০১. বিংশ শতকের আরম্ভে বাংলা দেশ

প্রথম অধ্যায় – বিংশ শতকের আরম্ভে বাংলা দেশ

ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে যে সমুদয় কারণে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর অসন্তোষ ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছিল তাহা এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে আলোচিত হইয়াছে। যাঁহারা মনে-মনে বিশ্বাস করিতেন যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে যে সমুদয় অভাব ও অভিযোগ যুক্তি ও প্রমাণের সাহায্যে সরকারের কর্ণগোচর করা হয় তাহা শীঘ্রই দূর হইবে এবং শাসনকার্যের উন্নতির জন্য যে-সকল প্রস্তাব পেশ করা হয় তাহা কার্যে পরিণত হইবে, তাহারা ক্রমশঃই নিরাশ হইয়া পড়িলেন। কারণ, কংগ্রেসের কুড়িটি বার্ষিক অধিবেশনের (১৮৮৫-১৯০৫) পরেও ভারতের রাজনীতিক অবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা গেল না। কংগ্রেসের বহুপূর্বে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গদেশের ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে বিলাতে পার্লিয়ামেন্টের নিকট এক আবেদনপত্রে যে সব দাবি করিয়াছিলেন, কংগ্রেস ১৯০৫ সনের পূর্বপর্যন্ত তাহার বেশীকিছু প্রার্থনা করেন নাই। সুতরাং অর্ধশতাব্দীর চেষ্টায়ও যখন কোন ফল পাওয়া গেল না, তখন কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের পন্থার উপর লোকে ক্রমশঃই বীতশ্রদ্ধ হইতে লাগিল।

কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার বহুপূর্বেই যে দেশাত্মবোধ ও রাজনীতিক আন্দোলন বঙ্গদেশে প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল তাহা তৃতীয় খণ্ডের একাদশ অধ্যায়ে বিবৃত হইয়াছে। বঙ্গদেশে যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনমত ক্রমেই প্রবল হইয়া উঠিতেছিল ঐ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে তাহার কিঞ্চিৎ আভাস দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু এ বিষয়ে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ বোম্বাই হইতে প্রকাশিত ‘ইন্দুপ্রকাশ’ নামক পত্রিকায় ১৮৯৩-৯৪ সনে যে এগারোটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন তাহা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি স্পষ্ট ভাষায় লিখিয়াছিলেন : “কংগ্রেসের আদর্শ ও লক্ষ্য ভ্রান্ত ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত, ইহার কার্যপ্রণালী ভ্রমাত্মক, ইহার নেতৃবৃন্দের কর্মে ও আচরণে আন্তরিকতা, অকপটতা ও একাগ্রতা নাই–সুতরাং তাঁহারা নেতা হইবার অযোগ্য। এককথায় বলতে গেলে লোকেরাও যেমন অন্ধ, নেতারাও তেমনি অন্ধ, অন্ততঃ এক চক্ষুহীন কানা। …আমরা কথায় কথায় গণতন্ত্রের দোহাই দেই, কিন্তু যে কংগ্রেসের সঙ্গে জনসাধারণের কোন সম্বন্ধ নাই, এবং যাহা কেবলমাত্র অতি অল্পসংখ্যক এক শ্রেণীর লোকের প্রতিনিধি, তাহাকে কোন মতেই ‘জাতীয়’ এই আখ্যা দেওয়া যায় না।”

অন্যত্র অরবিন্দ লিখিয়াছেন, “ক্ষয়রোগে আক্রান্ত রোগীর ন্যায় বাংলাদেশে কংগ্রেস দিন দিন মৃত্যুপথে চলিতেছে। ডব্লিউ. সি. বনার্জি (ব্যানার্জী), লালমোহন ঘোষ প্রমুখ কংগ্রেসের নেতৃবর্গ এখন আইনসভার (Legislative Council) ঊৰ্দ্ধ আবহাওয়ায় বিচরণ করেন এবং যুব সম্প্রদায়ের সহিত তাঁহাদের কোন সম্বন্ধ নাই। কিন্তু দেশে প্রকৃত দেশপ্রেমের উদ্দীপনা ক্রমেই বাড়িয়া চলিয়াছে।”

কংগ্রেসের সমালোচকেরা বলিতেন, “কংগ্রেসের প্রধান উদ্যোক্তা হিউম সাহেব কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে যে বাণী (manifesto) প্রচার করিয়াছিলেন (মার্চ, ১৮৮৩) এবং প্রধানতঃ যাহা কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা জোগাইয়াছিল, তাহাতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় লিখিয়াছিলেন :

(১) ব্যক্তির ন্যায় জাতির উন্নতিরও প্রধান উৎস অন্তরের প্রেরণা।

(২) যাহারা স্বাধীনতা চায় তাহারা নিজেরাই ইহার জন্য সংগ্রামে প্রথম অবতীর্ণ হইবে।

(৩) আত্মোৎসর্গ ও নিঃস্বার্থপরতা ভিন্ন ব্যক্তি বা জাতির সুখ ও স্বাধীনতা লাভ সম্ভব নহে।”

“কিন্তু বিগত বিশ বৎসরের মধ্যে কংগ্রেস এই মহৎ আদর্শের অনুযায়ী কোন কাজই করে নাই–ব্রিটিশ সরকারের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া নিজেরা চুপ করিয়া বসিয়া আছে।”

বঙ্গদেশের বাহিরে মহারাষ্ট্রে বালগঙ্গাধর তিলক ও পঞ্জাবে লালা লাজপৎ রায়ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করিতেন।

কংগ্রেসের সমালোচকেরা বলিতেন, কেবলমাত্র ইহার বার্ষিক অধিবেশনে কয়েকটি মন্তব্য পাশ করিয়া ফল পাওয়া যাইবে না। এইসব আবেদন-নিবেদনের পরিবর্তে আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হইবে এবং গঠনমূলক কার্য করিতে হইবে। এ বিষয়ে একমত হইলেও এই আত্মনির্ভরতার প্রকৃতি সম্বন্ধে গুরুতর মতভেদ দেখা যায়।

একদল আর্থিক উন্নতির দিকেই জোর দিলেন। দেশীয় শিল্পের উন্নতির জন্য স্বদেশী দ্রব্যের দোকান ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হইল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশী কাপড়ের দোকান খুলিলেন (১৮৯৭)-ইহার নাম ছিল স্বদেশী ভাণ্ডার। ১৯০১ সনে যোগেশ চৌধুরী ইণ্ডিয়ান স্টোর্স’ (Indian Stores) এবং দুই বৎসর পরে সরলা দেবী খুলিলেন’ লক্ষ্মী-ভাণ্ডার’। জামসেদপুরের লৌহখনির আবিষ্কর্তা প্রমথনাথ বসু। দেশীশিল্পের প্রদর্শনী এবং এই বিষয়ের একটি কনফারেন্সের ব্যবস্থা করিলেন।

শিক্ষাবিষয়ে আত্মনির্ভরতার দৃষ্টান্তস্বরূপ সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়-প্রবর্তিত ‘ডন সোসাইটি’ (১৯০২), ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ‘সারস্বত’ আয়তন এবং বোলপুরে রবীন্দ্রনাথের ‘শান্তিনিকেতন’ (১৯০১) প্রভৃতির উল্লেখ করা যাইতে পারে। ১৯০৪ সনে যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষের চেষ্টায় একটি সমিতি গঠিত হইল। ইহা আর্থিক বৃত্তি দিয়া বাঙ্গালী যুবকগণকে কার্যকরী শিল্প শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাইত। এইরূপ বৃত্তিভুক্ত অনেক যুবক দেশে ফিরিয়া শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতি সাধন করিয়াছেন।

রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে অনেকগুলি প্রবন্ধে অননুকরণীয় ভাষায় কিরূপে সরকারের উপর নির্ভর না করিয়া বাঙ্গালী সকল বিষয়ে আত্মনির্ভর হইতে পারে তাহার নির্দেশ দিয়াছেন। এই বিষয়ে কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ (১৩০৮-১২ বাংলা সালে লিখিত) ‘আত্মশক্তি’ নামক গ্রন্থে সংকলিত হইয়া গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ইহার মধ্যে ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আত্মনির্ভরতার সমর্থনে তিনি লিখিয়াছেন : “আমাদের দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ রাজ্যরক্ষা এবং বিচারকার্য রাজা করিয়াছেন। কিন্তু বিদ্যাদান হইতে জলদান পর্যন্ত সমস্তই সমাজ সহজে সম্পন্ন করিয়াছে।”

এই ব্যবস্থার পুনঃপ্রচলনের সম্বন্ধে লিখিয়াছেন : “স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। পূর্বে যখন রাষ্ট্র সমাজের সহিত অবিচ্ছিন্ন ছিল তখন রাজারই এই পদ ছিল। এক্ষণে, আমাদের সমাজপতি চাই। তাঁহার সঙ্গে তাঁহার পার্ষদ-সভা থাকিবে, কিন্তু তিনিই আমাদের সমাজের অধিপতি হইবেন। ইহার অধীনে দেশের ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট অংশে ভিন্ন ভিন্ন নায়ক নিযুক্ত হইবেন। সমাজের সমস্ত অভাব মোচন, মঙ্গলকর্ম চালনা ও ব্যবস্থা রক্ষা ইঁহারা করিবেন এবং সমাজপতির নিকট দায়ী থাকিবেন।”

১৮৯৬ সনে কংগ্রেস সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে বলিয়াছি। বঙ্গদেশের প্রভিনশ্যাল কনফারেন্স সম্বন্ধে আট বছর পরে তিনি লিখিয়াছেন : “এ কনফারেন্স দেশকে মন্ত্রণা দিবার জন্য সমবেত, অথচ ইহার ভাষা বিদেশী। আমরা ইংরেজিশিক্ষিতকেই আমাদের নিকটের লোক বলিয়া জানি-আপামর সাধারণকে আমাদের সঙ্গে অন্তরে অন্তরে এক করিতে না পারিলে যে আমরা কেহই নহি, একথা কিছুতেই আমাদের মনে হয় না।”

তারপর তিনি লিখিয়াছেন, “আমাদের দেশ প্রধানত পল্লীবাসী…পোলিটিক্যাল সাধনার চরম উদ্দেশ্য একমাত্র দেশের হৃদয়কে এক করা।…দেশের হৃদয় লাভকেই যদি চরম লাভ বলিয়া স্বীকার করি…তবে দেশের যথার্থ কাছে যাইবার কোন্ কোন্ পথ চিরদিন খোলা আছে, সেইগুলিকে দৃষ্টির সম্মুখে আনিতে হইবে। মনে করো, প্রোভিনশ্যাল কনফারেন্সকে যদি আমরা যথার্থই দেশের মন্ত্রণার কার্যে নিযুক্ত করিতাম, তবে আমরা কী করিতাম? তাহা হইলে আমরা বিলাতি ধাঁচের একটা সভা না বানাইয়া দেশী ধরনের একটা বৃহৎ মেলা করিতাম। সেখানে যাত্রা গান-আমোদ-আহ্লাদে দেশের লোক দূর দূরান্তর হইতে একত্র হইত। সেখানে দেশী পণ্য ও কৃষিদ্রব্যের প্রদর্শনী হইত। সেখানে ভালো কথক, কীর্তন-গায়ক ও যাত্রার দলকে পুরস্কার দেওয়া হইত। সেখানে ম্যাজিক লণ্ঠন প্রভৃতির সাহায্যে সাধারণ লোকদিগকে স্বাস্থ্যতত্ত্বের উপদেশ সুস্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া হইত এবং আমাদের যাহা কিছু বলিবার কথা আছে, যাহা কিছু সুখদুঃখের পরামর্শ আছে তাহা ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলিয়া সহজ বাংলা ভাষায় আলোচনা করা যাইত।”

কিন্তু এসব সত্ত্বেও যে পুরাতন যুগের পরিবর্তে এক নূতন যুগের সূচনা হইয়াছে রবীন্দ্রনাথ তাহা স্বীকার করিয়াছেন। তিনি বলেন : “কিন্তু বাঙ্গালির চিত্ত ঘরের মুখ লইয়াছে–নানা দিক হইতে তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। কেবল যে স্বদেশের শাস্ত্র আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতেছে এবং স্বদেশী ভাষা স্বদেশী সাহিত্যের দ্বারা অলংকৃত হইয়া উঠিতেছে তাহা নহে, স্বদেশের শিল্পদ্রব্য আমাদের কাছে আদর পাইতেছে, স্বদেশের ইতিহাস আমাদের গবেষণাবৃত্তিকে জাগ্রত করিতেছে, রাজদ্বারে ভিক্ষাযাত্রার জন্য যে পাথেয় সংগ্রহ করিয়াছিলাম, তাহা প্রত্যহই একটু একটু করিয়া আমাদিগকে গৃহদ্বারে পৌঁছাইয়া দিবারই সহায়তা করিতেছে।”

রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্লেষণ, বিশেষতঃ তিনি যে-প্রতীকারের পন্থা নির্দেশ করিয়াছেন তাহার মূল্যায়ন সম্বন্ধে মতভেদ থাকিতে পারে, কিন্তু উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিস্থলে বঙ্গদেশের ইতিহাসে যে এক যুগসন্ধি উপস্থিত হইয়াছিল একথা স্বীকার করিতেই হইবে।

এই প্রসঙ্গে পূর্বোক্ত ‘ডন সোসাইটি’র উল্লেখ করা যাইতে পারে। ইহার প্রতিষ্ঠাতা সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই যুগের উপযুক্ত মানুষ তৈরী করিবার জন্যই জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভগিনী নিবেদিতা, সখারাম গণেশ দেউস্কর প্রভৃতি অনেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি নিয়মিত বক্তৃতা দিতেন। সখারামের গ্রন্থ ‘দেশের কথা’ সে-যুগে যুবকগণের মনে অভূতপূর্ব উত্তেজনার সৃষ্টি করিয়াছিল। এখানে শিক্ষাপ্রাপ্ত বহু যুবক পরবর্তীকালে সশস্ত্র বিপ্লব ও অন্য নানাবিধ উপায়ে দেশসেবার কার্যে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের প্রেরণায় শারীরিক উন্নতিসাধনের দিকেও জাতীয়তাবাদীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। “নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ”– বিবেকানন্দের এই উক্তি জাতীয়তার মন্ত্র বলিয়া অনেকে গ্রহণ করিলেন। “বাঙ্গালী জাতিকে শৌর্যে বীর্যে বড় হইতে হইবে”– নানা স্থানে নানা ভাবে স্বামীজি ইহা উদাত্তস্বরে ঘোষণা করিলেন। ইহার জন্য তিনি যুবকগণকে ‘গীতা-পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলায় বেশী মনোযোগ দিতেও আহ্বান করিয়াছিলেন।

কলিকাতার বিভিন্ন স্থানে ‘আখড়া’ স্থাপিত হইল। এখানে প্রধানতঃ ডন, বৈঠক, মুগুর, কুস্তি প্রভৃতি ব্যায়াম শিক্ষা দেওয়া হইত। বাঙ্গালীর ভীরুতার অপবাদ দূর করা এবং সার্কাস প্রদর্শনীতে শ্যামাকান্তের শারীরিক ব্যায়ামের অদ্ভুত কৃতিত্ব এবং শক্তি ও সাহসের পরিচয় এইসব ব্যায়ামাগারের প্রেরণা যোগাইয়াছিল। শ্যামাকান্ত পরবর্তীকালে সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া ‘সোহং স্বামী’ নামে পরিচিত ছিলেন। উনিশ শতকের শেষ দশকে এবং বিশ শতকের প্রথম দশকে এইরূপ বহু সমিতি গড়িয়া উঠে। ইহার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া সম্ভবপর নহে।

১৮৯৭ সনে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ‘আত্মোন্নতি সমিতি’, ১৯০০-১৯০১ সনে ময়মনসিংহের সুহৃৎ সমিতি’, ১৯০২ সনে চন্দননগরে গোন্দলপাড়ায় বান্ধব সম্মিলনী’, ১৯০৪ সনে চিংড়িপোতায় (২৪ পরগণা) স্বাস্থ্য কেন্দ্র’, ১৯০৫ সনে ঢাকায় মুক্তি সংঘ’ ও বরিশালে ‘স্বদেশ বান্ধব সমিতি’, ১৯০৬ সনে ফরিদপুরে ব্রতী সমিতি’, ১৯০৭ সনে আহিরীটোলা লেনে ‘স্বদেশ সেবক সমিতি ও রাণাঘাটে ‘শক্তি সমিতি’, এবং ১৯০৮ সনে কলিকাতায় যুবক সমিতি’ প্রভৃতি এবং এগুলি ছাড়াও কলিকাতার বিভিন্ন পল্লীতে ও বঙ্গদেশের প্রায় সকল জিলাতেই এইপ্রকার সমিতি গড়িয়া উঠিয়াছিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলির লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্যচর্চা, সাহিত্য এবং নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের আলোচনা, জনশিক্ষা ও জনসেবা। ১৯০৩ সনে প্রতিষ্ঠিত সরলা দেবীর ‘লক্ষ্মী ভাণ্ডারের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। লক্ষ্মী ভাণ্ডার ছিল কিছুটা আখড়া, কিছুটা ভাণ্ডার এবং মূলতঃ দেশসেবক দলের মিলনক্ষেত্র। ১৯০৪ সনে তিনি বালিগঞ্জে স্বাস্থ্য অ্যাকাডেমী’ (academy) স্থাপন করেন। এইখানে দস্তুরমত আক্রমণ ও প্রতিরোধ প্রণালী, লাঠি, ছোরা, তলোয়ার পরিচালনা, যুযুৎসু, বক্সিং, ড্রিল প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হইত এবং প্রথম তিনিই এসব কাজের যোগ্য শিক্ষক মূৰ্ত্তাজা সাহেবকে নিযুক্ত করেন। বড় লাঠিখেলায় তিনি কয়েকজন বিখ্যাত শিষ্য তৈরী করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে পুলিন দাস অন্যতম। ১৯০৪ সালে সরলা দেবী ‘বীরাষ্টমী ব্রতে’র প্রবর্তন করেন। এখানে নানারকম শক্তির পরীক্ষা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইত। তিনি নিজে রঙ্গমঞ্চে অসিহস্তে ইহা চালনার দক্ষতা প্রদর্শন করিতেন।

এই সমুদয় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান প্রধান পরিচালকবর্গের মধ্যে অনেকে পবরর্তীকালে বিপ্লবী নেতারূপে প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন এবং বাহিরের কুস্তির আখড়া প্রভৃতি বিপ্লবী কেন্দ্রের বহিরাবরণ মাত্র ছিল। পূর্বোক্ত গঠনমূলক কর্ম ছাড়াও দেশের খুব অল্পসংখ্যক লোকের মনে বিপ্লবাত্মক ভাবও ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিতেছিল। অনেক দেশের ইতিহাসে দেখা যায় যে, বিদেশী অথবা দেশীয় স্বেচ্ছাচারী শাসনের দুর্গতি ও লাঞ্ছনা দূর করিবার অন্য কোন উপায় না দেখিয়া একদল লোক গুপ্ত সমিতি গঠনপূর্বক হিংসাত্মক ও বিপ্লবাত্মক কার্যপদ্ধতি অবলম্বন করে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখিলে মনে হইবে যে, উনিশ শতকের শেষদিকেই এই মনোবৃত্তির বীজ বাংলা দেশে উপ্ত হইয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) যে পরবর্তীকালে বাংলার বিপ্লবীদের প্রেরণা যোগাইয়াছিল তাহা তাঁহাদের অনেকেই স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু তাহার পূর্বেই সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর ম্যাসিনির (MazZini) ও ইতালীর মুক্তিসংগ্রাম সম্বন্ধে ওজস্বিনী বক্তৃতা (১৮৭৫) এবং প্রায় ঐ সময়েই যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘আর্য-দর্শন’ পত্রিকায় এই সম্বন্ধে প্রবন্ধাবলী যে যুবকদের মনে কিরূপ উদ্দীপনা জাগাইয়াছিল ও ইহার ফলে কতকগুলি গুপ্ত সমিতির সৃষ্টি হইয়াছিল তাহা বিপিনচন্দ্র পাল তাঁহার আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তিনি নিজে এইরূপ এক সমিতির সভ্য ছিলেন। ইহার সভ্যগণকে নিজের গায়ের রক্তে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করিতে হইত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার ‘জীবন স্মৃতি’ গ্রন্থে এইরূপ একটি গুপ্ত সমিতির উল্লেখ করিয়াছেন। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। “কলিকাতার এক গলির মধ্যে এক পোড়ো বাড়িতে সেই সভা বসিত। দ্বার আমাদের রুদ্ধ, ঘর আমাদের অন্ধকার, দীক্ষা আমাদের ঋমন্ত্রে”। বলা বাহুল্য, এই সমুদয় সমিতি অনেকটা ছেলেখেলার মত ছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এইসব সভা “বীরত্বের প্রহসন মাত্র অভিনয় করিতেছিল। অভিনয় সাঙ্গ হইয়া গিয়াছে, ফোর্ট উইলিয়ামের একটি ইষ্টকও খসে নাই”। কিন্তু ক্ষুদ্র বীজ মাটির অন্তরালে থাকিলেও তাহা হইতে বিশাল বটবৃক্ষের জন্ম হয়। বাংলা দেশ যে এককালে সশস্ত্র বিপ্লববাদের কেন্দ্র হইয়া উঠিয়াছিল এবং উহা কেবল ফোর্ট উইলিয়াম নহে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করিয়াছিল, এই গ্রন্থে তাহার যে বিস্তৃত বিবরণ আছে তাহার ভূমিকাস্বরূপ উনিশ শতকের এই প্রথম প্রয়াস উল্লেখ করিলাম। কিরূপে বিপ্লববাদ ভারতের মুক্তিসংগ্রামের একটি বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিল তাহা অন্যত্র বিস্তৃত হইবে। কিন্তু পূর্বোক্ত বিপ্লববাদীদের প্রহসন অভিনয়ের পরিবর্তে প্রকৃত বিপ্লববাদের সূচনা ১৯০৫ সনের পূর্বেই যে আবার ধীরে ধীরে দেখা দিয়াছিল তাহার সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করিব।

এ সম্বন্ধে শ্রীসতীশচন্দ্র বসুর উক্তিই বিশেষ প্রামাণিক বলিয়া মনে হয়। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দের কনিষ্ঠ ভ্রাতা) তাঁহার ‘ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নামক সুপরিচিত গ্রন্থের পরিশিষ্টে এই উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছেন। এই উক্তির তারিখ ১৭ই নভেম্বর ১৯৪৭, অর্থাৎ ইহা বর্ণিত ঘটনার প্রায় চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বৎসর পরে স্মৃতির উপর নির্ভর করিয়া লিখিত; সুতরাং ইহাতে ভুলভ্রান্তি থাকা অসম্ভব নহে। কিন্তু ইহা অপেক্ষা অধিকতর নির্ভরযোগ্য কোন বিবরণ এখনও পাওয়া যায় নাই। সুতরাং এই সুদীর্ঘ বিবরণের সারমর্ম দিতেছি। কোটেশনযুক্ত বাক্যগুলি ঐ উক্তি হইতে হুবহু উদ্ধৃত করা হইয়াছে।

অনুশীলন সমিতির উৎপত্তি বিষয়ে সতীশচন্দ্র বসুর বিবৃতি যতদূর সম্ভব তাহারই ভাষায় সংক্ষেপে উদ্ধৃত করিতেছি : “আমি আগে নারায়ণচন্দ্র বসাকের আখড়ায় (গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রীট) ব্যায়াম করিতাম। এই স্থান হইতে আমি জেনারেল এসেমী কলেজের জিমনাষ্টিক ক্লাবে ভর্তি হই। গৌরহরি মুখোপাধ্যায় (ডা. যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের খুল্লতাত) এই ক্লাবের মাষ্টার ছিলেন। কলেজের অধ্যাপক Wann উপরোক্ত ব্যায়াম ক্লাবের সভাপতি ছিলেন, কিন্তু ঐ ক্লাবে লাঠিখেলার অনুমতি পাওয়া যায় নাই। এইজন্য ইহার পর মদন মিত্র লেনে একটি ছোট লাঠিখেলার ক্লাব স্থাপন করিলাম। আমরা উপদেশ গ্রহণের জন্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদিগের নিকট যাইতাম-যথা, রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী সারদানন্দ, Sister Nivedita (সিষ্টার নিবেদিতা) প্রভৃতি। ভগিনী নিবেদিতা বলিলেন, তোমরা স্বামীজির উপদেশ জান, বস্তীতে স্বাস্থ্যসম্বন্ধীয় কার্য করিবে, লাঠি, মুগুর খেলা করিবে শরীর চর্চা করিবে। এই সূত্রে তেঘরিয়ার শশী চৌধুরী আমাদিগকে ব্যারিষ্টর আশুতোষ চৌধুরীর কাছে লইয়া যান। আমি শশীদাকে বলি আমাদের সভাপতি বা নেতা নাই। চৌধুরী ক্লাবের কথা শুনিয়া বলিলেন, এই কর্মের উপযুক্ত লোক হইতেছেন ব্যারিষ্টর প্রমথনাথ মিত্র। চৌধুরী মিত্রের নামে পত্র দিয়া তাঁহার কাছে আমাদের পাঠাইয়া দেন। তাঁহাকে সব কথা বলিলে তিনি excited হইয়া আমাকে জাপটাইয়া ধরিলেন। পরে তিনি ক্লাবের Commander-in-Chief বা পরিচালক হইলেন। সাতদিন বাদে তিনি আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, বরোদা হইতে একটা দল আসিয়াছে–তোমাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী উদ্দেশ্য তাহাদেরও। সর্বপ্রকারের training (সামরিক শিক্ষা) তাহারা দিবে। তাহাদের সহিত তোমাদের amalgamate (সংযোগ) করিতে হইবে। আমরাও রাজী হইলাম। এই সময়ে উভয় দলে মিল হইয়া গেল। তাহার ফলে যে দল গঠিত হইল তাহার সভাপতি হইলেন প্রমথনাথ মিত্র, সহকারী সভাপতি হইলেন চিত্তরঞ্জন দাশ (দেশবন্ধু) ও অরবিন্দ ঘোষ, কোষাধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সঙ্গে দলে আসিলেন, অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরেন্দ্রনাথ হালদার (চিত্তরঞ্জনের শ্যালক) ব্যারিষ্টরদ্বয়। সভ্যদের ঘোড়ায় চড়া অভ্যাস করার জন্য হালদার মহাশয় একটি ছোট ঘোড়া দলকে দান করিয়াছিলেন। এই সঙ্গে একটি ব্যায়ামের আখড়া (১০৮ নং) আপার সার্কুলার রোডে স্থাপিত হইল। বরোদা হইতে আগত যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলিলেন, মদন মিত্র লেনের আখড়া পৃথকভাবে থাকুক। আমাদের অল্প বয়সের সভ্যেরা (Junior members) মদন মিত্র লেনের আখড়ায় থাকুক, আর বয়স্ক সভ্যেরা (Senior members) যতীনবাবুর নেতৃত্বে আপার সার্কুলার রোডের আখড়ায় ব্যায়াম অভ্যাস করুক। এই সময়ে অরবিন্দ একবার ছদ্মবেশে মদন মিত্র লেনের আখড়ায় আসিয়াছিলেন। এই কথা আমি মিত্র মহাশয়ের কাছ হইতে শ্রবণ করি।”

সমিতির নামকরণ সম্বন্ধে সতীশচন্দ্র বসু বলেন : মদন মিত্র লেনে ক্লাব স্থাপনের পরে “আমরা নরেন্দ্রবাবুকে (নিউ ইণ্ডিয়ান স্কুলের হেডমাষ্টার নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) আখড়ার নামকরণের জন্য অনুরোধ করিলাম। তাহাতে তিনি অনুশীলন সমিতি’ এই নাম ধার্য করেন। এই নামটি বঙ্কিমবাবুর সাহিত্য হইতে গৃহীত হয়।” ‘অনুশীলন সমিতি’ সম্বন্ধে সতীশচন্দ্রের বিবৃতি হইতে আরও অনেক কথা জানা যায়। তাহা সংক্ষেপে বলিতেছি। “এই সময়ে যে দীক্ষামন্ত্র গ্রহণ করিতে হইত, তাহাতে ‘ধর্মরাজ্য সংস্থাপন করার কথার উল্লেখ ছিল বলিয়া আমার মনে হয়”। ..”যতীনবাবুর নেতৃত্বে সার্কুলার রোডে আখড়া স্থাপিত হয় এবং তৎসংলগ্ন একটি বাড়ীতে তিনি সপরিবারে এবং দলের সভ্য অবিনাশ ভট্টাচার্য, রবীন্দ্র বসু এবং বারীন ঘোষ প্রভৃতি কর্মীদের সহিত বাস করিতে থাকেন। ইতিমধ্যে জনকতক কর্মী কড়েয়ায় রাজনীতিক ডাকাইতি করেন। একজন ফিরিঙ্গিকে ধরিয়া তাহার টাকা ছিনাইয়া লওয়া হয়। তারকেশ্বরে এই প্রকারের প্রচেষ্টা প্রথম হয়। একবার এই উদ্দেশ্যে ভগ্নী নিবেদিতার কাছ হইতে তাহার রিভলবার চাহিতে কেহ গিয়াছিলেন। তাহাতে তিনি বিষম রাগান্বিত হন। এবং এই যাচঞা প্রত্যাখ্যান করিয়া দেন। মিত্র সাহেবও এইসব ডাকাইতির বিপক্ষে ছিলেন। এই সময়ে যতীনবাবু ও বারীন ঘোষের মধ্যে ঝগড়ার ফলে সার্কুলার রোডের আখড়া উঠিয়া যায়। যতীনবাবু দেশে চলিয়া যান। অরবিন্দ দ্বিতীয়বার কলিকাতা আসিয়া বলেন, যতীনবাবুর যে ক্লাবটা উঠিয়া গিয়াছে তাহা পুনঃস্থাপন করিতে হইবে এবং তদনুযায়ী নলিনী মিত্রের সহিত পরামর্শ করিয়া তাঁহার বাড়ীর কাছে নন্দনবাগান (?) মাঠে ‘Boxing Club’ খুলিলাম।

“যতীনবাবু পরে সোহম স্বামীর কাছ হইতে নিরালম্ব স্বামী নাম গ্রহণ করিয়া সন্ন্যাস দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং স্বীয় গ্রামে একটি আশ্রম স্থাপন করেন। সোহম স্বামীর পূর্বের নাম ছিল শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি সার্কাসে বাঘের সহিত লড়িতেন এবং যাহাতে ব্যায়াম রীতি দেশে প্রচলিত হয় তাহার চেষ্টা করিতেন। এক অনুগত বন্ধুকে তিনি বলিয়াছিলেন, কতকগুলি মানুষ প্রস্তুত কর।

“এক্ষণে দলের কথায় ফেরা যাউক। একই পার্টির আখড়ার নাম ছিল ‘অনুশীলন সমিতি’ আর কাগজের নাম ছিল যুগান্তর। ইহা দলের বিভিন্ন বিভাগ মাত্র। ভূপেন (দত্ত) ছিল অনুশীলন ও যুগান্তরের intermediary link (মধ্যবর্তী সংযোগস্থল)”।

স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫ সন) ও তাহার পরবর্তীকালের কিছু বিবরণ সতীশচন্দ্র বসুর এই উক্তিতে পাওয়া যায়–তাহাও সংক্ষেপে উল্লেখ করিতেছি।

“স্বদেশী আন্দোলন উপলক্ষে পূর্ববঙ্গে ভ্রমণকালীন (পি.) মিত্র সাহেব ১৯০৫ সালে শ্রীপুলিন দাস ও জুনিয়ার উকিল আনন্দ চক্রবর্তী (পাকড়াশী) এই দুই জনকে দলভুক্ত করেন। পরে তিনি অনুশীলনের কর্মস্থল এই প্রকারে নির্ধারিত করেন। কলিকাতার অনুশীলন হইবে Head Office (কেন্দ্রীয় স্থান)। কলিকাতার অধীনে ঢাকায় পুলিন দাসের একটা Head Quarter থাকিবে। বরিশাল, ফরিদপুর, মৈমনসিংহ, পাবনা, রাজসাহী, মালদহ পুলিন দাসের কর্তৃত্বের বাহিরে থাকিবে।

“একবার ১৯০৫ খৃঃ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় Bampfylde Fuller কে বরিশাল হইতে তাড়াইবার জন্য Anti-Circular Societyর ছেলেদের পাঠাইয়াছিলেন, কিন্তু তাহারা পুলিশের কাছে মার খায়। এই কার্যে অশ্বিনী দত্ত মহাশয় তাহার বরকন্দাজ দিয়াছিলেন। কিন্তু এই দল পুলিশের হাতে অপমানিত হইয়া ফিরিয়া আসে। তৎপর সুরেন্দ্রবাবুর অনুরোধে মিত্রসাহেব অনুশীলন হইতে বারজন খেলোয়াড় পাঠান। তাহারা পুলিশকে লাঠি খেলায় হারায়। ইহাতে মুসলমান জনতা পুলিশকে মারিতে যায়। কিন্তু আমি ও বরিশাল কলেজের অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাহাদের বাধা প্রদান করি। মুসলমানেরা বলিল ‘লাট সাহেবকে এখানে ঢুকিতে দিব না আর অনুশীলন বাবুরা যাহা বলিবে তাহা করিব’। ফুলারের স্টীমার ঘাটে আসিলে অনুশীলনের ছেলেরা চীৎকার করিয়া বলিল, ‘Fuller go back’। ফুলারকে প্রত্যাবর্তন করিতে হইয়াছিল।”

“১৯০৮ খৃঃ অনুশীলন সমিতি বেআইনী প্রতিষ্ঠান বলিয়া ঘোষিত হইলে সব শাখা পৃথক হইয়া যায়। ইহার পর এই সমিতির নাম পরিবর্তিত করিয়া আমরা ‘Bengal Youngmen’s Zamindary Co operative Society’ নাম রাখি। মিত্র মহাশয় জজ সারদাচরণ মিত্রকে এই নতুন সমিতির সভাপতি করিয়া দেন।

“ঢাকার অনুশীলন সমিতি বাহার ডাকাইতির পর পুনরায় ডাকাইতি করে। ইহাতে প্রমথনাথ মিত্র মহাশয় পুলিন দাসকে এই প্রতিষ্ঠান হইতে তাড়াইয়া দেন। মিত্র মহাশয় ডাকাইতির বিপক্ষে ছিলেন।”

অস্ত্রসংগ্রহ সম্বন্ধে সতীশচন্দ্র বসু বলেন :

“প্রথম যুদ্ধের সময় ঢাকার অবনী আমেরিকা হইতে ফিরিয়া আসিয়া আমাকে প্রথমে একটা রিভালবার দেন; পরে তাঁহার সন্ধান দ্বারা আরো ১১টা আমি পাই। এই সময়ে আমরা অনেক রিভালবার পাই। আমরা চন্দননগরে শিশিরকুমার বসুর মারফৎ কতকগুলি অস্ত্র লুক্কায়িত করি। পরে ঢাকা, মৈমনসিংহ ও মালদহে বেশী পরিমাণে অস্ত্র যায়। আশুবাবু চারিদিকে এইসব মাল পাঠান। ঢাকায় মাল সর্ববেশী প্রেরিত হয়, তৎপর রঙ্গপুরে যায়।

“১৯১৪ খৃঃ যখন সর্বদল এক হইয়া বৈপ্লবিক কার্য করিতে লাগিল তখন কেবল পুলিন দাস (ঢাকার অনুশীলন) আমাদের সহিত যোগদান করে নাই। ইহার ফলে, মৈমনসিংহ, বরিশাল প্রভৃতি স্থানের অনুশীলনের বিশিষ্ট কর্মীরা কলিকাতায় আমাদের সহিত এক যোগে কর্ম করিতে লাগিল। খুলনা ও যশোহরের অনুশীলন বিশিষ্টভাবে ঢাকার দলের বিপক্ষে ছিল। ননায়াখালী, ত্রিপুরা, বরিশালের অনুশীলন কলিকাতার সহিত এক যোগে ছিল।

“যুদ্ধের সময় ঢাকায় অনুশীলন ব্যতীত বাংলার সর্ব কর্মীই এক হইয়াছিল। যুদ্ধের সময় আমরা arms smuggling (গুপ্তভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করিয়াছি। আমরা প্রত্যেক জেলায় অনুশীলন এবং তাহার বাহিরের কর্মীদের এই মাল দিতাম। কর্মী হইলেই তাহাকে আমরা মাল দিতাম। মাল দিবার পর কর্মীদের নিকট বুয়ার যুদ্ধের কয়েদীদের দ্বারা লিখিত পুস্তিকা বিতরণ করিতাম। এই পুস্তিকাতে গেরিলা যুদ্ধ কি করিয়া করিতে হয় তাহা বিবৃত আছে। ছেলেরা training পাইয়া excursionএ যাইত। যুদ্ধের সময় কেবল কর্মীদের সস্তায় মাল প্রদত্ত হইয়াছে। যুদ্ধের পর গভর্নমেন্টের চারিদিকে অনুসন্ধান আরম্ভ হইলে কর্মীরা অস্ত্রশস্ত্র নদী বা সাগরের জলে ভাসাইয়া দেন।”

ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের পূর্বোক্ত গ্রন্থে বিপ্লবী দলের একজন বিশিষ্ট কর্মী শ্ৰীঅবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য বৈপ্লবিক সমিতির প্রারম্ভ কালের ইতিহাস সম্বন্ধে যে বিবৃতি লিপিবদ্ধ করেন (১০ই নভেম্বর, ১৯৪৭) তাহার সংক্ষিপ্ত মর্ম দিতেছি।

“১৯০২ খৃঃ অরবিন্দ কর্তৃক গুপ্ত সমিতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হইয়া যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১০৮ এ বা বি আপার সার্কুলার রোডে অবস্থান করেন। সেই সময় থেকে জেলে যাওয়া (সাত বৎসরের জন্য দ্বীপান্তর) পর্যন্ত যতীন ও বারীনদের সঙ্গে বিপ্লবের কার্যে লিপ্ত ছিলাম।”

ইহার পর আখড়ার বিবরণ দিয়া তিনি এই কর্মের জন্য চাঁদা আদায়ের প্রসঙ্গে বলেন, “অরবিন্দ প্রথম থেকেই মোটা টাকা দিতেন–আসলে অরবিন্দের টাকাতেই চলিত।-সি. আর. দাশ ও অন্যান্য লোকের কাছ হইতে চাঁদা আদায় করিতাম।”

“বারীনের সঙ্গে যতীন্দ্রের মনান্তর হওয়ায় আখড়া ভাঙ্গিয়া যায়-অরবিন্দ আসিয়া ঝগড়া মিটাইয়া দেন। আমরা আলাদা হইলেও বারীন ও আমার এবং যতীনবাবুর খরচা অরবিন্দ বরাবর দিয়া যাইতেন।

“বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ‘No Compromise’ নামক pamphlet লইয়া সুরেন্দ্রনাথের কাছে যাই। তিনি সেটা মনোযোগ দিয়া পাঠ করিয়া চমকিয়া উঠিলেন এবং বলিলেন, এই রকম ইংরেজী কে লিখিয়াছেন, কোন বাঙ্গালী এই রকম লিখিতে পারেন না। আমি উত্তরে তখন অরবিন্দের পরিচয় তাহার কাছে দিলাম। আমি যখন সুরেন্দ্রবাবুকে আমাদের কথা বলি, তিনি চমকাইয়া উঠেন, একটি গুপ্তস্থানে গিয়া উভয়ের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘বাবা, এইসব তোমরা কর, ইহাতে তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে। আমি যতদূর সম্ভব তোমাদের আর্থিক সাহায্য করিব কিন্তু তোমাদের এই কার্যে আমি যাইতে পারিব না। আমরা বুড়ো হইয়া গিয়াছি। তোমরা youngmen, তোমরা ইহা কর।

“এই সময়ে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের কাছেও যাই। তিনি আমাদের খুব উৎসাহিত করেন। অশ্বিনীকুমার দত্তও উৎসাহিত করেন। তাঁহার সঙ্গে কলিকাতায় দেখা হয়। তিনি বলেন, আমরা এখন বুড়ো হইয়া পড়িয়াছি; এখন আমাদের শক্তিতে কুলায় না। তোমরা এই গাছটাকে একবার নাড়া দিয়া দাও, যাহাতে পাখিগুলা কিচির-মিচির করিয়া জাগিয়া উঠে অর্থাৎ যাহাতে দেশের লোকের ঘুম ভাঙ্গে।

“পুনরায় যতীনবাবু আমাদের সঙ্গ হইতে আলাদা হইয়া যান, তাঁহার সঙ্গে আমাদের বনিত না।

“১৯০৬ খৃঃ সুবোধ মল্লিকের বাড়িতে Party Conference হয়। বিভিন্ন জেলা হইতে সভ্যেরা আসেন। প্রত্যেকেই নিজের জেলার কার্যের progress (উন্নতি) বিষয়ে সংবাদ পেশ করেন। ১৯০৭ খৃঃ উক্ত স্থানে পুনরায় conference হয়। উদ্দেশ্য ছিল পথ ও কর্ম-পদ্ধতি বিষয় নির্ধারিত করা।”

অবিনাশচন্দ্র মহারাজা সূর্যকান্ত, গগন ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অবিনাশ চক্রবর্তী (মুন্সেফ) প্রভৃতির অর্থসাহায্য উল্লেখ করিয়াছেন-সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর রিভলবার জোগাইতেন।

তারপর অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখিয়াছেন :

“ ‘যুগান্তর’ আমাদের দেশের কার্যের জন্য উৎসর্গীকৃত কাগজ ছিল। ইহা আমাদের বৈপ্লবিক দলের কাগজ ছিল। পার্টি মেম্বার প্রকাশ মুজমদারের প্রেসে যুগান্তর প্রথম ছাপা হয়। তিন সপ্তাহ তথা হইতে কাগজ বাহির হয়। এই প্রেস কুমারটুলীতে ছিল। তারপর যুগান্তরের নিজের প্রেস হয় (সাধনা প্রেস)।

প্রকাশচন্দ্র মজুমদার এম. এ. প্রথমে কটকে মাষ্টার ছিলেন। তথায় তিনি দলভুক্ত হন। আমার নামেই প্রেসটা ক্রয় করা হয়। প্রকাশবাবুর কাছ হইতে ধারে প্রথমে প্রেসটা কেনা হয়। অবিনাশ চক্রবর্তী ও মেদিনীপুরের জমিদার নন্দ অর্থ সাহায্য করিতেন”।

অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্যের বিবৃতিতে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষের উল্লেখ আছে। ইনি পরে কেবল রাজনীতিক্ষেত্রে নহে, আধ্যাত্মিক শক্তির জন্য সমগ্র জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সম্বন্ধে তাহার মন্তব্য পূর্বেই উদ্ধৃত হইয়াছে।

বাংলা দেশের বিপ্লববাদ প্রতিষ্ঠায় অরবিন্দের অবদান সম্বন্ধে সঠিক সংবাদ সাধারণের মধ্যে খুব বেশী প্রচলিত নহে। সুতরাং এ সম্বন্ধে একটু বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন। ১৮৭২ সনে ১৫ই অগষ্ট তাহার জন্ম হয়। তাঁহার পিতা ছিলেন একজন উগ্র সাহেব। সুতরাং তিনি শিশু অরবিন্দকে বাংলা ভাষায় কথা বলিতেও শেখান নাই। আট বছর বয়সেই তাহাকে বিলাত পাঠান। সেখানে তিনি বিলাতী পরিবারের বিলাতী আবহাওয়ায় মানুষ হইবেন, ইহাই ছিল তাঁহার পিতার সঙ্কল্প। অথচ অরবিন্দের পিতা ‘Bengalee’ সংবাদপত্র হইতে ইংরেজের অত্যাচারের কাহিনী কাটিয়া পুত্রের নিকট পাঠাইতেন এবং চিঠিতে ইংরেজ সরকারকে নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী বলিয়া তীব্র নিন্দা করিতেন। এইগুলি পাঠ করিয়া অতি অল্পবয়স হইতেই অরবিন্দের মনে ইংরেজশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ জাগে। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং ‘মজলিস’ নামে ভারতীয় ছাত্রবৃন্দের আলোচনাসভায় ভারতে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বহু বক্তৃতা করিতেন। তিনি ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন, কিন্তু ইংরেজ সরকারের অধীনে জজ-ম্যাজিষ্ট্রেটগিরি করিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। এই কারণে উক্ত পরীক্ষার একটি অঙ্গ হিসাবে অশ্বারোহণের পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকায় তাঁহার চাকুরী হইল না। কেহ কেহ বলেন, কেমব্রিজ মজলিসে তাহার বিদ্রোহাত্মক বক্তৃতার জন্যই ইংরেজ সরকার এই অজুহাতে চাকুরী দিলেন না। বিলাতে ছাত্র অবস্থায়ই অরবিন্দ Lotus and Dagger নামে এক গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির সভ্য ছিলেন। দেশে ফিরিয়া (১৮৯৩ সন) অরবিন্দ বরোদা কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হইলেন। এই সময়েই তিনি যে বোম্বাই হইতে প্রকাশিত ইন্দু প্রকাশে’ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। বিপ্লববাদের সহিতও তাঁহার কিছু সংস্রব ছিল। কারণ তিনি তাঁহার আত্মজীবনীতে পশ্চিমভারতে একজন রাজপুত ঠাকুরের নেতৃত্বে গঠিত একটি গুপ্ত সমিতির বিশদ বর্ণনা দিয়াছেন। এই সময়েই তিনি বাংলায় গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠার কল্পনা করেন। এ বিষয়ে তাহার প্রধান সহায় ও পরামর্শদাতা ছিলেন শ্রীযতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি বাঙ্গালী জাতিকে বীর্যবান করিবার ব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি বরোদায় যাইয়া সৈন্যদলে ভর্তি হইলেন। তখন বাঙ্গালীর পক্ষে কোন সৈন্যদলে যোগ দেওয়া খুবই কঠিন ছিল। যতীন্দ্রনাথ নিজের উপাধি উপাধ্যায় রূপে পরিবর্তিত করিয়া অবাঙ্গালী পরিচয়ে সৈন্যদলে ভর্তি হইলেন। অরবিন্দ যতীন্দ্রনাথকে বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলায় পাঠাইলেন। কলিকাতায় তাঁহার কার্যাবলী সম্বন্ধে অবিনাশ ভট্টাচার্যের বিবরণ পূর্বেই উদ্ধৃত করিয়াছি। কিন্তু যতীন্দ্রনাথ কলিকাতায় আসেন ১৯০০ বা ১৯০১ সনে-অবিনাশবাবু যে ১৯০২ সন লিখিয়াছেন, তাহা ঠিক নহে। যতীন্দ্রনাথ কিছুকাল পরে, সম্ভবতঃ পি. মিত্র ও বারীনের সহিত মতভেদ হওয়ার ফলেই, কলিকাতার গুপ্ত সমিতির সংস্রব ত্যাগ করিয়া দেশভ্রমণে বাহির হইলেন। পুলিশ রিপোর্ট হইতে জানা যায় যে, তিনি দার্জিলিং, নেপাল, তিব্বত, বিহার ও উত্তর প্রদেশের বহু স্থানে তিন বছর ঘুরিয়া পেশোয়ার যান (১৯০৭ সন)। পথে পথে সামরিক ছাউনিতে দেশীয় সৈন্যদের সঙ্গে তিনি দেখা করিতেন। পেশোয়ারে পুলিশ সন্দেহ করে তিনি সৈন্যগণকে সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিতেছেন এবং সরকারী আদেশে তিনি ঐ প্রদেশ ছাড়িয়া আসিতে বাধ্য হন (১৯০৭ সন)। তারপর পঞ্জাবে তিনি বহু বিপ্লবী নায়কের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইহাদের মধ্যে লালা লাজপৎ রায়, সর্দার অজিত সিং, লালা আমির চাঁদ, ভগৎ সিংহের পিতা, সর্দার কিষণ সিং, লালা হরদয়াল (তখন ছাত্র), লালচাঁদ ফলক (১৯১৫ সনে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী) প্রভৃতির নাম করা যাইতে পারে। কেহ কেহ বলেন যে পরবর্তীকালে পঞ্জাবীরা আমেরিকার যুক্তপ্রদেশে যে বিখ্যাত ‘গদর পার্টি নামে বিপ্লবী সমিতি গঠন করে এবং বাসবিহারী বসু পঞ্জাবে যে বিপ্লবী দল গড়িয়া তোলেন তাহার বীজ বপন করেন যতীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। ইহার সম্বন্ধে বিশেষ কোন প্রমাণ নাই। তবে বাংলা দেশে তিনি ১৯০৩ সনের পরে কোন বিপ্লবী সমিতির সহিত যুক্ত ছিলেন না। পঞ্জাব হইতে তিনি তাঁহার জন্মভূমি চান্না গ্রামে (বর্ধমান জিলা) ফিরিয়া যান এবং সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া সেখানেই আশ্রম স্থাপন করেন। তখন তিনি নিরালম্ব স্বামী নামে পরিচিত হন।

অনেকের মতে “যতীন্দ্রনাথই বাঙ্গলায় বিপ্লবী ভাবধারা বহন করে এনে কলিকাতায় সর্বপ্রথম বিপ্লবী সঙ্ঘ গড়ে তুলেছিলেন”।৮

বিপ্লবী নেতাদের মধ্যে যে অনেকের উপর ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ছিল তাহার বিশিষ্ট প্রমাণ এই যে, যতীন্দ্রনাথের ন্যায় আরও কয়েকজন বিপ্লবী পরবর্তী জীবনে রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়াছিলেন অথবা স্বতন্ত্রভাবে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করিয়াছেন। এ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দকেই তাঁহারা গুরুর পদে বরণ করিয়াছিলেন। স্বয়ং শ্রীঅরবিন্দ যে স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। তিনি নিজেই ইহা স্বীকার করিয়াছেন।

এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতার নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই মহীয়সী আইরিশ মহিলা ধর্মপ্রাণা ছিলেন। ধর্মশিক্ষা ও সাধনার জন্যই স্বামীজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া এদেশে আসেন। কিন্তু এদেশে আসিয়াই তিনি ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হইয়া পড়েন। তিনি যে সশস্ত্র বিপ্লবীদের নানাভাবে উৎসাহ দিয়াছেন এবং সাহায্য করিয়াছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। শ্রীঅরবিন্দ নিজেই ব্যক্ত করিয়াছেন, নিবেদিতা তাহার দলে ছিলেন। “বিপ্লবী ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা, তাদের বিপদে-আপদে সাহায্য করা, টাকা দিয়ে, অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে, আবার বোমা তৈরী শিখবার জন্য বিদেশে ছেলে পাঠানো ইত্যাদি কত কি”। শ্রীঅরবিন্দের মতে, “এক কথায় বলা যায়, বিপ্লবীদের সাফল্যের মূলে তার দান অপরিসীম।”৯ এই সকল ও অনুরূপ আরও অনেক ঘটনা আলোচনা করিলে বেশ বোঝা যায় যে, বিশ শতকের গোড়ার দিকে ও তাহার কিছু পূর্ব হইতে বঙ্গদেশের একদল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং ইহার কার্যপদ্ধতি সম্বন্ধে উদাসীন বা হতাশ হইয়া পড়েন। কেহ কেহ দেশের অগ্রগতির জন্য জাতীয় সংগঠন ও জাগরণের অন্যবিধ নানা উপায় বা পথের অনুসন্ধান ও আলোচনা করিতেছিলেন। এই পরিবর্তন কেবল বাংলা দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ভারতের অন্য প্রদেশেও ইহার সূচনা দেখা দিয়াছিল।

মহারাষ্ট্রে গণপতি ও শিবাজী উৎসব প্রতিষ্ঠা করিয়া তিলক জাতীয় চেতনা উদ্বোধনের চেষ্টা করেন। ১৮৯৬ সনে দুর্ভিক্ষের সময়ও তিনি খাজনা বন্ধ করিবার জন্য কৃষকদের উপদেশ দেন।

১৯০১ সনে পঞ্জাবকেশরী লালা লাজপৎ রায় লিখিলেন, প্রতি বৎসর ইংরেজীশিক্ষিত সম্প্রদায় কংগ্রেস নামে যে উৎসবের অনুষ্ঠান করেন তাহার চেয়ে শিল্পশিক্ষা এবং পণ্যোৎপাদনের সম্বন্ধে আত্মনির্ভরতা (Technical Education and Industrial Self-help) আমাদের পক্ষে অধিকতর প্রয়োজনীয়। এই প্রসঙ্গে তিনি আরো একটি উক্তি করেন, যাহা পরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই মূল্যবান। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে রাজনীতিক ক্ষেত্রে একটি বিরোধের ভাব ছিল, সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে উত্তরভারতের অনেক মুসলমানই কংগ্রেসের বিরোধী ছিলেন এবং তাহার ফলে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এই প্রভেদ যে চরমে পৌঁছিয়াছিল-এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে তাহা বলা হইয়াছে। পূর্বে যে-প্রবন্ধের উল্লেখ করা হইয়াছে তাহাতে লাজপৎ রায় লিখিয়াছেন, হিন্দু-মুসলমানের মিলন অসম্ভব (chimera), সুতরাং কংগ্রেসকে স্পষ্টভাষায় খোলাখুলিভাবে কেবল হিন্দুর সংগঠন বলিয়াই ঘোষণা করিতে হইবে।

উপরোক্ত বিবরণ হইতে এই সিদ্ধান্ত অনায়াসে করা যায় যে বাংলা তথা ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে পুরাতন কংগ্রেসের যুগ শেষ হইয়াছে এবং এক নূতন যুগের সম্ভাবনা ক্রমশঃই স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু এই নবযুগ কীভাবে প্রকট হইবে এবং ইহার প্রকৃতি কী হইবে অর্থাৎ ভবিষ্যৎ মত ও পথের সন্ধান সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ও অনিশ্চিত ছিল। এই সময়ে এমন একটি ঘটনা ঘটিল যাহার প্রভাবে এই অনিশ্চয়তা দূর হইল। প্রথমে বাংলাদেশ এবং পরে তাহার অনুকরণে সমগ্র ভারতবর্ষ যে নূতন পথের সন্ধান পাইল সেই পথে অগ্রসর হইয়াই ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছিল। এই ঘটনাটি হইল ১৯০৫ সনের বঙ্গ বিভাগ। এই বঙ্গভঙ্গের জন্য প্রধানতঃ দায়ী তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জন।

লর্ড কার্জন ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই জানুআরি ভারতের বড়লাট হইয়া আসেন এবং ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই নভেম্বর পদত্যাগ করেন। মাঝে তিনি ছুটি নিয়া বিলাত গিয়াছিলেন এবং ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল হইতে ৯ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে অনুপস্থিত ছিলেন।

তাঁহার শাসনকালের বিস্তৃত ঘটনাবলী বর্তমান গ্রন্থে অপ্রয়োজনীয়, কারণ ইহা বঙ্গদেশের ইতিহাস-ভারতবর্ষের ইতিহাস নহে। সুতরাং বাংলার ইতিহাসে তাঁহার সম্বন্ধে কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় কয়েকটি তথ্যই উল্লেখ করিব।

প্রথমতঃ, তিনি কলিকাতা পৌরসভায় (Municipal Corporation) জনসাধারণের ক্ষমতা লোপ করিয়া ইহাকে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে ইহা আলোচিত হইয়াছে। ঐ বৎসর জাতীয় কংগ্রেসে একটি প্রতিবাদসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয়।

দ্বিতীয়তঃ, তিনি কলিকাতা (ও অন্য দুইটি) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় সরকারী কর্তৃত্বের প্রাধান্য স্থাপন করেন এবং আরও কয়েকটি অনিষ্টকর ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। ইহা পরবর্তী অধ্যায়ে বিবৃত হইবে।

তৃতীয়তঃ, ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই ফেব্রুআরি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে চ্যান্সেলারের ভাষণে কার্জন বলেন, প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের লোকের মধ্যে যে শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক গুরুতর প্রভেদ বর্তমান, তাহা এককথায় বুঝাইতে গেলে বলিতে হয় যে প্রাচ্যদেশবাসীরা “অত্যুক্তিবাদী ও অতিরঞ্জনপ্রিয়। এ দেশীয় সংবাদপত্র সম্বন্ধে এই উক্তি বিশেষভাবে প্রযোজ্য”।১০

১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই ফেব্রুআরি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে কার্জন বলেন,

“সত্যবাদিতার উচ্চতম আদর্শ প্রধানতঃ পাশ্চাত্ত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য….পাশ্চাত্তে যখন সত্যবাদিতা একটি উচ্চ স্তরের নীতি বলিয়া সম্মান লাভ করে, তখনও প্রাচ্যে এই ধারণার অস্তিত্ব ছিল না, বরং ছল চাতুরী দ্বারা সত্য গোপন করাই তখন প্রশংসার যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইত।…ইউরোপীয়ানরা মিথ্যাকে যেরূপ ঘৃণা করে এ দেশবাসী যে তেমন করে না ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।”

কার্জনের এই উক্তিটি তখন এদেশে বিষম উত্তেজনা সৃষ্টি করিয়াছিল। নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণ ইহার তীব্র নিন্দায় সোচ্চার এবং বিশেষ ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন। কিন্তু সত্তর বৎসর পরে আজ এই ভাষণ পড়িলে কার্জনের উক্তি যে খুবই আপত্তিজনক ও নিন্দনীয়, এরূপ মনে হয় না।

অতি প্রাচীন ভারতে সত্যের উচ্চ আদর্শ সম্বন্ধে কার্জনের ঠিক জ্ঞান ও ধারণা ছিল না, ইহা সত্য হইলেও মোটামুটি বিগত চার-পাঁচ শতাব্দীর কথা মনে করিয়াই তিনি এই উক্তি করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। ইহা ধরিয়া লইয়া এই শতাব্দীর প্রথমে বিলাত-প্রবাসের অভিজ্ঞতা হইতেই বর্তমান লেখক কার্জনের তুলনামূলক সমালোচনা সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন।

কার্জনের উক্তি অপ্রিয় হইলেও সত্য-আমরা মোটামুটি শাস্ত্রবাক্য পালন করি: “সত্য বলিবে কিন্তু অপ্রিয় সত্য বলিবে না”-কার্জন এই নীতি লঙ্ন করিয়াছেন, কিন্তু ইহাই তাঁহার উক্তি সমর্থন করে।

কার্জনের শাসন-নীতির বিরুদ্ধে জনমত যে ন্যায্য ও সঙ্গত ছিল তাহা পরবর্তী অধ্যায়ে বিবৃত হইবে। কিন্তু ইতিহাসের অপক্ষপাত বিচারে মনে হয় যে ন্যায্য ক্ষোভের যথেষ্ট কারণ থাকার জন্যই সমসাময়িক ভারতীয়েরা কার্জনের উক্তির জন্য তাঁহার প্রতি সুবিচার করে নাই।

এই কারণেই এই অধ্যায়ের পরিশিষ্টে কার্জনের মূল উক্তিটি উদ্ধৃত করিয়াছি। কারণ কার্জনের এই অর্ধ-বিস্মৃত উক্তি সম্বন্ধে এখনও বিরুদ্ধমত প্রচলিত আছে, অথচ মূল ভাষণটি দুপ্রাপ্য এবং অনেকেই তাহা পড়েন নাই।

চতুর্থতঃ, অনেকেই মনে করেন যে ভারতবাসী, বিশেষতঃ বাঙ্গালীর প্রতি কার্জন অবজ্ঞার ভাব পোষণ করিতেন। এ সম্বন্ধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার আত্মজীবনীতে নিজের যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করিয়াছেন তাহা নিম্নে সংক্ষেপে বিবৃত হইল।

১৮৯৯ ফেব্রুআরি মাসে ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ হইতে কার্জনকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাইবার উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ ও আরও কয়েকজন সদস্য বড়লাটের ভবনে উপস্থিত হন। সদস্যদের মধ্যে দুইজন “পাম্প শু” জুতা পায়ে দিয়া গিয়াছিলেন। বড়লাটের এডিকং আদেশ করেন, হয় তাঁহারা জুতা খুলিয়া আসিবেন নচেৎ চলিয়া যাইবেন। তাহারা চলিয়া আসিলেন। কিন্তু আরও দুই একজন সদস্য তাহাদের সঙ্গে চলিয়া আসিতে চাহিলে, ইহাতে বড়লাটের প্রতি অসৌজন্য দেখান হইবে ভাবিয়া সুরেন্দ্রনাথ তাঁহাদিগকে নিরস্ত করিলেন।

লর্ড কার্জন ব্যক্তিগতভাবে এই রূঢ় আচরণের জন্য কতদূর দায়ী ছিলেন তাহা বলা যায় না। হয়ত এই রীতিই তখন প্রচলিত ছিল। তবে কার্জনের গর্ব ও ঔদ্ধত্য নানাভাবে পরিস্ফুট হওয়ায় এটিও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে; কিন্তু, এই ব্যবহারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবে প্রতিবাদ না-করায়-বরং তাহাতে বাধা দেওয়ায়, বিশ শতকের প্রথমে বাঙ্গালীর (তথা ভারতবাসীর) যে দাসত্বসুলভ মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়, বাংলার ইতিহাসে তাহা উল্লেখযোগ্য বলিয়া মনে করি! স্বদেশী আন্দোলনের পরে ইহার দৃষ্টান্ত বড় একটা পাওয়া যায় না। এই আন্দোলনে যে গুরুতর জাতীয় পরিবর্তন ঘটিয়াছিল, ইহা তাহার একটি দৃষ্টান্ত।

পঞ্চম ও সর্বশেষ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুতর ঘটনা বঙ্গদেশের ব্যবচ্ছেদ–যাহা বঙ্গভঙ্গ বলিয়া সুপরিচিত। যে স্বাধীনতা-সংগ্রাম ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে এক যুগান্তর আনয়ন করিয়াছিল বঙ্গব্যবচ্ছেদে তাহার সূচনা হয়। পরবর্তী অধ্যায়ে ইহার বিস্তৃত অলোচনা করা হইয়াছে।

লর্ড কার্জন ভারতীয় সেক্রেটারী অব ষ্টেটকে লিখিয়াছিলেন যে, তাঁহার ভারতশাসন শেষ হইবার পূর্বেই তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সমাধি রচনা করিবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি বঙ্গভঙ্গ দ্বারা ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমাধিমন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছিলেন। কলিকাতার ময়দানে তাজমহলের সমকক্ষতাস্পর্ধী যে ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল’ লর্ড কার্জনের গৌরব বহন করিয়া মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে তাহাকে ভারতে ব্রিটিশশাসনের সমাধিমন্দির বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি করা হইবে না। লর্ড কার্জনের ঘটনাবহুল শাসনকালের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া বাঙ্গলার ইতিহাসে অপ্রসাঙ্গিক। বঙ্গভঙ্গ বঙ্গদেশের তথা ভারতবর্ষের একটি স্মরণীয় ঘটনা বলিয়া ইহা বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইয়াছে। অন্যান্য ঘটনা-যেমন নূতন পৌরশাসন-বিধির পরিবর্তন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠন, ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠা, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নূতন ব্যবস্থা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সম্বন্ধে নূতন নীতি, তিব্বত অভিযান–প্রভৃতির দ্বারা বঙ্গদেশ প্রভাবান্বিত হইলেও এগুলি মুখ্যতঃ ভারতীয় প্রসঙ্গ। এইজন্য মাত্র বঙ্গদেশে ইহার প্রভাব বা কার্যকারিতা সংক্ষেপে যথাস্থানে উল্লেখ করা হইবে।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে, যখন কলিকাতা হইতে ব্রিটিশভারতের রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয় তখন লর্ড কার্জন ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছিলেন।

পরিশিষ্ট Extract from the speech of Lord Curzon at the Calcutta University Convocation held on 11th February, 1905.

“The highest ideal of Truth is to a large extent a Western conception. …Undoubtedly Truth took a high place in the moral codes of the West before it had been similarly honoured in the East..We may prove it by the common innuendo that lurks in the words “oriental diplomacy” by which is meant something rather tortuous and hypersubtle. The same may be seen in oriental literature. In your epics truth will often be enrolled as a virtue; but quite as often it is attended with some qualification and very often praise is given to successful deception practised with honest aim.’ I remember reading in an Indian newspaper the following paragraph :

“There is not a question but that lying is looked upon with much more disfavour by European than by Native society. The English opinions on this subject are strong, distinct and uncompromising in the abstract. Hindu and Mohammedan opinions are fluctuating, vague and to a great extent dependent upon times, place and persons”:

(1) The allunion was to many well-known passages in the Ramayana, Mahabharata and other works. In one place the Mahabharata says, “There in nothing higher that to speak the truth. Yet, it is better to speak what is beneficial than to speak the truth”. In another place the permissible kinds of falsehood are stated to be five in number “on an occasion of marriage or of love or when life is in danger, or when one’s entire property is about to be taken away, or for tha sake on a Brahaman.”

(2) The Indian Mirror, a Bengali daily, Published in Calcutta.

N. B. The above two footnotes are probably added by Sir Thomas Raleigh from whose book “Lord Curzon in India” (1906, pp. 222-3) the above extract is quoted (omitting some passages as indicated by asterisks).

তথ্যনির্দেশ

১. ইহার মধ্যে প্রথম আটটি ও একাদশ–মোট নয়টি প্রবন্ধ নিম্নলিখিত গ্রন্থে পুনমুদ্রিত Prof. Haridas Mukherjee 3 Prof. Uma Mukherjee প্রণীত Sri Aurobindo’s Political Thought (1958), Part II, pp. 61-123. প্রবন্ধগুলির নাম “News Lamps for Old” বিশেষ অর্থসূচক।

২. রবীন্দ্র রচনাবলী’ তৃতীয় খণ্ড (বিশ্বভারতী) ৩য় সংস্করণ ১৩৪৮, পৃ. ৫১৭-৬৩৬। পরবর্তী উদ্ধৃত বাক্যগুলির পৃষ্ঠাসংখ্যা বন্ধনীর মধ্যে দেওয়া হইয়াছে।

৩. B.C. Pal. Memoirs of My Life and Times I. pp. 245–6.

৪. তদেব, পৃ. ২৪৬-৮।

৫. “জীবন স্মৃতি” (১৯৪০) পৃ. ১৪৮-৪৯।

৬. তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৪৯ পৃ. ১৭৯-১৯৪।

৭. A.C. Guha-First Spark of Revolution (1971) p. 104.

৮. শ্রীকালীচরণ ঘোষ-”জাগরণ ও বিস্ফোরণ”–প্রথম ভাগ, পৃ. ৯৮।

৯. তদেব, পৃ. ১০২।

১০. If I were asked to sum up in a single word the most notable characteristics of the East-physical, intellectual as compared with the West, the word exaggeration or extravagance is the one that I should employ. It is particularly patent on the surface of the Native press. (Convocation Address, Calcutta University, p. 924) Releigh, Vol. II, pp. 216-7.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *