০৫. সেকেন্ড পিরিয়ডের পর

০৫.

সেকেন্ড পিরিয়ডের পর ঢং ঢং ঘণ্টা বেজে গেল। এইমাত্র খবর এসেছে কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ হরেন শাসমল মারা গেছেন, তাঁর আত্মার প্রতি সম্মান জানাতে তড়িঘড়ি কলেজ ছুটি দিয়ে দিয়েছেন প্রিন্সিপাল। এমন উড়ো শোকের ঘটনায় ছেলেমেয়েরা ভারী আহ্লাদিত। এক্ষুনি কোথায় কোন সিনেমা হলে ঢোকা যায় তাই নিয়ে উচ্চৈঃস্বরে আলোচনা চলছে, এক দল নাচতে নাচতে কফিহাউসের দিকে চলে গেল, কেউ কেউ ছুটেছে কমনরুমে টেবিল টেনিস পিটতে। কয়েকজন এখনও উদ্দেশ্যহীন। তারা অলস মেজাজে গজল্লা করছে কলেজের বারান্দায়।

বাবুয়ার দিনটাই বিস্বাদ হয়ে গেল। এখন এই পড়ে পাওয়া সময়টা নিয়ে সে করে কী? বাড়ি ফিরবে? ফেরা যায়। নয় ফিরে শুয়েই রইল সন্ধে পর্যন্ত। কিন্তু তার অসুবিধে বিস্তর। দাদু কাকিমাকে হাজার কৈফিয়ত দিতে হবে, বাবুয়ার যা একদম পছন্দ নয়। আরও সমস্যা আছে। সকাল থেকে বাবুয়ার আজ একটু গা ম্যাজম্যাজ, এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আর দেখতে হবে না, জ্বর আসবেই। শীতের শুরুতেই বাবুয়া ভোগে বেশি, এ সময়ে আলস্য দেখিয়ে শরীরকে অকারণ উদ্ব্যস্ত না করাই ভাল। অবশ্য হাঁটতে হাঁটতে কলেজ স্কোয়ার চলে যেতে পারে বাবুয়া। কয়েকটা বুড়ো সেখানে ভারী মন দিয়ে তাস খেলে, তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে বাবুয়ার মন্দ লাগে না। কথায় কথায় খুব ঝগড়া করে বুড়োগুলো, স্পেড হার্টস ক্লাব ছাড়া আর কিছু তাদের জগতেই নেই…কী অদ্ভুত!

আর একটা কাজও করতে পারে বাবুয়া। ধীরে সুস্থে রওনা দিতে পারে বাড়ির দিকে। হেঁটে হেঁটে। আগেও একদিন গিয়েছে, বেশ লেগেছিল। একটার পর একটা পাড়া, একটার পর একটা জায়গা পেরিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, ক্রমশ শহরটা বদলে যাচ্ছে…। মানে ঠিক শহর নয়, শহরের টোপোগ্রাফি, আশপাশের লোকজন। ঘিঞ্জি বউবাজার পেরিয়ে মুসলিম জোন, তারপর অ্যাংলোইন্ডিয়ান পাড়া, তারপর শুধু অফিসের জঙ্গল…। বাড়িঘরের আকৃতি পালটে পালটে যাচ্ছে, রাস্তাঘাটেরও। গন্ধও যেন বদলে বদলে যায়। কোথাও বাজারের বিশ্রি পচা দুর্গন্ধ, কোথাও চাঁপ বিরিয়ানির সুঘ্রাণ, কোথাও বা কাঠের ফার্ণিচারের বার্নিশ-ঝাঁঝ। অফিস পাড়ায় কোনও গন্ধ নেই। নাকি আছে? এটা মিশ্র গন্ধ, অথবা গন্ধহীন। আবার দক্ষিণে পৌঁছলে অবাঙালি গন্ধ, বাঙালি গন্ধ…।

অল্প অল্প উজ্জীবিত বোধ করছিল বাবুয়া। হ্যাঁ, এটাই বেশ হবে। এখান থেকে বাড়ি অনেকটা পথ। শ্লথ পায়ে হাঁটলে ঘণ্টা দু-আড়াই তো লেগেই যায়। এখন বাজে একটা, পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে তিনটে। তখন নো জেরা, নাথিং। কলেজের শেষ ক্লাসগুলো বেশির ভাগ দিনই হয় না, বাড়ির লোকরা জানে।

বাবুয়া নোটখাতা গুছিয়ে কলেজের গেট দিয়ে বেরোচ্ছে, ইউনিয়নের তিন চারটে ছেলে এসে ধরল,—অ্যাই, কাল আসছিস তো?

বাবুয়া দাঁড়িয়ে গেল,—হ্যাঁ, কেন?

—পোস্টার দেখিসনি? কাল মিছিল আছে।

—ও, হ্যাঁ…। তো?

—তো কী রে? বিশাল র‍্যালি করতে হবে কাল। জিনস পাঞ্জাবি পরা একজন এগিয়ে এল। আলগা হাত রেখেছে বাবুয়ার কাঁধে,—ইরাকে মার্কিন হানাদারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এ তো আমাদের কর্তব্য।

—আমি মিছিলে যাব না। বাবুয়া শান্ত স্বরে বলল।

—কেন জানতে পারি?

—ইচ্ছে।

—তাহলে কি ধরে নেব তুই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করিস?

—তা তো বলিনি।…মিছিলে না যাওয়া মানেই কি সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করা?

—আমরা তাই বুঝি।

—ভুল বোঝো। বাবুয়া আলতো করে কাঁধ থেকে ছেলেটার হাত নামিয়ে দিল।

এগোচ্ছিল, ছেলেটার কথা কানে এল,—দেখব কাল বুকনি কোথায় থাকে! কেমন না যাস!

আরেকটা গলা ভেসে এল,—কেন ইনডিভিজুয়াল অ্যাপ্রোচ করছিস? কাল গেট আটকে দেব। তারপর সব কটাকে লাইন দিয়ে বার করব।

বাবুয়া ঘুরে দাঁড়াল,—কাজটা কি মার্কিন হানাদারির চেয়ে আলাদা কিছু? নিজেদের ইচ্ছে জোর করে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাকে কী বলে? বলে একটু থামল। হাসল,—তোমরা যদি আমেরিকার জায়গায় থাকতে তা হলে ইরাক কেন, গোটা পৃথিবীটারই অস্তিত্ব থাকত না।

কথাটার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে দু-এক সেকেন্ড সময় লাগল ছেলেগুলোর। তারপরই রে রে করে তেড়ে এসেছে,—কী বললি তুই? আমরা সাম্‌মাজ্যবাদী?

—উহুঁ। বলছি, অনর্থক জোর ফলানোটা উচিত কাজ নয়। মহৎ আদর্শের ধ্বজা উড়িয়ে করলেও নয়। বাবুয়ার হাসি ঈষৎ প্রসারিত হল। নরম স্বরে বলল,—মিছিল আমার ভাল লাগে না, ভাই। নিজেকে কেমন ভেড়ার পালের একজন বলে মনে হয়।

ছেলেগুলো মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে, একটু বুঝি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বাবুয়া আর দাঁড়াল না। হাঁটা শুরু করেছে। ক’পা যেতে না যেতেই তমাল। পাস-কোর্সের ছেলে, গত বছরই বাবুয়ার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, হিস্ট্রির ক্লাসে। শ্যামলা রং, রোগাসোগা চেহারা, মুখে সামান্য চোয়াড়ে ভাব আছে। টি এস বি নিখাদ বাংলাতেই ইতিহাস পড়ান, শুনতে শুনতে ইংরিজিতে রানিং নোটস নেয় বাবুয়া, দেখে তমাল ভারী অভিভূত হয়েছিল। পথেঘাটে ক্লাসে করিডরে যেখানেই মুখোমুখি হোক, দু পাঁচ দশ মিনিট বাবুয়ার সঙ্গে থাকবেই তমাল। এমন গুণমুগ্ধ, একটু স্তাবক ধরনের বন্ধুই বাবুয়া পছন্দ করে। এরা ঠিক বন্ধু হয় না, ভক্তর মতোই থাকে, হয়তো সেই জন্যই। স্কুলে পড়ার সময়ে টাউনের ছোটকু বিশে পার্থরাও ছিল এই শ্রেণীর। প্রায় লোফার হওয়ার দরুণই বাবুয়ার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। কলকাতায় এসে ওদের অভাব খুব অনুভব করত বাবুয়া, সেই অভাব তমাল কিছুটা মেটায়।

তমাল পান-দোকানের ঝুলন্ত দড়ির আগুন থেকে সিগারেট ধরাচ্ছিল। প্রায় লাফিয়ে বাবুয়ার পাশে এল,—কী ডায়ালগ দিলে গুরু!

বাবুয়া অবহেলার স্বরে বলল,—ডায়ালগ কীসের? যা সত্যি তা তো বলতেই হবে।

—তুমি পারো! আমার তো ওদের দেখলেই হাঁটু কাঁপে।

—ফুঃ, ওদের ভয় পাওয়ার কী আছে? যারা দল বেঁধে জুলুম করে, তারা কক্ষনও সাহসী হয় না।

—না রে, তুই জানিস না, ফার্স্ট ইয়ারের একটা ছেলেকে যা কেলিয়েছে! কী সাবস্‌ক্রিপশন না ডোনেশন দিতে চায়নি…!

—বলার টেকনিক আছে। ফোর্স শুড বি ট্যাকলড্‌ উইথ র‍্যাশনালিটি। উদ্ধত হবে না, কিন্তু মনের ইচ্ছেটা বোল্ডলি জানিয়ে দেবে। উইথ ইওর ওন লজিক।

তমাল ঘটঘট ঘাড় নাড়ল,—ঠিক বলেছিস।…কিন্তু পারি না গুরু। ইউ ক্যান।

তমালের বিচিত্র ইংরিজিতে হেসে ফেলল বাবুয়া। হাঁটতে হাঁটতে তমাল স্টিম ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া ছাড়ছে, বাবুয়ার নাকে মুখে ঢুকে যাচ্ছে ধোঁয়া। ওই গন্ধে তার তীব্র বীতরাগ, সেই শৈশব থেকেই। তার বাবা সিগারেট ছাড়া থাকতে পারে না বলেই কি? বোধ হয়।

ডান হাত নাকের সামনে ঝাপটিয়ে লঘু ধমক দিল বাবুয়া,—অ্যাই, তোকে বলেছি না, আমার সঙ্গে থাকার সময়ে সিগারেট খাবি না?

—সরি গুরু। আর দুটো টান দিয়েই…। তমাল লজ্জিত মুখে হাসল,—চললি কোথায় এখন? বাড়ি?

—আর কোথায় যাব?

—ছুটিটা হয়ে মাইরি হেব্‌বি লাভ হল। সন্ধেবেলা মামাতো দাদার বিয়ে, বরযাত্রীর নেমন্তন্ন, সেই শালকিয়ায়। ভেবেছিলাম বোধহয় আর যাওয়াই হবে না। যাক, পোবলেম সলভ হয়ে গেল।

কী প্রবলেম?

—টিউশনি। বরযাত্রী গেলে টিউশনিটা শালা কামাই হয়ে যেত।

—তুই টিউশনি করিস? বাবুয়া ভীষণ অবাক হল। সে স্বচক্ষে দেখেছে, ইংরিজি দূরস্থান, বাংলাতেও একটি বাক্য শুদ্ধ লিখতে পারে না তমাল। সে কিনা ছাত্রছাত্রী পড়ায়!

তমাল দাঁত ছিরকুটিয়ে হাসছে,—অনেক দিন ধরেই তো পড়াচ্ছি। তোকে বলিনি বুঝি?

—কাকে…মানে কোন ক্লাস?

—ক্লাস থ্রি।

—কী পড়াস?

—অল সাবজেক্ট। বাংলা ইংরিজি ইতিহাস ভূগোল অঙ্ক…

—দ্যায় কত?

—সত্তর।

—মাত্র? কদিন যেতে হয়?

—রোজই। সানডে বাদ।…কাল পরশু দু দিন যাওয়া হয়নি, আজ নাগা করলে টাকা কেটে নেবে।

কথায় কথায় আরও অনেক কিছু জানতে পারল বাবুয়া। তমাল নাকি ইলেভেনে পড়ার সময় থেকেই টিউশনি করছে। লিমিট ওই ক্লাস ফোর। এক সময়ে হাতে নাকি অনেকগুলো টিউশনি ছিল তমালের, ছ সাতটা বাচ্চাকে পড়াত, ইদানীং বাজার মন্দা যাচ্ছে। ওই ছাত্রীটি আছে, আর এক ছাত্র আছে ক্লাস ওয়ানের। দুটো মিলিয়ে একশো কুড়ি। তমালের হাত খরচের অনেকটাই উঠে যায়। তমালের বাবা দমদমের দিকে একটা ওষুধ কারখানায় কাজ করতেন, বছরখানেক হল স্বেচ্ছা অবসর প্রকল্পে বসে গেছেন। তমালের টাকা থেকে দু চার পয়সা সংসারেও ঢোকে। নিয়মিত না হলেও মাঝে মাঝে।

শুনতে শুনতে বাবুয়া বিমোহিত হচ্ছিল। অধম বন্ধুর ওপর এক ধরনের সম্ভ্রম জাগছিল তার। সামান্যতম বিদ্যার পুঁজির সদ্ব্যবহার করে পরিবারের জোয়ালে কাঁধ লাগাচ্ছে তো! এতটুকুনি হলেও নিজের মাটি তো আছে! তুলনায় বাবুয়া কী? একটা প্যারাসাইট ছাড়া কিচ্ছু না। প্যারাসাইটও নয়, টোটাল ননএন্‌টিটি। প্রায় অস্তিত্বহীন এক অস্তিত্ব। যতই বাবুয়া অপছন্দ করুক, সহপাঠীদের পিতৃপরিচয় না জানতে দিক, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে প্রতি মুহূর্তে টের পায় বরেণ্য বিজ্ঞানী প্রফেসার বোধিসত্ত্ব মজুমদারের ছেলে হয়ে থাকাটাই তার ভবিতব্য। বাবুয়া জীবনে যত সার্থকই হোক, লোকে আগে তাকে চিনবে বোধিসত্ত্ব মজুমদারের ছেলে বলে। অসহ্য। পরিবারের একজন কেউ দীপ্যমান হলে বাকি সকলকে তার আলোতেই আলোকিত হতে হবে, এ কেমন কথা? সূর্য আছে বলে কি অন্য নক্ষত্ররা দিনের বেলা মিথ্যে হয়ে যাবে?

বাবুয়া ভেবেছিল কলকাতায় চলে এলে ওই জ্যোতিষ্কের সর্বগ্রাসী আলো থেকে পরিত্রাণ পাবে। হা হতোস্মি, কারা বাস করে লেক টেরেসের বাড়িতে? ওখানে কেউ বা বোধিসত্ত্ব মজুমদারের প্রতিফলিত গরিমায় ডগমগ বাবা, কেউ গরবিনী মা, কেউ বা পুলকিত ভাইঝি। এমনকী কাকা যে কাকা, অত বড় একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির পারসোনেল ম্যানেজার, তারও প্রথম পরিচয় সে বোধিসত্ত্ব মজুমদারের ভাই। এক অতিকায় সার্চলাইটের আলোয় ঝলমল শুধু কয়েকটা সাধারণ মানুষ সকলে। অসহ্য!

নয় নয় করে কলকাতাতেও তো বাবুয়ার দেড় বছর হয়ে গেল, অ্যাদ্দিন সে নিজেই বা কী চেষ্টা করেছে ওই জ্যোতিষ্কের কক্ষপথের বাইরে আসার?

বাবুয়া অন্যমনস্ক ভাবে বলে উঠল,—এ সব টিউশনি তুই জোটাস কোথ্‌থেকে বল তো?

তমাল সিগারেটটা ফুটপাথে ফেলে পা দিয়ে চাপল,—জুটে যায়। কলকাতায় এ কাজটা এখনও মোটামুটি অ্যাভেলেবল।

—তাই বুঝি?…তা দে না আমাকে এক আধটা।

—করবি তুই?

—না করার কী আছে!

—তোর পড়াশুনোর ক্ষতি হবে না?

—বিকেলটা তো আমার ফাঁকাই পড়ে থাকে। তখনই না হয়…। কী রে, চুপ মেরে গেলি কেন? লাইনে কম্পিটিটার ঢুকতে দিতে চাস না?

—না মানে…তোর তো তেমন দরকার নেই।

—কী করে জানলি?

—দেখে যা মনে হয়। তমাল একটু সঙ্কুচিতভাবে বলল।

—সব দেখাটাই সত্যি নয়। মানুষের প্রয়োজনের অনেক লেভেল আছে। কারও পেটের তাড়না, কারও সেরিব্রাল ক্রাইসিস।…ও তুই বুঝবি না।

বউবাজার মোড়ে যানজট। সার সার ট্রাম দাঁড়িয়ে। ঠেলা রিকশা বাস ট্যাক্সি আর মানুষের ভিড়ে চারদিক থই থই। হেলে দুলে রাস্তা পার হল দুজনে। ফুটপাথ ধরল আবার। চরম কোলাহলের মাঝেও বাতাসে এখন ফুলের গন্ধ। দোকানের ফুল।

তমাল বলল,—সত্যিই যদি করতে চাস তো আছে। দুজনকে পড়াতে হবে এক সঙ্গে। ভাই বোন। ছেলেটা নাইন, মেয়েটা সেভেন।

কত দেবে?

—বেশি পারবে না। দুজন মিলিয়ে ধর দুশো। শুধু অঙ্ক আর ইংরিজি।

বাবুয়া দমে গেল একটু। সে তেমন উড়নচণ্ডী স্বভাবের নয়, তার কোনও নেশা নেই, তবু শ’দুয়েক টাকা তার সাপ্তাহিক হাতখরচেই চলে যায়। একটা পছন্দসই বই কিনল, কি একটা দুটো গানের ক্যাসেট…।

ভাবনাটা আসতেই নিজেকে ধমকাল বাবুয়া। সে তো সেই বোধিসত্ত্ব মজুমদারেরই টাকা!

বলল,—কদিন পড়াতে হবে?

—তিনদিন। কথা বলে নিতে পারিস, দুদিনও হতে পারে। আমিই করতাম, আমাকেই ধরেছিল, কিন্তু…অঙ্ক, ইংরিজিটা হেববি বের করে। বিশেষত অ্যালজেব্রা, জিওমেট্রি।

সাবজেক্ট নিয়ে বাবুয়া ভাবিত নয়, যদিও অঙ্কে তার এক চোরা বিবমিষা আছে। সেটাকে অবশ্য আমল দিল না এখন। বলল,—তুই তাহলে কথা বল।

—আজই গিয়ে দেখি চল। তমাল কবজি উলটে ঘড়ি দেখল,—এখন কি পাওয়া যাবে? যেতেও পারে। চল, ট্রাই নিয়ে দেখি।

—কোথায় রে?

—এই তো কাছেই। আমি যেখানে পড়াতে যাই। লেবুতলা পার্কের পাশে।

সুড়ুৎ করে বাঁয়ের গলিতে ঢুকে পড়ল তমাল। জটিল গোলকধাঁধার মতো রাস্তা। গলির গলি তস্য গলি পেরিয়ে একটা নোনা ধরা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। অন্য বাড়িগুলোরও এখানে বয়স অনেক। সত্তর আশি একশো…। ঠাকুমার মাথায় মাখার নারকেল তেলের মতো গন্ধ বাড়িগুলোর গায়ে। এরকম ধরনের পাড়ায় বাবুয়া আগে কখনও আসেনি।

বাড়িটা দেখেও বাবুয়ার বেশ কৌতূহল জাগছিল। জরাজীর্ণ বটে, কিন্তু সামনেই এক প্রকাণ্ড লোহার দেউড়ি। জং ধরা ধরা। দেউড়ি ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই অন্ধকার একটু গলিপথের পর বিশাল এক উঠোন। শ্যাওলা লাগা, ভিজে ভিজে। উঠোনের চারদিক ঘিরে সরু টানা বারান্দা। সেখানে পর পর ঘর। কোনও ঘরের দরজা হাট, কোনওটায় তালা, কোথাও পরদা ঝুলছে। সর্বত্রই মলিন ছাপ, তবু দেখে বোঝা যায় বাড়িটার এক সময়ে সুদিন ছিল। দরজা জানলাগুলো ইয়া বড় বড়, জানলায় আবার খড়খড়ি আছে, দোতলার স্যান্ডকাস্টিং করা রেলিঙে বাহারি কারুকাজ। বারান্দার মেঝেতেও লাল সিমেন্ট, কালো স্কার্টিং করা, এখনও তার প্রাচীন ঔজ্জ্বল্য পুরোপুরি মরেনি।

গোটা কয়েক বাচ্চা ক্যালক্যাল করে ছুটোছুটি করছে বারান্দায়। সামলে সুমলে তাদের কাটিয়ে বাঁ ধারের একটা ঘরের দরজায় গিয়ে গলা খাঁকারি দিল তমাল,—কাকিমা? কাকিমা আছেন?

ফুল ছাপ পরদার ওপারে ঘরঘর সেলাই মেশিনের শব্দ হচ্ছিল। থেমে গেল,—কে?

—আমি। তমাল। মিঠুর মাস্টারমশাই।

মহিলা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। মাঝারি রং, মাঝারি গড়ন, বয়স চল্লিশের আশে পাশে। দেখতে তেমন সুন্দর নয়, তবে একটা আলগা লাবণ্য আছে। চোখ দুটি ভারী উজ্জ্বল, মণির রং কুচকুচে কালো। পরণে আটপৌরে তাঁতের শাড়ি, হাতে শাঁখা পলা নেই, কপালে সিঁদুরও না।

মহিলা কিছু বলার আগে তমাল বলে উঠল,—আপনি বুলটু রিন্‌টির টিউটর খুঁজছিলেন…এই যে এনেছি।

মহিলা শশব্যস্ত,—ও, তাই? আসুন আসুন।

বাইরের মালিন্যের তুলনায় ঘরের ভেতরটা বেশ পরিপাটি। ঘরটাও যথেষ্ট বড়। দেয়াল জানলা বর্ণহীন হলেও সাজানো আসবাব তাদের অনেকটা আড়াল করে দেয়। ডবল বেডের খাট আছে একটা, আলমারি, ড্রেসিংটেবিল, খান কয়েক চেয়ার, মোড়া…। টিভি, ফ্রিজও আছে। এত কিছুতেও ঘরটাকে জবরজং লাগে না।

তমাল একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,—এ আমার ক্লাসমেট। শুদ্ধসত্ত্ব মজুমদার। দারুণ ব্রিলিয়ান্ট ছেলে।

মহিলা হাত জোড় করে নমস্কার করল,—বসুন না, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?

এত আপনি আজ্ঞে, এত নমস্কার টমস্কারে বাবুয়া আড়ষ্ট বোধ করছিল। মহিলা মার বয়সী না হোক কাকিমার বয়সী তো বটেই। বোকা বোকা হেসে বলল,—আপনি আমাকে তুমিই বলুন।

—ওমা ছি ছি, আপনি আমার ছেলেমেয়ের মাস্টারমশাই…। আমার মেয়ের কিন্তু একদম মাথা নেই। ছেলে ভাল, তবে বড় ফাঁকিবাজ। আপনাকে কিন্তু একটু কড়া হতে হবে মাস্টারমশাই।

তমাল বলল,—সে ভাবতে হবে না। শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের ভীষণ সিরিয়াস ছেলে। ওর চোখের দিকে তাকালে বুলটু প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলবে।…আগে যে পড়াত সে কিন্তু বড় ন্যাদোস ছিল কাকিমা। বাচ্চাদের সঙ্গে অত হাহা হিহি করলে বাচ্চারা মানে?

—না না, উনিও ভাল ছিলেন। মহিলা তমালকে থামিয়ে দিল,—আপনারা চা খাবেন তো? বসাই?

বাবুয়া চা খায় না। কিন্তু না বলল না এই মুহূর্তে। মুখে একটু গুরুগম্ভীর ভাব ফুটিয়ে বলল,—স্টুডেন্টরা কোথায়।

—ছেলের ডে স্কুল, চারটেয় ফিরবে। রিন্‌টি কোন ঘরে গেল দেখি। বলতে বলতে দরজায় গিয়ে গলা ওঠাল,—রিন্‌টি, অ্যাই রিন্‌টি?

বার কয়েক ডাকাডাকির পর খুব রোগা একটি মেয়ে দৌড়ে এসেছে। ঘরে ঢুকেই থমকে গেল। জুলজুল চোখে দেখছে তমাল বাবুয়াকে।

মহিলা বলল,—প্রণাম করো। ইনি তোমাদের মাস্টারমশাই।

বাবুয়া দ্রুত পা সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল, তার আগেই মেয়েটা ঢুকুস করে একটা প্রণাম ঠুকে দিয়েছে। তমালকেও করল, তমাল প্রসন্ন মুখে হাত ছোঁয়াল রিন্‌টির মাথায়।

বাবুয়া গলা ঝাড়ল,—কোন স্কুলে পড়ো?

—তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাপীঠ।

—তোমার দাদা।

—বরদাচরণ। আমাদেরই ডে। রিন্‌টি বেশ সপ্রতিভ উত্তর দিচ্ছে।

ঘরের পিছন দিকের ফালি মতো জায়গায় চলে গেছে মহিলা। সম্ভবত ওটাই রান্নাঘর। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চা নিয়ে ফিরে এল। শুধু চা নয়, সঙ্গে অল্প চানাচুর বিস্কুটও এনেছে।

রিন্‌টিকে টুকটাক প্রশ্ন করছিল বাবুয়া। মহিলা জিজ্ঞাসা করল,—কেমন বুঝছেন ছাত্রীকে?

—মন্দ কী! ওকেও একটু খাটতে হবে।

—হাফ ইয়ারলিতে ইংরিজিটা খুব খারাপ করেছে। অঙ্কও ধার ঘেঁষে। ছেলেটা অবশ্য সবেতেই টায়ে টুয়ে পাশ।…ওদের নিয়ে আমার বড় চিন্তা মাস্টারমশাই। ছোট যখন ছিল, নিজেই নিয়ে বসতাম। এখন আর বিদ্যেতেও কুলোয় না, সময়ও নেই।

বাবুয়া চোরা চোখে তমালের দিকে তাকাল। প্রশ্ন জড়ো হচ্ছে মনে। মহিলা কি বিধবা? চাকরি বাকরি করে? তাহলে দুপুরবেলা বাড়িতে কেন?

মহিলা নিজেই কিছুটা উত্তর দিয়ে দিল,—সন্ধেবেলা যে ঘাড় ধরে পড়তে বসাব, তাই বা পারি কই! আমার তো বেশির ভাগ দিনই নাইট ডিউটি, সাড়ে ছটা সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হয়। রাস্তাঘাটে আজকাল যা ভিড় জ্যাম…সেই আলিপুর অবধি যাওয়া…। দিনভর সংসারের কাজকর্মও রয়েছে…।

তমাল কচকচ করে বিস্কুট চিবোতে চিবোতে উদাস মন্তব্য ছুড়ল,—তা ঠিক। আপনার যা খাটুনি যায়…।

—হুঁ। আলগা মাথা নাড়ল মহিলা,—তা মাস্টারমশায়ের সঙ্গে সমস্ত কথাবার্তা হয়ে গেছে তো?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, ও সব ঠিক আছে। তমাল চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বাবুয়াকে চোখ টিপল,—বল কী বলবি বলছিলি? তিন দিন নয়, দু দিন…।

—না না, আমি তিন দিনই আসব। বাবুয়া ঝটপট বলে উঠল,—আমি কিন্তু বিকেলের দিকে আসব। এই ধরুন সাড়ে চারটে পাঁচটা…।

—সেই ভাল। আমি থাকতে থাকতে এলে…। নইলে কে কোথায় কোন ঘরে গিয়ে বসে থাকবে…! আমি বেরিয়ে গেলেই তো সব নাচন শুরু করে দেয়। বিকেল বেলাটাই নয়… আপনি তা হলে সামনের সোমবার থেকেই…

আরও দু চারটে কথাবার্তা বলে বাবুয়ারা উঠে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই নিজের টিউশনিতে গেল না তমাল, মোড়ে এসে সিগারেট ধরাল,—কী গুরু, চলবে তো?

—দেখা যাক। তমালের ধূমপানে বিরক্তি প্রকাশ করল না বাবুয়া। ঠোঁট টিপে বলল,—মহিলার বেশ সেন্স অফ কার্টসি আছে!

—তেজও আছে খুব। মীরা কাকিমাকে এ পাড়ার সব্বাই চমকায়।…কত বড় বংশের মেয়ে জানিস? দুর্গা মল্লিকের নাম শুনেছিস? বিশাল রইস আদমি ছিল। তার নাতনি।

—হুঁ। তা এ দশা কেন?

—গ্রহের ফের। কম বয়সে একটা লক্কা পায়রার সঙ্গে ভেগেছিল। লোকটা হেব্‌বি লুজ ছিল মাইরি। খেত, ঘুমোত, আর এদিক ওদিক মাগিবাজি করে বেড়াত। মীরা কাকিমা অনেক দিন সহ্য করেছে। দু দুটো বাচ্চা হওয়ার পরও যখন শোধরাল না, তখন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে…। বাপের বাড়িতেও যায় না মাইরি। নার্সিং শিখে ছেলেমেয়ে দুটোকে মানুষ করছে। খুব খাটে। বয়স হার্ডলি থারটিফাইভ, এখনও কতটা জীবন স্ট্রাগল করতে হবে বল? তুমি গুরু ওর বাচ্চাদের একটু স্পেশাল কেয়ার নিয়ো।

হেঁটে ফেরার বাসনাটা ঝেড়ে ফেলল বাবুয়া, মৌলালির মোড়ে এসে বাসে উঠল। তিনটে বাজে, বাসে এখনও গাদাগাদি ভিড় হয়নি, জোড়া গির্জার কাছে এসে বসার জায়গাও পেয়ে গেল। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, অঘ্রাণের রোদ্দুর এখন আর তেমন চড়া নয়। থেকে থেকে বাতাস আসছে জানলা দিয়ে। শুকনো, নরম হেমন্তের বাতাস। ভাল লাগছিল।

সদ্য দেখে আসা পরিবেশটার কথা ভাবছিল বাবুয়া। তাদের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারস, কিংবা তাদের লেক টেরেসের বাড়ি, সবের থেকেই একেবারে অন্য রকম। একই বাড়িতে এক সঙ্গে কতগুলো পরিবার, তার আবার একটা মাত্র ঘরে মা ছেলে মেয়ে থাকে খায় শোয়, কোথাও দিয়ে এতটুকু সূর্য ঢোকে না—এভাবেও বেঁচে থাকে মানুষ! নার্সিং করে কত আর রোজগার করে মহিলা? দু হাজার? তিন হাজার? তাই দিয়েও তো দিব্যি মাথা উঁচু করে আছে!

নাহ, তমাল আজ বেশ চমক দিয়েছে!

বাড়ি পৌঁছে আবার চমক। মা। একতলায় দাদু ঠাকুমার ঘরে বসে কথা বলছে, পাশে কাকিমা আর মিলি। আজকে কি আসার কথা ছিল মার? রোববার তো ফোনে কিছু বলল না?

সচরাচর এই ঘরে ঢোকে না বাবুয়া। ঢুকতে ইচ্ছে করে না। কেন কে জানে! দাদু ঠাকুমার দেয়ালে বাবার বিশাল ফোটো, রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছে বাবা, ঘরে পা রাখলেই ওই ছবিতে চোখ চলে যায়, সেই জন্যই কি?

আজ বাবুয়া পায়ে পায়ে দরজায় এল,—তুমি হঠাৎ?

—এলাম। রাখী পূর্ণ চোখে তাকাল,—কিছু কেনাকাটা আছে।

—ও।…থাকছ কদিন?

—দেখি। কাল তো আছিই।

মিলি হই হই করে উঠল,—আসল কথাটা বললে না জেম্মা?…জানো দাদাভাই, জেঠু একটা দারুণ ইনভিটেশান পেয়েছে। বার্লিনে। ওখানে একটা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স হচ্ছে…। কোন মাসে যেন গো জেম্মা?

—মার্চের ফাস্ট উইকে।

—জেম্মাও যাচ্ছে। উইথ ফ্যামিলি ওরা ডাকছে।

—ও।…বাহ্, ভাল খবর। বাবুয়ার স্বর নিস্পৃহ।

দীপালি জিজ্ঞাসা করল,—গেলে কন্টিনেন্ট ট্যুর করে এসো দিদি। তোমার কোথাও তো তেমন যাওয়া হয়নি।

—দেখি, উনি যা মানুষ, নড়তেই চান না। হয়তো বার্লিনেই গেঁথে যাবেন। ওঁর কিছু পুরনো বন্ধুবান্ধব আসবে ওখানে, তাদের সঙ্গে দেখা হবে বলে এখনই বেশ এক্সসাইটেড।

প্রভাবতী প্রশ্ন করলেন,—তোমাদের কত দিনের জন্য যাওয়া বড় বউমা?

অরবিন্দ বললেন,—কদ্দিন আবার কী! বুদ্ধর যদ্দিন ইচ্ছে, তদ্দিন। ও কি কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করেই পালিয়ে আসতে পারবে নাকি? ইউনিভার্সিটিগুলো ওকে ছাড়বেই না।

—সেবার স্টেটসে গিয়ে দাদা চার মাস পরে ফিরেছিলেন, না দিদি?

—চার মাস কোথায়, ছ মাস। বলেছিলেন দু মাসে ফিরব। আমার তখন যা ভাবনা গেছে! একে ঠাণ্ডার জায়গায় গেলেন, তায় শীতকাল…।

বাবুয়ার উপস্থিতি যেন মুছে গেছে। অনুপস্থিত এক মানুষই এখন রয়েছে ঘর জুড়ে। নিঃশব্দে বাবুয়া দোতলায় চলে এল। প্যান্ট শার্ট বদলে আধশোওয়া হল বিছানায়, একটা বই নিয়ে। খিদে পাচ্ছে অল্প অল্প। কাকিমা এ সময়ে রোজ দোতলাতেই থাকে, বাবুয়া ফিরলেই ঘরে জলখাবার এসে যায়, আজ সে সম্ভাবনা কম। বাবুয়া অবশ্য চাইলেই পেয়ে যাবে, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলা বাবুয়ার ধাতে নেই। যাক গে যাক, ক্ষুধার্ত মানুষকে ভুলে ওরা এখন নয় বিদ্বান ভগবানকে নিয়েই পড়ে থাকুক।

বেশিক্ষণ কাটল না, রাখী এসেছে ঘরে। মৃদু সুরভি ছড়িয়ে বাবুয়ার মাথার পাশে বসল। হাত রেখেছে ছেলের বুকে।

বাবুয়া সোজা হল,—কিছু বলবে?

—তোর কী হয়েছে রে বাবুয়া? একদমই যাচ্ছিস না কেন?

—যাব।

—যাব যাবই তো শুধু বলে যাচ্ছিস। এত করে ডাকলাম, জন্মদিনেও এলি না।

—আমার জন্মদিন তেমন কোনও ইভেন্ট নয় মা।

—বললেই হল! তোর বাবা তোকে সেদিন খুব মিস করেছে। বার বার তোর কথা বলছিল।

—ফোনে বলেছ তো। শুনেছি।

—কত স্পেশাল রান্না হয়েছিল সেদিন! তোর বাবা খাচ্ছে, আর ছটফট করছে।…একটা স্পেশাল ডে, ছেলেকে কাছে পেলে বাবা কত খুশি হয়…।

মা কি বাবার দূত হয়ে এসেছে? অথবা শান্তি সংস্থাপনের স্বঘোষিত মসিহা? বাবার সঙ্গে তো বাবুয়ার কোনও দিনই কোনও সংঘর্ষ হয়নি, তবে?

বাবুয়া বইয়ের পাতায় চোখ রাখার ভান করল। মনে মনে বলল, বাবার কথা ছাড়ো মা। তোমার কথা বলো, তোমার কথা বলো।

.

০৬.

—কনগ্র্যাচুলেশন্‌স্‌ প্রফেসার মজুমদার।

—কীসের জন্য বলুন তো?

—থিয়োরিটিকাল ফিজিক্সের অত বড় একটা সিমপোজিয়ামে ইউ আর দা লোন ইন্ডিয়ান রিপ্রেজেন্টেটিভ। এ তো এক দুর্লভ সম্মান, নয় কি? অ্যাজ ইওর কলিগ আমি কত ইলেটেড ফিল করছি জানেন? অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ প্রাউডও।

—আরে না, ও তেমন কিছু না। সাতসকালে প্রফেসর অজিত ব্যানার্জির প্রশস্তিবাক্যে বুঝি বা একটু লজ্জাই পেল বোধিসত্ত্ব। অস্বস্তিভরা মুখে বলল,—থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। তারপর বলুন, আপনার কী খবর? কবে ফিরলেন নর্থ বেঙ্গল থেকে?

—এই তো কালই। অজিত চেয়ার টেনে বসল,—ডিপার্টমেন্টে ঢুকেই আপনার খবর পেলাম। ভাবলাম একটু নক করে যাই…

প্রফেসার অজিত ব্যানার্জির সাবজেক্ট সলিড স্টেট ফিজিক্স, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা নয়। বোধিসত্ত্বরই প্রায় সমবয়সি, এক-আধ বছরের বড়ও হতে পারে। একটু গপ্পোবাজ ধরনের মানুষ, প্রসঙ্গ থেকে ঘন ঘন প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়। কটা ছেলে তার আন্ডারে রিসার্চ করতে এসেছে বলতে বলতে আলিপুরদুয়ারে জমির কাঠা কত, সেখান থেকে দুধের দাম আবার বাড়ল, শীতটা কেন জাঁকিয়ে পড়ছে না…। লোকটার সঙ্গে কথা বলার একটাই সুবিধে, বোধিসত্বকে বেশি বাক্য ব্যয় করতে হয় না। মাঝে মাঝে হুঁ হ্যাঁ করে গেলেই হয়, অজিত একাই বকে যেতে থাকে। অসুবিধে অজস্র। সব চেয়ে বড় অসুবিধে, অজিত মিনিট পাঁচ-দশ ঘরে থাকলেই বোধিসত্ত্বর মাথা ধরে যায়। কথাও বলতে হয় হিসেব করে, মেপেজুপে। একটা বেফাঁস মন্তব্য হলেই গোটা ডিপার্টমেন্টে রাষ্ট্র হয়ে থাকে। অজিত কখনও কখনও বড় বেশি পাণ্ডিত্যও জাহির করে, বোধিসত্ত্বর যা একদম পছন্দ নয়।

বোধিসত্ত্বর টেবিলে খোলা বই। সে দিকে তাকিয়ে অজিত আলাপ প্রসারিত করল,—পড়াশুনো করছিলেন? ডিসর্টাব করলাম?

—ওই আর কী!…সেকেন্ড ইয়ার পি জি-র ক্লাস আছে, একটু প্রিপেয়ার করে নিচ্ছিলাম লেকচারটা।

—আপনি পারেনও বটে। কাদের জন্য এত খাটেন? ছেলেমেয়েরা আজকাল আর নলেজ চায় না প্রফেসার মজুমদার, দে আর ওনলি ইন্টারেস্টেড ইন এগজামিনেশান ওরিয়েন্টেড পড়াশুনো। চেয়ারের কাঁধে হাত ছড়িয়ে দিল অজিত,—এই তো, নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা নিয়ে এলাম।…দেখলাম তো ছেলেমেয়েগুলোকে, বেসিকস পর্যন্ত জানে না। স্পেকট্রাল লাইনের সিম্‌পল্‌ প্রশ্ন করছি, আর সব ভ্যাবাগঙ্গারামের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে!

বোধিসত্ত্ব চাপা বিরক্তি অনুভব করল। অজিতের এই হামবড়া ভাবটা একেবারেই অসহ্য। পরীক্ষার সময় অজিত কীভাবে নাকাল করে ছেলেমেয়েদের তা পুরোদস্তুর জানা আছে বোধিসত্ত্বর। এখানে বিভাগীয় প্রধান হয় পালা করে। বছর তিনেক আগে বোধিসত্ত্ব ওই পদে ছিল, সেবার দেখেছে অজিতের সেট করা পেপার হাতে নিয়ে স্টুডেন্টদের কী নাজেহাল দশা! একটা মেয়ে তো পরীক্ষার হলেই অজ্ঞান হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে ওই পেপারে সেবার জেনারেল গ্রেস দিতে হয়েছিল। লোকটা বোঝে না, পরীক্ষার কোয়েশ্চেনটা তার জ্ঞানের বহর দেখানোর জায়গা নয়। ছেলেমেয়েরা যদি বিদ্বান হয়, নিজেদের অন্তরের তাগিদেই হবে। তাদের ফেল করিয়ে ধর্ষকামী সুখ পাওয়া যেতে পারে মাত্র, তার বেশি কিছু নয়।

অসন্তোষ চেপে বোধিসত্ত্ব বলল,—ক্লাস নেওয়ার আগে পড়াশুনোটা আমি নিজের জন্যই করি প্রফেসার ব্যানার্জি। নিজেকে পুরোপুরি তৈরি না করে ক্লাসে ঢুকতে আমার খুব আনইজি লাগে?…মনে হয় ছেলেমেয়েদের ঠকাচ্ছি।

অজিত দাঁত বার করে হাসল,—এই জন্যই বোধ হয় আপনি ছেলেমেয়েদের কাছে এত পপুলার!

বোধিসত্ত্ব উচ্চবাচ্য কিছু করল না। মনে মনে বলল, পপুলারিটির জন্য আমি পড়াশুনো করি না অজিতবাবু, অ্যাজ এ টিচার পড়ানোটা আমার রিলিজিয়ন। কোনও স্টুডেন্ট কখনও যদি ক্লাসে এমন কোনও প্রশ্ন করে, যার উত্তরের জন্য আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে পারিনি, আমার নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়।

দুম করে কথার মোড় ঘুরে গেল অজিতের,—তা প্রফেসার মজুমদার, বার্লিন যাওয়ার জন্য আপনার পেপার রেডি?

—মোটামুটি।

—আপনি নাকি নতুন পেপার কিছু পড়ছেন না?

—ঠিক নতুনও নয়, আবার পুরনোও নয়। ফিজিকাল রিভিউতে লাস্ট যেটা পাবলিশড হয়েছিল, ওটাই মাজা ঘষা করছি। রিগার্ডিং ব্ল্যাক হোল নতুন কিছু আইডিয়া ইনকরপোরেট করছি…

—অর্থাৎ নতুন কাজ আছে, তাই তো?

—হ্যাঁ। তা আছে।

—অথচ প্রফেসার সামন্ত বলে দিলেন, আপনি নাকি পুরনো পেপারটাই পড়বেন! একই আইডিয়ার চর্বিতচর্বণ!…কোনও মানে হয় এই সব জেলাসির? কোথায় একই ডিপার্টমেন্টের লোক বলে গর্বে বুক ফুলে উঠবে, তা নয়…!

এবারও চুপ করে রইল বোধিসত্ত্ব। তার প্রতি এখানকার অধ্যাপককুলের প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা আছে, বোধিসত্ত্ব জানে। থাকতেই পারে। জ্ঞানে, বিদ্যায়, বুদ্ধিতে নিজেদের যতই উন্নত প্রজাতির জীব মনে করুক না কেন, আদতে তারা মানুষ তো বটে। অর্থাৎ ষড়রিপুর দাস।

মাঝে মাঝে এ নিয়ে আহতও হয়েছে বোধিসত্ত্ব। কখনও বা সহকর্মীদের বঙ্কিম কটাক্ষে, কখনও বা শীতল ঔদাসীন্যে, কিন্তু তাই বলে এই লোকটার কথার ওপর ভিত্তি করে আলটপকা কমেন্ট করার মতন মূর্খ সে নয়। এই ডিপার্টমেন্টাল নারদটা এখন মানে মানে বেরিয়ে গেলে বাঁচে।

আলগাভাবে বোধিসত্ত্ব জিজ্ঞাসা করল,—আপনার ঘড়িতে কটা বাজে প্রফেসার ব্যানার্জি?

—নটা দশ।

—দেখেছেন, আমার ঘড়ি পাঁচ মিনিট স্লো!…ক্লাসের টাইম তো হয়ে গেল!

ইশারাটা বুঝল অজিত। উঠে দাঁড়াল,—চলি তা হলে। মর্নিং-এ আমার আজ ক্লাস নেই, আফটারনুনেই আসব।

অজিত চলে যেতেই ঝটিতি বই-এর পাতায় ডুব দিল বোধিসত্ত্ব। এই সময়টায় তার বাহ্যজ্ঞান থাকে না, তবু যেন হালকা ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেল। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে সত্যি সত্যি। এখন পর পর দুটো পিরিয়ড, আরেকটু সময় নিয়ে লেকচারটা তৈরি করতে পারলে ভাল হত। সপ্তাহে মাত্র গোটা আটেক ক্লাস নিতে হয়, পি-জি এম-ফিল মিলিয়ে, এটুকুতেও যদি নিষ্ঠায় ঘাটতি পড়ে যায়…! এতদিন ধরে পড়াচ্ছে, প্রায় একই বিষয়, তবুও কেন যে এখনও ক্লাসে যেতে বুক কাঁপে? কোনও অসামান্য ছাত্র তার জ্ঞানের পরিধির বাইরে কোনও বিচিত্র প্রশ্ন করে বসবে, এই আশঙ্কায় কি? নাকি প্রশ্নটার আশায়? কে জানে হয়তো সেই প্রশ্ন থেকেই নিজের মনের জিজ্ঞাসার কোনও নতুন দিগন্ত খুলে যাবে বোধিসত্ত্বর!

আজকের পড়ানোর বিষয় ভাবতে ভাবতেই বোধিসত্ত্ব অন্যমনস্কভাবে চেয়ার ছাড়ল। কিছু বই-এর র‍্যাক, স্টিলের ক্যাবিনেট আর চেয়ার টেবিলে সাজানো বোধিসত্ত্বর এই ঘরটা ডিপার্টমেন্টের একেবারে শেষ প্রান্তে, ক্লাসরুম এখান থেকে অনেকটা দূর। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোচ্ছে বোধিসত্ত্ব, খালি হাতে। সে কক্ষনও রোল কলের রেজিস্টার নেয় না। তার ক্লাসে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীরই পারসেন্টেজ বাঁধা। আসো, না আসো, পেয়ে যাবে।

ক্লাসে ঢুকেই অন্যমনস্কভাব কেটে গেল বোধিসত্ত্বর। আজ ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি ভালই, চল্লিশ-বিয়াল্লিশ জন আছে, দেখে বোধিসত্ত্ব বেশ সতেজ সপ্রাণ বোধ করল। ভরাট কণ্ঠস্বরে শুরু করেছে বক্তৃতা। বোর্ডের পাশে চক ডাস্টার রাখা থাকে, লিখছে, মুছছে জটিল সমীকরণ। মিনিট পনেরো পরে থেমে গেল। তার পড়ানোর পদ্ধতিটা একটু অদ্ভুত। শুরুতে কিছুটা ধরিয়ে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পাশে চেয়ার টেনে এনে বসে পড়ে, কোনও একজন স্টুডেন্টকে বোর্ডে পাঠিয়ে দেয়, সেই তখন লেখে, আর বোধিসত্ত্ব ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একসঙ্গে বিষয়টা আলোচনা করতে থাকে। টুকরো টুকরো ভাবে বোঝায় কিছু, হঠাৎ হঠাৎ উঠে যায় বোর্ডে, আবার হয়তো কখনও বলে টানা দশ মিনিট, পনেরো মিনিট…

আজও একইভাবে ক্লাস এগোচ্ছিল। বোর্ডে চিরশ্রী, সামনের সারির জয়দীপ আর ভেঙ্কটরমনের মাঝখানে বোধিসত্ত্ব। কথার ফাঁকে হঠাৎই বোধিসত্ত্বর নজর গেল দয়িতায়। ফোর্থ রো-তে বসে একদম ফাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটা! বুঝছে না কিছু? লাস্ট দিন ক্লাসে অ্যাবসেন্ট ছিল, লাইব্রেরি থেকে বেরনোর সময়ও কয়েকদিন দেখা হয়নি, হয়েছেটা কী? এমনিতে তো মেয়েটা ক্লাসে বেশ চনমনে থাকে!

বোধিসত্ত্ব স্বভাবগতভাবে তেমন কৌতূহলী নয়। অন্তত ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে। তবু আজ প্রশ্ন করে ফেলল,—হোয়াটস রং দয়িতা? তুমি কিছু শুনছ না মনে হচ্ছে?

দয়িতা নড়ে উঠল।

—কী হয়েছে তোমার? ফিলিং আনইজি?

—না স্যার। দয়িতা অস্পষ্ট স্বরে বলল।

—নো। সামথিং ইজ রং। তুমি কি বুঝতে পারছ না?

দয়িতা আবছাভাবে ঘাড় নাড়ল।

—বলো তো, হাউ দা স্ট্রেঞ্জনেস ইজ কনজার্ভড ইন দি ইভেন্ট অব ডিকে প্রসেস?

দয়িতা উঠে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই আছে।

বোধিসত্ত্বর কপালে ভাঁজ পড়ল,—কী হল, চুপ করে আছ কেন? বলো।

দয়িতার ঘাড় আরও ঝুলে গেল। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে।

—তুমি কিন্তু ক্লাসে মনোযোগী হচ্ছ না দয়িতা। ইটস নট ফেয়ার। বোধিসত্ত্বর স্বর অপ্রসন্ন,—বোসো।

ঝুপ করে বসে পড়ল দয়িতা, কিন্তু অবনত মস্তক সোজা হল না।

বোধিসত্ত্ব আবার লেকচার শুরু করল। পড়াতে পড়াতে আরও কয়েকবার চোখ পড়ল দয়িতার দিকে। একইভাবে বসে আছে মেয়েটা, কাঠ হয়ে, সামান্যতম নড়াচড়া পর্যন্ত করছে না।

প্রায় দু ঘণ্টার ক্লাস। দেড় ঘণ্টা পর থেকেই অল্প অল্প ক্লান্ত বোধ করছিল বোধিসত্ত্ব। বয়সের জন্য কি? বোধিসত্ত্বর সেরকমই মনে হল, আজকাল এরকম হচ্ছে মাঝে মাঝে। ক্লাস ছেড়ে বেরনোর সময়ও দয়িতা একইভাবে বসে আছে দেখে বোধিসত্ত্বর একটু খারাপই লাগল। সে কি বেশি রূঢ় হয়েছিল মেয়েটার ওপর? ক্লাসে অমনোযোগী ছাত্রছাত্রীরা তাকে পীড়িত করে, কিন্তু সে তো কখনও মেজাজ হারায় না! এও কি বয়সের দোষ?

কী ভেবে ক্লাসরুমের দরজায় ঘুরে দাঁড়াল বোধিসত্ত্ব। ডাকল,—দয়িতা?

—হ্যাঁ, সার? দয়িতা ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল।

—তুমি একবার আমার রুমে এসো তো।

—কেন স্যার?

—এসো। যা বলছি শোনো।

রুমে ফিরে বোধিসত্ত্ব দেখল শামিম বসে আছে তার প্রতীক্ষায়। শামিম আহমেদ, বাংলাদেশের ছেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ ডি, বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে পড়ায়, বয়স বছর বত্রিশ, এখানে বোধিসত্ত্বর তত্ত্বাবধানে পোস্টডক্টরাল রিসার্চ করছে। ভারী মেধাবী ছেলে, অসম্ভব জ্ঞানস্পৃহা, মাত্র সাত মাসে বোধিসত্ত্বকে মুগ্ধ করে দিয়েছে শামিম।

কাজ নিয়ে কথা শুরু হয়ে গেল। কাল ও মহাশূন্য নিয়ে নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা আছে শামিমের। যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছে বোধিসত্ত্বকে, কয়েকটা ছোটখাটো গণনাও করে দেখাল। কয়েকদিন ধরেই চলছে আলোচনাটা, বোধিসত্ত্ব মোটামুটি সন্তুষ্টই।

বলল,—তোমার যা কাজ হয়েছে তাতেই তো স্বচ্ছন্দে একটা পেপার হয়ে যায়।

—হুঁ, তা হয়। নিচু স্বরে বলল শামিম, সে কখনও গলা ওঠায় না,—সত্যি বলতে কি স্যার, পেপার আমি একটা করেও ফেলেছি। যদি বলেন তো সোমবার আপনাকে মোটামুটি রাইট আপটা দেখিয়ে যেতে পারি।

—ভেরি গুড, লেট না করাই তো ভাল।

—ইচ্ছে আছে স্যার আমেরিকান জার্নাল অব থিয়োরিটিকাল ফিজিক্সে পাঠাব।

—পাঠাও। আমি ফরওয়ার্ডিং নোট দিয়ে দেব। বাট ওয়ান থিং, দিস উইল বি ইওর পেপার।

—কিন্তু স্যার…শামিম একটু চুপ থেকে বলল,—আমি যে ভেবেছিলাম পেপারটা আপনার আমার জয়েন্ট নামে পাবলিশ করব!

—কেন? আমি এ ব্যাপারে কোনও কাজ করিনি। ইউ হ্যাভ ডান ইট অ্যালোন।

—আপনার নাম থাকলে স্যার ব্যাপারটার ওয়েট বাড়বে।

দরজায় কেউ নক করছে,—আসতে পারি স্যার?

—কে?

—আমি দয়িতা।

মুহূর্তের জন্য নামটা মাথায় ঢুকল না বোধিসত্ত্বর, পরমুহূর্তেই মনে পড়েছে। ডাকল,—ও হ্যাঁ, এসো। ভেতরে এসো।

দয়িতা ঘরে ঢুকে একটু যেন জড়োসড়ো।

বোধিসত্ত্ব বলল,—এক সেকেন্ড।…আগে শামিমকে ছেড়ে দিই। তোমার লাঞ্চের দেরি হয়ে যাবে না তো?

ঢকঢক দু দিকে ঘাড় নাড়ল দয়িতা।

—আফটারনুনে তোমার কটায় ক্লাস?

—দুটোয়।

—তা হলে তো সময় আছে। বলেই বোধিসত্ত্ব আবার শামিমের দিকে ফিরেছে,—হ্যাঁ, যা বলছিলাম।…শোনো, তোমার কাজ তোমার নামেই বেরবে। এটাই কাম্য। সেখানে আমার নামের লেজুড় যোগ করলে তোমার মর্যাদা বাড়বে না। সেকেন্ডলি, আমি যে কাজ করি না সেখানে আমি কোনওভাবে আমার নাম যোগ করতে দিই না। এটা অবশ্য খুবই চালু প্রথা, গাইডের নাম রিসার্চ স্কলারের পেপারের শোভা বৃদ্ধি করে। এবং তোমাদের গবেষণার সুবাদেই আমাদের পেপারের সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু আমি বাজারচলতি রক্তচোষা সিস্টেমটা ঘোরতর অপছন্দ করি। তোমার ক্রেডিটটা তোমারই থাকলে আমার বেশি ভাল লাগবে।

বোধিসত্ত্বর স্বরে সরল ঋজুতা। শামিমের মুখ উজ্জ্বল হাসিতে ভরে গেল,—ও কে স্যার, তাই হবে। তবে রেফারেন্সে আমি আপনার কথা উল্লেখ করব স্যার।

—আচ্ছা আচ্ছা। দেখা যাবে। তুমি কাজটা কমপ্লিট করো তো।

শামিম খাতাপত্র গুছিয়ে উঠে পড়ল, দয়িতার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যসূচক হাসি হাসল একটু।

দয়িতার মুখে হাসি ফুটল না। আরও যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে সে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙুলের নখ খুঁটছে।

শামিম যাওয়ার পর একটা সিগারেট ধরাল বোধিসত্ত্ব। বহুক্ষণ পর মস্তিষ্কে ধোঁয়ার প্রবেশ, ক্লান্তি কেটে যাচ্ছে।

হাসিমুখে দয়িতাকে জিজ্ঞাসা করল,—হ্যাঁ বলো, তোমার সমস্যাটা কী?

দয়িতা অস্ফুটে বলল,—কীসের সমস্যা স্যার?

—তুমি তো ক্লাসে কখনও অমনোযোগী থাকো না?

দয়িতা নীরব।

—তুমি কি কোনও কারণে ডিসটার্বড আছ?

চোখ তুলেই নামিয়ে নিল দয়িতা।

—বলতে আপত্তি থাকলে বোলো না। বাট প্লিজ বি অ্যাটেনটিভ ইন মাই ক্লাস।

দয়িতা আবার চোখ তুলল, নামাল। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল সামান্য,—স্যার…

—কিছু বলবে?

—স্যার, আমার বিয়ের ঠিক হয়েছে।

—ইজ ইট? বাহ্, এ তো ভাল খবর। বোধিসত্ত্ব গমগমিয়ে হেসে উঠল। হালকা কৌতুকের স্বরে বলল,—ওহ্‌হো, এইজন্যই এত উদাস? বরের কথা ভাবছিলে? হা হা হা।

দয়িতা নিরুত্তর।

—কবে বিয়ে? ফাইনালটা দিচ্ছ তো?

দয়িতা অস্ফুটে বলল,—এ বিয়েতে আমার মত নেই স্যার।

—ও, তাই বুঝি? বোধিসত্ত্ব থমকে গেল। ঘাড় দোলাল বুঝদারের মতো,—সেইজন্যই টেনশানে আছ?

দয়িতার চোখের ওঠাপড়াটা ঘটল আবার। উত্তর নেই।

—কী করে ছেলে? কেন অপছন্দ?

এবারও কোনও সাড়াশব্দ নেই।

—ও কে, ও কে। বোধিসত্ত্ব আলগা গলা বাড়ল,—বাড়ির লোকরা কি জোর করছে? অপছন্দ হলে জানিয়ে দাও, কোরো না বিয়ে।

—কিন্তু আমি যে…এতক্ষণে দয়িতার স্বর শোনা গেল,—আমি যে মত দিয়ে ফেলেছি।

এবার বোধিসত্ত্বই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মেয়েটা কী চায়? একবার বলে মত নেই, একবার বলে রাজি হয়ে গেছি! স্ট্রেঞ্জ! নাহ, মেয়েদের নিয়ে কোনও সমীকরণ গড়া সম্ভব নয়। এতগুলো আননোন ফ্যাক্টর মেয়েদের মনে কাজ করে! এই তো রাখীও, ছেলে এলে একদিকে কী উল্লসিত, আবার কেমন যেন সিঁটিয়েও থাকে! এই প্রথম বিদেশ যাবে বলে উৎসাহী, না নিরুৎসুক, তাই কি বোঝা গেছে?

নাহ, মেয়েটাকে ডেকে পাঠানো ভুলই হয়েছে।

বোধিসত্ত্ব নিস্পৃহ স্বরে বলল,—তা হলে আর কী, চোখকান বুজে করেই ফ্যালো।

সহসা বিস্ফোরণ ঘটল যেন। দয়িতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল,—আমি পারব না স্যার। কিছুতেই পারব না।

—কেন, বিয়ে না করতে পারার কী আছে? পড়াশুনোর কথা যদি ভাব, বিয়ের পরও কন্টিনিউ করতে পারো।

দু দিকে অস্থিরভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছে দয়িতা। অঝোরে জল গড়াচ্ছে দু গাল বেয়ে। বোধিসত্ত্ব বিচলিত বোধ করল, এত কাঁদে কেন মেয়েটা? বোধিসত্ত্ব কি মেয়েটার মনের কোনও স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করে ফেলল?

অপরাধী অপরাধী মুখে উঠে এল বোধিসত্ত্ব। আলগা হাত রাখল মেয়েটার পিঠে,—আহা, শান্ত হও।…আমি কি তোমাকে কোনওভাবে হার্ট করেছি?

—করেছেনই তো। দয়িতার স্বর বদলে গেল। সজল চোখে স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছে,—আপনি কি কিছুই বুঝতে পারেন না।?

—না তো! কী?

—আপনিই দায়ী। আপনিই।..আপনার জন্যই আমি…

ছিটকে সরে গেল বোধিসত্ত্ব, যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছে। দয়িতার দিকে আবার তাকাতেই কেঁপে উঠেছে আমূল। এ কী দৃষ্টি জ্বলে মেয়েটার চোখে? পাগল না কী? বলে কী মেয়েটা?

গম্ভীর স্বরে বোধিসত্ত্ব বলল,—যাও, হোস্টেলে চলে যাও।

চকিতে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে দয়িতা। এক সেকেন্ড স্থির থেকে স্বচ্ছ সবুজ ওড়নায় চোখ মুছে নিল। পায়ে পায়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল ক্ষণিক। আবছায়ামাখা গলায় বলল,—সরি স্যার।…তবে আমি কিন্তু মিথ্যে বলিনি।

—আঃ যাও। বোধিসত্ত্ব প্রায় চেঁচিয়েই ফেলল।

দয়িতার নিষ্ক্রমণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েছে বোধিসত্ত্ব।

টেবিলে কনুইয়ের ভর, টিপছে কপাল, মাথা নিচু। অযাচিত এক আলোড়ন জাগছে বুকে। যেন ভূতলের অনেক গভীরে নড়ে চড়ে উঠছে কিছু, গোপন কন্দর বেয়ে তারই রেশ এসে পৌঁছচ্ছে ওপরে।

কেন এমন হচ্ছে?

প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে এসে এই ধরনের আবেগ কি বোধিসত্ত্বকে শোভা পায়?

দয়িতা একটা অল্পবয়সী মেয়ে, ঝোঁকের মাথায় কী বলতে কী প্রলাপ বকে ফেলেছে…! বোধিসত্ত্ব কষে ধমকাল নিজেকে। গোটা পরিস্থিতিটাকেই যুক্তির নিগড়ে বাঁধতে চাইল। অনেক মেয়েরই কি বাবার প্রতি অন্ধ ভালবাসা থাকে না? ইলেকট্রা কমপ্লেক্স? হয়তো দয়িতার এটাও সেই ধরনেরই কোনও অনুভূতি! তাইই হবে, অন্য কিছু হওয়া সম্ভব নয়। মেয়েটাকে সেও তো কক্ষনও আলাদা চোখে দেখেনি! দয়িতা তো তার কন্যাসমাই, নয় কি? ওই বয়সের মেয়েদের আবেগ নাকি লাগামছাড়া, এমনই কী একটা যেন বলেছিল না রাখী? আবেগ কি খুব ছোঁয়াচে, বোধিসত্ত্বও আপ্লুত হয়ে পড়ছে কেন? পড়ছে, নাকি পড়তে চাইছে?

দূর, ব্যাপারটা পুরোটাই ছেলেমানুষি। দয়িতার পাগলামিও আইডল ওয়রশিপ ছাড়া কিছু নয়। সিম্পল কেস অব মূর্তিপুজো। মেয়েটাকে নিয়ে এত ভাবাও এক ধরনের স্টুপিডিটি।

একা একাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল বোধিসত্ত্ব। ফাঁকা ঘরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হাসি, ধাক্কা মারছে কানে।

বোধিসত্ত্ব থেমে যাওয়ার পরও মিলিয়ে গেল না হাসিটা। পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরতে লাগল। ঘুরতেই লাগল।

.

০৭.

দুপুরে ক্লাস থেকে ফিরেই শুয়ে পড়েছিল দয়িতা। স্নান করতে উঠল না, খেতে গেল না, শুয়েই রইল। কম্বল মুড়ি দিয়ে। অনেকটা পালাজ্বরের রুগিদের মতো। কোলাহলমুখর হস্টেল এক সময়ে শূন্য হয়ে গেল, মেয়েরা সব যে যার চলে গেল দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লাসে, দয়িতা তখনও শুয়ে! উঠল একবার, শেষ দুপুরে। অঘ্রাণের নরম রোদ্দুর মাখা নির্জন করিডোরে একা একা হাঁটল কিছুক্ষণ, আবার এসে গড়িয়ে পড়েছে বিছানায়। পেটের চনচনে খিদেটা কখন মরে গেছে, জড়িয়ে এল চোখ। কিন্তু ঘুম আসে কই! মাঝে মাঝে ছেঁড়া ছেঁড়া তন্দ্রা লেপটে যাচ্ছে চোখের পাতায়, মিলিয়েও যাচ্ছে। যা থাকছে তা হল এক আচ্ছন্নতার ঘোর। ঝিমধরা নেশা নেশা অনুভূতি।

এরই মধ্যে স্বপ্ন দেখছিল দয়িতা। স্বপ্ন, না দৃশ্য? সে জেগে আছে না ঘুমিয়ে তাই সে ঠাহর করতে পারছে না, স্বপ্ন আর দৃশ্যের তফাত সে বুঝবে কী করে! তা সে স্বপ্নই হোক, কি দৃশ্য, একই ছবি ফুটছে বার বার, যেন ভিডিও-রিপ্লে!…ধু-ধু মাঠ, দূরে এক আবছা বটগাছ। মাঠের মধ্যিখান দিয়ে হাঁটছে দয়িতা। মাঠটা দেখে মনে হয় রুক্ষ, কিন্তু দয়িতা পা ফেললেই কোত্থেকে যেন ঘাস গজিয়ে উঠছে মাঠে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ঘাস, ক্রমশ যেন মাঠটা শরবন হয়ে গেল। বটগাছটাও উঁচু হয়ে গেছে অনেক, প্রকাণ্ড এক দৈত্যের আকার ধারণ করেছে। দয়িতা কিছুতেই আর ঘাস ঠেলে এগোতে পারল না। হাঁপাচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।…এখানেই ছবি শেষ। আবার শুরু হচ্ছে নতুন করে।

কে চালায় ওই ভিডিও টেপ? কে টেপে অদৃশ্য বাটন?

পশ্চিমের সূর্য ডুবে গেল যথাসময়ে। আকাশে রঙের খেলা শেষ, তরল আঁধার ঘন হল সন্ধেয়। দয়িতার ঘরের উত্তরের জানলাটা খোলা, হুহু করে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছে। দয়িতাকে স্পর্শ করছিল না সে বাতাস। মেয়েরা একে একে হস্টেলে ফিরল, কলকাকলিতে ভরে গেল চারদিক। দয়িতার কানে কোনও শব্দই ঢুকছিল না।

চিরশ্রী ঘরে ফিরে থমকে দাঁড়াল,—কী রে দয়ি, পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস যে? ক্লাসে গেলি না?

দয়িতা নির্বাক চোখে তাকাল।

চিরশ্রীর ভুরুতে ভাঁজ পড়ল,—কী হয়েছে রে তোর? শরীর খারাপ?

দয়িতা চেতনায় ফিরল। মাথা নেড়ে বলল,—নাহ।

—বললেই হল! তোর চোখমুখ কেমন লাগছে! জ্বর এসেছে না কি?

—না।

—মাথা ধরেছে? পেট ব্যথা?

—না।

—তা হলে শুয়ে কেন?

—এমনিই। দয়িতা হাতের পিঠে চোখ ঢেকে নিল। হৃদয়ের আন্দোলন লুকোনোর এটাই শ্রেষ্ঠ উপায়। কান্না আবেগ সুখ দুঃখ সবই তো প্রতিফলিত হয় ওই চোখেই। অস্ফুটে বলল,—ঠিক আছি রে।

—তা হলে ক্লাসে গেলি না কেন?

—ইচ্ছে করছিল না।

—স্ট্রেঞ্জ! এমন ইচ্ছের কারণ জানতে পারি?

—সব ইচ্ছের কি কারণ থাকে?

—অফকোর্স। আউট অফ নাথিং ইচ্ছে গ্রো করতেই পারে না। আর এটা তো ইচ্ছে নয়, অনিচ্ছে। খেয়েছিস?

—না।

—বি এম-এর ঝাড় খেয়ে খাওয়াও বন্ধ করে দিলি?

একটু কি কেঁপে উঠল দয়িতা? বুকটা কি চিনচিন করে উঠল হঠাৎ? বোধিসত্ত্ব কি সত্যিই তার সঙ্গে খুব নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলেন? না, তাও তো ঠিক বলা যায় না। বরং একটু বুঝি নার্ভাসই হয়ে গিয়েছিলেন। ওই ঘাবড়ে যাওয়া ভাবটাকে কাটাতেই হয়তো অত জোরে…!

নীল শালে মোড়া চিরশ্রী নিজের বিছানায় গিয়ে বসেছে। এলোমেলো শয্যায় যত্রতত্র বই। জন গ্রিশামের একখানা বই খুলে পেজমার্কটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল একটু, রেখে দিল। কনুইয়ে ভর রেখে আধশোয়া হয়েছে,—তোর ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছে বল তো?

—কী আবার হবে? দয়িতা নিচু স্বরে বলল।

—বি এম তখন ডেকে কী বললেন?

—কিছুই না।

—শুধুমুদু ডাকলেন? কিছু না বলে ছেড়ে দিলেন? স্যারের কি সময় বেশি হয়ে গেছে?

দয়িতা উত্তরটা এড়িয়ে গেল। মিথ্যে মিথ্যে কিছু একটা বানিয়ে বলে দেওয়া যায়, কিন্তু তাতে এখন তার উৎসাহ নেই। সত্যি বলতে কি, মিথ্যে বলতে তার ভালও লাগে না। সে তো আর ওই শয়তান সৌমিকটার মতো দুমুখো সাপ নয়।

দেয়ালের দিকে পাশ ফিরল দয়িতা। টের পাচ্ছিল, চিরশ্রী বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, পায়চারি করছে, ঘুরে ঘুরে দেখছে তাকে। তার অন্য ইন্দ্রিয়রা এখন অসাড় বলেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রখর হয়েছে, কম্বল ফুঁড়ে চিরশ্রীর দৃষ্টি যেন বিঁধছে দয়িতাকে।

চিরশ্রী বিড়বিড় করে বলল,—তোর বিহেভিয়ারটা কী রকম যেন পিকিউলিয়ার হয়ে গেছে। অন্য বার বাড়ি গেলে নাচতে নাচতে ফিরিস, এবার এলি মুখ হাঁড়ি করে। ছত্রিশ বার খোঁচানোর পর জানা গেল তোর নাকি বিয়ের ঠিক হয়েছে! ভাল হয়েছে, কিন্তু তার জন্য এত আপসেট কেন? সন্ধেবেলা বেরোনোর জন্য তিড়িং বিড়িং করে লাফাতিস, কদিন ধরে গুম হয়ে ঘরে বসে আছিস! আজ ক্লাসে আনমাইন্ডফুল হয়ে ফালতু ফালতু ঝাড়ও খেয়ে গেলি! বিয়ের ঠিক হলে দুটো কারণে মানুষ আনমাইন্ডফুল হয়। এক, বর পছন্দ না হলে। আদারওয়াজ বরের চিন্তায় মজে থাকলে। তোর কেসটা কী?

দয়িতা কেঠো হাসল,—ধর, বরের চিন্তাতেই মজে আছি।

—সরি। ধরতে পারলাম না। বরের ভাবনায় কারও মুখ অমন নিমপাতা-খাওয়া হয়ে থাকে না।…বিয়েটাতে কি তুই অ্যাট অল ইন্টারেস্টেড নস? আর ইউ বিয়িং ফোর্সড টু ম্যারি?

দয়িতা বড় করে নিশ্বাস ফেলল। তপ্ত বাতাস বুঝি ছড়িয়ে গেল ঘরে, বুঝি চিরশ্রীকেও ছুঁল।

চিরশ্রী কাছে এসে টানল দয়িতাকে, নরম গলায় বলল,—অ্যাই দয়ি…অ্যাই?

—উঁ?

—কী হয়েছে? আমায় বল না।

—আমার ভাল্লাগছে না। কিছু ভাল লাগছে না।

—কেন রে? ছেলেটাকে পছন্দ হয়নি?

চিরশ্রীর সঙ্গে দয়িতার তেমন সখ্য নেই। মেয়েটার জ্ঞান দেওয়া স্বভাব, বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব দয়িতার পছন্দ হয় না। তবু এই মুহূর্তে চিরশ্রীর কোমল স্বরে বুকটা কেমন হুহু করে উঠল। চোখ হঠাৎ জলে ভরে গেছে।

সে দিকে তাকিয়েই বুঝি উত্তর পেয়ে গেছে চিরশ্রী। দয়িতার গা ঘেঁষে বসে বলল,—বুঝলাম, কিন্তু তার জন্য এত ভেঙে পড়েছিস কেন?

—কী করব? দয়িতা জোরে নাক টানল।

—স্ট্রেট নেগেট করে দে।

—উপায় নেই।

—কেন?

—আশীর্বাদ হয়ে গেছে, ডেটও ফাইনাল। এইটিনথ জানুয়ারি।

—স্ট্রেঞ্জ! মেয়ের অমতে বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দেবে? এটা কি মধ্যযুগ নাকি?

—জোর কেউ করেনি রে। দয়িতা ভেজা গলায় বলল,—আমিই সেভাবে অমত করিনি।

—সো হোয়াট? এখন না বলে দে।

—হয় না রে। এখন দু বাড়িরই মান সম্মানের প্রশ্ন এসে যাবে।

—বারে বা, বাবা-মার তুচ্ছ মানসম্মানের জন্য মেয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে? মানসম্মান আগে, না জীবন আগে?

এ প্রশ্নটা দয়িতাকেও কুরে কুরে খাচ্ছে। তবু যেন সে নৈতিক জোর পাচ্ছে না কিছুতেই। কী যে বুদ্ধিভ্রংশ হল তার? কেন যে সৌমিকের অফিসে ছুটল? কেনই বা সেই বজ্জাতটাকে দিয়ে কায়দা করে বিয়ে ভাঙাতে চাইল? কেন যে সে নিজেই তার অমতটা গেয়ে রাখল না?

চিরশ্রী উঠে জানলায় গেল। বাইরেটা দেখল একটু, বন্ধ করে দিল কাচের পাল্লা। ফিরে স্টিলের চেয়ারে বসে বিছানায় পা তুলে দিল।

গম্ভীর মুখে প্রশ্ন জুড়ল,—ছেলেটার সঙ্গে তোর আলাপ হয়েছে?

—হুঁ।

—আগেই হয়েছিল? না এবারই হল?

—এবারই।

—কেমন ছেলে?

—ছেলেরা যেমন হয়।

—দেখতে কেমন?

—চলেবল্‌।…ভালই।

—করে কী?

—ফরেন ব্যাঙ্কের অফিসার। কস্টিং করেছে।

—অর্থাৎ পাত্র হিসেবে খারাপ নয়!

—বলতে পারিস।

—কথাবার্তা কী রকম? চালচলন?

—একটু টিমিড টাইপ।

—কেবলুস?

—কেবলুস নয়, সেয়ানাই। দেখায় ভালমানুষ।

—অর্থাৎ ডাবল ফেসেড ম্যান? এতক্ষণে যেন ক্লু খুঁজে পেল চিরশ্রী,—তোর কি এই কারণেই অপছন্দ?

—তা ছাড়া কী! দয়িতাও যেন যুক্তি পেয়ে গেল,—ও ধরনের মুখে এক, কাজে এক ছেলে আমার একটুও সহ্য হয় না।

—কী মুখে এক, কাজে এক আচরণ করেছে?

দয়িতা থমকে গেল। বলবে, কি বলবে না প্রথমটা ভেবে পেল না। শেষ পর্যন্ত দ্বিধা কাটিয়ে উগরেই দিল। ভারটা অন্তত লাঘব হোক।

বিনা মন্তব্যে শুনল চিরশ্রী। রীতিমতো মনোযোগ সহকারে। কাহিনী সমাপনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চেপে ধরেছে দয়িতাকে,—তুই ছেলেটাকে না দেখেই তাকে বাতিল করার জন্য মরিয়া হয়ে গেলি কেন?

—বললাম তো, বাবা-মার ঠিক করা পাত্র…নেগোসিয়েশান ম্যারেজ আমার ভাল লাগে না…

—বকোয়াস্‌। এ কথা তো তুই বাবা-মাকেই বলতে পারতিস।

—পারতাম। তবে…

—উঁহু, তোর লজিকটা তত টেনেবেল হচ্ছে না দয়ি। ইনফ্যাক্ট তুই যা বললি তাতে তো ছেলেটাকে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। সেন্স অফ হিউমার আছে। তুই তাকে নিয়ে খেলতে চেয়েছিলি, পালটা চালে সে তোকে মেট্‌ করে দিয়েছে…। আমার তো মনে হয় দিস ইন্টেলিজেন্ট চ্যাপই তোর উপযুক্ত বর হতে পারে।

—অসম্ভব, কক্ষণও না। আমি ওকে বর ভাবতেই পারব না।

—কেন?

চোখ নয়, যেন সার্চলাইট ফেলল চিরশ্রী। আবরণ ভেদ করে দেখে নিচ্ছে দয়িতার হৃদয়ের অন্তঃস্তল। অস্বস্তি হচ্ছিল দয়িতার, মুখ ঘুরিয়ে নিল।

চিরশ্রী শব্দ করে হেসে উঠল,—লুক দয়ি, আমি জানি তোর কোনও আন্‌সার নেই। তুই এমন কিছু অ্যাকাডেমিক মাইন্ডেডও নস যে লেখাপড়া শেষ হচ্ছে না বলে একটা ছেলেকে ক্যানসেল করতে হবে। আবার আজীবন কুমারী থাকবি এমন বাসনাও তোর নেই। ইফ দিজ আর ট্রু, তখন হোয়াই নট দিস চ্যাপ?…অবশ্য একটা ফ্লিমজি গ্রাউন্ড তোর আছে।

দয়িতা সচকিত হল,—মানে?

—মুখ ফুটে বলতে হবে? চিরশ্রী ঠোঁটের কোণে নিয়ে গেল হাসিটাকে,—তুই মিলস অ্যান্ড বুনের পরে আর কোনও বই পড়িসনি দয়ি। এবং তোর মেন্টাল এজও বাড়েনি। এখন তোর চোখে পুরুষ মানে সামওয়ান এক্সট্রাঅর্ডিনারি, যার তুলনায় মেয়েরা একদম তুচ্ছ।

—কী মিন করতে চাইছিস?

—ওরে গাধা, স্যারের সঙ্গে তোর আর কদ্দিন দেখা হবে? চার-ছ মাস? মেরে কেটে এক বছর? তারপর তুইই বা কোথায়, বিএমই বা কোথায়? চোখের প্রেমে মন ভরে না রে দয়ি, ইউ নিড সামথিং ট্যানজিবল্‌। ওই প্লেটনিক লাভ এক দু-মাসই ভাল। বুদ্ধিমান মেয়েরা তারপরই টপ করে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয়। কদিন হয়তো খারাপ লাগবে, পরে নিজের ছেলেমানুষির কথা ভেবে নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়বি।

দয়িতা ঝট করে উঠে বসল। সংশয় তো তার মনেও আছে, কেন সেটাকে উসকে দিচ্ছে চিরশ্রী? মন কি অত লজিক মেনে চলে? অনাগত সুখের কল্পনায় কেউ কি এই মুহূর্তের কষ্টটাকে উপেক্ষা করতে পারে?

শুকনো গলায় দয়িতা বলল,—তোর অনেক অভিজ্ঞতা আছে মনে হচ্ছে?

—অভিজ্ঞতার দরকার হয় না। কমন্‌ সেন্স আবেগে জেবড়ে না গেলেই বলা যায়।

—ঠিক আছে, যা। আমি ইমোশনে চলি, ইমোশনেই চলব। দয়িতা আবার কম্বলে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ল।

চিরশ্রী এসে দয়িতাকে ঠেলল আবার,—অ্যাই পাগলি, চল চল, খাবি চল।

—আমার ভাল্লাগছে না। আমায় ডিস্টার্ব করিস না।

—পেট ঠাণ্ডা নেই বলেই তোর মুড খিঁচড়ে আছে। ডিনারটা নামিয়ে একটা স্ট্রোল মেরে আয়, চিত্ত একেবারে সতেজ হয়ে যাবে।…শুড্ডাটার সঙ্গেও একটা মিনি মোলাকাত করে আসতে পারিস।

—তুই যাবি এখান থেকে?

হাসতে হাসতে পালাল চিরশ্রী।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দয়িতা উঠে বসেছে। নাকের পাটা ফুলে গেছে তার, বিষণ্ণতার ওপর চেপে বসেছে এক ক্রোধের আস্তরণ। পলকের জন্য সৌমিকের মুখটা মনে পড়ল। কেন শয়তানি করল ছেলেটা? ছেলেটা অতি চতুর, না অতি নির্বোধ? একবারও কি বুঝতে পারেনি দয়িতার প্রস্তাবের মধ্যে প্রত্যাখ্যান লুকিয়ে আছে? একটা চিঠি লিখবে নাকি ছেলেটাকে? লিখলে হয়। ছেলেটার অন্তত জানা দরকার যাকে বিয়ে করার জন্য তার নাল পড়ছে সে অন্য একজনে আসক্ত। এবং সেই অন্য একজন কোনও হেঁজিপেঁজি নয়। হাজারখানা সৌমিককে জড়ো করলেও তার কড়ে আঙুলের সমান হবে না। তার পরও যদি কলজের জোর থাকে তো ছেলেটা তাকে বিয়ে করুক।

পরিকল্পনাটায় দয়িতা বেশ উত্তেজিত বোধ করল। ঝড়ের গতিতে টেবিলে এসে বসেছে, কাগজ টেনে লিখছে খসখস। দু লাইন লিখল, ছিঁড়ে ফেলল। আবার লিখল, আবার ছিঁড়ল। মনঃপূত হচ্ছে না ভাষা। কোনওটা বেশি রুক্ষ মনে হয়, কোনওটা বা অতি মোলায়েম। ঠিক কোন ভাষাতে লিখলে যে গায়ে জ্বালা ধরবে সৌমিকের, অথচ দয়িতাও খাটো হবে না? হচ্ছে না, হচ্ছে না…

ধুততেরি বলে উঠে পড়ল দয়িতা। কাগজগুলো দোমড়াল, মোচড়াল, ঠেসে গুঁজে দিল ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। হঠাৎই আয়নায় চোখ পড়েছে। ইশ, কী চেহারা হয়েছে! চুলগুলো কাকের বাসা, চোখের নীচে কালি, ঠোঁট দুটো শুকিয়ে খটখট করছে। কার জন্য দয়িতার এই দশা? বোধিসত্ত্ব বোধিসত্ত্ব…! দয়িতাকে আবার বলে কি না যাও। কেন যাবে দয়িতা। দয়িতাকে হটিয়ে দেওয়া কি এতই সহজ? মোটেই না, মোটেই না।

গায়ে একটা শাল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল দয়িতা। নিজের চাবিতে দরজা লাগিয়ে হনহন করিডোর পার হচ্ছে। মিনিট কয়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেল ইউনিভার্সিটি গেটে। ক্যান্টিনের অদূরে বিশাল এক জারুল গাছ, তার তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়েই আছে। ছায়া মেখে। ছায়ামানবী হয়ে। বেশ ভাল ঠাণ্ডা পড়ে গেছে এ অঞ্চলে, হাত পা হিম হয়ে আসছে, তবু স্থির দাঁড়িয়ে দয়িতা। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে তিনটে ছেলে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে সামনে দিয়ে হেঁটে গেল, প্রফেসার তেওয়ারি চলেছেন লাইব্রেরিতে, দয়িতার দিকে কারুরই চোখ পড়ল না।

প্রায় আধ ঘণ্টাটাক প্রতীক্ষার পর তার দর্শন মিলল। দীর্ঘ ঋজু শরীর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। ঝটিতি নিজেকে আরও অন্ধকারে লুকিয়ে ফেলল দয়িতা। অধীর চোখে দেখছে তাকে। ক্যান্টিন পেরিয়ে একটু গিয়েই থামল বোধিসত্ত্ব, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, চোখ চালাচ্ছে অন্ধকারে।

কাকে খোঁজে? দয়িতাকে কি?

দয়িতার বুক ছলাৎ ছল। হ্যাঁ, খুঁজছেন স্যার। দয়িতাকেই। না হলে ওভাবে গেটের সামনে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়বেন কেন?

এক ছুটে মানুষটার কাছে পৌঁছে যেতে ইচ্ছে করল দয়িতার। কিন্তু গেল না। উদ্বেল হৃদয় নিয়ে দূর থেকে দেখছে বোধিসত্ত্বর ক্রিয়াকলাপ। সিগারেট ধরাল বোধিসত্ত্ব, বাড়ির পথে এগোচ্ছে এবার। ক’পা গিয়েই ঘুরে তাকাল। আবার হাঁটা শুরু করেছে।

তীব্র আনন্দের শিহরনে কাঁপছিল দয়িতা। বোধিসত্ত্ব দৃষ্টিসীমার আড়ালে যাওয়ার আগেই আঁধার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। মোহগ্রস্তের মতো চলেছে বোধিসত্ত্বর পিছু পিছু। আর একবার কি ফিরে তাকাবেন না তিনি? আর একটিবার?

না, পিছন ফিরছে না বোধিসত্ত্ব। সিগারেট শেষ করে ছুড়ে দিল রাস্তার ধারে, নতুন একটা ধরাল। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেল বাড়ির গেটে। রোজকার মতো আলো জ্বলে উঠল বোধিসত্ত্বর বারান্দার, নিবেও গেল।

দয়িতার ফুসফুস নিংড়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস গড়িয়ে এল। শীতল চরাচরে এক কুচি উষ্ণ বাতাস।

.

০৮.

বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে খবরের কাগজ দেখছিল বোধিসত্ত্ব। রবিবার সকালটাই বোধিসত্ত্বর কাগজ পড়ার সময়। কাগজ পড়া সম্পর্কে বোধিসত্ত্বর এক বিটকেল ধারণা আছে, সপ্তাহের যে কোনও একদিন মন দিয়ে কাগজ ওলটালেই মোটামুটি সাত দিনের হালচাল বুঝে নেওয়া যায়। এ ব্যাপারে রবিবারই শ্রেষ্ঠ দিন, ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকে, এ দিন সময় কিছুটা শ্লথ গতিতে হাঁটে।

রবিবার তিন তিনটে কাগজ আসে বাড়িতে। ইংরিজি বাংলা মিলিয়ে। সব কটারই আদ্যোপান্ত গোগ্রাসে গেলে বোধিসত্ত্ব, এমনকি বিজ্ঞাপনও। কত যে মনোহরণ পণ্যসামগ্রী বেরিয়েছে আজকাল। টিভি ফ্রিজ ওয়াশিং মেশিন ইনভার্টার ভিসিপি ভিসিআর…। গাড়ির বিজ্ঞাপনও কত। দেখতে ভারী মজা লাগে বোধিসত্ত্বর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কী অদ্ভুতভাবে চাহিদা বদলে যায় মানুষের। বোধিসত্ত্বর মনে পড়ে তার শৈশবে, কৈশোরে, এমনকি যৌবনেও পাতাজোড়া রেডিওর বিজ্ঞাপন থাকত। ঠোঁটে আঙুল এক শিশু, তার পাশে রেডিও। বিজ্ঞাপনটা ভারী জনপ্রিয় ছিল, কী ধুম পড়ে গিয়েছিল সেই রেডিও কেনার। আশ্চর্য, এখনও পৃথিবী থেকে রেডিও নিশ্চিহ্ন হয়নি, অনেক বাড়িতেই শোনে, কিন্তু সেই বিজ্ঞাপন আর কোথায়!

আরও কত কী যে মনে হয়! বিজ্ঞানের ওপর ভর করে প্রযুক্তি গড়ে উঠছে, প্রযুক্তি তৈরি করছে বাসনা। এই বাসনা আবার তৈরি করছে চাহিদা। চাহিদার অন্তহীন খিদে মেটাতে নিত্যনতুন ছলাকলার আশ্রয় নিচ্ছে প্রযুক্তি, নিয়ন্তা বিজ্ঞান বনে যাচ্ছে প্রযুক্তির তাঁবেদার। ভূমিকাটাই বদলে যাচ্ছে বিজ্ঞানের। ছিল স্বপ্নদ্রষ্টা, হয়ে গেছে সুইচ। কোথায় যে এর শেষ কে জানে!

আজ বোধিসত্ত্বর একটা ছোট্ট খবরে চোখ আটকে গেল। ইংরিজি কাগজের ভেতরের পাতায় বেরিয়েছে। সানফ্রান্সিসকোর অদূরে এক পাহাড়ি গাঁয়ের বাসিন্দারা নাকি আবার ইউ এফ ও দেখতে পেয়েছে। শুক্রবার মধ্যরাতে এক টিলার ওপর নাকি নেমেছিল ফ্লাইং সসার, হরেক রকম চোখ ধাঁধানো আলোর খেলা দেখিয়ে আবার উড়ে গেছে! ওড়ার সময় নাকি এত শব্দ হয়েছে, পাশের পাহাড়টা থরথর করে কাঁপছিল। গ্রামবাসীরা ভয় পেয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল। তাই কোন দিকে সসারটা উড়ে গেল তা তাদের দেখা হয়নি।

কাগজ মুড়ে রেখে হা হা হেসে উঠল বোধিসত্ত্ব। চেঁচিয়ে ডাকল—শুনছ?

রাখী বাগানে। ফুলগাছের পরিচর্যা করছে। রূপচাঁদের দাদার বিয়ে, দিন সাতেকের ছুটি নিয়ে পরশু সে মোহনপুর গেছে, কদিন এখন বাগান দেখার কাজ রাখীর। এক সার চন্দ্রমল্লিকা লাগানো হয়েছে, কচি কচি চারাগুলো ঝাড়া দিয়ে উঠেছে বেশ, গোড়ার মাটি ঝুরো করে আন্দাজ মতো তাতে সার মেশাচ্ছে রাখী।

মাটি ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঘাড় ঘোরাল,—কী হল, এত হাসছ কেন?

—সেই কেস! আবার আমেরিকানগুলো ইউ এফ ও দেখেছে।

—কী ফো?

—ইউ এফ ও আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট। এ ক্ষেত্রে ফ্লাইং সসার।

—ও।

—আচ্ছা, শুধু আমেরিকানগুলোই ওগুলো দেখতে পায় কেন বলো তো? অন্য গ্রহের জীবরা কি শুধু আমেরিকানদেরই দর্শন দেয়?

রাখী বোকা বোকা মুখে তাকাল,—আমি কী করে বলব?..হয়তো অন্য গ্রহ থেকে আমেরিকাটা কাছে হয়।

বোধিসত্ত্ব আরও জোরে হেসে উঠল,—তুমি যে দেখছি আমেরিকানদের থেকেও স্টুপিড!

—আমি তো স্টুপিডই। রাখী হাসিমুখে সরে গেল গাছের কাছ থেকে। কোণের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,—এই গাঁদার বেড এবার ওদিকটায় করলে কেমন হয়?

বোধিসত্ত্বর হাসি মরে গেল। খবরটা পড়ার আনন্দই মাটি। বিজ্ঞান সম্পর্কে চরম কৌতূহলহীন হয়ে কী করে যে এক বিজ্ঞানীর সঙ্গে এতদিন কাটিয়ে দিল রাখী!

—মন্দ কী, লাগাও। দায়সারা গোছের জবাব দিয়ে আবার কাগজে মন দিল বোধিসত্ত্ব।

—এবার কিছু প্যানজি লাগালে ভাল হয় না? রূপচাঁদ বলছিল ফিরে টাউনের বড় নার্সারিটা থেকে নিয়ে আসবে।

—ভালই তো।… ডালিয়া করছ না?

—ডালিয়া ছাড়া শীতের বাগান মানায়? ডালিয়া তো থাকবেই।

—গুড। যাও, চা নিয়ে এসো।… আর হ্যাঁ, বাথরুমে শেভিং সেটটা রেখে দাও, আমি এক্ষুনি দাড়ি কামাতে যাব।

—গরম জল লাগবে?

—না।

অপসৃয়মান রাখীকে দেখতে দেখতে বোধিসত্ত্ব ঠোঁটে সিগারেট লাগাল। তার হুকুম তামিল করার জন্য রাখীর চেয়ে যোগ্য আর বোধ হয় কেউ নেই। এত নির্দ্বিধায়, নিঃসাড়ে কাজ করে যায় যে, শুধু সেই কারণেই এক এক সময়ে বউটাকে বড় পানসে লাগে। পাপোশ, এক্কেবারে পাপোশ।

প্রথম শীতের লাজুক রোদুর সিঁড়ি টপকে বারান্দা ছুঁয়েছে। উত্তুরে বাতাস বইছে সরসর, মৃদু শব্দ উঠছে গাছগাছালিতে, পাঁচিল ধারের নিমগাছের পাতারা ভীরু যুবতীর মতো কাঁপছে তিরতির। কোথাও একটা পিক পিক পাখি ডেকে উঠল। একদল আদিবাসী কামিন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে চলে গেল ক্যাম্পাস গেটের দিকে। প্রত্যেকেরই মাথায় ঝুড়ি, হাঁটার ভঙ্গি ভারী স্বচ্ছন্দ, সূর্যরশ্মি ঠিকরোচ্ছে কালো চামড়ায়। রবিবারের সকাল আরও যেন একটু ফুটে উঠল।

বোধিসত্ত্বর মধ্যেও চারিয়ে যাচ্ছিল সকালটা। সিগারেট শেষ করে অলস মেজাজে হাঁটছে বাগানে, খালি পায়ে। শিশিরে ভিজে যাচ্ছে পা, ঘাসের ছোঁয়ায় বিচিত্র এক বিক্রিয়া হচ্ছে শরীরে, সতেজ চনমনে হয়ে উঠছে বোধিসত্ত্ব। গ্যারেজের সামনে এসে দাঁড়াল একবার। সাদা অ্যাম্বাসাডার যেন ঈষৎ মলিন। রূপচাঁদই রোজ ধোয়ামোছা করে গাড়ি, তার বিহনেই কি এই হাল? নিজে ধোবে আজ? একটু এক্সসারসাইজ হয় তা হলে। থাক গে, বোধিসত্ত্বর হাতে বালতি দেখলে রাখীই হয়তো কেড়ে নিয়ে…।

ভেতরে ফোন বাজছে। উৎকট ধ্বনি। বোধিসত্ত্ব কুপিত চোখে বাড়ির দিকে তাকাল। কে রে বেআক্কেলে এই মনোরম সকালটাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে দিচ্ছে? বেশ কয়েক বার ঝনঝন করে থামল ঝঙ্কার। ক্ষণপরেই রাখীর আর্ত ডাক। প্রায় ছুটেই ঘরে এল বোধিসত্ত্ব।

টেলিফোনের সামনেই নীরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রাখী। বোধিসত্ত্ব জিজ্ঞাসা করল,—কী হয়েছে? কার ফোন?

—বারাসত থেকে। রন্টুর। বাবার…

—কী হয়েছে?

—স্ট্রোক। আজ ভোরে। নার্সিং হোমে ভর্তি করেছে।

—কোথায়? বারাসতেই?

—তাই তো বলল। রাখী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল,—এবার কলকাতায় গিয়ে ভেবেছিলাম বাবার সঙ্গে দেখা করে আসব। কাজেকর্মে আটকে গেলাম… আর বোধ হয় হল না।

—আহা, এত উতলা হচ্ছ কেন? কী বলল রন্টু? কী কন্ডিশন?

—বলল তো বেশ সিরিয়াস। ইনটেনসিভ কেয়ারে রেখেছে। রাখী মুখে আঁচল চাপল,—থার্ড অ্যাটাক হয়ে গেল। এই সাতাত্তর বছর বয়সে আর কি বাবা সামাল দিতে পারবে?

শ্বশুরমশায়ের ওপর বোধিসত্ত্বর তেমন টান নেই। থাকার কথাও নয়। সূর্যকান্ত চৌধুরী বারাসত কোর্টের নামী ল’ইয়ার ছিলেন, তাঁর চিন্তাভাবনার জগৎ চিরকালই মক্কেল মোকদ্দমা মামলাকে ঘিরে, শ্বশুর জামাই-এর কোনও দিনই তেমন নৈকট্য তৈরি হয়নি। সূর্যকান্ত গুণী জামাইকে সমীহ করেন বটে, তবে একটু দূর থেকে। বোধিসত্ত্বরও শ্বশুরবাড়িতে যাতায়াত খুব কম। বরাবরই। তা ছাড়া সাতাত্তর বছর বয়সে কারও মৃত্যু ভীষণ একটা শোকাবহ ঘটনাও নয়। নিজের বাবা-মা মারা গেলেই কি এখন বোধিসত্ত্ব হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদবে?

তবু বোধিসত্ত্বর খারাপ লাগছিল। মৃত্যুর মধ্যে মানুষের যে গভীর অনস্তিত্ব লুকিয়ে থাকে, সেটা বড় পীড়া দেয় তাকে।

এগিয়ে গিয়ে রাখীর কাঁধে হাত রাখল বোধিসত্ত্ব,—মন খারাপ কোরো না। দেখো, এবারও উনি সারভাইভ করে যাবেন।

—বলছ?

—বলছি।…এক কাজ করো। তুমি লেট কোরো না, এক্ষুনি চলে যাও।

—তুমি যাবে না?

—আমি এক্ষুনি কী করে যাই! একটা কাজ হাফ-ফিনিশড হয়ে পড়ে আছে। তুমি বরং রাতে একটা ফোন কোরো। যদি তেমন অবস্থা হয়…আশা করি হবে না…তাহলে কালই চলে যাব।

রাখী আঁচলে নাক মুছল,—রূপচাঁদ নেই, তোমার অসুবিধে হবে না? তোমার খাওয়া-দাওয়া, দেখাশুনো…

—ও নিয়ে ভেবো না। বোধিসত্ত্ব কাঁধ ঝাঁকাল,—সামহাউ ম্যানেজ করে নেব। দীনেশকে খবর দেব? গাড়ি বার করে তোমায় স্টেশনে দিয়ে আসবে?

—থাক, তুমি ওর বাড়ি চিনতে পারবে না। আমি রিকশাতেই চলে যাব।

ঘরে গিয়ে দ্রুত হাতে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে রাখী। তারই মধ্যে চা করল, জলখাবার বানাল, ফ্রিজে রাখা কাঁচা মাছ বার করে রান্না চড়িয়ে দিল। বোধিসত্ত্বর জন্য রান্নাবান্না গুছিয়ে রেখে পৌনে বারোটার ট্রেন ধরবে।

বোধিসত্ত্ব ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে আবার খবরের কাগজে ডুবেছে, সাড়ে নটা নাগাদ দরজায় বেল। রাখী কাজে ব্যস্ত, নিজেই উঠে দরজা খুলল বোধিসত্ত্ব। দুজন অচেনা মানুষ। একজন বছর পঁয়ত্রিশের যুবক, গালে সযত্নলালিত দাড়ি, পরনে জিনস। অন্যজনের বয়েস একটু বেশি, কাঁধে ইয়া বড়ো এক ব্যাগ।

বোধিসত্ত্ব ভুরু কুঁচকোল,—কাকে চাই?

—আপনার কছেই এসেছিলাম স্যার। যুবকটি চামড়ার জ্যাকেটের পকেট থেকে কার্ড বার করে বাড়িয়ে দিল,—দৈনিক দিনরাত পত্রিকার সায়েন্স পেজের জন্য আমরা আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই।

বোধিসত্ত্ব কার্ডটা দেখল না। নীরস স্বরে বলল,—“অ্যাপয়েমেন্ট ছাড়া তো আমি ইন্টারভিউ দিই না।

—আমরা স্যার কাল অনেকবার আপনার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, লাইন পাইনি। ডিসেম্বরে আমরা একটা স্পেশাল পুলআউট বার করছি। মহাবিশ্বের ওপর। আপনার সাক্ষাৎকার ছাড়া পুলআউট স্যার অসম্পূর্ণ থাকবে।

ছেলেটির কথাবার্তার ভঙ্গি বেশ বিনীত। সামান্য নরম হল বোধিসত্ত্ব। তবু কাটাতে চাইল ছেলেটাকে,—আমার যে ভাই আজ একটু অসুবিধে আছে। এক ক্লোজ রিলেটিভ খুব অসুস্থ, তাকে নিয়ে টেনশনে আছি…

—কিন্তু আমরা যে স্যার অনেক আশা করে এসেছিলাম…

পিছনের লোকটা বলে উঠল,—সেই কাকভোরে বেরিয়েছি স্যার। সেই সাড়ে পাঁচটার ট্রেন ধরেছি হাওড়া থেকে।

—আপনি যে ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারে যাচ্ছেন, সে ব্যাপারেও কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল।

—আপনার খুব বড় ছবি দিয়ে ছাপা হবে স্যার। আপনার ইন্টারভিউই পুলআউটটাকে লিড করবে।

—বেশি সময় নেব না স্যার।

ওফ, পারেও বটে ঘ্যান ঘ্যান করতে। বোধিসত্ত্ব বিরক্ত মুখে বলল,—আসুন। বাট প্লিজ মেক ইট ব্রিফ।

সোফায় বসেই ছোট্ট টেপ রেকর্ডার বার করে ফেলল ছেলেটা। সাংবাদিকের চোখে বসার জায়গাটাকে জরিপ করে নিল। অন্যজন ঢাউস ব্যাগ নামিয়েছে কাঁধ থেকে, ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা রেডি করছে। পটাপট কটা শাটার মেরে নিল ঘরে, অনুমতি না নিয়েই। সম্ভবত আঙুল শুলোচ্ছিল।

বোধিসত্ত্ব রুক্ষ স্বরে বলল,—কোয়েশ্চেনেয়ার তৈরি করেছেন?

—মোটামুটি।

—শুরু করুন।

ছেলেটা সুইচ অন করল,—স্যার, প্রথমেই জানতে চাইব, মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণা করার প্রেরণা আপনি পেলেন কোথ্‌থেকে? আপনাদের পরিবারের কেউ কি এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন?

ছেঁদো প্রশ্ন। অনেক ম্যাগাজিনে আগে এর জবাবও দিয়েছে বোধিসত্ত্ব। সিগারেট ধরিয়ে ভাবলেশহীন গলায় বলল,—আমাদের বাড়িতে বিজ্ঞানচর্চার রেওয়াজ ছিল না। পড়াশুনোর চর্চা ছিল। আমার বাবা ছিলেন রেলের অফিসার, তবে অসম্ভব বই পড়ার নেশা ছিল তাঁর। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অত্যন্ত জ্ঞানস্পৃহা ছিল। আমার ইনকুইজিটিভ্‌নেসটা সম্ভবত বাবার কাছ থেকে পাওয়া। …এ ছাড়া ছোটবেলায় আমার খুব ছাদে যাওয়ার নেশা ছিল। বিশেষত রাতে। অন্ধকার মহাশূন্যে আকাশভর্তি তারা আমায় ভীষণ টানত। কীভাবে এই তারাদের জন্ম হল, কেন সব তারারই একটি নির্দিষ্ট অবস্থান আছে, কীভাবে তারারা মুভ করছে, এ সব আমাকে দারুণ অবাক করত। স্পেশালি স্বর্গগঙ্গা, আই মিন ছায়াপথ। যা আকাশের এ পাশ থেকে ও পাশে চলে গেছে। বলতে পারেন, তখন থেকেই আমার সৃষ্টি নিয়ে কৌতূহল।

পর পর আরও কয়েকটা রুটিন প্রশ্ন করল ছেলেটা। বাঁধা গতের উত্তর দিল বোধিসত্ত্ব। মিছিমিছি সময় নষ্ট হচ্ছে, বোধিসত্ত্বর বিরক্তি বাড়ছিল। পাতা ভরানোর জন্য তার মুখ থেকে কিছু কথা আউড়ে নেওয়া কি এত জরুরি?

একসময়ে অসহিষ্ণুভাবে বলল,—আপনি আমার কাজটা সম্পর্কে কি কিছু জানেন?

—হ্যাঁ, জানি বইকী। ছেলেটার চটজলদি উত্তর,—আপনি এখন ব্ল্যাক হোল নিয়ে কাজ করছেন।

—সে নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই?

—আছে স্যার। ছোট্ট একটা চিরকুট বার করে দেখে নিল ছেলেটা,—আসছি স্টেপ বাই স্টেপ।…আপনি স্যার ব্ল্যাক হোলের কনসেপ্টটা পেলেন কোথ্‌থেকে?

—কনসেপ্টটা তো আমার নয়। আমি শুধু কনসেপ্টটাকে একটু ডেভেলপ করার চেষ্টা করছি।

—কীভাবে করছেন তা যদি একটু বলেন স্যার?

—এটা তো নিশ্চয়ই জানেন, ব্ল্যাক হোলকে যতটা কালো বলে কল্পনা করা হচ্ছে, আসলে সেগুলো ততটা কৃষ্ণ নয়। ইনফ্যাক্ট, ব্ল্যাক হোলের সাইজ ক্রমশ রিডিউস করছে, এবং তাদের কেউ কেউ উবেও যাচ্ছে। উবে যাওয়ার পর কৃষ্ণ গহ্বরগুলো কীসে পরিণত হচ্ছে, সেটা এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। সৃষ্টিরহস্যকে জানতে গেলে এটা জানা অত্যন্ত জরুরি। আমার এখন সব ভাবনাচিন্তা এই বিষয় নিয়ে।

—অর্থাৎ আপনি কৃষ্ণ গহ্বরের উবে যাওয়ার রহস্য উদ্ঘাটিত করতে চান, তাই তো? বোধিসত্ত্বর চোখ কুঁচকে গেল। ছেলেটা কি কোনও হিরে চুরির রহস্য উদ্ঘাটনের কথা ভাবছে নাকি? প্রশ্নটাই কেমন যেন লঘু ধরনের। একটু কড়াভাবেই বোধিসত্ত্ব উত্তর দিতে যাচ্ছিল, রাখীকে চোখে পড়ল। ইশারায় ডাকছে রাখী।

বোধিসত্ত্ব উঠে গেল,—কী বলছ?

—মাছের ঝোল করে রাখলাম। আজ কাল দুদিনের মতো। আলাদা আলাদা বাটিতে ফ্রিজে রেখে দিচ্ছি। গরম করে খেয়ো।

—হুঁ।

—ওবেলা কি ভাত খাবে? তা-হলে বেশি করে চাল বসাব। না হলে কিন্তু বাইরে থেকে রুটি এনে নিতে হবে।

কথাগুলো ভাল করে মাথায় ঢুকছিল না বোধিসত্ত্বর। ব্ল্যাক হোলের সঙ্গে ভাত মাছের ঝোল, কী বিচিত্র কম্বিনেশন। অন্যমনস্কভাবে ঘাড় নেড়ে দিল,—যা ভাল বোঝো করো।

—আমি তা হলে চানে ঢুকে যাচ্ছি।

—যাও।

ফিরে এসে বোধিসত্ত্ব আবার সোফায় বসল। কাগজের ছেলে দুটো অনেক দূর থেকে এসেছে, বকবকও করছে অনেক, উঠে গিয়ে রাখীকে বলে আসবে চা দিতে? থাক গে, রাখীর আজ মন খারাপ, তাড়াহুড়োও আছে, অনর্থক চাপ না বাড়ানোই ভাল। অন্য দিন হলে রাখী তো নিজেই এতক্ষণে…

ছেলেটা একটু বাধো বাধো গলায় বলল,—স্যার, আপনার অনেকটা মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম। আর একটা দুটো প্রশ্ন আছে।

—বলুন।

—সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর নিয়ে আপনার কিছু নিজস্ব ধ্যানধারণা আছে, আমরা জানি। তাই নিয়ে যদি কিছু বলেন…

—আমার ভাবনার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাবনা মিলবে না। আমি ঈশ্বরে কণামাত্র আগ্রহী নই। আমি শুধু তাঁর মেজাজমর্জি বুঝতে চাই। ঈশ্বর এখানে আমার কাছে নেহাতই একটা টার্ম মাত্র। এই সৃষ্টিটা আদৌ হল কেন, এর কী প্রয়োজন ছিল, এই সব চিন্তার মধ্যে হয়তো আপনাদের ঈশ্বরের স্থান থাকলেও থাকতে পারে।

—কিন্তু স্যার, ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকলে মানুষের নৈতিক ব্যাপার-স্যাপারগুলোর কী হবে?

—ওটা আমার ফিজিক্সের আওতায় পড়ে না। মানুষের নৈতিকতা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই।… তবে হ্যাঁ, ফিজিক্সের মধ্যে দিয়ে, অঙ্কের মধ্যে দিয়ে আমি একটা র‍্যাশনালিটির সন্ধান পাই। মানুষের জীবনে তার প্রয়োজন থাকলেও থাকতে পারে।

—স্যার, লাস্ট প্রশ্ন। কোনও মহাকাশযান যদি কখনও ব্ল্যাক হোলের মধ্যে পড়ে যায়, তা হলে সত্যিই কি তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? মানে ওই গর্তটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে কি?

ব্ৰহ্মতালু জ্বলে গলে বোধিসত্ত্বর। ব্ল্যাক হোল মানে গর্ত? এতক্ষণ ধরে যা বললেন, সবই বেনা বনে মুক্তো ছড়ানো? সাংবাদিকরা সাধারণত পল্লবগ্রাহী ধরনেরই হয়, নিজেদের যতটা চালাক আর জ্ঞানী বলে প্রতিপন্ন করতে চায় তারা মোটেই তা নয়। বোধিসত্ত্ব জানে। কিন্তু ইন্টারভিউ নিতে এসেও এমন মূর্খের মতো উক্তি করবে? এ কি মহাকর্ষ শব্দটারও অর্থ জানে?

গম্ভীর মুখে বোধিসত্ত্ব বলল,—এর উত্তর আপনাদের কোনও সায়েন্স ফিকশনের বইতেই পাবেন।

আশ্চর্য, ছেলেটা কথাটার অন্তর্নিহিত ব্যঙ্গটাও বুঝল না। খুশি খুশি মুখে টেপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়েছে,—তা হলে কটা স্ন্যাপ নিয়ে নিক স্যার?

বোধিসত্ত্ব হ্যাঁ না কিছু বলল না। ফটোগ্রাফার লোকটা নিজেই নানা রকম পোজ দিতে দিতে গোটা চারেক ছবি তুলল। আলোর ঝলকানিতে চোখ বুজে ফেলল বোধিসত্ত্ব।

দুই মূর্তিমান বেরিয়ে যাওয়ার পরই বোধিসত্ত্বর মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল। কৃষ্ণগহ্বর, মহাবিশ্ব নিয়ে এরা কী লিখবে তা তো বোঝাই যাচ্ছে, এদের লেখা পড়েই সাধারণ মানুষের ভাবনাগুলো আরও জট পাকিয়ে যায়। নিজে একটা বই লিখলে কেমন হয়? সহজ সরল ভাষায়? অনেকটা পপুলার সায়েন্সের মতো করে? অঙ্ক টঙ্ক নয় তেমন নাই দিল, ব্যাপারগুলো কি বোঝানো যাবে না? বাংলায় লিখবে? না ইংরিজিতে? বাংলাই ভাল। কোথা থেকে শুরু করা যায় বইটা? নিউটন, গ্যালিলিও, নাকি আইনস্টাইন?

নিমগ্ন ভাবনার মাঝেই রাখী বেরিয়ে গেল। কাগজ নিয়ে বইটার একটু আধটু খসড়াও করে ফেলল বোধিসত্ত্ব। কোন অধ্যায়ের পর কোন অধ্যায় যেতে পারে, কোন কোন ডায়াগ্রাম ব্যবহার করা যায়, এই সব।

হুঁশ ফিরল খিদের ডাকে। ঘড়িতে চোখ পড়তেই লাফিয়ে উঠেছে। একটা বাজে, এক্ষুনি লাইব্রেরি ছুটতে হবে। হকিং রেডিয়েশান থেকে একটা নতুন চিন্তার সূত্র পেয়েছে বোধিসত্ত্ব, ভাবনাটাকে আরও এগোতে হবে আজ। বাড়িতে বসেও করা যায় কাজটা, তবে লাইব্রেরিতে ইন্টারনেট আছে…

ঝড়ের গতিতে স্নান খাওয়া সেরে বোধিসত্ত্ব বেরিয়ে পড়ছিল, হঠাৎ খেয়াল হল বাড়ির দরজা জানলা সব খোলা। এত দরজা জানলা বন্ধ করা যে কী ঝকমারি। লাইব্রেরিতে পৌঁছতে পৌঁছতে আড়াইটে বেজে গেল। ঘণ্টা দুয়েক দানোয় পাওয়া মানুষের মতো খাটল বোধিসত্ত্ব, তবু তেমন কাজ এগোল না। কোথায় যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এমন প্রায়শই হয়। ব্যাপারটাকে বোধিসত্ত্ব বিশেষ আমল দিল না। সে কাজ করে প্রধানত ইনট্যুইশনের ওপর। আগে কিছু ভেবে নেয়, পরে ভাবনাকে আঙ্কিক পদ্ধতিতে মেলায়। আজ বোধ হয় ভাবনাতেই ভুল ছিল।

লাইব্রেরি ছাড়ার আগে বোধিসত্ত্ব মগজটাকে সাফ করে নিল। ভ্রান্ত চিন্তা মাথায় জমে থাকলে পরদিন কাজ করা কঠিন হয়ে ওঠে। আগামীকাল বাকি জীবনের প্রথম দিন, কাল নয় আবার গোড়া থেকে শুরু করা যাবে।

বাইরে এক মায়াবী বিকেল। আকাশে হালকা নীলের আভা। সূর্য এখন গাছগাছালির ওপারে, তার শেষ আলো মেখে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন যেন সোনামোড়া হর্ম্য। পাতায় পাতায় কাঁচা হলুদের ছোঁয়া। মাঝ আকাশে ভেসে রয়েছে এক সাদাটে চাঁদ। যেন চাঁদ নয় সে, চাঁদের ছায়া। পড়ন্ত বিকেলের রূপ দেখছে চাঁদ। চোরের মতো।

ইউনিভার্সিটি গেটে এসে বোধিসত্ত্ব দাঁড়িয়ে পড়ল। ঠিক এই স্থানটিতে এসে আজকাল কেমন যেন বৈকল্য জাগে সহসা। অজান্তেই চোখ ঘুরে যায় পিছনে, আশেপাশে। আজ ছুটির দিন, চারদিকে ছেলেমেয়েরা ঘোরাঘুরি করছে। না, এদের মধ্যে নেই সে। দয়িতা নামের মেয়েটা কি সে দিনের পর থেকে উবে গেল? আজ নিয়ে চারদিন হল, একবারও ইউনিভার্সিটিতেও দেখা পাওয়া গেল না তো? বেশ লাগত মেয়েটাকে। ভারী সুন্দর এক রিনরিন সুরে কথা বলে, তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ চোখে, পাশে এলে মনে হয় যেন তাজা প্রাণের সৌরভ ছড়িয়ে গেল। খুব আহত হয়েছে কি দয়িতা? তাকে এড়িয়ে চলছে? এখন নিজেরও যে কেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে? অযথা রূঢ় না হয়ে মেয়েটাকে আরেকটু কি বোঝানো উচিত ছিল সে দিন? কীই বা বোঝাত? নিজেরই বুকটা কেঁপে উঠেছিল যে!

ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে হাঁটা শুরু করল বোধিসত্ত্ব। বাড়ি ঢোকার মুখে মুহূর্তের জন্য রাখীর কথা মনে পড়ল। একা চলায় মোটামুটি অভ্যস্ত রাখী, নিশ্চয়ই ঠিক মতোই পৌঁছেছে। শ্বশুরমশাই এখন কেমন কে জানে! কিছু একটা হয়ে গেলে ছুটতেই হবে, কোনও মানে হয়!

অনেক দিন পর স্বহস্তে গ্যাস জ্বালিয়ে বোধিসত্ত্ব চা করল। লিকার চা। দুধ চিনি ছাড়া। ঈষৎ অবসন্ন ভাব লেগে আছে শরীরে, এতেই কাটবে। টিভি চালিয়ে সোফায় বসে চায়ে চুমুক দিল। চিরাচরিত অভ্যাসে হাত ঢুকিয়েছে পকেটে, ওমনি মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। যাহ, একটাও সিগারেট নেই।

ঝুঁঝকো আঁধার নেমেছে। সিগারেট কিনে ফিরছে বোধিসত্ত্ব, হাতে টর্চ। গেট খুলে আংটা লাগাতে গিয়ে হঠাৎই খানিক দূরে চোখ আটকে গেল।

বোধিসত্ত্ব গলা ওঠাল,—কে? কে ওখানে?

সাড়া নেই।

টর্চের আলো ফেলল বোধিসত্ত্ব। এবং হকচকিয়ে গেল, —তুমি! তুমি এখানে?

অন্ধকার লাইটপোস্টের নীচে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দয়িতা বুঝি কুঁকড়ে গেল। অস্ফুটে বলল কী যেন, বোধিসত্ত্ব শুনতে পেল না।

গলা খাঁকারি দিয়ে বোধিসত্ত্ব বলল,—ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? এসো, ভেতরে এসো।

বাধ্য ছাত্রীর মতো বোধিসত্ত্বকে অনুসরণ করল দয়িতা। ঘরের দরজায় পা রেখেও দাঁড়িয়ে পড়েছে।

বোধিসত্ত্ব আবার বলল,-কী হল? এসো।

আড়ষ্ট পায়ে ঢুকল মেয়েটা। বসল না সোফায়, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

দয়িতার আড় ভাঙাতেই বোধিসত্ত্ব স্বচ্ছন্দ গলায় বলল,—চা খাবে নাকি? যদি লিকার চলে তো এক্ষুনি করে দিতে পারি। দুধ চা হলে টাইম লাগবে।

দয়িতার চোখে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন।

হা হা হেসে উঠল বোধিসত্ত্ব,—মিসেস নেই। কলকাতা গেছে। আমার এখন সেলফহেল্পের পালা চলছে।

দয়িতা ঢোক গিলল,—আপনি একা?

—মানুষ তো একাই দয়িতা। জন্মানোর সময়েও, মরার সময়েও।…কী হল বলো, খাবে চা? এর পর কিন্তু আমার মুড চলে যাবে।

দয়িতা বোকা বোকা মুখে তাকাল,—আপনি চা করতে জানেন স্যার?

—আমি অনেক কিছুই করতে জানি। ভাত ডিমসেদ্ধ আলুসেদ্ধ মাছভাজা…লন্ডনে থাকার সময়ে টানা তিন বছর নিজে রান্না করে খেয়েছি। ইন ফ্যাক্ট, কুকিং ইজ অ্যান ইজি জব। ছেলেরা চাইলেই পারে। তোমরা মেয়েরাই এটাকে কুক্ষিগত করে রেখেছ। আই মিন, তোমরা এই একটা ব্যাপারে আমাদের ডিপেন্ডেন্ট করে রাখতে ভালবাস।

মহাভারত পড়েছ, আই হোপ। নিশ্চয়ই জানো, ভীম ওয়াজ এ গ্রেট কুক। বড় বড় হোটেলেও দ্যাখো…

বোধিসত্ত্ব থেমে গেল। বড্ড বেশি কথা বলছে কি? নির্জন গৃহে মেয়েটির সান্নিধ্য কি তাকে প্রগলভ করে তুলল?

কথার থেকে নৈঃশব্দ্য আরও বেশি অস্বস্তিকর। বোধিসত্ত্ব গলা নামিয়ে বলল,—দাঁড়িয়ে কেন এখনও? বোসো।

দয়িতা বড় সোফার কোণটিতে বসল বটে, কিন্তু ভাবটা এমন যেন ধমক খেলেই ছুট্টে পালাবে। কাঁপছে কি মেয়েটা? এ যেন ব্যাধের সামনে হরিণী।

উলটো দিকের সোফায় বসে বোধিসত্ত্ব সিগারেট ধরাল। দু এক সেকেন্ড দয়িতার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল একটু। মৃদুস্বরে বলল,—তুমি ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?

দয়িতা চুপ।

—এখানে কি কারও কাছে এসেছিলে?

জোরে জোরে দু দিকে মাথা নাড়ল দয়িতা।

—তা হলে?

দয়িতার থুতনি বুকে ঠেকে গেল,—আমি তো রোজই আসি।

—রোজ? কখন?

—আপনার পেছন পেছন।

—স্ট্রেঞ্জ! কেন?

দয়িতা ঝট করে চোখ তুলল। ভীরু আঁখি জ্বলে উঠেছে হঠাৎ,—আপনি তো জানেন, কেন!

মেয়েটার স্বর অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ, সরাসরি বিদ্ধ করল বোধিসত্ত্বকে। হাঁটুর জোর কমে গেছে সহসা, শীত শীত করছে।

চাপা স্বরে বলল,—পাগলের মতো কথা বোলো না।

—আমি পাগল নই।

—তুমি যা বলছ তার মানে বোঝ?

—বুঝি।

—এটা যে ঠিক নয়, অন্যায়, তা বোঝ?

—কীসের অন্যায়? কেন অন্যায়?

—বি লজিকাল দয়িতা, বি র‍্যাশনাল। বোধিসত্ত্ব গলা ভারী করতে চাইল, তবু যেন দুলে গেল স্বর,—সোসাইটির কিছু নিয়মকানুন আছে, মানুষকে তা মেনে চলতে হয়।

—সমাজের জন্য মানুষ? না মানুষের জন্য সমাজ? মন কি সব সময় আইন মেনে চলে?

উত্তরোত্তর সপ্রতিভ হচ্ছে দয়িতা, একটু একটু করে সিঁটিয়ে যাচ্ছে বোধিসত্ত্ব। সিঁটিয়ে যাচ্ছে, না আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে? তালু শুকিয়ে আসছে, জ্বালা জ্বালা করছে শরীর। এই জ্বালা কখন আসে বোধিসত্ত্ব জানে।

খরখরে জিভে তালু ভিজিয়ে নিল বোধিসত্ত্ব। যেন নিজেকেই সাবধান করছে, এমন স্বরে বলল,—“আমি বুড়ো মানুষ দয়িতা। তোমার বাবার মতো।

—মতো, কিন্তু বাবা নন। আপনার বয়স হওয়ায় আমার কিছু যায় আসে না।

—আমি বিবাহিত। আমার একটা কলেজে-পড়া ছেলে আছে।

—তাতেও আমার কিছু যায় আসে না।

—থামো। বাচালপনা কোরো না। বোধিসত্ত্ব গর্জে উঠল। হুঙ্কারটা নিজের কানেই ভারী হাস্যকর ঠেকল বোধিসত্ত্বর। ব্যাধ হরিণ বনে গেলে কি এই স্বরে আর্তনাদ করে? ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বোধিসত্ত্ব বলল,—তুমি কী চাও বলো তো? কী চাও?

—জানি না। আমি কিছু জানি না। চকিত কান্নায় ভেঙে পড়ল দয়িতা,—আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না…মরে যাব…মরে যাব…

চোখের জল যে আগ্নেয়গিরির লাভা হয়ে যেতে পারে, ধারণা ছিল না বোধিসত্ত্বর। এক প্রস্ফুটিত যৌবন আকুল হয়ে বলছে আমায় গ্রহণ করো, এমন আহ্বান কি মুনিঋষিদের পক্ষেও প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব? উন্মুখ অম্বাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ভীষ্ম, পরিণাম কি ভাল হয়েছিল? ভীষ্ম তো দূরস্থান, বোধিসত্ত্ব এমন কিছু জিতেন্দ্রিয় পুরুষ নয়, কতক্ষণ সে নিজেকে সংযত রাখবে?

কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে দয়িতা, দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছে। মাতালের মতো টলমল পায়ে দয়িতার কাছে গেল বোধিসত্ত্ব, দু হাতে খামচে ধরেছে দয়িতার কাঁধ। টেনে তুলল দয়িতাকে। সজল মুখ তুলে তাকিয়েছে দয়িতা, বোধিসত্ত্বর ঠোঁট নেমে এল দয়িতার ঠোঁটে। ওষ্ঠ থেকে শুষে নিচ্ছে জল। জল, না আগুন?

বোধিসত্ত্বর শিরা উপশিরায় রক্তকণিকারা নেচে উঠল। ছুটছে এলোপাতাড়ি, ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মাসাইদের ড্রাম বেজে উঠল বুকে। গুমগুম গুমগুম।

.

০৯.

বারাসতে লালজিবাবার আশ্রমটি স্টেশনের কাছেই। হাঁটাপথে জোর মিনিট দশেক, রিকশায় আরও কম। একদম ন্যাশনাল হাইওয়ের গায়ে অবস্থান বলে সামনে দিয়ে হরদম বাসও যাচ্ছে, দূরদূরান্তের ভক্তদেরও আশ্রমে পৌঁছতে কোনও অসুবিধে নেই।

সৌমিকরা অবশ্য বাস ট্রেন কিছুই ধরেনি। তারা এসেছে গাড়িতে। ভাড়ার গাড়ি। সঙ্গে আজ মণিদীপা প্রবীরও আছে। সারাটা দিন সকলে মিলে আশ্রমেই কাটাবে তারা।

উদ্যোগটা মূলত কবিতার। উদ্দেশ্য দুটো। রথ দেখা, এবং কলা বেচা। হরিদ্বার থেকে গুরুদেব এসেছেন, অনেকটা সময় তাঁর সান্নিধ্যও পাওয়া যাবে, দিনভর এক সঙ্গে কাটালে দুই পরিবারের সম্পর্কও নিবিড় হবে আরও। মণিদীপা প্রবীরেরও সৌমিককে ভাল করে দেখা হয়ে যাবে।

সৌমিক ঘুরে ঘুরে আশ্রমটা দেখছিল। এবং মুহুর্মুহু চমৎকৃত হচ্ছিল। এ আশ্রমে সে একবারই এসেছিল, অনেক কাল আগে, তা প্রায় বছর দশেক হবে। সেই মা-বাবার দীক্ষা নেওয়ার সময়। তখন কী চেহারা ছিল, আর এখন কী! জায়গা এতটাই ছিল, তবে ধু-ধু করত। দুটো মাত্র টালির বাড়ি ছিল তখন, আর একখানা মাঝারি সাইজের মন্দির। আর এখন এ তো মিনি টাউনশিপ। সাদামাটা মন্দির গায়ে শ্বেতপাথর গেঁথে বিশাল আকার ধারণ করেছে, ধ্যান জপ কীর্তনের জন্য এক অতিকায় হলঘর তৈরি হয়েছে, স্বচ্ছ জলের পুকুরটার এখন চারপাশ বাঁধানো, টালির চালা অদৃশ্য হয়ে সার সার পাকা দোতলা উঠে গেছে আশ্রমবাসীদের জন্য। ওদিকে গোয়ালে হাই তুলছে গোটা আষ্টেক জার্সি গাই, এদিকে লকলক করছে সবজিখেত, ফুলবাগান। পিছনে রয়েছে মিনি ওয়াটার পাম্পিং স্টেশন, জেনারেটার রুম। কী সুন্দর একটা গেস্টহাউসও বানিয়েছে। যেন একেবারে থ্রিস্টার হোটেল। সবই কী পেল্লাই পেল্লাই। রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর, এমনকি আশ্রমকে ঘিরে রাখা পাঁচিলটা পর্যন্ত।

এত টাকা এল কোথ্‌থেকে? কোনও ব্যাঙ্ক এদের ফিনান্স করে নাকি?

প্রবীরও এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ আশ্রমে সে একদমই নবাগত। একটু বুঝি ছটফটই করছিল সে, সৌমিককে সামনে পেয়ে স্বস্তি বোধ করল।

সৌমিক হেসে জিজ্ঞাসা করল,—কী, আপনি গেলেন না?

—কোথায়?

—গুরুদেবকে দর্শন করতে?

—আমি পাপী-তাপী মানুষ, আমার ও সব পোষায় না। হাসতে হাসতেই গলা নামাল প্রবীর,—এই, এখানে সিগারেট চলে না?

—ঠিক জানি না।… আমি তো এখানে আসি না…

—ও। বলেই পুট করে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করল প্রবীর। একবার চোখ বুলিয়ে নিল চারদিকে। গেরুয়া বসন পরা সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা ভাবলেশহীন মুখে যাতায়াত করছে এ দিক ও দিক। সম্ভবত তাদের দেখে আঁচ করতে চাইল নিয়মটা। দুষ্টু হেসে বলল,—নো স্মোকিং বোর্ড তো নেই। ধরানোই যাক, কী বলো?

সৌমিক কাঁধ ঝাঁকাল,—হ্যাঁ হ্যাঁ, ধরান। কিছু বললে নয় ফেলে দেবেন।

কুণ্ঠাভাব ঝেড়ে ফেলে সিগারেট ধরাল প্রবীর। প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল সৌমিকের দিকে,—চলে?

সৌমিক ঝটিতি মাথা নাড়ল দু দিকে।

—কাম অন, লজ্জা পেয়ো না। ইউ আর অ্যাডাল্ট এনাফ টু স্মোক পাবলিকলি।

—আমি খাই না।

—একদম না?

—না।

—অকেশনালিও না?

—না। গন্ধটাই আমার…

—আমার মেয়ে কিন্তু এই গন্ধটাই খুব পছন্দ করে। সিগারেটের গন্ধকে ও কী বলে জানো? ম্যানলি স্মেল।

সৌমিক বোকা বোকা মুখে হাসল সামান্য। বিয়ের পর কি দয়িতার ইচ্ছেয় তাকে সিগারেট ধরতে হবে? আজ দয়িতাও এলে বেশ হত, জিজ্ঞেস করে নেওয়া যেত।

পলকের জন্য দয়িতার মুখটা শূন্যে দুলে গেল। সেই মেলার মাঠের। মেয়েটার ইচ্ছে অনিচ্ছে বোধ বড় তীব্র, তার চাওয়ার সঙ্গে কি তাল মেলাতে পারবে সৌমিক?

বাগানটা হলুদে ছেয়ে আছে। টেনিস বল সাইজের গাঁদা, দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আর একটাও মরসুমি ফুলের গাছ নেই বাগানে। জবা গোলাপ দু-চারটে আছে বটে, কিন্তু গাঁদার সাম্রাজ্যে তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া কঠিন। বৃক্ষময় আশ্রমে প্রতিটি বড় গাছের নীচেই বাঁধানো সিমেন্টের বেদি। সিগারেট শেষ করে একটা ঘোড়ানিম গাছের তলায় বসল প্রবীর, সৌমিককেও বসাল।

পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল,—ফিউচার নিয়ে কী ভাবছ?

সৌমিক হাসল,—কী ভাবব? কিছুই না।

—চাকরি চেঞ্জ করার কোনও প্ল্যান নেই?

—আপাতত না।

—ব্যাঙ্কের চাকরি ভাল লাগে? স্টিরিওটাইপ মনে হয় না?

—সব চাকরিই তো স্টিরিওটাইপ।

—খাসা বলেছ। এতক্ষণে প্রবীরের স্বর গমগম করে উঠল। যেন মনের মতো কথাটি শুনতে পেয়েছে হবু জামাইয়ের মুখে। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,—এখনকার কোম্পানিতে যখন ঢুকলাম, প্রথমটা মনে হয়েছিল এদের মার্কেটিং জবটা খুব চ্যালেঞ্জিং হবে। ধুস, কোথায় কী! রুটিন জব, রুটিন টেনশান, রুটিন এক্সাইটমেন্ট…। কোনও কিছুতেই আপত্তি করি না, তাই কাজও চাপছে দিন দিন…।

—সমু…অ্যাই সমু…

সৌমিক প্রবীরের বাক্যালাপে ছেদ পড়ল। দয়িতার বাবাটাকে মন্দ লাগছিল না সৌমিকের, কিন্তু কবিতা বসুরায় শান্ত মতো কথা বলতে দিলে তো!

আবার হাঁকছে কবিতা,—অ্যাই সমু, শোন না এদিকে।

সৌমিক বেজার মুখে উঠে গেল,—কী?

—গুরুদেবকে প্রণাম করবি চল।

—আমি! কেন?

—আশ্চর্য, তাঁর আশীর্বাদ নিবি না?

—তোমরাই তো নিচ্ছ!

বেঁটেখাটো ভারিক্কি কবিতা পলক স্থির চোখে দেখল ছেলেকে। দৃঢ় গলায় বলল,—সিনক্রিয়েট কোরো না। এসো।

এই সিনক্রিয়েট করতে চায় না বলেই তো কবিতা বসুরায়ের এই উৎপীড়ন সহ্য করে সৌমিক। এই সিনক্রিয়েট করতে চায় না বলেই তো সেই অদৃশ্য বুলডগটার সঙ্গে আজও সৌমিকের পাঞ্জা কষা হল না।

একে রবিবার, তায় গুরুদেব আছেন, আশ্রমে আজ খুব ভিড়। মন্দিরেও। লালজিবাবা বসেন মন্দিরের পিছনটায়, তাঁর দরজায় দর্শনার্থী থইথই। ছোট্ট ঘরখানার মেঝে জুড়ে কার্পেট পাতা, সেখানেও নারী পুরুষ শিশুতে ঠাসাঠাসি। লালজিবাবার আসন একটু উঁচুতে, মার্বেল পাথরের মঞ্চে। গেরুয়া বরণ ধুতি পরে আছেন তিনি, খালি গায়ে জড়ানো নকশাদার কাশ্মীরি শাল। চেহারাটি তাঁর ভারী মনোহর। চওড়া কাঁধ, চওড়া কপাল, উন্নত নাক, টকটকে ফরসা রং, দু গাল দিয়ে ঠিকরোচ্ছে লাল আভা। বয়স পঞ্চাশ থেকে সত্তরের মধ্যে যা ইচ্ছে হতে পারে। টানা টানা চোখ দুটিও তাঁর অতি সৌম্য, স্নেহময়। ঘরে ধূপধুনোর পাট নেই, তবু এক আশ্চর্য সুরভি তাঁকে ঘিরে আছে।

ছেলের কবজি ধরে সুকৌশলে ভিড় কাটিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল কবিতা, প্রায় টানতে টানতে সৌমিককে লালজিবাবার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল,—এই আমার ছেলে, গুরুদেব।

লালজিবাবা নিম্নস্বরে এক বয়স্কা সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। ঘুরে তাকালেন—ও তুই? তুইই সৌমিক?

সৌমিক হাত জোড় করে নমস্কার করতে যাচ্ছিল, প্রথম সারিতে উপবিষ্ট ক্ষীণতনু বাসুদেব তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। ছেলের কানে ফিসফিস করে বলল, করছিস কী? মাথা নোওয়া, প্রণাম কর।

লালজিবাবা বুঝি অন্তর্যামীর মতো টের পেয়ে গেলেন কথাগুলো। স্মিত মুখে হাত তুললেন,—থাক বাবা। মাথা নোওয়ালেই কি আর বেশি সম্মান জানানো হয়?…আয় সৌমিক, আমার কাছে এসে বোস।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসল সৌমিক। একটু জড়োসড়ো হয়ে। ঘরসুদ্ধ লোক হাঁ করে দেখছে, কেমন যেন সঙের মতো লাগছে নিজেকে।

লালজিবাবা সৌমিকের মাথায় হাত রাখলেন,—তোর মা তোকে নিয়ে মিছিমিছি বড় উতলা হয়। এমন সুন্দর বুদ্ধিমান ছেলে কটা মায়ের কপালে জোটে রে? …তোরই বিয়ে তো?

—হ্যাঁ। ওই মণিদির মেয়ের সঙ্গে। আপনিই তো ছবি দেখে জোড় মেলালেন।

সৌমিকের হাতের চেটোটা টিপছেন লালজিবাবা। দৃষ্টি সৌমিকের কপালে। বলে উঠলেন,—রাজযোটক। অনন্ত সুখ। অপার ঐশ্বর্য।

মণিদীপাও ধড়মড় করে উঠে এসেছে,—মাঘের কোন তারিখটা তবে স্থির করব গুরুদেব?

—সাতের পরে, কুড়ির আগে। মঙ্গল কিংবা শনি নয়।

—ন তারিখটা বুধবার আছে গুরুদেব।

—ওই দিনই কর তবে। শুভস্য শীঘ্রম। আবার সৌমিকের হাতের চেটো টিপছেন লালজিবাবা,—কী রে, মেয়েকে দেখেছিস?

কবিতা তড়িঘড়ি বলে উঠল,—আপনি যখন ঠিক করে দিয়েছেন, ও আর কী দেখবে গুরুদেব?

—তবু আজকালকার ছেলে-মেয়ে, ওরা একটু পরস্পরকে দেখে নেবে না?

—ছবি দেখেছে। পছন্দও হয়েছে।

—বেশ।… বুঝলি সৌমিক, মানুষের জন্ম মৃত্যু বিয়ে সবই তাঁর হাতে। শুধু জন্ম মৃত্যু বিয়ে কেন, সব কিছুই। এই যে সূর্য উঠছে, অস্ত যাচ্ছে, চাঁদ উঠছে, তারা ফুটছে, এ তো সবই তাঁরই ইচ্ছের নিয়মে বাঁধা। তিনি চেয়েছেন বলেই আমরা আছি, তিনি না চাইলে নেই। এটা বুঝলেই সংসারে আর সুখের কমতি থাকে না। বুঝলি?

গুরুদেবের বলার ভঙ্গিটি চমৎকার। মোহাবিষ্টের মতো মাথা নেড়ে ফেলল সৌমিক,—হুঁ।

—তোরাও খুব সুখী হবি। যা, বিয়ের পর একবার জোড়ে দেখা করে যাস কিন্তু।

ছাড়া পেয়ে বাঁচল সৌমিক। তিরবেগে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বুকের গভীরে আন্দোলিত হচ্ছে লালজিবাবার কথাগুলো। তোরা খুব সুখী হবি! দয়িতাই তার সুখের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে এই ধরণীতে! অথবা দয়িতার জন্য সে। ভাবনাটায় কী অদ্ভুত এক তৃপ্তি আছে। প্রশান্তি আছে। দয়িতার কোন গুণ দেখে সে দিন বিমোহিত হয়েছিল সে? কথা বলার স্বচ্ছ অনাড়ষ্ট ভঙ্গি? আপরাইটনেস? খ্যাপামো? নাকি অন্য কিছু, যা ব্যাখ্যার অতীত?

পায়ে পায়ে সৌমিক আশ্রমের গেটে এল। অনাগত ভবিষ্যতের ছবি ভেসে উঠছে মনশ্চক্ষে। বিশাল উঁচু স্কাইস্ক্র্যাপারের একদম ওপরতলার ফ্ল্যাট। প্রশস্ত ব্যালকনিতে পাশাপাশি দুটো বেতের আরামকেদারা। মুখোমুখি বসে আছে এক প্রৌঢ় দম্পতি। কারা ওরা? সৌমিক আর দয়িতা না? কপালে অনেক ভাঁজ পড়ে গেছে সৌমিকের, দয়িতারও চুলে বয়সের রং। কী নিয়ে যেন কথা বলছে দুজনে। কী কথা? আকাশে কান পাতল সৌমিক। সেই কবে মেলার মাঠে ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল সৌমিক, তারই গল্প বলতে বলতে হেসে খুন হচ্ছে দয়িতা। কী চোখ, ওই বয়সেও বিজলি হানছে চোখে! কেঁপে কেঁপে উঠছে প্রৌঢ় শরীর! এই কি অনন্ত সুখ?

ছবিটা ছিঁড়ে গেল সহসা। কোথা থেকে যেন কান্নার রোল ভেসে আসছে! সৌমিক ইতিউতি তাকাল। আশ্রমের পাঁচিল ঘেঁষে একটা বড়সড় বাড়ি, দেখে মনে হয় ধনী গৃহ, আওয়াজটা আসছে ওখান থেকেই। বাড়িটার সামনেও ছোটখাটো এক জটলা। ঈষৎ কৌতূহল জাগল সৌমিকের, এগোল বাড়িটার দিকে। ভিড় থেকে বেরিয়ে আসছে একটা মোটাসোটা লোক, হাতে বাজারের থলি।

সৌমিক তাকেই শুধোল,—কী হয়েছে দাদা?

—মারা গেছে। লোকটার উদাসীন উত্তর।

—কে মারা গেছে?

—উকিলবাবু। বুড়ো খুব লড়ছিল কদিন, টেঁসে গেল।

—কী হয়েছিল?

—বেশি পয়সা থাকলে যা হয়। সেরিব্রাল।…

মৃত মানুষের সম্পর্কে এমন চ্যাটাং চ্যাটাং মন্তব্য শুনতে ভাল লাগছিল না সৌমিকের, চুপচাপ ফিরে এল আশ্রমে। দূর থেকে দেখতে পেল একটা বেদিতে রুমালচোর খেলার ভঙ্গিতে বসে আছে দু জোড়া স্বামী স্ত্রী। কবিতা-বাসুদেব। প্রবীর-মণিদীপা।

তাকে দেখতে পেয়েই হাতের ইশারায় ডাকল মণিদীপা। সৌমিক কাছে যেতেই বলল,—কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছ? এসো, কথা বলি।

সৌমিক সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করল,—বলুন।

—তোমাকে তো সামনের সপ্তাহে একদিন আসতে হবে বাবা।

—কেন বলুন তো?

—তোমাকে একটু মুনিয়ার বাবার সঙ্গে বেরতে হবে যে। স্যুটের মাপ দিতে হবে, পাঞ্জাবির মাপ দিতে হবে।…আমিও থাকব।

—ও।

—তা ছাড়া বুম্‌বার সঙ্গেও একদিন আলাপ করে যাও এসে। সে তো অলরেডি তোমার ফ্যান বনে গেছে।

—কেন? সৌমিক ভুরু তুলল,—আমার মধ্যে কী আছে?

—আরে ওই যে তুমি বলেছ মুনিয়াকে এমনি দেখবে না, একেবারে ছাদনাতলায় দেখবে, ওটাই বুম্‌বাকে দারুণ ইমপ্রেস করেছে। সবাইকে বলছে, দিদির জন্য এরকমই একটা স্মার্ট ডেয়ারডেভিল ছেলে দরকার ছিল।

সৌমিক হেসে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে এও টের পেল দয়িতা, থুড়ি মুনিয়া, সে দিন তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কথাটা এখনও বাড়িতে অপ্রকাশ্য রেখেছে।

মণিদীপাও মিটিমিটি হাসছে। শাশুড়ি নয়, শ্যালিকার স্বরে রঙ্গ করল,—তা তোমরা হানিমুনে কোথায় যাচ্ছ?

—না মানে…

—এখনও ঠিক করোনি? এর পর তো টিকিট পাবে না। কোথায় যাবে ভাবছ? পাহাড়ে?

সৌমিক মনে মনে বলল,—আমি ঠিক করার কে? দয়িতা যেখানে যেতে চাইবে, সেখানেই যাব।

কবিতা ঝপাং করে বলে বসল,—না না, শীতকালে ওরা পাহাড়ে যাবে কি? সমুর ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আমার মনে হয় ওদের গোয়া-টোয়ার দিকে যাওয়াই ভাল।

—কিংবা ওয়ালটেয়ার। বাসুদেব সমর্থনের আশায় স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল। ভয়ে ভয়ে বলল,—কিংবা পুরী, গোপালপুর।

বিষম ক্রোধে সৌমিকের ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। ভেবেছে কী কবিতা বসুরায় অ্যান্ড কোম্পানি? বিয়েতে রাজি হয়েছে বলে কি ধরে নিয়েছে আবার তাদের খাঁচায় ফিরে এসেছে সৌমিক? এবং তার মধুচন্দ্রিমাও নিয়ন্ত্রিত হবে এদেরই অঙ্গুলি হেলনে? বিয়েটা হয়ে গেলেই শোধ নেবে সৌমিক, প্রথম সুযোগেই দয়িতাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে। তার বউয়ের ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগই দেবে না কবিতাকে। নিজের স্বামীকে বগলের চাপে স্যান্ডুইচ করে রেখে দিয়েছে, গলা টিপে ধরে রেখেছে লোকটার ব্যক্তিত্বের, তাকে নিয়েই থাকুক বাকি জীবন।

মণিদীপা বেশ বুদ্ধিমতী মহিলা। সৌমিকের অসন্তোষ আঁচ করে ফেলেছে। কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল,—কবিতাদি, আমরা কিন্তু ওদের জন্য এমনি ইংলিশ খাটের অর্ডার দিচ্ছি। বক্স খাট দিলে কি ভাল হত?

—সে তুমি তোমার মেয়ে-জামাইকে যা দেবে…। আগেই তো বলেছি, আমাদের কিচ্ছু চাওয়ার নেই।

—মুনিয়ার বাবা বলছিল, মেয়েকে আলাদা করে ড্রেসিংটেবিল দেওয়ার দরকার নেই। আজকাল তো সবাই দেয়ালেই আয়না লাগিয়ে র‍্যাক ট্যাক ফিটিং করে নেয়। সেটাই মডার্ন হয়, কী বলো?

—যা ভাল বোঝে।… তোমরা কি ফ্রিজ দিচ্ছ? দিলে কিন্তু ভাই বড়টা দিয়ো। ফ্রস্ট ফ্রি।

—কোন কোম্পানির দেব?

—সবই তো এক। উনিশ আর বিশ। তবে ভাই ওয়াশিং মেশিন দিলে কিন্তু ওইটা দিয়ো…ওই যে কী একটা নতুন বেরিয়েছে…

এটাই কি তবে দেনাপাওনার মডার্ন ফর্ম? অসহ্য অসহ্য, অথচ কোনও সিন ক্রিয়েট করতে পারবে না সৌমিক। আশ্চর্য, মণিদীপাও কী অবলীলায় মেনে নিচ্ছে কবিতার বায়নাক্কা।

দুই গুরুবোনের বকধার্মিক আলাপচারিতার মাঝে কখন যেন উঠে গিয়েছিল প্রবীর, বোধ হয় ধূমপান সারতে। ফিরে এসেই তাড়া লাগাচ্ছে,—কী গো, প্রায় একটা তো বাজে, পেটপুজোর কী হবে?

মণিদীপা কলকল করে উঠল,—আসার পথে এত কিছু খেলে, কচুরি সিঙাড়া জিলিপি…এর মধ্যেই খিদে পেয়ে গেল? আমার তো বাবা পেট এখনও গজগজ করছে।

প্রবীর কাঁচুমাচু মুখে বলল,—কী করি বলো, এ তোমাদের আশ্রমের জলহাওয়ার গুণ।

বাসুদেব বলল,—প্রসাদ তো রেডি হয়ে গেছে, গেলেই হয়।

—চলুন তবে।

খাবার ঘরে পংক্তিভোজনের সুচারু বন্দোবস্ত। অন্তত শ’খানেক লোকের পাত পড়েছে একসঙ্গে। নিরামিষ হলেও মেনু মন্দ নয়, পোলাও ডাল সবজি চাটনি মিষ্টি, যে যত পারো খাও। মাসিক একশো এক টাকা করে আশ্রমে চাঁদা পাঠায় অন্তত হাজার খানেক ভক্ত, ভগবান এখানে একটু তো ভালমন্দ খাবেনই।

সৌমিকের আহার বেশ গুরু হয়ে গেল। আঁচাতে না আঁচাতেই ভারী হয়ে এল চোখের পাতা। বাসুদেব-প্রবীর আর মণিদীপা-কবিতায় জোর মেশামেশি চলছে এখন, সন্ধের আরতি না দেখে কেউ এখান থেকে নড়বে না।

সৌমিক হাঁটতে হাঁটতে পুকুরধারে এল। শিরীষতলার বেদিতে গড়াচ্ছে। অলস মেদুর মধ্যাহ্ন এখন দয়িতায় মাখামাখি। উঁহু, মুনিয়া মুনিয়া মুনিয়া…! কোথায় যেন একটা পাখি ডেকে উঠল। অচিন পাখি। পাখিটার ডাক বুকে নিয়ে ঘুমে তলিয়ে গেল সৌমিক।

ঘুম ভাঙল এক আশ্চর্য অপরাহ্নে। চোখের সামনে এক কোমল গোলাপি আকাশ, পাশেই এক শীতল পুষ্করিণী, স্বচ্ছ জলের মাথায় শীতের সমাখা পাতলা পাতলা কুয়াশা, বাতাসে হিমরেণু। এক লয়ে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে কোথাও। কোথায় হচ্ছে? এই পৃথিবীতেই কি?

অদ্ভুত এক মন-কেমন-করা অনুভূতি নিয়ে একটুক্ষণ আচ্ছন্নের মতো শুয়ে রইল সৌমিক। শীত করছে বেশ, কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ছেলে পুকুরের বাঁধানো শানে বসে একটার পর একটা ঢিল ছুড়ছে জলে। কেমন যেন গভীর আত্মমগ্ন ভাব ছেলেটার। ডুবে আছে উদাসীন খেলায়। যেন গাছ পুকুর আকাশের মতো সে-ও এক নীরব অস্তিত্ব মাত্র। ছেলেটি পোশাকে আসাকে বেশ আধুনিক, বয়স কোনওভাবেই কুড়ি-একুশের বেশি হবে না, এই রকম ছেলেরা সচরাচর এমন ভাবে চুপ মেরে বসে থাকে না। ছেলেটার মুখমণ্ডলে ভগবৎ প্রেমে আপ্লুত ভাবও নেই। প্রকৃতিপ্রেমিক?

সৌমিক তেমন আলাপি নয়, তবু কথা বলতে ইচ্ছে করল ছেলেটার সঙ্গে। মৃদু স্বরে, প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে বলল,—হ্যালো?

ছেলেটা চমকে ফিরল। প্রত্যুত্তর করল না কোনও।

পাশে এসে বসল সৌমিক,—দিনটা আজ খুব সুন্দর, তাই না?

ছেলেটা অস্ফুটে বলল,—হুঁ।

—বাড়ির সবাই কোথায়? মন্দিরে?

—আমি একা।

একা শব্দটার মধ্যে এক গাঢ় নির্জনতার আভাস পেল সৌমিক। যেন এই মুহূর্তে তার একা থাকাটাও প্রতিফলিত হল ওই শব্দে। একটু বুঝি কৌতূহলও জাগল।

সৌমিক আলগা স্বরে বলল,—একা কেন?

—এমনিই।

—এখানেই থাকা হয়?

—নাহ, কলকাতায়। এখানে আমার মামারবাড়ি। পাশেই।

—মামারবাড়ি ছেড়ে আশ্রমে যে? সৌমিকের ঠোঁটে দাদাসুলভ হাসি,—সমবয়সী সঙ্গীসাথী নেই বুঝি?

ছেলেটা দুঃখী চোখে তাকাল,—আমার দাদু মারা গেছেন আজ। সবাই এখন শ্মশানে।

—ও, আচ্ছা। সরি। …এই সকালেই যিনি মারা গেলেন? পাশের বাড়িতে?

—হুঁ।

—তা সকলের সঙ্গে শ্মশান যাওয়া হয়নি কেন?

—আমার শ্মশান ভাল লাগে না। আই হেট ডেথ।

—বাট ডেথ ইজ ডেসটিনি। সৌমিক একটু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল।

—আই হেট ডেসটিনি টুউ।

বেশ তেজী আছে তো ছেলেটা!

—নামটা জানতে পারি? সৌমিক জিজ্ঞেস না করে পারল না।

—কার? আমার?

—ইয়েস।

—শুদ্ধসত্ত্ব মজুমদার।…আপনি?

—আমি সৌমিক বসুরায়।

আলাপটা হয়েই গেল। সৌমিক জানতেও পারল না নিয়তিকে ঘৃণা করা এই ছেলেটির সঙ্গে আলাপ হওয়াই আজ তার নিয়তি ছিল।

ঠিক নিয়তি কি? না নিয়তির পরিহাস?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *