২.০৯ নবাব সিরাজউদ্দৌলার ছাউনি

হালসিবাগানে উমিচাঁদের বাড়ির বাগানের ভেতরে তখন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ছাউনি পড়েছে। হাজার হাজার লোকের রান্নার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। সামনে তিন সার সেপাই পাহারা দিচ্ছে। তার পেছনে গোলন্দাজ, তার পেছনে অনেক দূরে আমির-ওমরাওদের ছাউনি।

দূর থেকে কাউকে দেখলেই বন্দুক উঁচিয়ে ধরে পায়দল ফৌজ। কুয়াশার মধ্যে ভাল করে দেখা যায়, তবু উঁচিয়ে ধরে।

বলে–উই আসছে শালারা–উই আসছে

কেউই আসে না। আসলে নবাবের ফৌজের সামনাসামনি আসার কারও সাহসই নেই। মুর্শিদাবাদ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ত্রিবেণী পেরিয়ে আসতে কি কম সময় লাগে।

সকাল হতে-না-হতেই কান্ত ছাউনি থেকে বেরিয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলে। আকাশটা কুয়াশায় ঢাকা। যেন ঢাকাই চাদর দিয়ে সবকিছু ঢাকা। কদিন ধরে হাঁটাহাঁটি চলেছে। দিন নেই রাত নেই কেবল হাঁটা। কোথায় সেই মুর্শিদাবাদ, আর কোথায় কলকাতা! নবাবের ফৌজের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে সোজা বাগবাজারে পেরিন সাহেবের বাগানের কাছে এসেই ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে মুখোমুখি মুলাকাত। তখন রাত হয়েছে বেশ। অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ছাউনি পড়ল। কান্ত একেবারে নবাবের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কে কী বলছে, কে কী করছে, কে কী ভাবছে সব বোঝবার চেষ্টা করছিল, জানবার চেষ্টা করছিল। মরালী বলে দিয়েছিল কান্তকে–সবসময়ে নবাবের কাছে থাকবে।

কান্ত বলেছিল–কিন্তু আমাকে যদি নবাব কাছে থাকতে না দেয়?

মরালী বলেছিল–দেবে, তোমাকে থাকতে দেবে-নবাবের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে

কান্ত বলেছিল–বশির মিঞা যদি কিছু বলে? আমাকে সে যে উমিচাঁদের বাড়ি যেতে বলেছিল দরবার খাঁ’র খোঁজ করতে

মরালী বলেছিল–তা তুমি আমার কথা শুনবে, না বশির মিঞার কথা শুনবে?

তোমার কথা শুনব মরালী, তোমার কথাই আমি শুনব! তুমি যা বলবে তাই করব। তোমার জন্যে আমি সব করতে পারব। তুমি শুধু বলে দাও আমাকে কী কী করতে হবে।

তোমাকে শুধু নবাবের পাশে পাশে থাকতে হবে, দেখবে যেন নবাবের কোনও ক্ষতি না হয়। কে কী বলছে, কে কী করছে, সব দেখবে, তারপর আমাকে জানাবে, আমাকে সেখান থেকে খবর দেবে!

এমনি করেই নবাবের ফৌজের দলের সঙ্গে কান্ত এসেছিল।

 একদিন দশহাজারি মনসবদার ইয়ার লুৎফ খাঁ জিজ্ঞেস করেছিল–তুমি কে? তুম কৌন?

মনসবদার সাহেব দেখত লোকটা সবসময় নবাবের পাশে পাশে থাকে। নবাবও যেন লোকটাকে বিশ্বাস করে। যখন ছাউনির মধ্যে নবাব সকলকে ডেকে কথা বলে, সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে, তখন অন্য পাহারাদারদের সঙ্গে সেও থাকে। তার সামনে নবাব গোপন কথা বলতেও দ্বিধা করে না। যখন বরানগরে এসে একেবারে কোম্পানির ফৌজের মুখোমুখি হল, তখন পরামর্শ হচ্ছিল সকলের সঙ্গে। ইয়ার লুৎফ খাঁ ছিল, মিরজাফর আলি ছিল, মেহেদি নেসার ছিল, ইয়ারজান, মোহনলাল, মিরমদন সবাই ছিল। কেউ বললে–কামান দাগতে, কেউ বললে–কোম্পানির ছাউনিতে দূত পাঠাতে, কেউ বললে–পিছু হটে নবাবগঞ্জে যেতে। কেউ বললে–কোম্পানির ফৌজে ষাট হাজার গোরা পল্টন আছে, কেউ বললে–বিশ হাজার, কেউ বললে–দশ হাজার। সে এক বিপজ্জনক অবস্থা। কান্ত তখন চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনত। কত রকম লোক কান্ত জীবনে দেখেছে। বেভারিজ সাহেব, ষষ্ঠীপদ, ভৈরব, সারাকত আলি, বাদশা, সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ, বশির মিঞা, বশির মিঞার ফুপা মনসুর আলি মেহের সাহেব। কিন্তু এরা সব অন্যরকম। কিন্তু অন্যরকম হলেও ভেতরে ভেতরে যেন সবাই এক। এতদিন এদের নামই শুনে এসেছে, এতদিন এদের ভয়ই করে এসেছে, এতদিন হয়তো এদের শ্রদ্ধা ভক্তিও করে এসেছে। সম্মানে, প্রতিষ্ঠায়, প্রতিপত্তিতে এরা তো সকলের চেয়ে বড়ই। কিন্তু এতদিনে বুঝল যাদের সে দূর থেকে দেখেছিল, তাদের কাছাকাছি আসতে তারা যেন সবাই ছোট হয়ে গেল। সবাই কেবল নিজের নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। ওর দুটো চাকর, আমার কেন একটা চাকর থাকবে। ওর তিনটে বাঁদি, আমার কেন একটাও বাঁদি থাকবে না। কারও খাওয়াদাওয়ার কিছু ত্রুটি হলে গালাগালি দেয় বাবুর্চিকে। খেদমত করতে গাফিলতি করলে বান্দাদের চড়-চাপড় খেতে হয়। অথচ এরাই তো দেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা।

একদিন গুঞ্জন উঠল–ও লোকটা কে? ওর কী কাজ? ও কেন এসেছে ফৌজের সঙ্গে?

 কান্তকে জিজ্ঞেস করলে কান্ত বলে আমি নবাবের খিদমদগার!

তা নবাবের খিদমদগার তো তুমি সব কথায় কান, দাও কেন? তুই কেন সবসময় আমাদের কাছে থাকবি?

তা সে জনাব আপনি নবাবকে বলুন। আমাকে কেন বলছেন?

কিন্তু আশ্চর্য, নবাবকে বলবার সাহস নেই কারও। সেখানে যখন সবাই যায় তখন মাথা নিচু করে থাকে, যেন কত ভক্তি!

তিন-চারটে কামানের গোলা ছুঁড়তেই ওদিক থেকে ফিরিঙ্গিরাও গোলা ছুঁড়তে লাগল। একটা গোলা একেবারে বাবুর্চিখানার পাশেই এসে পড়ল। সমস্ত ছাউনিটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। প্রথমটায় কান্তর কানে তালা লেগে গিয়েছিল। তারপর একটু চেতনা ফিরতেই দেখলে নবাব মাথা থেকে তাজটা সরিয়ে রাখলে। তারপর বললেন–ইয়ার লুৎফ খাঁ-কে ডাকো

দশহাজারি মনসবদার ইয়ার লুৎফ খাঁ তখন ঘামতে ঘামতে এসে কুর্নিশ করে দাঁড়াল।

জাঁহাপনা, কোম্পানির ফৌজ এগিয়ে আসছে।

নবাব বললেন–ফির কামান দাগো

তারপর একটার পর একটা সমস্ত সন্ধেটা শব্দের চোটে অন্ধকার খানখান হয়ে যেতে লাগল। শীতের কুয়াশায় ঢাকা অন্ধকার চিরে গোলাগুলো আকাশের বুকের ওপর ফাটতে লাগল পরপর। কান্ত নবাবের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। মুখখানার দিকে চেয়ে দেখছিল বারবার। মনে হল উত্তেজনায় নবাবের বুকের ভেতরটা ফেটে যেতে চাইছে। কিন্তু মুখে একটাও কথা নেই। শুধু একবার বললেন–একটু শরবত আনতে বলো

নবাবকে দেখে কান্তর মায়া হচ্ছিল। বন্ধ ছাউনির মধ্যে মশার উৎপাত। একটা পাখা দিয়ে কান্ত নবাবকে হাওয়া করতে লাগল। নবাব কিছু বললে–না। মনে হল যেন নবাবের আরাম হচ্ছে। তারপর যখন রাত বাড়ল ওদিক থেকে সমস্ত চুপ হয়ে গেল। আর কোনও সাড়াশব্দ নেই কোম্পানির ফৌজের।

ইরাজ খাঁ ঘরের মধ্যে এসে বললে–আমার মনে হয় এখান থেকে এখন আমাদের সরে যাওয়া দরকার বাবাজি–

কেন? নবাব জিজ্ঞেস করলেন। নবাবের নিজের শ্বশুর ইরাজ খাঁ। ইরাজ খাঁ’র কথা সহজে ঠেলতে পারেন না নবাব।

ইরাজ খাঁ বললে–বুদ্ধ না করে ওদের কাছে না হয় দূত পাঠানো যাক, দেখা যাক না কী উত্তর দেয় ওরা–

কথাটা যেন ভাবিয়ে তুলল নবাবকে। কান্ত চেয়ে দেখলে নবাবের কপালের রেখাগুলো কুঁচকে এল। এতদূর এসে পেছিয়ে যাওয়া! যারা এতদিন তাকে সম্মান দেয়নি, মসনদ পাবার পর একটা নজরানা পর্যন্ত দেয়নি, যারা বরাবর তাকে অগ্রাহ্য করেই এসেছে, সেই শয়তানদের কাছে দূত পাঠানো!

কিংবা এখান থেকে তিন ক্রোশ দূরে নবাবগঞ্জে গিয়ে ওদের মতিগতি লক্ষ করি, জায়গাটা ভাল

ওরা কী বলে? মিরমদন আর মিরজাফরজি?

ওরা বলতে সাহস করছে না তোমাকে, ওরাই আমাকে কথাটা তোমার কাছে তুলতে বলেছে!

কিন্তু ফিরিঙ্গিরা যদি ভাবে আমি ওদের কামানের গোলার ভয়ে পালিয়ে গেছি?

ইরাজ খাঁ বললে–তুমি হলে বাংলার নবাব, তুমি ওদের ভয় পাবে এ কথা কে বিশ্বাস করবে?

 তা হলে এখানেই থাকি! এ-জায়গাটার নাম কী?

এটা বরানগর! এখানে চারদিকে জঙ্গল, কাল সকালবেলাতেও যদি কোম্পানির ফৌজ আমাদের ওপর হামলা করে আমরা জঙ্গলের ভেতরে কাউকে যে দেখতেই পাব না।

আর নবাবগঞ্জ?

 সেখানে সব ফাঁকা বাবাজি। চারদিকে ফাঁকা জায়গা। খোলা মাঠ।

কান্ত ইরাজ খাঁ’র দিকে চেয়ে লোকটার কথাগুলো বোঝবার চেষ্টা করতে লাগল। তবে কি নবাবের নিজের শ্বশুরও নবাবের বিরুদ্ধে! কিন্তু কান্তর কথা কে শুনবে! কে তার পরামর্শ নেবে।

নবাব রাজি হতেই সমস্ত ছাউনির লোক সেই রাত্রেই আবার চলতে শুরু করল। ত্রিশ ক্রোশ রাস্তা। কোথায় বরানগর আর কোথায় নবাবগঞ্জ। সেখান থেকেই খবর পাঠানো হল কোম্পানির দফতরে। কথাবার্তা করবার জন্যে লোক পাঠাও। তোমাদের সঙ্গে ফয়সালা করবে নবাব।

দুদিন ধরে নবাব সেই নবাবগঞ্জেই অপেক্ষা করলে, তবু কেউ এল না। নবাব রেগে গেল। ফৌজ, হাতি, পাইক, বরকন্দাজ সবাই যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এতদূর এসে যুদ্ধ করতে না পেয়ে সবাই যেন খেপে গেল। সেই দিনই আবার মুখোমুখি হামলা করতে হবে ফিরিঙ্গি ফৌজের ওপর।

কিন্তু পথেই কথা উঠল বরানগরে গিয়ে কাজ নেই। সোজা গিয়ে উমিচাঁদের বাগানে উঠলেই ভাল হয়।

কেন?

 মিরজাফর আলি বললে–ফিরিঙ্গিদের একটা মওকা দেওয়া ভাল!

কিন্তু উমিচাঁদকে কি এখনও বিশ্বাস করতে বলো? সে ফিরিঙ্গিদের কাছে খুরাকি বেচে টাকা কামিয়েছে! সে তো নিমকহারাম!

ইয়ার লুৎফ খাঁ সব কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল। বললে–জাঁহাপনা, সওয়ানে নেগার খবর এনেছে। আহমদ শা আবদালি দিল্লি হামলা করেছে দিল্লি থেকে তারা বাংলাদেশের দিকে ধাওয়া করছে–

খবরটা শুনে নবাব খানিকক্ষণের জন্যে বিমূঢ় হয়ে রইল। এ-ধরনের আবহাওয়ার সঙ্গে কান্তর কোনওকালে পরিচয় ছিল না। চিরকাল ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। লড়াই ফড়াইয়ের মধ্যে থাকতে ভাল লাগে না। বন্দুক-কামান জিনিগুলোকে চিরকাল ভয় করে এসেছে। অথচ সমস্ত দিন সেই সবই দেখতে হয়। সকাল থেকে ফৌজের লোকেরা কুচকাওয়াজ করে, শরীরটাকে মজবুত রাখবার জন্যে দৌড়ঝাঁপ করে, আর যখন ছুটি হয় তখন সার সার কলাপাতা পেড়ে ভাত খেতে বসে। হালসিবাগানের মধ্যেখানে হাজার হাজার লোক খেতে বসে। এক-একজন দু’বার-নিবার করে ভাত চেয়ে খায়। ফৌজিকাছারি সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। সেখান থেকে টাকা নিয়ে চাল কিনে আনে লোকেরা, সেই চাল এনেসকাল থেকে রান্না শুরু হয়। মাছ হয়, মাংস হয়। কালিয়ার গন্ধে হালসিবাগানের বাতাস একেবারে মাতাল হয়ে ওঠে। কিন্তু খিদে পেলেও তখন খাবার উপায় নেই কাতর। নবাব না খেলে সে খেতে পারে না।

সেদিন হঠাৎ কে একজন জিজ্ঞেস করলে–তুমি কে?

কান্ত বললে–আমি কান্ত সরকার

 কায়স্থ?

কান্ত জিজ্ঞেস করলে–তুমি?

আমি ভাই সদগোপ। আমাদের জল-চল।

 কান্ত হেসে উঠল। বললে–ফৌজের দলে আবার কায়স্থ-সদগোপ কী? তোমার নাম কী?

শশী! কাজকম্ম কিচ্ছু পাইনে, তাই নাম লিখিয়েছি সেপাইয়ের দলে। লড়াইটা না হলে আবার চাকরিটা চলে যাবে। লড়াই হবে, না হবেনা? তুমি শুনেছ কিছু? তুমি তো দেখেছিনবাবের কাছাকাছি থাকো। শুনছি নাকি লড়াই করবে না নবাব! শুনে তো ভয় লেগে গেছে। নতুন চাকরি, অনেক কষ্টে চাকরিটা পেয়েছি, লড়াই না-হলে তো চাকরিটাও যাবে ভাই

তা এমন চাকরি নিলেই বা কেন?

নিয়েছি কি সাধে ভাই, টাকা না উপায় করলে খাব কী? বাপের খেতখামার তো কিছু নেই, গতরে খেটে খেতেই হবে!

ছেলেটাকে বেশ ভাল মনে হল। লড়াই বন্ধ হবে শুনলেই দুঃখ হয়। কেবল জিজ্ঞেস করে কিছু শুনলে ভাই তুমি?

কান্ত বলে তুমি তো ফৌজের দলের সঙ্গে থাকো, তুমি কিছু শুনতে পাও না?

শশী বললে–ওরা তো বলে লড়াই হবে না

কেন? হবে না কেন?

শশী বলে–ওরা বলছিল নবাব নাকি যুদ্ধ করতে চায় না। দিল্লি থেকে নাকি আহমদ শা আবদালি বাংলাদেশে হামলা করতে আসছে বলে নবাব একটু দ্বিধা করছে–তুমি কিছু জানো ভাই?

ছেলেটাকে দেখে কান্তর বড় ভাল লাগল। আশ্চর্য, ওর তো ভয় করছে না! কিন্তু বেশিক্ষণ বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলবারও সময় থাকে না। হালসিবাগানে আসার পরদিন থেকেই নানা লোকের সঙ্গে নানা সলাপরামর্শ করছেনবাব। ইয়ার লুৎফ খাঁ, মিরমদন, মোহনলাল, মিরজাফর সবাই যেন খুব ভাবনায় পড়েছে।

উমিচাঁদও থাকে নবাবের সঙ্গে। হালসিবাগানে আসার সঙ্গে সঙ্গে উমিচাঁদ সাহেবনবাবের সামনে এসে লম্বা কুর্নিশ করে দাঁড়িয়েছিল। তারপরে দুজনে একটা ঘরের ভেতরে গিয়ে কী সব কথা বলতে লাগল। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হল না। কান্ত বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।

কিন্তু সন্ধে পর্যন্ত কিছুই জানা গেল না।

নবাব বসে ছিল। হঠাৎ বাগানের গেটের কাছে কোম্পানির একটা পালকি গাড়ি এসে দাঁড়াল। ফৌজের লোকেরা রাস্তা ছেড়ে দিলে। অবাক কাণ্ড। রাজা দুর্লভরাম সামনে এগিয়ে গেল।

আসুন আসুন

কান্ত দেখলে গাড়ি থেকে তিনজন নামল। দু’জন ফিরিঙ্গি সাহেব, আর একজন বাঙালি টিকিওয়ালা।

নবাবের সামনে আসতেই রাজা দুর্লভরাম ফিরিঙ্গি দু’জনের জামাকাপড় সব খুঁজে খুঁজে দেখলে। কান্ত নবাবের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। কুর্তা, ইজের তন্নতন্ন করে দেখে কোথাও কিছু পাওয়া গেল না।

নবাব জিজ্ঞেস করলে–এরা কারা দুর্লভরাম

 জাঁহাপনা, এরা কর্নেল ক্লাইভ সাহেবের আর্জি নিয়ে এসেছে–এর নাম স্ক্র্যাফটন—

আর ও?

ওর নাম মিস্টার ওয়ালস

 আর ও কে?

দুর্লভরামও জানত না লোকটাকে। গায়ে একটা চাদর, মাথায় টিকি, পায়ে খড়ম। লোকটা বোকার মতো হ করে সব চেয়ে দেখছিল।

সাহেব নিজেই লোকটার পরিচয় দিলে–জাঁহাপনা, এ আমাদের কর্নেলের নতুন মুনশি কর্নেলের খাস মুনশি নবকৃষ্ণ, আমাদের ইন্টারপ্রেটার হিসেবে এসেছে

বোসো।

সমস্ত আবহাওয়াটা থমথম করতে লাগল। নবাবের শ্বশুর ইরাজ খাঁ, মিরমদন, মিরজাফর, উমিচাঁদ সবাই হাজির ছিল।

হঠাৎ কান্তর দিকে বোধহয় মিরজাফর আলির নজর পড়েছে। বললেও কেন এখেনে? উসকো বাহার যানে বোলো

কান্ত বাইরেই চলে যাচ্ছিল। নবাবের কানে গিয়েছিল কথাটা। বললে–না, ও রহেগা—

বাইরে শশী পঁড়িয়ে ছিল। শশী বলে দিয়েছিল–ভেতরে কী হল আমাকে জানিয়ে দিয়ো ভাই, বড় ভাবনায় পড়েছি

কান্ত বলেছিল–কেন, অত ভাবনা করছ কেন? লড়াই হলে তো সকলের পক্ষেই খারাপ

শশী বলেছিল–কিন্তু যদি ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে একটা মিটমাট হয়ে যায় তো আমার চাকরি কি থাকবে, হয়তো ছাঁটাই করে দেবে

কান্ত কথা দিয়েছিল, ঘরে যা যা কথা হবে সব জানাবে। আহা বেচারি! দুটো খেতে পাবে বলে সেপাইয়ের দলে নাম লিখিয়েছে। কিন্তু জানে না, প্রাণে মারা গেলে তখন কে খাবে? তখন কোথায় থাকবে তোর খাওয়া?

হঠাৎ স্ক্র্যাফটন সাহেব কুর্নিশ করে নবাবের সামনে দাঁড়িয়ে উঠল।

নবাব তাকিয়া হেলান দিয়ে বসেছিল। বললে–বলো—

*

ছোটমশাই এসে নামলেন বাগবাজারের পেরিন সাহেবের বাগানের ঘাটে। ঘাট জমজমাট। ইংরেজ ফৌজ ঘিরে রেখেছে সমস্ত জায়গাটাকে। বজরাটাকে ঘাটে বেঁধে ওপরে উঠছিলেন তিনি।

উদ্ধব দাস সঙ্গে ছিল। বললে–অধীনের বড় খিদে পেয়েছে আজ্ঞে

ছোটমশাই রেগে গেলেন তোমার নিজের বউয়ের খোঁজে বেরিয়ে এমন খিদে পায় কী করে শুনি? তুমি তো তাজ্জব লোক

উদ্ধব দাস হাসল। বললে–তা বউ পালিয়ে গেছে বলে কি খিদে পেতেও দোষ হুজুর?

 ছোটমশাই থামিয়ে দিলেন। বললেন–তুমি থামো

ঘাট পেরিয়ে যেতেই উদ্ধব দাস বললে–ধরুন হুজুর, আপনার যদি আমার মতো বউ পালিয়ে যেত তো আপনি কি খিদে-তেষ্টা ত্যাগ করতে পারতেন?

বলছি থামো! আবার কথা বলছ?

বরানগর থেকে নৌকো করে বাগবাজারে আসতে কতক্ষণ বা সময় লাগে! কিন্তু ছোটমশাইয়ের মনে হচ্ছিল যেন এক যুগ পার হয়ে গেল। লোকটাও সঙ্গ ছাড়ে না। পথেই খবর পাওয়া গেল ক্লাইভ সাহেব বাগবাজারে গিয়ে উঠেছে।

ছোটমশাই জিজ্ঞেস করেছিল–তুমি কদ্দূর যাবে?

উদ্ধব দাস বলেছিল–আমার কাছে কোনও দূর-দূরান্তর নেই হুজুর, আপনি আমাকে বলুন না, এখনই আপনার সঙ্গে আমি হেঁটে কেষ্টনগর চলে যাচ্ছি, গিয়ে আয়েশ করে মুগের ডাল খাব–

মুগের ডাল?

হুঁ হুজুর, কেষ্টনগরের মহারাজের অতিথিশালায় মুগের ডালটা এমন করে না, সে খেলে আমি বউয়ের কথাও ভুলে যাই। মুগের ডাল খেতে আমি বড় ভালবাসি যে–

কথা বলতে বলতে একেবারে ক্লাইভ সাহেবের ছাউনির ফটকে এসে হাজির হয়ে গেল।

ফটকে গোরা পল্টন পাহারা দিচ্ছিল। কিছুতেই ঢুকতে দেয় না। ছোটমশাই বললে–বলল, আমি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে এসেছি।

গোরা পল্টন ওসব কথা শুনতে চায় না। তার কাছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ৰফন্দ্র কেউ নয়। বললে–ঢুকতে দেবার হুকুম নেই কর্নেল সাহেবের

বলে রাইফেল খাড়া করে পথ আটকে রইল।

ছোট মশাই বললেন–এ তো মহা মুশকিল হল দেখছি, আমি অত দূর থেকে দেখা করতে এলুম

উদ্ধব দাস বললে–দাঁড়ান হুজুর, আপনাকে তো ঢুকতে দিলে না, দেখুন আমাকে কী রকম ঢুকতে দেয়

বলে এগিয়ে গেল গোরা পল্টনটার দিকে। বললে–তুমি তোমার কর্নেল সাহেবকে গিয়ে একবার খবর দাও না পল্টন সাহেব

কী খবর দেব? কাউকে ঢুকতে দেবার অর্ডার নেই!

উদ্ধব দাস বললে–বলো গে, পোয়েট এসেছে

পোয়েট?

পল্টনটাও যেন অবাক হয়ে গেল। মিলিটারি ক্যাম্পে আবার পোয়েট কী করতে এল?

হ্যাঁ হ্যাঁ পল্টন সাহেব, পোয়েট! পদ্য লিখি, কাব্য লিখি গো! রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়ের নাম শুনেছ তো, তিনি যেমন অন্নদামঙ্গল লিখেছেন, তেমনি আমিও কাব্য লিখছি

গোরা পল্টনটার কী মনে হল কে জানে। ভেতরে চলে গেল। তারপর খানিক পরেই আবার ফিরে এসে বললে–কাম অন–

উদ্ধব দাস ছোটমশাইয়ের দিকে তাকাল। বললে–চলে আসুন হুজুর–চলে আসুন দেখলেন তো, সাহেব আমায় কত খাতির করে? চলে আসুন

*

রবার্ট ক্লাইভের তখন নিশ্বাস ফেলবার সময় নেই। তবু বিপদ আর বিপর্যয়ের মধ্যেও মাথা ঠান্ডা রাখতে তার জুড়িও কেউ নেই তখনকার দিনে। বিপদের মধ্যেই যেন ক্লাইভের মাথাটা হালকা হত বেশি। বিপদের মধ্যেই যেন পুরোপুরি নিশ্বাস ফেলে রবার্ট ক্লাইভ। নইলে সেন্ট ফোর্ট ডেভিডের যুদ্ধের পরই সোজা নিজের দেশে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারত পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে। ওদিকে পাঠান সর্দার দুরানি আহমদ শা আবদালি মথুরা কনকার করে দিল্লির কাছে এসে পড়েছে, সে-খবরটা পৌঁছে গিয়েছিল ক্লাইভের কানে। সেখান থেকে পুব দিকে আসছে তার আর্মি, সেখবরও কানে এসে গিয়েছিল। এ সময় নবাবকে যা বলা হবে তাই-ই সে শুনবে, তাও আঁচ করে নিয়েছিল। আর যুদ্ধটা যদি আরও কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখা যায় তবে নবাবেরই লাভ, কোম্পানির লোকসান।

নবাবের কাছে যাবার সময় স্ক্র্যাফটনকে বলে দিয়েছিল চুপি চুপি দেখে আসবে নবাবের ফৌজে কত সোলজার আছে, আর্টিলারি কত, এইসব

তিনজন তো তোক। স্ক্র্যাফটন, ওয়াল আর নতুন মুনশি নবকৃষ্ণ।

ফাস্ট কনডিশন হল নবাবকে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে!

তাতে যে নবাব রাজি হবে না তা তো জানা কথাই। তবু নবাবকে বোঝাতে হবে যে কোম্পানির সদিচ্ছে আছে টুস করতে। কোম্পানি নবাবের সঙ্গে একটা রফা করতে চায় ভয় পেয়ে।

একটা করে কথা বলে স্ক্র্যাফটন, আর সেটা ফারসিতে বুঝিয়ে দেয় নবকৃষ্ণ।

কান্ত চুপ করে নবাবের পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল, সব শুনছিল।

নবাব সব শুনে বললে–ঠিক আছে, আপনারা এখন দেওয়ানখানায় গিয়ে অপেক্ষা করুন, আমি কাল সকালে তপনাদের আমার মতামত জানাব

তিনজনেই বেরিয়ে এল দরবার থেকে। কান্ত দেখলে তিনজনেই খুব ভয় পেয়ে গেছে। উমিচাঁদ সাহেব তিনজনকে নিয়ে বাইরে এল।

শশী বাইরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে। কান্তকে দেখে তার দিকেই এগিয়ে আসছিল।

 কী হল ভাই, কিছু শুনলে? লড়াই হবে?

কান্ত সেকথার উত্তর দিলে না। দু’জন গোরা সাহেব তখন উমিচাঁদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলছে। কান্ত কাছাকাছি গিয়ে কান খাড়া করে রইল। সব কথা জানাতে হবে মরালীকে। মরালী চেহেল্‌-সুতুনের ভেতর চুপ করে বসে থাকবে কান্তর চিঠির জন্যে। দু’দিন খবর দিতে না পারলেই ছটফট করে কান্ত। খবরটা লিখে একটা লেফাফার মধ্যে এঁটে দেয়। তারপর দেওয়ানখানার ভেতরে গিয়ে খাসনবিশের হাতে দেয় লেফাফাখানা।

খাসনবিশ বলে–এত চিঠি কাকে লেখো বাবুসাহেব?

বুড়ো সারাফত আলিকে জনাব। আমার ওপর বুড়োর খুব মেহেরবানি কিনা, চিঠি না পেলে আবার ভাববে বড্ড!

সারাফত আলি তোমার কে বাবুসাহেব? তুমি তো হিন্দু–

কান্ত বলে হিন্দু হলে কী হবে জনাব, সারাফত আলি সাহেব আমার বাপের মতন। আমাকে রোজ রোজ খত্ লিখতে বলেছে

সেই চিঠি নিজামতের চিঠির সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে রোজ মুর্শিদাবাদে যায়। ঘোড়ার ডাক মাঝখানে বদলি হয়। এক ঘোড়া থেকে আর এক ঘোড়ার পিঠে ওঠে। তারপর সারাফত আলির নামের চিঠি আবার নিজামত-দফতর থেকে কেমন করে নজর মহম্মদের হাত দিয়ে সোজা একেবারে মরালীর হাতে গিয়ে পৌঁছোয়।

মরালী চেহেল্‌-সুতুনে বসেই জানতে পারে স্ক্র্যাফটন আর ওয়ালস্ সাহেব দুজনে নবাবের কাছে এসেছিল ফয়সলা করতে। আর উমিচাঁদ সাহেব নবাবকে কেমন করে খোশামোদ করে ভাব করে ফেলেছে। পড়তে পড়তে মরালী কেমন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। মনে হয় যদি সম্ভব হত নিজেই চলে যেত হালসিবাগানে।

কান্ত লেখে–এখানে খুব শীত পড়েছে। তোমার কথা খুব মনে পড়ে। এখানে সবাই উৎসুক হয়ে ভাবছে কী হবে! কেউ ভাবছে যুদ্ধ বাধবে, কেউ ভাবছে সন্ধি হয়ে যাবে। যে-দু’জন ফিরিঙ্গি এসেছিল কর্নেল ক্লাইভ সাহেবের চিঠি নিয়ে, তাদের মতলব খারাপ বলে মনে হল। তাদের কথাবার্তার ধরন ভাল লাগল না। তাদের সঙ্গে যে ফারসি জানা মুনশি এসেছিল তার নাম নবকৃষ্ণ। তাকেও খুব শয়তান মনে হল। নবাব তাদের সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করলেন। এইরকম ভাল ব্যবহার পেয়ে পেয়েই ওরা বড় প্রশ্রয় পেয়ে গেছে। তাদের দেওয়ানখানায় থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। তাদের জন্যে আবার নবাব ভাল খানাপিনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তুমি থাকলে হয়তো অন্য ব্যবস্থা হত। কিন্তু আমি তো কিছু বলতে পারি না। এমনিতেই সবাই আমাকে সন্দেহ করে। সবাই জিজ্ঞেস করে–আমি কে? আমাকে নবাব কেন পাশে পাশে থাকতে দেন। সবাই আমাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। নবাব না থাকলে আমাকে বোধহয় সবাই খুনই করে ফেলত। আমি কাউকেই কিছু বলি না। আমি শুধু চুপচাপ সব দেখি সব শুনি। তেমন কিছু বিপদ হলেই তোমাকে আমি সব জানাব। আমাকে এখানকার খাসনবিশ সাহেব জিজ্ঞেস করছিল আমি কাকে চিঠি লিখি। সারাফত আলি সাহেব আমার কে? এরা কেউ এখনও জানে

যে আমি তোমাকে সব খবর খুঁটিয়ে জানাই। নবাব সত্যিই খুব ক্লান্ত। এবার নবাবের সঙ্গে তয়ফাওয়ালিরা কেউই আসেনি। মুখ দেখে মনে হয় খুব ভাবনায় পড়েছেন নবাব। ঘুমোবার সময়ও আমি কাছাকাছি থাকি। পাহারাদারদেরও আমি পাহারা দিই। ঘুমোতে ঘুমোতে নবাব এক-একবার কী যেন কথা বলেন। ভাল বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়–মিরজাফর আলিকে ডাকছেন। কখনও উমিচাঁদ,কখনও ইয়ার লুৎফ খাঁ। আজকে এখানেই শেষ করি। পরে কী হয় তোমাকে জানাব।

চিঠিটা নিয়ে দেওয়ানখানার দিকে যেতে গিয়েই দেখলে, উমিচাঁদ সাহেব দুজনকে কাছে ডাকলে।

সাহেব দুজন কাছে এল। নকৃষ্ণও কাছে এসে দাঁড়াল।

 কী বুঝলেন মিস্টার উমিচাঁদ? নবাব কি কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে রাজি হবে?

উমিচাঁদ সাহেবের মুখখানা কথা বলতে গিয়ে যেন বেঁকে গেল।

 বললে–নবাবকে তা হলে তোমরা চেনোনি সাহেব। নবাব সিরাজউদ্দৌলা অত সোজা চিজ নয়। ওর মুখ দেখে বোঝবার উপায় নেই মনে মনে কী প্যাঁচ কষছে–

সাহেব দু’জন অবাক হয়ে গেল উমিচাঁদ সাহেবের কথা শুনে। বললে–খুব পাচোয়া লোক নাকি? মুখ দেখে তো কিছু বোঝা যায় না?

উমিচাঁদ সাহেব বললে–হাজি আহম্মদের বংশধর তো, ওদের মুখ দেখে কখনও বোঝা যায়? ওর গ্র্যান্ড ফাদার ওইরকম করে সরফরাজ খাঁ-কে খুন করে গ্রোন নিয়ে নিয়েছিল। ওদের রক্তের মধ্যে ওই গুণ রয়েছে যে

তা হলে কী হবে?

যেন মহা ভাবনায় পড়েছিল সাহেবরা।

ওই দেখলে না সাহেব, তোমাদের রাত্তিরে দেওয়ানখানায় থাকতে বললে! তোমাদের ভাল করে খাইয়েদাইয়ে খাতির করবার মানেটা কী? অত খাতির কি ভাল?

ওয়ালস্ সাহেব জিজ্ঞেস করলে–সত্যি, কেন এত খাতির বলুন তো?

উমিচাঁদ বললে–কাল যে আরও গোলন্দাজ ফৌজ এসে পৌঁছেচ্ছে, তোমাদের কোনওরকমে কাল পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে চায়, তারপরেই দুমদাম করে গুলি চালাবে

সাহেবরা ভয়ে ভয়ে দেওয়ানখানার দিকে গেল। দেওয়ানখানার একধারে একটা ঘরে তিনজনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে গিয়ে কী করলে কে জানে। কোনওরকমে দুটি খাওয়াদাওয়া সেরেই দরজা বন্ধ করে দিলে। ঘরের আলো নিভে গেল।

খাসনবিশমশাই বললে–কী গো কান্তবাবু, ডাকের কিছু চিঠি আছে নাকি?

তখন চারদিকের আলোই নিভে গেছে। নবাবও খেয়ে নিয়েছেন। সমস্ত হালসিবাগানটা যেন ভয়ে থমথম করছে। রাত বেশি নয়। শশী এসেছিল। জিজ্ঞেস করলে কী হল ভাই? কিছু খবর পেলে?

কান্ত বললে–যা হল তা তো দেখলে! কালকে আবার কথাবার্তা চলবে।

ছেলেটা যেন বড় মুষড়ে পড়েছিল। আশ্চর্য, এ সংসারে কত লোকের কত রকমের সমস্যা। কান্তর একরকম সমস্যা, শশীর আর এক রকমের। মিরজাফর আলি, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ সকলেরই নানারকম সমস্যা। নবাবের আবার অন্যরকম ভাবনা। কেউ চাইছে যুদ্ধ হোক। যুদ্ধ হলে চাকরিটা বজায় থাকবে। যুদ্ধ হলে উমিচাঁদ অনেক টাকা মুনাফা করবে। যুদ্ধ হলে মিরজাফর আলির আবার অন্যরকম লাভ। নবাবকে বিপদে ফেলে লাভ। কারও লাভ নবাবকে বাঁচিয়ে রেখে, কারও লাভ নবাবকে মেরে।

নিজের ঘরে এসে কান্ত আবার আলো জ্বালিয়ে চিঠিটা শেষ করতে বসল–তারপর উমিচাঁদ সাহেবের কথাগুলো শুনে আমার খুব খারাপ লাগল মরালী। আমার ঘুম এল না। তোমার কথা মনে পড়তে লাগল। ভাবলাম তুমি বোধহয় এখন আরাম করে মখমলের বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছ। সন্ধেবেলা খাসনবিশ আমায় জিজ্ঞেস করেছিল আমার কোনও চিঠি ডাকে দেবার আছে কিনা। আমি বলেছিলাম না। কারণ তখনও আমার অনেকখানি লিখতে বাকি আছে…

হঠাৎ শশী বাইরে থেকে ডাকলে-কান্ত,কান্ত…।

কান্ত ধড়ফড় করে উঠে পড়েছে। চারদিকে যেন হইচই পড়ে গেছে। সবাই যেন ব্যস্ত! কী ব্যাপার? কী হল হঠাৎ? এত গোলমাল কীসের? কেউ জানে না কী হয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। সেই তিনজন লোক দেওয়ানখানা থেকে পালিয়েছে। নবাব তখন ঘুমোচ্ছিলেন। খবর গেল সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে।

ইয়ার লুৎফ খাঁ তৈরিই ছিল বোধহয়।

শশীকে তখন আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। তার তখন আর আনন্দের বোধহয় শেষ নেই। সমস্ত হালসিবাগানটা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল রাতারাতি। ফৌজের সমস্ত লোক ইয়া’ ইয়া’ করে চিৎকার করে উঠল। গর্জন করে উঠল একসঙ্গে।

আর সঙ্গে সঙ্গে…

কান্ত চিঠিটা বার করে সেই হট্টগোলের মধ্যে দু’ছত্র তাতে লিখে দিলে। মরালী জানুক। নইলে সে যা মেয়ে, বড় ভাববে। তারপর তাড়াতাড়ি দেওয়ানখানায় খাসনবিশের কাছে গিয়ে হাজির। খাসনবিশ তখন দফতর গুটিয়ে ফেলেছে।

আমার একটা খত আছে খাসনবিশ সাহেব!

কীসের খত? কী লেখা আছে এতে?

আজ্ঞে হুজুর, তেমন কিছু নয়। সারাফত আলি সাহেবকে লিখছি এখানকার কথা, সারাফত আলি সাহেব আমার বাপের মতন তো, শেষকালে আমার জন্যে ভেবে মরবে!

অনেক ধরা করার পর বোধহয় দয়া হল খাসনবিশের। ডাকের থলির মুখটা আবার খুলে তার মধ্যে চিঠিখানা পুরে দিলে। তারপর দফতর গুটিয়ে তল্পিতল্পা গুছোতে লাগল।

সে-চিঠি যখন পরদিন নিজামত কাছারিতে গিয়ে পৌঁছুল, নজর মহম্মদ সেখানা নিয়ে সোজা মরালীর হাতে দিলে।

মরালী পড়তে লাগল–তোমাকে চিঠি লেখা শেষ করে যখন শুতে যাচ্ছি তখন হইহই পড়ে গেল ছাউনির মধ্যে। শশীর ডাকে আমার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে শুনি অবাক কাণ্ড। যা ভয় করেছিলাম তাই। সেই স্ক্র্যাফটন আর ওয়ালস্ সাহেব তারা ঘরের আলো নিভিয়ে ঘুমোতে গেল ভেবেছিলাম। কিন্তু তা নয়। আমাদের ফৌজের সেপাইরা যখন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন তারা রাত্রের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে গেছে। সেই নবকৃষ্ণ মুনশি বলে যে-লোকটা সঙ্গে ছিল, সে-ও তাদের সঙ্গে পালিয়েছে। তারপর আর কী হয়েছে কেউ জানে না। এই একটু আগেই ক্লাইভ সাহেবের গোলন্দাজ ফৌজ আমাদের নবাবের ঘরের পাশেই একটা কামানের গোলা ছুঁড়ে মেরেছে। আর একটু হলেই নবাবের ছাউনির ওপরে পড়ত। তা হলে নবাবও আর বাঁচতেন না, আমিও বাঁচতুম না মরালী। আজ এখানেই শেষ করছি। খাসনবিশ সাহেবকে বলে কয়ে খোশামোদ করে এ-চিঠি পাঠাতে দেওয়ানখানায় যাচ্ছি। দেখি যদি রাজি হয়।

বাঁদি এসে বললে–গোসলখানায় গরম পানি দেব বেগমসাহেবা?

সেকথার উত্তর না দিয়ে মরালী জিজ্ঞেস করলে–নানিবেগমসাহেবা কোথায়?

তারপর তার উত্তরের অপেক্ষা না করে সোজা গেল একেবারে নানিবেগমের মহলের দিকে।

নানিবেগমসাহেবা তখন মসজিদ থেকে নমাজ পড়ে আসছিল। মরালী গিয়ে বললে–সর্বনাশ হয়েছে নানিজি, তোমার মির্জা খুব বিপদে পড়েছে–

তা তুই কী করে জানলি?

এই দেখ নানিজি, কান্ত খত্ লিখেছে

তা এখন কী করবি?

 এসবই উমিচাঁদ সাহেবের ফাঁদ নানিজি! আমি ঠিক বলছি এ উমিচাঁদ সাহেবের ফাঁদ। আমি হালসিবাগানে যাব নানিজি! আমি এক্ষুনি যাব

নানিবেগমসাহেবা আলিবর্দি খাঁর সঙ্গে অনেক লড়াই দেখেছে। ঘোড়ায় চড়েছে, উটে চড়েছে, হাতিতে চড়েছে। কতবার নানিবেগমের কানের পাশ দিয়ে কামানের গোলাও চলে গেছে। কতবার জানে মারা যেতে যেতে বেঁচে গেছে। যুদ্ধ কাকে বলে তা নানিজির জানা আছে।

বললে–পাগল নাকি তুই? এই লড়াইয়ের মধ্যে যাবি কী করে?

না নানিজি, তুমি বন্দোবস্ত করে দাও, আমি যাব।

সেখানে কি তুই যেতে পারবি?মুখেই বলছিস, সেখানে গেলে ভয়ে মরে যাবি। আমি কত লড়াইতে গেছি তোর নানাজির সঙ্গে। আমি জানি যে!

তা সব জেনেও আমি কি করে চুপ করে থাকব, বলো! একটা লোককে সবাই মিলে খুন করে ফেলবে আর আমরা এখানে চুপ করে বসে বসে তাই শুনব? আমাদের কি হাত-পা নেই! ওরা যে বদমাইশ লোক নানিজি, ওরা যে শয়তান! আমরাও কি ওদের মতন শয়তানি করতে জানি না?

তা তুই কি সেখানে গিয়ে লড়াই করবি নাকি ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে?

হ্যাঁ নানিজি, আমি লড়াই-ই করব!

নানিজি বললে–তা হলে তুই মরগে যা, আমি যেতে পারব না—

না নানিজি, তুমি চলে!

আমি কিছুতেই যাব না।

মরালী বললে–কিন্তু তুমি না গেলে আমি যাব কী করে নানিজি? আমি একলা কী করে যাব? তোমার তো লড়াইয়ের মধ্যে যাওয়া অভ্যেস আছে–

তা হোক, আমি যেতে পারব না।

তা হলে আমি একলা যাই?

যা, তোর যা খুশি তাই করগে যা!

মরালী বললে–তা হলে সেখানে গিয়ে মরে গেলে তুমি কিন্তু কাঁদতে পারবে না।

নানিজি বললে–আমার কাঁদতে বয়ে গেছে, আমার নিজের তিন-তিনটে মেয়ে বিধবা হল তাই-ই আমি বলে কাঁদলুম না

তা হলে বেশ, আমি যাই! আমি কিন্তু বলে রাখছি আর ফিরব না। আর আমার মুখ দেখতে পাবে না তোমরা।

নানিজি চলে যেতে যেতেও ফিরে দাঁড়িয়ে বললে–সেই জন্যেই তো বলছি তুই যাসনে।

না নানিজি, আমি যাবই। তুমি যাও আর না-যাও, আমি যাবই যাব!

বলে মরালী সোজা নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল। নানিজি আর পারলে না। বললে–এই মেয়ে, শোন শোন

মরালী তবু শুনল না। যেমন নিজের মহলের দিকে যাচ্ছিল তেমনি চলতে লাগল। নানিজি তার পেছনে আসতে লাগল। তারপর একেবারে নিজের ঘরের মধ্যে এসে মরালী দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে।

বাইরে থেকে নানিজি বলতে লাগল–ওরে দরজা খোল, আমার কথা শোন—

ভেতর থেকে মরালী বললে–আগে কথা দাও তুমি যাবে আমার সঙ্গে।

যাব রে যাব, তুই আগে দরজা খুলবি তো!

সত্যি যাবে?

হ্যাঁ যাব। কিন্তু কে তোর অভিমানের দাম দেবে বল তো! কে তোকে দেখবে? কার ভরসায় এত আবদার করিস মেয়ে বল তো তুই, আমি কি চিরকাল বাঁচব? আমি মরে গেলে কে তোর মান–

মরালী দরজা খুলে দিলে। নানিবেগম ভেতরে ঢুকে বললে–কী অভিমান শুনি?

 বলে মরালীকে ধরতেই মরালী নানিবেগমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বললে–আমার যে কেউ নেই নানিজি, আমার যে কেউ নেই। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বলল যে, তার কাছে গিয়ে আমি বায়না করব, আবদার করব! আমার মাও নেই, বাপও নেই, ভাইও নেই, সোয়ামিও নেই। তুমি ছাড়া কে আমার দুঃখ বুঝবে বলো? আমি সাধ করে কি কলকাতায় যেতে চাইছি নানিজি! তোমার মির্জাকে যে ওরা মেরে ফেলবে, যেমন করে ওই মেহেদি নেসার, ইয়ারজান, সফিউল্লা আমার সর্বনাশ করেছে, তেমনি করে তোমার মির্জারও যে সর্বনাশ করবে ওরা!

তা মৃত্যুই যদি ওর কপালে থাকে তো তুই কি বাঁচাতে পারবি ওকে?

মরালী বললে–নবাব মরলে যে সবাই মরবে নানিজি! নবাব মারা গেলে যে সব ছারখার হয়ে যাবে! উমিচাঁদ, মিরজাফর সবাই যে ওই ফিরিঙ্গিটার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এবার যে তোমার চেহেলসতুও চলে যাবে। নবাব মারা গেলে তুমি কেমন করে বাঁচবে তা একবার ভাবছ না?

বাঁদিটা ঘরের দিকে আসছিল। নানিবেগম তাকে দেখতে পেয়ে বললে–পিরালিকে একবার ডেকে দে তো আমার কাছে।

বলে মরালীকে বললে–যাওয়া তো অত সোজা নয় রে মেয়ে, গেলে তার আগে ডিহিদারকে খবর দিতে হবে, সে বজরা তৈরি করে রাখবে, খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে, থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে, বেগমরা তো আর বাইরে বেরোলেই হল না, বাঁদিদের সঙ্গে নিতে হবে, খোজারা যাবে।

না নানিজি, কাউকেই সঙ্গে নিতে পারবে না। কেউ যেন জানতে না পারে বেগমরা যাচ্ছে। সাজগোজও করব না, যেমন করে গাঁয়ের বউ-ঝিরা বাপের বাড়ি যায়, শ্বশুরবাড়ি যায়, তেমনি করে যাব

তা সঙ্গে একটা বাঁদিও নিবি না?

না! জানি তোমার একটু কষ্ট হবে নানিজি। কিন্তু তোমার মির্জার ভালর জন্যে একটু কষ্টও করতে পারবে না তুমি? না-হয় নিজে একটু কষ্টই করলে, তাতে তোমার কী এমন ক্ষতি হবে? তুমি জানো না নানিজি, ওদিকে বোধহয় যা-হবার তা এতক্ষণে হয়ে গেছে। ফিরিঙ্গিরা তোমার মির্জার ছাউনির ওপর কামানের গোলা ছুঁড়েছে

পিরালি আসতেই নানিজি বললে–শান পিরালি, আমাদের তাঞ্জামের ইন্তেজাম করে দে, আমরা বেরোব

কতদূর যাবেন বেগমসাহেবা?

সে তোকে জানতে হবে না। নিজামতকাছারিতে খবর দিতে হবে ত্রিবেণীর ডিহিদারকে যেন এক্ষুনি এত্তেলা ভেজিয়ে দেয়, আমি যাব। খবরটা না-মালুম থাকবে, কেউ যেন না না পায়, কেউ যেন নিশানা না পায় দেখিস আমি আর মরিয়ম বেগমসাহেবা যাব, শুধু আমরা দু’জন

বাঁদি? খোজা?

নেহি, কোই নেহি যা, দেরি করিসনে, জলদি করতে বলবি, গড়বড় যেন না হয় দেখিস। যা—

পিরালি খাঁ কুনিশ করে চলে গেল।

নানিবেগম বললে–তা হলে তুই তৈরি হয়ে নে মেয়ে আমিও তৈরি হয়ে নিই–

মরালী নানিবেগমকে আনন্দে জড়িয়ে ধরল একেবারে। বললে–তুমি কত ভাল নানিজি! তুমি কত ভাল–সত্যি নানিজি, তুমি কত ভাল

নানিজি বিরক্ত হয়ে উঠল–তুই ছাড় বাপু, তোকে আর অত আদর করতে হবে না–তোর কী? আমার এখন কত ভাবনা বল তো, তুই তো শুধু আমার সঙ্গে গিয়েই খালাস, আমার কত দায়িত্ব বল দিকিনি

মরালী নানিবেগমকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরলে। বললে–বা রে, তুমি তা হলে নানিজি হয়েছিলে কেন? নানিজি হলে তো নাতনির ধকল নিতেই হবে।

*

১৭৫৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। বাগবাজারের বাগানবাড়ির ভেতরে তখন ইন্ডিয়ার ম্যাপটিকে নতুন করে নতুন রং দিয়ে আঁকবার তোড়জোড় করছিল কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ। যে-মানুষ ঘরেরও নয়, বাইরেরও নয়, যে-মানুষটার কাছে সমস্ত পৃথিবীটাই তার নিজের দেশ, যে-মানুষ পরের দেশের মানুষকেই আত্মীয় মনে করে নিজের ঘরে আশ্রয় দেয়, সে-মানুষ যখন পৃথিবীর মানচিত্র বদলাবে বলে মনস্থ করে, তখন তাকে ঠেকানো বড় শক্ত। তার কাছে সোলজার না থাকুক, তার কাছে কামানবন্দুক না থাকুক, সে তার উদগ্র ইচ্ছার অসামান্য সম্বল দিয়ে যে অসাধ্য সাধন করতে পারে, তাতে কে সন্দেহ করবে!

যখন খবরটা পেল যে পোয়েট এসেছে, তখন তার সময়ই ছিল না কথা বলবার মতো। তবু কেন কে জানে, পোয়েটকে ভেতরে ডাকতে বললে।

ছোটমশাই উদ্ধব দাসের পেছন পেছন যাচ্ছিল।

 কী পোয়েট, তোমার খবর কী?

তারপর পেছনে আর একজন জেন্টলম্যানকে দেখে একটু অবাক হয়ে গেল। কিন্তু ছোটমশাই তার আগেই নিজের পরিচয় দিয়ে দিলে।

আমি এসেছিলুম আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে।

হু আর ইউ?–এ কে পোয়েট?

আজ্ঞে, ইনি হলেন বাবুমশাই, ভারী সজ্জন ব্যক্তি! হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

কোথা থেকে আসছেন আপনি?

আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে আসছি..

কী কাজ?

আপনাকে একটু আড়ালে সে সম্বন্ধে কথা বলতে চাই!

কর্নেল ক্লাইভ ছোটমশাইয়ের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলে। যখন নবাবের সঙ্গে চরম একটা বিরোধ চলছে, ঠিক তখন এ-লোকটা কেন দেখা করতে এল?

ক্লাইভ বললে–পোয়েটের সামনে আপনার বলতে আপত্তি কী! পোয়েট তো এসব পলিটিকসের মধ্যে থাকে না।

উদ্ধব দাস বললে–ঠিক বলেছেন সাহেব, আমি শুধু হরির কথা নিয়ে আছি, এই যে আমার বউ অপরের কাছে আছে, আমি কি তার কথা ভাবছি? আমার যে বউ আমার সঙ্গে কথাই বললে–না, আমি কি সে কথাই ভাবছি?

ক্লাইভ বললে–তোমার খুব মনের জোর আছে পোয়েট, তোমার মতো যদি মনের জোর পেতাম

পাবেন সাহেব, পাবেন, একটু চেষ্টা করলেই পাবেন!

কী করে পাব? আমার নিজের দেশের লোকরা, আমার আত্মীয়রা আমাকে হেট করে, সে-যন্ত্রণা আমি ভুলতে পারি না। তাই তো তোমাদের ইন্ডিয়াতে মরতে এসেছি।

ছোটমশাইও চমকে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন-মরতে এসেছেন? মরতে এসেছেন মানে?

ক্লাইভ সে কথার উত্তর না দিয়ে উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে বললে–এত মনের জোর তুমি কোথায়। পাও পোয়েট?

ওই যে বললুম, হরির জন্যে! হরি?

 হু ইজ হরি? হরি কে?

উদ্ধব দাস বললে–আজ্ঞে, হরি মানেই মানুষ আর মানুষ মানেই হরি—মানুষই আমার গড!

 মানুষই তোমার গড? খুব নতুন কথা বলেছ তো হে! তুমি তোমার পোইট্রিতে এই কথা লিখেছ নাকি?

লিখব হুজুর, মহাকাব্য লিখব। রায় গুণাকর যেমন অন্নদামঙ্গল কাব্য লিখেছে, আমি তেমনি একটা কাব্য লিখব আমার বউকে নিয়ে। রায় গুণাকর লিখেছে গড নিয়ে, আর আমি লিখব মানুষের মাহাত্ম্য নিয়ে।

ক্লাইভ কী যেন ভাবতে লাগল খানিকক্ষণ। অনেক ভাবনা মাথার মধ্যে গজগজ করছে। ছাউনির মধ্যে কোম্পানির আর্মির লোকরা হইচই করছে। স্ক্র্যাফটন আর ওয়ালস্ গেছে নবাবের কাছে টুসের টার্ম নিয়ে। সঙ্গে গেছে সেই নতুন মুনশি নবকৃষ্ণ। কিন্তু অত সহজে নবাবকে বশে আনা যাবে না। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা অত সহজ মানুষ নয়। ফ্রেঞ্চ জেনারেল বুশিকে তলে তলে ডেকে পাঠিয়েছে সাউথ ইন্ডিয়া থেকে। বাইরের দিকে একবার তাকালে ক্লাইভ। তাকিয়ে দেখলে কেউ আসছে কি না। শীতের রাতটা বড় অন্ধকার ঠেকল।

ছোটমশাই বললেন–আপনি বোধহয় খুব ব্যস্ত সাহেব, আপনি যদি বলেন তো না-হয় কাল সকালে আবার আসব।

রাত্তিরে কোথায় থাকবেন?

 আমার বজরা আছে ঘাটে। সেখানেই খাওয়াদাওয়া করব, সেখানেই ঘুমোব!

ক্লাইভ বললে–কিন্তু কাল সকালে কী ঘটবে তা আজ বলতে পারছি না-নবাবের ক্যাম্পে আমি আমার এজেন্টদের পাঠিয়েছি।

ছোটমশাই বললেন–আমি সেই নবাবের সম্বন্ধেই কথা বলতে এসেছি।

নবাবের বিরুদ্ধে?

হ্যাঁ।

কী কথা?

ছোটমশাই উদ্ধব দাসের দিকে একবার চাইলেন।

ক্লাইভ বললে–ওকে কোনও ভয় নেই, ও হার্মলেস পোয়েট

 ছোটমশাই বলতে লাগলেন–আপনি যদি নবাবের সঙ্গে লড়াই করেন তো আমরা সবাই আপনার পেছনে আছি। আমরা সবাই নবাবের বিরুদ্ধে

ক্লাইভ সোজাসুজি চাইলে ছোটমশাইয়ের দিকে। জিজ্ঞেস করলে কেন? আপনারা সবাই নবাবের এগেনস্টে কেন? নবাব আপনাদের কী ক্ষতি করেছে?

কী ক্ষতি করেননি তাই বলুন? আমরা সামান্য জমিদার, আমাদের খাজনা বাড়িয়েছে, আমাদের মাথটু বেড়েছে, আওয়াব বেড়েছে। আমাদের কথা আপনার বিশ্বাস না হয় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন, তার জমিদারির আয় কী আর খরচ কী! নবাব কি প্রজাদের জমিদারদের তালুকদারদের সুখ দেখেছে কখনও। আলিবর্দি খাঁ-ও দেখেনি, এই নতুন নবাবও দেখছে না। তারপর ডিহিদার, ফৌজদার, কোতোয়াল, চৌকিদারদেরও অত্যাচার কি কম বেড়েছে মনে করেছেন? সবাই মনে মনে তিতিবিরক্ত হয়ে আছে নিজামতের ওপর। আমরা মেয়ে বউ নিয়ে ঘর পর্যন্ত করতে পারিনে।

কেন?

আজ্ঞে, সুন্দরী বউ থাকলে তো আর কথাই নেই, নবাবের ঠিক নজরে পড়ে যাবে।

 সেকী?

হ্যাঁ, আমার কথা বিশ্বাস না হয় আপনি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, নাটোরের মহারানি রানিভবানীকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

 ক্লাইভ উদ্ধব দাসের দিকে চাইলে। বললে–কী গো পোয়েট, সব সত্যি?

ছোটমশাই বললেন–ও কী জানে সাহেব, আমি নিজেই তো ভুক্তভোগী, আমার নিজের বউকেই তো নবাব নিজের হারেমে নিয়ে গেছে!

ক্লাইভ অবাক হয়ে গেল–সত্যি?

হ্যাঁ সাহেব, যা বলছি সব সত্যি। আমার নিজের বউকে হারেমে নিয়ে গিয়ে কলমা পড়িয়ে তাকে মুসলমান করে দিয়েছে, নাম রেখেছে মরিয়ম বেগম,–সেই জন্যেই তো আপনার কাছে ছুটে এসেছি প্রতিকারের জন্যে।

তুমি কিছু জানো পোয়েট?

উদ্ধব দাস বললে–আমি কী জানব হুজুর, আমার নিজের বউয়েরই খোঁজখবর রাখতে পারিনে, আমি রাখব পরের বউয়ের খবর?

ক্লাইভ বললে–তা তোমার বউ তোমার কাছে যাবে না তার আমি কী করব? তুমি আর একটু আগে এলে না কেন?

আমি কি আর আমার বউয়ের জন্যে এসেছি হুজুর, এদিকে এসেছিলাম, তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। বউ আমার কেমন আছে হুজুর?

ক্লাইভ বললে–তোমার বউ তো আমার এখেনে নেই।

নেই?

না, একটু আগেও ছিল, ভাবলাম এখানে কামানের গোলাটোলা পড়তে পারে তাই তাদের পাঠিয়ে দিলাম বাইরে। সঙ্গে লোক দিয়েছি, কোনও ভাবনা নেই তোমার। একটু আগে এলেই দেখা করিয়ে দিতাম তোমার সঙ্গে…।

হঠাৎ দৌড়োতে দৌড়োতে ঘরে ঢুকেছে স্ক্র্যাফটন, ওয়ালস্ আর নবকৃষ্ণ। ক্লাইভ তাদের দেখেই অবাক হয়ে গেছে। এত রাত্রে তো ফিরে আসার কথা নয়। কী হল?নবাব এগ্রি করেছে আমার টার্মসে?

ওয়ালস তখন হাঁফাচ্ছিল। বললে–নবাব ওয়ারের প্রিপেরেশন করছে।

সেকী?

হ্যাঁ, মিস্টার উমিচাঁদ বললে–আরও ক্যানন এসে পৌঁছোবে কাল, আমাদের ওখানে ডিটেন করে রাখতে চেয়েছিল, তাই লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে এসেছি। আমাদের মনে হয় আজ রাত্রেই নবাব অ্যাটাক করবে আমাদের।

ক্লাইভ জিজ্ঞেস করল–আর ইউ শিয়োর? ঠিক বলছ তুমি?

একমুহূর্তে যেন সেই মিষ্টি চেহারাটা কেমন লোহার মতো কঠিন হয়ে উঠল। সে-চেহারা দেখে আর চেনা গেল না ক্লাইভ সাহেবকে। এক মুহূর্তে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে। আর চোখ দুটো নিষ্ঠুর হয়ে পৃথিবীকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে।

উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে দেখলে ক্লাইভ। বললে–পোয়েট, তোমরা এখন যাও–আই মাস্ট গেট প্রিপেয়ার্ড কাল সকালে আবার এসো।

উদ্ধব দাসের যেন কোনও বিকার নেই। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল।

বললে–চলুন বাবুমশাই চলুন–আমরা যাই, কাল আবার আসব।

ছোটমশাইও অগত্যা উঠলেন। বাগানের ফটক পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। তারপর সোজা গঙ্গার ঘাটের দিকে চলতে লাগলেন। এত আশা করে এসেছিলেন। সব কথা ভাল করে বুঝিয়ে বলা হল না সাহেবকে।

অন্ধকার ঘাট। গঙ্গার জল তরতর করে বয়ে চলেছে।

উদ্ধব দাস বললে–বড় খিদে পেয়েছে বাবুমশাই।

ছোটমশাই সে কথার উত্তর দিলেন না। মনটা তার ছটফট করছিল ছোট বউরানির জন্যে। খিদে-তেষ্টা সবকিছু তার ক’দিন থেকেই উড়ে গিয়েছে।

হঠাৎ দূর থেকে একটা বিকট শব্দ হতেই তিনি চমকে উঠেছেন। কামানের শব্দ নাকি? লড়াই বাধল নাকি নবাবের সঙ্গে?

উদ্ধব দাস বললে–ওই কামানের শব্দ শুনলেন বাবুমশাই?

 সেকথায় কান না দিয়ে ছোটমশাই মাঝিদের বললেন–ওরে, বজরা ছেড়ে দে শিগগির, কাছি। খোল–লড়াই লেগে গেছে।

ত্রিবেণীর ঘাটে তখন সবে ভোর হয়েছে। ছোটমশাইয়ের বজরার ভেতরে তখন ছোটমশাই ঘুমোচ্ছিলেন। অনেক কষ্টে বাগবাজারের ক্লাইভ সাহেবের ছাউনি থেকে পালিয়ে এসেছেন। নবাবের সঙ্গে কোম্পানির যে এমন লড়াই বাধবে ভাবতেই পারেননি। পাগলা লোকটাও সঙ্গে ছিল।

বাইরে বজরার গলুইয়ের ওপর উদ্ধব দাস তখন চেঁচিয়ে গান ধরেছে

আমি রব না ভব-ভবনে
 শুন হে শিব শ্রবণে ॥
যে নারী করে নাথ
পতিবক্ষে পদাঘাত
 তুমি তারই বশীভূত
 আমি তা সব কেমনে ॥
পতিবক্ষে পদ হানি
সে হল না কলঙ্কিনী
মন্দ হল মন্দাকিনী
ভক্ত হরিদাস ভণে ॥

গানটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গলা ছেড়ে গাইছিল উদ্ধব দাস।

হঠাৎ যেন মনে হল আর একটা বজরা এসে লাগল ঘাটে। বজরার বাইরে লোকজন ছিল। ঘাটে যেন আরও অনেক লোকজন জড়ো হয়েছে। পালকি নিয়ে যেন ত্রিবেণীর ডিহিদারও হাজির রয়েছে। সবাই বেশ সন্ত্রস্ত সন্ত্রস্ত ভাব।

উদ্ধব দাস দেখলে, বজরা থেকে দু’জন মেয়ে নামল বোরখায় সমস্ত শরীর ঢেকে। পা-টা উঁচু করতেই দেখা গেল ফরসা টকটক করছে গায়ের রং। তাতে মেহেদি পাতার রং লাগিয়েছে আলতার মতো।

.

ভেতরে মুখ বাড়িয়ে ডাকলেও বাবুমশাই, বাবুমশাই গো!

ছোটমশাই ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন–আবার কী?

আজ্ঞে, বাইরে এসে দেখে যান—

কী দেখব!

কারা যেন ঘাটে এসে নামল!

সেসব দিনের কথা উদ্ধব দাসের মনে আছে। দেখতে পাগলা হলে কী হবে, উদ্ধব দাস সব বুঝত। আমাদের এই সংসারটাই তো ধোঁকার টাটি হে! সব দেখবে সব জানবে, কিছু বললেই বিপদ।

ছোটমশাইয়ের বজরাটা ত্রিবেণীর ঘাটে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সেই হাতিয়াগড় থেকে কবে বেরিয়েছিলেন ছোটমশাই। তারপরে গেছেন কেষ্টনগরে, তারপর কলকাতার বরানগরে। সেখান থেকে বাগবাজার পেরিন সাহেবের বাগানে। কিন্তু হঠাৎ এমন লড়াই বেধে যাবে কে জানত। কামানের গোলার শব্দ পেয়েই নৌকো ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই নৌকো ভাসতে ভাসতে ত্রিবেণীতে এসে কাছি বেঁধেছিল। মাঝরাত পর্যন্ত ভাল ঘুম আসেনি। পাগলটা বক করেছিল অনেকক্ষণ। অনেক ছড়া শুনিয়েছিল। তারপর ছোটমশাই বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন–তুমি এখন যাও হে আমি এখন ঘুমোব

উদ্ধব দাস তার বেগম মেরি বিশ্বাস’ কাব্যে লিখে গেছে তখনও সে জানে না যে তার সহধর্মিণীর সঙ্গেই দেখা হয়ে যাবে সেদিন। তখনও জানে না তার বউ-ই সেই ভোরবেলা নানিবেগমকে নিয়ে সেই ত্রিবেণীর ঘাটেই এসে আবার উঠবে।

নবাবি কায়দা বড় কড়া। বজরা থেকে নামবার আগেই গানটা মরালীর কানে গিয়েছিল–আমি রব না ভব-ভবনে

যে-মেয়ে বাংলাদেশের এক অখ্যাত জনপদে জন্মেছিল কোন এক অখ্যাত গ্রাম্যকবির গৃহিণী হবার জন্যে, ইতিহাসের অমোঘ প্রয়োজনে আবার সেই মেয়েকেই নবাবের চেহেসূতুনে এসে উঠতে হয়েছিল। ইতিহাসের প্রয়োজনে এমনি করেই এক-একটা জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে বারবার। মরিয়ম বেগম থেকে শুরু করে জোয়ান-অব-আর্ক পর্যন্ত এর নজিরের আর সীমাসংখ্যা নেই সংসারে। নইলে স্বামী-পুত্রকন্যা-সংসার নিয়ে মত্ত থাকলে কে আর মরিয়ম বেগমদের চিনত, কে আর জোয়ান-অব-আর্কদের জানত। কে আর তাদের নিয়ে কাব্য লিখত। ছছটমশাইকে আবার ডাকলে উদ্ধব দাস-ও বাবুমশাই, উঠুন, উকুন

কেমন যেন হাবভাব দেখে উদ্ধব দাসের সন্দেহ হয়েছিল এরা সাধারণ গৃহস্থ ঘরের বউ-ঝি নয়। সঙ্গের লোক-জন-পাইক-জমাদার সবাই যেন কোন সন্তব্যস্ত হয়ে কাজ করছে। নইলে ডিহিদারের অত ভোরে আসার দরকার কী?

ও বাবুমশাই, বাবুমশাই

ছোটমশাই সত্যিই তখন ঘুমোচ্ছিলেন। ডাকাডাকিতে আর থাকতে পারলেন না। বড় কষ্ট যাচ্ছে ক’দিন ধরে। এবার সঙ্গে কাউকে আনেনওনি। মাঝিমাল্লা যারা ছিল তারাই যা-কিছু করছে। গোকুলও নেই যে দেখবে। এমন করে একলা একলা থাকার অভ্যেস নেই তার। পাশে কেউ না থাকলে ঘুমও আসে না। তারপর যা শীত পড়েছে।

বাইরে আসতেই উদ্ধব দাস বললে–ওই দেখুন

কী দেখব?

নবাবজাদিটাদি কেউ হবে বোধহয়।

 কীসে বুঝলে?

আজ্ঞে বোরখার তলায় আমি পায়ের রং দেখছিলাম। দাঁড়ান আমি জিজ্ঞেস করে আসি বলে উদ্ধব দাস আর সেখানে দাঁড়াল না। গলুই থেকে ডাঙায় ঝাঁপিয়ে পড়ল।

হোমশাই বললেন–কী দেখতে যাচ্ছ ওদিকে?

উদ্ধব দাস বললে–আপনি তখন বলছিলেন না যে আপনার বউ নবাবের হারেমে আছে? আমি জিজ্ঞেস করে আসছি ওদের, আপনার বউয়ের খবর জানে কিনা–আপনার বউয়ের কী নাম বলছেন?

তা ওদের জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছ কেন? তোমাকে ওসব জিজ্ঞেস করতে হবে না।

 তা আপনার বউয়ের কী নাম রেখেছে ওরা সেইটেই বলুন না! মরিয়ম বেগম না কী যেন?

না না, খবরদার ওসব কথা জিজ্ঞেস করতে যেয়ো না।

কিন্তু উদ্ধব দাসের বারণ শোনার মতো অবস্থায় তখন। সে তখন হনহন করে গঙ্গার পাড় ভেঙে ওপরে উঠছে।

ওপরে বিরাট একটা অশ্বত্থ গাছ। ঝাঁকড়া মাথায় সারা জায়গাটা আরও অন্ধকার করে রেখেছে। সেপাইলশকররা একটা পালকিকে ঘিরে রয়েছে চারদিকে। উদ্ধব দাস সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। বোরখা-পরা মেয়েমানুষ দুটো পালকির ভেতরে উঠতে যাচ্ছে।

একজন সেপাইকে গিয়ে উদ্ধব দাস জিজ্ঞেস করলে–এঁরা কারা গো?

সেপাইটা কথাটায় তত কান দেয়নি প্রথমে। উদ্ধব দাস আবার জিজ্ঞেস করলে–এঁরা কে গো। সেপাইবাবাজি?

তবু কেউ কান দিলে না সেকথায়। ডিহিদার নিজে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে। পালকিতে উঠলেই সেটা চলতে শুরু করবে। ত্রিবেণীর ডিহিদারের ওপর হুকুম আছে বেগমদের হালসিবাগান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে তবে তার ছুটি।

উদ্ধব দাস আবার চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলেও কোন বেগম গো?

একজন সেপাই বললে–ও নানিবেগমসাহেবা আর…

হঠাৎ হইহই পড়ে গেছে। একজন সেপাই ধরে ফেলেছে উদ্ধব দাসকে। ধরে একেবারে মারে আর কী!

উদ্ধব দাসও তখন চেঁচাচ্ছে–তোমরা বলো আগে ও মরিয়ম বেগম কিনা

–ভাগো ইহাসে–ভাগো–

উনি যে বাবুমশাইয়ের বউ গো তোমরা বাবুমশাইয়ের বউকে চেহেল্-সুতুনে চুরি করে ধরে রেখেছ।

ছোটমশাই বজরার ওপর থেকে বেশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন কথাগুলো। এ-পাগলটার কি ভয়-ডর নেই। এইবার বোধহয় পাগলাটাকে ধরবে ওরা। ধরে নিয়ে যাবে। চারদিকে বড় কুয়াশা। ভাল করে দেখা যায় না, শুধু কথাগুলো শোনা যায়। ওরা যত চেঁচায়, এও তত চেঁচায়।

এতক্ষণে ডিহিদারের কানে গেছে কথাটা। ক্যা হুয়া?

উদ্ধব দাস হাত জোড় করে ডিহিদারকে বললে–হুজুর, ধর্মাবতার, আমাদের বাবুমশাইয়ের বউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এরা।

বাবুমশাইয়ের বউ? কোন বাবুমশাই? তুমি কে?

আজ্ঞে, আমি হরির দাস উদ্ধব দাস। আমাকে সেপাইবাবাজি বললে, মরিয়ম বেগমসাহেবা যাচ্ছে, তাই আমি বললাম উনি তো বাবুমশাইয়ের বউ, তোমরা ওঁকে মরিয়ম বেগমসাহেবা নাম দিয়েছ ওঁকে ছেড়ে দাও।

সেই ভোরবেলা ত্রিবেণীর ঘাটে সেদিন সে এক কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। ঘাটের অন্য দিকে যেসব নৌকো বাঁধা ছিল হল্লা চিৎকার শুনে মাঝিমাল্লারা তখন জেগে উঠেছে। হল্লা শুনে তারাও ঘাটের ওপর গিয়ে হাজির হয়েছে। সেই ঝাপসা অন্ধকারের মধ্যে ভিড় জমে গেল চারদিকে।

হুজুর, আমি কী অপরাধ করলাম? আমি তো কারও গায়ে হাত তুলিনি?

ডিহিদার বোধহয় বেশি কথা শোনবার লোক নয়। হুকুম দিলে বাঁধে একে—

তা বাঁধো বাবাজি, কেউ আমাকে বাঁধতে পারেনি, দেখো, তোমরা যদি পারো

তোকে বাঁধতে পারিনে ভেবেছিস?

উদ্ধব দাস বললে–হুজুর, কেউ কি কাউকে বাঁধতে পারে? ভালবাসাই তো একমাত্র বন্ধন হুজুর, সে কি আপনাদের আছে? তা হলে একটা ছড়া শুনবেন হুজুর? আমি ভালবাসা নিয়েই একটা ছড়া লিখেছি–শুনুন–

আশার অধিক দেয় যদি তাকে বলে দান।
পণ্ডিত যারে মান্য করে তাকেই বলে মান ॥
দরিদ্র দুর্বলে দয়া তাকেই বলে পুণ্য।
স্বনামে যে বিক্রিত হয় তাকেই বলি ধন্য ।
দেবতায় করে বশীভূত তাকেই বলি সাধ্য।
বাহুবলে করে যুদ্ধ তাকেই বলি বীর।
আখের ভেবে কর্ম করে তাকেই বলি ধীর ॥
ইশারায় কর্ম করে তাকেই বলি বশ।
মফসসলে ব্যাখ্যা করে তাকেই বলি যশ ॥
দশের কাছে দুষ্য হয় না তাকেই বলি ভাষা।
অন্তরেতে ভালবাসে তাহাই ভালবাসা ॥

উদ্ধব দাস আরও বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ডিহিদার মশাইয়ের বোধহয় একটু রসবোধের অভাব ছিল। বললে–থাম থাম পাগলা।

তারপরে সেপাইদের একজনকে কী ইঙ্গিত করতেই সে উদ্ধব দাসের কাছে এসে তার গলাটা ধরলে। ধরে বললে–চল

সামান্য শান্তিতে বোধহয় ডিহিদার খুশি হল না। বললে–হাত দুটো বাঁধ আগে ওর

উদ্ধব দাসও হাত দুটো বাড়িয়ে দিলে। বললে–এই নাও বাবাজি, বাঁধো

কিন্তু সেপাইরা অত সহজ মানুষ নয়। তারা যাকে বাঁধে তাকে মরণবাঁধন দিয়েই বাঁধে। পালকির ভেতরে তখন বেগমসাহেবারা তৈরি। পালকিও যাবে, সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধব দাসকেও বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে।

দূর থেকে ছোটমশাই সব দেখছিলেন। পাগলটার যেন কোনও ভয় ভীতি নেই। সেপাইদের সঙ্গে সমানে ছড়া কেটে চলেছে। কুয়াশাও তখন বেশ কেটে এসেছে চারদিকে। অল্প অল্প আলো ফুটে বেরোচ্ছে।

হঠাৎ এক কাণ্ড ঘটল ওদিকে।

অত লোকজন, অত সেপাই ডিহিদার মাঝিমাল্লা, সবাই থমকে গেছে কাণ্ড দেখে। পালকির ভেতর থেকে বেগমসাহেবা ছুটে বেরিয়ে এসেছে দিনের আলোয়। এমন ঘটনা স্বাভাবিক নয়, সহজও নয়।

ছেড়ে দাও, ওকে ছেড়ে দাও

সারা শরীর বোরখায় ঢাকা। মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবু কথা বুঝতে কারও অসুবিধা হল না। যে-সেপাই উদ্ধব দাসের হাত বাঁধছিল সে হতভম্ব হয়ে রইল। এতক্ষণে যেন ডিহিদার সাহেবের হুঁশ হল।

ছাড়ো

উদ্ধব দাস কিন্তু অবাক হয়নি। সেই অবস্থাতেই ছড়া কেটে উঠল–অন্তরেতে ভালবাসে তাহাই ভালবাসা

ডিহিদার কোনও উপায় না পেয়ে সেপাইকে উদ্ধব দাসের হাত ছেড়ে দিতে বললে।

ধমকে উঠল মরালী–কেন ওকে ধরলে তোমরা? কী করেছে ও?

উদ্ধব দাস বললে–আমি কিছুই অপরাধ করিনি মাঠাকরুন, এরা শুধু শুধু আমাকে বাঁধছে—

ডিহিদার বললে–না বেগমসাহেবা, এ-লোকটা আমার সেপাইকে জিজ্ঞেস করছিল বেগমসাহেবারা কোথায় যাচ্ছে, বেগামসাহেবার নামালিয়ম বেগম কিনা, এইসব

না মাঠাকরুন, আমি তা জিজ্ঞেস করিনি, বাবুমশাই আমার সঙ্গে বজরাতে রয়েছেন, তাঁর বউকে নবাবের লোকরা পরোয়ানা দিয়ে চেহেল্‌-সুতুনে নিয়ে গিয়ে মরিয়ম বেগম নাম দিয়ে দিয়েছে–

কোথায় বাবুমশাই?

আজ্ঞে হুই যে মাঠাকরুন, হুই যে বজরার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সুন্দরপানা চেহারা–আপনি তো ওঁরই বউ মাঠাকরুন! আপনার জন্যে উনি কেঁদে কেঁদে মরছেন।

ডিহিদার আর থাকতে পারলে না। বললে–চোপরাও–

বোরখার আড়াল থেকে ধমকানি এল–আপনি থামুন, আপনিনবাবের নৌকর, আমি বেগমসাহেবা কথা বলছি এর সঙ্গে, আপনি কোন এক্তিয়ারে বাধা দিচ্ছেন?

ডিহিদার চুপ করে গেল।

উদ্ধব দাস বললে–কেন মিথ্যে মিথ্যে চেঁচামেচি করছেন ডিহিদারসাহেব, আমি তো হরির দাস উদ্ধব দাস, আমি তো প্রভুর কোনও ক্ষতি করিনি–বেগমসাহেবাদেরও কোনও বেইজ্জত করিনি

তারপর একটু থেমে বললে–তা ছাড়া আমার নিজেরই তো বউ পালিয়ে গেছে প্রভু

তোমার বউ পালিয়ে গেছে নাকি?

পাশ থেকে কে একজন ফুট কাটলে।

আজ্ঞে হ্যাঁ প্রভু, আমার নিজের বউ, আমার নিজের বিয়ে করা বউ প্রভু, বিয়ের রাতে বাসরঘর থেকে পালিয়ে গেছে

তা বউ পালিয়ে গেছে আর তুমি ফ্যা ফ্যা করে হাসছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ, হাসি আর গান গাই। সেই বউ নিয়ে তো ছড়া বেঁধেছি, আমি রব না ভব-ভবনে! গানটা গাইব মাঠাকরুন?

মরালী বললে–না

আজ্ঞে মাঠাকরুন, গাই না! দেখবেন কেমন সোন্দর সুর, যে শোনে সেই বলে বাহা–সব্বাই গানটা শুনে বাহবা দেয়

তা দিক, আমার শোনবার সময় নেই। তুমি কোথায় থাকো?

ডিহিদার বুঝতে পারলে না বেগমসাহেবা কেন এত কথা বলছে পাগলাটার সঙ্গে।

উদ্ধব দাস বললে–আমার কথা আর কী শুনবেন মাঠাকরুন, আমার কথা শোনবার মতো নয়–আমি ভিখিরি, দেবাদিদেব শিবও যেমন আমিও তেমনি দু’জনেই ভিক্ষে করে বেড়াই, দু’জনেরই সংসার থেকেও সংসার নাই

তারপর মরালীর দিকে চেয়ে বললে–বাবুমশাইকে তাই তো বলছিলুম মাঠাকরুন, আপনার বউ চলে গেছে ভালই হয়েছে বাবুমশাই, আমার মতন ভিখিরি সেজে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ুন, দেখবেন আর কোনও দুঃখু থাকবে না

ডিহিদার সেপাইরা অনেকক্ষণ সহ্য করেছে। আর দেরি সহ্য হচ্ছিল না কারও। কিন্তু নবাবের বেগমসাহেবা নিজে কথা বলছে, তাতে বাধা দেয়ই বা কী করে? ওদিকে অনেকখানি সকাল হয়ে গেছে। হুকুম ছিল ত্রিবেণীতে বজরা থেকে নামবার সঙ্গে সঙ্গে শিবিকা তৈরি থাকবে, সেই শিবিকা বেগমসাহেবাদের নিয়ে সোজা গন্তব্যস্থানের দিকে যাবে। নবাবগঞ্জেও খবর দেওয়া হয়ে গেছে। সেখানেও ডিহিদার আছে। সেই নবাবগঞ্জের ডিহিদার আবার শিবিকা পৌঁছে দেবে হালসিবাগানে।

ডিহিদার সাহেব আবার সামনে এসে কুর্নিশ করে দাঁড়াল।

বেগমসাহেবা, তাঞ্জাম নবাবগঞ্জে পৌঁছুতে তাওয়াকুফ হয়ে যাবে

মরালী ডিহিদারের দিকে ফিরে ধমকে উঠল–থামুন আপনি, বেগমসাহেবার সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় তার কায়দা জানেন না

নানিবেগমসাহেবা অনেকক্ষণ ধরে তাঞ্জামের ভেতরে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু আর পারলে না। তাঞ্জাম থেকে বেরিয়ে সোজা মরিয়ম বেগমসাহেবার কাছে এল। মেয়ে কার সঙ্গে কথা বলছে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে!

মরালী বললে–যাচ্ছি নানিজি, চলো, বলে নানিজির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল।

হঠাৎ পাগলা উদ্ধব দাস একটা কাণ্ড করে বসল। বললে–মাঠাকরুন কি চলে যাচ্ছেন?

কী রে মেয়ে, কার সঙ্গে কথা বলছিস? দেরি হয়ে যাচ্ছে যে!

এই উল্লুক! বলে ওদিক থেকে ধমকে উঠল একজন সান্ত্রি!

কিন্তু আশ্চর্য! উদ্ধব দাস সেকথায় কানই দিলে না। গালাগালি দিয়ে উদ্ধব দাসকে রাগানো যায় না। উদ্ধব দাসের কাছে গালাগালিও যা, স্তুতিও তাই।

বললে–আমার যে একটা কথা ছিল মাঠাকরুন

মরালী ফিরে দাঁড়াল–আমার সঙ্গে?

হা মাঠাকরুন।

বলো! বলে মরালী উদ্ধব দাসের কাছে এসে দাঁড়াল।

 উদ্ধব দাস বললে–সকলের সামনে তো বলা যাবে না, আপনাকে একটু অন্তরালে বলব—

নানিবেগমসাহেবা পেছন থেকে বললে–ও মেয়ে, আবার কার সঙ্গে কথা বলছিস? কে ও?

 মরালী বললে–দাঁড়াও নানিজি, আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি

ওর সঙ্গে তোর এত কী কথা? তোর সকলের সঙ্গে কী এত কথা থাকে রে?

মরালী বললে–শুনিই না নানিজি, কী বলতে চায় ও?

 বলে উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে বললে–এসো।

ঘাটের ওপর যেখানটায় অশ্বত্থ গাছটা ছিল সেখান থেকে একটু এগিয়েই একটা মন্দির। মন্দিরের ওপাশে একটু ঝোঁপঝাড়ের মতন। বজরার গলুইয়ের ওপর থেকে ছোটমশাই এতক্ষণ সব কাণ্ড দেখছিলেন। চারদিকে বেশ ফরসা হয়ে এসেছে। সবাই চুপচাপ উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে আছে। পাগলাটার সাহস দেখে সবাই তাজ্জব হয়ে গেছে। এত সেপাই-সান্ত্রি, ডিহিদার সাহেব নিজে দাঁড়িয়ে, আর পাগলা লোকটা কিনা বেগমসাহেবার সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে ফেললে!

ছোটমশাই গলুইয়ের ওপাশে সরে গিয়ে দেখতে লাগলেন। যতটা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর দেখা গেল না। পাগলাটা বোরখা-পরা বেগমসাহেবার সঙ্গে মন্দিরের আড়ালে চলে গেল। সত্যিই কি ছোট বউরানি নাকি! পাগলাটা তো ঠিক ধরেছে? পাগলা হলে কী হবে, লোকটার তো চোখ আছে!

*

গোবিন্দ মিত্তিরের বাগানবাড়িতে তখন নবাবের ছাউনি পড়েছিল। কান্ত শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে চিঠি লিখছিল–তোমাকে একদিন চিঠি লিখতে পারিনি মরালী। একদিন যে কী রকম করে কেটেছে তা ভগবানই জানেন। তুমি আমাকে যে ভার দিয়েছ তা বর্ণে বর্ণে পালন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি একলা কত পারব। শেষপর্যন্ত নবাব ভীষণ বিপদে পড়েছিলেন। আমরাও সবাই বিপদে পড়েছিলুম। ফিরিঙ্গিরা যে এত ফন্দিবাজ তা আগে কেউ জানতে পারেনি। আমাদের ফৌজ নিয়ে পালাতে হয়েছিল। হালসিবাগান ছেড়ে। সে এক বিপর্যয় কাণ্ড। শেষপর্যন্ত যদি কন্নড় দেশ থেকে ফরাসি জেনারেল বুশিসাহেব এসে পড়ত তা হলে আর এমন হত না। ওদিক থেকে আহমদ শা আবদালির মথুরা লুঠ করে দিল্লি চড়াও হবার খবর কানে আসাতে নবাব কেমন হয়ে গেছেন। কদিন ধরেই দেখছিলাম নবাব খুব মনমরা। আমি কী করব। ওদিকে জগৎশেঠজির দেওয়ান রণজিৎ রায় মশাই এসে পরামর্শ দিলেন ফিরিঙ্গি কোম্পানির সঙ্গে মিটমাট করে নিতে।

বাইরে থেকে কে যেন ডাকলেও কান্ত, কান্ত!

শীতের দিনে অত ভোরে আবার কে ডাকে? তাড়াতাড়ি চিঠিটা বিছানার তলায় লুকিয়ে রেখে বাইরে এল কান্ত।–কে?

আমি শশী গো? কী করছিলে? চিঠি লিখছিলে নাকি?

 কান্ত বললে–তুমি এত সকালে? কী খবর?

 ভাই, খবর তো আমার কাছে নয়, তোমার কাছেই। খবর নিতেই তো এসেছি।

কান্ত বললে–আমার কাছে আর কোনও নতুন খবর নেই

শশী বললে–রণজিৎ রায় লোকটা ভাল নয় তো ভাই

কেন?

শশী বললে–বেশ তো লড়াই চলছিল, ও বেটা আবার কী করতে এল? যুক্ষুটুঙ্কু সব থামিয়ে দেবে নাকি?

কান্ত চেপে গেল। বললে–তা জানি না

তা হলে ওদের ক্লাইভ আর ওয়াটসন সাহেব দু’জনে নবাবের সঙ্গে দেখা করতে এল কেন? মিটমাটের কথা বলতে বুঝি?

কান্তর এমনিতেই বিরক্তি লাগছিল। তাড়াতাড়ি চিঠিটা শেষ করে ফেলা যেত। কিন্তু তা হবার নয়।

শশী চলেই যাচ্ছিল। হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে বললে–একটা কথা তোমাকেকদিন ধরে ভাই জিজ্ঞেস করব করব ভাবছি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে নাকি?

কান্ত অবাক হয়ে গেল শশীর কৌতূহল দেখে।

বললে–কেন? ও-কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?

না, দেখি কিনা, তুমি রোজ রাত জেগে চিঠি লেখো। এত চিঠি বউ না থাকলে আরকাকে লিখবে।

কান্ত বললে–কেন, বিয়ে না করলে আর কারও খবর নিতে নেই? মানুষের কি বউ ছাড়া আর কেউ থাকতে নেই? বাপ-মা-ভাই-বোনও তো থাকে মানুষের।

শশী বললে–কিন্তু তুমি তো নিজেই বলছ তোমার সংসারে কেউ নেই।

 কান্ত বললে–তা তো বলেছি, কিন্তু পরও তো সময়ে সময়ে নিজের মানুষের চেয়ে আপন হয়

শশী বললে–সে তো হল মনের মানুষ! তোমার আবার তেমন মনের মানুষ কেউ আছে নাকি?

না ভাই, আমি লিখি সারাফত আলি সাহেবকে?

সারাফত আলি? সে আবার কে?

সে মুর্শিদাবাদের চকবাজারে একজন খুশবু তেলওয়ালা!

কিন্তু সে তো মুসলমান!

তা মুসলমান কি মনের মানুষ হয় না? তুমি তো হাসালে দেখছি

শশীর যেন ভুল ভাঙল। বললে–না, আমি ভেবেছিলুম তোমার বউ আছে, সেই বউয়ের কথা ভেবে ভেবে রাত জেগে তাকে চিঠি লেখো–

বাইরে তখন বেশ আলো হয়েছে। এখনই সব ফৌজের সেপাইরা কুচকাওয়াজ করতে বেরোবে। দাঁতন নিয়ে সবাই মুখ ধুতে যাচ্ছে। তৈরি হয়ে নিতে হবে তাড়াতাড়ি। শশীর আর সময় ছিল না। শশী চলে যেতেই কান্ত চিঠিটা বার করে আবার লিখতে বসল।

*

এদিকে ত্রিবেণীর ঘাটের ওপর শিবের মন্দিরটার আড়ালে যেতেই মরালী উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে বললে–কী বলবে, বলো।

উদ্ধব দাস বললে–আমার শুধু একটি জিজ্ঞাসা মাঠাকরুন, আমি শুধু আপনার আসল নামটি জিজ্ঞেস করব আপনার নামই কি মরিয়ম বেগম?

মরালী বললো হ্যাঁ

তা হলে আপনিই তো বাবুমশাইয়ের বউ?

মরালী বললেন– না

কেমন যেন সন্দেহ হল উদ্ধব দাসের। বললে–আপনি মাঠাকরুন মিছেই নারাজ হচ্ছেন, আপনি ভাবছেন আপনি মুসলমান হয়ে গেছে বলে বাবুমশাই আপনাকে গ্রহণ করবেন না। কিন্তু তিনি আপনার জন্যে পাগল মাঠাকরুন।

মরালী বললে–কিন্তু বাবুমশাইয়ের জন্য তোমার এত টান কেন? তুমি কী করো?

আমি? আমি কিছুই করিনে মাঠাকরুন। আমি ছড়া বানাই আর হরির নাম করি–আমি ভক্ত দাস আমার নাম উদ্ধব দাস, আজ্ঞে।

তোমার সংসার নেই।

 উদ্ধব দাস বললে–সংসার করা আমার হল না মাঠাকরুন! আমার কথা ছেড়ে দেন—

তোমার বউ ছেলেমেয়ে?

 বউই নেই তার ছেলেমেয়ে!

তুমি বিয়ে করোনি?

করেছিলুম মাঠাকরুন! কিন্তু বিয়ের রাতেই আমার বউ পালিয়ে গেল—

তারপর?

 তারপর আর কী মাঠাকরুন। তারপরে আর কিছু নেই।

মরালী জিজ্ঞেস করলে কেন, তোমার বউ পালিয়ে গেল কেন?

আজ্ঞে মাঠাকরুন, পালিয়ে তো যাবেই, আমার মতো বাউন্ডুলে বরের সঙ্গে কে ঘর করবে তাই বলুন? আর আমি যে কুরূপ মাঠাকরুন। কে আমাকে পছন্দ করবে! আমি তাই একটা ছড়া বেঁধেছি মাঠাকরুন, শুনবেন? শুনুন

না, ছড়া থাক। তুমি আর একটা কথার উত্তর দাও।

কী, আজ্ঞে করুন–

তোমার বাবুমশাই কি হাতিয়াগড়ে থাকেন?

তা তো জিজ্ঞেস করিনি মাঠাকরুন, আমার নিজের বিয়ে হয়েছিল হাতিয়াগড়ে–তা আমার সঙ্গে বাবুমশাইয়ের পথে দেখা। আমি গিয়েছি বরানগরে ক্লাইভ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে, এদিকে বাবুমশাইও গিয়েছেন

ক্লাইভসাহেব? ক্লাইভ সাহেবকে তুমি চেনো?

উদ্ধব বললে–তা চিনব না? ক্লাইভসাহেব যে আমাকে কবি বলে খুব খাতির করে মাঠাকরুন। আমার ছড়া শোনে, আমার গান শোনে। ক্লাইভ সাহেবের ছাউনিতেই আমার বউ ছিল যে–সাহেব বড় ভাল লোক

বোরখার ভেতরে মরিয়ম বেগম যেন উসখুস করতে লাগল।

বললে–তোমার বউ ক্লাইভ সাহেবের কাছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ মাঠাকরুন! আমি কথা বলতে গেলাম। ভাবলাম জিজ্ঞেস করব কেন আমার কাছ থেকে পালিয়ে গেল, কিন্তু আমার সঙ্গে কথাই বললে–না আমার সামনে বেরোলেই না সাহেব অনেক বললে–তবু বেরোল না

তা তোমার বউ সাহেবের কাছে এল কী করে?

তা কী করে বলব মাঠাকরুন।

সাহেবের কাছেই থাকে নাকি এখনও?

হ্যাঁ মাঠাকরুন, এখনও থাকে, তবে এবার যখন দেখা হল, বললেন, তাদের কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ হচ্ছে কিনা, তাই ছাউনির ভেতরে আর রাখতে সাহস হয়নি। আমরা যখন ফিরে আসছিলাম তখন আজ্ঞে কামানের গোলার শব্দ পেলাম–খুব কামানের লড়াই হয়ে গেল নবাবের সঙ্গে

নবাব কোথায় তা জানো তুমি?

আজ্ঞে না মাঠাকরুন! আমি ভিখিরি মানুষ, নবাব বাদশাদের খবর জেনে আমার কী লাভ? ছড়া বানিয়ে আমি নবাবিসুখ পাই।

বোরখাটা আবার নড়ে উঠল। বেগমসাহেবা বললে–আমার একটা কথা রাখবে তুমি?

আজ্ঞা করুন।

তুমি আবার একটা বিয়ে করে ফেলল।

না মাঠাকরুন। একবার বিয়ে করেই ভুল করে ফেলেছি, আর করব না। আমাকে বিয়ে করে কোনও কন্যাই সুখী হবে না ।

বেগমসাহেবা বললে–ক্লাইভ সাহেবের ঘর করছে বলে তোমার আপত্তি?

না মাঠাকরুন, আমি জাত মানিনে, আমার বউ যদি মুসলমানের ছোঁয়া অন্নও খেত তাতেও আমি আপত্তি করতাম না–

তোমার বউ মুসলমান হয়েছে নাকি? হলেও হতে পারে মাঠাকরুন। মুসলমান হওয়া কি খারাপ? আমরাও যেমন মানুষ তারাও তেমনি মানুষ তো। মানুষ মাত্তরই তো হরি মাঠাকরুন? তাঁদের মধ্যেও হরি আছেন, তাই তো আমি হরির মধ্যেই মানুষকে দেখতে পাই, আবার মানুষের মধ্যে হরিকে। আমি হরি নিয়ে একটা ছড়া বেঁধেছি, একটু শুনবেন আজ্ঞে?

না, আমি এখন হালসিবাগানে যাচ্ছি, আমার সময় নেই। যদি আমি কখনও তোমাকে ডেকে পাঠাই তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে?

কেন করব না মাঠাকরুন? আমি এমন কী একটা পির-পয়গম্বর মানুষ। অধীনকে যখনই ডাকবেন, তখনই…

হঠাৎ নানিবেগম এসে হাজির।

ওরে মেয়ে, ওদিকে যে সব্বনাশ হয়েছে রে, মির্জা লড়াইতে হেরে গিয়ে ফিরে আসছে।

 মরালী বললে–কী বলছ নানিজি?

তারপর উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে বললে–তুমি এখন যাও, পরে তোমাকে ডাকব–

উদ্ধব দাস বললে–তা তো যাচ্ছি মাঠাকরুন, কিন্তু বাবুমশাইকে গিয়ে কী বলব বনে যান? বাবুমশাই যদি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান তো আপনি দেখা করবেন তো?

কী করে দেখা করব?

 যেমন করে আমার সঙ্গে দেখা করবেন বলেছেন, তেমনি করে দেখা করবেন!

 তোমার কথা আলাদা।

উদ্ধব দাস বললে–কেন মাঠাকরুন, আমি কেন আলাদা হতে যাব? আপনার নিজের স্বামীর সঙ্গে দেখা করবেন, আপনার অনিচ্ছ কীসের? আপনার স্বামীর চেয়ে কি আমি আপন হলাম মাঠাকরুন!

মরিয়ম বেগম বললে–দেখো, আমার এখন অত কথা বলবার সময় নেই, তুমি কোথায় থাকো। বলো, আমি তোমায় খবর পাঠাব–

তবেই হয়েছে। আমার কি আর থাকার ঠিক আছে মাঠাকরুন।

নানিজি বললে–তোর কথা দেখছি আর শেষ হবে না, চল!

মন্দিরের ওপাশে তখন আরও লোকজনের আনাগোনার শব্দ হচ্ছে। কুয়াশা নেমে গিয়ে দিন হয়েছে। নবাবগঞ্জের ডিহিদার এসেছে নতুন খবর নিয়ে। হালসিবাগান থেকে নবাব ছাউনি তুলে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিল কেউ জানে না। সেখানে খবর দিতে গিয়েছিল ডিহিদার। নানিবেগমসাহেবা হালসি গানে আসছে সে-খবরটা নবাবকে না দিলে চলে কী করে! সেখানেও নবাব নেই। তারপর গিয়েছিল কলকাতার আরও দক্ষিণে। দক্ষিণে যাওয়াও অত সোজা নয়। ফিরিঙ্গিরা শহরের দক্ষিণে খাদ কেটে রেখেছিল। নবাবের ফৌজের সঙ্গে ফিরিঙ্গিদের ফৌজের খুব একচোট লড়াই লেগে গিয়েছিল সেখানে। শেষকালে দেখা পাওয়া গেল গোবিন্দ মিত্তিরের বাগানবাড়িতে। সেখান থেকে সব খবর নিয়ে সোজা ঘোড়া ছুটিয়ে ডিহিদার নিজে চলে এসেছে ত্রিবেণীতে।

বেগমসাহেবা কি এখন হালসিবাগানে যাবেন?

 দু’জনেই তাঞ্জামের ভেতর তখন উঠে এসেছে। নানিবেগম বললো হ্যাঁ চলো—

কিন্তু সেখানে গিয়ে কোনও ফয়দা নেই বেগমসাহেবা, নবাব ছাউনি তুলে নিয়ে ফিরে আসছেন

ফিরিঙ্গি কোম্পানির সঙ্গে সব ফয়সালা হয়ে গিয়েছে, ডিহিদার নিজে এসেছে খবর দিতে

নানিবেগম বললেফয়সালা হয়ে গিয়েছে? বিলকুল?

মরালী বললে–তা হোক ফয়সাল, তবু চলো নানিজি, রাস্তায় নবাবের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে

হুকুম হয়ে যেতেই ডিহিদারের দল তাঞ্জাম কাঁধে তুলে নিলে। সেপাইয়ের দল সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলতে লাগল। মাঝিমাল্লারা আবার সবাই যে-যার নৌকোয় গিয়ে উঠল।

ছোটমশাই হাঁ করে বসে ছিলেন। উদ্ধব দাস বজরায় আসতেই সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–কী কথা হচ্ছিল তোমার সঙ্গে এতক্ষণ? ও কে? জানতে পারলে নাকি কিছু?

উদ্ধব দাস বললে–উনি আপনারই সহধর্মিণী আজ্ঞে

কী করে জানলে? জিজ্ঞেস করলে নাকি? কী নাম?

মরিয়ম বেগম। প্রথমে কিছুতেই স্বীকার করতে চান না। শেষে বললাম বাবুমশাই আপনাকে আবার ফিরিয়ে নেবেন মাঠাকরুন, আপনি ফিরে চলুন–

তুমি বললে–ওই কথা?

তা বলব না? মুসলমান হলে কি একেবারে জাত চলে গেল মানুষের? মুসলমানরা কি মানুষ নয়, হিন্দুরাই মানুষ? চলুন আজ্ঞে, এবার লড়াই থেমে গেছে, আবার বাগবাজারে যাই

লড়াই থেমে গেছে! কে বললে?

ওই তো নবাবগঞ্জের ডিহিদার নিজে এসে খবর দিয়ে গেল, এখন দু’দলে ভাব হয়ে গেছে। এখন তো আর কামান ছোঁড়াছুড়ি হচ্ছে না সেখানে, ভয় কী আপনার?

ছোটমশাই বললেন কিন্তু নবাব যে তা হলে আরও বেড়ে উঠবে! একে সবাই নবাবের জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠেছি, এর পর যে হাতে মাথা কাটবে

উদ্ধব দাস বললে–আমার কোনও ভয় নাই আজ্ঞে, আমি ভিখিরি মানুষ, আমায় আবওয়াবও দিতে হয় না মাথটও দিতে হয় না–আমি হরির দাস, আমি মাথট দিই হরিকে আমার একটা ছড়া শুনবেন? শুনুন —

বলে উদ্ধব দাস ছড়া আরম্ভ করলে —

যে-বিদ্যায় ফল নাই
তাকে মিথ্যা বিদ্যা জানি।
যে ব্যবসায় লভ্য নাই,
তাকে নাহি মানি।
যে-পুষ্প নয় দেবের আধার
মিথ্যা তাকে ধরা।
যে-ভূষণে শোভা নাই
মিথ্যা তাকে পরা ॥
 যেকার্ষের যশ নাই
মিথ্যা সেই কার্য।
যে রাজ্যে বিচার নাই।
মিথ্যা সেই রাজ্য ॥
 যে-গৃহে অতিথি নাই।
মিথ্যা সেই গৃহ।
যে-দেহতে ধর্ম নাই।
 মিথ্যা সেই দেহ।
 যে-দ্রব্যে রস নাই।
মিথ্যা তাহার মান।
যে-গীতে নাই হরির নাম
মিথ্যা সেই গান ॥

ছড়া থামিয়ে উদ্ধব দাস বললে–চলুন বাবুমশাই, এখন আপনার গৃহিণীর তো সন্ধান পাওয়া গেল, এবার আমার গৃহিণীর সন্ধান পাই কিনা চলুন দেখি গিয়ে

কোথায় যাব?

কেন, আবার সেই ক্লাইভ সাহেবের ছাউনিতে। তখন তো লড়াই হচ্ছিল বলে চলে এসেছিলুম, এখন তো লড়াই থেমে গেছে, এখন আপনার আর ভয় কী? আর আপনিও ক্লাইভ সাহেবকে গিয়ে বলবেন যে আপনার সহধর্মিণীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন

ছোটমশাই আবার বাগবাজারের পেরিন সাহেবের বাগানের দিকে ফিরে চললেন।

*

বাদশাহি ফার্মান অনুসারে কোম্পানি সমস্ত বাণিজ্যাধিকার পুনঃপ্রাপ্ত হইনো কোম্পানি কলিকাতার দুর্গ সংস্কার করিতে পারিবেন৷ কলিকাতায় টাকশাল নির্মাণ করিয়া, কোম্পানির নামে মুদ্রিত টাকা প্রচলন করিবার অধিকার পাইবেন। এই মুদ্রায় কোনও বাটা দিতে হইবেনা। কোম্পানির যে সমস্ত কুঠিনবাব দখল করিয়াছেন তাহা ছাড়িয়া দিবেন। এবং বিগত আক্রমণে তাঁহাদের যে সমস্ত দ্রব্যাদি লুণ্ঠিত হইয়াছে তাহা প্রত্যর্পণ করিবেন। অথবা ন্যায়বিচারে ওই সমুদয় নষ্ট দ্রব্যের যাহা মূল্য তাহা দিবেন। ৩৯৬

বারবার সন্ধিপত্রটা পড়া হল। জগৎশেঠজির দেওয়ান নিজে খসড়াটা তৈরি করেছিল। কোথাও কোনও ফাঁক না থেকে যায়। কান্ত ক’দিন থেকেই পাশে পাশে থেকেছে। একবারও কাছ-ছাড়া হয়নি। ঘুমের মধ্যেও নবাবকে যেন কথা বলতে শুনেছে সে। পাশের ঘর থেকে উঠে এসে দেখেছে। যারা পাহারা দেয় বন্দুক নিয়ে তারাও তখন বসে বসে ঘুমের ঘোরে ঢুলছে।

কান্ত তাদের জাগিয়ে দিয়েছে। সজাগ করে দিয়ে বলেছে–ঘুমোচ্ছ কেন সেপাইজি

তারা আচমকা ঠেলা খেয়ে সামনে কান্তবাবুকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছে।

 দেখছ না বাবা, চারদিকে এত শত্ৰু, এসময় কি এমন করে ঘুমোতে আছে?

 সেপাইটা বললে–কই, কোথায় ঘুমোচ্ছি

না বাপু, ঘুমিয়োনা। তোমরাও যদি ঘুমোও তাহলে কার ভরসাতে নবাব ঘুমায় বলো তো? তোমরা মাইনে পাচ্ছ তোমাদের কাজের জন্যে, আর দেখছ তো নবাব কত ভাবনায় পড়েছে, একটা মানুষ নেই যে সৎ পরামর্শ দেয়

সত্যিই একটা লোকও ছিল না সেদিন নবাবের সঙ্গে, যে নবাবের শুভাকাঙ্ক্ষী। সবাই আসত। রাজা দুর্লভরাম, মিরজাফর, ইরাজ খাঁ, রণজিৎ রায়, মোহনলাল, উমিচাঁদ। সকলকেই বিশ্বাস করতে চাইত, সকলের ওপরেই নির্ভর করতে চাইত নবাব।

বাংলা বিহার ওড়িষ্যার নবাব সকলকেই জিজ্ঞেস করত–মেরা ক্যা গলত হয়

দেওয়ান রণজিৎ রায় বলত–না জাঁহাপনা, আপনার কোনও গলত নেই, গলত ওদের, ওই ফিরিঙ্গি বোম্বেটেদের

তব?

ওই তিব’-এর উত্তর এক-একজন এক-একরকম দিত। কেউ বলত এখন কিছুদিন ওদের ঠান্ডা করে রাখা দরকার জাঁহাপনা। জেনারেল বুশি যতদিন না এসে পৌঁছোয় ততদিন ওদের ঠেকিয়ে রাখুন। তারপর আমরাই ওদের আবার সাত সাগর তেরো নদীর ওপারে পাঠিয়ে দেব!

কিন্তু আমার মিরবকশি কি ওদের মিরবকশির চেয়ে কমজোরি? আমি একলা ওদের হাটিয়ে দিতে পারব না? আমি কি বাংলার নবাব নই? ওরা কি আমার চেয়েও বেশি তাকতদার?

না জাঁহাপনা, কেন আপনি ওকথা বলছেন?

তা হলে এতে দস্তখত দিতে বলছ কেন আমাকে?

আপনার ভালর জন্যেই দস্তখত করতে বলছি জাঁহাপনা।

আমার ভাল আমি নিজে বুঝব না, আর তোমরা আমার চেয়ে বেশি বুঝবে দেওয়ানজি?

রণজিৎ রায় বললে–জাঁহাপনা, আজ তিরিশ সাল আমি নিজামতের সঙ্গে কাজ করছি, বরাবর নিজামতের ভালটাই দেখেছি, আজ হঠাৎ এমন কী হয়েছে যে আমি নিজামতের লোকসান করতে যাব?

তারা কী বলে? মিরজাফর আলি খাঁ?

আবার সমস্ত বুঝেও মিরজাফর আলিকেই ডেকে পাঠালেন নবাব। মিরজাফর আলি খাঁ সাহেব আড়াতাড়ি নবাবের খাসকামরায় ঢুকে সেই একই কথা বলেছিল। সবাই পরামর্শ করেই কথা বলছে। সবারই এক মত।

কান্ত সেকদিন চুপ করে সব দেখেছে। চুপ করে সব শুনেছে। যখন ওয়াটসন আর ক্লাইভ সাহেব তুলেট কাগজটা পড়ে নবাবকে দস্তখত করতে দিলে তখন নবাবের হাত কাঁপছিল। কান্ত ভাল করে চেয়ে দেখেছে শুধু হাত কাঁপা নয়, নবাব দস্তখত করার আগে সকলের মুখের দিকেও একবার তাকালে। দেওয়ান রণজিৎ রায়ের দিকে চাইতে দেওয়ানজি মাথা নেড়ে সায় দিলে। আর সঙ্গে সঙ্গে কান্ত চমকে উঠল। তার মনে হল কলমটা সে কেড়ে নেয় নবাবের হাত থেকে। যে-হাত দিয়ে নবাব তরোয়াল চালাতে পারে সে-হাত দিয়ে যেন দাসখত লেখা মানায় না।

কিন্তু ক্লাইভ সাহেব তাতেও যেন খুশি নয়। বললে–এতে আরও দু’জনের দস্তখত চাই

কার কার?

রাজা দুর্লভরাম আর মিরজাফর আলি খাঁ সাহেবের।

তারা দুজনে তৈরিই ছিল। তাড়াতাড়ি কলমটা নিয়ে দুজনেই দস্তখত করে দিলে নবাবের দস্তখতের নীচেয়। সত্যিই এ দস্তখত নয়, দাসখত। বাংলা বিহার ওড়িষ্যার নবাবের দাসখত। তামাম হিন্দুস্থানের দাসখত! মোগল বাদশার দাসখত। এই দাসখত নিয়েই নবাব সমস্ত হিন্দুস্থানের পত্তনি লিখে দিলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পায়ে। পারে অনেক দিন কান্ত ভেবেছিল, কেন সেদিন নবাবের হাত থেকে সে কলমটা ছিনিয়ে নেয়নি। ছিনিয়ে নিলে তার আর কী এমন শাস্তি হত? কতটুকু শাস্তি হত! আর সে-শাস্তির তুলনায় যে-শান্তি সে পরে পেয়েছিল তার গুরুত্ব যে অনেক বেশি। সেদিনই তার মনে পড়ে গিয়েছিল চকবাজারের রাস্তার ধারেই সে গণতকারের কথাটা। সেই তুচ্ছ বিনা পয়সার ভবিষ্যৎবাণী যে তার জীবনে অমন করে অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাবে তাই-ই কি সে আগে থেকে কোনওদিন কল্পনা করতে পেরেছিল?

কিন্তু সেকথা এখন থাক।

আবার নবাবের ফৌজ সার বেঁধে চলেছে কলকাতা ছেড়ে। এবার আর বুক চিতিয়ে চলতে পারছে কেউ। সবাই যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। কারও সঙ্গে লড়াই হল না, কারও সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা হল না, কে বীর কে ভীরু, কে শক্তিমান কে দুর্বল, তারও যাচাই হল না, তবু একদল সমস্ত লজ্জা সমস্ত অপমান সমস্ত কলঙ্ক মাথায় নিয়ে মাথা নিচু করে ফিরে চলে গেল। আর একদল বিগল আর ব্যান্ড বাজিয়ে সেদিন সারাটা রাত পেরিন সাহেবের বাগানে মদের ফোয়ারা ছুটিয়ে দিলে। কলকাতায় ফোর্টে সেদিন জয়ের উল্লাসে নাচের তাণ্ডব চলল সমস্ত রাত। যখন ফুর্তি করে করে হয়রান হয়ে পড়ল সবাই তখন কেল্লার ভেতরের ভাঙা চাৰ্চটার ভেতর থেকে ব্যান্ডের গম্ভীর মিউজিক বেজে উঠল–গড সেভ দি কিং …

*

ভোরবেলাই ক্লাইভের ঘুম ভেঙে গেছে।

কে?

পেরিন সাহেবের বাগানের প্রত্যেকটা গাছও তখন যেন বড় ক্লান্ত হয়ে বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যপাদে এসে সমস্ত হিন্দুস্থানই যেন তখন অসাড় হয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমরা ভাবতাম তোমাদের রাজারাজড়াদের লড়াই হচ্ছে হোক, আমাদের তা নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। আমরা জাতিভেদ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি, আমরা নতুন করে রঘুনন্দন মিশ্রকে দিয়ে মেলবন্ধন করিয়ে নিয়েছি। সম্রাট আকবরের আমল থেকে শায়েস্তা খাঁ’র চট্টগ্রাম বিজয় পর্যন্ত আরাকানের মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুরা আমাদের ঘরবাড়ি সমস্ত লুঠ করেছে। তারপর এসেছে সুদূর মারাঠা দেশ থেকে বর্গিরা। তবু আমরা রাঢ়ী বড় না বারেন্দ্র বড়, সেই সমস্যা নিয়েই মাথা ঘামিয়েছি, একবার চোখ মেলেও দেখিনি পর্যন্ত যে কে আমাদের রাজা, কে আমাদের বাদশা, কে আমাদের হর্তাকর্তা-বিধাতা। আর দেশের যদি কেউ রাজা বাদশা থাকেও তো সে ভাল না খারাপ তা নিয়েও আমরা মাথা ঘামাইনি। ততক্ষণ আমরা পাশা খেলেছি দাবা খেলেছি, আর নয়তো ঘরের দাওয়ায় বসে ন্যায়শাস্ত্রের পুঁথি লিখেছি। ওদিকে হিন্দুস্থানের বাইরে যে আর এক সভ্যতা তার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে পৃথিবীকে গ্রাস করবার জন্যে সাত সাগর-তেরো নদী পাড়ি দিয়েছে, তার খবরও আমরা রাখিনি। তখন আমরা সব বাচস্পতি মিশ্ররা মিলে কুলীনের গুণ ব্যাখ্যা করে তালপাতায় লিখেছি।

আচারো বিনয়ো বিদ্যা প্রতিষ্ঠা তীর্থদর্শনম।
নিষ্ঠাবৃত্তিস্তপো দানং নবধা কুললক্ষণম ॥

কিন্তু ক্লাইভ সাহেব ঘুমোবার জন্যে ইন্ডিয়ায় আসেনি। আওয়াজ কানে যেতেই চেঁচিয়ে উঠেছে। কে?

আমি হরিচরণ, সাহেব!

 তাড়াতাড়ি দরজা খুলেই হরিচরণকে দেখে অবাক হয়ে গেল।

 তুমি? ওরা কোথায়?

 আজ্ঞে, ওঁরাও এসেছেন। খবর পেলাম লড়াই থেমে গেছে, তাই আবার ওঁদের নিয়ে এখানেই ফিরে এলাম

পেরিন সাহেবের বাগানের তখন একেবারে অন্য চেহারা। সেই বড় বড় দেবদারু গাছগুলোর পাতা আগুনের ঝলসানি লেগে শুকিয়ে গেছে। নবাবের কামানের যে-গোলাটা এসে বাগানের কাছাকাছি পড়েছিল সেখানে সেটা একটা বিরাট গর্ত তৈরি করে দিয়েছে। কোথায় হালসিবাগানের উমিচাঁদের বাগান, সেখান থেকে ফৌজের গোলন্দাজরা গোলা ছুঁড়েছিল এখানে। তারপর যে কাণ্ডটা ঘটল তা যেমন আকস্মিক তেমনই ভয়াবহ। রাত পোয়াল কোনওরকমে, কিন্তু যখন ভোর হল তখন চারদিকে আর কিছু দেখা যায় না। কেবল সাদা ধবধবে কুয়াশা আর কুয়াশা। ভিজে সঁতসেঁতে জমির ওপর থেকে আকাশের মাথা পর্যন্ত সবকিছু কুয়াশায় ঢাকা।

যখন কুয়াশা কাটল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে।

কিন্তু চোখ চাইতেই দেখা গেল নবাবের ছাউনির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফিরিঙ্গি ফৌজ। তখন আর ফিরে আসা যায় না। ক্লাইভ তখন পাগলের মতন হয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে আর ফেরবার উপায় নেই। তাড়াতাড়ি সকলকে চমকে দিয়ে অর্ডার দিলে ব্যাটালিয়ান, ফায়ার

কিন্তু যাকে ধরবার জন্যে এত আয়োজন, সেই নবাব তার আগেই হালসিবাগান ছেড়ে পালিয়েছে।

নবাবের সঙ্গের লোকজন তখন ধরে বসেছে–এখান থেকে সরে যেতেই হবে–

সমস্ত ঘটনাটা কান্ত নিজের চোখে দেখলে। কেউ যুদ্ধ করতে চায় না। শুধু শশী প্রাণপণে লড়ছিল। যখন পালিয়ে গিয়ে আবার ছাউনি গেড়েছিল দক্ষিণের জলাজমির পাশে, তখনও শশীর দুঃখ যায়নি।

যুদ্ধটা মিটে যেতে তারই বড় কষ্ট হয়েছিল।

বললে–তা হলে কী হবে ভাই কান্তবাবু, নবাব কেন মিটমাট করে নিলে?

যেন কান্ত মালিক। সেই কবে একদিন বেভারিজ সাহেবের গদিতে চাকরিতে ঢুকেছিল, তারপর নিজামতের চরের চাকরি থেকে কেমন করে এই নবাবের খিদমদগারের চাকরিতে ঢুকে পড়েছে! কে তার ভাগ্যকে নিয়ে এমন করে ঘুরিয়ে বেড়াচ্ছে?

আমরা কি লড়াই করতে পারি না? আমাদের গায়ে কি জোর নেই ভাই? তুমিই বলো।

কান্ত বললে–নবাব যা ভাল বুঝেছে তাই করেছে, তুমি আমি তার বিচার করব?

তা তুমি নবাবকে বুঝিয়ে বলতে পারো না? আর তুমি না বুঝিয়ে বলতে পারো, আর কেউ নেই? আমাদের ফেীজ আর ওদের ফৌজ? ওরা তো পেট ভরে খেতেই পাচ্ছে না

খেতে পাচ্ছে না?

আরে না। আমাদের চরেরা খবর এনেছে যে! আর দুটো দিন যদি চেপে থাকতে পারত তো ওরা সুড়সুড় করে পগার পার হয়ে যেত।

তুমি ঠিক জানো?

শশী বললে–আরে হ্যাঁ, আমাদের বকশিসাহেব জানে সব। ফিরিঙ্গিদের গোস্ত না হলে তো চলে, ওরা আজ পনেরো দিন গোস্ত খেতে পায়নি

কী করে তা হলে চালিয়েছে?

শুধু নুন দিয়ে ভাত খেয়েছে বেটারা! ওদের রসদও ফুরিয়ে গিয়েছে, টাকাও ফুরিয়ে গিয়েছে—

কান্ত অবাক হয়ে গেল কথাগুলো শুনে। তবে কেন নবাব এমন কাজ করতে গেল।

শশী বললে–আর আমরা তো লড়াইতে জিতেই গিয়েছিলুম ভাই

সত্যিই নবাবের ফৌজ জিতেই গিয়েছিল। কুয়াশাটা কেটে যেতেই যেন একেবারে হাজার হাজার কামানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েছিল ক্লাইভের সেপাইরা। তখন এগোবারও উপায় নেই, পেছোবারও উপায় চলে গিয়েছে।

ক্লাইভ সাহেব সে-গল্প করেছে উদ্ধব দাসের কাছে। সে অনেক পরের কথা। তখন নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা মারা গেছে, মুর্শিদাবাদের মসনদেরও হাতবদল হয়েছে। উদ্ধব দাস গল্প শুনত, বেগম মেরী বিশ্বাস গল্প শুনত। আর শুনত ক্লাইভ সাহেবের খানসামা চাপরাশিরা।

ক্লাইভ বলত–তুমি লাক মানো পোয়েট? ভাগ্য? ভাগ্যলিপি?

উদ্ধব দাস বলত–না সায়েব, আমি হরি ছাড়া কাউকেই মানি না

ক্লাইভ বলত–ড্যাম ইয়োর হরি। আমি গড মানি না, আমি মানি শুধু লাক, আমি মানি শুধু চান্স। আর মানি কেবল এইটেকে–

বলে নিজের বন্দুকটা তুলে ধরে দেখাত।

বলত–এই বন্দুকটা দেখছ তো, এইটে আমাকে ক্লার্ক থেকে কম্যান্ডার করেছে, আবার হয়তো একদিন কম্যান্ডার থেকে ক্লার্ক করে দেবে! আই বিলিভ ইন হিম। হি ইজ মাই গ্রেটেট ফ্রেন্ড এ-ই আমার সবচেয়ে বিশ্বাসী বন্ধু

তারপর একটু থেমে আবার বলত-পলাশির লড়াইতে আমার যে ক্ষতি না হয়েছে, সেদিনের সেই মারহাট্টা ডিচের যুদ্ধে তার বেশি ক্ষতি হয়েছিল। সেদিন আমার সাতান্নজন ব্রিটিশ সোলজার মারা গিয়েছিল আর একশো সাঁইত্রিশজন উল্ডেড হয়েছিল–তা ছাড়া দুটো কামান আমার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলুম এবার আমার লাস্ট চান্স। আমি শেষ হয়ে গিয়েছি। কিন্তু এই বন্দুকটাই আমাকে সাহস দিলে–আই ফট, অ্যান্ড আই ফট টু দি লাস্ট!

তারপর?

তারপর? তার পরের কথা হয়তো আমার কান্ট্রিম্যানরাও ভুলে যাবে, তোমরাও ভুলে যাবে। আমি জানি আমি মারা যাবার পর আমার দেশের লোকরা আমাকে গালাগালি দেবে, তোমাদের হিস্টোরিয়ানরাও আমার নামে ব্ল্যাকম্পট দেবে। তারা বলবে আমি গুন্ডা, আমি ডাকাত, আমি তোমাদের নবাবকে খুন করেছি, আমি তোমাদের দেশ কনকার করেছি, কিন্তু বিলিভ মি, আজ যে আমি তোমাদের ভালবেসেছি, তার কারণ, আই লাভ ইউ, আমি নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাকে ঘৃণা করিনি, তার এগেনস্টে আমার কোনও গ্রাজ ছিল না। আমার ঘৃণা ছিল আমার নিজের ওপর, আমার গ্রাজ ছিল আমার নিজের ওপর। কেন আমি কিছু করতে পারিনা, কেন আমাকে সবাই ওয়ালেস মনে করে, কেন আমার নিজের ফাদার আমাকে হেট করে, কেন আমাকে কেউ ভালবাসে না! আমাকে জীবনে কেউ ভালবাসেনি পোয়েট, নোবডি লাভড মি, আমি একলা, আই অ্যাম অ্যালোন ইন দিস ওয়ার্ল্ড; সেই জন্যেই তোমাদের নবাবকে খুন করে আমি আমার লোনলিনেসের প্রতিশোধ নিয়েছি। তাই তোমাদের কাস্ট্রিকে কনকার করে আমি সকলের তাচ্ছিল্যের রিভেঞ্জ নিয়েছি

তারপর একটু থেমে বলত–এই যে তোমাদের বেগম মেরী বিশ্বাস, এও জানে! যেদিন শুনলুম নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা খুন হয়েছে, সেদিন আমি কেঁদেছি, হ্যাঁ, তোমাদের হিস্টোরিয়ানরা হয়তো। বিশ্বাস করবে না পোয়েট, কিন্তু বিলিভ মি, বিশ্বাস করো, আই হ্যাভ শেড টিয়ার্স, আমি রিয়্যালি কেঁদেছি, কিন্তু সে কান্না আমার কেউ দেখেনি, আমাদের চোখের জল দেখাতে নেই, আমি ওয়ারিয়র, আমার কাঁদতে নেই, আমার কাদা ক্রাইম, আমাদের ডিউটি শুধু ডু অর ডাই

বলে রবার্ট ক্লাইভ শুধু গড়গড় করে গড়গড়ার নলটা টানত আর পেট-ভরতি ধোঁয়া ছাড়ত।

যখন রাত অনেক হত, দমদমার বাগানবাড়ির বাইরের আলোগুলো যখন একে একে নিভে আসত, তখন উদ্ধব দাস উঠত। বলত আমি আসি সায়েব।

সেকালে অনেকে দেখেছে সেই উদ্ধব দাসকে। তখন মিরজাফর খাঁ’র রাজত্ব। আরও অরাজক, আরও ভয়ানক সেকাল। রাস্তায় ডাকাতের ভয়। একলা একলা পথে বেরোয় না কেউ। বেরোলে দল বেঁধে বেরোয়। বিশেষ করে রাত্তিরবেলা। কিন্তু তখন ব্রিটিশ রাজত্বের সবে গোড়াপত্তন হতে শুরু করেছে। সেই যুগে উদ্ধব দাস একা একা রাস্তায় চলত। পায়ে তখন খড়ম উঠেছে, গায়ে চাদর, হাতে একটা তুলোট কাগজের পুঁথি। লোকে উদ্ধব দাসকে কিছু বলত না। জানত বুড়ো নিরীহ কবি, কাব্য লিখছে ভারতচন্দ্রের মতো। তখন লেখা শেষও হয়নি। তবু লোকে পুঁথির নাম জানত। বলত বেগম মেরী বিশ্বাস কাব্য।

আর আসলে কান্তই বা তখন কোথায়? ইতিহাসের জঞ্জালের সঙ্গে নিজামতের চর কান্ত সরকারও কখন আর সকলের সঙ্গে তলিয়েই গিয়েছিল। নানিবেগম, ঘসেটি বেগম, ময়মানা বেগম, গুলসন বেগম, তক্কি বেগম, বব্বু বেগম, সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ, বশির মিঞা, মেহেদি নেসার, সফিউল্লা খাঁ, ইয়ারজান, ছোটমশাই, সবাইয়ের সঙ্গে কান্ত সরকারও বিস্মৃতির তলায় তলিয়ে গিয়েছে। তার কথা আর কারও মনে নেই। এই এতদিন পরে বেগম মেরী বিশ্বাস’ পুঁথি আবিষ্কার না হলে হয়তো চিরকালের মতোই সে তলিয়ে যেত। কিন্তু দুশো বছর পরে যে আবার তার নামটা ছাপার অক্ষরে উঠল এ-ও ওই উদ্ধব দাসের জন্যে! উদ্ধব দাস লিখে গেছে…।

কিন্তু সেকথা এখন থাক। উদ্ধব দাসের কথা বলার অনেক সময় পরে পাব। আগে সেইদিনকার সেই পেরিন সাহেবের বাগানের ঘটনাটা বলি।

ভোরবেলা তখনও কেউ জাগেনি। কিন্তু রবার্ট ক্লাইভের তখন অনেক কাজ। অনেক ভাবনা। শুধু নবাবের সঙ্গে ফয়সালা হলেই যে সব সমস্যার সুরাহা হয়ে গেল এমনই আশা আর যারই থাক, রবার্ট ক্লাইভের ছিল না।

ক্লাইভ অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে বলেছিল–একটা এনিমি গেল, এবার অন্য এনিমিটার শেষ করে দিতে হবে

সমস্ত বেঙ্গলে যদি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ব্যাবসা করে যেতে হয় তা হলে এখানে ফ্রেঞ্চদের বাড়তে দিলে চলবে না। আজ যদি সাউথ থেকে জেনারেল বুশি এসে পৌঁছোত তো এমন করে সন্ধিপত্রে সই করত না নবাব।

কাগজের ওপর নিজের দস্তখত করতে নবাবের বড় কষ্ট হচ্ছিল। যেন হাতের আঙুলগুলো কঁপছিল। জেনারেল বুশি এসে পৌঁছোল না। নবাব যেন বড় একলা। বড় নিঃসহায়। তাকে নিঃসহায় পেয়ে যেন তাকে দিয়ে এরা দাসখতই লিখিয়ে নিচ্ছে।

বাইরে এসে ক্লাইভ বললে–এবার চন্দননগর

 প্রথমে অ্যাডমিরাল বুঝতে পারেনি। জিজ্ঞেস করেছিল–হোয়াই? কেন?

তুমি বুঝতে পারছ না, আজ যদি জেনারেল বুশি এসে পড়ত তো আজ কি এই ভিকট্রি হত? যতদিন চন্দননগরে ফ্রেঞ্চ পাওয়ার থাকবে ততদিন এখানে আমাদের কোম্পানির কোনও আশা নেই–

হাউ ডু ইউ নো?

ক্লাইভ বললে–আই নো। আমি জানি। ফ্রেঞ্চদের সম্বন্ধে আমার চেয়ে তুমি বেশি জানোনা ওয়াটসন, দে আর স্কাউড্রেলস–তারা চায় ইন্ডিয়া থেকে হটিয়ে দিয়ে নিজেরা বিজনেস করবে। আর বিজনেস মানেই রুল করবে ওভার ইন্ডিয়া! একটা কান্ট্রির দু’জন মাস্টার থাকতে পারে না

হোয়াট ইউ মিন?

আই মিন হোয়াট আই সে! আমি বেঙ্গলের ফ্রেঞ্চ টেরিটোরি অ্যাটাক করব

তুমি কি পাগল হয়েছ? এখুনি তো তুমি টুস-টার্মস-এ সিগনেচার করে এলে? তাতে লেখা রয়েছে নেটিভ বা ইউরোপের যে-কেউ নবাবের ফ্রেন্ড সে ইংরেজদেরও ফ্রেন্ড, যে নবাবের এনিমি সে ইংরেজদেরও এনিমি–

ক্লাইভ ঘোড়াটার লাগাম ধরে টান দিলে একটা।

সেদিন রবার্ট ক্লাইভ অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের কথার উত্তর দিতে পারেনি। সেদিন রাস্তায় চলতে চলতে কেবল মনে হয়েছে, কীসের সন্ধি, কীসের মিটমাট, কীসের ফয়সালা। লাইফ-ই কি টুস মেনে চলে? লাইফের সঙ্গেই তো অনেকবার সন্ধি করতে চেয়েছে রবার্ট ক্লাইভ। অনেকবার। কতবার ভেবেছে, আবার ইংলন্ডে ফিরে যাবে। ইংলন্ডে ফিরে গিয়ে পার্লামেন্টের মেম্বর হবে। দেশে ফিরেও তো গিয়েছিল একবার। বিয়ে করে সংসার পাতবে একদিন। আর দশজন যেমন করে সংসারী হয়ে ইংলন্ডের সিটিজেন হয়ে বাস করছে, তেমনি করে সে-ও সিভিল লিস্টের খাতায় নাম লিখিয়ে ভদ্রলোক হবে। কিন্তু তা পেরেছে কি? কেন পারে না তা? লাইফের সব সন্ধি কেন ওলটপালট হয়ে যায়? লাইফের সব হিসেব কেন গোলমাল হয়ে যায়?

সেই অবস্থাতেই রাত্রে বাড়িতে এসে ভেবেছে কেবল। তারপর হঠাৎ অনেক রাত্রে ক্যাম্পে খবর এসেছে, ইউরোপে ফ্রান্সের সঙ্গে ওয়ার বেধে গেছে ইংলন্ডের। ওয়ার। ওয়ার।

খবরটা পেয়েই বিছানার ওপর উঠে বসেছে ক্লাইভ।

মাদ্রাজের গভর্নর ডেসপ্যাঁচ পাঠিয়েছে ক্যালকাটার সিলেক্ট কমিটিকে যেন এখুনি চন্দননগর অ্যাটাক করা হয়।

ডেসপ্যাচটা পেয়ে পর্যন্ত সারারাত কর্নেল ক্লাইভ ঘরের মধ্যে পায়চারি করেছে। অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে ঠিক এই কথাই বলেছিল সন্ধেবেলা।

কিন্তু নবাবের সঙ্গে যে আমরা টুস করেছি?নবাব যদি সে-টুস না ভাঙে তো আমরা সে-টুস কী করে ভায়োলেট করতে পারি?

ক্লাইভ বলেছিল–পারি। লাভ আর ওয়ারের ব্যাপারে কোনও নিয়ম কেউ কখনও মানেনি, আমরাও মানব না

কিন্তু এই ইন্ডিয়াতে ফ্রেঞ্চরা যে নবাবের ফ্রেন্ড!

ক্লাইভ বলেছিল–এখন আর তারা নবাবের বন্ধু নয়। ফ্রেঞ্চরা এখন আমাদের শত্রু, সুতরাং নবাবেরও শত্রু!

তা হলে নবাবকে সেকথা জানিয়ে আগে চিঠি লেখো–তারপরে চন্দননগর অ্যাটাক করো!

 ক্লাইভ বলেছিল–ঠিক আছে, আমি নবাবকে লেটার লিখব

বলে দু’জনে দু’দিকে চলে গিয়েছিল। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন হয়তো ফোর্টের ভেতর গিয়ে আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছিল, কিন্তু ক্লাইভের ঘুম নেই। ঘরের মধ্যে একবার বিছানায় শুয়েছে, আবার উঠে পায়চারি করেছে।

তারপর যখন ভোর হয়েছে, তখনই হরিচরণের ডাক।

দুর্গাকে দেখে সাহেবের মুখে হাসি বেরোল। পাশেই ঘোমটা দেওয়া সেই ম্যারেড লেডি!

কী বাবা, আমাদের কিছু হিল্লে করতে পারবে তুমি? এখন তো তোমাদের লড়াই থেমে গেছে।

হরিচরণ বললে–আমরা সেই ত্রিবেণী পর্যন্ত গিয়েছিলুম হুজুর

 ত্রিবেণী? তা অত দূর পর্যন্ত গিয়েছিলে তো আবার ফিরে এলে কেন? তোমাদের হাতিয়াগড়ে ফিরে যেতে পারলে না?

দুর্গা বললে–ফিরব কী করে? সেখানে দেখি, সেই বাউন্ডুলে লোকটা একটা বজরার ওপর বসে বসে গান গাইছে

কার কথা বলছ? আমাদের সেই পোয়েট? সে তো তোমরা চলে যাবার পরেই আবার এই ক্যাম্পে এসেছিল।

এখানেও এসেছিল? মরবার আর জায়গা পেলে না মিনসে? আবার এখেনে এসেছিল কী করতে? মরতে?

সায়েব বললে–সে একজন জেন্টলম্যানকে নিয়ে এসেছিল এখানে। তোমরা নেই শুনে চলে গেল

তা মিনসেকে তুমি কেন ঢুকতে দিলে বাবা এখেনে?

ক্লাইভ বললে–পোয়েটকে আমার বড় ভাল লাগে দিদি

 তা ভাল লাগে ততো ভাল লাগুক, তা বলে তোমার বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দাও কেন?

 ক্লাইভ বললে–তা তোমার মেয়েরই তো হাজব্যান্ড সে? তাকে আমি তাড়িয়ে দিতে পারি?

হ্যাঁ বাবা তাড়িয়ে দিয়ে, আমি বলছি, তাড়িয়ে দিয়ো, অমন জামাইয়ের মুখে ঝাটা মারি আমি! তুমি যদি তাকে ধরে রাখতে বাবা তো আমি তোমার সামনে তার মুখে সাত ঝাটা মেরে বিদায় করতাম

ক্লাইভ হাসল। অদ্ভুত এই ইন্ডিয়ার মানুষরা। নিজের জামাইকে এরা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় অপমান করে। অথচ জামাই কিছু বলতে পারে না। মুখ বুজে চলে যায়। ক্লাইভ ম্যাড্রাসে এদের কথা শুনেছিল। অথচ এই বেঙ্গলেই হাজব্যান্ডের চিতায় উঠে ওয়াইফরা নাকি পুড়ে মরে। এরা এত ফেথফুল, আবার এত জুয়েল। কী অদ্ভুত মানুষ এই বেঙ্গলি লেডিরা।

আবার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল দু’জনের। ঘরের মধ্যে পৌঁছিয়ে দিয়ে ক্লাইভ বললে–তোমাদের এখানে হয়তো খুব কষ্ট হবে দিদি

দুর্গা বললে–তা কষ্ট তো হবেই সায়েব, আমাদের কপালে কষ্ট থাকলে কে খণ্ডাবে বলো? নইলে নিজের ঘরদোর থাকতে আমরা ম্লেচ্ছদের হাতে পড়ি?

ক্লাইভ হাসতে লাগল–আমরা বুঝি এখনও আনটাচেবল দিদি? এতদিন যে আমার এখানে থাকলে তোমরা, তোমাদের জাত চলে যাবে তো!

ওমা, কী বলছ তুমি সায়েব? জাত যাবে না? আমাদের জাতের আছেটা কী শুনি? জাত তো তুমি আমাদের মেরে দিয়েই বসে আছ

তা হলে কী হবে?

কী আর হবে! প্রায়শ্চিত্তির করতে হবে। সাধ করে কি তোমার এখানে আসতে চাইনি আমরা! আমরা হরিচরণকে পইপই করে বললাম, আমাদের অন্য কোথাও নিয়ে চলল! তা ও-ও হয়েছে তোমার মতো

সাহেব দুর্গার কথা বুঝতে পারলে না। হরিচরণকে জিজ্ঞেস করলে প্রায়শ্চিত্তির মানে কী?

হরিচরণ বুঝিয়ে দিলে। ব্রাহ্মণদের ডেকে খাওয়াতে হবে, ভুরিভোজন করাতে হবে। অনেক টাকা দক্ষিণে দিতে হবে। গোবর খেতে হবে।

গোবর? তার মানে?

হরিচরণ গোবর কথাটা বুঝিয়ে দিতেই সাহেব বললে–ও, ইউ মিন কাউ ডাং? দ্যাট ইজ গোবর? কেন? গোবর খেতে হবে কেন?

আজ্ঞে, তা তো খেতেই হবে। গোবর খেলে সব পাপ ধুয়ে মুছে পবিত্র হয়ে যাবে!

ক্লাইভ বললে–তা হলে তুমি? তুমি গোবর খাবে না?

আজ্ঞে, আমি তো সেপাইদের দলে নাম লিখিয়েছি, আমার আত্মীয়স্বজনেরা জানে, আমার জাত চলে গিয়েছে।

তা তুমি যে দেশে টাকা পাঠাও তোমার বাড়িতে, সে-টাকা তারা নেয়?

হরিচরণ বললে–সে-টাকা তারা কি অমনি নেয়, গঙ্গাজলে ধুয়ে তবে সিন্দুকে তোলে

 ক্লাইভ হাসতে লাগল।

দুর্গা বললে–আর যদি কখনও এখানে আসে সে-মিনসে তো তাকে ঢুকতে দিয়ো না বাবা, তা তোমায় বলে রাখছি–

কী করেছে তোমার জামাই, বলো তো দিদি?

 দুর্গা বললে–করবে আবার কী, সে আমার জামাই নয়

কিন্তু সে যে বলেছিল, তার ওয়াইফের নাম মরালী

তা মরালী কি আর কারও নাম হতে নেই? এই যে তোমার নাম ক্লাইভ, ওনামে কি আর কেউ নেই তোমাদের দেশে? একলাই তুমি একেশ্বর হয়ে জন্মেছ?

সত্যি বলছ?

দুর্গা বললে–তা সত্যি বলছি না তো কি মিথ্যে কথা বলব তোমার সঙ্গে?

 ক্লাইভ বললে–তা হলে ত্রিবেণীতে তাকে দেখে তোমাদের অত ভয় হয়ে গেল কেন?

তা রাস্তাঘাটে বাউন্ডুলে মিনসে দেখে ভয় হবে না? তুমি নেই, যদি অপমান করে, হেনস্থা করে, যদি মেয়ের হাত ধরে টানাটানি করে?

ক্লাইভ বললে–কিন্তু আমি তো পোয়েটকে জানি, পোয়েট তো তা করবার লোক নয়, পোয়েট তো ভেরি গুড ম্যান–

দুর্গা বললে–তা তুমি কি মেয়েমানুষ যে তোমার হাত ধরে সে টানাটানি করবে? তুমি তো বেটাছেলে, তোমার সঙ্গে সে তো ভাল ব্যাভার করবেই বাছা–

ক্লাইভ সাহেব হো হো করে হাসতে লাগল।

দুর্গা বললে–হেসো না বাছা, আমরা মরছি নিজের জ্বালায় আর তুমি দাঁত বার করে হাসছ–

ক্লাইভ বললে–হাসতে যে আমার বড় সাধ দিদি। ছোটবেলা থেকে যে হাসবার সুযোগই পাইনি। কেবল সকলের সঙ্গে ঝগড়া আর মারামারি করেছি, কেউ আমাকে হাসতেই দেখেনি জীবনে, এই শুধু তুমি আজ হাসতে দেখলে–এই তো তোমার সঙ্গে আমি হাসছি, কিন্তু তুমি জানো না কাঁদতে পারলে আমি বেঁচে যাই

ওমা, তোমার আবার কী হল, তুমি তো দিব্যি খাচ্ছদাচ্ছ আর লড়াই করছ

 ক্লাইভ সাহেবের মুখখানা যেন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল সাহেব। যেন আর চিনতেই পারা গেল না তাকে। আর দাঁড়াল না সাহেব সেখানে। ঘর ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

দুর্গা হরিচরণকে জিজ্ঞেস করলে তোমার সাহেবের কী হল গো? মুখখানা অমন সাদা হয়ে গেল কেন হঠাৎ?

হরিচরণ বললে–ওরকম হয় মাঝে মাঝে, ও নিয়ে তুমি ভেবো না

তা আমাদের ওপর রাগ করলে নাকি?

হরিচরণ বললে–না, রাগ করবে কেন? মাথার মধ্যে ভাবনা রয়েছে তো, কেবল ভাবছে আর। কেবল ভাবছে–

মদ খেয়েছে বুঝি?

হরিচরণ বললে–না তো, সাহেব তো আর মদ খায় না, তুমি বলার পর থেকে তো সাহেব মদ ছেড়ে দিয়েছে, গোরুর গোস্ত খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে

সেকী?

হ্যাঁ দিদি, আর তা ছাড়া ওসব পাবে কোথায় যে খাবে! এতদিন তো নবাবের ভয়ে কেউ খাবারদাবার কিছু বেচতই না আমাদের, আমরা তো পেট ভরে খেতেও পাইনি

ওমা, তাই নাকি?

হরিচরণ বললো দিদি, তোমাদের কিছুই বলিনি এতদিন তোমরা মনে কষ্ট পাবে বলে

দুর্গা বললে–তা তো আমরা জানতুম না! না বাপু, আমরা তোমাদের ঘাড়ে বসে আর খাব না

হরিচরণ বললে–না দিদি, এখন আর তা নেই, এখন তো নবাবের সঙ্গে মিটমাট হয়ে গেছে, এখন টাকা ছাড়লেই সব মাল পাওয়া যাবে

তা হলে সাহেব তোমার অমন গম্ভীর হয়ে যায় কেন হঠাৎ?

হরিচরণ বললে–সে তোমাকে পরে বলব দিদি, সে অনেক কথা।

দুর্গা বললে–বলো না শুনি—

হরিচরণ বললে–কাউকে বোলো না যেন, কেউ জানে না, সাহেবের মা মারা গেছে

সেকী? কবে?

 মাস ছয়েক আগে। মা ছাড়া তো সায়েবের আপনার কেউ ছিল না। বাপ তো না-থাকার মধ্যেই। কেবল মদ গিলেই পড়ে থাকে দিনরাত

তা অশৌচ টশৌচ কিছু হয় না সায়েবদের?

তুমিও যেমন দিদি, ওদের আবার অশৌচ হবে। আর খবর তো এল মারা যাবার দুমাস পরে, তখন মা মরে ভূত হয়ে গেছে

দুর্গার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল–আহা গো

জানো দিদি, সাহেব লুকিয়ে লুকিয়ে এক-একদিন কাঁদে, কেউ টের পায় না, শুধু আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি

দুর্গা বললে–কাঁদতে বুঝি সায়েবের লজ্জা করে খুব?

না, লজ্জা করবে কেন? কিন্তু আমাদের কর্নেল তো, সায়েবকে কাঁদতে দেখলে সেপাইদের মন যদি নরম হয়ে যায় তো তারা তো যুদ্ধ করতে পারবে না। সেইজন্যে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে

দুর্গার নাক দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল–আহা গো, এ কী চাকরি বাছা তোমাদের, মায়ের মিত্যুতেও প্রাণভরে কাঁদতে পারবে না–এমন চাকরি না করলেই পারো

হঠাৎ দূর থেকে ডাক এল-হরিচরণ!

হরিচরণ বললে–ওই সাহেব ডাকছে দিদি, আমি আসছি, তোমাদের সব ব্যবস্থা আমি এসে করে দিচ্ছি–

বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হরিচরণ।

ছোট বউরানি এতক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। এতক্ষণে কাছে এসে বললে–দুগ্যা, এ তো বড় জ্বালা হল দেখছি–ঘুরে ফিরে সেই আমাদের এখেনেই আসতে হচ্ছে–

দুর্গা বললে–তা কী করবে বলল, আমার কি দেশে ফিরে যেতে অসাধ? কপালের গেরো থাকলে কে খণ্ডাবে?

তা এদের লড়াই তো থেমে গেল, এবার হাতিয়াগড়ে ফিরে যেতে আপত্তি কী? এখন তো রাস্তা ফাঁকা

দুর্গা বললে–রাস্তা না-হয় ফাঁকা, কিন্তু সেই রেজা আলি বেটা তো এখনও হাতিয়াগড়ে ঘাঁটি আগলে বসে আছে। একবার জানতে পারলে কি আর রেহাই দেবে তোমাকে? আর সেই বশির মিঞা, সে-ও তো ওত পেতে আছে

তা নবাব যদি কোনওকালে না মরে তো চিরকাল এমনি করে এখানে পড়ে থাকব?

 দুর্গা বললে–তাই তো নবাবের মিত্যু কামনা করছি ছোট বউরানি, দিনরাত মিত্যু কামনা করছি

তা তুই নবাবকে উচাটন করতে পারিস না? নবাবকে বাণ মারতে পারিস না? তা হলে তুই ছাইয়ের মন্তর শিখেছিস

দুর্গা বললেন ছোট বউরানি, এবার দেখছি তাই-ই করতে হবে। এ ফিরিঙ্গিদের দিয়ে কিছু হল না। মায়ের মিত্যুতে যেসব মানুষ কেঁদে ভাসিয়ে দেয় তাকে দিয়ে কিছু হবে না, আমাদের সায়েব দেখছি মেয়েমানুষেরও বেহদ্দ, আমাকে শেষকালে ঝাড়ফুক করতে হবে

*

নাদির শা’র আমলে যে বংশের ইতিহাস শুরু, সেবংশ বড় সাধারণ বংশ নয়। বড় সামান্য অবস্থা থেকে একেবারে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব। হাজি আহম্মদই শুধু যে সারাফত আলির সর্বনাশ করেছিল তা-ই নয়, ছোট ভাই আলিবর্দি খাঁর প্রসাদেও দিল্লির বাদশার সর্বনাশের অন্ত ছিল না। হলওয়েল সাহেব লিখেছে–মারাঠারা যখন মহম্মদ শার কাছে চৌথের দাবি করেছিল তখন বাদশা বলেছিলেন–নবাব আলিবর্দি খাঁ খাজনা পাঠায়নি, আমি চৌথ দেব কী করে?

মারাঠারা নাছোড়বান্দা। বললে–আমাদের চৌথ চাই-ই চাই–চৌথ আমরা ছাড়ব না

সেকথা শুনে বাদশা বলেছিলেন–তোমরা যাও বাংলাদেশে, আলিবর্দিকে উৎখাত করে তোমরা তোমাদের পাওনা উসুল করে নাও–আমার কোনও আপত্তি নেই

এক-একজন ঐতিহাসিকের এক-এক রকম মত। কিন্তু গোলাম হোসেন বলেছেন, আলিবর্দি দিল্লির বাদশার কাছ থেকে পেয়েছিলেন সাতহাজারি মনসবি আর সুজা-উল-মুলক হেসাম-উ-দ্দৌলা উপাধি। আর তার বিনিময়ে নবাব নজরানা পাঠিয়েছিলেন এক কোটি টাকা।

উদ্ধব দাসও লিখেছে। সে কিন্তু এসব টাকাকড়ি লেনদেনের কথা লেখেনি। তার কাছে সবাই সমান। দিল্লির বাদশা থেকে শুরু করে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা, কর্নেল ক্লাইভ, মিরজাফর, বেগম মেরী বিশ্বাস, কান্ত সরকার, ছোটমশাই সবাই একাকার। সে কারও চাকরও নয়, কারও কাছ থেকে তার উপাধি পাওয়ার লোভও ছিল না। কোনও নবাব কি রাজাকে খুশি করবার জন্যেও সে বেগম মেরী বিশ্বাস’ লেখেনি। তাই তার লেখার মধ্যে ক্লাইভ সাহেবের নিলেও আছে, আবার গুণগানও আছে। তেমনি নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার নিন্দে-প্রশংসা আছে। উদ্ধব দাস নিজে নিন্দে-প্রশংসার ধার ধারত না বলেই এমন অকাতরে সবকিছু লিখে যেতে পেরেছে সে।

এক জায়গায় এসে কিন্তু থমকে গেছে উদ্ধব দাস।

উদ্ধব দাস লিখেছে তোমরা কেউ নবাবকেও চিনতে পারোনি, ক্লাইভ সাহেবকেও চিনতে পারোনি। আমি তো তোমাদের মতো দূর থেকে দেখিনি ওদের। একেবারে কাছাকাছি ছিলাম, একেবারে ঘেঁষাঘেঁষি। লোকে আমাকে পাগল বলত তাই আমাকে কাছে ঘেঁষতে দিত। ভাবত আমি কিছুই বুঝি না বুঝি।

সত্যিই তো, কান্তই কি বুঝত মরালীর বরের মনের মধ্যে এত কাব্য ছিল। নইলে মরালীর জন্যে অমন করে সবকিছু ভুলে গিয়ে নিজেকে জলাঞ্জলি দিলে। আর মরালীই কি জানত উদ্ধব দাসের বাইরের পাগল চেহারাটার আড়ালে অমন একটা রসিক মন লুকিয়ে আছে। যদি বুঝত তা হলে তো সমস্ত ইতিহাসটাই উলটে যেত। বুঝলে হয়তো শেষপর্যন্ত পলাশির যুদ্ধটাই হত না। যখন বুঝল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তখন আর শোধরাবার সময় নেই। তখন সব নিশ্চিহ্ন হয়ে নিঃশেষ হয়েছে।

গোবিন্দ মিত্তিরের বাগানবাড়িতে যখন সমস্ত লেখাজোখা সইসাবুদ শেষ হয়েছে তখন হঠাৎ নবাবের ছাউনিতে খবর এল, ত্রিবেণীর ঘাটে নানিবেগম এসে হাজির হয়েছে।

হঠাৎ নানিবেগম সাহেবা এল কেন?

তা জানি না জাঁহাপনা।

কথাটা কান্তর কানেও গেল। কান্তর সমস্ত শরীরে একটা রোমাঞ্চ খেলে গেল। নানিবেগমসাহেবার সঙ্গে আর কেউ এসেছে নাকি? আর কেউ?

এখানে কে তাদের আসতে বললে?

তাও জানি না জাঁহাপনা!

উমিচাঁদ সাহেব আর ওয়াটস্ সাহেব দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। কাশিমবাজারের কুঠি নতুন করে খোলা হবে। নবাবের দরবারেও ফিরিঙ্গি কোম্পানির একজন প্রতিনিধি রাখতে হবে। নবাবই বেছে নিয়েছেন। ওয়াটস সাহেবকে। বেশ নাদুসনুদুস চেহারা। তারা নবাবের সঙ্গেই রওনা দেবে রাজধানীর দিকে।

তা তারা যে আসবে তা আগে খবর দাওনি কেন?

আগে খবর মেলেনি জাঁহাপনা!

নবাব মির্জা মহম্মদ যেন অস্বস্তিতে উসখুস করতে লাগলেন। বাংলার নবাব যেন ছেলেমানুষ। দিদিমার সামনে নিজের দৌরাত্ম প্রকাশ করতে লজ্জা হতে লাগল।

সঙ্গে বেগমসাহেবাও আছেন জাঁহাপনা।

আবার বেগমসাহেবা সঙ্গে এসেছেন কেন? কোন বেগমসাহেবা? মিরজাফর আলি, রণজিৎ রায়, ইয়ার লুফৎ খাঁ, ইরাজ খাঁ সবাই অবাক হয়ে গেল। নবাবের ছাউনিতে বেগমসাহেবাদের আসা নতুন নয়। কিন্তু সে তো নবাবের সঙ্গে। এমন করে হুকুম না পেয়ে তো আসার নিয়ম নেই!

 কোন বেগমসাহেবা?

 মরিয়ম বেগমসাহেবা।

নবাব চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর শরবতের পাত্রে চুমুক দিলেন। অনেক ঝড়ঝাপটা গিয়েছে কদিন ধরে। ফিরিঙ্গিদের হাতে বন্দি হতে হতে নবাব বেঁচে গিয়েছেন। তারপর ফিরিঙ্গিদের সবকিছু শর্তে নির্বিকারে দস্তখত দিয়ে লজ্জায় মুখ কলঙ্কিত করে রয়েছেন। ঠিক এই সময় এখানে না এলে হত না?

সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। খানিক পরেই ছাউনির বাইরে যেন ঘোড়ার খুরের শব্দ হল। ওই ওরা এল নাকি?

কে?

জাঁহাপনা, কর্নেল ক্লাইভ সাহেবের খত নিয়ে ফিরিঙ্গি ঘোড়সওয়ার এসেছে।

নবাব বললেন–ভেতরে নিয়ে এসো

ঘোড়সওয়ার ভেতরে এল না। তার চিঠি নিয়ে এল নবাবের পাহারাদার। সে-চিঠি সে মিরবকশির হাতে দিলো মিরবকশি সে-চিঠি মিরমুনশির হাতে দিলে। মিরমুনশি সে-চিঠি খুলে পড়তে লাগল নবাবকে শুনিয়ে শুনিয়ে

ইয়োর মেজেস্টি, মনসুর-উল-মুলক, সিরাজ-উ-দ্দৌলা শা কুলি খান, হেবাৎ জঙ, আলমগির! আপনার সন্ধির শর্ত অনুযায়ী ইহা জ্ঞাপন করা যাইতেছে, আপনি স্বীকার করিয়াছেন ইংরাজের শত্রু নবাবের শত্রু এবং ইংরাজের বন্ধু নবাবেরও বন্ধু। সম্প্রতি ইয়োরোপ প্রদেশ হইতে ইন্ডিয়ায় সংবাদ আসিয়াছে যে, ফ্রান্সের সহিত ইংলন্ডের যুদ্ধ-ঘোষণা হইয়াছে। সুতরাং এখন হইতে ফ্রান্স আমাদের শত্রু। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ফরাসি-অধিকৃত চন্দননগরও শত্রু অধিকৃত দেশ। চন্দননগরের ফরাসি কোম্পানি আমাদের শত্রুস্থানীয়। আশা করা যায়, সন্ধির শর্ত অনুযায়ী তারা আজ হইতে আপনারও শত্রু বলিয়া গণ্য হইলেন। আমরা আজ ফরাসিদের চন্দননগর আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইতেছি আশা করি, আপনি আমাদের সহায় হইবেন।

*

পেরিন সাহেবের বাগানের ভেতরে তখন সার সার সোলজার দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেল ক্লাইভের কম্যান্ড পেলেই তারা কুইক-মার্চ করতে শুরু করবে।

ক্লাইভ সাহেব নিজে তখনও তার নিজের কামরায়। একটা লড়াই মিটতে-না-মিটতে আর-একটা লড়াই। তবু সেন্ট-ফোর্ট-ডেভিডের কম্যান্ডার শেষবারের মতো নিজের মনটাকে চাঙ্গা করে নিচ্ছিল। হাতের বন্দুকটা আর একবার পরীক্ষা করে নিচ্ছিল।

হঠাৎ গার্ড এসে খবর দিলে নবাবের বেগমসাহেবার তাঞ্জাম এসেছে।

 হোয়াট!!!

 নবাবের বেগমসাহেবার তাঞ্জাম।

তবু যেন ক্লাইভের কানে কথাটা ঢুকল না।

বললে–হোয়াট ডু ইউ মিন?

গার্ড আবার স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বললে–মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার বেগমসাহেবা কর্নেল সাহেবের সঙ্গে মিট করতে এসেছে

ক্লাইভ চিৎকার করে উঠল–আর ইউ ম্যাড? কে বেগম? কোন বেগম? নাম কী বেগমসাহেবার?

মরিয়ম বেগম!

.

এমন যে হবে কেউ ভাবতে পারেনি। আজকে যা ইতিহাস, সেদিন তা ছিল বাস্তব সত্য। উদ্ধব দাসের সময়ে মানুষ ভাবতেই পারত না জাহাজ চড়ে যে-সব সাদা চামড়ার মানুষরা এখানে ব্যাবসা করতে এসেছে, তারা একদিন আবার এখানকার নবাবের কাছ থেকে মসনদ কেড়ে নেবে। তারা ভাবত, যেমন পশ্চিম থেকে বর্গিরা এসে ধান চাল লুঠ করে এখানকার মানুষদের খুন-জখম করে পালিয়ে যায়, এই সাদা চামড়ার মানুষরা তেমনি একদিন দেশ ছেড়ে চলে যাবে নবাবের ভয়ে।

কিন্তু তখনকার মানুষরা বড় ধর্মভীরু ছিল।

তারা বলত–মাথার ওপর ভগবান আছে হে, যা করবার তিনিই করবেন আমরা তো নিমিত্ত মাত্র–

কিন্তু হিন্দুর যেমন ভগবান আছে, মুসলমানেরও তেমনই আছে আর একটা ভগবান। আর শুধু হিন্দু-মুসলমান কেন, খ্রিস্টানদেরও কি ভগবান নেই? সকলেরই তো নিজের নিজের আলাদা আলাদা ভগবান। সকলের ভগবানই তাদের নিজেদের ভক্তদের মঙ্গল কামনা করত। তাই খ্রিস্টানরা যেত গির্জায়, মুসলমানরা যেত মসজিদে, আর হিন্দুরা মন্দিরে।

আসলে অষ্টাদশ শতাব্দিতে যা ঘটল সেটা বোধহয় ভগবানে ভগবানে লড়াই। মুসলমানের আল্লাহর সঙ্গে খ্রিস্টানের যিশুর লড়াই। আর তাই যদি না হবে তো এমন বিপর্যয়ই বা ঘটবে কেন?

ইংরেজরা যেদিন প্রথম হিন্দুস্থানে এল সেদিনের সাল-তারিখ ইতিহাসের পাতার এক কোণে হয়তো লেখা আছে। কিন্তু কে জানত সেদিন যে, হিন্দুস্থানের ম্যাপের রং মবলক বদলিয়ে দিয়ে তবে তারা এখান থেকে দেশে ফিরে যাবে? সামান্য ষোলো হাজার টাকা তো মাত্র। ধারাপাতের ষোড়শ শব্দের পরে তিনটে গোল গোল শূন্য বসালে যা হয় তাই। বলতে গেলে মিনি-মাগনায় পাওয়া সেই কলিকাতা, সুতানটি আর গোবিন্দপুরের জমিদারি যে এম্পায়ারে পরিণত হবে তাই-ই বা কে জানত? সেন্ট ফোর্ট ডেভিডের কম্যান্ডার কর্নেল রবার্ট ক্লাইভই কি তা কল্পনা করতে পেরেছিল?

নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা আলমগিরের কথা ছেড়ে দাও। দাদুর আদরের নাতি, উত্তরাধিকারসূত্রে অমন লাখেরাজি মৌরসিপাট্টার জমিদারি পেয়ে অনেকেরই মাথা বিগড়ে যায়। যার মাথা বিগড়ে যায় না, সে বাহাদুর মানুষ। কিন্তু রবার্ট ক্লাইভ?

ক্লাইভের আগে আরও অনেক ক্লাইভ এসেছে। ক্লাইভের পূর্বপূরুষ থেকেই তো শুরু হয়েছিল এম্পায়ার তৈরির কাজ। তারা নে এল এই মাছিমশা বনজঙ্গলের দেশে? কে তাদের আসতে বলেছে? তুমি আমি যখন বটতলার চণ্ডীমণ্ডপে বসে রামায়ণ-মহাভারত পড়ে হরিধ্বনি দিয়ে পরকালের সুখ ঐশ্বর্যের স্বর্গবাস কায়েম করতে চেয়েছি, তখন ইহলোকের সুখ-ঐশ্বর্যের পাকা বন্দোবস্ত কায়েম করতে আর-এক দেশের আর-এক মানুষের দল যে ঝড়ঝাপটা-বিপদ-বিসংবাদ অগ্রাহ্য করে পালতোলা কাঠের জাহাজ নিয়ে সমুদ্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তা কল্পনা করতেও পারিনি। যারাই এখানে এসেছে তারা চেয়েছে বিনা মাশুলে ব্যাবসা করতে। বিনা মাশুলে ব্যাবসা করে নিজেদের দেশে টাকা-মোহর-সোনা-দানা পাঠাতে। এ-দেশের রক্ত শুষতে। কিন্তু নবাব বাদশা তাতে বাধা দিলেই তিনি খারপ হয়ে গেলেন। মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে যত নবাব ফিরিঙ্গিদের ব্যবসায় মাশুল আদায় করতে চেয়েছে, সকলের সঙ্গেই খিটিমিটি বেধেছে ইংরেজ কাউন্সিলের। যেন এটা ফিরিঙ্গিদের দেশ। যেন নবাব এখানকার মানুষের স্বার্থ না দেখে বিলেতের মানুষের স্বার্থ দেখবে। যেন নিজেদের দেশের মানুষদের উপোস করিয়ে রেখে বিদেশের মানুষকে খাওয়ানোর দায়িত্বটা বেশি বড়।

কিন্তু আসলে স্বার্থের প্রশ্নই নয়। প্রশ্নটা নতুন পৃথিবীর সঙ্গে পুরনো পৃথিবীর বিরোধের প্রশ্ন। একটা সভ্যতা আচার-নিয়ম-নিষ্ঠা-অনুষ্ঠানের শাসনে জর্জর। বিলাস-আরাম-অনাচার আঘাতে মরামরো। আর একটা বিদেশি নতুন সভ্যতা তার সমস্ত জড়তা কাটিয়ে উদার-অভ্যুদয়ের উচ্ছ্বাসে পুরনোকে নির্মূল করে তার জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবার মানসে পৃথিবীর চারদিকে প্রভুত্ব বিস্তার করতে চায়। নতুনের সঙ্গে পুরনো পারবে কেন? কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ যে সেই নতুনেরই প্রতিনিধি। নবাবের আরাম চাই, নবাবের তোয়াইফ চাই, নবাবের চেহেল-সুতুন চাই, মতিঝিল, হিরাঝিল, মনসুরগদি, বেগম বাঁদি-খোঁজা সব কিছুই চাই। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর যে সভ্যতার ট্রেডমার্ক নিয়ে ক্লাইভ এসেছে, তাদের কাছে নবাবের মসনদের নাম ফিউডালিজম। ক্লাইভের কাছে কলোনিয়ালিজম আরও বড় রাজতন্ত্র। তারা সেই উপনিবেশবাদের মন্ত্র নিয়েই এখানে এসেছে নিজেদের সাম্রাজ্যের প্রসার প্রতিষ্ঠা করতে, তাই তারা ঠান্ডা মাটির ওপরে ঘুমিয়ে কাটাতে পারে, মশার কামড় খেয়েও নিশ্চিন্ত থাকতে পারে, খেতে না পেলেও মুখে হাসি ফোঁটাতে পারে। তারাই যে অষ্টাদশ শতাব্দীর নতুন সভ্যতার ভগীরথ। সে ভগীরথকে যে ঠেকাবে তেমন শক্তি হিন্দুস্থানে কার আছে?

তবু সেই ভোরবেলা রবার্ট ক্লাইভ একটু ভেবে নিলে।

 নবাবের বেগম তার ক্যাম্পে এসেছে। এ যেমন অবিশ্বাস্য তেমনই অভাবনীয়।

একলা এসেছে, না সঙ্গে আর কেউ আছে? ৪০৮

সঙ্গে নবাবগঞ্জের ডিহিদার সাহেব আছে। আর তাঞ্জামের মধ্যে আছেন বেগমসাহেবারা!

আমার সঙ্গে কী দরকার, কিছু বলেছে?

না, শুধু আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান, আর কিছু বলেননি।

নবাবের বেগমসাহেবা! তাদের এই ক্যাম্পের মধ্যে কোথায় বসাবে, কেমন করে খাতির করবে তার ব্যবস্থাটা একবার ভেবে নিলে ক্লাইভ। তারপর বললে–আচ্ছা, ভেতরে নিয়ে আয়–

ওদিকে ব্যাটালিয়ন তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাদের নিয়ে রওনা দিতে হবে চন্দননগরের দিকে। এই অবস্থায় নবাবের বেগমের সঙ্গে ভাল করে কথা বলাও যাবে না।

কিন্তু ভাববারও আর সময় পাওয়া গেল না। দু’জন সেপাইয়ের সঙ্গে বোরখা-পরা একটা মূর্তি এসে দাঁড়াতেই ক্লাইভ সসম্মানে নিচু হয়ে কুর্নিশ করলে।

আমি চেহেল সুতুনের বেগমসাহেবা মরিয়ম বেগম।

ক্লাইভ নিচু হয়ে বোরখা-পরা মূর্তিটার দিকে চেয়ে বললে–আমি আপনার কী নজরানা দিতে পারি বলুন?

মরালী বললে–নজরানা নিতে আমি আসিনি

ক্লাইভ বললে–বেগমসাহেবা নজরানা নিতে না এলেও, কোম্পানির উচিত নজরানা দেওয়া

মরালী বললে–না, নজরানা নেওয়ার এ সময় নয়, আর এ জায়গাও নয়। আপনি যখন মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে যাবেন তখন নজরানা নিয়ে যাবেন, এখন নয়।

এ তো বেগমসাহেবার অনুগ্রহ!

অনুগ্রহ করতে আসিনি আমি। আমি আজ অনুরোধ করতে এসেছি কোম্পানির কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের কাছে!

ক্লাইভ বললে–ওকথা বলবেন না বেগমসাহেবা। আমি কোম্পানির সারভেন্ট, আর নবাবের আন্ডারে কোম্পানি হিন্দুস্থানে কারবার করে টাকা উপায় করতে এসেছে। নবাব যা হুকুম করবেন কোম্পানি তা মাথা পেতে পালন করতে বাধ্য!

কালকে যে-ঘটনা ঘটে গেছে তার পরেও কি আর সে কথা বলা চলে?

ক্লাইভ বিনীত সুরে বললে–কোম্পানি যদি অন্যায় করে কিছু করে থাকে তো সে কথা বলা চলে বই কী!

মরালী বললে–কিন্তু নবাব তো কাল কোম্পানির ফৌজের সঙ্গে লড়াইতে হেরে গেছে, হেরে গিয়েই ফয়সালা করতে বাধ্য হয়েছে।

ক্লাইভ একটু চুপ করে থেকে বললে–বেগমসাহেবাকে কি এই কথা বলতেই নবাব আমার কাছে পাঠিয়েছেন?

মরালী বললে–নবাব এত বেইমান নয় কর্নেলসাহেব, নবাব যেকাগজে দস্তখত করেছেন তিনি তার মর্যাদা রাখতে জানেন। তা নাকচ করবার জন্যে আমি আপনার কাছে আসিনি। আমি এসেছি অন্য কাজে

অর্ডার করুন বেগমসাহেবা।

মরালী বললে–লোকের মুখে শুনেছিলুম, ইংরেজ কোম্পানির নতুন কর্নেলসাহেব খুব মতলববাজ, মানুষকে বিপদে ফেলে কাজ হাসিল করতে ওস্তাদ।

ক্লাইভ বললে–বেগমসাহেবারা চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে থেকে সব সময়ে সত্যি খবর পান না বলেই সন্দেহ হয়–

কর্নেলসাহেব দেখছি চেহেল্‌-সুতুনের খবরও রাখেন?

চেহেল্‌-সুতুনের খবর না রাখলে যে কোম্পানির চলে না বেগমসাহেবা।

কেন? চেহেল্-সুতুনে যে সুন্দরী মেয়েমানুষ থাকে তার খবর বুঝি বিলেতের কোম্পানির দফতরেও পৌঁছিয়েছে?

ক্লাইভ হাসল। বললে–সুন্দরী-মেয়েমানুষ থাকে সে খবর না পৌঁছোলেও সেখানকার বেগমসাহেবাদের তহবিলে যে অনেক টাকা আছে, তার খবর পৌঁছিয়েছে।

কোম্পানি তা হলে শুধু হিন্দুস্থানের টাকাই নয়, বেগমসাহেবাদের টাকার দিকেও নজর দেয়?

ক্লাইভ বললে–না বেগমসাহেবা, নজর কোম্পানির সাহেবরা দেয় না, বরং ঠিক তার উলটো। বেগমসাহেবারাই বরং কোম্পানির তহবিলের টাকার দিকে নজর দেন।

মরালী বললে–তার মানে?

তার মানে যে বেগমসাহেবা জানেন তা নয়, কিংবা হয়তো নতুন করে আমার মুখ থেকে মানেটা শুনতে চাইছেন। বেগমসাহেবা নিশ্চয় জানেন, নবাবের মা কোম্পানির কাছে মাল বিক্রি করতেন, এবং তার জন্যে নগদ মোটা মুনাফা পেতেন। এতদিন পরে নবাবের সঙ্গে বোঝাঁপড়া হবার ফলে সে কারবার তাদের আবার চালু হবে। তাতে কোম্পানিরও লাভ, বেগমসাহেবাদেরও লাভ বই লোকসান নেই।

মরালী বললে–বেগমসাহেবাদের লাভ হলে যে নবাবের লাভ হয় না এটা বোধহয় কর্নেল সাহেবের জানা আছে। বাংলার নবাবের আর বেগমদের স্বার্থ যে এক নয়, তাও বোধহয় কর্নেল সাহেবের জানতে বাকি নেই!

ক্লাইভ বললেনবাবের হাঁড়ির খবর আমাদের জানবার কথা নয়, বেগমসাহেবা।

তা তো নয়, কিন্তু নবাবের ক্ষতি করবার জন্যে ষড়যন্ত্র করবার সময় তো সে কথা মনে থাকে না কর্নেল সাহেবদের!

ক্লাইভ সেকথার উত্তর না দিয়ে বললে–বেগমসাহেবা কি ঝগড়া করবার জন্যেই এখানে এসেছেন? এখন কিন্তু আমার ঝগড়া করবার সময় নেই

মরালী বললে–সময় আমারও নেই কর্নেলসাহেব, কিন্তু অনেক কষ্টে সময় করে নিয়ে এসেছি

চেহেল্‌-সুতুনের বেগমসাহেবাদের সময় কাটে না বলেই তো জানা ছিল একদিন।

এবার থেকে জেনে রাখুন, চেহেল্-সুতুনের সব বেগমসাহেবা মাটির পুতুল নয়।

ক্লাইভ বললে–মাটির পুতুল তো আমি বলিনি তাঁদের, আমি শুধু বলেছি নবাবের কথায় তারা ওঠেন বসেন!

কিন্তু নবাবের কথায় উঠলে বসলে কি নবাবের বেগমসাহেবারা কোম্পানির ফিরিঙ্গি আমলাদের সঙ্গে সোরার কারবার করতে পারতেন? নবাবের কথা যদি বেগমসাহেবা শুনতেন তা হলে কি আমিই কর্নেল সাহেবের সঙ্গে এমন করে এখানে দেখা করতে আসতে পারতাম?

ক্লাইভের চোখ দুটো এবার কৌতূহলী হয়ে উঠল।

তা হলে নবাবের অমতেই কি বেগমসাহেবা কোম্পানির ক্যাম্পে এসেছেন?

মরালী বললে–নবাবের বেগমসাহেবারা মাটির পুতুল নন বলেই আসতে পেরেছি।

তারপর একটু থেমে বললে–কিন্তু নবাব আপনাদের কী শত্রুতা করেছে যে, তাকে দিয়ে এমন অপমানের শর্তে দস্তখত করিয়ে নিলেন?

ক্লাইভ বললে–বেগমসাহেবা দেখছি নবাবের আম-দরবারের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান।

 মরালী বললেনবাবের লোকসান হোক এ আমরা চাই না বলেই এত কথা বলছি।

 যাক, তবু একজনকে পাওয়া গেল যিনি নবাবের লোকসান কামনা করেন না। বেগমসাহেবা যে নবাবের শুভাকাঙ্ক্ষী, এটা জেনেও আনন্দ হল।

মরালী বললে–আপনার উপহাস শোনবার জন্যে আমি এখানে আসিনি কর্নেলসাহেব, আর আপনার উপহাসের পাত্রীও আমি নই।

ক্লাইভ বললে–আমার অপরাধ মাপ করবেন বেগমসাহেবা

মাপ করবার কথা নয়, নবাব যখন দাসখতে দস্তখত করে দিয়েছে, তখন সবকিছু অপমানের জন্যে। তৈরি হয়েই আপনার কাছে এসেছি

বলুন, বেগমসাহেবার আমি কী উপকার করতে পারি?

মরালী বললে–আমি মুর্শিদাবাদ থেকে বেরিয়েছিলুম নবাবকে সৎ-পরামর্শ দেবার জন্যে। কারণ আশেপাশে যারা আছে, তারা কেউই নবাবের মঙ্গল চায় না। কিন্তু আমি এসে পৌঁছোবার আগেই যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন আমি এসেছি অন্য কাজে!

হুকুম করুন!

আমার সঙ্গে নানিবেগমসাহেবা আছেন, তিনি বাইরে তাঞ্জামে অপেক্ষা করছেন।

 সেকী? তাকে বাইরে রেখে এসেছেন কেন? ভেতরে নিয়ে আসুন।

বলে ক্লাইভ নিজের আর্দালিকে কী হুকুম করতে যাচ্ছিল, কিন্তু মরালী বাধা দিলে।

বললে–একটা বিশেষ কারণেই তাকে বাইরে রেখে এসেছি, নানিবেগমের সামনে সে কথা বলা যাবে না।

তা হলে এদেরও বাইরে যেতে বলি?

 বলে ইঙ্গিত করতেই গার্ড-পাহারা-সেপাই সবাই বাইরে চলে গেল। ক্লাইভ সাহেবের ঘরের মধ্যে তখন একেবারে দুজনে দুজনের মুখের দিকে চেয়ে রইল।

এবার বলুন বেগমসাহেবা।

মরালী বললে–আপনার ছাউনিতে একজন জেনানা আছে

জেনানা!

মিথ্যে কথা বলবেন না কর্নেলসাহেব। আমি খুব ভাল লোকের মুখ থেকে খবর পেয়েছি আপনার ছাউনিতে একজন হিন্দু মেয়েমানুষ আছে, গেরস্তের বউ; আপনি তাকে আপনার অন্দরমহলে লুকিয়ে রেখে দিয়েছেন।

ক্লাইভ কিছু উত্তর দিতে পারলে না। চুপ করে রইল।

মরালী বলতে লাগল–বরাবর মুর্শিদাবাদের নবাবদেরই বদনাম আছে যে, তারা নাকি পরের বউ-মেয়ে-ঝিদের চেহেল্‌-সুতুনে এনে পুরে রাখে। কর্নেল সাহেবেরও কি সেই দোষ আছে?

কে বেগমসাহেবাকে একথা বললে?

কর্নেলসাহেব আগে বলুন যে, আমি যে-খবর পেয়েছি সে-খবর মিথ্যে!

ক্লাইভ বললে–বেগমসাহেবা তো নিজে মুসলমান, আমি যদি হিন্দু মেয়েকে নিজের জেনানাতে রেখেই থাকি, তাতে বেগমসাহেবার কীসের আপত্তি? বেগমসাহেবা কি আমার প্রাইভেট লাইফের ওপরেও নজর দিতে চান? আর আমি যদি হিন্দু মেয়েকে নিয়ে ঘরে তুলে থাকিই তো তাতেও কি নবাবের বিরুদ্ধাচরণ করা হয়? নবাব যদি একশো-দু’শশা জেনানা রাখতে পারেন তার চেহেল্‌-সুতুনে, নবাবের প্রজারা কি তা পারে না? আর তা ছাড়া, আমি তো নবাবের প্রজাও নই

হঠাৎ বাইরে থেকে গার্ড ডাকলে—হুজুর

 কে?

অ্যাডমিরাল ওয়াটসন সাহেব আয়া হুজুর।

ক্লাইভ সাহেবের মুখটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তারপর বললে–একটু ওয়েট করতে বলো—

গার্ড চলে যেতেই বেগমসাহেবার দিকে চেয়ে ক্লাইভ বললে–আমি লর্ড জেসাস ক্রাইস্টও নই, নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজউদ্দৌলাও নই, আমি যদি আমার ক্যাম্পে মেয়েমানুষ রাখিই তো কার কীসের ক্ষতি? নবাবের সঙ্গে আমার সন্ধির যে-টার্মস তাতে তো মেয়েমানুষ রাখা-না রাখার কোনও শর্তও নেই। আমি আমার ক্যাম্পের ভেতরে বসে যা-খুশি তাই-ই করতে পারি

মরালী বললে–তারা কি এখন এখানে আছে?

ক্লাইভ বলে–বেগমসাহেবা কার কাছ থেকে শুনলেন, সেকথা আগে বলুন।

মরালী বললে–শুনেছি একজন রাস্তার লোকের কাছ থেকে

কে সে?

সে একজন পাগল, পাগল কবি!

 পোয়েট? তার সঙ্গে বেগমসাহেবার কোথায় দেখা হল?

ত্রিবেণীতে! কিন্তু যেখানেই দেখা যোক, কথাটা সত্যি কি না কর্নেলসাহেব বলুন, যদি সত্যি হয় তো আমি কর্নেল সাহেবকে অনুরোধ করব তাদের নিজেদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে। পরের বাড়ির বউকে নিজের কাছে আটকে রাখা যে ভাল নয় তা কর্নেলসাহেব নিশ্চয়ই বোঝেন।

ক্লাইভ বললে–বেগমসাহেবার সদুপদেশ পালন করতে পারলে আমি খুশিই হতাম, কিন্তু বাংলাদেশের নবাবের যা চরিত্র তাতে তাকে একলা ছাড়তেও ভয় হয়। আমার হাত থেকে ছাড়া পেলেও নবাবের দৃষ্টি থেকে ছাড়া পাবে এমন আশা কম, বেগমসাহেবা।

মরালী বললে–বাংলার নবাব সম্বন্ধে অনেক কথাই বলতে পারতাম কর্নেলসাহেব, কিন্তু এখন সেসময় আমার নেই–যা হোক, আমার অনুরোধ আমি রেখে গেলাম কর্নেল সাহেবের কাছে, যদি সম্ভব হয় কর্নেলসাহেব সে-অনুরোধ রাখবেন, আর সম্ভব না হলে রাখবেন না আমার কিছু করবার নেই–

কিন্তু সেই গৃহস্থবাড়ির বউয়ের জন্যে বেগমসাহেবার এত উদ্বেগ কেন, জানতে পারি কি?

মরালী বললে–উদ্বেগ অন্য কারণে, উদ্বেগ তিনিও আমার মতো মেয়েমানুষ বলে! মেয়েমানুষ না হলে মেয়েমানুষের দুঃখ কে বুঝবে, কর্নেলসাহেব তা নিজেই বুঝতে পারেন।

কিন্তু যদি এমন হয় যে তারা নিজের ইচ্ছেতেই এখানে আছে? তাদের নিজেদের গরজেই এখানে আছে? তা হলেও কি বেগমসাহেবা আমাকেই দোষী করবেন?

হিন্দু মেয়েরা কি স্বামীকে ছেড়ে নিজের গরজে পরপুরুষের আশ্রয়ে থাকে কর্নেলসাহেব? তাও কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?

ক্লাইভ বললে–তা হলেই বুঝুন বেগমসাহেবা, নবাবের শাসনে দেশের কী অবস্থা হয়েছে, হিন্দু মেয়েরা বরং আমাদের মতো ম্লেচ্ছ লোকের আশ্রয়ে আসা নিরাপদ মনে করে, তবু নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় বেরোতে সাহস পায় না।

তারপর একটু থেমে বললে–বেগমসাহেবা হয়তো সবই জানেন, তবু যদি তার মনে না থাকে তো জানিয়ে রাখি যে, হাতিয়াগড়ের এক রানিবিবিকেও নবাব নিজের খেয়াল স্যাটিসফাই করবার জন্যে। নিজের হারেমে পুরে রেখেছেন

আপনি কী করে জানলেন? কে বললে–আপনাকে?

ক্লাইভ বললে–আমি জানি, আমি বিশ্বাসযোগ্য লোকের মুখে শুনেছি

কে সে?

তার নাম না-ই শুনলেন বেগমসাহেবা। নাম জানলে হয়তো তার ওপর নিজামতের অত্যাচার বাড়তে পারে!

সেই রানিবিবির এখনকার নাম কী?

বেগমসাহেবা যদি প্রতিজ্ঞা করেন কাউকে বলবেন না, তা হলে বলব।

 মরালী বললে–প্রতিজ্ঞা করছি বলব না, এবার বলুন?

মরিয়ম বেগম!

মরালী হেসে উঠল–কী আশ্চর্য, মরিয়ম বেগম তো আমারই নাম, কিন্তু আমি তো হাতিয়াগড়ের রানিবিবি নই!

ক্লাইভ বললে–তা হলে অন্য মরিয়ম বেগম। চেহেল্‌-সুতুনে শুনেছি তিন-চারশো বেগমসাহেবা আছেন, বেগমসাহেবা কি সকলকেই চেনেন? আরও ক’জন মরিয়ম বেগম আছেন, বেগমসাহেবার পক্ষে কি তা জানা সম্ভব?

কিন্তু কে কর্নেল সাহেবকে এত খবর জানালে, তা তো কর্নেল সাহেব বললেন না!

মনে আছে!

ক্লাইভ বললে–হাতিয়াগড়ের রাজাসাহেব নিজেই

 তিনি কি নিজেই এসেছিলেন কর্নেল সাহেবের কাছে?

 কিন্তু বেগমসাহেবার একথার আর উত্তর দেওয়া হল না। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন সোজাসুজি ঘরে ঢুকে পড়েছে, আর বাইরে বেশিক্ষণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারেনি। অ্যাডমিরালকে দেখে বেগমসাহেবাও যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। ক্লাইভও অপ্রস্তুত! বোরখা-রা মূর্তিটা বিনা সম্ভাষণেই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল।

অ্যাডমিরালের চোখ-মুখ তখন লাল হয়ে উঠেছে অস্বস্তিতে!

রবার্ট, হোয়াট ইজ দিস? 

ক্লাইভ বললে–কীসের কী?

আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব বাইরে? চন্দননগর অ্যাটাক করার প্রোগ্রাম কি ভুলে গেছ তুমি? নবাবের কাছে যে চিঠি লেখা হয়েছিল তার রিপ্লাই এসেছে?

রিপ্লাইয়ের জন্যে আমি ওয়েট করব না ঠিক করেছি। রিপ্লাইয়ের জন্যে যদি ওয়েট না করে তো এতক্ষণ কার জন্যে ওয়েট করছিলে? হু ইজ দ্যাট পরদা-লেডি? তোমার সঙ্গে এর কী রিলেশন? মেয়েদের ওপর উইকনেস কি এখনও তোমার গেল? মেয়েরা কি খুঁজে খুঁজে তোমার কাছেই আসে কেবল? কই, আমার কাছে তো আসে না কেউ?

তারপর ভাল করে ক্লাইভের দিকে চেয়ে বললে–টেল মি রবার্ট, হু ইজ সি? তোমার কাছে কী করতে এসেছিল?

ক্লাইভ বললে–সেকথা তোমার জানবার দরকার নেই—

ইজ ইট এ সিক্রেট?

 ইয়েস!

 ও কি নিজামতের স্পাই?

না! ওকথা থাক, অন্য কথা বলল। আমি উমিচাঁদকে খবর দিয়েছিলাম আমাদের চিঠি পেয়ে নবাব কী বলেছে তা জানাতে! আমি উমিচাঁদের রিপ্লাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। সেই চিঠি পেলেই আমি আর্মি নিয়ে হুগলি রিভার পেরিয়ে চন্দননগরের দিকে যাব।

আর কতক্ষণ ওয়েট করব?

 যতক্ষণ না উমিচাঁদের চিঠি আসে। সেই লেটার পেলেই বুঝব নবাব আমাদের ফ্রেন্ড না এনিমি। উমিচাঁদের লেটার না পেলে আমি কিছুই ডিসাইড করতে পারছি না!

বাইরের তাঞ্জামের ভেতরে ঢুকতেই নানিবেগম বললে–ওমা, এতক্ষণ কী করছিলি রে তুই? আমার তো ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে আসছিল। এত কী কথা তোর সাহেব-ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে?

মরালী ভেতরে ঢুকেই বোরখার মুখটা মাথায় তুলে দিয়েছিল। বাইরের সেপাইদের হুকুম দিলে চলো, নবাব-ছাউনিতে চলো

বাইরে তখন বেশ দিন। দূর থেকে কে যেন ঘোড়া ছুটিয়ে আসছিল। ভেতর থেকে তার আওয়াজ শোনা গেল। হয়তো নবাবের লোক। নানিবেগম কলকাতায় আসছে খবর পেয়ে নিজামতের খাসনবিশ হয়তো ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, না, তা নয়। ঘোড়সওয়ারটা আওয়াজ তুলতে তুলতে ধুলো উড়িয়ে কোম্পানির বাগানের দিকে এগিয়ে গেল। তাঞ্জাম সোজা এগিয়ে চলতে লাগল। তাঞ্জামের ভেতর থেকে তখন শুধু তাঞ্জামের বেহারাদের ভারী নিশ্বাস পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে হুম, হাম, হুম, হাম, হুম…

*

নবাবের ফৌজি সেপাই গোবিন্দ মিত্তিরের বাগান থেকে বেরিয়ে সোজা নবাবগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। সমস্ত দিন চলে সন্ধেবেলা একটা বাগানের নীচে এসে ঘাটি গেড়েছিল সবাই। সেখানে সারারাত থেকে আবার ভোরবেলা রওনা দিতে হবে।

কিন্তু ভোরবেলাই চিঠিটা এল কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের।

চিঠিটা সবাই দেখলে। উমিচাঁদ আর ওয়াটস্ পাশেই ছিল। চিঠিটা পড়ে নবাব সবাইকে দেখালে একের পর এক। শুধু কান্ত চুপ করে সকলের মুখের দিকে চেয়ে দেখতে লাগল। কারও মুখে কোনও কথা নেই।

তোমার কী মতলব জাফর খাঁ?

শুধু জাফর আলি খাঁ নয়, কলকেই মতামত জিজ্ঞেস করলেন নবাব। এই সেদিন ফিরিঙ্গিরা যা বলেছে তাতেই রাজি হয়ে নবাব দস্তখত দিয়ে এসেছে। একটা রাত কাটতে না কাটতেই আবার নতুন আবদার জুড়ে দিয়েছে। এরা কি সত্যিই শান্তি চায়, না লড়াই চায়?

কান্ত নবাবের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে নিজের দুঃখ চেপে রাখতে চেষ্টা করল। কান্তকে তো কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না। কান্তর তো কিছু বলবার অধিকারও নেই।

শশীর তখনও চাকরি যায়নি। ফৌজের দলের সঙ্গে সে-ও চলেছে।

তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসেছে সে কান্তর কাছে।

আবার কী চিঠি এসেছে ভাই?

কার চিঠি?

ওই যে ফিরিঙ্গিদের ছাউনি থেকে নাকি চিঠি এসেছে শুনলাম? আবার লড়াই লেগে গেল নাকি?

কান্ত বললে–আমি জানি না বোধহয় লড়াই হবে না—

শশী বললে–লড়াই হবে না তো নানিবেগমসাহেবা কী জন্যে আসছে?

কে বললে–নানিবেগমসাহেবা আসছে?

 শশী বললে–আরে, তুমি কিছু শোনোনি? নানিবেগমসাহেবা আসছে বলেই তো ছাউনি পড়েছে এখেনে।

কে বললে–তোমাকে নানিবেগমসাহেবা আসছে?

 আরে, নবাবগঞ্জের ডিহিদারের লোক এসে যে খবর দিয়ে গেছে। সে নিজেই আমাকে বললে।

কান্ত অবাক হয়ে গেল। সত্যি? ঠিক বলছ?

 হ্যাঁ, ঠিক না তো কি বেঠিক? নানিবেগমসাহেবার সঙ্গে আর একজন বেগমসাহেবাও আসছে যে!

 কে সে? নাম কী তার?

 বললে–মরিয়ম বেগমসাহেবা। নবাবের নাকি খুব পেয়ারের বেগম।

কান্ত আর পঁড়াল না সেখানে। সোজা নবাবের দরবার-ঘরে ঢুকে গেল একেবারে। সেখানে তখন সবাই রয়েছে। নবাব তখন হুকুমনামা পাঠাচ্ছে মিরবকশির কাছে। জেনারেল বুশি যদি বাংলাদেশে আসে তো তার আগেই আজিমাবাদের পথে যেন তাকে আটকে দেওয়া হয়!

সমস্ত দরবার-ঘরটা তখন থমথম করছে।

হুকুমনামাটায় দস্তখত করে দিয়ে হঠাৎ নবাব মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলে এখনও নানিবেগমের তাঞ্জাম আসছে না কেন? কত দূরে তাঞ্জাম?

ডিহিদারের লোক কুর্নিশ করে বললে–জাঁহাপনা, তাঞ্জাম এই দিকে আসছিল, আসতে আসতে বাগবাজারে পেরিন সাহেবের বাগানের দিকে গেছে, ফিরিঙ্গি ফৌজের ছাউনির দিকে

কেন?

 মরিয়ম বেগমসাহেবার মর্জি!

.

বেগম মেরী বিশ্বাসের সে-মর্জির কারণ খুঁজতে গেলে মরালীর মনের মধ্যেইঢুকতে হয়। যে-মেয়েনগণ্য এক গ্রামের মধ্যে জন্মেছিল, তার পক্ষে এ-ঘটনা সত্যিই অবিশ্বাস্য। তবু চেহেসূতুনের অন্ধকার বন্দিদশার মধ্যে যে সেদিন তাকে মরতে হয়নি, সেইটেই এক পরম আশ্চর্যের ব্যাপার। নইলে অন্য বেগমরা যেভাবে দিন কাটাত সেইভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিলেই তো চলত। তাতে কেউই বাধা দিত না। এমনকী চেহেল্‌-সুতুন যেদিন খুঁড়িয়ে গেল সেদিন অন্য সকলের সঙ্গে মরালীও গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারত। বহুদিন আগে ছোটবেলায় হাতিয়াগড়ের গায়ে যেসব মেয়েদের বিয়ে হতে দেখেছে সে, তারা কেউ কেউ শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসে গল্প করত মরালীর কাছে। মরালী চুপ করে সব শুনত মন দিয়ে।

একসময় মরালী জিজ্ঞেস করত–তোর সতিন তোকে আদর করে ভাই?

 কেষ্ট দাসীর নতুন বিয়ে হয়েছিল। সে বললে–দুর, সনি কখনও সতিনকে আদর করে? সতিন তো বুকের কাঁটা রে–

তখন থেকেই বিয়ের নাম শুনলে ভয় হত তার। বলত–তোর বর কার সঙ্গে শোয়?

 আমার সতিনের সঙ্গে! সতিন যে বড়।

তুইও তো বড়।

দুর, আমার সতিন আমার মায়ের বয়েসি।

আর তোর বর? তোর বরের বয়েস কত?

আমার বর আমার বাবার চেয়েও বড়। খুব রাগ ভাই মানুষটার, হাঁপানি আছে কিনা

তা নতুন বউ ফেলে পুরনো বউয়ের কাছে শোয় কেন?

কেষ্ট দাসী বলত–ওমা, তা শোবে না, আমার সতিনের গায়ে যে খুব জোর, আমার সঙ্গে শুলে বরকে মেরে একেবারে হাড় গুঁড়িয়ে দেবে না। আমার সতিন তো তাই আমার বরকে বলে। বলে তুমি বিয়ে করেছ বেশ করেছ, পোড়ারমুখিকে মা হতে দেব না

শুনে মরালীর হাড় হিম হয়ে আসত। আহা, সেই কেষ্ট দাসীর শেষকালে পেটে ছেলে হল। কিন্তু আঁতুড়ঘরে মরা-ছেলে বিইয়ে সেই যে চোখ মটকে পড়ে রইল, আর উঠল না। তখন থেকেই শোভারাম বিয়ের কথা তুললেই মরালী ভেতরে ভেতরে সিটিয়ে উঠত। নয়ানপিসির কাছে গিয়ে বলত–তুমি বাবাকে বলো পিসি, আমি বিয়ে করব না–

নয়ানপিসি চোখ কপালে তুলে বলত–ছিঃ, ওকথা মুখে আনতে নেই, বিয়ে না করে কি আঁটকুড়ি থাকতে আছে?

কেন, আঁটকুড়ি থাকলে কী হয়?

তা জানিসনে বুঝি, সোমথ মেয়ে আঁটকুড়ি থাকলে ভূতে ঢেলা মারে যে!

ভূতে ঢেলা মারলে বুঝি আমিও ভূতকে ঢেলা মারতে পারিনে?

নয়ানপিসি অবাক হয়ে যেত মরির তেজ দেখে। শোভারামকে বলত–তুমি দাদা, একটু তাড়াতাড়ি ওর বিয়ের জোগাড়যন্ত্র করো, আমি ওর মতিগতি ভাল বুঝছিনে–

আবার বহুদিন পরে যখন চেহেল্‌-সুতুনে গিয়েছিল মরালী তখনও সেইরকম। তখনও নানিবেগম দেখত এ এক অদ্ভুত মেয়ে। অনেক মেয়ে দেখেছেনানিবেগম। সকলকে নিয়ে এতদিন সামলে এসেছে। কেউ এসেছে কান্দাহার থেকে, কেউ খারাশান। কেউ বা চট্টগ্রাম, আবার কেউ বা আগ্রার তয়ফাওয়ালি ঘরানার মেয়ে। কিন্তু প্রথম দিনটা থেকেই মরালী যেন নানিবেগমের বুকটা জুড়ে সব আদর কেড়ে নিয়েছে। কোনও নিয়মকানুন মানবে না, কোনও আদবকায়দা শিখবে না।

পেশমন বেগম কতবার নালিশ পেশ করেছে–মরিয়ম বেগমকেই তুমি বেশি ভালবাসো নানিজি, আমাদের দিকে একবারও নজর দাও না

মরিয়ম বেগমের কাছে এসে নানিবেগম কতবার বলেছে–সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারিসনে কেন তুই, সবাই যে তোর নামে শিকায়ৎ করে–

মরালী বলত–তা হলে তুমি আমাকে বকো আমাকে মারো—

নানিবেগম বলত–তুই রাগ করছিস কেন, আমি কি তাই বলেছি?

মরালী বলত–তা হলে আমিই খারাপ, ওরা সবাই ভাল

 সে এক তুমুল কাণ্ড বাধিয়ে বসত তখন মরিয়ম বেগম। খাবে না, দাবে না, কিছু করবে না। বিছানায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকত। সমস্ত চেহেল্‌-সুতুনে যখন সবাই গান-বাজনা নিয়ে আছে, তখন মরালী নিজের ঘরে মুখ-গোমড়া করে থাকলে নানিবেগমের ভাল লাগত না। নিজের মেয়েরা মায়ের দিকে ফিরেও চেয়ে দেখত না। মির্জা মহম্মদ ঘসেটি বেগমকে মতিঝিল থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নজরবন্দি করে রেখেছে, ময়মানা বেগমের ছেলেকে খুন করে ফেলেছে, সমস্তই যেন নানিবেগমের দোষ। আমিনা বেগমের ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে সোরার কারবার বন্ধ হয়ে গেছে, তাও যেন নানিবেগমের দোষ। যতদিন নবাব আলিবর্দি খাঁ সাহেব বেঁচে ছিল ততদিন নানিবেগমের ভয়ে সবাই তটস্থ থাকত। চেহেল্‌-সুতুনের সব কানুন কায়দা সবাই মেনে চলত। ভিস্তিখানায় ঠিক সময়ে পানি দিত ভিস্তিওয়ালা। ঠিক সময়ে ইনসাফ মিঞা নহবতখানায় উঠে নহবতে সুর লাগাত। জুম্মা মসজিদে ঠিক সময়ে সিন্নি চড়ত।

কী ভাবছিস রে মেয়ে? 

মরালী বললে–তোমার কথা ভাবছি নানিজি

তাঞ্জামের ভেতর দুলতে দুলতে মরালী যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, একদিন মরবার সংকল্প নিয়ে এসেছিল সে চেহেল্-সুতুনে, এখন বেরিয়েছে চেহেল্‌-সুতুনকে বাঁচাবার জন্যে; কোথায় সেই মুর্শিদাবাদ আর কোথায় এই কলকাতা!

নানিবেগম আবার জিজ্ঞেস করলে সত্যি বল তো, তুই ফিরিঙ্গি ছাউনিতে কী করতে গিয়েছিলি? মির্জা শুনলে কী বলবে বল তো! মির্জার কানে কথাটা যাবে না ভেবেছিস?

মরালী বললে–লোকটাকে দেখতে গিয়েছিলুম নানিজি—

কোন লোকটাকে?

ওই যে লোকটা তোমার মির্জাকে এত জ্বালাচ্ছে।

কে? লোকটা কে?

ক্লাইভ গো, ক্লাইভ।

তুই তারই সঙ্গে দেখা করে এলি!

 হ্যাঁ নানিজি, লোকটাকে যত খারাপ ভেবেছিলুম তত খারাপ নয়।

নানিজি বললে–বলিহারি মেয়ে তুই বটে, তুই কী বলে তার সঙ্গে দেখা করলি? মির্জা যদি কিছু বলে?

মরালী বললে–বললেই বা, আমি তো তোমার মির্জার ভালর জন্যেই দেখা করলুম।

কিন্তু তোকে যদি ধরে রাখত?

মরালী বললে–এই দেখো, আমার কাছে কী রয়েছে দেখো–

বলে ওড়নাটা তুলে নানিজিকে দেখালে। একটা ধারালো ছোরা চকচক করে উঠল সেই অন্ধকারের মধ্যে।

আমার সঙ্গে কিছু ইতরামি করলে সফিউল্লা সাহেবকে যা করেছি, ক্লাইভেরও তাই করতাম। আমাকে তো চেনে না কেউ! এখন ক্লাইভ সাহেবকে দেখলুম, এবার উমিচাঁদ সাহেবকে দেখব দেখি কত বড় শয়তান সে! নানিজি, তুমি কিন্তু কিছু বলতে পারবে না তোমার মির্জাকে। আমি তোমার মির্জার ভালর জন্যেই যা-কিছু করছি। যখন একবার কাজে নেমেছি নানিজি, তখন এর শেষ দেখে তবে, ছাড়ব

তারপর একটু থেমে বললে–একটু তাড়াতাড়ি বেহারাদের চালাতে বলো নানিজি, অনেক দেরি হয়ে গেছে, তোমার মির্জা বোধহয় এতক্ষণ ছাউনি তুলে মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা দিয়েছে। তার আগেই আমাদের পৌঁছোনো দরকার–জলদি চালাতে বলল, জলদি—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *