২৫. প্রবীরের ফ্ল্যাটের আবহ

২৫.

প্রবীরের ফ্ল্যাটের আবহ বদলে গেছে অনেকটাই।

নিরানন্দ ঝিমন্ত পুরীতে এখন এক আলগা স্বস্তির আমেজ। হঠাৎ বুড়িয়ে যাওয়া প্রবীর যেন বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে আবার। অফিস থেকে ফিরে সে আর ধোঁকে না, পুরনো মেজাজে গমগম হাসছে, রসিকতা জুড়ছে, উৎপটাং গল্প আড্ডা চলছে মেয়ের সঙ্গে। মণিদীপাও আর তিরিক্ষে হচ্ছে না কথায় কথায়। কত কী যে রান্না করছে রোজ! এই হয়তো মেয়ের জন্য স্যুপ বানাল, এই মেটেচচ্চড়ি, পিৎজা, কিংবা ভেটকি মাছের পাতুরি…। মেয়ের শরীর এখন ভারী দুর্বল, প্রোটিনে ভিটামিনে তাকে চাঙ্গা করে তুলতে হবে। বাচ্চা হওয়ার ধকল বলে কথা। যত্নআত্তিও করছে বটে মেয়ের, সামান্য জলটুকুও গড়িয়ে খেতে হচ্ছে না দয়িতাকে। বুম্‌বাও আবার স্বমূর্তিতে বিকশিত। তার কণ্ঠ একেবারেই বেসুরো, তবু আগের মতো যখন তখন গান ধরছে হেঁড়ে গলায়, মোড়ের ফুচকাওলার কাছ থেকে দিদির জন্য আলুকাবলি কিনে আনছে, চুড়মুড় কিনে আনছে…।

নিছক স্বস্তি নয়, বাড়িতে যেন এখন বেশি সুখী সুখী পরিবেশ।

শুধু দয়িতাই যে কেন মন থেকে আহ্লাদিত হতে পারছে না? কেন যেন মনে হয় তাকে ঘিরে একটা সাজানো নাটক অভিনীত হয়ে চলেছে। রাতে খাবার টেবিলে বসে প্রবীর যখন দয়িতার ছোটবেলার কোনও গল্প বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, দয়িতার তখন বড় কান্না পায়। বাবা এত চড়া পর্দায় অভিনয় করে কেন? মণিদীপা যখন অনাগত সন্তানের দোহাই দিয়ে দয়িতাকে জোর করে খাওয়ায়, তখন কি তার মুখে একটা চোরা বিষাদ খেলা করে না? দয়িতার মুখ চেয়ে এক অবাঞ্ছিত শিশুর আগমনকে মেনে নিয়েছে মা, দয়িতা জানে। বুম্‌বা যখন হাসতে হাসতে দিদির ঘরে ঢোকে, দয়িতা স্পষ্ট টের পায় দরজার ওপারেও বুম্‌বার মুখ গোমড়া ছিল।

দয়িতা যেখানে নেই, কেন যে সেখানে নিচু গলায় কথা বলে বাড়ির লোক!

রিটার্ন অফ দা প্রডিগাল ডটার! বিপথগামী কন্যার প্রত্যাবর্তনের উৎসবের পরিবেশ বুঝি এরকমই হয়!

কী অসহ্য গ্লানি! যদি বাবা সব সময়ে মুহ্যমান থাকত, মা কথা বলতে বলতে চোখের জল ফেলত, বুম্‌বা টেরচা চোখে তাকাত দিদির দিকে, তা হলে হয়তো দয়িতার এমনটা লাগত না। কেন সবাই এত মধুর ব্যবহার করবে তার সঙ্গে? কোন মহৎ কাজ করে এসেছে সে? বোধিসত্ত্বকে ছেড়ে কেন চলে এল দয়িতা সে প্রশ্নটা পর্যন্ত কেউ করল না একবার!

এরই মাঝে টুকটাক আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা। এই তো গত রোববার মাসি আর টুনটুনি, সারাটা দিন এ বাড়িতে কাটিয়ে গেল। নিজের আসন্ন বিয়ে নিয়ে কত অজস্র রকম বকবকম করল টুনটুনি, কিন্তু ভুলেও বোধিসত্ত্বর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করল না। পরশু হঠাৎ পিসি পিসেমশায়ের আবির্ভাব। দুজনেই এমন স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে কথা বলছিল যেন দয়িতা মাস কয়েকের জন্য কোথাও বেড়াতে গিয়েছিল, এই ফিরল। দয়িতার পেটের বাচ্চাটা সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে, অথচ বাচ্চাটা যে কোথ্‌থেকে এল তা নিয়ে কণামাত্র কৌতূহল নেই!

কী নিষ্ঠুর ঠাট্টা! কী শীতল রসিকতা!

যেদিন তাকে গাইনির কাছে নিয়ে গেল বাবা-মা দয়িতা নিজের নাম দয়িতা মিত্র লিখল, টুঁ শব্দটি করল না বাবা। ভাবটা এমন, যে আসছে সে মিত্র পদবিতেই পরিচিত হবে, এটাই স্বতঃসিদ্ধ।

সবাই মিলে দয়িতার জীবন থেকে মাঝের ছটা মাসকে কি মুছে ফেলতে চায়? মোহ কেটে গেছে দয়িতার, এতেই সবাই উৎফুল্ল?

কিন্তু তা কী হয়?

সময় কি জলের দাগ, এমনি এমনি মিলিয়ে যাবে?

বড় অপমান! বড় অপমান! সে একটা ভুল করেছিল বলে সবাই তাকে দয়া করছে, ক্ষমাঘেন্না করে নিচ্ছে! তার ভবিষ্যত জীবনটা কেমন হতে চলেছে তাও হয়তো অনুমান করে নিয়েছে সকলে! বাচ্চা হওয়ার পর হয় ঢেঁসকুমড়ো হয়ে বাড়িতে বসে থাকবে দয়িতা, নয়তো একটা চাকরি বাকরি জোটাবে, তারপর বাচ্চা নিয়ে স্বামী পরিত্যক্তা নারীর মতন বাপের বাড়িতে আশ্রিতা আশ্রিতা ভঙ্গিতে কাটিয়ে দেবে বাকিটা জীবন! কিন্তু লোকজনের চোখ থেকে সহানুভূতির ছায়াটা মুছবে না। দুঃখী দুঃখী চোখে তারা দেখবে দয়িতাকে, আর প্রায় দয়িতার সামনেই কানাকানি করবে, আহা রে অত গুণী মেয়েটার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল!

ভাবতেই বিবমিষা। দয়িতা তো কিছুতেই ফিরতে চায়নি এখানে, কেন তাকে জোর করে আনা হল? সেদিন তার ডেরায় গিয়ে মা অমন হাউমাউ করে সিন ক্রিয়েট করল বলেই না দয়িতা নিজের মান বাঁচাতে…

ভাল্লাগছে না দয়িতার, কিচ্ছু ভাল লাগছে না। ওই শয়তান ছেলেটাই যত নষ্টের মূল। কেন যে দয়িতা বিশ্বাস করেছিল সৌমিককে। মনে রাখা উচিত ছিল এই সেই ট্রেটার যে মেলার মাঠে তাকে কথা দিয়েছিল বিয়েটা ভেঙে দেবে, অথচ পরদিনই ল্যা ল্যা করে…। একটা ঘর খুঁজে দেওয়ার তোর মুরোদ নেই, দয়িতাকে তুই ফাঁসিয়ে দিলি! এখন আবার গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে! মা আবার মাঝে মাঝে তাঁকে ফোন করে অফিসে, দুপুরের দিকে, দয়িতা স্বকর্ণে শুনেছে। আমন্ত্রণ পেয়েও এ বাড়ির ছায়া মাড়াচ্ছে না, এত ভয়!

ভাবলেই দয়িতার গা রি রি করে ওঠে। কী রইল আর তার জীবনে? প্রথম প্রথম এখানে এসে চাকরিতে বেরিয়েছিল কয়েক দিন, বাবা মাও বাধা দেয়নি, কিন্তু শরীরটাই এমন বেইমানি শুরু করল। বিশ্রী জ্বর-সর্দি কাশি, যখন তখন মাথা টলে চোখ অন্ধকার, এই অবস্থায় বাইরে বেরোনো যে কী দুঃসাধ্য! তার তো আর বসে বসে চাকরি নয়, ছোটাছুটি না করতে পারলে অফিসই বা তাকে ছেড়ে কথা বলবে কেন! পাঁচ মাস পর তার বাচ্চা হবে বলে কোম্পানি তো আর ব্যবসা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। একেই তো অফিসে মেয়েদের দেড়া কাজ করতে হয়, প্রতি পলে পুরুষদের সমকক্ষ বলে প্রতিপন্ন করতে হয় নিজেদের…।

অগত্যা আপাতত চাকরিকেও টা টা। কী বিচ্ছিরি বর্ণহীন দিন যে কাটছে এখন! শুধু বিশ্রাম বিশ্রাম বিশ্রাম, অন্তহীন বিশ্রাম। বাড়িতে জবুথবু হয়ে শুয়ে বসে থাকা। বুকের মধ্যে মেঘ ছেয়ে থাকে সর্বক্ষণ। এ ভাবেই যদি দিন কাটবে, তা হলে বোধিসত্ত্বকে ছেড়ে সে চলে এল কেন? বোধিসত্ত্বও তো এইটুকুই চেয়েছিল, চাকরি বাকরি না করে সে বাড়িতে থাকুক। অবশ্য শুধু তার চাকরি করা নয়, বোধিসত্ত্ব তার বাচ্চাটাকেও চায়নি। ভ্রূণটা নষ্ট করে দিলেই বা কী এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হত পৃথিবীর? বোধিসত্ত্ব যে ভাবে চেয়েছিল, সে ভাবে থাকলেই তো সব ল্যাটা চুকে যেত।

সত্যি কি ল্যাটা চুকত? অস্তিত্বহীন আত্মসমর্পণকে কি বেঁচে থাকা বলে? তার যে একটা স্বাধীন সত্তা আছে, সেটাই তো বোধিসত্ত্ব মেনে নিতে পারছিল না। কী নির্দয় মানুষ, কেমন মুখের ওপর বলে দিল এবার কেটে পড়ো। তারপর একবার দয়িতার খোঁজ পর্যন্ত করল না! দয়িতা কোথায় গেল, কেমন আছে, তাও জানতে ইচ্ছে করল না বোধিসত্ত্বর। দয়িতা যেদিন সল্টলেকে জামাকাপড় আনতে গেল, কী ভীষণ পাথরের মতো মুখ করে বসে ছিল। দয়িতার ওপর সামান্যতম টান থাকলেও তো তাকে সেদিন আটকাত বোধিসত্ত্ব, যা হয়েছে সব ভুলে গিয়ে আবার তাকে থেকে যেতে বলত, নয় কি?

দয়িতা বিদেয় হতে বোধিসত্ত্ব যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এত রিলিভড্‌ যে সল্টলেকের ফ্ল্যাট ছেড়ে লাফাতে লাফাতে নিজের বাড়ি ফিরে গেল। অথচ ওই লোকটার জন্য হঠাৎ খুব মন কেমন করছিল বলেই না দয়িতা বোকার মতো আবার একদিন অফিসফেরতা ছুটে গিয়েছিল সল্টলেকে! কী দেখল? ইয়া বড় তালা ঝুলছে। নামার সময়ে উলটো ফ্ল্যাটের মিসেস সাহার মুখোমুখি। তিনি রসালো চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুনিয়ে দিলেন লটবহর সমেত কবেই নাকি স্বগৃহে চলে গেছেন প্রফেসার সাহেব। কে জানে, অ্যাদ্দিনে হয়তো রাখীর সঙ্গে মিলমিশ হয়ে গেছে! স্ত্রী পুত্র নিয়ে আবার সুখে ঘরসংসার করছেন প্রফেসার বোধিসত্ত্ব মজুমদার।

এই মুহূর্তে ওই বোধিসত্ত্বর জন্য দয়িতার হৃদয়ে কী অনুভূতি থাকা উচিত?

বিরাগ? উপেক্ষা? অবিমিশ্র ঘৃণা?

কিন্তু কোনওটাই যে আর আসে না। চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে এক ধূসর ছবি। ক্যাম্পাস টাউনের কুয়াশামাখা পথ বেয়ে লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে এক দীর্ঘকায় পুরুষ, লোহার গেট খুলে একটা বাড়িতে ঢুকে গেল, পিছন পিছন নিঃশব্দে আসা একটি তৃষ্ণার্ত মেয়ের দিকে ক্ষণিকের জন্যও ফিরে তাকাল না।…

কী নিষ্ঠুর যে ওই চলে যাওয়া! নিষ্ঠুর? না নিরাসক্ত? কী অবলীলায় দয়িতার মাধ্যাকর্ষণ ছিন্ন করে ঘটনাদিগন্তের ওপারে মিলিয়ে গেল বোধিসত্ত্ব, বুঝি এক কৃষ্ণগহ্বরে। দয়িতার মহাবিশ্বে বোধিসত্ত্বর বিকিরণ আর পৌঁছবে না কোনওদিন।

ওফ্‌, কেন যে ছবিটা দেখে দয়িতা!

তবে বুঝি ওই ছবিটাই শুধু সত্যি ছিল। বাকি সবটাই স্বপ্ন। কিংবা কাল্পনিক সময়ে ঘটা অলীক ঘটনা!

কেন যে দয়িতা বোধিসত্ত্বর মতো স্মৃতিহীন হতে পারে না।

.

২৬.

মেঘলা বিকেলের মরে আসা আলোয় সৌমিককে দেখতে পেল দয়িতা। জানলা থেকে।

এ বছর আষাঢ় মাসেই জোর কদমে বর্ষা এসে গেছে। মেঘেদের অন্তহীন পল্টন ছেয়ে ফেলেছে শহরের আকাশ। সূর্যদেব প্রায় পাকাপাকিভাবেই ফেরার। জলদগম্ভীর তূর্যধ্বনি বাজছে দিনভর, অস্ত্রের ঝঙ্কারও শোনা যায় ঘন ঘন। রুপোলি বিদ্যুতের আঘাতে আকাশ ফালা ফালা, তার ক্ষতবিক্ষত দেহ থেকে অবিরাম ঝরে যায় অশ্রুকণা। কখনও টিপটিপ, কখনও বা মুষলধারায়।

আজও সকাল থেকে আকাশ একেবারে স্লেটবরণ। বিকেল হতে না হতেই দিনের আলো নিভু নিভু, এই বুঝি আঁধার ঝাঁপিয়ে এল। একটানা অনেকক্ষণ কেঁদে আকাশ চোখ মুছছে এখন, এলোপাথাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছে তার ভেজা দীর্ঘশ্বাস।

দয়িতা নিজের ঘরেই ছিল। একা। মণিদীপা টিভি দেখছে, দয়িতা আওয়াজ পাচ্ছিল। টুকরো হাসি, টুকরো গান। দয়িতার হাতে চিকেন স্যুপের বাটি। সঙ্গে দু পিস পাউরুটিও দিয়েছে মণিদীপা, হালকা সেঁকে। পাউরুটি চিবোতে দয়িতার ঘোর অনীহা, তবুও।

চামচে সামান্য একটু স্যুপ তুলে ঠোঁটে ছোঁয়াল দয়িতা। সঙ্গে সঙ্গে মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। আজকাল বেশ খিদে হয় দয়িতার, কিন্তু জিভে এখনও এতটুকু স্বাদ নেই। বেশি করে নুন গোলমরিচ ছড়িয়ে আনবে? কিংবা সস টস?

বিছানা ছেড়ে নামতে যাবে, পেটে আবার সেই তরঙ্গের ওঠাপড়া। নড়ছে, নড়ছে…। দয়িতা হাত রাখল পেটে। এই তো এখানে নড়ে উঠল, এই তো দুলে দুলে সরে গেল এ পাশে…! কদিন ধরে খুব খলবল করছে। আপনাআপনি চোখ বুজে এল দয়িতার। তারই শরীরের অভ্যন্তরে অঙ্কুরিত হচ্ছে এক প্রাণ, সেই প্রাণ তারই দেহ থেকে সংগ্রহ করছে বেঁচে থাকার রসদ—ভাবনাটাই যে কী অদ্ভুত মাদকতাময়! কী কঠিন মায়ার বাঁধনে যে বেঁধে ফেলেছে দয়িতাকে ওই অদেখা প্রাণ! অনেকক্ষণ না নড়লে চোরা আতঙ্কে বুক কেঁপে ওঠে। একেই কি মাতৃত্ব বলে?

পেটে হাত বোলাল দয়িতা। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,—কী রে, শুনতে পাচ্ছিস?

স্পষ্ট উত্তর পেল দয়িতা—হুঁউউ।

—কেমন লাগছে ভেতরে?

—দিব্যি আছি।

—দূর বোকা। গুটিয়ে মুটিয়ে জলে ভাসছিস, অন্ধকার, হাওয়া নেই, ওখানে তোর ভাল লাগতেই পারে না।

—উঁহু, আমার বেশ লাগছে। কী সুন্দর জীবন! কোনও চিন্তা নেই, ভাবনা নেই…

—দূর বোকা! বাইরে এলে আরও বেশি ভাল লাগবে।

—কেন?

—কত কী আছে বাইরে। আলো বাতাস পাখি ফুল গাছ…সারাজীবন দেখেও তোর চোখ ভরবে না।

—আর কিছু নেই বুঝি? ঝড় দুর্যোগ দুঃখ যন্ত্রণা কান্না?

—চুপ। আমি আছি না!

আন্দোলন থেমে গেল। ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? ধীরে ধীরে চোখ খুলল দয়িতা। হৃদয়ের প্রতিধ্বনি চিনচিনে কষ্ট হয়ে কোন এক গহীন অন্দরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের কোষে কোষে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে পড়ছে এক গাঢ় বিষণ্ণতা। এও কি মাতৃত্ব?

পড়ে থাকা স্যুপের বাটি আর ছুঁয়ে দেখল না দয়িতা। মন্থর পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে জানলায়। ওপারে সজল বিকেল, ভিজে রাজপথ বেয়ে সরীসৃপের মতো পিছলে পিছলে যাচ্ছে গাড়িঘোড়া, অতিকায় পোকার মতো নড়াচড়া করছে মানুষ। আকাশ আরও ঘন হয়ে এল। এক্ষুনি আবার বৃষ্টি নামবে কি?

সহসা দয়িতার আনমনা চোখ টানটান। জল কাদা মাখা পথ মাড়িয়ে ছপছপ হেঁটে আসছে কে ও? প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটোনো, হাতে বন্ধ ছাতা। দয়িতাদের বাড়ির সামনে এসে ওপর পানে চাইল একবার। আকাশ দেখল? না জানলায় দাঁড়ানো দয়িতাকে?

দয়িতা স্যাঁত করে সরে এল। মুহূর্তে বিষাদ ছাপিয়ে চাগাড় দিয়েছে ক্রোধ। অ্যাদ্দিনে আসার সাহস হল কেন্নোটার! ঝপাৎ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল দয়িতা। শুয়ে শুয়েই কানে এল ডোরবেলের আওয়াজ, মার উচ্ছ্বাসধ্বনি। সৌমিক কী যেন বলল মাকে, মার স্বর খাদে নেমে গেল। আর কিছু শোনা যায় না, বাতাসে থমথমে নৈঃশব্দ্য।

ঈষৎ অসহিষ্ণু হয়েই দেয়ালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছে দয়িতা, দরজায় সৌমিক। ভেতরে আসার অনুমতি নিল না, গটগটিয়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,—ম্যাডামের এখন শরীর কেমন?

দয়িতা মুখ ঘুরিয়ে নিল। আগুন চোখে দেয়াল দেখছে।

সৌমিক ফের গলা ঝাড়ল,—শুনলাম খাওয়াদাওয়া নাকি ঠিক মতো করছ না?

এতদিন পর ছেলেটা কি ফাজলামি করতে এসেছে? নাকি মজা দেখতে? খুব কলজের জোর বেড়েছে তো!

দয়িতার হিংস্র চোখ সৌমিকের দিকে ঘুরল। সৌমিকের তাপ-উত্তাপ নেই, হাসি হাসি মুখ,—আজ ওয়েদারটা কী বিশ্রী। অফিস কেটেও চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম তোমাদের এখানে পৌঁছতে পারব কি না। ভাগ্যিস বৃষ্টিটা ধরল।

দয়িতা দাঁতে দাঁত ঘষল। মেনিমুখো ছেলেটার এত বুকের পাটা হল কবে থেকে?

—কথা বলছ না কেন? সৌমিক মৃদুমৃদু হাসছে,—থ্রোট প্রবলেম?

—তুমি কী এমন হরিদাস পাল যে তোমার সঙ্গে কথা বলতে হবে? দয়িতা আর থাকতে না পেরে ঝাং করে উঠে বসেছে।

—আমি তো হরিদাস পাল নই। সৌমিকের চোখে হাসি খেলা করছে,—আমি সৌমিক বসুরায়।

—লিমিট লিমিট। দেয়ার শুড বি লিমিট। রাগে কাঁপছে দয়িতা। উদ্গত চিৎকার কোনওক্রমে সামলে হিসহিসিয়ে উঠল,—আমাকে আবার মুখ দেখাতে তোমার লজ্জা করল না? কেন এসেছ এ বাড়িতে?

—কীসের লজ্জা? সৌমিক কাঁধ ঝাঁকাল,—আর এ বাড়িতে তো আমি আসিই। তুমি যখন ছিলে না, তখনও আসতাম।

—যাদের কাছে আসতে তাদের কাছে যাও। এ ঘরে পা রেখেছ কেন?… বুঝতে পারছ না, আই কান্ট টলারেট ইয়োর প্রেজেন্স, এনি মোর?

দয়িতাকে তবু পাত্তা দিল না সৌমিক। চেয়ার টেনে বসেছে। মুচকি হেসে বলল,—আজ তো আমি অন্য কারুর কাছে আসিনি, তোমার কাছেই এসেছি। টু মিট ইউ।

—কোন আহ্লাদে?

—সে তো তুমিও জানো, আমিও জানি। তোমায় ছেড়ে আমি থাকতে পারি না, তাই।

এত সহজে, এমন অবলীলায় কথাটা উচ্চারণ করল সৌমিক, দয়িতা কয়েক মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল। সৌমিকের স্বরভঙ্গি এত অকপট, যেন বাতাস দুলে গেল একটু।

দয়িতার রাগের ফণাও যেন নেতিয়ে পড়ছে হঠাৎ। অজান্তেই। মাথা ঝাঁকিয়ে সমে ফেরাল নিজেকে। চোখের কোণ দিয়ে দেখছে সৌমিককে।

হিম হিম গলায় বলল,—আমাকে একটা কথার জবাব দেবে সৌমিক?

—ও, শিওর।

—আমার সঙ্গে তুমি এত বড় শত্রুতাটা করলে কেন?

—শত্রুতা? আমি? তোমার সঙ্গে?

—ন্যাকামি কোরো না। অ্যান্ড ডোন্ট আটার তুমি আমার ভাল চেয়েছিলে…আমার ফিজিকাল কন্ডিশান দেখে তোমার নার্ভাস লাগছিল…ও সব বুলশিট আমি বিশ্বাস করি না।

—কোরো না।

—তুমি কি আমার ওপর প্রতিশোধ নিলে সৌমিক? আমাকে ঘেঁটি ধরে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে?

—কিসের প্রতিশোধ?

—তোমাকে রিফিউজ করার।

সৌমিকের উজ্জ্বল মুখ পলকের জন্য ম্লান। পলকে হাসিটা ফিরে এসেছে,—আমাকে কি তোমার খুব প্রতিশোধপিপাসু মনে হয়?

—জানি না। বুঝতে পারি না। রিফিউজ করার পরও তুমি আমায় পছন্দ করে বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিলে, ক্যাম্পাস টাউনে ছুটলে, সল্টলেক ধাওয়া করলে…কী যে সব মাথায় ভুজুংভাজুং ঢুকিয়ে দিয়ে এলে, আমার সংসারটা আর গড়েই উঠতে পারল না।

সৌমিকের ভুরু কুঁচকে গেল,—তুমি কি তোমার সংসার ভাঙার জন্যও আমাকে অ্যাকিউজ করছ?

—নাহ্। আমাদের মধ্যে ফাঁক তো ছিলই। সেটাই প্রকট হয়েছে। দয়িতা একটুক্ষণ থমকে রইল। তারপর বলল,—কিন্তু আমার এই ক্ষতিটা তুমিই করেছ। তুমিই।

—তোমাকে নিরাপদ ছাদের নীচে এনে দেওয়াটা তোমার ক্ষতি করা?

—জীবনের সব কিছুই কি এত সরল হিসেবে চলে সৌমিক? দয়িতার গলা ধরে এল,—আমার এখানে এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করে না।

—কেন? মাসিমা মেসোমশাই তোমায় পেয়ে কত খুশি হয়েছেন…

—বাজে কথা। আমি এদের একেবারেই পর হয়ে গেছি। সবাই আমাকে খুব যত্নআত্তি করছে, আদর করছে…কিন্তু আমার সুখদুঃখের কথা কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে না। এ যেন হোটেলের সুইটে বাস করা। বাবা-মা আমাকে ভালবাসে না এ কথা বলছি না, কিন্তু আমাদের মাঝখানে একটা দেয়াল উঠে গেছে। একটা অদৃশ্য দেয়াল।

—একটু সময় যেতে দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।

—কী জানি, হয়তো হবে। আবার বিষণ্ণতা দখল নিচ্ছে দয়িতাকে,—আমার আর বাঁচার স্পৃহাটা পর্যন্ত চলে যাচ্ছে, সৌমিক।

—এ সময়ে ও সব কথা ভাবতে নেই দয়িতা। যে আসছে তার কথা ভেবে মনটাকে অন্তত হাসিখুশি রাখো।

—পারছি না যে।

সৌমিক কী যেন ভাবল একটু। তারপর ঝপ করে বলে উঠল,—তা হলে তুমি আমার সঙ্গে চলো।

—কোথায়?

—বা রে, তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম আলাদা একটা ফ্ল্যাট দেখে নিচ্ছি… তোমাকে আমি এক সেকেন্ডের জন্যও মনখারাপ করে থাকতে দেব না, দেখো। সৌমিক বোকা বোকা মুখ করে হাসল,—তা ছাড়া তুমি তো তোমার বাচ্চাকে বোধিসত্ত্বর পরিচয়ে মানুষ করবে না…

—করব নাই তো।

—বাট হি নিডস এ ফাদার। টম ডিক হ্যারি, এনিওয়ান। দয়িতার কথারই পুনরাবৃত্তি করল সৌমিক,—আমি ডিক হতে পারি। সৌমিক ডিক বসুরায়।

—তুমি? দয়িতার চোখ গোল গোল হয়ে গেল,—তুমি কেন হতে যাবে?

—কারণ…কারণ…কারণ…। সৌমিক তোতলাতে তোতলাতে বলে ফেলল,—কারণ আমি তোমাকে ভালবাসি।

—কিন্তু আমি তো তোমায় ভালবাসি না।

সরল রূঢ় কথাটার অভিঘাতে ক্ষণিকের জন্য নিস্পন্দ সৌমিক। বড় করে শ্বাস টানছে ফুসফুসে। ঘরে শেষ বিকেলের আবছায়া। সৌমিকের মুখেও।

খানিক পরে সৌমিক বলল,—এ আর নতুন কথা কী! আমি জানি তো। তবে তার জন্য আমার কোনও অসুবিধে হবে না।

—মানে?

—একজন ভালবাসলেই কাজ চলে যাবে। তুমি শুধু আমাকে একটু সহ্য করে নিয়ো।

ছেলেমানুষ। মনে মনে বলল দয়িতা।

মুখে বলল,—আমিও বোধিসত্ত্বকে একতরফা ভালবাসতাম সৌমিক। সে সম্পর্ক কিন্তু টেকেনি।

—তুমি বোধিসত্ত্ব নও দয়িতা। তুমি একজন সাধারণ মেয়ে, আমিও একদম সাধারণ ছেলে। এবং সাধারণ বলেই আমরা কেউ কারুর কাছে নগণ্য নই। এটাই আমাদের সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখবে।

কথাটায় যেন এক গভীর সত্য আছে, মনে হল দয়িতার। বৃহৎ মানুষের সব কিছুই বড় মাপের, সেখানে প্রতি পলে নিজের অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে হয়। সে বা রাখী কেউই তার ব্যতিক্রম নয়। ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া নিয়ে যে জগৎ গড়ে ওঠে, সেই জগৎটাই তো বোধিসত্ত্বর কাছে মূল্যহীন। মান অভিমান হর্ষ বিষাদ—ছোট ছোট সরু সুতোর ফোঁড়ে সংসারের নকশি কাঁথাটা বোনা হয়। এ সত্য বোধিসত্ত্ব জানেই না।

সৌমিক নিচু স্বরে বলল,—কী ভাবছ দয়িতা?

—কিছু না।

তুমি আমায় ভাল না বাসতে পারো, বন্ধু তো ভাবো। কী, ভাবো না? বন্ধুত্বের সুবাদেও তো আমরা এক ছাদের নীচে বাস করতে পারি৷ মুখে যাই বলো, তুমি জানো আমি মানুষ হিসেবে তেমন শয়তান নই। তোমার বাচ্চার একেবারে অযোগ্য বাবাও আমি হব না।

—দয়া দেখাচ্ছ?

কে কাকে দয়া দেখায়! সৌমিকের বুকটা বুঝি মুচড়ে উঠল। যার মুখের এক চিলতে হাসি দেখার জন্য সে এভারেস্টের চূড়া থেকে বরফ কুড়িয়ে আনতে পারে, সেই কিনা আজ নিজেকে করুণার পাত্রী ভাবে! আহা রে, ভেতর থেকে না জানি কতটা ভেঙেছে দয়িতা।

সৌমিক মাথা নামিয়ে বলল,—আমি অতি দুর্বল মানুষ। তুমি তো জানো, দয়া যে করে তারও কিছু প্রত্যাশা থাকে। নিদেনপক্ষে কৃতজ্ঞতার। সে দিক দিয়ে ভাবতে গেলে সে নিজেও তো দয়ার পাত্র, নয় কি? কিন্তু তোমার কাছে আমার সেই কৃতজ্ঞতাটুকুও চাওয়ার ক্ষমতা নেই।

দয়িতার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। সৌমিকের স্বর যেন অচেনা অচেনা ঠেকে! বড় দুঃখী দুঃখী!

সৌমিক একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল,—কেউ জানে না, নান…। আমার ঘাড়ের কাছে একটা বুলডগ অবিরাম ঘাঁউ ঘাঁউ করছে। আজ নয়, সেই ছোটবেলা থেকে। তারই তাড়া খেয়ে আমি ছুটছি, দিবারাত্র ছুটছি। ঘাড় গুঁজে পড়াশুনো করে গেছি, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিশিনি, ভাল চাকরিতে জুতে গেছি, আর্নিং হেল অব আ লট…যে পৃথিবীতে আমি ঘুরে মরছি তার বাইরেও একটা অন্য ভুবন আছে, আমি জানি, চোখ বুজলেই আমি সেই স্বপ্নের পৃথিবীটাকে দেখতে পাই… কিন্তু আমি সে দিকে এক পা এগোতে পারি না… জাস্ট ফর দ্যাট বুলডগ। ইট নেভার স্পেয়ারস মি ফর আ মোমেন্ট। ঘাড় ফেরালেই তার গর্জন আমার বুক হিম করে দেয়। ডোন্ট মাইন্ড, ওই বুলডগটা তোমার প্রফেসার সাহেবের ঘাড়ের কাছেও আছে। সেও একইভাবে গর্জায়, প্রফেসার সাহেবকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তফাত একটাই। আমার বুলডগটা ফিট করে দিয়েছে আমার মা, আর প্রফেসার সাহেব নিজেই বুলডগটাকে পুষেছেন। হয়তো এই জন্যই তিনি অসাধারণ। আত্মধিক্কারে সৌমিকের ঠোঁট পলকের জন্য বেঁকে গিয়েছিল, পরক্ষণে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল—বাট দিস ক্যান নট গো অন ফর এভার। এই কদিন ধরে ওই বুলডগটার সঙ্গে আমার যুদ্ধ চলছে। ওই কুত্তাটাকে আমি এবার ভাগাবই।

সৌমিকের চোখের মণি জ্বলছে দপদপ চেয়ার ছেড়ে বিছানায় এসে বসল। দয়িতার নিরাভরণ হাত কোলের ওপর জড়ো হয়ে আছে, ঝুঁকে দয়িতার একটা হাত ছুঁল সৌমিক।

অধীর স্বরে বলল,—কিন্তু তুমি না পাশে থাকলে আমি যে কিছুতেই লড়াইটা জিততে পারব না দয়িতা। আই নিড ইউ। আই নিড ইউ ভেরি ব্যাডলি।

পুরুষের কণ্ঠে এমন তীব্র আকুতি দয়িতা আগে কখনও শোনেনি। হঠাৎই কেন যে শীত শীত করছে? বাষ্প জমছে চোখে, অজান্তেই।

হাতে চাপ বাড়ছে ক্রমশ। সৌমিকের স্পর্শ চারিয়ে যেতে চাইছে দয়িতার গভীরে। সামনে কৃতাঞ্জলিপুটে এক প্রার্থী পুরুষ, বাইরের পৃথিবীতে একটা মেঘলা দিন হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, এলোমেলো নেচে বেড়াচ্ছে আর্দ্র বাতাস—এরা কোন দিকে ঠেলছে দয়িতাকে? গহীন কুয়োর অতলে একটা ঢেউও কি উঠবে না?

সৌমিক গাঢ় স্বরে বলল,—চুপ কেন দয়িতা?

দয়িতা অস্পষ্টভাবে মাথা নাড়ল,—ভাবছি।

—কী ভাবছ?

দয়িতা উত্তর দিল না। আশ্চর্য, এমন মুহূর্তেও বোধিসত্ত্বকে মনে পড়ে! কুয়াশামাখা পথে মিলিয়ে গেল দীর্ঘদেহী পুরুষ, দয়িতার দিকে ফিরেও তাকাল না…।

ওই নিষ্ঠুর লোকটাকে উচিত জবাব একটা দেওয়াই যায়। বোধিসত্ত্ব মজুমদার যে দয়িতার জীবন নষ্ট করতে পারে না, সৌমিককে বিয়ে করে দয়িতা সেটা দেখিয়ে দিতেই পারে। শুধু তাই নয়, বোধিসত্ত্বর সন্তান জীবনভর সৌমিককেই বাবা বলে জানবে, তার জীবনে বোধিসত্ত্বর কোনও অস্তিত্বই থাকবে না, এটা কি বোধিসত্ত্বর অহংকে একটুও আঘাত করবে না? বোধিসত্ত্বর জন্য সৌমিকও কম কষ্ট পায়নি, চাইলে সৌমিকও একটা প্রতিশোধ নিতেই পারে।

ছিঃ, শুধু এইটুকু কারণেই সৌমিকের সঙ্গে জীবন শুরু করবে দয়িতা? ঘর বাঁধবে? সংসার করবে? এ কি সৌমিককে ঠকানো নয়?

শুধু সৌমিকের জন্য কি তার হৃদয়ে কোনও বিশেষ অনুভূতি নেই? ভালবাসার কি একটাই রং?

সৌমিক ফিসফিস করে বলল,—মুনিয়া, প্লিজ…

দয়িতা চমকে তাকাল। তার চোখের মণি অসম্ভব রকমের নিষ্প্রভ এখন। মুক্তোদানা কখন যেন গড়িয়ে গেছে গাল বেয়ে, চিকচিক করছে জলের রেখা। প্রায় অন্ধকার ঘরে টুকরো আলো এসে পড়েছে একটা, মণিদীপা ড্রয়িংরুমের আলো জ্বেলে দিয়েছে, দয়িতার শ্যামলা মুখে আলো-ছায়ার জাফরি। একটু বুঝি কেঁপে উঠল দয়িতার ঠোঁট।

ভাঙা ভাঙা গলায় দয়িতা বলল,—আমায় একটু সময় দাও সৌমিক। একটু ভাবি।

—একটু কেন, অনেক ভালো। সৌমিক নরম করে হাসল,—যত খুশি ভাবো। আমি তো রইলামই।

সৌমিকের শেষ বাক্যটুকু দয়িতার বুকের গভীরে বসে রইল একটুক্ষণ। তারপর ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগল ঘরময়। রঙিন প্রজাপতির মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *