০৮. জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়

জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়

অথ অষ্টম-সমুল্লাসারম্ভঃ
অথ সৃষ্ট্যুৎপত্তিস্থিতিপ্রলয়বিষয়া ব্যাখ্যাস্যামঃ

ইয়ং বিসৃষ্টিয়ত আ বভূব যদি বা দধে যদি বান। গো অসাধ্যক্ষঃ পরমে বোমসসা অঙ্গ বেদ যদিবা ন বেদ ॥১॥ ॥ ঋ০ ম০১০।১২৯৭। তম আসীত্তমসা গূঢ়মগ্রে প্রকেতং সলিলং সর্বৰ্মা ইদম্। তুচ্ছেনাভৃপিহিতং য়দাসীত্ত পসস্তন্মহিনা জায়তৈক ॥ ২॥ ঋ০১০১০।১২৯।৩ ॥ হিরণ্যগর্ভঃ সমবাগ্রে ভূতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ। স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম৷ ৩ ॥ ঋ০ম০১০।১২১।১ ॥ পুরুষ এবেদ সর্বং য়দভূতং য়চ্চ ভাব্যম। উমৃতত্বস্যেশানোয়দন্নেনাতিরোহতি ॥ ৪ ॥  যজু ০ অ০ ৩১। ২ ॥ য়তো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে য়েন জাতানি জীবন্তি। য়ৎ প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব তদব্রহ্মেতি ॥ ৫ ॥ তৈত্তিরীয়োপ নি

হে (অঙ্গ) মনুষ্য! যাহা হইতে এই বিভিন্ন প্রকার সৃষ্টি প্রকাশিত হইয়াছে যিনি ধারণ ও প্রলয়। কর্তা, যিনি এই জগতের স্বামী এবং যাঁহার ব্যাপকতার মধ্যে সমস্ত জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় হইয়া থাকে তিনিই পরমাত্মা। তাঁহাকে তুমি জান। অপর কাহাকেও সৃষ্টিকর্তা বলিয়া স্বীকার করিও না ॥ ১ ॥

এই সমস্ত জগৎ সৃষ্টির পূর্বে অন্ধকারাচ্ছন্ন, রাত্রিরূপে অবিজ্ঞেয়, আকাশরূপ সব জগৎ তথা তুচ্ছ অর্থাৎ অনন্ত পরমেশ্বরের সম্মুখে একদেশী ও আচ্ছাদিত ছিল। অনন্তর পরমেশ্বর নিজ। শক্তিবলে কারণস্বরূপ হইতে কাৰ্য্যরূপ করিয়াছেন ॥ ২ ॥

হে মনুষ্যগণ! যিনি সূৰ্য্যাদি সমস্ত তেজস্বী পদার্থের আধার, যিনি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ জগতের এক অদ্বিতীয় পতি, যিনি জগতের উৎপত্তির পূর্বে বিদ্যমান ছিলেন এবং যিনি পৃথিবী হইতে সূৰ্য্য পর্যন্ত সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন, সেই পরমাত্মদেবের প্রতি প্রেম ভক্তি কর ॥ ৩ ॥

হে! মনুষ্যগণ! যিনি সকলের মধ্যে পূর্ণ পুরুষ, যিনি অবিনাশী কারণস্বরূপ, যিনি জীবগণের অধিপতি এবং যিনি পৃথিবী আদি জড় পদার্থ ও জীব হইতে পৃথক, সেইপুরুষই ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সমস্ত জগতের সৃষ্টিকর্তা ॥ ৪ ॥

যে পরমাত্মার রচনা হইতে পৃথিবী আদি সমস্ত ভূত উৎপন্ন হয়, যাঁহাতে জীবন ধারণ করে। এবং যাহার মধ্যে প্রলয় প্রাপ্ত হয়, তিনি ব্রহ্ম। তাঁহাকে জানিবার ইচ্ছা কর ॥ ৫ ॥

জন্মাদ্যস্য য়তঃ। শারীরক সূ০অ০১। সূ০ ২ ॥

যাহা দ্বারা এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয় হয়, সেই ব্রহ্ম জানিবার যোগ্য।

প্রশ্ন –এই জগৎ কি পরমেশ্বর হইতে উৎপন্ন হইয়াছে? না অপর কেহ ইহার সৃষ্টিকর্তা?

উত্তর –নিমিত্ত কারণ পরমাত্মা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। কিন্তু ইহার উপাদান কারণ প্রকৃতি।

প্রশ্ন –পরমেশ্বর কি প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেন নাই?

উত্তর — না। প্রকৃতি অনাদি ॥

প্রশ্ন –অনাদি কাহাকে বলে? কতগুলি পদার্থ অনাদি?

উত্তর –ঈশ্বর, জীব এবং জগতের কারণ–এই তিনটি অনাদি।

প্রশ্ন –এ বিষয়ে প্রমাণ?

উত্তর –দ্বা সুপর্ণা সয়ুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে ॥ তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্যনশনন্যো অভি চাকশীতি৷ ১৷ ঋ০ ম০ ১ ১৬৪২০ ॥ শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ ॥ ২ যজু অ০ ৪০ ॥

(দ্বা) ব্ৰহ্ম ও জীব উভয়ে (সুপর্ণা) চেতনত্ব, পালকত্ব প্রভৃতি গুণবশতঃ সদৃশ; (সয়ুজা)। ব্যাপ-ব্যাপকভাবে সংযুক্ত (সখায়া) পরস্পর মিত্রতাযুক্ত; সনাতন এবং অনাদি (সমান) তদ্রূপই (বৃক্ষ) অনাদি মূলস্বরূপ কারণ এবং শাখারূপ কাৰ্য্যযুক্ত বৃক্ষ; অর্থাৎ যাহা স্কুল হইয়া পুনশ্চ প্রলয়ে ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়, সেই তৃতীয় অনাদি পদার্থ;– এই তিনের গুণ কর্ম, স্বভাবও অনাদি। (তয়োরন্যঃ) এই জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে প্রথম জীব এই বৃক্ষরূপ সংসারে পাপ-পূণ্যরূপ ফলসমূহ (স্বাত্তি) উত্তমরূপে ভোগ করে। আর দ্বিতীয় পরমাত্মা, কর্মফল (অনশ্ন) ভোগ না করিয়া চারিদিকে অর্থাৎ অন্তরে বাহিরে সর্বত্র প্রকাশমান হইয়া আছেন। জীব অপেক্ষা ঈশ্বর, ঈশ্বর অপেক্ষা জীব এবং উভয় হইতে প্রকৃতি ভিন্ন-স্বরূপ এবং তিনটিই অনাদি ॥ ১ ॥ (শাশ্বতীভ্যঃ) অর্থাৎ অনাদি সনাতন জীবরূপ প্রজার জন্য পরমাত্মা বেদ দ্বারা সকল বিদ্যা প্রকাশ করিয়াছেন ॥ ২ ॥

অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাংবীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং স্বরূপাঃ ॥ অজো হ্যেকো জুষমাণোনুশেতে, জহাত্যেনাংভুক্তভোগামজোতন্যঃ ॥ ॥ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের বচন ॥

প্রকৃতি, জীব এবং পরমাত্মা এই তিন অজ অর্থাৎ যাহার কখনও জন্ম হয় না এবং ইহারা কখনও জন্মগ্রহণ করে না। অর্থাৎ এই তিন সমগ্র জগতের কারণ। ইহাদের কোন কারণ নাই। অনাদি জীব, এই অনাদি প্রকৃতিকে ভোগ করিতে আবদ্ধ হয়। কিন্তু পরমাত্মা তাহাতে আবদ্ধ হন না এবং ভোগ করেন না।

ঈশ্বর এবং জীবের লক্ষণ ঈশ্বর বিষয়ে বর্ণিত হইয়াছে। এখন প্রকৃতির লক্ষণ লিখিত হইতেছে —

সত্ত্বরজস্তমসাং সাম্যাবস্থা প্রকৃতিঃ, প্রকৃতের্মহান মহতোহঙ্কারো হঙ্কারাৎ পঞ্চতন্মাত্রাণভয়মিন্দ্রিয়ং পঞ্চতন্মাত্রেভ্যঃ স্থলভূতানি পুরুষ ইতি পঞ্চবিংশতির্গণঃ ॥ সাঙ্খ সূ০ ॥

(সত্ত্ব) শুদ্ধ (রজঃ) মধ্য (তমঃ) জাড্য অর্থাৎ জড়তা–এই তিন বস্তুর মিলনে যে এক সংঘাত হয়, তাহার নাম ‘প্রকৃতি। প্রকৃতি হইতে ‘মহত্তত্ব’ বুদ্ধি, তাহা হইতে অহংকার’, অহঙ্কার হইতে পঞ্চ তন্মাত্রা’, সূক্ষ্ম ভূত ও দশ ইন্দ্রিয় এবং একাদশ মন; পঞ্চতন্মাত্রা হইতে পৃথিবী আদি পঞ্চ ভূত–এই চতুর্বিংশতি এবং পঞ্চবিংশতি ‘পুরুষ’ অর্থাৎ জীব ও পরমেশ্বর। ইহাদের মধ্যে প্রকৃতি অবিকারিণী ও মহত্তত্ব, অহঙ্কার তথা পঞ্চ সূক্ষ্ম-ভূত প্রকৃতির কাৰ্য্য এবং ইন্দ্রিয় সমূহ, মন ও স্থূল-ভূত সমূহের কারণ। পুরুষ কাহারও প্রকৃতি, উপাদান কারণ নয় এবং কাহারও কাৰ্য্য নহে।

প্রশ্ন –সদেব সসাম্যেমগ্র আসীৎ ॥ ১ ॥ অসদ্বা ইদমগ্র আসীৎ ॥ ২ ॥ আত্মা বা ইদমগ্র আসীৎ ॥ ৩ ॥ ব্ৰহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ ॥ ৪ ॥ (শত০)। এগুলি উপনিষদের বচন।

হে শ্বেতকেতো! এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে সৎ ॥ ১ ॥ অসৎ ॥ ২ ॥ আত্মা ॥ ৩ ॥ এবং ব্রহ্মরূপ। ছিল ॥ ৪ ॥ পরে–

দৈক্ষত বহুঃ স্যাং প্রজায়েয়েতি ॥ ১ ॥ সোকাময়ত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি ॥ ২ ॥ ছা০ উপ০

তৈত্তিরীয় ও উপনিষদ্ ব্রহ্মানন্দবল্লী, অনু০ ৬ ॥ সেই পরমাত্মাই স্বেচ্ছায় বহুরূপ হইয়াছেন ॥১,২ ॥ সৰ্ব্বং ঋদ্বিদং ব্রহ্ম নেহ নানান্তি কিঞ্চন। ইহাও উপনিষদের বচন। নিশ্চয়ই সে সমস্ত জগৎ ব্রহ্ম। উহাতে অপর নানা প্রকারের কোন পদার্থ নাই, কিন্তু সমস্তই ব্রহ্মরূপ ॥ ৩ ॥

উত্তর–এই সকল বচনের অনর্থ করিতেছ কেন? কেননা, উপনিষদে সমস্ত লিখিত আছে :– সোম্যান্নেন শুঙ্গেনাপো মূলমন্বিচ্ছাদ্ভিসোম্য শুনে তেজোমূলমন্বিচ্ছ, তেজসা সোম্য শুঙ্গেন সম্মুলমন্বিচ্ছ, সম্মুলাঃ সোম্যমাঃ প্রজাঃ সদয়তনাঃ সপ্রতিষ্ঠাঃ ॥ ছান্দোগ্য উপনিষদ

হে শ্বেতকেতো! তুমি অন্নরূপে পৃথিবী কাৰ্য্য হইতে জলরূপ মূল কারণকে জানিও। কাৰ্য্যরূপ জল হইতে তেজোরূপ মূল এবং তেজোরূপ কাৰ্য্য হইতে সন্ধ্রপ কারণ নিত্য প্রকৃতিকে জানিবে। এই সত্যস্বরূপ প্রকৃতির সমস্তই জগতের মূল গৃহ ও স্থিতির স্থান। এ সমস্ত জগৎ সৃষ্টির পূর্বে অসৎ সদৃশ এবং জীবাত্মা, ব্রহ্ম ও প্রকৃতিতে লীন হইয়া বিদ্যমান ছিল, অভাব ছিল না।

আর এই যে, ‘সর্বং খলু’এই বচনটি দেখিতেছইহা কিহী কা ইট কী কা রোড়া ভানুমতী নে কুড়বাঁ জোড়া’র ন্যায়ই লীলা খেলা কারণ —

সৰ্ব্বং খন্বিদং ব্রহ্ম তজ্জলানিতিশান্ত উপাসীত ॥ ছান্দোগ্য।

এবং ‘নেহ নানাস্তি কিঞ্চন ৷ ইহা কঠবল্পীর বচন ॥

যেরূপ শরীরের অঙ্গ যতকাল শরীরে থাকে, ততকাল পর্যন্ত উহা কার্যকরী থাকে, কিন্তু পৃথক্ হইলে অকর্মণ্য হইয়া যায়, সেইরূপ প্রকরণস্থ বাক্য ‘সার্থক। কিন্তু প্রকরণ হইতে পৃথক্‌ অথবা বাক্যান্তরের সহিত সংযুক্ত হইলে, ‘অনর্থক হইয়া পড়ে। উক্ত বচনের অর্থ এইরূপ

হে জীব!তুমি ব্রহ্মের উপাসনা কর। সেইব্রহ্ম হইতে জগতের উৎপত্তি, স্থিতি এবং জীবনধারণ। হইয়া থাকে। ব্রহ্ম সৃজন এবং ধারণ করেন বলিয়া এই সমস্ত জগৎ বিদ্যমান অথবা তাহার সহচারী রহিয়াছে। তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য কাহারও উপাসনা করিও না। এই চেতন মাত্র, অখণ্ড ও একরস ব্রহ্ম রূপে নানা বস্তুর সংমিশ্রণ নাই। কিন্তু যাবতীয় বস্তু পৃথক পৃথক্ স্বরূপে পরমেশ্বর রূপ আধারে অবস্থিত আছে।

প্রশ্ন –জগতের কারণ কতগুলি?

উত্তর –তিনটি। প্রথম নিমিত্ত, দ্বিতীয় উপাদান এবং তৃতীয় সাধারণ। যদ্বারা নির্মিত কোন কিছু নির্মিত হয়, যদ্ব্যতীত হয় না, তাহাকে ‘নিমিত্ত’ কারণ বলে। উহা স্বয়ং হয় না, কিন্তু অপরকে প্রকারান্তর করিয়া নির্মাণ করে। দ্বিতীয় উপাদান কারণ। যদ্ব্যতীত কোন কিছু নির্মিত হয় না এবং যাহা অবস্থান্তররূপ হইয়া নির্মিত অথবা বিকৃত হয়, তাহাই উপাদান কারণ। তৃতীয় সাধারণ কারণ’ যাহা নির্মাণ কার্য্যের সাধন এবং সাধারণ নিমিত্ত তাহাকে সাধারণ কারণ বলে।

নিমিত্ত কারণ দ্বিবিধ। প্রথম ও মুখ্য নিমিত্ত কারণ ‘পরমাত্মা। তিনি কারণ হইতে সকল সৃষ্টির সৃজন, ধারণ, প্রলয় এবং সকল ব্যবস্থার রক্ষক। দ্বিতীয় কারণ পরমেশ্বরের সৃষ্টি হইতে পদার্থ সমূহ লইয়া বহুবিধ কাৰ্যান্তর নির্মাণকারী সাধারণ নিমিত্ত কারণ ‘জীব’ ॥

উপাদান কারণ –প্রকৃতি, পরমাণু। উহাকে সমস্ত জগৎ নির্মাণের সামগ্রী বলা হয়। উহা জড় পদার্থ বলিয়া স্বয়ং নির্মিত অথবা বিকৃত হইতে পারে না। কিন্তু অপর কাহারও দ্বারা নির্মিত বা বিকৃত হইয়া থাকে। কখনও কখনও জড় নিমিত্ত দ্বারা জড়ের উৎপত্তি এবং বিকৃতিও হয়। উদাহরণস্বরূপ পরমেশ্বর সৃষ্ট বীজ ভূমিতে পতিত হইয়া জলপ্রাপ্ত হইলে বৃক্ষাকার এবং অগ্নি প্রভৃতি জড় পদার্থের সংযোগ বশতঃ বিকৃতও হইয়া থাকে। কিন্তু নিয়মানুসারে এই সকল পদার্থের নির্মাণ অথবা বিকৃত হওয়া পরমেশ্বর ও জীবের অধীন।

যখন কোন বস্তু নির্মিত হয়, তখন যে যে সাধন অর্থাৎ জ্ঞান, দর্শন, বল, হস্ত ও নানাবিধ উপকরণ এবং দিক, কালও আকাশ আদি সাধারণ কারণ। উদাহরণ স্বরূপ ঘট নির্মাণকর্তা কুম্ভকার নিমিত্ত মৃত্তিকা; উপাদান; দণ্ড, চক্র প্রভৃতি সামান্য নিমিত্ত এবং দিক্‌ কাল, আকাশ, আলোক, চক্ষু, হস্ত, জ্ঞান ও ক্রিয়া প্রভৃতি নিমিত্ত সাধারণ এবং নিমিত্ত কারণও হইয়া থাকে। এই তিন কারণ ব্যতীত কোন বস্তু নির্মিত অথবা বিকৃত হইতে পারে না।

প্রশ্ন –নবীন বেদান্তিগণ কেবল পরমেশ্বরকেই জগতের অভিন্ননিমিত্তোপাদন কারণ বলিয়া মানেন।

যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহ্নতে চ ॥ ইহা উপনিষদের বচন।

মাকড়সা যেরূপ বাহির হইতে কোন পদার্থ না লইয়া দেহ নির্গত তন্তু দ্বারা জাল রচনা করিয়া স্বয়ং তন্মধ্যে খেলা করে, ব্রহ্মাও সেইরূপ নিজ হইতে জগৎ রচনা করিয়া স্বয়ং জগদাকার হইয়া ক্রীড়া করিতেছেন।

সেই ব্ৰহ্ম ইচ্ছা ও কামনা করিলেন, আমি ‘বহুরপ’ অর্থাৎ জগদাকার হইব। সংকল্প মাত্রেই সমস্ত জগঞ্জপে নির্মিত হইল। কেননা আদাবন্তে চয়ন্নাস্তি বর্তমানেপি তত্তথা ॥ ইহা মাক্যোপনিষদের কারিকা।

যাহা আদি ও অন্তে থাকে না, তাহা বর্তমানেও নাই। কিন্তু সৃষ্টির আদিতে জগৎ ছিল না, ব্রহ্ম ছিলেন। প্রলয়ান্তে জগৎ থাকিবে না। (কেবল ব্রহ্মই থাকিবেন)। তাহা হইলে বর্তমানে সমস্ত জগৎ ব্রহ্ম নহে কেন?

উত্তর– যদি আপনার কথানুসারে ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণ হন, তবে তিনি পরিণামী ও অবস্থান্তরযুক্ত বিকারী হইয়া পড়িবেন। কেননা উপাদান কারণের গুণ-কর্ম-স্বভাব কাৰ্য্যেও স্থিত থাকে।

কারণগুণপূর্বকঃ কায় গুণণা দৃষ্টঃ ॥ বৈশেষিক সু০।

যদি উপাদান কারণের সদৃশ কাৰ্যে গুণ থাকে, তবে ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দ স্বরূপ কাৰ্য্যরূপ জগৎ হওয়াতে অসৎ, জড় এবং আনন্দরহিত হইবেন। ব্রহ্ম অজ কিন্তু জগৎ হইয়াছে। ব্রহ্ম অদৃশ্য কিন্তু জগৎ দৃশ্য। ব্রহ্ম অখণ্ড কিন্তু জগৎ খণ্ডরূপ। যদি ব্রহ্ম হইতে পৃথিবী প্রভৃতি কাৰ্য্য উৎপন্ন হয়। তবে পৃথিবী প্রভৃতি কাৰ্য্যের জড়ত্বাদি গুণ ব্রহ্মেও থাকিবে। অর্থাৎ পৃথিবী আদি জড় পদার্থের ন্যায় ব্রহ্মও জড় পদার্থ হইবে। যেরূপ পরমেশ্বর চেতন সেইরূপ পৃথিবী আদি কাৰ্য্যেরও চেতন হওয়া উচিত।

আপনি যে মাকড়সার দৃষ্টান্ত দিয়াছেন, উহা আপনার মতের সাধক নহে বরং বাধক। কেননা, মাকড়সার জড়রূপ শরীর তন্তুর উপাদান কারণ, আর জীবাত্মা নিমিত্ত কারণ। ইহাও পরমাত্মার অদ্ভুত রচনা কৌশল। কারণ অন্য জন্তু শরীর হইতে জীব তন্তু বাহির করিতে পারে না। সেইরূপ সর্বব্যাপক ব্রহ্ম নিজের মধ্যে ব্যাপ্য প্রকৃতি ও পরমাণুরূপ কারণ হইতে স্থূল জগৎ নির্মাণ করিয়া। উহাকে দৃশ্যতঃ স্থলরূপ করিয়া তন্মধ্যে ব্যাপক হইয়া সাক্ষীভূত আনন্দময় হইয়া রহিয়াছেন। আর । যে পরমাত্মা ঈক্ষণ’ অর্থাৎ দর্শন, বিচার, এবং কামনা করিলেন, “আমি সমস্ত জগৎ নির্মাণ করিয়া প্রকাশিত হইব’, অর্থাৎ যখন জগৎ উৎপন্ন হয় তখনই জীবগণের বিচার, জ্ঞান, ধ্যান, উপদেশ এবং শ্রবণের মধ্যে পরমেশ্বর প্রকাশিত এবং বিবিধ স্থূল পদার্থের সহিত বিদ্যমান থাকেন। যখন প্রলয় হয়, তখন পরমেশ্বর এবং মুক্ত-জীব ব্যতীত অপর কেহ তাহা জানিতে পারে না।

পূর্বোক্ত যে কারিকা উহা ভ্রমমূলক। কেননা, সৃষ্টির আদিতে অর্থাৎ প্রলয়কালে জগৎ স্থলরূপে। প্রকাশিত ছিল না, এবং সৃষ্টির অন্ত অর্থাৎ প্রলয়ের আরম্ভ হইতে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত জগতের কারণ সূক্ষ্মরূপে অপ্রকাশিত থাকে। কারণঃ

তম আসীত্তমসা গুঢ়মগ্রে ॥ ১ ইহা ঋগ্বেদের বচন। আসীদিদং তমোভূতমপ্রজ্ঞাতমলক্ষণ। অপ্রতকর্মবিজ্ঞেয়ং প্রসুপ্তমিব সর্বতঃ ॥২॥ মনু।

এই সমস্ত জগৎ সৃষ্টির পূর্বে প্রলয় অবস্থায় অন্ধকারে আবৃত ও আচ্ছাদিত ছিল। প্রলয়ারম্ভের পরেও সেইরূপই থাকে। সেই সময় উহা কাহারও জানিবার, তর্ক করিবার অথবা সুস্পষ্ট চিহ্ন দ্বারা ইন্দ্রিয় সমূহের উপলব্ধি যোগ্য ছিল না, হইবে না। কিন্তু বর্তমানে উহা জানা যায়, স্পষ্ট চিহ্ন সমূহের দ্বারা জানিবার যোগ্য এবং যথার্থরূপে উপলব্ধ হয় ॥১,২ ॥

পুনশ্চ উক্ত কারিকাকার বর্তমানে ও জগতের যে অভাব লিখিয়াছেন উহাও সর্বদা প্রমাণ বিরুদ্ধ। কারণ প্রমাতা প্রমাণ দ্বারা যাহা জ্ঞাত এবং প্রাপ্ত হয় তাহা কখনও অন্যথা হইতে পারে না।

প্রশ্ন– পরমেশ্বরের জগৎ নির্মাণ করিবার প্রয়োজন কী।

উত্তর –নির্মাণ না করিবার প্রয়োজন কী?

প্রশ্ন –নির্মাণ না করিলে তিনি আনন্দে থাকিতেন এবং জীবগণেরও সুখ-দুঃখ হইত না।

উত্তর- ইহা অলস ও অপদার্থের কথা, পুরুষকার সম্পন্ন ব্যক্তির নহে। আর প্রলয়বস্থায় জীবের সুঃখ-দুঃখই বা কী? সৃষ্টির সুখ-দুঃখ তুলনা করিলে সুখ বহু গুণে অধিক হইবে এবং বহু পবিত্ৰাত্মা জীবও মুক্তিসাধন করিয়া মোক্ষানন্দ ভোগ করেন। জীব প্রলয়কালে কর্মহীনের ন্যায়। সুষুপ্তিতে পড়িয়া থাকে। ঈশ্বর প্রলয়ের পূর্ব সৃষ্টিতে পাপপুণ্যের ফল জীবগণকে কীরূপে দিতে পারিতেন? জীবগণই বা কীরূপে কর্মফল ভোগ করিতে পারিত?

যদি কেহ তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘চক্ষুর প্রয়োজন কী? তুমি বলিবে, দর্শন’। তাহা হইলে জগৎ সৃষ্টি ব্যতীত ঈশ্বরে সৃষ্টিবিজ্ঞান, বল এবং ক্রিয়ার প্রয়োজন কী? তুমি উত্তরে অন্য কিছুই বলিতে পারিবে না। আর জগৎসৃষ্টি দ্বারাই পরমাত্মার ন্যায়শীলতা, ধারণ এবং দয়া প্রভৃতি গুণ সার্থক হইতে পারে। তাহার অনন্ত সামর্থ্য জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয় ব্যবস্থা দ্বারাই সার্থক হইয়া থাকে। যেরূপ নেত্রের স্বাভাবিক গুণ দর্শন, সেইরূপ জগৎ সৃষ্টি করিয়া সমস্ত জীবকে অসংখ্য পদার্থ প্রদান পূর্বক পরোপকার করা ঈশ্বরের স্বাভাবিক গুণ।

প্রশ্ন –প্রথমে বীজ না বৃক্ষ?

উত্তর –বীজ। কেননা বীজ হেতু, নিদান, এবং কারণ ইত্যাদি শব্দ একার্থবাচক। যেহেতু কারণের নাম বীজ, এইজন্য কাৰ্য্যের পূর্বেই থাকে।

প্রশ্ন –যদি পরমেশ্বর সর্বশক্তিমান হইয়া থাকেন তাহা হইলে তিনি কারণ এবং জীবকেও উৎপন্ন করিতে পারেন। যদি করিতে না পারেন তবে তিনি সর্বশক্তিমানও হইতে পারেন না।

উত্তর –সর্বশক্তিমান শব্দের অর্থ পূর্বে লিখিত হইয়াছে। যিনি অসম্ভব কাৰ্য্য করিতে পারেন, তাহাকেই কি সর্বশক্তিমান বলে? যদি ঈশ্বর অসম্ভব কাৰ্য্য অর্থাৎ কারণ ব্যতীত কাৰ্য্য করিতে পারেন তাহা হইলে তিনি কারণ ব্যতীত দ্বিতীয় ঈশ্বর সৃষ্টি করিতে স্বয়ং মৃত্যুগ্রস্ত হইতে এবং জড়, দুঃখী, অন্যায়কারী, অপবিত্র ও দুষ্কর্মকারী ইত্যাদিও হইতে পারেন কি না? ঈশ্বর স্বাভাবিক নিয়মানুসারে অর্থাৎ যেমন অগ্নি উষ্ণ, জল শীতল এবং পৃথিবী আদি সমস্ত জড় –এই সকলকে তিনি বিপরীত গুণবিশিষ্ট করিতে পারেন না। যেমন তিনি জড় হইতে পারেন না সেইরূপ জড়কে চেতনও করিতে পারেন না। ঈশ্বরের নিয়ম সত্য ও পূর্ণ বলিয়া তিনি তাহার পরিবর্তন করিতে পারেন না। সুতরাং সৰ্ব্বশক্তিমান শব্দের অর্থ এই পৰ্য্যন্তই যে, পরমাত্মা কাহারও সাহায্য ব্যতীত নিজের সকল কার্য্য সম্পন্ন করিতে পারেন।

প্রশ্ন –ঈশ্বর সাকার অথবা নিরাকার? নিরাকার হইলে তিনি হস্তাদি সাধন ব্যতীত জগন্নির্মাণ করিতে পারেন না। কিন্তু সাকার হইলে কোন দোষ ঘটে না।

উত্তর –ঈশ্বর নিরাকার। যাহা সাকার অর্থাৎ শরীর বিশিষ্ট তাহা ঈশ্বর নহে। কারণ তাহা হইলে তিনি পরিমিত শক্তিসম্পন্ন, দেশ-কাল-বস্তুসমূহে পরিচ্ছিন্ন এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ছেদন-ভেদন, শীতোষ্ণ ও জ্বরপীড়াদিযুক্ত হইবেন। তাহাতে জীবের গুণ ব্যতীত ঈশ্বরের গুণ থাকিতে পারে না। যেমন তুমি ও আমি সাকার অর্থাৎ শরীরধারী বলিয়া অণু-পরমাণু-ত্রসরেণু এবং প্রকৃতিকে স্ববশে আনিতে পারিনা; এবং সেইসব সূক্ষ্ম পদার্থগুলিকে ধরিয়া স্কুল করিতে পারি না। সেইরূপ স্থূলদেহধারী সূক্ষ্ম পদার্থ হইতে সূক্ষ্ম জগৎ নির্মাণ করিতে পারিবে না। পরমেশ্বরের ভৌতিক ইন্দ্রিয় গোলক ও হস্ত পদাদি অবয়ব নাই, কিন্তু তিনি তাহার অনন্ত শক্তি, বল এবং পরাক্রম দ্বারা যে সকল কার্য্য করেন, তাহা জীব ও প্রকৃতি দ্বারা কখনও হইতে পারে না। তিনি প্রকৃতি অপেক্ষাও সূক্ষ্ম এবং উহাতে ব্যাপক বলিয়া প্রকৃতিকে জগদাকার দান করেন এবং সর্বগত হওয়ার কারণে সকলের ধারণ ও প্রলয় করিতে পারেন।

প্রশ্ন –মনুষ্যাদির মাতা-পিতা সাকার বলিয়া যেরূপ তাহাদের সন্তানেরাও সাকার হইয়া থাকে এবং মাতা-পিতা নিরাকার হইলে সন্তানেরাও নিরাকার। সেইরূপ পরমেশ্বর নিরাকার হইলে তাহার সৃষ্ট জগৎ নিরাকার হওয়া উচিত।

উত্তর –আপনার এই প্রশ্ন বালকোচিত। কারণ, আমি এইমাত্র বলিয়াছি যে, পরমেশ্বর জগতের উপাদান কারণ নহেন কিন্তু নিমিত্ত কারণ। আর যাহা স্থল উহা প্রকৃতি ও পরমাণু জগতের উপাদান কারণ। উহারা সর্বথা নিরাকার নহে কিন্তু পরমেশ্বর অপেক্ষা স্থূল আকারের এবং অন্য কাৰ্য্য অপেক্ষা সূক্ষ্ম ॥

প্রশ্ন –পরমেশ্বর কি কারণ ব্যতীত কাৰ্য্য করিতে পারেন না?

উত্তর –না। কেননা যাহার ‘অভাব’ অর্থাৎ যাহা বর্তমান নয় উহার ‘ভাব’ অর্থাৎ বর্তমান। হওয়া সর্বথা অসম্ভব। যদি কেহ গল্পচ্ছলে বলে,–”আমি বন্ধ্যার পুত্র-কন্যার বিবাহ দেখিয়াছি, সে নরশৃঙ্গের ধনুক এবং আকাশকুসুমের মালা ধারণ করিয়াছিল। সে মৃগ তৃষ্ণিকার জলে স্নান এবং গন্ধর্ব নগরে বাস করিত, সেখানে বিনা মেঘে বৃষ্টি এবং মৃত্তিকা ব্যতীত সব অন্নাদি উৎপন্ন হইত” এ সকল যেরূপ অসম্ভব, সেইরূপ কারণ ব্যতীত কাৰ্য্যোৎপত্তিও অসম্ভব। আবার যদি কেহ বলে, “মম মাতাপিতরৌ ন স্তোহেমেবমেব জাতঃ। মম মুখে জিহ্বা নাস্তি বদামি চ,” আমার মাতা পিতা ছিল না, আমি এমনই হইয়াছি। আমার মুখে জিহ্বা নাই, কথা বলিতেছি”। “গর্তে সাপ ছিল না, কিন্তু বাহির হইয়া আসিল।” “আমি কোনও স্থানে ছিলাম না, ইহারা কোন স্থানে ছিল না, কিন্তু আমরা সকলে আসিয়াছি।” এইরূপ অসম্ভব কথা, প্রমত্তগীত অর্থাৎ পাগলদের কথা।

প্রশ্ন –যদি কারণ ব্যতীত কাৰ্য্য না হয়,তবে কারণের কারণ কী?

উত্তর –যাহা কেবল কারণরূপই তাহা কাহারও কাৰ্য্য হয় না; যাহা কাহারও কারণ এবং কাহারও কাৰ্য্য উহা স্বতন্ত্র পদার্থ। যথা পৃথিবী গৃহাদির কারণ এবং জলাদির কাৰ্য্য। কিন্তু আদি কারণ প্রকৃতি, সে অনাদি।

.

মূলে মূলাভাবাদমূলং মূলম। সাংখ্য সূ০।

মূলের মূল অর্থাৎ কারণের কারণ হয় না। অতএব যাহা সকল কার্যের কারণ, তাহার কারণ নাই। কেননা, কোন কাৰ্য্যের আরম্ভের পূর্বে তিনটি কারণ অবশ্যই থাকে। যথা–বস্ত্র নির্মাণের পূর্বে তন্তুবায়, তুলার সূত্র ও নালিকা প্রভৃতি বর্তমান থাকে বলিয়া বস্তুনির্মিত হয়, সেইরূপ জগদুৎপত্তির পূর্বে পরমেশ্বর, প্রকৃতি, কাল এবং আকাশ ছিল বলিয়া এবং জীব অনাদি, সে কারণ এই জগতের উৎপত্তি হইয়া থাকে। এই সকলের মধ্যে কোনো একটি না থাকিলে জগও। হইত না।

অত্র নাস্তিকা আহু : শূন্যং তত্ত্বং ভাবোয়বি নশ্যতি বস্তুধর্মৰ্বাদ্বিনাশস্য ॥ ১ ॥ সাংখ্য সূ০ ॥ অভাবা ভাবোৎপত্তির্নানুপমৃদ্য প্রাদুর্ভাবাৎ ॥ ২ ॥ ঈশ্বরঃ কারণং পুরুষকর্মাফল্যদর্শনাৎ ॥ ৩ ॥ অনি মিত্ততো ভাববাৎপত্তিঃ কন্টকতৈক্ষ্যাদিদর্শনাৎ ॥ ৪ ॥ সর্বৰ্মনিত্যমুৎপত্তিবিনাশধর্মকত্বাৎ ॥ ৫ ॥ সর্ব নিত্যং পঞ্চভূতনিত্যত্বাৎ ॥ ৬ ॥ সর্বং পৃথভাবলক্ষণপৃথাৎ ॥ ৭ ॥ সর্বমভাবো ভাবেম্বিতরেতরাভাবসিদ্ধেঃ ॥ ৮ ॥ ন্যায় সূ০। অ০ ৪।১ ॥

(প্রথম নাস্তিক)–শূন্যই একমাত্র পদার্থ। সৃষ্টির পূর্বে শূন্য ছিল এবং অন্তেও শূন্য থাকিবে। কারণ, যাহা ভাব অর্থাৎ বর্তমান পদার্থ, তাহার অভাব শুন্যে পরিণত হইবে।

উত্তর –আকাশ, অদৃশ্য, অবকাশ এবং বিন্দুকেও শূন্য বলে। শূন্য জড় পদার্থ। এই শূন্যের মধ্যে সমস্ত পদার্থ অদৃশ্য থাকে। যেমন একটি বিন্দু হইতে রেখা, রেখা সমূহ হইতে বর্তুলাকার হইয়া থাকে, সেইরূপ ঈশ্বরের রচনানুসারে ভূমি এবং পর্বতাদি সৃষ্ট হইয়া থাকে। পুনশ্চ, শূন্যের জ্ঞাতা শূন্য নহে ॥ ১ ॥

(দ্বিতীয় নাস্তিক) –অভাব হইতে ভাবের উৎপত্তি হইয়া থাকে। যথা–অঙ্কুর বীজকে না ফাটাইয়া উৎপন্ন হয় না। কিন্তু বীজকে ভাঙিয়া দেখিলে তন্মধ্যে অভাব দৃষ্ট হইয়া থাকে। যেহেতু পূর্বে অঙ্কুর দৃষ্ট হয় নাই, অতএব উহা অভাব হইতে উৎপন্ন হইয়াছে।

উত্তর –যাহা বীজকে উপমর্দন করে (ফাটায়) তাহা প্রথম হইতেই বীজের মধ্যে ছিল। না থাকিলে কখনও উৎপন্ন হইত না। ২।

তৃতীয় নাস্তিক বলে যে –পুরুষ কর্ম করিলে কর্মফল পাওয়া যায় না। অনেক কর্ম নিষ্ফল হইতে দেখা যায়। অতএব অনুমান করা যায় যে কর্মফলপ্রাপ্তি ঈশ্বরাধীন। ঈশ্বর যে কর্মফল দিতে ইচ্ছা করেন তাহা তিনি দিয়া থাকেন, যে কর্মফল দিতে ইচ্ছা করেন না, তাহা তিনি দেন না। সুতরাং কর্মফল ঈশ্বরাধীন।

উত্তর– কর্মফল ঈশ্বরাধীন হইলে কর্মব্যতীত ঈশ্বর ফল দেন না কেন? সুতরাং ঈশ্বর মনুষ্যদিগকে কর্মানুযায়ী ফল দিয়া থাকেন। ঈশ্বর স্বাধীনভাবে পুরুষকে কর্মফল দিতে পারেন না, কিন্তু জীব যেমন কর্ম করে ঈশ্বর তদ্রূপই ফল দান করেন ॥ ৩ ॥

চতুর্থ নাস্তিক –নিমিত্ত ব্যতীত পদার্থের উৎপত্তি হইয়া থাকে। উদাহরণস্বরূপ, বাবলা প্রভৃতি বৃক্ষের কন্টক তীক্ষাগ্র দেখা যায়। এতদ্বারা জানা যায় যে, যখন যখন সৃষ্টি আরম্ভ হয় তখন তখন শরীরাদি পদার্থ নিমিত্ত ব্যতীত উৎপন্ন হইয়া থাকে।

উত্তর–যাহা হইতে কোন পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাহাই তাহার নিমিত্ত। কন্টক বৃক্ষ ব্যতীত উৎপন্ন হয় না কেন? ॥ ৪ ॥

পঞ্চম নাস্তিক বলে যে, সকল পদার্থেই উৎপত্তি ও নাশবান সুতরাং সব অনিত্য। শ্লোকার্ধৈন প্রবক্ষ্যামি য়দুক্তং গ্রন্থকোটিভিঃ। ব্ৰহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মব নাপরঃ ॥

ইহা কোনও গ্রন্থের শ্লোক। নবীন বেদান্তিগণ পঞ্চম নাস্তিক শ্রেণীর অন্তর্গত। কারণ তাহাদের মতে কোটি কোটি গ্রন্থের এই সিদ্ধান্ত যে, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন নহে।

উত্তর –সকলের অনিত্যতা নিত্য হইলে সকল অনিত্য হইতে পারে না।

প্রশ্ন –সকলের অনিত্যতাও অনিত্য, যেরূপ অগ্নি কাষ্ঠকে নষ্ট করিয়া স্বয়ং নষ্ট হইয়া যায়।

উত্তর –যাহা যথার্থরূপে উপলব্ধ হয়, তাহার বর্তমান অনিত্যত্ব ও পরমসূক্ষ্ম কারণকে কখনও অনিত্য বলা যাইতে পারে না। যদি বেদান্তিগণ ব্রহ্ম হইতে জগতের উৎপত্তি স্বীকার করেন, তবে ব্রহ্ম সত্য বলিয়া তাহার কাৰ্য্য কখনও অসত্য হইতে পারে না। যদি বল রঞ্জুও সর্পাদি স্বপ্নবৎ কল্পিত, তথাপি তাহা হইতে পারে না। কারণ কল্পনা গুণ। গুণ দ্রব্য এবং দ্রব্য হইতে গুণ পৃথক্ থাকিতে পারে না। কল্পনাকারী নিত্য হইলে তাহার কল্পনাও নিত্য হওয়া আবশ্যক। নতুবা তাহাকেও অনিত্য বলিয়া স্বীকার কর।

যথা –দর্শন ও শ্রবণ ব্যতীত স্বপ্ন কখনও হয় না। জাগ্রত অবস্থায় অর্থাৎ বর্তমানে যে, সত্য পদার্থের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ হইতে প্রত্যক্ষাদি জ্ঞান হয়, সংস্কার অর্থাৎ তাহার বাসনারূপ জ্ঞান আত্মাতে থাকে। তাহাই স্বপ্নে প্রত্যক্ষরূপে দৃষ্ট। যেরূপ সুষুপ্তি অবস্থায় বাহ্য পদার্থ সম্বন্ধে জ্ঞানাভাব সত্ত্বেও বাহ্য পদার্থ সমূহ বিদ্যমান থাকে, সেইরূপ প্রলয়েও কারণদ্রব্য বিদ্যমান থাকে। সংস্কার ব্যতীত স্বপ্ন হইলে জন্মান্ধেরও রূপের সম্বন্ধ হওয়া উচিত। সুতরাং স্বপ্নাবস্থায় পদার্থ সমূহের জ্ঞানমাত্র থাকে, বাহিরে সকল পদার্থ বিদ্যমান থাকে।

প্রশ্ন –যেরূপ জাগ্রত অবস্থায় দৃশ্যমান্ পদার্থ সমূহ স্বপ্ন ও সুষুপ্তিতে অনিত্য, সেইরূপ। জাগ্রত অবস্থায় দৃশ্যমান্ সমূহকেও স্বপ্নবস্থার দৃশ্যমান পদার্থ সমূহের ন্যায় মনে করা উচিত।

উত্তর –এইরূপ কখনও মনে করা যায় না। কারণ স্বপ্ন এবং সুষুপ্তিতে বাহ্য পদার্থ সমূহের জ্ঞানাভাব মাত্র হয়, অভাব হয় না। যেরূপ কাহারও পশ্চাদ্ভাগে অনেক পদার্থ অদৃষ্ট থাকিলে ঐ সকলের অভাব হয় না, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি অবস্থাও সম্বন্ধে সেইরূপ। অতএব যাহা পূর্বে বলা হইয়াছে, ব্রহ্ম, জীব এবং জগতের কারণ অনাদি এবং নিত্য তাহাই সত্য ॥ ৫ ॥

ষষ্ঠ নাস্তিক বলে যে, –যেহেতু পঞ্চভূত নিত্য, অতএব সমস্ত জগৎ নিত্য।

উত্তর –ইহা সত্য নহে। কারণ যে পদার্থের উৎপত্তি ও বিনাশের কারণ দৃষ্ট তাহা নিত্য নহে। সমস্ত স্থূল জগৎ, শরীর এবং ঘটপটাদি পদার্থকে উৎপন্ন ও বিনষ্ট হইতে দেখা যায়। সুতরাং কাৰ্য্যকে নিত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না ॥ ৬ ॥

সপ্তম শ্রেণীর নাস্তিকেরা বলে যে, সকল পদার্থ পৃথক পৃথক্, এক নহে। আমরা যে সকল পদার্থ দেখি, তন্মধ্যে কোন দ্বিতীয় একই পদার্থ দৃষ্ট হয় না।

উত্তর –অবয়ব সমূহের মধ্যে অবয়ব, বর্তমান কাল, আকাশ, পরমাত্মা এবং জাতি –এই সকল পৃথক পৃথক পদার্থসমুহের মধ্যে একই। এই সকল হইতে পৃথক কোন পদার্থ থাকিতে পারে না। সুতরাং সমস্ত পদার্থ পৃথক্‌ নহে, কিন্তু স্বরূপতঃ পৃথক পৃথক্‌ এবং পৃথক পৃথক পদার্থ সমূহের মধ্যে এক পদার্থও আছে ॥

অষ্টম নাস্তিক বলে যে, –সকল পদার্থের মধ্যে ইতরেতর অভাবের সিদ্ধি হয় বলিয়া সমস্ত অভাবরূপ। যথা –অনশ্বে গৌঃ; অগৌরশ্বঃ’। গো অশ্ব নহে, অশ্ব গো নহে। সুতরাং সমস্ত অভাবরূপ মানা উচিত।

উত্তর –সকল পদার্থেইতরেতরাভাব যোগ আছে। কিন্তু ‘গবি গৌরশ্বেশ্বে ভাবরূপা বর্তত এব”, গো তে গো এবং অশ্বে অশ্বের ভাবই আছে, অভাব কখনও হইতে পারে না। পদার্থে ভাব না থাকিলে ইতরেতরাভাব কাহার মধ্যে বলা যাইবে? ॥ ৮ ॥

নবম নাস্তিক বলে যে –স্বভাব হইতে জগতের উৎপত্তি হয়। যেমন জল ও অন্ন একত্র পচিলে কৃমি; বীজ, পৃথিবী ও জলের সংমিশ্রণে তৃণ, বৃক্ষ, প্রস্তরাদি উৎপন্ন হয় এবং যেরূপ সমুদ্র ও বায়ুর সংযোগ বশতঃ তরঙ্গ, তরঙ্গ হইতে সমুদ্রফেন; এবং হরিদ্রা চুণ ও লেবুর রসের সংমিশ্রণে তিলক মৃত্তিকা প্রস্তুত হয়, সেইরূপ সমস্ত জগৎ তত্ত্ব সমূহের স্বাভাবিক গুণ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। ইহার সৃষ্টিকর্তা কেহই নাই ॥

উত্তর –জগতের উৎপত্তি স্বভাব হইতে হইলে উহার কখনও বিনাশ হইবে না। আবার বিনাশও স্বভাব হইতে হয় স্বীকার করিলে, উৎপত্তিও হইবে না। উভয় স্বভাব যুগপৎ দ্রব্যে স্বীকার করিলে কখনও উৎপত্তি ও বিনাশের ব্যবস্থা হইতে পারে না। নিমিত্ত বশতঃ উৎপত্তি ও বিনাশ স্বীকার করিলে নিমিত্ত উৎপন্ন ও বিনাশশীল দ্রব্য হইতে পৃথক্‌ মনে করিতে হইবে। স্বভাব হইতে উৎপত্তি ও বিনাশ হইলে একই সময়ে উৎপত্তি ও বিনাশ হওয়া সম্ভব নহে। যদি স্বভাব হইতেই উৎপত্তি হয়, তবে এই পৃথিবীর নিকটে অন্য পৃথিবী, চন্দ্র, সূৰ্য্য আদি উৎপন্ন হয় না কেন? যে যে পদার্থের যোগে যাহা যাহা উৎপন্ন হয় তাহা তাহা ঈশ্বরকৃত পদার্থ ছাড়া অন্য কিছু নহে, যেরূপ বীজ, অন্ন ও জলাদি যোগে তৃণ বৃক্ষ এবং কীটাদি উৎপন্ন হয়, তদ্ব্যতীত হয় না। হরিদ্রা, চুণ ও লেবুর রস, দূর দূর দেশ হইতে আসিয়া স্বয়ং মিলিত হয় না। কিন্তু কেহ মিলিত করিলেই মিলিত হয়। আবার যথোচিত পরিমাণে মিলিত করিলেই তিলক মৃত্তিকা প্রস্তুত হয়, ন্যূনাধিক পরিমাণে অথবা অন্য প্রকার হইলে তিলক মৃত্তিকা হয় না। সেইরূপ পরমেশ্বর কর্তৃত প্রকৃতি ও পরমাণু, জ্ঞান ও যুক্তিপূর্বক সংমিশ্রিত না হইলে জড় পদার্থের কোন কার্যসিদ্ধির উপযোগী পদার্থ বিশেষরূপে নির্মিত হওয়া অসম্ভব। অতএব স্বভাব হইতে সৃষ্টি হয় না, কিন্তু পরমেশ্বরের রচনাক্রমে সৃষ্টি হইয়া থাকে ॥ ৯ ॥

প্রশ্ন –এই জগতের কর্না ছিল না, নাই এবং হইবে না। কিন্তু অনাদিকাল হইতে ইহা যেরূপ নির্মিত ছিল সেইরূপই আছে। ইহার কখনও উৎপত্তি হয় নাই এবং কখনও বিনাশ হইবে না।

উত্তর –কৰ্ত্তা ব্যতীত কোনো ক্রিয়া অথবা ক্রিয়াজন্য কোনো পদার্থ নির্মিত হইতে পারে না। পৃথিব্যাদিপদার্থের মধ্যে সংযোগ বিশেষ হইতে রচনা দৃষ্ট হয়। ইহা কখনও অনাদি হইতে পারে না। যাহা সংযোগ হইতে উৎপন্ন হয়, তাহা সংযোগের পূর্বে এবং বিনাশের অন্তে থাকে না। যদি তুমি ইহা স্বীকার না কর, তবে সর্বাপেক্ষা কঠিন প্রস্তর, হীরক এবং ইস্পাত প্রভৃতি ভাঙিয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া, অথবা গলাইয়া কিংবা ভস্ম করিয়া দেখ যে, এ সকলের মধ্যে পৃথক পৃথক পরমাণু সমূহ মিলিত রহিয়াছে কিনা। যদি মিলিত হইয়া থাকে, তবে কালক্রমে অবশ্য পৃথক পৃথও। হইয়া যাইবে ॥

প্রশ্ন –অনাদি ঈশ্বর কেহই নাই। কিন্তু যিনি যোগাভ্যাস দ্বারা অণিমা প্রভৃতি ঐশ্বর্য প্রাপ্ত হইয়া সর্বজ্ঞত্বাদি গুণযুক্ত পূর্ণজ্ঞানী হন, সেই জীবকেই পরমেশ্বর বলে।

উত্তর –যদি অনাদি ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা না হন, তবে সাধনা দ্বারা সিদ্ধিপ্রাপ্ত জীবগণের আধার জীবন, শরীর এবং ইন্দ্রিয়গোলক কীরূপে নির্মিত হইতে পারে? এই সকল ব্যতীত জীব সাধনা করিতে পারে না। সাধনা ব্যতীত সিদ্ধি কীরূপে হইবে? জীব যতই সাধনা করিয়া সিদ্ধ হউক না কেন, কখনও সনাতন, অনাদি এবং অনন্ত-সিদ্ধিসম্পন্ন পরমেশ্বর সদৃশ হইতে পারিবে না। কারণ জীবের চরম সীমা পর্যন্ত জ্ঞানবৃদ্ধি হইলেও তাহার জ্ঞান ও সামর্থ্য পরিমিত। তাহার জ্ঞান ও সামর্থ্য অনন্ত হইতে পারে না। দেখ। আজ পর্যন্ত ঈশ্বরকৃত সৃষ্টিক্রমকে পরিবর্তন করিতে পারেন এরূপ যোগী জন্মায় নাই, জন্মাইবেনও না। অনাদি সিদ্ধ পরমেশ্বর নেত্র দ্বারা দেখিবার এবং কর্ণ দ্বারা শুনিবার ব্যবস্থা করিয়াছেন, কোনও যোগী তাহা পরিবর্তন করিতে পারেন না। সুতরাং জীব কখনও ঈশ্বর হইতে পারে না।

প্রশ্ন –কল্প-কল্পান্তরে ঈশ্বর কি ভিন্ন-ভিন্ন রূপ সৃষ্টি করেন, অথবা একরূপ সৃষ্টি করেন?

উত্তর –এখন যেরূপ আছে, পূর্বেও সেইরূপ ছিল এবং ভবিষ্যতে সেইরূপ থাকিবে কোনরূপ প্রভেদ করা হয় নাই ॥

সূয়াচন্দ্রমসৌ ধাতা যথাপূর্বৰ্মকল্পয়ৎ। দিবং চ পৃথিবীং চান্তরিক্ষমথথা স্বঃ ॥ ঋ০। ম০ ১০। ১৯০৷৩ ॥

(ধাতা) পরমেশ্বর যেরূপ পূর্বকল্পে সূৰ্য্য, চন্দ্র, বিদ্যুৎ, পৃথিবী এবং অন্তরীক্ষ প্রভৃতি সৃষ্টি করিয়াছিলেন বর্তমানেও সেইরূপ এবং ভবিষ্যতেও সেইরূপ করিবেন। অতএব পরমেশ্বরের কার্য ভ্রম-প্রমাদ রহিত বলিয়া সর্বদা একরূপই হইয়া থাকে। যিনি অল্পজ্ঞ এবং যাঁহার জ্ঞানের ক্ষয়-বৃদ্ধি হয়, তাঁহারই কাৰ্য্যে ভুলভ্রান্তি হইয়া থাকে, ঈশ্বরের কাৰ্য্যে হয় না।

প্রশ্ন –সৃষ্টি বিষয়ে শাস্ত্রে ঐক্য আছে, না বিরোধ?

উত্তর –ঐক্য আছে।

প্রশ্ন –ঐক্য থাকিলে– তস্মাদ্বা এতস্মাদাত্মন আকাশঃ সম্ভুতঃ। আকাশদ্বায়ুঃ। বায়োরগ্নিঃ। অগ্নেরাপঃ। অদ্ভ্যঃ পৃথিবী। পৃথিব্যা ওষধয়ঃ। ওষধিভ্যোন্ন অন্নাদ্রেত। রেতসঃ পুরুষ। স বাএষ পুরুষোন্নরসময়ঃ ॥ ইহা তৈত্তিরীয় উপনিষদের বচন ॥

সেই পরমেশ্বর এবং প্রকৃতি হইতে আকাশ=অবকাশ, অর্থাৎ যে কারণরূপ দ্রব্য সর্বত্র বিস্তৃত ছিল, উহাকে একত্র করাতে অবকাশ উৎপন্ন হয়, বস্তুতঃ আকাশের উৎপত্তি হয় না। কেননা, আকাশ ব্যতীত প্রকৃতি ও পরমাণু কোথায় থাকিতে পারে? আকাশের পরে বায়ু, বায়ুর পরে অগ্নি, অগ্নির পরে জল, জলের পরে পৃথিবীর উৎপত্তি হয়। পৃথিবী হইতে ওষধি, ওষধি হইতে অন্ন, অন্ন হইতে বীৰ্য্য অর্থাৎ পুরুষ অর্থাৎ শরীর উৎপন্ন হয়।

এস্থলে আকাশাদি ক্রমানুসারে, এই ছান্দোগ্যে অগ্ন্যাদি এবং ঐতরেয়ে জলাদি ক্রমানুসারে সৃষ্টি হইয়াছে (এইরূপ বলা হইয়াছে)। বেদে কোন স্থলে পুরুষ হইতে, কোন স্থলে হিরণ্যগর্ভ আদি হইতে, মীমাংসায় কর্ম, বৈশেষিকে কাল, ন্যায়ে পরমাণু, যোগে পুরুষার্থ, সাংখ্যে প্রকৃতি এবং বেদান্তে ব্রহ্ম হইতে সৃষ্টির উৎপত্তি মানা হইয়াছে। এমতাবস্থায় কাহাকে সত্য আর কাহাকে মিথ্যা স্বীকার করিব?

উত্তর –এ বিষয়ে সকলই সত্য, কেহই মিথ্যা নহে। যিনি বিপরীত বুঝেন তিনিই মিথ্যা। কেননা পরমেশ্বর জগতের নিমিত্ত কারণ এবং প্রকৃতি জগতের উপাদান কারণ। যখন মহাপ্রলয় হয়, তাহার পর আকাশাদি ক্রম, অর্থাৎ যখন আকাশ এবং বায়ু প্রলয় হয় না এবং অগ্নির আদির হয়, তখন অগ্ন্যাদিক্রমে সৃষ্টি হইয়া থাকে। আবার যখন বিদ্যুৎ এবং অগ্নির নাশ হয় না,তখন জলক্রমে সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ যে যে প্রলয়ে যে যে পদার্থ পৰ্য্যন্ত প্রলয় হয় তাহার পর সেই পদার্থ হইতে সৃষ্টির উৎপত্তি হইয়া থাকে। পুরুষ এবং হিরণ্যগর্ভ প্রভৃতি প্রথম সমুল্লাসে লিখিতও হইয়াছে ঐ সমস্ত পরমেশ্বরের নাম।

একই কাৰ্য্যে একই বিষয়ে বিরুদ্ধ হওয়াকে ‘বিরোধ’বলে। ছয় শাস্ত্রে ঐক্য এইরূপঃ – ‘মীমাংসার মতে’ কর্ম চেষ্টা ব্যতীত জগতে কোন কাৰ্য্যই হয় না। ‘বৈশেষিক’ মতে সময় ব্যতীত সৃষ্টি হয় না। ‘ন্যায়মতে’–উপাদান কারণ ব্যতীত কোন বস্তু সৃষ্ট হইতে পারে না। ‘যোগমতে’–বিদ্যা, জ্ঞান এবং বিচার ব্যতীত সৃষ্টি হইতে পারে না। ‘সাংখ্যমতে’– তত্ত্বসমূহের মিলন ব্যতীত সৃষ্টি হয় না। আর ‘বেদান্তমতে’–সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি না করিলে কোন পদার্থ উৎপন্ন হইতে পারে না। অতএব ছয় কারণ হইতে সৃষ্টি হইয়া থাকে। উক্ত ছয় কারণের ব্যাখ্যা এক এক শাস্ত্রে এক-এক প্রকার লিখিত হইয়াছে। সুতরাং ইহাদের মধ্যে কোন বিরোধই নাই।  

যেরূপ ছয়জন পুরুষ মিলিয়া দেওয়ালের উপর ঘরের চাল স্থাপন করে, সেইরূপ ছয় শাস্ত্রকার মিলিয়া সৃষ্টিরূপ কাৰ্য্যের ব্যাখ্যা পূর্ণ করিয়াছেন। উদাহরণস্বরূপ–পাঁচ জন অন্ধ ও একজন ক্ষীণদৃষ্টি ব্যক্তিকে কেহ হস্তীর এক এক অঙ্গের কথা বলিল। তাহাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করা হইল হাতি কীরূপ? তাহাদের মধ্যে একজন বলিল—স্তম্ভের ন্যায়, দ্বিতীয় জন বলিল–কুলোর। ন্যায়, তৃতীয় জন বলিল–মুষলের ন্যায়, চতুর্থ ব্যক্তি বলিল–ঝাঁটার ন্যায়, পঞ্চম ব্যক্তি বলিল–বেদীর ন্যায় এবং ষষ্ঠ ব্যক্তি বলিল–কৃষ্ণবর্ণ চারিটি স্তম্ভের উপর কিঞ্চিৎ মহিষাকার। সেইরূপ আধুনিক অনার্য নবীনগ্রন্থ পাঠী এবং প্রাকৃতভাষী লোকেরা ঋষি প্রণীত গ্রন্থপাঠ না করিয়া ক্ষুদ্রবুদ্ধি-কল্পিত নবীন সংস্কৃত ও ভাষাগ্রন্থ পাঠ করেন এবং একে অন্যের নিন্দায় তৎপর হইয়া মিথ্যা বিবাদে রত থাকেন। তাহাদের কথা কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তির অথবা অন্য কাহারও স্বীকার যোগ্য নহে। কারণ অন্ধ অন্ধের অনুসরণ করিলে দুঃখ পাইবে না কেন? বাস্তবিক আধুনিক অল্পবিদ্যাযুক্ত স্বার্থপর এবং ইন্দ্রিয়াসক্ত ব্যক্তিদের লীলাখেলা জগতের সর্বনাশ করিতেছে।

প্রশ্ন –যদি কারণ ব্যতীত কার্য না হয়, তবে কারণের কারণ নাই কেন?

উত্তর –ওহে সরলবুদ্ধি ভাতৃগণ নিজের বুদ্ধি কিছু কার্যে প্রয়োগ করিতেছ না কেন?

দেখ! সংসারে দুইটি পদার্থ আছে, তন্মধ্যে একটি ‘কারণ’ অপরটি ‘কাৰ্য’। যাহা কারণ, তাহা ‘কাৰ্য্য’ নহে এবং যখন সে কাৰ্য্য তখন সে ‘কারণ’ নহে। যতকাল মনুষ্য, সৃষ্টিকে যথার্থরূপে বুঝিতে না পারে, ততকাল পর্যন্ত তাহাদের সম্যক্ জ্ঞান লাভ হয় না।

‘নিত্যায়াঃসত্ত্বরজস্তমসাং সাম্যাবস্থায়াঃ প্রকৃতরুৎপন্নানাং পরমসূক্ষ্মাণাং পৃথক পৃথবৰ্ত্তমানানাং তত্ত্বপরমানাং প্রথমঃসংযোগারম্ভঃ সংয়োগবিশেষাদবস্থান্তরস্য স্থলাকার প্রাপ্তিঃ সৃষ্টিরুচ্যতে ॥‘

অনাদি নিত্যস্বরূপ সত্ত্ব, রজ ও তমো গুণের সাম্যাবস্থারূপে প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন যে পরমসূক্ষ্ম পৃথক পৃথক্‌ বিদ্যমান তত্ত্বাবয়ব সমূহের প্রথম সংযোগারম্ভ সেই সংযোগ বিশেষ হইতে অবস্থান্তর অন্যান্য অবস্থায় সূক্ষ্ম ও স্থুলাকার হইতে হইতে বিচিত্ররূপে নির্মিত হইয়াছে। এইরূপ সংসর্গ হওয়াকে ‘সৃষ্টি’ বলে।

ভাল, যে পদার্থ প্রথম সংযোগে মিলিত হয় ও মিলন ঘটায়, যাহা সংযোগের আদি এবং বিয়োগের অন্ত অর্থাৎ যাহার বিভাগ হইতে পারে না, তাহাকে ‘কারণ’ আর যাহা সংযোগের পরে নির্মিত হয়, কিন্তু বিয়োগের পর তদ্রপ থাকে না, তাহাকে ‘কাৰ্য’ বলে। যে সেই কারণের কারণ, কার্যের কার্য কর্তা, সাধনের সাধন এবং সাধ্যের সাধ্য নামে অভিহিত করে, সে চক্ষু থাকিতেও অন্ধ, কর্ণ থাকিতেও বধির এবং জ্ঞান থাকিতেও মূঢ়। চক্ষুর চক্ষু, প্রদীপের প্রদীপ, সূর্যের সূৰ্য্য কি কখনও হইতে পারে? যাহা হইতে কোন বস্তু উৎপন্ন হয়, তাহা ‘কারণ’ এবং যাহা উৎপন্ন হয় তাহা কাৰ্য। আর যিনি কারণকে কাৰ্য্যরূপে নির্মাণ করেন তিনি কর্তা।

নাসতো বিদ্যতে ভাবোনাভাবে বিদ্যতে সতঃ ॥ উভয়োরপি দৃষ্টোন্তনয়েস্তত্বদর্শিভিঃ ॥ ভগবদ্গীতা ॥

কদাপি ‘অসৎ’ এর ভাব বর্তমান, এবং ‘সৎ’ এর অভাব অবর্তমান হয় না। তত্ত্বদর্শিগণ এই উভয়ের তত্ত্ব নির্ণয় করিয়াছেন। পক্ষপাতী, দুরাগ্রাহী, মলিনাত্মা, বিদ্যাহীন লোকেরা কীরূপে ইহা সহজে জানিতে পারিবে?

যে ব্যক্তি বিদ্বান্ ও সৎসঙ্গপরায়ণ হইয়া সম্পূর্ণরূপে বিচার করে না, সে সর্বদা ভ্রমজালে জড়াইয়া থাকে। যাঁহারা সকল বিদ্যার সিদ্ধান্ত জানেন, জানিবার জন্য পরিশ্রম করেন এবং জানিবার পর অকপটভাবে অপরকে জানান, তাহারা ধন্য। সুতরাং যে ব্যক্তি কারণ ব্যতীত সৃষ্টি মানে, সে কিছুই জানে না।

সৃষ্টির সময় উপস্থিত হইলে পরমাত্মা পূর্বোক্ত পরমসূক্ষ্ম পদার্থ সমূহকে সম্মিলিত করেন। ঐ সকলের প্রথম অবস্থায় পরমসূক্ষ্ম প্রকৃতিরূপে কারণ অপেক্ষা যাহা কিঞ্চিৎ স্থূল তাহার নাম মহত্তত্ত্ব। যাহা মহত্তত্ত্ব অপেক্ষা কিঞ্চিৎ স্থূল তাহার নাম অহঙ্কার। অহঙ্কার হইতে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচ সূক্ষ্মভূত শ্রোত্র, ত্বক, নেত্র,জিহ্বা এবং ঘ্রাণ–এই পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের এবং বাক, হস্ত, পাদ, উপস্থ ও মলদ্বার–এই পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় এবং একাদশ মন অপেক্ষাকৃত স্থূলরূপে উৎপন্ন হয়। উক্ত পঞ্চতন্মাত্রা হইতে অনেক স্থলাবস্থা প্রাপ্ত হইয়া ক্রমে ক্রমে যে পঞ্চস্থলভূত উৎপন্ন হয়, আমরা। ঐ সকলকে প্রত্যক্ষ করি। তাহা হইতে নানাবিধ ওষধি এবং বৃক্ষাদি উৎপন্ন হয়। ওষধি এবং বৃক্ষাদি হইতে অন্ন, অন্ন হইতে বীৰ্য্য এবং বীৰ্য্য হইতে শরীর উৎপন্ন হয়। কিন্তু আদিতে মৈথুনী সৃষ্টি হয় না। পরমাত্মা স্ত্রীপুরুষের শরীর সৃষ্টি করিয়া তাহাতে জীবসংযোগ করিয়া দিলে মৈথুনী সৃষ্টি চলিতে থাকে।

দেখ! শরীর রচনার মধ্যে কীরূপ সৃষ্টিবিদ্যার পরিচয় পাওয়া যায়। পণ্ডিতগণ তাহা দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়া থাকেন। ভিতরে অস্থিযোজনা, নাড়ীবন্ধন, মাংস লেপন, চর্মাচ্ছাদন, প্লীহা-যকৃৎ, ক্ষুদ্রপাখার ন্যায় ফুসফুস স্থাপন, রুধিরশোধন, সঞ্চালন, বিদ্যুতের স্থাপন, জীব সংযোজন, শিরোরূপ মূলরচনা, লোম-নখাদি স্থাপন, তারের ন্যায় চক্ষুর অতীব সূক্ষ্ম শিরা রচনা, ইন্দ্রিয়মার্গ প্রকাশ, জীবের জাগ্রত স্বপ্ন-সুষুপ্তি অবস্থায় ভোগের জন্য বিশেষ স্থানের নির্মাণ, সকল ধাতুর বিভাগ, কলাকৌশল স্থাপন প্রভৃতি অদ্ভুত সৃষ্টি পরমেশ্বর ব্যতীত অপর কে করিতে পারে?

এতদ্ব্যতীত ধাতুপূর্ণ ভূমি, বট প্রভৃতি বৃক্ষাদি বীজের মধ্যে অতি সূক্ষ্ম রচনা, অসংখ্য হরিৎ, শ্বেত, পীত, কৃষ্ণ, চিত্রবিচিত্র ও মিশ্রিত বর্ণের পত্র পুষ্প এবং ফল-মূল নির্মাণ; মিষ্ট, ক্ষার, কটু, কসায়, তিক্ত, অম্ল প্রভৃতি বিবিধ রস, সুগন্ধাদিযুক্ত পত্র, পুষ্প, ফল, অম্ল এবং কন্দ মূল প্রভৃতি রচনা, কোটি কোটি পৃথিবী ও চন্দ্র সূৰ্য্যাদি লোকের সৃষ্টি, ধারণ, ভ্রমণ করান এবং নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি পরমেশ্বর ব্যতীত কেহই করিতে পারে না।

যখন কেহ কোন পদার্থ দেখে, তখন তাহার দ্বিবিধ জ্ঞান উৎপন্ন হয়–প্রথমতঃ পদার্থের জ্ঞান, দ্বিতীয়তঃ পদার্থের রচনা দেখিয়া রচয়িতা কর্তার জ্ঞান। উদাহরণস্বরূপ–কোন ব্যক্তি বনে একখানি সুন্দর অলঙ্কার পাইয়া মনে করিল যে, উহা সুবর্ণ নির্মিত এবং কোন চতুর স্বর্ণকার উহা নির্মাণ করিয়াছে। সেইরূপ নানাবিধ সৃষ্টির রচনা দ্বারা সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বরের প্রতিপাদন হইয়া। থাকে।

প্রশ্ন –মানুষের সৃষ্টি কি প্রথমে হইয়াছিল, অথবা পৃথিব্যাদির?

উত্তর –পৃথিব্যাদির (সৃষ্টি প্রথমে হইয়াছিল। কারণ পৃথিব্যাদি ব্যতীত মনুষ্যের স্থিতি ও পালন হইতে পারে না।

প্রশ্ন –সৃষ্টির আদিতে কি এক অথবা বহু মানুষের উৎপত্তি হইয়াছিল?

উত্তর –বহু। কারণ যে সকল জীবের কর্ম ঐশী সৃষ্টিতে উৎপন্ন হইবার উপযুক্ত, ঈশ্বর সৃষ্টির আদিতে তাহাদের জন্ম দিয়া থাকেন। যজুর্বেদে লিখিত আছে, ‘মনুষ্যা ঋষয়শ্চ য়ে, ততো মনুষ্যা অজায়ন্ত’। এই প্রমাণ দ্বারা নিশ্চিতরূপে জানা যাইতেছে যে, আদিতে অনেক অর্থাৎ শত শত, সহস্র মনুষ্য উৎপন্ন হইয়াছিল। সৃষ্টি দেখিলেও জানা যায় যে, মনুষ্য জাতি বহু মাতাপিতার সন্তান।

প্রশ্ন –আদি সৃষ্টিতে কি মনুষ্যাদি বাল্য, যৌবন বা বৃদ্ধাবস্থায় জন্ম হইয়াছিল? না তিন অবস্থাতেই হইয়াছিল?

উত্তর –যৌবন অবস্থায়। কেননা, শৈশব অবস্থায় উৎপন্ন করিলে তাহাদের প্রতিপালনের জন্য অন্য মনুষ্যাদির প্রয়োজন হইত। আবার বৃদ্ধাবস্থায় সৃষ্টি করিলে মৈথুনী সৃষ্টি হইত না। সুতরাং যুবাবস্থাতেই সৃষ্টি হইয়াছিল।

প্রশ্ন –সৃষ্টির আরম্ভ আছে না নাই।

উত্তর –নাই। যেরূপ দিনের পূর্বে রাত্রি, রাত্রির পূর্বে দিন, দিনের পর রাত্রি, রাত্রির পর দিন, এইরূপে চলিয়া আসিতেছে, সেইরূপ সৃষ্টির পূর্বে প্রলয়, প্রলয়ের পূর্বে সৃষ্টি, সৃষ্টির পরে প্রলয়, প্রলয়ের পরে সৃষ্টি, চক্রবৎ অনাদিকাল হইতে এইরূপ চলিয়া আসিতেছে। সৃষ্টির আদি অথবা অন্ত নাই। কিন্তু যেমন দিন বা রাত্রির আরম্ভ ও অন্ত দেখিতে পাওয়া যায়, সেইরূপ সৃষ্টি এবং প্রলয়ের আদি অন্ত হইয়া থাকে। কেননা, যেরূপ পরমাত্মা,জীব ও জগতের কারণ –এই তিন স্বরূপতঃ অনাদি, সেইরূপ জগতের সৃষ্টি ও স্থিতি এবং প্রলয় প্রবাহরূপে অনাদি।

যেরূপ নদীর প্রবাহ কখনও শুষ্ক,কখনও অদৃশ্য এইরূপ দৃষ্টিগোচর হয়, আবার বর্ষাকালে দৃশ্য ও গ্রীষ্মকালে অদৃশ্য হয়, সেইরূপ জগদ্ব্যাপার সমূহকে প্রবাহরূপে জানা উচিত। যেরূপ পরমেশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাব অনাদি, তাঁহার জগতের সৃষ্টি-স্থিতি প্রলয় করাও সেইরূপ অনাদি। ঈশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাবের যেমন আরম্ভ ও অন্ত নাই, সেইরূপ তাঁহার কর্তব্য কর্মের আরম্ভ ও অন্ত নাই।

প্রশ্ন– পরমেশ্বর কোন কোন জীবকে মনুষ্য জন্ম, কোন জীবকে সিংহাদি ক্রুর জন্ম, কোনো কোনো জীবকে হরিণ ও গবাদি পশু জন্ম, কোনো কোনো জীবকে বৃক্ষ-কৃমি পতঙ্গ প্রভৃতি জন্ম দিয়াছেন। ইহাতে পরমাত্মার পক্ষপাত ঘটিতেছে।

উত্তর –পক্ষপাত ঘটিতেছে না। কারণ পূর্ব সৃষ্টিতে জীবের কৃত ঐ সকল কর্মানুসারে ব্যবস্থা করা হইয়াছে। কর্ম ব্যতীত জন্ম ব্যবস্থা করিলে পক্ষপাত করা হইত।

প্রশ্ন –মনুষ্যের আদি সৃষ্টি কোথায় হইয়াছিল?

উত্তর –ত্রিবিষ্টপ অর্থাৎ যাহাকে তিব্বত বলে (সেই দেশে)।

প্রশ্ন –আদি সৃষ্টিতে কি এক জাতি ছিল অথবা অনেক জাতি ছিল?

উত্তর –এক মানব জাতি ছিল। পরে ‘বিজানীহ্যার্য়ন্‌ যে চ দস্যবঃ’ ইহা ঋগ্বেদের বচন। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের ‘আর্য্য’ বিদ্বান্ এবং ‘দেব’ নাম এবং দুষ্টদের ‘দস্যু’ অর্থাৎ ডাকাইত ও মুর্খ নাম–এইরূপ আৰ্য্য ও দস্যু এই দুই নাম হইল। ‘উত শূদ্র উতার্য়্য’ ঋগ্বেদের বচন। আর্যদের মধ্যে পূর্বোক্তরূপে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র– এই চার বিভাগ করা হইল। দ্বিজ বিদ্বানদিগের নাম ‘আৰ্য্য’ এবং মুর্খদের নাম ‘শূদ্র’ ও ‘অনাৰ্য্য’ অর্থাৎ ‘অনাড়ী’ হইল।

প্রশ্ন –তৎপর তাঁহারা এদেশে কীরূপে আসিলেন?

উত্তর –যখন আৰ্য্য ও দস্যু, অর্থাৎ বিদ্বান দেব ও অবিদ্বান্ অসুরের মধ্যে কলহ বিবাদ বশতঃ নানা উপদ্রব হইতে লাগিল তখন আৰ্য্যগণ সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে এই ভূখণ্ডকে সর্বোৎকৃষ্ট জানিয়া এদেশেই আসিয়া বসবাস করিতে লাগিলেন। এই জন্য এই দেশের নাম ‘আৰ্য্যাবর্ত’ হইল।

প্রশ্ন –আৰ্য্যাবৰ্ত্তের সীমা কতদূর পর্যন্ত?

উত্তর –আসমুদ্ৰাতু বৈ পূর্বাদাসমুদ্রা পশ্চিমাৎ। তয়োরেবান্তরংগিয়োরায়াবৰ্ত্তংবিদুৰ্বধাঃ ॥১ ॥ সরস্বতীদৃদ্বত্যোর্দেবনদ্যোয়ন্তর। তং দেবনির্মিতং দেশমায়াবর্তং প্রচক্ষতে ॥২॥। মনু।

উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বিন্ধ্যাচল, পূর্বে ও পশ্চিমে সমুদ্র ॥ ১ ॥ পশ্চিমে সরস্বতী অর্থাৎ অটক নদী এবং পূর্বদিকে দৃষদ্বতী নদী। উহা নেপালের পূর্বভাগের পর্বতশ্রেণী হইতে উৎপন্ন । হইয়া বঙ্গ-আসামের পূর্ব এবং ব্রহ্মদেশের পশ্চিম দিয়া দক্ষিণের সমুদ্রে পতিত হইয়াছে। ইহার নাম ব্রহ্মপুত্র। আর সে উত্তরস্থ পর্বতশ্রেণী হইতে নির্গত হইয়া দক্ষিণের উপসাগরে মিলিত হইয়াছে। উত্তরে হিমালয়ের মধ্যরেখা, দক্ষিণে পর্বত পৰ্য্যন্তও বিন্ধ্যাচল হইতে রামেশ্বর পর্যন্ত–এই সব অঞ্চলের অন্তবর্তী দেশগুলিকে ‘আয্যাবৰ্ত্ত এই জন্য বলা হয়, কেননা এই আর্যাবর্তে দেব। অর্থাৎ বিদ্বানগণ বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন এবং আৰ্য্যগণের এইদেশে বসবাস করায় আৰ্য্যাবৰ্ত্ত নামে প্রসিদ্ধ ॥২॥

প্রশ্ন –ইহার পূর্বে এদেশের কী নাম ছিল? এদেশে তখন কাহারা বাস করিত?

উত্তর –ইহার পূর্বে এদেশের কোন নাম ছিল না। আর্যদের পূর্বে এদেশে কেহ বাসও করিত না। কারণ আৰ্য্যগণ সৃষ্টির আদিতে কিছুকাল পরে একেবারে তিব্বত হইতে এদেশে আসিয়া বসবাস করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন।

প্রশ্ন– কেহ কেহ বলেন যে, আৰ্য্যগণ ইরাণ হইতে আসিয়াছিলেন বলিয়া তাহাদের নাম। আৰ্য রাখা হইয়াছে। তাহাদের পূর্বে এদেশে বন্য লোকেরা বাস করিত। আর্য্যগণ তাহাদিগকে অসুর ও রাক্ষস এবং নিজেদের দেবতা বলিতেন। তাহাদের সহিত আৰ্যদের যে সংগ্রাম হইয়াছিল, তাহা দেবাসুর সংগ্রাম নামে আখ্যায়িকা সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।

উত্তর –ইহা সর্বথা মিথ্যা। কারণঃ বি জানীহ্যায় য়ে চ দস্যবো বহিষ্মতে রন্ধয়া শাসদব্রতান্ ঋ০ ম০১৫১/৮ ॥ উতশূদ্রে উতায়ে॥ ইহাও ঋগ্বেদের প্রমাণ ॥

ইহা লিখিত হইয়াছে যে, ধার্মিক, বিদ্বান্ এবং আপ্ত পুরুষদিগের নাম ‘আৰ্য। তদ্বিপরীত ব্যক্তিদের নাম দস্যু’ অর্থাৎ ডাকাইত, দুর্বৃত্ত, অধার্মিক এবং মুখ। সেইরূপ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য দ্বিজাদিগের নাম ‘আৰ্য্য’ এবং শূদ্রের নাম ‘অনাৰ্য’ অর্থাৎ অনাড়ী।

যখন বেদ এইরূপে বলে,তখন কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি বিদেশীয়দিগের কপোল কল্পনা কখনও বিশ্বাস করিতে পারেন না। আবার দেবাসুর সংগ্রামে আৰ্য্যাবৰ্ত্তীয় অর্জুন ও মহারাজ দশরথ প্রভৃতি হিমালয় পর্বতে আৰ্য্যদিগের সহিত দস্যু, ম্লেচ্ছ অসুরদিগের সহিত যে যুদ্ধ হইয়াছিল তাহাতে দেব অর্থাৎ আৰ্যদের রক্ষা এবং অসুরদের পরাজয় করিতে সহায়ক হইয়াছিলেন।

এতদ্বারা ইহাই সিদ্ধ হইতেছে যে, আর্যাবর্তের বাহিরে চতুর্দিকে অর্থাৎ হিমালয়ের পূর্বে অগ্নিকোণে, দক্ষিণে, নৈঋৎকোণে, পশ্চিমে, বায়ুকোণে, উত্তরে এবং ঈশানকোণের দেশ সমূহে যে। সকল মনুষ্য বাস করিত, তাহাদেরই নাম ‘অসুর। কারণ যখনই হিমালয় প্রদেশস্থ আৰ্যদের উপর যুদ্ধার্থ আক্রমণ হইত, তখনই রাজা মহারাজাগণ ঐ সকল উত্তরাঞ্চল প্রভৃতি স্থানে আৰ্যদের সহায়তা। করিতেন। শ্রীরামচন্দ্রের সহিত দক্ষিণদেশে যে যুদ্ধ হইয়াছিল তাহার নাম দেবাসুর সংগ্রাম নহে, কিন্তু ‘রাম-রাবণ’ অথবা আৰ্য্য-রাক্ষস সংগ্রাম।

কোন সংস্কৃতগ্রন্থে বা ইতিহাসে এইরূপ লিখিত নাই যে, আৰ্য্যগণ ইরাণ হইতে আসিয়াছিলেন। বা এদেশীয় বন্য মনুষ্যদিগকে যুদ্ধে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া এদেশের রাজা হইয়াছিলেন। তাহা হইলে বিদেশীয়দের লেখা কীরূপে গ্রাহ্য হইতে পারে।? আর—

আয়বাচোম্লেচ্ছবাচঃ সৰ্ব্বে তে দস্যবঃ স্মৃতাঃ ॥ ম্লেচ্ছ দেশত্ত্বতঃ পরঃ ॥২॥ । মনু।

আর্যাবর্ত ভিন্ন অন্য দেশকে ‘দস্যুদেশ’ এবং ‘ম্লেচ্ছদেশ’ বলে। এতদ্বারা সিদ্ধ হইতেছে যে, আৰ্য্যাবর্তের বাহিরে পূর্বদেশ,ঈশান, উত্তর, বায়ব্য এবং পশ্চিমদেশবাসীদের নাম ‘দস্যু’ ও ‘ম্লেচ্ছ’ তথা ‘অসুর’ এবং নৈঋত, দক্ষিণ এবং আগ্নেয় দিক আৰ্য্যাবৰ্ত্তবহির্ভূত দেশবাসীদের নাম ছিল রাক্ষস। এখনও দেখ, হাবশীদিগের চেহারা, যেরূপ রাক্ষসদের বর্ণনা আছে, তদ্রপ ভয়ঙ্কর দেখায়।

আর্যাবর্তের ঠিক নিম্নদেশের অধিবাসীদের নাম ‘নাগ’। আৰ্য্যাবৰ্ত্তবাসীদের পদতলে অবস্থিত বলিয়া সেই দেশের নাম পাতাল। নাগবংশীয় অর্থাৎ নাগনামা লোকদিগের বংশের লোকেরা সেই দেশে রাজত্ব করিতেন। এখানেই উলোপীর সহিত অর্জুনের বিবাহ হইয়াছিল। অর্থাৎ ইক্ষাকু হইতে কৌরব পাণ্ডবের সময় সমস্ত পৃথিবীতে আর্যদের রাজত্ব ছিল এবং আৰ্য্যাবৰ্ত্ত ব্যতীত অন্যান্য দেশেও বেদের অল্পবিস্তার প্রচার ছিল। এ বিষয়ে প্রমাণ এই যে, ব্রহ্মার পুত্র বিরাট্‌, বিরাটের পুত্র মনু, মনুর মরীচি প্রভৃতি দশ পুত্রের মধ্যে স্বায়ম্ভব প্রমুখ সাতজন রাজা ছিলেন। তাহাদের বংশের সন্তান ইক্ষাকু ছিলেন আৰ্য্যাবর্তের প্রথম রাজা। তিনি আৰ্য্যাবৰ্ত্তেবসতি স্থাপন করিয়াছিলেন।

দুর্ভাগ্যবশত আৰ্যদের মধ্যে আলস্য, প্রমাদ এবং পরস্পর বিরোধ হেতু এখন অন্যান্য দেশে রাজ্য করা ত দূরে থাকুক, আর্যাবর্তেও উহাদের অখণ্ড, স্বতন্ত্র, স্বাধীন এবং নির্ভয় রাজ্য নাই। যাহা কিছু আছে তাহাও বিদেশীয়দের পদানত হইয়াছে। অল্প কয়েকজন মাত্র রাজা স্বতন্ত্র আছেন। দুর্দিন উপস্থিত হইলে দেশবাসীদিগকে অনেক প্রকার দুঃখভোগ করিতে হয়।

যিনি যতই করুন না কেন, স্বদেশীয় রাজ্যই সর্বশ্রেষ্ঠ। বিদেশীয় শাসন মমতান্তরে আগ্রহ রহিত নিজের ও পরের প্রতি পক্ষপাতশূন্য এবং প্রজাদিগের প্রতি মাতাপিতার ন্যায় দয়ালু, কৃপালু ও ন্যায়পরায়ণ হইলেও সম্পূর্ণ সুখকর হয় না। ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, পৃথক পৃথক্‌ শিক্ষা ও আচার-ব্যবহার সম্বন্ধীয় বিরোধদূর হওয়া অতীব দুষ্কর। তাহাদূর না হইলে পরস্পরের মধ্যে পূর্ণ উপকার ও উদ্দেশ্য সিদ্ধহওয়া কঠিন। সুতরাং বেদাদিশাস্ত্রে এবংইতিহাসে যে সকল ব্যবস্থার কথা উল্লেখ আছে, সেই সকল মান্য করা সৎপুরুষদিগের কর্তব্য।

প্রশ্ন –জগতের উৎপত্তিতে কত কাল ব্যতীত হইয়াছে?

উত্তর –এক অর্বুদ ছিয়ানব্বই কোটি, কয়েক লক্ষ ও কয়েক সহস্র বৎসর জগতের উৎপত্তি এবং বেদপ্রকাশের পর অতীত হইয়াছে। ইহার বিশদ ব্যাখ্যা মপ্রণীত “ভূমিকায়”* [* ঋগ্বেদাদিভাষ্য ভূমিকায় বেদোপত্তি বিষয় দেখুন] লিখিত হইয়াছে। উক্ত গ্রন্থে দ্রষ্টব্য। সৃষ্টির উৎপত্তি ও রচনা এইরূপ জানিতে হইবে।

সর্বাপেক্ষা সূক্ষ্ম খণ্ড অর্থাৎ যাহাকে বিভক্ত করা যায় না, তাহার নাম পরমাণু, ষাট পরমাণু মিলিয়া এক অণু হয়। দুই অণু মিলিয়া এক দ্বাণুক যাহা স্থূলবায়ু, তিন ঘণুক হইতে অগ্নি, চারি দ্বণুক হইতে জল এবং পাঁচ ঘণুক হইতে পৃথিবী অর্থাৎ তিন দ্ব্যণুকে এক ত্রসরেণু ও তাহার দ্বিগুণ হইলে পৃথিবী আদি দৃশ্য পদার্থ উৎপন্ন হইয়া থাকে। পরমাত্মা এইরূপ ক্রমানুসারে পরমাণু মিলিত করিয়া পৃথিবী ইত্যাদি নিৰ্মাণ করিয়াছেন।

প্রশ্ন –ইহাকে কে ধারণ করে? কেহ বলে ‘শেষ’ অর্থাৎ সহস্র ফণাযুক্ত সর্পের মস্তকের উপর পৃথিবী অবস্থিত। দ্বিতীয় কেহ বলে–বৃষশৃঙ্গের উপর পৃথিবী আছে। তৃতীয় কেহ বলে– পৃথিবী কিছুরই উপর নাই। চতুর্থ কেহ বলে– বায়ু পৃথিবীর আধার। পঞ্চম কেহ বলে –সূৰ্য্যের দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া পৃথিবী স্বস্থানে অবস্থিত আছে। ষষ্ঠ কেহ বলে –পৃথিবী গুরুত্ব বশতঃ আকাশের নিম্নে চলিতেছে। এ সকল কথার মধ্যে কোটি সত্য বলিয়া মানিব?

উত্তর –যাহার মতে পৃথিবী শেষ সর্প ও বৃষশৃঙ্গের উপর অবস্থিত তাহাকে জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে যে সর্প ও বৃষের মাতাপিতার জন্মকালে পৃথিবী কাহার উপর ছিল। সর্প ও বৃষ প্রভৃতি কিসের উপর আছে? বৃষ পক্ষাবলম্বী মুসলমান ত নির্বাক্ হইবে কিন্তু সর্পপক্ষাবলম্বী বলিবে যে, সর্প কুর্মের উপর, কূর্ম জলের উপর, জল অগ্নির উপর, অগ্নি বায়ুর উপর এবং বায়ু আকাশে অবস্থিত। তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে হইবে যে, সমস্ত সৃষ্টি কাহার উপরে আছে? অবশ্য বলিবে যে, পরমেশ্বরের উপর। আবার যখন কেহ জিজ্ঞাসা করিবে যে শেষ এবং বৃষ কাহার সন্তান? তাহারা বলিবে যে, শেষ কশ্যপ ও কদ্রুর এবং বৃষ গাভীর সন্তান। কশ্যপ মরীচির, মরীচি মনুর, মনু বিরাটের এবং বিরাট্‌ ব্রহ্মার পুত্র। আদিতে ব্রহ্মা সৃষ্ট হইয়াছিলেন। শেষ সর্পের জন্মের পূর্বে পাঁচ পুরুষ গত হইয়াছিল। তখন কে পৃথিবীকে ধারণ করিত? অর্থাৎ কশ্যপের জন্মকালে পৃথিবী কাহার উপর ছিল? তখন ‘তেরী চুপ মেরী ভী চুপ’–তাহার পর বিবাদ আরম্ভ হইবে। ইহার সত্য অভিপ্রায় এই যে, যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহাকে ‘শেষ’ বলে। কোনো কবি বলিয়াছেন, ‘শেষাধারা পৃথিবীত্যুক্ত অর্থাৎ শেষের আধার পৃথিবী। কেহ বাক্যের অর্থ না বুঝিয়া সর্পের মিথ্যা কল্পনা করিয়াছে। কিন্তু পরমেশ্বর সৃষ্টি ও প্রলয়ের পরে অবশিষ্ট অর্থাৎ পৃথক্‌ থাকেন। এইজন্য তাঁহাকে ‘শেষ’ বলা হয় এবং তিনিই পৃথিবীর আধার। সত্যেনোত্তভিতা ভূমিঃ। ইহা ঋগ্বেদের বচন।

সত্য অর্থাৎ যিনি ত্রৈকল্যাবাধ্য এবং যাঁহার কখনও নাশ হয় না, সেই পরমেশ্বর পৃথিবী, আদিত্য ও যাবতীয় লোক সমূহ ধারণ করিয়াছেন।

‘উক্ষা দাধার পৃথিবীমূত দ্যাম ॥ ইহাও ঋগ্বেদের বচন। এই ‘উক্ষা’শব্দের অর্থ কেহ বৃষ বুঝিয়া থাকিবে। কারণ বৃষের নামও উক্ষা। কিন্তু সেই মূঢ়ের এই জ্ঞান হইল না যে, বৃষের এত বড় পৃথিবী ধারণ করিবার ক্ষমতা কোথা হইতে আসিল? বর্ষণ। দ্বারা পৃথিবীর উপর জলসিঞ্চন করে বলিয়া সূৰ্য্যের নাম ‘উক্ষা। সূৰ্য্য নিজ আকর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে ধারণ করিয়াছে। কিন্তু পরমেশ্বর ব্যতীত সূৰ্য্যাদির ধারণকর্তা অপর কেহই নাই।

প্রশ্ন –পরমাত্মা এতগুলি প্রকাণ্ড ভূমণ্ডল কীরূপে ধারণ করিতে পারেন?

উত্তর –অনন্ত আকাশের সম্মুখে বৃহৎ বৃহৎ ভূমণ্ডল কিছুই নহে অর্থাৎ যেমন সমুদ্রের। সম্মুখে ক্ষুদ্র জলকণাবৎও নহে। সেইরূপ পরমেশ্বরের সম্মুখে অসংখ্যাত লোকালোকান্তর একটি পরমাণু সদৃশও বলা যাইতে পারে না। পরমেশ্বর অন্তরে বাহিরে সর্বত্রব্যাপক অর্থাৎ বিভু প্রজাসু ইহা ঋজুর্বেদের বচন –সেই পরমাত্মা সকল প্রজার মধ্যে ব্যাপক হইয়া সকলকে ধারণ করিতেছেন। তিনি খ্রীষ্টান, মুসলমান এবং পৌরাণিকদিগের অনুসারে বিভূ না হইলে সমস্ত সৃষ্টিকে কখনও ধারণ করিতে পারিতেন না। কারণ, প্রাপ্তি বিনা কেহ কাহাকেও ধারণ করিতে পারে না। যদি কেহ বলেন যে, এই সকল লোক পরস্পর পরস্পরের দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া স্থিত। আছে, পরমেশ্বরের ধারণ করিবার প্রয়োজন কী? তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে হইবে, এই সৃষ্টি কি অনন্ত না ‘সান্ত’? যদি তিনি বলেন, ‘অনন্ত’ তবে তাঁহাকে বলিতে হইবে যে, সাকার বস্তু কখনও অনন্ত হইতে পারে না। যদি তিনি বলেন ‘সান্ত’, তবে জিজ্ঞাস্য শেষ সীমায় অর্থাৎ যাহার পরে আর কোন লোক নাই, সেখানে কাহার আকর্ষণে ধারণ হইতে পারে? যেমন সমষ্টি ও ব্যষ্টি; মিলিত ভাব সমুদয় বৃক্ষ সমষ্টিকে অরণ্য বলে, কিন্তু এক একটি বৃক্ষকে পৃথক পৃথক গণনা করা হইলে ব্যষ্টি বলে। সেইরূপ সমস্ত ভূমণ্ডল সমষ্টির নাম জগৎ। এইরূপ সমগ্র জগতের ধারণ ও আকর্ষণ কর্তা পরমেশ্বর ব্যতীত অন্য কেহই নহে। সুতরাং যিনি সমস্ত জগতের রচয়িতা, তিনিই পরমেশ্বর ॥

স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমা ॥ (যজু০ ১৩৪) ইহা যজুর্বেদের বচন।

যে পরমাত্মা পৃথিবী আদি আলোকবিহীন লোক-লোকান্তর,সূৰ্য্যাদি আলোকময় লোকসমূহ এবং অন্যান্য যাবতীয় পদার্থকে সৃজন ও ধারণ করিয়া সকলের মধ্যে ব্যাপক রহিয়াছেন, তিনিই সমস্ত জগতের কৰ্ত্তা ও ধৰ্ত্তা ॥

প্রশ্ন –পৃথিবী আদি লোক কি ভ্রমণ করে, না স্থির আছে?

উত্তর –ভ্রমণ করে।

প্রশ্ন– কেহ কেহ বলে যে, সূৰ্য্য ভ্রমণ করে, কিন্তু পৃথিবী ভ্রমণ করে না। আবার কেহ কেহ বলে যে, পৃথিবী ভ্রমণ করে সূৰ্য্য ভ্রমণ করে না। ইহার মধ্যে কোন কথাটি সত্য বলিয়া মানিব?

উত্তর –এই দুইটিই অর্ধসত্য। কারণ বেদে লিখিত আছে যে, আয়ং গৌঃ পৃশ্নিরক্রমীদসদ মাতরং পুরঃ। পিতরং চ প্রয়স্বঃ ॥ যজুঅ০৩৷৬ ॥

অর্থাৎ এই ভূমণ্ডল জলের সহিত সূর্যের চতুর্দিকে ভ্রমণ করিতেছে। অতএব পৃথিবী ভ্রমণ করে।

আ কৃষ্ণেন রজসা বর্তমানো নিবেশয়নুমৃতং মর্ত ঞ্চ। হিরণ্যয়েন সবিতা রথেন য়াতি ভুবনানি পশ্য ॥ যজু ০ অ০ ৩৩৪৩

বর্ষাদির প্রবর্তক, প্রকাশস্বরূপ, তেজোময় এবং রমণীয় স্বরূপযুক্ত সবিতা অর্থাৎ সূৰ্য্য অমৃতরূপ বৃষ্টি কিরণ দ্বারা যাবতীয় প্রাণী ও অপ্রাণীর মধ্যে অমৃত প্রবেশ করাইয়া থাকে এবং মূৰ্ত্তিমা পদার্থ সমূহকে আলোকিত করিয়া তথা সমস্ত লোকের সহিত আকর্ষণ যুক্ত হইয়া স্বীয় পরিধিতে ভ্রমণ করিতে থাকে কিন্তু কোন লোকের চতুর্দিকে ভ্রমণ করে না। এইরূপ এক এক ব্রহ্মাণ্ডে এক এক সূৰ্য্য প্রকাশক এবং অন্য সমস্ত লোকলোকান্তর প্রকাশ্য। যেমন —

‘দিবি সোমো অধি শ্রিতঃ ॥ ’অথর্ব কাং০ ১৪। অনু০১। ম০১ ॥

যেরূপ এই চন্দ্রলোক সূৰ্য্য দ্বারা আলোকিত হয়, সেইরূপ পৃথিবী আদি লোকও সূর্য্যেরই আলোকে আলোকিত হইয়া থাকে। কিন্তু দিন রাত্রি সর্বদা বর্তমান থাকে। কারণ ভ্রমণ করিতে করিতে পৃথিব্যাদি লোকের যে অংশ সূৰ্য্যের সম্মুখে উপস্থিত হয়, সেই অংশে দিন এবং যে অংশ পশ্চাৎ অর্থাৎ অন্তরালে থাকে, সেই অংশ রাত্রি হয়। অর্থাৎ উদয়, অস্ত, সন্ধ্যা, মধ্যাহ্ন এবং মধ্যরাত্রি আদি যত কাল বিভাগ আছে, ঐ সকল দেশদেশান্তরে সর্বদা বর্তমান থাকে। অর্থাৎ যখন আর্যাবর্তে সূর্যোদয় হয় তখন পাতাল অর্থাৎ আমেরিকার সূৰ্যাস্ত হয়। যখন আর্যাবর্তে সূৰ্যাস্ত হয়, তখন পাতালে সূর্যোদয় হয়। যখন আৰ্য্যাবর্তে মধ্যদিন বা মধ্যরাত্রি হয় তখন পাতালে মধ্যরাত্রি বা মধ্যদিন থাকে।

যাহারা বলে যে, সূৰ্য্য ভ্রমণ করে,কিন্তু পৃথিবী ভ্রমণ করে না, তাহারা অজ্ঞ। কেননা, এরূপ হইলে, কয়েক সহস্র বৎসরের দিন ও রাত্রি হইত। সূৰ্য্যের নাম ‘ব্রধ’, ‘সূৰ্য্য পৃথিবী অপেক্ষা লক্ষ লক্ষ গুণ বড় এবং কোটি কোটি ক্রোশ দূরে অবস্থিত। যেমন সর্ষপের সম্মুখে পর্বতের ঘুরিতে অনেক বিলম্ব হয়,কিন্তু সর্ষপের ঘুরিতে অধিক সময়ের প্রয়োজন হয় না; সেইরূপ পৃথিবী ভ্রমণ। করে বলিয়া যথা নিয়মে দিন রাত্রি হয়, সূর্যের ভ্রমণের জন্য নহে আর যাহারা বলে যে, সূৰ্য্য স্থির। থাকে তাহারা জ্যোতির্বিদ্যাবিদ নহে। কেননা, ভ্রমণ না করিলে সূৰ্য্য একরাশি হইতে অন্য রাশি অর্থাৎ স্থান প্রাপ্ত হইত না, এবং গুরু পদার্থ ভ্রমণ ব্যতীত আকাশে কখনও নির্দিষ্ট স্থানে থাকিতে পারে না।

আবার জৈনগণ বলেন যে, পৃথিবী ভ্রমণ করে না,কিন্তু ক্রমশঃ নিম্নে চলিয়া যাইতেছে। তাহারা একথাও বলে কেবল জম্বুদ্বীপে দুই সূৰ্য্য ও দুই চন্দ্র আছে। তাহারা ত ভাঙের নেশায়। গভীর নেশায় নিমগ্ন। কেননা, যদি পৃথিবী ক্রমশঃ নিম্নে চলিয়া যাইত তাহা হইলে চতুর্দিকে বায়ুচক্র গঠিত না হওয়াতে পৃথিবী ছিন্নভিন্ন হইয়া যাইত। আর নিম্নস্থলের অধিবাসীদের বায়ু সংস্পর্শ হইত না, কিন্তু উপরি অধিবাসীদের অধিক বায়ু স্পর্শ হইত, এবং বায়ুর গতিও একরূপ হইত। দুই সূৰ্য্য ও দুই চন্দ্র থাকিলে রাত্রি এবং কৃষ্ণপক্ষ হওয়াও অসম্ভব হইত। এই জন্য এক পৃথিবীর নিকটে এক চন্দ্র এবং অনেক পৃথিবীর মধ্যে এক সূৰ্য্য আছে।

প্রশ্ন –চন্দ্র, সূৰ্য্য এবং নক্ষত্র কীরূপ পদার্থ? ঐ সকলের মধ্যে মনুষ্যাদি সৃষ্টি আছে কি না?

উত্তর –এই সমস্ত ভূগোল লোক এবং ইহাদের মধ্যে মনুষ্যাদি প্রজাও আছে। কেননা ‘এতেষু হীদ ওঁ সর্বং বসু হিতমেতে হীদ ৪ সর্বং বাসয়ন্তে তদ্যদিওঁ সর্বং বাসয়স্তে তস্মাদ্যসব ইতি৷ শত০ কা০১৪

পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু আকাশ, চন্দ্র, নক্ষত্র ও সূৰ্য্য–এই সকলের নাম ‘বসু। কারণ এই সকলের মধ্যে যাবতীয় পদার্থ এবং প্রজা বাস করে। ইহারাই সকলকে বাস করাইয়া থাকে। যেহেতু এই সকল বাসগৃহ স্বরূপ, অতএব এই সকলের নাম বসু।

পৃথিবীর ন্যায় চন্দ্র, সূৰ্য্য ও নক্ষত্র বসু। সুতরাং এই সকলের মধ্যে এইরূপ প্রজা থাকা সম্বন্ধে কি সন্দেহ থাকিতে পারে? পরমেশ্বরের এই ক্ষুদ্র পৃথিবী মনুষ্যাদি জীব সৃষ্টিতে পরিপূর্ণ। সুতরাং ঐ সকল লোক কি শূন্য থাকিবে? পরমেশ্বরের কোন কর্মই নিরর্থক নহে। এই সকল অসংখ্য লোকে কি মনুষ্যদি সৃষ্টি ব্যতীত কখনও সফল হইতে পারে? অতএব সর্বত্র মনুষ্যাদির সৃষ্টি আছে।

প্রশ্ন –এই পৃথিবীতে মনুষ্যাদি সৃষ্টির যেরূপ আকৃতি ও অবয়ব দৃষ্ট হয়, অন্যান্য লোকেও কি তদ্রপ না তদ্বিপরীত?

উত্তর –আকৃতিতে কিছু প্রভেদ হওয়া সম্ভব। এই পৃথিবীতে যেমন চীনা, হাবসী ও আৰ্য্যাবর্ত, ইওরোপ প্রভৃতি দেশে অবয়ব ও রঙরদপ এবং আকৃতিরও কিঞ্চিৎ পার্থক্য থাকে, লোক-লোকান্তরেও সেইরূপ ভেদ থাকে। কিন্তু যে জাতির যে প্রকার সৃষ্টি এই দেশে আছে, অন্য

জাতির সৃষ্টি অন্যান্য লোকেও আছে। যে যে শরীরে স্থানে নেত্রাদি অঙ্গ আছে, সেই সেই। লোকান্তরেও সেই সেই শরীরে সেই স্থানে সেই জাতিরও সেইরূপই হইয়া থাকে কেননা–

সূয়াচন্দ্রমসৌ ধাতায়থা পূর্বৰ্মকয়ৎ ॥ দিবং চ পৃথিবীং চান্তরিক্ষমথথা স্বঃ ॥ ঋ০১০১০।১৯০

‘ধাতা’= পরমাত্মা পূর্বকল্পে সূৰ্য্য, চন্দ্র, দ্যুলোক, ভূমি, অন্তরীক্ষ এবং তত্রস্থ সুখ-বিশেষ পদার্থ সেইরূপ রচনা করিয়াছেন। তথা সমস্ত লোক-লোকান্তরেও রচনা করিয়াছেন। তন্মধ্যে কিছুমাত্র প্রভেদ থাকে না।

প্রশ্ন –এই লোকে যে সকল বেদ প্রকাশিত হইয়াছে ঐ সকল লোকেও সেই সকল বেদ প্রকাশ আছে কিনা?

উত্তর –ঐ সকলের প্রকাশ আছে। একই রাজার রাজ্যাবস্থা ও নীতি যেমন সকল দেশে একই রূপ হইয়া থাকে, রাজরাজেশ্বর পরমাত্মার বেদোক্ত নীতিও সেইরূপ তাহার সমস্ত সৃষ্টিরাজ্যে একই প্রকার আছে।

প্রশ্ন –যদি এই জীব ও প্রকৃতিস্থ তত্ত্ব অনাদি এবং এই সকল ঈশ্বর সৃষ্ট না হয়, তাহা হইলে এই সকলের উপর ঈশ্বরের অধিকার থাকাও উচিত নহে। কারণ সকলেই স্বতন্ত্র।

উত্তর –যেমন রাজা ও প্রজাবর্গ রাজার অধীনে থাকে, সেইরূপ জীব ও জড় পদার্থ পরমেশ্বরের অধীন, যেহেতু পরমেশ্বর সকল সৃষ্টির রচয়িতা, জীবগণের কর্মফলদাতা সকলের যথাবৎ রক্ষক এবং অনন্ত শক্তিশালী, এমতাবস্থায় অল্প সামর্থবান (জীব) ও জড় পদার্থ অধীন হইবে না কেন? এই কারণে জীব কর্মে স্বতন্ত্র, কিন্তু কর্মফল ভোগে ঈশ্বরের ব্যবস্থানুসারে পরতন্ত্র। সেইরূপ সর্বশক্তিমান্ পরমেশ্বর সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টি, সংহার এবং পালন করিয়া থাকেন।

অতঃপর বিদ্যা, অবিদ্যা, বন্ধ এবং মোক্ষবিষয়ে লিখিত হইবে। এস্থলে অষ্টম সমুল্লাস সম্পূর্ণ হইল।

ইতি শ্রীমদ্দয়ানন্দসরস্বতী স্বামীকৃতে সত্যার্থপ্রকাশে
সুভাষাবিভূষিতে সৃৎপত্তিস্থিতি-প্রলয় বিষয়েষ্টমঃ
সমুল্লাস ও সম্পূর্ণঃ ॥৮ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *