২০. ঋতুচক্র যেন বদলে গেছে

২০.

ঋতুচক্র যেন অনেকটাই বদলে গেছে এ বছর। জ্যৈষ্ঠ প্রায় পড়তে চলল, অথচ এখনও একটাও কালবৈশাখীর দেখা নেই। বৈশাখ মাসে বাতাস বেশ শুকনো থাকে, রোদের তাপ গা ঝলসে দেয় বটে, কিন্তু সন্ধে হলেই ভারী মনোরম এক হাওয়াও বয়। এই শহরের নিজস্ব হাওয়া, গঙ্গা নদীর গন্ধ মাখা।

এ বছর সবই কেমন উলটোপালটা। কোথায় গেল ধুলোর ঝড়, কোথায় বা সেই বাতাস, সব যেন নিরুদ্দেশে চলে গেছে। এখন চব্বিশ ঘণ্টাই শুধু উৎকট গরম। থমথমে। প্যাচপ্যাচে। ভ্যাদভ্যাদে। পাখার নীচেও স্বস্তি নেই, ঘাম হচ্ছে অবিরল। বাতাসে এত আর্দ্রতা, অথচ আকাশ ঝকঝকে নীল। এ যেন বৈশাখ নয়, এ যেন নির্মেঘ ভাদ্র।

বদল ঘটে গেছে বোধিসত্ত্বরও। অনেকটাই। অন্তত দয়িতার চোখে। যে মানুষটা কদিন আগে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিল, সেও আত্মমগ্ন ছিল বটে, তার কিছুটা পরিচয় দয়িতা আগে পেয়েওছে, কিন্তু বার্লিন-প্রত্যাগত বোধিসত্ত্ব মজুমদার যেন তার চেয়েও অন্য কিছু। নিজের অস্তিত্বের বাইরে গোটা বিশ্ব সম্পর্কেই সে যেন অচেতন এখন। ভীষণ বইকুনো হয়ে গেছে বোধিসত্ত্ব, নিজের গবেষণার বাইরে আর কোনও কিছুতেই সে এখন আগ্রহী নয়।

আগ্রহ নেই দয়িতাতেও। বিন্দুমাত্র না। আজকাল দয়িতার সঙ্গে দিনান্তে একটিও কথা হয় কি না সন্দেহ। বড় জোর খাবার টেবিলে দু-চারটে হেঁড়া ছেঁড়া সংলাপ। আশ্চর্য, দয়িতার শরীরও যেন আর টানে না বোধিসত্ত্বকে। আগে পড়াশুনোর সময়ে দয়িতা পাশে গিয়ে দাঁড়ালে বোধিসত্ত্ব কাছে টেনে নিত দয়িতাকে, নিজের কাজকর্ম সম্পর্কে বোঝাত, সঙ্গে সঙ্গে চলত লঘু শরীরী খেলা। চুমু খাচ্ছে, তারকার নোভা থেকে সুপার নোভা হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করছে, হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে দয়িতার দেহে, কাল্পনিক কালের অস্তিত্ব বোঝাচ্ছে…। ওফ্‌, সে কী অসহ্য পুলক! দয়িতার শরীর যেন লক্ষ সেতার হয়ে বেজে উঠছে! মাঝে মাত্র কটা দিন তো গেছে, এখন যেন পড়ার ঘরে দয়িতার উপস্থিতিটাও টের পায় না বোধিসত্ত্ব। গভীর রাতে যখন বিছানায় এসে শোয়, তখন যেন পোড়া কাঠ। দয়িতা বেশ কয়েকবার নিজে থেকে এগিয়েছে, নির্লজ্জ হয়েছে, তবু জাগাতে পারেনি বোধিসত্ত্বকে।

মাত্র কদিনেই দয়িতা পুরনো হয়ে গেল?

না কি দয়িতার সন্তান হবে, এই সংবাদটাই নিরুত্তাপ করে দিয়েছে বোধিসত্ত্বকে?

কিংবা দয়িতা সন্তান নষ্ট করবে না জেনে ক্ষুব্ধ হয়েছে বোধিসত্ত্ব?

দয়িতা কোনওটাই পুরোপুরি মানতে পারে না। মানতে ইচ্ছে করছে না দয়িতার।

মাত্র ক’মাসেই বোধিসত্ত্বর কাছে দয়িতার সব রহস্য ঘুচে গেছে, এও কি সম্ভব?

উঁহু, বাচ্চা নষ্ট না করা নিয়ে তেমন ক্ষোভ আছে বলেও তো মনে হয় না। তেমন থাকলে নিশ্চয়ই কোনও না কোনও মুহূর্তে টের পেত দয়িতা। বোধিসত্ত্ব মোটেই আবেগ গোপন করতে পারে না, দয়িতা জানে।

বোধিসত্ত্ব যেদিন বিদেশ থেকে ফিরল, সেদিনই দয়িতা বোধিসত্ত্বর গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল,—অ্যাই, রাগ কোরো না প্লিজ, আমি কিন্তু তোমার কথা শুনিনি।

ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল বোধিসত্ত্ব,—কী কথা?

—বারে, তুমি আমাকে ফোনে বললে না…? দয়িতা ফিক করে হেসেছিল,—যে আসছে সে আসুক না। আমার খুউব ইচ্ছে করছে…ছেলে হলে কী নাম হবে বাছা শুরু করে দিয়েছি, মেয়ে হলেও।…

বোধিসত্ত্ব নিষ্পলক দেখছিল দয়িতাকে। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল। শুনেই যে ফোনে অত চিৎকার করল, ঘোর অমত থাকলে মোটেই সে সামনাসামনি ওভাবে চুপ করে যেত না। প্রথম প্রতিক্রিয়ায় নিশ্চয়ই লজ্জা পেয়েছিল বোধিসত্ত্ব। বুড়ো বয়সে বাবা হওয়া বলে কথা! তার ওপর বিচ্ছেদের মামলাটাও এখনও চোকেনি…।

মনে মনে যুক্তি সাজিয়ে মনকে প্রবোধ দিচ্ছে দয়িতা। তার ওপর বোধিসত্ত্বর আকর্ষণ ফুরিয়ে গেছে, এ ধারণাটাই বোধহয় মনগড়া। দয়িতার বোঝা উচিত, তপস্বী যখন ধ্যানে বসে তখন তার আর বাহ্যজ্ঞান থাকে না। বার্লিনের সেমিনার বোধিসত্ত্বকে অনুপ্রাণিত করেছে, প্রফেসর বোধিসত্ত্ব মজুমদার এখন মহাশূন্যে মগ্ন এক পরিপূর্ণ বিজ্ঞানী। হয়তো এই আত্মভোলা দশা এখন চলবে বেশ কয়েক মাস। দয়িতা মিছিমিছি তাল বেতাল ভাবে কেন?

শুধু দয়িতা কেন, কোন জাগতিক ব্যাপারেই কি এখন হুঁশ আছে বোধিসত্ত্বর? কদিন ধরেই ফোন করছিল বোধিসত্ত্বর ভাই, দুম করে একদিন নিজেই এসে হাজির। সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে এই প্রথম। আপাত কারণ, বোধিসত্ত্বর একটা দেড় লাখ টাকার ইনশিওরেন্স পলিসি ম্যাচিওর করেছে, কাগজপত্র এসে পড়ে আছে লেক টেরেসের বাড়িতে, ভাই বারবার ডাকা সত্ত্বেও দাদা যাচ্ছে না, তাই ভাই নিজেই এসে…। সম্ভবত শুধু চিঠি পৌঁছে দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল না, দেশে ফিরেও দাদা কেন একবারও ও বাড়ি মাড়াল না তাই নিয়ে কৌতূহল ছিল, অথবা উদ্বেগ। সম্ভবত কেন, তাইই। ওই ভাইকেই বা বোধিসত্ত্ব পাত্তা দিল কই? কী, কেমন আছিস, বাবা মার কী খবর গোছের খানকয়েক উত্তাপহীন প্রশ্ন, ব্যস। বেচারা ভাই আড়ে আড়ে দয়িতাকে দেখতে দেখতে চলে গেল। যেন দয়িতাই বোধিসত্ত্বকে পরিবার সম্পর্কে নিষ্পৃহ করে দিয়েছে।

আহা রে, পারলেও দয়িতা তা করবে কেন? ওই বিরাট মাপের মানুষটাকে সে কি অত ক্ষুদ্রতার মাঝে টেনে নামাতে পারে?

এত সব দয়িতা ভাবে বটে, তবুও মনটা কেমন যেন খচখচ করে। করতেই থাকে। ফ্ল্যাটের শব্দহীনতায় কখনও সখনও চোরা গুমসুনির ঘ্রাণ পায় দয়িতা। মনে হয় যেন কোনও এক অজানা সমুদ্রে ঘনীভূত হচ্ছে নিম্নচাপ, দয়িতার অজ্ঞাতেই। যে কোনও মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়বে এই সংসারে।

বুক ঢিপঢিপ করে দয়িতার। কেন এত বদলে গেল বোধিসত্ত্ব?

এ কি শুধুই বিজ্ঞানের সাধনা? নাকি অন্য কিছু?

আজকাল কম্পিউটার ফাঁকা পেলেই আঙুল নিশপিশ করে দয়িতার। বোধিসত্ত্ব বিদেশে থাকার সময়ে সে কম্পিউটার শেখার একটা বই কিনেছিল, তাই দেখে দেখে হাত মকশো করছে। ভাল লাগে বেশ, এ যেন এক নতুন ভাষা শিক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য একটা ক্ষীণ আশাও জাগে। গুচ্ছের চাকরির দরখাস্ত ছেড়েছে, কোথায় কখন এই সামান্য জ্ঞানটুকু কাজে লেগে যায়!

আজ কম্পিউটারের ইঁদুরকে ওঠা নামা করাতে করাতে দয়িতা বারবার আনমনা হয়ে পড়ছিল। কদিন ধরে শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে, গা গুলোনো ভাব বেড়ে গেছে ভীষণ। একটু কিছু খেলেই হড়হড় করে বমি। একবার ডাক্তারের কাছে যাবে কি?

কথাটা মনে হতেই কে যেন বুকের ভেতর বেহালার ছড় টেনে দিয়ে গেল। বোধিসত্ত্বরই তো এ সময়ে দয়িতাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত, নয় কি? কিন্তু সে এক অলীক সম্ভাবনা। দয়িতা বাঁচল কি মরল, সুস্থ না অসুস্থ, খেয়ালই করে না বোধিসত্ত্ব। আজও খাবার টেবিলে বই মুখে বসে ছিল বোধিসত্ত্ব, বেসিনে ওয়াক ওয়াক করছিল দয়িতা, লোকটা একবার চোখ তুলে তাকালও না। দয়িতা আদৌ ডাক্তার দেখিয়েছে কি না, কোনও ওষুধ খাচ্ছে কি না, জিজ্ঞেস করে কখনও? যেচে দয়িতা বলল তো শুনল, ব্যস ওই পর্যন্ত। নাহ্‌, দয়িতাকে একাই ছুটতে হবে।

পলকের জন্য রাখীকে মনে পড়ল দয়িতার। ছেলে হওয়ার আগে ওই মহিলারও কি এই দশা হয়েছিল? আহা রে বেচারা, এত বছর ধরে ঘর করেছে বোধিসত্ত্বর, না জানি কত কঠিন পথ পার হতে হয়েছে তাকে! তবু সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে পারল না!

চোরা বিদ্বেষের বদলে রাখীর ওপর দয়িতার একটু একটু করুণাই জন্মাচ্ছে ইদানীং। কত সেবাযত্ন করেছে, কত খিদমত খেটেছে, সবই বিফলে গেল রাখীর। সৌমিক সেদিন আড়ে ঠারে বোঝাচ্ছিল মহিলার নাকি খুব তেজ…! হয়তো তেজ নয়, হয়তো অভিমান জমে পাথর হয়ে গেছে বুকে! মাত্র কটা দিন তো ঘর করছে দয়িতা, এর মধ্যেই তার হৃদয়েও কি বাষ্প জমেনি?

ভাবনার মাঝেই ডোর-বেল!

ইনস্টিটিউট থেকে ফিরল বোধিসত্ত্ব। মুখমণ্ডলে স্বভাবসুলভ দূরমনস্কতা।

অন্যদিন এ সময়ে বিশেষ কথা হয় না। আজ নিরালা দুপুরের বিষণ্ণতা মুছতে দয়িতা জোর করে একটু উচ্ছল হল। তরল গলায় বলল,—কী স্যার, আজও অফিস কাটলে?

বোধিসত্ত্ব উত্তর দিল না। জুতো ছেড়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকল। শার্ট ছাড়ছে।

পিছন পিছন দয়িতা। ঠোঁট টিপে বলল,—এক্ষুণি কাজ নিয়ে বসবে নাকি? কী বিশ্রী গরম, একটু রেস্ট নিয়ে নাও।

—আমার জিরোনোর সময় নেই। বোধিসত্ত্বর গলা যেন ঈষৎ রুক্ষ,—শুয়ে বসে থাকার জন্য আমি বাড়ি ফিরিনি।

—আহা, আমি কি ওরকম বিশ্রামের কথা বলেছি? দয়িতা মুচকি হাসল,—একটু কথাও তো বলতে পারো আমার সঙ্গে। কিংবা ধরো আমায় কিছুক্ষণ কম্পিউটার শেখালে…। কাছে এগিয়ে বোধিসত্ত্বর বুকে হাত রাখল দয়িতা,—অ্যাই, আমায় একটু ইন্টারনেটের অপারেশনটা দেখিয়ে দেবে?

বোধিসত্ত্ব দয়িতার হাতটা নামিয়ে দিল,—আমার এখন ওয়েস্ট করার মতো সময় নেই।

—বাব্বাহ্‌, কী রাগ! দয়িতা ভ্রূভঙ্গি করল,—ঠিক আছে, কিচ্ছু শেখাতে হবে না।..চা খাবে? নাকি লেবুর সরবৎ?

—আমি সরবৎ খাই? প্রায় খেঁকিয়ে উঠল বোধিসত্ত্ব,—যদি ইচ্ছে হয় তো চা করো। স্টাডিরুমে দিয়ে যাও।

দয়িতার কেমন অচেনা লাগছিল বোধিসত্ত্বকে। মানুষটার ঔদাসীন্য সে দেখেছে, কিন্তু এত তুচ্ছ কারণে বিরক্তি তার অগোচর ছিল। বোধিসত্ত্ব আজ এত রূঢ় কেন? হলটা কী?

বাথরুম ঘুরে বোধিসত্ত্ব পড়ার ঘরে ঢুকেছে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চা নিয়ে হাজির দয়িতা। টেবিলে কাপ নামাতে নামাতে বলল,—মেজাজ আজ এমন চটিতং কেন? ইনস্টিটিউটে কোনও ঝামেলা ঝঞ্ঝাট হয়েছে নাকি?

জবাব না দিয়ে দয়িতাকে ঝলক দেখল বোধিসত্ত্ব। পরক্ষণেই চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।

—হলটা কী আমায় বলবে তো? দয়িতা নরম গলায় বলল, মনে রাগ পুষে রাখলে নিজেরই পড়া হ্যাম্পার করবে।

বোধিসত্ত্ব এবারও নিরুত্তর। চায়ের কাপ টানল।

—তোমার রিসার্চ নিয়ে কোনও প্রবলেম? দয়িতা আলগা হাত রাখল বোধিসত্ত্বর পিঠে,—কোথাও আটকে গেছ?

অকস্মাৎ চায়ের কাপ রেখে লাফিয়ে উঠল বোধিসত্ত্ব। হনহনিয়ে শোওয়ার ঘর থেকে নিয়ে এসেছে একটা সাদা উইনডো খাম। টেবিলে আছড়ে ফেলে বলল,—এটা কী জানতে পারি?

—কী ওটা? দয়িতা অবাক।

—কিছুই বুঝতে পারছ না? বোধিসত্ত্বর স্বর বেশ চড়া।

খাম খুলে চিঠিটায় চোখ বুলিয়েই খুশিতে চলকে উঠেছে দয়িতা,—ওমা, এ তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার! কী কাণ্ড, চাকরিটা হয়ে গেছে?

বলেই বোধিসত্ত্বর দিকে তাকাল। পড়তে চেষ্টা করল বোধিসত্ত্বকে। মিটিমিটি হেসে বলল,—ও, তোমায় আগে থেকে কিছু জানাইনি বলে? কবে ইন্টারভিউটা দিয়েছি জানো? তুমি ফেরার আগে। গত মাসের সাতাশ তারিখে। চাকরিটা যে আদৌ হবে, আমি কি ভেবেছিলাম?

—চাকরির চেষ্টা করছ, তাও তো কখনও বলোনি?

—অ্যাই, বাজে কথা বোলো না। সেদিন খাবার টেবিলেই তো কথা হচ্ছিল…।

—সে তো কথার ছলে কথা। একটা চাকরি পেলে বেশ হয়…একা একা বাড়িতে বসে থাকতে ভাল লাগে না…! তা বলে তুমি যে সিরিয়াসলি চেষ্টা করছ…

দয়িতা একটু আহত বোধ করল। ভার গলায় বলল,—অত বলাবলির কী আছে? সত্যি তো আমি একা, আমার তো একটা কিছু ইনভলভ্‌মেন্ট লাগবেই। আমার নিজস্ব জগৎ। নিজের জানলা।

—সংসার পড়ে থাকবে, আর তুমি চাকরি করতে বেরিয়ে যাবে? তুমি এ কথা ভাবলে কী করে?

—সংসার সংসারের মতো চলবে, এখানে আমার কী করার আছে?

—নেই?

—অফকোর্স নেই। রান্নাবান্না আমি করে রেখেই বেরোব। নইলে লোক রেখে নেব। বলতে বলতে অজান্তেই চোখ বড় হয়ে যাচ্ছিল দয়িতার, সত্যি সত্যি তুমি চাও না আমি চাকরি করি? মেয়েদের চাকরি করা তুমি পছন্দ করো না?

বোধিসত্ত্ব একটুক্ষণ চুপ। তারপর নীরস স্বরে বলল,—দ্যাখো দয়িতা, আমি পিউরিটান নই। আমি প্র্যাগমাটিক। যে ফ্যামিলিতে মেয়েদের চাকরির প্রয়োজন আছে, সেখানে মেয়েরা চাকরি করুক। আমি তাতে কিছু খারাপ দেখি না। কিন্তু তোমার তো সেরকম অভাবও নেই। নেসেসিটিও নেই। বরং তোমার ঘরে থাকা অনেক বেশি জরুরি।

—কেন?

—সবই তোমায় বুঝিয়ে বলতে হবে? তুমি জানো আমি একটা বড় কাজে হাত দিয়েছি। কাজটা আমার পারসোনাল নয়, পৃথিবীর মানুষের জন্য কাজ। এটা আমার মিশান। ফর দিস পারপাস, আমার একজন সর্বক্ষণের সঙ্গী চাই। জাস্ট টু লুক আফটার মি। তুমি নাচতে নাচতে চাকরি করতে বেরিয়ে যাবে, আর আমি হাতের কাছে কাজের জিনিস খুঁজে পাব না…! আমি নিজের কাজের চিন্তা করব, নাকি সাংসারিক ব্যাপার নিয়ে মাথা খারাপ করব?

দয়িতা ক্রমশ স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বোধিসত্ত্ব তাকে কী ভাবে? দেখাশুনা করার লোক? চাকরানি? সেবাদাসী?

এই প্রথম বোধিসত্ত্বর সামনে কঠিন স্বরে কথা বলল দয়িতা,—অর্থাৎ তুমি চাও আমার নিজস্ব কোনও ভুবন থাকবে না, তাই তো?

—তা কেন? স্বাধীন ভাবে তো অন্য কাজও করতে পারো। যেমন ধরো, ওই যে পপুলার সায়েন্সের বইটা লিখব লিখব করছি, তুমি বসে বসে সেটার খসড়া করো। কাজটা তোমার খারাপও লাগবে না। আফটার অল এটাই তোমার লাইন।

—অর্থাৎ কিনা তোমার গণ্ডি টেনে দেওয়া ঘরেই আমায় থাকতে হবে, তাই তো?

বিদ্রূপটা বুঝি বিঁধল বোধিসত্ত্বকে। তেতে যাওয়া গলায় বলল,—এতে অন্যায়টা কী আছে, শুনি? নিশ্চয়ই টিভি কোম্পানির সেল্‌স অফিসার ট্রেনি হওয়ার জন্য ফিজিক্স নিয়ে এম এসসি পড়োনি?

বোধিসত্ত্বকে এখন আর আত্মভোলা বৈজ্ঞানিক বলে মনে হচ্ছে না। যেন সুচতুর কৌশলী এক অতি সাধারণ পুরুষ। অপযুক্তির সুতোয় বাঁধতে চাইছে দয়িতাকে।

দয়িতার ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল,—আমি অন্য চাকরি করলে তুমি মেনে নেবে? একটা স্কুলে লিভ ভ্যাকান্সিতে চাকরি পাওয়ার কথা চলছে। কপালে থাকলে পার্মানেন্ট হয়ে যেতে পারি। সায়েন্স টিচার। পেলে করব?

—যা ইচ্ছে করো। বোধিসত্ত্ব দাঁতে দাঁত ঘষছে। বিড়বিড় করে বলল,—আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।

—কী বোঝা উচিত ছিল? তুমি কি ভেবেছিলে আমি তোমার রাখীর মতো ঘরে বসে দিনরাত জাবর কাটব?

মুখটা পলকে পাংশু হয়ে গেল বোধিসত্ত্বর। প্রায় তক্ষুনি চেঁচিয়ে উঠেছে হঠাৎ,—তুমি থামবে? তুমি যাবে এখান থেকে? উইল ইউ প্লিজ লিভ মি অ্যালোন? তোমার যা প্রাণ চায় তাই করো তুমি। আমি তোমাকে আর কিছু বলব না। ঠিক আছে?

কয়েক সেকেন্ড হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে পায়ে বেরিয়ে এল দয়িতা। মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। শোওয়ার ঘরে এসে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। থিতু করতে চাইছে নিজেকে। ছি ছি, বোধিসত্ত্বর সঙ্গে এই আচরণের কোনও অর্থ হয়? যে লোক চিরকাল সেবা পেতে অভ্যস্ত, দুম করে বউয়ের চাকরি পাওয়া কি সে সহজে মানতে পারে? অন্তত এই বয়সে?

আশ্চর্য, দয়িতা তো নিজেই বোধিসত্ত্বর ছায়ায় থাকতে চেয়েছিল! অথচ আজ যখন বোধিসত্ত্ব তাকে পুরোপুরি নিজের অধিকারে রাখতে চায়, তখন দয়িতা ছটফট করে কেন? তা ছাড়া শরীরের এখন যা অবস্থা, এক্ষুনি এক্ষুনি চাকরি নিলে কদিন করতে পারবে তার ঠিক নেই, তবে কেন মিছিমিছি ঝগড়াই বা করল?

দুম করে রাখীর কথা তুলে নিজেকেই কি ছোট করল না দয়িতা?

সারাটা বিকেল, সারাটা সন্ধে ধিকিধিকি অনুশোচনার আগুনে পুড়ল দয়িতা। বোধিসত্ত্ব পড়ার ঘরেই রয়েছে, মাঝে মাঝে পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকে দেখছিল দয়িতা। ঠিক যেমন ভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত ক্যাম্পাস টাউনের লাইব্রেরিতে কর্মরত বোধিসত্ত্বকে। রাতের জন্য অপেক্ষা করছিল দয়িতা। ঠিক যেমন ভাবে একা একা প্রতীক্ষায় থাকত বোধিসত্ত্বর। চা দিচ্ছে বোধিসত্ত্বকে, কফি দিচ্ছে, রান্নাবান্না সেরে রাতে খেতেও ডাকল, সবই রুটিন মতো। কিন্তু বোধিসত্ত্বর দিকে সরাসরি চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না দয়িতা। যেন সে বোধিসত্ত্বর সহবাসে অভ্যস্ত রমণী নয়, যেন সে সেই ক্যাম্পাস টাউনের ছাত্রী দয়িতা, বোধিসত্ত্বর চোখে চোখ পড়লে যার বুক থরথর…! এই ফ্ল্যাটের আলোগুলোও বড় বেশি প্রখর আজ, দয়িতার বড্ড নার্ভাস লাগছিল।

মাঝরাত পার করে বোধিসত্ত্ব বিছানায় এল। তখনও দয়িতা জেগে। চরাচর নিঝুম হয়ে গেছে। লবণহ্রদের এদিকটায় প্রচুর গাছগাছালি, মাঝে মাঝে রাতচরা পাখির ডাক শোনা যায়। দয়িতা চোখ বুজে পাখির চকিত ডাক শুনছিল।

পাশে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে বোধিসত্ত্ব। হয়তো গরমে। হয়তো বা কোনও জটিল চিন্তায়।

অন্ধকারে বোধিসত্ত্বর ঘনিষ্ঠ হল দয়িতা। গাঢ় স্বরে বলল,—ঘুম আসছে না?

বোধিসত্ত্ব মৃদু স্বরে কী যেন বলল, দয়িতা বুঝতে পারল না।

ফের বলল,—আমি তোমায় খুব হার্ট করেছি, তাই না? আয়াম সরি। বোধিসত্ত্বর নাকে নাক ঘসল দয়িতা,—তুমি যদি না চাও, আমি চাকরি করব না।

—থাক। বোধিসত্ত্ব একটু যেন সরে গেল,—আমার চাওয়া না চাওয়ার কতটুকু তুমি মানো?

—বারে, আমি তোমার কোন কথা মানি না? আমি বলে তোমার মোস্ট ওবিডিয়েন্ট স্টুডেন্ট! দয়িতা খিলখিল হেসে উঠল। জড়িয়ে ধরেছে বোধিসত্ত্বকে। তরুলতা হয়ে। মহীরুহকে। ফিসফিস করে বলল,—আমায় একটু আদর করো, আমায় একটু আদর করো…।

বোধিসত্ত্ব ছাড়াল না নিজেকে, দয়িতার গায়েও হাত রাখল না। শীতল স্বরে বলল,—শোনো দয়িতা, তোমাকে কতকগুলো কথা বলি। আগেও অনেকবার বলেছি, আবারও বলছি, আমি তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়, আমি কোনওভাবেই তোমার ম্যাচ নই। তুমিই আমার ওপর হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়লে। যা সব কাণ্ডকারখানা শুরু করলে তাকে প্রায় পাগলামিই বলা যায়। কথা নেই, বার্তা নেই, আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করলে না, দুম করে বাড়িঘর ছেড়ে চলে এলে। আমার কাছে থাকবে বলে। অর্থাৎ সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল প্রায় একতরফাই। তাই এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তোমার অনেক দায়িত্ব আছে।

—সম্পর্কটা শুধুই একতরফা ছিল? দয়িতার হাত শিথিল হয়ে গেল,—তুমি আমায় ভালবাসনি?

—হ্যাঁ, উইকনেস আমারও ছিল। আমি তা অস্বীকার করছি না। ইন্‌ ফ্যাক্ট আমি তার মূল্যও চুকিয়েছি। ওখানে আমার গবেষণা কত স্মুথলি এগোচ্ছিল। অত দিনের পুরনো পরিবেশ ছেড়ে আমি এক কথায় চলে এসেছি। তোমার জন্য।…জানো, তুমি আমার কাছে আছ বলে যখন চারদিকে ছিছিক্কার পড়ে গেছে, তখন ভাইস চান্সেলার আমায় ডেকে কী বলেছিলেন?…বলেছিলেন, ডক্টর মজুমদার আপনার নামে উড়ো কম্‌প্লেন আসছে। বুঝতেই তো পারছেন, মরাল টারপিচিউডের কেস, একটা এনকোয়্যারি করার কথা উঠেছে…এখন আপনি যদি শুধু একটা রিটন্‌ দ্যান…যে মেয়েটি আপনার সঙ্গে বাস করছে সে আপনার আত্মীয়…শুধু পড়াশুনোর সুবিধের জন্যই আপনার কাছে রয়েছে…ব্যস তা হলেই আমি গোটা ব্যাপারটা উড়িয়ে দেব। আপনার মতো প্রফেসারকে আমাদের ইউনিভার্সিটি লুজ করতে চায় না। আপনি প্লিজ…। আমি কিন্তু তাঁর কথায় এগ্রি করিনি দয়িতা। আই টেন্ডারড মাই রেজিগ্‌নেশান। কারণ মিথ্যাচার আমার স্বভাব নয়। তোমার আমার প্রকৃত সম্পর্কটাকে আমি অন্য কোনও মোড়কে দেখাতে চাইনি। এখানেও তোমায় নিয়ে কে কী ভাবে আমি কেয়ার করি না। একটুক্ষণ অন্ধকার নীরব। তারপর আবার বোধিসত্ত্বর স্বর ফুটেছে। আত্মগত ভাবে বলে উঠল,—তোমাকে আমার কাছে রাখব বলে রাখীকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি। ছেলেকে ত্যাগ করেছি।

—সে তো আমিও সব ছেড়ে…

—ও তো তোমার হুইম্‌স্‌। খেয়াল। যেমন এখনও তুমি তোমার খেয়াল মতো চলছ! তোমার কাছে আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনও মূল্য নেই।

—তুমি আমায় এত বকছ কেন? চাকরি করতে চাওয়া কী এমন অপরাধ?

—অপরাধ কেন হবে, ওটা আমাকে ডিফাই করার একটা উদাহরণ। তুমি অত্যন্ত অবুঝ। ইনসেন্সেটিভ। ইম্‌ম্যাচিওর। গোঁয়ার্তুমি করে পেটের বাচ্চাটাকে নষ্ট করছ না। আমার কথা ভেবেছ একবার? আমার তো মনে হয় তুমি বাচ্চাটারও ফিউচার ভাবছ না। তার কী পরিচয় হবে, সমাজে সে কী ভাবে অ্যাক্সেপ্টেড্‌ হবে…

দয়িতা আহত স্বরে বলল,—যে আসছে সে আমাদের ভালবাসার সন্তান।

—ও সব কেতাবি বুলি ছাড়ো। বি প্র্যাকটিকাল। এটা ইউরোপ আমেরিকা নয়। রাখীর সঙ্গে এখনও আমার ডিভোর্স হয়নি, তাই এক্ষুনি এক্ষুনি তোমায় আমি বিয়েও করতে পারছি না। যদি এই পিরিয়ডে বাচ্চাটা জন্মায়…ছি ছি ছি, আমার তো একটা মানসম্মান আছে! অ্যাট দিস এজ…! শুধু তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম বলে আমায় আরও কত হিউমিলিয়েশান সহ্য করতে হবে, বলো? তুমি আমায় ফোর্স করছ। ব্ল্যাকমেল করছ। আমি ন্যায়ের পথে থাকতে চাই বলে ওই আনওয়ান্টেড চাইল্ডকে আমায় হজম করতে হবে।…এটা কি খুব বাড়াবাড়ি নয়? এবং তারপরও আমি তোমার কাছ থেকে পুরো লয়্যালটি পাব না। যা আমি রাখীর কাছে পেতাম। টোটাল ওবিডিয়েন্স। নিঃস্বার্থ কো-অপারেশান। রাখীরও বিদ্যেবুদ্ধি কিছু কম ছিল না। কিন্তু সে আমার বাইরে নিজস্ব জানলা, নিজস্ব ভুবন এসব কিছু খোঁজেনি।

অন্ধকারকে গাঢ়তর মনে হচ্ছিল দয়িতার। বোধিসত্ত্বর স্বর কী অদ্ভুত রকম আবেগহীন! বিজ্ঞানী নয়, এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুরুষ নির্বিকার ভঙ্গিতে জাহির করছে নিজেকে। দয়িতা আর সহ্য করতে পারছিল না। বুকের মধ্যে দামাল তুফানের দাপাদাপি। দু চোখ ঠিকরে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে আগুন আর জল। সরে গেল বোধিসত্ত্বর পাশ থেকে। দেয়ালের দিকে ফিরে শুয়েছে। নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন।

তীব্র যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে হৃৎপিণ্ড।

পিঠে বোধিসত্ত্বর হাত,—আমার কথা একটু বোঝো দয়িতা। একটু রিয়ালাইজ করার চেষ্টা করো।…এসো কাছে এসো।

দয়িতা ছিটকে সরে গেল,—তুমি আমায় ছোঁবে না। একদম ছোঁবে না।

—আহ্‌, ছেলেমানুষি কোরো না। বোধিসত্ত্ব বদলে যাচ্ছে দ্রুত। জ্বোরো রুগীর মতো তপ্ত হাতে টানছে দয়িতাকে। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল,—অনেক বকেছি, এবার পিস। এসো, আদর করে দিই।

—থাক।

—কেন?

—ভাল্লাগছে না। আমার আদর চাই না।

—কিন্তু আমার যে চাই।

অবিকল কামার্ত বিড়ালের স্বর। গা ঘিনঘিন করে উঠল দয়িতার। বাধাও দিল না, এগিয়েও এল না। নিঃসাড়ে সহ্য করছে যৌন প্রহার।

নিবৃত্ত হল কামনা। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধিসত্ত্ব। নীলচে অন্ধকারে দয়িতা বসে আছে নিঝুম। নিজেকে খুঁড়ছিল। সে আদতে কে এখন? একটা মেয়েমানুষ? শুধুই একটা শরীর? যার হৃদয় থাকতে নেই, বোধ থাকতে নেই, নিজস্ব কিছু চাওয়া পাওয়া থাকতে নেই…! এখন থেকে বুঝি অস্তিত্ব বিলোপের সাধনা শুরু করতে হবে।

অজান্তেই দয়িতার চোয়াল কঠিন হয়ে গেল। দু চোখের মণি জ্বলছে আঁধারে।

.

২১.

আগামী সোমবার থেকে বোধিসত্ত্বদের ইনস্টিটিউটে একটা সিমপোজিয়াম শুরু হতে চলেছে। বিষয়—মিস্ট্রি অব ইউনিভার্স। তিন দিনের এই আলোচনাচক্র ঘিরে কলকাতার গবেষক মহলে এখন দারুণ আগ্রহ। আসছেন বেশ কয়েকজন নামী বিজ্ঞানী। বাঙ্গালোরের প্রফেসর অনন্ত শাস্ত্রী, দিল্লির প্রফেসর নরেন্দ্র মাথুর, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হরিহরণ…! তবে এঁরা নিতান্তই উপগ্রহ মাত্র, প্রফেসর বোধিসত্ত্ব মজুমদারই এক আলোচনাচক্রের মুখ্য আকর্ষণ। বিদেশে সমাদৃত কৃষ্ণগহ্বরের তত্ত্ব নিয়ে স্বদেশে এই প্রথম তাঁর প্রকাশ্য বক্তৃতা।

ইনস্টিটিউটে নিজের রুমে বসে কাগজপত্র ঘাঁটছিল, বোধিসত্ত্ব। বার্লিনে পড়া পেপারটা নতুন করে সাজাচ্ছে, গোছাচ্ছে, আর একটু বিস্তারিত করছে। কাজে মন বসছে না কিছুতেই, চোরা চিন্তারা উঁকি দিচ্ছে ঘনঘন। দয়িতা শেষ পর্যন্ত চাকরিটা নিয়েই নিল? বোধিসত্ত্ব এতবার আপত্তি জানানো সত্ত্বেও? কেন এমন করছে দয়িতা? কী চায়? বোধিসত্ত্ব কি দয়িতার চোখে মূল্যহীন হয়ে গেছে এখন? কিন্তু তা হলে বোধিসত্ত্বর সন্তানকে কেন নষ্ট করল না দয়িতা? মানসিক চাপ তৈরি করার জন্য, যাতে দয়িতাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে বাধ্য হয় বোধিসত্ত্ব? কোনও অজুহাতেই বোধিসত্ত্ব যাতে সম্পর্কটা না ছিঁড়তে পারে তার জন্য একটা পাকাপাকি বন্ধন তৈরি করতে চায়? বোধিসত্ত্ব তাকে পরিত্যাগ করবে, এমন ভাবনাই বা এল কেন দয়িতার? এ কি শুধুই নিরাপত্তাহীনতা? নাকি বোধিসত্ত্বকে অবিশ্বাস? দুটো মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের ভিত তখনই গড়ে ওঠে, যখন দুজনের মধ্যে সত্যিকারের অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়। দয়িতার সঙ্গে কি বোধিসত্ত্বর সেই অন্তরঙ্গতা নেই? যা আছে তবে কি তা শুধুই শরীর? দুটো অসম নারী-পুরুষের কামজ আকর্ষণ? বোধিসত্ত্ব নিজেও কি এখনও সহধর্মিণী হিসেবে ভাবতে পারে দয়িতাকে?

বোধিসত্ত্ব মাথা ঝাঁকাল আপন মনে। সিগারেট ধরিয়েছে একটা। চেয়ার ছেড়ে পায়ে পায়ে জানলায় এসে দাঁড়াল। পিছনে অনেকটা ফাঁকা জমি। গ্রীষ্মের প্রখর তাপে পুড়ছে বন্ধ্যা পৃথিবী। চোখ বুজে ফেলল বোধিসত্ত্ব। মনকে চোখ ঠেরে লাভ নেই, দয়িতা এখনও তার চোখে সেই ছাত্রীই রয়ে গেছে। অথবা তার প্রৌঢ় জীবনের দিকে ধেয়ে আসা এক প্রমত্ত যৌবন। সেই স্বপ্নে দেখা ধুমকেতু। সম্পর্কের এই ফাঁকিটা ধরা পড়ে গেছে বলেই কি এত খেপে গেল দয়িতা? কিন্তু এর জন্য বোধিসত্ত্বকে প্রতি পদে হেয় করে দয়িতার কী সুখ?

—আসতে পারি স্যার?

বোধিসত্ত্ব চমকে ফিরল। শামিম।

লহমায় অধ্যাপকের মুখোশ এঁটে নিয়েছে বোধিসত্ত্ব। চেয়ারে এসে বসল।

স্মিত মুখে বলল,—কখন এলে কলকাতায়?

—এই তো, সকালের ট্রেনে।

—কদিন থাকবে তো এখন?

—হ্যাঁ, নেক্সট উইকটা থেকে যাব ভাবছি। সিমপোজিয়ামটাও অ্যাটেন্ড করব…ঢাকা থেকে আমার আপা আর দুলাভাই এসেছেন, ডাক্তার দেখাতে, ওদের সঙ্গে সঙ্গেও একটু থাকতে হবে…। শামিম চেয়ার টেনে বসল,—আমার পেপারটা পাঠিয়ে দিয়েছি স্যার। ফিজিকাল রিভিউতে।

—গুড। আমার মনে হয় অ্যাকসেপ্টেড হয়ে যাবে।

—আপনার সঙ্গেও কিছু ডিসকাশন ছিল স্যার।…আপনি যে অলীক সময়ের কনসেপ্টটা নিয়ে আপনার পেপারে আলোচনা করেছেন, ওটা নিয়েই…

—হ্যাঁ বলো। বোধিসত্ত্ব নড়েচড়ে বসল।

—ওর ম্যাথ্‌মেটিকাল অ্যাপ্রোচটা একটু অন্যভাবে করা যায় না স্যার? মানে আমি ভাবছিলাম…

টেবিল থেকে কাগজ টেনে নিয়েছে শামিম। খসখস লিখছে। ঝুঁকে দেখল বোধিসত্ত্ব। ছোট্ট একটা মন্তব্য করল। একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে রইল শামিম, আবার মনোযোগী হয়েছে কাগজ কলমে। বেল বাজিয়ে চায়ের অর্ডার দিল বোধিসত্ত্ব, ধীরে ধীরে ডুবছে অনন্ত সময়ে, অলীক সময়ে। প্রশ্ন চলছে, উত্তর চলছে, প্রত্যুত্তর চলছে, কখনও গলা চড়ছে, নামছে, দুজনেরই ক্রমে বাহ্যজ্ঞানরহিত দশা।

হঠাৎ টেবিল থেকে দৃষ্টি উঠেছে বোধিসত্ত্বর। আটকেছে দরজায়। এক অপরিচিত ভদ্রলোক, আড়ষ্ট মুখে দাঁড়িয়ে!

পড়াশুননার মাঝে ছন্দপতন ঘটলে বিরক্ত হয় বোধিসত্ত্ব, তবু স্বভাবসুলভ ভদ্রতা বজায় রেখে জিজ্ঞেস করল,—বলুন, কী ব্যাপার?

—আপনিই তো প্রফেসর মজুমদার? আপনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।

—ও। বলুন?

ভদ্রলোক অস্বস্তি ভরা চোখে শামিমকে দেখল একবার, গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,—দরকারটা পারসোনাল।

শামিম ইঙ্গিত বুঝেছে। একঝলক ভদ্রলোককে দেখল, একবার বোধিসত্ত্বকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়েছে,—আমি তা হলে এখন চলি স্যার।..কাল ফ্রাইডে, কাল যদি দুপুরের দিকে একবার আসি…

—চলে এসো। আমি এর মধ্যে তোমার আরগুমেন্টটা নিয়ে একটু ভাবি।

শামিম বেরিয়ে যেতেই ভদ্রলোককে ডাকল বোধিসত্ত্ব,—প্লিজ বসুন।

বলতে বলতেই আগন্তুককে জরিপ করে নিয়েছে বোধিসত্ত্ব। মধ্যবয়স্ক, প্রায় তারই সমবয়সী হবে। ঝকঝকে সম্ভ্রান্ত চেহারা, পরনে দামি শার্ট প্যান্ট, মুখের আদল যেন কেমন চেনা চেনা। ঝটিতি মগজের কম্পিউটার হাতড়াল বোধিসত্ত্ব। আদৌ আগে লোকটাকে দেখেছে কি?

ভদ্রলোক বসেছে চেয়ারে, তবে কথা বলছে না। কেমন অদ্ভুত স্থির চোখে দেখছে বোধিসত্ত্বকে। ঈষৎ অস্বস্তিবোধ করল বোধিসত্ত্ব। অজান্তেই সিগারেটের প্যাকেটটা টানল একবার, অজান্তেই সরিয়ে রাখল।

খানিক অধৈর্যভাবেই বলল,—হ্যাঁ বলুন কী বলতে চান?

—আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম প্রবীর মিত্র। কথাটা বলে একটুক্ষণ থেমে রইল লোকটা, সম্ভবত বোধিসত্ত্বর মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া ফোটে কি না দেখার অপেক্ষায়। তারপর কেটে কেটে স্পষ্ট উচ্চারণে বলল,—আমি দয়িতার বাবা।

অপ্রত্যাশিত এই চমকের জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না বোধিসত্ত্বর। আমূল ঝাঁকুনি খেয়েছে। হতচকিত স্বরে বিড়বিড় করতে পারল শুধু,—ও…আচ্ছা…নমস্কার…বলুন?

—আপনি কি বলার কিছু রেখেছেন?

স্বরটা কি একটু চড়ায় উঠেছিল প্রবীরের? অন্তত বোধিসত্ত্বর তো সেইরকমই মনে হল। অকস্মাৎ টের পেল কুলকুল ঘামছে। নিজেকে ধমকাল বোধিসত্ত্ব। আশ্চর্য, সে কি দয়িতার ধরা পড়ে যাওয়া কিশোর প্রেমিক? লোকটার সামনে কুঁকড়ে থাকার কোনও কারণই নেই।

বোধিসত্ত্ব জোর করে গলায় ভারিক্কি ভাব আনল,—আপনার আসার উদ্দেশ্যটা কিন্তু এখনও জানতে পারিনি।

হঠাৎ যেন ছায়া ঘনাল প্রবীরের মুখে। ঝুঁকেছে টেবিলে।

সামান্য কাতর স্বরে বলল,—আমি শুধু আপনার কাছে একটা কথাই জানতে এসেছি, প্রফেসর। আপনি এত জ্ঞানী মানুষ হয়েও আমার মেয়েটার এই সর্বনাশ করলেন কেন?

—আপনার ল্যাঙ্গোয়েজটা আপত্তিকর মিস্টার মিত্র। বোধিসত্ত্ব চেয়ারে হেলান দিল। স্বর আরও গম্ভীর,—আমি সজ্ঞানে আপনার মেয়ের কোনও ক্ষতি করিনি। আপনার মেয়ে স্ত্রীর মর্যাদায় আমার সঙ্গে বাস করছে।

—স্ত্রীর মর্যাদায়। কিন্তু স্ত্রী হয়ে নয়।

—এটা একটা টেম্পোরারি অ্যারেঞ্জমেন্ট। আমার সঙ্গে আমার স্ত্রীর ডিভোর্সটা হয়ে গেলেই উই উইল গেট ম্যারেড। বোধিসত্ত্ব খানিকটা বক্তৃতার ঢং আনল গলায়,—শুনুন মিস্টার মিত্র, আপনার সোশাল স্ট্যাটাস সম্পর্কে আমার পরিষ্কার কোনও ধারণা নেই। দয়িতা আমাকে কখনও সেভাবে কিছু বলেনি, আমিও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করিনি। আফটার অল ইটস আ রিলেশন বিটুইন আ ম্যান অ্যান্ড আ উওম্যান। তাদের পরিবার পরিজনরা কখনওই সম্পর্কের ব্যাপারে বিচার্য বিষয় নয়। তবু আমি মোটামুটি অনুমান করে নিতে পারি, যেহেতু আপনি দয়িতার বাবা, আপনি একজন শিক্ষিত স্বচ্ছ মনের মানুষ। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমাদের এই একত্র বসবাস এমন কিছু গর্হিত অপরাধ নয়। এবং বাই ফোর্সও কিছু ঘটেনি। এবং আপনার মেয়ে মাইনরও নয়।

—তবু সমাজের কিছু নিয়ম আছে।

—ঠুনকো নিয়ম। আমি মানি না। বোধিসত্ত্ব মনে মনে যুক্তিগুলো সাজাতে পেরে স্বস্তিবোধ করছিল। সিগারেট ধরাল একটা। কাঠিটা অ্যাশট্রেতে গুঁজতে গুঁজতে বলল,—আরও নিখুঁতভাবে বলতে গেলে, আমরা দুজনেই মানি না।

—শুনেছি আপনার একটি ছেলে আছে। আমার মেয়েরই বয়সী প্রায়। অর্থাৎ আমার মেয়ে আপনার কন্যাসম…

—এর থেকে অনেক বেশি বয়সের ডিফারেন্সে পৃথিবীতে প্রচুর বিয়ে হয়েছে। এবং তার মধ্যে প্রচুর হ্যাপি ম্যারেজও আছে। শেষ কথাটা বলতে গিয়ে একটু বুঝি গলা কেঁপে গেল বোধিসত্ত্বর। আবার গলা কঠিন করে বলল,—তা ছাড়া আমি তো বয়স গোপন করিনি। আপনার মেয়ে সব জেনেশুনেই এই লোকটাকে পছন্দ করেছে।

প্রবীর দু-এক সেকেন্ড চুপ। তারপর বলল, জানতাম। জানতাম আপনি এই কথাগুলোই বলবেন। ইনফ্যাক্ট, এই জন্যই আমি আগে আপনার কাছে আসিনি। আজ কেন যে…! আফটার অল আমি তো বাবা…মেয়েটাকে বুকে করে মানুষ করেছি…আমি ভুলতে পারি না…। প্রবীরের গলা ধরে এল,—আপনি বুকে হাত দিয়ে বলুন তো প্রফেসার, আপনি ন্যায় কাজ করেছেন?

—আমি বিবেকের কাছে কোনও অন্যায় করিনি। আপনার মেয়ে যেভাবে আমার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল, ওকে ফিরিয়ে দেওয়াটাই অন্যায় হত। আর অসম বয়সের কোনও মেয়েকে ভালবাসাটাও অন্যায় নয়।

—বিবেক? আপনি বিবেক দেখাচ্ছেন? প্রবীর সহসা ফুঁসে উঠেছে,—আমার ফ্যামিলিটা যে শ্যাটার্ড হয়ে গেল, তা নিয়ে আপনার বিবেক কিছু বলে না? মুনিয়া…আই মিন দয়িতাকে নিয়ে কত আশা ছিল আমাদের, স্বপ্ন ছিল। ওনলি ফর ইউ…। আপনি কি জানেন শুধু আপনার জন্যই আমার স্ত্রী আজ একজন পার্মানেন্ট হিস্টিরিয়া পেশেন্ট? আমার মেয়েকে নিয়ে চারদিকে হাসাহাসি হয়, আমি প্রাণপণে কান বন্ধ করে রাখি, স্টিল…। আমার মেয়ের পড়াশুনো ঘুচে গেল, কেরিয়ার নষ্ট হয়ে গেল…। কোনও কারণে হয়তো আমার মেয়ের আপনার ওপর দুর্বলতা জেগেছিল, তারই সুযোগ নিয়ে আপনি আমার সরল মেয়েটাকে সিডিউস করলেন! আপনার বিবেক কি এ সব কিছুই দেখে না?

দরজায় টাইপিস্ট ব্রজেন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। পিছনে আর একজন কে যেন। বোধিসত্ত্বর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সরে গেল।

বোধিসত্ত্ব দপ করে জ্বলে উঠল,—আপনি কি আমার বিবেক জাগাতে এসেছেন?

—আমার অত স্পর্ধা কোথায়। আপনি দেশবরেণ্য ব্যক্তি কিংবা বলতে পারেন জগৎবরেণ্য। আপনাদের বিবেকও অন্য ধাতুর। চাইলে নিজের বউকে ছেঁড়া জুতোর মতো ছুড়ে ফেলে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে যথেচ্ছাচার করতে পারেন। হোক না সে মেয়ে আপনার নিজের মেয়ের থেকেও ছোট! আপনাদের সবই মানায়। আপনাদের বিবেক সবই মেনে নেয়। মহৎ লোকদের স্খলন তো তাদের মহত্ত্বেরই লক্ষণ! আপনাদের প্রতিভাই আপনাদের যা খুশি করার লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে! সমাজের থেকে অনেক উঁচু স্তরের মানুষ আপনারা! প্রবীর চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল,—মাপ করবেন, আপনাকে ডিসটার্ব করে গেলাম।…আপনার মেয়ে নেই, থাকলেও হয়তো বুঝতেন না, এই ধরনের ঘটনা আমাদের মতো ঘরোয়া মধ্যবিত্তের কোথায় গিয়ে লাগে।

বোধিসত্ত্ব জোরালো গলায় আর কিছু বলতে পারল না। মিনমিনে স্বরে বলল,—আপনি কিন্তু ওভার ইমোশনাল হয়ে পড়ছেন মিস্টার মিত্র। বি রিজনেবল্‌। আমি আপনার মেয়ের কোনও ক্ষতি করিনি।

—আর ক্ষতি! আপনি যদি আর একজন কাউকে পেয়ে আজ বাদে কাল ওকেও তাড়িয়ে দেন…ওর ইহকাল পরকাল এমনিই ঝরঝরে হয়ে গেছে। প্রবীর দরজায় গিয়েও কী ভেবে ঘুরে দাঁড়াল। সরাসরি বোধিসত্ত্বর চোখে চোখ রেখে বলল,—আমার মেয়ের ফিউচার কী হবে আমি জানি না। তাতে আমার কিছু যায় আসেও না। প্রতিটি মানুষই তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করে। আমার মেয়েও করবে। আপনিও।

প্রবীর চলে গেছে অনেকক্ষণ। একের পর এক সিগারেট ধরাচ্ছে বোধিসত্ত্ব, নেভাচ্ছে, আবার ধরাচ্ছে। কপালের দু পাশের রগ দুটো দপদপ করছে। মস্তিষ্কের কোষে অসহ্য জ্বালা। তীব্র অপমান বিষ্ঠার মতো লেগে আছে গোটা গায়ে।

এত কথা তাকে শুনতে হল? দয়িতার জন্য?

কেন প্রবীর নামের লোকটাকে আগেই বেয়ারা ডেকে ঘাড় ধরে বের করে দিল না বোধিসত্ত্ব? পাতলা পার্টিশনের ওপারে অফিসের লোকদের বসার জায়গা, নির্ঘাত ওখানেও সব কথা শোনা গেছে। ছি ছি, কোথায় রইল বোধিসত্ত্বর মানসম্মান?

চুলোয় যাক কাজ। ভরদুপুরে বাড়ি ফিরে এল বোধিসত্ত্ব। শূন্য ফ্ল্যাটে দাপাচ্ছে। গজরাচ্ছে। প্রবীরের পরুষবাক্যে দয়িতার কোনও হাত নেই, এ কথা আর সুস্থ মাথায় ভাবতে রাজি নয় সে। চক্রান্ত, চক্রান্ত, এ সবই দয়িতার হীন চক্রান্ত। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দয়িতাই তো দায়ী। কে তাকে বিয়ে ভেঙে বোধিসত্ত্বর কাছে ল্যাল-ল্যাল করে ছুটে আসতে বলেছিল? বোধিসত্ত্বর শান্তির সংসার ভাঙার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল কে? দয়িতা। দয়িতাই। এখন ওই দয়িতাই তাকে টেনে আরও পাঁকে নামাচ্ছে।

বিনিময়ে যদি দয়িতার নিঃশর্ত আনুগত্যটুকুও পেত বোধিসত্ত্ব! রাখীর রূপযৌবন না থাক, ওইটুকু তো ছিল! আর খিদের মুখে ওই দুটো নারী-শরীরে কতটুকুই বা তফাত!

জামাকাপড় না বদলেই বোধিসত্ত্ব শুয়ে পড়ল বিছানায়। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে, একটু চা খেলে ভাল হত, কে করে দেবে চা? বাথরুমে গিয়ে হড়াস হড়াস জল ঢালতে ইচ্ছে করছে গায়ে, শরীর যদি একটু জুড়োয়, কে গুছিয়ে দিয়ে আসবে তোয়ালে চপ্পল পাজামা? যার কাছ থেকে এই সামান্য সেবা পাওয়ার কথা, তিনি তো এখন আপন ভুবনে বিভোর!

তখনই বোধিসত্ত্বর দু চোখের পাতা জুড়ে হঠাৎ রাখী রাখী রাখী। কী নিস্তরঙ্গ নিরুদ্বিগ্ন জীবনটাই না ছিল! অসামান্য নিপুণতায় সংসার ভরিয়ে রেখেছিল রাখী। স্বচ্ছন্দ বাতাস হয়ে মিশে ছিল ঘরের আনাচেকানাচে। তার জায়গায় ওই অবুঝ জেদি দয়িতা? হাহ্‌।

বোধিসত্ত্বর জন্য প্রবীর মিত্রের মেয়ের নাকি পড়াশুনো ঘুচে গেল! দয়িতার জন্য বোধিসত্ত্বর একমাত্র সন্তানের কেরিয়ার নষ্ট হয়নি? এ সব ক্ষতির হিসেব কে রাখে?

বাইরেও এখন এক তপ্ত রুক্ষ দুপুর। মাঝ আকাশে অতিকায় হাইড্রোজেন গোলার নিউক্লিয়ার ফিউশন নিষ্ঠুর তাপ ছড়াচ্ছে। পৃথিবীর সিলিকেট স্তরে প্রতিফলিত হচ্ছে, বিকিরিত হচ্ছে সেই তীব্র উত্তাপ। ট্রোপোস্ফিয়ারে হাওয়া বইছে এলোমেলো। শুকনো, আগুনমাখা।

ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিল বোধিসত্ত্বর। অনুশোচনায়। অচেনা কষ্টে। ছটফট করতে করতে উঠে পড়ল, ফ্ল্যাট বন্ধ করে নীচে নেমে এসেছে। কারস্পেসে ঝিমোচ্ছে গাড়ি। বাড়ি পৌঁছেই ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়েছিল, নিজেরও স্টিয়ারিং ধরতে ইচ্ছে করছে না। হনহনিয়ে কম্পাউন্ডের বাইরে এসে বোধিসত্ত্ব দাঁড়াল ক্ষণেক। দ্বিধা সঙ্কোচ কাটিয়ে বিজন রাস্তা থেকে একটা ট্যাক্সি ধরেছে।

ভি আই পি রোড ধরে ছুটছে ট্যাক্সি। বারাসতের পথে।

সচেতন মন্থর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামল রাখী। একতলার বৈঠকখানায় ঢোকার মুখে এক পল বুঝি থেমেছিল, পরমুহূর্তে নিজেকে শক্ত করে নিয়ে চৌকাঠ ডিঙোল।

ভাবলেশহীন স্বরে বলল,—তুমি হঠাৎ?

বৈঠকখানার জানলা সব বন্ধ এখন। ছায়া ছায়া ঘরে সোফায় বসে সিগারেট খাচ্ছিল বোধিসত্ত্ব, মাথা ঝুঁকিয়ে। ধড়মড়িয়ে মুখ তুলেছে।

জ্বলন্ত সিগারেট নিভিয়ে দিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল,-এলাম।

শুধু এই শব্দটুকু শোনার জন্য কত যুগ অপেক্ষা করেছে রাখী! তবু এই মুহূর্তে শব্দটা যেন তেমন অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারল না। বরং কেমন কেজো শোনাল। রাখীর কানের ভুল? নাকি রাখীর মন পাথর হয়ে গেছে?

বোধিসত্ত্ব দেখছে রাখীকে। আধো অন্ধকারে চাহনিটাকে পরিষ্কার পড়তে পারছিল না রাখী। ওই দৃষ্টি এড়াতেই বুঝি জানলা খুলে দিয়ে এল একটা। আলো বাড়ল, সামান্য। স্বস্তিও বাড়ল একটু।

প্রায় স্বাভাবিক স্বরেই রাখী বলল,—অফিস থেকে আসছ?

—হ্যাঁ, মানে…না…মানে বাড়ি থেকেই।

—চা খাবে?

—থাক, তোমায় কষ্ট করতে হবে না।

—আমি কেন কষ্ট করব! শুকনো হাসি ফুটল রাখীর ঠোঁটে, এ বাড়িতে কাজের লোকরাই চা করে।

—ও।…তা হলে বলো।

অন্দরে নির্দেশ দিয়ে ফিরে এসে বসল রাখী। খানিক তফাতে। উলটো দিকের বড় সোফায়।

একটুক্ষণ দুজনেই চুপ। নৈঃশব্দের চাপ বাড়ছে ক্রমশ।

বোধিসত্ত্বই বরফ ভাঙল,—বাড়িটা এত সাইলেন্ট কেন? কেউ নেই?

আর কাকে আশা করছে বোধিসত্ত্ব? বাবুয়াকে? রন্টু মিত্ৰাদের? মিত্রা অবশ্য সত্যিই নেই, গরমের ছুটি পড়তেই ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। রন্টুর কোর্ট এখনও বন্ধ হয়নি। বাবুয়া ইদানীং দুপুরে বাড়ি থাকে না, আজও বেরিয়েছে রোজকার মতো।

কিন্তু বোধিসত্ত্বকে কেন এত খবর দিতে যাবে রাখী! নীরস গলায় বলল,—তুমি নিশ্চয়ই কাগজপত্র সব পেয়ে গেছ? আমি কিন্তু অনেকদিন সইসাবুদ করে পাঠিয়ে দিয়েছি।

—না না, আমি সে জন্য আসিনি। বোধিসত্ত্ব তাড়াতাড়ি বলে উঠল,—জাস্ট তোমরা কেমন আছ দেখতে…আই মিন এমনিই।

রাখীর বিশ্বাস হল না। অমন মুখ কালো করে তাদের দেখতে এসেছে বোধিসত্ত্ব? বিদেয় করা বউ-ছেলেকে? হুঁহ্‌। তাও যদি না সে মানুষটাকে হাড়েমজ্জায় চিনত! যেটুকু চেনার বাকি ছিল তাও তো চিনিয়ে দিয়েছে। নির্ঘাত বিবেকের তাড়নায়…! উঁহু, বিবেক নয়। অহং। এতটুকু না কেঁদে রাখী ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছে, খোরপোশ প্রত্যাখ্যান করেছে, ভাইকে বার বার পাঠিয়েও বাবুয়াকে কবজা করতে পারল না বোধিসত্ত্ব…মানী লোকের মানে তো লাগবেই!

রাখী স্থির চোখে তাকাল,—কেস কবে নাগাদ কোর্টে উঠছে?

—ঠিক জানি না। বোধিসত্ত্বর গলা ঝপ করে নেমে গেল,—লইয়ারকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

—আমার নিশ্চয়ই কোর্টে যাওয়ার দরকার নেই।

বোধিসত্ত্ব উত্তর না দিয়ে চুপ মেরে গেল। ভাবছে কী যেন। সিগারেট ধরাল আর একটা। তামাকের ধোঁয়া পাক খাচ্ছে ফ্যানের হাওয়ায়। ক্ষণিক দুলেই পলকে হারিয়ে যাচ্ছে নীলচে ঘূর্ণি। গন্ধটা তবু রয়ে যায় বাতাসে। উগ্র কটু ঘ্রাণ।

হঠাৎই বোধিসত্ত্ব বলে উঠল,—একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

রাখীর ভুরু জড়ো হল।

—তুমি কি এখনও আমার ওপর…?

রাখীর ভুরুর ভাঁজ আরও ঘন হল।

—বিশ্বাস করো, তখনকার পরিস্থিতির ওপর আমার কোনও কন্ট্রোল ছিল না। রাদার আমি নিজেই পরিস্থিতির শিকার। আমি কখনও তোমায় অপমান করতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম ব্যাপারটার একটা সম্মানজনক সমাধান হোক। উইদাউট হাটিং এনিওয়ান।

কী বলতে চায় বোধিসত্ত্ব? দুজন মেয়েমানুষ নিয়ে একসঙ্গে ঘর করার ইচ্ছে ছিল নাকি? রাখী সেটা বাধ্য স্ত্রীর মতো মেনে নিলে সম্মানজনক সমাধান হয়ে যেত? ইট কাঠ পাথরের মতো রাখী জীবনযাপন করেছে ঠিকই, কিন্তু সত্যি সত্যি সে তো ইট কাঠ পাথর নয়! বোধিসত্ত্ব কি ভুলে গেছে সেই রাতে রাখীকে সে কী কী কথা বলেছিল?

রাখী সোজাসুজি তাকাল,—হঠাৎ এ সব কথা উঠছে কেন?

—ওঠা উচিত নয়, আমি জানি। বোধিসত্ত্ব বড় করে শ্বাস ফেলল,—যাক গে, ছাড়ো। তুমি এখন আছ কেমন?

—কেমন থাকব বলে তুমি আশা করেছিলে? সহসা বুক মুচড়ে ওঠা কান্নাটা হাসি হয়ে ঠিকরে এল রাখীর গলা থেকে,—ভাল আছি, খুব ভাল আছি। রন্টু আমায় মাথায় করে রেখেছে।

—হ্যাঁ, রন্টু তোমায় খুব রেসপেক্ট করে।

রাখী মনে মনে বলল, করেই তো। রন্টু তো চেয়েছিল কোর্টে দাঁড়িয়ে তোমায় লেজেগোবরে করতে, নেহাত এই বয়সে লোক হাসাতে চাইনি বলেই না রন্টুকে জোর করে আটকেছি!

চা এসে গেছে। সঙ্গে হালকা জলখাবার। ফ্রেঞ্চ টোস্ট, সন্দেশ। রাখী সেরকমই বলে এসেছিল ভেতরে।

বোধিসত্ত্ব আমতা আমতা করে বলল,—এ সব আবার কেন? শুধু চা হলেই তো হত।

এত তিক্ততার মধ্যেও সত্যি কথাটা বেরিয়ে এল রাখীর মুখ থেকে,—তোমার খিদে পেয়েছে, আমি মুখ দেখেই বুঝতে পারছি।

বুঝি ঈষৎ চমকাল বোধিসত্ত্ব। মাথা নামিয়ে চায়ের কাপপ্লেট তুলে নিয়েছে হাতে। অস্পষ্ট স্বরে বলল,—ফিউচার নিয়ে কিছু ভেবেছ?

—কার ফিউচার?

—তোমার।

—আপাতত তো এখানেই আছি। বাবুয়ার একটা চাকরির কথা চলছে, হয়ে গেলে তখন হয়তো বাবুয়া আমায় বাড়ি ভাড়া করে কলকাতায় নিয়ে যাবে।

—বাবুয়া সত্যিই আর পড়াশুনো করবে না? তুমি ওকে বোঝাও…

রাখী সঙ্গে সঙ্গে কথাটার জবাব দিল না। ছেলেকে সে কম বোঝায়নি, রন্টু প্রচুর রাগারাগি করেছে, কিন্তু বাবুয়া অনড়। হয়তো বোধিসত্ত্বর ছেলে বলেই এত একরোখা হয়েছে বাবুয়া।

একটু চুপ থেকে রাখী শীতল স্বরে বলল,—যে ছেলেকে একুশ বছর বয়সে মায়ের দায়িত্ব নিতে হয়, তার আর পড়াশুনোর বিলাসিতা সাজে না।

বোধিসত্ত্বর মুখ লাল হয়ে গেল,—এ তো অন্যায় জেদ। তোমরা দুজনেই তোমাদের গোঁ ধরে থাকবে…

—থাক। ন্যায় অন্যায়ের কথা তোমার মুখে নয় নাই শুনলাম। রাখীর ঠোঁট বেঁকে গেল,—আমাদের মতো সামান্য মানুষদের নিয়ে চিন্তা করছ কেন? তোমার কথা বলো। আছ কেমন?

বোধিসত্ত্ব নীরব হয়ে গেল। বেশ খানিকক্ষণ পর মাথা নাড়ছে দু দিকে,—জানি না।

—সে কী? রাখীর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল,—এর মধ্যেই ইন্টেলেক্টের খিদে মিটে গেল?

বোধিসত্ত্ব অসহায় মুখে তাকাল,—তুমি এখন টিজ করবে, আমি জানি।…সত্যি আমি কী করব বুঝতে পারছি না। আই নিড ইওর সাজেশান।

—আমার? রাখী প্রচণ্ড অবাক। ক্ষোভ অভিমান ছাপিয়ে কৌতূহল জাগছে। বোধিসত্ত্বর কি তবে চোখ ফুটল? রাখীর কাছে ফিরতে চায়? বুকে ঢেঁকির পাড় পড়ছে। তবু যথাসম্ভব স্বর নির্লিপ্ত রেখে বলল,—কী হয়েছে?

—আমার সমস্যাটা একমাত্র তুমিই বুঝতে পারবে।…ও এত ছেলেমানুষ, ম্যাচিওরিটি আসেনি, সাংসারিক সেন্সও সেভাবে গ্রো করেনি…আমি যে এখন ওকে নিয়ে কী করি…! জানো, এর মধ্যে আবার ও প্রেগন্যান্ট হয়ে বসে আছে। কত বার করে বললাম, নষ্ট করে দাও…এত অ্যাডামেন্ট মেয়ে…!

রাখী সম্পূর্ণ বোবা হয়ে গেল। এই মানুষটা দেবতা, না দানব? অসঙ্কোচে ওই কথা সে তার সামনে উচ্চারণ করে কী করে? সহসা যেন মনশ্চক্ষে দয়িতাকে দেখতে পেল রাখী। এই মুহূর্তে আর ঈর্ষা নয়, কেমন যেন করুণা জাগছে মেয়েটার ওপর। ওই মেয়েটার কাছেও আপনভোলা বিজ্ঞানীর আত্মসর্বস্ব ক্রূর রূপটা ধরা পড়ে গেছে, মাত্র ক মাসের মধ্যেই? বেচারা।

রাখী ভার গলায় বলল,—কেন বাচ্চা নষ্ট করবে? শুধু প্রেম করেই দায়িত্ব খালাস হয়ে যাবে তোমার?

—কিন্তু এই বয়সে…! তা ছাড়া তুমি তো জানো, ও সব ঝামেলা টামেলা আমার পোষায় না। আমার হাতে এখন কত কাজ, সো মেনি থিংস টু ডু…

—বুলি কোপচিও না। রাখীর গলা চড়ে গেল,—সত্যি করে বলো তো তুমি কী চাও? তুমি কি এক্সপেক্ট করছ, আমি মেয়েটাকে গিয়ে বোঝাব যাতে সে বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলে? আশ্চর্য!

বোধিসত্ত্বর মুখ কেমন করুণ হয়ে গেছে। ফ্যাসফেসে গলায় বলল,—না মানে…আমি সত্যিই খুব অশান্তির মধ্যে আছি।

—এ তো তোমারই ডেকে আনা অশান্তি। নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই পড়েছ, এখন আঁকুপাঁকু করলে চলবে কেন?

খানিকক্ষণ পাথরের মতো বসে থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল বোধিসত্ত্ব। জীবন্ত দীর্ঘশ্বাসের মতো হাঁটছে। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

নিচু গলায় বলল,—আমি কি মাঝে মাঝে তোমার কাছে আসতে পারি রাখী? তুমি যেমন খুশি বিহেভ কোরো, যত খুশি অপমান কোরো, তবু…

—না। কক্ষনও না। আমার ছেলে যাকে ঘৃণা করে এমন মানুষের আমি মুখ দেখতে চাই না।

বোধিসত্ত্ব ঘাড় নিচু করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কী রুগ্‌ণ লাগছে লোকটাকে, সাত বুড়োর এক বুড়ো বলে মনে হচ্ছে। এত চেহারা খারাপ হয়ে গেল কেন? মেয়েটা কি একটুও যত্নআত্তি করে না?

হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল রাখী। বোধিসত্ত্বর ঘর ছাড়ার পর এই প্রথম। মানুষটাকে প্রাণ ভরে কথা শোনানোর সুপ্ত বাসনা চরিতার্থ হয়েছে আজ, তবু হৃদয়ে এতটুকু জয়ের উল্লাস নেই। জমে থাকা রাগ অভিমান যন্ত্রণা গলে গলে পড়ছে দু চোখ বেয়ে।

এখনও বোধিসত্ত্ব এই পৃথিবীতে তাকেই একমাত্র আপন ভাবে? শুধু তার কাছেই মনের কথা বলতে ছুটে আসে?

কেন? কেন? কেন?

এক গাঢ় অবসন্নতা গ্রাস করে ফেলছিল বোধিসত্ত্বকে। বারাসত থেকে ফিরে কিছুক্ষণ মড়ার মতো শুয়ে ছিল বিছানায়, তারপর উঠে স্টাডিরুমে ঢুকেছে। সামনে নিথর কম্পিউটার, বই কাগজের স্তূপ, বসে আছে তো বসেই আছে। দৃষ্টি শূন্য, মগজ ফাঁকা, বয়ে যাচ্ছে সময়। দয়িতা ফিরল অফিস থেকে, ঘরের কাজকর্ম সারছে, রান্নাবান্না করল, কালো কফি দিয়ে গেল বোধিসত্ত্বকে, কথাও বলল টুকটাক, কিন্তু বোধিসত্ত্ব যেন বোধিসত্ত্বতেই নেই আজ। দয়িতার কথার উত্তরে হুঁ হ্যাঁ করে গেল শুধু।

রাত বাড়ছে।

নীরবে খাওয়াদাওয়া সারল বোধিসত্ত্ব। ইদানীং দুজনের কথাবার্তা কমই হয়, দয়িতাও সেভাবে লক্ষ্য করেনি বোধিসত্ত্বকে। কথা বাড়ালেই যেখানে বাদানুবাদ হয়, সেখানে নীরবতা অনেক স্বস্তির।

বেসিনে হাত ধুয়ে বোধিসত্ত্ব আর ঘরে গেল না, ব্যালকনিতে এসে বসেছে। সিগারেট ধরাল। বাতাস এখনও ঠাণ্ডা হয়নি, ছোট ছোট ঝাপটায় জ্বালা জ্বালা করছে গা। দূরে বাড়িঘরের আলোর দিকে তাকিয়ে আছে বোধিসত্ত্ব। অনেকটা নিচু দিয়ে একটা প্লেন উড়ে গেল। উড়োজাহাজের আলো জ্বলছে নিভছে।

বোধিসত্ত্বর বুক বেয়ে একটা লম্বা শ্বাস গড়িয়ে এল। অনুচ্চ স্বরে ডাকল,—দয়িতা?

দয়িতা টিভি দেখছিল। সাড়া দিয়েছে,—বলছ কিছু?

—হ্যাঁ। শোনো একটু।

ব্যালকনির দরজায় এল দয়িতা। ব্যালকনির ছোট্ট দোলনাটা হাতের ইশারায় দেখাল বোধিসত্ত্ব,—বোসো। কথা আছে।

দয়িতার চোখ ছোট হল,—খুব জরুরি কথা? সময় লাগবে?

—হুঁ।

—তা হলে এক সেকেন্ড ওয়েট করো। আমি ভিটামিনটা খেয়ে আসি।…খেয়ে উঠেই খাওয়ার কথা, কালও ভুলে গেছি।

ছোট্ট একটা পিন ফুটল বোধিসত্ত্বর বুকে। ইচ্ছে করেই কি এ সময়ে ভিটামিনটার কথা তুলল দয়িতা? নিজে নিজে ডাক্তার দেখায়, শরীরস্বাস্থ্য এখন ঠিক রাখার জন্য তাকে ওষুধ দেওয়া হয়েছে, সচেতনভাবেই ট্যাবলেটের স্ট্রিপগুলো ড্রেসিংটেবিলে ছড়িয়ে রাখে। যেন প্রতি পলে বোধিসত্ত্বকে মনে করিয়ে দিতে চায় সে কত দায়িত্বজ্ঞানহীন! মানুষ যে কত বিচিত্রভাবে ঘনিষ্ঠ জনকে আহত করতে পারে! বোধিসত্ত্ব কী করে প্রমাণ করবে সে হৃদয়হীন নয়?

প্রমাণ করার দায়ও আছে কি বোধিসত্ত্বর?

ওষুধ খেয়ে এসে দোলনায় বসেছে দয়িতা। দুলছেও যেন মৃদু মৃদু। দুলছে? সত্যিই দুলছে? নাকি বোধিসত্ত্বর চোখের ভুল?

বোধিসত্ত্ব স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করল,—তোমার অফিস চলছে কেমন?

দয়িতা বুঝি চমকাল একটু। বলল,—মন্দ কী!

—কাজটা ভাল লাগছে?

—ঠিকই আছে। ট্রেনিং পিরিয়ড তো, খাটাচ্ছে খুব।

—অফিসে জানিয়েছ তুমি প্রেগন্যান্ট?

—জানাব। আর কটা দিন যাক।

—পরে ছুটি টুটি পেতে কোনও প্রবলেম হবে না তো?

—দেখি কী হয়! পরের কথা পরে ভাবব।

—তোমার এক্সপেক্টেড ডেট কবে?

—টোয়েন্টি সিক্সথ নভেম্বর।

—ও। তা হলে তো অনেকটাই দেরি আছে।…এই অফিসে তোমায় স্যালারি-ট্যালারি তো ভালই দেবে, তাই না?

—হঠাৎ এ সব প্রশ্ন? দয়িতা সোজা হয়ে বসল,—ঠিক কী জানতে চাও বলো তো?

বোধিসত্ত্ব একটুক্ষণ নীরব। তারপর জোর করে হাসি ফুটিয়েছে মুখে,—শোনো, তোমায় কতকগুলো প্র্যাক্টিকাল কথা বলি। রিগার্ডিং মাই ওয়ার্ক। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, তোমাকে বলেছিলাম প্রফেসার রিড্‌সন আমার লেটেস্ট কাজটাকে খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করেছিলেন? উনি আমাকে একটা অফারও দিয়েছিলেন। টু জয়েন হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি। সঙ্গে সঙ্গে প্রোপোজালটা অ্যাকসেপ্ট করিনি…কিন্তু কথাটা কদিন ধরে ভাবছি খুব। এখানে, আই মিন ইন্ডিয়ায়, আমার কাজের প্রোগ্রেস মোটেই স্মুথ নয়। ওখানে গেলে আমি বেশ কয়েকজন সমমনস্ক বিজ্ঞানী পাব। উই ক্যান ওয়ার্ক টুগেদার, কন্টিনিউয়াসলি মত বিনিময় করতে পারব, বেশ কয়েকটা অবজার্ভেটরি থেকে স্টেডি ফ্লো অব ডাটা থাকবে, গবেষণার ছোটখাটো বাধাগুলো পেরিয়ে যেতে আমার অনেক সুবিধে হবে…

—তুমি কি চলে যেতে চাইছ? দয়িতার গলা দুলে গেল।

—মনে হচ্ছে যেতেই হবে। বোধিসত্ত্ব মাথা নাড়ল,—তুমি তো জানেনা দয়িতা, আমার লাইফের একটাই মিশন। সৃষ্টির রহস্য জানা। বোঝা। মানুষকে তা জানানো।…আমাদের জীবনের স্প্যানটা এত ছোট! এতগুলো বছর চলে গেছে, আর কদিনই বা বাঁচব…

বোধিসত্ত্বর আবেগটা বুঝি স্পর্শ করেছে দয়িতাকে। আরও মৃদু স্বরে বলল,—বেশ তো। যাও না।

—কিন্তু তুমি?

—তুমি কি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাও না?

—ইচ্ছে হলে যেতে পারো। তবে আমি তোমায় ফোর্স করব না। তুমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন।…তুমি যদি এখানে থেকেও যাও, আমি তোমার সবরকম বন্দোবস্ত করে যাব। টাকা পাঠাব রেগুলার…তোমার জন্য…যে আসছে তার জন্য…

দয়িতার চোখ এতক্ষণ বোধিসত্ত্বতে স্থির ছিল, সহসা দৃষ্টি ঘুরে গেছে ব্যালকনির বাইরে। হিম গলায় বলল,—তোমার অসীম মহানুভবতা।

—ওভাবে বলছ কেন? তোমার দায়িত্ব যখন নিয়েছি এটা তো আমার কর্তব্য। বোধিসত্ত্ব আর একটা সিগারেট ধরাল। আস্তে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, তুমি তোমার বাপেরবাড়ি গিয়েও থাকতে পারো।

—বাপেরবাড়ি? দয়িতার গলা উঠল সামান্য,—আমার তো কোনও বাপেরবাড়ি নেই!

—এ তোমার অভিমানের কথা। তাঁরা তোমার জন্য এখনও খুবই কনসার্নড।

—তাই নাকি?

—হুঁ।…তোমার বাবা আজ আমার অফিসে এসেছিলেন।

—বাবা? দয়িতা ঝটিতি ঘাড় ঘুরিয়েছে।

—হ্যাঁ। তুমি ওখানে গেলে তাঁরা খুশিই হবেন। বলেই নিজেকে সংশোধন করে নিল বোধিসত্ত্ব,—মানে…মেয়েরা তো এ সময়ে বাপেরবাড়িতে গিয়েই থাকে।…তুমি ভেবো না, আমি নিয়মিত তোমার খোঁজখবর নেব।

দয়িতা শেষ কথাটা যেন শুনতেই পেল না। তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল,—বাবা তোমায় বলল আমি ওখানে গেলে তারা খুশি হবে?

—না, তা নয়…তবে আমার মনে হল…মানবচরিত্র আমি একটু-আধটু বুঝি দয়িতা। তোমাকে একবার চোখের দেখা দেখলে তাঁদের রাগ অভিমান সব ধুয়ে যাবে।

দয়িতা এক লহমা নিষ্পলক। পরক্ষণেই হাসতে শুরু করল। হাসছে, হাসছে…। খিলখিল হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে। কিশোরীর চপল হাসি ক্রমশ বদলে যাচ্ছে উন্মাদিনীর খলখলে। এক সময়ে বুঝি হাসি শান্ত হল, লাল হয়ে গেছে দয়িতার মুখ। হাঁপাচ্ছে।

দম নিতে নিতে বলল,—আমার একটা কথার জবাব দিতে পারো? তোমার এখনও ডিভোর্স না হওয়া বউ তোমাকে এত বছর ধরে সহ্য করেছিল কী করে?

বাক্যটা শিসের গুলির মতো কানে বিধে গেল বোধিসত্ত্বর। কী তীব্র মর্মভেদী দৃষ্টি হানছে দয়িতা, যেন লেজার বিমে পুড়িয়ে দিচ্ছে বোধিসত্ত্বর হাড়পাঁজর! ওইটুকুন মেয়ের চোখে চোখ রাখতে পারল না বোধিসত্ত্ব, মাথা নামিয়ে বসে আছে বিমূঢ়।

দয়িতা চলে গেল ঘরে, ঈষৎ স্খলিত পায়ে। একটু পরে ক্ষীণ একটা শব্দ কানে এল বোধিসত্ত্বর। কাঁদছে কি দয়িতা? উঠে দেখতে বোধিসত্ত্বর সাহস হল না।

মধ্যরাত গড়িয়ে গেছে বহুক্ষণ।

হাওয়া বইছে মৃদু মৃদু। পৃথিবী এখন অনেক শীতল। চাঁদ উঠেছিল, ডুবে গেছে। লবণ হ্রদের পথবাতিরা ঝিমোচ্ছ এখন। নিশাচর পাখিরা ডেকে উঠছে হঠাৎ হঠাৎ, অনেকটা দূর থেকে। অন্ধকারে কৃষ্ণচূড়া ফুল জ্বলছিল ধিকিধিকি, কালচে আগুনের মতো।

বোধিসত্ত্ব স্টাডিরুমে। ইজিচেয়ারে। ভারী চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায় মাঝে মাঝে, চমকে চমকে খুলে যায়। ছেঁড়া ছেঁড়া তন্দ্রায় ধূমকেতুর স্বপ্নটা আসছে ঘুরেফিরে। সেই ধূমকেতু যে আছড়ে পড়েছিল নক্ষত্রের গায়ে। কী প্রবল বিস্ফোরণ! তালা লেগে যাচ্ছে কানে, মাথা ঝিমঝিম করছে।

ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বোধিসত্ত্ব। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে পায়ে পায়ে বাথরুমে। আলো জ্বালল, মুখ দেখছে আয়নায়। সে তো সেই একই মানুষ আছে, তবু তাকে অন্যরকম ভাবে কেন দয়িতা? অথবা রাখী? কেন তারা তাকে দেবতা ভেবেছিল? কেনই বা সে এখন দানব তাদের চোখে? সে তো নিছকই এক ইন্দ্রিয়পরায়ণ রিপুতাড়িত সাধারণ মানুষ, তাকে অন্য কিছু কল্পনা করে কেন এরা কষ্ট পায়?

বাথরুম থেকে বেরিয়ে শোওয়ার ঘরের দরজায় থামল বোধিসত্ত্ব। দরজা ভেজানো, খুলল নিঃশব্দে। নিয়মিত নিশ্বাসের শব্দ, একটানা, উঠছে পড়ছে। বোধিসত্ত্বকে জাগিয়ে রেখে কী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে দয়িতা! আলো জ্বালবে কি বোধিসত্ত্ব? ছিঁড়েখুড়ে দেবে সুখনিদ্রা? ওই যৌবন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তবু যদি আর একবার…!

না, আর নয়। বোধিসত্ত্ব চলেই যাবে। জাগতিক মোহ মায়া ত্যাগ করে, নিজস্ব মহাজগতের সন্ধানে। কাজই তার বন্ধন, কাজেই তার মুক্তি।

এতক্ষণে বুঝি শান্ত হয়েছে চিত্ত। বোধিসত্ত্ব ফিরেছে স্টাডিরুমে। ইজিচেয়ারে শরীর ছেড়ে দিল। অন্ধকারের কণারা পরিব্যাপ্ত হচ্ছে ক্রমশ, ছেয়ে ফেলছে চরাচর। বোধিসত্ত্বর চোখে ঘুম নামছে, গভীর ঘুম।

সকালে একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙল বোধিসত্ত্বর। চোখ খুলতেই বুকটা ধক করে উঠেছে। ফ্ল্যাটটা এত ভয়ঙ্কর রকমের নিঝুম লাগে কেন?

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ছিটকে ড্রয়িংরুমে বেরিয়ে এল বোধিসত্ত্ব। শোওয়ার ঘরে চোখ চালাল, উঁকি দিল বাথরুমে, রান্নাঘরে।

নাহ্‌, দয়িতা কোথাও নেই।

.

২২.

ফোনটা এল দুপুরবেলায়।

অফিসে আজ কাজের চাপ তুলনামূলকভাবে কম ছিল সৌমিকের। এ কিউবিকল ও কিউবিকল ঘুরে খুচরো আড্ডা দিচ্ছিল। কেজো আড্ডা। অফিসেরই কথা হচ্ছিল নানা রকম, তবে খানিকটা হালকা মুডে। সবে সিটে ফিরে টিফিনে বেরোবে কি বেরোবে না ভাবছে, তখনই দূরভাষে চেনা স্বর।

—সৌমিক, খুব ব্যস্ত আছ নাকি?

শিথিল সৌমিক পলকে টান টান। বোধিসত্ত্ব ফেরার পর থেকে সে আর একদিনও দয়িতাকে ফোন করেনি। অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে, তবুও না। কেন আর যেচে কাবাবমে হাড্ডি বনা! থাকো সুখে উচ্চ বৃক্ষচূড়ে কপোত কপোতী যথা…

অপ্রত্যাশিত ফোন পাওয়ার বিস্ময় গোপন রেখে সৌমিক লঘু স্বরে বলল,—যাক, অ্যাদ্দিনে তাও আর কাউকে মনে পড়ল!

কথাটা যেন শুনতেই পায়নি দয়িতা। ঠাণ্ডা স্বরে বলল,—তুমি কি আজ আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারবে?

—আজ? কখন?

—এই ধরো বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। আমি তোমার জন্য এসপ্ল্যানেডে ওয়েট করব। মেট্রো স্টেশনের গেটে।

—হ্যাহ্‌, ওখানে কেন? তুমি আমার অফিসে চলে এসো।

—না। তুমিই এসো। কে সি দাসের দোকানের উলটো দিকের গেটে। দয়িতা দু-এক পল নীরব। তারপর বলল,—অবশ্য তোমার যদি অসুবিধে না থাকে…

—না না, অসুবিধে কীসের? আমি চলে যাব।

সৌমিক একটু দম নিয়ে স্বাভাবিক কুশল প্রশ্ন শুরু করতে যাচ্ছিল, তার আগেই লাইন কেটে গেছে! ভুরু কুঁচকে সৌমিক নামিয়ে রাখল রিসিভারটা। চমকিত ভাব অবশ্য বেশিক্ষণ রইল না, মেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেছে সহসা। মনে মনে ভাবার চেষ্টা করল হঠাৎ কেন ডাক পাঠাল রাজকন্যা? ঘরে শুধু এক মুখ দেখে দেখে বোর হয়ে গেছে, তার সঙ্গে আড্ডা দেবে আজ? কিন্তু তা হলে তো বাড়িতেই ডাকতে পারত! চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থেকে কি রাজকন্যা হাঁপিয়ে উঠেছে? কে জানে, হয়তো মার্কেটিং করবে! সৌমিককে ব্যাগ বইতে হবে। কিন্তু দয়িতার গলাটা তো তেমন উচ্ছল লাগল না, বরং যেন কেমন ভার ভারই…? কদিন ধরে গুমোট বেড়েছে খুব, বর্ষা আসার পূর্বলক্ষণ। চারদিকে এখন জ্বরজারির ধুম পড়েছে, দয়িতারও সর্দি-উর্দি লেগেছে নাকি?

আবার টেলিফোন।

রিফ্লেক্স অ্যাকশানে রিসিভার তুলতেই ওপারে কবিতা বসুরায়।

—টিফিন হয়ে গেছে?

রোজকার মতো চাঁছাছোলা জবাব দিল না সৌমিক। প্রসন্ন গলায় বলল,—এই তো যাব যাব করছি। পেট রীতিমতো হাঁকডাক শুরু করে দিয়েছে।

—উলটোপালটা কিছু খেয়ো না যেন। মনে রেখো, আজ তোমার স্টু-এর দিন।

—মনে আছে। আমার জিভটাও স্টু-ই চাইছে আজ।

—ফিরছিস কখন?

—দেখি।…একটু দেরি হতে পারে।

—আমি সন্ধেবেলা থাকব না। টেবিলে স্যান্ডুইচ রেখে যাব, মনে করে খেয়ে নিস।

—জো হুকুম।

ফোন রেখেই সৌমিক হালকা শিস দিতে দিতে ক্যান্টিন। মোটামুটি টইটুম্বর হয়ে ফিরল সিটে, কাজে বসল। দারুণ চনমনে ভাব এসে গেছে, নেশাডুর মতো ডুবে যাচ্ছে যন্ত্রগণকের নীরস পরদায়। কীভাবে যে হুস করে সময় কেটে গেল!

সাড়ে চারটে নাগাদ তলব পড়ল জি এমের ঘরে। জরুরি মিটিং। মিনিট পনেরোর পর থেকে উশখুশ করতে শুরু করেছে সৌমিক। ঘনঘন ঘড়ি দেখছে। পাঁচটা বাজতে দশ! পাঁচটা বাজতে পাঁচ! পাঁচটা বেজে যাওয়ার পর রীতিমতো অস্থির দশা। পাঁচটা দশ নাগাদ আর থাকতে পারল না, স্কুলের বাচ্চাদের মতো অভিনয় শুরু করে দিয়েছে। স্টমাক পেনের অজুহাত দিয়ে কোনওক্রমে বেরিয়ে পড়ল মিটিং ছেড়ে। রাজকন্যার আহ্বান এসেছে আজ, মিথ্যে বললে আজ কোনও দোষ নেই।

ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচটা ছোঁয়ার আগেই সৌমিক প্রায় ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গেছে নির্ধারিত স্থানে। দরদরিয়ে ঘামছে। মুখে রুমাল বোলাতে বোলাতে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। দয়িতা নেই।

সৌমিক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। দীন অভাজনের জন্য প্রতীক্ষা করা কি রাজকন্যাকে মানায়!

কলকাতায় এখন ঝলমলে বিকেল। সূর্য এখন সোনার জলের পালিশ বোলাচ্ছে চতুর্দিকে, সোনা মেখে ঝিকমিক করছে বাড়িঘর গাড়িঘোড়া। আকাশে আজ টুকরো টুকরো মেঘ আছে বটে, কিন্তু ওই মেঘেরাই যেন নীলের শোভাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। লাখো মানুষের চ্যাঁ ভ্যাঁও এখন মধুর গুঞ্জন বলে মনে হয়। যেন এই শহর এখন এক অতিকায় মৌচাক।

রোদ্দুরের তেজ ক্ষয়ে আসছে ক্রমশ। একটু একটু করে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিল সৌমিক। সাত জন্মে সে কোথাও কোনও মেয়ের জন্য দাঁড়ায়নি, প্রতীক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত যে এত দীর্ঘ হয় সে জানবে কী করে! ছটা বাজে প্রায়, এখনও এল না! শয়ে শয়ে লোক নেমে যাচ্ছে মেট্রো স্টেশনের গহ্বরে, শয়ে শয়ে উঠেও আসছে, তাদের প্রত্যেককে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিল সৌমিক। যদি এদের মধ্যে কেউ হঠাৎ কোনও যাদুমন্ত্রবলে দয়িতা হয়ে যায়! উঁহুঁ, হচ্ছে না, হচ্ছে না। হল কী দয়িতার? প্র্যাকটিকাল জোক করল না তো? সৌমিকের মতো হাঁদাগঙ্গারামকে নিয়ে নিষ্ঠুর ঠাট্টা?

ইত্যাকার ভাবনায় সবে পীড়িত হতে শুরু করেছে সৌমিক, তখনই লেনিন মূর্তির পাশের চাতালে হঠাৎ দৃষ্টি স্থির। আসছে দয়িতা। ধীর পায়ে, দিনের শেষ রোদ্দুরটুকু মেখে। একটু বুঝি অন্যমনস্কও।

একদম কাছে এসে সৌমিককে দেখতে পেল দয়িতা। ফ্যাকাশে হাসল,—অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ তো?…সরি।

—না না, তেমন কিছু নয়। সৌমিক আলগা কাঁধ ঝাঁকাল,—আমিও এই মাত্রই…।

দুজনেই একটুক্ষণ চুপ। সৌমিক দেখছিল দয়িতাকে। একটু মুটিয়েছে দয়িতা, তবে মুখে একটা হালকা কালো ছাপ পড়েছে যেন। বিষণ্ণতার ছাপ? ছি, দয়িতা বিষগ্ন হবে কেন!

সৌমিক তরল গলায় বলল,—মুখ-চোখ এত শুকনো কেন? শরীরে যুত নেই মনে হচ্ছে?

—অফিসে যা ধকল যাচ্ছে সারাদিন! দয়িতা গলা ঝাড়ল,—এদিক ওদিক টইটই করে ছোটা!

—তুমি চাকরি করছ? কবে থেকে?

—এই তো, মাস দেড়েক।

—এতদিন? স্ট্রেঞ্জ!…আমায় কিন্তু তোমার জানানো উচিত ছিল। আফটার অল চাকরির পরামর্শটা তোমায় আমিই প্রথম দিয়েছিলাম। সৌমিক ঝকঝকে দাঁত মেলে হাসল,—কোথায় চাকরি করছ?

—তেমন বলার মতো কিছু নয়। একটা টিভি কোম্পানিতে, সেলসের কাজ। ডিলারদের কাছে যেতে হয়, অর্ডার নিতে হয়…অবশ্য কলকাতার মধ্যেই।

সৌমিক গম্ভীর হতে গিয়েও হেসে ফেলল। বোধিসত্ত্ব মজুমদারের দুটো ফ্যামিলিই শেষে সেলস লাইনে? এই তো গত সপ্তাহে বাবুয়া এসেছিল অফিসে। সে এখন ঘুরে ঘুরে ওয়াটার পিউরিফায়ার বেচছে। সৌমিকের কাছ থেকেও কিছু রেফারেন্স নিয়ে গেল যদি কাউকে এক-আধটা মাল বেচতে পারে। ছোকরা বহুত জিদ্দি আছে, পড়াশুনো জলাঞ্জলি দিয়ে এই সামান্য কাজে নেমেও মুখের হাসিটি টসকায়নি। কী আয়রনি, বলতে গেলে যার জন্য বাবুয়া আজ সেলসম্যান, সেও কিনা…!

সৌমিক হাসতে হাসতে বলল,—চাকরি করলে তো একটু খাটতে হবেই। এমনি এমনি কেউ মাইনে দেবে?

—সে তো বটেই। দয়িতা কেমন অদ্ভুত স্বরে বলল,—দুনিয়ার কেউই কাউকে এমনি এমনি কিছু দেয় না। কড়ায় গণ্ডায় হিসেব বুঝে নেয়।

কথার সুরটা কানে লাগল সৌমিকের। একটু থমকেছে। জোর করে হাসি ধরে রেখে বলল,—বস খুব ডেঁটেছে বুঝি আজ?…পছন্দ না হলে চাকরিটাকে কুইটস করে দাও। ট্রাই ফর অ্যান অফিস জব। আই মিন ডেস্ক ওয়ার্ক।

দয়িতা আরও অদ্ভুত স্বরে বলল,—তদ্দিন খাব কী?

—মানে? সৌমিকের চোখ গোল গোল,—প্রফেসর সাহেবের কি অন্ন কম পড়িয়াছে? তুমি রোজগার না করলে খাওয়া জুটবে না?

—আমি এখন বোধিসত্ত্ব মজুমদারের সঙ্গে থাকি না।

সৌমিকের মুখ হাঁ হয়ে গেছে। চেষ্টা করেও হাঁ বন্ধ করতে পারছে না।

দয়িতা মৃদু গলায় বলল,—চলো, কোথাও একটা গিয়ে বসি। আমার খুব খিদে পেয়েছে।

প্রাণপণ চেষ্টায় সৌমিক ধাতস্থ করল নিজেকে,—হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। কোথায় যাবে? কী খাবে?

—মুড়ি-টুড়ি যা হয় কিছু।…রেস্টুরেন্টে ঢুকব না, বড্ড গরম লাগছে।

দয়িতা আস্তে আস্তে কার্জন পার্ক অভিমুখে হাঁটা শুরু করল। পাশে পাশে সৌমিকও। অজস্র ট্রামলাইনের সমান্তরাল আঁকিবুকি ছেদ করে ভিন্ন এক সমান্তরাল রেখায় হাঁটছে দুজনে। নিঃশব্দে। সন্ধে একটু একটু করে ডানা মেলছে শহরে, আবছায়ামাখা দয়িতার মুখখানা যেন আরও রহস্যময়। যেন পাহাড়ি ঝর্না হঠাৎ গতি হারিয়ে জমাট বেঁধেছে ওই নারীতে।

সৌমিক অপাঙ্গে দয়িতাকে দেখছিল। একটাও প্রশ্ন করতে সাহস হচ্ছে না। কী হল হঠাৎ দয়িতার? কবে এত বদলাল? কেন বদলাল?

কাঁধের ওড়না গুছিয়ে নিয়ে সন্তর্পণে একটা বেঁটে রেলিং পার হল দয়িতা। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো সৌমিকও। ঘাসের ওপর দয়িতার মুখোমুখি বসেছে। কার্জন পার্কে এখন ঝালমুড়িওলাদেরই সময়, না ডাকতেই হাজির একজন। দয়িতার থমথমে মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে দু ঠোঙা মশলামুড়ি কিনল সৌমিক। দয়িতা ঠোঙাটা হাতে নিল বটে, কিন্তু খাচ্ছে না। দুটো চারটে মুড়ি খুঁটছে, মুখে ফেলছে, তার ফাঁকা চোখ এখনও ঘনায়মান অন্ধকারে।

গ্রীষ্মের সন্ধে। পার্কে ভিড় আছে ভালই। দু-চার হাত অন্তরই ছোট ছোট জটলা। কেউ বা অফিসফেরতা, কেউ বা আড্ডাবিলাসী, কেউ একা উদাস। এই ধরনের ভিড়ে অদ্ভুত এক নির্জনতা থাকে, কেউ কারও কথা শোনে না।

তবু সৌমিক নিচু স্বরে বলল,—খাচ্ছ না কেন? খিদে পেয়েছে বলছিলে?

—হ্যাঁ। খাই।

দয়িতার আঙুল একটু বুঝি সপ্রতিভ হল। আকাশে যেভাবে তারা ফোটে, একটু একটু করে ভাষাও ফুটে উঠছে দয়িতার চোখে।

শুকনো গলায় বলল,—খুব অবাক হয়েছ, তাই না?

অবাক শব্দটার ব্যাপ্তি এত কম! বুকের মধ্যে কী যে তুফান চলছে সৌমিকের!

সামান্য গলা ওঠাল সৌমিক,—তুমি কি সত্যিই প্রফেসার মজুমদারের সঙ্গে…?

—যেচে মিথ্যে শোনাব বলে তো ডাকিনি।

—হঠাৎ হলটা কী?

—কী যে হল! দয়িতা হাত ওলটাল। একটা ঘন শ্বাস ফেলে বলল,—আমি নিজেও ভাবতে পারিনি। দুম করে সব ফুরিয়ে গেল।

—বুঝেছি। প্রফেসার সাহেবের সঙ্গে জোর ঝগড়া হয়েছে।

—প্রফেসার সাহেব ঝগড়া করার স্তরের লোকই না।

—তবে? সৌমিক চোখ সরু করল,—ভুল বোঝাবুঝি?

—ভুল বোঝাবুঝি মানুষে মানুষে হয় সৌমিক। বোধিসত্ত্ব মজুমদার কি সাধারণ মানুষ? ও একটা লিভিং আইডিয়া। অ্যাবস্ট্রাক্ট নাউন।

দয়িতার স্বর কী ভীষণ তাপহীন! বিষণ্ণতা ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে এক গাঢ় নিরাসক্তি!

সৌমিক জোর করে হাসার চেষ্টা করল,—গভীর মান অভিমানের পালা চলছে মনে হচ্ছে?

—মান অভিমান কখন চলে সৌমিক? যখন মান অভিমানের মূল্য থাকে।

—এ আমি মানতে পারলাম না। এও তোমার অভিমানেরই কথা। তুমি নিজেও জানো প্রফেসার মজুমদার তোমায় কত ভালবাসেন। ভালবাসা শব্দটা উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছিল সৌমিকের, তবু বলল,—তোমায় ভালবেসেই না তিনি স্ত্রী ছেড়েছেন, সংসার ছেড়েছেন, সন্তান ছেড়েছেন…

—ভুল। মিথ্যে। বোধিসত্ত্ব কখনও কিচ্ছু ছাড়েনি। স্ত্রী ছেলের ওপর তার টানই ছিল না, ছাড়ার প্রশ্ন আসে কোথথেকে? জানো, যে দিন ওর স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, সেদিনই কী অনায়াসে তাকে ডিভোর্স করার জন্য ব্যস্ত হয়েছিল বোধিসত্ত্ব…অতদিন এক সঙ্গে ঘর করার পরও।

—কিন্তু সে তো তোমারই জন্যে? তোমাকেই ভালবেসে?

—আমিও তাই ভেবেছিলাম। বোকা বোকা, কী বোকা আমি। দয়িতা অস্থিরভাবে মাথা ঝাঁকাল,—বোধিসত্ত্ব মজুমদার ভালবাসতেই জানে না। সে কোনওদিনই কাউকে ভালবাসেনি। একমাত্র নিজের কাজকে ছাড়া…। দয়িতার নিশ্বাস পড়ছে জোর জোর,—উঁহু, নিজের গবেষণাকেও সে ভালবাসে না। সে শুধু ভালবাসে নিজেকে। সুদ্ধু নিজেকে। নিজের সুখ, নিজের তৃপ্তি, নিজের খ্যাতি যশ…। কাজও তার কাছে আত্মসুখ চরিতার্থ করার একটা টুল।…আত্মসুখ মানে ইগো। বোধিসত্ত্বর আমিত্ব। অহং। আমরা ছিলাম সেই আমিময় মানুষের সুখ সাপ্লাই-এর মেটিরিয়াল। আমি, রাখী…। বোধিসত্ত্ব মজুমদার আত্মরতি ছাড়া আর কিছু বোঝে না সৌমিক।

—হঠাৎ এই রিয়েলাইজেশন?

—হল।

—বুঝলাম। সৌমিক আবার জোর করে হাসল,—তুমি প্রফেসার সাহেবের ওপর খুব চটে আছ।

—না সৌমিক, আমি ওই স্টেজ পার হয়ে এসেছি। এই মুহূর্তে বোধিসত্ত্বর ওপর আমার রাগ ঘৃণা কিচ্ছু নেই। দয়িতা চোখ তুলল,—যেখানে আমি আমি হিসেবে মূল্যহীন, সেখানে আমি থাকব কেন?

—অনেক হয়েছে, এবার ঝেড়ে কাশশা তো। সৌমিক ঈষৎ অসহিষ্ণু হল,—লাস্ট যে দিন দেখা হল, সে দিনও তো তুমি বোধিসত্ত্বতে বেশ গদগদ ছিলে?

দয়িতার চোখ নিষ্পলক হয়ে সৌমিককে গেঁথে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর মুখ ঘুরিয়ে চুপ করে বসে আছে।

সৌমিকও আর কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। খোঁচাখুঁচি করতেও আর ইচ্ছে করছে না। দয়িতার সঙ্গে বোধিসত্ত্বর কী হয়েছে জেনেই বা কটা হাত-পা গজাবে সৌমিকের? দুদিন বাদে আমে-দুধে মিশে গেলে সৌমিক তো আবার যে আঁটি সেই আঁটিই।

একটু দূরের এক জটলায় তুমুল হাস্যরোল উঠেছে। জনা কয়েক যুবক নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-তামাশা করছে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে। মাতঙ্গিনী হাজরার স্ট্যাচুর সামনে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিল এক রমণী, একটা বেঁটেখাটো লোক গলা নামিয়ে কী যেন বলল তাকে, দুজনে হাঁটতে হাঁটতে আরও অন্ধকারে চলে গেল।

সৌমিক সে দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তেতো স্বরে বলল, বাড়িতে তো নেই বললে, তা তুমি এখন আছ কোথায়?

দয়িতা ঘাড় ফেরাল,—কটা দিন এক কলেজের বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। দমদমে। পয়লা তারিখ থেকে পাইকপাড়ায় শিফট করেছি। আপাতত ওখানেই পেয়িং গেস্ট।

—ও।…সল্ট লেক ছেড়েছ কদ্দিন?

—তা প্রায় দিন কুড়ি।

—এত দিন? প্রফেসারসাহেব জানেন তুমি কোথায় আছ?

—পরশু গিয়েছিলাম সল্ট লেকে। কিছু জামাকাপড় আনতে। তখন কথা হয়েছে।…বলে এসেছি, আমি আর ফিরছি না।

—তিনি তোমায় আটকালেন না? মিটমাট হল না?

—তোমায় কত বার বলব সৌমিক আমাদের ঝগড়া হয়নি! দয়িতা বিরাট বড় একটা শ্বাস ফেলল,—আমাদের সম্পর্কটা ছিঁড়ে গেছে। পুরোপুরি। ইটস টোটালি ওভার।

কথাটা এত স্পষ্ট, এত গভীরভাবে উচ্চারণ করল দয়িতা, যে সৌমিকের বুকের ভেতরটা শিরশির করে উঠল। আশ্চর্য, যদি সত্যিই ওদের সম্পর্ক ভেঙে গিয়ে থাকে, সৌমিকের তো খুশি হওয়া উচিত, কিন্তু মনে তেমন খুশির লহর উঠছে কই? দয়িতার তীব্র বিষাদ কি ছোঁয়াচে রোগ হয়ে সৌমিককে ধরে ফেলল? নাকি খেয়ালি মেয়েটার নতুন পাগলামিতে সৌমিক সন্ত্রস্ত?

দয়িতা হঠাৎ বলল,—তোমায় কেন ডেকেছি আন্দাজ করতে পারছ?

সৌমিক দ্রুত ঘাড় নাড়ল,—নাহ্‌।

—আমার একটা উপকার করে দিতে হবে সৌমিক।

—বলো।

—জানি তোমার ওপর জুলুমবাজি করছি…এটা শোভন নয়…

—অত কিন্তু কিন্তু করছ কেন? বলেই ফ্যালো।

—আমি খুব বিপদে পড়ে গেছি সৌমিক। আমার একটা থাকার জায়গা চাই।

—কেন? এখন যেখানে আছ, অসুবিধে হচ্ছে?

—এক্ষুনি এক্ষুনি হচ্ছে না, তবে অসুবিধে হবে।

—বুঝলাম না।

দয়িতা মাথা নামাল,—আমি প্রেগন্যান্ট সৌমিক।

সৌমিক নিমেষে হতবুদ্ধি। মগজে কথাটা পৌঁছুতে বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে দয়িতার দিকে।

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,—প্রফেসার মজুমদার জানেন?

—জানে তো বটেই।

—তার পরও তিনি তোমায়…?

—সে বাচ্চাটা চায় না সৌমিক। দয়িতা কথা কেড়ে নিল,—বাচ্চাটা তার কাছে আনওয়ান্টেড।

—কেন?

—ওফ, তুমি এত ছেলেমানুষ সৌমিক! এখনও বুঝিয়ে বলতে হবে? বোধিসত্ত্ব আমাকে শুধু তার নর্মসহচরী হিসেবে চায়। শুধু খিদমত খাটব, সেবা করব, বিছানায় নিয়মিত সুখ দেব, ব্যস। বাচ্চা মানে তো এক্সট্রা ঝক্কি। তা সে পোয়াবে কেন? এমনকী আমার চাকরি করাটাও সে মোটেই মেনে নিতে পারে না।

সৌমিকের কাছে রহস্যটা স্বচ্ছ হচ্ছে ক্রমশ। মহৎ মানুষদের মাপার মাপকাঠি আলাদা, তাঁরা স্বভাবতই একটু আত্মকেন্দ্রিক হন, সৌমিক জানে। কিন্তু তা বলে এতটা স্বার্থপর হবে? গা রি রি করে উঠল সৌমিকের। বাবুয়া তা হলে মানুষটাকে চিনতে ভুল করেনি!

নাহ, দয়িতা চলে এসে ভাল করেছে। ওই বোধিসত্ত্ব মজুমদারের ছায়াও মাড়ানো উচিত নয়।

দয়িতা নিচু গলায় বলল,—পারবে একটা ঘর খুঁজে দিতে?

—সে না পারার কী আছে? সৌমিক কাঁধ ঝাঁকাল,—দেখি, দালাল ফালালদের বলি।

—ওয়ানরুম ফ্ল্যাট হলেই চলবে। একা থাকব…

—নো প্রবলেম। ডোন্ট ওরি।

বহুক্ষণ পর দয়িতার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি উঁকি দিয়েছে,—কাজটা কিন্তু যত সহজ ভাবছ, তত সহজ নয়।

—কেন?

—চেষ্টা তো আমিও করছি…দেখছি…কলকাতা শহরে একা মেয়েকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না।

—স্ট্রেঞ্জ! পয়সা দিয়ে থাকবে, দেবে না কেন?

—তুমি এখনও সত্যিই ছেলেমানুষ আছ। কথাটা দ্বিতীয়বার বলল দয়িতা,—একা মেয়ে মানেই ধরে নেওয়া হয় খারাপ মেয়ে। তার ওপর পেটে বাচ্চা রয়েছে জানলে তো আরওই দেবে না।

—এ কী অন্যায় কথা? তুমি তা হলে এখন কোথায় যাবে?

—দ্যাখো না, তোমার চেনাজানা কাউকে বলে যদি…

সৌমিক ক্ষণিকের জন্য দিশেহারা। দয়িতা বিপদে পড়ে তার কাছে সাহায্য চাইছে, অথচ সে কিছুই করতে পারবে না, এ কী করে হয়? তবে এও তো সত্যি, তার তেমন চেনাজানা কেউ নেই, যে দয়িতাকে থাকতে দিতে পারে।

সৌমিক ফস করে বলে ফেলল,—তোমার বাবা মার কাছে ফিরে যাচ্ছ না কেন?

—সে আর সম্ভব নয়।

—কেন নয়? আমি জানি, তোমায় তাঁরা মাথায় করে রাখবেন।

—ভুল জানো। তারা হয়তো আমায় সোয়ালো করে নেবে, কিন্তু আমি তাদের সংসারে কাঁটার মতো ফুটব। তা ছাড়া আমি আমার সন্তানকে বোধিসত্ত্বর পরিচয়ে মানুষ করতে চাই না, আমার বাবা-মা সেটা মানতেই পারবে না।

—বোধিসত্ত্বর পরিচয়ে মানুষ করতে চাও না? মানে? তোমার বাচ্চার কোনও বাবা থাকবে না?

—সে টম ডিক হ্যারি যা হোক একটা কিছু নাম দিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু বোধিসত্ত্ব নয়, কক্ষনও না। বাচ্চাটা আমার, শুধু আমার।

নাহ্‌, মেয়েটা এক্কেবারে পাগল হয়ে গেছে। এ যে কী চায়, আর কী চায় না, বোঝা শিবেরও অসাধ্য।

হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল সৌমিকের,—আচ্ছা ধরো, আমি যদি একটা বাড়ি ভাড়া নিই…আমাকে তো নিশ্চয়ই দেবে?

—দিতে পারে। তো?

—তা হলে তো সমাধান হয়েই গেল। আমি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করছি। আমার নামে। তুমি সেখানে থাকবে।

—কী পরিচয়ে?

—সে একটা কিছু বলে দেওয়া যাবে।

দয়িতা একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল,—তা হয় না সৌমিক। আমার তো নিন্দে হবেই, তা হোক, আমি আর নিন্দে টিন্দে নিয়ে ভাবি না। তোমারও বদনাম হবে।

—আমি কেয়ার করি না।

—না। আমার জন্য তুমি একবার চরম হিউমিলিয়েটেড হয়েছ, আর নয়।

দয়িতার স্বর অস্বাভাবিক রকম দৃঢ়। যেন এটা বিচারকের রায়, এর কোনও নড়চড় করা চলবে না।

সৌমিক অসহায় মুখে বলল,—এ ছাড়া তবে আর কী উপায়?

—আমার নাম করেই চেষ্টা করো। দ্যাখো পাও কি না। দুনিয়ায় এক-আধজন সদাশয় বাড়িওয়ালা তো থাকলেও থাকতে পারে। সময় আছে…তাড়াহুড়ো নেই।

সৌমিক ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। কেন তার প্রস্তাবে রাজি হতে চাইছে না দয়িতা? সৌমিককে কি বিশ্বাস করে না? কী ভাবছে? উপকার করার নাম করে সৌমিক দয়িতার ওপর জোর ফলাবে?

শহর এখন আলোর নদী। মাঝে পার্ক যেন অন্ধকারের দ্বীপ। আলোর স্রোত আছড়ে পড়ছে দ্বীপে তবু যেন আঁধার কাটছে না। এ এক বড় প্রতারক মুহূর্ত। হেঁয়ালিমাখা।

.

২৩.

বাস থেকে নেমে প্রকাণ্ড ব্যাগটাকে কাঁধে তুলে নিল বাবুয়া। ওফ্‌, ব্যাগ তো নয়, বস্তা। পাহাড়ের মতো ভারী। দু’ দুটো ইয়া ইয়া ওয়াটার পিউরিফায়ার আছে ব্যাগে, কী ওজন! হাক্লান্ত শরীরে বোঝাটা যেন আরও দ্বিগুণ লাগছে। সারাদিন এই নিয়েই ঘুরতে হয়েছে, চিনচিন করছে কাঁধ, একটা রিকশা ধরে নেবে কি?

একটু দোনামোনা করে বাবুয়া শেষ পর্যন্ত রিকশা নিল না। হাঁটছে। দু-চার পা অন্তর অন্তর কাঁধ বদলাচ্ছে। দত্তদা আজ অফিসে বলছিলেন এই লাইনে চাকরি করতে হলে স্পন্ডিলাইটিস বাঁধা, নিদেনপক্ষে ফ্রোজেন শোল্ডার। বাবুয়ারও বোধ হয় কাঁধটা গেল।

হেলাবটতলার মোড়ে উজ্জ্বল আলোকের সমারোহ। ক্যাসেটের দোকানে জোর টেপ চালিয়েছে, হিন্দি গানের কলি উড়ে আসছে উচ্চকিত। বাতাসে সিঙাড়া কচুরির গন্ধ, রোল চাউমিনেরও। থিকথিক করছে মানুষ, জটলা করছে, আড্ডা মারছে, কেনাকাটা সারছে। শেষ জ্যৈষ্ঠের সন্ধ্যায় এখন প্রখর ব্যস্ততা।

জনাকীর্ণ অঞ্চলটা পেরিয়ে এল বাবুয়া। সামনে এখন অপেক্ষাকৃত নির্জন পথ। অন্ধকার অন্ধকার। হাওয়া বইছে মৃদু মৃদু, ঘরে ফেরার টানে বাবুয়ার ক্লান্তি যেন কাটছে ধীরে ধীরে। আজকের দিনটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মনে করার চেষ্টা করল বাবুয়া। রোজকার রোজ দিন কেমন গেল, এটা দিনের শেষে স্মরণ করাটা খুব জরুরি। এতে স্মৃতিশক্তি তাজা থাকে। আজ সারাদিনে বাবুয়ার পাঁচ জায়গায় ডেমনস্ট্রেশন ছিল। তিনটে অফিস, দুটো শোরুম। খুব তঙ্‌ করেছে লোকগুলো। কত ভাবেই না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, মাল নিল না। একটাই লাভ, তৃতীয় অফিস থেকে দু-দুটো ঠিকানা পাওয়া গেছে। কালই ছুটতে হবে, দেরি করা চলবে না, নইলে হয়তো অন্য কোম্পানির লোক পৌঁছে যাবে সেখানে। আগামীকালটা নিশ্চয়ই আজকের মতো বন্ধ্যা যাবে না।

লালজিবাবার আশ্রমের গেটে বিশাল এক হ্যালোজেন বাতি। অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে আলো। ওই আলোতেই বাবুয়া দেখতে পেল মামার বাড়ির গেটে এক সাদা ফিয়াট দাঁড়িয়ে। লেক টেরেসের গাড়িটা না? কাকা এসেছে? হঠাৎ কাকার আগমন?

ভুরু কুঁচকে বাড়ি ঢুকল বাবুয়া। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে ড্রয়িংরুমের সামনে থমকে দাঁড়িয়েছে। কাকা একা নয়, সঙ্গে কাকিমাও। হাত পা নেড়ে কী যেন বলছে কাকিমা, মা ভাবলেশহীন মুখে শুনছে। মামা মামিও আছে ঘরে, মামার চোখ টেরচা, মামির গোল গোল। কাকা সিগারেট ধরাল, অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়ছে। এ যে মহাসম্মেলন!

শরীর টানছে, এখন নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেই হয়, তবু বাবুয়া ড্রয়িংরুমেই ঢুকে পড়ল। গোবদা ব্যাগখানা কাঁধে ঝুলিয়ে। সটান গিয়ে বসেছে রাখীর পাশে।

বাবুয়ার আবির্ভাব মাত্রই থেমে গেছে গুঞ্জন। গোটা ঘর জুড়ে নেমে এসেছে এক নৈঃশব্দের গুমোট। যেন এইমাত্র শুরু হল কোনও মৌন সভা।

বাবুয়া চোখ ঘোরাল,—কেস কী? সবাই এমন ফ্রিজশট হয়ে গেলে কেন? আমি কি এখানে অবাঞ্ছিত?

রন্টু তাড়াতাড়ি বলে উঠল,—ঘরে গিয়ে রেস্ট নে না। সারাদিন খেটেখুটে এলি!

দীপালি বলে উঠল,—খুব পরিশ্রম করিস, না রে? তোর চেহারাটা খুব কাহিল হয়ে গেছে। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে, হনু ঠিকরে উঠেছে…

মিত্রা হাঁ হাঁ করে উঠল,—না না, ওর শরীর তো ঠিকই আছে। কাজ থেকে ফিরল বলে একটু যা…

—হ্যাঁ রে, তোর ওয়াটার পিউরিফায়ারের মার্কেট কেমন? শান্তশীল সোফায় হেলান দিয়েছে,—রেসপন্স পাচ্ছিস?

বাবুয়া মুচকি হাসল,—তোমরা বুঝি বোধিসত্ত্ব মজুমদারের কথা আমার সামনে আলোচনা করতে চাও না? আমি কিন্তু এখন যথেষ্ট অ্যাডাল্ট, আমার কাছে গোপন করার কিছু নেই।

—হ্যাঁ তো। ঠিকই তো। বাবুয়ার সামনে লুকোছাপার কী আছে? দীপালি নড়ে বসল,—ও শুনুক, বুঝুক, বিচারবিবেচনা করুক।

সঙ্গে সঙ্গে রন্টু সায় দিয়েছে,—রাইট। কথাটা বাবুয়ারও জানা দরকার। আফটার অল বাবুয়াও তো অ্যাফেক্টেড পার্টির একজন।

দীপালি রাখীর দিকে ফিরল। প্রসঙ্গ ঘোরানোর ছলনাটুকু ধরা পড়ার জন্য সে এখন আর বিব্রত নয়। অনেকটা স্বচ্ছন্দ স্বরে বলল,—হ্যাঁ, যা বলছিলাম…ফোন পেয়েই তোমার দেওর তো ছুটল সল্ট লেকে। গিয়ে দেখে দাদার ধুম জ্বর, একা ফ্ল্যাটে কাতরাচ্ছেন দাদা। অগত্যা দাদাকে তুলে নিয়ে এল বাড়িতে।

শান্তশীল গলা ঝাড়ল,—এখন অবশ্য জ্বরটা আর নেই। তবে ভাইরাল ফিভার ছিল তো, বড্ড উইক হয়ে পড়েছে। আমি তো মনে করতে পারছি না, লাস্ট কবে দাদাকে এমন দুর্বল হয়ে পড়তে দেখেছি। টলে টলে হাঁটছে, দেওয়াল ধরে ধরে বাথরুমে যাচ্ছে…

—এ সব কথা এখানে শোনাচ্ছেন কেন শান্তদা? রন্টুর গলায় ঝাঁঝ,—দিদির ও সব জেনে কোনও লাভ নেই।

—লাভ লোকসানের কথা ভেবে এখানে আসিনি রন্টু। শুধু বলতে এসেছি, আমাদের ফ্যামিলির দুঃস্বপ্নের ফেজ ইজ ওভার। সেই মহিলাটি…উঁহু, মহিলা বলব কেন, সেই ফ্ৰিভলাস্‌ মেয়েটি মানে মানে বিদায় নিয়েছে। শান্তশীলের দৃষ্টি রাখীতে ফিরল,—আমি তোমায় আগেই বলেছিলাম বউদি, ওই সম্পর্ক কক্ষনও টিকতে পারে না। ও সব মেয়ে ঘর ভাঙতে পারে, ঘর গড়া ওদের ধাতুতে নেই। দাদা একটা মোহের বশে…। কী, আমি বলিনি কথাগুলো?

—ব্যস, বলেই দায়িত্ব খতম? রন্টু প্রায় খিঁচিয়ে উঠল,—আপনাদের কোনও মরাল ডিউটি ছিল না? দাদাকে রেজিস্ট করতে পারেননি? বলতে পারেননি, ও সব বেহায়াপনা চলবে না?

মিত্রা স্বামীর হাত ধরে টানল,—আহ্‌, উত্তেজিত হচ্ছ কেন?

—হব না? আমার দিদিটা তিলে তিলে দগ্ধে মরছে, আর তিনি ওখানে ফূর্তি মারছেন! আর এঁরা ফেন্সের বাইরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছেন! দাদা ফ্যামিলিকে আলো করে রেখেছেন, তাই তাঁর সব কলঙ্ক মাপ? দিদির চরম অপমানের সময় কোথায় ছিলেন আপনারা? কী করেছেন?

দীপালি মিনমিন করে বলল,—কেন, দিদি বাবুয়াকে তো আমরা অনেক বার ওখানে গিয়ে থাকতে বলেছি!

—সেটা তো আরও বেশি অপমানকর। বর একটা অন্য মেয়েছেলের সঙ্গে লিভ-টুগেদার করছে, আর বউ মুখ বুজে শ্বশুরবাড়িতে পড়ে আছে…সুর্য চৌধুরীর মেয়ে অমন অপমানের ভাত খাওয়ার জন্য জন্মায়নি। দিস্ ম্যান ইজ দেয়ার টু প্রোটেক্ট হিজ দিদিজ্‌ ইজ্জত। নিজের বুকে আঙুল ঠুকছে রন্টু, গমগমে গলায় বলল,—আমি ভাবতে পারি না শান্তদা, আপনারা সব উচ্চশিক্ষিত লোক…আপনারা এই অপকর্মটি কেন মাথা নিচু করে মেনে নিলেন? একটু স্পাইন নেই আপনাদের? জানেন, অ্যাডাল্টারির মামলা করে আপনাদের গোটা ফ্যামিলির প্রেস্টিজ আমি ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারতাম? আপনারাও অফিসকাছারিতে মুখ দেখাতে পারতেন না…

বাঁধভাঙা বন্যার মতো তোড়ে ঠিকরে আসছে কথাগুলো। রন্টুর অনেকদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যেন ফেটে ফেটে পড়ছে। অপমানে টকটকে লাল হয়ে গেছে দীপালির মুখ, নাকের পাটা ফুলছে, শ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। মিত্রা চোখ পিটপিট করছে, যেন স্বামীকে আর সামলাতে না পেরে সে হাল ছেড়ে দিয়েছে, এমন একটা মুখভাব তার।

বাবুয়া আড়চোখে মাকে দেখল একবার। রাখী আশ্চর্য রকম নীরব। যেন গোটা ঘটনাটার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই। যেন সে কোনও নাটকের অভিনয় দেখছে স্থির চোখে।

মা কি উপভোগ করছে? নাকি কষ্ট পাচ্ছে? মামার এই কড়া কড়া কথায় কি সায় আছে মার?

দীপালি বুঝি কোনও প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, শান্তশীল হাত তুলে থামাল তাকে।

সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে বলল,—রন্টুকে বলতে দাও। এই কথাগুলো আমাদের প্রাপ্যই ছিল। সত্যি তো আমরা সেভাবে দাদাকে বোঝানোর চেষ্টা করিনি, এড়িয়ে গেছি…দাদার ব্যক্তিত্বটাই এরকম, আমরা তো কোনওদিন তার ওপর কথা বলতে শিখিনি।

একটুক্ষণ থেমে রইল শান্তশীল। যেন নিজের কথাগুলোর প্রতিক্রিয়া অনুভব করছে। রন্টুও থমকেছে সামান্য, ঘাড় গোঁজ করে আছে।

শান্তশীল ঠাণ্ডা গলায় বলল,—তবে রন্টু…আমরা কিন্তু দাদাকে কক্ষনও মরালি সাপোর্ট করিনি। নিজেদের মধ্যে বার বার আলোচনা করেছি দাদা কাজটা ঠিক করেনি। দীপালি তো রোজ বলত, দাদা চরম অন্যায় করেছে, দাদাকে একদিন খেসারত দিতেই হবে। তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না রন্টু… যে বাবা মা বড় ছেলে বলতে পাগল ছিল, তারাও আর বাড়িতে ছেলের নাম করত না! মা নিজে একদিন আমায় বলেছে, বড় বউমার কাছে আমার খুব যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কোন মুখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই বল?

—সরাসরি হয়তো বলা হয়নি, কিন্তু ইনডাইরেক্ট প্রোটেস্ট তো হয়েছে। দীপালি মাথা ঝাঁকাল,—অন্তত আমি করেছি। দাদা কত বার বলেছেন, তবু তাঁর সল্ট লেকের বাড়িতে আমি একটি দিনের তরেও যাইনি।

—যাক গে যাক, দোষী আমরা হয়ে আছি, হয়ে থাকবও। শান্তশীল ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল।

—দোষ নয় শাস্তদা। রন্টুর স্বর একটু নরম হয়েছে,—আপনি আমাদের অ্যাগনিটা ফিল করার চেষ্টা করুন।

—করিনি? বউদি কি আমাদের পর? বাবুয়ার জন্য কি আমাদের বুকটা হু হু করে না? মা তো নাতির নাম শুনলেই চোখ মুছতে শুরু করে।

বাবুয়ার মনটা সামান্য ভারী হয়ে গেল। কতকাল দাদু ঠাকুমার সঙ্গে দেখা হয় না! ওই লোকটার জন্যে। ওই লোকটার জন্যে।

কাজের মেয়েটা বিশাল এক ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল। হেলাবটতলা মোড়ের গরম গরম ফিশফ্রাই আর সন্দেশ। মিত্রা উঠে দাঁড়িয়েছে, একটা একটা করে প্লেট এগিয়ে দিচ্ছে সকলকে।

বাবুয়াকেও দিল,—খেয়ে নে। সেই কোন সকালে দুটি ভাত মুখে গুঁজে বেরিয়েছিস।

দ্বিধাগ্রস্ত মুখে একখানা ফিশফ্রাই হাতে তুলে নিল বাবুয়া। ধরেই আছে, খাচ্ছে না। চুঁই চুঁই করছে পেট, তবুও না। কেন যে চোরা বিবমিষা জাগে!

শান্তশীলরা হাত গুটিয়ে বসে আছে। রন্টু ভদ্রতা করে বলল,—নিন শান্তদা।

—আবার এ সব আনাতে গেলে কেন?

—আহা, ঝগড়াঝাঁটি যাই করি, কুটুমবাড়ি তো বটে।

—আমি ঠিক এই কথাটাই বলতে চাই। শান্তশীল কথাটাকে যেন লুফে নিল,—অনেক ঝড় বয়ে গেছে, মনোমালিন্যও কম হল না, কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা তো এখনও পুরোপুরি ছেঁড়েনি।

—বটেই তো। দিদি জামাইবাবুর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও একটা রিলেশান তো থেকেই যায়। যতই যাই হোক, আপনি বাবুয়ার কাকাই থাকবেন, আমি বাবুয়ার মামা। এ সম্পর্ক কোনও কোর্ট ছিঁড়তে পারে না।

—তা ঠিক। তবে…শান্তশীল একটু ইতস্তত করে বলল,—দাদা-বউদির সম্পর্কটা যে ছিঁড়ে গেছে, তাই বা কী করে বলি? …আই মিন, দাদা আর ডিভোর্স কেসটা নিয়ে এগোতে আগ্রহী নয়।

মা একটু কেঁপে উঠল যেন? নাকি বাবুয়ার চোখের ভুল!

রন্টু ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছে। শান্তশীল ঘাড় হেলাল,—হ্যাঁ, তাই। বিশ্বাস করো, দাদা এখন সত্যিই খুব রিপেন্টেড। মাঝের কটা মাস দাদা সম্পূর্ণ ভুলে যেতে চায়।

মিত্রা চোখ ঘোরাল,—তা কী করে সম্ভব? তিনি যখন যা চাইবেন, তাই হবে?

—মানুষ কি ভুল করে না মিত্রা? দীপালি বলে উঠল।

—মানুষই তো ভুল করে। ভুল করে বলেই তো সে মানুষ। ঈশ্বর নয়। শান্তশীল ফস করে আর একটা সিগারেট বার করে ঠোঁটে গুঁজল,—ভুল করে, শোধরায়, ভুল করে, শোধরায়… দাদা তো জীবনে এই একবারই মাত্র…চিরটা জীবই তো দাদা পুরোপুরি লয়াল ছিল। তোমরা তো নিজের চোখে দেখেছ, বউদিকে কীভাবে মাথায় করে রাখত দাদা! বউদি ছিল দাদার সংসারের অধীশ্বরী।

রন্টু গোমড়া মুখে বলল,—আমরা তো কখনও বলিনি, জামাইবাবু দিদিকে কষ্টে রেখেছিল!

—ছোট্ট একটা ভুল?…. ছোট নয়, ধরে নিচ্ছি খুব বড়সড় একটা ভুল করেছে দাদা। ভুলও নয়, অপরাধ। অন্যায়। তুমি তো কোর্টকাছারি করো, নানারকম আসামি দ্যাখো, তুমিই বলো, গিল্টি প্লিড করলে জজসাহেব আসামির ওপর দয়া দেখান না? দাদা আবার নতুন করে বউদির সঙ্গে জীবন শুরু করতে চাইছে, একটা সুযোগ পাবে না? রাখীর চোখে চোখ রাখল শান্তশীল,—তোমার কাছে দাদা এর মধ্যে একদিন এসেছিল না?

বাবুয়া চমকে তাকাল। মা তো কিছু বলেনি তাকে!

রন্টু মিত্রাও মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। রন্টু অস্ফুটে বলল,—কবে?

এতক্ষণে রাখীর ঠোঁট নড়ল,—গত মাসে। একদিন দুপুর নাগাদ। তোরা তখন কেউ ছিলি না।

শান্তশীল বলল,—দাদা সে দিন ওই কথাই বলতে এসেছিল। ঠারে ঠোরে তোমায় বোধ হয় কিছু বলেও ছিল।… অন্তত দাদার কথা শুনে আমার সেরকমই তো মনে হল। চামচ দিয়ে সন্দেশ কাটছে শান্তশীল। ছোট একটা টুকরো মুখে তুলে বলল,—আর একটা কথা তো বলা হয়নি। দাদা খুব শিগগিরই জার্মানি চলে যাচ্ছে। এক দু-মাসের জন্য নয়, হয়তো পার্মানেন্টলি ওদেশে সেটলও করে যেতে পারে।

—তাই নাকি? কবে যাচ্ছেন?

—সেপ্টেম্বরে। হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির কাজের পরিবেশ খুব ভাল, দাদারও খুব পছন্দ। দাদার ইচ্ছে বউদি দাদার সঙ্গে চলুক। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, দুজনে আবার একসঙ্গে…। আরে বাবা, দুজনেরই তো বয়স হয়ে গেছে, নাকি? বুড়ো বয়সে আর মান অভিমান পুষে রাখলে চলে?

রন্টুকে একটু চিন্তান্বিত দেখাল,—এ ব্যাপারে আমি কোনও কথা বলব না। ওটা পুরোপুরি দিদির ব্যাপার, দিদি যা চাইবে তাই হবে।

—অবশ্যই। বউদির ডিসিশানই ফাইনাল। শান্তশীল আবার ফিরেছে রাখীর দিকে—দাদা ভেতর থেকে একদম ক্ষয়ে গেছে বউদি। বোধিসত্ত্ব মজুমদার এখন একজন ভেঙেপড়া মানুষ। হি নিডস ইউ। এই পৃথিবীকে দাদার কিছু দেওয়ার আছে, তুমি পাশে না থাকলে কিছুতেই তা হবে না। …আমি তোমাকে জোর করছি না, তুমি একটু ভাবো।

—আমার তো মনে হয় একটা মিটমাট করে নেওয়াই ভাল। দুম করে মন্তব্যটা করেই থমকে গেল মিত্রা। ভয়ে ভয়ে স্বামীকে দেখছে। আমতা আমতা করে বলল,—মানে সবাই যেভাবে বলছেন…! জামাইবাবুও তো ঠেকে শিখেছেন, আর কোনও নতুন ভুলভ্রান্তি করবেন বলে মনে হয় না।

দীপালি বলল,—আমি তো বলব শিক্ষাটার প্রয়োজনও ছিল। এতে দাদার সংসারের বনেদটা আরও শক্ত হবে।

—বাবুয়াকে নিয়েও বউদির চিন্তা করার কোনও কারণ নেই। আমরা আছি, ওর মামারবাড়ি আছে…

চা এসে গেল! মাকে একটুক্ষণ একদৃষ্টে জরিপ করে নিয়ে উঠে পড়ল বাবুয়া। কেমন একটা গদগদ পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে, এক মুহূর্তও আর এ ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। নাহ্, কাকা কাকিমা মার্ক অ্যান্টনিকেও হার মানাতে পারে। তেরিয়া মামা পর্যন্ত পালটি খেয়ে গেল!

নিঃশব্দে বেরিয়ে যাচ্ছিল বাবুয়া, দরজা পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই শান্তশীল ডাকল,—কী রে, চললি যে বড়?

—টায়ার্ড খুব। গা প্যাচ প্যাচ করছে, চান করব।

—এবার একদিন আয় বাড়িতে। জুলি মিলি সব সময়ে তোর কথা বলে।

—দেখি।

—দেখি না, আয়। দাদু-ঠাকুমা কোন দিন আছে, কোন দিন নেই, দুজনের কারুরই শরীর ভাল যাচ্ছে না…দেখা না হলে পরে কিন্তু আফসোস করবি।

—হুম্।

বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘর থেকে চলে এল বাবুয়া। সোজা নিজের ঘর, প্যান্টশার্ট বদলে বাথরুম। অনেকক্ষণ ধরে স্নান করল, শাওয়ারের জলধারা চেপে চেপে ঘষছে গায়ে। যেন ক্লেদ মুছছে। বাথরুম থেকেই শুনতে পেল কাকা কাকিমা ডাকছে তাকে, যাচ্ছি যাচ্ছি বলছে। বাবুয়া সাড়া করল না, ভাল করে সাবান ডলছে গায়ে। রক্তকণিকার দাপাদাপি প্রশমিত হচ্ছে ক্রমশ। হঠাৎই ফুঁপিয়ে উঠল। কেন যে কান্না আসে? কোথ্‌থেকে আসে?

বাথরুম থেকে বেরিয়ে বাবুয়া একটু থতমত খেয়ে গেল। মা। তারই খাটে শুয়ে আছে, হাতে চোখ ঢেকে। |

বাবুয়া স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণে আনল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। দীর্ঘ মুকুরে আর একবার দেখল মাকে।

যথাসম্ভব স্বাভাবিক স্বরে বলল,—তা হলে জার্মানি চললে?

রাখী উত্তর দিল না। হাতও সরাল না।

প্রাণপণ চেষ্টা করেও গলার ব্যঙ্গটা আটকাতে পারল না বাবুয়া,—ক্ষমাই পরম ধর্ম, কী বলো? মেরেছ কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না?

রাখী এবারও চুপ।

—লেক টেরেস যাচ্ছ কবে? আই মিন, রিইউনিয়ানের ডেট কিছু ফিক্স হল?

স্প্রিং-টেপা পুতুলের মতো উঠে বসল রাখী। গুমগুমে গলায় বলল,—আমি লেক টেরেসে ফিরে গেলে তোর ভাল লাগবে?

—আমার ভাল লাগা না লাগাতে কী আসে যায়! এ তো তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার।

—না। তুইও আছিস। তুই কী চাস?

—আমি চাওয়া না চাওয়ার বাইরে।

—তুই ফিরবি?

—প্রশ্নই ওঠে না।

—কেন?

—কারণ আমার গায়ের চামড়া যথেষ্ট মোটা নয়। ও বাড়ির প্রতিটি ইট আমায় প্রতি সেকেন্ডে মনে করিয়ে দেবে, কী ভয়ানক হিউমিলিয়েশন সহ্য করতে হয়েছে আমাকে।

—তোর আর কী হয়েছে? হয়েছে তো আমার।

—আমার কাছে দুটোয় কোনও তফাত নেই। বাবুয়া রাখীর চোখে চোখ রেখেও সরিয়ে নিল,—তবে তোমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। তোমার বাবার ওপর যথেষ্ট উইকনেস আছে, আমি জানি। আমার জন্য তোমার হেজিটেট করার দরকার নেই।

—আমার একারই উইকনেস আছে? তোর নেই? তুই বাবাকে ভালবাসিস না?

বাবুয়া সহসা জবাব দিতে পারল না। সেই কোন শৈশব থেকে ওই লোকটা তার মনে বিতৃষ্ণার অনুভূতি গড়ে দিয়েছে, পদে পদে তাকে বাধ্য করেছে হীনম্মন্যতাবোধে আক্রান্ত হতে, কখনও লোকটা চোখ তুলে চেয়েও দেখেনি কীভাবে বেড়ে উঠছে বাবুয়া, তবু যেন কী একটা আছে! ইথারের মতো। সর্বব্যাপী, অথচ অস্তিত্বহীন। নইলে কেন শুধু ওই লোকটার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য দাঁতে দাঁত ঘষছে বাবুয়া? কেন তাকে উপেক্ষা করতে পারে না? কেন একদম ভুলে যেতে পারে না? আক্রোশ কি ভালবাসারই কোনও প্রতিশব্দ?

বাবুয়ার স্বর রূঢ় হল,—আমার কথা বাদ দাও। বলছি তো, তোমার ভালবাসা আছে, তুমি চলে যাও।

—ভালবাসি বলেই ফিরে যাব, এ তুই ভাবলি কী করে? ভালবাসা জিনিসটাই বড় জটিল রে বাবুয়া। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ভালবাসাকে ভালবাসা বলে না, এ আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। রাখী সামান্য গলা নামাল,—শুনলি তো, তোর বাবা আমার কাছে এসেছিল। মেয়েটা কেন চলে গেছে আমি জানি।

বাবুয়ার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে গেল,—কেন?

—সে আমি তোকে বলতে পারব না। তাতে তোর বাবাকে ছোট করা হয়। শুধু জেনে রাখ, তোর কাকা কাকিমা যা বলে গেল, সেটাই ধ্রুব সত্য নয়। ওই মেয়েটা খারাপ, তোর বাবা ভাল, এটা বললে মেয়েটার ওপর অবিচার করা হয়। আবার ওই মেয়েটাই ভাল, তোর বাবা খারাপ, তাও আমি বলছি না। শুধু বলতে পারি, মেয়েটা চলে যাওয়ার জন্যই আমার ডাক পড়েছে। এত বড় অসম্মান আমি কী করে মাথা পেতে নেব?

বাবুয়া বিছানার কোণে এসে বসল। নিষ্পলক চোখে দেখেছে মাকে। তার চেনা মা, সাদাসিধে আটপৌরে মা, কোন জাদুমন্ত্রবলে এক অচেনা নারীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল? না নারী নয়, মানুষ।

রাখীর কাঁধে হাত রাখল বাবুয়া,—তবু আর একবার ভেবে দ্যাখো মা। আরও ভাবো। সময় নাও। বাবা পার্মানেন্টলি চলে যাচ্ছে, তুমি তার সঙ্গে গেলে হয়তো বাকি জীবনটা সুখেই কাটাতে পারবে।

—তুই আমাকে আর সুখের লোভ দেখাস না তো। আমি যে তার চোখে কী, তা তো আমি জানি। তার চেয়ে বরং সে আরও নাম করুক, গোটা পৃথিবীতে তার যশ ছড়িয়ে পড়ুক, আমরা দূর থেকে খুব খুশি হব। আমাদের ছেড়ে থাকা তার অভ্যাস হয়ে গেছে, বিদেশে সে ভালই থাকবে।

এত অকম্পিত গলায় কথাগুলো কাকে বলছে মা? বাবুয়াকে? না নিজেকেই?

আহা রে মা, বাবুয়ার দুঃখী মা!

.

২৪.

আজ দিনভর থমথমে গরম ছিল। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ জমে আছে, বাতাস একেবারে নিথর। এমন একটা আবহাওয়া যেন নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।

প্রবীর আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই ফিরেছিল। বছরের এই সময়টায় কাজের চাপ কম থাকে, ছটা সাড়ে ছটার মধ্যেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়া যায়। বাড়ি ফিরেই আর কোনও কথা নেই, ধরাচুড়ো ছেড়ে সোজা বাথরুম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শাওয়ারের নিচে। ঘামাচি বেরিয়েছে খুব, জলের ছোঁয়ায় কুটকুটে ভাবটা যদি একটু কমে।

বুম্‌বা ঘরে। পড়ার টেবিলে। গ্রীষ্মাবকাশ প্রায় শেষ হয়ে এল, গোটা ছুটিটায় পড়াশুনোর পাট শিকেয় তুলে রেখেছিল, টো-টো করেছে যত্রতত্র, ইদানীং বইখাতা নিয়ে বসছে একটুআধটু। মণিদীপা রান্নাঘরে, বাপ ছেলের জন্য কফির জল চড়িয়েছে। সন্ধেবেলা বাড়িতে চা হয় না, কফি পানই রেওয়াজ।

স্নান সেরে বেরিয়ে গায়ে ভাল করে পাউডার মাখল প্রবীর। ড্রয়িংরুমে এসে বসল, রিমোটে অন করল টিভি। খেলাধুলোর চ্যানেলে প্রবীরের তেমন আগ্রহ নেই, লারেলাপ্পা নাচাগানাও সে পছন্দ করে না, গুচ্ছের অবৈধ প্রেমের সিরিয়ালও না। বিবিসি-র খবর শুনছে, তন্ময় হয়ে। শ্রীলঙ্কায় আজ আবার মানববোমার বিস্ফোরণ, চোদ্দজন ঘটনাস্থলেই মৃত। ছি ছি, কী হচ্ছে দেশটায়। পরদায় বীভৎস ডেডবডিগুলোর ছবি, গা শিরশির করে উঠল প্রবীরের। দাবি আদায় করতে গিয়ে মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কেন?

মণিদীপা ডাকছে—টেবিলে এসো, জলখাবার দিয়েছি।

—বুম্‌বা খেয়েছে?

—ওর এসব চিঁড়ে-মুড়ি ভাজা পোষায় না। চাউমিন করে দিয়েছিলাম। বলেই মণিদীপা গলা ওঠাল, বুমবা, তোমার কফি কি ঘরে দিয়ে আসব?

—আসছি মা। এক সেকেন্ড।

—তাড়াতাড়ি আয়। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

প্রবীর টিভিতে চোখ রেখেই ডাইনিং টেবিলে এল। চিঁড়েভাজা থেকে বাদাম বেছে বেছে খুঁটছে। মণিদীপা ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে কাপে, তারও চোখ টিভিতে। হঠাৎই বলল—দিদি আজ ফোন করেছিল।

প্রবীর কথাটায় তেমন আমল দিল না। দিদি বোনে তো প্রায়ই ফোনালাপ চলে, এতে আর নতুনত্ব কী আছে!

মণিদীপা আবার বলল,—টুনটুনির বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল।

—তাই? প্রবীর সামান্য নড়েচড়ে বসল,—কবে?

—তেসরা শ্রাবণ।

—সেই ডাক্তার পাত্র?

—হুঁ। খুব ভাল ছেলে পেয়ে গেল দিদি। কার্ডিওলজিতে ডিপ্লোমা করেছে, এখনই তিন তিনটে নার্সিংহোমের সঙ্গে অ্যাটাচড্‌…

—টুনটুনির ডাক্তার বর পছন্দ হল? গাঁইগুঁই করছিল না? বলছিল, ডাক্তারদের কোনও পার্সোনাল লাইফ থাকে না…?

—সবাই তোমার মেয়ের মতো নাকি? টুনটুনি বাবা মা-র খুব বাধ্য, দিদি জামাইবাবু যাকে ঠিক করে দেবে, তাকেই হাসিমুখে মেনে নেবে।

প্রবীর ঈষৎ ম্লান হয়ে গেল। কেন যে এখনও প্রতিটি সংলাপে ঘুরেফিরে মুনিয়া চলে আসে!

বুম্‌বা হেলেদুলে টেবিলে এসেছে। তার পরনে শর্টস আর হাফ পাঞ্জাবি, মুখভর্তি দাড়ি। কলেজ না খুললে সে দাড়িতে হাত ছোঁয়াবে না পণ করেছে।

কফির দিকে তাকিয়েই মুখ বিকৃত করল বুম্‌বা, অ্যাঃ, দুধ দিয়ে একেবারে সাদা করে দিয়েছ! আর একটু কফি মিশিয়ে দাও।

—বেশি ব্যাপকতামি কোরো না। যেমন দিয়েছি তেমন খেয়ে নাও।

বুম্‌বা কথাটার পরোয়া করল না। কাপ হাতে রান্নাঘরে গিয়ে নিজেই কফি নিয়ে নিল একটু। চামচে গুলতে গুলতে ফিরে এসে বসেছে চেয়ারে।

ছেলেকে একবার কটমট করে দেখে নিয়ে আবার প্রবীরে ফিরল মণিদীপা, টুনটুনিকে বিয়েতে কী দেওয়া যায় বলো তো?

—আমি কী বলব! সে তো তোমার ডিপার্টমেন্ট।

—গয়না একটা তো দিতেই হবে।

—হার ফার কিছু দিয়ে দাও। হাজার দশ বারোর মধ্যে। আফটারঅল টুনটুনি তো প্রায় আমাদের বাড়িরই মেয়ে।

—হুম্‌।… জড়োয়া দিলে কেমন হয়?

—দিতেই পারো। আজকাল তো খুব হিরের ফ্যাশান হয়েছে।

—অনেক দাম পড়ে যাবে। বাজেটে কুলোবে না।

বুম্‌বা পুট করে বলে উঠল, অত কেনাকিনিতে যাচ্ছ কেন? দিদির জন্য তো অনেক গড়িয়েছিলে, ওর থেকে কিছু একটা চালিয়ে দাও।

প্রবীর মণিদীপা দুজনেই থমকে গেল। শুধু গয়না কেন, মেয়ের জন্য শাড়িও কেনা হয়েছিল একগাদা। আলমারিতে সব তাল করা আছে। মাঝে মাঝেই মণিদীপা সেগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে, ফুঁপিয়ে ওঠে হঠাৎ হঠাৎ, এখনও। প্রবীর স্বচক্ষে দেখেছে।

প্রবীর গোমড়া মুখে বলল, তা হয় না রে। একজনের নাম করে কেনা হয়েছিল…

—সো হোয়াট? আলমারিতে তুলে রেখে কী হবে? অত দামের জিনিস…ভোগে না লাগলে সবই তো বেকার।

—আঃ বুম্‌বা। যা হয় না তা নিয়ে কথা বলিস না। ছেলেকে মৃদু ধমক দিল প্রবীর। পরিবেশটা হালকা করার জন্য বলল, ওগুলো তোর বউয়ের জন্য তোলা রইল।

—বাহ্, আমার বউকে পুরনো মাল গছাবে? বুম্‌বাও ঠাট্টা জুড়েছে, তারপর বউভাতের দিন দেখা যাবে বেনারসিটা ঝুরঝুর করে খসে পড়ছে!

—আলোচনাটা থামাবে তোমরা? মণিদীপা দুম করে রেগে গেল, আমার ভাল লাগছে না।

—যো আজ্ঞা। বুম্‌বা কাঁধ ঝাঁকাল, আমি জাস্ট একটা প্র্যাক্টিকাল সলিউশনের কথা বলছিলাম।…দাও না তোমরা টুনটুনিদিকে যা খুশি।

—হ্যাঁ, তুই চুপই থাক। বেশি ফোপরদালালি মারিস না। কথাটা বলে মণিদীপা গুম হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর ফাঁকা কাপ হাতে উঠে গেল রান্নাঘরে। সিঙ্কে ধুয়ে সাজিয়ে রাখল বাসনের জায়গায়। রান্নাঘর থেকেই গলা ওঠাল, কাল কি তুমি আমার সঙ্গে আশ্রমে যাচ্ছ? না, যাচ্ছ না?

—কাল কী করে হবে? উইক ডে…আমি তো আগেই বলেছিলাম…

—একটা দিন ছুটি নেওয়া যায় না?

—তুমি রোববার চলো।

—আশ্চর্য! মণিদীপা উত্তেজিত মুখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল, তুমি জানো গুরুদেব শনিবার বেনারস চলে যাচ্ছেন…!

—উপায় নেই গো। কাল একটা জার্মান টিম আসছে, তাদের নিয়ে প্ল্যান্টে যেতে হবে।

—তা হলে এবার আর আমার দর্শন হল না।

আহা, তুমি একাই যাও না। বলতে গিয়েও কথাটা গিলে নিল প্রবীর। ইদানীং লালজিবাবার আশ্রমে যাওয়া অনেক বেড়ে গেছে মণিদীপার এবং প্রতিবারই প্রবীরকে তার সঙ্গী হতে হয়। হিল্লিদিল্লি সর্বত্র একা একা চরে বেড়াতে রাজি মণিদীপা, কিন্তু বারাসতে সে এখন আর কিছুতেই একা যাবে না। কী যে এক ভয় ঢুকেছে, আশ্রমে যদি কবিতাদির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! আরে ছোঃ, কবিতা বসুরায় কি বাঘ-ভাল্লুক নাকি? তবে হ্যাঁ, মহিলা কিছু মুখরা বটে! বাড়ি বয়ে এসে যা ছ্যারছ্যার কথা শুনিয়ে গিয়েছিল। সন্তানের জন্য বাবা-মাকে যে কত সহ্য করতে হয়! ওই বোধিসত্ত্ব লোকটাকেই তো প্রবীরের সে দিন ঘুষি মারা উচিত ছিল। মারতে পেরেছিল কি?

বুম্‌বা টেবিল ছেড়ে উঠে যাচ্ছে। প্ৰবীর বলল, অ্যাই, তুই কাল মার সঙ্গে যাবি।

—আমি? বুম্‌বা প্রায় আঁতকে উঠল, আমি কেন?

—কেন নয়? মণিদীপা গরগর করে উঠেছে, তোমার কী রাজকার্য আছে শুনি?

—আছে।

—কী কাজ?

বুম্‌বা গা মোচড়াল,—আমার ম্যাটিনি শো’র টিকিট কাটা আছে।

—তুই সিনেমা দেখতে যাবি? তবু গুরুদেবের কাছে যেতে পারবি না?

—কেন? সিনেমা দেখা কি খারাপ কাজ? আমার ও সব গুরুদেব টুরুদেব পোষায় না। যত্ত সব ফালতু লোক…।

—গুরুদেব ফালতু? তোর যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা?

—যা বলেছি ঠিকই বলেছি। ভণ্ড বুজরুক একটা। দিদির নামে তো কত কী ভাল কথা বলেছিল, কী ফলেছে অ্যাঁ? মার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল বুমবা। হাত নেড়ে বলল, বি র‍্যাশনাল মা। ও সব গুরুদেব ফুরুদেব এবার ছাড়ো। ও সব লোকের কাছে গিয়ে মনের শান্তি আসে না।

—চোপ্‌। দপ করে জ্বলে উঠল মণিদীপা, কী দুটো সন্তানই না গর্ভে ধারণ করেছিলাম। দুটোই সমান অবাধ্য। দুটোই সমান বেপরোয়া।

—দিদির সঙ্গে আমার তুলনা করছ কেন?

—হুঁহুঁ, তুলনা করবে না! সে একভাবে জ্বালিয়েছে, তুমি একভাবে জ্বালাবে।

—এ তো মহা মুশকিল হল। দিদি কী করেছে তার জন্য আমায় সারাজীবন কথা শুনে যেতে হবে?

—এক ঝাড়েরই তো বাঁশ তোমরা। আলাদা হবে কী করে? বড়দের একটা কথাও তোমরা মান্য করতে শিখেছ?

—মা, তুমি আনরিজ্‌নেবল কথা…

—ফের? ফের তর্ক? তোর মুখ আমি ভেঙে দেব।

বলতে বলতে উন্মত্তের মতো ছেলের দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল মণিদীপা, প্রবীর কোনওক্রমে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল। মণিদীপা জোর করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, তার প্রমত্ত শক্তির সঙ্গে পেরে উঠছে না প্রবীর। এ সময়ে কোথ্‌থেকে যে এত জোর এসে যায় মণিদীপার গায়ে। ডাক্তার বলে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ। ফেজ অব টেম্পোরারি ইনস্যানিটি। কস্মিনকালে এ রোগ ছিল না মণিদীপার, মুনিয়া চলে যাওয়ার পর থেকে উপসর্গটা শুরু হয়েছে। ওষুধ চলছে নিয়মিত। এই স্নায়বিক বিকার যে কবে থিতোবে পুরোপুরি?

বুমবাকে চোখের ইশারায় সরিয়ে দিয়ে মণিদীপাকে চেপে ধরে চেয়ারে বসাল প্রবীর। দু চোখের মণি স্থির হয়ে আছে মণিদীপার, আগুনে নিঃশ্বাস পড়ছে বড় বড়, বুকটা হাপরের মতো ফুলে উঠছে, চুপসে যাচ্ছে।

মিনিট পনেরোর মধ্যে মোটামুটি স্বাভাবিক হল মণিদীপা। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল, আলো নিভিয়ে। প্রবীরের চোখ আবার টিভির পরদায়। মন বসছে না, চেয়েই আছে, দেখছে না কিছু। ভাবছিল কাল ছুটিটা নিয়েই নেবে। শরীর খারাপ টারাপ যা হোক কিছু বলে। বুম্‌বা এখন রাজি হলেও তার সঙ্গে মণিদীপাকে পাঠানো সঙ্গত হবে না।

বাড়ি জুড়ে এখন থমথমে নীরবতা। টিভি চলছে, প্রায় নিঃসাড়ে। বুম্‌বা এ সময়ে ব্যালান্সশিট কষতে কষতে গান শোনে, আজ তার ঘরও শব্দহীন।

তখনই বেল বাজল।

দরজা খুলে সামান্য অবাকই হল প্রবীর। সৌমিক।

—আরে, এসো এসো। কী খবর? অনেকদিন পর…?

—এই…আসাই হয় না…! সৌমিক আলগা হাসল, বুম্‌বা কোথায়? মাসিমা?

—সবাই আছে। ডাকছি। তুমি বোসো।

সৌমিককে বসিয়ে ঘরে গেল প্রবীর। চুপিসাড়ে ডাকল, মণি, সৌমিক এসেছে।

মণিদীপা ঘুরে শুল, তো?

—এসো একবার।

—আমার ভাল্লাগছে না। তুমি গল্প করো।

—ছি, এমন করে না। প্রবীর হাত রাখল মণিদীপার চুলে, ছেলেটা কদ্দিন পর এল…।

বুঝি একটা বাতাসের শব্দ শোনা গেল,—যাও, আমি আসছি।

ফিরে এসে প্রবীর দেখল বুম্‌বার সঙ্গে কথা বলছে সৌমিক। বুম্‌বার মুখ এখন নির্মেঘ, বেশিক্ষণ মেজাজ খারাপ করে থাকা তার ধাতে নেই।

সোফায় বসে সিগারেট ধরাল প্রবীর। টুকটাক কুশল প্রশ্ন করছে নিয়মমাফিক। মা-বাবার কী খবর, অফিস কেমন চলছে…। মাত্র ক মাসে হাসিখুশি ছেলেটাকে বেশ ভালই বেসে ফেলেছে প্রবীর। ছেলেটার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বললে মন ঝরঝরে হয়ে যায়।

কিন্তু আজ সৌমিক যেন কেমন দূরমনস্ক। মুখটাও কেমন শুকনো শুকনো লাগে। মণিদীপা এসে জিজ্ঞেস করল, সৌমিক নিশ্চয়ই অফিস থেকে আসছে, কিছু খাবেটাবে কি না। এমন প্রশ্নে অবলীলায় ঘাড় নাড়ে সৌমিক, আজ না না করে উঠল। বুম্‌বা শারজা কাপে ইন্ডিয়ার পরাজয় নিয়ে তর্ক জোড়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সৌমিক যেন উদাসীন।

প্রবীরের খটকা লাগছিল। জিজ্ঞেস করল,—তোমার কি শরীরটা ভাল নেই?

—না তো। ঠিকই আছি তো। ফাইন। সৌমিক নার্ভাস মুখে হাসল, ইনফ্যাক্ট, আমি আজ একটা দরকারে এসেছিলাম।

—কী বলো তো?

—একটা খবর দেওয়ার ছিল। সৌমিক আমতা আমতা করল, মানে…রিগার্ডিং দয়িতা।

মণিদীপা সোফায় হেলান দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে টান টান। ফ্যাসফেসে গলায় বলল, কী হয়েছে মুনিয়ার?

—হয়নি কিছু।…মানে… আবার হয়েছেও।

প্রবীরের চোখ সরু হল, বুঝলাম না।

সৌমিক একঝলক দেখে নিল বুম্‌বাকে। মাথা নামিয়ে বলল, কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না, দয়িতাও আমায় পইপই করে বলতে বারণ করেছে…দয়িতা এখন আর প্রফেসর মজুমদারের সঙ্গে থাকে না।

—কীই?

—প্রফেসর মজুমদারের সঙ্গে দয়িতার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

—সে কী কথা? প্রবীর আর মণিদীপা কোরাসে ঝনঝন করে উঠেছে, সে তা হলে এখন কোথায়?

—পাইকপাড়ায়। এক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হয়ে আছে।

সংবাদটা হজম করতে বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল প্রবীরের। হতচকিত স্বরে বলল, কবে থেকে?

—মাস দেড়েক তো বটেই। বেশিও হতে পারে।

সহসা এক তীক্ষ্ণ সূঁচ বিঁধল প্রবীরের হৃৎপিণ্ডে। দেএএড় মাআআস? মুনিয়া তাদের একবার জানানোরও প্রয়োজন মনে করল না? এত পর হয়ে গেছে বাবা-মা? না কি এ অভিমান? জেদ?

মণিদীপার দৃষ্টি কেমন অস্বচ্ছ হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে বলল, ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল? মাত্র এ ক মাসের ভেতরে? কেন?

সৌমিক উত্তর দিল না। আবার মাথা নিচু করেছে।

প্রবীর মনে মনে হিসেব কষছিল। সে বোধিসত্ত্বর কাছে গিয়েছিল কবে? সেও তো ওই মাস দেড় দুই-ই হবে। সে দিন তো বোধিসত্ত্বর কথায় আঁচ পাওয়া যায়নি তাদের সম্পর্কে চিড় ধরেছে? বোধিসত্ত্ব কি চেপে গিয়েছিল? খুবই সম্ভব। লোকটার যতই নামডাক থাক, প্রবীর কিছুতেই তাকে একজন শঠ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না টাইপ৷ নিশ্চয়ই বাড়ি গিয়ে মুনিয়ার সঙ্গে অশান্তি করেছে। হয়তো শুনিয়েছে বাবা এসে কত অপমান করে গেছে। মুনিয়া হয়তো সেটা সহ্য করতে না পেরেই…!

উঁহুঁ, বাবা মার জন্য যদি অত টান থাকত, তা হলে তো মেয়ে এখানেই ফিরে আসত।

আরও একটা সম্ভাবনার কথাও উঁকি দিয়ে গেল প্রবীরের মাথায়। সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়ার পর এখন কি অনুতাপ এসেছে মুনিয়ার? সঙ্কোচ কাটাতে পারছে না তাই সৌমিককে দূত করে পাঠিয়েছে?

প্রবীর ভুরু কুঁচকে তাকাল, তোমার সঙ্গে মুনিয়ার দেখা হল কী করে?

—হঠাৎই। একদিন এসপ্ল্যানেডের মোড়ে…। সৌমিক গলা ঝাড়ল, ও অফিস থেকে ফিরছিল…

—মুনিয়া চাকরি করে?

—করে তো।… মানে ওই নিয়েই তো বোধহয় প্রফেসর মজুমদারের সঙ্গে…

—মুনিয়া বলল তোমায়?

—হ্যাঁ… কথা শুনে তো তাই মনে হল।

এতক্ষণে যেন বোধিসত্ত্বকে আরও একটু চিনতে পারল প্রবীর। লোকটা শুধু শরীরের দিক দিয়েই বুড়ো নয়, ব্যাকডেটেড। রক্ষণশীল। বিজ্ঞানচর্চা ওর ভড়ং। মস্তিষ্ক বৈজ্ঞানিক হলেও হৃদয়টা আধুনিক হয়নি।

প্রবীর প্রশ্ন করল, কোথায় চাকরি করছে মুনিয়া?

—ছোট একটা কোম্পানিতে। সেল্‌সের কাজ।

—হঠাৎ চাকরি শুরু করল?

—বলল, একা একা ঘরে বসে বোর হচ্ছে…

আশ্চর্য, সৌমিককে এত কথা বলেছে, অথচ বাবা-মাকে একবার কিছু জানায়নি মেয়ে!

প্রবীরের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল, তোমার সঙ্গে কি মুনিয়ার যোগাযোগ ছিল?

—না মানে…। সৌমিক চোখ তুলেই নামিয়ে নিল, মানে ওই একদিনই…

প্রবীরের কেন যেন মনে হল সৌমিক সব সত্যি বলছে না। চকিতে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা প্রশ্ন খেলে গেল মাথায়। উকিলি ঢঙে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, একটা কথা…। তুমি মুনিয়াকে চিনলে কী করে? তোমার সঙ্গে তো তার কখনও পরিচয় হয়নি?

সৌমিক নতমুখেই বলল, ও একদিন আমার অফিসে এসেছিল।

—কবে?

—অনেকদিন আগে। আমাদের বিয়েটা স্থির হওয়ার ঠিক পর পরই।

—স্ট্রেঞ্জ! বলোনি তো কোনওদিন?

সৌমিক চুপ।

—কেন গেছিল? বিয়ে ভাঙতে?

সৌমিক এবারও চুপ।

প্রবীরের বিস্ময় বাড়ছিল। বিয়ে ভাঙতেই যদি গিয়ে থাকে, সৌমিক সেটা কাউকে জানায়নি কেন? মুনিয়া চলে যাওয়ার পরও কেন এখানে যাতায়াত বজায় রেখেছে? নেহাতই ভদ্রতাবোধ? নাকি প্রবীরদের ভাল লেগে গেছে তাই? নাহ্‌, কেমন যেন গোলমেলে ঠেকছে।

প্রবীর ফের প্রশ্ন করল, তোমার সঙ্গে কবে দেখা হয়েছিল মুনিয়ার?

—এই তো…ছ-সাত দিন আগে।

—সঙ্গে সঙ্গে জানাওনি কেন?

—বললাম না, দয়িতা ভীষণভাবে মানা করেছিল।

—তা হলে আজই বা বলতে এলে কেন?

মণিদীপা হাঁ হাঁ করে উঠল, তুমি ওকে এত জেরা শুরু করলে কেন?…তা হ্যাঁ বাবা সৌমিক, মুনিয়া এখন আছে কেমন?

এতক্ষণ পর সৌমিক একটা বড় করে শ্বাস ফেলল। দু দিকে মাথা নেড়ে বলল, ভাল নেই মাসিমা। ওর শরীর একদম ঠিক নেই।

—কী হয়েছে?

—দয়িতা প্রেগন্যান্ট। অ্যানিমিয়া মতনও হয়েছে, প্রেশারও খুব লো…

—বাচ্চা হবে মুনিয়ার? তবুও একা একা পড়ে আছে? মণিদীপা ছটফট করে উঠল।

—আমি তো সেইজন্যই এসেছি মাসিমা। আমি চাই আপনারা এ সময়ে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ান। জোর করে ওকে এখানে নিয়ে চলে আসুন।

—সে তো আনতেই হবে। নইলে কি বেঘোরে মরে যাবে…মণিদীপার মুখে-চোখে অস্থিরতা, তুমি আমাকে ঠিকানাটা দাও বাবা, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

সৌমিক পার্স থেকে একটা চিলতে কাগজ বার করে মণিদীপার হাতে দিল। মণিদীপা দেখছে ঠিকানাটা। প্রবীরকে বলল, রাজা মণীন্দ্র রোড…তুমি চেনো?

প্রবীর গম্ভীর স্বরে বলল, দাঁড়াও। আমার সৌমিকের সঙ্গে আরও কিছু কথা আছে।…তোমাকে ঠিকানা দেওয়ার জন্য মানা করেছে মুনিয়া, তাই তো?

—হ্যাঁ।

—তার মানে ও চায় না আমরা ওকে নিয়ে আসি?

—হ্যাঁ।

—তা হলে আমরা যাব কেন? এটা ওর নিজের বাড়ি, ইচ্ছে করলেই ও এখানে ফিরে আসতে পারে। যখন খুশি।

—এটা জেদাজেদির সময় নয় মেসোমশাই। দয়িতার সত্যিই খুব বিপদ। আমাকে বলছে একটা ঘর খুঁজে দিতে, একা একা থাকতে চায়। ওর মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে।

—ঘরও খুঁজে দিতে বলেছে?

—বলেছে তো। সৌমিক ঢোক গিলল, কত বোঝালাম একা কোনও মেয়ে ঘরভাড়া পায় না, কিছুতেই কিছু বুঝতে চায় না।

—আমি যাব বোঝাতে। এক্ষুনি। আমি ওর মা, আমি গিয়ে ডাকলে ও কক্ষনও আমায় ফেরাতে পারবে না। মণিদীপা উঠে দাঁড়াল, কী গো, তুমি এখনও বসে আছ? ওঠো। চলো। অ্যাই বুম্‌বা, তুইও চল।

বুম্‌বা হতভম্ব। ফ্যালফ্যাল তাকাচ্ছে।

—না। আমরা কেউ যাব না। প্রবীর জেদি ঘোড়ার মতো ঘাড় বেঁকাল, সে যখন চায় না আমাদের, কেন যাব?

—তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? এ কি মান-অভিমান করার সময়?

—নাহ্‌, অভিমান তো তারই একচেটিয়া।

—প্লিজ মেসোমশাই…

—তুমি অনুনয় করছ কেন? তোমার কিসের দায়?

—আমি দয়িতার ভাল চাই মেসোমশাই। ওকে দেখে সে দিন এত মায়া হল…

—কিসের মায়া? কেন মায়া?

সৌমিক কেমন বিহ্বল চোখে তাকাল। এই মুহূর্তে মেয়ের জন্য উদ্বেগ প্রবীরকে কুরে কুরে খাচ্ছে, সৌমিকের ওই দৃষ্টি যেন ঠাণ্ডা প্রলেপ বুলিয়ে দিল তাতে।

নরম গলায় বলল, আমায় একটা সত্যি জবাব দেবে সৌমিক? মুনিয়াই কি তোমায় পাঠিয়েছে?

—না না, বিশ্বাস করুন…। সৌমিক যেন কেঁপে উঠল, ও এখানে আর ফিরতে চায় না মেসোমশাই। কোন মুখে ফিরবে, বলুন? আমি চাই আপনারা ওকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসুন, ওর কোনও ওজর আপত্তি শুনবেন না। শুধু একটাই রিকোয়েস্ট, কাইন্ডলি ওকে বলবেন না ঠিকানাটা আমার কাছ থেকে পেয়েছেন।

—কেন সৌমিক?

—ও তা হলে আমায় কোনওদিন ক্ষমা করতে পারবে না।

—তাতেই বা তোমার কী আসে যায়?

সৌমিক উত্তর দিল না। প্রবীরের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছে।

প্রবীরের বুকটা টনটন করে উঠল। মেয়ের জন্য নয়, সৌমিকের জন্য। ছেলেটা বড্ড ভাল, একটু বেশি রকমের ভাল। মুনিয়া কখনওই এই ছেলের যোগ্য ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *