১১. আর্য্যাবর্ত্তীয় মত মতান্তরের খণ্ডন-মণ্ডন বিষয়

আর্য্যাবর্ত্তীয় মত মতান্তরের খণ্ডন-মণ্ডন বিষয়

উত্তরাৰ্দ্ধস্যঃ
অনুভূমিকা

ইহা প্রমাণসিদ্ধ যে পাঁচ সহস্র বৎসর পূর্বে বেদ-মত ব্যতীত অন্য কোন মত ছিল না। বেদোক্ত সমস্ত বিষয় বিদ্যার অবিরুদ্ধ। বেদের প্রতি অপ্রবৃত্তি উৎপন্ন হওয়ায় মহাভারতের যুদ্ধ ঘটে এবং ইহাতেই পৃথিবীতে অবিদ্যান্ধকার বিস্তৃত হয়। ফলে মনুষ্যের বুদ্ধিভ্রমযুক্ত হয় এবং যাঁহার মনে যেরূপ চিন্তার উদয় হইল, তিনি তদ্রূপই প্রচলন করিলেন।

ঐ সকল মতের মধ্যে (৪) চারিটিই অর্থাৎ বেদবিরুদ্ধ পৌরাণিক, জৈন, খৃষ্টান এবং মুসলমান মত অন্য সমস্ত মতের মূল। এ সকল মত ক্রমান্বয়ে একটির পর একটি করিয়া চলিয়া আসিয়াছে। এখন এই চারিটি মতের শাখা এক সহস্রের কম নহে। যাহাতে এ সকল মতাবলম্বীর, তাহাদের শিষ্যগণ এবং অন্য সকলের পরস্পর সত্যাসত্য বিচার করিতে অধিক পরিশ্রম না হয়, এই উদ্দেশ্য লইয়া এই গ্রন্থরচিত হইয়াছে।

এই গ্রন্থে যে সকল সত্যমতের মণ্ডন ও অসত্য মতের খণ্ডন করা হইয়াছে, তাহা সকলকে জানানো আবশ্যক মনে করা হইয়াছে। এই বিষয়ে আমরা বিদ্যাবুদ্ধি অনুসারে পূর্বোক্ত চারটি মতের মূলগ্রন্থ পাঠ করিয়া যতদূর জানিতে পারিয়াছি, তাহা সকলের নিকট নিবেদন করা সঙ্গত মনে করিয়াছি। কারণ গুপ্তবিজ্ঞানের পুনঃপ্রাপ্তি সহজ নহে। পক্ষপাত পরিত্যাগ পূর্বক এই গ্রন্থ পাঠ করিলে কোন্ মত সত্য ও কোমত অসত্য তাহা সকলেই জানিতে পারিবেন। তাহার পর আপন বিচারবুদ্ধি অনুসারে সত্যমত গ্রহণ ও অসত্যমত বর্জন করা সকলের পক্ষে সহজ হইবে।

ইহাদের মধ্যে পুরাণাদি গ্রন্থের শাখা-শাখান্তর রূপ মত আর্যাবর্ত দেশে প্রচলিত হইয়াছে। ইহাদের দোষ-গুণ সংক্ষেপে ১১শ সমুল্লাসে প্রদর্শিত হইতেছে। যদি আমার এই কাৰ্য্য দ্বারা কোন উপকার হইয়াছে বলিয়া কেহ মনে না করেন, তবে তিনি যেন বিরোধও না করেন। কারণ কাহারও অনিষ্টকরা, অথবা কাহারও সহিতবিরোধ করা আমার অভিপ্রেত নহে, কিন্তু সত্যাসত্য নির্ণয় করা ও করান(ই) আমার উদ্দেশ্য।

এইরূপ ন্যায়দৃষ্টি সহকারে কাৰ্য্য করা সকলের পক্ষে একান্ত কর্তব্য। মনুষ্যজন্ম সত্যাসত্য নির্ণয় করিবার ও করাইবার জন্য; বাবিবাদ করা, করাইবার জন্য নহে। এই মত-মতান্তরের বিবাদবশতঃ জগতে যে সকল অনিষ্টঘটিয়াছে, এবং ঘটিবে, তাহা পক্ষপাতরহিত বিদ্বান্ব্যক্তিরা জানিতে পারেন।

যতদিন মানবজাতির মধ্যে মিথ্যা মত-মতান্তরের বিরুদ্ধে বাদ দূর না হইবে, ততদিন পর্যন্ত পরস্পরের মধ্যে আনন্দ থাকিবে না। যদি আমরা সকলে বিশেষতঃ বিদ্বান ব্যক্তিরা, ঈর্ষা, দ্বেষ পরিত্যাগ ও সত্যাসত্যের নির্ণয় করিয়া সত্যগ্রহণ ও অসত্যবৰ্জন করিতে ও করাইতে ইচ্ছা করি, তবে তাহা আমাদের পক্ষে অসাধ্য নহে।

অনুভূমিকা ইহা নিশ্চিত যে, বিদ্বান্ব্যক্তিদের বিরোধই সকলকেবিরোধ-জালে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। যদি তাহারা কেবলমাত্র স্বার্থসাধনে তৎপর না হইয়া সকলের প্রয়োজন সিদ্ধ করিতে ইচ্ছা করেন, তবে এখনইমতের ঐক্য হইতে পারে।ইহার উপায় এই গ্রন্থের শেষে লিখিত হইবে। সর্বশক্তিমান্ পরমাত্মা সকল মনুষ্যের আত্মায় একমত হইবার উৎসাহ প্রদান করুন।

অলমিতিবিস্তরেণ বিপশ্চিদ্বরশিরোমণিষু ॥

.

অথৈকাদশ-সমুল্লাসারম্ভ : উত্তরাৰ্দ্ধঃ
অথার্যাবর্ত্তীয়মতখণ্ডনমণ্ডনে বিধাস্যামঃ

এবার আৰ্য্যাবৰ্ত্তদেশের অধিবাসী আৰ্যদের মতের খণ্ডন-মণ্ডন করা হইবে।

পৃথিবীতে আৰ্য্যাব সদৃশ কোন দেশ নাই। এইজন্য এ দেশের নাম ‘সুবর্ণভূমি’। কারণ এই দেশই সুবর্ণ প্রভৃতি রত্ন উৎপন্ন করে। এই নিমিত্ত আৰ্য্যগণ সৃষ্টির আদিতে এই দেশেই আসিয়া বসবাস করিয়াছিলেন। আমরা সৃষ্টি প্রকরণে বলিয়া আসিয়াছি যে, শ্রেষ্ঠ পুরুষদের নাম ‘আর্য্য’ এবং আৰ্য্যেতর মনুষ্যদের নাম ‘দস্যু’।

পৃথিবীর সকল দেশই এ দেশের প্রশংসা করিয়া থাকে এবং মনে করে যে, ‘স্পর্শমণি’ পাথরের কথা যাহা শুনা যায় তাহা মিথ্যা, কিন্তু আৰ্য্যাবর্তই যথার্থ স্পর্শমণি। ইহার স্পর্শমাত্রই লৌহরূপ দরিদ্র-বিদেশী স্বর্ণ অর্থাৎ ধনাঢ্য হইয়া উঠে।

সৃষ্টি হইতে আরম্ভ করিয়া পাঁচ সহস্র বৎসর পূর্ব পর্যন্ত, আৰ্যদের সার্বভৌম চক্রবর্তী অর্থাৎ পৃথিবীতে সর্বোপরি একমাত্র রাজ্য ছিল। অন্যান্য দেশে মাণ্ডলিক অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজা ছিলেন। কৌরব-পাণ্ডব শাসন পৰ্য্যন্ত পৃথিবীর যাবতীয় রাজন্য ও প্রজাবর্গ এতদ্দেশীয় রাজ্য ও রাজশাসন মান্য করিতেন। কেননা এই মনুস্মৃতিতে যাহা সৃষ্টির আদিতে রচিত হইয়াছে, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এতদ্দেশপ্রসূতস্য সকাশাদগ্রজন্মনঃ। স্বং স্বং চরিত্রং শিক্ষেরণ পৃথিব্যাং সর্বমানবাঃ ॥ মনু।

এই আৰ্য্যাবৰ্ত্তদেশে প্রসূত ব্রাহ্মণ অর্থাৎ বিদ্বাদিগের নিকট হইতে পৃথিবীর মনুষ্য ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র, দস্যু এবং ম্লেচ্ছাদিসকলে স্ব স্ব যোগ্য বিদ্যা, চরিত্র শিক্ষা ও বিদ্যাভ্যাস করিতেন।

মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ এবং মহাভারতের যুদ্ধ পর্যন্ত সমস্ত রাজ্য এতদ্দেশীয় রাজ্যাধীন ছিল। শোনো! চীনের ভগদত্ত, আমেরিকার বভ্রূবাহন, যুরোপের বিড়ালাক্ষ অর্থাৎ মার্জারের চক্ষুর ন্যায় চক্ষুবিশিষ্ট ইউনান্ নামধেয় যবন এবং ইরাণের শল্য প্রভৃতি রাজন্যবর্গ রাজসূয় যজ্ঞে এবং মহাভারতের যুদ্ধে আদিষ্ট হইয়া আগমন করিয়াছেন। রঘুবংশের রাজত্বকালে রাবণও এদেশের অধীন ছিলেন। রামচন্দ্রের সময়ে রাবণ বিদ্রোহী হইলে, রামচন্দ্র তাহাকে দণ্ডদান। করেন এবং তাহাকে রাজ্যচুত ও বিনাশ করিয়া তাহার ভ্রাতা বিভীষণকে রাজ্যদান করেন।

স্বায়ম্ভব রাজা হইতে আরম্ভ করিয়া পাণ্ডব পৰ্য্যন্ত আৰ্যদের চক্রবর্তী রাজত্ব ছিল। তাহার পর আৰ্য্যগণ পরস্পর বিরোধ বশতঃ যুদ্ধ করিয়া বিনষ্ট হইয়াছেন। কারণ, পরমাত্মার সৃষ্টিতে দাম্ভিক, অন্যায়কারী এবং বিদ্যাহীনদের রাজ্য দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় না। জগতে ইহা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি যে, প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রচুর ধন হইলে আলস্য, পুরুষকারের অভাব, ঈষ্যা-দ্বেষ, বিষয়াসক্তি এবং প্রমাদ বৃদ্ধিপাপ্ত হয়। তাহাতে দেশে বিদ্যা ও সুশিক্ষা নষ্ট হয় এবং দুগুণ ও দুষ্টব্যসন বর্ধিত হয়। ফলে মদ্য-মাংস সেবন, বাল্যবিবাহ এবং স্বেচ্ছাচার প্রভৃতি দোষ বৃদ্ধি পায়।

যখন যুদ্ধবিভাগে যুদ্ধবিদ্যা কৌশল এবং সৈন্যবল এতদূর বৃদ্ধি পায় যে, পৃথিবীতে অপর কেহ তাহাদের সমকক্ষ হইতে পারে না তখনই তাহাদের পক্ষপাত ও অভিমান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অন্যায়ও বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। এই সকল দোষ ঘটিলে নিজেদের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হয় অথবা

অধিকতর শক্তিশালী কোন নিম্নবংশোৎপন্ন পুরুষ দণ্ডায়মান হইয়া সেই রাজাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হয়। শিবাজী ও গোবিন্দ সিং মুসলমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হইয়া মুসলমান সাম্রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন করিয়াছেন।

অথকিমেতৈবা পরেতন্যেমহা ধনুর্ধরাশ্চক্ৰবৰ্ত্তিনঃ কেচিৎ সুদ্যুম্নভূরিদ্যুমেন্দ্রদ্যুম্নকুবলয়ায়ৌবনাশ্ববশ্বাশ্বপতিশশবিন্দু হরিশ্চন্দ্ৰাম্বরীষননশয়াতিয়য়াত্যনরণ্যাক্ষসেনাদয়ঃ। অথ মরুত্তভরতপ্রভৃতয়ো রাজানঃ ॥মৈক্র্যপনি ॥

এইসব প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হয় যে, সৃষ্টি হইতে আরম্ভ করিয়া মহাভারতের যুগ পৰ্য্যন্ত আৰ্য্যকুলেই সার্বভৌম চক্রবর্তীনৃপতিগণ উৎপন্ন হইয়াছিলেন। এখন দুভার্গ্যবশতঃ তাঁহাদের সন্তানগণ রাজ্যভ্রষ্ট হইয়া বিদেশীয়দের পাদাক্রান্ত হইতেছেন। এখানে যেরূপ সুদ্যুম্ন, ইন্দ্রদ্যুম্ন,ভূরিদ্যুম্ন, কুবলয়াশ্ব, যৌবনাশ্ব, বদ্ধ্যশ্ব, অশ্বপতি, শশবিন্দু,হরিশ্চন্দ্র, অম্বরীষ,ননকু, শর্যাতি, যযাতি, অরণ্য, অক্ষসেন, মরুত্ত এবং ভরত সার্বভৌম অর্থাৎ সর্বদেশপ্রসিদ্ধ চক্রবর্তী রাজাদিগের নাম লিখিত হইয়াছে, সেইরূপ স্বায়ম্ভব প্রভৃতি চক্রবর্তী রাজাদিগের নাম মনুস্মৃতি এবং মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থেও স্পষ্টরূপে লিখিত আছে। ইহাকে মিথ্যা মনে করা অজ্ঞানী ও পক্ষপাতীদের কাৰ্য ॥

প্রশ্ন –আগ্নেয়াস্ত্র প্রভৃতি যে সকল বিদ্যার কথা লিখিত আছে, ঐ সকল কি সত্য? সেই সময়ে কামান এবং বন্দুক ছিল কি না?

উত্তর –একথা সত্য যে, এ সকল শস্ত্র ছিল। কারণ এ সকল পদার্থবিদ্যা দ্বারা সম্ভব।

প্রশ্ন –এসকল কি দেবতাদের মন্ত্র দ্বারা সিদ্ধ হইত?

উত্তর –না, যেসব বাক্য অস্ত্রশস্ত্রকে কাৰ্য্যকারী করিত, তাহা ছিল ‘মন্ত্র’ অর্থাৎ বিচার দ্বারাই উহা কার্যকারী করিত ও প্রচলন করিত। আর যে ‘মন্ত্র’ শব্দময়, উহা দ্বারা কোনদ্রব্য উৎপন্ন হয় na। যদি কেহ বলে যে, মন্ত্র দ্বারা অগ্নি উৎপন্ন হয়, তাহা হইলে সেই ব্যক্তি সেই মন্ত্র জপ করিলে তাহার হৃদয় ও জিহ্বা ভস্মীভূত হইবে। ফলে সে শত্রুকে বিনষ্ট করিতে গিয়া স্বয়ং বিনষ্ট হইবে। অতএব বিচারের নাম ‘মন্ত্র’। উদাহরণস্বরূপ, রাজকার্য্যের বিচারকর্তাকে ‘রাজমন্ত্রী’ বলা হয়। ‘মন্ত্র’ অর্থাৎ বিচার দ্বারা প্রথম যাবতীয় সৃষ্ট পদার্থের জ্ঞান হয়। পরে সেই জ্ঞান কাৰ্য্যে প্রয়োগ করিলে, বহুবিধ পদার্থ এবং কলা কৌশল উৎপন্ন হইয়া থাকে।

যদি লৌহের বাণ অথবা গোলা নির্মাণ করিয়া তন্মধ্যে এরূপ কোন পদার্থ রাখা হয় যে, উহার সহিত অগ্নি সংযোগ করিলে বায়ুতে ধূম বিস্তৃত হয় এবং সূর্যকিরণ বায়ু সংস্পর্শে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়, তবে তাহাকে আগ্নেয়াস্ত্র বলা হয়। তাহা নিবারণ করিতে ইচ্ছা করিলে, তাহার উপর বারুণাস্ত্র প্রয়োগ করিবে। যেরূপ কেহ আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ করিয়া শত্রুসেনা বিনষ্ট করিতে ইচ্ছা করে, সেইরূপ সেনাপতি নিজ সেনার রক্ষার্থে বারুণাস্ত্র দ্বারা আগ্নেয়াস্ত্র ক্রিয়া নিবারণ করিবে। বারুণাস্ত্র এইরূপ দ্রব্যসংযোগে নির্মিত যে, বায়ুস্পর্শ মাত্রই তাহার ধূম মেঘ হইয়া তৎক্ষণাৎ বর্ষণ করিতে আরম্ভ করে এবং অগ্নি নির্বাপিত হয়। সেইরূপ ‘নাগপাশ’ অস্ত্র শত্রুর উপর প্রয়োগ করা মাত্রই তাহার অঙ্গ দৃঢ়ভাবে বদ্ধ করিয়া ফেলে। সেইরূপ ‘মোহনাস্ত্র’ নামে অপর একটি অস্ত্রে মাদকদ্রব্য নিক্ষেপ করিলেই তাহার ধূম লাগিবা মাত্র সমস্ত শক্রসেনা নিদ্রিত অথবা মুর্চ্ছিত হইয়া পড়ে। এইরূপ বহুবিধ অস্ত্রশস্ত্র ছিল। ইহা ছাড়া তার, সীসক অথবা অন্য কোন পদার্থ হইতে বিদাৎ করিয়া শত্রু বিনাশ করা হইত তাহাকেও ‘আগ্নেয়াস্ত্র’ এবং ‘পাশুপতাস্ত্র’ বলা হইত।

 ‘কামান’ এবং ‘বন্দুক’ অন্য দেশীয় ভাষার শব্দ, সংস্কৃত এবং আৰ্য্যাবৰ্ত্তীয় ভাষার নহে। কিন্তু বিদেশীগণ যাহাকে ‘কামান’ এবং ‘বন্দুক’ বলে সংস্কৃত ভাষায় তাহাকে ‘শতঘ্নী’ ও ‘ভুশু ণ্ডী’ বলে। যাঁহারা সংস্কৃত বিদ্যা অধ্যয়ন করেন নাই তাহারা ভ্রমে পতিত হইয়া যাহা তাহা লেখেন এবং বলেন। বুদ্ধিমান্ লোকেরা তাহা প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করিতে পারেন না।

যত প্রকার বিদ্যা পৃথিবীতে বিস্তৃত হইয়াছে, ঐ সমস্ত আৰ্যাবৰ্ত্ত হইতে মিশরীগণ, মিশরীয়দিগের নিকট হইতে গ্রীকগণ, গ্রীকদের নিকট হইতে রোমকগণ, রোমকদিগের নিকট হইতেঅন্যান্য য়ুরোপীয় দেশে ওয়ুরোপহইতে আমেরিকা প্রভৃতি দেশেবিস্ততহইয়া পড়িয়াছে। এখন পর্যন্ত আৰ্য্যাবৰ্ত্তে সংস্কৃতবিদ্যার যত প্রচার আছে, অন্য কোন দেশে তত নাই। যাহারা বলে যে, জার্মানীতে সংস্কৃতের বহুল প্রচার আছে এবং মোক্ষমূলর সাহেব যত সংস্কৃত অধ্যয়ন করিয়াছেন, অন্য কেহ তত করেন নাই, ইহা কেবল কথার কথা মাত্র। কারণ ‘য়স্মিন্ দেশে দ্রুমো নাস্তি তত্রৈরণ্ডোপি দ্রুমায়তে’ অর্থাৎ যে দেশে কোন বৃক্ষ নাই, সে দেশে এরকেই বৃহৎ বৃক্ষ বলিয়া মানিয়া লওয়া হয়। সেইরূপ য়ুরোপে সংস্কৃতের প্রচার না থাকাতে জার্মানগণ এবং মোক্ষমূলর সাহেব যৎ সামান্য যাহা পাঠ করিয়াছেন তাহাই সে দেশের পক্ষে অধিক। কিন্তু আর্যাবর্তের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে উহাদের সংস্কৃত পাণ্ডিত্য নগণ্য মনে হইবে। কারণ আমি জার্মানদেশবাসী জনৈক ‘প্রিন্সিপালের’ পত্র হইতে জানিয়াছি যে, জার্মানীতে সংস্কৃত ভাষায়। লিখিত পত্রের অর্থ করিতে পারেন, এমন লোকও নিতান্ত বিরল।

মোক্ষমূলর সাহেবের সংস্কৃত-সাহিত্য ও কিঞ্চিৎ বেদব্যাখ্যা পাঠ করিয়া আমি জানিতে পারিয়াছি যে, তিনি নানা স্থলে আৰ্য্যাবৰ্ত্তীয় টীকাকার দিগের টীকা দেখিয়া যেমন তেমন। করিয়া একটা কিছু লিখিয়াছেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘য়ুঞ্জতি ব্ৰত্ন মরুষং চরন্তং পরিতভুয়ঃ। রোচন্তে রোচনা দিবি ॥ (ঋ০) তিনি এই ‘ব্রপ্নং’ পদের অর্থ ‘অশ্ব’ করিয়াছেন। ইহা অপেক্ষা ‘সায়ণাচাৰ্য যে সূৰ্য্য অর্থ করিয়াছেন,উহা উত্তম। কিন্তু ইহার প্রকৃত অর্থ ‘পরমাত্মা। ইহা মপ্রণীত ‘ঋগ্নেদাদিভাষ্যভূমিকা গ্রন্থে দ্রষ্টব্য। উক্ত গ্রন্থে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। সংস্কৃতে জার্মান দেশেও মোক্ষমূলর সাহেবের পাণ্ডিত্য কতটুকু তাহা এই দৃষ্টান্ত হইতেই বুঝিতে পারা যাইবে।

ইহা নিশ্চিত যে, পৃথিবীতে যত বিদ্যা ও যত মত প্রচারিত হইয়াছে ঐ সকল আৰ্য্যাবর্ত দেশ হইতেই হইয়াছে। দেখ, ‘গোল্ডষ্টকর’ নামক ফরাসী দেশীয় জনৈক সাহেব, তৎপ্রণীত বাইবেল ইন-ইণ্ডিয়া’ নামক গ্রন্থে লিখিতেছেন যে, আৰ্য্যাবৰ্ত্ত সমস্ত বিদ্যা কল্যাণের ভাণ্ডার। সমস্ত বিদ্যা ও সমস্ত মত এই দেশ হইতেই বিস্তৃত হইয়াছে। তিনি পরমেশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতেছেন, ‘হে পরমেশ্বর। পূর্বকালে আৰ্য্যাবৰ্ত্ত যেরূপ উন্নত ছিল, আমাদের দেশকেও সেইরূপ করুন।’ তাহার লেখা উক্ত গ্রন্থে দ্রষ্টব্য।

বাদশাহ দারাশিকোহও নিশ্চিত রূপে জানিয়াছিলেন যে, সংস্কৃত ভাষায় যেমন পূর্ণ বিদ্যা আছে, তদ্রপ অন্য কোন ভাষায় নেই। তিনি উপনিষদের অনুবাদে লিখিতেছেন,–”আমি আরবী প্রভৃতি অনেক ভাষা অধ্যয়ন করিয়াছি কিন্তু তাহাতে মনের সংশয় দূর হয় নাই এবং আমি আনন্দ পাই নাই। যখন সংস্কৃত পড়িলাম ও শুনিলাম, তখন নিঃসংশয় হইয়া পরম আনন্দ লাভ করিলাম।

কাশীর ‘মানমন্দিরে শিশুমার চক্র’ দেখ! ইহার সম্পূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ না থাকিলেও, ইহা কেমন সুন্দর!ইহা দ্বারা আজ পৰ্য্যন্ত খগোলের অনেক বৃত্তান্ত জানা যায়। যদি সবাই জয়পুরাধীশ ইহার সংরক্ষণ এবং ভগ্ন অংশগুলির পূননির্মাণ করেন, তবে অতি উত্তম কাৰ্য্য হইবে।

মহাভারতের যুদ্ধ এই সর্বশ্রেষ্ঠ দেশকে এরূপ আঘাত করিয়াছে যে, আজ পর্যন্ত ইহা তাহার পূর্বাবস্থায় উপনীত হইতে পারে নাই। ভাই ভাইকে হত্যা করিলে যে সর্বনাশ হইবে তাহাতে সন্দেহ কী? বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি ॥ ইহা কোন কবির বচন।

বিনাশকাল নিকটবর্তী হইলে বুদ্ধি বিপরীত হইয়া থাকে। তাহাতে মনুষ্য বিপরীত কাৰ্য্য করে। কেহ সরলভাবে বুঝাইলে সে বিপরীত বুঝে এবং বিপরীত বুঝাইলে সরল বুঝে।

বহু প্রসিদ্ধ বিদ্বান, রাজা-মহারাজা এবং ঋষি–মহর্ষিগণ মহাভারতের যুদ্ধে নিহত হইয়াছিলেন এবং অনেকে স্বয়ং মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিলেন। তাহার ফলে বিদ্যা ও বেদোক্ত ধর্মের প্রচার নষ্ট হইয়া যায়। সকলে পরস্পর ঈষা,দ্বেষ এবং দম্ভ প্রকাশ করিতে থাকে। সেই সময় যিনি শক্তিশালী হইলেন, তিনিই দেশকে বশীভূত করিয়া রাজ্য অধিকার করিলেন। এইরূপে আৰ্য্যাবর্তে সর্বত্র খণ্ড খণ্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সে অবস্থায় দ্বীপ-দ্বীপান্তরের রাজ্যব্যবস্থা কে করে?

ব্রাহ্মণ বিদ্যাহীন হইলে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রগণ যে বিদ্যাহীন হইবে সে বিষয় বলিবার কী আছে? পরম্পরাক্রমে অর্থ সহিত বেদাদি শাস্ত্র পাঠ করিবার যে প্রথা ছিল, তাহাও লুপ্ত হইল। ব্রাহ্মণগণ কেবল জীবিকার্থ যাহা পাঠমাত্র করিতেন, তাহাও ক্ষত্রিয় প্রভৃতিকে শিক্ষা দিতেন না। গুরু বিদ্যাহীন হইলে ছলনা, কপটতা এবং অধর্মও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ব্রাহ্মণগণ ভাবিলেন–নিজেদের জীবিকা উপার্জনের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সুতরাং তাঁহারা সকলে সহমত হইয়া স্থির করিলেন এবং ক্ষত্রিয় প্রভৃতিকে এই বলিয়া উপদেশ দিতে লাগিলেন, ‘আমরাই ত তোমাদের পূজ্য দেব। আমাদের সেবা ব্যতীত তোমাদের স্বর্গলাভ অথবা মুক্তিলাভ হইবে না। আমাদের সেবা না করিলে তোমরা ঘোর নরকে পতিত হইবে।

সর্বমান্য বেদ এবং ঋষি-মুনিদের শাস্ত্রে লিখিত ছিল যে, পূর্ণবিদ্যা ধার্মিকদিগের নাম ব্রাহ্মণ। কিন্তু সেই নাম মুখ, বিষয়াসক্ত, কপট, লম্পট, অধার্মিকগণ নিজের উপর আরোপ করিয়া লইল। হায় রে! আপ্ত বিদ্বানদিগের লক্ষণ কি এ সকল মুখের মধ্যে কখনও ঘটিতে পারে? যখন ক্ষত্রিয় প্রভৃতি যজমান সংস্কৃত বিদ্যায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ হইলেন, তখন তাহাদিগের। নিকট যে সকল অলীক গল্প বলা হইত, সেইসকল হতভাগ্যের দল তাহা বিশ্বাস করিত; সেই সময় হইতে এই তথাকথিত ব্রাহ্মণদিগের বিশেষ সুবিধা হইতে লাগিল। তাহারা সকলকে নিজেদের বাজালে জড়িত করিয়া বশীভূত করিলেন এবং বলিতে লাগিলেন ‘ব্রহ্মবাক্য জনার্দনঃ। অর্থাৎ ব্রাহ্মণের মুখ হইতে যে কোন বাক্য নিঃসৃত হউক না কেন, তাহাকে সাক্ষাৎ ভগবানের মুখনিঃসৃত বলিয়া জানিবে।

যখন জ্ঞানান্ধ অথচ ধনাঢ্য ক্ষত্রিয়াদি শিষ্য জুটিতে লাগিল, তখন তথাকথিত ব্রাহ্মণ নামধারিগণ যেন বিষয়ানন্দের উপবন লাভ করিল। তাহারা ইহাও ঘোষণা করিল যে, পৃথিবীর যাবতীয় উৎকৃষ্ট বস্তু সব ব্রাহ্মণের জন্য অর্থাৎ তাহারা গুণ-কর্ম-স্বভাবের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণাদি বর্ণ-ব্যবস্থা নষ্ট করিয়া উহাকে জন্মের ভিত্তিতে স্থাপন করিল। তাহারা যজমানের নিকট হইতে মৃতকের দান পৰ্য্যন্ত গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিল। যাহার যেমন ইচ্ছা, সে সেইরূপই করিতে লাগিল, এমন কি তাহারা বলিল, “আমরা ভূদেব, আমাদের সেবা ব্যতীত কেহ দেবলোক প্রাপ্ত হইতে পারে না। তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করা আবশ্যক, তোমরা কোন্ লোকে প্রবেশ করিবে? তোমরা কাৰ্যতঃ ঘোর নরকভোগের উপযুক্ত। তোমরা কৃমি, কীট, পতঙ্গাদি হইবে। তখন তাহারা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বলে, “আমরা যদি শাপ দিই, তবে তোমাদের সর্বনাশ হইবে। কারণ শাস্ত্রে লিখিত আছে ব্রহ্মদ্রোহী বিনশ্যতি’অর্থাৎ যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণবিদ্বেষী তাহার সর্বনাশ হইয়া থাকে।” অবশ্য ইহা সত্য যে, যাহারা পূর্ণবেদজ্ঞ, পরমাত্মার জ্ঞাতা, ধর্মাত্মা ও সমস্ত জগতের হিতকারী পুরুষদিগের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করে, তাহারা নিশ্চয়ই বিনষ্ট হইবে কিন্তু যাহারা প্রকৃত ব্রাহ্মণ নহে তাহাদের ব্রাহ্মণ নাম হইতে পারে না এবং তাহারা সেবার উপযুক্ত নহে।

প্রশ্ন –তবে আমরা কে?

উত্তর –তোমরা ‘পোপ।

প্রশ্ন– ‘পোপ’ কাহাকে বলে?

উত্তর –রোমান ভাষায় ইহা জ্যেষ্ঠ এবং পিতার নাম ‘পোপ’ কিন্তু এখন যাহারা ছলনা ও কপটতার দ্বারা অপরকে প্রভাবিত করিয়া স্বার্থসিদ্ধি করে তাহাদিগকে ‘পোপ’ বলে।

প্রশ্ন –আমরা তো ব্রাহ্মণ এবং সাধু; কারণ আমাদের পিতা ব্রাহ্মণ, মাতা ব্রাহ্মণী এবং আমরা অমুক সাধুর শিষ্য।

উত্তর –ইহা সত্য। কিন্তু শোনো ভাই, পিতা ব্রাহ্মণ ও মাতা ব্রাহ্মণী হইলে এবং স্বয়ং কোন সাধুর শিষ্য হইলে কেহ ব্রাহ্মণ অথবা সাধু হইতে পারে না, কিন্তু যাঁহারা পরহিতকারী তাহারা নিজ গুণকর্মস্বভাব দ্বারাই ব্রাহ্মণ এবং সাধু হইয়া থাকেন।

শুনিয়াছি রোমের পোপ তাহার শিষ্যদিগকে বলিতেন, তোমরা যদি তোমাদের পাপ আমার নিকট প্রকাশ কর, তবে ক্ষমা করিয়া দিব। আমার সেবা আমার আদেশ ব্যতীত কেহই স্বর্গে যাইতে পারে না। যদি তোমরা স্বর্গে যাইতে ইচ্ছা কর, তবে আমার নিকট যত টাকা গচ্ছিত রাখিবে, তত মূল্যের সামগ্রী স্বর্গে পাইবে। ইহা শুনিয়া যখন কোন জ্ঞানান্ধ ধনাঢ্য ব্যক্তি স্বর্গে যাইবার ইচ্ছা করিয়া পোপকে প্রচুর ধন দিত, তখন তিনি যীশু ও মেরীর মূর্তির সম্মুখে দাঁড়াইয়া এইরূপ হুণ্ডী লিখিয়া দিতেন —

‘হে খোদার বান্দা যীশুখৃষ্ট। অমুক ব্যক্তি স্বর্গে যাইবার জন্য তোমার নামে আমার নিকট লক্ষ মুদ্রা জমা করিয়া দিয়াছে। সে স্বর্গে উপস্থিত হইলে তুমি তোমার পিতার স্বর্গরাজ্যে পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রা মূল্যের যান-বাহন-ভৃত্য, পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রার ভোজ্য পানীয় ও বস্ত্রাদি এবং পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রা আত্মীয়-স্বজন-ভাই-বন্ধু প্রভৃতির নিমন্ত্রণের জন্য প্রদান করাইবে।”

আবার পোপ মশাই সেই হুণ্ডী পত্রের নিম্নভাগে স্বাক্ষর করিয়া তাহার হস্তে দিয়া বলিতেন, ‘তোমার আত্মীয়স্বজনকে বলিয়া রাখিবে যে, যখন মৃত্যু হইবে, তখন যেন এই হুণ্ডী পত্রটি কবরের মধ্যে তোমার মস্তকের নীচে রাখিয়া দেয়। পরে যখন স্বর্গীয় দূত তোমাকে লইতে যাইবার জন্য উপস্থিত হইবেন তখন তিনি সেই হুণ্ডী-পত্র সহিত তোমাকে স্বর্গ লইয়া গিয়া লিখিত পরিমাণে সকল সামগ্রী প্রদান করাইবেন।

এখন দেখ! পোপ যেন স্বর্গের ঠিকাদারী লইয়াছেন। ইউরোপে যতদিন মূর্খতা ছিল, ততদিন সে দেশেও এইরূপ পোপ লীলা প্রচলিত ছিল। কিন্তু বিদ্যা বিস্তারের ফলে পোপের মিথ্যা লীলা এখন আর বেশী চলে না, তবে নির্মুলও হয় নাই।

সেইরূপ জানা আবশ্যক যে, আর্যাবর্তেও যেন লক্ষ লক্ষ ‘পোপ’ অবতার হইয়া লীলা বিস্তার করিতেছে। রাজা-প্রজা সকলকে বিদ্যাশিক্ষা এবং সৎসঙ্গ লাভে বাধা দেওয়া এবং দিবারাত্র তাহাদিগকে বিভ্রান্ত করা ব্যতীত পোপদের অন্য কোন কাজ নাই; কিন্তু স্মরণ রাখিতে হইবে যে, যাহারা ছলনা, কপটতা প্রভৃতি কুৎসিৎ ব্যবহার করে, তাহাদিগকেই ‘পোপ’ বলে। তাহাদের মধ্যেও যাঁহারা ধার্মিক, বিদ্বান্ এবং পরোপকারী, তাহারা যথাথই ব্রাহ্মণ এবং সাধু। এরূপ ছল-কপট স্বার্থপর লোকেরা যাহারা সকলকে প্রতারিত করিয়া স্বার্থসিদ্ধি করে ‘পোপ’ শব্দে তাহাদিগকেই বুঝিতে হইবে এবং সৎপুরুষদিগকে ব্রাহ্মণ ও সাধু নামে গ্রহণ করিতে হইবে।

দেখ! সব্রাহ্মণ এবং সাধু না থাকিলে বেদাদি সত্যশাস্ত্রগ্রন্থসমূহ স্বরসহিত পঠন পাঠন কে। করিত এবং কেইবা জৈন, মুসলমান এবং খৃষ্টান প্রভৃতির জাল হইতে নিজেকে মুক্ত রাখিয়া। আর্য্যগণকে বেদাদি সত্যশাস্ত্রে শ্রদ্ধাশীল করিয়া বর্ণাশ্রমে রাখিত? ব্রাহ্মণ ও সাধু ব্যতীত কে উহা করিতে সমর্থ হইত? ‘বিষাদপ্যমৃতং গ্রাহ্যম’–পোপালীলা দ্বারা বিভ্রান্ত না হইয়া জৈন প্রভৃতি মত হইতে আৰ্যদের নিরাপদ থাকাকে বিষ পরিত্যাগ করিয়া অমৃত গ্রহণের ন্যায় গুণ মনে করিতে হইবে।

যজমানগণ বিদ্যাহীন হইলে ব্রাহ্মণগণ কিঞ্চিৎ পূজাপাঠ করিয়া গর্বিত হইয়া উঠিল। তাহারা। একমত হইয়া রাজন্যবর্গকে বলিল যে, ব্রাহ্মণ এবং সাধুগণ দণ্ডনীয় নহেন। দেখ! প্রকৃত ব্রাহ্মণ এবং সাধুদের সম্বন্ধেই ব্রাহ্মণো ন হন্তব্যঃ “সাধুর্নহন্তব্যঃ” –ঈদৃশ বচনগুলি যাহা প্রকৃত ব্রাহ্মণ ও সাধুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য পোপগণ ঐ গুলি নিজেদের সম্বন্ধে আরোপ করিল। তাহারা মুনিদের নামে মিথ্যাবচনপূর্ণ গ্রন্থসমূহ রচনা করিয়া তাহাদিগকে শুনাইতে লাগিল এবং প্রসিদ্ধ ঋষি-মহর্ষিদের নাম লইয়া নিজেদের উপর হইতে দণ্ড-ব্যবস্থা রহিত করিল। অনন্তর তাহারা যথেচ্ছাচার করিতে আরম্ভ করিল। অর্থাৎ এইরূপ কঠোর নিয়মাবলী প্রচলিত করাইল যে, পোপদের আজ্ঞা ব্যতীত কেহ শয়ন, উত্থান, উপবেশন, যাতায়াত এবং পান-ভোজনাদিও করিতে না পারে।

তাহারা নৃপতিদের মনে এমন ধারণা বদ্ধমূল করাইল যে, “পোপ” সংজ্ঞক তথাকথিত ব্রাহ্মণ ও সাধুগণ যাহা ইচ্ছা তাহা করিলেও তাহাদিগকে কখন দণ্ড দেওয়া হইবে না। অর্থাৎ কেহ তাহাদিগকে দণ্ডদানের ইচ্ছাও করিবে না। যখন এইরূপ মূর্খতা উপস্থিত হইল, তখন ‘পোপ’ গণ যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে লাগিল। মহাভারতের যুদ্ধের এক সহস্র বৎসর পূৰ্ব্ব হইতেই এই বিকৃতির সূত্রপাত হইয়াছিল। কারণ ঐ সময়ে ঋষি-মুনিগণ থাকা সত্ত্বেও আলস্য, প্রমাদ এবং ঈর্ষা-দ্বেষের অঙ্কুর উৎপন্ন হইয়া ক্রমশঃ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইতেছিল।

সত্যোপদেশের অভাবে আর্যাবর্তে অবিদ্যা বিস্তৃত হইয়া পড়িল এবং পরস্পরের মধ্যে কলহ বিবাদ আরম্ভ হইল। কেননা–

উপদেশ্যোপদেষ্ঠুত্বাৎ তৎসিদ্ধিঃ ॥ ইতরথান্ধ পরম্পরা ॥ সাংখ্য সূ০ ॥

অর্থাৎ সদুপদেষ্টা থাকিলে ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ ভালভাবে সিদ্ধ হইয়া থাকে এবং সদুপদেষ্টা ও শ্রোতার অভাবে অন্ধপরস্পরা চলিতে থাকে। পুনরায় সৎপুরুষগণ জন্মিয়া সতোপদেশ দান করিলে অন্ধপরস্পরা নষ্ট হওয়ায় আলোক পরস্পরা চলিতে থাকে।

পুনরায় পোপগণ তাহাদের পুজা এমন কি তাহাদের চরণ পুজাও করাইতে আরম্ভ করিল এবং বলিতে লাগিল; ইহাতেই তোমাদের কল্যাণ হইবে। যখন জনসাধারণ ইহাদের বশীভূত হইল তখন তাহারা প্রমাদ ও বিষয়াসক্তিতে নিমগ্ন হইয়া মেষ ও মেষপালকবৎ ভণ্ড গুরু ও শিষ্যে জড়াইয়া পড়িল। তাহাদের বিদ্যা-বল-বুদ্ধি পরাক্রম এবং শৌর্যবীৰ্য্যাদি যাবতীয় শুভগুণ নষ্ট হইতে লাগিল। অতঃপর তাহারা বিষয়াসক্ত হইয়া গোপনে মাংস সেবন করিতে লাগিল।;

তাহাদের মধ্যে বামমার্গী আবির্ভূত হইয়া ‘শিব উবাচ’ ‘পাৰ্বত্বাচ’ এবং ‘ভৈরব উবাচ’ ইত্যাদির নাম লিখিয়া তন্ত্রগ্রন্থ রচনা করিল এবং তন্মধ্যে এই সকল বিচিত্র লীলাখেলা সন্নিবিষ্ট করিল–

মদ্যং মাংসং চ মীনং চ মুদ্রা মৈথুনেমব চ ॥ এতে পঞ্চমকারাঃ সুর্মোক্ষদা হিয়ুগে যুগে ॥ ১ কালীতন্ত্র। প্রবৃত্তে ভৈরবীচক্রে সর্বেবর্ণা দ্বিজাতয়ঃ। নিবৃত্তে ভৈরবীচক্রে সর্বেবর্ণা পৃথক্‌ পৃথক্‌ ॥ ২ ॥ কুলার্ণবতন্ত্র। পীত্বা পীত্বা পুনঃ পীত্বা যাবৎ পততিভূতলে। পুনরুত্থায় বৈ পীত্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে ॥ ৩ ॥ কু ০ ০ মাতৃয়োনিং পরিত্যজ্য বিহরে সর্বমোনিযু ॥ ৪ ॥ রুদ্রযামল তন্ত্র। বেদশাস্ত্ৰপুরাণানি সামান্য গণিকা ইব ॥ একৈব শাম্ভবী মুদ্রা গুপ্তা কুলবধূরিব। ৫ ॥ হঠঘোষ প্রদীপিকা উপদেশ।

এই সকল গণ্ডমূর্খ পোপের লীলা দেখ! এই বামমার্গীগণ বেদবিরুদ্ধ মহাপাপজনক কাৰ্য্যগুলিকে উৎকৃষ্ট বলিয়া মনে করিল। তাহারা মদ্য, মাংস, মীন অর্থাৎ মৎস, মুদ্রা, পুরী, কচুরী, বৃহৎ রুটি প্রভৃতি চর্ণ; যোনি, পাত্ৰাধার মুদ্রা এবং পঞ্চম মৈথুন অর্থাৎ সকল পুরুষ শিব এবং সকল স্ত্রীকে। পাৰ্বতী তুল্য মনে করিয়া–

অহং ভৈরবস্তুং ভৈরবী হ্যাঁবরেস্তু সঙ্গমঃ ॥ কু০ ৩ ॥

যে কোনও স্ত্রী বা পুরুষ হউক না কেন, এই নিরর্থক অকথ্য বচন পাঠ করিয়া সমাগম করা বামমার্গীগণ দোষজনক মনে করে না। অর্থাৎ যে সকল হীনচরিত্রা স্ত্রীলোককে স্পর্শ করিতে নাই, তাহাদিগকে ইহারা অতি পবিত্র মনে করে। শাস্ত্রে রজস্বলা স্ত্রীলোকের স্পর্শ নিষিদ্ধ। বামমার্গীগণ তাহাকেও অতি পবিত্র মনে করে। ইহাদের মাথা মুণ্ডহীন শ্লোক শোন–

রজস্বলা পুষ্করংতীর্থং চাণ্ডালী তু স্বয়ং কাশী। চর্মকারী প্রয়াগঃ স্যাদ্রজকী মথুরা মতা ॥ অযোধ্যা পুসী প্রোক্তা ॥ ইত্যাদি ॥ রুদ্রযামল তন্ত্র

রজস্বলার সহিত সমাগম পুষ্করস্নান, চণ্ডালীর সহিত সমাগম কাশীযাত্রা, চর্মকারিণীর সহিত সমাগম প্রয়াগ স্নান, রজকীর সহিত সমাগম মথুরা যাত্রা জানিবে এবং কঞ্জরীর সহিত লীলা মনে করিবে যেন অযোধ্যা তীর্থ পর্যটন করিয়া আসিলাম।

ইহারা মদ্যের’নাম, ‘তীর্থ, মাংসের’নাম ‘শুদ্ধি’ও ‘পুষ্প’, ‘মৎসের’নাম তৃতীয়া’ও ‘জলতুম্বিকা, মুদ্রার নাম ‘চতুর্থী’ এবং মৈথুনের নাম ‘পঞ্চমী’রাখিয়াছে। এইরূপ নাম রাখিবার কারণ এই যে, অন্য কেহ যেন বুঝিতে না পারে। ইহারা নিজেদের ‘কৌল’, ‘আদ্র, বীর’, শাম্ভব’ এবং ‘গণ’ প্রভৃতি নাম রাখিয়াছে। যাহারা বামমার্গী নহে তাহাদের ইহারা ‘কন্টক’, ‘বিমুখ এবং শুষ্কপশু’ প্রভৃতি। নাম রাখিয়াছে ॥

যখন ভৈরবীচক্র হয় তখন ব্রাহ্মণ হইতে চণ্ডাল পৰ্য্যন্ত সকলের নাম ‘দ্বিজ’ কিন্তু ভৈরবীচক্র হইতে পৃথক হইবার পর সকলেই নিজ নিজ বর্ণের হইয়া যায় ।

ভৈরবীচক্রে বামমার্গীগণ ভূমি অথবা পিঁড়ির উপর বসিয়া একটি বিন্দু ত্রিকোণ, চতুষ্কোণ অথবা বর্তুলাকার চিহ্ন রচনা করিয়া তদুপরি মদ্যের কলস স্থাপন করে এবং উহার পূজা করে। অনন্তর এই মন্ত্র পাঠ করে, “ব্রহ্মশাপং বিমোচয়”, হে মদ্য। তুমি ব্রহ্মাদি অভিশাপ হইতে মুক্ত হও।

যে স্থানে বামমার্গীগণ ব্যতীত অন্য কেহ প্রবেশ করিতে পারে না এইরূপ কোনও গুপ্ত স্থানে। স্ত্রী পুরুষ সম্মিলিত হয়। সে স্থানে পুরুষেরা একটি স্ত্রীলোককে বিবস্ত্রা করিয়া পূজা করে। স্ত্রীলোকেরাও একজন পুরুষকে বিবস্ত্র করিয়া পূজা করে। অতঃপর কেহ কাহারও স্ত্রী, কাহারও কন্যা, কাহারও আপন মাতা, অথবা ভগ্নী এবং পুত্রবধূ প্রভৃতি সে স্থানে উপস্থিত হয়। একটি পাত্রে মদ্যপূর্ণ করিয়া মাংস এবং বড়া একখানি থালাতে রখিয়া দেওয়া হয়। তাহাদের আচার্য্য সেই মদ্যপাত্র হস্তে লইয়া ‘ভৈরববাহ’, ‘শিবোহ’ = ‘আমি ভৈরব’ ‘আমি শিব’ বলিয়া। তাহা পান করে।

অনন্তর সেই উচ্ছিষ্ট পাত্র হইতে সকলে উহা পান করে। যখন কাহারও স্ত্রীকে, কোনও বেশ্যাকে অথবা কোনও পুরুষকে বিবস্ত্র করিয়া তাহার হস্তে তরবারি দিয়া স্ত্রীর নাম দেবী ও পুরুষের নাম মহাদেব রাখা হয় এবং তাহাদের উপস্থেন্দ্রিয়ের পূজা করা হয়, তখন সেই দেবী অথবা শিবকে। মদ্যের পেয়ালা পান করাইয়া, সেই উচ্ছিষ্ট পাত্র হইতে সকলে এক এক পেয়ালা পান করে। সেইরূপ পান করিতে করিতে ক্রমশঃ উন্মত্ত হইয়া পড়ে। তখন কাহারও ভগ্নী, কন্যা অথবা মাতা, যে কেহ। হউক না কেন, যে যাহার সহিত ইচ্ছা কুকর্ম করে। কখনও অত্যাধিক মত্ত হইয়া পড়িলে তাহারা পরস্পর জুতা, লাথি, ঘুসি মারা-মারি এবং নিজেদের মধ্যে কেশাকেশি করে।

কাহারও কাহারও সেই স্থানেই বমন হয়। তখন তাহাদের মধ্যে কোনও সিদ্ধি প্রাপ্ত অঘোরী অর্থাৎ যে ব্যক্তি সকলের মধ্যে সিদ্ধ বলিয়া গণ্য, সে সেই বমি ভক্ষণ করে। ইহাদের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সিদ্ধ ব্যক্তি সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে–

হালাং পিবতিদীক্ষিতস্য মন্দিরে সুপ্তোনিশায়াং গণিকাগৃহেযু।বিরাজতে কৌলবচক্রবর্তী। কু০ ত

যে ব্যক্তি দীক্ষিত অর্থাৎ শৌণ্ডিকের গৃহে যাইয়া বোতলের পর বোতল মদ্যপান করে, বেশ্যালয় যাইয়া তাহার সহিত কুকর্ম করিয়া শয়ন করে এবং নির্লজ্জ ও নিঃশঙ্ক ভাবে এইসকল কুকর্ম করে,

সে বামমার্গীদিগের মধ্যে চক্রবর্তী রাজার ন্যায় সর্বোপরি সম্মান প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ যে সর্বাপেক্ষা। অধিক কুকর্মী সেই তাহাদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, আর যে সৎকর্ম করে এবং কুকর্ম হইতে ভীত হয়, সেই নিকৃষ্ট। কারণ :

‘পাশবদ্ধো ভবেজ্জীবঃ পাশমুক্তঃ সদা শিবঃ ॥ জ্ঞান সঙ্কলিনী তন্ত্র।

তন্ত্রে এইরূপ কথিত আছে, যে ব্যক্তি লোকলজ্জা, শাস্ত্ৰলজ্জা, কুললজ্জা এবং দেশলজ্জা, প্রভৃতি পাশে আবদ্ধ হইয়া থাকে সে ‘জীব’ আর যে নির্লজ্জ হইয়া কুকর্ম করে সে ‘সদাশিব’ ॥ ‘উড্ডীস তন্ত্র’ আদি গ্রন্থে এক প্রকার প্রয়োগ লিখিত আছে যে, এক গৃহের চতুর্দিকে প্রকোষ্ঠ থাকিবে। তন্মধ্যে মদের বোতল পূর্ণ করিয়া রাখিবে। ইহাদের এক এক প্রকোষ্ঠ হইতে এক বোতল মদ্য পান করিয়া দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠে যাইবে, সেই প্রকোষ্ঠ হইতে এক বোতল মদ্য পান করিয়া তৃতীয় প্রকোষ্ঠে এবং তৃতীয় প্রকোষ্ঠ হইতে মদ্য পান করিয়া চতুর্থ প্রকোষ্ঠে যাইবে। কাষ্ঠবৎ ভূমিতে পতিত না হওয়া পর্যন্ত মদ্য পান করিবে। একবার মদের ঘোর কাটিয়া গেলে পুনরায় পূর্ববৎ মদ্য পান করিয়া পতিত হইবে। তৃতীয়বার এইরূপে পান করিয়া পতিত হইবার পর উঠিলে আর পূর্বজন্ম হয় না। ইহা সত্য যে, এইরূপ লোকের পুনরায় মনুষ্যজন্ম হওয়াই কঠিন এবং সে বহুকাল পর্যন্ত নীচ যোনিতে পড়িয়া থাকিবে।

বামমার্গীগণের তন্ত্রগ্রন্থে এইরূপ নিয়ম আছে যে, একমাত্র মাতা ব্যতীত অন্য কোন স্ত্রীলোককে ছাড়া উচিত নহে, অর্থাৎ কন্যা অথবা ভগ্নী সে যে কেহ হউক না কেন, সকলের সহিত সমাগম করা উচিত। বামমাগীদিগের মধ্যে দশমহাবিদ্যা প্রসিদ্ধ। তন্মধ্যে একজন মাতঙ্গী বিদ্যাবিশিষ্ট বলে, মাতরমপি ন ত্যজেৎ’, অর্থাৎ মাতারও সহিত সমাগম না করিয়া ছাড়িবে না। ইহারা স্ত্রী-পুরুষের সমাগম কালে এই জপ করে, আমরা যেন সিদ্ধিপ্রাপ্ত হই। এমন পাগল মহামুখ সম্ভবতঃ সংসারে খুবই কম আছে।

যে ব্যক্তি মিথ্যা প্রচার করিতে ইচ্ছা করে, সে অবশ্যই সত্যের নিন্দা করে। দেখ! বামমার্গীগণ বলে যে, বেদ, শাস্ত্র, পুরাণ সামান্য গণিকাতুল্য। কিন্তু তাহাদের শাম্ভবী মুদ্রা গুপ্ত কুলবধূ সদৃশ।

এই কারণে ইহারা কেবল বেদবিরুদ্ধ মত চালাইয়াছে। পরে তাহাদের মত বিশেষরূপে প্রচারিত হইলে তাহারা ধূর্ততার সহিত বেদের নামেও বামমার্গের কিঞ্চিৎ লীলা-খেলা চালাইল। অর্থাৎ

সৌভ্রামণ্যাং সুরাং পিবেৎ প্রেক্ষিতং ভক্ষয়েন্মাংস বৈদিকী হিংসা হিংসান ভবতি ॥ ন মাংস ভক্ষণে দোযোন মদ্যে ন চ মৈথুনে ॥ প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং নিবৃত্তিস্তু মহাফলা ৷ মনু

‘সৌত্রামণী’ যজ্ঞে মদ্যপান করিবে। ইহার অর্থ এই যে, ‘সৌক্রামণী’ যজ্ঞে সোমরস অর্থাৎ সোমলতার রস পান করিবে। ‘প্রেক্ষিত’অর্থাৎ যজ্ঞে মাংসভোজন করায় দোষ নাই। বামমার্গীগণ এইরূপ বাক্যগুলি প্রচলিত করিয়াছে। তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করা উচিত যে, যদি বৈদিকী হিংসা হিংসা না হয়, তবে তোমার ও তোমার আত্মীয় স্বজনকে বধ করিয়া হোম করা হইলে চিন্তার কী আছে? ॥

মাংসভক্ষণ, মদ্যপান এবং পরস্ত্রীগমন প্রভৃতিতে দোষ নাই, এ রূপ বলা চ্যাংড়ামী। কারণ প্রাণীদিগকে কষ্ট না দিলে মাংস পাওয়া যায় না। বিনা অপরাধে কষ্ট দেওয়াও ধর্ম–কাৰ্য্য নহে। মদ্যপানও সর্বৰ্থা নিষিদ্ধ। কারণ, আজ পর্যন্ত বামমাগীদিগের গ্রন্থব্যতীত অন্য কোন গ্রন্থেমদ্যপানের বিধি নাই, অন্য সর্বত্র নিষেধ আছে। বিবাহ ব্যতীত মৈথুনেও দোষ আছে, উহাকে নির্দোষ বলা দূষণীয়।

এইরূপে মুনি ঋষিদিগের গ্রন্থে বচন প্রক্ষিপ্ত করিয়া এবং নিজেদের নামে গ্রন্থ রচনা করিয়া ‘গোমেধ’, ‘অশ্বমেধ’ নামক যজ্ঞ করাইতেও আরম্ভ করিল। এই সকল পশুকে হত্যা করিয়া হোম করিলে, যজমান এবং পশু স্বর্গলাভ করে, ইহাও তাহারা ঘোষণা করিল। এ বিষয়ে ইহা নিশ্চিত যে, ইহারা ব্রাহ্মণগ্রন্থে অশ্বমেধ, গোমেধ, নরমেধ প্রভৃতি শব্দগুলির প্রকৃত অর্থ জানিতে পারে নাই। কেননা, জানা থাকিলে এরূপ অনর্থ করিবে কেন?

প্রশ্ন –অশ্বমেধ, গোমেধ এবং নরমেধ প্রভৃতি শব্দের অর্থ কী?

উত্তর –ইহাদের অর্থ এই :–

“রাষ্ট্রং বা অশ্বমেধঃ; ‘অন্নং হি গৌঃ; অগ্নিৰ্বা অশ্ব; আজং মেধঃ ॥ শতপথ ব্রাহ্মণ।

অশ্ব গবাদি পশু এবং মনুষ্য বধ করিয়া হোম করিবার কথা কোথাও উল্লেখ নাই। কেবল বামমার্গীদের গ্রন্থেই এইরূপ অনর্থ লিখিত আছে। বামমার্গীগণই এই সমস্ত প্রচলিত করিয়াছে। আর যে যে স্থলে এ সকলের উল্লেখ আছে, সেই সেই স্থলে বামমার্গীদের দ্বারাই প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। দেখ! রাজা ন্যায় ও ধর্মানুসারে প্রজাপালন করিবেন। বিদ্যাদি দাতা যজমান ঘৃতাদি দ্বারা অগ্নিতে হোম করা ‘অশ্বমেধ’, অন্ন, ইন্দ্রিয়, কিরণ, পৃথিবী ইত্যাদি পবিত্র রাখা নরমেধ’। মনুষ্যের মৃত্যুর পর বিধিপূর্বক তাহার শরীর- দাহ করাকেও নরমেধ’ বলে।

প্রশ্ন –যজ্ঞকর্তা বলেন যে, যজ্ঞ করিয়া যজমান ও পশু উভয়কে স্বর্গে পাঠান হইত এবং পুনরায় হোম করিয়া পশুকে পুনজ্জীবিত করা হইত। এ সকল কথা সত্য কিনা?

উত্তর –না। কেননা, যাহারা বলে যে, স্বর্গে যায়, তাহাদিগকে বধ করিয়া হোমানলে আহুতি দিয়া স্বর্গে পাঠাইয়া দেওয়া উচিত। অথবা তাহারা তাহাদের প্রিয় মাতা-পিতা এবং স্ত্রী, পুত্ৰাদিকে বধ করিয়া হোমানুষ্ঠান দ্বারা (স্বর্গে) পাঠাইয়া দেয় না কেন? অথবা যজ্ঞকুণ্ড হইতে তাহাদের জীবিত করিয়া লওয়া হয় না কেন?

প্রশ্ন –যজ্ঞের সময় বেদ মন্ত্র পাঠ করা হইত। বেদে ঐ সকল বিষয় না থাকিলে কোথা হইতে পাঠ করিত?

উত্তর –মন্ত্র কাহাকেও কোথায় পাঠ করিতে বাধা দেয় না। কারণ উহা এক প্রকার শব্দ। কিন্তু মন্ত্রের অর্থ এইরূপ নহে যে, পশুকে বধ করিয়া হোম করিবে। অগ্নয়ে স্বাহা’ ইত্যাদি মন্ত্রের অর্থ এই যে, অগ্নিতে হবি এবং সৃষ্টিকর ও অন্যান্য গুণ সৃষ্টিকারী ঘৃতাদি উত্তম পদার্থ দ্বারা হোম করিলে বায়ু, বৃষ্টি ও জল বিশুদ্ধ হইয়া জগতের পক্ষে সুখকর হয় কিন্তু মুখের এই সত্যার্থ বুঝিত না, কারণ যাহারা স্বার্থপর তাহারা কেবল তাহাদের স্বার্থসিদ্ধির কথা ব্যতীত অন্য কিছুই জানে না, মানেও না।

‘পোপ’দের এইরূপ অনাচার এবং মৃতকের শ্রাদ্ধ-তর্পণাদি অনুষ্ঠান দেখিয়া বেদাদি শাস্ত্রের মহাভয়ঙ্কর নিন্দক বৌদ্ধ ও জৈনমত প্রচলিত হইল। শুনা যায় যে, এদেশে গোরখপুরে একরাজা ছিলেন। পোপেরা তাঁহার দ্বারা যজ্ঞ করাইয়া অশ্বের সহিত তাহার মহিষীর সমাগম করায়। তাহাতে রাজমহিষীর মৃত্যু হওয়ায় রাজার মনে বৈরাগ্যের উদয় হয় অতঃপর তিনি নিজ পুত্রকে রাজ্য ভার দিয়া সাধু হইয়া পোপদের রহস্য প্রকাশ করিতে থাকেন।

তাহারই শাখা রূপে চার্বাক’ এবং ‘আভণক’ মতের উৎপত্তি হয়। এই সকল মতবাদীরা এইরূপ শ্লোক রচনা করিয়াছেন —

পশুশ্চেন্নিহতঃ স্বর্গং জ্যোতিষ্ট্যোমে গমিষ্যতি। স্বপিতায়জমানেন তত্র কথংন হিংস্যতে ॥ ১ ॥ মৃতানামিহ জনাং শ্রাদ্ধং চেস্তৃপ্তিকারণম্ ॥ গচ্ছতামিহ জন্তুনাং ব্যর্থং পাথেয়কল্পন৷ ২ ॥

যদি পশু বধ করিয়া অগ্নিতে হোম করিলে পশু স্বর্গে যায়, তবে যজমান স্বীয় পিতা প্রভৃতিকে বধ করিয়া স্বর্গে প্রেরণ করে না কেন? ॥ ১ ॥

যদি মৃতের তৃপ্তির জন্য শ্রাদ্ধ-তর্পণ করা হয়, বিদেশযাত্রীর পান-ভোজনের জন্য পাথেয় লওয়া বৃথা ॥ ২॥

শ্রাদ্ধ-তপণ দ্বারা মৃতের নিকট অন্নজল উপস্থিত হইলে কোন জীবিত প্রবাসী ও পথচারীর জন্য গৃহে ভোজ্য সামগ্রী রন্ধন করিয়া তাহার নামে অন্ন, জলপূর্ণ পাত্র রাখিয়া দিলে, ঐ সকল তাহার নিকটে পৌঁছিবে না কেন? যদি কোন জীবিত ব্যক্তি দূরদেশে অথবা দশ হাত দূরে অবস্থান করিলেও তদুদ্দশ্যে প্রদত্ত অন্ন তাহার নিকট না পৌঁছায় তাহা হইলে তো মৃত ব্যক্তির নিকট কোনও প্রকারেও প্রদত্ত বস্তু পৌঁছিতে পারিবে না।

জনসাধারণ তাহাদের এইরূপ যুক্তিসিদ্ধ উপদেশ মান্য করিতে লাগিল এবং তাহাদের মতের প্রসার হইতে লাগিল। যখন অনেক রাজা ও ভূস্বামী তাহাদের মতকে গ্রহণ করিল তখন পোপগণও তাহাদের দিকে আকৃষ্ট হইল। কারণ তাহারা যেখানে মজা পায় সেখানেই ঝেকে। সুতরাং তাহারা শীঘ্রই জৈন মতাবলম্বী হইতে লাগিল।

জৈনদের মধ্যে অন্যরূপ অনেক পোপ-লীলা আছে। তাহা দ্বাদশ-সমুল্লাসে লিখিত হইবে।

অনেকে ইহাদের মত স্বীকার করিল বটে, কিন্তু পার্বত্য দেশ, কাশী, কান্যকুজ, পশ্চিম এবং দক্ষিণ দেশের অনেকে জৈন মত স্বীকার করিল না।

জৈনগণ বেদার্থ না জানিয়া বাহিরের পোপ-লীলা ভ্রমবশতঃ বেদ মনে করিয়া বেদেরও নিন্দা করিতে লাগিল। তাহারা বেদের অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, যজ্ঞোপবীত এবং ব্রহ্মচর্য প্রভৃতি অনুষ্ঠানও নষ্ট করিল। যে স্থানে বেদসম্বন্ধীয় যত পুস্তক পাইল, সে সকল নষ্ট করিয়া আৰ্যদের উপর তাহারা রাজ্যশাসন প্রতিষ্ঠিত করিল এবং তাহাদের উপর উৎপীড়ন করিতে লাগিল। যখন তাহারা নির্ভয় ও নিশঙ্ক হইল, তখন স্বমতালম্বী গৃহস্থ ও সাধক ব্যক্তিদের সম্মান এবং বেদমার্গীদের অপমান করিয়া পক্ষপাতপূর্বক তাহাদিগকে দণ্ড দিতে লাগিল। তাহারা নিজে সুখে স্বাচ্ছন্দে থাকিয়া অহঙ্কারে স্ফীত হইয়া বিচরণ করিতে লাগিল।

জৈনগণ ‘ঋষভদেব’ হইতে ‘মহাবীর’ পৰ্য্যন্ত আপন তীর্থঙ্করদের বৃহৎ বৃহৎ মূর্তি নির্মাণ করিয়া পূজা করিতে লাগিল। এইরূপে জৈনদের দ্বারা পাষাণাদি মূর্তির পূজা প্রচলিত হইল। পরমেশ্বরে বিশ্বাস হ্রাস পাইল এবং লোকে পাষাণাদি মূর্তির পূজায় প্রবৃত্ত হইল। এইরূপে আৰ্য্যাবর্তে তিন শত বৎসর ব্যাপী জৈন-রাজত্বের ফলে বেদার্থ-জ্ঞান লুপ্ত প্রায় হইয়া গেল। এ সকল ঘটনার পর আনুমানিক প্রায় সার্ধ দ্বিসহস্র বৎসর অতীত হইয়া গেল।

পরে দ্বাবিংশ শত বৎসর পূর্বে দ্রাবিড় দেশোদ্ভব শঙ্করাচাৰ্য্য নামক জনৈক ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচর্য্য বলে ব্যাকরণাদি যাবতীয় শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া ভাবিতে লাগিলেন, হায়! সত্য আস্তিক বেদমত বিলুপ্ত এবং নাস্তিক জৈনমত প্রচলিত হওয়ায় বিশেষ অনিষ্ট হইতেছে। যে কোনও প্রকার হউক এই মতের অপসারণ আবশ্যক। শঙ্করাচাৰ্য শাস্ত্রধ্যয়নও করিয়াছিলেন। জৈনগ্রন্থসমূহও অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। তাঁহার যুক্তিও ছিল প্রবল। তিনি চিন্তা করিতে লাগিলেন কীভাবে ইহাদের সরান যায়। অবশেষে তিনি স্থির করিলেন যে উপদেশ ও শাস্ত্র বিচার দ্বারা ইহারা নিরস্ত হইবে।

এইরূপ চিন্তা করিয়া তিনি উজ্জয়িনী নগরীতে আগমন করিলেন। তখন উজ্জয়িনীতে সুধা রাজা ছিলেন। তিনি জৈনগ্রন্থ এবং কতিপয় সংস্কৃত গ্রন্থও পাঠ করিয়াছিলেন। শঙ্করাচাৰ্য্য উজ্জয়িনীতে উপস্থিত হইয়া বেদ বিষয়ে উপদেশ করিতে লাগিলেন। তিনি রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া তাহাকে বলিলেন—’আপনি সংস্কৃত ও জৈন গ্রন্থ পাঠ করিয়াছেন এবং আপনি জৈন মত মানেন। এইজন্য আপনার নিকট নিবেদন এই যে, আপনি জৈন পণ্ডিতদের সহিত আমার শাস্ত্র বিচারের ব্যবস্থা। করুন। প্রতিজ্ঞা এই থাকিবে যে, যিনি পরাজিত হইবেন তিনি বিজেতার মত স্বীকার করিবেন এবং আপনিও বিজেতা মত গ্রহণ করিবেন।

যদিও সুধন্বা জৈনমতালম্বী ছিলেন, তথাপি সংস্কৃত গ্রন্থ পাঠের ফলে তাহার বুদ্ধিতে কিঞ্চিৎ জ্ঞানালোক ছিল। তজ্জন্য তাহার মন অত্যন্ত পশুতায় আচ্ছন্ন ছিল না। কারণ বিদ্বান্ব্যক্তিরা। সত্যাসত্যের পরীক্ষা করিয়া সত্যকে গ্রহণ ও অসত্য বৰ্জন করিয়া থাকেন। যতদিন রাজা সুধন্থা। কোনও প্রসিদ্ধ বিদ্বান্ ও উপদেশক লাভ করেন নাই ততদিন পর্যন্ত তাহার মনে এই সংশয় ছিল। যে, এ সকল মত মতান্তরের মধ্যে কোটি অসত্য। শঙ্করাচার্য্যের বাক্য শুনিয়া তিনি অত্যন্ত। আনন্দের সহিত বলিলেন, “আমি নিশ্চয় শাস্ত্র বিচার দ্বারা সত্যাসত্যের নির্ণয় করাইব।

তিনি দূর-দূর হইতে জৈন পণ্ডিতদিগকে আমন্ত্রণ করিয়া এক সভা আহ্বান করিলেন। উক্ত সভায় আলোচ্য বিষয় ছিল শঙ্করাচার্য্যের বেদ মত এবং জৈনদের বিরুদ্ধ মত অর্থাৎ শঙ্করাচার্য্যের। পক্ষ ছিল বেদমত স্থাপন এবং জৈনদের পক্ষ ছিল স্বমত স্থাপন ও বেদমত খণ্ডন। কয়েক দিন। শাস্ত্ৰবিচার হইল। জৈনদের মত ছিল– সৃষ্টিকর্তা অনাদি ঈশ্বর বলিয়া কোনও কিছু নাই। এই জগৎ ও জীব অনাদি, এই দুইয়ের উৎপত্তি ও বিনাশ কখনও হয় না। শঙ্করাচার্য্যের মত ছিল– অনাদিসিদ্ধি পরমাত্মাই জগতের কা; জগৎ মিথ্যা ও জীব মিথ্যা। সেই পরমেশ্বর নিজ মায়া দ্বারা জগৎ নির্মাণ করিয়াছেন, তিনিই ধারণ এবং প্রলয়কৰ্ত্তা। আর এই জীবও প্রপঞ্চ স্বপ্নবৎ মিথ্যা। পরমেশ্বর স্বয়ং এই সকল রূপে লীলা করিতেছেন।

বহুদিন পর্যন্ত শাস্ত্র বিচার চলিবার পর অবশেষে প্রমাণ ও যুক্তিদ্বারা জৈনমত খণ্ডিত হইল এবং শঙ্করাচার্য্যের মত অখণ্ডিত রহিল। তখন জৈন পণ্ডিতগণ এবং রাজা সুধন্বা জৈনমত পরিত্যাগ করিয়া শঙ্করাচার্যের মত গ্রহণ করিলেন। মহা হট্টগোল বাধিয়া গেল। রাজা সুধন্বা তাহার আত্মীয়, বন্ধুবর্গ এবং অন্যান্য রাজাদিগকে পত্র লিখিয়া শঙ্করাচার্য্যের সহিত শাস্ত্ৰবিচার করাইলেন। কিন্তু তখন জৈন পরাজয়কাল উপস্থিত, সুতরাং তাহারা পরাজিত হইতে লাগিল।

অনন্তর সুধা প্রমুখ রাজন্যবর্গ সমগ্ৰ আৰ্য্যাবৰ্ত্তেশঙ্করাচার্য্যের পর্যটনের ব্যবস্থা করিলেন এবং তাঁহার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভৃত্যাদি সঙ্গে দিলেন।

সেই সময় হইতে পুনরায় সকলের যজ্ঞোপবীত সংস্কার হইতে লাগিল এবং বেদের পঠন পাঠন প্রচলিত হইল। শঙ্করাচাৰ্য্য দশ বৎসরের মধ্যে আর্যাবর্তের সর্বত্র পৰ্যটন করিয়া জৈনমত খণ্ডন করিলেন। কিন্তু শঙ্করাচার্য্যের সময়েই জৈন বিধ্বংস হইয়াছিল। বর্তমান কালে যত জৈনমূৰ্ত্তি বাহির করা হইতেছে, ঐ সকল শঙ্করাচার্য্যের সময়ে ভগ্ন হইয়াছিল। যে সকল মূৰ্ত্তি অভগ্ন অবস্থায় বাহির করা হইয়াছে, সেইগুল ভগ্ন হইবার ভয়ে জৈনগণ ভূমিতলে পুঁতিয়া রাখিয়াছিল। আজ পর্যন্ত কোন কোন স্থান হইতে সেই সকল মূর্তি বাহির হইতেছে।

শঙ্করাচার্য্যের পূর্বে শৈবমতও কিঞ্চিৎ প্রচলিত ছিল। তিনি সেই মত এবং বামমাগীদের মতও খণ্ডন করিলেন। সে সময় এ দেশে প্রভূত ধন ছিল এবং স্বদেশ ভক্তিও ছিল। শঙ্করাচার্য্য এবং রাজা সুধন্বা জৈন মন্দির সমূহ ভগ্ন করান নাই, কারণ তাহার ইচ্ছা ছিল সেই সব মন্দিরের মধ্যে বৈদিক পাঠশালা স্থাপন করা।

বেদ-মত পুনঃ প্রবর্তনের পর তাঁহারা বেদ বিদ্যা প্রচার সম্বন্ধে চিন্তা করিতেছিলেন, এমন সময় দুইজন জৈন যাঁহারা উপরে উপরে নামমাত্র বেদ মতাবলম্বী এবং অন্তরে অন্তরে গোঁড়া। জৈন অর্থাৎ কপটমুনি; শঙ্করাচাৰ্য্য তাহাদের প্রতি অতিশয় প্রসন্ন ছিলেন। ইহারা সুযোগ পাইয়া শঙ্করাচাৰ্য্যকে এমন বিষমিশ্রিত বস্তু ভোজন করাইল যে, তাহার অগ্নিমান্দ্য হইল। পরে শরীরে স্ফোটকাদি হইয়া ছয় মাসের মধ্যে তাহার দেহান্ত ঘটিল।

তখন সকলে নিরুৎসাহ হইল। যে বিদ্যা প্রচারের কথা ছিল, তাহাও আর হইয়া উঠিল না। তিনি শারীরক ভাষ্য প্রভৃতি যেসকল গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, তাঁহার শিষ্যবর্গ সে সকল প্রচার করিতে লাগিলেন। তিনি জৈনমত খণ্ডনের জন্য ব্রহ্ম সত্য, জগন্মিথ্যা এবং জীব-ব্রহ্মের একতা ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন, সে বিষয়ে তাঁহারা উপদেশ দিতে লাগিলেন।

দক্ষিণে ‘শৃঙ্গেয়ী’ পূর্বে ‘ভূ-গোবর্ধন’ উত্তরে যোশী এবং দ্বারিকায় সারদা মঠ খাড়া করিয়া শঙ্করাচার্যের শিষ্য মোহান্ত এবং ঐশ্বর্যশালী হইয়া আনন্দভোগ করিতে লাগিলেন কারণ শঙ্করাচার্যের পর তাঁহার শিষ্যদের বিশেষ সম্মান লাভ হইয়াছিল।

এক্ষণে বিচাৰ্য্য এই যে, জীব ও ব্রহ্মের একতা এবং জগৎ মিথ্যা, যদি ইহাই শঙ্করাচার্য্যের মত হয়, তবে তাহা যুক্তিসঙ্গত নহে কিন্তু যদি তিনি জৈনমত খণ্ডনার্থে উক্ত মত স্বীকার করিয়া থাকেন তবে অপেক্ষাকৃত ভাল।

নবীন বেদান্তিগণের মত এইরূপ–

প্রশ্ন–জগৎ স্বপ্নবৎ; রঞ্জুতে সর্প,শুক্তিতে রজত, মৃগতৃষ্ণায় জল, গন্ধব নগর এবং ইন্দ্রজালবৎ এই সংসার মিথ্যা। এক ব্রহ্মাই সত্য।

সিদ্ধান্তী –তুমি মিথ্যা কাহাকে বলিতেছ?

নবীন বেদান্ত –যাহা নাই, অথচ আছে বলিয়া প্রতীত হয় তাহাই মিথ্যা।

সিদ্ধান্তী –যে বস্তু নাই, তাহার প্রতীতি কীরূপে হইতে পারে?

নবীন –অধ্যারোপ দ্বারা।

সিদ্ধান্তী –অধ্যারোপ কাহাকে বলে?

নবীন–বস্তুন্যবস্তুারোপণমধ্যাসঃ। অধ্যারোপাপবাদাভ্যাংনিপ্রপঞ্চৎ প্রপঞ্চতে।

এক বস্তুতে অন্য বস্তুর আরোপকে ‘অধ্যাস’অথবা অধ্যারোপ বলে এবং তাহার নিরাকরণকে ‘অপবাদ’ বলে। এই দুই হইতে প্রপঞ্চরহিত ব্রহ্মে প্রপঞ্চরূপ জগৎ বিস্তৃত হয়।

সিদ্ধান্তী –তুমি রঞ্জুকে বস্তু এবং সর্পকে অবস্তু মনে করিয়া এই ভ্রম জালে পতিত হইয়াছ। সর্প কি বস্তু নহে? যদি বল যে রজ্জুতে সর্প নাই, তবে অন্য স্থানে আছে। তোমার হৃদয়ে তাহার সংস্কার মাত্র আছে। সুতরাং সেই সৰ্পও অবস্তু রহিল না। সেইরূপ স্থাণুতে পুরুষ এবং শুক্তিতে রজত ইত্যাদি ব্যবস্থা বুঝিতে হইবে। আবার স্বপ্নেও যে সকল বস্তুর ভান হইয়া থাকে, ঐ সকল  বস্তু অন্যত্র থাকে এবং আত্মাতেও ঐ সকলের সংস্কার থাকে। সুতরাং স্বপ্ন ও বস্তুতে অবস্তুর আরোপ সদৃশ নহে।

নবীন –যাহা কখনও দৃষ্ট বা শ্ৰত হয় নাই, যেমন নিজের শিরচ্ছেদ হইয়াছে, নিজেই রোদন করিতেছি; উপরের দিকে জলপ্রবাহ চলিতেছে এবং যাহা কখনও সংঘটিত হয় নাই তাহা দেখা যাইতেছে; এই সকল কীরূপে সত্য হইতে পারে?

সিদ্ধান্তী –এই দৃষ্টান্ত তোমার পক্ষ সিদ্ধ করিতেছে না। কারণ দর্শন, শ্রবণ ব্যতীত সংস্কার হয় না। সংস্কার ব্যতীত স্মৃতি এবং স্মৃতি ব্যতীত সাক্ষাৎ অনুভূতি হয় না। যখন কেহ কাহারও নিকট শ্রবণ করে অথবা দেখে যে, সংগ্রামে অমুকের গলা কাটা হইয়াছে এবং ভ্রাতা-পিতা। প্রভৃতিকে প্রত্যক্ষভাবে রোদন করিতে দেখিয়াছে এবং প্রস্রবণের জল ঊধ্বদিকে উঠিতে দেখিয়াছে। বা শুনিয়াছে; সেই সব সংস্কার তাহার আত্মায় থাকে। যখন সে জাগ্রত অবস্থায় পদার্থ হইতে পৃথক্ করিয়া দেখে, তখন সে নিজের আত্মাতেই পূর্বদৃষ্ট অথবা পূর্বশ্রুত সেই পদার্থ সমূহ দেখিতে পায়। যখন নিজের মধ্যেই তাহা দেখে,তখনই নিজের গলা কাটা, নিজের রোদন এবং ঊর্ধ্বগামী জলপ্রবাহ দেখিতে পায়।

ইহাও বস্তুতে অবস্তুর আরোপের ন্যায় হইল না। কিন্তু যেমন চিত্রকর পূর্ব দৃষ্ট, শ্রুত অথবা কৃত বিষয় আত্মা হইতে বাহির করিয়া কাগজের উপর লেখে অথবা প্রতিচ্ছবি অঙ্কনকারী প্রতিচ্ছবি দেখিয়া নিজ আত্মাতে উহাকে ধারণ করিয়া যেরূপ হুবহু আকৃতি অঙ্কন করে, ইহাও সেইরূপ। অবশ্য ইহা সত্য যে, কখনও কখনও স্বপ্নে স্মরণযুক্ত প্রতীতি, যথা –নিজ অধ্যাপককে দেখে। এবং কখনও কখনও বহু পূর্বে দৃষ্ট ও শ্ৰত অতীত জ্ঞান সম্বন্ধে সাক্ষাৎকার হইয়া থাকে। তখন। স্মরণ থাকে না যে আমি ঐ সময়ে যাহা দেখিয়াছিলাম বা শুনিয়াছিলাম, তাহাই দেখিতেছি, শুনিতেছি, করিতেছি। জাগ্রতাবস্তায় যে নিয়মে স্মরণ হয়, স্বপ্নাবস্থায় সে ভাবে (নিয়মপূর্বক) হয় না। (দেখ! জন্মান্ধের রূপের স্বপ্ন হয় না)। অতএব তোমার অধ্যাস ও অধ্যারোপের লক্ষণ। মিথ্যা। আর বেদান্তিগণ যে ‘বিবৰ্ত্তবাদ’অর্থাৎ রজ্জুতে সর্পের প্রতীতি হওয়ায় দৃষ্টান্ত দিয়া থাকেন, তাহাও যুক্তিসঙ্গত নহে।

নবীন –অধিষ্ঠান ব্যতীত অধ্যস্তের প্রতীতি হয় না। রঞ্জু না থাকিলে সর্পেরও প্রতীতি হইতে পারে না। রজুতে সর্প তিন কালেই থাকে না। কিন্তু কিঞ্চিৎ অন্ধকার ও কিঞ্চিৎ আলোক সংযোগে অকস্মাৎ রঞ্জু দর্শনে সর্পের ভ্রম হওয়াতে দ্রষ্টা ভয়ে কম্পিত হয়। যখন সে প্রদীপাদি দ্বারা ইহা দেখে, তখন তাহার ভ্রম ও ভয় নিবৃত্ত হইয়া যায়। সেইরূপ ব্রহ্ম জগতের যে মিথ্যা প্রতীত হইয়াছে, ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার হইলে উহার নিবৃত্তি এবং ব্রহ্মের প্রতীতি (হয়) যথা সর্পের নিবৃত্তি ও রজ্জর প্রতীতি হইয়া থাকে।

সিদ্ধান্তী –ব্রহ্মে জগতের ভান কাহার হইয়াছে?

নবীন –জীবের।

সিদ্ধান্তী –জীব কোথা হইতে হইল?

নবীন –অজ্ঞান হইতে।

সিদ্ধান্তী –অজ্ঞান কোথা হইতে আসিল এবং কোথায় থাকে?

নবীন –অজ্ঞান অনাদি এবং উহা ব্রহ্মে থাকে।

সিদ্ধান্তী –ব্রহ্মে ব্রহ্মের অথবা অন্য কাহারও অজ্ঞান হইল? আর সেই অজ্ঞান কাহার হইল?

নবীন –চিদাভাসের।

সিদ্ধান্তী –চিদাভাসের স্বরূপ কী?

নবীন –ব্রহ্ম, ব্রহ্মে ব্রহ্মের অজ্ঞান অর্থাৎ নিজ স্বরূপকে নিজেই ভুলিয়া যায়।

সিদ্ধান্তী –ব্রহ্মের ভ্রম হইবার হেতু কী?

নবীন –অবিদ্যা।

সিদ্ধান্তী –অবিদ্যা সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞের গুণ না অল্পজ্ঞের?  

নবীন –অল্পজ্ঞের।

সিদ্ধান্তী –তাহা হইলে তোমার মতে এক অনন্ত, সর্বজ্ঞ, চেতন ব্যতীত অন্য কোন চেতন আছে, না নাই? আর অল্পজ্ঞতা কোথা হইতে আসিল? অবশ্য যদি অল্পজ্ঞ চেতনকে ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন স্বীকার কর তাহা হইল তো কথাই নাই। যদি ব্রহ্মের কোনও এক স্থানে নিজ স্বরূপের অজ্ঞানতা থাকে, তবে সেই অজ্ঞানতা সর্বত্র বিস্তৃত হইয়া পড়িবে। যেমন শরীরের এক স্থানের ব্রণের যন্ত্রণা সমস্ত শরীরের অবয়বগুলিকে অকর্মণ্য করিয়া দেয়, সেইরূপ ব্রহ্মও যদি এক দেশে অজ্ঞান ও ক্লেশযুক্ত হয়, তবে সমস্ত ব্রহ্মই অজ্ঞান হইয়া ক্লেশ অনুভব করিবে।

নবীন –এ সকল উপাধির ধর্ম, ব্রহ্মের নহে।

সিদ্ধান্তী –উপাধি জড় না চেতন? উহা সত্য না মিথ্যা?

নবীন –অনির্বচনীয় অর্থাৎ তাহাকে জড় বা চেতন, সত্য না মিথ্যা বলিতে পারা যায় না।

সিদ্ধান্তী– তোমার এইরূপ বলা “বদলো ব্যাঘাতঃ” এর ন্যায়। কারণ যাহাকে অবিদ্যা বলিতেছ, উহা জড় কি চেতন, সৎ কি অসৎ তাহাই বলিতে পারিতেছ না। কথাটা এইরূপ–কেহ পিতল মিশ্রিত সুবর্ণকে,–সুবর্ণ না পিতল, উহাকে পরীক্ষা করিবার জন্য কোন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নিকট লইয়া গেলে তখন সে ইহাই বলিবে —

“আমি ইহাকে সুবর্ণও বলিতে পারি না, পিতলও বলিতে পারে না; কিন্তু ইহাতে উভয় সংমিশ্রণ আছে।

নবীন –দেখ! যেমন ঘটাকাশ, মঠাকাশ, মেঘাকাশ এবং মহাকাশ উপাধি অর্থাৎ ঘট, ঘর এবং মেঘ থাকাতে আকাশ ভিন্ন প্রতীত হয়; বাস্তবিক পক্ষে মহদাকাশই আছে। সেইরূপ মায়া-অবিদ্যা, সমষ্টি-ব্যষ্টি এবং অন্তঃকরণের উপাধি বশতঃ ব্রহ্ম অজ্ঞানীদের নিকট পৃথক পৃথক প্রতীয়মান হইতেছে, বাস্তবিক পক্ষে সে একই। নিম্নলিখিত প্রমাণে কী বলা হইয়াছে দেখুন–

অগ্নিয়থৈকো ভুবনং প্রবিষ্টো রূপং রূপং প্রতিরূপোবভূব। একস্তথা সর্বভূতান্তরাত্মা রূপং রূপং প্রতিরূপা বহিশ্চ৷ মুন্ডক ॥

যেমন অগ্নি দীর্ঘ,বিস্তৃত, গোলাকার, ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ সর্ববিধ আকৃতির বিশিষ্ট পদার্থের মধ্যে ব্যাপক হইয়া তদাকার দেখায়, অথচ তাহা হইতে পৃথক্‌, সেইরূপ সর্বব্যাপী পরমাত্মা অন্তঃকরণে ব্যাপক হইয়া অন্তঃকরাণাকার হইতেছেন। কিন্তু তিনি অন্তঃকরণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক।

সিদ্ধান্তী –তোমার ইহা বলাও নিরর্থক। কারণ যেরূপ ঘট, মঠ, মেঘ এবং আকাশকে ভিন্ন মানিতেছ, সেই কাৰ্য্য-কারণস্বরূপ জগৎ এবং জীবকে ব্রহ্ম হইতে তথা ব্রহ্মকে এ সকল হইতে ভিন্ন মানিয়া লও।

নবীন –যেরূপ অগ্নি সকল পদার্থে প্রবিষ্ট হইয়া তদাকার দেখায়, সেইরূপ পরমাত্মা জড় এবং জীবের মধ্যে ব্যাপক হইয়া সাকার (অর্থাৎ) অজ্ঞানদিগের নিকট সাকার দেখায়, বস্তুতঃ ব্রহ্ম জড়ও নহেন, জীবও নহেন। যেমন সহস্র জল ঘট রক্ষিত হইলে তন্মধ্যে সূর্য্যের সহস্র প্রতিবিম্ব দৃষ্ট হয়, প্রকৃতপক্ষে সূৰ্য্য এক, ঘটগুলি নষ্ট হইলে, জল গড়াইয়া কিংবা ছড়াইয়া পড়িলে সূৰ্য্য নষ্ট হয় না, গড়াইয়া ছড়াইয়া পড়ে না। সেইরূপ অন্তঃকরণে যে ব্রহ্মের আভাস পতিত হইয়াছে, তাহাকে “চিদাভাস’ বলে। যতক্ষণ অন্তঃকরণ আছে, ততক্ষণ জীবও আছে। জ্ঞান দ্বারা অন্তঃকরণ নষ্ট হইলে, জীব ব্রহ্মস্বরূপ হয়। অজ্ঞ জীব ব্রহ্মস্বরূপ সম্বন্ধে যতদিন এই চিদাভাসকে কর্তা, ভোক্তা, সুখী, দুঃখী, পাপী, পূণ্যাত্মা এবং জন্ম-মরণধর্মী ইত্যাদি মনে করিয়া এ সকল নিজের মধ্যে (যতদিন) আরোপ করে, ততদিন পর্যন্ত সে সংসার বন্ধন হইতে মুক্ত হয় না।

সিদ্ধান্তী –তোমার এই দৃষ্টান্ত নিরর্থক। কারণ সূৰ্য্য সাকার পদার্থ, জল-কুণ্ডও সাকার। সূৰ্য্য জল-কুণ্ড হইতে এবং জল কুণ্ড সূৰ্য্য হইতে পৃথক্ বলিয়া প্রতিবিম্ব পতিত হয়। নিরাকার হইলে ঐ সকলের প্রতিবিম্ব কখনও পড়িত না। পরমেশ্বর নিরাকার এবং আকাশবৎ সর্বব্যাপক বলিয়া কোন পদার্থ হইতে তাঁহার, কিংবা কোন পদার্থের তাহা হইতে পৃথক্‌ হওয়া অসম্ভব। আবার পরস্পরের মধ্যে ব্যাপ্য ব্যাপক সম্বন্ধ বশতঃ একও হইতে পারে না। অর্থাৎ অন্বয় ব্যতিরেকভাবে দেখিলে ব্যাপ-ব্যাপক মিলিত অথচ সর্বদা পৃথক থাকে। এক হইলে নিজের মধ্যে ব্যাপ্য-ব্যাপকভাবে সম্বন্ধ কখনও ঘটিতে পারে না। বৃহদারণক্যের অন্তর্যামী ব্রাহ্মণে ইহা স্পষ্টরূপে লিখিত আছে। আর ব্রহ্মের আভাসও পড়িতে পারে না। কারণ আকার ব্যতীত আভাস হওয়া অসম্ভব।

তুমি যে অন্তঃকরণোপাধি দ্বারা ব্রহ্মকে জীব মানিতে ছ, তাহা বালকোচিত। অন্তঃকরণ চলমান এবং খণ্ড-খণ্ড, আর ব্রহ্ম অচল এবং অখণ্ড। যদি তুমি ব্ৰহ্ম এবং জীবকে পৃথক্ না মান, তবে ইহার উত্তর দাও; ‘অন্তকরণ যে স্থানে যাইবে সে সে স্থানের ব্রহ্মকে অজ্ঞানী এবং যে যে স্থান পরিত্যাগ করিবে, সে সে স্থানের ব্রহ্মকে জ্ঞানী করিবে না?’ যথা–আলোকের মধ্যে ছাতা যে-যে স্থানে যায়, সে-সে স্থানে আলোককে আবরণযুক্ত এবং যে-যে স্থান হইতে ছাতা সরিয়া যায়, সে-সে স্থানের আলোককে আবরণ-রহিত করে; সেইরূপ অন্তঃকরণ ব্রহ্মকে ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞাণী, অজ্ঞান বদ্ধ এবং মুক্ত করিতে থাকিবে।

অখণ্ড ব্রহ্মের এক দেশে প্রভাব সর্বদেশে হওয়ায় সমস্ত ব্রহ্ম অজ্ঞানী হইবে; কেননা তিনি চেতন। আবার মথুরায় যে অন্তঃকরণস্থ ব্রহ্ম যে বস্তু দেখিয়াছে, কাশীতে সেই অন্তঃকরণস্থ ব্রহ্মের স্মরণ হইতে পারে না। কারণ — “অন্যদৃষ্টমন্যো ন স্মরতীতি ন্যায়াৎ” একের দৃষ্ট বস্তুর স্মরণ অন্যের হয় না। যে চিদাভাস মথুরায় দেখিয়াছিল, সে চিদাভাস কাশীতে থাকে না। কেননা, যাহা মথুরাস্থ অন্তঃকরণের প্রকাশক, তাহা কাশীতে ব্রহ্ম নহে।

যদি ব্রহ্মাই জীব হইয়া থাকে, উভয়ে পৃথক্ না হয় তাহা হইলে, জীবের সর্বজ্ঞ হওয়া উচিত। ব্রহ্মের প্রতিবিম্ব পৃথক্ হইলে ‘প্রত্যভিজ্ঞা’ অর্থাৎ পূর্বদৃষ্ট ও পূর্বত বিষয়ের জ্ঞান কাহারও হইবে না। যদি বল যে, ব্রহ্ম এক বলিয়া স্মরণ হয়, তবে কোন স্থানে অজ্ঞানতা অথবা দুঃখ হইলে, সমস্ত ব্রহ্মের অজ্ঞানতা বা দুঃখ হওয়া উচিত। আবার এতাদৃশ দৃষ্টান্ত দ্বারা নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ স্বভাব ব্রহ্মকে তুমি অশুদ্ধ, অজ্ঞান এবং বদ্ধ প্রভৃতি দোষযুক্ত এবং অখণ্ডকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলে।

নবীন –নিরাকারেরও আভাস হইয়া থাকে, যেমন দর্পণে অথবা জলাদিতে আকাশের যে। আভাস পড়ে তাহা নীল, অথবা অন্য কোন প্রকার আভার গাঢ় বর্ণ দেখায়, সেইরূপ অন্তঃকরণে। ব্রহ্মের আভাস পতিত হয়।

সিদ্ধান্তী –আকাশের যদি রূপই না থাকে, তাহা হইলে কেহ নেত্র দ্বারা উহাকেই দেখিতেই পাইবে না। যে পদার্থ দেখাই যায় না, তাহা দর্পণে জলাদিতে কীরূপে দেখিবে? সাকার বস্তু গভীর অথবা অগভীর দৃষ্ট হয়, নিরাকার (দৃষ্ট) হয় না।

নবীন –তবে যাহা উপরে নীলবৎ দৃষ্ট হয়, উহা আদর্শ বা জলে তাহারই ভান হয়! তবে উহা কোন্ পদার্থ?

সিদ্ধান্তী –তাহা পৃথিবী হইতে উত্থিত জল, পৃথিবী এবং অগ্নির ত্রসরেণু। যে-স্থান হইতে বর্ষা হয়, সে-স্থানে জল না থাকিলে বর্ষা কোথা হইতে হইবে? সুতরাং যাহা দূরে দূরে শিবিরের ন্যায় দৃষ্ট হয়, তাহা জলচক্র। যেরূপ কুয়াশা দূর হইতে ঘন দেখায়, কিন্তু নিকট হইতে পাতলা এবং দূরে শিবিরের ন্যায় দেখায়, সেইরূপ আকাশে জল দৃষ্ট হয়।

নবীন –তবে কি আমার রঞ্জু, সর্প এবং স্বপ্নদির দৃষ্টান্ত মিথ্যা?

সিদ্ধান্তী –না। তোমার ধারণা মিথ্যা; ইহা আমি পূর্বে লিখিয়াছি। আচ্ছা, বল তো প্রথমে কাহার অজ্ঞানতা হয়?

নবীন –ব্রহ্মের।

সিদ্ধান্তী –ব্রহ্ম অল্পজ্ঞ না সর্বজ্ঞ?

নবীন –সর্বজ্ঞও নহেন, অল্পজ্ঞও নহেন। কেননা সর্বজ্ঞতা এবং অল্পজ্ঞতা উপাধিযুক্তেরই হইয়া থাকে।

সিদ্ধান্তী –কে উপাধিযুক্ত?

নবীন –-ব্রহ্ম।

সিদ্ধান্তী –তাহা হইলে ব্রহ্মই সর্বজ্ঞ ও অল্পজ্ঞ হইলেন। তবে তুমি সর্বজ্ঞ ও অল্পজ্ঞের নিষেধ করিয়াছিলে কেন? যদি বল যে, উপাধি কল্পিত অর্থাৎ মিথ্যা, তাহা হইলে কল্পক অর্থাৎ কে কল্পনাকারী?

নবীন –জীব ব্রহ্ম, না অন্য (কেহ)?

সিদ্ধান্তী –অন্য। কেননা জীব ব্রহ্ম-স্বরূপ হইলে, যে মিথ্যা-কল্পনা করিয়াছে, সে ব্রহ্ম হইতে পারে না। যাহার কল্পনা মিথ্যা, সেকি কখনও সত্য হইতে পারে?

নবীন –আমরা সত্য ও অসত্যকে মিথ্যা বলিয়া মানি এবং বাণীদ্বারা বলাও মিথ্যা।

সিদ্ধান্তী –যখন তুমি বল ও মিথ্যা স্বীকার করো তখন তুমি মিথ্যাবাদী নও কেন?

নবীন– শুনুন সত্য-মিথ্যা আমার মধ্যেই কল্পিত। আমি উভয়েরই সাক্ষী অধিষ্ঠান।

সিদ্ধান্তী –যদি তুমি সত্য-মিথ্যার আধার হও তুমি সাধু ও চোর সদৃশ হইবে। তাহা হইলে ইহা দ্বারা তুমি প্রামাণিকও রহিলে না। কেননা যে সর্বদা সত্য মানে, বলে এবং সত্য আচরণ করে কখনও মিথ্যা বলে না, মানে না এবং আচরণ করে না, সেই প্রামাণিক। যখন তুমি নিজেই নিজের বাক্যকে মিথ্যা বলিয়া স্বীকার করিতেছ সে অবস্থায় তুমি নিজেই মিথ্যাবাদী।

নবীন –যে অনাদি মায়া ব্রহ্মের আশ্রয় এবং যাহা ব্রহ্মকেই আবৃত করে, তাহাকে মানেন কিনা?

সিদ্ধান্তী –মানি না। কারণ তুমি মায়ার অর্থ এ রূপ করিতেছ যে, যে বস্তু নাই, অথচ আভাস হয়। যাহার বিচারশক্তি নাই সে-ই ইহা স্বীকার করিবে। কারণ যে-বস্তু নাই, তাহার আভাস হওয়া সর্বদা অসম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, বন্ধ্যার পুত্রের প্রতিবিম্ব কখনও হইতে পারে না। আর তুমি “সম্মুলাঃ সোম্যেমাঃ প্রজাঃ” ইত্যাদি ছান্দোগ্য (আদি) উপনিষদোক্ত বচনের বিরুদ্ধ বলিতেছ।

নবীন –তুমি কি বশিষ্ঠ,শঙ্করাচার্য্য প্রভৃতি এবং নিশ্চলদাস পর্যন্ত যাঁহারা তোমার চেয়েও অধিক পণ্ডিত হইয়াছেন তাহারা যাহা লিখিয়াছেন তুমি তাহাদের খণ্ডন করিতেছ? আমরা তো বশিষ্ঠ, শঙ্করাচাৰ্য্য এবং নিশ্চলদাস প্রভৃতিকে অধিক বিদ্বান্ মনে করি।

সিদ্ধান্তী –তুমি কি বিদ্বান না অবিদ্বান?

নবীন –আমিও অল্প অল্প বিদ্বান্।

সিদ্ধান্তী –ভাল কথা, তাহা হইলে তুমি আমার সম্মুখে বশিষ্ঠ, শঙ্করাচার্য্য এবং নিশ্চলদাসের পক্ষ স্থাপন কর। আমি উহার খণ্ডন করিতেছি, যাঁহার পক্ষ সিদ্ধ হইবে, সেই বড় হইবে। যদি তাহাদের এবং তোমার বাক্য অখণ্ডনীয় হয় তুমি যুক্তি দ্বারা আমার কথা খণ্ডন করিতে পারিতেছ না কেন? খণ্ডন করিতে পারিলে, তাহাদের এবং তোমার কথা মাননীয় হইবে।

অনুমান হয় যে, শঙ্করাচার্য প্রভৃতি জৈনমত খণ্ডন করিবার জন্যই এই মত স্বীকার করিয়া থাকিবেন। কারণ দেশ-কালানুযায়ী স্বপক্ষ সিদ্ধ করিবার জন্য বহু স্বার্থন্বেষী বিদ্বান্ ব্যক্তি সজ্ঞানের। বিরুদ্ধেও আচরণ করিয়া থাকেন। যদি তাহারা এই সকল যুক্তি অর্থাৎ জীব ও ঈশ্বরের একত্ব, জগৎ মিথ্যা আদি ব্যবহার সত্য বলিয়া মানিয়া থাকেন, তাহা হইলেও তাঁহাদের মত সত্য হইতে পারে না।

আবার, নিশ্চলদাসের পাণ্ডিত্য দেখ –“জীবো-ব্রহ্মাচভিন্নশ্চেতনত্বাৎ”। তিনি “বৃত্তিপ্রভাকর” গ্রন্থে জীব ও ব্রহ্মের একত্বহেতু অনুমান লিখিয়াছেন –“চেতন হওয়ায় জীব হইতে ব্রহ্মা অভিন্ন। ইহা নিত্যন্ত অল্প-বুদ্ধি ব্যক্তির বাক্যের ন্যায়। কেননা, সাধ্য মাত্র দ্বারা একের সহিত অন্যের একত্ব সিদ্ধ হয় না; বৈধ ভেদক হইয়া থাকে। যদি কেহ বলে যে, “পৃথিবী জলা ভিন্না জড়ত্বাৎ’জড় বলিয়া পৃথিবী জল হইতে অভিন্ন। এই বাক্য যেরূপ কখনও সঙ্গতহইতে পারে না, সেই নিশ্চলদাসোক্ত লক্ষণও ব্যর্থ। কারণ জীবের অল্প, অল্পজ্ঞতা এবং ভ্রান্তিমত্ত্বাদি ধর্ম জীবে ব্রহ্মের এবং সর্বগত, সর্বজ্ঞত্ব এবং বিভ্রান্তিত্ত্বাদিবৈধৰ্ম ব্রহ্মে জীবের বিরুদ্ধ। অতএব ব্রহ্ম এবং জীব ভিন্ন ভিন্ন।

যেরূপ গন্ধবত্ত্ব এবং কঠিনত্ব প্রভৃতি পৃথিবীর ধর্ম, রসবত্ব ও দ্রব্যত্বাদি জলের ধর্মের বিরুদ্ধ হওয়ায় পৃথিবী ও জল এক নহে, সেইরূপ জল ও ব্রহ্ম বৈধৰ্ম (যুক্ত) হওয়ায়, জীব ও ব্রহ্ম কখনও এক ছিল না, এক নহে এবং কখনও এক হইবে না। নিশ্চলদাস প্রভৃতির পাণ্ডিত্য বুঝিবার পক্ষে ইহাই যথেষ্ট যে, তাহাদের মধ্যে কতটুকু পাণ্ডিত্য ছিল। যে ব্যক্তি যোগবাসি’ রচনা করিয়াছে, সে কোনও আধুনিক বেদান্তী হইয়া থাকিবে। বাল্মীকি, বশিষ্ঠ অথবা রামচন্দ্র দ্বারা ন কথিত, ন শ্রুত। কারণ তাঁহারা সকলে বেদানুযায়ী ছিলেন। তাঁহাদের পক্ষে বেদবিরুদ্ধ রচনা করা, বলা অথবা শ্রবণ করা সম্ভব নহে ॥

প্রশ্নে –ব্যাসদেব রচিত শারীরক সূত্রেও কি জীব-ব্রহ্মের একত্ব দৃষ্ট হয় না? দেখ—

সম্পাদ্যাভsবির্ভাবঃ স্বেনশব্দাৎ ॥ ১ ॥ ব্রাহ্মেণ জৈমিনিরুপন্যাসাদিভ্যঃ ॥২॥ চিতিতন্মাত্রেণতদাত্মাদিত্যৌডুলৌমিঃ ॥ ৩ ॥ এবামপন্যাসাৎপূর্ববাদবিরোধংবাদরায়ণঃ ॥ ৪ ॥ অতএব চানন্যাধিপতিঃ ॥ ৫ ॥

অর্থাৎ যে জীব পূর্বে ব্রহ্মস্বরূপ ছিল, সেই জীব স্বীয় স্বরূপকে প্রাপ্ত হইয়া প্রকট হয়। কারণ ‘স্ব’ শব্দের দ্বারা ব্রহ্মস্বরূপের গ্রহণ হয় ॥ ১ ॥

‘অয়মাত্মা অপহতপাপমা’ ইত্যাদি উদ্ধৃত বাক্যে উপন্যাস’ ঐশ্বৰ্য্য প্রাপ্তি পর্যন্ত হেতু দ্বারা ব্রহ্মস্বরূপে জীব স্থিত থাকে, ইহা জৈমিনি আচার্যের মত ॥ ২ ॥

ঔডুলোমি –আচার্যের মতে তদাত্মক-স্বরূপ-নিরূপণাদি বৃহদারণ্যকের হেতুরূপ বচনানুসারে, জীব চৈতন্যমাত্র স্বরূপ অবস্থায় মুক্তিতে স্থিত থাকে ৷ ৩ ॥

ব্যাসদেব –পূর্বোক্ত এই সকল উদ্ধরণ ঐশ্বৰ্য্য প্রাপ্তিরূপ হেতু দ্বারা জীবের ব্রহ্মস্বরূপ হওয়ায় পক্ষে অবিরোধ মানেন ॥ ৪ ॥

যোগী ঐশ্বৰ্য্য সহিত নিজে ব্রহ্মস্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া অন্য অধিপতি রহিত অর্থাৎ স্বয়ং নিজের রূপ এবং সকলের অধিপতি ব্রহ্মস্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া মুক্তিতে অবস্থিত থাকেন ॥ ৫ ॥

উত্তর –এ সকল সূত্রের অর্থ এইরূপ নহে। কিন্তু ইহার প্রকৃত অর্থ এইরূপ শুনুন! যতদিন জীব স্বীয় শুদ্ধস্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া সর্ববিধ মল রহিত হইয়া পবিত্র না হয়, ততদিন পৰ্য্যন্ত যোগবলে ঐশ্বৰ্য্য এবং নিজের অন্তর্যামী ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইয়া আনন্দে স্থিত হইতে পারে না ॥ ১ ॥

এইরূপে যখন পাপাদি রহিত যোগী ঐশ্বৰ্য্যযুক্ত হয়, তখনই তিনি ব্রহ্মের সহিত মুক্তির আনন্দ ভোগ করিতে সমর্থ হয় জৈমিনি আচার্য্যের এইরূপ মত ॥ ২ ॥

যখন জীব অবিদ্যা প্রভৃতি দোষ-মুক্ত হইয়া শুদ্ধ চৈতন্য মাত্র স্বরূপে স্থির হয় তখনই ‘তদাত্মক অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ প্রাপ্ত হয় এইরূপ ঔডুলোম আচার্য্যের মত ॥ ৩ ॥

জীব যখন ব্রহ্মের সহিত যুক্ত হইয়া ঐশ্বৰ্য্য ও শুদ্ধ বিজ্ঞান (প্রাপ্ত হইয়া) জীবদ্দশাতেই জীবন্মুক্ত হয়, তখন জীব নিজের নির্মল পূর্বস্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া আনন্দিত হয়। এইরূপ ব্যাসমুনি’র মত ॥ ৪ ॥

যখন যোগী সত্যসঙ্কল্প হন, তিনি স্বয়ং পরমেশ্বরকে লাভ করিয়া মুক্তিসুখ প্রাপ্ত হন। সে স্থানে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র থাকে। সংসারে যেরূপ কেহ প্রধান অপর অপ্রধান থাকে, মুক্তিতে সেইরূপ হয় না। কিন্তু সমস্ত মুক্ত জীব একভাবেই থাকে ॥ ৫ ॥

যদি এরূপ না হয়, তাহা হইলে—

নেতরোনুপপত্তেঃ ॥ ১ ॥ ভেদব্যপদেশাচ্চ ॥ ২ ॥ ৷ বিশেষণভেদব্যপদেশাভ্যাং (চ) নেতরেী ॥ ৩ ॥ অস্মিন্নস্য চ তদ্যোগং শাস্তি ॥ ৪ ॥ ৷ অন্তস্তদ্ধর্মোপদেশাৎ ॥ ৫ ॥ ভেদব্যপদেশাচ্চান্যঃ ॥ ৬ ॥ গুহাং প্রবিষ্টাবাত্মানৌ হি তদ্দর্শনাৎ ॥ ৭ ॥ অনুপপত্তেস্তু নশারীরঃ ॥ ৮ ॥ অন্তয়াম্যধিদৈবাদিষু তদ্ধর্মব্যপদেশা ॥ 9 ॥ শারীরশ্চোভয়েডপিহি ভেদে নৈনমধীয়তে ॥ ১০৷ ব্যাসমুনিকৃতবেদান্তসূত্রাণি ।

অর্থ –ব্রহ্মেতর জীবসৃষ্টিকর্তা নহে। কারণ এই অল্প, অল্পজ্ঞ (অল্প) সামর্থযুক্ত জীবের পক্ষে সৃষ্টিকর্তৃত্ব সম্ভব নহে। অতএব জীব ব্রহ্ম নহে ॥ ১ ॥

রসং হ্যেবায়ং লব্ধানন্দী ভবতি’ ইহা উপনিষদের বচন ॥ জীব এবং ব্রহ্ম ভিন্ন, কারণ এই দুইয়ের ভেদ প্রতিপাদন করা হইতেছে। এইরূপ না হইলে রস অর্থাৎ আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইয়া জীব আনন্দস্বরূপ হইত, এই প্রাপ্তিবিষয় ব্রহ্ম এবং পাইবার পাত্র জীবের নিরূপণ হইতে পারিত না। অতএব জীব ব্রহ্ম নহে। ২ ॥

দিব্যো হ্যমূৰ্ত্তঃ পুরুষঃ স বাহ্যভ্যন্তরো হ্যজঃ ॥ অপ্রাণো হ্যমনঃ শুভ্রোহ্যক্ষরাৎপরতঃ পরঃ ॥ মুণ্ডকোপনিষদ ॥

দিব্য, শুদ্ধ, মূৰ্ত্তিমত্ত্বরহিত, সর্বত্র পূর্ণ, অন্তরে-বাহিরে নিরন্তর ব্যাপক, ‘অজ’ জন্ম-মরণ-শরীর। ধারণাদি রহিত, শ্বাসপ্রশ্বাস শরীর ও মনের সহিত সম্বন্ধরহিত, প্রকাশ স্বরূপ ইত্যাদি পরমাত্মার বিশেষণ, আর ‘অক্ষর’ নাশ রহিত প্রকৃতির অতীত অর্থাৎ প্রকৃতি অপেক্ষা জীব সূক্ষ্ম, উহা অপেক্ষাও পরমেশ্বর সূক্ষ্ম, অর্থাৎ ব্রহ্ম সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম। প্রকৃতি এবং জীব হইতে ভেদ প্রতিপাদন। রূপ হেতু সমূহ দ্বারা সিদ্ধ হয় যে, প্রকৃতি এবং জীব হইতেই ব্রহ্ম ভিন্ন ॥ ৩ ॥

এই সর্বব্যাপক ব্রহ্মে জীবের যোগ অথবা জীবে ব্রহ্মের যোগ প্রতিপাদিত হওয়াতে জীব এবং ব্রহ্ম ভিন্ন। কারণ ভিন্ন পদার্থের মধ্যেই যোগ হইয়া থাকে ॥ ৪ ॥

এই ব্রহ্মের অন্তর্যামী আদি ধর্ম কথিত হইয়াছে। জীবের অভ্যন্তরে ব্রহ্ম ব্যাপক বলিয়া, ব্যাপ্য জীব ব্যাপক ব্রহ্ম হইতে পৃথক্‌। কারণ ব্যাপ্য ব্যাপক সম্বন্ধও ভেদে সংঘটিত হয় ॥ ৫ ॥

যেরূপ পরমাত্মা জীব হইতে ভিন্ন-স্বরূপ, সেইরূপ ইন্দ্রিয়, অন্তঃকরণ, পৃথিব্যাদি ভূত, দি, বায়ু ও সূৰ্য্যাদি দিব্যগুণসমূহের ভোক্তা দেবতাবাচ্য বিদ্বান্ হইতেও পরমাত্মা পৃথক্ ॥ ৬ ৷

“গুহাং প্রবিষ্টৌসুকৃতস্য লোকে”ইত্যাদি উপনিষদ্‌বচনানুসারে জীব এবং পরমাত্মা পৃথক। উপনিষদের বহু স্থলে ইহা প্রদর্শিত হইয়াছে ॥ ৭।

“শরীরে ভবঃ শারীরঃ”; শরীরধারী জীব ব্রহ্ম নহে। কারণ ব্রহ্মের গুণ-কর্ম-স্বভাব জীবে ঘটে না ॥ 8 ॥

অধিদৈব=সমস্ত দিব্য মন আদি ইন্দ্রিয় প্রভৃতি যাবতীয় পদার্থ, অধিভূত=পৃথিব্যাদি ভূত, অধ্যাত্ম=সকল জীবের মধ্যে পরমাত্মা অন্তর্যামী রূপে স্থিত আছেন। কারণ পরমাত্মার ব্যাপকত্ব প্রভৃতি ধর্ম উপনিষদে সর্বত্র ব্যাখ্যাত হইয়াছে ॥ ৯ ॥

শরীরধারী জীব ব্রহ্ম নহে। কারণ ব্রহ্ম হইতে জীবের ভেদ স্বরূপতঃ সিদ্ধ ॥ ১০ ॥

এই সমস্ত শারীরক সূত্র দ্বারাও স্বরূপত ব্রহ্ম এবং জীবের ভেদ সিদ্ধ হয়।

সেইরূপ বেদান্তীদিগের উপক্রম এবং উপসংহার ঘটিতে পারে না, কেননা ‘উপক্রম’ অর্থাৎ আরম্ভ ব্রহ্ম হইতে এবং ‘উপসংহার’ অর্থাৎ প্রলয়ও ব্রহ্ম হইতেই হইয়া থাকে। যদি ব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কোন বস্তু স্বীকার না কর তাহা হইলে উৎপত্তি এবং প্রলয়ও ব্রহ্মের ধর্ম হইয়া পড়িবে। কিন্তু বেদাদি সত্য-শাস্ত্রসমূহে উৎপত্তি ও বিনাশ রহিত ব্রহ্মের প্রতিপাদন করা হইয়াছে। ব্রহ্ম নবীন বেদান্তীদিগের উপর কুপিত হইবেন। কারণ নির্বিকার, অপরিণামী, শুদ্ধ, সনাতন এবং অভ্রান্ত। ইত্যাদি বিশেষণযুক্ত ব্রহ্মে বিকার, উৎপত্তি এবং অজ্ঞান প্রভৃতি কোন রূপই সম্ভব হইতে পারে না। তথা উপসংহার=প্রলয় হইবার পরেও, ব্রহ্ম, কারণাত্মক জড় এবং জীব সর্বদা বিদ্যমান। থাকে। এই জন্য উপক্রম এবং উপসংহারও বেদান্তীদিগের মিথ্যা কল্পনা। এইরূপ অনেক ভ্রান্তিপূর্ণ। কথা আছে, যাহা সেই সকল শাস্ত্র ও প্রত্যক্ষ্যাদি প্রমাণ-বিরুদ্ধ।

অতঃপর জৈন এবং শঙ্করাচার্যের কতিপয় অনুযায়ী যে সকল উপদেশ দিয়াছিলেন তাহার সংস্কার আর্যাবর্তে প্রসারিত হইয়াছিল। তাহাদের নিজেদের মধ্যে খণ্ডন-মণ্ডনও চলিতেছিল। শঙ্করাচার্য্যের তিন শত বৎসর পরে উজ্জয়িনী নগরীতে রাজা বিক্রমাদিত্য কিঞ্চিৎ প্রতাপশালী হইয়াছিলেন। তিনি রাজন্যবর্গের মধ্যে আরদ্ধ যুদ্ধ মিটাইয়া শাস্তি স্থাপন করেন। তৎপরে রাজা ভর্তৃহরি কাব্যদি শাস্ত্র এবং অন্যান্য (বিষয়ে) ও কথাঞ্চিৎ বিদ্যা লাভ করিয়াছিলেন। তিনি সংসার বিরাগী হইয়া রাজ্য পরিত্যাগ করেন।

বিক্রমাদিত্যের পাঁচশত বৎসর পরে ভোজ রাজা হইলেন। তিনি ব্যাকরণ এবং কাব্য অলঙ্কারাদির এরূপ প্রচার করিলেন, যে তাহার রাজ্যে মেষপালক কালিদাসও রঘুবংশ-কাব্যের রচয়িতা হইয়াছিলেন। কেহ ভোজরাজার নিকট শ্লোক রচনা করিয়া লইয়া গেলে, তাহাকে প্রচুর ধন দেওয়া হইত এবং তিনি সম্মানও লাভ করিতেন। অতঃপর রাজন্যবর্গ এবং ধনাঢ্যগণ বিদ্যাধ্যয়নই পরিত্যাগ করিলেন।

যদিও শঙ্করাচার্য্যের পূর্বে এবং বামমার্গীদের পরে শৈবাদি সম্প্রদায়ের মতবাদীরা ছিল, তথাপি তাহাদের শক্তি সামর্থ্য ছিল না। মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সময় হইতে শৈবদিগের প্রভাব বৃদ্ধি পাইতেছিল। বামমার্গীদের দশ মহাবিদ্যা প্রভৃতি শাখার ন্যায় শৈবদিগের পাশুপত প্রভৃতি বহু শাখা ছিল।

জনসাধারণ শঙ্করাচাৰ্য্যকে শিবের অবতার বলিয়া নির্ধারণ করিল। তাহার অনুযায়ী সন্ন্যাসিগণও শৈবমত অবলম্বন করিলেন এবং বামমার্গীদিগকেও তাহাদের সহিত মিলাইতে ছিলেন। বামমার্গীগণ শিবপত্নী দেবীর উপাসক হইলেন। উভয়ে অদ্যাবধি রুদ্রাক্ষ ভস্মধারণ করেন। কিন্তু বামমার্গীরা যেরূপ বেদবিরোধী শৈবগণ সেরূপ নহেন।

ধিক্‌ধিকপালং ভস্ম-রুদ্রাক্ষ-বিহীন ॥ ১ ॥ রুদ্রাক্ষা কণ্ঠদেশে দশনপরিমিতা মস্তকেবিংশতী দ্বে, ষ ষট্‌ কর্ণপ্রদেশে করয়ুগলতান্ দ্বাদশা দ্বাদশৈব। বাহ্লােরিন্দোঃ কলাভিঃ পৃথগিতিগদিতমেকমেবংশিখায়াম, বক্ষস্যষ্টাধিকং য়ঃ কলয়তিশতকংস স্বয়ংনীলকণ্ঠঃ ॥২॥(শিবপূরাণ)

এইরূপে ইহারা বহুবিধ শ্লোক রচনা করিয়া বলিতে লাগিল যে, যাহার কপালে ভস্ম এবং রুদ্রাক্ষ নাই, তাহাকে ধিক্। “তং ত্যজেদন্ত্যজং যথা”তাহাকে চণ্ডালবৎ বর্জন করা কর্ত্তব্য। ১ ॥

যিনি কণ্ঠে বত্রিশ, মস্তকে চল্লিশ, কর্ণে ছয়-ছয়টি, হস্তে বার-বারাটি, বাহুতে ষোলটি, শিখায় একটি হৃদয়ে একশত আটটি রুদ্রাক্ষ ধারণ করেন, তিনি সাক্ষাৎ মহাদেবের তুল্য ॥ ২ ॥ শাক্তরাও এইরূপ মানে ॥

বামমার্গী এবং শৈবগণ অতঃপর একমত হইয়া ভগলিঙ্গ স্থাপন করিল। তাহারা উহাকে ‘জলাধারী’ এবং “লিঙ্গ’ নাম দিয়া পূজা করিতে লাগিল। নির্লজ্জদের একটুও লজ্জা হইল না যে, তাহারা এই জঘন্য কাৰ্য্য করিতেছে কেন? জনৈক কবি লিখিয়াছেন, “স্বার্থ দোষং ন পশ্যতি” স্বার্থপর লোকেরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য কুকাৰ্য্যকেও শ্রেষ্ঠ কাৰ্য্য মনে করে এবং তাহাতে কোন দোষ দেখে না। তাহারা পাষাণাদির মূর্তি এবং যোনি লিঙ্গের পূজায় ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষসিদ্ধ মনে করিতে লাগিল।

রাজা ভোজের পরবর্তীকালে জৈনগণ নিজেদের মন্দির সমূহে মূর্তি স্থাপন করিয়া মূর্তির দর্শন ও স্পর্শনাদির জন্য যাতায়াত আরম্ভ করিতে লাগিল তাহাদের শিষ্যরাও তাহাদের অনুকরণ করিতে আরম্ভ করিল। তখন ত এই সব পোপের শিষ্যগণও জৈনদের মন্দিরে যাতায়াত করিতে লাগিল। অপর দিকে পশ্চিম পথে ভিন্ন মত এবং যবনগণও আৰ্য্যাবৰ্ত্তে যাতায়াত করিতে লাগিল। তখন পোপগণ এই শ্লোক রচনা করিলেন —

নবদেদয়াবনীং ভাষাং প্রাণৈঃ কণ্ঠগতৈরপি। হস্তিনা তাড্যমানো-পিন গচ্ছেজ্জৈনমন্দির ॥

যতই কষ্ট হউক না কেন, প্রাণ কণ্ঠাগত হইলেও অর্থাৎ মৃত্যুর সময় উপস্থিত হইলেও যাবনী অর্থাৎ ম্লেচ্ছভাষা মুখেও উচ্চারণ করিবে না। উন্মত্ত হস্তী কর্তৃক তাড়িত হইয়াও জৈন মন্দিরে প্রবেশ করিবে না। সে স্থানে প্রবেশ করিয়া রক্ষা পাওয়া অপেক্ষা হস্তীর সম্মুখীন হইয়া মরা ভাল।

ইহারা নিজেদের চেলাদের এইরূপ উপদেশ দিতে লাগিল। যখন কেহ তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিত, তোমাদের মত সম্বন্ধে কোন প্রামাণিক গ্রন্থের প্রমাণ আছে কী? তখন তাহারা উত্তর দিত, “হ্যাঁ আছে”। যখন বলা হইত, দেখাও তো’? তখন তাহারা মার্কণ্ডেয় পুরাণাদির বচন পাঠ করিত, এবং দুর্গাপাঠে দেবীর যে বর্ণনা লিখিত আছে, তাহা শুনাইত।

রাজা ভোজের রাজ্যে কেহ কেহ ব্যাসদেবের নামে মার্কণ্ডেয় পুরাণ ও শিবপুরাণ রচনা করিয়াছিলেন। সে বৃত্তান্ত জানিতে পারিয়া রাজা ভোজ উক্ত পণ্ডিতদের হস্তচ্ছেদনাদি দণ্ডদান করিলেন এবং তাহাদিগকে বলিলেন যে, যে কেহ কাব্যগ্রন্থাদি রচনা করিবেন তিনি নিজ নামেই করিবেন, ঋষিমুনিদিগের নামে করিবেন না। এ বিষয় রাজা ভোজ প্রণীত “সঞ্জীবনী” নামক ইতিহাসে লিখিত আছে। এই গ্রন্থ গোয়ালিয়র রাজ্যে “ভিণ্ড” নগরে তেওয়ারী ব্রাহ্মণদের গৃহে আছে। লখুনার রাওসাহেব এবং তাঁহার গোমস্তা রামদয়াল চৌবে মহাশয় উহা স্বচক্ষে দেখিয়াছেন।

উহাতে স্পষ্ট লিখিত আছে যে, ব্যাসদেব ৪৪০০ এবং তাহার শিষ্যগণ ৫৬০০ শ্লোকযুক্ত অর্থাৎ সর্বসমেত ১০,০০০ শ্লোকযুক্ত মহাভারত রচনা করিয়াছিলেন। উক্ত শ্লোকসংখ্যা মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সময়ে ২০,০০০ হয়। মহারাজ ভোজ বলেন যে, তাঁহার পিতার সময়ে ২৫,০০০ এবং তাহার অর্ধেক বয়সে ৩০,০০০ শ্লোকযুক্ত মহাভারত পাওয়া গিয়াছে। শ্লোকসংখ্যা এইরূপ বৃদ্ধি পাইতে থাকিলে, মহাভারত এক উটের বোঝা হইয়া পড়িবে।

আর ঋষিমুনিদের নামে পুরাণাদিগ্রন্থ রচিত হইতে থাকিলে,আৰ্য্যাবৰ্ত্তবাসীগণ ভ্রমজালে পতিত হইবে এবং বৈদিককর্ম রহিত হইয়া ভ্রষ্ট হইয়া পড়িবে। এতদ্বারা জানা যায় যে, রাজা ভোজের। মধ্যে কিছু কিছু বৈদিক সংস্কার ছিল।

ইহার ভোজ প্রবন্ধ (নামক গ্রন্থে) লিখিত আছে –

ঘটেকয়া ক্রোশদশৈকমঃ সুকৃত্রিমো গচ্ছতি চারুগত্যা। বায়ুং দদাতি ব্যজনংসুপুঙ্কলং বিনা মনুষ্যেণ চলত্যজ ॥

রাজা ভোজের রাজ্যে এবং তৎসমীপবর্তী স্থানে এমন বহু সুদক্ষ শিল্পী ছিলেন যে, তাহারা। যন্ত্রকাযুক্ত এক ঘোটকাকার যান নিৰ্মাণ করিয়াছিলেন। উহা অর্ধ ঘন্টার কম সময়ে ১১ ক্রোশ এবং পূর্ণ এক ঘন্টায় ২৭তক্রোশ পথ যাইত। উহা স্থলেও অন্তরিক্ষেও যাতায়াত করিত। তাহারা এক প্রকার পাখা এইরূপ প্ৰস্তুত করিয়াছিল যে, উহা মনুষ্য দ্বারা চালিত না হইয়াও কলা-যন্ত্রবলে সৰ্ব্বদা চালিত হইত এবং প্রচুর বায়ু সঞ্চার করিত। এই দুই পদার্থ আজ বিদ্যমান থাকিলে ইউরোপীয়গণ অহঙ্কারে এত স্ফীত হইত না।

যখন পোপগণ তাহাদের শিষ্যদিগকে জৈনদের নিকটে যাইতে বাধা দিয়াও তাহাদের জৈনমন্দিরে যাতায়াত বন্ধ করিতে পারিল না এবং লোকেরা জৈনদের উপদেশ শুনিবার জন্যও যাতায়াত করিতে লাগিল তখন জৈন পোপগণ পৌরাণিক পোপের শিষ্যদিগকে বিভ্রান্ত করিতে লাগিল। পৌরাণিকগণ ভাবিল যে, ইহার কোন উপায় করা উচিত। তাহা না হইলে তাহাদের শিষ্যগণ জৈন হইয়া যাইবে। সুতরাং পৌরাণিক-পোপগণ ইহা স্থির করিল যে, জৈনদের ন্যায় তাহাদেরও অবতার মূৰ্ত্তি এবং কথাগ্রন্থ রচিত হউক। ইহারা জৈনদের ২৪ তীর্থঙ্করের ন্যায় ২৪ অবতার, মন্দির এবং মূর্তি নির্মাণ করাইল। আর যেরূপ জৈনদের ‘আদি’ ও ‘উত্তর’ পুরাণাদি আছে তদ্রপ অষ্টাদশ পুরাণ রচনা করিতে লাগিল।

রাজা ভোজের দেড়শত বৎসরের পরে বৈষ্ণব মত আরম্ভ হয়। “শঠকোপ’ নামক এক ব্যক্তি কঞ্জর-কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। তাহার দ্বারা এই মতবাদ কিঞ্চিৎ প্রচলিত হইয়াছিল। মেথর কুলোম্ভব ‘মুনির্বাহন এবং তৃতীয় যবনকুলোদ্ভব যবনাচাৰ্য্য আচাৰ্য্য হইলেন। তদনন্তর চতুর্থ ব্রাহ্মণকুলজাত ‘রামানুজ’ আবির্ভূত হইলেন। তিনি তাঁহার মতবাদ প্রসারিত করেন।

শাক্তগণ শিবপুরাণাদি, দেবীভাগবতাদি এবং বৈষ্ণবগণ বিষ্ণু পুরাণাদিরচনা করিলেন। তাহারা এই সমস্ত গ্রন্থ নিজেদের নামে প্রকাশ করিলেন না। কেননা, তাহাদের নামে রচিত হইলে কেহই প্রামাণিক বলিয়া স্বীকার করিবে না। এইজন্য তাহারা ব্যাসাদি ঋষিমুনিদিগের নামে পুরাণ রচনা করিলেন। বাস্তবিক পক্ষে, এ সকল গ্রন্থের নাম “নবীন” রাখাই উচিত ছিল। কিন্তু যদি কোনো দরিদ্র ব্যক্তি নিজ পুত্রের নাম “মহারাজাধিরাজ” এবং আধুনিক পদার্থের নাম ‘সনাতন’ রাখে, তাহাতে আশ্চর্য কী?

ইহাদের পরস্পরের মধ্যে যেমন বিবাদ আছে, সেইরূপ পুরাণগুলির মধ্যেও বিবাদ রহিয়াছে। দেখ! দেবীভাগবতে শ্রীপুরের অধিষ্ঠাত্রী “শ্রী” নাম্নী এক দেবীর উল্লেখ আছে। তিনি সমগ্র জগৎ-ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহাদেবকেও সৃষ্টি করেন। দেবীর যখন ইচ্ছা হইল, তখন তিনি তাহার হাত রগড়াইলেন। তাহাতে তাহার হস্তে এক ফোস্কা পড়িল। সেই ফোস্কা হইতেব্রহ্মা উৎপন্ন হইলেন। দেবী ব্রহ্মকে বলিলেন, “তুমি আমাকে বিবাহ কর”। ব্রহ্মা বলিলেন, “তুমি যে আমার মা, আমি তোমাকে বিবাহ করিতে পারি না।” তাহা শুনিয়া মাতা ক্রুদ্ধ হইলেন এবং পুত্রকে ভস্ম করিয়া দিলেন।

তিনি পুনরায় হাত রগড়াইয়া পূর্বের ন্যায় দ্বিতীয় পুত্র উৎপন্ন করিলেন এবং তাহার নাম ‘বিষ্ণু’রাখিলেন। বিষ্ণুকেও সেইরূপ বলিলেন। তিনি মানিলেন না, তাহাকেও তিনি ভস্ম করিয়া দিলেন। দেবী পুনরায় তৃতীয় পুত্র উৎপন্ন করিয়া তাহার নাম ‘মহাদেব’রাখিলেন, এবং তাহাকেও বলিলেন, –“তুমি আমাকে বিবাহ কর।” মহাদেব বলিলেন, “আমি তোমাকে বিবাহ করিতে পারি না, তুমি অন্য স্ত্রীদেহ ধারণ কর। দেবী তাহাই করিলেন। তখন মহাদেব বলিলেন, –“এই দুই স্থানে ভস্মের ন্যায় কী পড়িয়া আছে”। দেবী বললেন, –“ইহারা তোমার দুই ভাই; ইহারা আমার আজ্ঞা পালন করে নাই বলিয়া আমি ইহাদিগকে ভস্ম করিয়াছি”। মহাদেব বলিলেন, “আমি একা কী করিব? ইহাদিগকে জীবিত কর এবং আরও দুইজন স্ত্রীলোক উৎপন্ন কর। তিন জনের বিবাহ তিন জনের সহিত হইবে”। দেবী তাহাই করিলেন। অনন্তর তিন জলের সহিত তিন জনের বিবাহ হইল। বাহবা! মাতাকে বিবাহ করিল না, কিন্তু ভগ্নীকে করিল? ইহাকে কি উচিত কাৰ্য্য বলিয়া মনে করা সঙ্গত? পরে দেবী ইন্দ্রাদিকে উৎপন্ন করিয়া ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং ইন্দ্রকে তাহার পাল্কিবাহক ভৃত্য করিলেন। এইরূপ মনগড়া লম্বা চওড়া আষাঢ়ে গল্প রচিত হইয়াছে। তাহাদিগকে যদি কেহ জিজ্ঞাসা করে “দেবীর শরীর এবং শ্রীপুরের সৃষ্টিকর্তা কে? দেবীর মাতাপিতা। কাহারা ছিলেন”? যদি বলে যে দেবী অনাদি। যদি তাহার হয়, সংযোজক বস্তু কখনও অনাদি হইতে পারে না। যদি মাতার সহিত পুত্রের বিবাহে ভয় হয়, তবে ভ্রাতার সহিত ভগ্নির বিবাহ করা। এমন কি ভাল কথা হইল?

এই “দেবীভাগবতে” যেমন মহাদেব, বিষ্ণু এবং ব্রহ্মাদির হীনতা ও দেবীর মহত্ত্ব বর্ণিত হইয়াছে সেইরূপ “শিবপুরাণে” দেবী প্রভৃতির অনেক হীনতা বর্ণিত হইয়াছে অর্থাৎ ইহারা সকলে মহাদেবের দাস এবং মহাদেব সকলের ঈশ্বর ॥

যদি রুদ্রাক্ষ’ অর্থাৎ বৃক্ষবিশেষের ফলের বীজ এবং ভস্ম ধারণ করিলে মুক্তি হয় বলিয়া মনে কর তাহা হইলে ভস্মে লুণ্ঠিত গর্ভ প্রভৃতি পশুর, কুঁচাদি ধারণকারী ভীল ও কঞ্জর প্রভৃতির শূকর, কুকুর, গর্দভাদি ভস্মলুণ্ঠিত পশুদের মুক্তি হয় না কেন?

প্রশ্ন –”কালাগ্নিরুদ্ৰোপনিষদ্‌” গ্রন্থে ভস্মলেপন করিবার যে বিধান আছে তাহা কি মিথ্যা? এবং “ত্রায়ুষং জমদগ্নে” যজুর্বেদবচন ইত্যাদি বেদমন্ত্রে ভস্মধারণের বিধান আছে। আর পুরাণে বর্ণিত আছে যে, রুদ্রের চক্ষু হইতে অশ্রুপাত হওয়াতে যে বৃক্ষ হইয়াছিল, তাহার নাম ‘রুদ্রাক্ষ’। এইজন্য রুদ্রাক্ষধারণে পুণ্য হয় বলিয়া লিখিত হইয়াছে। একটি মাত্র রুদ্রাক্ষ ধারণ । করিলেও সকল পাপ হইতে মুক্ত হইয়া স্বর্গে যাওয়া যায়, যমরাজ এবং নরকের ভয় থাকে না।

উত্তর –“কালাগ্নিরুদ্ৰোপনিষদ্ কোন ছাইমাখা ব্যক্তি অর্থাৎ ভস্মধারী রচনা করিয়াছে। কারণ “য়াস্য প্রথমা রেখা সা ভূর্লোক” ইত্যাদি বচন (উক্ত গ্রন্থে) নিরর্থক। প্রতিদিন হস্তরচিত ভস্মরেখা কীরূপে ভূলোক বা তাহার বাচক হইতে পারে? আর “ত্রায়ুষং জমদগ্নে” ইত্যাদি যে সমস্ত মন্ত্র আছে তাহা ভস্ম অথবা ত্রিপুন্ড্র ধারণের সূচক নহে; কিন্তু “চক্ষুবৈ জমদগ্নিঃ”শতপথ– “হে পরমেশ্বর। আমার নেত্রের জ্যোতিঃ ত্র্যায়ুষম্‌=তিন গুণ অর্থাৎ তিনশত বৎসর পর্যন্ত থাকুক; আর আমিও এরূপ ধর্মযুক্ত কর্ম করি যেন আমার দৃষ্টিশক্তি নাশ না হয়”।

কী আশ্চর্য্য –ইহা বড় মূর্খর্তার কথা যে, চোখের জল হইতেও বৃক্ষ উৎপন্ন হইতে পারে। কেহ কি পরমেশ্বরের সৃষ্টিক্রমের অন্যথা করিতে পারে? পরমাত্মা যে-বৃক্ষের যে-বীজ রচনা করিয়াছেন, সে বীজ হইতেই সেই বৃক্ষ উৎপন্ন হইতে পারে; অন্যথা নহে। এই হেতু রুদ্রাক্ষ, ভস্ম, তুলসী, কমলাক্ষ, ঘাস এবং চন্দনাদি কণ্ঠে ধারণ করা উহা বন্য পশুবৎ মনুষ্যের কাৰ্য্য।

এইরূপে বামমার্গী এবং শৈবগণ অতিশয় মিথ্যাচারী, বিরোধী এবং কর্তব্যতাগী। তাহাদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ, তিনি এ সকল কথা বিশ্বাস না করিয়া সৎকর্ম করিয়া থাকেন। যদি রুদ্রাক্ষ এবং ভস্মরণ করিলে যমরাজের দূত ভয় পায় তবে সম্ভবতঃ পুলিশের সিপাহীরাও ভয় পাইয়া থাকিবে। কুকুর, সিংহ, সর্প, বৃশ্চিক, মক্ষিকা এবং মশক প্রভৃতিও যদি রুদ্রাক্ষ এবং ভস্মধারীদিগকে ভয় না করে, তবে ন্যায়াধীশগণ তাহাদিগকে ভয় করিবেন কেন?

প্রশ্ন –বামমার্গীগণ এবং শৈবগণ ভালো না হউন, কিন্তু বৈষ্ণবগণ ত ভালো?

উত্তর –ইহারাও বেদবিরোধী বলিয়া তদপেক্ষা অধিক মন্দ।

প্রশ্ন –নমস্তে রুদ্রমন্যবে।’ (শিবায় চ শিবতরায় চ) ‘বৈষ্ণবমসি। বামনায় চ। গণনাং ত্বা গণপতিওঁহবামহে। ভগবতী (হি) ভূয়াঃ। সূয় আত্মা জগতস্তষশ্চ।

এই সব বেদ-প্রমাণ দ্বারা যদি শৈব প্রভৃতি মত সিদ্ধ হয়, তবে আমার খণ্ডন করিতেছেন। কেন?

উত্তর –এই সকল বচন দ্বারা শৈব প্রভৃতি সম্প্রদায় সিদ্ধ হয় না। কারণ, রুদ্র’=পরমেশ্বর, প্রাণাদি বায়ু, জীব এবং অগ্নি ইত্যাদির নাম। যিনি ক্রুদ্ধ হইয়া দুষ্টদিগের রোদন করান, সেই রুদ্র পরমাত্মাকে নমস্কার করা প্রাণ ও জঠরাগ্নিকে অন্ন দিবে। “নম ইতিঅন্ননাম’ –নিঘন্টু ২৭। যিনি মঙ্গলকারী সমস্ত জগতের কল্যাণকারী সেই (শিব) পরমাত্মাকে নমস্কার করা কর্তব্য।

‘শিবস্য পরমেশ্বরস্যায়ং ভক্তঃ শৈবঃ। বিষ্ণোঃ পরমাত্মনোভয়ংভক্তো বৈষ্ণবঃ।

‘গণপতে সকল জগৎস্বামিনোয়ং সেবকো গাণপতঃ। ভগবত্যা ব্যাণ্যা অয়ং সেবকো ভাগবতঃ। সূয়স্য চরাচরাত্মনোয়ং সেবকঃ সৌরঃ।

এই সকল রুদ্র-শিব- বিষ্ণুও- গণপতি এবং সূৰ্য্যাদি পরমেশ্বরের নাম এবং “ভগবতী’ সত্যভাষণযুক্ত বাণীর নাম। এসকল না বুঝিয়া লোকে এইসব ঝগড়া বাধাইয়াছে; যথা–

কোনো বৈরাগীর দুই চেলা ছিল। তাহারা প্রতিদিন গুরুর পা টিপিয়া দিত। তাহারা ভাগ করিয়া একজন দক্ষিণ এবং অন্য জন বাম পদের সেবার ভার লইয়াছিল। একদিন তাহাদের একজন বাজার করিবার জন্য কোন স্থানে গমন করে। অপর জন নিজ পদের সেবা করিতে থাকে। ইত্যবসরে গুরুদেব পার্শ্বপরিবর্তন করাতে উক্ত শিষ্যের সেবা পদের উপর তাহার গুরু-ভ্রাতার সেবা পদ পতিত হইল। হাতে সে লাঠি লইয়া সেই পদের উপর আঘাত করিতে লাগিল। গুরু বলিলেন, “ওরে দুষ্টু! তুই একি করিলি?” চেলা বলিল,–”আমার সেব্যপদের উপর এই পা আসিয়া পড়িল কেন?” ইত্যবসরে যে চেলা বাজারে গিয়াছিল, সে ফিরিয়া আসিল। সেও সেব্য পদের সেবা করিতে আরম্ভ করিল। সে দেখিল তাহার সেব্য পদখানি ফুলিয়া গিয়াছে, তখন সে বলিল –”গুরুদেব! আমার এই সেব্য পা-খানির কী হইয়াছে?” গুরু সমস্ত বৃত্তান্ত করিলেন। তখন সেই মূর্খও নিঃশব্দে দণ্ড লইয়া সজোরে গুরুর অন্য পায়ের উপর প্রহার করিতে লাগিল। গুরু উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিলে দুই চেলা লাঠি লইয়া তাহার দুই পদের উপরে প্রহার করিতে লাগিল।

মহা কোলাহল উপস্থিত হইল। তাহা শুনিয়া লোকেরা আসিয়া বলিল, “সাধু! আপনার কী হইয়াছে?” তাহাদের মধ্যে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি সাধুকে শিষ্যদের হাত হইতে ছাড়াইয়া, সেই মূর্খ চেলাদিগকে এই বলিয়া উপদেশ দিলেন –“দেখ, এই পা দুইখানি তোমাদের গুরু দেবেরই। এই পদযুগলের সেবা করিলে তাহার সুখ হয়, আর ব্যথা দিলে তাহারই কষ্ট হয়।”

একই গুরুর সেবায় শিষ্যেরা যেমন লীলা খেলা করিল, সেইরূপ এক অখণ্ড সচ্চিদানন্দ অনন্ত স্বরূপ পরমাত্মার বিষ্ণু এবং রুদ্র প্রভৃতি যে অনেক নাম আছে এবং যে সকল নামার্থ প্রথম সমুল্লাসে বর্ণিত হইয়াছে, সেই সত্যার্থ না জানিয়া শৈব, শাক্ত এবং বৈষ্ণবাদি সম্প্রদায় পরস্পরের নিন্দা করিয়া থাকে। যাহারা অল্পবুদ্ধি মানুষ তাহারা নিজেদের বুদ্ধি খাটাইয়া চিন্তা করে না যে, বিষ্ণু, রুদ্র এবং শিবাদি নাম এক অদ্বিতীয়, সর্বনিয়ন্তা ও সর্বান্তর্যামী জগদীশ্বরের অনেক গুণ-কর্ম-স্বভাব সূচক বলিয়া তাঁহারই বাচক। বলুন তো এমন মূর্খদের উপর কি ঈশ্বরের কোপ না হইয়া পারে?

এবার চক্রাঙ্কিত বৈষ্ণবদের অদ্ভুত লীলা দেখুন!

তাপঃ পুং তথা নাম মালা মন্ত্রস্তথৈব চ। অমী হি পঞ্চ সংস্কারাঃ পরমৈকান্তহেতবঃ ॥১॥ অতপ্ততনুর্ন তদামো অণুতো। ইতি তেঃ ॥

অর্থাৎ (তাপঃ)=শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্মের (ধাতব) চিহ্ন সমূহকে অগ্নিতে তপ্ত করিয়া বাহুমূলে দাগ দিবার পর দুগ্ধপূর্ণ পাত্রে (তপ্ত চিহ্নগুলিকে) শীতল করা হয় এবং কেহ কেহ সেই দুগ্ধ পানও করেন।

এখন দেখুন! প্রত্যক্ষ মনুষ্য মাংসের স্বাদও সম্ভবতঃ তাহাতে থাকে। ইহারা এইরূপ কর্ম দ্বারা পরমেশ্বরকে লাভ করিবার আশা করে এবং বলে যে, শঙ্খ-চক্রাদির দ্বারা শরীর তপ্ত করা ব্যতীত জীব পরমেশ্বরকে লাভ করিতে পারে না। কারণ সে ‘আমঃ’ –অর্থাৎ অপরিপক্ক।

আবার কাহারও নিকট রাজ্যের চাপরাস প্রভৃতি চিহ্ন থাকিলে সকলে তাহাকে রাজপুরুষ জানিয়া ভয় করে, সেইরূপ বিষ্ণুর শঙ্খ-চক্রাদি অস্ত্র চিহ্ন দেখিয়া যমরাজ এবং তাহার দূতগণ ভীত হন ও বলেন —

দোহা –বানা বড়া দয়াল কা, তিলক ছাপ ঔর মাল। য়ম ডরপৈ কালু কহে, ভয় মানে ভূপাল ॥

অর্থাৎ ভগবানের ভেক, তিলক, ছাপ এবং মালা ধারণ করা শ্রেষ্ঠ কর্ম। তদ্বারা যমরাজ এবং রাজাও ভীত হন।

এইরূপই ‘পুন্ড্রম’= ললাটে ত্রিশূলের ন্যায় চিত্র অঙ্কিত করা। ‘নাম’=নারায়ণ দাস, বিষুদাস অর্থাৎ দাস শব্দান্ত নাম রাখা, ‘মালা’ পদ্মবীজের মালা এবং পঞ্চম ‘মন্ত্র’ যথা–

ওমনমো নারায়ণায়’ ॥১॥ ইহা জনসাধারণের জন্য এই মন্ত্র রচনা করিয়াছে। তথা –শ্ৰীমন্নারায়ণচরণংশরণং প্রপদ্যে ॥ শ্ৰীমতে নারায়ণায় নমঃ ॥ ২॥ শ্ৰীমতে রামানুজায় নমঃ ॥৩॥ ইত্যাদি মন্ত্র ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্তদিগের জন্য রচনা করিয়াছিলেন। দেখুন! ইহাও এক প্রকার ব্যবসায় বিশেষ! যেমন মুখ তেমন তিলক! এই পাঁচ চক্রাঙ্কিতগণ মুক্তির হেতু বলিয়া মানেন।

এই মন্ত্রগুলির অর্থ –আমি নারায়ণকে নমস্কার করি। আমি লক্ষ্মীযুক্ত নারায়ণের চরণারবিন্দের শরণ লই। আমি শ্রীযুক্ত নারায়ণকে নমস্কার করিতেছি।অর্থাৎ শোভাযুক্ত নারায়ণকে আমার নমস্কার ॥ ২ ॥ আর শ্রীযুক্ত রামানুজকে আমার নমস্কার ॥ ৩ ॥

বামমার্গীগণ যেমন পঞ্চ-মকার মানে, চক্রাঙ্কিতগণও সেইরূপ পাঁচ সংস্কার মানে। তাহারা শঙ্খ-চক্র দ্বারা দাগ দিবার জন্য যে বেদ মন্ত্রের প্রমাণ উল্লেখ করিয়া থাকে উহার পাঠ এবং অর্থ। এইরূপ —

পবিত্রং তে বিততংব্ৰহ্মণতে প্রভুর্গাত্রাণি পয়েষি বিশ্বতঃ। অতপ্ততদূর্ন তদামো অণুতেতাস ইহন্তস্তৎসমাশত ॥১ ॥ তপোপবিত্রং বিততং দিবম্পদে ॥ ২॥ (ঋ০ম০৯। সূ০৮৩ মন্ত্র১,২)।

হে ব্রহ্মাণ্ডপতে! বেদের রক্ষক, সর্বসামর্থযুক্ত, সর্বশক্তিমান্ প্রভো। আপনি নিজ ব্যাপ্তি দ্বারা সংসারের সকল অবয়বকে প্রাপ্ত করিয়া রাখিয়াছেন। ব্রহ্মচর্য্য, সত্যভাষণ, শম,-দম, যোগাভ্যাস, জিতেন্দ্রিয় এবং সৎসঙ্গ ইত্যাদি তপশ্চৰ্য্যা রহিত অপরিপক্ক অন্তঃকরণ-যুক্ত-আত্মা, আপনারা সেই স্বরূপকে প্রাপ্ত হয় না কিন্তু যাহারা পূর্বোক্ত তপঃ দ্বারা শুদ্ধ তাহারাই তপশ্চৰ্য্যা করিতে করিতে আপনার শুদ্ধ স্বরূপকে উত্তমরূপে প্রাপ্ত হইয়া থাকেন ॥ ১ ॥

যাঁহারা প্রকাশ-স্বরূপ পরমেশ্বরের সৃষ্টিতে বিস্তৃত, পবিত্র আচরণরূপ তপশ্চৰ্য্য করেন, তাহারাই পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হইবার উপযুক্ত ॥ ২।

এবার বিচার করুন যে, রামানুজীয় প্রভৃতি ব্যক্তিরা এই মন্ত্র দ্বারা কীরূপে “চক্রাঙ্কিত হওয়া সিদ্ধ করে? আচ্ছা, বলুন তো! তাহারা কি বিদ্বান্ ছিল না অবিদ্বান্? যদি বলেন যে, বিদ্বান্ ছিল, তবে মন্ত্রটির এইরূপ অসম্ভব অর্থ করিল কেন? এই মন্ত্রে “অতপ্ততনুঃ” শব্দ আছে, কিন্তু “অতপ্তভুজৈকদেশঃ” (নাই)। আবার ‘অতপ্ততনুঃ ইহার অর্থ নখশিখা পৰ্য্যন্ত সমুদায়।

যদি চক্রাঙ্কিতগণ এই প্রমাণ অনুসারে অগ্নি দ্বারাই দগ্ধ করা স্বীকার করে তবে নিজ নিজ শরীরকে কোন চুল্লীর মধ্যে নিক্ষেপ করিয় দগ্ধ করুক। তাহা হইলেও এই মন্ত্রার্থের বিরুদ্ধ হয়। কেননা, এই মন্ত্রে সত্যভাষণাদি পবিত্র কর্মানুষ্ঠানকে তপ বলিয়া গ্রহণ করা হইয়াছে।

ঋতং তপঃ সত্যং তপোদমস্তপঃ স্বাধ্যয়স্তপঃ ॥ তৈত্তিরীয়ঃ

অর্থাৎ এ সকলকে তপ বলে। ঋতং তপঃ=যথার্থ শুদ্ধভাব, সত্য মানা, সত্য বলা, সত্য করা, মনকে অধর্ম-মার্গ হইতে নিবৃত্ত করা, বাহ্যেন্দ্রিয় সমূহকে অন্যায় আচরণ হইতে বিরত রাখা অর্থাৎ দেহেন্দ্রিয়-মন দ্বারা শুভ কর্মের আচরণ করা, বেদাদিসত্যবিদ্যার অধ্যয়ন-অধ্যপনা, বেদানুসার আচরণ করা, প্রভৃতি উত্তম ধর্মযুক্ত কর্মানুষ্ঠানের নাম ‘তপ’।

কোন ধাতুকে তপ্ত করিয়া তদ্বারা গাত্র চর্ম দগ্ধ করাকে ‘তপ’ বলে না।

দেখ! চক্রাঙ্কিতগণ নিজদিগকে শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণববলিয়া মনে করে। কিন্তু তাহারা তাহাদের পরম্পরা এবং কুকর্মের প্রতি লক্ষ্য রাখে না। “শঠকোপ” নামক এক ব্যক্তি চক্রাঙ্কিতদের আদি পুরুষ ছিলেন। চক্রাঙ্কিতদের গ্রন্থসমূহে এবং নাভা-ডোমরচিত ভক্তমাল গ্রন্থে লিখিয়াছে বিক্রীয়শূর্পং বিচ্চার য়োগী’ এই বচন চক্রাঙ্কিতদের গ্রন্থে উল্লেখ আছে।

‘শঠকোপ’ যোগী কুলা নির্মাণ করিত এবং তা বিক্রয়ার্থ বিচরণ করিত অর্থাৎ সে ‘কঞ্জর জাতিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। সম্ভবতঃ সে ব্রাক্ষণদের নিকট অধ্যয়ন করিতে অথবা উপদেশ শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করিলে তাহারা তিরস্কার করিয়া থাকিবেন। এই নিমিত্ত সে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধ সম্প্রদায়, তিলক এবং চক্রাঙ্কিত প্রভৃতি শাস্ত্রবিরুদ্ধ মনগড়া নানা বিষয়ের প্রচলন করিয়া থাকিবে। শঠকোপের চেলা “মুনির্বাহন” চণ্ডাল বর্ণে উৎপন্ন হইয়াছিল। তাহার চেলা “যাবনাচাৰ্য্য” যবন কুলে তাহার জন্ম। কেহ নাম পরিবর্তন করিয়া তাহাকে “যামুনাচাৰ্য্য” ও বলিয়া থাকেন। তাহার পরে ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব রামানুজ চক্রাঙ্কিত হইলেন।

তাঁহার পূর্বে কতিপয় ভাষা গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। রামানুজও কিঞ্চিৎ সংস্কৃত অধ্যয়ন করিয়া সংস্কৃতে শ্লোকবদ্ধ গ্রন্থশারীরক সূত্র ও শঙ্করাচাৰ্য্যকৃত শারীরক সূত্রের টীকার বিরুদ্ধে উপনিষদের টীকা রচনা করেন। তিনি শঙ্করাচার্য্যের অনেক নিন্দা করেন। উদাহরণ স্বরূপ –শঙ্করাচার্য্যের মত অদ্বৈত অর্থাৎ জীব-ব্রহ্ম একই, দ্বিতীয় কোন বস্তু বাস্তবিক নহে। জগৎ প্রপঞ্চ সমস্ত মিথ্যা মায়ারূপ এবং অনিত্য। রামানুজের মত ইহার বিপরীত। রামানুজের মতে জীব, ব্রহ্ম এবং মায়া তিনটিই নিত্য।

এস্থলে বিচাৰ্য্য এই যে, শঙ্করাচার্য্যের ন্যায় ব্রহ্মাতিরিক্ত জীব এবং কারণবস্তু স্বীকার না করা। যুক্তিসঙ্গত নহে। আর রামানুজের এই অংশে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ অর্থাৎ জীব এবং মায়া সহিত পরমেশ্বর এক, এইরূপ তিনকে মানা সর্বদা ব্যর্থ। কণ্ঠি, তিলক, মালা এবং মূর্তিপূজা প্রভৃতি। পাষণ্ড মত প্রচলন করা প্রভৃতি ও অসঙ্গত কথা চক্রাঙ্কিতদের মধ্যে আছে। চক্রাঙ্কিত মত যেরূপ বেদবিরুদ্ধ, শঙ্করাচার্য্যের মত সেরূপ নহে।

প্রশ্ন –মূর্তিপূজা কোথা হইতে প্রচলিত?

উত্তর –জৈনদের নিকট হইতে।

প্রশ্ন –জৈনগণ কোথা হইতে প্রচলিত করিল?

উত্তর –নিজেদের মূর্খ হইতে।

প্রশ্ন –জৈনগণ বলেন যে, শান্ত, ধ্যানাবস্থিত, উপবিষ্ট মূৰ্ত্তি দর্শন করিলে নিজের আত্মারও শুভ পরিণাম সেইরূপই হইয়া থাকে।

উত্তর –জীব চেতন, কিন্তু মূৰ্ত্তি জড়। তবে কি জীবও মূর্তির ন্যায় জড় হইয়া যাইবে? মূর্তিপূজা কেবল পাষণ্ড মত বিশেষ, জৈনরা ইহা চালাইয়াছে। এইজন্য দ্বাদশ সমুল্লাসে এই মতের খণ্ডন করা হইবে।

প্রশ্ন –বৈষ্ণব প্রভৃতি সম্প্রদায় মূৰ্ত্তিবিষয়ে জৈনদের অনুকরণ করে নাই। কেননা বৈষ্ণবদের মূৰ্ত্তি সমূহ জৈনদের মূর্তির ন্যায় নহে।

উত্তর –হ্যাঁ, ইহা অবশ্য সত্য যে, জৈনদের মূর্তির অনুকরণে (বৈষ্ণবদেব) মূৰ্ত্তি নির্মিত হইলে, জৈনমতের সহিত (বৈষ্ণবরা) মিলিয়া যাইত। এই জন্য মূৰ্ত্তির বিপরীত নির্মাণ করা হইয়াছিল। কেননা, জৈনদের সহিত বিরোধ করা বৈষ্ণবদের এবং বৈষ্ণবদের সহিত বিরোধ করা জৈনদের প্রধান কার্য ছিল। যথা –জৈনরা তাহাদের মূর্তি সমূহ বিবস্ত্র নির্মাণ করিত, আর বৈষ্ণবরা তদ্বিরূদ্ধ যথেষ্ট শৃঙ্গারযুক্ত, স্ত্রীলোকের সহিত রঙ্গ-রাগ-ভোগ বিষয়াসক্তি যুক্ত আকৃতি দণ্ডায়মান এবং উপবিষ্ট মূর্তি নির্মাণ করিত। জৈনগণ শঙ্খ-ঘন্টা-কাঁসর প্রভৃতি বাজায় না। কিন্তু বৈষ্ণবাদি মহাকোলাহল করিয়া থাকে।

এইরূপ লীলা-খেলা রচনা করাতেই ত বৈষ্ণবাদি সম্প্রদায় ভক্ত পোপদের শিষ্যেরা জৈনদের জাল হইতে রক্ষা পাইয়াইহাদের লীলায় জড়িত হইল। তাহারা ব্যাসাদি মহর্ষির নামে মনগড়া অসম্ভব গল্প রচনা করিয়া ঐ সকল গ্রন্থের নাম ‘পুরাণ’ রাখিয়া কথকতাও আরম্ভ করিল।

অতঃপর এমনই বিচিত্র মায়া রচনা করিতে লাগিল যে, প্রস্তর মূর্তি নির্মাণ করিয়া গুপ্ত কোন পর্বতে অরণ্যাদিতে রাখিত। পরে ইহারা চেলাদের মধ্যে প্রচার করিত যে, রাত্রিকালে মহাদেব, পার্বতী, রাধাকৃষ্ণ, সীতারাম, লক্ষ্মীনারায়ণ, ভৈরব এবং হনুমান প্রভৃতি তাহাকে স্বপ্নে বলিয়া। দিয়াছেন, –‘আমি অমুক স্থানে আছি আমাকে সে স্থান হইতে আনিয়া মন্দিরে স্থাপন কর এবং তুমি আমার পূজারী হইলে মনোবাঞ্ছিত ফল প্রদান করিব।’

জ্ঞানান্ধ ধনাঢ্যগণ এ সকল পোপলীলা সত্য বলিয়া মানিয়া লইতেন এবং জিজ্ঞাসা করিতেন, “এখন এই মূৰ্ত্তি কোথায় আছে”? তখন পোপ-মহারাজ বলিতেন, “অমুক পৰ্ব্বতে বা অরণ্যে আছে; আমার সঙ্গে চল দেখাইব”। তখন জ্ঞানান্ধ সেই ধূক্তের সঙ্গে সে স্থানে যাইয়া মূর্তি দর্শন করিত এবং আশ্চর্য্য হইয়া তাহার পায়ে পড়িয়া বলিত,– “আপনার এই দেবতার বড়ই কৃপা; এবার ইহাকে আপনি লইয়া চলুন, আমি মন্দির নির্মাণ করাইয়া দিব। মন্দিরে এই দেবতার স্থাপনা করিয়া আপনিই পূজা করিবেন। আমরাও মনোবাঞ্ছিত ফল লাভ করিব।” একজনের এইরূপ লীলা-খেলা রচনার পর দেখাদেখি অন্যান্য সকল পোপ’তাহাদের আপন জীবিকার্থে ছলনা-কপটতা সহকারে মূর্তি স্থাপন করিতে লাগিল।

প্রশ্ন –পরমেশ্বর নিরাকার, তিনি ধ্যানগম্য নহেন। এই জন্য অবশ্যই মূৰ্ত্তি থাকা উচিত। ভাবিয়া দেখুন –যে ব্যক্তি কিছুই করে না সেও যদি মূৰ্ত্তির সম্মুখে যাইয়া করজোড়ে পরমেশ্বরের নাম স্মরণ ও নাম উচ্চারণ করে, ইহাতে ক্ষতি কী?

উত্তর –পরমেশ্বর নিরাকার এবং সর্বব্যাপক। তাঁহার মূৰ্ত্তিই নির্মিত হইতে পারে না। আর যদি মূর্তি দর্শন মাত্রই পরমেশ্বরের স্মরণ হয়,তাহা হইলে ঈশ্বর রচিত পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, এবং বনস্পতি প্রভৃতি বহুবিধ পদার্থ যাহাতে অদ্ভুত রচনা কৌশল রহিয়াছে, সেই পৃথিবীও পর্বতাদি পরমেশ্বরে রচিত মহামূৰ্ত্তি স্বরূপ এবং যাহা হইতে ঐ সকল মনুষ্যকৃত মূৰ্ত্তি সমূহ নির্মিত হয় সে সকল দেখিয়া কি পরমেশ্বরের স্মরণ হইতে পারে না? তুমি বলিতেছ যে, মূৰ্ত্তি দর্শনে পরমেশ্বরের স্মরণ হয়, তোমার এই উক্তি সর্বথা মিথ্যা। কারণ সেই মূৰ্ত্তি সম্মুখে না থাকিলে যখন পরমেশ্বরের স্মরণ হইবে না, তখন মনুষ্য নির্জন পাইয়া চৌর্য্য এবং লাম্পট্য প্রভৃতি কুকর্মে রত হইতে পারে। কেননা, সে জানে যে, এ সময় এ স্থানে কেহই আমাকে দেখিতেছে না। ফলে সে অনর্থ না করিয়া পারে না। এইরূপ পাষাণাদি মূর্তি পূজায় অনেক দোষ ঘটে।

এখুন দেখুন! যিনি পাষাণাদি মূর্তিকে না মানিয়া সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্যামী এবং ন্যায়কারী পরমাত্মাকে সর্বত্র জানেন এবং মানেন, তিনি তাঁহাকে সকলের সদসৎ কর্মের দ্রষ্টা এবং স্বয়ং পরমাত্মা হইতে ক্ষণ মাত্রও দূর নহেন জানিয়া কুকর্ম করা দূরে থাকুক, মনেও কুচেষ্টা করিতে পারেন না। কারণ তিনি জানেন, “যদি আমি বাক্য, মন ও কর্ম দ্বারাও কোন কুকর্ম করি, তবে এই অন্তর্যামীর ন্যায়বিধানে কিছুতেই দণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইব না।”

আবার কেবলমাত্র নাম স্মরণেও কোনও ফল হয় না। “মিশি, মিশ্রি’ বলিলে মুখে মিষ্ট এবং “নিম্ব, নিম্ব’ বলিলে তিক্ত হয় না। কিন্তু জিহ্বা দ্বারা আস্বাদন করিলেই মিষ্টত্ব অথবা তিক্তত্ব জানা যায়।

প্রশ্ন –নাম লওয়া কি সর্বথা মিথ্যা? পুরাণের সর্বত্র নাম স্মরণের বিশেষ মাহাত্ম্য লিখিত আছে।

উত্তর –তোমাদের নাম লইবার প্রণালী উত্তম নহে। তোমরা যেভাবে নাম স্মরণ করো উহা মিথ্যা।

প্রশ্ন –আমাদের প্রণালী কীরূপ?

উত্তর –বেদ-বিরুদ্ধ।

প্রশ্ন –ভাল, এখন আপনি আমাদের সকলকে নাম স্মরণের বেদোক্ত প্রণালী বলিয়া দিন।

উত্তর –নামস্মরণের প্রণালী এইরূপ হওয়া উচিত, যথা — ঈশ্বরের এক নাম “ন্যায়কারী”। ইহার অর্থ এই যে, যেরূপ পক্ষপাত রহিত হইয়া পরমাত্মা সকলের প্রতি যথোচিত ন্যায় বিচার করেন, সেইরূপ গুণ গ্রহণ করিয়া সকলে অন্যের প্রতি সর্বদা ন্যায় সঙ্গত ব্যবহার করিবে; কখনও অন্যায় করিবে না। এইরূপ একটি মাত্র নামের দ্বারাও মনুষ্যের কল্যাণ হইতে পারে।

প্রশ্ন –আমরাও জানি যে, পরমেশ্বর নিরাকার কিন্তু তিনি শিব, বিষ্ণু, গণেশ, সূৰ্য্য এবং দেবী প্রভৃতির শরীর ধারণ করিয়া, রামও কৃষ্ণাদিরূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। এই নিমিত্ত তাহাদের মূৰ্ত্তি নির্মিত হয়। ইহাও কি মিথ্যা?;

উত্তর –অবশ্যই মিথ্যা। কারণ “অজ একপাৎ”, “অকায়” ইত্যাদি বিশেষণ দ্বারা বেদে উক্ত হইয়াছে, পরমেশ্বর জন্ম-মরণ রহিত। তিনি শরীর ধারণ করেন না। এইরূপ যুক্তি দ্বারাও। পরমেশ্বরের অবতার কখনও সিদ্ধ হইতে পারে না। কারণ তিনি আকাশবৎ সর্বত্র ব্যাপক ও অনন্ত এবং সুখদুঃখ ও দৃশ্যত্ব প্রভৃতি গুণ রহিত। তিনি এক ক্ষুদ্র বীর্য্যে, গর্ভাশয়ে এবং ক্ষুদ্র শরীরে কীরূপে আসিতে পারেন? যিনি একদেশী, তাঁহার যাতায়াত আছে, কিন্তু তিনি অচল ও অদৃশ্য এবং তাহা হইতে একটি পরমাণুও পৃথক্‌ নহে। তাহার অবতার হয় বলা, ইহা যেন বন্ধ্যা-পুত্রের বিবাহ দিয়া তাহার পৌত্র দর্শন করার ন্যায়।

প্রশ্ন –যেহেতু পরমেশ্বর ব্যাপক, অতএব তিনি মূর্তিতে আছেন। সুতরাং যে কোনো পদার্থে ইচ্ছা মত ভাবনা আরোপ করিয়া তাহার পূজা করা কি ভাল নহে? দেখঃ

‘ন কাষ্ঠে বিদ্যতে দেবোন পাষাণে ন মৃন্ময়ে। ভাবে হি বিদ্যতে দেবস্তস্মাভাববা হি কারণম্ ॥ চাণক্য গরুডপুরাণ

পরমেশ্বর কাষ্ঠ, পাষাণ অথবা মৃত্তিকা নির্মিত কোনো পদার্থে থাকেন না, তিনি ভাবেই বিদ্যমান। থাকেন। যে স্থানে ভাবনা করা যায়, সে-স্থানেই পরমেশ্বর আছেন।

উত্তর –যেহেতু পরমেশ্বর সর্বব্যাপক অতএব কোনো বস্তু-বিশেষে ভাবনা করা, অন্যত্র না। করা, ইহা যেন কোন চক্রবর্তী রাজাকে সকল রাজ্যসত্তা হইতে বিচ্যুত একখানি ক্ষুদ্র পর্ণকুটীরের অধিপতি মনে করা। দেখ, ইহা কত বড় অপমান। তুমিও সেইরূপ পরমেশ্বরের অপমান করিতেছ। যদি পরমেশ্বরকে ব্যাপক বলিয়া মান, তাহা হইলে উদ্যান হইতে পুষ্প-পত্র ছিন্ন করিয়া তাহাকে অর্পণ কর কেন? চন্দন ঘর্ষণ লেপন কর কেন? ধূপ জ্বালাও কেন? ঘন্টা-কাসী- ঘড়িয়াল-ঝুঁজে কাষ্ঠের দ্বারা আঘাত কর কেন? পরমেশ্বর তোমার হস্তে আছেন, তবে হাতজোড় কর কেন? তিনি অন্ন এবং জলাদিতে আছেন,তবে তাহাকে নৈবদ্য অপর্ণ কর কেন? তিনি জলে আছেন। তবে তাঁহাকে স্নান করাও কেন? সমস্ত পদার্থেই ত পরমাত্মা ব্যাপক আছেন। তুমি ব্যাপকের। পূজা কর, না ব্যাপ্যের? যদি ব্যাপকের পূজা কর, তবে প্রস্তর কাষ্ঠাদির উপর পুষ্প চন্দনাদি অর্পণ কর কেন? যদি ব্যাপ্যের পূজা কর, তবে “আমি পরমেশ্বরের পূজা করিতেছি”, এমন মিথ্যা কথা। বল কেন? “আমি প্রস্তরাদির পূজারী” –এই সত্য কথাটি বল না কেন?

এখন বল –“ভাব” সত্য কি মিথ্যা? যদি বল ভাব সত্য, তবে পরমেশ্বর তোমার অধীন। হইয়া বদ্ধ হইবেন, আর তুমি মৃত্তিকায় সুবর্ণ-রজতাদি প্রস্তরে হীরা, পান্না প্রভৃতি, সমুদ ফেনায়। মুক্তা, জলে ঘৃত-দুগ্ধ-দধি প্রভৃতি এবং ধূলিতে ময়দা, শর্করা প্রভৃতির ভাবনা করিয়া ঐ সকলকে। সেই সেই রূপে প্রস্তুত কর না কেন? সৰ্ব্বদা সুখের ভাবনা কর, কিন্তু সুখী হও না কেন? তোমরা কখনও দুঃখের ভাবনা কর না, কিন্তু দুঃখ হয় কেন? অন্ধ ব্যক্তি নেত্রের ভাবনা করিয়া দেখে না। কেন? মৃত্যুর ভাবনা কর না কিন্তু মৃত্যুগ্রস্ত হও কেন? সুতরাং তোমার ভাবনা সত্য নহে। যে বস্তু। যাহা তাহাকে তাহাই মনে করার নাম ভাবনা। জলকে অগ্নি এবং অগ্নিকে জল মনে করা অভাবনা। কেননা, যে বস্তু যাহা, তাহাকে তাহাই জানার নাম জ্ঞান। অতএব তুমি অভাবনাকে ভাবনা এবং ভাবনাকে অভাবনা বলিতেছ।

প্রশ্ন –হ্যাঁ মহাশয়! যতক্ষণ না বেদমন্ত্র দ্বারা আবাহন করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত দেবতা আগমন করেন না। কিন্তু আবাহন করা হইলে তৎক্ষণাৎ দেবতা আগমন করেন এবং বিসর্জন করা হইলে চলিয়া যান।

উত্তর –যদি মন্ত্রপাঠ করিয়া আবাহন করিলেই দেবতা উপস্থিত হন, তবে মূৰ্ত্তি চেতন হয় না কেন? বিসৰ্জন করিলেই চলিয়াই বা যান কেন? আবার সেই দেবতা কোথা হইতেই বা আগমন করেন? কোথায়ই বা চলিয়া যান। অন্ধগণ! শ্রবণ করো, পূর্ণ পরমাত্মা আগমনও করেন না গমনও করেন না। যদি মন্ত্রবলে পরমেশ্বরকে আবাহন করিয়া আনাইতে পার, তবে সেই মন্ত্রবলে স্বীয় মৃতপুত্রের শরীরে জীবকে আবাহন করিয়া আনাইতে পার না কেন? শত্রুর শরীরে জীবাত্মার বিসৰ্জন করিয়া তাহাকেমারিতে পার না কেন?নির্বোধ, সরলমতি ভাই সব! পোপগণ তোমাদিগকে প্রত্যারিত করিয়া স্বার্থসিদ্ধ করিয়া থাকে। বেদে পাষাণাদি মূৰ্ত্তির পূজা করা, পরমেশ্বরের আবাহন বিসর্জন করার একটিও অক্ষর নাই।

প্রশ্ন–”প্রাণাইহাগচ্ছন্তু সুখং চিরং তিষ্ঠন্তু স্বাহা। আত্মেহাগচ্ছতু সুখং চিরং তিতু স্বাহা ॥ ইন্দ্রিয়াণীহাগচ্ছন্তু সুখং চিরং তিষ্ঠন্তু স্বাহা ॥”

এই সব বেদমন্ত্র রহিয়াছে। আপনি “নাই” বলিতেছেন কেন?

উত্তর –আরে ভাই। বুদ্ধিটাকে একটু কাৰ্য্যে প্রয়োগ কর। এগুলি কপোলকল্পিত, বামমার্গীদের বেদবিরুদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থোক্ত পোপ রচিত পংক্তি, বেদ-বচন নহে।

প্রশ্ন –তন্ত্র কি মিথ্যা?

উত্তর –হ্যাঁ, সৰ্ব্বথা। বেদে যেমন আবাহণ এবং প্রাণ-প্রতিষ্ঠাদি পাষাণদি মূৰ্ত্তি বিষয়ক একটিও মন্ত্র নাই, সেইরূপ “মানং সমর্পয়ামি” ইত্যাদি বচনও নাই। অর্থাৎ এতটুকুও নাই যে, “পাষাণাদিমূৰ্ত্তিং রচয়িত্বা মন্দিরেষু গন্ধাদিভিরয়েৎ” অর্থাৎ পাষাণ-মূর্তি নির্মাণ করিয়া মন্দিরে স্থাপন করিবে এবং চন্দন আতর তণ্ডুলাদি দ্বারা পূজা করিবে –এইরূপ বাক্যের লেশমাত্রও নাই ॥

প্রশ্ন –যদি বেদে বিধি না থাকে, তবে খণ্ডনও নাই। যদি খণ্ডনও থাকে, তবে “প্রাপ্তেী সত্যাং নিষেধঃ”মূৰ্ত্তি থাকিলেই ত খণ্ডন হইতে পারে।

উত্তর –বিধি ত নাই-ই, অধিকন্তু পরমেশ্বরের স্থলে অন্য কোনও পদার্থকে পূজনীয় না মানিবার (বিধান) এবং (মূৰ্ত্তির) সর্বদা নিষেধ করা আছে।

অপূর্ববিধি কি হয় না? শোন এইরূপ আছে –অন্ধতমঃ প্রবিশন্তি য়েতসম্ভুতি মুপাসতে। ততো ভূয় ইবতে তমো য় উ সম্ভত্যা রতাঃ ॥১॥ যজুঃ ॥ অ০4০। ম০ ৯ ॥ ন তস্য প্রতিমা অস্তি ॥২ ॥ যজু০ অ০ ৩২।ম০৩ ॥ যদ্বাচনভদিতং য়েন বাগ্যুদ্যতে। তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে ॥ ১ ॥ য়ন্মনসা ন মনুতে য়েনাহুর্মনো মতম্‌। তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে৷২ ॥ য়চ্চক্ষু ন পশ্যতি য়েন চক্ষুংষি পশ্যন্তি ॥ তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপামতে৷৩ ॥ হচ্ছুেত্রে নশৃণোতি য়েন শ্রোত্রমিদং তম্ ॥ তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে৷4 ॥ য়প্রাণেন ন প্রাণিতি যেন প্রাণঃ প্ৰণীয়তে। তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে ॥ ৫ ॥ কেনোপনি ॥

যাহারা ব্রহ্মের স্থানে “অসম্ভুতি” অর্থাৎ অনুৎপন্ন অনাদি প্রকৃতি কারণের উপাসনা করে, তাহারা অন্ধকার অর্থাৎ অজ্ঞানতা এবং দুঃখসাগরে নিমগ্ন হয়। আর যাহারা ব্রহ্মের স্থানে ‘সম্ভুতি’ অর্থাৎ কারণ হইতে উৎপন্ন কার্যরূপ পৃথিব্যাদি ভূত, পাষাণ ও বৃক্ষাদির অবয়ব এবং মনুষ্যাদির শরীরের উপাসনা করে, তাহারা উক্ত অন্ধকার অপেক্ষাও অধিকতর অন্ধকার অর্থাৎ মহামূর্খ চিরকাল ঘোর দুঃখরূপ নরকে পতিত হইয়া মহাক্লেশ ভোগ করে ॥ ১ ॥

যিনি সমস্ত জগতে ব্যাপক, সেই নিরাকার, পরমাত্মার প্রতিমা, পরিমাণ, সাদৃশ্য অথবা মূর্তি নাই ॥ ২ ॥

বাণীর যাহা ইদন্তা অর্থাৎ যেরূপ ইহা জল। গ্রহণ করুণ” –সেরূপ বিষয় নহে কিন্তু যাঁহার ধারণ এবং সত্তা দ্বারা বাণী প্রবৃত্ত হয়, তাহাকেইব্রহ্ম বলিয়া জান এবং (তাহারাই) উপাসনা কর; আর যাহা তাহা হইতে ভিন্ন, তাহা উপাসনীয় নহে ॥ ১ ॥

মনের দ্বারা ইয়ত্তা করিয়া যাঁহা মনন বহির্ভুত, যিনি মনকে জানেন সেই ব্রহ্মকে তুমি জান ও তাঁহারই উপাসনা কর। যাহা ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন জীব ও অন্তঃকরণ ব্রহ্মের স্থানে, তাহার উপাসনা করিও না ॥ ২ ॥

যাহা চক্ষু দ্বারা দৃষ্ট হয় না কিন্তু যাঁহার দ্বারা চক্ষু দেখিতে পায়, তাহাকেই তুমি ব্ৰহ্ম বলিয়া জান। এবং তাহারই উপাসনা কর। আর যাহা ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন সূৰ্য্য-বিদ্যুৎ-অগ্নি আদি জড় পদার্থ আছে, তাহাদের উপাসনা করিও না ॥ ৩ ॥

যাহা শ্রোত্র দ্বারা শোনা যায় না, কিন্তু যাঁহার দ্বারা শ্রোত্র শ্রবণ করে, তুমি তাহাকে ব্রহ্ম বলিয়া জান এবং তাহারই উপাসনা কর। তাহা হইতে ভিন্ন শব্দ প্রভৃতির উপাসনা তৎস্থলে করিও না ॥ ৪ ॥

যাহা প্রাণ দ্বারা চালিত হয় না কিন্তু যাঁহার দ্বারা প্রাণ গতিশীল, সেই ব্রহ্মকেই তুমি জান, এবং তাহারই উপাসনা কর। তাহা হইতে ভিন্ন, বায়ুর উপাসনা করিও না ॥ ৫ ॥

ইত্যাদি অনেক নিষেধ আছে। নিষেধ প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত উভয়েরই হইয়া থাকে। প্রাপ্তের নিষেধ –যেমন কেহ কোথায়ও বসিয়া আছে, তাহাকে সে স্থান হইতে উঠাইয়া দেওয়া। অপ্রাপ্তের নিষেধ –যেমন (কেহ বলিল)” হে পুত্র। তুমি কখনও চুরি করিও না, কূপে পতিত হইও না, অসৎ-সংসর্গ করিও না, তাহা মনুষ্যের জ্ঞানে অপ্রাপ্ত, পরমেশ্বরের জ্ঞানে প্রাপ্তের নিষেধ করা হইয়াছে। এই কারণে পাষাণদি মূর্তির পূজা অত্যন্ত নিষিদ্ধ।

প্রশ্ন–মূর্তিপূজা করিলে পুণ্য না থাকুক, পাপও ত নাই?

উত্তর –কর্ম দ্বিবিধ। প্রথম বিহিত–বেদে তাহা সত্যভাষণাদি কর্তব্য বলিয়া প্রতিপাদিত হইয়াছে। দ্বিতীয় নিষিদ্ধ –বেদে যাহা মিথ্যাভাষণাদি অকৰ্ত্তব্য বলিয়া আছে; যথা, বিহিত

কর্মের অনুষ্ঠান করিলে ধর্ম তাহা না করিলে অধর্ম। সেইরূপ নিষিদ্ধ কর্ম করিলে অধর্ম এবং তাহা না করিলে ধর্ম। যখন তোমরা বেদ নিষিদ্ধ মূর্তি পূজা প্রভৃতি কর্ম কর তখন তোমরা পাপী নহ কেন?

প্রশ্ন –দেখ! বেদ অনাদি। সে সময়ের মূর্তির কী প্রয়োজন? কারণ, প্রথমে তো দেবতাগণ প্রত্যক্ষ ছিলেন। এই পদ্ধতি ত পরবর্তীকালে তন্ত্র-পুরাণ হইতে প্রচলিত হইয়াছে। যখন মনুষ্যের জ্ঞান ও সামর্থ্য হ্রাস পাইল, তখন তাহারা পরমেশ্বরের ধ্যান ধারণ করিতে অসমর্থ হইল। কিন্তু সে ত মূৰ্ত্তির ধ্যান করিতে পারে। এই কারণে অজ্ঞানদিগের জন্য মূর্তিপূজা। কেননা, সোপান-পরম্পরা অতিক্রম করিয়াই গৃহের ছাদে পৌঁছান যায়। প্রথমে সোপান পরিত্যাগ করিয়া উপরে উঠিতে ইচ্ছা করিলে, উঠা যায় না। এই কারণে মূৰ্ত্তিই প্রথম সোপান।

ইহার পূজা করিতে করিতে যখন জ্ঞান হইবে এবং অন্তকরণ পবিত্র হইবে, তখন পরমাত্মার ধ্যান করিতে পারিবে। যেমন প্রথমতঃ স্থূল লক্ষ্যের প্রতি তীর অথবা গুলি, গোলা প্রভৃতি নিক্ষেপ করিতে করিতে পরে সূক্ষ্ম লক্ষ্যও বিদ্ধ করিতে সমর্থ হয়, সেইরূপ স্থূল মূৰ্ত্তির পূজা করিতে করিতে পরে সূক্ষ্ম ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। যেরূপ বালিকাগণ যতদিন যথার্থ পতি লাভ না করে, ততদিন পর্যন্ত পুতুল খেলা করে, এইসব কারণে মূর্তিপূজা করা দুষ্ট কর্ম নহে।

উত্তর –যেহেতু বেদবিহিত আচরণ ধর্ম এবং বেদবিরুদ্ধ আচরণ অধর্ম অতএব তোমার বলা সত্ত্বেও মূর্তিপূজা করা অধর্মপ্রমাণিত হইল। যে সকল গ্রন্থ বেদবিরুদ্ধ ঐ সকল গ্রন্থের প্রমাণ উপস্থিত করা মানে নাস্তিক হওয়া; শ্রবণ কর —

নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ ॥১॥ য় বেদবাহ্যাঃ স্মৃতয়ো য়াশ্চ কাশ্চ কুদৃষ্টয়ঃ। সর্বাস্তা নিষ্ফলাঃ প্ৰেত্য তমোনিষ্ঠ হি তাঃ স্মৃতাঃ ॥২ ॥ উৎপদ্যন্তে চ্যন্তে চয়ান্যতোনানি কানিচিৎ। তানৰ্বাক্কালিকতয়া নিষ্ফলান্যনৃতানি চ ॥৩॥ মনু০ অ০১২

মনু বলিতেছেন যে, যে ব্যক্তি বেদের নিন্দা অর্থাৎ অপমান করে, (বেদ) ত্যাগ ও (বেদ) বিরুদ্ধ আচরণ করে তাহাকে “নাস্তিক” বলে ॥১॥

যে সকল গ্রন্থবেদবহির্ভূতকুৎসিত মনের ব্যক্তিদের দ্বারা রচিত, যাহা সংসারকে দুঃখ-সাগরে নিমজ্জিত করে, সে-সকল নিষ্ফল, অসত্য, অন্ধকার সদৃশ,ইহলোক ও পরলোকে দুঃখদায়ক ॥২ ॥

এই সমস্ত বেদবিরুদ্ধ গ্রন্থ যাহা রচিত হইতেছে, সে সমস্ত আধুনিক বলিয়া শীঘ্র নষ্ট হইয়া যায়। এ-সকল গ্রন্থ মানা নিষ্ফল ও মিথ্যা ॥ ৩ ॥

এইরূপে ব্রহ্ম হইতে আরম্ভ করিয়া মহর্ষি জৈমিনি পৰ্য্যন্ত মত এই যে, –বেদবিরুদ্ধ মত স্বীকার না করা এবং বেদানুকূল আচরণ করাই ধৰ্ম্ম। কেননা, বেদ সত্য অর্থের প্রতিপাদক। এতদ্বিরুদ্ধ যে সমস্ত তন্ত্র ও পুরাণ (গ্রন্থ) আছে সে সমস্ত বেদ বিরুদ্ধ বলিয়া মিথ্যা। সুতরাং যাহারা বেদবিরুদ্ধ আচরণ করে, সেই সমস্ত গ্রন্থে বর্ণিত মূর্তি পূজাও অধর্ম।

জড়-পূজার দ্বারা মনুষ্যের জ্ঞান কখনও বৃদ্ধি হইতে পারে না বরং তাহাদের মধ্যে যে জ্ঞান আছে মূর্তিপূজা করিয়া তাহাদের মধ্যে তাহাও নষ্ট হইয়া যায়। অতএব জ্ঞানীদিগের সেবা ও সংসর্গই জ্ঞানবৃদ্ধির কারণ, পাষাণাদি নহে। পাষাণাদি-নির্মিত মূর্তি পূজা দ্বারা কি কেহ কখনও পরমেশ্বরকে ধ্যানে আনিতে পারে? না-না। মূর্তি পূজা সোপান নহে কিন্তু উহা একটি প্রকাণ্ড গর্ত। তন্মধ্যে পতিত হইলে মনুষ্য চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যায়। সেই গর্ত হইতে সে পুনরায় বাহির হইতে পারে না, কিন্তু তন্মধ্যেই সে মরিয়া যায়। হ্যাঁ, অল্প ধার্মিক বিদ্বান্ হইতে, পরবিদ্বান্ যোগীদের সঙ্গ লাভ করিয়া, সদ্বিদ্যা এবং সত্যভাষণাদি পরমেশ্বর লাভের সোপান। যথা উপর। গৃহে যাইবার জন্য নিঃশ্রেণী। কিন্তু মূৰ্ত্তি-পূজা করিতে করিতে কেহ জ্ঞানী ত হয় নাই, প্রত্যুত সমস্ত মূর্তিপূজক অজ্ঞানী থাকিয়া মনুষ্য জন্ম বৃথা নষ্ট করিয়া অনেকে মরিয়া গিয়াছে, আর যাহারা এখনও আছে বা থাকিবে, তাহারাও মনুষ্য জন্মে ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষপ্রাপ্তি রূপ ফল। হইতে বঞ্চিত হইয়া বৃথা নষ্ট হইয়া যাইবে।

মূৰ্ত্তি-পূজা ব্রহ্ম প্রাপ্তি বিষয়ে স্থূল লক্ষ্য সদৃশ নহে, কিন্তু ধার্মিক বিদ্বান্ হওয়া এবং সৃষ্টি বিদ্যাই স্থূল লক্ষ্যবৎ। এই সকল বৃদ্ধি করিতে করিতে মনুষ্য ব্রহ্মকেও লাভ করে। আর মূর্তি পূজা। পুতুল খেলার ন্যায় নহে, কিন্তু প্রথম অক্ষর পরিচয় এবং সুশিক্ষা, পুতুল খেলার ন্যায় ব্রহ্ম প্রাপ্তির সাধন। শুনুন। মনুষ্য সুশিক্ষা ও বিদ্যালাভ করিলে, যথার্থ স্বরূপ পরমাত্মাকেও প্রাপ্ত হইবে।

প্রশ্ন –সাকারে মন স্থির হয় কিন্তু নিরাকারে স্থির হওয়া কঠিন। এইজন্য মূর্তিপূজা থাকা উচিত।

উত্তর –সাকারে মন কখনও স্থির হইতে পারে না কারণ, মন সাকারকে সহসা গ্রহণ করিয়া, তাহারই এক-এক অবয়বের মধ্যে বিচরণ করে, এবং অন্য বস্তুর প্রতি ধাবিত হয়। কিন্তু নিরাকার অনন্ত পরমাত্মার গ্রহণে মন যথাশক্তি প্রবল বেগে ধাবিত হইলেও তাহার অন্ত পায় না। নিরবয়ব বলিয়া মন চঞ্চলও থাকে না। কিন্তু তাহার গুণ-কর্ম-স্বভাব বিবেচনা করিতে করিতে মন আনন্দে মগ্ন হইয়া স্থির হইয়া যায়।

আর যদি সাকারে মন স্থির হইত, তাহা হইলে জগতে সকলের মনই স্থির হইত। কারণ জগতে মনুষ্য স্ত্রী, পুত্র, ধন এবং মিত্র প্রভৃতি সাকার পদার্থে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু নিরাকারে যুক্ত করা পর্যন্ত কাহারও মন স্থির হয় না। কেননা, মন নিরবয়ব বলিয়া নিরাকারে স্থির হইয়া যায়।

প্রথমতঃ –অতএব মূর্তি পূজা করা অধর্ম।

দ্বিতীয়তঃ –মূর্তিপূজা উপলক্ষ্যে লোকেরা কোটি কোটি টাকা মন্দিরে ব্যয় করিয়া দরিদ্র হইয়া পড়ে এবং মন্দিরে প্রমাদ ঘটে।

তৃতীয়তঃ –মন্দিরে স্ত্রী-পুরুষের মেলামেশা হয়। তাহাতে ব্যভিচার, কলহ-বিবাদ এবং রোগাদি উৎপন্ন হয়।

চতুর্থতঃ –মূর্তিপূজাকেই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের সাধন মনে করিয়া লোকেরা পুরুষকার রহিত হয় এবং বৃথা মনুষ্য জন্ম নষ্ট করে।

পঞ্চমতঃ –বিবিধ প্রকারের বিরুদ্ধ স্বরূপ, নাম ও চরিত্র বিশিষ্ট মূৰ্ত্তিসমূহের কারণে পূজারীদিগের মতের ঐক্য নষ্ট হয়। ফলে তাহারা বিরুদ্ধ মতে চলে এবং পরস্পরের মধ্যে ভেদবৃদ্ধি সৃষ্টি করিয়া দেশের সর্বনাশ করে।

ষষ্ঠতঃ –মূর্তিপূজার ভরসায় শত্রুর পরাজয় এবং নিজের বিজয় মনে করিয়া মূর্তিপূজক নিশ্চেষ্ট থাকে। ফলে নিজের পরাজয় হইলে রাজ্য স্বাতন্ত্র্য এবং ঐশ্বৰ্য্য সুখ-শত্রুর অধীন হয় এবং স্বয়ং পরাধীন হইয়া সরাই রক্ষকের টাট্ট এবং কুম্ভকারের গর্দভের ন্যায় শত্রুর বশীভূত হইয়া বহুবিধ দুঃখ প্রাপ্ত হয়।

সপ্তমতঃ –যদি কেহ কাহাকেও বলে, আমি তোমার উপবেশনের আসন বা নামের উপর পাথর চাপা দিতেছি, তখন সে যেমন ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে প্রহার করে অথবা কটু কথা বলে, সেইরূপ যাহারা পরমেশ্বরের উপাসনা- স্থান হৃদয় এবং নামের উপর পাষাণ আদি মূর্তি স্থাপন করে, পরমেশ্বর সেই দুর্বুদ্ধিদিগের সর্বনাশ করিবেন না কেন?

অষ্টমতঃ –লোকেরা ভ্রান্ত হইয়া মন্দিরে মন্দিরে ও দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করিতে করিতে কষ্টভোগ করে, ধর্ম, সংসার এবং পারমার্থিক কাৰ্য্য নষ্ট করে, চোর প্রভৃতি দ্বারা উৎপীড়িত হয় এবং প্রতারকদের দ্বারা প্রতারিত হইতে থাকে।

নবমতঃ –দুষ্টবুদ্ধি পূজারীদিগকে যে ধন দেওয়া হয়, তাহা তাহারা বেশ্যা পরস্ত্রীগমন, মদ্যপান, মাংসাহার এবং কলহ-বিবাদে ব্যয় করে। তাহাতে সুখের মূল নষ্ট হইয়া দুঃখ সৃষ্টি করে।

দশমতঃ –মাতাপিতা প্রভৃতি মাননীয়দের অপমান এবং পাষাণাদি মূৰ্ত্তির সম্মান করিয়া মানুষ কৃতঘ্ন হইয়া পড়ে।

একাদশতঃ –যখন কেহ সেই মূর্তিগুলি ভাঙিয়া ফেলে কিংবা চোর অপহরণ করে, তখন মূর্তিপূজক “হায়! হায়।” করিয়া কাদিতে থাকে।

দ্বাদশতঃ– পূজারীগণ পরস্ত্রী এবং পূজারিণীগণ পরপুরুষদের সঙ্গবশতঃ প্রায়ই কলুষিত হইয়া দাম্পত্য প্রেমের আনন্দ লাভ হইতে বঞ্চিত হয়।

ত্রয়োদশতঃ –প্রভু এবং ভৃত্যের মধ্যে যথোচিত আজ্ঞা পালন না হওয়াতে তাহারা পরস্পরের বিরুদ্ধভাবাপন্ন হইয়া ছিন্ন ভিন্ন হইয়া যায়।

চতুৰ্দশতঃ — যাহারা জড় পদার্থের ধ্যান করে, তাহাদের আত্মাও জড়বুদ্ধি হয়। কারণ ধ্যেয়র জড়ত্ব-ধর্ম অন্তঃকরণ দ্বারা অবশ্য আত্মায় সঞ্চারিত হয়।

পঞ্চদশতঃ– পরমেশ্বর জল বায়ুর দুর্গন্ধ নিবারণ এবং আরোগ্যের জন্য পুষ্পদি সৃষ্টি করিয়াছেন কিন্তু পূজারীগণ তাহা তুলিয়া নষ্ট করে। কে জানে, এই সকল পুষ্পের সুগন্ধ আকাশে বিস্তৃত হইয়া কতদিন পর্যন্ত জলবায়ু শুদ্ধ করিত। পূর্ণ সুগন্ধ বিস্তৃত হওয়ার সময় পর্যন্ত এই সকলের সুগন্ধ থাকিত। পূজারিগণ কিন্তু মাঝখানে তাহা নষ্ট করিয়া দেয়। পুদি কর্দমের সহিত মিশিয়া পচিয়া বিপরীত দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। প্রস্তরের উপরে অর্পণ করিবার জন্যই কি পরমাত্মা পুষ্পদি সুগন্ধ দ্রব্য সৃষ্টি করিয়াছেন?

যোড়শতঃ –প্রস্তরের উপর অর্পিত পুষ্প-চন্দন এবং আতপ প্রভৃতি জল ও মৃত্তিকার সহিত সংযুক্ত হইয়া ক্রমশঃ নর্দৰ্মা অথবা কুণ্ডের মধ্যে আসিয়া পচিবার পর, তাহা হইতে পুরীষ-গন্ধের ন্যায় দুর্গন্ধ আকাশে উত্থিত হয় এবং সহস্র জীব সেই নর্দমা অথবা কুণ্ডের মধ্যে পতিত হইয়া মরিয়া পচিতে থাকে। মূর্তিপূজায় এইরূপ অনেক দোষ আছে। অতএব পাষাণাদি নির্মিত মূর্তি পূজা সজ্জন ব্যক্তিদের পক্ষে সর্বথা ত্যক্তব্য। যাঁহারা প্রস্তরমূৰ্ত্তির পূজা করিয়াছেন, করেন এবং করিবেন, তাঁহারা পূর্বোক্ত দোষ হইতে রক্ষা পান নাই, পাইতেছেন না এবং পাইবেনও না ॥

প্রশ্ন –আপনার মতে কোনরূপ মূর্তিপূজা করিতে বা করাইতে নাই। কিন্তু আমাদের আর্যাবর্তে প্রাচীন পরম্পরা অনুসারে “পঞ্চদেব পূজা” শব্দ চলিয়া আসিতেছে। শিব, বিষ্ণু, অম্বিকা, গণেশ, এবং সূর্যের মূর্তি নির্মাণ করিয়া পূজা করে । ইহা কি পঞ্চায়তন পূজা করা নহে?

উত্তর –কোন প্রকারের মূর্তি পূজা করিবে না। কিন্তু নিম্নে যে “মূৰ্ত্তিমান” সম্বন্ধে বলা হইবে, তাহার পূজা অর্থাৎ সম্মান করা উচিত। সেই পঞ্চদেব পূজা এবং পঞ্চায়তন পূজা শব্দের অর্থ অতি উত্তম। কিন্তু বিদ্যাহীন মূঢ়গণ তাহার সদর্থ পরিত্যাগ করিয়া কদৰ্থ গ্রহণ করিয়াছে। আজকাল যে শিবাদি পঞ্চমূর্তি নির্মাণ করিয়া পূজা করা হয়, তাহার ত খণ্ডন এখনই করা হইয়াছে। এখন সত্য, বেদোক্ত এবং বেদানুকূল পঞ্চায়তন, দেবপূজা ও মূর্তিপূজার বিষয় শ্রবণ কর —

মা নো বধীঃ পিতরং মাতরম্ ॥ ১ ॥ যজু ॥ আচার্য্য উপনয়মানো ব্রহ্মচারিণমিচ্ছতে ॥ ২ ॥ অথর্ব৷ অতিথিগৃহানুপগচ্ছেৎ ॥ ৩ ॥ ॥ অর্থব ॥ অর্চত প্রার্চত প্রিয়মেধাসো অর্চত ॥ ৪ ॥ ঋগ্বেদ ॥ ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাসি ত্বামের প্রত্যক্ষং ব্রহ্ম বদিষ্যামি৷৫ ॥ তৈত্তিরীয়োপনি কতম একো দেব ইতি স ব্রহ্ম ত্যদিত্যাচক্ষতে৷৬ ॥ শতপথ (কাং১৪) প্রপাঠ৫। ব্রাহ্ম০৭। কণ্ডিকা০১০ ॥ মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব, আচাৰ্য্যদেব ভব, অতিথিদেবো ভব ॥৭॥৷ তৈত্তিরীয়োপনি। পিতৃভিড্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভির্দেবরৈস্তথা। পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণমীসুভিঃ ॥ ৮ ॥ মনুঃ পূজ্যো (হি) দেববৎ পতিঃ ॥৯ ॥ মনুস্মৃতৌ

প্রথম দেবতা –মাতা। মূর্তিমতী পূজনীয়া অর্থাৎ সন্তানগণ কায়-মন-বাক্যে সেবা করিয়া মাতাকে প্রসন্ন রাখিবে। কখনও তাহাকে হিংসা অর্থাৎ তাড়না করিবে না ॥১॥

দ্বিতীয় দেবতা –পিতা। সম্মানের পাত্র। মাতার ন্যায় তাহারও সেবা করিবে ॥ ২ ॥

তৃতীয় দেবতা — আচার্য্য। যিনি বিদ্যাদাতা কায়-মন-বাক্য দ্বারা তাঁহার সেবা করিবে।৩ ॥

চতুর্থ দেবতা –অতিথি। অর্থাৎ যিনি বিদ্বান, ধার্মিক, অকপট এবং সকলকে সুখী করেন, তাঁহার সেবা করিবে। ৪ ॥

পঞ্চম দেবতা–স্ত্রীর পক্ষে পতি এবং পতির পক্ষে স্বপত্নী ॥ ৫ ॥

এই পাঁচ মূর্তিমান দেব। ইহাদিগের সংসর্গে মনুষ্যদেহের উৎপত্তি, পালন, সত্যশিক্ষা, বিদ্যা ও সত্যোপদেশ লাভ হইয়া থাকে! ইহারাই পরমেশ্বর প্রাপ্তির সোপান-পরম্পরা। যাহারা ইহাদিগের সেবা না করিয়া পাষাণাদি মূৰ্ত্তির পূজা করে, তাহারা অতীব পামব, নরকগামী।

প্রশ্ন –মাতাপিতা প্রভৃতির সেবা হউক, এবং মূর্তিপূজাও করা হউক, তাহা হইলে ত কোন দোষ নাই?

উত্তর –পাষাণদিমূৰ্ত্তির পূজা সর্বথা পরিত্যাগ করিবে, মাতাপিতা প্রভৃতিমূর্তিমান্ দেবতাদিগের সেবা করাতেই কল্যাণ। ইহা বড়ই অনর্থের কথা যে, (মানুষ) সাক্ষাৎ মাতাপিতা প্রভৃতি প্রত্যক্ষ সুখদাতা, সুখদায়ক দেবতাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া অদেব পাষাণ প্রভৃতিতে মাথা ঠোকা স্বীকার করিয়াছে!

তাহারা এইজন্য স্বীকার করিয়াছে যে, যদি মাতাপিতার সম্মুখে নৈবেদ্য অথবা পূজা সামগ্রী রাখা হয়, তবে তাহারা তাহা স্বয়ং ভক্ষণ করিয়া ফেলিবেন এবং তাহারা নৈবেদ্য ও পূজা সামগ্রী। গ্রহণ করিয়া লইলে তাহাদের মুখে অথবা হস্তে কিছুই পড়িবে না। এইজন্য তাহারা পাষাণাদির মূর্তি নির্মাণ করিয়া তাহাদের সম্মুখে নৈবেদ্য সাজাইয়া রাখে এবং পুঁ পুঁ, টং টং, শব্দে শঙ্খ-ঘন্টা বাজাইয়া কোলাহল করে। তাহারা মূর্তিকে অঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করিয়া স্বয়ং ঐ সকল উপভোগ করে। যেমন কাহাকেও এই বলিয়া ছলনা অথবা উত্যক্ত করে, “ত্বমঙ্গুষ্ঠং গৃহাণ ভোজনং পদার্থং বাহং গ্রহীষ্যামি”–তুমি ঘন্টা লও” এবং অঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করিয়া তাহার সম্মুখ হইতে সেই সকল বস্তু লইয়া স্বয়ং উপভোগ করে। পূজারিদিগের অর্থাৎ পূজানামক সৎকর্মের শত্ৰুদিগের লীলা-খেলাই এইরূপ। তাহারা মূর্খদিগকে মূর্তির সাজসজ্জার জাঁক-জমক দেখাইয়া নিজে প্রতারকের ন্যায় সাজিয়া গুছিয়া হতভাগ্য ও অনাথদিগের সামগ্রী লইয়া আনন্দ উপভোগ করে। কোন ধার্মিক রাজা থাকিলে তিনি এ সকল পাষাণপ্রিয় ব্যক্তিদের পাষাণ ভাঙা, গড়া ও গৃহনির্মাণাদি কাৰ্য্যে নিযুক্ত করিয়া তাহাদের খাওয়া পরা ও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করিতেন।

প্রশ্ন –যেমন স্ত্রী প্রকৃতির পাষাণমূৰ্ত্তি দেখিয়া কাম উৎপত্তি হয় সেইরূপ বীতরাগ এবং শান্তদিগের মূর্তি দর্শনে বৈরাগ্য ও শান্তিলাভ হইবে না কেন?

উত্তর –তাহা হইতে পারে না। কারণ মূৰ্ত্তির জড়ত্বধর্ম আত্মায় সংক্রামিত হওয়াতে বিচার শক্তি হ্রাস পায়। বিবেক ব্যতীত বৈরাগ্য, বৈরাগ্য ব্যতীত বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান ব্যতীত শান্তি লাভ হয় না। যাহা কিছু হইবার তাহা সৎপুরুষদিগের সংসর্গে, উপদেশ এবং তাঁহাদের ইতিহাস প্রভৃতি পাঠের ফলে হইয়া থাকে। কাহারও দোষগুণ না জানিয়া মূর্তিমাত্রে প্রীতি উৎপন্ন হয় না। গুণজ্ঞানই প্রীতির কারণ।

এইরূপ মূর্তিপূজা প্রভৃতি কুকর্মের জন্যই আৰ্য্যবর্তে কোটি কোটি নিষ্কর্মা পূজারী, ভিক্ষুক, অলস এবং পুরুষকারবিহীন মনুষ্য রহিয়াছে। তাহারা সমস্ত সংসারে মূঢ়তা বিস্তার করিতেছে। মিথ্যা এবং ছলনাও অনেক বিস্তার লাভ করিয়াছে।

প্রশ্ন –দেখুন! কাশীতে ঔরঙ্গজেব বাদশাহকে “লাটভৈরব” আদি সকলে অনেক চমৎকার দেখাইয়াছিলেন। যখন মুসলমানগণ ঐ সকল দেবমূৰ্ত্তি ভগ্ন করিতে গিয়া কামান দাগিল ও গোলা প্রভৃতির বর্ষণ করিল তখন বড় বড় ভ্রমর বহির্গত হইয়া সৈন্যদিগকে ব্যাকুল করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছিল।

উত্তর –উহা পাষাণকৃত চমৎকার নহে। কিন্তু সে স্থানে সম্ভবতঃ ভীমরুলের চাক থাকিয়া থাকিবে। উহাদের স্বভাবই ক্রুর। কেহ উহাদিগকে উত্যক্ত করিলে উহারা তৎক্ষণাৎ দংশন করিবার জন্য ছুটিয়া আসে। দুগ্ধধারার যে চমৎকার তাহাও পুজারীদিগের লীলা-খেলা।

প্রশ্ন –দেখুন –মহাদেব’ ম্লেচ্ছদিগকে দর্শন দিবেন না বলিয়াই কূপের মধ্যে এবং “বেণীমাধব’ জনৈক ব্রাহ্মণের গৃহে গিয়া লুকাইয়াছিলেন। ইহাও কি চমৎকার নহে।

উত্তর –বলতো কোটপাল, কালভৈরব, লাটভৈরব আদি যাঁহাদের রক্ষক, ভূত-প্রেত এবং গরুড় প্রভৃতি যাঁহাদের অনুচর, তাহারা যুদ্ধ করিয়া মুসলমানদিগকে কেন তাড়াইয়া দিল না? পুরাণে মহাদেব এবং বিষ্ণু সম্বন্ধে আখ্যায়িকা আছে যে, তাহারা ত্রিপুরাসুর প্রভৃতি মহাভয়ঙ্কর, বহু দুরাত্মাদিগকে ভস্ম করিয়াছিলেন তাহা হইলে মুসলমানদিগকে ভস্ম করিলেন না কেন? এতদ্বারা প্রমাণিত হইতেছে যে, বিবশ পাষাণগুলি কী লড়িবে আর কিইবা লড়াইবে?মুসলমানগণ মন্দির এবং মূর্তিসমূহ ভগ্ন করিতে করিতে কাশীর নিকট উপস্থিত হইলে, পূজারীগণ সেই পাষাণ-লিঙ্গকে কূপে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন এবং বেণীমাধবকে ব্রাহ্মণের গৃহে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন। যদি কালভৈরবের ভয়ে যমদূত পৰ্য্যন্ত কাশীতে না যায়, এবং প্রলয়কালেও কাশীকে বিনষ্ট হইতে না দেয়, তাহা হইলে ম্লেচ্ছদের দূতকে সে ভয় দেখায় না কেন? নিজ রাজার মন্দিরকে নষ্ট হইতে দিল কেন? এ সমস্তই পোপ মায়া।

প্রশ্ন –গয়াতে শ্রাদ্ধ করিলে পিতৃপুরুষগণের পাপখণ্ডন হয়; সে-স্থানে শ্রাদ্ধের পুণ্যপ্রভাবে পিতৃপুরুষগণ স্বর্গে গমন করেন এবং হাত বাড়াইয়া পিণ্ড গ্রহণ করেন। এসকল কথাও কি মিথ্যা?

উত্তর– সর্বথা মিথ্যা। যদি সে-স্থানে পিণ্ডদানের এইরূপ প্রভাব হয় তবে পিতৃপুরুষগণের সুখের জন্য যে-সকল পাণ্ডাকে লক্ষ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়, তাহার ব্যয় গয়াবাসী বেশ্যাগমনাদি পাপে করে, সেই পাপের খণ্ডন হয় না কেন? আর আজকাল পাণ্ডা ব্যতীত অন্য কাহাকেও হাত বাহির করিতে দেখা যায় না। কোন ধূৰ্ত্ত কখনও ভূমিতে গর্ত খনন করিয়া তন্মধ্যে সম্ভবতঃ কোন এক জনকে বসাইয়া দিয়া থাকিবে। পরে তাহার মুখের উপর কুশ বিছাইয়া পিণ্ডদান করিলে সেই ভণ্ড তাহা গ্রহণ করিয়া থাকিবে। যদি এইরূপ কোন নির্বোধ ধনাঢ্য ব্যক্তিকে কেহ প্রতারিত করে, তবে তাহাতে কিছুই আশ্চর্যের নহে। সেইরূপ রাবণ যে বৈদ্যনাথকে আনয়ন করিয়াছিলেন তাহাও মিথ্যা কথা।

প্রশ্ন –দেখুন! কলিকাতার কালীকে এবং কামাখ্যা প্রভৃতি দেবীকে লক্ষ লক্ষ লোক মানে, ইহা কি চমৎকার নহে?

উত্তর –কিছুই না। এ-সকল অন্ধলোক মেষের ন্যায় একে অন্যের অনুগমন করে এবং গর্তে ও কূপে পতিত হয়, পিছনেও সরিতে পারে না। এইরূপ মুখেরা একে অন্যের অনুগমন করিয়া মূর্তিপূজারূপ গর্তে আবদ্ধ হয় এবং দুঃখভোগ করে।

প্রশ্ন –আচ্ছা, একথা যা। কিন্তু জগন্নাথ ধামে প্রত্যক্ষ চমৎকার আছে।

প্রথমতঃ –কলেবর পরিবর্তনের সময় চন্দনকাষ্ঠখণ্ড সমুদ্র হইতে নিজে নিজেই আসে। দ্বিতীয়তঃ –চুল্লির উপর উপর্যুপরি সাতটি হাঁড়ী রাখা হইলেও উপরের হাঁড়ীগুলির অন্ন প্রথমে সিদ্ধ হয়, আর সে স্থানে কেহ জগন্নাথের প্রসাদ ভোজন না করিলে তাহার কুষ্ঠরোগ হয়।

তৃতীয়তঃ –রথ নিজে নিজেই চলে।

চতুর্থতঃ– পাপীরা জগন্নাথের দর্শন পায় না।

পঞ্চমতঃ –ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজার রাজ্যে দেবতারা মন্দির নির্মাণ করিয়াছেন।

ষষ্ঠতঃ– কলেবর পরিবর্তনের সময় একজন রাজা, একজন পাণ্ডা এবং একজন সূত্রধর। মরিয়া যায়। এইসব আশ্চৰ্যজনক ব্যাপারকে কি আপনি মিথ্যা বলিতে পারেন?

উত্তর –এক ব্যক্তি যিনি বার বৎসর পর্যন্ত জগন্নাথের পূজা করিয়াছিলেন তিনি সংসার বিরাগী মথুরায় আগমন করিলে আমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয়। আমি তাঁহাকে ঐ সকল কথার উত্তর জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। তিনি বলিলেন যে, এসকল মিথ্যা। বিচার করিলে নির্ণয় হয় যে, কলেবর পরিবর্তনের সময় উপস্থিত হইলে নৌকাযোগে চন্দনাকাষ্ঠ আনিয়া সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। ঐ সকল কাষ্ঠ সমুদ্রের তরঙ্গাঘাতে কিনারায় গিয়া ঠেকে। সূত্রধরগণ ঐ সকল কাষ্ঠ লইয়া মূর্তি নির্মাণ করেন।

পাকের সময় গৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দেওয়া হয়। পাঁচক ব্যতীত অন্য কাহাকেও যাইতে বা দেখিতে দেওয়া হয় না। ভূমির উপর চতুর্দিকে ছয়টি এবং মধ্যস্থলে একটি চক্রাকার চুল্লী নির্মিত হয়। হাঁড়িগুলির তলদেশে ঘৃত, মৃত্তিকা এবং ছাই মাখাইয়া, ছয়টি চুল্লীতে তণ্ডুল পাক করিবার পর হাঁড়িগুলির তলা মাজিয়া মধ্যস্থলের সেই হাঁড়ীতে চাউল ঢালিয়া দিয়া তাহাদের উপরে সেই ছয়টি হাঁড়ী রাখিয়া ছয়টি চুল্লীর মুখ লৌহ নির্মিত তাওয়া দ্বারা বন্ধ করা হয়। দর্শনকারী ধনাঢ্য হইলে তাহাকে ডাকিয়া দেখান হয়। উপরের হাঁড়ীগুলি হইতে পক্ক অন্ন এবং নীচের হাঁড়ীগুলি হইতে অপক্ক তণ্ডুল বাহির করিয়া তাহাকে দেখাইয়া বলা হয়, “হাঁড়ীর জন্য কিছু রাখিয়া দিন।” তখন সেই নির্বোধ ধনাঢ্য ব্যক্তি টাকাও মোহর দান করে; আবার কেহ কেহ মাসিক বৃত্তিও বাঁধিয়া দেয়।

শূদ্র ও নিম্নশ্রেণীর লোকেরা মন্দিরে নৈবেদ্য আনয়ন করে। নৈবেদ্য নিবেদন করা হইলে সেই শূদ্র ও নিম্নশ্রেণীর লোকেরা তাহা উচ্ছিষ্ট করিয়া দেয়। পরে যদি কেহ টাকা দিয়া হাঁড়ী লইতে ইচ্ছা করে, তবে তাহার গৃহে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। দরিদ্র গৃহস্থ ও সাধু সন্ন্যাসী হইতে আরম্ভ করিয়া শূদ্র ও অন্ত্যজ পর্যন্ত সকলে এক পংক্তিতে বসিয়া একে অন্যের উচ্ছিষ্ট ভোজন করে। এক পংক্তি হইতে উঠিয়া গেলে তাহাদের উচ্ছিষ্ট পাতার উপরেই অন্য এক পংক্তি বসাইয়া দেওয়া হয়। কী মহা অনাচার!

অনেকে আবার সে স্থানে উচ্ছিষ্ট ভোজনের পরিবর্তে স্বহস্তে পাক ও ভোজন করিয়া চলিয়া আসে। তাহাদের কুষ্ঠ প্রভৃতি রোগ কিছুই হয় না। সেই জগন্নাথ পুরীতে অনেকেই প্রসাদ ভোজন করে না। তাহাদেরও কুষ্ঠ প্রভৃতি রোগ হয় ন। জগন্নাথ পুরীতে অনেক কুষ্ঠরোগী আছে, প্রতিদিন উচ্ছিষ্ট ভোজন করা সত্ত্বেও তাহাদের কিন্তু রোগ দুর হয় না।

জগন্নাথে এই বামমার্গীগণ ‘ভৈরবী চক্র’রচনা করিয়াছে। কেননা ‘সুভদ্রা’শ্রীকৃষ্ণ ও বলদেবের ভগ্নী। তাহাকেই দুই ভ্রাতার মধ্যস্থলে স্ত্রী ও মাতার আসনে বসাইয়াছে। ভৈরবী চক্র না হইলে এ ব্যাপার কখনও হইত না।

আবার রথচক্রের সহিত যন্ত্র কৌশল থাকে। যখন ঘুরান হয় তখন উহা ঘোরে এবং রথ চলে। মেলার মধ্যস্থলে রথ উপস্থিত হইলে যন্ত্রের কাটা বিপরীতভাবে ঘুরাইবা মাত্র রথ স্থির হইয়া যায়। তখন পূজারীগণ এই বলিয়া চীৎকার করিতে থাকে –“দান দাও, পুণ্য কর তবেই জগন্নাথ প্রসন্ন হইলে নিজেই রথ চালাইবেন, তখন তোমাদেরও ধর্মরক্ষা হইবে।” যতক্ষণ পূজা-সামগ্রী আসিতে থাকে, ততক্ষণ তাহারা ঐভাবেই চীৎকার করিতে থাকে। সামগ্রী আসা শেষ হইলে একজন ব্রজবাসী (পাণ্ডা) উত্তম বস্ত্র পরিধান করিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া করজোড়ে স্তুতি পাঠ করে –“হে প্রভো জগন্নাথ। আপনি কৃপা করিয়া রথ চালান এবং আমাদের ধর্মরক্ষা করুন।” এই সব বলিয়া সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণাম করিয়া রথে আরোহণ করে। যখন যন্ত্রের কাটা সোজা ঘুরাইয়া দেওয়া হয় এবং সহস্র সহস্র লোক ‘জয়’ ‘জয়’ শব্দে রঞ্জু আকর্ষণ করে। তখন রথ চলিতে থাকে।

যে সময় বহুলোক (জগন্নাথ) দর্শনার্থ গমন করে তখন এত বড় প্রকাণ্ড মন্দিরে দিবাভাগে অন্ধকার থাকে এবং প্রদীপ জ্বালাইতে হয়। মূর্তিগুলির সম্মুখে পদ্দা টানিয়া দেয়, দুই দিকে পর্দা খাটাইবার ব্যবস্থা থাকে। তখন পাণ্ডা ও পুজারীগণ ভিতরে দাঁড়াইয়া থাকে। একদিকে পর্দা টানা মাত্র তৎক্ষণাৎ অন্য পদ্দা টানিয়া দেওয়া হয় এবং দর্শনার্থিগণ “জয় জয়” ধ্বনি করিতে থাকে। অতঃপর তাহারা প্রসন্নচিত্তে ধাক্কা খাইতে খাইতে প্রস্থান করে।

ইন্দ্রদ্যুন্ন রাজার বংশধরগণ অদ্যাবধি কলিকাতায় আছেন। তিনি একজন ঐশ্বৰ্য্যশালী রাজা এবং দেবীর উপাসক ছিলেন। তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া এই উদ্দেশ্যে মন্দির নির্মাণ করাইয়াছিলেন যে, পূর্বোক্ত রীতি অনুসারে আর্যাবর্তে ভোজন সম্বন্ধীয় গোলযোগ দুর করিবেন। কিন্তু মুখগণ কখনও তাহা পরিত্যাগ করিবে কি? কাহাকেও ‘দেবতা’ মানিতে হইলে যেসকল শিল্পীরা মন্দির নির্মাণ করিয়াছিল, তাহাদিগকেই মানা উচিত।

কলেবর পরিবর্তনের সময় রাজা, পাণ্ডা বা সূত্রধর মরে না। কিন্তু তাহারা তিনজনই সে স্থানে নেতৃত্ব করিয়া থাকে। সম্ভবতঃ তাহারা দরিদ্রগণকে কষ্ট দিয়া থাকিবে। তাহারা সকলে একমত হইয়া কলেবর পরিবর্তনের সময় তিন জনই উপস্থিত থাকে। মূৰ্ত্তির বক্ষস্থল ফঁপা রাখা হয়, তাহাতে একটি স্বর্ণ-সম্প্রট শালগ্রাম রক্ষিত থাকে। উহাকে প্রতিদিন ধুইয়া চরণামৃত প্রস্তুত করা। হয়। সম্ভবতঃ রাত্রির শয়ন-আরতির সময়ে তাহারা ঐ শালগ্রামের পাত্রে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মাখাইয়া দিয়া থাকিবে। তাহা ধুইয়া ঐ তিনজনকে হয়তো পান করাইয়া থাকিবে। তাহাতে তিনজন কখনও মরিয়া গিয়া থাকিবে। যদি মরিয়াই থাকে সম্ভবত এইরূপেই মরিয়াছে। কিন্তু ভোজন-ভট্টগণ ঘোষণা করিয়া থাকে যে, জগন্নাথদেব নিজের কলেবর পরিবর্তন করিবার সময় তিনজন ভক্তকেও সঙ্গে লইয়া গিয়াছেন। পরস্ব ধন লইবার জন্য এইরূপ অনেক মিথ্যা কথা রটান হইয়া থাকে।

প্রশ্ন –রামেশ্বরে যে গঙ্গোত্তরীর জল ঢালিবার সময় লিঙ্গ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়, তাহাও কি মিথ্যা?

উত্তর –হা মিথ্যা। কারণ উক্ত মন্দিরে দিবসেও অন্ধকার থাকে। দিবা-রাত্র প্রদীপ জ্বলে। যখন জল ঢালা হয়, তখন সেই জলে বিদ্যুতের ন্যায় প্রতিবিম্ব উদ্ভাসিত হয় ইহা ছাড়া অন্য কিছুই নহে। পাষাণের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না। যতখানি ততখানিই থাকে। এইরূপ লীলা খেলা দ্বারা বেচারা। নির্বুদ্ধিলোকদিগকে প্রতারণা করা হয়।

প্রশ্ন –রামচন্দ্র রামেশ্বরকে স্থাপন করিয়াছিলেন কেন? বাল্মিকীই বা রামায়ণে তাহা লিখিবেন কেন?

উত্তর –রামচন্দ্রের সময়ে উক্ত লিঙ্গ অথবা মন্দিরের নামগন্ধও ছিল না। কিন্তু ইহা সত্য যে, দক্ষিণ দেশীয় রাম নামক জনৈক রাজা মন্দির নির্মাণ করাইয়া লিঙ্গের নাম রামেশ্বর রাখিয়াছিলেন। রামচন্দ্র সীতাকে লইয়া হনুমান প্রভৃতির সহিত আকাশ পথে বিমানে বসিয়া লঙ্কা হইতে অযোধ্যায় ফিরিবার কালে সীতাকে বলিয়াছেন :

অত্র পূর্বং মহাদেবঃ প্রসাদমকরোদ্বিভূঃ। সেতুবন্ধ ইতি বিখ্যাত ॥ বাল্মিকী রা লঙ্কা কা০ (সর্গ ১২৫৷ শ্লোকঃ২০)।

“অয়ি সীতে! তোমার বিয়োগে ব্যাকুল হইয়া ভ্রমণকালে আমি এই স্থানেই চাতুর্মাস্য উদ্যাপন কালে পরমেশ্বরের উপাসনা ও ধ্যান করিয়াছিলাম। যিনি সর্বত্র বিভু (ব্যাপক) যিনি দেবাদিদেব মহাদেব পরমাত্মা, তাহারই কৃপায় আমরা এ-স্থানে সকল সামগ্রী প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। দেখ! আমরা এই সেতুবদ্ধ করিয়া লঙ্কায় আসিয়া রাবণকে বধ করি এবং তোমাকে লইয়া আসিয়াছি।” এতদ্ব্যতীত বাল্মিকী প্রণীত রামায়ণে অন্য কিছুই লেখা নাই।

প্রশ্ন–রঙ্গ হৈ কালিয়াকন্ত কো। জিসনে হুক্কা পিলায়া সন্ত কো ॥

দক্ষিণে কালিয়াকান্তের একটি মূর্তি আজ পর্যন্ত হুঁকায় তামাক খাইয়া থাকে। মূর্তিপূজা মিথ্যা হইলে এই চমৎকারও মিথ্যা হইত।

উত্তর –মিথ্যা মিথ্যা। এ সমস্তই পোপ-লীলা। উক্ত মূর্তিটির মুখ হয় তো ফাপা। উহার পৃষ্ঠদেশ হইতে প্রাচীরের অপর পার্শ্বে, অন্য গৃহে নল সংলগ্ন থাকিবে। যখন পূজারী তামাক সাজাইবার পর হুঁকায় নল সংলগ্ন করিয়া সেই নল মূৰ্ত্তির মুখে সংলগ্ন করে এবং পর্দা ফেলিয়া দিয়া বাহির চলিয়া আসে। সে সময় হুঁকার পিছনের লোক নলে মুখ দিয়া হয়ত টানিতে থাকে, তাহাতে হুঁকা গড়গড় শব্দ করে। সম্ভবতঃ অন্য একটি ছিদ্র মূৰ্ত্তির নাসিকা ও মুখের সহিত সংলগ্ন থাকে। যখন পিছন দিকে ফুঁ দেওয়া হয় তখন সম্ভবতঃ নাসিকা ও মুখের ছিদ্র দিয়া ধূম নির্গত হয়। সেই সময় পূজারীগণ অনেক মূঢ়ের ধন সামগ্রী লুণ্ঠন করিয়া তাহাদিগকে নিঃস্ব করিয়া থাকিবে।

প্রশ্ন –দেখুন! “ডাকোরজীর মূর্তি দ্বারিকা হইতে ভক্তের সহিত চলিয়া আসিয়াছিল। মূৰ্ত্তিটি কয়েক মণ ভারী ছিল উহাকে সওয়া রতি সোনার দ্বারা ওজন করা হয়। ইহাও কি চমৎকার নহে?

উত্তর –না। সেই ভক্ত হয়ত মূর্তিটি চুরি করিয়া আনিয়াছিল। সওয়া রতি সোনা দ্বারা মূর্তি ওজন করার কথা সম্ভবতঃ কোন ভাংখোরের অলীক গল্প।

প্রশ্ন –দেখুন! অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সোমনাথদেব ভূমি হইতে উর্দ্ধে থাকিতেন। ইহাও কি মিথ্যা?

উত্তর –অবশ্য মিথ্যা। শুনুন! নীচে ও উপরে চুম্বক প্রস্তর সংলগ্ন ছিল। উহার আকর্ষণে মূর্তিটি মধ্যস্থলে স্থির থাকিত। ‘মহম্মদ গজনবী’ যখন আক্রমণ করিল তখন এই চমৎকার ব্যাপার হইল যে, সোমনাথের মন্দির ভগ্ন এবং পূজারী ও ভক্তদের দুর্দশা হইল। লক্ষ লক্ষ সৈন্য দশ সহস্ৰ সৈন্যের সম্মুখে পলায়ন করিল।

তখন পোপ-পূজারীগণ, পূজা, পুরশ্চরণ, স্তুতি এবং প্রার্থনা করিতে লাগিল, “হে মহাদেব! তুমি এই ম্লেচ্ছদিগকে বিনাশ কর, আমাদের রক্ষা কর”। তাহারা তাহাদের শিষ্য-সেবকদিগকে এবং রাজাদিগকে বুঝাইতে লাগিল, “আপনারা নিশ্চিত থাকুন; মহাদেব ভৈরব অথবা বীরভদ্রকে পাঠাইয়া দিবেন। তাঁহারা ম্লেচ্ছদিগকে বিনাশ করিবেন, অথবা তাহাদিগকে অন্ধ করিবেন। এখনই আমাদের দেবতার আবির্ভাব ঘটিবে। হনুমান, দুর্গা এবং ভৈরব স্বপ্ন দিয়াছেন যে, তাহারা সমস্ত কাৰ্য্য সম্পন্ন করিয়া দিবেন”। সেই নিরীহ সরলপ্রকৃতির রাজা এবং ক্ষত্রিয়গণ পোপদিগের দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ায় বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া রহিলেন।

কত জ্যোতিষী পোপ বলিল, “এখনও তোমাদের আক্রমণের মূহূর্ত উপস্থিত হয় নাই। একজন বলিল যে, অষ্টম স্থানে চন্দ্রমা আছে। অপর একজন সম্মুখে যোগিনী দেখাইল। ইহারা এ সকল ছল চাতুরীতে ভুলিয়া রহিলেন। কত পোপ-পূজারীগণ এবং তাহাদের শিষ্যগণ ধৃত হইল। পূজারীগণ করজোড়ে ইহাও বলিল, ‘তিন কোটি টাকা গ্রহণ করুন, মন্দির এবং মূৰ্ত্তি ভগ্ন করিবেন না। মুসলমানগণ বলিল,-”আমরা ‘বুৎপরস্ত’ অর্থাৎ মূর্তিপূজক নহি কিন্তু বুৎশিকন’ অর্থাৎ মূর্তিভঞ্জক। তাহারা তৎক্ষণাৎ মন্দির ভগ্ন করিল।

উপরের ছাদ ভগ্ন হইল, চুম্বক-প্রস্তর পৃথক হইয়া যাওয়াতে মূর্তিটি পড়িয়া গেল। যখন সোমনাথের মূর্তি ভগ্ন হইয়াছিল; শুনা যায় যে,তাহা হইতে ১৮ কোটি মূল্যের রত্ন বাহির হয়। তখন পূজারী এবং পোপাদিগের উপর কশাঘাত হইতে লাগিল; তাহারা রোদন করিতে লাগিল। বলিল –“ধন-ভাণ্ডার দেখাও’। তাহারা মায়ের চোটে তৎক্ষণাৎ বলিয়া দিল। তখন শত্রুগণ। সমস্ত ধনভাণ্ডার লুণ্ঠন করিয়া তাহাদিগকে বেদম প্রহার করিল। পোপ এবং তাহাদের শিষ্যদিগকে ‘গোলাম এবং ‘বেগারী’ করিল। তাহাদের দ্বারা যাঁতা চালান, ঘাস কাটান এবং মল-মূত্রাদি পরিষ্কার করান হইল। তাহাদিগকে ছোলা খাইতে দিল।

হায়! কেন তাহারা প্রস্তরপূজা করিয়া নিজেদের সর্বনাশ করিল? কেনই বা তাহারা পরমেশ্বরে ভক্তি করিল না? সেরূপ করিলে তাহারা ম্লেচ্ছদিগের দাঁত ভাঙিয়া দিতে পারিত এবং বিজয়ী হইত। দেখ যত সংখ্যক মূৰ্ত্তি আছে, তত সংখ্যক শূরবীরের পূজা (সম্মান প্রদর্শন) করিলেও কথঞ্চিৎ রক্ষা হইত। পূজারীগণ পাষাণের এত ভক্তি করিতেন, কিন্তু একটি মূর্তিও উড়িয়া গিয়া শত্রুর মস্তকে পড়িল না। যদি তাহারা কোন শৌর্যবীৰ্য্য সম্পন্ন পুরুষকে মূর্তির ন্যায় সেবা করিত, তবে তিনি তাঁহার সেবকদিগকে যথাশক্তি রক্ষা এবং শত্ৰুদিগকে বিনাশ করিতেন।

প্রশ্ন –দ্বারিকায় রণছোড়জীর নর্সীমহিতার নিকট হুণ্ডী পাঠাইয়া ছিলেন এবং তাঁহার ঋণ পরিশোধ করিয়াছিলেন, ইত্যাদি কথা কি মিথ্যা?

উত্তর –কোন বণিক টাকা দিয়া থাকিবেন, কিন্তু কেহ মিথ্যা রটনা করিয়া থাকিবে যে, শ্রীকৃষ্ণ সেই টাকা পাঠাইয়াছেন। যখন সংবৎ ১৯১৪ সালে ইংরেজগণ কামানের দ্বারা মন্দির ও মূৰ্ত্তিগুলি উড়াইয়া দিয়াছিল, তখন মূৰ্ত্তি কোথায় গিয়াছিল? কিন্তু বাঘেরগণ কীরূপ বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করিয়া শত্ৰুদিগকে বিনাশ করিয়াছিলেন! মূৰ্ত্তি ত একটি মাছির ঠ্যাংও ভাঙিতে পারে নাই। শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় কেহ থাকিলে তিনি শত্ৰুদিগকে পিষিয়া ফেলিতেন এবং শত্রুও পলায়ন করিত। আচ্ছা –বলতো, যাহাদের রক্ষক মার খায় তাহাদের শরণাগত মার খাইবে না কেন?

প্রশ্ন –জ্বালামুখী ত প্রত্যক্ষ দেবী, সব কিছুই ভক্ষণ করে। আর নৈবেদ্য প্রদত্ত হইলে তাহার অর্ধেক রাখিয়া দেয়। মুসলমান বাদশাহগণ তাহার উপরে জলধারা প্রবাহিত করাইলেন, তাহাকে লোহার চাটু দিয়া ঢাকিয়া দিলেন, তা সত্ত্বেও তাহার অগ্নিশিখা নির্বাপিত ও রুদ্ধ হয় নাই।

হিংগলাজও অর্ধরাত্রিতে বাহক পৃষ্ঠে চড়িয়া পর্বতোপরি দর্শন দান করেন এবং পর্বতকে। গর্জন করান। চন্দ্রকূপ কথা বলে। যোনি-যন্ত্র হইতে নির্গত হইলে পুনর্জন্ম হয় না। ঠুমরা (বীজবিশেষ) বাঁধিলে পূর্ণ মহাপুরুষ হওয়া যায়। হিংলাজ দর্শন করিয়া না আসা পর্যন্ত অর্ধেক মহাপুরুষ হইয়া থাকে এ সকল কথা কি মানিবার যোগ্য নহে?

উত্তর –না। কারণ জ্বালামুখী পর্বত হইতে যে অগ্নি নির্গত হয়, তন্মধ্যে পূজারীদিগের বিচিত্র লীলা আছে। যথা বঘারের ঘৃত চামচে যে অগ্নি শিখা উৎপন্ন হয়, চামচটিকে অগ্নি হইতে পৃথক করা হইলে অথবা ফুঁ দিলে তাহা নিভিয়া যায়। অগ্নি কিঞ্চিৎ ঘৃত ভক্ষণ করে, অবশিষ্ট ছাড়িয়া যায়, উক্ত স্থানেও সেইরূপ। চুল্লীর জ্বলন্ত শিখায় যাহা নিক্ষেপ করা হয়, তাহা সব ভস্ম । হইয়া যায়। বনে বা গৃহে অগ্নি লাগিলে, অগ্নি সে সমস্তই খাইয়া ফেলে। একটি মন্দির, কুণ্ড এবং ইতস্ততঃ ব্যতীত সেখানে বিশেষ কী আছে?

হিংগলাজের না আছে কোন বাহন, আর না আছে অন্য কিছু। সে স্থানে পোপ,পূজারীদিগের লীলা-খেলা ব্যতীত অন্য কিছুই নাই। সে-স্থানে জল এবং চোরাবালির একটি কুণ্ড নির্মাণ করিয়া রাখা হইয়াছে। উহার তলদেশ হইতে বুদ্বুদ উত্থিত হয়। মূঢ়গণ তাহা দেখিয়া যাত্রা সফল মনে করে। পোপগণ ধনহরণার্থে যোনি যন্ত্র নির্মাণ করাইয়া রাখিয়াছে। ঠুমরা ও সেইরূপ পোপলীরা। যদি তদ্বারা মহাপুরুষ হওয়া যায়, তবে কোন পশুর পৃষ্ঠে ঠুমরা’র বোঝা চাপাইয়া দিলে কি পশু মহাপুরুষ হইয়া যাইবে? অত্যুত্তম ধর্মযুক্ত পুরুষকার দ্বারাই ত মহাপুরুষ হওয়া যায়।

প্রশ্ন –অমৃতসরের দীর্ঘিকা অমৃতরূপ। একটি রিঠা ফলের অর্ধেক মিষ্ট, একটি প্রাচীর নড়ে কিন্তু পড়ে না। রেওয়ালসরে ভেলা ভাসে, অমরনাথে নিজে নিজেই লিঙ্গ তৈরী হয়। হিমালয় হইতে এক জোড়া পায়রা আসিয়া সকলকে দর্শন দিয়া চলিয়া যায়। ইহাও কি মানিবার যোগ্য নহে?

উত্তর –না। উক্ত পুষ্করিণীটি নামেই ‘অমৃতসর। কোন কালে সেইস্থানে হয়ত বন ছিল, উক্ত সরোবরের জল সম্ভবতঃ ভাল ছিল। সেকারণ উহার নাম অমৃতসর রাখা হইয়া থাকিবে। উহার জল অমৃত হইলে পৌরাণিকদিগের বিশ্বাস অনুযায়ী কেহ মরিবে না। প্রাচীর এমন ভাবে গাঁথা হইয়া থাকিবে যে, উহা নড়ে কিন্তু পড়িয়া যায় না। রিঠায় কলমের আরোপ হইয়া থাকিবে অথবা উহা অলীক গল্প মাত্র। রেবালসরে ভেলা ভাসার মধ্যে কোন কারিগরী থাকিবে। অমরনাথে বরফের পর্বত নির্মিত হয়, জল জমিয়া ক্ষুদ্র লিঙ্গ তৈরী হইলে আশ্চর্যের কী আছে? আর জোড়া পায়রা পোষা থাকিতে পারে। পাহাড়ের আড়াল হইতে হয়ত মানুষ ঐগুলি ছাড়িয়া দেয়। এবং উহা দেখাইয়া টাকা হরণ করে।

প্রশ্ন– হরিদ্বার স্বর্গের দ্বার। হরের পাওড়ীতে, স্নান করিলে পাপ দূর হয়। তপোবনে বাস করিলে তপস্বী হওয়া যায়। দেবপ্রয়াগ, গঙ্গোত্তরীতে গোমুখ, উত্তর কাশীতে গুপ্তকাশী ত্রিযুগী নারায়ণের দর্শন হয়। কেদার ও বদ্রীনারায়ণের পূজা ছয় মাস মনুষ্যগণ এবং ছয় মাস দেবগণ করিয়া থাকে। মহাদেবের মুখ পশুপতি’ নেপালে, নিতম্ব কেদারে, তুঙ্গনাথে জানু এবং অমরনাথে চরণ আছে। ইহাদের দর্শন এবং এসব স্থানে স্নান করিলে মুক্তিলাভ হয়। ইচ্ছা করিলে কেদার ও বদ্রীনাথ হইতে স্বর্গে যাওয়া যায়। এইসব কথা কীরূপ?

উত্তর –হরদ্বার উত্তর হইতে পর্বত সমূহে যাইবার একটি পথের আরম্ভ স্থল। “হরের পাওড়ী” স্নানের জন্য নির্মিত কুণ্ডের সোপানাবলী। সত্য বলিতে কী–উহা “হাড়পাওড়ী”। কারণ দেশ-দেশান্তর (হইতে আনীত) মৃতকের হাড়গুলি ঐ স্থানে ফেলা হয়। পাপ কখনও কোথাও ভোগ ব্যতীত দূর হইতে পারে না অথবা খণ্ডনও হয় না। তপোবন যখন ছিল, তখন ছিল। এখন ত উহা ভিক্ষুক বন’। তপোবনে যাইলে বা বাস করিলে তপ হয় না। কেননা সে স্থানে বহু মিথ্যাবাদী দোকানদারও বাস করে।

‘হিমবতঃ প্রভবতি গঙ্গা’ পর্বতের উপর হইতে জল নামিতেছে। ধনার্থীরা গোমুখের আকার গড়িয়া থাকিবে। আর সেই পাহাড়ই পোপদিগের স্বর্গ। সেখানে ‘উত্তরকাশী’ প্রভৃতি স্থানে ধ্যানীদিগের পক্ষে উত্তম; কিন্তু দোকানদারের জন্য এই সকল স্থানেও দোকানদারী আছে।’দেবপ্রয়াগ’ পৌরাণিক কেচ্ছার লীলা-স্থল। অর্থাৎ অলকনন্দা ও গঙ্গা যেখানে মিলিত হইয়াছে; সেখানে দেবতাগণ বাস করেন। এইরূপ কেচ্ছা না শুনাইলে কে- ইবা সে স্থানে যাইবে,আর কে-ইবা পয়সা দিবে? ‘গুপ্তকাশী’ত নহে, উহাত প্রসিদ্ধ কাশী।‘ তিন যুগের ধুনী’ত দেখা যায় না; খাখীদিগের ধুনী এবং পার্শীদিগের অগ্যারী যেরূপ সর্বদা জ্বলিতে থাকে সেইরূপ পোপদিগের দশ বিশ পুরুষের ধুনী হয়তো থাকিবে। তপ্তকুণ্ড’ ও পর্বতের অভ্যন্তরে উত্মা’ উত্তাপ থাকে, উহাতে জল তপ্ত হইয়া বাহিরে আসে। উহার নিকটে অপর একটি কুণ্ডে উপরের জল অথবা সে-স্থানের জল আসে। এইজন্য উহা শীতল।

‘কেদার’ স্থান, সেখানকার ভূমি অতি উত্তম। কিন্তু সেখানেও পোপগণ এবং তাহাদের চেলারা একখণ্ড জমাট প্রস্তরের উপর মন্দির নির্মাণ করাইয়া রাখিয়াছে। সে-স্থানে মোহন্ত, পূজারী, পাণ্ডারা চোখ থাকিতে কানা ও ট্র্যাক ভারী যাত্রীদের নিকট হইতে ধন লইয়া বিষয়ানন্দ উপভোগ করে। বদ্রিনারায়ণেও এইরূপ অনেক ঠগ বিদ্যার পণ্ডিত বসিয়া আছে। “রাবলজী’ সেখানকার প্রধান ব্যক্তি। এক স্ত্রীর কথা ত দূরে থাকুক তাহার অনেক রক্ষিতা স্ত্রী আছে। পশুপতি একটি মন্দিরের নাম এবং পঞ্চমুখী মূৰ্ত্তির নাম রাখিয়াছে। যখন জিজ্ঞাসা করিবার কেহ থাকে না, তখনই এইরূপ লীলা বলবতী হয়। কিন্তু তীর্থস্থানের লোকেরা যেমন ধূর্ত ও পরস্বাপহরী হয়। পার্বত্যবাসীরা সেরূপ হয় না। তথাকার ভূমি অত্যন্ত রমণীয় এবং পবিত্র।

প্রশ্ন –বিন্ধ্যাচলে ‘বিন্ধ্যেশ্বরী কালী অষ্টভূজা’ প্রত্যক্ষ সত্য এবং বিন্ধ্যেশ্বরী দিনে তিন বার তিন রূপ পরিবর্তন করেন এবং তাঁহার আবেষ্টনীর মধ্যে একটি মক্ষিকাও থাকে না। প্রয়াগ তীর্থরাজ, সে স্থানে মস্তক মুণ্ডন করিলে সিদ্ধিলাভ হয়। গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে স্নান করিলে। ইচ্ছাসিদ্ধি লাভ হয়। সেইরূপ অযোধ্যা কয়েকবার উড়িয়া যাবতীয় অধিবাসীদিগের সহিত স্বর্গে চলিয়া গিয়াছিল। মথুরা’সকল তীর্থ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, বৃন্দাবন’লীলা স্থান, আর গোবর্ধন ব্রজযাত্রা মহাভাগ্যে লাভ হয়। সূর্য গ্রহণের সময়ে ‘কুরুক্ষেত্রে লক্ষ লোকেরা মেলা হয়। এসকল কথা কি মিথ্যা?

উত্তর –প্রত্যক্ষরূপে তিনটি মূর্তি দৃষ্ট হয়, সেগুলি পাষাণ মূৰ্ত্তি। তিন কালে তিন প্রকারে রূপ ধারণ করিবার কারণ এই যে, উহা পূজারীদিগের বেশ ভূষা পরাইবার চাতুর্য্য। আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি যে, সেস্থানে সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ মক্ষিকা থাকে।

‘প্রয়াগে’ সম্ভবতঃ কোন শ্লোকরচিয়তা নাপিত ছিল। সে পোপকে কিছু ধন দিয়া মুণ্ডন মাহাত্ম্য রচনা করিয়া বা করাইয়া থাকিবে। প্রয়াগে স্নান করিয়া লোকে যদি স্বর্গে যাইত, তাহা হইলে কাহাকেও গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতে দেখা যাইত না। কিন্তু সকলকেই গৃহে প্রত্যাগমন করিতে দেখা যায়। অথবা কেহ সে-স্থলে ডুবিয়া মরে,তাহার জীবাত্মাও সম্ভবতঃ আকাশে বায়ুর সহিত। বিচরণ করিয়া জন্মগ্রহণ করে। তীর্থরাজ’ নামও পয়সা সংগ্রহকারীরা রাখিয়াছে। জড়পদার্থে রাজা-প্রজাভাব কখনও থাকিতে পারে না।

ইহা নিত্যন্ত অসম্ভব কথা যে, অযোধ্যানগরী, বস্তী, কুকুর, গর্দভ, চর্মকার এবং পায়খানা। সমেত তিনবার স্বর্গে গিয়াছিল। স্বর্গে ত যায় নাই, অযোধ্যা যেখানে ছিল সেইখানেই আছে। কিন্তু পোপদিগের মুখের উড়া কথায় অযোধ্যা স্বর্গে উড়িয়া গিয়াছিল। সেই উড়া গল্প শব্দরূপে উড়িয়া। বেড়াইতেছে। নৈমিষারণ্য প্রভৃতিরও পোপালীলা এইরূপ।

‘মথুরা ত্রিলোক হইতে বিলক্ষণ’ ত নহে। কিন্তু সেখানে তিনটি জন্তু অত্যন্ত লীলাধারী। তাহাদের উৎপাতে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে কাহারও সুখে থাকা কঠিন। প্রথমটি ‘চৌবে’– যে। কেহ স্নান করিতে যায়, তাহার নিকট হইতে কর আদায় করিবার জন্য তাহাকে দাঁড়াইয়া বলিতে শুনিবেন–”যজমান! আনো ভাঙমির্চী এবং লাড়ু খানা-পীনা করি এবং যজমানের জয়গান করি”। দ্বিতীয়টি–’জলে কচ্ছপ’ কামড়ে খায়। এদের উৎপাতে ঘাটে স্নান করাও কঠিন ব্যাপার। তৃতীয়টি –আকাশের উপরে রক্তমুখ ‘বানর’ পাগড়ী, টুপী, অলংকার এমন কি জুতা পৰ্য্যন্ত ছাড়ে না। কামড়ায় ও ধাক্কা দিয়া ফেলিয়া মারে।

এই তিনটিই পোপ এবং পোপমশাই এর চেলাদের পূজনীয়। কচ্ছপগুলিকে মণ-মণ ছোলা ও অন্ন, বানরগুলিকে মণ-মণ-গুড়-ছোলা প্রভৃতি এবং চৌবেদিগকে দক্ষিণা ও লাড়ু দিয়া সেবকগণ সেবা করিতে থাকে।

আর বৃন্দাবন যখন ছিল তখন ছিল। এখন ত সেখানে বেশ্যাবনের ন্যায় ছোঁকড়া-ছুকড়ি এবং গুরু-শিষ্যের লীলাখেলা ছড়াইতেছে। সেইরূপ গোবর্ধনের দীপমালিকের মেলায় এবং ব্রজযাত্রায় পোপদিগের বিশেষ সুবিধা হইয়া থাকে। কুরুক্ষেত্রও সেইরূপ জীবিকার লীলা-খেলা বুঝিতে হইবে। ইহাদের মধ্যে যাঁহারা ধার্মিক এবং পরোপকারী তাহারা পোপ লীলা হইতে দূর থাকেন।

প্রশ্ন –মূর্তিপূজা এবং তীর্থ সনাতন কাল হইতে প্রচলিত আছে, ইহা কীরূপে মিথ্যা হইতে পারে?

উত্তর –তুমি কাহাকে সনাতন বল? যাহা চিরকাল চলিয়া আসিতেছে, তাহাকে ত? ইহা চিরকাল ছিল, তবে বেদ এবং ব্রাহ্মণাদি ঋষি মুনিকৃত গ্রন্থ সমূহে তাহার উল্লেখ নাই কেন? এই মূর্তিপূজা আড়াই অথবা তিন সহস্র বৎসরের কাছাকাছি বামমার্গী এবং জৈনদের দ্বারা প্রচলিত হইয়াছিল। প্রথমে আৰ্য্যাবর্তে ইহা ছিল না।

এইসব তীর্থ সমূহও ছিল না। যখন জৈনগণ গিরনার, পালিটানা, শিখর, শত্রুঞ্জয় এবং আবু প্রভৃতি তীর্থ রচনা করিয়াছিল সে সময় পৌরাণিকগণও সেইসব তীর্থের অনুকূলে তীর্থ রচনা করে। যদি কেহ এই সকলের আরম্ভ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে ইচ্ছা করেন, তবে তিনি পাণ্ডাদিগের অতি প্রাচীন খাতাপত্র এবং তাম্রলিপি প্রভৃতি দেখিবেন। তা হইলে ইহা নির্ণয় হইবে যে, এই সব তীর্থগুলি পাঁচশত অথবা একসহস্র বৎসরের এদিকেই নির্মিত হইয়াছে। সহস্র বৎসরের ওদিকের লেখা কাহারও নিকট দেখা যায় না। সুতরাং তীর্থগুলি সব আধুনিক।

প্রশ্ন –যে যে তীর্থ অথবা নামের মাহাত্ম, অর্থাৎ যেমন “অন্যক্ষেত্রে কৃতং পাপং কাশীক্ষেত্রে বিনশ্যতি” ইত্যাদি কথা আছে উহা সত্য কিনা?

উত্তর –না, কারণ যদি পাপ দূর হইত, তাহা হইলে দরিদ্র ব্যক্তিরা ঐশ্বৰ্য্য ও রাজসিংহাসন এবং অন্ধ ব্যক্তিরা চক্ষু লাভ করিত এবং কুষ্ঠরোগীগণের কুষ্ঠরোগ সারিয়া যাইত। কিন্তু তাহা হয় না অতএব কাহারও পাপ বা পুণ্য দূর হয় না।

গঙ্গা গঙ্গেতি গো ব্রয়োদ্যোজনানাংশতৈরপি। মূচ্যতে সর্বপাপেভ্যো বিষ্ণুলোকং স গচ্ছতি ॥ ১ ॥ পদ্মপুরাণ। হরিহরতি পাপানিহরিরিত্যক্ষরদ্বয়ম্ ॥ ২ ॥ পদ্মপুরাণ। প্রাতঃকালে শিবং দৃষ্টা নিশি পাপংবিনশ্যতি। আজন্মকৃতংমধ্যাহ্নে সায়াহ্নে সপ্তজন্মনাম্ ॥৩॥ তীর্থদর্পণ পন্ডা অর্পণ। ইত্যাদি শ্লোক পোপ পুরাণোক্ত।

যদি শত-সহস্র ক্রোশ দূর হইতেও কেহ গঙ্গা-গঙ্গা বলে, তাহা হইলে তাহার সমূহ পাপ নষ্ট হইয়া সে, “বিষ্ণুলোক’অর্থাৎ বৈকুণ্ঠে গমন করে৷১ ॥

“হরি” এই অক্ষরদ্বয়ের নাম উচ্চারণে সমস্ত পাপ হরণ করে। রামকৃষ্ণ, শিব এবং ভগবতী প্রভৃতি নামের মাহাত্মও সেইরূপ ॥২॥

যদি কেহ প্রাতঃ কালে শিব অর্থাৎ লিঙ্গ অথবা উহার মূর্তি দর্শন করে, তাহার রাত্রিকৃত পাপ দূর হয়, মধ্যাহ্নকালে দর্শন করিলে সমস্ত জীবনের এবং সায়ংকাল দর্শন করিলে সাতজন্মের পাপ দূর হয় ॥ ৩ ॥

প্রশ্ন –এই দর্শন-মাহাত্ম কি মিথ্যা হইয়া যাইবে?

উত্তর –ইহা যে মিথ্যা, সে বিষয়ে সংশয় কোথায়? কেননা গঙ্গা-গঙ্গা অথবা হরে রাম, কৃষ্ণ, নারায়ণ, শিব এবং ভগবতী নামস্মরণে কখনও পাপ দূর হয় না। যদি দূর হইত তাহা হইলে। কেহই দুঃখী থাকিত না, আর পাপ করিতে কেহ ভীত হইত না, আজকাল যেমন পোপলীলায়। পাপ বৃদ্ধি হইতেছে। মূঢ়দিগের বিশ্বাস এই যে, তাহারা পাপ করিয়া নামস্মরণ অথবা তীর্থযাত্রা করিবে তাহা হইলে পাপের নিবৃত্তি হইবে। এই বিশ্বাসে পাপ করিয়া তাহারা ইহলোক এবং পরলোক নষ্ট করে। কিন্তু কৃতপাপের ফলভোগ করিতেই হয়।

প্রশ্ন –আচ্ছা, কোন তীর্থ, নাম-স্মরণ–সত্য কিনা?

উত্তর –হাঁ। বেদাদিসত্য-শাস্ত্রের অধ্যয়ন-অধ্যাপন, ধার্মিকবিদ্বান্ ব্যক্তিদের সঙ্গ, পরোপকার, যোগাভ্যাস, নির্বৈরতা, নিষ্কপটতা, সত্যভাষণ, সত্যগমন, সত্যানুষ্ঠান, ব্রহ্মচর্য্য আচাৰ্য্য অতিথি-মাতা-পিতার সেবা, পরমেশ্বরের স্তুতি-প্রার্থনা-উপাসনা, শান্তি, জিতেন্দ্রিয়তা, সুশীলতা, ধর্মসঙ্গতপুরুষকার এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান আদি শুভগুণ-কর্ম দুঃখ হইতে উদ্ধার করে বলিয়া এসকলের নাম ‘তীর্থ।

জল-স্থলময় স্থান আদি কখনও তীর্থ হইতে পারে না। কারণ “জনা য়ৈস্তরন্তি তানি তীর্থাণি” মনুষ্য যে কর্ম করিয়া দুঃখ হইতে পার হয় তাহার নাম ‘তীর্থ। জল, স্থল পার করে না কিন্তু ডুবাইয়া মারে। তবে নৌকা প্রভৃতির নাম ‘তীর্থ’ হইতে পারে। কারণ তদ্বারা সমুদ্রাদি পার হওয়া। যায়।

সমানতীর্থে বাসী ॥১॥ (অষ্টা ৪ ॥ ৪ ॥ ১০৭) নমস্তীৰ্থায় চ ॥২॥ (যজু অ০১৬)।

যে-সকল ব্রহ্মচারী একসঙ্গে একই আচার্য্যের নিকট একই শাস্ত্র অধ্যয়ন করে, তাহারা সকলেই ‘সতীর্থ’ এবং সমান-তীর্থসেবী ॥১॥

যিনি বেদাদি শাস্ত্র এবং সত্যভাষণাদি ধর্মলক্ষণযুক্ত বলিয়া সাধু, তাঁহাকে অন্নাদি প্রদান পূর্বক তাঁহার নিকট হইতে বিদ্যাগ্রহণ করা ইত্যাদিকে ‘তীর্থ’ বলে ॥

নাম-স্মরণ ইহাকে বলে, যথা– য়স্য নাম মহদয়শঃ ॥ যজুঃ

পরমেশ্বরের নাম মহাযশ অর্থাৎ ধর্মযুক্ত কর্মকরা। যথা–ব্রহ্ম, পরমেশ্বর, ঈশ্বর, ন্যায়কারী, দয়ালু এবং সর্বশক্তিমান্ প্রভৃতি নাম পরমেশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাব সূচক। যথা –’ব্রহ্ম’সর্বাপেক্ষা বৃহৎ, পরমেশ্বর ঈশ্বরের ঈশ্বর, ঈশ্বর সামর্থ্যযুক্ত, ন্যায়কারী’ যিনি কখনও অন্যায় করেন না। ‘দয়ালু’ যিনি সকলের প্রতি কৃপাদৃষ্টি রাখেন। সর্বশক্তিমান্ যিনি নিজ সামর্থ্য দ্বারা সমস্ত জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করেন, কাহারও সাহায্য গ্রহণ করেন না। ব্রহ্ম’ বিবিধ জাগতিক পদার্থসমূহের স্রষ্টা। বিষ্ণু সর্বত্র ব্যাপক এবং রক্ষাকা। মহাদেব’ সমস্ত দেবগণের দেব।’রুদ্র প্রলয়কারী, ইত্যাদি নামের অর্থ নিজের মধ্যে ধারণ করিবে। অর্থাৎ তিনি মহকার্য দ্বারা মহান এবং সমর্থদিগের মধ্যে সমর্থবান হইবেন। সর্বদা সামর্থ্য বৃদ্ধি করিতে থাকিবে। কখনও অধর্ম করিবে না! সকলের প্রতি দয়া করিবে। সকল প্রকার সাধন সফল করিবে। শিল্পবিদ্যার সাহায্যে সর্ববিধ পদার্থ নির্মাণ করিবে। সংসারে সকলের সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখের ন্যায় মনে করিবে। সকলকে রক্ষা করিবে। বিদ্বান্ ব্যক্তিদের মধ্যে বিদ্বান্ হইবে। কু-কর্মকারী এবং কু-কর্মে প্রেরণাদানকারীদিগকে যথাবিধি দণ্ড দিবে এবং সজ্জনদিগকে রক্ষা করিবে।

পরমেশ্বরের নাম সমূহের এইরূপ অর্থ জানিয়া তাহার গুণকর্মস্বভাবের ন্যায় (অনুকূলে স্বীয় গুণ-কর্ম-স্বভাব) নির্মাণ করিয়া যাওয়াই পরমেশ্বরের নামস্মরণ।

প্রশ্ন –গুরুব্রহ্মা গুরুর্বিষু গুরুদেব মহেশ্বরঃ ॥ গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ ॥ গুরুগীতা

এইসব গুরুমাহাত্ম তো সত্য? গুরুর চরণ ধুইয়া পান করা, যেরূপ আজ্ঞা দিবেন,সেরূপ পালন করিবে, গুরু লোভী হইলে তাহাকে বামনের তুল্য, ক্রোধী হইলে নরসিংহের সদৃশ, মোহগ্রস্ত হইলে রামের তুল্য এবং কামী হইলে কৃষ্ণের সমান জানিবে। গুরু যেরূপ পাপই করুক না কেন, তথাপি অশ্রদ্ধা করিবে না। সন্ত অথবা গুরুর দর্শনার্থ গমনকালে পদে পদে অশ্বমেধের ফল লাভ হয়। এসকল কথা কি ঠিক নয়?

উত্তর –ঠিক নহে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং পরব্রহ্ম পরমেশ্বরের নাম। তাহার তুল্য গুরু কখনও হইতে পারে না। এই ‘গুরুমাহাত্ম্য এবং ‘গুরুগীতা’ ও এক মহা পোপলীলা। ‘গুরু’ ত মাতাপিতা ও আচাৰ্য্য এবং অতিথি; তাহাদের সেবা করা এবং তাঁহাদের নিকট বিদ্যা ও সুশিক্ষা গ্রহণ করা ও দান করা গুরুশিষ্যের কর্তব্য।

কিন্তু গুরু লোভী, ক্রোধী, মোহী এবং কামুক হইলে তাহাকে সর্বৰ্থা বর্জন করিবে। তাহাকে উচিত শিক্ষা দান করা কর্তব্য। সহজ শিক্ষায় সংশোধন না হইলে পাদ্য-অর্ঘ্য অর্থাৎ তাড়নাদণ্ড, প্রাণহরণ পৰ্য্যন্তও দোষজনক নহে।

যাহার মধ্যে বিদ্যা এবং অন্যান্য সদ্‌গুণের গুরুত্ব না থাকে (এরূপ মনে করা) তাহা হইলে অযথা কণ্ঠি, তিলকধারী এবং বেদবিরুদ্ধ মন্ত্রোপদেশকারী গুরু, গুরুই নহে; কিন্তু তাহাদের মেষপালকবৎ জানিও। মেষপালক যেমন মেষ ও ছাগীর দুগ্ধাদি লইয়া প্রয়োজনসিদ্ধি করে, সেইরূপ তাহারাও শিষ্যদের=চেলা-চেলীদের ধন হরণ করিয়া স্বার্থসিদ্ধি করে।

দোহা –গুরু লোভী চেলা লালচী, দোঁনে খেলে দাও। ভবসাগর মে ডুবতে, বৈঠ পত্র কী নাও।

গুরুদেব মনে করেন যে, চেলা-চেলীরা কিছু না কিছু দিবেই; চেলা মনে করে যে, মিথ্যা শপথ এবং পাপমোচনাদির কাজে গুরুর প্রয়োজন হইবে, এই লোভে দুই কপট মুনিই সমুদ্রে প্রস্তরনির্মিত নৌকায় আরোহণকারীর ন্যায় ভব-সাগরে ডুবিয়া মরে।

এমন গুরু ও চেলার মুখে ছাই। তাহার নিকট কেহই দাঁড়াইও না, দাঁড়াইলে দুঃখসাগরে ডুবিবে। যেরূপ পোপ লীলা পূজারী ও পৌরাণিকেরা চালাইয়াছে সেইরূপ এইসব মেষপালক গুরুর দলও লীলা জুড়িয়াছে। এ সমস্ত স্বার্থপর লোকের কাৰ্য্য। যাঁহারা পরার্থপর তাহারা স্বয়ং দুঃখ। পাইলেও জগতের উপকার করিতে বিরত হন না। আর লোভী ও কু-কর্মী গুরুর দল গুরুমাহাত্ম্য এবং গুরু-গীতা প্রভৃতি রচনা করিয়াছে।

প্রশ্ন –অষ্টাদশপুরাণানাং কৰ্ত্তা সত্যবতীসুতঃ ॥১ ॥ ইতিহাসপুরাণাভ্যাং বেদার্থমুপবৃংহয়েৎ ॥২। মহাভারত পুরাণানি খিলানি চ ॥ ৩ ॥ মনু ইতিহাসপুরাণঃ পঞ্চমো বেদানাং বেদঃ ॥৪ ॥ ছান্দোগ্য দশমেহনি কিঞ্চিৎপুরাণমাচক্ষীত ॥ ৫ ॥ পুরাণবিদ্যা বেদঃ ॥৬ ॥ সূত্রম্ (শতপথ ১৩ ৩।১।১৩)

ব্যাসদেব অষ্টাদশ পুরাণের রচয়িতা। ব্যাসের বচন অবশ্য প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করা উচিত ॥ ১।

ইতিহাস মহাভারত এবং অষ্টাদশ পুরাণের সাহায্যে বেদার্থ পড়িবে ও পড়াইবে। কেননা ইতিহাস ও পুরাণ বেদার্থের অনুকূল ॥২॥

পিতৃকর্মে পুরাণ (খিল অর্থাৎ) হরিবংশ কথা শ্রবণ করিবে ॥ ৩ ॥

ইতিহাস ও পুরাণ পঞ্চম বেদ নামে প্রসিদ্ধ ॥ ৪ ॥

অশ্বমেধের সমাপ্তিতে দশম দিবসে কিঞ্চিৎ পুরাণের কথা শ্রবণ করিবে ॥ ৫ ॥

পুরাণ-বিদ্যা বেদার্থজ্ঞাপক বলিয়া বেদ ॥ ৬ ॥

এই সমস্ত প্রমাণ দ্বারা পুরাণ সমূহের এবং ইহাদের প্রমাণ দ্বারা মূর্তিপূজা এবং তীর্থেরও প্রামাণিকতা সিদ্ধ হয়। কারণ পুরাণ সমূহে মূর্তি পূজা এবং তীর্থের বিধান আছে।

উত্তর –ব্যাসদেব অষ্টাদশ পুরাণের কর্তা হইলে পুরাণগুলিতে এত অলীক গল্প থাকিত না, কেননা শারীরক সূত্র, যোগশাস্ত্র ভাষ্য প্রভৃতি ব্যাসোক্ত গ্রন্থ সমূহ অবলোকন করিলে জানা যায় যে, ব্যাসদেব মহান্ বিদ্বান, সত্যাবাদী, ধার্মিক যোগী ছিলেন। তিনি এরূপ মিথ্যা কথা কখনও লেখেন নাই। এতদ্বারা সিদ্ধ হয় যে, যে সকল সম্প্রদায়ী লোকেরা পরস্পর বিরোধী ভাগবতাদি নবীন কপোল কল্পিত গ্রন্থসমূহ রচনা করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে ব্যাসদেবের গুণের লেশমাত্রও ছিল না। আর বেদশাস্ত্রের বিরুদ্ধে অসত্য কথা লেখা ব্যাসদেবের ন্যায় বিদ্বান্ পুরুষের কার্য নহে। কিন্তু ইহা (বেদশাস্ত্র) বিরোধী, অবিদ্বান ব্যক্তিদের কর্ম।

‘ইতিহাস’ ও ‘পুরাণ’ শিবপুরাণাদি নাম নহে কিন্তু –

“ব্রাহ্মণানীতিহাসান্ পুরাণানি কল্পা গাথানারাশংসীরিতি ॥ তৈত্তি আরণ্যক। ইহা ব্রাহ্মণ এবং সূত্রের বচন।

ঐতরেয়, শতপথ, সাম এবং গোপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থেরই ইতিহাস, পুরাণ, কল্প, গাথা এবং নারাশংসী = এই পাঁচটি নাম। ইতিহাস’= যেমন জনক– যাজ্ঞবল্ক্য সংবাদ। পুরাণ’= জগতের উৎপত্তি প্রভৃতির বর্ণনা। কল্প’= বৈদিক শব্দ সমূহের সামর্থ্য-বৰ্ণন এবং অর্থ নিরূপণ করা। ‘গাথা’=কাহারও দৃষ্টান্ত দাান্তরূপ কথা প্রসঙ্গ বলা নারাশংসী’=মনুষ্যদিগের প্রশংসনীয় অথবা অপ্রংসনীয় কর্মের কথন করা। ইহাদের দ্বারাই বেদার্থের বোধ হইয়া থাকে।

‘পিতৃকর্ম’ অর্থাৎ জ্ঞানীদিগের প্রশংসা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ শ্রবণ করা এবং অশ্বমেধের অন্তেও ইহা শ্রবণের কথা লিখিত আছে। কারণ ব্যাসকৃত গ্রন্থের শ্রবণ-শ্রাবণ তাঁহার জন্মের পরেই সম্ভব, পূর্বে নহে। যখন ব্যাসদেবের জন্ম হয় নাই, যে সময়েও বেদার্থের অধ্যয়ন-অধ্যাপন এবং শ্রবণ-শ্রাবণ হইত। সুতরাং সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ব্রাহ্মণগ্রন্থ সমূহেই এই সকল ঘটনা থাকিতে পারে। এই নবীন কপোল কল্পিত শ্রীমদ্ভাগবত এবং শিবপুরাণাদি মিথ্যা অথবা দূষিত গ্রন্থসমূহে এইসব থাকিতে পারে না।

ব্যাসদেব বেদ অধ্যয়ন-অধ্যাপন দ্বারা বেদার্থ বিস্তার করিয়াছিলেন তাহার নাম ‘বেদব্যাস’ হইয়াছিল। পারাপারের মধ্যরেখাকে ‘ব্যাস’ বলা হয়। অর্থাৎ ঋগ্বেদের আরম্ভ হইতে অথৰ্ব্ব বেদের পার পর্যন্ত চারি বেদ পড়িয়াছিলেন। আর শুকদেব এবং জৈমিনি প্রভৃতি শিষ্যদিগকে পড়াইয়া ছিলেন। বাস্তবিক পক্ষে তাহার জন্ম নাম ছিল “কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন।” যদি কেহ বলেন যে, ব্যাসদেব বেদ সমূহ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহাদের একথা মিথ্যা। কেননা ব্যাসদেবের পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, পরাশর, শক্তি, বশিষ্ঠ এবং ব্রহ্মা প্রভৃতিও চারিবেদ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। তাহা না হইলে একথা প্রযুক্ত হয় কীরূপে?

প্রশ্ন –পুরাণের সকল কথাই কি মিথ্যা? না, কোনও সত্যও আছে।

উত্তর –অনেক কথাই মিথ্যা। তবে ‘ঘুণাক্ষর ন্যায়’অনুসারে সত্যও আছে। যাহা সত্য তাহা বেদাদি সত্য-শাস্ত্রের; কিন্তু যাহা মিথ্যা তাহা পোপদের পুরাণরূপ গৃহের। যথা– ‘শিবপুরাণে’ শৈবগণ শিবকে পরমেশ্বর মানিয়া বিষ্ণু, ইন্দ্র, গণেশ এবং সূৰ্য্যাদিকে তাঁহার দাস ঠিক করিয়াছেন। বৈষ্ণবগণ “বিষ্ণু পুরাণ’ প্রভৃতিতে বিষ্ণুকে পরমাত্মা এবং শিব প্রভৃতিকে বিষ্ণুর দাস করিয়াছেন। ‘দেবীভাগবতে’দেবীকে পরমেশ্বরী কিন্তু শিব এবং বিষ্ণু প্রভৃতিকে তাহার বিষ্ণুর কিঙ্কর করিয়াছেন। ‘গণেশখণ্ডে’ গণেশকে ঈশ্বর এবং অবশিষ্ট সকলকে দাস করা হইয়াছে।

বলুন তো, এসকল কথা যদি এই সমস্ত সম্প্রদায়ীলোকদের না হয়, তবে কাহাদের? যে কোন একজন সাধারণ ব্যক্তির রচনায় এমন পরস্পর বিরুদ্ধ কথা থাকিতে পারে না, এবং বিদ্বানদের রচিত হইলে এসকল কখনও থাকিতে পারে না। ইহাদের একটিকে সত্য বলিয়া স্বীকার করিলে অপরটি মিথ্যা হয়, আর দ্বিতীয়টিকে সত্য স্বীকার করিলে তৃতীয়টি মিথ্যা, আবার তৃতীয়টিকে সত্য মানিলে অন্য সবগুলিই মিথ্যা হয়।

শিবপুরাণ-বিশ্বাসী শিব হইতে, বিষ্ণুপুরাণ-বিশ্বাসী বিষ্ণু হইতে, দেবী-পুরাণ-বিশ্বাসী দেবী। হইতে, গণেশখণ্ড-বিশ্বাসীরা গণেশ হইতে, সূৰ্য্যপুরাণ-বিশ্বাসীরা সূৰ্য্য হইতে,বায়ুপুরাণবাদী বায়ু হইতে সৃষ্টির উৎপত্তি ও প্রলয় বর্ণনা করিয়া,পুনরায় এক-এক যাহা জগতের কারণরূপে লিখিত হইয়াছে, তাহার উৎপত্তি এক-এক হইতে লিখিয়াছে।

যদি কেহ তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করে, “যিনি জগতের উৎপত্তি-স্থিতি-প্রলয়কা, তিনি উৎপন্ন হইতে পারেন কিনা? আর যিনি উৎপন্ন, তিনি কখনও সৃষ্টির কারণ হইতে পারেন কিনা? একথায় তাহাদের কেবল চুপ হইয়া থাকা ব্যতীত অন্য কিছু বলা সম্ভব নহে।

ইহাদের সকলের শরীরের উৎপত্তিও ইহা হইতেই হইয়া থাকিবে। যাঁহারা নিজেরাই সৃষ্ট পদার্থ এবং পরিচ্ছিন্ন, তাহারা জগতের সৃষ্টিকর্তা কীরূপে হইতে পারেন? আর (জগতের) সৃষ্টি ও বিলক্ষণ-বিলক্ষণ প্রকারে মানা হইয়াছে, যাহা সর্বথা অসম্ভব। যথা–

শিবপুরাণে শিব ইচ্ছা করিলেন “আমি সৃষ্টি করিব”। তখন তিনি নারায়ণ (নামক) এক জলাশয় উৎপন্ন করিলেন। তাহার নাভি হইতে কমল হইল এবং কমল হইতে ব্রহ্ম উৎপন্ন হইলেন। ব্রহ্মা দেখিলেন যে, সমস্ত জলময়। তখন তিনি অঞ্জলি ভরিয়া জল তুলিয়া দেখিলেন এবং পুনরায় জল ফেলিয়া দিলেন। তাহা হইতে এক বুদ্বুদ হইল এবং বুদ্বুদ হইতে একজন পুরুষ উৎপন্ন হইল। সে ব্রহ্মকে বলিল, “রে পুত্র। সৃষ্টি কর। ব্রহ্মা তাঁহাকে বলিলেন, “আমি তোমার পুত্র নহি কিন্তু তুমি আমার পুত্র”। তাহাদের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হইল এবং দুইজনে দিব্য সহস্র বর্ষ পৰ্য্যন্ত জলের উপরে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।

তখন মহাদেব চিন্তা করিলেন, “আমি যাহাদিগকে সৃষ্টি করিবার জন্য পাঠাইয়াছিলাম তাহারা দুইজন ঝগড়া-লড়াই করিতেছে”। তখন তাহাদের উভয়ের মধ্য হইতে এক তেজোময় লিঙ্গ উৎপন্ন হইয়া শীঘ্র আকাশে চলিয়া গেল। উহা দেখিয়া উভয়ে আশ্চর্যান্বিত হইয়া চিন্তা করিলেন, “ইহার আদি অন্ত জানা আবশ্যক, যে ইহার আদি অন্ত জানিয়া প্রথমে ফিরিয়া আসিবে, সে পিতা এবং যে পরে, কিংবা সীমা না জানিয়া ফিরিয়া আসিবে, সে পুত্র বলিয়া কথিত হইবে।”

বিষ্ণু কুর্মরূপ ধারণ করিয়া নীচে চলিলেন, আর ব্রহ্মা হংসরূপ ধারণ করিয়া উপরে উড়িলেন ॥ উভয়ে মনোবেগে চলিলেন, তাহারা দিবা সহস্রবৎসর পর্যন্ত চলিতে থাকিলেও তাহার অন্ত । পাইলেন না। তখন বিষ্ণু নিম্ন হইতে উপরে এবং ব্রহ্মা উপর হইতে নিম্নে চলিতে লাগিলেন। ব্রহ্মা ভাবিলেন “যদি সে অন্ত জানিয়া ফিরিয়া আসে তাহা হইলে আমাকে পুত্র হইতে হইবে”। এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, এমন সময়ে একটি গাভী ও একটি কেতকী বৃক্ষ উপর হইতে অবতরণ করিল। ব্রহ্মা তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমরা কোথা হইতে আসিলে”? তাহারা বলিল, “আমরা এক সহস্র বৎসর ধরিয়া এই লিঙ্গের আধার হইতে চলিয়া আসিতেছি”। ব্রহ্মা জিজ্ঞাসা করিলেন এই লিঙ্গের অন্ত আছে –না নাই”? তাহারা বলিল, –“নাই”।

তখন ব্রহ্মা বলিলেন, তোমরা আমার সঙ্গে চল আর এইভাবে সাক্ষ্য দিও –আমি। (গাভী) এই লিঙ্গের উপর দুগ্ধধারা বর্ষণ করিতাম’, আর বৃক্ষ তুমি বলিবে –‘আমি পুষ্প বর্ষণ করিতাম। তোমরা এইরূপ সাক্ষ্য দিলে আমি তোমাদিগকে যথাস্থানে লইয়া যাইব। তাহারা। বলিল,- “আমরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিব না।”তখন ব্রহ্মা কুপিত হইয়া বলিলেন, –“যদি সাক্ষ্য না দাও তো তোমাদিগকে এখনই ভস্ম করিব। তখন উভয়েই ভীত হইয়া বলিল, –আপনি যেরূপ বলিবেন আমরা আপনার কথা অনুযায়ী সেইরূপ সাক্ষ্য দিব।

বিষ্ণু পূর্বে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। ব্রহ্মাও উপস্থিত হইলেন। বিষ্ণুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি (লিঙ্গের) অন্ত জানিয়া আসিয়াছ, কি না?” বিষ্ণু বলিলেন, –“আমি ইহার অন্ত পাই নাই”। ব্রহ্মা বলিলেন, “আমি জানিয়া আসিয়াছি”। বিষ্ণু বলিলেন– “কোনও সাক্ষী উপস্থিত কর।” তখন গাভী এবং বৃক্ষ সাক্ষ্য দিল। “আমরা উভয়েই লিঙ্গের মস্তকে ছিলাম।” তখন লিঙ্গ হইতে বৃক্ষকে অভিশাপ দিল, “যেহেতু তুমি মিথ্যা বলিয়াছ, সেই হেতু তোমার ফুল জগতে আমার অথবা অন্য কোন দেবতার পূজায় লাগিবেনা। কেহ অর্পণ করিলে তাহার সর্বনাশ হইবে।” গাভীকে অভিশাপ দিল, –“যে মুখ দিয়া তুই মিথ্যা বলিয়াছিস, সে মুখে তুই বিষ্ঠা খাইবি। কেহ তোর মুখের পুজা করিবে না, কিন্তু পূজা করিবে তোর পুচ্ছের।” বিষ্ণুকে বর দান করিল, –“যেহেতু তুই সত্য বলিয়াছিস, এইজন্য সর্বত্র তোর পূজা হইবে।”

পুনরায় উভয়ে লিঙ্গের স্তুতি করিলেন। তাহাতে প্রসন্ন হইয়া এক জটাজুট মূর্তি সেই লিঙ্গ হইতে আবির্ভূত হইল। মূর্তি বলিল –“আমি তোমাদিগকে সৃষ্টি করিবার জন্য পাঠাইয়াছিলাম, তোমরা বিবাদে প্রবৃত্ত রহিলে কেন? ব্রহ্মা ও বিষ্ণু বলিলেন, –আমরা সামগ্রী ব্যতীত কীরূপে সৃষ্টি করিব?” তখন মহাদেব জটা হইতে একটি ভস্মের গোলা বাহির করিয়া বলিলেন,–”যাও ইহার দ্বারা সমস্ত সৃষ্টি রচনা কর” ইত্যাদি।

আচ্ছা, এই পুরাণ রচয়িতা পোপদিগের যদি কেহ জিজ্ঞাসা করে, যখন সৃষ্টিতত্ত্ব ও পঞ্চমহাভূত ছিল না, তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহাদেবের শরীর,জল, কমল, লিঙ্গ, গাভী, কেতকী-বৃক্ষ এবং ভস্মের গোলা কি তোমাদের পিতামহের ঘর হইতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল?

সেইরূপ ভাগবতে’ বিষ্ণুর নাভী হইতে কমল, কমল হইতে ব্রহ্ম, ব্রহ্মর দক্ষিণ চরণের অঙ্গুষ্ঠ হইতে স্বায়ম্ভুব, বাম অঙ্গুষ্ঠ হইতে শতরূপা রাণী, ললাট হইতে রুদ্র, মরীচি প্রভৃতি দশ পুত্র এবং সেই পুত্র হইতে দশ (দক্ষ) প্রজাপতির জন্ম হয়। কশ্যপের সহিত দশ (দক্ষ) প্রজাপতির ত্রয়োদশ কন্যার বিবাহ হয়, তাহাদের মধ্যে দিতি হইতে দৈত্য, দনু হইতে দানব, অদিতি হইতে আদিত্য, বিনতা প্রভৃতি অন্যান্য স্ত্রী হইতে হস্তী, অশ্ব, উষ্ট্র, গর্দভ, মহিষ, তৃণ, উলু এবং বাবলা প্রভৃতি কন্টকবৃক্ষ উৎপন্ন হইল।

আহা মরি মরি! ভাগবত রচয়িতা দেখি, লাল বুঝকড়। কী আর বলিব? এ সকল মিথ্যা কথা লিখিতে তোমার একটুও লজ্জা ও সংকোচ হইল না? একেবারেই কি অন্ধ হইলে? স্ত্রী-পুরুষ রজো-বীৰ্য্যসংযোগে মনুষ্যের উৎপত্তি ত হইয়াই থাকে, কিন্তু পরমেশ্বরের সৃষ্টিক্রমের বিরুদ্ধে কখনও সৃষ্টি হইতে পারে না। হস্তী, উষ্ট্র, সিংহ, কুকুর, গর্দভ এবং বৃক্ষাদির (অপশু) স্ত্রী-গর্ভাশয়ে স্থিত হইবার অবকাশ কীরূপে থাকিতে পারে? সিংহ প্রভৃতি উৎপন্ন হইয়া নিজেদের পিতামাতাকে ভক্ষণ করিল না কেন? মনুষ্যদেহ হইতে পশু পক্ষী ও বৃক্ষাদির উৎপত্তি কীরূপে সম্ভব হইতে পারে?

ইহাদের রচিত এই মহা অসম্ভব লীলা-খেলাকে ধিক। ইহারা অদ্যাবধি সংসারকে বিভ্রান্ত করিতেছে। ভাবিয়া দেখুন পোপগণ এবং তাহাদের বাহ্য এবং অন্তদৃষ্টিহীন চেলারা এই সমস্ত মহামিথ্যা শ্রবণ করে এবং বিশ্বাস করে। অত্যন্ত আশ্চর্যের কথা ইহারা কি মানুষ না অন্য কিছু? এই সব ভাগবতাদি পুরাণ রচয়িতা মাতৃগর্ভেই বিনষ্ট হয় নাই কেন? অথবা জন্মকালেই ইহাদের মৃত্যু হয় নাই কেন? কেননা, এসকল পোপের হাত হইতে রক্ষা পাইলে আৰ্য্যাবৰ্ত্ত বহু দুঃখ হইতে অব্যাহতি পাইত।

প্রশ্ন –এসকল বিষয়ে বিরোধ হইতে পারে না। কারণ “যাহার বিবাহ তাহারই গীত।” বিষ্ণুর স্তুতিকালে বিষ্ণুকেই পরমেশ্বর, অন্যকে দাস এবং শিবের স্তুতিকালে শিবকে পরমাত্মা, অপরকে কিঙ্কর করিয়াছে। পরমেশ্বরের মায়ায় সমস্তই হইতে পারে। পরমেশ্বর মনুষ্য হইতে পশ্যাদি, পশ্বাদি হইতে মনুষ্যাদির উৎপত্তি করিতে পারেন। দেখুন, যিনি কোন কারণ ব্যতীত মায়া দ্বারা সকল সৃষ্টি করিয়া ফেলিলেন, তাহার পক্ষে অসম্ভব কী আছে? তিনি যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারেন।

উত্তর –ওহে ভোলার দল। বিবাহে যাহার গান গাওয়া হয়, তাহাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং অপর সকলকে নিকৃষ্ট বলিয়া নিন্দা, অথবা তাহাকে সকলের পিতা তো করা হয় না? বলতো পোপ মহাশয়! তুমি ভাট এবং তোষামোদকারী চারণ অপেক্ষাও বড়গোছের ‘গপুসে’কিনা? যাহার পক্ষ গ্রহণ কর, তাহাকেই সর্বাপেক্ষা বড় কর, আর যাহার বিরুদ্ধে যাও তাহাকেই সর্বাপেক্ষা হেয় কর। সত্য এবং ধর্মে তোমার প্রয়োজন কী? স্বার্থসিদ্ধি করাই তো তোমার প্রয়োজন। মনুষ্যেই মায়া থাকা সম্ভব। যাহাতে ছলনা ও কপটতা আছে, তাহাকেই ‘মায়াবী’ বলে। পরমেশ্বরের ছলনা, কপটতা প্রভৃতি দোষ নাই। অতএব তাহাকে মায়াবী বলিতে পারো না। আদি সৃষ্টিতে কশ্যপ এবং কশ্যপ পত্নীদের দ্বারা পশু, পক্ষী, সর্প এবং বৃক্ষাদির জন্ম হইয়া থাকিলে, আজকালও তদ্রপ ২৬২ সন্তান হয় না কেন? পূর্বে সৃষ্টিক্রম লিখিত হইয়াছে, তাহাই যথার্থ।

অনুমান হয় যে পোপ মহাশয় নিম্নলিখিত বাক্যের দ্বারা বিভ্রান্ত হইয়া থাকিবেনঃ- তস্মাৎ কশ্যপ্য ইমাঃ প্রজাঃ ॥

শতপথে লিখিত আছে যে, এই সমস্ত সৃষ্টি কশ্যপের রচিত।

কশ্যপঃ কস্মাৎ পশ্যকো ভবতীতি। নিরু।

সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বরের নাম “কশ্যপ”। উহা এই কারণে যে, তিনি ‘পশ্যক’ অর্থাৎ “পশ্যতীতি পশ্যঃ, পশ্য এব পশ্যকঃ।”যিনি নির্ভম হইয়া চরাচর জগৎ, যাবতীয় জীব, তাহাদের কর্ম এবং বিদ্যাকে যথাবৎ দেখেন। আর “আদ্যন্তবিপর্যয়শ্চ” মহাভাষ্যের এই বচনানুসারে আদি অক্ষর অন্তে এবং অন্ত্য বর্ণ আদিতে আসায় “পশ্যক” এর স্থানে “কশ্যপ” হইয়াছে। ইহার অর্থ না জানিয়া, ঘটী ঘটী ভাঙ গলায় ঢালিয়া ইহারা সৃষ্টি বিরুদ্ধ বর্ণনা করিয়া স্বীয় জন্ম নষ্ট করিয়াছে।

উদাহরণস্বরূপ, মার্কণ্ডেয় পুরাণের দুর্গাপাঠে দেবগণের শরীর হইতে তেজ নির্গত হইয়া এক ‘দেবী’ উৎপন্ন হইলেন, বলা হইয়াছে। তিনি মহিষাসুরকে বধ করিলেন। রক্তবীজের শরীর হইতে এক বিন্দু রক্ত ভূমিতে পতিত হওয়ায় তৎসদৃশ রক্তবীজ উৎপন্ন হইয়া সমস্ত জগৎ রক্তবীজে পরিপূর্ণ হওয়া এবং রক্তনদী বহিয়া যাওয়া এইরূপ বহু অলীক গল্প লিখিত আছে। যদি রক্তবীজের দ্বারা সমস্ত জগৎ পরিপূর্ণ হইয়াছিল, তখন দেবী, দেবীর সিংহ এবং তাঁহার সেনারা কোথায় ছিল? যদি বল যে, রক্তবীজ দেবীর নিকট হইতে দূরে দূরে ছিল, তাহা হইলে ত সমস্ত জগৎ রক্তবীজে পরিপূর্ণ হয় নাই। যদি ভরিয়া গিয়া থাকে, সে অবস্থায় পশু, পক্ষী, মনুষ্যদি প্রাণী, জলের কুম্ভীর, হাঙ্গর, মৎস্য, কচ্ছপ এবং বনস্পতি প্রভৃতি কোথায় ছিল? এখানে নিশ্চিত যে, ইহারা সকলে দুর্গাপাঠ রচয়িতা পোপের গৃহে প্রতিপালিত হইয়া থাকিবে!!! দেখুন, ভাঙের নেশায় কীরূপ অসম্ভব কথার কেচ্ছা রচনা করা হইয়াছে। এ সকল গল্পের কূল-কিনারা নাই!!

এক্ষণে, যাহাকে “শ্রীমদ্ভাবগত” বলা হয়, তাহার লীলাখেলা শোন। নারায়ণ ব্রহ্মকে চতুঃশ্লোকী ভাগবতের উপদেশ প্রদান করেন।

‘জ্ঞানং পরমণ্ডহ্যং মেয়দ্বিজ্ঞানসমন্বিতম্ ॥ সরহস্যং তদঞ্চ গৃহাণ গদিতং ময়া’ ॥ ভাগবত

শ্লোকার্থ –“হে ব্রহ্মা! তুমি আমার পরম গুহ্য জ্ঞান যাহা বিজ্ঞান ও রহস্যপূর্ণ এবং ধর্ম-অর্থ-কাম মোক্ষের অঙ্গস্বরূপ, তাহাই আমার নিকট গ্রহণ কর।”

(সমীক্ষা) যখন বিজ্ঞানযুক্ত জ্ঞান বলা হইয়াছে, তখন, “পরম” অর্থাৎ (শ্রেষ্ঠ) জ্ঞানের এই বিশেষণ নিরর্থক, আর “গুহ্য” বিশেষণ দ্বারা “রহস্য” ও পুনরুক্ত হইয়াছে। যখন মূল শ্লোক। নিরর্থক, তখন অন্য নিরর্থক নহে কেন? যখন ভাগবতের মূলই মিথ্যা, তখন উহার বৃক্ষ মিথ্যা হইবে না কেন? ব্রহ্মকে বর দান করার হইল–

‘ভবান কল্প বিকল্পেযু নবিমুহ্যতিকৰ্হিচিৎ ॥ ভাগ০

“আপনি কল্প=সৃষ্টি এবং বিকল্প=প্রলয়ে কখনও মোহপ্রাপ্ত হইবেন না। এইরূপ লিখিত থাকা সত্ত্বেও পুনরায় দশম স্বর্গে ‘মোহিত হইয়া বংস হরণ করিলেন। এই দুই কথার মধ্যে একটি সত্য হইলে, অপরটি মিথ্যা এইরূপে উভয় কথাই মিথ্যা হইয়া পড়ে।

বৈকুণ্ঠে তো রাগ, দ্বেষ, ঈষ্যা এবং দুঃখ নাই। যদি তাহাই হয় তাহা হইলে বৈকুণ্ঠ দ্বারে সনকাদির ক্রোধ হইল কেন? ক্রোধ থাকিলে ঐস্থান স্বর্গই নহে। জয় ও বিজয় তো দ্বারপাল। প্রভুর আজ্ঞা অবশ্য তাহাদের পালনীয়। তাহারা সনকাদিকে বাধা দিলেন ইহাতে তাহাদের অপরাধ হইল কী? বিনা অপরাধে তাহাদের প্রতি অভিশাপ ফলিতেই পারে না। যখন অভিশাপ ফলিল –“তোমরা পৃথিবীতে পতিত হও”। এই কথায় সিদ্ধ হইতেছে যে, সেস্থানে পৃথিবী ছিল না। আকাশ, বায়ু, অগ্নি এবং জল ছিল। তাহা হইলে এইরূপ দ্বার, মন্দির এবং জল কীসের আশ্রয়ে। ছিল? আবার, জয়-বিজয় এই বলিয়া সনকাদির স্তুতি করিল, “মহারাজ” আমরা পুনরায় কবে বৈকুণ্ঠে আসিব”? তিনি বলিলেন, “যদি প্রেম সহকারে নারায়ণকে ভক্তি কর, তাহা হইলে সপ্তম জন্মে; আর যদি বিরুদ্ধভাবে ভক্তি কর, তবে তৃতীয় জন্মে বৈকুণ্ঠ প্রাপ্ত হইবে”।

(সমীক্ষা) এ স্থলে বিচাৰ্য্য এই যে, জয় ও বিজয় নারায়ণের ভৃত্য। তাহাদের রক্ষা এবং সহয়তা করা নারায়ণের কর্তব্য। যদি বিনা অপরাধে কেহ কাহারও ভৃত্যকে যন্ত্রণা দেয়, সে তাহার ভৃত্যের দুর্দশা ঘটাইবে। জয়-বিজয়কে পুরস্কৃত করা এবং সনকাদিকে অধিক দণ্ড দান করা নারায়ণের কর্তব্য ছিল। কারণ সনকাদি ভিতরে প্রবেশ করিবার জন্য জিদ ধরিয়া ভৃত্যদিগের সহিত বিবাদ করিল কেন? তাহাদিগকে অভিশাপই বা দিল কেন? ভৃত্যদের পরিবর্তে সনকাদিকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করা নারায়ণের পক্ষে ন্যায়সঙ্গত কাৰ্য্য ছিল। নারায়ণ এরূপ অজ্ঞানের ন্যায় কাৰ্য্য করিলে

তাহার সেবক বৈষ্ণবদের দুর্দশা যতই অধিক হউক না কেন, তাহা অল্পই বলিতে হইবে।

অতঃপর জয় ও বিজয় হিরণ্যাক্ষ এবং হিরণ্যকশ্যপ রূপে জন্মগ্রহণ করে। হিরণ্যাক্ষ বরাহ কর্তৃক নিহত হয়। তাহার সম্বন্ধে এরূপ লিখিত আছে যে, সে পৃথিবীকে মাদুরে ন্যায় জড়াইয়া উপাধান করিয়া শয়ন করিয়াছিল। বিষ্ণু বরাহরূপ ধারণ করিয়া তাহার মস্তকের নিম্ন হইতে পৃথিবীকে মুখে করিয়া ধরিলেন। তখন হিরণ্যাক্ষ জাগিয়া উঠিল এবং উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ হইতে লাগিল। বরাহ হিরণ্যাক্ষকে বধ করিল।

(সমীক্ষা) যদি কেহ পোপদিগকে জিজ্ঞাসা করে, “পৃথিবী কি গোলাকার অথবা মাদুরের ন্যায়”? তাহারা কিছুই বলিতে পারিবে না। কারণ পৌরাণিকগণ ভূগোল বিদ্যার শত্রু। ভাল, যখন পৃথিবীতে জড়াইয়া উপাধান করা হইল, তখন সে কীসের উপর শয়ন করিয়াছিল? বরাহই বা কীসের উপর দিয়া দৌড়াইয়া আসিল? বরাহও পৃথিবীকে মুখে ধারণ করিল, কিন্তু উভয় কীসের উপরে দাঁড়াইয়া যুদ্ধ করিল? দাঁড়াইবার জন্য ত অন্য কোন স্থানই ছিল না। তবে তাহারা সম্ভবতঃ ভাগবতাদি পুরাণ রচয়িতা পোপের বুকের উপর দাঁড়াইয়া যুদ্ধ করিয়াছিল। কিন্তু পোপগণ তখন কীসের উপর শয়ন করিয়াছিল। কথাটা এইরূপ — “গল্পীর গৃহে গল্পী গিয়ে গল্প করে গেল” মিথ্যাবাদীর গৃহে মিথ্যাবাদী গল্পী আসিলে, গল্পের অভাব হয় কি?

বাকী রহিল “হিরণ্যকশ্যপ”। হিরণ্যকশ্যপের পুত্র প্রহ্লাদ। সে এক ভগবদ্ ভক্ত বালক। সে পিতৃকর্তৃক বিদ্যাশিক্ষার্থ পাঠশালায় প্রেরিত হইয়াছিল। প্রহ্লাদবিদ্যালয়ের অধ্যাপকদিগকে বলিত, “আমার তালপাতায় রাম রাম লিখিয়া দাও”। তাহার পিতা তাহা শুনিয়া তাহাকে বলিল, “তুই আমার শত্রুর ভজনা করিতেছি কেন?” বালক তাহা মানিল না। তখন তাহার পিতা তাহাকে বাঁধিয়া পর্বত হইতে ফেলিয়া দিল, কূপে নিক্ষেপ করিল কিন্তু তাহাতে তাহার কিছুই হইল না। হিরণ্যকশ্যপ একটি লৌহস্তম্ভ অগ্নিতে উত্তপ্ত করিয়া প্রহ্লাদকে বলিল, “যদি তোমাদের ইষ্টদেব “রাম” সত্য হয় তাহা হইলে এই স্তম্ভ ধরিলেও তুমি জ্বলিবে না।” প্রহ্লাদ উহা ধরিতে উদ্যত হইল। তখন তাহার মনে সংশয় উপস্থিত হইল, দগ্ধ না হইয়া সে রক্ষা পাইবে কিনা। নারায়ণ সেই স্তম্ভের উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পিপীলিকা শ্রেণী চালিত করিলেন। প্রহ্লাদ তাহাতে নিশ্চিত হইয়া স্তম্ভ ধরিল। স্তম্ভ বিদীর্ণ হইল। স্তম্ভের ভিতর হইতে নৃসিংহ আবির্ভূত হইয়া তাহার উদর বিদীর্ণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর নৃসিংহ প্রহ্লাদকে স্নেহের সহিত লেহন করিতে লাগিলেন। নৃসিংহ প্রহ্লাদকে বলিলেন, –“তুমি বর প্রার্থনা কর”। প্রহ্লাদ পিতার সঙ্গতি প্রার্থনা করিল। নৃসিংহ বরদান করিলেন, “তোমাদের একুশ পুরুষ সঙ্গতি লাভ করিল।”

(সমীক্ষা) এখন দেখ, এও এক গল্পীর ভাই গল্পী! যদি ভাগবতের কোন শ্রোতা অথবা পাঠককে ধরিয়া পাহাড়ের উপর হইতে নিক্ষেপ করা হয়, তবে কেহই তাহাকে রক্ষা করিতে পারিবে না, সে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া মরিবেই। প্রহ্লাদের পিতা তাহাকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য পাঠাইয়া কি কোন মন্দ। কর্ম করিয়াছিল? কিন্তু প্রহ্লাদ এমনই মুখ, সে অধ্যয়ন পরিত্যাগ করিয়া বৈরাগী হইতে চাহিয়াছিল।

প্রজ্জ্বলিত স্তম্ভে পিপীলিকা বিচরণ করিতেছিল এবং প্রহ্লাদ স্তম্ভ স্পর্শ করিয়াও দগ্ধ হইল না। যে ব্যক্তি এ সকল কথা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করে, তাহাকেও উত্তপ্ত স্তম্ভের সংলগ্ন করা উচিত। যদি সে দগ্ধ না হয়, তবে মানিতে হইবে যে, প্রহ্লাদ দগ্ধ হয় নাই। অধিকন্তু, নৃসিংহও জ্বলিয়া গেল। না কেন?

পূর্বে সনকাদিকে বর দেওয়া হইয়াছিল যে, তৃতীয় জন্মের পর সে বৈকুণ্ঠে আসিবে। তোমাদের নারায়ণ কি তাহা ভূলিয়া গিয়াছিলেন? ভাগবতের মতে ব্রহ্মা, প্রজাপতি, কশ্যপ, হিরণ্যাক্ষ এবং হিরণ্যকশ্যপ চতুর্থ পুরুষের অন্তর্গত। প্রহ্লাদের একুশ পুরুষও হয় নাই, অথচ একুশ পুরুষ সদ্গতি করিয়াছে বলা কত বড় ভুল! আবার সেই হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশ্যপ, রাবণ ও কুম্ভকর্ণ এবং পরে। শিশুপাল ও দন্তবক্র রূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। তাহা হইলে নৃসিংহের বর কোথায় উড়িয়া গেল? প্রমাদগ্রস্ত লোকেরাই প্রমাদপূর্ণ কথা বলে, শোনে এবং বিশ্বাস করে। যাঁহারা বিদ্বান্ তাঁহারা কখনও সেরূপ করেন না।

পূতনা ও অক্রুর সম্বন্ধে দেখুন যে — রথেন বায়ুবেগেন জগাম গোকুলং প্রতি ॥ (ভাস্ক০ পূ০অ৩৮। শ্লোক ২৪)।

অক্রুর কংস কর্তৃক প্রেরিত হইয়া সূর্যোদয় হইতে বায়ুবেগবিশিষ্ট অশ্বযুক্ত রথে যাত্রা করিলেন এবং সূর্যাস্তকালে চারি মাইল দূরবর্তী গোকুলে উপনীত হইলেন। অশ্বগুলি সম্ভবতঃ ভাগবত-রচিয়তাকে প্রদক্ষিণ করিতেছিল, অথবা অক্রুর ও অশ্বচালক পথ ভুলিয়া ভাগবত-রচয়িতার গৃহে আসিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল?

লিখিত আছে যে, পূতনার শরীর ছিল ছয় ক্রোশ বিস্তৃত এবং অতিশয় দীর্ঘ। শ্রীকৃষ্ণ মথুরা ও গোকুলের মধ্যস্থলে পূতনাকে বধ করিয়া নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। যদি তাহাই হইত তবে মথুরা এবং গোকুল উভয়ই ধসিয়া গিয়া এই পোপের বাড়ীও চাপা পড়িত।

অজামীলের কথাও আবোল-তাবোল লিখিত হইয়াছে। তিনি নারদের উপদেশে তাঁহার পুত্রের নাম নারায়ণ’ রাখিয়াছিলেন। তিনি মৃত্যুকালে পুত্রকে নাম ধরিয়া ডাকেন।ইত্যবসরেনারায়ণ লাফাইয়া গিয়া উপস্থিত হইলেন। নারায়ণ কি তাহার মনের ভাব জানিতেন না যে, তিনি তাঁহার পুত্রকে ডাকিতেছিলেন, তাঁহাকে নহে? যদি এইরূপই নাম মাহাত্ম হয় তবে আজকালও যাঁহারা নারায়ণের নাম স্মরণ করেন, নারায়ণ তাহাদের দুঃখ মোচনের জন্য আগমন করেন না কেন? আর ইহা সত্য হইলে, কারাগারে কয়েদিগণ নারায়ণ’ শব্দ উচ্চারণ করিয়া মুক্তিপ্রাপ্ত হয় না কেন?

এইরূপ সুমেরু পর্বতের পরিমাণও জ্যোতিষশাস্ত্রবিরুদ্ধ লিখিত হইয়াছে। প্রিয়ব্রত রাজার রথচক্রের রেখা দ্বারা সমুদ্র’ হইয়াছে। পৃথিবীর আয়তন ঊনপঞ্চাশ কোটি যোজন ইত্যাদি। এত মিথ্যা গাল-গল্প ভাগবতে লিখিত আছে যে, তাহারা সীমা-পরিসীমা নাই।

এই ভাগবত বোবদেব-রচিত। তাঁহার ভ্রাতা জয়দেব ‘গীত-গোবিন্দ রচনা করিয়াছিলেন –‘আমি শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ রচনা করিয়াছি। সেই লিপির তিনটি পাতা আমার নিকটে ছিল। তন্মধ্যে একটি পাতা হারাইয়া গিয়াছে। সেই পাতায় লিখিত শ্লোকগুলির অভিপ্রায় লইয়া আমি নিম্নলিখিত দুইটি শ্লোক রচনা করিয়াছি। যিনি দেখিতে ইচ্ছা করেন, তিনি হিমাদ্রি’ গ্রন্থে দেখিয়া লইবেন।

‘হিমাদ্রেঃ সচিবস্যার্থে সূচনা ক্রিয়তেধুনা। স্কন্ধ্যাধ্যায়কথানাংচয়ৎপ্রমাণং সমাসতঃ ॥১॥ শ্রীমদ্ভাগবতং নাম পুরাণংচ ময়েরিতম্ ॥ বিদুষা বোবদেবেন শ্রীকৃষ্ণস্য যশোন্বিতম ॥ ২ ॥

নষ্ট পাতায় এই মর্মের শ্লোক ছিল যে, রাজসচিব হিমাদ্রি ‘বোবদেব’ পণ্ডিতকে বলিয়াছিলেন, ‘আপনার রচিত সম্পূর্ণ শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করিবার অবকাশ আমার নাই। অতএব আপনি শ্লোকবদ্ধ সংক্ষিপ্ত সূচীপত্র রচনা করেন, যেন আমি তাহা পাঠ করিয়া শ্রীমদ্ভাগবতের বিষয়ে সংক্ষেপে জানিতে পারি। তদনুসারে ‘বোবদেব’ নিম্নলিখিত সূচীপত্র রচনা করেন। তন্মধ্যে দশম শ্লোকটী, পূর্বোক্ত নষ্ট পাতার হারাইয়া গিয়াছে সুতরাং একাদশ শ্লোক হইতে লিখিত আছে। নিম্নলিখিত শ্লোকগুলি ‘বোবদেব’ রচিত —

বোধয়ন্তীতিহি প্ৰাহুঃ শ্রীমদ্ভাগবতং পুনঃ। পঞ্চ প্রশ্নাঃ শৌনকস্য সূতস্যাত্রোত্তরং ত্রি৷১১ ॥ প্রশ্নাবতারয়োশ্চৈব ব্যাসস্যানিবৃতিঃকৃৎ ॥ নারদস্যাত্ৰ হেতূক্তি: প্রতীত্যর্থং স্বজন্ম চ ॥ ১২ ॥ সুপ্তঘ্নং দ্রোণ্যভিভবস্তদাৎ পাণ্ডবা বনম্। ভীষ্মস্য স্বপদপ্রাপ্তিঃ কৃষ্ণস্য দ্বারিকাগমঃ ॥১৩ ॥ শ্রোতুঃ পরীক্ষিত জন্ম ধৃতরাষ্ট্রস্য নির্গমঃ। কৃষ্ণমত্যাগসূচা ততঃ পার্থমহাপথঃ ॥১৪ ॥ ইত্যষ্টাদশভিঃ পাদৈরধ্যায়ৰ্থঃ ক্ৰমাৎস্মৃতঃ। স্বপর প্রতিবন্ধানং স্ফীতং রাজ্যং জহৌ নৃপঃ ॥১৫ ॥ ইতি বৈ রাজ্ঞো দাৰ্চোক্তৌ প্রোক্তা দ্রৌণিজয়াদয়ঃ ॥১৬ ৷ ইতি প্রথমঃ স্বন্ধঃ ॥১ ॥

‘বোবদেব’ পণ্ডিত এইরূপ দ্বাদশ স্কন্ধের সূচীপত্র রচনা করিয়া সচিব হিমাদ্রিকে দিয়াছিলেন। যিনি বিস্তৃতরূপে দেখিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহার পক্ষে বোবদেব রচিত হিমাদ্রি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।

এইরূপে অন্যান্য পুরাণের লীলা-খেলাও বুঝিতে হইবে। তবে কোনটিতে অল্প, কোনটিতে অধিক আছে।

দেখ! মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের ইতিহাস অতি উত্তম। তাঁহার গুণ, কর্ম, স্বভাব ও চরিত্র আপ্তপুরুষোচিত। শ্রীকৃষ্ণ জীবনে কোন অধর্ম আচরণ করিয়াছিলেন, মহাভারতে এরূপ কোথাও লেখা নাই।

কিন্তু এই ভাগবত-রচয়িতা তাঁহার সম্বন্ধে মনগড়া অনুচিত দোষারোপ করিয়াছেন। দুগ্ধ-দধি-মাখন প্রভৃতি অপহরণ; কুজদাসীর সহিত সমাগম; পরস্ত্রীদিগের সহিত রাসলীলা, ক্রীড়া ইত্যাদি মিথ্যা দোষসমূহ শ্রীকৃষ্ণে আরোপ করা হইয়াছে। ভিন্নমতাবলম্বীগণ এসকল পাঠ করিয়া, শুনিয়া, অন্যকে পাঠ করাইয়া ও শুনাইয়া শ্রীকৃষ্ণের নানাপ্রকার নিন্দা করিয়া থাকেন। এই ভাগবত না থাকিলে শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় মহাত্মাদিগের নিন্দা কীরূপে হইতে পারিত?

শিবপুরাণের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের বর্ণনা আছে। উহার বর্ণনা সর্বৰ্থা অসম্ভব। কিন্তু নাম রাখা হইয়াছে জ্যোতির্লিঙ্গ। বাস্তবিক পক্ষে ঐ সকল লিঙ্গে জ্যোতির লেশমাত্রও নাই। রাত্রিকালে প্রদীপ ব্যতীত অন্ধকারে লিঙ্গ দেখাও যায় না। এসকল পোপ মহাশয়ের লীলা।

প্রশ্ন –যখন বেদপাঠের সামর্থ্য রহিল না, তখন স্মৃতি, যখন স্মৃতি-পাঠের বুদ্ধি রহিল না। তখন শাস্ত্র, যখন শাস্ত্র পাঠের সামর্থ্য রহিল না তখন কেবল স্ত্রী শূদ্রাদির জন্য পুরাণ রচিত হইল। কারণ ইহাদের বেদপাঠ এবং বেদ শ্রবণ করিবার অধিকার নাই।

উত্তর –ইহা মিথ্যা কথা। কারণ অধ্যয়ন-অধ্যাপন দ্বারাই সামর্থ্য জন্মে এবং বেদপাঠ ও বেদ শ্রবণ করিবার অধিকার সকলের আছে। দেখ! গাগী প্রভৃতি নারীরা বেদাধ্যয়ন করিতেন। ছান্দোগ্যে বর্ণিত আছে যে, শূদ্র জনশ্রুতিও রৈক্যমুনির নিকট বেদাধ্যয়ন করিয়াছিলেন। যজুর্বেদের ষড় বিংশ অধ্যায়ের দ্বিতীয় মন্ত্রে স্পষ্টরূপে লিখিত আছে যে, মনুষ্যমাত্রেরই বেদপাঠ এবং বেদশ্রবণ করিবার অধিকার আছে। পুনঃ যাঁহারা ঐরূপ মিথ্যাগ্রন্থ রচনা করিয়া মনুষ্যদিগকে সত্যাগ্রন্থপাঠে বিরত করে এবং তাহাদিগকে ভ্ৰমজাল জড়িত করিয়া স্বার্থসিদ্ধি করে, তাহারা মহাপাপী নহে কেন?

দেখ! কেমন সব গ্রহের ফের রচনা করিয়া বিদ্যাহীন মনুষ্যদিগকে গ্রাস করিয়াছে –‘আ কৃষ্ণেন রজ০॥১॥ সূর্যের মন্ত্র।

ইমং দেবাৎ অসপত্ন সুবধ্ব ২ ॥ চন্দ্রের মন্ত্র। অগ্নিমুৰ্ধা দিবঃ ককুৎপতিঃ০॥৩॥ মঙ্গলের মন্ত্র। ‘উদ্বুধ্যস্বাগ্নে’ ॥৪॥ বুধের মন্ত্র। বৃহম্পত্যে অতিয়দয়ো’ ॥ ৫ ॥ বৃহস্পতির মন্ত্র। ‘শুক্রমন্ধসঃo ॥ ৬ ॥ শুক্রের মন্ত্র। শিন্নো দেবীরভিষ্টয়’ ॥ ৭ ॥ শনির মন্ত্র। কয়া নশ্চিত্র আ ভূব ॥৮ ॥ রাহুর মন্ত্র। ‘কেতুং কৃথন্নকেতবে ॥৯॥ ইহাকে কেতুর কণ্ডিকা বলে।

কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে (আকৃষ্ণে০) ইহা সূৰ্য্য এবং পৃথিবীর আকর্ষণসূচক ॥ ১ ॥ দ্বিতীয় মন্ত্র– রাজগুণ বিধায়ক ॥ ২ ॥ তৃতীয় মন্ত্র –অগ্নিসূচক ॥৩॥ চতুর্থমন্ত্র –যজমানবাচক ॥৪॥ পঞ্চম মন্ত্র –বিদ্বানদের বাচক ॥ ৫ ॥ ষষ্ঠ মন্ত্র –বীৰ্য্য এবং অন্ন বাচক ॥ ৬ ॥ সপ্তম মন্ত্র — জল, প্রাণ এবং পরমেশ্বর বাচক ॥৭ ॥ অষ্টম মন্ত্র –মিত্র বাচক ॥ ৮ ॥ নবম মন্ত্র — জ্ঞান গ্রহণ-বিধায়ক কিন্তু । এসব গ্রহ-বাচক নহে৷৯ ॥ অর্থ না জানিয়া লোকেরা ভ্রমজালে পতিত ইয়াছে।

প্রশ্ন –গ্রহের ফল হয় কিনা?

উত্তর –পোপ লীলায় যেরূপ বর্ণিত আছে, সে-রূপ নহে কিন্তু সূৰ্য্য ও চন্দ্রের কিরণ দ্বারা উষ্ণতা ও শীতলতা অথবা ঋতুবৎ কাল-চক্রের সম্বন্ধ বশতঃ ইহারা প্রকৃতির অনুকূলে কিংবা প্রতিকূলে সুখ-দুঃখের নিমিত্ত হইয়া থাকে, পরন্তু পোপলীলা-কারীরা বলে –“শোন শ্ৰেষ্ঠী। যজমানগণ। আজ তোমাদের অষ্টমে চন্দ্র এবং সূৰ্য্যাদির ক্র গ্রহ ঘরে আসিয়াছে। আড়াই বৎসরের জন্য শনৈশ্চর তোমার পায়ে আশ্রয় করিয়াছে। তোমার খুব বিঘ্ন ঘটিবে। এই গ্রহ বাড়ী-ঘর ছাড়াইয়া বিদেশে ভ্রমণ করাইবে। কিন্তু যদি তুমি গ্রহের দান, জপ, পাঠ এবং পূজা করাও,তবে দুঃখ হইতে রক্ষা পাইবে।”ইহাদিগকে বলা উচিত,– “শোন, পোপমহাশয়! তোমার সহিত গ্রহের কী সম্বন্ধ? গ্ৰহ কী বস্তু”?

পোপ মহাশয়–

দৈবাধীনং জগৎ সর্বং মন্ত্রাধীনাশ্চ দেবতাঃ। তেমন্ত্রা ব্রাহ্মণাধীনাস্তম্মাব্রাহ্মণদেবত ॥

দেখ! কেমন প্রমাণ রহিয়াছে। সমস্ত দেবতা মন্ত্রের অধীন। মন্ত্র সমূহ ব্রাহ্মণের অধীন। এই জন্য ব্রাহ্মণকে ‘দেবতা’ বলে। অতএব মন্ত্রবলে দেবতাকে আবাহন ও প্রসন্ন করিয়া কাৰ্যসিদ্ধি করাইবার অধিকার আমাদেরই আছে। মন্ত্র-শক্তি না থাকিলে তোমাদের ন্যায় নাস্তিকেরা আমাদিগের সংসারে থাকিতেই দিত না।

সত্যবাদী –তবে কি চোর, দস্যু এবং কুকর্মিগণও তোমাদের দেবতাদিগের অধীন? তাহা হইলে তো দেবতারাই তাহাদের দ্বারা দুষ্ট কর্ম করাইয়া থাকিবেন, যদি তাহাই হয়, তোমাদের দেবতা ও রাক্ষসদের মধ্যে কোন প্রভেদ রহিল না। যদি তোমরা তোমাদের অধীনস্থ মন্ত্রবলে যাহা ইচ্ছা তাহাই করাইতে পার, তাহা হইলে তো দেবতারাই দুষ্ট কর্ম করাইয়া থাকিবেন, যদি তাহাই হয় তোমাদের দেবতা ও রাক্ষসদের মধ্যে কোন প্রভেদ রহিল না। যদি তোমরা তোমাদের অধীনস্থ মন্ত্রবলে যাহা ইচ্ছা তাহাইকরাইতেপার, তাহাহইলে সেইসবমন্ত্রবলে দেবতাদিগকেবশীভূত করিয়া রাজা-মহারাজের ধনসম্পত্তি উঠাইয়া নিজের গৃহে স্থাপন করিয়া আনন্দ ভোগ কর না কেন? শনৈশ্চর প্রভৃতির তৈলাদি ছায়া দান গ্রহণ করিবার জন্য গৃহে গৃহে ঘুরিয়া মর কেন? আর যাহাকে তোমরা কুবের বলিয়া মানো, তাহাকে বশীভূত করিয়া ইচ্ছামত যত পারো ধন লও। হতভাগ্য দরিদ্রদিগকে লুণ্ঠন করিতেছ কেন?

যদি তোমাদিগকে দান করিলে গ্রহ প্রসন্ন হয় এবং না করিলে অপ্রসন্ন হয়, তবে সুৰ্য্যাদি গ্রহের প্রসন্নতা এবং অপ্রসন্নতা আমাদিগকে প্রত্যক্ষ দেখাও। যদি একজনের অষ্টম স্থানে চন্দ্র-সূৰ্য্য এবং অপরের তৃতীয় স্থানে থাকে, তবে তাহাদিগকে জৈষ্ঠমাসে নগ্নপদে উত্তপ্ত ভূমির উপর চলিতে দেওয়া হউক। যাহার প্রতি গ্রহ প্রসন্ন তাহার চরণ ও শরীর দগ্ধ না হওয়া, এবং যাহার প্রতি ক্রুদ্ধ তাহার দগ্ধ হওয়া উচিত। তাহাদের গায়ের কাপড় খুলিয়া পৌষমাসে পূর্ণিমার সমস্ত রাত্রি তাহাদিগকে মাঠে রাখা হউক। তাহাতে যদি শীতানুভব হয় আর অপরের না হয়, তাহা হইলে জানা যাইবে যে, গ্রহ নূর কিংবা সৌম্য দৃষ্টি যুক্ত।

গ্রহ কি তোমাদের কুটুম্ব যে, তোমাদের ডাক কিংবা টেলিগ্রামে তাহাদের সহিত যোগাযোগ রক্ষা করিয়া চলে? কিংবা তাহাদের নিকট যাতায়াত কর? অথবা তাহারা কি তোমাদের নিকট যাতায়াত করে? তোমাদের মধ্যে মন্ত্রশক্তি থাকিলে স্বয়ং রাজ্য অথবা ধনাঢ্য হও না কেন? কিংবা শত্ৰুদিগকে বশ করা না কেন?

যাহারা বেদ ও ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন করে না, বেদের বিরুদ্ধে পোপলীলা প্রচলিত করে, তাহারাই ‘নাস্তিক’। তোমাদিগকে গ্রহ-দান দিবার পরিবর্তে যাহার উপর গ্রহদৃষ্টি আছে, সেই যদি তাহা ভোগ করে, তবে তোমাদের চিন্তার বিষয় কী আছে? যদি বল না, তাহাদিগকেই দান করিলে গ্রহ প্রসন্ন হয়, অপরকে দান করিলে হয় না, তবে কি তোমরাই গ্রহগণের ঠিকা লইয়াছ? যদি লইয়া থাক তবে সূৰ্য্যাদিকে স্বগৃহে আবাহন করিয়া পুড়িয়া মর।

ইহাই সত্য যে, সূৰ্য্যাদি লোক জড় পদার্থ। তাহারা কাহাকেও সুখ বা দুঃখ দিবার চেষ্টা করে না। কিন্তু গ্রহদানোপজীবী তোমরা যত জন আছ তোমরা সকলেই মূর্তিমান গ্রহ। কারণ ‘গ্রহ’ শব্দের অর্থ তোমাদের উপরেই খাটে। “য়ে গৃত্নি তে গ্রহাঃ” যাহারা গ্রহণ করে, তাহাদের নাম ‘গ্রহ। যতক্ষণ তোমাদের চরণ– রাজা, ধনাঢ্য, বণিক এবং দরিদ্রের নিকট না যায়, ততক্ষণ পৰ্য্যন্ত নবগ্রহের কথা কাহারও স্মরণ হয় না। যখন তোমরা সাক্ষাৎ মূর্তিমান সূৰ্য্য এবং শনৈশ্চরাদি দূর গ্রহরূপে তাহাদিগকে আক্রমণ কর তখন কিছু গ্রহণ না করিয়া তোমরা তাহাদিগকে ছাড় না ॥ যাহারা তোমাদের কবলে পতিত না হয় তাহাদিগকে তোমরা নাস্তিক বলিয়া নিন্দা করিতে থাক।

পোপ –দেখুন মহাশয়! জ্যোতিষের ফল প্রত্যক্ষ। আকাশে অবস্থানকারী সূৰ্য্য, চন্দ্র, রাহু এবং কেতুর সংযোগরূপ গ্রহণ সম্বন্ধে জ্যোতিষ পূর্বেই সূচনা দেয়। ইহা যেরূপ প্রত্যক্ষ সেইরূপ গ্রহেরও ফল প্রত্যক্ষ। দেখুন। ধনাঢ্য, দরিদ্র, রাজা, ভিক্ষুক, সুখী এবং দুঃখী হওয়া গ্রহেরই ফল।

সত্যবাদী –গ্রহণরূপে যে প্রত্যক্ষ ফলের কথা বলিতেছ উহা গণিতবিদ্যার ফল, ফলিতের। নহে। গণিত বিদ্যা সত্য আর ফলিত বিদ্যা স্বাভাবিক সম্বন্ধজাত ফলব্যতীত মিথ্যা। যেরূপ অনুলোম এবং প্রতিলোম ভ্রমণকারী পৃথিবী ও চন্দ্রের সম্বন্ধে গণিতের সাহায্যে স্পষ্ট জানা যায় যে, অমুক সময়ে, অমুক দেশে এবং অমুক অবয়বে সূৰ্য্য অথবা চন্দ্রগ্রহণ হইবে, যথা—

ছাদয়ত্যৰ্কমিন্দুর্বিধুং ভূমিভাঃ ॥ ইহা সিদ্ধান্তশিরোমণির’ বচন ॥

“সূর্যসিদ্ধান্ত” ইত্যাদিতে ও এরূপ আছে–যখন সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে চন্দ্রমা আসে তখন। ‘সূর্যগ্রহণ’আর যখন সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে পৃথিবী আসে তখন ‘চন্দ্রগ্রহণ’ হইয়া থাকে অর্থাৎ চন্দ্রমার ছায়া পৃথিবীর উপর এবং পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রমার উপর পতিত হয়। সূৰ্য্য জ্যোতির্ময়, সুতরাং সূর্যের ছায়া কাহারও উপর পতিত হয় না। কিন্তু যেমন প্রকাশমান সূৰ্য্য অথবা প্রদীপ হইতে দেহাদির ছায়া বিপরীত দিকে পতিত হয় তদ্রূপ গ্রহণ সম্বন্ধে বুঝিতে হইবে।

মনুষ্যগণ স্ব স্ব কর্মানুসারে ধনাঢ্য, দরিদ্র, রাজা, প্রজা, এবং ভিক্ষুক হইয়া থাকে, গ্রহের ফেরে নহে। বহু জ্যোতিষী গ্রহ সম্বন্ধীয় গণিত বিদ্যা অনুসারে স্ব স্ব পুত্রকন্যার বিবাহ দেয় তবুও তাহাদের মধ্যে ব্যতিক্রম হইয়া থাকে। তাহাদের মধ্যে বিধবা এবং মৃতদার পুরুষও দৃষ্ট হয়। যদি বল সত্যই হয়। তবে এইরূপ হইবে কেন? অতএব কর্মের গতিই সত্য, গ্রহের গতি সুখ ও দুঃখ ভোগের কারণ নহে। ভাবিয়া দেখ, গ্রহ আকাশে অবস্থিত, পৃথিবীও আকাশে বহুদূরে অবস্থিত। তাহাদের সহিত কর্তা ও কর্মের কোন সাক্ষাৎ নাই। জীব কর্মকর্তা এবং কর্মের ফলভোক্তা। পরমাত্মা তাহাকে কর্ম ভোগ করান।

তোমরা যদি গ্রহ ফল স্বীকার কর, তবে ইহার উত্তর দাও–”যে ক্ষণে একজন মনুষ্যের জন্ম হয়, সেই ক্ষণটিকে ধ্ৰুবাত্ৰুটি মানিয়া তোমরা জন্ম পত্র রচনা কর, সে ক্ষণে পৃথিবীতে অন্য কাহারও জন্ম। হয় হয় কিনা। যদি বল ‘না’হয় না; তবে মিথ্যা বলা হয়। যদি বল হয়’তবে একজন চক্রবর্তীরাজরূপে পৃথিবীতে দৃষ্ট হয়, অপর একজন সেরূপ হয় না কেন? অবশ্য তোমরা ইহা বলিতে পার যে, ইহা । তোমাদের উদর পূর্ণ করিবার লীলা খেলা মাত্র, তাহা হইলে কেহ হয়তো স্বীকার করিয়া লইবে।

প্রশ্ন –গরুড়পুরাণও কি মিথ্যা?

উত্তর –হ্যাঁ, মিথ্যা?

প্রশ্ন –তবে মৃত জীবের কী প্রকার গতি হইয়া থাকে?

উত্তর –তাহার যেমন কর্ম।

প্রশ্ন –যমরাজ রাজা, তাহার মন্ত্রী চিত্রগুপ্ত। কাজলবর্ণ পর্বতাকার শ্রীরধারী ভয়ঙ্কর তাহার অনুচরগণ জীবদিগকে লইয়া যায় এবং তাহাদিগের পাপ-পুণ্যানুসারে নরকে নিক্ষেপ করে, অথবা তাহারা স্বর্গে লইয়া যায়। জীবগণ যাহাতে বৈতরণী নদী পার হইতে পারে তজ্জন্য দানপুণ্য, শ্রাদ্ধ-তর্পণ এবং গোদান প্রভৃতি করা হইয়া থাকে। এ সকল মিথ্যা কীরূপে হইতে পারে?

উত্তর –এ সকল পোপালীলার আষাঢ়ে গল্প। অন্যান্য স্থানের যে সকল জীব যমলোকে যায়, যমরাজ এবং চিত্রগুপ্ত তাহাদের ন্যায় বিচার করিয়া থাকেন। কিন্তু যদি যমলোকবাসী জীবগণ পাপ-কর্ম করে, তাহা হইলে অন্য যমলোকের অস্তিত্ব স্বীকার করিতে হইবে। সেই স্থানের ন্যায়াধীশ তাহাদের প্রতি ন্যায় বিচার করিবেন।

যমদূতের শরীর পর্বতাকার হইলে দৃষ্টিগোচর হয় না কেন? পৰ্বাতাকার হইলে মৃত জীবদিগকে লইয়া যাইবার সময় তাহাদের একটি অঙ্গুলিও দ্বারের মধ্যে দিয়া যাইতে পারে না। তাহারা পথ এবং গলির মধ্যে আটকাইয়া যায় না কেন? যদি বল যে, তাহারা সূক্ষ্ম দেহ ধারণ করে, তবে পূর্বের পর্বতাকার শরীরে প্রকাণ্ড অস্থিগুলি পোপ মহাশয় নিজের গৃহ ব্যতীত অন্য কোথায় রাখিবেন? বনে আগুন লাগিলে পিপীলিকাদি জীব বিনষ্ট হয়। তাহাদিগকে ধরিবার জন্য অসংখ্য যমদূত উপস্থিত হইলে, সে স্থানে তখন অন্ধকার হওয়া উচিত। যখন জীবগণকে ধরিবার জন্য তাহারা সকলে ধাবমান হইবে তখন একের উপর অন্যের ধাক্কা লাগিবে। তাহাদের প্রকাণ্ড অবয়বগুলি ভূপৃষ্ঠে গঠিত বিশাল পর্বতশিখরের ন্যায় গরুড় পুরাণের পাঠক ও শ্রোতাদের প্রাঙ্গণে গিয়া পড়িবে। তাহারা চাপা পড়িয়া মরিবে অথবা তাহাদের গৃহদ্বার এবং যাতায়াতের পথ অবরুদ্ধ হইয়া যাইবে। তখন তাহারা কীরূপে বহির্গত হইয়া চলাফেরা করিতে সমর্থ হইবে;

শ্রাদ্ধ, তর্পণ, পিণ্ডদান মৃতজীবদিগের নিকট ত সে সমস্ত দ্রব্য পৌঁছায় না; কিন্তু মৃতকদিগের প্রতিনিধি পোপ মহাশয়ের গৃহে, উদরে এবং হস্তে সেগুলি গিয়া পৌঁছায়। বৈতরণীতে গাভী উপস্থিত না হইলে মৃতক কাহার পুচ্ছ ধরিয়া পার হইবে? মৃতকের হস্ত ত এখানেই দগ্ধ অথবা প্রোথিত করা হইয়াছে। তাহা হইলে সেই মৃতক গো-পুচ্ছ ধরিবে কীরূপে? একটি উপযুক্ত দৃষ্টান্ত। আছে—

এক ছিল জাঠ। তাহার গৃহে ছিল একটি অতি উত্তম গাভী। গাভীটি প্রত্যহ কুড়ি সের দুগ্ধ দিত। তাহার দুগ্ধ খুবই সুস্বাদু। পোপ মহাশয়ও সেই দুগ্ধ কখনও কখনও পান করিতেন। জাঠের পুরোহিত ভাবিতেছিল, “জাঠের পিতার মৃত্যুকালে এই গাভীটি সংকল্প করাইয়া গ্রহণ করিব।” দৈবযোগে কয়েক দিনের মধ্যে জাঠের পিতার মৃত্যুকাল উপস্থিত হইলে তাহার বাক্‌রোধ হইল। তখন তাহাকে পালঙ্ক হইতে ভূমিতে নামান হইল। পোপ জাঠকে ডাকিয়া বলিল, –“যজমান! এখন তুমি ইহার হাত দিয়া গোদান করাও।” জাঠ পিতার হস্তে দশটি টাকা রাখিয়া বলিল, –“সংঙ্কল্প বাক্য পাঠ করুন।” পোপ বলিলেন, –“বাঃ বাঃ। পিতা কি বার বার মরে? এ সময় একটি অল্পবয়সী, সর্বৰ্থা উৎকৃষ্ট, দুগ্ধবতী সাক্ষাৎ গাভী আনয়ন কর। এইরূপ গাভীই দান করান উচিত।”

জাঠ মহাশয় –“আমার নিকট তো একটি মাত্র গাভী আছে। সেইগাভীটি না হইলে আমার পুত্রকন্যাদের নির্বাহ হইবে না। অতএব সেই গাভীটি দিব না। এই কুড়িটি টাকা লইয়া সঙ্কল্পবাক্য পাঠ করুন। এই টাকায় অন্য একটি দুগ্ধবতী গাভী ক্রয় করিবেন।”

পোপ মহাশয় –“বাহবা, বাহবা! তুমি কি তোমার পিতা অপেক্ষা গাভীকেই বড় মনে করিতেছ? তুমি কি তোমার পিতাকে বৈতরণী নদীতে ডুবাইয়া কষ্ট দিতে ইচ্ছা কর? তুমিতো বেশ সুপুত্র দেখিতেছি।”

তখন জাঠের কুটুম্বগণও পোপের পক্ষ গ্রহণ করিল। কারণ পোপ তাহাদিগকে পূর্বেই বিভ্রান্ত করিয়া রাখিয়াছিল এবং সেই সময়ে তাহাদের সকলকেও ইঙ্গিত করিল। সকলে মিলিয়া জিদ ধরিলে অবশেষে গাভীটি পোপকেই দান করা হইল। সে সময় জাঠ কিছুই বলিল না। তাহার পিতার মৃত্যু হইল। পোপ বৎস সহিত গাভীটি এবং দুগ্ধদোহন পাত্রটি লইয়া স্বগৃহে প্রস্থান করিল। সে পরে গাভী এবং দুগ্ধপাত্র গৃহে রাখিয়া পুনরায় জাঠের গৃহে উপস্থিত হইয়া মৃতকের সহিত শ্মশান ভূমিতে গমন করিয়া দাহকর্ম করাইল। সে স্থানে সে কিঞ্চিৎ পোপলীলা চালাইল। পরে দশগাত্র এবং সপিণ্ডকরণ প্রভৃতিতেও জাঠকে সে শোষণ করিল। মহাব্রাহ্মণগণও লুণ্ঠন করিল। পেটুকেরাও অনেক সামগ্রী উদরস্থ করিল। এইরূপে সকল কাৰ্য্য সমাপ্ত হইল। অপরদিকে জাঠ ‘এর তার বাড়ী হইতে দুগ্ধ চাহিয়া আনিয়া দিন যাপন করিতে লাগিল। চতুর্দশ দিবসের প্রাতঃ কালে সে পোপের গৃহে উপস্থিত হইয়া দেখিল যে, গাভী দোহন করিয়া দুগ্ধপাত্র পূর্ণ করা। হইয়াছে। পোপ উঠিয়া যাইবার জন্য প্রস্তুত। ইত্যবসরে জাঠ সেখানে উপস্থিত। তাহাকে দেখিয়া পোপ বলিল ‘যজমান! এস, বসো।

জাঠ –পুরোহিত মহাশয়! আপনিই এদিকে আসুন।

পোপ –আচ্ছা, দুধ রাখিয়া আসি।

জাঠ –না, না দুগ্ধপাত্র লইয়া এদিকে আসুন। তখন দুর্ভাগা পোপ দুগ্ধপাত্র রাখিয়া বসিল।

জাঠ –আপনি তো বড় মিথ্যাবাদী?

পোপ –কী মিথ্যা কথা বলিয়াছি?

জাঠ –বলুন তো, আপনি গাভীটিকে লইয়াছিলেন কেন?

পোপ –তোমার পিতাকে বৈতরণী পার করাইবার জন্য।

জাঠ –আচ্ছা, তাহা হইলে আপনি গাভীটিকে বৈতরণী নদীর তীরে পাঠাইয়া দেন নাই কেন? আমিতো আপনার ভরসায় বসিয়া আছি; আর আপনি নিজের গৃহে গাভীটিকে বাঁধিয়া নিশ্চেষ্ট আছেন। না জানি, আমার পিতা বৈতরণীতে কতই হাবুডুবু খাইয়াছেন!

পোপ– না, না। এ দানের পুণ্য প্রভাবে সে স্থানে অন্য গাভী উৎপন্ন হইয়া তাহাকে পার। করিয়া দিয়া থাকিবে।

জাঠ –বৈতরণী এ স্থান হইতে কতদূর এবং কোন দিকে?

পোপ –আনুমানিক ত্রিশকোটি ক্রোশ দূরে। পৃথিবীর আয়তন ঊনপঞ্চাশ কোটি যোজন এবং ইহার দক্ষিণ নৈঋত কোণে বৈতরণী নদী।

জাঠ –যদি এতদূরে পত্র বা টেলিগ্রামে সংবাদ গিয়া থাকে এবং উত্তর আসিয়া থাকে যে, সে স্থানে পুণ্যপ্রভাবে গাভী উৎপন্ন হইয়া অমুকের পিতাকে পার করিয়াছে, তবে সেই পত্র বা টেলিগ্রাম দেখান।

পোপ –আমার নিকট গরুড়পুরাণ বচন ব্যতীত অন্য কোন ডাক বা টেলিগ্রাম নাই।

জাঠ –আমি কীরূপে বিশ্বাস করিব যে, এই গরুড় পুরাণ সত্য?

পোপ –সকলেই যেরূপ বিশ্বাস করে।

জাঠ –আপনাদের পূর্ব পুরুষেরা আপনাদের জীবিকার জন্য এই পুস্তক রচনা করিয়াছেন। কারণ, পিতার নিকট কেহই পুত্র অপেক্ষা অধিক প্রিয় নহে। যখন আমার পিতা আমার নিকট পত্র টেলিগ্রাম পাঠাইবেন, তখনই আমি বৈতরণীর তীরে গাভী পাঠাইব এবং তাহাকে পার করিয়া গাভীটিকে গৃহে আনয়ন করিব। তাহা হইলে আমার ও আমার পুত্রকন্যাদের দুগ্ধদান চলিতে থাকিবে। “দিন, দিন” এই বলিয়া জাঠ দুগ্ধপূর্ণ পাত্র, গাভী এবং বৎস লইয়া স্বগৃহে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইল।

পোপ –তুমি দান করিয়া পুনর্বার গ্রহণ করিতেছ, তোমার সর্বনাশ হইবে।

জাঠ –চুপ করুন, নতুবা তের দিন পর্যন্ত দুগ্ধভাবে আমি যে কষ্ট পাইয়াছি, তাহার ক্ষতিপূরণ লইব ॥

তখন পোপ নীরব রহিল। জাঠ, গাভী ও বৎস লইয়া স্বগৃহে পৌঁছিল। জাঠের ন্যায় লোক থাকিলে সংসারে পোপ লীলা চলিতে পারে না।

(পোপদিগের মতে) দশগাত্র পিন্ড দ্বারা দশাঙ্গ সপিণ্ড করিলে শরীরের সহিত জীবের মিলন হয়। তাহাতে অঙ্গুষ্ঠ মাত্র শরীর নির্মিত হইবার পর জীব যমলোকে গমন করে। যদি তাহাই হয়, তবে মৃত্যুকালে যমদূতের আগমন বৃথা। ত্রয়োদশাহের’ পরে আগমন করা উচিত। যদি শরীর নির্মিত হয়, তবে মৃত জীব নিজের স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয় এবং বন্ধুদিগের মোহে ফিরিয়া আসে না কেন?

প্রশ্ন –স্বর্গে কিছুই পাওয়া যায় না। এস্থানে যাহা দান করা হয়, তাহাই সে স্থানে পাওয়া যায়। অতএব সমস্তই দান করা উচিত।

উত্তর –তোমাদের সেই স্বর্গ অপেক্ষা ইহলোক শ্রেষ্ঠ। এস্থানে ধর্মশালা আছে, লোকে দান করে, বন্ধু ও জ্ঞাতিবর্গের নিকট হইতে প্রচুর নিমন্ত্রণ পাওয়া যায় এবং উত্তম-উত্তম পরিধেয় পাওয়া যায়! তোমাদের কথিত প্রমাণ অনুসারে স্বর্গে কিছুই পাওয়া যায় না। এরূপ নির্দয়, কৃপণ এবং কাঙ্গাল স্বর্গে পোপ যাইয়া বিনষ্ট হউক। সে স্থানে সজ্জনদের কী প্রয়োজন?

প্রশ্ন –যদি তোমাদের কথা মত যমলোক এবং যম না থেকে থাকে, তবে জীব মৃত্যুর পর কোথায় যায় এবং কেই বা তাহার সম্বন্ধে ন্যায় বিচার করে?

উত্তর– তোমার গরুড়পুরাণের কথা ও প্রমাণ নহে, বেদোক্ত বাক্যই প্রমাণ, যথা–

য়মেন বায়ুনা, সত্যরাজ। ইত্যাদি বেদবাক্য দ্বারা সিদ্ধ হইতেছে যে, বায়ুর নাম “যম”। জীব শরীর পরিত্যাগ করিয়া বায়ুর সহিত অন্তরীক্ষে থাকে। সত্যকর্তা, পক্ষপাতরহিত, পরমাত্মা “ধর্মরাজ”সকলের বিচারক।

প্রশ্ন –আপনার কথানুসারে সিদ্ধ হইতেছে, কাহাকেও গোদান করা এবং কোনরূপ দান-পুণ্য করা উচিত নহে।

উত্তর –তোমার এ কথা সর্বথা ব্যর্থ। কারণ, সু-পাত্রকে ও পরোপকারীকে পরহিতার্থে স্বর্ণ, রৌপ্য, হীরক,মুক্তা-মাণিক্য, অন্ন, জল, বাসস্থান এবং বস্ত্রাদি অবশ্য দান করা উচিত। কিন্তু কু-পাত্রকে কখনও ‘দান-পুণ্য’ করা উচিত নহে।

প্রশ্ন –কুপাত্র এবং সুপাত্রের লক্ষণ কী?

উত্তর– ছলনা-কপটতাযুক্ত স্বার্থপর, বিষয়াসক্ত, কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহযুক্ত, পরের অনিষ্টকারী লম্পট, মিথ্যাবাদী, বিদ্যাহীন, কুসঙ্গী ও অলস হওয়া; দাতার নিকট বারংবার প্রার্থনা করা ও ধর্ণা দেওয়া; দাতা দান না করিলেও জিদের বশতঃ যাঞ্চা করিতে থাকা; সন্তুষ্ট না হওয়া; যে দান করে না, তাহার নিন্দা করা ও তাহাকে অভিশাপ ও গালি দেওয়া, কোন ব্যক্তি অনেক বার সেবা করিয়া পুনরায় সেবা না করিলে তাহার শত্রু হওয়া; বাহিরে সাধুর বেশ ধরিয়া লোককে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করা; নিজের নিকট ধন থাকা সত্ত্বেও ‘আমার নিকট কিছুই নাই’বলা; সকলকে ফুসলাইয়া স্বার্থসিদ্ধি করা; দিবা-রাত্রি ভিক্ষারত থাকা; নিমন্ত্রিত হইলে ভাঙ-সিদ্ধি প্রভৃতি মাদকদ্রব্য যথেষ্ট পরিমাণে সেবন করিয়া অত্যধিক পরদ্রব্য ভোজন করা; উন্মত্ত, প্রমাদগ্রস্ত এবং সত্যামার্গ-বিরোধী হওয়া; স্বার্থ সাধনে অসত্য পথে চলা; শিষ্যদিগকে কেবল নিজেরই সেবা করিবার এবং অপর কোন যোগ্যব্যক্তির সেবা না করিবার উপদেশ দেওয়া, সদূবিদ্যাদি প্রবৃত্তির বিরোধী হওয়া; জাগতিক ব্যবহারে অর্থাৎ স্ত্রী-পুরুষ,মাতা, পিতা,সন্তান, রাজা-প্রজা এবং আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অপ্রীতি সৃষ্টি করা, এবং ‘সমস্তই মিথ্যা, জগৎও মিথ্যা? এইরূপ দুষ্ট উপদেশ দান করা ইত্যাদি কুপাত্রের লক্ষণ।

যাঁহারা ব্রহ্মচারী ও জিতেন্দ্রিয়; যাঁহারা বেদাদি বিদ্যার অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করেন; যাঁহারা সুশীল, সত্যবাদী, পরোপকারপ্রিয়, পুরুষকার সম্পন্ন, উদার, বিদ্যা ও ধর্মে নিরন্তর উন্নতিশীল, ধর্মাত্মা, শান্ত, নিন্দা-স্তুতিতে হর্ষ-শোক রহিত, নির্ভয়, উৎসাহী, যোগী, জ্ঞানী, যাঁহারা সৃষ্টিক্রম, বেদাজ্ঞা এবং গুণ-কর্ম-স্বভাবের অনুকূল আচরণ করেন। যাঁহারা ন্যায়নিষ্ঠ, পক্ষপাতরহিত, সত্যোপদেষ্টা, সত্যশাস্ত্রের অধ্যয়ন-অধ্যাপনাকারীদিগের পরীক্ষক। যাঁহারা প্রশ্ন সমূহের যথার্থ সমাধান করেন; যাঁহারা আত্মবৎ অপরেরও সুখ-দুঃখ এবং লাভ-হানি অনুভব করেন; যাঁহারা অবিদ্যাদি ক্লেশ, হঠকারিতা, দুরাগ্রহ এবং দম্ভরহিত; যাঁহারা অপমানকে অমৃতবৎ এবং সম্মানকে বিষবৎ মনে করেন। সন্তোষী= যাঁহারা সন্তুষ্ট অর্থাৎ যে-কেহ প্রীতির সহিত যাহা কিছু দান করে, তাহাতেই প্রসন্ন থাকেন। যাঁহারা বিপকালে একবার যাঞ্চা করিয়া প্রত্যাখ্যাত বা বজ্জিত হইলেও দুঃখিত বা কুচেষ্টা না করিয়া সে স্থান হইতে তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া তাহার নিন্দা করেন না।

সুখীজনের সহিত মিত্রতা, দুঃখীজনের প্রতি করুণা প্রদর্শন এবং পুণ্যাত্মাদিগের সহিত “আনন্দ” তথা পাপীদিগের প্রতি “উপেক্ষা”অর্থাৎ রাগ-দ্বেষ রহিত থাকা। সত্যমননকারী, সত্যবাদী, সত্যকারী অকপট, ঈৰ্য্যা-রাগ-দ্বেষরহিত, গম্ভীর প্রকৃতি, সজ্জন, ধর্মনিষ্ঠা ও সর্বথা দুরাচার রহিত থাকা; যাঁহারা নিজের শরীর,মন এবং ধনকে পরোপকারে নিয়োজিত করেন এবং পরের সুখের জন্য যিনি নিজের প্রাণ পৰ্য্যন্ত বিসর্জন দেন–এইরূপ শুভলক্ষণযুক্ত লোকদিগকেই ‘সুপাত্র বলে।

কিন্তু দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি আপকালে প্রাণীমাত্রেই অন্ন, জল, বস্ত্র, ঔষধ, পথ্য এবং স্থান পাইবার অধিকারী।

প্রশ্ন — দাতা কয় প্রকারের?

উত্তর –তিন প্রকারের উত্তম, মধ্যম ও অধম। যিনি দেশ-কাল-পাত্র বিবেচনা করিয়া সত্যবিদ্যা এবং ধর্মোন্নতিরূপ পরোপকারার্থ দান করেন, তিনি উত্তম দাতা’। যিনি কীৰ্ত্তি ও স্বার্থসাধনের জন্য দান করেন তিনি মধ্যম দাতা’। আর তিনিই নীচ দাতা’ যিনি নিজের অথবা পরের কোনও উপকার করিতে পারেন না কিন্তু বেশ্যাগমনাদি কাৰ্য্যে ভাড় এবং ভাটদিগকে দান করেন, দান করিবার সময় যিনি তিরস্কার এবং অপমানাদি কুচেষ্টাও করেন। যিনি সুপাত্র এবং কুপাত্রের মধ্যে পার্থক্য রাখেন না, কিন্তু “সকল অনুই টাকার ষাট সের” এইরূপ বলিয়া বিক্রেতাদিগের ন্যায় বিবাদ করেন; অপর দিকে ধর্মাত্মাকে কষ্ট দিয়া সুখী হইবার জন্য তিনি দান করেন; তিনি অধম দাতা’। যিনি পরীক্ষার পর বিদ্বান্ ও ধর্মাত্মাদিগকে সম্মান প্রদর্শন করেন তিনি উত্তম দাতা। যিনি পরীক্ষা করেন বা না করেন, কেবল আত্মপ্রশংসাৰ্থ দান করেন, তিনি মধ্যম দাতা। যিনি পরীক্ষা ব্যতীত অন্ধের ন্যায় নিষ্ফল দান করেন, তিনি নীচ দাতা।

প্রশ্ন –দানের ফল কি ইহলোকে ফলিয়া থাকে, অথবা পরলোকে?

উত্তর –সর্বত্র ফলিয়া থাকে।

প্রশ্ন –নিজে নিজেই ফলে, কিংবা কোনও ফলদাতা আছেন?

উত্তর –ফলদাতা পরমেশ্বর। যেমন কোনও দস্যু-তস্কর স্বয়ং কারাগারে যাইতে চাহে না। রাজা তাহাকে যাইতে বাধ্য করেন এবং ধর্মাত্মাদিগকে দস্যু-তস্করাদির হাত হইতে রক্ষা করিয়া সুখভোগ করান, সেইরূপ পরমাত্মা সকলকে পাপপুণ্যের দুঃখ-সুখরূপ ফল যথোচিত ভোগ করাইয়া থাকেন।

প্রশ্ন –গরুড়পুরাণাদি গ্রন্থ বেদার্থ অথবা বেদের পরিপোষক কি না?

উত্তর –না, বেদবিরোধী ও বিপরীতগামী। তন্ত্রও সেইরূপ। যেমন কেহ একজনের মিত্র হইয়া সমস্ত সংসারের শত্রু হয়, পুরাণ তন্ত্রবিশ্বাসিগণও সেইরূপ। কারণ এই সকল গ্রন্থ পরস্পরের মধ্যে বিরোধ করাইয়া থাকে। কোনও বিদ্বান ব্যক্তিদের এই সকল গ্রন্থ মানা উচিত নহে। এই সকল মানা বিদ্যাহীনতার পরিচায়ক।

দেখ, শিবপুরাণে ত্রয়োদশী, সোমবার; আদিত্যপুরাণে রবিবার; চন্দ্রখণ্ডে সোম গ্রহযুক্ত মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনৈশ্চর, রাহু এবং কেতু; বৈষ্ণব মতে একাদশী; বামন মতে দ্বাদশী; নৃসিংহ বা অনন্তের চতুর্দশী, চন্দ্রমার পৌর্ণমাসী; দিপালদিগের দশমী; দুর্গার নবমী; বসুদিগের অষ্টমী; মুনিদিগের সপ্তমী; কার্তিক স্বামীর ষষ্ঠী; নাগের পঞ্চমী; গণেশের চতুর্থী; গৌরীর তৃতীয়া; অশ্বিনীকুমারের দ্বিতীয়া; আদ্যাদেবীর প্রতিপদ এবং পিতরদের অমাবস্যা –এসকল পৌরাণিক পদ্ধতি অনুসারে উপবাসের দিন। সর্বত্র ইহাই লিখিত আছে যে, যে ব্যক্তি এই সকল বার এবং তিথিতে খাদ্য পানীয় গ্রহণ করে সে নরকগামী হয়।

তাহা হইলে পোপ এবং পোপের শিষ্যদিগের কোনও বার অথবা কোনও তিথিতে ভোজন করা উচিত নহে। কারণ পান–ভোজন করিলে নরকগামী হইতে হইবে। “নির্ণয়সিন্ধু”, “ধর্মসিন্ধু, “ব্রতার্ক” প্রভৃতি প্রমাদগ্রস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা রচিত গ্রন্থসমূহে এক একব্রতের দুর্দশাও করা হইয়াছে। উদাহরণ স্বরূপ, শৈবগণ একাদশীতে, এইরূপ কেহ কেহ দশমী বিদ্ধাতে, কেহ কেহ দ্বাদশীতেই একাদশীর ব্রত করিয়া থাকে। কেমন বিচিত্র পোপলীলা! ক্ষুধায় মৃত্যুমুখে পতিত হইলেও বিবাদ করে।

যে ব্যক্তি একাদশীর ব্রত প্রচলন করিয়াছে, তাহার মধ্যে কেবল স্বার্থপরতাই আছে, দয়ার লেশমাত্রও নাই। তাহারা বলেন –’একাদশ্যামনে পাপানি বসন্তি’।

একাদশীর দিনে, সমস্ত পাপ অন্নে বাস করে। পোপকে জিজ্ঞাসা করা আবশ্যক, “কাহার পিপ বাস করে। তোমার বা তোমার পিতা প্রভৃতির?” যদি সকলের সমস্ত পাপ একাদশীতে (একাদশীর অন্নে) গিয়া বাস করে, তাহা হইলে একাদশীর দিন কাহারও কোনও প্রকার দুঃখ থাকা। উচিত নহে। কিন্তু তাহা তো হয় না; বরং বিপরীত, ক্ষুধাদির দ্বারা দুঃখ হইয়া থাকে। দুঃখ পাপেরই ফল। অতএব উপবাসে দুঃখভোগ করা পাপ।

ইহার বিশেষ মাহাত্ম বর্ণিত হইয়াছে। তাহা পাঠ করিয়া বহুলোক প্রতারিত হয়। এই বিষয়ে। একটি গাথা আছে —

ব্রহ্মলোকে এক বেশ্যা ছিল। সে কোনও অপরাধ করায় তাহাকে শাপ দেওয়া হয়। তুমি মর্ত্যে যাও। সে পৃথিবীতে পতিত হইয়া স্তুতিপূর্বক (শাপ দাতাকে) জিজ্ঞাসা করিল, “আমি কীরূপে পুনরায় স্বর্গে আসিতে পারিব?’ (শাপ দাতা) তাহাকে বলিল “যদি কেহ তোমাকে কখনও একাদশী ব্রতের ফল দান করে, তাহা হইলেই তুমি স্বর্গে ফিরিয়া আসিবে।” সে বিমান সহিত কোন নগরে পতিত হইল। তথাকার রাজা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে”? তখন সে সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করিয়া বলিল, –“যদি কেহ আমাকে একাদশীর ফলদান করে, তবে আমি পুনরায় স্বর্গে যাইতে পারি।”

রাজা নগর অনুসন্ধান করাইয়া একাদশীব্রতের অনুষ্ঠাতা কোনও ব্যক্তির সন্ধান পাইলেন না। একদিন কোন শূদ্র দম্পত্তির মধ্যে কলহ হয়। স্ত্রী দিবারাত্র অনাহারে থাকে। দৈবযোগে সেদিন। ছিল একাদশী। সে বলিল, “আমি তো একাদশী জানিয়া করি নাই, কিন্তু দৈবাৎ সেদিন উপবাস করিয়াছিলাম।” রাজার সিপাহীদিগকে এইরূপ বলা হইলে, তাহারা তাহাকে রাজার সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিল। রাজা তাহাকে বলিলেন, –“তুমি এই বিমানকে স্পর্শ কর। সে স্পর্শ করিবামাত্র বিমান তৎক্ষণাৎ উপরে উড়িয়া গেল।

ইহা হইল অজ্ঞাতসারে অনুষ্ঠিত একাদশী ব্রতের ফল। আর জ্ঞাতসারে ইহা অনুষ্ঠিত হইলে তাহার ফলের কী সীমা-পরিসীমা আছে!!! বাহ রে কানার দল। একথা যদি সত্য হয়, তাহা। হইলে আমি একটি পানের খিলি, যাহা স্বর্গে পাওয়া যায় না–স্বর্গে পাঠাইতে ইচ্ছা করি। একাদশী ব্রতধারী তোমরা আপন আপন একাদশীর ফলদান কর। যদি একটা পানের খিলি উপরে যায় তাহা হইলে আমরাও লক্ষ কোটি পান সে স্থানে পাঠাইব এবং আমরাও একাদশী করিব। আর যদি তা না হয়, তাহা হইলে তোমাদিগকে এইরূপ উপবাসের মৃত্যুরূপ আপৎকাল হইতে রক্ষা করিব।

এই চব্বিশটি একাঁদেশীর পৃথক পৃথক্ নাম রাখা হইয়াছে। কোনটির “ধনদা”, কোনটির “কামদা”, কোনটির “পুত্রদা”, এবং কোনটির “নির্জলা”ইত্যাদি নাম। অনেক দরিদ্র, বিষয়াসক্ত, নিঃসন্তান লোক একাদশীর ব্রত করিতে করিতে বৃদ্ধ হইয়াছে, অনেক মরিয়া গিয়াছে; কিন্তু ধন, কাম্যবস্তু এবং পুত্র লাভ হয় নাই। আর জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্ল পক্ষে যখন এক ঘন্টাকাল জল না পাইলে মানুষ ব্যাকুল হইয়া পড়ে, তখন ব্রতকারীদিগের দারুণ কষ্ট উপস্থিত হয়। বিশেষতঃ। বঙ্গদেশে বিধবাদিগের একাদশীর দিন অত্যন্ত দুর্দশা হইয়া থাকে।

এই সব লিখিবার সময় নির্দয় কক্সাইদের মনে একটুও দয়া হইল না। নহিলে যদি নির্জলার নাম ‘সজলা’ এবং পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম ‘নির্জলা’ রাখিত, তাহা হইলে অপেক্ষাকৃত ভাল হইত। কিন্তু পোপের দয়ার প্রয়োজন কী? কেহ বাঁচুক আর মরুক, পোপের পেট পূর্ণ করো।

গর্ভবতী অথবা সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী, বালক বা যুবকদিগের কখনও উপবাস করা উচিত নহে। আর যদি করিতেই হয়, তো যে দিন অজীর্ণ অথবা ক্ষুধামান্দ্য হয়, সেদিন শর্করা =সরবত অথবা দুগ্ধ পান করিয়া থাকা উচিত। যে ব্যক্তি ক্ষুধার সময়ে আহার করে না, আর যে ক্ষুধা ব্যতীত আহার করে, তাহারা উভয়েই রোগ সাগরে হাবু-ডুবু খাইয়া দুঃখ ভোগ করে। এ সকল প্রমাদগ্রস্তের কথা ও লেখাকে কাহারও প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করা উচিত নহে।

এবার গুরু-শিষ্য, মন্ত্রোপদেশ এবং মত-মতান্তরের ব্যবহার সম্বন্ধে আলোচনা করা যাইতেছে।

মূর্তিপূজক সম্প্রদায়ী লোকেরা প্রশ্ন করে যে, বেদ অনন্ত, ঋগ্বেদের ২১, যজুৰ্ব্বেদের ১০১, সামবেদের ১০০০ এবং অর্থবেদের ৯শাখা আছে। তন্মধ্যে অল্প কয়েকটি পাওয়া যায়। অবশিষ্টগুলি লুপ্ত হইয়াছে। লুপ্ত শাখাসমূহে মূর্তিপূজা এবং তীর্থের প্রমাণ আছে। উহাতে না থাকিলে পুরাণে ঐ সকল কোথা হইতে আসিবে? যদি কাৰ্য্য দেখিয়া কারণের অনুমান হয়, তবে পুরাণ দেখিয়া মূর্তিপূজা বিষয়ে সংশয়ের কী থাকিতে পারে?

উত্তর –যেমন বৃক্ষশাখা বৃক্ষ সদৃশ হইতে থাকে, বিপরীত নহে, সে ক্ষুদ্র হউক অথবা বৃহৎ, তাহাতে বিরোধ হইতে পারে না; সেইরূপ যতগুলি শাখা পাওয়া যায়, তন্মধ্যে পাষাণাদি মূর্তির এবং জল-স্থলরূপী তীর্থসমূহের প্রমাণ যখন পাওয়া যায় না, তখন অনুমান করা যাইতে পারে যে, লুপ্ত শাখা গুলিতেও ঐ সকল ছিল না। চারি বেদ সম্পূর্ণ পাওয়া যায়। শাখাসমূহ কখনও বেদবিরুদ্ধ হইতে পারে না। যদি উহারা বেদ ব্রুিদ্ধ হয় তাহা হইলে সেগুলিকে কেহই শাখা সিদ্ধ করিতে পারিবে না। যদি ইহাই সত্য হয় তাহা হইলে পুরাণ বেদের (লুপ্ত) শাখা (অনুসারে) নহে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক লোকেরা এ সকল পরস্পর বিরুদ্ধ গ্রন্থ রচনা করিয়া রাখিয়াছে।

যদি কেহ আপনারা বেদকে পরমেশ্বর কৃত স্বীকার করেন তাহা হইলে “আলায়ন” প্রভৃতি ঋষি-মুনিদিগের নামে প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহকে বেদ স্বীকার করেন কেন? যেমন শাখা-পত্র দেখিয়া অশ্বত্থ, বট এবং আস্র প্রভৃতি বৃক্ষ চিনিতে পারা যায়, সেইরূপ ঋষি-মুনিদেব বেদাঙ্গ, চারি ব্রাহ্মণ অঙ্গ, উপাঙ্গ এবং উপবেদ প্রভৃতির সাহায্যে বেদার্থ জানা যায়। এজন্য এসকল গ্রন্থকে শাখা’ বলিয়া মানা হইয়াছে। যাহা বেদ-বিরুদ্ধ তাহা প্রামাণ্য এবং যাহা বেদানুকূল তাহা অপ্রমাণ হইতে পারে না।

যদি তুমি অদৃষ্ট শাখাসমূহের মধ্যে মূৰ্ত্তি প্রভৃতির প্রমাণ আছে বলিয়া কল্পনা কর, তবে যদি কেহ এইরূপ মত প্রকাশ করে যে লুপ্ত শাখাগুলির মধ্যে বিপরীত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ অন্ত্যজ ও শূদ্রের নাম ব্রাহ্মণাদি এবং ব্রাহ্মণাদির নাম শূদ্র ও অন্ত্যজাদি, অগমনীয়া গমনীয়, অকৰ্ত্তব্য কৰ্ত্তব্য, মিথ্যাভাষাণাদি ধর্ম, সত্যভাষণাদি অধর্ম; এই সব হয়তো লিখিত আছে, তাহা হইলে আমি তোমাকে যে উত্তর দিয়াছি, তুমি তাহাকে সেই উত্তর দিবে। অর্থাৎ বেদ প্রসিদ্ধ শাখাসমূহে যেরূপ ব্রাহ্মণাদির নাম ব্রাহ্মণাদি এবং শূদ্রাদির নাম শূদ্রাদি লিখিত আছে, সেইরূপ অদৃষ্ট শাখা সমূহেও আছে স্বীকার করা উচিত। নতুবা বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা প্রভৃতি সমস্ত অন্যথা হইয়া যাইবে।

বলতো জৈমিনি ব্যাস এবং পতঞ্জলির সময় পৰ্য্যন্ত শাখা বিদ্যমান ছিল না, ছিল না? যদি বল যে ছিল, তাহা হইলে তুমি তাহার নিষেধ করিতে পারিবে না আর যদি বল যে ছিল না, তাহা হইলে শাখাগুলির থাকার সম্বন্ধে প্রমাণ কী?

দেখ! জৈমিনি মীমাংসায় সমস্ত কর্মকাণ্ড, পতঞ্জলি মুনি যোগশাস্ত্র সমস্ত উপাসনাকাণ্ড এব্যং। ব্যাসমুণি শারীরকসূত্রে সমস্ত জ্ঞানকাণ্ড বেদানুকূল বলিয়া লিখিয়াছেন। উক্ত গ্রন্থসমূহে পাষাণ আদি মূর্তিপূজা এবং প্রয়াগাদি তীর্থের নাম গন্ধও নাই, কোথা হইতে লিখিবেন? যদি (চারি) বেদের কোনও স্থলে এসকল থাকিত, তবে তাহারা কখনও উল্লেখ না করিয়া ছাড়িতেন না। অতএব লুপ্ত শাখাসমূহেও মূর্তিপূজা প্রভৃতির প্রমাণ ছিল না।

এই সমস্ত শাখা বেদ নহে। কেননা, ইহাতে ঈশ্বরকৃত বেদের প্রতী অনুসারে ব্যাখ্যা এবং সাংসারিক লোকের ইতিহাস প্রভৃতি লিখিত হইয়াছে। অতএব বেদে ইহা কখনও থাকিতে পারে না। বেদেও কেবল মনুষ্যদিগকে বিদ্যা বিষয়ক উপদেশ দান করা হইয়াছে। তাহাতে কোন মনুষ্যের নাম মাত্রও নাই; এ কারণ মূর্তিপূজার সর্বথা খণ্ডনই আছে।

দেখ, মূর্তিপূজা দ্বারা শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, নারায়ণ এবং শিব প্রভৃতির বড়ই নিন্দা এবং উপহাস হইয়া থাকে। সকলেই জানে যে, তাহারা মহান রাজাধিরাজ ছিলেন এবং তাঁহাদের স্ত্রী সীতা, রুক্মিণী, লক্ষ্মী এবং পার্বতী মহারাণী ছিলেন। কিন্তু পূজারীগণ তাহাদের মূর্তিগুলি মন্দিরে স্থাপন করিয়া তাহাদের নামে ভিক্ষা চায়। অর্থাৎ তাহাদিগকে ভিখারী সাজায় এবং সকলের কাছে বলে–

“আসুন মহারাজ, রাজা মহাশয়; শেঠ! সাহুঁকারগণ! দর্শন করুন, বসুন, চরণামৃত গ্রহণ। করুন; কিছু পূজাসামগ্রী অর্পণ করুন; মহারাজ। সীতারাম, কৃষ্ণ, রুক্মিণী বা রাধা-কৃষ্ণ, লক্ষ্মী-নারায়ণ এবং মহাদেব পার্বতী আজ তিন দিন যাবৎ বাল্যভোগ অথবা রাজভোগ অর্থাৎ জলপান বা ভোজ্য পানীয় প্রাপ্ত হন নাই। আজ ইহাদের নিকট কিছুই নাই। রাণী অথবা শেঠপত্নীগণ! আজ সীতাদেবীর “নথ” প্রভৃতি গড়াইয়া দিন। যদি ভোজ্যসামগ্রী পাঠান,তবে রাম-কৃষ্ণাদির ভোগ নিবেদন করিব।”

“বস্ত্র সব ছিঁড়িয়া গিয়াছে। মন্দিরের কোণগুলি ভগ্ন হইয়াছে। উপর হইতে জল চুঁইয়া পড়িতেছে। যাহা কিছু ছিল, দুষ্ট চোর সে সমস্তই উঠাইয়া লইয়া গিয়াছে। দেখুন, ইঁদুর কোন কোন সামগ্রী কাটিয়া ফেলিয়াছে। একদিন ইঁদুরগুলি এমন অনর্থ করিল যে, ঠাকুরদের চক্ষু বাহির করিয়া লইয়া। পলাইয়া গেল। আমরা রৌপ্যের চক্ষু নির্মাণে অসমর্থ তজ্জন্য কড়ির চক্ষু লাগাইয়া দিয়াছি।

রামলীলা এবং রাসমণ্ডলও অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। সীতারাম এবং রাধাকৃষ্ণ নাচিতেছেন। রাজা এবং মোহন্ত প্রভৃতি তাহাদের সেবকগণ আনন্দে বসিয়া আছে। আর পূজারী অথবা মোহান্ত মহাশয় আসন অথবা গদীর উপর পা বালিস ঠেস্ দিয়া বসিয়া থাকেন।

অত্যধিক গরমেও মন্দিরে তালা লাগাইয়া ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দেয়, আর নিজেরা সুন্দর। বায়ুতে পালঙ্ক বিছাইয়া শয়ন করে। অনেক পূজারী যেরূপ বানরী আপন শাবককে গলায় ঝুলাইয়া রাখে, তদ্রপ তাহারা নিজেদের নারায়ণকে কৌটার মধ্যে বন্ধ করিয়া বস্ত্রাদি দ্বারা বাঁধিয়া আপন। গলায় ঝুলাইয়া রাখে।

যখন কেহ মূৰ্ত্তি ভগ্ন করে, তখন পূজারী “হায়! হায়!” করিয়া বুকে করাঘাত করিতে করিতে প্রলাপ বকিতে থাকে –“দুর্বৃত্তগণ সীতা-রাম, রাধা-কৃষ্ণ অথবা শিব-পার্বতাঁকে ভাঙিয়া ফেলিয়াছে। এবার নিপুণ শিল্পী নির্মিত অপর একটি শ্বেতপ্রস্তরের মূর্তি স্থাপন করিয়া পূজা করিতে হইবে। ঘৃত ব্যতীত নারায়ণের ভোগ হয় না। অধিক (ঘৃত) না হউক, অল্প অবশ্যই পাঠাইবেন” –ইত্যাদির। বিষয় ধনাঢ্যদিগের নিকট উপস্থিত করা হইয়া থাকে।

রাসমণ্ডল অথবা রামলীলার শেষে সীতা-রাম অথবা রাধাকৃষ্ণের দ্বারা ভিক্ষা করান হয়। যে স্থানে মেলা অথবা ভীড় হয়, সে স্থানে কোনও চ্যাংড়া ছেলের মাথায় মুকুট পরাইয়া তাহাকে ‘কানাই’ সাজান হয় এবং তাহাকে পথিমধ্যে বসাইয়া তাহার দ্বারা ভিক্ষা করান হয়। এ সকল কীরূপ দুঃখের বিষয় তাহা তোমরা বিবেচনা কর।

আচ্ছা, বল তো? সীতা-রাম প্রভৃতি কি এরূপ দরিদ্র এবং ভিক্ষুক ছিলেন? ইহা তাহাদের উপহাস ও নিন্দা ব্যতীত কী? ইহাতে নিজেদের মাননীয় পুরুষদের অত্যন্ত নিন্দা হইয়া থাকে। যে সময়ে সীতা, রুক্মিণী, লক্ষ্মী এবং পার্বতী বিদ্যমান ছিলেন, যদি সে সময়ে তাহাদিগকে পথিমধ্যে কিংবা কোন গৃহে দাঁড় করাইয়া পূজারীগণ বলিত, “এস, ইহাদের দর্শন কর, কিছু পূজা সামগ্রী দাও, “তাহা হইলে তাহারা কখনও সে সকল লোকের কথামত এরূপ কাৰ্য্য করিতেন না এবং করিতে দিতেন না। কেহ তাহাদিগকে এইরূপ উপহাস করিলে তাহারা কি তাহাকে দণ্ড না দিয়া ছাড়িতেন? অবশ্য, পূজারীগণ তাহাদের নিকট হইতে দণ্ড পান নাই সত্য কিন্তু তাহাদের কৃতকর্মের জন্য মুৰ্ত্তিবিরোধী ব্যক্তিরা তাহাদের অনেক “প্রসাদী”লাভ করাইয়াছেন এবং এখনও করাইতেছেন। যতদিন তাহারা এই কুকর্ম ত্যাগ না করিবে, ততদিন তাহারা এইরূপ ভোগ করিতে থাকিবে, তাহাতে সন্দেহ কী? এইসকল কর্মের দ্বারাই আৰ্য্যাবর্তের মহা অনিষ্ট এবং পাষাণাদির মূর্তিতে বিশ্বাস করিয়া অনেক অনিষ্ট হইয়া গিয়াছে। এ সকল পরিত্যাগ না করিলে, প্রত্যহ আরও অধিক অনিষ্ট হইতে থাকিবে।

মূর্তিপূজকদের মধ্যে বামমার্গীগণ গুরুতর অপরাধী। তাহারা চেলা করিবার সময় সাধারণকে–

দং দুর্গায়ৈ নমঃ। ভং ভৈরবায় নমঃ। ‘ঐংহ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে ॥ ইত্যাদি।

মন্ত্র সমূহের উপদেশ দিয়া থাকে। আর বিশেষ করিয়া বঙ্গদেশে একাক্ষরী মন্ত্রোপদেশ দেওয়া হয়, যথা–

হ্রীং শ্রীং ক্লীং ॥ শাবর তন্ত্র।

ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পূর্ণাভিষেক ইত্যাদি করান হয়। এইরূপ দশমহাবিদ্যার মন্ত্র—

হ্রাংহ্রীংহ্রং বগলামুখৈ ফট স্বাহা’ শাবর তন্ত্র।

কোনে কোনো স্থলে ‘হ্রুং ফট স্বাহা’৷ কামরত্ন তন্ত্র

মারণ, মোহন, উচ্চাটন, বিদ্বেষণ, বশীকরণ আদি প্রয়োগ করিয়া থাকে। উক্ত মন্ত্র দ্বারা তো কিছুই হয় না, কিন্তু ক্রিয়া দ্বারাই সমস্ত করিয়া থাকে। যখন কাহারও প্রতি মারণমন্ত্র প্রয়োগ করা হয়, তখন যে প্রয়োগ করায় তাহার নিকট হইতে ধন লইয়া, যাহাকে মারিতে হইবে তাহার আকৃতিবৎ আটা অথবা মৃত্তিকার পুতুল নির্মাণ করা হয়। সেই পুতুলের বক্ষে, নাভিতে এবং কণ্ঠে ছুরি প্রবেশ করাইয়া দেওয়া হয়। উহার চক্ষু এবং হস্ত পদে কীলক বিদ্ধ করা হয়। সেই পুতুলের উপর ভৈরব এবং দুর্গা মূর্তি নির্মাণ করিয়া তাহার হস্তে ত্রিশূল দিয়া উহার হৃদয়ের উপরে বসাইয়া দেয় এবং একটি দেবী নির্মিত করিয়া মাংসাদির হোম করিতে থাকে এবং অন্যদিকে দূত আদি প্রেরণ করিয়া যাহার উপর মারণ মন্ত্র প্রয়োগ করা হয় তাহাকে বিষ প্রভৃতি দ্বারা মারিবার ব্যবস্থা করা হয়। যদি নিজের পুরশ্চরণের মধ্যেই তাহাকে বিনাশ করা যায়, তবে মন্ত্র প্রয়োগকারী নিজেকে ভৈরব অথবা দেবী সিদ্ধ বলিয়া প্রকাশ করে এবং ‘ভৈরবো ভূতনাথশ্চ” ইত্যাদি মন্ত্র পাঠ করে —

“মারয়-মারয়, উচ্চাটয়-উচ্চাটয়, বিদ্বেষয়-বিদ্বেষয়, ছিন্ধি-ছিন্ধি, ভিন্ধি-ভিন্ধি, বশীকুরু-বশীকুরু, খাদয়-খাদয়, ভক্ষয়-ভক্ষয় ত্রোটয়-ক্রোটয়, নাশয়-নাশয়, মম শত্রু বশীকুরু-মম শত্রু বশীকুরু, হুং ফট স্বাহা”। কামরত্ন তন্ত্র।

ইত্যাদি মন্ত্র জপ করে এবং তাহারা যথেষ্ট পরিমাণে মদ্যপান ও মাংস ভোজন করে। জ্বযুগলের মধ্যস্থলে তাহারা সিন্দুরের রেখা ধারণ করে; কখনও কখনও কালী প্রভৃতির জন্য কোন মানুষকে ধরিয়া বধ করে এবং তদ্বারা হোম করিবার পর তাহার মাংস কিঞ্চিৎ ভোজনও করে। যদি কেহ ভৈরবী চক্রে যাইয়া মদ্যপান এবং মাংসভক্ষণ না করে, তবে তাহাকে বধ করিয়া হোম করা হয়। উক্ত তান্ত্রিকদের মধ্যে যে ব্যক্তি অঘোরী’ সে মৃত মনুষ্যের মাংস ভক্ষণ করে। যাহারা “অজরী” “বজরী” করে, তাহারা মূত্রপান এবং বিষ্ঠাভক্ষণও করে।

তাহাদের মধ্যে এক “চোলীমাগী” এবং অপর “বীজমাগী”। চোলীমাগীগণ কোনও গুপ্ত। স্থানে অথবা ভূমিতে একটি স্থান নির্মাণ করে। সে স্থানে সকলের স্ত্রী, পুরুষ, বালক, বালিকা ভগ্নী, মাতা এবং পুত্রবধূ প্রভৃতি সম্মিলিত হইয়া একত্র মাংসভক্ষণ এবং মদ্য পান করে। একটি স্ত্রীলোককে বিবস্ত্রা করিয়া পুরুষেরা তাহাকে দুর্গাদেবী নাম দিয়া তাহার গুপ্ত-ইন্দ্রিয়ের পূজা করে। একটি পুরষকে উলঙ্গ করিয়া তাহার গুপ্ত-ইন্দ্রিয়ের পূজা স্ত্রীলোকেরা করে।

যখন মদ্যপান করিতে করিতে সকলে উন্মত্ত হইয়া উঠে, তখন স্ত্রীলোকদিগের কঁচুলী অর্থাৎ রক্ষাবরণীগুলি একটি প্রকাণ্ড মাটির পাত্রে রাখা হয়। তখন এক একজন পুরুষ সেই মৃত্তিকা পাত্রের মধ্যে হাত দিয়া যে যাহার কঁচুলী পায়; — সে তাহার মাতা, ভগ্নী,কন্যা পুত্রবধূ, যে কেহ হউক না কেন, ঐ সময়ের জন্য তাহার স্ত্রী হইয়া যায়। তখন তাহারা পরস্পর কুকর্ম করে। অতাধিক নেশা হইলে পরস্পর কলহ প্রবৃত্ত হইয়া জুতা মারামারি করে। প্রাতঃকালে কিঞ্চিৎ অন্ধকার থাকিতে থাকিতে সকলে স্ব স্ব গৃহে প্রস্থান করে। তখন মাতা মাতা, কন্যা কন্যা, ভগ্নী ভগ্নী এবং পুত্রবধূ পুত্রবধু হইয়া যায়। বীজমাগী’ পুরুষেরা সমাগমের পর বীর্য জলে নিক্ষেপ করিয়া পান করে। সেই পামরগণ এই সকল কর্মকে মুক্তির সাধন বলিয়া মনে করে। ইহাদের বিদ্যা, বিচার এবং সৌজন্য প্রভৃতি কিছুই নাই।

প্রশ্ন –শৈব মতালম্বীরা ত ভাল?

উত্তর –কেমন করিয়া ভাল হইবে? “যেমন প্রেতনাথ তেমন ভূতনাথ”। বামমার্গীগণ যেরূপ মন্ত্র-উপদেশ দ্বারা লোকের ধন হরণ করে, শৈবগণও সেইরূপ ‘ওম নমঃ শিবায় এই পঞ্চাক্ষরাদি মন্ত্রোপদেশ দান করে, রুদ্রাক্ষ ও ভস্মধারণ করে, মৃত্তিকা ও পাষাণাদির লিঙ্গ নির্মাণ করিয়া পূজা করে।

আর মুখে “হর হর, বম্ বম্” উচ্চারণ করিয়া ছাগ শব্দবৎ বড় বড় শব্দ করে। তাহাদের মতে এইরূপ করিবার কারণ এই যে, তালি বাজাইলে এবং ‘বম্‌ বম্‌’ শব্দ করিলে পার্বতী প্রসন্ন হন, কিন্তু মহাদেব অপ্রসন্ন হন। কারণ, যখন ভস্মসুরের সম্মুখ হইতে মহাদেব পলায়ন করেন, তখন বিদ্রূপ-সূচক বম্ বম্ শব্দ এবং বিদ্রূপ করিয়া তালি বাজান হইয়াছিল। গাল বাজাইলে পার্বতী অপ্রসন্ন কিন্তু মহাদেব প্রসন্ন হন। কারণ পার্বতীর পিতা দক্ষ-প্রজাপতির শিরচ্ছেদ করিয়া তাহাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হইয়াছিল। এবং তাহারা ধড়ের উপর ছাগমুণ্ড সংলগ্ন করা হইয়াছিল। তাহারই অনুকরণে গাল বাজাইয়া থাকে। শৈবগণ শিবরাত্রির প্রদোষ ব্রত করে এবং তদ্বারা মুক্তি হয় বলিয়া মনে করে।

সুতরাং তাহারাও বামমার্গীদের ন্যায়ই ভ্রান্ত। তাহাদের মধ্যে বিশেষ করিয়া কানফাটা, নাথ, গিরি, পুরি, অরণ্য, পর্বত ও সাগর এবং অনেক গৃহস্থও শৈব হওয়া থাকে। কেহ কেহ “দুই অশ্বের উপরে আরোহণ করে” অর্থাৎ বামমার্গী এবং শৈব উভয়মতই মানিয়া থাকে। আবার কেহ কেহ বৈষ্ণবও হইয়া থাকে, সে বিষয়ে প্রমাণ

‘অন্তঃশাক্তা বহিশ শৈবা সভামধ্যে বৈষ্ণবাঃ। নানারূপধরা কৌলাঃ বিচরন্তীহ মহীতলে ॥ ইহা তন্ত্রের শ্লোক

এই বামমার্গীগণ বহুরূপে পৃথিবীতে বিচরণ করে। ইহারা অন্তরে শাক্ত’ অর্থাৎ বামমার্গী, বাহিরে ‘শৈব’অর্থাৎ রুদ্রাক্ষ ভস্মধারী, কিন্তু সভায় বৈষ্ণব, বিষ্ণুর উপাসক বলিয়া পরিচয় দেন।

প্রশ্ন– বৈষ্ণব ত ভাল?

উত্তর –ছাই ভাল! যেমন উহারা, তেমন ইহারা। বৈষ্ণবদের লীলা খেলা দেখ। তাহারা নিজেদের বিষ্ণুর দাস বলে। তাহাদের মধ্যে শ্রীবৈষ্ণব অর্থাৎ চক্রাঙ্কিতগণ নিজদিগকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে, অবশ্য এ সকল কিছুই নহে।

প্রশ্ন –এ সকল কিছু নহে কেন? সব কিছুই আছে দেখুন! ললাটে নারায়ণের চরণারবিন্দ সদৃশ তিলক এবং মধ্যস্থলে পীতবর্ণ “শ্রী” রেখা। এই কারণে আমরা ‘শ্রীবৈষ্ণব’ নামে কথিত। এক নারায়ণ ব্যতীত আমরা অপর কাহাকেও মানি না। আমরা মহাদেবের লিঙ্গ দর্শনও করি না। কেননা, আমাদের ললাটে ‘শ্রী’ বিরাজমান। উহার দর্শনে লজ্জা হয়। আমরা “আলমন্দার” প্রভৃতি স্তোত্র পাঠ করি। মন্ত্রের দ্বারা নারায়ণের পূজা করি। মাংসভক্ষণ ও মদ্যপান করি না। তবে আমরা ভাল নহি কেন?

উত্তর –এই তিলকে ‘হরি-পদাকৃতি’ এবং এই পীত রেখাকে “শ্রী” স্বীকার করা বৃথা। কারণ ইহা তোমাদের হস্তের কারুকার্য্য। আর তোমাদের ললাটের চিত্র হস্তি-ললাটের অঙ্কিত চিত্র বিচিত্র রেখার ন্যায়। তোমাদের ললাটে বিষ্ণুর পদচিহ্ন কোথা হইতে আসিল? কেহ কি বৈকুণ্ঠে যাইয়া বিষ্ণু ললাটে ধারণ করিয়া আসিয়াছে?

বিবেকী –কপালে শ্রী জড়পদার্থ না চেতন?

বৈষ্ণব –চেতন।

বিবেকী –তবে এই রেখা জড় হওয়ায় ‘শ্রী’ নহে। আমরা জিজ্ঞাসা করি, শ্রী নির্মিত,অথবা নির্মিত নহে। যদি নির্মিত না হয়, তবে উহা ‘শ্রী’ নহে, কারণ তোমরা প্রতিদিন স্বহস্তে উহা নির্মাণ করিয়া থাক। সুতরাং উহা শ্রী’ হইতে পারে না। যদি তোমাদের ললাটে ‘শ্রী’ থাকে তবে বহু বৈষ্ণবের মুখশ্রীহীন অর্থাৎ বিশ্রী, শোভা রহিত দৃষ্ট হয় কেন! ললাটে শ্রী থাকা সত্ত্বেও উদরপূর্তির জন্য গৃহে গৃহে ভিক্ষা এবং সদাব্রত গ্রহণ করিয়া ঘুরিয়া বেড়াও কেন? ললাটে ‘শ্রী’ কিন্তু কাৰ্য্যে মহাদরিদ্র –ইহা উন্মাদ ও নির্লজ্জের কথা।

ইহাদের মধ্যে “পরিকাল” নামক এক ভক্ত, সে ছিল বৈষ্ণব। চৌর্য্য, দস্যুবৃত্তি এবং ছলকপটতা দ্বারা পরস্ব হরণ করিয়া সে বৈষ্ণবদের নিকট অৰ্পণ করিতে আনন্দ পাইত। একদিন পরিকাল চুরি করিতে গিয়া লুণ্ঠনের উপযুক্ত সামগ্রী না পাইয়া ব্যাকুলচিত্তে ঘুরিতে ফিরিতে লাগিল। নারায়ণ বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার ভক্ত দুঃখ পাইয়াছে। তিনি ধনাঢ্য বণিকরূপ ধারণ করিয়া অঙ্গুরীয় প্রভৃতি অলঙ্কারে নিজেকে সুসজ্জিত রথারোহণ পূর্বক পরিকালের সমক্ষে উপস্থিত হইলেন। তখন পরিকাল রথের নিকট যাইয়া বণিককে, ‘তোমার সমস্ত অলঙ্কারাদি শীঘ্র খুলিয়া দাও, নতুবা তোমাকে হত্যা করিব। নারায়ণের অঙ্গুরীয় খুলিতে বিলম্ব হইলে, পরিকাল তাহার অঙ্গুলী কাটিয়া অঙ্গুরীয় গ্রহণ করিল। ইহাতে নারায়ণ অত্যন্ত প্রসন্ন হইয়া চতুর্ভুজ মূর্তি ধারণ করিলেন, এবং তাহাকে দর্শন দিয়া বলিলেন, –“তুমি আমার অতি প্রিয় ভক্ত; কারণ তুমি সব ধন লুণ্ঠন ও অপহরণ করিয়া বৈষ্ণবদিগের সেবা করিয়া থাক। অতএব তুমি ধন্য”!তখন পরিকাল বৈষ্ণবদিগের নিকট উপস্থিত হইয়া সমস্ত অলঙ্কার তাহাদের অর্পণ করিল।

এক সময়ে জনৈক বণিক পরিকালকে ভৃত্যরূপে নিযুক্ত করিলেন এবং তাহাকে জাহাজে দেশ দেশান্তরে লইয়া গেলেন। সে স্থান হইতে সুপারী লইয়া জাহাজ পূর্ণ করা হইল। পরিকাল একটি সুপারী ভাঙিয়া দুইভাগ করিয়া বণিককে বলিল, “আমার এই অর্ধেক সুপারী জাহাজে রাখুন এবং লিখিয়া দিন যে, জাহাজে পরিকালের অর্ধেক সুপারী আছে”।

বণিক বলিলেন,– ‘তুমি যদি ইচ্ছা কর, তবে এক সহস্র সুপারী লইতে পার’। পরিকাল বলিল, না, আমি এরূপ অধার্মিক নহি যে, মিথ্যা বলিয়া কিছু গ্রহণ করিব। আমারতো অর্ধেক সুপারীর প্রয়োজন”। দুর্ভাগা সরলচিত্তবণিক তাই লিখিয়া দিলেন। জাহাজ স্বদেশের বন্দরে উপস্থিত হইলে, সুপারী নামাইবার আয়োজন করা হইল। তখন পরিকাল বলিল– “আমার অর্ধেক সুপারী আমাকে দিন”। বণিক তাহার অর্ধখণ্ড সুপারী দিতে উদ্যত হইলেন। তখন পরিকাল কলহ করিতে লাগিল। সে বলিল, “জাহাজেত আমার অর্ধেক সুপারী আছে। আমি অর্ধেক ভাগ লইব”। ঝগড়া-বিবাদ রাজপুরুষদিগের নিকট পৰ্য্যন্ত গেল। পরিকাল বণিকের লেখা দেখাইয়া বলিল দেখুন “এই ব্যক্তি অর্ধেক সুপারী দিবার কথা লিখিয়াছে”। বণিক অনেক বলিলেন, কিন্তু পরিকাল মানিল না। সে অর্ধেকসুপারী লইয়া বৈষ্ণবদিগকে অর্পণ করিল। তখন তো বৈষ্ণবগণ। অত্যন্ত প্রসন্ন হইল। যে পরিকাল দস্যু এবং তস্কর ছিল তাহার মূৰ্ত্তি অদ্যাবধি মন্দিরে রাখিয়া। থাকে।

ভক্তমাল গ্রন্থে এই আখ্যায়িকা লিখিত আছে। বুদ্ধিমানেরা দেখিবেন যে, ‘বৈষ্ণবগণ’ তাহাদের ‘সেবক’ এবং নারায়ণ –এই তিন মিলিয়া চোরমণ্ডলী কিনা? অন্য মত মতান্তরের মধ্যে কেহ কেহ কোন কোন বিষয়ে কিঞ্চিৎ ভালও আছেন, কিন্তু এই মতে থাকিয়া সর্বথা ভাল হওয়া যায় না।

এখন বৈষ্ণবদের মধ্যে নানাপ্রকার ভেদ, ভিন্ন ভিন্ন প্রকার তিলক ও কণ্ঠি ধারণ করিতে দেখা যায়। রামানন্দী’ –দুই পার্শ্বে গোপীচন্দন মধ্যে রক্তবর্ণ বিন্দু; ‘নিমাবত’ দুইটি সূক্ষ্মরেখার মধ্যে একটি কৃষ্ণবর্ণ বিন্দু; মাধব’ কৃষ্ণবর্ণ রেখা; গৌড়ীয় বাঙ্গালী কাটারীর ন্যায় যুপকাষ্ঠ রেখা এবং ‘রামপ্রসাদীর’দুই রেখাদ্বয়ের মধ্যে শ্বেতবর্ণ গোলাকার টীকা ধারণ করে। ইহাদের বিলক্ষণ-বিলক্ষণ কথন। রামানন্দীরা লাল রেখাকে লক্ষ্মীর চিহ্ন এবং নারায়ণের হৃদয়ে শ্রী শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের হৃদয়ে রাধা বিরাজমান আছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি বলিয়া থাকেন।

ভক্তমাল গ্রন্থে এক আখ্যায়িকা আছে। “কোনও এক ব্যক্তি বৃক্ষতলে ঘুমাইতেছিল। ঘুমন্ত অবস্থাতেই তাহার মৃত্যু হয়। উপর হইতে একটি কাক বিষ্ঠা ত্যাগ করিলে, তাহা মৃতের ললাটে তিলকাকার হইয়া যায়। তাহাকে লইবার জন্য যমদূত সেখানে উপস্থিত। ইত্যবসরে বিষ্ণুদূতও পৌঁছিয়াছে। তখন উভয়ের মদ্যে কলহ বাধিয়া গেল। যমদূত বলিল, –“আমাদের স্বামীর আদেশ আমরা ইহাকে যমলোকে লইয়া যাইব”। বিষ্ণদূত বলিল, –“আমাদের প্রভুর আদেশ ইহাকে বৈকুণ্ঠে লইয়া যাইব। দেখ, ইহার ললাটে বৈষ্ণবী তিলক আছে; ইহাকে তোমরা কীরূপে লইয়া যাইবে”? তখন যমদূত চুপ করিয়া চলিয়া গেল এবং বিষ্ণুদূত আনন্দের সহিত তাহাকে বৈকুণ্ঠে লইয়া গেল। নারায়ণ তাহাকে বৈকুণ্ঠে রাখিলেন। দেখ, যখন অকস্মাৎ তিলক রচিত হইবার এমন মাহাত্ম্য, তখন যাহারা প্রীতির সহিত স্বহস্তে তিলক রচনা করে, তাহারা সে নরক হইতে মুক্ত হইয়া বৈকুণ্ঠে যাইবে, তাহাতে আশ্চৰ্য্য কী!

আমরা জিজ্ঞাসা করি –যখন ক্ষুদ্র তিলক ধারণ করিলে বৈকুণ্ঠে যাওয়া যায়, তখন সমস্ত মুখে তিলক লেপন করিলে, সমস্ত মুখ কৃষ্ণবর্ণ করিলে অথবা সমস্ত শরীরে তিলক লেপন করিলে বৈকুণ্ঠের উপরে যাওয়া যায় কিনা? অতএব এসব কথা ব্যর্থ।

ইহাদের মধ্যে অনেক খাখী’বল্কলনির্মিত কৌপীন পরিধান করিয়া ধুনি জ্বালিয়া আগুন পোহায়, জটা বৃদ্ধি করে; সিদ্ধপুরুষের বেশ ধারণ করে; বকের ন্যায় ধ্যানাবস্থিত থাকে; গঞ্জিকা, ভাঙ এবং চরসের নেশা করে এবং চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া রাখে। সকলের নিকটেই তাহারা অল্প অল্প অন্ন, আটা ময়দা ও পয়সা-কড়ি ভিক্ষা এবং গৃহস্থের ছেলেদিগকে বিভ্রান্ত করিয়া চেলা করিয়া লয়। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশ মুটে-মজুর শ্রেণীর লোক।

কেহ বিদ্যাশিক্ষা করিতে ইচ্ছা করিলেও তাহাকে পড়িতে দেয় না এবং বলে যে– “পঠিতব্যং তদপি মৰ্তব্যংদন্তকটাকটেতি কিং কৰ্ত্তব্য”।

সাধু সন্নাসীদের বিদ্যাশিক্ষা করিবার কী প্রয়োজন? কেননা, পড়ুয়ারাও মরে, তাহা হইলে দন্ত কটাক্ট করা কেন? সাধুদের পক্ষে চারি ধাম ঘুরিয়া আসা, সন্তদিগের সেবা করা রামের ভজন করা (যথেষ্ট)।

যদি কেহ মূর্খ ও অবিদ্যার মূর্তি না দেখিয়া থাকে, তবে সে ‘খাখী’দর্শন করিয়া আসুক। বয়সে খাখীদের মাতা-পিতার সমান হইলেও তাহাদের নিকট যে কেহ উপস্থিত হয়, তাহারা তাহাকে ‘খোকা’, ‘খুকি’ বলিয়া সম্বোধন করে। রূংখড়, সূংখড়, গোড়ীয়ে এবং জমাতওয়ালে, সুতরেসাঈ তথা অকালী, কাণফাটা, জোগী, ঔঘড় প্রভৃতি সকলেই খাখীদের অনুরূপ।

জনৈক খাখীর চেলা শ্রীগণেশায় নমঃ’উল্টা সিধা বলিতে বলিতে কূপে জল ভরিতে গিয়াছিল। সে স্থানে একজন পণ্ডিত বসিয়াছিলেন। তিনি তাহাকে ‘স্ত্রীগনেসাজনমে’ মুখস্থ করিতে শুনিয়া বলিলেন, “এই সাধু! অশুদ্ধ মুখস্থ করিতেছ। শ্রীগণেশায় নমঃ –এইরূপ বল’। সাধু তৎক্ষণাৎ ঘটিতে জল পূর্ণ করিয়া গুরুর নিকটে গিয়া বলিল, –’একজন বামুন আমার আবৃত্তিকে অশুদ্ধ বলিতেছে। খাখী তাহা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ উঠিয়া কূপের নিকট গেল এবং পণ্ডিতকে বলিল, –‘তুমি আমার চেলাকে বিভ্রান্ত করিতেছ? গণ্ডমুখ তুমি কী পড়িয়াছ? দেখ, তুমি তো একই প্রকারের পাঠ জান, আর আমি ইহার তিন প্রকারের পাঠ জানি– ‘স্ত্রীগণেসাজনুমে, ‘স্ত্রীগণেসায়ন্নমে, ‘স্ত্রীগণেসায়নর্মে।

পণ্ডিত –শোনো সাধু! বিদ্যা বড় কঠিন। অধ্যয়ন ব্যতীত বিদ্যালাভ হয় না।

খাখী –যাও, যাও; আমি অনেক বিদ্বানকে মর্দন করিয়া ভাংয়ের সহিত বাটিয়া একেবারে গিলিয়া খাইয়াছি। সন্তদের গৃহ মহা-বিস্তৃত। তুমি বেচারা অপদার্থ কী জানিবে?

পণ্ডিত –দেখ, যদি তুমি বিদ্যাশিক্ষা করিতে তাহা হইলে এরূপ কুৎসিত শব্দ বলিতে না; তোমার মধ্যে সর্বপ্রকার জ্ঞান থাকিত ॥

খাখী –ওরে তুই কি আমার গুরু হইতে চাহিস্? আমি তোর উপদেশ শুনিব না ॥

পণ্ডিত –শুনিবে কেন? বুদ্ধি নাই। উপদেশ শুনিবার ও বুঝিবার মত বিদ্যা আবশ্যক।

খাখী –যে সমস্ত বেদ শাস্ত্র পড়িয়াছে অথচ সাধুদিগকে মানে না, জানিও সে কিছুই পড়ে নাই ॥

পণ্ডিত –অবশ্য, আমরা সন্তদের সেবা করি; কিন্তু তোমার মত আখাড়াবাজদের সেবা করি না। কেননা সজ্জন, বিদ্বান্, ধার্মিক এবং পরোপকারী পুরুষকে ‘সন্ত’ বলে।

খাখী –দেখ, আমি দিবা-রাত্র বিবস্ত্র থাকি, ধুণি জ্বালাই; শত শত বার গাঁজা-চরসে দম দিই; তিন তিন ঘটী ভাঙু পান করি; গাঁজা-ভাঙু এবং ধুতুরা পাতার তরকারী করিয়া খাই; সংখিয়া ও আফিম অনায়াসে গলাধঃকরণ করি; নেশায় বিভোর হইয়া দিবারাত্র নিশ্চিন্ত থাকি। সংসারকে কিছুই মনে করি না। ভিক্ষা করিয়া রুটি খাই এবং সারা রাত্রি এমন কাশির বেগ উঠে যে কেহ। পার্শ্বে শয়ন করিলে তাহার নিদ্রা হয় না ইত্যাদি সিদ্ধি ও সাধুত্ব আমার মধ্যে আছে। তবে তুমি। আমার নিন্দা করিতেছ কেন? সাবধান, অপদার্থ! আমাকে বিরক্ত করিলে তোমাকে ভস্ম করিয়া ফেলিব।

পণ্ডিত –এ সব অসাধু, মূর্খ এবং সর্বনাশার লক্ষণ,সাধুর নহে। শোনো, সাপ্পেতি পরাণি ধর্মকায়াণি স সাধুঃ যিনি ধর্মসঙ্গত উত্তম কার্য করেন, সর্বদা পরোপকারে রত, যিনি দোষরহিত বিদ্বান্, যিনি সত্যোপদেশ দ্বারা সকলের হিত সাধনে তৎপর, তাহাকেই সাধু’ বলে।

খাখী –যাও যাও, সাধুর কাৰ্য কী জানিবে?সাধুদের মহা পরাক্রম। সাধুর সহিত বাগবিতণ্ডা করিও না, নতুবা এক চিমটার আঘাতে মাথা ফাটাইয়া দিব।

পণ্ডিত — আচ্ছা, খাখী স্বস্থানে যাও; আমার উপর অধিক ক্রুদ্ধ হইও না। জান তো, রাজ্য কীরূপ? মারিলে ধরা পড়িবে, জেল ভোগ করিবে, বেত খাইবে কিংবা কেহ তোমাকেও আঘাত করিয়া বসিবে, তখন কী করিবে?

খাখী –চরে চেলা। কোন্ রাক্ষসের মুখ দেখাইলি?

পণ্ডিত –তুমি কখনও মহাত্মার সঙ্গ কর নাই, নতুবা জড়বুদ্ধি ও মূর্খ থাকিতে না।

খাখী –আমি নিজেই মহাত্মা। আমার অন্য কাহারও প্রয়োজন নাই।

পণ্ডিত যাহাদের ভাগ্য মন্দ, তাহাদেরই তোমাদের মত বুদ্ধি ও অহংকার হইয়া থাকে। খাখী স্বস্থানে চলিয়া গেল, পণ্ডিতও গৃহে ফিরিয়া গেলেন।

সন্ধ্যা-আরতি সমাপ্ত হইলে বহু খাখী সেই খাখীকে বৃদ্ধ জানিয়া ‘ডণ্ডোৎ’ ‘ডণ্ডোৎ’ বলিতে বলিতে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিয়া সেখানে বসিল। খাখী জিজ্ঞাসা করিলেন, –“ওরে রামদাসিয়ে। তুই কী পড়িয়াছিস্?

রামদাস –মহারাজ, আমি ‘বেসুসহসর নাম’ পড়িয়াছি।

খাখী –ও রে গোবিন্দদাসিয়ে। তুই কি পড়েছিস্?

গোবিন্দদাস –আমি অমুক খাখীর নিকট ‘রামসতবরাজ’ পড়িয়াছি।

তখন রামদাস বলিল– মহারাজ! আপনি কি পড়িয়াছেন?

খাখী –আমি গীতা পড়িয়াছি।

রামদাস –কাহার নিকট?

খাখী –যা রে চ্যাংড়া, আমি কাহাকেও গুরু করি না। দেখ, আমি ‘পরাগরাজ’ এ থাকিতাম। আমি অক্ষরও চিনিতাম না। লম্বা ধুতিপরা কোন পণ্ডিতকে দেখিলে গীতার পুঁথি লইয়া জিজ্ঞাসা করিতাম, এই মুকুট পরা অক্ষরের নাম কী? এই ভাবে জিজ্ঞাসা করিতে করিতে আঠার অধ্যায় গীতা বাটিয়া খাইয়াছি, কিন্তু কাহাকেও গুরু করি নাই।

হায়রে, এরূপ বিদ্যার শত্রুদের অবিদ্যা আশ্রয় না দিলে তাহারা কোথায় যাইবে।

এইসব খাখীরদল নেশা, প্রমাদ, বিবাদ, ভোজন, শয়ন, ঝুঁজপিটা, ঘন্টা-ঘড়িয়ালও শঙ্খবাজান, ধুণি প্রজ্বলিত রাখা,স্নান-প্রক্ষালন করা এবং চতুর্দিকে বৃথা পর্যটন করা ব্যতীত অন্য কোন সকাৰ্য্য করে না। কেহ ইচ্ছা করিলে হয়তো প্রস্তরকে দ্রবীভূত করিতে পারে, কিন্তু খাখীদের আত্মায় জ্ঞান-সঞ্চার করা কঠিন। কারণ, তাহারা সচরাচর শূদ্রবর্ণ, শ্রমজীবী, কৃষক এবং কাহার শ্রেণীর লোক, স্ব স্ব বৃত্তি পরিত্যাগ করিয়া কেবল ভস্মলেপন করিয়া বৈরাগী, খাখী প্রভৃতি হয়। তাহারা বিদ্যা অথবা সৎসঙ্গ আদির মাহাত্ম জানেও না।

ইহাদের মধ্যে নাথদের মন্ত্র –নমঃ শিবায়, খাখীদের নৃসিংহায় নমঃ, রামাবতদের ‘শ্রীরামচন্দ্রায় নমঃ’ অথবা সীতারামাভ্যাং নমঃ’, ‘কৃষ্ণোপাসকদের –শ্রীরাধাকৃষ্ণাভ্যাং নমঃ নমো ভগবতে বাসুদেবায় এবং বাঙ্গালী বৈষ্ণবদের ‘গোবিন্দায় নমঃ। এসকল মন্ত্র কর্ণে পড়িবামাত্রই শিষ্য করিয়া লওয়া হয়। এবং এই ধরণের শিক্ষা দেওয়া হয় যে ‘বৎস! তুষার মন্ত্র পাঠ কর —

‘জল পবিতর সথল পবিতর, ঔর পবিতর কুআ। শিব কহে সুন পাৰ্ব্বতী, তুম্বা পবিতর হুআ ৷

বলুন তো, এইরূপ যোগ্যতার সাধু অথবা বিদ্বান্ থাকিলে জগতের কি কোনও হিত হইতে পারে? খাখীগণ দিবারাত্র কাষ্ঠ ও শুষ্ক গোময় জ্বালায়। এক মাসে বহু টাকার কাষ্ঠ পোড়াইয়া ফেলে। এক মাসে যে কাষ্ঠ জ্বালায় সেই কাষ্ঠ-মূল্যের কম্বলাদি বস্ত্র ক্রয় করিলে শতাংশের একাংশ ধন ব্যয় করিয়া আনন্দে থাকিতে পারে। কিন্তু তাহাদের এতটুকু বুদ্ধি আসিবে কোথা হইতে?

সেই ধুনির আগুনে তপ্ত হয় বলিয়াই তাহারা নিজেদের নাম তপস্বী রাখিয়াছে। যদি এইরূপে তপস্বী হওয়া যায়, তবে বন্য মনুষ্যেরাও তাহাদের অপেক্ষাঅধিক তপস্বী। যদি জটাবৃদ্ধি, ভস্মলেপন এবং তিলক ধারণ করিলে তপস্বী হওয়া যায়, তবে সকলেই তাহা করিতে পারে। ইহারা বাহিরে ত্যাগী, কিন্তু অন্তরে মহা সংগ্রহী।

প্রশ্ন– কবীরপন্থী তো ভাল?

উত্তর –না।

প্রশ্ন –ভাল নহে কেন? তাহারা পাষাণাদি মূর্তিপূজার খণ্ডন করে। কবীর সাহেব ফুল হইতে উৎপন্ন হইয়াছিলেন, এবং অন্তে ফুলই হইয়া গিয়াছিলেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহাদেবের যখন জন্ম হয় নাই তখনও কবীর সাহেব ছিলেন। কবীর একজন মহান্ সিদ্ধপুরুষ ছিলেন; এমন কি যে। কথা বেদ পুরাণও জানিতে পারে না, কবীর তাহা জানেন, সত্যপথও কবীরই দেখাইয়াছেন। ইহাদের মন্ত্র সত্য নাম কবীর’ ইত্যাদি।

উত্তর –পাষাণাদি মূৰ্ত্তি পরিত্যাগ করিয়া পালঙ্ক, গদী, তাকিয়া, খড়ম, এবং জ্যোতিঃ অর্থাৎ দীপ প্রভৃতির পূজা করা পাষাণমুৰ্ত্তি পূজা অপেক্ষাও কম নহে। কবীর সাহেব কি কীট অথবা ফুলের কুঁড়ী ছিলেন যে, তিনি ফুল হইয়া গেলেন?

এ বিষয়ে নিম্নবর্ণিত যাহা শুনা যায়, তাহা সত্য হইতে পারে। কাশীতে এক তাঁতি বাস করিত। তাহার সন্তানাদি ছিল না। একদিন অল্প রাত্রি থাকিতে সে এক গলিপথ দিয়া যাইতে ছিল। এমন সময় সে দেখিতে পাইল পথিপার্শ্বে একটি ঝুড়িতে ফুলের মধ্যে সদ্যোজাত একটি শিশু রহিয়াছে। সে শিশুটিকে তুলিয়া লইয়া তাহার স্ত্রীকে দিল। তাহার স্ত্রী শিশুটিকে পালন করিতে লাগিল। শিশুটি যখন বড় হইল তখন সে তাঁতির কাজ আরম্ভ করিল। (একদিন) সে সংস্কৃত অধ্যয়ন করিবার জন্য কোন পণ্ডিতের নিকট যায়। পণ্ডিত তাহাকে অপমান করিয়া বলিল –‘আমরা তাঁতিকে পড়াই না। এইভাবে সে আরও কয়েকজন পণ্ডিতের নিকটে উপস্থিত হয়। কিন্তু কেহই তাহাকে পড়াইল না।

তখন সে ‘অগড়ং বগড়ং’ভাষায় কিছু কিছু রচনা করিয়া তাঁতি প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর লোকদিগকে বুঝাইতে লাগিল। সে তম্বুরা লইয়া গান করিত, ভজন রচনা করিত। বিশেষ করিয়া, সে পণ্ডিত, শাস্ত্র এবং বেদের নিন্দা করিত। কয়েক জন মূর্খ তাহার জালে আবদ্ধ হইয়া পড়ে। তাহার মৃত্যুর পর লোকে তাহাকে সিদ্ধপুরুষ বানাইয়া ফেলিল। সে জীবদ্দশায় যাহা যাহা রচনা করিয়াছিল তাহার শিষ্যগণ ঐ সকল পাঠ করিত।

তাহারা সিদ্ধান্ত করিল, কর্ণর বন্ধ করিলে যে শব্দ শ্রুত হয়, তাহাই অনাহত শব্দ। কবীর পন্থিগণ মনের বৃত্তিসমূহকে ‘সুরতি বলে। মনকে সেই শব্দ শুনিতে প্রবৃত্ত করাকে পরমেশ্বরের ধ্যান বলে এবং যিনি তাহা করেন তিনিই সন্ত। ‘কাল’ সেখানে পৌঁছাইতে পারে না। তাহারা বর্ষাফলকের ন্যায় তিলক এবং চন্দনাদি কাষ্ঠের ‘কণ্ঠী’ ধারণ করে।

ভাবিয়া দেখ যে, ইহার দ্বারা আত্মার উন্নতি এবং জ্ঞানের বৃদ্ধি হইতে পারে কি? ইহা কেবল ছেলেখেলার মত লীলা।

পাঞ্জাব প্রদেশে নানক সাহেব এক মতবাদ প্রবর্তন করেন। তিনিও মূর্তিপূজার খণ্ডন করিতেন, এবং অনেককে মুসলমান মত গ্রহণ হইতে রক্ষাও করিয়েছিলেন। তিনি সাধু হন নাই, কিন্তু গৃহস্থই ছিলেন। দেখ! তিনি নিম্নলিখিত মন্ত্র’ উপদেশ রূপে দিতেন। ইহা দ্বারা জানা যায় যে, তাঁহার অভিপ্রায় ভাল ছিল।

ও সত্যনাম কর্তা পুরুষ নির্ভো নির্বৈর অকালমূৰ্ত্ত অজোনি সহভং গুরুপ্রসাদ জপ। আদি সচ, জুগাদি সচ হৈ ভী সচ, নানক হোসী ভী সচ ॥

অর্থাৎ ওম যাহার সত্য নাম। তিনি কর্তা পুরুষ ভয় ও বৈররহিত অকাল মূর্তি যিনি কালও যোনীতে আসেন না। তিনি প্রকাশমান, তাহারই জপ গুরুর কৃপায় কর। সেই পরমাত্মা আদিতে সত্য ছিলেন, যুগাদির আদিতে সত্য, বর্তমানে সত্য এবং ভবিষ্যতে ও সত্য থাকিবেন।

উত্তর –নানকের অভিপ্রায় তো ভাল ছিল; কিন্তু তাহার বিদ্যা মোটেই ভাল ছিল না। অবশ্য, ভাষা সেই দেশের গ্রাম্য ভাষা, তিনি সেই ভাষাই জানিতেন, বেদাদিশাস্ত্র এবং সংস্কৃত ভাষা কিছুই জানিতেন না; জানিলে ‘নির্ভয়’ শব্দকে ‘নির্ভো লিখিতেন? এবিষয়ে প্রমাণ তাঁহার রচিত (সংস্কৃত স্তোত্র’)। তিনি ভাবিয়া ছিলেন, আমি সংস্কৃতেও পারদর্শিতা দেখাই, কিন্তু অধ্যয়ন ব্যতীত সংস্কৃত আয়ত্ত করা কীরূপ সম্ভব? অবশ্য, সে সকল গ্রামবাসী কখনও সংস্কৃত শুনে নাই, সংস্কৃত (স্ত্রোত্র) রচনা করিয়া তাহাদের নিকট সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত বলিয়াও পরিগণিত হইয়া থাকিবেন।

নিজের মান-মর্যাদা এবং যশোলিঙ্গা ব্যতীত কখনও এইরূপ করিতেন না। খ্যাতি–প্রতিপত্তি লাভের ইচ্ছা তাহার অবশ্যই ছিল। নতুবা তিনি যাহা জানিতেন, সেই ভাষাই ব্যবহার করিতেন। এবং বলিতেন –“আমি সংস্কৃত অধ্যয়ন করি নাই।তাহার কিছু অহঙ্কার ছিল, একারণ মানমৰ্য্যাদার জন্য কঞ্চিৎ দম্ভও প্রকাশ করিয়া থাকিবেন। এইজন্য তাহার গ্রন্থেরও নানাস্থানে বেদের নিন্দা এবং স্তুতিও আছে। কেননা, তিনি যদি এরূপ না করিতেন তাহাকেও কেহ বেদের অর্থ জিজ্ঞাসা করিত। অর্থ জানা না থাকিলে তাহার প্রতিষ্ঠা নষ্ট হইত। এই কারণে তিনি প্রথমেই তাহার শিষ্যদিগের সমক্ষে কোন কোন স্থলে বেদের বিরুদ্ধে বলিতেন এবং কোন কোন স্থলে প্রশংসা না করিলে লোকে তাহাকে নাস্তিক বলিত। যথা

বেদ পঢ়ত ব্রহ্মা মরে। চারোঁ বেদকহানি। সন্তকিমহিমা বেদনা জানী ৷(নানক) ব্রহ্মজ্ঞানী আপ পরমেশ্বর ॥

বেদপাঠিগণ কি মরিয়া গিয়াছেন? নানকদেব প্রভৃতি কি নিজদিগকে অমর মনে করিতেন? তাঁহারা কি মরেন নাই? বেদ সমস্ত বিদ্যার ভাণ্ডার। কিন্তু যিনি চারি বেদকে কাহিনী বলেন, তাঁহার সকল কথাই কাহিনী। যে জন মুখকে সাধু বলে, সে বেচারা বেদের মহিমা কখনও জানিতে পারে কি? যদি নানক কেবল বেদেরই সম্মান করিতেন, তাহা হইলে তাহার সম্প্রদায় চলিত না, তিনি গুরুও হইতে পারিতেন না। কেননা, তিনি তো সংস্কৃত বিদ্যা অধ্যয়ন করেন নাই, এ অবস্থায় তিনি কীরূপে অন্যকে শিক্ষা দিয়া শিষ্য করিতেন?

অবশ্য ইহা সত্য যে, যে সময়ে তিনি পাঞ্জাবে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, সে সময়ে পাঞ্জাবে সংস্কৃতের চর্চাই ছিল না এবং সে দেশ মুসলমান কর্তৃক উৎপীড়িত ছিল। সে সময় তিনি কিছু লোককে রক্ষা করিয়াছিলেন। নানক দেবের জীবদ্দশায় তাহার শিষ্যও সংখ্যায় অধিক হয় নাই। কেননা, অশিক্ষিত লোকদের রীতি এই যে, তাহারা ব্যক্তি বিশেষকে মৃত্যুর পর সিদ্ধ পুরুষ বলিয়া প্রচার করে এবং পরে তাহার অনেক মাহাত্ম্য বর্ণনা করিয়া তাহাকে ঈশ্বরের তুল্য স্বীকার করে।

হাঁ, নানকদেব অত্যন্ত ধনাঢ্য বা রাজাও ছিলেন না। কিন্তু তাহার শিষ্যগণ নানকচন্দ্রোদয়’ এবং ‘জন্মশাখী’ প্রভৃতি গ্রন্থে লিখিয়াছেন, তিনি প্রকাণ্ড সিদ্ধ এবং ঐশ্বৰ্য্যশালী পুরুষ ছিলেন। নানকদেব ব্রহ্মাদির সহিত সাক্ষাৎ করিয়া অনেক কথোপকথন করিয়াছিলেন। সকলে সম্মান করিয়াছিলেন। নানকদেব বিবাহে অশ্ব, রথ, হস্তী, সুবর্ণ, রৌপ্য, মুক্তা এবং পান্না প্রভৃতি রত্নসমূহের ইয়ত্তা ছিল না। বলুন তো! এসব অলীক গল্প নহে তো কী? অবশ্য এ বিষয়ে তাঁহার শিষ্যগণই দোষী, তিনি নহেন। তাঁহার পুত্র হইতে উদাসী’ সম্প্রদায় এবং রামদাস হইতে ‘নিৰ্ম্মল’ সম্প্রদায় প্রবর্তিত হয়।

তাহার উত্তরাধিকারীরা হিন্দী ভাষায় বিভিন্ন রচনা করিয়া গ্রন্থের মধ্যে সন্নিবিষ্ট করিয়াছেন। গুরু গোবিন্দ সিংহ ছিলেন ইহাদের দশম গুরু। তাহার পর ঐ গ্রন্থে কাহারও ভাষা মিশ্রিত করা হয় নাই। কিন্তু তাহার সময় পর্যন্ত যতগুলি ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র পুস্তক ছিল সেই সমস্ত একত্র করিয়া পুস্তকাকারে বাঁধাইয়া রাখা হইয়াছিল। ইহারাও নানক সাহেবের পর বহু ভাষা গ্রন্থ রচনা করেন। অনেকে নানা প্রকার পুরাণকে মিথ্যা গল্পের ন্যায় রচনা করিয়াছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্রহ্মজ্ঞানী। তাঁহার শিষ্যগণ, তিনি ঈশ্বর হইয়াছেন মনে করিয়া কর্মোপাসনা ছাড়িয়া তাহার দিকে ঝুঁকিতে আরম্ভ করিলেন। ইহা অনর্থ সৃষ্টিকরিল। নতুবানানকঈশ্বর-ভক্তি সম্বন্ধে যাহা কিছু লিখিয়াছিলেন, যদি তাহার শিষ্যগণ সে বিষয়ে তাঁহার অনুসরণ করিতেন, তাহা হইলে খুবই ভাল হইত।

এখন ‘উদাসী’রা বলেন –“আমরা বড়’; ‘নির্মলে’রা বলেন, –“আমরা বড়’; অকালী এবং ‘সুতরেসাঈ’রা বলেন, “আমরা সবার উপরে।

ইহাদের মধ্যে গোবিন্দ সিং শৌর্যবীর্যসম্পন্ন ছিলেন। মুসলমানগণ তাঁহার পূর্বপুরুষদিগকে অনেক দুঃখ দিয়াছিল। তিনি তাহাদের প্রতিশোধ লইবার ইচ্ছা করেন কিন্তু তাঁহার নিকট কোন যুদ্ধোপকরণ ছিল না। আর অপরদিকে মুসলমানদের বাদশাহী ক্রমবর্ধমান অগ্নি শিক্ষার ন্যায় বৃদ্ধি পাইতেছিল। তিনি এক পুরশ্চরণ করাইলেন এবং ঘোষণা করিলেন, যে, ‘দেবী আমাকে বর দিয়াছেন এবং খড়গ দিয়া বলিয়াছেন,– ‘তুমি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, তোমার বিজয় হইবে। বহু লোক তাহার সহযোগী হইল।

তিনি বামমার্গীদিগের ‘পঞ্চ মকার’ এবং চক্রাঙ্কিতদিগের ‘পঞ্চ সংস্কারের ন্যায় ‘পঞ্চ ককার’ প্রবর্তন করিলেন। ইহার ‘পঞ্চ ককার’ ছিল যুদ্ধোপয়োগী। প্রথম ‘কেশ’—- অর্থাৎ ইহা ধারণ করিলে যুদ্ধকালে লাঠি ও তরবারির আঘাত হইতে (মাথা) কতকটা রক্ষা। পাইবে। দ্বিতীয় কঙ্গণ’ –অকালীগণ ইহা মস্তকের উপর পাগড়ীর মধ্যে ধারণ করেন এবং হাতে কড়া’— এতদ্বারা হস্ত এবং মস্তক রক্ষা পাইবে। তৃতীয় কচ্ছা’ অর্থাৎ হাঁটুর উপরে এক প্রকার জাঙ্ঘিয়া, ইহা দৌড়াইবার পক্ষে এবং লাফাইবার পক্ষে সুবিধাজনক। সচরাচর মল্লযোদ্ধা বাজিকরণ এই উদ্দেশ্য ধারণ করে, যেন শরীরের মর্মস্থান নিরাপদে থাকে এবং কোন প্রতিবন্ধ উপস্থিত না হয়। চতুর্থ ‘কঙ্গা’ (চিরুণী)— দ্বারা কেশ সংস্কার করা হয়। পঞ্চম ‘কাচু’ (কৃপাণ) ইহা শক্রর সহিত সম্মুখ যুদ্ধে কাজে লাগে।

এই সব কারণে গুরু গোবিন্দ সিংহ স্বকীয় বুদ্ধিমত্তা দ্বারা ঐ সময়ের জন্য এ সকল ধারণের রীতি প্রচলিত করিয়াছিলেন। এখন ও সকল ধারণ করিবার কোন প্রয়োজন নাই। কিন্তু (একসময়) যুদ্ধের প্রয়োজনে যাহা ধারণ করা কর্তব্য ছিল, এখন তাহা ধর্মের অঙ্গরূপে স্বীকৃত হইয়াছে।

ইহারা মূর্তিপূজা করেন না, কিন্তু মূর্তিপূজা অপেক্ষা বিশষেরূপে গ্রন্থপূজা অধিক করিয়া থাকেন। ইহা কি মূর্তি পূজা নহে? কোন জড় পদার্থের সম্মুখে মস্তক অবনত করা কিংবা কোন জড় পদার্থের পূজা করা –সমস্তই ‘মূর্তিপূজা। মূর্তিপূজকেরা যেরূপ ব্যবসা ফাদিয়া তাহাদের জীবিকার ব্যবস্থা করিয়া থাকে, ইহারাও সেইরূপ করিয়াছেন। পূজারীগণ যেমন মূর্তি দর্শন করায় এবং পূজা সামগ্রী নিবেদন করায়, নানকপন্থীরাও সেইরূপ গ্রন্থের পূজা করেন, অন্যের দ্বারা পূজা করান এবং পূজা সামগ্রী নিবেদনও করান। মূর্তিপূজকেরা বেদের সম্মান করেন, গ্রন্থসাহেবপন্থীরা বেদকে ততদূর সম্মান করেন না।

অবশ্য ইহা বলা যাইতে পারে যে, ইহারা বেদ শ্রবণ করেন নাই, দর্শনও করেন নাই, কী করিবেন? যদি তাহারা দেখিতেন ও শ্রবণ করিতেন, তাহা হইলে যে সকল বুদ্ধিমান হঠকারী লোক দুরাগ্রহী নহেন তাহারা যে কোনও সম্প্রদায়ভুক্ত হউক না কেন, বেদমত গ্রহণ করিতেন। যাহা হউক, নানকপন্থীরা ভোজন সম্বন্ধীয় গোলযোগ অনেকটা দূর করিয়াছেন। যেভাবে এই সমস্ত দূর করিয়াছেন সেই ভাবে যদি তাঁহারা বিষয়াসক্তি এবং দুরভিমান দূর করিয়া বেদমতের উন্নতি সাধন করিতেন তাহা হইলে বড়ই ভাল হইত।

প্রশ্ন –দাদুপন্থীদিগের পন্থা ত ভাল?

উত্তর –ভাল তো বেদ মার্গ। যদি পার তো অনুসরণ কর; নতুবা সর্বদা হাবুডুবু খাইতে থাকিবে। দাদুপন্থীদের দাদুজীর জন্ম গুজরাটে হইয়াছিল। পরে তিনি জয়পুরের নিকটবর্তী ‘আমের’ এ বাস করিতে থাকেন। তিনি তেলীর কাজ করিতেন। ঈশ্বরের সৃষ্টিলীলা বিচিত্র। দাদুরও পূজা হইতে লাগিল। এখন (হঁহার চেলার দল) বেদাদিশাস্ত্রের যাবতীয় উপদেশ পরিত্যাগ করিয়া ‘দাদুরাম-দাদুরাম’ জপ করাকেই মুক্তির সাধন বলিয়া মানিয়া লইয়াছে। যখন সত্যোপদেষ্টার অভাব হয় তখনই এই ধরণের ভ্রান্ত মত প্রচলিত হইয়া থাকে।

অল্পদিন হইল ‘রামসনেহী’ নামে অপর একটি মত সাহপুরা হইতে প্রচলিত হইয়াছে। তাহারা বেদোক্ত ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া রাম রাম জপ করাকেই শ্রেষ্ঠ এবং তাহাতেই জ্ঞান, ধ্যান ও মুক্তি মনে করেন। কিন্তু ক্ষুধার সময় রাম নাম’ হইতে অন্ন ব্যঞ্জন নির্গত হয় না; ভোজ্য, পানীয় প্রভৃতি তো গৃহস্থের গৃহেই পাওয়া যায়। ইহারাও মূর্তিপূজার নিন্দা করে বটে, কিন্তু নিজেরাই মূৰ্ত্তি হইয়া বসিয়াছে। ইহারা স্ত্রীলোকদের সংসর্গে অধিক সময় যাপন করে। কেননা রামজী রামকী’ ব্যতীত আনন্দই পায় না। (এবার রামস্নেহী মত সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বিবরণ লিখিতেছি)। রামচরণ’ নামে একজন সাধু ছিলেন। তাঁহার মত প্রধানতঃ মেওয়াড়ের অন্তর্গত শাহপুরা হইতে প্রচলিত হয়। তিনি “রাম রাম” শব্দকেই ‘পরম মন্ত্র এবং ইহাকে সিদ্ধান্ত বলিয়া মানেন। তাহার একটি গ্রন্থে সন্তদাস প্রভৃতির বাণী এই রূপ লিখিত আছে —

তাহার বচন ভরম রোগ তব হী মিট্যা, রট্যা নিরঞ্জন রাই। তব জম কা কাগজ ফট্যা, কটা কর্ম তব জাই’৷ সাথী ৬ ॥

এখন বুদ্ধিমানেরা বিচার বিবেচনা করিয়া দেখুন যে, “রাম” “রাম” উচ্চারণ করিলেই কি অজ্ঞানতা জনিত ভ্রম, অথবা যমরাজের পাপানুকূল শাসন, অথবা কৃতকর্ম কি কখনও নষ্ট হইতে পারে, না নষ্ট হওয়া সম্ভব? ইহা কেবল মনুষ্যদিগকে পাপে জড়িত করা এবং তাহাদের মানব-জন্ম নষ্ট করা মাত্র। এস্থলে ইহাদের পরম গুরু “রামচরণ”; তাহার কতিপয় বাক্য উদ্ধৃত করা হইল–

মহমা নব প্রতাপ কী, সুণৌ সরবণ চিত লাই। রামচরণ রসনা রটে, ক্ৰম সকল ঝড় জাই ॥ জিন জিন সুমিয়া নবকুঁ, সো সব উত্তর‍্যা পার ॥ রামচরণ জো বীর্যা, সসা হী জমকে দ্বার ॥ ২ ॥ রাম বিনা সব ঝুট বতায়ো ॥ (চৌ০২)। রাম ভজত ছুট্যা সব ক্রম্মা। চন্দ অরু সুর দেই পরকম্মা। রাম কহে তিনকুঁ ভৈ নাহী। তীন লোক মে কীরতি গাহী। রাম রটত জম জোর ন লাগৈ ৷ (১১) ৷ রাম নাম লিখ পথর তরাষ্ট্র। ভগতি হেতি ঔতার হী ধরহী৷ উঁচ নীচ কুল ভেদ বিচারৈ। সো তো জনম আপণো হারৈ৷ সৰ্তা কৈ কূল দীসৈ নাহী। রাম রাম কহরাম সম্হাঁহী ॥ ঐসসা কুণ জো কীরতি গাবৈ। হরি হরিজন কৌ পার ন পাবৈ ॥ রাম সস্তা কা অন্ত ন আবৈ। আপ আপকী বুদ্ধি সম গাবৈ ॥ (নাম প্রতাপ) ইহার খণ্ডন–

ইহার খন্ডন –প্রথমতঃ রামচরণ প্রভৃতির গ্রন্থপাঠে জানা যায় যে, তিনি একজন সরল প্রকৃতির গ্রাম্য মানুষ ছিলেন। তিনি লেখাপড়া জানিতেন না। নহিলে এ হেন নিরর্থক গল্প। লিখিবেন কী করিয়া? ইহা বলা তাঁহার ভুল যে, রাম রাম বলিলে কর্মের খণ্ডন হয়। এইরূপ শিক্ষা দ্বারা তাঁহারা কেবল তাহাদের এবং অপরের জীবন নষ্ট করিয়া থাকেন।

যমের ভয় ত মস্ত বড় হয় কিন্তু রাজ-সিপাহী, চোর ডাকাত, ব্যাঘ্ৰ, সৰ্প, বৃশ্চিক এবং মশক প্রভৃতির ভয় কখনও দূর হয় না। দিবারাত্র ‘রাম রাম জপ করিতে থাকুন কিছুই হইবে না। ‘শর্করা-শর্করা’ বলিলে যেমন মুখ মিষ্ট হয় না, সেইরূপ সত্যভাষণাদি কর্ম না করিয়া কেবল (মুখে) “রাম রাম’ বলিলে কিছুই হয় না। আর যদি রাম রাম বলিলে তাহাদের কথা রাম না শুনেন, তবে চিরজীবন রাম রাম বলিলেও শুনিবেন না। আর যদি শুনেন তাহা হইলে দ্বিতীয় বার ‘রাম রাম’ বলা ব্যর্থ।

এই সমস্ত লোক নিজেদের উদরপূর্তি ও অপরের জীবন নষ্ট করিবার জন্য একে ভণ্ডামি খাড়া করিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমরা শুনি এবং দেখি যে, নাম রাখা হইয়াছে ‘রামসনেহী’, কিন্তু কাজ করেন ‘রাঁড়সনেহী’। যে দিকে দেখিবেন সে দিকেই সাধুদের বিধবারা ঘিরিয়া রহিয়াছে।

ভণ্ডামী প্রচলিত না হইলে আৰ্য্যাবর্তের এমন দুর্দশা হইবে কেন? তাহারা নিজেদের চেলাদিগকে এঁটো ভোজন করায়। স্ত্রীলোকেরাইহাদিগকে দণ্ডবৎ সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে। নির্জন স্থানে স্ত্রীলোকদের সহিত সাধুদের বৈঠক চলে।

এবার ইহার দ্বিতীয় শাখা–

মারওয়াড়ের অন্তর্গত ‘খেড়াপা’ গ্রাম [যোধপুর রাজ্যের একটি বৃহৎ গ্রাম] হইতে তাহাদের একটি শাখা গজাইয়া ওঠে; তাহার বৃত্তান্ত এইরূপ। ‘রামদাস’ নামে এক বড়ই চতুর চর্মকার ছিল। তাহার দুইটি স্ত্রী। সে প্রথমে বহুদিন পর্যন্ত অঘোরী হইয়া কুকুরের সহিত একত্র ভোজন করিত। ইহার পর সে হইল কুণ্ডাপন্থী। অবশেষে সে রামদেবের ‘কামাড়িয়া’ হইল [রাজপুতানায় চর্মকারগণ গৈরিক বস্ত্র পরিধান করিয়া ‘রামদেব’ প্রভৃতির গান করিয়া থাকে। তাহারা এই গানকে ‘শব্দ’ বলে, তাহারা চর্মকার এবং অন্যান্য জাতিকে শুনায়। উহাদিগকে কামড়িয়া বলা হয়]। সে তাহার দুই স্ত্রীর সহিত গান করিত। পৰ্যটন করিতে করিতে সীথল গ্রামে চর্মকারদের গুরু রামদাসের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয়। রামদাস তাহাকে রামদেবের মতবাদ সম্বন্ধে উপদেশ দিয়া চেলা করে। সেই রামদাস ‘খেড়াপা’ গ্রামে আখড়া করিয়া এতদঞ্চলে তাহার মত প্রচার করিতে লাগিল।

ওদিকে ‘সাহপুরে’ রামচরণের মত প্রচার হইতে লাগিল। তাহাদের এইরূপ বৃত্তান্ত শুনা যায়। রামচরণ ছিল জয়পুরের একজন বণিক। সে ‘দাঁতড়া গ্রামে জনৈক সাধুর নিকট ভেক নেয় এবং তাহাকেই গুরু করে। পরে সে সাহপুরে আখড়া গড়িয়া তোলে ॥

সরল প্রাণ লোকদের মধ্যে ভ্রান্ত মত শীঘ্রই বদ্ধমূল হয়। তাহার মতও জমিয়া উঠিল। যাহারা রামচরণের পূর্বোক্ত উপদেশানুসারে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে, তাহাদের মধ্যে উচ্চ-নীচ কোন ভেদ থাকে না, ব্রাহ্মণ হইতে অন্ত্যজ পর্যন্ত তাহাদের চেলা হইয়া থাকে। এখনও তাহার কুণ্ডাপন্থী সদৃশই আছে। কেননা, তাহারা মাটির সরায় সাধুদের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করে। তাহারা অন্যের সন্তানদিগকে বৈদিকধর্ম, মাতা-পিতা এবং সাংসারিক ব্যবহার হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া চেলা করিয়া লয়। আর ‘রাম’ নামকেই ‘মহামন্ত্র এবং ইহাকেই ‘ছুচ্ছম’ [‘ছুচ্ছম’ অর্থাৎ সূক্ষ্ম] বেদ বলিয়া মানে ও বলে। রাম রাম বলিলে অনন্ত জন্মের পাপ দূর হয়। ইহা ছাড়া কাহারও মুক্তি হয় না।

যিনি শ্বাস প্রশ্বাসের সহিত রাম নাম জপ করিবার উপদেশ দেন, তাহারা তাহাকেই সত্য গুরু বলে, সত্য গুরুকে পরমেশ্বর অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বলিয়া বিশ্বাস করে এবং তাহার মূৰ্ত্তি ধ্যান করে। সাধুদের চরণ ধুইয়া পান করে। যখন চেলা গুরুর নিকট হইতে দূর দেশে গমন করে তখন তাহারা গুরুর নখ ও শ্মশ্রু-কেশ নিজের নিকটে রাখিয়া দেয় এবং ঐ সকল প্রক্ষালন করিয়া নিত্য চরণামৃত রূপে পান করে।

তাহারা রামদাস এবং হররামদাসের বাণী গ্রন্থকে বেদ অপেক্ষাও অধিক মান্য করে এবং উহাকে পরিক্রমা করিয়া তাহারা আট বার দণ্ডবৎ প্রণাম করে। গুরু নিকটে থাকিলেও তাহাকে দণ্ডবৎ প্রণাম করা হয়। স্ত্রী-পুরুষকে একই নাম রাম রাম’ মন্ত্রের উপদেশ দেওয়া হয়। ইহারা নাম স্মরণ করাকে কল্যাণকর এবং অধ্যয়ন করাকে পাপ মনে করে।

ইহাদের সাথী-–

পণ্ডিতাই পানে পড়ী, ও পূরব লো পাপ রাম রাম সুমরাবিনা রইগৌরীতো আপ ॥১॥ বেদ পুরাণ পঢ়ে পঢ় গীতা, রাম ভজন বিন রই গয়ে রীতা ॥

এই সব ধরনের পুস্তক রচনা করিয়াছে। ইহাদের মতে স্ত্রীর পক্ষে পতিসেবা পাপ, গুরু ও সাধু সেবাই ‘ধর্ম। তাহারা বর্ণাশ্রম মানে না। ব্রাহ্মণ রামম্নেহী’ না হইলে তাহাকে নীচ, চণ্ডাল, কিন্তু রামস্নেহী হইলে তাহাকে উত্তম মনে করে।

তাহারা ঈশ্বর অবতার স্বীকার করে না, কিন্তু রামচরণের বচনে যাহা উপরে লেখা হইয়াছে যে, ভগতি হেতি ঔতার হী ধরহী ॥

ভক্তি এবং সাধুদিগের হিতার্থে অবতার হওয়াও স্বীকার করে। তাহাদের ঐ সমস্ত ছল চাতুরী আৰ্য্যাবর্তের পক্ষে অহিতকারী। এতদ্বারা বুদ্ধিমান অধিক বুঝিয়া লইবেন ॥

প্রশ্ন –গোকুলিয়া গোঁসাইদের মত তো অতি উত্তম? দেখ! ইহারা কীরূপ ঐশ্বৰ্য্য ভোগ করে? এই ঐশ্বৰ্য্য লীলা ব্যতীত কি এরূপ হওয়া সম্ভব?

উত্তর –এ সকল ঐশ্বৰ্য্য গৃহস্থদের, গোঁসাইদের কিছুই নহে।

প্রশ্ন –বাহবা! বাহবা! এসকল গোঁসাইদের প্রতাপেই হইয়াছে। কেননা, অপর কাহারও পক্ষে ঐশ্বৰ্য্য সম্ভব পর হয় না কেন?

উত্তর –অন্যেরাও এরূপ ছল-প্রপঞ্চ রচনা করিলে যে ঐশ্বৰ্য্য লাভ করিবে তাহাতে আর সন্দেহ কোথায়? আর ইহাদের অপেক্ষা অধিক ধূৰ্ত্তৰ্তা করিলে অধিক ঐশ্বৰ্য্য লাভ তো হইতেই পারে।

প্রশ্ন –বাহবা! ইহাতে ধূর্ততার কী আছে? এসব ত ‘গোলোকের’ লীলা!

উত্তর –গোলোকের লীলা নয় কিন্তু গোঁসাইদের লীলা। গোলোকের লীলা হইলে গোলকও তেমনই হইবে।

‘তৈলঙ্গ’ দেশ হইতে এই মত প্রচলিত হইয়াছে। লক্ষণভট্ট নামক জনৈক তৈলঙ্গী ব্রাহ্মণ, বিবাহের পর কোন কারণে মাতা-পিতা এবং স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া কাশী গমন করে এবং ‘আমার বিবাহ হয় নাই, এইরূপ মিথ্যা বলিয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করে।

দৈবযোগে তাহার মাতা-পিতা ও স্ত্রী শুনিতে পায় যে, সে কাশীতে গিয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছে। তাহার মাতা-পিতা ও স্ত্রী কাশীতে উপস্থিত হইয়া যিনি তাহাকে সন্ন্যাস দিয়াছিলেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনি আমাদের পুত্রকে কেন সন্ন্যাসী করিয়াছেন? এই দেখুন। ইহার যুবতী স্ত্রী রহিয়াছে।

তাহার স্ত্রী বলিলেন, –‘যদি আপনি আমার পতিকে আমার সঙ্গী না করেন, তবে আমাকেও সন্ন্যাস দিন।’ তখন সাধু লক্ষণভট্টকে ডাকিয়া বলিলেন, তুমি তো বড় মিথ্যাবাদী –সন্ন্যাস পরিত্যাগ করিয়া গৃহাশ্রমে যাও। কারণ তুমি মিথ্যা বলিয়া সন্ন্যাস লইয়াছ। সে তাহাই করিল এবং সন্ন্যাস পরিত্যাগ করিয়া তাহাদের সহিত যাত্রা করিল।

দেখুন, এই মতের মূলেই মিথ্যা এবং কপটতা। সে তৈলঙ্গ দেশে উপস্থিত হইলে কেহই তাহাকে সমাজে গ্রহণ করিল না। তখন সেস্থান হইতে বাহির হইয়া ভ্রমণ করিতে করিতে কাশীর নিকটবর্তী ‘চরণার্গঢ়’, এর নিকটে ‘চম্পারণ্য’ নামক বনে উপস্থিত হইয়াছিল। সে স্থানে কেহ একটি শিশুকে জঙ্গলে ফেলিয়া তাহার পর দূরে-দূরে চারিদিকে অগ্নি জ্বালিয়া চলিয়া গিয়াছিল। যাহারা শিশুকে ফেলিয়া গিয়াছিল, তাহারা ভাবিয়াছিল যে, অগ্নি জ্বালাইয়া না রাখিলে এখনই কোন জীব শিশুটিকে মারিয়া ফেলিবে।

লক্ষণভট্ট ও তাহার পত্নী শিশুটিকে পুত্ররূপে গ্রহণ করিয়া আবার কাশীবাসী হইল। শিশুটি বড় হইলে তাহার মাতাপিতার মৃত্যু হয়। সে কাশীতে বাল্যকাল হইতে যৌবন পৰ্য্যন্ত কিঞ্চিৎ

লেখাপড়াও শিখিতেছিল। ইহার পর অন্য কোথাও যাইয়া বিষ্ণুস্বামীর মন্দিরে চেলা হইল। সেখানে। কোন গোলযোগ উপস্থিত হওয়ায় সে পুনরায় কাশী চলিয়া আসে এবং সন্ন্যাস গ্রহণ করে। সে সময়ে কোন এক সমাজ বহিষ্কৃত ব্রাহ্মণ কাশীতে বাস করিতেন। তাঁহার একটি যুবতী কন্যা ছিল। ব্রাহ্মণ তাহাকে বলিল,- তুমি সন্ন্যাস পরিত্যাগ করিয়া আমার কন্যাকে বিবাহ কর। তাহাই হইল। যাহার পিতা যে সব লীলা খেলা খেলিয়াছিল, পুত্রই বা সেরূপ করিবে না কেন? সে পূর্বে যে বিষ্ণুস্বামীর মন্দিরে চেলা হইয়াছিল স্ত্রীকে লইয়া সে সেই স্থানে চলিয়া গেল; কিন্তু তাহারা বিবাহিত বলিয়া সেখান হইতেও বিতাড়িত হইল।

পরে সে অবিদ্যার গৃহস্বরূপ ব্রজদেশে যাইয়া স্বীয় নানা প্রকার ছল-চাতুরী এবং যুক্তি দ্বারা নিজের প্রপঞ্চ বিস্তার করিতে লাগিল। সে মিথ্যা প্রচার করিল, শ্রীকৃষ্ণের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছে; তিনি আমাকে বলিয়াছেন গোলোক হইতে যে সমস্ত ‘দৈব জীব’গণ মর্ত্যলোকে আসিয়াছে, তাহাদিগকে ‘ব্রহ্মসম্বন্ধ’ প্রভৃতি দ্বারা পবিত্র করিয়া গোলোকে প্রেরণ কর। সে এইভাবে মূর্খদিগকে প্রলোভনের কথা শুনাইয়া অল্প কয়েকজনকে অর্থাৎ ৮৪ জনকে বৈষ্ণব করিল।

নিম্নলিখিত মন্ত্র রচনা করিয়া তাহার মধ্যেও ভেদ রাখিল, যথা—

“শ্রীকৃষ্ণঃশরণং মম’ ॥১॥ ক্লীং কৃষ্ণায় গোপীজনবল্লভায় স্বাহা ॥ ২॥ এই দুইটি সাধারণ মন্ত্র, কিন্তু পরবর্তী মন্ত্রটি ব্রহ্মসম্বন্ধ এবং সমর্পণ করাইবার জন্য শ্রীকৃষ্ণশরণংমম সহস্ৰপরিবৎসরমিতকালজাতকৃষ্ণবিয়োগজনিতপক্লেশানন্ত তিরোভাববাহং ভগবতে কৃষ্ণায় দেহেন্দ্রিয় প্রাণান্তঃকরণ তদ্ধর্মাংশ্চ দারাগারপুত্রাপ্তবিত্তেহপরাণ্যাত্মনা সহসমপয়ামি, দাসোহং কৃষ্ণ তবাম্মি।

(সমীক্ষা) এই মন্ত্রোপদেশ দ্বারা শিষ্য-শিষ্যাদিগকে সমর্পণ করান হইয়া থাকে। ‘ক্লীং কৃষ্ণায়েতি’ ইহা ‘ক্লীং’ তন্ত্রগ্রন্থোক্ত। ইহার দ্বারা জানা যায় যে এই বল্লভমতও বামমার্গীদের প্রকার ভেদ মাত্র। এই কারণেই গোঁসাইগণ প্রায়ই স্ত্রীসঙ্গ করে; ‘গোপী’ (জন) বল্লভেতি’–শ্রীকৃষ্ণ কি কেবল গোপীদেরই প্রিয় ছিলেন। অপর কাহারও প্রিয় ছিলেন না? ‘স্ত্রৈণ’ অর্থাৎ স্ত্রীসংসর্গে আসক্ত, তাহারাই স্ত্রীলোকদিগের প্রিয় হইয়া থাকে। শ্রীকৃষ্ণ কি এইরূপ ছিলেন?

এবার ‘সহস্র পরিবৎসরেতি’ –সহস্র বৎসরের গণনা ব্যর্থ। কারণ, বল্লভ এবং তাহার শিষ্যগণ তো সর্বজ্ঞ নহে। শ্রীকৃষ্ণের বিয়োগ কি এক সহস্র বৎসর পূর্বে হইয়াছিল? আর ইহা ত আজকালকার কথা। কিন্তু যে সময়ে বল্লভ মত ছিল না এবং যখন বল্লভেরও জন্ম হয় নাই, তৎপূর্বে তিনি তাহার দৈবী জীবদিগের জন্য আসেন নাই কেন? ‘তাপ’ এবং ক্লেশ’ উভয়ই পর্যায়বাচী শব্দ; সুতরাং দুইটির মধ্যে একটিই গ্রহণ করা উচিত ছিল, দুইটি নহে ॥

‘অনন্ত’ শব্দের পাঠ করা নিরর্থক। কেননা ‘অনন্ত শব্দ রাখিলে ‘সহস্র’ শব্দের পাঠ রাখা উচিত নহে। সহস্র’ পাঠ রাখিলে ‘অনন্ত’ শব্দের পাঠ সর্বত্থ ব্যর্থ। আর যে ব্যক্তি অনন্তকাল পৰ্য্যন্ত তিরোহিত’অর্থাৎ আচ্ছাদিত থাকে, তাহার মুক্তির জন্য বল্লভের প্রয়োজনও ব্যর্থ। কারণ অনন্তের অন্ত হয় না।

ভালরে ভাল। দেহেন্দ্রিয়, প্রাণান্তঃকরণ এবং উহার ধর্ম, স্ত্রী, পুত্র,স্থান, বাসস্থান এবং প্রাপ্তধন কৃষ্ণকে অর্পণ করিতে হইবে কেন? কেননা কৃষ্ণ পূর্ণকাম; তিনি কোনও প্রকার দেহাদির ইচ্ছা করিতে পারেন না। কারণ ‘দেহ’ বলিতে নখ-শিখাগ্র পর্যন্ত বুঝায়। দেহের মধ্যে মন্দ যাহা কিছু আছে, মলমূত্রাদি পর্যন্ত তাহা কীরূপে সমর্পণ করা যাইবে?

আবার পাপ পুণ্যরূপ যে কর্ম, উহা কৃষ্ণকে অর্পণ করা হইলে কৃষ্ণই উহার ফলভোগী হইবেন। অর্থাৎ নাম তো লওয়া হয় কৃষ্ণের, কিন্তু সমর্পণ করান হয় নিজের জন্য। তাহা হইলে দেহের মধ্যে মলমূত্রাদি সমস্তই গোঁসাই ঠাকুরকে ‘অপর্ণ করা হয় না কেন? তবে কি মিষ্টি-মিষ্টি গেলা আর তেতো-তেতো থু!? আবার ইহাও লিখিত আছে যে, গোঁসাই ঠাকুরকেই অর্পণ করিবে, অন্য কোন মতাবলম্বীকে করিবে না। এসকল নিত্যন্ত স্বার্থপরতার কথা। অপরের ধনসামগ্রী হরণ এবং বেদোক্ত ধর্মের নাশের জন্য এ সকল লীলা রচিত হইয়াছে। বল্লভের প্রপঞ্চ দেখ–

শ্রাবণস্যামলে পক্ষে একাদশ্যাংমহানিশি। সাক্ষা ভগবতা প্রোক্তং তদক্ষরশ উচ্যতে ॥১॥ ব্রহ্মসম্বন্ধকরাণাৎসর্বেষাং দেহজীবয়োঃ। সর্বদোষনিবৃত্তিৰ্হি দোষাঃ পঞ্চবিধ্যাঃ স্মৃতাঃ ॥ ২ ॥ সহজা দেশকালোত্থা লোকবেনিরূপিতাঃ। সংয়োগজাঃস্পর্শজাশ্চন মন্তব্যাঃ কদাচন ॥ ৩॥ অন্যথা সর্বদোষণাংন নিবৃত্তিঃ কথঞ্চন। অসমর্পিতব্যুনাং তস্মাদ্বজ্জনমাচরেৎ ॥৪॥ নিবেদিভিঃ সমর্পৈব সর্বংকুয়াদিতি স্থিতিঃ। ন মতং দেবদেবস্য স্বামিভুক্তিসমর্পণম্ ॥ ৫ ॥ তস্মাদাদৌ সর্বকায়ে সর্বস্তুসমর্পণম্। দত্তাপহারবচনং তথা চ সকলং হরেঃ ॥ ৬ ॥ ন গ্রাহ্যমিতি বাক্যং হিভিন্নমার্গপরং মত। সেবকানাং য়থা লোকে ব্যবহারঃ প্রসিধ্যতি ॥ ৭৷ তথা কায়ং সমর্পৈব সর্বেষাং ব্রহ্মতা ততঃ। গঙ্গাত্বে গুণদোষাণাং গুণদোষাদিবর্ণন ॥ ৮ ॥

এই সব শ্লোক গোঁসাইদের ‘সিদ্ধান্ত রহস্যাদি’ গ্রন্থে লিখিত আছে। ইহাই গোঁসাইদের মতের মূলতত্ত্ব। আচ্ছা যদি কেহ ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা করে, শ্রীকৃষ্ণের দেহান্তের কম পক্ষে পাঁচ সহস্র বৎসর অতীত হইয়াছে। তিনি (এমতাবস্থায়) বল্লভের সহিত শ্রাবণ মাসের অর্ধরাত্রে কীরূপে সাক্ষাৎ করিলেন? ॥ ১ ॥

যে ব্যক্তি গোঁসাইদের চেলা হয় এবং তাহাকে সমস্ত পদার্থ সমর্পণ করে তাহার শরীর এবং আত্মার সকল দোষ নিবৃত্তি হয়। মূর্খদিগকে বিভ্রান্ত করিয়া স্বমতে আনিবার ইহাই বল্লভের প্রপঞ্চ! গোঁসাইয়ের চেলা চেলিদের সমস্ত দোষ নিবৃত্ত হইলে তাহারা রোগ এবং দারিদ্র প্রভৃতি দুঃখের দ্বারা পীড়িত থাকে কেন? ঐ সকল দোষ পঞ্চবিধ ॥ ২ ॥

এক — সহজ দোষ –যাহা স্বাভাবিক কামক্রোধাদি হইতে উৎপন্ন। দুই –কোন দেশ-কালে যে সমস্ত নানাবিধ পাপ করা হয়।

তিন –সংসারে যাহাকে ‘ভক্ষাভক্ষ্য বিষয়ক দোষ বলা হয় এবং মিথ্যা ভাষণাদি যাহা বেদোক্ত দোষ।

চার –সংযোগজ–যাহা কুসঙ্গ অর্থাৎ চুরি, জারী= মাতা, ভগ্নী কন্যা, পুত্রবধূ ও গুরুপত্নী প্রভৃতির সহিত সমাগম করা।

পাঁচ –স্পর্শজ = অস্পর্শনীয়দের স্পর্শ করা। গোঁসাইদের মতাবলম্বিগণ এই পাঁচ প্রকার দোষ কখনও স্বীকার করে না অর্থাৎ তাহারা যথেচ্ছাচার করে ॥ ৩ ॥

গোঁসাই মত গ্রহণ ছাড়া নাকি কোন প্রকার দোষেরই নিবৃত্তি হয় না। তাই গোঁসাইদের চেলারা সমর্পণ না করিয়া কোন বস্তু ভোগ করে না। একারণ ইহাদের চেলারা নিজেদের স্ত্রী, পুত্রবধূ এবং ধন সামগ্রীও সমর্পণ করে। কিন্তু সমর্পণের নিয়ম এইরূপ যে, যতক্ষণ পর্যন্ত গোঁসাই ঠাকুরের চরণ স্ত্রী সেবায় সমর্পিত না হয় তত সময় স্বামী নিজের স্ত্রীকেও স্পর্শ করিবে না ॥৪॥

এইভাবে গোঁসাইদের চেলারা সমর্পণ করিবার পর নিজ নিজ ভোগ্য বস্তু সমূহ ভোগ করে। কেননা স্বামীর ভোগের পর সমর্পণ হইতে পারে না ॥ ৫ ॥

অতএব সকল কাৰ্যে সকল বস্তু প্রথমে সমর্পণ করিতে হয়। প্রথমে গোঁসাই ঠাকুরকে ভাৰ্য্যাদি সমৰ্পণ করিয়া পরে গ্রহণ করিবে। তদ্রপ হরিকে সকল পদার্থ সমর্পণ করিয়া গ্রহণ করিবে ॥৬ ॥

গোঁসাই ঠাকুরের মত ব্যতীত অন্য মতবিষয়ক কোন কথাও গোঁসাইদের চেলা-চেলীরা কখনও শুনিবে না এবং গ্রহণ করিবে না। ইহাই তাহাদের প্রসিদ্ধ ব্যবহার ॥৭ ॥

এইরূপে সকল বস্তু সমৰ্পণ করিয়া সকলের মধ্যে ব্রহ্মবুদ্ধি রাখিবে। তাহার পর যেরূপ গঙ্গায় অন্য জল মিলিত হইয়া গঙ্গারূপ হইয়া যায়, সেইরূপ অপর মতে যাহা দোষ, নিজ মতে তাহা গুণ হইয়া যায়। অতএব নিজ মতের গুণাবলী বর্ণন করিতে থাকিবে ॥ ৮ ॥

এবার বিচার করিয়া দেখুন, গোঁসাইদের মতবাদ অন্য সকল মতবাদ অপেক্ষা অধিক স্বার্থপরতা পূর্ণ কিনা? আচ্ছা, যদি কেহ এই গোঁসাইদিগকে জিজ্ঞাসা করে, –“তোমরা তো ব্রহ্মের একটি লক্ষণও জান না, শিষ্য-শিষ্যাদের সকলকে সেই ‘ব্রহ্ম’ সম্বন্ধে বোধ কীরূপে করাইবে? যদি বল ‘আমি ব্রহ্ম, আমার সহিত সম্বন্ধ হইলেই ব্রহ্মের সহিত সম্বন্ধ হয়, তাহা হইলে বলিতে হইবে –‘ব্রহ্মের গুণ-কর্ম-স্বভাব একটিও তোমাদের মধ্যে নাই। তুমি কি কেবল ভোগ বিলাসের জন্য ব্রহ্ম সাজিয়া বসিয়া আছ?

ভাল, তুমি ত শিষ্য-শিষ্যাদিগের নিজের নিকটে সমর্পিত করিয়া পবিত্র কর; কিন্তু তুমি এবং তোমার স্ত্রী,কন্যা এবং পুত্রবধূ প্রভৃতি অসমর্পিত থাকাতে, তাহারা অপবিত্র রহিয়া যায় কিনা? তোমরা অসমর্পিত বস্তুকে অপবিত্র মনে কর, তাহা হইলে অসমর্পিত মাতা-পিতা হইতে উৎপন্ন বলিয়া তোমরা অপবিত্র হইবে না কেন? অতএব তোমাদের স্ত্রী, কন্যা এবং পুত্রবধূ প্রভৃতিকে অন্য মতাবলম্বীদের নিকট সমর্পিত করা কর্তব্য। যদি বল না না, তাহা হইলে তোমরাও অপর স্ত্রী, পুরুষ এবং ধন-সম্পত্তিকে সমর্পিত করা ও করান ত্যাগ কর। আচ্ছা, এতদিন যাহা হইয়াছে, এবার মিথ্যাপ্রপঞ্চ প্রভৃতি কুকর্মগুলি পরিত্যাগ করিয়া পরমেশ্বরোক্ত সুন্দর বেদবিহিত সুপথে চলিয়া স্বীয় মানব জীবন সফল কর এবং ধর্ম-অর্থ কাম-মোক্ষ — এই চতুবর্গ ফল প্রাপ্ত হইয়া আনন্দ ভোগ কর।

আরও দেখ। গোঁসাইগণ তাহাদের সম্প্রদায়কে ‘পুষ্টিমার্গ’ বলে। অর্থাৎ পান-ভোজন করা, পুষ্ট হওয়া, স্ত্রীলোকদিগের সংসর্গ এবং যথেষ্ট ভোগবিলাস করাকে পুষ্টিমার্গ বলে। কিন্তু তাহাদিগকে বলা অবশ্যক যে,যখন তোমরা অত্যন্ত দুঃখদায়ক ভগন্দর প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হইয়া ছটফট করিতে করিতে তিলে তিলে মৃত্যুমুখে পতিত হও, তাহা কি তোমাদের অজানা?

সত্য বলিতে কী, উহা ‘পুষ্টিমার্গ’ নহে, কিন্তু ‘কুষ্ঠিমার্গ। যেমন কুষ্ঠরোগীর দেহ হইতে সমস্ত ধাতু গলিয়া গলিয়া বহির্গত হয় এবং সে বিলাপ করিতে করিতে দেহত্যাগ করে, ইহাদের লীলা-খেলার মধ্যেও সেইরূপ দেখিতে পাওয়া যায়। অতএব তাহাদের পন্থাকে ‘নরকমার্গ’ বলাই সঙ্গত। কেননা, দুঃখের নাম নিরক’ এবং সুখের নাম ‘স্বর্গ।

গোঁসাইগণ এইরূপ মিথ্যাজাল রচনা করিয়া, দুর্ভাগা সরল-প্রকৃতির জনসাধারণকে জালে জড়িত করে এবং নিজেকে শ্রীকৃষ্ণ মনে করিয়া সকলের স্বামী সাজিয়া বসে। ইহারা বলে– “যত দৈবী জীব গোলোক হইতে ইহলোকে আসিয়াছে, তাহাদের উদ্ধারের জন্য আমি লীলা পুরুষোত্তম রূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছি। যতদিন আমাদের উপদেশ গ্রহণ না করিবে, ততদিন গোলোক প্রাপ্তি ঘটিবে না। সেখানে একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই পুরুষ, অপর সকলেই স্ত্রীলোক।

বাহরে বাঃ! তোমাদের মত কী চমৎকার!! গোঁসাইদের যত চেলা আছে, তাহারা সকলেই গোপী হইবে।

এখন ভাবিয়া দেখুন যে, যে ব্যক্তির দুইটি স্ত্রী, তাহার কী মহাদুর্দশা। আর যেখানে একজন পুরুষ তাহার পিছনে কোটি-কোটি স্ত্রী যুক্ত রহিয়াছে, তাহার দুঃখের কি সীমা-পরিসীমা আছে?

যদি বল যে শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে মহান্ সামর্থ্য আছে, তিনি সকলকে সন্তুষ্ট করেন। তাহা হইলে তাঁহার যিনি স্ত্রী অর্থাৎ স্বামিনী, ঠাকুরাণি তাঁহার সামর্থ্যও শ্রীকৃষ্ণের তুল্য হইবে; কারণ তিনি শ্রীকৃষ্ণের অর্ধাঙ্গিনী। যদি ইহলোকে স্ত্রী-পুরুষদের কাম-চেষ্টা তুল্য, অথবা পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোকের অধিক হয়, তাহা হইলে গোলকেও তদ্রপ হইবে না কেন? যদি তাহাই হয়, তবে অন্য স্ত্রীদের সহিত স্বামিনী, ঠাকুরাণির কলহ বিবাদ হইতে থাকিবে; কারণ সপত্নীভাব অত্যন্ত ঘৃণ্য। এমতাবস্থায় গোলোকে স্বর্গ হওয়ার পরিবর্তে নরকবৎ হইয়া উঠিবে। আবার যেরূপ বহুস্ত্রীগামী পুরুষ ভগন্দর প্রতি রোগে পীড়িত থাকে, গোলোকেও সেইরূপ থাকিবে। ছি! ছি!! ছি!!! এমন গোলোক অপেক্ষা বেচারার মর্তলোকই ভাল। দেখ! ইহলোকে গোঁসাই ঠাকুর, নিজেকে শ্রীকৃষ্ণ মনে করে, এবং বহু স্ত্রীলোকের সহিত লীলা করিয়া ভগন্দর ও প্রমেহাদি রোগে পীড়িত হইয়া মহাদুঃখ ভোগ করে। এবার বলুন, যাঁহার নিজ স্বরূপ গোঁসাই ঠাকুর, সে যদি পীড়িত হয়, তাহা হইলে লোকনাথ শ্রীকৃষ্ণও এসকল রোগে পীড়িত হইবেন না কেন? তিনি যদি পীড়িত না হন, তাহা হইলে যে গোঁসাই ঠাকুর তাঁহার স্বরূপ, সে পীড়িত হয় কেন?

প্রশ্ন –মর্ত্যলোকে তিনি লীলাবতার ধারণ করেন বলিয়া রোগ এবং দোষাদি হইয়া থাকে, গোলোকে হয় না। কারণ, সেস্থানে রোগ দোষ নাই।

উত্তর –“ভোগে রোগভয়”; যেখানে ভোগ সেখানে রোগ অবশ্যই থাকে। আর শ্রীকৃষ্ণের কোটি-কোটি স্ত্রী হইতে সন্তান হয় কিনা? যদি হয়, তবে কি কেবল পুত্রই হয় না, কেবল কন্যাই হয়, না দুইই হয়?

যদি বল যে, কেবল কন্যাই হয়, তবে তাহাদের বিবাহ কাহাদের সহিত হয়? কেননা, সে স্থানে। তো কৃষ্ণ ব্যতীত অপর কোন পুরুষ নাই। যদি অপর জন থাকে, তবে তোমার প্রতিজ্ঞা হানি ঘটিল। যদি বল যে, কেবল পুত্রই হয় তাহা হইলেও এই দোষই ঘটিবে যে, তাহাদের বিবাহ কোথায় এবং কাহাদের সহিত হয়? অথবা নিজেদের ঘরেই ঝামেলা মিটাইয়া লওয়া হয়; অথবা যদি বল যে অন্য কাহারও পুত্র কন্যা তো আছে, তাহা হইলেও তোমার –“গোলোকে একটিমাত্র পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ” এই প্রতিজ্ঞার হানি হইল। আর যদি বল যে সন্তান হয়ই না, তাহলে শ্রীকৃষ্ণে নপুসংকত্ব এবং স্ত্রীতে বন্ধ্যাত্ব দোষ আসিবে ॥

ভাল, তবে এই গোলোক কীরূপ হইল? ইহা যেন দিল্লীর বাদশাহের বেগম সেনা৷ গোঁসাইগণ যে শিষ্যদের তন-মন-ধন আপনাদিগকে আপন স্বার্থে অর্পিত করাইয়া লয় তাহাও উচিত নহে। কারণ, বিবাহের সময় পতি পত্নীর দেহ একে অপরকে সমর্পণ করিয়াই দেয়। পুনরায় সমর্পিত দেহ অন্যকে পুনরায় সমর্পণ করা যায় না। কেননা, মনের সহিতই দেহ সমর্পণ হইতে পারে। মন ব্যতীত দেহ সমর্পণ করিলে সে ব্যভিচারী হইবে, অবশিষ্ট রহিল ধন। এবিষয়েও এই লীলা-খেলা জানিও অর্থাৎ মন ব্যতীত কিছুই সমর্পণ হইতে পারে না। গোঁসাইদের অভিপ্রায় এই যে, উপার্জন করিবে চেলা, আর আনন্দভোগ করিবে গোঁসাইরা।

বল্লভ সম্প্রদায়ভুক্ত গোঁসাইগণ কেহই তৈলঙ্গী জাতির নহে। যদি কেহ তাহাদিগকে ভুল করিয়া কন্যাদান করে, সেও জাতিচ্যুত ও ভ্রষ্ট হইয়া যায়। কারণ ইহারা জাতিচ্যুত, বিদ্যাহীন এবং তাহারা দিবারাত্র বিষয়ে আসক্ত থাকে।

আরও দেখুন! যখন কেহ গোঁসাই ঠাকুরদের আগমন উৎসব করে, তখন ঠাকুর তাহার গৃহে যাইয়া চুপচাপ কাষ্ঠ-পুত্তলিকার ন্যায় বসিয়া থাকে। কোন কাজও করে না। বেচারা মুখ না হইলে কথা অবশ্যই বলিত। সুতরাং তাহার পক্ষে ‘মুখানাং বলং মৌনম্’ অর্থাৎ মৌনই বল, কেননা কথা বলিলে তাহার রহস্য প্রকাশ হইয়া পড়িবে। কিন্তু মেয়েদের দিকে অত্যন্ত ধ্যান দিয়া দৃষ্টিপাত করিতে থাকে। আর গোঁসাইঠাকুর যাহার দিকে তাকাইবে, তাহার ভাগ্য প্রসন্ন জানিবে। তজ্জন্য তাহার পতি, ভ্রাতা, বন্ধু এবং মাতা-পিতা অত্যন্ত প্রসন্ন হয়।

স্ত্রীলোকেরা গোঁসাই ঠাকুরের চরণ স্পর্শ করে। যাহার প্রতি গোঁসাই ঠাকুরের মন বা কৃপা যখন আকৃষ্ট হয় তখন সে পদ দ্বারা তাহার একটি অঙ্গুলি টিপিয়া দেয়। তখন সেই স্ত্রীলোক এবং তাহার প্রতি আত্মীয়স্বজন নিজদিগকে ধন্য ও ভাগ্যবান মনে করে। তখন তাহার পতি প্রভৃতি সকলে তাহাকে বলে, ‘তুই গোঁসাই ঠাকুরের চরণ সেবায় যা।’ যে সকল স্থলে তাহার পতি আদি অপ্রসন্ন হয়, সে স্থলে দূতী এবং কুটনী দ্বারা কাৰ্য্যসিদ্ধি করান হয়। সত্য বলিতে কী, একাৰ্য্য সমাধ্য করাইবার জন্য মন্দিরে গোসাইদের অনেক স্ত্রীলোক থাকে।

এবার ইহাদের দক্ষিণার লীলা, অর্থাৎ এইভাবে দাবী কবে–গোঁসাই ঠাকুরের জন্য প্রণামী আনো। বউরাণীর, নন্দনের, কন্যা রত্নের, গৃহকর্তার, বহিরাগতের, গায়কের এবং নাপিতের এইরূপ সাত-আট দোকান হইতে যথেষ্ট মাল আত্মসাৎ করে। গোঁসাই ঠাকুরের কোন সেবকের মৃত্যুকাল উপস্থিত হইলে সে তাহার বক্ষের উপর চরণ রাখে এবং যাহা কিছু পায় তাহাই পকেটস্থ করে। বলুন এই কর্ম কি মহাব্রাহ্মণ এবং ডোম বা মুদ্দফরাসের নহে?

কোন কোন শিষ্য বিবাহের সময় গোঁসাই ঠাকুরকে আনাইয়া তাহার দ্বারাই পুত্রকন্যার বিবাহ দিয়া থাকেন। কোন কোন সেবক গোঁসাই ঠাকুরকে ‘কের স্নান করায় অর্থাৎ গোঁসাই ঠাকুরের শরীরে কেসরের (জাফরান) প্রসাধন লেপন করিয়া একটি বৃহৎ পাত্রের মধ্যে পিঁড়ি পাতিয়া স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়া তাহাকে স্নান করায়, কিন্তু বিশেষরূপে স্ত্রীলোকেরাই স্নান করাইয়া থাকে। তাহার পর গোঁসাই যখন পীতাম্বর পরিধান করিয়া, খড়ম পায়ে দিয়া বাইরে আসে তখন ধুতি পাত্রে ছাড়িয়া দিয়া আসে। তাহার সেই সিক্ত বস্ত্র নিড়াইয়া পাত্রে রাখা হয়। আর সেবকগণ সেই নিড়ান বস্ত্রের জল আচমন করে। উত্তম মশলাযুক্ত একটি পানের খিলি গোঁসাই ঠাকুরকে দেওয়া হয়। সে উহা চর্বণ করিয়া কিঞ্চিৎ গিলিয়া ফেলে, বাকীটুকু সেবকের জন্য রাখে। (কোনো ভক্ত) তাহার মুখের নিকট একটি রৌপ্যের ডিবা ধরিলে, সে সেই পাত্রে পানের পিক্‌ নিক্ষেপ করে। তাহারও “প্রসাদী” বিতরণ করা হয়। ইহার নাম “বিশিষ্ট প্রসাদী”।

এখন ভাবিয়া দেখুন, ইহারা কোন শ্রেণীর মনুষ্য? যে-স্থানে মূঢ়তা এবং অনাচার থাকে সে স্থানে এরূপই হয়। অনেকে সমর্পণ গ্রহণ করে। তাহাদের কেহ কেহ বৈষ্ণবদের হাতেই ভোজন করে, অন্যের হাতের ভোজন করে না। কেহ কেহ বৈষ্ণবদের হাতেও ভোজন করে না। এমন কি জ্বালানি পৰ্য্যন্ত ধুইয়া গ্রহণ করে। কিন্তু আটা, গুড়, চিনি এবং ঘি প্রভৃতি ধোয় না, ধুইলে যে নষ্ট হইয়া যাইবে। সুতরাং বেচারা করিবে কী? ধুইলে ত এসকল হাতছাড়া হয়!

গোঁসাইগণ বলেন –“আমরা ঠাকুরের সঙ্গে রঙ্গ-রস ভোগের জন্য অনেক ধন ব্যয় করি”। কিন্তু এসকল রঙ্গ-রাগ ভোগ তাহারা নিজেরাই করে। বাস্তবিক বলিতে কী, তাহাতে ভয়ানক অনর্থ হইয়া থাকে। উদাহরণ স্বরূপ –হোলির সময় পিচকারী ভরিয়া স্ত্রীলোকের অস্পর্শনীয় অর্থাৎ গুপ্ত স্থানে রং নিক্ষেপ করে। ব্রাহ্মণের পক্ষে রস বিক্রয় যে নিষিদ্ধ কর্ম, গোঁসাই ঠাকুররা তাহাও করিয়া থাকে।

প্রশ্ন –গোঁসাই ঠাকুর রুটি, ডাল, কঢ়ী –বেসন, দই ও মশালা দিয়া ঘাঁটা একপ্রকার ব্যঞ্জন; ভাত-তরকারী ও মঠরী– ময়দার তৈরী খাস্তা-নিমকী জাতীয় খাদ্য; তথা নাড়ু প্রভৃতি প্রকাশ্যভাবে বাজারে বসিয়া তো বিক্রয় করে না, কিন্তু নিজের ভৃত্যদের পাতায় ভাগ করিয়া দেয়, তাহারা সেগুলি বিক্রয় করে, গোঁসাই ঠাকুর নিজে বিক্রয় করে না।

উত্তর –গোঁসাই ঠাকুর তাহার ভৃত্যদিগকে মাসিক বেতন রূপে (টাকা) দিলে, তাহারা খাদ্য দ্রব্যের পাতা লইবে কেন? গোঁসাই ঠাকুর তাহার ভৃত্যদিগকে বেতনের পরিবর্তে ডাল-ভাত প্রভৃতি দিয়া থাকে। তাহারা ঐসকল বাজারে লইয়া গিয়া বিক্রয় করে। গোঁসাইগণ স্বয়ং বাজারে বিক্রয় করিলে, তাহাদের ব্রাহ্মণ ভৃত্যগণ রস বিক্রয়রূপ পাপ হইতে রক্ষা পাইত এবং শুধু গোঁসাইগণ রস বিক্রয়রূপ পাপের ভাগী হইত। প্রথমে তো, তাহারা এই পাপে নিজেরা ডুবে, পরে অপরকেও তাহাতে ডুবায়। কোথাও কোথাও নাথদ্বারা প্রভৃতি স্থানে গোঁসাই ঠাকুররা নিজেই বিক্রয় করিয়া থাকে। রস বিক্রয় করা নীচ কর্ম, শ্রেষ্ঠদের নহে। এইরূপ লোকেরাই আর্যাবর্তের অধোগতি আনিয়াছে।

প্রশ্ন– স্বামী নারায়ণের মত কেমন?

উত্তর –“য়াদৃশী শীতলাদেবী তাদৃশো বাহনঃ খরঃ”। গোঁসাইদের যেরূপ ধন-হরণ প্রভৃতি বিচার লীলা আছে, স্বামী নারায়ণ মতাবলম্বীদেরও সেইরূপ আছে।

দেখুন, অযোধ্যার নিকটবর্তী কোন গ্রামে সহজানন্দ’ নামক এক ব্যক্তির জন্ম হয়। ব্রহ্মচারীরূপে সে গুজরাট, কাঠিয়াবাড় এবং কচ্ছভুজ প্রভৃতি দেশে ঘুরিয়া বেড়াইত। সে দেখিল, এ দেশের লোক মূর্খ এবং সরল প্রকৃতির, ইহাদিগকে যেদিকে আকৃষ্ট করা যাইবে সেই দিকেই আকৃষ্ট হইবে ॥

সে সেখানে দুইচারিজন শিষ্য করিল। শিষ্যেরা একমত হইয়া ঘোষণা করিল যে, সহজানন্দ ‘নারায়ণের অবতার’ এবং তিনি একজন মহান্ সিদ্ধ পুরুষ। তিনি চতুর্ভুজ মূৰ্ত্তি ধারণ করিয়া ভক্তদিগকে সাক্ষাৎ দর্শনও দানও করেন।

এককালে কাঠিয়াবাড় অঞ্চলে কোনো ‘কাঠী’অর্থাৎ ‘দাদাখাচর’, একজন পার্বত্য ভূম্যধিকারী ছিল। শিষ্যগণ তাঁহাকে বলিল যে, “যদি আপনি চতুর্ভূজ নারায়ণ দর্শনের ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমরা সহজানন্দের নিকট প্রার্থনা করিতে পারি”। তিনি বললেন- “বেশ ভাল কথা”। তিনি ছিলেন সরল প্রকৃতির লোক। সহজানন্দ একটি গৃহের মধ্যে থাকিয়া মস্তকে মুকুট এবং দুই হাত উপরে তুলিয়া শঙ্খ-চক্র ধারণ করিল। অপর ব্যক্তি তাহার পশ্চাতে দাঁড়াইয়া দুই হাতে গদা-পদ্ম ধারণ করিয়া সহজানন্দের বগলের ভিতর দিয়া গদা-পদ্ম হাত দুখানি সম্মুখের দিকে প্রসারিত করিল। এইরূপে সহজানন্দ চতুর্ভুজ হইয়া গেল।

স্বামী নারায়ণের শিষ্যগণ দাদাখাচরকে বলিল– “একবার চক্ষু খুলিয়া দেখিবা মাত্র চক্ষু মুদিয়া এদিকে চলিয়া আসিবেন;অধিক দর্শন করিলে নারায়ণ ক্রুদ্ধ হইবেন। শিষ্যদের মনে এই চিন্তা ছিল যে, তিনি তাহাদের কপটতা যেন পরীক্ষা করিতে না পারেন। তাহারা দাদাখাচরকে

লইয়া গেল। সহজানন্দজী জরীর কাজকরা উজ্জ্বল রেশমী বস্ত্র পরিধান করিয়া অন্ধকার গৃহে। দণ্ডায়মান ছিল। তাহার শিষ্যগণ সেই গৃহাভিমুখে লণ্ঠনের আলো দেখাইল। দাদাখাচর তাকাইবা মাত্র চতুর্ভুজ মূর্তি দেখিলেন। তৎক্ষণাৎ দীপ আড়াল করিয়া দেওয়া হইল। তখন সকলে অবনত মস্তকে নমস্কার করিয়া অন্যদিকে চলিয়া গেল।

ইত্যবসরে শিষ্যগণ বলিতে লাগিল, “ধন্য আপনার ভাগ্য! আজ আপনি মহারাজের শিষ্য হইয়া পড়ুন।” তিনি বলিলেন, “বেশ ভাল কথা। তখন তাহারা সকলে স্থানান্তরে গমন করিল। সেস্থানে তাহারা দেখিল যে, সহজানন্দ অন্য বস্ত্র পরিধান করিয়া গদীর উপর বসিয়া আছেন। তখন শিষ্যগণ বলিল” ঐ দেখুন! এখন অন্যরূপ ধারণ করিয়া এস্থানে বিরাজমান।”

‘দাদাখাচর’ তাহাদের দলে আবদ্ধ হইলেন। তখন হইতে স্বামী নারায়ণ মত বদ্ধমূল হইল, কারণ, দাদাখাচর ছিলেন, একজন প্রসিদ্ধ জমিদার। সহজানন্দ সে স্থানেই স্বীয় মতের শিকড় পোক্ত করিল। ইতস্ততঃ পৰ্যটন করিয়া সকলকে উপদেশ দান করিত এবং অনেককে সাধুও করিত।

কখনও কখনও কোন সাধুর কণ্ঠশিরা রগড়াইয়া তাহাকে মূচ্ছিত করিয়া দিত এবং সকলকে। বলিত, ‘আমি ইহাকে সমাধিতে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি। এইরূপ ধূর্ততায় কাঠিয়াবাড়ের সাদাসিধে। সকল প্রকৃতির লোকেরা তাহার প্যাঁচে জড়াইয়া পড়িল। তাঁহার মৃত্যুর পর তাহার শিষ্যগণ। নানাপ্রকার ভণ্ডামীও ছড়াইতে লাগিল।

এ বিষয়ে নিম্নলিখিত দৃষ্টান্তই সমুচিত। কোনও এক চোর চুরি করিবার সময় ধরা পড়ে। বিচারক তাহার নাক, কান কাটিয়া দিবার দণ্ড দেন। তাহার নাক কাটা হইলে সে ধূর্ত নাচিতে, গাহিতে এবং হাসিতে লাগিল। লোকে জিজ্ঞাসা করিল –“এমন কী কথা”? সে বলিল– “বড়ই আশ্চর্যের কথা, আমি এমনটি কখনও দেখি নাই” ॥

সকলে বলিল, “কথাটি কী বলো”। সে বলিল, “আমার সম্মুখে সাক্ষাৎ চতুর্ভুজ নারায়ণ দাঁড়াইয়া আছেন দেখিয়া আমি অত্যন্ত প্রসন্ন হইয়াছি এবং নাচিয়া গাহিয়া নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতেছি, আমি সাক্ষাৎ নারায়ণ দর্শন করিতেছি”। সকলে জিজ্ঞাসা করিল, –“আমাদের দর্শন হইতেছে না কেন?” সে বলিল, –“নাকটি অন্তরায় সৃষ্টি করিয়াছে। নাক কাটাইয়া ফেল, নারায়ণের দর্শন পাইবে, নতুবা নহে ॥

তাহাদের মধ্যে কোন এক মূর্খ ইচ্ছা করিল যে, নাক যায় যা কিন্তু নারায়ণের দর্শন লাভ অবশ্যই করা উচিত। সে বলিল, –“আমারও নাক কাটিয়া আমাকে নারায়ণ দেখাও”। সেই ধূৰ্ত্ত তাহার নাকটি কাটিয়া কানে-কানে বলিল, –“তুমিও এইরূপ কর, নতুবা তোমার এবং আমার উভয়েরই উপহাস হইবে”। সেও ভাবিল নাক তো আর পাওয়া যাইবে না, সুতরাং এরূপ করাই সঙ্গত। তখন সেও সে স্থানে সেই ধূক্তের মত নাচিতে, লাফাইতে, গাহিতে, বাজাইতে এবং হাসিতে লাগিল ও বলিল, “আমিও নারায়ণ দেখিতেছি”।

এইরূপে ক্রমে ক্রমে এক সহস্র লোকের দল গড়িয়া উঠিল। চতুর্দিকে হুলুস্থুলু পড়িয়া গেল। সে তাহার সম্প্রদায়ের নাম রাখিল “নারায়ণদর্শী”।

কোন মূর্খ রাজা তাহা শুনিয়া তাহাদিগকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। যখন রাজা তাহাদের সম্মুখে উপস্থিত হইল, তখন তাহারা মহা আনন্দে নাচিতে, লাফাইতে এবং হাসিতে আরম্ভ করিল। তখন রাজা জিজ্ঞাসা করিল, “ব্যাপার কী”? তাহারা বলিল, –“আমরা সাক্ষাৎ নারায়ণ দেখিতেছি”।

রাজা –আমি দেখিতেছি না কেন?

নারায়ণদর্শী –যতক্ষণ নাক আছে ততক্ষণ দেখা যাইবে না। নাকটি কাটাইলে নারায়ণকে প্রত্যক্ষ ভাবে দেখা যাইবে।

রাজা ভাবিল কথাতো সত্য। রাজা বলিল, –গণকঠাকুর! শুভ মুহূর্ত দেখুন”। উত্তরে গণকঠাকুর বলিলেন, “যে আজ্ঞা অন্নদাতা!! দশমীর দিন প্রাতঃকালে আট ঘটিকার সময়, নাক কাটাইবার এবং নারায়ণ দর্শন করিবার অতি উত্তম মুহূর্ত আছে”।

বাহবা পোপ মহাশয়। নিজের পুঁথি পত্রে নাক কাটিবার এবং কাটাইবার মুহূর্তও লিখিয়া রাখিয়াছ? রাজার ইচ্ছানুসারে যখন উক্ত এক সহস্র নাককাটার জন্য ভোজনের ব্যবস্থা দেওয়া হইল,তখন তাহারা অত্যন্ত হৃষ্টচিত্তে নাচিতে, লাফাইতে এবং গাহিতে লাগিল। এই কাণ্ড দেখিয়া রাজার দেওয়ান প্রমুখ কোন কোন বুদ্ধিমান্ ব্যক্তির ভাল মনে হইল না ॥

রাজার চারি পুরুষের নব্বই বৎসরের এক বৃদ্ধ দেওয়ান ছিলেন। তাঁহার প্রপৌত্র সে সময়ে দেওয়ানের কাজে নিযুক্ত ছিলেন, তিনি বৃদ্ধ দেওয়ানের নিকট যাইয়া তাহাকে সেই বিষয়ে জানাইলেন। তখন বৃদ্ধ বলিলেন, –ইহারা ধূৰ্ত্ত, তুমি আমাকে রাজার নিকটে লইয়া চল”। তিনি লইয়া গেলেন। তিনি আসনে বসিলে রাজা অত্যন্ত আনন্দের সহিত নাককাটাদের কথা শুনাইলেন। বৃদ্ধ দেওয়ান বলিলেন, –“শুনুন মহারাজ! এখন শীঘ্র কিছু করা উচিত নহে। পরীক্ষা না করিয়া কাজ করিলে অনুতাপ করিতে হয়।

রাজা –হাজার হাজার লোক কি মিথ্যা বলিতেছে?

দেওয়ান –সত্য বলিতেছে কি মিথ্যা বলিতেছে, পরীক্ষা ব্যতীত উহা কীরূপে বলিতে পারেন?

রাজা –পরীক্ষা কীরূপে করা উচিত?

দেওয়ান– বিদ্যা, সৃষ্টিক্রম এবং প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ দ্বারা।

রাজা –যে এ সকল বিষয় অধ্যয়ন করে নাই, সে কীরূপে পরীক্ষা করিবে?

দেওয়ান –বিদ্বাদের সংসর্গে জ্ঞান বৃদ্ধি করিয়া।

রাজা –যদি বিদ্বান পাওয়া না যায়?

দেওয়ান– পুরুষকার সম্পন্নর পক্ষে কিছুই দুর্লভ নহে। রাজা –তাহা হইলে আপনিই বলুন, কী করা যায়?

দেওয়ান –আমি বৃদ্ধ, গৃহেই বসিয়া থাকি, আর অল্প কয়েক দিনই তো বাঁচিব, অতএব আমিই প্রথমে পরীক্ষা করিয়া লই, তাহার পর যাহা করা উচিত তাহাই করিবেন।

রাজা –অতি উত্তম কথা। গণকঠাকুর। দেওয়ানের জন্য মুহূর্ত দেখুন।

গণকঠাকুর –যাহা আজ্ঞা হয় মহারাজ! এই শুক্ল পঞ্চমীর বেলা দশটায় উত্তম মুহূর্ত আছে। যে দিন পঞ্চমী সেদিন বেলা আট ঘটিকায় বৃদ্ধ দেওয়ান রাজার নিকটে যাইয়া বলিলেন যে, হাজার দুয়েক সৈন্য লইয়া যাত্রা করা উচিত। —

রাজা –সেখানে সৈন্যের প্রয়োজন কী?

দেওয়ান –আপনি রাজা ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানেন না। আমি যেরূপ বলি সেরূপ করুন ॥

রাজা –আচ্ছা যাও ভাই, সেনা প্রস্তুত কর। সার্ধ নয় ঘটিকায় গাড়ীতে চড়িয়া সকলের। সহিত রাজা যাত্রা করিলেন। রাজাকে দেখিয়া তাহারা নাচিতে, গাহিতে লাগিল। রাজা উপবেশন করিলেন। তাহাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বাগ্রে নাক কাটাইয়াছিল, নাককাটা সম্প্রদায়ের সেই মোহন্তকে ডাকিয়া বলা হইল, –“আজ আমাদের দেওয়ানকে নারায়ণ দর্শন করাইয়া দাও।” মোহন্ত বলিল,–“আচ্ছা” ॥

বেলা দশটার সময় একটি লোক দেওয়ানের নাকের নীচে একটি থালা ধরিয়া রাখিল। তখন সেই মোহন্ত ধারালো ছুরিকা দ্বারা তাহার নাসিকা ছেদন করিয়া থালায় রাখিয়া দিল। দেওয়ানের নাক হইতে রক্তের ধারা বহিতে লাগিল। দেওয়ানের মুখ মলিন হইয়া গেল। তখন সেই ধূর্ত দেওয়ানের কানেও মন্ত্রোপদেশ প্রদান করিল, “আপনিও হাসিয়া সকলকে বলুন, আপনি নারায়ণ। দর্শন করিতেছেন। ছিন্ন নাসিকা তো আর ফিরিয়া পাইবেন না। এইভাবে না বলিলে, বড়ই উপহাস হইবে, সকলে ঠাট্টা বিদ্রূপ করিবে”। সে এই বলিয়া সরিয়া গেলে, দেওয়ান হাতে গামছা লইয়া নাক কাটাস্থান চাপা দিলেন।

রাজা দেওয়ানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “নারায়ণ দেখিতেছেন কি না বলুন”। দেওয়ান রাজার কানে কানে বলিলেন, –“কিছুই দেখিতেছি না; এই ধূর্ত অনর্থক হাজার-হাজার মানুষকে নষ্ট। করিয়াছে”। রাজা দেওয়ানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন কী করা কর্তব্য”? দেওয়ান বলিলেন, –“ইহাদের সকলকে ধরিয়া কঠোর দণ্ড দেওয়া উচিত। ইহাদের সকলকে যাবজ্জীবন কারাগারে বন্দী করিয়া রাখা উচিত। আর এই দুর্বৃত্ত, যে এই সব লোককে নষ্ট করিয়াছে, তাহাকে গাধার পিঠে চড়াইয়া নিতান্ত নিগ্রহ সহ বধ করা উচিত”। যখন রাজা এবং দেওয়ান কানে কানে কথা। বলিতেছিলেন, তখন তাহারা ভীত হইয়া পলায়ন করিতে উদ্যত হইল; কিন্তু চতুর্দিক সৈন্যবেষ্টিত থাকায় তাহারা পলায়ন করিতে পারিল না। রাজা আদেশ দিলেন, এই সব লোককে ধরিয়া তাহাদের পায়ে ‘বেড়ী’ পড়াইয়া দাও, এবং এই দুবৃত্তের মুখে কালি মাখাইয়া, ইহাকে গাধার পিঠে চড়াও। ইহার গলায় ছেঁড়া জুতার মালা পরাইয়া সর্বত্র ঘুরাও। চ্যাংড়াদের দিয়া ধূলি ছাই নিক্ষেপ করাও। পথের চৌমাথায় জুতার দ্বারা প্রহার করাও এবং কুকুরকে দিয়া খাওয়াইয়া বধ । কর। এরূপ না করিলে, অন্যেরাও এইরূপ কুকর্ম করিতে ভয় পাইবেন না”। এইরূপ করিবার। পর “নাককাটা-সম্প্রদায় বিলুপ্ত হইল। বেদবিরোধীদল এইভাবে পরের ধন হরণে অতিশয় চতুর। ইহাই সম্প্রদায়ীদের লীলা-খেলা।

স্বামী নারায়ণ মতালম্বীগণও অপরের ধন হরণ, ছলকপটতাপূর্ণ কর্ম করে এবং না জানি কত শত মূর্খকে মৃত্যুকালে এই বলিয়া বিভ্রান্ত করে, –“সহজানন্দ” শ্বেত-অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া তোমাকে মুক্তিধামে লইয়া যাইবার জন্য আসিয়াছেন; এবং নিত্য এই মন্দিরে একবার করিয়া আসিয়া থাকেন”। মেলার সময় পূজারীগণ মন্দিরের ভিতর থাকে। নীচে দোকান সাজাইয়া রাখা হয়। মন্দির হইতে দোকানে যাইবার একটি সংকীর্ণ পথ থাকে। কেহ নারিকেল নিবেদন করিলে, উহা সেই দোকানে আবার পাঠান হয় অর্থাৎ এইরূপ নিবেদিত একটি নারিকেল দিনের মধ্যে সহস্র বার বিক্রয় করা হয়। এইভাবে সমস্ত সামগ্রী বিক্রয় করা হয়।

যে সাধু যে শ্রেণীর, তাহার দ্বারা তদ্রপ কাৰ্য্যই করান হইয়া থাকে। যথা –নাপিত হইলে তাহা দ্বারা নাপিতের, কুম্ভকার হইলে কুম্ভকারের, শিল্পী হইলে শিল্পীর, বণিক হইলে বণিকের এবং শূদ্র হইলে শূদ্রের কার্য করান হইয়া থাকে।

ইহারা নিজেদের শিষ্যদের প্রতি এক প্রকার শুল্ক ধার্য্য করিয়াছে এবং প্রতারণা দ্বারা লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় করিয়াছে ও করিয়া চলিয়াছে। যে মানুষটি গদীতে বসে, সে গৃহস্থ, বিবাহ করে, অলঙ্কারাদি পরিধান করে। যখন কোন স্থানে আগমনোৎসব হয়, তখন গোকুলিয়াদের ন্যায় গোঁসাই ঠাকুর তাহার স্ত্রীর নামে পূজা–সামগ্রী লয় ॥

ইহারা নিজেদের সৎসঙ্গী’ এবং অপরাপর মতাবলম্বীদিগকে ‘কুসঙ্গী’ বলে। নিজেরা ছাড়া অপর কেহ, সে যতই উত্তম, ধার্মিক এবং বিদ্বান্ হউক না কেন, ইহারা কখনও তাহাদের সম্মান ও সেবা করে না। কারণ, ইহারা ভিন্নমতাবলম্বীর সেবা করাকে পাপজনক বলিয়া গণ্য করে। ইহাদের সাধুরা প্রকাশ্যভাবে স্ত্রীলোকের মুখ দর্শন করে না, কিন্তু গোপনে না জানি তাহাদের কত লীলা-খেলা হয়? ইহাদের খ্যাতি সর্বত্র হ্রাস পাইয়াছে; কোথাও কোথাও পরস্ত্রী গমন প্রভৃতি লীলা-খেলাও সাধুদের মধ্যে প্রকাশ পাইয়াছে।

ইহাদের মধ্যে কোন প্রধান ব্যক্তির মৃত্যু হইলে, তাহার মৃতদেহ গুপ্ত কূপে নিক্ষেপ করিয়া রটাইয়া বেড়ায় যে, “অমুক মহারাজ সশরীরে বৈকুণ্ঠে গিয়াছেন। সহজানন্দ আসিয়া তাহাকে লইয়া গিয়াছেন। আমরা অনেক প্রার্থনা করিলাম –“মহারাজ! হঁহাকে লইয়া যাইবেন না; কেননা এই মহাত্মা থাকিলেই ভাল হয়।” সহজানন্দ বলিলেন, –“না, এখন বৈকুণ্ঠে ইহার অত্যন্ত প্রয়োজন; সে কারণে হঁহাকে লইয়া যাইতেছি”। আমরা স্বচক্ষে সহজানন্দকে এবং তাহার বিমানকে দেখিয়াছি। তিনি সে মুমূর্মুকে বিমানে বসাইয়া পুষ্পবর্ষণ করিতে করিতে ঊর্ধ্বে লইয়া গেলেন”।

কোন সাধু রোগী হইলে যখন তাহার জীবনের আশা থাকে না, তখন সে বলে, “আমি কাল রাত্রে বৈকুণ্ঠে গমন করিব”। শুনা যায় সে, যদি সেই রাত্রিতে তাহার মৃত্যু না হয়, বা মূচ্ছিত। অবস্থায় থাকে, তখন তাহাকেও কূপে নিক্ষেপ করা হয়। এইরূপ করিবার কারণ সম্ভবতঃ এই যে, সেই রাত্রিতে নিক্ষেপ করা না হইলে, তাহাকে মিথ্যাবাদী হইতে হয়। সেইরূপ কোন গোকুলিয়া গোঁসাইয়ের মৃত্যু হইলে, তাহার চেলারা বলে, “গোঁসাইঠাকুর লীলা-বিস্তার করিতে গিয়াছেন”।

স্বামী নারায়ণ মতাবলম্বী এবং গোঁসাইদের মন্ত্র একই; যথা –“শ্রীকৃষ্ণ শরণং মম। এই মন্ত্রের এইরূপ অর্থ করা হয় –“আমি শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হইয়াছি। অপরদিকে ইহার অর্থ, ‘শ্রীকৃষ্ণ আমার শরণাগত, শরণপ্রাপ্ত’, এইরূপও হইতে পারে। এই সমস্ত যত সম্প্রদায় আছে তাহারা বিদ্যাহীন হওয়ায় মাথামুণ্ডহীন শাস্ত্রবিরুদ্ধ বাক্য রচনা করে, কারণ ইহারা বিদ্যার রীতিনীতি সম্বন্ধে অজ্ঞ ॥

প্রশ্ন –মাধ্ব মত তো ভাল?

উত্তর –যেরূপ অন্য মতাবলম্বী, সেইরূপ মাধ্বমতাবলম্বী, কেননা ইহারাও চক্রাঙ্কিত। ইহাদের এবং চক্রাঙ্কিতদের মধ্যে পার্থক্য এই মাত্র যে, রামানুজীয় কেবলমাত্র একবার চক্রাঙ্কিত হয়, কিন্তু মাধ্বগণ প্রতি বৎসর একবার করিয়া চক্রাঙ্কিত হয়। চক্রাঙ্কিতগণ ললাটে পীতবর্ণ রেখা এবং মাধ্বগণ কৃষ্ণবর্ণ রেখা অঙ্কন করেন। জনৈক মাধ্ব পণ্ডিতের সহিত কোন এক মহাত্মার শাস্ত্ৰবিচার হইয়াছিল।

মহাত্মা –তুমি কৃষ্ণবর্ণ রেখা এবং তিলক ধারণ করিয়াছ কেন?

শাস্ত্রী –এ সকল ধারণ করায় আমি বৈকুণ্ঠে যাইব। আর শ্রীকৃষ্ণের শরীর কৃষ্ণবর্ণ, তাই আমরা কৃষ্ণবর্ণ তিলক ধারণ করিয়া থাকি।

মহাত্মা –যদি কৃষ্ণরেখা এবং তিলক ধারণ করিলে বৈকুণ্ঠে যাওয়া যায়, তাহা হইলে সমস্ত মুখ কৃষ্ণবর্ণ করিলে কোথায় যাওয়া যাইবে? যদি শ্রীকৃষ্ণের শরীর কৃষ্ণবর্ণ ছিল, সেই রূপ তোমরাও তোমাদের সমস্ত শরীর কৃষ্ণবর্ণ কর, তাহা হইলে শ্রীকৃষ্ণের সহিত তোমাদের সাদৃশ্য হইবে। অতএব মাধ্ব মতও পূর্বোক্ত মত সমূহের সদৃশ।

প্রশ্ন –লিঙ্গাঙ্কিত মত কীরূপ?

উত্তর –চক্রাঙ্কিতদের ন্যায়। চক্রাঙ্কিতগণ চক্র দ্বারা চিহ্নিত হয় এবং লিঙ্গাঙ্কিতগণ লিঙ্গাকৃতি দ্বারা চিহ্নিত হইয়া থাকে। চক্রাঙ্কিতগণ যেমন নারায়ণ ব্যতীত অপর কাহাকেও মানে না, সেইরূপ লিঙ্গাঙ্কিতগণ লিঙ্গ দ্বারা চিহ্নিত হয় এবং ইহারা মহাদেব ব্যতীত অপর কাহাকেও মানে না। লিঙ্গাঙ্কিতদের বিশেষত্ব এই যে, তাহারা একটি পাষাণ লিঙ্গকে স্বর্ণ অথবা রৌপ্যমণ্ডিত করিয়া গলদেশে ধারণ করে। জলপান করিবার সময় সেই লিঙ্গকে দেখাইয়া পান করে। তাহাদের মন্ত্রও শৈবদের মত।

প্রশ্ন –ব্রাহ্মসমাজ এবং প্রার্থনা সমাজ ভাল কিনা?

উত্তর –কোনও কোনও বিষয়ে ভাল, আবার বহু বিষয়ে মন্দ ॥

প্রশ্ন –ব্রাহ্মসমাজ এবং প্রার্থনা সমাজ সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, কারণ ইহাদের নিয়ম অতি উত্তম।

উত্তর –নিয়ম সর্বাংশে উত্তম নহে; কেননা বেদবিদ্যাহীন ব্যক্তিদের কল্পনা সর্বথা সত্য। কীরূপে হইতে পারে? ব্রাহ্মসমাজ এবং প্রার্থনা সমাজ অল্পসংখ্যক লোককে খৃষ্টান মতের কবল হইতে রক্ষা করিয়াছে, পাষাণাদিমূৰ্ত্তির পূজাও কতক পরিমাণে দূর করিয়াছে এবং তাহাদিগকে অন্যান্য জাল গ্রন্থের কবল হইতে কিয়ৎ পরিমাণে রক্ষা করিয়াছে। এসকল ভাল কথা। কিন্তু —

(১) ইহাদের মধ্যে স্বদেশ-ভক্তি নিতান্ত অল্প। ইহারা খৃষ্টান-আচার বহুপরিমাণে গ্রহণ করিয়াছেন; পান ভোজন এবং বিবাহাদির নিয়মও পরিবর্তন করিয়াছেন।

(২) স্বদেশের প্রশংসা অথবা পূর্বপুরুষদের গৌরব করা তো দূরে থাকুক, তৎস্থলে শতমুখে নিন্দা করিয়া থাকেন। তাহাদের বক্তৃতায় ইংরেজ প্রভৃতি খৃষ্টানদের পেট ভরিয়া প্রশংসা করিয়া থাকেন কিন্তু ব্রহ্মাদি মহর্ষিদের নামটুকুও মুখে আনেন না। প্রত্যুত তাহারা এমনও বলিয়া থাকেন যে, এই সংসারে আজ পর্যন্ত ইংরেজ ব্যতীত অপর কেহ বিদ্বান্ হয় নাই; আৰ্য্যাবৰ্ত্তৰ্বাসিগণ চিরকাল মুখ ছিলেন এবং তাহাদের কখনও উন্নতি হয় নাই।

(৩) ব্রাহ্মগণ বেদাদির প্রশংসা করাত দূরে থাকুক, নিন্দা করিতেও পরাঙ্খ হন না। ব্রাহ্মসমাজের উদ্দেশ্যে রচিত পুস্তকে সাধুদের গণনায় ঈশা’, ‘মুস্য’, মহম্মদ’, নানক, এবং ‘চৈতন্য লিখিত আছে। কোন ঋষি মহর্ষির নামও নাই। ইহা হইতে জানা যায় যে, ইহারা যাঁহাদের নাম লিখিয়াছেন, ইহারা তাহাদেরই মতানুযায়ী। একবার ভাবিয়া দেখুন উক্ত সমাজের সভ্যগণ যদিও আৰ্য্যাবৰ্ত্তে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, এদেশেরই অন্ন-জল গ্রহণ করিয়াছেন ও করিতেছেন, তথাপি মাতাপিতা, পিতামহের পন্থা পরিত্যাগ করিয়া বিদেশীয় মতের দিকে অধিক আকৃষ্ট হইয়া থাকেন। ব্রাহ্ম সমাজী ও প্রার্থনা সমাজীরা এতদ্দেশীয় সংস্কৃত বিদ্যায় অনভিজ্ঞ হইয়াও নিজেদের বিদ্বান্ বলিয়া প্রকাশ করেন, ইংরাজী ভাষা পড়িয়া পাণ্ডিত্যাভিমানী হইয়া রাতারাতি একটা মত প্রচারে প্রবৃত্ত হওয়া মানব সমাজের স্থায়ী ও বৃদ্ধিকর কাৰ্য্য করা কীভাবে সম্ভব হইতে পারে?

(৪) ইংরেজ, যবন এবং অন্ত্যজ প্রভৃতির সহিতও হঁহারা পানভোজন সম্পর্কে কোন ভেদাভেদ রাখেন না। ইহারা সম্ভবতঃ ইহাই বুঝিয়াছেন যে, সকলের সহিত পানভোজন করিলেই এবং জাতিভেদ ভাঙ্গিয়া দিলেই তাঁহাদের এবং তাহাদের দেশের উন্নতি হইবে। কিন্তু ও সকল কাৰ্য্য দ্বারা উন্নতি তো হয়ই না, বরং বিপরীত বিকারই ঘটিয়া থাকে।

(৫) প্রশ্ন –জাতিভেদ ঈশ্বর কৃত না মনুষ্যকৃত?

উত্তর –ঈশ্বরকৃত ও মনুষ্যকৃত দুইই।

প্রশ্ন –ঈশ্বরকৃতই বা কোনটি আর মনষ্যকৃতই বা কোনটি?

উত্তর –মনুষ্য, পশু, পক্ষী, বৃক্ষ, জলচর জাতি পরমেশ্বরকৃত। যেরূপ গো, অশ্ব এবং হস্তী প্রভৃতি মধ্যে; অশ্বত্থ, বট এবং আভ্র প্রভৃতি বৃক্ষের মধ্যে; হংস, কাক এবং বক প্রভৃতি পক্ষীর মধ্যে এবং মৎস্য, কুম্ভীর প্রভৃতি জলজন্তুর মধ্যে জাতিভেদ সেইরূপ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং অন্ত্যজ প্রভৃতি মানুষের মধ্যে জাতিভেদ ঈশ্বরকৃত আছে। পরন্তু মনুষ্য মধ্যে ব্রাহ্মণ প্রভৃতি সামান্য জাতি নহে, কিন্তু সামান্য বিশেষাত্মক জাতিতে পরিগণিত।

ইহার পূর্বে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা প্রসঙ্গে যেরূপ লিখিত সেইরূপ গুণ-কর্ম-স্বভাব দ্বারাই বর্ণ ব্যবস্থা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। গুণ-কর্ম-স্বভাব পূর্বোক্ত অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রাদি বর্ণের পরীক্ষা করিয়া ব্যবস্থা অবলম্বন করা রাজা এবং বিদ্বাদিগের কর্তব্য। ইহাই মনুষ্যকৃত।

ভোজন ভেদও ঈশ্বরকৃত এবং মনুষ্যকৃত হইয়া থাকে। যথা সিংহ মাংসাহারী, আর গণ্ডার, মহিষ প্রভৃতি তৃণভোজী। এই ব্যবস্থা ঈশ্বর কৃত, কিন্তু দেশ-কাল-বস্তু ভেদে ভোজন মনুষ্যকৃত।

প্রশ্ন –দেখুন! ইউরোপীয়গণ বুট, জুতা,কোট, পেন্টলুন পরিধান করিয়া হোটেলে সকলের হস্তে ভোজন করেন। এই কারণ তাঁহারা নিজ উন্নতির পথে অগ্রসর হইতেছেন।

উত্তর –ইহা আপনার ভুল, কারণ মুসলমান এবং অন্ত্যজগণ সকলের হস্তে ভোজন করা সত্ত্বেও তাহাদের উন্নতি হয় না কেন?

ইওরোপীয়দিগের মধ্যে বাল্যবিবাহ নাই; বালক বালিকাদের মধ্যে বিদ্যা ও সুশিক্ষার প্রচলন আছে। তাঁহাদের মধ্যে স্বয়স্বর বিবাহ প্রচলিত আছে। তাহারা অসৎলোকের উপদেশ গ্রহণ করেন না; বিদ্বান্ হইয়া তাহারা যে কোনও লোকের পাষণ্ড মতে আবদ্ধ হন না; তাহারা যাহা কিছু করেন, সকলে পরস্পর বিচার-বিবেচনা করিয়া সভায় স্থির করেন, আপন স্বজাতির উন্নতির জন্য তনু-মন-ধন উৎসর্গ করেন, আলস্য পরিত্যাগ করিয়া সর্বদা উদ্যোগ করিতে থাকেন।

দেখুন। তাহারা ন্যায়ালয় ও কার্যালয়ে স্বদেশ-নির্মিত জুতা পরিয়া যাইবার অনুমতি দেন, কিন্তু এতদ্দেশীয় জুতা পরিয়া যাইতে দেন না। এইটুকু দ্বারা বুঝিয়া লাইবেন যে, তাহারা।

স্বদেশ-নির্মিত জুতার যতটুকু সম্মান করেন, ভিন্নদেশীয় মনুষ্যের ততটুকুও সম্মান করেন না।

দেখুন! একশত বৎসরের কিছু অধিক হইল, ইউরোপীয়গণ এদেশে আসিয়াছেন। কিন্তু তাহারা স্বদেশে যেরূপ মোটা বস্ত্রাদি পরিধান করিতেন, আজ পর্যন্ত তাহারা সেইরূপ বস্ত্রই পরিধান করিতেছেন। তাহারা স্বদেশের রীতি-নীতি পরিত্যাগ করেন নাই; কিন্তু আপনারা অনেকে তাহাদের অনুকরণ করিয়াছেন। এই কারণ আপনারা নির্বোধ আর তাহারা বুদ্ধিমান বলিয়া বিবেচিত। অনুকরণ করা কোন বুদ্ধিমানের কার্য নহে। আর তাহারা যে কর্মে নিযুক্ত থাকেন তাহা যথোচিত রূপে সম্পাদন করেন। সর্বদা আজ্ঞানুবর্তী থাকেন এবং বাণিজ্যাদিতে স্বদেশবাসীদের সহায়তা করেন।

এই সকল উত্তম গুণ ও কর্ম দ্বারা তাহাদের উন্নতি হয়। তাহারা বুট, জুতা, কোট, পেন্টলুন। পরিধান; হোটেলে পান-ভোজনাদি সাধারণ ও গর্হিত কাৰ্য্য দ্বারা উন্নত হন নাই।

ইউরোপীয়দিগের মধ্যেও জাতিভেদ আছে। দেখুন! যে কোনও উচ্চপদস্থ ও উচ্চাধিকারী ইউরোপীয়ই হন না কেন, তিনি যদি ভিন্ন দেশীয় বা ভিন্ন মতাবলম্বী কন্যাকে বিবাহ করেন, অথবা যদি কোন ইউরোপীয় কন্যার সহিত কোন ভিন্নদেশীয় পুরুষের বিবাহ হয়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ অন্যেরা তাহাদের সহিত সহভোজন এবং বৈবাহিক সম্বন্ধ বন্ধ করিয়া দেন। ইহা জাতিভেদ নহে। তো কী? আপনারা সরল প্রকৃতির, তাই আপনাদিগকে এই বলিয়া বিভ্রান্ত করা হয় যে, তাহাদের মধ্যে জাতিভেদ নাই। আপনারাও আপন মূর্খতা বশতঃ তাহা বিশ্বাস করেন। অতএব যাহা কিছু করিবেন তাহা বিচার-বিবেচনা করিয়া করা উচিত, যাহাতে পরে অনুতাপ করিতে না হয়।

দেখুন! রোগীর জন্যই বৈদ্য এবং ঔষধের প্রয়োজন হয়, নীরোগের জন্য নহে। যাঁহারা বিদ্বান্ তাহারা নীরোগ; আর যাঁহারা বিদ্যাহীন তাহারা অবিদ্যারোগগ্রস্ত। সেই রোগ দূর করিবার জন্য রহিয়াছে সত্য-বিদ্যা এবং সত্য উপদেশ। এতদ্দেশীয়দিগের রোগ এই যে, তাহারা অবিদ্যাবশতঃ মনে করে যে, পান-ভোজন দ্বারাই ধর্ম থাকে এবং চলিয়া যায়। কাহাকেও পান ভোজন বিষয়ে অনাচার করিতে দেখিলে তাহারা বলে এবং মনে করে যে, সে ধর্মভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে। কেহ তাহার কথা শুনে না, তাহার নিকট বসে না এবং তাহাকে নিকটে বসিতেও দেয় না। এখন বলুন আপনাদের বিদ্যা কি স্বার্থের জন্য, না পরমার্থের জন্য? যদি আপনাদের বিদ্যা দ্বারা ঐ সব অবিদ্যাগ্রস্ত লোকেরা লাভবান হয়, তবেই তাহা পরমার্থ। যদি বলেন “তাহারা গ্রহণ করে না, আমরা কী করিব? ইহা আপনাদের দোষ, তাহাদের নহে। কারণ আপনারা সদাচারী হইলে তাঁহারা আপনাদের সংসর্গে আসিয়া উপকৃত হইতেন। কিন্তু আপনারা সহস্র লোকের হিত তুচ্ছ। করিয়া শুধু নিজেরা সুখভোগ করিয়াছেন। ইহা আপনাদের গুরুতর অপরাধ কারণ পরের উপকার করা ‘ধর্ম এবং পরের অনিষ্ট সাধনকে ‘অধর্ম’ বলে।

অতএব অজ্ঞদিগকে দুঃখসাগর হইতে পার করিবার জন্য বিদ্বানদিগের পক্ষে যথাযোগ্য আচরণ দ্বারা নৌকাস্বরূপ হওয়া কর্ত্তব্য। সর্বথা মূখের ন্যায় কাৰ্য্য করা উচিত নহে; কিন্তু যাহাতে প্রত্যহ তাহাদের এবং নিজেদের ক্রমশঃ উন্নতি হয়, তাহাই করা কর্তব্য।

প্রশ্ন –আমরা কোন পুস্তককে ঈশ্বরকৃত অথবা সর্বাংশে সত্য বলিয়া স্বীকার করি না, কারণ মানব-বুদ্ধি নির্ভান্ত হয় না। অতএব মনুষ্য প্রণীত সমস্ত গ্রন্থই ভ্রান্ত। এই জন্য আমরা সকল গ্রন্থ হইতে সত্য গ্রহণ এবং অসত্য বৰ্জন করি। বেদ, বাইবেল, কোরাণ অথবা যে কোন গ্রন্থই হউক না কেন, সর্বত্রই আমাদের পক্ষে গ্রহণীয়, কোন গ্রন্থের অসত্য গ্রহণীয় নহে।

উত্তর –যে যুক্তির দ্বারা নিজেরা সত্যগ্রাহী হইতে ইচ্ছা করিতেছেন, তাহাই আপনাদিগকে অসত্যগ্রাহী প্রতিপন্ন করিতেছে। কারণ যখন কোন মনুষ্যই নির্ভান্ত নহে, তখন আপনারাও মনুষ্য বলিয়া ভ্রান্ত। মনুষ্যের বাক্য সর্বাংশে প্রামাণিক নহে, সুতরাং আপনাদের বাক্যও বিশ্বাসযোগ্য নহে। আবার আপনাদের বাক্য সর্বৰ্থা বিশ্বাস করা উচিত –যদি ইহাই হয়, তাহা হইলেও বিষাক্ত অন্নের ন্যায় উহা পরিত্যাজ্য।

অতএব আপনাদের রচিত ব্যাখ্যা-গ্রন্থগুলি কাহারও পক্ষে প্রমাণ স্বরূপ গৃহীত হইতে পারে না। “চতুর্বেদী মহাশয় ষড়বেদী হইতে গিয়া নিজের দুই বেদ হারাইয়া দ্বিবেদী হইয়া পড়িলেন”। অপর সকলের ন্যায় আপনারাও সর্বজ্ঞ নহেন। সময় বিশেষে হয়তো আপনারাও ভ্রমবশতঃ অসত্য গ্রহণ এবং সত্য পরিত্যাগ করিয়া থাকেন। এইজন্য আমাদের ন্যায় অল্পজ্ঞদিগের পক্ষে পরমাত্মার বচনেরই সহায়তা গ্রহণ করা কর্ত্তব্য। বেদ বিষয়ক ব্যাখ্যানে যেরূপ লিখিয়া আসিয়াছি, আপনাদের সেরূপ স্বীকার করা উচিত, নতুবা “য়তো নষ্টস্ততো ভ্রষ্টঃ” হইতে হইবে। যেহেতু বেদে সকল সত্য পাওয়া যায় এবং তাহাতে অসত্যের লেশমাত্র নাই। অতএব বেদ গ্রহণ সম্বন্ধে সংশয় করা কেবল নিজের ও অপরের অনিষ্ট করা মাত্র।

এই কারণেই আৰ্য্যাবৰ্তর্বাসীগণ আপনাদিগকে নিজের বলিয়া মনে করেন না এবং আপনারা আর্যাবর্তের উন্নতির কারণ হইতে পারেন নাই। আপনারা যেন সকলে ঘরের ভিক্ষুক প্রতিপন্ন হইয়া মনে করিয়াছেন, “আমরা এইরূপে নিজেদের এবং অপর সকলের হিতসাধন করিব”। কিন্তু তাহা করিতে পারিবেন না।

কোন সন্তানের মাতাপিতা দুইজন, সংসারের সকল সন্তানের পালনভার গ্রহণ করিলে, সকলের পালন তো অসম্ভব হয়ই, অধিকন্তু নিজ সন্তানদেরও নষ্ট করিয়া ফেলেন, আপনাদেরও সেই অবস্থা। ভাবিয়া দেখুন, বেদাদি সত্যশাস্ত্র সমূহ স্বীকার না করিয়া আপনারা কি কখনও আপনাদের বাক্যের সত্য এবং অসত্যতার পরীক্ষা করিয়া আর্যাবর্তের উন্নতিসাধন করিতে সমর্থ হইবেন?

দেশের যে রোগ হইয়াছে, তাহার ঔষধ আপনাদিগের নিকটে নাই। ইউরোপীয়গণ আপনাদের অপেক্ষা রাখেন না, এবং আৰ্য্যাবর্তৃর্বাসিগণ আপনাদিগকে ভিন্ন মতাবলম্বী সদৃশ মনে করেন। এখনও যদি আপনারা বুঝিয়া বেদাদি শাস্ত্র মান্য করিয়া দেশের উন্নতিসাধনে প্রবৃত্ত হন, তবেই আপনাদের কল্যাণ। আপনারা বলেন যে, সমস্ত সত্য পরমেশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত হয়, তাহা হইলে পরমেশ্বর কর্তৃক ঋষিদিগের প্রকাশিত সত্যস্বরূপ বেদকে মানেন না কেন? অবশ্য না মানিবার কারণ এই যে আপনারা বেদ পড়েন নাই, পড়িবার ইচ্ছাও করেন না; এমতাবস্থায় আপনাদের বেদোক্ত জ্ঞান কীরূপে হইবে?

(৬) খ্রীষ্টান এবং মুসলমানদিগের ন্যায় আপনারাও উপাদান কারণ ব্যতীত জগতের উৎপত্তি এবং জীবের উৎপন্ন হওয়া স্বীকার করেন। সৃষ্টির উৎপত্তি এবং জীব ও ঈশ্বর বিষয়ের ব্যাখ্যা। প্রসঙ্গে ইহার উত্তর দ্রষ্টব্য। কারণ ব্যতীত কাৰ্য্য হওয়া যেরূপ অসম্ভব, উৎপন্ন বস্তুর নাশ না। হওয়াও সেরূপ অসম্ভব।

(৭) আপনাদের ইহাও একটি দোষ যে, আপনারা বিশ্বাস করেন যে, অনুতাপ এবং প্রার্থনা। দ্বারা পাপের নিবৃত্তি হয়। এই বিশ্বাসের দ্বারা জগতের পাপ অনেক বৃদ্ধি পাইয়াছে। কেননা পৌরাণিকগণ তীর্থযাত্রার সাহায্যে জৈনগণ নবকার মন্ত্রজপ এবং তীর্থাদি দ্বারা; খ্রীষ্টানগণ খ্রীষ্টের প্রতি বিশ্বাস দ্বারা এবং মুসলমানগণ “তোবাঃ, তোবাঃ’ শব্দউচ্চারণ দ্বারা ভোগ ব্যতীত পাপ মোচন হয় বলিয়া বিশ্বাস করেন। ইহাতে পাপ হইতে ভয়ের পরিবর্তে পাপের অধিক প্রবৃত্তে জন্মে। এ বিষয়ে ব্রাহ্ম এবং প্রার্থনা সমাজের সভ্যগণ পৌরাণিক প্রভৃতির সদৃশ। তাঁহারা যদি বেদ মানিতেন তাহা হইলে ভোগ ব্যতীত পাপ-পুণ্যের নিবৃত্তি হয় না জানিয়া, সর্বদা পাপ হইতে ভীত এবং ধর্মে প্রবৃত্ত হইতেন। ভোগ ব্যতীত পাপের নিবৃত্তি স্বীকার করিলে ঈশ্বর অন্যায়কারী হইয়া থাকেন।

(৮) আপনারা কর্মের অনন্ত উন্নতি বিশ্বাস করেন; তাহা কখনও হইতে পারে না। কারণ সসীম জীবের গুণ-কর্ম-স্বভাবের ফলও নিশ্চয়ই সসীম হইবে।

প্রশ্ন –যেহেতু পরমেশ্বর দয়ালু, অতএব তিনি সসীম কর্মেরও অনন্ত ফল দান করিতে পারেন।

উত্তর –তাহা হইলে পরমেশ্বরের ন্যায়কারিতা নষ্ট হইবে এবং কেহই সৎকর্মে উন্নতি করিতে পারিবে না; কারণ পরমেশ্বর অল্প সৎকর্মেরও অনন্ত ফল দান করিবেন এবং জীব যত পাপই করুক না কেন, তাহা অনুতাপ ও প্রার্থনা দ্বারা মোচন হইয়া যাইবে। এইভাবে ধর্মহানি এবং পাপকর্ম বৃদ্ধি পাইয়া থাকে।

প্রশ্ন –আমরা স্বাভাবিক জ্ঞানকে বেদ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ মনে করি, নৈমিত্তিক জ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে করি না। কেননা, পরমেশ্বর প্রদত্ত স্বাভাবিক জ্ঞান আমাদের না থাকিলে বেদের অধ্যয়ন-অধ্যাপন, অর্থবোধ এবং অর্থ-ব্যাখ্যা কীরূপে করিতে পারিবেন? এই কারণেই আমাদের মত অতি উত্তম।

উত্তর –আপনাদের একথা নিরর্থক; কারণ কাহারও দ্বারা প্রদত্ত জ্ঞান স্বাভাবিক হইতে পারে না। সহজাত স্বাভাবিক। ইহার হ্রাসবৃদ্ধি হইতে পারে না। স্বাভাবিক জ্ঞানের দ্বারা কেহই উন্নতি করিতে পারে না? নৈমিত্তিক জ্ঞানই উন্নতির কারণ। দেখুন! আপনারা এবং আমরা বাল্যকালে কর্তব্যাকর্তব্য এবং ধর্মাধর্ম কিছুই যথার্থরূপে জানিতাম না। বিদ্বাদিগের নিকট জ্ঞানলাভ করিয়াই। কৰ্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্য ও ধর্মাধর্ম বুঝিতে আরম্ভ করিলাম। অতএব স্বাভাবিক জ্ঞানকে সর্বোপরি স্বীকার । করা যুক্তি সঙ্গত নহে।

(৯) আপনারা যে পূর্বজন্ম স্বীকার করেন না উহা খৃষ্টান এবং মুসলমানদিগের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়া থাকিবেন। পুনর্জন্ম ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইহার যে উত্তর দেওয়া হইয়াছে, তাহাতে বুঝিতে পারিবেন। কিন্তু ইহা জানিয়া রাখুন যে, জীব শাশ্বত অর্থাৎ নিত্য এবং কর্মও প্রবাহরূপে নিত্য। কর্ম কর্মীর পরস্পর নিত্য সম্বন্ধ। জীব কি কোন স্থানে নিষ্কর্মা হইয়া বসিয়াছিল অথবা থাকিবে? আপনাদের কথানুসারে পরমেশ্বরও নিষ্কর্মা হইয়া পড়িবে। পূর্বজন্ম এবং পরজন্ম স্বীকার না। করিলে, কৃতহানি, অকৃতাভ্যাগম, নৈঘৃণ্য এবং বৈষম্য দোষও ঈশ্বরে ঘটিবে। কারণ জন্ম ব্যতীত পাপ-পুণ্যের ফলভোগ হইতে পারে না। কেননা অপরের যেরূপ সুখ-দুঃখ এবং লাভক্ষতি করা হইয়াছে, তদনুসারে ফলভোগ শরীর ধারণ ব্যতীত হইতে পারে না। পূর্বজন্মের পাপ-পুণ্য ব্যতীত ইহজন্মে সুখ-দুঃখের প্রাপ্তি কীরূপে সম্ভবপর হইতে পারে?

দ্বিতীয়তঃ –এসকল পূর্বজন্মের পাপ-পুণ্য অনুসারে না হইলে পরমেশ্বর অন্যায়কারী হইয়া পড়িবেন, এবং ভোগ ব্যতীত কৃত কর্ম নাশবৎ হইবে। এই নিমিত্ত আপনাদের একথাও যুক্তি সঙ্গত নহে।

(১০) আর এক কথা এই যে, পরমেশ্বর ব্যতীত দিব্যগুণবিশিষ্টপদার্থসমূহ এবং বিদ্বাদিগকে দেবতা বলিয়া স্বীকার না করাও সঙ্গত নহে। কারণ পরমেশ্বর মহাদেব। যদি তিনি দেব না হইতেন তাহা হইলে তাহাকে সব দেবগণের স্বামী মহাদেব কীরূপে প্রসিদ্ধ করা হইত?

(১১) অগ্নিহোত্র পরহিতকর কাৰ্য্য সমূহকে কর্তব্য বলিয়া মনে না করা সঙ্গত নহে ॥

(১২) ঋষি মহর্ষি কৃত উপকার স্বীকার না করিয়া যীশু প্রভৃতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়াও ভাল কথা নহে ॥

(১৩) কারণ-বিদ্যা বেদ ব্যতীত, অন্য কাৰ্য-বিদ্যার প্রতি প্রবৃত্তি স্বীকার করা সর্বথা অসম্ভব।

(১৪) বিদ্যার চিহ্নস্বরূপ যজ্ঞোপবীত এবং শিখাকে পরিত্যাগ করিয়া মুসলমান এবং খ্রীষ্টানদের ন্যায় হওয়া বৃথা। পেন্টলুন প্রভৃতি পরিধান করিতেছেন এবং ‘পদক’ পাইবার ইচ্ছাও করিতেছেন, আর যজ্ঞোপবীত প্রভৃতি কিবিরাট্‌ ভার হইয়া গিয়াছে?

(১৫) ব্রহ্মা হইতে আরম্ভ করিয়া পরবর্তীকালে আর্যাবর্তে অনেক বিদ্বান হইয়াছেন। তাহাদের প্রশংসা না করিয়াই ইউরোপীয়দিগের প্রশংসায় কোমর বাঁধিয়া উঠিয়া পড়া, পক্ষপাত এবং তোষামোদ ব্যতীত আর কী হইতে পারে?

(১৬) বীজাঙ্কুরের ন্যায় জড় ও চেতনের সংযোগ জীবের উৎপত্তি মানা, উৎপত্তির পূর্বে জীব তত্ত্বকে ও এবং উৎপন্ন বস্তুর বিনাশকে না মানা পূর্বাপর বিরুদ্ধ। উৎপত্তির পূর্বে চেতনা এবং জড় না থাকিলে জীব কোথা হইতে আসিল এবং কাহার যোগ ঘটিল? জীব ও জড় উভয়েই সনাতন বলিয়া স্বীকার করাই ঠিক। কিন্তু সৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোন তত্ত্বের অস্তিত্ব না থাকিলে আপনাদের পক্ষও ব্যর্থ হইয়া যাইবে।

অতএব যদি সমাজের উন্নতি করিতে চাহেন, তাহা হইলে ‘আৰ্যসমাজ’র সহিত মিলিত হইয়া, তাহার উদ্দেশ্য অনুসারে আচরণ করা স্বীকার করুন; নতুবা কিছুই লাভ হইবে না। কেননা, যে দেশের পদার্থ দ্বারা আপনার শরীর গঠিত হইয়াছে, এখনও উহার প্রতিপালন হইতেছে এবং ভবিষ্যতেও হইবে, আপনাদের আমাদের সকলের উচিত প্রীতি সহকারে মিলিয়া মিশিয়া তনু-মন-ধন অৰ্পণ দ্বারা তাহার উন্নতি সাধন করা। একারণ আৰ্য সমাজের দ্বারা আর্যাবর্তের উন্নতি যেরূপ সম্ভব অন্য কাহারও দ্বারা সেরূপ সম্ভব নহে। যদি এই সমাজকে যথোচিত সহায়তা দান করেন, তাহা হইলে অতি উত্তম। কেননা সমাজের সৌভাগ্য বৃদ্ধি করা সমষ্টির কাৰ্য্য, একজনের নহে ॥

প্রশ্ন –আপনি সকলেরই খণ্ডন করিয়া আসিতেছেন; কিন্তু স্ব স্ব ধর্মে সকলেই উত্তম। কাহাকেও খণ্ডন করা উচিত নহে। যদি করেন, তাহা হইলে আপনি ইহাদের অপেক্ষা বিশেষ কী বলিতেছেন? যদি বিশেষ কিছু বলেন, তবে কি (আপনি মনে করেন) আপনার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অথবা আপনার সমকক্ষ কেহ ছিল না বা নাই? আপনার এইরূপ অহঙ্কার করা উচিত নহে। কারণ পরমাত্মার সৃষ্টিতে একজন আর একজন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, তুল্য ও ন্যূন অনেক রহিয়াছে, কাহারও গর্ব করা উচিত নহে।

উত্তর –ধর্ম সকলের এক অথবা অনেক? যদি বলেন অনেক, তবে একটি অপরটির বিরুদ্ধ না অবিরুদ্ধ? যদি বলেন বিরুদ্ধ, তবে ধর্ম এক ব্যতীত দুই হইতে পারে না। যদি বলেন অবিরুদ্ধ তবে পৃথক পৃথক্ ধর্ম থাকা বৃথা। অতএব ধর্ম ও অধর্ম একটিই অনেক নহে। আমি ইহাই বিশেষ বলিতেছি যে, যদি কোন রাজ্য সম্প্রদায়ের উপদেষ্টাদিগকে একত্র করেন, তাহা হইলে এক সহস্রের কম হইবে না। কিন্তু এগুলিকে মুখ্যরূপে দেখিলে “পুরাণী”, “কিরাণী”, “জৈনী” এবং “কুরাণী” এই চারিটিই দেখিতে পাওয়া যাইবে। কেননা এই চারিটির মধ্যে সব সম্প্রদায় আসিয়া যাইবে।

যদি কোন রাজা ইহাদিগকে এক সভায় সম্মিলিত করেন, তাহা হইলে কেহ জিজ্ঞাসু হইয়া প্রথমে বামমার্গীকে জিজ্ঞাসা করিবে, “মহাশয়! আমি আজ পর্যন্ত কোন গুরু অথবা কোন ধর্ম স্বীকার করি নাই। সকল ধর্মের মধ্যে কোন্ ধর্ম শ্রেষ্ঠ, আমি সেই ধর্ম গ্রহণ করিব।

বামমার্গী –আমাদের।

জিজ্ঞাসু –আর, এই নয় শত নিরানকাইটি কীরূপ?

বামমার্গী — সবই মিথ্যা ও নরকগামী। কারণ “কৌলাৎ পরতরং নহি” এই বাক্যের প্রমাণ অনুসারে আমাদের ধর্ম অপেক্ষা অপর কেহ শ্রেষ্ঠ নহে।

জিজ্ঞাসু –আপনাদের ধর্ম কী?

বামমার্গী –ভগবতাঁকে মানা, মদ্যমাংসাদি পঞ্চ মকারের সেবন এবং রুদ্রযামল প্রভৃতি চৌষট্টি তন্ত্র মানা, ইত্যাদি। যদি তুমি মুক্তির ইচ্ছা কর তাহলে আমাদের শিষ্য হইয়া যাও।

জিজ্ঞাসু –আচ্ছা। এবার অন্যান্য মহাত্মাদের সহিতও সাক্ষাৎ করিয়া আসি, যাঁহার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং প্রীতি হইবে, তাহারই চেলা হইব।

বামমার্গী –ওহে! কেন ভ্রমে পড়িয়া আছ? ইহারা তোমাকে বিভ্রান্ত করিয়া তাহাদের জালে আবদ্ধ করিবে। কাহারও নিকট যাইও না, আমাদের শরণাগত হও; নতুবা অনুতাপ করিতে হইবে। দেখ! আমাদের মতে ভোগ এবং মোক্ষ দুই-ই আছে।

জিজ্ঞাসু –আচ্ছা, দেখিয়া তো আসি।

ইহার পর তিনি “শৈব” মতবাদীর নিকট উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনিও সেইরূপ উত্তর দিলেন, কিন্তু বিশেষ এতটুকু বলিলেন যে, শিবপূজা, রুদ্রাক্ষ ও ভস্মধারণ এবং লিঙ্গাৰ্চ্চন। ব্যতীত কখনও মুক্তি হয় না। জিজ্ঞাসু তাঁহার নিকট হইতে নবীন বেদান্তীর নিকট গমন করিলেন।

জিজ্ঞাসু –বলুন মহারাজ! আপনার ধর্ম কী?

বেদান্তী –আমরা ধর্মাধর্ম কিছুই মানি না। আমরাই সাক্ষাৎ ব্রহ্ম। আমাদের মধ্যে ধর্মাধর্ম কোথায়? এই জগৎ সবই মিথ্যা। যদি জ্ঞানী এবং শুদ্ধ-চেতন হইতে ইচ্ছা করেন, তবে নিজেকে। ব্রহ্ম স্বীকার করুন এবং জীব ভাব পরিত্যাগ করিয়া নিত্য মুক্ত হউন।

জিজ্ঞাসু –যদি আপনি ব্রহ্ম এবং নিত্য মুক্ত হন, তাহা হইলে আপনাদের মধ্যে ব্রহ্মের গুণ-কর্ম-স্বভাব নাই কেন? এবং দেহে আবদ্ধ হইয়া আছেন কেন?

বেদান্তী –আপনি দেহ দেখিতেছেন, একারণেই আপনি ভ্রান্ত। আমি ব্ৰহ্ম ব্যতীত অপর কিছুই দেখিতেছি না।

জিজ্ঞাসু –দ্রষ্টা আপনি কে? এবং কাহাকে দেখিতেছেন?

বেদান্তী –দ্রষ্টা ব্রহ্ম; ব্রহ্ম ব্রহ্মকেই দেখিতেছেন।

জিজ্ঞাসু– ব্রহ্ম কি দুইটি?

বেদান্তী –না, (ব্রহ্ম) নিজেই নিজেকে দেখিতেছেন।

জিজ্ঞাসু –কেহ কি নিজেই নিজের স্কন্ধে আরোহণ করিতে পারে? আপনার কথা নিঃসার, কেবল পাগলের প্রলাপ।

জিজ্ঞাসু পরে জৈনদের নিকট উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলে তিনিও সেইরূপ বলিলেন। কিন্তু বিশেষ এইটুকু বলিলেন যে, জৈনধর্ম ব্যতীত অপর সকল ধর্মই মিথ্যা। জগতের কর্তা ঈশ্বর বলিয়া কেহই নাই। জগৎ অনাদি কাল হইতে যেমনটি ছিল তেমনটিই আছে, পরেও তেমনটিই থাকিবে। তুমি আমার চেলা হইয়া পড়। কারণ আমি ‘সম্যত্বী’ অর্থাৎ সর্বতোভাবে উত্তম। উত্তম উপদেশ মান্য করি। জৈন মার্গ ব্যতীত সমস্ত ‘মিথ্যাত্বী।

জিজ্ঞাসু অগ্রসর হইয়া খ্রীষ্টানকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনিও বামমার্গীর ন্যায় প্রশ্নোত্তর করিলেন। বিশেষ এইমাত্র বলিলেন, “সকল মনুষ্যই পাপী, নিজ সামর্থ্যবলে পাপ দূরীভূত হয় না। যীশুখৃষ্টে বিশ্বাস ব্যতীত কেহ পবিত্র হইয়া মুক্তি লাভ করিতে পারে না। যীশু সকলের প্রায়শ্চিত্তের জন্য স্বীয় জীবন বিসর্জন দিয়া প্রদর্শন করিয়াছিলেন। তুমি আমার চেলা হইয়া পড়”।

জিজ্ঞাসু তাহা শুনিয়া মৌলবী সাহেবের নিকট গমন করিলে তাহার সহিতও পূর্বোক্তরূপ প্রশ্নোত্তর হইল। তিনি বিশেষ এইমাত্র বলিলেন –লাশরীক খুদা, তাহার পৈগম্বর ও কোরাণ শরীফকে স্বীকার না করিয়া কেহই নিজাত পাইতে পারে না। যে ব্যক্তি এই মজহবকে মানে না সে দোজখী, কাফীর ও ওয়াজিবুল ক।

জিজ্ঞাসু তাহা শুনিয়া বৈষ্ণবদের নিকট উপস্থিত হইলে তাহার সহিতও পূর্বোক্তরূপ সম্বাদ হইল। তিনিও বিশেষ এইমাত্র বলিলেন, “আমার তিলক এবং ছাপ দেখিয়া যমরাজ ভীত হন।

জিজ্ঞাসু তাহা শুনিয়া মনে মনে ভাবিল, “যখন মশা, মাছি, চোর, ডাকাত, পুলিশ, সিপাহী এবং শত্রুরা (তিলক দেখিয়া) ভয় পায় না তখন যমরাজের অনুচরগণ ভয় পাইবে কেন?

জিজ্ঞাসু আরও যত অগ্রসর হইতে লাগিলেন,সকল মতাবলম্বী ততই নিজ নিজ মতকে সত্য বলিয়া প্রকাশ করিল। কেহ বলিল আমাদের কবীর সত্য, কেহ নানক, কেহ দাদু, কেহ বল্লভ, কেহ সহজানন্দ, তিনি মাধব আদিকেও বড় অবতার বলিতেও শুনিলেন।

এইরূপ সহস্র সহস্র লোককে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলেন যে, তাহাদের মধ্যে পরস্পর বিরোধ রহিয়াছে। তখন তিনি বিশেষ ভাবে জানিলেন যে, তাহাদের মধ্যে কেহ গুরুরূপে স্বীকার করিবার যোগ্য নহে। কারণ তাহাদের এক একজনের মত যে মিথ্যা, সে বিষয়ে নয় শত নিরানব্বই জন সাক্ষ্য দিয়াছে। যেরূপ মিথ্যাবাদী দোকানদার বা বেশ্যা এবং ভেডুয়া প্রভৃতি নিজ নিজ বস্তুর গৌরব এবং অপরের নিন্দা করে, ইহারাও তদ্রূপ।

তিদ্বিজ্ঞানার্থংস গুরুমেবাভিগচ্ছে। সমিপাণিঃ শ্রোত্রিয়ংব্রহ্মনিষ্ঠম্ ॥১॥ তস্মৈ স বিদ্বানুপসন্নায় সম্যক্ প্রশান্তচিত্তায় শর্মান্বিতায়। য়েনাক্ষরং পুরুষং বেদ সত্যং প্রোবাচ তাং তত্ত্বতো ব্রহ্মবিদ্যাম্ ॥২॥ মুন্ডকো ১খ০২। ১২, ১৩।

সেই সত্য বিষয়ে জ্ঞান লাভার্থ শিষ্য সমিপাণি অর্থাৎ করজোড়ে কৃতাঞ্জলি হইয়া অরিক্ত হস্ত হইয়া বেদবিৎ ব্রহ্মনিষ্ঠ এবং ব্রহ্মজ্ঞ গুরুর নিকট যাইবে এই সব ভদগের জালে পড়িবে না ৷১ ॥ এইরূপ কোন জিজ্ঞাসু বিদ্বানের নিকট তিনি সেই সমাগত শান্তচিত্ত, উপস্থিত হইলে। জিতেন্দ্রিয় জিজ্ঞাসুকে যথার্থ ব্রহ্মবিদ্যা পরমাত্মার গুণ-কর্ম স্বভাব সম্বন্ধে উপদেশ দিবেন। যে সমস্ত সাধন অবলম্বন করিলে সেই শ্রোতার ধর্ম, অর্থ, কাম-মোক্ষ লাভ হয় এবং পরমাত্মাকে জানা যায়, তাহাও শিক্ষা দিবেন ॥২ ॥

যখন সে এইরূপ পুরুষের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল –“মহারাজ! সম্প্রদায়বাদিদের ধাঁধায় আমার চিত্ত বিভ্রান্ত হইয়াছে, কেননা আমি যদি ইহাদিগের মধ্যে কাহারও শিষ্যত্ব গ্রহণ করি তাহা হইলে নয় শত নিরানব্বইটি সম্প্রদায় আমার শত্রু আর একজনকে আমার মিত্ররূপে পাইব।

কিন্তু যাহার নয় শত নিরানব্বই জন শত্ৰু সে কখনও সুখী হইতে পারে না। অতএব আপনার উপদেশ গ্রহণ করিব; আপনি আমাকে উপদেশ প্রদান করুন।

আপ্ত বিদ্বান্ –এই সমস্ত মত অবিদ্যা-প্রসূত এবং বিদ্যাবিরোধী। (মতবাদিগণ) মূর্খ পামর এবং বন্য মনুষ্যদিগকে বিভ্রান্ত করিয়া এবং নিজেদের জালে আবদ্ধ করিয়া স্বার্থসিদ্ধি করে। সেই অসহায় লোকেরা আপন মানব জীবনের ফল হইতে বঞ্চিত হইয়া নিজ মনুষ্য জন্ম বৃথা নষ্ট করে। দেখ, যে বিষয়ে উক্ত সহস্র মতের মধ্যে ঐক্য আছে, উহা বেদ-মত গ্রাহ্য; কিন্তু যে বিষয়ে পরস্পরের মধ্যে বিরোধ আছে উহা কল্পিত, মিথ্যা এবং অগ্রাহ্য ॥

জিজ্ঞাসু –ইহার পরীক্ষা কীরূপে হইবে?

আপ্ত বিদ্বান — তুমি সকলের নিকট যাইয়া এ সমস্ত বিষয় জিজ্ঞাসা কর; সকলেই একমত হইবে ॥

তখন সেই জিজ্ঞাসু সহস্র জনমণ্ডলী মধ্যে দণ্ডায়মান হইয়া বলিলেন –“সকলে শুনুন! সত্য ভাষণে ধর্ম আছে, –না মিথ্যা ভাষণে”? সকলে সমস্বরে বলিল, –সত্যভাষণে ধর্ম, আর অসত্যভাষণে অধর্ম”। সেইরূপ বিদ্যাভ্যাস, ব্রহ্মচর্য্যপালন, পূর্ণযৌবনে বিবাহ, সৎসংসর্গ, পুরুষকার। এবং ব্যবহার প্রভৃতিতে ধর্ম (আছে?) না, অবিদ্যা গ্রহণে, ব্রহ্মচর্য পালন না করায়, ব্যভিচার, অসৎসংসর্গ, আলস্য, অসত্যাচরণ, ছল, কপটতা, হিংসা এবং পরের অনিষ্ট সাধন ইত্যাদি কর্মে ধর্ম আছে?” সকলে একমত হইয়া বলিল –“বিদ্যাদি গ্রহণে ধর্ম এবং অবিদ্যাদি গ্রহণে অধর্ম”।

তখন জিজ্ঞাসু সকলকে বলিলেন,– এইরূপে তোমরা সকলে একমত হইয়া সত্য ধর্মের উন্নতি এবং অসত্য মার্গের হানি কর না কেন?

তাহারা সকলে বলিল,- এইরূপ করিলে আমাদিগকে কে মানিবে? আমাদের শিষ্যগণ। আমাদের আজ্ঞানুবর্তী থাকিবে না; আমাদের জীবিকা নষ্ট হইবে এবং আমরা যে আনন্দ করিতেছি, তাহা হইতেও বঞ্চিত হইব। অতএব ইহা জানা সত্ত্বেও আমরা স্ব স্ব মত প্রচার করি এবং সে বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করিয়াই চলি; কারণ কথায় বলে, “রুটি খাও শর্করা দিয়া, সংসারকে ঠগাও ধোঁকা দিয়া।” সংসারে যাহারা সরল প্রকৃতির এবং সত্যপরায়ণ, তাহাদিগকে কেহ কিছু দেয় না, জিজ্ঞাসাও করে না। কিন্তু যাহারা ভণ্ডামি করে ধোঁকা দেয় তাহারাই ধন সামগ্রী পায় ॥

জিজ্ঞাসু –তোমরা যে এইরূপ ভণ্ডামি করিয়া জনসাধারণের প্রতারিত করিতেছ; তজ্জন্য রাজা তোমাদিগকে দণ্ড দেন না কেন?

মতবাদী –আমরা রাজাকেও আপন চেলা করিয়া লইয়াছি। আমরা যেরূপ পাকা ব্যবস্থা করিয়াছি, তাহা নষ্ট হইবার নহে ॥

জিজ্ঞাসু –তোমরা যে ছলনা দ্বারা অন্য মতাবলম্বীকে প্রতারণা ও ক্ষতিগ্রস্ত করিতেছ, তজ্জন্য পরমেশ্বরের নিকট কী উত্তর দিবে? তোমরা তো ঘোর নরকে পতিত হইবে। সামান্য জীবিকার জন্য এইরূপ গুরুতর অপরাধ করা পরিত্যাগ করনা কেন?

মতবাদী –যখন যাহা হইবে, তখন দেখা যাইবে। নরক কিংবা পরমেশ্বরের দণ্ড যখন হইবে তখন হইবে; এখন তো আমরা আনন্দ ভোগ করিতেছি; (লোকে) আমাদিগকে সন্তুষ্ট চিত্তে ধন-সামগ্রী দান করে, আমরা তো বলপূর্বক আদায় করি না, তবে রাজা দণ্ড দিবেন কেন?

জিজ্ঞাসু –কেহ-কেহ অল্প বয়স্ক বালককে ফুসলাইয়া ধনসামগ্রী হরণ করিলে সে যেরূপ দণ্ডিত হয়, সেইরূপ তোমাদের দণ্ড হয় না কেন?

অজ্ঞো ভবতি বৈ বালঃ পিতা ভবতি মন্ত্রঃ ॥ মনুঃ ॥

জ্ঞানহীনকে ‘বালক’ এবং বুদ্ধিমান জ্ঞানদাতাকে ‘পিতা’ এবং ‘বৃদ্ধ’ বলে। যাঁহারা বুদ্ধিমান বিদ্বান, তাহারা তোমাদের কথায় জড়ায় না; কিন্তু যাহারা বালকের ন্যায় অজ্ঞানী, তাহাদিগকে প্রতারিত করিলে তোমাদের অবশ্য রাজদণ্ড হওয়া উচিত।

মতবাদী –রাজা প্রজা সকলেই যখন আমাদের মতাবলম্বী, তখন আমাদিগকে দণ্ড দিবে কে? যখন সেইরূপ ব্যবস্থা হইবে, তখন এ সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া অন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিব।

জিজ্ঞাসু –তোমরা নিশ্চেষ্ট থাকিয়া নিরর্থক লোকের ধন হরণ করিতেছ। যদি তোমরা বিদ্যাশিক্ষা করিয়া গৃহস্থের বালক-বালিকাদিগকে শিক্ষা দাও, তাহা হইলে তোমাদের এবং গৃহস্থের কল্যাণ হয়।

মতবাদী –শৈশব হইতে মৃত্যু পর্যন্ত সুখভোগ পরিত্যাগ করা, বাল্যকাল হইতে যৌবন বিদ্যাশিক্ষায় নিযুক্ত থাকা, তদনন্তর অধ্যাপন ও উপদেশ প্রদান কার্য্যে চিরজীবন পরিশ্রম করার প্রয়োজন কী? আমরা তো এমনিই লক্ষ লক্ষ টাকা পাই, ফুর্তি করি, ঐসব পরিত্যাগ করিব কেন?

জিজ্ঞাসু –ইহার পরিণাম তো মন্দ। দেখ। তোমরা ভয়ানক রোগগ্রস্ত হও, শীঘ্র মরিয়া যাও, বুদ্ধিমানের দ্বারা নিন্দিত হও; তথাপি বুঝ না কেন?

মতবাদী –ওরে ভাই। টকা ধর্মষ্টকা কর্মটকা হি পরমং পদ। য়স্য গৃহেটকা নাস্তি, হা!টকা টকটায়তে ॥১ ॥ আনা অংশকলাঃ প্রোক্তা রূপ্যোসৌ ভগবান্ স্বয়ম্। অতস্তং সর্বইচ্ছন্তি রূপ্যং হি গুণবত্তমম্ ॥

তুমি ছেলেমানুষ সংসারের বিষয় কিছু জান না। দেখ! টাকা ব্যতীত ধর্ম, টাকা ব্যতীত কর্ম, এবং টাকা ব্যতীত পরম পদ লাভ হয় না। যাহার গৃহে টাকা নাই, সে “হায় টাকা! হায় টাকা”! করিতে করিতে টক্ টক্ করিয়া অপলক নেত্রে ভাল জিনিসের দিকে তাকাইতে থাকে, আর মনে মনে চিন্তা করে “ হায়! আমার নিকট টাকা থাকিলে আমিও এই উত্তম জিনিষ ভোগ করিতে পারিতাম”! ॥ ১ ॥

কেননা, সকলেই ষোলকলাযুক্ত ভগবানের কথা শ্রবণ করে। কিন্তু তাহাকে দেখিতে পায় না, পরন্তু ষোল আনা এবং পয়সা কড়িরূপ অংশ যাহা কলাযুক্ত টাকা উহাই সাক্ষাৎ ভবান। এই নিমিত্ত সকলেই টাকার অন্বেষণে নিযুক্ত। কারণ টাকা দ্বারাই সকল কাৰ্য্য সিদ্ধ হয়॥২ ॥

জিজ্ঞাসু –সত্যই তোমাদের ভিতরের লীলা-খেলা আত্মপ্রকাশ করিল। তোমরা নিজের সুখের জন্যই এই সকল ভণ্ডামি খাড়া করিয়াছ। কিন্তু ইহাতে জগতের নাশ হয়। কেননা যেরূপ। সত্যোপদেশ দ্বারা সংসারের উপকার হয়, সেইরূপ মিথ্যা উপদেশ দ্বারা অনিষ্ট হইয়া থাকে। তোমাদের যদি ধনেরই প্রয়োজন থাকে, তোমরা চাকুরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যাদি দ্বারা ধন জমা কর না কেন?

মতবাদী –তাহাতে অধিক পরিশ্রম এবং কখনও ক্ষতি হইয়া থাকে। কিন্তু আমাদের এই লীলা-খেলায় হানি কখনও হয় না, সর্বদা লাভই লাভ। দেখুন! তুলসীপত্র নিক্ষেপ করিয়া, চরণামৃত দিয়া, কণ্ঠি বাঁধিয়া দিয়া মস্তকমুণ্ডিত করিলে শিষ্যগণ চিরজীবন পশুবৎহইয়া যায়, পরে তাহাদিগকে যেমন ইচ্ছা তেমন করিয়া চালাইতে পারা যায়।

জিজ্ঞাসু –এই সমস্ত লোক তোমাদিগকে এত ধন দেয় কেন?

মতবাদী –ধর্ম, স্বর্গ এবং মুক্তি লাভের জন্য। জিজ্ঞাসু –যখন তোমরা নিজেরাই মুক্ত নও, মুক্তির স্বরূপ অথবা সাধনও জান না তখন। তোমাদের সেবকগণ কী পাইবে?

মতবাদী –ইহলোকে কী পাওয়া যায়? না, মৃত্যুর পর পরলোকে পাওয়া যায়। তাহারা আমাদিগকে যত দান করে এবং আমাদের যত সেবা করে, সমস্তই পরলোকে পাওয়া যায়।

জিজ্ঞাসু –তাহারা তাহাদের প্রদত্ত সামগ্রী লাভ করুক বা না করুক, তোমরা গ্রহণকারীরা কী পাইবে? নরক বা অন্য কিছু?

মতবাদী –আমরা ভজনা করাইয়া থাকি, ইহার সুখ আমরা পাইব ॥

 জিজ্ঞাসু –তোমাদের ভজনা তো টাকার জন্য। সেইসব টাকা তো এখানেই পড়িয়া থাকিবে। আর যে মাংস পিন্ডটি পোষণ করিতেছ, তাহাও ভস্ম হইয়া এখানেই পড়িয়া থাকিবে, পরমেশ্বরের আরাধনা করিলে তোমাদের আত্মাও পবিত্র হইত।

মতবাদী –কেন, আমরা কি অপবিত্র?

 জিজ্ঞাসু –তোমাদের অন্তর অপবিত্র।

মতবাদী –তুমি কীরূপে জানিলে?

জিজ্ঞাসু –তোমাদের রীতি নীতি ব্যবহারে।

মতবাদী –মহাত্মাদিগের ব্যবহার হস্তীদন্ত সদৃশ। ভোজনের জন্য একরূপ এবং দেখাইবার জন্য অন্যরূপ। সেইরূপ আমরাও অন্তরে পবিত্র, কেবলমাত্র বাহিরে লীলা করিয়া থাকি।

জিজ্ঞাসু –তোমাদের অন্তর পবিত্র হইলে, তোমাদের বাহিরের কর্মও পবিত্র হইত। অতএব তোমাদের অন্তরও অপবিত্র।

মতবাদী –আমরা যেরূপই হই না কেন, আমাদের শিষ্যগণ অবশ্যই ভাল।

জিজ্ঞাসু –তোমরা যেরূপ গুরু সেইরূপ তোমাদের শিষ্যরাও হইবে।

মতবাদী –এইরূপ কখনও হইতে পারে না; কারণ মানুষের গুণ, কর্ম ও স্বভাব ভিন্ন ভিন্ন।

জিজ্ঞাসু –বাল্যকালে একইরূপ শিক্ষা লাভ করিলে, সত্যভাষণাদি অধর্ম পরিত্যাগ করা। হইলে, একমত অবশ্যই হইত। আর যদি মতদ্বৈধ অর্থাৎ ধর্মাত্মা ও অধর্মাত্মা সদা থাকে তো

থাকুক। পরন্তু ধর্মাত্মা অধিক এবং অধর্মাত্মা অল্প হইলে সংসারে সুখবৃদ্ধি হয়। আবার অধার্মিকের সংখ্যা অধিক হইলে দুঃখবৃদ্ধি হইয়া থাকে। বিদ্বানেরা সকলে একরূপ উপদেশ প্রদান করিলে একমত হইতে কিঞ্চিমাত্রও বিলম্ব হয় না।

মতবাদী –আজকাল কলিযুগ, সত্যযুগের কথা বলিও না।

জিজ্ঞাসু –’কলিযুগ’ কালের নাম। কাল নিষ্ক্রিয় বলিয়া কোন ধর্মাধর্মের সাধক অথবা বাধক হইতে পারে না। কিন্তু তোমরাই কলিযুগের মূৰ্ত্তি গড়িতেছ। মনুষ্যই সত্যযুগ কলিযুগ (রূপ), তাহা না হইলে, সংসারে অধর্মাত্মা থাকিত, ধর্মাত্মা কেহই থাকিত না। এ সমস্ত দোষগুণ সংসর্গজাত, স্বাভাবিক নহে ॥

এই পৰ্য্যন্ত কথোপথনের পর (জিজ্ঞাসু) আপ্তপুরুষের নিকট যাইয়া বলিলেন, — “মহাশয়! আপনি আমাকে উদ্ধার করিয়াছেন। নতুবা আমিও কাহারও জালে পতিত হইয়া নষ্ট ভ্রষ্ট হইতাম। এবার আমিও পাষণ্ড মতগুলির খণ্ডন এবং বেদোক্ত সত্যমতের মণ্ডন করিতে থাকিব।”

আপ্ত –সর্বমানব, বিশেষ করিয়া বিদ্বান্ এবং সন্ন্যাসীদের কর্তব্য, তাহারা যেন মানব সমুদায়কে সত্য মতের মণ্ডন ও অসত্যের খণ্ডন পাঠ করাইয়া ও সত্য শ্রবণ করাইয়া উপদেশ দিয়া উপকৃত করে।

প্রশ্ন –ব্রহ্মচারী, সন্ন্যাসী তাহারা তো ভাল?

উত্তর –এসব আশ্রম ভাল, কিন্তু আজকাল এসকল আশ্রমেও মেলা গোলমাল। এরূপ বহু। মানুষ আছে যাহারা নামে ব্রহ্মচারী আর মিছামিছি জটাবৃদ্ধি করিয়া সিদ্ধ পুরুষের ভান করে। তাহারা জপ ও পুরশ্চরণ প্রভৃতিতে নিযুক্ত থাকে, লেখাপড়া করিবার নামও করে না; যে জন্য ব্রহ্মচারী নাম ধারণ, সেই ব্রহ্ম অর্থাৎ বেদ পাঠে তাহারা কিছুমাত্র পরিশ্রম করে না। এইসব ব্রহ্মচারী ছাগীর গলস্তনবৎ নিরর্থক ॥

সেইরূপ সন্ন্যাসী যাহারাদণ্ড এবং কমগুলু লইয়া কেবলমাত্র ভিক্ষা করিয়া বেড়ায়, বৈদিকধর্মের কিছুই উন্নতি করে না, বাল্যকালে সন্ন্যাসগ্রহণ করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। এইরূপ ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসী জল, স্থল ও পাষাণাদি নির্মিত মূর্তির দর্শন ও পূজা করিয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করে। যথার্থ জানিয়াও মৌন থাকে। প্রচুর ভোজ্য ও পানীয় গ্রহণ করিয়া একান্ত দেশে নিদ্রায় কাল যাপন করে, ঈর্ষা-দ্বেষের বশীভূত হইয়া পরনিন্দা ও কুকর্ম দ্বারা জীবন যাত্রা নির্বাহ করে, কাষায় বস্ত্র এবং দণ্ড মাত্র ধারণ করিয়া নিজেকে কৃতকৃত্য এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে। কোনরূপ উত্তম কর্মের অনুষ্ঠান করে না, তাদৃশ (ব্রহ্মচারী বা) সন্ন্যাসী বৃথাই জগতে বাস করে। যাহারা জগতের হিতসাধন করে তাহারা যথার্থই সন্ন্যাসী।

প্রশ্ন –গিরি, পুরী,ভারতী প্রভৃতি গোঁসাইগণ তো ভাল? কেননা, তাহারা মণ্ডলী গঠন করিয়া ইতস্ততঃ পর্যটন করেন, শত শত সাধককে আনন্দ দান করেন আর সর্বত্র অদ্বৈত মত প্রচার করেন এবং কিছু কিছু অধ্যয়ন-অধ্যাপনাও করিয়া থাকেন। এইজন্য তাহারা ভালই হইবেন।

উত্তর –এই দশটি [১) তীর্থ, (২) আশ্রম, (৩) সরস্বতী, (৪) পুরী, (৫) ভারতী, (৬) বন, (৭) অরণ্য (৮) গিরি, (৯) পর্বত। (১০) সাগর। ইহারা দশনামী।] নাম পরবর্তীকালে কল্পিত হইয়াছে, এ (নাম) সনাতন নহে। তাহাদের মণ্ডলী সমূহ কেবল ভোজনার্থে রহিয়াছে। অধিকাংশ সাধু কেবল ভোজনার্থেই মন্ডলীর মধ্যে থাকে। তাহারা দম্ভীও কেননা তাহারা একজনকে মোহস্ত করিয়া রাখে। তাহাদের মধ্যে যে প্রধান সে সন্ধ্যাবেলায় যখন বেদীতে উপবেশন করে, তখন সমস্ত ব্রাহ্মণ এবং সাধুগণ দণ্ডায়মান হইয়া পুষ্পহস্তে —

নারায়ণং পদ্মভবং বসিষ্ঠং শক্তিং তৎপুত্ৰপরাশরং চ। ব্যাসং শুকং গৌড়পদংমহান্তম্ ॥

ইত্যাদি শ্লোক পাঠ করিয়া হরহর’ বলিয়া তাহার উপর পুষ্পবর্ষণ করিয়া সাষ্টাঙ্গে নমস্কার করে। যদি কেহ এ না করে, সেস্থানে তাহার থাকাও কঠিন হয়। সংসারের লোককে দেখাইবার জন্য তাহারা এইরূপ করিয়া থাকে। এইরূপ করিলে তাহাদের সম্মান এবং ধন-সামগ্রী লাভ হয়।

কত মঠধারী গৃহস্থ হইয়াও সন্ন্যাসের অভিমান মাত্র করিয়া থাকে। কোনও ধর্ম করে না। পঞ্চম সমুল্লাসে সন্ন্যাসীদের যাহা কর্তব্য লিখিত হইয়াছে, তাহারা উহার আচরণ না করিয়া বৃথা সময় নষ্ট করে। কেহ তাহাদিগকে সদুপদেশ প্রদান করিলেও তাহারা তাহার বিরোধী হইয়াউঠে। বহুলাংশে তাহারা রুদ্রাক্ষ এবং ভস্ম ধারণ করে এবং কেহ কেহ শৈব সম্প্রদায়ের অভিমান করে।

কেহ যখন শাস্ত্ৰবিচারে প্রবৃত্ত হয় তখন তাহারা স্বমত অর্থাৎ শঙ্করাচার্য্যোক্ত মতের স্থাপন এবং চক্রাঙ্কিত প্রভৃতি মতের খণ্ডন করিতে থাকে। তাহারা যথাবৎ বেদ মার্গের উন্নতি সাধনে। তৎপর এবং পাষণ্ড মার্গের খণ্ডনে প্রবৃত্ত হয় না। এ সকল সন্ন্যাসী মনে করে, আমাদের খণ্ডন-মণ্ডনের কী প্রয়োজন? আমরা তো মহাত্মা’। এইরূপ মনুষ্যও সংসারে ভারস্বরূপ।

এইরূপ হয় বলিয়াই তো বেদমার্গ বিরোধী বামমার্গ প্রভৃতি সম্প্রদায়, খ্রীষ্টান, মুসলমান এবং জৈন প্রভৃতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং অদ্যাবধি বৃদ্ধি হইয়া চলিয়াছে, আর ইহাদের নাশ হইয়া চলিয়াছে তবুও তাহাদের চোখ খুলিতেছে না। খুলিবে কেন? মনে পরোপকার বুদ্ধি এবং কর্তব্য কর্মে উৎসাহ থাকিলে তো খুলিবে! কিন্তু ইহারা আত্ম প্রতিষ্ঠা এবং খাওয়া পরা ছাড়া অন্য কিছুই বুঝে না। ইহারা লোকনিন্দাকে অত্যন্ত ভয় করে ॥

পুনঃ লোকৈণা=ইহলোকে সম্মান, বিত্তৈণা=ধনবৃদ্ধিতে তৎপর হইয়া বিষয়ভোগ, পুত্রৈণা = পুত্রবৎ শিষ্যদিগের প্রতি মোহ সৃষ্টি –এই ত্রিবিধ এষণা পরিত্যাগ করা কর্তব্য। যখন এষণাই ঘুচিল না সন্ন্যাসী কীরূপে হইবে? অর্থাৎ পক্ষপাত রহিত বেদোপদেশ দ্বারা অহর্নিশ জগতের কল্যাণ সাধনে মত্ত থাকা সন্ন্যাসীর কর্ত্তব্য। নিজ নিজ আশ্রমোচিত অধিকাংশ কর্ম সমূহ সম্পাদন না করিলে সন্ন্যাসী প্রভৃতি নাম ধারণ করা বৃথা। নহিলে যেরূপ গৃহস্থ ব্যবহার ও স্বার্থের জন্য পরিশ্রম করে, সন্ন্যাসীগণ ততোধিক পরিশ্রম সহকারে পরহিত সাধনে তৎপর থাকিলে সমস্ত আশ্রমের উন্নতি হইতে পারে।

দেখুন, আপনাদের সম্মুখে পাষণ্ড মত সমূহ প্রসার লাভ করিতেছে, খ্রীষ্টান এবং মুসলমান পৰ্য্যন্ত হইয়া যাইতেছে। তোমাদের দ্বারা নিজেদের সামান্য মাত্র গৃহরক্ষা এবং অপরকে মিলাইয়া নিজের করা সম্ভব হইতেছে না। উহা সম্ভব তো তখনই হইবে, যদি তোমরা ইচ্ছা কর। যতদিন না তোমরা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য যত্নবান হইবে, ততদিন পর্যন্ত আৰ্য্যাবৰ্ত্ত এবং অন্যান্য দেশের উন্নতি হইবে না। উন্নতির কারণ বেদাদি সত্যশাস্ত্রসমূহের অধ্যয়ন অধ্যাপন, ব্রহ্মচর্য্যাদি আশ্রম সমূহের যথাবৎ অনুষ্ঠান ও সত্যোপদেশ হইলেই দেশের উন্নতি হয়।

সত্য সত্যই বহু ভণ্ডামির ঘটনা চোখের সামনে ঘটিতেছে– সাবধান! যথা, কোনও সাধু-দোকানদার পুত্রাদি লাভ করাইবার কথা বলিলে, তাহাদের পুত্রাদি লাভের কথা শুনিয়া বহু স্ত্রীলোক তাহাদের নিকট যাইয়া করজোড়ে পুত্র প্রার্থনা করে। আর সাধুবাবাজী সকলকেই পুত্র প্রাপ্তির আশীর্বাদ দেয়। তাহাদের মধ্যে যাহাদের পুত্র লাভ ঘটে, তাহারা মনে করে, সাধু বাবার বচন বলেই এইরূপ হইয়াছে। যদি কেহ তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করে যে, “শূকরী, কুকুরী, গর্দভী এবং কুকুটী প্রভৃতি শাবকগুলি কোন্ সাধু বাবার বচন বলে হইয়া থাকে”? তখন তার মুখে কথা সরিবে না। যদি কেহ বলে –“আমি সন্তানকে জীবিত রাখিতে পারি, তবে সে নিজে মরে কেন?

বড় বড় বুদ্ধিমানদের মধ্যেও এরূপ বহু আছে যাহারা এমন মায়া বিস্তার করে যে, লোকেরা প্রতারিত হয়। যথা ধনসারীর ঠগ। ইহারা পাঁচ সাত জন মিলিয়া দূর দেশে গমন করে। সে স্থানে যাইয়া তাহাদের মধ্যে যে উত্তম শারীরিক গঠনযুক্ত এইরূপ একজনকে সিদ্ধ পুরুষ সাজায়। যে নগরে অথবা গ্রামে ধনাঢ্যদিগের বসবাস, তন্নিকটবর্তী কোন বনে তাহারা সেই সিদ্ধ পুরুষকে বসাইয়া রাখে।

তাহারা দলের কয়েকজন সাধক অপরিচিত সাজিয়া একে-তাকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কি এরূপ কোন মহাত্মাকে এখানে দেখিয়াছেন”? এই কথা শুনিয়া লোকেরা জিজ্ঞাসা করে, “কে সে মহাত্মা এবং কীরূপ”? বলে, “তিনি একজন মহান্ সিদ্ধ পুরুষ। তিনি মনের কথা বলিয়া দেন, তিনি মুখে যাহা বলেন, তাহাই ফলিয়া যায়। আমি কাহারও নিকট শুনিয়াছি তিনি নাকি এদিকে আসিয়াছেন”। তখন গৃহস্থ বলে –“আপনার সহিত যদি সেই মহাত্মার সাক্ষাৎ হয় আমাকেও বলিবেন, আমরাও দর্শন করিব এবং তাহাকে আমার মনের কথা জিজ্ঞাসা করিব।

এইরূপে তাহারা সমস্ত দিন নগরে ঘুরিয়া বেড়ায় এবং সেই সিদ্ধ পুরুষের কথা প্রচার করিয়া রাত্রিকালে একত্রিত সিদ্ধ সাধকের দল ভোজনাদি সারিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। পুনরায় দুইতিন দিন ধরিয়া প্রাতঃকালে নগরে বা গ্রামে যাইয়া পূর্বের ন্যায় বলিয়া বেড়ায়। পরে একদিন সেই চারি সাধক এক এক করিয়া ধনাঢ্যদের বলে, –“সেই মহাত্মার সন্ধান পাইয়াছি। তোমার দর্শন করিবার ইচ্ছা থাকিলে চল”। ধনাঢ্য যাইতে উদ্যত হইলে, সাধকেরা তাহাকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কোন্ কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা কর আমাদের তাহা বল।” তখন কেহ পুত্রলাভ, কেহ রোগ নিবারণ এবং কেহ শত্রুজয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করে। সাধকেরা সেখানে ধনাঢ্যকে লইয়া যায়। সিদ্ধপুরুষের সহিত তাহাদের পূর্ব সঙ্কেত অনুসারে অর্থাৎ ধনকাঙ্ক্ষীকে দক্ষিণ পার্শ্বে, পুত্রাকাঙ্ক্ষীকে সম্মুখে, আরোগ্যকামীকে বামপার্শ্বে এবং শত্ৰুজয়াকাঙ্ক্ষীকে পিছন দিক হইতে উপস্থিত করিয়া সম্মুখবর্তী লোকদিগের মধ্যে বসায় ॥

দর্শনার্থীগণ নমস্কার করিলে, সেই সময় সিদ্ধপুরুষ স্বীয় অলৌকিক শক্তির দাপটে উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠে– “এখানে আমার নিকট কি ছেলে আছে যে, তুই পুত্রকামনা করিতে আসিয়াছি”? এইভাবে ধনাকাঙ্ক্ষীকে বলে, “এখানে কি টাকার থলি আছে যে, তুই ধনাকাঙ্ক্ষা করিয়া আসিয়াছিস? ফকিরদের কাছে কি ধন জমা থাকে”? রোগীকে বলে, –“আমি কি বৈদ্য যে, তুই রোগমুক্তি আকাঙ্ক্ষা করিয়া আসিয়াছিস্? আমি বৈদ্য নহি যে, তোর রোগ সারাইব। যা, কোনও বৈদ্যর নিকট যা”।

আবার যদি আগন্তুকের পিতা রোগী হয়, সাধক বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, মাতা রোগী হইলে তর্জনী, ভ্রাতা রোগী হইলে মধ্যমা, স্ত্রী রোগী হইলে অনামিকা এবং কন্যা রোগী হইলে কনিষ্ঠা অঙ্গুলী দ্বারা সঙ্কেত করে। সিদ্ধ পুরুষ তাহা দেখিয়া বলে, “তোমার পিতা, মাতা, স্ত্রী, ভ্রাতা বা কন্যা রোগাক্রান্ত হইয়াছে”। তখন তাহারা চারিজনই মোহিত হইয়া যায়। সাধকেরা তাহাদিগকে বলে,” দেখুন। আমরা যেরূপ বলিয়াছিলাম, ঠিক সেইরূপ কিনা”?

গৃহস্থেরা বলে, –“হ্যাঁ, আপনারা যেরূপ বলিয়াছেন ঠিক সেইরূপই, আপনারা আমাদের বড়ই উপকার করিয়াছেন। আমাদের বড়ই সৌভাগ্য যে, এমন মহাত্মার দর্শন পাইয়া কৃতার্থ হইলাম”।

তখন সাধকেরা বলে, –“শোনো ভাই! এই মহাত্মা মনোগামী। ইনি বহুদিন এখানে থাকিবার মানুষ নহেন, যদি কিছুইহার আশীর্বাদ লইতে হয়, তাহা হইলে নিজ নিজ সামর্থ্যানুসারে তন-মন-ধন। দ্বারা ইহার সেবা কর। কারণ সেবায় মেওয়া মিলে; ইনি যদি কাহারও প্রতি প্রসন্ন হন, না জানি কী বর প্রদান করিবেন। সাধুসন্তদের মহিমা অপার”।

গৃহস্থগণ এইরূপ তোষামোদে কথা শুনিয়া অতীব আনন্দের সহিত তাহার প্রশংসা করিতে করিতে গৃহাভিমুখে প্রস্থান করে। সাধকেরাও পাছে কেহ তাহাদের ভণ্ডামি প্রকাশ করিয়া দেয়, এই ভয়ে তাহাদের সঙ্গে সঙ্গেই যাইতে থকে এবং কোন ধনাঢ্যের, কোন বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ হইলে তাহার নিকট সিদ্ধপুরুষের প্রশংসা করে; আর যাহাদের সঙ্গে যায়, তাহাদের সম্বন্ধেও সমস্ত বৃত্তান্ত প্রকাশ করে।

যখন নগরময় প্রচার হয় যে, “অমুক স্থানে একজন মহান্ সিদ্ধ পুরুষ আসিয়াছেন, তাঁহার। নিকট চল”। তখন মানুষ দলে দলে যাইয়া সিদ্ধপুরুষকে জিজ্ঞাসা করে ‘মহারাজ’! আমার মনের কথা বলুন। সে সময়ের ব্যবস্থা গোলমেলে হইলে সিদ্ধপুরুষ –“আমাকে বেশী বিরক্ত কর না” এই বলিয়া চুপচাপ্ মৌনি হইয়া যায়। তখন সাধকেরাও তাড়াতাড়ি বলিয়া ওঠে, “আপনারা। বেশী বিরক্ত করিলে ইনি চলিয়া যাইবেন”।

আগন্তুকদের মধ্যে কেহ ধনাঢ্য থাকিলে, তিনি সাধকদের মধ্যে কাহাকেও পৃথকস্থানে ডাকাইয়া বলেন, “যদি আমার মনের কথা বলাইয়া দিতে পারেন, তবে সত্য বলিয়া স্বীকার করিব”। তখন সাধক জিজ্ঞাসা করে, “কী কথা বলুন তো”? ধনাঢ্য সাধককে মনের কথা বলিয়া দিলে সাধক। তাহাকে পূর্বোক্ত সঙ্কেত অনুসারে সিদ্ধপুরুষের নিকট বসাইয়া দেয়। সিদ্ধপুরুষ বুঝিয়া তৎক্ষণাৎ মনের কথা বলিয়া দেয়। তাহা শুনিয়া উপস্থিত সকলে বলিতে থাকে, “আহা কী মহান্ সিদ্ধপুরুষ”!

অতঃপর কেহ মিষ্টান্ন, কেহ টাকা, কেহ মোহর, কেহ বস্ত্র, কেহ বা সিধা সামগ্রী অর্পণ করে। এইরূপে যতদিন সিদ্ধপুরুষকে বহু লোক মান্য করিতে থাকে, ততদিন সে যথেষ্ঠ লুণ্ঠন করে। কোন কোন স্থলে দুই একজন নির্বোধ ধনাঢ্যকে পুত্র প্রাপ্তির আশীৰ্বাদ স্বরূপ কিঞ্চিৎ ভস্ম তুলিয়া দিয়া তাহার নিকট হইতে সহস্র টাকা লইয়া বলে, “যদি তোমার সত্য ভক্তি থাকে, তবে পুত্র লাভ হইবে”।

এইরূপ বহু প্রতারক আছে, কেবলমাত্র বিদ্বানব্যক্তিদের দ্বারাই তাহাদের পরীক্ষা হইতে পারে, অন্য কাহারও নহে। যাহাতে কেহ প্রতারিত না হয় এবং কেহ প্রতারণা করিতে না পারে এবং অপরকে প্রতারণাকারীদের হাত হইতে রক্ষা করিতে হয়, তাহা হইলে শাস্ত্রাধ্যয়ন এবং সৎসংসর্গের। প্রয়োজন। কারণ, বিদ্যাই মনুষ্যের নেত্র। বিদ্যাশিক্ষা ব্যতীত জ্ঞান হয় না। যাহারা বাল্যকাল হইতে সুশিক্ষা প্রাপ্ত হয়, তাহারাই মনুষ্যপদ বাচ্য এবং বিদ্বান হইয়া থাকে। যাহারা কুসঙ্গে থাকে, তাহারা দুষ্ট পাপী এবং মহামূর্খ হইয়া বড়ই দুঃখ ভোগ করে। একারণ জ্ঞানকে বিশেষ বলা হইয়াছে, যে জানে সেই মানে–

ন বেত্তি য়ো য়স্য গুণপ্রকর্ষং স তস্য নিন্দাং সততং করোতি। য়থাকিরাতী করিকুম্ভজাতা মুক্তাঃ পরিত্যজ্য বিভৰ্ত্তি গুঞ্জাঃ ॥৪॥ চা নী০।

যে ব্যক্তি যাহার গুণ সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ সে নিরন্তর তাহার নিন্দা করে। যথা –বন্য ভীল গজমুক্তা পরিত্যাগ করিয়া গুঞ্জার হার গলায় ধারণ করে। সেইরূপ যিনি বিদ্বান্,জ্ঞানী, ধার্মিক, সৎসঙ্গী, যোগী, পুরুষকারসম্পন্ন, জিতেন্দ্রিয় এবং সুশীল,তিনিই যথার্থ কাম, মোক্ষ লাভ করিয়া ইহজন্মে এবং পরজন্মে সর্বদা আনন্দে থাকে।

এস্থলে আৰ্য্যাবৰ্ত্তীয় মত-মতান্তরের সম্বন্ধে সংক্ষেপে লিখিত হইল। অতঃপর আৰ্য্যবংশীয় রাজাদিগের যে সামান্য ইতিহাস পাওয়া গিয়াছে, তাহা সজ্জনদিগের অবগতির জন্য প্রকাশ করা যাইতেছে : —

এবার মহারাজ যুধিষ্ঠির”হইতে মহারাজ “যশপাল” পৰ্য্যন্ত আৰ্য্যাবৰ্ত্তীয় রাজবংশের ইতিহাস লিখিতেছি। এবং শ্রীমান মহারাজ “স্বায়ম্ভব” মনু হইতে মহারাজ যুধিষ্ঠির” পৰ্য্যন্ত ইতিহাস মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে লিখিত আছে। ইহা দ্বারা সজ্জনবৃন্দ যুধিষ্ঠির হইতে তৎপরবর্তীকালের কিঞ্চিৎ ইতিহাস জানিতে পারিবেন।

আমি এ বিষয়ে রাজপুতানার অন্তর্গত উদয়পুর মেবার রাজ্যের রাজধানী চিতোরগড়ের শ্রীনাথদ্বার হইতে প্রকাশিত এবং বিদ্যার্থী সম্মিলিত “হরিশচন্দ্র চন্দ্রিকা” এবং “মোহনচন্দ্রিকা” নামক পাক্ষিক পত্রিকা হইতে অনুবাদ করিয়াছি। যদি আৰ্য্যগণ এইরূপ ইতিহাস এবং অন্যান্য। বিদ্যা পুস্তক সমূহের অনুসন্ধান করিয়া প্রকাশিত করেন, তাহা হইলে দেশের বড়ই কল্যাণ হয়।

উক্ত পত্রিকাদ্বয়ের সম্পাদক মহাশয়, ১৭৮২ (সতর শত বিরাশী) বিক্রমাব্দে লিখিত একখানি গ্রন্থ তাহার কোন বন্ধুর নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়া তাহা হইতে সংগ্রহ করিয়া প্রচলিত ১৯৩৯ সম্বতের মার্গশীর্ষ শুক্লপক্ষের ১৯ কিংবা ২০ কিরণে দুই পাক্ষিক পত্র মুদ্রিত করেন। প্রমাণ স্বরূপ তাহা নিম্নে প্রদত্ত হইল ॥

আৰ্য্যাবর্তদেশীয় রাজবংশাবলী

ইন্দ্রপ্রস্থে আৰ্য্যগণ শ্রীমন্মহারাজ যশপাল’পৰ্য্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন।শ্ৰীমন্মহারাজ যুধিষ্ঠির হইতে মহারাজ যশপাল’ পৰ্য্যন্ত রাজবংশের আনুমানিত ১২৪ (এক শত চব্বিশ) জন রাজা, মোট ৪১৭৫ বৎসর নয় মাস ১৪ দিন যে রাজত্ব করিয়াছিলেন, তাহার বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল।

রাজা—পুরুষ—বর্ষ—মাস–দিন।
আৰ্যরাজা—১২৪—৪১৭৫—৯–১৪

শ্ৰীমন্মহারাজা যুধিষ্ঠির প্রভৃতি আনুমানিক ৩০ পুরুষ ১৭৭০ বৎসর ১১ মাস ১০ দিন রাজত্ব করিয়াছিলেন। ইহার বিবরণ —

আৰ্যরাজা—বর্ষ—মাস—দিন
১। রাজা যুধিষ্ঠির
২। রাজা পরীক্ষিত
৩। রাজা জনমেজয়
৪। রাজা অশ্বমেধ
৫। দ্বিতীয় রাম
৬। ছত্রমল
৭। চিত্ররথ
৮। দুষ্টশৈল্য
৯। রাজা উগ্রসেন
১০। শূরসেন।
১১। ভুবনপতি
১২। রণজীৎ
১৩। ঋক্ষক
১৪। সুখদেব
১৫। নরহরিদেব
১৬। সুচিরথ
১৭। শূরসেন (২য়)
১৮। পর্বতসেন
১৯। মেধাবী
২০। সোনচীর
২১। ভীমদেব
২২। নৃহরিদেব
২৩। পূর্ণর্মল
২৪। করদবী
২৫। অলংমিক
২৬। উদয়পাল
২৭। দুবনমল
২৮। দমাত
২৯। ভীমপাল
৩০। ক্ষেমক

রাজা ক্ষেমকের প্রধান মন্ত্রী বিশ্রবা ক্ষেমক রাজাকে মারিয়া সিংহাসন অধিকার করেন। তাঁহার বংশ ১৪ পুরুষ, ৫০০ বৎসর, ৩ মাস, ১৭ দিন রাজত্ব করেন। তাহাদের তালিকা —

আৰ্যরাজা
১। বিশবা
২। পুরসেনী
৩। বীরসেনী
৪। অনঙ্গশায়ী
৫। হরিজিৎ
৬। পরমসেনী
৭। সুখপাতাল
৮। কদ্রুত
৯। সজ্জ
১০। অমরচূড়
১১। অমীপাল
১২। দশরথ
১৩। বীরসাল
১৪। বীরাসালসেন

রাজা বীরসাল সেনের প্রধান মন্ত্রী বীরমহা প্রধান তাঁহাকে হত্যা করিয়া রাজাধিকার করেন। তাঁহার বংশ ১৬ পুরুষ ৪৪৫ বৎসর ৫ মাস ৩ দিন রাজত্ব করেন। তাহাদের তালিকা–

আৰ্য্যরাজা–বর্ষ ম—মাস–দিন
১। রাজা বীরমহা
২। অজিত সিংহ
৩। সর্বদত্ত
৪। ভূবনপতি
৫। বীরসেন (প্রথম)
৬। মহীপাল
৭। শত্রশাল
৮। সঙ্ঘরাজ
৯। তেজপাল
১০। মানিক চাঁদ
১১। কামসেনী
১২। শক্রমর্দন
১৩। জীবনলোক
১৪। হরিরাও
১৫। বীরসেন (২য়)
১৬। আদিত্যকেতু।

প্রয়াগের রাজা ধন্ধর’মগধদেশের রাজা আদিত্যকেতুকে মারিয়া রাজ্যাধিকার করেন। তাহার বংশ ৯ পুরুষ ৩৭৪ বৎসর ১১ মাস ২৬ দিন রাজত্ব করেন। তাঁহাদের তালিকা

আর্যরাজা—বর্ষ—মাস–দিন
১। রাজা ধন্ধর
২। মহর্ষি
৩। সনুরষ্ঠী
৪। মহাযুদ্ধ
৫। দুরনাথ
৬। জীবনরাজ
৭। রুদ্রসেন
৮। আরীলক
৯। রাজপাল

সামন্ত মহান্ পাল রাজা রাজপালকে হত্যা করিয়া রাজ্যাধিকার করেন। তিনি এক পুরুষে ১৪ বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁহার বৃদ্ধি নাই।

রাজা বিক্রমাদিত্য অবন্তিকা (উজ্জায়নী) হইতে আক্রমণ চালাইয়া রাজা মহাপালকে নিহত করিয়া রাজ্যাধিকার করেন। তাঁহার বংশ ১ পুরুষ ৯৩ বৎসর রাজত্ব করেন। তাহার কোন বৃদ্ধি নাই।

শালিবাহনের মন্ত্রী সমুদ্রপাল, যোগীপৈঠনের রাজা বিক্রমাদিত্যকে হত্যা করিয়া রাজাধিকার করেন। তাঁহার বংশ ১৬ পুরুষ, ৩৭২ বৎসর, ৪ মাস ২৭ দিন রাজত্ব করেন। তাঁহাদের তালিকা–

আৰ্য্যরাজা
১। সমুদ্রপাল
২। চন্দ্রপাল
৩। সাহায়পাল
৪। দেবপাল
৫। নরসিংহপাল
৬। সামপাল
৭। রঘুপাল
৮। গোবিন্দপাল
৯। অমৃতপাল
১০। বলীপাল
১১। মহীপাল
১২। হরীপাল
১৩। সীসপাল
(কোনও ইতিহাসে ভীমপালও লিখিত আছে)
১৪। মদনপাল
১৫। কর্মপাল
১৬। বিক্রমপাল

রাজা বিক্রমপালকে পশ্চিমাঞ্চলের রাজা মলুখচন্দ্র বহরা আক্রমণ করিয়া সম্মুখ যুদ্ধে বিক্রম পালকে নিহত করিয়া ইন্দ্রপ্রস্থর সিংহাসন অধিকার করেন। তাঁহার বংশ ১০ পুরুষ ১৯১ বৎসর ১ মাস ১৬ দিন রাজত্ব করেন। তাঁহাদের তালিকা–

আৰ্যরাজা—বর্ষ—মাস–দিন
১। মলুখ চন্দ
২। বিক্রম চন্দ
৩। অমীনচন্দ
(ইহার নাম কোথাও মানকচন্দ ও লিখিত আছে)
৪। রামচন্দ
৫। হরীচন্দ
৬। কল্যাণচন্দ
৭। ভীমচন্দ
৮। লোবচন্দ
৯। গোবিন্দচন্দ
১০। রাণী পদ্মাবতী
(এই পদ্মাবতী গোবিন্দচন্দের রানী ছিলেন)

রাণী পদ্মাবতী নিঃসন্তানা অবস্থায় পরলোক গমন করেন। এই নিমিত্ত তাঁহার সমস্ত মন্ত্রিগণ সর্বসম্মতি ক্রমে হরিপ্ৰেম বৈরাগীকে সিংহাসনে বসাইয়া তাহার নামে রাজত্ব করিতে থাকেন। এই বংশ ৪ পুরুষ, ৫০ বৎসর ০ মাস ২১ দিন রাজত্ব করেন। তাঁহাদের তালিকা

আৰ্যরাজা
১। হরিপ্রেম
২। গোবিন্দপ্রেম
৩। গোপালপ্রেম
৪। মহাবাহু।

রাজা মহাবাহু রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া তপস্যার্থে বনে গমন করেন। ইহা শুনিয়া বঙ্গ দেশের রাজা আধীসেন ইন্দ্রপ্রস্থে আসিয়া নিজে রাজত্ব করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার বংশ ১২ পুরুষ, ১৫১ বৎসর ১১মাস ২দিন রাজত্ব করেন। তাঁহাদের তালিকা

আৰ্যরাজা
১। রাজা আধীসেন
২। বিলাবলসেন
৩। কেশবসেন
৪। মাধসেন
৫। ময়ূরসেন
৬। ভীমসেন
৭। কল্যাণসেন
৮। হরিসেন
৯। ক্ষেমসেন
১০। নারায়ণসেন
১১। লক্ষ্মীসেন
১২। দামোদর সেন

রাজা দামোদরসেন তাহার পাত্রমিত্রদিগকে অনেক কষ্ট দিতেন। এই নিমিত্ত তাহার জনৈক পাত্রমিত্র দীপসিংহ সৈন্য সংগ্রহ করিয়া তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং তাঁহাকে যুদ্ধে নিহত করিয়া স্বয়ং রাজত্ব করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার বংশ ৬ পুরুষ, ১০৭ বৎসর ৬ মাস ২ দিন রাজত্ব করেন। তাঁহাদের তালিকা

আৰ্যরাজা
১। দীপসিংহ
২। রাজসিংহ
৩। রণসিংহ
৪। নরসিংহ
৫। হরিসিংহ
৬। জীবনসিংহ

কোন কারণ বশতঃ রাজা জীবনসিংহ তাঁহার সমস্ত সৈন্য উত্তরদিকে প্রেরণ করেন। বৈরাটের রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান সেই সংবাদ পাইয়া জীবনসিংহকে আক্রমণ করেন এবং তাঁহাকে যুদ্ধে। নিহত করিয়া ইন্দ্রপ্রস্থে রাজত্ব করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার বংশ ৫ পুরুষ, ৮৬ বৎসর ৩ মাস ২০ দিন রাজত্ব করেন। তাঁহাদের তালিকা

আৰ্যরাজা
১। পৃথ্বী রাজ
২। অভয়পাল
৩। দুৰ্জ্জনপাল
৪। উদয়পাল
৫। যশপাল

সুলতান শাহাবুদ্দিন ঘোরী গজনীর দুর্গ হইতে রাজা যশপালকে আক্রমণ করেন এবং ১২৪৯ সালে তাঁহাকে প্রয়াগের দুর্গে বন্দী করেন। অতঃপর সুলতান শাহাবুদ্দিন ইন্দ্রপ্রস্থে (দিল্লীতে) রাজত্ব করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার বংশ ৫৩পুরুষ, ৭৪৫ বৎসর, ১ মাস ও ১৭ দিন রাজত্ব। করেন। তাহাদের বিষয়ে অনেক ইতিহাসে লিখিত আছে। এই নিমিত্ত এ স্থলে উহা লিখিত হইল না। অতঃপর বৌদ্ধ এবং জৈনমতের সম্বন্ধে লিখিত হইবে।

ইতি শ্রীমদ্দয়ানন্দসরস্বতী স্বামীকৃতে সত্যার্থপ্রকাশে
সুভাষাবিভূষিতে আয়্যার্বত্তীয়মতখণ্ডনমণ্ডনবিষয়ে
একাদশঃ সমুল্লাসঃ সম্পূর্ণঃ ॥ ১১ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *