০৬. রাজধর্ম

রাজধর্ম

অথ ষষ্ঠ– সমুল্লাসারম্ভঃ
অথ রাজধৰ্মা ব্যাখ্যাস্যামঃ

রাজ ধর্মান প্রবক্ষ্যামিয়থাবৃত্তো ভবেনূপঃ ॥ সম্ভবশ্চয়থাতস্য সিদ্ধিশ্চ পরমায়থা ॥ ১ ॥ ব্রাহ্মং প্রাপ্তেন সংস্কারং ক্ষত্রিয়েণয়থাবিধি ॥ ২ ॥ সর্বস্যাস্য মথান্যায়ং কৰ্ত্তব্যং পরিরক্ষণম্ ॥২॥ মনু ০ ॥

মনু মহারাজ ঋষিদিগকে বলিতেছেন, ‘চারি বর্ণ ও চারি আশ্রমের ব্যবহার বর্ণনা করিবার পর রাজ ধর্ম বর্ণনা করিব। রাজার যেরূপ হওয়া উচিত, সেইরূপ যাহাতে হওয়া সম্ভব হয়, যাহাতে তাহার পরম সিদ্ধি লাভ হইতে পারে, তাহা সর্বতোভাবে বর্ণনা করিতেছি’ ॥১॥

ব্রাহ্মণ যেমন পরম বিদ্বান্ হইয়া থাকেন, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে উচিত তিনিও সেইরূপ বিদ্বান্ ও সুশিক্ষিত হইয়া ন্যায়ানুসারে যথাবৎ রাজ্য রক্ষা করিবেন ॥২॥

উহার প্রণালী এইরূপ — ত্রীণি রাজানা বিদথে পুরুণি পরি বিশ্বানি ভূষথঃ সদাংসি ॥ ঋ০৩৩৮৬

ঈশ্বর উপদেশ করিতেছেন যে, (রাজানা) রাজা ও প্রজাবর্গ মিলিত হইয়া (বিদথে) সুখপ্রাপ্তি এবং বিজ্ঞানান্নোতি বিধায়ক রাজাপ্রজা বিষয়ক ব্যবহারে (ত্রীণি সদাংসি) তিন সভা অর্থাৎ বিদ্যাৰ্য্য সভা, ধৰ্মাৰ্য্য সভা, এবং রাজাৰ্য্য সভা গঠিত করিয়া (পুরুণি) বহুবিধ (বিশ্বানি) সমগ্র প্রজা সন্ধীয় মনুষ্যাদি প্রাণীগণকে (পরিভূষথঃ) বিদ্যা, স্বাতন্ত্র, ধর্ম, সুশিক্ষা এবং ধনাদি দ্বারা সর্বপ্রকারে অলঙ্কৃত করিবে।

তংসভা চ সমিতিশ্চ সেনা চ ॥১॥ অথর্ব ০ কা ০১৫।২।২। সভ্য সভাং মে পাহি য়ে চ সভ্যাঃ সভাসদঃ ॥২॥ অথর্ব কা০ ১৯৭৫৫ ॥৬ ॥

(ত) সেই রাজধর্মকে (সভা চ) তিন সভা, (সমিতিশ্চ) সংগ্ৰামাদি ব্যবস্থা এবং (সেনা চ) সেনা মিলিত হইয়া পালন করিবে।১ ॥

সভাসদ ও রাজার কর্তব্য এই যে, রাজা সভাসদ্বর্গকে আজ্ঞা দিবেন, হে (সভা) সভার যোগ্য প্রধান সভাস। তুমি (মে) আমার (সভা) সভার ধর্মসঙ্গত ব্যবস্থা (পাহি) পালন কর, এবং (যে চ) যাহারা (সভ্যাঃ) সভার উপযুক্ত (সভাসদ) সভাসদ তাহারাও সভার ব্যবস্থা পালন করুক৷ ২ ॥

ইহার অভিপ্রায় এই যে, কোন এক ব্যক্তিকে রাজ্যের স্বতন্ত্র অধিকার দেওয়া উচিত নহে। কিন্তু রাজা যিনি সভাপতি, তাহার অধীন সভা, সভার অধীন রাজা, প্রজার অধীন রাজা ও সভা

এবং রাজসভার অধীন প্রজাবর্ণ থাকিবে। এইরূপ না হইলে– রাষ্ট্রমেব বিশ্যাহন্তী তস্মাদ্ৰাষ্ট্ৰী বিশং ঘাতুকঃ। বিশমেব রাষ্ট্রায়াদ্যাংকরোতি তস্মাদ্ৰাষ্ট্ৰী বিশমত্তি ন পুষ্টং পশুং মন্যত ইতি ॥ ’শত০ কা০ ১৩।২। ৩

রাজন্যবর্গ প্রজা হইতে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন থাকিলে (রাষ্ট্রের বিশ্যহন্তি) রাজ্যে প্রবেশ করিয়া প্রজার নাশ করিতে থাকিবে। সেই কারণে একক রাজা স্বেচ্ছাচারী অথবা উন্মত্ত হইয়া (রাষ্ট্রী বিশং ঘাতুকঃ) প্রজানাশক হইয়া থাকে অর্থাৎ (বিশমেব রাষ্ট্রায়াদ্যাং করোতি) সেই রাজা প্রজাকে ভক্ষণ করে [অত্যন্ত পীড়ন করে] অতএব কোন ব্যক্তিবিশেষকে রাজ্যে স্বাধীন করা উচিত নহে। (ন পুষ্টং পশুং মন্যতে) যেরূপ সিংহ অথবা কোন মাংসাহারী হৃষ্টপুষ্ট পশুকে বধ করিয়া ভক্ষণ। করে, সেইরূপ (রাষ্ট্রী বিশমত্তি) স্বতন্ত্র রাজা প্রজার নাশ করে, অর্থাৎ কাহাকেও নিজ অপেক্ষা বলশালী হইতে দেয়না এবং ধন্যাঢ্যদিগকে লুণ্ঠন করিয়া ও অন্যায়রূপে দণ্ড দিয়া স্বার্থসিদ্ধি করে। এইজন্য–

ইন্দ্রো জয়াতিন পরাজয়াতা অধিরাজোরাজসুরাজয়াতৈ। চকৃত্য ঈড্যো বন্দ্যশ্লোপসদ্যো নমস্যো ভবেহ। ॥১॥ অথর্ব কা০ ৬১০৯৮১

হেমনুষ্যগণ! যিনি (ইহ) সকল মনুষ্যের মধ্যে (ইন্দ্ৰঃ) পরমেশ্বৰ্য্যবিধাতা, শত্ৰুদিগকে (জয়তি) জয় করিতে সমর্থ (ন পরাজয়াত) যিনি শত্ৰুদিগের অপরাজেয় (রাজসু) রাজন্যবর্গের মধ্যে (অধিরাজঃ) সর্বোপরি বিরাজমান্ (রাজয়াতৈ) এবং প্রকাশমান, (চকৃত্যঃ) সভাপতি হইবার বিশেষ উপযুক্ত, (ঈড্যাঃ) প্রশংসনীয় গুণ-কর্ম-স্বভাববিশিষ্ট, (বন্দ্যঃ) বন্দনাযোগ্য (চোপসদ্যঃ) সমীপে যাইবার এবং শরণ লইবার যোগ্য, (নমস্যঃ) সৰ্বৰ্মান্য (ভব) হইবেন, তাঁহাকেই সভাপতি রাজা করিবে।

ইমং দেবাঅসপত্নহওঁসুবধংমহতেক্ষায়মহতে জৈষ্ঠায়মহতেজানরাজ্যায়েন্দ্রসেচন্দ্রিয়ায় ॥ ২ ॥ যজু অ০ ৯।৪০

হে (দেবাঃ) বিদ্বন্মগুলি, রাজা ও প্রজাগণ। তোমরা (ইমম) এইরূপ পুরুষকে (মহতে ক্ষত্রায়) মহা চক্রবর্তী রাজ্যের জন্য, (মহতে জৈষ্ঠ্যায়) সর্বাপেক্ষা মহান্ হইবার জন্য (মহতে জানরাজ্যায়) মহান্ বিদ্বজ্জন পরিপূর্ণ রাজ্য পালন করিবার জন্য এবং (ইন্দস্যেন্দ্রিয়ায়)পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন রাজ্য ও ধন রক্ষা করিবার জন্য, (অসপত্ন সুবধ্ব) সর্ব সম্মতিক্রমে সর্বত্র পক্ষপাতরহিত, পূর্ণবিদ্যা ও বিনয় সম্পন্ন এবং সকলের মিত্র সভাপতি রাজাকে সৰ্ব্বাধীশ মানিয়া সমস্ত পৃথিবীকে শত্রুশূন্য। কর। (২) আর

স্থিরা বঃ সন্ত্ৰায়ুধা পরাণুদেবীউত প্রতিষ্কভে। য়ুষ্মকমস্তু তবিষী পনীয়সী মা মর্ত্যস্য মায়িনঃ ॥১॥ ঋ০ ০ ১।৩৯।২

ঈশ্বর উপদেশ দিতেছেন, হে রাজপুরুষগণ! (বঃ) তোমাদিগের (আয়ুধা) আগ্নেয়াদি অস্ত্র। এবং শতঘ্নী’=কামান, ভূশণ্ডী’বন্দুক, ধনুর্বাণ, করবাল=তরবারি প্রভৃতিশস্ত্র শত্ৰুদিগের (পরাণুদে) পরাজয়ের জন্য (উত প্রতিষ্কভে) এবং প্রতিরোধের জন্য (বীলু) প্রশংসিত এবং (স্থিরা) দৃঢ় (সন্তু) হউক। (য়ুষ্মক) তোমাদের (তবিষী) সেনা (পনিয়সী) প্রশংসনীয় (অস্তু) হউক, যাহাতে তোমরা সর্বদা বিজয়ী হও, কিন্তু (মা মর্ত্য মায়িনঃ) নিন্দিত ও অন্যায়কারীদের জন্য পূর্বোক্ত সামগ্রী সকল না হউক। অর্থাৎ যতদিন মনুষ্য ধার্মিক থাকে, ততদিন পর্যন্তই রাজ্যের উন্নতি হইতে থাকে, কিন্তু মনুষ্য দুষ্টাচারী হইলে নষ্টভ্রষ্ট হইয়া যায়।

শ্রেষ্ঠবিদ্বান্‌দিগকেবিদ্যা সভার অধিকারী, ধার্মিকবিদ্বাদিগকে ধর্মসভার অধিকারী এবং প্রশংসনীয়। ধার্মিক পুরুষদিগকে রাজসভার সভাসদ করিবে। আর যিনি ইহাদের সকলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। গুণ- কর্ম– স্বভাবসম্পন্ন মহাপুরুষ, তাহাকে রাজসভার সভাপতি রূপে বরণ করিয়া সর্বপ্রকার। উন্নতি সাধন করিবে। এই তিন প্রকার মতানুসারে রাজনীতি সংক্রান্ত উত্তম নিয়ম এবং সেই সব নিয়মের অধীনে সকলে চলিবে। সর্বহিতকর কাৰ্যে সকলে সহমত থাকিবে। সর্বহিতার্থে পরতন্ত্র এবং ধর্মানুমোদিত কর্মে অর্থাৎ যাহা যাহা আপন কৰ্তব্য কর্ম উহাতে স্বতন্ত্র থাকিবে।

পুনশ্চ সেই সভাপতির কীরূপ গুণ থাকা আবশ্যক—

ইন্দ্রানিলয়মার্কাণামগ্নেশ্চ বরুণস্য চ। চন্দ্রবিত্তেশয়োশ্চৈব মাত্রা নিত্য শাশ্বতীঃ ॥১॥ মনু০ ৭৪ তপত্যাদিত্যবচ্চৈষ চক্ষুংষি চ মনাংসি চ ॥ ন চৈনং ভুবিশক্লোতি কশ্চিদপ্যভিবীক্ষিতুম৷ ২ ॥ সোভগ্নিৰ্ভবতি বায়ুশ্চ সোর্কঃ সোমঃ স ধর্মরাট। স কুবেরঃ স বরুণঃ স মহেন্দ্রঃ প্রভাবতঃ ॥ ৩ ॥

মনু পুনশ্চ সেই সভাপতির কীরূপ গুণ থাকা আবশ্যক–

সেই সভাধ্যক্ষ রাজা, ইন্দ্র অর্থাৎ বিদ্যুতের ন্যায় শীঘ্র ঐশ্বর্য্যোৎপাদক, বায়ুর ন্যায় সকলের প্রাণবৎ প্রিয় ও হৃদয়ের ভাববেত্তা, যম অর্থাৎ পক্ষপাতহীন ন্যায়াধীশের ন্যায় আচরণকারী, সূর্যের তুল্য ন্যায়ধর্ম ও বিদ্যা প্রকাশক, অন্ধকার, অর্থাৎ অবিদ্যা ও অন্যায় নিরোধক, অগ্নির ন্যায় দুষ্টদিগের ভস্মকারী, বরুণ অর্থাৎ বন্ধনকারীর ন্যায় দুষ্টদের বহুপ্রকারে বন্ধনকারী, চন্দ্রের ন্যায়। শ্রেষ্ঠদিগের আনন্দদাতা এবং ধনাধ্যক্ষের ন্যায় ধনভাণ্ডার পূর্ণকারী (ব্যক্তি) সভাপতি হইবেন ॥১॥

যিনি সূৰ্য্যের ন্যায় প্রতাপশীল এবং যিনি স্বকীয় তেজঃ প্রভাবে বাহিরে সকলকে এবং ভিতরে সকলের মনকে উত্তপ্ত করেন, পৃথিবীতে যাঁহাকে কেহই ত্রুর দৃষ্টিতে দেখিতে সমর্থ নহে ॥ ২

যিনি স্বকীয় প্রভাবে অগ্নি, বায়ু, সূৰ্য্য, সোম ধর্ম প্রকাশক, ধনবৰ্ধক, দুষ্টের বন্ধনকারী এবং মহান ঐশ্বৰ্য্যশালী,তিনি সভাধ্যক্ষ = সভাধীশ হইবার উপযুক্ত ৷৩ ॥

প্রকৃত রাজা কে? স রাজা পুরুষো দণ্ডঃ স নেতশাসিতা চ সঃ। চতুর্ণামাশ্রমাণাঞ্চ ধর্মস্য প্রতিভূঃ মৃতঃ ॥১॥ দণ্ডঃ শাস্তি প্রজাঃ সর্বা দণ্ড এবাভিরক্ষতি। দণ্ড সুপ্তেষু জাগর্তিদণ্ডং ধর্মং বিদুৰ্বধাঃ ॥ ২ ॥ সমীক্ষ্য স ধৃতঃ সম্যক্ সর্বা রঞ্জয়তি প্রজাঃ ॥ অসমীক্ষ্য প্রণীতস্তু বিনাশয়তি সর্বতঃ ॥ ৩ ॥ দুষ্যেয়ুঃ সর্ববণাশ্চ ভিদ্যের সর্বসেতবঃ ॥ সর্বলোকপ্রকোপশ্চ ভবেন্ডস্য বিভ্ৰমাৎ ॥ ৪ ॥ য়ত্র শ্যামো লোহিতাক্ষো দণ্ডশ্চরতি পাপহা ॥ প্রজাস্তত্র ন মুহ্যন্তি নেতা চেৎ সাধু পশ্যতি ॥ ৫ ॥ তস্যাহুঃ সংপ্রণেতারাং রাজানং সত্যবাদিন। সমীক্ষ্যকারিণং প্রাজ্ঞং ধর্মকামার্থকোবিদ ॥ ৬ ॥ তং রাজা প্রণয়ন্সম্যক্ ত্রিবর্গেণাভিবর্ধতে ॥ কামাত্মা বিষমঃ ক্ষুদ্রোদণ্ডেনৈব নিহন্যতে ॥ ৭ ॥ দণ্ডো হিসুমহত্তেজো দুর্ধরশ্চাকৃতাত্মভিঃ। ধর্মাদ্বিচলিতংহন্তি নৃপমেব সবান্ধব৷৮ ॥ সোসহায়েন মূঢ়েন লুক্কেনাকৃতবুদ্ধিনা। নশকো ন্যায়তো নেতুংসক্তেন বিষয়েষু চ ॥ ৯ ॥ শুচিনা সত্যসন্ধেয়থাশাস্ত্রানুসারিণা। প্রণেতুং শক্যতে দণ্ডঃ সুসহায়েন ধীমতা ॥১০ ॥ মনু ০

যে দণ্ড সেই পুরুষ, রাজা, সেই ন্যায়ের প্রচারক, এবং সকলের শাসনকর্তা। দণ্ডই চারিবর্ণ ও চারি আশ্রম ধর্মের প্রতিভূ অর্থাৎ জামিন ॥ ১ ॥

দণ্ডই প্রজাদিগের শাসক ও রক্ষক। দণ্ড নিদ্রিত প্রজাদিগের মধ্যে জাগ্রত থাকে। এই কারণে। বুদ্ধিমান লোকেরা দণ্ডকেই ধর্ম বলিয়া থাকেন ॥ ২ ॥

সুপরিচালিত দণ্ড প্রজাদিগকে আনন্দিত করে, কিন্তু বিনাবিচারে পরিচালিত হইলে উহা রাজাকে সর্বপ্রকারে বিনাশ করে ৷ ৩ ॥

দণ্ড ব্যতীত সকল বর্ণ দূষিত ও সকল মৰ্য্যাদা ছিন্নভিন্ন হয়। দণ্ড যথোচিত না হইলে সকলে প্রকুপিত হইয়া উঠে ॥ ৪ ॥

যে স্থানে কৃষ্ণবর্ণ, রক্তনেত্র এবং ভয়ঙ্কর পুরুষের ন্যায় পাপনাশক দণ্ড বিচার করে, সে স্থানে দণ্ডপরিচালক পক্ষপাতবিহীন ও বিদ্বান্ হইলে প্রজাগণ মোহগ্রস্ত না হইয়া আনন্দিত থাকে ॥ ৫ ॥

যদি দণ্ড পরিচালক সত্যবাদী, বিচারশীল, বুদ্ধিমান এবং ধর্ম-অর্থ-কামসিদ্ধি বিষয়ে সুপণ্ডিত হন, তবে বিদ্বন্মমণ্ডলী তাঁহাকেই দণ্ডবিধাতা বলিয়া থাকেন ॥৬ ॥

যে রাজা সুচারুরূপে দণ্ড পরিচালনা করেন, তিনি ধর্ম-অর্থ-কাম সিদ্ধি বৃদ্ধি করিয়া থাকেন। কিন্তু রাজা বিষয়াসক্ত, কুটিল, ঈষ্যাৰ্পরায়ণ, ক্ষুদ্রচেতা ও হীনবুদ্ধি হইলে দণ্ড বিনাশপ্রাপ্ত হয় ॥ ৭৷

দণ্ড অতিশয় তেজোময়, যাহারা বিদ্যাহীন ও অধর্মাত্মা তাহারা উহা ধারণ করিতে পারে না। সুতরাং দণ্ড অধার্মিক রাজাকে সপরিবারে বিনাশ করে ॥ ৮ ॥

কারণ যিনি আপ্ত পুরুষদিগের সহায়তা, বিদ্যা এবং সুশিক্ষা হইতে বঞ্চিত এবং যিনি বিষয়সক্ত ও মূঢ়চেতা, তিনি কখনও ন্যায়পূর্বক দণ্ডবিধান করিতে সমর্থ হন না ॥৯॥

যিনি পবিত্ৰাত্মা, সত্যাচার যুক্ত ও সৎসঙ্গী, যিনি নীতি শাস্ত্রানুসারে যথোচিত কাৰ্য্যকরী, যিনি শ্ৰেষ্ঠদিগের সহায়তাপ্রাপ্ত এবং যিনি বুদ্ধিমান,তিনি ন্যায়দণ্ডবিধানে সমর্থ ॥১০৷ এইজন্য :

সৈনাপত্যং চ রাজ্যং চ দণ্ডনেতৃত্বমেব চ। সর্বলোকাধিপত্যংচ বেদশাস্ত্রবিদৰ্হতি ॥১॥ দশাবরা বা পরিদ্যং ধর্মং পরিকল্পয়েৎ। বরা বাপি বৃত্তস্থা তৎ ধর্মংন বিচালয়েৎ ॥ ২॥ ত্রৈবিদ্যো হৈতুকস্তক নৈরুক্তো ধর্মপাঠকঃ। এয়শ্চাশ্রমিণঃ পূর্বে পরিষৎস্যাদ্দশাবরা ॥ ঋগ্বেদবিদ্যজুর্বিচ্চ সামবেদবিদেব চ ॥ বা পরিষজ্ঞেয়া ধর্মসংশয়নির্ণয়ে ॥ ৪ ॥ একোচপি বেদবিদ্ধৰ্মংয়ং ব্যবস্যেদ দ্বিজোত্তমঃ। সবিজ্ঞেয়ঃ পরো ধর্মোনাজ্ঞানামুদিততায়ুতৈঃ ॥ ৫ ॥ অব্ৰতানামমন্ত্রাণাং জাতিমাত্রোপজীবিনা। সহস্রশঃ সমেতানাং পরিষত্ত্বং ন বিদ্যতে ॥ ৬ ॥ য়ংবদন্তি তমোভূতা মূখা ধর্মমতদ্বিদঃ। তৎ পাপংশতধা ভূত্বা তদ্বক্তৃনমুগচ্ছতি ॥ ৭ ॥

মনু সকল সেনা ও সেনাপতির উপর আধিপত্য, রাজ্যাধিকার, দণ্ডবিধি সংক্রান্ত সকল কার্যের আধিপত্য এবং সর্বোপরি বর্তমান সর্বাধীশ রাজ্যাধিকার–এই চতুর্বিধ অধিকারে পূর্ণবেদশাস্ত্র প্রবীণ পূর্ণবিদ্যাযুক্ত, ধর্মাত্মা, জিতেন্দ্রিয় এবং সুশীল ব্যক্তিদিগের নিযুক্ত করা কর্তব্য। অর্থাৎ প্রধান সেনাপতি, প্রধান রাজ্যাধিকারী, প্রধান ন্যায়াধীশ, সভাপতি অথবা রাজা–এই চারি জনের সর্ববিদ্যাবিশারদ হওয়া আবশ্যক৷১ ॥

ন্যূনকল্পে দশজন বিদ্বান অথবা কমপক্ষে তিনজন বিদ্বান্ পুরুষের সভা যে ব্যবস্থা করিবেন সেই ধর্ম অর্থাৎ ব্যবস্থা কেহই উল্লঙ্ঘন করিবেন না ৷২ ॥

এই সভায় চারিবেদ, [ হৈতুক অর্থাৎকারণ অকারণের জ্ঞাতা] ন্যায়শাস্ত্র, নিরুক্ত এবং ধর্মশাস্ত্রাদির জ্ঞাতা বিদ্বান্ সভাসদ থাকিবেন। কিন্তু তাঁহাদের ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ এবং বানপ্রস্থ হওয়া চাই।ন্যূনকল্পে দশজন বিদ্বান্ এইরূপ সভায় থাকিলে উহাকে সভা বলিয়া গণ্য করা হইবে৷৩ ॥

যে সভায় ঋগ্বেদ, যজুবেদ এবং সামবেদজ্ঞ তিনজন সভাস থাকেন, সেই সভার নির্ধারিত ব্যবস্থা কেহই উল্লঙ্ঘন করিবেন না ॥৪॥ যদি সর্ববেদবিদ দ্বিজশ্রেষ্ঠ সন্ন্যাসী একাকীও কোন ধর্ম ব্যবস্থা করেন তবে তাহাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। কারণ সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ, ও কোটি কোটি অজ্ঞ ব্যক্তি মিলিত হইয়া কোন ব্যবস্থা করিলেও তাহা কখনও মান্য করা উচিত নহে ॥ ৫ ॥

ব্রহ্মচর্য সত্যভাষাণাদি ব্রত, বেদবিদ্যা এবং বিচারহীন আজন্ম শূদ্রবৎ বর্তমান এইরূপ সহস্র মানুষের মেলাকে সভা বলা যাইবে না৷৬ ॥

অবিদ্যাযুক্ত, বেদজ্ঞান বিহীন মুখের যে ধর্মোপদেশ প্রদান করে, তাহা কখনও মান্য করা উচিত নহে। কারণ যাহারা মূখোপদিষ্ট ধর্মানুসারে চলে, তাহাদের শত শত প্রকার পাপ ঘটিয়া থাকে ॥ ৭ ॥

এই জন্য তিন সভায় অর্থাৎ বিদ্যাসভা, ধর্মসভা ও রাজসভায় কখনও মূর্খদের স্থান দিবে। না। কিন্তু সর্বদা বিদ্বান্ এবং ধার্মিক পুরুষদের প্রতিষ্ঠিত করিবে। আর তাহারা সকলে এইরূপ হইবেন —

ত্রৈবিদ্যেভ্যস্ত্রয়ীং বিদ্যাং দণ্ডনীতিঞ্চ শাশ্বতীম্ ॥ আন্বীক্ষিকীং চাত্মবিদ্যাং বার্তারাশ্চ লোকতঃ ॥ ১ ॥ ইন্দ্রিয়াণাং জয়ে য়োগং সমাতিষ্ঠেদ্দিবানিশম্ ॥ জিতেন্দ্রিয়ো হিশক্লোতি বশে স্থাপয়িংপ্রজাঃ ॥২॥ দশ কামসমুখানি তথাষ্টৌ ক্রোধজানি চ। ব্যসনানি দুরন্তানি প্রয়ত্নেন বিবর্জয়েৎ ॥ ৩ ॥ কামজেযু প্রসজো, হিব্যসনেষু মহীপতিঃ বিয়ুজ্যত্যের্থধর্মাভ্যাং ক্রোধজেম্বাত্মনৈব তু ॥ ৪ ॥ মৃগয়াগো দিবাস্বপ্নঃ পরিবাদঃ স্ত্রিয়োমদ। তৌয়ত্রিকং বৃথাট্যাচ কামজো দশকো গণঃ ॥ ৫ ॥ পৈশুন্যাংসাহসং দ্রোহঈাসূয়ার্থদূষণম্ ॥ বাগদণ্ডজং চ পারুষ্যং ক্রোধজো পি গণোষ্টিকঃ ॥ ৬ ॥ দ্বয়োরপ্যেতয়োমূলংয়ং সর্বে কবয়োবিদুঃ। তং যত্নেন জয়েল্লোভং তজ্জাবেতাবুভৌ গণেী ॥ ৭ ॥ পানমক্ষাঃ স্ত্রিয়শ্চৈব মৃগয়া চয়থাক্রম। এতৎকষ্টতমং বিদ্যাচ্চতুস্কং কামজে গণে ॥ ৮ ॥ দণ্ডস্য পাতনং চৈব বাপারুষ্যার্থদূষণে। ক্রোধজেপিগণে বিদ্যাৎকষ্টমেতৎত্রিকং সদা ॥৯॥ সপ্তকস্যাস্য বর্গস্য সর্ব ত্রৈবানুষঙ্গিণ। পূর্বং পূর্বং গুরুতরংবিদ্যাদ্ব্যসনমাত্মবান্ ॥ ১০ ॥ ব্যসনস্য চ মৃত্যোশ্চ ব্যসনং কষ্টমুচ্যতে। ব্যসন্যধোধো ব্রজতি স্বয়াত্যব্যসনী মৃতঃ ॥১১ ॥ মনু রাজা ও রাজসভার সভাস–সেই ব্যক্তি তখনই হইতে পারবেন যখন তিনি চারি বেদে বর্ণিত কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান রূপ বিদ্যাবেত্তাদের নিকট তিন বিদ্যা–সনাতন দণ্ডনীতি, ন্যায়বিদ্যা। অর্থাৎ পরমাত্মার গুণ-কর্ম-স্বভাবের যথার্থ জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মবিদ্যা এবং লোকের সহিত বাত্তারম্ভ = (প্রশ্নোত্তর করা) শিক্ষা করিয়া সভাসদ সভাপতি হইতে পারিবেন ৷১ ॥

সভাসদ্বর্গ ও সভাপতি ইন্দ্রিয় জয় করিবেন, ইন্দ্রিয় সমূহকে সর্বদা আত্মবশে রাখিয়া ধর্মাচরণ করিবেন, অধর্ম কাৰ্য্য হইতে বিরত থাকিবেন এবং অপরকেও বিরত করিবেন। এইজন্য দিবারাত্র নির্দিষ্ট সময়ে যোগাভ্যাসও করিতে থাকিবেন। কারণ যাঁহারা জিতেন্দ্রিয় নহেন অর্থাৎ নিজের ইন্দ্রিয় সমূহকে (মন,প্রাণ ও শরীর রূপ প্রজাকে) জয় করিতে পারেন না, তাহারা বাহিরের প্রজাদিগকে কখনও আত্মবশে রাখিতে সমর্থ হন না ॥২॥

কামজ দশ এবং ক্রোধজ আট দুষ্ট ব্যসনে আসক্ত হইলে মনুষ্যের পক্ষে তাহা হইতে মুক্ত হওয়া কঠিন।

দৃঢ়োৎসাহী হইয়া যত্নের সহিত স্বয়ং ঐসকল ব্যসন পরিত্যাগ করিবে এবং অন্যকেও পরিত্যাগ করিতে প্রবৃত্ত করিবে ৷ ৩ ॥

যে রাজা কামজ দশ দুষ্ট ব্যসনে আসক্ত হন, তিনি অর্থ অর্থাৎ রাজ্য ধনাদি এবং ধর্ম হইতে বিচ্যুত হইয়া পড়েন। যিনি ক্রোধ জনিত আট দুর্ব্যসনে আসক্ত হন, তাহার শরীরও বিনষ্ট হয় ৷ ৪ ॥

কামজ ব্যসন গণনা করা যাইতেছে। যথা–মৃগয়া, অক্ষ অর্থাৎ পাশা খেলা এবং জুয়া খেলা। ইত্যাদি, দিবা নিদ্রা, কামকথা, পরনিন্দা অর্থাৎ অপরের কুৎসা, অত্যধিক স্ত্রীসংসর্গ, মাদক দ্রব্য অর্থাৎ মদ্য, অহিফেন, ভাং গাঁজা এবং চরস প্রভৃতির সেবন, গীত, বাদ্য ও নৃত্য করা তথা করান, দেখা ও শ্রবণ করা, ইতস্ততঃ বৃথা ভ্রমণ–এই দশটি কামজ ব্যসন ॥ ৫ ॥

ক্রোধজ ব্যসনগুলি গণনা করা যাইতেছে, যথা–(পৈশুন্য) অর্থাৎ পরের কুৎসা করা, (সাহস) বিনা বিচারে বলপূর্বক পরস্ত্রীর সহিত কুকর্ম করা; (দ্রোহ) দ্রোহ রাখা; (ঈর্ষা) অর্থাৎ অপরের উন্নতি বা শ্রীবৃদ্ধি দেখিয়া অন্তর্দাহ উপস্থিত হওয়া; (অসূয়া) দোষে গুণ এবং গুণে দোষারোপ করা; (অর্থদূষণ) অর্থাৎ অধর্মযুক্ত কুকর্মে ধন সম্পত্তি ব্যয় করা; (বাদণ্ড) কঠোর। বাক্য বলা এবং (পারুষ্য) বিনা অপরাধে কটুবাক্য বলা অথবা বিশেষ দণ্ডদান করা–এই আটটি। ক্রোধ হইতে উৎপন্ন হয় ॥ ৬ ॥

যে সকল বিদ্বান্ পুরুষ কামজ ও ক্রোধজ ব্যসন সমূহের মূল জানেন এবং যাহা দ্বারা এই সকল দুগুণে মানুষ আসক্ত হইয়া থাকে সেইলোভকে সর্বপ্রযত্নে পরিত্যাগ করিবেন ॥৭ ॥

কামজ ব্যসন সমূহে বৃদ্ধি প্রাপ্ত দুগুণ, প্রথম-মদ্যাদি অর্থাৎ মাদক দ্রব্য সেবন, দ্বিতীয়পাশা প্রভৃতির দ্বারা জুয়া খেলা, তৃতীয়-অত্যাধিক স্ত্রীসংসর্গ, চতুর্থ-মৃগয়া। এই চারিটি মহা দুষ্ট ব্যসন ॥ ৮ ॥

ক্রোধজ ব্যসন সমূহের মধ্যে বিনা অপরাধে দণ্ডদান, কঠোর বাক্য প্রয়োগ এবং অন্যায় রূপে ধনসম্পত্তি ব্যয় করা–এই তিনটি দোষ ক্রোধ হইতে উৎপন্ন এবং অত্যন্ত দুঃখজনক। ৯ ॥

এই কামজ ও ক্রোধজ ব্যসনের মধ্যে যে সাতটি দোষ গণনা করা হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে পূর্ব পূর্ব দোষ পর পর দোষ অপেক্ষা গুরুতর অর্থাৎ বৃথা বাক্য ব্যয় করিয়া কঠোর বচন, কঠোর বচন অপেক্ষা অন্যায়রূপে দণ্ডদান,অন্যায়রূপে দণ্ডদান অপেক্ষা মৃগয়া, মৃগয়া অপেক্ষা অতিরিক্ত স্ত্রীসংসর্গ, তদপেক্ষা জুয়া অর্থাৎ দ্যুৎ ক্রীড়া এবং দ্যুৎ ক্রীড়া অপেক্ষা মদ্যাদি সেবন অধিকতর দুৰ্বসন ॥ ১০ ॥

এই বিষয়ে নিশ্চয় জানিতে হইবে যে, দুষ্ট ব্যসনে আসক্ত হওয়া অপেক্ষা মৃত্যুঃ শেয়ঃ । কারণ দুরাচারী ব্যক্তি যদি অধিক দিন জীবিত থাকে তাহা হইলে সে অধিকাধিক পাপ করিয়া নীচ গতি অর্থাৎ অধিকতর দুঃখ ভোগ করিতে থাকিবে। আর যে ব্যক্তি কোনও দুষ্ট ব্যসনে আসক্ত হয় না, সে মরিলেও সুখলাভ করিতে থাকিবে। অতএব বিশেষতঃ রাজার এবং সর্বমানবের উচিত, কখনও মৃগয়া ও মদ্যপান প্রভৃতি দুষ্ট ব্যসনে আসক্ত না হওয়া এবং দুষ্ট ব্যসন হইতে পৃথক থাকিয়া সর্বদা ধর্মসঙ্গত গুণ-কর্ম স্বভাব অনুয়ায়ী আচরণ ও সৎকর্মে নিযুক্ত থাকিয়া উত্তমোত্তম কর্ম করা ॥ ১১ ॥

রাজসভাসদ এবং মন্ত্রী কীরূপ হওয়া উচিত মৌলাশাস্ত্রবিদঃশূরাঁল্লব্ধলক্ষ্যান্ কুলোতা। সচিবা সপ্ত চাস্টেী বা প্রকুবর্তি পরীক্ষিতান॥১॥ অপি য়ৎসুকরং কর্ম তদপ্যেকেন দুষ্কর। বিশেষতোসহায়েন কিছু রাজ্যং মহোদয় ॥ ২ ॥

তৈঃ সাৰ্দ্ধং চিন্তয়েন্নিত্যং সামান্যং সন্ধিবিগ্রহ। স্থানং সমুদয়ং গুপ্তিং লব্ধপ্রশমনানি চ ॥ ৩ তেষাং স্বং স্বমভিপ্রায়মুপলভ্য পৃথক পৃথক। সমস্তানাঞ্চ কায়েষু বিদধ্যাতিমাত্মনঃ ॥ ৪ ॥ অন্যানপি প্রকুর্বীত শুচী প্রাজ্ঞানবস্থিতা। সম্যগর্থসমাহর্তৃনমাত্যান্ সুপরীক্ষিতান ॥ ৫ ॥ নিবৰ্ত্তেৰ্তাস্য আবদ্ভিরিতি কর্তব্যতা নৃভিঃ। তাবতোতন্দ্রিতা দক্ষা প্রকুবীতবিচক্ষণা ॥ ৬ ॥ তেষামর্থেনিয়ুঞ্জীতশূরান্দক্ষা কুলোতা। শুচীনাকরকর্মান্তে ভীরুনন্তর্নিবেশনে ॥ ৭ ॥ দূতং চৈব প্রকুর্বীত সর্বশাস্ত্রবিশারদম ॥ ঈঙ্গিতকারচেষ্টাং শুচিং দক্ষং কুলোদ্গত ॥ ৮ ॥ অনুরক্তঃ শুচিদক্ষঃ স্মৃতিমান্ দেশকালবিৎ। বপুপমা বীতভীর্বাগ্মী দূতো রাজ্ঞঃ প্রশস্যতে ॥ ৯ ॥ মনু।

স্বরাজ্য ও স্বদেশোদ্ভব, বেদাদি শাস্ত্রবেত্তা, শৌর্যবীৰ্য্যশালী, যাঁহার লক্ষ্য অর্থাৎ বিচার নিষ্ফল হয় না, কুলীন এবং সুপরীক্ষিত এমন সাত-আট জন ধামিক ও চতুর ‘সচিবান্’অর্থাৎ মন্ত্রী নিযুক্ত করিবে ॥ ১ ॥

কারণ এই যে, বিশেষ সাহায্য ব্যতীত সহজ কর্মও একাকী সম্পাদন করা কঠিন। সুতরাং সুমহান রাজকাৰ্য্য একজনের দ্বারা কীরূপে সম্পন্ন হইতে পারে অতএব কোন ব্যক্তি বিশেষকে রাজা করিয়া তাহার বুদ্ধির উপর রাজকার্যের ভার ন্যস্ত করা নিতান্ত গর্হিত ॥ ২ ॥

সুতরাং সভাপতির কর্তব্য এই যে, তিনি প্রতিনিয়ত রাজকার্যে সুদক্ষ বিদ্বান্ মন্ত্রীদিগের সহিত পরামর্শ করিবেন। তদনুসারে কাহারও সহিত ‘সন্ধি’= মিত্রতা, কাহারও সহিত ‘বিগ্রহ’= বিরোধ করিবেন এবং স্থান’=স্থিতি ও সময় দেখিয়া নিজ রাজ্য রক্ষা করিয়া স্থির ভাবে অপেক্ষা করিবেন। সমুদয় যখন নিজের অভ্যুদয় অর্থাৎ উন্নতি হইবে, তখন দুষ্টশকে আক্রমণ করিবেন।’গুপ্তি’=মূল রাজসেনা এই রাজকোষাদিরক্ষা করিবেন। লব্ধ প্রমনানি’=অধিকৃত দেশ সমূহের মধ্যে শান্তিস্থাপন ও উপদ্রব নিবারণ করিবেন। এই ছয়গুণ সম্বন্ধে প্রত্যহ চিন্তা করিবেন ৷ ৩ ॥

সভাসদ পৃথক পৃথক্‌ বিচার ও অভিপ্রায় শ্রবণ করিয়া বহুপক্ষ সঙ্গত এবং নিজের ও পরের হিতজনক কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইবেন ॥ ৪ ॥

পবিত্ৰাত্মা, বুদ্ধিমান, স্থিরবুদ্ধি, ধন সামগ্রী সংগ্রহে অতিশয় নিপুণ এবং সুপরীক্ষিত ব্যক্তিকে মন্ত্রী নিযুক্ত করিবেন ॥ ৫ ॥

যতজন লোকের দ্বারা (রাজ) কাৰ্য্য সম্পাদিত হইতে পারে, ততজন নিরলস বলবান্ এবং সুচতুর প্রধান পুরুষকে অধিকারী অর্থাৎ কর্মচারীরূপে নিযুক্ত করিবেন ॥ ৬ ॥

ইহাদের অধীনে শৌর্য-বীৰ্য্য-বলশালী, বলবান সদ্বংশজাত ও সচ্চরিত্র কর্মচারীদিগকে গুরুতর কাৰ্য্যে এবং ভীরু ও দুর্বলচিত্তদিগকে আভ্যন্তরীণ কার্যে নিযুক্ত করিবেন ॥ ৭ ॥

প্রশংসনীয় কুলোদ্ভব, চতুর, পবিত্রচিত্ত, আকার-ইঙ্গিত ও চেষ্টা দ্বারা অন্তরের ভাব ও ভবিষ্যৎ জ্ঞাতা, সর্বশাস্ত্রবিশার ব্যক্তিকে দূত পদে নিযুক্ত করিবেন ॥ ৮ ॥

যিনি রাজকার্য্যে অত্যন্ত উৎসাহী ও অনুরক্ত; যিনি অকপট, পবিত্ৰাত্মা ও সুচতুর; যিনি বহুকালের কথাও বিস্মৃত হন না; যিনি দেশ কালানুযায়ী আচরণ করেন এবং যিনি সুরূপ, নির্ভীক ও মহান্ বাগ্মী তিনি রাজদূত পদের উপযুক্ত ॥ ॥

কাহাকে কী কী অধিকার প্রদান করা উচিত? অমাত্যে দণ্ড আয়ত্তো দণ্ডে বৈনয়িকী ক্রিয়া। নৃপতৌ কোশরাষ্ট্রেদূতে সন্ধিবিপর্যয়ৌ ॥১॥ দূত এব হি সংধত্তে ভিনত্ত্যেব চ সংহতা। দূতস্তৎ কুরুতে কর্ম ভিদ্যন্তে য়েন বা ন বা ॥ ২॥ বুদ্ধ্বা চ সর্বং তত্ত্বেন পররজচিকিতম্। তথা প্ৰয়ত্নমাতিষ্ঠেয়থাত্মানংনপীডয়েৎ ॥ ৩ ॥ ধনুদুর্গং মহীদুর্গমজুর্গং বার্ফমেব বা। নৃদুগং গিরিদুর্গং বা সমাশ্ৰিত্য বসেৎ পুর ॥ ৪ ॥ একঃশতং যোধয়তি প্রাকারস্থাে ধনুর্ধরঃ। শতং দশসহস্রাণি তস্মাদ দুর্গংবিধীয়তে ॥ ৫ ॥ তৎস্যাদায়ুধসম্পন্নং ধনধান্যেন বাহনৈঃ ॥ ব্রাহ্মণৈঃ শিল্পিভিয়ন্ত্রৈয়বসেনোদকেন চ ॥ ৬ ॥ তস্য মধ্যে সুপয়াপ্তংকারয়ে গৃহমাত্মনঃ ॥ গুপ্তং সর্বত্ত্বকং শুভ্রং জলবৃক্ষসমন্বিত ॥ ৭ ॥ তদধ্যাস্যোদ্বহে ভায়াংসবর্ণাং লক্ষণান্বিতাম। কুলে মহতি সস্তৃতাংহৃদ্যাং রূপগুণান্বিতা৷ ৮ ॥ পুরোহিতং প্রকুত বৃণুয়াদেব চৰ্বিজম্। তেস্যি গৃহ্যাণি কর্মাণি কুয়ুর্বৈর্তানিকানি চ ॥ ৯ ॥ মনু।

অমাত্যকে দণ্ডাধিকার প্রদান করিবেন। দণ্ডের সহিত বিনয় ব্যবস্থা অর্থাৎ যাহাতে অন্যায়। রূপে দণ্ডদান না করা হয়, তাহার ব্যবস্থা থাকিবে। রাজকোষ এবং রাজকাৰ্য্য রাজার অধীন, সকল কাৰ্য্য সভার অধীন, এবং কাহারও সহিত মিত্রতা ও বিরোধ করিবার অধিকার দূতের অধীন থাকিবে ॥ ১৷

যিনি বিরোধের মধ্যে মিলন করেন এবং মিলিত দুর্বৃত্তদিগকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দেন, তাহাকেই দূত বলে। শত্ৰুদিগের মধ্যে বিরোধ উৎপাদন করাই দূতের কাৰ্য৷ ২ ॥

সভাপতি এবং সভাসদ্বর্গ বা দূতাদি বিরোধী রাজার রাজ্যের যথার্থ অভিপ্রায় জ্ঞাত হইয়া এইরূপ চেষ্টা করিবেন যাহাতে নিজেদের উপর কোন উপদ্রব উপস্থিত না হয় ॥৩॥

এই উদ্দেশ্যে সুন্দর বন এবং ধন-ধান্য পূর্ণ দেশে (ধনুর্গম) ধনুর্ধারী সৈন্যবেষ্টিত দুর্গ, (মহীদুর্গম) মৃত্তিকা নির্মিত দুর্গ, (অব্দুর্গম) জলবেষ্টিতদুর্গ, (বাক্ষর্ম) বনবেষ্টিত দুর্গ, (নৃদুর্গম) চতুর্দিকে সৈন্য পরিবেষ্টিত দুর্গ এবং (গিরিদুর্গম) অর্থাৎ চতুর্দিকে পর্বতবেষ্টিত দুর্গ নির্মাণ করিয়া তাহাদের মধ্যে নগর স্থাপন করিবেন ॥ ৪ ॥

নগরের চতুর্দিকে (প্রাকার) প্রাচীর নির্মাণ করিবেন। কারণ তাহার অভ্যন্তরে থাকিয়া একজন ধনুর্ধারী ও শস্ত্রধারী বীরপুরুষ একশত শত্রুর বিরুদ্ধে এবং একশত বীরপুরুষ দশসহস্র শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে সমর্থ হন। এইজন্য দুর্গনির্মাণ অবশ্য কর্তব্য ॥ ৫ ॥

সেই দুর্গ অস্ত্র-শস্ত্র, ধন-ধান্য, বাহন অধ্যাপক ও উপদেষ্টা ব্রাহ্মণ, (শিল্পী) কারুকর, যন্ত্র, নানাবিধ কলা, (যবসেন) পশু চারণের তৃণ ও জল প্রভৃতি দ্বারা পরিপূর্ণ থাকিবে ॥ ৬ ॥

উহার মধ্যে জল, সর্বপ্রকার বৃক্ষ ও পুষ্পদি বিশিষ্ট এবং ঋতুতে সুখজনক, শ্বেতবর্ণ, ভবন নিজের জন্য নির্মাণ করিবেন, যেন তাহার মধ্যে যাবতীয় রাজকার্য নির্বাহ হইতে পারে ॥ ৭ ॥

এইভাবে অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য দ্বারা বিদ্যাধ্যয়নের পর এই পর্যন্ত রাজকাৰ্য্য করিয়া রূপ- গুণ সম্পন্না হৃদয়বল্লভা, উচ্চকুলসম্ভবা, সুলক্ষণা, আত্মসদৃশ বিদ্যাগুণকর্মস্বভাব বিশিষ্টা ও ক্ষত্রিয় কুলজাতা একমাত্র স্ত্রীকেই বিবাহ করিবেন। অন্য স্ত্রীলোকদিগকে অগম্যা জানিয়া তাঁহাদের প্রতি দৃষ্টিপাতও করিবেন না ॥ ৮।

রাজপরিবারে অগ্নিহোত্র ও পক্ষেষ্টি প্রভৃতি যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য ঋত্বিক ও পুরোহিত গ্রহণ করিবেন এবং স্বয়ং সর্বদা রাজকার্য্যে তৎপর থাকিবেন। অর্থাৎ দিবারাত্র রাজকার্যে নিযুক্ত থাকা এবং কোন কাৰ্য্য বিকৃত হইতে না দেওয়াই রাজার পক্ষে সন্ধ্যোপাসনাদি কর্ম ॥ ৯ ॥

সাংবৎসরিকমাপ্তেশ্চ রাষ্ট্রাদাহরয়েদ বলি৷ স্যাচ্চায়পরো লোকে বৰ্ত্তেত পিতৃবন্বযু ॥ ॥ অধ্যক্ষান্ বিবিধা কুয়্যাৎ তত্রতত্র বিপশ্চিতঃ। তোস্য সর্বাণ্যবেক্ষের নৃণাং কার্য্যাণি কুবর্ত্য ॥ ২৷ আবৃত্তানাং গুরুকুলাবিপ্রাণাং পূজকো ভবেৎ। নৃপাণ্যময়য়া হ্যে নিধিব্রাহ্মো বিধীয়তে ৷৩ ॥ সমোত্তমাধমৈরাজা ত্বাহূতঃ পালয়ন্ প্রজাঃ ॥ ন নিৰ্বৰ্ত্তেত সংগ্রামাৎ ক্ষাত্রং ধর্মমনুস্মর ॥ ৪ ॥ আহবেযু মিথোন্যোন্যং জিঘাংসন্তো মহীক্ষিতঃ। যুধ্যমানাঃ পরংশক্ত্যা স্বর্গংয়ান্ত্যপরাঘুখাঃ ॥ ৫ ॥ ন চ হন্যাৎ স্থলারূটংন ক্লীবং ন কৃতাঞ্জলি। ন মুক্তকেশং নাসীনংন তবাশ্মীতি বাদিন ॥ ৬ ৷ ন সুপ্তংন বিসন্নাহংন নগ্নংন নিরায়ুধ। নায়ুধ্যমানং পশ্যন্তংন পরেণ সমাগত৷ ৭ ॥ নায়ুধব্যসনং প্রাপ্তংনাত্তংনাতিপরিক্ষত। ন ভীতং ন পরাবৃত্তং সতাং ধর্মমনুস্মরন৷ ৮ ॥ য়স্তু ভীতঃ পরাবৃত্তঃ সংগ্রামে হন্যতে পরৈঃ। ভদ্ভুয়দুষ্কৃতংকিঞ্চিৎ তৎসর্বং প্রতিপদ্যতে৷ ৯ ॥ য়চ্চাস্য সুকৃতং কিঞ্চিদমূত্রার্থমুপার্জিত। ভর্তা তৎসমাদত্তে পরাবৃত্তহতস্য তু৷ ১০ ॥ রথাশ্বং হস্তিনং ছত্রং ধনং ধান্যং পশূ স্ত্রিয়। সর্বদ্রব্যাণি কুপ্যং চ য়া য়জ্জয়তি তস্য তৎ॥১১ ॥ রাজ্ঞশ্চ দরুদ্ধারমিত্যে বৈদিকী শ্রুতিঃ। রাজ্ঞা চ সর্বয়োধেভ্যো দাঁতব্যমপৃথগ জিতম্ ॥১২ ॥ মনু।

আপ্ত পুরুষদের দ্বারা প্রজাদের নিকট হইতে বার্ষিক কর আদায় করিবেন এবং সভাপতি রূপ রাজা ও অন্যান্য রাজপুরুষ, এই সব সভা বেদবিধি অনুসারে প্রজাদের সহিত পিতার ন্যায় ব্যবহার করিবেন ॥১॥

সভা উক্ত রাজকার্য্যে ভিন্ন ভিন্ন বিদ্বান অধ্যক্ষকে নিযুক্ত করিবেন। তাহাদের কর্তব্য হইবে বিভিন্ন কার্যে নিযুক্ত রাজকর্মচারিগণ নিয়মানুসারে কাৰ্য্য করিতেছেন কিনা, তাহা পৰ্যবেক্ষণ করা। যাঁহারা সমুচিত কাৰ্য্য করেন, তাহাদিগকে পুরস্কৃত করিবেন এবং যাহারা বিরুদ্ধ কাৰ্য্য। করেন, তাহাদিগকে উপযুক্ত দণ্ড দিবেন৷ ২ ॥

যে কেহ বেদ প্রচার রূপ রাজার অক্ষয় ধন ভাণ্ডারের প্রচারের জন্য যথারীতি ব্রহ্মচর্য দ্বারা বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়নান্তে গুরুকুল হইতে প্রত্যাগত হইলে রাজা ও রাজসভা তাহার ও তাহার। আচার্য্যের যথোচিত সম্মান করিবেন ॥ ৩ ॥

এতদ্বারা বিদ্যোন্নতি হওয়াতে রাজ্যের অশেষ শ্রীবৃদ্ধি হইয়া থাকে। প্রজাপালক রাজাকে তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট অথবা ততুল্য কেহ কখনও সংগ্রামে আহ্বান করিলে তিনি ক্ষাত্র ধর্ম স্মরণ করিয়া যুদ্ধ যাত্রায় নিবৃত্ত হইবেন না। অর্থাৎ তিনি এইরূপ কৌশল সহকারে তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবেন, যেন নিশ্চিত রূপে নিজের বিজয় লাভ হয় ॥ ৪ ॥

যে রাজা সংগ্রামে পৃষ্ঠপ্রদর্শন না করিয়া শক্ৰহননেচ্ছায় নির্ভয়ে যথাশক্তি যুদ্ধ করেন তিনিই সুখ লাভ করেন। সুতরাং সংগ্রামে কখনও পরাঙ্খ হওয়া উচিত নহে তবে শত্রুকে জয় করিবার। জন্য কখনও কখনও তাহার আত্মগোপন করাও আবশ্যক। কারণ যেরূপে শত্রুকে জয় করা যায়, সেইরূপ কাৰ্য্যই করা উচিত। যেরূপ সিংহও ক্রোধবশতঃ সম্মুখে অগ্রসর হইয়া শীঘ্র শস্ত্রাগ্নিতে ভস্ম হইয়া যায়, সেইরূপ মূর্খতাবশতঃ বিনষ্ট হইবে না ॥ ৫ ॥

যাহারা যুদ্ধকালে ইতস্ততঃ দাঁড়াইয়া থাকে, যাহারা নপুসংক, কৃতাঞ্জলি, উন্মুক্তকেশ ও উপবিষ্ট; যাহারা বলে ‘আমি তোমার শরণাগত’৷ ৬ ॥

যাহারা নিদ্রিত, মুর্চ্ছিত, নগ্ন, অস্ত্র-শস্ত্রহীন, যুদ্ধদর্শক, শত্রুর সঙ্গী ॥ ৭ ॥

যাহারা অস্ত্র-শস্ত্রাঘাতে পীড়িত, দুঃখগ্রস্ত, অত্যন্ত আহত, ভীত এবং পলায়নপর, এতাদৃশ যোদ্ধৃগণ সৎপুরুষদের ধর্ম স্মরণ করিয়া তাহাদিগকে কখনও বধ করিবেন না।

কিন্ত তাহাদিগকে বন্দী করিয়া যে শিষ্ট, তাহাকে কারাগারে রাখিয়া দিবেন এবং যথোচিত খাদ্য এবং পরিধেয় প্রদান করিবেন। আহতদিগকে বিধিপূর্বক ঔষধাদি প্রদান করিবেন, তাহাদিগকে উত্যক্ত না করিয়া এবং কষ্ট না দিয়া তাহাদের দ্বারা উপযুক্ত কাৰ্য্য করাইয়া লইবেন। বিশেষরূপে লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে, স্ত্রীলোক, বালক, বৃদ্ধ, রোগাতুর এবং শোকার্ত্তজনের উপরে কখনও অস্ত্র প্রয়োগ করা উচিত নহে। কিন্তু তাহাদের পুত্র কন্যা সকলকে নিজ সন্তানবৎ পালন করা কৰ্ত্তব্য। নারীদিগকে নিজ ভগ্নী অথবা কন্যাবৎ মনে করিবেন ও পালন করিবেন। কখনও তাহাদের প্রতি বিষয়াসক্তির দৃষ্টিতে দেখিবেন না। রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত হইলে, যাহাদের নিকট হইতে পুনঃ পুনঃ যুদ্ধাশঙ্কা না থাকে তাহাদের সসম্ভ্রমে মুক্ত করিয়া স্বগৃহে অথবা দেশে প্রেরণ করিবেন। কিন্তু যাহাদের দ্বারা ভবিষ্যতে বিঘ্ন হইবার সম্ভাবনা, তাহাদের সর্বদা কারারুদ্ধ রাখিবেন ॥ ৮ ॥

যে ভৃত্য ভীত হইয়া পলায়ন করিবার পর শত্রু কর্তৃক নিহত হয়, সে তাহার প্রভুর সমস্ত অপরাধ প্রাপ্ত হইয়া দণ্ডনীয় হইবে ॥ ৯ ॥

যে খ্যাতি প্রতিপত্তি দ্বারা সে ইহলোকে এবং পরলোকে সুখী হইতে পারিত, তাহা তাহার প্রভু প্রাপ্ত হন। যে ব্যক্তি পলায়নের পর নিহত হয়, তাহার কিছুমাত্র সুখলাভ হয় না, প্রত্যুত তাহার সমস্ত পুণ্যফল নষ্ট হইয়া যায়। যিনি ধর্মানুসারে যথোচিত যুদ্ধ করেন, তিনি সম্মান প্রাপ্ত হন ॥ ১০ ॥

যুদ্ধে যে যে সৈনিক অথবা সেনাধ্যক্ষ রথ, অশ্ব, ছত্র, ধন, ধান্য, গবাদি পশু, নারী এবং অন্য সকল প্রকার দ্রব্য, ঘৃত, তৈলের কলস প্রভৃতি যাহা যাহা জয় করিবেন, তিনি তাহা প্রাপ্ত হইবেন, এইরূপ ব্যবস্থা কখনও ভঙ্গ করা উচিত নহে ॥ ১১।

কিন্তু সৈনিকগণ ঐ সকল বিজয় লব্ধ সামগ্রীর এক ষোড়শাংশ রাজাকে দিবেন ৷

রাজাও সকলের সম্মিলিত যুদ্ধে জয়লব্ধ যোড়শাংশ সৈন্যদের দিবেন। যুদ্ধে নিহত সৈনিকের অংশ তাহার স্ত্রী ও সন্তানদের দিবেন এবং তাহার স্ত্রী ও অসমর্থ বালকদের যথোচিত পালন করিবেন। যখন বালকগণ সমর্থ হইবে, তখন তাহাদের সকলকে যোগ্যতানুসারে অধিকার দিবেন। নিজ নিজ রাজ্যবৃদ্ধি, সম্মান, বিজয় এবং আনন্দবৃদ্ধির ইচ্ছা করেন, তিনি কখনও এই সকল নিয়ম উল্লঙ্ঘন করিবেন না ॥ ১২ ॥

অলব্ধং চৈব লিপ্সেত লব্ধং রক্ষেৎ প্রয়ত্নতঃ। রক্ষিতংবর্ধয়েচ্চৈব বৃদ্ধং পাত্ৰেযু নিঃক্ষিপেৎ ॥১॥ অলমিচ্ছেদ্দণ্ডেন লব্ধং রক্ষেদবেক্ষয়া। রক্ষিতং বর্ধয়ে বৃদ্ধা বৃদ্ধং দানেন নিঃক্ষিপেৎ ॥ ২ ॥ অমায়য়ৈব বৰ্ত্তেতন কথঞ্চন মায়য়া। বুধ্যেতারি প্রয়ুক্তাং চ মায়াং নিত্যং স্বসংবৃত : ॥ ৩॥ নাস্যং দ্বুিদং পরো বিদ্যাচ্ছিদ্রং বিদ্যাৎ পরস্য তু। গৃহেৎকূর্মইবাঙ্গানি রক্ষেদ্বিবরমাত্মনঃ ॥৪॥ বকবচ্চিন্তয়েদৰ্থান সিংহবচ্চ পরাক্রমে। বৃকবচ্চাবলুম্পেত শশবচ্চ বিনিষ্পতেৎ ॥ ৫ ॥ এবং বিজয়মানস্য য়েস্য স্যুঃ পরিপন্থিনঃ। তানায়েদ্বশং সর্বান্ মামাদিভিরুপক্রমৈঃ ॥ ৬ ॥ যখোদ্ধরতি নিদাতা কক্ষং ধান্যংচ রক্ষতি। তথা রক্ষেপো রাষ্ট্রং হন্যাচ্চ পরিপন্থিনঃ ॥৭॥ মোহদ্রাজা স্বরাষ্ট্রংয়ঃ কর্যয়ত্যবেক্ষয়া সোমচিরাদ ভ্ৰশ্যতে রাজ্যাজ্জীবিতাচ্চ সবান্ধবঃ ॥ ৮ ॥ শরীর কৰ্ষণাৎ প্রাণাঃ ক্ষীয়ন্তে প্রাণিনাংয়থা। তথা রাজ্ঞামপি প্রাণাঃ ক্ষীয়ন্তে রাষ্ট্রকর্ষণাৎ ॥ ৯ ॥ রাষ্ট্রস্য সংগ্রহেনিত্যংবিধানমিদমাচরেৎ। সুসংগৃহীতরাষ্ট্ৰোহি পার্থিবঃসুখমেধতে ॥ ১০ ॥ দ্বয়োস্ত্রয়াণাং পঞ্চানাংমধ্যে গুল্মমধিষ্ঠিত। তথা গ্রামশতানাং চকুয়্যাদ্ৰাষ্ট্ৰস্য সংগ্রহ ৷১১ ॥ গ্রামস্যাধিপতিং কুয়াদ্দশগ্রামপতিং তথা। বিংশতীশং শতেশং চ সহস্র পতিমেব চ ॥ ১২ ॥ গ্রামদোষান্ সমুৎপন্ন্যান্ গ্রামিকঃশনকৈঃ স্বয়ম্ ॥ শংসে গ্রামদশেশায় দশেশো বিংশতীশিনম্ ॥ ১৩ ॥ বিংশতীশস্তু তৎ সর্বংশতেশায় নিবেদয়েৎ। শংসে গ্রামশতেশস্তু সহস্রপতয়ে স্বয়ম্ ॥ ১৪ ॥ তেষাং গ্রাম্যাণিকায়াণি পৃথকায়াণি চৈব হি। রাজ্ঞো ন্যঃ সচিবঃ স্নিগ্ধস্তানি পশ্যেদতন্দ্রিতঃ ॥ ১৫ ॥ নগরে নগরে চৈকং কুয়াৎসর্বার্থচিন্তকম্ ॥ উচ্চৈঃস্থানং ঘোররূপংনক্ষত্রাণামিব গ্রহ৷ ১৬ ॥ স তাননুপরিক্রামেৎসৰ্বানে সদা স্বয়ম্ ॥ তেষাংবৃত্তং পরিণয়েৎসম্যাগ্রাষ্ট্রেযুচ্চরৈঃ ॥১৭ ॥

রাজ্ঞো হি রক্ষাধিকৃতাঃ পরস্বাদায়িনঃশঠাঃ। ভৃত্যা ভবন্তি প্ৰায়েণ তেভ্যো রক্ষেদিমাঃ প্রজাঃ ॥ ১৮ ॥ য়ে কায়িকেভ্যোর্থমেব গৃহ্নীয়ুঃ পাপচেতসঃ ॥ তেষাং সর্বস্বমাদায় রাজা কুয়াৎ প্রবাসন৷ ১৯ ॥ মনু রাজা এবং রাজসভা অলব্ধ ধন পাইবার ইচ্ছা করিবেন, লব্ধ ধন যত্ন সহকারে রক্ষা করিবেন, রক্ষিত ধনের বুদ্ধি করিবেন এবং বর্ধিত ধন বেদবিদ্যা, বিদ্যার্থী, বেদোপদেশক, অসমর্থ ও অনাথদিগের প্রতিপালনের জন্য ব্যয় করিবেন ॥ ১ ॥ এই চতুর্বিধ পুরুষকারের প্রয়োজন জানিয়া আলস্য পরিত্যাগ পূর্বক উত্তমরূপে ইহার অনুষ্ঠান করিবেন। দণ্ড দ্বারা অপ্রাপ্ত বস্তু পাইবার ইচ্ছা করিবেন, প্রাপ্ত ধন নিত্য দেখা শুনা করিয়া রক্ষা করিবেন এবং রক্ষিত ধনের বৃদ্ধি অর্থাৎ সুদ প্রভৃতি গ্রহণ করিয়া বৃদ্ধি করিবেন। বর্ধিত ধন পূর্বোক্ত রূপে সর্বদা ব্যয় করিবেন৷ ২ ॥

কাহারও সহিত কখনও কপট ব্যবহার করিবেন না, কিন্তু সকলের সহিত অকপট ব্যবহার করিবেন। প্রত্যহ আত্মরক্ষা করিয়া শত্রুর ছল জানিয়া উহার প্রতিরোধ করিবেন ॥ ৩ ॥ ৷

কোন শত্রু যেন নিজের ছিদ্র অর্থাৎ দুর্বলতা জানিতে না পারে, কিন্তু স্বয়ং শক্রর ছিদ্র অবগত থাকিবেন। কচ্ছপ যেরূপ নিজ অঙ্গকে গুপ্ত করে রাখে সেইরূপ শত্ৰুপ্রবেশের ছিদ্র গোপন রাখিবেন ॥ ৪ ॥

বক যেরূপ ধ্যানস্থিত হইয়া মৎস্য ধরিবার জন্য তাকাইয়া থাকে, সেইরূপ অর্থসংগ্রহের চিন্তা করিতে থাকিবেন এবং ধন-সম্পত্তি ও বল বৃদ্ধি করিয়া শত্রুকে জয় করিবার জন্য সিংহ সদৃশ পরাক্রম দেখাইবেন। ব্যাঘ্রের ন্যায় লুক্কায়িত থাকিয়া শত্রুকে ধরিয়া ফেলিবেন এবং সমীপাগত বলবান্ শক্রর নিকট হইতে শশকের ন্যায় দূরে পলায়ন করিয়া পরে তাহাকে ছলপূর্বক করায়ত্ত করিবেন ॥ ৫ ॥

ঈদৃশ বিজয়ী সভাপতির রাজ্যে যদি পরিপন্থী অর্থাৎ দস্যু ও লুণ্ঠনকারী থাকে, তাহাদিগকে সাম’= মিলাইয়া লইবেন; দান’=কিঞ্চিৎ দান দ্বারা এবং’ভেদ’= ছিন্নভিন্ন করিয়া বশীভূত করিবেন। এই সকল উপায়ে বশীভূত না হইলে, অত্যন্ত কঠোর দণ্ড দ্বারা বশীভূত করিবেন ॥ ৬ ॥

ধান-ভানুনী যেরূপ তুষ পৃথক করিয়া তণ্ডুল রক্ষা করে, অর্থাৎ তণ্ডুলকে চূর্ণ হইতে দেয় না। রাজাও সেইরূপ দস্যু তস্করদিগকে বিনাশ করিয়া রাজ্য রক্ষা করিবেন ॥ ৭ ॥

যে রাজা মোহ ও অবিচার বশতঃ স্বীয় রাজ্যকে দুর্বল করে, সে জীবদ্দশাতেই রাজ্য ও বন্ধুবান্ধবের সহিত শীঘ্র বিনাশ প্রাপ্ত হয়। ৮ ॥

শরীর ক্ষীণ হইলে যেরূপ প্রাণীদিগের প্রাণও ক্ষীণ হইয়া যায় সেইরূপ রাজা প্রজাবর্গকে দুর্বল করিলে, সে তাহার প্রাণ অর্থাৎ বল এবং বন্ধু-বান্ধব প্রভৃতির সহিত বিনাশ প্রাপ্ত হয় ॥ ৯ ॥

অতএব রাজা ও রাজসভা রাজকার্য্যে সম্পাদনের জন্য সচেষ্ট থাকিবেন, উহা যেন যথোচিত ভাবে সম্পাদিত হয়। যে রাজা রাজ্যপালনে তৎপর থাকেন, তাহার সর্বদা সুখবৃদ্ধি হইয়া থাকে ॥ ১০ ॥

এই উদ্দেশ্য দুই, তিন, পাঁচ ও শতগ্রামের মধ্যে এক একটি রাজকীয় কার্যালয় রাখিতে হইবে। তন্মধ্যে যোগ্যতা অনুসারে ভৃত্য অর্থাৎ কর্মচারী প্রভৃতি রাজপুরুষ নিযুক্ত করিয়া যাবতীয় রাজকার্যে সুচারুরূপে সম্পাদন করিতে হইবে ॥ ১১ ॥

এক এক গ্রামের উপর একজন প্রধান কর্মচারী থাকিবেন। তাদৃশ্য দশখানি গ্রামের উপর দ্বিতীয় কর্মচারী, বিংশ গ্রামের উপর তৃতীয়, একশত গ্রামের উপর চতুর্থ এবং এক সহস্র গ্রামের। উপর পঞ্চম কর্মচারী থাকিবেন। অর্থাৎ আজকাল যেরূপ এক গ্রামে একজন “পাটোয়ারী, তাদৃশ দশখানি গ্রামের উপর এক থানা, দুই থানার উপর এক বড় থানা, তাদৃশ পাঁচ বড় থানার এক “তহশীল” এবং দশ তহশীলদের উপর এক জিলা নির্ধারিত থাকে, সেইরূপ ব্যবস্থা থাকিবে। আমাদের মনু প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্র হইতে এবম্বিধ রাজনীতি গ্রহণ করা হইয়াছে ॥ ১২ ॥ ৷

এইরূপ ব্যবস্থা করিয়া আদেশ দিতে হইবে যে, পূর্বোক্ত এক এক গ্রাম্যাধ্যক্ষ গ্রামগুলির মধ্যে প্রত্যহ যে সকল দোষ ঘটিবে, ঐ সকল দোষ দশগ্রামের অধ্যক্ষকে গোপনে জানাইবেন। সেই দশ গ্রামের অধ্যক্ষ সেইরূপে দশগ্রামের বিষয় প্রত্যহ বিংশগ্রামের অধ্যক্ষকে জানাইবেন ॥ ১৩ ॥

সেইরূপে বিংশ গ্রামের অধ্যক্ষ বিংশ-গ্রামের বিষয়, প্রত্যহশতগ্রামের অধ্যক্ষকে জানাইবেন। সেইরূপ শতগ্রামের অধ্যক্ষ শতগ্রামের বিষয়, সহস্র গ্রামের অধ্যক্ষকে প্রত্যহ জানাইবেন। আবার প্রত্যেক বিংশ গ্রামের পাঁচ অধ্যক্ষ প্রতি সহস্র গ্রামের অধ্যক্ষকে এবং প্রত্যেক সহস্র গ্রামের দশ অধ্যক্ষ দশ সহস্র গ্রামের অধ্যক্ষকে এবং লক্ষ গ্রামের রাজসভাকে প্রতিদিনের অবস্থা জানাইবেন। আবার ঐ সকল রাজসভা মহারাজসভাকে অর্থাৎ সার্বভৌম চক্রবর্ত্তী মহারাজসভাকে সমস্ত পৃথিবীর অবস্থা জানাইবেন ॥ ১৪ ॥

সেইরূপ প্রত্যেক দশ সহস্র গ্রামের উপর দুইজন সভাপতি থাকিবেন। তাহাদের একজন রাজসভায় থাকিয়া এবং অপর অধ্যক্ষ নিরলসভাবে ভ্রমণ করিয়া, ন্যায়াধীশ প্রভৃতি রাজকর্মচারিদিগের কার্যাবলী সর্বদা পরিদর্শন করিবেন ॥ ১৫ ॥

প্রধান প্রধান নগর সমূহে বিচার সভার জন্য এক একটি সুন্দর, সমুন্নত এবং চন্দ্রমা সদৃশ বিশাল ভবন নির্মিত হইবে। সেই স্থানে যাঁহারা বিদ্যাবলে সকল বিষয়ের পারদর্শিতা লাভ করিয়াছেন, সেইরূপ মহান্ জ্ঞানীবৃদ্ধগণ বসিয়া বিচার করিবেন। যে সকল নিয়ম দ্বারা রাজা ও প্রজাবর্গের উন্নতি হয়, তাহারা সে সকল নিয়ম এবং বিদ্যা প্রকাশিত করিবেন ॥ ১৬ ॥

নিত্য ভ্রমণকারী সভাপতির অধীনে সমস্ত গুপ্তচর এবং দূত থাকিবেন, ইহারা রাজপুরুষ ও প্রজাবর্গের সঙ্গে নিত্য সম্পর্ক রাখিবেন এবং ভিন্ন ভিন্ন বর্ণেরও হইবেন। রাজা গুপ্ত ভাবে তাহাদের নিকট হইতে রাজকর্মচারী এবং প্রজাবর্গের সমস্ত দোষগুণ অবগত হইয়া অপরাধীদের দণ্ড দিবেন। এবং গুণবানকে সম্মানিত করিবেন ॥ ১৭ ॥

রাজা ধার্মিক সুপরীক্ষিত বিদ্বান্ এবং উচ্চ কুল সভৃত ব্যক্তিদিগের হস্তে প্রজা রক্ষার ভার ন্যস্ত করিবেন। শঠ, পরস্পাপহরী তস্কর এবং দস্যুদিগকেও কুকর্ম হইতে রক্ষা করিবার জন্য পূর্বোক্ত রক্ষাকারী বিদ্বান্ ব্যক্তিদের অধীনে রাজভৃত্য নিযুক্ত করিয়া তাহাদের দ্বারা প্রজাবর্গের যথোচিত। রক্ষার ব্যবস্থা করিবেন ॥ ১৮ ॥

যে রাজকর্মচারী অন্যায়রূপে বাদী ও প্রতিবাদীর নিকট হইতে গোপনে ধন লইয়া পক্ষপাতপূর্বক। অন্যায় করে, তাহাকে যথোচিত দণ্ডদান করা কর্তব্য। তাহার সর্বস্ব হরণ করিয়া তাহাকে এমন। স্থানে রাখিবেন, যেন সে স্থান হইতে তাহার প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব না হয়। তাহাকে দণ্ডদান করা না হইলে, তাহার অনুসরণ করিয়া অন্য রাজকর্মচারিগণও তাহার ন্যায় কুকর্ম করিতে পারে। কিন্তু। তাহাকে দণ্ড দেওয়া হইলে অন্য সকলে রক্ষা পাইবে।

যে পরিমাণ ধন দ্বারা রাজকর্মচারীদের উত্তমরূপে যোগক্ষেম হইতে পারে এবং তাহারা ধনাঢ্য হইতে পারেন, সেই পরিমাণ ধন অথবা (তৎপরিবর্তে) ভূমি, রাজ্যের পক্ষ হইতে মাসিক বা বার্ষিক হিসাবে অথবা এককালে তাহাদিগকে প্রদান করিবেন। বৃদ্ধ কর্মচারিগণও অর্ধেক পাইবেন, কিন্তু স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, কেবলমাত্র তাঁহাদের জীবদ্দশাতেই তাহাদের উক্ত ব্যবস্থা স্থির থাকিবে, মৃত্যুর পর নহে। রাজা তাহাদের সন্তানদিগকে যোগ্যতানুসারে সম্মান অথবা চাকুরী অবশ্য দিবেন। যাঁহার সন্তান যতদিন সমর্থবান না হয় এবং স্ত্রী যতদিন জীবিত থাকেন, ততদিন তাহাদের নির্বাহার্থে উচিত পরিমাণ ধন দিতে হইবে। কিন্তু তাহাদের স্ত্রী ও পুরুষগণ কু-কর্মরত হইলে কিছুই পাইবে না। রাজা এই নীতি চিরকাল পালন করিবেন ॥ ১৯।

যথা ফলেন য়ুজ্যেত রাজা কৰ্ত্তা চ কৰ্মণাম। তথা বেক্ষ্য নৃপো রাষ্ট্রেকল্পয়েৎ সততং করা ॥ ॥ যথাSল্পা Sল্পমদন্ত্যাদ্যংবায়োকোবৎসল্পদাঃ। তথাল্পাল্পো গ্রহীতব্যো রাষ্ট্রাদ্ৰাজ্ঞাব্দিকঃ করঃ ॥ ২ ॥ নোচ্ছিন্দ্যাদাত্মনো মূলং পরেষাং চাতিতৃষ্ণয়া। উচ্ছিদ হ্যাঁত্মনো মূলমাত্মানংতাশ্চ পীডয়েৎ ॥ ৩ ॥ তীক্ষ্ণশ্চৈব মৃদুশ্চ স্যাৎ কায়ং বীক্ষ্য মহীপতিঃ। তীক্ষ্ণশ্চৈব মৃদুশ্চৈব রাজা ভবতি সম্মতঃ ॥ ৪ ॥ এবং সর্বংবিধায়েদমিতিকৰ্ত্তব্যমাত্মনঃ ॥ যুক্তশ্চৈবপ্রমত্তশ্চ পরিরক্ষেদিমাঃ প্রজাঃ ॥ ৫ ॥ বিক্রোশন্ত্যো য়স্য রাষ্ট্রাড্রিয়ন্তে দস্যুভিঃ প্রজাঃ। সম্পশ্যতঃ সভৃত্যস্য মৃতঃ স ন তু জীবতি৷ ৬ ॥ ক্ষত্রিয়স্য পরোধর্মঃ প্রজানামেব পালন। নির্দিষ্টফলভোক্তা হি রাজা ধর্মেণ য়ুজ্যতে ॥ ৭ ॥ মনু ০।

রাজা কর্মাধ্যক্ষ, বা প্রজাগণ যাহাতে সুখরূপ ফল লাভ করিতে পারেন, সেইরূপ বিচার পূর্বক রাজা ও রাজসভা রাজ্যের কর নির্ধারণ করিবেন ৷১ ॥

জলৌকা, গোবৎস এবং ভ্রমর যেরূপ অল্প অল্প করিয়া খাদ্য গ্রহণ করে, সেইরূপ রাজাও প্রজাবর্গের নিকট হইতে অল্প অল্প বার্ষিক কর গ্রহণ করিবে॥২॥

অতি লোভ বশতঃ কখনও নিজের বা অপরের সুখের মূলোচ্ছেদ অর্থাৎ নাশ করিবেন না। কারণ, যিনি সদাচরণ ও সুখের মূলোচ্ছেদ করেন, তিনি নিজেকে এবং অপর সকলকে কেবল দুঃখই দিয়া থাকেন ॥ ৩ ॥

যে মহীপতি কাৰ্য্য দেখিয়া কঠোর এবং কোমল হন, তিনি দুষ্টদিগের প্রতি কঠোর এবং শিষ্টদিগের প্রতি কোমল ব্যবহার দ্বারা অত্যন্ত সম্মানিত হইয়া থাকেন ॥ ৪ ॥

এইরূপে রাজ্যের সমস্ত ব্যবস্থা করিয়া রাজা অপ্রমও ভাবে নিরন্তর প্রজা পালনে নিযুক্ত থাকিবেন ॥ ৫ ॥

যখন রাজ্যে দস্যুগণ রোরুদ্যমান্ প্রজাবর্গের ধনসম্পত্তি ও প্রাণ হরণ করিতে থাকে, তখন যে রাজা ভৃত্য এবং অমাত্যগণের সহিত তাহা দেখেন, তাঁহাকে জীবিত মনে না করিয়া ভৃত্য ও

অমাত্য সহিত মৃত মনে করিবে। এবং সেই রাজা মহা দুঃখভাগী হয়। ॥৬ ॥

অতএব প্রজা পালন করাই রাজার পরম ধর্ম। মনুস্মৃতির সপ্তম অধ্যায়ে যেরূপ কর গ্রহণের কথা আছে এবং সভা যেরূপ কর নির্ধারিত করে, সেইরূপ করভোগী রাজা ধর্মপরায়ণ। হইয়া সুখী হন। তাহার বিপরীত আচরণ করিলে দুঃখ ভোগ করিতে হয়॥৭॥

উত্থায় পশ্চিমে য়ামে কৃতশৌচঃ সমাহিতঃ। হুতাগ্নিব্রাহ্মণাশ্চার্ল্ড প্রবিশেৎস শুভাং সভাম্ ॥১॥ তত্র স্থিতঃ প্রজাঃ সর্বাঃ প্রতিনন্দ্য বিসর্জয়েৎ। বিসৃজ্য চ প্রজাঃ সর্বা মন্ত্রয়েৎ সহ মন্ত্রিভিঃ ॥২॥ গিরিপৃষ্ঠং সমারুহ্য প্রাসাদং বারহোগতঃ ॥ আরণ্যে নিঃশলাকে বা মন্ত্ৰয়েদবিভাবিতঃ ॥ ৩ ॥ যস্য মন্ত্রংন জানন্তি সমাগম্য পৃথনাঃ ॥ সকৃৎস্নাং পৃথিবীং ভূঙক্তে কোশহীননা পিপার্থিবঃ ॥৪ ॥ মনু।

রাজা রাত্রির শেষ প্রহরে গাত্রোত্থান পূর্বক শৌচান্তে নিবিষ্ট চিত্তে পরমেশ্বরের ধ্যান এবং অগ্নিহোত্র করিবেন। তাহার পর ধার্মিক ও বিদ্বানদিগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিয়া ভোজনান্তে সভায় প্রবেশ করিবেন ॥ ১ ॥

তিনি সভায় উপস্থিত দণ্ডায়মান্ প্রজাবর্গকে সসম্ভ্রমে বিদায় দিয়া প্রধান মন্ত্রীর সহিত রাজ্যব্যবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা করিবেন ॥ ২ ॥

পরে তাহার সহিত ভ্রমণ করিতে যাইবেন। পর্বত শিখরে অথবা কোন নির্জন গৃহে, অথবা শলাকাশূন্য নির্জন অরণ্যে বসিয়া বিরুদ্ধ ভাবনা পরিত্যাগ পূর্বক মন্ত্রীর সহিত পরামর্শ করিবেন ॥ ৩ ॥

অপর লোকেরা মিলিত হইয়া যে রাজার গূঢ় মন্ত্রণ জানিতে পারে না অর্থাৎ যাঁহার মন্ত্রণা গভীর, শুদ্ধ এবং পরোপকারার্থ সর্বদা গুপ্ত থাকে, সেই রাজা ধনহীন হইলেও সমস্ত পৃথিবীতে রাজ্য বিস্তারে সমর্থ হন। অতএব সভাসদবর্গের অনুমোদন ব্যতীত রাজা স্বেচ্ছানুসারে কোন কার্য করিবেন না ॥ ৪ ॥

আসনং চৈব য়ানং চ সন্ধিং বিগ্রহেমব চ। কায়ং বীক্ষ্য প্রয়ুঞ্জীত দ্বৈধং সংশ্রয়মেব চ ॥ ১ ॥ সন্ধিং তু দ্বিবিধং বিদ্যাদ্ৰাজা বিগ্রহমেব চ। উভেয়ানাসনে চৈব দ্বিবিধঃ সংশ্রয়ঃ স্মৃতঃ ॥ ২॥ সমানয়ানকর্মা চবিপরীতস্তথৈব চ। তথা ত্বায়তিসংযুক্তঃসন্ধিজ্ঞেয়য়া দ্বিলক্ষণঃ ॥৩ ॥ স্বয়ংকৃতশ্চ কায়ার্থমকালে কাল এব বা ॥ মিত্রস্য চৈবাপকৃতে দ্বিবিধো বিগ্রহঃ মৃতঃ ॥ ৪ ॥ একাকিনশ্চাত্যয়িকে কায়ে প্রাপ্তেদৃচ্ছয়া। সংহতস্য চ মিত্রেণ দ্বিবিধং য়ানমুচ্যতে ॥ ৫ ॥ ক্ষীণস্য চৈব ক্রমশো দৈবাৎ পূর্বকৃতেন বা। মিত্রস্য চানুরোধেন দ্বিবিধং স্মৃতমাসনম্ ॥ ৬ ॥ বলস্য স্বামিনশ্চৈব স্থিতিঃ কায়ার্থসিদ্ধয়ে। দ্বিবিধংকীর্ততে দ্বৈধং ষাড়গুণ্যগুণবেদিভিঃ ॥ ৭ ॥ অর্থসম্পাদনার্থং চ পীড়্যমানঃসশভিঃ ॥ সাধু ব্যপদেশার্থং দ্বিবিধঃ সংশ্রয়ঃ স্মৃতঃ ॥ ৮ ॥ য়দাবগচ্ছেদায়ত্যামাধিক্যং ধ্রুবমাত্মনঃ। তদাত্বে চাল্পিকাং পীডাং তদা সন্ধিং সমাশ্রয়েৎ ॥ ৯ ॥ য়দা প্রহৃষ্টা মন্যেত সর্বাস্তু প্রকৃতীৰ্ভশম্ ॥ অত্যুদ্ভুিতং তথাত্মানংতদা কুবতি বিগ্রহ৷ ১০ ॥ য়দা মন্যেত ভাবেন হৃষ্টং পুষ্টং বলং স্বক। পরস্য বিপরীতং চ তদা য়ায়াদ্রিপুং প্রতি৷১১ ॥ য়দা তু স্যাৎ পরিক্ষীণা বাহনেন বলেন চ ॥ তদাসীত প্রয়ত্নেনশনকৈঃ সায়ন্নরী ॥ ১২ ॥ মন্যেতারিং য়দা রাজা সর্বথা বলবত্তর। তদা দ্বিধা বলংকৃত্বা সাধয়েৎকায়মাত্মনঃ। ১৩ ॥ য়দা পরবলানাং তু গমনীয়তমো ভবেৎ। তদা তু সংশ্রয়েৎ ক্ষিপ্রং ধার্মিকং বলিনং নৃপম্ ॥ ১৪ ॥ নিগ্রহং প্রকৃতীনাং চ কুয়াদ্যোটরিবলস্য চ। উপসেবে তং নিত্যং সর্বয়ত্নৈগুরুং যথা ॥ ১৫ ॥ যদি তত্রাপি সংপশ্যে দোষং সংশ্রয়কারিত। সুয়ুদ্ধমেব তত্রাপি নির্বিশঙ্কঃ সমাচরেৎ ॥ ১৬ ॥ মনু।

 রাজা এবং রাজকর্মচারীদের সর্বদা এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক যে, আসন=স্থিরতা, যান = শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা, সন্ধি = শত্রুর সহিত মিত্রতা স্থাপন, বিগ্রহ = দুষ্টশত্রুর সহিত যুদ্ধকরা, দ্বৈধ=সেনা দুইভাগে বিভক্ত করিয়া স্ববিজয় সাধন করা এবং সংশ্রয় = দুর্বল অবস্থায় অন্য কোন শক্তিশালী রাজার আশ্রয় গ্রহণ করা–এই ছয় প্রকার কর্ম যথোচিত বিচার পূর্বক করা কর্তব্য ॥১॥

সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, দ্বৈধীভাব এবং সংশয়–রাজা এইগুলির দুই প্রকারের প্রত্যেকটি সম্যকরূপে অবগত হইবেন ॥ ২ ॥

সন্ধি’= শত্রুর সহিত সন্ধি অথবা বিপরীত আচরণ করিবেন, কিন্তু নিরন্তর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্তব্য করিতে থাকিবেন। এই দুই প্রকারের সন্ধি হইয়া থাকে ॥ ৩ ॥

‘বিগ্রহ’ = কাৰ্যসিদ্ধির জন্য যথা সময়ে বা অসময়ে স্বয়ংকৃত অথবা মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে অপরাধী শত্রুর সহিত কৃত বিরোধ–এই দুই প্রকার বিরোধ’ করা উচিত ॥ ৪ ॥

‘যান’ = অকস্মাৎ কোন কাৰ্য্য উপস্থিত হইলে, একাকী অথবা মিত্রপক্ষের সহিত মিলিত হইয়া শত্রুর বিরুদ্ধে যাত্রা করা,–ইহাকে দুই প্রকারের গমন বলে ॥

‘আসন’ = স্বয়ং কোন কারণ বশতঃ ক্ষীণ অর্থাৎ হীনবল হইলে অথবা কোন মিত্রপক্ষের অনুরোধে স্বস্থানে বসিয়া থাকা–এই দুই প্রকারের ‘আসন’ ॥ ৷ ৬ ॥

‘দ্বৈধ’ = কোন কার্যসিদ্ধির জন্য সেনাপতি ও সৈন্যদের দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া বিজয়লাভ করা,–এই দুই প্রকারের ‘দ্বৈধ’॥ ৭ ॥

‘সংশ্রয়’ = কোন কার্যসিদ্ধির জন্য কোন শক্তিশালী অথবা কোন মহাত্মার ‘আশ্রয় গ্রহণ করা যাহাতে শত্রু কর্তৃক উৎপীড়িত হইতে না হয়, এই দুই প্রকারের ‘আশ্রয়’ (সংশ্রয়)৷৮ ॥

যখন জানা যাইবে যে, অমুক সময়ে যুদ্ধ হইলে কিছু কষ্টে পড়িবে, কিন্তু তাহার পরে যুদ্ধ করিলে আপন বুদ্ধি ও বিজয় লাভ অবশ্য হইবে, তখন শক্রর সহিত সন্ধি করিয়া উচিত সময় পর্যন্ত ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিবেন ॥ ৯ ॥

যখন নিজের সমস্ত প্রজা অথবা সেনা অত্যন্ত প্রসন্ন, উন্নতিশীল এবং উৎকৃষ্ট বলিয়া মনে হইবে এবং নিজেকেও সেইরূপ মনে করিবেন, তখনই শত্রুর সহিত ‘বিগ্রহ’ = যুদ্ধ করিবেন ॥ ১০ ॥

যখন নিজের বল অর্থাৎ সেনাকে হৃষ্ট, পুষ্ট, ও প্রসন্ন দেখিবেন এবং শত্রুর বল তদ্বিপরীত ক্ষীণ বলিয়া জানিবেন, তখনই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিবেন ॥ ১১ ॥

সেনা বল-বাহনে ক্ষীণ হইয়া গেলে রাজা শত্ৰুদিগকে ধীরে ধীরে যত্নের সহিত শান্ত করিয়া । স্বস্থানে অবস্থান করিবেন ॥ ১২ ॥

যে সময়ে রাজা শত্রুকে অত্যন্ত বলবান্ মনে করিবেন, তখন দ্বিগুণ অথবা দুই প্রকারের সেনা গঠন করিয়া স্বকাৰ্য্য সাধন করিবেন ॥ ১৩ ॥

যখন রাজা স্বয়ং বুঝিতে পারিবেন, শত্রু শীঘ্রই আক্রমণ করিবে, তখনই অবিলম্বে কোন ধার্মিক এবং শক্তিশালী রাজার আশ্রয় গ্রহণ করিবেন ॥ ১৪ ॥

যে সকল প্রজা এবং নিজ সেনা শত্ৰুশক্তিকে নিগ্রহ অর্থাৎ প্রতিরোধ করে, সর্ব প্রকার যত্নের। সহিত গুরুর ন্যায় সর্বদা তাহাদের সেবা করিবেন ॥ ১৫ ॥

যাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করিবেন, সেই পুরুষের কর্মে দোষ দেখিলেও নিঃশঙ্কচিত্তে ভাল ভাবে যুদ্ধে লিপ্ত থাকিবে ৷ ১৬ ॥

কোন ধার্মিক রাজার সহিত কখনও বিরোধ করিবেন না, কিন্তু তাহার সহিত সর্বদা মিত্রতা রক্ষা করিবেন। কিন্তু দুর্বৃত্ত এবং শক্তিশালী রাজাকে জয় করিবার জন্য পূর্বোক্ত সকল উপায় অবলম্বন করা উচিত।

সর্বোপায়ৈস্তথা কুয়ান্নীতিজ্ঞ পৃথিবীপতিঃ। যথাস্যাভ্যধিকান সুর্মিত্রোদাসীনশত্রবঃ ॥১॥ আয়তিং সর্বকায়াণাং তদাত্বংচ বিচারয়েৎ ॥ অতীতানাং চ সর্বেষাং গুণদোষৗ চ তত্ত্বতঃ ॥২॥ আয়ত্যাং গুণদোষাত্বে ক্ষিপ্রনিশ্চয়ঃ। অতীতে কায়শেষজ্ঞঃশক্রভির্নাভিভূয়তে ॥ ৩ ॥ য়থৈনং নাভিসংদধ্যুর্মিত্রোদাসীনশত্ৰবঃ ॥ তথা সর্বং সংবিধ্যাদেষ সামসিকো নয়ঃ ॥ ৪ ॥ মনু০৭ ॥

যাহাতে মিত্র উদাসীন (মধ্যস্থ) এবংশত্রু অধিকসংখ্যকনা হয়, তজ্জন্য নীতিজ্ঞ এবং পৃথিবীপতি রাজা সর্বপ্রকার উপায় অবলম্বন করিবেন ॥ ১৷

সকল কাৰ্য্য সম্বন্ধে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্তব্য এবং কৃতকর্মের দোষগুণ সম্যক্রপে বিচার করিবেন ॥ ২ ॥

তদনন্তর দোষ দূরীকরাণার্থ এবং গুণ সংরক্ষণার্থ যত্ন করিবেন। যে রাজা ভবিষ্যৎ অর্থাৎ পরে করণীয় কর্ম সমূহের দোষ-গুণ অবগত হইয়া বর্তমান কর্তব্য অবিলম্বে নির্ধারণ করেন এবং কৃতকর্ম সম্বন্ধীয় অবশিষ্ট কর্তব্য জ্ঞাত থাকেন, তিনি কখনও শত্রু কর্তৃক পরাজিত হন না ॥ ৩ ॥

রাজকর্মচারিগণ বিশেষতঃ সভাপতি রাজা এরূপ সর্বপ্রকার চেষ্টা করিবেন, যেন রাজন্যবর্গের মিত্র উদাসীন এবং শত্রু প্রভৃতিকে বশীভূত করিয়া কেহ বিরুদ্ধাচরণ করাইতে না পারে। এইরূপ ভ্রমে কখনও পতিত হইবেন না। ইহাকেই সংক্ষেপে ‘বিনয়’ অর্থাৎ রাজনীতি বলে ॥ ৪ ॥

কৃত্বা বিধানংমূলে তুমাত্রিকংচয়থাবিধি। উপগৃহ্যাস্পদং চৈব চারা সমন্বিধায় চ ॥১॥ সংশোধ্য ত্রিবিধংমার্গং ষডবিধংচ বলং স্বক। সাংপরায়িককল্পেনয়ায়াদরিপুরংশনৈঃ ॥২॥ শক্রসেবিনি মিত্রে চ গূঢ়ে য়ুক্ততরো ভবেৎ। গতপ্রত্যাগতে চৈব সহি কষ্টতরো রিপুঃ ॥ ৩ ॥ দণ্ডব্যুহেন তন্মার্গংয়ায়াতুশকটেন বা বরাহমকরাভ্যাং বা সূচ্যা বা গরুডেন বা ৷ ৪ ॥ য়তশ্চ ভয়মাশঙ্কেত্ততে বিস্তারয়েবল। পদ্মেন চৈব নূহেন নিবিশেত সদা স্বয়ম্ ॥ ৫ ॥ সেনাপতিবলাধ্যক্ষৌ সর্বদিক্ষুনিবেশয়েৎ। য়তশ্চ ভয়মাশঙ্কে প্রাচীং তাং কল্পয়েদ্দিশ ॥ ৬ ॥ গুল্মশ্চ স্থাপয়েদাপ্তা কৃতসংজ্ঞাসমন্ততঃ। স্থানে যুদ্ধে চকুশলানভীরূনবিকারিণঃ ॥৭॥ সংহতা রোধয়েদল্পাকামং বিস্তারয়েবহু। সুচা বজ্রেণ চৈবৈতা ব্যুহেন ব্যুহ্য থোধয়েৎ ॥ ৮ ॥ স্যন্দনাশ্বৈঃ সমেয়ুধ্যেদপে নৌদ্বিপৈস্তথা। বৃক্ষগুল্মবৃতে চাপৈরসিচৰ্মায়ুধৈঃ স্থলে ॥ ৯ ॥ প্রহর্ষয়েলং ব্যহ্য তাশ্চ সম্যক পরীক্ষয়েৎ। চেষ্টাশ্চৈব বিজানীয়াদরীন য়োথয়তামপি ॥ ১০ ॥ উপরুধ্যারিমাসীত রাষ্ট্রং চাস্যোপপীডয়েৎ। দূষয়েচ্চাস্য সততংয়বসান্নোদকেন্ধন ॥ ১১ ॥ ভিন্দ্যাচ্চৈব তোগানি প্রাকারপরিখাস্তথা সমবস্কন্দয়েচ্চৈনং রাত্রেী বিত্ৰাসয়েত্তথা ॥১২ ॥ প্রমাণানি চ কুর্বীত তেষাং ধর্মান্যথোদিতা। রত্নেশ্চ পূজয়েদেনং প্রধানপুরুষেঃ সহ ॥ ১৩ ॥ আদানমপ্রিয়করং দানঞ্চ প্রিয়কারক। অভীপ্সিতানামর্থানাং কালে যুক্তং প্রশস্যতে ॥১৪ ॥ মনু০৭।

শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা কালে, রাজা নিজ রাজ্য রক্ষার ব্যবস্থা সর্বত্র দূত অর্থাৎ চতুর্দিকে। সমাচার দাতা পুরুষদিগকে গুপ্তভাবে স্থাপন পূর্বক যাত্রার উপযোগী যথাবিধি যাবতীয় সামগ্রী–সেনা, যান, বাহন এবং অস্ত্র শস্ত্রাদি সহকারে যাত্রা করবেন ৷১ ॥

ত্রিবিধ মার্গ, অর্থাৎ প্রথম ‘স্থল’ = ভূমিতে, দ্বিতীয় ‘জল’ = সমুদ্র বা নদীতে এবং তৃতীয় ‘আকাশ’ মার্গ শুদ্ধ করিয়া, ভূমি মার্গে রথ, অশ্ব, হস্তী, জলে নৌকা এবং আকাশে বিমান প্রভৃতি যানে গমন করিবেন। পদাতি, রথ, অশ্ব, হস্তী; অস্ত্র-শস্ত্র, ভোজ্য পানীয় প্রভৃতি যথোচিতভাবে সঙ্গে লইয়া পূর্ণ বল সহকারে কোন কারণ ঘোষণা পূর্বক ধীরে ধীরে শত্রুর নগরের সমীপে গমন করিবেন ॥ ২ ॥

যে ব্যক্তি (ভিতরে) শত্রুর সহিত মিলিত থাকে, কিন্তু বাহিরে রাজার সহিতও মিত্রতা দেখায়, অর্থাৎ গুপ্ত কথা গোপনে শত্রুর নিকট প্রকাশ করে তাহার গমনাগমন এবং তাহার সহিত কথোপকথন সম্বন্ধে অত্যন্ত সাবধান থাকিবেন। কেননা যে ব্যক্তি ভিতরে শত্রু, কিন্তু বাহিরে মিত্র, তাহাকে ভয়ঙ্কর শত্রু মনে করা উচিত ॥ ৩॥

রাজা সমস্ত রাজকর্মচারী ও জনসাধারণকে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দিবেন, নিজেও শিক্ষা করিবেন। পূর্ব শিক্ষা প্রাপ্ত যোদ্ধৃগণই উত্তমরূপে যুদ্ধ করিতে ও করাইতে সমর্থ। শিক্ষাকালে ‘দণ্ডব্যুহ’ = দণ্ডের ন্যায় সৈন্য পরিচালন, ‘শকট’ = যেরূপ শকট অর্থাৎ গাড়ীর ন্যায় ব্যুহ রচনা, ‘বরাহ’= যেরূপ শূকর। একে অন্যের পশ্চাতে দৌড়াইতে থাকে এবং কখনও কখনও সকলে দলবদ্ধ হয়, ‘মকর’ = কুম্ভীর যেমন জলে বিচরণ করে সেইরূপ সৈন্য সাজাইবে। ‘সূচীনূহ’ = যেমন সূচীর অগ্রভাগ । সূক্ষ্ম, পশ্চাৎভাগ স্থূল এবং সূত্র তদপেক্ষা স্থূল হয় সেইরূপ রীতি অনুসারে সৈন্য সাজাইবে এবং যেরূপ নীলকণ্ঠ (গরুড়) উপরে এবং নিম্নে লক্ষ্যবস্তুর উপর ছোঁ মারে সেইরূপ সৈন্যগণকে সাজাইয়া যুদ্ধ পরিচালনা করিবেন ॥৪ ॥

যে দিকে ভয়ের কারণ জানা যাইবে সেদিকে সৈন্য বিস্তার করিবেন এবং চতুর্দিকে সেনাপতিদের স্থাপিত করিয়া ‘পদ্মব্যুহ’ রচনা করিবেন, অর্থাৎ সৈন্যদের সকলকে চারিদিকে পদ্মাকারে স্থাপন করিয়া স্বয়ং মধ্যস্থলে অবস্থান করিবেন ॥ ৫ ॥

সব সেনাপতি এবং বলাধ্যক্ষকে অর্থাৎ আদেশদাতা ও সৈন্যচালক বীরকে আট দিকে রাখিবেন, কিন্তু অন্যদিকেও সুব্যবস্থা রাখিবেন, নতুবা পশ্চাৎ এবং পার্শ্বভাগ হইতে শত্রুর আক্রমণের সম্ভাবনা থাকে ॥ ৬ ॥

যাঁহারা গুল্ম অর্থাৎ দৃঢ় স্তম্ভ সদৃশ যুদ্ধ বিদ্যায় সুশিক্ষিত, ধার্মিক, স্থিতি ও যুদ্ধ বিষয়ে নিপুণ, নির্ভীক ও নির্বিকার চিত্ত, তাহাদিগকে সেনার চতুর্দিকে রাখিবেন ॥ ৭ ॥

অল্প সংখ্যক সৈন্য লইয়া বহু সংখ্যক সৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিতে হইলে সৈন্যদিগকে মিলিত করিয়া যুদ্ধ করাইবেন। আবশ্যক হইলে তাহাদের সকলকে সহসা নানাদিকে বিভক্ত করিয়া দিবেন। নগর, দুর্গ বা শত্রুসেনার অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হইয়া যুদ্ধ করিতে হইলে সূচীৰূহ অথবা বজ্রব্যুহ রচনা করিয়া অর্থাৎ দুই দিকে ধার বিশিষ্ট খড়গ যেমন দুইদিক কাটিয়া চলে সেইরূপ যুদ্ধ করিতে। করিতে প্রবেশ করিতে থাকিবেন। এইরূপ নানাবিধ ব্যুহ অর্থাৎ সৈন্য রচনা করিয়া যুদ্ধ পরিচালনা। করিবেন।

সম্মুখে শতঘ্নী = কামান বা ভূশুণ্ডী = বন্দুক চলিতে থাকিলে সপব্যুহ = অর্থাৎ সর্পের ন্যায় শায়িত হইয়া অগ্রসর হইতে থাকিবেন। যখন কামানের নিকটে গিয়া উপস্থিত হইবেন,তখন। শত্রুকে বধ অথবা ধৃত করিয়া কামানের মুখ শত্রুর দিকে ঘুরাইয়া সেই কামান অথবা বন্দুক প্রভৃতি দ্বারা শত্রুকে বধ করিবেন, অথবা উচ্চপদস্থ সৈনিক পুরুষগণকে কামানের মুখের সম্মুখে । অশ্ব পৃষ্ঠে ধাবিত করাইয়া শত্রু বিনাশ করিবেন। মধ্যস্থলে সুনিপুণ অশ্বারোহী সৈন্য থাকিবে। তাহারা এক একবার আক্রমণ করিয়া শত্রু সৈন্যদিগকে ছিন্নভিন্ন করিয়া বন্দী অথবা বিতাড়িত করিবেন ॥ ৮ ॥

সমতলভূমিতে যুদ্ধ করিতে হইলে রথ, অশ্ব এবং পদাতিক লইয়া, সমুদ্রে যুদ্ধ করিতে হইলে নৌকা দ্বারা, অল্প অল্প জলে যুদ্ধ করিতে হইলে হস্তী দ্বারা, বৃক্ষোপরি ও ঝোঁপের মধ্যে যুদ্ধ করিতে হইলে ধনুর্বাণ দ্বারা এবং বালুকাময় স্থানে যুদ্ধ করিতে হইলে ঢাল ও তরবারির দ্বারা যুদ্ধ করিবেন ও করাইবেন ॥ ৯।

যুদ্ধকালে যোদ্ধৃগণকে উৎসাহিত ও আনন্দিত করিবেন। যুদ্ধ স্থগিত হইলে শৌর্য্য ও উৎসাহবৰ্ধক বক্তৃতা, ভোজ্য,পানীয়, অস্ত্রশস্ত্রের সহায়তা এবং ঔষধাদি দ্বারা সকলের চিত্ত প্রসন্ন রাখিবেন। ব্যুহ ব্যতীত যুদ্ধ করিবেন না ও করাইবেন না। যুদ্ধনিরত সৈন্যদের কাৰ্য্যের প্রতি দৃষ্টি রাখিবেন। তাহারা যথার্থ যুদ্ধ করিতেছে,–না কপটতা করিতেছে, তাহা লক্ষ্য করিবেন ॥ ১০ ॥

কোন সময় উচিত মনে হইলে, চতুর্দিকে সৈন্য বেষ্টিত করিয়া শত্রুদের অবরুদ্ধ করিবেন এবং তাহার রাজ্য উপদ্রুত করিয়া তৃণ, অন্ন, জল এবং ইন্ধন নষ্ট ও দূষিত করিয়া দিবেন। ১১।

শত্রুর পুষ্করিণী, নগর প্রাচীর ও খাত ধ্বংস করিয়া রাত্রিকালে ভীতি প্রদর্শন পূর্বক তাহাদের সন্ত্রস্ত করিবেন। এইরূপে বিজয় লাভের চেষ্টা করিবেন ॥ ১২॥

বিজয় লাভের পর শত্রুর সহিত প্রমাণ অর্থাৎ প্রতিজ্ঞা পত্রাদি লিখাইয়া লইবেন, এবং উচিত সময়ে মনে হইলে তাহারই বংশের কোন ধার্মিক পুরুষকে এই শর্তে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করিবেন–”আপনাকে আমার আজ্ঞা অর্থাৎ ধর্মানুমোদিত রাজনীতি অনুসারে কাৰ্য্য করিয়া ন্যায়। পথে প্রজা পালন করিতে হইবে। এইরূপ উপদেশ প্রদান করিয়া তাহার সন্নিকটে এমন লোক রাখিবেন, যাহাতে পুনরায় উপদ্রব না হয়। প্রধান পুরুষদের সহিত মিলিত হইয়া শত্রুকে রত্নাদি উত্তম সামগ্রী প্রদান পূর্বক সম্মানিত করিবেন। এমন কাৰ্য্য করিবেন না, যাহাতে তাহার যোগক্ষেমও সিদ্ধ না হয়। তাহাকে কারারুদ্ধ করিয়া রাখা হইলেও তাহার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করিবেন, যেন সে মনস্তাপ বিস্মৃত হইয়া আনন্দে থাকিবে পারে ॥ ১৩ ॥

যেহেতু সংসারে অন্যের সম্পত্তি গ্রহণ করা অপ্রীতিকর এবং অপরকে দান করা প্রীতিকর, এইজন্য বিশেষ করিয়া সময়োচিত কর্ম করা এবং পরাজিত শত্রুকে তাহার মনোবাঞ্ছিত সামগ্রী প্রদান করা অতি উত্তম। কখনও শত্রুকে বিদ্রূপ করিয়া উত্যক্ত করিবেন না এবং তোমাকে জয় করিয়াছি’ এরূপ কথা বলিবেন না। কিন্তু তাহাকে আমার ভাই’ ইত্যাদি সম্মান সূচক বাক্য বলিয়া তাহার সহিত সদ্ব্যবহার করিবেন ॥ ১৪ ॥

হিরণ্যভূমিসংপ্রাপ্ত্যা পার্থিব্যে ন তথৈধতে। যথা মিত্রং ধ্রুবংলধ্বা কৃশমপ্যায়তিমম্ ॥ ১ ॥ ধর্মজ্ঞং চ কৃতজ্ঞং চ তুষ্টপ্রকৃতিমেব চ ॥ অনুরক্তং স্থিরারম্ভং লঘুমিত্রং প্রশস্যতে ॥ ২॥ প্রাজ্ঞং কুলীনং শূরং চ দক্ষং দাতারমেব চ ॥ কৃতজ্ঞং ধৃতিমন্তঞ্চ কষ্টমাহুররিংবুধাঃ ॥ ॥ ৷ আয়তা পুরুষজ্ঞানং শৌয়ংকরুণবেদিতা। স্থেলিলক্ষ্যং চ সততমুদাসীনগুণোদয়ঃ ॥ ৪ ॥ । মনু ০৭।

মিত্রের লক্ষণ–রাজা অটলপ্রীতি সম্পন্ন দূরদর্শী কাৰ্যদক্ষ, সমর্থবান বা দুর্বল মিত্র প্রাপ্ত হইয়া যেরূপ সমৃদ্ধশালী হইয়া থাকেন, সুবর্ণ ও ভূমি লাভ করিয়াও তদ্রপ হন না ॥ ১ ॥

ধর্মজ্ঞ, কৃতজ্ঞ’ অর্থাৎ যিনি কৃত উপকার সর্বদা স্বীকার করেন, প্রসন্ন স্বভাব, অনুরক্ত এবং দৃঢ়কর্মা ব্যক্তি ক্ষুদ্র মিত্রকে লাভ করিয়া তিনি প্রশংসিত হন ॥ ২৷

ইহা নিশ্চয় জানা আবশ্যক যে, বুদ্ধিমান, কুলীন, শৌর্যবীৰ্য্যশালী নিপুণ, দাতা, কৃতজ্ঞ এবং ধৈৰ্য্যশীল পুরুষকে কখনও শত্রু করা উচিত নহে। কারণ ঈদৃশ ব্যক্তিকে শত্ৰু করিলে দুঃখভোগ করিতে হয় ॥ ৩ ॥

উদাসীনের লক্ষণ–যাঁহার প্রশংসনীয় গুণ, কর্ম এবং উত্তম-অধম মনুষ্য সম্বন্ধে জ্ঞান আছে, যিনি শৌয্য-বীৰ্য্য- করুণাসম্পন্ন এবং যিনি স্থূল লক্ষ্য, অর্থাৎ কোন বিষয়ের ভিতরে প্রবেশ না করিয়া নিরন্তর ভাসা-ভাসা কথা শুনাইয়া থাকেন, তাহাকে ‘উদাসীন’ বলে ॥৪॥

এবং সর্বমিদং রাজা সহ সংমন্ত্র মন্ত্রিভিঃ ॥ ব্যায়াম্যাপ্লত্য মধ্যাহ্নে ভোক্তমন্তঃপুরং বিশেৎ ॥ মনু

রাজা পূর্বোক্তরূপে প্রাতঃকালে গাত্রোত্থান করিয়া শৌচাদির পর সন্ধ্যোপাসনা ও অগ্নিহোত্র করিয়া ও করাইয়া মন্ত্রীদিগের সহিত মন্ত্রণা করিবেন। অনন্তর কর্মচারী ও সেনাধ্যক্ষের সহিত মিলিত হইবেন। তাহাদিগকে আনন্দিত করিয়া নানা প্রকার ব্যুহ শিক্ষা অর্থাৎ ‘কুচকাওয়াজ’ শিক্ষা দিবেন, এবং স্বয়ং অভ্যাস করিবেন। অনন্তর যাবতীয় অশ্বশালা, হস্তীশালা, গোশালা, অস্ত্রাগার, চিকিৎসালয় এবং রাজকোষ পরিদর্শন করিবেন। প্রত্যহ ঐ সকলের প্রতি দৃষ্টি রাখিবেন। কোন দোষ ঘটিলে তাহা সংশোধন করিবেন। তাহার পর ব্যায়াম শালায় যাইয়া ব্যায়াম করিবেন। মধ্যাহ্ন ভোজনার্থে ‘অন্তপুরে’ অর্থাৎ যে স্থানে পত্নী প্রভৃতি থাকেন সে স্থানে প্রবেশ করিবেন। সুপরীক্ষিত বুদ্ধি-বল-পরাক্রমবর্ধক ও রোগনাশক নানাবিধ অন্ন, ব্যঞ্জন পানীয় প্রভৃতি সুগন্ধ যুক্ত মিষ্টান্নাদি এবং নানা রসযুক্ত আহাৰ্য্য দ্রব্য ভোজন করিবেন। এইরূপে সর্বদা সুখে থাকিয়া সমস্ত রাজকার্য্যে উন্নতি করিতে থাকিবেন। প্রজাদিগের নিকট হইতে কর গ্রহণ প্রণালী–

পঞ্চাশদ্ভাগ আদেয়ো রাজ্ঞা পশুহিরণ্যয়োঃ। ধান্যানমষ্টমো ভাগঃ ষষ্ঠো দ্বাদশ এব বা ৷ মনু ০

ব্যবসায়ী অথবা শিল্পীদিগের নিকট হইতে সুবর্ণ ও রৌপ্যের লভ্যাংশের পঞ্চাশদ্ভাগ, তণ্ডুল প্রভৃতি অন্নের ষষ্ঠ, অষ্টম বা দ্বাদশ ভাগ গ্রহণ করিবেন।

যদি ধন গ্রহণ করা হয় তবে এইরূপে করিবেন যাহাতে কৃষক প্রভৃতি নির্ধন হইয়া দুঃখে পতিত না হয়।

কেননা প্রজাবর্গ ধনাঢ্য ও নীরোগ থাকিলে এবং তাহারা যথেষ্ট খাদ্য ও পানীয় প্রাপ্ত হইলে রাজার অত্যন্ত উন্নতি হইয়া থাকে। রাজা প্রজাবর্গকে নিজ সন্তানের ন্যায় সুখী করিবেন এবং প্রজাগণ রাজা ও রাজকর্মচারীদের পিতৃতুল্য মনে করিবেন। ইহা সত্য যে, রাজার রাজা কৃষক প্রভৃতি যাহারা শ্রমশীল, রাজা তাহাদিগের রক্ষক। প্রজা না থাকিলে কে কাহার রাজা? আর রাজা না থাকিলে কে কাহার প্রজা? রাজা প্রজা উভয়েই স্ব স্ব কাৰ্য্যে স্বতন্ত্র, কিন্তু প্রীতিকর সম্মিলিত। কাৰ্য্যে পরতন্ত্র থাকিবেন। রাজা বা রাজকর্মচারীগণ প্রজাদিগের সাধারণ সম্মতির বিরুদ্ধে কাৰ্য্য করিবেন না। রাজকর্মচারী অথবা প্রজাবর্গ রাজ-আজ্ঞার বিরুদ্ধে চলিবে না। রাজার নিজ রাজকীয়। কাৰ্য্য অর্থাৎ যাহাকে “পলিটিক্যাল” বলে তাহা সংক্ষেপে বর্ণিত হইল। যিনি ইহা বিশেষরূপে জানিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তিনি চারি বেদ, মনুস্মৃতি, শুক্ৰনীতি, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠ করিয়া নির্ণয় করিবেন ॥

প্রজাদিগের প্রতি ন্যায় বিচার সম্বন্ধীয় ব্যবহার মনুস্মৃতির অষ্টম ও নবম অধ্যায়োক্ত রীতি অনুসারে করা উচিত। এ স্থলেও তাহা সংক্ষেপে লিখিত হইতেছে —

প্রত্যহং দেশদৃষ্টেশ্চশাদৃষ্টেশ্চ শাস্ত্রদৃষ্টোশ্চ হেতুভিঃ। অষ্টাদশসু মার্গেফ্ট নিবদ্ধানি পৃথক পৃথক্‌ ॥ ১ ॥ তেষামাদ্যমৃণাদানংনিক্ষেপোস্বামিবিক্রয়ঃ ॥ সম্ভয় চ সমুথানং দত্তস্যানপকর্ম চ ॥ ২ ॥ বেতনস্যৈব চাদানং সংবিদশ্চ ব্যতিক্রমঃ। ক্রয়বিক্রয়ানুশয়ো বিবাদঃ স্বামিপালয়োঃ ॥৩ ॥ সীমাবিবাদ ধর্মশ্চ পারুষ্যে দন্ডবাচিকে। স্তেয়ং চ সাহসং চৈব স্ত্রীসং গ্রহণমেব চ ॥ ৪ ॥ স্ত্রীপুংধর্মো বিভাগশ্চ দূতমায় এব চ। পদান্যষ্টাদশৈতানি ব্যবহারস্থিতাবিহ ॥ ৫ ॥ এযু স্থানেযু ভূমিষ্ঠংবিবাদং চরতাং নৃণা। ধর্মং শাশ্বতমাশ্ৰিত্য কুয়াকার্যবিনির্ণয় ॥ ৬ ॥ ধর্মো বিদ্ধধর্মেণ সভাংয়ত্ৰোপতিষ্ঠতে ॥ শল্যং চাস্য ন কৃন্তন্তি বিদ্ধাস্তত্র সভাসদঃ ॥ ৭ ॥ সভা বা ন প্রবেষ্টব্যা বক্তব্যাং বা সমঞ্জস ॥ অব্রুবন বিব্রুবন বাপিনরো ভবতিকিন্দ্বিষী ॥ ৮ ॥ যত্র ধর্মো হ্যধর্মেণ সত্যং য়ত্রাতেন চ ॥ হন্যতে প্রেক্ষমাণানাংহতস্তত্র সভাসদঃ ॥ 9 ॥ ধর্ম এব হতো হস্তি ধর্মোরক্ষতি রক্ষিতঃ। তস্মাৰ্দ্ধর্মোন হস্তব্যো মা নো ধর্মো হতোবধীৎ ॥ ১০ ॥ বৃষো হি ভগবান্ ধর্মস্তস্য য়ঃ কুরুতে হল। বৃষলং তং বিদুর্দেৰ্বাস্তস্মাদ্ধৰ্মংন লোপয়েৎ ॥১১ ॥ এক এব সুহৃদ্ধর্মো নিধনেপ্যনুয়াতিয়ঃ। শরীরেণ সমন্নাসং সর্বৰ্মন্যদ্ধি গচ্ছতি ॥ ১২ ॥ পাদোSধর্মস্য কর্তারং পাদঃ সাক্ষিণমৃচ্ছতি। পাদঃসভাসদঃ সর্বান্ পাদোরাজানমৃচ্ছতি ॥১৩ ॥ রাজা ভবতনেনাস্তু মুচ্যন্তে চ সভাসদঃ। এনো গচ্ছতি কৰ্ত্তারং নিন্দাহোয়ত্র নিন্দ্যতে ॥ ১৪ ॥ মনু ০। সভা, রাজা এবং রাজকর্মচারীগণ সকলে প্রত্যহ দেশাচার এবং শাস্ত্রবিধি অনুসারে নিম্নলিখিত অষ্টাদশ বিবাদাস্পদ মার্গে বিবাদযুক্ত কর্ম সমূহের বিচার পূর্বক মীমাংসা করিবেন। যে সকল নিয়ম শাস্ত্রোক্ত নহে অথচ প্রয়োজনীয়, রাজা ও প্রজাবর্গের উন্নতিকল্পে সেই সকল উৎকৃষ্ট নিয়ম বিধিবদ্ধ করিবেন ॥ ১ ॥

অষ্টাদশ মার্গ এইরূপ, ইহার মধ্যে –(১) ঋণদানকাহাকেও ঋণ দেওয়া ও কাহারও নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করা সম্বন্ধে বিবাদ হওয়া। ২–(নিক্ষেপ)–গচ্ছিত রাখা অর্থাৎ কেহ কাহারও নিকট ধনসম্পত্তি রাখিয়া ফেরত চাহিলে না দেওয়া। ৩–(অস্বামিবিক্রয়)–স্বামী না হইয়া পরের বস্তু বিক্রয় করা। ৪–(সন্থায় চ সমুন)–দলবদ্ধ হইয়া কাহারও উপর অত্যাচার করা। ৫-(দত্তস্যানপকর্ম চ) দত্ত বস্তু আত্মসাৎ করা ॥ ২ ॥

৬-(বেতনস্যৈব চাদান)–বেতন অর্থাৎ কাহারও চাকুরীর পারিশ্রমিক হইতে অংশ গ্রহণ করা, অথবা কম দেওয়া অথবা না দেওয়া। ৭–(সংবিদশ্চ ব্যতিক্রমঃ)–প্রতিজ্ঞা বিরুদ্ধ আচরণ। করা। ৮–(ক্রয়-বিক্রয়ানুশয়)–অর্থাৎ ক্রয় বিক্রয় সম্বন্ধে বিবাদ হওয়া। ৯–(বিবাদঃ স্বামী পালয়োঃ) পশুর সত্ত্বাধিকারী এবং পালনকারীর মধ্যে বিবাদ হওয়া ॥৩ ॥

১০–সীমানা সংক্রান্ত বিবাদ হওয়া।১২-কাহাকেও কঠোর দণ্ডদান করা। ১২ কাহাকেও কাঠোর বাক্য বলা। ১৩–চুরি ও ডাকাতি করা। ১৪–বলপূর্বক কোন কাৰ্য্য করা। ১৫–কোন। স্ত্রীপুরুষের মধ্যে ব্যভিচার হওয়া ॥ ৪ ॥

১৬–স্ত্রী ও পুরুষের ধর্মে ব্যতিক্রম ঘটা। ১৭–(বিভাগ) অর্থাৎ দায়ভাগ সম্বন্ধে বিবাদ হওয়া। ১৮–দূত, অর্থাৎ কোন জড় পদার্থ ও সমাহ্বায় অর্থাৎ কোন চেতন পদার্থ পণ রাখিয়া জুয়া খেলা। এই অষ্টাদশ প্রকার পরস্পর বিরোধ ব্যবহারের স্থল ॥ ৫ ॥

এই সকল বিষয়ে বাদী প্রতিবাদীদিগের সনাতন ধর্মানুসারে ন্যায় বিচার করিতে হইবে, অর্থাৎ কখনও কাহারও প্রতি পক্ষপাত করিবেন না।

অধর্ম কর্তৃক ধৰ্ম আহত হইয়া সভায় উপস্থিত হইলে যদি ধর্মের শল্য, অর্থাৎ তীরবৎ কলঙ্ক, বাহির করা ও অধর্মকে ছেদন করা না হয়, অর্থাৎ ধার্মিক ব্যক্তি সম্মান লাভ না করে এবং ‘অধার্মিক ব্যক্তি দণ্ডিত না হয়, তাহা হইলে সেই সভাস্থ সভাসদ বর্গকে আহতবৎ মনে করা হয় ॥ ৭ ॥

ধার্মিক মানুষের কর্তব্য এই যে, তিনি সভায় প্রবেশ করিলে সত্যই বলিবেন, নতুবা কখনও সভায় প্রবেশ করিবেন না। যিনি সভায় অন্যায় হইতেছে দেখিয়াও নীরব থাকেন, অথবা সত্য ন্যায়ের কথা বলেন, তিনি মহাপাপী৷ ৮ ॥

যে সভায় সভাসদ্বর্গের সম্মুখে ধর্ম অধর্ম কর্তৃক বিনষ্ট হয়, সেই সভায় বুঝিতে হইবে সকলেই মৃত তুল্য, তাহাদের মধ্যে কেহই জীবিত নাই বলিয়া জানিবে ॥৯॥

বিনিষ্ট ধর্ম বিনাশকারীকে বিনাশ করে। রক্ষিত ধর্ম রক্ষককে রক্ষা করে। সুতরাং বিনষ্ট ধর্ম কখনও যেন আমাকে বিনাশ করিতে না পারে, এই ভয়ে ধর্মকে কখনও বিনাশ করিবে না ॥ ১০ ॥

যে ব্যক্তি সকল ঐশ্বৰ্য্য ও সুখবর্ষণকারী ধর্মের লোপ করে, তাহাকেই বিদ্বানেরা বৃষল অর্থাৎ শূদ্র ও নীচ বলিয়া মনে করে। সুতরাং ধর্মালোপ করা কাহারও উচিত নহে ॥ ১১॥

এই সংসারে ধর্মই একমাত্র সুহৃদ। মৃত্যুর পরেও ধর্ম সহগামী হইয়া চলে আর অন্য সকল সঙ্গী বা সকল সামগ্রী দেহনাশের সহিত তাহাকে ত্যাগ করে কিন্তু ধর্ম কখনও দেহনাশের সহিত তাহার সঙ্গীকে ত্যাগ করে না ॥১২।

যখন রাজসভায় পক্ষপাত বশতঃ কোন অন্যায় সংঘটিত হয়, তখন সেখানে অধর্ম চার ভাগে বিভক্ত হয়। উহাদের মধ্যে প্রথম–অধর্মকারী,দ্বিতীয়–সাক্ষী, তৃতীয়–সভাসদ্বর্গ এবং চতুর্থ– পাপ ধর্মহীন সভার সভাপতি রাজ্য করে ॥ ১৩ ॥

যে সভায় নিন্দনীয়ের নিন্দা, যোগ্যের স্তুতি, দণ্ডনীয়ের দণ্ড এবং মাননীয়ের সম্মান হয়, সেই সভায় রাজা ও সভাসদ্বর্গ পবিত্র ও নিষ্পাপ হইয়া যায়। পাপ পাপকারীকেই আশ্রয় করে ॥ ১৪ ॥

আপ্তাঃ সর্বেষুবর্ণেষু কায়াঃ কায়েষু সাক্ষিণঃ। সর্বধর্ম বিদোতলুব্ধা বিপরীতাস্তু বর্জয়েৎ ॥ ১ ॥ স্ত্রীণাংসাক্ষ্যংস্ক্রিয়ঃ কুয়ুদ্বিজানাং সদৃশ্য দ্বিজাঃ। শূদ্রাশ্চ সন্তঃশূদ্রাণামন্ত্যানামন্ত্যয়োনয়ঃ ॥ ২ ॥ সাহসেষু চ সর্বেষু স্তেয়সংগ্রহণেষু চ ॥ বাদণ্ডয়েশ্চ পারুষ্যেন পরীক্ষেত সাক্ষিণঃ ॥ ৩ ॥ বহু ত্বংপরিগৃহ্নীয়াৎসাক্ষিদ্বৈধেনরাধিপঃ। সমেষুঃ তুগুণোৎকৃষ্টান্ গুণিদ্বৈধে দ্বিজোত্তমা ॥ ৪ ॥ সমক্ষদর্শণাৎ সাক্ষ্যং শ্রবণাচ্চৈব সিধ্যতি। তত্র সত্যংব্রুবন্ সাক্ষী ধর্মার্থাভ্যাংনহীয়তে ॥ ৫ ॥ সাক্ষী দৃষ্টতাদন্যবিব্রুবন্নায়ুসংসদি। অবান্নরকমভ্যেতি প্ৰেত্য স্বর্গাচ্চ হীয়তে ॥ ৬ ॥ স্বভাবেনৈব য়দক্ৰয়ুস্তদ গ্রাহং ব্যাবহারিক। অতো অন্যক্ৰিয়ুধর্মার্থং তদপার্থক ॥ ৭ ॥ সভান্ত : সাক্ষিণঃ প্রাপ্তানৰ্থিপ্রত্যর্থিসন্নিধে। প্রাবিবাকোনুয়ুঞ্জীতবিধিনাতুনেন সান্তুয়৷৮ ॥ য়দদ্বয়েরনয়োর্বের্থ কায়েস্মিন্ চেষ্টিতং মিথঃ। তব্ৰুত সর্বং সত্যেন য়ুষ্মকং হ্যত্র সাক্ষিতা ॥৯॥ সত্যং সাক্ষ্যে ব্রুবন্ সাক্ষী লোকনাপ্নোতি পুষ্কলা। ইহা চানুত্তমাং কীৰ্ত্তিং বাগে ব্রহ্মপূজিতা ॥ ১০ ॥ সত্যেন পূয়তে সাক্ষী ধর্মঃ সত্যেন বর্ধতে। তস্মাৎসত্যংহি বক্তব্যং সর্বর্বর্ণেষু সাক্ষিভিঃ ॥ ১১ ॥ আত্মৈব হ্যাঁত্মনঃ সাক্ষী গতিরাত্মা তথাত্মনঃ। মাবমংস্থাঃ স্বমাত্মানং নৃণাংসাক্ষিণমুত্তমম্ ॥ ১২। য়স্য বিদ্বান্ হিবদতঃ ক্ষেত্ৰজ্ঞো নাভিশঙ্কতে। তম্মান দেবাঃ শেয়াসং লোকেন্যং পুরুষং বিদুঃ ॥১৩ ॥ একোচ হমস্মীত্যাত্মানংয়ত্ত্বং কল্যাণমন্যসে। নিত্যংস্থিতস্তে হৃদ্যেষঃ পুণ্যপাপেক্ষিতা মুনিঃ ॥১৪ ॥ মনু

সকল বর্ণের ধার্মিক, বিদ্বান, অকপট, সর্বপ্রকার ধর্মজ্ঞ, নির্লোভী এবং সত্যবাদী ব্যক্তিকে ন্যায় ব্যবস্থার সাক্ষী করিবে, তদ্বিপরীত ব্যক্তিকে কখনও সাক্ষী করিবে না৷ ১ ॥

স্ত্রীলোকের সাক্ষী স্ত্রীলোক, দ্বিজের সাক্ষী দ্বিজ, শূদ্রেরসাক্ষী শূদ্র, এবং অন্ত্যজের সাক্ষী অন্ত্যজ হইবে ॥ ২॥

চুরি, ব্যভিচার, কঠোর বাক্য এবং দন্ডনিপাত প্রভৃতি যে সকল অপরাধ বল পূর্বক করা হয়, তৎসম্বন্ধে সাক্ষীর পরীক্ষা গ্রহণ না করা অত্যন্ত আবশ্যকীয় মনে করিবে কারণ এই সকল কাৰ্য্য গোপনে করা হইয়া থাকে ॥ ৩ ॥

উভয় পক্ষের সাক্ষীদিগের মধ্যে বহুমতানুসারে, তুল্য সাক্ষীদিগের মধ্যে উত্তম গুণসম্পন্ন পুরুষদিগের সাক্ষ্য অনুসারে এবং উভয় পক্ষের সাক্ষী উত্তম গুণসম্পন্ন ও তুল্য হইলে দ্বিজোত্তম। অর্থাৎ ঋষি-মহর্ষি যতিদের সাক্ষ্য অনুসারে ন্যায় বিচার করিবেন ॥৪ ॥

দ্বিবিধ সাক্ষী প্রামাণ্য হইয়া থাকে– প্রথম সাক্ষাৎ দৃষ্টা, দ্বিতীয় শ্রোতা, যে সাক্ষী সভায়। জিজ্ঞাসিত হইয়া সত্য কথা বলেন, তিনি অধার্মিক, দন্ডাই নহেন। কিন্তু যে সাক্ষী মিথ্যা কথা বলে সে যথোচিত দন্ডনীয়। ৫ ॥

যে সাক্ষী রাজসভায় অথবা শ্রেষ্ঠ পুরুষদের কোন সভায় দৃষ্ট ও শ্রুত বিষয়ের বিরুদ্ধে কথা। বলে, সে বর্তমান ‘অবা নরক’ অর্থাৎ জিহ্বাছেদন জনিত দুঃখরূপ নরক ভোগ করে এবং মৃত্যুর পর সুখ হইতে বঞ্চিত হয় ॥ ৬ ॥

সাক্ষী কোনো ঘটনা সম্বন্ধে স্বাভাবিকরূপে যাহা বলে তাহাই গ্রাহ্য। তদ্ভিন্ন অপরের শিখান। কথা যাহা বলে, তাহা ন্যায়াধীশ বৃথা মনে করিবেন ॥৭॥

অর্থ=বাদী ও প্রত্যর্থ=প্রতিবাদীর সম্মুখে সভায় উপস্থিত সাক্ষীগণকে, ন্যায়াধীশ এবং প্রাড়বিবাগ অর্থাৎ উকিল অথবা ব্যারিষ্টার শান্তভাবে এইরূপ জিজ্ঞাসা করিবেন ॥৮ ॥

‘হে সাক্ষিগণ! এই দুইজনের কাৰ্য্য সম্বন্ধে আপনারা যাহা জানেন, তাহা সত্য সহিত বর্ণনা। করুন এ বিষয়ে সাক্ষী আপনারা ৷ ৯ ॥

যে সাক্ষী সত্য কথা বলেন, তিনি জন্মান্তরে উত্তম জন্ম এবং উত্তম লোকান্তরে জন্মলাভ করিয়া সুখভোগ করেন। তিনি ইহজন্মে ও পরজন্মে উত্তম কীৰ্ত্তিলাভ করেন। কারণ বেদেলিখিত আছে, এই বাণীই সম্মান এবং অপমানের হেতু। সত্যবাদী সম্মানিত ও মিথ্যাবাদী নিন্দিত হইয়া থাকে ॥১০ ॥

সত্য বলিলে সাক্ষী পবিত্র হয় এবং সত্য বলিলে ধৰ্মোন্নতি হয়। অতএব, সকল বর্ণের সাক্ষী সত্যই বলিবে ॥ ১১ ॥

আত্মাই আত্মার সাক্ষী, আত্মাই আত্মার গতি। ইহা জানিয়া হে পুরুষ! তুমি সকল মনুষ্যের উৎকৃষ্ট সাক্ষী স্বরূপ স্বীয় আত্মার অপমান করিও না অর্থাৎ সত্যভাষণ যাহা তোমার মন, আত্মা ও বাণীতে আছে উহা ‘সত্য এবং যাহা ইহার বিপরীত উহা ‘মিথ্যা’ ॥১২॥ যে বক্তা বিদ্বান, ‘ক্ষেত্রজ্ঞ’অর্থাৎ দেহের জ্ঞাতা আত্মা ও অন্তরে শঙ্কিত হয় না, বিদ্বান ব্যক্তিরা। তাহাকে ছাড়া অন্য কাহাকেও উত্তম (শ্রেষ্ঠ) পুরুষ মনে করেন না ॥১৩ ॥

হে কল্যাণকারী পুরুষ! যদি তুমি “আমি একাকী” এই মনে করিয়া মিথ্যা কথা বল, উহা। উচিত নহে। কিন্তু আর একজন যিনি তোমার হৃদয়ে অন্তর্যামী রূপে বিদ্যমান, পাপ পুণ্যের প্রতেক্ষ দ্রষ্টা মুনি স্বরূপ রহিয়াছেন, সেই পরমাত্মাকে ভয় করিয়া সদ্য সত্য কথা বলিবে ॥১৪ ॥

লোভান্মেহাভয়ান্মৈ ত্রাৎকামাৎ ক্রোধাত্তথৈব চ। অজ্ঞানা বালবাচ্চ সাক্ষ্যংবিথমুচ্যতে ॥১॥ এষামন্যতমে স্থানে য়ঃ সাক্ষ্যমনৃতং বদে। তস্য দন্ড বিশেষাংস্তু প্রবক্ষ্যাম্যনুপূর্বশঃ ॥২॥ লোভাৎসহস্রং দন্ড্যস্তু মোহাৎপূর্বন্ত সাহস। ভয়াদ দ্বৌ মধ্যমৌ দন্ডৌ মৈত্রাং পূর্বং চতুগুণম্ ॥ ৩ ॥ কামাদ্দশগুণং পূর্বং ক্রোধাতু ত্রিগুণং পরম্। অজ্ঞানাদ দে শতে পূর্ণে বালি শ্যাম্তমেব তু ॥৪॥ উপস্থমুদরং জিহ্বা হস্তৌ পাদৌ চ পঞ্চম ॥ চক্ষুর্নাসা চ কণৌ চ ধনং দেহস্তথৈব চ ॥ ৫ ॥ অনুবন্ধং পরিজ্ঞায় দেশকালো চ তত্ত্বতঃ। সারা পরাধেী চালোক্য দন্ডংদন্ডেযু পায়েৎ ॥ ৬ ॥ অধর্মদন্ডনং লোকেয়শোঘ্নং কীৰ্ত্তিনাশনম্ ॥ অস্বর্গঞ্চ পরত্রাপি তস্মাৎ পরিবর্জয়েৎ ॥ ৭ ॥ অদন্ড্যান্দন্ডয় রাজা দন্ড্যাংশ্চৈবাপ্যদন্ডয়ম্ ॥ অয়শো মহদাপ্নোতি নরকং চৈব গচ্ছতি ॥ ৮ ॥ বান্ডং প্রথমং কুয়াাদ্ধিগন্ডং তদন্তর৷ তৃতীয় ধনদন্ডং তু বম্বদন্ডমতঃ পরম্ ॥ ৯ ॥ মনু০৮ ॥

লোভ, মোহ, ভয়, মিত্রতা, কাম, ক্রোধ, অজ্ঞতা এবং বালবুদ্ধি বশতঃ যে সাক্ষ্য দেওয়া হয় তাহা মিথ্যা বলিয়া মনে করিতে হইবে ॥১॥

কোন ক্ষেত্রে সাক্ষী মিথ্যা সাক্ষী দিলে তাহাকে নিম্নলিখিত রূপ নানাবিধ দন্ডদান দেওয়া কর্তব্য ॥ ২॥

লোভবশত মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে সাক্ষীর নিকট হইতে[দন্ডস্বরূপ] ১৫.৬২ (পনের টাকা দশ আনা) দন্ড লইবে। মোহবশতঃ মিথ্যা সাক্ষী দিলে [দন্ডরূপ] ৩.১২ (তিন টাকা দুই আনা) লইবে। ভয়বশতঃ মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে [দন্ডস্বরূপ] ৬.২৫ (ছয় টাকা চারি আনা) লইবে। যে পুরুষ মিত্রতা বশতঃ মিথ্যা সাক্ষ্য দিবে তাহার নিকট হইতে [দন্ডস্বরূপ] ১২.৫০ (বার টাকা আট আনা ) লইবে ॥ ৩ ॥

কামনাবশতঃ মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে [দন্ডস্বরূপ] ২৫.০০ (পঁচিশ টাকা) লইবে। ক্রোধবশতঃ মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে [দন্ডস্বরূপ] ৪৬.৮৭ (ছয়চল্লিশ টাকা চৌদ্দ আনা) লইবে, অজ্ঞতাবশতঃ মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে[দন্ডস্বরূপ] ৬.০০ (ছয় টাকা) লইবে। বালবুদ্ধি বশতঃ মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে [দন্ডস্বরূপ] ১.৫৬ (এক টাকা নয় আনা) লইবে ॥ ৪

উপস্থেন্দ্রিয়, উদর, জিহ্বা, হস্ত, পদ, চক্ষু, নাসিকা, কর্ণ, দেহ এবং ধন –এই দশ স্থানের উপর দন্ড প্রয়োগ করা হইয়া থাকে । ৫ ॥

কিন্তু যে দন্ড ব্যবস্থা লিখিত হইয়াছে এবং হইবে, উদাহরণ স্বরূপ লোভবশতঃ সাক্ষ্য দিলে ১৫.৬২ (পনের টাকা দশ আনা) দন্ড লেখা হইয়াছে। কিন্তু অপরাধী অত্যন্তদরিদ্র হইলে তাহার নিকট হইতে অল্প এবং ধনাঢ্য হইলে দ্বিগুণ, ত্রিগুণ বা চতুগ্রুণ পৰ্য্যন্ত দন্ড আদায় করিবে অর্থাৎ দেশ-কাল-পাত্র বিবেচনা করিয়া যাহার যেমন অপরাধ, তাহাকে সেইরূপ দন্ডদান করিতে হইবে ॥ ৬ ॥

কারণ এই সংসারে যিনি অধর্মানুসারে দন্ডদান করেন, তাহার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এবং পরজন্মের ভাবী কীর্তি নষ্ট হইয়া যায়। তাহাতে পরজন্মেও দুঃখোৎপত্তি ঘটে। অতএব, কাহার ও প্রতি অধর্মানুসারে দন্ডদান করিবে না ॥ ৭ ॥

যে রাজা দন্ডনীয়কে দন্ডদান করেন না, কিন্তু যে দন্ডাহ্নহে তাহাকে দন্ড দেন, তিনি জীবদ্দশায় ঘোর নিন্দা এবং মৃত্যুর পর মহাদুঃখ প্রাপ্ত হন। সুতরাং অপরাধীকে সর্বদা দন্ডদান করিবেন, নিরপরাধীকে কখনও দন্ডদান করিবেন না ॥ ৮ ॥

প্রথমতঃ –বাক্ দন্ড দিবেন অর্থাৎ তাহার নিন্দা করিবেন, দ্বিতীয়তঃ –‘ধি’ দন্ড দিবেন, অর্থাৎ তোমাকে ধিক্‌’ তুমি এইরূপ কুকর্ম করিয়াছ কেন? এইরূপ তিরস্কার করিবেন। তৃতীয়তঃ ‘অর্থ’ দন্ড দিবেন, এবং চতুর্থতঃ –‘বধ’ দন্ড অর্থাৎ চাবুক বা বেত্রাঘাত বা শিরোচ্ছেদ দন্ড দিবেন ॥ ৯ ॥

য়েন য়েন থাঙ্গেন স্তেনো নৃবিচেষ্টতে। তত্তদেব হরে দস্য প্রত্যাদেশায় পার্থিবঃ ॥১॥ পিতাচায় সুহৃন্মাতা ভায়া পুত্রঃ পুরোহিতঃ। নাদন্ড্যো নাম রাজ্ঞোস্তি য়ঃ স্বধর্মেন তিষ্ঠতি ॥২॥ কার্যাপণং ভবেন্ড্যোয়ক্ৰান্যঃ প্রাকৃতো জন । তত্র রাজা ভবেন্ড্যঃ সহস্রমিতি ধারণা ॥ ৩ ॥ অষ্টাপাদ্যন্ত শূদ্রস্য স্তেয়ে ভবতিকিন্বিষম্। যোডশৈব তু বৈশ্যস্য দ্বাত্রিংশৎ ক্ষত্রিয়স্য চ ॥ ৪ ॥ ব্রাহ্মণস্য চতুঃষষ্টিঃ পূর্ণং বাপি শতং ভবেৎ। দ্বিগুণ বা চতুঃষষ্টিস্তদ্দোষগুণবিদ্ধিসঃ ॥ ৫ ॥ ঐন্দ্ৰং স্থানভিপ্রেক্ষ্ময়শ্চাক্ষয়মব্যয়। নোপেক্ষেত ক্ষণমপি রাজা সাহসিকংনর ॥ ৬ ॥ বাদুষ্টাত্তস্করাচ্চৈব দণ্ডেনৈব চহিংসতঃ। সাহসস্য নরঃ কৰ্ত্তা বিজ্ঞেয়ঃ পাপকৃত্তমঃ ॥ ৭ ॥ সাহসে বর্তমানন্তু গো ময়তি পার্থিবঃ ॥ সবিনাশংজত্যাশু বিদ্বেষং চাধিগচ্ছতি ॥ ৮ ॥ নমিত্ৰকারণাদ্রাজা বিপুলাদ্বা ধনাগমৎ। সমুৎস্পৃজেৎ সাহসিকা সর্বভূতভয়াবহান্ ॥ ৯ ॥ গুরুং বা বালবৃদ্ধৌ বা ব্রাহ্মণং বা বহুশ্রুত। আততায়িনমায়ান্তংহন্যাদেবাবিচারয় ॥ ১০ ॥ নাততায়িবধে দোষো হর্ভবতিকশ্চন। প্রকাশং বা প্রকাশং বা মনস্তন্মমৃচ্ছতি ॥১১ ॥ যস্য স্তেনঃ পুরে নাস্তি নান্যস্ত্রীগোন দুষ্টবা। ন সাহসিকদণ্ডগ্লৌ স রাজা শক্ৰলোকভা ॥ ১২৷ মনু০৮ ॥

চোর যে যে অঙ্গ দ্বারা মানব-সমাজে বিরুদ্ধ চেষ্টা করে, রাজা সকলের শিক্ষার্থ, তাহার সেই সেই অঙ্গ ছেদন করিবেন ॥ ১ ॥

পিতা, মাতা, স্ত্রী, পুত্র, আচাৰ্য, পুরোহিত বা মিত্র যে কেহ হউন না কেন, যিনি স্বধর্মে স্থির থাকেন না, তিনি রাজার অদণ্ড্য নহেন। অর্থাৎ যখন রাজা ন্যায়াসনে উপবিষ্ট হইয়া বিচার করেন, তখন কাহারও প্রতি পক্ষপাত না করিয়া অপরাধীকে যথোচিত দণ্ড দান করিবেন ॥ ২ ॥

যে অপরাধে সাধারণ লোকের এক পয়সা দণ্ড হয়, সে অপরাধে রাজার এক সহস্র পয়সা দণ্ড হইবে। অর্থাৎ জনসাধারণ অপেক্ষা রাজার সহস্র গুণ দণ্ড হওয়া উচিত।

মন্ত্রী অর্থাৎ রাজার দেওয়ানের’আটশত গুণ, তদপেক্ষা নিম্নপদস্থের সাতশত গুণ, তদপেক্ষাও নিম্নপদস্থের ছয় শত গুণ,–এইরূপে ক্রমশ নিম্নপদস্থের অল্প দণ্ড হইবে। ভৃত্য অর্থাৎ চাপরাসী প্রভৃতির আট গুণ অপেক্ষা কম দণ্ড হওয়া উচিত নহে। কারণ, প্রজা অপেক্ষা রাজকর্মচারিদিগের দণ্ড অধিক না হইলে তাহারা প্রজাদিগকে বিনাশ করিবে। যেমন, সিংহ অধিক দণ্ড দ্বারা কিন্তু ছাগী অল্প দণ্ড দ্বারা বশীভূত হয়, সেইরূপ রাজা হইতে আরম্ভ করিয়া সর্বনিম্ন ভৃত্য পৰ্য্যন্ত রাজকর্মচারীর অপরাধের জন্য প্রজা অপেক্ষা অধিক দণ্ড হওয়া উচিত ॥ ৩ ॥

সেইরূপ কিঞ্চিৎ বিবেকের সঙ্গে চুরি করিলে শূদ্রের আট গুণ, বৈশ্যের ষোল গুণ এবং ক্ষত্রিয়ের বিশ গুণ দণ্ড হইবে ॥ ৪

ব্রাহ্মণের চৌষট্টি গুণ, শত গুণ বা অথবা একশত আটইশ গুণ দণ্ড হওয়া উচিত। অর্থাৎ যাহার জ্ঞান ও মর্যাদা যত অধিক, অপরাধের জন্য তাহার তত অধিক দণ্ড হওয়া আবশ্যক। ॥ ৫ ॥

রাজাধিপতি এবং ধর্ম ও ঐশ্বর্যাভিলাষী রাজা বলপূর্বক কুকর্মকারী দস্যুদিগকে দণ্ড দিতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করিবেন না। ৷৬ ॥

দুঃসাহসিক পুরুষদিগের লক্ষণ–যাহারা দুষ্ট বচন বলে, চুরি করে এবং বিনা অপরাধে দণ্ড দেয়, তাহাদের অপেক্ষাও যাহারা দুঃসাহসের সহিত বলাৎকার করে, তাহারা অধিক পাপিষ্ঠ ও দুর্বৃত্ত ॥ ৭ ॥

যে রাজা এই সকল লোককে দণ্ড না দিয়া সহ্য করেন, তিনি শীঘ্রই বিনাশ প্রাপ্ত হন এবং তাঁহার রাজ্যে বিদ্রোহ উপস্থিত হয় ॥ ৮ ॥

মিত্রতার খাতিরে অথবা প্রচুর ধনলাভের আশায় রাজা এই সকল প্রাণী পীড়ক দুবৃত্তের বন্ধন। ছেদন করিয়া কখনও ছাড়িয়া দিবেন না ॥ ৯ ॥

গুরু হউক বা পুত্রাদি বালক, পিতা প্রভৃতি বৃদ্ধ, ব্রাহ্মণ অথবা বহুশ্রুত বিদ্বান, যে কেহ হউন না কেন, যিনি ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া অধর্মচারী হইবেন এবং বিনা অপরাধে অপরকে হত্যা করিবেন। তাঁহাকে বিনা বিচারে বধ করিবেন অর্থাৎ বধ করিবার পর বিচার করিবেন ॥ ১০ ॥

দুবৃর্তদের প্রকাশ্যে বধ করিলে হন্তার পাপ হয় না। কারণ, ক্রুদ্ধকে ক্রোধ দ্বারা বধ করাকে ক্রোধের সহিত ক্রোধের যুদ্ধ মনে করিতে হইবে৷১১৷

যে রাজ্যের রাজ্যে চোর, পরস্ত্রীগামী, কটুভাষী, দুঃসাহসী দস্যু এবং দণ্ডপ্ন অর্থাৎ রাজাজ্ঞা লঙ্ঘনকারী নাই, সেই রাজাই অতীব শ্রেষ্ঠ ॥ ১২ ॥

ভর্তারং লঙ্ঘয়েদ্যা স্ত্রী স্বজ্ঞাতিণ্ডণদর্পিতা ॥ তাংশ্বভিঃ খায়েদ্রাজা সংস্থানে বহুসংস্থিতে ॥ ॥ ৷

পুমাংসংদাহয়েৎ পাপংশয়নে তপ্ত আয়সে। অভ্যাদধশ্চ কাষ্ঠানি তত্র দহ্যেত পাপকৃৎ ॥ ২ ॥ দীর্ঘাধ্বনিয়থাদেশংয়থাকালংকরো ভবেৎ। নদীতীরে তদ্বিদ্যাৎসমুদ্রে নাস্তি লক্ষণম্ ॥৩॥ অন্যহন্যবেক্ষেত কন্তান বাহনানি চ ॥ আয়ব্যয়ৌ চ নিয়তাবাকরান কোষমেব চ ॥৪॥ এবং সর্বানিমা রাজা ব্যবহারা সমাপয়ন্। ব্যপোহ্য কিন্বিষং সর্বং প্রাপ্নোতি পরমাং গতি ॥ ৫ ॥ মনু

যে স্ত্রী তাহার জাতি ও গুণের অহঙ্কারে স্বামীকে পরিত্যাগ করিয়া ব্যভিচার করে, তাহাকে বহু স্ত্রী-পুরুষের সম্মুখে জীবিত অবস্থায় কুকুর-দষ্ট করিয়া বধ করাইবে ॥১॥

সেইরূপে যে পুরুষ তাহার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া পরস্ত্রী বা বেশ্যাগমন করে, সেই পাপীকে। উত্তপ্ত লৌহ পালঙ্কে শায়িত করিয়া বহু লোকের সম্মুখে জীবিত অবস্থায় ভস্মীভূত করিবে। ॥২॥

প্রশ্ন –রাজা অথবা রাণী, অথবা ন্যায়াধীশ বা তাহার স্ত্রী, ব্যভিচার প্রভৃতি কুকর্ম করিলে তাঁহাদেরও দণ্ড হইবে?

উত্তর –সভা (দণ্ড দিবেন) অর্থাৎ প্রজাদিগের অপেক্ষা তাহাদিগের অধিক দণ্ড হওয়া উচিত।

প্রশ্ন– রাজা প্রভৃতি তাহাদের নিকট দণ্ড গ্রহণ করিবেন কেন?

উত্তর –রাজাও একজন পুণ্যাত্মা ভাগ্যবান্ পুরুষ। তঁহাকে দণ্ড দেওয়া না হইলে এবং তিনি দণ্ড গ্রহণ না করিলে, অপর লোকেরা দণ্ড মানিবে কেন? আর প্রজাবর্গ, প্রধান রাজ্যাধিকারী এবং রাজসভা ধর্মানুসারে দণ্ড দিতে ইচ্ছা করিলে রাজা একাকী কী করিতে পারেন? এরূপ ব্যবস্থা না থাকিলে রাজা, প্রধান ও সমস্ত সমর্থ ব্যক্তি অন্যায়ে নিমজ্জিত হইবে। তাহারা ন্যায় ও ধর্মকে ডুবাইয়া দিবে এবং প্রজাবর্গের সর্বনাশ করিয়া নিজেরাও বিনষ্ট হইবে। অর্থাৎ পূর্বোক্ত শ্লোকের অর্থ স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, ন্যায়যুক্ত দণ্ডেরই নাম রাজা ও ধর্ম। যে ব্যক্তি ইহার বিলোপ। করে তদপেক্ষা নীচ আর কে আছে?

প্রশ্ন –এরূপ কঠিন দণ্ড হওয়া উচিত নহে। কারণ, মনুষ্য জীবনদাতা অথবা কোন অঙ্গ। নির্মাতা নহে। অতএব এরূপ দণ্ড দেওয়া যাইতে পারে না।

উত্তর –যাঁহারা ইহাকে কঠোর দণ্ড মনে করেন, তাহারা রাজনীতি বুঝিতে পারেন না। কারণ, একজনের এইরূপ দণ্ড হইলে সকলে কুকর্ম হইতে দূরে থাকিয়া ধর্মপথে স্থির থাকিবে। বাস্তবিক এই দণ্ড এক রাই (সর্যপ) পরিমাণেও সকলের ভাগে পড়িবে না। কিন্তু লঘু দন্ড দেওয়া হইলে কুকর্ম অত্যন্ত বৃদ্ধি পাইতে থাকিবে। আর আপনি যাহাকে লঘু দণ্ড বলিতেছেন, তাহা কোটি কোটি গুণ অধিক হওয়ায় কোটি কোটি গুণ কঠিন হইবে। কারণ, বহু লোক কুকর্ম করিলে তাহাদের সকলকে অল্প অল্প দণ্ড দিতে হইবে। অর্থাৎ যদি এক ব্যক্তিকে এক মণ ও অপর এক ব্যক্তিকে এক পোয়া দণ্ড দেওয়া হয়, তাহা হইলে সেই দুজনকে এক মণ এক পোয়া দণ্ড দেওয়া হইল। তাহাতে একজনের ভাগে বিশ সের অর্ধ পোয়া দণ্ড পড়িল। দুর্বৃত্তগণ এইরূপ লঘু দণ্ড বুঝিবে কী? আবার একজনকে এক মণ এবং অপর সহস্ৰ জনের প্রত্যেককে এক পোয়া হিসাবে। দণ্ড দেওয়া হইল, তাহাতে মনুষ্য জাতির উপর সর্বশুদ্ধ দণ্ড হইল ছয় মণ দশ সের। তাহা অধিক। সুতরাং গুরুতর হইল। কিন্তু এক মণ দণ্ড অল্প এবং সুগম।

দীর্ঘপথ, উপসাগরে, বা নদী তথা মহানদীতে দেশের আয়তন অনুসারে কর স্থাপন করা কর্তব্য। মহাসমুদ্রে নিশ্চিত কর নির্ধারণ করা যায় না। কিন্তু যেমন সুবিধাজনক মনে হইবে, রাজা ও সমুদ্রপথে জলযান পরিচালকগণ যাহাতে লাভবান হইতে পারেন, সেইরূপ ব্যবস্থা করিতে হইবে। কিন্তু স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, যাঁহারা বলেন, পূর্বকালে জাহাজ চলিত না তাহাদের কথা মিথ্যা। জলপথে দেশ দেশান্তরে ও দ্বীপ দ্বীপান্তরে যাত্রী নিজ প্রজাদিগকে সর্বদা রক্ষা করিবেন এবং তাঁহাদের কোনরূপ কষ্ট হইতে দিবেন না ৷৩ ॥

রাজা প্রত্যহ কর্ম সমাপ্তির পর হস্তী, অশ্ব প্রভৃতি বাহন, দৈনন্দিন আয়, ব্যয়, আকর অর্থাৎ রত্নাদির খনি এবং কোষ = ধন ভাণ্ডার পর্যবেক্ষণ করিবেন ॥ ৪ ॥

এইরূপে যাবতীয় কাৰ্য্য যথোচিত ভাবে সম্পন্ন করিয়া ও করাইয়া, রাজা সর্বপাপবিমুক্ত হইয়া পরমগতি অর্থাৎ মোক্ষ সুখ প্রাপ্ত হন৷ ৫ ॥ ৷

প্রশ্ন –সংস্কৃত শাস্ত্র-গ্রন্থে যে রাজনীতি আছে, তাহা সম্পূর্ণ না অসম্পূর্ণ?

উত্তর –সম্পূর্ণ। কারণ, পৃথিবীতে যতপ্রকার রাজনীতি আছে এবং হইবে, ঐ সকল সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থ হইতে গৃহীত হইয়াছে এবং হইবে। যাহা স্পষ্টরূপে লিখিত হয় নাই, প্রত্যহং লোকদৃষ্টাশ্চ শাস্ত্রদৃষ্টাশ্চ হেতুভিঃ ॥ তৎ সম্বন্ধে–

যে সকল নিয়ম রাজা ও প্রজার পক্ষে সুখকর ও ধর্মসঙ্গত বিবেচিত হইবে, পূর্ণ বিদ্বাদিগের রাজসভা সেই সকল নিয়ম বিধিবদ্ধ করিবেন।

কিন্তু সর্বদা লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে যতদূর সম্ভব বাল্য বিবাহ হইতে দেওয়া হইবে না। যৌবন ব্যতীত ও প্রসন্নতা ব্যতীত বিবাহ করিবেন না এবং করিতে দিবেন না। যথোচিত ব্রহ্মচর্য্য সেবন করিবেন ও করাইবেন। ব্যভিচার ও বহুবিবাহ রহিত করিবেন! ইহাতে শরীরের ও আত্মার সর্বদা পূর্ণ বল থাকিবে। যদি কেবল আত্মার বল, অর্থাৎ বিদ্যাও জ্ঞান বৃদ্ধি করা হয়, আর শারীরিক বলবৃদ্ধি করা না হয় তাহা হইলে একই বলবান পুরুষ জ্ঞানী ও শত-শত বিদ্বান্‌কে জয় লাভ করিতে পারে। এবং যদি কেবল শারীরিক বল বৃদ্ধি করা হয়, আত্মার নয় তাহা হইলেও বিদ্যা ব্যতীত রাজ্যপালনের সুব্যবস্থা কখনও হইতে পারে না। তাহাতে, সকলে পরস্পর ছিন্নভিন্ন হইয়া এবং কলহ বিবাদে প্রবৃত্ত হইয়া নষ্ট-ভ্রষ্ট হইয়া যাইবে। অতএব সর্বদা শারীরিক ও আধ্যাত্মিক বল বৃদ্ধি করা কর্তব্য।

ব্যভিচার ও অতিরিক্ত বিষয়ে আসক্ত থাকার ন্যায় বল-বুদ্ধি-নাশক আর কিছুই নাই। বিশেষতঃ ক্ষত্রিয়দিগের দৃঢ়াঙ্গ ও বলিষ্ঠ হওয়া আবশ্যক। কারণ ক্ষত্রিয়গণ বিষয়ে আসক্ত হইলে রাজ্য ও ধর্ম নষ্ট হইয়া যায়।

এবিষয়েও লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে ‘যথা রাজা তথা প্রজা’, যেমন রাজা তেমনই প্রজা। এই জন্য কখনও দুরাচরণ করিবে না, কিন্তু সর্বদা ধর্ম ও ন্যায়াচরণ করিয়া সকলের সংশোধনের দৃষ্টান্ত হওয়া রাজা এবং রাজকর্মচারিদিগের একান্ত কর্তব্য।

এস্থলে সংক্ষেপে রাজধর্ম বর্ণিত হইল। বিশেষ করিয়া বেদ, মনুস্মৃতির সপ্তম, অষ্টম ও নবম অধ্যায়, শুক্রনীতি তথা বিদুরপ্রজাগণ, এবং মহাভারতের শান্তি পর্বের অন্তর্গত রাজধর্ম ও আপদ্ধর্ম প্রভৃতি পাঠ করিয়া পূর্ণ রাজনীতি আয়ত্ত করিবেন, এবং (তদ্বারা) মাণ্ডলিক অথবা সার্বভৌম চক্রবর্তী রাজ্য গঠন করিবেন। মনে রাখিবেন, ‘বয়ং প্রজাপতেঃ প্রজা অভূম’ ইহা যজুর্বেদের বচন। আমরা প্রজাপতি অর্থাৎ পরমেশ্বরের প্রজা, পরমাত্মা আমাদের রাজা, আমরা তাঁহার আজ্ঞাবহ ভৃত্য তুল্য। তিনি কৃপা করিয়া নিজ সৃষ্টিতে আমাদিগকে রাজ্যধিকারী করুন এবং আমাদের দ্বারা সত্য ও ন্যায় প্রবর্তিত করান। অনন্তর ঈশ্বর এবং বেদ বিষয় লিখিত হইবে।

ইতি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীকৃতে সত্যার্থপ্রকাশে
সুভাষাবিভূষিতে রাজধর্ম বিষয়ে
ষষ্ঠঃ সমুল্লাসঃ সম্পূর্ণঃ ॥ ৬ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *