেই!

টাকা নেবে তুমি? আসরফি? মোহর?

না, আমার কিছুই চাই না। আমি জাঁহাপনার কাছে কাছে থাকতে চাই শুধু! যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন জাঁহাপনার কাছে থাকব, আর কিছুই চাই না।

মির্জা মহম্মদ বললে–কিন্তু আমার কাছে থাকলে যে চিরকালের মতো সুখের আশা জলাঞ্জলি দিতে হবে, তা পারবে?

কিন্তু আমি তো সুখ চাই না জাঁহাপনা।

মানুষ হয়ে জন্মিয়ে সুখ চাও না এ তো বড় তাজ্জব কথা। আমার বেগমদের মধ্যে এমন কথা তো আগে কখনও কারও মুখে শুনিনি!

মরালী বললে–জাঁহাপনা কি সকলের মনের কথা জানেন? সকলে কি জাঁহাপনার কাছে নিজেদের মন খুলে কথা বলে?

তুমি তো অনেক কথাই জানো দেখছি।

মরালী বললে–অনেক কথা না-জানলে কি জাঁহাপনার কাছে সাহস করে এসেছি? অনেক কথা জানি বলেই তো এমন করে মন খুলে কথা বলছি! আমার শুধু একটা অনুরোধ জাঁহাপনা, যদি লড়াই করতে যান তো আমাকে শুধু আপনার সঙ্গে যেতে দিন! তয়ফাওয়ালিরা যেমন যায়, বাঁদিরা যেমন যায়, বেগমসাহেবারা যেমন যায়, এবার তাদের মতো আমাকে জাঁহাপনার সঙ্গে যেতে দিন।

তা হয় না।

কেন হয় না জাঁহাপনা? আমি কি জাঁহাপনাকে সেবা করতে পারব না?

মির্জা মহম্মদ বললে–এবার সেলড়াই নয় বেগমসাহেবা, এবার সেরকম লড়াই নয়। এবার ফিরিঙ্গিদের একেবারে হিন্দুস্তান ছাড়া করে দিয়ে আসব। যাতে তারা আর এখানকার নোনা মাটিতে শেকড় গজাতে না পারে!

হঠাৎ বাইরে যেন কীসের গোলমাল হল। ভোর হয়ে এল নাকি? নাকি নবাবি ফৌজ কলকাতায় যাবার জন্যে তৈরি হয়ে এসেছে। কিন্তু কই, ভোরই যদি হবে ইনসাফ মিঞার নহবত বাজে না কেন?

নেয়ামত দৌড়োত দৌড়োতে এসেছেজাঁহাপনা, সরাবখানার খিদমদগারকে ধরেছি

মির্জা মহম্মদ বললে–কোতোয়ালের কাছে নিয়ে যা–এখন আমি ব্যস্ত আছি

জাঁহাপনা, তার সঙ্গে আর একজন ছিল, দু’জনে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলছিল সরাবখানায়।

কে সে?

আমি তাকে নিয়ে আসছি জাঁহাপনা–বলে নেয়ামত দৌড়ে বাইরে গেল। গিয়েই আবার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এল দু’জনকে নিয়ে। একজন বুড়োমানুষ, তার সঙ্গে কান্ত!

মরালী দেখেই চমকে উঠেছে। কান্ত আবার এখানে এল কী করে!

জাঁহাপনা, এ আমাদের সরাবখানার খিদমদগার, আর এ…

 মির্জা মহম্মদ ভাল করে চেয়ে দেখছিল কান্তর দিকে। যেন চেনা-চেনা লাগছিল। মরালীও অবাক হয়ে গিয়েছিল। নানিবেগমসাহেবাও কান্তর দিকে চেয়ে দেখছিল। এই ছেলেটাকেই তো চেহেল্‌-সুতুনে মরিয়ম বেগমের ঘরে সন্ধেবেলা দেখেছিল!

জাঁহাপনা, এর নাম ইব্রাহিম খাঁ। আর এ হল কাফের। এই কাফেরটার সঙ্গে এ সরাবখানার ভেতরে গুজগুজ ফিসফিস করে কথা বলছিল।

মির্জা মহম্মদ দু’জনের দিকে চেয়েই কেমন যেন তাদের মনের ভেতরের মতলব বার করবার চেষ্টা করলে।

জাঁহাপনা, এই ইব্রাহিম খাঁ’র মতলব ভাল নয়। বাইরের আদমির সঙ্গে বাতচিত করে, চকবাজারে গিয়ে সলাপরামর্শ করে, সারাফত আলির আদমি বাদশার সঙ্গে…

ইব্রাহিম খাঁ আর পারলে না। মরিয়ম বেগমের দিকে চেয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে–মা, তুমি আমাকে বাঁচাও মা, আমি বুড়োমানুষ। আমাকে তুমি চিনতে পারবে কি মা আমি সেই সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাই, আমার পিতা ইন্দিবর ঘটক, পিতামহ ঈশ্বর কালীবর ঘটক…

মরালী চমকে উঠল। বললে–আপনি সেই ঘটকমশাই?

হ্যাঁ মা, আমি এই কান্ত বাবাজির সঙ্গে একটু কথা বলছিলাম, এরা আমাকে ধরে এনেছে।

মরালী কান্তর দিকে চাইলে আবার আর তুমি? তুমি আবার কী করতে এসেছিলে এখানে?

তোমার জন্যে!

আবার তুমি এসেছ? আমি বলেছি না, আমি ডাকলে তবে আসবে! কেন এলে?

মির্জা এতক্ষণ সব শুনছিল। মরিয়ম বেগমের দিকে চেয়ে বললে–তুমি এদের চেনো নাকি?

হ্যাঁ জাঁহাপনা। এ আমার বিয়ের সময় ঘটকালি করেছিল জাঁহাপনা। আগে হিন্দু ছিল। আমি প্রথমে চিনতে পারিনি, নবাবের কোনও ক্ষতি করবার ক্ষমতা এর নেই জাঁহাপনা।

আর এ?

এর কথা আমি পরে বলব। ওরা আগে চলে যাক

মির্জা মহম্মদ ইঙ্গিত করতেই নেয়ামত দু’জনকে নিয়ে বাইরে চলে গেল।

মরালী আবার বললে–এর জন্যেই আমি জাঁহাপনাকে বলতে এসেছিলাম।

ওর সঙ্গে তোমার কীসের সম্পর্ক?

কোনও সম্পর্ক নেই জাঁহাপনা। একদিন ওর সঙ্গেই আমার বিয়ে হবার কথা হয়েছিল। কিন্তু হয়নি। তারপর চেহেলসূতুনে আসবার সময় ও-ই আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছিল।

কিন্তু এখনও কেন তোমার কাছে আসে?

ও আমার ভাল চায়!

তোমার ভাল চেয়ে ওর লাভ?

মরালী বললে–ভাল চাওয়া যার স্বভাব সে লোকের ভালই চাইবে, লাভ-লোকসানের কথা ভাববে । এই আমি যেমন জাঁহাপনার ভাল চাই—

ওর সম্বন্ধে তুমি কী বলতে এসেছিলে?

জাঁহাপনা, আমার একটি শুধু আর্জি, জাঁহাপনার সঙ্গে যদি আমাকে না যেতে দেন তো ওকে জাঁহাপনার সঙ্গে যেতে দিন, ও জাঁহাপনাকে মদত দেবে, ও জাঁহাপনার সেবা করবে। ও জাঁহাপনার পাশে পাশে থাকবে, জাঁহাপনার কোনও ক্ষতি না হয় তাই দেখবে। ও জাঁহাপনার…

কিন্তু তার জন্যে তো অন্য লোক আছে!

মরালী বললে–এরপর আমি আর কাউকেই বিশ্বাস করি না জাঁহাপনা। ও কাছে থাকলে আমি তবু নিশ্চিন্ত হব, নইলে যে চেহেল্‌-সুতুনে বসে বসে আমার ভাবনায় দিন কাটবে না।

মির্জা মহম্মদ নানিবেগমসাহেবার দিকে চাইলে এবার।

নানিজি, তবে যে তুমি বলেছিলে আমাকে কেউ ভালবাসে না। এই তো একজন রয়েছে যে আমার ভাল চায়, যে আমার জন্যে ভাবে

নানিবেগম কথা বলবার আগেই নহবতখানায় ইনসাফ মিঞার নহবতে টোড়ির সুর বেজে উঠল। সুরটা শুনেই যেন সবাই সচেতন হয়ে উঠেছে।

মির্জা মহম্মদ বললে–তোমার কথাই রইল বেগমসাহেবা, ও থাকবে আমার সঙ্গে, কিন্তু তোমরা এখন যাও, আমায় তৈরি হতে হবে আমি এখুনি হুকুমত জারি করে দিচ্ছি

তারপর ডাকলে–নেয়ামত!

ততক্ষণে মরালী নবাবকে কুর্নিশ করে আম-দরবার থেকে বেরিয়ে এসেছে। নানিবেগমও বেরিয়ে এসেছে মরালীর পেছন পেছন। চবুতরার ওপরে তাঞ্জাম দাঁড়িয়ে ছিল। দু’জোড়া হাতিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ে তাল ঠুকছিল।

মুর্শিদাবাদের আকাশের পুব দিকটায় তখন অন্ধকার পাতলা হয়ে এসেছে। পাতলা হয়ে এসেছে মোগল ঐশ্বর্যের শেষ আড়ম্বরের গাঢ় রং। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা তখনও জানত না যে এবারে যে সূর্য পুব দিক থেকে উঠছে সে অন্যদিনের চেয়েও প্রখর, অন্যদিনের চেয়েও উজ্জল। ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে যে-সভ্যতা আরব সমুদ্র পেরিয়ে হিন্দুস্থানে এসে আসন গাড়তে এসেছিল সে অন্যরকম। হিন্দুস্তানের পশ্চিম আকাশে তার আবির্ভাব একদিন অমোঘ হয়েছিল বলেই এ-দেশের মানুষ নিজের অর্থ, নিজের ঐশ্বর্য, নিজের গৃহলক্ষ্মীকে পর্যন্ত তার পায়ে জলাঞ্জলি দিয়েছিল। কিন্তু এবার আর অত সহজে ওদের খিদে মিটবে না। এবার যে আসছে সমস্ত পৃথিবী তার মুঠোর মধ্যে চাই। আগে যারা এসেছিল তারা এখানকার মসনদ নিয়েছিল, এবার এরা নেবে মুনাফা। কারবারের মুনাফা, মসনদের মুনাফা আর মনুষ্যত্বের মুনাফা নিয়ে তবে এরা হিন্দুস্তানকে রেহাই দেবে।

তাঞ্জাম যখন মতিঝিলের ফটক পেরিয়ে আবার চকবাজারের রাস্তায় পড়ল তখন নবাবি ফৌজ তৈরি হয়ে নিয়েছে। সেই ভোরবেলাই নহবতের টোড়ির রাগের সঙ্গে ফৌজি কাড়া-নাকাড়ার খাদ মিশে তুমুল হট্টগোল শুরু করে দিয়েছে। আর সারা মুর্শিদাবাদ সেই হট্টগোলেই ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে।

*

ছোটমশাইয়ের বজরা যখন বরানগরের ঘাটে পৌঁছোল তখন বিকেল হয়ে গেছে। শীতকাল। জঙ্গুলে জায়গা, আশেপাশে কোথাও কোনও লোকজনের দেখা নেই, কোথায় ফিরিঙ্গি কোম্পানির কর্নেল সাহেবের ছাউনি তাও জানা নেই। ছোটমশাই বজরা থেকে নেমে ঘাটে উঠলেন। ঘাটের উপরেই একটা ভাঙা পোডো মন্দির। এককালে ওলন্দাজরা ছিল এ জায়গাটায়। ইংরেজ ফিরিঙ্গিরা আসার পর তারা হুগলির দিকে চলে গিয়েছে।

রাস্তায় চলতে চলতে একজনের সঙ্গে দেখা হল।

 ছোটমশাই জিজ্ঞেস করলেন–ওগো, ও মশাই

লোকটা কাছে এল। ছোটমশাই জিজ্ঞেস করলেন–এখানে ফিরিঙ্গি কোম্পানির ছাউনিটা কোথায় বলতে পারো? পল্টনরা থাকে?

লোকটা বললে–আজ্ঞে, আরও পোটাক রাস্তা পেরোতে হবে

সেখানে ক্লাইভ বলে একজন ফিরিঙ্গি ফৌজি বড়সাহেব থাকে?

 লোকটা বললে–তা জানিনে হুজুর–থাকতে পারে।

 তা তোমরা এতদিন এখেনে আছ, আর ফিরিঙ্গি ফৌজের খবর রাখ না!

হুজুর, আমরা ওসব খবর রাখব কী, ফিরিঙ্গিদের মাল কেনা-বেচা করতে মানা করে দিয়েছে। সরকার!

বলে লোকটা যেদিকে যাচ্ছিল সেইদিকেই চলে গেল। চাষি লোক, হাতে একটা পাঁচনবাড়ি। সাপখোপের ভয়ে পাঁচনবাড়ি নিয়ে পথ চলছে। আরও ওদিকে লম্বা আকাশ-ছোঁয়া ধানখেত। নতুন ধান বুনেছে গাঁয়ের লোকেরা।

ছোটমশাই যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যে নিশানা দিয়েছিলেন সেই নিশানা ধরেই চলেছিলেন। কিছু দূর গিয়েই মনে হল অনেকগুলো গোলপাতায় ছাওয়া চালাঘর। ওইগুলোই বোধহয় ফৌজি ছাউনি। ফিরিঙ্গিদের পল্টন-লশকররা বোধহয় ওইখানেই থাকে। কিন্তু কাছে গিয়ে কারও দেখা পেলেন না। সব ফাঁকা পড়ে আছে। ঘর-দোর নির্জন। মাটির এঁটো হাঁড়িকুড়ি ভাঙাচোরা অবস্থায় ছড়িয়ে আছে। গেল কোথায় সব! ঘর-দোর সমস্ত ছেড়ে গেল কোথায় সব! দু-চারটে কুকুর ভাতের লোভে ছোঁকছোঁক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে। ছোটমশাইকে দেখে একটু বোধহয় ভয় পেল। তারপর আবার এটো ভাতের হাঁড়ি চাটতে লাগল।

ওদিক থেকে আর একটা লোক আসছিল।

ছোটমশাই তাকেও ডাকলেন–ওগো, ও মশাই, শুনছ—

লোকটা পাগল কচ্ছমের বলে মনে হল। কাছে এসে বললে–আমি মশাইনই গো, মশাইনই আমি।

তবে তুমি কে?

এজ্ঞে আমি হরির দাস উদ্ধব দাস।

তুমি ফিরিঙ্গি-পল্টনের লোক?

 না বাবুমশাই, ফিরিঙ্গি-পল্টনের লোক হতে যাব কোন দুঃখে? আমি হরির লোক।

 কোন হরি?

এজ্ঞে শ্রীহরি পতিতপাবন ভগবান। শ্রীহরির নাম শোনেননি বাবুমশাই? আমি তারই লোক। আপনি কার লোক?

ছোটমশাই বুঝলেন লোকটা পাগল। বেশি ঘাঁটাতে চাইলেন না। শুধু বললেন–তুমি এখেনে কী করতে এসেছ?

এজ্ঞে, আমার বউ এখেনে আছে, তারই সন্ধানে এসেছি।

তোমার বউ? এই পল্টনের ছাউনিতে তোমার বউ এল কেমন করে?

উদ্ধব দাস বললে–আমার বউই তো আমার বালাই বাবুসাহেব—

বালাই? তার মানে?

 উদ্ধব দাস বললে–তবে শুনুন একটা ছড়া বলি–

ভূতের বালাই রাম।
যোগীর বালাই কাম ॥
পথের বালাই টাকা।
পিঁপড়ের বালাই পাখা ।
সতীর বালাই সজ্জা।
ভিখিরির বালাই লজ্জা ॥
ব্যাঙের বালাই সর্প৷  
বুলীর বালাই দর্প ।
সেপাইয়ের বালাই ডর।
 সকলের বালাই পর ॥
 নন্দের বালাই হর।
ইংরেজের বালাই জ্বর ॥
মউমাছির বালাই মউ।
আর, আমার বালাই বউ ॥

বলে উদ্ধব দাস হাহা করে হেসে উঠল। সেই নির্জন নিরিবিলি বিকেলবেলায় পাগলাটার হাসিটা যেন প্রতিধ্বনি হয়ে আবার ছোটমশাইয়ের কাছেই ফিরে এল।

তা এখানে কর্নেল ক্লাইভ সাহেবের ডেরাটা কোথায় বলতে পারো?

উদ্ধব দাস বললে–ওই তো, ওইটে। ওই ফিরিঙ্গি সাহেবটাই তো আমার বউটাকে তার বাড়িতে রেখে দিয়েছে বাবুমশাই, সাহেবটা এজ্ঞে খুব ভাল লোক, আমার বউই আমার কাছে আসতে চায় না।

কেন? আসতে চায় না কেন?

আমাকে পছন্দ হয় না বাবুমশাই। আমি যে কুরূপ!

ছোটমশাই আর বেশি কথা না বলে কর্নেল সাহেবের ডেরার দিকেই এগোতে লাগলেন। বেশ খড়ের চালের বাড়ি। চালের ওপর লাউডগা লকলক করে লতিয়ে উঠেছে। উদ্ধব দাসও ছোটমশাইয়ের পেছন পেছন চলতে লাগল।

*

পলাশির যুদ্ধের পরে একদিন বাগানবাড়ির বারান্দায় বসে গড়গড়া টানতে টানতে কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ বেঙ্গলে আসার পর থেকে সমস্ত ঘটনাগুলো মনে মনে আলোচনা করে দেখেছিল। বেশি বয়েস হলেই হয়তো অতীত জীবনটা ঝালিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। তখন মনে হয় এতদিন এই পৃথিবীতে বেঁচে থেকে করলুম কী! এক-একটা যুদ্ধ করেছি আর ইন্ডিয়ানদের খুন করেছি। নিজের লোকও কিছু খুন হয়েছে। কিন্তু কার জন্যে এসব করলাম? এতে কার কী লাভ হল? আমি কার লাভ চেয়েছিলাম? আমার নিজের, না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির, না ইন্ডিয়ার? সেদিন ইন্ডিয়ার ম্যাপটাই চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল কর্নেল ক্লাইভের।

সত্যিই, সেদিন যখন খবর এল নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা ত্রিবেণী পর্যন্ত এসে গেছে, তখন আর ভাববারও সময় ছিল না।

তাড়াতাড়ি ছাউনি থেকে ফিরে এসেই ডাকলে হরিচরণ—

হরিচরণ ছিল না। দুর্গা বেরিয়ে এল। বললে–কী বাবা, হরিচরণ তো নেই

সাহেব বললে–দিদি, এদিকে একটা ডেঞ্জার হয়েছে, নবাব আসছে কলকাতায়, আমি তো ফৌজ নিয়ে নবাবের মোকাবিলা করতে যাচ্ছি–

তার মানে? তুমি আর ফিরবে না?

ফিরব না তো বলিনি। বলছি নবাবের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করতেই হবে এবার। আর ঠেকানো গেল না। কিন্তু তোমাদের কথা ভেবেই একটু অস্থির হচ্ছি

কোথায় লড়াই হবে! এখেনে নাকি?

যে রবার্ট ক্লাইভকে ফৌজের লোকরা এত ভয়, করে, যে রবার্ট ক্লাইভের নামে মুর্শিদাবাদের নবাব-নিজামত পর্যন্ত থরথর করে কাঁপে, যার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আমির-ওমরাওরা পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে পরামর্শ করে, সুদূর করমণ্ডল উপকূল থেকে শুরু করে বাংলার প্রত্যন্ত প্রদেশ পর্যন্ত যে-রবার্ট ক্লাইভের নাম ছড়িয়ে গেছে অত্যাচারের প্রতিভূ হিসেবে, সেই লোকটাই যখন আবার দুর্গার সামনে দাঁড়ায়, ছোট বউরানির কাছে আসে, তখন সে যেন একেবারে ঘরের ছেলে হয়ে যায়।

তা হলে আমি চললুম দিদি, তোমরা এখানে থাকতে পারবে তো?

কিন্তু সাহেব, তুমি যদি আর না ফেরো?

ফিরব না মানে?

বলা তো যায় না কিছু বাবা, গুলি-গোলা নিয়ে লড়াই করতে যাচ্ছ, মারা যেতে কতক্ষণ!

সাহেব হেসে উঠল–আমি অত সহজে মরব না দিদি, মরলে অনেক আগেই মরে যেতুম! দুদু বার পিস্তল ছুঁড়েছি নিজের বুক লক্ষ্য করে, তবু যখন মরিনি তখন আর মরব না আমি চলি দিদি

দুর্গা অবাক হয়ে গেল। বললে–তুমি চললে কী গো, তা হলে আমরা কোথায় যাব? এখানে আমাদের দেখবার কে থাকবে?

সাহেব বললে–তা হলে না-হয় আমার সঙ্গে চলো!

তোমার সঙ্গে কোথায় যাব গো? তোমরা তো লড়াই করবে, তোমাদের সঙ্গে আমরাও কি লড়াই করতে গিয়ে মরব নাকি? তার চেয়ে আমাদের বাপু যেমন করে তোক হাতিয়াগড় পৌঁছে দাও, মরতে হয় আমরা নিজের দেশে গিয়ে মরব।

সাহেব বললে–হাতিয়াগড়ে এখন এই অবস্থায় তোমাদের পাঠাই কী করে? কোন রাস্তায় কখন কী হয় কে বলতে পারে?

তারপর একটু ভেবে বললে–তার চেয়ে আমাদের তো পল্টন-লশকর-সেপাইরা সব যাচ্ছে, আমাদের সঙ্গেই চলোরাস্তাঘাট ঠিক আছে বুঝলে তোমাদের দেশে পাঠিয়ে দেব

তোমরা কদ্দূর যাবে?

তা কি আগে থেকে বলতে পারা যায় দিদি, নবাব তো ত্রিবেণী পর্যন্ত এসে গেছে, আমরাও পল্টন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে মোলাকাত হয় সেখানেই লড়াই বেধে যাবে।

দুর্গা সব শুনে একটু ভাবলে। বললে–তারপর?

তার পরের কথা আমিও জানি না, কেউ জানে না। এখানে তোমরা একা থাকার চেয়ে তো সেই ভাল! এখানে সেদিন কী কাণ্ডটা হয়েছিল বলে তো! আমি সেই সময়ে না এসে পড়লে সেই স্পাইটা তো তোমাদের সর্বনাশ করত!

সে-লোকটার শেষপর্যন্ত কী হল বাবা?

সাহেব বললে–কী আর হবে, স্পাইটাকে গুলি করে মারলুম!

 দুর্গা চমকে উঠল–জ্যান্ত লোকটাকে গুলি করে মারলে তোমরা?

তা মারব না! ও যে স্পাই দিদি!

কী সর্বনাশ, গুলি করতে তোমাদের একটু বাধল না গো?

 সাহেব হেসে উঠল। বললে–কত হাজার হাজার লোককে গুলি করে মেরেছি এই হাত দিয়ে তা তো গুনে রাখিনি!

কী করে মারো বাবা তোমরা? তোমাদের প্রাণে একটু মায়া-দয়া নেই! মারতে হাত কাঁপে না তোমাদের? তোমার চেহারা দেখে তো বাপু বোঝা যায় না তুমি আবার লোক খুন করতে পারো!

সাহেব বললে–আমি তা হলে আসি দিদি, তোমাদের জন্যে সব ব্যবস্থা করে আমি তোক পাঠিয়ে দিচ্ছি, হরিচরণ এলেই তোমরা তার সঙ্গে চলে যাবে

তা এমনি করেই সেদিন হঠাৎ আস্তানা গুটিয়ে নিয়ে ক্লাইভকে চলে যেতে হয়েছিল বরানগর ছেড়ে। সেসব ক্লাইভের মনে ছিল। সে-দিনগুলো স্মৃতির খাতায় চিরকাল জ্বলজ্বল করত কর্নেল ক্লাইভের। বিকেল-বিকেল রওনা দিয়েছিল পল্টনরা। ক’টাই বা পল্টন। নবাব যদি ইচ্ছে করে তো পিষে মেরে ফেলতে পারত সে ক’জনকে। দল বেঁধে সার সার পল্টনরা চলেছে। পল্টনদের দেখে গাঁ থেকে দলে দলে তোক পালাচ্ছে। খেত-খামার ছেড়ে লোকগুলো সব কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

গোরুর গাড়ির ভেতরে বসে ছোট বউরানি বাইরের দিকে চেয়ে দেখছিল। গাঁ-গঞ্জে কেউ কোথাও নেই। শীতকালের বেলা। দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে আসে। চারদিক দেখলে ভয় হয়।

দুর্গা সাহস দিলে। বললে–ভয় কী? আমি তো সঙ্গে রয়েছি

বউরানি বললে–আমি তো আর ভরসা পাচ্ছিনে দুগ্যা কোথায় কোথায় সাহেবের সঙ্গে ঘুরছি : বল দিকিনি আবার কোথায় আমাদের নিয়ে যাচ্ছে কে জানে! একটা মেয়েছেলের মুখ পর্যন্ত দেখতে

পাচ্ছিনে, সব পল্টন–

তা মেয়েছেলে না-ই বা রইল, আমি তো আছি, সাহেব তো আছে!

বউরানি বললে–সায়েবই বা কোথায়, তার তো টিকিই দেখা যাচ্ছে না–

তা বরানগর থেকে বাগবাজার কি কম রাস্তা! কেবল বন-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া। গাড়ির ছইয়ের ভেতর পরদা দিয়ে ঢাকা। গাড়োয়ানের মুখখানা পর্যন্ত দেখা যায় না। চলতে চলতে এক জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামল।

এ কোথায় নিয়ে এল গো আমাদের? ও দুগ্যা, এ যে জঙ্গল রে—

দুর্গাও তখন পরদাটা তুলে বাইরে চেয়ে দেখছে। তখন রীতিমতো ঘুটঘুঁটে রাত। গাড়িটা থামতেই হরিচরণ এল। বললে–নেমে পড়ো দিদি, নেমে পড়ো

এ আমাদের কোথায় নিয়ে এলে হরিচরণ? এখেনে কোথায় থাকব?

হরিচরণ বললে–কেন? এ তো বাগবাজারের পেরিন সাহেবের বাগান, এখেনে তোমাদের কোনও ভয়-ডর নেই, ঘরদোর সব আছে, চান করা-খাওয়াদাওয়ার সব বন্দোবস্ত আছে।

আর তোমার সায়েব?

সায়েব খুব ব্যস্ত দিদি! পল্টনরা সব সেজেগুজে তৈরি হয়ে নিচ্ছে, লড়াই হবে কিনা?

 দুর্গার মাথাটা ঘুরে গেল। বললে–লড়াই হবে কী গো! লড়াই হলে আমরা যাব কোথায়?

মনে হল হরিচরণ যেন বেশ ভয় পেয়েছে। সেও যেন বেশ ভাল্লায় পড়েছে। তবু নামতে হল বাগানে। পেরিন সাহেবের বাগানে ঘর-দোর অনেক। এককালে পল্টন-মশকর সব থাকত। এখানেই আগে একদিন বড় রকমের একটা লড়াই হয়ে গেছে। বড় বড় সব গাছ চারদিকে। পাশেই গঙ্গা। ইচ্ছে করলে রোজ গঙ্গাস্নান করতে পারবে ওরা।

দুর্গা আর বউরানি একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল। ঘরটা একেবারে একটেরে। ওদিকের পল্টনদের হইচই কানে আসে না। হরিচরণ বললে–তোমরা একটু বোসো এখেনে, আমি তোমাদের খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করে আসছি

কিন্তু তবু যেন হরিচরণের কথায় বিশ্বাস হল না। কোথায় নবাবের সঙ্গে এরা যুদ্ধ করবে, তা নয়, মেয়েমানুষ নিয়ে এদের আর এক বিড়ম্বনা।

সত্যিই বিড়ম্বনা। বাগানের ভেতর আর একখানা বন্ধ ঘরে তখন ক্লাইভ আর একজনের সঙ্গে চুপি। চুপি কথা বলছে।

লোকটার পায়েও জুতো নেই। গায়ে শুধু একটা উড়ুনি। মাথার পেছন দিকে একটা টিকি!

তোমার কী নাম বললে?

 হুজুর, নবকৃষ্ণ!

নবকৃষ্ণ! নবকৃষ্ণ! ক্লাইভ যেন নামটা উচ্চারণ করে নিজের জিভটাকে সড়োগড়ো করতে চাইলে। লোকটার দিকে আবার ভাল করে চেয়ে দেখলে। গরিব লোক। লোকটার জীবনের ইতিহাস শুনেও অবাক হয়ে গেল ক্লাইভ।

হ্যাঁ হুজুর, সাহেবদের কোম্পানিতে কাজ করতে আমার বড় সাধ! আমার বড় সাধ আমি কোম্পানির সেবা করি।

কত টাকা মাইনে চাও?

আজ্ঞে, হুজুরদের শ্রীচরণে আশ্রয় পেলেই আমি ধন্য হয়ে যাব, আমি মাইনে চাই না।

অদ্ভুত লোকটা। রবার্ট ক্লাইভ যেন লোকটার মধ্যে নিজেকেই দেখতে পেয়েছিল সেদিন। তারই মতো একটা অনাথ ছেলে। ত্রিভুবনে কেউ নেই। শুধু নিজের পায়ে মাটির ওপর দাঁড়াবার মতো একটা আশ্রয় পেলেই খুশি। সুতোনুটির গঙ্গার ঘাটে কোম্পানির জাহাজগুলো পাল তুলে এসে থামে, আর ছেলেটা ঘাটের কাছে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সাহেবদের জাহাজ থেকে নামতে দেখলেই সেলাম করে। গুড মর্নিং করে। কেউ যদি কোনওরকমে একটা চাকরি দেয় কোম্পানির দফতরে তো খেতে পরতে পায়!

তারপর?

যেন রবার্ট ক্লাইভের নিজের সঙ্গেই মিলে যাচ্ছিল। এই লোকটাই পারবে। একে দিয়েই কাজ উদ্ধার হবে। মনে মনে সব ঠিক করে ফেলেছিল। আর শুনছিল কথাগুলো। উমিচাঁদ লোকটা জহুরিই বটে। বেছে বেছে ঠিক লোককেই পাঠিয়ে দিয়েছে।

হঠাৎ হরিচরণ ঘরে ঢুকল। সাহেবের ঘরে হরিচরণের অবাধ গতি!

হুজুর, ওদের এখেনে এনে তুলেছি। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ওরা ভয় পাচ্ছেন, বলছেন লড়াই হলে ওদের কী হবে! আমি বলেছি কিছু ভয় নেই। বুঝিয়ে সুঝিয়ে হুজুরের কাছে এসেছি।

ক্লাইভ সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলে। বললে–তুই যা, আমি কাজ সেরে যাচ্ছি এখুনি

হরিচরণ চলে যাচ্ছিল। সাহেব বললে–কলকাতার কেল্লা থেকে পল্টনরা এসে পৌঁছেছে?

 আজ্ঞে এখনও আসেনি হুজুর।

আসার খবর আর দিতে হল না। ওদিক থেকে তখন বিউগল বাজাতে বাজাতে পল্টনরা এসে পড়েছে। পেরিন সাহেবের বাগানের বাইরে মশালের আলোতে সব আলোময় হয়ে উঠেছে।

তা হলে আমি কি বসব হুজুর?

সাহেব বললে–বোসো, তোমাকে আমি আজ থেকেই চাকরি দিলুম। কলকাতার কেল্লা থেকে আমাদের আর্মি আসার কথা, তারা না আসাতে ভাবছিলুম খুব

সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের বারান্দায় দাঁড়াল। ওয়াটসন তা হলে কথা রেখেছে। মোট দাঁড়াল পাঁচশো গোরা পল্টন, সাড়ে পাঁচশো গোরা লশকর, আটশো দিশি সেপাই, ষাটজন গোরা গোলন্দাজ আর দুটো কামান।

সামনে এসে দাঁড়াল স্ক্র্যাফটন। হাতে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের নোট। ক্লাইভকে স্যালিউট করে চিঠিটা এগিয়ে দিলে। ক্লাইভ বললে–এসো, ভেতরে কে আছে দেখো

কে?

 ক্লাইভ বললে–আমার নতুন ক্লার্ক

 নবকৃষ্ণ চুপ করে ঘরের ভেতরে বসে ছিল। দুজন সাহেব ভেতরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়াল।

এই আমার নতুন ক্লার্ক। ফারসি-জানা মুনশি!

কিন্তু আমাদের ক্লার্ক রামচাঁদ তো আছে। সেও তো ফারসি জানে! আবার একে কেন রাখলেন কর্নেল?

আছে, দরকার আছে। ওদিককার কী খবর আছে বলো? নবাবের সঙ্গে আমি কত আছে?

স্ক্র্যাফটন বললে–খবর পেয়েছি ওদের সঙ্গে আছে আঠারো হাজার ক্যাভালরি, ফিফটিন থাউজ্যান্ড সোলজার, পঞ্চাশটা এলিফ্যান্ট আর চল্লিশটা ক্যানন

কথাটা শুনে কেমন যেন চুপ করে রইল সাহেব কিছুক্ষণ! তারপর দাঁড়িয়ে উঠল।

বহুদিন আগে সেন্ট পোর্ট ডেভিডের সোলজাররা একদিন এই লোকটার আসল মূর্তি দেখেছিল। স্ক্র্যাফটন আর নবকৃষ্ণ সে-মূর্তি দেখেনি। কিন্তু দেখলে, এক মুহূর্তে যেন চেহারাটা হঠাৎ বদলে গেল। বাইরে মশাল জ্বালিয়ে গোরা পল্টনের দল বিউগল বাজাচ্ছে তখনও।

কী, ভয় পাচ্ছ মুনশি?

 নবকৃষ্ণ ভয় পেয়েছিল মনে মনে। কিন্তু মুখে বললে–আমি হুজুরের সারভেন্ট স্যার

সাহেব বললে–তা হলে স্ক্র্যাফটন, তুমি আমার অর্ডার জানিয়ে দাও আর্মির লোকদের, আজকেই এখুনি মার্চ শুরু হবে

তারপর বললে–আমি একটু ওদিক থেকে আসছি

বলে সোজা বারান্দা পেরিয়ে, বাগান পেরিয়ে একেবারে গঙ্গার পাড়ের ওপর ঘরখানার দিকে দৌড়ে গেল সাহেব। হরিচরণ সাহেবকে দৌড়ে আসতে দেখে অবাক হয়ে গেছে।

ওরা কোথায়?

 হুজুর, খেতে বসেছেন। ডাকব?

না, ওরা খেতে খেতে আমার মুখ দেখবে না। আমি পরে আসব’খন।

বলে সাহেব চলেই যাচ্ছিল। কিন্তু দুর্গা খবর পেয়েই তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

সায়েব!

দিদির ডাক শুনে ক্লাইভ ফিরল। বললে–তামি জানতুম না তোমরা খেতে বসেছ দিদি, তা হলে আমি ডাকতুম না। কিন্তু দিদি, তোমাদের কথা ভেবেই আমি দৌড়ে এসেছি তোমাদের আর এখানে রাখতে পারলুম না দিদি

ওমা, সেকী? আমাদের আবার কোথায় পাঠিয়ে দেবে?

যেখানে তোক তোমরা যাও, আমার হরিচরণ তোমাদের সঙ্গে যাবে, আরও লোকজন দেব। নবাব এদিকেই আসছে।

আর তোমরা?

আমরা একটু পরেই সোলজার নিয়ে মার্চ করতে শুরু করব, নবাব আসবার আগেই অ্যাটাক করব নবাবের আর্মিকে। হরিচরণ, বিকুইক! এই নে টাকা। দিদিদের যদি কোনও ক্ষতি হয় তো তোকে আর আস্ত রাখব না!

কিন্তু যাব কোনদিকে হুজুর?

যাবি কোনদিকে তাও কি বলে দিতে হবে আমাকে! তা হলে এতদিন আমার সঙ্গে থেকে কী ট্রেনিং পেলি? যেখানে গেলে ওরা সেফ থাকবে সেখানে নিয়ে যাবি। সঙ্গে বন্দুক থাকবে তোর, ডেকয়েটরা যদি চুরি করতে আসে ফায়ার করবি। তোমার কিছু ভয় নেই দিদি, যেখানেই তুমি যাও, আমি ঠিক খবর নেব তোমার, আমার জন্যে ভেবো না। আমি মরব না–

কথাটা বোধহয় তখনও ভাল করে শেষ হয়নি। হঠাৎ দূর থেকে নবাবের আর্মির মশালের আলো দেখা গেল। ক্লাইভ সাহেব আর দাঁড়াল না। দৌড়োতে দৌড়োতে আবার চলে এসেছে আর্মির মধ্যে। সবাই তৈরিই ছিল। সেখানে গিয়েই চিৎকার করে উঠল–ব্যাটালিয়ন!

ওদিকে ছোট ঘরখানার মধ্যে নবকৃষ্ণ স্ক্র্যাফটন সাহেবের মুখের দিকে একবার চাইলে। এখনও তো সাহেব আসছে না!

জিজ্ঞেস করলে সাহেব কোথায় গেল হুজুর?

স্ক্র্যাফটন সাহেব বললে–তুমি কার লোক? কে পাঠিয়েছে তোমাকে? কী করে কর্নেল সাহেবের নজরে পড়লে তুমি?

নবকৃষ্ণ বললে–হুজুর, সবই মায়ের দয়ায়।

মা? ইয়োর মাদার?

ইয়েস স্যার, আমার মা। মাদার সিংহবাহিনী!

হু ইজ সিংহবাহিনী?

আমার ইষ্টদেবী হুজুর। মাদারের কাছে আমি রোজ প্রে করি হুজুর, যেন কোম্পানির ভাল হয়, কোম্পানি যেন নবাবকে হারিয়ে হিন্দুস্থানের কিং হয়। দেখবেন হুজুর, মাদার আমার মনোবাসনা পূর্ণ করবেন!

কথাটা শেষ হবার আগেই বাইরে কানফাটানো একটা শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা শব্দ। রবার্ট ক্লাইভের গলার শব্দও শোনা গেল। সমস্ত শব্দ ছাপিয়ে ক্লাইভের গলা তখন চেঁচাচ্ছে ব্যাটালিয়ন, ফায়ার-ফায়ার–

স্ক্র্যাফটন দরজা খুলে দৌড়ে বাইরে চলে গেল। নবকৃষ্ণর বুকটা তখন দূরদূর করে কাঁপছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *