আর্য্যাদিগের সনাতন বেদবিহিতমতের বিশেষ ব্যাখ্যা
।। ওঁম ।।
স্বমন্তব্যামন্তব্য প্রকাশঃ ॥
যে সর্বতন্ত্ৰসিদ্ধান্ত অর্থাৎ সার্বভৌমিক ও সার্বজনিক ধর্ম সকলে সর্বদা মান্য করিয়া আসিতেছে, এখনও মান্য করে এবং ভবিষ্যতেও মান্য করিবে; তথা যে ধর্মের বিরোধী কেহই হইতে পারে না, তাহাকে সনাতন ও নিত্যধর্ম বলে।
অজ্ঞ লোকেরা অথবা ভিন্নমতবাদী কর্তৃক বিভ্রান্ত লোকেরা যে বিরুদ্ধ জ্ঞান এবং ধারণা পোষণ করে, তাহা সুধীজনের পক্ষে গ্রহণীয় নহে; কিন্তু আপ্ত অর্থাৎ সত্যবিশ্বাসী, সত্যবাদী, সত্যকর্মা, পরিহিতব্রত ও পক্ষপাতরহিত জ্ঞানীগণ যাহা বিশ্বাস করেন, তাহাই সকলের পক্ষে বিশ্বাসের উপযুক্ত; তাঁহারা যাহা বিশ্বাস করেন না; তাহা বিশ্বাস ও প্রমাণযোগ্য নহে।
ঈশ্বর এবং যাবতীয় পদার্থ সম্বন্ধে বেদাদি সত্য শাস্ত্রসমূহে যাহা লিখিত আছে এবং ব্রহ্মা হইতে জৈমিনি পৰ্য্যন্তমুনিঋষিগণ যাহা বিশ্বাস করিতেন আমিও তাহাই বিশ্বাস করি এবং তাহাই সজ্জনদিগের নিকট প্রকাশ করিতেছি।
আমি জানি যে যাহা তিন কালে সকলের পক্ষে সমভাবে বিশ্বাসের উপযুক্ত, তাহাই আমার মত। কোন নবীন কল্পনা বা মত প্রচলিত করিব, এমন উদ্দেশ্যের লেশমাত্রও আমার নাই; কিন্তু স্বয়ং সত্যবিশ্বাস করা এবং অপরকেও সত্য বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্ত করানই আমার উদ্দেশ্য।
আমি যদি পক্ষপাত করিতাম, তাহা হইলে আৰ্য্যাবর্তের প্রচলিত মত সমূহের মধ্যে কোন একটির প্রতি বিশেষ আগ্রহশীল হইতাম।কিন্তু আমি আৰ্য্যাবর্তকিংবা অপর কোন দেশের ধর্ম-বিরুদ্ধ আচার-ব্যবহার গ্রহণ এবং সঙ্গত আচার-ব্যবহার বর্জন, কিংবা বর্জনের ইচ্ছাও করি না; কারণ তাহা করা মানবতার বহির্ভূত।
যিনি মননশীল হইয়া সকলের সুখ দুঃখ ও লাভালাভ নিজের ন্যায় মনে করেন, এবং যিনি শক্তিশালী অন্যায়কারীকে ভয় করেন না, কিন্তু দুর্বল ধর্মাত্মা হইতেও ভীত হন, তাহাকেই মনুষ্য বলে। কেবল তাহাই নহে, কিন্তু ধর্মাত্মা ব্যক্তি যতই অসহায় দুর্বল ও গুণহীন হউন না কেন, তিনি তাঁহার শক্তি প্রয়োগ করিয়া তাঁহাদের রক্ষা ও উন্নতি বিধানে যত্নবান থাকেন এবং তাঁহাদের প্রিয় আচরণ করেন। অধার্মিক ব্যক্তিরা সাম্রাজ্যাধিকারী, সহায়সম্পন্ন প্রবল-পরাক্রম এবং গুণবান্ হইলেও তিনি সর্বদা তাহাদের অধঃপতন ও বিনাশ সাধনে সচেষ্ট থাকেন এবং তাহাদের প্রতি অপ্রিয় আচরণ করেন। তাৎপৰ্য এই যে, যতদূর সম্ভব, অন্যায়কারীদিগকে সর্বতোভাবে হীনবল এবং ন্যায়কারীদিগকে শক্তিশালী করিবার জন্য দারুণ দুঃখভোগ, এমন কি প্রাণ বিসর্জন করিতে হইলেও এই মানবতারূপ ধর্মসাধনে পশ্চাৎপদনা হওয়াইমনুষ্যের কর্তব্য।
এই বিষয়ে শ্রীমন্মহারাজ ভর্তৃহরি এবং অন্যান্য জ্ঞানীদিগের রচিত কয়েকটি শ্লোক নিম্নে উদ্ধৃত করা যাইতেছে:–
নিন্দনীতিপুণা, যদিবা স্তুবন্তু, লক্ষ্মীঃ সমাবিশ গচ্ছতু বা যথেষ্ট ॥ অদ্যৈব বা মরণমস্তু য়ুগান্তরে বা ন্যায়াৎ পথঃ প্রবিচলন্তি পদংন ধীরাঃ ॥১॥(ভর্তৃহরিঃ) ন জাতু কামান্ন ভয়ান্ন লোভাদ, ধর্মং ত্যজেজ্জীবিতস্যাপি হেতোঃ। ধর্মো নিত্যঃ সুখদুঃখে ত্বনিত্যে, জীবোনিত্যো হেতুরস্য ত্বনিত্যঃ ॥২॥(মহাভারতে) এক এব সুহৃদ্ধৰ্মো নিধনেপ্যনুয়াতিয়ঃ ॥ শরীরেণ সমং নাশং সর্বৰ্মন্যদ্ধি গচ্ছতি ॥৩ ।। (মনুঃ) সত্যমেব জয়তে নামৃতং সত্যেন পন্থা বিততো দেবয়ানঃ। য়েনাS্যক্রমন্ত্যষয়গা হ্যাঁপ্তকামা য়ত্র তৎসত্যস্য পরমং নিধানম্ ।।৪ ।। (মুন্ডকো) নহি সত্যাৎপরো ধর্মোনামৃতং পাতকং পরম্। নহি সত্যাৎ পরং জ্ঞানং তস্মাৎসত্যং সমাচরেৎ ॥৫॥(উপনিষদ্)।
এ সকল মনস্বী রচিত শ্লোকের মর্মানুসারে সকলেরই দৃঢ়নিশ্চয় থাকা কর্তব্য। যে যে বিষয়ে আমার যেরূপ বিশ্বাস এস্থলে তাহা সংক্ষেপে বর্ণনা করা যাইতেছে। এই গ্রন্থের পৃথক পৃথক্ প্রকরণে এ সকল বিষয়ের বিশেষ ব্যাখ্যা প্রদত্ত হইয়াছে।
১। প্রথমতঃ “ঈশ্বর” –যাঁহার ব্রহ্ম এবং পরমাত্মা প্রভৃতি নাম, যিনি সচ্চিদানন্দাদিলক্ষণযুক্ত, যাঁহার গুণ, কর্ম ও স্বভাব পবিত্র, যিনি সর্বজ্ঞ, নিরাকার, সর্বব্যাপক, জন্মরহিত অনন্ত, সর্বশক্তিমান, দয়ালু, ন্যায়কারী, সকল সৃষ্টির কর্তা, ধর্তা, হর্তা এবং সত্য ও ন্যায়ানুসারে জীবদিগের কর্মফলদাতা ইত্যাদি লক্ষণযুক্ত,তাহাকেই পরমেশ্বর বলিয়া স্বীকার করি।
২। চারি “বেদ” কে– (বিদ্যা ধর্মযুক্ত, ঈশ্বর প্রণীত, সংহিতা মন্ত্রভাগকে) অভ্রান্ত ও স্বতঃ প্রমাণ বলিয়া বিশ্বাস করি। বেদ স্বতঃ প্রমাণ, বেদের প্রমাণ অন্য কোন গ্রন্থ সাপেক্ষ নহে। যেমন। সূৰ্য্য ও প্রদীপ স্বভাবতঃ স্ব স্ব স্বরূপ প্রকাশ করে এবং ভূমণ্ডল প্রভৃতিরও প্রকাশক, চারি বেদও সেইরূপ। চারিটি বেদের ব্রাহ্মণ –অঙ্গ ছয়টি, উপাঙ্গ ছয়টি, উপবেদ চারিটি এবং (এগার শত সাতাশটি) শাখা আছে। এ সকল গ্রন্থব্রহ্মাদিমহর্ষি রচিত বেদব্যাখা স্বরূপ পরতঃ প্রমাণ। এগুলি। বেদানুকূল হইলেই প্রমাণ; তন্মধ্যে বেদবিরুদ্ধ বচনগুলিকে অপ্রমাণ মনে করি।
৩। “ধর্মাধর্ম” –বেদের অবিরুদ্ধ পক্ষপাত রচিত, ন্যায়াচরণ, সত্যভাষণ এবং ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন ইত্যাদি “ধর্ম”। বেদবিরুদ্ধ পক্ষপাত অন্যায়াচরণ, মিথ্যাভাষণ এবং ঈশ্বরের আজ্ঞালঙ্ঘন ইত্যাদি “অধর্ম”।
৪। “জীব” –যাহা ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ এবং জ্ঞানাদি গুণাযুক্ত, অল্পজ্ঞ এবং নিত্য তাহাকে “জীব” মানি!
৫। “ঈশ্বরের সহিত জীবের সম্বন্ধ” –ঈশ্বর ও জীবের স্বরূপ বৈধৰ্ম বশতঃ ভিন্ন; কিন্তু ব্যাপ্য, ব্যাপকত্ব ও সাধর্ম বশতঃ অভিন্ন। অর্থাৎ যেমন মূর্ত দ্রব্য আকাশ হইতে কখনও পৃথক ছিল না, পৃথনহে এবং পৃথক্ থাকিবে না, সেইরূপ পরমেশ্বরের সহিত জীবের ব্যাপ্য-ব্যাপক, উপাস্য-উপাসক এবং পিতা-পুত্র ইত্যাদি সম্বন্ধ স্বীকার করি।
৬। “ঈশ্বর,জীব এবং প্রকৃতি” –প্রথম ঈশ্বর, দ্বিতীয় জীবাত্মা ও তৃতীয় প্রকৃতি অর্থাৎ জগতের কারণ –এই তিন পদার্থ “অনাদি”,ইহাকে নিত্যও বলে। নিত্য পদার্থের গুণকর্মস্বভাবও নিত্য।
৭। ”প্রবাহরূপে অনাদি” –সংযোজক দ্রব্য, গুণ ও কর্ম বিয়োগের পর থাকে না; কিন্তু যে সামর্থ্য প্রথম সংযোগের কারণ, তাহা ঐ সকলের মধ্যে অনাদি। তদ্বারা পুনরায় সংযোগ ও বিয়োগ ঘটিয়া থাকে। এই তিনটিকে প্রবাহরূপে “অনাদি” বলিয়া মানি।
৮। “সৃষ্টি” –পৃথক পৃথক্ দ্রব্য সমূহের জ্ঞান ও যুক্তি পূর্বক মিলিত হইয়া নানারূপে গঠিত হওয়াকে “সৃষ্টি”বলে।
৯। “সৃষ্টির প্রয়োজন” –সৃষ্টি দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্টিনিমিত্ত গুণকর্মস্বভাবের সফলতা হয়; যেমন, যদি কেহ কাহাকেও জিজ্ঞাসা করে, “নেত্রের প্রয়োজন কী? সে উত্তরে বলে দর্শন। সেইরূপ সৃষ্টিদ্বারাই পরমেশ্বরের সৃষ্টিশক্তির সফলতা এবং জীবের সমুচিত কর্মফলভোগ ইত্যাদি সম্ভব।
১০। “সৃষ্টির সকর্তৃকা” –সৃষ্টিরচনা দেখিলেই সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বরের প্রমাণ পাওয়া যায়। যেহেতু পদার্থ সমূহের মধ্যে এমন সামর্থ্য নাই যে, সে নিজে নিজে যথাযোগ্যভাবে মিলিত হইয়া বীজাদি স্বরূপে নির্মিত হইতে পারে, অতএব, সৃষ্টিকর্তা অবশ্য আছেন।
১১। ”বন্ধ”সনিমিত্তক –অবিদ্যাই বন্ধনের হেতু। ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্যের উপসনারূপ পাপকর্ম এবং অজ্ঞান প্রভৃতির ফল দুঃখ, এই দুঃখের নাম বন্ধন, কারণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভোগ করিতে হয়।
১২। “মুক্তি” –সর্ববিধ দুঃখ ও বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া সর্বব্যাপক ঈশ্বর এবং তাঁহার সৃষ্টির মধ্যে ইচ্ছানুসারে বিচরণ করাকে ‘মুক্তি’ বলে। নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত মুক্তির আনন্দ ভোগ করিবার পর পুনরায় জীবকে সংসারে আগমন করিতে হয়।
১৩। “মুক্তির সাধন’– ঈশ্বরোপাসনা অর্থাৎ যোগ্যাভ্যাস, ধর্মানুষ্ঠান, ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা বিদ্যোপার্জন, আপ্তবিদ্বানদের সংসর্গ, সত্যবিদ্যা, সুবিচার এবং পুরুষকার ইত্যাদি মুক্তির সাধন।
১৪। ”অর্থ” –যাহা ধর্ম দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহা অর্থ, যাহা অধর্ম দ্বারা সিদ্ধ হয় তাহা অনর্থ।
১৫। ”কাম” –যাহা ধর্ম ও অর্থ দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাকে “কাম” বলে ॥ ১৬। “বর্ণাশ্রম” –গুণ ও কর্মের যোগ্যতানুসারে বর্ণাশ্রম’ব্যবস্থা স্বীকার করি। ১৭। “রাজা” –যিনি শুভ গুণ-কর্ম-স্বভাব দ্বারা প্রকাশমা; যিনি পক্ষপাত রহিত হইয়া ন্যায় ও ধর্মানুসারে প্রজাদের সহিত পিতৃবৎ আচরণ করেন এবং তাহাদিগকে পুত্রতুল্য জানিয়া তাহাদের উন্নতি ও সুখবৃদ্ধিকল্পে সর্বদা যত্নবান থাকেন, তাহাকে রাজা’বলে।
১৮ “প্রজা” –যাঁহার গুণ-কর্ম-স্বভাব পবিত্র, যিনি পক্ষপাত রহিত হইয়া ন্যায় ও ধর্মাচরণ সহকারে রাজা ও সর্বসাধারণের উন্নতি কামনা করেন এবং যিনি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করিয়া তাঁহার সহিত পুত্রবৎ আচরণ করেন, তাঁহাকে ‘প্রজা’ বলে ॥
১৯। “ন্যায়কারী” –যিনি সর্বদা বিচার পূর্বক অসত্য বর্জন ও সত্যগ্রহণ করেন, যিনি অন্যায়কারীদিগকে বিতাড়িত করিয়া ন্যায়কারীদের উন্নতি বিধান এবং আত্মবৎ সকলের সুখ কামনা করেন তিনিই ন্যায়কারী। আমি তাঁহার আচরণ সঙ্গত মনে করি।
২০। “দেব”, বিদ্বানদিগকে “দেব”, মূর্খদিগকে “অসুর”, পাপীদিগকে “রাক্ষস” এবং অনাচারীদিগকে “পিশাচ”মনে করি।
২১।”দেবপূজা” –পূর্বোক্ত বিদ্বান্, মাতা, পিতা, আচাৰ্য্য, অতিথি, ন্যায়বারাজা, ধর্মাত্মা, পতিব্রতা স্ত্রী এবং স্ত্রীব্রত পতি –ইহাদের সম্মানকে দেবপূজা’ এবং তাহার বিপরীত আচরণকে অদেব’ পূজা বলি। ইঁহারাই পূজাৰ্হ। পাষাণ নির্মিত জড়মূৰ্ত্তিকে সর্বথা অপূজ্য মনে করি।
২২। “শিক্ষা –যদ্বারা বিদ্যা, সভ্যতা, ধর্মপরায়ণতা এবং জিতেন্দ্রিয়তা প্রভৃতি বৃদ্ধি পায় ও অজ্ঞতা প্রভৃতি দূরীভূত হয়, তাহাকে ‘শিক্ষা’বলে।
২৩।”পুরাণ” –ভাগবতাদি গ্রন্থ পুরাণ নহে; কিন্তু ব্রহ্মাদিরচিত”ঐতরেয়” প্রভৃতিব্রাহ্মণগ্রন্থ সমূহেরই নাম ‘পুরাণ’, ‘ইতিহাস’, ‘কল্প’, ‘গাথা’এবং নারাশংসী বলিয়া মনে করি।
২৪। “তীর্থ’–সত্যভাষণ, বিদ্যাচর্চা,সৎসঙ্গ, যমাদি যোগাভ্যাস, পুরুষকার এবং বিদ্যাদান প্রভৃতি যে সকল শুভকর্ম দ্বারা দুঃখসাগর হইতে উত্তীর্ণ হওয়া যায়, সে সকলকে ‘তীর্থ’বলি, অন্য জলস্থল প্রভৃতি তীর্থ নহে ॥
২৫।”প্রারন্ধ ও পুরুষকার” –যেহেতু পুরুষকার হইতে সঞ্চিত প্রারদ্ধ উৎপন্ন হয় এবং পুরুষকার সুপরিচালিত হইলে সমস্তই শুদ্ধ, এবং বিকৃত হইলে সমস্তই বিকৃত হয়, অতএব প্রারদ্ধ অপেক্ষা পুরুষকার শ্রেষ্ঠ।
২৬। মনুষ্যের কর্তব্য” –সুখ-দুঃখ এবং লাভালাভ বিষয়ে সকলের সহিত আত্মবৎব্যবহার করা শ্রেয়ঃ;বিপরীত আচরণ করা নিন্দনীয়।
২৭।”সংস্কার” –যদ্বারা শরীর, মন এবং আত্মার উন্নতি সাধিত হয়, তাহার নাম ‘সংস্কার। গর্ভাধান হইতে অন্ত্যোষ্টি পৰ্য্যন্ত ষোড়শবিধ সংস্কারকে কর্তব্য বলিয়া মনে করি। দাহান্তে মৃতের পক্ষে করণীয় কিছুই নাই।
২৮। “যজ্ঞ’ –বিদ্বাদের প্রতি সমুচিত সম্মান প্রদর্শন, শিল্পকাৰ্য্যে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার উপযোগ, বিদ্যাদান, শুভগুণবৃদ্ধি এবং অগ্নিহোত্রানুষ্ঠানকে যজ্ঞ বলে। অগ্নিহোত্র দ্বারা বায়ু, বৃষ্টি, জল এবং ওষধি পবিত্র হয়, তাহাতে জীবগণ সুখানুভব করে। ইহাকে উত্তম মনে করি।
২৯। শ্রেষ্ঠ মনুষ্যদিগকে “আৰ্য” এবং দুষ্টপ্রকৃতির মনুষ্যদিগকে “দস্যু”বলে। আমারও এই মত স্বীকাৰ্য্য ॥
৩০।”আৰ্য্যাবর্ত” –এ দেশের নাম “আর্য্যাবর্ত”,কারণ আদি সৃষ্টি হইতে আর্য্যগণ এ দেশে বাস করিতেছেন। আর্যাবর্তের উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বিন্ধ্যাচল, পশ্চিমে অটকনদী এবং পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদী। এই চতুঃসীমার মধ্যবর্তী ভূমিখণ্ডের নাম “আৰ্য্যাবর্ত”। যাঁহারা এ দেশে চিরকাল বাস করিতেছেন, তাঁহাদের নাম “আৰ্য”।
৩১।”আচাৰ্য” –যিনি সাঙ্গোপাঙ্গো বেদের অধ্যাপক, যিনি সত্যাচার গ্রহণ এবং মিথ্যাচার। বর্জন করান, তাঁহাকে ‘আচার্য্য বলে।
৩২। “শিষ্য” –যিনি সত্যবিদ্যা ও সত্যশিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত; যিনি ধর্মাত্মা ও বিদ্যাকাঙ্ক্ষী এবং যিনি আচার্য্যের প্রিয় আচরণ করেন তাহাকে ‘শিষ্য’বলে।
৩৩। “গুরু” –মাতা এবং পিতা ‘গুরু’; তদ্ব্যতীত যাঁহার উপদেশে সত্যগ্রহণ এবং অসত্য বর্জন করা হয় তাহাকেও ‘গুরু’ বলে ॥
৩৪।”পুরোহিত” –যিনি যজমানের হিতকারী এবং সত্যোপদেষ্টা, তাহার নাম পুরোহিত।
৩৫। “উপাধ্যায়” –যিনি বেদের অংশ বিশেষ কিংবা বেদাঙ্গ সমূহের অধ্যাপক, তাহার নাম উপাধ্যায়।
৩৬। “শিষ্টাচার”–ধর্মাচরণ ও ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা বিদ্যালাভ করিয়া প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের সাহায্যে সত্যাসত্য নির্ণয় করাকে “শিষ্টাচার”বলে। যিনি তাহা করেন, তিনি শিষ্ট।
৩৭। “প্রমাণ” –প্রত্যক্ষাদি অষ্টবিধ প্রমাণ’ স্বীকার করি।
৩৮।”আপ্ত”—- যিনি যথার্থ বক্তা ও ধর্মাত্মা এবং যিনি সকলের সুখের জন্য সচেষ্টতাঁহাকেই ‘আপ্ত’বলি।
৩৯। “পরীক্ষা” –পরীক্ষা পাঁচ! প্রথমতঃ –ঈশ্বর ও তাঁহার গুণ-কর্ম-স্বভাব এবং বেদবিদ্যা; দ্বিতীয়তঃ– প্রত্যক্ষাদি অষ্টবিধ প্রমাণ; তৃতীয়তঃ–সৃষ্টিক্রম; চতুর্থঃ- আপ্তদের ব্যবহার; পঞ্চমতঃ –নিজ আত্মার পবিত্রতা এবং বিদ্যা। এই পঞ্চবিধ পরীক্ষা দ্বারা সত্যাসত্য নির্ণয় করিয়া সত্যগ্রহণ ও অসত্যবর্জন করা কর্তব্য।
৪০। “পরোপকার” –যদ্বারা সকলের দুরাচার ও দুঃখ দূরীভূত এবং শ্রেষ্ঠচার ও সুখ বৰ্দ্ধিত হয়, তাহাকে পরোপকার’বলে।
৪১। “স্বতন্ত্র ও পরতন্ত্র” –জীব নিজ কর্মে স্বতন্ত্র, কিন্তু ভোগ বিষয়ে ঐশ্বরিক বিধানে পরতন্ত্র। পরমেশ্বরও সেইরূপ তাঁহার সত্য ও মঙ্গল কর্মে স্বতন্ত্র।
৪২। “স্বর্গ” –অত্যন্ত সুখভোগ এবং তাহার সাধন প্রাপ্তির নাম স্বর্গ। ৪৩। “নরক” অত্যন্ত দুঃখভোগ ও দুঃখের সাধন প্রাপ্তির নাম নরক।
৪৪। “জন্ম” –শরীর ধারণ পূর্বক প্রকট হওয়ার নাম জন্ম। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ভেদে জন্ম ত্রিবিধ।
৪৫। “জন্ম ও মৃত্যু” –শরীরের সহিত জীবাত্মার সংযোগ হওয়াকে ‘জন্ম’ এবং বিয়োগ হওয়াকে মৃত্যু’বলে ॥
৪৬। বিবাহ” –স্বেচ্ছায় প্রকাশ্যভাবে যথাবিধি পাণিগ্রহণের নাম ‘বিবাহ ॥
৪৭। “নিয়োগ” –বিবাহের পর, পতির মৃত্য ঘটিলে কিংবা অন্য কোন কারণে পতিবিয়োগ ঘটিলে, কিংবা পতির স্থায়ী নপুংসকত্ব প্রভৃতি রোগ, স্ত্রীর স্ববর্ণ অথবা তদপেক্ষা উচ্চবর্ণ পুরুষ দ্বারা এবং আপৎকালে পুরুষের তাদৃশ স্ত্রীতে সন্তানোৎপত্তিকরাকে নিয়োগ’বলে।
৪৮। “স্ততি” –গুণজ্ঞান, গুণকীর্তন এবং গুণশ্রবণের নাম ‘স্তুতি’, স্তুতির ফল প্রীতি ইত্যাদি।
৪৯। “প্রার্থনা” –যাহা জ্ঞান-বিজ্ঞানাদিনিজশক্তির অতীত, কিন্তু ঈশ্বরের সহিত যোগবশতঃ প্রাপ্ত হওয়া যায়, ঈশ্বরের নিকট তাহা যাঞ্চা করাকে প্রার্থনা’ বলে। প্রার্থনার ফল নিরহঙ্কার ইত্যাদি ॥
৫০। “উপাসনা” –ঈশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাবের ন্যায় নিজের গুণ-কর্ম-স্বভাব পবিত্র করা এবং ঈশ্বর সর্বব্যাপক, আমিতাহার নিকটে আছিএবংতিনি আমার নিকটেআছেন, এইরূপজ্ঞান সহকারে যোগাভ্যাস দ্বারা ঈশ্বর সাক্ষাৎকার করার নাম উপাসনা’। উপাসনার ফল জ্ঞানোন্নতি ইত্যাদি।
৫১। সগুণ ও নির্গুণ “স্তুতি-প্রার্থনা-উপাসনা” –পরমেশ্বরে যে সকল গুণ বিদ্যমান তাহাকে সে সকল গুণবিশিষ্ট এবং যে সকল গুণের অভাব, সে সকল গুণরহিত জানিয়া প্রশংসা করাকে যথাক্রমে সগুণ ও নির্গুণ স্তুতি বলে। শুভগুণগ্রহণ এবং দোষ বর্জনার্থ পরমাত্মার সহায়তা প্রার্থনা করাকেযথাক্রমে সগুণ ও নিষ্ঠুণ প্রার্থনা বলে। পরমেশ্বর সর্বগুণময় এবং সর্বদোষরহিত জানিয়া নিজ আত্মাকে তাহাতে এবং তাহার আজ্ঞায় সমর্পণ করাকে সগুণ এবং নিগুর্ণ উপাসনা বলে।
আমার সিদ্ধান্ত সমূহ সংক্ষেপে প্রদর্শিত হইল। এসকলের ব্যাখ্যা এই “সত্যার্থ প্রকাশে” বিভিন্ন প্রকরণে প্রদত্ত হইয়াছে। “ঋগ্বেদাদি ভাষ্যভূমিকা” গ্রন্থেও এ সকল ব্যাখ্যাত হইয়াছে। তাৎপৰ্য্য এই যে, যে সকল বিষয় সকলের পক্ষে বিশ্বাসের উপযুক্ত, আমিও সে সকল বিশ্বাস করি; যেমন সকল মতেই সত্যবাদিতা শ্রেষ্ঠ, এবং অসত্যবাদিতা হেয়; এইরূপ সিদ্ধান্ত আমিও মানি। মত-মতান্তরের বিরোধ আমার নিকটপ্রীতিকর নহে। কারণ, সাম্প্রদায়িকমতবাদ প্রচারের ফলে মনুষ্যেরা অন্ধবিশ্বাসে জড়িত হইয়া পরস্পরের প্রতিশত্রুভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছে। আমি অসত্য খণ্ডন এবং সত্যপ্রচার দ্বারা সকলকে একই মতে আনিবার জন্য যত্নবান রহিয়াছি। আমার অভিপ্রায় এই যে, সকল বিদ্বেষ পরিত্যাগ পূর্বক পরস্পরের প্রতি পরমপ্রীতিপরায়ণ হউক এবং সকলেই পরস্পরের সাহায্যে যত্নবান হউক। সর্বশক্তিমান পরমাত্মারও সহায়তা এবং আপ্তদের। সহানুভূতি প্রভাবে আমার এই সিদ্ধান্ত সত্ত্বর পৃথিবীতে সর্বত্র প্রসারিত হউক। এই সিদ্ধান্ত দ্বারা সকলে সহজে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ লাভ করিয়া উন্নতি ও আনন্দ লাভ করিতে থাকুন। ইহাই আমার জীবনের সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য।
অলমতিবিস্তরেণ বুদ্ধিমদ্বয়েযু ॥
ওম্ শন্নো মিত্রঃ শং বরুণ। শন্নো ভবত্বয়মা ৷ শন্ন ইন্দ্রো বৃহস্পতিঃ। শন্নো বিষ্ণুরুরুক্রমঃ ॥ নমো ব্ৰহ্মণে নমস্তে বায়ো। ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাসি। ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মবাদিষম্। ঋঅবাদিষ। সত্যমবাদিষ। তন্মামাবীৎ তদ্বক্তারমাবীৎ। আবীম্। আবীদ্বক্তার। ও শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। ইতি শ্রীমৎপরমহংসপরিব্রাজকাঁচাৰ্যাণাং পরমবিদূষাং শ্রীবিরজানন্দ সরস্বতী স্বামিং শিষ্যেণ শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী-স্বামিনা বিরচিতঃ স্বমন্তব্যামন্তব্যসিদ্ধান্তসমন্বিতঃ সুপ্রমাণযুক্তঃ সুভাষাবিভূষিতঃ সত্যার্থপ্রকাশোয় গ্রন্থঃ সম্পূৰ্ত্তিমগমৎ।