এবার ভিন্ন কিছু হোক – আরিফ আজাদ
প্রথম প্রকাশ : একুশে বইমেলা ২০২২
.
নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ সবকিছু কেবল বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য।
.
পাঠকের মন্তব্য
[এক] বেলা ফুরাবার আগে আমার পড়া অনন্য এক আত্মান্নয়নমূলক বই। মুসলিম জীবনের নিয়মতান্ত্রিক টিপসগুলো এত সুন্দর উপস্থাপনায় আমি ইতোপূর্বে কখনো পড়িনি। জীবনমুখী বিষয়গুলো পড়তে গিয়ে বইয়ের পাতা থেকে আমি ইতিহাসেরও শিক্ষা নিয়েছি দারুণভাবে। পশ্চিমের আধুনিক জীবনের বিপরীতে কীভাবে জীবনটাকে প্র্যাক্টিসিং-জীবন হিসেবে সাজানো যায়, তার দারুণ অনুপ্রেরণা রয়েছে এই বইয়ে। আমাদের দুটো জীবন–এক. দুনিয়ার জীবন, দুই. আখিরাতের জীবন। দুনিয়ার জীবনপদ্ধতি হচ্ছে আখিরাতের জীবনের ইনভেস্টমেন্ট। মৃত্যুপরবর্তী জীবনের ইনভেস্টমেন্টের সিকিউরিটি নিশ্চিত করে কীভাবে দুনিয়ার জীবনকে উপভোগ্য এবং উপজীব্য করে অতিবাহিত করা যায়, সে বিষয়েরই প্রতিপাদ্য চিত্র বেলা ফুরাবার আগে। উদভ্রান্ত, উদাসীন সময়ের পাটাতন থেকে মানুষেরা ফিরছে জীবনের নতুন অনুচ্ছেদে। মুক্তির শীতল পরশে নতুন পৃথিবীর বার্তা বইছে। ভীষণ বেপরোয়া স্রোত এবার বাঁক নিয়েছে। জীবনের এই বেপরোয়া স্রোতকে আমরা নতুন জাগরণে উত্তাল করবো। আসুক তবে আদর্শের সেই কাঙ্ক্ষিত ঢেউ, আমরা তাতে হবো লীন।
–কাজী শাখাওয়াত হোসাইন
[দুই] সন্ধ্যেনামা মেঠোপথে সদাইপাতি নিয়ে শশব্যস্ত পা-চালানো পথিকের মতোই আমাদের জীবন। সূর্যাস্তের আগেই ঘরে ফিরবার তাড়া! অনন্তের জন্য সওদা গুছিয়ে জীবনের অলিগলি ধরে বিরামহীন পথচলা… ক্ষণস্থায়ী জীবনের সওদাটুকুই পরকালের সম্বল। জীবনের লেনাদেনায় সেটুকুন গোছাতে পারলেই সফলতা। জীবনের সওদা গোছানোর অনুপম পাঠ নিয়ে লেখা হয়েছিল বেলা ফুরাবার আগে বইটি। হৃদয়ছোঁয়া বইটির প্রতিটি পাঠেই কাষ্ঠকঠিন হৃদয়ে জেগেছে প্রশান্তিময় কুরআনি বসন্ত। মনের বিষণ্ণতার প্রহরগুলোতে প্রাণসঞ্চারের কোশেশ করেছে অনুপম এই বইটি। বইটির দ্বিতীয় সিকুয়েন্স আসছে শুনে আপ্লুত হয়েছি। বইটির দ্বিতীয় সিকুয়েন্সও পাঠকপ্রিয় হোক। বিশ্বাসী তারুণ্যকে শেখাক আসমানি শুদ্ধতার পাঠ। জীবনের উঠোনজুড়ে ছড়িয়ে দিক ফিরদাউসের খুশবু। আমাদের পাথরপ্রতিম হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ঝরুক প্রিয় লেখকের এই সিরিজটি।
–জোবায়ের বিন বায়েজীদ
[তিন] এ ছোট্টকায় জীবনে অনেক দেখেছি যে, সব জিনিসে দারুণ উপকার থাকলেও কিছু না কিছু অপকারিতাও থেকেই যায়। এই প্রথম কোনো বই পড়ে আমারও বেশ উপকার হয়েছে। কিন্তু তাজ্জবের বিষয়–এই বইটিতে কোনো অপকারিতা খুঁজে পাইনি আমি। অসম্ভব চমকপ্রদ ভাষাভঙ্গিতে লেখা বইটির নাম বেলা ফুরাবার আগে৷ বইটির ফিরিস্তি দেখেই খুলে ফেলি ৬৪ নম্বর পৃষ্ঠার ‘আমরা তো স্রেফ বন্ধু কেবল অধ্যায়টি। প্রবল মনোযোগে দেদারসে পড়তে লাগলাম। সেদিন শুধু এটাই পাঠোদ্ধার করতে পেরেছিলাম যে, আহ! যেমন জীবন পরিচালনা করছি তা তো মোটেও ঠিক নয়। সেদিনের পর থেকেই হারাম রিলেশনশিপের প্রতি আমার ভেতরে অনেকদিনের যে একটা আকর্ষণ জিইয়ে ছিল তা মুহূর্তেই উবে গেল। অধ্যায়টি এত ভালো লেগেছে যে, তারপর আমি সম্পূর্ণ বইটি একনাগাড়ে পড়ে ফেললাম। বইটি সবারই পড়া প্রয়োজন। প্রধানত তরুণ-তরুণীদের। তাই আমি আমার সামথ্যানুযায়ী এপর্যন্ত দশোধ্বজন তরুণ-তরুণীকে বইটি হাদিয়া দিয়েছি। রবের কাছে একটাই আরজি–তিনি যেন লেখকের হৃদয়-নিংড়ানো এ কাগুঁজে কথাগুলোকে তার জন্যে জান্নাতে যাওয়ার উৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে কবুল করে নেন, আমিন।
–কোহিনূর হাসান সাদিয়া
.
প্রকাশকের কথা
ইবলিসশয়তানের সাথে মানুষের শত্রুতা চিরন্তন।অভিশপ্তহওয়ার পর সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য সে তার সর্বোশক্তি প্রয়োগ করে সবরকমের চেষ্টা করে যাবে।
রন্দ্রে রন্ধ্রে ঘুরে বেড়ানো ইবলিসের খপ্পর থেকে সম্পূর্ণভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ আমাদের সামনে নেই। সে তার বাহারি ফাঁদ পেতে সর্বদা আমাদেরকে গন্তব্য থেকে বিচ্যুত করতে মরিয়া। সে আমাদের জান্নাতে নবি-রাসুলদের প্রতিবেশী হতে দিতে চায় না, আমাদের নিয়ে সে অনন্ত জাহান্নামে পুড়তে চায়। ইবলিসের ফাঁদে পড়ে আমরা পদে পদে বিভ্রান্ত হই। হওয়াই স্বাভাবিক। ইবলিসের শক্তির সাথে পেরে ওঠা আমাদের পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব, যদি না আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের সাহায্য করেন। আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বান্দাকে তখনই সাহায্য করেন, যখন বান্দা কায়মনোবাক্যে তাঁকে ডাকে। হৃদয়ের গভীর থেকে তাঁকে স্মরণ করে।
আল্লাহর নির্দেশিত একটা জীবনব্যবস্থা আমাদের সামনে রয়েছে, কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে সেই জীবনপদ্ধতি থেকে বারবার আমরা ছিটকে যাই। আমরা নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো অথবা অন্যের বানানো জীবনপদ্ধতিকে আপন করে বাঁচতে শুরু করি। এভাবে আস্তে আস্তে আমাদের অন্তরগুলোতে মরিচা ধরে যায় এবং আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি যে, আল্লাহ হয়তো আর কোনোদিনও আমাদের ক্ষমা করবেন না। আমরা হয়তো চিরতরে আল্লাহর ক্ষমা লাভের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি।
আত্মবিশ্বাসে ফাঁটল ধরিয়ে শয়তান ভুলের রাস্তায় আমাদের নিমজ্জিত রাখে। সময় বয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহর নির্দেশিত রাস্তায় ফিরে আসা আমাদের আর হয়ে ওঠে। না। একদিন ফুরিয়ে আসে জীবনপ্রদীপের তেজ, ধীরে ধীরে নিভে যেতে থাকে। সেটা। আর যেদিন ফুরিয়ে যায় আয়ু, সেদিন স্তিমিত হয়ে যায় জীবনের সকল আয়োজন, বন্ধ হয়ে যায় আশা এবং ভরসারও দরোজা।
কিন্তু এমন ঘনঘোর অন্ধকারে একটা মানবজীবন কি কেটে যেতে পারে? তাকে সৃষ্টির পেছনে স্রষ্টার যে উদ্দেশ্য, তা পূরণ না করেই সে চুকিয়ে দেবে জীবনের পাঠ? বোধোদয়ের আলোক-রেখা কখনোই কি উদিত হবে না তার চিন্তার আকাশে?
শয়তানি প্ররোচনায় বিচ্যুত অন্তরগুলোকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টার চাইতে মহৎ কিছু আর কী আছে দুনিয়ায়! যারা হারিয়ে ফেলেছে সরল পথের দিশা, যারা ভুলে গেছে তাদের অনন্ত গন্তব্যের রাস্তা, যারা ডুবে আছে এক নিঃসীম অন্ধকারে, তাদের অন্তরগুলোকে জাগিয়ে তুলতে, অন্ধকারের গহ্বর থেকে তাদের টেনে তুলতে দরকার সঠিক পরিচর্যা এবং সুন্দর আহ্বান। অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য আর তিরস্কারের ভাষায় নয়, তাদের ডাকতে হবে ভালোবাসার সাথে। তাদের ভুলগুলোকে ধরিয়ে দিতে হবে পরম যত্ন করে, যাতে তারা হতাশ ও বিরক্ত না হয়ে পড়ে।
আত্মভোলা মানুষগুলোকে আল্লাহর রাস্তায় ডাকবার, তাদের ভুলগুলোকে পরম যত্নের সাথে চিহ্নিত করে সেসব থেকে বেরিয়ে আসার উপায় বাতলানোর ব্যাপারে লেখক আরিফ আজাদ ইতোমধ্যেই মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, তার লেখা বইগুলো প্রতিনিয়ত হাজারো মানুষের হিদায়াতের অসিলা হচ্ছে, তরুণ-যুবা বৃদ্ধ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে আরিফ আজাদ তার আলো হাতে পৌঁছে যাচ্ছেন এটা আমাদেরসহ গোটা উম্মাহর জন্যেই বড়ো আশাব্যঞ্জক ঘটনা।
সাজিদ সিরিজের জনক আরিফ আজাদ প্রথম নিজ বলয়ের বাইরে আসেন বেলা ফুরাবার আগে বইয়ের মাধ্যমে। বলাই বাহুল্য, এই কাজটাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ভরপুর বারাকাহ দিয়ে তাকে সিক্ত করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। এই। বইটা আমাদের চারপাশের কত যুবক-যুবতীর হিদায়াতের অসিলা হয়েছে, কতো দিশেহারা ক্লান্ত প্রাণ যে স্বস্তি আর শান্তি নিয়ে নীড়ে ফিরেছে তা গণনার ঊর্ধ্বে, আলহামদুলিল্লাহ। প্রকাশনার ভেতরে থাকা হয় বলে সেই পরিবর্তনের অনেক গল্প, অনেক ঘটনাকে আমরা আরো কাছ থেকে দেখি এবং আল্লাহর কাছে বারংবার কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে পড়ি।
শুধু পাঠকের প্রত্যাশা ছিল বেলা ফুরাবার আগে বইয়ের দ্বিতীয় কিস্তি যেন বের হয়। পাঠকের প্রত্যাশা বলেই নয়, এই সিরিজের ধারাবাহিক কিস্তিগুলো সত্যিই দরকারি। মানুষের সমস্যাগুলোকে ঠিক এভাবে সামনে আনার এবং সম্ভাবনাগুলোকে এভাবে জাগিয়ে তোলার কাজটা একটা বইয়ে সমাপ্ত হতে পারে না। আর মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বানের একটা কার্যকর পদ্ধতি যখন সামনে উঠে আসে, তখন সেটাকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোই উচিত বলে মনে করি। এই জায়গায় লেখক আরিফ আজাদকে আমরা সফল বলতে পারি নিঃসন্দেহে। তিনি যে শব্দশৈলী, যে ধারায় মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় ফিরতে উদ্বুদ্ধ করেন তা পাঠকেরা ভালোবেসে গ্রহণ করেছেন। ফলে এই সিরিজে এই ধারায় আরো নতুন নতুন সমাধান নিয়ে তিনি হাজির হবেন, আরো নতুন সম্ভাবনার দ্বারকে উন্মোচন করবেন পাঠকদের সামনে সে প্রত্যাশা আমাদের সকলেরই ছিলো। আমাদের সেই প্রত্যাশার একটা পরিণতির নাম হলো–এবার ভিন্ন কিছু হোক৷
বেলা ফুরাবার আগে বইয়ের পরের কিস্তি এবার ভিন্ন কিছু হোক৷ যেহেতু এর আগের কিস্তির আলোচ্য বিষয়াদি, বর্ণনার ধারা, ভাষার ব্যবহার, শব্দশৈলীর প্রয়োগ সম্পর্কে পাঠকেরা অবগত আছেন, এই কিস্তির ব্যাপারে তাই নতুন করে বলার কিছু নেই। আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি, এই কিস্তিতেও পাঠকেরা বইটির পাতায় পাতায়, পরতে পরতে নিজেদের খুঁজে পাবেন। এ-ও বলতে পারি, বরাবরের ন্যায় মনে হবে প্রিয় লেখক বুঝি পাশে বসেই গল্পচ্ছলে আপনাদের শোনাচ্ছেন কথাগুলো।
এই সিরিজটাকে লেখক আরিফ আজাদ বলেছেন সাজিদ’ তৈরির মিশন। আলহামদুলিল্লাহ, সিরিজটাকে ঘিরে পাঠকদের উচ্ছ্বাস, আনন্দ আর আবেগের ফল্গুধারা দেখে আমরা বিশ্বাস করি লেখক সফলতার সঠিক রাস্তায় আছেন। আমাদের মহান রব তার এই মিশনকে কবুল করে নিন, তার কাজে ভরপুর কামিয়াবি দান করুন এবং তার কাজগুলোকে পরকালে তার নাজাতের অসিলা করে নিন–কায়মনোবাক্যে এই প্রার্থনা-ই করি মহামহিম দয়াময়ের কাছে। বইটির সাথে জড়িত হতে পেরে সমকালীন পরিবার সবিশেষ আনন্দিত আর আপ্লুত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেন আমাদের ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করে আমাদেরকেও কবুল করেন। আমিন।
.
লেখকের কথা
‘জীবনের জাগরণে’ সিরিজের প্রথম বই ছিলো বেলা ফুরাবার আগে। বইটা আমার কতো যে প্রিয় আর বইটাকে ঘিরে গত দুবছরে কতো কতো ঘটনার যে জন্ম হয়েছে, তা বলে শেষ করার মতো না। কীভাবে শুকরিয়া আদায় করলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার এই অপার নিয়ামতের হক আদায় হবে, তা আমার জানা নেই; কিন্তু তাঁর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে শেষ করতে পারা আদৌ কি সম্ভব? আলহামদুলিল্লাহ।
বেলা ফুরাবার আগে বইটা যখন লিখি, তখন আমার ধ্যান-জ্ঞান সব যেন বইটাকে ঘিরেই। আমি স্বপ্ন দেখতাম–আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ইচ্ছাতে এই বই যুবক-যুবতীদের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। তারা সালাতের প্রতি উদগ্রীব হচ্ছে, হারাম রিলেশান ছেড়ে দিচ্ছে, ফোন মেমোরি থেকে ডিলেট করে দিচ্ছে সমস্ত গান, যা না শুনলে রাতে তাদের ঘুম হতো না। ফোনের গ্যালারি থেকে তারা মুছে দিচ্ছে সেসকল ছবি আর ভিডিও, যা তাদের কু-প্রবৃত্তিকে তৃপ্ত করতে একদা। তারা বিনয়ী হচ্ছে, সময়ের গুরুত্ব বুঝছে, তারা সুন্নাহ আর নফল পালনের দিকে ঝুকছে, ফজর আর তাদের কাযা হচ্ছে না–বইটা লিখবার প্রাক্কালে এসবই ভাবতাম আর আল্লাহর কাছে অনেক দুআ করতাম। আল্লাহকে বলতাম, তিনি যেন আমার স্বপ্নগুলোকে সত্যি করেন আর বইটাকে কবুল করেন।
আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর বারাকাহ আর প্রকাশ্য সাহায্য যে কী জিনিস, তা আমি বরাবরের ন্যায় আবারও উপলদ্ধি করলাম। বেলা ফুরাবার আগে বইটাকে নিয়ে আমি যে যে স্বপ্ন একদা মনে মনে আঁকতাম, হাঁটতে হাঁটতে যে দৃশ্যগুলো দোলা দিয়ে যেতো আমার হৃদয়ে, সেসবকিছুই আমার রব বাস্তবে পরিণত করেছেন। গোটা বাংলাদেশ তো বটেই, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশের মাঝে বইটাকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস, যে আগ্রহ আমি দেখেছি, সোশ্যাল মিডিয়া, মেইল ও ইনবক্সে বইটা পড়ার পর যে সমস্ত পরিবর্তনের কথা আমি শুনেছি মানুষের কাছ থেকে, তা দেখে আমি বিশ্বাস করি যে, আমার মহান রব আমার দুআগুলো কবুল করেছেন। তিনি বইটাকে যুবক-যুবতীসহ অনেক অনেক মানুষের পরিবর্তনের অসিলা হিশেবে গ্রহণ করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
বইটা প্রকাশের দুবছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ বইটা পড়ে তাদের পরিবর্তনের কথা জানাচ্ছেন। এ যে কী মধুর ভালো লাগা, বর্ণনার জন্য যথাযথ শব্দ দুনিয়ার কোনো ভাষাতে মজুত নেই। আলহামদুলিল্লাহ!
বেলা ফুরাবার আগে বইটাকে আমি বলেছিলাম ‘সাজিদ’ তৈরির মিশন। প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ পড়ে যারা সাজিদ হতে চাইবে, তারা যখন জানতে চাইবে সাজিদ হতে হলে তাদের কী কী করতে হবে, আমি বলেছিলাম তারা যেন বেলা ফুরাবার আগে বইটাতে চোখ বুলায়। আমি ভীষণভাবে বিশ্বাস করি–আত্মিকভাবে। নিজেকে পরিশুদ্ধ করা না গেলে কখনোই পরম পবিত্রতার সন্ধান লাভ সম্ভব নয়। আত্মার সেই শুদ্ধতার দিকে যুবক-যুবতীদের ধাবমান করতেই আমি বইটার কাজে হাত দিয়েছিলাম। যেহেতু যুবক বয়সের সমস্যাগুলোর ভেতর দিয়ে আমি নিজেও যেতাম এবং এখনো যাই, তাই সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা আমার জন্য কঠিন কিছু ছিলো না। সেই সমস্যাগুলোর পরতে পরতে আমি হাঁটতে চেষ্টা করেছি এবং বের করে আনতে চেয়েছি সেসবের সম্ভাব্য সবচেয়ে সঠিক চিকিৎসাটাই।
অনেক পাঠক আমাকে বেলা ফুরাবার আগে বইয়ের দ্বিতীয় কিস্তি আনার অনুরোধ করেছেন। যুবক বয়সের যেহেতু সমস্যার অন্ত নেই এবং তা ক্রমবর্ধমান, তাই আমারও খুব ইচ্ছে ছিলো এই ধরণের আরো বই নিয়ে কাজ করার। আলহামদুলিল্লাহ, মহান রব আমার সেই বাসনাটাও পূরণ করেছেন। এবার ভিন্ন কিছু হোক নামে এই সিরিজের পরের বইটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রকাশের সুযোগ দিলেন আমাকে। আমার রবের দরবারে অফুরান কৃতজ্ঞতা।
এবার ভিন্ন কিছু হোক বইটা বেলা ফুরাবার আগে বইয়ের পরের কিস্তি। দুটো বই প্রায় একই ধাঁচে লেখা। আমি চেষ্টা করেছি অধ্যায়গুলোকে জীবনঘনিষ্ঠ রাখতে, যাতে পাঠকেরা পড়ার সময় নিজের অবস্থাকে কল্পনা করতে পারেন। যিনি বইটা হাতে নিয়ে পড়বেন, তার যেন মনে হয় বইটা আমি তার জন্যই লিখেছি এবং বইয়ের কথাগুলো যেন আমি তার পাশে বসে বসে তাকে শোনাচ্ছি। পাঠকের মনোযোগ যাতে বিচ্ছিন্ন না হয়, সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার চেষ্টা করেছি আমি, আলহামদুলিল্লাহ।
এই বইতেও পাঠকেরা অনেকগুলো সমস্যার সমাধান পাবেন এবং আরো পাবেন। অনেক আশার আলোও। যেহেতু আমি খুবই আশাবাদী একজন মানুষ, তাই মানুষকে আশা নিয়ে বাঁচতে সৃপ্ন দেখাতেই আমি ভালোবাসি। আর কেনই-বা নিশারাবাদী হবো? অবিশ্বাসীরা ছাড়া আর কারা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়?
বেলা ফুরাবার আগে বইয়ের মতো এই বই নিয়েও আমার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা–তিনি এই বইটাকে যেন কবুল করেন আর আমার নাজাতের অসিলা বানিয়ে দেন। তিনি যেন আমাকে সর্বদা মাটির মানুষ থাকার সুযোগ দেন। সমস্ত অহংকার, রিয়া আর বড়োত্ব থেকে তিনি যেন আমাকে মুক্ত রাখেন।
বরাবরের মতোই আমার পাঠকদের কাছে অনুরোধ–পড়া শেষ হলে বইটা নিজের কাছে রেখে দেবেন না। আপনার নিকটাত্মীয়, বন্ধু, ভাই-বোন বা এমন কারো কাছে বইটা হস্তান্তর করবেন, যার জন্য বইটাকে আপনি দরকারি মনে করবেন। সকল পাঠকের জন্য আমার অফুরান ভালোবাসা। ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা এই বইটার পেছনে যারা বিভিন্নভাবে শ্রম দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা সমকালীন প্রকাশনের প্রতি, বইটাকে পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে যাবতীয় বন্দোবস্তের ভার গ্রহণের জন্যে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেন আমাদের সবাইকে জান্নাতের সবুজ উদ্যানে একত্রিত করেন। আমিন।
ওয়ামা তাওফিক্বী ইল্লা বিল্লাহ।
আরিফ আজাদ
.
সুচিপত্র
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
যে সুতোয় বাঁধা জীবন
গাহি নতুনের গান
পতনের আওয়াজ পাওয়া যায়
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর
কখনো ভুল হলে
বন্দিশিবির থেকে
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
যে যাই বলুক পিছে
খুলে যাক জীবনের বন্ধ দুয়ার
খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে
হৃদয়ের জানালাটা খুলে দাও না
জীবনের কম্পাস
ভালোবাসা ভালোবাসি
সমুদ্রের সাধ
এবার ভিন্ন কিছু হোক
.
০১. আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
এক.
যাপিত জীবনের গল্প থেকেই বলি–আমরা যখন রোগে-শোকে ভুগি, যখন শরীরে আমরা অনুভব করি কোনো রোগের উপস্থিতি, তখন আমরা ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার, যিনি আমাদের সামনের চেয়ারে উপবিষ্ট থাকেন মাথাভরতি ডাক্তারি-বিদ্যা নিয়ে, তার কাছে আমরা খুলে বলি আমাদের অসুবিধের আদ্যোপান্ত। তিনি বোঝার চেষ্টা করেন আমাদের অসুস্থতা। প্রয়োজনে যন্ত্রপাতি দিয়ে আমাদের শরীর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেন। রোগ নির্ণয়ের পর আমাদের ওষুধ ও জীবনযাত্রার একটা ছক নির্ধারণ করে দিয়ে তা যথাযথভাবে অনুসরণ করার কঠোর হুঁশিয়ারিও প্রদান করেন।
পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে কিংবা আশানুরূপ ফলাফল না এলে আমরা ছুটে যাই শিক্ষকদের কাছে। তাদের কাছে–যারা আমাদের চোখে অধিকতর যোগ্য। কৃতকার্যতার অথবা ভালো ফলাফলের পথ বাতলে দিতে যারা সবিশেষ পারদর্শী, তাদের দুয়ারে ধরনা দিই আমরা। ভালো ফলাফলের রাস্তা বাতলে দিয়ে তারা ধন্য করেন আমাদের। কৃতকার্য হতে হলে যে পথ ধরে এগুতে হবে, যে কঠোর-কঠিন সাধনায় লেগে থাকতে হবে মুখ বুজে–সেই পথ তারা আমাদের চিনিয়ে দেন। মাঝে মাঝে জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, যখন ফিকে হয়ে আসে জীবনের সমস্ত রং, তখন আমরা এমন কাউকে খুঁজি, যে আমাদের একটু আশার আলো দেখাবে। এমন কাউকে–যার কাছে গেলে আমরা খুঁজে পাবো জীবনের ছন্দ, যার স্পর্শ পেলে হয়তো দপ করে জ্বলে উঠবে নিভুনিভু হওয়া জীবন-প্রদীপ।
যাপিত জীবনের শূন্যতাগুলোকে উত্তম বিকল্প দিয়ে প্রতিস্থাপনের বেলায় আমাদের থাকে আপ্রাণ প্রচেষ্টা। যখনই কোনো শূন্যতার বলয়ে আমরা ঘুরপাক খাই, আমাদের অবচেতন মন তার নিজের মতো করে সেই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করে। বস্তুত মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যই এটা। মানুষ শূন্যস্থান পছন্দ করে না বলেই তা পূরণে সে সবিশেষ তৎপর হয়ে ওঠে।
দুই.
রোগ হলে আমরা ডাক্তারের কাছে ছুটি, পরীক্ষায় ভালো ফল লাভের উপায় জানতে ধরনা দিই যোগ্য শিক্ষকের কাছে। বিষিয়ে ওঠা জীবনের যাতনা থেকে মুক্তি পেতে আমরা পাগলের মতন খুঁজে নিই পছন্দের ব্যক্তি, বস্তু অথবা মাধ্যম, যা-কিছু আঁকড়ে ধরলে আমরা বেঁচে থাকার প্রেরণা পেতে পারি; তবে যদি প্রশ্ন করি– নফসের তাড়না থেকে বাঁচতে কখনো কি আমাদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে? যে কুপ্রবৃত্তির বলয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে সেঁটে আছে জীবন, সেই বলয় ভাঙতে কখনো কি হৃদয়ে দানা বেঁধেছে একটুখানি সাহস?
শরীরে রোগ বাসা বাঁধলে তাকে আমরা সমস্যা বলছি। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়াকে ডাকছি অপ্রাপ্তি বলে। জীবনের ছন্দপতনের নাম দিয়েছি হতাশা; কিন্তু কুপ্রবৃত্তির যে জালে আমি সারাটাজীবন ধরে আটকা পড়ে আছি, তার জন্য কোনো নাম কিংবা কোনো অভিধা কখনো কি ভেবেছি একবারও?
যে তাড়না আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে আল্লাহর নৈকট্য থেকে, যে ধোঁকা আমাকে আত্মমগ্ন করে রেখেছে অবাধ্যতায়, যে আত্মপ্রবঞনায় কেটে যাচ্ছে জীবনের সোনালি সময়, সেই ঘনঘোর অন্ধকার থেকে পালাতে কখনো কি আমার মন চেয়েছে?
কেন আমি বারবার বন্দি হয়ে যাই নফসের শেকলে? কেন কুপ্রবৃত্তির মায়াজাল ভেদ করা আমার জন্য দুরুহ হয়ে ওঠে? কেন বৃত্তের একই কেন্দ্রে আমার নিত্য ভুলের বিচরণ? যে উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় আমার আগমন, সেই উদ্দেশ্য থেকে কেন আমি ভীষণরকম বিচ্যুত? রুহের জগতে মহামহিম আল্লাহ যখন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আমিই কি তোমার রব নই?’, তখন আমি মহোৎসাহে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে, বিস্ময়মাখানো কণ্ঠে বলেছিলাম, ‘অবশ্যই, আপনিই আমার রব।’[1] তবে আজ কেন ভুলে গেলাম আমার জীবনের সেই প্রথম আর পরম স্বীকৃতির কথা?
এই যে কুপ্রবৃত্তির বাঁধনে আমি বন্দি হয়ে আছি, সেই শৃঙ্খল ভাঙার উপায় কী? কোন উপায়ে আমি নিজেকে মুক্ত করতে পারবো এই চোরাফাঁদ থেকে? কোন পথে নিহিত আমার মুক্তি? কীভাবে আমি জীবনের সেই আসল উদ্দেশ্যের বাঁকে ফিরতে পারবো–এসব নিয়ে যদি একটু ভাববার ফুরসত পাই, আমার জন্য সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসবে মহাগ্রন্থ আল কুরআন। যখনই আমি সমস্যার বৃত্তে ঘুরপাক খাবো, তখন যদি নিবিষ্ট মনে আমি খেয়াল করি আল্লাহর কালাম–এই আয়াতের দিকে, আমি পেয়ে যেতে পারি আমার কাঙ্ক্ষিত সেই সমাধান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া। তাআলা বলছেন–
তাদের পরে এলো এমন এক অসৎ জাতি, যারা সালাত বিনষ্ট করলো এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণকরলো(2)
আমি যদি বুদ্ধিমান হই এবং আমার বিবেচনাবোধ আর উপলব্ধি ক্ষমতা যদি একেবারে ফুরিয়ে না গিয়ে থাকে, তাহলে এতক্ষণে আমি বুঝে গেছি, আমার শূন্যতাটা আসলে কোথায়। কোন জায়গায় এসে আমার জীবন থমকে গেছে, কোন কেন্দ্রে এসে আমি আসলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি, কোন ভ্রান্তির মায়াজালে আমি আটকে পড়েছি তা এতক্ষণে আমার চোখে পড়ার কথা।
হ্যাঁ, আমি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথাই বলছি। এটাই তো মানবজীবনের ছন্দ। এই ছন্দের শূন্যতাই তো জীবনে ছন্দপতন ঘটায়। এটি আমার কথা নয়, স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কথা। তিনি ধ্বংস ও অভিশপ্ত এক জাতির উদাহরণ টেনে বলছেন, এমন এক জাতি এলো, যারা সালাত বিনষ্ট করলো এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করলো। আল্লাহ তো বলতে পারতেন, তারা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করলো এবং সালাত বিনষ্ট করলো। কিন্তু তিনি সেভাবে বলেননি। তিনি আগে সালাত বিনষ্টের কথা বলেছেন এবং এরপর বলেছেন কুপ্রবৃত্তির অনুসরণের কথা।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অভিশপ্ত এক জাতির বর্ণনা দিতে গিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন যে, তারা সালাত বিনষ্ট করেছে এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। তারা কিন্তু আগেই কুপ্রবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়েনি। আগে তারা সালাত ছেড়েছে। সালাত ছেড়ে দেওয়াতে সহজেই তারা কুপ্রবৃত্তির দিকে আকৃষ্ট হয়েছে এবং এর ফলস্বরূপ তারা হয়ে পড়েছে অভিশপ্ত। মোদ্দাকথা–সালাত হলো বান্দা ও শয়তানের মাঝে একটা শক্ত বেষ্টনী। একটা মজবুত দেওয়াল। বান্দা যখন নিজেকে সালাতের সাথে যুক্ত রাখে, তখন শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে না। যে বান্দা নিজেকে সালাতে হাজির রাখে, শয়তানের তির সেই বান্দাকে আঘাত করতে পারে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সেই বান্দাকে তাঁর সুরক্ষা-বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন। ভাবছেন, এটিও কি আমার কথা? একদম না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই বলেছেন–
নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে দূরে রাখে।[3]
সালাত হচ্ছে বর্মের মতো। যতক্ষণ সালাত নামের বর্মটা সত্যিকার অর্থেই আমার দেহের সাথে লেপ্টে থাকবে, ততক্ষণ শত্রুর আঘাত আমাকে আহত করতে পারবে না। শত্রুর সমস্ত আঘাত এই বর্মে লেগে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। অথবা সালাতকে আমরা একটা সুরক্ষা-বলয়ের সাথেও তুলনা করতে পারি। যতক্ষণ আমি এই বলয়ের মাঝে থাকবো, ততক্ষণ আমার দ্বারা কোনো মন্দ কাজ সংঘটিত হবে না। সালাত যখন আমার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়াবে, তখন যাবতীয় মন্দ কথা, মন্দ ভাবনা আমার অন্তরে আর উদিত হতে পারবে না অথবা উদিত হলেও সেসবের ব্যাপারে আমি বেখেয়াল হবো না। যখনই মন্দ চিন্তা আর মন্দ ভাবনা আমার অন্তরে দখল নিতে চাইবে, তখনই আল্লাহর রহমতে আমার ভেতরে সেসবের ব্যাপারে অনুশোচনা তৈরি হবে এবং আপ্রাণ প্রচেষ্টায় আমি সেগুলোকে আমার ভাবনার জগৎ থেকে মুছে ফেলতে চাইবো।
কিন্তু যখন আমি সালাত ত্যাগ করবো, যখন সালাতের ব্যাপারে আমার হৃদয়-মন উদাসীন হয়ে উঠবে, তখন আমার অন্তরে ঢুকে পড়বে কুপ্রবৃত্তির হাওয়া। যেহেতু আমার সাথে সালাতের তখন সম্পর্কচ্ছেদ হয়েছে, সেহেতু কুপ্রবৃত্তির আশকারাকে প্রতিহত করার এবং অন্তরে উদিত হওয়া সেই মন্দ ভাবনা আর মন্দ চিন্তাগুলোকে ঝেড়ে ফেলার মতো যথেষ্ট শক্তি আর উৎসাহ আমার ভেতর অবশিষ্ট থাকবে না। আমাকে সালাতবিহীন অবস্থায় পেয়ে কুপ্রবৃত্তির যে হাওয়া আমার অন্তরে জেঁকে। বসবে, সেই হাওয়া আমাকে বিফল, বিভ্রান্ত ও ব্যর্থ বানিয়ে ছাড়বে।
সেই অভিশপ্ত জাতি, যাদের উদাহরণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনে টেনেছেন, তাদের কথাই ভাবুন। তারা প্রথমে বিনষ্ট করলো তাদের সালাত। এরপর কী হলো? কুপ্রবৃত্তি তাদের অন্তরে জেঁকে বসলো। কুপ্রবৃত্তির সেই মায়াজাল ভেদ করে তাদের আর বের হয়ে আসা হলো না। এই দ্বৈত পদস্থলনের ফলে তারা পরিণত হয়েছে চরম অভিশপ্ত এক জাতিতে, যাদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা উদাহরণ হিশেবে পেশ করেছেন। কী এক ভয়ানক ব্যাপার, ভাবা যায়!
এবার চলুন আমরা নিজেদের জিজ্ঞেস করি–কেন আমরা শয়তানের ওয়াসওয়াসা কাটিয়ে উঠতে পারি না? কেন নিজেদের নফসকে দমিয়ে রাখা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে? কুপ্রবৃত্তির কাছে কেন আমরা বারংবার পরাজিত, ব্যর্থ, শৃঙ্খলিত হচ্ছি? কেন রবের আহ্বানে সাড়া দিতে আমরা অপারগ? কুরআনের সুরলহরি কেন আমাদের অন্তরে প্রশান্তি এনে দিতে পারে না? উত্তরের জন্য চলুন দৃষ্টি ফেরাই নিজেদের জীবনের দিকে। আত্মসমালোচনার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের জিজ্ঞেস করি–আমি কি আমার সালাত ঠিক রাখতে পেরেছি? আমার সালাত কি সেভাবে আদায় হচ্ছে, যেভাবে আদায় হলে তা সত্যিকারের সালাত হয়ে ওঠে?
যদি আপনি নফসের ধোঁকায় মজে থাকেন, যদি কুপ্রবৃত্তির কালোছায়া গ্রাস করে থাকে আপনার অন্তর, তাহলে ওপরের জিজ্ঞাসার উত্তরে আপনাকে বলতে হবে, আমি আমার সালাত ঠিক রাখতে পারিনি। সালাত আদায়ে আমি ভীষণ অলস, অথবা আমার সালাতে কোনো প্রাণ নেই। সালাতে যেভাবে আল্লাহর সান্নিধ্য অনুভব করতে হয়, তার ছিটেফোঁটাও আমি অনুভব করতে পারি না।
অর্থাৎ, এককথায় আপনি সালাতকে বিনষ্ট করছেন। হয়তো সালাতে হাজিরই হচ্ছেন না, অথবা হাজির হলেও তা একেবারে গা বাঁচানো হাজিরা। সেই হাজিরায় জায়নামাযে আপনার দেহ দাঁড়ায় বটে, মন দাঁড়ায় না। যে সালাতে দেহ আর মনের যৌথ সম্মিলন ঘটে না, সেই সালাত শারীরিক ব্যায়াম বৈ আর কোনোকিছু হয় না।[4]
তাহলে উপায়? কোন পথে ফেরা যাবে গন্তব্যে? কোন উপায়ে জীবনকে নতুন ছন্দে মাতানো যাবে আবার? কোন সে জিয়নকাঠি, যার স্পর্শে জীবন ফিরে পাবে প্রাণ? মরা গাঙে আসবে বসন্তের জোয়ার? উত্তর আছে ওই একই জায়গায়, ঠিক যে জায়গা থেকে শূন্যস্থানের সৃষ্টি–সালাত। আয়াতটির দিকে আরেকবার খেয়াল করুন–
‘তাদের পরে এলো এমন এক অসৎ জাতি, যারা সালাত বিনষ্ট করলো এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করলো।’[5]
তারা অভিশপ্ত হয়েছিলো, জীবনের ছন্দ হারিয়েছিলো কেবল সালাত বিনষ্ট করে। সালাত বিনষ্ট করায় তারা আপনাআপনি ঢুকে পড়েছে কুপ্রবৃত্তির মায়াবৃত্তে। সেই বৃত্ত থেকে তারা আর বেরোতে পারেনি। তারা হয়েছে পথভ্রষ্ট। আজ আমরা যারা জীবনের ছন্দ হারিয়ে হাপিত্যেশ করছি, জীবনের গতিপথ মন্থর হয়ে যাওয়ায় যারা সমাধানের রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছি, আমাদের কি একটু সময় হবে সালাতগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করার? যাপিত জীবনের দৈনন্দিন রুটিনে সালাতটাকে ‘অবশ্যকর্তব্য’ করে নেওয়ার ব্যাপারে একটু মনোযোগী কি আমরা হতে পারি না? বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ না করলে আমাদের অস্তিত্ব যেমন সংকটে পড়ে যাবে, ঠিক সেভাবে সালাতের ব্যাপারে উদাসীনতা মন্থর করে দেবে আমাদের জীবনের সকল ছন্দ, সকল গতিময়তাকে। তাই, কুপ্রবৃত্তির ধোঁকার মাঝে আর হাবুডুবু খাওয়া নয়। আর নয় রোজকার অগোছালো জীবন। আজ, ঠিক এই মুহূর্ত থেকে চলুন আমরা হয়ে উঠি এক অন্য মানুষ। আমাদের জীবনকে আমরা রাঙিয়ে তুলি সালাত দিয়ে। আর রাঙিয়ে তুলি আমাদের দুনিয়া-আখিরাত–দুটোই।
তিন.
জীবনে কি এমন হচ্ছে যে, কোথাও কোনো সফলতা পাচ্ছেন না? মনে হচ্ছে যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই ব্যর্থতা আপনাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য ওত পেতে আছে? পরীক্ষায় আশানুরূপ সফলতা আসছে না, বারবার ব্যবসায় লোকসান গুনছেন, একটা ভালো চাকরির আশায় দিনের পর দিন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, কিন্তু কোনোভাবেই একটা চাকরির বন্দোবস্ত হচ্ছে না। সংসার থেকে যেন বারাকাহ উঠে গেছে। আয়-রোজগারে খুব মন্দা পরিস্থিতি। হয় এমন?
আচ্ছা, কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কেন এমন হচ্ছে? কেন আপনি বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন? কেন সফলতা হাতছানি দিয়েও দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে? কেন আপনার সংসারে আগের সেই বারাকাহ, আগের সেই স্থিতিশীলতা আপনি এখন পাচ্ছেন na? কেন আপনার ব্যবসার পুঁজি, শ্রম, সময়ের বিনিয়োগ আগের চেয়ে ভালো হওয়া সত্ত্বেও আপনি সাক্ষাৎ পাচ্ছেন না সফলতার? কখনো খতিয়ে দেখেছেন শূন্যতাটা আসলে কোথায়?
আপনার এই ব্যর্থতার একটা সম্ভাব্য কারণের উল্লেখ পাওয়া যাবে কুরআনে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন–
আর (আমার রব) আমাকে বানিয়েছেন আমার মায়ের প্রতি অনুগত; এবং তিনি আমাকে অবাধ্য, হতভাগ্য করেননি।[6]
আয়াতের কথাগুলো ঈসা আলাইহিস সালামের, যখন তিনি মায়ের কোলে থাকাবস্থাতেই তার গোত্রের লোকজনের সাথে কথা বলেছেন। এই আয়াতে তিনি তার গোত্রের লোকদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আমার রব আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত বানিয়েছেন। মায়ের অনুগত মানে কী? মায়ের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, মায়ের হকের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া। মায়ের অবাধ্য না হওয়া, মায়ের দেখভাল করা, মায়ের প্রতি রূঢ়, বিরূপ আচরণ না করা, মায়ের মনোবাঞ্ছ, মনোবাসনা পূরণ করা ইত্যাদি মায়ের অনুগত হওয়ার অন্তর্ভুক্ত। ঠিক এরপরেই ঈসা আলাইহিস সালাম বললেন, তিনি আমাকে বানাননি অবাধ্য, হতভাগ্য।
আয়াতটির দুটো অংশ। প্রথম অংশে মায়ের অনুগত হওয়ার কথা, দ্বিতীয় অংশে অবাধ্য না হওয়া এবং হতভাগা না হওয়ার কথা।
এই আয়াতে ‘হতভাগ্য’ বলতে আরবি ‘শাক্বিইয়া’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ–বিফল হওয়া, ব্যর্থ হওয়া, অসফল হওয়া। Lack Of Success এই একই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে একই সুরার ৪ নম্বর আয়াতে, যেখানে যাকারিয়া আলাইহিস সালাম দুআর মধ্যে বলছেন, হে আমার রব, আমি তো কখনো আপনাকে ডেকে ব্যর্থ হইনি।
আয়াতটি থেকে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় যে–ঈসা আলাইহিস সালাম মায়ের অনুগত হওয়ার দাবি উত্থাপনের ঠিক পরেই বললেন, তাকে ব্যর্থ বা অসফল বানানো হয়নি। তাহলে, মায়ের আনুগত্যের সাথে সফল হওয়া না-হওয়ার একটা সম্পর্ক প্রতীয়মান হচ্ছে না এখানে? এটাই হচ্ছে এই আয়াতে কুরআনের বার্তা।
এবার তাহলে নিজেদের জীবনের দিকে একটু তাকানো যাক। এই যে জীবনজুড়ে অসফলতার ছড়াছড়ি, ব্যর্থতার সকরুণ গল্প, এই ব্যর্থতা ঠিক কী কারণে আপনার ওপর নিপতিত হয়েছে, তা কি খুঁজে বের করা উচিত নয়? যদি জিজ্ঞেস করি– মায়ের সাথে আপনি কি যথাযথ আচরণ করেন? মায়ের হকগুলোর ব্যাপারে, মায়ের অধিকারগুলোর ব্যাপারে আপনি কি সর্বদা তৎপর ছিলেন বা আছেন? আপনি কি মায়ের সাথে গলা চড়িয়ে কথা বলায় সিদ্ধহস্ত? তার মতামতকে, তার আবদারকে অগুরুত্বপূর্ণ মনে করে আপনি কি সহজেই উড়িয়ে দেন? আপনি কি মায়ের চাহিদাগুলোর যথেষ্ট মূল্যায়ন করেন?
এই জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর যদি না হয়, তাহলে আজই আপনার মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত। যে ভুল আপনি গর্ভধারিণী মায়ের সাথে করে এসেছেন, যে অশোভন আচরণে আপনি বারংবার ক্ষত-বিক্ষত করেছেন তার অন্তর, সমস্ত কিছুর জন্য তার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চান। পা জড়িয়ে ধরে কাঁদুন। ছোটোবেলায় যেভাবে তার আঁচল-তলে লুকোতেন, তার গলা জড়িয়ে কাঁদতেন, ঠিক সেভাবে। বিশ্বাস করুন আপনার ব্যর্থতার কারণ ঠিক এখানেই লুকিয়ে আছে। এখানে এসেই আপনি বারবার হেরে যাচ্ছেন। আপনার জীবনে বারাকাহর যে ঘাটতি, তার শুরুটা ঠিক এখান থেকেই।
মায়ের সামান্য অবাধ্যতা জীবনে কীরকম বিপদ ডেকে আনতে পারে তার একটা দৃষ্টান্ত আমরা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে পাই। হাদিসে বনু ইসরাইল যুগের একজন নেককার বান্দার কথা বলতে গিয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বনু ইসরাইল সম্প্রদায়ে জুরাইজ নামে অত্যন্ত নেককার একজন লোক ছিলেন। আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য তার ছিলো আলাদা একটা জায়গা এবং সেখানে তিনি সারাদিন ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। একদিন এমনই এক সময়ে জুরাইজ যখন তার ইবাদতে মগ্ন, তার মা এসে তাকে ঘরের বাইরে থেকে ডাক দিলেন। মায়ের ডাক শুনে তিনি কি ইবাদত ত্যাগ করে মায়ের কাছে ছুটে যাবেন, না ইবাদত সম্পূর্ণ করে তারপর মায়ের ডাকে সাড়া দেবেন–এ নিয়ে ভারি দোটানায় পড়ে গেলেন। শেষপর্যন্ত ইবাদত সম্পূর্ণ করে তারপর মায়ের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি মনস্থির করলেন। এভাবে দ্বিতীয়বার এসে তার মা তাকে ডাকলেন, কিন্তু তখনো ইবাদতে রত থাকায় তিনি সাথে সাথে মায়ের ডাকে সাড়া দিতে পারলেন না। তৃতীয়বার আবারও তার মা এলেন এবং তাকে ডাক দিলেন। তৃতীয়বারও ছেলের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মা এবার হতাশ হয়ে বলে বসলেন, ইয়া আল্লাহ, কোনো এক নষ্টা নারীর মুখ দেখার আগে যেন ওর মৃত্যু না হয়।’
জুরাইজের ধর্মপ্রীতি এবং একনিষ্ঠ ইবাদত-বন্দেগির সুনাম তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো হুড়মুড় করে। সবাই তার দুনিয়া-বিমুখতা, খোদাভীতির প্রশংসায় গদগদ। সেসময় ওই এলাকায় এক পতিতার আগমন ঘটলো, পুরুষদের সাথে যে অবৈধ সম্পর্ক করে বেড়ায়। লোকের মুখে মুখে জুরাইজের গল্প শুনে সে বললো, ‘ও এই ব্যাপার! তোমরা দেখো, আমি যদি তার কাছে যাই, আমাকে দেখে সে তার ধর্মকর্ম শিকেয় তুলতে বাধ্য হবে।’
পতিতা বোঝালো–জুরাইজ যতই ধর্মকর্ম করুক, যতই আল্লাহওয়ালা হোক, তার রূপের কাছে জুরাইজকে হার মানতেই হবে। সকলে বললো, ‘তাই নাকি? তো যাও না, গিয়ে পারলে জুরাইজকে গিয়ে বলল এসব।’
সেই পতিতা জুরাইজের কাছে এলো এবং নানানভাবে সে জুরাইজকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলো; কিন্তু আল্লাহর বান্দা জুরাইজকে সে কোনোভাবেই প্রলুব্ধ করতে পারলো না। সে যারপরনাই ব্যর্থ হলো।
জুরাইজকে প্রলুব্ধ করতে না পারার বেদনা তার মাঝে প্রবল হয়ে উঠলো। অপমানের শোধ নিতে সে বেশ কদর্য এক কাজের দ্বারস্থ হলো। এক রাখালের সাথে সে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায় এবং অনৈতিকভাবে এক সন্তান গর্ভে ধারণ করে। যখন সেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো, তাকে কোলে নিয়ে সে পুরো জনপদে ঘুরে ঘুরে বলে বেড়াতে লাগল, দেখে যাও তোমরা সবাই, জুরাইজ আমার সাথে ব্যভিচারে জড়িয়েছিলো। এই যে শিশুকে দেখছো, এটা জুরাইজের সন্তান।
বলা বাহুল্য–জনপদের সবাই হতবাক হয়ে গেলো এবং মহিলার এমন চাক্ষুষ প্রমাণ দেখে তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো যে–এহেন জঘন্য কাজটা জুরাইজই করেছে। জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে জুরাইজকে মারধর করতে শুরু করলো। শুধু তা-ই নয়, জুরাইজ যেখানটায় বসে এক ধ্যানে আল্লাহর ইবাদত করতো, সেই ঘরটাকেও তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো।
জুরাইজের কাছে যখন শিশুটাকে আনা হলো, তখন তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমাকে তোমরা একটুখানি সময় দাও। আমি আমার রবের কাছে একটু প্রার্থনা করতে চাই।
জুরাইজকে সময় দেওয়া হলো। প্রার্থনা শেষে শিশুটাকে উদ্দেশ্য করে জুরাইজ বললেন, ‘বলো, কে তোমার বাবা?’
আল্লাহর কী অপার মহিমা, সদ্যজাত শিশুটা সকলের সামনে বলে উঠলো, ‘আমার বাবার নাম অমুক। আর অমুক জায়গায় সে মেষ চরায়।’
কোলের শিশুর মুখে এহেন জবাব শুনে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যায় সবাই! জুরাইজের ধার্মিকতা নিয়ে, তার আমল-ইবাদত নিয়ে যে সন্দেহ জেগেছিলো তাদের মনে, তা সাথে সাথে উবে যায়। তারা জুরাইজের কাছে বেশ অনুতপ্ত হয় এবং তার প্রার্থনার ঘরটাকে মাটির বদলে স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করে দিতে চায়; কিন্তু সে প্রস্তাবে জুরাইজ সম্মত হলেন না। তিনি বললেন, ‘তার দরকার নেই। আমার ঘরটা আগে যেমন। ছিলো, তেমনটা করে দিলেই আমার জন্য যথেষ্ট।’[7]
হাদিসটা এখানেই শেষ হয়। এই যে আল্লাহর নেককার বান্দা জুরাইজের জীবনে এই বিপর্যয় নেমে এসেছিলো, এটা কেন হয়েছিলো? কারণ মায়ের ডাকে সাড়া না দেওয়ায় তার মা একদিন বিরক্তিভরে আল্লাহর কাছে এই বদ-দুআ করেছিলেন। তার মা আল্লাহকে বলেছিলেন, কোনো পতিতার মুখ না দেখিয়ে যেন আল্লাহ জুরাইজের মৃত্যু না দেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা জুরাইজের মায়ের সেই দুআ কবুল করেছিলেন। জুরাইজের মতো নেককার, আমলদার বান্দাকে তিনি ঠিকই পতিতার মুখোমুখি করেছেন এবং তাকে সম্মুখীন করেছেন ভয়াবহ লাঞ্ছনার। জুরাইজ কেবল প্রার্থনার মাঝে মগ্ন থাকতো বলেই তার মায়ের ডাকে সাড়া দিতে পারেননি এবং সেই কারণে এত কঠিন অবস্থার মুখোমুখি তার হতে হয়েছিলো। শাইখ আব্দুল মাজিদ প্রশ্ন করেছেন–আমরা যারা মোবাইল ইন্টারনেটে বুঁদ হয়ে থাকি সারাদিন, মায়েরা দশটা কথা বললে আমরা যারা একটা কথাও শুনি না, বিরক্তিভরে এড়িয়ে যাই, আমাদের মায়েরা যদি আমাদের জন্য কোনো বদ-দুআ করেন, তাহলে ভাবুন তো, জীবনে কী ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের?
মায়ের অবাধ্য যারা, তারা সত্যিকার অর্থেই হতভাগা। তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় শান্তি। জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে তারা নিদারুণ ব্যর্থ হবেই। আর আখিরাতে চূড়ান্ত ব্যর্থতা তো আছেই। সুতরাং, আমাদের বারংবার ব্যর্থতার কারণ আমাদের নিরন্তর হেরে যাওয়ার সম্ভাব্য সূত্রটা সম্ভবত এখানেই লুকোনো। ভেবে দেখা উচিত, আমাদের জীবনে আমাদের মায়েরা কোন অবস্থানে আছেন।
চার.
আজকালকার দুনিয়ায় ‘ভাল্লাগেনা’ একটা রোগের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের চারপাশে তাকালে আমরা এমন হাজার হাজার লোকের সন্ধান পাবো, যারা জীবন নিয়ে চরম পর্যায়ের হতাশ। এমন নয় যে, তাদের অর্থকড়ি, প্রভাব-প্রতিপত্তি কিংবা নাম-যশ-খ্যাতির অভাব। তাদের কোনোকিছুরই অভাব নেই। তাদের সবকিছু আছে, তবু সবকিছু থেকেও যেন কোথাও কিছু নেই। তাদের জীবনে যেন এক বিশাল শূন্যতা বিরাজ করে আছে! প্রাপ্তিতে ভরে ওঠা তাদের জীবনপাতাটা জুড়ে যেন এক অদৃশ্য অপ্রাপ্তির আনাগোনা। আচ্ছা, কেন এমন হয়?
কখনো কখনো কি জীবন থেকে পালাতে মন চায় আপনার? মাঝে মাঝে হাহাকার করে ওঠে মন? ভীষণ মর্মপীড়ায় মাঝে মাঝে হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়? দুনিয়াকে বিষাক্ত লাগে? কবির মতন করে বলতে মন চায়, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ?’
কখনো কি ভেবেছেন, কেন জীবনে আপনি তৃপ্তি পাচ্ছেন না? সবকিছু থেকেও কেন আপনার কিছু নেই? কেন আপনার কাজে মন বসে না? একজীবনে পরিতৃপ্তির জন্য যা কিছু উপকরণ দরকার, তার সবটাই তো আপনার কাছে আছে, তবু কেন আপনি ভীষণরকম একা? আপনি হয়তো জানেন না, আপনার এই দুর্বিষহ জীবনের নেপথ্য কারণ। ঠিক কোন কারণে আপনার ভরা বাসন্তী-জীবনে যাতনার প্লাবন, তা আপনার কাছে অজানা; তবে আপনার এই অজ্ঞাত, অনির্ণেয় দুঃখ-ভারাক্রান্ত জীবনের একটা কারণ সম্ভবত আমি জানি। আপনাকে উদ্দেশ্য করেই সম্ভবত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন–
‘আর যে আমার স্মরণ থেকে বিস্মৃত হবে, তার জীবন হয়ে পড়বে সংকুচিত।’[8]
আয়াতটির সাথে আপনার জীবনের কি কোনো মিল পাচ্ছেন? এই যে আপনার জীবনজুড়ে হাহাকার, অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তি এবং গভীর শূন্যতাবোধ–এর কারণ সম্ভবত আপনি আল্লাহর স্মরণ থেকে বিস্মৃত হয়েছেন। আল্লাহর স্মরণ মানে হলো–জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে আল্লাহর অনুশাসন অনুসরণ করে চলা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যা যা আপনার জন্য হালাল করেছেন, তা গ্রহণ করা এবং যা-কিছু তিনি হারাম করেছেন, তা এড়িয়ে চলা। প্রকৃতভাবে আল্লাহকে ভয় করা, আল্লাহকে ভালোবাসার নামই হলো আল্লাহর স্মরণ।
উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে আরো সহজ হবে। ধরা যাক, আপনি কোনো অফিসের বড় কর্মকর্তা এবং আপনার অধীনে ব্যাপক আকারে কর্মী নিয়োগ হয়ে থাকে। যেহেতু কর্মী নিয়োগের সকল ব্যাপার-স্যাপার আপনার হাত দিয়েই সম্পন্ন হয়, সুতরাং আপনি চাইলে এখানে স্বচ্ছভাবেও নিয়োগ দিতে পারেন অথবা রাখতে পারেন কোনো জালিয়াতির সুযোগ।
নিয়োগ সাধারণত মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই হয়। আপনার অফিসেও সেটাই হওয়ার কথা। কিন্তু একজন চৌধুরি সাহেব, যার আবার পকেটভর্তি টাকা, তিনি আপনার হাতে লাখ দুয়েক টাকার একটা বান্ডিল গছিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অমুক আর অমুক আমার লোক। তাদেরকে অমুক অমুক পোস্টে বসিয়ে দেবেন।’
যে দুটো পোস্টে চৌধুরি সাহেবের লোক বসিয়ে দেওয়ার জন্য আপনার কাছে বায়না এবং লোভনীয় সুযোগ এসেছে, সে পোস্টের জন্য আবেদন জমা পড়েছে হাজার হাজার, কিন্তু কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে, একটা লোক দেখানো পরীক্ষা কিংবা ইন্টারভিউ নিয়ে আপনি সকলকে একে একে বাদ করে দিলেন নানান ছুতোয়। আপনার পকেটে যেহেতু নগদ দুই লাখ টাকা ঢুকে পড়েছে, সেহেতু আর কোনোদিকে তাকানোর সময় কি আপনার আছে? চুলোয় যাক ওসব সততা আর স্বচ্ছতা!
আরো ধরা যাক, সেই দুই লাখ টাকা দিয়ে আপনি কুরবানির ঈদের জন্য একটা ই-য়া-য়া সাইজের গরু কিনলেন। আপনার কেনা গরুর সাইজ দেখে পাড়া-মহল্লায় তো হৈহৈ-রৈরৈ অবস্থা! এত বড় গরু দিয়ে এই তল্লাটে আগে কেউ আর কুরবানি দিতে পারেনি। আপনিই প্রথম!
চারদিক যখন আপনার সক্ষমতা আর সম্পদ ত্যাগ করে এত বড় নজির স্থাপনের ভূয়সী প্রশংসায় মাতোয়ারা, আপনার অন্তরে তখন কিন্তু আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই। কারণ আপনি জানেন আপনার অর্জিত টাকা কোনোভাবেই হালাল নয়। আপনি জালিয়াতি ও প্রতারণা করে এই টাকা লাভ করেছেন। আপনি অনেকগুলো মানুষের হক নষ্ট করেছেন আর ধূলিসাৎ করেছেন অনেকগুলো মানুষের স্বপ্ন। আপনি একজন ঠগ, প্রতারক আর জালিয়াত। আর কেউ না জানুক, আর কেউ না দেখুক, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তো জানেন আপনার এই অসতোর ব্যাপারে। বাইরের দুনিয়া আপনাকে যতই মুত্তাকি, যতই পরহেযগার, যত হৃদয়বানই ভাবুক না কেন, আল্লাহর চোখে আপনি অসৎ ও জালিম ছাড়া আর কিছুই নন। সুতরাং, হালাল টাকায় একটা বকরি কুরবানি দিয়ে একজন প্রকৃত মুমিন যে প্রশান্তি আর পুলক অনুভব করে, দুই লাখ টাকায় গরু কিনে আপনি তার ধূলিকণা পরিমাণ তৃপ্তিও পাবেন না। সেই পুলক আল্লাহ আপনাকে দেবেন না। আপনার হৃদয়ে নেই কোনো স্থিরতা, নেই কোনো প্রশান্তি।
এই যে–আপনার তো সবই আছে। একটা বড় কোম্পানির হর্তাকর্তা আপনি, কত লোক আপনার অধীনস্থ, বড় অঙ্কের টাকা মাস শেষে বেতন পান আপনি, কী বিশাল সাইজের গরু দিয়ে কুরবানি করেন, বছরের উমরাটাও হয়তো-বাদ যায় না। এতসব করেও অন্তরে কেন শান্তির লেশমাত্র পান না জানেন? কারণ আপনি প্রকৃতার্থে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত। আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তাতেই আপনি ডুবে আছেন আগাগোড়া। আপনার সব থাকবে–উন্নতি, পদোন্নতি, বাড়ি আর গাড়ি। কিন্তু যা থাকবে না, তা হলো অন্তরের প্রশান্তি। এইটার জন্য বিস্বাদ হয়ে উঠবে আপনার জীবন। বিষিয়ে উঠবে আপনার দেহমন। এক অদৃশ্য যাতনার সাগরে ডুবে থাকবেন আপনি। আপনার দালানকোঠা হয়তো আকাশ ছোঁবে, আপনার ক্ষমতার বলয় হয়তো বহুগুণ বিস্তৃত হবে, আপনার নাম-যশ-খ্যাতি হয়তো সীমানা ছাড়িয়ে যাবে, কিন্তু অন্তরের অন্তর্দহনে পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হতে থাকবেন আপনি।
এটা কেবলই একটা উদাহরণ মাত্র। জীবনের পদে পদে, ব্যক্তিক কিংবা সামাজিক অথবা প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ হৃদয়ে অটুট রাখতে হবে। জীবনের প্রতিটা অলিতে-গলিতে আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে আল্লাহর হুকুম-আহকাম; তবেই আমরা প্রকৃত জীবনের স্বাদ লাভ করতে পারবো, নচেৎ আমাদের জীবন ভীষণ বিভীষিকাময় হয়ে উঠবে ধীরে ধীরে। আমরা হারিয়ে ফেলবো জীবনের ছন্দ। আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত হলে আল্লাহ আমাদের জীবনকে কঠিন করে তুলবেন আর নিরানন্দ করে দেবেন জীবনের সবকিছু।
পাঁচ.
জীবনের গোলকধাঁধায় আমরা মাঝেমধ্যেই পথ হারাই। মাঝে মাঝে ভীষণ শূন্যতাবোধে যখন হাহাকার করে ওঠে মন, যখন জীবন খুঁজে পায় না জীবনের মানে, তখন জীবন থেকে এক টুকরো ছুটি নিয়ে আমরা নিজেকে খুঁজতে বসি। ভাবতে বসি–কোথায় গিয়ে ঠিক খেই হারাচ্ছে সব? হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়– ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’। সেই আপনাকে, অর্থাৎ নিজেকে খুঁজে পেতে হলে, খুঁজে পেতে হলে জীবনের সত্যিকার মানে, আমাদের ফিরতে হবে আমাদের রবের দেখানো পথে। সেই পথে, যে পথ গিয়ে মিশেছে অনন্ত অসীমে।
———-
[1] সুরা আরাফ, আয়াত : ১৭২
[2] সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৫৯
[3] সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৪৫
[4]এতে সালাতের হক আদায় হয় না। কেবল সালাতের বিধান পালিত হয়।
[5] প্রাগুক্ত
[6] সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৩২
[7] সহিহুল বুখারি : ১২০৬; সহিহ মুসলিম : ২৫৫০; মুস্তাখরাজু আবি আওয়ানা : ১১১২১; শুআবুল ঈমান :৭৪৯৪
[8] সুরা ত-হা, আয়াত : ১২৪