২.০৬ হাতিয়াগড় থেকে ফিরে

কান্ত সত্যিই জানত না বশির মিঞা এত তাড়াতাড়ি হাতিয়াগড় থেকে ফিরে আসবে। আর জানলেও কিছু করবার ক্ষমতা ছিল না তার তখন। তখন যে কোথা দিয়ে কান্তর সময় কেটে গিয়েছিল তাও জানতে পারেনি। চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে সময় বলে যেন কিছু নেই। সময় যেন চেহেল্-সুতুনের মতোই সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর নড়তে চায় না।

আর কান্তও জানত না যে আবার তাকে যেতে হবে চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে।

সমস্ত চেহেল্-সুতুন জুড়ে তখন আবার শান্তি নেমে এসেছে। নবাব মির্জা মহম্মদ নেই। পিরালি খাঁ নজর মহম্মদ, বরকত আলিরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে নবাবি করছে। নবাব মুর্শিদাবাদে না থাকলে যেন

নানিবেগমও কেউ নয়। নানিবেগম চেহেল-সুতুনে শুধু থাকে, এই পর্যন্ত। তার বেশি কিছু নয়। আমিনা বেগম কোনওদিনই মির্জাকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ছেলেকে বিয়েই মা খালাস! তখন থেকেই এই চেহেল সুতুনে বড় হয়েছে মির্জা। ছোট ছেলে এক্রামুদ্দৌলা ছিল, তাকেও পুষ্যি নিয়েছিল দিদি। দিদি ঘসেটি বেগম তখন অনেক টাকার মালিক। তখন থেকেই কথা শোনাত।

বলত তুই তোর ছেলেকে শাসন করতে পারিস না?

আমিনা বলত–আমি শাসন করব? ও কি আমার ছেলে?

ন্যাকামি রাখ, শাসন করতে না পারিস তত আমার ওপর ভার দে, আমি ওকে শায়েস্তা করে দিচ্ছি

আমিনা বলত না দিদি, একটু বয়েস হোক, বয়েস হলেই সেয়ানা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু ওর ওপর তোমার এত বিষনজর কেন বলো তো?

যখনই ঘসেটি, আমিনা, ময়মানা মুর্শিদাবাদে আসত তখনই মির্জাকে নিয়ে ঝগড়া লাগত তিন বোনে। নবাব আলিবর্দি তখন বেঁচে। তার কানে কথাটা যেতেই তিনি মির্জাকে কাছে ডাকতেন। বলতেন–দুনিয়াটাই এইরকম রে মির্জা, তোকে নবাবি দেব বলে তোর ওপরে ওদের এত রাগ–

সেই মির্জা বড় হল। সেই মির্জার বিয়ে হল। তখন মির্জার বয়েস পনেরো বছর। সেই তখনই হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই এসেছেন দ্বিতীয় পক্ষের রানিকে নিয়ে। গরিবের ঘরের মেয়ে রাসমণি। কখনও মুর্শিদাবাদ দেখেনি। বড় বউরানি বারণ করেছিলেন, কিন্তু ছোট বউরানির আবদার এড়াতে পারেননি। সেখানেই নজরে পড়ে গেল মেহেদি নেসারের।

পেশমন বেগমের ঘরে বসে মরালী এইসব গল্পই বলছিল।

পেশমন জিজ্ঞেস করলে তা তোমার সোয়ামি কিছু বললে–না?

 বলবে আবার কী! আমি তো কিছুই জানতুম না। আমার স্বামীও কিছু জানতেন না।

তারপর একটু থেমে মরালী জিজ্ঞেস করলে তা তুমি এখানে কী করে এলে?

আমি ভাই বাইজির লেড়কি! আমার মা দিল্লির বাদশার দরবারে নাচগান করত, আমি সঙ্গে সঙ্গে থাকতুম। ওইসব দেখে আমিও নাচতে শিখলুম গান গাইতে শিখলুম। তারপর মুজরো নিয়ে গান গেয়ে বেড়াতুম, শেষকালে এই নবাবের বিয়ের সময় এখানে এলুম মুজররা নিয়ে, সে ভাই আজ এগারো-বারো বছরের কথা, তারপর থেকেই এখেনে–

তোমারই বুঝি অসুখ হয়েছিল?

 পেশমন বললে–তোমাকে কে বললে?

প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম তখন কান্নার শব্দ শুনতাম কিনা, তাই গুলসনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, গুলসনই বলেছিল তোমার কথা! তা এখন সেরে গেছে তো সব?

পেশমন যেন কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। বললে–এ রোগ ভাই সারে না

কেন, চিকিৎসা করলেও সারবে না?

এ কী করে সারবে। এ যে মালেখুল্লিয়া দিমাগি!  

সে আবার কী রোগ?

এ এইসব জায়গাতেই বেশি হয়। নবাববাদশাদের এসব রোগ থাকে। সারারাত ধরে নাচ-গান করার পর খুব মদটদ খেলে তখন কি আর শরীরের কিছু থাকে! এ আর সারবে না

এ রোগ অন্য কারও আছে?

কত বাঁদির আছে, কত বেগমের আছে। আমি দিল্লির বাদশার হারেমের মধ্যেও তো গিয়েছি, থেকেছি, সেখানেও আছে–

সবাই তোমার মতন ভোগে?

 ভোগে বই কী! ভুগে ভুগে মরে যায়। আমিও ভাই আর বেশিদিন বাঁচব না–

তা ওষুধ খাও না কেন কবিরাজের, হেকিমের।

খাই, আরক খাই। সারাফত আলির আরক খাই, তাইতেই একটু কম থাকে।

মরালী বললে–আমি সারাফত আলির নাম শুনেছি ওই নজর মহম্মদের কাছে। দেখিনি কখনও আমিই কি দেখেছি। ও এসে আমাকেও মাঝে মাঝে বলে কিনা

কী বলে?

আরক খেতে বলে। বলে, আরক খেলে তবিয়ত ভাল থাকে—

পেশমন হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে আর কিছু বলে না?

আর কী বলবে?

আরও কিছুদিন থাকো এখানে, দেখবে তোমার ঘরে বাইরের লোক এনে দেবে। বাইরের লোক এনে দিলে ওরা অনেক টাকা পায়। ওদের অনেক টাকা। ওরা খোঁজাগিরি করে, কিন্তু ওরা আমাদের কিনতে পারে–

অত টাকা নিয়ে ওরা কী করে?

টাকা থাকলে সবকিছু করা যায়। টাকাই তো সব ভাই দুনিয়ায়।

কী করে অত টাকা উপায় করে?

কারবার করে। মহাজনি কারবার করে। সোরা রেশম ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে বেচা-কেনা করে।

কিন্তু সবাই তো খেতে-পরতে পাচ্ছে এখানে, তা হলে কেন এত টাকা-টাকা করে?

পেশমন বললে–বাঃ, এখন তো খেতে-পরতে পাচ্ছি, কিন্তু চিরকাল খেতে-পরতে পাব তার কি কোনও ঠিক-ঠিকানা আছে? লড়াই করতে গিয়ে যদি নবাব মারা যায় তো তখন কী হবে?

তখন যে নবাব হবে সেই খাওয়াবে?

তা কি বলা যায়? তখন যারা জওয়ান মেয়ে তাদের না হয় রাখবে, কিন্তু বুড়োহাবড়াদের? তাদের যদি লাথি মেরে তাড়িয়ে দেয়? তোমার এখন কম বয়েস, তোমাকে এখন নানিবেগম খুব খাতির করছে, সাজাচ্ছে-গোজাচ্ছে। বুড়ো হয়ে গেলে তোমাকে আর দেখবে ভেবেছ? আমাকেও তো প্রথম প্রথম খুব সাজাত গোজাত, নবাবের সামনে এগিয়ে দিত, যাতে নবাবের মন ভোলে, কিন্তু এখন? এখন যে আমি এত ভুগছি, আমার দিকে চেয়ে দেখে কেউ?-

-তা তুমি টাকা জমাওনি?

ভাই, আমি বোকার মতন কেবল ফুর্তি করে মরেছি। ভেবেছি চিরকাল বুঝি যৌবন থাকবে! এখন হায় হায় করছি

তা এখান থেকে পালানো যায় না?

হ্যাঁ, খুব যায়। ঘুষ দিলে পালানো যায়। খোজারা সব করতে পারে। কিন্তু পালিয়েই বা যাব কোথায়? কোন চুলোয় গিয়ে উঠব? আমার তো কেউ নেই আর। মা ছিল এককালে, আমার সঙ্গে এখানেই। থাকত। কিন্তু মা মারা যাবার পর আর কার কাছে যাব? আর কে আছে?

বাবা?

ও আমার কপাল, আমাদের আবার বাবা থাকে নাকি?

কথাটা বলেই মরালী যেন কেমন লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল। তারপর পেশমন হেসে উঠতে খানিকটা হালকা হয়ে গেল জিনিসটা। মরালী বললে–নবাব তো এখন নেই, আমি যদি কোথাও বাইরে যেতে চাই, আমাকে এরা যেতে দেবে?

পেশমন জিজ্ঞেস করলে কোথায় যাবে তুমি?

মরালী একটু দ্বিধা করে বললে–কাউকে বোলো না যেন তুমি, আমি যাব সারাফত আলির দোকানে

সারাফত আলির দোকানে? কার কাছে?

 সেখানে একজন থাকে। তার কাছেই যাব—

কে সে? তোমার কেউ হয়?

 মরালী বললো –হ্যাঁ

কে?

মরালী বললে–আমার খুব আপনার লোক–

তার কাছে কী করতে যাবে?

মরালী বললে–আমার বাবা কেমন আছে, তাকে খবর আনতে বলেছিলাম, ভাবছি সেইটে জেনে আসতে যাব, ক’দিন ধরে বাবার কথা মনে পড়ছে

তা তাকে এখানে ডেকে পাঠাও না। টাকা দিলেই তাকে ওরা ডেকে নিয়ে আসবে এখেনে

 মরালী বললে–না, এখানে তাকে আনতে চাই না, তা ছাড়া আমি টাকা কোথায় পাব? আমি একবার নিজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলে ভাল হত! কতদিন যে বাবাকে দেখিনি! বাবা জানেও না। যে আমি এখানে। আমার তো ভাই-বোন নেই, আমার মা-ও নেই–

তা শ্বশুরবাড়িতে তোমার স্বামী তো আছে?

তা আছে, কিন্তু সে-সম্পর্ক তো এখানে আসার পর চুকেবুকে গেছে ভাই চিরকালের মতো। তার জন্যে আমি বেশি ভাবছি না, আমার বাবার জন্যেই বেশি মন কেমন করছে

পেশমনের বোধহয় মায়া হল মরিয়ম বেগমের জন্যে। বললে–তুমি কিছু ভেবো না, আমি তোমার ব্যবস্থা করে দেব

কী করে ব্যবস্থা করবে?

সে ভার আমার ওপর ছেড়ে দাও ভাই তুমি! বরকত আলি যে-খোঁজাটা আছে না, ও আমার খুব হাত-ধরা। বরকত আলিকে বললে–তোমাকে তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে

সেদিন শুধু এইটুকু কথাই হয়েছিল পেশমন বেগমের সঙ্গে। কিন্তু সত্যি সত্যিই যে শেষপর্যন্ত পেশমন পাকা বন্দোবস্ত করে ফেলবে তা কল্পনাও করতে পারেনি মরালী! সেদিন মরালীকে ডেকে কথাটা বলতেই মরালী নিজেই চমকে উঠেছে।

বরকত আলিও সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন বেশ অনেক রাত হয়ে গেছে। ভয় ভয়ও করতে লাগল। কেন সে কথাগুলো বলতে গেল পেশমনকে। শেষপর্যন্ত যদি কোনও বিপদ হয় তার। যদি তার কোনও সর্বনাশ হয়?

বরকত আলি বললে–চলিয়ে বেগমসাহেবা চলিয়ে, কুছ ডর নেই–

পেশমন বললে–যাও না ভাই, ভয়টা কীসের? নবাব তো আর মুর্শিদাবাদে নেই। এখানে তো আমি রইলম। আর তুমি ওই বেগমের সাজপোশাক ছেড়ে একটা পায়জামা পরে নাও না। কুর্তা-পায়জামা পরলে আর রাত্তিরবেলায় কে তোমায় চিনছে? আর তা ছাড়া তুমি তো তাঞ্জামে করে যাবে, কে দেখতে পাচ্ছে? সবাই ভাববে কোনও আমির-ওমরা কেউ বুঝি বা

বরকত আলিও সেই একই কথা বললে। কোথা থেকে সে কুর্তা-পায়জামা তাজ এনে জোগাড় করে রেখেছে। একী কাণ্ড! ওই পরে কি কোথাও যাওয়া যায়? যদি জানাজানি হয়ে যায়? যদি…

মরালী বললে–আমার যে ভয় করছে ভাই–

পেশমন বললে–ওমা, সেকী, আমি বলে তোমার জন্যে এত তোড়জোড় করে সব ব্যবস্থা করলুম, আর এখন তুমি পেছিয়ে যাচ্ছ?

বরকত আলি বললে–আমি তাঞ্জামের বন্দোবস্ত ভি করেছি, কোথায় যাবেন বেগমসাহেবা, চলুন

পেশমন আরও সাহস দিয়ে বললে–তোমার কিচ্ছু ভয় করবার দরকার নেই ভাই, এরকম আমরা কতবার করেছি, আমি করেছি, আমিনা বেগমসাহেবা করেছে, ভয় কী?

তা তুমি চলো না ভাই আমার সঙ্গে, আমি যাব আর চলে আসব, বেশিক্ষণ দেরি হবে না আমার শুধু জেনে আসব বাবা কেমন আছে, আর কিছু নয়

পেশমন বললে–আমি থাকলে বরং এদিকটা সামলাতে পারব। নানিবেগম কি কেউ যদি খোঁজ করে তো আমি তবু বলতে পারব যে তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ। কিন্তু দু’জনে একসঙ্গে বেরোলে সন্দেহ করবে যে–

মরালী বরকত আলিকে জিজ্ঞেস করলে তুমি সারাফত আলির দোকানটা চেনো? ‘পেশমন বললে–হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব চেনে, দু’বেলা ওখানে যাচ্ছে ওরা আরক কিনতে, খোশগল্প করতে

মরালী বললে–আমি কিন্তু তাঞ্জাম থেকে নামব না–

সে আমি জানি বেগমসাহেবা!

যদি কেউ জিজ্ঞেস করে তাঞ্জামের ভেতরে কে, তুমি কী বলবে?

আমি বলব সফিউল্লা ওমরাহ সাহেব

ওই সারাফত আলির দোকানের পেছনের ঘরে সে থাকে। তুমি সেখানে গিয়ে তাকে ডেকে আনবে। যদি জিজ্ঞেস করে কে ডাকছে, তা হলে তুমি বলবে, ওমরাহ সফিউল্লা খাঁ সাহেব-বুঝলে?

সে-সব আপনাকে কিছু বলতে হবে না বেগমসাহেবা! পেশমন বেগমসাহেবাকে কত কত জায়গায়। নিয়ে গেছি আমি, সেখানে রাত কাবার করে ফিরিয়ে এনেছি, কেউ টের পায়নি! আপনি জিজ্ঞেস করুন না পেশমন বেগমসাহেবাকে!

দেখো, আমাকে যেন বিপদে ফেলো না তুমি বরকত! তা হলে তোমার কিছুই হবে না, আমারই বিপদ

মনে আছে, সেদিন নিজের চেহারা দেখেও নিজেকে চিনতে পারেনি মরালী! পেশমন বেগম একেবারে নিখুঁত করে সাজিয়ে দিয়েছিল তাকে। চুস্ত পায়জামার সঙ্গে চুড়িদার আচকান, আর মাথায় তাজ! চেহারা দেখে পেশমন বেগমই একেবারে গলে গিয়েছিল। মরালীর গালে নিজের ঠোঁট ঠেকিয়ে লম্বা করে চুমু খেয়ে নিলে।

বললে–তোমাকে যে কী মানান মানাচ্ছে ভাই, কী বলব–এসো তুমি

সেই অন্ধকার রাত্রে চেহেল্‌-সুতুনের চোরা ফটক দিয়ে বেরোল বরকত আলি আর আর-একজন ওমরাহ সফিউল্লা খাঁ সাহেব। পেছনে কোন মহলে তখন গুলসন বেগমের গলায় একটা নতুন ঠুংরির সুর ভেসে আসছে–

যো হোনেকা থি, উও তো হো গয়ি
আভি উসকো ক্যা পরোয়া…

মোটা মোটা খিলেন। মুরশিদকুলি খাঁর আমলের ইটের তৈরি। পায়ের তলাতেও ইট বাঁধানো সড়ক। নতুন নাগরা জুতোর তলায় ইটগুলো যেন কথা কয়ে উঠল। তারাও যেন বলতে লাগল যে হোনেকা থি, উও তো হো গয়ি, আভি উসকো ক্যা পরোয়া

বাইরের খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়েও মরালীর মনে হলসমস্ত আকাশ বাতাস–অন্তরীক্ষ সবাই যেন একসঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইছে–যো হোনেকা থি, উও তো হো গয়ি, আভি উসকো ক্যা পরোয়া–

তাঞ্জামের ফটকটা খুলে হঠাৎ মরালী বরকত আলিকে ডাকলে।

ও গানটার মানে কী বরকত আলি?

 কোন গানটার বেগমসাহেবা?

ওই যে গুলসন বেগমসাহেবা চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে গাইছিল। যো হোনেকা থি, উও তো হো গয়ি, আভি উসকো ক্যা পরোয়া

বরকত আলি বললে–ওর মতলব হচ্ছে বেগমসাহেবা, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর কেন ভেবে। মরছ, ও তো হয়েই গেছে, ও নিয়ে ভেবে তো কোনও লাভ নেই–

মরালীরও মনে হল–সত্যিই লাভ নেই। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে কেন ভেবে মরছি, ও তো হয়েই গেছে, ও নিয়ে ভেবে তো কোনও লাভ নেই!

তাঞ্জামটা চারটে বেহারার কাঁধে চকবাজার দিয়ে হুমহুম করে এগিয়ে চলতে লাগল।

*

এ এক বিচিত্র দেশ। এই বেঙ্গল! রবার্ট ক্লাইভ এ-দেশে আগে কখনও আসেনি। ম্যাড্রাস দেখেছে, আর্কট দেখেছে, ত্রিচনাপল্লি দেখেছে, কাঞ্চিপুরম দেখেছে। কিন্তু এ অন্যরকম। এখানকার রোগা-রোগা কালো কালো মানুষগুলো ফিরিঙ্গিদের দিকে কেমন রেসপেক্ট-মেশানো দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখে। ভিলেজের লোকগুলো দিনেরবেলায় লুকিয়ে থাকে। কিন্তু সন্ধের পর তখন আর তাদের ভয় থাকে না। লুকিয়ে লুকিয়ে চাল-ডাল বিক্রি করে যায় জাহাজের কাছে এসে।

ফলতার খাঁড়ির মুখে অনেকদিন কাটল। শেষে আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে রাজি হল না কেউ। রবার্ট ক্লাইভ একদিন অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে বললে–দিস ইজ টেরিব–আমি আর ওয়েট করতে পারব না–উই মাস্ট অ্যাটাক হুগলি ফোর্ট

কটা লড়াইতে জিতে ক্লাইভ সাহেব তখন বেঙ্গলের ব্যাটল ফিল্ডে নিজের ক্ষমতা দেখাবার জন্যে ছটফট করছে।

তারপর একদিন দলবল নিয়ে ফিরিঙ্গিদের কটা জাহাজ এসে হাজির হল এই এখানে।

ক্লাইভ বাইরে মুখ বাড়িয়ে চারদিকে দেখে জিজ্ঞেস করলে–এ-জায়গাটার নাম কী?

অ্যাডমিরাল ওয়াটসন বললে–বজবজ

এখান থেকে হুগলি কতদূর আর?

তা দূরই হোক আর যাই হোক, সুপশায়ারের সেই বখাটে ছেলেটার যেন কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ নেই। বললে–আরও এগিয়ে চলো, লেট আস গো নিয়ারার

নিয়ারার মানে কোথায়? আছে, আর একটা জায়গা আছে কাছাকাছি। তার নাম মায়াপুর। মায়াপুর পর্যন্ত তো যাওয়া যাক, তার পরের কথা পরে ভাবলেই হবে।

বেশ জংলা-জংলা জায়গাটা। জাহাজগুলো এসে থামল সেখানে। দলের নৌকোগুলো হুগলি-রিভারের ভেতরে অনেক দূর দূর গিয়ে টহল দিয়ে আসে। দেখে আসে কোথায় কাছাকাছি নবাবের ফৌজ আছে। আর ওয়াটসন সেখান থেকে রাজা মানিকচাঁদের চিঠির জন্যে হাঁ করে অপেক্ষা করে বসে থাকে। চোখে দূরবিন লাগিয়ে দেখে দূরের ভিলেজগুলোর দিকে। নবাবি-ফৌজ কতদূরে!

চারদিকে বেরিয়ে যায় নৌকোগুলো।

কোনওটা পুব দিকে, কোনওটা দক্ষিণে। সারারাত টহল দেয়, আশেপাশের গাঁ থেকে প্রভিশনস কিনে আনে। না পেলে লুঠপাট করে আনে। মুরগি, ভেড়া, গোরু। ওয়ারের সময় অত নিয়ম মানতে গেলে চলে না। দ্যাট ব্ল্যাক নিগার অব এ প্রিন্স! তাকে একটা লেসন দিতে হবে। ক্লাইভের সোনালি রক্ত ভাবতে ভাবতেই গরম হয়ে ওঠে। বলে–লেট আস গো নিয়ারার

নিয়ারার মানে কোথায়? আছে, আর একটা জায়গা আছে কাছাকাছি। কিন্তু অত দূরে যাওয়া কি সেফ? রাজা মানিকচাঁদের হাতে তৈরি আছে, দু’হাজার ফুট-সোলজার আর পনেরোশো ঘোড়া। যে-কোনও মোমেন্টে রাজা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে আমাদের ওপর।

নৌকোগুলো রাত্রে বেরিয়ে যায়, আর ভোররাত্রেই ফিরে আসে। খবর নিয়ে আসে কোথায় কতদূরে রাজা মানিকচাঁদ।

দিনের পর দিন যায়, রাতের পর রাত। চারখানা চিঠি দেবার পরও কোনও উত্তর আসে না নবাবের কাছ থেকে। সমস্ত ইন্ডিয়ার ইস্ট কোস্ট জয় করে এসে এই সাউথ বেঙ্গলে এসে হেরে যাবে নাকি ফোর্ট সেন্ট ডেভিডের কম্যান্ডার?

ক্লাইভ আবার বললে–লেট আস গো নিয়ারার

কিন্তু সেদিনই রাত্তিরে জাহাজের ঘরে ধাক্কা পড়ল। কে? কে? কে?

তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ক্লাইভ। বন্দুকটা পাশেই থাকে বরাবর, সেটা হাতে নিয়ে সামনে বেরিয়ে এসেছে। মেজর কিলপ্যাট্রিক, অ্যাডমিরাল ওয়াটসন সবাই-ই উঠে পড়েছে। কিন্তু কোথাও তো সাড়াশব্দ নেই, ফায়ারিং হচ্ছে না কোথাও। হোয়াটস্ আপ? কী হল?

কর্নেল, দু’জন লেডিকে ধরে এনেছে সেপাইরা।

দু’জন লেডি?

হ্যাঁ কর্নেল, দু’জন লেডি!

স্পাই নাকি? ফিমেল স্পাই? স্ট্রেঞ্জ! ভেরি স্ট্রেঞ্জ! এ-দেশে ফিমেল স্পাইও আছে নাকি নবাবের আর্মিতে!

নৌকো করে নেভির যে-লোকরা টহল দিতে বেরিয়েছিল তারা তখন দু’জন মেয়েমানুষকে ধরে এনে জাহাজে তুলে ফেলেছে।

আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম কর্নেল ফ্রেঞ্চ বোট। আমরা বন্দুক ফায়ার করতেই ওরাও ফায়ার করলে। তখন বোটটাকে আমরা ক্যাপচার করে দেখি বোটের ভেতরে এই দু’জন লেডি!

লেডি দু’জন তখন ঘোমটা দিয়ে জাহাজের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে।

তোমরা কে? কারা তোমরা? হু আর ইউ?

একজন সেপাই ভাল করে বাংলা করে বুঝিয়ে দিলে। একজন লেডি তো তখন থরথর করে। কাঁপছে। পাশের মেয়েমানুষটার সাহস হয়তো একটু বেশি। সে বললে–হুজুর, আমরা নবাবের কেউ নই, আমরা হিন্দু

তোমরা রাত্তিরে কোথায় যাচ্ছ?

হুজুর কাশীধামে! বাবা বিশ্বনাথ দর্শন করতে!

তোমরা কাদের লোক? নাম কী তোমাদের?

হুজুর, আমার নাম দুগ্যা! আমি এঁর দাসী। ইনি হাতিয়াগড়ের জমিদার ছোটমশাইয়ের নফরের মেয়ে। নফর শোভারাম বিশ্বাস। ইনি তারই মেয়ে–শ্ৰীমতী মরালীবালা দাসি–

ঘোমটার ভেতর ছোট বউরানি তখন ভয়ে ঘেমে নেয়ে উঠে একেবারে মূৰ্ছা যাবার জোগাড়।

*

সংসারে এক-একটা মানুষ জন্মায় যারা ঠিক ইতিহাসের মতো। এক-একটা শতাব্দী পার হয়ে যায়, হঠাৎ এমনি এক-একটা মানুষের সাক্ষাৎ মেলে। ইতিহাসের মতোই তারা কাউকে পরোয়া করতে জানে না। সংসার তাদের অবহেলা করে, সমাজ তাদের তাচ্ছিল্য করে, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব তাদের নিরুৎসাহ করে, তবু সেই প্রতিকূল ভাগ্যকে অস্বীকার করে তারা অমোঘ ভবিতব্যের দিকে এগিয়ে চলে।

এমনি একজন মানুষ এই লেফটেন্যান্ট কর্নেল ক্লাইভ।

নিজের দেশে তাকে কেউ সম্মান দিলে না। নিজের দলের লোকও কেউ তাকে শ্রদ্ধা করলে না। অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের সঙ্গে রোজই খিটিমিটি বাধতে লাগল। তবু রবার্টের গো, বাংলার। সুবাদার নবাবের অত্যাচার সে বন্ধ করবেই।

যারা দিশি সেপাই তারা নৌকো করে অনেক দূরে চলে যায়। গিয়ে লোকের সঙ্গে কথা বলে, মেলামেশা করে। তাদের মনের কথাগুলো জানবার চেষ্টা করে। তারা কি ফিরিঙ্গিদের চায়, না নবাবকে চায়! গাঁয়ের লোকের বাড়িতে গিয়ে হুঁকো নিয়ে তামাক খেতে খেতে গল্প করে।  

গাঁয়ের লোকেরা বলে–আমরা হলুম উলুখড় গো, সেপাইমশাই, আমাদের কাছে ফিরিঙ্গিরাও যা, ও নবাবও তাই

সেপাইরা বলে–তা এই যে তোমরা উপোস করছ, নবাব তোমাদের খেতে দিচ্ছে? নবাব তোমাদের কথা ভাবছে? নবাব তো মতিঝিলের ভেতরে বসে বসে ফুর্তি করছে বেগমদের নিয়ে–

তা ফিরিঙ্গিরাও পয়সা হলেই ফুর্তি করবে। পয়সা হবার পর কে আর গরিবগুরবোদের কথা ভাবে বলো? আমরা বড়লোক হলে আমরাই কি আর তা ভাবব?

সেপাইরা তবু বোঝায়।

বলে–এই আমাদের দেখো না, ফিরিঙ্গিদের পল্টনে নাম লেখাবার আগে আমরাও তোমাদের মতো ভাবতুম, তারপর এখন দলে ঢুকে দেখছি অন্যরকম

কী রকম দেখছ শুনি?

আরে, এ তোমাদের নবাবের পল্টনের মতন নয়। এখানে এরা ভাল খেতে-পরতে দেয়, ভাল করে কথা বলে, ভাল মাইনে দেয়। দেখছ না, খেয়েদেয়ে কী রকম খোদার খাসি হয়েছি–

এইরকম ঘুরে ঘুরে দেখে এসে সবাই রিপোর্ট দেয় রবার্ট ক্লাইভকে, ক্লাইভ সব মন দিয়ে শোনে।

 জিজ্ঞেস করে সবাই অ্যান্টিনবাব, সবাই নবাবের বিরুদ্ধে?

হ্যাঁ হুজুর, সবাই চায় ফিরিঙ্গিরা ফিরে আসুক। সবাই সেপাইয়ের দলে নাম লেখাতে চায়!

কেন চায়?

চায় এইজন্যে যে এখানে নাম লেখালে তাদের ভাল হবে। তারা পেট ভরে খেতে পাবে।

 এখন খেতে পায় না?

এখন খেতে পাবে কী করে হুজুর, নবাব মারে জমিদারদের, জমিদার মারে প্রজাদের। কারও ঘরে ফসল উঠতে দেখলে ডিহিদারের নজর পড়ে, তারপর হুজুর মুসলমান প্রজা হলে সাত খুন মাফ, আর কাফের হলে তার আর রক্ষে নেই।

অ্যাডমিরাল ওয়াটসন আর রবার্ট ক্লাইভ দু’জনেই মন দিয়ে সব কথা শোনে। ওয়াটসন যুদ্ধ করতে এসেছে, এত কথা শুনে কী লাভ বুঝতে পারে না। জিজ্ঞেস করে–এসব কথা নিয়ে আমাদের কী দরকার, নবাবের ফৌজ কোথায় গেল সব খবর জানলেই তো যথেষ্ট!

কিন্তু কর্নেল ক্লাইভ বলে-না

সত্যিই, ছেলেটা সেই যুগেই বুঝে নিয়েছিল যে লড়াই করতে গেলে শুধু ফৌজের খবর নিলেই চলবে না। সেখানকার মানুষের মতিগতির খবরও নিতে হবে। সেখানকার মানুষের সুখ-দুঃখের খবর। নিতে হবে।

কর্নেল ক্লাইভ জাহাজের ওপরে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে দেশটাকে দেখে। শীতকালের দিনেরবেলায় বেশ আরাম দেয় রোদটা। বরফের দেশের লোক গায়ের জামা খুলে রোদ পোয়ায়। রাত্রে আবার কনকনে শীতের ঠান্ডা। জাহাজ থেকে নেমে হেঁটে গিয়ে গাঁয়ের মধ্যে চলে যায়। ফিরিঙ্গি দেখে ছেলে-বুড়ো সবাই পালায়। তবু সাহেব হতাশ হয় না। লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন সাবধান করে দিয়েছিল খুব কেয়ারফুল রবার্ট, ওরা সাউথ-ইন্ডিয়ান নয়, ওরা বেঙ্গলি, ওরা ভেরি ডেঞ্জারাস

ভেরি ডেঞ্জারাস মানে?

 মানে, ওরা ভেরি ডিজ-অনেস্ট! ওরা লায়ার, আনফেথফুল

ক্লাইভ বললে–কিন্তু ডেঞ্জারাস হোক আর আনফেথফুলই হোক, ওদের নিয়েই আমাকে চলতে হবে, ওদেরই তো কান্ট্রি এটা, আমরা তো ফরেনার!

তারপর বললে–না অ্যাডমিরাল, আমার কিন্তু খুব ভাল লাগে, আই লাইক দেম—

কী রকম, তুমি কি ওদের সঙ্গে মেশো নাকি? ওরা যে ভয়ানক পাজি!

ক্লাইভ বলে–তা আমাদের কান্ট্রির লোকেরাই কী কম পাজি! আমাদের কান্ট্রির লোকরাই কি আমার সঙ্গে কম ডিজ-অনেস্টি করেছে? আমাকে কি তারা কম হেট করেছে? তা না হলে সাধ করে কি আমি আবার পালিয়ে এসেছি ইন্ডিয়াতে?

কথা বলতে বলতে কর্নেল ক্লাইভ নিজেকে আবার হঠাৎ সামলে নেয়। বেশি বললে–আবার ওরা অন্যরকম ভাববে। ইন্ডিয়ায় সার্ভিস করতে এসে নিজের অফিসারকে আর চটাবে না আগেকার মতো! সবাই সেলফিশ! সবাই ডেঞ্জারাস। একসঙ্গে এক জাহাজে যাদের সঙ্গে খায়দায়-ঘুমোয় তাদেরও যেন হেট করতে ইচ্ছে করে ক্লাইভের। যাদের জন্যে ক্লাইভ এত কিছু করল তারা তার কী উপকার করেছে। আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে কখন তন্দ্রা আসে, আর চোখ দুটো বুজে আসে। স্বপ্ন দেখে, ইংলন্ডের লোকেরা তার গলায় ফুলের গারল্যান্ড পরিয়ে দিচ্ছে, তাকে পার্লামেন্টের মেম্বার করে নিচ্ছে। স্বপ্ন দেখে, ইংলন্ডের লোকেরা বলছে–হিয়ার ইজ এ হিরো, হিয়ার ইজ এ কম্যান্ডার

কিন্তু স্বপ্নটা ভেঙে গেলেই আবার যে-কে-সেই। নিজের কান্ট্রির ওপর আবার ঘেন্না হয়। তার চেয়ে এরা অনেক ভাল। এই ইন্ডিয়ানরা। এরা ভয়ে ভাল করে কথা বলে না বটে, কিন্তু ইংলন্ডের লোকদের মতো নয়। বড় সরল, বড় বোকা। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বললেও মনের কথা চেপে রাখতে পারে না ওরা। সব বলে দেয়। বলে–আপনারা হুজুর বড় ভাল লোক আপনারা হুজুর আমাদের সঙ্গে বেশ ভাল করে কথা বলেন।

ক্লাইভ জিজ্ঞেস করে–কেন, নবাবের লোকরা ভাল করে কথা বলে না?

না হুজুর, তবে আর আমাদের দুঃখটা কীসের? তারা আমাদের কাফের বলে। আমাদের কলমা পড়িয়ে মুসলমান করতে চায়। আপনারা যদ্দিন কলকাতায় ছিলেন তদ্দিন লোকে কত সুখ্যাত করেছে আপনাদের! আপনারা চলে যাবার পর আবার সেখানে যে-কে-সেই!

তোমরা কি চাও আমরা আবার আসি?

লোকেরা বলে–নবাবের সঙ্গে আপনারা পারবেন কী করে আপনাদের কি আর অত ফৌজ আছে?

সে তোমাদের ভাবতে হবে না, বেশি ফৌজ থাকলেই লড়াইতে জেতা যায় না, তোমরা যদি আমাদের দিকে থাকে তা হলেই আমরা জিতব।

লোকগুলো বেশ ঘরোয়া হয়ে গিয়েছিল ক’দিনেই। ক্লাইভকে খেজুররস খাওয়াত, আসকে পিঠে-পুলি খাওয়াত। ক’দিনেই বেশ জমিয়ে নিয়েছিল গাঁয়ের লোকদের সঙ্গে। শেষকালে ঠিক যাবার আগের দিনই ওই কাণ্ডটা ঘটল। বেশ মুশকিলে পড়ল ক্লাইভ সাহেব। দু’জন লেডি, তাদের নিয়ে কী করবে!

তা এদের এখেনে ধরে নিয়ে এলি কী জন্যে? হোয়াই?

সেপাইদেরও দোষ নেই। এরকম তারা করে থাকে বরাবর। নবাবের ফৌজি সেপাইরা মেয়েছেলে পেলে ধরে নিয়ে এসে মিরবকশিকে উপহার দেয়। এইসব দিয়েই তো চাকরিতে উন্নতি হয়। এই-ই তো রেওয়াজ!

অ্যাডমিরাল ওয়াটসন বললে–এই নিগার মেয়েদের নিয়ে এখন কী করবে তুমি?

ক্লাইভ বললে–কিন্তু এদের কার কাছে ছেড়ে দেব?

ওয়াটসন বললে–সেই কথা নিয়ে এখন মাথা ঘামাবে নাকি তুমি?

 কিন্তু এদের কে দেখবে? চেহারা দেখে মনে হয় খুব রেসপেক্টবল ফ্যামিলির ওয়াইফ। আর ওটা তার মেঙ-সারভেন্ট। দেখি, আমি ওদের কী করতে পারি–

বলে সেই রাত্রেই ক্লাইভ লেডি দু’জনের কাছে গেল। লেডি দু’জন তখন শীতে কাঁপছে। সঙ্গে সেই সেপাইটাও রয়েছে। সে বাংলা কথা বুঝিয়ে দিতে পারবে।

সেই যে রাত্রে ধরে এনেছে, তখন থেকে ছোট বউরানি দুর্গার কোল ঘেঁষে বসে আছে। একে গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া, তার ওপর ফিরিঙ্গিদের জাহাজ। ম্লেচ্ছ। জীবনে কখনও দুর্গা এমন কাণ্ডর মধ্যে পড়েনি। ছোট বউরানিও না। সেপাই হরিচরণ বারবার বুঝিয়েছে তোমাদের কিছু ভয় নেই গো, আমাদের কর্নেলসাহেব খুব ভাল লোক।

দুর্গা বলেছে তুমি তো বলছ বাছা, কিন্তু ওরা তো ম্লেচ্ছ, গোরু খায়, ওরা কী করে ভাল লোক হবে?

হরিচরণ বলেছে গোরু খেলেই কি আর খারাপ লোক হয়, দেখবে তোমাদের কোনও ক্ষেতি হবে

দুর্গা বলেছে–দেখো বাপু, তোমাদের সাহেব আমাদের যেন ছুঁয়ে দেয় না, তা হলে আমাদের জাত যাবে

কিন্তু সাহেব যখন এল তখন দুর্গা একগলা ঘোমটা দিয়ে দিলে। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে যতটা দেখা যায় চেয়ে দেখলে সাহেবের মুখের দিকে। লাল টকটকে মুখখানা। মুখময় যেন ঘামাচি ভরতি। দেখে দুর্গা যে দুর্গা, তারও বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠল।

সাহেব বললে–আমার সেপাইরা তোমাদের ভুল করে ধরে এনেছে, ভেবেছে ফ্রেঞ্চ বোট–তা তোমরা কোথায় যাবে বলল, আমি তোমাদের সেখানেই পাঠিয়ে দিচ্ছি–বলো কোথায় যাবে?

দুর্গা বললে–আমরা কাশীধামে যাচ্ছিলাম, সেইখানেই যাব—

কাশী? কাশীধাম? সে কোথায়?

 হরিচরণ বললে–সে উত্তরে, সে অনেক দূর হুজুর, ছ’মাসের পথ

সাহেব বললে–কিন্তু অত দূরে তোমরা দু’জন লেডি যাবেই বা কী করে? তোমাদের সঙ্গে কেউ নেই?

দুর্গা বললে–আমাদের সঙ্গে তো আমাদের বিশ্বাসী পাহারাদার ছিল, তার কাছে বন্দুক ছিল সে তো গুলি খেয়ে মরে গেছে, আর মাঝিরা কোথায় গেছে জানি না

সাহেব বললে–মাঝিদের আমরা ধরে রেখেছি পাছে তারা ভয় পেয়ে তোমাদের ছেড়ে পালিয়ে যায়; কিন্তু সঙ্গে তোমাদের নিজেদের কোনও পুরুষ নেই? এই লেডির হাজব্যান্ড কোথায়?

হরিচরণ সব বুঝিয়ে দিলে সাহেবকে। দুর্গার কাছে সবই শুনে নিয়েছিল সে। মহিলাটির হাজব্যান্ড হুজুর পাগলাটে মানুষ। বিয়ে হবার পর থেকেই সে নিরুদ্দেশ। সে হল পোয়েট। বাংলাদেশে তো জাতকুল মিলিয়ে বিয়ে দিতে হয়, তাই ওইরকম পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল এঁর। ইনি বড় দুঃখী সাহেব, এরা বাবা বিশ্বনাথের চরণে আশ্রয় নেবার জন্যে যাচ্ছিল, হঠাৎ পথের মধ্যে এই বিপদ!

হরিচরণ দুর্গার দিকে ফিরে বললে–তা তোমরা কোথায় যাবে ঠিক করো আগে, সেইরকম ব্যবস্থা করে দেবে–তবে সাহেব কাশীধামে পৌঁছিয়ে তো দিতে পারবে না। যদি নিজের দেশে ফিরে যেতে চাও তো বলো–

সাহেবও বললে–আমাদের নিজেদেরই তো এখানে দাঁড়াবার জায়গা নেই, আগে ছিল, এখন নবাবের সঙ্গে ওয়ার চলছে–এ-অবস্থায় আমরাই বা তোমাদের কতটুকু সাহায্য করতে পারি

তা বটে! দুর্গাই বা কী বলবে! সব কথা কি খুলে বলা যায় সবাইকে!

 সাহেব বললে–তা হলে তোমরা এখন ভাবো–ভেবে বোলো

বলে সাহেব চলে গেল। হরিচরণকে ওদের দেখাশোনা খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে বললে। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন পাশের জাহাজে ছিল। সেখানে যেতেই অ্যাডমিরাল জিজ্ঞেস করলে–তুমি কী ঠিক করলে রবার্ট?

ক্লাইভ বললে–ওদের বলে এসেছি ভাবতে, ভেবে যা ঠিক করে তাই হবে

অ্যাডমিরাল রেগে গেল–আমি ওদের কথা বলছি না, লেট দেম গো টু হেল এখন এগিয়ে যাবে, না এখানেই ক’দিন থেকে ওয়াচ করবে

ক্লাইভ বললে–জাহাজ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ভাল লেট আস গো নিয়ারার

ওয়াটসন বললে–না, জাহাজ নয়, হাঁটা-পথে গিয়ে ওদের অ্যাটাক করা ভাল-

খানিক তর্ক হল। কিন্তু অ্যাডমিরাল ওয়াটসন চাকরিতে বড়, সুতরাং তার কথায় সায় দিতে হল। হাঁটা-পথেই যাবে ইংরেজ ফৌজ। দশ মাইল রাস্তা। সেপাইরা পথের নিশানা জানে। তারাই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। শীতকাল, রাস্তায় কাদা নেই, যেতে কষ্টও হবে না কারও।

ছোট বউরানি ভোরবেলা ডাকলে–দুগ্যা—

কী বউরানি?

তুই বললি না কেন আমরা কেষ্টনগরে যাব, তা হলে এখানে আর এমন করে পড়ে থাকতে হত না—

দুগ্যা বললে–হ্যাঁ, কেষ্টনগরের কথা বলি আর সব জানাজানি হয়ে যাক, তখন?

কিন্তু আমার যে বড় ভয় করছে!

ভয় কীসের সাহেবকে? দুর, সাহেব এমনিতেই জব্দ হয়ে গেছে।

 কীসে জব্দ হল?

তোমাকে দেখে!

তোর মরণ। ফের যদি ওকথা বলবি তো আমি এই গঙ্গায় ঝাঁপ দেব বলে রাখছি!

সাহেব কিন্তু সত্যিই ভাল। মাঝে মাঝে হরিচরণকে দিয়ে খবর নেয়। নিজেও আসে। কোনও কষ্ট হচ্ছে কিনা, খাওয়াদাওয়ার অসুবিধে হচ্ছে কিনা এইসব। পল্টনের দল হেঁটে হেঁটে চলেছে, আর জাহাজগুলো চলেছে গঙ্গার ওপর দিয়ে।

কিন্তু সেদিন সাহেবও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। জাহাজ দাঁড়িয়ে ছিল গঙ্গায় নোঙর বেঁধে, হঠাৎ খবর এল মানিকচাঁদ দু’হাজার ফুট-সোলজার আর দেড় হাজার ঘোড়সওয়ার নিয়ে আগেই কখন বজবজে এসে হাজির হয়েছে টের পায়নি কেউ। হঠাৎ দুমদাম শব্দ পেয়েই দুর্গার ঘুম ভেঙে গেছে। ছোট বউরানিও উঠে বসেছে। উঠে বসে জিজ্ঞেস করলে–ও কীসের শব্দ রে দুগ্যা?

বাইরে ডাঙায় তখন হট্টগোল। সেদিকে উঁকি মেরে দেখে দুর্গা বললে–হরিচরণকে ডাকি

হরিচরণকে আর ডাকতে হল না। তার আগেই সাহেব এসে হাজির। একেবারে পাচ্ছে। পেছনে পেছনে হরিচরণ।

এসেই বললে–লেডিজ, আমাদের বড় বিপদ হয়েছে, জানি না আমাদের কপালে কী আছে। তোমরা যদি কোথাও যেতে চাও, এই হরিচরণ তোমাদের বোটে করে নিয়ে যাবে। আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। উইশ ইউ গুড লাক–

তখন আর ভাববারও সময় নেই ক্লাইভ সাহেবের। মাত্র এই ক’টা সোলজার নিয়ে মানিকচাঁদের সঙ্গে লড়াই করা মানেই তো মারা যাওয়া।

ওদিক থেকে ওয়াটসন চিৎকার করছে–রবার্ট, রবার্ট

আর দাঁড়াতে পারলে না সাহেব। দুর্গা হঠাৎ উঠল। উঠে সাহেবের কাছ থেকে এক হাত দূরে হঠাৎ মাথাটা মেঝের ওপর ঠেকিয়ে গড় করলে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললে–তোমার ভাল হবে সাহেব, তোমার কথা আমাদের অনেকদিন মনে থাকবে

নৌকো ছেড়ে দিলে। হরিচরণও উঠল। মাঝিরা তৈরি ছিল। সেদিকে অত দেখবার সময় নেই ক্লাইভের। মেজর কিলপ্যাট্রিক, অ্যাডমিরাল ওয়াটসন, রবার্ট ক্লাইভ তখন আর এক লড়াইয়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

দূর থেকে কখনও কামানের শব্দ আসছে। ছোট বউরানি বললে–ফিরিঙ্গিটা ভাল লোক, না দুগ্যা, আমাদের তো কিছু করলে না

দুর্গা বললে–করবে কী করে, আমি যে তার আগেই উচাটন করে দিয়েছিলাম, দেখলে না, আমি সামনে গড় হয়ে পেন্নাম করলাম। তার মানেটা কী?

শ্রীনাথ তখন প্রাণপণে বইঠা বেয়ে চলেছে। হরিচরণ ফিরিঙ্গি কোম্পানির সেপাই। সেপাই হলেও ক্লাইভ সাহেব তাকে এই কাজের ভার দিয়েছে। যে-কোনও নিরাপদ জায়গায় এদের পৌঁছে দিয়ে আবার যেমন করে হোক ফৌজের দলে ফিরে যেতে হবে।

কিন্তু তখনও হরিচরণ জানে, না দুর্গাই জানে যে, তাদের জন্যে আরও এক নতুন বিপদ অপেক্ষা করে আছে!

বজবজের ওপারে আলিগড়, আর ওদিকে মকওয়া। দুটো জায়গাতেই দুটো মাটির কেল্লা রয়েছে। নবাবের বজবজের কেল্লার ভেতর থেকে রাজা মানিকচাঁদের সেপাইরা গোলা ছুড়ছে। বড় বড় কামানের গোলা এসে পড়তে লাগল গোরা পল্টনদের সামনে।

কর্নেল ক্লাইভের মাথায় তখন বজ্রাঘাত। আর পেছনে চলে না। অর্ডার দিলে ফরওয়ার্ড মার্চ

শ্রীনাথ তখন প্রাণপণে বইঠা বেয়ে চলেছে। হরিচরণ বললে–আরও জোরে চালাও ছিন্নাথ ফিরিঙ্গিদের আর ভরসা নেই, রাজা মানিকচাঁদ এবার আর ছেড়ে কথা বলবে না, এবার পালাবে এ-তল্লাট ছেড়ে

নৌকোটা যেন তিরের মতো সোঁ সোঁ করে এগিয়ে চলল।

*

সারাফত আলি যথারীতি দোকানে বসে মৌতাতে ঝিমোচ্ছিল। এই ঝিমুনিটাই তার বড় আরামের জিনিস। এই আরামটার জন্যেই সে আগরবাতি জ্বালায়, গড়গড়ায় তামাকের ধোঁয়া টানে। এই আরামের মধ্যেই মনে মনে সে অনেক মতলব আঁটে। তার মনে হয় একদিন চেহেসূতুন গুঁড়ো হয়ে মাটিতে মিশিয়ে ধুলো হয়ে যাবে। হাজি-আহম্মদের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এ-মসনদ চিরকাল এমনি চলবে না। ভাইতে ভাইতে লড়াই শুরু হয়ে গেছে। এবার শওকত জঙ আসছে নবাব হয়ে। শওকত জঙকেও আবার যেতে হবে। তারপর ফিরিঙ্গিরা আসবে, ফিরিঙ্গিরাও যাবে। এমনি করেই দুনিয়াদারি চলবে ইন্তেকাল পর্যন্ত। এই-ই দুনিয়া। কিন্তু তবু সারাফত আলির মনে হয় চোখের সামনে সব ঘটনাটা না দেখতে পারলে যেন তৃপ্তি নেই।

হঠাৎ সামনে একটা তাঞ্জাম এসে দাঁড়াতেই যেন সারাফত আলির নেশাটা জমে উঠল।

 কৌন?

না, খদ্দের নয়, খোজা বরকত আলি।

 হুজুর, কান্তবাবু এই খুলিতে থাকে?

 থাকে। কেন?

ওমরাহ সফিউল্লা খাঁ সাহেব একবার মুলাকাত করতে চান।

কান্তবাবু কি আবার আমির-ওমরার সঙ্গে দোস্তালি লাগিয়েছে।

 কী জরুরত?

তা জানি না মিঞাসাহেব, খাঁ সাহেব তাঞ্জামের অন্দরে বসে আছেন, কান্তবাবুর সঙ্গে বাতচিজ আছে–

এই সফিউল্লা, ইয়ারজান, মেহেদি নেসার একদিন এই চকবাজারের রাস্তায় রাস্তায় বেত্তমিজি করে বেড়িয়েছে। জেনানাদের বোরখা উঠিয়ে মুখ দেখেছে, গঙ্গায় চান করতে করতে আওরতদের দেখে শিষ দিয়ে খোয়ার করেছে। আর এখন আবার তাঞ্জাম না হলে এক পা নড়তে পারে না। ইজ্জতদার আদমি হয়ে গেছে। তাজ্জব দুনিয়া।

সারাফত আলি সেইখানে বসেই চেঁচিয়ে উঠলে কী, সফিউল্লাসাহাব, মিঞাসাহেবকে আর যে পছনতে পারেন না দেখছি! আমি খুশবু তেলওয়ালা সারাফত আলি। বহুত বহুত বন্দেগি জনাব

বরকত আলি একটু ভড়কে গেল।

সারাফত আলি তখনও বলে চলেছে–তাঞ্জামটা সাবনে নিয়ে আসুন না সফিউল্লাসাহাব, আমাকে অত ডর কেন?

বরকত আলি তাঞ্জামের কাছে গেল। মুখ নিচু করে বললে–মিঞাসাহেব বাত করছে আপনার সঙ্গে

মরালী বললে–জিজ্ঞেস করো, কান্তবাবু কুঠিতে আছে কি না–

সারাফত আলি সাহেব তখনও চেঁচাচ্ছে। বহুদিন পরে সফিউল্লার সঙ্গে দেখা, এমন সুযোগ ছাড়া যায় না, যাদের এককালে কুকুর-বেড়ালের মতো মনে করেছে সারাফত আলি, তারাই আজ মুর্শিদাবাদের মসনদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তারাই এখন আট-বেহারার তাঞ্জামে চড়ে চকবাজারের রাস্তা দিয়ে বুক ফুলিয়ে চলছে।

সে-সব দিনের কথা বেবাক ভুলে গেলে খাঁ সাহেব! আজকে মির্জা মহম্মদের পা চেটে চেটে বুড়ো মিঞাসাহেবকেও ইয়াদ রাখলে না। নিমকহারামের বাচ্চা যত–

নেশার ঝোঁকে মিঞাসাহেব যা-নয়-তাই বলে সফিউল্লা খাঁ সাহেবকেনাগাড়ে গালাগালি দিয়ে যেতে লাগল। চকবাজারের রাস্তার কিছু লোক জড়ো হয়ে গেল খুশবু তেলের দোকানের সামনে। বাদশাও এসে দাঁড়াল ভেতরে। বরকত আলি দেখলে এ এক মহাবিপদ শুরু হয়ে গেল।

মিঞাসাহেব বললে–কোথায় যাচ্ছিস তুই? দাঁড়া এখানে। তুই তো নবাবের নোকরি করিস, সফিউল্লা সাহেব তোর কৌন? তুই সফিউল্লা খা’র পা চাটিস কেন? সফিউল্লা তোকে তলব দেয়?

বুড়ো যেন হঠাৎ অনেকদিন পরে একেবারে হাজি আহম্মদকে সামনে পেয়েছে হাতের কাছে। হাতের কাছে পেয়ে তার বিবি চুরির বদলা নিচ্ছে।

মরালী তাঞ্জামের মধ্যে তখন থরথর করে কাঁপছিল। কী করতে গিয়ে কী হয়ে গেল। চকবাজার থেকে পালাতে পারলেই যেন বাঁচে সে। চেহেল্-সুতুনের ভেতরেই যেন তার নিশ্চিন্ত আশ্রয়। অথচ বরকত আলি হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে আর গালাগালিগুলো শুনছে।

ততক্ষণে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। চকবাজার সুষ্ঠু সব লোক এসে ভেঙে পড়েছে দোকানের সামনে৷ বুড়োকে সবাই নিরীহ মানুষ, নেশাখোর মানুষ বলে জানে, সে হঠাৎ কেন চিল্লাচিল্লি করছে তা বুঝতে পারলে না।

কিন্তু ওদিকে আর এক কাণ্ড হল। ওদিক থেকে আর একটা আট-বেহারার তাঞ্জাম আসছিল। সেটা এই ভিড়ের সামনে এসেই হঠাৎ থেমে গেল।

কৌন?

তাঞ্জামের দরজার পাল্লা দুটো ভোলাই ছিল। তার ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে বেরিয়ে এল নবাব মির্জা মহম্মদের ইয়ার ওমরাহ সফিউল্লা খাঁ।

সবাই তাজ্জব হয়ে গেছে। এ কোন সফিউল্লা সাহেব!

আরে মিঞাসাহেব, এত গালাগালি দিচ্ছ কোন বেল্লিককে?

আরে তুম সফিউল্লা সাহেব?

বুড়ো সারাফত আলিও যেন এতক্ষণে চমকে উঠেছে। তা হলে এতক্ষণ কোন সফিউল্লাকে গালাগালি দিচ্ছিল সে? তারপর বরকত আলিকে দেখে বললে–এই, তোর তাঞ্জামের মধ্যে কোন সফিউল্লা? অ্যাঁ?

সফিউল্লা সাহেব তখন নিজেই মরালীর তাঞ্জামের দরজাটা হাট করে খুলে দিয়েছে।

আরে তুম কোন হো?

মরালীর সমস্ত শরীরই কাঁপছিল। এবার কান দুটোও ঝা ঝা করে উঠল! কেন যে বরকত আলি সফিউল্লা খাঁ সাহেবের নাম করতে গিয়েছিল, আর কে যে সফিউল্লা সাহেব তাও সে জানে না। মাথার ওপর যেন বাজ ভেঙে পড়ল তার।

ততক্ষণে মরালীর হাত ধরে টান দিয়েছে সফিউল্লা সাহেব। একেবারে নরম তুলতুলে হাত। কী যেন সন্দেহ হতেই সফিউল্লা সাহেব মুখ নিচু করে তাঞ্জামের ভেতরে উঁকি দিয়েছে। আশেপাশের ভিড়ের মধ্যে থেকেও অনেকে উঁকি মেরে দেখলে। ভারী কচি মুখখানা।

বরকত আলি হাঁহাঁ করে বাধা দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু ওমরাহ সফিউল্লাকে বাধা দেবার সাহস নেই খোজা বরকত আলির। আর ঠিক সঙ্গে সঙ্গে মরালী চিৎকার করে উঠেছে–ছাড়ো, হাত ছাড়ো–

প্রথমটায় সফিউল্লা একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুর্শিদাবাদের ফুর্তির স্বাদ একবার পেয়ে যার হাড় পেকে গেছে, সে অত সহজে ছাড়বার পাত্র নয়।

জিজ্ঞেস করলে–কে, ও কৌন, বরকত আলি? কোন সফিউল্লা?

বরকত আলি তখন বোবা! পাথরের মতো সে ঠায় চুপ দাঁড়িয়ে আছে। তার নোকরি তো এবার যাবেই, কিন্তু কোতল থেকে রেহাই পাবে কি না তাই-ই তখন সে ভাবছে।

সফিউল্লা সাহেব আবার হাত ধরতে যেতেই মরালী এক চড় মেরেছে সফিউল্লা সাহেবের গালে।

আর যাবে কোথায়! সফিউল্লা সাহেব চিৎকার করে উঠেছে কোতোয়াল!

মরালীর মনে আছে সে-সব দিনের কথা। সমস্ত মুর্শিদাবাদ যেন একেবারে আনচান করে উঠেছিল। এত বড় দুঃসাহসের কথা তখন কেউ ভাবতেই পারেনি। কল্পনা করতেও ভয় পেয়েছিল। নানিবেগম পাগলের মতো ছুটে এসেছিল মতিঝিলে। বলেছিল–এ কী করলি মা তুই, এমন করে নিজের সর্বনাশ কেন করতে গেলি?

কিন্তু মরালীই কি জানত এমন হবে!

সফিউল্লা সাহেব গালে চড় খেয়ে চুপ করে থাকবার মানুষ নয়। একেবারে হিড়হিড় করে টেনে বার করলে মরালীকে। আর টানাটানিতে তার মাথার তাজটা খসে পড়ে গেল। আর সবাই দেখলে একজন জেনানা, একেবারে খাস বেগম-মহলের জেনানা।

সফিউল্লা খাঁ সাহেব আর দেরি করেনি।

একবার শুধু বরকত আলিকে জিজ্ঞেস করেছিল–এ কে? এ কোন বেগম?

কিন্তু বরকত আলিরও তো গর্দানের ভয় আছে! বরকত আলিরও তো জানের ভয় আছে। সে বোবার মতো দাঁড়িয়ে থেকে তারপর কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল, আর দেখতে পাওয়া যায়নি তাকে। তারপর সারাফত আলির চোখের সামনে দিয়ে চকবাজারের হাজার হাজার মানুষের সামনে দিয়ে সফিউল্লা সাহেব একেবারে মরালীকে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল মতিঝিলে। মতিঝিলের ফটক বন্ধ করে দিয়েছিল পাহারাদার। তারপর মতিঝিলের একটা ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে সফিউল্লা সাহেব চিৎকার করে উঠেছিল–তুমি কে? তুম কৌন?

সে-ঘটনার কথা মনে আছে মরালীর। মরালী তখন হাঁসফাস করছে।

 বললে–আমাকে ছেড়ে দাও

সরাবখানার ভেতরে বসে ইব্রাহিম খাঁ সব দেখছিল। মরালীকে দেখেই চমকে উঠেছে আবার। আবার মুখপুড়ি এখানে এসেছে সফিউল্লা খাঁ সাহেবের সঙ্গে। মুখপুড়ি চরিত্রটা একেবারে খারাপ করে ফেলেছে গো! ছি ছি ছি!

ইতিহাসের আর একটা শিক্ষা এই যে, যে-জাত একবার ক্ষয় হবার মতো হয়, তখন তার সবদিক দিয়ে সর্বাঙ্গে ক্ষয়ের লক্ষণ প্রকাশ পায়। আলিবর্দি খাঁর মসনদ ছিল ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের মসনদ। মানুষের মনুষ্যত্বকে অস্বীকার করার মসনদ। শুধু তো জয় দিয়ে ইতিহাসের বিচার হয় না, তার পরাজয়ও ইতিহাসের মানদণ্ডে বিচার করে দেখতে হয়। মসনদ যখন পঁড়িয়ে থাকে তখনও তার পরীক্ষা, যখন পতন হয়, তখনও তাই। তাই শান্তির সময়ের হালচাল দেখে পতনের সময়ে চমকে উঠতে নেই। পতনের বীজ লুকিয়ে থাকে শান্তির মধ্যে। সে-পতনের বীজ পুঁতে গিয়েছিলেন আলিবর্দি খ নিজেই। নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা শুধু তার অসহায় উত্তরাধিকারী।

সেদিন মতিঝিলের মধ্যে নবাব সুজাউদ্দিনের আত্মাও বোধহয় চমকে উঠেছিল তার নিজের মূর্তি। দেখে। সফিউল্লা যেন তারই প্রতিচ্ছায়া, তারই মানস-শয়তান। শুধু সুজাউদ্দিনই নয়। সরফরাজ, আলিবর্দি সবাই যেন নিজেদের প্রতিমূর্তি দেখে একসঙ্গে তারস্বরে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন। আর। শুধুই কি সরফরাজ, আলিবর্দি খা? হোসেনকুলি খাঁ, করিম খাঁ, ভাস্কর পণ্ডিত, যারা এতদিন ঘুমিয়ে ছিল বিস্মৃতির অতলগর্ভে, তারাও হঠাৎ জেগে উঠে বলে উঠল–শাবাশ–শাবাশ ।

মতিঝিলের খিদমদগাররাও জানতে পারেনি ইতিহাসের প্রতিশোধ তখনও ষোলোকলা পূর্ণ হতে কতখানি বাকি আছে। মরালীও জানতে পারেনি সেদিন তার অতখানি দুঃসাহস কে অমন করে জুগিয়ে দিয়েছিল। কারা! কারাই বা তারা। সেদিন সে তার অতীত ভাবেনি, বর্তমান ভাবেনি, ভবিষ্যৎও ভাবেনি। ভাবেনি কী তার প্রতিফল, কতখানি তার শাস্তি, কেমন তার প্রতিক্রিয়া। সাধারণ গ্রামের একটা মেয়ে সে। নিয়তির অমোঘ চক্রে সে এসে পড়েছিল বাংলার ইতিহাসের এক বিষণ্ণ সন্ধিক্ষণে। সে জানতে পারেনি, তাকে উপলক্ষ করেই ইতিহাসের গতি একদিন নতুন করে মোড় ঘুরবে।

সফিউল্লা সাহেব তখন মতিঝিলের একটা ঘরের মেঝের ওপর অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। শ্বেতপাথরের ঠান্ডার ওপরেও সফিউল্লা সাহেবের গরম রক্ত যেন জমে বরফ হয়ে উঠতে জানে না। শীতকালের ঠান্ডাতেও টগবগ করে ফুটছে সে-রক্ত। সফিউল্লা সাহেবের ঠান্ডা দেহটার পাশে টগবগে গরম রক্ত গড়গড় করে গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে নর্দমার দিকে।

আমাকে অপমান? আমার ইজ্জৎ কি তোমার মা-বোনের ইজ্জতের চেয়ে কোনও অংশে ছোট? আমি কি তোমার রক্তের হকদার? মানুষের সম্মানের দাম কি রাস্তার ধুলো? যদি রাস্তার ধুলোই হয় তো সেই রাস্তার ধুলোতেই তোমার ঠাই হোক!

সঙ্গে সঙ্গে মতিঝিলের খিদমদগাররাও বোধহয় গন্ধ পেয়েছিল। বাইরে থেকে নেয়ামত দরজা ঠেলছে। কেওয়াড়ি খোলো, কেওয়াড়ি খোলো, কেওয়াড়ি খোলো

কেওয়াড়ির তলার ফাঁক দিয়ে সফিউল্লা সাহেবের গরম রক্ত বাইরের বারান্দায় এসে তখন এদিক-ওদিকে মাথা কুটতে লেগেছে। তবে কি আরও অনেকের মতো মরিয়ম বেগমও খুন হয়ে গেল!

আবার সেই এক চিৎকার এল–কেওয়াড়ি খোলো, কেওয়াড়ি খোলো, কেওয়াড়ি খোবলা

মরালী তখন পাথর হয়ে গেছে। মতিঝিলের শ্বেতপাথরের থামগুলোর মতোই নিথর-নিশ্চল নিষ্প্রাণ পাথর।

*

চেহেসূতুনের ভেতরের বাগানে তখনও সেই গানটা ভাসছে–যো হোনেকা থি, উও তো হো গয়ি, আভি উসকো ক্যা পরোয়া

মতিঝিলে যাওয়া হয়নি কান্তর। ইব্রাহিম খাঁর কাছে গিয়েই বা কী লাভ। বশির মিঞা হাতিয়াগড়ে গিয়েছিল। সেখানে কী করছে কে জানে! হয়তো এবার সব জানাজানি হয়ে যাবে। তার আগে যদি মরালী বেরিয়ে আসে তো বেঁচে যাবে!

মহিমপুরের দিক থেকেই ফিরে আসছিল আবার। সব যেন গোলমাল হয়ে গেছে কান্তর। যেভাবে কান্ত জীবন আরম্ভ করেছিল, সে যেন আজ কল্পনা। হয়তো এ-চাকরিও তার থাকবে না বেশিদিন। মেহেদি নেসার সাহেব তার ওপর চটে গেছে, মনসুর আলি মেহেদি সাহেবও চটে গেছে। এরপর কে তাকে রাখবে! সারাফত আলি সাহেব? কিন্তু সারাফত আলি সাহেবের যে-চাকরি সে-চাকরিও কি তার পোষাবে!

নজর মহম্মদ না?

 নজর মহম্মদও দেখতে পেয়েছে তাকে।

আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম কান্তবাবু! আজকে চেহেল্‌-সুতুনে যাবেন না? নবাব তো ফৌজ নিয়ে পূর্ণিয়ায় লড়াই করতে গেছে।

মেহেদি নেসার সাহেব?

 মেহেদি নেসার সাহেব ভি গেছে। চলিয়ে।

আমার কাছে তো এখন মোহর নেই নজর মহম্মদ, চলো, সারাফত আলি সাহেবের খুশবু তেলের দোকানে চলো।

নজর মহম্মদ বললে–সে আমি পরে মোহর নিয়ে নেব, আপনি সেজন্য ভাববেন না। আমি মিঞাসাহেবের পুরনো খদ্দের

অনেক আশা নিয়ে সেদিন কান্ত চেহেল্-সুতুনে গিয়েছিল। কিন্তু তখন কি জানত সেখানে গিয়ে সে আর এক অদৃশ্যপূর্ব নাটকের মধ্যে জড়িয়ে পড়বে।

মরালী তার একটু আগেই চলে গেছে। পেশমন বেগম তখন সবে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। পেশমন বেগম একদিন নাচতে এসেছিল, গান গাইতে এসেছিল। একদিন অনেক আশা নিয়ে দিল্লির বাদশার দরবারে মার সঙ্গে যাতায়াত শুরু করেছিল। সে অনেকদিন আগের কথা। পেশমনের মা বলেছিল আখের চিনে জিন্দগির পথে চলবি মা, নইলে দুনিয়া থেকে একেবারে বরবাদ হয়ে যাবি

সেই বরবাদই শেষ পর্যন্ত হয়ে গেছে পেশমন বেগম। আজ আর তার ডাক পড়ে না। আজ মতিঝিলের দরবারে গুলসনের ডাক আসে। অথচ একদিন পেশমন না হলে মহফিলের আসরই বসতে পারত না। সে-সব দিন আর নেই। সেসব দিন আর আসবেও না।

বাইরে থেকে গুলসনের গান ভেসে আসছিল তখনও। গুলসন আজ নিজের ঘরে বসেই সন্ধে থেকে গানের তালিম দিচ্ছে। যো হোনেকা থি, উও তো হো গয়ি, আভি উসকো ক্যা পরোয়া। যা হবার ছিল তা তো হয়েই গেছে, এখন আর তা নিয়ে ভেবে কী লাভ! সমস্ত চেহেলসুতুনটাই যেন ওই কথা বলে চলেছে। গুলসন যেন সকলের হয়েই সকলের মনের কথা বলে চলেছে। কী হবে এই জীবন। রেখে! কী হবে রোজ রাত্তিরে এই সেজেগুজে, কী হবে এই রূপ-যৌবন-মোহর প্রশংসা নিয়ে। সবই তো নিরর্থক। সবই তো মিথ্যে! তাই শুধু ফুর্তি করে যাও। যা হবার তা হবেই। একদিন ছিল যখন নবাব। মির্জা মহম্মদ পেশমনের পায়ে মাথা বিকিয়ে দিতে পারলে ধন্য হয়ে যেত। একদিন ছিল যখন মেহেদি নেসার, ইয়ারজান, সফিউল্লা সাহেব পেশমনকে খোশামোদ করে গান শুনতে চাইত। একদিন ছিল যখন এই চেহেল্-সুতুন পেশমনের সেবার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকত। আজ তাকে নিজের ঘরে একলা কাটাতে হচ্ছে। পেশমন বেগমের হাসি পেল সেদিনের কথা ভেবে।

এতক্ষণ বোধহয় মরিয়ম বেগম চকবাজারে পৌঁছে গেছে। চুস্ত পায়জামা সেরোয়ানি আর তাজ মাথায় দিয়ে নিজের বালমের সঙ্গে দেখা করছে।

একদিন পেশমন বেগমও খোজাদের সঙ্গে নিয়ে তাঞ্জামে করে চকবাজারে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে রাত কাটিয়ে এসেছে। তারপর আজ আর তার কোথাও ডাক পড়ে না। এখন গুলসনের পালা। কিন্তু একদিন গুলসনেরও দিন চলে যাবে। তখন মরিয়ম বেগমের পালা শুরু হবে। এমনি করেই অনাদি অনন্তকাল ধরে চেহেল্‌-সুতুন চলবে, ইতিহাস গড়িয়ে গড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাবে। আর তারপর একদিন পেশমনের মতো মরিয়ম বেগমও মুছে যাবে চেহেল্-সুতুন থেকে। তখন আবার আসবে নতুন একজন। সেই নতুনকে নিয়েই আবার কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে তখন!

কে?

হঠাৎ মনে হল যেন ঘরের বাইরে কার ছায়া নড়ে উঠল।

আমি বেগমসাহেবা, আমি নজর মহম্মদ!

নজর মহম্মদকে দেখেই পেশমন উঠে বসল। এমন তো হয় না কখনও। নজর মহম্মদ তো এমন সন্ধেবেলা কখনও আসে না তার ঘরে।

একজন জওয়ান এসেছে বেগমসাহেবা। খুব খুবসুরত জওয়ান, আপনার ঘরে আনব?

 এমন ঘটনাও যেন অনেকদিন তার জীবনে ঘটেনি। একটু অবাক হয়ে গেল পেশমন।

 আমার ঘরে?

হ্যাঁ বেগমসাহেবা, সারাফত আলির খুশবু তেলওয়ালার আদমি। বহুত খুবসুরত!

পেশমন তবু বললে–আমার ঘরে? ঠিক জানিস তুই? অন্য দুসরি কোনও বেগম নয়, আমি?

নজর মহম্মদ তাড়াতাড়ি গিয়ে কান্তকে ঘরে ডেকে নিয়ে এসেছে। কান্তও কম অবাক হয়নি। এ কার ঘরে আজ নজর মহম্মদ তাকে নিয়ে এল। এ তো রানিবিবি নয়। এ তো মরিয়ম বেগম নয়। এ তো মরালী নয়।

কান্ত চুপ করেই দাঁড়িয়ে ছিল। নজর মহম্মদ এ কার ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেল তাকে। পেশমন বেগমও যতখানি অবাক, কান্তও ততখানি।

বাইরের পৃথিবীতে যখন পূর্ণিয়ায় শওকত জঙ-এর সঙ্গে নবাব মির্জা মহম্মদের লড়াই চলছে আর যখন মানিকচাঁদ বজবজের কেল্লার ওপর থেকে ফিরিঙ্গিদের পল্টনদের ওপর কামানের গোলা ছুড়ছে, যখন হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে নিয়ে দুর্গা গঙ্গার বুকের ওপর বজরার ছইয়ের ভেতরে বসে দুর্গানাম জপ করছে, তখন এখানে এই চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে পেশমন আর এক স্বপ্ন দেখতে লাগল।

স্বপ্নই বটে।

এতদিন তো নজর মহম্মদ কাউকে তার ঘরে আনেনি! হঠাৎ কি আবার তার ভাগ্য ফিরে গেল। কিন্তু নিজের ওপরেই মায়া হতে লাগল পেশমন বেগমের। এখন তো সে বাতিল হয়ে গেছে। এখন কেন একে তার ঘরে নিয়ে এল নজর মহম্মদ!

বৈঠিয়ে;

একটা গদিমোড়া বসবার জায়গা দেখিয়ে দিয়ে পেশমন বেগম তাকে আদর-অভ্যর্থনা করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

বসুন আপনি

কান্ত বসল না। বললে–আমি কিছু বুঝতে পারছি না,নজর মহম্মদ আমাকে এ কোথায় নিয়ে এল!

পেশমন বেগম বললে–আপনি কিছু ভাববেন না জনাব, আমি তো আছি, আমার নাম পেশমন বেগম। আপনি আরাম করে বসুন–

তারপর পাশের কামরায় গিয়ে নিজের বাঁদিকে ডেকে নিয়ে এল। ঘাগরা-পরা মেয়ে একটা হাসি হাসি মুখ। হাতে কাঁচের একটা পাত্রে শরবত এনেছে।

পেশমন বললে–এই শরবতটা খেয়ে নিন, এ আপনার পা টিপে দেবে।

কান্ত আগের বারে এখানে এসেছিল মরালীর কাছে। সেবার তো শরবত এনে দেয়নি কেউ। পা টিপে। দিতেও আসেনি কেউ। এবারে এরা এমন করছে কেন? নাকি চেহেলসূতুনের বেগমদের এই-ই নিয়ম!

আমি শরবত খাব না–আমার তেষ্টা পায়নি!

পেশমন যেন আদরে ফেটে পড়ল–তা কেমন করে হয় জনাব, আপনি আমার মেহমান, আপনাকে তা হলে কী দিয়ে খাতির করব? নিন

কান্ত ঢোক ঢোক করে শরবতটা গিলে বেগমসাহেবার হাতে ফেরত দিলে।

 নাচ দেখবেন, নাচ?

কান্ত আরও আড়ষ্ট হয়ে পড়ল! এতখানি ধাড়ি একজন মেয়েমানুষ তার সামনে নাচবে সেটাই বা কী রকম!

আপনি আরাম করে বসুন জনাব, আমার বাঁদি আপনার পা টিপে দিক, পা টিপলে আপনার তকলিফ দূর হবে, আপনি অনেক দূর থেকে আসছেন

কান্ত বললে–আমি অনেক দূর থেকে আসিনি তো, আমি সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকান থেকে আসছি

পেশমন বললে–সে তো আমি জানি সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকান থেকে অনেক জওয়ান আসে, এসে চেহেল্‌-সুতুনের শরবত খেয়ে যায় আমার বাঁদি তাদের পা টিপে দেয়,

কান্ত বললে–আমি আগে আসিনি, একবার শুধু এসেছিলাম

কোন বেগমসাহেবার ঘরে? গুলসন বেগম?

কান্ত বললে–না।

তক্কি বেগম?

না না, ওসব কেউ-ই না—

পেশমন বেগম বললে–আপনি আর কারও ঘরে যাবেন না জনাব। সবাই আপনার কাছ থেকে টাকা খিচে নেবে। টাকাও খিচে নেবে, ঔর আরাম ভি পাবেন না। আপনি নজর মহম্মদকে বলে আমার ঘরে আসবেন। রাতভর আমার ঘরে থাকতে পারবেন, কেউ দেখতে পাবে না, কেউ জানতেও পারবে না। নজর মহম্মদ আমার বড় পেয়ারের খোঁজা, বড় বিশ্বাসি আদমি, ওকে বলে দেবেন, ও সোজা আপনাকে আমার ঘরে নিয়ে আসবে

বাঁদিটা হঠাৎ তার পায়ে হাত দিতেই কান্ত পা দুটো টেনে নিয়েছে। বললে–না না, পা টিপতে হবে না, তুমি যাও।

কেন, টিপুক না

কান্ত বললে–না না, ওকে যেতে বলে দিন

পেশমন বাঁদিকে বাইরে চলে যেতে বলতে সে চলে গেল। তারপর বললে–আপনার খুব শরম বুঝি?

না, শরম নয়, আমার পা কখনও কাউকে দিয়ে টেপাইনি আগে। পেশমন বেগম হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসল। একেবারে কান্তর মুখের কাছাকাছি এসে গেল। প্রায় গায়ের ওপর পড়ে আর কী। মুখের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করলে আপনার বয়েস কত জনাব?

কান্ত নিজের মুখখানা সরিয়ে নিতে যেতেই পেশমন বেগম তার মুখখানা দুই হাতের পাতা দিয়ে ধরে ফেলেছে।

বলুন জনাব, আপনার উমর কত?

পেশমন বেগমকে এড়াবার জন্যেই কান্ত নিজের বয়েসটা বলে দিলে।

 কিন্তু তাতে উলটো ফল হল। কান্তর বয়েসটা শুনে যেন পেশমন বেগম একেবারে খেপে গেল। কান্তর পাশেই বসে দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরলে। বললে–তোমার কানে কানে একটা কথা বলব, মুখটা সরিয়ে নিয়ে এসো–

কী কথা?

পেশমন বেগম বললে–কী কথা শুনতে চাও তুমি বলো! আমি তাই-ই বলব। আমি তোমার মতন সুন্দর একটা জওয়ান চেয়েছিলুম, জানো জনাব! ঠিক তোমার মতন খুবসুরত! তুমি খুব খুবসুরত! দুনিয়ামে সব চিজ ঝুটা, তা জানো৷ আসল চিজ শুধু মহব্বত, আর সব চিজ ঝুটা–সব–

কান্ত হঠাৎ বললে–নজর মহম্মদ কোথায় গেল?

পেশমন যেন আরও জোরে আঁকড়ে ধরল কান্তকে। বললে–নজর মহম্মদকে দূরে হটাও, সবাইকে দূরে হটাও, এখন আর কেউ নেই চেহেল সুতুনে জনাব, শুধু তুমি আছ আর ম্যায়! মহব্বত তোমার ভাল লাগে না জনাব? মহব্বত?

যেন আবোল-তাবোল সব কথা বলতে লাগল বেগমটা। বলতে লাগল–আমি সব পেয়েছি জনাব, জিন্দগিতে যা কিছু জেনানারা চায়, সব পেয়েছি। রুপেয় পেয়েছি, আসরফি পেয়েছি, রূপ পেয়েছি, জওয়ানি পেয়েছি, দিল্লির দরবারে আমি সব কুছ পেয়েছি জনাব, শুধু মহব্বত পাইনি। এখানে নাচ-গান করতে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম এখানে এসে মহব্বত পাব, কিন্তু এই মুর্শিদাবাদের চেহেল্‌-সুতুনে এসে আমার সব খোয়া গেল। আমার রূপ গেল, আসরফি ভি গেল, তবু মহব্বত আমি পেলাম না জনাব, তবু মহব্বত আমি পেলাম না

বেগমটার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

এ কী বিপদে পড়ল কান্ত! বেগমটাকে যত ছাড়াতে চায়, ততই জড়িয়ে ধরে সে।

কান্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললে–আমি উঠি এবার বেগমসাহেবা

না না না, আমাকে তুমি মহব্বত দেবে জনাব? আমি যে মহব্বত পাইনি! আমি কী নিয়ে বাঁচব? আমি তোমার কাছে আর কিছু চাই না, আমি শুধু মহব্বত চাই আমাকে মহব্বত দেবে না?

কান্ত আর পারলে না। তাড়াতাড়ি বেগমটাকে সরিয়ে উঠে পঁড়াল। তারপর ঘরের দরজাটার দিকে এগিয়ে যেতেই বেগমটা হাতটা ধরে ফেলেছে।

তোমাকে যেতে দেব না জনাব, তুমি রাতভর আমার ঘরে থাকবে। আমায় তুমি মহব্বত দেবে

কান্তর মনে হল সে চিৎকার করে নজর মহম্মদকে ডাকে।

নজর মহম্মদ! নজর মহম্মদ!

কিন্তু তার আগেই বেগমটা তার মুখ চাপা দিয়ে দিয়েছে নিজের হাতের পাতা দিয়ে।

বলো, তুমি আমার এখানে রাতভর থাকবে, আমায় মহব্বত দেবে?

কান্ত বললে–আমি তো আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসিনি

বেগমটা ততক্ষণে তার মুখখানা নিয়ে নিজের মুখের ওপর চেপটে দিতে শুরু করেছে। তার গাল, ঠোঁট, নাক সব যেন জখম করে দিতে চাইছে। বেগমটার গায়ে এত জোর! কান্তর মনে হল তার ঠোঁট দিয়ে যেন রক্ত বেরোতে শুরু করেছে।

আমি মরিয়ম বেগমের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম বেগমসাহেবা, ভুল করে নজর মহম্মদ আমাকে আপনার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।

বেগমটা যেন আরও খেপে গেল।

 মরিয়ম বেগম তো বাইরে গেছে।

বাইরে? কোথায়?

চকবাজারে তার বালমের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। কেন, আমাকে তোমার পছন্দ হচ্ছে না? আমি জওয়ান নই? আমি সুন্দরী নই? আমায় মহব্বত দেবে না তুমি?

শেষকালে বেগমটা বোধহয় একেবারে পাগলের মতো হয়ে গেল। আঁচড়ে কামড়ে খামচে একেবারে একাকার করে দিলে কান্তকে। কান্তকে বোধহয় পিষে গুঁড়িয়ে ফেলবে বেগমটা! কান্ত প্রাণপণে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলে। কিন্তু কিছুতেই ছাড়বে না বেগমটা। কেবল বলে–আমাকে মহব্বত দাও জনাব, মহব্বত দাও–

শেষপর্যন্ত কান্ত বোধহয় হেরেই যেত বেগমটার গায়ের জোরের দাপটে, কিন্তু চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে হঠাৎ যেন অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ হতে লাগল। কোথায় যেন ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল। অনেক মেয়েলি গলার আওয়াজ আসতে লাগল কানে। তাতেও বেগমটা কাবু হয়নি। বেগমটার লাল মুখ আরও টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। শরীরের সমস্ত রক্ত যেন তার মুখে এসে জমাট বেঁধে গেছে।

হঠাৎ সেই সময়ে বলা নেই কওয়া নেই, নজর মহম্মদ হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে এসে ঢুকেছে। সেদিন নজর মহম্মদ ঠিক সেই সময়ে পেশমন বেগমের ঘরে ঢুকে না পড়লে কী হত বলা যায় না। হয়তো কান্তকে আঁচড়ে কামড়ে খামচে মেরেই ফেলত বেগমটা।

পেশমন বেগমের তখন উত্তাল-উদ্দাম অবস্থা। তার ওড়নি-ঘাগরা ছিঁড়ে গেছে টানাটানিতে। নজর মহম্মদকে সেই অবস্থায় ঘরে ঢুকতে দেখেই বেগমসাহেবা পাগলের মতো চিৎকার করে উঠেছে–তুম কুঁ আয়া? তুম কুঁ অন্দর ঘুষা? নিক যাও–নিক যাও–নিকলো ইহাসে

বেগমসাহেবা, খুব বিপদ হয়েছে!

যো কুছ হোনে দেও, আব তুম নিকলো, নিকল যাও–নিকল যাও

নজর মহম্মদকেই বোধহয় সেদিন খুন করে ফেলত বেগমটা। কিন্তু নজর মহম্মদ বেগমটার মুখের ওপরেই বললে–মতিঝিলমে সফিউল্লা খাঁ সাহাব খুন হো গিয়া

যেন আগুনে জল পড়ল।

সফিউল্লা সাহেব রাতে মতিঝিলে ঢুকেছিল, এখন নেয়ামত খবর পাঠিয়েছে, সাহাব খুন হয়েছে।

কে খুন করেছে?

মরিয়ম বেগমসাহেবা!

কান্ত চিৎকার করে উঠল–কে? কার নাম বললে?

নজর মহম্মদ আবার সেই একই উত্তর দিলে–মরিয়ম বেগমসাহেবা খুন করেছে খাঁ সাহেবকে।

মরিয়ম বেগমের নামটা শুনে কান্তর মাথাতেও যেন শরীরের সমস্ত রক্ত উঠে জমাট বেঁধে গেল। মরিয়ম বেগম! রানিবিবি! মরালী! মরালী খুন করেছে সফিউল্লা খাঁ সাহেবকে?

তুমি ঠিক শুনেছ নজর মহম্মদ? ভুল শোনোনি তো?

না হুজুর, নেয়ামত কোতোয়ালকে খবর ভেজিয়ে দিয়েছে। মতিঝিলের ঘরে খুন ঝরছে। ঝুট শুনব কেন হুজুর? নানিবেগমসাহেবাকে ভি খবর দিয়ে দিয়েছি আমি। নানিবেগমসাহেবা লুৎফুন্নিসা বেগমসাহেবাকে খবর ভেজিয়ে দিয়েছে। আপনি এখন চলুন হুজুর, এখন চেহেল্‌-সুতুন তালাস করতে পারে কোতোয়াল সাহাব। পিরালি খাঁ চেহেল্‌-সুতুনের পাগলা-ঘন্টি বাজিয়ে দিয়েছে চলিয়ে, বাহার চলিয়ে

পেশমন বেগমের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে বলে কান্ত মুক্তির নিশ্বাস ফেলবার সময়টাও পেল না। তার মনে হল, এ আবার কোন বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়ল মরালী।

বাইরে আসতে আসতে কান্ত জিজ্ঞেস করলে মরিয়ম বেগম মতিঝিলে কী করতে গিয়েছিল নজর মহম্মদ? আমি তো মরিয়ম বেগমের সঙ্গে দেখা করতেই চেহেলসুতুনে এসেছিলুম

নজর মহম্মদ–কিন্তু হুজুর, পেশমন বেগমসাহেবা ভি আচ্ছি জওয়ান বেগম, উও ভি মরিয়ম বেগমসে খুবসুরত–

হোক খুবসুরত, তুমি তো আমাকে বলোনি যে মরিয়ম বেগম চেহেল সুতুনে নেই, তা হলে আমি আজ এখানে আসতুম না।

নজর মহম্মদ বললে–তা আমার মালুম হবে কী করে হুজুর, আমি কী করে জানব যে মরিয়ম বেগমসাহেবা বরকত আলির সঙ্গে চকবাজারে যাবে?

চকবাজারে? চকবাজারে কোথায়?

হুজুর, সারাফত আলির দোকানে। মরিয়ম বেগম তাঞ্জামে করে সারাফত আলির দোকানে গিয়েছিল আপনার সঙ্গে মুলাকাত করতে!

সারাফত আলির দোকানে গিয়েছিল? আমার সঙ্গে দেখা করতে?

হ্যাঁ হুজুর, আর আমি এদিকে আপনাকে নিয়ে চেহেল্‌-সুতুনে চলে এসেছি। আমি হুজুর তখন তো জানি না যে বরকত আলি মরিয়ম বেগমকে নিয়ে সারাফত আলির দোকানে গেছে। সেখানে যাবার পরই তো সফিউল্লাসাহেব মরিয়ম বেগমকে মতিঝিলে নিয়ে গেছে

কান্ত আকাশ থেকে পড়ল যেন সব শুনে।

বললে–এখন তা হলে কী হবে নজর মহম্মদ? মরিয়ম বেগমের কী হবে?

নজর মহম্মদ বললে–কাজির কাছে কাছারিতে বিচার হবে!

বিচার হয়ে যদি প্রমাণ হয় যে মরিয়ম বেগম সফিউল্লা খাঁ সাহেবকে খুন করেছে, তা হলে কী হবে?

তা হলে ফাঁসিতে লটকে দেবে, হুজুর।

ফাঁসি হয়ে যাবে মরিয়ম বেগমের?

তা তো হবেই হুজুর। কোতোয়াল সাহাব যে বড়া কড়া আদমি, ঔর কাজিসাহাব ভি বড়া কড়া সদরস সুদুর

কথা বলতে বলতে দু’জনেই চোরাফটকের কাছে এসে পড়েছিল। রাত গভীর। বাইরের আকাশে তারাগুলো ভাল করে দেখা যায় না কুয়াশার জন্যে। যে-গানটা সন্ধেবেলা চেহেল্‌-সুতুনের ভেতর। হচ্ছিল সেটা অনেক আগেই থেমে গেছে। যো হোনেকা থি উও তো হো গয়ি, আভি উসকো ক্যা পরোয়া। কান্তর মনে হল তবু যেন কিছু করার আছে। সে যেন মরালীর কিছু উপকার করতে পারে এখনও। সমস্ত বুকটা তার দুরদুর করে কাঁপতে লাগল। যদি সত্যিই মরালীর ফাঁসি হয়ে যায়! যদি কাজি সাহেব তার ফাঁসির হুকুম দিয়ে বসে! কিন্তু কেন সে খুন করতে গেল সফিউল্লা সাহেবকে? মরালী কি জানে না যে সফিউল্লা খাঁ সাহেব নবাব মির্জা মহম্মদের কত পেয়ারের দোস্ত!

ফটকের কাছে পৌঁছে দিয়ে নজর মহম্মদ তখন চলে গেছে।

 হঠাৎ পেছন ফিরে কান্ত চিৎকার করে ডাকল-নজর মহম্মদ

 কী হুজুর?

পেছনের অন্ধকার থেকে নজর মহম্মদ আবার এগিয়ে কাছে সরে এল। বললে–আস্তে আস্তে কথা বলুন হুজুর, আজ বড় কড়া পাহারা বসে গেছে শহরে–

কান্ত গলা নামিয়ে বললে–বলছি কী, তোমাদের কাজিসাহেব, তোমাদের সদরস সুদুরকে বলে কয়ে মরিয়ম বেগমের ফাঁসিটা ঠেকানো যায় না?

না হুজুর, ঠেকানো যায় না।

কেন? যদি নবাবকে খুব করে পায়ে ধরি, তা হলে?

না হুজুর, তা হলেও ঠেকানো যাবে না। তবে এক কাজ করলে ঠেকানো যায়

কী কাজ? বলো না নজর মহম্মদ, কী কাজ?

আপনার টাকা আছে? কিছু টাকা খরচ করতে পারবেন?

টাকা? কত টাকা?

আসরফি! এক হাজার আসরফি!

কান্তর যেন একটু আশা হল। বললে–এক হাজার আসরফি দিলে মরিয়ম বেগমসাহেবার ফাঁসি আটকানো যাবে?

বিলকুল!

সত্যি বলছ তুমি? এক হাজার আসরফি দিলে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে ছেড়ে দেবে? …।

 আলবত ছেড়ে দেবে হুজুর, কেউ না ছাড়ে তো আমাকে বলবেন। আমার কাছে আসবেন আপনি এক হাজার আসরফি নিয়ে, মহকুমে কাজার সদরস সুদুরের সঙ্গে আমি আপনার মুলাকাত করিয়ে দেব। গুনে গুনে এক হাজার আসরফির পয়জার মারব তার মুখে আর সে তোবা তোবা বলে মরিয়ম বেগমকে ছেড়ে দেবে! তা হুজুর, মরিয়ম বেগমের জন্যে ঝুটমুট কেন এতগুলো আসরফি খরচ করতে যাবেন? পেশমন বেগমকে কি আজ আপনার পসন হল না? পেশমন বেগম কি আপনাকে সুখ দিলে না?

কান্তর গাটা রি-রি করে উঠল।

বললে–ওকথা থাক, তুমি মরিয়ম বেগমের কথা বলো! মরিয়ম বেগমের জন্যে আমি সব করতে পারি। বলো, কী করলে একবার তার সঙ্গে দেখা করতে পারি।

কোথায়? মতিঝিলে? মতিঝিলে গিয়ে মুলাকাত করবেন? তা হলেও, ভি টাকা লাগবে আপনার। নেয়ামত খিদমদগারকে দিতে হবে, কোতোয়ালকে ভি দিতে হবে–

কত লাগবে?

পাঁচ মোহর।

পাঁচ মোহরের কমে হয় না?

নজর মহম্মদ বললে–কী যে বলেন হুজুর, কোতোয়াল তো এক মোহর দিলে বাতই বলবে না। নেয়ামত নেবে এক মোহর, আরও দু’জন খিদমদগার আছে, তারা নেবে এক মোহর, তারপর ফটকের পাহারাদার আছে, তারাও ভি নেবে এক-দু’ মোহর। তা পাঁচ মোহর না দিতে পারেন, চার মোহর দেবেন,–আমার সঙ্গে কোতোয়ালের জান-পহচান আছে, আমি বলে-কয়ে বন্দবস্ত করে দেব

তারপর কান্তকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললে–আপনি কিছু ঘাবড়াবেন না হুজুর, মোহর দিলে দিল্লির মসনদ ভি আপনার পায়ের তলায় এনে দিতে পারি, মরিয়ম বেগম তো দূর অস্ত! আপনি কিছু ঘাবড়াবেন না, সারারাত আপনার পরেশান হয়েছে, এখন আরামসে নিদ দিনগে যান।

বলে কান্তর পিঠ চাপড়ে দিয়ে নজর মহম্মদ আবার ফটকের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন বাইরের জগতে অন্ধকার পাতলা হয়ে আসছে। আর খানিক পরেই হয়তো চেহেল-সুতুনের মসজিদের ওপর থেকে মৌলভি সাহেব আজান পড়তে শুরু করবে সুর করে করে। আর তারপর ইনসাফ মিঞা নহবতে টোড়ির আলাপ তুলবে উদারার নিখাদ থেকে।

কান্ত তাড়াতাড়ি চকবাজারের দিকে পা বাড়াল।

*

পাটনার নায়েব-নাজিম রামনারায়ণকে আগের থেকে খবর পাঠানো হয়েছিল। শওকত জঙকে দু’দিক থেকে আক্রমণ করা হবে। রামনারায়ণ সেপাই নিয়ে ওদিক থেকে এগোবে। আর এদিকে রাজা মোহনলাল সেপাইদের নিয়ে গঙ্গা পেরিয়ে মালদহ জেলার সোমদহ, হিয়াৎপুর আর বসন্তপুর গোলার দিকে এগিয়ে গিয়ে পৃর্ণিয়ার ওপর গোলা ছুড়বে।

ছাব্বিশ বছরের নবাব শান্তি পেতে চেয়েছিল জীবনে। নানিবেগমের কাছে শান্তির জন্যে খোদাতালার দরবারে দোয়া চাইতে বলেছিল। কিন্তু শান্তি চাইবার আগে শান্তির যোগ্যতা অর্জন না করলে চলবে কেন? শান্তি আমি তোমাকে দেব, কিন্তু শান্তির বোঝাই কি তুমি বইতে পারবে? শান্তির যন্ত্রণা কি অশান্তির যন্ত্রণার চেয়ে কিছু কম দুর্বিষহ মির্জা মহম্মদ!

রাজা মোহনলাল বলেছিল–আপনি জাঁহাপনা এখানে থাকুন, আমি শওকত জঙ সাহেবের সঙ্গে ফয়সালা করে আসি

নবাব মির্জা মহম্মদ নিজের মনেই হাসলেন। মোহনলাল হয়তো ভাল মনে করেই কথাটা বলেছে। সে নবাবের মঙ্গলই চায়। নবাবকে বাঁচাতেই চায় সে। কিংবা হয়তো ভেবেছে নবাব ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সংকোচ করবে! শওকতের গায়ে তরোয়াল ছোঁয়াতে দ্বিধা করবে।

একবার শুধু জিজ্ঞেস করলেন–জাফর আলি আছে?

মোহনলাল বললে–আছে জাঁহাপনা

ওর দিকে একটু লক্ষ রাখবে মোহনলাল। ওকে আমি বিশ্বাস করি না। আর কে কে আছে সঙ্গে?

আর আছে দোস্তমহম্মদ খাঁ, মিরকাজেম খাঁ, আর আছে দিলির খাঁ আর আসালৎ খাঁ

ওরা আবার কারা?

ওরা হল জাঁহাপনা, উমের খাঁ’র ছেলে।

নবাব মির্জা মহম্মদ একটু আশ্বস্ত হলেন। শওকত জঙ-এর দলে আছে শ্যামসুন্দর, আর আছে লালুহাজারি। ওদের ওপর একটু নজর রাখবে ভাল করে।

রাজা মোহনলালকে কিছু বলতে হয় না। নবাবের মনের কথাটুকু যেন সে আগে থেকে জানতে পারে। সে কামান থেকে গোলা ছোড়বার হুকুম দিয়ে দিলে। গোলাগুলো গিয়ে নবাবগঞ্জ আর মনিহারির মধ্যিখানের বিলের মধ্যে দুমদাম করে পড়তে লাগল।

রাত্রে যখন নবাব মির্জা মহম্মদ শুতে গেলেন, তখনও গোলা ছোঁড়ার শব্দ আসছিল কানে। কিন্তু বিছানায় শুয়ে শুয়েও ঘুম এল না। সমস্ত জীবনটার কথা মনে পড়তে লাগল। কোথায় মসনদ পাবার পর এখন মতিঝিলে বিশ্রাম নেবার কথা, কিংবা চেহেল সুতুনের ঘরে পালকের বিছানায় শুয়ে বেগমসাহেবাদের গান শোনা আর কোথায় এই পূর্ণিয়া! কোন অপ্রত্যাশিত কোণ থেকে এই আবার আর-এক অশান্তি এসে হাজির হয়েছে।

হঠাৎ মনে হল কে যেন ঘরে ঢুকেছে।

কে?

নবাব মির্জা মহম্মদ উঠে বসলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন–কৌন হ্যায়?

আমি মিরজাফর!

এত রাত্রে তুমি? লড়াইয়ের কী খবর?

খবর ভাল নয়। এ-লড়াইয়ের খবর ভাল হতে পারে না।

কেন? ওকথা বলছ কেন?

ভাল খবর কী করে তুমি আশা করো?

নবাব মির্জা মহম্মদ যেন চমকে উঠলেন। তবু নিজের মনের ভাব নিজের মনেই চেপে রাখলেন।

বললেন–তুমি আছ, তবু কেন খারাপ খবর আশা করব?

মিরজাফর আলি যেন একটু দ্বিধা করতে লাগল। তারপর বললে–আমাকে কি তুমি আমার যথার্থ সম্মান দিয়েছ মির্জা? আমাকে কি তুমি নিজের রিস্তাদার বলে বিচার করেছ যে ভাল খবর আশা করবে?

তার মানে?

তার মানে মানিকচাঁদকে তুমি আলিনগরের রাজা করে দিলে। অথচ আমি কি ফিরিঙ্গিদের কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দিইনি? আবার এবার পূর্ণিয়ার লড়াইতেও তুমি হয়তো আর কাউকে আরও বড় চাকরি দিয়ে দেবে, তা হলে কেন আমি তোমার স্বার্থের জন্যে প্রাণ দিয়ে লড়াই করব?

নবাব মির্জা মহম্মদ রেগে উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ নিজেকে সামলে নিলেন।

 বললেন–এই কথাই বলতে তুমি এখানে এসেছ লড়াই ছেড়ে?

লড়াই ছেড়ে নয়, লড়াইতে হেরে। আমিই তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি।

আর শওকত জঙ?

মিরজাফর আলি গম্ভীর গলায় বললে–শওকত জঙ জিতেছে, সে আসছে তোমার সঙ্গে মোলাকাত করতে।

বলছ কী তুমি? তুমিই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে?

মিরজাফর আলি বললে–তুমি কারও সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করোনি? তুমি রাজা রাজবল্লভকে তাড়িয়ে দাওনি? তুমি ঘসেটিকে চেহেল্‌-সুতুনের ফাটকে আটকে রাখোনি? তুমি হুসেন কুলি খা-কে খুন করোনি? নিজে বিশ্বাসঘাতক হয়ে আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলতে তোমার লজ্জা করল না?

নবাব মির্জা মহম্মদ স্তম্ভিতের মতো মিরজাফর আলির দিকে চেয়ে রইলেন। মিরজাফর আলি কি তাকে ভয় দেখাতে এসেছে নাকি?

মোহনলাল কোথায় গেল?

শওকত জঙ তাকে ধরে নিয়ে বন্দি করে রেখেছে।

 সেকী? দোস্তমহম্মদ খাঁ, মিরকাজেম খাঁ, দিলির খাঁ, আসাল খাঁ, তারা কোথায়?

তারা খুন হয়ে গেছে!

তা হলে তুমি? তুমি এখনও চুপ করে আছ? আমি কি একটু বিশ্রাম করতেও পাব না? তোমাদের দিয়ে কি আমার একটা উপকারও হবে না? তুমি আমার কাছে এসেছ নিজের কঁদুনি গাইতে?

মিরজাফর আলির মুখের ভেতর দাঁতে দাঁত চাপার শব্দ হল।

বললে–না, আমি এসেছি তোমার কাছে জবাবদিহি চাইতে!

কীসের জবাবদিহি?

এই অন্যায় ব্যবহারের।

আমার সেপাইরা কোথায়? আমার সিপাহশালার না হয় নেই, কিন্তু সেপাই-লস্কর–গোলন্দাজ, তারা কোথায়?

মিরজাফর যেন দাঁত বার করে হাসতে লাগল। আজ মির্জা মহম্মদের বিপদের দিনেই যেন মিরজাফর আলির হাসবার পালা। অন্য সময় হলে বুকে এক লাথি দিয়ে জাফর আলিকে ছুঁড়ে ফেলে। দিতেন তিনি। কিন্তু এ-সময় আশেপাশে যে কেউ নেই তার।

কই, জবাবদিহি দাও!

 নবাব মির্জা মহম্মদের যেন শ্বাসরোধ হয়ে এল। বললেন–জবাবদিহি চাইছ তুমি কার কাছে তা জানো?

চাইছি নবাব আলিবর্দি খাঁর আদরের নাতির কাছে।

 খবরদার, জাফর আলি খাঁ!…

নবাবগঞ্জের জল-হাওয়ার বোধহয় কোনও জাদু আছে। যে-মির্জা মহম্মদ কখনও কোনওদিন ঘুমিয়ে পড়ে না, তার যে কেমন করে এমন অকাতর ঘুম এসেছিল কে জানে! হঠাৎ বাইরে হইহই শব্দে নবাব উঠে বসলেন। ছোট একটা শিবির। বাইরের বিল থেকে ব্যাঙ ডাকার শব্দ আসছিল। তাকে ছাপিয়ে আর একটা আওয়াজ কানে আসতেই তার ঘুম ভেঙে গেছে।

কোথায়? মিরজাফর আলি খাঁ কোথায় গেল হঠাৎ?

খবর দিলে প্রথম রাজা মোহনলাল নিজে। রাজা মোহনলাল এত বড় সুখবরটা আর কারও মুখ দিয়ে শোনাতে চায়নি বলেই নিজে এসেছে।

ভেবেছিলাম, আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন জাঁহাপনা।

নবাব বললেন মিরজাফর আলি কোথায়? তাকে দেখছি না

মোহনলাল বললে–মিরজাফর সাহেব আজকে জান দিয়ে লড়েছে জাঁহাপনা। শওকত জঙ খুন হয়ে গেছে, এই খবরটা দিতে এলাম

পেছন পেছন আরও অনেকে এল। একেবারে ভিড় করে দাঁড়াল সবাই। দোস্ত মহম্মদ, মিরকাজেম, দিলির, আসালৎ। সবাই এসে নবাবের সামনে কুর্নিশ করে দাঁড়াল।

জাফর আলি সাহেব কোথায়? আসেনি?

মোহনলাল বললে–তাঁর হাতে চোট লেগেছে জাঁহাপনা, দাওয়াই লাগাতে গেছে হেকিমখানায়

চলো, আমি যাই জাফর আলি সাহেবকে দেখে আসি

মিরজাফর আলির হাতে চোট লেগেছিল। সত্যিই জাফর সাহেব প্রাণ দিয়ে লড়েছে আজ। হেকিমখানার একটা খাঁটিয়ায় শুয়ে ছিল। মির্জাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করলে।

আপনি আমার জন্যে যা করেছেন জাফর আলি সাহেব, আমি তা ভুলব না-

বলে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলেন নবাব মিরজাফর আলিকে। তখনও তার সারা গায়ে ঘাম ঝরছে। তখনও মিরজাফরের মুখে কোনও কথা নেই। হঠাৎ স্বপ্নটার কথা মনে পড়ল মির্জা মহম্মদের।

নবাবগঞ্জের মাঠের ওপর তখন সেপাইরা ছুটে ছুটে পালাচ্ছে। এ দৃশ্য আগেও অনেকবার দেখেছে মির্জা। কলকাতার লড়াইয়ের পর ঠিক এই রকমই ঘটেছিল। ঠিক তারই পুনরাবৃত্তি। বাংলার ইতিহাসের সে এক সন্ধিক্ষণ। তবু সেদিন মির্জার মনে হয়েছিল এ হয়তো ভালই হল। এ না হলে কি তিনি জানতে পারতেন, মিরজাফর আলি তার কত আপন, কত আত্মীয়! এ না হলে কি তিনি জানতে পারতেন, যে-মসনদের ওপর তিনি বসে আছেন তা পাথরের না মাটির!

মির্জা মহম্মদের চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। এরা তার এত আপনার জন। অথচ এদেরই তিনি এত সন্দেহ করেছেন। এদেরই তিনি এত অপমান করেছেন। কিন্তু সম্মান বিলোনো কি অত সহজ। তার হাতে তো সম্মানের অফুরন্ত ভাড়ার নেই। ক’জনকে তিনি রাজা করবেন, ক’জনকে মহারাজা। অথচ তিনি নিজেই কি নবাব বলে নিজেকে ঘোষণা করতে পারেন!

সম্মান যারা নিতে জানে, সম্মান তারা দিতেও জানে। সম্মান দিলে তবে সম্মান নেবার অধিকার জন্মায়। তুমি আমাকে মনে মনে গালাগালি দিয়েছ তোমাকে মর্যাদা দিইনি বলে! কিন্তু আমাকে কে সম্মান দিয়েছে? আমাকে কে মর্যাদা দিয়েছে? আমি তো তোমাদের শত্রুতা আর ঘৃণার ওপর দাঁড়িয়ে তোমাদের কাছ থেকে নিজের সম্মান আদায় করে নিয়েছি। কই, আমি তো সেজন্য তোমাদের কাউকে আঘাত দিইনি। কাউকে অপমানও করিনি। হোসেন কুলি খাঁ-কে আমি খুন করেছি স্বীকার করছি, কিন্তু সে তো আমাকে অপমান করেছে বলে নয়। সে তো হাজি-মহম্মদের বংশে কলঙ্ক দিয়েছিল বলে। কিন্তু তার আগে তো আমি নানিবেগমের মত চেয়ে নিয়েছি, নানানবাবের সমর্থন চেয়ে নিয়েছি! আর ঘসেটি? আমার শৈশব থেকে যে আমার শত্রুতা করেছে, যে আমার মৃত্যু কামনা করে আসছে, তাকেও আমাকে ক্ষমা করতে বলো? রাজা মানিকচাঁদের কথা বলছ তোমরা। কিন্তু রাজা মানিকচাঁদ কি বিপদের দিনে তোমাদের মতো আমার পাশ থেকে কখনও সরে দাঁড়িয়েছে?

আমি আজ আপনার ওপর খুব খুশি জাফর আলি খাঁ!

মিরজাফর আলি তখনও চুপ করে ছিল। একটু পরে বললে–আমি এখানে আসবার আগে নানিবেগমের কাছে প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলাম–

আপনি আপনার প্রতিজ্ঞা রেখেছেন দেখে আমি খুব খুশি জাফর আলি খাঁ।

আমি আপনার বান্দা, নবাব!

 মিরজাফর আলি কি মির্জা মহম্মদকে না দিয়ে ছাড়বে না নাকি!

মিরজাফর আবার বললে–আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম যে, শওকত জঙকে লেখা চিঠি বলে যেটা আপনি দেখেছেন, সেটা জাল!

নবাব বললেন–এখন আমার বিশ্বাস হল জাফর আলি, সত্যিই জাল–

রাত বোধহয় তখন ভোর হয়ে আসছে। ওপারে নবাবগঞ্জ আর মনিহারি, আর এপারে বলডিয়াবাড়ি। মাঝখানে শুধু একটা বিল। ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে যেন রাত্রের সমস্ত কদর্যতা চোখের ওপর স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল।

বেগমরা কোথায়?

রাজা মোহনলাল বললে–সবাইকে সৈয়দ আহম্মদ সাহেবের হাবেলিতে নজরবন্দি করে রেখেছি জাঁহাপনা

নবাব বললেন–ওদের সম্পত্তি যা কিছু আছে, যারা মুর্শিদাবাদে যেতে চায়, সকলকে মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দাও–কাউকে যেন কোনও অসম্মান করা না হয়, দেখো তুমি

আর শওকত জঙ সাহেব?

তাকে কবর দেবে। সে তো এখন সম্মান-অসম্মানের বাইরে চলে গেছে।

নিজের শিবিরের কাছে এসে হাতিটা থামল।

জাঁহাপনা, রাজা মানিকচাঁদের চিঠি নিয়ে এসেছে আলিনগরের উজিরের লোক।

কীসের চিঠি?

সেই হাতির পিঠে বসেই চিঠিটা হাতে নিলেন নবাব। জরুরি চিঠি। তাড়াতাড়ি লেফাফা খুলে পড়তে লাগলেন–

রাজা মানিকচাঁদ লিখেছে

…ফিরিঙ্গিরা দলবল লইয়া ফিরিয়া আসিয়া আমাদিগের বজবজের কেল্লা অধিকার করিয়া ফেলিয়াছে। আরও দুঃসংবাদ এই যে, বজবজ কেল্লা অধিকার করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই। তাহাদের আক্রমণে আমাদের সৈন্যদল টানা দুর্গমধ্যে চল্লিশটি কামান ফেলিয়া রাখিয়া পলায়ন করিয়াছিল, সে । দুর্গও ফিরিঙ্গিরা ১ জানুয়ারি তারিখে অধিকার করিয়া ফেলিয়াছে। ২ জানুয়ারি তারিখে রবার্ট ক্লাইভ সাহেব সহসা কলিকাতা-দুর্গ অতর্কিতে আক্রমণ করাতে আমি সৈন্যদল সমেত কলিকাতা-দুর্গ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া আসিয়াছি। ইহার পর কী ঘটিয়াছে জানি না। শুনিয়াছি তাহারা হুগলি-দুর্গ আক্রমণ করিয়াছে। দুর্গ ও ফৌজদারি সম্পত্তি এবং হুগলি নগর লুণ্ঠন করিয়া তাহারা সরকারি গোলাবাড়ি আদি আক্রমণ করিতেছে। আমি আজই মুর্শিদাবাদ যাত্রা করিতেছি, সাক্ষাতে সমুদয় সংবাদ বলিব। ভবদীয় বশংবদ

রাজা মোহনলাল পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। নবাব তারই হাতে চিঠিটা দিলেন। তারপর হুকুম দিলেন–সোজা মুর্শিদাবাদ চলো, মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা, তারপর দরকার হলে কলকাতা থেকে সোজা হুগলি!

সে হুকুম শুনল মোহনলাল। শুনল মিরজাফর আলি খাঁ, শুনল দোস্ত মহম্মদ খাঁ, মিরকাজেম খাঁ, দিলির খাঁ, আসালৎ খাঁ, সবাই।

আর ইতিহাস সেই মুহূর্তে আবার আর একদিকে মোড় ঘুরল।

.

তখন বেশ ভোর হয়েছে। চকবাজারের রাস্তায় তখন কান্তর পা দুটো যেন আর চলতে চাইছে না। কোথায় কার কাছে যে সান্ত্বনা চাইবে, কার কাছে যে পরামর্শ চাইবে, তারও যেন কোনও হদিশ নেই। ছোটবেলা থেকে একলাই সে বড় হয়েছে, একলাই নিজের অন্নসংস্থান করে নিয়েছে, তবু কখনও তার যেন নিজেকে এত নিঃসঙ্গ নিঃসহায় মনে হয়নি।

আকাশের দিকে একবার চোখ তুলে চাইল কান্ত।

যার কেউ নেই, তার হয়তো এই আকাশ আছে, এই সসাগরা পৃথিবী আছে, অন্তত এই নিঃসঙ্গ নির্জীব রাত্রিটা আছে। হে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের দেবতা, হে অনন্ত-অনাদি-অদৃষ্ট সৃষ্টিকর্তা, তোমার কাছে কোনওদিন কিছু অঞ্জলি পেতে আমি চাইনি। তোমার কাছে নিজের জন্যে কোনওদিন কিছু প্রার্থনা করবার প্রয়োজন আমার হয়নি। কিন্তু আজ চাইছি। আজ আমাকে তুমি ভিক্ষা দাও। আজ তুমি এমন কিছু আমাকে দাও যা দিয়ে আমি আর একজনের শৃঙ্খল মোচন করতে পারি। সে কিছু অপরাধ করেনি। আমি শপথ করে বলতে পারি, তার কোনও অপরাধ নেই। সে নিষ্পাপ। সে আর একজনের ক্ষতি নিবারণ করবার জন্যে নিজে এই পাপ মাথায় তুলে নিয়েছে। আর আমি তার এই পাপের সাহায্য করেছি তাকে এখানে এনে এই চেহেল্‌-সুতুনে তুলে দিয়ে। আমারই সব পাপ ভগবান, আমারই সব অপরাধ। আমিই দোষী, আমিই অপরাধী! তুমি তার ওপর প্রসন্ন হও ঈশ্বর! তোমার প্রসন্নতা আমার চিরন্তন অন্তরের সম্পদ হয়ে আমার অনন্তজীবনের সম্বল হোক!

কে?

হঠাৎ রাস্তায় চলতে চলতে পায়ে একটা ধাক্কা লাগতেই কান্ত চমকে উঠেছে–কে!

এমন শীতের রাত্রে এরকম করে যে রাস্তায় মানুষ শুয়ে থাকবে তা যেন ভাবতেই পারা যায় না। অন্যমনস্ক অবস্থায় চলতে গিয়ে লোকটার পায়ে ধাক্কা লেগে গিয়েছে।

কে তুমি?

মাথা নিচু করে দেখতে গিয়ে কেমন সন্দেহ হল। ঠিক যেন চেনা চেনা চেহারা।

উদ্ধব দাস!

তাড়াতাড়ি ভাল করে মুখটা দেখেই আবার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। মদের গন্ধে যেন কান্তর বমি এসে গেল। আশ্চর্য, লোকটা মদ খেয়ে রাস্তার ওপরেই শুয়ে পড়ে আছে। খেয়ালও নেই কিছু যদি পালকি-বেহারারা যেতে গিয়ে পায়ে হোঁচট লাগে। যদি নবাবের হাতির দল চলতে চলতে লোকটাকে চাপা দিয়ে পিষে দেয়।

লোকটাকে দুহাতে ধরে রাস্তার একধারে শুইয়ে দিল কান্ত। তবু লোকটার সাড় নেই। তারপর আবার চকবাজারের পথ ধরে চলতে লাগল।

তারপর সারাফত আলির দোকানের কাছে এসে পেছন দিকে গিয়ে ডাকলে-বাদশা, ও বাদশা

 বাদশা তখনও ওঠেনি। বাদশা দেরি করে ওঠে ঘুম থেকে। সারাফত আলি ওঠে আরও দেরি করে।

 বাদশা, ও বাদশা, আমি কান্তবাবু

অনেকবার ডাকতে তবে বাদশার ঘুম ভাঙল। ঘুমচোখে দরজা খুলে দিয়ে বললে–এত দেরি হল বাবুজি? আপনাকে যে একজন তালাশ করতে এসেছিল

কে? কে তালাশ করতে এসেছিল?

একটা তাঞ্জামে করে সফিউল্লা খাঁ সাহেব এসেছিল চেহেল্‌-সুতুন থেকে।

তুমি কী বললে? বা

দশার তখন ঘুমের ঘোর কেটে গেছে। বললে–আসলে সফিউল্লা খাঁ সাহেবনয় বাবুজি, মরিয়ম বেগম।

তারপর?

তারপর আসলি সফিউল্লা খাঁ সাহেব মরিয়ম বেগমকে ধরে নিয়ে গেল হুজুর মতিঝিলে।

তারপর সেখানে গিয়ে কী হয়েছে, তার কিছু শুনেছ?

না বাবুজি, আর কিছু শুনিনি!

ভালই হয়েছে। সফিউল্লা সাহেবের খুন হয়ে যাওয়ার খবরটা এখনও শোনেনি তা হলে বাদশা। না শুনেছে ভালই হয়েছে। বাদশা আবার ঘুমোতে গেল। কান্তও নিজের ঘরের ভেতর ঢুকল। ছি ছি, মাতাল লোকটাকে কিনা উদ্ধব দাস বলে ভুল করেছিল সে। উদ্ধব দাস কেন মদ খেতে যাবে আর মদ খেয়ে ওরকম’রাস্তাতেই বা শুয়ে থাকবে কেন?

শুতে গিয়েও কান্ত কিন্তু শুতে পারল না। পাশেই সারাফত আলির ঘর। সেই একখানা ঘরেই সারাফত আলি ঘুমোয়, বসে, যা কিছু করে। একটা মাত্র দেয়ালের ফারাক। ভাবনাটা আসতেই সমস্ত ঘুম মাথায় উঠে গেল কান্তর। সারাফত আলির তো অনেক টাকা। অনেক মোহর, অনেক আসরফি! চাইলে এক হাজার আসরফি দেয় না! কিন্তু যদি না দেয়। সারাফত আলির সমস্ত টাকাকড়ি যা কিছু একটা সিন্দুকের ভেতর থাকে। আধখানা মাটিতে পোঁতা। অত টাকা মিঞাসাহেবের কী হবে! যদি কান্ত। মোহরগুলো সিন্দুক ভেঙে নিয়ে নেয়। বুড়ো জানতে পারবে? বুড়ো সন্দেহ করবে? কিন্তু সাফত আলি সন্দেহ করলেই বা, জানতে পারলেই বা। মরালী তো ছাড়া পাবে! মরালীকে তো ছেড়ে দেবে সদরস সুদুর। বুড়োর টাকা খাবার তো কেউ নেই। তবু টাকাটা সদ্ব্যয় হবে। এক হাজার আরফি নিলে বুড়োর আর কীসের ক্ষতি!

ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে এল। সারাফত আলির নাক-ডাকা তখন থেমে গিয়েছে। এইবার বোধহয় উঠবে মিঞাসাহেব। দিনেরবেলা সিন্দুকটা ভাল করে দেখে নেবে কান্ত, তারপর সন্ধেবেলা যখন আগরবাতি জ্বেলে দিয়ে বুড়ো আফিং খেয়ে তামাক টানতে শুরু করবে তখন নেশার বেঁকে কিছুই বুঝতে পারবে না মিঞাসাহেব। নেশার মৌতাতে তখন মশগুল হয়ে থাকবে। তখনই সিন্দুক ভাঙা ভাল।

কথাটা ভেবে যেন নিশ্চিন্ত হল কান্ত। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল।

*

হুগলি তখন পুড়ছে। রবার্ট ক্লাইভের একদিন ঘুম ছিল না। সেন্ট কোর্ট ডেভিডের কম্যান্ডর বেঙ্গলে এসেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অপমানের প্রতিশোধ নিতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রতিশোধ বড় কঠিন প্রতিশোধ। এক একটা ফোর্ট দখল করেছে আর্মি আর প্রতিশোধের নেশা যেন বেড়ে গেছে রবার্ট ক্লাইভের। এমন করে ভাগ্য উলটে যাবে নিজামতি ফৌজের এ যেন রাজা মানিকচাঁদ ভাবতেই পারেনি। নবাব মির্জা মহম্মদও।

কিন্তু রাজা মানিকচাঁদ তো জানত না কাকে বলে অপমান। অপমান যে নিজে না পেয়েছে, সে অপমানের প্রতিশোধ নিতেও জানে না। রাজা মানিকচাঁদ জানত না অপমান শুধু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরই নয়, অপমান কর্নেল ক্লাইভের নিজেরও। নবাবের ফৌজকে হারিয়ে ক্লাইভ যেন নিজেরই অপমানের প্রতিশোধ নিচ্ছে। তোমরা আমাকে রেসপেক্ট দাওনি, তোমরা আমাকে দেশছাড়া করেছ, তোমরা আমাকে কিক করে তাড়িয়ে দিয়েছ এখানে। আমি তাই এসেছি তোমাদের অপমানের প্রতিশোধ নেব বলে। এই তোমরা, যারা আমার স্বজাত, যারা আমার স্বধর্মী! তোমরা দূর থেকে দেখো কাকে তোমরা মাতৃভূমি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছ, সে একটার পর একটা লড়াইতে জিতে তোমাদের মুখে কালি লেপে দিচ্ছে।

হরিচরণ বড় মুশকিলে পড়েছিল। কোথায় কোম্পানির চাকরি নিয়ে পল্টনের দলে কাজ করবে না, এই এদের নিয়ে হুগলিতে এসে উঠেছিল।

 বজরার মধ্যে দু’জন চুপ করে বসে ছিল।

 হরিচরণ বাইরে থেকে ডাকলে–দিদি

কে? হরিচরণ? এসো—

হরিচরণ আসতেই দুর্গা জিজ্ঞেস করলে–কী বাবা; কিছু হদিস পেলে?

হরিচরণ বললে–বড় যে ভয় করছে দিদি, কেউ বলছে নবাব আলিগড়ের দিকে আসছে, কেউ বলছে পূর্ণিয়ার দিকে গেছে। কিছু তো টের পাচ্ছিনে। বুঝতে পাচ্ছিনে কী করব!

দুর্গা বললে–তা হলে এক কাজ করো না বাবা, আমাদের হাতিয়াগড়ের দিকে পৌঁছিয়ে দাও না, ঘরের লোক ঘরে ফিরে যাই, বাবা বিশ্বনাথ আমাদের মাথায় থাকুন

তবে তাই চলি।

শ্রীনাথ বইঠা ধরে ছিল। হরিচরণ শ্রীনাথকে গিয়ে সেই কথাই বললে। বজরা আবার হাতিয়াগড়ের দিকেই ফিরে চলল। শ্রীনাথের সব রাস্তাই চেনা। ছোটমশাইকে নিয়ে বহুদিন এই বজরার বইঠা বেয়েছে। সকালবেলা বজরার জানালাটা দিয়ে সূর্য উঠতে দেখা যায়, আবার সন্ধ্যাবেলা এ-পাশের জানালাটা দিয়ে সেই সূর্যটাকেই ডুবতে দেখা যায়।

ছোট বউরানি বলে–আর কতদিন এইরকম কাটবে রে দুগ্যা?

দুর্গা বলে–পাঁজি পুঁথি দেখে না বেরুলে এই হয় গো, তোমার বড় বউরানির যা মেজাজ, হুকুম করলে তো আর কারু না’ বলবার সাধ্যি নেই

হঠাৎ আবার হরিচরণের মতিগতি বদলে যায়। বলে–না দিদি, আর হাতিয়াগড়ের দিকে যাওয়া হবে না

দুর্গা জিজ্ঞেস করে কেন?

শুনলাম ওলন্দাজরা ওদিকে নৌকোর ওপর কামান সাজিয়ে বসে আছে, নদীতে নৌকো দেখলেই গোলা ছুড়বে

দুর্গা বললে–তা হলে কী করবে হরিচরণ?

হরিচরণ বললে–কী করব এখন তাই বলো? অন্য কোথাও যাবে তো চলো

দুর্গা বললে–তা হলে কেষ্টনগরে নিয়ে যেতে পারো?

তা কেষ্টনগরেই যাচ্ছি! বলে হরিচরণ শ্রীনাথকে নৌকোর মুখ ঘোরাতে বললে।

 ছোট বউরানি বললে–দুগ্যা, তুই উচাটন করতে পারিসনে? এত লম্বা-চওড়া কথা বলিস, ওদের উচাটন করে দে না

কাকে?

কেন, নবাবকে!

 দুর্গা বললে–শেষপর্যন্ত তাই-ই করতে হবে দেখছি। কিন্তু বজরায় বসে তো আর উচাটন হয় না। ঘোড়ার খুরই বা কোথায় পাব আর পারাভস্মই বা কোথায় পাব? একবার ড্যাঙায় নানামলে তো আর তা হচ্ছে না।

বউরানি বললে–এই ফিরিঙ্গি সাহেবটা খুব ভালমানুষ, না দুগ্যা? আমি তো ভয় পেয়েছিলাম প্রথমে, কিন্তু ম্লেচ্ছ হোক আর যাই হোক বাপু, বড় মিষ্টি কথা ফিরিঙ্গিটার–

দুর্গা বললে–আমি তো তাই গড় হয়ে পেন্নাম করে এলাম আসবার সময়,

হরিচরণ আবার সেদিন বাইরে এসে ডাকলে–দিদি

কী হরিচরণ?

হরিচরণ ভেতরে এসে বললে–কেষ্টনগরের দিকে যাওয়া যাবে না দিদি। চূর্ণি নদীর মোহনায় ফরাসিরা নৌকোর মহড়া দিচ্ছে–নদীর দিকে কামান সাজিয়ে বসে আছে গোরা পল্টনরা।

কেন?

ইংরেজ ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে যে ফরাসি ফিরিঙ্গিদের লড়াই বেধেছে গো।

দুর্গা বললে–তা বাছা, সবাই কি লড়াই করে করেই মরবে! ফিরিঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে লড়াই। ক্রছে, নবাবের সঙ্গেও লড়াই করছে, হলটা কী? আমরা সাতজন্মে তো এত লড়াই দেখিনি কখনও। আমাদের সময় বর্গিরা আসত, আবার লুটপাট করে চলে যেত, এমন নাগাড়ে লড়াই চলত না তো তখন! তা তুমি বাপু কাছাকাছি কোথাও নিয়ে চলো, বজরার দুলুনি আর সহ্য হচ্ছে না আমার মেয়ের যেখানে পারো আমাদের নামিয়ে দাও, ডাঙায় পা রেখে বাঁচি

শেষকালে একদিন হরিচরণ বললে–চলো দিদি, এবার একটা ভাল জায়গা পেইছি

 কোথায় গো? কোথায় ভাল জায়গা? নাম কী জায়গার?

হুগলি!

হুগলি? এখানে আবার ভাল জায়গা কোথায় আছে? তোমার জ্ঞাতিগুষ্ঠি কেউ আছে নাকি?

হরিচরণ বললে–না, জ্ঞাতিগুষ্ঠি আমি কোথায় পাব দিদি? এখানে একজন সজ্জন সাহেব আছে দিদি, বড় ভালমানুষ। কাশিমবাজার কুঠির ডাক্তারসাহেব এখানে এই চুঁচুড়োয় পালিয়ে এসে আছেন। নবাবের ভয়ে এখানে রয়েছেন। আমার চেনা সাহেব দিদি। তোমাদের বিপদের কথা সাহেবকে বললুম কিনা

দুর্গা বললে–ওমা, জানাশুনো নেই কিছু না, অমনি তার বাড়িতে গিয়ে উঠব?

তার বাড়িতে তো উঠছ না তোমরা, তার আলাদা একটা বাড়ি খালি পড়ে আছে, সেখানে গিয়ে উঠবে! তারপর তোমাদের সেখানে নামিয়ে দিয়ে আমি হাতিয়াগড়ে গিয়ে খবর দিয়ে আসব, তখন চলে যেয়ো, দুটো তো মাত্তর দিন! থাকতে পারবে না তোমরা? আর এ তো নবাবের এলাকাও নয়, ওলন্দাজদের জমিদারির মধ্যে পড়ল চুঁচুড়ো, ভয়টা কী তোমাদের?

তা অগত্যা তাই-ই সাব্যস্ত হল। সার্জন ডাক্তার উইলিয়ম ফোর্থ। বেশ পাকা দেয়াল বাড়িটার। কিন্তু খড়ের চাল। চারদিকে বাগান। বাগানে বেশ বড় বড় গাছ। ফোর্থ সাহেব কোম্পানির ডাক্তার হয়ে এসেছিলেন। কাশিমবাজার কুঠি ভেঙে দেবার পর এই চুঁচুডোর ডাচদের এলাকায় এসে লুকিয়ে আছেন। হরিচরণকে চুঁচুড়োর ঘাটে দেখে সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন–তুমি হরিচরণ? এখানে কেন? বোটের ভেতর কে?

হরিচরণ বলেছিল–আজ্ঞে, আমাকে কর্নেল ক্লাইভ দু’জন মেয়েমানুষকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছিয়ে দিতে হুকুম দিয়েছেন

কোন মেয়েমানুষ? কাদের লোক? ইউরোপিয়ান? ইংলিশ লেডি?

না হুজুর, হিন্দুর মেয়ে। নবাবের ফৌজের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি ওঁদের নিয়ে। হাতিয়াগড়ে যাবার উপায়ও নেই, কেষ্টনগরে যাবারও উপায় নেই, ক’দিন ধরে জলে জলে ঘুরে বেড়াচ্ছি, খাওয়াদাওয়া মাথায় উঠেছে, উপোস করছি সবাই মিলে।

বেশ ফাঁকা বাড়িটা। বাইরে থেকে দেখা যায় না। মেয়েদের ভেতরে উঠিয়ে দিয়ে তাদের রান্না-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়ে হরিচরণ সাহেবের ঘরে এল।

সাহেব জিজ্ঞেস করলে–ওদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

হরিচরণ বললে–বাজারে কোনও জিনিসই পাওয়া যাচ্ছে না, ফিরিঙ্গিদের কেউ জিনিসপত্তর বেচতে চাইছে না, সবাই পালিয়ে যাচ্ছে। বলছে, রাজা মানিকচাঁদ নাকি হুকুম দিয়ে গেছে ফিরিঙ্গিদের কেউ চাল ডাল বেচবে না। আমি হিন্দু বলে কিছু কিনে এনেছি, কিন্তু পরে কী হবে?

সাহেব বললে–পরে সব পাবে।

কী করে পাব? না পেলে ওঁরা খাবেন কী? আমি তো হুজুর হাতিয়াগড়ে ওঁদের আত্মীয়স্বজনদের খবর দিতে যাব, তখন কে দেখবে ওঁদের?

সাহেব বললে–তা তুমি যাও, আমি ওঁদের সব দেখাশোনার বন্দোবস্ত করব–তোমার কোনও ভাবনা নেই ওঁদের জন্যে

হরিচরণ সেই রাত্রেই হাতিয়াগড় যাবার জন্যে বন্দোবস্ত করছে, এমন সময় দুমদাম করে কামানের গোলা পড়তে লাগল হুগলি ফোর্টের ওপর। একটার পর একটা। সে আর থামে না। হরিচরণ বাইরে এসে দেখে অবাক কাণ্ড। ওলন্দাজদের ওপর কারা গোলা ছুড়ছে! দূর থেকে আগুন দেখা গেল। চুঁচুডোর ঘাট থেকে সোজা দেখা যায় হুগলির কেল্লাটা। হুড়মুড় করে দৌড়োত দৌড়োতে লোকগুলো ছুটে আসতে লাগল চুঁচুড়োর দিকে।

দুর্গা বললে–এ আবার কোথায় নিয়ে এলে আমাদের হরিচরণ, যে-দিকে যাই সেদিকেই যে নবাবের সেপাই, যাই কোথায় আমরা?

জাহাজ থেকে গোরাপল্টনরা নেমে একেবারে বাড়িঘর সব জায়গায় আগুন লাগিয়ে দিলে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে লাগল হুগলি শহরে। একটা আগুনের ফুলকি চুচুড়োতে এসে পড়লেই এখানকার বাড়িঘরও পুড়তে শুরু করবে। দোকান-পাটকেল্লা-শহর-ফৌজদারের দপ্তর সব পুড়ে তখন ছাই হয়ে যাবার জোগাড়। ছোট বউরানির সারারাত ঘুম নেই। দুর্গা কেবল হরিচরণকে ডাকে। বলে–তুমি বাপু একলা আমাদের ফেলে রেখে কোথাও যেয়ো না–এ আমাদের কী বিপদে ফেললে বলো দিকিনি তুমি? কোথায় তোমার সাহেব? সাহেবকে ডাকো দিকিনি একবার আমার কাছে, আমি কথা শুনিয়ে দিচ্ছি ডাকো–আমি এখন মেয়েকে নিয়ে কী করি? ভাল জ্বালা হল দেখছি তোমার কথায় বিশ্বাস করে–

সাহেব এল না, কিন্তু এল আর একজন সাহেব। রবার্ট ক্লাইভ!

 একী হরিচরণ, তোমরা এখানে?

 স্যার, এই ডাক্তারসাহেব আমাদের এখানে রেখেছেন।

ক্লাইভ বললে–তা তো শুনলাম, কিন্তু ওদের বাড়ি পৌঁছে দিতে পারলে না?

হরিচরণ বললে–যাব কোথা দিয়ে? চারদিকে রাজা মানিকচাঁদ কামান সাজিয়ে রেখেছে যে। আলিগড়ের দিকে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে কামানের শব্দ এল, টানার দিকে গিয়েছিলাম, শুনলাম রাজা মানিকচাঁদ ওত পেতে আছে ওখানে। হাতিয়াগড়ের দিকে যাবার চেষ্টা করলাম সে-পথও বন্ধ। কেষ্টনগরের দিকে যাচ্ছিলাম ওদের রাখতে, সেদিকেও শুনলাম চূর্ণি নদীর মোহনায় কামান সাজানো। হাঁটা-পথে যাওয়ার চেষ্টা করিনি হুজুর, তাতে মেয়েছেলে নিয়ে আরও বিপদ

তা এখন কী করবে ওদের নিয়ে? কলকাতায় যাবে? কলকাতার কেল্লা তো আমরা নিয়ে নিয়েছি।

হরিচরণ বললে–ওদের জিজ্ঞেস করে দেখি তা হলে!

ততক্ষণে হুগলির ওদিকের আকাশটা ধোঁয়ায় ধোঁয়া হয়ে গেছে। রাজা মানিকচাঁদের সেপাইরা দলে ছিল দু’হাজার জন। তারা তখন কেল্লা ফেলে পালাচ্ছে। ক্লাইভ তাদের পেছনে গোরা পল্টনদের লেলিয়ে দিয়ে ফোর্থ সাহেবের কাছে চলে এসেছিল। সেখানে এসেই এদের খবরটা শুনতে পেয়েছে।

ফোর্থ সাহেব জিজ্ঞেস করেছিল–হু আর দোজ লেডিজ? তুমি চেনো নাকি ওদের?

ক্লাইভ সেকথার উত্তর না দিয়ে সোজা এখানে চলে এসেছিল। শেষকালে এত জায়গা থাকতে ওদের এখানে নিয়ে এসেছে হরিচরণ!

*

বজবজ জয় হয়েছে, টানা জয় হয়েছে, মেটিয়াবুরুজ জয় হয়েছে, কলকাতা জয় হয়েছে, শেষকালে এই হুগলি ফোর্ট! এখনও তার জয়ের অনেক বাকি আছে যে। কোম্পানির ইনসাল্টের প্রতিশোধ নিতে হবে যে! লেফটেনান্ট কর্নেল ক্লাইভকে ইংলন্ড যে অপমান করেছে, তারও যে প্রতিশোধ নিতে হবে! তার নিজের ওপরেও যে প্রতিশোধ নিতে হবে কর্নেল ক্লাইভকে। যে-পৃথিবী সম্মান দেয় অন্যায়কে, যে পৃথিবী শ্রদ্ধা করে ডিসঅনেস্টিকে, যে-পৃথিবী মিথ্যেকে মর্যাদা দেয়, সে-পৃথিবীর ওপরেও যে প্রতিশোধ নিতে হবে! যে বাপ-মা তাকে সংসারে নিয়ে এসে তাচ্ছিল্য আর অবহেলা দিয়ে তার অভ্যর্থনা করেছে, তাদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়াও যে বাকি আছে এখনও। ওরা ভাবে, ওই অ্যাডমিরাল ওয়াটসন, ক্যাপ্টেন কুট, মেজর কিলপ্যাট্রিক, গভর্নর হলওয়েল, ড্রেক, সবাই ভাবে ক্লাইভ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি করে বলেই বুঝি এত প্রাণ দিয়ে লড়ছে। চাকরি না করলেও যে লড়ত এটা তারা জানে না। তারা একথা কল্পনাও করতে পারে না। তারা জানে না ইংলন্ডকে আর ক্লাইভ তার বার্থপ্লেস বলে মনে করে না। এই ইন্ডিয়াই তার দেশ, এই বেঙ্গলই তার মাতৃভূমি। এখানকার লোকদের সে নিজের লোক বলে মনে করে ফেলেছে।

তা ক’দিন আর লাগল হুগলি জয় করতে। ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯ জানুয়ারি। নদিন। নদিনেই হুগলি শহর পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। হুগলি থেকে ব্যান্ডেল পর্যন্ত একখানা বাড়ি একখানা খামারও আস্ত রইল না।

সেদিন ক্লাইভ জাহাজ নিয়ে আবার কলকাতার কেল্লায় ফিরে এল, দু’জন লেডিকে সঙ্গে দেখে সেদিন সবাই অবাক হয়ে গেছে।

হলওয়েল, ড্রেক, ওয়াটসন সবাই তাজ্জব হয়ে গেছে দেখে। রবার্ট কি নেটিভ মেয়ের সঙ্গে লাভে পড়ল নাকি! স্ট্রেঞ্জ!

ওয়াটসন জিজ্ঞেস করলে–তুমি কি ওই নেটিভ গার্লদের ফোর্টের মধ্যে রাখবে নাকি?

 ক্লাইভ বলে–যদি রাখি সে আমার খুশি, তোমার অর্ডার মানব এমন লোক পাওনি আমাকে।

জানো, এখানে ইংলিশ লেডিরা রয়েছে, এর ভেতরে তোমার নেটিভ মিস্ট্রেসদের রাখতে দেব না, দ্যাটস মাই কমান্ড

ক্লাইভের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। একটা ঘুষি উঁচিয়ে ওয়াটসনের মুখের ওপর মারতে যাচ্ছিল–স্টপ দ্যাট ননসেন্স, আর একবার ওই কথা উচ্চারণ করলে আমি তোমার মুখ ভেঙে ক্রাশ করে দেব!

ওরা তোমার মিস্ট্রেস নয় বলতে চাও?

ক্লাইভের আর সহ্য হল না। তার হাতের ঘুষিটা গিয়ে সোজা ওয়াটসনের মুখের ওপর ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

আর সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে দৌড়ে এসেছে ড্রেক। দু’জনকে দু’হাতে ঠেকিয়ে দিয়েছে।

ক্লাইভ বললে–আমি কি চাকরির ভয় করি মনে করেছে ওয়াটসন? আমি কি নিজের সেফটির কেয়ার করি মনে করেছে ও? দি কাওয়ার্ড, দি ব্যাস্টার্ড, দি–

খবর পেয়ে কেল্লার ভেতরের আরও সবাই এসে পড়েছে সেখানে। ফোর্টের ভেতরে নবাব একটা মসজিদ তৈরি করিয়েছিল, সেটা তখন ভাঙা হচ্ছিল। আলিনগর নাম বদলে আবার ক্যালকাটা নাম লেখা হচ্ছিল চারদিকে। ভেতরে সেপাই, পল্টন, রাজমিস্ত্রিদের ভিড়, পল্টনরা সব কেল্লা সব শহর লুটপাট করে যা-কিছু এনেছে তাই নিয়ে হইচই শুরু করে দিয়েছে। রাজমিস্ত্রিরা ভাঙা কেল্লা আবার সারিয়ে তুলছে। তার মধ্যে হঠাৎ কর্নেল আর অ্যাডমিরালের ঝগড়া কথাকাটাকাটি শুনে দৌড়ে কাছে। এসেছে।

অলরাইট, আমি এখানে থাকব না, আমি বরানগরে গিয়ে থাকব।

ড্রেক অনেক বোঝাতে লাগল–কর্নেল, আপনি ইংরেজদের এই বিপদের সময় রাগ করলে চলবে কী করে? যখন এনিমি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন আপনি কেন নন-কোঅপারেট করছেন?

ক্লাইভ বললে–তা আমি ইংলিশ আর্মির কম্যান্ডার, না ওয়াটসন? কে?

ড্রেক বললে–ফোর্টের মধ্যে আমিই হচ্ছি গভর্নর, আমার কথা তো আপনারা দুজনেই শুনবেন! তারপর কাউন্সিলের সিলেক্ট কমিটি যা ঠিক করে তাই-ই হবে

তবে তাই-ই হোক, আমি কিন্তু এখানে থাকব না। আমি বরানগরের ক্যাম্পে গিয়ে উঠছি, আমি সেখানে নেটিভদের সঙ্গে মোর কম্ফোর্টেবলি থাকতে পারব–আই হেট ইউ পিপল অল

দুর্গা, ছোট বউরানি, হরিচরণ সবাই ব্যাপারটা দেখেছিল। শুধু তাদের জন্যেই সাহেবকে এত অপমান সইতে হল। বরানগরের পথে যেতে যেতে ক্লাইভ চেয়ে দেখলে চারদিকে। সমস্ত শহরটা পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল সাহেবের। শহর ভাঙা কত সহজ! হুগলিও তো। নিজে পুড়িয়ে এসেছে এমনি করে। এমনি করে কি সমস্ত ইন্ডিয়াকেই পোড়াতে হবে? কান্ট্রি না পোড়ালে কি নতুন করে কান্ট্রি গড়া যায় না? কে জানে! হয়তো নতুন করে ইন্ডিয়াকে গড়বার জন্যেই। লর্ড জেসাস ক্রাইস্ট ক্লাইভকে পাঠিয়েছে এই এখানে। হয়তো রবার্ট ক্লাইভই নতুন করে গড়ে তুলবে ইন্ডিয়াকে। হয়তো ইন্ডিয়াই হবে রবার্ট ক্লাইভের মাদারল্যান্ড। এই মাদারল্যান্ডেই রবার্ট ক্লাইভ খুঁজে পাবে নিজেকে। আশ্চর্য! কত স্বপ্নই না দেখেছিল একদিন ক্লাইভ।

সেদিন বরানগরে পৌঁছেই দুর্গা একেবারে সাহেবের কাছে এসে হাজির হয়েছিল।

দুর্গা বলেছিল আমাদের জন্যে তোমার অনেক হেনস্থা হল বাবা, তোমায় অনেক দুর্গতি সইতে হল

ক্লাইভ জিজ্ঞেস করেছিল–আপনাদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? অসুবিধে হলে বলবেন!

তুমি থাকতে আর আমাদের অসুবিধে হবে কী করে বাবা। হরিচরণকে তো আমাদের সেবা করবার জন্যেই ছেড়ে দিয়েছ, সে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি। ছেলেটি বড় ভাল বাবা!

সাহেব বললে–সব ইন্ডিয়ানরাই ভাল, ইউরোপিয়ানরাই খারাপ

ও কথা কেন বলছ বাবা! তুমিও তো ফিরিঙ্গি, তুমি কি খারাপ?

ক্লাইভ বললো দিদি, আমি খারাপ! আমি লেখাপড়া শিখিনি, আমি ইললিটারেট, মুখ, আমার বাবা-মা, আমার সোসাইটি, আমার ফ্রেন্ডস, আমাদের পার্লামেন্ট, সবাই আমাকে ওয়ার্থলেস বলে এইখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল আমি এখানকার ক্লাইমেটে মাছিমশার কামড়ে অসুখ হয়ে মারা যাব। মারা গেলেই ওরা গ্ল্যাড হত। কেন যে মারা গেলুম না, গড নোজ।

সাহেব গম্ভীর মুখে বসে ছিল। কথা বলতে গিয়ে যেন খই ফুটতে লাগল মুখ দিয়ে।

বলতে লাগল–মরতেই আমি চেয়েছিলুম দিদি! বিলিভ মি! আমি মরতেই চেয়েছিলুম! প্রত্যেকটা লড়াইতে আমি ফায়ার আর্মসের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছি মরে যাবার জন্যে। আমি নিজের বুক লক্ষ্য করে দু-দুবার পিস্তলের গুলি ছুঁড়েছি। তবুও মরিনি। লোকে আমাকে বলে কী জানো দিদি, বলে আমি নাকি খুব বীর। আমি নাকি খুব সাহসী! কিন্তু ওরা তো আসল কথাটা জানে না, ওরা তো জানে না মরার মতো শক্ত কাজ আর নেই। আমি সেই শক্ত কাজটাই করতে পারলুম না। আই ওয়ান্ট টু ডাই দিদি, আই ওয়ান্ট টু ডাই। আমি মরতেই চাই–

দুর্গা বললে–ছি বাবা, ওকথা কি মুখে আনতে আছে? আমাদের হিন্দুঘরে একটা কথা আছে–মরার বাড়া গাল নেই। ওকথা বারবার বোলো না

সাহেব বলতে লাগল ও তুমি বুঝবে না দিদি, মরার মতো সুখ নেই এই ওয়ার্লডে! এখানকার নবাব যেমন বাঁচার জন্যে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, আমি তেমনই মরার জন্যে যুদ্ধ করতে ইন্ডিয়ায় এসেছি কিন্তু মরতে পারলাম কই? কলকাতার ফোর্টে আজ আমাদের যে সব ইউরোপিয়ান দেখলে, ওদের সঙ্গে এইজন্যে আমার বনে না! ওরা তোমাদের ইনসাল্ট করল বলেই সে ইনসাল্ট আমার গায়ে লাগল। আমি তাই এখানে চলে এসেছি! ওরা ইন্ডিয়ানদের হেট করে, ওরা ইন্ডিয়াতে এম্পায়ার তৈরি করতে চায়, কিন্তু আমি ওদের বলে বোঝাতে পারি না যে, বেঙ্গলের নবাব খারাপ হতে পারে, কিন্তু ইন্ডিয়ানরা আমাদের সঙ্গে কী দোষ করেছে? তারা তো কোনও অন্যায় করেনি। তাদের কেন আমরা হেট করব? তাদের কেন আমরা ক্ষতি করব?

নিজের ঘরে যেতেই ছোট বউরানি জিজ্ঞেস করলে–এতক্ষণ কী গল্প করছিলি রে দুর্গা? সাহেবের সঙ্গে এত কী গল্প তোর? হাতিয়াগড়ে ফেরত পাঠিয়ে দেবার কথা কিছু বললে?

দুর্গা বললে–সাহেবটা পাগল বউরানি, একেবারে বদ্ধ পাগল

কেন? কী বলছিল?

বলে কিনা সাহেব মরতে এসেছে এখানে। সাহেবের মরতে বড় সাধ!

ওমা, সেকী? মরতে চায় কোন দুঃখে?

তবেই বোঝো! পাগল কি আর সাধে বলছি! এমন মানুষের সঙ্গে থাকলে আমরাও কোন দিন মারা পড়ব দেখছি! তাই তো বললাম সাহেবকে। বললাম-তুমি বাবা আমাদের একটা হিল্লে করে তারপর মরো বাঁচো আমরা দেখতে যাচ্ছিনে!

তা কী বললে?

বলবে আবার কী! নিজের মাথার ঘায়েই কুকুর পাগল!

হঠাৎ হরিচরণ ঘরে ঢুকেছে। বললে–দিদি, একটা সুখবর আছে, তোমার জামাই এসেছে।

দুর্গা তো অবাক। বললে–কী বলছ তুমি হরিচরণ? জামাই আমার আবার কে?

 হরিচরণ বললে–কেন, তোমার মেয়ের বর?

ছোট বউরানির বুকখানা হাত করে উঠল। দুর্গা বললে–কে? ছোটমশাই? ছোটমশাই? ছোটমশাই খবর পেয়ে গেছে?

না দিদি, এ যে বললে–এর বউয়ের নাম মরালীবালা। তাই শুনেই তো ডেকে আনলাম। লোকটা বরানগরের পথে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল, ভারী ভাল গান গাইতে পারে তোমার জামাই, দিদি–আমি রব না ভব-ভবনে গান শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম–তোমার নাম কী? সে বললে–উদ্ধব দাস! তোমার জামাইয়ের নাম উদ্ধব দাস তো!

দুর্গা বললে–না হরিচরণ, তুমি ওকে বিদেয় করে দাও বাছা, ও পাগল মানুষ, তোমাদের সাহেবের মতো বদ্ধপাগল–

তবে যে ও বললে–হাতিয়াগড়ে ওর শ্বশুরবাড়ি, ওর বউয়ের নাম মরালীবালা, ওর শ্বশুরের নাম শোভারাম বিশ্বাস। তুমি যা যা বলেছিলে, সব তো মিলে যাচ্ছে–

তারপর আর উত্তরের অপেক্ষা না করে বললে–যাই, ওকে ডেকে নিয়ে আসি গে, ওকে আমি বলেছি যে ওর বউ এখানে আছে–

বলেই ঘরের বাইরে চলে গেল।

দুর্গা ছোট বউরানির দিকে চাইলে। বললে–হরিচরণ আবার এ কী বিপদে ফেললে বলল তো ছোট বউরানি। এই এতগুলো পাগলকে নিয়ে তো দেখছি মহা মুশকিলে পড়া গেল

*

মুর্শিদাবাদের চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে তখন তুমুল হইচই বেধে গেছে। মরিয়ম বেগমের খবরটা যেন দেখতে দেখতে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল সব জায়গায়।

রাত থেকেই শুরু হয়েছিল। ভোর হবার পর থেকে আরও বেড়ে গেল। লুৎফুন্নিসার ঘরে নানিবেগম দৌড়োতে দৌড়োতে এসেছে।

শুনেছিস বহু, আমাদের মরিয়ম বেটির কাণ্ড?

লুৎফুন্নিসা আগেই শুনেছিল। শুধু পাথরের চোখ দিয়ে একবার চেয়ে দেখলে নানিবেগমের দিকে। কোনওদিনই তার মুখে ভাষা নেই, আজও যেন তার মুখে কথা ফুরিয়ে গিয়েছে। শিরিনার কোলে নতুন মেয়েটা তার দুধ খাচ্ছিল, সেই দিকেই চেয়ে রইল অপলক দৃষ্টি দিয়ে।

তুই কিছু বলবিনে তা হলে? তা হলে কার কাছে আমি যাই বল তো? কে আমার কথা শুনবে?

তবু কিছু উত্তর দিলে না লুৎফুন্নিসা। সকালবেলা নানিবেগমের নাস্তা পর্যন্ত খাওয়া হয়নি। অন্যদিন কোরান পড়তে পড়তে রাত ভোর হয়ে যায়, আজ শেষরাত্রির দিকে খবর পাওয়ার পর থেকেই নানিবেগম সোজা উঠে এসেছে বাইরে।

এসেই আমিনা বেগমের ঘরে গিয়েছিল–শুনেছিস আমিনা?

আমিনার বরাবর দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যেস। যখন আজিমাবাদে জৈনুদ্দিন আহম্মদের সঙ্গে ছিল, তখন থেকেই বড় আয়েশি মেয়ে সে। তিন ছেলের মা, তিনটে ছেলে প্রসব করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ভেবেছিল এক ছেলে যখন নবাব হবেই, তখন তার আর কী ভাবনা। বড় ছেলের যদি কোনও ক্ষতিও হয়, আরও দু’জন তো রইল। ফজলকুলি খাঁ, আর মির্জা মেহেদি! কিন্তু বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে যে ছেলেরা এমন করে পর হয়ে যাবে কে ভেবেছিল। ঘুম থেকে ওঠবার আগেই তার পা টিপে দেবার আরামটুকুর জন্যে বিছানায় শুয়ে থাকত আমিনা বেগম। যখন প্রথম তন্দ্রা ভাঙত তখন ডাকত–সাকিনা

সাকিনা বলত–জি, বেগমসাহেবা

তারপর সেই সকালবেলাই মাথার কাছে আসত টাটকা আঙুরের রস। তাতে এক ছিটে আফিং মেশানো থাকত। সেই নেশাতে চোখ খুলত বেগমসাহেবার। তখন পেয়ালা আসত, পেয়ালায় থাকত দুধ। সেই দুধের সঙ্গে কাশ্মীরি জাফরান মিশিয়ে প্রথম নাস্তা হত। তারপর গোসলখানা। সেখানে থাকত ঝারির গরম জল। সমস্ত পোশাক-পরিচ্ছদ–ওড়নি, কাঁচুলি, ঘাগরা, সব খুলে নিয়ে বেগমসাহেবাকে। ঝারির তলায় বসিয়ে দিত সাকিনা বাঁদি। তারপর গা ডলে দিত, চুল খুলে দিত। তারপর আসত তেল। পদ্মফুলের পাপড়ি নিংড়ে যে রস বেরোয় তার সঙ্গে ভৃঙ্গরাজের রস মিশিয়ে তেল তৈরি করে আমিনা বেগমসাহেবার চুলে মাখাতে হবে। চুলের গোড়ায় গোড়ায় ঘষে ঘষে দিতে হবে সেই তেল। তারপর যখন গোসলখানা থেকে বেরোবে তখন পায়ে জরিদার চটি পরিয়ে দিতে হবে। আমিনা বেগম তখন ঘরে এসে কেদারায় বসে রোদ্দুরে চুল শুকোবে। তখন আসবে আসল নাস্তা!

খেতে খেতে বেগমসাহেবা তখন হিসেবের খাতা বার করতে বলবে সাকিনাকে! উমিচাঁদের কাছে কত পাওনা, জগৎশেঠজিকে কত দিতে হবে। সুদ কত হল মহাজনিতে। দিনের সব হিসেব ওই সময় থেকেই শুরু হয় আমিনা বেগমের।

এই-ই বরাবরের নিয়ম!

শুধু আমিনার কেন, চেহেল্‌-সুতুনের সব বেগমের ঘরেই এই-ই নিয়ম। কারও কম কারও বেশি। আগের রাত্রে যে একটু অনেক রাত পর্যন্ত গান গেয়েছে, অনেক রাত পর্যন্ত ফুর্তি করেছে, সে আরও দেরি করে ওঠে। তারপর যত বেলা বাড়ে তত খোঁজা আর বাঁদিদের হাঁকডাক বেড়ে যায়। তখন এ-ওর ঘরে যায়। এ-ওর কেচ্ছা ওর কাছে গিয়ে বলে, ও-এর কেচ্ছা তাঁর কাছে গিয়ে শোনায়। তখন নতুন করে আবার বেরোয় বীণ, নতুন করে আবার সারেঙ্গির ঢাকা ভোলা হয়। কিংখাবের মখমলের আর জরির ঘাগরা আবার ঝলমল করে ওঠে। তখন থেকেই গুজগুজ ফিসফিস শুরু হয়। আসরফির হিসেবে শূন্যের পর শূন্য বসে। অঙ্কের খাতায় হিসেবের শূন্য সংখ্যায় বেড়ে বেড়ে পাতা ভরতি করে দেয়। তারপর যখন বেলা পড়ে আসে তখন চেহেল্‌-সুতুনের খানা-খানায় মোরগ মশাল্লামের সঙ্গে কড়া জাফরানের গন্ধ বেগমদের তন্দ্রা ছুটিয়ে দেয়। তখন সেতার ছেড়ে তক্কি বেগম বলে–যা তো মামুদা, কী খানা বানাচ্ছে দেখে আয় তো

পেশমন বেগম আগের দিন সারারাত বেলেল্লাগিরি করে অসাড় হয়ে ঘুমোচ্ছিল।

বাঁদি আঙুরের রসের ভিতর এক পুরিয়া আফিং মিশিয়ে মুখের কাছে এনে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে মিহি গলায় ডাকলে–বেগমসাহেবা–

পেশমন বেগমের সারা মুখে-গালে-ঠোঁটে নখের আঁচড়ের দাগ লেগে ছিল। সেই ঘুম-চোখেই বললে–দে জবিন, পেয়ালা দে ।

ওটা আঙুরের রস নয়, ওটা সরাব। ওটা না খেলে বেগমদের জড়তা কাটে না সকালে।

 বেগমসাহেবা, বেলা হয়ে গেছে, ধুপ উঠেছে!

 সবুর কর, সবুর কর, ডাকিসনে এখন

বলে আড়মোড়া খেতে লাগল বিছানায়। মখমল-মোড়া শিমুল তুলোর পুরু গদির ওপর দু-তিনবার গড়িয়ে নিলে পেশমনের ভোরের নেশা কাটে না।

কিন্তু সেদিন নানিবেগমের ডাকাডাকিতে পেয়ালায় মুখ দেবার আগেই উঠে বসতে হল।

বেগমসাহেবা, নানিবেগম আয়ি।

কাল মরিয়ম কোথায় ছিল রে পেশমন? রাত্তিরে কোথায় ছিল? চকবাজারে কখন গেল? কে নিয়ে গেল? কী করতে গিয়েছিল সেখানে? কে আছে তার চকবাজারে?

নানিবেগম সোজা ঘরের মধ্যে ঝড়ের মতো এসেছিল। পেশমন সোজা হয়ে ওঠবার সময়টুকু পর্যন্ত পেলে না।

বললে, আমি তো জানি না বেগমসাহেবা!

তোর সঙ্গে মরিয়ম মেয়ের দেখা হয়নি কাল? তোর ঘরে আসেনি?

বেগমসাহেবা!

আমি যে দেখি তোদের দুজনের খুব ভাব। ক’দিন ধরে যে তোর ঘরে খুব আসত সে!

তা আসত, কিন্তু কাল আসেনি মরিয়মবিবি।

চকবাজারে কী করতে গিয়েছিল সে তুই জানিস? তুই কারও কাছে পাঠিয়েছিলি?

আমি কেন তাকে বাইরে পাঠাতে যাব বেগমসাহেবা? বাইরে আমার কে আছে যে তার কাছে আমি পাঠাতে যাব?

হেঁয়ালি রাখ, আমি যেন জানি না তোর মতিগতি! আমি যেন জানি না তুই কী রকম স্বভাবের মেয়ে! আমাকে তুই নতুন পেয়েছিস এখেনে? আমি এতকাল চেহেল্‌-সুতুন চরিয়ে এলাম, আমি চিনিনে তোদের? তা তুই না পাঠিয়ে থাকিস তো কে পাঠিয়েছে বল?

পেশমন বললে–আমি কিছুই জানি না বেগমসাহেবা!

আলবত জানিস!

পেশমন বেগম এবার কেঁদে ফেললে। বললে–আমি জানি না বেগমসাহেবা, সত্যি বলছি আমি জানি না, আমারও কপালের দোষ বেগমসাহেবা, এতদিন আছি চেহেল্-সুতুনে তবু আমার এই বদনাম দিলে তুমি বেগমসাহেবা? এখনও আমাকে কেউ বিশ্বাস করলে না?

মড়াকান্না রাখ তুই বাপু, তোর কান্না শোনবার সময় নেই এখন, আমি এখন যাই

হঠাৎ পিরালি খাঁ ঘরের সামনে কুর্নিশ করলে–বেগমসাহেবা

কী রে পিরালি?

শওকত জঙ বাহাদুর খুন হয়ে গেছে বেগমসাহেবা। পূর্ণিয়ার লড়াই ফতেহ হয়ে গেছে। পূর্ণিয়া থেকে ময়মনা বেগমসাহেবারা মুর্শিদাবাদের দিকে আসছে ।

নানিবেগমের মাথাটা হঠাৎ যেন ঘুরে উঠল। ঠিক নেশা করলে যেমন হয় তেমনি। আল্লা! অনেক দিন বেঁচে থাকলে বোধহয় এমনিই হয়। এমনি ভাবেই সব আঘাত সইতে সইতে পাথর হয়ে যেতে হয়। শওকত জঙকে মনে পড়ল নানিবেগমের। সেই মির্জার সঙ্গে একই বিছানায় একদিন শুয়ে কাটিয়েছে, কতদিন নানিবেগমের কোলে ওঠবার জন্যে দু’জনে ঝগড়া মারপিট করেছে। আজ আবার তার মৃত্যুসংবাদটাও বেঁচে থেকে সহ্য করতে হবে মুখ বুজে। এতটুকু চোখ ছলছল করলে চলবে না।

ময়মানা বেগমসাহেবা রওয়ানা দিয়েছে পূর্ণিয়া থেকে।

আর মির্জা? মির্জা আসছে না?

জাঁহাপনা ভি আসছেন বেগমসাহেবা! পূর্ণিয়া থেকে সওয়ানে-নেগার খবর নিয়ে এসেছে। নিজামতের দফতরে!

নানিবেগম বললে–ঠিক আছে পিরালি, আমার তাঞ্জাম বার করতে বল, আমি মতিঝিলে যাব মরিয়ম বেগমকে দেখতে–নেয়ামতকে বলে দিবি ফাটকের দরজা খুলে দেবে আমার জন্যে?

*

ভোরবেলা চেহেল্‌-সুতুনের নহবতখানায় গিয়ে উঠে বসতে গেল ইনসাফ মিঞা। এই নহবতখানায় জীবন কেটে গেল ইনসাফের। নবাব মির্জা মহম্মদের যে বছর সাদি হল তখন নতুন নোকরিতে ভরতি হল ইনসাফ মিঞা। বাপ আতাউল্লা খা এক-একটা করে নহবতের ফুটো টিপতে আর ছাড়তে শিখিয়েছিল ছেলেকে। নহবতে ফুঁ দিতে শিখিয়েছিল।

ইনসাফ মিঞা বলত-ইসমে ফোকর ছোড়না ঔর বন্ধ করুনাই আসলি কাম

ছোট সাগরেদ মমতাজ মিঞা তবলা নিয়ে চাটি দিত আর লোভর মতো একদৃষ্টে চেয়ে দেখত ওস্তাদজির ফুটো ছাড়া আর ফুটো বন্ধ করার কেরামতি! কবে ওস্তাদজির মতো বাজাতে পারবে, কবে ফুটো ছেড়ে আর বন্ধ করে সুরের দিমাগ টলিয়ে দেবে। সারা মুর্শিদাবাদ শহর দিওয়ানা করে দেবে। ইনসাফ মিঞার মত! কবে? কবে?

টোড়ি রাগটা ভারী বেয়াড়া। আগের দিন রাত্রেই ইনসাফ মিঞা ঠিক করেছিল টোড়িটা আজ দিলচস করে বাজাতে হবে! সবে এসে নহবতখানায় যন্তরটা নিয়ে বসেছে, হঠাৎ ছোট শাকরেদ এসে বললে–ইয়া বিসমিল্লা ওস্তাদজি, গজব খবর, মরিয়ম বেগমনে সফিউল্লা খাঁ সাহাবকো খুন কিয়া

ইনসাফের টোড়ির মেজাজটা বেসুরো হয়ে বিগড়ে গেল হঠাৎ।

 ক্যা বেহুদা আদমি, তুমহে ইয়ে সুর কভি বাজানা নেহি আয়েগা

 সত্যিই মেজাজ বিগড়ে যাবার মতো খবরই বটে। কিন্তু ইনসাফ মিঞা ওকথায় কান না দিয়ে উদারার নিখাদে ফুঁ দিলে। আর সঙ্গে সঙ্গে ছোট শাকরেদ বাহবা দিয়ে উঠল–শাবাশ উস্তাদজি–শাবাশ

তখন ফরসাও ভাল করে হয়নি। মুর্শিদাবাদ শহর ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে সুর অনেক দূর ভেসে ভেসে চলতে লাগল। সত্যিই অনেক দূর। সেই একেবারে আওরঙ্গজেবের শাকরেদ শায়েস্তা খাঁর আমলে গিয়ে যেন। আছড়ে পড়তে লাগল ইনসাফ মিঞার টোড়ি। বাদশা তখন দাক্ষিণাত্যে, আর ওদিকে মারাঠা-শক্তির কেন্দ্রমণি ছত্রপতি শিবাজি তার সাম্রাজ্যের ভেতর-বাইরে আঘাত হেনে একেবারে ফোপরা করে। তুলছে। কখনও কর্ণাটক, কখনও মহারাষ্ট্র, একের শান্তি আসে তো অন্যের বিদ্রোহ। একেবারে জেরবার হয়ে গেছেন বাদশা। একে ঠান্ডা করলে ও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ওদিকে। নিজের তৈরি চালাকির জালে নিজেই জড়িয়ে পড়েছেন বাদশা। পশ্চিমে কান্দাহার বাদকশান হাতছাড়া হয়েই যে রেহাই পেলেন তাই-ই নয়, হিন্দুস্থানের প্রত্যন্তর দেশে সবাই তখন বাদশার বিরুদ্ধে মাথা তুলে উঠে বলছে–অয়মহং ভো! তরোয়াল উঁচিয়ে বলে উঠল–অয়মহং ভো! আর কোথায় ছিল এই পূর্ব সীমান্তের এক চেতো বরদার শোভসিংহ, সেও যেন তখন তরোয়াল উঁচিয়ে বলে উঠল–অয়মহং ভো!

ইনসাফ মিঞার নহবতের টোড়ি রাগ তার সর্গমের কড়ি-কোমল পরদায় বলতে লাগল–তুমি নাদির শাহ একদিন এসেছিলে হিন্দুস্থান লুঠ করতে, আর এসেছিলে সুন্দরী মেয়েমানুষ ভোগ করতে। মার্কোপোলোর সময় থেকেই তাই তোমরা এখানে এসেছ আর লুঠ করে সর্বস্ব নিয়ে চলে গেছ। এরা কিছু বলেনি, এই হিন্দুরা। তোমাদের সময় থেকে আমরা জেনে এসেছি মোগল দরবারে বিদ্যে বুদ্ধির চেয়ে সুন্দরী মেয়েমানুষেরই খাতির বেশি, ঘুষের প্রতিপত্তি সর্বাধিক। তোমাকে ঘুষ দিয়ে তাই আবার আর-এক নাদির শাহের দল এখন এসেছে। এরা আরও চতুর, আরও শঠ। এদের হাতে কিন্তু এবার নাদির শাহের মতো তরোয়াল নেই, এবার আছে দাড়িপাল্লা। সেই দাঁড়িপাল্লা দিয়েই এরা আবার ওজন করে নেবে তোমার পাপ আর তোমার পুণ্য, যাচাই করে নেবে তোমার বিদ্যে আর তোমার বুদ্ধি, পরখ করে নেবে তোমার শক্তি আর তোমার বিত্ত। তুমি এদের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার চেষ্টা কোরো না নবাবজাদা। করলে তুমি হারবে। কারণ তোমার চেহেল্-সুতুনের মধ্যেই তোমার পরাজয়ের বীজ লুকিয়ে আছে। কারণ তুমি নিজেই তোমার নিজের শত্ৰু, তোমার নিজের আত্মীয়স্বজনই তোমার বৈরী। তুমি যে শত্রু নিয়েই জন্মেছ, আবার শত্রু সৃষ্টি করতেও তুমি যে অদ্বিতীয়। তোমারই দীর্ঘশ্বাস চেহেল্‌-সুতুনের ভেতর পুঞ্জীভূত হয়ে দিনের পর দিন পাথরের দেয়ালে যে মাথা কুটে মরছে আর তুমি মতিঝিলের দরবারে বসে সব দেখেও চোখ বুজে রয়েছ আর আমির-ওমরাওরা যা বলছে তাই বিশ্বাস করছ।

নহবত আরও বলছে–মনে রেখো, বাইরের জগতে যখন মানুষের আকাশে নতুন গ্রহ-উপগ্রহের উদয় হয়েছে, তুমি তখনও রয়ে গেছ সেই চেহেল্‌-সুতুনের আদিম খোসবাগে। তুমি তখনও গুলসন বেগমের ঠুংরির লয়ে লয়ে মাথা দোলাচ্ছ, মরিয়ম বেগমের আত্মবঞ্চনার সুযোগ নিচ্ছ। তোমার দুঃখ নিয়ে তো তোমার বিচার করবনা নবাব! তোমার কাজই যে তোমার বিচারকর্তা। তুমি হা-হুঁতাশ করো, তুমি অনুতাপ করো, তুমি ক্ষমা চাও, তবু তোমাকে আমরা অব্যাহতি দেব না। ইতিহাসের নিষ্ঠুর দাঁড়িপাল্লা দিয়ে তোমার তুল্যমূল্য বিচার করে তোমাকে মাথায় তুলে নেব কিংবা ছুঁড়ে ফেলে দেব পায়ের তলার মাটিতে।

ইনসাফ মিঞার টোড়ির সুরে লয়ে কান্তর যেন নেশা লেগেছিল। মতিঝিলের সেই শ্বেতপাথরের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে কান্ত ওপরে উঠতে লাগল। সামনে নেয়ামত, পেছনে নজর মহম্মদ, দু’জনে দুটো মোহর নিয়েছে। ফাটকের ভেতর মরালীর সঙ্গে শুধু একবার দেখা করিয়ে দেবে। আর কিছুই নয়। তারপর যা হবার হবে। এই কড়ার।

কান্তও ঘুমোয়নি সারারাত, মরালীও ঘুমোয়নি।

একী, তুমি?

 ফাটকের লোহার শেকলটা যেন হঠাৎ বাঙ্ময় হয়ে উঠল।

কান্ত বললে–এ কী করলে তুমি মরালী? এমন করে নিজের সর্বনাশ কেন করতে গেলে?

 মরালী বললে, তুমি এখানে কী করে এলে?

আমার কথা ছেড়ে দাও, আমার যা-হয় হোক, কিন্তু তোমার কথা ভেবে ভেবে যে আমি পাগল হয়ে গেছি, আমি যে দিন-রাত ছটফট করে মরছি

মরালী বললে–তুমি পালিয়ে যাও গো, তুমি এখানে আর এসো না, নইলে তোমাকেও এরা

আমার মতো ধরে রাখবে–তোমাকেও এই ফাটকের মধ্যে পুরে রাখবে! .

কিন্তু কেন তুমি চকবাজারে যেতে গেলে? আমি তো তোমার কাছেই গিয়েছিলুম তখন। তোমার সঙ্গে দেখা করতেই তো চেহেল-সুতুনে গিয়েছিলুম আমি!—

মরালী বললে–সে যা হবার হয়ে গেছে, তুমি চলে যাও এখান থেকে, তোমার দুটি পায়ে পড়ছি তুমি চলে যাও।

তোমাকে আমি এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবই মরালী!

কী করে ছাড়াবে?

আমি এক হাজার আসরফি ঘুষ দেব মহকুমে কাজার সদরস সুদুরকে!

 অত আসরফি কোথায় পাবে?

কেন সারাফত আলির সিন্দুক ভাঙব!

মরালী চমকে উঠল-না না, অমন সর্বনাশ কোরো না, কেন আমার জন্যে ওকাজ করতে যাবে। আমি তোমার কে যে তুমি অতখানি ঝুঁকি মাথায় তুলে নেবে? না না, খবরদার, অমন কাজটি কোরো না! আমার জীবনের কোনও দাম নেই, আমার কে আছে বলো না যে তার জন্যে ভাবব? তুমি চলে যাও এখান থেকে, আর কখনও এসো না-যাও–লক্ষ্মীটি যাও

কান্ত বললে–দেখো, এখানে এখন নবাব নেই, এই-ই সুযোগ! এমন সুযোগ আর আসবে না। তুমি কথা দাও যে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিলে তুমি আমার সঙ্গে পালিয়ে যাবে?

পালিয়ে কোথায় যাব?

কেন, সেদিন তো পালিয়ে যেতে রাজি ছিলে তুমি, যেদিন তোমাকে নিয়ে প্রথম এখানে আসি?

 কিন্তু আমি কী পরিচয় দেব আমার? লোকে যদি জিজ্ঞেস করে কী বলব তাদের?

যা সত্যি কথা তাই-ই বোলো!

কী সত্যি কথা?

হঠাৎ নেয়ামত খাঁ দৌড়ে এসেছে বাবুজি, ভাগ যাইয়ে, ভাগ যাইয়ে

নজর মহম্মদও ভয় পেয়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

 চলুন বাবুজি, জলদি চলুন–

কান্ত বুঝতে পারলে না কিছু। মরালীকে এখানে এভাবে ছেড়ে যেতে তার ইচ্ছে হচ্ছিল না। দুটো মোহর দিয়েছে সে এইটুকু কথা বলবার জন্যে?

কান্ত বললে–কেন, যেতে বলছ কেন? আমার যে আরও অনেক কথা বলবার আছে মরিয়ম বেগমের সঙ্গে

নেয়ামত খাঁ বললে–নেহি হুজুর, জলদি ভাগ যাইয়ে হাসে, নানিবেগম আতি হ্যায়

আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল যেন মতিঝিলের একতলার চবুতরে একটা তাঞ্জাম থামবার শব্দ হল। হাতির চলার শব্দও কানে এল! কী হবে তা হলে? এইটুকু কথা বলেই তাকে বিদায় নিতে হবে! এইটুকু কথার জন্যেই দুটো মোহর দিতে হল!

*

নানিবেগম আসতেই নেয়ামত ফাটকের দরজা খুলে দিয়েছে। কোতোয়ালের লোক মোহরের ভাগ পেয়েছিল, তাই কান্তকে কিছু বলেনি। কান্ত কথা বলবার সময় আড়ালে চলে গিয়েছিল। এবার নানিবেগম আসতেই লম্বা সেলাম আলেকুম করলে।

একদিন এই ফাটকের ভেতরেই জগৎশেঠজি বন্দি হয়ে ছিল। কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস্ সাহেবের বিবিকেও এখানে আটকে থাকতে হয়েছে একদিন। হলওয়েল, কলেট সবাইকে এমনি করে পাহারা দিয়েছে কোতোয়ালের এই পাহারাদার। শুধু তাই নয়। ঘসেটি বেগমসাহেবাকেও একদিন এখানে নজরবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে এই পাহারাদারের ভাবে। আজ মরিয়ম বেগমকেও সেই তাদের সঙ্গে একই ফাটকের অন্দরে আটকে থাকতে হচ্ছে।

তবু মরালী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।

সফিউল্লা খাঁ’র দেহটা সকালবেলাই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। রক্তের দাগও ধুয়ে মুছে ফেলা হয়েছে। যাদের আসবার, যাদের দেখা করবার আর তদন্ত করবার কথা তারা তা করে গেছে।

কোতোয়াল জিজ্ঞেস করেছিল–আপনি সফিউল্লা খাঁ সাহেবকে খুন করেছেন?

মরালী বলেছিল –হ্যাঁ

কেন?

আমার ওপর অত্যাচার করতে এসেছিল।

 আপনি হারেমের বেগম, আপনি চকবাজারে মর্দানা সেজে কেন গিয়েছিলেন? সেখানে কী কাম ছিল আপনার?

কী কাজ?

সব কথা আমি বলব না।

সব কথা খুলে না বললে–কিন্তু আপনারই লোকসান হবে, তা জানেন তো? মহকুমে কাজার সদরস। সুদুরের কাছারিতে আপনার বিচার হবে। খুন করলে দণ্ড হয় তা জানেন তো?

মরালীর চোখে জল পর্যন্ত নেই, গলা একটুকু কঁপা পর্যন্ত নেই, একেবারে কাটাকাটা উত্তর দিয়েছিল সেদিন। আর শুধু একবার নয়। নিজামতি কাছারির এক-একজন আমির-ওমরাহ বারবার করে তদন্ত করে গেল। প্রত্যেকবারই একই উত্তর দিয়েছে সে। প্রত্যেকবারই একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছে। শেষকালে যখন আর পারেনি তখন বলেছে আমাকে আর বারবার বিরক্ত করবেন না আপনারা, আমাকে ফাঁসি দিন, ডালকুত্তা দিয়ে খাইয়ে দিন, আমাকে মেরে ফেলে আপনাদের হাতির পিঠের ওপরে শুইয়ে সকলকে দেখান না–আমি তো আমাকে ছেড়ে দেবার জন্যে আপনাদের পায়ে ধরে সাধতে যাচ্ছিনে

মরিয়ম বেগমের তেজ দেখে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। এমন তেজি বেগম তো আগে দেখা যায়নি। আর তারপরই এসেছিল কান্ত! তুমি কেন এলে? তোমাকে দেখে যদি আমি শক্ত থাকতে না পারি! যদি ভেঙে পড়ি। যদি আমি ওদের পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে ফেলি! তুমি যাও, তুমি সামনে থাকলে আমি ভেঙে পড়ব, আমি হাত-জোড় করে ক্ষমা চাইব। তুমি কেন এলে! তোমাকে এখানে দেখলে। সবাই যে তোমাকেও সন্দেহ করবে। তোমাকেও ফাটকে পুরে রাখবে। আমার সঙ্গে তোমাকেও ওদের। কুকুর দিয়ে কামড়িয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে খাওয়াবে।

কান্ত তবু যেতে চায়নি।

 বলেছিল–তোমাকে এ-অবস্থায় ফেলে আমি যাই কী করে?

মরালী বলেছিল আমার জন্যে তোমার কেন ক্ষতি হবে বলো তো? আমি তোমার কে? আমার সঙ্গে তোমার কীসের সম্পর্ক?

আমি যে তোমাকে সঙ্গে করে এখানে এনেছি মরালী! সম্পর্ক না থাকলে কি এমন করে আসি এখানে? কেন তুমি গিয়েছিলে বলো তো আমার কাছে? আমি তো তোমার কাছে যাই-ই, তবু কেন তুমি এ ঝুঁকি নিলে? আমাকে একবার নজর মহম্মদকে দিয়ে খবর দিলেই তো তোমার কাছে। যেতাম!

মরালী বলেছিল–কিন্তু বাবাকে যে অনেক দিন দেখিনি, বাবার খবর জানতেই তো গিয়েছিলাম

তা আমাকে ডাকতে পারলে না তুমি?

মরালী যেন একটুখানি করুণ হয়ে এসেছিল খানিকক্ষণের জন্যে। কেন এ তার জন্যে এতখানি ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসেছে। এর সঙ্গে তো কোনও সম্পর্কই নেই তার। সম্পর্ক হতে গিয়েও তো শেষপর্যন্ত সম্পর্ক হয়নি তার সঙ্গে। অথচ যার সঙ্গে তার সত্যিকারের সম্পর্ক হল সে এল না। সে তো তাকে খোঁজবার চেষ্টাও করলে না একবার।

তুমি আর এসো না এখানে, জানো? এখানকার সবাই আজ আমার কাছে এসে বারবার অনেক কথা জিজ্ঞেস করে গেছে। আমি কেন মেরেছি সফিউল্লা খাঁ সাহেবকে, কেন আমি চকবাজারে গিয়েছিলুম, কার সঙ্গে দেখা করতে। সব কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে গেছে, তোমার কাছে গিয়েও তারা হয়তো জিজ্ঞেস করবে, তোমাকেও হয়তো জিজ্ঞেস করবে তোমার সঙ্গে আমার কীসের সম্বন্ধ, কেন তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে যাও চেহেল্-সুতুনে–একবার সন্দেহ করলেই তোমার কাছে যাবে ওরা, তখন তোমাকেও ফাটকে পুরবে

আর ঠিক এই সময়েই এসেছিল নানিবেগম।

 কান্ত ঠিক সময়েই লুকিয়ে পড়েছিল, নইলে নানিবেগম দেখতে পেত। নানিবেগমের ওপরে রাগ হয়ে গিয়েছিল মরালীর। ঠিক সেই সময়েই কি নানিবেগমের আসতে হয়।

এ কী করলি মা, কী সর্বনাশ করলি তুই? কেন ওকে খুন করতে গেলি? তুইও কি আমাকে পাগল করে ছাড়বি না?

ফাটকের ভেতরে ঢুকে নানিবেগম একেবারে দুই হাতে জড়িয়ে ধরেছে মরালীকে। দুই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে তার।

আর দুটো দিন সবুর কর মা, মির্জা আসুক পূর্ণিয়া থেকে, আমি তাকে বলে তোকে ছাড়িয়ে নেব, হুট করে যেন তুই কিছু বলে বসিসনি কোতোয়ালকে।

পেছন থেকে নেয়ামত খা ডাকলে–বেগমসাহেবা

নেয়ামত বাইরে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। তারও দায়িত্ব আছে কিছু। মোহর নিয়ে একটু আগেই কান্তকে এখানে আসতে দিয়েছিল, কিন্তু নানিবেগমসাহেবাকে যেতেও বলতে পারলে না।

তুই থাম এখন। তুই যা আমার সামনে থেকে, ভাগ ইহাসে

তারপর মরালীকে জিজ্ঞেস করলে–হাতিয়াগড়ে তোর সোয়ামিকে খবর দেব? তোর সতিনকে চিঠি লিখব?

মরালীর এতক্ষণে কথা বেরোল। বললে–না

নানিবেগম বললে–তবু খবর পেলে তারা এখানে মহকুমে কাজায় এসে উকিল দিতে পারত।

মরালী বললে–না নানিজি, কাউকে খবর দিতে হবে না, আমার কেউ নেই

কেউ নেই তোর? বলছিস কী তুই?

না নানিজি, আমার কেউ নেই! কেউ থাকলে কি তোমরা আমাকে এখানে এমন করে আনতে পারতে? কেউ থাকলে কি আর আজ আমাকে এমন করে জানোয়ারটার বুকে ছুরি বসাতে হত?

ছুরি কোথায় পেলি তুই মা? কে ছুরি দিলে তোকে?

ভগবান জুগিয়ে দিয়েছে নানিজি, লজ্জানিবারণ ভগবান আমাদের।

তা খুন করতে তোর হাতে বাধল না? জলজ্যান্ত পুরুষমানুষটাকে খুন করে ফেললি তুই?

 নানিজি, তুমি আমাকে ভালবাসো তাই তোমার এত কথার জবাব দিচ্ছি, নইলে দেখতে এতদিন আরও কটাকে খুন করে ফেলতাম! খুন করলে তোমারও ভাল হত, তোমার নাতিরও ভাল হত! এত লোককে তোমার নাতি খুন করেছে আর এগুলোকে খুন করতে পারেনি?

কে? কাদের কথা বলছিস তুই মা?

তুমি সব জানো নানিজি, সব জেনেশুনেও তুমি আমাকে এত কথা জিজ্ঞেস করছ? তুমি কি মনে করছ তোমার চেহেল্‌-সুতুন থাকবে? তুমি কি মনে করেছ তুমি তোমাকে নাতিকে টিকিয়ে রাখতে পারবে?

নানিবেগম তাড়াতাড়ি মরালীর মুখে হাত চাপা দিয়ে দিলে। যদি কেউ শুনতে পায় তো তাদের দু’জনেরই গর্দান যাবে।

এ ক’দিনে আমি সব দেখে নিয়েছি নানিজি! আমার আর দেখতে কিছু বাকি নেই। আমি তো একটাকে খুন করলুম, যদি পারো তো তুমি বাকিগুলোকেও খুন করে ফেলো, নইলে

কার কথা বলছিস তুই?

কেন, মেহেদি নেসার, ইয়ারজান

নানিবেগম আর সহ্য করতে পারলে না। নানিবেগমেরও ভয় হল। এ-মেয়ের কি এতটুকু ভয়-ডর নেই গা!

মরালী বলে চলল–তোমার ভালর জন্যেই বলছি আমি নানিজি, তোমার নাতিরও ভালর জন্যে বলছি, আমি তো এখন চলেই যাচ্ছি, কিন্তু একদিন তোমাদেরও আমার মতন চলে যেতে হবে নানিজি!

তোমার কোরান তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। যেমন আমার মাথার সিঁদুর আমাকে বাঁচাতে পারেনি, তেমনি কেউ কাউকেই বাঁচাতে পারবে না–

নানিবেগম কিছুই বুঝতে পারল না। এ-মেয়েটা এসব কী কথা বলছে।

তোমাকে আমি চুপি চুপি বলে যাই নানিজি, আমি যদি ওই পাষণ্ডটাকে খুন না করতাম তো ওই তোমাদের সকলকে খুন করত!

কে বললে–রে এ কথা তোকে?

 নানিবেগম মরালীকে ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল।

 বল, কে বললে–তোকে ওকথা?

মরালী বললে–আমি বললে–তো তুমি বিশ্বাস করবে না নানিজি! কিন্তু আমি বলছি একদিন ওই পাষণ্ডই তোমার নাতিকে খুন করত! শুধু ও একলা নয়, ওর সঙ্গে আরও অনেক পাষণ্ড আছে। পারলে তাদেরও আমি খুন করতাম, কিন্তু আর যে উপায় নেই, ওরা যে আমায় ধরে ফেললে রাত্রে-নইলে

নানিবেগম বললে–তুই সত্যি বলছিস মা?

মরতে চলেছি আমি, এখন কেন মিছে কথা বলতে যাব নানিজি? মিছে কথা বলে কি পাতকি হব ভগবানের কাছে?

নানিবেগম ফাটকের বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে নেয়ামত খাঁ দূরে দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে কোতোয়ালের পাহারাদারও দাঁড়িয়ে আছে।

নানিবেগম তাদের দিকে চেঁচিয়ে বললে–এই, তোরা দূরে সরে যা, যা

যেন অনিচ্ছার সঙ্গেই তারা আরও দূরে সরে গেল। নানিবেগমকে কোনও কিছু কথা বলা তাদের এক্তিয়ারে নেই।

বল মা, এবার বল, বলে মরালীর কানের কাছে মুখ সরিয়ে আনলে নানিবেগম।

মরালী বললে–ওই পাষণ্ডটার কুর্তার ভেতরে একটা চিঠি পেয়েছি আমি! ওই ছোরাটা টেনে নিতে গিয়ে চিঠিটাও বেরিয়ে এসেছিল–

কীসের চিঠি? কার চিঠি? কে কাকে লিখেছে?

মরালী বললে–সে তুমি জানতে চেয়ো না নানিজি, জানলে তোমাদের অনেক আমির-ওমরাও জড়িয়ে পড়বে–আমি তো সকলের নাম জানি না, মনে হল নবাব তাদের বিশ্বাস করেন

সে চিঠি কই, দেখি? দেখা আমাকে। আমি কাউকে বলব না, দেখা–

মরালী বললে–সে আমি তোমাকে দেখাব না নানিজি, আমি মহকুমে কাজার সদরস সুদুর সাহেবকে দেখাব

তা আমাকে দেখালে দোষ কী? আমি তো বলছি কাউকে বলে দেব না।

না নানিজি, তুমি জানো না, যখন পাষণ্ডটা মরছে, ঝরঝর করে রক্ত বেরোচ্ছে বুক দিয়ে, তখনও আমার হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নেবার জন্যে হাত-পা ছুঁড়তে চেষ্টা করেছে, আমি তখন তার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে ক্যাত কাঁত করে লাথি মেরেছি, তবে হারামজাদা মরেছে–

নানিবেগমসাহেবা তখন মরালীর চিবুকটা ধরে আদর করতে লাগল–তা বেশ করেছিস মা, তুই লাথি মেরেছিস, কিন্তু আমাকে সেটা দেখাতে দোষ কী! তাতে তো তোরই ভাল হবে–

না নানিজি, তাতে আমারও ভাল হবে না তোমারও ভাল হবে না। যারা জানে আমার কাছে চিঠিটা। আছে তারা সকাল থেকে কেবল আমার কাছে এসেছে, আমাকে কেবল জিজ্ঞেস করেছে, আমি ওমরাহসাহেবকে কেন খুন করেছি তাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছে–

নানিবেগম বললে–তা হলে তুই চিঠিটা দেখা মা আমাকে, আমি একবার দেখে আবার তোকে ফিরিয়ে দেব–আমি শুধু মির্জাকে বলব কোন কোন লোক তার শত্ৰু, কোন কোন লোক তাকে মসনদ থেকে সরাতে চাইছে–

মরালী বলে–শুধু মসনদ থেকে নয় নানিজি, এই পৃথিবী থেকেই নবাবকে সরাতে চাইছে–নবাবকে একেবারে খুন করবার ষড়যন্ত্র করেছে।

ওমা, কী সব্বনাশ? দেখি মা, কার কার নাম আছে ওতে–

হঠাৎ নেয়ামত কাছে এসে ডাকলে-নানিবেগমসাহেবা–

নানিবেগম পেছন ফিরে দেখলে নেয়ামত আর কোতোয়ালের লোক আবার ফাটকের কাছে সরে এসেছে।

নানিবেগম ঝাঁঝিয়ে উঠল–আবার এখানে সরে এসেছিস, বেল্লিক কহিকা, বাহার নিকল–

মেহেদি নেসার সাহেব এসেছেন বেগমসাহেবা, মেহেদি নেসার সাহেব, ইয়ারজান সাহেব মরিয়ম বেগমসাহেবার সঙ্গে মুলাকাত করতে এসেছে–

ঠিক এই সময়েই এল! আর আসবার সময় পেলে না। নামগুলো শুনে নানিবেগম প্রথমে ভেবেছিল চলে যেতে বলবে তাদের, কিন্তু কী ভেবে আবার বললে–আচ্ছা নিয়ে আয় তাদের–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *