চতুর্দশ অধ্যায় – মুক্তিসংগ্রাম (১৯৪৩-৪৭)
যেভাবে ২৮শে মার্চ (১৯৪৩) ফজলুল হকের মন্ত্রীসভার অবসান হয় তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। গভর্নর তাঁহাকে আশ্বাস দিয়াছিলেন যে, তিনি সকল দলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া একটি জাতীয় মন্ত্রিসভা গঠন করিবেন, কিন্তু এইরূপ প্রচেষ্টার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অতঃপর ২৪শে এপ্রিল ১৯৪৩ গভর্নরের আমন্ত্রণে খাজা নাজিমুদ্দীন নূতন মন্ত্রীসভা গঠন করেন। কংগ্রেসের নির্দেশ অমান্য করিয়া তুলসী গোস্বামী ও বরদা পাইন এই মন্ত্রীসভায় যোগ দেন এবং তপশীল সম্প্রদায়ভুক্ত কয়েকজন হিন্দুও মন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু ইহাকে কোনক্রমেই জাতীয় মন্ত্রীসভা বলা যায় না বরং লীগ মন্ত্রীসভা বলাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।
নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীসভা গঠন করিবেন এই সংবাদ প্রচারিত হইবার পরই ফজলুল হক এবং কৃষক-প্রজা পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা শামসুদ্দীন আহমদ বড়লাটকে টেলিগ্রামে ও বাংলার গভর্নরকে চিঠি দিয়া ইহার প্রতিবাদ করেন এবং বলেন যে, সমস্ত দল লইয়া মন্ত্রীসভা গঠন করা সম্ভবপর না হইলে ৯৩ ধারা অনুসারে গভর্নরের শাসন যেমন চলিতেছে তেমনি চলুক। অবশ্য এই প্রতিবাদে কোন ফল হয় নাই।
মন্ত্রীসভা গঠনের দিনই (২৪শে এপ্রিল ১৯৪৩) কলিকাতা টাউন হলে আবদুল হালিম গজনভীর সভাপতিত্বে একটি বিপুল জনসভায় ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়। প্রধান বক্তা ফজলুল হক বিস্তারিতভাবে তাঁহার পদত্যাগের ঘটনা ব্যাখ্যা করেন। তিনি গভর্নরকে লিখিত দুইটি পত্র সভায় পাঠ করিয়া শোনান। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে সকল দলের মন্ত্রীসভা গঠন করা একান্ত প্রয়োজন এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তিনি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু নাজিমুদ্দীন পরিচালিত মন্ত্রীসভাকে সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা কোনমতেই বলা চলে না। তিনি এক গভীর ষড়যন্ত্রের বলি হন। তাই তিনি ন্যায়বিচার দাবী করেন। সভাপতি ও আরও কয়েকজন বক্তা গভর্নরের কার্যাবলীর তীব্র নিন্দা করেন।” শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন যে, ফজলুল হকের স্বাধীন মতামতের জন্যই গভর্নর ও কলিকাতার ইংরেজ বণিক সম্প্রদায় তাঁহার প্রতি রুষ্ট। এই সভায় একটি প্রস্তাবে ফজলুল হকের নিকট হইতে যেভাবে পদত্যাগপত্র আদায় করা হয় তাহার এবং মুসলিম লীগ-পরিচালিত সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল মন্ত্রীসভা গঠনেরও তীব্র নিন্দা করা হয়।
নাজিমুদ্দীনের শাসনকালের কলঙ্কজনক প্রধান ঘটনা ১৯৪৩ সনের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ইংরেজরাজত্বের প্রারম্ভে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ (বাংলা ১১৭৬ সাল, ইংরেজী ১৭৭০ সন) ইতিহাসের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠে’ তাহার যে-চিত্র আঁকিয়াছেন, সংক্ষিপ্ত হইলেও তাহা ইহাকে চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবে। ইংরেজরাজত্বের অবসানকালে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ (বাংলা ১৩৫০ সাল, ইংরেজী ১৯৪৩ সন) সাহিত্যে তেমনভাবে স্থান না-পাইলেও এমন অনেক লোক এখনও জীবিত আছেন যাঁহারা তাহার ভীষণ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। বর্তমান লেখকও ইহাদের একজন। ত্রিশ বৎসর পরে আজিও দুঃস্বপ্নের মত কলিকাতার রাজপথে জীবিত কঙ্কাল ও মৃত নরনারীর দেহ তাঁহার স্মৃতিপটে ভাসিয়া উঠে।
এই দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ বিশ্বযুদ্ধ ও শাসনকর্তাদের অকর্মণ্যতা। জাপান ব্রহ্মদেশ অধিকার করিলে (মার্চ, ১৯৪৩) ঐ দেশ হইতে বাংলায় চাউলের আমদানি বন্ধ হইয়া যায়। কিন্তু সমগ্র ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করিলে ইহা নিঃসন্দেহে বলা যায়-এবং ইংরেজ লেখকেরাও ইহা স্বীকার করিয়াছেন যে, ইহার ফলে চাউলের যে ঘাটতি হয় তাহা খুব বেশী নহে। সমগ্র দেশে সমবণ্টন হইলে খাদ্যদ্রব্যের অভাবে লোকের মৃত্যু হইবার কোন কারণ ছিল না। যেসব প্রদেশে খাদ্যশস্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত ছিল, কতকটা তাহা বঙ্গদেশে আনিবার ব্যবস্থার অভাব, এবং কতকটা সেইসব দেশের ও বঙ্গদেশের ব্যবসায়ীগণের এই সুযোগে উচ্চ মুনাফার আকাঙ্ক্ষায় অধিক পরিমাণে চাউলের সঞ্চয়,–এই সমুদয় কারণেই বাংলাদেশে খাদ্যভাবে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। আর-একটি গুরুতর কারণ–জাপানী আক্রমণের ভয়ে পূর্ববঙ্গ হইতে নৌকাসকল নষ্ট বা অপসারণ করা হয় যাহাতে শত্রুপক্ষ উহার সাহায্যে বর্ষাকালে দেশের ভিতরে সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র, রসদ প্রভৃতি চলাচল না করিতে পারে। ইহার ফলে এদেশীয় কৃষক ও মহাজনদের পক্ষে প্রয়োজনমত খাদ্যদ্রব্য চালনা করা সম্ভবপর হয় নাই।
কিন্তু ভারতের আরও কয়েক প্রদেশেও বাহির হইতে চাউল আনিতে হইয়াছিল। সেসকল স্থানে সরকারের প্রচেষ্টায় অনেক পরিমাণ চাউল আনার ব্যবস্থা করায় লোকের দুর্দশা হইলেও অন্নাভাবে মৃত্যু হয় নাই। কিন্তু বঙ্গদেশের শাসন-কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা বা অযোগ্যতার ফলে তাহা সম্ভব হয় নাই। একজন ইংরেজ লেখক লিখিয়াছেন, বঙ্গদেশের অপদার্থ এবং সম্ভবতঃ ঘুষখোর মুসলিম লীগ মন্ত্রীর দল এবং অযোগ্য কর্মচারীরা অন্য প্রদেশের ন্যায় খাদ্যের সুব্যবস্থা করিতে পারে নাই। কলিকাতায়ও ইহা অত্যন্ত দেরীতে আরম্ভ হইয়াছিল এবং প্রয়োজনমত খাদ্য মফঃস্বলে পাঠাইবার ব্যবস্থা না-করায় গ্রামবাসীরা দলে দলে পদব্রজে কলিকাতায় ও অন্য শহর অভিমুখে যাত্রা করিয়াছে, তারপর পথকষ্টে ও অনাহারে শিশু, বৃদ্ধ, স্ত্রীলোক পথে পথে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় মরিয়াছে।
২১শে নভেম্বর (১৯৪৩) পণ্ডিত হৃদয়নাথ কুরু বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করিয়া দুর্ভিক্ষের করাল দুঃখ দেখিয়া অত্যন্ত বিচলিত হন এবং বড়লাট লর্ড ওয়াভেল সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া বাংলার দুর্দশার বর্ণনা করেন। বাংলা গভর্নমেন্টের অকর্মণ্যতা ও দোষত্রুটির উল্লেখ করিয়া বলেন যে, মন্ত্রীরা দুর্ভিক্ষ অপেক্ষা রাজনীতিক দলাদলি ও দ্বন্দ্ব লইয়াই বেশী ব্যস্ত আছেন। পরবর্তী জানুআরি মাসে লর্ড ওয়াভেল বিলাতে টেলিগ্রাম করেন যে, বাংলাদেশে মন্ত্রীসভা উঠাইয়া দিয়া ৯৩ ধারা মতে গভর্নরের হাতে শাসনভার ন্যস্ত হউক। কিন্তু বিলাতের কর্তৃপক্ষ ইহাতে রাজী হন নাই। ফেব্রুআরি মাসে বড়লাট বিলাতে টেলিগ্রাম করেন, “বঙ্গদেশের দুর্ভিক্ষের ন্যায় এতবড় দুর্দশা ব্রিটিশ রাজত্বে খুব কমই ঘটিয়াছে। ইহাতে দেশে বিদেশে ব্রিটিশের অখ্যাতি রটিবে। অবিলম্বে খাদ্যদ্রব্য এদেশে না পাঠাইলে দুর্ভিক্ষ আরও গুরুতর আকার ধারণ করিবে।” ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট প্রথমে ইহাতে রাজী হয় নাই। কিন্তু বড়লাটের পুনঃপুনঃ তাগিদের ফলে বিলাত হইতে খাদ্যদ্রব্যের আমদানি করায় দুর্ভিক্ষের প্রকোপ অনেকটা হ্রাস পায়। এ-বিষয়ে লর্ড ওয়াভেলের অন্যান্য কার্যও প্রশংসাজনক।
লর্ড ওয়াভেল ২০শে অক্টোবর (১৯৪৩) বড়লাটের কার্যভার গ্রহণ করেন। একসপ্তাহের মধ্যেই কলিকাতায় আসিয়া দেখিলেন যে, যদিও প্রায় ছয়মাস যাবৎ দুর্ভিক্ষের প্রকোপ চলিতেছে, তথাপি প্রতীকারের কোন বিশেষ ব্যবস্থাই লওয়া হয় নাই। তাঁহার নির্দেশে মন্ত্রীরা এ-বিষয়ে অবহিত হইয়া নিম্নলিখিত তিনটি ব্যবস্থা
অবলম্বন করেন :
১। যেসব দুর্ভিক্ষপীড়িত অসংখ্য লোক কলিকাতার রাস্তায় বা মাঠে পড়িয়া আছে, তাহাদিগের জন্য শহরের বাহিরে মাথা উঁজিয়া থাকিবার মত বাসস্থান নির্মাণ করিয়া সেখানে তাহাদের স্থানান্তরিত করিয়া খাদ্যদ্রব্য বিতরণের ব্যবস্থা করা।
২। সৈন্যদলের সাহায্যে খাদ্যদ্রব্য মফঃস্বলের গ্রামে গ্রামে প্রয়োজনমত পাঠাইবার ব্যবস্থা করা।
৩। কলিকাতায় রেশন Ration প্রথা প্রচলিত করা। এ সমুদয় ব্যবস্থা তিনি নিজে তত্ত্বাবধান করিলেও মন্ত্রীগণ ও সরকারী কর্মচারীদের অযোগ্যতা ও ঔদাসীন্যে এবং মজুতদার ব্যবসায়ীদের অসাধুতা ও অর্থলোভের ফলে খাদ্যদ্রব্য যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করা যায় নাই–সুতরাং কষ্টের লাঘব কিছুটা হইলেও বহু লোক অনাহারে মরিয়াছে। এই মৃতের সংখ্যা সরকারী রিপোর্ট অনুসারে দশ লক্ষ-সাধারণের মতে মৃতের সংখ্যা ইহা অপেক্ষা অনেক বেশী–প্রায় পনেরো লক্ষ। লর্ড ওয়াভেল লর্ড লিনলিথগোর নিকট হইতে কার্যভার গ্রহণকালে ভারতের অবস্থার বিষয়ে তাঁহার সহিত যে আলোচনা করেন তাহা সংক্ষেপে তাহার ডায়েরীতে (diary) লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তিনি ১৯শে অক্টোবর লিখিয়াছেন :
“খাদ্যসমস্যা সম্বন্ধে লিনলিথগো বলিলেন যে, জুলাই মাসে তাঁহার মনে হইয়াছিল (expected) যে, বাংলাদেশে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দশ কি পনেরো লক্ষে পৌঁছিবে, কিন্তু এখন মনে হইতেছে যে এই সংখ্যা কিছু কমও হইতে পারে।”
ইহা হইতে বেশ বোঝা যায়, যদিও জুলাই মাসের পূর্ব হইতেই বাংলার দুর্ভিক্ষ গুরুতর আশঙ্কার কারণ হইয়াছিল তথাপি পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে প্রতীকারের বিশেষ কোন ব্যবস্থা হয় নাই।
বড়লাট ওয়াভেলের মতে যে ইহার জন্য মন্ত্রীরাই দায়ী তাহার প্রমাণ এই যে, ওয়াভেল স্বচক্ষে কলিকাতার অবস্থা প্রত্যক্ষ করিয়া বিলাতের কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করিয়াছিলেন যে, ৯৩ ধারা মতে বাংলার শাসনভার গভর্নরের হাতে দেওয়া হউক। ইহা পূর্বেই বলিয়াছি যে কর্তৃপক্ষ মুসলিম মন্ত্রীদের অপসারণ করিতে রাজী হন নাই।
নাজিমুদ্দীনের মন্ত্রীসভার শাসনকালের দ্বিতীয় দুঃখজনক ঘটনা ১৯৪৪ সনে বস্ত্রের অভাব। ইহা এতদূর চরমে পৌঁছিয়াছিল যে, নরনারীর লজ্জানিবারণ দুরূহ হইয়া উঠিয়াছিল, এমনকি মৃতের সকার ও বিবাহের উৎসবে নূতন কাপড়ের অভাব হইত। বিধানপরিষদে ইহা লইয়া প্রতিদিনই তুমল তর্কবিতর্ক হইত। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, মাড়োয়ারী কালোবাজারীরা সরবরাহ মন্ত্রী ও ঐ বিভাগের কর্মচারীদের উৎকোচ দিয়া মূল্যবৃদ্ধির জন্য এই কৃত্রিম অভাব ঘটাইতেছে। নলিনাক্ষ সান্যাল এই অভিযোগ করিলে ঐ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শহীদ সুরাওয়ার্দি ও তাঁহার মধ্যে যে বচসা হয় তাহার বিবরণ নিম্নে দেওয়া হইল:
“মন্ত্রী–আমার বিরুদ্ধে যে এইরূপ হীন কুৎসা রটনা করে সে পাজী ও Faestsint (dirty liar)
সান্যাল–আপনি আগাগোড়া মিথ্যাবাদী (downright liar)।
মন্ত্রী–যে অভিযোগ করিয়াছে সে জঘন্য মিথ্যাবাদী (filthy liar)”।
পরস্পরকে এইপ্রকার গালাগালি চারিদিকের আপত্তি সত্ত্বেও বহুক্ষণ ধরিয়া। চলিয়াছিল।
১০ই মার্চ ‘বস্ত্র-সংকট দিন’ প্রতিপালিত হইল। বাংলার কয়েকজন প্রসিদ্ধ নেতা-বিধানচন্দ্র রায়, কিরণশঙ্কর রায়, ভগীরথ কনোরিয়া, যোগেশ গুপ্ত, ভূপেশ গুপ্ত, বসন্তলাল মোরারকা প্রভৃতির আহ্বানে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে একটি জনসভায় ইহার প্রতীকারের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। বিধানসভার সভাপতি সৈয়দ নৌসের আলি এই জনসভার সভাপতি ছিলেন। তিনি তাঁহার ভাষণে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করেন। দুইজন প্রসিদ্ধ ভারতীয় নেতা তেজবাহাদুর সঞ্চ ও কুনওয়ার জগদীশপ্রসাদ কলিকাতায় আসিয়া স্বচক্ষে লোকের দুরবস্থা দেখিয়া বিশেষ ক্ষুব্ধ হন এবং বড়লাটকে এই মর্মে তারবার্তা প্রেরণ করেন : “যে সকল নারীরা বস্ত্রাভাবে বাহির হইতে পারে না তাহাদিগের মনে কি ইহাতে সান্ত্বতা পাইবে যে উলঙ্গ থাকিব, তবু প্রাদেশিক শাসনবিষয়ে কেন্দ্রীয় শাসনের হস্তক্ষেপ সহ্য করিব না?
এই দুঃসময়ে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় শাসনের সম্বন্ধ লইয়া তর্ক করা অতি অশোভন এবং বাংলার এই বস্তুসংকট অবিলম্বে দূর করা দরকার।”
কেন্দ্রীয় সরকার অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে তুলনা করিয়া দেখাইলেন যে, বাংলার বস্ত্রাভাবের কোন কারণ থাকিতে পারে না। ইতিমধ্যে বাংলা গভর্নমেন্ট নূতন এক আইন (অর্ডিন্যান্স) পাশ করিয়া তদনুসারে সমস্ত কাপড়ের গুদাম খুঁজিয়া দেখিবার ব্যবস্থা করিলেন। ফলে বহু গুদামজাত কাপড়ের সন্ধান পাওয়া গেল। শুধু বড়বাজার, জোড়াসাঁকো, জোড়াবাগান ও হেয়ার স্ট্রীটে তিন হাজার গুদাম সীল করা হইল (২৫শে মার্চ)। পরদিন সুরাওয়ার্দি ঘোষণা করিলেন, বেআইনীভাবে লুকানো বহু কাপড় পাওয়া গিয়াছে এবং এগুলি সরকার বাজেয়াপ্ত করিবে।
তাহার পর যাহা হইল তাহা বাংলাদেশের গণতন্ত্র-শাসনপ্রণালীর এক অভিনব পদ্ধতির সূচনা বলা যাইতে পারে। সংক্ষেপে বলিতে গেলে, ইহা হইতেছে–টাকা দিয়া বিধানপরিষদের সদস্যদের ভোট ক্রয় করিয়া মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করিতে বাধ্য করা। ১৯৪৫ সন, ২৮ মার্চ। তখন বাজেট সেশন চলিতেছে। কৃষিবিভাগের খাতে সরকার যে টাকা বরাদ্দ করিয়াছেন বিধানপরিষদে তাহার মঞ্জুরি সম্বন্ধে আলোচনা হইবে। ইহার পূর্বে কয়দিন যাবৎ অন্যান্য খাতের দাবি সবই মঞ্জুর হইয়াছে। কারণ, নাজিমুদ্দীনের দল ও ইউরোপীয় সদস্য মিলিত হইলেই সংখ্যাধিক্য হয়। কাজেই সেদিনও কেহ কোনও গোলমালের আশঙ্কা করে নাই। সরকারী প্রচার-বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী পি. এস. মাথুর এ-বিষয়ে যাহা লিখিয়াছেন তাহার মর্ম সংক্ষেপে লিখিতেছি :
“মধ্যাহ্নভোজনের বিরতির সময় প্রচার ও প্রকাশন বিভাগের মন্ত্রী (Publicity Minister) পুলিনবিহারী মল্লিক টেলিফোনে আমাকে জানাইলেন, ‘শুনিলাম মাড়োয়ারীরা টাকার থলি লইয়া বিধানসভাগৃহের আশেপাশে ঘুরিতেছে আমাদের দলের কয়েকজনকে ঘুষ দিয়া আমাদের বিপক্ষে ভোট দেওয়াইবার জন্য। আপনার ফটোগ্রাফার লইয়া আসিয়া যদি ছবি তুলিয়া রাখিতে পারেন তবে খুব ভাল প্রমাণ। থাকিবে। আমি গেলাম, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না।… আমি সরকারী গ্যালারিতে বসিয়া বিধানসভার ব্যাপার দেখিতে লাগিলাম।… মন্ত্রীরা যে আসনে বসেন (Treasury Benches) সেখানে খুব চাঞ্চল্য দেখিলাম। সাধারণতঃ ধীর স্থির নাজিমুদ্দীন সাহেব ঘন ঘন ঘর-বাহির করিতেছেন। হঠাৎ শহীদ সাহেব (সুরাওয়ার্দি) উত্তেজিতভাবে ঢুকিয়া বলিলেন, তাঁহাদের দলের চারিজন সদস্যের কোন পাত্তা পাওয়া যাইতেছে না। ফিরিবার সময় একদল একত্রে উপবিষ্ট সদস্যের প্রতি এমনভাবে ক্রুর দৃষ্টিতে চাহিলেন যেন পারিলে খুন করিয়া ফেলিতেন (looked daggers drawn)…। প্রশ্নোত্তর শেষ হওয়ামাত্র এই ১৫ জন সদস্য ধীরে সুস্থে উঠিয়া মন্ত্রীদলের বিরোধীদের সঙ্গে গিয়া বসিলেন। …হঠাৎ ভীষণ চাঞ্চল্য দেখা দিল, চারিদিকে দৌড়াদৌড়ি ও টেলিফোন বাজিতে লাগিল। একজন দৌড়াইয়া
আসিয়া আমাকে বলিল, যে চারজন গভর্নমেন্ট দলের সদস্যের এতক্ষণ পাত্তা পাওয়া যায় নাই তাহাদের সন্ধান মিলিয়াছে, তাহারা হুগলীর পশ্চিমে এক বাগানবাড়ীতে আছে, কিন্তু এখন আর আনিবার সময় নাই। অন্য কয়েকজন শহরেই আছে, কিন্তু এখনও পৌঁছে নাই। সাহেব সদস্যেরা লাঞ্চ (lunch) খাইয়া এখনও ফিরিয়া আসে নাই। এখন কৃষিবিভাগের বরাদ্দ টাকা ভোটে দিলে মন্ত্রীর দলের পরাজয় ঘটিবে। চতুর শহীদ সাহেব দাঁড়াইয়া উঠিয়া নানা ছলছুতায় বক্তৃতা ও আপত্তির প্রশ্ন (Point of Order) তুলিয়া কিছুক্ষণ সময় কাটাইবার চেষ্টা করিলেন। তারপর কৃষিবিভাগের মন্ত্রী উঠিয়া বরাদ্দ টাকার দাবি মঞ্জুর করার প্রস্তাব করিলেন। বিপক্ষদল যেসব সংশোধনী প্রস্তাব (Cut-amendment) দিয়াছিলেন তাহা প্রত্যাহার করিলেন এবং দাবি করিলেন যে, মন্ত্রীর বরাদ্দের প্রস্তাব এখনই ভোটে দেওয়া হউক। তখন একজন মন্ত্রী দাঁড়াইয়া উঠিয়া বক্তৃতা দিতে লাগিলেন। এমন সময় ঘন ঘন বিপদবার্তার সংবাদ পাইয়া সাহেব সদস্যেরা তাড়াতাড়ি লাঞ্চ খাইয়া ফিরিলেন। একজন বলিয়া উঠিলেন, মন্ত্রীসভার ত্রাণকর্তারা আসিয়াছে। সাহেবেরা বলিলেন, যেসব সংশোধনী প্রস্তাব বিরোধীপক্ষ প্রত্যাহার করিয়াছে তাহারাই সেইসব প্রস্তাব উপস্থাপিত করিয়া বক্তৃতা করিবেন, কারণ কৃষির ন্যায় একটি গুরুতর বিষয়ে কোন আলোচনা হইবে না, ইহা সঙ্গত নহে। সভাপতি ইহাতে আপত্তি করিলেন। কিন্তু ভোট দিবার সঙ্কেতসূচক ঘণ্টা বাজিবার পূর্বেই গোলমাল আরম্ভ হইল। নাজিমুদ্দীন, সুরাওয়ার্দি, ফজলুর রহমান এবং এই দলের আর কয়েকজন সবেগে সভাপতির টেবিলের দিকে ধাবমান হইলেন এবং শহীদ সাহেব সভাপতির মাইকটি ধরিয়া রহিলেন। অপরদিকে বিরোধীদলের নলিনাক্ষ সান্যাল, আশুতোষ লাহিড়ী, রাধানাথ দাস এবং অন্য কয়েকজন সভাপতিকে রক্ষার জন্য ছুটিলেন। ব্যাপার গুরুতর হইল দেখিয়া সরকারী হুইপ’ (whip) মহম্মদ আলি মন্ত্রীর দলকে টানিয়া ফিরাইয়া নিয়া গোলমাল থামাইলেন। তখন ভোট দিবার জন্য ঘণ্টা বাজিল।…সরকারী পক্ষের সদস্য আলি মৃধা চীৎকার করিয়া বলিলেন, শহরে কাপড়ের চোরাই মাল আটক করায় মাড়োয়ারীরা এবং তাহাদের বন্ধুগণ মোটা টাকা দিয়া মন্ত্রীদলের ভোট ভাঙ্গাইয়াছে। সর্বশেষে ভোট দিবার স্থানে গেলেন শহীদ সুরাওয়ার্দি। যাইবার সময় বলিলেন, যদি ভোটে হারিয়া আমাদের পদত্যাগ করিতে হয় তবে তাহার একমাত্র কারণ কালোবাজারের মজুতদার মুনাফাখখারদের টাকার লোভে সদস্যেরা আমাদের বিপক্ষে ভোট দিয়াছে। কাপড় মজুতদারদের চোরাই মাল ধরার ব্যবস্থা না করিলে আজ আমাদের এই বিপত্তি হইত না।”
বিপত্তি সত্যই ঘটিল। ভোট গণনা করিয়া দেখা গেল, মন্ত্রীদের পক্ষে ৯৭ ও বিপক্ষে ১০৬ ভোট। নাজিমুদ্দীনের মন্ত্রীত্ব শেষ হইল। সংবিধানের ৯৩ ধারা অনুসারে গভর্নর কেসী (Cassey) স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করিলেন।”
কিন্তু ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে এই ঘটনার ভাবী ফল হইল এই যে, ভবিষ্যতে আর কোন মন্ত্রীদল কালোবাজারী মজুতদারদের ঘটান নাই–এবং ঘুষের টাকার লেনদেনের ব্যাপারটা রাজনীতির অঙ্গস্বরূপ হইয়াছে। এই ঘটনার পর ত্রিশ বত্সর অতীত হইয়াছে, কিন্তু মন্ত্রী ও দলের সদস্যরা কালোবাজারী ও মজুতদারদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখিয়াই চলিয়াছেন। জীবনযাত্রার নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র (রুটি, তেল, চিনি প্রভৃতি) সহসা বাজার হইতে লোপ পায়-সরকার দাম বাড়াইয়া দেন। অমনি আলাদিনের প্রদীপের মত জাদুমন্ত্র-বলে পরদিনই ঐসকল জিনিসের প্রাচুর্য দেখা যায়। বাংলার তদানীন্তন গভর্নর কেসী স্বয়ং এই মন্তব্য করিয়াছেন। তবে এই বাড়তি দামের ফলে যে মোটা মোটা টাকা লাভ হয় তাহা কালোবাজারীরা পুরাপুরি ভোগ করে না। তাহারা এক অংশ রাখে, আর বাকী অংশ ‘বুঝ লোক যে জান সন্ধান। ঐতিহাসিকের পক্ষে সে-গবেষণার অনেক বিপদ আছে। তবে প্রাচীন যে একটি প্রবাদ আছে-’ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে (History repeats itself)–তাহার একটি ঘরোয়া ও সাম্প্রতিক নিদর্শন দিবার জন্যই এই ঘটনাটির বিস্তৃত বর্ণনা দিলাম।
এক ইংরেজ কবি নদীর সম্বন্ধে বলিয়াছেন, “(নানা রকমের মানুষ (আমার তীর দিয়া) আসে ও চলিয়া যায় কিন্তু আমি চিরকাল একভাবেই চলিতেছি।” ভারতের কালোবাজারী ও মুনাফালোভী মজুতদারদের মুখেও সেই কথা সাজে–মন্ত্রীর দল আসে যায়, রাজ্যের উত্থান-পতন হয়, পরাধীন জাতি স্বাধীন হয়, কিন্তু আমি চিরকাল অর্থাৎ যতদিন (বর্তমান ভুয়া) গণতন্ত্র থাকিবে, ততদিন আছি!
নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীসভা পতনের প্রধান কারণ–ঢাকার নবাব হবিবুল্লার শেষমুহূর্তে দলত্যাগ। তাঁহার দলত্যাগের প্রধান কারণ-তাহার ইচ্ছা ছিল সরবরাহ বিভাগের মন্ত্রী হওয়া। কিন্তু, তাহা হইল না। নবাবসাহেব ও তাঁহার দলত্যাগী সঙ্গীদের মধ্যে ১০ জন সদস্য (১৯শে এপ্রিল ১৯৪৫) এক বিবৃতিতে বলেন যে, নাজিমুদ্দীনের মন্ত্রীসভার দুই বৎসরের (এপ্রিল, ১৯৪৩ হইতে মার্চ, ১৯৪৫) কুশাসনের অর্থাৎ দুর্নীতি, কলুষতা ও অযোগ্যতার ফলে বাংলাদেশের সর্বনাশ হইয়াছে। শাসনকার্যে যতকিছু মন্দ ঘটিতে পারে তাহার সবই এই আমলে ঘটিয়াছে। ১৯৪৪ সনে দলের ৪৬ জন সদস্য যে সমুদয় শাসনসংস্কারের প্রস্তাব করিয়াছিলেন, এবং পরে ১৯৪৫ সনের ১৫ই মার্চের মধ্যে এইসব ব্যবস্থা করার জন্য ১৭ জন সদস্য যে স্মারকলিপি পাঠাইয়াছিলেন, তাহার সম্বন্ধে মন্ত্রীরা কিছুই করেন নাই। আর একটি অভিযোগ ছিল যে, বাহির হইতে বাংলা দেশে বস্ত্রাদি আমদানি করিবার জন্য যে ২০ জন নিযুক্ত হইয়াছিলেন তাহার মধ্যে মাত্র একজন মুসলমান–বাকী ১৯ জন হিন্দু ও তাঁহাদের অধিকাংশই মাড়োয়ারী। ইহা হইতে বেশ বোঝা যায় যে, নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীসভা মাড়োয়ারীদের খুব অনুগ্রহ করিতেন (Nazimuddin Cabinet was interested in the Marwari Community),
এইসব অভিযোগের সত্যতা নির্ণয় করা কঠিন এবং ইহার আলোচনা নিপ্রয়োজন। দুই বৎসর (১৯৪৩-৪৫) শাসনকার্যের পর নাজিমুদ্দীনের মন্ত্রীসভার অবসান হইল। অতঃপর ১৯৪৬ সনের নির্বাচনের ফলে শহীদ সুরাওয়ার্দি মন্ত্রীসভা গঠন করেন। মধ্যবর্তী সময়ে বাংলার শাসনভার গভর্নরের হস্তেই ন্যস্ত ছিল।
পরবর্তীকালের পরিপ্রেক্ষিতে এই খাদ্যসংকট সম্বন্ধে কয়েকটি মন্তব্য করা প্রয়োজন। প্রথমতঃ, বাংলার এই সংকট সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্য ও অজ্ঞতা। ভারত সরকারের এই বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সদস্য (Commerce Member) বলিলেন যে, সমস্যাটি মোটেই গুরুতর নহে এবং তাহার প্রেরিত কর্মচারী (Textile Commissioner) বাংলা দেশ ঘুরিয়া (অর্থাৎ কেবলমাত্র ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও কলিকাতা এই তিনটি শহর পরিদর্শন করিয়া) ইহা সমর্থন করিয়া বলিলেন যে, বাংলায় যে বস্ত্র মজুত আছে তাহাতে বস্ত্ৰসংকটপ্রভৃতি অভিযোগ অতিরঞ্জিত। কলিকাতা ত্যাগ করিবার অব্যবহিত পূর্বে হাওড়া স্টেশন হইতে তিনি শ্রীযুক্ত মাথুরকে টেলিফোন করিলেন যে, তাহার উক্তির সঙ্গে নিম্নলিখিত কথা কয়টি যোগ করিতে হইবে : “বাংলা দেশের গভর্নর ও কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা দেশের বস্ত্ৰসরবরাহের অপ্রাচুর্য সম্বন্ধে একমত।” শ্রীযুক্ত মাথুর গভর্নরকে ইহা জানাইলে তিনি উহা ছাপিতে নিষেধ করিলেন এবং তাঁহার নিম্নলিখিত মন্তব্যটি যোগ করিতে বলিলেন : “গভর্নর মনে করেন যে এখনও কয়েকটি গুরুতর সমস্যা সমাধানের প্রয়োজন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বস্ত্র কমিশনার মি. ভেলোদির (Vellodi) বাংলা দেশে ভ্রমণের একমাত্র ফল এই যে, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে কোন্ কোন্ বিষয়ে মতানৈক্য তাহা নির্ধারিত হইয়াছে।”
দ্বিতীয়তঃ, বাংলার তদানীন্তন গভর্নর কেসী অবসর গ্রহণের পর তাঁহার ভারতের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে একখানি গ্রন্থ লিখিয়াছেন। তাহাতে বস্ত্ৰসংকট সম্বন্ধে মাড়োয়ারী বস্তুব্যবসায়ীরা কিভাবে মুনাফা বাড়াইবার জন্য কৃত্রিম উপায়ে সংকট সৃষ্টি করিয়া দাম বাড়াইয়া থাকে, এবং বিধান পরিষদের সদস্যদের ভোটের জন্য মুক্তহস্তে উৎকোচ প্রদান করে, তাহার উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছেন : “ইহা বিশেষ দুঃখের বিষয় যে, মুসলমান ও তপশীলভুক্ত জাতীয় রাজনীতিকগণের অনেকেই (certain portion) প্রলোভনে পড়িয়া (seduced) এক দল ত্যাগ করিয়া অন্য দলে যোগদান করিতে দ্বিধাবোধ করে না। আদর্শবাদীরা ইহাদের সম্বন্ধে কঠোর মন্তব্য করিতে পারেন, কিন্তু যে-দেশে গণতন্ত্রের আমদানি খুব বেশীদিন হয় নাই সে দেশে এরূপ হওয়া অস্বাভাবিক নহে।
তৃতীয়তঃ, বাংলায় যখন ১৩৫০ সনের দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তখন আহমদনগর দুর্গে অন্তরীণে আবদ্ধ ছিলেন। বাংলার বস্ত্রসংকটের সময় তিনি এই দুই সংকট সম্বন্ধে নিম্নলিখিত মন্তব্য করেন : “বিদেশী স্বেচ্ছাতন্ত্রশাসনে খুব ভাল লোক যোগদান করে না। সরকারী ও বেসরকারী উভয় শ্রেণীর বহুসংখ্যক লোকের মধ্যেই নৈতিক অধোগতি দেখা যায়। উডহেড কমিশনের (Woodhead Commission) রিপোর্ট অনুসারে বাংলার দুর্ভিক্ষে যে পনেরো লক্ষ লোকের মৃত্যু হইয়াছিল, কালোবাজারীরা তাহাদের মাথাপিছু এক হাজার টাকা লাভ করিয়াছিল (অর্থাৎ পনেরো কোটি টাকা)। মানুষ কী করিয়া এত নির্মম ও নিষ্ঠুর হইতে পারে তাহা বোধগম্য হওয়া শক্ত। আমি একটি পোকাও মারি না, কিন্তু যদি সকল কালোবাজারীদিগকে এইসঙ্গে গলায় দড়ি দিয়া রাস্তায় বাতির থামে (lamp post) ঝুলাইয়া মারা যায় তাহা হইলে আমার জীবনে সর্বাপেক্ষা আনন্দ হইবে।”
গভর্নর কেসী যে সাম্প্রতিক গণতন্ত্রের কথা বলিয়াছেন (১৯৩৫ সংবিধান) তাহার পর চল্লিশ বৎসর অতীত হইয়াছে। তখন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর আমলে বিদেশী শাসনের পরিবর্তে তাঁহার নিজের হস্তেই সমুদয় শাসনক্ষমতা ছিল। কিন্তু ১৯৪৩-৪৪ সালের রাজনীতিক আবহাওয়ার পরিবর্তন যাহা হইয়াছে তাহা অধোগতির দিকেই। কালোবাজারীদের চক্রান্তে দ্রব্যমূল্য পণ্ডিত নেহেরুর শাসনকালেও ১৯৪৪ সনের তুলনায় দশগুণ বাড়িয়াছিল, কালোবাজারীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাইয়াছিল। তাঁহার কন্যার শাসনকালে অবস্থা আরও খারাপ হইয়াছে, অথচ একটি কালোবাজারীকেও গলায় দড়ি দিয়া প্রকাশ্য রাস্তায় হত্যা করা হয় নাই। বরং লোকের ধারণা যে, গণতন্ত্রের জন্যই কালোবাজারীর সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়িতেছে, কারণ প্রত্যেক রাজনীতিক দলই ভোটের জন্য বহু অর্থ ব্যয় করে সরকারী দল ব্যবসায়ীদিগকে কালোবাজারীর সুযোগ দিয়া তাহাদের লব্ধ অর্থের মোটা অংশ পাইয়া তাহাদ্বারা ভোট ক্রয় করেন। সুতরাং কালোবাজারীরা সংখ্যায় বাড়িতেছে এবং দ্রব্যের মূল্যও প্রতি বৎসর বাড়িতেছে। এই ধারণার সত্যতা নির্ণয় করার উপায় নাই। কিন্তু বাংলা দেশের তথা ভারতের শতকরা নব্বইজন যে এই ধারণা পোষণ করেন তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। বিশেষতঃ দ্রব্যমূল্য বাড়িবার, এবং যে জিনিস দুপ্রাপ্য, দাম বাড়িবামাত্র তাহার প্রাচুর্য ঘটা এবং যে-চাউলের অভাবে বাঙ্গালী দুরবস্থার চরমে পৌঁছাইয়াছে–যথেষ্ট মূল্য (স্বাধীনতার পূর্বেকার ৪০। ৫০ গুণ) দিলে যে, যে-কোন পরিমাণ সেই চাউল প্রকাশ্যে কিনিতে পারা যায়, এই সমুদয় পরিস্থিতির আর কোন যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত কেহ দিতে পারে নাই।
বাংলা দেশের পরবর্তী ইতিহাস বুঝিতে হইলে ১৯৪২ সনের পর ভারতের বৃহত্তর রাজনীতিক্ষেত্রে যে কয়েকটি গুরুতর ঘটনা ঘটিয়াছিল তাহা সংক্ষেপে উল্লেখ করা আবশ্যক।
১. ভারতীয় শাসন-সংস্কারের চেষ্টা
১৯৪২ সনের বিপ্লব ঐ বৎসর শেষ হইবার পূর্বেই থামিয়া গেল। কিন্তু ঐ বিপ্লব আরম্ভ হইবার পরেই গান্ধী ও বড়লাট লর্ড আরউইনের মধ্যে চিঠিপত্রের বিনিময়ে তুমুল বাদ-প্রতিবাদ হয়। প্রত্যেকেই অপরকে ইহার জন্য দায়ী বলিয়া অভিযুক্ত করেন। গান্ধী পুনঃপুনঃ এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ১৯৪২ সনে ভারতীয়দের পক্ষ হইতে যে হিংসাত্মক কার্য হইয়াছে, ইহা যে কেবল তাহার নির্দেশমত হয় নাই তাহা নহে, এগুলি সম্পূর্ণরূপে তাহার মতের বিরোধী। একথাটি যে সম্পূর্ণ সত্য, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহা স্বীকার করিলে বলিতে হইবে যে, ১৯৪২ সনের বিপ্লব যদি ভারতের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করিয়া থাকে, তবে সে বিষয়ে গান্ধীর কোন কৃতিত্ব নাই। এবং ইহা স্বীকার করিলে গান্ধীই যে ভারতের স্বাধীনতা আনিয়াছেন এই দাবির মূল্য অনেক কমিয়া যায়।
ঐ বিপ্লব দমনে গভর্নমেন্ট যে বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়াছে তাহার প্রতিবাদে গান্ধী ১৯৪৩ সনের ৯ই ফেব্রুআরি হইতে ২রা মার্চ পর্যন্ত অনশন্ত্রত পালন করেন।
এই বৎসরই বাংলায় ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয়। ইহার বিবরণ পূর্বেই দেওয়া হইয়াছে। দুর্ভিক্ষ ও সরকারী অত্যাচারে যখন দেশের অবস্থায় চরম বিপর্যয় ঘটিয়াছে সেই সময় সাড়ে সাত বৎসর বড়লাটগিরি করিয়া লর্ড লিনলিথগো বিদায় নিলেন (২০শে অক্টোবর, ১৯৪১) এবং ভারতের সেনাপতি লর্ড ওয়াভেল (Wavell) তাঁহার স্থানে বড়লাট নিযুক্ত হইলেন। এই সময় বিশ্বযুদ্ধের গতিও ফিরিল এবং ব্রিটিশ অর্থাৎ মিত্রশক্তির জয় সুনিশ্চিত হইল। সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীরও মত পরিবর্তিত হইল। তিনি ভারত ছাড়’ দাবি ছাড়িয়া দিলেন এবং “হয় স্বাধীনতা নয় মৃত্যু”–এই দৃঢ় পণের পরিবর্তে ইংরেজের যুদ্ধব্যাপারেও সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলেন। তিনি এই মর্মে বড়লাটকে চিঠি লিখিলেন যে, স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিলে এবং আপাততঃ জাতীয় মন্ত্রীসভা গঠন করিলেই তিনি আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করিবেন।
গান্ধী যখন অনশব্রত পালন করিতেছিলেন (ফেব্রুআরি, ১৯৪৩) তখন রাজগোপালাচারী তাহার অনুমতিক্রমে মুসলমানদের নেতা জিন্নার সঙ্গে পাকিস্তান’ স্বীকার করিয়া একটি আপস করার জন্য কথাবার্তা চালাইতেছিলেন। গান্ধী তাঁহার পত্রের উত্তরে ইংরেজ গভর্নমেন্টের নিকট হইতে জবাব পাইলেন যে, তাঁহার প্রস্তাব গ্রহণ তো দূরের কথা, এমনকি আলোচনারও অযোগ্য, তখন গান্ধী জিন্নার শরণাপন্ন হইলেন। যে পাকিস্তানের সম্ভাবনামাত্র থাকায় ক্রীপসের প্রস্তাব কংগেসে ও হিন্দু মহাসভা অগ্রাহ্য করিয়াছিল, গান্ধী সেই পাকিস্তান-দাবী স্বীকারের ভিত্তিতে জিন্নার সহিত মিটমাটের জন্য তাঁহার সঙ্গে আলোচনা করিতে স্বীকৃত হইলেন এবং জিন্নার সহিত সাক্ষাৎকার প্রার্থনা করিয়া লিখিলেন, “আমি চিরদিনই তোমার বন্ধু ও অনুগত ভৃত্য, আমাকে হতাশ করিও না (I have always been a servant and friend to you. Do not disappoint me)”। এই প্রস্তাব ও কাকুতি-মিনতিতে গান্ধীর একান্ত অনুরক্ত ভক্তগণ ছাড়া সমগ্র হিন্দুসমাজে বিষম বিক্ষোভ সৃষ্টি করিল। সাভারকর লিখিলেন যে, ভারতবর্ষ গান্ধী বা রাজগোপালাচারীর নিজস্ব সম্পত্তি নহে যে তাঁহারা নিজেদের ইচ্ছামত যাহাকে ইচ্ছা, ইহার যে-কোন অংশ দানদাতব্য করিতে পারেন।
গান্ধী ও জিন্নার কথাবার্তা ৯ই হইতে ২৭শে সেপ্টেম্বর (১৯৪৪) পর্যন্ত চলিল; কিন্তু কোন ফল হইল না। গান্ধী হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান (১৯৪৭ সনে যেমন হইয়াছিল) এইরূপ বিভাগ মোটামুটি মানিতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু হিন্দু ও মুসলমান যে দুই পৃথক জাতি–জিন্নার এই মত গ্রহণ না-করায় আপস হইল না।
ইতিমধ্যে বড়লাট যুদ্ধান্তে ভারতের নূতন শাসনপ্রণালী স্থির করিবার জন্য সকল রাজনৈতিক দলের ২১ জন প্রতিনিধির একটি বৈঠক ডাকিলেন। ২৫শে জুন (১৯৪৫) সিমলায় ইহার প্রথম অধিবেশন হইল। বড়লাট প্রস্তাব করিলেন যে, তাঁহার কার্যনির্বাহক সমিতিতে (Executive Council) অতঃপর তিনি ও সেনাপতি ছাড়া আর সকল সদস্যপদেই ভারতীয়েরা নিযুক্ত হইবেন। এই সমিতিতে বর্ণহিন্দু ও মুসলমান সদস্যের সংখ্যা সমান হইবে। জনসাধারণ ও সংবাদপত্র এই প্রস্তাব অনুমোদন করিল কিন্তু গান্ধী আপত্তি করিলেন যে, বর্ণহিন্দু ও তপশীলভুক্ত হিন্দু–এইরূপ শ্রেণীবিভাগ অসঙ্গত। জিন্না দাবী করিলেন যে, মুসলমান সদস্য সকলেই মুসলিম লীগের সদস্য হইবেন। তপশীলভুক্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি শিবরাজ দাবী করিলেন যে, মুসলমান ও তাঁহাদের সদস্যসংখ্যা পরস্পরের লোকসংখ্যার অনুপাতে নির্ণয় করিতে হইবে এবং এই সম্প্রদায়ের সদস্যনির্বাচনে কংগ্রেসের কোন হাত থাকিবে না। কংগ্রেস এই দুই সম্প্রদায়ের দাবী সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করিল। মোটের উপর কোন বিষয়েই কোন মীমাংসা হইল না এবং ১৪ই জুলাই এই বৈঠক শেষ হইল।
ইহার ফলে, ভারতের রাজনীতিক ক্ষেত্রে যে নিরাশার সৃষ্টি হইয়াছিল, অনতিকাল পরেই তাহা দূর হইবার সূচনা দেখা গেল। যুদ্ধে বিজয়লাভের পর বিলাতে পার্লিয়ামেন্টের নূতন নির্বাচনে শ্রমিকদল (Labour Party) সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করিয়া মন্ত্রীসভা গঠন করিল (২৬শে জুলাই, ১৯৪৫)। নির্বাচনের পূর্বে শ্রমিকদলের নেতা (২৩শে মে, ১৯৪৫) একটি সভায় পরিষ্কার ভাষায় বলিয়াছিলেন যে, তাঁহারা ভারতের পূর্ণস্বাধীনতার ব্যবস্থা করিবেন। নির্বাচনে জয়লাভের পরই এই প্রতিশ্রুতি পালনের কথা উল্লেখ করিয়া প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ঘোষণা করিলেন (২১শে অগষ্ট, ১৯৪৫) যে, স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রস্তুত করিবার জন্য একটি কনফারেন্সের ব্যবস্থা করিবেন এবং ইহার প্রথম পদক্ষেপ-স্বরূপ ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বিধানসভাগুলির পুনর্নির্বাচনের জন্য সদস্য নির্বাচন করা হইবে। ১৯৪৫ সনের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় বিধান পরিষদের এবং ১৯৪৬-এর মার্চ মাসে প্রাদেশিক বিধানসভার নির্বাচন হইল।
নূতন নির্বাচনের ফলে প্রধানতঃ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ-এই দুইটি দলের প্রতিনিধিরাই নির্বাচিত হইলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যেসব মুসলমান প্রধান প্রদেশ লইয়া পাকিস্তান গঠিত হইবার কথা, তাহাদের মধ্যে বংলাদেশ ও সিন্ধু প্রদেশ ব্যতীত আর দুইটিতে মুসলিম লীগ সদস্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়ায় মন্ত্রীসভা গঠন করিতে পারিল না। বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার কথা পরে বলা হইবে।
২. আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্মচারীদের বিচার
কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানের উপর দিয়া গত ৩/৪ বত্সর যে ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রবাহিত হইয়াছিল তাহাতে ইহার কাঠামো একেবারে ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। কিন্তু, এই সময় সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের (Indian National Army) তিনজন কর্মচারীর বিচার উপলক্ষে এই ফৌজের বিস্তৃত কাহিনী সমগ্র ভারতের এক অদ্ভুত উন্মাদনার সৃষ্টি করিল। বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হাতে বন্দী প্রায় পঁচিশ হাজার ভারতীয় সিপাহী দেশ-উদ্ধারের জন্য সুভাষচন্দ্রের এই ফৌজে যোগ দিয়াছিল, কিন্তু জাপানের পরাজয়ের পর আবার ইংরেজের হস্তে বন্দী হইয়াছিল। সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং রাজভক্ত সিপাহীদের উপর অত্যাচার করার অপরাধে ইহাদের তিনজন কর্মচারী অভিযুক্ত হন এবং দিল্লীর দুর্গে তাঁহাদের বিচার হয়। ভারতবাসী এতদিন সুভাষচন্দ্রের এই সেনাদলের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানিত না। কিন্তু বিচারের সময় তাহাদের বীরত্ব, সাহস ও দেশের জন্য আত্মত্যাগের অপূর্ব কাহিনী বিবৃত হওয়ায় সমগ্র ভারতে তাঁহাদের প্রতি অসীম ভক্তি ও অপূর্ব সহানুভূতি জাগিয়া উঠিল। অভিযুক্ত তিনজন কর্মচারীর মধ্যে ছিলেন একজন হিন্দু, একজন মুসলমান এবং একজন শিখ। সুতরাং হিন্দু-মুসলমান, কংগ্রেস-মুসলিম লীগ এককথায় জাতি-বর্ণনির্বিশেষে ভারতের সকল সম্প্রদায় উত্তেজিত হইয়া উঠিল। সমগ্র ভারতের অভিযুক্ত সৈনিকদের প্রাণরক্ষার জন্য প্রবল আন্দোলন আরম্ভ হইল। কলিকাতায় জনতা ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল এবং পুলিশ গুলি ছাড়িল-ফলে ত্রিশজনের বেশি হত, বহুসংখ্যক পুলিশের গাড়ী, ট্রাম, বাস বিনষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হইল। ইংরেজ গভর্নমেন্ট এই অভূতপূর্ব ব্যাপারে স্তম্ভিত ও ভীত হইল। সুতরাং যদিও বিচারে ঐ তিনজন কর্মচারীর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হইয়াছিল, গভর্নমেন্ট ইহা রহিত করিয়া কেবল তাঁহাদের বরখাস্ত করিল এবং অপর সৈন্য বা সৈনিক কর্মচারীদের কোন শাস্তি দিল না।
পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস হইতে বিতাড়িত হইয়া ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন এবং বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে প্রথমে জার্মানি ও পরে জাপান–ইংরেজের এই দুই শত্রুর সঙ্গে যোগ দিয়া ইংরেজজাতির অধীনতাপাশ হইতে ভারতবর্ষকে মুক্ত করিতে চেষ্টা করেন। সুভাষের এই প্রচেষ্টায় কংগ্রেস-নেতাদের সহানুভূতি ছিল না। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, বিশেষতঃ জওহরলাল নেহেরু জাপানের সহায়তাদ্বারা ভারতমুক্তির বিরোধী ছিলেন এবং সুভাষের সৈন্যদলসহ জাপান ভারত আক্রমণ করিলে তাহাদের বিরুদ্ধে লড়িবেন এরূপ মত প্রকাশ করিয়াছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্মচারীদিগের বিচারের ব্যাপারেও তাঁহাদের সহানুভূতি ছিল না। কিন্তু সম্ভবতঃ দেশের লোকের মনোভাবের পরিচয় পাইয়া তাঁহারাও মত পরিবর্তন করিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্মচারীদের মামলায় কংগ্রেস তাহাদের পক্ষ অবলম্বন করিল এবং সামরিক আদালতে তাঁহাদের সমর্থনের জন্য ভুলাভাই দেশাই, তেজবাহাদুর সপ্রু এবং জওহরলাল নেহেরু উকীল নিযুক্ত হইলেন। ইহার ফলে কংগ্রেস অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করিল। কেহ কেহ মনে করেন যে, এই উদ্দেশ্যেই কংগ্রেস পূর্বমত পরিবর্তন করিয়া আজাদ হিন্দ ফৌজ সমর্থন করিয়াছিল। ইহা কতদূর সত্য বলা যায় না, কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের সমর্থন যে আসন্ন বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের সফলতার প্রধান কারণ, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
১৯৪৫ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলে কেন্দ্রীয় পরিষদে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগই যথাক্রমে ৫৭ ও ৩০টি আসন দখল করিল-বাকী তিনটি দলের মোট সদস্যসংখ্যা ছিল ১৫ জন।
৩. ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রথম পর্ব
কেবল বিধানসভার নির্বাচনে নহে, আজাদ হিন্দ ফৌজের কাহিনী প্রচারিত হওয়ায় ভারতে যে অভূতপূর্ব উদ্দীপনা দেখা দিয়াছিল, বিলাতের গভর্নমেন্টের উপরও তাহার প্রভাব বিস্তৃত হইয়াছিল। ভারতের নানা স্থানে সভা-সমিতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামার সংবাদে বিচলিত হইয়া ভারতবর্ষ-সম্বন্ধীয় মন্ত্রী (Secretary of State) ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৪৫ ঘোষণা করিলেন যে, অবিলম্বে পাৰ্লিয়ামেন্টের বিভিন্ন দলের ১০ জন সদস্য লইয়া গঠিত একটি প্রতিনিধি সমিতি (Delegation) ভারতে যাইবে। ব্রিটিশ জাতি যে ভারতীয়দিগকে পূর্ণস্বাধীনতা দিবে, ইহা ঘোষণা করিয়া এই সমিতি বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের সহিত এই বিষয়ে আলোচনা করিবে। ১৯৪৬ সনের ৫ই জানুআরি এই সমিতি ভারতে পৌঁছিয়া বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিল। জিন্না বলিলেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য দুইটি পৃথক সমিতি গঠন করিতে হইবে। পঞ্জাবের যেসব অঞ্চলে, যেমন আম্বালা জিলায়-অমুসলমানদের সংখ্যা খুব বেশী সেসব অঞ্চল তিনি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করিতে চাহেন না। নেহেরু বলিলেন, ব্রিটিশরাজ সম্ভবতঃ পাকিস্তান নামে পৃথক একটি রাজ্য গঠনের সমর্থন করিবেন, কিন্তু তাহার পূর্বে সীমান্তে অঞ্চলের লোকমত (Plebiscite) জানার ব্যবস্থা করিতে হইবে। একমাস বিভিন্ন নেতাদের সহিত আলোচনা করিয়া ব্রিটিশ প্রতিনিধিগণ দেশে ফিরিয়া গেলেন। ১৯৪৬ সনের ২৮শে জানুআরি বড়লাট ঘোষণা করিলেন যে, শীঘ্রই তিনি ভারতীয় নেতাদের লইয়া নূতন কার্যনির্বাহক সমিতি (Executive Council) এবং নূতন সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি সমিতি গঠন করিবেন। কিন্তু ১৮ই ফেব্রুআরি ভারতীয় নৌবাহিনী (Royal Indian Navy) বিদ্রোহ করিল এবং কয়েকটি রণতরী অধিকার করিয়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইল। এই সংবাদ নিকটবর্তী বম্বে নগরীতে পৌঁছিলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নিষেধ সত্ত্বেও তথায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা আরম্ভ হইল। হরতাল ঘোষণা করা হইল এবং ক্ষিপ্তপ্রায় জনতা ব্যাঙ্ক, ডাকঘর, পুলিশের থানা, খাদ্যদ্রব্যের দোকান লুঠ করিল ও আগুন লাগাইয়া দিল। পুলিশ ইহা থামাইতে না-পারায় সৈন্য ডাকিতে হইল। দুইশতের বেশী লোক নিহত হইল। অবশেষে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মধ্যস্থতায় ২৩শে ফেব্রুআরি ভারতীয় নৌবাহিনী আত্মসমর্পণ করিল। বম্বের ঘটনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ কলিকাতা, করাচি ও মাদ্রাজেও কিছু গোলযোগ হইয়াছিল।
১৯৪৬ সনের ১৮ই ফেব্রুআরি ভারতীয় নৌবাহিনী বিদ্রোহ করে। ঠিক তাহার পরদিনই বিলাতে পার্লিয়ামেন্টে ব্রিটিশমন্ত্রী ঘোষণা করিলেন যে, স্বাধীন ভারতের নূতন সংবিধান গঠনসম্বন্ধে চূড়ান্ত মীমাংসার জন্য মন্ত্রীসভার তিনজন সদস্য (Cabinet Mission) ভারতে যাইয়া ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করিবেন।
ভারতীয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহের সঙ্গে ভারতে ক্যাবিনেট মিশন’ (Cabinet Mission) পাঠাইবার প্রত্যক্ষ কোন কার্যকারণ সম্বন্ধ ছিল কিনা তাহা বলা কঠিন। তবে এই প্রসঙ্গে ইহাও বিশেষভাবে স্বরণীয় যে, জাপানী সৈন্য রেঙ্গুন অধিকারের চারিদিন পরেই ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতির দূত হিসাবে ক্রীপসকে ভারতে পাঠাইবার ঘোষণা করা হইয়াছিল। যাঁহারা মনে করেন মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিল, তাহাদের মনে রাখা দরকার যে, ১৯৩৩ সনে আইন অমান্য আন্দোলন ব্যর্থ ও পরিত্যক্ত হওয়ার পরে গান্ধী ভারতের মুক্তিসংগ্রামে আর কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন নাই। অপরদিকে সুভাষচন্দ্র কর্তৃক আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন ও সমগ্র ভারতবর্ষে স্বাধীনতাসংগ্রামের অগ্রদূত বলিয়া ইহার সম্বর্ধনায় ইংরেজ যখন বুঝিতে পারিল যে, যে-ভারতীয় সিপাহীদের সাহায্যে তাহারা ভারতবর্ষ জয় করিয়াছিল এবং এই বিশাল সাম্রাজ্য বিদেশীয় আক্রমণ ও স্বদেশীয় বিপ্লবের হাত হইতে এতদিন রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিল, সেই সিপাহীদের উপর আর নির্ভর করা চলে না, সেইদিনই সর্বপ্রথম তাহারা ভারতকে পূর্ণস্বাধীনতা দিবার প্রতিশ্রুতি দিল এবং তাহার জন্য ব্যবস্থা আরম্ভ করিল।
৪. ক্যাবিনেট মিশন
১৯৪৬ সনের ২৪শে মার্চ ক্যাবিনেট মিশন দিল্লী পৌঁছিল। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সঙ্গে বহু আলোচনা সত্ত্বেও দুইয়ের মধ্যে কোনরকম মিটমাটের সম্ভাবনা না দেখিয়া ১৬ই মে তাঁহারা ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতের গঠন-সম্বন্ধে একটি মোটামুটি ধারণা এবং ইহার সংবিধান প্রণয়নের ব্যবস্থাসম্বন্ধে একটি ঘোষণাপত্র প্রচার করিলেন। ইহার সারমর্ম এই : “ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যসমূহ মিলিয়া একটি যুক্তরাষ্ট্র (Federal Union) গঠিত হইবে। কেবলমাত্র বৈদেশিক রাজ্যের সহিত সম্বন্ধ, দেশরক্ষা এবং দেশের মধ্যে যাতায়াত ও সংবাদপ্রেরণ (অর্থাৎ রেলওয়ে, ডাক, টেলিগ্রাফ প্রভৃতি)-এই তিনটি বিষয়ের শাসনভার যুক্তরাষ্ট্রের হস্তে থাকিবে, অন্য সকল বিষয় প্রাদেশিক গভর্নমেন্ট ও দেশীয় রাজ্যের হস্তে থাকিবে। প্রাদেশিক বিধানসভার এবং যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত দেশীয় রাজ্যগুলির দ্বারা নির্বাচিত ২৯৬ জন সদস্য লইয়া গঠিত একটি সমিতি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন করিবেন–সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে এই সদস্যেরা নির্বাচিত হইবেন।
ব্রিটিশশাসিত ভারতের প্রদেশগুলি তিনভাগে বিভক্ত হইবে : (১) পঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্থান; (২) বঙ্গদেশ ও আসাম; (৩) অবশিষ্ট প্রদেশগুলি। প্রত্যেক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত প্রদেশগুলির প্রতিনিধিগণ পৃথক পৃথক মিলিত হইয়া ঐ-শ্রেণীভুক্ত প্রদেশগুলির সংবিধান গঠন করিবেন।
প্রত্যেক প্রদেশের বিধানসভা এই প্রণালীতে নির্বাচিত হওয়ার পর যে-কোন প্রদেশ ইচ্ছা করিলে সংযুক্ত ভারতরাষ্ট্র ত্যাগ করিয়া স্বতন্ত্র রাজ্য গঠন করিতে পারিবে।
এই ঘোষণায় ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব করিলেন যে, যে-পর্যন্ত নূতন সংবিধান প্রস্তুত না হয় ততদিন যে সমুদয় দল এই ঘোষণায় স্বীকৃতি দিয়াছে, সেই সমুদয় দলের প্রতিনিধি লইয়া বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতি (Executive Council) গঠিত হইবে।
৬ই জুন তারিখে মুসলিম লীগ ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে স্বীকৃতি জানাইল। কংগ্রেস বড়লাটের অস্থায়ী কার্যনির্বাহক সমিতিতে যোগদান করিতে রাজী হইল
; কিন্তু সংবিধান প্রণয়ন সভায় যোগদান করিতে সম্মত হইল। মুসলিম লীগ দাবী করিল যে, তাহাদের প্রতিনিধি লইয়াই বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতি গঠিত হউক। বড়লাট তাহাতে রাজী হইলেন না। ক্যাবিনেট মিশনের ঘোষণার কোন কোন অংশের প্রকৃত ব্যাখ্যা কী তাহা লইয়াও কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে মতভেদ হইল। কিছুদিন বাদবিতণ্ডা চলিবার পর মুসলিম লীগ ঘোষণা করিল যে, তাহারা ক্যাবিনেট মিশনের ঘোষণার স্বীকৃতি প্রত্যাহার করিতেছে। সুতরাং বড়লাট তাঁহার ঘোষণা-অনুযায়ী কেবলমাত্র কংগ্রেসের প্রতিনিধি লইয়া তাঁহার কার্যনির্বাহক সমিতি গঠন করিলেন। কংগ্রেসের এই জয়লাভে মুসলমানসম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হইল এবং ২৯শে জুলাই লীগ স্থির করিল যে ১৬ই অগষ্ট, ১৯৪৬ তাহারা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ (Direct Action) পালন করিবে। ইহার ফলে কলিকাতায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভীষণ দাঙ্গা, লুঠপাট ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড কয়েকদিন যাবৎ অনুষ্ঠিত হইল তাহার বিস্তৃত বিবরণ পরে দেওয়া হইবে। অতঃপর ২রা সেপ্টেম্বর পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের সদস্য লইয়া বড়লাটের নূতন কার্যনির্বাহক সমিতি গঠিত হইল এবং তাহারা মন্ত্রীসভার ন্যায় একযোগে শাসনকার্য চালাইতে লাগিলেন। লর্ড ওয়াভেল দেখিলেন যে, কংগ্রেসই ভারতশাসনে সর্বেসর্বা হইয়া উঠিয়াছে–সুতরাং তিনি অনেক চেষ্টা ও আলোচনার পর মুসলিম লীগকে মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে রাজী করাইলেন এবং নেহেরুকে বলিলেন যে, মুসলিম লীগ সংবিধান প্রণয়ন সভায় যোগদান করিবে। সুতরাং মুসলিম মন্ত্রী নিযুক্ত হইলেন। ২৬শে অক্টোবর দুই দল মিলিয়া যুক্ত মন্ত্রীসভা গঠিত হইল। কিন্তু ইহার ফলে কার্যনির্বাহক সমিতির মধ্যে দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধীদলের সৃষ্টি হইল। তারপর যখন সংবিধান প্রণয়ন সভার কার্য আরম্ভের ব্যবস্থা হইল তখন মুসলিম লীগ ইহাতে যোগদান করিল না এবং স্পষ্ট বলিল যে, তাহারা ইহাতে যোগ দিবে এমন কোন প্রতিশ্রুতি বড়লাটকে দেয় নাই। ওদিকে বিলাতে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ৬ই ডিসেম্বর ঘোষণা করিল যে, যদি মুসলিম লীগ যযাগদান না করে, তবে সংবিধান প্রণয়ন সভার সিদ্ধান্ত যেসব প্রদেশে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য সেইসব প্রদেশে প্রয়োগ করা হইবে না। ইহা সত্ত্বেও সংবিধান প্রণয়ন সভার প্রথম অধিবেশন হইল (৯ই ডিসেম্বর, ১৯৪৬)। মুসলিম লীগের সদস্যরা যোগ দিল না। এই অধিবেশনে রাজেন্দ্রপ্রসাদ সভাপতি নির্বাচিত হইলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে আইন করার জন্য কতকগুলি সমিতি গঠিত হইল।
৫. ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান
এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি দুইমাসেরও অধিক চলিবার পর ১৯৪৭ সনের ২০শে ফেব্রুআরি ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ঘোষণা করিল যে, ১৯৪৮ সনের জুন মাসের মধ্যে ভারতে ব্রিটিশশাসনের অবসান হইবে এবং ইহার ব্যবস্থা করিবার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন (ওয়াভেলের স্থানে) ভারতের বড়লাট নিযুক্ত হইয়াছেন। এই ঘোষণায় ভারতের মুসলমানসম্প্রদায় ছাড়া আর সকলেই গভীর আনন্দ প্রকাশ করিল। আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরম্ভ হইল। প্রথমে পঞ্জাব এবং পরে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বিগত ১৬ই অগষ্ট-এর ন্যায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম-হত্যা, লুঠপাট, আগুন লাগান ও অন্যান্য হিংসাত্মক কার্যের অনুষ্ঠান কয়েকদিন ধরিয়া চলিল।
এইরূপ পুনঃপুনঃ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দৃশ্যে বিচলিত হইয়া অতঃপর হিন্দু ও শিখগণ স্থির করিল যে, ভারতবর্ষে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান এই দুই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাই এই দুর্ভোগের একমাত্র প্রতিকার।
৬. ভারতের স্বাধীনতা লাভ
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সনের ২৪শে মার্চ বড়লাটের পদ গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ রাজত্ব শেষ হইবার পর ভারতের শাসনকার্য কিভাবে চলিবে তিনি ৩রা জুন তারিখে তাহার এক বিস্তৃত বিবরণ দিলেন। ইহার সারমর্ম এই :
১। যেসব অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য, সেইসব অঞ্চলের লোকেরা ইচ্ছা করিলে মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশ গঠিত হইবে, কিন্তু ইহা করার পূর্বে পঞ্জাব ও বঙ্গদেশের যে-অঞ্চলে হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য, সেইসব অঞ্চলের প্রতিনিধিরা ইচ্ছা করিলে এই দুই প্রদেশ সম্প্রদায়-অনুপাতে বিভক্ত করা হইবে।
২। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হইবে কি না তাহা ঐ প্রদেশের অধিবাসীদের ভোটদ্বারা স্থির করা হইবে।
৩। বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জিলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হইবে কি না তাহাও উক্ত জিলার অধিবাসীদের ভোটদ্বারা স্থির করা হইবে।
৪। বাংলাদেশ ও পঞ্জাব প্রদেশের যে-অংশ হিন্দুস্থান ও যে-অংশ পাকিস্ত নের অন্তর্ভুক্ত হইবে তাহার সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি কমিশন গঠিত হইবে।
ব্রিটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্তে হিন্দু বা মুসলমান কোন সম্প্রদায়ই পুরাপুরি খুশী হইল না। কিন্তু তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে ইহাই সর্বোকৃষ্ট ব্যবস্থা–প্রায় সকলেই ইহা স্বীকার করিল। সুতরাং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই এই সিদ্ধান্ত মানিয়া লইল। পঞ্জাব ও বাংলাদেশ দুই ভাগ করিয়া সীমান্ত নির্ধারণের জন্য স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের (Sir Cyril Radcliffe) সভাপতিত্বে দুইটি কমিশন গঠিত হইল। ১৯৪৭ সনের ১৬ই জুলাই ভারত-স্বাধীনতা বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে বিলাতের পার্লিয়ামেন্টে গৃহীত হইল এবং স্থির হইল যে ১৫ই অগষ্ট, ১৯৪৭ ভারত স্বাধীন রাজ্য বলিয়া ঘোষিত হইবে এবং ব্রিটিশশাসনের অবসান হইবে। তদনুসারে ১৪ই-১৫ই আগষ্টের মধ্যরাত্রে সংবিধান প্রণয়ন পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশনে ঘোষণা করা হইল যে, অতঃপর স্বাধীন ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যতন্ত্রের (British Common weatlh) অন্তর্ভুক্ত হইল এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই নূতন ভারত-রাজ্যের (Indian Dominion) প্রথম গভর্নর জেনারেল হইলেন।
মহম্মদ আলি জিন্না পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর-জেনারেল হইলেন এবং সেখানেও একটি সংবিধান প্রণয়ন পরিষদ গঠিত হইল।
৭. বঙ্গদেশ
অতঃপর ভারতের এই রাজনীতিক ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিত বাংলার ইতিহাস আলোচনা করিব। পূর্বেই বলা হইয়াছে, ১৯৪৬ সনের মার্চ মাসে সর্বত্র বিধান পরিষদের নির্বাচন হইল। বাংলার বিধান পরিষদে মোট ২৫০টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ ১১৫, কংগ্রেস ৮৪ এবং সাহেবরা ২৩টি আসন পাইল। কংগ্রেসের পরাজয়ে ক্ষুব্ধ হইয়া ইহার সভাপতি আবুল কালাম আজাদ প্রকাশ্যে বলিতে লাগিলেন যে, নির্বাচন ব্যাপারে অনেক গলদ (rigging) ঘটিয়াছে এবং সরকারী কর্মচারীরা নানারূপে খোলাখুলিভাবে মুসলিম লীগকে সাহায্য করিয়াছে।
ফজলুল হক বলেন যে, এই নির্বাচনে যে-প্রকার দুর্নীতি, উৎকোচগ্রহণ, বেআইনী কাজ এবং কর্মচারীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে লীগ জয়লাভ করিয়াছে তাহার অনুরূপ-দৃষ্টান্ত ইতিহাসে দেখা যায় না। আজাদ ও তাঁহার মুসলমান সহযোগী ফজলুল হক, নওশের আলি, সৈয়দ বদরুদুজা প্রভৃতি সাহেব-কর্মচারীদের পক্ষপাতিত্বের অনেক দৃষ্টান্ত দেখাইয়া এ-সম্বন্ধে অনুসন্ধানের জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করার প্রস্তাব করেন। প্রত্যুত্তরে শহীদ সুরাওয়ার্দি বলেন যে, নির্বাচনে কোন পক্ষপাতিত্ব হয় নাই, তাহার প্রমাণ যে, অনেক স্থলেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণের ভোটের সংখ্যার মধ্যে ব্যবধান খুব বেশী হয় নাই। এই প্রসঙ্গে বলা যাইতে পারে যে, স্বাধীন ভারতে ১৯৭১ সনের মার্চ মাসে বাংলাদেশের নির্বাচনে যখন কংগ্রেস কমিউনিষ্ট দলের নিকট পরাজিত হয়, এবং তাহার ঠিক এক বৎসর পরে যখন কমিউনিষ্ট দল কংগ্রেসের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় তখন যথাক্রমে কংগ্রেস ও কমিউনিষ্ট দল এইরূপ নির্বাচনে গলদের (rigging) অভিযোগ আনয়ন করিয়াছিল। এই সমুদয় অভিযোগের মধ্যে হয়ত কিছু সত্য ছিল, ফলে যে-কারণে এদেশে অপক্ষপাত ভোটদানের আদর্শ ও ব্যবস্থা যে এখনও সুপ্রতিষ্ঠিত হয় নাই সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। তবে ইহার ফলে মোটের উপর কোন্ দলের জয়-পরাজয় কতটা প্রভাবান্বিত হইয়াছিল তাহা বলা যায় না। বর্তমানে অর্থব্যয়ের পরিমাণের উপর যে ব্যক্তি বা দলের জয়-পরাজয় অনেকটা নির্ভর করে তাহা অস্বীকার করা কঠিন। ১৯৪৬-এর নির্বাচন ইহার দ্বারা কতদূর প্রভাবান্বিত হইয়াছিল তাহাও বলা শক্ত। তবে ১৯৪৬, ১৯৭১ ও ১৯৭২-কোন সনের নির্বাচন সম্বন্ধে কোন তদন্ত হয় নাই।
এই সময়ে বাংলাদেশের মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে বিরোধ তীব্র হইয়া উঠে। গত নির্বাচনের সময় হইতেই বিরোধ চলিতেছিল। সুরাওয়ার্দির ষড়যন্ত্রের ফলেই নাজিমুদ্দীন পুনরায় নির্বাচনপ্রার্থী হইতে পারেন নাই এবং তাঁহার স্থলে সুরাওয়ার্দি বাংলায় মুসলিম লীগের নেতা হন। ২রা এপ্রিল, ১৯৪৬ বাংলার গভর্নর বারোজ (Frederick John Burrows) হুসেন শহীদ সুরাওয়ার্দিকে মন্ত্রীসভা গঠন করিতে আহ্বান করিলেন। তিনি কংগ্রেস দলের নির্বাচিত নেতা কিরণশঙ্কর রায়ের নিকট মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের যুক্ত-মন্ত্রীসভা গঠনের প্রস্তাব করেন। উভয়ের মধ্যে যে কথাবার্তা হয় তাহার সফলতা এই দুইদলের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতামতের উপর নির্ভর করে। সুতরাং কংগ্রেস সভাপতি আবুল কালাম আজাদ নিজে অথবা কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির পক্ষে কয়েকটি শর্তে যুক্ত-মন্ত্রীসভার অনুমোদন করেন।
শর্তগুলি মোটামুটি এই :
(১) আটজন মুসলমান ও ছয়জন হিন্দু মন্ত্রী লইয়া মন্ত্রী-পরিষদ গঠিত হইবে।
(২) মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস যথাক্রমে মুসলমান ও হিন্দু মন্ত্রীগণকে নির্বাচিত করিবেন।
(৩) কেবলমাত্র প্রাদেশিক ব্যাপারই যুক্ত মন্ত্রী-পরিষদের কার্যক্রমের ও আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হইবে, পাকিস্তান সংগঠন প্রভৃতি সর্বভারতীয় বিষয় লইয়া ইহা কোন আলোচনা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে না।
(৪) রাজনীতিক বন্দী ও কয়েদীদের মুক্তিসম্বন্ধে মন্ত্রী-পরিষদের ঐক্যমত হইবে।
(৫) অসাধুতা ও কলুষতা নিবারণের উদ্দেশ্যে একটি বোর্ড সংগঠিত হইবে।
আপাতদৃষ্টিতে সুরাওয়ার্দির প্রস্তাবটি সাম্প্রদায়িক মিলনের সেতু বলিয়া পরিগণিত হইবার যোগ্য। কিন্তু কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ এই সুযোগে তাহাদের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহারা দাবি করিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য সকল মন্ত্রীর অর্ধেক সংখ্যা হইবে হিন্দু, ও অর্ধেক মুসলমান; একজন হিন্দু ‘হোম’ কিংবা সিভিল সাপ্লাই’ বিভাগের মন্ত্রী হইবেন; সমস্ত রাজনীতিক বন্দীকে–কয়েদী অথবা অন্তরীণে আবদ্ধ-মুক্তি দিতে হইবে; দুর্নীতি নিবারণের জন্য একটি বোর্ড স্থাপিত করিতে হইবে; সাম্প্রদায়িক ব্যাপারের সহিত সংশ্লিষ্ট কোন নূতন বিধান দুই সম্প্রদায়ের সম্মতি না হইলে প্রস্ত বি করা হইবে না, অথবা বিধানসভার সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট ছাড়া গৃহীত হইবে না। মাধ্যমিক শিক্ষার সংস্কারের জন্য মুসলিম লীগ যে একটি বিল পাশ করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন তাহা লইয়াও গুরুতর মতভেদ হইল।
যখন বঙ্গদেশের মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে এইরূপ আলোচনা চলিতেছিল তখন ভবিষ্যতে স্বাধীন ভারতের শাসনব্যবস্থা কিরূপ হইবে, ক্যাবিনেট মিশনের সেই প্রস্তাব লইয়া কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে গুরুতর মতভেদ উপস্থিত হইল। ফলে মুসলিম লীগের কর্তৃপক্ষ কংগ্রেসের শর্তগুলি গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিলেন। ২৯শে এপ্রিল (১৯৪৬) দুইদলের নিষ্ফল আলোচনা শেষ হইল। সুরাওয়ার্দি কংগ্রেসসদস্য বাদ দিয়াই অন্য কয়েকজন হিন্দুসদস্যসহ মন্ত্রীসভা গঠিত করিলেন। কেহ কেহ মনে করেন, সুরাওয়ার্দির প্রস্তাব গ্রহণ না-করা কংগ্রেসের পক্ষে বিষম ভুল হইয়াছিল এবং তাহাদের দোষেই হিন্দু-মুসলমানের মিলনের ভিত্তিতে অখণ্ড বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের শেষ আশা নির্মূল হইয়াছিল।
সুরাওয়ার্দির মন্ত্রীসভা অবিভক্ত বঙ্গদেশের শেষ শাসকমণ্ডলী। বঙ্গবিভাগ ছাড়াও আর যে দুইটি ঘটনা ইহাকে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করিবে তাহা হইল : (১) মুসলমানদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম, অর্থাৎ কলিকাতার বিরাট হত্যাকাণ্ড এবং (২) নোয়াখালিতে হিন্দুমেধযজ্ঞ। পাকিস্তানের সৃষ্টি ও বঙ্গভঙ্গ, এই দুইটি ঘটনার সহিত বিজড়িত। সুতরাং প্রথমে এই দুইটির বিস্তৃত আলোচনা করিব।
৮. কলিকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (Direct Action)
কী কারণে মুসলমানসপ্রদায় ১৬ই অগষ্ট (১৯৪৬) কলিকাতা শহরে ভীষণ দাঙ্গা হাঙ্গামা আরম্ভ করে তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। এইরূপ নিষ্ঠুর, ব্যাপক, দীর্ঘকালস্থায়ী এবং পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রণালী অনুসারে যে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন ও অগ্নিদাহ হইয়াছিল, সমগ্র ভারতবর্ষে নাদির শাহের দিল্লী-হত্যাকাণ্ডের পরে তাহা আর কখনও অনুষ্ঠিত হয় নাই। এবং ইহাই যে কংগ্রেসের পক্ষে বঙ্গব্যবচ্ছেদে সম্মত হওয়ার অন্যতম কারণ তাহাও বলা হইয়াছে। সুতরাং এই ঘটনাটির বিস্তৃত বিবরণ দিতেছি।
মুসলমানদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম-১৫ অগষ্ট (১৯৪৬)
পূর্বপ্রস্তুতি কলিকাতার প্রসিদ্ধ মাসিক পত্রিকা প্রবাসী’তে ঘটনার অব্যবহিত পরেই (১৩৫৩ আশ্বিন) এই সংগ্রামের যে-বিবরণ বাহির হইয়াছিল তাহা সংক্ষেপে উদ্ধৃত করিতেছি। প্রথমেই মন্তব্য করা হইয়াছে, “১৬ই অগষ্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম উপলক্ষে দাঙ্গা বাধাইবার জন্য লীগ বহু পূর্ব হইতেই প্রস্তুত হইতেছিল। লীগনেতাদের বক্তৃতা ও বিবৃতি এবং লীগ-পত্রিকাসমূহের মন্তব্য হইতে প্রয়োজনীয় অংশ উদ্ধৃত করিয়া দৈনিক ‘ভারত’ তাহা প্রমাণ করিয়াছে। লক্ষ লক্ষ উত্তেজনাপূর্ণ প্রচারপত্রও বিলি করা হয়। একটি উর্দু পুস্তিকায় লেখা হয় :
“এই রমজান মাসে ইসলাম ও কাফেরদের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য যুদ্ধ আরম্ভ হয়, …এই রমজান মাসেই আমরা মক্কায় জয়লাভ করি এবং পৌত্তলিকদের নিশ্চিহ্ন করিয়া দেই। এই মাসেই ইসলামের বনিয়াদ স্থাপিত হয়। আল্লার ইচ্ছায় পাকিস্তান লাভের উদ্দেশ্যে জেহাদ আরম্ভ করিবার জন্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগ এই রমজান মাস ঠিক করিয়াছেন।”
কলিকাতা জেলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারী এবং কলিকাতার মেয়র মহম্মদ ওসমানের স্বাক্ষরে এই পুস্তিকাটি প্রচালিত হয়।
পূর্বপ্রস্তুতির আর-একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণসম্বন্ধে বলা হইয়াছে : “বাংলায় ও সিন্ধুতে লীগ-মন্ত্রীসভা বিদ্যমান। এই দুই মন্ত্রীসভা ১৬ই অগষ্ট সরকারী ছুটি ঘোষণা করেন। সিন্ধুর গভর্নর ঝুনা সিভিলিয়ন ছুটির তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করিয়া ছুটি বাতিল করিয়া দেন। এই অপমান হেদায়তুল্লা মন্ত্রীসভা নীরবে পরিপাক করিতে বাধ্য হন। বাংলার গভর্নর নবাগত, তিনি ছুটি মঞ্জুর করিয়া বাংলায় অশান্তির আগুন জ্বালাইবার পথ করিয়া দেন। বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ এবং সংবাদপত্রসমূহ সুরাওয়ার্দি মন্ত্রীসভার উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া এই ছুটির তীব্র প্রতিবাদ করেন। আইন পরিষদের ইংরেজনেতাও ইহার বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করিয়া ছুটি বাতিল করিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু শুভ পরামর্শ মন্ত্রীরা শুনিলেন না।”
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, এই ঘটনার সাত বৎসর পর এই গ্রন্থের লেখক ভারত-সরকার কর্তৃক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস প্রণয়নের ভারপ্রাপ্ত হইয়া সরকারী গোপনীয় কাগজপত্র দেখিবার অনুমতি পান। এই উপলক্ষ্যে তিনি দিল্লীর দপ্তরখানায় কলিকাতা ১৯৪৬ সনের দাঙ্গা সম্বন্ধে একটি ফাইলে দিল্লী হইতে বাংলায় প্রেরিত গুপ্তচর সোজাসুজি দিল্লী-সরকারকে (বাংলা সরকারের অজ্ঞাতে) যেসব রিপোর্ট পাঠাইতেন তাহা রক্ষিত আছে। ইহাতে এমন সব দলিলপত্র আছে যাহাতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দি নিজে ১৬ই অগষ্টের দাঙ্গার ব্যবস্থা করেন। যে গুণ্ডা এই দাঙ্গার প্রধান নায়ক ছিল তাহার নাম আছে, এবং পুলিশ তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়া হাজতে নিলে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং গিয়া তাহাকে মুক্তি দেন, ইহারও উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থের লেখক এই দলিলগুলির কপি নিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু অনুমতি পান নাই-প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে অনুরোধ করিয়াও কোন ফল হয় নাই; কিন্তু তিনি কী কারণে তখনকার পরিস্থিতিতে এই সমুদয় ছাপানো উচিত নহে তাহা বর্তমান লেখককে বুঝাইয়া বলেন। সেইসব দলিলপত্র সম্ভবত এখনও আছে এবং পরিস্থিতিরও পরিবর্তন ঘটিয়াছে। ঐতিহাসিক সত্যের মর্যাদা রক্ষার জন্য সেই দলিলগুলি এখন প্রকাশ করা উচিত।
১৬ই অগষ্টের জেহাদ ও হিন্দুনিধন
১৫ই অগষ্ট (১৯৪৬) রাত্রিতে মুসলিম লীগের স্বেচ্ছাসেবকেরা কুচকাওয়াজ করিল, জেহাদের কথা লরীযোগে মুসলমান পাড়াগুলিতে প্রচার করিয়া বেড়াইল এবং সঙ্গে সঙ্গে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ এই চীৎকারধ্বনি শোনা গেল।
১৬ই শুক্রবার ভোর না হইতেই দলে দলে মুসলমানেরা পথে বাহির হইয়া পড়িল এবং দোকানদারদের দোকান বন্ধ করিবার জন্য জিদ করিল। তার পরেই আরম্ভ হইল দোকান-লুঠ এবং দোকানের লোকদের প্রহার ও ছুরিকাঘাত। ইতিমধ্যে মানিকতলা, রাজাবাজার, মেছুয়াবাজার, টেরিটিবাজার, বেলগাছিয়া প্রভৃতি মুসলমানপ্রধান অঞ্চলগুলিতে হিন্দুদের উপর আক্রমণ শুরু হয়। সর্বপ্রথম মুসলমানেরা মানিকতলার মোড়ে এক গোয়ালাকে প্রহার করে। তাহার দুধ ঢালিয়া দুগ্ধভাণ্ড ভাঙ্গিয়া দেয়। তখন ভোর প্রায় ছয়টা। তারপর একটি খাবারের দোকান লুঠ এবং লোকদের প্রহার করে। পুলিশ প্রথম হইতেই চক্ষের উপর লুণ্ঠন এবং ছোরা ও লাঠির আঘাত দেখিয়াও সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে। এইরূপে পথে গুণ্ডামি করিয়া নানাদিক হইতে বিরাট শোভাযাত্রা করিয়া গড়ের মাঠে সভায় যোগদান করে। তাহাদের প্রত্যেকের হাতেই লাঠি, ছোরা, তরবারি প্রভৃতি কোন-না-কোন অস্ত্র ছিল। লীগনেতারা ইহা অস্বীকার করিলেও বহু ফটোগ্রাফে উহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ রহিয়াছে। ময়দানের সভায় কাফের হিন্দুদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করিয়া জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়া হয়। সভার পর জেহাদের সৈনিকেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হইয়া হিন্দু দোকান লুণ্ঠন ও হিন্দুদের হত্যা আরম্ভ করে। চৌরঙ্গি এবং ধর্মতলার যেসব অংশ গভর্নমেন্ট হাউস হইতে দেখা যায়, সেইসব স্থানে বড় বড় লাঠি লইয়া জেহাদের সৈনিকেরা হিন্দুর দোকানপাট ভাঙ্গিয়া লুঠ করে। চৌরঙ্গি ধর্মতলার প্রায় মোড়ে কে.সি. বিশ্বাসের বন্দুকের দোকান লুঠ হয়। লালবাজারে পুলিশের প্রধান ঘাঁটি হইতে কয়েক গজমাত্র দূরে একটি ঘড়ির দোকান লুঠ হয় এবং উহার প্রায় ৩২৫ গজের মধ্যে পোলক স্ট্রীটে এবং টেরিটিবাজারে অনেক হিন্দু দোকানদার, দারোয়ান ও পথচারী নিহত হয়। গুণ্ডাদের সঙ্গে লাঠি, ছোরা, তরবারি তো ছিলই, প্রচুর পরিমাণে পেট্রল এবং কেরোসিন তেলও ছিল এবং লরী বা গাড়ীর অভাবও ছিল না। শহরের যেসব স্থানে মুসলমানেরা সংখ্যায় কম, সেইসব স্থানে লরীযোগে লোক পাঠাইয়া স্থানীয় মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি করা হইয়াছিল। সন্ধ্যার মধ্যেই শহরের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম পর্যন্ত আগুন জ্বলিয়া ওঠে। সর্বত্র মুসলমানেরা আক্রমণ চালাইতে থাকে এবং আক্রান্ত হিন্দুরা পুলিশকে টেলিফোন করিয়া ও সম্মুখে পুলিশ দেখিলে তাহাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিয়া একই উত্তর পাইতে থাকে-রাজনৈতিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিবার হুকুম নাই। পুলিশ সম্বন্ধে গুণ্ডাদের মনোভাব ছিল যেন “পুলিশ আমাদের লোককে কিছু বলিবে না।”
নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ প্রভৃতি পুলিশের চক্ষের উপর ঘটিয়াছে। বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশ এবং সার্জেন্টরা লুঠের মালের ভাগ আদায় করিয়াছেন।
১৬ই অগষ্টের পর
১৬ই অগষ্ট সন্ধ্যার মধ্যেই কলিকাতার হিন্দু অধিবাসীরা বুঝিতে পারিল যে পুলিশ তাহাদের জন্য কোন সাহায্য করিবে না–কারণ মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভাই গুণ্ডামির উদ্যোক্তা ও সমর্থক। এই ধারণা যে অমূলক নহে, তাহার সমর্থনস্বরূপ বলা যাইতে পারে যে সারাদিন পুলিশ নিষ্ক্রিয় না থাকিলে এরূপ ঘটিতে পারিত না। এই প্রসঙ্গে বলা যাইতে পারে যে, বোম্বাই শহরে দাঙ্গা নিবারণ করিতে গিয়া সাধারণ কনষ্টেবল তো দূরের কথা, অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মচারীরাও আহত হইয়াছেন, কিন্তু কলিকাতার বড় কর্মচারী তো দূরের কথা, কোন কনষ্টেবলের পিঠে পর্যন্ত একটি আঁচড় লাগে নাই। বাংলার মুসলিম লীগের মন্ত্রীগণ যাহা করিলেন, কোন দায়িত্বশীল শাসনকর্তৃপক্ষের সেরূপ আচরণ জগতের ইতিহাসে বিরল। কিন্তু ইহার যে প্রতিক্রিয়া হইল তাহাও ভয়ানক। হিন্দুরা যখন উপলব্ধি করিল যে যিনি রক্ষক তিনিই ভক্ষক, তখন তাহারা নিজেরাই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করিল। পাড়ায় পাড়ায় হিন্দু যুবকেরা দলবদ্ধ হইল, স্থির হইল–প্রতি পাড়ায় একটি বাড়ীতে যুবকগণ পালাবদল করিয়া ২০।২৫ জন সর্বদা হাজির থাকিবে। লাঠি ছোরা প্রভৃতিও সংগৃহীত হইল। ব্যবস্থা হইল, কোন বাড়ী মুসলমানেরা আক্রমণ করিলে বাড়ীর ছাদ হইতে শঙ্খধ্বনি করা হইবে–অমনি যুবকের দল সেই বাড়ী রক্ষার জন্য অগ্রসর হইবে। বর্তমান লেখকের বাড়ীর একতলায় এইরূপ একটি যুবকের দল মিলিত হইত। ইতিমধ্যে সরকারের নিকট এই সংবাদ পৌঁছিল। এইসব দল ধরিবার জন্য হিন্দু-পাড়ায় পুলিশের লরী রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিল। দিনে দরজা-জানলা বন্ধ করিয়া রাত্রে বাতি নিভাইয়া যুবকের দল চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত। ব্যবস্থা হইল, পুলিশের লরী অতিক্রম করিলেই দুইবার শঙ্খধ্বনি করিয়া সেই পাড়ার লোক অন্য পাড়াকে সতর্ক করিবে।
কিন্তু স্বাভাবিক নিয়ম-অনুসারে আত্মরক্ষার জন্য যে-ব্যবস্থা আরম্ভ হইয়াছিল তাহা প্রতিহিংসাত্মক আক্রমণে পর্যবসিত হইল। ১৭ই অগষ্ট প্রথমে হিন্দুরা মুসলমানদের অনেক স্থানে সফলতার সহিত বাধা দিতে সমর্থ হয়, কিন্তু ক্রমশঃই তাহারা উত্তেজিত হইয়া পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ করে। একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখি। আমার বাড়ীর কাছেই একটি বস্তিতে কয়েকঘর মুসলমান বাস করিত। আমার বাড়ীর সম্মুখ দিয়া লাঠিহাতে কয়েকজন যুবককে সেইদিক দৌড়াইতে দেখিয়া বাধা দিলাম–একটি যুবক উত্তেজিতস্বরে বলিল, “জানেন, পার্ক সার্কাসে কতজন হিন্দু নরনারী শিশু খুন হয়েছে? গভর্নমেন্ট যখন কিছু করবে না আমরা এর পাল্টা জবাব দিব।” পরে শুনিলাম সেই বস্তির মুসলমান সবাই নিহত হইয়াছে। ১৭ ও ১৮ই অগষ্ট এই দুইদিন আক্রমণ ও পাল্টা-আক্রমণ ভয়ানক ভাবে চলিতে থাকে। ১৮ই সন্ধ্যা নাগাদ মুসলমানেরা বুঝিতে পারে যে হিন্দুরা মারিতে আরম্ভ করিয়াছে; আর বেশীদূর অগ্রসর হইলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অদৃষ্টে অনেক ক্লেশ ও লাঞ্ছনা ঘটিবে–যে পাড়ায় মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যে পাড়ায় অধিকাংশ হিন্দুই হত, আহত ও পলায়িত, সেখানে আর অত্যাচার করিবার। কিছু নাই। বিশেষ দ্রষ্টব্য এই যে, ১৭ই হইতে পাল্টা হিন্দু-আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদল আমদানি করা হইল। মুসলমানেরা যেসব স্থানে আক্রান্ত হইয়াছিল সেখানেই সৈন্যদল ধাবিত হইল-মুসলমান-পরিবেষ্টিত হিন্দু জনসাধারণের রক্ষার জন্য কোন প্রয়াস দেখা যাইত না। অবশেষে ১৮ই সন্ধ্যার পর হিন্দুর পাল্টা জবাব দেখিয়া মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা ও গভর্নরের চৈতন্য হইল। লীগনেতারা সংগ্রাম বন্ধ করিবার চেষ্টা আরম্ভ করেন এবং গভর্নর আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার ভার প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দির হাত হইতে সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে অর্পণ করেন। ১৯শে অগষ্ট সোমবার হইতে অবস্থা আয়ত্তাধীন হয়।
ঐতিহাসিক মসলী ইংরেজ রাজত্বের অবসান’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে ১৬, ১৭, ১৮ অগষ্ট–এই তিনদিনে কলিকাতার ছয় হাজার লোক ছোরা, বন্দুক, লাঠি বা অগ্নিদাহে (hacked, battered, burned, stabbed or shot) নিহত এবং বিশ হাজার নারী ধর্ষিত (raped) এবং বিকলাঙ্গ (maimed)। প্রবাসী’র মতে ছয় হইতে আট হাজার লোক নিহত হয়, পনেরো হইতে কুড়ি হাজার আহত হয় এবং পাঁচ হইতে সাত কোটি টাকার সম্পত্তি লুণ্ঠিত হয়। লুণ্ঠিত সম্পত্তির মধ্যে শতকরা নব্বই ভাগই হিন্দুর। কলিকাতার প্রায় একলক্ষ লোক নিজের গৃহ ত্যাগ করিয়া প্রাণরক্ষার্থে পলাইতে বাধ্য হয়। সরকারী রিপোর্ট অনুসারে হত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে পাঁচ ও পনেরো হাজার।
কলিকাতার Statesman পত্রিকা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা এবং বিশেষতঃ প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দিকে দোষী সাব্যস্ত করিয়াছেন। তাঁহাদের সাহায্যেই আক্রমণকারী মুসলমানেরা অনায়াসে গাড়ী ও পেট্রল সংগ্রহ করিতে পারিত যখন আর কাহারও পক্ষে ইহা সম্ভব ছিল না। বাহির হইতে যে বহুসংখ্যক মুসলমান গুণ্ডা কলিকাতায় আনা হইয়াছিল, ইহা কেবল সন্দেহ বা অনুমানের উপর নির্ভর করে না। কলিকাতায় যাহা ঘটিয়াছিল তাহা সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা নহে, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বেপরোয়া যুদ্ধ (unrestrained civil war)। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বড়লাটকে বলিয়াছিলেন যে ১৬ই অগষ্ট সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করায় কলিকাতায় গুণ্ডাদের ধারণা হইয়াছিল যে, হিন্দুদের হত্যা, লুণ্ঠন প্রভৃতি সরকার অনুমোদন করিয়াছেন। আজাদ স্পষ্ট ভাষায় বাংলার মন্ত্রীসভা, বিশেষতঃ সুরাওয়ার্দিকে এই শোচনীয় ঘটনার জন্য দায়ী করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, “বৃহৎ একদল সৈন্য গাড়ীতে বসিয়া আছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমরা মারামারি থামাইতে চেষ্টা করিতেছ না কেন? তাহারা উত্তর দিল, আমাদের উপর আদেশ ও নির্দেশ–তৈরী হইয়া থাকিবে কিন্তু কিছু করিবে না (Their orders were to stand ready but not to take any action) 1”
এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, বাংলার গভর্নর কলিকাতায় চুপ করিয়া বসিয়া ছিলেন, বিশেষ কিছুই করিয়াছিলেন এমন প্রমাণ নাই। পণ্ডিত নেহেরু দিল্লীতে মন্ত্রীসভা গঠনে ব্যস্ত, বাংলার এই চরম সঙ্কটে একবার কলিকাতায় আসিবার সময় পান নাই। অথচ বিহারে যখন হিন্দুরা কলিকাতা ও নোয়াখালির প্রতিশোধে মুসলমানদের হত্যা করে, তখন তিনি বিহারে গিয়াছিলেন হিন্দুদিগকে দমন করিতে। কিন্তু বাংলার প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দি চুপ করিয়া বসিয়া ছিলেন না। কলিকাতায় হাঙ্গামার পর বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে উহা লইয়া যে আলোচনা হয় তাহাতে প্রকাশ পাইয়াছিল যে, পার্ক স্ট্রীট থানায় আনীত সাতজন অভিযুক্ত আসামীকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আসিয়া মুক্ত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন। এইরূপ আরও অনেক থানায় অন্যায়ভাবে মুক্তি বা জামিন দেওয়া হয়, বহুক্ষেত্রে গ্রেপ্তার করাই হয় নাই।
বড়লাট ওয়াভেলও কলিকাতার হিন্দুনিধনযজ্ঞ সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন। তাহার রোজনামচা (diary) প্রকাশিত হইয়াছে। ১৬-১৭ই অগষ্টে ইহার সম্বন্ধে কোন উল্লেখ নাই। ১৮ই অগষ্ট তিনি লিখিয়াছেন, “কলিকাতার অবস্থা পূর্ববৎ খারাপ, হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়াই চলিয়াছে। সকালে মন্ত্রী শরৎচন্দ্র বসু আমাকে টেলিফোনে জানাইলেন যে, পুলিশ হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদিগকে সাহায্য করিতেছে (favouring the Muslims against the Hindus)। কিন্তু গভর্নর বলিতেছেন যে, নিহতদের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানদের সংখ্যাই বেশী। মোটের উপর ব্যাপারটা খুবই খারাপ (Anyway it is a thoroughly bad business)”। ওয়াভেলের ডায়েরী হইতে দেখা যায় যে, ১৬ হইতে ১৮ই অগষ্ট যখন কলিকাতায় নরমেধযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইতেছিল তখন বড়লাট ও নেহেরু মন্ত্রীসভার গঠন নিয়াই ব্যস্ত ছিলেন, কলিকাতার বিষয় ভাবিবার সময় পান নাই বা আবশ্যক মনে করেন নাই।
১৯শে অগষ্ট বড়লাট লিখিয়াছেন, “সেনাপতি বলিলেন, কলিকাতায় যথেষ্ট ইংরেজি সৈন্য ও দেশী সিপাহী আছে এবং আরও আসিতেছে। আমার মনে হইল (I wonder) কংগ্রেসের দাবি অনুসারে যদি ইংরেজসৈন্য ভারত ছাড়িয়া যাইত তবে আজ কলিকাতার অবস্থা কী হইত! বারোসকে (Burrows বাংলার লাট) টেলিফোন করিয়াছিলাম যে, আমি কি কলিকাতায় যাইব? বারোস উত্তর দিলেন যে, আমি গেলে তিনি মুস্কিলে পড়িবেন (it might embarrass him)”। অথচ সুরাওয়ার্দির প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁহারা বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন।
পরে সুরাওয়ার্দি সম্বন্ধে বাতোস ওয়াভেলকে বলিয়াছিলেন যে, “সুরাওয়ার্দি অতিশয় বদ লোক, তাহার কথায় বিশ্বাস করা যায় না (cad and untrustworthy)।” ওয়াভেল নিজে সুরাওয়ার্দি সম্বন্ধে লিখিয়াছেন :
“আমার বরাবরই ধারণা এই যে, সুরাওয়ার্দি অত্যন্ত অহংকারী অকর্মণ্য এবং কুটিল প্রকৃতির রাজনীতিক (one of the most inefficient, conceited and crooked politicians in India)।” এই প্রসঙ্গে পূর্বোক্ত আসামীকে মুক্তি দেওয়ার কথা স্মরণ করা যাইতে পারে। যখন কলিকাতায় রক্তক্ষয়কারী সংগ্রাম থামিয়া অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে, তখন ওয়াভেল কলিকাতা পরিদর্শনে আসিয়া মাত্র ২৪ ঘণ্টা ছিলেন (২৫-২৬শে অগষ্ট) এবং আড়াই ঘণ্টা কাল শহর পরিদর্শন করিয়া লিখিয়াছেন, “এখন কলিকাতা শান্ত এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কয়েকটি অগ্নিদাহে ভস্মীভূত দোকান ও বাড়ী ছাড়া সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার আর কোন চিহ্ন নাই। কয়েকজন সৈনিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলিলাম এবং তাহাদিগকে ধন্যবাদ দিলাম। সকলেরই মত এই যে তাহারা চমৎকার কাজ করিয়াছে (every one agrees that they did magnificent)”।
“সকলেরই মত” অর্থাৎ সাহেব কর্মচারীদের এবং সুরাওয়ার্দির মত–কারণ তিনি তাঁহার সাক্ষাৎকারীদের মধ্যে কেবল ইহাদের উক্তি উল্লেখ করিয়াছিলেন। একমাত্র নাজিমুদ্দীন ব্যতীত অন্য কোন নাগরিক বা রাজনীতিকের সহিত সাক্ষাতের কোন বিবরণ দেন নাই। কলিকাতার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি মন্তব্য করিয়াছেন : “আমার মনে সবচেয়ে গুরুতর ঘটনা এই যে, (প্রধানমন্ত্রী) সুরাওয়ার্দি মুসলিম লীগের বন্ধুগণসহ সংগ্রামের প্রথম দিনে (১৬ই অগষ্ট) প্রায় সর্বদাই পুলিশ অফিসের যে-ঘর হইতে শহরের সর্বত্র পুলিশের গতিবিধি ও কার্যক্রম সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হয় (Control Room), সেইখানে ছিলেন এবং তাঁহার সাম্প্রদায়িক মনোভাব (his obvious communal bias)। পুলিশ যে গুলি করে নাই বা অন্য কোন কঠোর পন্থা অবলম্বন করে নাই, তাহার কারণ গত ফেব্রুয়ারী ও নভেম্বরের সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় তাহাদের বিরুদ্ধে রাজনীতিক কারণে পক্ষপাতিত্বের জন্য দোষারোপ করা হইয়াছিল (political criticism directed against them)। হার্ডউইক (Hardwick) মাত্র কয়েকমাস পুলিশ কমিশনারের কাজ করিয়াছে, তাহার যথেষ্ট কঠোরতা ও অভিজ্ঞতা নাই (lack a little in toughness as well as in experience),”.
অতঃপর বড়লাট কলিকাতা-অঞ্চলের সেনাপতি বুচারের সঙ্গে দেখা করেন (General Sir Roy Bucher)-ইনি স্বাধীনতার পর ভারতের প্রধান সেনাপতি হইয়াছিলেন। তিনি ১৮ই অগষ্ট সুরাওয়ার্দির সঙ্গে শহর-পরিদর্শনের সময় তাঁহার যে পূর্ণ সাম্প্রদায়িক ভাব (completely communal attitude) লক্ষ্য করিয়াছেন, সে-সম্বন্ধে মন্তব্য করিলেন। অতঃপর চীফ সেক্রেটারী ওয়াকার (Walker) এবং তাঁহার সহকারী (Assistant) মার্টিন (Martin) বড়লাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উভয়েই সুরাওয়ার্দির সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব (communal bias) সম্বন্ধে মত প্রকাশ করিলেন। তারপর বড়লাট বাংলার গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলিলেন, সুরাওয়ার্দির উপর কাহারও আস্থা নাই (forfeited every one’s confidence), বিধানসভায় ইউরোপীয়দের উপরই মন্ত্রীদের নির্ভর করিতে হয়। বর্তমান মন্ত্রীসভা অনায়াসেই দূর করা যায়, কিন্তু ৯৩ ধারা অনুসারে গভর্নরের নিজের হাতে শাসনভার গ্রহণ করাও সম্ভব নহে। তিনি আজিজুল হকের নেতৃত্বে বিভিন্ন দলের যুক্ত-মন্ত্রীসভার প্রস্তাব করিলেন। বড়লাট তাঁহাকে বলিলেন যে, আজিজুল হকের কার্যকুশলতা (ability) সম্বন্ধে তাঁহার ধারণা খুব ভাল নহে, তবে তিনি সুরাওয়ার্দি অপেক্ষা ব্যক্তি হিসাবে অনেক ভাল (pleasanter personality)।
সর্বশেষে ওয়াভেল কয়েকজন হিন্দু ও মুসলমান এবং (বেসরকারী) ইউরোপীয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন, কিন্তু নাজিমুদ্দীন ছাড়া আর কাহারও নাম বা কথাবার্তার উল্লেখ করেন নাই। নাজিমুদ্দীনের সম্বন্ধে কেবলমাত্র একটি কথা লিখিয়াছেন যে, তিনি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের বিবরণ Thcota (statement on communal lines about the riot)
বড়লাট ওয়াভেল তাঁহার রোজনামচায় (Diary) যাহা লিখিয়াছেন তাহা হইতে উল্লেখিত বিবরণ উদ্ধৃত করিলাম। কিন্তু কলিকাতা হইতে দিল্লী ফিরিবার তিনদিন পরে বিলাতে ভারতবর্ষের সেক্রেটারী অব ষ্টেটের নিকট নিম্নলিখিত টেলিগ্রাম করেন :
“১৬ হইতে ২৮শে অগষ্টের মধ্যে কলিকাতার এই সকল দাঙ্গায় ৪,৪০০ জন হত, ১৬০০ আহত এবং এক লক্ষ লোক গৃহহীন হইয়াছে।”
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্যাটেল দাবি করিয়াছিলেন যে, বাংলার অবস্থা ক্যাবিনেটে আলোচিত হউক এবং অনতিবিলম্বে বাংলা গভর্নমেন্টের হাত হইতে কলিকাতার উপদ্রুত অঞ্চলের শাসনভার কেন্দ্রীয় সরকার নিজহস্তে গ্রহণ করুক। কিন্তু বড়লাট রাজী হন নাই।
পূর্বোক্ত বিবরণ হইতে ইহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে, কলিকাতার তিনদিনব্যাপী সাম্প্রদায়িক সংগ্রাম মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের ফল। লীগ-মন্ত্রীসভা শাসনক্ষমতার যে অপব্যবহার করিয়াছে সভ্যজগতের ইতিহাসে তাহার তুলনা মেলা কঠিন এবং ইংরেজ গভর্নমেন্টও এ-বিষয়ে ঔদাসীন্য ও পক্ষপাতিত্বদোষে দুষ্ট।
একজন বাঙ্গালী হিন্দু লেখকের এই উক্তি অতিরঞ্জিত ও পক্ষপাতদুষ্ট বলিয়া মনে হইতে পারে। এইজন্য একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মাচারীর (শ্রীপ্রকাশস্বরূপ মাথুর, যিনি এই সময় বাংলা গভর্নমেন্টের ডিরেক্টর অব পাবলিসিটি ছিলেন) ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অপ্রকাশিত বিবরণ হইতে কয়েকটি ঘটনা ও মন্তব্যের সারাংশ উদ্ধৃত করিতেছি।
“১৬ই অগষ্ট সরকারী ছুটি–প্রাতঃকাল হইতে যানবাহন দোকানপাট সব বন্ধ–সর্বত্র একটা আতঙ্কের ছায়া। আমি আমার চৌরঙ্গীর বাসভবন হইতে হাঁটিয়া বেলা দেশটায় রাইটার্স বিল্ডিং গেলাম–মাত্র দুই-একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী (Home Secretary, Chief Secretary) আসিয়াছিলেন। সর্বশেষে আসিলেন আর একজন (Stracey, I.C.S.)। তিনি সদর স্ট্রীটে থাকেন, চৌরঙ্গী ও কার্জন পার্ক দিয়া হাঁটিয়া আসিয়াছিলেন। বলিলেন, ঠেলাগাড়ীতে আহতদের নিয়া যাওয়া হইতেছে এবং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডের কয়েকটি দোকান হইতে ধুয়া উঠিতেছে। হোম সেক্রেটারী মার্টিন লালবাজার পুলিশ ষ্টেশনে টেলিফোন করিলেন। জবাব আসিল, তাহারা ইহার কিছুই জানে না। ষ্ট্রাসী বলিলেন যে লালবাজার কন্ট্রোল রুমের (Control Room) যে ব্যবস্থা তাহাতে এইরকম গোলমালের দিনে ইহা বিশেষ কোন কাজে লাগিবে না এবং পুলিশ প্রকৃত ঘটনাসম্বন্ধে মোটেই ওয়াকিবহাল থাকিবে না। আমি ও স্ক্রাসী হাঁটিয়া বাড়ীর দিকে চলিলাম। রেড রোডে পৌঁছিয়া দেখিলাম প্রকাণ্ড একদল লোক শোভাযাত্রা করিয়া আসিতেছে–তাহাদের হাতে লাঠি, লোহার ডাণ্ডা ও বর্শা (spearheads)। রাস্তায় বা দুই রাস্তার মোড়ে কোন পুলিশ নাই–যতদূর দৃষ্টি যায় কোন পুলিশ প্যাট্রল দেখিলাম না।
“বাড়ী ফিরিয়া শুনিলাম, ভবানীপুর অঞ্চলে মারামারি হইয়াছে। আমি তাড়াতাড়ি মধ্যাহ্নভোজন সারিয়া লালবাজার যাইবার উদ্যোগ করিতেছি এমন সময় আমার চৌরঙ্গীর বাসভবনের উপরতলা হইতে দেখিলাম যে চেল্লার দিক হইতে একটি প্রকাণ্ড শোভাযাত্রা “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” এই ধ্বনি করিতে করিতে আসিতেছে। শোভাযাত্রার শেষভাগে আসিতেছিলেন বাংলার একজন মন্ত্রী আবদুর রহমান। চাহিয়া দেখি, একজন তাহার মাথা লক্ষ্য করিয়া একখানি থান ট তুলিয়াছে। আমি চীৎকার করিয়া উঠিলাম–সম্ভবতঃ ইহার ফলেই তাঁহার প্রাণ রক্ষা হইল। দুই-এক মিনিটের মধ্যেই দেখিলাম শোভাযাত্রার পশ্চাদ্ভাগ আক্রান্ত ও শোভাযাত্রীরা ছুটাছুটি করিয়া পলাইতেছে। শীঘ্রই আহত ব্যক্তিদের দ্বারা শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল ভরিয়া উঠিল। আমি স্থির করিলাম এইরূপ বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে হাঁটিয়া অফিসে যাইব না।
“বিকাল বেলা সাড়ে চারিটার সময় লালবাজার হইতে আমাকে নিবার জন্য মোটরসাইকেল আসিল। যাইতে যাইতে দেখিলাম যে, সমস্ত রাস্তায় ইট ছড়ান আছে এবং বউবাজার অঞ্চলের দোকানগুলি হইতে ধুয়া উঠিতেছে। লালবাজারের ঠিক পশ্চাতে টেরেটিবাজারে তখন তুমুল মারামারি চলিতেছে-তাহার চিৎকার
স্পষ্ট শুনিতে পাইতেছি। আমি সঙ্গী বা দেহরক্ষী (escort)-কে জিজ্ঞাসা করিলাম, পুলিশ কী করিতেছে? সে বলিল যে, কোন্ অবস্থায় কাহাকে কী করিতে হইবে কন্ট্রোলকক্ষ হইতে তাহার সুস্পষ্ট নির্দেশ ছাড়া কেহ কিছু করিবে না। অন্যান্য সার্জেন্টের ন্যায় সেও এই নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। তখন সে মন খুলিয়া আমাকে সব বলিতে লাগিল : গত ২১ নভেম্বর ইনসপেক্টর হ্যামণ্ড রামেশ্বর ব্যানার্জীকে গুলি করিয়া মারার অপরাধে সাসপেণ্ড হইয়া আছে এবং এ বিষয়ে তদন্ত এখনও চলিতেছে। আত্মরক্ষার্থে অথবা কর্তব্যবোধে কাহাকেও মারিলে এইরূপ হইবে ইহা। জানিয়া আমরা হ্যামণ্ডের মত অবস্থায় পড়িতে চাহি না। যদি কোন মুসলমানকে, বিশেষতঃ আজিকার এই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিনে মারি, লীগ সরকার আমাদের সর্বনাশ করিবে-আর যদি কোন হিন্দুকে মারি তাহা হইলে বিধানসভায় সরকারবিরোধী কংগ্রেস দল আমাদের বিরুদ্ধে তোলপাড় করিবে (raise hell)। সুতরাং আমরা কোন্ পথ ধরিব ঠিক করা খুব শক্ত। সার্জেন্টের এই উক্তি শুনিয়া বুঝিলাম যে পুলিশ সম্পূর্ণরূপে নৈতিক বুদ্ধিভ্রষ্ট ও উদাসীন (thoroughly demoralised and callous), 478 G9357013 Cara 0764194 (inefficient) coa নিষ্ক্রিয় (inactive)।” শ্রীমাথুরের এই সিদ্ধান্ত যে সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।
মাথুর লালবাজার পৌঁছাইয়া দেখিলেন যে, যে-বোর্ডে সব ঘটনাবলী লেখা থাকে (Incidents Board) তাহাতে কিছুই লেখা নাই। অর্থাৎ পুলিশ-স্টেশন অথবা ভ্রাম্যমাণ প্যাট্রলদের নিকট হইতে কোন টেলিফোন আসে নাই। তারপর মাথুর লিখিয়াছেন :
“বুঝিলাম, অবস্থা পুলিশের আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে (the ground was fast slipping under their feet)। আর একটি জিনিস বিশেষভাবে লক্ষ্য করিলাম, সেটি ইংরেজ শাসকবর্গ, বিশেষতঃ পুলিশ বিভাগের কর্মচারীদের মনোভাব। তাহারা প্রকাশ্যে বলিয়া বেড়াইতেছে যে, এটা হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া ও মারামারি-যখন তাহারা চাহে না যে, ব্রিটিশ শান্তিরক্ষার জন্য এদেশ শাসন করুকতখন তাহারা নিজেরাই শান্তিরক্ষার ব্যবস্থা করুক। তবে তাহারা যদি নতজানু হইয়া অনুতপ্ত চিত্তে আমাদের কাছে আসে (come in sackcloth and ashes) তবেই আমরা এই মারামারির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিব। পুলিশ কমিশনার হার্ডউইক (Hardwick) এবং তাহার অধীনস্থ কর্মচারীরা (ইহাদের মধ্যে একজন হিন্দু, পরে ইনসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ হইয়াছিলেন) কলিকাতাবাসীর (বিশেষতঃ হিন্দুদের) দুরবস্থা দেখিয়া বেশ আনন্দ উপভোগ করিতেছিলেন (chuckling over the plight of the people)। কয়েকটি টেলিফোনের কথাবার্তা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম (shocked)। টেলিফোন আসিল, গুণ্ডারা অত্যাচার করিতেছে, শীঘ্র সাহেব অর্থাৎ ফিরিঙ্গি সার্জেন্ট পাঠান। জবাব হইল, ক্যা বোলেগা মিষ্টার-আপ যো বোলতা হ্যায়, উস রকমকা সার্জেন্ট তো আপকাহি হুকমকা সাথ ইণ্ডিয়া কুইট কর গয়া। অন্য একসময়ে একজন পুলিশ কমিশনার হার্ডউইককে অনুরোধ করিলেন যে, আপনি নিজে এই ব্যাপারটির দিকে দৃষ্টি দিন। উত্তর হইল, হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই আমাদের এদেশ ছাড়িয়া যাইতে বলিতেছে, সুতরাং আমি কেন এর মধ্যে হস্তক্ষেপ করিব? আপনি কংগ্রেস অফিসে খবর দিন। স্বয়ং পুলিশ কমিশনারের মুখে এই কথা!
“আমি যখন লালবাজার পুলিশ অফিসে গেলাম, তখন প্রধানমন্ত্রী কন্ট্রোলরুমে বসিয়া আছেন–আমাকে দেখিয়া বলিলেন শহরে কী হইয়াছে বা হইতেছে কেহই কিছু জানে না, আপনি যথেষ্ট দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়া একবার যে-সকল অঞ্চলে গোলমাল হইয়াছে সেখানকার অবস্থা আমাকে জানান। আমি তখন মধ্য কলিকাতা এবং উত্তর ও দক্ষিণ কলিকাতার কিয়দংশ এবং দুইটি হাসপাতাল পরিদর্শন করিলাম, সমস্ত রাস্তায় মৃতদেহ পুঞ্জীভূত হইয়া আছে। প্রথমে আমি ও গাড়ীর চালক মৃতদেহগুলিকে সরাইয়া কোনমতে পথ করিয়া অগ্রসর হইলাম কিন্তু ক্রমে মৃতদেহের সংখ্যা এত বেশী হইল যে, আমাদের পক্ষে সরান সম্ভব হইল না। এবং মৃতদেহের উপর দিয়াই গাড়ী চালাইয়া গেলাম। আমি রাস্তায় মৃতদেহের সংখ্যা যথাসাধ্য গুনিলাম এবং হাসপাতালে গিয়া হতাহতের সংখ্যা টুকিয়া নিলাম। আমি যখন লালবাজারে ফিরিলাম তখন সঙ্গে সঙ্গে একজন খুব পুরাতন পুলিশ কর্মচারী আসিয়া মিলিটারী কায়দায় পুলিশ কমিশনার হার্ডউইককে অভিবাদন করিয়া বলিল, সব ঠিক হয়ে গেছে স্যার-লোকেরা মিথ্যাকথা বলছে। আমি নিশ্চিত জানি (I am positive) যে, কুড়িজনের বেশী মৃত এবং দুইশতের বেশী আহত হয়নি। আমি প্রতিবাদ করিলাম এবং একতাড়া কাগজ প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিলাম। ইহাতে প্রতি রাস্তায় মৃতদেহের ও দুইটি হাসপাতালের হতাহতের সংখ্যা আলাদা আলাদা লেখা ছিল। সুরাওয়ার্দি কাগজগুলি নিয়া হিসাব করিয়া বলিলেন, দুইশত হত এবং দুই হাজার বা তাহার বেশী আহত। আমার কাগজগুলি সুরাওয়ার্দি রাখিয়া দিলেন।
“কিছুক্ষণ পরে গভর্নর বারোস্ (Burrows) সাহেব কোন কোন স্থান ঘুরিয়া লালবাজারে আসিলেন। তিনি পুলিশের রিপোর্ট ও আমার রিপোর্ট দেখিলেন। সুরাওয়ার্দি আমার রিপোর্টের উপর জোর দিয়া বলিলেন যে, অবিলম্বে সৈন্যদল ডাকা হউক। কিন্তু চীফ সেক্রেটারী, হোম সেক্রেটারী ও পুলিশ কমিশনার তিনজনেই আপত্তি করিলেন–বলিলেন, পুলিশই ইহার ব্যবস্থা করিতে সক্ষম হইবে। সুরাওয়ার্দির সঙ্গে তাঁহাদের কিছু বাগবিতণ্ডা হইল। গভর্নর এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিলেন, পরে বলিলেন, ‘আরও কিছু সময় ধৈর্য ধরিয়া থাকা যাউক। এইরকম দুই-এক কথা বলিয়া চলিয়া গেলেন।”
এই কাহিনী বর্ণনা করিয়া শ্রীমাথুর শহর ঘুরিয়া যাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন তাহা এইভাবে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন : “লোকে পুলিশে খবর দেয় না, কারণ থানায় পুলিশ বা আর কেহ নাই যাহার কাছে রিপোর্ট করিবে যে কোনরূপ সাহায্য করিবে। হাসপাতালে যায় না, কারণ সেখানে ডাক্তার ও নার্স এত সংখ্যক নাই যে নূতন রোগীর অবস্থা করিতে পারে। খোলা কম্পাউণ্ডে বসিবার পর্যাপ্ত স্থান নাই, তাহাদের একমাত্র রাস্তায় পড়িয়া মরা ছাড়া আর কোন গতি নাই।”
শ্রীমাথুর লিখিয়াছেন, “লালবাজারে অনবরত টেলিফোন আসিতেছে, আর সুরাওয়ার্দি সাহেব ছোট ছোট কাগজের টুকরায় লিখিতেছেন। মাঝে মাঝে বলিতেছেন, রাজাবাজারের অবস্থা আরো খারাপ হইতেছে। হ্যারিসন রোডের বাঙ্গুর-ভবন চড়াও করিয়াছে। কলেজ স্ট্রীট ও ওয়েলেসলি স্ট্রীটে লুটপাট হইতেছে –অবিলম্বে সাহায্য পাঠান, ইত্যাদি। শহীদ সাহেবের উদ্ভ্রান্ত অবস্থা; পুলিশ অকর্মণ্য; সংখ্যায়ও যথেষ্ট নহে–গভর্নর উদাসীন। সন্ধ্যার পর অবস্থা আরও খারাপ হইল–লুটপাট, গৃহদাহ, হিন্দু-মুসলমানের সংঘর্ষ–এইসব সংবাদ নানাদিক হইতে আসিতে লাগিল। শহীদ সাহেব আর-একবার গভর্নরকে দিয়া সৈন্য আনাইবার চেষ্টা করিলেন। আমরা গভর্নমেন্ট হাউসে যাইয়া একঘণ্টা অপেক্ষা করার পর খবর আসিল যে, গভর্নরের রক্তের চাপ (blood-pressure) বাড়িয়াছে, দেখা করিতে পারিবেন না।
“শোনা গেল কারফু’ (ঘরের বাহির হইবার নিষেধাজ্ঞা) জারি করা হইয়াছে। আমার কাছে কিন্তু কোন খবর আসিল না। সুতরাং আমি রেডিও বা সংবাদপত্রের মাধ্যমে ইহার প্রচার করিতে পারিলাম না। খবরের কাগজের রিপোর্টারগণ লালবাজারে টেলিফোন করিয়া জানিল যে, কলিকাতার সর্বত্র এই আদেশ জারি করা হইয়াছে। কলিকাতা-পুলিশের শাসনব্যবস্থা ইহার পূর্বে বা পরে কখনও এত খারাপ হয় নাই। ইহা কি ইচ্ছাকৃত না আকস্মিক ঘটনা?”
২৫শে অগষ্ট বড়লাট ওয়াভেলের কলিকাতায় আসার কথা পূর্বেই লিখিয়াছি। এই সম্বন্ধে শ্রীমাথুর লিখিয়াছেন : “বাংলার লাট ও বড় বড় সাহেব কর্মচারীসহ বড়লাট কলিকাতার কয়েকটি রাস্তায় ঘুরিলেন। বড়লাট ওয়াভেল বাংলার লাটকে। অভিনন্দন জানাইয়া বলিলেন, আমরা শুনিয়াছিলাম যে, কলিকাতার রাস্তা মৃতদেহে ভরতি (littered with corpses)। কিন্তু, আমরা তো একটিও দেখিলাম না। বড়লাটের সেক্রেটারী জর্জ এবেল (Gorge Abell) আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিলেন। তিনিও বলিয়া উঠিলেন, এটা তো ভারী আশ্চর্য, নয় কি? আমি চুপ করিয়া থাকিতে পারিলাম না। এবেলকে বলিলাম, বড়লাট আটদিন পরে আসিয়াছেন মৃতদেহ সাজাইয়া রাখিবার নোটিশ পাই নাই। কিন্তু তিনি আসার তিনদিন পূর্ব পর্যন্ত আইওডিন-মাখা মুখোস পরিয়া দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া পাঁচহাজার আটশত উনসত্তরটি মৃতদেহ আমরা কলিকাতার রাস্তা হইতে সরাইতে সমর্থ হইয়াছি। যদিও আমি এই কথাগুলি খুব আস্তে আস্তে বলিয়াছিলাম, লাটসাহেব বারোস ইহা শুনিতে পাইয়া খুব অসন্তষ্ট হন এবং তিনি ও হোম সেক্রেটারী দুইজনেই আমাকে তাহা জানান। আমি প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আমি এখন কি করিব? তিনি উপদেশ দিলেন, লিখিয়া দাও যে, আমি যাহা বলিয়াছি তাহা ঠিক আমার মনের ভাব নহে (I did not mean what I had said)”। শ্রীমাথুর কী লিখিয়াছিলেন জানি না।
সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পর একটি শান্তিস্থাপন সমিতি গঠিত হইয়াছিল। ইহার তরফ হইতে বগুড়ার মহম্মদ আলি ৮ই মে যে বেতার-ভাষণ দিয়াছিলেন এবং যাহার খসড়া শ্রীমাথুর কর্তৃক সংশোধিত হইয়াছিল, তাহাতে বলা হইয়াছিল, “এই সংঘর্ষের ফলে বহু সহস্র হত ও আরও অনেক বেশী সহস্র আহত হইয়াছে এবং এক লক্ষ লোক গৃহহীন হইয়াছে।”
১৯৫০ সনে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সময় সৈন্যদল ডাকা হইয়াছিল। ১৯৪৬ সনের কলিকাতায় হিন্দুনিধনযজ্ঞের সময় যে নর্টন জোনস্ লালবাজারে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ছিলেন, তাঁহাকে এই সৈন্যদলের অধ্যক্ষ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, পুলিশ কি ইহা থামাইতে পারিত না? (অবসরপ্রাপ্ত) জোনস্ বলিলেন, ইচ্ছা করিলে নিশ্চয়ই পারিত। পুনরায় প্রশ্ন হইল, তাহা হইলে ১৯৪৬ সনে থামায় নাই কেন? জোনস্ কোন উত্তর দিলেন না। ইহার উপর টীকা অনাবশ্যক।
৯. নোয়াখালির হিন্দুমেধ যজ্ঞ
কলিকাতায় হিন্দুনিধন-পর্ব শেষ হওয়ার দুইমাস পরে ইহার পুনরাবৃত্তি হইল– কেবল নোয়াখালি শহরে নহে, ২৫০ বর্গমাইল বিস্তৃত প্রায় সমগ্র নোয়াখালি জিলায়। এই জিলার লোকসংখ্যার শতকরা ১৮ জন হিন্দু ও ৮২ জন মুসলমান। ১০ই অক্টোবর (১৯৪৬) লক্ষ্মীপূজার দিন স্থানীয় একজন মুসলমান বিধানসভার সদস্য আব্দুস সারওয়ারের নেতৃত্বে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে হত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ, শত শত হিন্দুনারী অপহরণ, ধর্ষণ ও অকথ্য লাঞ্ছনা ও নির্যাতনসহ মুসলমানের গৃহে আটক রাখা, হিন্দু নারী ও পুরুষের মুসলমান-ধৰ্মগ্রহণে বাধ্যকরণ প্রভৃতি এবং কোন কোন স্থানে ধনী সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ তাহার গৃহ আক্রমণকারী মুসলমানদের বাধা দেওয়ায় ঐ হিন্দুর সমস্ত পরিবারকে হত্যা করার ঘটনা মধ্যযুগের ব্যাপক বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনীকেও হার মানাইয়াছে। প্রায় এক সপ্তাহকাল সুরওয়ার্দির মন্ত্রীসভা অথবা বাংলা সরকারের নির্দেশে এই নির্মম অত্যাচারের কাহিনী একেবারে গোপন করিয়া রাখা হইয়াছিল। ১৭ই অক্টোবর সর্বপ্রথম ইহা প্রকাশিত হইতে লাগিল। সংবাদপত্রের বিবরণ অনুসারে পাঁচ হাজার লোক হত ও ইহার বহুগুণ আহত, এবং প্রায় দেড়লক্ষ লোকের গৃহ বিধ্বস্ত হয়। ইহারা বন্যপশুর ন্যায় জীবনযাপন করিতে বাধ্য হয়। জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট, বিভাগীয় কমিশনার এবং পূর্বাঞ্চলের সৈন্যাধ্যক্ষ (জেনারেল বুচার) প্রভৃতি বলেন, সংবাদপত্রের বর্ণনা অতিরঞ্জিত-বাস্তবিকপক্ষে ইহা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ নহে এবং দলবদ্ধ মুসলমানদের হিন্দুর উপর আক্রমণও নহে। অনেক পরে তাঁহারা স্বীকার করেন যে, একদল গুণ্ডা হিন্দুদের এবং কোন কোন স্থানে মুসলমানদের আক্রমণ করে এবং সৈন্যাধ্যক্ষ স্বীকার করেন যে হিন্দুদের ভয় পাইবার যথেষ্ট কারণ ছিল। প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দি ব্যোমযানে নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জিলার উপর দিয়া ঊর্ধ্ব হইতে ধ্বংসদৃশ্য পর্যবেক্ষণ করিয়া মন্তব্য করেন যে, সংবাদপত্রের বিবরণ wront arosfeco (grossly exaggerated-grossly was perhaps too mild a word)। এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক গোলাম সারওয়ারের নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইল; কিন্তু সে ও তাহার দল স্বচ্ছন্দে সমগ্র জিলায় ঘুরিয়া বেড়াইত, অথচ পুলিশ তাহাদের ধরিতে পারিল না। সুতরাং হিন্দুদের ধারণা হইল যে, গভর্নমেন্টের ইচ্ছা নহে যে সে ধরা পড়ে।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী যাইয়া উপদ্রুত অঞ্চলে গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছিলেন। নির্মলকুমার বসু তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। তিনি রীতিমত ডাযেরী (দৈনন্দিন ঘটনার বিবরণ) লিখিতেন। তাঁহার গ্রন্থ হইতে একটি বিবরণ উদ্ধৃত করিতেছি।
১৯৪৭ সনের ১০ই জানুয়ারি জগৎপুর নামক স্থানে স্ত্রীলোকদের এক সভায় ভাষণ দেন। এই সভায় একজন মহিলা ছিলেন। তিনি বলিলেন, তাঁহার স্বামী এবং আরও কয়েকজনকে হত্যা করিয়া মুসলমানেরা তাহাদিগকে গোর দেয়। বহুদিন পরে ঐ মহিলাটি তাঁহার স্বামীর দেহ আবিষ্কার করেন এবং তাঁহার পায়ের একখানা হাড় সভায় দেখান। গান্ধীজি নির্মল বসুকে বলেন যে, যেসব হিন্দু স্ত্রীলোক মুসলমান-কর্তৃক অপহৃত হইয়াছিল তাহাদের উক্তি লিখিয়া রাখ। নির্মলবাবু লিখিয়াছেন, “একজন মহিলা গান্ধীজির নির্দেশে অকপটে অত্যাচারের। কাহিনী সমস্ত আমাকে খুলিয়া বলিল। আমার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্য মনে হইল যে, যখন দুবৃত্তেরা এই হিন্দুনারীকে নিজের বাড়ীতে টানিয়া নিয়া গেল তখন বাড়ীর গৃহস্থ মুসলিম স্ত্রীলোকেরাও এই হতভাগিনী নারীর দুর্দশা বেশ উপভোগ করিল। পরদিন ঐ মেয়েটির মার সহিত দেখা করিলাম এবং তাহার অনুমতি লইয়া মেয়েটির সঙ্গে তাহাদের বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ দেখতে গেলাম। সব পুড়িয়া গিয়াছে, কেবল ঘরের ভিৎ ও কতকগুলি পোড়া কাঠের টুকরা চারিদিকে পড়িয়া আছে। মেয়েটি একটি জায়গা দেখাইয়া বলিল, মুসলমানেরা দুই ভাইকে খুন করে এবং বাড়ীতে আগুন লাগাইয়া প্রজ্জ্বলিত আগুনের মধ্যে তাহাদের দেহ নিক্ষেপ করে। পুড়িয়া কয়লাতে পরিণত কয়েকটি হাড়ের টুকরা কুড়াইয়া লইলাম। বাড়ীতে টিনের ঘর ছিল–টিনগুলি ও জিনিসপত্র পাড়াপড়শী মুসলমানেরা নিয়া গিয়াছে, শূন্য ভিটা পড়িয়া আছে।”
সংবাদপত্রের বিবরণে কিছু অতিরঞ্জিত থাকিতে পারে, কিন্তু * নির্মলকুমার বসু নিজে দেখিয়া ও শুনিয়া যাহা লিখিয়াছেন তাহার সত্যতা সম্বন্ধে বর্তমান লেখকের কোনপ্রকার দ্বিধা নাই।
কতকগুলি ঘটনা হইতে মনে হয় যে, সুরাওয়ার্দি বা বাংলা সরকারের পূর্বোদ্ধত মত অনেকটা অজ্ঞতা-প্রসূত, অর্থাৎ স্থানীয় কর্মচারীরা প্রকৃত ঘটনা উপরওয়ালাদের নিকট হইতে গোপন করিয়াছে।
সম্ভবত এইজন্য বাংলা গভর্নমেন্ট দুইজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে ত্রিপুরা ও নোয়াখালিতে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধান করিয়া দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্রকৃত ঘটনা সম্বন্ধে রিপোর্ট লিখিতে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ইহা অবশ্য খুব গোপন রাখা হইয়াছিল। বাহিরে খুব গুজব রটিয়াছিল যে, এডওয়ার্ড স্কিনার সিম্পসন (Edward Skinner Simpson) নামে একজন পুরানো জজসাহেব যে রিপোর্ট দিয়াছিলেন তাহা গভর্নমেন্ট ও মুসলিম লীগের গুরুতর অখ্যাতি বা কুখ্যাতির পরিচায়ক এবং ইহাতে হত্যা, লুণ্ঠন ও নারীনির্যাতন প্রভৃতির বিবরণী মোটামুটি সংবাদপত্রের কাহিনীরই সমর্থন করে। কিন্তু গভর্নমেন্ট এই রিপোর্টটি একেবারে চাপিয়া যান। শ্রীমাথুরের নিকট এই রিপোর্টের এক কপি ছিল, কিন্তু গভর্নমেন্ট খুব সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছিলেন যাহাতে এই রিপোর্টের কোন অংশ বাহিরে প্রচারিত বা প্রকাশিত না হয়। শ্রীমাথুর বহুকষ্টে ইহার সারাংশ গোপনে স্টেটম্যান পত্রিকার গোচরে আনিয়াছিলেন। এই পত্রিকার সম্পাদক সেই সারাংশেরও অনেক কাটছাঁট করিয়া যাহা ছাপাইয়াছিলেন তাহাই আজ আমাদের নিকট নোয়াখালির বীভৎস হিন্দুনিধন-পর্বের একমাত্র দলিল। ইহার ভাবার্থ নিম্নে দিতেছি :
“নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলার যেখানে যেখানে মুসলমানেরা আক্রমণ চালাইয়াছিল, তাহার প্রায় সর্বত্রই বাড়ীঘর, জিনিসপত্র ও দোকানপাটের এমন নিমূলভাবে ধ্বংসক্রিয়া সম্পন্ন হইয়াছে যে, বিরাট ধ্বংসাবশেষের পুঞ্জীভূত স্তূপ ছাড়া আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে, লুটপাট ও গৃহদাহ খুবই ব্যাপকভাবে হইয়াছে এবং যে গৃহগুলি ভস্মসাৎ হয় নাই তাহার সমস্ত দ্রব্যাদি লুণ্ঠিত হইয়াছে। অধিকাংশ হিন্দুপাড়াতেই বড় বাড়ীঘর কিছুই অবশিষ্ট নাই। ত্রিপুরা জিলার চাঁদপুর থানার অন্তর্গত বাইচুরের দৃশ্য অবর্ণনীয় (beggars description)। উন্মত্ত হিংস্র জনগণের ধ্বংসাত্মক কার্যের সম্বন্ধে প্রকৃত ধারণা করিতে হইলে এই স্থানটি দেখা দরকার।
“এই রিপোর্টে ধর্ষিতা হিন্দুনারীর সংখ্যানির্ণয়ের চেষ্টা করা হইয়াছে। কিন্তু অনেকে এই সম্বন্ধে কিছু বলিতে অনিচ্ছুক হওয়ায় সঠিক সংখ্যা বলা যায় না। কিন্তু উক্ত কর্মচারীটির কাছে অনেকে সাধারণভাবে রিপোর্ট করিয়াছেন এবং কোন কোন বাড়ীতে বা স্কুলঘরে হিন্দু স্ত্রীলোকদিগকে ৩৪ দিন আটক করিয়া রাখা হইয়াছিল।
“জোর করিয়া ব্যাপকভাবে দলে দলে হিন্দুদের ইসলামধর্মে ধর্মান্তরিত (mass conversion) করার বিবরণ প্রত্যেক গ্রামেই পাওয়া গিয়াছে। অনেক স্থলে পুরুষেরা আপত্তি করিলে তাহাদের স্ত্রীলোকদিগকে আটক করিয়া রাখিয়া তাহাদিগকে ইসলামধর্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য করা হইয়াছে। অনেককে প্রাণবধের ভয় দেখাইয়া ধর্ম পরিবর্তন করিতে বাধ্য করা হইয়াছে।”
তদন্তকারী (জজ সিম্পসন) নানাভাবে জানিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন যে আক্রমণকারী মুসলমানেরা স্থানীয় লোক অথবা বাহির হইতে আনা গুণ্ডার দল কি না। কিন্তু সকলে দৃঢ়তার সহিত পরিষ্কার বলিয়াছে যে, দুবৃত্তেরা ঐ গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোক।
তদন্তকারী কর্মচারীটি লিখিয়াছেন যে, সব ঘটনার প্রকৃত বিবরণ সংগ্রহ করিতে হইলে অন্ততঃ পঞ্চাশজন পুরানো (senior) সরকারী কর্মচারীকে ছয়মাসের জন্য নিযুক্ত করিতে হইবে।
১৩ই নভেম্বর (১৯৪৬) স্টেটসম্যান পত্রিকায় সিম্পসন-রিপোর্টের এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছাপা হয়। সেইদিন গান্ধীজি রামগঞ্জ গ্রামে গিয়াছিলেন। দেখিলেন, মরার মাথার খুলি ও হাড়গোড় চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়া আছে, ৩২টি বাড়ীর অর্ধদগ্ধ চালাঘর ও খুঁটি এবং গৃহের জিনিসপত্রের ধ্বংসাবশেষ তখনও (অর্থাৎ এক মাস পরে) চারিদিকে পড়িয়া আছে। গ্রামের স্ত্রীলোকেরা গান্ধীজিকে বলিল, মুসলমানেরা কিভাবে তাহাদের সিঁথির সিন্দুর মুছিয়া ও হাতের শাখা ভাঙ্গিয়া জোর করিয়া ইসলামধর্মে দীক্ষিত করিয়াছে। আচার্য কৃপালনীও আর একটি গ্রামে ঠিক ঐরূপ দেখিলেন এবং শুনিলেন। স্টেটসম্যানের রিপোর্ট যে নিদারুণ বাস্তব সত্য তাহার প্রমাণ হাতে-নাতে মিলিল।
এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে, গান্ধীজি কলিকাতায় থাকিতে প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দির নিকট এই রিপোর্টের এক কপি চাহিয়াছিলেন এবং সুরাওয়ার্দিও রাজী হইয়াছিলেন। কিন্তু, গভর্নর ও সেক্রেটারীগণ একবাক্যে দৃঢ়ভাবে আপত্তি করিলে তিনি দিতে ভরসা পান নাই।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, এই সময় আচার্য কৃপালনী কংগ্রেসের সভাপতি-বঙ্গদেশের লাটসাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি লিখিয়াছেন, “লাটসাহেব নোয়াখালির ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন উদ্বেগশূন্য… সুরাওয়ার্দি উপস্থিত ছিলেন। লাটসাহেব বলিলেন, প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন যে, এখন নোয়াখালিতে কোন গোলমাল নাই। মুসলমানকর্তৃক হিন্দুনারী অপহরণ ও ধর্ষণ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করায় বলিলেন, “ইহা তো হবেই, কারণ হিন্দুনারীরা মুসলমান নারী অপেক্ষা সুন্দরী। আমার ইচ্ছা হইল তাহার গালে চড় মারি।”
কলিকাতার ১৬ই অগষ্ট তারিখের প্রত্যক্ষ সগ্রামের বিবরণ সংবাদপত্রে প্রচারিত হওয়ায় গভর্নমেন্টের যে কুখ্যাতি ও দুর্নাম হইয়াছিল তাহার প্রতীকার করিতে গভর্নমেন্ট যথোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। ভারতরক্ষা আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হইবার পূর্বদিনে (২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬) ঐ আইনের বলে বাংলা সরকার সংবাদপত্রে বাংলার দাঙ্গার সঠিক বিবরণ প্রকাশ নিষিদ্ধ করিয়া এক হুকুমনামা (ordinance) জারী করেন। সংবাদপত্রের সম্পাদকগণ এবং জনসাধারণের প্রবল আপত্তিসত্ত্বেও যে হুকুমনামা বাহির হইল তাহার মর্ম মোটামুটি এইরূপ :
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সম্পর্কে যে-কোনও বিবৃতি, বিজ্ঞাপন, নোটিশ, সংবাদ, মন্তব্য প্রভৃতি প্রকাশিত হইবে তাহাতে
(১) যে স্থানের ঘটনা তাহার নাম থাকিবে না। (২) কোন লোক নিহত বা আহত হইলে কিভাবে নিহত বা আহত হইল তাহার উল্লেখ থাকিবে না। (৩) আততায়ী বা আক্রান্ত কোন্ সম্প্রদায়ের লোক তাহারও উল্লেখ থাকিবে না। (৪) কোনও উপাসনালয় বা ধর্মস্থান অপবিত্র করা হইলে তাহার কোন উল্লেখ থাকিবে না।
এই হুকুমনামা জারীর ফল হইল এই যে, নোয়াখালির হত্যাকাণ্ডের সংবাদ প্রায় সপ্তাহকাল পর্যন্ত কিছুই জানা যায় নাই। কলিকাতার ১৬ই অগষ্টের হত্যাকাণ্ডের বিস্তৃত বিবরণের কিয়দংশ ‘প্রবাসী’ পত্রিকা হইতে পূর্বে উদ্ধৃত করিয়াছি, কিন্তু নোয়াখালি-হত্যাকাণ্ড আশ্বিন মাসের শেষে ঘটিলেও কার্তিক মাসের প্রবাসী’তে তাহার উল্লেখমাত্র নাই। অগ্রহায়ণের প্রবাসী’তেও নোয়াখালির হত্যাকাণ্ডের কোন বিবরণ নাই–কেবল বাংলাদেশ বিভক্ত হওয়া উচিত কি না, এই প্রসঙ্গে নায়াখালির অত্যাচারের উল্লেখমাত্র আছে। পরে ইহার উল্লেখ করিব। ‘ভারতবর্ষ’ মাসিক পত্রিকায় সাধারণভাবে যে বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে (১৩৫৩, অগ্রহায়ণ, পৃ. ৫৭১-৭২) তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“গত ১০ই অক্টোবর হইতে সমগ্র নোয়াখালি জেলায় ও ত্রিপুরা জেলার স্থানে স্থানে যে বর্বরতা ও অত্যাচার আরম্ভ হইয়াছে তাহার তুলনা ইতিহাসে কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। হাজার হাজার লোককে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়, যাহারা তাহাতে বাধা দেয় তাহাদের গৃহে আগুন লাগাইয়া দিয়া সবংশে নিধন করা হইয়াছে। নোয়াখালির খ্যাতনামা উকীল রায়সাহেব রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী মহাশয় বাধা দিতে যাইয়া শুধু নিজের জীবন দেন নাই তাহার পরিবারের প্রায় ২৫ জন লোক নিহত হয়। এইরূপ বহু রাজেন্দ্রলালের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। দুবৃত্তরা হিন্দু মহিলাদিগকে বলপূর্বক বিবাহ করিয়া লইয়া গিয়া নিজ নিজ গৃহে আটক করিয়াছে। এখনও এইরূপ বহু নারী বোরখার মধ্যে আবৃত থাকিয়া পশুজীবন। যাপন করিতেছেন। একমাস অতীত হওয়ার পরও তাঁহাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা হয়। নাই। সেখানে সেনাবাহিনীকে পাঠান হইয়াছে বটে, কিন্তু সে সেনাবাহিনী স্থানীয় পুলিশের নির্দেশমত কাজ করিতেছে। পুলিশ সক্রিয় থাকিলে তথায় ঐ সকল অত্যাচার-অনুষ্ঠান কখনই সম্ভব হইত না। উপযুক্ত পাহারার অভাবে স্বেচ্ছাসেবকগণ উপদ্রুত অঞ্চলে প্রবেশ করিতে পারে না।…
যতদিন বাঙ্গালায় লীগগঠিত মন্ত্রীসভা থাকিবে ততদিন এখানে কিছু করা সম্ভব হইবে না।… ভারতের অন্যান্য প্রদেশের নেতারা ও বিলাত বা মার্কিনের জননায়কগণ পর্যন্ত বড়লাট এবং বাঙ্গালার গভর্নরের কার্যের নিন্দা করিয়াছেন।”
বাংলা সরকারের নিষেধাজ্ঞাসত্ত্বেও ভারতবর্ষ-সম্পাদক উপরোক্ত মন্তব্য লিপিবদ্ধ করিয়া যে সৎসাহসের ও নির্ভীক সত্যবাদিতার পরিচয় দিয়াছেন তাহা সর্বথা প্রশংসনীয়। বাংলা গভর্নমেন্ট নূতন হুকুমনামার বলে তাহার কোন শাস্তি বিধান করিয়াছিলেন এরূপ আমরা শুনি নাই। সুতরাং অনুমান করা অসঙ্গত নহে যে, সম্পাদকের বর্ণিত কাহিনীর ও মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার কোন যুক্তিসংগত কারণ তাঁহারা খুঁজিয়া পান নাই। অপহৃতা হিন্দুনারীর সম্বন্ধে উদ্ধৃত উক্তির সমর্থনে বলা যাইতে পারে যে, ডক্টর অমিয় চক্রবর্তী ও শ্রীযুক্তা মৈত্রেয়ী বসু নানাস্থানে ঘুরিয়া মহাত্মা গান্ধীকে জানান, “উপদ্ৰত অঞ্চলে বর্তমান সময়ে। সর্বপ্রধান কার্য–অসংখ্য অপহৃতা নারীকে উদ্ধার করা। অপহৃতা নারীদিগকে বর্তমানে বোরখা পরাইয়া রাখা হইয়াছে। ফলে কেহ তাহাদের চিনিতে পারে না। তাহারা ভীত অবস্থায় পশুজীবন যাপন করিতেছে।”
নোয়াখালিতে হিন্দুনিধনের করুণ কাহিনী শুনিয়া সাহায্যের জন্য কয়েকজন প্রসিদ্ধ হিন্দুনেতা নোয়াখালি গিয়াছিলেন। সর্বপ্রথম যান আচার্য কৃপালনী ও তাঁহার স্ত্রী। তারপর মহাত্মা গান্ধী, প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র বসু প্রভৃতি অনেকে।
মহাত্মা গান্ধী কলিকাতার নিকটবর্তী সোদপুর হইতে ৬ই নভেম্বর ১৯৪৬ যাত্রা করেন এবং পরদিন নোয়াখালি পৌঁছেন। ১৯৪৭ সনের ২রা মার্চ তিনি নোয়াখালি ত্যাগ করেন। প্রায় চারিমাস কাল তিনি উপদ্রুত অঞ্চলে পদব্রজে ভ্রমণ করেন, মুসলমানদের গ্রামে বাস করেন এবং বহু স্থানে সভা-সমিতি করিয়া সাম্প্রদায়িক শান্তি প্রতিষ্ঠা করিয়া যাহাতে হিন্দু ও মুসলমান পূর্বের ন্যায় বসবাস করিতে পারে তাহার জন্য উভয়পক্ষকেই আবেদন জানান।
মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালি-ভ্রমণ ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। তাহার অনুরক্ত ভক্ত ও সহচর * নির্মলকুমার বসু একখানি মুদ্রিত গ্রন্থের প্রায় ১৩০ পৃষ্ঠায় ইহার সম্পূর্ণ বিবরণ দিয়াছেন। সুতরাং ইহার বিস্তৃত বর্ণনার প্রয়োজন নাই। মহাত্মার আর একজন ভক্ত এ-বিষয়ে সংক্ষেপে যাহা লিখিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত করিতেছি : “প্রথমে নোয়াখালিতে কিছু কিছু উদ্ৰত অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং এক শিবিরে সহকর্মীদের সঙ্গে একত্রে থাকেন। কিছুদিন পরেই সহকর্মীদের বিভিন্ন কেন্দ্রে একাকী বা দুইজন করে থাকার নির্দেশ দেন। পুলিশের সাহায্য ভিন্নই একাকী যাতায়াত করতে বলেন, যেন হিন্দুদের মনে সাহসের সঞ্চার হয়। প্রতিদিন প্রার্থনাসভার ভিতর দিয়া ভগবানের উপর নির্ভরতার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আরো বলেন যে, জোর করে ধর্মান্তরিত করা ইসলামধর্ম অনুমোদন করে না। গ্রাম হতে গ্রামান্তরে পদব্রজে, এমনকি দীর্ঘদিন খালিপায়ে হেঁটে হিন্দু মুসলমান উভয়ের মধ্যে প্রেম মৈত্রী ও নির্ভীকতার বাণী প্রচার করেন। গ্রাম হতে গ্রামান্তরে যেতে তাকে অনেক সাঁকো পার হতে পায়। ছোট খালের উপর একখানা বাঁশ বা সুপারি গাছের অংশ হল সাঁকো… এ এক কঠোর তপস্যা।” পরের ও দেশের হিতার্থে মহাত্মাজীর এই দুশ্চর তপস্যা মহাত্মা’ উপাধির সার্থকতা সূচিত করে এবং তাহার লক্ষ্য ও কার্যপদ্ধতি যে সর্বৰ্থা প্রশংসনীয় তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু ঐতিহাসিকের বাস্তবদৃষ্টিতে ইহা অস্বীকার করা কঠিন যে, ইহার প্রত্যাশিত ফল অথবা কোন সুফলই হয় নাই এবং তাহার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। ইহা প্রাচীন প্রবাদ “বেণুবনে মুক্তা ছড়ানো”, অথবা রবীন্দ্রনাথের “এ কেবল ফুটা পাত্রে, জল ঢালা দিবারাত্রে”-এইসবের প্রকৃষ্ট নিদর্শন। গান্ধীজি আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখেও নির্ভীকতার আদর্শ আতঙ্কগ্রস্ত পলায়িত হিন্দুর সম্মুখে ধরিয়াছিলেন; তাহা মহাত্মার পক্ষে সম্ভব হইলেও জনসাধারণের মধ্যে দেখা যায় না-লাখে নয়, কোটিতেও এক মিলে কিনা সন্দেহ। জোর করিয়া ধর্মান্তরিত করা ইসলামধর্ম অনুমোদন করে কি করে না, সে তর্কের প্রয়োজন নাই; কিন্তু যে মুসলমানদের কাছে তিনি এই কথা বলিয়াছিলেন তাহাদের পূর্বপুরুষের শতকরা অন্ততঃ নব্বই জনকে যে জোর করিয়া মুসলমান করা হইয়াছিল–এবং প্রায় প্রত্যেক মুসলমানই যে ইহা অনুমোদন করিয়াছে, করিতেছে এবং করিবে, গান্ধীজির উপদেশ যে তাহাদের কাছে উপহাসের মতই মনে হইবে, এ সম্বন্ধে যাহারা প্রধানমন্ত্রী বা মহাত্মা নহেন–সাধারণ ব্যক্তি মাত্র, তাঁহাদের কোন সন্দেহ নাই। ঁ নির্মলকুমার বসু গান্ধীজির নোয়াখালি-ভ্রমণের সুদীর্ঘ কাহিনী শেষ করিয়া যাহা লিখিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত করিতেছি : “গান্ধীজি হিন্দুদিগকে উপদেশ দিয়াছিলেন অহিংসা ধর্মের অনুযায়ী তাহারা আক্রান্ত হইয়াও আক্রমণকারীকে আঘাত করিবে না–নিজের প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকিবে তথাপি প্রাণভয়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করিবে না বা গৃহ হইতে পলাইবে না, এবং স্ত্রীলোক হইলে প্রাণ দিবে কিন্তু মান-মর্যাদা (অর্থাৎ সতীত্ব) বর্জন করিবে না। মুসলমানদিগকে উপদেশ দিয়াছিলেন, তাহারা হিন্দুদিগকে ভাইয়ের মত ভালবাসিবে, ইত্যাদি।” এই সমুদয়ের উল্লেখ করিয়া কাহিনীর উপসংহারে লিখিয়াছেন, “হিন্দুর উপর ইহার যে প্রভাবই হইয়া থাকুক-মুসলমানদের প্রতি তাহার আবেদন আরও কম হইয়াছিল (his appeal to the common Muslims seemed to bear even less fruit).”
১২ই ফেব্রুয়ারি (১৯৪৭) কুমিল্লাতে এক জনসভায় উদারচেতা মুসলমান নেতা ফজলুল হক বলেন, “নোয়াখালিতে মহাত্মা গান্ধীর অবস্থান ইসলামের প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছে। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পরিবর্তে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি করেছেন…”।
নির্মলকুমার বসু কয়েকটি কথা বলিয়াছেন যাহাতে গান্ধীজির নোয়াখালি ভ্রমণপর্ব প্রায় শেষ হওয়ার সময়, অর্থাৎ প্রায় তিন-চারি মাস গান্ধীর উপদেশ বিতরণের পরেও মুসলমানদের উপর গান্ধীজি কিরূপ প্রভাব বিস্তার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন তাহার সম্বন্ধে আরও স্পষ্ট ধারণা করা যায়। নির্মলবাবু লিখিয়াছেন, “ইতিমধ্যে (অর্থাৎ ১৯৪৭ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে) গান্ধীর নোয়াখালিতে অবস্থানের বিরুদ্ধে মুসলমানদের আপত্তি আরও তীব্র হইয়া উঠিল।… ফেব্রুয়ারি মাসের শেষভাগে ইহা ইতরজননাচিত (vulgar) আকার ধারণ করিল। গান্ধী যে পথে যাইবেন সেই পথ ইচ্ছা করিয়া প্রত্যহ নোংরা করিয়া রাখিত (deliberately dirtied everyday) এবং ক্রমেই অধিকতর সংখ্যায় মুসলমানগণ তাঁহার সভায় আসা বন্ধ করিল।”
সাধারণ, অর্ধশিক্ষিত ও শিক্ষিত মুসলমান জনগণের উপর গান্ধীজির প্রচারের ফল কী হইয়াছিল উপরোক্ত উক্তি ও কাহিনী হইতেই ইহা বুঝা যাইবে। প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দি গান্ধীজির প্রতি খুব ভক্তিশ্রদ্ধা দেখাইয়াছিলেন–একবার ব্যোমযানে আকাশ হইতে দুর্গতদের অবস্থাও নাকি পর্যবেক্ষণ করিয়াছিলেন–যদিও সরেজমিনে হিন্দুদের অবস্থা দেখিবার জন্য নোয়াখালি যাওয়া আবশ্যক মনে করেন নাই। অবশ্য ইহার জন্য তাঁহাকে দোষ না দিয়া বাঙ্গালী হিন্দুদের অদৃষ্টকে ধিক্কার দেওয়াই উচিত। কারণ প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও কেন্দ্রীয় হিন্দু মন্ত্রী ও নেতাগণ বিহারে মুসলমানদের উপর অত্যাচারের কথা শুনিবামাত্র সেখানে ছুটিয়া গিয়াছিলেন, কিন্তু কলিকাতার ও নোয়াখালির হিন্দুনিধন-পর্বে বঙ্গদেশে আসা তো দূরের কথা, কিছুমাত্র বিচলিত হইয়াছিলেন এরূপ কোন প্রমাণ নাই। নেহেরু স্বয়ং ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, প্রয়োজনবোধ করিবামাত্র তিনি বিহারের হিন্দুদের উপর এরোপ্লেন হইতে বোমাবর্ষণ করিবেন। বাংলাদেশে নোয়াখালির ব্যাপক পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের এইরূপ প্রতীকারের কথা তাহার মনে উদয় হয় নাই। সুতরাং মুসলমান প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দিকে দোষ দিবার হিন্দুদের কোন অধিকার নাই। সমসাময়িক ঘটনা উপলক্ষ করিয়া একখানি মাসিক পত্রিকায় যথার্থই মন্তব্য করা হইয়াছিল : “বাঙ্গালী আজ পঞ্চাশ বত্সর স্বাধীনতার যুদ্ধ করিয়া ক্রমে ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া পড়িয়াছে। হৃত গৌরব, হৃত আসন, নত মস্তক লাজে যদি আজ সারা ভারতবর্ষে কেহ থাকে তবে সে বাঙ্গালী…।” এই সর্বস্বহারা, নেতৃত্বহীন, বুদ্ধি বিবেচনা ও রাষ্ট্রগঠন প্রতিভার দৈন্যে অভিশপ্ত… হিন্দু সম্প্রদায়ের অদৃষ্টকে ধিক্কার দেওয়া ছাড়া আর কিছু করিবার বা বলিবার অধিকার নাই। সুতরাং সুরাওয়ার্দিকে দোষ দিবার জন্য নহে, মহাত্মা গান্ধীর এই পরম অনুগত ভক্ত প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার মন্ত্রীপরিষদের উপর মহাত্মার চারিমাসব্যাপী নোয়াখালি পর্যটনের কী প্রভাব হইয়াছিল তাহা ঐ বৎসরের চৈত্রমাসের একখানি প্রসিদ্ধ মাসিক পত্রিকার নিম্নলিখিত মন্তব্য হইতে বোঝা যাইবে। বিহারে মুসলমানদের উপর হিন্দুর অত্যাচারের অব্যবহিত পরে সেখানকার হিন্দু মন্ত্রী যাহা যাহা করিয়াছেন তাহার উল্লেখ করিয়া পরে মন্তব্য করা হইয়াছে : “আর নোয়াখালিতে? লীগ গবর্নমেন্ট প্রথম হইতেই পক্ষপাতিত্বমূলক মনোভাব অবলম্বন করিয়াছেন। লীগের উচ্চতম নেতারা নোয়াখালি গিয়া যে দুবৃত্তেরা ছোরা দেখাইয়া প্রাণভয়ে মানুষকে ধর্মান্তর গ্রহণে বাধ্য করিয়াছে, নারীহরণ, নারীধর্ষণ, গৃহদাহ, লুণ্ঠন প্রভৃতি ঘৃণিত কাজ যাহারা করিয়াছে তাহাদিগকে নিবৃত্ত করিবার জন্য কোন চেষ্টা তো করেনই নাই বরং এমন কথা বলিয়াছেন এবং এমন আচরণ করিয়াছেন যাহার ফলে দুবৃত্তেরা প্রকারান্তরে উৎসাহই পাইয়াছে। তাহাদের মনে ধারণা জন্মিয়াছে যে, যে-কাজ তাহারা করিয়াছে তাহা অন্যায় নহে। … (উল্লিখিত) মানবসমাজের জঘন্যতম অপরাধের অভিযোগে যাহারা অভিযুক্ত হইয়াছে তাহাদের জামিন ও গ্রেপ্তারকালীন সময়ের জন্য পারিবারিক ভাতা প্রভৃতি লীগ পত্রিকাগুলি দাবি করিতেছে এবং এই নারকীয় কাণ্ডের নায়ক গোলাম সারোয়ারকে মৌলানা আখ্যা দিয়া তাহাকে উচ্চস্থান দানের জন্য লীগের সবকয়টি পত্রিকায় প্রতিযোগিতা শুরু হইয়া গিয়াছে। গ্রেপ্তার, জামীনদান প্রভৃতি সর্ববিষয়ে কোমলতা এত বেশী দেখান হইতেছে যে তাহার ফলে নোয়াখালি বা ত্রিপুরায় স্থায়ী শান্তি কিছুতেই প্রতিষ্ঠিত হইতে পারিতেছে না, পারেও না। … নোয়াখালির ঘটনার নায়কদের বিরুদ্ধে কঠোরতা অবলম্বন তো দূরের কথা, তাহাদের প্রতি কে বেশী দরদ দেখাইবেন তাহারই প্রতিযোগিতা তাহারা করিয়া চলিয়াছেন।”
এইসকল মন্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় গান্ধীজির অনুরক্ত এ.ভি. ঠক্করের চাঁদপুর হইতে ৯ই মার্চ (১৯৪৭) লিখিত একখানি চিঠিতে। তিনি লিখিয়াছেন, “নোয়াখালি ও ত্রিপুরায় এখনও অরাজকতা চলিতেছে। অক্টোবর হাঙ্গামার পর পাঁচমাস কাটিয়া যাওয়া সত্ত্বেও উপদ্রব হ্রাস পাইবার কোন লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। পক্ষান্তরে কোন কোন অস্থায়ী থানা বন্ধ করিযা দেওয়া হইতেছে। ইহার অর্থ, দুবৃত্তদের আরও অবাধে দুষ্কর্ম চালাইবার অনুমতি দান।” উপসংহারে তিনি লিখিয়াছেন যে, পুনর্বসতি কার্যের জন্য তিনি আর পূর্ববঙ্গে আসিবেন না। এই চিঠি লিখিয়াই তিনি বোম্বাই রওনা হইয়া যান।
বাংলার মুসলমান-নেতাগণের, বিশেষ করিয়া সুরাওয়ার্দির উপর গান্ধীজির নোয়াখালী-ভ্রমণের প্রভাব কিরূপ হইয়াছিল তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় ৯ই ফেব্রুআরির বঙ্গীয় মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভায় (গান্ধীজি তখনও নোয়াখালি ভ্রমণ করিতেছেন)। একখানি সমসাময়িক মাসিক পত্রিকার বিবরণ হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি : “এই সভায় অনেক সদস্য প্রধানমন্ত্রী মি. সুরাবর্দীকে চাপিয়া ধরেন এই বলিয়া যে, ত্রিপুরা ও নোয়াখালী জেলায় মুসলমানদের উপর পুলিশের অত্যাচার চলিতেছে এবং প্রধান মন্ত্রী তাহা কেন নিবারণ করিতে পারেন নাই। ইহারা দাবী করেন যে, জেলার সমস্ত হিন্দু পুলিশ কর্মচারীকে বদলী করা হউক।” মুসলমানদের প্রতি অবিচারের অভিযোগ করা হয়; তাহাতে সুরাওয়ার্দি বলেন যে, “নোয়াখালি ও ত্রিপুরায় যাহারা গ্রেপ্তার হইয়াছে তাহাদের সংখ্যা তিন হাজার নহে, আটশত মাত্র এবং কোন কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয় নাই-নোয়াখালির পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টকে বদলি করা হইয়াছে।”
এই আলোচনা সম্বন্ধে উক্ত পত্রিকায় মন্তব্য করা হইয়াছে, “নোয়াখালি ও ত্রিপুরায় যাহা ঘটিয়াছে তাহার তুলনায় ৮৫০ জন গুণ্ডা গ্রেপ্তার অতি সামান্য ব্যাপার। পুলিশ সুপারিন্টেন্টে ছিলেন মি. আবদুল্লা, তাঁহার পক্ষপাতিত্বের খ্যাতি সুবিদিত। ইনিই যদি ৮৫০ জনকে গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইয়া থাকেন তবে নিরপেক্ষ লোকের হাতে কত লোক গ্রেপ্তার হইত তাহা অনায়াসেই বুঝা যায়। তথাপি দলের লোকের চাপে বাধ্য হইয়া প্রধান মন্ত্রীকে ইহার বদলীর আদেশ দিয়া নোয়াখালিতে আর একজন মুসলমান সুপারিন্টেন্টে পাঠাইতে হইয়াছে।”
নোয়াখালির হত্যাকারে ব্যাপারে এই সময় বাংলায় হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে কিরূপ হিংস্র বিদ্বেষভাব বর্তমান ছিল এবং মহাত্মা গান্ধীর চেষ্টায়ও যে তাহার কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় নাই–স্বাধীনতাপ্রাপ্তির প্রাক্কালে তাহার প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ, এই বিদ্বেষভাবই যে বঙ্গদেশকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাগ করিয়া একটি ভারতে ও অন্যটি পাকিস্তানের সহিত যোগ করিবার জন্য বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্দোলনের সূত্রপাত করে তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। অনেক সুবিধা ও আপত্তিজনক পরিস্থিতির সম্ভাবনা সত্ত্বেও অধিকাংশ হিন্দু বাঙ্গালীই যে এই বঙ্গবিভাগের পূর্ণ সমর্থন করিয়াছিল, নোয়াখালি হত্যাকাণ্ড ও সে সম্বন্ধে মুসলিম লীগ মন্ত্রীর ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মনোভাব ও আচরণই যে তাহার অন্যতম প্রধান কারণ তাহা অস্বীকার করা কঠিন। এইজন্যই। নোয়াখালির ব্যাপারটি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিলাম।
নোয়াখালিতে মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত পরিভ্রমণ ও উপদেশ যে সাম্প্রদায়িক বিরোধের উপশমের কিছুমাত্র সাহায্য করে নাই তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে ইহা যে বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর কোন প্রভাবই বিস্তার করে নাই তাহার আর-একটি নিদর্শন পাওয়া যায় একটি সরকারী রিপোর্টে। ১৯৪৭ সনের ১৩ই মে তারিখে চট্টগ্রামের কমিশনার বাংলা গভর্নমেন্টের নিকট এই অতিগোপনীয় (confidential top secret) রিপোর্টে ‘নোয়াখালির অবস্থা’ সম্বন্ধে যে সুদীর্ঘ বিবরণ পাঠাইয়াছিলেন তাহা হইতে কিছু কিছু উদ্ধৃত করিতেছি।
“বাহিরে নোয়াখালি শান্ত মূর্তি ধারণ করিলেও হিন্দুরা এখনও আতঙ্কগ্রস্ত–বড় বড় শহরের বাহিরে গ্রামাঞ্চলে হিন্দুদের প্রতি মুসলমানদের ছোটখাট উৎপীড়ন ও গালাগালি এই আতঙ্কের কারণ। মোট লোকসংখ্যার চারি লক্ষ হিন্দু ও আঠারো লক্ষ মুসলমান–সুতরাং হিন্দুরা, বিশেষতঃ ভদ্রলোকেরা অক্টোবরের অত্যাচার স্মরণ করিয়া এখনও ভীত ও সন্ত্রস্ত অবস্থায় জীবন কাটাইতেছে। তাহাদের উপর যে অত্যাচার ও উৎপীড়ন চলিতেছে তাহা থানায় রিপোর্ট করিতে ভরসা পায় না। কারণ মুসলমানেরা ইহা জানিতে পারিলে অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়াইবে। যদি কেহ জানায়, তবে তদন্তের সময় মুসলমানদের ভয়ে ঘটনা অস্বীকার করে–যদিও অনেক স্থলে ইহা সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। মুসলমানদের চারি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। প্রথম, অতি অল্পসংখ্যক একদল হিন্দুদের সঙ্গে শান্তিতে ও সদ্ভাবে বাস করিতে ইচ্ছুক এবং কেহ কেহ মারামারি কাটাকাটির সময় অনেক হিন্দুকে আশ্রয় দিয়াছে। দ্বিতীয় দলই সংখ্যায় বেশী –ইহারা মুসলিম লীগের সমর্থক এবং হিন্দুরা জিলা ছাড়িয়া চলিয়া যায় ইহাই তাহাদের ইচ্ছা। ইহারা খুনোখুনি করিতে চায় না, কিন্তু নানাভাবে হিন্দুকে উৎপীড়ন করে–তবে অন্যেরা হিন্দুদের উপর হিংস্র অত্যাচার করিলে মুখ ফিরাইয়া থাকে এবং সময়বিশেষে তাহাতে যোগদানও করে। ইউনিয়ন বোর্ডের অনেক সভ্যেরা এই শ্রেণীর। তৃতীয় শ্রেণীর মুসলমানেরা, ধর্মের নামে, অর্থলোভে ও ব্যক্তিগত কারণে হিন্দুকে সর্বান্তঃকরণে ঘৃণা করে এবং তাহাদের সমূলে ধ্বংস করিতে প্রস্তুত। সাম্প্রতিক ঘটনায় ইহাদের শক্তি খুব বাড়িয়াছে এবং বহু গুণ্ডা লুঠের লোভে এই দলে যোগ দিয়াছে। এই দলের মধ্যে অনেকে খুব ভাল বক্তৃতা দিয়া সাধারণ লোককে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিতে পারে। আবুল কাশেম এবং আলি আকবর-এই শ্রেণীভুক্ত দুইজন নামকরা লোক। ইহাদের নামে অভিযোগ আছে, কিন্তু ইহারা ফেরারী আসামী–পুলিশ ইহাদের খোঁজ পাইতেছে না। চতুর্থ শ্রেণী-গুণ্ডার দল। এই জিলায় প্রায় ৫৬,০০০ লোক যুদ্ধের সময় ভাল মাহিনা পাইত-এখন লুঠ করিবার সুযোগ পাইলে তাহারা ছাড়িতে চায় না। চুরি ডাকাতি, আগুন লাগানো, হত্যা প্রভৃতি অপরাধে ইহারা সিদ্ধহস্ত, কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই হিন্দুরাই তাহাদের উপদ্রবের লক্ষ্য।
“হিন্দুদের উপর অন্যান্য রকমেও অত্যাচার ও লাঞ্ছনা চলিতেছে। বিগত হত্যাকাণ্ডের পর মুসলমানেরা পথে ঘাটে হিন্দুদের কাফের, মলউন প্রভৃতি বলিয়া সম্বোধন করে, টাকা পয়সা কাড়িয়া নেয়। বাজার করিয়া ফিরিবার সময় কেনা জিনিস জোর করিয়া ছিনাইয়া লওয়া, হিন্দুর বাড়ীর সুপারী নারিকেল পাড়িয়া নেওয়া, কাঠ টিন গরু বাছুর ছিনাইয়া লওয়া, হিন্দুর ধানক্ষেত নষ্ট করা, থানায় নালিশ করিলে অভিযোগকারীর বাড়ীতে আগুন লাগানো– এগুলি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনামাত্র। হিন্দু-সিনেমাগৃহ বন্ধ করিবার চেষ্টা চলিতেছে। যদিও তাঁতীদের অধিকাংশই হিন্দু, তাঁত চালাইবার লাইসেন্স শতকরা ৫০ জন মুসলমানকে দিতে হইবে–এরূপ দাবি করা হইয়াছে। বাজার হইতে হিন্দু দোকানদার দূর করিবার চেষ্টা হইতেছে এবং একজন বড় আড়ৎদার বলিল, সে এবং অনেকে উড়োচিঠি পাইয়াছে যে, দোকান বন্ধ না করিলে বিপদ ঘটিবে। বহু পুরানো হিন্দু দোকানদারদের সরাইয়া তাহাদের জায়গায় মুসলমান দোকানদার বসানো হইয়াছে। গত অগ্নিদাহ ও নিধনপর্বের পর যেসব হিন্দু নূতন করিয়া ঘর তুলিয়াছে তাহাদের শাসানো হইতেছে যে, তাহারা জিলা ছাড়িয়া না গেলে বিপদ ঘটিবে। গত অক্টোবরে হাঙ্গামার পর যাহারা আদালতে নালিশ করিয়াছিল তাহাদের ভয় দেখাইয়া মামলা তুলিয়া নিতে বাধ্য করা হইতেছে। হাঙ্গামায় সাত হাজার সাত শত পরিবারের গৃহ নষ্ট হইয়াছিল, বাইশ হাজারের উপর চাষী, তাঁতী বিতাড়িত হইয়াছিল। সরকারী সাহায্যে ইহাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হইয়াছে।
“গান্ধী-শিবিরের ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকগণের চেষ্টায় দুর্গতদের খুব বেশী উপকার হয় নাই। ইহাদের সঙ্গে স্থানীয় মুসলমানদের কোন যোগ নাই এবং উভয়ে উভয়কে সন্দেহের চোখে দেখে।
“হিন্দুদের নৈতিক ও মানসিক দৌর্বল্যের প্রধান কারণ অক্টোবর-হাঙ্গামার অপরাধীদের প্রতি গভর্নমেন্টের পক্ষপাতিত্ব এবং ইহার ফলে মুসলমান দুবৃত্তদের হিন্দুর উপর অত্যাচার ও উৎপীড়নের প্রবৃত্তি বৃদ্ধি। হাঙ্গামার পর ১৫২৯টি ফৌজদারী মামলা রুজু হয়–এবং আসামীর সংখ্যা ছিল তের হাজারের বেশী। ইহাদের মধ্যে মাত্র ১৬৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলিতেছে। ৫৬৬ জন আসামী এবং ইহাদের মধ্যে বহু দুর্দান্ত প্রকৃতির নেতা আছে–এখনও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নাই। যে ৬৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে মাত্র ৫০ জন এখন আটক আছে। হিন্দুরা জানে যে, পুলিশ দুবৃত্তদের গ্রেপ্তার করিতে চায় না এবং দুবৃত্তেরাও জানে, তাহাদের কোন শাস্তি হইবে না। পুলিশ নেতৃস্থানীয় এইরূপ দুই আসামী-আবুল কাসেম ও আলি আকবরের খোঁজ পায় না, অথচ তাহারা স্বচ্ছন্দে এই জিলার মধ্যেই ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এবং প্রকাশ্যে সভা সমিতিতে বক্তৃতা করিতেছে যে, গতবার সমস্ত হিন্দুকে হত্যা না-করা একটা মস্ত ভুল হইয়াছে এবং আগামী সংঘর্ষে তাহারা আর এরূপ ভুল করিবে না। ইহা সত্ত্বেও পুলিশ তাহাদিগকে গ্রেপ্তার করে নাই এবং ইহাতে একদিকে যেমন হিন্দুদের ভীতি, আর একদিকে তেমনি মুসলমানদের সাহস ও আক্রোশ বৃদ্ধি পাইতেছে। কর্তৃপক্ষের চাপে ম্যাজিষ্ট্রেটরা বহু দুবৃত্ত আসামীকে জামিনে খালাস দিতে বাধ্য হইতেছেন এবং তাহারা ভীতি প্রদর্শনে সাক্ষীদিগকে দিয়া মিথ্যা বলাইতেছে। পুলিশের ঔদাসীন্য, পক্ষপাতিত্ব, অত্যাচারের সঠিক খবর পাওয়া যাইতেছে না এবং গভর্নমেন্ট প্রচার করিতেছে যে, গোলমাল থামিয়া গিয়াছে। পুলিশের এইরূপ আচরণেই গত অক্টোবর মাসের ভীষণ হত্যাকাণ্ড সম্ভবপর হইয়াছিল এবং খুব সম্ভব শীঘ্রই ইহার পুনরাবৃত্তি হইবে।”
এস্থলে বলা আবশ্যক যে, গান্ধীজির বিশ্বস্ত ভক্ত শহীদ সুরাওয়ার্দি এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ও এইসকল জঘন্য ব্যাপারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাঁহারই। ২/৩ মাস পরেই কলিকাতায় গান্ধীজি সুরাওয়ার্দির সঙ্গে একত্রে বাস করার সময় কেন যে কলিকাতার হিন্দু জনসাধারণ এই দুইজনের প্রতি অসৎ ব্যবহার করিয়াছিলেন, এইসব ঘটনাই তাহার মূল কারণ। মহাত্মা গান্ধী এবং যাঁহারা তাহার ভক্ত তাঁহারা গান্ধীজির নোয়াখালি-ভ্রমণের ব্যর্থতায় কিছুমাত্র বিচলিত হন নাই, কিন্তু যাঁহারা মহাত্মা নহেন এবং মানুষের চিরাচরিত রীতি ও স্বাভাবকেই জাগতিক ব্যাপারে প্রাধান্য দেন, তাঁহারাই সবদেশে সর্বকালে ঐতিহাসিক ঘটনাকে বাস্তব রূপ দিতে সমর্থ হইয়াছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে তাঁহাদের মতামতের মূল্য অনেক বেশী। এইজন্যই মহাত্মা গান্ধী যখন নোয়াখালিতে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের স্বপ্নে বিভোর হইয়া অশেষ দুঃখকষ্ট সহ্য করিতেছিলেন তখন নোয়াখালির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আর একজন যে মন্তব্য করিয়াছিলেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“নোয়াখালির ঘটনায় একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হইয়া উঠিয়াছে। বাঙালী মুসলমানদের শতকরা ৯০ জন ধর্মান্তরিত মুসলমান (হিন্দু?)–ইহা স্বীকার করিলেও দেখা যাইতেছে, হিন্দুবিদ্বেষ তাহাদের অধিকাংশের মধ্যে প্রবলভাবে সংক্রামিত হইয়াছে। … মুসলমান সমাজে এখন যাহারা প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছে তাহাদের মধ্যে দুইটি জিনিস সবচেয়ে বেশী লক্ষণীয়; প্রথম, পরধর্মের প্রতি তাহাদের গভীর বিদ্বেষ; দ্বিতীয়, ভিন্নধর্মের অপহৃতা নারীকে গৃহে আনয়ন করার আগ্রহ। মুসলমানেরা এদেশে আসিবার পর হইতেই হিন্দুর দেবমন্দির ও বিগ্রহের উপর আক্রমণ আরম্ভ হয়। ইংরেজের প্ররোচনায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ পুনরায় জাগিলে পরে এতদিন এদেশে মন্দির ভাঙ্গাই চলিতেছিল; গত দুইমাসে ইহার প্রথম ব্যতিক্রম দেখা দিয়াছে দুই সম্প্রদায়েরই পরস্পর ধর্মস্থানের উপর আঘাত। প্রভেদ এই যে, পরিবারের কোন তরুণ কোন নারীকে বলপূর্বক হরণ করিয়া ঘরে আনিয়া তুলিবে, বাঙ্গালী হিন্দু ইহা কল্পনাও করিতে পারে না; কিন্তু মুসলমান সমাজে ইহা স্বাভাবিক ঘটনা হইয়া দাঁড়াইতেছে।
“নোয়াখালির উপদ্রুত অঞ্চলের সমস্ত হিন্দু অধিবাসীকে মুসলমানধর্মে দীক্ষিত করিবার চেষ্টা হইয়াছে এবং বহু বিশিষ্ট মুসলমানও হিন্দুনারী অপহরণে সহায়তা করিয়াছে। নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ প্রভৃতি অপেক্ষা এই দুই ঘটনাকেই আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া মনে করি। পূর্ববর্ণিত ইতিহাস মনে রাখিলে ইহার তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করাও কঠিন হইবে না। বাংলার হিন্দুই শুধু মুসলমানকে ভাই বলিয়া মনে করিবে, তাহার সহিত রক্তের সম্পর্ক খুঁজিয়া লইয়া তাহাকে আপন করিতে চাহিবে, আর মুসলমান শুধু হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করিয়া স্বধর্মবিস্তারের সুযোগ খুঁজিবে–এই মনোবৃত্তি বজায় থাকিতে দুই সম্প্রদায়ে মিলনের আশা সুদূরপরাহত।
“নোয়াখালির আঘাতেই বোধ হয় হিন্দু বাংলার ইতিহাস প্রথমবার ভাবরাজ্য হইতে বাস্তবতার কঠিন ভূমিতে নামিয়া আসিয়াছে। এই প্রথম সনাতন ব্রাহ্মণ সমাজ ধর্মান্তরিত হিন্দুকে বিনাপ্রায়শ্চিত্তে স্বধর্মে ফিরিবার অনুমতি দিলেন এবং বাংলার হিন্দুসমাজ অপহৃতা নারীকে নিজ নিজ পরিবারে প্রতিষ্ঠিত করিবার পথ খুলিয়া দিল। ধর্মান্তরকরণ ও নারীধর্ষণ দ্বারা মুসলমানের সংখ্যাবৃদ্ধির চেষ্টার পথে এতদিনে কাটা পড়িল।”
এইরূপ চিন্তার ধারা হয়ত প্রথমে অল্প লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ক্রমশঃই তাহা বিস্তারলাভ করিয়া হিন্দুর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে পরিণত হইল। ইহা আলোচনার পূর্বে পাকিস্তানের পূর্বকথা সংক্ষেপে বলা আবশ্যক।
১০. পাকিস্তানের পূর্বকথা
বঙ্গদেশের ইতিহাসের প্রধান ঘটনা ১৯৪৭ সনে পূর্ববঙ্গকে ভারতবর্ষ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা। সুতরাং পাকিস্তান-ধারণার পূর্ব ইতিহাস সংক্ষেপে বিবৃত করিতেছি।
উনিশ শতকের শেষভাগে প্রসিদ্ধ মুসলমান নেতা সৈয়দ আহম্মদ প্রচার করিতে আরম্ভ করেন যে, একসঙ্গে ভারতে বাস করিলেও হিন্দু ও মুসলমান দুইটি পৃথক জাতি। কিন্তু হিন্দুরা প্রায় সকলেই এবং মুসলমানদের মধ্যেও অনেকে এই মত গ্রহণ করে নাই। ১৯৩০ সনের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে সভাপতি ইকবাল দাবি করেন যে, ভারতবর্ষে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম ভারত স্থাপিত হউক। তাঁহার মতে পঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ অর্থাৎ যে সমুদয় অঞ্চলে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানের সংখ্যা বেশী, সেই সকল লইয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অথবা স্বাধীন একটি স্বতন্ত্র রাজ্য গঠিত হউক।
ইহার তিন বৎসর পরেই যখন লণ্ডনে গোলটেবিল বেঠকের অধিবেশনের অঙ্গস্বরূপ সিলেক্ট কমিটির অধিবেশন হয় তখন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রহমৎ আলি ঐ উপলক্ষে সমবেত মুসলমান-নেতাদের কাছে প্রস্তাব করেন যে পঞ্জাব, আফগান (অর্থাৎ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ), কাশ্মীর, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তান এই পাঁচটি প্রদেশ (যেখানে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ) লইয়া একটি স্বতন্ত্র মুসলমান রাজ্য গঠিত হউক এবং ইহার প্রথম চারিটির আদ্যক্ষর (P.A.K.S) এবং পঞ্চমটির শেষের অংশ (STAN) লইয়া ইহার নাম হউক পাকিস্তান (PAKISTAN)। ইহার সমর্থনে যুক্তিস্বরূপ রহমৎ বলেন যে, হিন্দু ও মুসলমান দুইটি ভিন্ন জাতি-কারণ তাহাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, প্রাচীন কাহিনী (tradition) সাহিত্য, অর্থনীতিক সমস্যা (economic system), উত্তরাধিকার আইন ও বিবাহপ্রথা এবং হিন্দুধর্ম, সংস্কৃতি প্রভৃতির মধ্যে মৌলিক প্রভেদ বর্তমান। তাহা ছাড়া হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে ভোজন করে না, উভয়ের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ হয় না এবং মুসলমানদের মাস ও বৎসর গণনা, আহার এবং পোশাক-পরিচ্ছদও আলাদা।
এই প্রসঙ্গে রহমৎ আলির পূর্বপরিচয় সংক্ষেপে দিতেছি। ১৯৩৩ সনে কেম্বিজের কয়েজন ছাত্র মিলিয়া পাকিস্তান ন্যাশনাল মুভমেন্ট’-নামক সংস্থা গঠন করেন। রহমৎ ইহার সভাপতি ছিলেন। ঐ বৎসর ৮ই জানুয়ারি ‘Now or Never নামক আট-পাতার একখানি ইংরেজি পুস্তিকার মাধ্যমে পাকিস্তানের আদর্শ প্রচারিত হয়। ইহার যুক্তিগুলি পূর্বেই উদ্ধৃত হইয়াছে এবং এই পুস্তিকাখানিতেই সর্বপ্রথম ‘পাকিস্তান নামটি ব্যবহৃত হয়। পাকিস্তান শব্দের অর্থ পবিত্র মানুষের দেশ’ এবং কিভাবে চারিটি দেশের আদ্যক্ষর এবং আর একটির অন্ত্য তিন অক্ষর লইয়া ‘পাকিস্তান’ এই নামের উদ্ভব হইল তাহাও পূর্বেই বলিয়াছি। লণ্ডনে উপস্থিত মুসলমান-নেতারা রহমতের প্রস্তাবে বিশেষ কোন গুরুত্ব আরোপ করিলেন না, বরং ইহা ছাত্রদের অলীক ও অবাস্তব কল্পনা বলিয়া উড়াইয়া দিলেন।
কিন্তু রাজনীতিক-ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে প্রভেদ যত বাড়িতে লাগিল ততই পাকিস্তান অর্থাৎ স্বতন্ত্র মুসলমানরাজ্যের কল্পনা বাস্তব দাবিতে পরিণত হইতে লাগিল। অবশেষে ১৯৪০ সনের ২৪শে মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে এই মর্মে একটি প্রস্তাব গৃহীত হইল।
এই অধিবেশনের সভাপতি মহম্মদ আলী জিন্না তাঁহার অভিভাষণে যে সমুদয় যুক্তিবলে এই প্রস্তাব সমর্থন করিলেন, পূর্বোক্ত রহমৎ আলির দ্বিজাতিতত্ত্বের সহিত তাহার বিশেষ কোন প্রভেদ নাই।
জিন্না বলিলেন, “হিন্দু ও মুসলমান দুইটি পৃথক্ জাতি। হিন্দু ও মুসলমানদের পৃথক্ ধর্ম, দর্শন, সামাজিক প্রথা ও সাহিত্য। তাঁহারা পরস্পর বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন না বা একসঙ্গে আহারও করেন না। জীবনসম্পর্কে তাঁহাদের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ পৃথক। হিন্দু ও মুসলমানেরা সাহিত্য ও ইতিহাসের দিক হইতে বিভিন্ন প্রকারের অনুপ্রেরণা লাভ করে। তাঁহাদের একের কাছে যাঁহারা বীর ও পূজনীয়, অন্যের কাছে তাঁহারা ঘৃণ্য শত্রু। সুতরাং এই দুই জাতি এক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হইলেও কখনও মিলিয়া মিশিয়া সুখে ও সন্তুষ্টচিত্তে থাকিতে পারিবে না। বিগত বারোশত বৎসরের ইতিহাস হইতে প্রমাণিত হয় যে, এই দুই জাতির মধ্যে জাতীয় ঐক্য কখনও গড়িয়া উঠে নাই। ইংরেজের ভয়ে একটি যে কৃত্রিম ঐক্য গড়িয়া উঠিয়াছিল, ইংরেজরাজত্ব অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই তাহারও অবসান হইবে। তখন ভারতের শাসনতন্ত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য থাকিবে। আমি আশা করি, ইংরেজ জোর করিয়া কখনও মুসলমানদের হিন্দুরাজ্যে বাস করিতে বাধ্য করিবে না। কারণ মুসলিম-ভারত এমন শাসনতন্ত্র গ্রহণ করিতে পারে না যেখানে হিন্দুর প্রাধান্য থাকিবে।”
জিন্নার এই উক্তি যে ভারতের ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করে, নিরপেক্ষ ব্যক্তিমাত্রেই তাহা স্বীকার করিবেন। ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস জানা থাকিলে জিন্না তাঁহার স্বপক্ষে অনেক দৃষ্টান্ত দেখাইতে পারিতেন। মুসলমানেরা যে হিন্দুরাজের অধীন হইয়া কখনও থাকিতে ইচ্ছুক ছিল না, বাংলাদেশের রাজা গণেশের পরিণাম তাহার চরম দৃষ্টান্ত। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে তাহা বর্ণিত হইয়াছে।
মুসলমানদের এই অধিবেশনে পাকিস্তান গঠনের মূল প্রস্তাব উত্থাপিত করেন বাংলা উদারচেতা প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক, মুসলমান-নেতাদের মধ্যে যিনি সর্বাপেক্ষা হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলিয়া যথার্থ খ্যাতির অধিকারী হইয়াছিলেন। তাঁহার প্রস্তাবের মূলকথা এই যে, “ভৌগোলিক দিক হইতে সন্নিহিত অঞ্চলগুলি (unit) এমনভাবে ভাগ করিতে হইবে যাহাতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চল, যেখানে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিবে এবং সেই সকল রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলি স্বশাসিত ও সার্বভৌম হইবে।”
লাহোরে এই প্রস্তাব গৃহীত হইবার চারি-পাঁচ মাস পরেই ভারত-সরকার জিন্নার দাবি সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করিলেন। ১৯৪০ সনের ৮ই অগষ্ট তারিখে বড়লাটের একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হইল। ইহাতে তিনি মন্তব্য করিলেন, “ইহা বলাই বাহুল্য যে ব্রিটিশরাজ ভারতশাসনের দায়িত্ব এমন কোন দলের হাতে অর্পণ করিতে পারেন না যাহার কর্তৃত্ব ভারতের জাতীয় জীবনের এক বৃহৎ ও শক্তিশালী অংশ স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহে। আর, ভারত সরকার এইরূপ অনিচ্ছুক অংশকে বলপূর্বক উক্ত দলের কর্তৃত্ব মানিয়া চলিতে বাধ্য করিতে প্রস্তুত নহেন।”
ইহার নির্গলিতাৰ্থ এই যে, যদি মুসলমানেরা হিন্দুর অধীনস্থ হইয়া থাকিতে না চায় তবে ইংরেজ গভর্নমেন্ট হিন্দুদের হস্তে শাসনভার দিয়া এদেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে প্রস্তুত নহে।
ইহার অবশ্যম্ভাবী ফল হইল এই যে, মুসলমানদের সম্মতি ব্যতীত কোন শাসনব্যবস্থাই জোর করিয়া তাহাদের ঘাড়ে চাপাইয়া দেওয়া যাইতে পারে না। অর্থাৎ, জিন্না ও মুসলিম লীগ যে-কোন শাসন-সংস্কারের বিরোধিতা করিলেই তাহা কার্যকরী হইবে না। এককথায় বলিতে গেলে, ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনবিধি কিরূপ হইবে, জিন্নার হস্তে তাহার নিয়ন্ত্রণের ভার দেওয়া হইল-কংগ্রেস যে-প্রস্তাবই করুক না কেন, তাহা প্রত্যাখ্যান বা নাকচ করার ক্ষমতা ইংরেজ গভর্নমেন্ট মুসলিম লীগের হাতে তুলিয়া দিলেন।
এইভাবেই পাকিস্তানের গোড়াপত্তন হইল। পরবর্তীকালে কেবল এইটুকু পরিবর্তন হইল যে, মুসলমানগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিতে কয়েকটি বিভিন্ন সার্বভৌম রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ঐ অঞ্চলগুলি মিলিয়া স্বতন্ত্র, স্বাধীন একটিমাত্র সার্বভৌম পাকিস্তান রাজ্য গঠিত হইবে। অর্থাৎ, ভারতবর্ষে অনেকগুলি ক্ষুদ্র রাজ্যের পরিবর্তে মাত্র দুইটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইবে–হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান। অতঃপর এইরূপ পরিবর্তনই যে মুসলিম লীগের একমাত্র আদর্শ ও লক্ষ্য হইয়া দাঁড়াইল এবং ১৯৪৭ সনে কিভাবে তাহা বাস্তবে পরিণত হইল তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে।
এই প্রসঙ্গে রাজনীতিক মত পরিবর্তনের কয়েকটি অপূর্ব দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ১৯৪৪ সনে গান্ধী ও রাজগোপালাচারী যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে মুসলিম লীগের নেতা জিন্নার সহিত একটি আপসরফার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থকাম হইয়াছিলেন। তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। কিন্তু, তথাপি গান্ধী ও নেহেরু পরিচালিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ১৯৪৬ পর্যন্ত দৃঢ়স্বরে পাকিস্তানের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছে। মহাত্মা গান্ধী (৩১শে মার্চ, ১৯৪৭) বলেন, “আমার মৃতদেহের উপর দিয়া ছাড়া কংগ্রেস ভারতে দুইটি বিভিন্ন রাজ্য, অর্থাৎ পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করিতে পারিবে না। আমি যতদিন বাঁচিয়া আছি ইহাতে সম্মতি দিব না।” মৌলানা আজাদের প্রশ্নের উত্তরে এই উক্তি করিয়া সত্যের উপাসক গান্ধীজি ১৪ই। জুন নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে ‘পঞ্জাব ও বাংলা দেশকে দুই খণ্ড করা হউক’ এই প্রস্তাব সমর্থন করিলেন। ফজলুল হকের কথা পূর্বেই বলিয়াছি। পণ্ডিত নেহেরু, প্যাটেল প্রভৃতিও প্রায় শেষপর্যন্ত প্রতিবাদ করিয়া অবশেষে। পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব সমর্থন করিলেন।
১১. বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের মুখপাত্র নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি (৬ই জানুআরি, ১৯৪৭) ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ই মে-র প্রস্তাব অনুযায়ী পাকিস্তানের ভিত্তিতে ভারতে দুইটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা অনুমোদন করে। কিন্তু ইহার সঙ্গে মন্তব্য করে যে, “এই প্রস্তাবে আসাম, সীমান্ত প্রদেশ এবং শিখদের যে অসুবিধায় ফেলা হইয়াছে, কমিটি তাহা বুঝিতে পারিতেছেন। … এইসব অধিবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাহাদের ঘাড়ে কোনকিছু বলপূর্বক চাপাইয়া দিতে গেলে কমিটি কখনও তাহা সমর্থন করিতে পারে না।” আশ্চর্যের বিষয় যে, পঞ্জাবে সংখ্যায় নগণ্য শিখদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করা হইল, কিন্তু বঙ্গদেশে শতকরা ৪৫ জন হিন্দু অধিবাসীদের পাকিস্তানের অন্তর্গত হইবার আশঙ্কা এই কমিটির মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করিল না। মহাত্মা গান্ধী আসামকে কংগ্রেসের মতের বিরুদ্ধে সেসনের বৈঠকে যোগদান না করিয়া পরিষদ্ হইতে বাহির হইয়া আসার পরামর্শ দিলেন; কিন্তু বাংলার হিন্দুদের সম্বন্ধে নীরব রহিলেন। বাংলার প্রতিনিধিরূপে উক্ত কমিটিতে যাহারা উপস্থিত ছিলেন তাঁহারাও যে এ-বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য করিয়াছিলেন তাহারও প্রমাণ নাই। এই অপদার্থ বাঙ্গালী নেতাদের দৃষ্টান্ত হইতেই বেশ বোঝা যায় যে, রাজনীতিক ক্ষেত্রে বাংলার কোন প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল না এবং বাঙ্গালী কংগ্রেস-নেতাদের অযোগ্যতাই তাহার কারণ।
কিন্তু কংগ্রেসের বাহিরে, অর্থাৎ গান্ধীজির নামেই মুগ্ধ হইয়া দেশের মঙ্গলকামনায় স্বাধীন চিন্তা যাহারা বিসর্জন দেন নাই, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ এই গুরুতর বিপদে সোচ্চার হইয়া উঠিলেন। এইরূপেই ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে এক বিরাট আন্দোলন গড়িয়া ওঠে। এই আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছাড়া আর কী কী উপায়ে সমস্যার সমাধান হইতে পারে, নানাশ্রেণীর লোক সে-বিষয়ে নানা প্রস্তাব করেন। এইগুলি সংক্ষেপে উল্লেখ করিতেছি এবং এই আন্দোলনের পরবর্তী ২৮ বৎসরের ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে ইহার গুণাগুণ সম্বন্ধেও কিছু বলিতেছি।
১. মহম্মদ আলি জিন্না ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান অধিবাসীদের নিজ নিজ সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় সরাইয়া লওয়ার প্রস্তাব করেন। তখন অনেকেই বলিয়াছেন, ইহা অসম্ভব ও সর্বথা অবাঞ্ছনীয়। গান্ধীজি বলেন, “লোকবিনিময়ের কথা আমি ভাবিতেই পারি না। আমি মনে করি উহা সম্পূর্ণ অসম্ভব প্রস্তাব। যিনি যে প্রদেশেই থাকুন না কেন, হিন্দুই হউন আর মুসলমানই হউন অথবা আর কোন ধর্মে বিশ্বাসী হউন, তিনি ভারতবাসী।” গান্ধীজির এই সিদ্ধান্ত যে কতবড় ভ্রান্ত ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের ২৭ বৎসরের ইতিহাসই তাহার চূড়ান্ত প্রমাণ। পাকিস্তান পশ্চিমএশিয়ার মুসলমান-দেশের সঙ্গেই যে এক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং ভারতের সম্পূর্ণ বিরোধী–ইহার চূড়ান্ত প্রমাণসত্ত্বেও যদি কেহ পাকিস্তানের লোক ভারতবাসী–এই দাবী করেন তবে তাঁহার মস্তিষ্কের সুস্থতা-সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার সঙ্গত কারণ আছে।
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই পঞ্জাবে রক্তস্রোতের মধ্যদিয়া জিন্নার প্রস্ত বিত লোকবিনিময়-পর্ব সম্পন্ন হইয়াছে। ফলে পাকিস্তান বা ভারতের অন্তর্ভুক্ত পঞ্জাবের কোন অংশেই সাম্প্রদায়িক সমস্যার অস্তিত্ব নাই।
পঞ্জাবে যাহা রক্তস্রোতের মধ্যদিয়া হইয়াছিল, পঞ্জাবে ও বঙ্গদেশে তাহা উভয় সম্প্রদায়ের সম্মতিক্রমে করা সম্ভবপর হইত না। পঞ্জাবের রক্তস্রোত ও অত্যাচার দুইপক্ষেই হইয়াছিল, কিন্তু বঙ্গদেশে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরাই কেবল নিষ্ঠুর হত্যা, লাঞ্ছনা ও সর্বস্বান্ত অবস্থার মধ্যদিয়া প্রতি ৪৫ বৎসর অন্তর দলে দলে বিতাড়িত হইয়া পশ্চিমবঙ্গে যে-অবস্থায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হইয়াছে তাহা অবর্ণনীয়। কিন্তু আশ্রয় তাহারা পায় নাই। আন্দামান হইতে আরম্ভ করিয়া ভারতের দূরপ্রদেশে কুকুর বিড়ালের মত বিতাড়িত হইয়াছে। স্বাধীন ভারতের দুরপনেয় কলঙ্ক বলিয়া তাহা চিরদিন ইতিহাসে উল্লিখিত হইবে। শান্তিপূর্ণভাবে লোকবিনিময় করিলে ইহা ঘটিত না–এরূপ অনুমান করা সঙ্গত নহে। মহাত্মা গান্ধীর জাতীয় আদর্শ ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ভাবোচ্ছাসের যূপকাষ্ঠে যে কোটি কোটি বাঙ্গালীর বলিদান হইয়াছে, বাঙ্গালী যদি কখনও আবার মনুষ্যপদবাচ্য হয় তবে ইহার জবাবদিহি চাহিবে। এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে, ১৯৪২ সনে ব্রিটিশ মন্ত্রী ক্রিপস ভারতের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার যে-প্রস্তাব লইয়া ভারতে আসিয়াছিলেন তাহাতে সাম্প্রদায়িকভাবে ভারত-বিভাগের সম্ভাবনা খুবই স্পষ্ট ছিল। সেই সময় একজন সাংবাদিক তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন যে, যদি কোন প্রদেশের এক অংশে কোন সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু অন্য অংশে সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়, তাহা হইলে কী ব্যবস্থা করা যাইবে? উত্তরে ক্রিপস্ বলিলেন, যদি ভারতীয়দের বিন্দুমাত্রও সাধারণ জ্ঞান থাকে (smallest amount of common sense) তবে এই দুই-অংশের মধ্যে প্রয়োজনমত সীমানির্দেশ দ্বারা লোকবিনিময় করিয়া প্রতি অংশেই এক-একটি সম্প্রদায়ের যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্থাপন করা যাইবে (rearrangement of boundaries as between the two Unions and exchange of population to get the larger majority in each)! অর্থাৎ, পঞ্জাব ও বাংলাদেশ ব্যতীত ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় পঞ্জাব ও বাংলাদেশের এক অংশ হিন্দুরাজ্য হইবে, অপর অংশ মুসলমানরাজ্য হইবে।
যে যুক্তির বলে গান্ধীজি এইরূপ প্রস্তাব অসম্ভব বলিয়া উড়াইয়া দিয়াছিলেন তাহার যে বিশেষ কোন মূল্য নাই এবং ঐ যুক্তির বলে ক্রিপস্ ও জিন্নার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পূর্ববাংলার হিন্দুদের যে কী সর্বনাশ হইয়াছে তাহা আজ সকলেই বুঝিতেছেন। যখন স্বাধীনতার পর পূর্ববাংলার লক্ষ লক্ষ হিন্দু নরনারী লাঞ্ছিত উৎপীড়িত ও সর্বস্বান্ত এবং চরম দুর্দশাগ্রস্ত হইয়া পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিল তখন পশ্চিমবাংলায় আন্দোলন আরম্ভ হইল যে, যত সংখ্যক হিন্দু বিতাড়িত হইয়া পূর্ববঙ্গ হইতে পশ্চিমবঙ্গে আসিয়াছে সেইসংখ্যক মুসলমানকে পূর্ববঙ্গে পাঠাইয়া নবাগত বিতাড়িত পূর্ববঙ্গীয় হিন্দুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হউক। ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল গান্ধীর প্রতিধ্বনি করিয়া বলিলেন যে, ইহা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতরাজ্যে (secular state of India) অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে নির্দেশ দিলেন, পূর্ববঙ্গ হইতে উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় লওয়া বন্ধ করিতে হইবে। যে দুইখানি চিঠিতে নেহেরু এই অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন তাহা চিরকাল মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জওহরলালের দুরপনেয় কলঙ্ক ও নিষ্ঠুরতর চরম নিদর্শন বলিয়া গণ্য হইবে।
২। দ্বিতীয় মতটি হইতেছে-বঙ্গবিভাগ যাহা সত্যসত্যই ঘটিয়াছে–অর্থাৎ বঙ্গদেশকে দুই ভাগ করিয়া পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গকে যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা। প্রধানতঃ পশ্চিমবঙ্গের লোকই এই প্রস্তাবের অনুমোদন করেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকার নিম্নলিখিত সম্পাদকীয় মন্তব্য ইহার সমর্থক যুক্তি হিসাবে গ্রহণ করা যাইতে পারে। ইহার সারমর্ম এই যে, নোয়াখালির ব্যাপার দেখিয়া স্পষ্টই বুঝা যায় যে বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হইলে পূর্ববঙ্গের হিন্দু বাঁচিবে না, সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাঙ্গালী হিন্দু (অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙ্গালী) ধ্বংস হইবে। সুতরাং বিপদে পড়িলে “অৰ্দ্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ”–এই নীতিবাক্য অনুসরণ করিয়া পশ্চিমবঙ্গকে পৃথক করিয়া স্বাধীন ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হউক। লেখক স্বীকার করিয়াছেন যে, পূর্ববঙ্গের উপর অত্যাচার চলিবে এবং “যে-ভাবে সুপরিকল্পিত উপায়ে হিন্দুদলন পর্ব আরম্ভ হইয়াছে তাহাতে পূর্ববাংলায় হিন্দু বাঁচিবে না। এক স্বীকারোক্তির পর নিম্নলিখিত উক্তিকয়টি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।
(ক) “গান্ধীজির ন্যায় আমরাও পূর্ববঙ্গ হইতে সকল হিন্দুর বাস্তুভিটা ত্যাগ করিয়া চলিয়া আসিবার ঘোর বিরোধী” (অর্থাৎ, লোকবিনিময়ের বিরোধী, কারণ এই প্রসঙ্গেই এই উক্তিটি করা হইয়াছে)।
(খ) “পূর্ববঙ্গের হিন্দুর ধন প্রাণ ও নারীর সম্মান রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আসিয়া দাঁড়াইতে পারেন নাই,’প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বাধা পড়িয়াছে … নূতন আমলে পূর্ববাংলার হিন্দুর সাহায্যপ্রাপ্তির পথ আরও বিঘ্নসঙ্কুল হইবে।”
(গ) “পূর্ববাংলার হিন্দুর উপর অত্যাচার হইলেই ভারতবর্ষের সর্বত্র বিহারের পুনরাবৃত্তি ঘটিবে, ইহা আমরা মনে করি না এবং উহা ঘটুক ইহাও আমরা প্রার্থনা করি না।”
এইসব পড়িয়া কেহ যেন মনে না করেন যে, ইহার বক্তা বা লেখক পূর্ববাংলার হিন্দুসম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন; কারণ তিনি লিখিয়াছেন, “পূর্ববাংলার হিন্দুকে বাঁচাইবার জন্য এমন উপায় আবিষ্কার করিতে হইবে যাহার দ্বারা অপরের রক্তপাত বা অনিষ্ট হয়, অথচ হিন্দুরাও বাঁচে।” এই উপায়টি যে কী, অর্থাৎ কোন্ যাদুমন্ত্রবলে মুসলমানদের রক্তপাত বা অনিষ্ট করিয়া হিন্দুর রক্তপাত বা অনিষ্ট বন্ধ করা যাইবে তাহা স্পষ্ট করিয়া কিছু বলেন নাই। তবে অন্যত্র তিনি মন্ত ব্য করিয়াছেন, “বাঙ্গালী হিন্দু নিজের এলাকায় বাঙ্গালী মুসলমানদের সর্ববিধ উন্নতির সুযোগ করিয়া দিয়া পূর্ববাংলার হিন্দুর প্রতি তাহাদের কর্তব্যবোধ জাগ্রত করিয়া দিবার সুযোগ যেমন পাইবে, তেমনি সেখানে কাহারও উপর অত্যাচার হইলে বাঙ্গালী হিন্দুর নিজস্ব গভর্নমেন্ট প্রতিকারের চেষ্টায় তৎক্ষণাৎ অগ্রণী হইতে পারিবে।” ইহা যদি লেখকের যথার্থ মত হয় তবে নবীনচন্দ্রের ভাষায় বলিতে হয় “ধন্য আশা কুহকিনী, তোমার মায়ায় মুগ্ধ মানবের মন”। আর যদি তাহা না হয় তবে বলিতে হয় ইহা স্বার্থপরতার মুখোস বা ছদ্ম-আবরণমাত্র।
২৭ বৎসরের বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ধৃত উক্তি পড়িলে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার দুইটি লাইন মনে হয়। একজন নিজের কন্যাকে বৃদ্ধের সহিত বিবাহ দিয়া আশীর্বাদ করিয়াছিলেন, সাবিত্রী সদৃশ ভব’। কিন্তু তাহার অকালবৈধব্য ঘটে। সেই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন যে, “কিমাশ্চর্যমতঃপর! আশীর্বাদের প্রথম অংশ ফল যেমন করে, ফল নাকো শেষের অংশ, যম দিল না ফিরে।” এক্ষেত্রেও বাঙ্গালী হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সর্ববিধ উন্নতির সুযোগ দিয়াছিলেন, তাহার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ-খুব কমসংখ্যক মুসলমানই হিন্দুশাসিত পশ্চিমবঙ্গ হইতে স্বরাজ্য পূর্ববঙ্গে গিয়াছেন, কিন্তু পুর্ববঙ্গের প্রতিক্রিয়া কী? অন্ততঃ পাঁচ-ছয়বার হৃত-সর্বস্ব, নিপীড়িত, অত্যাচারে জর্জরিত, পরিধান-বস্ত্রমাত্র সম্বল করিয়া লক্ষ লক্ষ হিন্দু নরনারী-শিশু, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পশুর মত বিতাড়িত মোট এক কোটির অধিক হিন্দু বাঙ্গালীর পশ্চিমবঙ্গে পলায়ন জ্বলন্ত অক্ষরে তাহা ইতিহাসের পাতায় লিখিয়া রাখিয়াছে। নেহেরু গভর্নমেন্ট একমাত্র বাক্যবাণ ও পত্রবাণ ছাড়া এই দুর্দশার প্রতিকারে অন্য অস্ত্র খুঁজিয়া পান নাই। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও নির্দেশ অনুযায়ী তাহারা সাহসের সহিত নিজ গৃহদ্বারে দাঁড়াইয়া প্রাণ দিতে সাহস পায় নাই।
পূর্ববঙ্গের একদল অধিবাসী ও কয়েকজন প্রসিদ্ধ নেতা বঙ্গবিভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করিয়াছিলেন। তাঁহাদের প্রধান প্রধান যুক্তিগুলি উল্লেখ করিতেছি।
১৯শে ফেব্রুআরি, ১৯৪৭ কুমিল্লার প্রসিদ্ধ নেতা শ্রীঅখিলচন্দ্র দত্তের অহ্বানে একটি সভায় বঙ্গবিভাগ প্রস্তাবের বিরোধিতা হয়। ইহাতে যেসব যুক্তি দেখানো হয় তাহার কয়েকটি উল্লেখ করিতেছি; ‘প্রবাসী সম্পাদক ইহার যে উত্তর দিয়াছেন তাহাও লিখিতেছি।
১। হিন্দুদের রক্ষার জন্য যখন সর্বপ্রযত্নে চেষ্টা করা উচিত, তখন বঙ্গভঙ্গ দ্বারা প্রতিকার করা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।
উত্তর-পশ্চিমবঙ্গের যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে বাংলার হিন্দুর প্রধান অংশ রক্ষা পাইবে। ইহাতে অন্য অংশকে সাহায্য করার ক্ষমতাও স্বাধীন অংশের বাড়িবে। সমস্ত হিন্দুদের রক্ষার জন্য কোনও ব্যবস্থা এ পর্যন্ত কার্যকরী হয় নাই–কথায় আরম্ভ ও কথায় শেষ হইয়াছে। (লোকবিনিময়ের দ্বারা যে সমস্যার সমাধান হইতে পারে, কোন পক্ষই তাহার উল্লেখ করেন নাই।)
২। সমগ্র আন্দোলনটি অবসাদ ও আত্মবিশ্বাসের অভাবে উদ্ভূত পরাজয়সুলভ মনোভাবসম্পন্ন।
উত্তর-পশ্চিমবাংলার অধিবাসীদের নিজের জীবন ও নিজের সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ব্যবস্থা করার অধিকার আছে, ঐ কথা বোধহয় দত্ত মহাশয়ের দলস্থ লোকে বিশ্বাস করে না।
৩। সাম্প্রদায়িকতা জাতীয় জীবনে একটি সাময়িক ঘটনামাত্র। বঙ্গভঙ্গ করা হইলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এক চিরস্থায়ী বিভেদ সৃষ্টি হইবে এবং দেশের ক্ষতি হইবে।
উত্তর-কত বড় ঘটনা এবং তাহার দ্বারা বাঙ্গালী হিন্দুর ভবিষ্যৎ কিভাবে বিপন্ন, তাহা কি কাহাকেও বুঝাইতে হইবে? সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ একপক্ষের মধ্যে বাড়িয়াই চলিয়াছে, ইহা ত বাস্তব সত্য।
(এই গ্রন্থের লেখকের মতে ভারতের ইতিহাস স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, ‘যেদিন মামুদ ঘোরী আসে সিন্ধুপার’ সেইদিন হইতে এই বিচ্ছেদ চলিয়াছে এবং যতদূর মানুষের যুক্তি ও দৃষ্টি যায়, ইহা কোন দিনই থামিবে না–যদি-না পারস্যের মত সমগ্র ভারতের হিন্দুরা ইসলামধর্মে দীক্ষিত হয়।)
৪। বঙ্গভঙ্গের দ্বারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সর্বোপরি অর্থনৈতিক ঐক্য নষ্ট হইয়া যাইবে।
উত্তর–ইহা সম্পূর্ণ ভুল। হিন্দুর সামাজিক সংস্কৃতির ঐক্যের কথা বহুদূরে থাক, অস্তিত্বনাশের চেষ্টা বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে এবং দ্রুতবেগে আরও অগ্রসর হইতেছে, ইহা অস্বীকার করা সম্ভব নহে। এ-চেষ্টা করিতেছে যাহারা, তাহাদের কবল হইতে কিছু অংশের বাঁচিবার চেষ্টাতেই বঙ্গবিভাগ করা হইতেছে। বাঙ্গালী হিন্দুসাধারণ সর্বস্বান্ত হইয়া গেলে কয়েকজন হিন্দু চোরাকারবারী বা লীগের ও ব্রিটিশ সরকারের চাটুকার বাদে বাংলার অর্থনৈতিক ঐক্য কাহার ভোগে আসিবে?
৫। ইহার দ্বারা তপশীলী সম্প্রদায়ের হিন্দুদের গুরুতর ক্ষতি হইবে। কারণ পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের মধ্যে তাহারা এক বিরাট অংশ। যদি বঙ্গভঙ্গ হয় তবে সম্পদশালী বৰ্ণহিন্দুরা দরিদ্র তপশীলী ও বর্ণহিন্দুদিগকে তাহাদের অদৃষ্টের উপর ছাড়িয়া দিয়া পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া আসিবে।
উত্তর–ইহা তো বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের বহুপূর্ব হইতেই চলিয়া আসিতেছে।
(উত্তরটি আংশিকভাবে সত্য। পূর্ববঙ্গের সম্পদৃশালী বৰ্ণহিন্দুগণ অনেকে কলিকাতায় ও কেহ কেহ পশ্চিমবঙ্গে বাস করিলেও তাহাদের মধ্যে একটি বড় অংশের পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যোগ একেবারে ছিন্ন হয় নাই। অনেকেই পূজার সময় বা অন্য উপলক্ষ্যে দেশে যাইতেন, জমিদার তালুকদারের মধ্যেও অনেকের পৈতৃক বাসস্থানের সহিত যোগাযোগ ছিল। বঙ্গবিভাগের পরে এই যোগসূত্র একেবারে ছিন্ন হইয়াছে এবং আরও অন্ততঃ পঁচিশ-ত্রিশ লক্ষ বর্ণহিন্দু জন্মের মত পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করিয়াছে বা করিতে বাধ্য হইয়াছে। যেসব তপশীলী হিন্দু বাধ্য হইয়া পূর্ববঙ্গে আছে তাহাদের মধ্যে অনেকেরই ইসলামধর্ম গ্রহণ করা ব্যতীত গত্যন্তর থাকিবে না, এ সম্ভাবনা একেবারে উড়াইয়া দেওয়া যায় না।)
অতঃপর শ্রীযুক্ত কামিনীকুমার দত্ত বঙ্গবিভাগের আন্দোলনের বিপক্ষে যে মত প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহা সংক্ষেপে উল্লেখ করিতেছি :
৬। এই আন্দোলনের ফলে সুস্থ এবং সবল জাতিগঠন-প্রচেষ্টা ব্যাহত হইবে। বাংলাদেশে হিন্দুরা সমগ্র জনসংখ্যার শতকরা ৪৫ ভাগ হইয়াও যথোপযুক্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা অর্জন এবং তাহাদের দাবি কার্যকরী করিয়া তুলিতে অক্ষম এইরূপ ভাবিয়াই বর্তমান আন্দোলন চালানো হইতেছে।
(এই যুক্তির অসারতা হইতে প্রতিপন্ন হয় যে পূর্ববাংলার নেতৃবৃন্দ কেবল যে কল্পনার মোহে আচ্ছন্ন হইয়া ছিলেন তাহা নহে, বাস্তবকেও সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করিয়াছিলেন। শতকরা ৪৫ জন বাঙ্গালী সুরাওয়ার্দি-সরকারের নির্মম লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কিছু করিতে পারেন নাই। বঙ্গদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হইলে শতকরা ২৫ জন, কি আরো কম বাঙ্গালীর কী দুরবস্থা হইবে তাহা তাঁহাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে নাই। বঙ্গদেশে “সুস্থ ও সবল জাতিগঠনের প্রচেষ্টায় মুসলমানদের অংশ কতটুকু ছিল এবং পাকিস্তান সরকারের আমলে ইহার যে কোন অস্তিত্ব থাকিতে পারে না, ইতিহাসের এই স্পষ্ট নির্দেশ বক্তাকে কিছুমাত্র বিচলিত করে নাই-ইহা কি অজ্ঞতা বা অনভিজ্ঞতার ফল? পশ্চিমবঙ্গ পৃথক রাজ্য হইলে “বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীর শতকরা ৬০ ভাগ লীগের কবল হইতে উদ্ধার পাইয়া সুস্থ ও সবল জাতিগঠনের সুযোগ পাইবে” এইরূপ আশা করাই অধিকতর সঙ্গত।)।
৭। (ক) হিন্দুদের স্বার্থহানি করিয়া মুসলমানেরাই চিরদিন রাষ্ট্রতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করিবে এবং হিন্দুদের কোন ইচ্ছাই কার্যকরী হইবে না–এইরূপ স্বতঃসিদ্ধ ধারণা করা ভুল।
(খ) পশ্চিমবঙ্গের যদি এইরূপ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মত যথেষ্ট শক্তি থাকিয়া থাকে, তবে কেন তাহারা উহা সম্মিলিত বঙ্গ বা বৃহত্তর বঙ্গ গঠনের কার্যে বিনিয়োগ করে না?
উত্তর-(ক) সাতশত বৎসরের মুসলমানশাসিত বঙ্গদেশের ইতিহাস পরিষ্কারভাবে সাক্ষ্য দেয় যে, মুসলমানেরা হিন্দুদিগকে রাষ্ট্রতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করিতে দিবে না। এই সাতশত বৎসরের মধ্যে কেবলমাত্র একজন হিন্দু রাজা গণেশ) কিরূপে সিংহাসন অধিকার করেন, কিরূপে মুসলমানেরা উত্তরপ্রদেশের মুসলমান নবাবকে আমন্ত্রণ করিয়া আনিয়া তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করে এবং কিরূপে তাঁহার পুত্র ইসলামধর্ম গ্রহণ করিলে তবে সে রাজ্য ফিরিয়া পায় এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে তাহা বর্ণিত হইয়াছে। সুতরাং পূর্বোক্ত স্বতঃসিদ্ধ ধারণার যথেষ্ট কারণ আছে, অন্যরূপ কোন সিদ্ধান্তের বশবর্তী হইয়া পাকিস্তানের অর্থাৎ ইসলাম-প্রভুত্ব স্বেচ্ছা বরণ করা বাতুলতামাত্র।
(খ) ইহার উত্তর অতি সহজ। হিন্দুশাসিত পশ্চিমবঙ্গে ভারতের হিন্দু যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গ যাহা করিতে সমর্থ হইবে মুসলমানশাসিত পূর্ববঙ্গে, পাকিস্ত নের শাসনাধীন পূর্ববঙ্গ তাহা করিতে পারিবে না–ইহা প্রকৃতই স্বতঃসিদ্ধ ধারণা।
শ্ৰীযুক্ত নীহারে দত্ত মজুমদারের একটিমাত্র যুক্তি উল্লেখযোগ্য।
৮। নোয়াখালির ধ্বংসকার্যসত্ত্বেও বাংলার বৃহত্তর অংশের হিন্দুরা মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দের সহিত একত্রে শান্তিতে বাস করিতে সক্ষম হইয়াছে। নোয়াখালি পৈশাচিক ঘটনার একটি দৃষ্টান্ত মাত্র।
উনিশ শতকে ইংরেজ-রাজত্বে এই উক্তি আংশিকভাবে সত্য হইলেও মুসলমান যুগের পক্ষে ইহা নিছক কল্পনামাত্র। সে-যুগে হিন্দুর যে শান্তি ছিল, তাহা মৃতের শান্তি। রাজনীতিক দাসত্ব, ধর্মের স্বাধীনতালোপ এবং সর্বপ্রকার সামাজিক লাঞ্ছনা সহিয়া বাঙ্গালী হিন্দুরা নীরবে দুঃসহ অভিশপ্ত জীবনযাপন করিয়াছে। মারাঠা বা শিখ জাতির মত বিদ্রোহ করে নাই-শক্তি বা সাহসের অভাব–রাজা রামমোহন রায় ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধের রাজনীতিকেরা ইহা স্পষ্ট ঘোষণা করিয়াছেন। বিংশ শতকের গোড়াতেই সর্বপ্রথম মুসলমানদিগকে কংগ্রেসের আওতায় আনিবার বৃথা প্রচেষ্টায় এই সমুদয় ঐতিহাসিক সত্য গোপন করিয়া রাজনীতিকেরা মুসলমানদের সম্বন্ধে মিথ্যা খ্যাতির প্রচার করিয়াছে। এ-সম্বন্ধে এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা করা হইয়াছে। ইংরেজ-রাজত্বের অবসানে যদি স্বাধীন মুসলমান রাজ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় তবে ইহার অধিবাসী হিন্দুরা যে পূর্বেকার মত লাঞ্ছনা অপমান অবিচার ও অত্যাচার সহ্য করিতে বাধ্য হইবে, ইহাই ন্যায়সঙ্গত অনুমান এবং বাংলার মুসলিম লীগ-শাসনে তাহার পূর্বাভাস পাওয়া গিয়াছে।
কলিকাতা হাইকোর্টের পঞ্চাশজন ব্যারিষ্টার বঙ্গবিভাগের দাবী জানাইয়া এবং উহার সমর্থনে যুক্তি প্রদর্শন করিয়া একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। তাঁহাদের প্রধান যুক্তি দুইটি। প্রথমতঃ তাঁহারা বলেন, পাকিস্তানে আমাদের বিশ্বাস নাই। আমরা এক দাসত্বের বিনিময়ে অন্য দাসত্ব চাই না। দ্বিতীয়তঃ-পশ্চিমবঙ্গে একটি শক্তিশালী পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হইলে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের রক্ষার কার্যকরী ব্যবস্থা হইবে।
সমগ্র বঙ্গদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রস্তাবেই বঙ্গবিভাগের আন্দোলন শুরু হয় এবং তাহারই পরিপ্রেক্ষিতে এই বিভাগের সপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তির আলোচনা করা হইল। কিন্তু ইতিমধ্যে একটি তৃতীয় প্রস্তাব হইল–পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না করিয়া অখণ্ড বঙ্গদেশকে একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র রাজ্যে পরিণত করা। ইহাতে বঙ্গবিভাগের বিরুদ্ধে কয়েকটি আপত্তির নিরসন হইবে, এবং অন্য কয়েকটি সম্ভাব্য অনিষ্টের একেবারে লোপ না হইলেও পরিমাণ কমিবে এরূপ আশা করা যায়।
এই প্রস্তাবটি একবারে নূতন বলা যায় না। ১৯৪০ সনের ২৪শে মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের যে অধিবেশনে পাকিস্তান-গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয় তাহাতে দাবি করা হয় যে, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তের মুসলমানগরিষ্ঠ অঞ্চলে পৃথক পৃথক স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হউক। গুরুত্ববিধায় মূল প্রস্ত বিটির প্রয়োজনীয় অংশ নিম্নে উদ্ধৃত হইল :
“That the areas in which the Muslims are numerically in a majority … should be grouped to constitute ‘Independent States’ in which the ‘Constitutent Units’ shall be autonomous and sovereign …”
কিন্তু ক্যাবিনেট মিশন আসিবার পর হইতেই লীগ দাবি করে যে, উত্তরভারতের এই সকল অঞ্চলই একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হউক। যখন স্বাধীনতালাভ আসন্ন হইল তখন মুসলমানদের পক্ষ হইতে সুরাওয়ার্দি এবং হিন্দুদের পক্ষ হইতে শরশ্চন্দ্র বসু–এই দুইজন নেতা হইলেন। তাঁহারা এই প্রস্ত বিটির সমর্থক-উদ্যোক্তা বলিলেও চলে। মহাত্মা গান্ধীও ইহার মোটামুটি সমর্থক। ছিলেন বলিয়াই মনে হয়; তবে অন্যান্য অনেক বিষয়ের ন্যায় এ-বিষয়েও গান্ধীজি
স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে প্রকাশ্যে কোন মতামত প্রকাশ করেন নাই। অন্ততঃ প্রথমে প্রতিবাদ করেন নাই, যদিও পূর্বোক্ত নেতারা তাহার সহিত এ-বিষয়ে আলোচনা ও পরামর্শ করিয়াছিলেন। অতঃপর এই তিনজনের অভিমত সম্বন্ধে তাঁহাদের নিজেদের উক্তিই উদ্ধৃত করিব। তৎপূর্বে প্রস্তাবটি ঠিক কী ছিল তাহার আভাস দিতেছি।
চিত্তরঞ্জন দাশ যে হিন্দু-মুসলিম চুক্তিপত্র (pact) করিয়াছিলেন প্রথমে প্রধানতঃ তাহার ভিত্তিতেই স্বাধীন অখণ্ড বঙ্গরাজ্যের পরিকল্পনা হইয়াছিল। কিন্তু অনেক বিশিষ্ট হিন্দুনেতা ইহার বিরুদ্ধে আপত্তি করিয়া বলিয়াছেন যে, ইহাতে প্রকারান্তরে হিন্দুর উপর মুসলমানের প্রাধান্য স্বীকৃত হইয়াছে, কারণ ইহাতে পৃথক ভোট দ্বারা নির্বাচিত বিধানসভার সদস্যসংখ্যা দুই সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যার অনুপাতে নির্ণীত হইবে এবং সরকারী চাকুরীর শতকরা ৫৫টি মুসলমানেরা পাইবে এইরূপ স্থির হইয়াছিল।
১৯৪৭ সনে সুরাওয়ার্দি ও শরৎ বসুর যৌথ প্রস্তাবে নিম্নলিখিত মৌলিক নির্দেশগুলি গৃহীত হইয়াছিল :
১. বঙ্গদেশ একটি স্বাধীন রাজ্য হইবে। ভারতের অন্য রাজ্যের সহিত ইহার কী সম্বন্ধ হইবে তাহা এই রাজ্য ঠিক করিবে। তবে বিধানসভার দুই-তৃতীয়াংশের ভোট ভিন্ন ইহা ভারত বা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হইতে পারিবে না।
২. বিধানসভার নির্বাচনে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী ভোট দিতে পারিবে। যৌথ ভোটদ্বারা লোকসংখ্যার অনুপাতে হিন্দু ও মুসলমান সদস্য নির্বাচিত হইবে।
এ-বিষয়ে গান্ধীজির দুইটি উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। প্রথমতঃ গান্ধীজি বলেন যে, তিনি এই প্রস্তাব সমর্থন করিবেন যদি বঙ্গদেশের প্রত্যেকটি হিন্দু প্রকাশ্যে বলিতে পারে (certify openly) যে, সে নির্ভয়ে বঙ্গদেশের যে-কোন স্থানে বাস করিতে পারিবে।
নোয়াখালিতে তখনও হিন্দুপীড়ন থামে নাই এবং কলিকাতা ও হাওড়া প্রভৃতি স্থানে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষের সংবাদ প্রচারিত হইয়াছে। সুতরাং গান্ধীজি স্পষ্ট করিয়া না বলিলেও তাঁহার এই উক্তি প্রস্তাবের বিরোধী বলিয়াই গ্রহণ করা যাইতে পারে। ৩রা জুন ক্যাবিনেট মিশনের ঘোষণার পাঁচদিন পর গুরগাঁও শহরে প্রার্থনান্তিক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “লোকে বলে, অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাজ্যের প্রস্ত বে আমার সমর্থন আছে বলিয়াই ইহা অনেকে অনুমোদন করিতেছে এবং শুনিয়াছি যে, এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট সংগ্রহের জন্য বহু অর্থ ব্যয় করা হইতেছে। আমি ঐক্যের জন্য মূল্য স্বীকার করি, কিন্তু অসদুপায়ে তাহা প্রতিষ্ঠা করিবার পক্ষপাতী নহি।
“শরৎ বসুর প্রস্তাব সমর্থন করার জন্য অনেকে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করিয়াছেন। শরত্যাবু আমার বন্ধু, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই এবং এই প্রস্তাব সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে পত্রবিনিময় হইয়াছে। কিন্তু অসদুপায়ে এবং প্রকাশ্যে যাহা করা যায় না আমি কোনদিন তাহা অনুমোদন করি না–সকার্যও অসদুপায়ে সম্পন্ন করার আমি বিরোধী।” এই সমুদয় উক্তি হইতে শরৎ বসুর প্রস্তাব সম্বন্ধে গান্ধীজির মতামত নির্ণয় করা কঠিন।
শরৎচন্দ্র বসু সর্বশ্রেণীর বাঙ্গালীরই শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁহার অক্লান্ত ও অকৃত্রিম দেশসেবা এবং ইহার জন্য অপূর্ব স্বার্থত্যাগ ও সরকারের হাতে বহুবিধ কষ্ট ও লাঞ্ছনাভোগ বঙ্গবাসী কখনই বিস্মৃত হইবে না। সুতরাং, তাহার মতামত বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করিতেছি। পাবনা জেলার হিমায়েতপুরে এক সভায় তিনি যাহা বলেন ‘প্রবাসী’ পত্রিকা (১৩৫৩ চৈত্র, ৫৭৯ পৃষ্ঠা) হইতে তাহার সারমর্ম উদ্ধৃত করিতেছিঃ “কিছু লোকের ইচ্ছা যে বাংলা বিভক্ত হওয়া উচিত। নেতাজীর কাম্য ছিল বৃহত্তম ভারত ও বৃহত্তর বাংলা গঠন। আমি নিজেও শ্রীহট্ট, সিংহভূম, মানভূম ও পূর্ণিয়া প্রভৃতি বাংলা ভাষাভাষী জেলাসমূহ বাংলার সহিত যুক্ত করিতে চাহি। এই মনোরম বঙ্গদেশকে ভাগ করিবার জন্য যদি কোন চেষ্টা হয় তবে আমার এক শক্তিশালী আন্দোলন শুরু হইবে এবং সকল শ্রেণীর লোকই এই আন্দোলনে যোগ দিবেন। আমরা সকলেই বাঙ্গালী। পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা সম্মিলিতভাবেই বসবাস করিবেন। বাংলা কিম্বা ভারত বিভক্ত হউক ইহা আমরা চাহি না।”
কেন্দ্রীয় পরিষদের বাংলার সদস্যগণ সর্দার প্যাটেল ও পণ্ডিত নেহেরুর সহিত সাক্ষাৎ করেন। তাঁহারা এই মত প্রকাশ করেন যে, বাংলার জাতীয়তাবাদীদিগকে স্থির করিতে হইবে যে, তাঁহারা “সাম্প্রদায়িক সরকারের” অধীনেই থাকিবেন, না অন্যান্য কংগ্রেস প্রদেশের মত শক্তিশালী কেন্দ্রে যোগ দিবেন। কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য বলেন, প্রয়োজন হইলে বাংলাকে দুইটি স্বতন্ত্র প্রদেশে ভাগ করা যাইবে এবং ইহাতে কোন কিছুই বাধার সৃষ্টি করিবে না আমরা এ-বিষয়ে পূর্ণ আশ্বাস পাইয়াছি। কংগ্রেস আশা করে যে, বাংলার দুইটি প্রদেশই কেন্দ্রে যোগ দিবে। তবে লীগ গণপরিষদে যোগ না দেওয়ার দরুন উহা যদি সম্ভব না হইয়া উঠে, তবে পশ্চিমবঙ্গ অবশ্যই কেন্দ্রে যোগ দিবে।
প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দির এ-বিষয়ে অভিমত সম্বন্ধে পূর্বোক্ত শ্রীমাথুর তাঁহার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও বিশ্বস্ততার ফলে যাহা জানিতে পারিয়াছিলেন তাহা সংক্ষেপে যতদূর সম্ভব তাহার কথায় লিপিবদ্ধ করিতেছি :
“১৯৪৭, ২৭ এপ্রিল। দিল্লীতে সুরাওয়ার্দি সাংবাদিকগণের সঙ্গে আলোচনা করিবেন (press meet)। আমি দিল্লীতে হোটেলের লাউঞ্জে বসিয়া আছি, পুরাতন বন্ধু আলতফ হোসেনের সঙ্গে দেখা (আলতফ বাঙ্গালী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাংলায় চট্টগ্রাম ও সম্ভবতঃ অন্যান্য সরকারী কলেজের অধ্যাপক ও পরে নাজিমুদ্দীনের প্রযত্নে করাচী ‘ডন’ (Dawn) পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন)। অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা সম্বন্ধে তাঁহার মতামত জিজ্ঞাসা করায় বলিলেন, মুসলিম লীগ কখনই এই প্রস্তাব গ্রহণ করিবে না। কারণ, প্রথমতঃ ইহার প্রস্তাবক (sponsor) সহীদ সুরাওয়ার্দিকে জিন্না দুই চক্ষে দেখিতে পারেন না (Persona non grata)। দ্বিতীয়তঃ, দুই জাতিদুই দেশ, মুসলিম লীগের এই মূলনীতি ইহার বিরোধী। তৃতীয়তঃ, লিয়াকৎ আলি খ ইহার বিরোধী। তারপর আলতফ বলিলেন, এই প্রস্তাবের প্রধান পরিকল্পক ও পৃষ্ঠপোষক (Authors) দুইজন-সুরাওয়ার্দি যাহার অতীত নাই’ (has no past) এবং শরৎচন্দ্র বসু যাহার কোন ভবিষ্যৎ নাই, (has no future); সুতরাং তাহাদের মাল বাজারে অচল।
“সন্ধ্যার সময় সাংবাদিকদের সভায় সুরাওয়ার্দি, আবেগপূর্ণ ভাষায় হিন্দুদের কাছে আবেদন করিলেন, অখণ্ড বঙ্গদেশের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। আমি অঙ্গীকার করিতেছি যে, ভবিষ্যৎ বর্তমানের ন্যায় হইবে না। ইহার সম্পদ সুখ শান্তি একটি বৃহৎ মহান জাতির উপযুক্ত হইবে। হিন্দুগণ পূর্বের কথা ভুলিয়া এই প্রস্তাব গ্রহণ করিলে আমি তাহাদের আশা ও দাবি পুরাপুরি মিটাইয়া দিবার অঙ্গীকার করিতেছি। আপনারাই বলুন, আমরা সকলে মিলিয়া এমন একটি শাসননীতি কি উদ্ভাবন করিতে পারি না যাহাতে সকল শ্রেণীর ও সম্প্রদায়ের লোকই সন্তুষ্ট হইবে এবং যাহার ফলে বাংলার প্রাচীন গৌরব ও ঐশ্বর্য আবার ফিরিয়া আসিবে।” একজন সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার কল্পনাপ্রসূত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হইলে ভবিষ্যতে কখনও ইহা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হইবে না–আপনি কি এই প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাস দিতে পারেন? সুরাওয়ার্দি উত্তর দিলেন, আমি তাহা কী করিয়া বলিব? স্বাধীন বঙ্গদেশ তাহার নিজের সংবিধান গঠন করিবে এবং ইহার বিধানসভাই এই সমুদয় বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে। আর একজন প্রশ্ন করিলেন, আপনি বঙ্গদেশ সম্বন্ধে যাহা বলিলেন, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সহিত মিলিত হইয়া সমগ্র ভারত সম্বন্ধে সেইরূপ একটি অখণ্ড রাজ্যের প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করুন না কেন?
সুরাওয়ার্দি ইহার সোজাসুজি কোন উত্তর না দিয়া কেবলমাত্র বলিলেন, আমি কেবল বাংলা সম্বন্ধে বলিতেছি এবং আমার ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করিতেছি। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নেতারা আছেন।
এই প্রসঙ্গে বলা যাইতে পারে যে, মুসলিমসম্প্রদায়ের নেতা জিন্নাও অখণ্ড বঙ্গরাজ্যের প্রস্তাবে সুরাওয়ার্দিকে বলিয়াছিলেন, যদি তোমার প্রস্তাবে ভবিষ্যতে বঙ্গদেশের ভারতের সঙ্গে যুক্ত হইবার কোন উপায় বা সম্ভাবনা মাত্রও থাকে, তাহা হইলে আমি উহা আলোচনা ও বিবেচনার অযোগ্য বলিয়া মনে করি।
সুরাওয়ার্দি সাংবাদিকদের সভায় পূর্বোক্ত প্রশ্নের সোজা উত্তর না দিলেও প্রকারান্তরে তাঁহার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে এইপ্রকার আপত্তি নিরসনের উদ্দেশ্যে বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার প্রস্তাবিত অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গরাজ্যে বর্তমান বঙ্গদেশের সঙ্গে মানভূম, সিংহভূম, সম্ভবতঃ পূর্ণিয়া এবং আসামের সুর্মা উপত্যকা ও অন্যান্য অংশ যুক্ত হইবে এবং ইহার ফলে মুসলিম ও হিন্দু অদিবাসীদের সংখ্যার মধ্যে খুব বেশী ব্যবধান থাকিবে না।
শ্ৰীযুক্ত মাথুর উদ্ধৃত বিবৃতিতে সুরাওয়ার্দির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সহানুভূতি দেখাইলেও ইহা যে একটি অবাস্তব কল্পনামাত্র তাহাও স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু উপসংহারে একটি গুপ্ত কাহিনী ব্যক্ত করিয়া সুরাওয়ার্দির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নিজেও সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন, অপরের মনেও সন্দেহের উদ্রেক করিয়াছেন। কাহিনীটি তাহার কথাতেই বলিতেছি।
“আমি প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দির সেক্রেটারি আসগার আলি শাহর (অর্থাৎ আই.এস.এস.) সঙ্গে কথাবার্তা বলিতেছিলাম, এমন সময় চাপরাশি একখানি কাগজে লেখা একটি বাণী (message) আনিয়া দিল-ইহা এখনই তারযোগে পাঠাইতে হইবে। পড়িয়া দেখিলাম, পাটনার মুসলমান ছাত্রেরা একটি সভা (Convention) ডাকিয়াছে। তাহাদের উদ্দেশ্য, বিহার প্রদেশ দুইভাগে বিভক্ত করিয়া একভাগ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির দাবি জানাইবে। সুরাওয়ার্দি এই বাণীতে ঐ উদ্দেশ্যকে স্বাগত জানাইয়া যাহা লিখিয়াছেন তাহার মোটামুটি মর্ম এই : মুসলমানদের আত্মপ্রকাশ ও আত্মোন্নতির জন্য একটি নিজস্ব বাসস্থানের প্রয়োজন (The Muslims need a homeland of their own and the freedom for self expression and self-realisation. I strognly endorse… the demand of Behar Muslim Students Convention)। আমি এই বাণীটি পড়িয়া আসগর আলিকে বলিলাম, যদি সুরাওয়ার্দির মনের ভাব এইরূপই হয়, তবে অখণ্ড বঙ্গদেশ সম্বন্ধে যাহা প্রচার করিতেছেন তাহা ভণ্ডামি (hoax) বলিয়াই বিবেচিত হইবে। আমার মত জিজ্ঞাসা করিলে আমি তাঁহাকে এইরূপ বাণী পাঠাইতে নিষেধ করিতাম। শাহ ইহা শুনিয়া খুব বিচলিত (upset) হইলেন এবং ছুটিয়া প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে গেলেন। কয়েক মিনিট পরে ঐ ঘরে আমার ডাক পড়িল। শহীদ সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি ইহা পছন্দ কর না? আমি ধীরভাবে বলিলাম, স্যার, আমার পছন্দ-অপছন্দে কিছু যায় আসে না; কিন্তু ডক্টর (শ্যামাপ্রসাদ) মূখার্জীর ইহা খুবই পছন্দ হইবে। তিনি আমার কথার ইঙ্গিত বুঝিলেন। বলিলেন, তুমি ঠিকই বলিয়াছ। তারপর বাণী (কাগজটি) ছিঁড়িয়া ফেলিয়া বলিলেন, তোমার কথা ঠিক, আমি মূর্খের মত কাজ করিতে যাইতেছিলাম (I was going to make a fool of myself)। আমি ঐ কক্ষ ত্যাগ করিয়া আসিলাম, কিন্তু আমার মনে নানাবিধ চিন্তার উদয় হইল। ভাবিলাম, তবে কি শহীদ সাহেব জিন্নার মনস্কামসিদ্ধির জন্যই বাঁকাচোরা পথ দিয়া বঙ্গদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছায় এই অভিনয় করিতেছেন? ভাবিয়া প্রাণে আঘাত পাইলাম।”
উল্লিখিত বিবরণ হইতে বোঝা যায় যে, অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের পরিকল্পনা ও আলোচনা প্রধানতঃ সুরাওয়ার্দি, শরৎ বসু ও গান্ধীজির মধ্যেই চলিতেছিল। মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা ইহার ঘোরতর বিরোধী ছিল। ভারত-বিভাগ স্থির হইবার পূর্বেই হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী দাবি করেন যে, অবিভক্ত ভারতবর্ষে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা দুইটি পৃথক প্রদেশে বিভক্ত হউক (১৯শে মার্চ, ১৯৪৭)। যখন ভারত-বিভাগ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ গ্রহণ করিল তখন এই বিষয়টি বাংলার মুসলিম নেতাদের বিশেষ চিন্তা ও উদ্বেগের কারণ হইল। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ পৃথক হইলে রাজনীতি ও অর্থনীতি-ব্যাপারে বঙ্গদেশের মেরুদণ্ড কলিকাতা শহর এবং পাটের কল, কয়লার খনি, এবং লৌহের কারখানা প্রভৃতি সমুদয়ই পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়িবে। সম্ভবতঃ এই বিপদের আশঙ্কা অখণ্ড বঙ্গদেশে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার প্রেরণা যোগাইয়াছিল। পূর্ববঙ্গের কোন কোন হিন্দুনেতাও সম্ভবতঃ অনেকটা ঐ কারণেই এই প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছিলেন। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ও কিরণশঙ্কর রায় এ-বিষয়ে গান্ধীজির সঙ্গে পরামর্শ করেন। গান্ধীজির নির্দেশে কিরণশঙ্কর রায় বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বড়লাট বলেন যে, যদি মুসলিম লীগ যৌথ নির্বাচন, যৌথ মন্ত্রীসভা এবং সরকারী চাকুরীতে সমানসংখ্যক হিন্দু-মুসলমানের নিয়োগ–এই তিনটি দাবি গ্রহণ করে তাহা হইলে স্বাধীন অখণ্ড বঙ্গদেশের প্রস্তাব গ্রহণ করাই উচিত। কিন্তু এই প্রস্তাব কার্যে পরিণত হয় নাই। সম্ভবতঃ মুসলিম লীগ ঐ তিনটি শর্ত গ্রহণ করতে রাজী হয় নাই।
অতঃপর শরৎচন্দ্র বসু অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গদেশ রাষ্ট্রের প্রস্তাব লইয়া গান্ধীজির সহিত আরেকবার সাক্ষাৎ করেন; কোন কোন বার সুরাওয়ার্দি এবং বঙ্গদেশের মুসলিম লীগের সেক্রেটারী আবুল হাসেমকে সঙ্গে লইয়া গিয়াছেন। হাসেম বলিলেন, “ভাষা, সংস্কৃতি ও অতীত ইতিহাস বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্যের চিরস্থায়ী বন্ধন প্রতিষ্ঠা করিয়াছে–হিন্দু ও মুসলমান আমরা সকলেই বাঙ্গালী; সুতরাং হাজার মাইল দূর হইতে পাকিস্তান আমাদের শাসন করিবে ইহা ঘৃণার বিষয়।” গান্ধীজি ইহা শুনিয়া খুশী হইলেন। হাসেমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা, যদি পাকিস্তান ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রচারের জন্য স্বাধীন বঙ্গদেশকে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের সহিত যুক্তরাজ্য (Voluntary Federation) গঠনের জন্য আহ্বান করে, তবে কি স্বাধীন অখণ্ড বঙ্গদেশ তাহা প্রত্যাখ্যান করিবে?” হাসেম ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোন উত্তর দিলেন না। চুপ করিয়া রহিলেন। গান্ধীজি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি যে বাঙ্গালীর সংস্কৃতির কথা বলিলেন, তাহার মূল উৎস উপনিষদে এবং বর্তমান যুগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাহাকে মূর্ত করিয়াছেন তাহা কেবল বঙ্গদেশের নহে, সর্বভারতীয় সংস্কৃতি-সুতরাং স্বাধীন অখণ্ড বঙ্গদেশ কি ভারতের সঙ্গে স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান গ্রহণ করিবে?” এবারও হাসেম চুপ করিয়া রহিলেন। সুরাওয়ার্দি গান্ধীর দ্বিতীয় প্রস্তাবে সম্মত হইয়া গান্ধীজিকে অনুরোধ করিলেন যাহাতে বঙ্গদেশ বিভক্ত না হয় তাহার ব্যবস্থা করিতে। কিন্তু তখন কলিকাতা ও নোয়াখালি হত্যাকাণ্ডের ফলে হিন্দুরা সুরওয়ার্দির উপর অত্যন্ত বিরূপ ছিল এবং তাঁহার প্রতিশ্রুতির কোন মূল্য দিত না। সুতরাং গান্ধীজি সুরাওয়ার্দিকে বলিলেন যে, সর্বপ্রথম তিনি হিন্দুদের বিশ্বাসভাজন হইবার চেষ্টা করুন। কিন্তু শরৎচন্দ্র বসু অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের আশা ছাড়িলেন না। ১৯৪৭ সনের মে-মাসে তাঁহার বাড়ীতে এই বিষয়টি আলোচনার জন্য একটি ক্ষুদ্র কনফারেন্স হইল। উপস্থিত ছিলেন সুরাওয়ার্দি, আবুল হাসেম, ঢাকার ফজলুর রহমান, বগুড়ার মহম্মদ আলি, কিরণশঙ্কর রায়, সত্যরঞ্জন বকসী প্রভৃতি কয়েকজন। আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হইল এবং শরৎ বসু ও আবুল হাসেম ইহাতে স্বাক্ষর করিয়া পাটনায় গান্ধীজির নিকট পাঠাইলেন (২৩শে মে, ১৯৪৭)।
ইতিপূর্বে মহাত্মা গান্ধী যখন সোদপুরে ছিলেন তখন তিনি শরৎ বসু ও মুসলিম নেতাদের বলিয়াছেন যে, অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি হইবে এই যে, যে-কোন গুরুতর বিষয়ে মন্ত্রীসভা ও বিধানসভার হিন্দু ও মুসলমান সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতি না থাকিলে কোন প্রস্তাব গৃহীত হইবে না। ইহার উল্লেখ করিয়া তিনি শরৎচন্দ্র বসুকে পত্র লিখিলেন, “তাঁহাদের বর্তমান প্রস্তাবগুলির মধ্যে এইপ্রকার কোন কথাই নাই, বাংলার হিন্দু ও মুসলমানের সংস্কৃতি যে অভিন্ন এরূপ কোন অভিব্যক্তি বা স্বীকৃতি নাই। আর কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ যে এই প্রস্তাব মানিয়া লইবে সে-বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তবে আমি কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক সমিতির নিকট এই প্রস্তাব উপস্থিত করিব।”
এই পত্র পাইয়া শরৎ বসু সুরাওয়ার্দির সহিত গান্ধীর চিঠিতে লিখিত বিষয়গুলি আলোচনা করিলেন, কিন্তু কোন সন্তোষজনক উত্তর পাইলেন না। ইতিমধ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই বড়লাটের ৩রা জুনের উক্তি অনুসারে বঙ্গদেশ ও পঞ্জাবের বিভাগ মানিয়া লইলেন। শরৎ বসু তথাপি আশা ছাড়িলেন না। তিনি ওই জুন দিল্লীতে গান্ধীজির সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। ৮ই জুন গান্ধীজি শরৎ বসুকে লিখিলেন, “তোমাদের অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের প্রস্তাব পণ্ডিত নেহেরু ও সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে আলোচনা করিয়াছি। উভয়েই ইহার ঘোরতর বিরোধী। তাঁহাদের মতে ইহা বর্ণহিন্দু ও তপশীলভুক্ত হিন্দুদের মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি করার একটি কৌশলমাত্র। তাঁহারা ইহা কেবল সন্দেহ করেন না, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন।”
কিন্তু শরৎ বসু তথাপি আশা ছাড়িলেন না। তিনি দিল্লীতে জিন্নার সঙ্গে দেখা করেন এবং ৯ই জুন কলিকাতা হইতে তাঁহাকে চিঠি লিখিয়া অনুরোধ করিলেন যে, তিনি যেন বাংলার বিধানসভার মুসলমান সদস্যগণকে পাকিস্তানে যোগদান করার বিরুদ্ধে ভোট দিতে নির্দেশ দেন। বলা বাহুল্য, ইহাতে কোন ফল হইল না। পূর্ববাংলার মুসলমান ও হিন্দুগণ যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে যোগদান করার প্রস্তাব বিপুল ভোটাধিক্যে গ্রহণ করিলেন।
এই প্রসঙ্গ শেষ করার পূর্বে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সহিত সংশ্লিষ্ট আর-একটি প্রস্তাব সম্বন্ধেও কিছু বলা উচিত। বাংলার গভর্নর বারোস (Burrows) প্রস্তাব করেন যে, কলিকাতা শহর ও বন্দরটি বাংলাদেশ হইতে পৃথক করিয়া একটি স্বতন্ত্র এলাকা করা হউক (free city and portan industrial and commercial pocket)। ব্রিটিশরাজ ইহার একজন গভর্নর মনোনীত করিবেন। তাহার সাহায্যের জন্য একটি পরামর্শদাতা মন্ত্রণাসভা (Council of Advisers) থাকিবে। সমান সংখ্যক নির্বাচিত হিন্দু ও মুসলমান এবং বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের একজন করিয়া মনোনীত সদস্য লইয়া এই সভা গঠিত হইবে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সনের জুন মাসে কলিকাতার অধিবাসীরা ভোট দিয়া স্থির করিবে যে, কলিকাতার ভবিষ্যৎ কী হইবে, অর্থাৎ ইহা ভারত অথবা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হইবে অথবা পৃথক স্বতন্ত্র একটি স্বাধীন নগরী হইবে। এই সময় কলিকাতা শহরে বিশ হাজার ও বাংলার অন্যান্য স্থানে পাঁচ হাজার বিদেশী (অ ভারতীয়) ছিল এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেও ছিল প্রধানতঃ অবাঙ্গালী ভারতীয় ও বিদেশী, বিশেষতঃ ইংরেজের হাতে। লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান বাঙ্গালীর স্বার্থ উপেক্ষা করিয়া প্রধানতঃ এইসব বিদেশীদের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াই যে এই পরিকল্পনার উদ্ভব হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু গভর্নরকে মুখপাত্র করিয়া নেতৃস্থানীয় কে বা কাহারা ইহার পশ্চাতে ছিলেন তাহা সঠিক জানা যায় নাই। তবে এ প্রস্তাব যে হিন্দু বা মুসলমান জনসাধারণ সমর্থন করে নাই তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
বঙ্গবিভাগ প্রস্তাব গৃহীত হইবার পর ৩রা জুলাই (১৯৪৭) পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি মন্ত্রীসভা গঠিত হইল। প্রধানমন্ত্রী হইলেন ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। ১৫ই অগষ্ট পর্যন্ত সুরাওয়ার্দি-মন্ত্রীসভা অবিভক্ত বঙ্গদেশ শাসন করিবে এবং তাহার পর ইহার আদেশ ও নির্দেশ কেবলমাত্র পূর্ববঙ্গের সম্বন্ধেই বলবৎ হইবে। পশ্চিমবঙ্গের সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে প্রফুল্ল ঘোষের মন্ত্রীসভার অনুমোদন প্রয়োজন হইবে। যদিও সুরাওয়ার্দি তখন আইনতঃ প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু পূর্ববঙ্গে নূতন প্রদেশ হইলে তাহার পরিবর্তে নাজিমুদ্দিনকেই বাংলার মুসলিম লীগ দল প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করিয়াছিলেন।
১৫ই অগষ্ট স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ফলে নোয়াখালিতে পুনরায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে, অর্থাৎ হিন্দুনিধনের আশঙ্কা করিয়া গান্ধী পুনরায় নোয়াখালি যাওয়া স্থির করিলেন। হৃতসর্বস্ব নোয়াখালির হিন্দুগণ যাহাতে তাহার অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন-নীতি অনুসরণ করে সে-বিষয়ে প্রথমবার অকৃতকার্য হইলেও তিনি পুনরায় সেই চেষ্টা করিতে মনস্থ করিলেন। তাঁহার ভক্ত ও অনুরক্ত সহচর ঁ নির্মলকুমার বসু এই মত প্রকাশ করিয়াছেন।
“কলিকাতায় পৌঁছিয়া গান্ধী সোদপুর আশ্রমে গেলেন (৯ই অগষ্ট, ১৯৪৭)। গান্ধীভক্ত প্যারেলাল তাহার বিরাট গ্রন্থে এই সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাহার সারমর্ম দিতেছি :
১৬ই অগষ্ট (১৯৪৬) প্রত্যক্ষ সংগ্রাম উপলক্ষে বিরাট হত্যাকাণ্ডের পরও কলিকাতায় কখনো প্রকৃত শান্তি বিরাজ করে নাই। সেই হত্যার স্মৃতি কোন সম্প্রদায়েরই মন হইতে মুছিয়া যায় নাই এবং ইহার ফলে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিকাণ্ড, বন্দুক ও রিভলবার ব্যবহার, বোমা ও অ্যাসিড নিক্ষেপ দ্বারা হত্যা প্রভৃতি প্রায় দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হইয়াছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে হিন্দু মুসলমানপাড়ায় এবং মুসলমান হিন্দুপাড়ায় যাইতে ভরসা পাইত না।”
গান্ধীজি সোদপুর আশ্রমে আসিবার অল্পক্ষণ পরেই মুসলিম নেতা মহম্মদ ওসমান ও আর একজন মুসলমান গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করিয়া বলিলেন, মুসলমান সরকারী কর্মচারীরা পূর্ববাংলায় বদলি হওয়ার পর হিন্দুরা স্থির করিয়াছে যে এবার মুসলমানদের অত্যাচারের প্রতিশোধ লইতে হইবে। একমাত্র গান্ধীজিই এখন কলিকাতার মুসলমানদের রক্ষা করিতে পারেন। কলিকাতায় যে আগুন জ্বলিয়াছে তাহা নিভাইবার জন্য তাঁহারা গান্ধীজিকে কয়েকদিন কলিকাতায় থাকিতে অনুরোধ করিলেন। সেইদিন বৈকালে প্রার্থনাসভায় মহাত্মা কেবল কলিকাতার পরিস্থিতি লইয়াই আলোচনা করিলেন–বলিলেন, সারা দিনই মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনিয়াছেন। লীগ মন্ত্রীসভার আমলে হিন্দুদের উপর কী অত্যাচার হইয়াছে তিনি তাহার অনুসন্ধান করিতে চাহেন না। ডাক্তার প্রফুল্ল ঘোষের মন্ত্রীসভার আমলে যদি মুসলমানদের ভয়ে ভয়ে কলিকাতায় বাস করিতে হয় তাহা হইলে মন্ত্রীসভার কলঙ্ক।
পরদিন মহম্মদ ওসমান পুনরায় আসিয়া গান্ধীকে অন্ততঃ আরও দুইদিন কলিকাতায় থাকিতে অনুরোধ করিলেন। গান্ধী বলিলেন, “আমি থাকিতে পারি যদি তোমরা আমাকে গ্যারান্টি দাও যে আমি নোয়াখালি না গেলে যদি মুসলমানেরা হিন্দুর উপর অত্যাচার করে তাহা হইলে আমি অনশনে প্রাণত্যাগ করিব এবং ইহার জন্য তোমরাই দায়ী হইবে।” কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করিয়া ওসমান অবশেষে রাজী হইয়া বলিলেন, “আমরা গোলাম সারওয়ার এবং তাহার সহযোগী কাশেম আলিকে টেলিগ্রাম করিব এবং শান্তিরক্ষার জন্য লোক পাঠাইব। অতঃপর গান্ধীজি ১১ই অগষ্টের পরিবর্তে ১৩ই অগষ্ট (১৯৪৭) নোয়াখালি যাইবেন এই ব্যবস্থা হইল।
১১ই অগষ্ট শহীদ সুরাওয়ার্দি করাচী হইতে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলেন এবং গান্ধীজিকে অনুরোধ করিলেন যে যতদিন কলিকাতায় শান্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত
হয় ততদিন তিনি কলিকাতায় থাকুন। গান্ধী বলিলেন, যেসব পাড়ায় হিন্দু মুসলমানের মারামারি চলিতেছে, যদি সুরাওয়ার্দি সেইসব পাড়ায় কোন বাড়ীতে পুলিশ বা সৈন্য না রাখিয়া একাকী গান্ধীর সঙ্গে একত্রে বসবাস করিতে রাজী হন। এবং তাঁহার সহিত একযোগে অকপটভাবে দুই সম্প্রদায়ের লোকের সহিত কথাবার্তা বলিয়া তাহাদের শান্তির পথে আনিতে প্রস্তুত থাকেন, তবে যতদিন কলিকাতায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হয় ততদিন তিনি এখানে থাকিবেন। সুরাওয়ার্দি সম্মত হইলেন। স্থির হইল, গান্ধী ১৩ই অগষ্ট বিকালে হায়দারী ম্যানসন’ নামে বেলিয়াঘাটার এক পোড় ভাঙ্গা বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করিবেন। কথা ছিল, সুরাওয়ার্দি ও গান্ধী ঠিক আড়াইটার সময় সোদপুর হইতে যাত্রা করিবেন, কিন্তু সুরাওয়ার্দি যথাসময়ে না-পৌঁছায় গান্ধীজি একাই রওনা হইলেন।
বেলিয়াঘাটার বাড়ীর ফটকে পৌঁছিয়া দেখিলেন, একদল যুবক কালো পতাকা লইয়া দাঁড়াইয়া আছে-কাগজে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে, এবং তাহারা চীৎকার করিয়া বলিতেছে, “আপনি এখানে আসিয়াছেন কেন? মুসলমানেরা যখন হিন্দুকে মারিতেছিল তখন আপনি আসেন নাই–এখন মুসলমানেরা বিপদে পড়িয়া আপনার কাছে নালিশ করিয়াছে, আপনি অমনি আসিয়া এইসব ন্যাকামি আরম্ভ করিয়াছেন (all this fuss is being made over it)। কেবল মুসলমানদের স্বার্থ না দেখিয়া কাঁকুড়গাছি, উল্টাডাঙ্গা প্রভৃতি যেসব অঞ্চল হইতে সমস্ত হিন্দুরা বিতাড়িত হইয়াছে সেসব জায়গায় গিয়া দেখুন।” নির্মল বসু অতিকষ্টে গান্ধীকে বাড়ীর মধ্যে লইয়া গেলেন।
ইতিমধ্যে সুরাওয়ার্দির গাড়ী আসিয়া পৌঁছিল এবং উত্তেজিত জনতা তাঁহার গাড়ী ঘেরাও করিল। ব্যাপারটি আশঙ্কাজনক হইয়া উঠায় গান্ধীজি বলিয়া পাঠাইলেন যে, যুবকদের কয়েকজন প্রতিনিধি তাঁহার ঘরে আসিলে তিনি এ বিষয়ে আলোচনা করিতে প্রস্তুত আছেন। তাহারা যেন গোলমাল না করে। কয়েকজন যুবক ও সুরাওয়ার্দি তখন বাড়ীতে ঢুকিলেন। বাহিরে অনবরত চীৎকার হইতে লাগিল–”গান্ধী ফিরিয়া যাও”। বাহিরের কয়েকজন গান্ধীজি যে-ঘরে বসিয়াছিলেন সেই ঘরের জানালা বাহিয়া উঠিয়া ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়া দেখিতে লাগিল। গান্ধীর পার্শ্বচরেরা অনুনয়-বিনয় করা সত্ত্বেও তাহারা না থামায় ভিতর হইতে জানালা বন্ধ করা হইল। ফলে হিতে বিপরীত হইল। বাহির হইতে ঢিলছোঁড়া আরম্ভ হইল। জানালার কাঁচ চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া কাঁচের টুকরা ঘরময় ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল। তখন কাঠের পাল্লা বন্ধ করিয়া কক্ষের লোকেরা আত্মরক্ষা করিল।
ইতিমধ্যে যুবকদলের প্রতিনিধিরা আসিয়া প্রথমেই প্রশ্ন করিল, “গত বৎসর মুসলমানদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সময় আপনি হিন্দুদের সাহায্যার্থে অগ্রসর হন নাই। আর আজ মুসলমান-পাড়ায় ছোটখাট হাঙ্গামার খবর শুনিয়াই আপনি তাহাদের সাহায্যের জন্য ছুটিয়া আসিয়াছেন। আপনি এখানে থাকিবেন ইহা আমরা চাই না।” প্রত্যুত্তরে গান্ধী বলিলেন, ১৯৪৬ সনের প্রতিশোধ ১৯৪৭ সনে লইয়া কী লাভ হইবে? তারপর অহিংসা ও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রীতির বন্ধন সম্বন্ধে মামুলি ধরনের সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়া উপসংহারে বলিলেন, “আমি বলিয়াছি নোয়াখালিতে হিন্দুর উপর অত্যাচার হইলে আমি অনশনে প্রাণ বিসর্জন করিব; সুতরাং প্রকারান্তরে হিন্দুকে রক্ষা করিবার দায়িত্ব এখন শহীদ সুরাওয়ার্দি এবং গোলাম সারওয়ার প্রভৃতি তাঁহার বন্ধুরাই গ্রহণ করিয়াছেন। এটি কম কথা নয়।” যুবকেরা উত্তর করিল, “আমরা অহিংসার উপর ধর্মাত্মক বক্তৃতা (Sermons) শুনিতে চাই না। আপনি চলিয়া যান–আমরা এখানে মুসলমানদের বাস করিতে দিব না।” গান্ধী বলিলেন, “তোমরা আমাকে সাহায্য করিলে আমি সমস্ত বিতাড়িত হিন্দুকে পুনরায় তাহাদের নিজ বাড়ীঘর ফিরিয়া পাইবার ব্যবস্থা করিতে পারি। অপরপক্ষে পুরানো অপরাধের ও শত্রুতার কথা মনে পুষিয়া রাখিলে কিছু লাভ হইবে না।”
এই সময় আঠারো বছরের একটি যুবক বলিয়া উঠিল, “ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সদ্ভাব থাকিতে পারে না।” গান্ধী উত্তর দিলেন, “তোমাদের সকলের চেয়ে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ জ্ঞান আমার অনেক বেশী। আমি জানি হিন্দুরা মুসলমানদের ‘চাচা’ বলে এবং হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের ধর্ম উৎসবে ও বিবাহাদি শুভকার্যে যোগ দেয়।”
যুবকটি কী উত্তর দিয়াছিল প্যারেলাল তাহা লেখেন নাই। কিন্তু এই গ্রন্থের লেখকের নিকট একাধিক ব্যক্তি বলিয়াছেন যে, প্রতিবেশী এইসব চাচারাই প্রতিবেশী হিন্দুর হত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারীধর্ষণের ব্যাপারে সানন্দে যোগ দিয়াছে। ১৮ বৎসরের যুবকের মুখ দিয়া যে ঐতিহাসিক সত্যের কথা বাহির হইয়াছিল-ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস যাঁহারা অপক্ষপাত মনোযোগের সহিত পাঠ করিয়াছেন তাহারাই তাহার সমর্থন করিবেন।
এইভাবে রাত্রি আটটা পর্যন্ত তর্কবিতর্ক চলিল। পরদিনও ইহার পুনরাবৃত্তি হইল। প্যারেলাল লিখিয়াছেন যে, যুবকেরা পরে গান্ধীর প্রতিশ্রুতিতে সন্তুষ্ট হইয়া ফিরিয়া গেল। গান্ধী তাহাদের মন পুরাপুরি জয় করিলেন (Compeletely won over)। কিন্তু, ঐদিনই (১৪ই অগষ্ট) সান্ধ্য উপাসনার সময় যাহা ঘটিয়াছিল প্যারেলালের গ্রন্থ হইতেই তাহা উদ্ধৃত করিতেছি।
“গান্ধীজির সান্ধ্য প্রার্থনাসভা বাড়ীর আঙ্গিনার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হইতেছিল। শ্রোতার সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশী। গান্ধী বলিতেছিলেন, যেসব মুসলমানেরা বাড়ী ছাড়িয়া পলাইতে বাধ্য হইয়াছিল তাহারা ফিরিয়া আসুক। যদি কলিকাতার বিশ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান এইরূপ পরস্পরের শত্রুভাবাপন্ন হয় (are at daggers drawn) আমি কোন্ মুখে নোয়াখালি যাইয়া হিন্দু-মুসলমানের মিলনের আবেদন করিব…? এমন সময় জনতার মধ্য হইতে তুমুল চীৎকার আরম্ভ হইল ‘সুরাওয়ার্দি কোথায়? গান্ধীজি বলিলেন, তিনি গোলমালের আশঙ্কায় সভায় আসেন নাই, কিন্তু আজ তোমাদের যেমন শান্ত দেখিতেছি তাহাতে কাল হইতে তাঁহাকে এই সভায় যোগদান করিতে বলিব। যেই প্রচারিত হইল যে সুরাওয়ার্দি সভায় নাই, অমনি বিশাল জনতার একেবারে পশ্চাদ্ভাগের একদল যুবক স্থির করিল যে, তাঁহাকে আক্রমণের ইহাই সুবর্ণ সুযোগ। সুরাওয়ার্দির রক্ত চাই’ চীৎকার করিতে করিতে তাহারা বাড়ীর দিকে অগ্রসর হইল। আবার ঢিলছেঁড়া আরম্ভ হইল। দরজা জানালা বন্ধ ছিল; কিন্তু মনে হইল, এক্ষনি ভাঙ্গিয়া পড়িবে। গান্ধীজি সান্ধ্যসভা হইতে ফিরিয়া আসিলে ঢিলছোঁড়া বন্ধ হইল; কিন্তু চীৎকার থামিয়া গেল না। গান্ধীজি একটি জানালা খুলিয়া যুবকদিগকে প্রথমে ভর্ৎসনা, পরে শান্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। বলিলেন, আমি ও সুরাওয়ার্দি একসঙ্গে কাজ করিতেছি–তোমরা যখন আমার সঙ্গে কাজ করিতে রাজী হইয়াছ তখন সুরাওয়ার্দির সঙ্গেও একযোগে কাজ করিবে, কারণ আমরা অভিন্ন (The two were as one) জনতা চীৎকার করিতে লাগিল, রাওয়ার্দি কোথায়? তিনি আমাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলে আমরা যাইব না। একজন সুরাওয়ার্দির বিশ্বস্ততার অভাব সম্বন্ধে মর্মভেদী বিদ্রূপ (caustic remark) করিলে গান্ধী বলিলেন, তিনি বিশ্বাসী ও অকপট না হইলে আমার সঙ্গে বেশীদিন থাকিতে পারিবেন না। শীঘ্রই সরিয়া পড়িবেন। কিছুক্ষণ পরে সুরাওয়ার্দি আসিয়া জনতার সম্মুখে দাঁড়াইলেন। জনতার ভিতর হইতে একজন বলিল, কলিকাতার অগষ্ট হত্যাকাণ্ডের জন্য আপনিই কি দায়ী নন? সুরাওয়ার্দি বলিলেন, হ্যাঁ আমরা সকলেই দায়ী। তখন প্রশ্নকর্তা বলিল, আমার প্রশ্নটির সোজা উত্তর দিবেন কি? উত্তর-হ্যাঁ আমিই দায়ী (It was my responsibility)
ইহার ফলে হিন্দু জনতা শান্ত হইল। মুসলমানদের মনোভাব পূর্বেই কিছু বদলাইয়াছিল। কলিকাতায় তাহারা সংখ্যায় লঘু এবং তাহাদের সহায়কারী মুসলমান মন্ত্রীও আর নাই; সুতরাং স্বাধীনতা দিবসে মিলিয়া-মিশিয়া কাজ করিতে তাহারা অগ্রসর হইল। ১৫ই অগষ্ট স্বাধীনতা দিবসে হিন্দু-মুসলমানদের ভ্রাতৃভাব ও সৌহার্দ্য দেখিয়া অনেকেই বিশ্বাস করিলেন যে, মহাত্মা গান্ধী যাদুবলে হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সম্ভাবনা দূর করিয়া অসাধ্য সাধন করিয়াছেন। সুরাওয়ার্দি বক্তৃতায় বলিলেন, অনেকে মনে করিতেন যে, হিন্দু-মুসলমানের মিলন কখনই হইবে না। কিন্তু, ভগবানের ইচ্ছায় ও গান্ধীজির কৃপায় তিন-চারদিন পূর্বেও যাহা অসম্ভব মনে হইত, তাহা যাদুবলে সম্ভব হইয়াছে। কিন্তু অতীতের পরিপ্রেক্ষিতে অভিজ্ঞ চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রেরই বোঝা উচিত ছিল যে, এই সাময়িক উচ্ছ্বাস জলের বুদবুদের মত মিলাইয়া যাইবে। অন্ততঃ গান্ধীজি নিজে ইহা বুঝিয়াছিলেন। ১৮ই অগষ্ট মীরাবেনের নিকট এক পত্রে তিনি লিখিলেন :
“এখানে জনতার খুব উল্লাস; কিন্তু আমি খুশী হইতে পারিতেছি না। হিন্দু মুসলমানের মিলন এত হঠাৎ ঘটিল যে ইহা কতদূর প্রকৃত সে-বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। লোকে মনে করে, আমিই ইহা ঘটাইয়াছি; কিন্তু আমি না থাকিলেও বোধ হয় ইহা ঘটিত-এই মিলন কতদূর অকৃত্রিম, কাল তাহা প্রমাণ করিবে (Time will show)।”
কিন্তু অশুভ লক্ষণ সেইদিনই দেখা দিল। সংবাদ আসিল, ব্যারাকপুর ও কাঁচড়াপাড়ায় হিন্দু-মুসলমানে সংঘর্ষ হইয়াছে। তবে তাহা শীঘ্রই মিটিয়া গিয়াছে।
ইহার পর বেশীদিন অপেক্ষা করিতে হইল না। ১৭ই অগষ্ট গান্ধী নিম্নলিখিত তারবার্তা পাইলেন : “গত সোমবার হইতে লাহোরে এরূপভাবে হিন্দুর হত্যাকাণ্ড আরম্ভ হইয়াছে যে তাহা পূর্ববর্তী রাওয়ালপিণ্ডির নৃশংস হিন্দুনিধন কাহিনীকেও অতিক্রম করিয়াছে। রাস্তায় শত শত মৃতদেহ পড়িয়া আছে। আনারকলি বাজার এবং অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের পল্লী অগ্নিতে ধ্বংস হইয়াছে। শহরের অধিকাংশ স্থানেই আগুন জ্বলিতেছে। হিন্দুদের পাড়ায় জলের নল কাটিয়া দিয়া জলসরবরাহ বন্ধ করা হইয়াছে। চারিদিক অবরোধ করিয়া পলায়নপর হিন্দুদিগকে পুলিশ ও সৈন্যদল গুলি করিয়া মারিতেছে, তিনশতেরও বেশী হিন্দু আগুনে পুড়িয়া মরিয়াছে। হিন্দুদের অন্ন ও জলের অভাব। তাহাদের ধ্বংস আসন্ন। আপনার উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন।”
পঞ্জাবের মারামারি ক্রমশঃই বাড়িয়া চলিল। পূর্ব পঞ্জাবে হিন্দু শিখেরা মুসলমানদের এবং পশ্চিম পঞ্জাবের মুসলমানেরা হিন্দু ও শিখদের হত্যা করিতে আরম্ভ করিল। দুই তরফা আক্রমণের ফলে লোকবিনিময়ের ব্যবস্থা আপনাআপনিই হইল। পশ্চিম পঞ্জাবের হিন্দু ও শিখের মধ্যে যাহারা পারিল পলাইয়া ভারতে আশ্রয় লইল-বাকী সব নিহত হইল। পূর্ব পঞ্জাবেও মুসলমানেরা হয় মরিল, নাহয় পলাইয়া বাঁচিল। মোটের উপর পূর্ব পঞ্জাব মুসলমানশূন্য ও পশ্চিম পাঞ্জাব হিন্দু ও শিখশূন্য হইল।
কলিকাতায়ও হিন্দু-মুসলমান মৈত্রীভাব স্বাধীনতা দিবসের মিলনোৎসবের পর বেশীদিন স্থায়ী হইল না। নোয়াখালিতে হিন্দুর প্রতি মুসলমানের বিদ্বেষের ভাব যে কিছুমাত্র কমে নাই, পূর্বোদ্ধত সরকারী রিপোর্ট তাহা প্রমাণিত করে। ঐ বিষয়ে প্যারেলাল তাঁহার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করিয়াছেন। নোয়াখালিতে গান্ধীর উপস্থিতি নিতান্ত প্রয়োজন মনে করিয়া প্যারেলাল ও চারু চৌধুরী কলিকাতায় আসিলেন (৩০শে অগষ্ট, ১৯৪৭)। ৩১শে গান্ধীজি তাঁহাদের মুখে সব শুনিয়া বলিলেন যে, তিনি ২রা সেপ্টেম্বর নোয়াখালি যাইবেন। এই ব্যবস্থা করিয়া প্যারেলাল ও চারুবাবু শহরে গেলেন। রাত্রি দশটার পর ফিরিয়া দেখেন, একদল হিন্দু যুবক বাড়ী ঘেরাও করিয়া আছে। তাহাদের গাড়ী দরজায় পৌঁছিলে কয়েকজন যুবক ইহা থামাইতে চেষ্টা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল–তোমরা কে? হিন্দু না মুসলমান? তাঁহারা কোনমতে যুবকদের ঠেলিয়া গৃহে প্রবেশ করিলেন। বাড়ীর আঙ্গিনা জনাকীর্ণ। অনেকে হলঘরে প্রবেশ করিয়াছে। আরও ক্রমাগত আসিয়া ঢুকিতেছে। পরদিন সমস্ত ব্যাপারটি শুনিয়া গান্ধীজি বলিলেন, “রাত্রি প্রায় দশটার সময় নানা স্থানে ব্যাণ্ডেজবাধা একটি যুবককে লইয়া একদল লোক শোভাযাত্রা করিয়া বাড়ীতে ঢোকে এবং চীৎকার করিতে আরম্ভ করে। আমার নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল, কিন্তু আমি চুপ করিয়া শুইয়া রহিলাম। যুবকদল পাথর ছুঁড়িয়া এবং হকিখেলার লাঠি দিয়া আসবাব, বাসনপত্র ও ছবির ফ্রেম এবং বাতির ঝাড় ভাঙিতে লাগিল। আভা ও মনু (গান্ধীর সঙ্গিনী দুইটি মেয়ে) পাছে গান্ধীর ঘুম ভাঙে এই আশঙ্কায় সাহস করিয়া বাহির হইয়া যুবকদিগকে শান্ত হইতে মিনতি করিল। তাহাদের সঙ্গের একজনের পরনে ছিল পায়জামা-একদল তাহাকে মুসলমান মনে করিয়া আক্রমণ করিল। কয়েকটি যুবক মেয়েদুইটিকে রক্ষা করিয়া তাঁহাদিগকে ঘরে যাইতে অনুরোধ করিল। মেয়েদের কাকুতি-মিনতিতে কোন ফল হইল না–চীৎকার ও ভাঙ্গাচোরা চলিতে লাগিল। ভিতরের হল হইতে জোরে জোরে ঘরের দরজায় আঘাত করার শব্দ শুনা যাইতেছিল। আমি একটি দরজা খুলিয়া চৌকাঠে দাঁড়াইয়া অনেক রকমে তাহাদের নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলাম–হাতজোড় করিয়া তাহাদিগকে বলিলাম, তোমরা ইচ্ছা করিলে আমাকে মারিতে পার, কিন্তু এরূপ হাঙ্গামা করিও না। কোন ফল হইল না, জানালা দরজা ভাঙ্গার শব্দ ক্রমশই বাড়িল।
ইতিমধ্যে একজন চেঁচাইয়া উঠিল–”সেই বদমায়েস (rascal) সুরাওয়ার্দিটা কোথায়? আমার মনে হইল তাহাকে পাইলে উহারা তাহার গায়ের চামড়া তুলিয়া ফেলিবে (lynch)। ভাগ্যক্রমে সুরাওয়ার্দি ছিলেন না, তাঁহাকে না পাইয়া ঐ আক্রমণকারী দল আমার উপর তাহাদের রাগের ঝাল ঝাড়িতে লাগিল। তারপর তাণ্ডব শুরু হইল (There was pandemonium)।”
পরবর্তী ঘটনা সংক্ষেপে বলিতেছি : ঐ সময় ঐ বাড়ীর দুইজন মুসলমান বাসিন্দা ছুটিয়া আসিল এবং তাহাদের পিছনে উত্তেজিত যুবকদল মার মার’ করিয়া ছুটিয়া আসিল। একজন মুসলমানের গাত্র বহিয়া প্রচুর রক্ত পড়িতেছিল। সে গান্ধীর পশ্চাতে গিয়া দাঁড়াইল। ইহা দেখিয়া একজন গান্ধীকে লক্ষ্য করিয়া একখানা থান ইট ছুঁড়িয়া মারিল-ইহা আর-একজন মুসলমানের গায়ে লাগিল। গান্ধীর মাথার পাশ দিয়া গিয়া একটা মোটা লাঠি দেয়ালে লাগিল। অল্পের জন্য গান্ধীর প্রাণরক্ষা হইল। বেদনাতুর গান্ধী আর্তস্বরে বলিয়া উঠিলেন, ১৫ই অগষ্টের শান্তি প্রতিষ্ঠার কি এই পরিণাম?
ইহার কিছুক্ষণ পরে পুলিশ আসিল-আক্রমণকারী যুবকের দল চলিয়া গেল। এই ঘটনার ফলে গান্ধীজি নোয়াখালি যাওয়া বন্ধ করিলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ আসিয়া গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কি হিন্দুমহাসভার নেতাদিগকে গ্রেপ্তার করিবেন? গান্ধীজি নিষেধ করিলেন এবং তাঁহাদের সহিত একযোগে কার্য করিতে নির্দেশ দিয়া রাত্রি প্রায় সাড়ে বারোটার সময় শুইতে গেলেন।”
ইহার পরের ঘটনা নির্মল বসু তাঁহার গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করিয়াছেন, আর ইহাতে নূতনত্বও কিছু নাই। ইহা পুনঃপুনঃ ঘটিয়াছে, সুতরাং অতিসংক্ষেপে তাহার উল্লেখ করিব।
১লা সেপ্টেম্বর মধ্য কলিকাতায় আবার হিন্দুরা মুসলমানদের আক্রমণ করে। যেসব মুসলমান মিয়াবাগান এবং বেলিয়াঘাটা অঞ্চলে নিজেদের বাড়ীতে ফিরিয়াছিল তাহারা পুনরায় রাজাবাজারের দিকে যাইতেছিল-পথে একটি গ্রিনেইড (grenade) গাড়ীর উপর পড়ায় দুইজন মুসলমানের মৃত্যু হয়।
(গান্ধী অনশন্ত্রত গ্রহণ করিলেন, সন্ধ্যা ৮-১৫ মিনিট)। দলে দলে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতারা আসিয়া তাহাকে এই ব্রত ত্যাগ করিতে বলিলেন। গান্ধী তাঁহাদিগকে এই মর্মে এক প্রতিশ্রুতি লিখিয়া দিতে বলিলেন যে, যদি আবার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা আরম্ভ হয় তবে তাঁহারা উহা বন্ধ করিবার জন্য নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিবেন। তাহারা অন্য ঘরে যাইয়া নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করিয়া ঐ মর্মে প্রতিশ্রুতি লিখিয়া দিলেন। গান্ধী বলিলেন, পুনরায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরম্ভ হইলে তিনি আমরণ অনশন্ত্রত গ্রহণ করিবেন। ৪ঠা সেপ্টেম্বর তারিখে রাত্রি ৯টা ১৫ মিনিটে গান্ধী অনশন্ত্রত ভঙ্গ করিলেন।
বলা বাহুল্য ইহার পরে বঙ্গদেশে বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হইয়াছে, পূর্ববঙ্গের হিন্দুগণ বারবার হাজারে হাজারে হত, আহত ও লাঞ্ছিত এবং নারীগণ বারবার ধর্ষিত হইয়াছে–কোন নেতাই প্রাণত্যাগ করেন নাই।
ইতিমধ্যে একটি শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটিল। শচীন মিত্র, স্মৃতীশ ব্যানার্জী এবং আরও কয়েকজন শান্তির বার্তা প্রচার করার জন্য মুসলমানপাড়ায় গিয়াছিলেন কিন্তু মুসলমানেরা ঐ দুইজনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে (৩রা সেপ্টেম্বর)। ৬ই সেপ্টেম্বর কলিকাতার ময়দানে করপোরেশনের আয়োজিত এক সভায় ইহার উল্লেখ করিয়া গান্ধী বলেন–তিনি ইহার জন্য দুঃখিত নহেন। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখিতে হইলে এইরূপ নির্দোষীর জীবন বিসর্জন দরকার।
দুঃখের বিষয়, এইরূপ ও অনুরূপ আত্মবিসর্জন একতরফা (অর্থাৎ কেবল হিন্দুদের দিক হইতেই) হইয়াছে; কিন্তু ইহাতেও ঐক্য বজায় থাকে নাই। আজীবন ইহা প্রত্যক্ষ করিয়াও গান্ধীর মতের কোন পরিবর্তন হয় নাই। সম্ভবতঃ মৃত্যুর অল্পকাল পূর্বে ধীরে ধীরে বাস্তব সত্যের আভাস তাহার মনে জাগিয়াছিল। ঐ ময়দানের সভাতেই পূর্বোক্ত উক্তির পর গান্ধী নিজের সম্বন্ধে বলিলেন যে, বিহার নোয়াখালি ও কলিকাতায় তিনি এক-একবার অনশব্ৰত গ্রহণ করিয়াছেন আর সাধারণের প্রতিশ্রুতির (ভবিষ্যতে সম্প্রীতিরক্ষার অঙ্গীকার) উপর নির্ভর করিয়া তাহা ভঙ্গ করিয়াছেন। ইহা একটি ছেলেখেলা (Child’s play) দাঁড়াইয়াছে, কিন্তু ইহার পর যদি সরকারী চেষ্টা ছাড়া নিজেদের ব্যবস্থায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে আমরণ অনশন ছাড়া তাঁহার আর কোন পথ নাই।
ইহার পরই তিনি ট্রেনে দিল্লী রওনা হইলেন (৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮)। ৩০শে জানুয়ারি দিল্লীতে নাথুরাম গডসের গুলিতে তাঁহার মৃত্যু হইল।
তাহার পর প্রায় ত্রিশ বৎসর অতীত হইয়াছে। এই সুদীর্ঘকালের বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক কেবল একটি সিদ্ধান্তই গ্রহণ করিতে পারেন–মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও লক্ষ্য যতই মহৎ হউক না কেন, কেবল সাধু-সন্তদের পক্ষেই ইহা সঙ্গত। রাজনীতিক জগতে ইহা মায়া-মরীচিৎকার অনুসরণ মাত্র। হয়ত ইহার প্রভাবই ভারত-বিভাগের প্রধান কারণ।
স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের রাজনীতিক অবস্থা বিশেষভাবে উপলব্ধি করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি রাজনীতিক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন নাই। আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা মনুষ্যত্ব গঠনেই আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। এই অনুপ্রেরণা ভারতের মুক্তিসংগ্রামে কতদূর কার্যকরী হইয়াছিল, স্বাধীনতার জন্য দুঃখকষ্ট ও লাঞ্ছনা সহ্য করিয়া হাসিতে হাসিতে ফাঁসির মঞ্চে উঠিয়া বাঙ্গালী যুবকেরা তাহার নিদর্শন রাখিয়া গিয়াছে। শ্রীঅরবিন্দ রাজনীতিক জীবন শেষ করিয়াই অধ্যাত্মসাধনায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। মহাত্মা গান্ধী একাধারে সাধু-সন্তোচিত আদর্শ ও রাজনীতিকের ভূমিকা অনুসরণ করিয়া কতদূর সফল হইয়াছিলেন-ভারতের স্বাধীনতার পরবর্তী ইতিহাস তাহার চিরন্তন সাক্ষীরূপে বিরাজ করিবে। তাঁহার ও তাঁহার উত্তরাধিকারীদের অদ্ভুত অসঙ্গত ও অস্বাভাবিক মুসলমানপ্রীতি যে ভারতের, বিশেষতঃ বঙ্গদেশ ও পঞ্জাবের কী গুরুতর অনিষ্ট সাধন করিয়াছে–একদিন ভবিষ্যদ্বংশীয়েরা তাহার বিচার করিতে পারিবে।
অন্যদিকে তাঁহার ভক্তবৃন্দ ও উত্তরাধিকারীরা তাঁহার চরিত্রে সাধু-সন্তের আদর্শ দ্বারা যে কতদূর প্রভাবান্বিত হইয়াছে, বর্তমান ভারতশাসনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ অভূতপূর্ব কলুষতা, অযোগ্যতা ও উজ্জ্বলতাই তাহার প্রকৃষ্ট পরিচয়। তবে এক্ষেত্রেও সম্ভবতঃ মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে মনে-মনে বাস্তবতার আভাস পাইয়াছিলেন, তাই তিনি মৃত্যুর পূর্বদিনে লিখিত নির্দেশ রাখিয়া গিয়াছিলেন যে, বর্তমান ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানটির প্রয়োজন ফুরাইয়াছে–ইহা যেন উঠাইয়া দেওয়া হয় এবং তাহার পরিবর্তে ইহা রাজনীতিক ক্ষেত্র ত্যাগ করিয়া লোকসেবক সংঘে পরিণত হইয়া লোকের সেবায় আত্মনিয়োগ করে। বলা বাহুল্য, ইহা কার্যে পরিণত হয় নাই। এই দলিলখানি গান্ধীর বাস্তবজগতের অনভিজ্ঞতার আর একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন মাত্র।
মহাত্মা গান্ধী ১৯২০ হইতে ১৯৪৭ পর্যন্ত কংগ্রেসের অবিসম্বাদিত নেতা ও নিয়ামক ছিলেন। ১৯২০ সনে তিলকের এবং ১৯২৫ সনে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর তাঁহার মত ও বাণী কংগ্রেসের নিকট বেদবাক্যরূপেই গৃহীত ও সম্মানিত হইত। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন যে, তাঁহার নিজের মতবিরোধী হইলেও গান্ধীর আদেশ ও নির্দেশ তিনি পুরাপুরি মানিয়া চলিতেন। ইহার ফল কী হইয়াছিল তাহা বর্তমান গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নহে। কিন্তু চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর গান্ধীর একাধিপত্যের ফলে বাংলা দেশের রাজনীতিক পরিস্থিতি, অর্থাৎ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের কী অবস্থা হইয়াছিল সে-সম্বন্ধে মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে লিখিত একটি সুচিন্তিত স্বাধীন মন্তব্য উদ্ধৃত করিতেছি।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির দুর্নীতির উল্লেখ করিয়া তিনি লিখিয়াছেন :
“বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির বর্তমান (১৯৪৭) গণ্ডীর মধ্য হইতে ভাল লোক পাওয়া অসম্ভব। ঐ কমিটির কর্ণধারদিগের মধ্যে নিজের স্বার্থ ও নিজের দলের স্বার্থচিন্তা ভিন্ন আর কোনও চেষ্টার চিহ্ন বাংলা দেশ বিগত বিশ বৎসরের মধ্যে পায় নাই বলিলেও চলে এবং উহার কার্যপদ্ধতির আমূল পরিবর্তন না হইলে আগামী বিশ বৎসরেও ঐ অবস্থার অবনতি ভিন্ন আর কিছুই হওয়া সম্ভব নহে। বর্তমানে সারা বাংলাদেশের প্রতিনিধি নির্বাচন তিন-চারিজন লোকের হাতে। … ইহাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সততা কাহারও কাহারও আছে, অর্থাৎ অসৎ উপায়ে অর্থোপার্জন বা পরস্বাপহরণ তাঁহারা করেন না। কিন্তু নিজ দলে ক্ষমতা বা প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধির জন্য দেশের মঙ্গলচিন্তা কখনও বিসর্জন দেন নাই এরূপ একজনও হঁহাদের মধ্যে নাই। নিজ দলের আজ্ঞাবাহী চর নহে এরূপ সৎ ও কর্মঠ লোক যাহাতে বি.পি.সি. সিতে প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে না পারে ইহার জন্য ইঁহারা সকলেই সতত চেষ্টিত এবং দেশের মঙ্গল কামনায় নিজ দলের স্বার্থ বলিদান দিতে হঁহারা কেহই প্রস্তুত নহেন। বরঞ্চ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘঁহারা দেশের ও দশের কল্যাণের বিষয় জলাঞ্জলি দিয়া নিজেদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থাই এতদিন করিয়া আসিয়াছেন। ইঁহাদের বিষয়ে শেষ কথা এই যে, হঁহাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সৎ ব্যক্তিগণ প্রায়ই হিতোপদেশের জরাব জাতীয় লোক এবং ইহাদের প্রত্যেকেরই গোষ্ঠীতে মার্জার শ্রেণীর নীচ লোক আছে যাহাদের পক্ষে এমন কোনও অসৎ কাজ নাই যাহা অসম্ভব, এবং তাহারই ফলে বাংলার আজ এই দুর্দশা…।
আজ বাংলাদেশ ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অতি অধম স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে। বিহারী চোখ রাঙ্গাইতেছে, আসামে বাঙালীর উপর যথেচ্ছাচার ও দুর্ব্যবহার চলিতেছে। অন্য প্রদেশের লোকে কৃপা, অবজ্ঞা বা অবহেলার সহিত বাংলা ও বাঙালীর কথা মনে আনে।”
এই মন্তব্যের পর ২৭ বৎসর অতীত হইয়াছে। কংগ্রেসের দুর্নীতি ও আসামে বাঙালীর প্রতি অত্যাচার বাড়িয়াই চলিয়াছে। অথচ কোন প্রতিকার নাই। স্বাধীন ভারতের প্রথম হইতেই বাঙালীর দুরবস্থা ও অবনতি কতদূর পৌঁছিয়াছিল, এবং ইহার কারণ কী তাহার সম্বন্ধে উল্লেখিত মন্তব্য যে কতদূর সত্য আজ আমরা তাহা মর্মে মর্মে বুঝিতেছি।
১২. বঙ্গবিভাগ ও মহাত্মা গান্ধী
মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস বঙ্গবিভাগের প্রস্তাব গ্রহণ করিলে স্থির হইল যে, বঙ্গদেশের বিধানসভায় ভারতীয় সদস্যগণ দুইভাগে বিভক্ত হইবে। যেসব জিলায়। মুসলমানদের সংখ্যা বেশী এবং অন্য সব জিলার সদস্যগণ-এই দুই দল পৃথকভাবে মিলিত হইয়া ভোট দিবে–তাহারা বঙ্গদেশকে বিভক্ত করার পক্ষে কি বিপক্ষে। যদি ইহার যে-কোন দলের অধিকসংখ্যক সদস্য দেশবিভাগ করার পক্ষে ভোট দেয়, তাহা হইলে বঙ্গদেশ দুইভাগ করা হইবে। তদনুসারে ২০শে জুন, ১৯৪৭ বঙ্গদেশের যে অংশে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাহার সদস্যদের মধ্যে ৫৮ জন। বঙ্গবিভাগে সপক্ষে এবং ২১ জন বিপক্ষে ভোট দিল। অন্য অংশের সদস্যদের মধ্যে ১০৬ জন বঙ্গবিভাগের বিপক্ষে এবং ৩৫ জন ইহার সপক্ষে ভোট দিল। ১৯৪৭ সনের ১৫ই ও ১৬ই জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাধারণ ও লর্ডসভা ভারত-স্বাধীনতার বিল পাশ করিল এবং ১৮ই ইহা আইনে পরিণত হইল। স্থির হইল যে, ১৫ই অগষ্ট (১৯৪৭) তারিখ হইতে ভারত স্বাধীন হইবে। অখণ্ড বঙ্গ বা বাংলাদেশ ভারতের মানচিত্র হইতে মুছিয়া গেল, তাহার পরিবর্তে হইল পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান।[২]
তথ্যনির্দেশ
১. হিন্দুর উপর মুসলমানের অত্যাচার যে মুসলিম লীগ নেতাদের পরিকল্পনামতই ঘটে এবং দুষ্কৃতকারীদের নেতারা যে লীগ-কর্তৃপক্ষের পরিচিত এবং আজ্ঞানুবর্তী–এই উক্তিই তাহার প্রমাণ।
২. সম্প্রতি পূর্ব-পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হইয়া ‘বাংলাদেশ’ এই নাম গ্রহণ করিয়াছে। ইহার বিরুদ্ধে ভারত-সরকার কোন আপত্তি জানায় নাই। কিন্তু তথাকথিত পশ্চিমবঙ্গ যে বাংলাদেশ, এই অতি প্রাচীন নাম ব্যবহার করিতে পারে না এবং পশ্চিমবঙ্গের লোক যে নিজেকে বাংলার অধিবাসী অথবা বাঙালী বলিতে পারিবে না, কোন ঐতিহাসিকের পক্ষে তা স্বীকার করা কঠিন। এই গ্রন্থে বাংলা বা বঙ্গ–এই প্রাচীন নাম বর্তমানকালের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ, এই দুই মিলিয়া যে ভৌগোলিক প্রদেশ তাহারই নাম বা সংজ্ঞাস্বরূপ ব্যবহৃত হইয়াছে।