০৯. যে যাই বলুক পিছে
এক.
আমার পরিবারকে কোনোভাবেই প্র্যাক্টিসিং পরিবার বলা যাবে না। গতানুগতিক গ্রাম্য পরিবারগুলো যেমন হয় অনেকটাই সেরকম। আম্মা আমার সাথে ঢাকায় থাকার ফলে ইসলামি অনুশাসনের রীতি-নীতিকে নতুনভাবে জানা শুরু করেছেন। এবং আলহামদুলিল্লাহ সে-মতে চলবার আপ্রাণ চেষ্টাও আম্মার মাঝে লক্ষণীয়।
যেহেতু আমার পরিবার সেভাবে প্র্যাক্টিসিং না, তাই একজন প্র্যাক্টিসিং মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করাটা আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিলো রীতিমতো। চ্যালেঞ্জটা বহু দিক থেকে–একটা নন-অ্যাক্টিসিং পরিবেশে একজন প্র্যাক্টিসিং মেয়েকে সর্বোতভাবে সহায়তা করা, যাতে তার দ্বীন পালনে কোনো অসুবিধে না হয়। আবার সেটা করতে গেলে আত্মীয়স্বজনদের যে টিটকারি, কথা কানাকানি, এমনকি নিজের পরিবারের মানুষগুলোর বিরূপ মনোভাবগুলোকেও সমানভাবে সামলানোটা কতটা দুরূহ, তা বিবাহিত জীবনের শুরুর দিকে বেশ ভালোমতন টের পেয়েছিলাম।
আমার বিয়ের দিনের ঘটনা। মসজিদ থেকে বিয়ের সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে আমরা বাসায় এলাম। আমাদের গ্রাম্য রীতিনীতি অনুসারে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর কনেকে মিষ্টি হাতে ছেলের দুলাভাইদের (যদি থাকে) সামনে যেতে হয়। তাদেরকে মিষ্টি খাইয়ে দিতে হয় এবং দুলাভাইরা শালার বউ দেখে বকশিশ প্রদান করে।
বলাই বাহুল্য, আমার বিয়ের দিনও সেরকম একটা গুঞ্জন উঠেছিলো। যদিও আমি আগেই বলে রেখেছিলাম–আমার স্ত্রী পর্দা করবেন। কোনো পুরুষ মানুষের সামনে যাবেন না, কিন্তু পরিবারের সদস্যরা ধরে নিয়েছিলো–অন্তত হিজাব পরে হলেও তো দুলাভাইদের সামনে মিষ্টির প্লেট হাতে আসতে পারে। খাইয়ে না দিক, অন্তত একটা সালাম দিয়ে চলে যাবে।
কিন্তু বেঁকে বসলাম আমি এবং আমার নব বিবাহিতা স্ত্রী। সাফ জানানো হলো– কোনো নন-মাহরাম পুরুষের সামনে আমার স্ত্রী যাবেন না। সেটা দুলাভাই হোক আর আমার নিজের ভাই। এগুলো তথাকথিত সামাজিকতা। এসব সামাজিকতা মানতে আমরা বাধ্য নই।
বুঝতে পেরেছি, সেই রাতে আমার বোনেরা কষ্ট পেয়েছিলো। তারা ভেবেছিলো, তাদের আদরের ছোটো ভাই তাদের জামাইকে অপমান করেছে। কী এমন হতো তার বউকে মিষ্টির থালা হাতে এক মিনিটের জন্য পাঠালে?
কিন্তু সামাজিকতা নয়, আমাদের যে সুন্নাহটাই মানতে হবে!
আমার স্ত্রীর পর্দার ব্যাপারে কেবল ওই একবার-ই পরিবেশ ঘোলাটে হয়েছিলো। এরপর পর্দা করা নিয়ে আর কোনো সমস্যার সম্মুখীন আমার স্ত্রীকে আজ পর্যন্ত হতে হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ; বরং আমার পরিবার আর আত্মীয়স্বজনদের সবাই এখন সমানভাবে সচেতন তার পর্দা করার বিষয়ে। কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে গেলে সেখানকার পুরুষেরাও আমার স্ত্রীর পর্দা করার ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেন এবং সেভাবে সবকিছুর আয়োজন করেন।
কয়েকদিন আগে দারুণ একটা ব্যাপার চোখে পড়লো। আমার স্ত্রী রান্না করছিলেন। রান্নাঘরের দরোজায় খেলছিলো আমার তিন বছরের ছোটো ভাগিনা। বাইরে থেকে হঠাৎ আমার বড় ভাই ঘরের ভেতরে এলে ভাগিনা জোরে বলতে শুরু করলো, ‘মামা, এখানে এসো না। মামি আছে এখানে।
আমার স্ত্রী আছে বিধায় রান্নাঘরে যে আমার বড় ভাই আসতে পারবে না, সেটা আমার তিন বছরের ভাগিনাও বুঝতে শিখে গেছে, আলহামদুলিল্লাহ। সে দেখছে যে, তার ছোটো মামি যে রুমে থাকে, সে রুমে তার বাবা, তার ভাই আসতে পারে না। তার বড় মামাও যে আসতে পারবে না, সেটা তার ছোট্ট মস্তিষ্ক বুঝে ফেলেছে।
আমি ভাবি, স্রোতে গা না ভাসিয়ে আমরা আল্লাহর বিধানকে আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করেছিলাম বলেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আজ তা আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
দুই.
দ্বীন মানা এবং নিজেকে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যে জড়তা সবচেয়ে বেশি কাজ করে, তা হলো–লোকে কী ভাববে সেই ভয়! দাড়ি রাখতে গেলে আমাদের আশেপাশের কথা ভাবতে হয়। এত কম বয়সে মুখে দাড়ি রাখলে এলাকার মুরুব্বিরা কীভাবে নেবে, বন্ধুরা কী ভাববে, ক্লাশের স্যারেরা কী মনে করবেন–এসব ভেবে অনেকে দাড়ি রাখার সাহস পায় না।
কেউ সুন্নাহ-সম্মত উপায়ে বিয়ে করবে, এক পয়সা যৌতুক নেবে না, মেয়ের বাপের বাড়ির কোনো পয়সা বিয়েতে খরচ হতে দেবে না, বিয়ের দিনই ধার্যকৃত মেয়ের সকল মোহরানা পরিশোধ করে দেবে, বিয়েকে যতটা সম্ভব সাদামাটা রাখবে, আড়ম্বর করে তুলবে না। কোনো গান-বাজনার আয়োজন রাখবে না, এমনভাবে সব আয়োজন করবে যাতে কোনো মহিলার পর্দার অসুবিধা না হয়, কোনো পুরুষের দৃষ্টির খিয়ানত না ঘটে। এভাবে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখেও কত তরুণকে আজীবন চলে আসা সেই পুরোনো রীতিতে বিয়ে করতে হয়, যেখানে যৌতুকের রমরমা কারবার, যেখানে বিয়ে মানেই মেয়ের বাপের নিঃস্ব হয়ে পড়া, যেখানে বিয়ে মানেই ধুমধাম আয়োজন, গান-বাজনার ছড়াছড়ি আর পর্দার বালাই তো থাকেই না। শুধু সমাজ কী ভাববে, আত্মীয়স্বজনেরা কী মনে করবে, বন্ধুবান্ধবেরা কীভাবে নেবে ব্যাপারটা–এসব পিছুটানের কারণেই অনেককে সুন্নাহ-সম্মত বিয়ের বিষয়টা পাশ কেটে যেতে হয়।
কোনো মেয়ে যদি পর্দা করার কথা ভাবে, সাথে তাকে আরো ভাবতে হয় তার চারপাশের কথা। কোনো বান্ধবীই যেহেতু পর্দা করে না, সে একা কীভাবে মানিয়ে নেবে নিজেকে? চারপাশ থেকে ভেসে আসবে–বোরকা-হিজাব বিয়ের পরেই না হয় পরো। এখন যদি এত ঢেকেঢুকে চলো, বিয়ে দিতে তো ভারি মুশকিল হয়ে যাবে। রাস্তাঘাটে-ক্যাম্পাসে মানুষের চোখে না পড়লে বিয়ের জন্য ভালো প্রস্তাব আসবে কোত্থেকে?
মোদ্দাকথা, দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি থেকে আমাদের সমাজগুলো যেহেতু যোজন যোজন দূরে, তাই মৌলিকভাবে দ্বীনের হুকুম-আহকাম মানতে গেলে, সে অনুসারে জীবন পরিচালনা করতে গেলে আমাদের সমাজ সেগুলোকে ‘নয়া কারবার’ হিশেবে গণ্য করে। সেই হুকুম-আহকাম যারা পালন করে, অনেক সময় তাদের বাঁকা চোখে দেখা হয়। এমনভাবে তার সাথে আচরণ করা হয়, যেন সে সমাজ-বিচ্যুত কোনো জীব! যেন তার কারণে সমাজের মান-ইজ্জত চলে যাচ্ছে, যেন তার কারণেই পরিবারের অন্য সবার মাথা কাটা যাচ্ছে!
ঘটনার এই সিলসিলা আসলে নতুন নয়। ইসলামের আবির্ভাবের সময়কাল থেকেই এই ধরনের সামাজিক, ব্যক্তিক, পারিবারিক আর রাষ্ট্রীয় বাধা মুসলিমদের পার করে আসতে হয়েছে।
সম্ভবত এমন কোনো নবি-রাসুল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রেরণ করেননি, যাদের প্রচারিত দ্বীনকে, যাদের নিয়ে আসা রীতিনীতিকে শুরুতে মানুষেরা ‘নয়া কারবার’ জ্ঞান করেনি। প্রায় সব নবি-রাসুলকেই তাদের সমাজের বিপরীতে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছে। অনেকসময় পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েও তাদের আঁকড়ে ধরতে হয়েছে সত্যের বাণী।
ইবরাহিম আলাইহিস সালামের বাবা ছিলো একজন মূর্তিপূজক। তার সমাজও ছিলো আগাগোড়া মূর্তিপূজায় নিমজ্জিত, কিন্তু ইবরাহিম আলাইহিস সালাম সেখানে দাঁড়িয়ে গেলেন তাওহিদের ঝান্ডা নিয়ে। তার নিয়ে আসা বিধানের সাথে তার সমাজের, তার রাষ্ট্রের, তার পরিবারের কোনোকিছুর সাথেই মিল ছিলো না, তথাপি ইবরাহিম আলাইহিস সালাম সত্যকে বাদ দিয়ে অসত্যকে গ্রহণ করেননি। সত্য হিশেবে তার সামনে যা প্রতিভাত হয়েছে, তা-ই তিনি সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছেন। পাছে লোকে কী বলবে, সমাজ কীভাবে নেবে, পরিবার কীভাবে দেখবে, বন্ধু-বান্ধবেরা কী মনে করবে–এসবকে তিনি পাত্তা দেননি একটুও।
আমাদের নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘আমার প্রিয় কুরাইশবাসী, আমি আপনাদের জন্য সত্যের এক পয়গাম নিয়ে এসেছি। আপনাদের সতর্ক করতে এসেছি লেলিহান আগুনের শিখা। থেকে’, তখন ব্যঙ্গভরে কুরাইশরা বলেছিলো, ‘মুহাম্মাদ, তুমি কি তোমার এসব প্রলাপ শোনাবার জন্য আমাদের এখানে জড়ো করেছো?’[১]
কুরাইশদের ঘৃণাভরা প্রত্যাখ্যানের পরও কিন্তু থেমে যাননি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। প্রতিকূল সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি তা পালন করে গেছেন, যা মহান রব নাযিল করেছেন। তা বলে গেছেন, যা বলা তার দায়িত্ব ছিলো। পাছে কে কী বললো–সেসবে তার ছিলো না কোনো ভ্রূক্ষেপ।
তিন.
সমাজের, পরিবারের, বিভিন্ন মহলের নানান কথা, তিরস্কার আর উপেক্ষাগুলো আমাদের পরিবর্তনের পথে বড় বাধা বটে। নিজেকে পরিবর্তন করতে চাইলেও অনেকসময় পারিপার্শ্বিক অবস্থা, নিকটজন আর পরিচিত মহল সেই পরিবর্তনকে কীভাবে না কীভাবে নেবে, সেটা ভেবে ভেবে আমরা বদলাতে পারি না নিজেদের। আমরা ভাবি, এদের ছাড়া তো আমার চলবে না, তাই আপাতত এদের মতো হয়ে চলি বা এদের মন জুগিয়ে বাঁচি।
কিন্তু আল্লাহর ওয়াদা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পরিবর্তনটা যদি আল্লাহর জন্যই হয়, তাহলে জেনে রাখুন–আপনার পাশে যখন আল্লাহ থাকেন, তখন দুনিয়ার আর কোনো সাহায্যকারীকেই আপনার দরকার নেই। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুকে উপদেশ দিতে গিয়ে একদিন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘জেনে রাখো, যদি সমগ্র উম্মাহ তোমার উপকার করতে একতাবদ্ধ হয়, তাহলে কেবল ততটুকু উপকারই করতে পারবে, যতটুকু তোমার তাকদিরে আল্লাহ লিখে রেখেছেন। আর যদি সমগ্র উম্মাহ তোমার ক্ষতি করতে জোটবদ্ধ হয়, তাহলে কেবল ততখানি ক্ষতিই করতে পারবে, যতখানি তোমার তাকদিরে লিখে রেখেছেন আল্লাহ।[২]
আপনি যদি মনে করেন, নিজেকে বদলে নিলে, মুখে দাড়ি রেখে নিলে, বোরকা-হিজাবে নিজেকে আবৃত করে নিলে, সুন্নাহর রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিলে চারপাশের মানুষেরা আপনাকে সাহায্য করা বন্ধ করে দেবে, আপনার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেবে, আপনার পাশে থাকা বন্ধ করে দেবে এবং এতে আপনার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে, আপনার জীবন স্থবির হয়ে যাবে; তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। চারপাশের মানুষেরা মিলে নয়, গোটা দুনিয়া সংঘবদ্ধ হয়েও যদি আপনার উপকারের চেষ্টা করে, কিন্তু তা যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনার তাকদিরে না রাখেন, তাহলে কারো সাধ্য নেই আপনার উপকার করে। আবার গোটা দুনিয়া একত্র হয়েও যদি আপনার বিরুদ্ধে লাগে, আপনার ক্ষতি করতে চায়, কিন্তু আল্লাহ যদি কোনো ক্ষতি আপনার তাকদিরে না রাখেন, কারো সাধ্য নেই যে, আপনার একবিন্দু ক্ষতি করে। এই যদি হয় অবস্থা–তাহলে বলুন, নিজেকে বদলানোর ব্যাপারে পাছে লোকে কী বলছে, তা ভেবে সময় নষ্ট করবার মতো সময় আপনার হাতে থাকা উচিত?
———-
[1] সহিহুল বুখারি : ৪৯৭১; সহিহ মুসলিম : ২০৮; তাফসিরুত তাবারি, খণ্ড : ১৯; পৃষ্ঠা : ৪০৮;
তাফসিরু ইবনি আবি হাতিম, খণ্ড :১০; পৃষ্ঠা : ৩৪৭৩; বাইহাকি : ১৭৭২৫
[2] জামি তিরমিযি : ২৫১৬; মুসনাদু আহমাদ: ২৭৬৩; মুসতাদরাকুল হাকিম: ৬৩০৩; রিয়াযুস সালিহিন : ৬২