০১. ঝড়ের গতিতে ডিনার

নীল ঘূর্ণি -সুচিত্রা ভট্টাচার্য

.

পূরবী ভট্টাচার্য
বিদ্যুৎ ভট্টাচার্য
প্রীতিভাজনেষু

.

ঝড়ের গতিতে ডিনার সারছিল দয়িতা। খাওয়া নয়, গলাধঃকরণ। রুটি ছিঁড়ছে, মুখে তুলছে, জল খাচ্ছে ঢকঢক। বিষম লাগল হঠাৎ, সামলাতে গিয়ে বুক আবার ধড়াস। বোধিসত্ত্ব আজ তাড়াতাড়ি চলে যাবেন না তো?

ডাইনিং হল এখন টইটম্বুর। হোস্টেলে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় দুশো। ইঞ্জিনিয়ারিং, রিসার্চ স্কলার, পিওর সায়েন্স সব মিলিয়ে-জুলিয়ে। তাদের অন্তত জনা সত্তর হলে মজুত এখন, নৈশ আহারের এটাই পিক টাইম। ডজন খানেক টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে মেয়েরা, গড়ে উঠেছে ছোট ছোট জোট। ইয়ার মাফিক। সাবজেক্ট মাফিক। কোথাও বা নিছক বন্ধুদের জটলা।

দয়িতার বাঁয়ে সুপর্ণা, ডাইনে মৈত্রেয়ী। ক্লাসমেট। এম.এসসি সেকেন্ড ইয়ার, ফিজিক্স। উলটো দিকে ঋতা, এক বছরের জুনিয়র।

সুপর্ণা ক্যান্টিন-ডিশের খোপ থেকে একটা ডিম তুলে নিয়ে লোফালুফি করছে,—এটা কিসের ডিম বল তো?

-গোলাপায়রা অফকোর্স। আমাদের কারনিসে যেগুলো দিনরাত বকম বকম করে। মৈত্রেয়ী হি হি হেসে উঠল।

ঋতা বিজ্ঞের মতো বলল,—পায়রার ডিম খুব টেস্টফুল হয় কিন্তু।

—তুই খেয়েছিস?

—আমি কেন খাব! বেড়ালগুলো খুব রেলিশ করে খায়, দেখেছি।

—পয়জনাস নয় তো? সুপর্ণার চোখে ছদ্ম ত্ৰাস,—খেলে পেট খারাপ হবে না?

—কাম অন্‌ সুপু, নাথিং উইল হ্যাপেন। বেড়ালগুলো তো দিব্যি হজম করছে।

—বেড়াল আর মানুষের মেটাবলিক সিস্টেম কি এক?

পাশের টেবিলে বসা দিল্লির মেয়ে অনুশা চেয়ার হেলিয়ে তাকাল,—ইয়ে আণ্ডা থোড়ি কববুকা হ্যায়। মাস্ট বি অফ ছিপকলি, আই বেট।

ব্যস, বিচিত্র সব গবেষণা শুরু হয়ে গেল। রাতের মেনু আজ অতি যাচ্ছেতাই। ওই ছুন্নি গুলি সাইজের ডিমের কারি, যার মশলা এক দিকে, ঝোলের নদী এক দিকে। সঙ্গে ঘাঁটা ঘাঁটা সবজি, সম্ভবত তাতে ফুলকপি আলু আছে। আর এক অজ্ঞাত বস্তুর চাটনি। বস্তুটা তেঁতুলও হতে পারে, আমসত্ত্ব হওয়াও অসম্ভব নয়। সব কটা পদই সমান বিস্বাদ। এই ক্যাম্পাস টাউনশিপের প্রতিটি পাচকই খারাপ রান্নায় ডক্টরেট। তবে মেয়েদের এ সব মোটামুটি জিভে সয়ে গেছে। গুলতানি করতে করতে খেয়ে যায়, কী খায় খেয়াল থাকে না। ডিম নিয়ে গবেষণাও এই ভুলে থাকার এক অঙ্গ।

গোটা হলেই জোর গজল্লা চলছে। কোনও টেবিলে ডিম-মেটাবলিজম-রিলেটিভিটি, কোথাও বা ঐশ্বরিয়া রাই, ক্লিন্টন, মনিকা লিউইনস্কি। কোথাও বা শচীন আজহার সৌরভ, কোথাও সলমন আমির শাহরুখ। এই টেবিলে ঝরনার কলকল, তো ওই টেবিলে ভাঙা রেকর্ডের বনঝন। শব্দ বাজছে, বেজেই চলেছে।

দয়িতা এসব কিছুই শুনছিল না। সে এখন এক প্রায়-বধির নারী, যার আনমনা চোখ ঘুরছে ঘরে, কিন্তু দেখছে না কিছুই। হৃৎপিণ্ডে তার এখন এক অবিরাম লাবডুব। হে ঈশ্বর, যেন দেখা পাই, যেন দেখা পাই।

কোনওক্রমে খাওয়া সেরে চেয়ার ছাড়ল দয়িতা। টেবিল-কেতা মেনে সঙ্গীদের উদ্দেশে ঠোঁট নাড়ল,—এক্সকিউজ মি…বাই…

সুপর্ণা টেরিয়ে তাকাল, —ওমা, তুই ছিলি নাকি এতক্ষণ?

মৈত্রেয়ীর মুখে বজ্জাতি হাসি, স্বর নিরীহ, —তোর টাইম হয়ে গেছে, না রে?

দয়িতা কথা বাড়াল, চোয়াল ফাঁক করল সামান্য। থালা হাতে এগোল সিঙ্কের দিকে। এখানে নিজের থালা নিজেকে তুলতে হয়। নিয়ম।

ডাইনিং হল থেকে দয়িতার ঘর বেশ খানিকটা পথ, হোস্টেলের একেবারে অন্য প্রান্তের দোতলায়। দু শয্যার কামরা। পরিমিত আসবাব। মাথা-পিছু একটা করে খাট চেয়ার টেবিল। লোহার। এর বাইরে কিছু লাগলে নিজেরাই ব্যবস্থা করে মেয়েরা। দয়িতার একটা বেঁটে মতন ওয়ার্ড্রোব আছে, রুমমেট চিরশ্রী সে ব্যাপারেও বিনদাস। দেয়ালে সে কটা অস্থায়ী হুক লাগিয়ে নিয়েছে, ছাড়া পোশাক সেখানেই অবলীলায় ঝুলিয়ে রাখে। ঘরে দুটো আয়নাও আছে, যার যার নিজস্ব। মেয়েরা অন্য মেয়ের আয়নায় নিজের মুখ দেখা পছন্দ করে না।

চিরশ্রী এখনও বিছানায় উপুড়, থ্রিলার গিলছে। মেয়েটা রীতিমতো গ্রন্থকীট। সারাক্ষণ তার হাতে হয় শিফ-কিটেল-ফেইনম্যান, নয় লুডলাম-জন লেকার-ফ্রেডরিক ফরসাইথ। ডাইনিং হল, কমনরুম, ক্যান্টিন, কোথথাও কেউ কখনও তাকে বই ছাড়া দেখেনি। দয়িতাদের ক্লাসে সেই ফার্স্ট গার্ল।

ঘরে ঢুকেই দয়িতা সোজা আয়নার সামনে। খচাখচ চিরুনি চালাচ্ছে কাঁধছোঁয়া স্টেপকাট চুলে, মুখে ক্রিম থুপল, গালে নড়াচড়া করছে অস্থির আঙুল। সময় নেই, সময় নেই…

আয়না দিয়েই চিরশ্রীকে দেখতে দেখতে বলল, খেতে গেলি না?

চিরশ্রী বই থেকে মুখ তুলল না। ছোট দুটো শব্দ এল,—উঁ? হুঁ।

—যা, যা, এর পর আর কিচ্ছু জুটবে না।

—হুম।

—আমি একটু আসছি। তুই থাকবি তো রুমে?

চিরশ্রী পড়াং করে ঘাড় ঘোরাল। ভুরুতে ভাঁজ,—আজও চললি?

দয়িতা ফিক করে হাসল,—আজ দেরি করব না, দেখিস।

চিরশ্রীর গোলগাল চশমা পরা মুখে একটা জন্মগত দিদি দিদি ভাব আছে। বই উলটে রেখে ভাবটাকে মুখে প্রকট করল চিরশ্রী। গিরজার পাদরির স্বরে বলল, —ইউ আর গোয়িং টুউ ফার, দয়ি।

—কদ্দুর আর গেছি! টুক করে ঠোঁটে ন্যাচারাল শাইন লিপস্টিক বুলিয়ে নিল দয়িতা, —মাত্র তো লাইব্রেরি থেকে মেন গেট। বড় জোর গেট থেকে বাড়ি।

—তাই বা যাবি কেন?

—ভাল লাগে তাই। ইচ্ছে করে, তাই।

—ইচ্ছেটাকে রেজিস্ট কর।

—পারি না রে।

—যত সব নেকু নেকু কথা! চিরশ্রী বাবু হয়ে বসল, —জানিস, তোকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে?

—আই কেয়ার এ ফিগ। আমি কি বি-এম-এর সঙ্গে প্রেম করছি নাকি? আই ডু অ্যাডমায়ার হিম। ওঁর সঙ্গে আমার কথা বলতে ভাল লাগে। ঝটপট ওয়ার্ড্রোব খুলল, বন্ধ করল দয়িতা। দুধ-সাদা স্বচ্ছ ওড়না বিছিয়ে দিল দু কাঁধে। লঘু স্বরে বলল,—আর যদি কারুর মনে মনে ইচ্ছে থাকে, সেও যেতে পারে। আমি জানি, অনেকেই বি-এম-এর জন্য ফিদা। আমাদের ক্লাসেরই। পরপর নাম করে যাব?

—হতে পারে। তবে তোর মতো খুকিপনা কেউ করবে না। চিরশ্রী অভিভাবকের মতো গম্ভীর,—দ্যাখ দয়ি, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে, এই বয়সে আর আইডল ওয়রশিপ মানায় না। এগুলো হল টিনএজ সিন্ড্রোম।

দয়িতা আর তর্কে গেল না। পরনের মেরুন কামিজ ঝটপট ঝাড়ল আলগা হাতে, টেবিল থেকে ছোঁ মেরে একটা বই তুলে নিল, আরেক বার ঘাড় এলিয়ে ঘাড় সোজা করে দেখে নিল নিজের পানপাতা মুখ। এক লহমায়। আলোর গতিতে। ভেজানো দরজা হাট করে বেরতে বেরতে কথা ছুড়ল,—আমি কিন্তু রুম-কি নিয়ে বেরোলাম না।

হরিণ-পায়ে হাঁটছে দয়িতা। সুছন্দ গতিতে পার হয়ে গেল থার্ড ইয়ার কেমিক্যালের তিন তর্করত যুবতীকে, করিডোরে সুতনুকা আর রাগিণী মৌজ করে সিগারেট খাচ্ছে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস টেনে পোড়া তামাকের পুরুষগন্ধটা বুকে ভরে নিল। কমন রুম থেকে ভেসে আসা চাকভাঙা মৌমাছির ধ্বনি ক্ষীণ ক্রমশ, দয়িতা এখন খোলা আকাশের নীচে।

গেটের সামনে চওড়া পিচরাস্তা। আইনস্টাইন সরণি। রাস্তাটা ভারী সুন্দর। দু ধারের বৃক্ষরাজি চাঁদোয়ার মতো ঢেকে রেখেছে পথ, ফাঁক দিয়ে আকাশ এখানে দেখা যায় কি যায় না। এ রাস্তা শুরু হয়েছে ইউনিভার্সিটির মেন গেট থেকে, এ পথেই সার সার ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেল। মেয়েদের হোস্টেল সবার আগে, মেন গেট থেকে বড় জোর শ’-তিনেক গজ দূর।

সবে নভেম্বর পড়েছে। এর মধ্যেই এ দিকে বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। দয়িতার মুহূর্তের জন্য মনে হল একটা চাদর নিয়ে নিল ভাল হত। পথ প্রায় নির্জন, বোধ হয় ঠাণ্ডার জন্যই। একটা-দুটো সাইকেল হঠাৎ হঠাৎ হুসহাস চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে, হোস্টেলের ছেলেরা চলেছে এ দিক সে দিক। অনেকটা দূরে দূরে পথবাতি জ্বলছে। নিওনের দ্যুতিতে আলোছায়ার মতো। কুয়াশা নামছিল।

মেন গেটের মুখে এসে দয়িতা ক্ষণিক দাঁড়াল। রোজই দাঁড়ায়। মুখে যাই বলুক, প্রতি দিন ঠিক এই সময়ে কোথথেকে এক দ্বিধা এসে আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরে তাকে, ভারী হয়ে যায় পা। তার এই হ্যাংলার মতো ছুটে যাওয়া দেখে বোধিসত্ত্ব কিছু মনে করেন না তো? দুৎ, লাইব্রেরিতে তো দয়িতা যেতেই পারে, যে কোনও সময়ে। বোধিসত্ত্ব তার শিক্ষক, তাঁর সঙ্গে দুটো কথা বলতে বলতে ফিরতেই পারে দয়িতা, এর মধ্যে এত কিন্তু কিসের? আর বোধিসত্ত্ব মজুমদারের মতো একজন বিশ্ববিশ্রুত অধ্যাপকের দয়িতাকে নিয়ে ভাবতে ভারী বয়েই গেছে। লতাকে নিয়ে মহীরুহ মাথা ঘামায় না। অস্তিত্বই কি টের পায়?

আশ্চর্য মানুষের মন! স্বপক্ষে সাজানো একের পর এক যুক্তি যতই অকাট্য হয়ে উঠতে থাকে, ততই এক গোপন কষ্টে ছেয়ে যায় বুক। ওই কষ্টটাই তাড়িয়ে নিয়ে চলে দয়িতাকে, মেন গেট পেরিয়ে বৃত্তাকার লন, তা পেরিয়ে ক্যান্টিন, তারপর লাইব্রেরি, নিশিতে পাওয়া মানবীর মতো দয়িতা ঢুকে পড়ে বিশাল রিডিংরুমে, অজস্র চোখ উপেক্ষা করে ম্যাজেনাইন ফ্লোরে উঠে যায়। সেখানে সার সার কিউবিকল। কাচঘেরা। বাঁ দিকের একদম শেষের খোপটি প্রফেসর বোধিসত্ত্ব মজুমদারের জন্য চিহ্নিত। মহাজগতের জন্মরহস্য নিয়ে জটিল এক অঙ্কের সমুদ্রে ডুবে থাকেন বোধিসত্ত্ব, ওই ছোট্ট ছয় বাই ছয় খোপটায়। সামনে বইয়ের স্তূপ, কাগজের পাহাড়, ইন্টারনেটে সংযুক্ত কম্পিউটার, আর মাথার পিছনে এক জোরালো আলো। দয়িতা কাচের এপারে দাঁড়ায়, মুগ্ধ চোখে একটুক্ষণ দেখে ধ্যানমগ্ন তপস্বীকে। আলোটাকে মনে হয় দিব্যজ্যোতি, বোধিসত্ত্বর শরীর থেকেই যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তার পর ধীর পায়ে নেমে আসে হলে, শুরু হয় প্রতীক্ষা…

আজ দয়িতার কপাল ভাল। লন পেরিয়ে ক্যান্টিনের দিকে যেতেই অদূরে বোধিসত্ত্ব। দয়িতা স্থাণু। ভাগ্যিস চিরশ্রীর সঙ্গে তর্ক বাড়ায়নি। আর দু মিনিট হলেই…।

বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসছেন বোধিসত্ত্ব মজুমদার। দীর্ঘ ঋজু কাঠামো, গড়ন খানিকটা রোগার দিকেই, মাজা গায়ের রং, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। ছাপ্পান্ন বছর বয়স। দেখে অবশ্য একটু বেশিই মনে হয়। চুলের জন্য। বোধিসত্ত্বর একমাথা চুল, একদম ধবধবে সাদা। মুখে তেমন লালিত্য নেই, বরং বেশ রুক্ষই। কাটা কাটা। শুধু চোখ দুটি ভারী উজ্জ্বল। কুচকুচে কালো চোখের মণি মোটা লেন্সের আড়ালেও অদ্ভুত দীপ্তিময়।

সামনে এসে গেছে বোধিসত্ত্ব। দয়িতার পাঁজরের নীচে গমকল চালু হয়ে গেল। তালু হঠাৎ শুকিয়ে কাঠ, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

রাস্তা ছেড়ে একটু সরে দাঁড়াল দয়িতা। অস্ফুটে বলল,—ফিরছেন স্যার?

ক্যান্টিনের বাইরের আলোটা জ্বলছে না, অন্ধকার সামান্য ঘন হয়ে আছে জায়গাটায়। বোধিসত্ত্ব থেমে চোখ কুঁচকোলেন,—ও তুমি… এখন লাইব্রেরি যাচ্ছ?

—হ্যাঁ…মানে…না। লাইব্রেরি থেকেই ফিরছিলাম স্যার, আপনাকে দেখে…আপনি স্যার আজ একটু তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন না?

—আর বোলো না। কী যেন একটা অকেশান আছে বাড়িতে। তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে। বোধিসত্ত্বর কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল,—বাই দ্য বাই, ঠিক কটা বাজে বল তো?

—আটটা দশ। কবজি চোখের একদম কাছে নিয়ে এল দয়িতা, —না না, আটটা বারো।

—তা হলে খুব বেশি দেরি হয়নি, কি বলো? হা হা। আপন মনে হাসলেন বোধিসত্ত্ব। হাতে হাত ঘষছেন। চকোলেট রঙের হাফস্লিভ সোয়েটার পরে আছেন, শার্টও হাফহাতা, সম্ভবত ঠাণ্ডা লাগছে। বুকপকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরালেন। দেশলাই কাঠি ফেলতে গিয়ে চোখ দয়িতার ডান হাতে, —ওটা কী বই?

দয়িতা ফাঁপরে পড়ল। ইশ, টেবিল থেকে তোলার সময়ে মলাটের রং পর্যন্ত দেখা হয়নি। বই ছাড়া হাতটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে, তাই না…

চোখ বুজে বলে দিল, —অ্যাটমিক স্পেকট্রার বই স্যার।

—কার?

—লাইব্রেরির।

—সে তো বুঝেছি। অথর কে?

সর্বনাশ, কোনও নাম মনে আসছে না। দয়িতা ঢোঁক গিলল,—দেখিনি স্যার নামটা। এমনিই উলটোচ্ছিলাম, মনে হল ইস্যু করে নিয়ে যাই…

—ইস্যু কাউন্টার তো ছটায় বন্ধ হয়ে গেছে। বোধিসত্ত্ব হাঁটা শুরু করল, —তুমি তা হলে অনেকক্ষণ এসেছ?

দয়িতা ঢক করে ঘাড় নেড়ে দিল।

—তোমাদের ডিনার টাইম হয়ে গেছে না? না খেয়ে লাইব্রেরিতে বসে ছিলে?

এই সব অতি তুচ্ছ জিজ্ঞাসাও বোধিসত্ত্ব মজুমদারের মাথায় আসে! মুগ্ধ দয়িতা তড়িঘড়ি মিথ্যে বলে দিল,—বিকেলে এক বন্ধু খুব খাইয়েছে। খিদে হয়নি।

—ও।

প্রশ্ন শেষ। চুপচাপ হাঁটছেন বোধিসত্ত্ব, নিঃশব্দে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সিগারেটের ধোঁয়া। তামাক পোড়ার প্রিয় গন্ধটা নিঃশ্বাসে মিশিয়ে নিচ্ছিল দয়িতা। বোধিসত্ত্বর ওই লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটা, বচ্চন-ভয়েস, হঠাৎ হঠাৎ দমকা হাসি, হঠাৎ হঠাৎ আত্মমগ্ন হয়ে যাওয়া—সবই দয়িতার কেন যে এত ভাল লাগে। এমনকি ওই সিগারেট টানার উদাস ভঙ্গিটাও।

অধ্যাপকদের বাংলো আইনস্টাইন সরণির দিকে নয়। মেন গেটের সামনে দিয়ে একটা আড়াআড়ি রাস্তা ক্যাম্পাস পেরিয়ে চলে গেছে শহরের অভিমুখে, ওই পথে আধ কিলোমিটারটাক এগোলে পর পর শিক্ষকদের বাসস্থান। প্রথমে লেকচারারদের ফ্ল্যাট, তার পরে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসারদের কটেজ, তারও পরে প্রফেসরদের বাংলো। প্রফেসরদের প্রায় সকলেরই নিজস্ব বাহন আছে, দূরত্বের জন্য কারুর তেমন অসুবিধে হয় না। বোধিসত্ত্বই শুধু হেঁটে যাতায়াত করেন, গাড়ি থাকা সত্ত্বেও।

মেন গেট পেরিয়ে ডান দিকে ঘুরল বোধিসত্ত্ব,—ঠিক আছে দয়িতা, তা হলে চলি?

দয়িতার মন আনচান করে উঠল। এত তাড়াতাড়ি সঙ্গচ্যুত হবে সে! হোস্টেল যে ভারী বিবর্ণ লাগবে এখন। বেশিরভাগ দিন এখান থেকেই বিদায় নিতে হয় তাকে, বোধিসত্ত্বর বাড়ি পর্যন্ত গেছে সে কালেভদ্রে। আজও তো বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারে, এখনও তেমন কিছু রাত হয়নি। অন্য দিন বোধিসত্ত্ব ওঠেনই নটার পর।

দয়িতা মরিয়া স্বরে বলল,—কাল স্যার আপনি ডিসকাশানটা কিন্তু শেষ করেননি।

—কী ব্যাপারে বলো তো?

—ওই যে স্যার আপনি বলছিলেন এই সৌরজগৎ ক্রমশ এক গ্রেটার ডিসঅর্ডারের দিকে এগোচ্ছে…এনট্রপি বাড়ছে, ইউনিভার্সটা ক্রমশ এক্সপ্যান্ড করছে…

—ও হ্যাঁ। বোধিসত্ত্বকে মুহুর্তের জন্য চিন্তিত দেখাল,—কিন্তু ও নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেকটা টাইম লেগে যাবে। তোমার দেরি হবে, আমারও তাড়া আছে…

—চলুন না স্যার, হাঁটতে হাঁটতেই শুনি।

—যাবে এখন ও দিকে? একা একা অনেকটা পথ ফিরতে হবে কিন্তু।

—ক্যাম্পাসের মধ্যে তো স্যার, অসুবিধের কী আছে? আমরা তো কত দিন রাত বারোটা একটার সময়েও হাঁটতে বেরই।

—তাই বুঝি? হা হা হা…

উদাত্ত হাসিতে অঘ্রানের রাত দুলে দুলে উঠছে। একটু দূরের ছায়া ছায়া কুয়াশা সহসা যেন ফিকে হয়ে গেল। চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে লাইব্রেরি থেকে কথা বলতে বলতে ফিরছে, গতি মন্থর করে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে এ দিকে। বোধিসত্ত্বকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলেই চেনে, ছাত্রছাত্রীদের মুখে সম্ভ্রম আর বিস্ময়।

এক ঝলক ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে নিয়েই দয়িতা মুখ ঘুরিয়ে নিল। দেখুক, দেখুক যত খুশি।

বোধিসত্ত্ব স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে পা ফেলছেন। দ্রুতগতিতে। তাল মিলিয়ে চলতে অসুবিধে হচ্ছিল দয়িতার। প্রায় ছুটতে হচ্ছে তাকে, হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প।

বোধিসত্ত্বর খেয়ালই নেই। যেতে যেতে বললেন,—হ্যাঁ, কাল যেন কোথায় শেষ করেছিলাম?

—জগৎসৃষ্টিতে বিশৃঙ্খলার ভূমিকা। আবার সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও কীভাবে নিয়ম লুকিয়ে থাকে…

—হ্যাঁ, কারেক্ট, কারেক্ট। বোধিসত্ত্ব মাথা ঝাঁকাল। ওপরে মেঘহীন আকাশ, তারায় তারায় খচিত, সে দিকে একবার চোখ তুলে দেখে নিল। তারপর হঠাৎই বলল,—তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?

—ঈশ্বর! প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারল না দয়িতা।

—হ্যাঁ, ঈশ্বর। ভগবান। আল্লাহ। গড। জিহোভা। যাকে আমরা ইমাজিন করি অ্যাজ ক্রিয়েটার অব দিস ইউনিভার্স। উপনিষদের ভাষায় যাকে বলে ব্রহ্ম।…বাই দ্য বাই, তুমি উপনিষদ পড়েছ?

—না স্যার।

—মানে তুমি ঈশ্বর বিশ্বাসী নও?

কী বললে বোধিসত্ত্ব মজুমদার খুশি হবে বুঝতে পারছিল না দয়িতা। এ সব প্রশ্নের মাথামুণ্ডুই বা কী?

আমতা আমতা করে বলল,—তা ঠিক নয় স্যার। বিশ্বাস করি…

—আমি পরীক্ষার আগে থানে পয়সা ছোড়ায় বিশ্বাসের কথা বলছি না। বোধিসত্ত্বর গলা দুন্দুভির মতো বেজে উঠল,—আর ইউ আ বিলিভার? তোমার কি মনে হয় সমস্ত সৃষ্টির পেছনে এক আদিম মহাশক্তি কাজ করছে? এজলেস, টাইমলেস, লিমিটলেস এক এনার্জি? কোনও একটা পয়েন্ট থেকে সে একটা সুইচ অন করে ফেলেছে, অ্যান্ড আফটার দ্যাট এভরিথিং ইজ গোয়িং অন অ্যান্ড অন অ্যান্ড অন…?

শব্দগুলো দয়িতার কানে অনুরণিত হচ্ছিল। আবিষ্টের মতো বলল,—হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এরকমটা মনে হয় বটে।

—হয়? বোধিসত্ত্ব শিশুর মতো খুশি,—মনে হয় তোমার? হয়? বাহ বাহ। তুমি তা হলে ব্যাপারটা ফিল করতে পারবে।

বলেই সহসা চুপ। যেন নীরবতা দিয়েই অনুভব করাতে চাইছেন কিছু। উদ্দাম গতিতে একসঙ্গে দশ-বারোটা সাইকেল চলে গেল পাশ দিয়ে। উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছে আরোহীরা। পরের সিমেস্টারের মাস দেড়েক বাকি আছে, ইউনিভার্সিটির ছেলেরা এখন কিছুটা ঝাড়া হাত-পা, সিনেমা রেস্টুরেন্টে বিনোদন খুঁজতে খুঁজতে ছুটছে শহরে। তাদের তুরীয়ান কনভয়টা নৈঃশব্দের সুর কেটে দিল।

বোধিসত্ত্ব যেন ঈষৎ বিরক্ত। আবার সিগারেট ধরিয়েছেন।

দয়িতা মৃদু স্বরে বলল,—তারপর স্যার?

—হ্যাঁ, যা বলছিলাম। বিলীয়মান ছাত্রদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন বোধিসত্ত্ব,—তুমি রিলিজিয়াস গডকে ভেবো না, ক্রিয়েটার গডকে ভাবো। সৃষ্টির নিয়মটা কী অদ্ভুত! সূর্য যদি একটু দূরে থাকে, পৃথিবী বরফ হয়ে যাবে। একটু সামনে থাকলে দাউ দাউ জ্বলে যাবে। অর্থাৎ সূর্য ইজ প্লেসড ইন আ প্রপার পজিশন। সেই সূর্যের আবার ক্ষয় হচ্ছে, কিন্তু ক্ষয়ের রেটটা এমনই মাপা যে পৃথিবী-টৃথিবি মিলিয়ে গ্রহদের এই পরিবারটা মোটামুটি ঠিকই আছে। এই ব্যালান্সটা যে করেছে সে কি একজন ম্যাজিশিয়ান নয়? আর আমার প্রশ্ন ঠিক ওইখানেই। জাদুকর এমনভাবে গড়ল কেন? অন্য আর কী কী ভাবে সে এই জগৎটা তৈরি করতে পারত? আদৌ কি অন্য কোনওভাবে গড়া যেত? আকাশপানে তর্জনী তুললেন বোধিসত্ত্ব,—উঁহু, পারত না। এই মহাজগতে কোনও চান্স ফ্যাক্টর নেই। যা ঘটেছে সবই অবভিয়াস। ঈশ্বর বা ওই ম্যাজিশিয়ানটা একটা হাত-পা বাঁধা পুতুল মাত্র। গোটা সৃষ্টি এমন এক অঙ্ক, যার একটাই মাত্র সলিউশন ছিল…

কথাগুলো দয়িতার পুরোপুরি বোধগম্য হচ্ছিল না। সে রিলেটিভিটির তত্ত্ব পড়েছে, মহাশূন্যে দূরত্ব আর সময়ের হ্রাস-বৃদ্ধির কথাও তার অজানা নয়, সৃষ্টিরহস্যের সঙ্গে কাল আর মহাশূন্য যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, এও তার জ্ঞানের পরিধির মধ্যে পড়ে, কিন্তু স্যার যেন তার থেকেও দুরূহ কিছু বোঝাতে চান। তবে মাথায় ঢুকুক আর নাই ঢুকুক, মোহাবিষ্টের মতো শুনছিল দয়িতা। হঠাৎই আবিষ্কার করল বোধিসত্ত্বর বাংলো এসে গেছে।

এত তাড়াতাড়ি পথ ফুরিয়ে গেল!

বোধিসত্ত্বর বাংলোর সামনে অনেকটা বাগান। ঢোকার মুখে লোহার গেট। মহাজাগতিক ঘোর নিয়েই গেটের দিকে এগোলেন বোধিসত্ত্ব, ঘোরের মধ্যেই হাত রেখেছেন গেটে।

দয়িতা দাঁড়িয়ে পড়ল,—এবার আমি যাই স্যার?

—যাবে?…ও। এসো। গেটের আংটা খুলে কয়েক পা এগিয়েও বোধিসত্ত্ব ঘুরে এলেন। হালকাভাবে বললেন, তোমাদের মেয়েদের কি ঠাণ্ডা লাগে না?

—কেন স্যার?

—সন্ধেবেলা বেরলে গায়ে একটা গরম কিছু দিও। এ সময়ে ঠাণ্ডা লেগে গেলে অসুখে পড়ে যাবে।

নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না দয়িতার। যে মানুষ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে অঙ্ক কষতে ভালবাসে, তার চোখে এই সামান্য কিছুও ধরা পড়ে?

বোধিসত্ত্ব আবার বলল,—সাবধানে যেও। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে।

দয়িতা তবু দাঁড়িয়ে রইল দু-চার সেকেন্ড। সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে গেলেন বোধিসত্ত্ব, এবার পায়ে পায়ে ফিরছে দয়িতা। শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ, রোমে রোমে হর্ষ জাগছে। বোধিসত্ত্ব কোনও দিন তার সঙ্গে এত কথা বলেননি।

হোস্টেলে ফিরেই আচ্ছন্ন ভাব কেটে গেল। করিডরে ঋতা। তাকে দেখে ঋতা ত্বরিত পায়ে এগিয়ে এল,—কোথায় কোথায় চরে বেড়াচ্ছিস, অ্যাঁ! তোর একটা ফোন এসেছিল।

দয়িতা অবাক গলায় বলল,—আমার?

—হ্যাঁ, কলকাতা থেকে। রঘুদা ধরেছিল। খুঁজছিল তোকে।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফেরা হল না দয়িতার। পা চালিয়ে ওয়ার্ডেন অফিসে এল। রঘুনাথ দত্ত এই অফিসের ক্লার্ক, আসে সন্ধেয়, থাকে নটা সাড়ে ন’টা অবধি। অজস্র টুকটাক কাজ থাকে হোস্টেলের, সারে সেগুলো। আজ খটাখট টাইপ করছে। সম্ভবত কারও কোনও রিসার্চ পেপার। এই কাজে রঘু দত্তর কিছু উপরি ইনকাম হয়।

দয়িতাকে দেখেই রঘু বলল,—তোমার বাবা এক্ষুনি তোমাকে একবার ফোন করতে বলেছেন।

তুৎ, কোনও মানে হয়? নির্ঘাত নাইরোবি থেকে কাকা এসে গেছে, শনিবার বাড়ি যেতে বলবে বাবা। কত কী করবে ভেবেছিল এই শনি-রোববারে, সব এখন মাথায় উঠল।

বেজার মুখে খাতায় ফোন নাম্বারটা এন্ট্রি করে ডায়াল ঘোরাল দয়িতা। বাবা নয়, মা ফোন ধরেছে। উচ্ছ্বাসভরা গলা, কলকল করছে।

দয়িতাও হেসে কথা শুরু করল। রিসিভার যখন রাখল, মুখ ছাই-এর মতো সাদা।

কাকা আসেনি। বিয়ে ঠিক হয়েছে দয়িতার। দামী লোভনীয় সুপাত্র।

.

০২.

ডোরবেলের আওয়াজে পলকের জন্য চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল রাখীর। পলকে ভুল ভাঙল। শব্দটা পরিচিত বটে, কিন্তু সে নয়। বাবুয়া কক্ষনও এক বারের বেশি বেল বাজায় না। সেই ধ্বনির রেশও অনেকক্ষণ লেগে থাকে বাতাসে। এ ঘণ্টি গৃহস্বামীর।

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রাখী বারান্দার আলো জ্বালল। দরজা খুলল অভ্যস্ত নিয়মে। বোধিসত্ত্ব ঢুকে যাওয়ার পরও একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল দরজায়। তারপর ছিটকিনি তুলে ফিরেছে ঘরে। মন্থর পায়ে।

বোধিসত্ত্ব সোজা স্টাডিরুমে গেছে। বইপত্র টেবিলে রেখে বাইরে এল। সোয়েটার খুলতে খুলতে বলল,—আজ কিন্তু আমি দেরি করিনি। তোমার কথা মতো তাড়াতাড়ি ফিরেছি।

রাখী সোয়েটারটা হাতে নিল। আনমনে বলল,—হুঁ।

—কিন্তু অকেশানটা কী আজ?

স্বামীর চোখের দিকে তাকাল রাখী,—তোমার মনে নেই?

—কী বলো তো?

—আজ কত তারিখ?

—আজ? আজ সিক্সথ নভেম্বর! বলেই ভুরু কোঁচকাল বোধিসত্ত্ব। পরক্ষণে ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি,—ও, আজ তো বাবুয়ার জন্মদিন! তাই তো, তাই তো…কই, বাবুয়া কোথায়? এসেছে?

—না। রাখী দু দিকে মাথা নাড়ল,—কাল অত করে ফোনে বলে দিলাম এক বার আসতে…

—দ্যাখো হয়তো কোনও কাজে আটকা পড়েছে। মিড উইক, ক্লাসটাস থাকে…কিংবা হয়তো দ্যাখো ওখানেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে বার্থডে পার্টি করছে।

বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইহই করবে বাবুয়া? অসম্ভব। বাবুয়া অমন ধারার হলে রাখীর কি ভাবনা ছিল? ছেলেকে হাতের তালুর মতো চেনে রাখী। ছেলে তার ঘোরতর অমিশুক, ঘরকুনো। সেই ছোট্টটি থেকেই। হয় বইয়ে মুখ গুঁজে আছে, নয় ঘরেই খুটুর খাটুর করছে, বড় জোর বাগানে গাছপালা নাড়াচাড়া। তাও এখানে স্কুলে পড়ার সময়ে এক-আধটা সঙ্গীসাথী ছিল। এই ক্যাম্পাসের প্রফেসার লেকচারারদের ছেলে নয়, টাউনের। ছোটকু, পার্থ আরও যেন কী সব নাম। কালেভদ্রে তারা আসতও বাড়িতে। মাধ্যমিকের পর তারাও যেন ক্রমশ উবে গেল। আশা ছিল, কলকাতায় পড়তে গিয়ে হয়তো বা বদলাবে ছেলে। হা হতোষ্মি! আরও গুটিয়ে গেল বাবুয়া, আরও। শ্বশুর শাশুড়ির অনবরত এক অভিযোগ, ছেলেকে কী মানুষ করেছ বড় বউমা, দিনান্তে বুড়োবুড়ির সঙ্গে যেচে দুটো কথা বলতেও ছেলের প্রাণ চায় না! শান্ত আর দীপালি তো শুধুই হাত উলটোয়। স্ট্রেঞ্জ ক্রিচার! স্ট্রেঞ্জ ক্রিচার! অ্যাদ্দিন কলকাতায় রইল, রোজ সেম রুটিন! বাড়ি আর কলেজ, কলেজ আর বাড়ি। নো সিনেমা, নো কফি হাউস, নো এন্টারটেনমেন্ট, কী করে এই বয়সের একটা ছেলে সারভাইভ করে আছে বউদি! আর জুলি-মিলি তো হেসেই সারা। দাদাভাই সারাক্ষণ অমন ঘুম ঘুম গলায় কথা বলে কেন গো জেম্মা! সাতবার ডাকলে একবার সাড়া পাওয়া যায়…!

সে কিনা আজ পার্টি দিচ্ছে। কী আকাশকুসুম কল্পনা!

কলকাতায় কি একটাও বন্ধু হয়েছে বাবুয়ার?

রাখীর বুকটা চিনচিন করে উঠল। বোধিসত্ত্ব কত কম চেনে ছেলেকে! হয়তো এটাই স্বাভাবিক। যে মানুষ লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান গণনায় মগ্ন, দু বিঘৎ দূরের প্রাণীকে কি চোখে পড়ে তার?

রাখী আর মুখ ফুটে কিছু বলল না। বেডরুম থেকে ধোপদুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবি এনে রাখল বাথরুমে। সেখান থেকেই গলা ওঠাল,—গিজার কি অন্‌ করে দেব?

বোধিসত্ত্ব সোফায়, চিঠিপত্র ঘাঁটতে বসে গেছে। তার বেশিরভাগ চিঠিই ইউনিভার্সিটির ঠিকানায় আসে, বাড়িরগুলো সবই প্রায় ব্যক্তিগত। হয় কোনও প্রিয় ছাত্রছাত্রীর, নয় কোনও বন্ধু সতীর্থ বা আত্মীয়স্বজনের।

একটা এয়ারমেল ছিঁড়তে ছিঁড়তে বোধিসত্ত্ব অন্যমনস্ক স্বরে বলল, গিজার কেন?

—জল বেশ কনকন করছে। গরম জলে হাতমুখ ধোওয়াই তো ভাল।

—দাও চালিয়ে। তবে দু-তিন মিনিটের বেশি নয়, জল একটু উষ্ণ হলেই বন্ধ করে দেবে।

বাথরুম থেকে বেরতে গিয়েও থমকাল রাখী। সোপকেসে সাবান নেই, এক্ষুনি এসে হাঁকডাক শুরু করবে বোধিসত্ত্ব, কাবার্ড খুলে গ্লিসারিন সাবান বার করে রাখল একটা। বাথরুমের দরজার সামনে রবারের চটিটি সাজাল, শাল এনে ভাঁজ করে ঝুলিয়ে দিল সোফার কাঁধে, সেন্টার টেবিলে এগিয়ে দিল পরিচ্ছন্ন ছাইদান।

বোধিসত্ত্বর সব কিছুই ঠিক ঠিক সময়ে ঠিক ঠিক জায়গায় জুগিয়ে যেতে হয় না হলে বিরক্ত হয় মানুষটা। সে দাড়ি কামানোর ব্রাশই হোক, কি চিরুনি, কিংবা রুমাল মোজা। আরও কত যে ফরমায়েশ আছে। কোনওটা নীরব, কোনওটা উচ্চকিত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা কফি, খাবার টেবিলে মাপ মতো গরম তরিতরকারি, পড়ার টেবিলে লাইটার সিগারেট, পায়ের কাছে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট, শরীরের চাহিদা মতো রাখীর জেগে থাকা বা ঘুমিয়ে পড়া।

তা সব কাজেই রাখী অতি নিপুণা। কিছুটা অভ্যাসে, কিছুটা ভালবাসায়, আর অনেকটাই শ্রদ্ধায়। তার দীর্ঘ চব্বিশ বছরের সুখী বিবাহিত জীবন তাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। সে জানে সে একটা হেঁজিপেঁজি লোকের বউ নয়, রাখী মজুমদার এক বিশাল মাপের মানুষ বোধিসত্ত্ব মজুমদারের সৌভাগ্যবতী স্ত্রী। এই মানুষটার সেবা করা মানে ধন্য হয়ে যাওয়া। দুনিয়ার কটা মেয়ের এমন কপাল হয়!

তবে হ্যাঁ, সেও এখন আর কচি খুকিটি নেই, মেঘে মেঘে তারও বেলা বেড়েছে। সামনের মার্চে সে হবে পুরো পঞ্চাশ। শরীরে নিয়মমাফিক আধিব্যাধি দেখা দিয়েছে। মাথা জ্বালা করে, কোমর হাঁটুতে ব্যথা, অল্পতেই হাঁপ ধরে, ক্লান্তি আসে…। তাও ভাগ্যিস প্রেশার সুগার নেই। তার তন্বীশ্যামাশিখরদশনা চেহারাও এখন বেশ ভারীর দিকে। বোধিসত্ত্বর মতো পুরো চুল সাদা না হলেও তার মাথায় এলোমেলো রুপোলি দাগ।

কিছুকাল আগেও সংসারের কাজকর্ম একা হাতে সারত রাখী। ঠিকে লোক ছিল, ঘর মুছত, বাসন মাজত, কাপড় কাচত, ব্যস ওইটুকুই। ইদানীং রাখী একটা সব সময়ের লোক রেখেছে। রূপচাঁদ। স্থানীয় আদিবাসী। বছর পনেরো বয়স। ঘরদোরও ঝাড়ে, রান্নাবান্নায়ও সাহায্য করে, আবার দরকার হলে বাগানে গিয়েও নিড়েন দেয়। ছেলেটার সব থেকে বড় গুণ, কথা বলে কম। এ বাড়ির মানুষরা স্বল্পভাষী, সে এখানে দিব্যি খাপ খেয়ে গেছে।

বোধিসত্ত্ব বেরিয়েছে বাথরুম থেকে। রূপচাঁদকে খাবার দাবার গরম করতে বলে রাখী ডাইনিং টেবিলে এসে বসল। রাতে বোধিসত্ত্ব খুব বেশি কিছু খায় না। রূপচাঁদের হাতে তৈরি গরম রুটি খান তিনেক, সবজি, স্যালাড আর মুরগি মাটন থাকলে এক-আধ টুকরো। আজ অনেক পদ। টাউন থেকে বড় বড় গলদা চিংড়ি এনেছিল রূপচাঁদ, তার মালাইকারি, কষা মাটন, কপির রোস্ট, ফ্রায়েড রাইস। এ ছাড়াও আছে পায়েস পুডিং। রূপচাঁদ সবই সাজিয়ে দিয়ে গেল টেবিলে।

খেতে বসে আবার বুঝি ছেলের কথা একবার মনে পড়ল বোধিসত্ত্বর। কোলে ন্যাপকিন বিছোতে বিছোতে বলল,—এত কিছু রাঁধলে, বাবুয়া এল না কেন খবর নিয়েছ?

ঠিক এই মুহূর্তে বাবুয়ার প্রসঙ্গ আর ভাল লাগছিল না রাখীর। আলগাভাবে বলল, নেব।

—খেয়ে উঠেই ফোন কর। একটা উইশ করে দাও।

রাখীর গলায় সামান্য ঝাঁঝ এসে গেল,—সে তো তুমিও করতে পারো।

—ঠিক তো। আমিও তো পারি। বলেই উঠে পড়েছে বোধিসত্ত্ব,—এক্ষুনি করছি।

এই মানুষের ওপর রাগ করা যায়? ঝাঁঝ ভুলে হেসে ফেলল রাখী। যেভাবে ফোনের দিকে দৌড়চ্ছে, কে বলবে ওই মানুষটাই এক মহাপণ্ডিত? শিশু, শিশু, একেবারে আলাভোলা শিশু।

মিনিট দু-তিনের মধ্যে ঘুরে এল বোধিসত্ত্ব। মুখ বেজার,—তুৎ, কলকাতার লাইনই পাওয়া যাচ্ছে না।

রাখীর মুখে হাসি,—তোমার উঠল বাই তো কটক যাই। একটু পরে কোরো। আগে ধীরেসুস্থে খেয়ে নাও তো।

—তখন যদি বাবুয়া ঘুমিয়ে পড়ে?

—বাবুয়া আর অত ছোটটি নেই। নটা বাজলেই আর ঘুমিয়ে পড়ে না মশাই। রাখী রঙ্গ করার মতো করে বলল,—সে এখন অনেক রাত অবধি জেগে পড়ে।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাবা বলছিল বটে, বোধিসত্ত্ব মাথা দোলাল,—পড়ে তো ইংরিজি, ওতে আবার রাত জাগার কী আছে?

—ও, তোমার ফিজিক্সই বুঝি একমাত্র সাবজেক্ট? ইংলিশ অনার্স কি তুড়ি মেরে পাশ করা যায়? ওকেও কাঁড়ি কাঁড়ি নোটস তৈরি করতে হয়, মেমরাইজ করতে হয়…

—তা হবে। আমি তো জানি লিটারেচার লোকে প্রাণের আনন্দে পড়ে। বলতে বলতে হা হা হেসে উঠল বোধিসত্ত্ব,—তোমার ছেলেকে বোলো, শেক্সপিয়রটা আমার তার থেকে ভাল পড়া আছে। এলিয়টও। চাইলে ছুটিছাটায় এসে আমার কাছে পড়ে যেতে পারে। মোটামুটি কাজ চালানো গোছের নোটও তৈরি করে দিতে পারি। পরীক্ষায় পাশ করে যাবে।

রাখী জানে কথাগুলো বর্ণে বর্ণে সত্যি। ফিজিক্সের নীরস তত্ত্ব আলোচনার মাঝে কী অবলীলায় না সাহিত্য থেকে উদ্ধৃতি দেয় বোধিসত্ত্ব। যেন উদ্ধৃতিও নয়, ঠোঁটের ডগায় চলে আসা শব্দগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরোচ্ছে। শেলি, কিটস, বায়রন, শেক্সপিয়র, হুইটম্যান, এলিয়ট, রিল্‌কে, রবীন্দ্রনাথ, বেদ, উপনিষদ কী না গুলে খেয়েছে মানুষটা। যখন ক্লাসেও লেকচার দেয় বোধিসত্ত্ব, ছেলেমেয়েরা নাকি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকে।

তবে রাখী এও জানে, বাবুয়া মরে গেলেও বাবার কাছে পড়বে না। যদি কণামাত্র সে ইচ্ছে থাকত, তা হলে মাধ্যমিকে অত ভাল রেজাল্ট করার পর হায়ার সেকেন্ডারিতে আর্টস নিত না ছেলে।

প্রসঙ্গটা ঘোরাতে চাইল রাখী। স্বামীর প্লেটে এক চামচ ফ্রায়েড রাইস তুলে দিয়ে বলল,—তোমার ছাত্রছাত্রীরা তোমার কাছে পড়ার জন্য পাগল হতে পারে। কিন্তু তোমার ছেলের পছন্দ নাও হতে পারে তোমার পড়ানো।

—ঠিক। বোধিসত্ত্ব আবার শব্দ করে হেসে উঠল,—বাবারা ইউজুয়ালি ভাল টিচার হয় না। ছেলের সামান্য ভুলভ্রান্তি দেখলে বাবারা তাড়াতাড়ি পেশেন্স লুজ করে। সেটা ছেলের পক্ষেও ভাল নয়, বাবার পক্ষেও না।

বোধিসত্ত্বর হাসিতে কি ছেলের প্রতি কোনও অভিমান লুকিয়ে আছে? নাকি এ শুধুই আত্মাভিমান? অহংবোধ? রাখীর মনে আছে, বাবুয়া যখন একদম নিচু ক্লাসে, ছেলেকে নিয়ে মাঝে মাঝে অঙ্ক কষাতে বসত বোধিসত্ত্ব। খেয়াল। একই অঙ্ক দু ভাবে করে দেখাচ্ছে ছেলেকে, তিন ভাবে, চার ভাবে, পাঁচ ভাবে…। ছেলেকে বলছে, এ বার তুই কর দেখি? ছেলে হয়তো দু ভাবে করল, কি মেরেকেটে তিন ভাবে, এই রকমই হা হা হেসে উঠত বোধিসত্ত্ব। তারপর থেকেই ছেলে বাবার থেকে শত হস্ত দূরে, অন্তত অঙ্ক কষার সময়ে। নিজেও তো আর ছেলের দিকে এগোয়নি বোধিসত্ত্ব। হয়তো উৎসাহটাই মরে গিয়েছিল।

তখন থেকেই কি বাপ-ছেলের দ্বন্দ্বের শুরু? কে জানে। হয়তো বাবুয়া ছেলে না হয়ে মেয়ে হলে এত সব সূক্ষ্ম মান-অভিমানের খেলা চলত না!

ভাবতে গিয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কথাটা,—তোমার একটা মেয়ে থাকলে ভাল হত।

বোধিসত্ত্ব মুখে এক টুকরো চিংড়ি ফেলে চিবতে চিবতে বলল,—কেন?

—এমনিই। মনে হল। রাখী হাসার চেষ্টা করল,—আচ্ছা, ওই মেয়েটা কে গো?

—কোন মেয়েটা?

—ওই যে, যে মেয়েটা তোমার সঙ্গে গেট পর্যন্ত এল…

—ও দয়িতা? এম-এসসি ফাইনাল ইয়ার।

—দয়িতা…দয়িতা…। নামটা বার কয়েক উচ্চারণ করল রাখী,—ভারী সুন্দর নাম তো!

—হ্যাঁ, একটু আনকমন।

—মেয়েটা আরও এক দিন তোমার সঙ্গে এসেছিল না?

—ও তো রোজই আসে।

—রোজ? কই, দেখি না তো!

—অ্যাদ্দূর আসে না। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে ওই দু-চার পা হয়তো সঙ্গে এল, হোস্টেলে ফিরে গেল…। আমার কাজের ব্যাপারে খুব কৌতূহল, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে চায়।

—ও।…তোমার আন্ডারে রিসার্চ করতে চায় বুঝি?

—না না, ওর তো স্পেশাল পেপার সলিড স্টেট। এমনিই খুব ইনকুইজিটিভ। থাকে না এক ধরনের স্টুডেন্ট!

রাখী মুচকি হাসল,—তোমায় খুব ভালবাসে বুঝি?

—নিশ্চয়ই লাইক করে। নইলে কি আর সন্ধেবেলা আড্ডাফাড্ডা ছেড়ে আমার বাণী শোনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে? হা হা হা।

—অত হেসো না। মেয়েদের ওই বয়সটা ভাল নয়।

—কেন?

—কেন আবার কী! ওই বয়সে মেয়েরা খুব ইম্‌পালসে চলে। অনেক উলটোপালটা কাণ্ড করে বসে।

—আমার প্রেমে পড়ে যেতে পারে বলছ?

—শুধু ঠাট্টা, শুধু ঠাট্টা।…এনো তো একদিন মেয়েটাকে, পাগলি কিনা বুঝে নেব!

—আমাকে নিয়ে এখনও তা হলে তোমার ভয় আছে? বোধিসত্ত্ব বিচিত্র মুখভঙ্গি করল,—শুনে বেশ প্রাউড লাগছে। ফিলিং ইয়ংগার।

—ফের ঠাট্টা?…পায়েসটা শেষ করো।

বোধিসত্ত্ব কথা কানেই তুলল না। স্বভাববিরুদ্ধ চটুল ভঙ্গিতে চোখ টিপল,—নাহ, জোয়ান আছি কি না আরেক বার পরীক্ষা করে নিতে হয়। তুমি যুবতী হতে পারবে তো?

হঠাৎই যেন বোধিসত্ত্বর চোখে কামনা চিকচিক। দেখছে রাখীকে, দৃষ্টির ভাষা বদলে গেছে। স্বামীর এই রূপ রাখীর ভীষণ চেনা। ছাপ্পান্ন বছর বয়সেও বোধিসত্ত্ব মজুমদার এক প্রবল পুরুষ। প্রায়শই গভীর রাতে রাখীকে তীব্র রিরংসায় ছিন্নভিন্ন করে বোধিসত্ত্ব। এখনও। এত বিদ্বান মানুষের মধ্যেও কোথথেকে যে এত আদিম খিদে লুকিয়ে থাকে! পেরে ওঠে না রাখী, এই পঞ্চাশ বছর বয়সে শরীর আর সাড়া দিতে চায় না, কষ্ট হয়, তবু তাকে নামতে হয় গোপন খেলায়।

খেলা, না সেবা?

যাক গে যাক, মানুষটার মস্তিষ্কের কোষগুলো যদি এতে তাজা থাকে, রাখী নয় কষ্ট একটু করলই।

অবশ্য এই মুহূর্তে রাখী সামান্য অস্বস্তি বোধ করছিল। চাপা স্বরে বলল,—হচ্ছেটা কী? রূপচাঁদ শুনলে কী ভাববে?

বোধিসত্ত্ব হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই উঠে দাঁড়িয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে কুলকুচি করল বেসিনে। সোফায় বসে সিগারেট ধরাল একটা। টিভি চালিয়ে পাঁচ-সাত মিনিট খবর শুনল বি বি সি-র, রিমোট টিপে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল ধরল। আগ্নেয়গিরির ওপর প্রোগ্রাম হচ্ছে। গলন্ত লাভার স্রোত দেখতে দেখতে দূরমনস্ক হয়ে গেল বোধিসত্ত্ব, টিভি বন্ধ না করে চলে গেল স্টাডিরুমে।

রূপচাঁদ টেবিল মুছছে। রাখী টুকটাক কাজ সারছিল। রূপচাঁদকে খাবার বেড়ে দিল, মাছ মাংস সব তুলে রাখল ফ্রিজে। পুডিংটা একেবারে না-ছোঁয়া পড়ে আছে, বোধিসত্ত্ব ভালবাসে না বলেই বোধ হয় বাবুয়া ভীষণ পুডিং ভালবাসে! পুডিং-এর বাটি হাতে নিয়ে রাখীর বুকটা আবার টনটন করে উঠল। কাল এটা বার করবে না, পরশুও না। যদি শনি-রোববারে আসে ছেলে!

বোধিসত্ত্বর বাংলোটি বেশ প্রকাণ্ডই। বেডরুম স্টাডিরুম ছাড়াও বড় বড় দুটো ঘর, বিশাল বিশাল খাবার জায়গা, বসার জায়গা, এ ধারে ও ধারে বারান্দা, তিন তিনটে বাথরুম। কাজের লোকদের থাকার জন্য বাগানে সারভেন্টস্ কোয়ার্টারও আছে। এত বড় বাড়ির ঝঞ্ঝাট অনেক, অজস্র দরজা-জানলা বন্ধ করতে হয়। কাচের পাল্লাওলা জায়েন্ট সাইজ দরজা-জানলাগুলো টেনে টেনে বন্ধ করল রাখী, ছিটকিনি তুলে দিল। ক্যাম্পাসে চোর-ডাকাতের উপদ্রব কম, সারা রাত সিকিউরিটি গার্ড এ তল্লাটে পাহারা দেয়। তবু কোথাও একটু ফাঁক থাকলেই সর্বনাশ, ইয়া ইয়া মেঠো ইঁদুর ঢুকে পড়বে, বোধিসত্ত্বর স্টাডি-রুমের একেবারে ভুট্টিনাশ করে ছাড়বে।

চারদিক গুছিয়ে রাখী শোওয়ার ঘরে এল। রূপচাঁদ বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে গেছে, ইচ্ছে করলে এখনই শুয়ে পড়া যায়। শুল না, আলগা একটা চাদর জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় এল। বেতের চেয়ার টেনে বসেছে।

বাইরেটা আরও শীতল এখন। আজ কুয়াশাও পড়েছে বেশ। একটু দূরের অন্ধকারে, বাগানে, পাঁচিলের ধারের ঝাঁকড়া গাছগুলোয়, দূরের লাইটপোস্টের গায়ে চাপ চাপ কুয়াশা। কুয়াশা মেখে সামনের সরু পিচরাস্তাও ভারী রহস্যময় এখন। একদম সুনসান পথটা যেন আবছায়া থেকে ক্রমশ গাঢ় অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

রাখী পথটাকে দেখছিল। অথবা দেখছিল না, পথ বেয়ে তার দুচোখ চলে যাচ্ছে অনেক দূর। সেই কলকাতায়। লেক টেরেসের বাড়ির দোতলার কোণের ঘরখানায় ওই তো এখন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বাবুয়া। বুকের নীচে পাশবালিশ না? হ্যাঁ, ওভাবেই তো পড়াশুনো করে বাবুয়া! বই সরিয়ে রেখে বাবুয়া চিত হল, হাত আড়াআড়ি চোখের ওপর। কী ভাবছে বাবুয়া? মার কথা?

সহসা রাখীর চোখ জলে ভরে গেল। বাবুয়া আজকাল একদমই এখানে আসতে চায় না। দশ বার ডাকলে যদি বা এল, রাত পোহালেই পালাই পালাই। কেন রে বাবুয়া এমন করিস! কোথায় তোর বাবার সঙ্গে কী হয়েছে, কোন মান অভিমানের পালা চলছে, তা তোরাই বোঝ, এই মা-টাকে কেন কষ্ট দিস তুই? এত করে মা ডাকল, তবুও এলি না?

কেউ বোঝে না, একা একা রাখীর যে কী করে দিন কাটে বাবা ছেলে কেউ বোঝে না। সারাটা দিন কথা বলার মতোও একটা লোক নেই।

—মা?

রাখী চমকে তাকাল। রূপচাঁদ।

আঙুলে দ্রুত চোখের কোল মুছে নাক টানল রাখী,—যাচ্ছিস?

—আজ্ঞা।

—ফ্লাস্কে বাবুর কফি করে রেখেছিস?

—আজ্ঞা।

—আর গরম জল? বাবু কিন্তু এখন ঠাণ্ডা জল খাবে না।

—জানি, জল গরম করে জগে ঢেলে দিয়েছি।

—যা তা হলে। সকালে গোলাপের গোড়াগুলো খুঁড়ে দিস।

—দিব আজ্ঞা।

তরতরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল রূপচাঁদ। রাখীও আর বসল না, দরজা লাগিয়ে স্টাডিরুমে এসেছে। বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলে মোটা মোটা বই ছত্রাকার, মাথা নিচু করে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় কী একটা জার্নাল পড়ছে বোধিসত্ত্ব।

রাখী স্বামীর পিঠে হাত রাখল,—কী গো, বাবুয়াকে তো ফোন করলে না?

বোধিসত্ত্বর চোখ নড়ল না। ঠোঁটও না।

—শুনছ? রাখী আবার ডাকল, এর পর বাবুয়া কিন্তু সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়বে।

—আহ, বিরক্ত করছ কেন? বোধিসত্ত্ব তাকিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে নিল,—একটা ইম্পর্ট্যান্ট আর্টিকল পড়ছি।

—ফোনটা করে এসে পড়ো।

—মহা জ্বালাতন। নিজে করো না।

—তুমি উইশ করলে বাবুয়া বেশি খুশি হবে।

—উইল ইউ প্লিজ লিভ দিস রুম? ঠাণ্ডা রাতটাকে চিরে হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠল বোধিসত্ত্ব,—এক কথা বার বার ঘ্যানাচ্ছ কেন? দেখছ না, আমি ব্যস্ত আছি?

রাখীর মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল। পায়ে পায়ে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। টেলিফোনের কাছে যেতে গিয়েও গেল না, দাঁড়িয়ে আছে স্থির।

হিম হিম বিষণ্ণতা ছড়িয়ে গেছে চরাচরে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে নিঝুম বাংলোটায়। রাত বাড়ছিল।

.

০৩.

সকালে আজ কুয়াশা পড়েছিল খুব। রোদ তেমন চড়া না হলেও সূর্য উঠেছে অনেকক্ষণ, ঘড়ির ছোট কাঁটা দশ ছুঁই ছুঁই, তবু হিমেল বাষ্পের রেশ এখনও রয়ে গেছে ময়দানে। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ঝাপসা ঝাপসা পেঁজা তুলোর চাক, সবুজ মাঠে লেপে আছে ফিকে ধোঁয়া।

সৌমিক ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ময়দানটা দেখছিল। এইমাত্র সে শেয়ার ট্যাক্সি থেকে নেমেছে, সঙ্গে সঙ্গেই অফিসে ঢুকে পড়া তার রুটিন, কিন্তু ওই দৃশ্যটা তাকে গেঁথে ফেলেছে সহসা। মাঠের ওপারটা তেমন স্পষ্ট নয়, মনে হয় ও দিকে একটা অন্য পৃথিবী আছে। মনে হয় কেন, আছে নিশ্চয়ই। কেমন সেই পৃথিবীটা? একটু কি কম কেজো? কম নিষ্প্রাণ, কম ডাল, কম বোরিং…

ভাবনাটা এগোতে পারল না। ঘাড়ের পিছনে বুলডগটার হুঙ্কার শুনতে পেল সৌমিক। ঘাঁউ ঘাঁউ ঘাঁউ…তীক্ষ্ণ হাড় ঠাণ্ডা করে দেওয়া আওয়াজ।

সৌমিক ঝটাকসে মুখ ফেরাল। নেই, জন্তুটা নিমেষে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সৌমিক অফিসের দিকে পা বাড়াল। যখনই সে একটু একা হতে চায়, তখনই কুত্তাটা শালা ঠিক টুঁটির পিছনে এসে হানা দেয়। চব্বিশটা বছর ধরে এই হয়ে আসছে। আশ্চর্য, একটি বারের জন্যও জানোয়ারটাকে দেখা গেল না! একবার, ফর ওয়ানস, যদি কুত্তাটা গর্জন করার আগেই সৌমিক ঘাড় ঘোরাতে পারে…।!

লিফ্‌টের সামনে লম্বা লাইন। সার সার নিরেট মুখ। এক ছাঁচে ঢালা। মনে মনে বিষণ্ণ হাসল সৌমিক। সেও তো ওই ছাঁচেরই। উদ্বিগ্ন মুখে সৌমিক কবজি উলটোল। দশটা বাজতে চার মিনিট আটাশ সেকেন্ড…ছাব্বিশ…চব্বিশ। সচরাচর সে লেট করে না, আজ কি নিয়ম ভেঙে যাবে?

না, খুব দেরি হল না। দশটা বাজার এক মিনিট তেরো সেকেন্ড আগে সৌমিক চলন্ত খাঁচায় পা রাখল। খাঁচায় আরও গোটা সাতেক চিড়িয়া। তিনজন তাদের অফিসের। ডেপুটি ম্যানেজার-টু, পদ্মনাভন। আর ক্যাশ কাউন্টারের প্রতীক-অনীতা। কিউতে দাঁড়িয়ে চোখে পড়েনি, পড়লেও কেউ কারুর দিকে তাকায়নি। রীতি। এখন তিনজনকেই একটা মাপা হাসি বেঁটে দিল সৌমিক।…হাই!…হ্যালো!…মর্নিং!…ব্যস, আবার যে যার অচেনা।

সৌমিকদের অফিস দশতলায়। সাধারণ অফিস নয়, বিদেশি ব্যাংক। সাইজ বিশাল, কয়েক হাজার বর্গফুট তো হবেই। অফিসের এক দিকে গোটা কয়েক বড় বড় চেম্বার আছে বটে, বাকি গোটা জায়গাটাই খোলামেলা। সেখানে অজস্র বেঁটে বেঁটে সুদৃশ্য কিউবিক্‌ল। এক রঙা। বাদামি। প্রায় সব কিউবিক্‌লই কম্পিউটার শোভিত। সৌমিকের খোপটি একেবারে কোণার দিকে, একটু বড়সড়ই। সে এই ব্যাংকের হাফ ডজন অ্যাসিন্ট্যান্ট ম্যানেজারদের একজন।

রিসেপশন থেকেই সৌমিক দেখতে পেল তার খোপে লোক বসে আছে। দ্রুত পায়ে প্যাসেজ পেরোল সৌমিক। জায়গায় বসতে বসতে বলল,—ইয়েস প্লিজ।

লোকটা শশব্যস্ত ভঙ্গিতে সোজা হল,—এই তো…আপনি এসে গেছেন স্যার?

স্যার শোনার বেশি অভ্যেস নেই সৌমিকের। এই অফিসে পরস্পরকে নাম ধরে ডাকাটাই রেওয়াজ, বড় জোর টাইটেল। সে সিনিয়ারই হোক, কি জুনিয়ার। ক্লায়েন্টরাই বা কজন আর স্যার বলে। বরং উলটোটাই তাকে বলতে হয়। অফিস ডেকোরামের অঙ্গ।

স্বভাবসিদ্ধ বিনীত ভঙ্গিতে সৌমিক আবার বলল,—ইয়েস স্যার। বলুন, হাউ ক্যান আই হেলপ্‌ ইউ?

লোকটা কাঠ কাঠ ভঙ্গিতে বলল,—আমাকে মনে পড়ছে না স্যার? লাস্ট মান্থে এসেছিলাম…। লোন রিপেমেন্ট নিয়ে একটা গণ্ডগোল ছিল…

কাস্টমাররাও ফেসলেস্‌। তবু মুখটা মনে পড়ল সৌমিকের। সমস্যাটাও। পর পর তিনটে পোস্ট ডেটেড চেক বাউন্স করেছিল লোকটার, ল’ইয়ারের নোটিস যেতেই সুড়সুড়িয়ে দুটো পেমেন্ট মিটিয়েছে। এক্সট্রা ইন্টারেস্ট ছাড়ের অ্যাপিল করেছিল, ব্যাংক আমল দেয়নি।

রুক্ষ না হয়েও সামান্য কঠিন হল সৌমিক,—ইয়েস, আই রিমেমবার।

—স্যার, ওই ইন্টারেস্টের ব্যাপারে প্রেয়ারটা আপনি নেগেট করেছেন…

—সরি স্যার। আই কান্ট হেলপ। ইটস্ রুল। হায়ার পারচেজে গাড়ি কেনার সময়ে আমি তো ডিটেলে আপনাকে ক্লজগুলো বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। এখন যা হবে, ব্যাংকের আইনেই হবে।

—ক্লজ তো স্যার অনেক কিছুই থাকে। তা বলে ডিসক্রিশান বলে একটা কথা থাকবে না? আপনি স্যার এত বড় একটা পোস্টে আছেন…

চাকরিতে প্রথম ঢোকার পর পর এমন ভাষায় অনুরোধ শুনলে প্রীত হত সৌমিক। তবে দু’ বছরেই তার চামড়া মোটা হয়ে গেছে। সে জানে তার পোস্টটার যতই গালভরা নাম থাক, সে একটা ডিগ্‌নিফায়েড্‌ কেরানি ছাড়া কিছু নয়। মাইনে সে পায় অনেক, কেটেকুটেও বাইশ হাজার ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু ব্যাংক তাকে একটা কারণেই দেয় মাইনেটা। ব্যাংক জানে একটা সৌমিক বসুরায়কে দিয়ে অন্তত আটটা দশহাজারি ক্লার্কের কাজ ওঠানো যাবে।

তবে এই মুহূর্তে নিজের অবস্থানটা কাস্টমারকে বুঝতে দিল না সৌমিক। এটাও অফিস ডেকোরাম। ঠোঁটে একটা আলগা হাসি ঝুলিয়ে বলল,—সরি স্যার। এটা ডিসক্রিশানের কেস নয়। হলে এটা হবে একটা ব্যাড প্রিসিডেন্স। যার জন্য হয়তো আমাদের গাদা গাদা ল-স্যুট ফেস করতে হবে।…বাই দা বাই, হোয়াট অ্যাবাউট ইওর থার্ড পেমেন্ট?

—এই তো স্যার, এই তো চেক এনেছি। বলতে বলতে পকেটে হাত ঢোকাল লোকটা,—স্যার, কেন আর ফ্যাকড়া রাখছেন? আমার সব পেমেন্টই তো ক্লিয়ার হয়ে গেল। একটা ক্লিন চিট দিয়ে দিন, ব্লু বুকটা ট্রান্সফার করে নিই।…কটা তো মাত্র ইন্টারেস্টের টাকা, তিন হাজার সাতশো সামথিং…

—ওইটুকুও বা দেবেন না কেন?

—এটা কিন্তু আপনাদের অবস্টিনেসি। চব্বিশটা পেমেন্টের মধ্যে মাত্র তিনটেয় গণ্ডগোল…লোকটা চোখ ছোট করল। ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে হাসল ধূর্তের মতো,—ধরুন যদি না-ই দিই, কী করবেন আপনারা? কেস করে ওই কটা টাকা উদ্ধার করবেন? ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবে।

ঠাণ্ডা হাসল সৌমিক। লোকটাকে এতক্ষণ পরে দেখল ভাল করে। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স, চকচকে কামানো গাল, পোশাক আশাক দেখে প্রাইভেট কোম্পানির মাঝারি অফিসার বলে মনে হয়। মুখে চোখে বেশ একটা সফিস্টিকেশনও আছে লোকটার। সম্ভবত রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে, গ্রুপ থিয়েটার দেখে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে রেগুলার মদ খায়, এবং কালেভদ্রে নীল ছবিও গেলে। এদের মেরুদণ্ড মোটেই খুব শক্ত হয় না। এদের থেকে ভেড়ুয়া মার্কা আলু পটল ব্যবসায়ীরাও অনেক বেশি তাকতদার। লোকটা জানে না ওই তিন হাজার সাতশো সামথিং টাকাই কীভাবে সৌমিকদের ব্যাংক উসুল করতে পারে। কোর্ট ফোর্টে যেতে হবে না, ক্লেম আদায় সেকশনে খবর দিলেই সভ্য-ভব্য পোশাক পরা পেশাদার লোক মাসল্‌ দেখিয়ে আসবে। প্রয়োজন হলে গাড়িটাও তুলে নেওয়া হবে।

বৃথা বাক্যব্যয় করল না সৌমিক। কম্পিউটার অন্‌ করে বলল,—ও কে। অ্যাজ ইউ প্লিজ। আমরা কিন্তু স্যার আমাদের কাস্টমারের সঙ্গে সুসম্পর্কই রাখতে চাই।

কী বুঝল কে জানে, লোকটা একটুক্ষণ বসে থেকে চলে গেল। সৌমিক ডুবে গেল কাজে। এই হায়ার পারচেজের চার্জে আসার পর থেকে ওয়ার্ক লোড বেড়েছে খুব। এই শুরু হল, বাড়ি ফিরতে আটটা-নটা বাজবে। আজকাল এত কেনার ঝোঁক বেড়েছে মানুষের, বাপস্‌। বিশেষত গাড়ি।

অবিরাম ডাটা ফিডিং চলছে। ধূসর পরদায় টিক টিক নাচছে সংখ্যা আর শব্দ। মাঝে মাঝে আসছে লোক, কথা বলছে সৌমিক, আবার মস্তিষ্কের সিগনালে চালু হয়ে যাচ্ছে আঙুল। এখন সৌমিককে দেখে বোঝা দায় কোনটা যন্ত্র? সৌমিক, না ওই যন্ত্রগণক? কে কাকে চালায়?

ঠিক বারোটায় কফি এল। পাতলা গদি আঁটা অস্বচ্ছন্দ চেয়ারে হেলান দিয়ে প্লাস্টিক কাপে চুমুক মারছে সৌমিক, নিবেদিতার প্রবেশ। সালোয়ার কামিজের ওড়না কাঁধে গোছাতে গোছাতে সামনের চেয়ারে বসল,—এই সৌমিক, নিউজ শুনেছিস?

মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে একটু অসহজ বোধ করে সৌমিক। তার চোখে মেয়েরা এখনও দূরের প্রাণী, অন্য গ্রহের বাসিন্দা। না মেশার ফল। সুযোগও হয়নি বিশেষ। সেই ছোটবেলা থেকে সে পড়েছে ছেলেদের স্কুলে, কলকাতার এক নামী ইংলিশ মিডিয়ামে। কলেজও তার কো-এড ছিল না। হ্যাঁ, ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময়ে টিউটোরিয়ালে দু-তিনটে মেয়ের সঙ্গে একটু একটু ভাব হয়েছিল, তবে টেঁকেনি। গল্প করতে করতে একদিন তারা যেই বাড়ি অবধি এল, ব্যস্‌ পরদিন থেকে শ্রীমতী কবিতা বসুরায় টিউটোরিয়ালের দরজায় খাড়া। একেবারে পক্ষিমাতার মতো ডানায় আগলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন ছেলেকে। যদি মেয়েদের পাল্লায় পড়ে ছেলের রেজাল্ট খারাপ হয়ে যায়। এম কমে কয়েকজন সহপাঠিনী ছিল বটে, কিন্তু কদিনই বা সৌমিক গেছে ইউনিভার্সিটি? তখন তো কস্টিং পরীক্ষার জন্য…।

তবে নিবেদিতার ব্যাপারটা আলাদা। সেই অর্থে নিবেদিতা ঠিক মেয়ে নয়। সে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, কার্ডস। পোস্টের মতোই লিঙ্গহীন। যদিও সে শরীরে পোশাকে টিপে চুড়িতে যথেষ্ট পরিমাণ রমণী, তেল কাজলে মোটামুটি সুন্দরীও। বয়সে সে সৌমিকের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়, ম্যারেড, সময়াভাবে এখনও গর্ভধারণ করেনি। নিবেদিতার সঙ্গে বাক্যালাপে সৌমিকের অসুবিধে নেই।

কফির কাপ ওয়েস্ট পেপার ব্যাস্কেটে ফেলে সোজা হল সৌমিক,—কী নিউজ রে?

—একটা বড়সড় রিশাফল্‌ হচ্ছে অফিসে। অনেকগুলো হেড এখান থেকে তুলে নিয়ে যাবে।

—কোথায়?

—মুম্বই অফকোর্স।

—কে কে যাচ্ছে?

—সন্দীপের নাম শুনলাম, রাজন…এখনও অবশ্য কনফার্মড নয়। নিবেদিতা দুলছে বসে বসে,—আমি তো বাবা পাঠালেই চলে যাব।

—কেন, এখানে ভাল লাগছে না?

—তা নয়। কলকাতা…চলতা হ্যায়। কিন্তু প্রসপেক্ট নেই। নখ খুঁটছে নিবেদিতা। নাক কুঁচকোল, পলকে চোখ উজ্জ্বল,—মুম্বই পাঠালে ডেফিনিটলি ভাল লিফট হবে।

—চলে যাবি? হোয়াট অ্যাবাউট ইওর রোহিত?

—বর আঁকড়ে পড়ে থাকলে চলবে? আর রোহিত তো শীতের পরেই স্টেটসে দৌড়চ্ছে। ওয়াই টু কের চক্করে। মিনিমাম এক বছর থাকবে। নিবেদিতা ঠোঁট ওলটাল,—ও সিলিকন ভ্যালিতে দলবল নিয়ে মস্তি করতে করতে কম্পিউটারে দু হাজার সাল আনবে, আর আমি এখানে শাশুড়ির বউমাটি হয়ে নার্স কাম আয়ার ডিউটি করব, জোক নাকি?

—কিন্তু এই যে তোরা দূরে দূরে থাকবি, এতে তোদের কনজুগাল লাইফ অ্যাফেক্ট করবে না? কেতাবি জ্ঞান আওড়াল সৌমিক, ছদ্ম উদ্বেগমাখা মুখে। পরক্ষণেই কথাটা গিলল,—অবশ্য তোদের একটা মারজিনাল সুবিধে আছে। ইস্যু টিস্যু নেই…।

—থাকলে কিছু একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট করতাম।

—তবু অসুবিধে তো হতই…

—কিছু না। মেন থিং ইজ, আগে লাইফের প্রায়োরিটিগুলো ঠিক করে নিতে হবে। কনজুগাল লাইফ মানে কি শুধু বিছানা আর কম্পানিয়নশিপ? অ্যামেনিটিজ লাগবে না? অ্যান্ড দ্যাট নিডস মানি। তুমিও টাকা বানাও, আমিও টাকা বানাই। তুমিও কেরিয়ার গড়ো, আমিও কেরিয়ার গড়ি। তবেই না একটা স্ট্যান্ডার্ড কনজুগাল লাইফ…বলতে বলতে চোখ টিপল নিবেদিতা,—তোকে এ সব কী বলছি? তুই তো এখনও বাচ্চা আছিস, কনজুগাল লাইফের সি’ও জানিস না।

সৌমিক মুচকি মুচকি হাসল,—আজ না হোক কাল তো জানতেই হবে। টিপস দে।

—এর কোনও টিপস হয় না। নদীতে পড়লে আপনিই সাঁতার শিখে যাবি। তারপর নিজের মতো করে কাটো।

লঘু আলাপচারিতার সময় শেষ। আবার কাজে বসার ক্যালরিটুকু নেওয়া হয়ে গেছে। ঝড়ের গতিতে চলে গেল নিবেদিতা। সৌমিকও কথাগুলো নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখার টাইম পেল না, পর পর কাস্টমার আসছে। এখন ব্যাংকের পিক আওয়ার, দুটো আড়াইটে অবধি আর মাথা তোলার অবকাশ নেই।

ফুরসত মিলল টিফিন আওয়ারে। নিবেদিতা তখন মেমারি থেকে মুছে গেছে। পেটে চনচনে খিদে। অফিসে টিফিন বয়ে আনার অভ্যেস নেই সৌমিকের, কিছু একটা আনিয়ে নেয় ক্যান্টিন থেকে। আজও নিল।

সবে খাওয়া শুরু করেছে, ফোন। হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলল সৌমিক,—ইয়েস, স্পিকিং।

—টিফিন করেছিস?

ওফ, মা।

সৌমিকের ভুরু কুঁচকে গেল,—করছিলাম।

কী খাচ্ছিস?

এটাও জানা জরুরি?

—টোস্ট কলা আর বয়েলড এগ।

—স্টু আনাসনি কেন?

—ইচ্ছে হল না।…জানোই তো স্টু ভালবাসি না।

—তা বলে কলা খাবি? কাল রাতে ঘঙঘঙ কাশছিলি না?

অসহ্য অসহ্য। কবিতা বসুরায় কি এখনও বোঝে না, তার প্রতি মুহূর্তের খবরদারিকে কী চোখে দেখে সৌমিক?

ভারী গলায় সৌমিক বলল,—ভুলে যেও না, আমার আটাশ বছর বয়স হয়ে গেছে। আই নো হোয়াট টু ইট।

—বটেই তো। বলবিই তো। মার মন তুই কী বুঝবি?…স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি গলা ঘড়ঘড় করছে। একেই ওই ঠাণ্ডায় গিয়ে বসে থাকিস…

সেন্টু! মানসিক চাপ তৈরি করার বস্তাপচা কৌশল!

সৌমিক স্বর আরও ভারী করল,—কাশির সঙ্গে কলার কোনও সম্পর্ক নেই। আর কিছু বলবে?

পলকের জন্য ও প্রান্ত নীরব। ফোন রেখে দেবে কি?

না। আবার শব্দ বাজছে,—কালকের কথা মনে আছে?

মেমারি সার্চ করল সৌমিক। ব্ল্যাংক সিগন্যাল। জিজ্ঞাসা করল,—কী কথা বলো তো?

—কাল ও বাড়ি যাওয়া আছে।

মগজে পিপ্‌ পিপ্‌ পিপ্‌ পিপ্‌। আশ্চর্য, ওই মারাত্মক কথাটা কী করে সৌমিক ভুলে ছিল এতক্ষণ? অফিস বেরনোর সময়েও তো মা কম ঘ্যান ঘ্যান করেনি!

বিরক্ত গলায় সৌমিক বলল,—এই কথাটা রিপিট করার জন্য ফোন করেছ? দেয়ার শুড বি সাম লিমিট, মা। দিস ইজ অফিস, তোমার পুতুল খেলার জায়গা নয়।

—আমি জানি। ফোন করছি, কারণ কালকের প্রোগ্রাম একটু চেঞ্জ হয়েছে। বিকেলে নয়, আমরা যাব কাল সকালে। দুপুরে ওরা আমাদের খেতে বলেছে। আগে থাকতে জানিয়ে রাখলাম, কাল দুপুরে অন্য কোনও প্রোগ্রাম রেখো না।

—থ্যাংকস।

তেতো স্বরে কথাটা বলে ঘটাং রিসিভার রেখে দিল সৌমিক। বিবমিষা জাগছে। মা একেবারে ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছে। আবার।

কম্পিউটারের ধূসর পরদায় ধূসরতর ছবি। একের পর এক। খুদে সৌমিক কমিক্স পড়ছে, হাত থেকে ছবিওলা বই কেড়ে নিল মা। হোম টাস্ক তো শেষ, এখন একটু…!না, সামসের পরের এক্সারসাইজটা করো। কুন্তল, অভিষেকের থেকে তোমার এগিয়ে থাকতে হবে, অন্তত এক পা। পার্কে ফুটবল খেলছে সৌমিক, ঘাড় ধরে মা হিড়হিড় করে মাঠ থেকে টেনে নিয়ে এল। ফুটবল চাষাড়ে খেলা, ওতে ব্রেন ভোঁতা হয়ে যায়, তুমি ক্রিকেট খেলতে পারো। ক্লাস সেভেনের সৌমিক একা একা স্কুলে যাবে বলে বায়না ধরেছে। কারুর মা আর যায় না, তুমি কেন যাবে? ঠাস করে চড় কষাল মা, এখনই বখে যাওয়ার শখ হয়েছে? মাধ্যমিকের পর কুচবিহারে পিসির বাড়ি যাওয়ার জন্য লাফালাফি করছে সৌমিক। ওখানে কত মজা, রুন্টুদা সাঁতার শেখাবে, সাইকেল চড়া শেখাবে, তোর্সা নদীতে নৌকোয় ঘোরাবে খুব, নিয়ে যাবে জয়ন্তী পাহাড়, যে পাহাড়ে সর্বক্ষণ মেঘ আটকে থাকে…! হল না। ছুটিটা তুমি হেলায় নষ্ট করতে পারবে না সৌমিক, সায়েন্সের টিউটর ঠিক করেছি, হায়ার সেকেন্ডারির সিলেবাস বিশাল, এখন থেকেই পড়াশুনো শুরু করে দাও। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে কবিতার খাতাটা ভ্যানিশ হয়ে গেল হঠাৎ। গান শুনতে ভালবাসে সৌমিক, পরীক্ষার ঠিক আগে অজ্ঞাত কারণে টেপ অচল।…আরও আরও কত ছবি! ছোটমামার বিয়েতে দারুণ হইচই চলছে বরানগরের বাড়িতে, রাতে দঙ্গল বেঁধে নাইট শোয়ে সিনেমা যাওয়া হবে। নমকহালাল। অমিতাভ বচ্চন। মার ঘাড় টেরা, ফিরতেই হবে। থাকি না মা, সবাই তো থাকছে। একটা তো রাত! না, আগামী সোমবার তোমার ক্লাসটেস্ট আছে, কাল তোমার স্যার পড়াতে আসবেন। দাদু-দিদার অনুরোধে পর্যন্ত গলল না মা। বইমেলা থেকে কেনা জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা অবলীলায় বেচে দিল কাগজঅলাকে। কেরিয়ারের কথা ভাবো সমু, কবিতা তো সারা জীবনের জন্য রইল।

কী মর্মভেদী ঘৃণা যে পাথর হয়ে আছে সৌমিকের বুকে। তার প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাসনাকে পায়ের তলায় পিষেছে মা!

সৌমিকও প্রতিশোধ নিয়েছে। কেন নেবে না? কেন পড়ে পড়ে মার খাবে? সে মোটেই কবিতা বসুরায়ের ইচ্ছের গাছ নয়। তাকে ঘেঁটি ধরেও জয়েন্ট এনট্রান্সে বসাতে পারেনি মা। তখন কবিতা বসুরায় এক পা পিছিয়েছিল। যাক, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হোক, সায়েন্টিস্ট হোক ছেলে। সত্যেন বোস…মেঘনাদ সাহা…সৌমিক বসুরায়..শুনতে খারাপ লাগবে না! রিসার্চ করতে বিদেশ যাবে ছেলে, ফিরে কোনও ইনস্টিটিউট ফিউটের ডিরেক্টর হয়ে বসবে…! সে গুড়েও বালি, মাকে লুকিয়ে দুম করে কমার্স স্ট্রিমে ভর্তি হয়ে গেল সৌমিক। কবিতা বসুরায় বুক চাপড়াচ্ছে, অন্নজল ত্যাগ করল। বাবা বোঝানোর চেষ্টা করল শেষে। কমার্স স্ট্রিমেও তো শাইন করা যায়, ওকে একটু ওর মতো করে বাড়তে দাও কবিতা। কিছুকাল গুম হয়ে রইল মা, সৌমিকের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলত না। তার পরে শুরু হল নতুন চাপ। চার্টার্ডটা করে এম বি এ করতেই হবে সমু…। শুধু মার ইচ্ছেটাকে উপহাস করার জন্যই না চার্টার্ডটা পড়া হল না সৌমিকের।

এত কিছুর পরেও কবিতা বসুরায়ের শিক্ষা হয়নি। এখন সৌমিকের বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে মা। এখানেও সৌমিকের নিজের কোনও চয়েস নেই। পাত্রীর কী গুণ না সে নাকি মার গুরুবোনের মেয়ে! গুরুদেব নাকি তাদের জোড় মিলিয়ে দিয়েছেন। আশ্চর্য, কথা পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছে মা! ধন্য সাহস!

মেয়েটাকে রিজেক্ট করে দেবে সৌমিক? কেন? একটা নারী শরীরের জন্য সে কি উন্মুখ হয়ে নেই? মাথায় আবার পিপ্‌ পিপ্‌ পিপ্‌। নিবেদিতার কথাটা মেমারিতে এসে গেল। কনজুগাল লাইফের তুই সি’ও বুঝিস না! সৌমিক মাথা ঝাঁকাল। বুঝি না’ই তো, কিন্তু বুঝতে চাই। বাট নট থ্রু দ্যাট গার্ল, যাকে মা পরিবেশন করে দেবে। শুধু মার ইচ্ছেটাই মেয়েটাকে অপছন্দ করার পক্ষে যথেষ্ট কারণ। কাল একটা সিন ক্রিয়েট করলে কেমন হয়? ওই বাড়িতে কাল সবার সামনে যদি না বলে দেয় সৌমিক?

হ্যাঁ, সৌমিক তাই করবে। কবিতা বসুরায়ের ইচ্ছের গাছটাকে জন্মের মতো মুড়িয়ে দেবে। ওফ্‌, মার ফেসটা তখন যা হবে না!

পারবে কি সত্যি সত্যি?

চিন্তাটা এই প্রথম নয়, কদিন ধরেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে মনে। রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বুজলে ভাবনাটা হঠাৎ হঠাৎ স্কাড টোমাহকের মতো হানা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সংশয়টাও। পারবে কি সৌমিক? মার বিপক্ষে তার সব অভ্যুত্থানই সফল হয়েছে কিন্তু কোনও জয়কেই সে উপভোগ করতে পারেনি। কী করে পারবে? মার ইচ্ছের গাছ মুড়োতে গিয়ে সে নিজেই তো একটা অন্য গাছে পরিণত হয়ে গেছে। এবং সেই অন্য গাছটাও মার ইচ্ছের গাছের থেকে তেমন কিছু আলাদা নয়। মা তাকে রুমাল করতে চেয়েছিল, সে বেড়াল হয়ে গেল, এমন তো ঘটল না! সেই একঘেয়ে ক্লান্তিকর জীবনছন্দ—আহার অফিস ঘুম, অফিস ঘুম আহার, ঘুম আহার অফিস…

দোষ সেই বুলডগটার। একটু সরতে চাইলেই এমন ঘাঁউ ঘাঁউ করে ওঠে কুত্তাটা। এইখানেই কবিতা বসুরায় জিতে গেছে, নির্ভুল ভাবে কুকুরটাকে ফিট করে দিতে পেরেছে সৌমিকের ঘাড়ের কাছে। অদৃশ্য এক জন্তু, তবু কী ভয়ঙ্কর তার হুঙ্কার! ছোট্‌ শালা সমু, ছোট্‌ ছোট্‌ ছোট্‌…ঘাঁউ ঘাঁউ ঘাঁউ…

একবার, ফর ওয়ান্স, যদি কুত্তাটা গর্জন করার আগেই সৌমিক ঘাড় ঘোরাতে পারত…!

কিউবিক্‌লে উৎপল। জুনিয়র অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট। ছোট্ট আলোচনা সেরে চলে গেল উৎপল, ঢুকল আরেক জন। সময় বয়ে চলেছে দ্রুত। চারটেয় মিটিং, জি এম-এর চেম্বারে। মুম্বই থেকে কয়েকটা নতুন স্কিমের সার্কুলার এসেছে, তারই বিস্তারিত পর্যালোচনা। নামেই ডিসকাশান, এসব মিটিং-এ রোবট হয়ে বসে থাকাই দস্তুর, মাঝে মাঝে যান্ত্রিক কুশলতায় ঘাড় নাড়ানোটাই একমাত্র কাজ। জি এম-এর চেম্বার থেকে যখন বেরোল সৌমিক, তখন তার মাথাটা ইঁট হয়ে গেছে।

সোজা কিউবিক্‌লে এল না সৌমিক, টয়লেটে গেল। মুখে চোখে জল ছেটাল খানিকটা। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে এসে দাঁড়াল জানলায়। এই অফিসে একমাত্র টয়লেট থেকেই বাইরের পৃথিবীটা দেখা যায়। আবার ময়দানের দিকে চোখ গেল সৌমিকের। দিনের আলো মলিন এখন, অনেক নীচের ময়দানের সবুজ ভেলভেটে বাদামি ছায়া। মানুষরা সব অস্পষ্ট, তবু তাদের এখনও দেখা যায়। কালচে পিঁপড়ের মতো মানুষ নড়াচড়া করছে ভেলভেটে। সৌমিক ওখানে থাকলে তাকেও কি এখান থেকে ওইটুকুই লাগবে? কোনটা মানুষের আসল মাপ? তাকে যেখান থেকে যতটুকুনই দেখায়, ততটুকুন কি?

অস্বস্তিকর চিন্তা। চোখ ওঠাল সৌমিক। দূরে একটা মাস্তুল মতো দেখা যায় না? গঙ্গায় জাহাজ ঢুকেছে? কোন দেশের জাহাজ? ওই জাহাজ কি ইচ্ছে করলে কোনও অচিন দেশে চলে যেতে পারে?

আবার বুলডগটার ঘাঁউ। ছোট্‌ ছোট্‌ ছোট্‌…

সচকিত সৌমিক টয়লেট থেকে বেরিয়ে বাদামী রঙ করা লক্ষণগণ্ডীতে ফিরল। বেশ কিছু ডাটা আরও ফিড করতে হবে কম্পিউটারে, কয়েকটা ইনফরমেশান স্টাডি করতে হবে, হেড অফিসে কিছু ই-মেলও পাঠানো দরকার।

মিনিট পনেরো পর একটা অচেনা সুগন্ধ নাকে লাগল সৌমিকের। কিউবিক্‌লের মুখে এক তরুণী এসে দাঁড়িয়েছে। শ্যামলা রঙ, মাঝারি হাইট, ঝকঝকে মুখ, গাঢ় উজ্জ্বল চোখ। পরনে সূক্ষ্ম এম্‌ব্রয়েডরি করা নীল সিল্‌কের কামিজ, নীল সালোয়ার, কাঁধে ফিরোজা রঙ ওড়না, রেশম রেশম চুল পিঠের ওপর ছড়ানো।

সৌমিক একটু অবাক হল। এ সময়ে কাস্টমার তো বড় একটা আসে না!

পেশাদারি ভদ্রতায় সৌমিক টান টান,—ইয়েস প্লিজ, হাউ ক্যান আই হেলপ্‌ ইউ?

মেয়েটা এক পা এগোল,—আপনিই কি সৌমিক বসুরায়?

—ইয়েস।

—আমি আপনার কাছেই এসেছি। ফর সাম পারসোনাল রিজন।

সৌমিক আড়ষ্ট হয়ে গেল,—বলুন।…বসুন না।

—থ্যাংকস্‌। মেয়েটা বসল না। সোজাসুজি বলল,—আপনি কি আমার সঙ্গে একটু বাইরে যেতে পারবেন?

সৌমিক চেয়ারে আটকে গেল,—কেন বলুন তো?

মেয়েটা আবছা হাসল। অথবা হাসল না, সৌমিকের মনে হল হাসছে।

তারপরই সপ্রতিভ গলায় বলল,—আমার নাম দয়িতা মিত্র। নামটা কি আপনার একদম অপরিচিত লাগছে?

সৌমিক হতচকিত হয়ে গেল। পাখি কেন নিষাদের দরজায়?

.

০৪.

চেয়ারে বসার পর ছেলেটাকে ভাল করে লক্ষ্য করল দয়িতা। হাইট মাঝারি, পাঁচ সাত-আট হবে। গায়ের রং বেশ ফরসা, আপেল আপেল। এত ফরসা ছেলেদের কেমন যেন আহ্লাদী মনে হয়। মুখের মধ্যে প্রথমেই নজরে আসে চোখ। ভাসা ভাসা, স্বপ্ন স্বপ্ন, যেন এইমাত্র ঘুম থেকে উঠল। কী বলে ওই রকম চোখকে? মায়াবী, না ভাবলেশহীন গরুর চোখ? তবে স্ট্রাইপড্‌ ফুলস্লিভের সঙ্গে মেরুন কণ্ঠলেঙ্গুটি, অল্প কোঁকড়া ফোলা ফোলা চুলে ঠিক তত ক্যাবলা দেখাচ্ছে না ছেলেটাকে। আলগা নার্ভাস ভাব ছেলেটার মুখেচোখে। সত্যিই কি সৌমিক বসুরায়কে অস্বস্তিতে ফেলতে পেরেছে দয়িতা?

অস্বস্তি দয়িতারও হচ্ছিল। তেমন একটা হাঁটুকাঁপা ধরনের না হলেও, হচ্ছিল। দুম করে ঝোঁকের মাথায় ছেলেটার অফিসে চলে আসা কি ঠিক হল? কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেত না?

অফিস জুড়ে ফ্লুরোসেন্ট টিউবের চড়া আলো। নিচু নিচু কিউবিক্‌লগুলোও বেজায় খোলামেলা, চোখ তুললেই এদিক ওদিকে মানুষ দৃশ্যমান। এমন উজ্জ্বল হাটের মাঝে অস্বচ্ছন্দ ভাব বেশিক্ষণ বজায় রাখা কঠিন।

দয়িতা সহজভাবে বলল,—আমি কি আপনাকে খুব ডিস্টার্ব করলাম?

সৌমিক কাঁধ ঝাঁকাল,—ওয়েল, ডিস্টার্বের কী আছে? র‍্যাদার ইট্‌স আ প্লেজ্যান্ট সারপ্রাইজ।

দয়িতা ঠোঁটের কোণ দিয়ে হাসল,—তা হলে চলুন উঠে পড়া যাক।

—দু মিনিট। একটা কাজ হাফ ডান পড়ে আছে…

—আমি কি ততক্ষণ বাইরে ওয়েট করব?

—না না, তা কেন, বসুন না আপনি।…কফি বলব?

—নো থ্যাংকস। আমি কফি খাই না।

—কোল্ড ড্রিঙ্কস চলবে?

—থ্যাংক ইউ। লাগবে না।

—অ্যাজ ইউ প্লিজ।

বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল সৌমিক। হনহন করে চলে গেল কোথায় যেন। নির্ঘাত টয়লেটে গেল ব্যাটা, নার্ভাসনেস কাটাতে। মিনিট কয়েকের মধ্যেই ফিরে কম্পিউটার থেকে প্রিন্টআউট বার করছে কিছু, আলগা চোখ বুলিয়ে রেখে দিল টেবিলে। চেয়ারের কাঁধ থেকে ব্লেজারটা তুলে নিয়েছে হাতে।

শ্রাগ্‌ করল আবার,—ওকে, লেটস মুভ।

বাইরে ভাল মতো অন্ধকার নেমে গেছে। নাগরিক অন্ধকার, মানে আলোর রোশনাই। গাড়িঘোড়ার আলো, রাস্তার আলো, দোকান-অফিসের আলো সবই এখন চোখ ধাঁধানো। বেচারা আঁধার গুটিসুটি মেরে মুখ লুকিয়েছে ময়দানে। দূষণের ধোঁয়া তাড়িয়ে দিচ্ছে সদ্য নামা কুয়াশাকে। শীতের আমেজ ভারী আবছা, শৈশবের স্মৃতির মতো।

ফুটপাতে জনস্রোত। বাড়িমুখো মানুষের অবিন্যস্ত মিছিল। উদ্‌ভ্রান্ত ভিড় কাটিয়ে কাটিয়ে হাঁটছিল দুজনে। নীরবে।

দয়িতাই কথা শুরু করল,—আমি কেন এসেছি আপনি গেস করতে পারছেন?

—বোধ হয় পারছি।

—কী আন্দাজ করছেন? টেরচা চোখে তাকাল দয়িতা।

সৌমিক ঢোক গিলল,—না মানে…আপনি বোধ হয় ফাইনাল এগজামের আগে আমার একটা ভাইভা নিতে চান।

দয়িতা হেসে ফেলেও গম্ভীর হল,—নট এগজ্যাক্টলি।…আমার আরও কিছু কথা ছিল। মোর দ্যান ভাইভা।

ফুটপাতে ঠেলে ওঠা ইটে হঠাৎ একটা হোঁচট খেল সৌমিক। সামলাতে সামলাতে বলল,—বলুন।

—হাঁটতে হাঁটতেই শুনবেন?

—বসবেন কোথায়?…বলেন তো পার্ক স্ট্রিটের দিকে যেতে পারি।

কী আহ্লাদ। ভাবছে কী, অ্যাঁ? চাঁদ ফুল পাখি তারা নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলবে দয়িতা? অত খায় না!

আরও গম্ভীর মুখে দয়িতা বলল,—না। অন্য কোথাও। বদ্ধ জায়গা আমি লাইক করি না।

এবার ইট ছাড়াই হোঁচট খেল সৌমিক, থমকে দাঁড়িয়েছে। ময়দানের দিকে আঙুল দেখাল,—ওখানে যাবেন? ওই যে একটা মেলা চলছে…

—মেলা?

দয়িতা আপত্তি করল না। মেলা মন্দ জায়গা নয়, রাস্তার ভিড়ে তালবেতাল হাঁটার চেয়ে ঢের ঢের ভাল। গাঢ় নির্জনতাও থাকে না, আবার ছড়ানো ছেটানো অলসমেজাজ লোকজনের মাঝে এক ধরনের নির্জনতা বুঝি থাকেও। মন খুলতে মেলার মাঠই বেশ।

রাস্তা পেরিয়ে ও-ফুটে গেল দুজনে, মেলার গেটে এল। শিল্পমেলা। ফাঁকা কাউন্টার থেকে টিকিট কাটল সৌমিক, ভেতরে ঢুকে দয়িতা দেখল জায়গাটা মোটামুটি জনশূন্যই। আছে কিছু স্যুট বুট টাই, আর ইয়া ইয়া প্যাভিলিয়নে হরেক কিসিমের মেশিন আর গাড়ি। দেশি, বিদেশি। দেশি কম, বিদেশিই বেশি। নিরালা মেলাপ্রাঙ্গণে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই প্রায় ঢুলু ঢুলু।

সৌমিক ঢুকেই একটা ট্রাক্টরের স্টলের সামনে স্থাণু। নড়ছেই না। অদ্ভুত ছেলে তো! দয়িতা যে জরুরি কথা বলতেই এখানে এল, তা যেন খেয়ালই নেই। ভাবটা এমন, যেন গিন্নিকে নিয়ে সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছে।

কটমট চোখে হলুদরঙা চাষযন্ত্রটাকে একটুক্ষণ নিরীক্ষণ করল দয়িতা। একই সঙ্গে মনে মনে ভেঁজে নিল কথাগুলো। যা বলার বলে ফেলাই ভাল।

নীরস স্বরে বলে উঠল,—আপনি নিশ্চয়ই আমায় খুব নির্লজ্জ ভাবছেন?

সৌমিক হকচকিয়ে পিছিয়ে এল,—না তো! কেন এরকম ভাবব?

—আপনারা ম্যাসকিউলিন জেন্ডার, যা খুশি ভেবে নিতেই পারেন। সোসাইটি আপনাদের তো সে রাইট দিয়েই রেখেছে।

—এ কথা বলছেন কেন?

—আপনারাই বলতে বাধ্য করেন।

—আমরা?

—ইয়েস। ইন ফ্যাক্ট, আপনিও তার মধ্যে একজন।

—আমি? আ-আ-আ আমি?

—তোতলাবেন না। তোতলানো ছেলে আমি দু চক্ষে দেখতে পারি না। গড়গড় করে কথাগুলো বলে ফেলতে পেরে বেশ চনমনে বোধ করছিল দয়িতা। পুট পুট পিন ফোটাল,—সেজে থাকে ভিজে বেড়ালটি…

—আ-আ-আ…সৌমিকের স্বর একেবারেই আটকে গেল।

ছেলেটার অবস্থা দেখে দয়িতার বুঝি দয়া হল সামান্য। গলা একটু নরম করে বলল,—আমি ইউজুয়াল তোতলাদের কথা বলছি। হোপফুলি ইউ ডোন্ট বিলং টু দ্যাট ক্লাস।

সৌমিকের দৃষ্টি কেমন বিস্ফারিত, ঠোঁট হাঁ হয়ে আছে। অসহ্য।

দয়িতা আবার ঝনঝন করে উঠল,—কথাগুলো কেন আপনাকে বলছি বুঝতে পারছেন না?

সৌমিক দু দিকে মাথা নাড়ল।

হাঁটতে আরম্ভ করল দয়িতা,—কারণ আমার বিয়েতে আপনি একজন পার্টি। এবং যে সে পার্টি নয়, ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট পার্টি। বর। কী করে আপনি এ বিয়েটা মেনে নিয়েছেন?

—মানব না? সৌমিক হাঁটছে পিছন পিছন, একটু বুঝি বা ভয়ে ভয়ে।

—কেন মানবেন? একটা প্রিমিটিভ সিস্টেম চলে আসছে, কেন তা ব্রেক করবেন না? স্বর সামান্য চড়ে গিয়েছিল দয়িতার। এক বয়স্ক সর্দারজি পাশ দিয়ে যেতে যেতে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। দয়িতা ঝট করে মুখ ফিরিয়ে নিল,—ছেলে মেয়েকে চেনে না, মেয়ে ছেলেকে চেনে না, কী একটা অং বং চং মন্ত্র পড়া হল, যদস্তু তদস্তু হল, ব্যস ওমনি দুটো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে ঘরে ঢুকে খিল এঁটে দিল! ইস, কী জঘন্য।

সৌমিক অস্ফুটে বলল,—তা বটে।

—ওই মুখেই তা বটে বলবেন, কাজের সময়ে তো একেবারে উলটোটি।

এতক্ষণে সৌমিকের মুখে হাসি ফুটল সামান্য। মলিন হাসি। মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল,—বিয়েটা যে আমার মতে হচ্ছে, তা আপনি ভাবলেন কী করে? এমনও তো হতে পারে, আমার মতামত না জেনেই বিয়ের ঠিক হয়েছে?

—তা হলে তো আরও খারাপ। তার মানে আপনি মায়ের নাড়ুগোপালটি সেজে বিয়ে করতে বসছেন!

একটুক্ষণ সৌমিক চুপ। কী যেন ভাবছে। পাশের দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছে এক জাপানি, আভূমি নত হয়ে বাও করছে দুজনকে, সাজানো প্যাভিলিয়নে চা ছাঁটার মেশিন দেখতে ডাকছে। তাকে আলগা প্রতিনমস্কার জানিয়ে সরে গেল সৌমিক। দয়িতার দিকে না ফিরেই শূন্যে কাটা কাটা বাক্যবন্ধ ছুড়ে দিল,—আপনার কি বিয়েতে আপত্তি? না আমাকে বিয়েতে আপত্তি?

—দুটোই। দয়িতা ঝটপট জবাব দিল।

সৌমিক অন্য দিকে মুখ রেখেই বলল,—বিয়েতে আপত্তিটা নয় বুঝলাম। কিন্তু আমাকে অপছন্দ করার কারণটা জানতে পারি কি?

—এত বড় একটা চাকরি করেন, লেখাপড়ায় নাকি ব্রিলিয়ান্ট, এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধিও আপনার নেই?

এবার সৌমিক অপাঙ্গে দেখছে দয়িতাকে। ভুরু কুঁচকে বলল,—আপনি কি আর কাউকে ভালবাসেন? আই মিন, বিয়ে করতে চান?

দয়িতা চকিতে উদাস। বোধিসত্ত্বকে কি ভালবাসে সে? চায়? আকাশকে কি চাইলেই পাওয়া যায়? কিংবা সমুদ্রকে? পাহাড়কে? এ চাওয়ায় তো কোনও প্রত্যাশা নেই, শুধু যন্ত্রণা আছে। এক গভীর সুখের যন্ত্রণা। এ সব কথা বললেও কি বুঝবে এই বোকা বোকা অনুভূতিহীন ছেলেটা? সম্ভাব্য স্ত্রীকে পাশে নিয়ে যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্র্যাক্টর দেখে…!

সৌমিক আবার বলল,—আপনি কিন্তু নিঃসংকোচে বলতে পারেন।

দয়িতা একটা নিশ্বাস ফেলল। উষ্ণ। ভেজা ভেজা। শান্তভাবে মাথা নেড়ে বলল,—নাহ্‌, তেমন কিছু নয়।

—ও।

সৌমিক আর কথা বাড়াল না। নিঃশব্দে হাঁটছে। অস্বাভাবিক মন্থর গতিতে। আকাশের দিকে তাকাল একবার, হিম পড়ছে বোধ হয়। ধুলো ঢাকতে এখানে ওখানে জল ছড়িয়েছে মেলাকর্তৃপক্ষ, কোথাও কোথাও কাদা কাদা মতন হয়ে আছে। অন্যমনস্কভাবে একটা কাদায় পা পড়ল সৌমিকের, অন্যমনস্কভাবেই পার হয়ে গেল।

কেটলি হাতে চা বিক্রি করছে এক কিশোর। তাকে হঠাৎ ডাকল সৌমিক। ভাঁড়ে চা নিল।

ফিরে দয়িতাকে জিজ্ঞাসা করল,—চলবে?

আলতো ঘাড় নাড়ল দয়িতা। চা ভীষণ গরম, ছোট্ট ছোট্ট চুমুক দিচ্ছে ভাঁড়ে। উষ্ণ পানীয় নেমে যাচ্ছে গলা বেয়ে, মন্দ লাগছে না।

অস্বস্তিটা একটু একটু ফিরে আসছিল দয়িতার। এত কড়া ভাষায় ছেলেটাকে কথাগুলো না বললেই হত। একজন অচেনা মানুষ, যে ক্ষণিক পরিচয়ের পর আবার চিরকালের মতো অপরিচিত হয়ে যাবে, সে কী বিশ্রী একটা ধারণা করল দয়িতার সম্পর্কে! কিছুই যায় আসে না, আবার কিছু যেন যায় আসেও। এই পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তেই হোক, একটা মানুষ তার প্রতি তীব্র বিরাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই ভাবনাতেও একটা বিজবিজে অস্বস্তি। প্রত্যাখ্যান কি একটু শালীন করা যায় না?

দয়িতা গলা নামিয়ে বলল,—সরি সৌমিক, আমি আপনাকে ঠিক হার্ট করতে চাইনি।

সৌমিক বলল না কিছু। ভাঁড়টা ঘাসে ফেলে চেপে চেপে গুঁড়ো করছে।

দয়িতা বলল,—শুনুন আপনাকে পছন্দ অপছন্দের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ইউ আর নো-বডি। বলেই একবার দেখে নিল সৌমিককে,—ইটস আ ম্যাটার অফ প্রিন্সিপল্‌। কোথাকার কে এক গুরুঠাকুর না গুরুদেব সে আমাদের মতো দুজনের ফেট ডিসাইড করবে, এটা মেনে নেওয়ার কোনও মানে হয় না। বাবা মা চাইলেও নয়।

—হুঁ।

—কিন্তু আমার প্রোটেস্ট জানানোর একটু প্রবলেম আছে। বুঝতেই তো পারছেন, কী যুক্তি দেখাব? আপনি ওয়েল কোয়ালিফায়েড, মোটা মাইনে পান, আপনার চেহারাও খারাপ নয়, অ্যাপারেন্টলি তেমন কোনও ভাইসও নেই। বাবা মা এর থেকে বেশি মেয়ের বিয়ের জন্য আর কী চায়! তার ওপর আপনি খোদ গুরুদেবের চয়েস। সুতরাং আমার কোনও আপত্তিই স্ট্যান্ড করবে না। কিন্তু আপনার কথা আলাদা।

—কেন? সৌমিক ভুরু কুঁচকে তাকাল,—আলাদা কীসে?

—ওই যে বললাম…ম্যাসকিউলিন জেন্ডার! ওটাই আপনার প্রিভিলেজ। আপনি অনায়াসে আমায় রিজেক্ট করতে পারেন।

—আমি! আমি কেন রিজেক্ট করব?

—কেন নয়? দয়িতা চোখ ঘোরাল,—আপনার ফেভারে তো অনেক পয়েন্ট। পাত্রী রূপেও কিছু অপ্সরী নয়, বিদ্যেতেও সরস্বতী নয়। অ্যাভারেজ। আপনার যা চেহারা, যা প্রসপেক্ট, আপনি বেটার ডিশ চাইতেই পারেন। অ্যান্ড অ্যাজ অ্যান এবল ম্যাসকিউলিন জেন্ডার সেটাই বোধ হয় আপনার উচিত হবে।

—বলছেন? এতক্ষণে সৌমিকের ঠোঁটে পাতলা হাসি।

—বলছি। আমি আপনাকে ওপেন ওফার দিচ্ছি। কাল আমাদের বাড়ি আসুন, এবং বাবা মা সকলের সামনে মুখের ওপর আমায় বাতিল করে দিন। আমি কিছু মনে করব না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

—তার মানে…আপনি…শুধু প্রিন্সিপলের জন্যই বিয়েটা?

—প্রিন্সিপল্‌টা কি ইর‍্যাশনাল মনে হল? সৌমিকের মুখ থেকে খপ করে কথা কেড়ে নিল দয়িতা।

—না, তা নয়…

—আইডিয়াটা খারাপ? সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না…

—সাপ? মানে ওই প্রিমিটিভ নিয়ম?

—অফ কোর্স। দয়িতা সরাসরি সৌমিকের চোখের দিকে তাকাল,—কী, পারবেন তো?

সৌমিক মাথা নামিয়ে নিল। ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে হাসিটা ঝুলেই আছে।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল দয়িতা। যাক বাবা, আহত পৌরুষের ক্ষতস্থানে প্রলেপ পড়েছে কিছুটা। চিরশ্রী ঠিকই বলে, মেয়েরা সামান্য উসকে দিলেই ছেলেরা ভেড়া বনে যায়।

আহা রে বালাই ষাট, ছেলেটা একটু কেবলুশ আছে বটে, কিন্তু ভেড়া কেন হবে? ভাল ছেলে, ভালমানুষ ছেলে, গুড়ি গুডি বয়।

কিন্তু তুমি যতই গুড বয় হও সৌমিক, আমার বোধিসত্ত্বর কাছে তুমি কিচ্ছু না।

রাত্রে খাবার টেবিলে বসে কথা হচ্ছিল। ওই বিয়ে নিয়েই।

প্রবীর জিজ্ঞাসা করল,—মাঘের গোড়ার দিকে ডেট ফেললে তোর অসুবিধে হবে না তো মুনিয়া?

মণিদীপা স্যালাডে লেবু চিপছিল। বলল,—অসুবিধে কীসের? ওর ফাইনাল তো মার্চের লাস্টে। ইচ্ছে হলে একটা মিনি হনিমুনও সেরে নিতে পারবে।

বুম্বা সদ্য কলেজে ঢুকেছে এ বছর, কমার্স নিয়ে পড়ছে। সে ফোড়ন কেটে উঠল,—আজকাল মধুচন্দ্রিমার কি গ্রেডেশান হচ্ছে মা? মিনি হনিমুন? ম্যাক্সি হনিমুন?

—অ্যাই, তুই চুপ কর তো। মণিদীপা ছেলেকে লঘু ধমক দিয়ে স্বামীর দিকে ফিরল,—মনে খুঁতখুঁত থাকলে অত দেরি কোরো না, অঘ্রাণেই দিন দ্যাখো।

—এত তাড়াতাড়ি? মেয়ের বিয়ের অ্যারেঞ্জমেন্ট কি মুখের কথা! এখন বললে একটা ভাল বিয়েবাড়ি বুক করতে পারব? মাঘ মাসেই কোথায় পাই দ্যাখো। তার ওপর তোমাদের মার্কেটিং করতে কদ্দিন লাগাবে…শাড়ি আছে, কসমেটিকস আছে, ফার্নিচার আছে, গয়না গড়ানো আছে…। সুবীরদেরও টাইম দিতে হবে, ওরা নাইরোবি থেকে আসবে…

—ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। গয়না। মণিদীপা হাতায় কপি তুলে প্রবীরের পাতে দিল,—কোনটা কোনটা ভাঙি বলো তো?

—সে তুমি বোঝো। আমি কী বলব?

—ভাবছি বড় নেকলেসটা ভাঙব না। তোমার মা হাতে করে দিয়েছিলেন, থাক। ওটা ওই অবস্থাতেই পালিশ টালিশ করে মুনিয়াকে দিয়ে দেব। ওদের তো এখন ওই সাবেকি ডিজাইনই বেশি পছন্দ। ওতে পুরো ছ ভরি আছে, আমি ওজন করে দেখেছি। চূড় ব্রেসলেটও…আলাদা করে শুধু চুড়ি গড়াতে হবে। অন্তত দশ গাছা। ওই সোনাটুকু কিন্তু কিনতে হবে, বুঝলে?

—কতটা লাগবে?

—কম করেও এগারো-বারো ভরি তো বটেই। একদম ফংফঙে জিনিস দিলে কবিতাদির কাছে মান থাকবে?

নিঃশব্দে খেতে খেতে আলোচনাটা শুনছিল দয়িতা। কী অদ্ভুত অলীক এক বিষয় নিয়ে কথা চালিয়ে যাচ্ছে বাবা-মা! যে ঘটনাটা ঘটবেই না তা নিয়ে মধুর কল্পনার জাল বুনে চলেছে। আশ্চর্য, যেন দয়িতার বিয়ে দিতে পারলেই এদের জীবনের মোক্ষলাভ হয়। আরও আশ্চর্য, এই বাবা-মা তাকে নাকি স্বাধীন করে গড়েছে! তার ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে নাকি রেসপেক্ট করে! অথচ কলকাতায় পা দেওয়ার পরে একবারও কেউ জিজ্ঞাসা করল না, হ্যাঁ রে মুনিয়া, তোর ওই ছেলে পছন্দ তো!

ঠিক করেছে দয়িতা, পাকা গুটি কাচিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু এবারটা নয় পার করে দিল দয়িতা, নেক্সট বার? এখন তো সম্বন্ধ বার বার আসবে, কতবার ঠেকাবে দয়িতা? এক সময়ে কি নুয়ে পড়বে? কী হবে তখন বোধিসত্ত্বর? হৃদয়ের কোন মণিকোঠায় থাকবেন তিনি?

প্রসঙ্গ সরেছে সামান্য। গয়না থেকে ফার্নিচারে। ক্রমশ কালকের আয়োজনের দিকে গড়াচ্ছে।

মণিদীপা দয়িতাকে জিজ্ঞাস করল,—হ্যাঁ রে মুনিয়া, কাল কী কী করা যায় বল তো?

দয়িতা ঠোঁট উলটোল,—আমি কী বলব?

—কিছু একটা সাজেস্ট কর। প্রবীর মেয়ের দিকে তাকাল,—তোরা আজকালকার ছেলেদের টেস্ট বুঝিস।

—দিদি ছেলেদের টেস্ট কী বুঝবে? আমায় জিজ্ঞেস করো। বুম্বা চুপ থাকতে পারল না,—উই লাইক শর্টকাট। নো ঝোলঝাল, শুঙ্কনো শুকনো। চিকেন করলে চিলি চিকেন, মাটন করলে কাবাব, মাছ করলে ফিস তন্দুরি…

দয়িতা মুখ বেঁকাল,—ছেলেটা একা আসবে না মা। তার মা-বাবাও থাকবে।

—হ্যাঁ, সেটাও ভাবতে হবে। কবিতাদির বরকে নিয়ে কোনও প্রবলেম নেই। আশ্রমে তো দেখেছি নিরঞ্জনদা ভুনিখিচুড়িও কেমন সাপটেসুপটে খায়।…কবিতাদি মাছ খুব ভালবাসে। সেবার হরিদ্বারে গুরুদেবের কাছে গিয়ে বেচারার খুব অসুবিধে হচ্ছিল।

—তোমরা মেয়েরা কেনই বা যে দীক্ষা নাও। প্রবীর পুট করে মন্তব্য ছুড়ল,—ঈশ্বরের পায়ে সর্বস্ব অর্পণ করবে, কিন্তু মাছ মাংসটুকু ছাড়তে পারবে না।

—আহা, গুরুদেব কক্ষণও মাছ মাংস খেতে বারণ করেন না।

—সে তো উনি নিজে ছাড়তে পারেননি, তাই। বুম্বা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল কথাটা।

অগ্ন্যুৎপাতের আশঙ্কা। প্রবীর তাড়াতাড়ি বলে উঠল,—যাক গে যাক, তোমার কবিতাদিকে কাল কী মাছ খাওয়াবে বলো। চিংড়ি? কই? ভেটকি? রুই?

—চিংড়ি এনো। আর…মুনিয়া, তুই কী রাঁধবি?

—দিদি? বুম্বা আবার ফুট কাটল,—ও কোনও একটা রেডিও আইসোটোপের বড়া ভেজে দেবে। লেজার বিম দিয়ে।

দয়িতা তীব্র দৃষ্টি হানল ভাইয়ের দিকে। গম্ভীর মুখে বলল,—আমাকে কেন রাঁধতে হবে?

—ওটা নিয়ম। একটা কিছু করতেই হয়। কবিতাদিকে আমি মিথ্যে বলতে পারব না।

—আমার দ্বারা হবে না। এম এসসি পড়ছি রাঁধুনি হওয়ার জন্য নাকি?

—ও কী কথা মুনিয়া! মেয়েরা যত বিদুষীই হোক, তাদের রান্নাবান্না একটু জানতেই হয়। নইলে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে নিন্দে হবে না?

বাহ বাহ, কী যুক্তি! শুধু এই অপমানজনক শব্দ কটার জন্যই বিয়ে ভেঙে দেওয়া উচিত। মা কি ওই সৌমিকটাকে জিজ্ঞেস করতে পারবে, হ্যাঁগো বাছা, তুমি বাড়ির কী কী কাজ জানো! বেসিন সাফ করতে পারো? ঝুল ঝাড়তে পারো? পরদায় রিং পরাতে? আশ্চর্য, বাবাও কোনও প্রতিবাদ করছে না! অথচ এই বাবাই না তার কেরিয়ার নিয়ে কত ভাবে? এম এসসি করে তোকে থামলে চলবে না মুনিয়া, পিএইচ ডি করতে হবে! আজকাল লেকচারারের চাকরি জোটাতে গেলেও…।

বাবা-মা কী ধরনের মানুষ? সেই কী একটা কবিতা আছে না, ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি, সেই প্রজাতির?

হঠাৎ একটা চাপা প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠল দয়িতার মনে। বিয়ে তো ভেঙে যাচ্ছেই, তার আগে মা গদগদ মুখে তার গুরুবোনকে একটু মেয়ের গুণপনা শোনাক না! সৌমিক বসুরায় যখন চ্যাটাং চ্যাটাং করে মেয়েকে বাতিল করে দেবে, তখন গুণবতী কন্যার মা’র মুখের ছবিটা কেমন হবে?

গোমড়া মুখেই দয়িতা বলল,—হুকুম করো কী করতে হবে? আমার শ্বশুর-শাশুড়ি কীসে তৃপ্ত হবেন?

বুম্বা দিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে এল,—আহা, চটছিস কেন? লক্ষীদি ফিশফ্রাই গড়ে দেবে, গ্যাস জ্বালিয়ে দেবে, কড়ায় তেল দিয়ে দেবে, তুই খালি হাতে করে ছাড়বি। ব্যস, সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।

রাগ ভুলে পেট গুলিয়ে হাসি এল দয়িতার। একই প্রবচনের কত রকম প্রয়োগ! এই প্রবচনেই না শেষমেষ পুরোদস্তুর ধরাশায়ী হল সৌমিক! আহা রে, দয়িতা যখন মেট্রো রেলের গহ্বরে নেমে যাচ্ছিল তখন ওপর থেকে হাত নাড়ছিল বেচারা!

আরও কিছুক্ষণ নৈশ টেবিলবৈঠক চালিয়ে সবাই যে যার মতো উঠল। ড্রয়িং স্পেসে পা ছড়িয়ে এখন টিভিতে স্পোর্টস চ্যানেল ধরবে বুম্বা, মণিদীপাও গিয়ে বসবে ছেলের পাশে। খুনসুটি শুরু হবে দুজনের। স্পোর্টস চ্যানেল, না সিনেমা! মণিদীপাই হারে বেশিরভাগ দিন। আজ অবশ্য শুক্রবার, লোকাল কেব্‌লে ভাল হিন্দি ছবি দেখাচ্ছে, মণিদীপা আজ জিতলেও জিততে পারে। প্রবীরের টিভির নেশা নেই, সে এখন বসবে অফিসের ফাইল নিয়ে। বহুজাতিক সংস্থায় দায়িত্বপূর্ণ পদে চাকরি, কোম্পানির ফাইল ঘরে স্তৃপ না হলে মানায় না।

বাড়ি এলে দয়িতা এ সময়ে বাবার সঙ্গে বসে টুকটাক কথা বলে, মা ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমশকরা করে। আজ মুড নেই, সোজা চলে এল নিজের ঘরে। হ্যাঁ, নিজের ঘর, একেবারে নিজস্ব। বছর চারেক হল উত্তরের রায়বাগান স্ট্রিটে সাবেকি বসতবাড়ি কিনেছে প্রবীর, বুম্বা দয়িতা দুজনেরই আলাদা আলাদা ঘর আছে এখানে। শান্তি, ভাইবোনে ঝগড়াঝাটি লাগে কম। দয়িতার ঘরটা খুব বড় না হলেও ছিমছাম, সাজানো। সিঙ্গলবেড খাট, ওয়ারড্রোব, মিনি বুককেস, শৌখিন জিনিসপত্র রাখার ঝুলন্ত খোপ খোপ র‍্যাক, জানলা দরজায় বেডকভারের সঙ্গে মানানসই বাহারি পরদা, অফহোয়াইট দেয়ালে যামিনী রায়ের পেন্টিং-এর বাঁধানো প্রিন্ট। মেয়ে না থাকলেও রোজ এ ঘর নিজের হাতে গুছিয়ে রাখে মণিদীপা।

আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়েছে দয়িতা। চোখ বুজতেই সন্ধেটা ঝেঁপে এল। পাশ ফিরে দয়িতা জড়িয়ে ধরল বালিশটাকে। কার জন্য করল এ সব আজ? বোধিসত্ত্ব…? কী করছেন বোধিসত্ত্ব এখন? আজ কি এসেছিলেন লাইব্রেরিতে? ফেরার পথে দয়িতার কথা কি একটুও মনে পড়েছিল? কী যেন বলছিলেন সে দিন বোধিসত্ত্ব? কোনও একটা পয়েন্ট থেকে সুইচ অন করে দেওয়া হয়েছে, তারপর থেকে এই ইউনিভার্সটা চলছে…চলছে…চলছে…! সুইচ-অন করা ঈশ্বর এক হাত-পা বাঁধা পুতুল, যা ঘটেছে তার বাইরে তাঁর নাকি আর কিছু করার ছিল না!

অন্ধকারে দয়িতা আপন মনে হাসল। আজ সন্ধেয় অন্য আর কিছু কি করতে পারত দয়িতা? সেও তো এখন একটা হাত-পা বাঁধা পুতুল!

ঘুমিয়ে পড়ল দয়িতা।

জাগল বুমবার ডাকে,—দিদি, অ্যাই দিদি, নিউজ! তোর উড-বি বরটা আজ আসছে না।

—সে কী! দয়িতা চোখ রগড়াল,—কে বলল?

—হ্যাঁরে, কবিতামাসি ফোন করেছিল। তোর বর নাকি তোকে একেবারে ছাদনাতলায় দেখবে। তার আগে নয়। ওরা অবশ্য আসছে আজ…তোকে আশীর্বাদ করতে।

দয়িতা নিঃসাড়। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না দয়িতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *