১০. রাখী বাপের বাড়ি থেকে ফিরল

১০.

রাখী বাপের বাড়ি থেকে ফিরল তিন সপ্তাহ পর। বাবা নার্সিংহোমে শুনে তড়িঘড়ি বারাসত ছুটেও এবার আর তাঁকে সজ্ঞানে দেখতে পায়নি রাখী। সন্ন্যাসরোগে আগাগোড়াই অচেতন ছিলেন সূর্যকান্ত চৌধুরী, অর্থ-প্রতিপত্তি-ডাক্তার-স্পেশালিস্ট কোনও কিছুতেই তাঁর অবস্থার উন্নতি হল না, দিন পাঁচেক পর মারা গেলেন তিনি। চার দিনের কাজ রাখী বারাসতের বাড়িতেই সারল, ইচ্ছে অনিচ্ছের দোলাচলে ভুগতে ভুগতে শ্রাদ্ধশান্তি চোকা পর্যন্ত রয়েই গেল। কিছুটা রন্টুদের জোরাজুরিতেও বটে, আবার সঙ্গে ভাবল এখন চলে গেলে আবার শ্রাদ্ধতে তো আসতেই হবে, বার বার এই ছোটাছুটি…। তাছাড়া ভিড়ের বাড়িতে শোকের অভিঘাতও কম হয়, দুঃখ তাড়াতাড়ি থিতিয়ে আসে। ইদানীং বাপেরবাড়ির আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কমই দেখা হয়, কটা দিন তাঁদের সঙ্গও মন্দ লাগল না রাখীর।

এ ক’দিন বাবুয়াও রাখীর কাছে কাছে ছিল। দু-চার দিন কলেজ গেছে বটে, তবে ফিরেছে বারাসতেই। এটা রাখীর উপরি পাওয়া। বোধিসত্ত্ব একটিবারের জন্যও আসেনি, আসতে পারেনি। কাজের চাপ। এটা রাখীর মন্দভাগ্য।

ফেরার সময়েও একটু মনমরা ভাব ছিল রাখীর। নিজস্ব ঘরদোরে পা রেখেই তা কেটে যাওয়ার কথা, কিন্তু তেমনটা হল না। উলটে এক বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছিল। কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে সংসারের। ছন্দপতনটা যে ঠিক কোথায় রাখী বুঝতে পারছিল না। এখানে সবই তো চলছে অভ্যস্ত নিয়মে, ভোরবেলা উঠছে বোধিসত্ত্ব, দিন শুরু হচ্ছে, রাখীর, বোধিসত্ত্বর ঘড়ির কাঁটায় একটু একটু করে দিন এগোচ্ছে তার, স্বামীর ঘড়ির কাঁটাতেই ফুরোচ্ছে সময়—তবে এমন অনুভূতি জাগে কেন?

কাজেকর্মে বেশ কয়েকবার দেশ বিদেশ গেছে বোধিসত্ত্ব, সেই সময়টুকু ছাড়া আর কখনও স্বামীর থেকে এত দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকেনি রাখী। বারাসতে অহরহই মন খচখচ করত, না জানি একা একা কেমন আছে বোধিসত্ত্ব। খাওয়া দাওয়া ঠিক হচ্ছে কিনা, হাতের কাছে ঠিক সময় ঠিক ঠিক জিনিস জুটছে কিনা, এই সময় রূপচাঁদ দুম করে কটা দিনের জন্য বাড়ি চলে গেল…!

রোজ রাত্রেই অবশ্য রাখী ফোনে খবর নিয়েছে, বোধিসত্ত্বর স্বরেও বিরক্তির আভাস পায়নি। তবু চিন্তাটা ছিল। মনে হত তাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না বলেই বুঝি বোধিসত্ত্ব নিজের অসুবিধের কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। রূপচাঁদ ফেরার পর রোজ তাকে ফোনে নির্দেশ দিয়েছে রাখী। সকাল বিকেল। তবু নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। অথচ এখানে এসে কী দেখল? বোধিসত্ত্ব বেশ বহাল তবিয়তেই আছে। শীর্ণ মলিন স্ত্রীবিহনে দিশেহারা তো নয়ই, বরং যেন একটু বেশিই প্রাণোচ্ছল, চনমনে। কী অবলীলায় বলে দিল, আরও কটা দিন থেকে এলে পারতে রাখী, অন্তত ক্রিসমাস পর্যন্ত।

রাখীর অনুপস্থিতিতে বোধিসত্ত্বর কণামাত্র অস্বাচ্ছন্দ্য হয়নি, এই ভাবনা থেকেই কি বেদনা জাগছে রাখীর?

অন্য একটা সূক্ষ্ম অভিমান অবশ্য থাকতে পারে। যাব বলেও বোধিসত্ত্ব গেল না বারাসত! সূর্যকান্ত অসুস্থ হলেন, মারা গেলেন, তাঁর ক্রিয়াকর্ম হল। যত কাজই থাকুক, এক বেলার জন্যও কি ও বাড়িতে গিয়ে দাঁড়াতে পারত না বোধিসত্ত্ব? কর্তব্য বলেও তো একটা কথা আছে। শ্রাদ্ধের দিন রাখীর শ্বশুরবাড়ির সবাই এল, শ্বশুর শাশুড়ি শান্ত দীপালি জুলি মিলি, একমাত্র বোধিসত্ত্ব বাদ। আত্মীয়স্বজনদের কাছে কম কৈফিয়ত দিতে হয়েছে রাখীকে! এখানে ফিরে রাখী বার কয়েক মৃদু অনুযোগও জানিয়েছিল, বোধিসত্ত্ব আমলই দিল না। কী করব বলো, কাজে আটকে গেলাম। তোমরা তো ছিলে, তোমরা থাকা মানেই আমার থাকা…!

কিন্তু শুধু ওই কারণেই কি এমন বিচিত্র অনুভূতি জাগে? রাখী তো জানেই তার স্বামী একজন মহৎ মানুষ, জগৎ সংসারের স্বাভাবিক রীতিনীতি তার জন্য প্রযোজ্য নয়, তার ওপর অভিমান করা রাখীকে মোটেই মানায় না। এই অভিমান মূল্যহীনও বটে। হিমালয় কি তরুলতার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়? ওই দীর্ঘশ্বাসটুকু গোপন রেখেই তো গড়ে উঠেছে রাখীর সংসারের সুর তাল লয় ছন্দ। তুচ্ছ কারণে ওই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে কেন?

শীত জাঁকিয়ে এসে গেছে। ক্যাম্পাস টাউনে ঠাণ্ডা ভালই পড়ে, এবার যেন মাত্রাটা হঠাৎই খুব চড়া। দুপুরের পর থেকে সূর্যের তেজ মরে যায় একদম। হাওয়া বয় থেকে থেকে। কনকনে উত্তুরে হাওয়া, হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।

মনের অস্থির অস্থির ভাবটাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছিল রাখী। সংসারে ডুবছিল, চোখ কান বুজে। একদিন বাগান নিয়ে পড়ল। রূপচাঁদকে সঙ্গে নিয়ে সারাদিন চলল মাটির পরিচর্যা। নিজে থেকে কিছু ডালিয়া আর গাঁদার চারা এনে বসিয়েছে রূপচাঁদ, এখনও ফুল ফোটেনি, শুধু চন্দ্রমল্লিকাতেই আলো হয়ে আছে বাগান। গাছগুলোকে স্নান করাল প্রাণ ভরে, গোড়ায় সার দিল, ছাঁটল অবাঞ্ছিত ডালপালা। সে চিনা প্রবাদটা অক্ষরে অক্ষরে মানে, জীবনভর সুখ চাইলে বাগান নিয়ে থাকো।

ক’দিন পর টাউনে গেল রাখী। ক্যাম্পাসের বাজার বড্ড ছোট, তেমন বড় একটা কিছু মেলে না, পছন্দসই জিনিস কিনতে টাউনের মার্কেটই ভরসা। টাউনে হরেক কিসিম মানুষের বাস। তেলেগু ওড়িয়া পাঞ্জাবি মারোয়াড়ি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান…। তাদের রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্যও মেলে হরেক রকম। বিশেষত রেলবাজারে।

সারা বিকেল গোটা বাজারটাই চষল রাখী। টাটকা ভেটকি মাছের ফিলে কিনল বেশ খানিকটা। পরশু বড়দিন, বাবুয়া এলেও আসতে পারে, ফিশফ্রাই খেতে খুব ভালবাসে বাবুয়া। নলেন গুড় নিল কেজিখানেক, ওই গুড়ের গন্ধ বোধিসত্ত্বর খুব প্রিয়। ক্রিসমাসে কেক তো বানাতেই হয়, তারও উপকরণ কিছু কম নয়, চকোলেট পাউডার, আইসিং সুগার, ক্রিম, মাখন, ভ্যানিলা…। ডালিয়া চারার জন্য খোলও কিনল মনে করে। এছাড়া সংসারের টুকিটাকি তো আছেই, চিজ মার্মালেড আচার আপেল আঙুর কমলা… দিনেশ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে, একের পর এক মাল জমা করে আসছে গাড়িতে। আগরওয়ালদের বিশাল দোকানে বিপুল শীতবস্ত্রের সম্ভার, সেখানেও রাখী দাঁড়াল কিছুক্ষণ। দোনামোনা করতে করতে বোধিসত্ত্বর জন্য একটা পুলওভারও কিনে ফেলল। আকাশনীল। আকাশের রং বোধিসত্ত্বকে টানে বেশি, রাখী জানে।

সওদা সেরে মুচমুচে কটা প্যাটিস নিয়ে গাড়িতে উঠছে, কল্পনার সঙ্গে দেখা। কেমিস্ট্রির ডক্টর তিমির হাজারির স্ত্রী। থাকে রাখীদের লাইনেই, দুটো বাংলো পর। বয়সে রাখীর চেয়ে বছর কয়েকের ছোট, রূপটান আঁকা মুখে পড়ন্ত যৌবনের আভা।

কল্পনাই দেখে এগিয়ে এল,—কবে ফিরলেন রাখীদি?

—এই তো, গত বেস্পতিবার।

—স্যাড নিউজটা শুনেছি। উনিই বলছিলেন…! কী রকম বয়স হয়েছিল বাবার?

—সাতাত্তর।

—স্ট্রোক, না?

—সেরিব্রাল। কয়েক সেকেন্ড চুপ রইল রাখী। বুঝি বা বাবাকে মনে পড়ল। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে সরে এল প্রসঙ্গ থেকে,—আপনিও কি মার্কেটিং?

—এখানে তো আমাদের একটাই রিক্রিয়েশান। বাজারে ঘোরা। কল্পনা হাসল,—আপনার ছেলে আসছে ছুটিতে?

—আসার তো কথা।

টুকটাক ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্যালাপ চলল খানিকক্ষণ। উদ্দেশ্যহীন প্রশ্ন, দায়সারা গোছের উত্তর। যেমনটা ক্যাম্পাস টাউনের রেওয়াজ। তাছাড়া কল্পনা রাখীর প্রতিবেশী বটে, তবে এমন কিছু সখী নয়। পথেঘাটে দেখা হলে এরকমই কুশল বিনিময় হয় তাদের।

হঠাৎই কল্পনা জিজ্ঞাসা করল,—আপনাদের কোনও রিলেটিভ এখানে পড়ছে নাকি এখন?

রাখী থমকে গেল,—রিলেটিভ? কই, না তো!

—ও, তাহলে ছাত্রী টাত্রী হবে… ক’দিন ধরে প্রায়ই দেখছি ডক্টর মজুমদারের সঙ্গে আসছে, রাত্তিরবেলা ডক্টর মজুমদার পৌঁছে দিয়ে আসছেন…

রাখী রীতিমতো চমকিত। কোনও ছাত্রীকে বাড়িতে সন্ধেবেলা পড়ানোর মানুষ তো বোধিসত্ত্ব নয়। নতুন কোনও রিসার্চস্কলার জয়েন করেছে কি? এক শামিমই আসে মাঝে মাঝে, সেও তো ছুটিছাটার সকালে, সন্ধেবেলা কখনওই নয়।

মনে একটু খটকা লাগলেও বেশি কথায় গেল না রাখী। ক্যাম্পাস টাউন মোটেই সুবিধের জায়গা নয়। কোন কথার কী অর্থ হবে, কী ভাবে তা পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে, তার ঠিক কী!

টাউন থেকে ক্যাম্পাস অনেকটা পথ। রেললাইনের ধার ঘেঁষে রাস্তা, অন্য দিকে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। অন্ধকার নেমে গেছে বহুক্ষণ, মাঠ এখন কুচকুচে কালো।

রাখী অন্ধকারটাকে দেখছিল। ড্রাইভারের লাগোয়া জানলা ওঠায়নি দিনেশ, ছুরির ফলার মতো ঢুকছে বাতাস, বিঁধে যাচ্ছে নাকে মুখে। শাল মোড়া রাখী সিটে জবুথবু। ভাবছিল। কোন মেয়ে পড়তে আসে বোধিসত্ত্বর কাছে? সেই যে একটা মেয়ে বোধিসত্ত্বর সঙ্গে সঙ্গে আসত, সেই কি কিছু বুঝতে টুঝতে…? কী যেন নাম মেয়েটার? কী যেন? রাখী একটুক্ষণ স্মৃতি হাতড়াল, তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে হাসছে মিটিমিটি। আপন মনে। বোধিসত্ত্ব বলেছিল না, মেয়েটা তার প্রতি ইনফ্যাচুয়েটেড? উঁহু, ইনফ্যাচুয়েটেড বলেনি, বলেছিল লাইক করে। করতেই পারে। বোধিসত্ত্বর মতো শিক্ষককে কোন ছাত্রছাত্রী না ভালবাসে? ওই মেয়েটাই যদি হয়, বোধিসত্ত্ব বলল না কেন? ভুলে গেছে? যেতেই পারে। অত ছোটখাটো ব্যাপার বোধিসত্ত্ব মাথায় রাখে না। মেয়েটা যদি ইউএফও টিউএফও কিছু হত, তাহলে হয়তো বোধিসত্ত্বর মাথায় ঘুরত সর্বক্ষণ।

সামনে ক্যাম্পাস টাউনের আলো। হঠাৎ উলটো দিক থেকে ভীমবেগে একটা ট্রাক ছুটে এল, রাখীদের সাদা অ্যাম্বাসাডারকে প্রায় ছুঁয়ে গেল গাড়িটা। একটু বুঝি বেসামাল ভাবে। পলকের জন্য কেঁপে উঠল রাখী। চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে ছত্রখান, ত্রস্ত চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে বিলীয়মান যন্ত্রদানবটাকে।

দিনেশ খেঁকিয়ে উঠল,—দেখেছেন, কী বিশ্রী ভাবে গাড়ি চালায়?

রাখী অস্পষ্ট ভাবে বলল,—হুঁ।

—ড্রাইভারটাকে ধরে চাবকানো উচিত। লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া উচিত। ভেবেছে কী, অ্যাঁ? আমরা তো আমাদের লাইনেই চলছি, বলুন?

গজগজ করে চলেছে দিনেশ। রাখী হেসে ফেলল,—এত চটে যাচ্ছ কেন? অমন ড্রাইভার তো থাকেই দু-চারটে! অন্যদেরই সাবধান হয়ে চলতে হয়।

—বারে বা, আমি বেপরোয়া চলব, তার জন্য অন্যদের সিঁটিয়ে থাকতে হবে?

রাখী আর কিছু বলল না। তাদের এই মধ্যবয়সী পার্টটাইম ড্রাইভারটি এমনিতে শান্তশিষ্ট, কিন্তু একবার খেপে গেলে একে চুপ করানো কঠিন। বকবক বকবক চলবে তো চলবেই।

বেশিক্ষণ অবশ্য গজরানোর সুযোগ পেল না দিনেশ, অচিরেই বাংলো এসে গেল। গাড়ির আওয়াজ পেয়েই ছুটে এসেছে রূপচাঁদ, মালপত্র নামাচ্ছে। একে একে, দেখে দেখে।

বাড়ির ভেতর থেকে যেন বোধিসত্ত্বর গলা শুনতে পেল রাখী। অবাক হয়ে ঘড়ি দেখল। ছটা চল্লিশ।

জিজ্ঞাসা করল,—তোর বাবু এসে গেছে?

—অনেকক্ষণ। দিদিমুনিও এসেছে।

—কে দিদিমণি?

—ওই যে, লিখাপড়া করে।

রাখী আরও অবাক। আজই মেয়েটার কথা শুনল, আজই মেয়েটা বাড়িতে…! একেই কী নাটকীয় ঘটনা বলে?

দ্রুত পা চালিয়ে দরজায় এল রাখী! দরজাতেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। ও মা, এ তো একেবারে বাচ্চা মেয়ে। পরনে ব্লু জিনস, বহুবর্ণের চকরাবকরা পুলওভার, গোছা গোছা চুল কাঁধ অবধি ছড়ানো। রঙটা তেমন ফর্সা নয়, তবে মুখখানা ভারী ঢলঢলে। মায়া মাখানো।

রাখীকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা। উলটো দিকের সোফা থেকে বোধিসত্ত্ব বলে উঠল,—এ দয়িতা।

দয়িতা! দয়িতা! নামটা মনে পড়ে গেছে। রাখী মধুর হাসল,—তুমি এর কথাই বলেছিলে? এই মেয়েটাই আসে তোমার সঙ্গে?

বোধিসত্ত্ব আলগা মাথা নাড়ল। দয়িতা হাত জোড় করে নমস্কার করল রাখীকে। সামান্য কুণ্ঠিত ভঙ্গি।

একটু যেন খারাপই লাগল রাখীর। ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি এলে প্রণামই করে তাকে, এই রীতিতেই সে অভ্যস্ত। মুখে অবশ্য ছায়াটা পড়তে দিল না রাখী। কত ধরনেরই যে ছেলেমেয়ে আছে, প্রণাম না করা মানেই কিছু অসম্মান দেখানো নয়।

হাসিমুখেই রাখী বলল,—চা টা কিছু খেয়েছ?

বোধিসত্ত্বর দিকে তাকাল দয়িতা। রাখী লক্ষ করল মেয়েটির চোখ দুটি ভারী বাঙ্ময়। বোধিসত্ত্বই তাড়াতাড়ি বলে উঠল,

—ও চা বেশি খায় না।

—তার মানে কিছু দাওনি, তাই তো? রূপচাঁদকে বলতে পারতে, কফি করে দিত। কী, তুমি কফি খাও তো?

দয়িতা বসে পড়েছে। আবার বোধিসত্ত্বর দিকে চোখ। বোধিসত্ত্ব হাসল,—খায়। দুধে কফি মিশিয়ে। বেশি চিনি দিয়ে।

এতক্ষণ পর এই বুঝি প্রথম সত্যিকারের খটকা লাগল রাখীর।

ছাত্রীর সম্পর্কে কি একটু বেশিই জেনে গেছে বোধিসত্ত্ব? এবং ঠিকঠাক মনেও রেখেছে? বোধিসত্ত্বর স্বভাবের সঙ্গে এটা তো ঠিক মেলে না। বোধিসত্ত্ব কি বলতে পারবে রাখী চা কফিতে আদৌ চিনি খায় কিনা?

ধোঁয়াটাকে বাড়তে দিল না রাখী। স্মিত মুখে বলল,—দাঁড়াও, আমিই করে আনছি।

এবার মেয়েটার কথা ফুটেছে। স্পষ্ট রিনরিনে স্বরে বলল,—শুধু কফি কিন্তু, আর কিচ্ছু না।

—ও মা, সে কী কথা? আমার সঙ্গে প্রথম দেখা হল…গরম প্যাটিস এনেছি, একটা অন্তত খাও।

—থ্যাঙ্কস। আমি বিকেলে টিফিন করেছি।

—তা হোক। তুমি বাচ্চা মেয়ে, একটা প্যাটিস ঠিক খেতে পারবে। বলেই লঘু রঙ্গ জুড়বার চেষ্টা করল রাখী,—কিচ্ছু না খাওয়ালে তুমি হোস্টেলে ফিরে বলবে, ম্যাডামটা খুব কিপটে…

আশ্চর্য, মেয়েটা হাসল না।

বোধিসত্ত্বই আবার বলল,—ওকে জোর করছ কেন? কফি যদি করে দিতে পারো তো দাও, নইলে ঘরে রেস্ট নাও গিয়ে।

বোধিসত্ত্বর স্বর কঠিনও নয়, কোমলও নয়, বড় বেশি যান্ত্রিক শোনাল রাখীর কানে। উষ্মা গোপন করতে ওই স্বরই ব্যবহার করে বোধিসত্ত্ব।

আহত মুখে রান্নাঘরে ঢুকে গেল রাখী। দুধ বসিয়েছে গ্যাসে। রান্নাঘর থেকেই কানে এল বোধিসত্ত্ব বলছে,—স্টাডিতে চলো। হাটের মাঝে কথা বলতে আমার অসুবিধে হয়।

ইচ্ছে করেই কি জোরে বলল কথাটা? রাখীকে শোনাতে?

রাখীর মুখ ছোট্ট হয়ে গেল। একটু কি অস্বাভাবিক আচরণ করছে না বোধিসত্ত্ব? ছাত্রীর সামনে স্ত্রীকে অপমান করলে যে নিজেরও সম্ভ্রমহানি হয়, এই শালীনতাবোধটুকুও কি ভুলে গেল?

রূপচাঁদ ডিপফ্রিজে ভেটকি মাছের ফিলে ঢোকাচ্ছে। রাখী হাত নেড়ে ডাকল তাকে। ফিসফিস করে বলল,—মেয়েটা আগেও এসেছে, না রে?

—আজ্ঞা।

—তুই আমায় বলিসনি তো?

—জিজ্ঞেস করেননি যে!

অকাট্য যুক্তি। যেচে কিছু বলার যে স্বভাব নেই রূপচাঁদের, রাখীর তাও অজানা নয়।

রাখী আবার প্রশ্ন করল,—রোজ আসত মেয়েটা? আমি যখন ছিলাম না…

—হ্যাঁ আজ্ঞা।

বাবুর সঙ্গে আসত?

—হ্যাঁ আজ্ঞা।

—কোথায় বসে পড়াশুনা করত? পড়ার ঘরে? না বসার ঘরে?

—ঠিক নেই। বসার ঘরেও থাকত, পড়ার ঘরেও থাকত।

—যেত কখন?

—ঠিক নেই। কখুনো আগে যেত, কখুনো রাতে খেয়ে যেত।

—খেয়ে যেত?

—আজ্ঞা। নিজের হাতেও এক দিন রান্না করেছিল। চাউচাউ।

রাখীর হঠাৎ সম্বিত ফিরল। এ কী করছে সে? নগণ্য একটা কাজের লোককে জেরা করে করে কী জানতে চাইছে? বোধিসত্ত্ব মেয়েটাকে স্নেহ করে, মেয়েটা বোধিসত্ত্বর কাছে আসতেই পারে। সারের কাছে বসে পড়াশুনোও করতেই পারে। প্রিয় অধ্যাপক একা রয়েছেন দেখে তাঁকে একদিন চাউমিন করে খাওয়ানোও এমন কিছু গর্হিত অপরাধ নয়। কিন্তু রূপচাঁদের কী ধারণা হচ্ছে রাখী সম্পর্কে? তার আধবুড়ি মালকিন বুড়ো বাবুটাকে সন্দেহ করে…? ছি ছি, রাখী কেন নিজেকে এত ছোট করে ফেলছে?

কফি নিয়ে স্টাডিরুমের দরজায় গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল রাখী। পর্দা ফেলা, ভেতরে অনুচ্চ স্বরে কথা বলছে বোধিসত্ত্ব, তার থেকেও নিচু গলায় কী যেন উত্তর দিচ্ছে দয়িতা। ছাত্রছাত্রীকে পড়ানোর সময়ে বোধিসত্ত্বর গলা এত নিচু গ্রামে থাকে কি? পড়ানো ছাড়া অন্য কী কথা বলতে পারে বোধিসত্ত্ব? পলকের জন্য রাখীর গা শিরশির করে উঠল। আবিষ্টের মতো কান পেতেছে দেয়ালে। নাহ্, কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না।

পিছনে মৃদু শব্দ। চমকে ঘাড় ফেরাতেই রূপচাঁদ। দৃষ্টি কেমন বিস্ফারিত রূপচাঁদের, যেন রাখী কোনও হিয়েরোগ্লিফিক।

তবে সন্দেহ বুঝি আরও আদিম ভাষা, আরও দুর্বোধ্য।

রাখী মরমে মরে গেল, ছেলেমানুষির একটা সীমা আছে। মুহূর্তে নিজেকে শক্ত করে ঢুকল স্টাডিরুমে।

টেবিলের দু পারে বসে আছে দুজন, মাঝে কফির ট্রে নামাল রাখী।

ট্রে রাখার সময় শব্দটা কি জোর হয়েছিল? মেয়েটা যেন কেঁপে উঠল?

রাখী চলে যেতে গিয়েও গেল না। এক অজানা তরঙ্গ যেন ঘুরছে ঘরের বাতাসে, বিকর্ষণ করছে রাখীকে, তবু জোর করে বসে পড়ল ডিভানে। এই ডিভানে কালেভদ্রে ঘুমোয় বোধিসত্ত্ব।

স্বর কোমল করে রাখী জিজ্ঞাসা করল,—তোমার সঙ্গে তো আলাপই হল না ভাল করে। বাড়ি কোথায় তোমার?

দয়িতা গলা ঝাড়ল,—কলকাতা।

—কলকাতার কোথায়?

—নর্থে। শোভাবাজার।

—কে কে আছেন বাড়িতে?

—সবাই আছে। বাবা মা…

—একমাত্র মেয়ে তুমি?

—না, ভাই আছে।

বোধিসত্ত্বর চোখ যেন টেবিল টেনিস বল। একবার দয়িতা, একবার রাখী…।

অসহিষ্ণু স্বরে বলে উঠল,—ওর বায়োডাটা জেনে তোমার কী হবে?

—এমনি। এত মিষ্টি মেয়েটা…। রাখী হাসল,—ওকে আমার খুব ভাল লাগছে।

বোধিসত্ত্ব চোখ সরিয়ে নিল,—ঠিক আছে, এবার তুমি যাও। লেট মি ফিনিশ মাই টপিক।

—ও, সরি।

রাখী উঠে সোজা শোওয়ার ঘরে চলে এল। কাপড় বদলাচ্ছে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। কাচে বিম্বিত ওই নারী এখন যথেষ্ট পৃথুলা, দুই গালে স্পষ্ট দেখা যায় বয়সের ভাঁজ, কপালে হানা দিতে শুরু করেছে বলিরেখা। দু যুগ হল বিয়ে হয়েছে তার, ছেলের কুড়ি বছর পূর্ণ হয়ে গেল, এখন কোন রন্ধ্রপথে ঢুকে পড়ার সাহস পায় কূট সন্দেহের বীজ? নিজের ওপর বেশ বিরক্ত হল রাখী। কত ছাত্রীই তো আছে বোধিসত্ত্বর, কতবার কত দেশে একাই গেছে তার স্বামী, কখনও তো তাকে পাহারা দেওয়ার কথা মনে হয়নি রাখীর। যৌবন ফুরিয়ে এলে আত্মবিশ্বাসও কি চলে যায়?

ঘরোয়া শাড়ি পরে রাখী শালে আষ্টেপৃষ্টে মুড়ে নিল নিজেকে। এটা ওটা কাজ সারছে সংসারের। বালিশের ওয়াড় বদলাল, মনে করে করে আজকের খরচের হিসেবটা লিখল ডায়েরিতে, ইস্ত্রি করা জামাকাপড় আলমারিতে গুছিয়ে তুলল…। শীতটা বাড়ছে, এবার রুমহিটার চালাতে হবে, আলমারির মাথা থেকে পাড়ল রুমহিটারটা। প্লাগ লাগিয়ে দেখে নিল যন্ত্র ঠিক আছে কিনা, তারপর বেরিয়ে এল ঘর থেকে। রূপচাঁদের সঙ্গে সঙ্গে রাতের রান্নায় হাত লাগিয়েছে।

সাড়ে আটটা নাগাদ দয়িতাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বোধিসত্ত্ব, ফিরল আধ ঘণ্টার মধ্যেই। শীতের রাত, রূপচাঁদ তাড়াতাড়িই নৈশাহারের টেবিল সাজিয়েছে, রাখী খেতে ডাকল বোধিসত্ত্বকে।

বোধিসত্ত্ব বড় গম্ভীর হয়ে আছে। রাখীর কোনও আচরণে রুষ্ট হয়েছে কি? ভয় ভয় করছিল রাখীর। জোর করে সহজ করতে চাইল পরিবেশটাকে।

স্বামীর প্লেটে স্যালাড তুলে দিতে দিতে বলল,—একটা কথা বলব?

—হুঁ।

—মেয়েটার টাইটেল কী গো?

—কোন মেয়েটা?

—ওই যে গো, তোমার ওই স্টুডেন্টটা। দয়িতা।

—কেন?

—বলো না, দরকার আছে। রাখীর চোখে রহস্য খেলে গেল। মুচকি মুচকি হাসছে,—রন্টুর বউ একটা ভাল মেয়ে খুঁজছিল। ছোট ভায়ের জন্য। তুমি তো দেখেছ ইন্দ্রনীলকে। ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, যাদবপুরের। এম বি এ করে স্টিফেনস ইন্ডিয়ার টপ এগজিকিউটিভ। বছরে মাইনেই শুধু সাড়ে তিন লাখ। ওর সঙ্গে এই মেয়েটির সম্বন্ধ করা যায় না?

বোধিসত্ত্ব চোখ তুলেই নামিয়ে নিল। বাইরের শীতলতার থেকেও হিম গলায় বলল,—তুমি আজকাল ঘটকালি করছ না কি?

—না করার কী আছে? আত্মীয়স্বজনের জন্য তো লোকে চেনাজানা মেয়েই খোঁজে। ইন্দ্রনীলদের দুবাইএ অফিস আছে, মাস কয়েকের মধ্যেই সেখানে চলে যাবে, তার আগে বিয়েটা…। মেয়েটা কী গো? ব্রাহ্মণ, না কায়স্থ?

বোধিসত্ত্বর স্বর আরও শীতল,—ছাত্রছাত্রীদের সম্বন্ধ করে বেড়ানো আমার কাজ নয়।

—তুমি কেন করবে? আমি করব। কাল এনো তো মেয়েটাকে, ঠিকানা টিকানা সব জেনে নেব।

—ও কাল বাড়ি চলে যাবে।

—ও… তাহলে নয় ক্রিসমাসের পরই…

—তোমার কি আর কোনও কাজ নেই? বোধিসত্ত্বর গলায় যেন সামান্য ঝাঁঝ—মেয়েটাকে নিয়ে পড়লে কেন? আজকালকার মেয়ে, দে ক্যান চুজ দেয়ার ওন লাইফপার্টনার।

—আমার মনে হয় না ওই মেয়ের পছন্দ করা কেউ আছে। রাখী হাসল,—যদি থাকতই, মাস্টারমশায়ের ওপর এত বেশি টান থাকত না। দেখছিলাম তো, কী মুগ্ধ চোখে তোমার কথা শুনছিল…

—উইল ইউ প্লিজ স্টপ দিস ননসেন্স? বোধিসত্ত্ব বিস্ফোরিত হল,—আমাকে শান্তিতে খেতে দেবে, না উঠে যাব?

রাখী নিশ্ৰুপ হয়ে গেল। চোরা চোখে দেখছিল স্বামীকে। সহসা যেন বদলে গেছে মানুষটার মুখচোখ। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে বোধিসত্ত্ব, খাবার খুঁটছে, এক দানাও মুখে তুলছে না।

বাইরে তীক্ষ হুইসিলের শব্দ। ইদানীং দু একটা চুরি ঘটেছে ক্যাম্পাসে, পাহারাদারির বন্দোবস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ, সন্ধে গাঢ় হলেই নাইটওয়াচম্যানরা বেরিয়ে পড়ে।

হুইসিলের শব্দটা দূরে চলে গিয়েও ফিরে এল। বাজছে রাখীর কানে। একটানা।

.

১১.

বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি সামগ্রী। মনোরম কারুকাজ করা দামি লেপ রঙে রং মিলিয়ে নামি কোম্পানির পিলোকভার, বেডশিট, চোখ ধাঁধানো মখমলের বেডকভার, তুলতুলে কম্বল, টুকটুকে শাল, বাহারি কার্ডিগান, অজস্র দেশি-বিদেশি কসমেটিক্‌স…। শাড়ি হবে কম করে ডজন খানেক। বালুচরী, জামদানি, বমকাই, কাঞ্জিভরম, নারায়ণপেট, গাদোয়াল, ঘটচোলা, চিনন সিল্ক, কলাক্ষেত্রম…! আছে বর্ণময় সালোয়ার-কুর্তা, আছে মেখলা, আছে কামনামদির নাইটি। বিয়ের কার্ডও উপস্থিত, শোভা পাচ্ছে খাটের একধারে।

আয়োজন দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিল দয়িতা। মা মাঝে মাঝেই ফোনে বলত বটে মাসির সঙ্গে কেনাকাটা করতে বেরচ্ছে রোজ, তা বলে এতদূর এগিয়ে গেছে! মাঘ মাসের ন তারিখ তো এখনও অনেক বাকি!

দয়িতা বিছানার কোণে বসে পড়ল। ক্রিসমাস ইভের সন্ধেটা পাঁশুটে ঠেকছে সহসা, ঘরে ফ্লোরেসেন্ট বাতি তেমন দ্যুতিহীন। এইমাত্র সে ক্যাম্পাসটাউন থেকে ফিরল, পথশ্রমের ক্লান্তি আছে বটে, কিন্তু এমন ঘোর ঘোর তো লাগার কথা নয়।

মণিদীপার চোখ জ্বলজ্বল করছে,—কী রে মুনিয়া, খুশি তো?

দয়িতা উত্তর দিল না।

—সবই তোর পছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে কিনেছি। রেভলনের সেট, ল্যাকমের সেট…! শুধু তোমার পারফিউম আর বেনারসিটা আমি কিনিনি, ওগুলো তুমি নিজে পছন্দ করে কিনবে।

দয়িতা এবারও উদাস।

মণিদীপা অধৈর্য হয়ে বলল,—কিছু একটা কমেন্ট কর। ভাল লাগছে, কি পছন্দ হচ্ছে না…। শাড়িগুলো চয়েসেবল হয়েছে?

দয়িতা মুখ খুলল,—এত তাড়াহুড়ো করার কী দরকার ছিল?

—কোথায় তাড়াহুড়ো! আর তো একমাসও হাতে নেই। এর পর তো নেমন্তন্নয় ছুটতে হবে। আর বাজার করার সময় পাব?

—আমি এলে করতে পারতে। যদি এখন বিয়েটাই না করি?

হুঁহ্‌, বিয়ে আবার করবে না! মণিদীপা এক গাল হাসল,—অমন ছেলের জন্য যে কোনও মেয়ের নোলা সপসপ করবে। আহা, কী ছেলে, লাখে একটা মেলে। কপাল করে এসেছিলি বটে!

দয়িতার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।

—ও হ্যাঁ, আর একটা জিনিস দেখানো হয়নি। বলতে বলতে আলমারি খুলল মণিদীপা। চ্যাপটা পিজবোর্ডের একটা বাক্স বার করেছে,—এই দ্যাখ, এই জামেওয়ারটা তোর বউভাতের, শ্বশুরবাড়ির থেকে দেবে। কালারটা খুব গর্জাস, না? টারকোয়েজ ব্লু! কাল পরশু ব্লাউজপিস কেটে শাড়িটা কবিতাদিকে ফেরত পাঠাতে হবে।

দয়িতা শাড়িটাকে ছুঁল না, শাড়িটার দিকে তাকিয়েও দেখল না। উঠে চলে যাচ্ছিল, মণিদীপা খপ করে চেপে ধরেছে হাত,—অ্যাই, তোর কী হয়েছে রে?

—ভাল্লাগছে না। গা গুলোচ্ছে।

—সে কী! শরীর খারাপ?

—না।

মণিদীপা মুচকি হাসল,—বুঝেছি, টেনশন হচ্ছে। বিয়ের আগে এরকম হয়। তোর বাবার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তো আমার সারাক্ষণ বুক কাঁপত।

—আমার বিয়েটাই করতে ইচ্ছে করছে না, মা।

দয়িতার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল চমকাতে বাধ্য হল মণিদীপা। মুখের উচ্ছল হাসি হাসি ভাব উবে গেছে, তীক্ষ্ণ চোখে নিরীক্ষণ করছে মেয়েকে। গলা একটু ভারী করেই বলল,—ইচ্ছের কারণটা জানতে পারি?

—শুনতে তোমার ভাল লাগবে না।

—তবু শুনি?

—তোমাদের চয়েসের ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়নি।

—কেন?

—সব কেনর উত্তর হয় না মা। আই ডিসলাইক হিম, ব্যস।

—যত সব ঢঙের কথা! তুমি তোমার ডিসলাইক নিয়েই থাকো এখন। বিয়ের পর বর নিয়ে আহ্লাদীপনা করলে তখন স্মরণ করিয়ে দেব। মেয়ের হাত ছেড়ে সরে যেতে গিয়েও দাঁড়াল মণিদীপা,—ও হ্যাঁ, কবিতাদি তোকে জানিয়ে দিতে বলেছে, তোদের হানিমুন হবে গোয়ায়। আই টি ডি সি-র হোটেলও বুক করা হয়ে গেছে। ভালই হল, কী বল? গোয়া তো তুই যাসনি।

দরজায় প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল দয়িতা। চোখের পলক না ফেলেই বলল,—তোমরা কি আমায় জোর করে বিয়ে দিতে চাও মা? আমার আপত্তি শুনবে না?

—ও কী অলুক্ষুনে কথাবার্তা! এখন আপত্তি থাকবেই বা কেন? তোমাকে তো না জানিয়ে কিছু ঠিক করা হয়নি!

—আমার মতামত চাওয়া হয়নি।

—অমত থাকলে জানাতেই পারতিস। তোর কাছে আমরা কোনও কথাই লুকিয়ে রাখিনি।

—এখন জানাচ্ছি।

—এখন! সমস্ত ঠিক হয়ে যাওয়ার পর?

—বিয়েটা তো হয়ে যায়নি মা। বিয়েটা আমার, আমি যখন ইচ্ছে অবজেকশান দিতে পারি। আমি যদি না চাই, তোমরা আমার ঘেঁটি ধরে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে পারবে না।

মণিদীপার দু চোখ ক্রমশ বিস্ফারিত। যেন দয়িতার কথাগুলো কানেই ঢুকছে, মগজে নয়। পায়ে পায়ে মেয়ের কাছে এল আবার। হাত রেখেছে মেয়ের কাঁধে। ধরা ধরা গলায় বলল,—কী হয়েছে আমায় খুলে বল তো মুনিয়া? পাগলামি করছিস কেন?

—আমি সুস্থই আছি। তোমরাই পাগলের মতো সাততাড়াতাড়ি সব কিছু…। রুক্ষ হতে না চেয়েও রুক্ষ হয়ে গেল দয়িতা। মণিদীপার হাত কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল—আমি এখন শুতে যাচ্ছি। ডোন্ট ডিসটার্ব মি, আমি রাতে খাবও না।

মণিদীপার গেঁথে থাকা চোখ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে দয়িতা নিজের ঘরে চলে এল। দরজা ভেজাল, আলো জ্বলিল না, গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। অবরুদ্ধ কথাগুলোকে অর্গলমুক্ত করে একটু কি মুক্তির স্বাদ পাচ্ছে দয়িতা? বুকটা ছুঁয়ে দেখল দয়িতা, হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে ধড়াস ধড়াস৷ কেন এই উত্তেজনা, একসময় না একসময় কথাটা তো বলতেই হত! এরা সব কিছু মিলিয়ে এমন জট পাকিয়ে ফেলেছে জানলে হয়তো আগেই…।

কেন সে বিয়ে করবে সৌমিককে? একটা সুন্দর অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে পারবে বলে? বছরে দুবার করে পছন্দ মতো জায়গায় বেড়াতে যেতে পারবে, সেই জন্য? দামি দামি আসবাবে সংসার সাজানোর মোহে? একটা প্রেমহীন রতিসম্ভোগের আশায়? ছি ছি, সে তো পশুর জীবন।

সব চেয়ে বড় কথা সেই মায়াবী পুরুষটাকে ভুলে যেতে হবে, যাঁর হাতে অনন্ত মহাশূন্যের চাবিকাঠি? ওই রহস্যময় মানুষটাকে ছেড়ে কোন বানানো স্বর্গে সুখ পাবে দয়িতা?

ঘরের আঁধার গাঢ়তর হচ্ছে ক্রমশ, দয়িতার সঙ্কল্পও দৃঢ় হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। চোখ বুজে অনুভব করছে বোধিসত্ত্বর স্পর্শ। শিরায়, ধমনীতে, রক্তকণিকায়, প্রতিটি রোমকূপে। তীব্র আবেগে তিনি চুম্বন করলেন দয়িতাকে, গাছের গুঁড়ি হয়ে আশ্রয় দিলেন আবিষ্ট তরুলতাকে। আগুন, মূর্তিমান বৈশ্বানর। শিশুর মতো কী খুঁজছিলেন তিনি দয়িতার দেহে? দয়িতা কি আকাশ হয়ে গিয়েছিল? অচেনা ব্রহ্মাণ্ডকে প্রাণ ভরে দেখছিলেন বোধিসত্ত্ব? সৃষ্টিরহস্যের মূলে পৌঁছতে চাইছিলেন?

অপরূপ এক প্রশান্তিতে ছেয়ে যাচ্ছিল দয়িতা। বোধিসত্ত্বই তার প্রেম, তার জীবনে প্রথম পুরুষ, তার ঈশ্বর। দয়িতা শুধুই তার ঈশ্বরে নিবেদিতপ্রাণ, সেখানে আর কারও স্থান হতেই পারে না।

—মুনিয়া, অ্যাই মুনিয়া…।

প্রবীরের গলা। ফিরল দয়িতা।

দরজা ঠেলে ঢুকে আলো জ্বালিয়েছে প্রবীর, পিছনে বুমবা।

দয়িতা চোখ কুঁচকে উঠে বসল। শালটা আলগা জড়িয়ে নিল গায়ে। অপ্রসন্ন মুখে বুমবার দিকে দৃষ্টিপাত করল। কী বুঝল কে জানে, সব সময়ে বড় বড় হাবভাব করা বুমবাও থতমত মুখে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

প্রবীর বিছানায় এসে বসল। দয়িতার সামনে। একটু লঘু সুরেই বলল,—মা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে…কী ভয় দেখিয়েছিস মাকে?

—ভয় তো দেখাইনি। দয়িতার স্বরে এখন আর কোনও জড়তা নেই,—আমার মনের কথা সাফ বলে দিয়েছি।

—প্রবলেমটা কী? হোয়াটস রং উইথ সৌমিক?

—সে তুমি বুঝবে না বাবা।

—বোঝাও। যদি আমায় কনভিন্স করতে পারো, আমি তোমার পাশে থাকব।

—আমাদের মেন্টাল লেভেল এক নয় বাবা।

—তুমি জানলে কী করে? তুমি কি তাকে মিট করেছ?

—করেছি। আমার তাকে পছন্দ হয়নি।

একটু বুঝি থমকে গেল প্রবীর। তারপর বলল,—কবে দেখা করেছিস?

—অনেক দিন আগে। প্রথম যখন বিয়েটা ঠিক হয়েছিল।

—তখনই বলিসনি কেন?

—তোমরা তো কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করোনি বাবা। আমার যে একটা মতামত আছে, আমি যে সাবালিকা হয়েছি, এ সব কথা তোমাদের মনেই হয়নি।

—শুধু এই কারণেই ওয়েট করছিলি? আমাদের অকওয়ার্ড সিচুয়েশানে ফেলার জন্য? প্রবীরের হালকা স্বর ক্রমশ ভারী,—সেবারের পরেও দু দুবার তুই কলকাতায় এসেছিস, আমরা তোর সঙ্গে ফোনে রেগুলার কথাও বলেছি…।

দয়িতা চুপ করে রইল।

প্রবীর সিগারেট ধরাল। অপাঙ্গে দেখছে মেয়েকে। নীরস স্বরে বলল,—সৌমিকের শর্টকামিংসটা কি জানতে পারি? আমি নিজে সৌমিকের সঙ্গে মিশেছি, ও যে শুধু এক্সটারনালি ভাল তা নয়, অ্যাট হার্টও সৌমিক ইজ আ নাইস চ্যাপ।

দয়িতা এখনও চুপ।

প্রবীর গলা নরম করে বলল,—দ্যাখ মুনিয়া, বিয়ের আগে থেকেই একটা ছেলে একটা মেয়ের মেন্টাল লেভেল এক হবে, এটা টু মাচ অব এক্সপেক্টেশান। হয় না, হতে পারে না। আফটার অল দুজনে দুটো আলাদা আলাদা পরিবারে বড় হয়ে ওঠা মানুষ তো। এই ধর না, আমি আর তোর মা। বিয়ের আগে আমরা তো এক ছাঁচের মানুষ ছিলামই না, এমনকি বিয়ের পরও নেই। এখনও তো কত কিছু আমাদের মেলে না। এই ঠাকুরদেবতা গুরুদেব… তোর মা মানে, আমি মানি না। তা সত্ত্বেও কি আমরা এক সঙ্গে থাকি না? ডু উই লুক আনহ্যাপি কাপল? বরং বলতে পারি, উই আর দা বেস্ট অফ পেয়ারস। যে যার মতে চলি, কিন্তু সংসারের সঙ্কটে এক সঙ্গে থাকি। সৌমিকের মধ্যে এই গুণটা আছে, আই ক্যান অ্যাশিওর ইউ। সৌমিক খুব অ্যাডজাস্টেবল ছেলে।

দয়িতা মনে মনে বলল, ব্যক্তিত্বহীন।

মুখে বলল,—হাজারটা খরগোশ জোড়া লাগিয়েও ঘোড়া হয় না বাবা। পছন্দ অপছন্দ তো ভেতরের জিনিস, সে কি তোমার যুক্তি মেনে চলে?

—এ কথা তো বললে চলবে না মুনিয়া। যুক্তিগ্রাহ্য কোনও কারণ না থাকলে আমাদের কথা তোমায় মানতেই হবে। অন্তত এই মুহূর্তে, যখন আমাদের আর ফেরার পথ নেই। তুমি দেখেছ বিয়ের কেনাকাটা হয়ে গেছে, ফার্নিচারের অর্ডার আমি দিয়ে এসেছি, তোমার মা গয়না গড়াতে দিয়ে দিয়েছে, এবং নিজের চোখে পর্যন্ত দেখেছ বিয়ের কার্ডও ছাপা হয়ে গেছে। তোমার রায়গড়ের মামা, কানপুরের পিসি, সকলের কাছে চিঠিও পোস্ট করা হয়ে গেছে…। সুবীর শুধু তোমার বিয়ে উপলক্ষেই অত দূর থেকে আসছে। বাসুদেববাবুরাও কত খরচাপাতি করে ফেলেছেন…

দয়িতার অস্বস্তি হচ্ছিল। বাবা যেন কথার পাকে পাকে জড়িয়ে ফেলছে তাকে, দুর্বল করে দিচ্ছে। বন্ধ জানলার কোনও এক ফাঁক দিয়ে কনকনে বাতাস আসছে, তবু যেন গরম লাগছে দয়িতার। ক্রুদ্ধ বাবার চেয়ে অসহায় বাবার সঙ্গে লড়া অনেক বেশি কঠিন, দয়িতার মনে হচ্ছিল।

খানিক ইতস্তত করে দয়িতা বলল,—ওদের অসুবিধে হবে কেন বাবা? অন্য কোনও মেয়ে দেখে ছেলের বিয়ে দিয়ে দেবে, তাকেই না হয় ও সব জিনিস…

—আর সৌমিকের স্যুটের অর্ডার যে দেওয়া হয়ে গেছে, তার কী হবে? মণিদীপা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে পিতাপুত্রীর কথা গিলছিল, বাজপাখির মতো ধেয়ে এসেছে ঘরে,—আংটি? ঘড়ি? বোতাম? পাঞ্জাবি? ওগুলো কি বুমবা পরে ঘুরবে?

চরম থমথমে পরিবেশেও দয়িতার হাসি পেয়ে গেল। মার সমস্ত শোক এখন শুধু ওইটুকু অপচয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে! এমনটাই বুঝি হয়। বড় বড় দুঃখের সময়ে অতি তুচ্ছ কারণ নিয়ে বিলাপ করে মানুষ।

মণিদীপা ছাড়ার পাত্রী নয়। প্রবীরকে বলল,—ওকে পাত্তা দিয়ো না তো। বেশি দিগ্‌গজ হয়ে বেশি পাখনা গজিয়েছে, না?

—আহ্, তুমি যাও তো। মণিদীপাকে প্রায় ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দিল প্রবীর। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে আবার বসেছে মেয়ের পাশে। বন্ধুর স্বরে বলল,—দেখছিস তো, তোর মা কেমন খেপে গেছে! মন থেকে সব ঝেড়ে ফ্যাল, নরমাল হ।

দয়িতা কষ্ট করে হাসল,—প্লিজ বাবা, এ বিয়ে আমি করতে পারব না।

—তুই আমাদের মানসম্মানের কথাও ভাববি না মুনিয়া? প্রবীরের দু চোখ করুণ হয়ে গেল। যেন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির জাঁদরেল অফিসার প্রবীর মিত্র নয়, যেন এক দীনহীন বাপ মেয়ের কাছে ভিক্ষে চাইছে,—আমাদের মুখটা তুই রাখ মুনিয়া।

—তুমিও কেন বুঝছ না বাবা, আমার পক্ষে সৌমিককে বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমার উপায় নেই।

প্রবীরের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। মুখ চোখের ভাষা বদলে গেছে। গলার স্বরও,—তুই কি আর কাউকে ভালবাসিস?

দয়িতা চমকে বাবার দিকে তাকাল। পরক্ষণে মাথা নামিয়ে নিয়েছে। মৃদু স্বরে বলল,—হুঁ।

—কে সে?

উত্তর নেই।

—আমাদের চেনা কেউ?

—না।

—তোর ইউনিভার্সিটির ছেলে?

—না।

—তা হলে কলকাতার?

—না।

—তবে কে সে?

আবার দয়িতার মুখে শব্দ নেই।

এতক্ষণে বুঝি প্রবীরেরও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল,—হেঁয়ালি করছিস কেন? যাকে ভালবাসিস তাকে নিয়ে আয়।

দয়িতার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,—তাকে আনা যাবে না।

—কেন, সে কি হিমালয় পর্বত?

দয়িতা আবার চুপ করে গেল। মনে মনে বলল, তার চেয়েও বড়।

প্রবীর সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল,—কী করে সে? রাস্তার লোফার টোফার নাকি?

দয়িতা মুখে কুলুপ এঁটে রইল। মনে মনে বলল, ছি বাবা, ও কথা বললে তোমার জিভ খসে যাবে।

প্রবীর আর থাকতে পারল না, বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। পায়চারি করছে ঘরে। উত্তেজিত স্বরে গজগজ করছে,—আমি বুঝতে পারছি না হোয়াট ননসেন্স ইজ গোয়িং অন! আমাদের পছন্দ করা ছেলেকে তুমি বিয়ে করবে না, তোমার পছন্দের ছেলেকে তুমি নিয়ে আসবে না, তা হলে ডেডলক অবস্থাটা কাটবে কী করে? আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শিদের যে বলব বিয়েটা ভেঙে দিচ্ছি, তার তো একটা গ্রাউন্ড লাগবে, না কি?

দয়িতা পুট করে বলে উঠল,—ছেলেটার নামে যা হোক কিছু রটিয়ে দাও। বলে দাও, আগে জানতে না, এখন জেনেছ!

—ছিঃ, ছি মুনিয়া, একটা নিরীহ ভাল ছেলের নামে আমি বদনাম রটাব, এই পরামর্শ দিচ্ছ? এই শিক্ষা পেয়েছ তুমি?

প্রবীরের ধিক্কার তীক্ষ্ণ শলাকার মতো বিঁধল দয়িতাকে। একটুক্ষণ মাথা হেঁট করে রইল দয়িতা। তারপর ভার গলায় বলল,—তা হলে সত্যি কথাটাই বোলো বাবা। বোলো, তোমার মেয়ে অন্য কাউকে ভালবাসে, সে এ বিয়ে করতে চাইছে না।

প্রবীর মেয়ের পাশে এসে বসল আবার। হাত রাখল মেয়ের মাথায়,—লোক জানাজানির দরকারটা কী? কাকে তুই ভালবাসিস আমায় খুলে বল, আমি তার সঙ্গেই তোর বিয়ে দেব। হ্যাঁ, বাসুদেববাবুদের কাছে আমাদের একটু ছোট হতে হবে, কিন্তু কী আর করা…! বুঝছিসই তো, অলরেডি লাখ টাকার ওপর খরচা হয়ে গেছে…খেটে রোজগার করা পয়সা…

প্রবীরের স্পর্শে বুকটা টলমল করে উঠল দয়িতার। ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলল,—তার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে না বাবা। হতে পারে না।

—কেন?

দয়িতার গলা কেঁপে গেল,—হি ইজ অলরেডি ম্যারেড।

—মানে? চাবুক খেয়ে যেন ছিটকে সরে গেল প্রবীর,—তুই একটা বিবাহিত লোকের সঙ্গে প্রেম করছিস? ভেবেছিস কী তুই, অ্যাঁ? স্বাধীনতা দিয়েছি বলে মাথায় চড়ে বসেছিস? এটা স্বাধীনতা, না স্বেচ্ছাচার? তোর এত বড় আস্পর্ধা, সেটা আবার তুই আমার সামনে উচ্চারণ করিস?

দয়িতা মিনমিন করে বলল,—আমি তো বলতে চাইনি বাবা, তুমি জোর করলে।

—ফের কথা। চুপ চুপ। প্রবীর গর্জে উঠল,—কে সেই লোক, যে আমার মেয়ের সঙ্গে অ্যাডাল্টারি করছে? আমি পুলিশে খবর দেব, তার কোমরে দড়ি দিয়ে রাস্তায় ঘোরাব…

প্রবীরের চিৎকারে মণিদীপা আর বুম্‌বাও ছুটে এসেছে ঘরে। তাদের উপেক্ষা করে দয়িতা বেপরোয়ার মতো বলে উঠল,—যাকে চেনো না, তার সম্পর্কে তুমি উলটোপালটা কথা বলতে পারো না বাবা। আমি তাকে ভালবাসি, সেটা আমার ব্যাপার। তাকে জড়াচ্ছ কেন?

ক্রোধে বিমূঢ় হয়ে গেছে প্রবীর, মুখে আর কথা ফুটছে না।

মণিদীপা হাউমাউ করে উঠল,—কী হয়েছে গো? কাকে কী জাড়ানোর কথা হচ্ছে?

—আর কী, আমাদের বংশের মুখে চুনকালি পড়ে গেল। প্রবীরের গলা ঘড়ঘড় করে উঠল,—তোমার গুণধর মেয়ে কোন এক বিয়েথা করা বজ্জাতের সঙ্গে প্রেম করছে। সেই জন্যই তিনি বিয়ে করতে পারবেন না।

—ও মা, এ কী সর্বনেশে কথা গো! মণিদীপা ডুকরে উঠল, মেয়েকে ঝাঁকাচ্ছে দু হাতে,—এই মুনিয়া, কী বলছিস তুই…!

দয়িতার আর লজ্জাসংকোচ নেই। দ্বিধা কেটে গেছে তার, স্পষ্ট গলায় বলল,—তোমরা এমন করছ, যেন এই ঘটনা পৃথিবীতে প্রথম ঘটল? হ্যাঁ, আমি একজনকে ভালবাসি। ইন্সিডেন্টালি অর অ্যাক্সিডেন্টালি হি ইজ ম্যারেড। যেহেতু একজন বিবাহিত লোককে বিয়ে করা আইন পারমিট করে না, সেহেতু আমি বিয়েই করব না। এতে তোমাদের এত গায়ে লাগছে কেন? আমি কীভাবে আমার জীবনটাকে লিড করব, সেটাও কি আমার বেছে নেওয়ার অধিকার নেই?

—চোওওপ। যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা। বুনো ষাঁড়ের মতো তেড়ে এল প্রবীর। এখন তার আর হিতাহিত জ্ঞান নেই, সপাটে চড় কষিয়েছে মেয়েকে। দাঁত দাঁত ঘষে বলল,—তোমার ভালবাসা আমি ঘুচিয়ে দেব। কোনও বাঁদরামি আমি সহ্য করব না। সৌমিককেই তোমায় বিয়ে করতে হবে। আজ থেকে তুমি বাড়ি থেকেই বেরোবে না। টিল ইওর ম্যারেজ।

খাটের কোণে ছিটকে পড়েছিল দয়িতা। বুঝি বা বাবার চণ্ডমূর্তিতে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্ত। কখনও কোনওদিন বাবা তার গায়ে হাত তোলেনি, আজই প্রথম…। হতচকিত দশা কাটিয়েই ফুঁসে উঠেছে আবার,—তোমরা কি ভেবেছ ফোর্স করে আমার বিয়ে দেবে? পারবে না।

—দেখি পারি কি না। দেখি তোর কোন লাভার আটকায়!

—লাভার আটকাবে কেন? আমিই আটকাব। আমিই পুলিশে খবর দেব। দেখব একটা সাবালিকা মেয়েকে কী করে বিয়েতে বসাও।

—শুনছ? শুনছ? মেয়ের কথা শুনছ?

—কিছু বলার নেই, কিচ্ছু বলার নেই…। মণিদীপা কেঁদে ফেলল,—এই মেয়েকে আমি গর্ভে ধারণ করেছিলাম? কেন আঁতুড়েই নুন খাইয়ে মেরে ফেলিনি।

—ও মরে গেছে। আমার চোখে মরে গেছে। আজ থেকে ভাবব আমার মেয়ে নেই। বলতে বলতেই আবার প্রবীর তেড়ে এসেছে মেয়ের দিকে। আগুনের গোলার মতো বনবন ঘুরছে তার দু চোখ,—স্বাধীনতা দেখাচ্ছ? সাবালিকা দেখাচ্ছ? আমারই পয়সায় খাবে, আর আমারই বুকে বসে দাড়ি ওপড়াবে? শে-এ-ষ বারের মতো বলছি, মুনিয়া…

শেষ বারের মতো কী বলছে প্রবীর শোনা হল দয়িতার। বুমবা টেনে সরিয়ে নিয়ে গেছে বাবাকে।

—ছি ছি ছি ছি মুনিয়া, তুই তাহলে এএই! মণিদীপা দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝখানে, দু দিকে মাথা ঝাঁকাচ্ছে,—তোর বাবা তোকে কত ভালবাসে, তাকে তুই এইভাবে আঘাত দিলি? তোর নরকেও ঠাঁই হবে?

বুম্‌বার গম্ভীর স্বর শোনা গেল,—মা, চলে এসো।

প্রবল ঝড়ের পর নিথর হয়ে গেছে গোটা বাড়ি। যেন শ্মশানভূমি। কিংবা কবরখানা। আধুনিক ফ্ল্যাটজীবনের সুবিধে আছে, কেউ কারও অন্দরমহলে উঁকি দেয় না, এই চিৎকার কান্নাতেও টনক নড়েনি কোনও প্রতিবেশীর। হয়তো তারা আড়ালে ফিসফিস করবে, তবে মুখে কিছু বলবে না। আজ অবশ্য সেই সম্ভাবনাও কম, আনন্দের ফোয়ারা ছুটছে বাইরে। পাশের ফ্ল্যাটে ক্রিসমাস ইভের পার্টি চলছে, হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে হর্ষধ্বনি। দেয়াল ফুঁড়ে আসা ওই আওয়াজ আঘাত করছে এ ফ্ল্যাটের নৈঃশব্দ্যকে, আরও প্রকট হয়ে উঠছে শব্দহীনতা।

দয়িতা বসে আছে, বসেই আছে। যেন সে এক দারুভূত প্রতিমা, নড়বেই না কোনওদিন। চোখের কোলে শুকনো জলের রেখা, গা থেকে খসে পড়া শাল লুটোচ্ছে বিছানায়, তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে কনকনে হাওয়া। এখন আর শীত তাপ কোনও কিছুরই অনুভূতি নেই দয়িতার।

রাতটা কেটে গেল। কী করে কাটল দয়িতা নিজেও জানে না। মগ্ন চৈতন্যের ওপার থেকে বুম্‌বা বুঝি ডেকেছিল একবার, খেতে বলেছিল, দয়িতা সাড়াও দেয়নি। একসময়ে জড়িয়েও এসেছিল দু’ চোখ, অজান্তেই।

তন্দ্রা ছিঁড়তেই টানটান হল দয়িতা। পলকের জন্য বোধিসত্ত্বর মুখটা মনে পড়ল। পরক্ষণে বাবা-মার মুখ, কালকের ঘটনার অনুপুঙ্খ। ফোঁস ফোঁস করে বড় বড় কয়েকটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, আপন মনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল কিছুক্ষণ।

…নাহ্, বোধিসত্ত্বকে ছাড়া দয়িতা বাঁচবে না…

অচঞ্চল পায়ে বাথরুম থেকে ঘুরে এল দয়িতা। কালকের কিটসব্যাগটা বিছানাতেই পড়ে আছে, এখনও খোলা হয়নি, ওয়ার্ড্রোব থেকে আরও দুটো সালোয়ার কামিজ বের করে চেপে চেপে ভরে নিল তাতে। শান্ত মাথায় টেবিল চেয়ারে বসে চিঠি লিখল একটা। বাবার উদ্দেশে। সে যে ক্যাম্পাস টাউনেই ফিরছে, সেটা বাড়ির লোকের জানা দরকার, না হলে থানা পুলিশের হুজ্জোত হতে পারে। তা ছাড়া যাদের সে কোনওভাবেই সুখী করতে পারল না, তাদের উতলা করে কী লাভ!

চিঠিটাকে টেবিলে খোলা অবস্থায় রেখে দয়িতা কিটসব্যাগ কাঁধে তুলে নিল। মায়াভরা চোখে ক্ষণিক তাকিয়ে রইল বিছানার দিকে, ঘরটাতেও চোখ বুলোল। আর হয়তো কোনওদিনই এখানে ফেরা হবে না।

ড্রয়িংস্পেসে এসেও পা আচমকা মাটিতে গেঁথে গেল দয়িতার। বাড়ির সকলে এখন গাঢ় ঘুমে। দয়িতা চোখ বুজে কান খাড়া করল। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায় কি?

বাঁ হাতের চেটোয় চোখের কোণ মুছে নিল দয়িতা। নিঃসাড়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল।

দয়িতার সামনে এখন এক অন্ধকারমাখা ভোর। কুয়াশায় ঢাকা।

.

১২.

স্লিপ পাঠিয়ে হোস্টেলের বাইরের গেটে অপেক্ষা করছিল সৌমিক। সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা টেনশানেও ভুগছিল। দুম করে এভাবে চলে আসাটা কি উচিত হল তার? যদি এখন দয়িতা দেখা না করে? যদি দরজা থেকেই হাঁকিয়ে দেয়?

বছরের শেষ দিন আজ। জব্বর ঠাণ্ডায় কলকাতার চেয়েও শীতটা এখানে অনেক বেশি, সম্ভবত খোলামেলা বলেই। প্রায় একটা বাজে এখন, অর্থাৎ প্রখর মধ্যাহ্ন, অথচ রোদ্দুরের তেজ দেখে তা টের পাওয়ার উপায় নেই, কেমন যেন মরা মরা ভাব। তাপ নেই, শুধু রংটাই আছে। বইছে হিমমাখা কনকনে হাওয়া, জামা সোয়েটার ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে হাড়গোড়ে। ঠাণ্ডার ঝাপটায় চারদিকের গাছপালা কাঁপছে ঠকঠক।

প্রতীক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত অনন্ত দীর্ঘ মনে হয়। মাত্র পাঁচ মিনিটেই হাঁপিয়ে উঠেছিল সৌমিক, ঝোঁকের মাথায় ছুটে আসার মূর্খামির জন্য নিজেকেই ধমকাচ্ছিল। এমন সময়ে ফিরল মহিলাটি।

দরজা থেকেই ঘোষণা করল,—দয়িতা মিত্র নেই।

সৌমিক এগিয়ে গেল। সন্দিগ্ধ স্বরে বলল,—তা কী করে হয়? হোস্টেলেই তো থাকার কথা।

—একটু আগেও ছিল। এখন ঘর তালাবন্ধ।

—গেছে কোথায়?

—বলতে পারব না।

—আপনাদের…খাবার ঘরে নেই তো?

—মেয়ে কম, খাওয়া দাওয়া অনেকক্ষণ চুকে গেছে।

—ও।

—এলে কিছু বলতে হবে?

সৌমিক একটুক্ষণ ভাবল। যদি দেখাই না হয়, মিছিমিছি আগমনবার্তা জানিয়ে লাভ কী? নিজেকে কী তাতে আরও খেলো করা হবে না? এমনিতেই হয়তো দয়িতা হাসছে মনে মনে, বিয়ের শখ উথলে ওঠা ছেলেটাকে জব্দ করতে পেরেছে বলে…।

গলা ঝাড়ল সৌমিক—থাক, দরকার নেই।

—আপনি আসছেন কোথ্‌থেকে?

যাক, শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা করেছে তা হলে! সৌমিক উত্তর দিল না, ঘুরে হাঁটা শুরু করল। অন্যমনস্ক মুখে, ফাঁকা চোখে। টানটান স্নায়ুতন্ত্রী ঝিমিয়ে পড়েছে সহসা। সেই কোন ভোরে ওঠা, এতটা পথ আসা, এত আশঙ্কা উদ্বেগ প্রশ্ন উত্তেজনা, সবই অর্থহীন মনে হচ্ছে এখন। দয়িতা মিত্র প্রত্যাখ্যান করেছে বলে কি সৌমিক বসুরায়ের জীবন অন্ধকার হয়ে গেল? ফুঃ। আছেটা কী দয়িতার মধ্যে? রূপ? গুণ? ফিগার? স্মার্টনেস? সবেতেই তো মেরে কেটে অ্যাবাভ অ্যাভারেজ। সৌমিক টুসকি বাজালে ওর থেকে ঢের ঢের গুণবতী মেয়ে সৌমিকের দরজায় লাইন লাগাবে। তা হলে সৌমিক সত্যিই এল কেন? কবিতা বসুরায় তো বলেইছে, ওই বিশেষ দিনে যেখান থেকে হোক এক হুরিপরি জোগাড় করে আনবে…।

কথাটা মনে পড়তেই সৌমিকের গা গুলিয়ে উঠল। আবার সেই কবিতা বসুরায়ের চক্কর! একটি বারের জন্য হলেও সে কবিতা বসুরায়ের পাতা ফাঁদে প্রলুব্ধ হয়েছিল, ওই মেয়ে পুতুলখেলার আয়োজন লাথি মেরে ভেঙে দিয়েছে। শুধু এই জন্যই তো দয়িতার কাছে সৌমিকের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু সেই বোধই বা জাগে কই! উলটে এক হীনম্মন্যতাবোধ সর্বক্ষণ কুরে কুরে খেয়ে চলেছে সৌমিককে। বুক আচ্ছন্ন হয়ে আছে তীব্র অপমানে। ঝোড়ো মেঘের দাপাদাপি চলছে সেখানে, গর্জন বাজছে, বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে…। এক এক বার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে সামনে পেলে গলা মুচড়ে মেরে ফেলে, পরক্ষণে এক অন্তিম হাহাকারে ছেয়ে যাচ্ছে হৃদয়। কান্না পাচ্ছে সৌমিকের।

কেন এমন হল সৌমিকের? কী হল?

সৌমিক হাঁটছে। উদ্দেশ্যহীন। শরীর ছেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ, পেট চুঁইছুঁই করছে। ইউনিভার্সিটির মেন গেটের সামনে এসে এদিক ওদিক দেখল। পথ প্রায় সুনশান, একটি পড়ুয়াও চোখে পড়ে না। ছুটি বলেই কি? এত ঝকঝকে রাস্তাঘাট, সার সার বৃক্ষরাজি, এত সুন্দর সুন্দর ছড়ানো ছেটানো বিল্ডিং, সবই বড় নিঝুম। দেখে মনে হয় কোনও জাদুছোঁয়ায় ঘুমিয়ে আছে জায়গাটা। এই নিদ্রিত পুরীতে কোথায় একা একা ঘুরে মরছে দয়িতা?

মেন গেট ছাড়িয়ে খানিক গেলে চায়ের দোকান। খদ্দেরহীন ফাঁকা বেঞ্চি হু হু করছে, ঝাঁপের ভেতর আলোয়ান মুড়ি দিয়ে ঢুলছে দোকানদার।

সৌমিক পায়ে পায়ে দোকানে এল,—চা হবে ভাই?

—শুধু চা?

—আর কী আছে?

লোকটা চোখ কচলাল,—রুটিটোস্ট হবে। ডিমভাজা হবে। বিস্কুট আছে…

—টোস্ট ডিমভাজাই দাও। সৌমিক বেঞ্চিতে বসল,—আগে এক কাপ চা।

স্টোভ জ্বালিয়ে কেটলি বসাল লোকটা। ডিম গুলছে বাটিতে, পেঁয়াজ লঙ্কা কুচোচ্ছে। রাস্তা কাঁপিয়ে, ধুলো উড়িয়ে একটা ট্রাক ছুটে গেল। উড়ন্ত ধুলো থিতিয়ে আসার আগেই সৌমিকের চোখের মণি স্থির। দয়িতা না?

হ্যাঁ, দয়িতাই তো। ইউনিভার্সিটি মেনগেটের পাশের ছোট্ট দরজাটা দিয়ে বেরিয়েছে দয়িতা, মাথা নিচু করে হোস্টেলের দিকে চলেছে। পরনে কালো জিনস্‌, গায়ে কালো শাল, চুল খোলা। যেন মূর্তিমতী শোকপ্রতিমা।

সৌমিক কিছুতেই সুস্থির বসে থাকতে পারল না। চেঁচিয়ে ডাকল—দয়িতা?

দয়িতা চমকে দাঁড়াল। চোখ কুঁচকে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। সৌমিককে চিনতে যেটুকু সময় লাগল সেটুকুই বুঝি স্থাণু ছিল দয়িতা, তারপর এগিয়ে এল অনাড়ষ্ট ভঙ্গিতে। ভুঁরু বেঁকিয়ে কৈফিয়তের সুরে জিজ্ঞাসা করল,—তুমি এখানে?

সরাসরি আপনি থেকে তুমি। সম্ভাব্য সম্পর্ক ছিঁড়ে যাওয়ার সূত্রেই কি এই তাচ্ছিল্য?

সৌমিকের গলা আপনা-আপনি তেতো হয়ে গেল,—বুঝতেই পারছ কেন এসেছি।

—না, বুঝলাম না।

কথা সাজানোই ছিল, সৌমিক অভিভাবকের সুরে উগরে দিল,—তুমি কিন্তু ভারী অন্যায় কাজ করেছ।

—কী অন্যায়? কীসের অন্যায়? আমার জীবন আমার মতো করে চালাব, এতে ন্যায় অন্যায়টা কী আছে শুনি?

কী তেজ! কী ঔদ্ধত্য! স্বাভাবিক নার্ভাসনেসটা উবে গেল সৌমিকের। রুক্ষ স্বর বেরিয়ে এল,—বলতে চাও, তোমার ওভাবে বাড়ি থেকে চলে আসাটা ঠিক কাজ হয়েছে? জানো, তোমার বাবা-মার কী অবস্থা এখন!

—অনুমান করতে পারি। কিন্তু আমি হেল্পলেস। ওদের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়ে চলা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

—তুমি আমায় বলতে পারতে। আমিই নয় বিয়েটা…

—তুমি বিয়ে ভেঙে দিতে? দয়িতার ঠোঁট বেঁকে গেল,—আমি তোমায় অ্যাপ্রোচ করিনি?

—সে তো কপট অ্যাপ্রোচ। সৌমিক ফস করে বলে ফেলল,—তুমি আমায় মিথ্যে বলেছিলে।

—মিথ্যে?

—নয়? আমি তোমাকে স্পেসিফিকালি জিজ্ঞেস করিনি, তুমি কাউকে পছন্দ করো কি না? তুমি না বলেছিলে বলেই না আমি…। কথাগুলো বলতে পেরে অনেকটা যেন তৃপ্তি বোধ করল সৌমিক। হাত উলটে বলল,—নিজে দোষ করলে, আর শাস্তি পাচ্ছে বাবা-মা! আশ্চর্য!

—ডোন্ট টক লাইক এ গুরুঠাকুর। দয়িতা তর্জনী নাড়াল,—আমি পছন্দ করি না।

চা বানিয়ে ডাকছে লোকটা। ঘুরে গিয়ে গ্লাস হাতে নিল সৌমিক। খানিক তফাত থেকে নিষ্পলক চোখে দেখছে দয়িতাকে। ওই রাগ রাগ মুখেও কী অপরূপ শিশুর সারল্য। বিচিত্র এক মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল সৌমিক। মেয়েটা নেশার মতো টানছে, এখনও! বোকা বোকা মুখে হাতের গ্লাস নেড়ে জিজ্ঞাসা করল দয়িতাকে চা খাবে কি না, অবাধ্য ঘোটকীর মতো দু দিকে মাথা নাড়ল দয়িতা।

নরম গলায় সৌমিক ডাকল,—ঠিক আছে, খেতে হবে না। এ দিকে এসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

দয়িতা এল বটে, তবে বেশ খানিকটা ব্যবধান রেখে দাঁড়াল। অবজ্ঞার স্বরে বলল,—আমার কিন্তু তোমার সঙ্গে কোনও কথা নেই।

সৌমিক মনে মনে বলল, জানি তো।

ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,—বাবা-মার সঙ্গে তুমি মিটমাট করে নাও। আমাকে তোমায় বিয়ে করতে হবে না।

দয়িতা কূট চোখে তাকাল,—তুমি কি বাবা-মার দূত হয়ে এসেছ?

—না। কেউ জানেই না আমি এখানে এসেছি।

—ও। মহৎ সাজার শখ হয়েছে?

টিটকিরিটা হজম করে নিল সৌমিক। এর চেয়ে অনেক বড় অপমানই তো সে আত্মস্থ করেছে। নয় কি? গলা নামিয়ে বলল,—আমার কিছু সাজারই বিন্দুমাত্র শখ নেই। আমি শুধু চাই আমাকে কেন্দ্র করে একটা ফ্যামিলিতে বাবা-মার সঙ্গে মেয়ের রিলেশান নষ্ট না হোক।

—ধন্যবাদ। আমার সঙ্গে আমার বাবা-মার কী রিলেশান হবে, সেটা আমিই বুঝে নেব। এ ব্যাপারে বাইরের লোকের নাক গলানোর প্রয়োজন নেই।

কথাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে বলল দয়িতা, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাঁটা দিয়েছে। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুক ভারী হয়ে এল সৌমিকের। অর্থহীন মন-কেমন করা, যুক্তিহীন বিষাদ। দয়িতার কাছ থেকে অন্য কোনও ব্যবহার কি প্রত্যাশিত ছিল? সৌমিক কি ভেবেছিল তাকে দেখে উদ্বাহু নৃত্য করবে দয়িতা?

টোস্ট অমলেট রেডি। সৌমিককে ডাকছে লোকটা। বেঞ্চিতে এসে বসল সৌমিক। খিদে মরে গেছে, জিভ বিস্বাদ। পাউরুটির কোণ খুঁটল একটু, মুখে তুলতে পারল না। প্লেট সরিয়ে পার্স বের করল,—কত হয়েছে ভাই?

—খেলেন না যে?

—ভাল্লাগছে না।

লোকটা চোখ পিটপিট করল,—চার টাকা দিন।

দাম মিটিয়ে উঠে পড়েছে সৌমিক, আবার দয়িতা। যেভাবে হনহন চলে গিয়েছিল, সেভাবেই ফিরে আসছে গটগটিয়ে। সৌমিকের সামনে এসে ঝপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল,—অ্যাই, তুমি কি শুধু বাবা-মার কথা শোনাতে এসেছিলে?

সৌমিক থমকে গেল। সত্যি তো, কী কথা বলতে এসেছিল সে? তার ছুটে আসাটা তো নেহাতই এক অন্ধ আবেগের তাড়না। কেন দয়িতা বিয়েটাকে এগোতে দিয়েও ভেঙে দিল, কেন তাকে শুধুমাত্র অপমান করল, এ সব প্রশ্ন আর করার কি কোনও মানে হয়? আসল সত্যিটা হল, সে মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলেছে, পতঙ্গের মতো ছুটে এসেছে আগুনের দিকে। কিন্তু এ কথাও কি আর উচ্চারণ করা যায়?

সৌমিক ঢোক গিলে বলল,—যা বলার তুমি তো বলেই দিয়েছ। আমার আর কী বলার থাকতে পারে?

কথাটায় চোরা ক্ষোভ ছিল, বুঝি অনুভব করতে পারল দয়িতা। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। তারপর হাঁটা শুরু করল। পাশাপাশি।

অপাঙ্গে এক ঝলক সৌমিককে দেখে নিয়ে হঠাৎ নরম গলায় বলল,—আমি বুঝতে পারছি কাজটা আমার ঠিক হয়নি। তুমি হিউমিলিয়েটেড ফিল করছ। তোমার জায়গায় আমি থাকলে আমিও হয়তো…। সরি, আয়াম এক্সট্রিমলি সরি।

সৌমিক নীরব।

দয়িতা আবার একটু সময় নিয়ে বলল,—তুমি খুব ভাল ছেলে সৌমিক। তোমাকে রিজেক্ট করার কোনও কারণ আমার কাছে নেই। কিন্তু কোনও কোনও ব্যাপারে মানুষ কখনও কখনও খুব অসহায় হয়ে পড়ে। আয়াম রিয়েলি হেলপ্‌লেস।

প্রায় বিড়বিড় করে সৌমিক প্রশ্ন করে ফেলল,—ভাগ্যবানটি কে জানতে পারি?

দয়িতা ঝটিতি মুখ তুলেছে। ভুরু কুঁচকে সৌমিককে দেখে নিল একটু। তারপর বলল,—তোমাকে বলাই যায়। ইউ হ্যাভ সাম রাইট টু নো। আমি একজন অধ্যাপককে ভালবাসি। প্রফেসার বোধিসত্ত্ব মজুমদার। নামটা শুনেছ?

—সেই বিজ্ঞানী? কদিন আগে কাগজে যাঁর বিরাট ইন্টারভিউ বেরিয়েছিল?

—হুঁ। শুধু বিজ্ঞানী নন, তিনি একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী।

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল সৌমিক—কিন্তু তিনি তো অনেক সিনিয়ার লোক। এজেড মানুষ।

—ভালবাসার সঙ্গে বয়সের কী সম্পর্ক? দয়িতার স্বরে সামান্য বিরক্তি যেন,—তিনি মোটেই বুড়ো নন। ফিজিকালি মেন্টালি অনেকের থেকে ইয়াং।

—তাঁর ফ্যামিলি নেই?

—অফকোর্স আছে। বউ আছে, কলেজে পড়া ছেলে আছে…। তাতে আমার কী আসে যায়? আমি তাঁকে ভালবাসি, তিনি আমাকে ভালবাসেন…ব্যাস।

সৌমিকের বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছিল না। মেয়েটা পাগল, না নির্বোধ? বয়স্ক অধ্যাপকরা বেশির ভাগই ধোঁয়াটে স্বভাবের মানুষ হয়। বিশেষ করে বিজ্ঞানীরা। সৌমিক যদ্দূর জানে, এদের সাংসারিক জ্ঞানগম্যিও অত্যন্ত কম। এমন একটা লোকের পায়ে মন প্রাণ নিবেদন করে কী পাবে দয়িতা? সেই অধ্যাপকই বা কী? একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে নীতিজ্ঞান বিবর্জিত হয়ে লটঘট চালিয়ে যাচ্ছে!

দয়িতা চুল দুলিয়ে হাসল,—আমি জানি তুমি কী ভাবছ। আমাদের সম্পর্কের পরিণতি কী, তাই তো? বলতে বলতে হঠাৎ দয়িতা উদাস। দূরমনস্ক। শীতের বাতাসের মতো ফিসফিসে স্বরে বলে চলেছে,—সব সম্পর্কেরই কি একটা নিখুঁত গোল পরিণতি থাকে? তাঁরও কিছু হেলপ্‌লেস্‌নেস্‌ আছে, বাইন্ডিং আছে। আমার ফিউচার আমি এখন তাঁর ওপরেই ছেড়ে রেখেছি। জানি, কনভেনশনাল বাবা মার পক্ষে এটা হজম করা কঠিন। কঠিন কেন, অসম্ভব। অ্যান্ড ফর দ্যাট রিজন্‌ আমি তাদের ছেড়ে চলেও এসেছি। ধরে নিতে পারো চিরকালের জন্য।…এই যে হোস্টেল, এখানেও আমি বেশি দিন থাকব না। দরকার হলে টাউনে চলে যাব। টিউশনি খুঁজছি, নিজের খরচা নিজে চালাব। ফাইনাল পরীক্ষা অব্দি অবশ্য এভাবেই দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে হবে, তার পর একটা চাকরি ঠিক জোগাড় করে নেব। বিপুলা এই ধরণীতে একটা মানুষের পেটের ভাত জোগাড় করার মতো বিদ্যে আমার আছে।…বুঝতে পারছ, কথাগুলো তোমায় কেন বলছি?

সৌমিক শুকনো গলায় বলল,—কেন আর! আমাকে শোনাতে ইচ্ছে করছে, তাই।

—আজ্ঞে না স্যার। আমি চাই আমার প্রতিটি কথা তুমি বাড়িতে গিয়ে রিপোর্ট করো। নট অ্যাজ এ খোঁচড়, বাট অ্যাজ এ মেসেঞ্জার। বাবাকে বোলো, যখন তাদের কথা শুনলামই না, তখন তাদের ওপর আর ডিপেন্ডেন্টও থাকতে চাই না। এটাই তো লজিকাল, নয় কি?

সৌমিকের মুখ গোমড়া হল,—আমি কেন তাঁদের বলতে যাব? আগেই তো বললাম, কেউ আমাকে এখানে পাঠায়নি, আমিও কাউকে বলে আসিনি।

—তাহলে তুমিই জেনে রাখো। আমার সিচুয়েশানটা তো বুঝলে, অতএব নো মোর হার্ড ফিলিংস। বলেই দয়িতা হাত বাড়িয়ে দিল,—তুমি কি এখন থেকে আমার বন্ধু হতে পারো না?

সৌমিক সম্মোহিতের মতো ধরে ফেলল হাতখানা। খুব কোমল হাত নয়, তবে বেশ উষ্ণ। ছুঁলেই যেন শিরা ধমনীতে বহমান রক্তকণিকারা চঞ্চল হয়ে ওঠে।

হাতটা হাতে রেখেই সৌমিক অস্ফুটে বলল,—তোমায় একটা কথা বলব?

—কী?

—তোমার কি মনে হয় না, তুমি ভুল করছ?

—জীবনে কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক, সেটা কি এত সহজে হিসেব করা যায়? আমি মুহূর্ত নিয়ে বাঁচতে ভালবাসি, সৌমিক। আমার কাছে এই মুহূর্তটাই সত্যি। তাঁকে ভালবাসাটাই একমাত্র ট্রুথ। ফিউচারে কী হবে, না হবে ভেবে আমি এই মুহূর্তগুলোকে নষ্ট করব কেন?

সৌমিকের বুক চিনচিন করে উঠল। এই যে এখন দয়িতার হাতে হাত, এই যে এখন বিন্দু বিন্দু দয়িতা চারিয়ে যাচ্ছে তার গভীরে, এক আশ্চর্য মানবীর ঘ্রাণে সুরভিত হয়ে উঠছে শীতের দুপুর…এই মুহূর্তটাও কি সত্যি নয়?

হোস্টেলের গেট এসে গেছে। দাঁড়িয়ে পড়েছে দয়িতা,—তুমি কি এক্ষুনি ফিরে যাবে?

সৌমিক হাতটা ছেড়ে দিল,—যাই।

ভারী মধুর হাসল দয়িতা,—রাগ নেই তো আর?

—নাহ্। সৌমিক দুদিকে মাথা নাড়ল। মনে মনে বলল, তোমার সঙ্গে সে সম্পর্ক গড়ে উঠল কই!

দয়িতা হাসিটা ধরেই আছে। বলল,—আমাকে ভুলে যেও প্লিজ। মনে কোরো একটা খুব যাচ্ছেতাই মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের ঠিক হয়েছিল, কপালজোরে বেঁচে গেছ।

সৌমিক ভারী নিঃশ্বাসটাকে বেরোতে দিল না বাইরে। মৃদু হেসে বলল,—তিনটে কতয় একটা ট্রেন আছে না?…ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।

হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের মাথায় এসে একবার ফিরে তাকাল সৌমিক। মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো দাঁড়িয়ে আছে দয়িতা! নেই।

স্টেশনে পৌঁছে সৌমিক দেখল এখনও কিছুটা সময় আছে। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মের বাইরে এল সৌমিক। আবেগ, অভিমান অনেকটা থিতিয়ে এসেছে, মনে এখন ভর করেছে এক অদ্ভুত নির্লিপ্তি। দয়িতার কথা যেন আর ভাবতেই ইচ্ছে করছে না, বরং খিদেটা চাগাড় দিচ্ছে।

এদিক ওদিক খুঁজল সৌমিক। দূর একটাও ভাল রেস্টুরেন্ট নেই। যা আছে সবই ছোটখাটো পাইস হোটেল। অপরিচ্ছন্ন চেহারা, ম ম করছে আঁশটে গন্ধ। দোকানি ব্যাপারিরাই এই সব রদ্দি খাবার দোকানে ভিড় করে।

চিন্তাটা মাথায় আসতেই সৌমিক নিজের ওপর রেগে গেল খুব। এই বিরাগ, এই অপশ্রদ্ধা, এও তো সেই কবিতা বসুরায়ের দান। কী বিষাক্ত এক নাগপাশে তাকে বেঁধে ফেলেছে কবিতা বসুরায়। নিজের অজান্তে সৌমিকের রুচিবোধ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয় ওই কবিতা বসুরায়ের শেখানো নিয়মে।

প্রায় জোর করে একটা হোটেলে ঢুকল সৌমিক। ভিড়ের মধ্যেই বসল, কষা মাংস নিল এক প্লেট, সঙ্গে রুটি, ঠেসে ঝাল দিয়েছে মাংসে, খেতে খেতে চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। একা মনে হেসে ফেলল সৌমিক। ব্যর্থ প্রেমের হতাশা কিনা শেষে মাংসের ঝোলের মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরল। রাগটাও, কান্নাটাও। সামনের বেঞ্চি থেকে একটা হাটুরে লোক জুলজুল চোখে দেখছে সৌমিককে, বোধহয় ওই মিটিমিটি হাসির অর্থ নিরূপণের চেষ্টা চালাচ্ছে। সৌমিকের ভ্রূক্ষেপই নেই, কচকচ পেঁয়াজ চিবোচ্ছে, এক চুমুকে গ্লাসের জল শেষ করে ফেলল। কবিতা বসুরায় যে মতলবই ভাঁজুক, সৌমিক আর বেলতলায় যাচ্ছে না। কনের বেনারসিটা মায়ের ভাগ্যেই নাচছে! হা হা!

ড্রামের ঘোলাটে জলে মুখ ধুয়ে কাউন্টারে পয়সা মেটাল সৌমিক, পরিতৃপ্ত মেজাজে মৌরি চিবোচ্ছে। সহসা চোখ আটকাল দোকানের বাইরে। সেই বারাসতের ছেলেটা! কাঁধে কিটস্‌ব্যাগ নিয়ে অলস মেজাজে স্টেশনের দিকে যাচ্ছে।

সৌমিক এগিয়ে গিয়ে ধরল ছেলেটাকে,—তুমি এখানে কোথায়?

বাবুয়াও অবাক হয়েছে। বলল,—আমার তো এখানেই বাড়ি। ক্যাম্পাস টাউনে। আপনি এখানে কোথায় এসেছিলেন?

—ওই ক্যাম্পাস টাউনেই। এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বলেই সৌমিকের মগজ-কম্‌পিউটার জোর ঝাঁকুনি খেল একটা। জিজ্ঞাসা করল,—তোমার নামটা যেন কী বলেছিলে সেদিন?

—শুদ্ধসত্ত্ব। শুদ্ধসত্ত্ব মজুমদার।

—তুমি প্রফেসার বোধিসত্ত্ব মজুমদারের ছেলে?

বাবুয়া হঠাৎই যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। দায়সারা ভাবে বলল,—হ্যাঁ।

সৌমিকের হৃৎপিণ্ড ধক ধক করে উঠল। হাঁটছে বাবুয়ার সঙ্গে সঙ্গে। কৌতুহলের কারণটা যেন অনুমানও না করতে পারে বাবুয়া, এমন ভাবে কথা শুরু করল,—তোমার বাবা তো বিখ্যাত ব্যক্তি।

বাবুয়া টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েছে। আলগা চোয়াল ফাঁক করল শুধু।

সৌমিক ফের বলল,—আগের দিন যখন আলাপ হল, কই তখন তো বাবার কথা কিছু বলোনি? এত পণ্ডিত মানুষ…

—পরিচয় তো হয়েছিল আপনার সঙ্গে আমার। বাবা সেখানে আসবে কেন?

—তা বটে। সৌমিক মাথা দোলাল,—তোমার মা সেই দাদুর মৃত্যুর সময়ে গেছিলেন…চলে এসেছেন নিশ্চয়ই?

—হ্যাঁ। অনেক দিন।

আমার সায়েনটিস্টদের সম্পর্কে ভীষণ কিউরিয়সিটি। সৌমিক হাসি হাসি ভাব ফোটাল মুখে,—কত গল্প শুনি সায়েনটিস্টদের…তোমার বাবা কী রকম? রাশভারী, অ্যাবসেন্ট-মাইন্ডেড?

—আমায় জিজ্ঞেস করছেন কেন? বাবুয়া একটু বিরক্ত মুখেই টিকিট কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এল,—জানতে ইচ্ছে থাকলে আমার বাবাকে গিয়েই প্রশ্ন করুন।

—না, তুমি তো অনেক ক্লোজ থেকে দ্যাখো, তাই…। সৌমিক আবার খোঁচাল, তোমার বাবা খুব বইয়ের পোকা, তাই না?

—হুঁ।

—আমার বন্ধু বলছিল ইউনিভার্সিটিতে নাকি প্রফেসার মজুমদার সকলের প্রিয়, বাড়িতে নিশ্চয়ই ছাত্রছাত্রীদের খুব উৎপাত হয়?

—না। বাবা একা থাকাই পছন্দ করে।

—তুমি কি প্রত্যেক উইকেই বাড়ি আসো?

—না।

—কলকাতায় তুমি কী নিয়ে পড়ছ যেন?

—ইংলিশ।

—কেন, সায়েন্স পড়লে না কেন?… এত বড় একজন বিজ্ঞানীর ছেলে হয়ে…

বাবুয়া প্রশ্নটার উত্তর দিল না। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,—আপনি কি এই ট্রেনেই ফিরছেন?

—হুঁ।… তোমার বাবা যেন এখন কী নিয়ে কাজ করছেন?

বাবুয়া এবারও উত্তর দিল না। ব্যস্ত মুখে ঘড়ি দেখছে। তাড়াহুড়ো করার ভঙ্গিতে বলল,—আমি একটু জল খেয়ে আসছি।

সৌমিক টের পাচ্ছিল বাবার প্রসঙ্গ ভাল লাগছে না বাবুয়ার। বোধিসত্ত্ব মজুমদারকে কি পছন্দ করে না ছেলেটা? কেন করে না? দয়িতাকে নিয়ে ওদের এখানেও অশান্তি বেধে গেছে কি?

নাহ্, ছেলেটাকে ছাড়লে চলবে না, ট্রেনে যেতে যেতে আরও ভাল করে ভাব জমাতে হবে। আপন মনে মাথা দোলাল সৌমিক। দয়িতার প্রেমিকটিকে অন্য আলোকেও চিনে রাখা দরকার।

.

১৩.

অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখছিল বোধিসত্ত্ব। কুচকুচে কালো অনন্ত মহাশূন্যে জীবন্ত মহাকাশযান হয়ে ছুটছে সে। তীব্র বেগে। অজানা পথে। বিপরীত দিক থেকে অবিরাম ধেয়ে আসছে ধূলিকণার মেঘ, অন্ধকারেও বোধিসত্ত্ব টের পাচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাচ্ছে একটা চাপা শব্দও। একঘেয়ে। একটানা। হঠাৎ ঝলসে ওঠে আলো, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। পরক্ষণেই আবার ঘন অন্ধকার।

আঁধার এক সময়ে ফিকে হয়ে এল। এবার কী যেন এক আলোময় বস্তু এগিয়ে আসছে বোধিসত্ত্বর দিকে। ধূমকেতু? হ্যাঁ, ধূমকেতুই। নিকট থেকে নিকটতর হল ক্রমশ। অবয়ব স্পষ্ট হল। কোমাটা ভারী উজ্জ্বল… আরে, এ যে দয়িতার মুখ! অসীম শূন্যে ভাসমান মুখ প্রায় আলোর গতিতে কাছে এসে গেছে, বোধিসত্ত্বর সঙ্গে মিলিত হচ্ছে ধূমকেতুরূপী দয়িতা। কী প্রচণ্ড উত্তাপ! বোধিসত্ত্ব ক্ষয়ে যাচ্ছে দ্রুত, ছোট হয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে বোধিসত্ত্ব-দয়িতা অতি ক্ষুদ্র হয়ে গেল। ওই বিন্দুভরের কী মারাত্মক টান, বিচ্ছুরিত আলোর কণাগুলোকে শুষে নিচ্ছে, শূন্য থেকে বেমালুম হারিয়ে গেল আলোর অস্তিত্ব। আঁধারের ঘনত্ব বাড়ছে, বাড়ছে…

বোধিসত্ত্বর রাতের প্রথম তন্দ্রাটা ছিঁড়ে গেল। অন্ধকারের এত গাঢ় রূপ আগে কখনও দেখেনি বোধিসত্ত্ব, ধকধক করছে বুক। টের পেল এই শীতেও ঘেমে গেছে খুব। লেপ সরিয়ে উঠে বসল বিছানায়। ঘরেও এখন গাঢ় আঁধার, কিছুই ঠাহর হয় না। একটুক্ষণের জন্য বোধিসত্ত্ব বুঝতেই পারল না সে ঠিক কোথায়। ক্ষণপরে সম্বিতে ফিরল, হাতড়ে হাতড়ে টিপল বেডসুইচটা, জ্বলে উঠেছে হালকা সবুজ নাইটবাল্‌ব। পাশেই রাখী। ঘুমোচ্ছে। দেয়ালের দিকে ফিরে। এক ঝলক তাকে দেখে খাট থেকে নামল বোধিসত্ত্ব। চেয়ারের গা থেকে শাল টেনে জড়াল, পায়ে পায়ে এসেছে স্টাডিরুমে। আরামকেদারায় বসে সিগারেট ধরাল একটা।

স্বপ্নটা এখনও কাঁপছে বুকে। বোধিসত্ত্ব আর দয়িতার মিলনে সৃষ্টি হচ্ছে কৃষ্ণগহ্বর? এমন স্বপ্নের অর্থ কী? দয়িতা কি তার জীবনে ধূমকেতু? অনন্ত এক দূরত্ব থেকে ক্ষণিকের জন্য কাছে আসবে, আবার মিলিয়ে যাবে মহাশূন্যে? এখন আর তা কী করে হয়? বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙিয়ে মেনকা কক্ষনও ফিরে যেতে পারে না। দ্বিধাসঙ্কোচের কাল পেরিয়ে গেছে, শুধু বোধিসত্ত্বর জন্যই সব ছেড়ে চলে এসেছে দয়িতা, এখন আর তাকে কোন অছিলায় ফেরাবে বোধিসত্ত্ব? কেনই বা ফেরাবে? এই প্রৌঢ় বয়সেও তাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে তেইশ বছরের তরতাজা যৌবন, ভাবনাটুকুতেই রোমে রোমে হর্ষ জাগে, শরীরের প্রতিটি কোষ যেন নতুন করে প্রাণ পায়।

সিগারেটে বড় করে একটা টান দিল বোধিসত্ত্ব। তামাকের ধোঁয়ায় ভরে নিল ফুসফুস। দয়িতা বয়সে তার কন্যাসম, কী আসে যায়? পুরুষ আর নারীর সম্পর্কের মাঝে বয়সটা কোনও ব্যবধানই নয়। মুগ্ধ ছাত্রী তার জীবনে অনেক এসেছে, কিন্তু এমন ব্যাকুল আত্মনিবেদন আগে কখনও ঘটেনি। দয়িতাই তাকে জাগিয়ে দিল, বুঝিয়ে দিল তার যৌবন এখনও ফুরোয়নি। শরীরী কামের অসহ্য তাড়নায় এখন পুড়ছে বোধিসত্ত্ব, এ কথাই বা সে অস্বীকার করে কী করে? যদি এর জন্যে মহাশূন্যে কৃষ্ণগহ্বর হয়ে যেতে হয়, তো সেও ভি আচ্ছা। তবু দয়িতাকে হারিয়ে ফেলার মতো মূর্খামি সে কিছুতেই করতে পারবে না।

রাত্রির এক অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা আছে। সে শুধু চরাচরে আঁধার নামিয়েই ক্ষান্ত হয় না, মনের গোপন অন্ধকারকেও সে প্রকট করে দিতে পারে। এই প্রায়ান্ধকার স্টাডিরুমে বসে গবেষণার কথা আর ভাবছিল না বোধিসত্ত্ব, ঘরের নীলাভ শূন্যস্থানে এখন শুধু দয়িতার হলোগ্রাম। নগ্ন দয়িতা। বাদামের মতো দেহের রং, কচি লেবুপাতার পেলবতা ত্বকে, উদ্ধত দুটি স্তন টানটান হয়ে আছে কামনায়, স্তনবৃন্তে হাত ছোঁয়ালে যেন কোটি ভোল্টের শক লাগে। কী মসৃণ নাভি, কী অপরূপ জঙ্ঘা, কী মোহময়ী ঊরুসন্ধি! বোধিসত্ত্বর শরীরের চাপে মোমের প্রতিমা গলে গলে যাচ্ছিল। বোধিসত্ত্বর মধ্যেও আগুন আছে তা হলে? এখনও? শরীর অস্থির অস্থির লাগছে বোধিসত্ত্বর। হাত বাড়িয়ে দয়িতাকে ছুঁতে চাইল বোধিসত্ত্ব, জিভ দিয়ে স্পর্শ করতে চাইল, মুখ ডোবাতে চাইল দয়িতার বুকের উপত্যকায়। নেই। কিছু নেই। বেবাক শূন্যতা। অতৃপ্তি বেড়ে গেল বহুগুণ।

বোধিসত্ত্ব কাঁপছে জ্বোরো রুগীর মতো। ওই মাদক যৌবন কি এক-দুবার ভোগ করে তৃষ্ণা মেটে? আরও চাই, আরও চাই, অনন্ত বারের জন্য চাই, চিরকালের জন্য চাই…

কিন্তু তাদের দুজনের সম্পর্কটা কী হবে? দয়িতা রোজ ছলছল চোখে বলছে সে আর হোস্টেলে থাকতে চায় না, বাবা মার অর্থে এক মুহূর্তের জন্যও আর প্রতিপালিত হওয়ার ইচ্ছে নেই তার। টাউনে ঘর খুঁজছে দয়িতা, কিন্তু চালাবে কী করে? বোধিসত্ত্ব টাকা দেবে? দিতেই পারে। অর্থটা কোনও সমস্যাই নয়। দয়িতা কি নিতে রাজি হবে? বোধিসত্ত্বই বা তখন দয়িতার কাছে যাবে কোন পরিচয়ে? তাদের সুন্দর সম্পর্কের মাঝে একটা ইতর গন্ধ এসে যাবে না?

ঘরের বড় আলোটা জ্বলে উঠল। ঘোর ঘোর ভাব কেটে গেল বোধিসত্ত্বর। পিছনে রাখী।

জড়ানো স্বরে বোধসত্ত্ব বলল,—কী হল? আলো জ্বাললে কেন?

—অন্ধকারে এসে ভূতের মতো বসে আছ কেন?

—ইচ্ছে হচ্ছে, বসে আছি।

—মানুষ বটে একটা…! এই শীতে… রুমহিটার জ্বালিয়ে নাওনি কেন? বলতে বলতে সুইচ অন করে বোধিসত্ত্বর পিছনে এসে দাঁড়াল রাখী। আলগা হাত রেখেছে বোধিসত্ত্বর পিঠে। নরম গলায় জিজ্ঞাসা করল,—ঘুম আসছিল না বুঝি?

রাখীর হাত অস্বস্তিকর রকমের ভারী ঠেকল বোধিসত্ত্বর। উত্তর না দিয়ে সরিয়ে দিল হাতখানা।

রাখী ঝুঁকে বোধিসত্ত্বকে দেখল,—কাজ নিয়ে বসবে এখন?

বোধিসত্ত্ব এবারও কোনও উত্তর দিল না। আর একটা সিগারেট লাগিয়েছে ঠোঁটে, দেশলাই জ্বালল। অভ্যাস মতো তাড়াতাড়ি অ্যাশট্রে বাড়িয়ে দিয়েছে রাখী, অভ্যাস মতোই বোধিসত্ত্ব সেখানে গুঁজে দিল কাঠিটা। রাখীর উপস্থিতি সচেতনভাবে উপেক্ষা করে ধোঁয়ার বৃত্ত রচনা করছে।

রাখীই গায়েপড়া হয়ে টানল বোধিসত্ত্বকে,—ওঠো, চলো। রাত দুটো বাজে, এখন আর কাজ নিয়ে পড়তে হবে না।

-আহ্‌, যাও তো। জ্বালিয়ো না।

—আমি বুঝি শুধু জ্বালাই?

বোধিসত্ত্ব ভুরু কুঁচকে তাকাল। রাখীর মুখে হাসি হাসি ভাব, ভঙ্গিটাও চপল। চোখে কী যেন ইশারা করতে চাইছে। ওই বেঢপ পঞ্চাশ বছরের বুড়িটা কি বোঝে না তার মধ্যে কোনও রহস্যময়তা নেই? এই মহিলার সঙ্গে রমণও যা, পাশবালিশের সঙ্গে খেলা করাও তাই। মুহূর্তের জন্য নিজের ওপর ধিক্কার জাগল বোধিসত্ত্বর। এই স্থূল রমণীটিকে দেখে এই কদিন আগেও কী করে সে বেসামাল হত? শরীর মনের ক্লান্তি কাটানোর জন্য এই কি একটা উপকরণ? ছিঃ!

বোধিসত্ত্বর বিরক্তিটা পড়তে পারেনি রাখী। স্বামীর একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা দেখে বুঝি বা একটু বিহ্বলই হয়ে গেছে সে। আদুরে ভঙ্গিতে আরও একটু ঘনিষ্ঠ হল। বোধিসত্ত্বর মাথা টেনে নিয়েছে বুকে,—চলো চলো, ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি এখানে।

ঝট করে মাথা ছাড়িয়ে নিল বোধিসত্ত্ব,—যাও না, তোমায় বারণ করেছে কে?

কখনও কখনও এমন অপমানে মাথা নিচু করে চলে যায় রাখী, আজ কিন্তু নড়ল না। অপলক চোখে দেখছে বোধিসত্ত্বকে,—তোমার কী হয়েছে বলো তো?

—কী আবার হবে! কিচ্ছু না।

—উহুঁ, আমাকে তুমি লুকোতে পারবে না। কদিন ধরেই দেখছি কেমন মনমরা হয়ে আছ, ভাবছ কী যেন…। ছেলেটা মাত্র দু দিনের জন্য এল, তার সঙ্গে পর্যন্ত ভাল করে কথা বললে না…

বোধিসত্ত্ব ঠোঁট বেঁকাল,—আমার ভাবনার কথা তুমি যদি টেরই পেয়ে যেতে, তা হলে তুমি তুমি হতে না, আমিও আমি হতাম না।

—সে তো বটেই। আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ…। তোমার বড় বড় ভাবনার আমি কীই বা বুঝি!

—জানোই যখন, প্রশ্ন করছ কেন? বোধিসত্ত্ব ভারিক্কি স্বরে বলল,—যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো।

রাখী ঘর ছাড়ল না। বোধিসত্ত্বকে অবাক করে ডিভানে গিয়ে বসেছে। বোধিসত্ত্বর চোখে চোখ রেখে বলল,—আমি মূর্খই হই, আর যাই হই, ঠিক এই মুহূর্তে কী ভাবছ আমি কিন্তু বলে দিতে পারি।

—কী ভাবছি?

—ওই মেয়েটার কথা। দয়িতা।

—কেন, ওই মেয়েটার কথা ভাবব কেন? বোধিসত্ত্ব বুঝি একটু চেঁচিয়েই ফেলল। শীতল বন্ধ বাড়িতে নিজের উচ্চকিত স্বর প্রতিধ্বনিত হল নিজেরই কানে। বড় শূন্যগর্ভ লাগল চিৎকারটা, উষ্ণ হয়ে উঠল বোধিসত্ত্ব।

রাখীর মুখ আবার সহজ স্বাভাবিক। হাসছে মিটিমিটি,—না, এমনিই মনে হল…। যাক গে যাক… মেয়েটা অনেকদিন আসছে না। কেন গো?

—আমি কী করে বলব?

—না, সেই কবে যেন… হ্যাঁ, ক্রিসমাসের দিন থমথমে মুখ করে এল, এ ঘরে বসে কাঁদছিল… তোমায় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বললে কী সব ফ্যামিলি প্রবলেম হচ্ছে…

—হচ্ছে তো। চলছে তো।

—তোমার সঙ্গে আর দেখা হয়েছে ওর?

—না হওয়ার কী আছে! ইউনিভার্সিটি খুলে গেছে, ক্লাস হচ্ছে…

—প্রবলেমটা কী গো?

—এই নিশুত রাতে সেটা জানা কি খুব জরুরি?

—না, এমনিই… কৌতূহল। ওইটুকু মেয়ে, পড়াশুনো করছে, ওর আবার ফ্যামিলি প্রবলেম… শুনতে খুব অবাক লাগে। কী ধরনের সমস্যা? বাবা-মার ঝামেলা? নাকি কোনও ছেলেকে পছন্দ করেছে, বাড়িতে রাজি হচ্ছে না?

বোধিসত্ত্ব আর মাথা ঠিক রাখতে পারল না। গর্জে উঠল, এত কথা বলছ কেন তুমি, অ্যাঁ? দয়িতার প্রবলেম জানার জন্য যদি এত ছটফটানি থাকে, যাও, ওর হোস্টেলে চলে যাও। অ্যান্ড আস্ক হার। আমাকে ওই ধরনের সিলি প্রশ্ন করবে না।

—রেগে যাচ্ছ কেন? রাখী আহত মুখে বলল,—তোমার সঙ্গে মেয়েটার এত ভাব আছে বলেই না…

—ভাব? হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ভাব? তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে বোধিসত্ত্ব। টাট্টুঘোড়ার মতো পা ঠুকছে মেঝেতে,—ভেবেছটা কী? যা খুশি তাই বলে যাবে! মুখে একটা লাগাম নেই! অশিক্ষিত মেয়েছেলেদের মতো ভাষা…

রাখী যেন হতবাক। বোধিসত্ত্বর ক্রোধের অভিঘাতটা সামলাতে দু-এক সেকেন্ড বুঝি সময় লাগল তার। মুখ লাল হয়ে গেছে। অস্ফুটে বলল,—কী এমন বললাম যে গায়ে ফোসকা পড়ে গেল?

—সে বোঝার বুদ্ধি কি তোমার ঘটে আছে?

—বটেই তো বটেই তো। তুচ্ছ একটা শব্দ নিয়ে মেজাজ দেখানো তোমারই সাজে বটে। রাখীর স্বর নীরস। বুঝি বা ঈষৎ রুক্ষও,—এই যে, আমি যখন বাপের বাড়ি গেলাম, তখন রোজ যে সকাল সন্ধে মেয়েটা আসত…তোমায় রান্না করে খাওয়াচ্ছে, সারাদিন এ বাড়িতে থাকছে…। তুমি আমাকে এ সব বলোনি, গল্প করেও না। পাড়া প্রতিবেশীদের মুখে আমায় শুনতে হয়েছে। তাও আমি সে নিয়ে তোমায় একটিও প্রশ্ন করিনি…

—তুমি কী বলতে চাও, অ্যাঁ? রাখীর কথা মাঝপথে থামিয়ে দিল বোধিসত্ত্ব,—তুমি কি আমায় সন্দেহ করো?

—আমি কিছুই করি না। ঘটনাটা বলছিলাম, আর বুঝতে চাইছিলাম তুমি অত রেগে যাচ্ছ কেন?

কথাটার অন্তর্নিহিত খোঁচাটা আরও উসকে দিল বোধিসত্ত্বকে। হিংস্র চোখে রাখীকে দেখল। গরগর করতে করতে বলল,—হ্যাঁ, তুমি যা ভাবছ তাই। তাইই। আমি ভালবাসি দয়িতাকে। কেন ভালবাসি শুনবে? সহ্য করতে পারবে? বিকজ, তুমি আমার জীবনে অসহ্য হয়ে উঠেছ। তোমার সঙ্গে আমার কিছু মেলে না। নাথিং। থট নয়, ওয়েভলেংথ নয়…। আমার মতো লোকের একটা ইন্টেলেক্টের ক্ষুধা থাকে, কোনও দিন তুমি সেটা মেটাতে পারোনি…

—বিয়ের এতকাল পরে তুমি এ সব কী বলছ? রাখীর চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে,—আমাদের একটা বিশ বছরের ছেলে আছে!

—সো হোয়াট? যা সত্যি, তা কোনও না কোনওদিন তো বলতেই হবে। তুমি একটি আদ্যন্ত বোদা, নগণ্য মহিলা। তোমার সঙ্গে দুটো মিনিট কথা পর্যন্ত বলা যায় না। ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ টু বি মাই কম্প্যানিয়ন। তোমাকে যে এত বছর আমি টলারেট করেছি, সেটা তোমার বাপ চোদ্দপুরুষের ভাগ্যি। দয়িতার কথা বলে আমায় উত্তেজিত কোরো না, তুমি দয়িতার পায়ের নখের যোগ্যও নও। এ বাড়িতে থাকতে হলে মুখ বুজে থাকবে, দয়িতাকে নিয়ে কখনও আর একটা প্রশ্নও নয়। ঢুকছে মাথায় কথাগুলো?

রাখী যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, চোখের পাতাও পড়ছে না তার। বজ্রাহত পোড়া গাছের মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর প্রায় টলতে টলতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

বোধিসত্ত্ব ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন মনে করল না। আবার আরামকেদারায় বসেছে। এক ঝটকায় কথাগুলো বলে ফেলে চাপা একটা মুক্তির উল্লাস জাগছে ভেতরে। আর অনাবশ্যক গোপনীয়তার খেলা খেলতে হবে না। বিবেকের কামড় থেকেও রেহাই মিলল যেন। তবু কী যেন একটা ফুটছে! রাখীকে তো কথাগুলো বুঝিয়েও বলা যেত, এত রূঢ় হওয়ার প্রয়োজন ছিল কি? একটু আবরণ থাকলে রাখী হয়তো যন্ত্রণা কিছু কম পেত।

রাতে আর ঘরে গেল না বোধিসত্ত্ব। রুমহিটারের তাপে স্টাডিরুম বেশ উষ্ণ হয়ে গেছে, ডিভানে একটা কম্বল রাখাই থাকে, কম্বলটা জড়িয়ে শুয়ে পড়ল গুটিসুটি মেরে। মাথা গরম হয়ে আছে, ঘুম আসতে চাইছে না। একটু তন্দ্রা আসে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়, আবার কখন যেন জড়িয়ে আসে চোখ। বার কয়েক উঠল, বাথরুমে গেল, অপাঙ্গে দেখল নিজেদের শোওয়ার ঘর। দরজা ভেজানো, ভেতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। কান্নারও না।

ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়ল বোধিসত্ত্ব।

চোখ খুলল রূপচাঁদের ডাকে,—বাবু, চা।

ধূমায়িত পেয়ালা হাতে বোধিসত্ত্ব ড্রয়িংরুমে এল। রাখী উঠে পড়েছে, কাজ করছে রান্নাঘরে। অন্য দিন এ সময়ে রাখী অন্তত একবার এসে বসে সোফায়, এক সঙ্গে চা খায়, আজ এল না। অভিমান হয়েছে খুব? তুচ্ছ অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়া বাহুল্য মনে হল বোধিসত্ত্বর। থাক, দু দিন গেলে আস্তে আস্তে সয়ে যাবে।

চা শেষ করে বাথরুমে ঢুকল বোধিসত্ত্ব। গিজার অন করাই ছিল, জলে পরিমিত উত্তাপ। তোয়ালে সাবান দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম সব কিছুই নিখুঁতভাবে সাজানো, যেমন থাকে। দরজায় রবারের চটিটাও। স্নান সেরে বেরিয়ে দেখল ব্রেকফাস্ট রেডি। টোস্ট পোচ কলা, যা নিত্যদিন খেয়ে মর্নিং সেশনে ইউনিভার্সিটি ছোটে বোধিসত্ত্ব। শোওয়ার ঘরের বিছানাতেও বোধিসত্ত্বর শার্ট ট্রাউজার্স সোয়েটার রাখা আছে অন্য দিনের মতো। একটু বেশি নীরবতা ছাড়া সংসারের কোথাও কোনও ছন্দপতন নেই, সবই বাঁধা লয়ে বহমান।

ফুলস্লিভ সোয়েটারটা গলিয়ে বোধিসত্ত্ব ডাইনিং টেবিলে এল। হাতে খবরের কাগজ, হেডিংয়ে চোখ বোলাচ্ছে। কাগজের ওপার থেকে হঠাৎই রাখীর গলা শুনতে পেল,—তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল।

বোধিসত্ত্ব কাগজ সরিয়ে রাখল। ঝলক দেখল রাখীকে। বাসি খোঁপা এলোমেলো, কয়েকটি রুপোলি চুল এসে পড়েছে কপালে। অসম্ভব শুকনো লাগছে রাখীর লাবণ্যহীন মুখ। শীতের খড়ি ওঠা ওঠা। তবে মুখটা বড় শান্তও লাগে, একটি রেখারও ওঠাপড়া নেই সেখানে।

বোধিসত্ত্ব গলা ঝাড়ল,—বলো।

—দুপুরের খাবারটা ঢাকা দেওয়া থাকবে। রূপচাঁদকে বলে রেখেছি গরম করে দেবে তোমাকে।

বোধিসত্ত্ব চোখ কুঁচকে তাকাল। কিছু বলার আগেই রাখী আবার বলে উঠল,—আমি দশটা একান্নর ট্রেনে চলে যাচ্ছি।

—কোথায়?

রাখী উত্তর দিল না। বুঝি প্রয়োজন মনে করল না। রান্নাঘরে গিয়ে কফি করে আনল। পেয়ালায় মেপে আধ চামচ চিনি দিল। নাড়ছে। একটু যেন অনাবশ্যক দীর্ঘ সময় ধরে।

হাতে এক পিস টোস্ট তুলেও নামিয়ে রাখল বোধিসত্ত্ব,—লেক টেরেসে যাচ্ছ?

—উত্তর নেই।

—ফিরছ কবে জানতে পারি?

—জানার কি তোমার প্রয়োজন আছে?

—একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?

রাখী গলা নামিয়ে বলল,—মেয়ের বয়সি একটা মেয়ের সঙ্গে নোংরামি করার থেকে এটা অনেক কম বাড়াবাড়ি।

অজান্তেই মুঠো শক্ত হয়ে গেল বোধিসত্ত্বর। শব্দ করে চেয়ার সরিয়ে উঠে পড়েছে। স্টাডিরুমে ঢুকল একবার, তারপর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল রাস্তায়।

মর্নিং-এ আজ একটাই ক্লাস। এম এসসি ফার্স্ট ইয়ার। ক্লাসটা মন দিয়ে করতে পারল না বোধিসত্ত্ব, ক্ষণে ক্ষণে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। কোনওক্রমে বেল পড়া অবধি কাটিয়ে ফিরে এল নিজের রুমে, ঝিম ধরা মুখে বসে রইল সারা সকাল। শামীমের সঙ্গে বসার কথা ছিল আজ, নিজের রুমেই। শরীরে জুত নেই, এই অজুহাতে কাটিয়ে দিল ছেলেটাকে। বাড়ি তাকে টানছে, অথচ যেতে পা সরছে না। বড় বিচিত্র অনুভূতি! বোধিসত্ত্বর কি ভয় করছে? বিবেকের দংশন হচ্ছে? নাকি নিছকই এক আশঙ্কা তাকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে? একটা দীর্ঘকালীন অভ্যাস তাকে ছেড়ে চলে যাবে, এই ভাবনাতে বুঝি এতটুকু স্বস্তি নেই!

সত্যি সত্যি বাড়ি ফিরল যখন, অন্য এক অনুভবে ছেয়ে গেল হৃদয়। নির্জন বাংলো মহাশূন্যের মতো খাঁ খাঁ লাগছে। কত সময় তো থাকে না রাখী, কই তখন তো এমন লাগে না। চলে যাবে, এই ঘোষণাটাই কি বাড়িটাকে ফাঁকা করে দিয়েছে আজ? চতুর্দিকে শুধু রাখীর ছোঁয়া। সোফায়, পরদায়, মেঝেয়, ডাইনিং টেবিলে, বাথরুমে, শোওয়ার ঘরে, এমনকি স্টাডিতেও। দেখতে দেখতে শরীরের সমস্ত উদ্যম নিঃশেষ হয়ে আসছিল বোধিসত্ত্বর। দয়িতাকে নিয়ে বেশ কিছুদিন চনমনে ছিল দেহ, আজ আবার অবসন্নতাটা ফিরে আসছে।

খেয়ে উঠে নিয়ম ভাঙল বোধিসত্ত্ব, আর ইউনিভার্সিটি গেল না। সারা দুপুর নিঝুম শুয়ে রইল বিছানায়। শীতের বাতাস সরসর ধ্বনি তুলছে বাইরের শুকনো পাতায়, বোধিসত্ত্ব শুনছিল। জানলায় চোখ রাখলেই দৃষ্টি যায় বড় বড় ডালিয়ায়। সাদা হলুদ খয়েরি মেরুন। দেখলেই বুক ব্যথিয়ে ওঠে।

…সত্যিই চলে গেল রাখী। …বোধিসত্ত্বকে ছেড়ে চলেই গেল।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল এল। বিকেল আর কতটুকু এখন, আসতে না আসতেই সন্ধে। বোধিসত্ত্ব সুস্থিত হচ্ছিল ক্রমশ। অন্য এক নারী চুম্বকের মতো টানছে এবার। চৌম্বক আকর্ষণ নয়, এ যেন মহাকর্ষ, অসীম দূরত্ব থেকেও যা টের পাওয়া যায়।

হৃদয়ের দোদুল্যমানকে ভেঙে ফেলল বোধিসত্ত্ব। রূপচাঁদকে ছুটি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল পথে। সোজা লাইব্রেরি গিয়ে নিজের কিউবিকলে বসে রইল খানিকক্ষণ। ঘড়ি দেখছে ঘন ঘন। দ্রুতগামী সময় আজকেই বা এত ধীরে চলে কেন?

সাড়ে সাতটা নাগাদ ছায়া পড়ল কিউবিকলে। সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানী বোধিসত্ত্ব মজুমদারের চোখের মণি জ্বলজ্বল, বুকে লাবডুব লাবডুব। কী অপরূপ আজ সেজেছে দয়িতা! সালোয়ার কামিজ নয়, শাড়ি পরেছে আজ। গাঢ় নীলরং জরিপাড় শাড়ি, গায়ে নীল শাল, কপালে নীল টিপ। এ কি অভিসারের সাজ? নাকি দয়িতা আজ আকাশ হয়েছে?

আজই কেন শাড়ি পরল দয়িতা?

সংখ্যা আর অক্ষরের অরণ্যকে সরিয়ে রাখল বোধিসত্ত্ব, বেরিয়ে পড়েছে দয়িতার সঙ্গে। হাঁটছে কুয়াশামাখা শীতার্ত পথ ধরে।

চুপচাপই ছিল দুজনে। এক সময়ে বোধিসত্ত্বই কথা বলল,—তোমার কি আজ ফেরার তাড়া আছে?

—আমার তো কোনও দিনই তাড়া থাকে না। দয়িতা ঝকঝকে দাঁত মেলে হাসল—আমার সময় তো আপনার হাতে।

—আহ্, আপনি কেন? কতদিন না বলেছি, তুমি বলবে!

দয়িতা কুলকুল হাসল,—আমি তো বলেইছি সময় লাগবে।

আবার গাঢ় নৈঃশব্দ্য। আবার নির্জন কুয়াশা মাখা পথ বেয়ে বহে চলা।

এক সময়ে বোধিসত্ত্ব বলল,—তোমাকে আর টাউনে ঘর দেখতে হবে না।

—কেন?

—তুমি আমার কাছে থাকবে।… কী, থাকবে তো?

—আমি তো থাকতেই চাই। কিন্তু…

—কোনও কিন্তু নয়। তুমি আমার সঙ্গে, আমার বাড়িতে থাকবে।

দয়িতা কেঁপে উঠল,—তা কী করে সম্ভব?

অনেকটা শীতল বাতাস ফুসফুসে ভরে নিল বোধিসত্ত্ব। উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। মৃদু স্বরে বলল,—রাখী নেই। চলে গেছে।

—সে কী! কেন? কবে?

—আজই।… আমি কাল রাত্রে তাকে সব বলেছি।

—কী বলেছেন?

—ট্রুথ। অ্যাবসোলিউট ট্রুথ। নাথিং বাট দা ট্রুথ।

কথাগুলো যেন দয়িতাকে নয়, নিজেকেই বলল বোধিসত্ত্ব।

দয়িতা সম্পূর্ণ নীরব হয়ে গেছে। মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে কী যেন। বাড়ির সামনেটায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল স্থাণুবৎ।

বোধিসত্ত্ব হাত ধরল দয়িতার,—এসো। থামলে কেন?

বাধ্য মেয়ের মতো বোধিসত্ত্বর হাত ধরে ভেতরে এল দয়িতা। আলো জ্বালল বোধিসত্ত্ব, দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর দয়িতার দু কাঁধ ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল ড্রয়িংরুমের মধ্যিখানে। ঠোঁটে আলতো চুমু খেয়ে বলল,—আজ থেকে এটাই তোমার বাড়ি।

দয়িতা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। যেন ব্যাপারটা ঠিক অনুধাবন করতে পারছে না। সন্দিগ্ধ চোখে তাকাচ্ছে চার দিকে। বুঝি বা তার মনে হচ্ছে এক্ষুনি কোনও ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে রাখী, ঘাড় ধরে বলবে, বেরোও।

অস্ফুটে বলে উঠল,—আমার খুব ভয় করছে।

—কীসের ভয়?

—জানি না…

—আমি তো আছি।

আবার দয়িতার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল বোধিসত্ত্ব। প্রখর হচ্ছে কামনা, বোধিসত্ত্বর ওষ্ঠ শুষে নিচ্ছে দয়িতার প্রাণরস। দু হাতে আঁকড়ে ধরেছে দয়িতাকে, জিভে জিভে ঘর্ষণ হচ্ছে। টের পাচ্ছে দয়িতার হাতও উঠে এসেছে তার পিঠে, সেও যেন ছটফট করছে তৃষ্ণায়।

বোধিসত্ত্ব মুখ সরিয়ে নিল। গাঢ় চোখ রেখেছে দয়িতার চোখের মণিতে,—ভয় কাটছে?

মাথা দোলালো দয়িতা,—জানি না।

—এই তো চেয়েছিলে তুমি, নয় কি?

চোখ নামিয়ে নিল দয়িতা,—জানি না।

বোধিসত্ত্বর স্বর গাঢ়তর হল,—তুমি আমার জন্য সবাইকে ছাড়তে পারো, আমি তোমার জন্য কিছু ছাড়তে পারি না?

—কিন্তু এটা কি উচিত হল? কেন তুমি ওঁকে চলে যেতে বললে? নয় আমি তোমায় দূর থেকেই…

—এখন কি ও সব ভাবার সময় দয়িতা? অতীত কবরে যাক, আমাদের সামনে এখন শুধুই ভবিষ্যৎ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি রাখীর কাছে ডিভোর্স চাইব। আশা করি ও কোনও ঝঞ্চাট পাকাবে না। বড় জোর কিছু অ্যালিমনি চাইতে পারে, সেনয় দিয়ে দেওয়া যাবে। চাইলে বাবুয়াও আমার পয়সাতে পড়াশুনো কন্টিনিউ করতে পারে…

দয়িতা বোধিসত্ত্বর মুখে হাত চাপা দিল। সরেও গেল একটু।

বোধিসত্ত্ব অবাক হল। দয়িতাকে প্রসন্ন করার জন্যই তো জানিয়ে দিতে চাইছে আগামী পদক্ষেপগুলোর কথা, তবু কেন দয়িতা…?

ভুরু নাচিয়ে বোধিসত্ত্ব জিজ্ঞাসা করল,—কী হল?

—কিছু না। আজ ও সব কথা থাক।

বোধিসত্ত্ব নিশ্চুপ হয়ে গেল। পলকের জন্য রাখীর মুখ ভেসে উঠেছে সামনে, এক ঝলক যেন বাবুয়াকেও দেখতে পেল।

দু দিকে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল বোধিসত্ত্ব। বিড়বিড় করে বলল,—থাক তবে। এসো…কাছে এসো।

.

১৪.

ক্যাম্পাস টাউন থেকে সোজা বাপেরবাড়ি এসে উঠেছে রাখী। না, ঠিক সোজা নয়, প্রথমে একবার লেক টেরেসে গিয়েছিল। বাবুয়ার কাছে। স্বামীকে ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের সান্নিধ্যটুকু বড়ো প্রয়োজন ছিল তার। থাকব না থাকব না করেও সেখানে থেকে গেল একটা রাত। বাবুয়া যথেষ্ট বুদ্ধিমান, মার ঘন মেঘে ছাওয়া মুখ দেখে সে বুঝি কিছু আন্দাজ করেছিল, এক বারের বেশি দু বার বলতে হয়নি বাবুয়াকে, একটিও প্রশ্ন না করে সে চলে এসেছে মার সঙ্গে।

মুখ ফুটে রাখী কাউকেই কিছু বলেনি। শ্বশুরবাড়িতেও না, বাপেরবাড়িতেও না। বিয়ের দু যুগ পর দেবতুল্য স্বামী এক হাঁটুর বয়সী মেয়েতে আসক্ত হয়েছে, এ কথা কী করে উচ্চারণ করে রাখী! তা বলে কি চাপা আছে ঘটনাটা? মোটেই না। সকলেই যে যার মতো করে বুঝে নিয়েছে। মারাত্মক কিছু না ঘটলে যে রাখীর মতো স্বামীঅন্তপ্রাণ মহিলা বোধিসত্ত্বকে ছেড়ে আসার পাত্রী নয়, এ কথা আত্মীয়মহলে না জানে কে! তা ছাড়া স্ক্যান্ডালের একটা নিজস্ব সৌরভ আছে, যতই গোপন রাখার চেষ্টা করা হোক, তা ছড়াবেই।

দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। পৌষ ফুরিয়ে মাঘ এসে গেল। রন্টু মিত্রা এখানে আদরযত্ন করছে খুব। এবার যেন একটু বেশি বেশি। ভাইপো ভাইঝিরা বড্ড বেশি পিসিমণি পিসিমণি করে পায়ে পায়ে ঘুরছে। রাখীর ভাল লাগছে না, কিচ্ছু ভাল লাগছে না। জিভ বিস্বাদ, দিন বিবর্ণ, রাত অসহ্য। অপমানটা যেন সর্বক্ষণ পাঁকের মতো লেগে আছে গায়ে। উফ্‌, কী চূড়ান্ত নির্বোধ সে! কী অদ্ভুতভাবে বোকা বনে গেল! এতকাল ঘর করার পর অবলীলায় লোকটা বলে দিল তুমি আমার ইন্টেলেক্টের ক্ষুধা মেটানোর যোগ্য নও। ওই মেয়ের নখের যুগ্যিও নও তুমি! ছিঃ, ছিঃ, কী অপমান!

রাখীর এখন কেবলই মনে হয় জীবনের দু দুটো যুগ বেবাক নষ্ট হয়ে গেছে। তার ভালবাসা মিথ্যে, এতদিনকার সহবাস মিথ্যে, সম্পর্ক মিথ্যে, সত্যি শুধু ওই অপমানটুকু। মাগো।

আশ্চর্য, মনে এত রাগ, এত জ্বালা, তবু এর মধ্যেও হঠাৎ হঠাৎ রাখীর মনকেমন করে ওঠে বোধিসত্ত্বর জন্য! কী করছে এখন বোধিসত্ত্ব? কেমন আছে? ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া হচ্ছে তো? রূপচাঁদ পারছে কি সব দিক সামলাতে? সারাদিনে একবারও কি রাখীকে মনে পড়ে বোধিসত্ত্বর? আসার সময়ে একটি বারের জন্যও বলল না, থেকে যাও রাখী! তিন সপ্তাহের ওপর হয়ে গেল, কই একবারও তো ফোন করল না! দয়িতার মধ্যে এমন কী আছে যে, রাখীকে ভুলেই যেতে হল?

বাবুয়ার মধ্যেও ইদানীং একটা পরিবর্তন এসেছে, লক্ষ করে রাখী। টেস্ট পরীক্ষা, পার্ট ওয়ানের ফর্ম ফিল্‌আপ্‌ সবই হয়ে গেছে, কলেজ এখন বন্ধ, বাড়িতে থাকার সময়ে বই নিয়ে বসল তো ঠিক আছে, না হলে মার সঙ্গেই সারাক্ষণ গল্প করে আজকাল। কলেজের স্যারদের কথা বলে, সহপাঠীদের গল্প শোনায়, কোথায় যেন একটা টিউশনি করছে, সেই বাচ্চা ছাত্রছাত্রীদের কাহিনীও শোনায় মাকে। এত কথা বলে যে, রাখীর মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় তাকে বুঝি ভুলিয়ে রাখতে চাইছে ছেলে। মার ভেতরটা যে পুড়ে যাচ্ছে, তা কি বাবুয়া বোঝে?

সরস্বতী পুজোর আগে দুম করে ঠাণ্ডাটা কমে গেল।

সেদিন সকাল থেকে একটু গা হাত পা ম্যাজম্যাজ করছিল রাখীর, দুপুরে শুয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল।

মিত্রা এসে ঠেলল হঠাৎ। হাসি হাসি মুখে বলল,—দিদি, তোমার দেওর এসেছে।

বোধিসত্ত্বর সঙ্গে যাই হোক, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে রাখীর যোগাযোগ এখনও অক্ষুণ্ণ আছে। দীপালি আর শান্তশীল তো প্রায় একদিন ছাড়া ছাড়াই ফোন করে, সেও তখন খবর নেয় শ্বশুর-শ্বাশুড়ির। বাইশ বছর ধরে যে পরিবারের সে অংশ হয়ে ছিল, দুম করে কি সেই পরিবারকে পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়? মুছবেই বা কেন? তাদের সঙ্গে তো রাখীর কোনও বিবাদ নেই।

তবু শান্তশীলের আগমনে খানিকটা অবাকই হয়েছে রাখী। জিজ্ঞাসা করল—একা এসেছে?

—হুঁ। মনে হয় অফিস থেকে। সঙ্গে গাড়ি আছে। মিত্রা চোখ ঘোরাল—দ্যাখো, কী বলে!

মিত্রার মুখভঙ্গিটা রাখীর ভাল লাগল না। পঞ্চাশ বছর বয়েসে পৌঁছে প্রায় চল্লিশের ভ্রাতৃবধূর এই ধরনের কৌতূহল অস্বস্তিকরও বটে। বিরক্ত হয়েও লাভ নেই, হয়তো এটাই স্বাভাবিক। মিত্রার জায়গায় রাখী থাকলে সে কি অন্যরকম আচরণ করত?

একতলায় রন্টুর চেম্বারের লাগোয়া বৈঠকখানা আছে একটা। শান্তশীলকে সেখানে বসায়নি মিত্রা, ওপরের ড্রয়িংরুমে নিয়ে এসেছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্থিত রেখে সেই ঘরে এল রাখী।

শান্ত সোফায় বসে সিগারেট খেতে খেতে ম্যাগাজিন উলটোচ্ছিল। গম্ভীর মুখে। রাখীকে দেখে ফ্যাকাশে হাসল। এ দিক ও দিক তাকিয়ে বলল,—বাবুয়াকে দেখছি না যে? পড়ছে?

রাখী কেজো গলায় বলল,—না, বেরিয়েছে। আজ ওর টিউশানির দিন।

—বাবুয়া টিউশানি করে? শান্তশীল বিস্ময় লুকোতে পারল না,—কোথায়? কবে থেকে?

—অনেকদিনই করছে। প্রায় মাস দেড়েক।

—স্ট্রেঞ্জ! বলেনি তো! ওর টিউশানি করার কী দরকার?

—তা তো বলতে পারব না। ওকেই জিজ্ঞেস কোরো।

শান্তশীল মাথা নামাল। চোখ থেকে হাই পাওয়ারের চশমা খুলে মুছছে। আবার পরে নিল। হঠাৎ চোখ তুলে বলল,—তুমি যাচ্ছ কবে?

—কোথায়?

—বাড়ি।

শান্ত কোন বাড়ির কথা বলছে? রাখীর ভুরুতে ভাঁজ।

ঝটিতি নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছে শান্তশীল,—অনেক দিন তো বাপেরবাড়ি হল, এবার লেক টেরেস চলো।

ও। তার মানে বোধিসত্ত্ব তাকে ফেরত আনার জন্য পাঠায়নি। রাখী স্থির চোখে তাকাল,—কেন?

—কেন আবার কী? আমরা তোমাদের মিস করছি। দীপালি আমি বাবা মা জুলি মিলি সক্কলে।

এবারও বোধিসত্ত্বর নাম করল না। রাখী মলিন হাসল,—এই কথা বলতে এত দূর দৌড়ে এলে? ফোনেই তো বলা যেত।

মিত্রা চা এনেছে। সঙ্গে প্লেটে সন্দেশ রসগোল্লা আঙুর কাজুবাদাম চানাচুর। শান্তশীল হাঁ হাঁ করে উঠল, আমলই দিল না মিত্রা, মুচকি হেসে চলে গেল ঘর ছেড়ে। অন্য সময়ে শান্ত দীপালিরা এলে সামনে বসে মিত্রা, দুটো কথা বলে, আজ যে সে একটুক্ষণও থাকবে না, জানে রাখী।

আর এই জানাটাই রাখীকে পীড়া দিচ্ছিল। অস্বস্তিটা বেড়ে যাচ্ছিল আরও।

শান্তশীল প্লেটের দিকে তাকালই না, শুধু চায়ের কাপটা টেনেছে। চুমুক দিয়ে বলল,—বুঝতেই তো পারছ বউদি, কেন এসেছি!

—না। সত্যিই বুঝতে পারছি না।

—কামঅন বউদি, বি প্রাক্টিক্যাল। তুমি এ রকম অনির্দিষ্ট কাল ধরে এখানে থাকতে পারো না। শান্তশীল গলা নামাল,—এটা একটা ফ্যামিলি প্রেস্টিজের ব্যাপার। বাবুয়াটাকেও নিয়ে চলে এলে…

—বাবুয়াকে আমি আনিনি। রাখীর স্বর ভারী হল, —বাবুয়া স্বেচ্ছায় এসেছে।

—ও কে। ও কে।…এ কথা তো মানো, তোমরা এখানে পড়ে থাকলে আমাদের খারাপ লাগে?

কথাটা রাখীর পছন্দ হল না। সে যে এখানে কেন আছে, তা নিশ্চয়ই আর এখন শান্তর অজানা নয়। তারপর এই ঢঙের কথাবার্তার কোনও মানে হয়!

রাখী চোখ কুঁচকোল,—তোমাদের আর কিছু খারাপ লাগে না?

শান্তশীল একটু চুপ করে থেকে বলল,—দ্যাখো বউদি, খারাপ তো আমাদের অনেক কিছুই লাগে। কিন্তু সব কিছুর ওপর তো আমাদের হাত নেই। তাও হয়তো তুমি ইম্‌পাল্‌সের মাথায় না চললে…। শান্তশীল ঝুঁকে কাপটা নামিয়ে রাখল,—তুমি তোমার জমি কামড়ে পড়ে থাকলে সিচুয়েশানটাই হয়তো অন্যরকম হত। তা হলে হয়তো দাদা…

রাখী সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল,—তোমার সঙ্গে তোমার দাদার দেখা হয়েছে?

শান্তশীল চুপ।

—গেছিলে ওখানে?

এবারও উত্তর নেই।

—কী দেখলে? রাখী আর স্থৈর্য রাখতে পারল না,—চুপ করে থেকো না, বলো।

শান্তশীল অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।

মুহূর্তে অসাড় হয়ে গেল রাখীর বুক। যে আশঙ্কাটা মনের মধ্যে ঘুরে মরছে অহরহ, সেটাই তবে সত্যি হল!

করতে না চেয়েও প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল রাখীর মুখ থেকে,—মেয়েটা তবে এখন তোমার দাদার সঙ্গেই আছে?

শান্তশীল হাত ওলটাল।

—বাবা-মা জানেন?

—শুনেছেন।

—কী বলছেন তাঁরা?

—আহ্‌ বউদি, ছাড়োনা ও সব কথা। শান্তশীল বাচ্চা ভোলানোর স্বরে বলল,—এটা কেন মনে রাখছ না, তুমি আমাদের বাড়ির বউ! বড় বউ! তোমার জায়গা আমাদের কাছে ঠিকই আছে।… চলো, ফিরে চলো।

শেষ কথাগুলো যেন কানেই গেল না রাখীর। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রুগির মতো বিকৃত হয়ে গেছে তার মুখ। হিসহিসিয়ে উঠল,—একটু আগে তুমি ফ্যামিলি প্রেস্টিজের কথা বলছিলে না? আমি এখানে থাকলে তোমাদের সম্মানহানি হয়, অ্যাঁ? তোমার দাদা যা করেছে তাতে বুঝি তোমাদের মুখে চুনকালি পড়ে না?

—দাদার কথা আলাদা বউদি।…আমরা কেউই দাদাকে সাপোর্ট করছি না। কিন্তু একটা কথা তো মানতেই হবে, হি ইজ আ জিনিয়াস। এবং জিনিয়াসদের এ রকম পদস্খলন ঘটেই থাকে। এমন ঘটাটা হয়তো অন্যায়। তবে আমাদের কমন নীতিবোধ দিয়ে এই সব মানুষদের বিচার করাও বোধহয় ঠিক নয়। এ ছাড়া আর একটা বাস্তব কথা বলি। এ সব ইনভল্‌ভ্‌মেন্ট বেশি দিন টেকেও না। দেখলাম তো মেয়েটাকে, ওই মেয়ে কদিন থাকবে দাদার কাছে? দু দিন বাদেই কেটে পড়বে।… এখন এই ক্রাইসিস মোমেন্টে তোমাকেই শক্ত হতে হবে। তুমি এই সময়ে হাল ছেড়ে দিলে চলবে কেন?

বারে বা, জিনিয়াসের স্ত্রী হয়েছে বলে কি তাকে সর্বংসহা হতে হবে? অন্য এক মেয়ের সঙ্গে আশনাই চালাবে তার বর, আর তাকে গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে কখন মতি ফিরবে স্বামীর? একটা শিক্ষিত মানুষ হয়ে এ কথা কী করে বলছে শান্তশীল? রাখীর অসম্মানটাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না?

শান্তশীল সিগারেট ধরাল আর একটা। আবার বলল,—দ্যাখো বউদি, দাদাকে তো আমি কম দিন দেখছি না…তোমাকে আমি অ্যাশিওর করতে পারি, দাদার কাছে তোমার একটা স্পেশাল পজিশান আছে। দাদা এখনও তোমার কথা ভাবছে, বাবুয়ার কথা ভাবছে…। হি হ্যাজ আ জেনুইন ফিলিং ফর বোথ অফ ইউ। ইনফ্যাক্ট, দাদার রিকোয়েস্টেই তোমার কাছে আজ এসেছি।

রাখীর ঠোঁট বেঁকে গেল,—আমাকে লেক টেরেসে থাকার নির্দেশটা কি তোমার দাদারই দেওয়া?

—উঁহুঁ, ওটা আমরাই চাইছি। দীপালি বলছিল, ওতে তোমার নিজের জায়গাটা সিকিওরড্‌ থাকবে।

—সরি শান্ত। আমি অতি নগণ্য মানুষ, তোমার দাদার তুলনায় কিচ্ছু না, কিন্তু একটা মানুষ তো বটে। যেখানে তোমার দাদার সঙ্গেই আমার কোনও সম্পর্ক এগ্‌জিস্ট করে না, আই মিন সম্পর্ক থাকছে না, সেখানে ওইভাবে জমি আঁকড়ানোর চেষ্টা করে কী লাভ? আমাকে অন্তত এইটুকু আত্মসম্মান বজায় রাখতে দাও।

—তুমি কি ডিসিশান নিয়েই ফেলেছ?

—ডিসিশান নেওয়ার আমি কে! রাখীর স্বরে বিদ্রূপ ফুটল,—ডিসিশান তো তোমার দাদাই নিয়েছে। আমি শুধু নিজের মান বাঁচানোর চেষ্টা করছি।

—দ্যাখো, যা ভাল বোঝ করো।…আমার শুধু খারাপ লাগছে বাবুয়ার কথা ভেবে। আফটার অল ও আমাদের বাড়ির ছেলে…

—না। বাবুয়া আমার ছেলে।

—এ সব কিন্তু জেদাজেদির কথা। তুমি চাইলেই কি বাবুয়ার পিতৃপরিচয় বংশপরিচয় সব মুছে যাবে? খ্যাতিমান বাবায় তারও কিছু অধিকার আছে, সেটা তুমি কেড়ে নিতে পারো না।

—আমি কেন কাড়তে যাব। বাবুয়া বড় হয়ে গেছে, যা ভাল বোঝে তাই করবে। তোমাদের কাছে যেতে চাক, কি তোমার দাদার কাছে, আমি বাধা দেব না।

শান্তশীল মাথা নাড়ল। আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। চেপে চেপে সিগারেট নেভাল অ্যাশট্রেতে। হঠাৎ ব্রিফকেস খুলে একটা বাদামি খাম বার করেছে। সামান্য ইতস্তত করে বাড়িয়ে দিল রাখীর দিকে,—এটা রাখো।

—কী আছে এতে?

—টাকা। তিন হাজার। দাদা পাঠিয়েছে।

—হঠাৎ।

—তোমার একটা খরচখরচা আছে না? বলেছে, প্রত্যেক মাসে পাঠাবে।

রাখীর কান্না পেয়ে গেল। এখনই তাকে খোরপোষ দিতে চায় বোধিসত্ত্ব? মানে তাকে পাকাপাকিভাবেই জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে! টাকার তার প্রয়োজন আছে ঠিকই, কদিনই বা এসেছে রন্টুর বাড়ি, এখনই মনে হয় ভায়ের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে। রন্টুর অবস্থা অবশ্য যথেষ্ট সচ্ছল, সে মোটেই দিদিকে বোঝা বলে মনে করে না, অন্তত এখনও পর্যন্ত। তবু এখানে এসে নিজের হাতে আগের মতো একটু আধটু খরচাপাতি করতে পারলে এ সঙ্কোচটা হয়তো রাখীর কেটে যেত। তা বলে রাখী ওই টাকা স্পর্শ করবে?

শুকনো গলায় রাখী বলল,—তোমার দাদা মহৎ মানুষ। তার অপার করুণা।…তাকে বোলো তার দয়া ছাড়াও আমি বেঁচে থাকতে পারব।

—ছেলেমানুষি কোরো না বউদি। টাকার ওপর রাগ করতে নেই। রেখে দাও।

—শান্ত, প্লিজ…

শান্তশীল থমকে গেল। সবার কাছে চিরটাকাল রাখী ব্যক্তিত্বহীন বলেই পরিচিত, কিন্তু এই মুহূর্তে তার স্বরে এমন এক অস্বাভাবিক দৃঢ়তা ছিল, যা তার সমবয়সী দেওরটিকে থমকাতে বাধ্য করল। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে খাম ভরে রাখছে ব্রিফকেসে।

উঠে পড়ল,—তুমি কিন্তু আমায় ভুল বুঝো না বউদি। আমি তোমার ভালর জন্যই…

রাখী কথা বাড়াল না। গাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে এল দেওরকে। পায়ে পায়ে ফিরল।

ঘরে ঢুকতেই মিত্রা উড়ে এসেছে যেন,—সত্যিই তা হলে জামাইবাবু মেয়েটাকে নিয়ে আছেন! ছি ছি ছি…

আড়াল থেকে তবে সব শুনেছে মিত্রা! যেটুকু জানত না, সেটুকু শূন্যস্থান পূরণ হয়ে গেল আজ! এই কদিন সব কথাই রাখা রাখা ঢাকা ঢাকা ছিল, শান্তশীল এসে আবরণটা ঘুচিয়ে দিয়ে গেল।

মিত্রা বলেই চলেছে,—তুমি মেয়েটাকে দেখেছ? তখনই মুড়ো ঝ্যাঁটা দিয়ে ও মেয়ের বিষ ঝেড়ে দিতে পারোনি? জামাইবাবুরও বলিহারি যাই! বুড়ো বয়সে ভীমরতি! তোমার কিন্তু আরও শক্ত হওয়া উচিত ছিল দিদি।

রাখীর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে না মিত্রা, নিজে নিজেই বকে যাচ্ছে। তার ক্ষোভটা খুব স্বতঃস্ফূর্ত, টের পাচ্ছিল রাখী। একই সঙ্গে মনে মনে সিঁটিয়েও যাচ্ছিল। এ বাড়িতে তার যথেষ্ট সম্মান আদর। শুধু রন্টুর দিদি, বা সূর্যকান্ত চৌধুরীর মেয়ে বলেই নয়, ওই বোধিসত্ত্ব মজুমদারের স্ত্রী বলেও এখানে তার একটা বিশেষ আসন আছে। আজ সেই মানুষটাকেই প্রাণ ভরে গাল পাড়ছে মিত্রা। অর্থাৎ রাখীরও এ বাড়িতে মর্যাদাটা কমে এল।

সন্ধ্যবেলা রন্টুও এসে ঘরে দাপাতে শুরু করল,—দিদি, মিত্রা যা বলছে সেটা কি ঠিক?

ছ বছরের ছোট ভায়ের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলতে প্রবৃত্তি হচ্ছিল না রাখীর। তবু ঘাড় নাড়ল।

—তুই আমায় কথাটা আগে বলিসনি কেন? দেখতাম জামাইবাবুর কত সাহস তোকে বাড়ি থেকে তাড়ায়!

রাখী মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল,—তোর জামাইবাবু আমায় তাড়ায়নি রে, আমি নিজেই চলে এসেছি।

—থাক থাক, আর জামাইবাবুকে গার্ড দিতে হবে না। এই করে করেই তো লোকটার মাথা খেয়েছিস। হুঁহ, বিজ্ঞানী! চোখের চামড়া নেই, বজ্জাতের ধাড়ি! এই যে সারাটা জীবন ধরে চোখ বুজে লোকটার সেবা করে গেলি, কী পেলি ভেবে দ্যাখ এবার!

কথাগুলো রাখীরও মনের কথা, তবু রন্টুর মুখে শুনতে মোটেই ভাল লাগছিল না। কিন্তু একবার যখন শুরু হয়ে গেছে, রন্টুকে আর থামায় কে! রীতিমতো জেরা শুরু করে দিয়েছে এবার,—তোকে নাকি টাকা পাঠিয়েছিল জামাইবাবু?

রাখী ঘাড় নাড়ল।

—আমার বাড়িতে আমার দিদি রয়েছে, সেখানে টাকা পাঠায়, অ্যাঁ? যদি সত্যি তোর টাকার দরকার হয়, ওই টাকা আমি গলায় গামছা দিয়ে বার করে আনব। দেব একটা অ্যাডাল্টারির মামলা ঠুকে, মাইনেটা পর্যন্ত অ্যাটাচড্‌ হয়ে যাবে। কী রে দিদি, দেব? পাঠাব একটা নোটিস?

রাখী সন্ত্রস্তভাবে বলল,—এক্ষুনি ও সব করার দরকার নেই, কটা দিন যাক।

—দ্যাখ তুই যা ভাল বুঝিস। তবে হ্যাঁ, ভাই হয়ে আমি তোর কাছে হাত জোড় করছি দিদি, ভুলেও আর তোর শ্বশুরবাড়িতে যাস না। শান্তদা এসে যাই বলে যাক, আমি তোকে লিখে দিতে পারি, আজ হোক কাল হোক ওরা ওদের দাদার পাশে গিয়েই দাঁড়াবে। আর তখন তোকে অনেক বেশি অপমানিত হয়ে ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হবে। বাবুয়া ফিরুক, আমি বাবুয়ার সঙ্গেও খোলাখুলি কথা বলে নিচ্ছি। আমি শিওর, ও তোর দিকেই থাকবে।…ভাবনা করার তো তোর কিছু নেই। এ বাড়ি তো তোরও বাড়ি, এ বাড়িতে তোরও অংশ আছে, তুই তোর নিজের জোরে এখানে থেকে যা।

রন্টু কি একটু বেশি সহানুভূতি দেখাচ্ছে না? কেন ওই সহানুভূতিকে নাটুকে আস্ফালনের মতো শোনায়? কোথায় মনের জোর বাড়বে তা নয়, রাখীর মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছে এক হীনম্মন্যতাবোধ। এ বাড়িতে তোরও অংশ আছে, কথাটা বলে কী স্মরণ করাতে চায় রন্টু?

রাখী তক্ষুনি কিছু বলল না ভাইকে। তবে একটা কথা উপলব্ধি করছিল, এ বাড়িতে আজ থেকে তার আর ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকবে না। সবই নিয়ন্ত্রিত হবে রন্টু আর রন্টুর বউয়ের অঙ্গুলিহেলনে। এরা দুজনেই তাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধাভক্তি করে, নিশ্চিতভাবে তার ভালই চাইবে, তবুও…। হয়তো বাড়ির খানিকটা জায়গা পাকাপাকি ছেড়ে দিয়ে বলল, দিদি এটা তোর জন্যে, তুই এখানেই থাক! হয়তো হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, এটা রাখ দিদি, তুই আর তোর ছেলে খরচ কর! বলবে ভাল মনেই, কিন্তু রাখী কি তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারবে?

নিজের ওপর ধিক্কার জাগছিল রাখীর। এককালে ফিলজফিতে অনার্স নিয়ে পাশ করেছিল সে, ঘরকন্নার কাজ করতে করতে কবে যেন সেই শিক্ষা মূল্যহীন হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলেও আজ আর তার অন্যের হাততোলা হয়ে থাকা ছাড়া বাঁচার উপায় নেই। এই পঞ্চাশ বছর বয়সে কোথায় কী কাজ জোটাবে সে? পরভৃৎ জীবনকেই পরম মোক্ষ ভেবে এতদিন সুখে দিন কাটিয়েছিল রাখী, একটা মাত্র ঝড়ে এই দুর্দশা হবে কে ভেবেছিল?

বাবুয়া ফিরল সাড়ে আটটা নাগাদ। ফিরেই রাখীর কাছে এসেছে,—শুয়ে পড়েছ যে? জ্বরটর এল নাকি?

—না, এমনিই। মাথাটা টিপটিপ করছে…

—ওষুধ খেয়েছ?

—দরকার নেই, কমে যাবে।… তোর এত দেরি কেন? কী পড়াচ্ছিলি এতক্ষণ?

—আর বোলো না, দুটোর মাথাতেই গোবর পোরা। সামনে অ্যানুয়াল পরীক্ষা, এখন একটু ভাল করে ধোলাই না দিলে চলে! বাবুয়া হাসল—আজ ছেলেটার ইতিহাস পরীক্ষা নিচ্ছিলাম। কী লিখেছে জানো? আকবরের বাবার নাম শাজাহান। আর মেয়েটা তো অঙ্ক কষতে গিয়ে…

—তোর কাকা কিন্তু তোর টিউশানি করা পছন্দ করছে না।

বাবুয়ার হাসি হোঁচট খেয়ে গেল। চোখ কুঁচকে তাকিয়েছে।

রাখী বিছানায় উঠে বসল—আজ শান্ত এসেছিল। কথা হচ্ছিল তোকে নিয়ে।

—তাই বলো। কখন এসেছিল?

—এই তো বিকেলের দিকে। তিনটে চারটের সময়।…আমাদের ও বাড়ি চলে যেতে বলেছে।

—ও।

ছেলের গোমড়া মুখখানা একটু দেখে নিয়ে রাখী বলল—তোকে একটা কথা বলব বাবুয়া? রাগ করবি না তো?

—রাগ করার মতো কিছু বলবে নাকি?

—না। ভাল কথাই বলব।…বলি কি, তুই লেক টেরেসে ফিরে যা। হপ্তায় হপ্তায় আসবি, আমার সঙ্গে দেখা করে যাবি, ইচ্ছে হল, মাঝে মাঝে এখানে এক আধদিন রয়ে গেলি…

—হঠাৎ এ কথা উঠছে কেন মা?

—শান্ত খুব জোর করছিল। বার বার বলছিল, বাবুয়া আমাদের বাড়ির ছেলে…। আমিও ভেবে দেখলাম, তুই কেন মিছিমিছি এখানে…! ওটাই তো তোর নিজের বাড়ি, নয় কি?

—আমার কোনও বাড়ি নেই। ওটা আমার ঠাকুরদার বাড়ি।

—এটা কি যুক্তির কথা হল বাবুয়া? তুই কি অস্বীকার করতে পারিস তুই ওই মজুমদার বাড়ির ছেলে?

—আমি কোনও বাড়ির ছেলে নয়। আমি তোমার ছেলে। তুমি যদি ও বাড়ি না যেতে পারো, আমিও পারি না।

ছেলের মুখে এ কথাই শুনতে চাইছিল রাখী, তবু মিনতির সুরে বলল—আমার যাওয়ার উপায় নেই রে। নইলে আমি নিশ্চয়ই যেতাম।

—আমি তোমাকে একবারও যেতে বলিনি মা। আমি শুধু বলছি, তোমার যেখানে থাকার অসুবিধে, সেখানে আমিও থাকব না।

—সে তো আমার এখানেও থাকতে ভাল লাগছে না।

—থেকো না এখানে। বলো তো আমি কাল থেকেই বাড়ি খুঁজতে পারি।

—যাহ্‌, তা হয় নাকি? আমার টাকা কোথায়?

—ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয় মা। লকারে তোমার নিজের যা গয়নাগাঁটি আছে, তুলে নাও। তার থেকে কিছু বেচে আমরা কটা মাস চালাতে পারব না? এর মধ্যে আমার পরীক্ষাও হয়ে যাবে।… কিছু একটা আমি জোগাড় করে নেব, তুমি দেখো।

—তুই চাকরি করবি? পড়াশুনো ছেড়ে দিবি? রাখী প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।

—আহ্ মা, পড়াশুনো আগে, না বেঁচে থাকাটা আগে? সময় সুযোগ পেলে পড়ব, নয়তো…। আগে আমায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

বাবুয়ার চোখমুখ ভাল ঠেকছিল না রাখীর। কেমন যেন অস্বাভাবিক রকমের জ্বলজ্বল করছে। মাকে খাওয়ানো পরানোর ভার নিতে চাইছে, কবে থেকে এত বড় হয়ে গেল বাবুয়া?

বাবুয়া পাশে এসে বসল—তুমি কিছু ভেবো না মা। এভরিথিং উইল বি ফাইন। আমি তো আছি।

রাখীর চোখে জল এসে গেল। তার কথা ভেবে ছেলে লেখাপড়া ছেড়ে দেবে, এ কথা যেন কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। ওইটুকু ছেলে কী চাকরি করবে? এ কী অসহায় অবস্থায় ছেলেকে ফেলে দিল রাখী?

বহুকাল পর বাবুয়া জড়িয়ে ধরেছে রাখীকে, সেই ছেলেবেলার মতো। গাল থেকে চোখের জল মুছে দিল, মাথায় হাত বোলাচ্ছে। মৃদু স্বরে বোঝাচ্ছে রাখীকে। যেন রাখী এখন বাচ্চা মেয়ে, বাবুয়া তার প্রাপ্তবয়স্ক অভিভাবক। যেন রাখী তার আশ্রয় নয়, সেই রাখীর আশ্রয়।

জীবন যে কাকে কখন কোথায় নিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *