২.০৫ খুশবু তেলের দোকান

সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানেও তখন সকাল হয়েছে। ইব্রাহিম খাঁ-কে সারা রাত হাওয়া করেছে কান্ত। বুড়ো মানুষ। কিন্তু টাকার জন্যে সরাবের হড়া বয়ে নিয়ে যেতে হয় ভাটিখানা থেকে। ইস্তানবুল খোরাসান, দিল্লি থেকে কিম্মৎদার দারু মুর্শিদাবাদের ঘাটে আসে নৌকায় করে। সেই হাড়া বয়ে বয়ে নিয়ে যেতে হয় মাথায় করে। বয়ে নিয়ে গিয়ে মতিঝিলের সরাবখানায় রাখতে হয়। মতিঝিলের ঠান্ডা ঘরের ভেতর সেই সরাব জমা হয় নবাবের জন্যে। মহফিলের দিন সবাই সেই সরাব খায়। শুধু নবাব সরাব খায় না। কিন্তু নবাব না খেলেও শাগরেদরা খায়, নবাবের ইয়াররা খায়। মেহেদি নেসার, ইয়ারজান, সফিউল্লা সাহেব খায়!

তা তোমার তো খুব মেহনত হয়। তুমি কত তলব পাও খাঁ সাহেব?

ইব্রাহিম খাঁ সারারাত ঘুমিয়ে তখন একটু সেরে উঠেছিল। বললে–তিন টাকা জনাব!

 তিন টাকা মাত্তর! কিন্তু দিনের আলোয় ইব্রাহিম খাঁ’র মুখের দিকে চেয়ে কান্ত আরও নিচু হয়ে কী যেন দেখতে লাগল। বড় চেনা-চেনা লাগল যেন মুখখানা।

ইব্রাহিম খাও দেখলে কান্তকে। কান্তকে যেন এতক্ষণে চিনতে পারলে।

কান্তও বললে–আচ্ছা খাঁ সাহেব, তোমাকে যেন কোথায় দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে বলো তো?

ইব্রাহিম খাঁ হঠাৎ বলাকওয়া-নেই তেড়েফুঁড়ে উঠে বসল।

উঠছ কেন? শুয়ে থাকো, শোও শোও

কিন্তু তখন আর কে তার কথা শোনে। বুড়ো উঠে একেবারে পালাবার জন্যে বাইরে চলে যায় আর কী! কান্তও বুড়োর কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেল। এমন হঠাৎ উঠে পড়বার কী হল!

কিন্তু দরজার কাছে আসতেই দিনের আলোয় মুখখানা দেখে স্পষ্ট চিনতে পারলে কান্ত।

আরে, তুমি সেই সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাই না?

বুড়ো হঠাৎ নিজের মুখখানা দু’হাতে ঢেকে ছুটে পালাবার চেষ্টা করতে লাগল। বলতে লাগল না, আমি ইব্রাহিম খাঁ, আমি ইব্রাহিম খাঁ

কিন্তু পালাবার আগেই কান্ত পুরকায়স্থ মশাইয়ের হাতখানা জোরে ধরে ফেলেছে। ধরে ফেলতেই পুরকায়স্থমশাই একেবারে ছেলেমানুষের মতো হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছে।

সচ্চরিত্র পুরকায়স্থকে দেখে কান্ত সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল। সেই বুড়ো মানুষটার যে এমন দশা হবে তা কল্পনাও করতে পারেনি। তার সংসার গেছে, বউ-ছেলেমেয়ে গেছে। গাঁয়ের লোকও তাকে দুরদুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তার ব্যাবসাও গেছে। কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়িয়েছে। না-খেয়ে দিন কাটিয়েছে, ছেলেমেয়েগুলোর জন্যে মন কেমন করেছে। রাতের অন্ধকারে গ্রামে গিয়ে তাদের দেখতে চেয়েছে। কিন্তু লোকের ভয়ে আবার চলে এসেছে সেখান থেকে। তারপর এখানে এসে মতিঝিলের নেয়ামত খ-কে ধরে এই চাকরি পেয়েছে। বুড়ো বয়েসে এই খাটুনির চাকরি করবার ক্ষমতাও নেই শরীরে, অথচ না করেও উপায় নেই। দুটো খেতে তো হবে।

কান্ত জিজ্ঞেস করলে–তা তোমাকে কী কী কাজ করতে হয়?

সচ্চরিত্র বললে–বাবাজি, কাজের কি আর অন্ত আছে? মদের গন্ধে আমার বমি আসে, কিন্তু নাকে কাপড় দিয়ে সেই মদের মধ্যেই কাটাতে হয়। মদের জাহাজ এলে সেই মদ মাথায় করে বয়ে আনতে হয়, ভাটিখানায় রাখতে হয়, রেখে আবার তদারকি করতে হয়। আবার মদের টান পড়লে খবর দিতে হয় জোগানের জন্যে অপচো নষ্ট হলে আমাকেই আবার তার জবাবদিহি করতে হয়–

মতিঝিলের পুরনো যারা খিদমদগার তাদের সবাইকে মেহেদি নেসার সাহেব তাড়িয়ে দিয়ে বরখাস্ত করে দিয়েছে। ঘসেটি বেগমের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও আর জায়গা নেই মতিঝিলে। বড় সাধ করে ঘসেটি বেগম তৈরি করেছিল মতিঝিল। একদিন তার আশা ছিল মুর্শিদাবাদের মসনদ তারই দখলে যাবে। মির্জার ভাই এক্রামউদ্দৌলাকে নবাব করার স্বপ্ন দেখত ঘসেটি। কিন্তু তাও চলে গেল। নিজের পেটের ছেলে হল না বলে মির্জার ভাইকে পুষ্যি নিয়েছিল। কিন্তু সে-ও মারা গেল। স্বামীও চলে গেল। তাতেও নবাবজাদির তত দুঃখ ছিল না! দেওয়ান রাজবল্লভ ছিল তার ডান হাত। হুসেনকুলিও ছিল ঘসেটির। আর একজন শাগরেদ। শেষ পর্যন্ত ছিল নজর আলি।

নবাবজাদিদের কেলেঙ্কারি কাণ্ড তুমি তো জানো নিশ্চয়ই বাবাজি! শুনেছও তো কিছু কিছু

কান্ত বললে–কিছু কিছু শুনেছি, সমস্ত জানি না

ও না-জানাই ভাল বাবাজি। সাধে কি আর এ-চাকরি করতে ভাল্লাগে না। ওসব রাজা-বাদশার কেচ্ছা-কিত্তি এখন দেখে দেখে আমার চোখ পচে যাচ্ছে–

এখনও দেখছেন নাকি আপনি? এখনও হয়?

তা হবে না? এই কালই তো হল বাবাজি! চেহেল্‌-সুতুন থেকে গুলসন বলে এক বেগমকে নাচতে নিয়ে গেছল মতিঝিলে। আমি তো ভেতরে যেতে পারিনে, আমার যাবার হুকুমই নেই। আমি সমস্ত রাত ধরে জেগেছি। আমি হলাম মদের ভাড়ারি, আমার তো ঘুমোলে চলে না। ভেতরে ঘুঙুরের শব্দ শুনছি আর মাতালদের চেঁচানি শুনছি আমার ভাঁড়ারে বসে বসে চোখ দুটো ঘুমে ঢুলে আসছে, কখন তাব পড়ে তার তো ঠিক নেই। হঠাৎ বশির মিল্লা…

বশির মিঞার নাম শুনেই কান্ত চমকে উঠল।

বশির মিঞাকেও আপনি চেনেন নাকি?

বশির মিঞাকে চিনব না? ওর পিসেমশাই হল মেহের আলি মনসুর সাহেব। মেহেদি নেসার সাহেবের আসল শাগরেদ বাবাজি! আমাকে এসে চুপি চুপি বললে– আমাকে একটু দারু পিলাও ইব্রাহিম! তা আমি বুড়োমানুষ, আমি হলাম চাকরস্য চাকর। আমি আর কী করব, আমি ঢালতে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ নেয়ামত খাঁ এসে হাজির, দেখতে পেয়েই আমাকে যা নয় তাই বলে মুখ খারাপ করে গালাগাল দিতে লাগল

আর বশির মিঞা?

বশির মিঞা তো ততক্ষণে সেখান থেকে চম্পট দিয়েছে। ওদিকে তখন নেশার তুফান উঠেছে। মতিঝিলের ভেতরে। মেহেদি নেসার সাহেবের আবার নেশা হলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না কিনা। অথচ আজ যে আমার এই দুর্দশা এ-সব তো ওই নেসার সাহেবের জন্যেই। ওই ইয়ারজান, সফিউল্লা সাহেব, ওরাই তো আমার মুখে ম্লেচ্ছ-মাংস পুরে দিয়েছিল, নইলে কি আর আজ আমার জাত যায়! নইলে কি আর আজ আমাকে মতিঝিলের ভাটিখানায় খিদমদগারের কাজ করতে হয়? নইলে কি বাবাজি আমি আজ লজ্জায় মুখ ঢেকে বেড়াই? তা তুমি এখানে কী করতে? আর বিয়েথা করেছ নাকি?

কান্ত মন দিয়ে সব শুনছিল। বললে–না।

তা আর কী করেই বা করবে? আর আমি থাকলে না-হয় একবার চেষ্টা করে দেখতুম! ওদিকে খবর শুনেছ তো? সেই পাগলটা, যার সঙ্গে শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়ের বিয়ে জোর করে দিয়ে দিলে, সেও তো সংসার করতে পারলে না। সেই মেয়েও শুনছি পালিয়েছে বাড়ি থেকে! অথচ তোমার সঙ্গে বিয়েটা হলে এমন ঝাটও হত না। তোমরা দুটিতে সুখী হতে, আমাকেও আর এই ইব্রাহিম খাঁ হতে হত না।

কান্ত হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা, আপনাদের মতিঝিলে কোনও চাকরি খালি আছে?

চাকরি? কেন? তোমার সেই সাহেব কোম্পানির সোরার গদির চাকরির কী হল? সেটা নেই? লড়াইয়ের সময় বুঝি গদিদি ফেলে সাহেবরা পালিয়েছে? নিজামতের চাকরিতে এই একটা সুবিধে বাবাজি, জাত থাকে না বটে, কিন্তু চাকরিটা পাকা! এ সহজে যায় না কারও–

আমাকে একটা চাকরি দিতে পারেন আপনি, আপনাদের মতিঝিলে?

তা এখন তুমি কী করছ?

কিছুই করছি না, সে না করারই মতো, একটা চাকরি খুঁজছি যে-কোনও চাকরি, ঘোরাঘুরির চাকরি না। বসে বসে খাতালেখার কি হিসেবপত্তর দেখাশোনার কাজ পেলে ভাল হয়।

সচ্চরিত্র বললে–আমি নেয়ামত মিঞাকে বলে তোমায় জানাব। নেয়ামত নেসার সাহেবের খুব পেয়ারের বোক! তা তোমায় কোথায় পাব? কোথায় তোমায় খবর দেব?

কান্ত বললে–এই এখানেই পাবেন আমাকে, এই সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের পেছনেই আমি থাকি

সচ্চরিত্র বললে–তা তুমি যেন আবার কাউকে বলে দিয়ো না বাবাজি যে, আমাকে তুমি দেখেছ। কাউকে বোলো না। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াই, বড় লজ্জা করে বাবাজি। আমি যে ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র, ঈশ্বর ইন্দীবর ঘটকের পুত্র, ওসব কথা ভুলতেই চেষ্টা করি! মনে রেখে তো কোনও লাভ নেই, কী বলল বাবাজি? মনে করলেই কেবল কষ্ট

তারপর একটু থেমে বলতে লাগল–যাই বাবাজি, মরে তো যেতামই, তুমি তবু তুলে এনে সেবা করলে বলে একটু গতরে শক্তি পেলুম। কবে এমনি করেই বেঘোরে প্রাণটা যাবে। বাপ-পিতেমো’র নামও, কেউ করবে না মরে গেলে পিন্ডি দিতেও কেউ থাকবে না

বাইরে তখনও কেউ জাগেনি। সারাফত আলির তখনও জাগবার সময় হয়নি। চেহেসূতুনের নহবতখানায় তখন ইনসাফ মিঞা টোড়িতে সুর ধরেছে।

সচ্চরিত্র সেই দিকে চোখ পড়তেই বললে–সুর তো বেশ মিঠে সুরই বাজাচ্ছে মিঞাসাহেব, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে ছুঁচোর কেত্তন চলেছে তা তো বাইরের লোক কেউ টের পাচ্ছে না। কাল তো চেহেল্-সুতুনের মধ্যে তুমুল কাণ্ড হয়ে গেছে বাবাজি!

কান্ত উদগ্রীব হয়ে উঠল। বললে–চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরেও আপনি যান নাকি?

না, ভেতরে আর কী করে যাব! কিন্তু চেহেল্‌-সুতুনের খবর তো মতিঝিলেও ভেসে ভেসে আসে।

কী হয়েছে কাল? বলুন না!

নেয়ামত মিঞার কাছে শুনছিলাম কাণ্ডটা! নজর মহম্মদ হঠাৎ দিনেরবেলায় এসে নেসার সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেল দেখে আমি নেয়ামতকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা কী! শুনে আমার তো চোখ কপালে উঠল বাবাজি। পাপের কি আর শেষ আছে চেহেল্-সুতুনে! আহা!

কান্ত আবার বললে–কী হয়েছে তাই বলুন না!

সচ্চরিত্র বললে–তোমরা বিয়েথা করোনি, ওসব তোমাদের না-শোনাই ভাল বাবাজি। মরিয়ম বেগম বলে একজন নতুন বেগমসাহেবা এসেছিল চেহেল্‌-সুতুনে। মরিয়ম বেগম হচ্ছে গিয়ে লস্করপুরের তালুকদার কাশিম আলির মেয়ে। লস্করপুরের তালুকদার কাশিম আলিকে একদিন ওই নেসার সাহেবই চর লাগিয়ে খুন করেছে, তা কেউ জানে না। তারপর তার তালুকদারিও গেছে, সবই গেছে, কিন্তু একটা মেয়ে ছিল, সেই মেয়ের নামই হল গিয়ে মরিয়ম বেগম। নেসার সাহেবের লোক তাকে ধরে নিয়ে এসে পুরেছিল চেহেল-সুতুনে। ও-সব ওই বশির মিটার কাজ। শুনলাম, নাকি কোন হিন্দু ছোঁড়াকে দিয়ে তাকে এখানে আনিয়েছিল। আজকাল টাকা পেলে কারও কিছু করতে তো আটকায় না। টাকার জন্যে আজকাল লোকে মানুষই বলে খুন করে ফেলছে টাকার এমনই গুণ বাবাজি

তা তারপর কী হল বলুন।

সচ্চরিত্র বললে–আমার তো সব শোনা কথা বাবাজি, ঠিক-ঠিক বলতে পারিনে। আমি তো নিজের চোখে দেখিনি কিছু। শুনলাম কাল নাকি একজন বাদিকে ধরে খোজারা খুব শাস্তি দিচ্ছিল–সে নাকি অন্তঃসত্ত্বা ছিল–তার নাম জুবেদা, ওই মরিয়ম বেগমের বাঁদি!

কী শাস্তি দিচ্ছিল?

তাকে একেবারে ন্যাংটো করে পা দুটো ওপরে বেঁধে মাটিতে হাত দুটো পুঁতে দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে। দিয়েছিল। বাঁদিটা আবার বোবা, মুখে কথা বলতে পারে না। তাই না জানতে পেরে মরিয়ম বেগম একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল খোজাদের ওপর! খোজারা হল চেহেল-সুতুনের কর্তা। নানিবেগমই বলো আর লুৎফুন্নিসা বেগমই বলো, ওরা তো আসল মালিক নয়। আসল মালিক হল খোজারা! তাদের কাজে বাধা দেওয়া! সে একেবারে হইচই কাণ্ড চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে। নানিবেগম চিৎকার শুনে নিজে দৌড়ে এসেছে। নজর মহম্মদ করেছে কী, মতিঝিলে এসে নেসার সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেছে। কিন্তু মজাটা কী হল জানো বাবাজি-মরিয়ম বেগম সেইখানে সকলের সামনে ফাস করে দিয়েছে যে, সে আসলে লস্করপুরের তালুকদার কাশেম আলির মেয়ে নয়, তার আসল পরিচয়টা বলে দিয়েছে। আসল পরিচয়টা বলে দিতেই নেসার সাহেবের মুখ চুন! নেসার সাহেব আর সেখানে দাঁড়ায়নি, সোজা মুখে চুনকালি মেখে পালিয়ে চলে এসেছে মতিঝিলে। এসে ঢোক ঢোঁক করে কেবল মদ গিলেছে আর নেয়ামতকে গালাগাল দিয়েছে

কান্ত শুনতে শুনতে শিউরে উঠল। জিজ্ঞেস করলে মরিয়ম বেগমের আসল পরিচয়টা কী বলেছে?

আরে, আসলে নাকি ও লস্করপুরের তালুকদারের মেয়েই নয়

মেয়ে নয় তো কে ও? কী বললে?

আরে, ও হল গিয়ে সেই হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই ছিল, যেখানে তোমার বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলাম গো, ও নাকি সেই ছোটমশাইয়ের দ্বিতীয়পক্ষের বউ রানিবিবি! হারামজাদা কিনা তাকে নিয়ে এসে চেহেল্‌-সুতুনে পুরেছে। ছি ছি ছি, ওদের কি কোনওকালে ভাল হবে বাবাজি!নরকেও ওদের ঠাঁই হবে না, এই তোমাকে বলে রাখলাম। যাই বাবাজি, আজকে এখন গিয়ে আমাকে আবার নমাজ পড়তে হবে–

কান্ত তবু ছাড়লে । বললে–তারপর কী হল বলুন!

তারপর আর কী হবে। তারপর নানিবেগম মরিয়ম বেগমকে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে চলে গেল। চেহেল্‌-সুতুনের সব বেগমরা জানত একরকম, এখন সব দোষটা নেসার সাহেবের ঘাড়ে এসে পড়ল। তাই তো রেগে গিয়ে হাড়া হাড়া মদ গিলেছে। তারপর শুনলুম জুবেদাকে নাকি ছেড়ে দিয়েছে, হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিতে হুকুম করেছে নানিবেগম। খোজাদের অপমানের একশেষ। এর পর কি আর তারা ছেড়ে কথা বলবে বলতে চাও?

সেকথা থাক, হাতিয়াগড়ের রানিবিবির কী হল বলুন? তার কোনও ক্ষতি হয়নি তো?

এখন কী ক্ষতি হবে! কিন্তু খোজারা কি এ অপমানের পর আর ছেড়ে কথা বলবে ভেবেছ? তারা তো মুশকিলে ফেলতে চাইবেই। এর আগেও তো কত বাঁদিকে ঝুলিয়ে রেখে তিন দিন তিন রাত ধরে–খাইয়ে-খাইয়ে ওইরকম করে মেরে ফেলেছে ওরা, তাতে তো কারও কিছু আপত্তি ওঠেনি! তোমার এমন কী সতীপনা করবার দরকার পড়েছিল শুনি? তুমি বাছা, যখন একবার চেহেলসূতুনে ঢুকেছ তখন জাত-জন্ম তো সব খুইয়েছ আমার মতন, তার ওপর আবার সতীপনা দেখাতে গেলে কেন? কী বলো, আমি কিছু অন্যায় বলেছি বাবাজি?

কান্ত কী আর বলবে! কথাগুলো শুনতে শুনতে যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল।

সচ্চরিত্র বলতে লাগল–এই যে আমি, আমার কথাই ধরো না, আমি তো অতবড় নামজাদা ঘটক বংশের সন্তান, আমার পিতা হলেন ঈশ্বর ইন্দীবর ঘটক, আমার পিতামহ ঈশ্বর কালীবর ঘটক, সেসব কথা কি আমি এখন মনে রেখেছি? সে কথা আমি কাউকে বলি? বরং পাছে কেউ চিনতে পারে বলে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে থাকি, এই দাড়ি রেখেছি। এখন কি আর ঘটকালি করি আমি কারও? না করব? সে-সব কথা আমি ভুলেই গেছি বাবাজি। আমি গাঁয়ে গেলে গাঁয়ের লোক আমায় তাড়িয়ে দেয়, আমার গায়ে থুতু দেয়। তা তো দেবেই! দেবে না? কী বলো তুমি? তারা তো অন্যায় কিছু করে না। তা আমি কি তাতে আপত্তি করছি? আপত্তি করব কার কাছে বাবাজি? কে আমার আপত্তি শুনছে? যেমন যুগ। পড়েছে, তার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই চলতে হবে তো? তাই বাবাজি, আমি ভাটিখানায় বসে চুপ করে নাকে কাপচাপা দিয়ে কাজ করি, আর তিন-সন্ধে নামাজ পড়ি। কী আর করব বলো? আমার নিজের মনে তো কোনও পাপ নেই। তবে শুধু ওই ম্লেচ্ছ মাংসটা এখনও খেতে পারিনি বাবাজি। ওটা খেতে কেমন যেন গা বমি-বমি করে এখনও–এমনি করেই যেক’দিন বেঁচে থাকি, কাটিয়ে দিতে পারলেই বিদেয় নেব! কিন্তু এও তোমাকে বলে রাখলাম বাবাজি, দিনকাল বড় খারাপ পড়েছে, খুব সাবধানে থাকবে। 

তা হলে আমার একটা চাকরির কিছু চেষ্টা করবেন?

সচ্চরিত্র বললে–আমার যদি পরামর্শ নাও তো বলি, এ-জায়গায় তুমি চাকরি কোরো না বাবাজি। তা হলে আমার মতো তোমারও ইহকাল-পরকাল দুই-ই যাবে!

না ঘটকমশাই, সে যা-হয় হবে, আপনি আমার একটা চাকরি দেখুন। নিজামতের চাকরিই আমায় করতে হবে।

কেন বাপু? নিজামতের চাকরির ওপর তোমার লোভ কেন এত? এর থেকে জমিদারি সেরেস্তার চাকরি একটা কোথাও জুটিয়ে নিলেই পারে। তাতে আয় কম হলেও ধর্মটা থাকে।

কান্ত বললে–সে আপনি বুঝবেন না ঠিক, মতিঝিলের চাকরি হলেই আমার ভাল হয়।

কেন?

সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ বুঝতে পারলে না কান্ত বাবাজির এত আগ্রহ কেন মতিঝিলের চাকরির ওপর।

তারপর বললে–ঠিক আছে, এখন যাই বাবাজি, আমার নমাজের দেরি হয়ে গেল

সারাফত আলির দোকানের সামনে তখনও লোকজনের চলাচল শুরু হয়নি। সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ। মশাই একা সেই রাস্তায় নেমে হনহন করে এগিয়ে চলল। মাটির হাঁড়াটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, সব মদ রাস্তার ধুলোর ওপর পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। একটু একটু খোঁড়াচ্ছে যেন। কান্তর মনে হল হাতির পায়ের তলায় চাপা পড়লে আর বাচত না লোকটা।

আস্তে আস্তে সচ্চরিত্র অনেক দূরে অদৃশ্য হয়ে যাবার পরও কান্ত সেইখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এই তো একটু দূরে চেহেল-সুতুন। সেই তারই ভেতরে এখন হয়তো ভীষণ তোলপাড় চলছে। কেন। বলতে গেল মরালী নিজের পরিচয়টা? মিথ্যে করে থোক, সত্যি করে থোক, কারও নাম বলবার। দরকারটা কী ছিল? যদি এখন হাতিয়াগড়ে খবর যায়! যদি খোঁজ পড়ে রানিবিবিকে তারা না-পাঠিয়ে মরালীকে পাঠিয়েছে, তা হলে? অথচ, কেউ জানতে না-পারলে হয়তো একদিন পালিয়ে যেতে পারত চেহেল্‌-সুতুন থেকে।

মনে হল এখনই যদি একবার গিয়ে সাবধান করে দিয়ে আসতে পারত মরালীকে।

হঠাৎ পেছনে আওয়াজ হতেই কান্ত ফিরে দেখলে। সারাফত আলি সাহেব জেগে উঠে দোকানে। এসেছে।

কী রে কান্তবাবু, সে-লোকটা কেমন আছে? সেই ইব্রাহিম খা? বেটা মরেছে না জিন্দা আছে?

কান্ত বললে–মতিঝিলে চলে গেছে।

তা হলে জিন্দা আছে? দারু পিয়ে পিয়ে কলিজায় ওদের কড়া পড়ে গেছে, ওরা কখনও মরে? ঝুটমুট তুই কালকে চেহেল্‌-সুতুনে গেলি না। নজর মহম্মদ এসে রাত্তিরে ডেকে ডেকে ফিরে গেল।

কান্ত জিজ্ঞেস করলে–আজ নজর মহম্মদ আসবে?

সারাফত আলি বললে–ক্যা মালুম, ও-লোককা মর্জি! আজ এলে যাবি তুই?

হা মিঞাসাহেব, আজকে যাবই। কালকে ইব্রাহিম খাঁ’র কাছে যা শুনলুম তাতে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছি–কালকে নাকি রানিবিবি নিজের আসল পরিচয় সকলের সামনে বলে দিয়েছে। সব জানাজানি হয়ে গিয়েছে। নেসার সাহেবকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে নানিবেগম, খোজা সর্দার পিরালি খাঁ খুব চটে গেছে রানিবিবির ওপর। এখন কী হবে বুঝতে পারছি না! এখন যদি কিছু সর্বনাশ হয়!

সারাফত আলি বললে–কুছ নেই হোগা! মোহর পেলেই সব ফয়সালা হয়ে যাবে। এক মোহরে কাম না হয় দো মোহর দেঙ্গে, দো মোহরে কাম না হলে তিন মোহর দেঙ্গে। মোহর দিলে সব জব্দ। সবাই খুশি। হিন্দুস্থানের বাদশা ভি মোহর পেলে সব ভুলে যায়, তো নজর মহম্মদ। নজর মহম্মদের বাপ পর্যন্ত মোহর পেলে কবর থেকে হাত বাড়াবে। তুই কিছু ভাবিসনি কান্তবাবু।

রাস্তায় কে যেন গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল। গানের সুরটা কানে আসতেই কান্ত সচেতন হয়ে উঠেছে। উদ্ধব দাস না!

আমি রবো না ভব-ভবনে
শুন হে শিব শ্রবণে!

কান্ত এক লাফে রাস্তায় নামল। তারপর চিৎকার করে ডাকতে লাগল-দাসমশাই, ও দাসমশাই–

উদ্ধব দাস পাগলাকছমের লোক। যেন শুনতেই পায়নি। বেশ গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে চলেছে। কান্ত দৌড়িয়ে কাছে যেতেই উদ্ধব দাস পেছন ফিরল।

কান্ত বললে–তোমাকেই তো আমি খুঁজছিলাম দাসমশাই

কিন্তু কথাটা বলেই কেমন যেন সন্দেহ হল। জিজ্ঞেস করলে আপনি উদ্ধব দাস না?

উদ্ধব দাস?

লোকটাও অবাক হয়ে গেছে। বেশ আপন মনেই গান গাইতে গাইতে আসছিল। হঠাৎ অচেনা লোকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বললে–আমি উদ্ধব দাস কেন হতে যাব বাবা, আমি তো পরমেশ্বর দাস।

কিন্তু এ-গান তো উদ্ধব দাসেরই বাঁধা। উদ্ধব দাসই তো এ-গান গায়।

লোকটা বললে–তা হতে পারে বাবা, গানটা একদিন এক মাঝির গলায় শুনেছিলাম, তাই মুখস্থ করে নিয়েছি। ভণিতাতে তো ভক্ত হরিদাসের নাম আছে।

কান্ত মনে মনে হতাশ হয়ে গেল। উদ্ধব দাসের সঙ্গে এখন দেখা হলে খুব ভাল হত। উদ্ধব দাসকে দেখা হলে বলা যেত যে তারই বউ চেহেল্‌-সুতুনে আছে। তার বড় বিপদ! অথচ আশ্চর্য! যার বউ, যে বিয়ে করল তার মাথাব্যথা নেই, সে কেমন আরামে গান গেয়ে গেয়ে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আর কোথাকার কে কান্ত, তাই নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। সে কেন ভাবছে এত! মরালীর কী হল না হল তা নিয়ে তার এত দুশ্চিন্তা কেন? মরালী তার কে? তার সঙ্গে তো তার কোনও সম্পর্ক নেই!

তারপর মনে হল–সে ভাববে না তো কে ভাববে! কে আর জানে আসল খবরটা। আসলে মরালীকে এই চেহে-সূতুনে নিয়ে আসার জন্যে সে নিজেই তো দায়ী। কান্ত নিজেই তো এনে এখানে এই পাপের রাজ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে তাকে।

যে-লোকটা গান গাইছিল, সে আবার গান গাইতে গাইতে চলে গেল। কান্ত আবার সারাফত আলির দোকানের দিকে ফিরে এল।

*

চেহেল সুতুনের ইতিহাসে যা কখনও হয়নি, সেদিন যেন তাই-ই হয়েছিল। সেদিনকার চেহেল্‌-সুতুনের নিয়মকানুনে যেন হঠাৎ ভাটা পড়ল। অনেক দিন পরে যখন অনেক কিছু বদলে গিয়েছিল, মুর্শিদাবাদের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছিল তখনকার দিনের কথা আর কারও মনে থাক আর না থাক, কান্তও তখন নেই, আর মরালী তো মেরী বিশ্বাস হয়ে গেছে সেই সময়কার সব কাহিনী একে একে। সংগ্রহ করে রেখে গেছে উদ্ধব দাস। সমস্ত কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখে গেছে পুঁথির পাতায়। মুর্শিদাবাদ, কাশিমবাজার, কলকাতা, পলাশি, সমস্ত যেন উদ্ধব দাস নিজের চোখে দেখেছে। লর্ড ক্লাইভের বাগানবাড়িটাও তার লেখায় বাদ পড়েনি। বিরাট বিরাট থামওয়ালা বাড়িটা। তার চারপাশে চল্লিশ বিঘে বাগান। সেই বাগানের মধ্যে বসে থাকত ক্লাইভ সাহেব। আর সেইখানে তখন থাকত মরালী। বেগম মেরী বিশ্বাস।

মানুষের মনের অন্তস্তলে কোথায় বুঝি এক অদৃশ্য অন্তর্লোক আছে। সেখানকার সন্ধান সে সবসময় নিজেও রাখে না। রাখবার চেষ্টাও করে না। কিংবা খবর রাখবার চেষ্টা করাই হয়তো পণ্ডশ্রম। কিংবা হয়তো সেইটুকু তার একান্ত গোপন সম্পদ। সেই সম্পদটুকু গোপনে পুষে রেখেই সে বুঝি তৃপ্তি পায়। তুমি আমার স্বামী হলেও তোমার প্রবেশ সেখানে নিষেধ। সেখানকার খবর কেউ যেন না জানতে পারে। আমি যতদিন বাঁচব ততদিন সেটুকু আমার। আর কারও নয়। আমার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ দিয়ে তাকে আমি আমার অন্তরে লালন করব। সে তুমি হাজার প্রশ্ন করলেও আমি বলব না। কান্তর কথা আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না তুমি।

কিন্তু উদ্ধব দাসের অদ্ভুত ক্ষমতা। সেই একান্ত গোপন খবরটুকুও সে বুঝি কেমন করে জেনে ফেলেছিল। বেগম মেরী বিশ্বাসের পাতায় পাতায় তা-ই সে সবিস্তারে লিখে গেছে। কবে একদিন কান্ত কেমন করে নিজের অগোচরে অন্তরের অনুরাগটুকু দিয়ে উদ্ধব দাস আর মেরী বেগমের অস্তিত্ব নিরাপদ করে গিয়েছিল তাও উদ্ধব দাস লিখতে বাকি রাখেনি। বাংলার ইতিহাসের এক অনিবার্য সন্ধিক্ষণে মরালীকে ঢুকতে হয়েছিল মুর্শিদাবাদের চেহেল্‌-সুতুনে, আর ভাগ্যবিধাতার এক অমোঘ নির্দেশে কান্তকেই আবার সেই দূর্ঘটনার সাক্ষী থাকতে হয়েছিল। আর উদ্ধব দাস? উদ্ধব দাসই বা এত জায়গা থাকতে সেদিন সেই রাত্রে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির অতিথিশালায় গিয়ে হাজির হবে কেন? হয়তো সে হাজির না থাকলে এই পলাশির যুদ্ধও হত না, হয়তো বাংলার ইতিহাসের পাতাগুলো অন্যরকম করে লেখা হত। হয়তো ক্লাইভ সাহেবকেও শেষ জীবনে নিজের জীবনটা নিজের হাতে নিতে হত না। হয়তো সেখানে হাজির না থাকলে নানিবেগম সুখী হত, লুৎফুন্নিসা বেগমও সুখী হত। মরালী, কান্ত, উদ্ধব দাস, মিরজাফর, সবাই জীবনটা সুখেই কাটিয়ে দিতে পারত।

কিন্তু হয়তো তা হবার নয়।

হবার নয় বলেই আজ এত বছর পরে তাদের নিয়ে বেগম মেরী বিশ্বাস’ লিখতে বসেছি।

 কিন্তু সেদিনকার কাহিনী কেমন করে বলব বুঝতে পারছি না। এই দুশো বছর পরে আমি কি বর্ণনা করতে পারব সেদিনকার মরালীর মনের অবস্থা?

মতিঝিলের দরবার-ঘরের ভেতরে তখন সকলের বিচার শেষ হয়ে গেছে। হয়তো সেটা সুবিচারই। কিংবা হয়তো অবিচার। কৃষ্ণবল্লভ, উমিচাঁদ, তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফিরিঙ্গিরা যখন লড়াইতে হেরেই গেছে তখন আর তা নিয়ে জল ঘোলা করে লাভ কী। হলওয়েল সাহেব মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ক্ষমা চেয়েছে। তার বিচারই শুধু তখনও বাকি ছিল।

আগের দিন রাত্রে গুলসন বেগমের নাচ হয়েছে সারারাত। মেহেদি নেসার, ইয়ারজান, সফিউল্লা সাহেব, তাদের তখনও নেশা কাটেনি বোধহয়। কিন্তু নবাব যে এত ভোরে উঠে সকলকে ডাকাডাকি করবে তা কেউ বুঝতে পারেনি।

নেয়ামত ছুটতে ছুটতে এসেছে।

জনাব, নবাব এত্তেলা দিয়েছে।

মতিঝিলের দরবার ততক্ষণে জমজমাট। সত্যিই নবাবের যেন ক্লান্তি নেই। যে-মির্জার সঙ্গে তারা একদিন ইয়ারকি করেছে, আড্ডা দিয়েছে, ফুর্তি করেছে, মহফিল জমিয়েছে, সেই মির্জাই যখন আবার লড়াই করতে যায়, যখন দরবার বসায়, তখন যেন আবার সে অন্য মানুষ। তখন যেন আর চেনা যায় না সেই মির্জাকে। তখন যেন সে সত্যিইনবাব। তখন যেন সে মুর্শিদাবাদের খোদাতালা। মির্জার সামনে দাঁড়িয়ে তখন মেহেদি নেসারও থরথর করে কাঁপে। যে-মিরজাফর আড়ালেতে কিছু বলে বেড়ায়, সামনে এসে কিছু বলবার আর সাহস থাকে না তার। নবাব শোলাম হোসেন খাঁ বাহাদুর এতদিনের লোক, আলিবর্দি খাঁর আমলের পুরনো নিজামতি দারোগা আর আরজবেগি, তাকে পর্যন্ত মক্কায় যাবার নাম করে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল নবাবের ভয়ে।

মেহেদি নেসার সাহেবরা যখন দরবারে এসে হাজির হল তখন হলওয়েল সাহেবের দুটো হাতে হাতকড়া। হাতকড়া-বাঁধা অবস্থায় নবাবের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সাহেব।

রাজা দুর্লভরাম একপাশে। তার ওপাশে মিরজাফর সাহেব। সমস্ত আবহাওয়াটাই যেন জাকুটি কুটিল। মেহেদি নেসার সাহেব মিরজাফর খাঁ’র দিকে চেয়ে দেখলে। বড় শান্ত সুখী মানুষটা। বাইরে থেকে দেখলে কিছু বোঝবার উপায় নেই।

বশির মিঞা গুটি গুটি পায়ে মেহেদি নেসার সাহেবের পেছনে এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে চুপি চুপি হাতে একটা চিঠি দিয়ে আবার বাইরে চলে গেল।

নেসার সাহেব চিঠিটা পড়ে আস্তে আস্তে কুর্নিশ করে চিঠিটা নবাবের হাতে দিলে।

চিঠিটা পড়তে পড়তে মির্জার চোখ দুটো কেমন জ্বলে উঠল তাও লক্ষ করলে নেসার সাহেব।

নবাব জিজ্ঞেস করলে–এখত কোত্থেকে এল?

 জাঁহাপনা, আমার দফতরের লোক আদায় করে এনেছে

আর সঙ্গে সঙ্গে যেন বোমা ফেটে উঠল মতিঝিলের দরবারঘরে। হয়তো বোমা ফাটলেও এত চমকাত না কেউ। আলিবর্দি খাঁর আমলে যে-মির্জাকে মিরজাফর দেখেছে এ যেন সে-মির্জা নয়।

এ-মির্জা এরকম গলার আওয়াজ কোথায় পেল! যাকে সবাই আড্ডাবাজ, ফুর্তিবাজ বলে জেনে এসেছে এতদিন, সে বুঝি একটা লড়াই জিতে এসেই একেবারে খাঁটি নবাবিআনা শিখে ফেলেছে।

পাঙ্খাওয়ালা পেছনে দাঁড়িয়ে বিরাট পাখা চালাচ্ছিল, হঠাৎ ভয় পেয়ে তার হাত থেকে পাখাটা পড়ে গেছে।

মিরজাফর আলি সাহেব!

১৭৩০ সালে যে-মির্জার জন্ম, তার বয়েস সবে ছাব্বিশ পেরিয়েছে। অথচ তারই সামনে পাকা ঝুনোঝানু সব আমিওমরা ভয়ে স্থির হয়ে রয়েছে স্থাণুর মতো।

মিরজাফর আলি সাহেব এক-পা এগিয়ে এসে মাথা নিচু করে কুর্নিশ করলে।

আপনি এ-চিঠি লিখেছেন?

বহু শতাব্দী আগে মোগলবংশ হিন্দুস্থান দখল করে নিয়েছিল। ততদিনে সে-দখল কায়েমি হয়েও গিয়েছিল। কিন্তু রাজনীতি বোধহয় চিরকালই বেকায়েম। রাজনীতির অভিধানে কায়েমি বলে কোনও শব্দ নেই। মসনদ আজ আছে, কাল নেই। কিন্তু নবাব আলিবর্দি খাঁ’র পাশে থেকে থেকে কবে যে মির্জা সেকথা শিখে নিয়ে রপ্ত করে ফেলেছিল তা বোধহয় তার ঘনিষ্ঠ ইয়ার মেহেদি নেসাররাও জানত না। তাই সেদিন সেই মতিঝিলের দরবারের মধ্যে নবাব মির্জা মহম্মদের গলা শুনে তারা চমকে গিয়েছিল।

আমার ভাইকে আপনি বিদ্রোহ করবার জন্যে এই চিঠি লিখেছেন? এ তো দেখছি আপনারই হাতের লেখা। দেখুন, আপনার হাতের লেখা আপনি চিনতে পারেন কি না, আপনি নিজেই পড়ে দেখুন

মিরজাফর আলি সাহেব চিঠিটা নিজের হাতে নিলে। তারপর আবার সেখানা ফিরিয়ে দিলে মির্জার হাতে।

কী দেখলেন?

 মিরজাফর আলি সাহেব কোনও উত্তর দিলে না।

তা হলে কি বুঝব আপনিও আমাকে ভুল বুঝলেন? আপনি জানেন যে, আমার বল-ভরসা বলতে যা-কিছু সব আপনারা। সেই আপনি কিনা আমার শত্রুতা করবার জন্যে তৈরি? আমি যে নতুন সিংহাসন পেয়ে সুস্থির হয়ে সবকিছু সুব্যবস্থা করব, তাও আপনারা আমাকে করতে সময় দেবেন না? ফিরিঙ্গিদের আমি বুঝতে পারি। তারা হিন্দুস্তানে এসেছে ব্যাবসা করে টাকা উপায় করতে। কিন্তু আপনারা? আপনারা যে আমার আত্মীয়! আপনাদের যে আমি সবচেয়ে বিশ্বাস করি। আপনারই যদি এমন করে বিশ্বাসঘাতকতা করেন তো আমি দাঁড়াব কোথায়? কার মুখের দিকে চেয়ে আমি রাজ্য চালাব?

তবু মিরজাফর আলি সাহেব চুপ!

আমি জানি আমার আড়ালে লোকে আমার নামে কী বলে! আমার নিজের দোষ নেই একথা আমি বলছি না। আমার নিজের দোষটাও আমি জানি, আমার কী ভাল তাও জানি। কিন্তু আপনারা? আপনাকেই আমি জিজ্ঞেস করছি, আমার কি কোনও গুণই নেই? এমন কোনও সদগুণ নেই যার জন্যে আমি আপনাদের সহানুভূতি পেতে পারি? আপনাদের ভালবাসা পেতে পারি? আপনারা কি সত্যিই চান আমার বদলে অন্য কেউ এই মসনদে বসলে দেশের মঙ্গল হবে? আপনারা মুখ ফুটে বলুন। সে-কথা! আমি স্বেচ্ছায় মসনদ ছেড়ে চলে যাব। যদি বোঝেন আমার মাসতুতো ভাই শওকত জঙ এলেই দেশের ভাল হবে, তা হলে তাই-ই বলুন, তা হলে তাকেই ডেকে এনে আমার জায়গায় বসিয়ে। দেব। আর যদি বোঝেন ঘসেটি বেগম এলেই দেশের ভাল হবে তো তাতেও আমি গররাজি নই। আমি এক্ষুনি আমার মাসিকে চেহেল্‌-সুতুনের বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি

মিরজাফর সাহেব তখনও চুপ করে আছে।

লোকে বলে আমি নাকি দেশ শাসনের কিছুই জানি না। আমি স্বীকার করছি দেশ শাসনের আমি কিছুই জানি না। কিন্তু আমি তো সবে দেশের ভার মাথায় তুলে নিয়েছি। আমাকে প্রথমে জানতে সময় দিন, বুঝতে অবসর দিন, তবে তো শিখতে পারব। তার পরেও যদি দেখেন আমি কিছুই জানি না, তখন আমাকে না-হয় সরিয়ে দেবেন। সরিয়ে দিয়ে যাকে খুশি আমার সিংহাসনে বসাবেন। আমি খুশি মনে আপনাদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে যাব। আর কখনও মুর্শিদাবাদে আসব না, প্রতিজ্ঞা করে যাব–

তখনও মিরজাফর আলি সাহেব চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিছু কথা বলেনি।

এই যে পাষণ্ড হলওয়েল দাঁড়িয়ে আছে, যদি মনে করেন এরাই দেশের ভাল করবে তো এদের হাতেই না-হয় এই মুর্শিদাবাদের মসনদ তুলে দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যদি মনে করেন যে, এরা দেশের দুশমন, এরা কারবার করবার নাম করে এখানে আমাদের ভাইতে-ভাইতে লড়াই লাগিয়ে দিয়ে নিজেরা এই মসনদ কেড়ে নেবার মতলব করছে, তবে তাদের শায়েস্তা করা কি এতই অন্যায়? যে তাদের শায়েস্তা করবে, তাকে কি আপনারা কুশাসক বলবেন? বলবেন কি সে দেশ শাসন করতে। জানে না?

তারপর একটু থেমে আবার বলতে লাগল–স্বীকার করছি আমার বয়েস কম, অভিজ্ঞতা কম, জ্ঞানও কম, কিন্তু আপনি আমার ডান হাত, আপনার তো অনেক বয়েস, আপনার তো অনেক অভিজ্ঞতা, আপনার তো অনেক জ্ঞান; আপনি সহায় থাকতে আমি দেশ শাসন করতে পারব না-ই বা কেন? যদি না পারি সে তো আপনারও লজ্জা! আপনারও কলঙ্ক! লোকে আপনাকেই দোষ দেবে, বলবে যে আপনার মতো অভিজ্ঞ আত্মীয় থাকতেও কম বয়েসি নবাবকে আপনি কিছু সাহায্য করেননি। কী হল, আপনি কথা বলছেন না কেন, উত্তর দিন?

মিরজাফর আলি সাহেব যেন বিব্রত বোধ করতে লাগল।

পাঙ্খাওয়ালা আরও জোরে জোরে পাখা নাড়ছে। মেহেদি নেসার, ইয়ারজান, সফিউল্লা, রাজা দুর্লভরাম সবাই পাথরের মূর্তির মতো নবাবের রায় শোনবার জন্যে কান পেতে রয়েছে।

উত্তর দিন, কেন আপনি এ-চিঠি লিখতে গেলেন?

ওদিকে একটা তাঞ্জাম দুলতে দুলতে এসে ঢুকল মতিঝিলের ফটকে। ঝালরদার, সোনা-চাদির ঝকমকে তাঞ্জাম। এ-তাঞ্জাম দেখলেই চিনতে পারে মতিঝিলের ফটকের পাহারাদার। এটা নানিবেগমের নিজস্ব তাঞ্জাম। কুর্নিশ করে পাহারাদার তাঞ্জাম ভেতরে পৌঁছিয়ে দিয়ে এল। সামনে ঝিল। সেই ঝিল পেরিয়ে এসে তাঞ্জাম সোজা ভেতরে চবুতরে ঢুকে গেল।

ও যদি আপনার হাতের সই হয় তো আপনি বলুন, ও-চিঠি কেন লিখতে গেলেন?

মতিঝিলের বাঁদি এসে তাঞ্জামের ঝালর তুলে ধরল। তাঞ্জাম থেকে নামল নানিবেগম। আর তার পেছন পেছন আর একজন বেগম নামল। তাকে এর আগে বাঁদি কখনও দেখেনি। দু’জনেই তাঞ্জাম থেকে নেমে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

আমার কথার উত্তর দেবেন না আপনি? উত্তর দিন!

ইব্রাহিম খাঁ সরাবখানার মধ্যে অন্ধকারে চুপ করে বসে ছিল। হাতির চোট খাবার পর সেদিন কিছু বিশেষ বোঝা যায়নি। কিন্তু পরদিন থেকেই গায়ে-গতরে একেবারে ব্যথা হয়ে টনটন করছিল।

ও-চিঠি জাল!

তাঞ্জামটা নজরে পড়েছিল ইব্রাহিম খাঁ’র। সিঁড়ির নীচেয় মতিঝিলের সরাবখানা। ঘুলঘুলিটা দিয়ে ওদিকটা দেখা যায়। হঠাৎ নজরে পড়ল দু’জন বেগম নামল তাঞ্জাম থেকে। নানিবেগমের তাঞ্জাম দেখলেই সবাই চিনতে পারে। নানিবেগমকে অনেকবার দেখেছে ইব্রাহিম খাঁ। কিন্তু পাশের বেগমকে দেখেই চমকে উঠল সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ। যেন খুব চেনা-চেনা মুখ। কোথায় যেন দেখেছে, কোথায় যেন বড় কাছ থেকে দেখেছে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলে না। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল। হাতিয়াগড়ের নফর শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়ে সেই মরালী না?

জাল? আপনি প্রমাণ করতে পারেন, এ-চিঠি জাল চিঠি?

নেয়ামত খাঁ তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকল। নবাবের সামনে এসে তিনবার কুর্নিশ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললে–জাঁহাপনা, নানিবেগম!

নানিবেগম! এখানে! মতিঝিলে! এই অসময়ে! নবাব মির্জা মহম্মদ যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। মেহেদি নেসারের কানেও কথাটা গিয়েছিল। সেও কেমন যেন শুকিয়ে গেল কথাটা শুনে। মিরজাফর আলি সাহেব, হলওয়েল, রাজা দুর্লভরাম, ইয়ারজান, সফিউল্লা, মোহনলাল সবাই একটু নড়ে দাঁড়াল এতক্ষণ পরে।

সরাবখানার অন্ধকারে সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ তখনও আকাশ-পাতাল ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়ে তো নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল বিয়ের পর। আবার এখানে এল কেমন করে?

নবাব মির্জা মহম্মদ মসনদ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পাশের ঘরের দিকে গেল। যাবার সময় বলে গেল আপনারা বসুন। আমি আসছি—

*

চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরেও বোধহয় তখন তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। সকলেই অবাক হয়ে গিয়েছিল নানিবেগমের হুকুম শুনে। লুৎফুন্নিসার ঘরে গিয়ে নানিবেগম বলেছিল–আমি মতিঝিলে যাচ্ছি বহু

এমন সাধারণত হয় না। নানিবেগমকে যারা জানে তারা শুধু তাকে এতদিন কোরান হাতে নিয়ে থাকতেই দেখেছে।

আমি গিয়ে মির্জাকে জিজ্ঞেস করব এই রানিবিবিকে কে এখানে আনতে হুকুম দিয়েছে, মির্জা নিজে মেহেদি নেসার

মরালী চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। সমস্ত চেহেলসূতুন আজ তাকে চিনে ফেলেছে। এতদিন এখানে এসেছে, কিন্তু কেবল নিজের ঘরের মধ্যেই কাটিয়েছে সারা দিনরাত। তাকে কেউ চিনত না, কেউ জানত না, এক গুলসন ছাড়া। মরালী ভেবেছিল এমনি করেই চারটে দেয়ালের মধ্যে বুঝি তার জীবন কেটে যাবে। সবাই তাকে মরিয়ম বেগম বলেই জানবে। তারপর একদিন সবার অগোচরে চেহেল্ সুতুনের বাইরে খোশবাগের কবরখানায় চারজন লোক তাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গিয়ে কবর দিয়ে দেবে। কিন্তু তা হল না। সব জানাজানি হয়ে গেল। জুবেদার ওই অবস্থা দেখে আর চেপে রাখতে পারেনি সে নিজেকে। একেবারে সকলের মুখোমুখি হয়ে নিজের পরিচয় সকলকে জানিয়ে দিয়েছে।

নানিবেগম প্রথমে অনেক সান্ত্বনা দিয়েছিল তোমার কিছু ডর নেহি বেটি, তুমি আমার কাছে কিছু চেপে রেখো না, বললো, তোমার কী হয়েছে?

মরালী বলেছিল–আমি অনেক দিন ধরে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলাম মা, আমার অনেক কথা বলবার ছিল কিন্তু কেউ আপনার সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দিত না

কে দেখা করতে দিত না?

 ওই আপনার খোজা নজর মহম্মদরা। একদিন গুলসন বেগমের সঙ্গে আপনার কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে আসছিলাম, তারপর ভয় পেয়ে ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ঢুকে পড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম

তারপর?

তারপর সেদিন রাত্তিরে লুৎফুন্নিসা বেগমসাহেবার ঘরে ভুল করে ঢুকে পড়েছিলাম, ভেবেছিলাম, ওইটেই বুঝি গুলসন বেগমের ঘর। সেখান থেকে নিজের ঘরে গিয়ে দেখি মেহেদি নেসার সাহেব আমার ঘরে বসে আছে, আর তারপরই নজর মহম্মদ আপনাকে গিয়ে খবর দিতেই আপনি এলেন, আপনি এসে আমাকে মেহেদি নেসার সাহেবের হাত থেকে বাঁচালেন। সেদিন আপনি আমায় আদর করলেন, আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন, আমি বললাম আমার নাম মরিয়ম বেগম। তখন আমি ভয়ে আপনাকে সত্যি কথা বলতে পারিনি মা–

হাতিয়াগড় থেকে এখানে তোমায় কে আনলে?

মরালী এক দণ্ড চুপ করে ভেবে নিলে। তারপর বললে–এখান থেকে পরোয়ানা গিয়েছিল হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের নামে–

নানিবেগম বললে–সে আমি জানি, তোমার বড় সতিন আমাকে চিঠি লিখেছিল

 চিঠিতে কী লিখেছিল?

নানিবেগম বললে–তুমি যা বললে–মা, সে-ও ওই কথাই লিখেছিল, আমি মেহেদি নেসারকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম চিঠিটার কথা সত্যি কি না।

কী বললে–মেহেদি নেসার সাহেব?

 নানিবেগম বললে–ওসব কথা তোমার শুনে দরকার নেই মা! এই মুর্শিদাবাদে কেউ সত্যি কথা বলে না, কাকে বিশ্বাস করব? মির্জা, আমার নাতি, তারও সময় নেই আমার সঙ্গে কথা বলার, সেও নানান হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়েছে তাকেই বা দোষ দিই কী করে, সবাই মিলে তাকে নাজেহাল করে দিচ্ছে

কেন? মরালী উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলে–কেন মা? কে নাজেহাল করছে?

নানিবেগম বললে–সে তুমি বুঝবে না মা, না বোঝাই ভাল লোমাদের! আমি কিছু কিছু বুঝি, এক এক সময় আমিই তো ভাবতাম, নবাবের বেগম হওয়ার চাইতে গরিবের ঘরের বউ হওয়া এর চেয়ে অনেক ভাল। তা সে-সব কথা থাক, আমার সঙ্গে তুমি এক জায়গায় যাবে?

নিশ্চয়ই যাব। কোথায় মা?

মতিঝিলে। মির্জার কাছে।

নামটা শুনেই মরালী ভয় পেয়ে গিয়েছিল প্রথমে। নবাব! নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা! যার মহফিলের আসরে গুলসন নাচতে গিয়েছিল। যেখানে গেলে ভাগ্য ফিরে যায় এক রাত্রের মধ্যে। যেখানে যেতে পারার জন্যে নজর মহম্মদকে ঘুষ দেয় বেগমরা। সেই মির্জা মহম্মদ! মরালীর সমস্ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। সেই মতিঝিলে নানিবেগমসাহেবা তাকে নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে!

ভয় পেয়ো না মা, ভয় কীসের? আমি তো তোমার সঙ্গে থাকব! আর লোকে মির্জার সম্বন্ধে নানান কথা বলে বটে, কিন্তু আমি তো মা আমার মির্জাকে চিনি। এই এতটুকু বেলা থেকে মা, ওই নাতি আমার কাছে মানুষ হয়েছে। আমিনা, ওর মা তো দেখতও না। শুধু কি এখানে, আমি যেখানে গিয়েছি সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি, ওর নানা যেদিন নবাবি পেয়েছিল সেইদিনই ও জন্মায়। ও আমায় খুব পয়া নাতি মা! ওর কত বুদ্ধি, ওর কত বিদ্যে, তা তোমরা কেউ জানো না। ওর ইয়ারবকশিরা ওকে খারাপ পরামর্শ দিয়ে দিয়ে ওইরকম করে দিয়েছে, নইলে ও ভয় করবার মতো ছেলেই নয়–তোমরা ওকে ভুল বুঝো না মা। আর তা ছাড়া আমি তো থাকছি সঙ্গে

তারপর মরালীকে নিয়ে সোজা লুৎফুন্নিসার ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল।

ক’দিন আগেই মরালী এই ঘরে একলা একলা এসেছিল। এই সেই নবাবের ঘর। মরালী আবার চেয়ে দেখলে চারদিকে। সেই বাঁদিটা আবার দরজা খুলে দিয়ে নানিবেগমকে কুর্নিশ করলে। কী চমৎকার দেখতে! তাকে দেখে একটু হাসল লুৎফুন্নিসা বেগম। যেন আত্মীয়তা পাতিয়ে ফেলেছে একদিনেই।

নানিবেগম বললে–আমি যাচ্ছি আমার এই বেটিকে নিয়ে মির্জার কাছে–

লুৎফুন্নিসা বললে–কিন্তু কেন যাচ্ছ তুমি নানিজি! যদি এখন তার মেজাজ খারাপ থাকে? যদি তোমার সঙ্গে দেখা না করে?

আমার সঙ্গে দেখা করবে না মির্জা? আমার মির্জাকে আমি চিনি না?

লুৎফুন্নিসা বললে–না নানিজি, আমি শুনেছি তার মেজাজ ভাল নেই, কলকাতা থেকে ফিরিঙ্গিদের ধরে নিয়ে এসেছে, তার দরবার হচ্ছে সেখানে–

তা হলই বা। তা বলে সে তার নানির সঙ্গে দেখা করবে না?

কিন্তু নানিজি, তুমি কী বলবে সেখানে গিয়ে?

আমি বলব, এই রানিবিবিকে হাতিয়াগড় থেকে কেন নিয়ে আসা হয়েছে, তার কৈফিয়ত চাইব মির্জার কাছে।

কিন্তু নানিজি, এ কি এই প্রথম? এর আগেও তো কতবার এরকম হয়েছে, কত লেড়কি এখানে এসেছে, তার বেলায় তো তুমি কিছু বলেনি। তারাও তো এই বহেনজির মতো কষ্ট পেয়েছে।

তাদের কথা আলাদা।

কেন? আলাদা কেন? তারা কি মানুষ নয়? তাদেরও কি স্বামী, বাপ, মা কেউ নেই? তারা কি এখানে এসে কেঁদে কেঁদে রাত কাটায়নি? তুমি তাদের জন্যে কী করেছ?

নানিবেগম কী যেন ভাবল একবার। তারপর বললে, তুই যা বলেছিস সব সত্যি বহু, কিন্তু তখন তো আমি একলা ছিলাম না মা। তখন যে নানানবাব ছিলেন মাথার ওপর, তাঁর কথার ওপর তো আমি কথা বলতে পারতাম না। এখন যত দিন যাচ্ছে, তত যে বাড়ছে–এর তো একটা বিহিত করা দরকার–

দেখো, তুমি যদি পারো, আমি কিছু জানি না।

নানিবেগম বললে–আমিনা কোথায় রে? আমিনাকে একবার বলে যাই

বলে মরালীকে নিয়ে আবার বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তারপর চলতে চলতে অন্য এক মহলে চলে। গেল। মরালীও সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিল। চারদিকে চেয়ে চেয়ে অবাক হয়ে যাচ্ছিল মরালী। এও যেন একটা শহর। শহরের রাস্তার দুপাশে বাড়ি ঘর-দোর। সামনে পেছনে যারা আসছে যাচ্ছে তারা নানিবেগমকে দেখে সবাই ভয়ে-ভক্তিতে নিচু হয়ে কুর্নিশ করছে। আর মরালীর মুখখানাকে দেখছে। মরিয়ম বেগমকে সবাই চিনতে পারছে। কাল যে কাণ্ড করে বসেছে মরালী, তারপর তাকে চিনতে আর কারও বাকি নেই।

আমিনা?

নানিবেগম ঘরের মধ্যে ঢুকল। এই আমিনা বেগম! নবাব-বেগমদের অনেক কথা বাইরের লোক জানে। মরালীও জানত। যেন সব স্বপ্নের জগৎ। হাতিয়াগড়ের মানুষেরা এই আমিনা, ঘসেটি, সবাইকার কাহিনী জানত। হোসেনকুলি খাঁ’র কথা জানত। নবাব আলিবর্দি খাঁ’র বড় আদরের মেয়ে এই আমিনা। মরালীর চোখ দুটো জুড়িয়ে গেল!

আমিনা বেগমও অনেকক্ষণ ধরে দেখলে মরালীকে। তারই পেটের ছেলে মির্জা মহম্মদ এই মেয়েকে হাতিয়াগড় থেকে এখানে নিয়ে এসেছে।

তুই যাবি আমার সঙ্গে?

আমিনা বেগম বললে–আমি যাব না মা, মিছিমিছি অপমান করে তাড়িয়ে দেবে। তাকে তুমি চেনো না

–নানিবেগম বললে–অবাক করলি তুই আমাকে, মির্জাকে আমি চিনব না তো তুই চিনবি? তাকে তুই মানুষ করেছিস না আমি করেছি?

আমিনা জ্বলে উঠল–মানুষ করলেই বা, আমাকে কি মির্জা মা বলে মনে করে? তা যদি করত তা হলে সেবারই আমার কথা শুনত

কোনবার?

 কেন? আমি বারণ করিনি ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে? আমার কথা শুনেছে সে? সে তো তুমি জানো। আমি নিজে মতিঝিলে গিয়ে ওকে বললাম তুমি হলে নবাব, বাংলার নবাব, তুমি কেন ওদের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে ছোট করবে? ওরা বেনের জাত, ওদের সঙ্গে লড়াই করলে ওদেরই সম্মান দেওয়া হবে! তা শুনেছে মির্জা আমার কথা? আমাকে উত্তরে কী বললে–জানো? আমি ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে আফিমের কারবার করি বলে নাকি আমি তাদের দিকে টেনে কথা বলছি শোনো কথা!

তারপর একটু থেমে বললে–তা কারবার করলেই আমার দোষ হয়ে গেল? আমার সঙ্গে তো তাদের কেবল টাকার সম্পর্ক! আমি আফিম বেচি সোরা বেচি, তারা কেনে; আমি টাকা পেলেই সম্পর্ক চুকে গেল–

মরালীর মনে হল যার মা এমন, তাকে কেমন দেখতে কে জানে। অথচ তাকে সবাই ভয় করে কেন? বাইরে থেকে যা-কিছু সে শুনেছিল কিছুই তো সে রকম নয়।

আমি যদি গিয়ে বলি, এই বেগমকে এর বাড়ি পাঠিয়ে দাও তো আমাকেই হয়তো শাসাবে, বলবে আমি হয়তো কিছু টাকা নিয়েছি এর কাছ থেকে, নইলে এর জন্যে এত টেনে বলছি কেন? আর আমার কথা না শুনে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে কী লাভটা হল? কত টাকা পেলে ও? কিছু তো টাকা পায়নি। টাকা পায়নি বলেই তো ফিরিঙ্গি সাহেব হলওয়েলকে ধরে নিয়ে এসেছে–যদি তাকে…

কাকে ধরে নিয়ে এসেছে?

তুমি শোনোনি কিছু? হলওয়েল সাহেবকে। এখানে মতিঝিলে হাতকড়া দিয়ে বেঁধে এনে যাচ্ছেতাই করে অপমান করছে। ইয়ারবকশিরা বলেছে ওকে চাপ দিলেই নাকি লাখ লাখ টাকা বেরোবে। ফিরিঙ্গিদের খাজাঞ্চিখানা থেকে

নানিবেগম আর দাঁড়াল না। বললে–তা হলে আমি একলাই এই মেয়েকে নিয়ে যাই

তারপর ঘরের বাইরে এসে কোন রাস্তা দিয়ে বেঁকে কোন রাস্তায় বেরোল তার কিছুই বোঝা গেল না। চবুতরের কাছে নানিবেগমের তাঞ্জাম দাঁড়িয়ে ছিল। তাতেই গিয়ে বসল। মরালীকেও নিয়ে সামনে বসাল। তারপর চলতে চলতে একেবারে চেহেল্-সুতুনের বাইরে এসে পড়ল তাঞ্জাম। চেহেল সুতুনের ভেতরে আসার পর, আবার এই প্রথম বাইরে যাওয়া। সমস্ত রাস্তা দু’জনেই চুপচাপ। নানিবেগমের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে মরালী। যেন খুব ভাবছে একমনে। যেন বড় উদ্বিগ্ন।

সকালবেলা চকবাজারের রাস্তায় তেমন ভিড় থাকে না। তবু তাঞ্জাম দেখে যেক’জন লোক ছিল তাদের সরিয়ে দিলে কোতোয়ালের লোক। তাঞ্জাম যাতা হ্যায় খেয়াল নেহি? নানিবেগমকা তাঞ্জাম। মুর্শিদাবাদের নোক রাস্তা করে দিলে তাঞ্জামের। তারপর দেখলে সে তাঞ্জামটা গিয়ে ঢুকল মতিঝিলের ভেতরে।

মরালীও পেছন পেছন চলছিল। মতিঝিলের শ্বেতপাথরের চবুতরে নেমে নানিবেগম আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। এবার মরালী চলতে লাগল পাশাপাশি। দূর থেকে কানে গেল যেন কার ভারী গলার আওয়াজ। যেন ভারী গলায় কে কাকে বকছে। নবাব নাকি! নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা। নানিবেগমের মির্জা মহম্মদ!

মাথার ওপরে ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে। সারা দেয়ালে পঙ্খের কাজ। পায়ের তলায় শ্বেতপাথর। যদি বকে তাকে নবাব! নবাবের হুকুম না-মানার জন্যে যদি নানিবেগমকেও বকুনি দেয়, কেন মরিয়ম বেগমকে পাঠাওনি তুমি?

হঠাৎ নানিবেগম বললে–তুই এই ঘরে দাঁড়া বেটি, আমি পাশের ঘরে গিয়ে মির্জাকে ডেকে পাঠাচ্ছি, মির্জা এখন দরবারে বসেছে

মরালী একলাই দাঁড়িয়ে রইল। মতিঝিলের নামই মরালী শুনে এসেছে এতদিন, দেখলে এই প্রথম। এখানেই গুলসন এসেছিল। এখানে আসবার জন্যেই সব বেগমরা পাগল। এখানে একবার এলে এক রাত্রেই ভাগ্য ফিরিয়ে নেওয়া যায়। সেই মতিঝিলের মধ্যে এসেই আজ দাঁড়িয়েছে সে। দেয়ালে দেয়ালে পাখাওয়ালা পরিদের মূর্তি। তাদের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ধরতে চাইছে পুরুষমানুষরা। এরাও ছাড়বে না, ওরাও ধরা দেবে না। কোথাও আবার দুটো হাঁস গলা জড়াজড়ি করে জলের ওপর ভাসছে। পাশের ঘরে চলে গেছে নানিবেগমসাহেবা। অলিন্দের দিকে পা বাড়াল মরালী। কাঠের জাফরি দিয়ে ঢাকা অলিন্দ। জাফরির ফাঁক দিয়ে বাইরে দেখা যায়। মরালী বাইরের দিতে চাইলে বিরাট ঝিল। ঝিলের ওপর হাজার হাজার পদ্ম ফুটে রয়েছে। ক’টা বক একমনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে জলের দিকে চেয়ে। টিপ করছে মাছ ধরবে বলে।

হঠাৎ পাশের দিকে নজর পড়তেই মনে হল কে যেন উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে। একটা বীভৎস মুখ, একমুখ দাড়ি।

মরালী চোখ ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করলে। কিন্তু খানিক পরে আবার চোখ দুটো ফেরাতেই সমস্ত শরীর যেন আতঙ্কে শিউরে উঠল। মুখটা যেন দাঁত বার করে হাসল। তার দিকে এগিয়ে আসতে চেষ্টা করলে। আর মরালীর মনে হল বীভৎস মূর্তিটা যেন গ্রাস করতে আসছে। মরালী তার চেপে রাখতে পারলে না। হঠাৎ ভয় পেয়ে আর্তনাদ করে উঠল–আঁ-আঁ-আঁ আঁ আঁ–

সঙ্গে সঙ্গে মনে হল কারা যেন পাশের ঘর থেকে দৌড়ে আসছে। অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ। সিঁড়ি দিয়ে দুমদাম শব্দ করে যেন কারা দৌড়ে দৌড়ে নীচে নামতে লাগল। তারপরে আর তার জ্ঞান নেই।

*

সারাফত আলির দোকানে আগের দিন সন্ধেবেলা কান্ত কেবল ছটফট করেছে। নজর মহম্মদের মুখখানাই কেবল দেখবার চেষ্টা করেছে। সন্ধেবেলা মুর্শিদাবাদের চকবাজারে কোথা থেকে এত লোক জমা হয় কে জানে। কাজই বা কীসের তাও কান্ত বুঝতে পারে না। হয়তো সারাদিন কাজকর্ম করে সন্ধেবেলা ফুর্তি করতে বেরোয়। তখন গণতকাররা ছক পেতে বসে রাস্তার মোড়ে। বসে মানুষের ভাগ্যকে কখনও আকাশে ওঠায়, কখনও পাতালে নামায়। বেলফুলের মালা নিয়ে ফিরি করতে বেরোয় মালিরা। ওদিক থেকে হাতির দল গঙ্গায় চান করে সার সার ফেরে পিলখানার দিকে। তখনই ইব্রাহিম খ মদের হাঁড়া মাথায় নিয়ে মতিঝিলের দিকে যায়।

সেদিনও হাতিগুলো যাচ্ছিল। ইব্রাহিম খাঁ কিন্তু গেল না। আগের দিন হাতির ধাক্কায় পড়ে গিয়ে হয়তো গায়ে-গতরে ব্যথা হয়ে পড়ে আছে ঘরে। বেলফুলের ফেরিওয়ালাও চলেছে। দোকানের ভেতরে সারাফত আলি তখন আগরবাতি জ্বেলে দিয়ে আফিমের নেশায় জোরে জোরে গড়গড়ার ধোঁয়া টেনে দোকানঘর অন্ধকার করে দিয়েছে। ঠিক এই সময়েই রোজ নজর মহম্মদ আসে। এসে গল্প করে। মিঞা সাহেবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে চেহেল-সুতুনের বেগম মহলের খবরাখবর দেয়। তারপর এক ফাঁকে আরকের পাত্রটা কাপড়ের খুঁটের ভেতরে লুকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সেদিনও যথাসময়ে আসার কথা। গরজটা নজর মহম্মদেরও যেমন, কান্তরও তেমনি। নজর মহম্মদ বিনা-নজরানাতে চেহেলসূতুনে নিয়ে যাবে না, সুতরাং কান্তকে নিয়ে গেলে তার লাভ কম নয়।

সারাফত আলি নেশার ঝোঁকেও কান্তকে দেখতে পেয়েই কী রে কান্তবাবু, নজর এল?

 কান্ত বললেনা মিঞাসাহেব, এখনও তো তার পাত্তা নেই

আসবে, আসবে, আনেই পড়েগা, না এসে যাবে কোথায়?

কারও মনে হয়েছিল নজর মহম্মদ আসতে দেরি করছে কেন? আজ যে কান্তর একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। মরালী কেন তার পরিচয়টা দিতে গেল! কেন অমন সর্বনাশ করতে গেল নিজের। নিজেরও সর্বনাশ, পরেরও সর্বনাশ! এখনই যদি কোনওরকমে একবার চেহেল্‌-সুতুন থেকে বার করে নিয়ে আসা যায় তা হলেই হয়তো সব দিক থেকেই রক্ষে পাবে মরালী।

আচ্ছা মিঞাসাহেব, আজ যদি নজর মহম্মদ আর না আসে?

সারাফত বললে–না আসে তো না আসবে! লেকন উসকে অনেই পড়েগা!

কিন্তু আজ আসবে না? আজ যে আমার জরুরি দরকার ছিল।

আজ না এলে কাল আসবে। মেরে পাস আনেই পড়েগা উসকো!

কিন্তু আজই যে আমার দরকার!

কেন? আজই তোর দরকার কেন?

কান্ত বললে–ওই যে ইব্রাহিম খাঁ, কালকে যে-লোকটা হাতির ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিল, তার কাছে যে চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরের কাণ্ড শুনলুম কিনা, এলাহি কাণ্ড নাকি ঘটে গেছে চেহেলসূতুনে–

দুর, ওরকম কাণ্ড চেহেল্-সুতুনে হামেশা হচ্ছে! ও চেহেল্‌-সুতুনকা মামুলি বাত!

না, মিঞাসাহেব, রানিবিবি একটা দারুণ কাণ্ড করে বসেছে নাকি।

কী কাণ্ড?

 নিজের আসল পরিচয়টা সক্কলকে বলে দিয়েছে রানিবিবি। এতদিন মরিয়ম বেগম বলে সবাই জানত রানিবিবিকে, এখন জেনে ফেলেছে, ও হচ্ছে হাতিয়াগড়ের জমিদারের দ্বিতীয় পক্ষের বউ! সেই জন্যেই তো আমার ভয় হচ্ছে খুব।

কেন, তোর ভয় কীসের? মরিয়ম বেগম হলেও যা, রানিবিবি হলেও তাই। ও একই বাহ্! বাদি ভি বাঁদি, বেগম ভি বাঁদি। বেগমরাও আমার আরক খায়, তোর রানিবিবিও আমার আরক খায়—

কান্ত রেগে গেল। বললে–না মিঞাসাহেব, রানিবিবি কিছুতেই তোমার আরক খায় না।

আজ খায় না কাল খাবে। পহেলে তো কেউ খায় না, পরে খায়। আমার আরক খেলে পহেলে তো আরাম মালুম দেয়, তারপর নেশা পড়ে যায়, তখন মরিয়ম বেগম,বু বেগম, গুলসন বেগম, তক্কি বেগম, ঘসেটি বেগম, আমিনা বেগম, সব গোলমাল হয়ে এককাট্টা হয়ে যায়

সারাফত আলি যখন কথা বলে তখন আর থামতে চায় না। তখন হাজি আহম্মদের একেবারে কুলুজি ধরে টান দেয়। কোথায় যেন একটা বোব অভিযোগের অশান্তি মনের মধ্যে দিনরাত ঘুরপাক খায়, তাই একটু ফুটো পেলেই একেবারে হুড়হড় করে বেরিয়ে পড়ে।

বলে মরিয়ম বেগমই হোক আর হাতিয়াগড়ের রানিবিবিই হোক, আমার আরক ওদের পিলিয়ে দে, ওসব বিলকুল সাফ হয়ে যাক

এসব কথা কাত্তর অনেক শোনা আছে। বুড়োর বকবকানি বেশি ভাল লাগে না। অথচ না-শুনলেও চলে না। বুড়ো বড় ভাল মানুষ। থাকতে দেয়, খেতে দেয়, ঘরভাড়া নেয় না। এত হিন্দু আছে। মুর্শিদাবাদের, তাদের ক’জন এমন করে করবে তার জন্যে। আবার লজ্জাও করে। মাগনা তার জন্যে এ কেন করে সারাফত আলি! নিশ্চয় কোনও ঘা খেয়েছে। এমন ঘা যা বুড়োবয়েস পর্যন্ত ভুলতে পারে না। বাদশাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল কান্ত আচ্ছা বাদশা, মিঞাসাহেবের এত রাগ কেন বলো। তো চেহেলসূতুনের ওপর? তুমি কিছু জানো?

বাদশা বলেছিল-না জনাব, আমি সে বলতে পারব না–

কান্ত বলেছিল আমার জন্যে এত মোহর কেন খরচ করছে? চেহেল্‌-সুন থাকল কি গেল তাতে মিঞাসাহেবের কী আসে যায়?

ও জনাব আমার জন্যে ভি খরচা করেছিল মিঞাসাহেব! আমি ভি চেহেল্‌-সুতুনে গিয়েছি কতবার। আমাকে ভি মিঞাসাহেব চেহেলসুতুন ভেঙে গুঁড়িয়ে গোরস্থান বানিয়ে দিতে বলেছিল। আমি পারিনি

নজর মহম্মদই তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল?

জি জনাব!

তুমি গিয়ে কার সঙ্গে দেখা করতে?

 বাদশার চোখ কান-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল কথা বলতে বলতে। চেহেল্‌-সুতুনের কথা মনে পড়তেই যেন অনেক লজ্জাকর স্মৃতি মনে উদয় হয়েছিল।

কান্ত তবু ছাড়েনি, জিজ্ঞেস করছিল–সত্যি, বলল না, তুমি যেতে কী করতে?

বাদশা কুড়িবাইশ বছরের জোয়ান ছেলে। বললে–বেগমরা সব তাগড়া তাগড়া, আমি ওদের সঙ্গে লড়তে পারব কেন বাবুজি? রাতের পর রাত গিয়ে গিয়ে আমার তবিয়ত খারাপ হয়ে গেল, আমার তাগদ চলে গেল–

কেন, তাগদ চলে গেল কেন?

সে আপনাকে কবুল করতে পারব না জনাব, জোয়ান লেড়কা চেহেল্-সুতুনে গেলে তার তাগদ ফুরিয়ে যায়, তাগড়া তাগড়া বেগম লোগ তাকে বরবাদ করে দেয়

বলে মিটিমিটি হাসতে লাগল বাদশা।

এর পরে বাদশার কথার মানে বুঝতে আর দেরি হয়নি। সেখান থেকে চলে গিয়েছিল কান্ত! কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল তার। তবে কি সারাফত আলি সেই জন্যেই তাকে পাঠাচ্ছে চেহেল সুতুনে!

যখন রাত আরও গম্ভীর হল তখনও নজর মহম্মদের দেখা নেই। আর দেখা হল না মরালীর সঙ্গে। তখন সারাফত আলির আর কথা বলবার ক্ষমতা থাকে না। আফিমের মৌতাত তখন তার মাথার ঘিলুতে গিয়ে ঠেকে। তখন আর ভাল-মন্দ জ্ঞান থাকে না তার। তখন চেহেল্‌-সুতুনের ওপরেও রাগ থাকে না। তখন সারাফত আলি নিজেকে নিয়েই ঝুঁদ হয়ে থাকে। ভাবনা-চিন্তা করবার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত তার লোপ পেয়ে যায়।

অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল কান্ত। নিজের ঘুপচি ঘরের মধ্যে শুয়ে শুয়েও নজর মহম্মদের কথা ভেবেছিল। তারপর ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল বশির মিঞার কথা। বশির মিঞার সঙ্গে তার পর থেকে আর দেখা হয়নি, হয়তো সে ব্যও আছে খুব। নবাব ফিরে এসেছে মুর্শিবাবাদে। চারদিকে সব থমথমে ভাব। নবাব ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মুর্শিদাবাদের চেহারা যেন আবার বদলে গিয়েছে।

ভোরবেলা বিছানা থেকে উঠেই সে বশির মিঞার বাড়ির দিকে যাবার জন্যে বেরিয়েছিল। যদি বশির মিঞা তাকে আবার কোনও একটা কাজ দেয় তো আবার তাকে এই অবস্থাতেই বাইরে যেতে হবে। হয় মোল্লাহাটি, নয়তো কেষ্টনগর, নয়তো অন্য কোথাও। সারা বাংলাদেশময় বশির মিঞার জাল পাতা আছে।

রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে বশির মিঞার বাড়ির সামনেও এসে দাঁড়াল। একবার ডাকতেও ইচ্ছে হল তার। কিন্তু আবার মনে হল তাকে ডেকেই বা কী হবে। তারপর আবার সেই রাস্তা দিয়েই সোজা চলতে লাগল। একেবারে সোজা মহিমাপুরের দিকে। ওদিকে জগৎশেঠ সাহেবের বাড়ি। বিরাট বাড়ি। সামনে বিরাট বাগান। ফটকের সামনে পাঠান পাহারাদার ভিখু শেখ দাঁড়িয়ে থাকে যমদূতের মতো। ভিখু শেখকে দেখলেই কান্তর ভয় করে।

তারপর এক জায়গায় গিয়ে কান্ত আবার ফিরল।

আবার কোথায় যাবে! কী করে সময়টা কাটাবে? সময় কাটাতেই অনেক সময় কান্ত বিব্রত হয়ে পড়ে। সন্ধের আগে আর নজর মহম্মদ আসছে না। যখন সারাফত আলি আবার আগরবাতি জ্বালিয়ে গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে তামাকের ধোঁয়া টানবে, সেই-ই নজর মহম্মদের আসার সময়। হঠাৎ কোতোয়ালের লোক তাড়া করতে লাগল-হটো হটো, হট যাও

রাস্তার একপাশে সরে এল কান্ত। একটা রুপোলি ঝালরদার পালকি চলেছে রাস্তা দিয়ে। সামনে পথ করতে করতে চলেছে নবাবের এক জোড়া হাতি। হাতি দুটোর শুড়ের মাথায় ঝালর ঢাকা। ওপর থেকে শুড়ের ডগা পর্যন্ত নকশাকাটা।

হটো হটো, হট যাও

পাশের একটা লোককে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল–নানিবেগমের পালকি। কান্ত আরও ভাল করে পালকিটার দিকে চেয়ে দেখলে। মরালীকে যে-পালকিটা করে সে এখানে নিয়ে এসেছিল সেটাতে এমন ঝালর দেওয়া ছিল না। এটা আরও দামি। পালকিটার গায়ে কাঠের ওপর নকশা আঁকা।

সকালবেলা নানিবেগম কোথায় যাচ্ছে?

মতিঝিলে। বোধহয় নবাবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে।

মতিঝিলের কথাটা শুনেই সেই ইব্রাহিম খাঁ’র কথা মনে পড়ল। সেই সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ। কী অদ্ভুত নাম রেখেছিল তার বাপ-মা। কান্ত মতিঝিলের দিকেই পা বাড়াল। তার সঙ্গে দেখা করলে হয়। পালকিটা হুহু করে সামনের দিকে এগিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল। কান্তও সেই দিকে পা বাড়াল।

যখন মতিঝিলের ফটকের সামনে গিয়ে পঁড়িয়েছে তখন পালকিটার আর দেখা পাওয়া গেল না সেখানা কোথায় ভেতরে চলে গেছে। হাতি দুটো শুধু ঝিলের ধারে ঘাসের ওপর চরে বেড়াচ্ছে।

ইব্রাহিম খাঁ ভেতরে আছে ভাই?

 ইব্রাহিম খাঁ?

হ্যাঁ, তোমাদের এই মতিঝিলের সরাবখানার খিদমদগার। এই খুব বুড়োমতন, প্রায় সত্তর বছর বয়েস, মুখময় কাঁচা-পাকা দাড়ি। তার সঙ্গে একবার দরকার ছিল আমার, দেখা হবে এখন?

পাহারাদার লোকটা বোধহয় ভাল। সংসারে যেমন এক-একজন ভাল মানুষ থাকে, তেমনি।

কান্ত আবার বললে–আমার বিশেষ জানাশোনা মানুষ, ভেতরে যাবার নিয়ম হয়তো নেই, না গো!

তারপর একটু থেমে নিজেই আবার বললে–তা আমাকে যদি ভেতরে যেতে দিতে আপত্তি থাকে তো তাকেই একবার ডেকে দাও না, দেখাটা করে কথা বলে চলে যাই

পাহারাদার লোকটা বললে–যাইয়ে, অন্দর মে যাইয়ে লেকন…

বলে যে কথাটা বললে–তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে নানিবেগম ভেতরে গেছে, নবাবেরও দরবার চলেছি সময়ে যেন বেশিক্ষণ ভেতরে না থাকে। দেখা করেই যেন বাবুজি চলে আসে।

কান্ত বললে–না না, আমি বেশিক্ষণ থাকব না, আমার কাজ এক দণ্ডেই মিটে যাবে, সামান্য একটুখানি শুধু দেখা করা

তারপর জিজ্ঞেস করলে কিন্তু কোন দিক দিয়ে আমি যাব? আমি তো সরাবখানাটা ঠিক চিনি –

লোকটা নিজেই একজনকে ডেকে শেষপর্যন্ত সুব্যবস্থা করে দিলে। সত্যি, নিজামতের লোকরা সবাই-ই কিছু খারাপ নয়। কিছু কিছু ভাল লোক এখানে আছে বই কী! ভাল লোক না থাকলে কবে একদিন এদের নিজামতি চলে যেত। ভাল লোক আছে বলেই তো নবাবিআনা চলছে এতকাল ধরে। লোকটার ভাল থোক। কান্ত নিজের মনে মনেই বললে, লোকটার ভাল হোক। ভাল লোকদের ভাল হলেই তো আনন্দ হয়। পৃথিবীর খারাপ লোকদের ভাল হতে দেখলেই কাত্তর বড় মন খারাপ হয়ে যায়। ষষ্ঠীপদ ভাল লোক, তার ভাল থোক। বশির মিঞা ভাল লোক, তার ভাল হোক। আসলে সারাফত আলিও ভাল লোক, তারও ভাল হোক। আর মরালী। মরালীও তত ভাল। মরালীও তো কোনও দোষ করেনি, তারও ভাল হোক। বর পছন্দ না-হওয়াতে পালিয়ে গিয়েছিল বলে কি আর সে রাতারাতি খারাপ মেয়ে হয়ে গেল? তা নয়। আসলে খারাপ-ভাল বিচার করাই শক্ত। মরালী যদি জোর-জরদস্তিতে আরক খেতে বাধ্য হয়, কেউ যদি সাপের বিষ জোর করে তার গলার ঢুকিয়ে দেয়, তাতেই কি সে খারাপ হয়ে যাবে? আর, বাদশা যা বলছিল, তাও যদি মরালীর ভাগ্যে ঘটে, তাতেই বা কী দোষ মরালীর! কী আশ্চর্য, বাদশা বলে কিনা সে রাত কাটাত চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে। রাত কাটিয়ে চেহারা খারাপ হয়ে গেল বলেই আর যায় না। তা হলে কান্তকেও কি সেই জন্যেই চেহেসূতুনে পাঠাচ্ছে সারাফত আলি। যাতে নেশা লাগে, লেগে শরীর খারাপ হয়?

আরে বাজি, তুমি?

একেবারে সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর মুখোমুখি দাঁড়াতেই কান্ত যেন আবার পৃথিবীতে ফিরে এল। সিঁড়ির নীচেয় অন্ধকার একটা ঘর। চারদিকে কড়ির জালা। সারাফত আলির দোকানে যেমন খুশবু তেল থাকে, তেমনি থরে থরে সাজানো। বেশ মিষ্টি-মিষ্টি কড়া-কড়া গন্ধ ঘরটার মধ্যে। যে-লোকটা কান্তকে পৌঁছিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সে তখন চলে গেছে।

কান্ত বললে–এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই আপনার কথা মনে পড়ল। কেমন আছেন এখন?

সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ কান্তকে দেখেই উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠেছে এই তোমার কথাই ভাবছিলাম বাবাজি, তোমাকে সেই বলেছিলাম না শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের কন্যার কথা? সেই যার সঙ্গে তোমার বিবাহের প্রস্তাব করেছিলাম?

কান্ত উদগ্রীব হয়ে বলে উঠল–হ্যাঁ, হাঁ, সে তো বলেছিলেন, তা তার কী হয়েছে?

সে তো নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল বিবাহের রাত্রে, সে তো তোমাকে বলেছি–হঠাৎ সেই কন্যাকে আজ এখানে দেখলাম।

এখানে?

হ্যাঁ এখানে। এই এখুনি নানিবেগমসাহেবার সঙ্গে এই মতিঝিলে তাঞ্জাম থেকে নামল। এই এখুনি। নেমে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল তুমি আসবার একটু আগে। সেই কথাই বসে বসে ভাবছিলাম, ভাবছিলাম শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের কন্যা এখানে এল কেমন করে, এমন সময়ে বাবাজি

কান্ত জিজ্ঞেস করলে আপনি ঠিক দেখেছেন?

তা বাবাজি, আমি এই সত্তর বছর বয়েস পর্যন্ত এত কন্যার বিবাহ দিয়েছি, আমার ভুল হবে?

কিন্তু এখানে কী করতে এল সে?

তা কে জানে বাবাজি, আমিও তো তাই অবাক হয়ে ভাবছি, এখানে এই মতিঝিলে সেকন্যা এল কেমন করে!

কিন্তু আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না ঘটকমশাই।

না বাবাজি, তোমাকে আমি দেখাতে পারি। এই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলেই দেখা যায়। আমি তোমাকে প্রমাণ দিতে পারি! অথচ শোভারাম বিশ্বাস মশাই ওদিকে পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মেয়ে-মেয়ে করে! খবরটা তাঁকে একবার দেব ভাবছি!

কান্ত বললে–না, ঘটকমশাই, বাপকে আর একথাটা বলবেন না, বড় মনোকষ্ট পাবেন। আপনি কাউকে বলবেন না। আমি শুধু ভাবছি আপনি ভুল দেখেননি তো? অন্য কাউকে দেখেননি তো?

তবে তুমি আমার সঙ্গে ওপরে চলো, আমি তোমায় চাক্ষুষ দেখিয়ে দিচ্ছি। চলো চলো আমার সঙ্গে

জোর করে পুরকায়স্থমশাই কান্তকে ওপরে নিয়ে চলল। বললে–একটু আস্তে আস্তে এসো বাবাজি, ওপরে আবার নবাবের দরবার বসেছে-কলকাতা থেকে সব ফিরিঙ্গি ধরে এনে বিচার করছে নবাব। সেই জন্যেই তো এই দিককার সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে এলাম তোমাকে চুপি চুপি তোমায় দেখিয়ে দিয়ে আবার নেমে যাব, কেউ দেখতে পাবে না, এসো, পা টিপে টিপে এসো–

এই-ই প্রথম ভেতরে ঢুকল কান্ত। এই মতিঝিলের ভেতরে। এলাহি ব্যাপার দেখে অবাক হয়ে গেল। চেহে সুতুন দেখেছে খানিকটা, কিন্তু এ যেন অন্যরকম। এ যেন সত্যিই রাজপ্রাসাদ। দিল্লি কখনও দেখেনি কান্ত, শুধু দিল্লির বাদশার কেল্লার গল্প শুনেছে। এ সত্যিই দেখবার মতো। কিন্তু এখানেই বা এল কেন মরালী। কেউ নিয়ে এল। না নিজে থেকে এল?

ওই দেখো বাবাজি! ওই দেখো

একটা বিরাট ঘর! চারদিকের জাফরি-ঢাকা বাইরের সিঁড়ির কোণ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা। খুব ভাল স্পষ্ট দেখা যায় না। তবু কান্ত পুরকাস্থ মশাইয়ের পেছন থেকে দেখতে চেষ্টা করলে।

কই? কোথায়?

ওই যে, ওই ঘুলঘুলিটার দিকে মুখ করে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। মুখটা এদিকে ফেরালেই চিনতে পারবে বাবাজি আর চিনতেই বা পারবে কী করে তুমি? তুমি তো বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়েকে দেখোনি। শুভদৃষ্টি হবার আগেই তো সব ভন্ডুল হয়ে গেল–ওই ওইটিই হচ্ছে বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়ে, ওরই সঙ্গে তোমার বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলাম বাবাজি, তা তোমারও কপালে নেই, আমারও দুঃসময় পড়ল তখন থেকে

হঠাৎ মরালী এই দিকে মুখটা ফিরিয়েছে। আর পুরকায়স্থমশাইকে দেখতে পেয়েছে। যেন ভয় পেয়েছে দেখে। পুরকায়স্থমশাই বোধহয় একটু সাহস করে এগিয়ে যেতে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে মরালী আর্তনাদ করে উঠেছে সারা মতিঝিল কাঁপিয়ে।

আর ওদিক থেকে যেন কাদের দৌড়ে আসার শব্দ শোনা গেল। দুমদাম করে শব্দ হচ্ছে। কান্ত ভয় পেয়ে গেল। যদি এখন কেউ তাদের এখানে দেখে ফেলে!

পুরকায়হমশাইও ভয় পেয়ে গেছে। বলল–শিগগির নেমে এসো বাবাজি, কী সব্বনাশ

বলে নিজেই আগে আগে সিঁড়ি দিয়ে নীচেয় নেমে গেল।

 নানিবেগম পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এসেছে। পেছনে পেছনে নবাব।

 নানিবেগম মরালীর মুখের কাছে মুখ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলে ক্যা হুয়া বিটি? ক্যা হুয়া?

মরালীর তখন আর কথা বলবার মতো অবস্থা নয়। নবাবওঁ মরালীকে দেখলে ভাল করে। জিজ্ঞেস করলে এ কৌন নানিজি?

নানিবেগম বললে–এই তো হাতিয়াগড়ের রানিবিবি!

হাতিয়াগড়ের রানিবিবি? এখানে কেন? এখানে কী করতে এসেছে?

নানিবেগম বললে–আমি চেহেল্-সুতুন থেকে সঙ্গে করে এনেছি

 চেহেল্‌-সুতুনে রানিবিবি কেন এসেছে? কী করতে?

নানিবেগম বললে–সে-জবাব কি আমি দেব? চেহেল্‌-সুতুনের মালিক কি আমি? যে-দিন থেকে তোর নানাজি মারা গেছে, সে-দিন থেকেই তো আমি সব দেখা-শোনা করা ছেড়ে দিয়েছি। আমি তো সেদিন থেকে আমার কোরান নিয়েই থাকতুম, কিন্তু হঠাৎ নজরে পড়ল এই বেটিকে। সবাই একে মরিয়ম বেগম বলে জানত এতদিন

মরিয়ম বেগম? সে কে?

তুই যদি কিছুই না-জানিস মির্জা, তা হলে কেন এদের কষ্ট দিতে চেহেল সুতুনে আনিস? কোথা থেকে সব ধরে ধরে আনিস এদের আর এদিকে আমার যে প্রাণ বেরিয়ে যায়।

মির্জা বললে–কিন্তু আমি কদিক দেখবনানিজি, আমি আমার চেহেল-সুকুন দেখব,না মুর্শিদাবাদ দেখব, না তামাম বাংলা মুলুক দেখব! চারদিকে যে আমার শক্ত ঘিরে রয়েছে। কেউ যে আমায় এক দণ্ডের জন্যে শান্তি দিচ্ছে না। কাকে বিশ্বাস করব আমি? কাকে বিশ্বাস করে সব কাজের ভার দেব বলতে পারো? যেদিন থেকে মসনদে বসেছি সেদিন থেকেই তোমার মেয়েরা, তোমার আত্মীয়রা আমাকে বিপদে ফেলতে চাইছে। তার ওপরে আছে ফিরিঙ্গিরা, তার ওপরে আছে শওকত জঙ

নানিবেগম মুখ তুললেন।

কেন? সে বেচারি তোর কী করেছে?

 তুমি তো কারও দোষ দেখতে পাও না। কিন্তু তাকে খেপিয়ে তোলবার লোকের তো অভাব নেই।

 কে খেপাচ্ছে তাকে? কারা তারা?

 তোমাকে সব কথা বলা যায় না নানিজি, সব কথা তুমি বিশ্বাসও করবে না। কিন্তু তুমি বলতে পারো কে শত্রু নয় আমার? তোমার জাফর আলি থেকে শুরু করে জগৎশেঠ পর্যন্ত কে শত্রুতা করছে না? কার নাম করব তোমার কাছে। আমি একদিনের জন্যেও একটু শান্তি পাব না? আমি কার কাছে কী এমন অপরাধ করেছি যে সবাই আমার শত্রুতা করবে? তুমি একজনের নাম করো যে আমার ভাল চায়, যে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, আমার ভাল হলে যে আনন্দ পায়

কেউ পায় না?

কে, তার নাম করো!

কেন, আমি তোর ভাল চাই না?

মির্জা হঠাৎ নানিবেগমকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলে। বললে–নানিজি, তুমি তো আমাকে মানুষ করেছ নানিজি! তুমি কেন একথা বলছ?

বলে দুই হাত জড়িয়ে ধরে রইল নানিজিকে। কিছুতেই আর ছাড়তে চায় না মির্জা।

নানিবেগম বললে–ওরে, ছাড় ছাড় আমাকে ছেড়ে দে

বলো আগে, তুমি ওকথা আর বলবে না?

হঠাৎ নেয়ামত ঘরের ভেতরে ঢুকে কুর্নিশ করে দাঁড়াল।

কী খবর?

 জাঁহাপনা, কলকাতার রাজা মানিকচাঁদের কাছ থেকে তোক এসেছে খত্ নিয়ে, জাঁহাপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

জাঁহাপনা, জাঁহাপনা, জাঁহাপনা! শুনতে শুনতে মির্জার কান যেন পচে যাবার অবস্থা হয়েছে।

 নানিবেগম মির্জার মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। মুখখানা যেন হঠাৎ অন্যরকম হয়ে গেল। এ যেন অন্য মির্জা। বহুদিন আগে যখন নানিবেগম বালেশ্বরে ছিলেন তখন নবাব আলিবর্দি খাঁ-কেও এক-একদিন তিনি এইরকম চিনতে পারতেন না। রাত্রে কতদিন ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখেছেন, নবাব ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন আর মুখে বিড়বিড় করছেন। আজ মির্জারও যেন সেই অবস্থা।

নানিবেগম বললে–তুই ভেতরে যা মির্জা, তোর অনেক কাজ, আমি আসি

 মরালীর তখন বোধহয় একটু জ্ঞান ফিরে এসেছে। চোখের পাতা একটু খুলেছে।

এই বেগমসাহেবাকে কী করে নিয়ে যাবে তুমি?

সে তোকে ভাবতে হবে না। তুই নিজের কাজ করগে যা

তা হলে তুমি খবর দিয়ে দিয়ো নানিজি, আজ রাত্তিরে আমি চেহেল্‌-সুতুনে যাব।

 বলে মির্জা চলে গেল। নানিবেগম মরালীকে জিজ্ঞেস করল–এখন তৰিয়ত কেমন লাগছে বেটি?

মরালী কোনও কথা বলতে পারল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শুধু।

 নানিবেগম জিজ্ঞেস করলে হঠাৎ কী হয়েছিল? অত চেঁচিয়ে উঠেছিলি কেন মা? কী হয়েছিল বল তো?

মরালী বললে–আমার মনে হল কারা যেন ঘরের ভেতর ঢুকে আমাকে ধরতে আসছিল যেন আমার দিকে চেয়ে চেয়ে দাঁত বার করে হাসছিল

দুর পাগলি মেয়ে! এই মতিঝিলে কে তোকে ধরতে আসবে? এখানে কার এত সাহস হবে? নিশ্চয়ই ভুল দেখেছিস তুই! স্বপ্ন দেখেছিস জেগে জেগে

তারপর একজন বাঁদিকে ডেকে মরালীকে ধরতে বললেন। মরালীর দিকে চেয়ে বললেন–চল, চেহেল্‌-সুতুনে গিয়ে হেকিমসাহেবকে ডেকে পাঠাব, সব ঠিক হয়ে যাবে, চল, মির্জাকে তোর কথা সব বলেছি, এখন দরবার চলছে, আজ রাত্তিরে মির্জা চেহেল সুতুনে আসবে, চল–

তাঞ্জাম তৈরিই ছিল। নানিবেগম আর বাঁদিটা দুজনে মিলে মরালীকে ধরে তাঞ্জামের ভেতর তুলে দিলে। তাঞ্জামটা আবার মতিঝিল পেরিয়ে রাস্তায় এসে পড়ল। আবার আগেকার মতন একজোড়া ঝালর-ঢাকা হাতি আগে আগে চলতে লাগল।

*

সন্ধেবেলা নজর মহম্মদ দোকানে আসতেই সারাফত আলি বললে–কী রে নজর, কাল এলি না তুই, বাবুজি তোর জন্যে রাত পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরেশান হয়ে গেল

নজর মহম্মদ বললে–কাল মিঞাসাহেব, চেহেল্‌-সুতুনে গোলমাল হয়ে গিয়েছিল সব

কী রকম?

ভেবেছিলুম আমি সব ফঁস করে দেব মিঞাসাহেব, মেহেদি নেসার সাহেব আমার নামে কাছারিতে নালিশ পেশ করেছে, ও হারামির বাচ্চাকে আমি এবার দেখে নেব। কিন্তু আমাকে শালা কিছুই করতে হল না। মরিয়ম বেগমসাহেবা খুদ নিজেই সব ফঁস করে দিয়েছে নানিবেগমসাহেবার কাছে। নানিবেগম আজ রানিবিবিকে নিয়ে মতিঝিলে গিয়েছিল।

কান্তও কথাটা কানে যেতেই ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়াল।

নানিবেগম নবাবকে সব ফাঁস করে দিয়েছে!

কান্ত আর থাকতে পারলে না, বললে–তারপর?

নজর মহম্মদ সারাফত আলির দিকে চেয়েই বলতে লাগল–মিঞাসাহেব নবাবের কি ফুরসুত আছে সব কথা শোনবার। দরবার আছে, লড়াই আছে, জেনানা আছে, একলা কত কাম করবে নবাব! হলওয়েল সাহেবকে পাকড়ে এনেছিল কলকাতা থেকে, তাকে ভি ছেড়ে দিল

কাহে?

 নানিবেগম নবাবকে বললে–ছেড়ে দিতে। জাফর আলি সাহেবকে খুব ধমক দিয়েছে নবাব। ভাইতে-ভাইতে লড়াই লাগিয়ে দেবার মতলব করছে তো? নানিবেগম জাফর আলি সাহেবকেও খুব ধমক দিয়েছে। নবাবের নোকরি হারামের নোকরি মিঞাসাহেব। চারদিকে কেবল দুশমনি। শালা দুশমন তাড়াতে-তাড়াতে রাতে নিদ ভি নেই নবাবের চোখে। অত ফুর্তিবাজ নবাব একেবারে হয়রান হয়ে গেছে মসনদে বসে।

সারাফত আলি বললে–তা আজ বাবুজিকে চেহেল্‌-সুতুনে নিয়ে যাচ্ছিস তো তুই?

নজর মহম্মদ ভয়ে আঁতকে উঠলইয়া আল্লা, আজ তো জান নিকলে যাবে আমাদের।

কেন?

নবাব খুদ নিজে চেহেল সুতুনে আসবে রাত্তিরে, রাত্তিরে চেহেল্‌-সুতুনে ঘুমোবে। হাতিয়াড়ের রানিবিবির সঙ্গে মুলাকাত করে সব বাঁচিত্ শুনবে, মেহেদি নেসার সাহেব যত ঝুট বাত বলেছে, তার সব ফয়সালা হবে, আজ বাবুজিকে চেহেল্‌-সুতুনে নিয়ে গেলে আমাদের জান চলে যাবে মিঞাসাহেব

কান্ত চুপ করে সব শুনছিল। বললে–রানিবিবির সঙ্গে নবাব দেখা করবে!

হাঁ জনাব, হাঁ। সব ফয়সালা হবে যে আজ। হুকুম হয়ে গেছে চেহেলসূতুনে। এই তো আজ জলদি লৌট যাচ্ছি, আজ কাজে গাফিলি করলে আমার জান চলে যাবে।

বলে আর দাঁড়াল না নজর মহম্মদ।

কান্ত অধীর হয়ে উঠেছিল। বললে–রানিবিবি দেখা করতে রাজি হয়েছে? রানিবিবি আপত্তি করেনি?

কিন্তু নজর মহম্মদের কানে সেকথা পৌঁছুল না। নজর মহম্মদ তখন হনহন করে বরাবর সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে চকবাজারের রাস্তা দিয়ে।

*

মতিঝিলের নবাব শুধু মতিঝিলের নবাবই না, বাংলা বিহার ওড়িষ্যার নবাব। যার একটা হুকুমে মুর্শিদাবাদের চেহেলসূতুনের ইটগুলো পর্যন্ত ভয়ে থরথর করে কাঁপে, যার একটা কথায় হাতিয়াগড়ের রাজা দ্বিতীয় পক্ষের বউকে সুড়সুড় করে চেহেল্‌-সুতুনে পাঠিয়ে দেয়, সে মানুষটাকে সেই-ই প্রথম দেখল মরালী। যেমন আর পাঁচজন মানুষ ঠিক তেমনি। তেমনি মুখ-চোখ কান কপাল সবকিছু। গলার আওয়াজটাও আর পাঁচজন মানুষের মতন। এই মানুষটাই ইচ্ছে করলে নাকি যে-কোনও লোকের ভাগ্য ফিরিয়ে দিতে পারে। এই মানুষটার কাছে যাবার জন্যেই গুলসন বেগম থেকে শুরু করে সব বেগম উদগ্রীব হয়ে থাকে। এই মানুষটাই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সকলের ভাগ্যবিধাতা। ভাবতেও অবাক লাগে।

নবাবের সব কথা কানে যায়নি ভাল করে। কিন্তু যেটুকু গিয়েছিল সেইটুকুতেই বড় মায়া হয়েছিল মরালীর মানুষটার জন্যে! সত্যি, কেউ কি নেই যে নবাবের ভাল দেখে! এমন কেউ কি নেই যেনবাবের ভাল চায়?

নানিবেগম আসবার সময় জিজ্ঞেস করেছিল–তুই অত ভয় পেয়েছিলি কেন বেটি? অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলি কেন? কী হয়েছিল তোর? মির্জাকে তোর এত ভয়?

মরালী সে কথার উত্তর না দিয়ে বলেছিল–নবাবের বুঝি অনেক শত্রু নানিজি?

 নানিবেগম বলেছিল–বেচারাকে সবাই মিলে বড় নাজেহাল করে দিচ্ছে মা, সাধে কি আর দুঃখ হয় আমার মির্জার জন্যে! সবাই ওর দুশমন মা, সবাই ওর দুশমন!

কেন? কীসের জন্যে শত্রুতা করে তারা? কী করেছে নবাব,

দুশমনির কি কোনও কারণ থাকে মা। ও এক-একজনের কপালে লেখা থাকে। তারা দুশমন নিয়েই জন্মায়, তারা লোকের ভাল করুক মন্দ করুক, তাদের দুশমন থাকবেই

কারণ না থাকলেও শত্রুতা করবে?

তা করে না? মির্জা তো আমার কোনও দোষ করেনি, তবু কেন আমার নিজের পেটের মেয়ে তাকে দেখতে পারে না? ওর নানারও ওইরকম ছিল মা, সারা জীবন তাকে জ্বলতে হয়েছে। তাই তো বলি, বড় হওয়াই পাপ। কারও বড় হওয়া লোকে ভাল চোখে দেখে না। তাই তো তোকে বলেছিলাম, নবাবের চেয়ে নবাবের প্রজারা অনেক সুখে আছে। তারা তবু রাত্তিরে আরাম করে ঘুমোতে পারে, শাক-ভাত যা হোক দুটো পেট ভরে খেয়ে শান্তি পায়। মির্জার আমার খেয়েও সুখ নেই, ঘুমিয়েও সুখ নেই। এই যে আমার সঙ্গে আজ কতদিন পরে দেখা হল, কত কথা বলবার ছিল, কিন্তু কোথা থেকে হঠাৎ মানিকচাঁদের চিঠি এল আর সব বন্ধ হয়ে গেল। এখন দেখি, আজ রাত্তিরে যদি আসে তো তোর একটা হিল্লে করে দেব মির্জাকে বলে

আমার আবার কী হিল্লে করবে নানিজি?

তোকে যদি হাতিয়াগড়ে ফেরত পাঠাবার জন্যে মির্জার মত করাতে পারি।

আমাকে ফেরত পাঠাবেন?

মরালী চমকে উঠল।

কেন? ফেরত পাঠালে তুই যাবি না? তোর কি চেহেল্‌-সুতুনে থাকতে ভাল লাগছে? ফেরত পাঠালে তোর সোয়ামি তোকে নেবে না?

মরালী বললে–না।

নানিবেগম আবার জিজ্ঞেস করলে–সত্যিই নেবে না?

মরালী আবার বললে–না। আমি মুসলমানের হাতে খেয়েছি, আমার জাত গেছে, এর পর কেউ কাউকে ঘরে নেয় না।

তা কী করবি বল? মির্জাকে আমি কী বলব?

মরালী বললে–আমি এখানেই থাকব।

নানিবেগম আরও অবাক হয়ে গেল। বললে–তুই থাকতে পারবি? কষ্ট হবে না থাকতে? তুই তো নজর মহম্মদ, পিরালি খাঁ, বরকত আলি ওদের দেখেছিস, ওদের মন জুগিয়ে চলতে পারবি?

মরালী হঠাৎ বলল–আমি আপনার কাছে থাকব নানিজি!

নানিবেগম হেসে ফেললে। বললে–দুর পাগলি, আমি আর ক’দিন! আমি তো আর বেশি দিন বাঁচব না। আমি মরে গেলে তুই কী করবি! কে তখন দেখবে তোকে?

মরালী বললে–ছোটবেলায় তো আমার মা-ও মারা গিয়েছিল, তখন কে আমায় দেখেছিল?

এরপর নানিবেগম আর কোনও কথা বলেনি। মরালীও আর কোনও কথা বলেনি। কেমন যেন সেইদিনই দু’জনের মন জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। সেদিন থেকে আর কোথাও যেতে মরালীতে কেউ বাধা দেয়নি। সেই দিন থেকেই মরালী চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে এ-মহল থেকে ও-মহলে ঘুরে বেড়িয়েছে। সেই তখন থেকেই মনে হয়েছিল, যে-লোকটার এত শত্রু তাকে একটু শান্তি দিতে হবে। আর তারপরে যখন সেই ক্লাইভ সাহেব এসেছিল জীবনে, তখনও সেই মানুষটার কথা ভুলতে পারেনি।

ক্লাইভ সাহেব মরালীকে মেরী বলে ডাকত। কোথাকার কোন সাত সাগর তেরো নদীর পারের দেশ। সেখান থেকে এসেছিল এখানে চাকরি করতে। সামান্য চাকরি। সাহেব এক একদিন চুপ করে বসে থাকত বাগানে। আবার এক একদিন প্রাণ ভরে গল্প করে যেত। ফরসা টকটক করছে গায়ের রং। কত লড়াই করেছে কত জায়গায়। কতবার আত্মহত্যা করতে গেছে।

মরালী জিজ্ঞেস করত–কেন গো। আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে কেন তুমি?

 সাহেব বলত–এখনও মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার তা জানো মেরী?

কেন? তোমার এত কষ্ট কীসের?

তখন সাহেবের প্রচুর টাকা। তখন রবার্ট ক্লাইভও যা, দিল্লির বাদশাও তাই। মরালীর অবাক লাগত সাহেবের কথা শুনে। মনে পড়ত মুর্শিদাবাদের নবাবের কথা। মুর্শিদাবাদের নবাবেরও ঘুম আসত না। রাত্রে। ক্লাইভ সাহেবও ঘুমোত না।

মরালী জিজ্ঞেস করত–সত্যি বলো না সাহেব, তোমার কীসের কষ্ট?

সাহেব বলত–সে কি তুমি বুঝতে পারবে? সবাই আমার শত্রু–এমন কেউ নেই যে আমার ভাল চায়, যে আমার ওয়েল-উইশার, এমন কেউ নেই আমার ভাল হলে যে আনন্দ পায়।

মরালী বলত–কেন, মেজর কিলপ্যাট্রিক সাহেব, ওয়াটসন সাহেব, তোমার কোম্পানির বড় সাহেবরা

সাহেব বলত–কেউ না, কেউ না, কেউ না

সাহেব ‘না’ বলত আর মাথা নাড়ত। যেন যন্ত্রণায় সাহেবের বুক ভেঙে যেত কথা বলতে বলতে। যে-মানুষটা দু’বার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল, দু’বারই বেঁচে গিয়েছিল। সাহেবের কথাগুলো শুনতে শুনতে মরালীর নানিবেগমের কথা মনে পড়ত। নানিবেগম বলেছিল–দুশমনির কি কোনও কারণ থাকে মা, ও এক-একজনের কপালে লেখা থাকে। তারা দুশমন নিয়েই জন্মায়। তারা ভালই করুক আর মন্দই করুক, তাদের দুশমন থাকবেই

কিন্তু এসব কথা এখন থাক।

উদ্ধব দাস তার কাব্যে এসব কথা অনেক পরে লিখেছে, আমি আগে থেকেই শেষের কথাগুলো বলে ফেলছি। মরালী কি তখন নবাবকে ভাল করে চিনেছে না ক্লাইভ সাহেবকেই চিনেছে! একজনের বয়েস ছিল তখন মাত্র ছাব্বিশ বছর। ছাব্বিশ বছরেই নবাবি পেয়ে সে-মানুষটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আর একজনের বয়েস ছিল তখন মাত্র একত্রিশ। সেই একত্রিশ বছর বয়সেই দেশ-ঘর-সমাজ ছেড়ে এসে হাজির হয়েছিল এই জলকাদা-মশা-মাছির দেশে।

নানিবেগম বলত–আমি তো সেই জন্যেই কোরান নিয়ে থাকি মা দিনরাত, খোদার কাছে দিনরাত দোয়া চাই, খোদাতালাকে কেবল বলি, মির্জা যেন আমার শান্তি পায় খোদা, মির্জা যেন আমার দুদণ্ড ঘুমোত পারে, মির্জা যেন ভাল থাকে।

সেদিন সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল চেহেল্-সুতুনের ভেতরে। নবাব মতিঝিল থেকে চেহেল্‌-সুতুনে আসবে। সব বেগমই আতর-কুম-পেশোয়াজ-পায়জোড় নিয়ে ব্যস্ত। গুলসন সেদিন আর লুকিয়ে লুকিয়ে এল না। একেবারে সোজা দিনের আলোতেই এসে ঘরে ঢুকল।

বললে–তুমি নাকি ভাই মতিঝিলে গিয়েছিলে?

মরালী বললে–তুমি কোত্থেকে শুনলে?

এমনি শুনলাম। নবাব তোমাকে কী বললে? তোমাকে দেখে হেসেছে?

মরালী বললে–হ্যাঁ।

তবে আর কী, ভাই। তবে তো তুমি মেরে দিয়েছ!

মরালী বললে–কেন, তুমিও তো কাল মতিঝিলে গিয়ে নেচে অনেক মোহর পেয়েছ শুনলাম, তোমারও তো ভাগ্য ভাল!

গুলসন বললে–কিন্তু তার জন্যে কত খরচ করতে হয়েছে, তা জানো! ওই নজর মহম্মদকে কত ঘুষ দিয়েছি, কত খোশামোদ করেছি, কিন্তু শেষপর্যন্ত মজুরি পোষাবে কি না কে জানে ভাই!

কেন?

সকলের চক্ষুশূল হয়ে গেছি যে ভাই! সবাই আমার দিকে টেরিয়ে টেরিয়ে চাইছে। যেন আমি সকলের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি। অথচ, তুমি তো ভাই জানো, আমি কারও মন্দ চাইনে। আমি চাই সকলের ভাল হোক! অথচ তোমরা যে ভাই কত টাকা রোজগার করছ, তার জন্য তো আমি কিচ্ছু বলি না

মরালী অবাক হয়ে গেল। বললে–টাকা? বেগমরা টাকা রোজগার করছে? সেকী?

ওমা, টাকা রোজগার করছে না? সবাই তো কারবার করে। তুমি কি ভাবছ কেবল সবাই চুপ করে বসে থাকে?

কীসের কারবার করে সবাই?

কত রকমের কারবার করে। কারবার কি একটা? সোরা কেনা-বেচা করে, আফিং কেনা-বেচা করে, রেশম কেনা-বেচা করে। ওই যে নবাবের মা, আমিনা বেগম, ওর কি কম টাকা মনে করেছ? বিধবা হয়ে এস্তোক এখেনে এসেছে, সেই থেকে লাখ লাখ টাকা আয় করেছে কলকাতার ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে কারবার করে। আর ওই বব্বু বেগম! ওরা সবাই লাখলাখ টাকার মালিক! আমি তো তাতে কিছু বলিনি কোনওদিন। আমি ভাবতুম যদি কোনওদিন কিছু টাকা পাই তো আমিও কারবারে খাটাব সে টাকা। কিছু সোরা কিনে ফিরিঙ্গিদের বেচব। এই ধরো পাঁচকুড়ি টাকার মাল বেচলে নকুড়ি টাকা ঘরে আসে, তা মন্দ কী। সেই জন্যেই তো ভাই নজর মহম্মদকে অত খোশামোদ করে মতিঝিলে গিয়েছিলাম–

তা এবার কারবার করবে তো?

ওমা, সে গুড়ে বালি ভাই। সেই যে কথায় আছে না, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। আমার হয়েছে তাই। ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই হবার পর থেকে তো সকলের কারবার বন্ধ।

কেন?

তা মাল কে নিবে যে কারবার করবে? ফিরিঙ্গিরাই তো মাল নিত। তারা যখন নেই তখন কে আর কিনবে? কাশিমবাজার কুঠি তো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে নবাব। কলকাতায় উমিচাঁদ সাহেব বলে। একজন মহাজন ছিল, তাকেও তো নবাব শায়েস্তা করে দিয়েছে। বেভারিজ সাহেব বলে একজন। ফিরিঙ্গি ছিল, সেও তো গদিটদি গুটিয়ে পগারপারে চলে গেছে। কিনবেটা কে?

তারপর একটু থেমে বললে–সেই জন্যেই তো সবাই নবাবের ওপর চটে গেছে! নবাবের মা পইপই করে ছেলেকে বারণ করেছিল লড়াই করতে। লড়াইতে নবাব জিতলে কী হবে, বেগমদের খুব লোকসান হল তো। টাকা আমদানি বন্ধ হল তো। ছেলের ওপর রাগ হবে না মায়ের? এখানে একজন বড় শেঠ আছে তার নাম ভাই জগৎশেঠ, সেও তো শুনেছি রেগে গেছে ওই জন্যে। তা রাগ হবে না, তুমিই বলো।

তারপর হঠাৎ গলাটা নিচু করে বললে–বললে–তো অনেক কথাই বলতে হয় ভাই, বলি না বলে তাই। কিন্তু জানি তো সব! আমার ওপর চোখ টাটালে আমিও একদিন রাগের মাথায় সব বলে দেব

কী বলবে?

তবে তোমাকে চুপি চুপি বলি। কাউকে যেন বোলো না ভাই। এখেনে চকবাজারে সারাফত আলি বলে একজন পাঠানের দোকান আছে। সে তো বলেছি তোমাকে। বাইরে খুশবু তেলের দোকান। কিন্তু তার মতলব খুব খারাপ ভাই, জানো। সে তো আরক বেচে। সে-আরক আমরা খাইও, কিন্তু আসল। ব্যপারটা আলাদা।

কী রকম?

এখন বুড়ো থুত্থুড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু শুনেছি যখন জোয়ান বয়েস ছিল তখন থাকত দিল্লিতে। সেখেনে নবাব আলিবর্দির দাদা হাজি আহম্মদ ওর বউকে ফুসলে নিয়ে আসে। খুব সুন্দরী বউ। সেই বউ ফুসলে নিয়ে আসার পর থেকেই হাজি আহম্মদের ভাগ্য ফিরল। তার আপন ভাই আলিবর্দি খাঁ, নিজের অন্নদাতা সুজাউদ্দিনের ছেলে নবাব সরফরাজ খাঁ-কে খুন করে এই মুর্শিদাবাদের নবাব হল, আর সারাফত আলির অবস্থা তার পর থেকেই খারাপ হতে শুরু করল। সেই সময় থেকে বুড়ো এইখেনে এসে দোকান খুলেছে, আর কেবল হাজি আহম্মদের বংশ ধ্বংস করবার চেষ্টা করছে–

হাজি আহম্মদের বংশ মানে?

সেটা আর বুঝলে না! নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা তোতা হাজি আহম্মদেরই নাতি হল। নবাব আলিবর্দি খাঁ’র তো নিজের ছেলে হয়নি। তিন মেয়ের সঙ্গে দাদার তিন ছেলের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। আমাদের নবাব তো হাজি আহম্মদেরই ছোট ছেলের ছেলে তাকেই তো আলিবদি খাঁ পুষ্যিপুত্তর নিয়েছিল–

তারপর গুলসন কথা বলতে বলতে যেন একটু দম নিতে লাগল।

মরালী বললে–তারপর?

তারপর এখেনে এসে বুড়ো সারাফত আলি ওই দোকান করেছে। আর খোজাদের ঘুষ দিয়ে দিয়ে আরক বেচছে! আর শুধু কি আরক? খোজাদের ঘুষ দিয়ে দিয়ে আর কী করে জানো ভাই?

মরালী জিজ্ঞেস করলে–কী?

নজর মহম্মদ তোমার কাছে এসে কিছু বলে না?

কী বলবে?

বাইরে থেকে জোয়ান জোয়ান ছোকরা আনবার কথা? তা আর কিছুদিন থাকে না, তখন দেখবে তোমাকেও ঠিক বলবে? আগে সারাফত আলি এখেনে একটা ছেলেকে পাঠাত, সে ভাই কী চমৎকার দেখতে তোমাকে কী বলব। তার নাম রশিদ। যেমন স্বাস্থ্য, তেমনি গড়ন। একেবারে কন্দর্পের মতো চেহারা ভাই, কিন্তু স্বাস্থ্য ভাল হলে কী হবে, এতগুলো তাগড়া তাগড়া বেগম, এদের সকলের সঙ্গে সে। একলা যুঝতে পারবে কেন? তা এখেনে এলেই সবাই মিলে তাকে ছেকে ধরত। সন্ধেবেলা আসত আর। ভোর হবার আগে কেউ ছাড়ত না। একেবারে ছিঁড়ে খেত তাকে। অমন স্বাস্থ্য ভাই, দু’দিনে শুকিয়ে। হাড়-সার হয়ে গেল! তারপর আর সে আসত না। তখন পাঠাত আর একটা ছেলেকে, তার নাম কেশর। সেও যেন ভাই একেবারে রাজপুত্তুরের মতন দেখতে! কোত্থেকে যে ভাই সারাফত আলি অমন বাছা বাছা ছেলেদের আমদানি করত কে জানে! এমনি করে এক-একজনকে সারাফত আলি চেহেলসূতুনে পাঠিয়েছে আর দুদিন পরেই তারা শুকিয়ে একেবারে আমসি হয়ে গেছে। এদানি একটা পাঠান ছেলে আসত, তার নাম বাদশা। ক’দিন ধরে খুব এল, সব বেগমদের ঘরে রাত কাটাতে লাগল পালা করে। কিন্তু একদিন সে-ও আর এল না, তার আসা বন্ধ হয়ে গেল। এখন আবার অন্য একজনকে ধরেছে

আবার আর একজন? এখানে রোজ রাত্তিরে আসে?

আমি এখনও দেখিনি তাকে। নজর মহম্মদ তো আমাকে কদিন ধরে খুব খোশামোদ করছে। রোজই বলে–গুলসন বিবি, একজন খুবসুরত জোয়ান লেড়কা আছে, তাকে আনব?

মরালী জিজ্ঞেস করলে সে কে?

ওই সারাফত মিনসের লোক, আর কে! এবার নাকি হিন্দু, আর মুসলমান নয়–রোজ খোশামোদ করছে। আনতে পারলে তো সারাফত আলির কাছ থেকে মোহর পাবে কিনা–

কেন?

সারাফত আলি তো ওই লোভ দেখিয়েই ছেলেগুলোকে এখেনে পাঠায়। বেটা হাজি আহম্মদের বংশ ধ্বংস করতে চায়। আর খোজারাও সেই টাকায় সোরা, আফিং, রেশম, এইসবের কারবার করে। খোঁজাগুলোর কি কম টাকা আছে নাকি, ভেবেছ? তা এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম–এ কে? একে কেমন দেখতে? নজর মহম্মদ বললে–খুব খুবসুরত দেখতে গুলসন বিবি। একেবারে তাজা জোয়ান। এ হিন্দুবাচ্চা। এর নাম কান্তবাবু

মরালী আকাশ থেকে পড়ল–কান্তবাবু? কান্ত কী? পদবি কী?

 কান্ত সরকার…

কিন্তু কথাটা পুরো শেষ হবার আগেই আরও কয়েকজন এসে হাজির। বব্বু বেগম, তক্কি বেগম, পেশমন বেগম, সবাই এসে ঢুকে পড়েছে মরালীর ঘরে। সবাই খবর পেয়ে গেছে নবাব চেহেল্‌-সুতুনে আসছে মরিয়ম বেগমের সঙ্গে দেখা করতে। সবাই হিংসে করছে আজ তাকে। সবাই দেখতে এসেছে নবাব চেহেসতুনে আসবে বলে কী সাজ করেছে মরিয়ম বেগম, কী পোশাক পরেছে। আজ যদি নবাবের ভাল লেগে যায় মরিয়ম বেগমকে তো আজ অনেক মোহর পাবে সে। অনেক টাকার মালিক হয়ে যাবে। মরালীও আজকে সবাইকে মুখোমুখি প্রথম দেখলে।

কিন্তু নানিবেগমই বাদ সাধল। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঢুকেই বললে–তুম সব ইহা কিউ? তুম যাও ইহাসে, সব নিকলোনিকলো–

সকলকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলে নানিবেগম। দিয়ে বাঁদিকে ডাকলে। জুবেদাকে বাতিল করে দেবার পর মরিয়ম বেগমের জন্যে নতুন বাদি এসেছে, তাকে ডাকলে। ডেকে মরালীকে সাজাতে বসল। মির্জা আসবে চেহেল্-সুতুনে এতদিন পরে, তবু যদি তার মন ভোলে। তবু যদি মরিয়ম বেগমের দিকে ফিরে চায়। তবু যদি মরিয়ম বেগমকে দেখে মনে শান্তি পায়। সুখ পায়। দিদিমার প্রাণ। মির্জার একটুকু সুখ শান্তি দেখলে তবু দিদিমার প্রাণটা জুড়োবে। সেইখানে বসে বসে মরালীকে প্রাণভরে সাজাতে বসল।

*

মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা জন্মেছিল ১৭৩০ সালে। আর এক দেশে, আর এক ভূখণ্ডে জন্মেছিল আর একটি ছেলে। তার জন্মের তারিখ ১৭২৫। শুধু পাঁচটা বছরের তফাত। তার নাম রবার্ট ক্লাইভ। ইংলন্ডে সুপশায়ারের বাজারের সেই ছেলেটাই যে একদিন কুড়ি বছর বয়েসে মাদ্রাজে এসে জাহাজ থেকে নামবে, তা তার বাপও জানত না, তার গর্ভধারিণীও জানত না। দু’বার পিস্তল নিয়ে নিজের বুক তাগ করে ঘোড়া টিপেছিল সেই ছেলে, কিন্তু গুলি বেরোয়নি। সেদিন সে-গুলি বেরিয়ে ক্লাইভের বুকে বিঁধলে উদ্ধব দাসকে বেগম মেরী বিশ্বাস’ লিখতে হয় না। মাসকাবারি ছটাকা মাইনের চাকরি। বিদেশ-বিভুইতে এসে এর চেয়ে ভাল চাকরি করবার বিদ্যেও নেই তার, বুদ্ধিও নেই। অন্তত বাপ-মায়ের তাই মনে হয়েছিল। বখাটে হয়ে যে জন্মেছে, তার কপালে ভবিষ্যতে এই ছাই-ই থাকে। তার চেয়ে এই-ই ভাল। এই ছটাকা মাইনে আর এই জল-জঙ্গল-মশা-মাছির দেশ। সারাদিন কোম্পানির আপিসে কলম পেযো, হিসেবপত্তর রাখো, আর রাত্তির হলে কুঠিবাড়ির এক কোণে নাক ডাকিয়ে ঘুমোও। কিন্তু শান্তি যার কপালে নেই, তার কোথাও গিয়েই শান্তি নেই। নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে এসেও তার যেন ঝগড়া করা স্বভাব গেল না। আশেপাশের সবাই যেন তার শত্রু। কেউ দেখতে পারে না ছেলেটাকে। ওপরওয়ালা কর্তারা সবাই বলে–ওয়ার্থলেস

ছেলেটা শোনে, শুনে রেগে যায়, রেগে গিয়ে ঝগড়া করে। হোম-বোর্ডে তার নামে কর্তারা কমপ্লেন করে। সে-চিঠি এখান থেকে বিলেতের কর্তাদের হাতে পৌঁছোতে ছ’মাস লাগে, উত্তর আসতেও আবার, ছ’মাস। কিন্তু ততদিনে ছেলেটা বুঝে নিয়েছে ইন্ডিয়ার মানুষদের হালচাল। বুঝে নিয়েছে ইন্ডিয়ার ক্লাইমেট। বুঝে নিয়েছে যে এদেশে চাকরি করা তার চলবে না। এখানে এসে ভুল করেছে সে। এখানে এসে একদিন চিঠি লিখেছিল দেশে–I have not enjoyed a happy day since 1 left my native country!

শেষকালে ইতিহাসের ভাগ্যবিধাতা ইন্ডিয়ার এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করলে, যার পর ছেলেটা আর চুপ করে থাকতে পারলে না, আগুনের কুণ্ডলীর মধ্যে সশরীরে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল।

তা সে আগুনই বটে। ১৭০৭ সালে বাদশা আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে সারা দেশে বলতে গেলে আগুনই জ্বলে উঠল। সে আগুন আর নিভল না। তারপর যখন ১৭৩৯ সালে নাদির শা দিল্লির বুকে ছুরি বসিয়ে দিলে, মোগল বংশের নাভিশ্বাস শুরু হল বলতে গেলে সেই তখনই। বলতে গেলে মোগল-সাম্রাজ্য তখনই চিরকালের মতো খতম হয়ে গেল। দক্ষিণে দুটো বড় ভূখণ্ড, কর্ণাটক আর দাক্ষিণাত্য। দুটোতেই তখন থেকে শুরু হল বংশানুক্রমিক সুবাদারগিরি। নিজাম-উল-মুলক আর কর্ণাটের নবাবের মতো বাংলাদেশেও সেই নিয়ম চালু হয়ে গিয়েছে ততদিনে। অর্থাৎ জোর যার মুলুক তার। সুবাদার, নবাব, জায়গিরদার, ডিহিদার থেকে পাহারাদার পর্যন্ত সবাই লুটেপুটে খাবার জন্যে মারমুখী হয়ে বসে আছে আর তরোয়াল শানাচ্ছে। খেতে ধান থাকতেও নিশ্চিন্ত থাকবার উপায় নেই। ঘরে সুন্দরী বউ রেখেও নির্লিপ্ত থাকবার অবস্থা নেই কারও।

ছেলেটা কিন্তু ততদিনে বেশ কেষ্ট-বিধু হয়ে উঠেছে। লড়াই করে অদ্ভুত সাহস দেখিয়ে নাম কিনেছে বেশ। হইচই পড়ে গেছে পার্লামেন্ট। কে এই রবার্ট ক্লাইভ? না, এ সেই ছ’ টাকা মাইনের রাইটার। পল্টনের দলে নাম লিখিয়ে রাতারাতি একেবারে সকলের নজরে এসে গেছে। এক-একটা লড়াই করে আর জয়জয়কার পড়ে যায় তার। ডাকো, ডাকো এখেনে, ডেকে পাঠাও ওকে। সেই ছেলেকে দেশে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে একেবারে সবাই বাহবা দিয়ে উঠল। হিপ হিপ হুররে। হিপ হিপ হুররে।

নাম-ধাম তো হল। টাকাও হয়েছে বেশ। কিন্তু মানুষের কি লোভের শেষ আছে?

ইতিহাসের অমোঘ বিধানে যাকে একদিন চিরস্মরণীয় হতে হবে, তার কপালে বুঝি অত সহজে শান্তি আসে না। তাকে সুখ শান্তি ঘুম আরাম কিছুই পেতে নেই। সে-সব সাধারণ মানুষের জন্যে। বাংলার নবাবের চেয়ে যে পাঁচ বছর আগে পৃথিবীতে এসেছে, তাকেই এখানে এসে মুখোমুখি মুলাকাত কতে হবে আবার তারই সঙ্গে, এই-ই যদি বিধান হয়ে থাকে তো হোক। ঈশ্বরের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। নিজের দেশে যার সম্মান নেই, তার বিদেশে যাওয়াই ভাল। যে-দেশে সে এতদিন কাটিয়ে গেছে, যে জল-হাওয়ায় সে এত লড়াই করে গেছে, যেখানকার মাটিতে সে নিজের প্রতিষ্ঠা করেছে নিজের হাতে, সেখানেই তার গতি হোক।

যেদিন আবার ছেলেটা করমণ্ডল উপকূলে জাহাজ থেকে নামল, ঠিক সেইদিনই কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছে ফিরিঙ্গিরা। ঠিক সেই একই দিনে। সেই ২০ জুন ১৭৫৬ সালে। এ এক অদ্ভুত যোগাযোগ ইতিহাসের।

ভাল করে নবাবের গায়ের ঘাম তখনও শুকোয়নি। একটু যে জিরিয়ে নেবে নবাব, একটু যে ফুর্তি করবে, একটু বিশ্রাম করবে চেহেল্‌-সুতুনে গিয়ে, তারও সময় দিলে না নবাবের খোদাতালা।

নবাব আবার দরবারে গিয়ে বসলে। দেওয়ান মানিকচাঁদের চিঠিটা নিয়ে পড়লে

দেওয়ানজি লিখেছে–আমাদের চরের মুখে খবর পেয়েছি, ফিরিঙ্গিরা ফলতার কাছে গিয়ে জাহাজ নোঙর করে ছিল এতদিন। এবার খবর পেলাম মাদ্রাজের সেন্ট ডেভিড কেল্লা থেকে কোম্পানি মেজর কিলপ্যাট্রিক বলে এক ফিরিঙ্গিকে পাঠিয়েছে আমাদের সঙ্গে লড়াই করবার জন্যে। আর একজন ফিরিঙ্গি আসছে, তার নাম রবার্ট ক্লাইভ। আমার মনে হয়, যুদ্ধের জন্যে আমাদের তৈরি থাকতে হবে।

শেষে লিখেছে–সঙ্গে ওয়াটসন নামক আরও একজন ফিরিঙ্গি যোদ্ধা আসছে। সত্য-মিথ্যা জানি না। চরের মুখের সংবাদ। কিন্তু সত্য হোক বা না হোক, ফিরিঙ্গি কোম্পানি যে বসে নেই এ তাহারই প্রমাণ। তাহারা আট-নয়শত ফিরিঙ্গি পল্টন এবং এক হাজার সিপাহি সংগ্রহ করতে মনস্থ করেছে। আমি তাহাদের অগ্রগমনে বাধা দিতে মনস্থ করেছি। এখন যা কর্তব্য হয় জানাতে আজ্ঞা হয়। ইতিবশংবদ…

ইব্রাহিম খাঁ তখনও হাঁফাচ্ছিল। বুড়ো মানুষ। কান্তকে বললে–তুমি চলে যাও বাবাজি, ও যা হবার তা হবে যে-যার কপাল নিয়ে এসেছে সংসারে। তুমিই বা কী করবে, আর আমিই বা কী করব–

কান্ত যাবার আগে বলে গেল আপনি যেন কাউকে বলবেন না পুরকায়স্থমশাই–

পুরকায়স্থমশাই বললে–না, না, আমি কেন বলতে যাব বাবাজি! আমার কী? যার চরিত্র খারাপ হবে তার চরিত্র খারাপ হবে। ভালই হয়েছে বাবাজি, ও কন্যার সঙ্গে তোমার বিবাহ হয়নি, নষ্ট-চরিত্রা কন্যার পাণিগ্রহণ পাপ। সে-পাপেও নিজেও মরে, অপরকেও মারে তুমি কিছু ভেবো না, ভগবান যা। করেন মঙ্গলের জন্য

কান্ত চলে যাবার পর ইব্রাহিম খাঁ সরাবখানার মধ্যেই বসে ছিল নাকে কাপড় চাপা দিয়ে। হঠাৎ যেন অনেকগুলো লোকের পায়ের শব্দ শোনা গেল। দরবার শেষ হয়ে গেল নাকি তবে! সবাই যাচ্ছে। কোথায়?

কিন্তু না। পায়ের শব্দটা আসছে বাইরের দিক থেকে। একটু উঁকি মেরেই দেখতে পেলে। জগৎশেঠজির তাঞ্জাম এসে চবুতরে নামল। সঙ্গে পাইক-পেয়াদাবরকন্দাজ। জগৎশেঠজি তাঞ্জাম। থেকে নেমে সোজা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন।

মতিঝলের দরবারে কতবার এসেছেন জগৎশেঠজি। তার আসা এই প্রথম নয়। কিন্তু এবার যেন জরুরি তলব দিয়েছে নবাব। নবাব-বাদশার ব্যাপার। তার মধ্যে চুনোপুঁটি সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর সমস্যা নিয়ে কে মাথা ঘামাবে। বড় আরামে আছে সব! খাচ্ছেদাচ্ছে ফুর্তি করছে, আর বেগমদের নাচ দেখছে গানা শুনছে। টাকার কথাও ভাবতে হয় না, কেমন করে পেট চলবে তাও ভাবতে হয় না।

হঠাৎ নেয়ামত খা-কে যেতে দেখে ইব্রাহিম জিজ্ঞেস করলে–খিদমদগারজি, আজ যে দারু খাচ্ছে। কেউ, কী হল? কেউ মদ খাবে না?

আরে দুর বুঢঢা! এখন সব মাথা গরম হয়ে রয়েছে, এখন দারু খাবে কে!

কেন? মাথা-গরম কীসের? নবাব-বাদশাদের আবার মাথা-গরম কীসে হল?

 নেয়ামত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলে গেল–তুই বুঝবিনে বুড়ো, জগৎশেঠজি এসেছে, নবাব রেগে একেবারে সব ভুলক্লাম করে দিচ্ছে, এখন চুপ কর

বলতে বলতে সোজা ওপরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দরবারের ভেতরে তখন নবাব চিৎকার করছে মহতাপচাঁদ জগৎশেঠের দিকে চেয়ে তা হলে আপনি কী করতে আছেন? বাদশার সনদ এনে দেওয়া তো আপনার কাজ! এতদিন আপনি আমাকে বাদশার সনদ এনে দেননি কেন?

সত্যিই এতদিন এ-জিনিসটার দিকে কারও নজর পড়েনি। পূর্ণিয়ার শওকত জঙ দিল্লির বাদশার কাছ থেকে উজির-এ-আজম-এর শিলমোহর করা সনদ এনে ফেলেছে। সেই সনদের জোরে শওকত জঙ কড়া চিঠি লিখেছে নবাবকে। সে-চিঠি তখনও নবাবের হাতে। সেই চিঠি পেয়েই নবাব অপমানে ছটফট করতে করতে মহতাপ জগৎশেঠকে ডেকে পাঠিয়েছিল।

এতদিন নবাব হয়েছি, সনদ আনতে এত দেরি হচ্ছে কেন? এই দেখুন শওকত কী লিখেছে আমাকে লিখেছে আমি স্বনামে বঙ্গ-বেহার-উড়িষ্যার সুবাদারি-পদের বাদশাহি সনদ পাইয়াছি। কিন্তু তুমি আমার ভ্রাতা, তোমার প্রাণ-বধের ইচ্ছা করি না। তুমি তোমার ভরণপোষণ-জন্য ঢাকা প্রদেশের যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারো, তোমার প্রার্থনা-মতো ইহার জন্য সনদ প্রদত্ত হইবে। ইতিমধ্যে রাজকোষ ও অন্যান্য দ্রব্যাদি আমার কর্মচারীগণকে বুঝাইয়া দিয়া ওই অঞ্চলে চলিয়া যাইবে। অতি শীঘ্র এই পত্রের উত্তর পাঠাইবে। আমি রেকাবে পা তুলিয়া উত্তরের অপেক্ষা করিতেছি।’ এরপর বলুন আপনার কী বলার আছে?

মহতাপ জগৎশেঠ বললেন–জাঁহাপনার যা-অভিরুচি তাই-ই করবেন।

 কিন্তু নবাব সুবাদার আমি, না শওকত জঙ!

 আপনি জাঁহাপনা, আপনি। আপনিই বাংলা-বেহার-উড়িষ্যার নবাব-সুবাদার।

কিন্তু তা হলে এতদিন আমি কীসের জোরে নবাবিআনা করছি? আমার সনদ কোথায়? সনদের কথাটাও কি আপনাকে আমায় মনে করিয়ে দিতে হবে? আপনারা কি আমাকে এটুকু সাহায্যও করবেন না? আপনারাই তো আমার বলভরসা। আপনারা যদি সহায় না হন তো আমি কার ভরসায় দেশ শাসন করব?

জগৎশেঠ বললেন–সনদ আনতে তো মোহর লাগবে-নজরানা লাগবে!

তা লাগবে লাগবে। যা লাগে তা তো আপনারই দেওয়া কাজ। কত মোহর লাগবে, কী কী নজরানা দিতে হবে, সে তত আপনিই জানেন। আপনারাই তো বরাবর সনদ আদায় করে এনে দিয়েছেন। তেমনি

আমার বেলাতেও দেবেন। আমি কি সেসব কথা নিয়েও মাথা ঘামাব?

কিন্তু সে যে অনেক টাকা।

অনেক টাকা লাগলে অনেক টাকাই দেবেন।

মহতাপ জগৎশেঠ উত্তরে অনেক কথাই বলতে পারতেন, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে বললে–তাতে প্রজাদের ওপর অত্যাচার হবে

সঙ্গে সঙ্গে নবাবের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল। সামনে তেড়ে এগিয়ে গিয়ে বললে–কী…?

ইব্রাহিম শুধু দেখেছিল সিঁড়ি দিয়ে কে যেন দুমদুম করে নেমে গিয়েছিল। তারপর ভাল করে চেয়ে দেখেছিল, নেয়ামত! আর কিছু জানতে পারেনি সে!

*

চেহেল্‌-সুতুনে তখন মরিয়ম বেগমকে মনের মতন করে সাজিয়ে তুলেছে নানিবেগম। কত রকমের গয়না পরিয়েছে। হিরে-মুক্তোর ছড়াছড়ি। চোখে সুর্মা দিয়েছে, কানে আতর। কোনও গয়নাটারই নাম জানে না মরালী। বাপের জন্মেও কখনও এসব দামি শৌখিন জিনিস দেখেনি। হাতির দাঁতের আয়নাটা নিয়ে বাঁদি মুখের সামনে ধরেছে। নিজেকে যেন তার সুন্দরী মনে হল বড়। ভালবাসতে ইচ্ছে করল তার।

নানিবেগম দেখেশুনে বললে–এবার পাঁয়জোড় পরিয়ে দে বেগমসাহেবাকে

বাঁদিটা তাই-ই পরাতে যাচ্ছিল।

মরিয়ম বেগম বললে–আবার পাঁয়জোড় পরে কী হবে নানিজি, আমার অভ্যেস নেই, পড়ে যাব শেষকালে

নানিবেগম বললে–তা হোক মা, পরো, মির্জা এখনই এসে যাবে সারা দিন-রাত ধরে দরবার করে খেটেখুটে মেজাজ গরম করে আসছে, তোমাকে খুবসুরত দেখালে তবু মনটা জুড়োবে বাছার। মির্জাকে তুমি ভয় কোরো না মা, তোমার মনে যা আছে সব খুলে বলবে। তোমার সোয়ামির কথা বলবে, তোমার সতিনের কথা বলবে, কেমন করে ডিহিদার পরওয়ানা পাঠিয়েছিল, তাও বলবে। কোনও কথা লুকোবে না। দেখবে, বাছা তোমার কথা সমস্ত মন দিয়ে শুনবে

 কিন্তু যদি রেগে যান?

রাগবে কেন মা? লোকে অন্যায় করলেই মির্জা রেগে যায়, নইলে কেন মিছিমিছি রাগ করতে যাবে তোমার ওপর? তুমি কী অপরাধ করেছ? তোমার তো কোনও দোষই নেই! লোকের মুখে মির্জার বিরুদ্ধে যা-কিছু শানো সেসব তো বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা!

তা সবাই ওঁর নামেই বা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে কেন?

তা বলবে না? বড় হলেই যে লোকের নজরে পড়ে। যাকে-তাকে গালাগাল দিয়ে তো আরাম হয় না মা! বড়কে গালাগাল দিতেও যেমন ভাল লাগে, বড়র গালাগাল শুনতেও যে তেমনি ভাল লাগে!

তারপর একটু থেমে বললে–তুমি যদি মা হাতিয়াগড়ে ফিরে যেতে চাও, তাও বলবে, আবার যদি তা না-চাও তো তাও বলবে মির্জাকে। আর যদি তুমি চাও যে কোনও জায়গায় গিয়ে নিরিবিলি বসবাস করবে, তাও বলবে। সে-ব্যবস্থাও করে দেবে আমার মির্জা। বাছার বড় দয়ার শরীর। তোমার জীবনটা যখন মির্জার জন্যে একবার নষ্ট হয়ে গেছে, তখন তো মির্জারই সব দায়িত্ব। জমি-জায়গা ইজারা দিয়ে তোমাকে কুঠি বানিয়ে দেবে, তুমি সেখানেই তোমার নিজের সংসার পাতবে, সেই-ই তো ভাল। তোমাকে এ চেহেল্‌-সুতুনেও থাকতে হল না, সোয়ামির সংসারেও যেতে হল না–আর একটা কথা…

কিন্তু কথা শেষ হবার আগেই নেয়ামত দৌড়োত দৌড়োতে এসেছে।

বন্দেগি নানিবেগমসাহেবা।

 কী রে নেয়ামত? মির্জা আসছে?

 না বেগমসাহেবা! নবাব খবর ভেজিয়েছে আজ চেহেল-সুতুনে আসতে পারবেন না।

কেন? কী হল? আবার কী খবর এল?

জগৎশেঠজিকে নবাব চড় মেরেছেন গোঁসা করে।

সেকী রে? কেন? কী করলে জগৎশেঠজি? নানিবেগম ভয়ে-আতঙ্কে শিউরে উঠল।

জগৎশেঠজি নবাবের মুখের ওপর জবাব করেছিল। তাই জগৎশেঠজিকে নবাব গ্রেফতার করে রেখে দিয়েছেন মতিঝিলে। তাকে ফাটকে পাঠানো হবে।

নানিবেগম দাঁড়িয়ে উঠলে। যেন মাথায় বজ্রাঘাত হল তার।

সেখানে আর কে কে আছে?

সবাই আছেন বেগমসাহেবা। মিরজাফর সাহেব, রাজা দুর্লভরাম, মিরবকশি, মোহনলাল, মিরমদন সাহেব, মেহেদি নেসার সাহেব, সবাই আছে–

মির্জা কী বলছে?

বেগমসাহেবা, মিরজাফর সাহেব নবাবকে বলেছে বাদশাহির সনদ না-পেলে নবাবের তরফে আর। কেউ থাকবে না–

নানিবেগম আর শুনতে পারলে না। তাড়াতাড়ি বললে–আমার তাঞ্জাম সাজাতে বল, আমি মির্জার সঙ্গে দেখা করতে যাব মতিবিলে। মিজার কপালে কি একটা দিনের জন্যেও শান্তি থাকতে নেই

বলে মরিয়ম বেগমের দিকে চেয়ে বললে–তুই একটু অপেক্ষা কর মা, আবার এক গণ্ডগোল বাধিয়ে বসেছে মির্জা, একটা দিনের জন্যে ওকে শান্তি দেবে না কেউ। কী কাণ্ড করে বস! জগৎশেঠজিকে চড় মেরে বসেছে, রেগে গেলে ওর জ্ঞান থাকে না ছোটবেলা থেকে কী যে করি ওকে নিয়ে–

বলে বাইরে গেল ছুটে গিয়ে আমিনা বেগমের ঘরে ঢুকলো বললে–শুনেছিস, জগৎশেঠজিকে চড় মেরেছে মির্জা, মেরে ফাটকে পুরে রেখেছে–মির্জা আজ চেহেল সুতুনে আসছে না–

আমিনা বেগম তখন বোধহয় নিজের কারবারের হিসেবপত্র দেখছিল। মুখ তুলে বললে–তুমিই দেখো, আমার ওসব দেখা আছে, তোমরাই আদর দিয়ে ওকে ছোটবেলা থেকে নষ্ট করে দিয়েছ–এখন বললে–কী হবে?

বলে আবার আফিঙের হিসেবের কাগজপত্রের মধ্যে মাথা গুঁজে দিলে।

নানিবেগম তখন গেল লুৎফুন্নিসার ঘরে।

সর্বনাশ হয়েছে বহু, জগৎশেঠজিকে চড় মেরেছে মির্জা, ফাটকে আটকে রেখেছে তাকে, জাফরসাহেব বলেছে মির্জার দলে আর থাকবে না! মির্জা খবর পাঠিয়েছে সে আজ চেহেল্-সুতুনে আসছে না। এখন যাবি? যাবি মা তুই মতিঝিলে? তা তুই গিয়েই বা কী হবে? তোর কথা তো ভারী শোনে সে! আমি একলাই যাই, দেখি জাফরসাহেবকে বলে-কয়ে ঠান্ডা করতে পারি কি না–আমার হয়েছে বুড়ো বয়েসে এক জ্বালা

বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নানিবেগম। লুৎফুন্নিসা বেগম একটা কথারও উত্তর দিলে না। শুধু পাথরের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। আর মরালীর ঘরে মরালীও তখন আস্তে আস্তে গয়নাগুলো সব খুলে ফেলতে লাগল একে একে। হঠাৎ তার যেন কাঁদতে ইচ্ছে করল প্রাণ ভরে।

*

মনসুর আলি মেহের সাহেবের দফতরে যথারীতি কান্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। কাজ না থাকলে নিজামতি কাছারিতে একবার করে হাজরে দিতে হয়। যদি কোথাও কাজ থাকে তো জেনে নিতে হয়, আর নয় তো হাজরে দিয়েই বাড়ি। সেই মোল্লাহাটি থেকে আসার পর আর কোনও কাজ পড়েনি তার ভাগে।

চলেই আসছিল কাছারি থেকে এসে সেই সারাফত আলির দোকানে ঢোকা। কিন্তু সারাফত আলিকেও যেন আর ভাল লাগত না। বাদশার কাছে সেই কথাগুলো শোনবার পর থেকেই যেন মনটা বিরস হয়ে গেছে মিঞাসাহেবের ওপর।

নিজামত কাছারির সবারই সেদিন যেন একটু ব্যস্ত ব্যস্ত ভাব। যেন অন্যদিনের চেয়ে বেশি তাড়াহুড়ো। কারও কথা বলবার সময় নেই।

সবে ফটকের কাছে এসেছে, হঠাৎ বশির মিঞার সঙ্গে দেখা। একেবারে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে। কান্তকে দেখতেই পায়নি। তারপর কান্তই ধরলে গিয়ে কী রে, কোথায় যাচ্ছিস?

বশির বিরক্ত হয়ে উঠল–আরে তোর জন্যেই তো যত গণ্ডগোল, তুই একেবারে সকলকে বিপদে ফেলেছিস।

আমি? বিপদে ফেলেছি? কাকে?

আবার কাকে? সক্কলকে। মেহেদি নেসার সাহেব ভীষণ গোঁসা করেছে আমার ওপর। যাকে-তাকে নোকরি দিয়েছি বলে আমাকে মুখখিস্তি করে গালমন্দ করলে। আমার ফুপা মনসুর আলি সাহেব পর্যন্ত আমাকে খামোখা যা-তা বললে–তোর জন্যে আমার পর্যন্ত বদনাম হয়ে গেল। আমি এত তকলিফ করে জাফর আলি সাহেবের চিঠি বেহাত করে নিয়ে এলুম, তবু সাবাস পেলুম না কারও কাছ থেকে। তুই আমার কী সব্বনাশ করলি বল তো!

তবু কান্ত কিছু বুঝতে পারলে না কী তার অপরাধ।

বশির বললে–এখন তোর জন্যে আমাকে আবার হাতিয়াগড় যেতে হচ্ছে—

হাতিয়াগড়? কেন?

আরে রেজা আলি যে ধরে ফেলেছে সব।

কী রকম?

আরে হাতিয়াগড়ের জমিদারসাহেব বিলকুল সব ঠকিয়ে দিয়েছে মেহেদি নেসার সাহেবকে। রানিবিবি বলে যাকে চেহেল্‌-সুতুনে পাঠিয়েছে, ও তো আসলি রানিবিবি নয়! আসলি রানিবিবিকে তো নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে। আর নিজের একটা নফর ছিল, তার লেড়কিকে রানিবিবি বলে চালিয়ে দিয়েছে। রেজা আলির চর সব খোঁজখবর নিয়ে জানিয়ে দিয়েছে নিজামতে। শালা মেহেদি নেসার সাহেব আমার ফুপাকে তলব দিয়েছিল, আমাকেও তলব দিয়েছিল। দু’জনকেই আচ্ছা করে গালাগালি দিলে, আমাকে জিজ্ঞেস করলে কে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, আমি বললুম তোর নাম

আমার নাম বলে দিলি?

বশির মিঞা বললে–হ্যাঁ, বলে দিলুম, শুনে তোকেও খুব আচ্ছা করে গালাগাল দিলে। এখন আমি যাচ্ছি হাতিয়াগড়ে, দেখি কী হয়–

বলে আর দাঁড়াল না। হনহন করে সোজা বাইরে বেরিয়ে গেল বশির মিঞা। আর ফিরেও একবার তাকাল না, দাঁড়াল না, থামল না।

*

রেজা আলির কাছে সব খবরই পৌঁছোয়। হাতিয়াগড়ের ডিহিদার বটে, কিন্তু খবর রাখতে হয় মুর্শিদাবাদের। মাঝে মাঝে মুর্শিদাবাদের কানুনগো কাছারি থেকে চিঠি আসে। তার ফয়সালা করতে হয়। ডিহিদারের দায়-ই কি কিছু কম? এক-এক সময় চাকরি রাখাই দায় হয়ে ওঠে রেজা আলির। বিটকেল সব হুকুম আসে নিজামতকাছারি থেকে। কখনও হুকুম আসে নানিবেগমের জন্যে পঞ্চাশ হুঁড়ি ঘি পাঠাও, ভাল আম তিন হাজার, কিংবা দশ কুড়ি মুরগি! বেশ ভালরকম জানে রেজা আলি, এ-জিনিস নানিবেগম চেয়েও দেখবে না, সমস্ত ভোগ করবে মেহেদি নেসার সাহেব। রাগে গরগর করে রেজা আলি, কিন্তু কিছু বলতেও পারে না। হুকুমমতো সব জিনিসই পাঠিয়ে দিয়ে হয় নৌকো বোঝাই করে।

আর মেহেদি নেসার সাহেবও জানে, রেজা আলি নিজের ঘর থেকে কিছু পাঠাবে না। পাঠাবে হাতিয়াগড়ের জমিদারের ঘর থেকে, কিংবা গাঁয়ের প্রজা-পাঠকদের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে।

সেদিনও তেমনি হুকুম এসেছে নিজামতকাছারি থেকে।

 যথারীতি ডিহিদারের লোক গেছে ছোটমশাইয়ের কাছারিতে। জগা খাজাঞ্চিবাবু তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে। নবাবের জ্বালায় কি মানুষ পাগল হয়ে যাবে? এই সেদিন ক’টা পাঁটি চাইতে এলে, দিলাম। তারপর আবার সেদিন গাছের গুড় চাইতে এলে, তাও দিলাম। তা আমরা কি নবাবের খাস প্ৰজা হে বাপু! যে যা চাইবে একেবারে দানছত্তর খুলে বসেছি? আমরা আবওয়াব দিইনে? আমরা মাথ পিলখানা দিইনে?

হঠাৎ যে জগা খাজাঞ্চিবাবু কেন এমন রেগে উঠল কে জানে। ডিহিদারের লোক বললে–তা হলে ডিহিদার সাহেবকে গিয়ে সেই কথা বলি গে?

জগা খাজাঞ্চিবাবুও বলে ফেললে–হ্যাঁ যাও, বলো গিয়ে ভয় করিনে আমরা

ঘটনাটা এমন কিছু নয়। যখন বড়মশাই এখানে ছিলেন তখন এমন অনেকবার কথা কাটাকাটি হয়েছে। যখন-তখন যা-তা আবদার করতে সাহস করেনি ডিহিদারের লোক। তখনকার ডিহিদারের সঙ্গে বড়মশাইয়ের বেশ ভাবসাব ছিল। একসঙ্গে ওঠা-বসা ছিল। এখন সে বড়মশাইও নেই, সেই ডিহিদারও নেই। এখন যেন আবদার দিনের-পর-দিন বেড়েই চলেছে। এমন করলে আর কদিন চালাতে পারবে জগা খাজাঞ্চিবাবু।

সব শুনে বড় বউরানি বললেন–তুমি ঠিক করেছ খাজাঞ্চিমশাই, কোনও অন্যায় করোনি—

আবার যদি আসে তো আবার আমি ওই কথাই বলব তো?

বড় বউরানি বললেন–হ্যাঁ, তাই বোলো

জগা খাজাঞ্চিবাবু কথাটা বলে চলেই যাচ্ছিল। কিন্তু বড় বউরানি আবার ডাকলেন। বললেন–আর একটা কথা শোনো, আমি যে চিঠি পাঠিয়েছিলাম নানিবেগমের কাছে, তার কোনও উত্তর আসেনি?

আজ্ঞে না, বড় বউরানি!

চিঠিটা বেগমসাহেবার হাতে ঠিক পৌঁছেছিল তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ, নিজামতের উঁকি মশাইয়ের হাত দিয়ে খোজাদের ঘুষ দিয়ে একেবারে চেহেল্‌-সুতুনে নানিবেগমসাহেবার হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল।

সে-চিঠির উত্তর আসেনি তাতে এমন কিছু ক্ষতি হয়নি হাতিয়াগড়ের। এখন দু’কূল বজায় আছে এইটেই শুভলক্ষণ! বউ বউরানি রোজ বুড়োশিবের মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে আরও অনেকক্ষণ ধরে জপতপ করেন। আর দুর্গা অনেক রাত্রে এসে চোরকুঠুরির ঘরের শেকলটা খুলে চুপিচুপি ঘরে ঢোকে। ছোট বউরানি জিজ্ঞেস করে–হা রে দুগ্যা এলি?

দুর্গা এসে ছোট বউরানির গা-গতর টিপে দেয়, পায়ে তেল মাখিয়ে দেয়। চুল আঁচড়ে দিয়ে চুড়ো করে খোঁপা বেঁধে দেয়। মিষ্টিমিষ্টি কথা শোনায়। বলে–আর দুটো দিন সবুর করো না ছোট বউরানি, আর দুটো তো মাত্তোর দিন

ছোট বউরানি জিজ্ঞেস করে–ডিহিদারের সে-লোকটা কোথায় গেল রে? আছে, না গেছে?

কোন লোকটা? সেই জনার্দন হারামজাদাটা? তাকে বাণ মেরে দিইছি

বাণ মেরেছিস? বলছিস কী তুই?

তা সত্যিই জনার্দন একদিন মুখে রক্ত উঠে মারা গিয়েছিল। সে এক কাণ্ড! রাজবাড়িতে কাজ করতে আসার পর থেকেই দুর্গার কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল লোকটার ওপর। কোথাও কিছু নেই, কারণে-অকারণে অমন ভেতরবাড়ির দিকে ছোঁক ছোঁক করে বেড়ায় কেন! তারপর যেদিন পেছন-পেছন গিয়ে দেখলে জনার্দন ডিহিদারের দফতরে গিয়ে ঢুকল, সেদিন আর সন্দেহ রইল না তার। তক্কে তক্কে রইল কখন জনার্দন আসে।

বহুদিন ধরে লোকটা খেতে পায়নি। বহুদিন ধরে রেজা আলিকে চাকরির জন্যে ধরেছিল। তিনটে মেয়ে নিয়ে এসে জনাইতে রেখে এসেছিল শ্বশুরবাড়িতে। যা-হোক করে দুটো টাকা হাতে পেলেই মেয়ে তিনটেকে নিয়ে আসবে হাতিয়াগড়ে, এই ছিল ইচ্ছে। কিন্তু কাজ কি অত সহজে মেলে। কোথায় জনাই আর কোথায় হাতিয়াগড়। মাঝে মাঝে বড় দেখতে ইচ্ছে করত মেয়েদের। মা-মরা মেয়ে তিনটের জন্যে মনটা ছটফট করত কেবল।

রেজা আলি বলেছিল–যদি রানিবিবির খবরটা কবুল করতে পারিস কাউকে দিয়ে তো তোর নোকরি মিলবে তার আগে নয়

কিন্তু কে কবুল করবে? কে জানে আসল ব্যাপারটা? কারওই তো জানবার কথা নয়। শেষকালে মরিয়া হয়ে উঠল জনার্দন। চোরকুঠুরির সন্ধানটা যখন একবার পেয়েছে তখন ভাবনা নেই। মাঝরাত্তিরে একদিন উঠল জনার্দন। জয় বাবা বুড়োশিবের জয়! জয় মা মঙ্গলচণ্ডীর জয়! যা থাকে কপালে বলে একদিন উঠল জনার্দন। ঘুমই আসেনি। কতদিন থেকেই ঘুম আসছে না ভেবে ভেবে। ভাবনাটা তিনটে মেয়ের জন্যেও বটে, আবার হাতিয়াগড়ের রানিবিবির জন্যেও বটে!

তখন সবাই নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছ। বর্ষার রাত। পুকুরঘাটের ওদিকে বেশ শব্দ করে ব্যাঙ ডাকছে। উঠোনের কোণের দিরে রেড়ির তেলের আলো টিমটিম করে জ্বলছে। দেখতেই হবে চোরকুঠুরির ভেতরে কে আছে।

আস্তে আস্তে জনার্দন অতিথিশালা থেকে উত্তর-পূর্ব কোণের দরজাটা দিয়ে ভেতরের রান্নাবাড়ির দরদালানে ঢুকল। তারপর টিপটিপ পায়ে একেবারে ভেতরবাড়ির খিড়কি পেরিয়ে সোজা ভেতরবাড়ির অন্দরমহলে ঢুকল। তারপর সরু একটা গলি। গলির ভেতর পর পর খিলেন করা থাম। তারপর শেষ দিকটায় দোতলায় ওঠবার আলাদা একটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়ির নীচের ঘরখানাই চোরকুঠুরি। চোরকুঠুরির সামনে জনার্দন দেখলে দরজার ওপর তালা ঝুলছে। এরই ভেতরে নিশ্চয়ই আছে ছোট বউরানি। একটা মতলব বার করল জনার্দন। আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিতে লাগল।

কে? দুগ্যা?

ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় প্রশ্নটা এল। ছোট বউরানির গলা। জনার্দন যদি কোনও উত্তর দেয় তো তখনই ধরে ফেলবে। হঠাৎ দরজার পাল্লা দুটো যেন একটু ফাঁক হয়ে গেল। সেই ফাঁকের ভেতর দিয়ে একটা গলার আওয়াজ বেরিয়ে এল–এই যে দুগ্যা, তুই এত দেরি করে এলি? এই চাবিটা নে দরজা খোল

জনার্দন অন্ধকারে নিঃশব্দে চাবিটা বউরানির হাত থেকে নিয়ে তালাটা খুলতেই একেবারে অন্ধকারের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। একেবারে নিজের ভবিষ্যতের মতো নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।

তুমি?

আমি! আমি ছোট বউরানি!

আর ‘আমি’ বলবার সঙ্গে সঙ্গে কে যেন একেবারে মারমুখী হয়ে জনার্দনের ওপর জোরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জনার্দন দু-একবার চিৎকার করবার চেষ্টা যে করেনি তা নয়। কিন্তু তার আগেই তার মুখ-কাননাক সব যেন কে কাপড় দিয়ে চেপে ধরলে। একটুখানি বাতাসের জন্যে হাঁসফাস করতে লাগল জনার্দন। একটুখানি কথা বলতে পারার জন্যে ছটফট করতে লাগল। তারপর যখন দম একেবারে বন্ধ হয়ে আসতে লাগল, তখন আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে এল সে।

.

পরদিন সকালে হাতিয়াগড়ের কেউ কিছু জানতেও পারলে না। যথারীতি বিশু পরামানিক এল ছোটমশাইকে খেউরি করতে। অতিথিশালার ঝি-ঝিউড়ি-চাকরনফর সবাই কাজকর্ম শুরু করে দিলে। তখনও জনার্দনের দেখা নেই। জনার্দন এমনিতে দেরি করেই কাজে আসত। শোভারামের মতো নিয়ম করে না-এলেও বেশি কামাই তার থাকে না। জগা খাজাঞ্চিবাবু বারবার করে বলে দিয়েছিল–এমন হাজরে দিতে দেরি করলে বাপু তোমায় দিয়ে আমাদের কাজ চলবে না–

কিন্তু জনার্দনের ওই এক কথা ছিল–মেয়ে! তিনটে মেয়ের দোহাই দিয়ে সে এমন অনেক কামাই করেছে।

সেদিন সবাই ভাবল, হয়তো জনার্দন মেয়েদের দেখতে গেছে, এসে পড়ল বলে। কিন্তু, যখন ছোটমশাই নেমে নীচেয় এলেন, তেল-গামছা নিয়ে গোকুল এসে হাজির, তবু জনার্দনের দেখা নেই।

জনার্দন কোথায় গেল?

ছোটমশাইয়ের কথার উত্তর কে আর দেবে। গোকুলই নিজে ছোটমশাইকে তেল মাখিয়ে দিলে। চান করিয়ে দিলে। ভিজে কাপড় নিয়ে শুকোতে দিলে উঠোনের দড়িতে। তারপর যথারীতি সংসার চলতে লাগল। কাক-পক্ষীতেও জানতে পারলে না কী ঘটনা ঘটে গেল হাতিয়াগড়ের বাড়ির চোরকুঠুরিতে।

আসলে ছোট বউরানিও কিছু জানতে পারেনি, বড় বউরানিও না। রোজ যেমন অনেক রাত্রে দুর্গা এসে চোরকুঠুরির দরজা খুলে দেয়, সেদিনও তাই দিয়েছে। তারপর ছোট বউরানি দুর্গাকে চোরকুইরির ভেতর রেখে বাইরে থেকে চাবি-তালা দিয়ে ওপরে ছোটমশাইয়ের ঘরে চুপি চুপি চলে গেছে। যাবার আগে দরজার পাল্লার ফাঁক দিয়ে চাবিটা দুর্গাকে দিয়ে গেছে। এমনি রোজই করে। তারপর যখন ভোররাত হয়, তখন কাক-চিল ওঠবার আগেই আবার ছোট বউরানি নীচের চোরকুঠুরির সামনে এসে দরজায় তিনবার টোকা দেয়। টোকার শব্দ পেলেই দুর্গা বলে–কে? দুগ্যা? কথাটা বললেই বুঝতে পারে ছোট বউরানি এসেছে। চাবিটা ফাঁক দিয়ে বাইরে বাড়িয়ে দেয়। সেই চাবি নিয়ে ছোট বউরানি তালা খুলে ভেতরে ঢোকে। তখন দুর্গা বাইরে তালা-চাবি দিয়ে আবার রোজকার সংসারের কাজ করে। এমনি রোজ।

ভোরবেলা সেদিনও ছোট বউরানি এসেছে। কিন্তু এসেই অবাক হয়ে গেছে। তালা খোলা কেন?

ভেতরে দুর্গা তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছিল।

 ছোট বউরানি ডাকতেই ধড়মড় করে উঠে পড়েছে। বললে–আজ তালা খোলা কেন রে দুগ্যা?

দুর্গাও যেন অবাক হয়ে গেছে।

 তালা খোলা? তবে বোধহয় তুমিও তালা দিতে ভুলে গেছ, আমিও ভুলে গেছি চাবি নিতে

সেদিন এই নিয়ে আর কিছু বলেনি দুর্গা। হয়তো তাড়াতাড়িতে চাবি নিতেই ভুলে গিয়েছিল ছোট বউরানি। এত বড় বাড়ির মধ্যে কোথায় ছোট বউরানি আছে, কোথায় নেই, তা কারও জানবার কথাই নয়। চুপি চুপি কখন চোরকুঠুরি থেকে বেরোয় মাঝরাত্রে, কখন ঢোকে তা কেউ জানতে পারেনি। তাই হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িতে এ নিয়ে কোনও চাঞ্চল্যই সৃষ্টি হয়নি। যথারীতি তরঙ্গিনীর সঙ্গে দুর্গার ঝগড়া হয়েছে, কথা-কাটাকাটি রয়েছে, তারপর আবার তা মিটেও গেছে।

কিন্তু হঠাৎ একদিন খবর পাওয়া গেল ভোররাত্রে।

ভোররাত্রের দিকেই কে যেন ওদিক পানে গিয়েছিল। গিয়ে দেখেছে জনার্দন ছাতিমতলার ঢিবির ওপর মরে পড়ে আছে। তারপরেই খবরটা রটে গেল চারদিকে। বিশু পরামানিকের কানেও গেল, গোকুলের কানেও গেল। যে-যেখানে ছিল সকলের কানেই গেল–জনার্দনকে সাপে কামড়ে মেরে ফেলেছে–

তা সাপের কামড় এমন কিছু নতুন নয়। এমন হাতিয়াগড়ে হামেশা ঘটে।

 ছোট বউরানি শুধু জানত যে আসলে সাপটাপ কিছু নয়। আসলে দুর্গাই বাণ মেরে, মেরে ফেলেছে জনার্দনকে।

তা বাণ মারতে গেলি কেন তুই ওকে?

 বাণ মারব না? ও যে তোমার পেছনে লেগেছিল গো! যে তোমার পেছনে লাগবে তাকেই বাণ মেরে, মেরে ফেলব অমনি করে!

তা আর কতদিন এমনি করে থাকব বল তো লুকিয়ে লুকিয়ে? আমি যে আর পারছিনে?

দুর্গা বলত–সে বড় বউরানিকে জিজ্ঞেস করো গে তুমি! তার হুকুম, আমি কী জানি!

কিন্তু বড় বউরানিকে জিজ্ঞেস করবার সাহস নেই কারও। সে বড় কঠিন ঠাই। বড় বউরানি এমন আবদার শুনলে শেষকালে মাধব ঢালিকে দিয়ে কেটে ফেলবার হুকুম দেবে। তার চেয়ে এ যেমন চলছে। চলুক। যেমন চুপি চুপি রাত্রে গিয়ে ছোটমশাইয়ের ঘরে ঢুকত ছোট বউরানি, তেমনি না-হয় চিরকালই ঢুকবে। কষ্ট যখন কপালে আছে তখন কে আর খণ্ডাবে।

কিন্তু ছোট বউরানির কপালে বুঝি সেটুকু শান্তিও নেই।

হঠাৎ একদিন একটা লোক এসে হাজির হল রাজবাড়ির অতিথিশালায়। নিরীহ গোবেচারা মানুষটা। গরিবগুরবো চেহারা। দুটো ভাত খেয়ে চুপ করে শুয়ে রইল।

জগা খাজাঞ্চিবাবু জিজ্ঞেস করলে তুমি কে? বাড়ি কোথায় তোমার?

লোকটা বললে–আজ্ঞে কর্তা, আমার নাম কার্তিক পাল, কুমোরের ছেলে, আমাদের জল চল, আমার দেশ মগরা, সরকার সাতগাঁয়

তুমি এখানে কী করতে এয়েছ?

আজ্ঞে কর্তা, আমি যাব কোন্নগর, বর্ষাকালে গাঁ-গঞ্জ সব ডুবে গেছে, তাই হাঁটা-পথে চলেছি–

তা থাকুক। দু-চার দিনের বিশ্রামের জন্যেই তো এই অতিথিশালা তৈরি করে দিয়েছিলেন বড়মশাই। এইরকম গরিবগুরবো লোকেদের সুবিধের জন্যে। তা লোকটা রইল। দু-তিন দিন খেলেদেলে পেট ভরে, ঘুমোতেও লাগল। আর কাজ না-থাকলেই এর-ওর সঙ্গে গল্প করতে লাগল। এদের নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ হাতিয়াগড়ের অতিথিশালায়।

কিন্তু মাথা ঘামাতে হল একদিন। একদিন ছোটমশাই হন্তদন্ত হয়ে জগা খাজাঞ্চিবাবুকে ডেকে পাঠালেন।

বললেন–অতিথিশালায় কেউ আছে এখন?

আজ্ঞে হ্যাঁ, একজন আছে

কে সে? কোত্থেকে আসছে?

তার নাম কার্তিক পাল। দেশ মগরা, সরকার সাতগাঁয়

কোথায় যাবে?

বললে–তো কোন্নগরে।

 আচ্ছা, যাও তুমি এখন!

সেই দিন মাঝরাত্রেই নদীর ঘাটে এসে ছোটমশাইয়ের বজরাটা লাগল। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। কিন্তু তারই মধ্যে রাজবাড়ির খিড়কির দরজা দিয়ে দু-চারজন মানুষ বেরিয়ে এল। কোথাও একটা জনপ্রাণী নেই। ঝাঁ ঝাঁ ঝিঁঝি-ডাকা রাত। শুধু কয়েকটা গেঁয়ো কুকুর একবার হল্লা করে উঠেছিল, কিন্তু চেনা-মুখ দেখে তখনই আবার পায়ের কাছে এসে ল্যাজ নাড়তে লাগল। তারপর বজরার ভেতরে গিয়ে ঢুকল দুটি ঘোমটা দেওয়া প্রাণী। বাইরে লাঠি-সড়কি নিয়ে পাহারা দিতে লাগল একজন জোয়ান পুরুষ। পুরনো সাতপুরুষের মাঝি। তারা বজরার কাছি খুলে দিলে। আর ইতিহাসের পালে পশ্চিমের ঝোড়ো। বাতাস লেগে বজরাটা সোঁ সোঁ করে ছুটে চলল স্রোতের মুখে তির বেগে! বদর বদর!

*

কান্ত আবার সারাফত আলির দোকানে ফিরে এল। বশির মিঞার কথা শোনবার পর থেকেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বশির মিঞা কী করে জানতে পারলে! কী করে জানতে পারলে শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়ে এসেছে চেহেল্‌-সুতুনে। একথা তো কেউ জানে না। একমাত্র জানে ইব্রাহিম খাঁ–ওই সচ্চরিত্র পুরকায়স্থমশাই! সে-ই কি বলে দিলে। তাকে এত করে বলে দেওয়ার পরও কি শেষপর্যন্ত বলে দিলে!

সারাফত আলি দেখতে পেয়েছে। বললে–কী রে কান্তবাবু, হাজরে হল দফতরে?

কান্ত বললে–হ্যাঁ

বেশি কথা বলতে ভাল লাগছিল না তার। মাথার মধ্যে তখন কেবল ঘুরছিল রানিবিবির কথা, মরালীর কথা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভাবনা যেন মাথার মধ্যে এসে ঢুকেছিল। যদি বশির মিঞা হাতিয়াগড়ে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে ছোটমশাই নিজের বউকে না-পাঠিয়ে নফরের মেয়েকে পাঠিয়েছে, তা হলে কী হবে! কী হবে তা যেন ভাবতেই ভয় হল।

কোথায় যাবার হুকুম হল তোর?

 কোথাও হুকুম হয়নি, শুধু হাজরে দিয়ে এলাম

সারাফত আলি বললে–তা হলে তো তোর খুব আরাম! তা হলে আজ আরাম করে চেহেলসূতুনে যা গিয়ে রাত কাটিয়ে আয়–

কান্ত বললে–তা কী করে যাব মিঞাসাহেব, কাল নজর মহম্মদ যে বলে গেল নবাব চেহেল্‌-সুতুনে আসবে চেহেল্‌-সুতুনেই রাত কাটাবে

দুর বোকা, নবাব তো কাল চেহেল্‌-সুতুনে যায়নি!

 যায়নি?

না রে, তুই কিছুই খবর রাখিস না, সে তো সব গোলমাল হয়ে গেছে। নবাব জগৎশেঠজিকে সব আমির-ওমরাদের সামনে বেইজ্জৎ করেছে–মিরজাফর সাহেব তাই নিয়ে হল্লা করেছে, তুই কিছুই খবর রাখিস না কান্তবাবু! নবাব তো যায়ইনি চেহে-সুতুনে

কান্ত সব শুনে অবাক হয়ে গেল। বললে–তারপর! তারপর কী হল?

তারপর নানিবেগম তাঞ্জাম নিয়ে গেল মতিঝিলে!

 নানিবেগম!

সমস্ত ঘটনা শুনল কান্ত। মিঞাসাহেবের কাছে কেমন করে যেন সব খবর আসে। মুর্শিদাবাদের যেখানে যা ঘটে সব যেন টের পায় সারাফত আলি। কান্তও দেখেছিল তাঞ্জামটা। মনে আছে নজর মহম্মদ চলে যাবার অনেক পরে এমনি একা-একা চকবাজারে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ জোড়া হাতি দেখে পিছিয়ে এসেছিল সে। নানিবেগমের তাঞ্জাম যাচ্ছিল মতিঝিলের দিকে। শুধু কান্ত নয়, রাস্তার অনেকেই দেখেছিল। সরাবখানার ভেতরে বসে ইব্রাহিম খাঁ’ও দেখেছিল। আগের দিন থেকেই মতিঝিলের ভেতরে যেন নাগাড়ে ঝড় বয়ে চলছিল। কলকাতা থেকে আসার পর থেকেই এমনি চলেছে। ফিরিঙ্গি কোম্পানির সঙ্গে লড়াইতে অনেক বাজেখরচা হবার পর থেকেই নবাবের মেজাজ বিগড়ে আছে। প্রথম দিন গুলসন বেগমকে দিয়ে নাচিয়েও নবাবের মেজাজ ঠান্ডা করতে পারা যায়নি। নেহাত না-হাসলে নয় তাই হেসেছে, না ফুর্তি করলে নয় তাই ফুর্তি করেছে আর পরদিন থেকেই শুরু হয়েছে দরবার। সেই দরবারেও রাগারাগি চেঁচামেচি চলেছে। নানিবেগম এসেছিল শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়েকে নিয়ে। তারপর কথা ছিল দরবার ভেঙে দিয়ে নবাব চেহেল্‌-সুতুনে যাবে। সেই যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। জগৎশেঠজিকে আটক করে রেখেছে। সেই খবরটা পেয়েই আবার নানিবেগম এসে গেছে

নবাব দরবার ভেঙে দিয়ে নিজের ঘরেই চলে যাচ্ছিল।

এমন সময় নেয়ামত খবর নিয়ে এল-নানিবেগমসাহেবা এসেছেন

নানিবেগম আসতেই যেন দরবার আবার নতুন করে বসল। এবার আর আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে কথা নয়। এবার একেবারে দরবারে মির্জার মুখোমুখি।

কিন্তু মির্জাকে কিছু বললে–না নানিবেগম। সোজা মিরজাফর আলি সাহেবের দিকে চেয়ে বললে–জাফর আলি খাঁ কি আমাকে চিনতে পারছ?

মিরজাফর মাথা নিচু করে বললে–বান্দা নিমকহারাম নয় নানিবেগমসাহেবা!

কিন্তু শুনলাম নিমকহারামের কাজই নাকি তুমি করেছ? মির্জার সঙ্গে তুমি দুশমনি করছ?

বেগমসাহেবা ভুল খবর পেয়েছেন মনে হয়!

তা হলে কি আমি মিছিমিছি মতিঝিলে এসেছি বলতে চাও?

মিরজাফর আলি বড় অনুগত সুরে তখন কথা বলছে। বললে–আপনি কেন এত কষ্ট করে এখানে আসতে গেলেন, আমার সঙ্গেই যদি আপনার কথা ছিল তো বান্দাকে ডাকলেই তো বান্দা যেত, বেগমসাহেবার চেহেল্‌-সুতুনে।

নানিবেগমসাহেবা এবার মির্জার দিকে চাইলে। বললে–শুনলাম জগৎশেঠজি এখানে আছেন, তাকে দেখছি না, তিনি কোথায়?

মির্জা সে কথার উত্তর না দিয়ে বললে–তুমি কেন আবার এখানে এলে নানিজি, আমি তো খবর পাঠিয়েছি যে আমি আজ চেহেলসূতুনে যেতে পারব না–

নানিবেগম বললে–আমার কথার উত্তর দাও আগে, বলো জগৎশেঠজি কোথায়?

তাকে আমি ফাটকে রেখেছি।

নিয়ে এসে তাঁকে ফাটক থেকে।

কিন্তু নানিজি, আমি যে নবাব হয়েছি বাংলা-বেহার-উড়িষ্যার, তার সনদই এখনও আনেননি তিনি। সনদ নেই অথচ আমি নবাবি করছি। সনদের কথাটাও কি আমাকে ভাবতে হবে? ওদিকে শওকত জঙ যে সনদ আনিয়েছে দিল্লির বাদশার কাছ থেকে এখন যে সে আমাকে লড়াই করবে ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখেছে! এর পরেও আমি ক্ষমা করব জগৎশেঠজিকে? এর পরেও তুমি আমাকে ক্ষমা করতে বল তাকে?

তবু, তাকে নিয়ে এসো আমার সামনে।

জীবনে মহতাপজি এত অপমান কখনও পাননি। বোধহয় তার ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ-পুরুষও কখনও বাংলার নবাবের হাতের এ-অপমান কল্পনা করতে পারেনি। দিল্লির বাদশার দরবারেও কোনওদিন কোনও বাদশাও এমন করে অপমান করতে সাহস পায়নি জগৎশেঠজিদের। মুখখানা তাই হয়তো কালো হয়ে উঠেছিল।

জগৎশেঠজি!

জগৎশেঠজি নানিবেগমসাহেবাকে দেখে নিচু হয়ে কুর্নিশ করলেন।

আমি আমার মির্জার হয়ে আপনার কাছে মাফ চাইছি জগৎশেঠজি। মির্জা ছোট ছেলে, এখনও ছেলেমানুষ, কিন্তু আপনার বয়েস হয়েছে, আপনি অনেক দেখেছেন, অনেক ভুগেছেন, আপনি এমন ভুল করবেন এ আমি ভাবতে পারিনি! আপনি জানেন মির্জার জন্ম থেকেই চারদিকে তার শত্রু। মানুষ যখন ছোট থাকে তখন তার শত্রু থাকে না। শত্রু হয় বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু যখন ও সবে জন্মেছে তখন থেকেই চারদিকে ওর দুশমন–আমি ওকে বুকে করে মানুষ করেছি-নইলে কবে ও খুন হয়ে যেত! আসলে মুর্শিদাবাদের মসনদই ওর শত্ৰু, সেই মসনদের জন্যেই ওর এত কষ্ট–তা তো আপনি জানেন

নানিজি!

মির্জা নানিবেগমের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্যে একবার ডাকলে। কিন্তু নানিবেগম তখনও বলেই চলেছে জগৎশেঠজির দিকে চেয়ে চেয়ে আমি আপনাকেও বলছি, আর মিরজাফর সাহেবকেও বলছি, আপনারা দুজনেই বুকে হাত দিয়ে বলুন যে, আপনাদের কাছে স্বার্থ বড় না নবাব বড়! আপনাদের দুজনেই আমার কাছে কবুল করুন আজ যে, নবাব যত অন্যায়ই করুক, তবু সে নবাবই! আপনারা আমার মির্জাকে না মানতে পারেন, কিন্তু কবুল করুন, নবাবকে আপনারা মানবেন! করুন কবুল! কবুল করুন!

জগৎশেঠজি, মিরজাফর আলি সাহেব দুজনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

আপনারা আমার মির্জাকে খুন করে ফেললেও আমি কিছু বলব না, কারণ সে আপনাদের মনে আঘাত দিয়েছে, আপনাদের সম্মানহানি করেছে। কিন্তু নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা! তাকে আপনারা কেমন করে অস্বীকার করেন বলুন! নবাবকে অস্বীকার করলে যে মুর্শিদাবাদের মসনদকেই অস্বীকার করা হয় জগৎশেঠজি! আপনারা কি সেই মসনদকেই অস্বীকার করতে চান? সনদ পায়নি বলেই কি সে নবাব নয়?

মির্জা আর একবার বাধা দিলে–আঃ, নানিজি!

তুমি থামো

 নানিবেগমসাহেবা এবার মির্জার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে–তুমি থামো! জানো তুমি কাদের ভরসায় নবাব হয়েছ? জগৎশেঠজি যদি তোমার বিরুদ্ধে যান তো তুমি নবাবি করতে পারবে? মিরজাফর সাহেব যদি তোমায় সাহায্য না করে তো তুমি তোমার মসনদ টিকিয়ে রাখতে পারবে? কে তোমার বল-ভরসা? কাদের ওপর নির্ভর করে তুমি ফিরিঙ্গি কোম্পানির সঙ্গে লড়াই করে এলে? কে তোমাকে টাকা জুগিয়েছে এতদিন? কে তোমার নানাকে টাকা জুগিয়ে এসেছিল এতদিন? তোমার লজ্জা করে না তাঁদের অপমান করতে? চাও, এখনই ক্ষমা চাও, এখনই মাফ চাও এঁদের কাছ! চাও

জগৎশেঠজি হঠাৎ বললেন–থাক বেগমসাহেবা থাক—

মিরজাফর আলির মুখখানাও যেন কেমন নরম হয়ে এল।

নানিবেগম বললে–না জগৎশেঠজি, আপনি মুর্শিদাবাদের মসনদের শুভাকাঙ্ক্ষী তাই ওকথা বললেন, কিন্তু মির্জার বয়েস কম, তাই এখনও কার সম্মান কীভাবে রাখতে হয় তা জানে না। সেসব ওর শেখা উচিত! ফিরিঙ্গি হলওয়েল সাহেবের বেলাতেও আমি কাল এই কথাই বলেছিলাম, আপনাদের বেলাতেও আমি আজ সেই কথাই বলছি। আমি যতদিন অন্তত বেঁচে থাকব ততদিন এই কথাই বলব, আমার সামনে কোনও অন্যায় হতে দেখলে আমি চুপ করে থাকব মনে করবেন না। এর পর যদি আমার মির্জা আপনাদের কোনও অপমান করে তো আমাকে আপনারা খবর দেবেন দয়া করে, আমি তার প্রতিকার করব। শুধু একটা কথা, দয়া করে মুর্শিদাবাদের পবিত্র মসনদের কখনও অসম্মান করবেন না আমাকে কথা দিন–

জগৎশেঠ মাথা নিচু করে কুর্নিশ করে বললেন–বেগমসাহেবার ইচ্ছেই বান্দার ইচ্ছে

 আর জাফর আলি সাহেব, তুমি?

মিরজাফর আলি খাঁ-ও মাথা নিচু করে বললে–বেগমসাহেবার ইচ্ছেই বান্দার ইচ্ছে

তবে আপনারা এখন আসুন!

না

নবাব হঠাৎ বললে–না, যাবার আগে শওকত জঙকে চিঠি লেখার কথাটাও বলে যান জাফর আলি সাহেব, বলে যান, কেন আমার বিরুদ্ধে তাকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন।

আমি তো বলেছি ও-চিঠি জাল!

নবাব বললে–তা হলে শওকত জঙ আমাকে যে-চিঠি লিখেছে, সে-চিঠিও কি জাল মনে করেন?

মিরজাফর আলি বললে–জাল কি না তা শওকত জঙই জানে!

তা হলে আমি যদি শওকত জঙের সঙ্গে কাল লড়াই করতে পূর্নিয়ায় যাই তো আপনি আমার সঙ্গে যেতে প্রস্তুত? যদি প্রস্তুত থাকেন তা হলে বুঝব আপনি আমার ভাল চান, আপনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী

নানিবেগম মিরজাফর আলির দিকে চাইলে।

বললে–বলো জাফর আলি সাহেব, মির্জার কথার জবাব দাও

তারপর আর যারা দাঁড়িয়ে ছিল সকলের দিকেই চেয়ে বললে–দুর্লভরাম, মোহনলাল, সবাই বলুন আপনারা নবাবের দলে ।

সবাই একে একে বললে–আমরা সবাই নবাবের দলে

 নবাব বললে–তা হলে আজকেই তৈরি হয়ে নিন–শেষরাত্রের দিকে যাত্রা করব

সবাই একে একে কুর্নিশ করে দরবারের বাইরে চলে গেল। তখনও নানিবেগম ঘরের মধ্যে মির্জার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

মির্জা বললে–নানিজি, তুমি আর আমাকে বাধা দিয়ো না

নানিবেগম বললে–আমি তোকে বাধা দেব কে বললে?

না নানিজি, যতবার আমি যা করতে গিয়েছি ততবার তুমি বাধা দিয়েছ, তোমার মত না নিয়ে কখনও আমি কিছু করিনি। হুসেনকে খুন করবার আগেও তোমাকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছি, এই মতিঝিল থেকে মাসিকে তাড়িয়ে দেবার সময়ও আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছি। কাল হলওয়েল সাহেবকে আমি ছেড়ে দিতে চাইনি, শুধু তোমার কথাতেই ছেড়ে দিলাম। আজ জগৎশেঠজিকেও আমি উচিত শিক্ষা দিতুম, কিন্তু তোমার কথাতেই আমি চুপ করে রইলুম। তুমি কি মনে করো ওদের মুখের কথাই ওদের মনের কথা? ওরা মনে মুখে এখনও এক হতে পারলে না–ওদের আমি বিশ্বাস কী করে করি বলো?

তা হোক মির্জা, ওদের নিয়েই তো তোকে চলতে হবে। ওদের চটালে চলবে কেন?

তা, কেন ওরা সত্যি কথা বলে না? সত্যি কথা বললে–তো আমি কোনও কিছু বলি না। আমার সঙ্গে যে ওরা মন-রাখা কথা বলে কেবল! ওরা কি মনে করে আমি এতই বোকা, আমি কিছু বুঝি না? আমি কি ছেলেমানুষ!

নানিবেগম বললে–কী করবি বল মির্জা, সকলে তো ভাল ভাগ্য নিয়ে জন্মায় না

তুমি আর ভাগ্যের দোহাই দিয়ো না নানিজি! আমি অত দুর্বল নই যে আমি ভাগ্যের দোহাই মেনে সব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করব, ভাগ্য যদি আমার বিপক্ষে থাকে তো ভাগ্যকে আমি জোর করে আমার বশে আনব! আমি শওকত জঙকে এবার এমন শিক্ষা দেব যে সে জীবনে কখনও তা ভুলবে না–

কিন্তু তা হলে চেহেল সুতুনে যাবি না আজ?

আজ কেমন করে যাব বলো নানিজি? আজ শেষরাত্রেই তো রওনা দেব

তা ওখান থেকে ফিরে এসে!

ফিরে এসে যাব কী করে? মানিকচাঁদ যে চিঠি লিখেছে তাতে তো খবর আরও খারাপ। ফিরিঙ্গিরা বোধহয় আর আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।

তা হলে কবে তোর সময় হবে শুনি?

মির্জা নানিবেগমের হাত দুটো ধরলে। বললে–তুমি তো দিনরাত কোরান পড়ো নানিজি, তুমি তো রোজ জুম্মা মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়ো, তুমি তোমার খোদাতালাকেই জিজ্ঞেস করে দেখো না, তাকে শুধু এই কথাটা জিজ্ঞেস কোরো যে তোমার মির্জা কবে সময় পাবে? কবে শান্তি পাবে সে?

নানিবেগম আর দাঁড়াতে পারলে না। তার চোখ তখন ভিজে এসেছে।

.

তারপর?

 কান্ত এতক্ষণ চুপ করে গল্প শুনছিল। জিজ্ঞেস করলে–তারপর মিঞাসাহেব, তারপর কী হল?

সারাফত আলি বললে–তারপর জিন্দিগি কি খেল শুরু হোনে লাগা। নানিবেগমসাহেবা আবার তাঞ্জামে চড়ে চেহেল্‌-সুতুনে চলে এল। নবাব চলে গেছে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে

কখন গেল?

আজ ভোররাত্তিরে চলে গেছে। এতক্ষণে বোধহয় রাজমহলে পৌঁছে গেছে নবাবি ফৌজ। এখন মুর্শিদাবাদ একেবারে ফাঁকা, চেহেল্‌-সুতুন ভি ফাঁকা–আজ নজর মহম্মদ এলে তার সঙ্গে তুই চেহেল্‌-সুতুনে যাবি, কোনও ডর নেই, কেউ কিছু বলবে না–নবাব তো পূর্ণিয়ায় লড়াই ফতে করতে গেছে

সে রাত্রের কথা রাত্রে হবে। সে তো এখন অনেক দেরি। কান্তর মনে হল, তার আগে বশির মিঞার কোনও খবর পেলে ভাল হত। সেখানে সেই হাতিয়াগড়ের অতিথিশালায় গিয়ে যদি খবর পায় যে সত্যি সত্যি তারা রানিবিবিকে না-পাঠিয়ে শোভারাম বিশ্বাসের মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে, তা হলে কী হবে!

কিন্তু সন্দেহটাই বা হল কেন? কে বলে দিলে?

এক সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাই জানে, সে-ই যদি বলে দিয়ে থাকে। তা ছাড়া আর তো কারও জানবার কথাও নয়। ইব্রাহিম খাঁ যদি কথায় কথায় বশির মিঞাকে বলে দিয়ে থাকে তা হলেই শুধু বশির মিঞার জানা সম্ভব।

কান্ত পায়ে পায়ে সোজা মতিঝিলের দিকেই চলতে লাগল।

*

দু’দিন ধরে চলেছে বজরাটা। ছোট বউরানি আবার অনেক দিন পরে বজরা করে চলেছে। বজরার জানালা দিয়ে দিনেরবেলা বাইরে চেয়ে দেখে দেখে প্রথম দিনটা কেটেছিল। কিন্তু রাত হলেই সব অন্ধকার। তখন বাইরে আর কিছু দেখা যায় না। তবু এ অনেক ভাল। সমস্ত দিন অন্ধকার চোরকুঠুরির মধ্যে আটকে থাকার চেয়ে এ অনেক ভাল।

দুর্গা পাহারা দিত। বলত–বাইরে অত মুখ বাড়িয়ে দেখোনা বউরানি, কে আবার দেখে ফেলবে, তখন আবার হেনস্থা হবে

ছোট বউরানি বলেছিল–এখানে আর কে দেখবে বল?

তা কি বলা যায় বউরানি, অমন রূপ করেছ, দেখবার লোকের কি আর অভাব হবে গো–একবার নবাবের ইয়ারবকশিরা দেখে ফেলেছিল তার জেরই এখনও সামলানো যায়নি, এখন আবার নতুন কী ঝঞ্জাট হয় কে বলতে পারে

 তা কেষ্টনগরে নামবার সময় যদি কেউ দেখে ফেলে আমাকে?

সে ছোটমশাই আগের থেকে সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে গো, তোমায় কিছু ভাবতে হবে না। কেষ্টনগরের ঘাটে পৌঁছোবার আগেই রাজার লোকজন সব তৈরি থাকবে, তারাই সব আড়াল করে নামিয়ে নেবে তোমাকে–

তা যদি তারাই কেউ দেখে ফেলে নিজামতের লোকদের জানিয়ে দেয়? টাকার লোভে সবাই এখন সবকিছু করতে পারে।

সেটি হবে না গো। সে বুদ্ধিও আমি করেছি। বড় বউরানি আমাকে বলে দিয়েছে যে—

কী বলে দিয়েছে?

বলেছে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি এ হচ্ছে হাতিয়াগড়ের নফর শোভারাম বিশ্বাসের মেয়ে মরালী! নিজের নাম কখনও ভুলেও যেন বলে ফেলো না বউরানি, তা হলে সব্বনাশ হয়ে যাবে!

ছোট বউরানি বললে–সে তো আমাকেও বলে দিয়েছে। কিন্তু একলা একলা থাকব কী করে বল তো দুগ্যা, রাত্তিরে কি একলা শুয়ে ঘুম আসবে। এতদিনের অভ্যেস

একলা শুতে হবে কেন তোমাকে শুনি। ছোটমশাই তো এখানে আসবে ঘন ঘন, এসে তো তোমার পাশেই শোবে–তোমাকে ছেড়ে ছোটমশায়ের কি ঘুম হবে বলতে চাও? আমি সেসব ব্যবস্থাও করে এসেছি যে! ওই বেটা বশির মিঞা এসেই তো যত গণ্ডগোল করে দিলে, নইলে তো জনার্দনটাকে আমি বাণ মেরে ঠান্ডা করে দিয়েছিলুম

বশির মিঞা? বশির মিঞাটা আবার কে রে?

ওই যে কার্তিক পাল। নিজামত থেকে ওকেই তো পাঠিয়েছিল, ও-বেটা যে নিজামতের চর। ও হাতিয়াগড়ে এসেছিল সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে। কদিন থেকে অতিথাশালায় এসে উঠেছে, চারদিকে নজর রাখছে। বলে কিনা মগরায় বাড়ি, কোন্নগরে যাবে আমার কাছে চালাকি পেয়েছে বাছাধন, দিতুম ওকে বাণ মেরে ঠান্ডা করে, কিন্তু বড় বউরানি বারণ করলে তাই..

তারপর একটু থেমে বললে–তোমার কিছু ভাবনা নেই গো, মহারাজা কেষ্টচন্দ্র তোমাকে লুকিয়ে রাখবে বলেছে। খুব মানী রাজা তো, দশজনে মানিগন্যি করে, কেউ সন্দেহ করতে পারবে না। এখন সু-ভালয়-ভালয় কেষ্টনগরে পৌঁছোতে পারলে হয়–

বিকেলবেলার দিকে একটু মেঘ করে এসেছিল। দেখতে দেখতে সেই মেঘ আরও কালো হয়ে আকাশ ছেয়ে ফেললে। বেশ মজবুত বজরা। ছ’খানা দাঁড়। পেছনে হাল ধরে আছে শ্রীনাথ। দুর্গা মেঘ দেখেই জানালার পাল্লা দুটো বন্ধ করে দিয়েছিল।

হঠাৎ শ্রীনাথ চিৎকার করে উঠল–দিদিমণি, সাবধান

কথাটা শুনে প্রথমে দুর্গা ভেবেছিল, বুঝি ঝড় উঠেছে তাই সাবধান করে দিচ্ছে শ্রীনাথ। কিন্তু তা নয়। খানিক পরেই বন্দুকের গুলির আওয়াজ কানে এল।

ছিন্নাথ, কী হল রে?

শ্রীনাথ উত্তর দেবার আগেই বজরাটা দুলে উঠেছে। সেই ঝাঁকুনিতেই ছোট বউরানি ভয়ে হাউমাউ করে উঠেছে। শ্রীনাথ একেবারে ছইয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। বললে–দিদিমণি গো, আর পারলাম না, সামাল নাও এখুনি

কেন, কী হয়েছে রে?

 শ্রীনাথ বললে–ফিরিঙ্গি বোম্বেটের নৌকো আসছে, সঙ্গে গোরাপল্টন

শ্রীনাথের কথা আর শেষ হল না। ওদিক থেকে ফিরিঙ্গিদের নৌকো থেকেও তখন দমাদম বন্দুকের শব্দ হতে লাগল। ছোট বউরানি তখন দুর্গাকে জাপটে ধরেছে। বললে–কী হবে এখন দুগ্যা?

*

রেজা আলি রোজ দফতরে বসে থাকত অপেক্ষা করে। মুর্শিদাবাদের খবরের জন্যেও অপেক্ষা করে থাকত, আবার বশির মিঞার খবরের জন্যেও অপেক্ষা করে থাকত। জীবনে অনেক অপব্যয়-অপকর্ম করে করে খুব নিচু থেকে উঠে আজ ডিহিদার হয়েছে। মুর্শিদাবাদে অনেক মুরগি পাঠিয়েছে, অনেক ঘি পাঠিয়েছে, অনেক আম-আনারাসকাঁঠাল পাঠিয়েছে নবাবকে, অনেক মেয়েমানুষও পাঠিয়েছেনবাবকে খুশি রাখবার জন্যে। শুধু তাই নয়, নবাবকে খুশি করবার জন্যে অনেক খুন-জখমও করতে হয়েছে। হাসিমুখে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে এনে খেতে বসিয়ে পেছন থেকে ছুরি মারতে হয়েছে। শুধু নবাব খুশি হবে বলে! এবং নবাব আলিবর্দি খাঁ বাহাদুর আলমগির খুশি হয়েছে বলেই রেজা আলি খা আজ ছোট থেকে উঠে উঠে হাতিয়াগড়ের ডিহিদার হতে পেরেছে। রেজা আলি খাঁ ভাল করেই জানে যে শুধু কাজ দেখিয়ে নোকরিতে বড় হওয়া যায় না। শুধু নবাবের হুকুম তামিল করেই জীবনে উন্নতি করা যায় না। উন্নতি করতে গেলে খোঁজ রাখতে হবে কে নবাবের দুশমন! সেই দুশমনকে হঠাতে পারলেই নির্ঘাত উন্নতি! সেই কাজই এতদিন ধরে চালিয়ে এসেছে রেজা। এবারও সেই একই কাজ।

এবার হাতিয়াগড়ের রাজার পালা এসেছে।

জনার্দনটা উজবুগ। শালার না আছে বুদ্ধি না আছে দিমাগ। শুধু নিজের সংসারের কথা ভাবতে ভাবতেই হয়রান হয়ে গেল। অত যদি মেয়েদের কথাই ভাববি তা হলে নোকরি করতে এসেছিলি কেন? নোকরিতে যদি উন্নতি করতে চাস তো নোকরির কথাই ভাব কেবল। কীসে ডিহিদার রেজা আলি খুশি থাকে সেই চেষ্টা কর। তা নয়, কেবল মেয়ে মেয়ে আর মেয়ে।

শেষপর্যন্ত লোক হাসিয়ে গেল জনার্দনটা। বেটা জান দিয়ে দিলে নোকরি করতে এসে। সাধে কি বেটাকে উজবুগ বলি!

শেষকালে এল বশির মিঞা। কানুনগো কাছারির মনসুর আলি মেহের সাহেবের রিস্তাদার। মুর্শিদাবাদের নিজামতি-চর। পাকা লোক। সব খবরাখবর মন দিয়ে শুনলে। তারপর বললে–কুছ পরোয়া নেই, আমি এর ফয়সালা করে দেব

রেজা আলি জিজ্ঞেস করেছিল–ঠিক পারবি তো রে? তোকেও জনার্দনটার মতো বাণ মেরে দেবে না তো আবার?

বশির মিঞা বলেছিল–কী বলছেন আপনি ডিহিদার সাহাব, এ যদি না ফয়সালা করতে পারি তো নোকরিই ছেড়ে দেব

দেখ তা হলে, কোশিস করে দেখ! ওদের বাড়িতে যে নোকরানিটা আছে, ওটাই আসলি হারামজাদি! ওকে কবজা করতে পারবি?

খুব পারব খাঁ সাহেব, খুব পারব। মেহেদি নেসার সাহেব আমাকে আচ্ছা করে গালাগালি দিয়েছে, আপনাকেও ভি গালাগালি দিয়েছে

রেজা আলি খাঁ সে কথায় বিশেষ গা করেনি। মেহেদি নেসার সাহেব গালাগালি দিলেই আর গা কিছু পচে যায় না। বললে–ঠিক আছে, তুই কাফের সেজে ওদের অতিথিশালায় গিয়ে ওঠ, কাফের নাম নিয়ে ওখানে দিন কতক থাক, হালচাল দেখ। তারপর আমাকে সব বলে যাবি।

সব ব্যবস্থা রেজা আলি সাহেবই বলে ঠিক করে দিয়েছিল। বশির মিঞাই কার্তিক পাল সেজে গিয়ে উঠেছিল রাজবাড়ির অতিথিশালায়। খেত আর ঘুমোেত। কিন্তু তালে ঠিক থাকত। কেবল ভাব করত গোকুলের সঙ্গে। রান্নাবাড়ির লোকদের সঙ্গে বসে বসে গল্প করত। বিশু পরামানিকের সঙ্গে কথা বলত, আর ছোটমশাইকে দেখলেই পালিয়ে চলে আসত!

জগা খাজাঞ্চিবাবু একদিন জিজ্ঞেস করেছিল–কী নাম তোমার?

আজ্ঞে কার্তিক পাল, আমরা কুমোর—

তোমার বাড়ি কোথায়?

আজ্ঞে মগরা। সরকার সাতগাঁ

সন্দেহ করছে নাকি? বশির মিঞা সেদিন থেকে আরও সাবধান হয়ে গেল। খেয়েদেয়ে নিয়ে ঘুমটা আরও বাড়িয়ে দিলে। যেন কোনও কিছুতেই তার মন নেই, এমনি ভাবখানা। দু-তিন দিন আরও থাকল, আরও মিশল, আরও দেখল। কিন্তু না, সব ঝুট। সব বাজে কথা। রেজা আলি খাঁ সাহেবের দফতরে এসে বললে–না খাঁ সাহেব, জনার্দনটা আপনাকে ঝুট খবর দিয়েছিল, বেটা চাকরি বাগাবার জন্য আপনাকে ওসব কথা বলেছে–

তা হলে দুসরি রানিবিবি কুঠিতে নেই?

না খাঁ সাহেব, না। তাকে চেহেল্‌-সুতুনে পাঠিয়ে দিয়েছে। মরিয়ম বেগম খুদ নিজে কবুল করেছে সে হাতিয়াগড়ের রানিবিবি!

তা হলে সেই হারামজাদি নোকরানিটা কোথায় গেল? তার সঙ্গে মুলাকাত হয়েছে তোর?

না খাঁ সাহেব, সে এখন নেই ওখানে।

 নেই ওখানে?

রেজা আলি খাঁ সাহেব যেন খবরটা শুনে চমকে উঠল। নেই?

না, খাঁ সাহেব, আমি খুব তালাস করেছি, সে নেই। রানিবিবি চলে যাবার পর সেও ভি চলে গেছে। কোথায় চলে গেছে? এই তো সেদিন পর্যন্ত ছিল এখানে।

ছিল, লেকন এখন চলে গেছে, এখন কাশী চলে গেছে। এখন তো কোনও কাম নেই তার, কাশী গিয়ে খোদাতালার নাম করছে।

কবে গেল?

তা জানি না খাঁ সাহেব, লে রানিবিবি ও-কুঠিতে নেই, আমি হলফ করে বলছি, রানিবিবি গেছে চেহেল-সুতুনে, মিছিমিছি আপনি ভি তকলিফ পেলেন, আমার ভি তকলিফ হল–

তারপর হাতিয়াগড় থেকে একদিন ভোররাত্তিরে বেরিয়ে পড়ল বশির মিঞা। যখন মুর্শিদাবাদে এল তখন শহর ফাঁকা। নবাব নেই, জাফর আলি সাহেব নেই, কেউ নেই। মতিঝিলের দরবার-ঘরও ফাঁকা। নবাব পূর্ণিয়ায় যাবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শহরটা যেন আবার ঝিমিয়ে পড়েছে। তবু নিজামতে গিয়ে দেখা করে সব খবর পেশ করতে হবে। এরকম অনেকবার হয়েছে। বশির মিঞা এতে মুষড়ে পড়ে না। ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই হবার আগে বশির মিঞা অনেকবার উমিচাঁদ সাহেবের বাড়ির দরোয়ান জগমন্ত সিংয়ের সঙ্গে ভাব করবার চেষ্টা করেছে। শেঠবাবুদের মুনশিবাবুর সঙ্গে কথা বলেছে, বেভারিজ সাহেবের সোরার গদির মালবাবু কান্তর সঙ্গে কাত কাটিয়েছে, তবে লড়াই ফতে হয়েছে শেষপর্যন্ত। এমন হয়। এমন হয়ে থাকে। একাজে বেকার ঘোরাঘুরি করতে হয় অনেক।

দফতর থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের হাবেলিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল কান্তর কথা। সে বোধহয় ভাবছে। যাবার আগে অনেক খারাপ কথা বলে গিয়েছিল কান্তকে। বেচারা বোধহয় খুব মুষড়ে পড়েছে। সারাফত আলির দোকানের দিকে চলতে লাগল বশির মিঞা।

খুশবু তেলের দোকানের পেছন দিকে থাকে কান্ত।

বাইরে থেকে বশির মিঞা ডাকতে লাগলকান্ত, এই কান্ত

ডাকাডাকিতেও কোনও সাড়া নেই। তখন বেশ ভোর-ভোর। এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি নাকি!

আবার ডাকলে–এই কান্ত, কান্ত

ভেতর থেকে বাদশা বেরিয়ে এল। বশির মিঞা বাদশার দিকে চেয়ে দেখলে। আগে বাদশাটার চেহারা ভাল ছিল। বদমায়েশি করে করে একেবারে জাহান্নমে গেছে।

বাদশা বললে–নেহি হ্যায় কান্তবাবু–ঘরমে নেহি হ্যায়—

এত ভোরে কোথায় গেল? রাত্তিরে বাড়িতে আসেনি?

 বাদশা বললে–না–

অবাক হয়ে গেল বশির মিঞা। রাত্রে বাড়ি আসেনি! তা হলে কোথায় গেল! কান্তবাবু তো জাহান্নমে যাবার ছেলে নয়। কোথায় গেল তা হলে?

বশির মিঞা ভাবতে ভাবতে আবার নিজের হাবেলির দিকে চলতে লাগল। এমন তো হয় না। সত্যিই বড় তাজ্জব ব্যাপার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *