১৫.
—দয়ি, অ্যাই দয়ি…শোন…
প্র্যাকটিকাল ক্লাস শেষ হতেই ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে তড়িঘড়ি করিডর ধরে হাঁটা শুরু করেছিল দয়িতা, মৈত্রেয়ীর ডাক শুনে ফিরে তাকাল। মৈত্রেয়ী একা নয়, সঙ্গে শুভজিৎ আর তন্ময় আছে।
দয়িতা ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল—কী বলছিস?
মৈত্রেয়ী এগিয়ে এল—তুই কর্নার টেবিলের জি এম কাউন্টারটায় কাজ করছিলি না?
—হ্যাঁ, কেন?
—তোর ডেটা দেখি। আমার রেজাল্টটা ঠিক আসছে না।
দয়িতা ব্যাগ থেকে খাতা বার করে মৈত্রেয়ীকে দিল। করিডরে আলো কম, ধারের জানলায় সরে গেল মৈত্রেয়ী, মন দিয়ে দেখছে খাতা। শুভজিৎও ঝুঁকে চোখ রাখল। দয়িতার রিডিংগুলো সাজানো গোছানো নেই, খুঁজে বার করতে অসুবিধে হচ্ছিল মৈত্রেয়ীর। নিজের নোটবই খুলল, মেলাচ্ছে।
তন্ময় আর দয়িতা কথা বলছিল। তন্ময় লেখাপড়ায় খুব সিরিয়াস, কথাবার্তার ভঙ্গিও বেশ কেজো ধরনের। গ্রাম্ভারি মুখে সে জিজ্ঞাসা করল—তুই চলে যাচ্ছিস নাকি? আজও পি এসের ক্লাসটা করবি না?
—তুৎ, বোর লাগে। দয়িতা প্রসঙ্গটা এড়াতে চাইল।
—যেমনই লাগুক, পি এসের নোট কিন্তু সলিড। আর বই ঘাঁটার দরকার হয় না।
—নোট তো নিবিই, কাল তোর খাতা থেকে টুকে নেব।
—তা নিস। তন্ময়ের মুখ আরও গম্ভীর—তুই কিন্তু আজকাল খুব ক্লাস বাংক করছিস দয়ি, প্রবলেমে পড়ে যাবি।
—যাহ্, ওর আবার প্রবলেম কী! মৈত্রেয়ীর মন্তব্য উড়ে এল,—দয়ির এখন বড় নাওয়ে খুঁটি বাঁধা আছে। কিংবা বলতে পারিস বড় খুঁটিতে নাও বাঁধা আছে।
দয়িতা শুনেও না শোনার ভান করল। হোস্টেল ছেড়ে আসার পর থেকে সে আর বোধিসত্ত্ব এখন গোটা ক্যাম্পাস টাউনের চাটনি খবর, অহরহ এরকম ছুটকো ছাটকা টিপ্পনীর সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে। প্রাণপণে চোখ কান বন্ধ রেখে উপেক্ষা করার চেষ্টা করে দয়িতা, তবু কখনও কখনও গায়ে বিধে যায় বইকী। উপায় নেই, মাস দেড়েক আরও এভাবেই কাটাতে হবে, ফাইনাল পরীক্ষাটা না হওয়া পর্যন্ত।
মৈত্রেয়ীর চোখ আবার খাতায় নেমে গেছে। নির্লিপ্ত ভঙ্গি, কোনও তাড়াহুড়ো নেই যেন।
দয়িতা আর একবার কবজি উলটোল। দশটা পঁচিশ। অধৈর্য গলায় বলল—খাতাটা তুই রেখে দে, কাল নিয়ে নেব।
—না বাবা, তোর জিনিস তুই নিয়ে যা। আমার আবার কোথায় মিসপ্লেসড হয়ে যাবে…
—তা হলে একটু তাড়াতাড়ি কর, প্লিজ।
—হোয়াই সো হারি, অ্যাঁ? গিয়েই কি এখন স্যারের লুঙ্গি কাচতে বসবি?
দপ করে চোখে আগুন জ্বলে উঠল দয়িতার। চোয়ালে চোয়াল চেপে সামলাল নিজেকে, ছোঁ মেরে কেড়ে নিল খাতা। মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে হনহন। পিছনে সমবেত হাসির রোল, দয়িতার কানে বিষ ঢালছিল।
অসহ্য! অসহ্য!
কোনওদিকে না তাকিয়ে দয়িতা ইউনিভার্সিটির গেট পেরল। মাথা রাগে ঝাঁ ঝাঁ করছে। দয়িতা বোধিসত্ত্বর সঙ্গে আছে কি নেই, দয়িতা বোধিসত্ত্বর ঘর ভাঙল কি গড়ল, তা নিয়ে তোদের এত কিসের মাথাব্যথা? উঁহু, মাথাব্যথা নয়, জ্বলুনি। হিংসে। হিংসেয় জ্বলছে সব। বোধিসত্ত্বর মতো এক বিশাল মাপের মানুষ এখন শুধু দয়িতার অধিকারে, এটাই কারও সহ্য হচ্ছে না। চিরশ্রী যে চিরশ্রী সে পর্যন্ত কথা বন্ধ করে দিল। হোস্টেল থেকে যে দিন বইপত্র জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে এল দয়িতা, সে দিন কী তার জ্ঞান দেওয়ার বহর! ঠিক কাজ করছিস না দয়ি, মোহে তুই অন্ধ হয়ে গিয়েছিস! ওরে কী আমার ঠাকুমা রে! কথা বলবি না বলিস না, দয়িতার ভারী বয়েই গেল।
বাড়ি পৌঁছে দয়িতা দেখল রূপচাঁদ ভাত আর ডাল করে ফেলেছে। কপি আলু কড়াইশুঁটিও কেটেকুটে রেডি, দয়িতার প্রতীক্ষায়।
দয়িতা কোমর বেঁধে রান্নায় নেমে পড়ল। বইখাতা ঠাঁইঠুই ছুঁড়ে দিয়েছে সোফায়, সালোয়ার কামিজের ওপর বেঁধে নিয়েছে অ্যাপ্রন। ধোঁয়া ওঠা তেলে আলু কপি ছাড়ল। নাক কুঁচকে মাছটাকে দেখল একবার। কই মাছ। বিচ্ছিরি বাঁকা বাঁকা কাঁটা, গাটাও কেমন হড়হড়ে, কাঁচা অবস্থায় আঁশটে গন্ধও আছে। রোজ মুরগি খেলেই তো হয়, কেন যে বোধিসত্ত্ব এত মাছ খেতে ভালবাসে! নুন হলুদ মাখানোই আছে, কড়ায় একটা একটা করে মাছ ছাড়ছে দয়িতা, আর সভয়ে তিনপা করে পিছিয়ে আসছে। বাপস্, কী জোর জোর ফাটে! পরশু পোনা মাছ ভাজতে গিয়েই হাতে ইয়া বড় একটা ফোসকা পড়েছিল দয়িতার।
খুন্তি দিয়ে সন্তর্পণে একটা মাছ উলটে দিয়ে দয়িতা সরে এল। রান্না বেশ ঝকমারির কাজ। প্রথম প্রথম দয়িতার বেশ কাহিল দশা হয়েছিল। সে একেবারেই রান্নাবান্না জানে না তা নয়, শৌখিন দু-চারখানা পদ চমৎকার বানিয়ে ফেলতে পারে। দহিচিকেন, বাটার পনির মশালা, কপির রোস্ট, মালাই কোপ্তা…। কিন্তু এ সব রান্না কি রোজ চলে? বোধিসত্ত্বর তো একেবারেই চলে না, তেল মশলা কম হালকা হালকা রান্নাই তার বেশি পছন্দ। অগত্যা টাউন থেকে ‘সহজ পাক প্রণালী’ একখানা কিনে এনেছে দয়িতা। তাই দেখে দেখে বড়ির ঝাল, শুক্তনি, আলু কপির ডালনা, পালংবেগুন, পাতলা পাতলা মাছের ঝোল…—মোটামুটি রপ্তই হয়ে গেছে। শুধু নুনের আন্দাজটাই এখনও ঠিকঠাক হয়নি, এই যা।
কই মাছ রান্না অবশ্য আজ এই প্রথম। মনে মনে একটু সমস্যাই হচ্ছিল দয়িতার। ডাকল—রূপচাঁদ?
রূপচাঁদ ঘর ঝাড়ামোছা শুরু করেছিল। দৌড়ে এসেছে—আজ্ঞা দিদিমণি?
—তেলকই কী করে রাঁধে, জানো?
—না আজ্ঞা।
—মাছটা তা হলে কীভাবে করি বলো তো?
—আজ্ঞা, ঝোল করে দিন।
—পেঁয়াজ দিয়ে? না সর্ষেবাটা?
—আজ্ঞা, জিরেও দিতে পারেন, মা জিরে দিয়ে ফুলকপি দিয়ে রান্তেন।
কথাটা সচেতনভাবে বলেনি রূপচাঁদ, তবু দয়িতার কানে লেগে গেল। অজান্তেই গম্ভীর হয়ে গেল মুখ। রূপচাঁদ ঘাড় নিচু করে তার আদেশ পালন করে যায় বটে, তবু এখনও যেন মনে হয় এ বাড়িতে দয়িতার উপস্থিতি তার পুরোপুরি হজম হয়নি। নইলে কারণে অকারণে রাখীর প্রসঙ্গে তোলে কেন? মাঝে মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকিয়েও থাকে দয়িতার দিকে, যেন আজব গ্রহের জীব দেখছে। সরলতা মাখা দৃষ্টিও কখনও কখনও এত অসহনীয় মনে হয়!
রূপচাঁদের কথা মতো কপি দিয়ে ঝোল করলেই শর্টকাট হত, কিন্তু দয়িতা সে পথে গেল না। পেঁয়াজ আদা রসুন দিয়ে কষকষে করে রাঁধল মাছ, আলাদাভাবে আলু-কপির তরকারি। কেন করল? অদৃশ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে রেষারেষি? খেতে বসে পাছে বোধিসত্ত্বর রাখীর কথা স্মরণে আসে, এই আশঙ্কায়? দয়িতা নিজেও ঠিক ঠিক জানে না।
বোধিসত্ত্ব ফিরল নিজের সময় মতোই। সাড়ে এগারোটায়। এসেই জুতো মোজা ছেড়ে বাথরুমে ঢুকছে। সেখান থেকেই চেঁচাল—রূপচাঁদ? অ্যাই রূপচাঁদ? গিজার চালাসনি কেন?
রূপচাঁদ দৌড়ে গেল—মনে ছিল না আজ্ঞা।
—মন তোমার থাকে কোথায়, অ্যাঁ? কান আমি ছিঁড়ে নেব।
—আহা, ওকে বকছ কেন? দয়িতা লঘু স্বরে বলল,—শীত তো কমে গেছে, একদিন ঠাণ্ডা জলে হাত-মুখ ধুলে কী এমন ক্ষতি হবে?
—আমার হ্যাবিট।
হ্যাবিটটা বদলাও। বলতে গিয়েও বলল না দয়িতা। কী যে সব আজেবাজে অভ্যেস তৈরি করে দিয়ে গেছে ওই মহিলা, কোনও কাজ লোকটা নিজের হাতে করতে পারে না। এক্ষুনি হাতের গোড়ায় তোয়ালে চাইবে, সাবান চাইবে, চটি চাইবে…! ভাবতে গেলে দয়িতার হাসিও পায়। লোকটা নামেই রাশভারী, ভেতরে ভেতরে এক্কেবারে শিশু, এখনও।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে খাবার টেবিলে বসেছে বোধিসত্ত্ব। মুখটা যেন একটু ভার ভার। দয়িতা ঝটিতি টক দই বার করল ফ্রিজ থেকে, স্যালাডের প্লেট সাজিয়ে দিল।
চামচে ভাত তুলতে তুলতে বলল—ওমনি বাবুর গোঁসা হল বুঝি?
—উঁ?
—বলছি, এত রাগ কেন?
বোধিসত্ত্ব চোখ তুলল—রাগ করিনি তো।
—কোরো না। অপাঙ্গে রূপচাঁদকে দেখে নিল দয়িতা, চাপা স্বরে বলল—তোমার রাগ দেখলে আমার বুক কাঁপে।
বোধিসত্ত্বর ঠোঁটে হাসি ফুটল। খাচ্ছে, তৃপ্ত মুখে। তবু যেন মাঝে মাঝে সামান্য অন্যমনস্ক, যেন মেঘলা ছায়া পড়ছে মুখে। আবার মিলিয়েও যাচ্ছে ছায়া। কই মাছটা কেমন হয়েছে জানতে খুব ইচ্ছে করছিল দয়িতার, জিজ্ঞেস করল না, বাধো বাধো ঠেকল। কেন নিজে থেকে কিছু বলে না বোধিসত্ত্ব?
দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে বোধিসত্ত্ব আবার ইউনিভার্সিটিতে যায়। এটাই রুটিন। আজ শুল না, স্টাডিরুমে বসে সিগারেট খাচ্ছে। দয়িতা খেয়ে উঠে স্নানে ঢুকেছিল, বেরিয়ে একটু অবাকই হল। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে স্টাডিরুমে এসেছে।
মুচকি হেসে বলল—বসে কেন? শোবে না?
—ইচ্ছে করছে না।
—ভাবছ কিছু?
—উঁ? নাহ্। বোধিসত্ত্ব হাত বাড়িয়ে দয়িতাকে কাছে টানল—তোমার আজ আর ক্লাস নেই?
—যাব না।
—কোনওদিনই তো সেকেন্ড হাফে যাচ্ছ না! আননেসেসারি ডুব মারছে কেন?
দয়িতা মনে মনে বলল, আমার আজকাল আর ইউনিভার্সিটি যেতেই ভাল লাগে না। সকাল বিকেল কক্ষনও না।
মুখে বলল—এখন সব থিয়োরির ক্লাস। না গেলেও চলে।
—সে কী কথা! ফিজিক্স নিয়ে পড়ছ, থিয়োরির ক্লাস না করলে চলবে?
-তুমি তো আছ। দয়িতা আদুরে বালিকার মতো বোধিসত্ত্বর কোলে বসল। দু হাতে গলা জড়িয়ে ধরেছে। ফিসফিস করে বলল—তুমি আমায় সব পেপার পড়িয়ে দিতে পারো না?
দয়িতার মাদক গন্ধে চকিতে আচ্ছন্ন বোধিসত্ত্ব। কণ্ঠ থেকে অধ্যাপকের সুর হারিয়ে গেছে, চটুল স্বরে বলল—এখন কোন পেপারটা পড়বে?
—তুমিই বলো। বোধিসত্ত্বর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিল দয়িতা।
বোধিসত্ত্ব আলগা চুম্বন করল দয়িতাকে। ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে চুম্বন, ঠোঁট ঘুরছে ঠোঁটে গালে কপালে চোখে গলায়। নাইটির ওপর হাউসকোট জড়িয়ে আছে দয়িতা, চপল হাতে আবরণ সরাচ্ছে বোধিসত্ত্ব। তার ঈষৎ খসখসে ত্বকের ছোঁয়ায় শিরশির করছে দয়িতার শরীর, বুজে গেছে দু চোখ, মাঘের দুপুরে আপ্লুত হচ্ছে চেনা ভাললাগায়।
হঠাৎই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ঝাঁকুনিতে সচকিত হল দয়িতা। স্টাডিরুমের দরজা ভেজানো নেই, পরদা দুলছে মৃদু মৃদু, ফাঁক দিয়ে এক ছায়ামূর্তি দেখা যায়। সঙ্গে সঙ্গে দয়িতা ছিটকে সরে গেছে।
কামার্ত বোধিসত্ত্ব বিহ্বল মুখে বলল কী হল?
দয়িতা দরজার দিকে ইশারা করল।
অমনি গর্জন করে উঠেছে বোধিসত্ত্ব—অ্যাই রূপচাঁদ, কী করছিস ওখানে?
স্থির দাঁড়িয়ে থাকা রূপচাঁদ নীরব।
—কী হল, জবাব দিচ্ছিস না কেন?
এতক্ষণে মিনমিনে গলা শোনা গেল—আজ্ঞা বাগানের কথা বলব ভাবছিলাম। গাঁদা সব মরে গেছে, ওগুলো তুলে ফেলে গোলাপের চারা লাগাব?
—এটা তোর বাগানের কথা বলার সময়? কোনও বাগান হবে না, ভাগ্, ভাগ্ এখান থেকে।
রূপচাঁদ সরে গেল বটে, কিন্তু দয়িতাতে আর ডুবল না বোধিসত্ত্ব। একটুক্ষণ বসে রইল ঝুম হয়ে, তারপর তেতো মুখে উঠে পড়েছে। চশমা পরল, ব্যাগ কাঁধে নিল, ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
দয়িতার ভারী অদ্ভুত লাগছিল। মানুষটা একটাও কথা না বলে চলে গেল কেন? নিজেই তো বলে রূপচাঁদ একটু হাবাগোবা ধরনের, কত সময়ই তো রূপচাঁদের অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে দয়িতাকে আলগা আদর টাদরও করেছে, তা বলে এই মুহূর্তে এত খেপে গেল কেন? কিছু একটা হয়েছে! কিছু একটা হয়েছে! বাড়ি ফেরার পর বোধিসত্ত্ব আজ কি একটু বেশি আনমনা ছিল না?
দুপুরটা বড় নির্জন এখন। ঠাণ্ডা কমে গেছে ঠিকই, তবে রোদুরের তেজ এখনও তেমন প্রখর নয়। বাতাসে বেশ একটা শীত শীত আমেজ আছে। শুকনো পাতারা কেঁপে কেঁপে ঝরে পড়ছে গাছ থেকে, উড়ছে হাওয়ায়। কোথায় যেন কুবো পাখি ডাকছে একটা, কুবকুব কুবকুব…।
গায়ে আলগা চাদর জড়িয়ে বাগানে এলোমেলো হাঁটছিল দয়িতা। ভাবছে। বাগানের কথা উল্লেখ করেই কি বোধিসত্ত্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল রূপচাঁদ? বাগান রাখীর অনেকখানি ছিল, দয়িতা শুনেছে। বাগানটা কি বোধিসত্ত্বকে রাখীর কথা মনে পড়িয়ে দিল?
রূপচাঁদ বারান্দায় ম্রিয়মাণ মুখে দাঁড়িয়ে। দয়িতা তার কাছে গিয়ে নরম গলায় বলল—ঠাণ্ডা তো কমে গেছে, এখন কি গোলাপফুল ভাল হবে, রূপচাঁদ?
রূপচাঁদ করুণ চোখে তাকাল—গোলাপ তো বারো মাসই হয় দিদিমণি।
—গোলাপের তো অনেক হ্যাপা। গোলাপগাছের যত্ন করতে জানো?
—আজ্ঞা, মা শিখিয়েছিল। মার বড় গোলাপের শখ ছিল।
এবার কি রূপচাঁদ ইচ্ছে করেই বলল কথাটা? দয়িতা বুঝতে পারল না। মা দিদিমণি শব্দগুলো কোন এক গ্রন্থিতে গিয়ে যেন আঘাত করে, মন বিস্বাদ হয়ে যায়।
ঘরে এসে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল দয়িতা। বাইরে হাওয়া বইছে এলোমেলো, মাঘের হাওয়া, আওয়াজ বাজছে সরসর। বাতাসটা যেন বুকের মধ্যেও ঢুকে পড়ছে। মাস খানেকের ওপর হয়ে গেল, এখনও এ বাড়ির সর্বত্র শুধু রাখী রাখী রাখী। রান্নাঘরের প্রতিটি হাতা চামচ থালা বাটিতে রাখীর ছোঁয়া, বাড়ির প্রতিটি দরজায় জানলায় দেয়ালে পরদায় রাখী প্রখরভাবে বিরাজমান। আলমারি খুললে রাখীর শাড়ি ব্লাউজ, ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার টানলে রাখীর ক্লিপ কাঁটা ক্রিম পাউডার সিঁদুর। এমনকি এই যে এখন বিছানায় শুয়ে আছে দয়িতা, এখানেও দিনে রাতে সর্বক্ষণ কী তীব্র রাখী রাখী গন্ধ! আদ্যন্ত রাখীতে সম্পৃক্ত হয়ে থাকা এই সংসারে দয়িতা তা হলে কে? তার অবস্থানই বা কোথায়? বোধিসত্ত্বর হৃদয়েই বা ঠিক কোনখানটায় আছে সে? বোধিসত্ত্বকে সে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসে, তার একটিমাত্র আহ্বানে আজন্মলালিত সংস্কার সম্পর্ক সব ত্যাগ করে চলে এসেছে…তবু এই মুহূর্তে সে বোধিসত্ত্বর কে? প্রেমিকা? রক্ষিতা? নর্মসহচরী? সে দিন বোধিসত্ত্বর ভাই এল বাড়িতে, তাকে দেখে সিঁটিয়ে রইল দয়িতা। কেন? দয়িতা কি তবে পাপবোধে ভুগতে শুরু করেছে? এখনই কি মনে হচ্ছে ভুল করে ফেলেছে সে?
এতাল বেতাল ভাবনার মাঝে কখন যেন জড়িয়ে এল দয়িতার চোখ। হালকা হালকা ঘুমের মাঝে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখছিল দয়িতা। কলকাতায় তাদের শোভাবাজারের ফ্ল্যাটটা প্রচুর আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। কী বিশাল হয়ে গেছে ফ্ল্যাটটা, এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো দেখা যায় না। কত অজস্র পরিচিত লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে। মাসি পিসি, কলেজের বন্ধু, ইউনিভার্সিটির বন্ধু, বাবা মা বুম্বা…। রাখীও আছে সেখানে। পরনে বেনারসি, খোঁপায় ফুল। বিয়ে হচ্ছে ফ্ল্যাটবাড়িটায়, বরের বেশে বোধিসত্ত্ব, কনের সাজে দয়িতা স্বয়ং। কী জোরে জোরে মন্ত্র পড়ছে পুরোহিত! যদিদং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম…। হঠাৎ কোথ্থেকে রে রে করে তেড়ে এল বাবা। আঙুল তুলে শাসাচ্ছে বোধিসত্ত্বকে। রাখীও ছুটে এসেছে, বিয়ের পিঁড়ি থেকে টেনে তুলছে দয়িতাকে। বিপুল হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে লোকজন। দুম করে বিয়েবাড়ি উবে গেল, দয়িতা দেখল সে শুয়ে আছে শোভাবাজারের বাড়িরই নিজের ঘরে, নিজের বিছানায়। আশ্চর্য, ঘরটায় ক্যাম্পাস টাউনের এই শোওয়ার ঘরের সব আসবাব! বাবা ঘরে ঢুকল। কাঁদো কাঁদো গলা, তোর মনে শেষে এই ছিল মুনিয়া? রাখী এল ঘরে। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রুগির মতো চেঁচাচ্ছে,—এই ঘর আমার, বেরিয়ে যাও তুমি, দূর হয়ে যাও। দয়িতা প্রতিবাদ করতে চাইল, ঠোঁটে শব্দ ফুটছে না। চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে, হিহি হাসছে রাখী। দয়িতা উঠে বোধিসত্ত্বকে খুঁজতে শুরু করল। এ ঘর থেকে ও ঘরে যাচ্ছে, ও ঘর থেকে এ ঘর, বোধিসত্ত্ব কোথথাও নেই। ধোঁয়া ধোঁয়া আবছায়ায় বুম্বাকে দেখা যাচ্ছে, মাকে দেখা যাচ্ছে, বাবাকে দেখা যাচ্ছে…। বাবা এসে দয়িতার হাত জড়িয়ে ধরল, মুনিয়া রে, ফিরে আয়। বাবার হাতের চাপ বাড়ছে ক্রমশ…
স্বপ্ন ছিঁড়ে গেল। ঘুমটাও। চোখ বোজা অবস্থাতেই দয়িতা টের পেল সত্যি সত্যি তার হাত চেপে ধরেছে কেউ।
—কী হল দয়িতা, অসময়ে ঘুমোচ্ছ কেন?
বোধিসত্ত্বর গলা। দয়িতা চমকে উঠে বসল। কটা বাজে এখন? সন্ধে হয়ে গেছে নাকি? উঁহু, এখনও তো আলো দেখা যায়। বোধিসত্ত্ব আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল যে?
দয়িতার মুখের কাছে নেমে এসেছে বোধিসত্ত্বর মুখ—শরীর খারাপ লাগছে নাকি, দয়িতা?
—নাহ্। দয়িতা মাথা নাড়ল—তুমি চলে এলে যে?
—এলাম। তুমি রোজ রোজ ক্লাস ডুব মারতে পারো, আমি একদিন লাইব্রেরি অফ করতে পারি না? হা হা হা।
গমগমে গলায় হাসছে বোধিসত্ত্ব। সেই বিখ্যাত হাসি। কিন্তু এই মুহূর্তে ওই হাসিতে যেন তেমন প্রাণ নেই, মনে হল দয়িতার।
মৃদু হেসে দয়িতা জিজ্ঞেস করল—চা খাবে তো?
—খেতেই পারি।
—জলখাবার খাবে কিছু? করব?
—না থাক। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট দিও।
বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরে এল দয়িতা। গ্যাস জ্বেলে কেটলিতে জল বসাল। ঘুমিয়ে পড়ে সত্যি গা ম্যাজম্যাজ করছে, সিঙ্ক থেকে মুখে চোখে জল ছিটিয়ে এল একটু। প্রতীক্ষা করছে জল ফোটার, চোখ গ্যাসের নীল শিখায় স্থির। স্বপ্নটা ঝাপটা মারছে হঠাৎ হঠাৎ, তীব্র এক মনকেমন করায় অসাড় হয়ে যাচ্ছে বুক। কতদিন পর বাবার মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল আবার। কী বিষণ্ণ, কী বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল বাবাকে! সত্যি সত্যি কি তার জন্য অমন দশা হয়েছে বাবার? তা হলে একদিনও খোঁজ নিল না কেন কেউ? অভিমান? হোস্টেল থেকে চলে আসার পর বাবা-মাকে চিঠি লিখেছিল একটা, জানিয়ে দিয়েছিল সে এখন বোধিসত্ত্বর সঙ্গে আছে, সে চিঠির কোনও জবাব আসেনি। হয়তো এটাই স্বাভাবিক, সে তো বাবা-মার চোখে মরেই গেছে। কিন্তু বুম্বাটা তো একবার আসতে পারত। দিদি কেমন আছে, কীভাবে আছে, তাও জানতে ইচ্ছে করে না?
জল ফুটে উঠেছে, উষ্ণ বাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। আঙুল দিয়ে চোখের কোণ মুছে নিল দয়িতা। চা ভেজাল, প্লেটে বিস্কুট সাজাল। ট্রে হাতে ড্রয়িংরুমে এসে দেখল কাকে যেন ফোন করছে বোধিসত্ত্ব।
দয়িতা বসল সামনের সোফায়। এদিক এদিক চোখ চালিয়ে খুঁজল রূপচাঁদকে, দেখতে পেল না। বোধ হয় নিজের ঘরেটরে গেছে।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে বোধিসত্ত্বর ফোনালাপ টুকরো টুকরো শুনতে পাচ্ছিল দয়িতা। সম্ভবত কলকাতায় ফোন করছে। কোনও সতীর্থ বা সহকর্মীর সঙ্গে নিজের গবেষণার বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে জোর। বার্লিন যাওয়া নিয়েও কী যেন বলল বোধিসত্ত্ব। ফোনে বড় অনুচ্চ স্বরে কথা বলে বোধিসত্ত্ব, ঠিক ঠিক শুনতে পাচ্ছিল না দয়িতা।
ফোন রাখতেই দয়িতা জিজ্ঞাসা করল—তোমার বার্লিন যাওয়া যেন কবে?
—মার্চের একুশ। বোধিসত্ত্ব সোফায় বসে কাপে ঠোঁট ছোঁয়াল।
—কদিন থাকবে ওখানে?
—মোটামুটি দু সপ্তাহ। কোনও কারণে ট্যুর এক্সটেন্ডেডও হতে পারে। তবে কোনওভাবেই এক মাসের বেশি নয়।
—আমি অদ্দিন একা থাকব?
—অদ্দিন কোথায়? কটা তো মাত্র দিন। তোমাকেও নিয়ে যেতে পারলে ভাল লাগত, কিন্তু…বোধিসত্ত্ব হোঁচট খেল। সামান্য থেমে থেকে বলল—মার্চ মাসে তোমার তো পরীক্ষাও আছে…
দয়িতা আর কথা বাড়াল না। কেন তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় সেও বোঝে বইকী। কোন পরিচয়ে তাকে নিয়ে যাবে বোধিসত্ত্ব?
নিজের অজান্তেই মুখটা বুঝি থমথমে হয়ে গেছে দয়িতার। বোধিসত্ত্বও যেন কিছু আন্দাজ করেছে। নিজে থেকেই বলল—নেক্সট উইকে একবার কলকাতা যাব ভাবছি।
দয়িতার ভুরুতে প্রশ্নচিহ্ন জাগল একটু। বোধিসত্ত্ব বলল—অনেক দিন হয়ে গেল, এবার ডিভোর্স স্যুটটা ফাইল করতে হবে না? ল’ইয়ারের সঙ্গে কথা বলে আসি।
দয়িতা চুপ করে রইল।
বোধিসত্ত্ব আবার বলল—রাখী মনে হয় কনটেস্ট করবে না, কী বলো? অ্যালিমনি অবশ্য একটা দিতে হবে। দ্যাট আই ক্যান অ্যাফোর্ড।
কথাটা দয়িতার শোনা, এবারও কোনও শব্দ করল না।
চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়েছে বোধিসত্ত্ব। এক সঙ্গে অনেকটা ধোঁয়া বুকে নিল, ছাড়ছে জোরে জোরে। একটু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল—আর একটা কথাও ভাবছিলাম, বুঝলে?
—কী?
—এখানকার এই চাকরিটা ছেড়ে দেব।
এবার বেশ চমকাল দয়িতা। অস্ফুটে বলল—হঠাৎ এমন চিন্তা?
—কলকাতায় থিয়োরিটিকাল ফিজিক্সের একটা ইন্সটিটিউট খুলেছে, সল্ট লেকে। বিজন গুহরায় ওখানকার ডিরেক্টর। আমাকে অনেকবার রিকোয়েস্ট করেছে ওদের ওখানে জয়েন করার জন্যে। বেশ লুক্রেটিভ অফার, ফ্ল্যাটট্যাটও দেবে। যেটুকুনি পড়ানো টড়ানোর ব্যাপার থাকবে, তাও ফর্ খুব সিলেকটেড্ ফিউ। আমার কাজকর্মের জন্যও অনেক বেশি সময় পাব… এতদিন না না করেছি, এবার ভাবছি ওটা নিয়েই নিই। তোমার কী মত?
দয়িতার হৃৎপিণ্ড লাফ দিয়ে উঠল। দুপুর থেকে জমে ওঠা মনের মেঘ পলকে উধাও। দারুণ খুশি খুশি গলায় বলল—ওমা, সে তো খুব ভাল হবে। আমার এখানে একদম ভাল লাগছে না।
—জানি তো। বুঝতে পারি তো৷ তোমার কথা ভেবেই না আমি আরও…। বোধিসত্ত্ব আলগা হাসল।
বাইরে আঁধার নামছে, ঘরে আলো এখন বেশ কম। আবছায়ার মাঝে নীলচে ধোঁয়ার মেঘ। সেই মেঘের আড়াল থেকে যেন বোধিসত্ত্ব বলল—নতুন সংসার গড়তে গেলে নতুন পরিবেশই ভাল, নয় কী?
—ঠিকই তো। বটেই তো। দয়িতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে,—আমি নিজেই তোমাকে কথাটা বলব ভাবছিলাম। বলতে বলতে অল্প অল্প মাথা দোলাচ্ছে দয়িতা, বাচ্চা মেয়ের মতো। আদুরে গলায় বলল—অ্যাই, আমরা কিন্তু এ বাড়ির কিচ্ছু নিয়ে যাব না।
—সে কী! এত জিনিস সব ফেলে দিয়ে যাবে?
—বেচে দাও। দান করে দাও। দয়িতা ঝরনার মতো হেসে উঠল—যার জিনিস তার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমার খেলাঘর আমিই বানিয়ে নেব।
—বেশ, তাই হবে।
দয়িতা নাচতে নাচতে উঠে ঘরের দুটো বড় বাতিই জ্বালিয়ে দিল। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়েছে ঘর, আলোময় বোধিসত্ত্বর মুখও। ইশ, সারা দুপুর মিছিমিছি আবোলতাবোল ভেবে মরেছে দয়িতা। বোধিসত্ত্ব কি কখনও দয়িতা ছাড়া আর কোনও ভাবনায় উদাস হতে পারে? মোটেই না।
.
১৬.
মার্চের গোড়াতেই তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদান করল বোধিসত্ত্ব। প্রথম দর্শনেই জায়গাটা তার বেশ পছন্দ হয়েছিল। সুন্দর তিনতলা বিল্ডিং, ছিমছাম পরিবেশ, অগাধ বইপত্র সমম্বিত লাইব্রেরি, গবেষণামনস্ক সহকর্মী…। এখানকার কাজের রীতিনীতি দেখেও সে মোটামুটি খুশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রুটিন মেপে এখানে ক্লাস নিতে হবে না। পড়ানোর কাজ আছে বটে, তবে তার ধারা একটু অন্য রকম। সারা বছর ধরেই এখানে ছোট ছোট পাঠক্রম চলে। কোনওটা তিন সপ্তাহের, কোনওটা চার সপ্তাহের, তিন মাসের বেশি কখনও নয়। ছাত্রছাত্রী বলেও বাঁধাধরা কিছু নেই। বিভিন্ন কলেজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকরা কিংবা তরুণ গবেষকরা আসে এখানে, বিশেষ একটা বিষয় ধরে পুঙ্খানুপঙ্খ আলোচনা চলে ক’দিন। যে যে পাঠ্যক্রমে বোধিসত্ত্ব যুক্ত থাকবে সেগুলোকে সুষ্ঠুভাবে চালনা করা ছাড়া বছরের বাকি সময়টা বোধিসত্ত্বর নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার অবসর।
নতুন প্রতিষ্ঠান বোধিসত্ত্বকে সুযোগ সুবিধেও দিচ্ছে বিস্তর। নিজস্ব কক্ষ, রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, ক্লার্ক, টাইপিস্ট, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, সব মিলিয়ে পুরোদস্তুর একটা অফিস। যখন তখন ব্যবহারের জন্য গাড়ি, সল্ট লেকে মনোরম ফ্ল্যাট, বোধিসত্ত্বর আর কী চাই!
দয়িতা এখন সুখের সাগরে ভাসছে। কিংবা ডুবে আছে। সে এখন ব্যস্ত নতুন সংসার রচনায়। সত্যি সত্যিই ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে একটি আসবাবও আনেনি সে, সবই নতুন করে কিনছে। খাট এল, আলমারি এল, সোফাসেট ফ্রিজ টিভি পরদা চাদর কিনল পছন্দ করে, বাসন-কোসনও যে কত কেনা হল। মাত্র সাত আট দিনে ভরে গেছে একটা শূন্য ফ্ল্যাট, নবীন সাজে ঝলমল ঝলমল। এ ঘর ঘুরে, ও ঘর ঘুরে, কত বার যে দেখে ফ্ল্যাটখানাকে, তবু যেন দয়িতার আশ মেটে না।
বোধিসত্ত্বরও মেজাজ ফুরফুরে বটে, তবে সে এখনও কাজে পুরোপুরি মন বসাতে পারেনি। সামনেই বার্লিন যাত্রা, তার খুঁটিনাটি প্রস্তুতি সারছে। ইউরোপের নানা জায়গায় তার পুরনো সহকর্মী আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, মনের ভেতর চিন্তাভাবনাকে যথাযথ ভাবে সাজানো। ভিসার জন্যও দুদিন কনস্যুলেটে ছোটাছুটি করতে হল। দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই ভেতরে ভেতরে চোরা টেনশন বাড়ছে তার। সেখানে গিয়ে কী অবস্থায় পড়বে, না পড়বে…। ছেলেমানুষি উদ্বেগ। অর্থহীন। তবু প্রতিবারই বিদেশ যাওয়ার আগে এমনটা হয়।
ফাল্গুন প্রায় শেষ হতে চলল। ঠাণ্ডা বিদায় নিয়েছে অনেকদিন, এখন রীতিমত গরম পড়ে গেছে কলকাতায়। সূর্য বেশ প্রখর থাকে দিনভর। বাতাসও গরম, তবে শুকনো শুকনো। বিশেষ ঘাম হয় না, এটুকুই যা রক্ষে। অবশ্য সন্ধ্যে নামলেই হাওয়াটা ভারী মিঠে হয়ে যায়। অন্তত সল্ট লেকে।
আজ ইনস্টিটিউট থেকে সোজা ফ্ল্যাটে ফিরল না বোধিসত্ত্ব। গেল লেক টেরেসে। শান্তশীলের সঙ্গে কয়েকটা জরুরি কথা আছে। এর মধ্যে দু- তিনবার সে এসেছে এ বাড়ি। একাই। দয়িতাকেও নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল, কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকে। বাবা-মার জন্য কি? হলেও হতে পারে, বোধিসত্ত্ব অতশত তলিয়ে ভাবেনি। লেক টেরেসে আসার ব্যাপারে দয়িতারও তেমন একটা উৎসাহ নেই।
দোতলায় ওঠার আগে বোধিসত্ত্ব একবার নিয়মমাফিক বাবা-মার দরজায় দাঁড়াল। অরবিন্দ ইজিচেয়ারে বসে কী একটা বই পড়ছেন, প্রভাবতী বিছানায় অর্ধশায়িত।
বোধিসত্ত্বকে দেখেই অরবিন্দ বই ভাঁজ করেছেন, টান হয়ে বসলেন প্রভাবতী। বোধিসত্ত্ব ঈষৎ অস্বস্তি বোধ করল। আজকাল তাকে দেখলেই বাবা-মা যেন একটু বেশি তটস্থ হয়ে পড়েন। বাবা-মার সঙ্গে তেমন নৈকট্য নেই বহুদিন, বরং একটা সমীহমাখা দূরত্বই ছিল, তবু ইদানীং বাবা-মার চোখে সে যেন কেমন বাইরের লোক বাইরের লোক! রাখীর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদটাই কি কারণ?
প্রভাবতী অরবিন্দ কেউই কিছু বলছেন না। যেন কথা খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না। অথবা অপেক্ষা করছেন বোধিসত্ত্বর কথার।
বোধিসত্ত্ব গলা ঝেড়ে প্রভাবতীকে জিজ্ঞেস করল—অসময়ে শুয়ে কেন? শরীর খারাপ?
—তেমন নয়, এই একটু গা ম্যাজ ম্যাজ, মাথা ভার…
—জ্বরটর নেই তো?
—মনে হয় না।
—সময়টা ভাল নয়। সিজন চেঞ্জ হচ্ছে… ওষুধ-বিষুধ কিছু খেয়েছ?
—শান্ত দিয়েছিল।
—শান্তকে বলব ডাক্তার দেখিয়ে নিতে?
—লাগবে না রে। এই বয়সে শরীর নিয়ে কথায় কথায় উতলা হতে নেই। প্রভাবতীর কুঞ্চিত গালে মৃদু হাসি ফুটেছে—তুই ভাল আছিস তো?
—আছি একরকম। এবার অরবিন্দর দিকে ফিরল বোধিসত্ত্ব—কী বই পড়ছ?
—গ্রাহাম গ্রিন।
—নভেল?
—হ্যাঁ। ট্রাভেল উইথ মাই আন্ট।
—খুব থ্রিলিং বই। বোধিসত্ত্ব আলগা হাসল। উপদেশের ঢঙে বলল—চোখের বেশি স্ট্রেন কোরো না। বয়সটা আশি হয়েছে, এটা মানো তো?
—হুঁ, এবার রেখে দেব।
সিঁড়ির কাছে গিয়ে বোধিসত্ত্বর পলকের জন্য মনে হল, মার কপালটা একবার ছুঁয়ে দেখা উচিত ছিল কি? মার চোখ দুটো কেমন ছলছল করছিল না?
অন্যমনস্ক মুখে ওপরে এসে বোধিসত্ত্ব দেখল শান্ত এসে গেছে, ভেতর বারান্দার সোফায় বসে কী যেন গল্প শোনাচ্ছে অফিসের, দীপালি হাসছে মুখ টিপে। জুলি-মিলিও আছে, তারাও হাসছে খিলখিল। কী সুখী পারিবারিক ছবি! শান্তর মতো বোধিসত্ত্ব কখনও বউ-ছেলের সঙ্গে এরকম হ্যা হ্যা হি হি করতে পারল না।
ভাবনাটায় কি হুল ছিল কোনও? বুকটা একটু জ্বালা জ্বালা করে কেন বরেণ্য বিজ্ঞানী বোধিসত্ত্ব মজুমদারের?
বোধিসত্ত্বর উপস্থিতি টের পেয়েই হাস্যরোলের দফারফা। জুলি-মিলি মুখের হাসি হাসি ভাব বজায় রেখেই সামান্য আড়ষ্ট পায়ে ঘরে চলে গেল। দীপালি উঠে জায়গা ছেড়ে দিল ভাসুরকে।
অনুচ্চ স্বরে বলল—দাদা, একটু চা করি?
শান্তশীল শশব্যস্ত মুখে বলল—চা কেন, কফি করো। সঙ্গে একটু অমলেট ভেজে দাও।
—নাহ্, শুধু কফিই খাব। দুধ ছাড়া। বোধিসত্ত্ব বসে সিগারেট ধরাল। ভাইয়ের দিকেও বাড়িয়ে দিয়েছে প্যাকেট। হালকা গলায় বলল—তুই আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরেছিস যে?
—খুব তাড়াতাড়ি তো নয়। সাতটা বেজে গেছে।
দু-একটা কথার পর কাজের কথা পাড়ল বোধিসত্ত্ব—ক্যাম্পাস টাউনের বাংলোটা তো আমার তালা বন্ধই পড়ে আছে রে। এবার তো ভেকেট করার জন্য ইউনিভার্সিটি নোটিস পাঠাবে।
—হুম্। শান্তশীল অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়ল—তুমি কি সত্যিই সব ফার্নিচার ডিসপোজ অফ করে দিতে চাও?
—তাই তো বলেছিলাম তোকে।…বিক্রিই করতে হবে এমন কথা নেই, বারাসতেও পৌঁছে দেওয়া যায়।
—বউদি কি নেবে?
—না নেওয়ায় কী আছে? সবই তো তার জিনিস। তার আনা, তার করা, তার বিয়েয় পাওয়া…
শান্তশীল একবার তাকিয়েই চোখ ঘুরিয়ে নিল। কী একটা বলতে গিয়েও বলল না। জোরে টান দিচ্ছে সিগারেটে।
বোধিসত্ত্বর বাকভঙ্গি কি বেশি রূঢ় হয়ে গেছে? দু-এক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বোধিসত্ত্ব বলল—জিনিসগুলো সব এ বাড়িতে এনে রাখলে কেমন হয়?
—এখানে জায়গা কোথায়? সব ঘরই তো প্যাকড। খাট-টাট নয় খুলে রাখা গেল, বাকি মাল কোথায় ঢোকাব? তোমার ঘর দুটোতেও তো এক্সটা স্পেস নেই।
—তা হলে বেচেই দে। ট্রাকে করে তুলে আন, কোনও অকশন শপে দিয়ে দে, যা পাওয়া যাবে সেটা নয় বাবুয়ার নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে দিবি।
—দেখি। বউদির সঙ্গে কথা বলি।
—তার সঙ্গে কথা বলার কী আছে? আমার ছেলের নামে আমি টাকা রাখব…?
—দেখছি।
—দেখছি নয়, ডু ইট কুইক। …গাড়িটাও পড়ে আছে, এখানে এনে গ্যারাজ করে দে। আমি বাইরে যাওয়ার আগে ল্যাটা চুকে গেলে ভাল হয়।
দীপালি এসেছে। সুদৃশ্য কফিমগ কাচের টেবিলে সাবধানে নামিয়ে বসল সোফায়। নিষ্প্রাণ তথ্য পরিবেশনের ভঙ্গিতে বলল—জানেন দাদা, জুলির সঙ্গে পরশু বাবুয়ার দেখা হয়েছিল। কলেজ স্ট্রিটে। বাবুয়া নাকি এখন আরও অনেকগুলো টিউশ্যানি ধরেছে।
বোধিসত্ত্ব গোমড়া হয়ে গেল। বাবুয়াটার ফিউচার ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে। রাখী অ্যালাউ করছে কী করে? রাখী কি ছেলের বারোটা বাজিয়ে বাবার ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়? আশ্চর্য জেদ। কিছুতেই বোধিসত্ত্বর টাকা ছোঁবে না!
ভার গলায় বোধিসত্ত্ব জিজ্ঞেস করল,—বাবুয়া আর একদিনও আসেনি, না?
দীপালি উত্তর দিল,—না।
বোধিসত্ত্ব গজগজ করে উঠল—এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি।
পরিবেশটা পুরো ছানা কেটে গেছে। কেউ আর মুখ খুলছে না, ক্ষণিক নৈঃশব্দ্যই থমথমে বাতাবরণ গড়ে তুলেছে।
বোধিসত্ত্বর খারাপ লাগল একটু। তার নিজের সমস্যা নিয়ে ভাইয়ের পরিবারের ওপর সে কি উৎপাত করছে? এত অল্পে সে মেজাজই বা হারাচ্ছে কেন?
আবহাওয়া লঘু করার জন্য বোধিসত্ত্ব বলল—যাক গে, ছাড়ো ও সব।…তোমরা কবে আসছ আমার ফ্ল্যাটে।
—যাব। শান্তশীল ঘাড় নাড়ল।
—আমি চলে যাওয়ার আগে একদিন আয়।
—দেখি। আমার তো এখন আবার ইয়ার এন্ডিং-এর চাপ শুরু হবে।
—তা হলে তুমি এক দিন এসো। বোধিসত্ত্ব দীপালির দিকে তাকাল—দয়িতা কেমন ঘরদোর সাজাল, একবার দেখে যাও। ও ছেলেমানুষ, তুমি ওকে একটু-আধটু সাজেশানও দিতে পারবে।
দীপালি হুঁ হ্যাঁ কিছুই বলল না।
বোধিসত্ত্ব ভুরু কোঁচকাল—কবে আসছ?
উত্তর নেই। দীপালি স্বামীর দিকে তাকাচ্ছে আড়ে আড়ে।
বোধিসত্ত্বর বিরক্তিটা ফিরে আসছিল। তার ফ্ল্যাটে পা দিতে কি আপত্তি আছে দীপালির? রাখীর সঙ্গে দীপালির এমন কিছু সখিত্ব তো ছিল না! হঠাৎ হঠাৎ এত দরদ উথলে ওঠে কেন? বোঝে না ওই নীরবতা হেয় করছে বোধিসত্ত্বকে?
শান্তশীল বুঝি অসন্তোষটা আঁচ করেছে। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ ঘোরাল—তা হলে লোকজন নিয়ে এই রোববারই ক্যাম্পাস টাউনে চলে যাই দাদা?
—যা ভাল বুঝিস। আমার হাতে সময় নেই, তাই তোকে বলা…। অবশ্য তোর যদি অসুবিধে থাকে আমিই নয় যা হোক একটা কিছু…
—না না। আমি যেতে পারব। তুমি শুধু চিঠিপত্রগুলো করে দিও।
বেরিয়ে এসে বোধিসত্ত্বর বিরক্তিটা আছড়ে পড়ল রাখীর ওপর। নিকটজনেরাও কি ভাবছে রাখীর ওপর সে অন্যায় করেছে? রাগের মাথায় সে কি বলেছে, না বলেছে, ওমনি দুম করে রাখী চলে যায়নি? তেজ দেখিয়ে? সামান্য ধৈর্য ধরলে একটা কোনও সমাধান কি হত না? দয়িতা তো তার বাংলায় এসে ওঠার জন্য বায়না ধরেনি, টাউনেই ঘর নিতে চেয়েছিল! রাখী রাখীর জায়গায় থাকতে পারত, দয়িতা দয়িতার জায়গায়! বিশ্বসংসারের কাছে বোধিসত্ত্বকে অপদস্থ করে, ছেলের চোখে বাপকে নীচে নামিয়ে, কী প্রতিপন্ন করতে চায় রাখী? বোধিসত্ত্ব মজুমদার একজন চরিত্রহীন লম্পট? আর সে নিজে এক দুখিনী হতভাগিনী একাকিনী নারী? দীর্ঘ দু যুগ একত্রে নিস্তরঙ্গ বসবাসের পর এই কি প্রাপ্য ছিল বোধিসত্ত্বর? শুধু তার জন্য কত সম্মান পেয়ে এসেছে রাখী, বিনিময়ে তাকে শুধু অপমান দিল?
হায় রে মানুষের মন! নিজের ফাঁদে নিজেই যখন, সে আটকে পড়ে, তখন স্বপক্ষে সাজানো যুক্তিজালের অসারত্ব কি সে টের পায়?
হৃদয়ের অতলে যে সামান্যতম দ্বিধাটুকু ছিল, তাও মুছে ফেলল বোধিসত্ত্ব। ক্রোধে গরগর করছে। সম্পর্কের ক্ষীণতম সুতোটুকুও সে আর টিকিয়ে রাখবে না।
উকিলের বাড়ি ঘুরে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বোধিসত্ত্ব ফ্ল্যাটে ফিরল। তাকে দেখেই পাখির মতো নেচে উঠেছে দয়িতা,—এই শোনো, কাল কিন্তু হাজার দুয়েক টাকা লাগবে।
বোধিসত্ত্বর চিত্ত এখন অনেক শান্ত হয়েছে, তবু যেন ঝাঁকুনি খেল সামান্য। নার্ভাস গলায় জিজ্ঞেস করল,—কেন?
—গোটা পঁচিশ টব কিনব। গাছ সমেত। এরিকাপাম অ্যাডেনিয়াম, ক্রোটন, অ্যারেলিয়া…
—দাঁড়াও দাঁড়াও। এত গাছে কী হবে?
লতার মতো বোধিসত্ত্বর গলা আঁকড়ে ধরল দয়িতা,—বা রে, গাছ ছাড়া ফ্ল্যাটটা ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে না? গ্রিন না থাকলে কি ঘরের বিউটি খোলে?
—বুঝলাম। কিন্তু কালই কেন? এক দু মাস যাক। আমি বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
—উমম, কালই চাই।
—বোধিসত্ত্ব নীরস গলায় বলল,—তোমার এই ফ্ল্যাট সাজানোয় এখনও পর্যন্ত কত খরচা হয়েছে হিসেব করেছ?
—কত আর! পঞ্চাশ ষাট হাজার।
—আজ্ঞে না। দয়িতার মৃণালভুজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল বোধিসত্ত্ব,—লাখ পেরিয়ে গেছে। আমার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স প্রায় শেষ। এবার একটু রয়ে সয়ে… বুঝলে?
পলকে দয়িতার উচ্ছাসভরা মুখ একটু বুঝি ম্লান। বড় শ্বাস ফেলে বলল,—বেশ, তাই হবে।
—ওমনি মুখ ভার হয়ে গেল? বোধিসত্ত্ব আলগা থুতনি নেড়ে দিল দয়িতার,—বুড়ো হচ্ছি, একটু সঞ্চয় তো থাকা দরকার। কী বলো?
দয়িতা চোখ পাকাল,—অ্যাই, নিজেকে বুড়ো বুড়ো বলবে না।
—তবু…বয়স বাড়ছে, এটা তো মানবে?
—সেটা বলতে পারো। দয়িতা আবার স্বচ্ছন্দ,—যাও যাও, হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে নাও। গরম গরম খানা হাজির হয়ে যাবে।
বোধিসত্ত্ব বাথরুমের দিকে এগোল না। মুখে আলগা গাম্ভীর্যের মুখোশ এঁটে বলল,—তোমায় এক্ষুনি আমি একটা দারুণ খবর দিতে পারি।
—কী গো?
—ডিভোর্সের পেপারে সই করে এলাম। কালই বারাসতে উকিলের নোটিস চলে যাবে।
দয়িতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল বটে, কিন্তু যতটা উচ্ছ্বাস আশা করেছিল বোধিসত্ত্ব ততটা যেন ঠিক ফুটল না।
হাসি হাসি মুখ, কিন্তু কেজো স্বরে প্রশ্ন করল,—তাই? কদ্দিন লাগবে ডিক্রি পেতে?
—ওদিক থেকে কনটেস্ট না করলে বেশিদিন লাগার কথা নয়। অবশ্য আমাদের হিন্দু ম্যারেজ ছিল তো, একবারে ডিভোর্স হয়তো হবে না।
—তা হলে?
—প্রথমে জুডিশিয়াল সেপারেশান থাকবে, তার পর ডিভোর্স। কদ্দিন পরে যেন। জলদি জলদি চাইলে ব্যাপারটা খুব হেলদি হবে না।
—বুঝলাম না।
—আমি তো রাখীর এগেনস্টে কোনও জোরালো গ্রাউন্ড আনতে পারছি না। তেমন হলে আমাকেই রাখীর কাছে হয়তো প্রস্তাব পাঠাতে হবে, যেন ও আমার এগেনস্টে অ্যাডাল্টারির চার্জ আনে। কেসটায় তখন তুমিও ফালতু জড়িয়ে যাবে।
দয়িতা কী বুঝল কে জানে, আর কোনও প্রশ্ন করল না। চুপচাপ রান্নাঘরে চলে গেছে।
খাওয়া দাওয়ার পর শুতে যাওয়ার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছিল, তখন আবার নিজে থেকেই তুলল কথাটা,—আমি কিন্তু একটু তাড়াতাড়িই ফয়সালা চেয়েছিলাম।
বোধিসত্ত্ব সামান্য চিন্তিত ছিল শব্দগুলো এখন আর ঠিকঠিক মাথায় ঢুকল না। বলল,—কীসের ফয়সালা?
—তোমার ডিভোর্সের।
—বা রে, বললাম না, তোমাকে আমি জড়াতে চাই না?
দয়িতা মুচকি হাসল,—কিন্তু আমরা যেভাবে রয়েছি, এটাকেও তো অ্যাডাল্টারিই বলে। নয় কি?
বোধিসত্ত্ব থমকাল একটু। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল,—তো?
—আমি বুঝতে চাইছি, তোমার কীসে অসুবিধে হচ্ছে? আমাকে জড়ানোয়? নাকি নিজেকে ব্যাভিচারী হিসেবে কোর্টে দাঁড় করানোয়? আমাদের সম্পর্কে যদি কোনও পাপ না থাকে, তা হলে তো সঙ্কোচেরও কোনও অর্থ হয় না। কী, ঠিক বলছি?
বোধিসত্ত্ব গুম হয়ে গেল। কথাটা কোথায় যেন ঘা মারছে! অহংবোধে? তা কী করে হয়? দয়িতাকে নিয়ে সে তো একটি বারের জন্যও সঙ্কুচিত হয়ে থাকেনি? ইউনিভার্সিটির উপাচার্য যখন তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল, তার নামে আসা উড়ো কমপ্লেনটা দেখাল, তখনও তো সে তার অবস্থান থেকে নড়েনি এতটুকু? লোকটা তার হাত ধরে অনুরোধ করেছিল, প্রফেসার মজুমদার, আপনি শুধু একবার লিখে দিন, দয়িতা মিত্র মেয়েটা আপনার রিলেটিভ, আপনি তাকে পড়াশুনোর সুবিধের জন্য বাড়িতে এনে রেখেছেন, ব্যস তা হলেই এই কমপ্লেন আমি নোংরা কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেব!…বোধিসত্ত্ব মুখের ওপর বলে দিয়েছিল, আমি মিথ্যে বলতে পারব না। আমি দয়িতাকে ভালবাসি, আমরা স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবনযাপন করছি, এটাই সত্যি। আপনাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে চাই না, হিয়ার আই টেন্ডার মাই রেজিগনেশন।
কিন্তু এও তো সত্যি, নিজেকে ব্যাভিচারী ভাবতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে সে! দয়িতা কী করে তাকে এত স্পষ্টভাবে পড়ে ফেলল?
রাতটা খুব মধুর কাটল না। একটু একটু যেন শৈত্য অনুভব করছিল বোধিসত্ত্ব। স্বাভাবিক ছন্দে শরীরের খেলায় আহ্বান করল দয়িতা, ঠিক ঠিক সাড়া দিতে পারল না আজ।
দয়িতা ঘুমিয়ে পড়ার পর বোধিসত্ত্ব পায়ে পায়ে পাশের ঘরে এল। তার স্টাডিরুম ভারী সুচারুভাবে সাজিয়ে রেখেছে দয়িতা। চেয়ারে গিয়ে বসল বোধিসত্ত্ব। একটা সিগারেট ধরাল, তারপর আর একটা, তারপর আর একটা…। কখন যেন টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়েছে। ডুবে গেছে বইতে। কাগজ টানল। অঙ্ক কষছে।
ধীরে ধীরে শরীরি জগৎ ছেড়ে অনন্ত মহাশূন্যে পাড়ি দিল বোধিসত্ত্ব। তার মানসলোকে এখন আর কোনও দয়িতা কিংবা রাখী নেই, সেখানে শুধু শ্বেতবামন আর কৃষ্ণগহ্বর।
.
১৭.
বাবুয়া এক মনে কোয়েশ্চেন পেপার দেখছিল। বুলটু রিন্টির। কাল রিন্টির অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হয়েছে, বুলটুর আজ। দুজনেরই শেষ পরীক্ষা ছিল অঙ্ক, প্রশ্নপত্রের ধারে ধারে উত্তরগুলো লিখে এনেছে ভাই বোন, মনে মনে মেলাচ্ছিল বাবুয়া।
মীরা প্লেটে ওমলেট আর মিষ্টি সাজিয়ে এনে রাখল বিছানায়। বাবুয়ার সামনে। খাটের ধারে চেয়ার টেনে বসেছে, বাবুয়া, বিছানায় ভাই বোন বই খাতা। প্রথম প্রথম এভাবে পড়াতে বাবুয়ার খুব অস্বস্তি হত, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।
মীরা প্লেট রেখে অন্য দিনের মতো চলে যায়নি, বিছানার কোণে বসল। মৃদু উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল,—কী বুঝছেন মাস্টারমশাই? কেমন করেছে দুজনে?
বাবুয়া প্রশ্নপত্র ভাঁজ করল,—মোটামুটি।
—অঙ্কে কেমন পাবে মনে হয়?
—রিন্টি যা উত্তর লিখে এনেছে তাতে তো সত্তর বাহাত্তর রাইট হওয়া উচিত। বুলটু সাতষট্টি। বলেই ঈষৎ জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা ভাই বোনের দিকে তাকাল বাবুয়া,—আমি কিন্তু তোমাদের কাছ থেকে আর একটু বেটার এক্সপেক্ট করেছিলাম।
বুলটু এক ঝলক মাকে দেখে নিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। রিন্টি নখ খুঁটছে।
মীরা ছোট্ট শ্বাস ফেলল,—আপনি আর কী করবেন মাস্টারমশাই? আপনি তো আপনার সাধ্যমতো করেছেন।
—হ্যাঁ। বাবুয়া অপ্রসন্ন মুখে ঘাড় নাড়ল,—ঘোড়াকে আমি ঝর্নার ধার অব্দি নিয়ে যেতে পারি। ঘোড়া জল খাবে কি না সে ঘোড়াই বুঝবে।
—আপনার ঘোড়া দুটো যদি একটু বুঝদার হত। মীরা ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে ছেলেমেয়ের দিকে তাকাল,—কতদিন ধরে বলছি আপনাকে, ধরে মারুন।
বাবুয়া যে কখনও বুলটু রিন্টির গায়ে হাত তুলবে না, মীরা ভালমতোই জানে। তবু প্রায়শই বলে কথাটা। ভেতরের দুঃখ থেকে বলে কি? কিংবা কোনও গভীর হতাশায়? তিল তিল শ্রমের ফসল বৃথা হয়ে গেলে মনে যে কী তীব্র নৈরাশ্যের জন্ম হয় তা তো এখন মাকে দেখে বুঝতে পারে বাবুয়া। এই মহিলার সঙ্গে মার যেন কোথায় মিল আছে। আবার নেইও। মীরা অনেক শক্তপোক্ত। মীরার চরিত্রে যে ঋজু ব্যক্তিত্ব আছে, মার মধ্যে তা কোথায়? ওই প্রবঞ্চকটার কথা ভেবে এখনও লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে মা! ছিঃ!
ভাবনাটাকে আর অন্য খাতে ঘুরতে দিল না বাবুয়া। চামচে ওমলেট কাটতে কাটতে বলল,—আমি তা হলে এখন মাসখানেক কিন্তু আসছি না।
—আপনার কবে থেকে যেন পরীক্ষা শুরু?
—এপ্রিলের নাইনথ। চলবে ছাব্বিশ তারিখ পর্যন্ত।
—ও। মাঝে এক দিনও আসবেন না? ওদের রেজাল্ট বেরোবে…
—সে নয় একদিন এসে দেখে যাব।
—প্লিজ, আসবেন কিন্তু। ওদের রেজাল্ট বেরোবে এপ্রিলের চোদ্দোয়। তারপর কিন্তু প্রতিদিনই আপনাকে আশা করব।…বসুন, জল ফুটে গেছে, চা-টা করে আনি।
এ অভ্যেসটাও ধরে গেছে বাবুয়ার, সে এখন নিয়মিত চা পান করে। বাড়িতেও দুধ খেতে এত ভালবাসত, এখন আর ছোঁয় না, মামা মামির শত উপরোধ সত্ত্বেও না। কত পুরনো অভ্যেসই তো বদলে গেল। সে আজকাল আর বই কেনে না, পছন্দসই ক্যাসেট কেনা ছেড়ে দিয়েছে, চুপচাপ শুয়ে গান শোনার বিলাসিতা পরিত্যাগ করেছে…। তাকে এখন ক্রমশ সাধারণ থেকে আরও সাধারণ হতে হবে, কেজো হতে হবে। শখশৌখিনতার জীবন তার জন্য নয়, সামনে এখন দীর্ঘ কৃচ্ছ্রসাধনার দিন।
মীরা রান্নাঘরে। বুলটু উশখুশ করছে,—স্যার, একটু রাজুদের ঘর থেকে ঘুরে আসব?
—বসে আছ কেন? যাও না। বাবুয়া হেসে ফেলল। ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল,—আমিও এবার উঠব।
বুলটু রিন্টি পলকে উধাও। মীরাও চা নিয়ে হাজির। ছেলেমেয়ের দৌড়ে পালানোর দৃশ্য দেখে সেও হাসছে মিটিমিটি। কাপ ডিশ বাবুয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,—ও হো, আপনাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি। আপনার বন্ধু তমালবাবু আপনাকে খুঁজছিলেন। আজ এখানে এলে আপনাকে একটু থাকতে বলেছেন। সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই উনি এসে যাবেন।
বাবুয়া আর একবার ঘড়ি দেখল। পাঁচটা দশ। পাঁচটা বাহান্নর ট্রেনটা না পেলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে, মা আবার উতলা হয়ে পড়বে। আজকাল এই এক নতুন সমস্যা হয়েছে মাকে নিয়ে। যে সময় বলে যাবে বাবুয়া তার থেকে পাঁচ মিনিট এদিক ওদিক হলেই ছটফট শুরু করে দেয়। একবার ছাদে উঠবে, একবার রাস্তায় বেরিয়ে আসবে…। নিরাপত্তাবোধের অভাব?
চিন্তিত মুখে বাবুয়া জিজ্ঞেস করল,—কী দরকার কিছু বলেছে?
—না তো। শুধু বললেন আপনি যেন…
নতুন টিউশনির খোঁজ দেবে কি? পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর টিউশনির সংখ্যা বাড়াবে না বাবুয়া, তমাল তা জানে। উফ্, তমালকে নিয়ে পেরে ওঠা মুশকিল। তমালের বীরপুজোর চাপে বাবুয়ার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত।
মীরা আবার বিছানায় বসল। দেখছে বাবুয়াকে। হঠাৎ বলল,—আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব মাস্টারমশাই? অনেকদিন ধরেই বলব বলব ভাবি…
—কী কথা?
—আপনি সব সময়ে এত গম্ভীর কেন? আপনার বয়সী ছেলেরা কত হাসিখুশি থাকে, চনমন করে…
বাবুয়া অস্বস্তিতে পড়ে গেল। জোর করে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করল মুখে,—না মানে…তেমন কোনও কারণ নেই।
—আপনার বয়সী ছেলেদের সব সময়ে গোমড়া দেখলে আমার কেমন ভয় ভয় করে।
—কেন? কীসের ভয়?
মীরা একটুক্ষণ চুপ। তারপর বলল,—আমার একটা ভাই ছিল। আমার থেকে বছর ছয়েকের ছোট। কলেজে ঢোকার পর থেকে কী হল, সারাক্ষণই মুখ থমথম। বাপের বাড়ির লোক বলতে ওই ভাই-ই একমাত্র আসত আমার কাছে। সাতটা কথা বললে একটার উত্তর দিত, নইলে চুপচাপ বসে আছে…। হঠাৎ একদিন শুনি স্লিপিং পিল খেয়ে…। মীরার গলা ধরে এল। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছছে। একটু সামলে নিয়ে বলল,—ডাক্তার বলেছিল মানসিক অবসাদ থেকেই…। পরে জানা গেল কোন এক মেয়ের সঙ্গে নাকি ওর…
—না না, আমার সেরকম কিছু নেই। বাবুয়া তাড়াতাড়ি বলে উঠল।
—তাও ভাল। মীরা ছোট্ট শ্বাস ফেলল,—আপনাকে দেখলে আমার খুব ভাইটার কথা খুব মনে পড়ে। লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিল আমার ভাই। আপনারই মতো।
মীরার ঘন কালো চোখের মণির দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে মাথা নামিয়ে নিল বাবুয়া। এ সময়ে কী যে বলা উচিত ভেবে পাচ্ছে না। নিঃশব্দে চা শেষ করে কাপ ডিশ নামিয়ে দিল খাটের নীচে।
নিজের মনেই মীরা বলে উঠল,—কেন যে ওসব পুরনো কথা মনে পড়ে! স্মৃতি মানেই দুঃখ।…মাঝখান থেকে আপনার মনটাও খারাপ করে দিলাম।
—না না, তাতে কী আছে! ইচ্ছে করলেই কি সব ভুলে থাকা যায়!
—হুম্!…যাক গে, আপনার কথা বলুন। আপনি কি এখনও বারাসতেই আছেন?
—হ্যাঁ।
মীরা বুঝি সামান্য লঘু হওয়ার চেষ্টা করল,—মামারবাড়ি থাকলে তো সবাই হাসিখুশি থাকে, আপনি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন কেন? শরীর খারাপ?
—কই, নাহ।…আমি তো ঠিকই আছি।
—বাবা-মার খবর কি? তাঁরা তো সেই বাইরেই আছেন?
বাবুয়ার মুখ থেকে ফস করে বেরিয়ে গেল,—না, মা এখন এখানেই আছে। মামার বাড়িতে।
—ওমা, বলেননি তো! কবে এসেছেন?
—অনেকদিন। বাবুয়ার মুখে মিথ্যে এল না,—সেই জানুয়ারিতে।
—তার মানে আপনার বাবা ওখানে এখন একা? বাবার অসুবিধে হচ্ছে না?
হুঁহ, অসুবিধে! অজান্তেই বাবুয়ার শরীর শক্ত হয়ে গেল। বাবা একা না দোকা সেই কলঙ্কের কথা কি লোকসমক্ষে উচ্চারণ করা যায়? কোন মুখে বলে, বাবা এখন আর ওখানে নেই, এই শহরেই মাত্র কয়েক মাইল দূরে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে ঘর বেঁধেছে তার পূজ্যপাদ পিতৃদেব? সল্টলেকে বোধিসত্ত্ব মজুমদারের চলে আসার খবরটা ছোট করে বেরিয়েছিল কাগজে, ভাগ্যিস সেই বোধিসত্ত্বই যে বাবুয়ার বাবা জানে না মীরা! সব কাহিনী শুনলে কী মীরা শিউরে উঠবে? নাকি মনে মনে হাসবে আর ভাববে পুরুষমানুষরা সব একরকমই হয়? সে কী বা নামী বিজ্ঞানী, অথবা মাতাল লম্পট বদচরিত্র স্বামী! সত্যি বলতে কি, দুজনে তফাৎই বা কোথায়? যে মানুষ বাইশ তেইশ বছর ঘর করা স্ত্রীকে অবলীলায় ডিভোর্সের নোটিস পাঠাতে পারে, সে কোন নিরিখে উচ্চ স্তরের?
বাবা এখন এমনিও দেশে নেই, কথাটা বলে দিলেই ল্যাটা চুকে যায়, সত্যেরও অপলাপ হয় না…। উঁহু, তার থেকেও প্রশ্ন আসতে পারে, কোথায় গেছে, কেন গেছে…!
বাবুয়ার ক্ষণিক নীরবতা নজরে পড়েছে মীরার। নিজের মনোমত কিছু একটা আন্দাজ করে নিল, আর বাবা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করল না। আলগা জিজ্ঞেস করল,—আপনার ফিউচার নিয়ে কী ভাবছেন মাস্টারমশাই? বাবার মতোই অধ্যাপক হবেন?
—না না, আমি ও লাইনে যাবই না।
—তবে কি কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসবেন? বি সি এস? আই এ এস?
—নাহ্। পার্ট ওয়ানটা দিয়েই চাকরির চেষ্টা করব।
—সে কি! পার্ট টু দেবেন না?
—ইচ্ছে নেই। গ্র্যাজুয়েট তো হয়েই যাচ্ছি, এবার একটা চাকরি জুটিয়ে নেব।
—ওমা কেন? আপনার এক্ষুনি চাকরির কী দরকার? আপনি লেখাপড়ায় এত ব্রিলিয়ান্ট, সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, বাড়ির অবস্থাও বেশ স্বচ্ছল…
হায় রে, জীবন যে কখন কাকে কোন অনিশ্চিতের দিকে ঠেলে দেয়! এই মীরাই কি জানত বড়ঘরের মেয়ে হয়েও তাকে একদিন নার্সের চাকরি করে এমন একটা এঁদো বাড়িতে জীবন কাটাতে হবে?
বাবুয়া একটু বেপরোয়ার মতোই বলল,—এমনিই। পড়াশুননা করতে আমার আর ভাল লাগে না।
—সেটা অবশ্য আপনার ব্যাপার। তীক্ষ্ণ চোখে বাবুয়াকে দেখতে দেখতে মীরা বলল,—পারলে পড়াশুনোটা চালাবেন মাস্টারমশাই। নিজে সুযোগ পেয়েও লেখাপড়াটা শেষ করতে পারিনি তো, এখন মাঝে মাঝে বড় আফশোস হয়। আর তাই তো ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে পড়েছি। দরকার হয়, খেটে মুখের রক্ত তুলব, তবু ওদের পড়াশুনো আমি চালাবই। বিশ্বসংসারকে আমারও কিছু দেখানোর আছে, কিছু প্রমাণ করার আছে…
মীরার মুখচোখ কী রকম যেন হয়ে গেছে! চোয়াল শক্ত, দপদপ করছে চোখের মণি, শ্যামলা মুখে স্থির হয়ে আছে আগুন। দুঃখকষ্টের মাঝেও যে কত তাপ লুকিয়ে থাকে, এই মহিলাকে দেখে তা বুঝি আন্দাজ করা যায়।
তমাল এসে গেছে, হাঁকাহাঁকি করছে। ঘরে উঁকি দিয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বার করল। বাবুয়া সঙ্গে সঙ্গেই উঠে পড়ল, বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়।
চৈত্র চলছে। বেলা পড়ে এল, তবু এখনও বেশ তাত চারদিকে। তালবেতাল হাওয়া উঠছে মাঝে মাঝে। শুকনো শুকনো। গলির মধ্যে উড়ছে পাতা, কাঠিকুটি। ঘুরে ঘুরে।
তমালের মুখে খই ফুটছে,—বস্, তুমি হঠাৎ লাপাতা হয়ে গেলে কেন? আমার কেসটা নিয়ে একটু ভাবো।
—কেন? কী হল তোর?
—তুমি কি চাও আমি পরীক্ষায় হড়কে যাই? শালা, বাপ কী বলে দিয়েছে জানো, পরীক্ষায় ফেল করলে পাছায় লাথি মেরে বের করে দেবে।
—তো আমি কী করব?
—পাশের নোটগুলো দিবি না? হিস্ট্রি পল সায়েন্সের ওই থানইটগুলো পড়ব আমি?
—তাই তো নিয়ম।
—পারব না বস। একটা সাজেশান বানিয়ে দাও। তমাল ঠোঁটে সিগারেট লাগাল,—পার পেপার আটটা কোয়েশ্চেন। পুরো মুখস্থ করে যাব, হলে বমি করে দিয়ে চলে আসব।
—হুম্। দেখছি।
—যদি বলিস তো তোর বাড়ি চলে আসতে পারি। বারাসতেই আছিস তো? অ্যাড্রেসটা দিয়ে দে…
—থাক। বাবুয়া মনে মনে একটু শঙ্কিত হল। তমাল গিয়ে কী দেখবে, কী জানবে, কী বুঝবে, কী রটাবে…! এক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল,—আমি পরশুদিন, মানে সোমবার কলেজে আসছি। শুনছি অ্যাডমিট কার্ড এসে যাবে…। তুইও ওই দিনই কলেজে আয়।
গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় এসেছে দুই বন্ধু। অফিস ছুটি হয়ে গেছে, গৃহাভিমুখী মানুষ উদভ্রান্তের মতো ছুটছে শেয়ালদার দিকে। সামান্য অমনোযোগী হলেই দুমদাম ধাক্কা লেগে যায়।
ভিড় আর কোলাহলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছিল বাবুয়া। শ্রমের। ঘামের। ফুটপাথ জুড়ে হকাররা চৈত্রসেলের পসরা সাজিয়ে বসেছে, তাদের জিনিসপত্রের। এই মিশ্র গন্ধে এতটুকু মিষ্টত্ব নেই, তবু যেন গন্ধটা বড় টানে বাবুয়াকে। কেন যে টানে? কাঁধে দায়িত্বের জোয়াল টানার সময় হয়ে এল বলেই কি?
তমাল একটু থেমেছিল। আবার বকবক শুরু করেছে,—তোর টিউশনি চলছে কেমন?
—মন্দ কী! ভালই তো। পরীক্ষা টরিক্ষা সব হয়ে গেল…
—এখন কটা দিন মার্কেট একটু ডাউন যাবে। জুন মাসটা পড়তে দে, তোকে আমি তখন টিউশনিতে ফ্লাড করে দেব।
—বলছিস?
—বলছি মানে? ওয়াদা। চলন্ত তমাল বাবুয়ার দিকে ফিরল,—এই, মীরা কাকিমার সঙ্গে কী কথা হচ্ছিল রে?
—তেমন কিছু না। এমনিই। টুকটাক।
—মীরা কাকিমা তোর খুব নাম করে। বলেই চোখ টিপল তমাল,—খুব খাওয়ায়, না?
—ওই চা বিস্কুট…
—ঢপ মেরো না গুরু। তোমার প্লেটে আজ ওমলেটের কুচি পড়ে ছিল, ম্যায় আপনি আঁখো সে দেখা।
বাবুয়া হেসে ফেলল,—তোর তো শকুনের চোখ রে। তোকে বুঝি টিউশনি বাড়িতে কিছু খেতে দেয় না?
—তমাল হালদারকে না খেতে দিয়ে উপায় আছে? তমাল খ্যাক খ্যাক হাসল,—একটা বাড়িতে চা পর্যন্ত ঠেকাত না, তাদের কী ভাবে টাইট দিয়েছিলাম জানিস? ছেলেকে পড়াতে পড়াতে ঝ্যাট করে মাকে ডেকে পাঠালাম। বললাম, আপনার ছেলেকে একটু দেখুন তো, আমি সামনের দোকান থেকে কচুরি সিঙাড়া খেয়ে আসছি! কলেজ থেকে ফিরছি তো, পেটে ছুঁচো ডন মারছে! ব্যস, ওমনি মা-টার ঘাড় ঝুলে গেল! এখন রোজ আমার জন্য একটা করে টিফিনকেক এনে রাখে।
বাবুয়ার পেট গুলিয়ে হাসি উঠে আসছিল। বলল,—তোর ওভাবে বলতে লজ্জা করল না?
—কীসের লজ্জা? পেটের ধান্দাতেই তো যাচ্ছি, না কী? বলতে বলতে একটা মোটাসোটা লোকের সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লেগে যাচ্ছিল তমালের, রক্তচক্ষে তার দিকে একবার তাকিয়ে নিল তমাল। পরক্ষণে হাসিমুখে বলল,—বুঝলে বস, মানো আর না মানো, মানুষের যত ফাইট সব এই পেটের তিন ইঞ্চি জায়গার জন্যে। এটি স্যাটিসফায়েড না থাকলে শরীরের আর বাকি সব অঙ্গ ফালতু হয়ে যায়।
বাবুয়া মাথা দোলাতে বাধ্য হল। মাঝে মাঝে বেশ দারুণ দারুণ উক্তি ঝাড়ে তমাল। পেটের চিন্তা আছে বলেই না বাবুয়াকেও ভবিষ্যৎটা বদলে ফেলতে হচ্ছে।
শেয়ালদা স্টেশন এসে গেছে। তমাল আরও একটুক্ষণ সঙ্গে থাকার জন্য ছটফট করছিল, বাবুয়া দাঁড়াল না। প্ল্যাটফর্মে থিকথিকে ভিড়, ট্রেন নেই। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছে বাবুয়া, ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। ক্লোজ সার্কিট টিভিতে ফুটবল খেলা চলছে, এক ঝলক সেদিকে দৃষ্টি রেখেও চোখ সরিয়ে নিল। একটা বনগাঁ লোকাল ঢুকতেই কাতারে কাতারে লোক দৌড়চ্ছে সেদিকে। বাবুয়া ভিড়ের অনুবর্তী হতে চায় না, অন্যকে ঠেলেঠুলে নিজের জায়গা করে নেওয়াতেও তার ঘোর আপত্তি, তবু দৌড়ল সেও। ঘোর লাগা মানুষের মতো। এই ভিড় স্টেশনে ঢুকলেই সুস্থ চিন্তাগুলো কেন যে এমন তালগোল পাকিয়ে যায়!
যাত্রী পেটে পুরেই ট্রেনের যাত্রা শুরু। বাবুয়া প্যাসেজে, কষ্টেসৃষ্টে দাঁড়িয়ে। এই গাদাগাদিতে, তাসপার্টিরা খেলায় মেতে গেছে, চিৎকার করে অফিসের গল্প করছে কেউ কেউ, কেউ বা চোখ বুজেছে। হকাররা ব্যবসা সারায় ব্যস্ত।
বাবুয়া নিজের মধ্যে ডুবে ছিল। মীরার মুখখানা দুলে উঠল চোখের সামনে। কী দৃঢ় স্বরে কথাগুলো বলছিল মহিলা! কিছু কি আঁচ করেছে বাবুয়ার সম্পর্কে? লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে বাবুয়া কী মীরার চোখে ছোট হয়ে গেল। তুৎ, অত কথা না বলে আগেই বেরিয়ে এলে ভাল হত। ওই তমালটার জন্য…! না, তমালের ওপর চটে লাভ নেই, ও অনেক টিউশনি দেবে। চাকরি তো আর হাতের মোয়া নয়, যে চাইলেই কেউ টুপ করে পেয়ে যাবে, হয়তো ক’মাস ওই টিউশনিই…। কী চাকরি জুটতে পারে বাবুয়ার? কাকাকে বললে ছোটমোটো কিছু হয়তো জোগাড় হয়ে যায়, কিন্তু …। উঁহু, কাকাকে নয়। কাকা বোধিসত্ত্ব মজুমদারেরই ভাই। কাকাও মাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কম অপমান করেনি। ক্যাম্পাস টাউনের ফার্নিচার বেচার টাকা দিতে চায়? ইনিয়ে বিনিয়ে কী ডায়ালগ? বউদি এ তো তোমারই প্রাপ্য! দাদা একটা ভুল করেছে বলে তুমি কেন তোমার হক ছাড়বে! বাড়ি থেকে মা আউট হয়ে গেল, তার কিছু করতে পারল না, হক দেখায়! সব তোলা থাকছে, বাবুয়া একদিন দেখে নেবে। গোটা মজুমদার ফ্যামিলিকে এমন শিক্ষা দেবে…। একটা সেলস্ম্যানের চাকরির চেষ্টা করলে কেমন হয়? লোকের দরজায় দরজায় ঘুরে জিনিস ফেরি করবে? সাবান পারফিউম কসমেটিক্স…? কাকা কাকিমাদের কোনও ছলে কথাটা শুনিয়ে দিলে বোধিসত্ত্ব মজুমদারের কানে কি পৌঁছবে না? সে কেন শুধু বিজ্ঞানীর ছেলে হবে, বোধিসত্ত্ব মজুমদারও ফেরিওয়ালার বাপ হোক। কথা সে কম বলে বটে, কিন্তু খারাপ বলে না। যুক্তিও সে ভালই সাজাতে পারে। ইংরিজিও তার মুখে মন্দ আসে না। তা হলে সেলস্ লাইনেই বা কেন উন্নতি করতে পারবে না বাবুয়া? তারপর যদি কিছু পয়সাকড়ি জমাতে পারে, তো স্বাধীন ভাবে কোনও একটা ব্যবসা…।
বাবুয়াকে পারতেই হবে। মীরার কথাগুলো আবার কানে আছড়ে পড়ল বাবুয়ার। বিশ্বসংসারকে বাবুয়া দেখিয়ে দেবে, বোধিসত্ত্ব মজুমদারের ছেলে হয়ে না থেকেও সে অন্ধকারে হারিয়ে যায়নি। সে প্রমাণ করে দেবে, শুদ্ধসত্ত্ব মজুমদারের মধ্যেও কিছু মালমশলা আছে। একেবারে নিজস্ব।
ট্রেন বারাসত পৌঁছল প্রায় সাতটায়। স্টেশন থেকে মামার বাড়ি বেশ খানিকটা পথ, ইদানীং রিকশা নেয় না বাবুয়া, রাস্তাটুকু হেঁটে মেরে দেয়। এক পয়সা বাঁচানোও তো এক পয়সা রোজগার।
উত্তেজনায় টগবগ করতে করতে বাড়ি এল বাবুয়া। ঢুকেই হাঁ। একতলার বৈঠকখানা ঘরে কার সঙ্গে কথা বলছে মা? সৌমিক নামের ছেলেটা না?
বাবুয়াকে দেখেই সৌমিক উচ্ছ্বসিত। যেন কতদিনের চেনা এমন ভঙ্গিতে বলে উঠল,—এতক্ষণে ফিরলে? সেই কখন থেকে তোমার জন্য বসে আছি।
বাবুয়া আরও হকচকিয়ে গেল। মাত্র দু’দিনের আলাপ, তাও প্রায় রাস্তাঘাটেই বলা যায়…সোজা বাড়ি চলে এল? একটু গায়ে পড়া ধরনের আছে বটে সৌমিক, ট্রেনে খুব বোর করেছিল…। হঠাৎ তিন মাস পরে উদয়ই বা হল কোত্থেকে?
বাড়িতে আসা অতিথির সঙ্গে কাঠ কাঠ ব্যবহার করাটা অভদ্রতা। বাবুয়া হালকা হেসে বলল,—হ্যাঁ, একটু দেরি হয়ে গেল। আপনি হঠাৎ?
—আমার তো পাশেই একটা ঠেক রয়েছে। লালজিবাবার আশ্রম। দুপুরে ছুটির পর এসেছিলাম, ভাবলাম তোমার সঙ্গে দেখা করে যাই।…
যুক্তিটা কেন যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না বাবুয়ার। লালজিবাবার আশ্রমে নিয়মিত আসে সৌমিক? কই, দেখে তো মনে হয় না!
সংশয়টা গোপন রেখেই বলল,—মা, তুমি সৌমিকবাবুকে চা-টা দিয়েছ?
—হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ। রাখী স্মিত মুখে বলল,—তোর বন্ধুর কোনও অযত্ন করিনি।…তবে ও তেমন কিছু তো খেলও না। কতবার করে বললাম, অফিস থেকে আসছ, একটু লুচিতরকারি করে দিই, তা এই ছেলের সবেতেই না না।
—মিষ্টি তো খেলাম মাসিমা! সৌমিক বাবুয়ার দিকে ফিরল,—তোমার পার্ট ওয়ানের প্রিপারেশন কদ্দূর?
—চলছে। আপনার অফিস?
—গয়ং গচ্ছ। অফিস একটি অত্যন্ত ডাল মনোটোনাস ব্যাপার, নাথিং টু টক অ্যাবাউট। সৌমিক কবজি উলটোল,—আজ তা হলে আসি মাসিমা।
—সে কী! বন্ধু এল, একটু গল্পগুজব করো…
—আজ আর হল না। এক্ষুনি বেরোলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে নটা বেজে যাবে। বলেই আবার বাবুয়ার দিকে ফিরেছে সৌমিক,—তুমি আমায় এগিয়ে দেবে না? চলো, একটু হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
খুবই স্বাভাবিক স্বর, তবু কথাটা কানে বাজল বাবুয়ার। কয়েক সেকেন্ড স্থির চোখে দেখল সৌমিককে। তারপর বলল,—চলুন।
সামনে রাস্তার আলোটা জ্বলছে না, গেটের বাইরেটা অন্ধকার। হুশ হুশ গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, ধাঁধিয়ে যাচ্ছে চোখ। গাড়ি মিলিয়ে গেলেই অন্ধকার গাঢ়তর।
দু-চার পা নীরবে হেঁটে সৌমিক বলল,—তুমি শুনলাম আজকাল খুব টিউশনি করছ?
—হুঁ। কেন বলুন তো?
—তোমার মা বলছিলেন, ছেলেটার খুব খাটুনি যায়, বই নিয়ে বসলেই ঢুলতে শুরু করে…
—তো?
—এত পড়ানোর কী দরকার? আগে নিজের পড়াশুনোটা করো?
বাবুয়ার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল, নিজের চরকায় তেল দিন। অনেক কষ্টে চুপ করে রইল।
আবার দু-চার পা নিঃশব্দে হাঁটল সৌমিক। আচমকা বলল,—আমি কেন এসেছি আন্দাজ করতে পারছ?
—আমাকে টিউশনি ছাড়ার জন্য উপদেশ দিতে নয়, এটুকু অন্তত অনুমান করছি।
—এবং কোনও আশ্রমেও আমি আসিনি। তোমাদের এখানেই এসেছি।
—আমারও এরকমটাই মনে হচ্ছিল। কারণটা জানতে পারি?
—যদি বলি তোমার মাকে দেখতে? একটু যেন দম নিল সৌমিক। তারপর বলল,—আই মিন, প্রোফেসার মজুমদারের স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করতে?
চমকে সৌমিকের দিকে তাকাল বাবুয়া? অন্ধকারে সৌমিকের মুখ ভাল দেখা যাচ্ছে না। ঈষৎ রুক্ষ ভাবেই বলল,—কেন?
—ওঁকে দেখে আন্দাজ করতে চাইছিলাম প্রোফেসার মজুমদার মানুষ কেমন! কেনই বা তিনি তাঁর স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছেন!
বাবুয়া পলকের জন্য নাড়া খেয়ে গেল। পরক্ষণেই দপ করে জ্বলে উঠল,—আপনার সাহস তো কম নয়! আমার বাবা-মার ব্যাপারে আপনার এত কৌতূহল কেন?
—কারণ তোমার বাবা, প্রোফেসার বোধিসত্ত্ব মজুমদার আমার একটা চরম ক্ষতি করেছেন। সৌমিকেরও গলা সামান্য উঠল,—আই হ্যাভ সাম স্কোর টু সেটল উইথ হিম।
—হতে পারে। সে আপনি যা ইচ্ছে করুন গিয়ে। কিন্তু আমার মার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?
—একটা পরোক্ষ সম্পর্ক আছে বইকী। তাঁকে ডেজার্ট করে অন্য একটি মেয়েকে নিয়ে ঘর বেঁধেছেন প্রোফেসার মজুমদার। ইন্স্ডেন্টালি অর অ্যাক্সিডেন্টালি, সেই মেয়েটির সঙ্গে আমার বিয়ে ফাইনাল হয়ে গিয়েছিল।
প্রবল ঝাঁকুনি খেল বাবুয়া। চলন্ত গাড়ির হেডলাইটে মুহূর্তের জন্য সৌমিকের মুখখানা দেখতে পেল। অদ্ভুত কঠিন, ভাবলেশহীন, যেন প্রস্তরমূর্তি কথা বলছে।
সৌমিক বুঝি বাবুয়াকে ধাক্কাটা সইয়ে নেওয়ার সময় দিল। কিছুক্ষণ পরে বলল,—তোমার বাবার ইরেস্পন্সিবল অ্যাক্ট কত কিছু শ্যাটার্ড করে দিয়েছে জানো? আমার কথা ছেড়েই দাও। দয়িতা, আই মিন মেয়েটার মা-বাবা শোকে পাথর হয়ে গেছেন। দুটো ফ্যামিলির মান সম্মান সব ধুয়ে মুছে গেল।
বাবুয়া নীরস স্বরে বলল,—তার সঙ্গেই বা আমার মার কী সম্পর্ক?
—আছে সম্পর্ক। তাঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে চাইছিলাম তাঁদের স্বামী স্ত্রীর রিইউনিয়নের আর সম্ভাবনা আছে কি না।
—সর্বনাশ, আপনি মাকে এ সব কথা কিছু বলেছেন নাকি?
—আমাকে কি তোমার অত নির্বোধ মনে হয়? ফর ইওর ইনফরমেশন, তোমার সঙ্গে যেদিন আমার লাস্ট দেখা হয়, সেদিন আমি ক্যাম্পাস টাউনে ওই মেয়েটিকেই মিট করতে গেছিলাম। তুমি কি আমার কথা শুনে কিছু বুঝতে পেরেছিলে? নিশ্চিন্ত থাকো, তোমার মাকেও আমি কিছু বুঝতে দিইনি। জাস্ট কথায় কথায় তোমার বাবার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম, দেখলাম ওঁর মুখটা কেমন স্টিফ হয়ে গেল। অ্যান্ড শি ওয়াজ ট্রায়িং টু অ্যাভয়েড দা টপিক।
—আপনাকে তাহলে আর একটা খবরও দিয়ে দিই। বাবার উকিল ডিভোর্সের নোটিস পাঠিয়ে দিয়েছে। এবং মা কনটেস্ট করছে না।
—ও, তাই বুঝি?
—খুব হতাশ হলেন মনে হচ্ছে? বাবুয়া একটু খোঁচা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারল না,—আমার বাবা মার মিলমিশ হয়ে গেলে আপনি বুঝি মেয়েটাকে বিয়ে করতেন? বাবার সঙ্গে লিভ টুগেদার করেছে জেনেও?
—ওইটেই তো আমার ট্রাজেডি। সৌমিক অন্ধকারকে ভারী করে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল,—আমি যে ওই মেয়েটাকে ভালবাসি। এখনও। অ্যান্ড শি ইজ মাই ডেসটিনি।
ভালবাসা শব্দটার মধ্যে যে এত তীব্রতা থাকতে পারে, বাবুয়ার জানা ছিল না। ভালবাসা কী এমন অনুভূতি, যে ছেলেটা…? ছেলেটা সত্যি সত্যি পাগল নয় তো?
এই প্রথম দয়িতা নামের মেয়েটার ওপর অনুকম্পা জাগছিল বাবুয়ার। এমন একটা ছেলেকে ছেড়ে তার বাবার মতো এক আত্মসর্বস্ব লোকের পিছনে ছুটল? আশ্চর্য!
বাবুয়া নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল,—আপনি কি বোধিসত্ত্ব মজুমদারের ওপর প্রতিশোধ নিতে চান?
আরও গলা নামাল সৌমিক। প্রায় ফিসফিস করে বলল,—ভাবছি।
.
১৮.
বোধিসত্ত্বর বিদেশযাত্রার দিন কয়েকের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠল দয়িতা। জীবনে এই প্রথম সে একা, পরিপূর্ণভাবে একা। নির্জনতা বিচ্ছিন্নতা একাকিত্ব শব্দগুলো তার পরিচিত বটে, কিন্তু এরা প্রত্যেকেই যে কী দুঃসহ ভার হয়ে বুকে চেপে বসতে পারে তা দয়িতার জানা ছিল না, এই প্রথম সে টের পাচ্ছিল। এই শহর তার আজন্ম চেনা, এই শহরের রূপ রস গন্ধ বর্ণ তার রক্তে মিশে আছে, বাবা-মা ভাই আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কে নেই এখানে, তবু মনে হয় এক শুনশান দ্বীপে বাস করে সে। এ এক আজব নির্বাসন। যেন এক কন্ডেমড্ সেলে স্থান হয়েছে দয়িতার, চেনা পৃথিবীর আলো বাতাস তার জন্য রুদ্ধ।
একেই বোধহয় নিরবলম্ব শূন্যতা বলে। এ যেন জলের তলায় বাস। অহরহ দু ফোঁটা অক্সিজেনের জন্য আঁকুপাঁকু করা।
দয়িতার দিনগুলো এখন অতি মন্থর। কাঁহাতক আর চাদর পাট সংসার গোছগাছ করে সময় কাটে! রোজ রোজ মার্কেটিংও ভাল লাগে না। কী বিরক্তিকর নিস্তরঙ্গ জীবন! শুয়ে থাকা, কড়িকাঠ গোনা, টিভির দিকে ফাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকা, ব্যালকনির টবে জল দেওয়া…। সময় যেন স্থাণু হয়ে আছে ফ্ল্যাটে। সকাল কিছুতেই দুপুরে ঘুরতে চায় না, প্রায়স্থবির দুপুরের বিকেলে পৌঁছতে অনীহা, বিকেল এলেও সন্ধে আসতে গড়িমসি করেই, আর রাত? সে তো এক একটা বছরের চেয়েও দীর্ঘ। ইচ্ছেয় হোক, আর অনিচ্ছেয় হোক, প্রতি পদে চোখ চলে যায় ক্যালেন্ডারে। বোধিসত্ত্ব ফিরবে কবে?
রোজ একবার বোধিসত্ত্বর ফোন পেলে হয়তো একঘেয়েমি কিছুটা কাটত দয়িতার। বার্লিন পৌঁছে মাত্র বার তিনেক দয়িতাকে ফোন করেছে বোধিসত্ত্ব। কেজো কথা কয়েকটা, তাও মাত্র মিনিট দু-চারের জন্য। বোধিসত্ত্ব এখন সেমিনার নিয়ে মহা ব্যস্ত। পেপার থিসিস সিম্পোজিয়ামের ফাঁকে ফাঁকে দয়িতার কথা কি মনে পড়ে বোধিসত্ত্বর? কিংবা রাতের একা শয্যায়?
অচেনা একাকিত্ব অভিমান হয়ে চারিয়ে যাচ্ছিল দয়িতার বুকে। নিজেকে এক পরিত্যক্ত নারী বলে মনে হয় হঠাৎ হঠাৎ। রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে আঁধারটাকে আরও গাঢ় লাগে। কী করে যে এই গহীন নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পাবে দয়িতা?
এরকমই একটা সময়ে কোথ্থেকে সহসা সৌমিক এসে হাজির।
ইদানীং সকালে একটু দেরি করে শয্যা ছাড়ে দয়িতা। ঠিকে ঝি আসে সাতটা নাগাদ, তাকে দরজা খুলে দিয়েই আবার বিছানায় ধপাস। বাসনকোসন যা দু-একটা পড়ে ঝড়ের গতিতে মেজে ফ্ল্যাটের দরজা টেনে বন্ধ করে চলে যায় কমলার মা, আবার তার দর্শন মেলে সেই বারোটায়। তখন ঘর ঝাড়পোঁছ করবে, কাপড়জামা থাকলে কাচবে…
আজও কমলার মা ভেবেই দয়িতা দরজা খুলতে উঠেছিল। ঘুম ঘুম চোখে, আলুথালু বেশে। ওমা, দরজায় এ কে? সৌমিক!
সৌমিকের হাতে এক গোছা রজনীগন্ধা। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। ফুলের তোড়া বাড়িয়ে দিল বলল,—মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্য ডে।
দয়িতার শরীর জুড়ে শিহরন খেলে গেল। তাই তো আজই তো ইলেভেনথ্ এপ্রিল! আশ্চর্য, এই দিনটার কথা দয়িতার মনেই ছিল না!
অদ্ভুত এক ভাললাগা ভোরের বাতাসের মতো ছুঁয়ে গেল দয়িতাকে। অপ্রস্তুত মুখে হাসল,—তুতুতুতুতুমি?
—বন্ধুর জন্মদিনে বন্ধু উইশ করতে আসতে পারে না?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই…বটেই তো…এমা, ছি ছি দাঁড়িয়ে কেন? এসো এসো।
সৌমিককে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে দয়িতা ছুটে শোওয়ার ঘরে এল। তার পরনে অতি স্বচ্ছ রাতপোশাক, চটপট হাউসকোট চাপিয়ে নিল গায়ে। বাসি চুল ঝামর হয়ে আছে, আলতো চিরুনি বুলিয়ে নিল একবার।
ফিরে এসে বসতে বসতে বলল,—আমার ঠিকানা পেলে কোথথেকে?
—তুমি নামী লোকের ঘরণী, তোমার অ্যাড্রেস পাওয়া কী এমন কঠিন?
সৌমিকের স্বরে কি বিদ্রূপ? মনে হল না দয়িতার। জিজ্ঞেস করল,—ওর ইন্সটিটিউট থেকে পেয়েছ?
সৌমিক জবাব দিল না। লঘু গলায় বলল,—সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম সেটা বলো? ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছ তো?
—হ্যাঁ…মানে…এমন দিনে সাতসকালে…
—দোহাই আবার প্রশ্ন কোরো না তোমার জন্মদিনটা জানলাম কী করে।
কৌতুহল যে দয়িতার হচ্ছে না তা নয়। মনে মনে আঁচ করে নিল তার বাড়ির সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে সৌমিকের। নিশ্চয়ই সেখান থেকেই কথা প্রসঙ্গে…।
মনটা ঈষৎ উদাস হয়ে গেল দয়িতার। আজ কি তার নাম করে বাড়িতে পায়েস করবে মা? প্রতিবারের মতো? গত বছর জন্মদিনে হোস্টেলে ফোন করেছিল বাবা, খুব সকালে। খাঁটি ফরাসি পারফিউম কিনেছিল দয়িতার জন্য। আজ কি আদরের মুনিয়ার কথা ভেবে বাবার একটুও মন খারাপ হবে না?
দয়িতার ক্ষণিক অন্যমনস্কতা সৌমিকের নজরে পড়েছে। মৃদু গলায় প্রশ্ন করল,—কী ভাবছ?
—কিছু নয়। ছোট্ট শ্বাস ফেলে দয়িতা কথা ঘোরাল।—তুমি এমন দিনে এসে, তোমার সঙ্গে ওর আলাপ করাতে পারলাম না। ও এখন…
—জানি। প্রফেসার মজুমদার এখন দূরদেশে।
—এও জানো?
—সেলিব্রিটিদের খবর তো রাখতেই হয়।
এ কথাটায় কি বিদ্রূপ আছে? দয়িতা ভুরু কুঁচকে এক ঝলক দেখল সৌমিককে। নাহ, সৌমিকের মুখ সহজ সরল স্বাভাবিক। ছিঃ, জন্মদিনের সকালে ফুল হাতে কেউ শ্লেষ ছুড়তে এসেছে, চিন্তাটাই কী অস্বাস্থ্যকর।
দয়িতা প্রসন্ন মুখে বলল,—বোসো, চা করে আনি…। এক্ষুনি এক্ষুনি কিন্তু পালাতে পারবে না। ব্রেকফাস্ট করে যেতে হবে।
—যাক, তাও ভাল। খাওয়ানোর কথা মনে পড়েছে। তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল এক্ষুনি বোধহয় উঠতে হবে, ভোর ভোর ট্যাক্সি ভাড়াটাই গচ্চা গেল। সৌমিক ভুরু নাচাল,—ব্রেকফাস্টের মেনুটা কী?
—দেখা যাক ঘরে খুদকুড়ো কী আছে। দয়িতা উঠে দাঁড়াল। হাসতে হাসতে বলল, বার্থডে কেক তো জুটবে না, হয়তো মুড়ি বাদাম…
বাইরে এক মনোরম সকাল ফুটেছে। রোদ্দুরে কাঁচা সোনার রং, ঝলমল করছে বাড়িঘর। কম্পাউন্ডের কৃষ্ণচূড়া গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে, চড়া লালে ধাঁধিয়ে যায় চোখ। বাতাসে একটা গন্ধ ভাসছে। চেনাও নয়, আবার অচেনাও নয়, এমনই এক সৌরভ।
রান্নাঘরে এসে দয়িতা চায়ের জল চড়িয়ে দিল। বোধিসত্ত্বর সঙ্গে থেকে থেকে সকালবেলা এক কাপ কালো চায়ের অভ্যেস ধরে গেছে দয়িতার, ঘুম থেকে উঠে চা না খেলে খোঁয়াড়ি কাটতে চায় না।
কাপে আন্দাজ মতো চিনি দিচ্ছিল, পিছনে কমলার মা। বছর পঁয়ত্রিশের কালেকুলো বউটার চোখে জিজ্ঞাসা ঝিকঝিক। ফিসফিস করে বলল,—কে গো বউদি? তোমার বাপেরবাড়ির লোক?
হ্যাঁ বললেই চুকে যেত, দয়িতার মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল,—না। আমার বন্ধু।
—এত সকালে বন্ধু…?
—তোমার আপত্তি আছে? দয়িতা সামান্য রুক্ষ হল,—যাও, চটপট ফ্রিজ থেকে দুটো ডিম বের করে আনো।
ঘুরে তাকাতে তাকাতে চলে গেল কমলার মা। দয়িতার একটু একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কমলার মার প্রশ্নের কোনও ঠিকঠিকানা নেই, মুখটাও বড় আলগা। প্রথম দিন কাজে এসেই জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কি বাবুর দ্বিতীয় পক্ষ! এই কম্পাউন্ডে আরও চারটে ফ্ল্যাটে কাজ করে কমলার মা, কোন কথা কোথায় কীভাবে পল্লবিত করে দেবে কে জানে! দয়িতা অবশ্য প্রতিবেশীদের আমল দেয় না, কে কী ভাবল তাতে তার বয়ে গেল। এই চত্বরে এখনই কি তাকে নিয়ে গুঞ্জন নেই?
বুক থেকে কীটপতঙ্গগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিল দয়িতা। সকালটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চনমনে একটা ভাব এসে গেছে মনে। যেন স্বল্পচেনা সৌমিক নয়, যেন বহুকাল পর কোনও আপনজন এসেছে ঘরে। গুনগুন করতে করতে চা পাতা ভেজাল দয়িতা, দ্রুত ডিম দুটো ফেটিয়ে, দুধ ময়দা গুলে, কাঁচালঙ্কা পেঁয়াজকুচি মিশিয়ে ভেজে ফেলল একখানা বড়সড় প্যানকেক। ঘরে কাজুবাদাম আছে, কলাও। টম্যাটো সসে প্যানকেক সাজাল, কাজুবাদাম কলাও রাখল ডিশে। ইশ, ঘরে একটু মিষ্টি থাকলে ভাল হত। জন্মদিনে মিষ্টিমুখ না করালে কি ভাল দেখায়!
সৌমিক খবরের কাগজ উলটোচ্ছিল। খাবারের প্লেট দেখে হাঁ হাঁ করে উঠেছে,—ওরেব্বাস, এ কী করেছ? খেতে চাইলাম বলে এত?
—খেয়ে নাও, খেয়ে নাও। দয়িতা হাসিমুখে উলটো দিকের সোফায় বসল,—নিশ্চয়ই তুমি আর বাড়ি ফিরবে না? এখান থেকেই অফিস যাবে?
—আজ কীসের অফিস? আজ তো গুড-ফ্রাইডে!
তাই বুঝি? বলতে গিয়েও দয়িতা সামলে নিল। তার কাছে এখন শনি, রবি, সোম, মঙ্গল ছুটির দিন কাজের দিন সবই তো সমান। তা ছাড়া সৌমিক পরে আছে জিনস আর টিশার্ট, এই পোশাকে কেউ অফিস যায় না, দয়িতার বোঝা উচিত ছিল।
দ্বিতীয়বার আর ভদ্রতা না দেখিয়ে সৌমিক প্লেট টেনেছে। প্যানকেকে চামচ চালাতে চালাতে বলল,—তোমার খাবার কই?
—আমি এখন কিছু খাব না।
—কেন?
—এমনিই। ভাল লাগছে না। তা ছাড়া মুখটুখ এখনও ধোয়া হয়নি…
—এহ, সক্কালবেলা এসে তোমায় খুব অকোয়ার্ড সিচুয়েশানে ফেলে দিলাম তো?
—না, না, আমার খুব ভাল লাগছে…বিশ্বাস করো…
সৌমিক এক সেকেন্ড দেখল দয়িতাকে। তারপর বলল,—আছ কেমন?
—কেমন দেখছ?
—আগের থেকে একটু রোগা হয়ে গেছ।
—যাহ, দিনরাত খেয়ে বসে শুধু মোটাচ্ছি…। দয়িতা চায়ের কাপ টানল। ফুরফুরে গলায় বলল,—আমার সংসার কেমন দেখছ, বলো?
—ফাইন। চতুর্দিকে পাখির চোখ বোলাল সৌমিক,—খুব সুন্দর লাগছে। টিপটপ ঝকঝকে।
—সব নিজে পছন্দ করে কিনেছি। পরদা, ফার্নিচার…। নিজের হাতে সাজিয়েছি সব কিছু।
বাহ্ বাহ্। সৌমিক একটু চুপ থেকে ঝপ করে বলল,—এম এসসি ফাইনালটা তা হলে আর দিলে না?
দয়িতা দীর্ঘশ্বাস চাপল। ইচ্ছে তো ছিল, হল কই! বোধিসত্ত্ব চলে যাওয়ার পর কদিন ধরে অনেক ভেবেছে। এপ্রিলের বারো তারিখ থেকে ফাইনাল, কটা দিন মরিয়া পড়াশুনো করে পরীক্ষাটা দিয়ে এলে হয়। ফর্ম ফিলআপ তো করাই আছে, গিয়ে শুধু অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে হলে ঢুকে পড়া…। এক দু-দিন বইখাতা খুলেও বসেছিল। পাতা উলটোনোই সার, মন বসল না। রাশি রাশি হাবিজাবি চিন্তা মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে ধরে। ক্যাম্পাস টাউনে গিয়ে সে উঠবে কোথায়? হোস্টেলে? চিরশ্রীর গেস্ট হয়ে কদিন…পরীক্ষা শেষ হওয়া অবধি…? দরকার কী? চিরশ্রী তাকে কী মনে নেবে, কত কৈফিয়ত চাইবে, কী জেরা করবে…! প্যাট প্যাট করে তাকাবে সবাই, মুচকি মুচকি হাসবে, বাক্যবাণ ছুড়বে, উফ অসহ্য। পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে, দয়িতা এখন আর একা নয়। তার অপমান মানে বোধিসত্ত্বর অপমান। উহুঁ, দয়িতার পক্ষে আর ক্যাম্পাস টাউনে পা রাখা সম্ভব নয়।
মনের খেদটা মুখে ফুটতে দিল না দয়িতা। হালকা স্বরেই বলল,—ধূস, কী হবে? এম এসসি পাশ করে কী এমন হাত পা গজায়?
—ডিগ্রিটা নিয়ে রাখলে পারতে। ভবিষ্যতে কখন কী কাজে লাগে…
আমার কোনও কাজেই লাগবে না। আমি এখন চুটিয়ে সংসার করব।
—ও বাবা, তুমি যে দেখছি একেবারে মা ঠাকুমাদের মতো কথা বলছ! সংসারের সঙ্গে কেরিয়ারের কী কন্ট্রাডিক্শান আছে?
—নেই?
—অফকোর্স না। এই তো আমাদের অফিসে একটা মেয়ে আছে, নিবেদিতা। ওর বর আমেরিকা গেল, ও চলে গেল বম্বে। জাস্ট টু বিল্ড দেয়ার ওন কেরিয়ার। আই মিন, যার যার নিজের কেরিয়ার। আজকালকার দিনের মেয়েরা কেরিয়ার ফেলে দিয়ে শুধু গৃহবধূটি হয়ে থাকে নাকি? সৌমিক হঠাৎ সামান্য উত্তেজিত,—তোমার কি মনে হয় না, ইউ নিড আ ওয়ার্ল্ড অফ ইওর ওন?
—বোধিসত্ত্বর জগৎই আমার জগৎ।
—খুব ভাল কথা। কিন্তু ম্যাডাম, এই অ্যাদ্দিন ধরে ঘাড় মুখ গুঁজে যে লেখাপড়া শিখলে, তার আর কী মূল্য রইল? শিক্ষা যদি কাজেই না লাগে…। সৌমিক প্লেট টেবিলে নামাল,—মেসোমশাইও ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন।
—কে মেসোমশাই?
—তোমার বাবা।
দয়িতা বেশ নাড়া খেয়ে গেল। চিনচিন একটা কষ্ট জমছে বুকে। বাবা এখনও তাকে নিয়ে এত ভাবে? কলকাতা আসার পর থেকে কত বার যে বাড়ির কথা মনে পড়েছে দয়িতার, টেলিফোন করার জন্য হাত নিশপিশ করেছে। পারেনি, কিছুতেই পারেনি। রিসিভার তুলছে, বোতামে আঙুল ছোঁয়াচ্ছে, কিন্তু চাপ দেওয়ার জোর পাচ্ছে না…। অপরাধবোধ?
দয়িতা অস্ফুটে বলল,—তুমি রেগুলার ও বাড়িতে যাও, তাই না?
—মাঝে মাঝে যাই।
—কেমন আছে সবাই? দয়িতার গলা আরও খাদে নেমে গেল।
—আছেন। মাসিমা বুম্বা ধাক্কাটা অনেকটা সামলে নিয়েছেন। শুধু মেসোমশাই…বাদ দাও, প্রফেসার মজুমদারের কথা বলো। কবে ফিরছেন?
—কাজ চুকলেই। দায়সারা গোছের উত্তর দিল দয়িতা। ভেতরে ভেতরে একটা চাপ অনুভব করছে। আবার জিজ্ঞেস করল,—বাবা এখনও আমার ওপর খুব রেগে আছে, না?
—না, রাগ আর নেই। তবে…
—তবে কী?
—রাগ ছাড়াও আরও অনেক অনুভূতি থাকে দয়িতা। দুঃখ হতাশা স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা…। লোকলজ্জা অপমান তো আছেই, ওটা নয় নাই ধরলাম। অবশ্য মনে মনে মেনে নিয়েছেন এটাই তাঁর ভবিতব্য ছিল।
—ভবিতব্যের কী আছে? আমার যাকে পছন্দ তাকে আমি বিয়ে করতেই পারি। বাবার তাকে পছন্দ নাও হতে পারে।
—আমিও তো মেসোমশাইকে ওই লাইনেই বুঝিয়েছি। কিন্তু…প্রবলেমটা কোথায় জানো? মানুষ যাকে বেশি ভালবাসে তার ক্ষেত্রে যুক্তি বুদ্ধি কাজ করে না, ইমোশানটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়।
—হুঁ।
দয়িতা চুপ করে গেল। সৌমিকও আর কথা বলছে না। বসন্তের সকাল ভারী হয়ে যাচ্ছে। সোনালি রোদ্দুরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে পড়ছে মলিন ছায়া। কমলার মা কাজ সেরে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময়ে আজ যেন একটু বেশি জোরে বন্ধ করল দরজা, শব্দটা বড় কানে লাগল দয়িতার। চোরা কান্না পাচ্ছে হঠাৎ। অকারণে।
নিজেকে ক্রমশ স্থিত করল দয়িতা। নতমুখ সৌমিককে অপাঙ্গে দেখছে। কেন আজ তার কাছে এসেছে ছেলেটা? শুধুই জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে? নাকি দয়িতার সংসার দেখতে? সে কতটা সুখী হয়েছে বুঝতে? এখনও এত কীসের আগ্রহ? দয়িতার বাবা মার কাছেই বা যায় কেন? কোন সম্পর্কের সুবাদে যায়? দয়িতাকে কেন ভুলতে পারছে না সৌমিক?
ব্যালকনি থেকে বাতাসের ঝাপটা এল একটা। ঘরে ঢুকে ঘুরন্ত পাখার হাওয়ায় হারিয়ে গেল। ঘরের নৈঃশব্দ্যও দুলে গেল যেন।
দয়িতা আচমকা কথা বলে উঠল,—তোমার বিয়ের কদ্দুর?
—উঁ?
—তোমার বিয়ের কী হল?
হঠাৎ দয়িতাকে চমকে দিয়ে হাসতে শুরু করেছে সৌমিক। হা হা হাসছে। হাসিতে গমগম করে উঠছে।
দয়িতা অবাক চোখে তাকাল,—এত হাসির কী হল?
—ন্যাড়া বেলতলায় কবার যায়? মাথায় অত বড় একখানা বেল পড়ার পরও আমার শিক্ষা হয়নি বলতে চাও?
—যাহ্, সব মেয়ে আমার মতো হবে নাকি?
—সে তো বটেই। সব মেয়ে তুমি হবে কী করে?
—বুঝলাম না।
—মানে আরও বিপজ্জনকও তো হতে পারে। ধরো, বিয়ের আসর থেকে চোঁ চাঁ দৌড় লাগাল। কিংবা হয়তো ফুলশয্যার রাতে বলল, তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও, আমি অন্য ছেলেকে ভালবাসি।
—ফাজলামি কোরো না। কবে বিয়ে করছ বলো? কথা দিচ্ছি, বিয়েতে যেতে না পারলেও তোমার বউকে একটা দারুণ প্রেজেন্ট দেব।
কয়েক সেকেন্ড দয়িতার চোখে চোখ রেখে স্থির তাকিয়ে রইল সৌমিক। এই প্রথম দয়িতার মনে হল ওই চোখে ভাষাও আছে। দৃষ্টিটায় অস্বচ্ছন্দ বোধ করছিল দয়িতা, চোখ নামিয়ে নিল।
সৌমিক ঘড়ি দেখছে,—তা হলে আজ উঠি?
দয়িতার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি সৌমিক, তবু তা নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করল না দয়িতা। বলল,—আবার এসো কিন্তু।
—আসব। সৌমিক উঠে দাঁড়িয়ে একটুখানি ইতস্তত করল,—তোমার চাকরি বাকরি পড়াশুনো নিয়ে বলছিলাম বলে কিছু মাইন্ড করোনি তো?
—না না…তুমি নিশ্চয়ই আমার ভালর জন্যই বলেছ।
—হ্যাঁ। বিলিভ মি। আফটার অল তুমি তো আর রাখী মজুমদার নও।
দয়িতা জোর ঝাঁকুনি খেল,—তুমি তাকে চেনো?
—অ্যাক্সিডেন্টালি পরিচয় হয়ে গেছে। বারাসতে মার গুরুদেবের আশ্রম, তার পাশেই ওঁর বাপের বাড়ি, সেখানেই একদিন পাকেচক্রে…। সৌমিক গলা ঝাড়ল,—খুব রেচেড কন্ডিশানে আছেন মহিলা।
—কেন? দয়িতা টেরচা তাকাল,—তার বাপের বাড়ির অবস্থা তো ভাল?
—না না, ওই সেন্সে রেচেড নয়। মেন্টালি এগ্জস্টেড। স্বামী ছাড়া কিছু তো বুঝতেন না, হয়তো সেই জন্যই…। দরজার দিকে এগোতে এগোতে পকেট থেকে সানগ্লাস বার করল সৌমিক। চোখে পরে নিয়ে ঘুরে তাকাল,—বুঝলে দয়িতা, এই জন্যই বলছি মেয়েদের সব সময়ে একটা আলাদা জগৎ থাকা ভাল। আই মিন, একটা নিজস্ব উইন্ডো।…প্রফেসার মজুমদার তোমায় ভালবাসেন ঠিকই, বাট হু ক্যান ফোরটেল দা ফিউচার? রাখী মজুমদার কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন এই বয়সে এসে তাঁকে এই রকম একটা সিচুয়েশানে পড়তে হবে?
দয়িতা ফোঁস করে উঠল,—তার জন্য সে নিজেই দায়ী। সে বোধিসত্ত্বর জীবনে নিজেকে ফিট করাতে পারেনি। তাদের মধ্যে একটা ভ্যাকুয়ম তৈরি হয়েছিল বলেই না আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল বোধিসত্ত্ব।…রাখী মজুমদার বুঝি এখন বোধিসত্ত্বকে দোষী করছে?
—তিনি সে ধরনের মহিলাই নন। ভেতর থেকে পুড়ে খাক হয়ে যাবেন, কিন্তু মুখ থেকে কখনও একটা উফ্ শব্দও বার হবে না।
—রাখীর দুঃখে আপ্লুত হয়ে গেছ মনে হচ্ছে? দয়িতার ঠোঁট বেঁকে গেল,—রাখী মজুমদার কি তোমায় উকিল পাকড়েছে?
—রাখী মজুমদারের উকিলের দরকার নেই। সৌমিকের স্বর গম্ভীর,—যা বললাম ভেবে দেখো। চলি।
তরতরিয়ে নেমে গেল সৌমিক। দয়িতা গুম। এতক্ষণে যেন সৌমিকের আসার উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট হচ্ছে। রাখীর কথা বলে তাকে একটু ঝাঁকাতে এসেছিল সৌমিক? তাই এত ভূমিকা, এত ভণিতা…? ছোকরার তো হেভি প্যাঁচ! জন্মদিন স্মরণ করিয়ে, বাবা মার কথা শুনিয়ে, দয়িতাকে আগে ভিজিয়ে নিয়ে…! দয়িতা পরীক্ষা দেবে কি দেবে না, চাকরি করবে কি করবে না, তাতে তোর কী? আমার বাড়িতে আমারই সঙ্গে দেখা করতে এসে তুই রাখীর কথা তুলিস কোন সাহসে?
দুপদাপিয়ে ঘরে ফিরে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল দয়িতা। শুয়ে আছে, শুয়েই আছে। পাশবালিশ আঁকড়ে, চোখ বুজে। মিষ্টি সকাল এখন হাকুচ তেতো।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দয়িতার রাগের ঝাঁঝ স্তিমিত হল খানিকটা। উঠল, মুখ টুখ ধুল, স্নান সারল, টুকটাক কাজ সারছে ঘরের। খিদে পেয়েছে জোর, অথচ জিভ বিস্বাদ, বয়াম খুলে নোনতা বিস্কুট খেল কয়েকটা। রান্নাঘরে এসে দুপুরের আহারের তোড়জোড় করছে। কৌটো থেকে চাল বার করতে গিয়ে থমকাল একটু, হাসল নিজের মনে। জন্মদিনে আজ কী খাবি রে মুনিয়া? ফ্রায়েড রাইস? ডিপফ্রিজে চিকেন আছে, সেদ্ধ করে যদি ফ্রায়েড রাইসে ছড়িয়ে দেওয়া যায়…? তুৎ, অনেক টাইম লাগবে, ভাল্লাগছে না। সেদ্ধ ভাতই খেয়ে নে। গরম গরম ভাতে ঘি আলুসেদ্ধ আর ডিমসেদ্ধ।
বগবগ ফুটছে সুগন্ধি চাল। দয়িতার চোখ ঝাপসা সহসা। নিজের অজান্তেই। বাড়িতে কি আজ তার নাম করে ভালমন্দ রান্না হচ্ছে? ধূস, মিছিমিছি সৌমিকের ওপর রাগ করল। মনে যাই থাক, ছেলেটা তো তবু দয়িতার জন্মদিনে…! শুধু ওই একজনই…। এই পৃথিবীতে আর তো কেউ তাকে আজ…! বোধিসত্ত্ব তো জানেই না…।
দ্রুত পায়ে ড্রয়িংরুমে এল দয়িতা। সেন্টার টেবিলে রজনীগন্ধার স্টিকগুলো ভারী অবহেলায় পড়ে আছে, সযত্নে তুলে মাপ মতো ডাঁটিগুলোকে ছাঁটল, সাজাল ফুলদানিতে। একটু দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে শুভ্র কুসুমগুচ্ছ। নাহ্, সৌমিক একটা কথা অন্তত ভুল বলেনি। একটা চাকরি বাকরির চেষ্টা করলে মন্দ হয় না। টাকা পয়সার প্রয়োজন তার তেমন নেই, রাখীর মতো ভোঁতা মহিলাও সে নয়, সুতরাং ভবিষ্যৎ অমঙ্গলের আশঙ্কাও সে করে না, কিন্তু পেটের বিদ্যেটাকে কাজে লাগাতে ক্ষতি কী? কেন সে রাখীর মতো পরজীবী হয়ে থাকবে? তা ছাড়া সত্যি কথা বলতে কি, বোধিসত্ত্ব ফিরে এলেও দয়িতার একাকিত্ব কি পুরোপুরি ঘুচবে? সংসারের কাজ আর কতটুকু, এই তো এখনই গোটা দিন ফাঁকা হয়ে যাবে…। দয়িতার পলকের জন্য মনে পড়ল, বার্লিন যাওয়ার আগে অষ্টপ্রহর পড়াশুনোয় ডুবে থাকত বোধিসত্ত্ব, দয়িতাকে প্রায় কাছেই ঘেঁসতে দিত না…। তখনই কি কম নিঃসঙ্গ লেগেছে দয়িতার? যা খ্যাপা উদাসীন মানুষ, ওর পাশে পাশে থাকতে গেলে বোধহয় নিজের একটা ভুবন গড়ে রাখাই ভাল।
ভাবনাটা ঝট করে দয়িতার মনে ধরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা উদ্যম এসে গেছে। জন্মদিনটা বৃথা যায় কেন, আজ থেকেই নয় চেষ্টা শুরু হোক।
খেয়ে উঠেই দয়িতা খবরের কাগজ নিয়ে বসল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে কর্মখালির বিজ্ঞাপন। চার পাঁচ দিনের পুরনো কাগজও বার করে ঘাঁটছে। শুধুমাত্র বি এসসি অনার্স কোয়ালিফিকেশানে কী কাজ জুটতে পারে? চাকরির বাজার এখন বেশ খারাপ, তাও দু-একটা উৎসাহব্যঞ্জক বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল দয়িতার। স্মার্ট, মুখে ইংরিজিতে খইফোটা রিসেপশনিস্ট চাই। সপ্রতিভ সুশ্রী সেলস্গার্ল। প্রাইভেট স্কুলে লিভ ভেকেন্সিতে শিক্ষয়িত্রী…। চোখ কান বুজে সব কটাতেই দরখাস্ত ঠুকে দেবে দয়িতা? আজই?
কটা দিন হুটোহুটি করে কেটে গেল। দয়িতা আবেদনপত্র টাইপ করাচ্ছে, আর ছাড়ছে। একদিন টুপ করে অফিস পাড়ায় ঘুরে এল। নাম লিখিয়েছে চাকরি দেওয়ার সংস্থায়। এজেন্সি অবশ্য খুব আশার কথা শোনায়নি, কম্পিউটার না জানলে তাদের মাধ্যমে কাজ পাওয়া কঠিন। শুনেই এদিক ওদিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ছুটল দয়িতা। ভর্তি হবে কি না ভাবছে।
এরই মধ্যে এক অভিনব চমক। একটা অবশ্যম্ভাবী ঘটনার আগাম বার্তা পেল দয়িতা।
কদিন ধরেই দয়িতার মনে সন্দেহটা দানা বাঁধছিল। সময় পেরিয়ে গেল, পিরিয়ড হয় না কেন? গা গুলোনো ভাবও আসছে একটা, কিছু খেতে ইচ্ছে করে না…! কী করবে এখন? ডাক্তারের কাছে ছুটবে? একাই? নাকি বোধিসত্ত্ব আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে?
ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা বাড়ছিল দয়িতার। সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলও। শেষমেষ আর তর সইল না, ছুটেছে ডাক্তারের কাছে। টেস্ট মেস্ট হল। দয়িতার অনুমানই সঠিক, রিপোর্ট পজেটিভ।
নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক অনির্বচনীয় অনুভূতিতে ছেয়ে গেল দয়িতা। আনন্দ আনন্দ আনন্দ, বুকের মধ্যে উথলে উঠছে খুশি। প্রফেসার বোধিসত্ত্ব মজুমদারের সন্তান ধারণ করার সৌভাগ্য পেয়েছে সে, ভাবা যায়! তার শরীরের অভ্যন্তরে, তারই শরীর থেকে প্রাণরস নিয়ে ভূমিষ্ঠ হবে এক আগামী বোধিসত্ত্ব! ছেলে কেন, মেয়েও হতে পারে। তা সে যাই হোক, তার আর বোধিসত্ত্বর সন্তান নিশ্চয়ই সাধারণ কেউ হবে না! আহা রে, সূর্যদেবের তেজ ধারণ করে কুন্তীরও কি এই পুলক জেগেছিল।
দয়িতার মনের উচ্ছলতা অবশ্য নিরবচ্ছিন্ন হল না। সুখের মাঝেও ছোট ছোট কাঁটা ফোটে কেন? হঠাৎ হঠাৎ? রাখীর সঙ্গে বিচ্ছেদটা যদি না ঘটে, তা হলে…? তখন দয়িতার সন্তানের পরিচয় কী হবে? বিজ্ঞানী বোধিসত্ত্ব মজুমদারের অবৈধ…? এ কার অসম্মান? বোধিসত্ত্বর? দয়িতার? না সেই অনাগত সন্তানের? সে যদি তখন দয়িতার দিয়ে তর্জনী তুলে বলে, তোমরা নিজের সুখ খুঁজছিলে বেশ করছিলে, আমায় পৃথিবীতে আনলে কেন? সমাজের তো একটা নিয়ম আছে, আইন আছে…! তুৎ, হু কেয়ারস? দয়িতা কবে সমাজ মেনেছে? আর রাখী তো কনটেস্ট করছেই না, বোধিসত্ত্ব তো বলেই গেল! না জেনেই বলেছে অবশ্য। স্রেফ আন্দাজ। মনে হয় আন্দাজটা সত্যি। না হলে খোরপোশের টাকা প্রত্যাখ্যান করে রাখী? খুব তেজ মহিলার, ভাঙবে তবু মচকাবে না! পরশু দুপুরে ফোন করেছিল সৌমিক, হাই হ্যালো করছিল, এর পর যেদিন রিং করবে, খবরটা সৌমিককে শুনিয়ে দেবে দয়িতা। যাক, রাখীর কানে পৌঁছে দিয়ে আসুক। মহিলা কি চিড়বিড়িয়ে জ্বলবে? ডিভোর্স হোক আর না হোক, রাখী মোটেই আর বোধিসত্ত্ব মজুমদারের স্ত্রী নয়। আশপাশে পাঁচজন এখন দয়িতাকেই বোধিসত্ত্বর বউ বলে জানে। মিসেস দয়িতা মজুমদার। হ্যাঁ, দয়িতা মজুমদার, দয়িতা মজুমদার…
সে দিন অনেক রাত অবধি এই সব কথাই ভাবছিল দয়িতা। ব্যালকনিতে বসে। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে, দয়িতার মনও দুলছে বাতাসে। তীব্র সুখে, চোরা উত্তেজনায়, অচেনা কষ্টে। হঠাৎ মার কথা মনে পড়ছে খুব। কে জানে কেন, নিজে মা হচ্ছে বলেই কি? সৌমিক যদি খবরটা পায়, বাড়িতে কি আর জানাবে না? তখন কি ছুটে না এসে থাকতে পারবে বাবা-মা?
ঘরে ফোন বাজছে। বিদেশের কল, রিং শুনেই বোঝা যায়। পড়িমরি করে দৌড়ল দয়িতা।
—হ্যালো? শুয়ে পড়েছিলে নাকি?
—না না, এই একটু ব্যালকনিতে…। দয়িতার গলায় খুশি মেশানো অভিমান,—অ্যাদ্দিন পর আমায় মনে পড়ল? জানো, পাক্কা এগারো দিন বাদে তুমি ফোন করলে!
—সময় পাচ্ছি কই? সক্কালবেলা হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি, ফিরছি সেই রাত্রে। তখন কলকাতায় রাত দুটো তিনটে। বলেছিলাম না, সন্ধে সন্ধে ফিরতে পারলে করব। আজ ফিরেছি…
দয়িতার অভিমান মুছে গেল। কলকল করে উঠেছে,—এই জানো, আমার একটা দারুণ সুখবর আছে।
—আমারও। ইনফ্যাক্ট, সেটা জানাতেই তোমায়…। হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি চারটে লেকচারের জন্য আমায় কল করেছিল, সেখানে ব্ল্যাকহোলের ওপর পেপারটা পড়লাম। বার্লিনের সেমিনারের চেয়েও এখানে পেপারটা বেশি অ্যাপ্রিসিয়েটেড হয়েছে। রিডসন আর কানিংহাম দুজনেই আমার লেকচার অ্যাটেন্ড করেছিলেন, দুজনেই খুব উচ্ছ্বসিত। বিজ্ঞানী বোধিসত্ত্ব মজুমদারের উৎফুল্ল কণ্ঠ শিশুর মতো উৎফুল্ল,—ওঁরা বলছেন, ক্রিয়েশন অফ ইউনিভার্সের থিয়োরিতে আমার চিন্তা নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। সৃষ্টির আদি মুহূর্তে পৌঁছতে গেলে…
—বুঝেছি বুঝেছি। তুমি বিশ্ব জয় করেছ। এবার আমার খবরটা শোনো। এটাও তোমার সৃষ্টি তত্ত্বে নতুন দিগন্ত…
—আহ, শোনো না সিরিয়াসলি। এখন থেকে আমার কৃষ্ণগহ্বরের তত্ত্বটাকে অস্বীকার করে সৃষ্টির আদি মুহূর্তে কেউ পৌছতেই পারবে না। সব চেয়ে বড় সাকসেস, স্ট্রিং থিয়োরির সঙ্গে আমার আইডিয়ার কোনও বিরোধ নেই। আমি ম্যাথমেটিকালি যেভাবে দেখিয়েছি…
—আমার কথাটা তুমি শুনবে না?
—শুনছি। ভাবো তো, স্বীকৃতিটা আমার দায়িত্ব কতটা বাড়িয়ে দিল! স্পেসের কনসেপ্টটা নিয়ে সবাইকে আবার নতুন করে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। আমাকেও। রাইনফিল্ড বলছিলেন…
—এই, শোনো না…
—আহ, জ্বালালে। বলো।
—আমি প্রেগনেন্ট।
—হোয়াট? প্রায় চিৎকার ঠিকরে এল ফোনে।
—তোমার বাচ্চা আসছে গো। আমাদের সন্তান।
—ও, নো! ও প্রান্ত কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীরব। কয়েক হাজার মাইল দূরত্বের মাঝে নৈঃশব্দ্যের তরঙ্গ ছুটছে। এক সময়ে আবার স্বর শোনা গেল,—আর ইউ শিওর?
—হ্যাঁ। আমি ডাক্তার দেখিয়েছি।…কী, কেমন সুখবর?
আবার ক্ষণিক নীরবতা। তারপর বোধিসত্ত্বর ভারী গলা,—শোনো দয়িতা, আনডিউ কমপ্লিকেশন আমার পছন্দ নয়। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অ্যাবরশন্ করিয়ে নাও। আমি এ মাসের টোয়েন্টিনাইনথ ফিরছি, তার আগেই…
দয়িতা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অফুটে বলল,—কেন?
—আহ্। আর কোনও নতুন প্রবলেম ডেকে আনার দরকার নেই। বোধিসত্ত্ব হুকুমের স্বরে বলল,—জাস্ট গেট রিড অফ ইট।
দয়িতার শরীর শক্ত হয়ে গেল। নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। হৃৎপিণ্ডটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
মাগোঃ।
.
১৯.
—তুই আজ অফিস থেকে ফিরছিস কখন?
—যখন ফিরি। সাড়ে সাতটা, আটটায়।
—অত দেরি? তোর তো ইয়ার এন্ডিং-এর পাট চুকে গেছে! কবিতা ছেলের থালার পাশে মাছের ঝোলের বাটি রাখল। নির্দেশের সুরে বলল,—শোন, আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরবি।
—কেন?
—বলছি যখন, নিশ্চয়ই কারণ আছে।…ফিরলেই দেখতে পাবি।
সৌমিক এতক্ষণে খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলেছে। অফিসের তাড়াহুড়োর সময়ে এই সব হেঁয়ালিবাক্য তার মোটেই পছন্দ নয়। হালকা বিরক্তির স্বরে বলল,—ঝেড়ে কাশো তো।
কবিতা সামান্য ইতস্তত করে বলল—আজ জয়শ্রীরা আসবে।
—কে জয়শ্রী?
—তানিয়ার মা।…তানিয়াও আসবে সঙ্গে।
মুহূর্তে সৌমিক পড়ে ফেলেছে কবিতাকে। আবার সেই খেলা! পুতুলনাচ!
রুক্ষ স্বরে বলল,—তোমায় বলেছি না, আমার আর সম্বন্ধ করতে হবে না?
—তুমি বললেই তো হবে না…। কবিতা ডাইনিং টেবিলের উলটোদিকে বসল,—আমার ছেলের ভালমন্দ আমাকে দেখতেই হবে।
—মা! আই ডোন্ট ফিল লাইক ম্যারিইং।
পলক থমকেছিল কবিতা, পলকেই খরখর করে উঠল,—দেখো সমু, কোনও ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি ভাল নয়। একটা বজ্জাত মেয়ের নষ্টামির জন্য তুমি শুকিয়ে যাবে, এ আমি হতে দেব না।
—আমি শুকিয়ে যাচ্ছি? স্ট্রেঞ্জ!
—মায়ের চোখকে তুই ফাঁকি দিতে পারবি না। কী চেহারা হয়েছে তোর, ছিঃ। চোখের নীচে কালি, কণ্ঠার হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, মুখে হাসি নেই, সব সময়ে অ্যাবসেন্ট-মাইন্ডেড ভাব…এ তো আর অনন্তকাল চলতে পারে না।..তা ছাড়া আমারও তো একটা সাধআহ্লাদ বলে কিছু আছে, না কি?
একটা ক্রোধ প্রজ্জ্বলিত হচ্ছিল সৌমিকের মাথায়। তবু নীরবে বসে রইল। অতি কষ্টে। দয়িতার সঙ্গে বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর প্রথম কটা দিন বেজায় উঠে পড়ে লেগেছিল কবিতা, পারলে তক্ষুনি তক্ষুনি ছেলেকে ছাদনাতলায় পাঠিয়ে দেয়। মাঝে বেশ ঝিমিয়ে গিয়েছিল, এখন আবার নেমে পড়েছে মাঠে। প্রায়শই নতুন নতুন মেয়ের ছবি আসছে বাড়িতে, যখন তখন সৌমিকের সামনে মেলে ধরা হচ্ছে, সৌমিকের অনিচ্ছা উপেক্ষা করেই। এবার কি পাত্রীপক্ষের সশরীরে বাড়িতে আক্রমণ শুরু হল?
নাহ্, আবার একটা যুদ্ধ লড়তে হবে সৌমিককে। কবিতা বসুরায়ের শিক্ষা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি।
সৌমিকের ক্ষণিক নীরবতাকে বুঝি সম্মতি বলে ধরে নিয়েছে কবিতা। নরম গলায় বলল,—তোর কষ্টটা আমি বুঝি রে সমু। অপমানটা তুই ভুলতে পারিসনি, তাই তো? তানিয়াকে একবার দ্যাখ, ও তোর সব দুঃখ ভুলিয়ে দেবে। এ তোর ওই দয়িতার মতো কাঠ-কাঠ অতিদিগ্গজ মেয়ে নয়, অনেক নরম নরম। ঠিক যেমনটি তোর দরকার। চাইলে জিনস পরে তোর পার্টিতেও যাবে, আবার হুকুম করলে তোর পা’ও টিপবে।
সৌমিক বিস্মিত চোখে তাকাল। এই বুঝি আজকাল ভাল বউ-এর কনসেপ্ট? কবিতা আবার বলল,—জয়শ্রী অনেক কড়া ধাতের মেয়ে, মণিদীপার মতো হালহ্যাল ঝ্যালঝ্যাল নয়। মেয়েকে লাই দিয়ে মাথায় তোলেনি জয়শ্রী। আমি তো কথা বলেছি তানিয়ার সঙ্গে…কী সফ্ট, কী বিনয়ী, সর্বদা হাসিখুশি। আর রূপ…
—মা তুমি থামবে?
—ঠিক আছে, তুই স্বচক্ষেই দেখে নিস। বাজিয়ে নিস।
আর পারল না সৌমিক, খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়েছে। বেসিন থেকে সোজা নিজের ঘর। প্যান্টশার্ট পরছে, চুল আঁচড়াচ্ছে, ব্রিফকেস গুছিয়ে নিল। তার মধ্যেই শুনতে পাচ্ছে তানিয়া নামের এক অজানা অচেনা মেয়ের রূপ গুণের বিবরণ। বাসুদেবের গলাও যেন কানে এল। কী যেন বলছে কবিতাকে, স্বরে আরও উচ্ছ্বাস বেড়ে গেল কবিতার।
বাড়ি থেকে বেরনোর সময়ে সৌমিক আবার কবিতার কবলে। হাসি হাসি মুখে কবিতা বলল,—তা হলে ক’টার মধ্যে ফিরছিস?
সৌমিকের ঠোঁটের কোণে একটা হিংস্র হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল। অস্ফুটে বলল, দেখি…
—সাতটা বাজাস না, ওরা কিন্তু এসে যাবে।
হ্যাঁ না কিছুই বলল না সৌমিক। বাতাসহীন বাড়ির বাইরে এসে বড় করে শ্বাস টানল একটা। মুক্তির শ্বাস নয়, যান্ত্রিক দিন শুরু করার আগে অক্সিজেন আহরণ। হাঁটতে শুরু করে ঝলক আকাশ দেখল সৌমিক। কেন যে এখনও ঊর্ধ্বপানে চোখ চলে যায়! আকাশ আজ মেঘলা মেঘলা, ফাঁকে ফাঁকে হালকা নীল। গুমোটটা বেড়েছে, বৃষ্টি হবে কি আজ? হলে বেশ হয়, তুমুল বর্ষণে কত দিন ডোবেনি শহরটা। কল্পচোখে বারিধারা দেখতে পেল সৌমিক। থই-থই জল, ঢেউ দুলছে পথে। মৃতপ্রায় সরীসৃপের মতো টলে টলে এগোচ্ছে গাড়িঘোড়া, আর্তনাদ তুলতে তুলতে। ধূসর হয়ে আসা গাছগাছালি ভিজে ভিজে গাঢ় সবুজ, পাতা বেয়ে জল ঝরছে টুপটুপ। ক্রমশ দয়িতার গভীর চোখের মতো সুন্দর হয়ে যাচ্ছে দিনটা…
সৌমিকের পা আচমকা থেমে গেল। সামনে শেয়ার ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষমাণ মানুষের লম্বা কিউ। ঘাড়ের পিছনে অদৃশ্য বুলডগটার গর্জন। ঘাঁউ।
বিকেল চারটে নাগাদ কাজ থেকে মাথা তোলার ফুরসত পেল সৌমিক। এতক্ষণ যন্ত্রগণকের পরদা অবিরাম রঙের হিল্লোল তুলছিল, তাকে নিষ্প্রাণ করে দিয়ে সৌমিক আড়মোড়া ভাঙল কয়েকটা, হাই তুলল, চোখ চালাল এদিক ওদিক। পাশের কিউবিক্লে কফিতে চুমুক দিচ্ছে নির্মাল্য, আঙুলের ফাঁকে স্যান্ডউইচ। সঙ্গে সঙ্গে সৌমিকের পেটেও খিদের অনুভূতি। মনে পড়ে গেল আজ টিফিনটাও করা হয়নি।
ক্যান্টিন যাবে, না খাবার আনিয়ে নেবে ভাবতে ভাবতে সৌমিত্র এসেছে পাশের কিউবিকলে। খেতে খেতে কাজ করতে থাকা নির্মাল্য কাজ থামিয়ে ঘুরে তাকাল, আয়, বোস।…আমিই একটু পরে তোর কাছে যেতাম।
নির্মাল্য সৌমিকের চেয়ে বছর তিনেকের বড়, প্রায় একই সঙ্গে এখানে চাকরিতে ঢুকেছে, একটা বন্ধু বন্ধু ধরনের সম্পর্কও আছে।
নির্মাল্য বলল,—স্যাটারডে ইভনিং-এ আমার বাড়িতে চলে আয়।
—কেন? কী আছে?
—ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। নির্মাল্য কাঁধ ঝাঁকাল,—একটা গেট-টুগেদার মতো করছি। অফিসের জনা পাঁচ-ছয়, আর কয়েকজন ক্লোজ রিলেটিভ।…আসবি তো?
—ও, শিওর। সৌমিক নির্মাল্যর হাতের স্যান্ডউইচের দিকে তাকাল। খিদে বেড়ে যাচ্ছে। আলগাভাবে বলল,—এটা তাদের কত নম্বর অ্যানিভার্সারি যেন? থার্ড?
—ফোর্থ।
—দেখতে দেখতে তোদের বিয়ের চার বছর হয়ে গেল?
—হল না? গুড্ডুরই অগস্টে তিন হবে…কী ফাস্ট যে দিন যায়! এবার ওর স্কুলের জন্য ছোটাছুটি শুরু হবে। দেখি, কোথায় কত ডোনেশান হাঁকছে।
—তুই একেবারে পুরো সংসারী বনে গেছিস!
—না বনে উপায় আছে? একে বলে ঠেলার নাম বাবাজি। বিয়ে-শাদি হোক, তুইও টের পাবি। নির্মাল্য স্যান্ডউইচ শেষ করে হাত ঝাড়ছে,—বাই দা বাই, একটা অ্যাডভাইস দে তো। মানে সাজেশান আর কি!
—কী ব্যাপার?
—মিমিকে কী প্রেজেন্ট করা যায় বল তো?
সৌমিক ফাঁপরে পড়ল। মাথা চুলকে বলল, একটা শাড়ি ফাড়ি দে।
—দূর, ও শাড়ি পরেই না।
—তা হলে সালোয়ার কামিজ।
—আমার সঙ্গে ওর টেস্ট মেলে না।
—ভাল পারফিউম…
—লাস্ট ইয়ারে পারফিউম দিয়েছি। এক জিনিস রিপিট করব?
—তা হলে একটা গয়না-টয়না কিছু…
—একটু আনইউজুয়াল কিছু ভাব না। এমন কিছু যা দেখে চমকে যাবে।
দু-চার সেকেন্ড ভাবল সৌমিক, কিছুই মাথায় এল না। অপ্রতিভ মুখে বলল, ট্র্যাডিশনাল কিছু দে না। বউকে চমকাতে চাইছিস কেন?
—চমকটা খুব এসেনশিয়াল রে। লাইফটা বড্ড ড্র্যাব হয়ে গেছে। দিস চমক উইল রিনিউ দা রিলেশান্শিপ।
—সে কী রে? মাত্র চার বছরেই…?
—চার বছর কী কম? হেল অফ আ টাইম।
—তোদের না কোর্টশিপ ম্যারেজ? মাত্র কদিনেই প্রেম উবে গেল?
—তা কেন? প্রেম প্রেমের জায়গায় আছে। কিন্তু রুটিন লাইফ মানেই মনোটনি। নিস্তরঙ্গ। এই অকেশানগুলোকে ঢেউ হিসেবে ইউজ করতে হয়।…নে নে, বল কিছু।
একটু চিন্তা করে ঠোঁট ওলটালো সৌমিক, নো আইডিয়া।
—দূর, তুই একটা যাচ্ছেতাই। ভাবলাম ব্যাচেলারের কাছ থেকে কোনও স্ট্রেঞ্জ টিপস পাওয়া যাবে…। বলতে বলতে হঠাৎ চোখ মুখ উদ্ভাসিত নির্মাল্যর,—আমার একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে।
—কী আইডিয়া?
—যদি মিমিকে একটা কাকাতুয়া উপহার দিই?
—বিবাহবার্ষিকীতে কাকাতুয়া?
—হ্যাঁ, ও তো পাখিটাখি ভালই বাসে।…পেয়ে চমকাবে না! খুশি হবে না? মিমি ভি খুশ, গুড্ডু ভি খুশ…।
সৌমিক হাঁ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। বিবাহবার্ষিকীতে এবার থেকে কি পশুপাখি বিনিময় শুরু হবে? মিমি হয়তো নির্মাল্যকে চমকে দেওয়ার জন্য কোনও কুকুর-টুকুর…লাসা ড্যাশান্ড কিংবা ছোটখাটো নেকড়ে টেকড়ে…! কোনদিকে যাচ্ছে ভালবাসা? সম্পর্ক? একে টিঁকিয়ে রাখতে কী প্রয়োজন উত্তেজনাময় চমকের?
ফোন বাজছে নিজের টেবিলে, দৌড়ে লক্ষ্মণরেখায় ফিরল সৌমিক।
—সৌমিত্র বসুরায় স্পিকিং।
—টিফিন করেছিস সমু?
ওফ, কবিতা বসুরায়! সৌমিত্র সতর্ক স্বরে বলল,—করেছি।
—কী খেলি?
—স্যান্ডউইচ কলা ডিম।
—গুড। টাইমলি ফিরছিস তো?
ফোন রেখে দাঁত কিড়মিড় করল সৌমিক। হুঁহ্, দেখাচ্ছি! থাক বসে। মুনিয়া হল না, এখন তানিয়া! যত্ত সব। এও কি মা’র গুরুদেবের ক্যান্ডিডেট? হতেই পারে। হওয়াই সম্ভব। গুরুদেবের স্যাংশান ছাড়া কি মা নতুন স্যাম্পল এনে ঢোকাবে বাড়িতে? হা হা, লালজিবাবা বলেছিল দয়িতা-সৌমিক রাজযোটক! এখন কী বলছে লোকটা? কঙ্খলে বসে ঢপের কীর্তন গাইছে, আর ঢুলুঢুল চোখে গঙ্গার শোভা দেখছে? এই তানিয়া সম্পর্কেও নিশ্চয়ই ওরকম একটা কিছু অভিমত দেবে লালজিবাবা? শালা।
পেটে আবার জোর মোচড়। খিদে। বড্ড ঘনঘন খাওয়ার অভ্যেস গড়ে দিয়েছে কবিতা বসুরায়! ক্যান্টিনে গিয়ে আজ ইচ্ছে করেই স্যান্ডউইচ নিল না সৌমিক, টোস্ট আর স্টু খেল। অনেকক্ষণ পর আহার্যের কণা প্রবেশ করছে পেটে, বিচিত্র এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে সর্বাঙ্গে। ঝিমঝিমে। মাদক। চোখ জড়িয়ে আসতে চায়। কস্মিনকালে যা করে না সৌমিক তাই করল আজ। কালো কফি খেল এক কাপ। কষটে ভাবটা বেশ লাগল, চনমনে হচ্ছে শরীর।
আবার যন্ত্রমানব হয়ে যন্ত্রগণকের সামনে বসা। বিল ভাউচার সুদের হিসেব। অক্ষরের নড়াচড়া। অনন্ত প্রবহমান সংখ্যার দিকে তাকিয়ে থাকা। বাইরে একটা বিকেল জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে, মরে যাচ্ছে, কাজে ডুবে আছে সৌমিক। সাতটা অবধি অফিসে থাকতেই হবে আজ। তারপর…? তারপর…?
—আসতে পারি?
সৌমিক চমকে তাকাল। কিউবিকলের প্রবেশ মুখে বাবুয়া!
—আরে আরে, কী খবর? তুমি?
—এলাম। বাবুয়া যেন ঈষৎ আড়ষ্ট,—ডিসর্টাব করলাম?
—না না, সে কী? এসো এসো। সৌমিক হাত বাড়িয়ে সামনের চেয়ারটা দেখাল বাবুয়াকে,—হঠাৎ কোত্থেকে?
—আজ পরীক্ষা শেষ হল…আপনার ব্যাঙ্কের নামটা মনে ছিল…ভাবলাম একটু দেখা করে যাই। অবশ্য আপনাকে পাব ভাবিনি।
—কেন?
—ছটা বেজে গেছে তো।…তাও একটা চান্স নিলাম।
—বেশ করেছ। সৌমিক চেয়ারে হেলান দিল, আমি সাতটা সাড়ে সাতটা অবধি থাকি। বিদেশি ব্যাঙ্ক তো, এখানে দশটা পাঁচটার বাঁধা গত চলে না।…যাক গে যাক, প্রথম দিন আমার অফিসে এলে, কী খাবে বলো?
—কিছু না।
—তা বললে হয়! পরীক্ষা দিয়ে আসছ…
—বিশ্বাস করুন, একটুও খিদে নেই। হল থেকে বেরিয়ে টিফিন করেছি। পেট এখনও গজগজ করছে।
—সত্যি বলছ?
—অপ্রয়োজনে মিথ্যে বলব কেন?
সৌমিক হেসে ফেলল। ছেলেটার এই তীক্ষ্ণ ঋজু ভঙ্গিটা খুব ভাল লাগে তার। খাওয়া নিয়ে পীড়াপীড়ি করল না আর, হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল,—তারপর? তোমার পরীক্ষা কেমন হল?
—সো সো।
—কী রকম এক্সপেক্ট করছ?
—ম্যাক্সিমাম ফিফ্টি ফাইভ পারসেন্ট।
—বাহ বাহ। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির স্ট্যান্ডার্ডে তো বেশ ভালই।…তা হলে এবার পার্ট-টু নিয়ে লেগে পড়ো। দ্যাখো, পারসেন্টেজ আরও ওঠানো যায় কিনা।
বাবুয়া ক্ষণকাল চুপ। আলগা চোখ বোলাচ্ছে চতুর্দিকে। হঠাৎই একটু উদাসীন স্বরে বলল,—পার্ট-টু আর দেবই না।
—সে কী! কেন?
—কী হবে? গ্রাজুয়েট তো হয়েই যাচ্ছি। বাবুয়া একটা বড় করে শ্বাস নিল,—আমি এখন চাকরি করতে চাই সৌমিকদা।
বাবুয়ার স্বরভঙ্গি খট করে কানে বাজল সৌমিকের। সৌমিকদা ডাকটাও।
সৌমিক চোখ সরু করে তাকাল,—কী ব্যাপার বলো তো? এখনই চাকরির কথা ভাবছ কেন?
—আমি মাকে নিয়ে আলাদা থাকতে চাই।
সৌমিক সামান্য থমকাল,—মামার বাড়িতে কিছু সমস্যা হচ্ছে?
বাবুয়া একটু সময় নিয়ে বলল,—সমস্যা বলতে আপনি যা ভাবছেন সেরকম কিছু নয়। আমার মামা-মামি মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভাল। আমাকে স্নেহ করেন, মা’র প্রতি রেসপেক্ট আছে, আমাদের যত্নআত্তিও করছেন খুব। তবুও…
—তবু কী।
—ও আপনি বুঝবেন না। আমাদের অবস্থায় তো আপনি পড়েননি! বাবুয়ার গলা খাদে নেমে গেল। হালকা শ্বাস ফেলে বলল,—আফটারঅল আশ্রিতের জীবন…
কথাটা যেন কোনও গোপন তন্ত্রীতে আঘাত করল সৌমিকের। কয়েক সেকেন্ড বাবুয়াকে নিষ্পলক দেখল সে। কয়েকদিন দাড়ি কামায়নি বাবুয়া, অল্পবয়সী মুখে একটা রুক্ষ ভাব ফুটে উঠেছে, কিন্তু চোখের কোণে দুঃখের আভাস, যা ওই তেজীয়ান মুখমণ্ডলের সঙ্গে এক্কেবারে বেমানান। ভেতরে ভেতরে একটা ঝড় চলছে বাবুয়ার, স্পষ্ট বোঝা যায়। এই বয়সেই ঝোঁকের মাথায় উলটোপালটা সিদ্ধান্ত নেয় মানুষ।
সৌমিক নরম স্বরে বলল,—আশ্রিতের জীবন বলছ কেন? মামারবাড়িতে তো তোমার মা’র কিছু ন্যায্য অধিকার আছে, সেই সূত্রে তোমারও।
—অধিকার? বাবুয়ার কণ্ঠস্বর বিষণ্ণ হয়ে গেল,—অধিকার শব্দটা বড় ফাঁপা সৌমিকদা। আমাদের এখন কোত্থাও কোনও অধিকার নেই।
—এ তোমার অভিমানের কথা। বারাসতের বাড়িতে তোমাদের ডেফিনিটলি রাইট আছে, শেয়ার আছে…
—আমাদের প্রকৃত অধিকারের জায়গাটাই কুটোর মতো ভেসে চলে গেল, এখন মামার কাছে রাইট শেয়ার ফলাব? বাবুয়া জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল, ও আমি পারব না সৌমিকদা।…দেখছি তো, মা সর্বক্ষণ কেমন সিঁটিয়ে থাকে, কাউকে কোনও কথা জোর দিয়ে বলতে ভরসা পায় না…। মামা-মামি কারণে অকারণে বাবার নিন্দে করে, সমালোচনা করে, টিজিং রিমার্ক করে…। করতেই পারে। বাবা যা কাজ করেছে তাতে করাটাই স্বাভাবিক। হয়তো এর থেকে বেশি ঘৃণাই বাবার প্রাপ্য। কিন্তু সেগুলো শুনে মা’র যে মনে কোথায় বাজে…! না সৌমিকদা, আমি আর ওখানে থাকতে পারব না।
বাবুয়ার কথাগুলো বুঝতে চাইছিল সৌমিক। বাবার ওপর বাবুয়ার যতই বিদ্বেষ থাক, বাবার উদ্দেশে ছোড়া কটূক্তিগুলো কোথায় যেন বিঁধছে বাবুয়াকে। বাবার কৃতকর্মের জন্য কি হীনমন্যতায় ভুগছে ছেলেটা? স্বামী গরবে এক সময়ে খুব গরবিনী ছিল রাখী, এখন স্বামী-পরিত্যক্তা নারী হয়ে ভায়ের বাড়িতে অবস্থান রাখীর কাছে দুঃসহ মনে হতেই পারে।
তবু যেন বাবুয়ার মনোগত বাসনাটাকে সমর্থন করতে পারল না সৌমিক। বলল,—তো কী করতে পার তুমি?
—ওই যে বললাম, মা’কে নিয়ে আলাদা হয়ে যাব, একটা চাকরিবাকরি জুটিয়ে নেব…যেমন করে হোক দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থেকে আমি আর আমার মা জীবন কাটাব। এতক্ষণে বাবুয়ার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল,—দেখবেন সৌমিকদা, আমি কিছুতেই হারব না। মাথা তুলে আমি দাঁড়াবই। সাম ডে অর আদার। এই গোটা পৃথিবীটাকে..অন্তত বোধিসত্ত্ব মজুমদারকে বুঝিয়ে দেব, তার কণামাত্র ভিক্ষে ছাড়াই শুদ্ধসত্ত্ব মজুমদার তার মা’কে নিয়ে সসম্মানে বেঁচে থাকতে পারে।
একটু বুঝি চড়ায় উঠে গিয়েছিল বাবুয়ার স্বর, সৌমিক ঝটিতি একবার চারদিকে দেখে নিল। অফিসে লোক কমে এসেছে, বেশিরভাগ কিউবিক্লই খালি, যারা আছে কেউই এদিকে তাকাচ্ছে না। ফাঁকা হলঘরে ঠাণ্ডা মেশিনটাকে এখন চড়া লাগে। শীত শীত করছে বেশ। সহসা ফোন বেজে উঠল। অভ্যাসমতো হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল সৌমিক। কার ফোন অনুমান করতে পারছে। বেজে বেজে ক্লান্ত হয়ে এক সময়ে নীরব হল দূরভাষ-যন্ত্র। চোরা স্বস্তি অনুভব করল সৌমিক। বেচারা তানিয়া!
আবার হঠাৎ বাবুয়ার গলা,—কী সৌমিকদা, পারব না আমি? আপনি কী বলেন?
তক্ষুনি তক্ষুনি জবাব দিতে পারল না সৌমিক। এইমাত্র কবিতা বসুরায়ের আহ্বানকে উপেক্ষা করেছে সে, কিন্তু অস্থি মজ্জা মস্তিষ্কে বাসা বেঁধে থাকা সেই কবিতা বসুরায়ই ক্ষণিক কল্পনাবিলাসী সৌমিককে যুক্তি বুদ্ধি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার বোধে বেঁধে ফেলছে এখন।
সোজা হয়ে বসে সৌমিক বলল,—বি প্র্যাক্টিকাল শুদ্ধসত্ত্ব।
—কেন? আমি অবাস্তব কথা কী বলছি? আমি কি একটা চাকরি জোগাড় করতে পারব না?
—তা হয়তো পারবে। কিন্তু কত টাকার? তোমার কোনও কাজের অভিজ্ঞতা নেই, কোনও টেকনিকাল কোয়ালিফিকেশন নেই, পড়াশুনোও করছ জেনারেল লাইনে…। চাকরির যা বাজার, বড়জোর সেলস টেলসে কিছু জুটবে। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে বড়জোর দু চার হাজার। তাতে তোমাদের চলবে?
—চালাতে হবে।
—ভদ্র পরিবেশে এখন একটা ঘরের ভাড়া কত জানো? দুটো মানুষের সংসার চালাতে কত খরচ হয় তোমার আন্দাজ আছে?
—তেমন হলে বস্তিতে গিয়ে উঠব। নুনভাত খেয়ে থাকব।
হুঁহ্, নুনভাত খেয়ে থাকব! দুধেভাতে থাকা ছেলে তো, সত্যি সত্যি নুনভাত খেয়ে থাকা যে কী জিনিস তা জানে না। মা’কে নিয়ে বস্তিতে তুললে একটা ক্যাডাভারাস কাণ্ড হবে, সাত দিনের মধ্যে পালাই পালাই রব তুলবে, কেঁদে কূল পাবে না। ছেলেটা একেবারে পুরো খ্যাপা হয়ে গেছে।
মুহূর্তের জন্য বোধিসত্ত্বের ওপর ভয়ঙ্কর রাগ হল সৌমিকের। কী নিষ্ঠুর লোক! কী অবলীলায় বউ ছেলেকে ভাসিয়ে দিল! দিব্যি সুন্দর একটা বৃত্তাকার জীবন হতে পারত ছেলেটার, সব কিছু এমন তালগোল পাকিয়ে গেল! শালা বিজ্ঞানী যে কী করে এমন ইর্যাশনাল হয়!
নিজেকে সামলে নিয়ে বাবুয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করল সৌমিক,—দ্যাখো শুদ্ধসত্ত্ব, মাথাগরম কোরো না, হুইম্সে চোলো না। টেক মাই সাজেশান, কটা বছর বারাসতেই দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকো। মনে করো এটা তোমার জীবনভর লড়াই-এর প্রস্তুতি। আলাদা যদি থাকতেই হয়, মামাকে বলে তোমার মা’র অংশ বুঝে নাও, সেখানে স্বাধীনভাবে থাকো।
পরামর্শটা একেবারেই মনঃপূত হয়নি বাবুয়ার। তীব্র দৃষ্টিতে দেখছে সৌমিককে। অস্থিরভাবে বিড়বিড় করে উঠল,—আপনি এ কথা বলছেন সৌমিকদা? আপনি?
—অন্যায় কি বলেছি?
—আপনার কাছে আমি এ কথা শুনব বলে আসিনি। ভেবেছিলাম হয়তো আপনি আমার সিচুয়েশনটা ফিল করতে পারবেন।
বলতে বলতে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে বাবুয়া। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল কিউবিক্ল ছেড়ে। একটি বারও আর পিছন ফিরে তাকাল না।
সৌমিক মাথা নিচু করে বসে আছে। নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগছে হঠাৎ। চুপচাপ থাকলেই বোধহয় ভাল হত। ছেলেটা কেন এসেছিল সৌমিকের কাছে? চাকরির কথাই পাড়তে এসেছিল? কিন্তু সৌমিকের কাছে কেন? আশা করেছিল সৌমিক তাকে সাহায্য করবে? কেন যে সহসা ঘোর বাস্তববাদী হয়ে উঠল সৌমিক? রোটি কাপড়া মকানের বাইরেও জীবনে তো কিছু আছে, না কী? কুয়াশার ওপারের পৃথিবী। নাহ্, বাবুয়ার আবেগকে বোধহয় আর একটু সহানুভূতির চোখে দেখা উচিত ছিল।
ম্রিয়মাণ মুখে লিফট ধরে নীচে নেমে এল সৌমিক। বাইরে এখন গাঢ় সন্ধে। বিশ্রী গুমোট। যানবাহনের কর্কশ ধ্বনি চিরে দিচ্ছে কানের পরদা, বিজবিজ করছে নাগরিক কোলাহল। সৌমিক এখন যাবে কোথায়? কবিতা বসুরায়ের গুহায় ফিরবে? অসম্ভব। কোনও পুরনো বন্ধুর বাড়ি? দীপঙ্কর, শুভ্র কিংবা রাতুল…? ভাল লাগছে না। তা হলে কোথায়?
আকাশকোণে বিদ্যুৎ চমকাল। মনকে যে খাতে ঘোরাতে চায় না সৌমিক, সেদিকেই ঘুরে গেল ভাবনা। দয়িতার কাছে গেলে কেমন হয়? এর মধ্যে দয়িতাকে বার কয়েক ফোন করেছে সৌমিক, দয়িতা একবারও তাকে যেতে বলেনি। শেষ দিন তো ভাল করে কথা পর্যন্ত বলল না। আজ উপযাচক হয়ে বাবুয়ার কথা শুনিয়ে আসবে? বলবে, দ্যাখো, কোন দিকে ঠেলে দিয়েছ একটা ভাল ছেলেকে? রাখীর কথা পাড়তেই সেদিন বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল দয়িতা, বোধিসত্ত্বের ছেলের নাম শুনলেও নিশ্চয়ই অচঞ্চল থাকতে পারবে না! দু-একদিনের মধ্যেই বোধিসত্ত্ব ফিরছে, নিশ্চয়ই খুশিতে দয়িতা ডগমগ, এখন একটু চোনা ফেলে দিলে কেমন হয়! একটু কাঁটা ফুটুক, কেন দয়িতা শুধু অবিমিশ্র সুখ ভোগ করে যাবে!
প্রতিশোধের লিপ্সায় মুহূর্তের জন্য উদ্দীপিত বোধ করল সৌমিক, পরক্ষণে এক চোরা বিষাদ চারিয়ে গেছে বুকে। রক্তের অন্তর্গত এক বিপন্ন বিস্ময়ের অনুভূতি। সুখ নেই, সুখ নেই, দয়িতাকে যন্ত্রণা দিয়ে সুখ নেই।