১৫. সমুদ্রের সাধ

১৫. সমুদ্রের সাধ

এক.

২০১৮ সালের শুরুরদিকে কোনো একটা কাজে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। রাত তখন সাড়ে এগারোটা কি বারোটা বাজে, হঠাৎ খুব করে মন চাইলো সমুদ্রের পাড়ে যেতে। ঢেউয়ের শোঁ শোঁ শব্দ যেন আমার কানে তোলপাড় শুরু করেছে আর যেন কী এক। মাতাল করা মোহিনী আবেশে আমাকে ডেকে চলেছে তার দিকে! সমুদ্র আমার বরাবরই পছন্দের। তীরহারা দিগন্তবিস্তৃত তার জলরাশি, ঢেউয়ের উথাল-পাতাল গর্জন, আকাশের নিচে তার নিঃসীম নিরন্তর বয়ে চলা আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে রাখে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা পাহাড় কেনার শখ ছিলো, আর আমার অনেক ইচ্ছে একটা সমুদ্র কেনার। একটা সমুদ্র–একান্ত নিজের করে!

সেই মাঝরাতে আমরা কয়েকজন মিলে চলে এলাম সমুদ্রের পাড়ে। সমুদ্রের যত কাছে আসি, শোঁ শোঁ শব্দ মাথার আরো ভেতরে ভীষণভাবে বাজতে থাকে। নিউরনে অনুরণনের মতো–যেন মহাশূন্যের কোথাও চলছে অবিশ্রান্ত মহাজাগতিক বোঝাপড়া।

সমুদ্রের কাছে এসে আমি একেবারে তাজ্জব বনে গেলাম! এ যেন সমুদ্র নয়, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ থেকে উড়ে এসে পড়া বিশাল এক শুভ্র বরফখণ্ড–যতদূর চোখ যায় তার বিস্তৃতি! পুরো সমুদ্র যেন ঢেকে আছে শাদা বরফের চাদরে। আমার ঘোর কাটে পাশ থেকে একজনের আওয়াজে, যখন সে বললো, ‘বাহ, সমুদ্রে এমন ফেনা তো আগে কোনোদিন দেখিনি!’

আচ্ছা, এই শুভ্র সফেদ বস্তু তাহলে সমুদ্রের ফেনারাশি বটে! এত সুন্দর তার আস্তরণ, এত চমৎকার তার জলের গায়ে লেপ্টে থাকার ধরন! শুভ্র ফেনার অলঙ্কার গায়ে সমুদ্রের এই রূপ ছিলো আমার কাছে নতুন ও নান্দনিক।

দুই.

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটা হাদিস পড়ে আমার সেদিনকার কক্সবাজারের ওই স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেলো। একটা উদাহরণ দিতে গিয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমুদ্রের ফেনার কথা উল্লেখ করেছিলেন বলেই হয়তো-বা, আমার মস্তিষ্ক স্মৃতির অতল গহ্বর থেকে ঠিক ওইদিনের স্মৃতিটাকে আমার মানসপটে মেলে ধরলো।

বেশ পরিচিত একটা হাদিস, তবু এর শব্দচয়নে আমার জীবনের ভালো একটা স্মৃতির উপাদানের উপস্থিতি থাকায় সেটা আমাকে একটু থমকে দাঁড়াতে বাধ্য। করলো। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে চাইলাম সেদিনের সেই মাঝ রাতের দৃশ্যটা

অথৈ জলের একটা সমুদ্র, চারদিকে তার ভাঙা-গড়ার তর্জন-গর্জন, বাতাসের বুক ফেড়ে আসা শোঁ শোঁ শব্দ আর দৃষ্টির সীমানা অবধি শুভ্র বরফের চাদর!

যে হাদিসটা আমাকে আমার স্মৃতির শহরে হারিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে সেটা হলো–নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতিটা ফরয সালাতের পরে তেত্রিশবার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদুলিল্লাহ এবং তেত্রিশবার আল্লাহু আকবার বলবে এবং এরপর এই দুআ পাঠ করবে—’লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাই’ইন কাদীর’, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার গুনাহ মাফ করে দেবেন, এমনকি তার গুনাহ যদি সমুদ্রের ফেনারাশির পরিমাণও হয়–তবু।[১]

আমি ভাবতে লাগলাম, সমুদ্রে কী পরিমাণ ফেনা থাকতে পারে? ভারত মহাসাগরের খুব ছোটো একটা অংশকে আমরা বঙ্গোপসাগর হিশেবে জানি। সেই ছোটো অংশটার খুবই ছোটো একটা কোণায় দাঁড়িয়ে আমি যে বিস্তৃত ফেনারাশি দেখেছি একদিন, তাও যদি হিশেবের খাতায় তুলি, আমার ধারণা সেটাও আমার কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাবে। যদি সেখানে গোটা ভারত মহাসাগরটাকে ধরা হয়? যদি এর সাথে যোগ করা হয় পৃথিবীর সমস্ত সাগর-মহাসাগরকে? যদি আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে তৈরি হওয়া ফেনারাশিকে আমার হিশেবের খাতায় তুলতে হয়–কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেই পরিমাণ?

জানি, এই পরিমাণটাকে কল্পনায় আনাও অসম্ভব, কিন্তু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন–যদি আমাদের গুনাহের পরিমাণ সেই অসম্ভবের পর্যায়েও পৌঁছায়, তবু আমাদের রব আমাদের সেই গুনাহগুলো অবশ্যই অবশ্যই মাফ করে দেবেন, যদি আমরা ক্ষমালাভের নিয়তে আমলটা করতে পারি।

তিন.

যদি জান্নাতে যেতে পারি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে একটা সমুদ্র চাবো। আমার সেই সমুদ্রের পাড়ে একদিন দাওয়াত করবো নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। সমুদ্রের অঢেল ফেনারাশির দিকে তাকিয়ে আমি নবিজিকে বলবো-ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি সমুদ্র ভালোবাসতাম। একদিন পাড়ে এসে সমুদ্রের ফেনারাশির বিস্তৃতি দেখে আমি যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে যাই। তারপর অন্য আরেকদিন আপনার একটা হাদিসে সমুদ্রের ফেনারাশির উল্লেখ পেয়ে আমি হারিয়ে যাই আমার পূর্বের সেই স্মৃতিতে। ওই হাদিসটা আমার মনে এত গভীরভাবে দাগ কেটে যায় যে– আপনার শেখানো আমলটাকে আমি আমার জীবনের পাথেয় করে নিই।

আমি কোন হাদিসটার কথা বলছি তা কি নবিজির মনে পড়বে? যদি মনে পড়ে তবু আলাপটাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য তিনি হয়তো জিগ্যেশ করবেন, কোন হাদিসটার কথা বলছো, বলো তো।’

‘ওই যে, সালাতের পরে তাসবিহ [২], তাহমিদ [৩] আর তাকবিরের[৪] পরে যে দুআটা পাঠ করলে আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন বলেছিলেন আপনি, সেটা।

এমনকি বান্দার গুনাহ যদি সমুদ্রের ফেনারাশির পরিমাণও হয়, তবু। জানেন ইয়া রাসুলাল্লাহ, একজীবনে এত এত গুনাহ করেছি যে, মাঝে মাঝে মনে হতো আমার গুনাহের স্তূপ করলে তা উচ্চতায় আকাশ স্পর্শ করবে; কিন্তু আমার পরম করুণাময় রব আমাকে মাফ করে দিয়েছেন। এমনকি আমার একটা সমুদ্র নিজের করে পাওয়ার শখ ছিলো বলে তিনি আমাকে এই সুবিশাল সমুদ্রটা উপহারও দিয়েছেন। কী সুমহান, কী অপার দয়া আমার রবের! আলহামদুলিল্লাহ!

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হয়তো মুচকি হেসে বলবেন, ‘রব্বানা ওয়া-লাকাল হামদ! সমস্ত প্রশংসা কেবল আমার রবের! দেখলে আরিফ, আমার রবের কোনো ওয়াদা মিথ্যে ছিলো না।

সত্যিই, আমাদের রবের কোনো ওয়াদাই মিথ্যে নয়।

———–
[1] সহিহ মুসলিম : ৫৯৭; সুনানুন নাসায়ি : ৯৭৯৭; মুআত্তা মালিক : ২২; সহিহু ইবনি হিব্বান : ২০১৩; সহিহু ইবনি খুযাইমা : ৭৫০

[2] তথা সুবহানাল্লাহ।

[3] অর্থাৎ আলহামদুলিল্লাহ

[4] তথা আল্লাহু আকবার

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *