১২. চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন মত বিষয়

চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন মত বিষয়

অনুভূমিকা ২

আর্যাবর্তীবাসীগণ সত্যাসত্যের যথাবৎ নির্ণায়ক বেদবিদ্যা হইতেদূরে সরিয়া গেলে অবিদ্যাবিস্তৃত হওয়ায় মত-মতান্তর মাথা তুলিয়া উঠে। পরিণাম স্বরূপ ইহাই জৈন প্রভৃতি বিদ্যাবিরুদ্ধমত প্রচারের কারণ হয়। কেননা বাল্মীকীয় (রামায়ণ) এবংমহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে জৈনদের নামমাত্রও উল্লেখ নাই, এবং জৈনদের গ্রন্থসমূহে বাল্মীকীয় (রামায়ণ) এবং (মহা) ভারতে বর্ণিত রাম এবং কৃষ্ণ প্রভৃতির গাথা বিস্তৃতভাবে লিখিত আছে। ইহা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, জৈনমত ইহাদের পরে প্রচলিত হয়। জৈনগণ বলিয়া থাকেন যে, তাঁহাদের মত অতি প্রাচীন। যদি তাহাই হইত, তাহা হইলে বাল্মীকীয় (রামায়ণ) প্রভৃতি গ্রন্থেঅবশ্যই তাঁহাদের কথার উল্লেখ থাকিত। অতএব জৈনমত এ সকল গ্রন্থের পরে প্রচলিত হইয়াছে।

যদি কেহ বলেন যে, জৈনদের গ্রন্থসমূহহইতে উপাখ্যান সমূহ অবলম্বন করিয়া (বাল্মীকীয়) রামায়ণ প্রভৃতি গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। তাহা হইলে তাহাদের নিকট জিজ্ঞাস্য, বাল্মীকীয় (রামায়ণ) প্রভৃতিতে তোমাদের গ্রন্থের উল্লেখ নাই কেন? অথচ তোমাদের গ্রন্থ সমূহে কেন আছে? পুত্র কি কখনও পিতার জন্ম দেখিতে পায়? কখনও নহে। ইহা দ্বারা ইহাই সিদ্ধহয় যে, জৈন-বৌদ্ধমত–শৈব-শাক্ত প্রভৃতি মতেরও পরে প্রচলিত হইয়াছে।

এবার এই দ্বাদশ সমুল্লাসে জৈনমত বিষয়ে যাহা যাহা লিখিত হইয়াছে তৎসম্পর্কে তাহাদের গ্রন্থোক্ত সন্ধান উল্লেখ পূর্বক জৈনগ্রন্থের প্রমাণ উদ্ধৃত করা হইয়াছে। এ বিষয়ে জৈনদিগের কিছু মনে করা উচিত নহে; কারণ তাঁহাদের মতবিষয়ে যাহা যাহা লিখিয়াছি সেই সব আলোচনার উদ্দেশ্য”সত্যাসত্যের নির্ণয়”করা; বিরোধ অথবা অনিষ্টসাধনার্থ নহে। ইহা পাঠ করিলে জৈন, বৌদ্ধ অথবা অপর যে কোন সম্প্রদায় সত্যাসত্য নির্ণয়ের জন্য চিন্তা করিবার এবং লিখিবার সুযোগ পাইবেন এবং তাহাতে তাহাদের জ্ঞানোদয়ও হইবে। যতক্ষণ পর্যন্ত বাদী প্রতিবাদীরূপে প্রীতিসহকারে তর্ক অথবা লিখিত বিচার না করা যায়, ততক্ষণ সত্যাসত্যের নির্ণয় হইতে পারে না। বিদ্বান্ ব্যক্তিদের মধ্যে সত্যাসত্যের নির্ণয় না হইলে অবিদ্বান্ব্যক্তিদিগকে ঘোরতর অন্ধকারে পতিত হইয়া দুঃখ ভোগ করিতে হয়। অতএব সত্যের জয় এবং অসত্যের ক্ষয়ের জন্য মিত্রভাবে তর্ক অথবা লিখিত মন্তব্য প্রকাশ করা মানব জাতির প্রধান কর্তব্য। তদ্ব্যতীত তাহাদের কখনও উন্নতি হইতে পারে না।

বৌদ্ধমত এবং জৈনমত সম্বন্ধে যাহা লিখিত হইয়াছে তাহা বৌদ্ধ এবং জৈন ব্যতীত অন্যান্য মতাবলম্বীদিগের পক্ষেও অপূর্ব লাভ ও বোধকারী হইবে। কারণ এই যে, তাহারা তাহাদের গ্রন্থ সমূহ অপর কোন মতাবলম্বীকে দেখিতে, পাঠকরিতে অথবা লিখিয়া লইতেও দেন না। বোম্বাই আৰ্যসমাজের মন্ত্রী শেঠ’সেবকলাল কৃষ্ণদাস’এবং আমার বিশেষ চেষ্টায় কতকগুলি জৈনগ্রন্থ হস্ত গত হইয়াছে। ঐ সকল গ্রন্থ কাশীস্থ ‘জৈন প্রভাকর’ যন্ত্রালয়ে মুদ্রিত হইয়াছে, তদ্ব্যতীত বোম্বাইতে”প্রকরণ রত্নাকর”নামক গ্রন্থখানিও মুদ্রিত হইয়াছে। তাহাতেও সকলের পক্ষে জৈন। মত কী, তাহা জানা সহজ হইয়াছে।

বলুন তো? ইহা কীরূপ বিদ্বজ্জনের কাৰ্য্য যে, নিজ নিজ মত সংক্রান্ত পুস্তকগুলি নিজেই দেখিবেন, অপর কাহাকেও দেখাইবেন না? ইহাতেই জানা যাইতেছে যে, যাঁহারা ঐ সকল গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মনে পূর্ব হইতেই সন্দেহ ছিল যে, তাঁহাদের এই গ্রন্থ সমূহে অনেক অসম্ভব কথা আছে, অন্যমতাবলম্বীগণ ঐ সকল পাঠকরিলে খণ্ডন করিবে এবং স্বমতাবলম্বীগণও ভিন্ন মত বিষয়ক গ্রন্থ পাঠ করিলে নিজ মতে শ্রদ্বা হারাইয়া ফেলিবে।

যাহা হউক, এমন অনেকেই আছেন যে, তাঁহারা নিজেদের দোষ দেখিতে পান না, কিন্তু অপরের দোষ দেখিতে অত্যন্ত উৎসুক। ইহা ন্যায়সঙ্গত কথা নহে। কারণ প্রথমে নিজের দোষ দেখিয়া পরে অন্যের দোষ সংশোধন করা কর্তব্য।

এবার বৌদ্ধ এবং জৈনমত বিষয়ক আলোচনা সদাশয় পাঠকবর্গের সমক্ষে উপস্থিত করা যাইতেছে, ইহা কীরূপ, তাহারাই বিবেচনা করিবেন।

কিমধিকলেখেন বুদ্ধিমদ্বয়ে

.

অথ দ্বাদশ-সমুল্লাসারঃ
অথ নাস্তিক মতান্তর্গত চারবাক বৌদ্ধ-জৈনমত
খণ্ডন মণ্ডন বিষয়া ব্যাখ্যাস্যামঃ ॥

এবার নাস্তিক মতের অন্তর্গত চারবাক, বৌদ্ধ ও জৈন মতের খন্ডন-মন্ডন বিষয়ে কথন করিতেছি। বৃহস্পতি’ নামক কোন এক ব্যক্তি ছিলেন, তিনি বেদ, ঈশ্বর এবং যজ্ঞাদি উত্তম কৰ্ম্মসমূহও স্বীকার করিতেন না। শুনুন তাঁহার মতে–

যাবজ্জীবং সুখং জীবেন্নাস্তি মৃত্যোরগোচরঃ ॥ ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ॥ সর্বদর্শন সংগ্রহ

মনুষ্যাদি কোন প্রাণী মৃত্যুর অগোচর নহে অর্থাৎ সকলকেই মরিতে হইবে। অতএব যতদিন শরীরে জীব থাকে, ততদিন সুখে থাকিবে। যদি কেহ বলে যে, ধর্মাচরণে কষ্ট হয় বটে, কিন্তু ধর্ম পরিত্যাগ করিলে পরজন্মে বহু দুঃখ ভোগ করিতে হইবে, তাহার প্রতি ‘চারাবাকের’ উত্তর, “ওহে ভাই! তুমি নির্বোধ; মৃত্যুর পরে শরীর ভস্ম হইয়া যায়। যে ব্যক্তি পান ভোজন করিয়াছিল; সে পুনরায় সংসারে আসিবে না। যে কোনরূপ হউক আনন্দে থাক; সংসারে নীতি অনুসারে চল; ঐশ্বৰ্য্য বৃদ্ধি কর এবং তদ্বারা যথেচ্ছ ভোগ কর। মনে রাখিও, এই লোকই আছে, পরলোক বলিয়া কিছু নাই।

দেখ! পৃথিবী, জল, অগ্নি এবং বায়ু –এই চারি ভূতের পরিণাম হইতে এই শরীর নির্মিত হইয়াছে। তাহাতে এ সকলের সংযোগ বশতঃ চৈতন্য উৎপন্ন হয়। যেমন মাদক দ্রব্য সেবন করিলে মাদকতা (নেশা) উৎপন্ন হয়, সেইরূপ জীব শরীরের সহিত উৎপন্ন হইয়া শরীরের নাশের সহিত স্বয়ং নষ্ট হইয়া যায়। তাহা হইলে পাপ-পূণ্যের ফল কাহার হইবে?

তচ্চৈতন্যবিশিষ্ট দেহ এব আত্মা দেবাতিরিক্ত আত্মনি প্রমাণাভাবাৎ ॥ চার্বাক দর্শন

চারি ভূতের সংযোগ বশতঃ এই শরীরে জীবাত্মা উৎপন্ন হয় এবং এ সকলের বিয়োগের সহিতই বিনাশ প্রাপ্ত হয়। কারণ, মৃত্যুর পর কোন জীব প্রত্যক্ষ হয় না। আমরা এক প্রত্যক্ষই মানি, কারণ প্রত্যক্ষ ব্যতীত অনুমানাদি হইতে পারে না। অতএব মুখ্য প্রত্যক্ষের সম্মুখে অনুমানাদি গৌণ বলিয়া তাহা গ্রহণীয় নহে। সুন্দরী স্ত্রীর আলিঙ্গনে আনন্দ সম্ভোগ করা পুরুষার্থের ফল।

উত্তর –পৃথিব্যাদি ভুত জড়। জড় হইতে কখনও চেতনের উৎপত্তি হইতে পারে না। যেরূপ বর্তমানে পিতৃ-মাতৃ সংযোগে দেহের উৎপত্তি; সেইরূপ সৃষ্টির প্রারম্ভে মনুষ্যাদির শরীরের নির্মাণকৰ্ত্তা পরমেশ্বর ব্যতীত অপর কেহ হইতে পারে না। মাদকতার ন্যায় চেতনতার উৎপত্তি ও বিনাশ হয় না। কারণ, চেতনেই মাদকতা হইতে পারে, জড়ে নহে ॥

পদার্থ সমূহ নষ্ট অর্থাৎ অদৃশ্য হয়, কিন্তু কাহারও অভাব হয় না। এইরূপে অদৃশ্য হইলে জীবেরও অভাব হয়, এইরূপ মনে করা উচিত নহে। দেহের সহিত সংযোগ ঘটিলেই জীবাত্মা প্রকট হয়। যখন (সে) শরীর পরিত্যাগ করে, তখন এই শরীর যে মৃত, পূর্বের ন্যায় মৃত শরীর চেতনাযুক্ত থাকিতে পারে না। বৃহদারণ্যকে উক্ত হইয়াছেঃ

“নাহং মোহংব্রবীমি, অনুচ্ছিত্তিধর্মায়মাত্মেতি”।

যাজ্ঞবল্ক্য বলিতেছেন, “হে মৈত্রেয়ী! আমি মোহবশতঃ বলিতেছিনা কিন্তু আত্মা অবিনাশী। আত্মার সংযোগ বশতঃ শরীর চেষ্টা করে।”

জীবের শরীর হইতে বিচ্ছিন্ন হইবার পর, শরীরে কোন জ্ঞানই থাকে না। যদি দেহ ব্যতীত পৃথক্‌ আত্মা না থাকিত তাহা হইলে মৃত্যুর পর শরীরে জ্ঞানের অভাব হইত না। অতএব যাহার সংযোগ হইলে চেতনতা এবং বিয়োগ হইলে জড়তা উৎপন্ন হয়, সে দেহ হইতে পৃথক্‌ ॥

চক্ষু সকলকে দেখে কিন্তু চক্ষু নিজেকে দেখিতে পায় না। সেইরূপ যে প্রত্যক্ষ করে, সে নিজেকে ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ করিতে পারে না। যেমন কেহ চক্ষু দ্বারা ঘট-পটাদি পদার্থ দেখে, সেইরূপ জ্ঞান দ্বারা চক্ষুকে দেখে। যে দ্রষ্টা সে দ্রষ্টাই থাকে, কখনও দৃশ্যও হয় না। যথা, আধার। ব্যতীত আধেয়, কারণ ব্যতীত কাৰ্য্য, অবয়বী ব্যতীত অবয়ব এবং কৰ্ত্তা ব্যতীত কর্ম থাকিতে পারে না সেইরূপ কর্তা ব্যতীত প্রত্যক্ষ কীরূপে হইতে পারে?

সুন্দরী স্ত্রীসংসর্গ পুরুষার্থ ফল হইলে, তজ্জনিত ক্ষণিক সুখ-দুখও পুরুষার্থের ফল হইবে ॥ এইরূপ স্বর্গসুখের হানি হওয়ায় দুঃখ ভোগ করিতে হইবে। যদি বলেন যে, দুঃখ মোচন এবং সুখবৃদ্ধির জন্য যত্নবান্ হওয়া উচিত, তাহা হইলে মুক্তিসুখের হানি হইবে। সুতরাং উহা পুরুষার্থ ফল নহে।

চারবাক –যাহারা দুঃখমিশ্রিত সুখ পরিত্যাগ করে, তাহারা মুখ। যেমন কৃষক ধান্য হইতে তণ্ডুল গ্রহণ করিয়া তুষ পরিত্যাগ করে, সেইরূপ এই সংসারে বুদ্ধিমান ব্যক্তি সুখ গ্রহণ এবং দুঃখ বৰ্জন করিবেন। কেননা যাহারা ইহলোকের উপস্থিত সুখ পরিত্যাগ করিয়া, অনুপস্থিত স্বর্গ সুখের ইচ্ছায় ধূৰ্ত কথিত বেদোক্ত অগ্নিহোত্রাদিকৰ্ম্ম, উপাসনা এবং জ্ঞানকাণ্ডের অনুষ্ঠান পরলোক লাভের আশায় করে, তাহার অজ্ঞানী। যদি পরলোকই নাই, তাহার আকাঙ্ক্ষা করা মূর্খর্তার কাজ; কেননা–

“অগ্নিহোত্রং ত্ৰয়ো বেদাদিণ্ডংভস্মগুণ্ঠনম ॥ বুদ্ধিপৌরুষহীনানং জীবিকেতি বৃহস্পতিঃ” ॥ চার্বাক দর্শন।

চারবাক মত প্রচারকবৃহস্পতিবলিতেছেন যে, নির্বোধ এবং পুরুষাৰ্থহীন লোকেরা অগ্নিহোত্র তিন বেদ, তিন দণ্ড এবং ভস্মলেপন করা তাহাদের জীবিকা করিয়া লইয়াছে।

কিন্তু কন্টকবিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি কারণে যে দুঃখ উৎপন্ন হয়, তাহারই নাম নিরক’, লোক প্রসিদ্ধ রাজা পরমেশ্বর’ এবং দেহের নাশ হওয়াকে ‘মোক্ষ’ বলে। মোক্ষ অন্য কিছুই নহে ॥

উত্তর –বিষয়সুখমাত্রই পুরুষকারের ফল এবং বিষয় দুঃখের নিবৃত্তি মাত্রই কৃতকৃত্যতা ও স্বর্গ মনে করা মূর্খতা। অগ্নিহোত্র প্রভৃতি যজ্ঞের দ্বারা বায়ু এবং জল পবিত্র হয়; তাহাতে আরোগ্য এবং ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ সিদ্ধি হয়। ইহা না জানিয়া বেদ, ঈশ্বর এবং বেদোক্ত ধর্মের নিন্দা করা ধূর্তের কার্য্য। ত্রিদণ্ড এবং ভস্মধারণের যে খণ্ডন হইয়াছে তাহা যুক্তিসঙ্গত।

কন্টকাদি হইতে উৎপন্ন দুঃখের নাম যদি নরক হয়, তদপেক্ষা অধিক কষ্টকর মহারোগাদি নরক নহে কেন? ঐশ্বৰ্য্যশালী এবং প্রজাপালনে সমর্থ রাজাকে শ্রেষ্ঠ মনে করা সঙ্গত, কিন্তু যে রাজা পাপী এবং অন্যায়কারী, তাহাকেও পরমেশ্বরের ন্যায় সম্মান করার মত মূর্খতা আর কী আছে? যদি শরীর বিয়োগমাত্রকেই মোক্ষ বলা হয়, তাহা হইলে গর্দভ, কুকুর প্রভৃতি এবং তোমাদের মধ্যে কী প্রভেদ রহিল? কেবল আকৃতিমাত্রই প্রভেদ রহিল।

অগ্নিরুষ্ণো জলংশীতং সমস্পর্শস্তথানিলঃ। কেনেদং চিত্রিতং তস্মাৎ স্বভাবাত্ত্যবস্থিতিঃ ॥১॥ নস্বর্গো নাপাবর্গো বা নৈবাত্মা পারলৌকিকঃ। নৈববর্ণাশ্রমাদীনাং ক্রিয়াশ্চ ফলদায়িকাঃ ॥২॥ পশুশ্চেন্নিহতঃ স্বর্গ জ্যোতিষ্টোমে গমিষ্যতি। স্বপিতা য়জমানেন তত্র কম্যান্ন হিংস্যতে ॥৩॥ মৃতানামপি জনাংশ্রাদ্ধং চেতৃপ্তিকারণম্। গচ্ছতামিহ জন্তুনাং ব্যর্থং প্যাথেয়কল্পন৷৪ ॥ স্বর্গস্থিতায়দা তৃপ্তিং গচ্ছেয়ুস্তত্র দানতঃ ॥ প্রাসাদস্যোপরিস্থানামত্র কম্যান্নদীয়তে৷৫ ॥ যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেদৃণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ। ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কূতঃ ॥৬ ॥ যদি গচ্ছেৎ পরং লোকং দেহাষে বিনির্গতঃ। কস্মভূয়োন চায়াতি বন্ধুস্নেহসমাকুলঃ ॥৭॥ ততশ্চ জীবনোপায়ো ব্রাহ্মাণৈবিহিতত্ত্বিহ ॥ মৃতানাং প্রেতকায়াণিন ত্বন্যবিদ্যতে ক্বচিৎ ॥৮ এয়ো বেদস্য কারো ভণ্ডধূৰ্ত্তনিশাচরাঃ ॥ জরীতুফরীত্যাদি পণ্ডিতানাং বঢ়ঃ স্মৃত ॥ ৷৯ ॥ অশ্বস্যা হি শিশ্নন্তু পত্নীগ্রাহ্যং প্রকীর্তিত। ভওৈস্তদ্বৎ পরং চৈব গ্রাহ্যজাতং প্রকীৰ্ত্তিত ॥ ১০ ॥

মাংসানাং খাদনং তদ্বন্নিশাচরসমীরিতম্ ॥ ১১ ॥ চার্বাক দর্শন।

“চারবাক’, ‘আভাণক’, ‘বৌদ্ধ’ এবং “জৈন ও জগতের উৎপত্তি, স্বভাব হইতে স্বীকার করে। স্বাভাবিক গুণের সহিত দ্রব্য সংযোগে সকল পদার্থ উৎপন্ন হয়। জগতের কৰ্ত্তা কেহই নাই ॥ ১ ॥

কিন্তু ইহাদের মধ্যে চারবাক’ ই এইরূপ স্বীকার করেন। বৌদ্ধ ও জৈনগণ পরলোক এবং জীবাত্মা স্বীকার করেন, কিন্তু চারবাক তাহা স্বীকার করেন না। অবশিষ্ট বিষয়ে উক্ত তিন সম্প্রদায়ের মত কোন কোন বিষয় ব্যতীত, প্রায় একরূপ। তাহাদের মতে স্বর্গ, নরক এবং পরলোকগামী কোন আত্মা নেই এবং বর্ণাশ্রমের ক্রিয়াও ফলদায়ক নহে ॥ ২ ॥

যজ্ঞে পশু বধ করিয়া হোম করিলে যদি সেই পশু স্বর্গে যায়, তাহা হইলে যজমান আপন পিতাকে বধ করিবার পর তাহাকে হোম করিয়া স্বর্গে প্রেরণ করে না কেন? ॥ ৩ ॥

যদি শ্রাদ্ধ-তর্পণ মৃত জীবদের পক্ষে তৃপ্তিকর হয়, তাহা হইলে বিদেশযাত্রী পাথেয় স্বরূপ অন্ন-বস্ত্র এবং টাকা কড়ি লইয়া যায় কেন? যদি মৃতের নামে অর্পিত পদার্থ স্বর্গে যায়, তাহা হইলে যাহারা বিদেশে গিয়াছে, তাহাদের আত্মীয়েরাও আপন গৃহে তাহাদের নামে বস্তু অর্পণ করিয়া বিদেশে প্রেরণ করিতে পারিবে। যদি উহা না পৌঁছায় তাহা হইলে সে সমস্ত বস্তু কীরূপে স্বর্গে পৌঁছাইবে? ॥৪ ॥

যদি মর্ত্যলোকে দান করিলে স্বর্গবাসী তৃপ্ত হয় তাহা হইলে ঘরের নীচের তলায় দান করিলে। ঘরের উপরতলার ব্যক্তিগণ তৃপ্ত হয় না কেন? ॥৫ ॥

অতএব যতকাল জীবিত থাকিবে, ততকাল সুখেই জীবন ব্যতীত করিবে। গৃহে কোন বস্তু না। থাকিলে ঋণ করিয়া আনন্দ ভোগ করিবে, ঋণ পরিশোধ করিতে হইবে না। কেননা, যে শরীরে জীব পান-ভোজন করিয়াছে, তাহাদের উভয়েরই পুনরাগমন হইবে না। এমতাবস্থায় কে কাহার নিকট চাহিবে, আর কেই বা পরিশোধ করিবে? ॥ ৬ ॥

যাহারা বলে যে, মৃত্যুর পর জীব শরীর হইতে বহির্গত হইয়া পরলোকে গমন করে এসব। কথা মিথ্যা। কেননা, উহা সত্য হইলে পরলোকগত জীব কুটুম্বদিগের মোহে আসক্ত হইয়া পুনরায় গৃহে ফিরিয়া আসে না কেন? ॥ ৭ ॥

সুতরাং ব্রাহ্মণগণ এ সমস্ত তাহাদের আপন জীবিকার্জনের উপায় করিয়াছে। মৃতকের জন্য দশগাত্রাদি মৃতক ক্রিয়া করিয়া থাকেন এ সমস্ত তাহাদের জীবিকার ফন্দি ॥ ৮ ॥

বেদ রচয়িতা ভণ্ড, ধূর্ত এবং নিশাচর অর্থাৎ রাক্ষস এই তিন জন। “জফরী”, “তুফরী”ইত্যদি পণ্ডিতদের ধূর্ততাপূর্ণ বচন ॥৯॥

ধূৰ্ত্তদের রচনা দেখুন! যজমানদের স্ত্রী অশ্বলিঙ্গ গ্রহণ করিবে। অশ্বের সহিত তাহার সমাগম করাইবে, যজমানের কন্যার সহিত ঠাট্টা পরিহাসের কথা ধূর্ত ভিন্ন অপর কেহ কি লিখিতে পারে? ॥১০ ॥

যে স্থলে মাংস ভক্ষণের কথা লেখা হইয়াছে, সেই বেদ ভাগ রাক্ষসের রচনা ॥১১ ॥

উত্তর –চেতন পরমেশ্বর কর্তৃক নির্মিত না হইলে, জড় পদার্থসমূহ স্বাভাবিকভাবে নিয়মপূর্বক মিলিত হইয়া উৎপন্ন হইতে পারে না। যদি স্বভাব হইতেই হইত, তবে দ্বিতীয় সূৰ্য্য, চন্দ্র, পৃথিবী এবং নক্ষত্রাদি লোক স্বয়ং নির্মিত হয় না কেন? ॥১॥

সুখভোগের নাম ‘স্বর্গ’ এবং দুঃখভোগের নাম নিরক’। জীবাত্মা না থাকিলে সুখ-দুঃখ কে ভোগ করিবে? বর্তমানের ন্যায় পরজন্মেও জীব সুখ-দুঃখের ভোক্তা।বর্ণাশ্রমীদের সত্যভাষণ এবং পরোপকার প্রভৃতি ক্রিয়াও কি নিষ্ফল হইবে? কখনই না ॥২॥

বেদাদি সত্যশাস্ত্রে কোথাও পশু বধ করিয়া হোম করিবার কথা লিখিত হয় নাই। মৃতকের শ্রাদ্ধ-তর্পণও কপোল কল্পিত। কারণ, এসকল বেদাদি সত্যশাস্ত্রবিরুদ্ধ এবং ভাগবতাদি পুরাণ মতাবলম্বীদের অনুকূল অভিমত, অতএব ইহার খণ্ডন অখণ্ডনীয় ॥৩॥৪॥৫ ॥

বিদ্যমান বস্তুর অভাব কখনও হয় না; বিদ্যমান জীবেরও অভাব হইতে পারে না। দেহ ভস্ম হয়, জীব ভস্ম হয় না। জীব অন্য শরীরে গমন করে অতএব ইহাতে কোন সন্দেহ নাই যে, যাহারা। ঋণ করিয়া পরের দ্রব্য ভোগ করে; এবং ঋণ শোধ করে না, তাহারা নিশ্চয় পাপী এবং পরজন্মে দুঃখস্বরূপ নরক ভোগ করে ॥ ৬ ॥

দেহ হইতে বাহির হইয়া জীব স্থানান্তরে গমন করে এবং দেহান্তর প্রাপ্ত হয়। তাহার পূর্বজন্ম ও কুটুম্ব প্রভৃতির কোন জ্ঞান থাকে না। এইজন্য কুটুম্বদের মধ্যে ফিরিয়া আসিতে পারে না। ॥ ৭ ॥

হ্যাঁ, ব্রাহ্মণগণ তাহাদের জীবিকার জন্য প্রেত-কর্ম রচনা করিয়াছে। ইহা বেদোক্ত নহে বলিয়া খণ্ডনীয় ॥ ৮ ॥

এখন দেখুন! যদি চারবাক প্রভৃতি বেদাদি সত্যশাস্ত্র দর্শন, শ্রবণ অথবা পাঠ করিতেন তাহা। হইলে কখনও বেদের নিন্দা করিতেন না এবং বলিতেন না যে, বেদ ভণ্ড, ধুর্ত এবং নিশাচর সদৃশ ব্যক্তিদের রচিত। অবশ্য মহীধরের ন্যায় টীকাকারগণই ভণ্ড, ধূৰ্ত্ত এবং নিশাচর সদৃশ; এই ধূর্ততা তাহাদের বেদের নহে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে,চারবাক, আভাণক, বৌদ্ধ এবং জৈনগণ মূল চারিবেদের সংহিতাগুলি দর্শন,শ্রবণ ও পাঠ করেন নাই এবং কোন বিদ্বান্ব্যক্তির নিকট অধ্যয়ন করেন নাই। এই নিমিত্ত তাহারা নষ্ট ভ্রষ্ট বুদ্ধি হইয়া,নিরর্থক বেদের নিন্দা এবং দুষ্টবুদ্ধি বামমার্গীদিগের প্রমাণশূন্য কপোল কল্পিত জঘন্য টীকাসমূহ পাঠ করিয়া বেদবিরোধী হইয়াছেন। ফলে তাহারা অবিদ্যারূপী অতল। সমুদ্রে নিপতিত হইয়াছেন।৯ ॥

কী বা বলিব,বিচার করা উচিত এই যে, স্ত্রীলোকের দ্বারা অশ্বলিঙ্গ গ্রহণ করান, অশ্বের সহিত তাহার সমাগম করান, যজমানের কন্যার সহিত হাস্য পরিহাস করা –বামমার্গী ব্যতীত কে এরূপ ভ্রষ্ট, অশুদ্ধ, বেদার্থ বিরুদ্ধে বেদ ব্যাখ্যা করিবে?

চারবাক প্রভৃতির জন্য দুঃখ হয় যে, তাহারা নির্বিচারে বেদের নিন্দায় তৎপর হইয়াছিলেন এবং স্বীয় বুদ্ধির কোন সদ্ব্যবহারই করেন নাই। তাহারা কিই বা করিবেন? সত্যাসত্যের বিচার পূর্বক সত্যের মণ্ডন এবং অসত্যের খণ্ডন করিবার মত বিদ্যাও তাহাদের ছিল না ॥১০ ॥

মাংসভোজনের কথাও বামমার্গী টীকাকারদের লীলা। এই নিমিত্ত তাহাদিগকে ‘রাক্ষস’ বলা উচিত। বেদের কোনও স্থলেও মাংস ভক্ষণের উল্লেখ নাই। সুতরাং যে সকল টীকাকার বেদ না জানিয়া, না শুনিয়া মনগড়া বেদের নিন্দা করিয়াছেন,ঐ সকল মিথ্যা বলিবার দায়ে তাহাদের নিশ্চয়ই পাপের ভাগী হইতে হইবে। ইহা সত্য যে, অন্ধকারে যাঁহারা বেদবিরোধী হইয়াছিলেন, হইয়াছেন এবং হইবেন, তাঁহারা অবশ্যই অবিদ্যারূপী অন্ধকারে ডুবিয়া সুখের পরিবর্তে যতই দারুণ দুঃখ ভোগ করুন না কেন, তাহা তাহাদের পক্ষে ততই অল্প হইবে। অতএব মনুষ্য মাত্রেই বেদানুকূল আচরণ করা কর্তব্য ॥১১ ॥

বামমার্গীগণ মিথ্যা কপোল কল্পনা করিয়া বেদের নামে নিজেদের প্রয়োজন সিদ্ধ করিয়াছে। অর্থাৎ যথেচ্ছ মদ্যপান, মাংসভোজন, পরস্ত্রীগমনাদি দুষ্ট কর্মের প্রবর্তনকল্পে বেদের উপর কলঙ্ক আরোপ করিয়াছে। ইহাদের দেখাদেখি চারবাক, বৌদ্ধ ও জৈনগণও বেদের নিন্দা করিতে আরম্ভ করে। নিজেরা পৃথক এক বেদ বিরুদ্ধ, অনীশ্বরবাদী অর্থাৎ নাস্তিক মত প্রচলন করে। চারবাকাদি যদি বেদের মূল অর্থ বিচার করিতেন, তাহা হইলে মিথ্যা টীকা সমুহ দেখিয়া তাহারা সত্য বেদোক্ত মত পরিত্যাগ করিতেন কি? তাহাদের করারই বা কী আছে? ‘বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধিঃ। যখন নষ্ট ভ্রষ্ট হইবার সময় আসে তখনই মানুষের বুদ্ধি বিপরীত হয় ॥

এখন চারবাক প্রভৃতির মধ্যে যে ভেদ আছে, তাহা লিখিত হইয়াছে। চারবাকদের সহিত ইহারা অনেক বিষয়ে একমত। চারবাক, দেহের উৎপত্তির সহিত জীবের উৎপত্তি এবং দেহ নাশের সহিত জীবের নাশ স্বীকার করেন, কিন্তু পুনর্জন্ম এবং পরলোক মানেন না। তাহারা এক প্রত্যক্ষ ব্যতীত অনুমানাদি প্রমাণ স্বীকার করেন না। চারবাক শব্দের অর্থ– যে ব্যক্তি প্রমাণ বাক্য প্রয়োগে প্রগম্ভএবং বিশেষার্থে ‘বৈতণ্ডিক’। বৌদ্ধ এবং জৈনগণ প্রত্যক্ষাদি চারি প্রমাণ, অনাদি জীব, পুনর্জন্ম, পরলোক এবং মুক্তিও স্বীকার করেন। চারবাকের সহিত বৌদ্ধ এবং জৈনদের এইটুকুই মতভেদ আছে। নাস্তিকতা, বেদ ও ঈশ্বর নিন্দা, পরমতদ্বেষ, অতঃপর আলোচ্য ছয় যত্ন (ছয় কর্ম) এবং জগতের অ-কর্তৃত্ব ইত্যাদি বিষয়ে সকলেই একমত। এই পৰ্য্যন্ত চারবাক মত সংক্ষেপে প্রদর্শিত হইল।

(এবার) বৌদ্ধমত সম্বন্ধে সংক্ষেপে লিখিত হইতেছে–

“কাৰ্য্যকারণভাবাঘা স্বভাবাদ্বা নিয়ামকাৎ। অবিনাভাব নিয়মমা দর্শনান্তরদর্শনাৎ”। বৌদ্ধদর্শন ॥

কার্য-কারণভাব’ অর্থাৎ কাৰ্য্যদর্শনে কারণের এবং কারণ দর্শনে কাৰ্যাদির সাক্ষাৎকার হয় অর্থাৎ প্রত্যক্ষ দ্বারা শেষে অনুমান হইয়া থাকে। এতদ্ব্যতীত প্রাণীদের সম্পূর্ণ ব্যবহার পূর্ণ হইতে পারে না। এই সব লক্ষণ দ্বারা অনুমানকে অধিক স্বীকার করিয়া চারবাক হইতে বৌদ্ধ একটি পৃথক শাখা হইয়াছে।

বৌদ্ধ চার প্রকারের। প্রথম–মাধ্যমিক’, দ্বিতীয়–যোগাচার’, তৃতীয় –‘সৌভ্রান্তিক এবং চতুর্থ –‘বৈভাষিক’। বুদ্ধ্যা নির্বৰ্ততে সঃ বৌদ্ধঃ। বুদ্ধি দ্বারা যাহা সিদ্ধ হয় অর্থাৎ যে যে বিষয় নিজের বুদ্ধিতে বুঝা যায়, তাহা মান্য করা এবং যাহা যাহা (নিজের) বুদ্ধিতে বুঝা যায় না, তাহা তাহা মান্য না করা।

ইহাদের মধ্যে প্রথম ‘মাধ্যমিক’ ‘সর্বশূন্য’ মানে। অর্থাৎ যত পদার্থ আছে সে সমস্ত ‘শূন্য’ অর্থাৎ আদিতে হয় না এবং অন্তে থাকে না, মধ্যে যাহা প্রতীত হয় উহাও প্রতীতিকালে আছে, পরে শূন্য হইয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ, উৎপত্তির পূর্বে ঘট ছিল না, প্ৰধ্বংসের পর থাকে না এবং ঘটজ্ঞান কালে প্রতীত হইয়া পদার্থান্তরে যাইতে যাইতে ঘটজ্ঞান থাকে না, এই কারণেই শূন্যই একমাত্র তত্ত্ব।

দ্বিতীয় ‘যোগাচার’ বাহ্যশূন্য মানে। অর্থাৎ পদার্থ অভ্যন্তরস্থ জ্ঞানে আভাস হয়, বাহিরে হয় না। যেমন আত্মায় ঘটজ্ঞান আছে বলিয়াই মনুষ্য বলে যে “ইহা ঘট”। ভিতরের জ্ঞান না থাকিলে বলিতে পারিতেন না। ইহারা এইরূপ মানে।

তৃতীয় ‘সৌত্রান্তিক’ তাহাদের মত বাহিরে পদার্থের অনুমান হয়, কেননা বাহিরের সাঙ্গোপাঙ্গ কোন পদার্থ প্রত্যক্ষ হয় না; কিন্ত একদেশ প্রত্যক্ষ হওয়াতে অনুমান করা হয়। ইহাদের মত এইরূপ।

চতুর্থ ‘বৈভাষিক’ তাহাদের মত, পদার্থ বাহিরে প্রত্যক্ষ হয়, ভিতরে হয় না। উদাহরণস্বরূপ, অয়ং নীলো ঘটঃ এই প্রতীতির মধ্যে নীলবর্ণ ঘটাকৃতি বাহিরে প্রতীত হয়। ইহারা এইরূপ মানে।

যদিও ইহাদের আচার্য্য বুদ্ধ এক, তথাপি শিষ্যদের বুদ্ধিভেদ বশতঃ চার প্রকার শাখা হইয়াছে। যেরূপ সূর্যাস্তের পর জার-পুরুষ পরস্ত্রীগমন ও চোর চৌৰ্য্য কর্মে, তথা বিদ্বান ব্যক্তি সত্য ভাষণাদি শ্রেষ্ঠ কর্ম করেন। সময় একই কিন্তু স্ব স্ব বুদ্ধি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন চেষ্টা করিয়া থাকে।

এবার পূর্বোক্ত চারিটির মধ্যে (প্রথম) মাধ্যমিক’ –সকলকে ক্ষণিক মানে। অর্থাৎ ক্ষণে ক্ষণে বুদ্ধির পরিণাম হওয়ায় পূর্বক্ষণে জাত বস্তু ছিল, পরক্ষণে দ্বিতীয় ক্ষণে সেইরূপ থাকে না। এই কারণে সমস্ত ক্ষণিক এইরূপ মানা উচিত। তাহারা এইরূপ মানে।

দ্বিতীয় ‘যোগাচার’ –সমস্ত প্রবৃত্তি দুঃখস্বরূপ; কারণ কোন বস্তুর প্রাপ্তিতে কেহই সন্তুষ্ট থাকে না। একটির প্রাপ্তিতে অন্যটির প্রাপ্তির ইচ্ছা বর্তমানই থাকে। ইহারা এইরূপ মানে।

তৃতীয় ‘সৌভ্রান্তিক’ –সমস্ত পদার্থ স্ব স্ব লক্ষণ দ্বারা লক্ষিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ, গোচিহ্ন দ্বারা গো এবং অচিহ্ন দ্বারা অশ্ব জানা যায়। সেইরূপ লক্ষণ সর্বদা লক্ষ্যে থাকে। তাহারা এইরূপ বলে।

চতুর্থ ‘বৈভাষিক’ –শূন্যকেই একমাত্র পদার্থ মানে।

প্রথম মাধ্যমিক সর্বশূন্য স্বীকার করিত। বৈভাষিকদের ঐরূপ পক্ষ আছে। বৌদ্ধদের মধ্যে এইরূপ বহু বিবাদ পক্ষ আছে। এইরূপে তাহারা চারি প্রকাবের ভাবনা স্বীকার করে।

উত্তর –যদি সমস্তই শূন্য হয়, তাহা হইলে শূন্যের জ্ঞাতা শূন্য হইতে পারে না এবং সমস্ত শূন্য হলে শূন্যকে শূন্য জানিতে পারে না। সুতরাং শূন্যের জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় দুই পদার্থ সিদ্ধ হয়।

যদি যোগাচার’ বাহ্যশূন্যতা স্বীকার করে, তাহা হইলে পর্বত ইহার ভিতরে থাকা উচিত। যদি বল যে, পর্বত ভিতরে আছে তবে তাহার হৃদয় পর্বতসদৃশ অবকাশ কোথায়? অতএব পর্বত বাহিরে আছে। কিন্তু পর্বতের জ্ঞান আত্মায় থাকে।

‘সৌত্রান্ত্রিক’ কোন পদার্থকে প্রত্যক্ষ বলিয়া স্বীকার করে না। এমতাবস্থায় সে স্বয়ং এবং তাহার বাক্যও অনুমেয় হওয়া উচিত, প্রত্যক্ষ হওয়া উচিত নহে। যদি কোন পদার্থই প্রত্যক্ষ না হয়, তবে “অয়ং ঘটঃ” এইরূপে প্রয়োগও হওয়া উচিত নহে; কিন্তু “অয়ং ঘটেকদেশঃ” ইহা ঘটের একদেশ। (এইরূপ প্রয়োগ হওয়া উচিত)।

ঘটের এক দেশের (অংশের নাম ঘট নহে, কিন্তু সমুদায়ের নাম ঘট। “ইহা ঘট” এই বলিলে ‘ঘট’ প্রত্যক্ষ হয়, অনুমেয় হয় না। কারণ সমস্ত অবয়বের মধ্যে অবয়বী এক। অবয়বী প্রত্যক্ষ হইলে, ঘটের সমস্ত অবয়বও প্রত্যক্ষ হয়, অর্থাৎ সাবয়ব (ঘট) প্রত্যক্ষ হয়।

চতুর্থ ‘বৈভাষিক’ বাহ্য পদার্থকে প্রত্যক্ষ স্বীকার করে, তাহা যুক্তি সঙ্গত নহে। কারণ যে স্থলে জ্ঞাতা এবং জ্ঞান থাকে, সেই স্থলেই প্রত্যক্ষ হয়। প্রত্যক্ষের বিষয় বাহির থাকে, (তথাপি) তদাকার জ্ঞান আত্মায় হয়।

যদি ক্ষণিক পদার্থ এবং ঐ পদার্থের জ্ঞানও ক্ষণিক হয়, তাহা হইলে, “প্রত্যভিজ্ঞা” অর্থাৎ “আমি এ কথা বলিয়াছিলাম” এইরূপ স্মরণ হওয়া উচিত নহে। কিন্তু পূর্বদৃষ্ট এবং পূর্বশ্রুত বিষয়েরই হইয়া থাকে। এই নিমিত্ত ক্ষণিক বাদও যুক্তি সঙ্গত নহে ॥

যদি সমস্ত দুঃখই দুঃখ হয় এবং সুখ কিছুই না থাকে, তাহা হইলে রাত্রির অপেক্ষায় দিন এবং দিনের অপেক্ষায় রাত্রির ন্যায়, সুখের অপেক্ষা ব্যতীত দুঃখ সিদ্ধ হইতে পারে না। অতএব সমস্তই দুঃখ এই মত যুক্তিসঙ্গত নহে।

যদি স্বলক্ষণই মানা যায়, তাহা হইলে নেত্র রূপের লক্ষণ হইবে আর রূপ লক্ষ্য হইবে। যথা ঘটের রূপ। ঘটের লক্ষণ চক্ষু লক্ষ্য হইতে ভিন্ন, কিন্তু গন্ধ পৃথিবী হইতে অভিন্ন। এইরূপ ভিন্নভিন্ন লক্ষ্য লক্ষণ স্বীকার করিতে হইবে। শূন্যের যে উত্তর পূর্বে দেওয়া হইয়াছে, এস্থলে তাহাই গ্রহণীয় অর্থাৎ শূন্যের জ্ঞাতা শূন্য হইতে ভিন্ন।

সর্বস্য সংসারস্য দুঃখাত্মকত্বং সর্বতীর্থঙ্করসংমত ॥ বৌদ্ধদর্শন ॥

যাহাদেরকে বৌদ্ধরা তীর্থঙ্কর বলিয়া মানে তাহাদেরকে জৈনরাও মানিয়া থাকে, এইজন্য। এরা উভয়ে এক।

বৌদ্ধ তীর্থঙ্করগণ পূর্বোক্ত ভাবনা চতুষ্টয় অর্থাৎ চারি প্রকার ভাবনা দ্বারা বাসনা-সমূহের নিবৃত্তি বশতঃ শূন্যরূপ নির্বাণ অর্থাৎ মুক্তি স্বীকার করে।

তাহারা তাহাদের শিষ্যদিগকে যোগাচার সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করে। তাহাদের মতে গুরুবাক্যই প্রমাণ। অনাদি বুদ্ধিতে বাসনা উৎপন্ন হয় বলিয়া বুদ্ধি অনেকাকার হইয়া প্রতীত হয় উহাদের চিত্তচৈত্তাত্মক স্কন্ধ পাঁচপ্রকারের।

রূপবিজ্ঞানবেদনাসংজ্ঞাসংস্কারসংজ্ঞকঃ ॥ বৌদ্ধদর্শন ॥

প্রথম— ইন্দ্রিয় সমূহের দ্বারা যে রূপাদি বিষয় গৃহীত হয় উহা ‘রূপস্কন্ধ’ ‘দ্বিতীয় আলয়বিজ্ঞান প্রবৃত্তি (বিজ্ঞান) অর্থাৎ যাহাতে রূপাদি বিষয় থাকে, উহার বিজ্ঞান প্রবৃত্তির জ্ঞানরূপ ব্যবহারকে ‘বিজ্ঞানস্কন্ধ’, তৃতীয় –রূপস্কন্ধ এবং বিজ্ঞানস্কন্ধ হইতে উৎপন্ন সুখদুঃখ প্রবৃত্তির প্রতীতরূপ ব্যবহারকে ‘বেদনাস্কন্ধ’, চতুর্থ –গবাদি সংজ্ঞার সম্বন্ধ নামীর সহিত স্বীকার করা ‘সংজ্ঞাস্কন্ধ। পঞ্চম –বেদনাস্কন্ধ হইতে উৎপন্ন রাগদ্বেষাদি ক্লেশ এবং ক্ষুধাতৃষ্ণাদি উপক্লেশ, মদ, প্রমাদ, ধর্ম ও অধর্মরূপ ব্যবহারকে ‘সংস্কারস্কন্ধ’ মানে।

সমস্ত সংসার দুঃখরূপ– দুঃখের ঘর– দুঃখের সাধনরূপ ভাবনা করিয়া সংসার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করা চারবাকদের মধ্যে অধিক মুক্তি এবং অনুমান তথা জীবের অস্তিত্ব স্বীকার না করা বৌদ্ধ মত।

দেশনা লোকনাথানাংসত্ত্বাশয়বশানুগাঃ। ভিদ্যন্তে বহুধা লোকেউপায়েবহুভিঃ কিল ॥ ১ ॥ গম্ভীরোত্তানভেদেন চিস্টোভয়লক্ষণ। ভিন্নাহি দেশনা ভিন্না শূন্যতাদ্বয়লক্ষণা ॥২॥ দ্বাদশায়তন পূজা শ্রেয়স্করীতি বৌদ্ধা মন্যন্তে’– অর্থানুপার্জ বহুশো দ্বাদশায়তনানি বৈ। পরিতঃ পূজনীয়ানি কিমন্যৈরিহপূজিতৈঃ ॥৩ ॥ জ্ঞানেন্দ্রিয়াণি পঞ্চৈব তথা কর্মেন্দ্রিয়াণি চ। মনো বুদ্ধিরিতি বোক্তং দ্বাদশায়তনং বুধৈঃ ॥ ৪ ॥ বৌদ্ধদর্শন। অর্থাৎ যে জ্ঞানী, বিরক্ত, জীবন্মুক্ত, লোকনাথ বুদ্ধ প্রভৃতি তীর্থঙ্করদের স্বরূপজ্ঞাতা, যে। বিভিন্ন পদার্থের উপদেষ্টা এবং বহুরূপে ও বহু উপায়ে যাহা বর্ণিত হইয়াছে উহাকেমান্য করিবে ৷১ ॥

ভিন্ন ভিন্ন গুরু প্রদত্ত পূর্বোক্ত শূন্যতা লক্ষণযুক্ত উপদেশ সমূহ মান্য করিবে। ঐ সকল অত্যন্ত গম্ভীর এবং প্রসিদ্ধ ভেদে কোনো স্থলে গুপ্ত ও কোনো স্থলে প্রকট ॥২ ॥

দ্বাদশায়তন পূজাই মোক্ষদায়িনী। তজ্জন্য বহু ধনসামগ্রী সংগ্রহ করিবে এবং দ্বাদশায়তন অর্থাৎ দ্বাদশ প্রকারের স্থান-বিশেষ নির্মাণ করিয়া সর্বতোভাবে পূজা করিবে। অপর কাহারও পূজা করিবার প্রয়োজন কী? ॥ ৩ ॥

ইহাদের দ্বাদশায়তন পূজা এই — পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় অর্থাৎ শো, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা এবং নাসিকা; পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় অর্থাৎ বাক, হস্ত, পাদ, গুহ্য এবং উপস্থ এই দশ ইন্দ্রিয় এবং মনও বুদ্ধি। ইহাদের সংস্কার অর্থাৎ আনন্দে প্রবৃত্ত রাখা ইত্যাদি বৌদ্ধদের মত ॥৪ ॥

উত্তর –সমস্ত সংসার দুঃখরূপ হইলে তাহাতে কোন জীবের প্রবৃত্তি থাকা উচিত নহে। সংসারে জীবের প্রবৃত্তি প্রত্যক্ষ দৃষ্ট হয়। এই কারণে সমস্ত সংসার দুঃখস্বরূপ হইতে পারে না, কিন্তু ইহাতে সুখ ও দুঃখ দুইই আছে। বৌদ্ধগণ যদি এই সিদ্ধান্ত স্বীকার করে, তাহা হইলে পান ভোজন এবং ঔষধ পথ্য প্রভৃতি সেবন করিয়া শরীর রক্ষায় যত্নবান হইয়া সুখ চায় কেন? যদি। বলে যে, তাহারা প্রবৃত্ত তো হয় সত্য কিন্তু ইহাকে দুঃখই মানে। ইহা বলাও অসম্ভব। কারণ জীব

সুখ জানিয়া প্রবৃত্ত এবং দুঃখ জানিয়া নিবৃত্ত হয়। সংসারে ধর্মক্রিয়া, বিদ্যা, সৎসঙ্গ আদি যাবতীয় শ্রেষ্ঠ ব্যবহার সুখ কারক। বৌদ্ধ ব্যতীত কোন বিদ্বান্ ব্যক্তি এ সকল লিঙ্গ দুঃখের (কারণ) বলিয়া মনে করিতে পারে না।

যে পঞ্চ স্কন্ধ বর্ণিত হইয়াছে সেগুলিও একেবারে অপূর্ণ। কেননা, এ সকল পরীক্ষা করিলে এক একটি স্কন্ধের মধ্যে অনেক ভেদ হইতে পারে।

পরমাত্মার পরিবর্তে যে সকল তীর্থঙ্করকে উপদেষ্টা এবং লোকনাথ বলিয়া (বৌদ্ধরা) মান্য করে আর অনাদিনাথেরও নাথ তিনি পরমাত্মা তাহাকে যদি না মানে তাহা হইলে সেই তীর্থঙ্করগণ কোথায় এবং কাহার নিকট হইতে উপদেশ পাইলেন? যদি বলে, তাহারা নিজে নিজেই জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন তবে তাহা অসম্ভব। যেহেতু কারণ ব্যতীত কাৰ্য্য হইতে পারে না। অথবা যদি মনে করা যায় যে, তাহাদের মতানুসারে তাহা হইতে পারে, তবে এখনও তাহাদের মধ্যে অধ্যয়ন, অধ্যাপন, শ্রবণ এবং জ্ঞানীদের সংসর্গ ব্যতীত কেহই জ্ঞানবান হয় না কেন? যেহেতু হয় না, অতএব এইরূপ বলা ভিত্তিহীন, যুক্তিশূন্য এবং সন্নিপাত রোগীর প্রলাপ সদৃশ।

যদি বৌদ্ধমতে সমস্তই শূন্যরূপ অদ্বৈত হয়, তবে তাহা যুক্তিবিরুদ্ধ, কারণ বিদ্যমান বস্তু কখনও শূন্যরূপ হইতে পারে না। অবশ্য সূক্ষ্ম কারণ রূপে পরিণত হয়। অতএব তাহাদের উক্তি ভ্রান্তিপূর্ণ।

যদি উপার্জিত অর্থব্যয় দ্বারা দ্বাদশায়তন পূজাকে মোক্ষসাধন বলিয়া মনে করেন, তাহা হইলে দশ প্রাণ এবং একাদশ জীবাত্মার পূজা করেন না কেন? যদি ইন্দ্রিয় এবং অন্তঃকরণের পূজাও মোক্ষসাধক হয়, তাহা হইলে বৌদ্ধ ও বিষয়াসক্তদের মধ্যে কী প্রভেদ রহিল? যদি বৌদ্ধগণ বিষয়াসক্তি হইতে নিস্তার না পাইলেন, তবে তাহাদের মুক্তিই বা কোথায় রহিল? আর এ ক্ষেত্রে মুক্তির প্রয়োজনই বা কী? আহা, অবিদ্যা বিষয়ে বৌদ্ধগণ কী প্রকার উন্নতিই না করিয়াছেন। এ বিষয়ে তাঁহারা ছাড়া, অপরের সহিত তুলনা দেওয়া যাইতে পারে এরূপ কেহই নাই ॥

বাস্তবিক বেদ ও ঈশ্বরের সহিত বিরোধ করিয়া তাহারা এই ফল লাভ করিয়াছেন যে, প্রথমতঃ সমস্ত সংসারকে দুঃখস্বরূপ ভাবনা করিয়া পরে মধ্যস্থলে পৌঁছিয়া দ্বাদশায়তন পূজা আরম্ভ করিয়া দিয়াছেন। এই দ্বাদশায়তন পূজা কি পার্থিব বস্তুর পূজা ব্যতীত অন্য কিছু? যদি তদ্বারা মুক্তিলাভ হইতে পারে, তবে কি কেহ চক্ষু বন্ধ করিয়া অন্বেষণ করিলেও রত্নলাভ করিতে পারিবে? বেদ এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকায় ইহাদের এমনই লীলা-খেলা হইয়াছে। যদি এখনও সুখের আকাঙ্ক্ষা থাকে, তাহা হইলে তাহারা বেদ এবং ঈশ্বরের শরণাপন্ন হইয়া জীবন সফল করুন।

‘বিবেকবিলাস’ নামক গ্রন্থে বৌদ্ধমত এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে। বৌদ্ধনাং সুগতো দেবো বিশ্বং চ ক্ষণভঙ্গুরম্। আর্য্যাসত্ত্বাখ্যয়া তত্ত্বচতুষ্টয়মিদং ক্ৰমাৎ ॥১॥ দুঃখমায়তনং চৈব ততঃ সমুদয়ো মতঃ। মার্গশ্চেত্যস্য চ ব্যাখ্যা ক্রমেণ ক্রয়তামতঃ ॥২॥ দুঃখংসংসারিণঃ স্কন্ধাস্তে চ পঞ্চ প্রকীৰ্ত্তিতঃ। বিজ্ঞানং বেদনা সংজ্ঞা সংস্কারো রূপমেব চ ॥৩॥ পঞ্চেন্দ্রিয়াণি শব্দাদ্যাবিষয়াঃ পঞ্চ মানসম্। ধর্মায়তনমেতানি দ্বাদশায়াতনানি তু ॥ ৪ ॥

রাগাদীনাং গণোয়স্মাৎ সমুদেতি নৃণাং হৃদি। আত্মাত্মীয়স্বভাবাখ্যঃ স স্যাৎসমুদয়ঃ পুনঃ ॥৫॥ ক্ষণিকাঃ সর্বসংস্কারা ইতিয়া বাসনা স্থিরা। সমার্গইতি বিজ্ঞেয়ঃ স চ মোক্ষোভিধীয়তে ॥ ৬ ॥ প্রত্যক্ষমনুমানং চ প্রমাণদ্বিতয়ং তথা। চতুঃপ্রস্থানিকা বৌদ্ধাঃ খ্যাতা বৈভাষিকাদয়ঃ ॥ ৭ ॥ অর্থো জ্ঞানান্বিতো বৈযিকেণ বহুমন্যতে। সৌত্রান্তিকেন প্রত্যক্ষগ্রাহ্যোর্থান বহির্মতঃ ॥৮ ॥ আকারসহিতা বুদ্ধিয়োগাচারস্য সংমতা। কেবলাং সংবিদং স্বস্থাংমন্যন্তে মধ্যমাঃ পুনঃ ॥৯॥ রাগাদিজ্ঞানসন্তানবাসনাচ্ছেদসম্ভবা। চতুর্ণামপি বৌদ্ধানাংমুক্তিরেষা প্রকীর্তিতা ॥১০ ॥ কৃত্তিঃ কমণ্ডলুমোন্ড্যংচীরং পূর্বাহ্নভোজন। সংঘো রক্তাম্বরত্বং চশিশিয়ে বৌদ্ধভিক্ষুভিঃ ॥১১ ॥

সুগতদেব ভগবান বুদ্ধ বৌদ্ধদের পূজনীয় দেব, জগৎ ক্ষণভঙ্গুর, আৰ্য পুরুষ ও আৰ্য্যাস্ত্রী এবং তত্ত্বসমূহের দ্বারা আখ্যা-সংজ্ঞাদি প্রসিদ্ধি, এই চারিটি বৌদ্ধদের মন্তব্য পদার্থ ॥১ ॥

এই বিশ্বকে দুঃখের (এবং শরীরকে দুঃখের) আলয় স্বরূপ জানিতে পারিলে, তদনন্তর ‘সমুদয়’ অর্থাৎ (রাগাদির) উৎপত্তি হয়। আর (মার্গ) এ সকলের ব্যাখ্যা ক্রমশঃ শ্রবণ কর ॥২॥

সংসারে কেবল দুঃখই আছে। পূর্বোক্ত পঞ্চস্কন্ধ সম্বন্ধে যাহা বর্ণিত হইয়াছে উহাকে জানিবে ৷৩ ॥

পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, উহাদের শব্দাদি পঞ্চ বিষয় এবং মন, বুদ্ধি = অন্তঃকরণ, ধর্মের এই দ্বাদশ আয়তন ॥ 8 ॥

মনুষ্যের হৃদয়ে যে রাগদ্বেষাদি সমূহের উৎপত্তি হয় ঐ সকলকে ‘সমুদয়’ এবং আত্মা ও আত্মার স্বভাব এবং গুণকে ‘অ্যাখ্যা’ বলে। এ সকল হইতে পুনরায় সমুদয় হইয়া থাকে।

সমস্ত সংসার ক্ষণিক। বাসনার স্থিরতাই বৌদ্ধদের ‘মার্গ। আর উক্তশূন্যতত্ত্ব=শূন্যরূপ হওয়ার নাম ‘মোক্ষ’ ॥ ৬ ॥

বৌদ্ধগণ প্রত্যক্ষ ও অনুমান এই দুইটি স্বীকার করেন। ইহাদের মধ্যে চারি প্রকার ভেদ আছে। যথা –‘বৈভাষিক’, ‘সৌত্রান্তিক’, ‘যোগাচার, এবং মাধ্যমিক’ ॥৭ ॥

তন্মধ্যে বৈভাষিক, –জ্ঞানে যে অর্থ আছে উহাকে বিদ্যমান বলিয়া মানে। কেননা, যাহা জ্ঞানে নাই, সিদ্ধপুরুষগণ তাহার অস্তিত্ব স্বীকার করিতে পারেন না। সৌত্রান্তিক –ভিতরকে। প্রত্যক্ষ পদার্থ স্বীকার করেন বাহিরকে নহে ॥ ৮ ॥

‘যোগাচার’ –আকার সহিত বিজ্ঞানযুক্ত বুদ্ধিকে স্বীকার করেন আর মাধ্যমিক’ –কেবল নিজের মধ্যে পদার্থ সমূহের জ্ঞান মাত্র মানেন, পদার্থ স্বীকার করেন না ॥৯ ॥

চারি প্রকার বৌদ্ধদের মতে বলা হইয়াছে যে, রাগাদি জ্ঞানপ্রবাহের বাসনার নাশ হইতে মুক্তিলাভ হয় ॥১০ ॥

মৃগাদির চর্ম, কমণ্ডলু, মুণ্ডিত-মস্তক, বল্কল-বস্ত্র, পূৰ্ব্বাহ্নে অর্থাৎ নয় ঘটিকার পূর্বে ভোজন, একাকী না থাকা এবং রক্তবস্ত্র ধারণ — ইহাই বৌদ্ধ সাধুগণের বেশ ॥১১ ॥

উত্তর –যদি সুগত বুদ্ধই বৌদ্ধদের দেব হন, তাহা হইলে তাহার গুরু কে ছিলেন? আর যদি বিশ্ব ক্ষণভঙ্গুর হয় তাহা হইলে দীর্ঘকাল পূর্বে দৃষ্ট পদার্থের ইহা উহাই, এইরূপ স্মরণ হইতে পারে না। যাহা ক্ষণ ভঙ্গুর তাহা পদার্থ রূপেই থাকে না; সুতরাং কাহার স্মরণ হইবে? যদি ক্ষণিকবাদই বৌদ্ধদের মার্গ হয় তাহা হইলে তাহাদের মোক্ষও ক্ষণভঙ্গুর হইবে ॥

যদি জ্ঞানবিশিষ্ট অর্থই দ্রব্য হয়, তবে জড় দ্রব্যেও জ্ঞান থাকা উচিত এইজন্য জ্ঞানে অর্থের প্রতিবিম্বসদৃশ থাকে। আর যাহা ভিতর জ্ঞানে দ্রব্য হয় তাহা বাহিরে হওয়া উচিত নয়। এবং সে সঞ্চালনা প্রভৃতি ক্রিয়া কাহার উপর করে? ভালো রে ভালো,যাহা বাহিরে দৃষ্ট হয় তাহা মিথ্যা কীরূপে হইতে পারে? বুদ্ধি আকারবিশিষ্ট দৃশ্যমান হওয়া উচিত।

যদি কেবলমাত্র জ্ঞানই হৃদয়ে আত্মস্থ হয় এবং বাহ্য পদার্থকে কেবল জ্ঞানরূপেই স্বীকার করা হয়, তাহা হইলে জ্ঞেয় পদার্থ ব্যতীত জ্ঞানই হইতে পারিবে না। যদি বাসনাচ্ছেদই মুক্তি হয় তবে সুষুপ্তি অবস্থাতেও মুক্তি হয় বলিয়া মনে করা উচিত। এইরূপ স্বীকার করা বিদ্যাবিরুদ্ধ, সুতরাং তিরস্করণীয়। বৌদ্ধদেবের মতবাদ সংক্ষেপে প্রদর্শিত হইল। ইহা পাঠ করিলে বুদ্ধিমান এবং বিচারশীল পুরুষেরা জানিতে পারিবেন যে, তাঁহাদের বিদ্যাবুদ্ধি এবং মতবাদ কীরূপ? ইহাকে জৈনরাও স্বীকার করিয়া থাকে।

এখান হইতে পরে জৈন মতের বর্ণনা আছে। প্রকরণরত্নাকর প্রথম ভাগ, নয়নচক্রসারে নিম্নলিখিত বিষয় লিখিত আছে।

বৌদ্ধগণ এক এক সময়ে নব নব ভাবে (১) আকাশ, (২) কাল, (৩) জীব এবং (৪) পুদ্গল– এই চার দ্রব্য স্বীকার করে। আর জৈনগণ ধর্মাস্তিকায়, অধর্মাস্তিকায়, আকাশাস্তিকায়, পুলস্তিকায়, জীবাস্তিকায় এবং কাল –এই ছয় দ্রব্য স্বীকার করে। তন্মধ্যে কালকে অস্তিকায় স্বীকার করে না, কিন্তু তাহাদের মতে কাল উপচার দ্রব্য কিন্তু যথার্থতঃ তাহা নহে।

উহাদের মধ্যে (প্রথম) ‘ধর্মাস্তিকায়’–ইহা গতি পরিণামীত্বরূপে পরিণাম প্রাপ্ত জীব এবং পুগল, গতি ধারণের স্বরূপ, উহা ‘ধর্মাস্তিকায়। উহা অসংখ্য স্থানে এবং অসংখ্য লোকে অসংখ্যপরিমাণে ব্যাপক হইয়া রহিয়াছে।

দ্বিতীয় ‘অধর্মাস্তিকায়’–ইহা স্থিরতা বশতঃ পরিণামী জীব এবং পুদ্গল স্থিতির আশ্রয়ের

তৃতীয় ‘আকাশাস্তিকায়’–ইহা সকল দ্রব্যের আধার এবং অবগাহন, প্রবেশ ও বহির্গমন প্রভৃতির কর্তা ও পুদ্গলের অবগাহনের হেতু এবং সর্বব্যাপী।

চতুর্থ ‘পুদগলাস্তিকায়’–ইহা কারণ রূপে সূক্ষ্ম, নিত্য, এক রস-বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শ কাৰ্য্যের লিঙ্গ, পূরণ ও দ্রবণ স্বভাববিশিষ্ট।

পঞ্চম ‘জীবাস্তিকায়’ –ইহা চেতনালক্ষণ জ্ঞান এবং দর্শনের উপযুক্ত অনন্ত পৰ্য্যায় রূপে পরিণামী, কৰ্ত্তা এবং ভোক্তা।

ষষ্ঠ ‘কাল’ –যাহা পূর্বোক্ত পাঁচ অস্তিকায়ের পরত্ব, অপরত্ব, নবীনত্ব ও প্রাচীনত্বের চিহ্ন স্বরূপ প্রসিদ্ধ এবং বর্তমান রূপ পৰ্য্যায় যুক্ত, উহাকে ‘কাল’ বলে।

সমীক্ষক — বৌদ্ধগণ যে চারিটি দ্রব্যকে প্রত্যেক সময়ে নূতন নূতন হয় বলিয়া মনে করেন, উহা মিথ্যা। কেননা আকাশ, কাল, জীব এবং পরমাণু ইহারা কখনও নূতন বা পুরাতন হয় না; কারণ ইহারা অনাদি এবং কারণ রূপে অবিনাশী। অতএব এ সকলের মধ্যে নূতনত্ব কিংবা পুরাতনত্ব কীরূপে সম্ভব হইতে পারে?

এ সকল বিষয়ে জৈনদের মতও সঙ্গত নহে। কারণ ধর্ম এবং অধর্ম ইহারা দ্রব্য নহে, কিন্তু গুণ। এই দুইটি জীবাস্তিকায়ের অন্তর্গত। অতএব আকাশ, পরমাণু, জীব এবং কাল মানাই সঙ্গত।

বস্তুতঃ বৈশেষিকে যে নয় দ্রব্য স্বীকৃত হইয়াছে, তাহাই সঙ্গত। কারণ পৃথিব্যাদি পাঁচ তত্ত্ব, কাল,দিক,আত্মা এবং মন এই নয়টি পৃথক পৃথক্ পদার্থ ইহা নিশ্চিত। একমাত্র জীবকেই চেতন মনে করা এবং ঈশ্বরকে না মানা, ইহা জৈন বৌদ্ধদের মিথ্যা ও পক্ষপাতের কথা।

এবার বৌদ্ধ এবং জৈনগণ যে সপ্তভঙ্গী’ এবং ‘স্যাবাদ’ মানে তাহা এইরূপ—

‘সন ঘটঃ ইহাকে প্রথম ভঙ্গ বলে। কারণ ঘট স্বীয় বিদ্যমানতায় যুক্ত। অর্থাৎ “ঘট আছে”, এই বাক্যটি অভাবের বিরোধ করিল।

দ্বিতীয় ভঙ্গ –“অসন্ ঘটঃ” অর্থাৎ ঘট নাই; প্রথম ঘটের ভাব এবং এই ঘটের অভাব বশতঃ দ্বিতীয় ভঙ্গ হইল।

তৃতীয় ভঙ্গ –“সন্নসন্ ঘটঃ” অর্থাৎ এই ঘট ত আছে, কিন্তু ইহা পট নহে। কেননা এই ভঙ্গ প্রথম ও দ্বিতীয় ভঙ্গ হইতে পৃথক্‌ হইল।

চতুর্থ ভঙ্গ –“ঘটোৎঘটঃ” যথা –“অঘটঃ পটঃ” নিজের মধ্যে অন্য পটের অভাবের। অপেক্ষা হওয়ায় ঘটকে অঘট বলা হয়। ঘটের যুগপৎ দুই সংজ্ঞা অর্থাৎ ঘট এবং অঘট।

পঞ্চম ভঙ্গ এই যে –ঘটকে পট বলা অসঙ্গত; অর্থাৎ ঘটের মধ্যে ঘটস্থ বক্তব্য এবং পটত্ব অবক্তব্য আছে।

ষষ্ঠ ভঙ্গ এই যে –যাহা ঘট নহে তাহাকে ঘট বলা যায় না; যাহা ঘট, তাহাই ঘট, তাহাকেই ঘট বলা সঙ্গত।

সপ্তম ভঙ্গ এই যে –যাহার সম্বন্ধে বলা অভিপ্রেত, তাহা নাই, আর তাহা ঘট বলিবার যোগ্যও নহে। ইহা সপ্তম ভঙ্গ নামে প্রসিদ্ধ। সেইরূপঃ

স্যাদস্তি জীবোয়ং প্রথমো ভঙ্গঃ ॥১॥ স্যান্নাস্তি জীববা দ্বিতীয়ো ভঙ্গঃ ॥২॥ স্যাদবক্তব্যে জীবস্তৃতীয়ো ভঙ্গঃ ॥৩ ॥ স্যাদস্তি নাস্তিরূপো জীবশ্চতুর্থো ভঙ্গঃ ॥৪॥ স্যাদস্তি (চ) অবক্তব্যো জীবঃ পঞ্চমমা ভঙ্গঃ ॥৫॥ স্যান্নাস্তি (চ) অবক্তব্যো জীবঃ ষষ্ঠো ভঙ্গঃ ॥৬॥ স্যাদস্তি নাস্তি (চ) অবক্তব্যে জীব ইতি সপ্তমো ভঙ্গঃ ॥৭ ॥ আহতদর্শন ॥

অর্থাৎ ‘আছে জীব’ এইরূপ বলা হইলে জীবের মধ্যে জীবের বিরোধী জড় পদার্থ সমূহের জীবে অভাব রূপ প্রথম ভঙ্গ বলে ॥১॥

দ্বিতীয় ভঙ্গ এই যে, –জড়ের মধ্যে জীব নাই’ এইরূপও বলা হয়। তাই ইহাকে দ্বিতীয় ভঙ্গ বলে ॥২॥

‘জীব আছে কিন্তু বলিবার যোগ্য নহে, ইহা তৃতীয় ভঙ্গ ॥ ৩ ॥

জীব যখন শরীর ধারণ করে, তখন প্রসিদ্ধ এবং যখন শরীর থেকে পৃথক হয় তখন অপ্রসিদ্ধ (অপ্রকট) থাকে’ এইরূপ বলা হইলে উহাকে চতুর্থ ভঙ্গ বলে ৷4 ॥

‘জীব আছে, কিন্তু বলিবার যোগ্য নহে এইরূপ বলা হইলে, ইহাকে পঞ্চম ভঙ্গ বলে৷৫ ॥

‘প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হয় না সুতরাং জীব চক্ষুপ্রত্যক্ষ নহে এইরূপ ব্যবহারকে ষষ্ঠ ভঙ্গ বলে ॥৬ ॥

‘একই সময়ে অনুমান দ্বারা জীবের হওয়া এবং জীবের অস্তিত্ব অদৃশ্য বলিয়া তাহার অস্তিত্বহীনতা; একরূপ না থাকা, কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে পরিণাম প্রাপ্ত হওয়া, অস্তি-নাস্তি,নাস্তি-অস্তির ব্যবহার না হওয়া ইহাকে ‘সপ্তম ভঙ্গ’ বলে ॥৭ ॥

এইরূপে নিত্যত্ব সপ্তভঙ্গী, অনিত্যত্ব সপ্তভঙ্গী, সামান্য ধর্ম, বিশেষ ধর্ম গুণ এবং পর্যায়ের প্রত্যক্ষ বস্তুতে সপ্তভঙ্গী হইয়া থাকে। সেইরূপ দ্রব্য, গুণ, কর্ম, স্বভাব এবং পৰ্য্যায় অনন্ত হওয়ায় সপ্তভঙ্গী অনন্ত। ইহা বৌদ্ধ তথা জৈনদের স্যাবাদ’ এবং সপ্তভঙ্গী ন্যায়’ নামে প্রসিদ্ধ।

সমীক্ষক –এই কথা একমাত্র অন্যোন্যাভাবে সাধর্ম-বৈধর্মে চরিতার্থ হইতে পারে। এই সকল প্রকরণ পরিত্যাগ করিয়া কঠিন জাল রচনা করার উদ্দেশ্যে অজ্ঞান ব্যক্তিদিগকে জালে আবদ্ধ করা। দেখ! জীবের অভাব অজীবে এবং অজীবের অভাব জীবে থাকেই। যেমন নাকি জীব এবং জড়ের অস্তিত্ব থাকায় সাধৰ্ম, চেতনত্ব তথা জড়ত্ব বৈধর্ম; অর্থাৎ জীবের মধ্যে চেতনত্ব ‘অস্তি’= আছে আর জড়ত্ব নাস্তি’= নাই। অতএব জড়ের মধ্যে জড়ত্ব আছে কিন্তু চেতনত্ব নাই। সুতরাং গুণ-কর্ম-স্বভাবের সাধর্ম এবং বৈধৰ্ম দ্বারা বিচার করিলে ইহাদের সপ্তভঙ্গী এবং স্যাদ্বাদ সহজে বোধগম্য হয়। এজন্য এত প্রপঞ্চ বিস্তারের প্রয়োজন কী?

এ বিষয়ে বৌদ্ধ এবং জৈনদিগের মত এক স্থল বিশেষ কিছু প্রভেদ থাকায় ভিন্ন ভাবও হয়।

চিদচিদ দে পরে তত্ত্বে বিবেকস্তদ্বিবেচন। উপাদেয়মুপাদেয়ং হেয়ং হেয়ংচ কুর্বর্তঃ ॥১॥ হেয়ংহি কর্তৃরাগাদি তৎকায়মবিবেকিনঃ। উপাদেয়ং পরং জ্যোতিরুপরোগৈকলক্ষণম্ ॥৩॥ আহতদর্শন।

জৈনগণও “চিৎ” ও “অচিৎ” অর্থাৎ চেতন এবং জড় দুইটি মাত্র পরতত্ত্ব স্বীকার করে। সেই দুইটির বিবেচনার নাম ‘বিবেক। যেগুলি গ্রহণযোগ্য সেগুলি গ্রহণ এবং যেগুলি বর্জনযোগ্য সেগুলিকে যাহারা বর্জন করেন তাহাদিগকে “বিবেকী’ বলে ॥ ॥ ॥

জগতের কৰ্ত্তা, রাগাদি এবং ঈশ্বর জগৎ রচনা করিয়াছে –এই অবিবেকী মতের বর্জন এবং যোগ দ্বারা লক্ষিত পরম জ্যোতিঃরূপ জীবের গ্রহণই উত্তম।২ ॥

তাৎপৰ্য্য এই যে, বৌদ্ধ এবং জৈনগণ জীব ব্যতীত অপর কোন চেতন তত্ত্ব এবং ঈশ্বরকে স্বীকার করে না। তাহাদের মতে কোন অনাদি সিদ্ধ ঈশ্বর নাই।

এ বিষয়ে রাজা শিবপ্রসাদ “ইতিহাস তিমির নাশক” ইত্যাদি নামক গ্রন্থে লিখিয়াছেন–

বৌদ্ধ এবং জৈন দুইটি নাম মাত্র, কিন্তু মত একই। এই দুইটি শব্দ পৰ্য্যায়বাচী। কিন্তু বৌদ্ধদের মধ্যে বামমার্গী, মদ্যপায়ী ও মাংসভোজী বৌদ্ধও আছে। তাহাদের সহিত জৈনদের বিরোধ আছে। কিন্তু মহাবীর এবং গৌতম গণধরকে, বৌদ্ধগণ ‘বুদ্ধ’ এবং জৈনগণ ‘গণধর’ এবং ‘জিনধর’ বলিয়া থাকে।

বৌদ্ধ জৈনদের মধ্যে পরম্পরা ক্রমে জৈনমত চলিয়া আসিয়াছে। রাজা শিবপ্রসাদ তাহার ‘ইতিহাস তিমির নাশক’ নামক গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে লিখিয়াছেন যে, স্বামী শঙ্করাচার্য্য প্রায় এক সহস্র বৎসর পূর্বে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। তাহার পূর্বে সমগ্র ভারতবর্ষে বৌদ্ধ অথবা জৈনধর্ম। বিস্তৃত হইয়াছিল।

এ বিষয়ে তিনি এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন “যাহা বেদবিরুদ্ধ এবং মহাবীর গণধর গৌতম স্বামীর সময় হইতে স্বামী শঙ্করাচার্য্যের সময় পর্যন্ত ভারতবর্ষে বিস্তৃত হইয়াছিল এবং উহা সম্রাট অশোক’ এবং সম্প্রতি মহারাজ মানিয়াছেন। বৌদ্ধমত বলিতে আমি সেই মতই। বুঝি। উহা হইতে জৈন কখনও কোন প্রকারেও বাহির হইতে পারে না। জিন’যাহা হইতে ‘জৈন’ হইয়াছে এবং ‘বুদ্ধ’ যাহা হইতে ‘বৌদ্ধ হইয়াছে, উভয়ই দুইটি পৰ্য্যায়বাচক। অভিধানে দুইটি শব্দের একই অর্থ লিখিত হইয়াছে। জৈন এবং বৌদ্ধ উভয়েই গৌতম কে মানে। নহিলে দীপবংশ প্রভৃতি বৌদ্ধগ্রন্থ সমূহে শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধকে প্রায়ই মহাবীর নামে উল্লেখ করা হইয়াছে। শাক্যমুনির সময়ে হয়ত বৌদ্ধ এবং জৈন মতদুইটি একই ছিল। আমরা যে গৌতমের অনুযায়ীদিগকে জৈন না লিখিয়া বৌদ্ধ লিখিয়াছি, তাহার কারণ এই যে, অন্য দেশীয়গণ তাহাদিগকে বৌদ্ধ নামেই অভিহিত করিয়াছেন”।

অমরকোষেও এইরূপ লিখিত আছে–

‘সর্বজ্ঞঃ সুগতো বুদ্ধো ধৰ্মারাজস্তথাগতঃ। সামন্তভদ্ৰো ভগবান মারজিল্লোকজিজ্জিনঃ ॥১॥ যডভিজ্ঞো দশবলোদ্বয়বাদী বিনায়কঃ। মুনীন্দ্রঃ শ্রীধনঃশাস্তা মুনিঃ শাক্যমুনিস্তু য়ঃ ॥২॥ সশাক্যসিংহঃ সর্বার্থঃ সিদ্ধঃশৌদ্ধোদনিশ্চ সঃ। গৌতমশ্চার্কবন্ধুশ্চ মায়াদেবীসুতশ্চ সঃ ॥৩ ॥ অমরকোষ কা০ ১বর্গ১, শ্লোক ৮ হইতে ।১০।

–এখন দেখুন, বুদ্ধ তথা জিন ও বৌদ্ধ তথা জৈন একেরই নাম কিনা? বুদ্ধ, জিন যে। একই অমরসিংহও কি একথা লিখিতে ভুলিয়া গেলেন? যাহারা বিদ্যাহীন জৈন তাহারা তো না। নিজেকে জানেন না অপরকে। তাহারা কেবল দুরাগ্রহ বশতঃ প্রলাপ বকিয়া থাকেন। কিন্তু। জৈনদের মধ্যে যাঁহারা বিদ্বান্ ব্যক্তি তাহার সকলে জানেন যে, ‘বুদ্ধ’ ও ‘জিন’ তথা বৌদ্ধ ও জৈন পৰ্য্যায়বাচী শব্দ এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

জৈনরা বলে যে –জীবই পরমেশ্বর হইয়া যায়। তাহারা তাহাদের তীর্থঙ্করদিগকেই কেবলী মুক্তিপ্রাপ্ত এবং পরমেশ্বর বলিয়া মানেন। তাঁহাদের মতে অনাদি পরমেশ্বর কেহই। নাই। সর্বজ্ঞ, বীতরাগ, অহন, কেবলী, তীর্থকৃত এবং জিন –এই ছয়টি নাস্তিকদের দেবতাদের নাম।

চন্দ্রসুরী “আপ্তনিশ্চয়ালঙ্কার” নামক গ্রন্থে আদি দেবের স্বরূপ এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন :

সর্বজ্ঞো বীতরাগাদিদোষস্ত্রৈলোক্যপূজিতঃ। য়থাস্থিতার্থবাদী চ দেবোন পরমেশ্বরঃ ॥১॥

“তৌতাতিত” ও এইরূপ লিখিয়াছেন —

সর্বজ্ঞো দৃশ্যতে তাবন্নেদানীমম্মাদিভিঃ ॥ দৃষ্টোন চৈকদেশোস্তিলিঙ্গং বা য়োনুমাপয়েতঃ ॥২॥ ন চাগমবিধিঃ কশ্চিন্নিত্যসর্বজ্ঞ বোধক। নচ তত্রার্থবাদানং তাৎপয়মপি কন্স্যতে ॥৩ ॥ ন চান্যার্থ প্রধানৈস্তৈস্তদস্তিত্বংবিধীয়তে। ন চানুবাদিতুংশকঃ পূর্বৰ্মন্যৈরবোধিতঃ ॥৪॥ আহতদর্শন ॥

যিনি রাগাদি দোষ রহিত, যিনি ত্রিলোকপূজ্য; যিনি পদার্থসমূহের যথার্থ বক্তা, সর্বজ্ঞ অহন দেব, তিনিই পরমেশ্বর ॥১॥

যেহেতু আমরা এ সময় পরমেশ্বরকে দেখিতেছি না অতএব কোন সর্বজ্ঞ, অনাদি পরমেশ্বর প্রত্যক্ষ নহেন। যদি ঈশ্বর বিষয়ে কোন প্রমাণ না থাকে তাহা হইলে অনুমানও প্রত্যক্ষ প্রযুক্ত হইতে পারে না। একদেশ প্রত্যক্ষ না হইলে অনুমান হইতে পারে না ॥ ২ ॥

প্রত্যক্ষ এবং অনুমান না থাকায় আগম অর্থাৎ নিত্য, অনাদি এবং সর্বজ্ঞ পরমাত্মার বোধক শব্দ প্রমাণও হইতে পারে না। অতএব ত্রিবিধ প্রমাণের অভাবে অর্থবাদ অর্থাৎ স্তুতি, নিন্দা, ‘পরকৃতি’অর্থাৎ পরের চরিত্র-বৰ্ণন ও পুরাকল্প’ অর্থাৎ ইতিহাসের তাৎপৰ্য্য প্রযুক্ত হইতে পারে না। ॥ ৩ ॥

তদ্ব্যতীত অন্যার্থপ্রধান বহুব্রীহি সমাসের ন্যায় পরোক্ষ পরমাত্মার সিদ্ধিরও বিধান হয় না। এমতাবস্থায় উপদেষ্টাদিগের নিকট ঈশ্বর সম্বন্ধে শ্রবণ ব্যতীত পুনরাবৃত্তি কীরূপ হইবে? ॥ ৪ ॥

ইহার প্রত্যাখ্যান অর্থাৎ খণ্ডন — অনাদি ঈশ্বর না থাকিলে, “অর্থন দেবের” মাতা-পিতা প্রভৃতির শরীরের ছাঁচ কে নির্মাণ করিত? সংযোগকৰ্ত্তা ব্যতীত যথাযোগ্য সর্বাবয়ব সম্পন্ন ও যথোচিত কাৰ্যসক্ষম শরীর নির্মিত হইতে পারে না। যে পদার্থ দ্বারা গঠিত উহা জড় হওয়ায় উহা

স্বয়ং এমন সুগঠিত হইয়া রচিত হইতে পারে না। কারণ জড় পদার্থের মধ্যে যথাযোগ্য নির্মিত হইবার জ্ঞানই নাই।

আবার যিনি প্রথমে রাগাদি দোষযুক্ত হইয়া, পরে দোষ হইতে রহিত হন তিনি কখনও ঈশ্বর হইতে পারে না। কারণ যে নিমিত্ত বশতঃ তিনি রাগাদি মুক্ত, সেই নিমিত্ত নষ্ট হইলে, তাহার কাৰ্য্যমুক্তিও অনিত্য হইবে।

যে অল্প এবং অল্পজ্ঞ সে কখনও সর্বজ্ঞ এবং সর্বব্যাপক হইতে পারে না। কেননা, জীবের স্বরূপ একদেশী এবং পরিমিত গুণ-কর্ম-স্বভাব বিশিষ্ট। সে সর্বতোভাবে সর্ববিদ্যার যথার্থ বক্তা হইতে পারে না। অতএব তোমাদের তীর্থঙ্কর কখনও পরমেশ্বর হইতে পারেন না ॥১॥

তোমরা কি কেবল প্রত্যক্ষ পদার্থই স্বীকার কর? অপ্রত্যক্ষ কি স্বীকার কর না? যেরূপ কান দ্বারা রূপ ও চক্ষু দ্বারা শব্দ গ্রহণ করা সম্ভব নয়, সেইরূপ অনাদি পরমাত্মাকে দর্শন করিবার সাধন শুভ অন্তঃকরণের প্রয়োজন। যাঁহারা পবিত্ৰাত্মা তাঁহারা বিদ্যা এবং যোগাভ্যাস দ্বারা পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ দর্শন করেন। যেমন অধ্যয়ন ব্যতীত বিদ্যালাভ হয় না সেইরূপ যোগাভ্যাস এবং বিজ্ঞান ব্যতীত পরমাত্মাকেও দর্শন করা যায় না।

যেমন পৃথিবীর রূপাদি গুণ দেখিয়া এবং জানিয়া, গুণ পূর্বক অব্যবহিত সম্বন্ধ দ্বারা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করা যায়, সেইরূপ এই সৃষ্টিতে পরমাত্মার রচনা বিশেষ চিহ্ন দেখিয়া পরমাত্মাকে প্রত্যক্ষ করা যায়। পাপাঁচরণের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গেই মনে যে ভয়, সংশয় এবং লজ্জা উৎপন্ন হয় তাহা পরমাত্মা হইতেই হয়; তদ্বারাও পরমাত্মা প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে। সুতরাং অনুমান সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে কি? ॥২ ॥

প্রত্যক্ষ ও অনুমান সিদ্ধ হওয়ায় আগম প্রমাণও নিত্য, অনাদি এবং সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের বোধক। অতএব ঈশ্বর বিষয়ে শব্দ প্রমাণও আছে। যখন জীব ত্রিবিধ প্রমাণ দ্বারা ঈশ্বরকে জানিতে পারে, তখন সে যথার্থরূপে ‘অর্থবাদ’ অর্থাৎ পরমেশ্বরের গুণাবলীর প্রশংসা করিতে সমর্থ হয়। কারণ, যে পদার্থ নিত্য, তাহার গুণ-কর্ম স্বভাবও নিত্য। তাহার প্রশংসায় কোনও প্রকার প্রতিবন্ধক নাই ৷৩ ॥

যেরূপ মনুষ্যদের মধ্যে কৰ্ত্তা ব্যতীত কোন কাৰ্য্য হয় না, সেইরূপ এই মহৎ কাৰ্য্যও কৰ্ত্তা ব্যতীত সর্বথা হওয়া অসম্ভব। ইহা যদি সত্য হয় তাহা হইলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে মূঢ়েরও সন্দেহ হইতে পারে না। উপদেশকদের নিকট হইতে পরমাত্মা সম্বন্ধে উপদেশ শ্রবণ করিবার পর তাহার পুনরুক্তিও সহজ সাধ্য ॥ ৪ ॥

অতএব জৈনদের পক্ষে প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব খণ্ডন করা ইত্যাদি ব্যবহার অনুচিত।

প্রশ্ন –অনাদেরাগমস্যার্থো ন চ সর্বজ্ঞ আদিমান্ ॥ কৃত্রিমেণ ত্বসত্যেন স কথং প্রতিপাদ্যতে ॥১॥ অথ তদ্বচনেনৈব সর্বজ্ঞsন্যৈঃ প্রতীয়তে। প্রকল্পেত কথং সিদ্ধিরন্যোন্যাশন্যায়োস্তয়োঃ ॥২॥ সর্বজ্ঞোক্ততয়া বাক্যং সত্যং তে তদস্তিতা। কথং তদুভয়ং সিধ্যেৎ সিদ্ধমূলান্তরাতে ॥৩॥ সর্বদর্শন ॥ প্রসঙ্গ বশতঃ সর্বজ্ঞ অনাদি শাস্ত্র সম্বন্ধে বলা সঙ্গত হইতে পারে না। কারণ মন গড়া অসত্য বাক্যের দ্বারা উহার প্রতিপাদন কীরূপে হইতে পারে? ॥ ১ ॥

যদি পরমেশ্বরেরই বাক্য দ্বারা পরমেশ্বর সিদ্ধ হয়, তাহা হইলে অনাদি ঈশ্বর দ্বারা অনাদি শাস্ত্রসিদ্ধি এবং অনাদি শাস্ত্র দ্বারা অনাদি ঈশ্বরসিদ্ধি –ইহাতে অন্যোন্যাশ্রয় দোষ ঘটে ॥২॥

কারণ, সর্বজ্ঞের বচন বলিয়া বেদবাক্য সত্য, আবার সেই বেদবাক্য দ্বারাই ঈশ্বরসিদ্ধি করিতেছ, ইহা কীরূপে প্রমাণ সিদ্ধ হইতে পারে? সেই শাস্ত্র এবং পরমেশ্বরের সিদ্ধির পক্ষে তৃতীয় কোন প্রমাণ আবশ্যক। যদি এইরূপ স্বীকার না কর তাহা হইলে দোষ ঘটিবে ॥৩ ॥

উত্তর –আমরা পরমেশ্বর এবং পরমেশ্বরের গুণ-কর্ম স্বভাবকে অনাদি মানি। অনাদি নিত্য-পদার্থ সমূহে অন্যোন্যাশয় দোষ ঘটিতে পারে না। যথা –কাৰ্য্য দ্বারা কারণের জ্ঞান এবং কারণ দ্বারা কাৰ্য্যের বোধ হয়; কাৰ্য্যে কারণের স্বভাব এবং কার্য্যের স্বভাব নিত্য থাকে। সেইরূপ পরমেশ্বর এবং তাহার অনন্ত বিদ্যাদি গুণ সমূহেও নিত্য থাকায় ঈশ্বর প্রণীত বেদে অবস্থা দোষ ঘটে না ॥ ১, ২, ৩ ॥

তোমরা যে তীর্থঙ্করকে পরমেশ্বর মান, তাহা কখনও যুক্তিসঙ্গত হইতে পারে না। কেননা, মাতাপিতা ব্যতীত তাহাদের শরীরই যদি না হইয়া থাকে তবে তাহারা তপশ্চৰ্য্যা, জ্ঞান ও মুক্তি কীরূপে লাভ করিতে পারেন? সংযোগের আদি নিশ্চয়ই আছে কারণ বিয়োগ না ঘটিলে সংযোগ হইতেই পারে না। অতএব অনাদি সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বরকে স্বীকার কর।

দেখ! যিনি যতই সিদ্ধ হউন না কেন, কাহারও পক্ষে শরীর প্রভৃতি রচনা সম্পূর্ণরূপে অবগত হওয়া সম্ভবপর নহে। যখন সিদ্ধজীব সুষুপ্তি অবস্থায় প্রবেশ করে তখন তাহার কোনও জ্ঞান থাকে না। আবার জীব যখন দুঃখপ্রাপ্ত হয়, তখন তাহার জ্ঞান হ্রাস পায়। ভ্রান্তবুদ্ধি জৈন ব্যতীত অপর কেহই পরিচ্ছিন্ন সামর্থ্যবিশিষ্ট একদেশস্থিত ব্যক্তিকে ঈশ্বর বলিয়া স্বীকার করিতে পারে না।

যদি তোমরা বল যে তীর্থঙ্করগণ তাহাদের মাতা-পিতা হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন, তবে তাহাদের মাতাপিতা কাহাদের হইতে? আর তাহাদের মাতা-পিতা কাহাদের হইতে উৎপন্ন হইয়াছিলেন? সুতরাং এইরূপে অবস্থা দোষ ঘটিবে।

অতঃপর “প্রকরণরত্নাকর” দ্বিতীয় ভাগ হইতে আস্তিক ও নাস্তিকদের আলোচনামূলক প্রশ্নোত্তর এখানে লিখিত হইয়াছে। কয়েক জন সুপ্রসিদ্ধ জৈন স্বীয় সম্মতি সহিত ইহা স্বীকার করিয়াছেন এবং উহা বোম্বাইতে মুদ্রিত হইয়াছে।

নাস্তিক –ঈশ্বরের ইচ্ছায় কিছুই হয় না, যাহা কিছুই হয় তৎ সমস্তই কর্ম হইতেই হয়।

আস্তিক –যদি সমস্তই কর্ম হইতে হয়, তাহা হইলে কর্ম কী হইতে হয়? যদি বল যে জীবাদি হইতে হয়, তবে জীব শ্ৰোত্রাদি সাধন দ্বারা যে সকল কর্ম করে, সে সকল কী হইতে হইল? যদি বল যে, অনাদি কাল এবং স্বভাব হইতে। তবে যাহা অনাদি তাহার কখনও অভাব হওয়া অসম্ভব। সুতরাং তোমাদের মতে মুক্তির অভাব হইবে। যদি বল –প্রাগভাববৎ অনাদি সান্ত, তবে বিনা চেষ্টায় সমস্ত কর্মের নিবৃত্তি হইবে।

যদি ঈশ্বর ফলদাতা না হইয়া থাকেন তাহা হইলে জীব পাপের দুঃখরূপ ফল কখনও স্বেচ্ছাক্রমে ভোগ করিবে না। যেরূপ চোর প্রভৃতি স্বেচ্ছায় চৌর্য্য অপরাধের দণ্ড ভোগ করে না কিন্তু রাজ্যব্যবস্থাধীনেই ভোগ করে সেইরূপ পরমেশ্বর ভোগ করান বলিয়াই জীব পাপপুণ্যের ফল ভোগ করে অন্যথা কর্মসঙ্কর উৎপন্ন হইবে, একের কৃতকর্মের ফল অপরজনকে ভোগ করিতে হইবে।

নাস্তিক –ঈশ্বর নিষ্ক্রিয়। কেননা, সক্রিয় হইলে তাহাকেও কর্মফল ভোগ করিতে হইত। অতএব যেরূপ আমরা কেবলই প্রাপ্ত মুক্তগণকে নিষ্ক্রিয় স্বীকার করি তোমরাও তাহা স্বীকার কর।

আস্তিক –ঈশ্বর নিষ্ক্রিয় নহেন, কিন্তু সক্রিয়। তিনি যদি চেতন হন কৰ্ত্তা নহেন কেন? তিনি যদি কৰ্ত্তা হন, তাহা হইলে ক্রিয়া হইতে কখনও পৃথক্‌ হইতে পারেন না। যেমন তোমাদের কৃত্রিম মনগড়া তীর্থঙ্কর যাহাকে জীব হইতে প্রস্তুত স্বীকার কর, এইরূপ ঈশ্বরকে কোনও বিদ্বান ব্যক্তি স্বীকার করিবে না। কারণ ঈশ্বর যদি নিমিত্ত হইতে উৎপন্ন হন, তবে তিনি অনিত্য এবং পরাধীন হইবেন। কেননা তিনি ঈশ্বরত্ব লাভের পূর্বে জীব ছিলেন, পরে কোন নিমিওহইতে ঈশ্বর হইয়াছেন। সুতরাং তিনি পরে আবার জীব হইবেন, নিজের জীবত্ব স্বভাবকে সে কখনও পরিত্যাগ করিতে পারিবে না, অনন্ত কাল হইতে জীব আছে ও থাকিবে। অতএব এই অনাদি স্বতঃসিদ্ধ ঈশ্বর স্বীকার করাই সঙ্গত।

দেখ! যেরূপ বর্তমানে জীব পাপপুণ্য করে এবং সুখ দুঃখ ভোগ করে; ঈশ্বর কখনও সেইরূপ করেন না। তিনি ক্রিয়াবা না হইলে এ জগৎকে কীরূপে সৃষ্টি করিতেন? যদি মনে করা যায় যে, কর্ম প্রাগভাববৎ অনাদি এবং সান্ত, তাহা হইলে কর্ম সমবায় সম্বন্ধ রূপে থাকিবে না। যদি সমবায় সম্বন্ধ না থাকে, তাহা হইলে কর্ম সংযোগজ হইয়া অনিত্য হইবে।

যদি মুক্তি অবস্থায় জীব ক্রিয়াহীন স্বীকার কর, তাহা হইলে মুক্তজীব জ্ঞানবান থাকে না; যদি বল জ্ঞানবান থাকে, তবে সে অন্তঃক্রিয়াযুক্ত হইল। জীব কি মুক্তি অবস্থায় পাষাণবৎ জড় হইয়া যায়, — একস্থানে পড়িয়া থাকে, এবং কোন চেষ্টা করে না? তাহা হইলে মুক্তি কী হইল? মুক্ত জীব তো অন্ধকার এবং বন্ধনে আবদ্ধ হইল।

নাস্তিক –ঈশ্বর ব্যাপক নহেন। তিনি যদি ব্যাপক হইতেন, তাহা হইলে সকল পদার্থই চেতন হইত। কিন্তু তাহা নহে কেন? আর ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র প্রভৃতির উত্তম, মধ্যম এবং নিকৃষ্ট অবস্থা হইল কেন? ঈশ্বর সর্বত্র সমভাবে থাকিলে ক্ষুদ্রত্ব এবং মহত্ত্ব থাকা উচিত নহে।

আস্তিক –ব্যাপ্য এবং ব্যাপক এক প্রকার হয় না। ব্যাপ্য একদেশী ব্যাপক সর্বদেশী। যেরূপ আকাশ সর্বত্র ব্যাপক কিন্তু ভূমণ্ডল এবং ঘটপটাদি যাবতীয় পদার্থ ব্যাপ্য একদেশী। যেরূপ পৃথিবী ও আকাশ এক নহে সেইরূপ ঈশ্বর এবং জগৎ এক নহে। যেরূপ আকাশ ঘটপটাদিতে ব্যাপক কিন্তু ঘট পটাদি আকাশ নহে; সেইরূপ চেতন পরমেশ্বর সকল পদার্থের মধ্যে আছেন কিন্তু সকল পদার্থ চেতন নহে। যেমন আকাশ সকলের মধ্যে সমান পৃথিবী ইত্যাদির অবয়বের সমান নয়, সেইরূপ পরমেশ্বরের সমান কেউ নয়।

যেমন পণ্ডিত-মূর্খ, ধর্মাত্মা-অধর্মাত্মা সকলেই সমান নহে; সেইরূপ বিদ্যাদি সদ্গুণ, সত্যভাষণাদি কর্ম এবং সুশীলতা প্রভৃতি স্বাভাবিক গুণের ন্যুনতাধিক্য বশতঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং অন্ত্যজদিগকে উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট ইত্যাদি বলা হইয়া হইয়া থাকে। এই গ্রন্থের চতুর্থ সমুল্লাসে’ বর্ণব্যবস্থা ব্যাখ্যাত হইয়াছে, তাহা সেস্থলে দ্রষ্টব্য।

নাস্তিক –ঈশ্বর জগতে অধিপতিত্ব এবং জগতরূপ ঐশ্বৰ্য কী কারণে স্বীকার করিলেন?

আস্তিক –ঈশ্বর কখনও অধিপতিত্ব ত্যাগ করেন নি, গ্রহণ করেন নি। কিন্তু অধিপতিত্ব ও জগঞ্জপ ঐশ্বৰ্য্য ঈশ্বরেই বর্তায় কখনও পৃথক হইতে পারেন না, গ্রহণ কী করিবেন? কেননা অপ্রাপ্তেরই গ্রহণ হইয়া থাকে। ব্যাপ্য হইতে ব্যাপক এবং ব্যাপক হইতে ব্যাপ্য পৃথক হইতে পারে না এইজন্য সদৈব স্বামিত্ব এবং অনন্ত ঐশ্বৰ্য অনাদি কাল হইতে ঈশ্বরেই নিহিত। গ্রহণও ত্যাগ জীবে ঘটিতে পারে; ঈশ্বরে নয়।

নাস্তিক –সৃষ্টি ঈশ্বর কৃত হইলে মাতা-পিতা প্রভৃতির প্রয়োজন কী? আস্তিক –ঈশ্বর ঐশী সৃষ্টির কর্তা, জৈবী সৃষ্টির কৰ্ত্তা নহেন। ঈশ্বর জীবের কৰ্ত্তব্য কর্ম করেন না। কিন্তু জীবই জীবের কৰ্ত্তব্য কর্ম করে। ঈশ্বর বৃক্ষ, ফল, ওষধি এবং অন্নাদি সৃষ্টি করিয়াছেন, মনুষ্য ঐ সকল কুটিয়া, পিষিয়া রুটি প্রভৃতি করিয়া ভক্ষণ না করিলে ঈশ্বর কি কখনও মনুষ্যের। পরিবর্তে এসকল কাৰ্য্য করিবেন? আবার যদি না করেন উহা জীবের পক্ষে জীবনধারণও হইতে পারিবে না। অতএব আদি সৃষ্টিতে জীবের শরীর সমূহ ও ছাঁচ নির্মাণ করা ঈশ্বরাধীন; তৎপর পুত্রাদি উৎপন্ন করা জীবের কর্তব্য।

নাস্তিক –যদি পরমাত্মা শাশ্বত, অনাদি, চিদানন্দ এবং জ্ঞানস্বরূপ হন, তাহা হইলে তিনি জগৎ-প্রপঞ্চ এবং দুঃখের মধ্যে পড়িলেন কেন? সাধারণ মনুষ্যও আনন্দ পরিত্যাগ করিয়া দুঃখ গ্রহণ করে না; ঈশ্বর করিলেন কেন?

আস্তিক –পরমাত্মা কোন প্রপঞ্চ এবং দুঃখের মধ্যে পতিত হন না এবং নিজের আনন্দও পরিত্যাগ করেন না। প্রপঞ্চ এবং দুঃখে পতিত হওয়া একদেশীর পক্ষে সম্ভব; সর্বদেশীর পক্ষে নহে। অনাদি, চিদানন্দ এবং জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মা ব্যতীত অপর কে জগৎ সৃষ্টি করিতে পারে? জীবের মধ্যে জগন্নিমাণের সামর্থ্য নাই এবং জড়ের মধ্যে স্বয়ংনিৰ্ম্মিত হইবার সামর্থও নাই।

অতএব সিদ্ধ হইতেছে যে, পরমাত্মাই জগতের নির্মাতা এবং তিনি সর্বদা আনন্দে অবস্থান করেন। পরমাত্মা পরমাণু হইতে যেরূপ জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন,সেইরূপ মাতাপিতা রূপ নিমিত্ত কারণ হইতে উৎপত্তি ব্যবস্থার নিয়মও তিনিই করিয়াছেন।

নাস্তিক –ঈশ্বর মুক্তিরূপ সুখ পরিত্যাগ করিয়া জগতের সৃজন ধারণ এবং প্রলয়কাৰ্য্যের ঝঞ্ঝাটের মধ্যে পড়িলেন কেন?

আস্তিক –ঈশ্বর সদা মুক্ত বলিয়া তোমাদের সাধন দ্বারা সিদ্ধি প্রাপ্ত তীর্থঙ্করদিগের ন্যায় একদেশীয় আবদ্ধরূপে মুক্তি যুক্ত, সনাতন পরমাত্মা নহেন, যিনি অনন্ত গুণ-কর্ম-স্বভাব বিশিষ্ট তিনি এই কিঞ্চিমাত্র জগতের সৃষ্টি–স্থিতি- প্রলয় করিয়াও বন্ধনে আবদ্ধ হন না কেননা বন্ধন এবং মুক্তি আপেক্ষিক অর্থাৎ বন্ধনসাপেক্ষ। যিনি কখনও বদ্ধ ছিলেন না, তাহাকে মুক্ত কীরূপে বলা যাইতে পারে? জীব একদেশী বলিয়া জীবের মুক্তি এবং বন্ধন প্রভৃতি সর্বদা হইতে থাকে। অনন্ত, সর্বদেশী এবং সর্বব্যাপক ঈশ্বর তোমাদের তীর্থঙ্করদিগের ন্যায় কখনও নৈমিত্তিক বন্ধন অথবা মুক্তিচক্রে পতিত হন না। এই নিমিত্ত পরমাত্মাকে সদা মুক্ত বলা হয়।

নাস্তিক –ভাং সেবনের পর মাদকতার ন্যায় জীব কর্মফল নিজে নিজেই ভোগ করে, সুতরাং ঈশ্বরের প্রয়োজন নাই।

আস্তিক –যেমন রাজশাসন ব্যতীত লম্পট, চোর-ডাকাত প্রভৃতি দুর্বৃত্তগণ স্বয়ং নিজদিগকে ফাঁসী দেয় না বা কারাগারে গমন করে না, এমন কি গমন করিতে ইচ্ছাও করে না; কিন্তু রাজ্যের ন্যায় ব্যবস্থানুসারে রাজা বলপূর্বক তাহাদিগকে ধৃত করাইয়া উপযুক্ত দণ্ডদান করেন। সেইরূপ পরমাত্মা স্বকীয় ন্যায় ব্যবস্থানুসারে জীবকে স্ব স্ব কর্মানুযায়ী সমুচিত দণ্ডদান করেন। কেননা, কোন জীব নিজ কুকর্মের ফলভোগ করিতে ইচ্ছা করে না। এই নিমিত্ত ন্যায়াধীশ (বিচারপতি) পরমাত্মার প্রয়োজন।

নাস্তিক –জগতে ঈশ্বর এক নহে; কিন্তু সকল মুক্ত জীবই ঈশ্বর।

আস্তিক –এইরূপ বলা সর্বদা নিরর্থক। কেননা যদি কেহ বদ্ধ হইবার পর মুক্ত হয়, তাহা হইলে পুনরায় তাহাকে অবশ্যই বন্ধনে পড়িতে হইবে। কারণ জীব স্বভাবত নিত্যমুক্ত নহে। যেরূপ তোমাদের চব্বিশ জন তীর্থঙ্কর পূর্বে বদ্ধ ছিলেন, পরে মুক্ত হইয়াছেন। সুতরাং তাহারা পুনরায় বন্ধনে আবদ্ধ হইবেন। আর যদি ঈশ্বর অনেক হন, তাহা হইলে তাহারা জীবদিগের ন্যায় পরস্পর কলহ বিবাদে প্রবৃত্ত হইবেন।

নাস্তিক –ও হে মূঢ়! জগতের কর্তা কেহই নাই। জগৎ স্বয়ংসিদ্ধ।

আস্তিক– ইহা জৈনদিগের বড় ভ্রম! ভালরে ভাল। জগতে কৰ্ত্তা ব্যতীত কোন কর্ম এবং কর্ম ব্যতীত কোন কাৰ্য্য হইতে দেখা যায় কি? কথাটা এইরূপ — গোধুম ক্ষেত্রে গোধুম নিজে নিজেই পিষ্ট হইবার পর রুটি হইয়া যেন জৈনদের উদরে চলিয়া যায়! কার্পাস নিজে নিজেই সূতা, কাপড়, জামা, চাদর, ধুতি এবং পাগড়ী প্রভৃতিতে কখনও পরিণত হয় না। এরূপ যখন হয় না, সে ক্ষেত্রে কর্তা ঈশ্বর ব্যতীত এই বিবিধ জগৎ এবং নানা প্রকার রচনা- বিশেষ, কীরূপে সম্ভব হইতে পারে?

যদি হঠকারিতা বশতঃ জগৎকে স্বয়ংসিদ্ধ মনে কর, তবে পূর্বোক্ত বস্ত্রাদি যে কৰ্ত্তা ব্যতীত হইতে পারে তাহা প্রত্যক্ষরূপে দেখাও। আর যদি ইহা সিদ্ধ করিতে না পার, তাহা হইলে তোমাদের প্রমাণ শূন্য বাক্য কোন্ বুদ্ধিমান স্বীকার করিবে? নাস্তিক –ঈশ্বর বিরক্ত, না –মোহগ্রস্ত? বিরক্ত হইলে তিনি জগৎপ্রপঞ্চের মধ্যে আবদ্ধ। হইলেন কেন? যদি তিনি মোহগ্রস্ত হন, তাহা হইলে তাহাতে জগন্নির্মাণের সামর্থ্য থাকিবে না।

আস্তিক –পরমেশ্বর বৈরাগ্য অথবা মোহ কখনও ঘটিতে পারে না কারণ তিনি সর্বব্যাপক, তিনি কাহাকে ত্যাগ করিবেন এবং কাহাকেই বা গ্রহণ করিবেন? পরমেশ্বর অপেক্ষা উত্তম কেহ নাই এবং তাহার অপ্রাপ্ত কোন পদার্থ নাই। এই নিমিত্ত তিনি কোনও বস্তুর প্রতি মোহগ্রস্ত হন না। বৈরাগ্য এবং মোহ জীবে সম্ভব, –ঈশ্বর নহে।

নাস্তিক –ঈশ্বর কে জগৎকর্তা ও কর্মফলদাতা স্বীকার করিলে তিনি প্রপঞ্চী ও দুঃখী হইবেন।

আস্তিক –ভাল! বহুবিধ কর্মের কর্তা ও প্রাণীদিগের কর্মফলদাতা, ধার্মিক, বিচারপতি এবং বিদ্বান্ ব্যক্তি কর্মে আবদ্ধ বা প্রপঞ্চী হন না এমতাবস্থায় অনন্ত সামর্থযুক্ত পরমেশ্বর কীরূপে প্রপঞ্চী এবং দুঃখী হইবেন? হাঁ, তোমরা অজ্ঞাতবশতঃ পরমেশ্বরকে নিজের মত এবং তীর্থঙ্করদের সদৃশ মনে কর। ইহা তোমাদের অবিদ্যার লীলা! যদি তোমরা অবিদ্যা প্রভৃতি দোষ হইতে মুক্ত হইতে চাও, তাহা হইলে বেদাদি শাস্ত্রের শরণাপন্ন হও। কেন মিছে ভ্রমে পড়িয়া ধাক্কা খাইতেছ?

জগৎ সম্বন্ধে জৈনরা যেরূপ মানে, এস্থলে প্রমাণ অনুসারে তাহা প্রদর্শন করা যাইতেছে। সূত্রগুলির মূল অর্থ সংক্ষেপে বিবৃত করিয়া সত্যাসত্য পরীক্ষা করা যাইতেছে —

মূলঃ –সামি অণাই অণন্তে, চউগঈ সংসারঘোরকান্তারে। মোহাইকম্মগুরুঠিই, বিবাগ বসউ ভমই জীবো ॥ প্রকরণরত্নাকর, ভাগ দ্বিতীয় ২। সূত্র ॥২॥

ইহা প্রকরণ রত্নাকর, ভাগ ২ নামক গ্রন্থের সম্যক্তৃপ্রকাশ প্রকরণে গৌতম ও মহাবীর সংবাদে আছে। ইহার সংক্ষিপ্ত এবং উপযোগী অর্থ এইরূপ — “এই জগৎ অনাদি এবং অনন্ত। ইহার কখনও উৎপত্তি হয় নাই, বিনাশও হয় না। ফল কথা, জগৎ কাহারও সৃষ্ট নহে। উহাই আস্তিক নাস্তিক সংবাদে লিখিত আছে, –“হে মূঢ়! জগতে কৰ্ত্তা কেহই নাই, ইহা কখনও সৃষ্ট হয় নাই। ইহার কখনও নাশ হয় না।”

সমীক্ষক –যাহা সংযোগজ, তাহা কখনও অনাদি এবং অনন্ত হইতে পারে না। আবার উৎপত্তি ও বিনাশ ব্যতীত কর্মও থাকে না। জগতের যত প্রকার বস্তু উৎপন্ন হইয়াছে ঐ সকল উৎপত্তি ও বিনাশশীল দৃষ্ট হয়। তাহা হইলে জগৎ উৎপত্তি এবং বিনাশশীল নহে কেন? তোমাদের তীর্থঙ্করদের সম্যক্ বোধ ছিল না, সম্যজ্ঞান থাকিলে এইরূপ অসম্ভব কথা লিখিলেন কেন?

যেমন তোমাদের গুরু, তেমন তোমরা শিষ্য। যাহারা তোমাদের কথা মানে, তাহাদের পদার্থজ্ঞান কখনও হইতে পারে না। বলতো যে, সংযোগজ পদার্থ প্রত্যক্ষ দৃষ্ট হয়, ইহার উৎপত্তি এবং বিনাশ স্বীকার কর না কেন? ইহার তাৎপৰ্য্য এই যে, জৈনাচাৰ্য্যদের ভূগোল ও খগোল বিদ্যা জানা ছিল না, এখনও ইহাদের মধ্যে এ বিদ্যা নাই। নতুবা নিম্নলিখিত এরূপ অসম্ভব কথাগুলি তাহারা মানেই বা কেন, লেখেই বা কেন?

দেখ, জৈনগণ এই সৃষ্টিতে পৃথিবীকায় অর্থাৎ পৃথিবীও জীবের শরীর এবং জলকায় প্রভৃতিকেও জীব স্বীকার করে। ইহাদের একথা কেহই স্বীকার করিতে পারে না। আরও দেখ, জৈনগণ যে সকল তীর্থঙ্করকে সম্যক জ্ঞানী এবং পরমেশ্বর বলিয়া মান্য করেন, তাহাদের কতকগুলি মিথ্যা বাক্যের নমুনা নীচে দেওয়া হইতেছে।

“রত্নসারভাগ” জৈনগণ এই গ্রন্থকে মানেন; ইহা নানকচন্দ জতী, ২৮শে এপ্রিল ১৮৭৯ খৃঃ বারাণসীস্থ জৈন প্রভাকর প্রেসে মুদ্রিত ও প্রকাশিত করিয়াছেন। গ্রন্থের ১৪৫ পৃষ্ঠায় পূর্বোক্ত কালের এইরূপ ব্যাখ্যা করা হইয়াছে —

সময়ের নাম সূক্ষ্মকাল। অসংখ্য সময়কে “আবলি” বলে। ১ কোটি ৬৬ লক্ষ ৭৭ হাজার ২ শত ১৬ “আবলি” তে এক “মুহূর্ত হয়। এইরূপ ৩০ মুহূর্তে এক “দিবস”, ১৫ দিবসে এক “পক্ষ”, দুই পক্ষে এক “মাস”, ১২মাসে এক “বর্ষ” হয়। এইরূপ ৭০ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি বৎসরে এক”পূর্ব” এবং এরূপ অসংখ্য “পূর্বে” এক “পল্যোপম”কাল হয়। অসংখ্যাত এইরূপ–৪ ক্রোশ চওড়া এবং সেই পরিমাণ গভীর একটি কূপ খনন করিয়া সেই কূপ ‘জুগুলিয়া’ মনুষ্যদের নিম্নবর্ণিতরূপ খণ্ড খণ্ড লোম দ্বারা পূর্ণ করিবে। অর্থাৎ “জুগুলিয়া” মনুষ্যদের লোম মনুষ্যদের লোমের ৪ হাজার ৯৬ ভাগ সূক্ষ্ম অর্থাৎ জুগুলিয়া মনুষ্যের ৪ হাজার ৯৬ টি লোম সংগ্রহ করিলে আধুনিক মনুষ্যের একটা লোম হয়।

এইরূপ জুগুলিয়া মনুষ্যের এক অঙ্গুলি পরিমাণ লোমকে সাত বার আট খণ্ড করিলে ২০৯৭১৫২ বিশ লক্ষ সাতানব্বই হাজার এক শত বাহান্ন খণ্ড হয়। এইরূপ লোম খণ্ড দ্বারা পূর্বোক্ত কূপ পূর্ণ করিবে। সেই কূপ হইতে একশত বৎসর অন্তর এক এক লোম বাহির করিবে। যে সময়ের মধ্যে ঐ সকল লোমখণ্ড বাহির করিলে কূপটি খালি হইয়া যাইবে, সেই সময়কে “সংখ্যাত কাল” বলিয়া জানিবে। আবার যখন উক্ত লোমখণ্ড সমূহের প্রত্যেকটিকে অসংখ্য খণ্ড করিয়া সেই লোম খণ্ডগুলি দ্বারা কূপটি এমন ঠাসাঠাসিভাবে পূর্ণ করিতে হইবে যেন তাহার উপর দিয়া কোন চক্রবর্তী রাজার সেনা চলিয়া গেলেও বসিয়া না যায়, ঐসকল লোম খণ্ড হইতে এক শত বৎসর অন্তর এক এক খণ্ড বাহির করিতে হইবে। এইরূপে কূপটি খালি করিতে যে সময় লাগিবে সেই সময়কে অসংখ্য “পূর্ব”বলে। এরূপ অসংখ্য “পূর্ব” বৎসরে এক “পল্যোপম” কাল হয়। এইরূপ কুপের দৃষ্টান্ত হইতে “পল্যোপম” কাল জানিতে হইবে।

এইরূপে দশ কোটি পল্যোপম কাল অতীত হইলে “সাগরোপম” কাল হয়। দশ কোটি সাগরোপম কাল ব্যতীত হইলে এক “উৎসপণী” কাল হয়। এক ‘উৎসর্পিণী’ এবং এক “অপৃসপর্ণী” কাল অতীত হইলে এক “কালচক্র” হয়। অনন্ত কালচক্র অতীত হইলে এক “পুদগলপরাবর্ত” হয়।

এখন প্রশ্ন হইতেছে যে, অনন্ত কাল কাহাকে বলে। সিদ্ধান্ত গ্রন্থসমূহে যে নয়টি দৃষ্টান্ত দ্বারা কালগণনা করা হইয়াছে, তাহার পরে কালকে অনন্তকাল বলে। “অনন্ত” “পুদগলপরাবৰ্ত্ত” কাল জীবের ভ্রমণ করিতে করিতে অতিবাহিত হইয়াছে ইত্যাদি।

সমীক্ষক –গণিতবিদ্যাবিশার ভ্রাতৃগণ! শুনুন আপনারা জৈনগ্রন্থের কালসংখ্যা গণনা করিতে পারিবেন কী? আর এই কাল গণনাও সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে পারিবেন কী? দেখুন! তীর্থঙ্করগণ কীরূপ গণিতবিদ্যা শিক্ষা করিয়া ছিলেন। জৈনমতাবলম্বীদের মধ্যে এইরূপ বহু গুরু শিষ্য আছেন যাঁহাদের অবিদ্যার পারাপার নাই।

জৈনদিগের অবিদ্যার কথা আরও শ্রবণ করুণ –রত্নসার ভাগ (১) পৃ০ ১৩৩ হইতে যে সমস্ত “বুটাবোল”অর্থাৎ জৈনদেরই সিদ্ধান্ত গ্রন্থ, যাহা তাহাদের তীর্থঙ্কর ঋষভদেব হইতে মহাবীর পৰ্য্যন্ত ২৪ তীর্থঙ্কর হইয়াছেন, ইহা তাহাদের বাক্য সমূহের সারসংগ্রহ। এইরূপ রত্নসার পৃ০ ১৪৮ এ লিখিত আছে।

মৃত্তিকা, প্রস্তর প্রভৃতি বিভিন্নাকৃতি পৃথিবী বিশেষকে পৃথিবীকায় জীব বলে। তন্মধ্যে অবস্থানকারী জীবের শরীর একটি অঙ্গুলির অসংখ্য ভাগের একভাগ অর্থাৎ অতীব সূক্ষ। তাহাদের আয়ুর পরিমাণ অর্থাৎ তাহারা অত্যধিক পক্ষে ২২ সহস্র বৎসর পর্যন্ত জীবিত থাকেন।

রত্ন (ভাগ ১) পৃ০ ১৪৯ — “এক একটি বনস্পতির শরীরে অনন্ত জীব থাকে, তাহাদিগকে সাধারণ বনস্পতি বলে। এ সমস্ত কন্দমূল প্রমুখ এবং অনন্তকায় প্রমুখ। তাহাদিগকে সাধারণ বনস্পতির জীব বলা চলে। তাহাদের আয়ুর পরিমাণ “অনন্ত মুহূর্ত” কিন্তু এখানে পূর্বোক্ত মুহূর্ত বুঝিতে হইবে ॥

তাহাদের এক এক শরীরে যে “একেন্দ্রিয়” অর্থাৎ স্পর্শেন্দ্রিয় আছে –তন্মধ্যে এক একটি জীব থাকে, তাহাকে প্রত্যেক বনস্পতি বলে। উহার দেহপরিমাণ এক সহস্র যোজন অর্থাৎ পৌরাণিকদিগের মতে চারি ক্রোশে এক যোজন হয়, কিন্তু জৈনমতে ১০,০০০, দশ সহস্র ক্রোশে এক যোজন হয়। এইরূপ চারি সহস্র ক্রোশের শরীর হয়। তাহার আয়ুর পরিমাণ অত্যধিক পক্ষে দশ সহস্র বৎসর হইয়া থাকে।

“এবার দুই ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট জীব অর্থাৎ শরীর এবং মুখ বিশিষ্ট যথা শঙ্খ, কড়ি এবং উকুন প্রভৃতির দেহমান অত্যধিক পক্ষে আটচল্লিশ ক্রোশ মোট হয় এবং আয়ুর পরিমাণ অধিক পক্ষে বার বৎসর।”

সমীক্ষক –এ স্থলে লেখকের ভুল হইয়াছে। কারণ এত প্রকাণ্ড শরীর বিশিষ্ট জীবের আয়ুর পরিমাণ অধিক লেখা উচিত ছিল। তবে আটচল্লিশ ক্রোশ শরীরবিশিষ্ট উকুন সম্ভবতঃ জৈনদের শরীরেই থাকে। কেবল তাহারাই এই উকুন দেখিয়া থাকিবেন। এত বড় উকুন দেখিবার ভাগ্য। আর কাহার আছে যে, সেরূপ উকুন দেখিবে!!!

ইহাদের অজ্ঞতার কথা আর ও দেখ। রত্নসার ভাগ (১) পৃ০ ১৫০ লেখা আছে– বৃশ্চিক, ছারপোকা, উঁশ এবং মক্ষিকার শরীরের আয়তন এক যোজন এবং আয়ুর পরিমাণ অত্যধিক পক্ষে ছয় মাস।

সমীক্ষক –দেখ ভাই! চারি ক্রোশ দীর্ঘ বৃশ্চিক, আর কেহ দেখে নাই। এরূপ আট মাইলের বৃশ্চিক এবং মক্ষিকা প্রভৃতি সম্ভবতঃ জৈনদের মতেই হইয়া থাকে। এইরূপ বিছা ও মাছি তাহাদের গৃহেই হয়ত থাকে। এবং তাঁহারাই কেবল ঐ সকল দেখিয়া থাকেন। পৃথিবীতে অপর কেহ এত বড় বৃশ্চিক এবং মক্ষিকা দেখে নাই। এরূপ বৃশ্চিক কোন জৈনকে দংশন করিলে তাহাদের কী দশা হইবে?

জলচর মৎস্যাদির শরীরের আয়তন এক সহস্র যোজন অর্থাৎ দশ সহস্র ক্রোশ যোজন অর্থাৎ দশ সহস্র ক্রোশ। যোজন হিসাবে এক একটি জলচর জীবের শরীর ১০,০০০, ০০০ এক কোটি ক্রোশ দীর্ঘ। তাহাদের আয়ুর পরিমাণ এক কোটি ‘পূর্ববর্ষ।

সমীক্ষক –এরূপ প্রকাণ্ড জলচর জীবকে জৈন ব্যতীত অপর কেহই দেখে নাই।

চতুষ্পদ হস্তী প্রভৃতির দেহায়তন দুই হইতে নয় ক্রোশ পৰ্য্যন্ত এবং আয়ুর পরিমাণ চুরাশী হাজার বৎসর ইত্যাদি।

সমীক্ষক –এরূপ বিশাল দেহধারী জীবকে জৈন ব্যতীত অপর কেহ দেখে নাই। জৈন ব্যতীত অপর কোন বুদ্ধিমান এ সকল কথা স্বীকার করিতেও পারে না।

রত্নসার ভাগ –(১) পৃ০ ১৫১ –‘জলচর’ গর্ভজ জীবের দেহায়তন অত্যধিক পক্ষে এক সহস্র যোজন অর্থাৎ এক কোটি ক্রোশ এবং আয়ুর পরিমাণ এক কোটি ‘পূর্ববর্ষ।

সমীক্ষক –এরূপ প্রকাণ্ড শরীর এবং এরূপ দীর্ঘ আয়ু বিশিষ্ট জীব সমূহকে জৈনাচাৰ্য্যগণ। স্বপ্নে দেখিয়া থাকিবেন। এ সমস্ত কি মহা অসত্য কথা নহে? এরূপ কি কখনও সম্ভব?

এবার শুনুন ভূমির পরিমাণ বিষয় ‘রত্নসার’ ভাগ (১) পৃ০ ১৫২ –“এই তির্যক লোকে অসংখ্য দ্বীপ এবং অসংখ্য সমুদ্র আছে। এ স্থলে অসংখ্য শব্দে আড়াই ‘সাগরোপম’ কালে যত সময় হয়, তত সংখ্যক দ্বীপ এবং সমুদ্র আছে জানিবে।”

এই পৃথিবীতে এক “জম্বুদ্বীপ” প্রথম, ইহা সকল দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত। ইহার আয়তন এক লক্ষ যোজন অর্থাৎ চার “লক্ষ” ক্রোশ। ইহার চতুর্দিকে ‘লবণ সমুদ্র’ আছে। ইহার আয়তন দুই লক্ষ যোজন অর্থাৎ আট “লক্ষ ক্রোশ।

এই জম্বুদ্বীপের চারিদিকে “ধাতকীখণ্ড” নামক দ্বীপ অবস্থিত। ইহার আয়তন চারি লক্ষ যোজন অর্থাৎ ষোলো “লক্ষ” ক্রোশ পরিমাণ। তাহার পিছনে “কালোদধি” সমুদ্র। উহার আয়তন আট লক্ষ অর্থাৎ বত্রিশ লক্ষ ক্রোশ পরিমাণ। তৎপরবর্তী ‘পুষ্করাবর্ত’ দ্বীপ। উহার পরিমাণ ‘ষোল লক্ষ যোজন ক্রোশ। এই দ্বীপের অভ্যন্তরভাগ খালি। এই দ্বীপের অর্ধাংশে মনুষ্য বাস করে, এতদ্ব্যতীত অসংখ্য দ্বীপ এবং সমুদ্র আছে, তাহাতে তিৰ্য্যগ্‌যোনির জীব বাস করে।

রত্নসার ভাগ (১) পৃ০ ১৫৩ –জম্বুদ্বীপে ছয়টি ক্ষেত্র (মহাদেশ) আছে যথাঃ –হিমবন্ত, ঐরণ্যবন্ত, হরিবৰ্ষ, রম্যক, দেবকুরু এবং উত্তরকুরু।

সমীক্ষক –ভূগোলবিদ্যাবিভ্রাতৃগণ! শ্রবণ করুণ। ভূমণ্ডলের আয়তন নির্ণয় করিতে গিয়া আপনারা ভুল করিয়াছেন, না –জৈনগণ ভুল করিয়াছেন? যদি জৈনগণ ভুল করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আপনারা তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিন। যদি আপনারা ভুল করিয়া থাকেন, তাহা হইলে তাঁহাদের নিকট বুঝিয়া লউন! একটু চিন্তা করিলেই বুঝা যাইবে যে, জৈনাচাৰ্য্যগণ এবং তাহাদের শিষ্যবর্গ ভূগোল, খগোল এবং গণিতবিদ্যা কিছুই অধ্যয়ন করেন নাই; নতুবা তাহারা এ সকল মহা-অসম্ভব গল্প রচনা করিবেন কেন?

এরূপ অজ্ঞ লোকেরা যে জগৎকে অকর্তৃক মনে করিবেনএবং ঈশ্বরকে মানিবেন না, তাহাতে আশ্চর্য্যের কী আছে? জৈনগণ তাহাদের গ্রন্থসমূহ কোন ভিন্ন মতাবলম্বী বিদ্বাকে দেখিতে দেন না, কারণ তাঁহারা ঐ সকলকে প্রামাণিক তীর্থঙ্করদের রচিত সিদ্ধান্ত গ্রন্থ বলিয়া বিশ্বাস করেন। উক্ত গ্রন্থসমূহ এরূপ অবিদ্যা ভরা কথায় পরিপূর্ণ যে, অপরকে দেখিতে দিলে ভণ্ডামি ধরা পড়িবে। জৈন ব্যতীত কোনও অল্প বুদ্ধির মানুষও ঐ সকল অলীক গল্পকে সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে পারিবে না।

জগৎকে অনাদি প্রমাণ করিবার জন্যই জৈনীরা এই সকল বিষয়ের অবতারণা করিয়াছে। কিন্তু এসকল সম্পূর্ণ মিথ্যা। অবশ্য, জগতের কারণ অনাদি, যেহেতু ঐসব পরমাণু তত্ত্বস্বরূপ অকর্তৃক। কিন্তু তন্মধ্যে নিয়মানুসারে নির্মিত অথবা বিকৃত হইবার সামর্থ্য মোটেই নাই। কেননা, পরমাণু দ্রব্য বিশেষ এবং স্বভাবতঃ পৃথক পৃথক্‌ ও জড় পদার্থ। সুতরাং উহারা নিজে নিজে যথাযোগ্যভাবে মিলিত হইয়া জগরূপে হইতে পারে না। অতএব জগতের কোন চেতন নির্মাতা অবশ্যই আছেন এবং সেই নির্মাতা জ্ঞানস্বরূপ।

দেখ! পৃথিবী এবং সূৰ্য্যাদি লোকসমূহকে নিয়মে রাখা অনন্ত, অনাদি চেতন পরমাত্মার কাৰ্য্য। স্থূল জগতের মধ্যে যে সংযোগ এবং রচনাবিশেষ দৃষ্ট হয়, তাহা কখনও অনাদি হইতে পারে না। যদি মনে কর যে, কাৰ্যজগৎ নিত্য, তাহা হইলে তাহার কোন কারণ থাকিবে না। কিন্তু যদি বল উহাই কার্যকারণরূপ হইবে, তাহা হইলে নিজের নিজের কার্যকারণ হওয়ায় অন্যোন্যাশয় এবং আত্মাশ্রয় দোষ ঘটিবে। কেহ নিজেই নিজের স্কন্ধে আরোহণ করিতে পারে না। নিজেই নিজের  পিতা পুত্র হইতে পারে না। সুতরাং জগতের কর্তা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে।

প্রশ্ন –যদি ঈশ্বরকে জগতের কৰ্ত্তা মনে করেন, তবে ঈশ্বরের কৰ্ত্তা কে?

উত্তর –কৰ্ত্তার কৰ্ত্তা এবং কারণের কারণ থাকিতে পারে না। কেননা প্রথম কৰ্ত্তা এবং কারণ। হইতেই কাৰ্য্য উৎপন্ন হয়, তাহাতে সংযোগ-বিয়োগ থাকে না। যাহা প্রথম সংযোগ-বিয়োগের কারণ, তাঁহার কোনও কৰ্ত্তা অথবা কারণ কোন প্রকারেই থাকিতে পারে না। ইহার বিশেষ ব্যাখ্যা ‘অষ্টম সমুল্লাস’ এর সৃষ্টি প্রকরণে প্রদত্ত হইয়াছে, সে স্থলে দেখিয়া লইবেন।

যখন জৈনদের স্থূলবিষয় সম্বন্ধেই যথার্থ জ্ঞান নাই, সে অবস্থায় তাহাদের পরমসূক্ষ্ম সৃষ্টিবিদ্যা সম্বন্ধে জ্ঞান কীরূপে থাকিতে পারে? অতএব “প্রকরণ রত্নাকর” প্রথম ভাগে যেরূপ লিখিত। হইয়াছে যে, জৈন মতে সৃষ্টি অনাদি, অনন্ত, দ্রব্য-পৰ্য্যায়ও অনাদি অনন্ত, প্রত্যেক গুণ ও প্রত্যেক দেশে বহু পৰ্য্যায়, প্রত্যেক বস্তুতেও অনন্ত পৰ্য্যায় বিদ্যমান, তাহাও অসম্ভব।

কারণ যাহার অন্ত অর্থাৎ সীমা আছে, তাহার সমস্ত সম্বন্ধও অন্তবিশিষ্ট হইয়া থাকে। যদি অনন্তকে অসংখ্য বলা হয়, তথাপি হইতে পারে না। তবে জীব সম্বন্ধে ইহা প্রযুক্ত হইতে পারে, কিন্তু পরমেশ্বর সম্বন্ধে নহে। কেননা, এক দ্রব্যে নিজের এক এক কাৰ্য-কারণ সামর্থ্যকে অবিভাগ পৰ্য্যায় দ্বারা অনন্ত সামর্থ্য মানা কেবল অবিদ্যার কথা।

যখন একটি পরমাণু দ্রব্যেরও সীমা আছে, তখন তাহাতে অনন্ত বিভাগরূপে পৰ্য্যায় কীরূপে থাকিতে পারে? সেইরূপ এক এক দ্রব্যে অনন্ত গুণ এবং গুণ প্রদেশস্থ অবিভাগরূপ অনন্ত। পৰ্য্যায়কেও অনন্ত মনে করা কেবল বালকোচিত কথা। যাহার অধিকরণের অন্ত আছে, তাহার অধিবাসীর অন্ত কেন থাকিবে না? এইরূপ অনেক লম্বা চওড়া মিথ্যা কথা লিখিত আছে।

জীব এবং অজীব এই দুই পদার্থ সম্বন্ধে জৈনসিদ্ধান্ত এইরূপ : —

“চেতনালক্ষণো জীবঃ স্যাদজীবস্তদন্যকঃ ॥ সৎকর্মপুদ্গলাঃ পুণ্যং পাপং তস্য বিপর্যয়ঃ ॥

ইহা “জিনদওসূরির” বচন এবং ইহাই প্রকারণরত্নকার’ প্রথম ভাগে নিয়নচক্ররে’ও লিখিত আছে যে চেতনা-লক্ষণবিশিষ্ট “জীব” এবং চেতনারহিত অজীব অর্থাৎ ‘জড়’। সৎকর্মরূপ পুদ্গল পুণ্য করায়, এবং পাপকর্মরূপ পুদ্গল পাপ করায়।

সমীক্ষক –জীব এবং জড়ের লক্ষণ তো যথার্থই, কিন্তু যে জড় রূপ পুদ্গল, সে কখনও পাপ-পুণ্য যুক্ত হইতে পারে না। কেননা পাপপুণ্য করা চেতনেরই স্বভাব। দেখ! যত জড় পদার্থ আছে, সেগুলি সবই পাপপুণ্য রহিত। জীবকে যদি অনাদি স্বীকার কর ইহা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু সেই অল্প ও অল্পজ্ঞ জীবকে মুক্তি অবস্থায় সর্বজ্ঞ স্বীকার করা মিথ্যা। কারণ, অল্প ও অল্পজ্ঞের সামর্থ্য ও সর্বদা সসীম রহিবে ॥

জৈনরা জগৎ, জীবের কর্ম এবং বন্ধ অনাদি স্বীকার করে। এ বিষয়েও জৈনতীর্থঙ্করগণ ভুল করিয়াছেন। কারণ, সংযুক্ত জগতের কাৰ্য্যকারণ, প্রবাহরূপ কাৰ্য্য, আর জীবের কর্ম এবং বন্ধনও অনাদি হইতে পারে না।

যদি অনাদি স্বীকার কর, তাহা হইলে কর্ম ও বন্ধ হইতে মুক্তি স্বীকার কর কেন? কেননা যাহা অনাদি পদার্থ, উহা কখনও মুক্ত হইতে পারে না। যদি স্বীকার কর যে, অনাদি পদার্থেরও নাশ আছে, তাহা হইলে তোমাদের সমস্ত অনাদি পদার্থেরই নাশ প্রসঙ্গ হইবে। আর যদি অনাদিকে নিত্য স্বীকার কর, তাহা হইলে কর্ম এবং বন্ধও নিত্য হইবে। আর যদি সর্ব কর্মনাশে মুক্তি স্বীকার কর তাহা হইলে সকল কর্মের খণ্ডন মুক্তির নিমিত্ত হইল। এমতাবস্থায় মুক্তি নৈমিত্তিক হইবে। সেরূপ মুক্তি সদা থাকিতে পারে না।

আবার কর্ম ও কৰ্ত্তার সম্বন্ধে নিত্য থাকায় কর্ম কদাপি নষ্ট হইবে না। অতএব তুমি যে তোমার এবং তীর্থঙ্করদের মুক্তি নিত্য স্বীকার কর উহা অসম্ভব হইবে।

প্রশ্ন –যেমন ধান্যের আবরণ মুক্ত করিলে অথবা ধান্যে অগ্নির সংস্পর্শ ঘটিলে উহার বীজ পুনরায় অঙ্কুরিত হয় না, সেইরূপ মুক্তিপ্রাপ্ত জীব পুনরায় জন্ম-মরণরূপ সংসারে ফিরিয়া আসে না।

উত্তর –জীবের সহিত কর্মের সম্বন্ধ তুষ ও বীজের সম্বন্ধের ন্যায় নহে। কিন্তু ইহাদের মধ্যে সমবায় সম্বন্ধ বিদ্যমান। অনাদিকাল হইতে জীবের সহিত কর্ম ও কর্তৃত্ব শক্তির সম্বন্ধ আছে। যদি জীবের মধ্যে কর্মশক্তিরও অভাব স্বীকার কর, তাহা হইলে সমস্ত জীব প্রস্তরবৎ হইয়া যাইবে। তাহাদের মুক্তিতে সুখভোগের সামর্থ্যও থাকিবে না।

যদি অনাদি কালের কর্মবন্ধন ছিন্ন হইলে জীব মুক্ত হয় স্বীকার কর, তাহা হইলে জীব তোমার নিত্য মুক্তি হইতেও বিচ্যুত হইয়া বন্ধনে আবদ্ধ হইবে। কেননা কর্মরূপ মুক্তির সাধন হইতেও মুক্ত হইলে জীব মুক্ত হয় স্বীকার কর, তবে নিত্য মুক্ত হইতেও বিচ্যুত হইয়া বন্ধনে আবদ্ধ হইবে। সাধন সমূহ দ্বারা সিদ্ধ পদার্থ কদাপি নিত্য হইতে পারে না।

যদি সাধন সিদ্ধ না হইলেও মুক্তিলাভ করা যায় স্বীকার কর, তাহা হইলে কর্ম না করিয়াও বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া পড়িবে। যেরূপ বস্ত্রে ময়লা লাগে এবং উহা ধুইলে ময়লা থাকে না, এবং পুনরায় তাহাতে ময়লা লাগে, সেইরূপ “মিথ্যাত্বাদি” হেতু এবং রাগ দ্বেষাদির আশ্রয় বশতঃ জীব কর্মফল প্রাপ্ত হয়। যদি সম্যজ্ঞান, দর্শন এবং চরিত্র দ্বারা জীব নির্মল হয় এবং ময়লা লাগিবার কারণ বশতঃ তাহাতে ময়লা লাগে স্বীকার কর, তাহা হইলে অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে যে, মুক্ত জীবও সাংসারিক হয় এবং সাংসারিক জীবও মুক্ত হয়। কারণ যেরূপ নিমিত্ত দ্বারা মলিনতা দূর হয়, সেইরূপ নিমিত্ত দ্বারা মালিন্যও স্পর্শ করিবে। অতএব স্বীকার কর যে, জীবের বন্ধ এবং মুক্তি প্রবাহরূপে অনাদি;কিন্তু অনাদি-অনন্ততা বশতঃ নহে।

প্রশ্ন –জীব নির্মল কখনও ছিল না, কিন্তু স্বভাবতঃ মলিন।

উত্তর –(জীব) যদি কখনও নির্মল ছিল না, তবে নির্মল কখনও হইতে পারিবে না। যেমন শুদ্ধ বস্ত্রে ময়লা লাগিলে, উহা ধৌত করার সঙ্গে ময়লা দূরীভূত হয়, কিন্তু বস্ত্রের স্বাভাবিক শ্বেতবর্ণ দূরীভূত হয় না; অথচ পুনরায় বস্ত্রে ময়লা লাগে, মুক্তিতেও সেইরূপ মলিনতা ঘটিবে।

প্রশ্ন –জীব প্রাক্তন কর্ম বশতঃ শরীর ধারণ করে সুতরাং ঈশ্বর মানা বৃথা।

উত্তর –যদি কেবল মাত্র কর্মই শরীর ধারণের কারণ হয়, ঈশ্বর কারণ না হন, তাহা হইলে সে জীব কখনও এরদপ হীন জন্ম ধারণ করিবে না যাহাতে তাহাকে অত্যন্ত দুঃখভোগ করিতে হয়। কিন্তু সর্বদা উত্তম উত্তম জন্মই গ্রহণ করিবে। যদি বল যে, কর্মের বাধা আছে; তথাপি স্বীকার করিতে হইবে যে, চোর যেরূপ নিজে নিজে কারাগারে যায় না, কিংবা নিজে ফাঁসীকাঠে ঝুলে না, কিন্তু রাজা তাহাকে দণ্ড দেন; সেইরূপ পরমেশ্বরের প্রেরণায় জীব শরীর ধারণ করে এবং তিনি কর্মানুসারে জীবকে ফলদান করেন এইরূপ স্বীকার কর।

প্রশ্ন –মদের নেশার ন্যায় কর্ম (ফল) নিজে নিজেই পাইয়া থাকে; ফলদানের জন্য অপরের প্রয়োজন হয় না।

উত্তর — তাহা হইলে, যেরূপ পাকা মদ্যপায়ীর উপর মাদকতার প্রভাব অল্প এবং অনভ্যস্তর উপর অধিক হয়, সেইরূপ যাহারা সর্বদা অধিক পাপপুণ্য কর্ম করে, তাহারা অল্প অল্প এবং যাহারা কখনও সখনও অল্প অল্প পাপপুণ্য করে তাহাদের অধিক ফল পাওয়া উচিত। আর ছোট। কর্মকর্তার অধিক ফল পাওয়া উচিত।

প্রশ্ন –যাহার যেমন স্বভাব, সে সেইরূপ ফললাভ করে।

উত্তর –যদি স্বভাব বশতঃই ফললাভ হয়, তাহা হইলে উহার নাশ অথবা ফললাভ হইবে । অবশ্য, যেমন নির্মল বস্ত্রে নিমিত্ত বশত: ময়লা সংযুক্ত হয়, আবার ময়লা ছাড়াইবার কারণ বশতঃ ময়লা দূরীভূতও হইয়া যায়, সেইরূপ মানাই যুক্তিসঙ্গত ॥

প্রশ্ন –সংযোগ ব্যতীত কর্ম পরিণাম প্রাপ্ত হয় না। যেমন দুগ্ধ এবং অম্লের সংযোগব্যতীত দধি প্রাপ্ত হয় না, সেইরূপ জীব এবং কর্মের সংযোগ ব্যতীত কর্ম পরিণাম প্রাপ্ত হয় না।

উত্তর –যেমন কোন তৃতীয় পক্ষ দুগ্ধ এবং অম্লের সংযোগ ঘটায়, সেইরূপ জীবের সহিত তাহার কর্মফলের সংযোগ ঘটাইবার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়। কারণ জড়পদার্থ স্বয়ং নিয়মানুসারে সংযুক্ত হয় না। এবং জীবও অল্পজ্ঞ বলিয়া স্বয়ং স্বকৃত কর্মফল প্রাপ্ত হইতে পারে না। ইহা দ্বারাই সিদ্ধ হয় যে, ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত সৃষ্টিক্রম ব্যতীত কর্মফলের ব্যবস্থা হইতে পারে না।

প্রশ্ন –যিনি কর্ম হইতে মুক্ত হন, তাহাকেই ঈশ্বর বলে।

উত্তর –অনাদি কাল হইতে জীবের সহিত কর্ম লাগিয়া রহিয়াছে। সুতরাং জীব কখনও কর্ম হইতে মুক্ত হইতে পারিবে না।

প্রশ্ন –কর্মের বন্ধন সাদি।

উত্তর –সাদি হইলে কর্মের যোগ অনাদি নহে। আর সংযোগ আদি হইলে জীব নিষ্কর্মা হইবে। নিষ্ক্রিয়ের কর্মসংযোগ হইলে মুক্তেরও কর্মসংযোগ হইবে। কর্ম ও কর্তার যে সমবায় অর্থাৎ নিত্য সম্বন্ধ, তাহা কখনও ছিন্ন হয় না। অতএব নবম সমুল্লাসে যে রূপ লিখিত হইয়াছে, সেইরূপ স্বীকার করাই সঙ্গত।

জীব নিজের জ্ঞান ও সামর্থ্য যতই বৃদ্ধি করুক না কেন, তাহার জ্ঞান এবং সামর্থ্য পরিমিত ও সসীমই থাকিবে। জীব কখনও ঈশ্বরের সমকক্ষ হইতে পারিবে না। অবশ্য জীব যোগাভ্যাস দ্বারা যতদূর সম্ভব সামর্থ্য বৃদ্ধি করিতে পারে।

জৈন আহতগণ যে দেহের পরিমাণ অনুসারে জীবেরও পরিমাণ স্বীকার করেন। তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করা আবশ্যক যে, যদি তাহাই হয় তবে হস্তীর জীব কীটের মধ্যে এবং কীটের জীব হস্তীর মধ্যে কীরূপে প্রবিষ্ট হইবে? ইহাও একপ্রকার মূর্খতা। কারণ, জীব এক সূক্ষ্ম পদার্থ, সে একটি পরমাণুতেও থাকিতে পারে। পরন্তু জীবের শক্তি শরীরস্থ প্রাণ, বিদ্যুৎ এবং নাড়ী প্রভৃতির সহিত সংযুক্ত থাকা সম্ভব। তদ্দারা জীব সমস্ত শরীরের অবস্থা অবগত হয়। জীব সৎসংসর্গ বশতঃ উত্তম এবং অসৎসংসর্গ বশতঃ অধম হইয়া যায়।

৮৩। ধর্মসমন্ধে জৈনদের ধারণা এইরূপ :–

মূল –রে জীব ভব দুহাইং ইক্কং চিয় হরই জিনময়ং ধম্মং। ইয়রাণং পণমংতো সুহকয়্যে মূঢ় মুসিওসি ॥ প্রকরণত্নাকর, ভাগ ২। ষষ্ঠীশতক ৬১। সূত্রাঙ্ক ৩ ॥

সংক্ষিপ্ত অর্থ –“ওরে জীব। এই একমাত্র জিনমত শ্ৰীবীতরাগভাষিত ধর্ম সংসার সম্বন্ধীয় জন্ম-জরা-মরণাদি দুঃখ হরণ কর্তা। এইরূপে জৈনমতাবলম্বীদিগকে সুদেব এবং সুগুরু জানিবে। অপর যে সকল জীব তাহাদের আপন কল্যাণার্থে বীতরাগ ঋষভদেব হইতে মহাবীর পর্যন্ত দেবগণ ব্যতীত পৃথক অন্য হরি, হর এবং ব্রহ্মাদি কুদেবগণের পূজা করে, তাহারা প্রতারিত হইয়াছে।”

ইহার ভাবার্থ এই যে, জৈনমতের সুদেব, সুগুরু ও সুধর্ম পরিত্যাগ করিয়া অন্য কুগুরু, কুদেব এবং কুকর্মের সেবা করিলে তাহাদের কোন রূপ কল্যাণ হয় না।

সমীক্ষক –এখন সুধীগণ বিচার করুন যে, জৈন ধর্মগ্রন্থ কীরূপ নিন্দনীয়।

মূল –অরিহং দেবো সুগুরু সুদ্ধং চ পঞ্চ নবকারো। ধন্নাণং কয়চ্ছাণং নিরন্তরং বসই হিয়য়ম্মি ॥০ প্রকা ভা০ ২। ষষ্ঠী০৬১সূ০১ ॥

সংক্ষিপ্ত অর্থ –যিনি অরিহন, দেবেন্দ্রকৃত পূজাদির যোগ্য, তদ্ভিন্ন কোনও উত্তম পদার্থ নাই, এইরূপ যিনি দেবাদিদেব শোভায়মান ‘অরিহন্ত’ দেব এবং যিনি জ্ঞানবান, ক্রিয়াবা, শাস্ত্রোপদেষ্টা, শুদ্ধ, কষায় মল রহিত, সেই শ্রীজিনভাষিত ‘সম্যত্ব’বিনয় এবং দয়ামূলক ধর্মই দুর্গত প্রাণীদিগকে উদ্ধার করে। আর অন্য হরিহরাদির ধর্ম জীবদিগকে সংসার হইতে উদ্ধার করিতে পারে না। সেই সর্বোত্তম ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট পঞ্চ অরিহন্তদেবকে নমস্কার। এই চারি পদার্থ ধন্য অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ, দয়া, ক্ষমা, সম্যক্তৃ, জ্ঞান, দর্শন এবং চারিত্র, –ইহাই জৈনধর্ম।

সমীক্ষক — যেখানে মনুষ্যমাত্রের প্রতি দয়া নাই, সেখানে দয়া এবং ক্ষমা কিছুই নাই। যেখানে জ্ঞানের পরিবর্তে অজ্ঞান, দর্শনের পরিবর্তে অন্ধকার এবং ‘চারিত্রের পরিবর্তে অনাহারে মরণ। কোনটা ভাল কথা? জৈনমতের নিম্ন লিখিতরূপ প্রশংসা করা হইয়াছে?

মূল –জইন কুণসি তব চরণং ন পঢ়সিন গুণোসি দেসি নো দাণম্। তা ইত্তিয়ং ন সক্কিসি, জং দেবো ইক্ক অরিহস্তো ৷ ০ ভা০ ২। ষষ্ঠী০৬০ সু০২ ॥

হে মনুষ্য। তোমার যদি তপশ্চৰ্য্যা এবং চারিত্র না থাকে, যদি তুমি সূত্র অধ্যয়ন প্রকরণাদি বিচার এবং সুপাত্রে দান করিতে অসমর্থ হও, তথাপি আমাদের একমাত্র আরাধ্য ‘অরিহন্ত’ দেব এবং সুগুরু সুধর্ম জৈনমতের প্রতি শ্রদ্ধাবান্ হওয়া সর্বোত্তম কথা ও উদ্ধারের কারণ।

সমীক্ষক –যদ্যপি দয়া ও ক্ষমা উত্তম বস্তু তথাপি পক্ষপাত দুষ্ট হইলে দয়া অ-দয়া এবং ক্ষমা অ-ক্ষমা হইয়া যায়। এইরূপ বলিবার তাৎপর্য এই যে, কোন জীবকে দুঃখ না দেওয়া সকল সময়ে সম্ভবপর হইতে পারেনা। কেননা দুষ্টকে দণ্ডদান করাও দয়ার মধ্যে গণ্য। কারণ, এক দুষ্টকে দণ্ড দেওয়া না হইলে সহস্র লোক দুঃখ ভোগ করে। সুতরাং সেই দয়া অ-দয়া এবং ক্ষমা অ-ক্ষমা হয়।

তবে ইহা সত্য যে সকল প্রাণীর দুঃখনাশ এবং সুখ প্রাপ্তির উপায় করাকে দয়া বলে। কেবল জল ছাঁকিয়া পান করা এবং ক্ষুদ্র প্রাণীদিগকে বাঁচানই দয়া নহে। কিন্তু জৈনদের এই দয়া কেবল কথার কথা মাত্র। কেননা, তাহারা সেরূপ আচরণ করেন না। মনুষ্য যে কোন মতাবলম্বী হউক না কেন, তাহার প্রতি দয়া করা, অন্ন পানীয় প্রভৃতি দ্বারা তাহার সেবা-যত্ন করা এবং ভিন্ন মতাবলম্বী বিদ্বাদিগেরও সম্মান ও সেবা কি দয়া নহে?

যদি জৈনদিগের সত্যই দয়া থাকিত, তাহা হইলে বিবেকসারের ২২১ পৃষ্ঠায় কী লিখিত হইয়াছে দেখ: —

প্রথমতঃ — জৈনগণ কোন ভিন্ন মতাবলম্বীর স্তুতি অর্থাৎ গুণকীর্তন কখনও করিবে না।

দ্বিতীয়তঃ — তাহাকে নমস্কার অর্থাৎ বন্দনা করিবে না।

তৃতীয়তঃ –“আলপন’ অর্থাৎ অন্যান্য মতাবলম্বীদের সহিত অল্প বলা।

চতুর্থতঃ –‘সংলপন’ অর্থাৎ তাহাদের সহিত বারংবার কথা না বলা।

পঞ্চমতঃ — তাহাদের সকলকে ‘অন্নবস্ত্রাদি দান’ অর্থাৎ ইহাদের কাহাকেও খাদ্য ও পানীয় প্রভৃতি না দেওয়া।

ষষ্ঠতঃ –‘গন্ধপুষ্পদি দান’ অর্থাৎ অন্য মতাবলম্বী পূজিত প্রতিমা পূজার জন্য পুষ্পগন্ধাদি না দেওয়া। এই ছয় ‘যতনা’ অর্থাৎ এই ছয় প্রকার কর্ম জৈনগণ কদাপি করিবে না।

সমীক্ষক –এখন সুধীগণের বিচার বিবেচনা করা উচিত যে, এই সমস্ত জৈনগণের মধ্যে ভিন্ন মতাবলম্বী তাহাদের প্রতি ইহাদের কত অদয়া, কুদৃষ্টি এবং বিদ্বেষ রহিয়াছে। যখন অন্য মতাবলম্বীদের প্রতি এত অদয়া তখন বলা যাইতে পারে যে, জৈনগণ দয়াহীন। পরিবারের সেবা করার মধ্যে ধর্ম কিছুই নাই। জৈন মতাবলম্বীগণ এক পরিবার সদৃশ। জৈনগণ এই জন্যই তাহাদের সেবা করেন, অন্য মতাবলম্বীদের সেবা করেন না। অতএব কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাঁহাদিগকে দয়ালু বলিতে পারেন কি?

‘বিবেকসার’ পৃষ্ঠা ১০৮-এ লিখিত আছে যে, –মথুরার রাজার নমুচী নামক দেওয়ানকে জৈন যতিগণ বিরোধী মনে করিয়া হত্যা করে এবং পরে আলোয়ণা (প্রায়শ্চিত্ত) করিয়া শুদ্ধ হন। ইহা কি দয়া ও ক্ষমানাশক কর্ম নহে? যখন জৈনগণ ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি এতদূর বৈরবুদ্ধি পোষণ করেন যে, হত্যা পৰ্য্যন্তও করিতে পারেন, এমতাবস্থায় তাহাদিগকে দয়ালুর পরিবর্তে হিংসক বলাই সার্থক।

“আহত প্রবচন সংগ্রহ পরমাগমনসার” গ্রন্থে সম্যকত্ব দর্শনাদির লক্ষণ বর্ণিত হইয়াছে। সম্যক্‌ শ্রদ্ধা, সম্যক্ দর্শন’, ‘জ্ঞান’ এবং চারিত্র’ –এই চারিটি মোক্ষ মার্গের সাধন। যোগদেব এসকল বিষয়ের ব্যাখ্যা করিয়াছেন। যে রূপে জীবাদি দ্রব্য অবস্থিত সেই জিন প্রতিপাদিত গ্রন্থানুসারে বিপরীত অভিনিবেশ ইত্যাদি রহিত জীব এবং অন্যান্য পদার্থ সম্বন্ধে যে শিক্ষা প্রদত্ত হইয়াছে, জিন মতে প্রীতি হওয়াকেই “সম্যক্ শ্ৰদ্ধান” এবং “সম্যক্ দর্শন” বলে। “রুচির্জিনোক্ততত্ত্বে সম্যক্ শ্ৰদ্ধানমুচ্যতে” সর্ব দর্শন সংগ্রহ।

জিন কর্তৃক তত্ত্বসমূহের প্রতি সম্যক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত, অর্থাৎ অন্য কোন তত্ত্বের প্রতি নহে।

অথাবস্থিততত্ত্বানাং সংক্ষেপাদ্বিস্তরেণ বা। মোববোধস্তমত্ৰাহুঃ সম্যগ জ্ঞানং মনীষিণঃ। সর্বদর্শন সংগ্রহ।

জীবাদির তত্ত্ব সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত অথবা বিস্তৃত বোধকে ‘সম্যক্ জ্ঞান’ বলে।

সর্বথামবদ্যমোগানাংত্যাগশ্চারিত্রমুচ্যতে ॥ কীৰ্ত্তিতং তদহিংসাদিব্ৰত ভেদেন পঞ্চধা ॥ অহিংসাসুনৃতাস্তেয়ব্রহ্মচর্চা পরিগ্রহাঃ। (সর্বদর্শন সংগ্রহ)

ভিন্ন মতাবলম্বীদের সহিত সম্বন্ধ সর্বপ্রকারে নিন্দনীয়। তাহা পরিত্যাগ করাকে ‘চারিত্র’ বলে। অহিংসাদি ভেদে “ব্রত পাঁচ প্রকার”।

প্রথমতঃ –‘অহিংসা কোন প্রাণীকে বধ না করা।

দ্বিতীয়তঃ– সুনৃত’ প্রিয় বাক্য বলা।

তৃতীয়তঃ –‘অস্তেয়’ চুরি না করা।

চতুর্থতঃ –‘ব্রহ্মচর্য্য উপস্থ ইন্দ্রিয়ের সংযমন।

পঞ্চমতঃ –‘অপরিগ্রহ সকল বস্তু পরিত্যাগ করা।

সমীক্ষক –এসকল বিষয়ের মধ্যে অনেকগুলিই ভাল; অর্থাৎ অহিংসা এবং চৌর্য্য প্রভৃতি নিন্দনীয় কর্ম পরিত্যাগ করা শ্রেয়। কিন্তু ভিন্নমতের নিন্দা করা প্রভৃতি দোষে উত্তম বিষয়গুলিও দোষযুক্ত হইয়াছে। উদাহরণস্বরূপ প্রথম সূত্রে লিখিত আছে– “অন্য হরিহর প্রভৃতির ধর্ম সংসার হইতে উদ্ধার করিতে পারে না!”

যাঁহাদের গ্রন্থ পাঠ করিলে পূর্ণবিদ্যা এবং ধর্মের সন্ধান পাওয়া যায়, তাহাদিগকে হেয় প্রতিপন্ন করিতে যাওয়া কি সামান্য নিন্দার কথা! যাঁহারা উল্লেখিত একান্ত অসম্ভব কথাগুলির বক্তা, সেই নিজের তীর্থঙ্করদের কীৰ্ত্তন করা কেবল হঠকারিতা মাত্র।

ভাল, যে জৈনের “চারিত্র”, “অধ্যয়ন” এবং “দান করিবার সামর্থ্য নাই, তিনি কেবল জৈনমতকে সত্য বলিলেই ভাল, আর অন্য শ্রেষ্ঠ হইলেও হেয় হইবেন কি? যাঁহারা এইরূপ বলেন, তাহাদিগকে ভ্রান্ত এবং বালকবুদ্ধি না বলিয়া কী বলা যাইবে?

এতদ্বারা ইহাই জানা যাইতেছে যে, হঁহাদের আচাৰ্য্যগণ স্বার্থপর ছিলেন। তাঁহারা সকল মতের নিন্দা না করিলে, তাহাদের এরূপ মিথ্যা মতে কেহই বিজড়িত হইত না এবং তাহাদের প্রয়োজনও সিদ্ধ হইত না। দেখ! ইহা সিদ্ধ হইতেছে যে, জৈনদের মত নিমজ্জনকারী। কিন্তু বেদ মত সকলকে উদ্ধার করে। যদি অপর লোকেরা বলে যে, হরিহর প্রভৃতি দেব সুদেব এবং ইহাদের ঋষভদেব প্রভৃতি কুদেব; তাহা হইলে জৈনদের পক্ষে উহা কি অপ্রীতিকর হইবে না?

জৈনমতের আচাৰ্য্য এবং বিশ্বাসীদের আরও ভুল দেখুন।

মূল –জিণবর আণা ভংগং, উমগ্ন উসুত্ত লেস দেসণউ। আণা ভংগে পাবন্তা জিণময় দুরং ধম্ম৷ প্রকর০ ভাগ০২। ষষ্ঠী০ ৬১। সু০ ১১।

(অর্থ) উন্মার্গ এবং উৎসূত্রের বচন দেখাইলে যদি জিনবর অর্থাৎ বীতরাগ তীর্থঙ্করদের আজ্ঞাভঙ্গ হয়, উহা দুঃখের কারণস্বরূপ তথা পাপজনক। তাহা হইলে জিনেশ্বর কর্তৃক উপদিষ্ট সম্যকত্ব প্রভৃতি ধর্ম গ্রহণ করা অত্যন্ত কঠিন। অতএব যাহাতে জিন আজ্ঞাভঙ্গ না হয়, তাহাই করা কর্তব্য ॥১১ ॥

সমীক্ষক –নিজ মুখে নিজের প্রশংসা করা, নিজের ধর্মকেই শ্রেষ্ঠ বলা এবং পরধর্মের নিন্দা করা মূর্খতা। জ্ঞানীগণ যাঁহার প্রশংসা করেন তাহার প্রশংসাই যথার্থ। চোরও তো নিজমুখে নিজের প্রশংসা করিয়া থাকে, তাই বলিয়া কি সে প্রশংসনীয় হইতে পারে? জৈনগণ এইরূপ বলিয়া থাকেন–

মূল বহু গুণবিজঝা নিলও, উসুত্তভাসী তহবিমুত্তব্বো। জহ বরমণিজু ত্তো বিহু বিঘ করো বিসহরো লো৷ প্রকর ভা০ ২। ষষ্ঠী সূ০ ১৮ ॥

(সং অর্থ) বিষধর সর্পের মণি যেমন পরিত্যাজ্য, সেইরূপ যিনি জৈনমতাবলম্বী নহেন, তিনি বড় ধার্মিক পণ্ডিতই হউন না কেন, জৈনদের তাহাকে বর্জন করা উচিত ১৮।

সমীক্ষক –দেখুন! ইহাদের কত বড় ভুল? যদি জৈনাচাৰ্য্যগণ এবং তাহাদের শিষ্যগণ বিদ্বান্ হইতেন, তাহা হইলে তাহারা বিদ্বানব্যক্তিদের প্রতি প্রীতিশীল হইতেন। যাঁহাদের তীর্থঙ্করগণ। পৰ্য্যন্ত বিদ্যাহীন, তাঁহারা বিদ্বাদিগের সম্মান করিবেন কেন? মল কিংবা ধূলার মধ্যে স্বর্ণ পতিত হইলে কেহ কি উহা পরিত্যাগ করে? এতদ্বারা ইহাই সিদ্ধ হয় যে জৈন ব্যতীত এমন পক্ষপাতী, হঠকারী, দুরাগ্রাহী এবং বিদ্যাহীন আর কে বা হইবে?

মূল –অইসয় পাবিয় পাবা, ধম্মিঅ পব্বেসু তোবি পাব রয়া। ন চলন্তি সুদ্ধধম্মা, ধন্না কিবিপাব পবেসু৷ প্রকর০ ভা০২। ষষ্ঠী সূ০ ২৯ ॥

(সং অর্থ) অন্যদশনী কুলিঙ্গী অর্থাৎ যাহারা জৈনমতের বিরোধী, জৈনগণ তাহাদের প্রতি দৃষ্টিপাতও করিবেন না ॥২৯ ॥

সমীক্ষক –ইহা কতদূর অজ্ঞতা সুধীগণ বিবেচনা করিবেন। ইহা যথার্থ যে, যাঁহার মত সত্য, তিনি কাহাকেও ভয় করেন না। জৈনাচাৰ্য্যগণ জানিতেন যে, তাঁহাদের মত অসার, শ্রবণ করাইলে তো উহা খণ্ডন হইয়া যাইবে, অতএব সকলের নিন্দা কর এবং মুখদিগকে জালে জড়াও।

মূল –নামংপি ত অসুহং জেণ নিদি ঠাই মিচ্ছ পাই। জেসি অণুসংগাউ ধম্মীণবি হোই পাব মই ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী ৬০। সু ২৭।

(সং অর্থ) যে সমস্ত ধর্ম জৈনধর্মের বিরুদ্ধে আছে, সেগুলি সবই পাপ কর্মে প্রবৃত্ত করে। অতএব কাহারও ধর্ম না মানিয়া জৈন ধর্মকে মানাই শ্রেষ্ঠ। ২৭

সমীক্ষক –এতদ্বারা জানা যাইতেছে যে, জৈনমার্গ সকলের সহিত বৈর, বিরোধ, নিন্দা এবং ঈৰ্য্যা প্রভৃতি দুষ্ট কর্মরূপ সমুদ্রে নিমজ্জনকারী।

জৈনদিগের ন্যায় অপর কোন মতাবলম্বী মহা-নিন্দুক এবং অধার্মিক নহে। এক দিক হইতে সকলের নিন্দা এবং অত্যধিক আত্মপ্রশংসা করা কি শঠের কাৰ্য্য নহে? যিনি যে মতাবলম্বীই হউন না কেন, বিচারশীল লোকেরা তাহাদের অপেক্ষা যাঁহারা ভাল তাহাদিগকে ভাল এবং মন্দকে মন্দ বলিয়া থাকেন।

মূল –হাহা গুরু অ অকঝং সামী নহু অচ্ছি কত্স পুকরিমো। কহো জিণ বয়ণং কহ সুগুরু, সাবয়া কহইয় অকঝং ॥ প্ৰ০ ভা০ ২। ষষ্ঠীসূ০ ৩৫ ॥

(সং অর্থ) কোথায় সর্বভাসিত জিনবচন, জৈনদের সুগুরু আর জৈনধর্ম? আর কোথায় তদ্বিপরীত কুগুরু ভিন্ন মতের উপদেষ্টা? অর্থাৎ আমাদের সুগুরু, সুদেব ও সুধর্ম এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের কুদেব, কুগুরু, কুকর্ম। ৩৫।

সমীক্ষক — বদরী বিক্রয়কারিণী কুঞ্জড়ী যেরূপ ইহাও সেরূপ। তাহারা যেরূপ নিজেদের টক কুলকে মিষ্ট এবং অন্যের মিষ্ট কুলকে টক্ ও খারাপ বলিয়া থাকে জৈনদের কথাও সেইরূপ ॥ ইহারা অন্য মতাবলম্বীদের সেবা করা নিত্যন্ত পাপজনক অকাৰ্য্য বলিয়া গণ্য করে ॥

মূল –সপ্পো ইক্কং মরণং, কুগুরু আণংতাই দেই মরণাই। তো বরিসল্পং গহিয়ুং, মা কুণ্ডরুসেবণং ভদ্দম্ ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী। সু০ ৩৭ ॥

যেরূপ প্রথমে লিখিত হইয়াছে যে, সৰ্পে মণি থাকিলেও উহাকে ত্যাগ করা উচিত, সেইরূপ ভিন্নমতাবলম্বীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধার্মিক পুরুষদের পরিত্যাগ করিবে। ইহা অপেক্ষাও বিশেষ নিন্দা অন্য মতাবলম্বীদের করিয়া থাকে। জৈনের সকলেই কুগুরু অর্থাৎ সর্প অপেক্ষাও মন্দ। তাহাদের দর্শন, সেবা ও সংসর্গ কখনও করা উচিত নহে। কেননা, সর্পসংসর্গে একবার মরণ হয়, আর অন্য মতাবলম্বী কুগুরুদের সংঘর্ষে অনেকবার জন্ম-মরণে পড়িতে হয়। অতএব হে ভদ্র। ভিন্নমতাবলম্বী কুগুরুদের নিকটও দাঁড়াইও না। কেননা তুমি যদি অন্য মতাবলম্বীদের সেবা কর তাহা হইলে দুঃখে পড়িবে।৩৭।

সমীক্ষক –দেখুন! অপর কোন মতাবলম্বী, জৈনদের ন্যায় কঠোর, ভ্রান্ত, দ্বেষযুক্ত ও নিন্দুক আত্মভোলা নহে। তাহারা মনে করিয়াছে যদি তাহারা পরনিন্দা এবং আত্মপ্রশংসা না করে, তাহা হইলে তাহাদের সেবা ও প্রতিষ্ঠা হইবে না, কিন্তু ইহা তাহাদের পক্ষে দুভার্গ্যজনক কেননা, যতদিন তাঁহারা উত্তম ব্যক্তিদের সেবা না করিবেন এবং তাঁহাদের সংসর্গে না আসিবেন, ততদিন পৰ্য্যন্ত তাঁহারা যথার্থ জ্ঞান ও সত্য ধর্ম লাভ করিতে পারিবেন না। অতএব জৈনীদের উচিত তাহাদের বিরুদ্ধ মত পরিত্যাগ করিয়া বেদোক্ত সত্য উপদেশ গ্রহণ করুন। তাহা হইলে তাহাদের পক্ষে মহান কল্যাণ হইবে।

মূল –কিং ভণিমো কিংকরিমো, তাণহয়াসাণ ধিদুঠাণং। জে দংসিউণ লিংগং খিংতি ন রয়ম্মি মুদ্ধজণং ॥ প্রক০ ০ ২। ষষ্ঠী সূ০ ৪০

(সং অর্থ) –যাহার কল্যাণের আশা নষ্ট হইয়া গিয়াছে, সেই দূরাগ্রাহী, কুকর্ম করিতে অতি চতুর, দুগুণ দুষ্ট দোষ যুক্ত ব্যক্তির সম্বন্ধে কী বলা যাইবে? আর কী করা যাইবে? কেননা, কেহ যদি তাহার উপকার করে, তৎপরিবর্তে সে তাহার সর্বনাশ করিবে? যেরূপ কেহ যদি সিংহের চক্ষুর বন্ধন খুলিতে যায় তাহা হইলে সিংহ তাহাকেই ভক্ষণ করিবে, সেইরূপ কুগুরু অর্থাৎ ভিন্ন মতাবলম্বীদের উপকার করিতে গেলে নিজেরই বিনাশ ডাকিয়া আনিবে। অতএব সর্বদা তাহাদের নিকট হইতে পৃথক্ থাকিবে।৪০ ॥

সমীক্ষক — যেরূপ জৈনীরা চিন্তা করে, সেইরূপ অপর মতাবলম্বীরা ভিন্ন পক্ষীয়গণ জৈনদের ন্যায় চিন্তা করিলে জৈনীদের কতদূর দুর্দশা হইবে? যদি কেহই তাহাদের উপকার না করে, তাহা হইলে তাহাদের অনেক কর্ম নষ্ট হইয়া কত না দুঃখ হইবে। সেইরূপ জৈনীরা অপর সকলের সম্বন্ধেও চিন্তা করেন না কেন?

মূল –জহ জহ তুট্টই ধম্মো, জহ জহ দুঠাণ হোই অই উদউ। সমিদ্দিঠি জিয়াণাং, তহ তহ উল্লসই সমত্তং ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী০ সূ০ ৪২ ॥

(সং অর্থ) –ইহা আশ্চর্যের বিষয় যে, যেরূপ দর্শনভ্রষ্ট, নিহ্নব, পাসচ্ছা, উসন্না ও কুসীলিয়াদি এবং অন্যদর্শনী, ত্রিদন্ডী, পরিব্রাজক তথা বিদিক দুষ্ট লোকদের অতিশয় বল, সম্মান ও আদর হইবে সেইরূপে সম্যকদৃষ্টি জীবদের সম্যত্ব বিশেষ প্রকাশিত হইবে ৷৪২ ॥

সমীক্ষক –এখন দেখুন! এই সব জৈন অপেক্ষা অধিক ঈর্ষা, দ্বেষ এবং বৈরবুদ্ধিযুক্ত অপর কেহ কি আছে? অন্যান্য মতের মধ্যেও অবশ্য ঈর্ষা-দ্বেষ আছে কিন্তু জৈনমতের ন্যায় অন্য কোন মতে নাই। দ্বেষই পাপের মূল, সুতরাং জৈনদের মধ্যে পাপাঁচরণ থাকিবে না কেন?

মূল–সংগোবি জাণ অহিউং তেসিং ধৰ্মাই জে পকুব্বন্তি। মুত্তণ চোরসংগং করন্তি তে চোরিয়ং পাবা ৷ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী০ সূ০ ৭৫ ॥

(সং অর্থ) –ইহার মুখ্য প্রয়োজন এতটুকু মাত্র যে, যেরূপ মূঢ়জন নাসিকাচ্ছেদাদি দন্ড ভয় না করিয়া চোরের সহিত সংসর্গ করে, সেরূপ যাহারা জৈন মত হইতে পৃথক্ চৌর্য্য বৃত্তিতে স্থিত তাহারা স্বীয় অকল্যাণের ভয়ে ভীত হয় না। ৭৫ ॥

সমীক্ষক — যে যেমন মানুষ সে প্রায়শঃ অপরকেও নিজের মত মনে করে। কেবলমাত্র জৈনমতেই সাধু সজ্জনের মত, অন্য সমস্ত মতই চোরের মত; একথা কি সত্য হইতে পারে? মনুষ্যের মধ্যে যতদিন অতি অজ্ঞান এবং কুসংঙ্গ বশতঃ ভ্রান্ত বুদ্ধি থাকে ততদিন সে ঈর্ষা, দ্বেষ আদি দুষ্টতা পরিত্যাগ করে না। জৈনতাবলম্বীরা যেরূপ ভিন্ন মতের প্রতি বিদ্বেষাভাবাপন্ন, সেরূপ। অন্য কেহ নহে।

মূল –জচ্ছ পসুমহিসলরকা, পৰ্ব্বং হোমন্তি পাব নবমী এ। পুঅন্তি তংপি সঢ়ঢ়া,হা হীলা বীয়রায়৷ ॥  প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী০ সূ০ ৭৬।

(সং অর্থ) –পূর্বে যে, ‘মিথ্যাত্বী’অর্থাৎ জৈন মার্গ ভিন্ন সকলে মিথ্যাবাদী সে নিজে’সম্যকত্বী’ অর্থাৎ অপর সকলে পাপী আর জৈনীরা সকলে পুণ্যাত্মা (এইরূপ বলা হইয়াছে) একারণ যে কেহ মিথ্যাত্বী ধর্মের স্থাপন করিবে সে পাপী। ॥ ৬ ॥

সমীক্ষক –যদি অন্যত্র চামুণ্ডা, কালিকা, জ্বালা প্রমুখের আগে “পাপ নৌমী” অর্থাৎ দুর্গানবমী তিথি ইত্যাদি পাপজনক হয়, তাহা হইলে কি তোমাদের অত্যন্ত কষ্টকর পজুসণ প্রভৃতি ব্রত পাপজনক নহে? এস্থলে বামমার্গীদের লীলার খণ্ডন যুক্তিসঙ্গত কিন্তু জৈনগণ যে শাসনদেবী এবং মরুতদেবী প্রভৃতিকে মানেন, তাহাদের পূজার খণ্ডন করিলেও ভাল হইত।

যদি বল যে, আমাদের দেবী হিংসক নহেন, তাহা হইলে ইহাদের কথা মিথ্যা বলা হইবে। কেননা শাসনদেবী একজন পুরুষের এবং দ্বিতীয় ছাগলের চক্ষু উৎপাটন করিয়াছিলেন। তাহা হইলে সে রাক্ষসী এবং দুর্গা কালিকার সহোদরা ভগ্নী নহে কেন? সেইরূপ নিজেদের ‘পচ্চখাণ’ প্রভৃতি ব্রতকে উৎকৃষ্ট আর ‘নবমী’ প্রভৃতিকে দুষ্ট বলা মূঢ়তা। কেননা নিজেদের উপবাসের প্রশংসা এবং আর সকলের উপবাসের নিন্দা করা মুখের কাজ। অবশ্য যে সত্যভাষণাদি ব্রত ধারণ। করে উহাতো সকলের পক্ষেই উত্তম। জৈন কিংবা অপর কাহারও উপবাস করা সত্য নহে।

মূল– বেসাণ বংদিয়াণয়, মাহণ ডুংবাণ জরকসিরকাণং। ভত্তা ভরকটুঠাণং, রিয়াণং জন্তি দূরেণং ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী। সূ০ ৮২

(সং অর্থ) –ইহার মুখ্য প্রয়োজন এই যে, যাহারা বেশ্যা, চারণ, ভাট প্রভৃতি এবং ব্রাহ্মণ, যক্ষ, গণেশ প্রভৃতি মিথ্যাদৃষ্টি দেব-দেবীর ভক্ত; যাহারা ইহাদের মানে তাহারা সকলে স্বয়ং দুঃখে ডুবিয়া মরে এবং অপরকেও ডুবাইয়া মারে। কারণ তাহারা ঐ সকল দেব-দেবীর নিকট সমস্ত বস্তু যাচনা করে এবং বীতরাগ পুরুষদের নিকট হইতে দূর থাকে। ॥ ৮২ ॥

সমীক্ষক –অন্য মার্গীদের দেব-দেবীকে মিথ্যা এবং নিজেদের দেবদেবীকে সত্য বলা কেবল পক্ষপাত মাত্র। আর অন্য বামমাগীদের দেবী আদির নিষেধ করেন কিন্তু শ্রাদ্ধদিনকৃত্য পৃষ্ঠা ৪৬-এ লিখিত আছে যে, শাসনদেবী’ এক ব্যক্তিকেরাত্রিকালে ভোজন করিবার অপরাধে চপেটাঘাত করেন এবং তাহার চক্ষু উৎপাটন করিয়া তৎপরিবর্তে একটি ছাগলের চক্ষু বাহির করিয়া সেই মানুষের চোখে বসাইয়া দেন। এই দেবীকে হিংসাকারিণী বলিয়া মনে করা হয় না কেন?’’রত্নাসাগর’ প্রথম ভাগ পৃষ্ঠা ৬৭তে লিখিত আছে যে, মরুতদেবী, প্রস্তরমূর্তি ধারণ করিয়া পথিকদিগকে সাহায্য করিতেন। ইহাকেও সেইরূপ মনে করেন না কেন?

মূল– কিং সোপি জণণি জাও, জাগো জণনীইকিং গও বিদ্ধিং ॥ জই মিচ্ছরও জাও, গুণেসু তহ মচ্ছরংবহই ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী০ সূ০ ॥ ৮১ ॥

(সং অর্থ) –যাহারা জৈনমত বিরোধী ‘মিথ্যাত্বী’ অর্থাৎ মিথ্যাধর্মাবলম্বী, তাহাদের জন্ম হয় কেন? যদিও বা জন্ম হয়, বৃদ্ধি পায় কেন? অর্থাৎ তাহাদের শীঘ্র মৃত্যু ঘটিলে তো ভাল হইত ॥ ৮১

সমীক্ষক –জৈনদের বীতরাগভাষিত দয়া ধর্ম কীরূপে দেখুন। তাহারা ইচ্ছা করেন না যে, ভিন্নমতাবলম্বীগণ জীবিত থাকুক। তাহাদের দয়াধর্ম কেবল কথার কথা মাত্র। তাঁহাদের যতটুকু দয়া আছে, তাহা ক্ষুদ্র প্রাণী এবং পশুদের জন্য, জৈনমত ভিন্ন কোন মনুষ্যের জন্য নহে।

মূল –সুদ্ধে মগগে জায়া, সুহেণ গচ্ছত্তি সুদ্ধ মংমি। জে পুণ অমৰ্গজায়া, মগে গচ্ছংতি তং চুয়্যং ॥ প্ৰক ভা০ ২। ষষ্ঠী সূ০ ৮৩ ॥

(সং অর্থ) –ইহার মুখ্য প্রয়োজন এই যে, জৈনকূলে জন্মগ্রহণ করিয়া মুক্তিলাভ করা কিছুই আশ্চর্যের বিষয় নহে। কিন্তু জৈনের কূলে জন্মগ্রহণ করিয়া কোন মিথ্যাত্বী ভিন্নপন্থীর মুক্তিলাভ করা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়। ইহার ফলিতাৰ্থ এই যে, কেবল জৈন মতাবলম্বীই মুক্তির অধিকারী, অপর কেহই নহে। যাহারা জৈনমত স্বীকার করে না, তাহারা নরকগামী হয়। ॥৮৩ ॥

সমীক্ষক –জৈনমতাবলম্বীদের মধ্যে কি কেহ দুষ্ট বা নরকগামী হয় না? সকলেই কি মুক্তি পায়? এসকল কি উন্মাদনা নহে; সরল বিশ্বাসী মানুষ ব্যতীত এ সকল কথা কে বিশ্বাস করিতে পারে?

মূল –তিচ্ছয়রাণং পূআ, সংমত্ত গুণাণ কারিণী ভণিয়া। সাবিয় মিচ্ছত্তয়রী, জিণ সময়ে দেসিয়া পূআ ॥ প্রক০ ভা ২। ষষ্ঠী সূ০ ৯০ ॥

(সং অর্থ) –একমাত্র জিন মুৰ্ত্তিসমূহের পূজাই সার, জিতের মূৰ্ত্তিসমূহের পূজা অসার। যে ব্যক্তি জিনের আজ্ঞা পালন করেন সে তত্ত্বজ্ঞানী, যে পালন করেন না, সে তত্ত্বজ্ঞানী নহেন ॥

সমীক্ষক –বলিহারী! কী বলিব!! তোমাদের মুর্তিগুলি কি বৈষ্ণব প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মূর্তিগুলির ন্যায় জড়পদার্থ দ্বারা নির্মিত নহে? বস্তুতঃ বৈষ্ণবাদির মূর্তিপূজার ন্যায় তোমাদের মূর্তিপূজাও মিথ্যা। তোমরা নিজেকে একমাত্র তত্ত্বজ্ঞানী বানাইয়াছ আর সকলকে অতত্ত্বজ্ঞানী বানাইতেছ। ইহা হইতে জানা যায় যে, তোমাদের মতে তত্ত্বজ্ঞান নাই।

মূল –জিণ আণাএ ধম্মো, আণা রহিআণ ফুডং অহমুত্তি। ইয় মুণি উণয় তত্তং, জিণ আণায় কুণহু ধম্মং ॥ প্রক০ ০ ২। ষষ্ঠী০ সূ০ ৯২ ॥

(সং অর্থ) –জিনদেবের আদিষ্ট দয়া এবং ক্ষমা প্রভৃতিই ধর্ম, তদ্ভিন্ন সমস্তই অধর্ম ॥৯২ ॥ সমীক্ষক –ইহা কত বড় অন্যায় কথা। জৈনমত ব্যতীত অপর কেহই কি সত্যবাদী এবং ধর্মাত্মা নহে? অপর কোন ধার্মিক ব্যক্তিকে মান্য করা কি উচিত নহে? অবশ্য যদি জৈনদের মুখ ও জিহ্বা চর্ম নির্মিত না হইত এবং অপরদের মুখ ও জিহ্বা চর্মনির্মিত হইত, তাহা হইলে এইরূপ বলা যাইতে পারিত। জৈনগণ তাহাদের গ্রন্থোক্ত বাক্য এবং সাধু প্রভৃতির এইরূপ উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন যে, তাহাতে মনে হয়, তাহারা ভাটের জ্যেষ্ঠ সহোদর।

মূল–বন্নেমি নারয়াউবি, জেসিংদূরকাই সম্ভরং তাণম্ । ভব্বাণ জণই হরি হর, রিদ্ধি সমিkীবি উদ্ধোসং ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী সূ০ ৯৫।

(সং অর্থ) –ইহার মুখ্য তাৎপৰ্য্য এই যে, হরিহর প্রভৃতি দেবগণের বিভূতি নরকের কারণ। তাহাদের দেখিলে জৈনগণের রোমাঞ্চ হয়। যেরূপ রাজাজ্ঞা লঙ্ঘন করিলে মানুষ। মরণ পৰ্য্যন্ত দুঃখ ভোগ করে, সেইরূপ জিনেন্দ্র আজ্ঞা ভঙ্গ করিলে জন্ম-মরণ দুঃখ ভোগ করিবে না কেন ॥৯৫ ॥

সমীক্ষক –জৈনাচাৰ্য্য প্রভৃতির মানসীবৃত্তি অর্থাৎ উপরি ছল, কপটতা এবং ভণ্ডামীর লীলা দেখুন! ইহাদের মনের কথাও এবার প্রকাশ পাইল!তাহারা হরিহরাদি এবং তাহাদের উপাসকদের ঐশ্বৰ্য্য এবং উন্নতি দেখিতেও পারেন না। তাহাদের রোমাঞ্চ এই জন্য হয় যে, অপরের উন্নতি কী করিয়া হইল? তাহারা প্রায় এইরকম কামনা করে যে, ইহাদের সব ঐশ্বৰ্য্য আমরা লাভ করি এবং ইহারা দরিদ্র হইলেই ভাল এবং তাহারা রাজাজ্ঞার দৃষ্টান্ত এইজন্য উপস্থাপন করিয়া থাকে যে, এই সব জৈনগণ রাজ্যের অত্যন্ত তোষামোদকারী, মিথ্যাবাদী ও ভীরু। মিথ্যা কথাও কি রাজাকে স্বীকার করিতে হইবে। বাস্তবিক জৈনদের অপেক্ষা অধিকতর ঈৰ্য্যাযুক্ত কেহই হইবে না।

মূল –জো দেই সুদ্ধ ধম্মং, সো পরমপ্পা জয়ম্মি ন হু অন্নো। কিংকল্পদ্রুম সরিসো, ইয়র তরূ হোই কইয়াবি ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী সূ০ ১০১ ॥

(সং অর্থ) –যাহারা জৈনধর্ম বিরোধী তাহারা মূর্খ; যাঁহারা জিনেন্দ্র ভাষিত ধর্মের উপদেষ্টা, সাধু অথবা গৃহস্থ অথবা গ্রন্থকার, তাহারা তীর্থঙ্কর তুল্য। তাহাদের তুল্য কেহই নাই ॥১০১ ॥

সমীক্ষক –হইবে নাই বা কেন? জৈনীরা যদি বালক বুদ্ধির না হইত তাহা হইলে এরূপ কথা বিশ্বাস করিবেন কেন? বেশ্যা যেরূপ আত্মপ্রশংসা ব্যতীত পরের প্রশংসা কখনও করে না, দেখা যাইতেছে ইহাও সেইরূপ।

মূল–মূলং জিংনিদ দেবো, তব্বয়ণং গুরুজনং মহাসয়ণং। সেসং পাবঠাণং পরমপ্পাণং চ বজ্জেমি ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী০ সূ০ ১০৩ ॥

(সং অর্থ) –জিনেন্দ্র দেব তদুক্তসিদ্ধান্ত তথা জিন মতের উপদেষ্টাগণকে ত্যাগ করা। জৈনদের উচিত নয় ॥১০৩ ॥

সমীক্ষক –জৈনদের ইহা হঠকারিতা, পক্ষপাত এবং অবিদ্যাপ্রসূত নহে, তো কী? কিন্তু তাহাদের অল্প কয়েকটি বাক্য ব্যতীত অবশিষ্ট সমস্তই পরিত্যাজ্য; যাঁহার কিছুমাত্র বুদ্ধি আছে, তিনি যদি জৈনদের দেব, সিদ্ধান্ত গ্রন্থ এবং উপদেষ্টাগণের বিষয় এবং তাহাদের উপদেশ শ্রবণ ও মনন তথা বিবেচনা করেন, তাহা হইলে নিঃসন্দেহে তৎক্ষণাৎ ঐ সকল পরিত্যাগ করিবেন।

মূল–বয়ণে বি সুগুরু জিণবল্লহ কেসিংন উল্লসইসমং। অহ কহ দিণমণি তেয়ং উলুআণংহরই অংধং ॥ প্রক০ ০ ২। ষষ্ঠী সূ০ ১০৮ ॥

(সং অর্থ) –যাঁহারা জিনবচনানুকূল আচরণ করেন, তাহারা পূজনীয় এবং যাঁহারা তদ্বিরুদ্ধ আচরণ করেন, তাঁহারা অপূজ্য। জৈনগুরুদিগকেই মান্য করিবে; অর্থাৎ অপর মতাবলম্বীদের মান্য করিবে না১০৮।

সমীক্ষক — বেশ তো, জৈনগণ অন্যান্য অজ্ঞানীদিগকে শিষ্য করিয়া পশুর ন্যায় জালে আবদ্ধ না করিলে, তাহারা তাহাদের জাল হইতে বাহিরে আসিয়া মুক্তিসাধন পূর্বক জীবন সফল করিতে পারিত। বল তো যদি তোমাদিগকে “কুমার্গী”, “কুগুরু”, “মিথ্যাত্বী”, এবং “কু-উপদেষ্টা”, বলে তাহা হইলে তোমাদের না জানি কত দুঃখ হয়! এমনই তো তোমরা অপরের দুঃখদায়ক, এই কারণেই তোমাদের মত অনেক অসার কথায় পরিপূর্ণ।

মূল– জে রজ্জধনাঈণং কারণভূয় হবংতি বাবারা। তেবিহু অইপাবজুয়া, ধন্না ছড়ডংতিভবভিয়া ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী সূ০ ১০৯।

(সং অর্থ) –মৃত্যু পর্যন্ত দুঃখ ভোগ হইলেও জৈনগণ কৃষি প্রভৃতি করিবে না; কারণ ঐ সকল কর্ম নরকে লইয়া যায় ॥

সমীক্ষক –এবার যদি কেহ জৈনদিগকে জিজ্ঞাসা করে যে, তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্যাদি কর কেন? এ সকল কর্ম পরিত্যাগ কর না কেন? পরিত্যাগ করিলে তোমাদের ভরণ-পোষণও হইতে পারিবে না। আর তোমাদের উপদেশ মত সকলে এ কর্ম পরিত্যাগ করিলে তোমরা কী খাইয়া জীবন ধারণ করিবে? এইরূপ অত্যাচারময় উপদেশ দেওয়া সৰ্বৰ্থা নিরর্থক। দুর্ভাগাগণ কী করিবে? বিদ্যা ও সৎসঙ্গের অভাবে যাহা মনে আসিয়াছে তাহাই বকিয়াছে।

মূল –তইয়া হমাণ অহমা কারণরহিয়া অনাণগণে । জে জপংতি উসুত্তং তেসিং ধিদ্ধিচ্ছং পংডিচ্চং ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী সূ০ ১২১ ॥

(সং অর্থ) –যাহারা জৈনশাস্ত্রবিরুদ্ধ শাস্ত্রের অনুয়ায়ী, তাহারা অধম অপেক্ষাও অধম। স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা থাকিলেও জৈনমতের বিরুদ্ধে কিছু বলিবে না এবং বিশ্বাসও করিবে না। তাই স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা থাকিলেও ভিন্ন মত পরিত্যাগ করিবে। ১২১ ॥

সমীক্ষক — তোমাদের আদি পুরুষ হইতে আজ পর্যন্ত যতজন হইয়া গিয়াছেন এবং হইবেন, তাহারা ভিন্ন মতকে গালি দেওয়া ব্যতীত আর কিছুই করেন নাই এবং করিবেন না। ভাল, যে সকল স্থলে জৈনগণ স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা দেখেন, সে সকল স্থলে হারা শিষ্যদেরও শিষ্য হইয়া যান। তবুও তাহারা এমন লম্বা চওড়া মিথ্যা কথা বলিতে একটুও সঙ্কোচ বোধ করেন না, ইহা বড়ই পরিতাপের বিষয়।

মূল –জং বীরজিত্স জিও মিরঈ উসসুত্ত লেসদেসণও। সাগর কোডা কোডিং হিংডই অইভীমভবরগ্নে। প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী সূ০ ১২২ ॥

 (সং অর্থ) –যদি কেহ বলে যে, জৈনসাধুগণ যেমন ধার্মিক অন্যেরাও সেইরূপ ধার্মিক। তাহা হইলে সে কোটি কোটি বৎসর নরকে বাস করিয়া তাহার পরেও নীচজন্ম প্রাপ্ত হইবে।১২২।

সমীক্ষক –বাহবা! বিদ্যার শত্রুগণ। তোমরা সম্ভবতঃ ইচ্ছা কর যে, কেহ তোমাদের মিথ্যাকথাগুলি খণ্ডন না করুক। তাই তোমরা এ সকল ভয়ঙ্কর বচন লিখিয়াছ। কিন্তু এ সকল অসম্ভব। তোমাদিগকে আর কত বুঝান যাইবে? তোমরা ত মিথ্যা, পরনিন্দা পরমত বিদ্বেষ প্রদর্শন এবং বিরোধ করিবার জন্য কটিবদ্ধ হইয়া স্বার্থসিদ্ধি করাটা যেন মোহনভোগের ন্যায় মনে করিয়াছ!

মূল –দূরে করণং দূর, ম্মি সাহণং তহ পভাবণা দূরে। জিণধম্মসদ্দহাণং, পিতিরকদুরকাইনিঠবই ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী সূ ১২৭

(সং অর্থ) –যে ব্যক্তি জৈনধর্মের কোন অনুষ্ঠান করে না, সেও কেবলমাত্র “জৈনধর্ম সত্য অন্য কোন ধর্ম সত্য নহে” –এই বিশ্বাস বলেই দুঃখ হইতে উত্তীর্ণ হয়। ১২৭।

সমীক্ষক –ভাল, মূর্খদিগকে নিজেদের মত জালে আবদ্ধ করিবার ইহা অপেক্ষা আর অধিক উপায় কী হইতে পারে? কেননা, কোনও কর্ম করিতে হইবে না, অথচ মুক্তি হইবে –এমন জড়বুদ্ধি যুক্ত আর কী আছে?

মূল–কইয়া হোহী দিবসসা, জইয়া সুগুরূণ পায়মূলম্মি। উসুত্ত লেস বিসলব, রহিও নিসুণেসু জিণধম্মং ॥ প্রক০ ভা০২ ষষ্ঠী সু ০১২৮ ॥

(সং অর্থ) –যে মনুষ্য জিনাগম অর্থাৎ জৈনশাস্ত্র শ্রবণ করিব, (উৎসূত্ত) ‘উৎসূত্র’ অর্থাৎ ভিন্ন মতের গ্রন্থ কখনও শ্রবণ করিব না এইরূপ ইচ্ছা করিবে, সে এতটুকু ইচ্ছা করিলেই দুঃখ সাগর হইতে উত্তীর্ণ হইয়া যায়।[১২৮ ॥

সমীক্ষক –ইহাও মুখদিগকে জালে আবদ্ধ করিবার জন্য বলা হইয়াছে। কারণ পূর্বোক্ত ইচ্ছা দ্বারা এখানকার দুঃখসাগর হইতেই উৰ্ত্তীণ হওয়া যায় না, ভোগ ব্যতীত পূর্বজন্মের সঞ্চিত পাপের দুঃখরূপ ফলও নষ্ট হয় না। এইরূপ বিদ্যাবিরুদ্ধ মিথ্যা কথা না লিখিলে লোকে বেদাদি শাস্ত্রের পাঠ ও শ্রবণ করিয়া এবং সত্যাসত্য অবগত হইয়া, তাদের অবিদ্যারূপী অসার গ্রন্থগুলি পরিত্যাগ করিত। কিন্তু অশিক্ষিত জনসাধারণকে এরূপ দৃঢ় ভাবে বাঁধিয়াছে যে, কোন বুদ্ধিমান সৎসঙ্গপরায়ণ ব্যক্তি ইচ্ছা করিলেই এই জাল হইতে মুক্ত হইলেও হইতে পারেন, অন্য জড়বুদ্ধির। পক্ষে মুক্ত হওয়া অত্যন্ত কঠিন।

মূল –জহা জিণহিং ভণিয়ং, সুয় ববহারংবিসোহিয়ং তত্স। জায়ই বিসুদ্ধ বোহী জিণ আণারাহগত্তাও ॥ প্রক০ ভা০ ষষ্ঠী সূ০ ১৩৮ ॥

(সং অর্থ) –যাঁহারা জিনাচাৰ্য্যদের দ্বারা উপদিষ্ট সূত্র, নিরুক্তি, বৃত্তি এবং ভাষ্য, চুর্ণী মানেন, তাহারাই শুভ ব্যবহার এবং দুঃসহ ব্যবহার (ব্রতাদি) দ্বারা চারিত্র যুক্ত হইয়া সুখ প্রাপ্ত হন, অপর মতের গ্রন্থপাঠ দ্বারা হওয়া যায় না। ॥১৩৮ ॥

সমীক্ষক — অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হইয়া মরা ইত্যাদি কষ্ট ভোগ করাকে কি চারিত্র বলে? যদি ক্ষুৎ পিপাসায় মরা ইত্যাদি চারিত্র হয়, তাহা হইলে বহু লোক যে দুর্ভিক্ষে অথবা অন্নাদির অভাবে মরে, তাহাদেরও শুদ্ধ হইয়া শুভফল প্রাপ্ত হওয়া উচিত। কিন্তু তাহারাও শুদ্ধ হয় না, তোমরাও শুদ্ধ হও না, পিত্তাদির প্রকোপ বশতঃ রোগী হইয়া সুখের পরিবর্তে দুঃখ ভোগ কর।

ন্যায়াচরণ, ব্রহ্মচর্য্য এবং সত্যভাষণদিই ধর্ম। আর অসত্যভাষণ এবং অন্যায়াচরণাদি পাপ। সকলের সহিত প্রীতিপূর্ণ পরোপকার্থে ব্যবহার এবং পরোপকার করাকে শুভ চরিত্র বলে। জৈনমতাবলম্বীদের ক্ষুধার্ত থাকা ইত্যাদি ধর্ম নহে। তাহাতে দুঃখ সাগরে নিমগ্ন হইতে হয়।

মূল –জই জাণিসি জিণনাহো, লোয়ায়ারা বিপরকএ ভূও। তা তং তং মন্নংতো, কহ মন্নসি লোঅ আয়ারং ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী০ সূ০ ১৪৮ ॥

(সং অর্থ) –যাঁহারা উত্তম প্রারদ্ধবান মনুষ্য তাহারাই জৈনধর্ম গ্রহণ করেন, অর্থাৎ যাঁহারা জিনধর্ম গ্রহণ করেন না, তাহাদের প্রারদ্ধ বিনষ্ট হইয়াছে। ১৪৮ ॥

সমীক্ষক –এই উক্তি কি ভুল এবং মিথ্যা নহে? অন্য মতাবলম্বীদের মধ্যে কি শ্রেষ্ঠপ্রারন্ধী এবং জৈনদের মধ্যেও কি নষ্টপ্রারদ্ধী কেহই নাই?

বলা হইয়াছে যে সাধর্মী অর্থাৎ জৈনধর্মীরা পরস্পরকে কষ্ট দিবে না, কিন্তু পরস্পর প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করিবে। ইহাতে সিদ্ধ হইতেছে যে, জৈনগণ ভিন্নধর্মাবলম্বীদের সহিত কলহ বিবাদ করা দোষজনক মনে করেন না।ইহা তাহাদের পক্ষে যুক্তি সঙ্গত নহে। কারণ, সৎপুরুষগণ সৎপুরুষদিগের সহিত প্রীতি প্রদর্শন করেন এবং উপদেশ প্রদান পূর্বক দুষ্টদিগকে সুশিক্ষিত করেন।

আবার অন্যত্র যে বলা হইয়াছে, ‘ব্রাহ্মণ, ত্রিদণ্ডী, পরিব্রাজকাচাৰ্য্য অর্থাৎ সন্ন্যাসী ও তাপস অর্থাৎ বৈরাগী প্রভৃতি সকলেই জৈনমতের শত্রু।‘

এখন দেখুন! যদি জৈনগণ সকলকেশভাবে দেখেন এবং নিন্দা করেন, তাহা হইলে তাহাদের দয়া-ক্ষমারূপ ধর্ম কোথায় রহিল? কেননা অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করিলে দয়া এবং ক্ষমা নষ্ট হয়, এবং ইহার ন্যায় হিংসারূপ অপর কোন দোষ নাই; জৈনীদের ন্যায় দ্বেষমূর্তি ঐরূপ অপর কেহ কি হয়?

(এই যে লেখা আছে –হরিহরাদি মিথ্যাত্বী (মিথ্যাবাদী) অপর মতাবলম্বী সন্নিপাত রোগী আর তাদের ধর্ম বিষ তুল্য)।

যদি কেহ ঋষভদেব হইতে মহাবীর পর্যন্ত ২৪ জন তীর্থঙ্করকে রাগদ্বেষমুক্ত “মিথ্যাত্বী” মিথ্যাবাদী বলে, জৈনদিগকে সন্নিপাতজ্বরগ্রস্ত, জৈনধর্মকে নরক এবং বিষবৎ মনে করে, তাহা হইলে কি তাহাদের প্রীতিকর হইবে? এই নিমিত্ত জৈনগণ নিন্দা ও পরমতদ্বেষরূপ নরকে ডুবিয়া মহাক্লেশ ভোগ করিতেছেন। তাহারা যদি এ সকল বিষয় পরিত্যাগ করেন তাহা হইলে তাহাদের বিশেষ কল্যাণ হইবে।

মূল –এগো অগুরূ এগো বিসাবগো চেই আণি বিবহাণি। তচ্ছয় জং জিণদব্বং, পরুপ্পরং তং ন বিচ্চন্তি ॥ প্রক০ ভা০ ২। ষষ্ঠী০ সূ০ ১৫০ ॥

(সং অর্থ) –শ্রাবকদের পক্ষে দেব, গুরু ও ধর্ম এক। চৈত্যবন্দন অর্থাৎ নিজের প্রতিবিম্ব মূৰ্ত্তি দেবমন্দির ও জিনের সম্পত্তি রক্ষা এবং মূর্তির পূজা করা ধর্ম।

সমীক্ষক –এখন দেখ! জৈনমত হইতেই মূর্তিপূজা সংক্রান্ত যাবতীয় কলহ-বিবাদ প্রচলিত হইয়াছে। ভ্রান্তি এবং অসত্যের মূলাধারও এই জৈনমত।

শ্রাদ্ধদিনকৃত্য –পৃষ্ঠা ১-এ মূর্তিপূজার প্রমাণ —

নবকারেণ বিবোহো॥১॥ অনুসরণং সাবউ ॥২ ॥ বয়ইং ইমে ॥ ৩ ॥ জোগো ॥৪ ॥ চিয়বণগো ॥৫॥ পচ্চরকাণং তু বিহি পুব্বং ॥৬॥ ইত্যাদি।

এই সব শ্রাবকগণ প্রথমে দ্বারে নবকারের জপ করিবে ॥১ ॥ দ্বিতীয় দ্বারে নবকারের জপ করিবার পর “আমি শ্রাবক” স্মরণ করিবে ॥২তৃতীয় দ্বারে আমার ‘অননুব্রতাদিক’ কত আছে। তাহা স্মরণ করিবে ॥ ৩ ॥ চতুর্থ দ্বারে মনে মনে বলিবে চারি বর্গের মধ্যে মোক্ষ শ্রেষ্ঠ। যথার্থ জ্ঞান। দ্বারা তাহা প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই নিমিত্ত তাহাকে যোগ বলে। এই ষড়বিধ উপায়ে সমস্ত পাপ দূরীভূত হইলে মনুষ্য পবিত্র হয়। তাহাও যোগ; এই বিষয়েও কথিত হইবে ॥ ৪ ॥

পঞ্চম দ্বারে চৈত্যবন্দন অর্থাৎ মূর্তিকে নমস্কার, দ্রব্যভাবে পূজা করা কথিত হইবে ॥ ৫॥ ষষ্ঠ প্রত্যাখ্যান দ্বারে “নবকারসী” প্রমুখ বিধিপূর্বক বলিবে ইত্যাদি ॥ ৬ ॥

অতঃপর এই গ্রন্থেই ক্রমান্বয়ে নানাপ্রকার বিধি লিখিত হইয়াছে অর্থাৎ সান্ধ্যভোজনকালে জিন বিম্ব অর্থাৎ তীর্থঙ্করদের মূর্তি ও দ্বার পূজা করিবে। দ্বার পূজার অনেক ঝামেলা। মন্দির নির্মাণের নিয়ম, পুরাতন মন্দিরকে নূতন করিয়া নির্মাণ করিলে ও উহার জীর্ণ সংস্কার করিলে মুক্তিলাভ হয়। মন্দিরে যাইয়া ভক্তিভাবে বসিবে। অতি প্রীতি সহকারে পূজা করিবে। “নমো। জিনেন্দ্রেভ্যঃ” ইত্যাদি মন্ত্র দ্বারা (মূর্তিসমূহকে) স্নান করাইবে এবং জলচন্দনপুষ্পধূপদীপনৈঃ ইত্যাদি মন্ত্র দ্বারা গন্ধাদি নিবেদন করিবে ॥

রত্নসারভাগ (১) পৃষ্ঠা ১২ এ মূর্তিপূজার এইরূপ ফল লিখিত হইয়াছে যথা –পূজারীকে রাজা কিংবা প্রজা কেহই রোধ করিতে পারে না।

সমীক্ষক –এ সকল কথা কপোলকল্পিত, কারণ অনেক জৈনপূজারীগণকে রাজারা রোধ করিয়া থাকেন।

রত্নাসারভাগ –(১) পৃষ্ঠা ১৩ এ লিখিত আছে “মূর্তিপূজা দ্বারা রোগ, পীড়াও মহাদোষ দূরীভূত হয়। কোন এক ব্যক্তি ৫ কড়ি মূল্যের ফুল নিবেদন করিয়া সে ১৮টি দেশের রাজত্ব লাভ করিয়াছিল। তাহার নাম কুমারপাল” ইত্যাদি।

সমীক্ষক –মুখদিগকে প্রলোভিত করিবার জন্য এ সকল মিথ্যা কথা লিখিত হইয়াছে। কারণ অনেক জৈন পূজা করিতে করিতে রোগী হয় এবং পাষাণাদি মূর্তির পূজা করিয়া এক বিঘা জমির উপরেও রাজত্ব করিতে পারে নাই। যদি পাঁচ কড়ির ফুল নিবেদন করিলে রাজ্য পাওয়া যায়, তাহা হইলে পাঁচ-পাঁচ কড়ির ফুল নিবেদন করিয়া সকলে পৃথিবীর আধিপত্য লাভ করে না কেন? রাজদণ্ডই বা ভোগ করে কেন? যদি মূর্তিপূজা দ্বারা ভবসাগর পার হইতে পারা যায় তো জ্ঞান, সম্যক্ দর্শন এবং “চারিত্রের প্রয়োজন কী?

রত্নসারভাগ –(১) পৃষ্ঠা ১৩ এ লিখিত আছে যে, গৌতমের অঙ্গুষ্ঠের মধ্যে অমৃত আছে। এবং তাহাকে স্মরণ করিলে মনোবাঞ্ছিত ফল পাওয়া যায়।

সমীক্ষক –যদি তাহাই হয় তবে জৈনমাত্রেই অমর হওয়া উচিত। তাহা কিন্তু হয় না। সুতরাং কেবল মূর্খদিগকে বিভ্রান্ত করিবার জন্য এ সকল কথা বলা হইয়াছে তাহা ছাড়া ইহাতে কোন তত্ত্ব নাই।

বিবেকসার, পৃষ্ঠা ৫২-এ ইহাদের মূর্তিপূজার শ্লোক লিখিত আছে, যথা –

জলচন্দন (পুষ্প) ধূপনৈরথ দীপাক্ষতকৈনৈবেদ্যবঃৈ। উপাচারবরৈবয়ং জিনেন্দ্রা রুচিরৈরদ্য (মুদা) যজামহে ॥

‘আমরা জল, চন্দন, আতপ চাউল, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবদ্য, বস্ত্র এবং অতি উৎকৃষ্ট উপচার সহকারে জিনেন্দ্র অর্থাৎ তীর্থঙ্করদিগের পূজা করিব।

সমীক্ষক –এই জন্যই আমরা বলি যে, মূর্তিপূজা জৈনদিগের দ্বারা প্রচলিত হইয়াছে। বিবেকসার, পৃ০ ২১ –জিন মন্দিরে মোহ আসে না এবং ইহা ভবসাগর পার করিয়া দেয়।

বিবেকসার, পৃষ্ঠা ৫১-৫২ এ লিখিত আছে মূর্তিপূজা দ্বারা মুক্তিলাভ হয়। জিন মন্দিরে গমন করিলে সগুণ জন্মে। যে ব্যক্তি জল, চন্দনাদি দ্বারা তীর্থঙ্করকে পূজা করে, সে নরক হইতে মুক্ত হইয়া স্বর্গে গমন করে।

বিবেকসার পৃষ্ঠা ৫৫-তে লেখা আছে, –জিনমন্দিরে ঋষভদেবাদির মূর্তিপূজনে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের সিদ্ধি হয়।

বিবেকসার, পৃষ্ঠা ৬১-জিন মূৰ্ত্তি সমূহের পূজা করিলে সমস্ত জগতের ক্লেশ দূর হয়।

সমীক্ষক — এখন দেখ! ইহাদের কথা কীরূপ অজ্ঞতাপূর্ণ এবং অসম্ভব। যদি এইরূপে পাপ এবং কুকর্ম দূর হয়, মোহ উপস্থিত না হয়, ভবসাগর হইতে উত্তীর্ণ হওয়া যায়, সদ্গুণ উৎপন্ন হয়, নরক ত্যাগ করে স্বর্গে যাওয়া যায়, ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ প্রাপ্তি ঘটে এবং সমস্ত ক্লেশ দূর হয়; তাহা হইলে জৈনীরা সকলে সুখী এবং সর্বসিদ্ধি প্রাপ্ত হন না কেন?

এই বিবেকসার, পৃষ্ঠা ৩-এ লিখিত আছে যে, –যাঁহারা জিনমূৰ্ত্তি স্থাপন করিয়াছেন তাহারা তাহাদের এবং আত্মীয় স্বজনদের জীবিকার ব্যবস্থা করিয়াছেন।

বিবেকসার, পৃষ্ঠা ২২৫-এ লেখা আছে –শিব এবং বিষ্ণু প্রভৃতির মূর্তিপূজা করা অত্যন্ত দূষণীয় অর্থাৎ নরকের সাধন।

সমীক্ষক –শিবাদির মূর্তিপূজা যদি নরকের কারণ হয় তাহা হইলে জৈনমূৰ্ত্তি সমূহ নরকের সাধন হইবে না কেন? যদি বলা হয়, “আমাদের মূর্তি সমূহ ত্যাগী, শান্ত এবং শুভ লক্ষণযুক্ত; এই জন্য উৎকৃষ্ট কিন্তু মূৰ্ত্তি শিবাদিরসেরূপ নয় সেইজন্য মন্দ। তাহলে ইহাদের বলা উচিত যে, তোমাদের লক্ষ লক্ষ টাকার মূর্তি সমূহ মন্দিরে থাকে এবং ঐ সকলকে চন্দন এবং কেশর চৰ্চিত করা হয়; এমতাবস্থায় ত্যাগী বলা যাইবে কীরূপে? শিবাদির মূৰ্ত্তি ছায়াহীন স্থানেও থাকে, তাহারা ত্যাগী নহে কেন? আর জৈনমূৰ্ত্তিকে যে শান্ত বলিতেছ, সমস্ত জড় পদার্থ নিশ্চল বলিয়া শান্ত। সুতরাং সকল মতের মূর্তিপূজাই ব্যর্থ।

প্রশ্ন –আমাদের মূর্তিসমূহ বস্ত্রালঙ্কার প্রভৃতি ধারণ করে না। এই কারণে উত্তম।

উত্তর –সকলের সম্মুখে নগ্ন মূৰ্ত্তি থাকা ও রাখা পশুবৎ লীলা।

প্রশ্ন– যেরূপ স্ত্রীলোকের চিত্র অথবা মূর্তি দেখিলে কাম উৎপন্ন হয় সেইরূপ সাধু এবং যোগীর মূর্তি দেখিলে শুভগুণ প্রাপ্ত হওয়া যায়।

উত্তর –যদি প্রস্তর মূর্তি দর্শনের ফল শুভ বলিয়া মনে কর, তাহা হইলে মূর্তির জড়ত্ব প্রভৃতি গুণও তোমাদের মধ্যে সংক্রামিত হইবে। জড়বুদ্ধি উৎপন্ন হইলে তোমরা সর্বথা বিনাশ প্রাপ্ত হইবে। দ্বিতীয়তঃ — শ্রেষ্ঠ বিদ্বান্ ব্যক্তিদের সেবা ও সঙ্গলাভ না করিলে মুঢ়তার আধিক্য ঘটে। এই গ্রন্থের একাদশ সমুল্লাসে মূর্তিপূজার যে সকল দোষের কথা উল্লেখ করা হইয়াছে, পাষাণদি মূর্তিপূজকদের পক্ষে ঐ সকল দোষ ঘটিবে। অতএব মূর্তিপূজায় যেমন মিথ্যা কোলাহল। প্রচলিত হইয়াছে, মন্ত্রেও সেইরূপ ইহাদের অনেক অসম্ভব কথা লিখিত আছে।

ইহাদের মন্ত্র এইরূপ –রত্নসার, ভাগ (১) পৃষ্ঠা ১-এ আছে–

নমো অরিহন্তাণং নামো সিদ্ধাণং নমো আয়রিয়াণং নমো উবজুঝায়ণং নমো পোত্র সব্বাসাহ্ণং। এসো পঞ্চ নমুক্কারো সব্ব পাবাপ্পণাসণে। মঙ্গলাণং চ সব্বেসি পঢ়মং হবই মংগলম্ ॥১॥

এই মন্ত্রের খুবই মাহাত্ম্য লিখিত হইয়াছে। সমস্ত জৈনদের ইহা গুরুমন্ত্র। এই মন্ত্রের এমন মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হইয়াছে যে, তাহা তন্ত্র, পুরাণ এবং ভাটের বর্ণানাকেও হার মানাইয়াছে ॥

শ্রাদ্ধদিনকৃত্য –পৃষ্ঠা ৩-এ লিখিত আছে —

নমুক্কারংতউ পঢ়ে ॥৯॥ জউকব্বং। মংতাণমংতো পরমো ইমুত্তি। ধেয়াণধেয়ং পরমংইমুত্তি। তত্তাণতত্তং পরমং পবিত্তং সংসারসত্তাণ দুহাহয়াণং ॥ ১০ ॥ তাণং অন্নংতু নো অৎথি। জীবাণং ভবসায়রে। বুডুং তাণং ইমংমুং। নমুক্কারং সুপোয়য়৷১১ ॥ কব্বং অণেগজম্মংতরসংচিআণং। দুহাণং সারীরিঅমাণুসাণং। কত্তোয় ভব্বাণভবিজ্জনাসো।ন জাবপত্তো নবকারমতো ॥১২ ॥

এই মন্ত্র পবিত্র এবং পরম মন্ত্র। ইহাই ধ্যানের যোগ্য মধ্যে পরম ধ্যেয়, তত্ত্বসমূহের মধ্যে তত্ত্ব। এই নবকার মন্ত্র’ দুঃখপীড়িত সাংসারিক জীবের পক্ষে সমুদ্র পারে উত্তীর্ণ হইবার নৌকা। সদৃশ ॥ ৯-১০ ॥

এই নবকার মন্ত্র নৌকা তুল্য। যাঁহারা এই মন্ত্র পরিত্যাগ করেন, তাহারা ভবসাগরে নিমজ্জিত হন। আর যাঁহারা ইহা গ্রহণ করেন, তাহারা দুঃখ অতিক্রম করেন। দুঃখমোচনকারী, পাপনাশক এবং মুক্তিজনক এই মন্ত্র ব্যতীত জীবের পক্ষে অপর কিছুই নাই৷১১ ॥

বহু ভবান্তরে উৎপন্ন শারীরিক ও মানসিক) দুঃখ মোচন করে এবং ভব্য জীবগণের পক্ষে ইহাই ভবসাগর তারণকারী। জীব যতদিন নবকার মন্ত্র প্রাপ্ত না হয়, ততদিন পর্যন্ত ভবসাগর হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারে না ॥১২ ॥ ৷

এই অর্থ সূত্রে ব্যাখ্যাত হইয়াছে। এই একমাত্র ‘নবকার’মন্ত্র ব্যতীত অগ্নি প্রমুখ অষ্টমহাভয়ের কেহ সহায় নাই। যেমন মহারত্ন বৈদূৰ্য্যমণি কিংবা শত্রুভয়ে অমোঘ শস্ত্র গ্রহণ করা হয়, সেইরূপ ‘ঞতকেবলী’ গ্রহণ করিবে। এই ‘নবকার’ মন্ত্র সমস্ত দ্বাদশাঙ্গীর’ রহস্য।

এই মন্ত্রের অর্থ এইরূপ –(নমো অরিহন্তাণং) –সমস্ত তীর্থঙ্করদিগকে নমস্কার। (নমোসিদ্ধাণং) –সব জৈন সিদ্ধ পুরুষদিগকে নমস্কার। (নমো আয়রিয়াণং) –জৈনাচাৰ্যদিগকে নমস্কার। (নমো উবঝায়াণং) –জৈন উপাধ্যায়দিগকে নমস্কার। (নমো লোএ সব্ব সাহ্ণং) –এই পৃথিবীতে যত জৈন সাধু আছেন, তাহাদিগকে নমস্কার।

যদিও মন্ত্রে জৈন পদ নাই, তথাপি বহু জৈনগ্রন্থে লিখিত আছে যে, জৈনমতাবলম্বী ব্যতীত অপর কাহাকেও নমস্কার করিবে না। সুতরাং ইহাই সঠিক অর্থ।

তত্ত্ববিবেক, — পৃষ্ঠা ১৬৯। যে ব্যক্তি কাষ্ঠ এবং প্রস্তরকে দেববুদ্ধিতে পূজা করে, সে উত্তম ফল লাভ করে।

সমীক্ষক –এরূপ হইলে সকলেই মুর্তিদর্শন করিয়া সুখরূপ ফল লাভ করে না কেন? রত্নসারভাগ (১) পৃষ্ঠা ১০ –পার্শ্বনাথের মূর্তি দর্শন করিলে পাপ বিনষ্ট হয়। কল্পভাষ্য, পৃষ্ঠা ৫১ এ লিখিত আছে যে, সওয়া লক্ষ মন্দিরের জীর্ণোদ্ধার করা হইয়াছে ইত্যাদি। মূত্তিপূজা বিষয়ে এইরূপ অনেক কথা লিখিত আছে। ইহাতে জানা যাইতেছে যে, জৈনমতই মূর্তিপূজার মূল কারণ।

এখন জৈন সাধুদের লীলা-খেলা-দেখুন ॥

বিবেকসার পৃষ্ঠা ২২৮ –কোন একজন জৈন সাধু ‘কোশা’ নাম্নী একটি বেশ্যা সম্ভোগ করিবার পর ত্যাগী হইয়া স্বর্গলোকে গমন করেন।

বিবেকসার, পৃষ্ঠা ১০১ (১০৬-১০৭) অণকমুনি ‘চরিত্রভ্রষ্ট হইয়া কয়েক বৎসর দত্ত শেঠের গৃহে বিষয় ভোগ করিবার পর দেবলোকে গমন করেন। শ্রীকৃষ্ণের পুত্র ঢণমুনিকে চুরি করিয়া পলায়ন করে, পরে তিনি দেবতা হন।

বিবেকসার পৃষ্ঠা ১৫৬ –কেবলমাত্র সাধুর চিহ্ন ও বেশধারী হইলেই জৈনসাধুদিগকে “শ্রাবকগণ” সম্মান করিবে। শুদ্ধচরিত্র হউন অথবা দুশ্চরিত্র হউন, সাধুমাত্রেই পূজ্য।

বিবেকসার, পৃষ্ঠা ১৬৮ –জৈন্যসাধুগণ চরিত্রহীন হইলেও অন্যান্য সম্প্রদায়স্থ সাধু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

বিবেকার, পৃষ্ঠা ১৭১ শ্রাবকগণ জৈন সাধুগণকে চরিত্রহীন এবং ভ্রষ্টাচারী দেখিয়াও তাঁহাদের সেবা করিবে।

বিবেকসার, পৃষ্ঠা ২১৬ –এক চোর পাঁচমুষ্টি কেশ উপড়াইয়া “চারিত্র” গ্রহণ করে। সে বহু কষ্ট এবং অনুতাপ করিবার পর ষষ্ঠ মাসে “কেবল” জ্ঞান প্রাপ্ত হইয়া সিদ্ধ হইল।

সমীক্ষক –এবার জৈন সাধু এবং গৃহস্থদিগের লীলা দেখুন। ইহাদের মতে বহু কদাচারী সাধুও সদ্গতি লাভ করিয়াছেন।

বিবেকসার, পৃষ্ঠা ১০৬- এ লিখিত আছে –শ্রীকৃষ্ণ তৃতীয় নরকে গিয়াছেন। বিবেকসার, পৃষ্ঠা ১৪৫-এ লিখিত আছে ধন্বন্তরি বৈদ্য নরকে গিয়াছেন।

বিবেকসার, পৃষ্ঠা ৪৮-এ লিখিত আছে যোগী, জঙ্গম, কাজী এবং মোল্লা অজ্ঞতা বশতঃ তপঃক্লেশ সহ্য করিয়া কুগতি লাভ করে।

রত্নসারভাগ (১) পৃষ্ঠা ১৭০-১৭১-এ লিখিত আছে, নয় জন বাসুদেব অর্থাৎ (১) ত্রিপৃষ্ঠ বাসুদেব, (২) দ্বিপৃষ্ঠ বাসুদেব, (৩) স্বয়ম্ভ বাসুদেব, (৪) পুরুষোত্তম বাসুদেব, (৫) সিংহপুরুষ বাসুদেব, (৬) পুণ্ডরীক বাসুদেব,(৭) দত্ত বাসুদেব, (৮) লক্ষণ বাসুদেব, (৯) শ্রীকৃষ্ণ বাসুদেব — ইহারা (যথাক্রমে) একাদশ, দ্বাদশ, চর্তুদশ, পঞ্চদশ,অষ্টাদশ, বিংশতি দ্বাবিংশতি তীর্থঙ্করের সময়ে নরকে গিয়াছেন। আর “নয় জন প্রতি বাসুদেব” অর্থাৎ (১) অশ্বগ্রীব প্রতিবাসুদেব, (২) তারক প্রতিবাসুদেব, (৩) মোদক প্রতিবাসুদেব, (৪) মধু প্রতিবাসুদেব, (৫) নিশুম্ভ প্রতিবাসুদেব, (৬) বলী প্রতিবাসুদেব, (৭) প্রহ্লাদ প্রতিবাসুদেব, (৮) রাবণ প্রতিবাসুদেব এবং (৯) জরাসিন্ধু প্রতিবাসুদেব — ইহারা সকলেই নরকে গিয়াছেন।

কল্প (সূত্র) ভাষ্যে লিখিত আছে যে –ঋষভদের হইতে মহাবীর পর্যন্ত ২৪ তীর্থঙ্কর সকলেই মোক্ষলাভ করিয়াছেন।

সমীক্ষক –ভাল! সুধীগণ বিবেচনা করুন, জৈন সাধু, গৃহস্থ ও তীর্থঙ্করদের মধ্যে অনেক বেশ্যা ও পরস্ত্রীগামী এবং চোর ছিল; তাহারা সকলেই স্বর্গ ও মুক্তিলাভ করিয়াছে কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ প্রভৃতি মহাধার্মিক মহাত্মাদের সকলেই নরকে গিয়াছেন, ইহা বলা কত বড় অন্যায়।

বাস্তবিক যদি বিচারপূর্বক দেখা যায়, তাহা হইলে জৈনসংসর্গ, এমন কি জৈনদের প্রতি দৃষ্টিপাত করাও ভদ্রলোকের পক্ষে দূষণীয় কারণ হঁহাদের সংসর্গে থাকিলে এ সকল অসম্ভব কথা হৃদয়ে বদ্ধমূল হইবে। কেননা, এই সকল মহাহঠকারী এবং দূরাগ্রহী লোকের সংসর্গে অনিষ্ট ব্যতীত অন্য কিছুই লাভ করিতে হইতে পারে না। অবশ্য জৈনদের মধ্যে যাঁহারা সৎপ্রকৃতি তাহাদের সংসর্গ দূষণীয় নহে।

বিবেকসার, পৃষ্ঠা ৫৫-এ লিখিত আছে — গঙ্গা প্রভৃতি তীর্থ এবং কাশী প্রভৃতি ক্ষেত্র সেবন করিলে কোন পরমার্থ সিদ্ধ হয় না কিন্তু জৈনদের গিরনার, পালীটাণা এবং আবু প্রভৃতি তীর্থ এবং ক্ষেত্র মুক্তি পৰ্য্যন্ত দানকারী।

সমীক্ষক –এ স্থলে বিবেচ্য এই যে, জৈনতীর্থসমূহও শৈব বৈষ্ণবতীর্থ সমূহের ন্যায়ই জড় স্বরূপ। সুতরাং নিন্দা ও অন্যের প্রশংসা করা মুখের কাৰ্য্য।

রত্নাসারভাগ (১) পৃষ্ঠা ২৩(২৪) –মহাবীর তীর্থঙ্কর গৌতমকে বলিতেছেন –ঊর্ধ্বলোকে স্বর্গ পুরীর উদ্ধভাগে এক সিদ্ধশীলা ক্ষেত্র আছে। উহা পঁয়তাল্লিশ লক্ষ যোজন দীর্ঘ এবং তদনুরূপ অন্তঃশূন্য তথা ৮ যোজন মোটা। উহা শ্বেত মুক্তহার অথবা গোদুগ্ধ অপেক্ষাও উজ্জ্বল, স্বর্ণময় প্রকাশমান এবং স্ফটিক হইতেও নিৰ্ম্মল। সেই সিদ্ধশীলা চতুর্দশ লোকের শিখরে অবস্থিত। সেই সিদ্ধশিলার উপর শিবপুর ধাম। সে স্থানে মুক্ত পুরুষগণ নিরবলম্বন হইয়া বাস করেন। সে স্থানে জন্ম-মরণাদি কোনও দোষ নাই। সে স্থানে সকলে আনন্দে থাকেন; পুনরায় জন্ম-মরণে আবদ্ধ হন না এই সকল কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত থাকেন। ইহাই জৈনদের মুক্তি।

সমীক্ষক –বিবেচ্য এই যে, পৌরাণিক মতে যেরূপ বৈকুণ্ঠ, কৈলাস, গোলোক এবং শ্রীপুর ইত্যাদি; খ্রীষ্টান মতে চতুর্থ আকাশ এবং মুসলমান মতে সপ্তম আকাশ মুক্তিস্থল বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে, জৈনদের সিদ্ধশিলা এবং শিবপুরও তদ্রূপ। তবে জৈনদের মতে সে স্থান উচ্চ হইলেও যাহারা আমাদের অপেক্ষা পৃথিবীর নিম্ন দেশে থাকে, তাহাদের পক্ষে নিম্ন। উচ্চ এবং নিম্ন। ব্যবস্থিত পদার্থ নহে। আৰ্য্যাবৰ্ত্তবাসী জৈনগণ যে স্থানকে উপর মনে করে, আমেরিকাবাসীগণ সে। স্থানকে নিম্ন মনে করে, এবং আৰ্য্যাবৰ্তর্বাসী যাহাকে নিম্ন মনে করে, আমেরিকাবাসীগণ তাহাকে উপর মনে করে।

যদি উক্ত শিলা পঁয়তাল্লিশ লক্ষের দ্বিগুণ, নব্বই লক্ষ ক্রোশ হইত, তথাপি তথাকার মুক্ত জীবগণ বন্ধনের মধ্যে থাকিত। কেননা, সেই শিলা অথবা শিবপুরের বাহিরে গেলেই তাহাদের মুক্তি শেষ হইবে। সে স্থানে সদা অবস্থান করায় তাহাদের প্রীতি এবং বাহিরে যাইতে অপ্রীতি হইবে। যে অবস্থায় বাধা প্রীতি এবং অপ্রীতি থাকে তাহাকে মুক্তি কীরূপে বলা যাইতে পারে? প্রকৃত মুক্তি কী, তাহা এই গ্রন্থের ‘নবম সমুল্লাসে’ ব্যাখ্যাত হইয়াছে; তদ্রপ স্বীকার করাই যুক্তি সঙ্গত।

জৈনগণ যাহাকে মুক্তি বলিয়া মনে করে, উহা তো বন্ধন। জৈনগণও মুক্তিবিষয়ে ভ্রম জালে আবদ্ধ রহিয়াছে। ইহা সত্য যে, বেদের প্রকৃত অর্থবোধ ব্যতীত মুক্তির স্বরূপ কেহই অবগত হইতে পারে না।

এবার জৈনদের আরও কিছু অসম্ভব ধারণা শ্রবণ কর। বিবেকার, পৃষ্ঠা ৭৮ –মহাবীরের জন্ম কালে তাঁহাকে এক কোটি ষাট লক্ষ কলসীর জলে স্নান করান হইয়াছিল।

বিবেকার পৃষ্ঠা ১৩৬ –রাজা দশর্ণ মহাবীরের দর্শনার্থ গমন করিলে সে সময়ে তিনি কিঞ্চিৎ দম্ভ প্রকাশ করেন। তাহা নিবারণের জন্য সে স্থানে ১৬,৭৭,৭২,১৬,০০০ এতগুলি ইন্দ্রের স্বরূপ এবং ১৩,৩৭,০৫,৭২,৮০,০০,০০,০০০ টি ইন্দ্রাণী উপস্থিত হন। তাহা দেখিয়া তিনি আশ্চর্যান্বিত হইলেন।

সমীক্ষক –এ স্থলে বিবেচ্য, এই যে, (এত জন) ইন্দ্র এবং ইন্দ্রাণীর দাঁড়াইবার জন্য এই পৃথিবীর ন্যায় কতগুলি পৃথিবীর প্রয়োজন।

শ্রাদ্ধদিনকৃত্য, আত্মনিন্দাভাবনা, পৃষ্ঠা ৩১-এ লিখিত আছে “বাবলী” কূপও জলাশয় খনন করান উচিত নহে।”

সমীক্ষক –ভাল তো, যদি সকলেই জৈনমত গ্রহণ করে এবং কূপ, জলাশয় বাবলী প্রভৃতি খনন না করায়, তাহা হইলে লোকে কোথা হইতে জল পান করিবে?

প্রশ্ন –জলাশয় প্রভৃতি খনন করাইলে তন্মধ্যে জীব ডুবিয়া যায়, যাহারা উহা খনন করায়, তাহাদের পাপী হইতে হয়। এই জন্য আমরা জৈনগণ এই কাৰ্য্য করি না।

উত্তর –তোমাদের বুদ্ধি নষ্ট হইয়াছে বুঝি? কেননা যদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব মরিলে পাপ হয় বলিয়া মনে হয়, তাহা হইলে বৃহৎ বৃহৎ গবাদি পশু এবং মনুষ্যাদি প্রাণী জলপান ইত্যাদি করিলে যে পুণ্য হয়, তাহা বিবেচনা করা না কেন?

তত্ত্ববিবেক, পৃষ্ঠা ১৯৬ (১৯৮) কোনও নগরীতে নন্দমণিকার নামক জনৈক শেঠ জলাশয় খনন করাইলে, ধর্মভ্রষ্ট হইয়া তিনি ষোড়শ প্রকার মহারোগে আক্রান্ত হন। মৃত্যুর পর তিনি সেই জলাশয়ে ভেক হইয়া জন্ম গ্রহণ করেন। মহাবীরের দর্শনের ফলে তিনি জাতিস্মর হন। মহাবীর বলিতেছেন, –“আমার আগমনবার্তা শুনিয়া, সে আমাকে পূর্বজন্মের ধর্মাচাৰ্য্য জানিয়া বন্দনা করিতে আসিতেছিল। পথিমধ্যে শ্রেণিকে’র অশ্ব-পদাঘাতে নিহত হইলে, সে শুভধ্যানযোগের ফলে ‘দর্দরাঙ্ক নামক মহৰ্দ্ধিক দেবতা হয়। আমি যে এস্থানে আসিয়াছি, তাহা সে তাহার সীমাবদ্ধ জ্ঞান বলে অবগত হইয়া আমাকে বন্দনা করে এবং আলৌকিক ঋদ্ধি প্রদর্শন করিয়া চলিয়া যায়।

সমীক্ষক –এইরূপ বিদ্যাবিরুদ্ধ অসম্ভব মিথ্যাবাদী মহাবীরকে সর্বোত্তম মনে করা ভ্রান্তির বিষয়।

শ্রাদ্ধদিনকৃত্য, পৃষ্ঠা৩৬-এ লিখিত আছে, –সাধুগণ মৃতকের বস্ত্র গ্রহণ করিতে পারেন।

সমীক্ষক –দেখুন! ইহাদের সাধুরাও মহাব্রাহ্মণদিগের সদৃশ হইয়াছে। মৃতকের বস্ত্র তো সাধুরা লইবেন, কিন্তু অলঙ্কার লইবে কে? সম্ভবতঃ অলঙ্কারগুলি মূল্যবান বলিয়া গৃহেই রাখিয়া দেওয়া হয়। এবার বলুন তাহারা কী হইলেন?

রত্নসার — পৃষ্ঠা ১০৫ –ভাজা করিলে, পেষাই করিলে, রন্ধন ইত্যাদি করিলে পাপ হয়।

সমীক্ষক –ইহাদের বিদ্যাহীনতা দেখুন! এ সকল কাৰ্য্য না করিলে মনুষ্যাদি প্রাণী কীরূপে জীবন ধারণ করিতে পারিবে। জৈনগণও পীড়িত হইয়া মরিয়া যাইবে।

রত্নসার –(ভাগ ১) পৃষ্ঠা ১০৪ –উদ্যান রচনা করিলে মালীর এক লক্ষ পাপ হয়।

সমীক্ষক — যদি মালীর এক লক্ষ পাপ হয় তবে অনেক জীব যে পত্র, ফল, ফুল এবং ছায়ায় আশ্রয় লইয়া আনন্দ ভোগ করে, তাহাতে কোটি গুণ পুণ্যও তো হয়। ইহা লক্ষ্য করিলে না, ইহা কীরূপ অজ্ঞানতা!

তত্ত্ববিবেক পৃষ্ঠা ২০২ (২০১) ‘নন্দিষেণ’ নামক জনৈক সাধু এক দিন ভ্রমক্রমে কোন বেশ্যাগৃহে গমন করেন এবং ধর্মানুসারে সেই বেশ্যার নিকট ভিক্ষা প্রার্থনা করেন। বেশ্যা বলিল– ‘এস্থানে ধর্মের কাজ নাই কিন্তু টাকার কাজ আছে। তখন সেই “লব্ধি”সাধু তাহার গৃহে সাড়ে বার কোটি স্বর্ণমুদ্রা বর্ষণ করাইলেন।

সমীক্ষক –নষ্টবুদ্ধি ব্যতীত কে এসকল কথা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিবে?

রত্নসারভাগ (১) পৃষ্ঠা ৬৭তে লিখিত আছে –“যদি কেহ কোন স্থানে অশ্বারূঢ় প্রস্তর মূর্তি স্মরণ করে, তাহা হইলে সেই মূৰ্ত্তি সে স্থানে উপস্থিত হইয়া তাহাকে রক্ষা করে”।

সমীক্ষক –জৈন মহাশয়! আজকাল তোমাদের গৃহে চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি শত্রুভয়ও হইয়া থাকে। তোমরা সেই মূর্তি স্মরণ করিয়া আত্মরক্ষা কর না কেন? পুলিশের থানা প্রভৃতি রাজদ্বারে যেখানে সেখানে ঘুরিয়া বেড়াও কেন?

এবার জৈনসাধুদের লক্ষণ —

সরজোহরণা ভৈক্ষ্যভুজো লুঞ্চিতমূৰ্দ্ধজাঃ ॥ শ্বেতাম্বরাঃ ক্ষমাশীলা নিঃসঙ্গা জৈনসাধবঃ ॥১ ॥ লুঞ্চিতাঃ পিচ্ছিকাহস্তাঃ পানিপাত্রা দিগম্বরাঃ। উধ্বাশিনো গৃহেদাতুদ্বিতীয়াঃসূৰ্জিনৰ্ষয়ঃ ॥২॥ ভুতেন কেবলংন স্ত্রীং মোক্ষমেতি দিগম্বরঃ। প্ৰাহুরেষাময়ং ভেদো মহান শ্বেতাম্বরৈঃ সহ ॥ ৩ ॥ সর্বদর্শন সংগ্রহ।

জিনদত্তসূরী এই সকল শ্লোকে জৈন সাধুগণের লক্ষণ বর্ণনা করিয়াছেন। সরজোহরণ –চমরী রাখা, ভিক্ষান্ন ভোজন করা, মস্তকের কেশ উপড়াইয়া ফেলা, শ্বেতবস্ত্র পরিধান করা, ক্ষমাশীল হওয়া এবং নিঃসঙ্গ থাকা এই সকল লক্ষণযুক্তকে ‘শ্বেতাম্বর’ সাধু বলে। জৈন সাধুদের ‘জতী’ বলা হয় ॥১॥

অপর জন ‘দিগম্বর’ অর্থাৎ কোন বস্ত্র ধারণ না করা, মস্তকের কেশ উপড়াইয়া ফেলা, “পিচ্ছিকা”– একটি পশমের তন্তু নির্মিত সম্মার্জনী ঝাড়ু লাগাইবার সাধন বগলে রাখা, কেহ ভিক্ষা দিলে হস্তে লইয়া ভক্ষণ করা, ইহারা দ্বিতীয় প্রকারের দিগম্বর সাধু। ভিক্ষাদাতা গৃহস্থের ভোজন সমাপ্ত হইলে যাঁহারা ভোজন করেন তাহারা ‘জিনৰ্ষিতৃতীয় প্রকারের সাধু ॥২ ॥

দিগম্বরের সহিত শ্বেতাম্বরের প্রভেদ এই যে, দিগম্বর মতে স্ত্রীলোকের সংসর্গ নাই কিন্তু শ্বেতাম্বরে আছে। এইভাবে তাহারা মোক্ষ প্রাপ্ত হয়। জৈনসাধুদের মধ্যে প্রভেদ এই মাত্র ॥৩ ॥

জৈনদের মধ্যে কেশ লুঞ্চন সর্বত্র প্রসিদ্ধ। পাঁচ মুষ্ঠি কেশ ছিন্ন করা ইত্যাদি কথাও লিখিত আছে।

বিবেকসার, পৃষ্ঠা ২১৬ এ লিখিত আছে যে, –“এক ব্যক্তি পাঁচ মুষ্টি কেশ লুঞ্চন করিয়া চারিত্র গ্রহণ করিয়াছিল। অর্থাৎ পাঁচ মুষ্টি মস্তকের কেশ উৎপাটন করিয়া সাধু হইল। কল্পসূত্রভাষ্য, পৃষ্ঠা ১০৮ –“কেশ লুঞ্চন করিবে, গরুর লোমের সমান করিয়া রাখিবে।”

সমীক্ষক –জৈনগণ। এখন বল দেখি তোমাদের দয়া ধর্ম কোথায় রহিল? ইহা কি হিংসা নহে? কেশ লুঞ্চন স্বহস্তে হউক বা তাহার গুরুর হস্তে অথবা অপর কাহারও দ্বারা,কী ভীষণ কষ্ট সেই জীবের হয় বলতো? জীবকে কষ্ট দেওয়াই তো হিংসা।

বিবেকসার পৃষ্ঠা ৭-৮ লিখিত আছে যে, সম্বৎ ১৬৩৩ সালে শ্বেতাম্বর সম্প্রদায় হইতে ‘ঢুণ্ডিয়া’ এবং ঢুণ্ডিয়া হইতে ‘তেরপন্থী’ প্রভৃতি সম্প্রদায় উদ্ভূত হইয়াছে। ঢুণ্ডিয়াগণ প্রস্তরাদি নির্মিত মূৰ্ত্তি মানেন না এবং স্নানাহারের সময় ব্যতীত সর্বদা বস্ত্রের পট্টি মুখে বাঁধিয়া রাখেন। জতী প্রভৃতিও গ্রন্থপাঠের সময় মুখে পট্টি বাঁধেন, অন্য সময় পট্টি বাঁধেন না।

প্রশ্ন –মুখে পট্টি বাঁধা অবশ্য কর্তব্য। কারণ, “বায়ুকায় অর্থাৎ যে সকল সূক্ষ্মদেহধারী জীব বায়ুতে থাকে, তাহারা মুখবাষ্পের উষ্ণতায় মরিয়া যায়। যাঁহারা মুখে পট্টি বাঁধে না, তাহাদের পাপ হয়। এ কারণ আমরা মুখে পট্টি বাঁধা উচিত মনে করি।

উত্তর –ইহা বিদ্যা এবং প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের রীতি অনুসারে যুক্তি বিরুদ্ধ। কেননা, জীব অজর, অমর; মুখবাষ্প দ্বারা কোন জীব কখনও মরিতে পারে না। তোমাদের মতেও তো জীব অজর এবং অমর।

প্রশ্ন –জীব তো মরে না, কিন্তু উষ্ণ মুখবাষ্প হইতে তাহারা কষ্টভোগ করে, সে কারণে যাহারা কষ্ট দেয়, তাহাদের পাপ হয়। অতএব মুখে পট্টি বাঁধা ভাল।

উত্তর –তুমি যাহা বলিতেছ তাহা সর্বথা অসম্ভব। কারণ কষ্ট না দিলে কোন জীবের সামান্য মাত্রও নিৰ্বাহ হইতে পারে না। যদি তুমি মনে কর যে, মুখবাষ্প দ্বারা জীবের কষ্ট হয়, তাহা হইলে চলিতে ফিরিতে, হস্ত উত্তোলন এবং নেত্রাদি সঞ্চালন করিতেও অবশ্য কষ্ট হইয়া থাকে। সুতরাং তোমরাও জীবকে কষ্ট না দিয়া পার না।

প্রশ্ন –অবশ্য, যতসময় পারা যায় ততসময় জীবের রক্ষা করাই উচিত। কিন্তু যে স্থলে রক্ষা করা অসম্ভব সেস্থলে নিরূপায়। কেননা, বায়ু প্রভৃতি সমস্ত পদার্থে জীব পরিপূর্ণ হইয়া রহিয়াছে। মুখে বস্ত্র না বাঁধিলে বহুসংখ্যক জীব মরে এবং বস্ত্র না বাঁধিয়া রাখিলে অল্পসংখ্যক জীব মরিবে।

উত্তর –তোমাদের কথাও যুক্তিহীন। কারণ বস্ত্র বাঁধিলে জীবের অধিক কষ্ট হয়। যখন কেহ মুখে বস্ত্র বাঁধে, তখন তাহার মুখের বায়ু রুদ্ধ হইয়া নিম্নে অথবা পার্শ্বে এবং মৌন থাকা কালে একত্র হইয়া নাসিকা দ্বারা বেগে নির্গত হয়। তাহাতে বায়ু অধিক উষ্ণ হয় এবং তোমাদের মতানুসারে জীবের অধিক কষ্ট হইবে।

দেখ, যেমন কোন গৃহে অথবা কোন প্রকোষ্ঠের সকল দ্বার রুদ্ধ করিলে অথবা গৃহদ্বারে পর্দা টাঙাইলে উষ্ণতা বৃদ্ধি হয়, কিন্তু খোলা থাকিলে উষ্ণতা অল্প হয়। তদনুসারে তোমাদের মতে জীবকে অধিক কষ্ট দেওয়া হয়। মুখ বন্ধ থাকিলে অল্প হয়, সেইরূপ মুখে বস্ত্র বাঁধিলে উষ্ণতা অধিক এবং মুখ খোলা থাকিলে বায়ু রুদ্ধ এবং জমাট হইয়া নাসারন্ধ্র দ্বারা বেগে নির্গত হইতে থাকে। তখন সম্ভবতঃ জীবগণের উপর অধিক চাপ পড়ে এবং তজ্জন্য তাহাদের অধিক ক্লেশ

দেখ! যদি কেহ মুখ দিয়া অগ্নিতে ফুঁ দেয়, সে সময় মুখের বায়ু প্রসারিত হয় অল্প বেগে, কিন্তু নল দ্বারা ফুঁ দিলে উহা একত্র হইয়া অধিক বেগে অগ্নির উপর পতিত হয়। সেইরূপ মুখে বস্ত্র বাঁধিয়া বায়ু রুদ্ধ করিলে, উহা নাসিকা দ্বারা অত্যন্ত বেগের সহিত বহির্গত হইয়া জীবগণকে অধিক দুঃখ দেয়। এই নিমিত্ত যাহারা মুখে পট্টি বাঁধে না, তাহারাই অধিকতর ধার্মিক। তদ্ব্যতীত পড়িবার সময় মুখে বস্ত্র বাঁধিলে অক্ষরগুলি যথাযোগ্য স্থান এবং প্রযত্নের সহিত উচ্চারণও হয় না। নিরনুনাসিক অক্ষরগুলি সানুনাসিক উচ্চারণ করিলে দোষ ঘটে।

আবার মুখে পটি বাঁধিলেও দুর্গন্ধ বৃদ্ধি পায়। কেননা শরীরের অভ্যন্তর দুর্গন্ধে পরিপূর্ণ। শরীর হইতে যত বায়ু নির্গত হয় তাহা যে দুর্গন্ধযুক্ত ইহা প্রত্যক্ষ। উহাকে রুদ্ধ করিলে দুর্গন্ধও। অধিক বৃদ্ধি পায়। যথা –বদ্ধ শৌচাগার অধিক, কিন্তু খোলা শৌচাগার অল্প দুর্গন্ধযুক্ত হয়, সেইরূপ মুখে বস্ত্র বাঁধিলে, দন্তধাবন, মুখপ্রক্ষালন, স্নান এবং বস্ত্র ধৌত না করিলে তোমাদের শরীর হইতে অধিকতর দুর্গন্ধ উৎপন্ন হয়। ফলে পৃথিবীস্থ জীবগণ নানাপ্রকার রোগাক্রান্ত হইয়া। যতই কষ্ট ভোগ করে; ততই তোমাদের পাপ বৃদ্ধি পাইতে থাকে।

মেলা প্রভৃতিতে অধিক দুর্গন্ধ ইহলে বিসূচিকা বা ওলাউঠা ইত্যাদি নানা রোগের সৃষ্টি হয়। তাহাতে জীবগণের অধিক কষ্ট হয়; কিন্তু দুর্গন্ধ অল্প হইলেও রোগ অল্প হওয়ায় জীবকুলকে অধিক কষ্ট ভোগ করিতে হয় না। অতএব তোমরা অধিক দুর্গন্ধ বৃদ্ধি কর বলিয়া অধিক অপরাধী। কিন্তু যাহারা মুখে বস্ত্র বাঁধে না, পক্ষান্তরে দন্তধাবন, মুখপ্রক্ষালনও স্নান করে এবং বস্ত্র পরিষ্কার করে তাহারা তোমাদের অপেক্ষা অনেক ভাল।

অন্ত্যজদিগের দুর্গন্ধযুক্ত সংসর্গ হইতে পৃথক থাকা খুব ভাল। যেরূপ তাহাদের দুর্গন্ধাদি সংস্পর্শে থাকিলে বুদ্ধি নিৰ্ম্মল হয় না, সেইরূপ তুমিও তোমাদের সহচরদিগের বুদ্ধিও সেই কারণে বৃদ্ধি পায় না। যেমন রোগাধিক্য এবং স্বল্পবুদ্ধি ধর্মানুষ্ঠানে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, সেইরূপ। তোমার ও তোমাদের দুর্গন্ধযুক্ত সহচারীদিগেরও অবস্থা হইয়া থাকে।

প্রশ্ন –যেরূপ বদ্ধ গৃহে প্রজ্জ্বলিত অগ্নির শিখা বহির্গত হইয়া বাহিরের জীবদিগকে কষ্ট দিতে পারে না, সেইরূপ আমরাও মুখে বস্ত্র বাঁধিয়া এবং বায়ুকে রুদ্ধ করিয়া বাহিরের জীবদিগকে

স্বল্প দুঃখ দিয়া থাকি। মুখে পট্টি বাঁধিলে বাহিরের বায়ুস্থিত জীবের কষ্ট হয় না। যেরূপ সম্মুখবর্তী। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকে হস্ত দ্বারা আড়াল করিলে উত্তাপ কম অনুভূত হয়, সেইরূপ মুখে বস্ত্র বাঁধিলে। বহিঃবায়ুস্থিত জীবদিগের কষ্ট হয় না। তবে, বায়ুস্থ জীবগণ শরীরধারী বলিয়া তাহাদের অবশ্য কষ্ট হইয়া থাকে।

উত্তর –তুমি যাহা বলিলে, তাহাও বালকোচিত। প্রথমতঃ দেখ! গৃহে বায়ু সঞ্চালনের জন্য। দেওয়ালে ছিদ্র না থাকিলে, অগ্নি জ্বলিতেই পারে না। যদি ইহা প্রত্যক্ষ দেখিতে ইচ্ছা কর, তবে একটি ফানুসের মধ্যে প্রদীপ জ্বালিয়া সমস্ত ছিদ্র বন্ধ করিয়া দেখ। প্রদীপ তৎক্ষণাৎ নিভিয়া যাইবে। বাহিরের বায়ুর সহিত যোগ ব্যতীত যেমন মনুষ্যাদি প্রাণী পৃথিবীতে জীবন ধারণ করিতে পারে না, সেইরূপ অগ্নিও জ্বলিতে পারে না। এক দিক হইতে অগ্নির বেগ রোধ করা হইলে, অন্য দিক হইতে অগ্নি বেগে নির্গত হয় এবং হস্তদ্বারা আড়াল করিলে মুখে অগ্নির উত্তাপ কম লাগে, কিন্তু হস্তে অধিক উত্তাপ লাগিতে থাকে। অতএব তোমাদের কথা যুক্তিসঙ্গত নহে।

প্রশ্ন –সকলেই জানে যে, যখন কোন নিম্নপদস্থ ব্যক্তি কোন উচ্চ পদস্থ ব্যক্তির কানে কানে, কিংবা কাছাকাছি হইয়া কথা বলে, তখন সে মুখের সামনে হাতের আড়াল দিয়া থাকে যেন মুখ। হইতে থুথু নির্গত হইয়া তাঁহার উপরে না পড়ে, এবং তিনি যেন দুর্গন্ধ অনুভব না করেন। আর যখন পুস্তক পাঠ করে তখন অবশ্যই মুখ হইতে থুথু উড়িয়া পুস্তকের উপর পতিত হয়, এবং পুস্তকটি উচ্ছিষ্ট ও বিকৃত হয়। এই নিমিত্তে মুখে বস্ত্র বাঁধা ভাল।

উত্তর –এতদ্বারা সিদ্ধ হইল যে, জীবরক্ষার্থ মুখে পট্টি বাঁধা বৃথা। যদি কোন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সহিত কথা বলি, সে সময়ে মুখে হস্ত অথবা আবরণ দিবার উদ্দেশ্য এই যে, সেই গোপনীয় কথা যেন অপর কেহ শুনিতে না পায়। কারণ প্রকাশ্যে কথা বলিবার সময় কেহ হস্ত কিংবা আবরণ রাখে না। সুতরাং জানা যাইতেছে যে, গোপনীয় কথার জন্যই এইরূপ করা হইয়া থাকে।

দম্ভধাবন প্রভৃতি না করায় তোমাদের মুখ প্রভৃতি অবয়ব হইতে অত্যন্ত দুর্গন্ধ নির্গত হয়। তখন তোমরা কাহারও নিকট, কিংবা কেহ তোমাদের নিকট বসিলে দুর্গন্ধ ব্যতীত অন্য কী আসিতে পারে?

মুখে হস্ত আড়াল অথবা আবরণ দিবার আরও অনেক প্রয়োজন আছে। যথা বহুলোকের সম্মুখে কোন গোপনীয় কথা বলিবার সময় মুখে হস্তের আড়াল কিংবা আবরণ না দিলে, অন্যলোকদিগের দিকে বায়ু প্রসারিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে কথাগুলি ছড়াইয়া পড়ে। যখন তাহারা দুই জন নির্জন স্থানে কথা বলে, তখন মুখে হস্ত অথবা আবরণ রাখে না। কারণ এই যে, সে স্থানে তৃতীয় কোন শ্রোতা থাকে না।

যদি বলা হয় যে, উচ্চপদস্থ ব্যক্তির উপর থুথু না পড়াই উদ্দেশ্য তাহা হইলে কি নিম্নপদস্থ ব্যক্তির উপর থুথু নিক্ষেপ করা সঙ্গত? ঐ থুথু হইতে রক্ষা পাওয়াও যায় না; কারণ যখন কেহ দূর হইতে কথা বলে, তখন বায়ু তাহার দিক হইতে অন্যের দিকে যায়, এবং তাহার থুথু সূক্ষ্ম ত্রসরেণুরূপে অন্যের শরীরের উপরে পতিত হয়। তাহা দোষজনক মনে করা অজ্ঞতা।

কারণ, মুখের উষ্ণতায় জীব মরিলে, বৈশাখ কিংবা জৈষ্ঠমাসে সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে “বায়ুকায়” জীব না মরিয়া একটিও জীবিত থাকিত না। সুতরাং সেই উষ্ণতায় যখন জীব মরে না, তখন তোমাদের সিদ্ধান্ত মিথ্যা। কেননা যদি তোমাদের তীর্থঙ্করগণ পূর্ণবিদ্য হইতেন তাহা হইলে তাহারা এইরূপ কথা কখনও বলিতেন না।

দেখ! যে সকল জীবের বৃত্তি সমূহ সমস্ত অবয়বের সহিত বিদ্যমান্ থাকে, তাহাদের পক্ষেই কষ্টবোধ করা সম্ভবপর। এ বিষয়ে প্রমাণ–

পঞ্চাবয়বয়োগাৎসুখসংবিত্তিঃ ॥ ইহা সাংখ্য শাস্ত্রের সূত্র ॥

পঞ্চ বিষয়ের কথিত পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ হইলেই জীব সুখ-দুঃখ অনুভব করিয়া থাকে। যথা বধিরকে গালি দেওয়া, অন্ধকে রূপ দেখান, অথবা অন্ধের সম্মুখে সর্প এবং ব্যাঘ্রাদি ভয়ঙ্কর জীবের চলিয়া যাওয়া, সেইরূপ স্পর্শজ্ঞানহীনের পক্ষে স্পর্শ, ঘ্রাণশক্তিবিহীনের পক্ষে গন্ধ এবং জিহ্বা হীনের পক্ষে রসাস্বাদন করা অসম্ভব। পূর্বোক্ত বায়ুকায় জীব সম্বন্ধেও একথা প্রযোজ্য।

দেখ! যখন মনুষ্যের জীব সুষুপ্তি অবস্থায় থাকে, তখন তাহার সুখ-দুঃখ কিছুই অনুভব হয় না; তখন জীব শরীরস্থ থাকিলেও, তাহার সহিত বাহ্যাবয়বগুলির সম্বন্ধ না থাকায় সুখ-দুঃখ অনুভবও হইতে পারে না।

আধুনিক চিকিৎসকগণ রোগীকে মাদকদ্রব্য খাওয়াইয়া অথবা তাহার ঘ্রাণ গ্রহণ করাইয়া তাহার শরীরে অস্ত্রোপচার করিয়া থাকেন। তখন রোগীর কিছুই দুঃখ অনুভব হয় না। সেইরূপ বায়ুকায় এবং অন্যান্য স্থাবর দেহধারী জীবদের কখনও সুখ-দুঃখ হইতে পারে না।

যেমন মূর্হিত অবস্থায় কোন প্রাণী সুখ-দুঃখ অনুভব করিতে পারে না। তাহা হইলে ঐ সকল জীবকে দুঃখ-কষ্ট হইতে রক্ষা করার কথা উঠিতেই পারে না। যখন তাহাদের সুখ-দুঃখ প্রাপ্তিই প্রত্যক্ষ হয় না, তখন অনুমানাদি কীরূপে যুক্তিযুক্ত হইতে পারে?

প্রশ্ন –তাহারা তো জীব; সুতরাং তাহাদের সুখ-দুঃখ হইবে না কেন?

উত্তর –ও হে। সরলবৃদ্ধি ভ্রাতৃগণ। শোন, সুষুপ্তি অবস্থায় তোমাদের সুখ-দুঃখের অনুভব। হয় না কেন বলিতে পার? সুখ-দুঃখ প্রাপ্তির হেতু আত্মার সহিত মন ও ইন্দ্রিয়ের প্রসিদ্ধ সম্বন্ধ আছে, এইমাত্র ইহার উত্তর দেওয়া হইয়াছে যে, চিকিৎসক যেরূপ মাদক দ্রব্য ঘ্রাণ করাইয়া অস্ত্রোপচার করিলে রোগীর দুঃখানুভব হয় না। সেইরূপ অতিমূচ্ছিত জীবদেরও সুখ-দুঃখানুভব হয় না, কারণ সেস্থলে সুখ-দুঃখের কোন সাধন নাই।

প্রশ্ন –দেখ! আমরা ‘নিলোতি’ যত প্রকার হরিৎ শাক পাতা, তরিতরকারী কন্দমূল আছে উহা ভক্ষণ করি না। কারণ শাকপাতাতে বহু এবং কন্দমূলে অনন্ত জীব আছে। এ সকল বস্তু। ভোজন করিলে, তন্মধ্যে যে সকল জীব আছে তাহাদিগকে হত্যা করা এবং দুঃখ দেওয়ার জন্য আমরা পাপী হইব।

উত্তর –তোমরা অজ্ঞতা বশতঃ এইরূপ বলিতেছ। তোমরা কীরূপে মনে কর যে, হরিৎ শাক-পাতা ভক্ষণ করিলে জীবহত্যা করা কিংবা তাহাকে কষ্ট দেওয়া হয়? এ সকলের কষ্ট হয়। তাহাত তোমরা প্রত্যক্ষ দেখিতে পাও না। যদি দেখিতে পাও, তবে আমাদিগকে দেখাও। কিন্তু, তোমরা কখনও তাহা প্রত্যক্ষরূপে দেখিতে বা আমাদিগকে দেখাইতে পারিবে না। যেস্থলে প্রত্যক্ষের অভাব, অনুমান, উপমান এবং শব্দ প্রমাণও ঘটিতে পারে না। সুতরাং আমরা পূর্বে যে উত্তর দিয়া আসিয়াছি, ও সম্বন্ধেও তাহাই উত্তর। কেননা, যে সকল জীব অত্যন্ত অন্ধকারে, মহাসুষুপ্তি এবং মহা মাদকতায় আচ্ছন্ন থাকে, তাহারাও সুখদুঃখ অনুভব করে, এইরূপ মত প্রকাশ করায় তোমাদের তীর্থঙ্করগণ ভ্রমে পতিত হইয়াছেন বুঝা যায়। তাহারা তোমাদের এইরূপ যুক্তি এবং বিদ্যাবিরুদ্ধ উপদেশ দিয়াছেন।

ভাল, সীমাবদ্ধ গৃহের মধ্যে অনন্ত জীব কীরূপে থাকিতে পারে? যখন কন্দের অন্ত প্রত্যক্ষ করিতেছ, তখন তন্মধ্যে অবস্থানকারী জীবের অন্ত থাকিবে না কেন? সুতরাং তোমাদের যুক্তি নিতান্ত ভুল।

প্রশ্ন –দেখ! তোমরা জল না ফুটাইয়া পান কর, তাহাতে খুব পাপ হয়। আমরা যেরূপ উষ্ণ জল পান করি সেইরূপ তোমরাও জল ফুটাইয়া পান করিবে।

উত্তর –ইহাও তোমাদের ভ্রম। তোমরা যখন জল ফুটাও, তখন জলের মধ্যে যে সকল জীব থাকে, তাহারা মরিয়া যায়। তাহাদের শরীর জলের সহিত সিদ্ধ হইতে থাকে এবং সেই জল। মৌরির আরকের ন্যায় হয়। তোমরা তাহাদের দেহের আরক পান কর। তাহাতে তোমাদের। ঘোরতর পাপ হইয়া থাকে। আর যাহারা জল ফুটাইয়া পান করে না, তাহাদের পাপ হয় না। কারণ জল উত্তপ্ত না করিয়া পান করিলে জলের জীবগুলি উদরস্থ হইবার পর কিঞ্চিৎ উত্তাপ প্রাপ্ত হইয়া নিঃশ্বাসের সহিত জীবগুলি বাহির হইয়া যাইবে। বাস্তবিক জলকায় জীবদিগকে সুখ-দুঃখ পূর্বোক্ত নিয়মে ঘটিতে পারে না এবং এ সম্বন্ধে কাহারও পাপ হয় না।

প্রশ্ন –জঠরাগ্নির উত্তাপে যদি জীবগুলি বাহির হইয়া যাইতে পারে, তবে জল ফুটাইবার। সময় উত্তাপ বশতঃ তাহারা জল হইতে বহির্গত হইবে না কেন?

উত্তর –হাঁ, অবশ্য বহির্গত হয়, কিন্তু তোমাদের মতানুসারে মুখবায়ুর উত্তাপে জীব মরিয়া যায়। সুতরাং জল উত্তপ্ত করিলে তোমাদের মতানুসারে জীবগুলি মরিয়া যাইবে অথবা অধিক

কষ্ট পাইয়া বহির্গত হইবে। তাহাদেরও শরীর জলের মধ্যে সিদ্ধ হইয়া যাইবে। তাহাতে তোমাদের অধিক পাপ হইবে, না হইবে না?

প্রশ্ন –আমরা স্বহস্তে জল ফুটাইনা, বা কোনও গৃহস্থকেও ফুটাইতে দিই না। অতএব আমাদের পাপ হয় না।

উত্তর –তোমরা ফুটান জল ব্যবহার না করিলে এবং পান না করিলে গৃহস্থেরা জল ফুটাইবে কেন? সুতরাং তোমরাই সেই পাপের ভাগী, বরং তোমরা অধিকতর পাপী। কারণ যদি এক গৃহস্থকে জল ফুটাইতে বলিতে, তাহা হইলে একই স্থানে জল ফুটান হইত। কিন্তু গৃহস্থগণ জানে। না যে, কখন কোন সাধু কাহার গৃহে উপস্থিত হইবেন, এইজন্য প্রত্যেক গৃহস্থ স্ব স্ব গৃহে জল ফুটাইয়া রাখে। অতএব তোমরাই মুখ্যতঃ ইহার পাপের ভাগী।

দ্বিতীয়তঃ –অধিক কাষ্ঠ দগ্ধ করিবার এবং আগুন জ্বালাইবার জন্য উল্লিখিত যুক্তি ও প্রমাণ অনুসারে রন্ধন, কৃষি এবং বাণিজ্যাদিতে তোমরাই অধিকতর পাপী এবং নরকগামী হইয়া থাক। যেহেতু জল ফুটান সম্বন্ধে তোমরাই প্রধানতঃ দায়ী এবং যেহেতু তোমরাই উপদেশ করিয়া থাক যে, ফুটান জল পান করা উচিত এবং জল না ফুটাইয়া পান করা উচিত নহে। অতএব তোমরাই মুখ্যতঃ সেই পাপের ভাগী। তাই যাহারা তোমাদের উপদেশ মান্য করিয়া ঐরূপ কার্য করে, তাহারাও পাপী।

এখন দেখ, তোমরা ঘোরতর অবিদ্যার মধ্যে রহিয়াছ কি না। ক্ষুদ্র প্রাণীদের প্রতি দয়া করা এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিন্দা ও অপকার করা কি সামান্য পাপ? যদি তোমাদের তীর্থঙ্করদের মত সত্য হইত, তাহা হইলে ঈশ্বর সৃষ্টিতে এত জল বর্ষণ, এত নদী এবং এত জলই বা উৎপন্ন করিলেন কেন? সূৰ্য্যকে সৃষ্টি না করিলেই হইত, কারণ তোমাদের মতানুসারে ইহাতে কোটি কোটি জীব মরে। যে সকল তীর্থঙ্করকে তোমরা ঈশ্বর বলিয়া বলিয়া বিশ্বাস কর, তাঁহারা তো বিদ্যমান ছিলেন; তাহারা দয়া করিয়া সূর্যের উত্তাপ এবং মেঘোৎপত্তি নিবারণ করিলেন না কেন?

পূৰ্ব্বে যেরূপ বর্ণিত হইয়াছে সেইরূপে যে সকল প্রাণী জীবন ধারণ করে, তাহারাই সুখ-দুঃখ অনুভব করিতে পারে, কন্দমূলাদি মধ্যে যে সকল জীব অবস্থিতি করে, তাহাদের পক্ষে তাহা অসম্ভব। আবার সকল জীবকে সর্ব প্রকার দয়া করাও দুঃখের কারণ। কেননা, সকলেই যদি তোমাদের মতানুযায়ী হয় এবং দস্যু-তস্কর প্রভৃতিকে কেহই দণ্ড না দেয়, তাহা হইলে কী পরিমাণ পাপ প্রবল হইয়া উঠিবে? যথোচিত দণ্ডদান এবং শ্রেষ্ঠদিগকে পালন করার নামই দয়া। ইহার বিপরীত আচরণ করিলে দয়া এবং ক্ষমা রূপ ধর্ম নষ্ট হইয়া যায়।

বহু জৈন দোকান করে, ব্যবসাক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলে, পরের ধন আত্মসাৎ করে এবং দরিদ্রদিগকে প্রতারণা করে। এ সকল কুকর্ম নিবারণাৰ্থ বিশেষ উপদেশ দাও না কেন? মুখে পট্টি বাঁধার ভড়ং কর কেন?

শিষ্য-শিষ্যা করিবার সময় কেশ লুঞ্চন এবং বহুদিন ব্যাপী উপবাস দ্বারা পরের অথবা নিজের আত্মাকে কষ্ট দেওয়া, স্বয়ং দুঃখ ভোগ করিয়া অপরকেও দুঃখ দেওয়া, এবং আত্মঘাতী হওয়া অর্থাৎ আত্মাকে ক্লিষ্ট করা ইত্যাদি হিংসাজনক কাৰ্য্য কর কেন?

জৈনগণ হস্তী, অশ্ব, বৃষ এবং উষ্ট্রের উপর আরোহণ করা এবং লোক খাটান পাপ মনে করে কেন? তোমাদের মধ্যে সাধারণ শিষ্যবর্গ যে সকল অর্থশূন্য কথা সত্য বলিয়া প্রমাণ করিতে পারে না, তোমাদের তীর্থঙ্করগণও সে সকল সত্য বলিয়া প্রমাণ করিতে পারেন না। যখন তোমরা শাস্ত্র আবৃত্তি কর বা প্রবচন দাও শ্রোতা এবং তোমাদের বিশ্বাস অনুসারে অনেক জীব বলার পথে মরিয়া যায়। তোমরা সেই পাপের মুখ্য কারণ হও কেন? এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা হইতে বিশেষরূপে লইতে হইবে যে, জল, স্থল এবং বায়ুস্থ স্থাবর শরীর বিশিষ্ট অত্যন্ত মূচ্ছিত জীবদের সুখ বা দুঃখানুভাব হইতে পারে না।

এখন জৈনদের আরও কিছু অসম্ভব কথার উল্লেখ করা যাইতেছে; এ সকল শ্রবণ করা উচিত। এবং লক্ষ্য রাখা উচিত যে, নিজ হস্তের সার্ধ ত্রিহস্ত পরিমাণে হয় এক ‘ধনুষ’ এবং কাল গণনা সম্বন্ধে পূর্বে যাহা লেখা হইয়াছে সেইরূপ জানা উচিত।

রত্নসার, ভাগ ১, পৃষ্ঠা ১৬৬-১৬৭ পৰ্য্যন্ত লেখা আছে —

(১) ঋষভ দেবের শরীর ৫০০ (পাঁচ শত) ধনু লম্বা ও ৮৪০০০০০ (চুরাশী লক্ষ) পূর্ব’* বর্ষ আয়ু।

(২) অজিত নাথ। ইহার ৪৫০ (সাড়ে চার শত) ধনুষ পরিমাণের শরীর এবং ৭২০০০০০ (বাহাত্তর লক্ষ) পূর্ব’ বর্ষ আয়ু।

(৩) সম্ভব নাথ। ইহার ৪০০ (চারশত) ধনু পরিমাণের শরীর এবং ৬০০০০০০ (ষাট লক্ষ) ‘পূর্ব’ বর্ষ আয়ু।

(৪) অভিনন্দন। ইহার ৩৫০ (সাড়ে তিন শত) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ৫০০০০০০ (পঞ্চাশ লক্ষ) পূর্ব বর্ষ আয়ু।

(৫) সুমতিনাথ। ইহার ৩০০(তিন শত) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ৪০০০০০০ (চল্লিশ লক্ষ) ‘পূর্ব’ বর্ষ আয়ু।

(৬) পদ্ম প্রভ। ইহার ১৪০ (এক শত চল্লিশ) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ৩০০০০০০ (ত্রিশ লক্ষ) ‘পূর্ব’ বায়ু আয়ু। [‘পূর্ব’ ইহার পরিমাণ– সত্তর লক্ষ ছাপান্ন সহস্র বৎসর।]

(৭) ‘সুপার্শ্বনাথ। ইহার ২০০ (দুই শত) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ২০০০০০০ (কুড়ি লক্ষ) ‘পূর্ব’ বর্ষ আয়ু।

(৮) চন্দ্রপ্রভ। ইহার ১৫০ (একশত পঞ্চাশ) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ১০০০০০০ (দশ লক্ষ) ‘পূর্ব’ বর্ষ আয়ু।

(৯) সুবিধিনাথ। ইহার ১০০ (একশত) ধনুষ, পরিমাণ শরীর এবং ২০০০০০ (দুই লক্ষ) ‘পূর্ব’ বর্ষ আয়ু।

(১০) শীতলনাথ। ইহার ৯০ (নব্বই) ধনু পরিমাণ এবং ১০০০০০ (এক লক্ষ) পূর্ব বর্ষ আয়ু।

(১১) শ্রেয়াংসনাথ। ইহার ৮০ (আশী) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ৮৪০০০০০ (চুরাশী লক্ষ) বর্ষ আয়ু।

(১২) বাসুপূজা স্বামীর ৭০ (সত্তর) ধনুষ পরিমাণ শরীর এবং ৭২০০০০০ (বাহাত্তর লক্ষ) বর্ষ আয়ু।

(১৩) বিমলনাথ। ইহার ৬০ (ষাট) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ৬০০০০০০ (ষাট লক্ষ) বর্ষ আয়ু।

(১৪) অনন্তনাথ। ইহার ৫০ (পঞ্চাশ) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ৩০০০০০ (ত্রিশ লক্ষ) বর্ষ আয়ু।

(১৫) ধর্মনাথ। ইহার ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) ধনু পরিমাণ শরীর ১০০০০০০ (দশ লক্ষ) বর্ষ আয়ু।

(১৬) শান্তিনাথ। ইহার ৪০ (চল্লিশ) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ১০০০০০ (এক লক্ষ) বর্ষ আয়ু।

(১৭) কুথুনাথ। ইহার ৩৫ (পঁয়ত্রিশ) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ৯৫০০০ (পঁচানব্বই সহস্র) বর্ষ আয়ু।

(১৮) অমরনাথ। ইহার ৩০ (ত্রিশ) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ৮৪০০০ (চুরাশী সহ) বর্ষ, আয়ু।

(১৯) মল্লীনাথ। ইহার ২৫ (পঁচিশ) ধনুষ পরিমাণ শরীর এবং ৫৫০০০ (পঞ্চান্ন সহস্য) বর্ষ আয়ু।

(২০) মুণিসুব্রত। ইহার ২০ (কুড়ি) ধনুষ বর্ষ আয়ু। পরিমান শরীর এবং ৩০,০০০ (ত্রিশ সহস্র) বর্ষ আয়ু।

(২১) নমিনাথ। ইহার ১৪ (চৌদ্দ) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ১০০০০ (দশ সহস্র) বর্ষ আয়ু।

(২২) নেমিনাথ। ইহার ১০ (দশ) ধনু পরিমাণ শরীর এবং ১০০০ (এক সহস্র) বর্ষ আয়ু।

(২৩) পার্শ্বনাথ। ইহার ৯ (নয়) হাত পরিমাণ দেহ এবং ১০০ (এক শত) বর্ষ আয়ু।

(২৪) মহাবীর স্বামী। ইহার ৭ (সাত) হাত পরিমাণ এবং ৭২ (বাহাত্তর) বর্ষ আয়ু।

সমীক্ষক –এই ২৪ জন তীর্থঙ্কর জৈনমতের প্রবর্তক, আচাৰ্য্য এবং গুরু। জৈনগণ হঁহাদিগকে পরমেশ্বর বলিয়া বিশ্বাস করেন। ইহারা সকলেই মোক্ষপ্রাপ্ত হইয়াছেন। এস্থলে সুধীজনের বিবেচ্য এই যে, এত প্রকাণ্ড শরীর এবং এত আয়ু হওয়া কি সম্ভবপর? এইরূপ অতি অল্প সংখ্যক মনুষ্যের পক্ষে এই পৃথিবীতে বাস করা সম্ভব। এ সকল জৈন আখ্যায়িকা অবলম্বন করিয়া পৌরাণিকগণ এক লক্ষ দশ সহস্র বৎসর এবং এক সহস্র বৎসর আয়ুর কথা উল্লেখ করিয়াছেন। তাহাও অসম্ভব। সুতরাং জৈনদিগের কথা কীরূপে সম্ভব হইতে পারে?

এখন আরও শুনুন : –কল্পভাষ্য, পৃষ্ঠা ৪-এ লিখিত আছে যে, “নাগকেতু” গ্রামের সমান একখণ্ড শিলা স্বীয় অঙ্গুলির উপর ধারণ করিলেন।

কল্পভাষ্য, পৃষ্ঠা ৩৭ — “মহাবীর” অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা পৃথিবীর উপর চাপ দিলে শেষনাগ কাঁপিয়া উঠিল।

কল্পভাষ্য পৃষ্ঠা ৪৬ –সর্প মহাবীরকে দংশন করিল, রুধিরের পরিবর্তে দুগ্ধ নির্গত হইল এবং সেই সৰ্প অষ্টম স্বর্গে চলিয়া গেল!

কল্পভাষ্য পৃষ্ঠা ৪৭ –মহাবীরের চরণের উপর পায়সান্ন রন্ধন করা হইল, কিন্তু চরণ পুড়িল।

কল্পভাষ্য পৃষ্ঠা ১৬ –ক্ষুদ্র পাত্রে উষ্ট্র আনয়ন করা হইল।

রত্নসার ভাগ ১ পৃষ্ঠা, ১৪৫ –শরীরের ময়লা পরিষ্কার করিবে না এবং চুলকাইবে না।

বিবেকসার, ভাগ ১, পৃষ্ঠা ২১৫ –“দমসার” নামক জনৈক সাধু ক্রুদ্ধ হইয়া উদ্বেগজনক একটি সূত্র পাঠ করিয়া এক নগরে আগুন লাগাইয়া দেন। তিনি তীর্থঙ্কর মহাবীরের অতিশয় প্রিয় পাত্র ছিলেন।

বিবেকসার, ভাগ ১, পৃষ্ঠা ২২৭ রাজার আদেশ মান্য করা অবশ্য কর্ত্তব্য।”কোশা” নাম্মী কোন বেশ্যা একখানা থালার উপরে রাশীকৃত সর্ষপের মধ্যে পুষ্পচ্ছাদিত উৰ্দ্ধমুখ কুঁচের উপর উত্তমরূপে নৃত্য করা সত্ত্বেও তাহার চরণ চবিদ্ধ হইল না। সর্ষপেরও স্তূপ ছড়াইয়া পড়িল না!!!

তত্ত্ববিবেক পৃষ্ঠা ২২৮ –“স্কুল” নামক কোন মুনি পূর্বোক্ত “কোশা” নাশ্ৰী বেশ্যার সহিত ১২ বৎসর সম্ভোগ করিবার পর দীক্ষা গ্রহণ করিয়া সঙ্গতি লাভ করিলেন। কোশা বেশ্যাও জৈনধৰ্ম্ম পালন করিয়া সঙ্গতি লাভ করে।

বিবেকার, ভাগ ১, পৃষ্ঠা ১৯৪ –জনৈক সিদ্ধ পুরুষের কন্থা–যাহা গলায় ধারণ করা হয়, সে বৈশ্যকে প্রতিদিন পাঁচ শত করিয়া স্বর্ণমুদ্রা দিত।

বিবেকার ভাগ ১ পৃষ্ঠা ২২৮ –বলবান্ ব্যক্তির আদেশ, দেব আদেশ, ঘোর বনে কষ্টের সহিত জীবন যাপন, গুরু, মাতা, পিতা, কুলাচাৰ্য, জাতিবর্গ ও ধর্মোপদেষ্টা; এই ছয় জনের বিরুদ্ধাচরণ বশতঃ ধর্ম পালনে ব্যতিক্রম হইলে ধর্মহানি হয় না।

সমীক্ষক –এখন হঁহাদের মিথ্যা কথাগুলি কীরূপ তাহা বিচার করুন। একজন মানুষ গ্রামের সমান এক খণ্ড প্রস্তর কি অঙ্গুলীর উপর ধারণ করিতে পারে? ॥১ ॥

অঙ্গুষ্ঠের চাপে কখনও কি পৃথিবী ধসিয়া যাইতে পারে? এবং যখন শেষ নাগই নাই; সে অবস্থায় কাপিবে কে? * ‘পূর্ব’ ইহার পরিমাণ– সত্তর লক্ষ ছাপান্ন সহস্র বৎসর। ২ ॥

ভাল! –শরীরের দংশন করা হইলে তাহা হইতে দুগ্ধ নির্গত হয়, ইহা কেহই দেখে নাই। ইহা ইন্দ্রজাল ব্যতীত আর কিছুই নহে ॥ ৩ ॥

তাহার দর্শনকারী সর্প তো স্বর্গে গেল, কিন্তু মহাত্মা শ্রীকৃষ্ণ প্রভৃতি তৃতীয় নরকে গেলেন, ইহা কত বড় মিথ্যা কথা! ॥ ৫ ॥

যখন মহাবীরের চরণের উপর পায়সান্ন রন্ধন করা হইয়াছিল, তখন তাহার চরণ পুড়িয়া গেল। কেন? ॥ ৬ ॥

ভাল, একটি ক্ষুদ্র পাত্রে কি একটি উষ্ট্র স্থান পাইতে পারে? ॥ ৫ ॥

শরীরের ময়লা পরিষ্কার না করিলে, না চুলকাইলে চর্মরোগ জন্মে এবং দুর্গন্ধরূপ মহানরক ভোগ করিতে হয় ॥৭ ॥

যে সাধু নগরে আগুন লাগাইলেন, তাহার দয়া এবং ক্ষমা কোথায় গেল? যদি মহাবীরের সংসর্গেও তাহার আত্মা পবিত্র না হয়, তবে মহাবীরের মৃত্যুর পর জৈনগণ তাহার আশ্রয়ে কখনও পবিত্র হইবে না ॥ ৮ ॥

রাজার আদেশ পালন করা অবশ্য কর্তব্য; কিন্তু জৈনগণ বণিক বলিয়া রাজার ভয়বশতঃ ইহা লিখিয়া থাকিবেন। ৯।

কোশা বেশ্যার শরীর যতই লঘু হউক না কেন, সরিষা-স্তূপের উপর উর্দ্ধমুখ উঁচ রাখিয়া, তদুপরি নৃত্য করা সত্ত্বেও সূচবিদ্ধ না হওয়া এবং সর্ষপ রাশি বিকর্ণ না হওয়া, সম্পূর্ণ মিথ্যা নহে। তো কি? ॥ ১০ ॥

ভাল! –বস্ত্র নির্মিত কন্থা কীরূপে প্রতিনিয়ত ৫০০ স্বর্ণমুদ্রা দিতে পারে? ॥১১।

যাহাই ঘটুক না কেন, কাহারও কোন অবস্থায় ধর্ম পরিত্যাগ করা উচিত নহে ॥

ইঁহাদের অসম্ভব কাহিনীগুলি লিখিতে গেলে এই গ্রন্থখানি জৈনদের অসার গ্রন্থগুলির ন্যায় অনেক বাড়িয়া যাইবে। এই জন্য অধিক লেখা হইল না। প্রকৃত পক্ষে জৈনদের অল্প কয়েকটি কথা ব্যতীত অবশিষ্ট সমস্তই মিথ্যায় পরিপূর্ণ। দেখুন : —

দো সসি দো রবি পঢ়মে। দুগুণা লবণংমি ধায় সংডে। বারস সসি বারস রবি। তপমিইংনিদিঠ সসি রবিণো॥ তিগুণা পুব্বিল্পজুয়া। অণংতরাণংতরং মিখিত্তংমি। কালো এ বয়ালা। বিসওরী পুস্কর দ্বং মি ॥ প্রক০ ভা০৪ সংগ্ৰহণী সূত্র ৭৭/৭৮ ॥

যে জম্বুদ্বীপের আয়তন একলক্ষ যোজন অর্থাৎ চার লক্ষ ক্রোশ লেখা আছে, সেই জৈনগ্রন্থে জম্বুদ্বীপকে প্রথম দ্বীপ বলা হইয়াছে। ইহাতে দুইটি চন্দ্র এবং দুইটি সূৰ্য্য আছে। সেইরূপ লবণসমুদ্রে’ তাহার দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪টি চন্দ্র এবং ৪টি সূৰ্য্য আছে। “ধাতকীখণ্ডে” ১২টি চন্দ্র এবং ১২টি সূৰ্য্য আছে। ইহার তিনগুণ করিলে ৩৬ হয়, তাহার সহিত জম্বুদ্বীপের ২ এবং লবণ সমুদ্রের ৪ যোগ করিলে ৪২টি চন্দ্র ও ৪২টি সূৰ্য্য কালোদধি সমুদ্রে আছে ॥

এইরূপে পরবর্তী দ্বীপ ও সমুদ্র সমূহের মধ্যে চন্দ্র ও সূৰ্য্য আছে। পূর্বোক্ত ৪২কে তিনগুণ করিলে ১২৬ হয়। তাহার সহিত ধাতকীখণ্ডের ১২, লবণ সমুদ্রের ৪ এবং জম্বুদ্বীপের ২ যোগ করিলে পুঙ্কর দ্বীপে ১৪৪ চন্দ্র এবং ১৪৪ সূৰ্য্য আছে। ইহাও অর্ধেক মনুষ্য-ক্ষেত্রের গণনা। কিন্তু যে স্থানে মনুষ্যের বসতি নাই, সে স্থানেও অনেক চন্দ্র ও অনেক সূৰ্য্য আছে এবং যে পশ্চাৎ অর্ধ পুষ্করদ্বীপে অনেক চন্দ্র ও সূৰ্য্য আছে। ঐগুলি স্থির আছে।

পূর্বোক্ত ১৪৪-কে তিন গুণ করিলে ৪৩২ হয়; এবং তাহার সহিত পূর্বোক্ত জম্বুদ্বীপের ২ চন্দ্র, ২ সূৰ্য্য, লবণ সমুদ্রের ৪, ধাতকীখণ্ডের ১২ও কালোদধি সমুদ্রের ৪২ যোগ করিলে পুষ্কর সমুদ্রে ৪৯২ চন্দ্র এবং ৪৯২ সূৰ্য্য আছে।

এ সকল বিষয় শ্রীজিনভদ্রগণীক্ষমা শ্ৰমণ কর্তৃক বৃহৎ “সঙ্ঘয়ণী”, “জ্যোতীকরণ্ডক পয়ন্না” এবং “চন্দ পন্নতি” তথা “সূরপন্নতি” প্রভৃতি মুখ্য জৈন সিদ্ধান্ত গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে।

সমীক্ষক — এখন ভূগোল এবং খগোলবিদ্যাবিৎ পণ্ডিতগণ শুনুন। জৈনদের মতে এই পৃথিবীতে এক প্রকার গণনা অনুসারে ৪৯২ এবং অন্যপ্রকার গণনা অনুসারে অসংখ্য চন্দ্র এবং সূৰ্য্য আছে। আপনাদের সৌভাগ্য এই যে আপনারা বেদানুকূল “সূর্যসিদ্ধান্ত” প্রভৃতি জ্যেতিষ গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করিয়া ভূগোল এবং খগোলতত্ত্ব যথার্থরূপে জানিতে পারিয়াছেন। যদি আপনারা। জৈনমতের অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকিতেন, তাহা হইলে আজ কাল জৈনগণ যেরূপ অন্ধকারে আছেন, আপনাদিগকেও সেইরূপ চিরজীবন অন্ধকারে থাকিতে হইত।

এ সকল অজ্ঞ লোকের মনে সংশয় উপস্থিত হইয়াছিল যে, জম্বুদ্বীপে এক চন্দ্র এবং এক সূর্যের দ্বারা কাজ চলিতে পারে না। তাহাদের মনে হইল যে এক চন্দ্র এবং এক সূৰ্য্য এত প্রকাণ্ড পৃথিবীকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে আলোকিত করিতে পারে না। যাহাদের বিশ্বাস সূৰ্য্য অপেক্ষা পৃথিবী বৃহত্তর, তাহারাই এইরূপ ভ্রমে পতিত হয়।

দো সসি দো রবি পংতী। এগংতরিয়া ছঠি সংখায়া। দ্বাদশ সমুল্লাস মৈরুং পয়াহিণং তা। মাণুসখিত্তে পরিঅডংতি ॥ প্রক০ ভা০ ৪ ॥ সংগ্রহসূ০ ৭৯ ॥

(সং অর্থ) –মনুষ্যলোকে চন্দ্র- পঙক্তি এবং সূৰ্য্য-পঙক্তির সংখ্যা বলা যাইতেছে –দুই চন্দ্র পুংক্তি ও দুই সূৰ্য্য পংক্তি (শ্রেণি) আছে। এ সকল এক এক লক্ষ যোজন অর্থাৎ ৪ লক্ষ ক্রোশ ব্যবধানে ভ্রমণ করে। যেমন সূৰ্য্য পঙক্তির অভ্যন্তরে এক চন্দ্র-পঙক্তি আছে, সেইরূপ। চন্দ্র-পঙক্তির অভ্যন্তরেও এক সূৰ্য্য-পঙক্তি আছে। এইভাবে ৪ পঙক্তি আছে। এক এক চন্দ্র-পঙক্তিতে ৬৬ চন্দ্র, এবং এক এক সূৰ্য্য-পঙক্তিতে ৬৬ সূৰ্য্য আছে।

উক্ত চারি পঙক্তি জম্বুদ্বীপের মেরুপৰ্বত প্রদক্ষিণ করিতে করিতে মনুষ্য ক্ষেত্রে পরিভ্রমণ করে। অর্থাৎ যে সময়ে জম্বুদ্বীপের মেরু হইতে একটি সূৰ্য্য দক্ষিণ দিকে ভ্রমণ করে, সেই সময় । দ্বিতীয় সূৰ্য্য উত্তর দিকে ভ্রমণ করে। সেইরূপে লবণ সমুদ্রের’ এক এক দিকে দুইটি করিয়া সূৰ্য্য ভ্রমণ করে। ধাতকীখণ্ডের’ ৬, ‘কালোদধির; ২১, ‘পুষ্করার্ধের’ ৩৬, সর্বসমেত ৬৬টি সূৰ্য্য দক্ষিণ দিকে, এবং ৬৬টি সূৰ্য্য উত্তর দিকে স্ব স্ব ক্রমানুসারে ভ্রমণ করে।

দুই দিকের সূৰ্য্যসমষ্টি ১৩২ এবং ৬৬ করিয়া দুই দিকের চন্দ্র-পঙক্তি সর্বসমেত ১৩২ টি চন্দ্র মনুষ্যক্ষেত্রে ভ্রমণ করে। এইরূপ চন্দ্রের সহিত নক্ষত্রাদিরও বহু পঙক্তি আছে।

সমীক্ষক –ভ্রাতৃগণ! এখন দেখুন। এই পৃথিবীস্থ ১৩২টি সূৰ্য্য এবং ১৩২টি চন্দ্র সম্ভবতঃ জৈনদের গৃহেই উত্তাপ দিয়া থাকে। ভাল! তাহাই যদি হয় তবে তাহারা বাঁচিয়া আছে কেমন করিয়া? রাত্রিতেও সম্ভবতঃ তাহারা শীতে জমিয়া বরফ হইয়া যায়। যাহারা ভূগোল এবং খগোল সম্বন্ধে অজ্ঞ তাহারাই এইরূপ অসম্ভব কথা বিশ্বাস করে, অপর কাহারও পক্ষে তাহা অসম্ভব। যেখানে একটি মাত্র সূৰ্য্য এই পৃথিবীর ন্যায় অন্য বহু ভূমণ্ডলকে আলোকিত করিতেছে, এই ক্ষুদ্র পৃথিবীর সম্বন্ধে কী বলিবার আছে?

যদি পৃথিবী ভ্রমণ না করিত এবং সূৰ্য্য পৃথিবীর চারি দিকে ভ্রমণ করিত, তাহা হইলে কয়েক বৎসরব্যাপী দিন এবং কয়েক বৎসরব্যাপী রাত্রি হইত। সুমেরু হিমালয় পর্বত ব্যতীত অপর কোন পর্বত নহে। কলসীর তুলনায় সরিষাবীজ যেমন, সূর্যের তুলনায় ইহা তদপেক্ষা ক্ষুদ্র। যতদিন জৈনগণ এই মতেই থাকিবেন, ততদিন পর্যন্ত তাঁহারা এ সকল বিষয় বুঝিতে পারিবেন না, সর্বদা অন্ধকারেই থাকিবেন।

সমত্তচরণ সহিয়া। সব্বং লোগং ফুঁসে নিরবসেসং। সত্তয় চ উদয়ভাএ। পংচয় সুয় দেস বিরঈ ॥ প্রক০ ভ০৪। সংগ্রহ সূ০ ১৩৫ ॥

(সং অর্থ) –যে সকল “কেবলী” সম্যক চারিত্রযুক্ত, তাঁহারা “সমুদঘাত” অবস্থা বশতঃ সমস্ত চতুর্দশ রাজ্যলোক আত্মপ্রদেশ সদৃশ বিচরণ করিবেন।

সমীক্ষক –জৈনগণ ১৪ রাজ্য স্বীকার করেন। তন্মধ্যে চতুর্দশ রাজ্যের চূড়ার উপর অবস্থিত সর্বাত্মসিদ্ধি বিমানের ধ্বজার উপর অল্প দূরে সিদ্ধশীলা এবং দিব্য আকাশ আছে। তাহার নাম “শিবপুর”। যাঁহারা “কেবলী” অর্থাৎ “কেবল জ্ঞান, সর্বজ্ঞতা এবং পূর্ণ পবিত্রতা লাভ করেন। তাঁহারা সেই লোকে গমন করেন এবং নিজ আত্মপ্রদেশ সম্বন্ধে সর্বজ্ঞ হইয়া অবস্থিতি করেন।

এখন বিবেচ্য এই যে, যাহার প্রদেশ আছে, সে বিভু নহে; যে বিভু নয় সে কখনও সর্বজ্ঞ এবং “কেবল” জ্ঞানী হইতে পারে না। কারণ, যাহার আত্মা একদেশী, সেই যাতায়াত এবং বন্ধ, মুক্ত, জ্ঞানী বা অজ্ঞান হন। যিনি সর্বব্যাপী এবং সর্বজ্ঞ, তিনি কখনও তদ্রপ হইতে পারে না। জৈন তীর্থঙ্করগণ জীবরূপে অল্প এবং অল্পজ্ঞ হইয়া ছিলেন। তাহারা কখনও সর্বব্যাপক এবং সর্বজ্ঞ হইতে পারেন না। কিন্তু যে পরমাত্মা অনাদি, অনন্ত সর্বব্যাপক, সর্বজ্ঞ, পবিত্র এবং জ্ঞানস্বরূপ জৈনগণ তাহাকে মানেন না। তাহাতেই সর্বজ্ঞাদি প্রভৃতিগুণ যাথাতথ্য প্রযোজ্য।

গর্ভনর তিপলিয়াউ।তিগাউ উক্কোস চে জহন্নেণং। মুচ্ছিম দুহাবি অন্তমুহু। অগুল অসংখ ভাগতণু৷ প্রক০ রত্না, ভাগ ৪ সং সূ০ ২৪১ ॥

(সং অর্থ) –এখানেই দুই প্রকার মনুষ্য আছে –এক গর্ভজ, অন্য গর্ভ ব্যতীত উৎপন্ন। তাহাদের মধ্যে গর্ভজ মনুষ্যের আয়ু উৎকৃষ্ট তিন “পল্যোপম” এবং শরীর তিন ক্রোশ পরিমিত জানিবে।

সমীক্ষক –ভাল! এই পৃথিবীতে তিন “পল্যোপম” আয়ু এবং তিন ক্রোশ পরিমিত শরীরবিশিষ্ট অতি অল্পসংখ্যক মনুষ্যেরই সমাবেশ হইতে পারিবে। তদুপরি তিন “পল্যোপম”, আয়ু যেমন পূর্বে ব্যাখ্যাত হইয়াছে, সেইরূপ যদি বাঁচে, তাহা হইলে তাহাদের সন্তানগণও সেইরূপ তিন ক্রোশ শরীর বিশিষ্ট হওয়া উচিত। এরূপ হইলে বোম্বাই-এর ন্যায় নগরীতেই দুই এবং কলিকাতার ন্যায় নগরীতে তিন কিংবা চারিজন মনুষ্য বাস করিতে পারিবে।

জৈনগণ লিখিয়াছে যে, এক একটি নগরে লক্ষ লক্ষ মনুষ্য বাস করে। তাহা হইলে তাহাদের বাসোপযোগী নগরের আয়তনও লক্ষ লক্ষ ক্রোশ হওয়া আবশ্যক। তাহা হইলে সমস্ত পৃথিবীর এইরূপ একটি নগরও বসবাসের যোগ্য হইবে না।

পণয়াল লরকজোয়ন, বিরকংভা সিদ্ধিসিলফলিহবিমলা। তদুবরি গজোয়ণংতে লোগংতো তচ্ছসিদ্ধঠিঈ ॥ প্রক০ রত্না ৪ সংগ্রহ, সূ ২৫৮ ॥

(সং অর্থ) –সর্বার্থসিদ্ধি বিমানের ধ্বজার উপর ১২ যোজন পরিমিত যে সিদ্ধশিলা আছে, তাহা দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে এবং গভীরতায় ৪৫ লক্ষ যোজন। সেই সিদ্ধশিলা সিদ্ধভূমি শুভ্র, উজ্জ্বল সুবর্ণময় এবং স্ফটিকবৎ নির্মল। কেহ কেহইহার নাম “ঈষৎ” “প্রাগ্‌ভরা”বলে। এই সর্বার্থসিদ্ধশিলা বিমান অপেক্ষা ১২ যোজন অলোক (লোকাতীত)। এই পরমার্থ “কেবলী (বহু) শ্রুত” গণ জানেন।

এই সর্বার্থসিদ্ধশিলা মধ্যভাগে ৮ যোজন স্থূল। সে স্থান হইতে চারিদিশা এবং চারি উপদিশায় হ্রাস পাইতে-পাইতে ইহা মক্ষিকার ডানার ন্যায় লঘু এবং খোলা ছত্রাকার স্থাপিত আছে। এই শিলা হইতে উর্ধে এক যোজন অন্তরে লোকান্ত। সে স্থানে সিদ্ধগণ বাস করেন ॥ ২৫৮ ॥

সমীক্ষক — এখন বিবেচ্য এই যে সর্বার্থসিদ্ধি বিমানের ধ্বজার উপরে ৪৫ যোজন পরিমিত শিলা জৈনদের মুক্তিধাম। কিন্তু স্থানটি এমন উত্তম এবং নির্মল হওয়া সত্ত্বেও তন্মধ্যে অবস্থানকারী মুক্ত জীবগণ এক প্রকার বদ্ধ। কেননা, উক্ত শিলার বাহিরে আসিলেই তাহাদের মুক্তিসুখের অবসান হয় আর ভিতরে থাকিলে তাহারা বায়ুসেবনও করিতে পারিবে না। এ সকল কেবল কল্পনা মাত্র এবং অজ্ঞানদিগকে জালে আবদ্ধ করিবার জন্য ভ্রমজাল স্বরূপ।

বি তি চউরিংদিস সরীরং। বারসূজোয়ণংতিকোস চউকোসং। জোয়ণ সহসপণিং দিয়। উহে বুচ্ছংতবিসেসংতু ॥ প্রক০ ভা০ 4। সংগ্রহ সূ০ ২৬৭ ॥

(সং অর্থ) –সাধারণতঃ এক ইন্দ্রিয়বিশিষ্ট উৎকৃষ্ট জীবের শরীর এক সহস্র যোজন, দুই ইন্দ্রিয়বিশিষ্ট শঙ্খ প্রভৃতির ১২ যোজন। সেইরূপ কীটপতঙ্গাদির তিন ইন্দ্রিয়বিশিষ্ট শরীর তিন ক্রোশের জানিবে। চারি ইন্দ্রিয়বিশিষ্ট ভ্রমর প্রভৃতির ৪ ক্রোশ এবং পঞ্চেন্দ্রিয়বিশিষ্ট জীবের শরীর এক সহস্র যোজন অর্থাৎ চারি সহস্র ক্রোশ জানিবে। ॥২৬৭ ॥

সমীক্ষক — চারি সহস্র ক্রোশ পরিমিত শরীরধারী হইতে অতি অল্পসংখ্যক অর্থাৎ কয়েক শত মনুষ্যের দ্বারা পৃথিবী ঠাসাঠাসিভাবে ভরিয়া যায়, কাহারও নড়িবার চড়িবার স্থান থাকে না। অতঃপর বাসস্থান এবং পথের কথা জৈনদের নিকট জিজ্ঞাসা করিতে হইবে। যেহেতু তাহারা। লিখিয়াছেন, অতএব তাহাদের গৃহেই স্থান দিবেন।

তবে চারি সহস্র ক্রোশ পরিমাণের শরীরবিশিষ্ট কয়েক জন মনুষ্যের বাসের জন্য ৩২ সহস্র ক্রোশ পরিমিত গৃহ আবশ্যক। জৈনদের সমস্ত ধন নিঃশেষে ব্যয় করিলেও এইরূপ গৃহ নির্মিত হইবে না। আবার সেই গৃহের ৮ সহস্র ক্রোশ পরিমিত ছাদ নির্মাণ করিবার জন্য কড়ি বর্গা কোথায় পাওয়া যাইবে? যে ব্যক্তি তন্মধ্যে স্তম্ভ লাগাইবে তাহার পক্ষে ভিতরে প্রবেশ করাও সম্ভবপর হইবে না। অতএব এ সকল কথা মিথ্যা ॥

তে থুলা পল্লে বিহু সংখিজ্জাচেবহুংতি সব্বেবি। তেইক্কিক্ক অসংখে। সুহুমে খংডে পকল্পেহ ॥ প্রক০ ভা০ ৪ ॥

লঘুক্ষেত্র, সমাস প্রকরণ, সূত্র ৪ ॥ (সং অর্থ) –পূর্বোক্ত এক অঙ্গুলী পরিমিত লোমের খণ্ড সমূহ দ্বারা চারি বর্গ ক্রোশ পরিমাণ এবং ততদূর গভীর যদি একটি কূপ খনন করা হয় এবং উহাতে এক অঙ্গুলী পরিমিত যতগুলি খণ্ড হয় ঐ সকলের সমষ্টি ২০,৫৭,১৫২ হইবে। ঘন যোজন পল্যোপমে অত্যধিক পক্ষে এরূপ ৩৩০, ৭৬২১০৪,২৪৬৫৬২৫,৪২১৯৯৬০, ৯৭৫৩৬০০,০০০০০০০ সংখ্যক লোমখণ্ড হইবে ॥ ইহাও সংখ্যাত কাল। পূর্বোক্ত এক লোমখণ্ডের অসংখ্যাত খণ্ড মনে মনে কল্পনা করিলে। অসংখ্যাসূক্ষু রোমাণু হইবে ॥

সমীক্ষক –এখন ইহাদের গণনা পদ্ধতি দেখুন। এক অঙ্গুলী পরিমিত লোমকে কত খণ্ড করা হইয়াছে। ইহা কি কেহ কখনও গণনার মধ্যে আনিতে পারে? আবার তাহার উপরান্ত মনে মনে অসংখ্য খণ্ড কাল কল্পনা করা হয়। এতদ্বারা ইহাও সিদ্ধ হইতেছে যে, সংখ্যাত কাল গণনায়  ইহারা যেন হস্তদ্বারা পূর্বোক্ত খণ্ডগুলি করিয়াছে; যখন হস্তদ্বারা করা সম্ভব হয় নাই, তখন মন। দ্বারা করিয়াছে। ভাল, এক অঙ্গুলী পরিমিত লোমের অসংখ্য খণ্ড হওয়া কি সম্ভব?

জম্বুদ্বীপমাণং গুলজোয়ণলরক বট্টবিরকংভো। লবণাঈয়াসেসা। বলয়াভা দুগুণ দুগণায় ॥ প্রক০ ভা০ ৪। লঘুক্ষেত্রসমা০ সূ০ ১২ ॥

(সং অর্থ) –প্রথম জম্বুদ্বীপের আয়তন এক লক্ষ যোজন। উহা শূন্যগত। লবণ সমুদ্র প্রভৃতি সাত সমুদ্র এবং সাত দ্বীপের প্রত্যেকটির আয়তন জম্বুদ্বীপের আয়তন হইতে পর পর দ্বিগুণ। যেমন পূর্বে লিখিত হইয়াছে, এই একটি পৃথিবীতে জম্বুদ্বীপ প্রভৃতি সাত দ্বীপ এবং সাত সমুদ্র আছে ॥

সমীক্ষক –জম্বুদ্বীপ হইতে দ্বিতীয় দ্বীপ দুই লক্ষ যোজন, তৃতীয় –চারি লক্ষ যোজন, চতুর্থ– আট লক্ষ যোজন, পঞ্চম –ষোল লক্ষ যোজন, ষষ্ঠ –বত্রিশ লক্ষ যোজন এবং সপ্তম –চৌষট্টি লক্ষ যোজন দূরবর্তী। মহাসুমদ্রের আয়তনও এতটা অথবা তদপেক্ষা অধিক। তাহা হইলে এই ১৫ সহস্র ক্রোশ পরিধি বিশিষ্ট ভূমণ্ডলে এ সকলের সমাবেশ কীরূপে হইতে পারে? অতএব এ সকল কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

কুরুনই চুলসী সহসা। ছচ্চেবন্তরনঈউ পইবিজয়ং। দোদো মহা নঈউ। চউদস সহসাউ পত্তেয়ং ॥ প্রক০ রত্না ভা০ ৪। লঘুক্ষেত্রসমা০ সূ০ ৬৩ ॥

(সং অর্থ) –কুরুক্ষেত্রে ৮৪ সহস্র নদী আছে ॥ ৬৩ ॥

সমীক্ষক — কী আর বলিব কুরুক্ষেত্র অতি ক্ষুদ্র দেশ। সে দেশ না দেখিয়া এমন মিথ্যা কথা লিখিতে ইহাদের লজ্জাও হইল না?

জামুত্তরাউতাউ। ইগেগসিংহাসণাউঅইপুং। চউসুবি সুনিয়াসণ, দিসি ভবজিণ মজ্জণং হোঈ ॥ প্রক০ রত্নাকার ভা০ ৪, লঘুক্ষেত্র সমা০ সূ০ ১১৯ ॥

(সং অর্থ) –এই শিলার ঠিক উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে এক একটি সিংহাসন আছে জানিবে। দক্ষিণ দিকে অতিপাণ্ডু কম্বলা, উত্তর দিকে অতিরক্ত কম্বলা নামক শিলা অবস্থিত। এসকল সিংহাসনের উপর তীর্থঙ্করগণ উপবেশন করেন।

সমীক্ষক –জৈন তীর্থঙ্করদের জন্মোৎসব প্রভৃতি অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত শিলাখণ্ড দেখুন। জৈনদের মুক্তিধাম সিদ্ধশিলাও এইরূপ। জৈন গ্রন্থসমূহে এমনই বহু গোলমেলে কথা আছে। সে সকলের কথা আর কী বর্ণনা করা যাইবে? যাহা হউক, জল ছাঁকিয়া পান করা, ক্ষুদ্র প্রাণীদের নাম মাত্র দয়া করা এবং রাত্রিকালে ভোজন না করা, এই তিনটি উত্তম বিষয় ব্যতীত হাঁহাদের অবশিষ্ট কথাই অসম্ভব।

এস্থলে যতদুর লিখিত হইল তাহা হইতেই সুধীগণ অধিক জানিয়া লইবেন। এস্থলে উদাহরণ স্বরূপ কিঞ্চিৎমাত্র লিখিত হইয়াছে। ইহাদের সমস্ত অসম্ভব কথাগুলি লিখিতে গেলে এত বড় পুস্তক হইয়া যাইবে যে, সমস্ত জীবনে তাহা পাঠ করিয়া শেষ করা যাইবে না। যেরূপ হাঁড়ির ফুটন্ত চাউলের মধ্য হইতে একটি চাউল দানা পরীক্ষা করিলেই সমস্ত চাউল সিদ্ধ না অসিদ্ধ জানা যায়, সেইরূপই এই সামান্য বিবরণ পাঠ করিয়া সদাশয় পাঠকবর্গ অনেক বিষয় বুঝিতে পারিবেন। সুধীগণের জন্য বিশেষ বিস্তৃত বিবরণের প্রয়োজন নাই, কারণ দিক-দর্শনের ন্যায় অল্প দেখিয়া সম্পূর্ণ অভিপ্রায় অবগত হইয়া থাকেন। অতঃপর খ্রীষ্টান মত সম্বন্ধে লিখিত হইবে ।

ইতি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতীস্বামীকৃতে সত্যার্থপ্রকাশে
সুভাষাবিভূষিতে নাস্তিক মতান্তর্গত
চারবাক-বৌদ্ধ জৈনমত খণ্ডণ-মণ্ডণ বিষয়ে
দ্বাদশঃ সমুল্লাসঃ সম্পূর্ণঃ ॥১২ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *