ষষ্ঠ অধ্যায় – দমন ও শাসননীতি (১৯০৭-১৯২০)
ক। ১৯০৭-১৯১১
১. সরকারের দমননীতি
সন্ত্রাসবাদীদের প্রধান ঘাঁটি মুরারিপুকুর বাগানে বিপ্লবীদের গ্রেপ্তারের ফলে এই বিপ্লবকেন্দ্র পরিত্যক্ত হইল এবং আদালতের বিচারে বড় বড় নেতাদের দ্বীপান্তর ও কারাদণ্ড হওয়ায় দলটি প্রায় নেতাশূন্য হইল। অরবিন্দ মুক্তিলাভ করিয়াও বেশিদিন সক্রিয় রাজনীতিতে লিপ্ত থাকিলেন না, ১৯১০ সনে পণ্ডিচেরীতে চলিয়া গেলেন। চরমপন্থীরা কংগ্রেস হইতে বিতাড়িত হওয়ার পর (১৯০৭) তাহাদের প্রসিদ্ধ নেতা লালা লাজপৎ রায় অন্তরীণে আবদ্ধ হইলেন। তিলকও ছয় বৎসরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলেন (১৯০৮)।
সন্ত্রাসবাদের সূচনাতেই গভর্নমেন্ট ইহা কঠোরহস্তে দমন করিবার উদ্দেশ্যে বিপ্লবীদের সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করিবার জন্য এক আইন পাশ করিলেন, তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। এই আইনের খসড়া যখন বিধানসভায় আলোচিত হয় তখন নরমপন্থী দলের অন্যতম নেতা রাসবিহারী ঘোষ ইহার প্রতিবাদ করিয়া বলিয়াছিলেন, ইহার একমাত্র ফল হইবে বিদ্রোহী গুপ্ত সমিতির বিস্তার। কার্যতঃ তাহাই হইল। সন্ত্রাসবাদীরা বঙ্গদেশে বহু গুপ্ত সমিতি স্থাপন করিল। সুতরাং মুরারিপুকুর বাগানে সন্ত্রাসবাদীদের কেন্দ্র ধ্বংস হইলেও ধীরে ধীরে আবার ছোট ছোট কেন্দ্র বঙ্গদেশের বহুস্থানে স্থাপিত হইল। ইহার ফলেই গভর্নমেন্ট নূতন নূতন কঠোর আইন করিতে লাগিল।
মজঃফরপুরে বোমানিক্ষেপের ফলে ১৯০৮ সনে ‘Explosive Substances Act’ বিধিবদ্ধ হইল। এই আইন অনুসারে নিম্নলিখিত কার্যগুলি গুরুতর অপরাধ বলিয়া গণ্য হইল :
(১) বোমা এবং তাহা প্রস্তুত করার দ্রব্য ও যন্ত্রপাতি রাখা।
(২) বোমা তৈরী করিতে সাহায্য করা।
(৩) বোমা তৈরী করিবার মাল-মসলা সংগ্রহ করা।
ইহার যে-কোন কার্যের জন্য অপরাধীর শাস্তি চৌদ্দ বত্সর পর্যন্ত দ্বীপান্তর। যদি কেহ বোমা ছেড়ে এবং ফলে কোন লোকের প্রাণহানি যদি না-ও হয় তাহার শাস্তি সাত বৎসর কারাদণ্ড হইতে কুড়ি বৎসর দ্বীপান্তর। বোমা হুঁড়িবার অভিপ্রায় থাকিলে বা চেষ্টা করিলেও ঐ একই শাস্তি। এইসব অপরাধ সংঘটনের নিমিত্ত কোনরূপ সাহায্য, অর্থদান বা অর্থভিক্ষা–বোমা নির্মাণের দ্রব্য বা স্থানের ব্যবস্থা করা–তুল্যরূপ দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে।
সংবাদপত্রকে আয়ত্তাধীনে আনিবার জন্য ১৯০৮ সনে যে নূতন আইনের সৃষ্টি হইল, তাহার ফলে ম্যাজিষ্ট্রেট যদি মনে করেন, সংবাদপত্রের কোন রচনা, কোন ব্যক্তিকে হত্যা, হিংসাত্মক কর্ম বা পূর্বোক্ত বোমা আইনে যে-সকল কার্য অপরাধ বলিয়া গণ্য হইয়াছে, তাহা করিবার জন্য প্রণোদিত করে, তবে তিনি ঐ রচনা প্রকাশ বন্ধ করিতে এবং যে ছাপাখানায় উহা মূদ্রিত হইয়াছে বা হইবার বন্দোবস্ত করা হইয়াছে তাহা বাজেয়াপ্ত করিতে পারিবেন। এই আইনের বলে ইংরেজী ‘বন্দে মাতরম্’ এবং বাংলা ‘সন্ধ্যা’ ও ‘যুগান্তর’-কলিকাতা হইতে প্রচারিত এই তিনটি পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করা হয়।
১৯০৮ সনের ১১ই ডিসেম্বর বিধানসভায় একদিনের অধিবেশনেই এক নূতন আইন দ্বারা ভারতীয় দণ্ডবিধির (Indian Penal Code) অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়। ইহার বলে, অভিযুক্ত ব্যক্তির এমন সব অধিকার কাড়িয়া নেওয়া হয় যাহার ফলে আদালতের বিচার বিচারকের স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়। ম্যাজিষ্ট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্বন্ধে গোপনে অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ না দিয়াই সরাসরি হাইকোর্টের তিনজন বিচারক দ্বারা গঠিত এক বিশেষ আদালতে তাহাকে সোপর্দ করিতে পারেন–যেখানে জুরী থাকিবে না, এবং যে-সকল প্রমাণ আইনগ্রাহ্য নহে তাহাও গ্রহণ করা যাইবে। এই আইনের বলে গভর্নমেন্ট যদি কোন সমিতি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে (Association) শান্তি ও শৃঙ্খলার পরিপন্থী মনে করে, তবে তাহাও বেআইনী বলিয়া ঘোষণা করিতে পারিবে। এইরূপ কোন সমিতি কোন সভার আয়োজন করিলে সভার যাহারা যে কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ করিবে অথবা এই সভায় উপস্থিত থাকিবে বা কোনপ্রকারে এই সভা পরিচালনায় সাহায্য করিবে তাহারা সকলেই কারাদণ্ড ভোগ করিবে। প্রাদেশিক গভর্নমেন্ট বিজ্ঞপ্তিদ্বারা বেআইনী সমিতি কর্তৃক অধিকৃত যে-কোন স্থান দখল করিতে পারিবে, ঐ স্থান হইতে যে-কোন ব্যক্তিকে বহিষ্কৃত করিতে পারিবে এবং সভার উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের ব্যবহৃত অথবা উহার ব্যবহারযোগ্য অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিতে পারিবে। এতদ্ব্যতীত ঐ সমিতির ব্যবহারের উদ্দেশ্যে গচ্ছিত ধন-সম্পত্তিও সরকার বাজেয়াপ্ত করিতে পারিবে। কোন সমিতির নাম পরিবর্তন করিলে, এমনকি, ইহা উঠিয়া গেলেও ইহার সদস্যেরা যতদিন পূর্বোক্ত মত কার্য করিবে ততদিন ঐ সমিতিরই সদস্য বলিয়া গণ্য হইবে। সন্ত্রাসবাদী দলের বিরুদ্ধে এই আইন প্রণয়ন করিলেও অনেক জনহিতকর সভা-সমিতি এই আইনের ফলে বা বলে অবলুপ্ত হইয়াছে।
এইসব আইন-প্রণয়নের জন্য কুখ্যাত ১৯০৮ সনের শেষভাগে ১৪ই ডিসেম্বর বাংলার নয় জন নেতাকে ১৮১৮ সনের ৩নং রেগুলেশনের ধারামতে অন্তরীণ অর্থাৎ বিনা বিচারে কয়েদ করা হয়।
বন্দী নেতৃবৃন্দের নাম এবং তাঁহাদের কোথাকার জেলে রাখা হয় তাহার উল্লেখ করিতেছি :
(১) অশ্বিনী কুমার দত্ত–বরিশালের দেশপূজ্য নেতা (লখনৌ, ব্রহ্মদেশ)
(২) মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা (ব্রহ্মদেশ)
(৩) কৃষ্ণ কুমার মিত্র (আগ্রা)
(৪) রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক (লখনৌ, ফৈজাবাদ)
(৫) শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু (রাওয়ালপিণ্ডি)
(৬) পুলিনবিহারী দাস
(৭) ভূপেশচন্দ্র নাগ
(৮) সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়–ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপক
(৯) শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী (চুনার ও ব্রহ্মদেশ)
প্রায় চৌদ্দ মাস আটক রাখিয়া ঘঁহাদিগকে ১৯১০ সনের ৯ই ও ১০ই ফেব্রুআরি তারিখে মুক্তি দেওয়া হয়। জনমত-গঠন ও প্রচারের সকল পন্থা রোধ করিয়া এবং বিশিষ্ট কর্মী ও নেতাগণকে কারারুদ্ধ করিয়াও গভর্নমেন্ট সন্তুষ্ট হইল না। ১৯১০ সনে সংবাদপত্র সম্বন্ধে নূতন আর-একটি আইন প্রণীত হইল। এই আইন-অনুসারে সংবাদপত্রের প্রকাশক ও যে মুদ্রাযন্ত্রে ইহা ছাপা হয় তাহার স্বত্বাধিকারীকে যথাক্রমে পাঁচশত ও পাঁচহাজার টাকা পর্যন্ত জামিন রাখিতে হইবে এবং বিদ্রোহমূলক বা আপত্তিজনক কোন লেখা ছাপা হইলে এই টাকা বাজেয়াপ্ত করা হইবে। বিদ্রোহাত্মক’ ও ‘আপত্তিজনক’-এই দুইটির যে ব্যাপক সংজ্ঞা দেওয়া হইল তাহাতে জজ, ম্যাজিষ্ট্রেট প্রভৃতি উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের এবং দেশীয় রাজাদের বিরুদ্ধে অথবা গভর্নমেন্টের কার্য সম্বন্ধে অপ্রীতিকর কোন মন্তব্য করিলেই তাহা এই আইনের আওতায় পড়িবে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সৈনিকদের রাজভক্তি নষ্ট করার প্রচেষ্টা, ভয় দেখাইয়া বিপ্লবীদের কার্যের জন্য লোকের নিকট হইতে টাকা আদায়ের চেষ্টা, বিপ্লবীদের খুঁজিয়া বাহির করিবার ও শাস্তি দিবার জন্য সাহায্যকারীকে বাধা দেওয়া–এ সমস্তই আপত্তিজনক বলিয়া বিবেচিত হইবে। আর, কোন লেখা এই আইন-অনুসারে আপত্তিজনক কিনা তাহা আদালতের পরিবর্তে স্থানীয় সরকারই স্থির করিবে।
এইসব অপরাধের ফলে সংবাদপত্রের জামিনের টাকা একবার রাজেয়াপ্ত হইলে আবার নূতন করিয়া অধিক পরিমাণে, এক হইতে দশ হাজার টাকা, জামিন দিতে হইবে। তৃতীয়বার এই অপরাধ অনুষ্ঠিত হইলে কেবল জামিনের টাকা নহে, মুদ্রাযন্ত্র ও আপত্তিজনক রচনাটিও বাজেয়াপ্ত করা হইবে। স্থানীয় সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করিলে তিনজন বিচারকের দ্বারা গঠিত একটি বিশেষ আদালতে (Special Bench) তাহার বিচার হইবে।
এই আইনের একটি ধারা-অনুসারে স্থানীয় গভর্নমেন্ট ডাকঘর ও শুল্ক অফিসকে এই নির্দেশ দিতে পারিবে যে, কোন প্যাকেট বা পার্শেলে সরকারী সংজ্ঞা অনুযায়ী কোন আপত্তিজনক দ্রব্য আছে এরূপ সন্দেহ হইলেই তাহা গভর্নমেন্টের নিকট পাঠাইতে হইবে।
এই আইন-অনুসারে কোন পুস্তক, সংবাদপত্র ও অন্য কোন দলিলপত্রে কোন ‘নিষিদ্ধ’ বিষয় থাকিলে স্থানীয় গভর্নমেন্ট তাহা বাজেয়াপ্ত করিতে পারিবে। বলা বাহুল্য, এই নিষিদ্ধ বিষয়টির যে ব্যাপক সংজ্ঞা ও সুদীর্ঘ তালিকা দেওয়া হইয়াছে তাহাতে গভর্নমেন্টের অপ্রীতিকর যে-কোন বিষয়ই ইহার অন্তর্ভুক্ত করা যাইতে পারে।
এই প্রসঙ্গে ইহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে ১৯০৯ সনে যে নূতন শাসন সংস্কার প্রবর্তন করা হয় তদনুযায়ী গঠিত বিধানসভায় যেখানে অনেক ভারতীয় সদস্য ছিলেন-এই আইনটি যখন গৃহীত হয় তখন ভারতীয় সভ্যেরা, এমনকি, গোখেল স্বয়ং ইহা সমর্থন করিয়াছিলেন। কারণ তাঁহাদের মতে কেবল হত্যা ও ডাকাতি নহে, ইহার অপেক্ষাও গুরুতর, ব্রিটিশশাসনের পরিবর্তে স্বাধীনতার দাবির জন্য সংবাদপত্রের রচনাগুলিই দায়ী। বলা বাহুল্য, ভারতীয় জনগণের ‘প্রতিনিধিদের এই সুবিবেচনার নিদর্শন দেখিয়া বড়লাট লর্ড মিন্টো বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করেন।
এ স্থলে বলা আবশ্যক যে বিদ্রোহাত্মক লেখার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনে অনেক কঠোর বিধান পূর্ব হইতেই ছিল এবং বিদ্রোহের সংজ্ঞা ছিল রাজভক্তির অভাব এবং গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব। তাহা সত্ত্বেও, আবার এই সমুদয় নূতন আইন প্রবর্তিত হইল। ধাতুর অস্ত্র অর্থাৎ বন্দুক ভারতীয়দের পক্ষে পূর্ব হইতেই নিষিদ্ধ ছিল, লেখনীই ছিল ভারতীয়দের আত্মরক্ষার একমাত্র অস্ত্র-তাহাও এবারে লোপ পাইল।
মুদ্রাযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের ফল
সমগ্র ভারতে Press Act মুদ্রাযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের দশ বছরে (১৯০৯-১৯) কী ফল হইয়াছিল তাহা নিম্নলিখিত বিবরণ হইতে বুঝা যাইবে। এই দশ বৎসরে। ৩৫০টি মুদ্রাযন্ত্র ও ৩০০টি পত্রিকা দণ্ডিত হয়, ৪০,০০০ পাউণ্ড (প্রায় ছয়লক্ষ টাকা) জামিন দাবি করা হয়, ৫০০ মুদ্রিত পুস্তক বাজেয়াপ্ত করা হয়, এবং ২০০ মুদ্রাযন্ত্র ও ১৩০টি পত্রিকা জামিন দিতে অক্ষম হওয়ায় বন্ধ হইয়া যায়। বঙ্গদেশের ‘অমৃত বাজার পত্রিকা’ ও ‘বসুমতী’ এবং অন্যান্য প্রদেশের পাঁচটি ইংরেজী এবং চারটি দেশীয় ভাষায় প্রসিদ্ধ পত্রিকা দণ্ডপ্রাপ্ত হয়। অপরপক্ষে, ইংরেজ পরিচালিত পত্রিকাগুলি ভারতীয়দিগের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ লেখা প্রকাশ করা সত্ত্বেও তাহাদের কোন দণ্ডভোগ করিতে হয় না। ৯৯১টি পুরাতন পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়–ইহার মধ্যে ৭০৫টির নিকট হইতে মোটা টাকার জামিন দাবি করা হয়। ১৭৩টি নূতন মুদ্রাযন্ত্র এবং ১২৯টি নূতন পত্রিকা অতিরিক্ত জামিনের দাবিতে অল্পকালের মধ্যেই বন্ধ হইয়া যায়। কলিকাতার ‘বন্দে মাতরম্ ও যুগান্তর পত্রিকাদ্বয়ের সম্পাদকদের বিদ্রোহের অপরাধে সাজা হয়-তাহাতে ফল না-হওয়ায় নূতন আইনের বলে এই দুইটি পত্রিকা বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়।
বিদ্রোহমূলক রচনার জন্য দণ্ড
ভারত সরকার বিদ্রোহাত্মক লেখার জন্য যে কঠোর শাস্তি দিতেন তাহাতে ভারত সচিব মর্লি পর্যন্ত যথেষ্ট উদ্বেগ ও অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন। তিনি বড়লাট মিন্টোকে লিখিয়াছিলেন, একটি বিদ্রোহাত্মক পুস্তিকা (Pamphlet) রচনার জন্য গ্রন্থকারের দ্বীপান্তর দণ্ড হইয়াছে, এই সংবাদ পাঠ করিয়া আমি বিশেষ অস্বস্তি (restive) বোধ করিলাম। সামান্য রাজনীতিক অপরাধের জন্য বেত্রাঘাত দণ্ড দেওয়া হইয়াছে, ইহাও সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ। এইরূপ শাস্তিবিধানের এইসব উদাহরণ উল্লেখ করিয়া তিনি বড়লাট লর্ড মিন্টোকে লিখিয়াছিলেন, “এই প্রকার দণ্ড অমানুষিক (monstrous), বর্বরোচিত (outrageous)-ইহা কোন মতেই সমর্থনযোগ্য নহে। ইহা শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উপায় নহে, ইহার একমাত্র পরিণতি বোমা তৈরী”। বালগঙ্গাধর তিলকের লেখার জন্য ছয় বৎসর কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয়। ইহাতে সমগ্র ভারতের ন্যায় বঙ্গদেশও বিষম বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। বর্তমান লেখক তখন কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। ছাত্রদল সাহেব-প্রিন্সিপ্যালকে বলিয়া সেদিন কলেজ কামাই করিয়াছিল। এই উপলক্ষে বম্বের বহু মিল বন্ধ রাখা হইয়াছিল এবং পুলিশের সহিত জনতার সংঘর্ষ বাধিয়াছিল। মুসলমানেরা এই আন্দোলনে যোগদান করে নাই। কিন্তু ইহার ফল হইল এই যে, কারাগার হইতে মুক্তিলাভের পর তিলক সমগ্র ভারতের হিন্দুসম্প্রদায়ের নেতার পদে অধিষ্ঠিত হইলেন।
২. শাসন-সংস্কার
বড়লাট লর্ড কার্জনের জবরদস্ত শাসনে, বিশেষতঃ বঙ্গভঙ্গের ফলে যে দেশময় আন্দোলন হয় এবং ক্রমশঃ উহা সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি করে তাহাতে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট বিচলিত হইলেন। বিশেষতঃ ১৯০৫ সনের শেষভাগে উদারনীতিক দল (Liberal Party) ব্রিটেনের রাজ্যশাসনে ক্ষমতাসীন হইলে এবং লর্ড কার্জনের পদত্যাগ এবং নূতন বড়লাট মিন্টোর আগমনের ফলে ভারতের শাসন সম্বন্ধে নূতন চিন্তাধারার লক্ষণ দেখা দিল। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট বুঝিলেন, কঠোর দমনীতি অবলম্বন করিয়া ভারতে, বিশেষতঃ বঙ্গদেশে, শান্তি ও শৃঙ্খলা আনা প্রয়োজন। কিন্তু কেবল তাহাই যথেষ্ট হইবে না, ভারতীয়দের–অন্ততঃ তাহাদের মধ্যে যাঁহারা নরমপন্থী তাঁহাদের-সন্তোষবিধানের জন্য শাসনসংস্কার করিয়া ভারতীয়দের হস্তে অধিকতর শাসনক্ষমতা দিবার ব্যবস্থা করাও তদ্রপ প্রয়োজন। সুতরাং নূতন ভারত-সচিব মর্লি ও বড়লাট মিন্টো উভয়েই একমত হইয়া নিম্নবর্ণিত কয়েকটি শাসনসংস্কারের ব্যবস্থা করেন।
(১) বিলাতে ভারত-সচিবের সাহায্যার্থে যে একটি কমিটি ছিল তাহার সকল সদস্যই ছিল ইংরেজ। ১৯০৭ সনের নূতন বিধান অনুসারে দুইজন ভারতীয় এই সমিতির সদস্য নিযুক্ত হইলেন–একজন অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালী সিভিলিয়ান (I. c. S) শ্রীকৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত ও আর-একজন মুসলমান, সৈয়দ হোসেন বিলগ্রামী। অবশ্য চৌদ্দজন সদস্যের মধ্যে মাত্র দুইজন ভারতীয়–সুতরাং ইচ্ছা থাকিলেও তাঁহাদের বিশেষ কিছু করিবার ক্ষমতা ছিল না। বিশেষতঃ ইহারা দুইজনই মনোনীত সদস্য। বলা বাহুল্য যে, যাঁহারা ইংরেজ গভর্নমেন্টের অনুগত তাঁহাদের মধ্য হইতেই এই দুই সদস্য মনোনীত হইতেন।
(২) এতদিন পর্যন্ত বড়লাটের মন্ত্রণা-পরিষদের (Executive Council) সদস্যগণ সকলেই ছিলেন ব্রিটিশ। ১৯০৯ সনে এক নূতন বিধানে স্থির হইল, একজন ভারতীয় ইহার সদস্য হইবেন। তদনুসারে বাঙ্গালী ব্যারিষ্টার শ্রীসত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ প্রথম ভারতীয় সদস্য নিযুক্ত হইলেন (২৪শে মার্চ, ১৯০৯)।
(৩) প্রাদেশিক শাসন পরিষদের গঠনে গুরুতর পরিবর্তন হইল। ১৮৯২ সনের আইনে সমগ্র বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার প্রাদেশিক বিধান পরিষদে মাত্র আটজন সদস্য ছিলেন এবং তাঁহারা মিউনিসিপ্যালিটি, জিলা বোর্ড, জমিদার, বিশ্ববিদ্যালয় ও চেম্বার অফ কমার্সের সুপারিশে মনোনীত বা নির্বাচিত হইতেন (তৃতীয় খণ্ড)।
১৯০৯ সনের নূতন আইনে (Indian Councils Act) বঙ্গদেশ শাসনের ব্যবস্থায় যে সমুদয় পরিবর্তন সাধিত হইল তাহার মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :
(ক) প্রাদেশিক বিধানসভায় মনোনীত ও নির্বাচিত ৫১ জন সদস্য থাকিবেন। ইঁহাদের মধ্যে ২৬ জন নির্বাচিত ও ২৫ জন মনোনীত হইবেন। মনোনীতদের মধ্যে ২০ জন থাকিবেন সরকারী কর্মচারী।
নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য-মুসলমান, জমিদার, বিশ্ববিদ্যালয়, চেম্বার অব কমার্স প্রভৃতি বিশিষ্ট সম্প্রদায় বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা নির্বাচিত হইবেন। অবশিষ্ট সদস্য জনসাধারণ নির্বাচিত করিবে।
অন্যূন ২৫ বছর বয়স্ক পুরুষেরাই শুধু সদস্য নির্বাচিত হইতে পারিবে এবং তাহাদের বৃটিশ প্রজা হইতে হইবে। নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা সদস্য হইতে পারিবে নাঃ
(ক) যাহারা সরকারী চাকুরী হইতে বরখাস্ত হইয়াছে;
(খ) আদালতের বিচারে যাহারা ছয় মাসের বেশী কারাদণ্ড হইতে পারে এরূপ অপরাধ করিয়া দণ্ডিত হইয়াছে;
(গ) সপ্তাবে থাকিবার জন্য যাহাদের জামিন দিবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে;
(ঘ) আদালতে ওকালতি-বৃত্তির অধিকার হইতে যাহারা বঞ্চিত হইয়াছে;
(ঙ) অতীত জীবনের কার্য ও ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে যে-সকল ব্যক্তির নির্বাচন জনস্বার্থের অনুকূল নহে বলিয়া সরকার বিজ্ঞাপিত করিয়াছেন।
তবে সপারিষদ গভর্নর-জেনারেল এই পাঁচ শ্রেণীর লোককে নির্বাচন প্রার্থী হইবার অনুমতি দিতে পারেন।
পূর্বেকার বিধানসভার তুলনায় নবগঠিত প্রাদেশিক বিধানসভার ক্ষমতা অনেক বাড়িল। ইহার মধ্যে সরকারী আয়-ব্যয়ের বাজেট সম্বন্ধে বিতর্ক ও আলোচনা বা ইহার সংশোধনের বা পরিবর্তনের প্রস্তাব করার অধিকার থাকিলেও এগুলি গ্রহণ করা বা না-করা গভর্নমেন্টের ইচ্ছাধীন। অন্যান্য বিষয়েও সদস্যেরা জনগণের স্বার্থে যে-কোন প্রস্তাব করিতে পারবেন এবং এ-বিষয়ে ভোটও নেওয়া হইবে। কিন্তু প্রস্তাবগুলি ভোটে অনুমোদিত হইলেও গভর্নমেন্ট তাহা কার্যে পরিণত করিতে বাধ্য থাকিবে না। অর্থাৎ, এইগুলি অনুরোধ মাত্র’, বাধ্যতামূলক নির্দেশ নহে।
নরমপন্থী দল ইংরেজ উপনিবেশের ন্যায় স্বায়ত্তশাসন দাবি করিয়াছিলেন, কিন্তু এই নূতন সংবিধানে তাহার কোন আভাসই নাই। লোকেরা আলোচনা ও বিতর্ক করিবার এবং প্রশ্ন করিবার অধিকার পাইল, কিন্তু শাসনক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে গভর্নমেন্টের হাতেই রহিল।
এই শাসন-সংস্কারের একটি প্রধান লক্ষণীয় বিষয়, চরমপন্থীদের শাসনক্ষমতা হইতে সম্পূর্ণরূপে দূরে রাখা। কারণ গভর্নমেন্ট ইচ্ছা করিলেই এই দলের নেতাদের বিধানসভার সভ্যপদ-প্রার্থী হইবার অনধিকারী বলিয়া ঘোষণা করিতে পারিতেন। ছয়মাসের বেশি জেল খাঁটিলে কেহ বিধানসভার সদস্য হইতে পারিবে না, এই ধারা অনুসারে চরমপন্থী বা সন্ত্রাসবাদীদের কাহারও সদস্য হইবার সম্ভাবনা রহিল না। মোটের উপর নূতন শাসন-সংস্কার বিধির একমাত্র লক্ষ্য ছিল যতটুকু ক্ষমতা ভারতবাসীর হাতে দেওয়া গেল তাহা একমাত্র নরমপন্থীদের হাতেই থাকে। ইহার একমাত্র কারণ এই যে, ভক্ত ও অনুরক্ত রাজনীতিক দল হইতে সরকারের কোন ভয়ের সম্ভাবনা ছিল না।
যখন এই নূতন আইন ঘোষিত হইল তখন সাধারণভাবে বিধানসভায় দেশীয় লোকের সংখ্যা অনেক বাড়িবে বলিয়া নরমপন্থীরা খুব উফুল্ল হইয়াছিলেন। কিন্তু যখন ভারত-সরকার ইহার Regulations বা কার্যপ্রণালীর নিয়ম প্রণয়ন করিলেন তখন দেখা গেল যে প্রকৃত ক্ষমতা কিছুই ভারতবাসীরা পাইল না। তখন নরমপন্থীরা বলিতে লাগিলেন, বিলাতের মন্ত্রীসভা যাহা দিয়াছিলেন কার্যপ্রণালীর নিয়ম অনুসারে তাহা সবই ভুয়া হইয়া গেল। তথাপি তাঁহারা এই আশা পোষণ করিতে থাকিলেন যে, এই নিয়মাবলীর পরিবর্তন হইবে।
নূতন সংস্কারের যে-অংশটি নরমপন্থীরাও আপত্তিজনক মনে করিলেন তাহা হইল মুসলমানদিগের স্বতন্ত্রভাবে বিধানসভার সদস্য নির্বাচনের অধিকার। ইহার ফলে সাম্প্রদায়িক মনোমালিন্য বৃদ্ধি পাইবে ও ভারতের জাতীয়তা বিনষ্ট হইবে, ইহা সকলেই বুঝিয়াছিল। আলিগড়ের মুসলমান নেতা সৈয়দ আহমদ উনিশ শতকের শেষ দশক হইতেই প্রচার করিতেছিলেন যে, হিন্দু ও মুসলমান দুইটি স্বতন্ত্র জাতি। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস বরাবর ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিতেছিল। কিন্তু ১৯০৬ সনের ১লা অক্টোবর মুসলমানসম্প্রদায় লর্ড মিন্টোর নিকট এক ডেপুটেশন পাঠাইয়া এই দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করিয়া প্রার্থনা করিয়াছিল যে, নির্বাচিত বিধানসভায় মুসলমানসম্প্রদায়কে পৃথকভাবে ভোট দিয়া নিজেদের সদস্য নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হউক। মিন্টো এই প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়াছিলেন।
ইহার তিনমাস পরেই ঢাকা শহরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ‘মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠিত হইল (১৯০৬, ৩১শে ডিসেম্বর)। ১৯০৯ সনের নূতন শাসন-সংস্কারে এই পৃথক নির্বাচন কার্যে পরিণত হইল। এইভাবে হিন্দু ও মুসলমানসম্প্রদায়ের মধ্যে ইংরেজ সরকার যে ভেদ ও বিরোধের বীজ বপন করিল, তাহাই কালে পাকিস্তানরূপ এক মহামহীরুহে পরিণত হইল। বড়লাট লর্ড মিন্টোর নিকট মুসলমানদের ডেপুটেশন পৃথক নির্বাচনের যে দাবি জানাইয়াছিল তাহা কেবল বিধানসভার নির্বাচনে সীমাবদ্ধ ছিল না। বড়লাট উত্তরে বলিয়াছিলেন, মিউনিসিপ্যালিটি, জিলা বোর্ড, আইন-পরিষদ-যেখানেই জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হইবে সেখানেই মুসলমানগণ স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসাবে নির্বাচন করিবার অধিকার পাইবে এবং সদস্যসংখ্যা লোকসংখ্যার অনুপাতে নির্ধারিত হইবে না।-–এই সম্প্রদায়ের রাজনীতিক গুরুত্ব এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তাহাদের নিকট হইতে যে উপকার পাইয়াছে তাহারই উপর উহা নির্ভর করিবে।
হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এই ভেদ ও বিরোধ সৃষ্টি করিবার জন্য বড়লাটের নিকট মুসলমানসম্প্রদায়ের ডেপুটেশন, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা এবং ১৯০৯ সনের শাসন-সংস্কার প্রভৃতি যে অনেক পরিমাণে ইংরেজ গভর্নমেন্টরই কূটনীতির ফল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কারণ ইহার সমর্থনে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড, যিনি পরে বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হইয়াছিলেন, তিনি স্বয়ং এইরূপ মত প্রকাশ করিয়াছেন।[২]
হিন্দুসম্প্রদায়ের প্রতি মুসলিমনেতাদের মনোভাব কিরূপ ছিল পূর্বোক্ত সৈয়দ আহমদ ছাড়াও অন্য কয়েকজন মুসলিমনেতার উক্তি হইতে তাহা স্পষ্ট বুঝা যাইবে।
মুসলিম লীগের সেক্রেটারি স্পষ্টই বলিয়াছিলেন, “হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে রাজনীতিক ঐক্য সম্ভব নয়–কারণ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য ও আদর্শ আমাদের লক্ষ্য ও আদর্শ হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন।”
আলিগড় কলেজের ছাত্রদের সম্বোধন করিয়া বকর-উ-মুল্ক বলেন : “ঈশ্বর করুন, ভারতে যদি ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান হয় তাহা হইলে হিন্দুদেরই একচ্ছত্র প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হইবে এবং আমাদের ধন-প্রাণ-সম্পদ সবই বিপন্ন। হইবে। ইহা ঠেকাইবার একমাত্র উপায় ব্রিটিশরাজকে সর্বপ্রকারে সমর্থন করা। আমরা যেন মনে রাখি যে, মুসলমানেরা ব্রিটিশ সৈন্যের একটি শাখা এবং আমরা জীবনপণ করিয়া ব্রিটিশ রাজত্ব রক্ষা করিব।” নবাব মহসিন-উল-মুল্ক বলেন, “হিন্দুদের মতো আমাদের কলমের জোর নাই, কিন্তু আমাদের হাত তরবারি চালাইবার শক্তি রাখে।” বঙ্গদেশের সুপরিচিত মুসলমান নেতা আবদুল্লাহ সুরাওয়ার্দি ১৯০৮ সনে বিলাতে ভারতের জাতীয়তাবাদীতে বিশ্বাসী একজন কলেজের ছাত্র ছিলেন। জিয়াউদ্দিন আহমদও তখন ইউরোপে পাঠ্যাবস্থায় ছিলেন এবং পরে তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলার হইয়াছিলেন। সুরাওয়ার্দি ছিলেন কৃষ্ণবর্মা কর্তৃক লণ্ডনে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় স্বায়ত্তশাসন সমিতির (Home Rule League) সহকারী সভাপতি। জিয়াউদ্দিন সুরাওয়ার্দিকে লিখিলেন, “তুমি কি সত্যই বিশ্বাস কর যে, ভারতবর্ষ স্বায়ত্তশাসন পাইলে মুসলমানদের কোন লাভ হইবে”? Home Rule (স্বায়ত্তশাসন) ছিল আলিগড় অর্থাৎ সৈয়দ আহমদের রাজনীতির বিরোধী এবং আলিগড়-নীতিই ছিল মুসলমানদের, বিশেষতঃ উত্তরভারতের (Upper India) মুসলমানদের রাজনীতি।
মুহম্মদ আলি (যিনি প্রথমে মহাত্মা গান্ধীর অনুরক্ত ভক্ত ছিলেন এবং পরে তাঁহার কুৎসা ও নিন্দায় পঞ্চমুখ হন) ১৯০৮ সনে প্রকাশ্য সভায় বলিয়াছিলেন : “মুসলমান ও হিন্দুর স্বার্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং হিন্দুদের রাজনীতিক আন্দোলনে যোগ দিলে তাহাদের গুরুতর অনিষ্ট হইবে। মুসলমানেরা ভারতবর্ষের জাতীয় ঐক্যের যূপকাষ্ঠে আত্মবলিদান দিবে এরূপ আশা করাই অন্যায়। ইহা করিলে মুসলমানদিগকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু দেবদূতদের (angelic majority) পদানত হইয়া তাঁহাদের দয়ার উপর নির্ভর করিয়াই জীবন যাপন করিতে হইবে।”
ইংরেজ সাংবাদিক ভ্যালেন্টাইন চিরল (Sir Valentine Chirol), সিভিলিয়ান গ্রিফিথস্ এবং অন্যান্য বহু ইংরেজ লেখক মুসলমানদিগের হিন্দুর প্রতি এই বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের উপর সম্পূর্ণ সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাইয়াছেন। গ্রিফিথস্ স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন যে, মুসলমানদের স্বার্থ (interests) ও হিন্দুর স্বার্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন, এবং এই দুইয়ের সম্মিলন (fusion) অসম্ভব।
সমগ্র ভারতবর্ষে-বঙ্গদেশে ও পাঞ্জাবে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল খুব বেশী। তাই এই দুইটি প্রদেশে এই ভেদনীতির ফল বিষময় হইয়াছিল, উপরন্তু এই দুইটি প্রদেশই স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িকভাবে দুইটি খণ্ড দেশে পরিণত হইল। সুতরাং হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমগ্র ভারতের সমস্যা হইলেও বঙ্গদেশের ইতিহাসে ইহার ফল হইয়াছে সর্বাপেক্ষা গুরুতর।
১৯০৯ সনের শাসন-সংস্কার মুসলমানদের পৃথক সম্প্রদায় হিসাবে ভোট দিবার অধিকার দিয়া এই সাম্প্রদায়িক বিভেদকে ভারতের চিরন্তন সমস্যায় পরিণত করিল। বিশেষতঃ গোখেল প্রমুখ হিন্দুনেতারা সর্বদা প্রচার করিতে লাগিলেন যে, ভারতীয় রাজনীতির গোড়ার কথা হইতেছে, হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে আন্তরিক সহযোগিতা না থাকিলে ভারতের জাতীয় জীবনের ভবিষ্যৎ অন্ধকার এবং একথা অস্বীকার করা যায় না যে, বর্তমানে এই জাতীয় ঐক্যের সম্পূর্ণ অভাব। হিন্দুদের এই মনোভাবের সম্পূর্ণ সুযোগ লইয়া মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুদের সঙ্গে রাজনীতিক ঐক্য ও মিলনের মূল্যস্বরূপ তাহাদের অধিকারের দাবি ক্রমশঃই বাড়াইতে লাগিল, ফলে স্বাধীনতালাভের পূর্ব পর্যন্ত ইহা বঙ্গদেশের একটি গুরুতর রাজনীতিক সমস্যা হইয়া দাঁড়াইল।
এই ভেদনীতির ফলে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ভারতীয় রাজনীতির একটি অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হইল। বঙ্গদেশে মৈমনসিংহ ও কুমিল্লায় এবং বঙ্গের বাহিরে পেশওয়ারে (১৯১০), অযোধ্যা ও ফৈজাবাদে (১৯১২), আগ্রায় (১৯১৩), শাহাবাদে (১৯১৭) ও কতরপুরে (১৯১৮) গুরুতর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হইয়াছিল।
বঙ্গভঙ্গের অবসান
১৯১০ সনের নভেম্বর মাসে ভারতের শাসন-বিভাগে দুইটি পরিবর্তন ঘটিল। ভারত-সচিব মণ্টেণ্ড পদত্যাগ করিলেন এবং তাহার স্থানে লর্ড ক্রু উক্ত পদে নিযুক্ত হইলেন। বড়লাট লর্ড মিন্টোর কার্যকাল শেষ হইলে লর্ড হার্ডিং ভারতের বড়লাট হইয়া আসিলেন। তিনি বম্বের মাটিতে পা দিয়াই ঘোষণা করিলেন যে, মহামান্য ব্রিটিশ সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী ১৯১১ সনের ডিসেম্বরে ভারতে আসিয়া দিল্লীতে এক দরবার করিবেন।
কলিকাতায় আসিয়া তিনি বঙ্গদেশের অবস্থা ব্যক্তিগতভাবে পর্যবেক্ষণ করিয়া যে-মন্তব্য লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন তাহার সারমর্ম দিতেছি :
“আমি ভারতে আসিবার পূর্বে শুনিতাম যে, বঙ্গদেশ বিভক্ত হওয়ার ফলে সেখানে বিদ্রোহ খুব ব্যাপকভাবে বিরাজমান। ডাকাতি এবং পুলিশ কর্মচারী ও গুপ্তচরদিগের হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অথচ সাধারণ আদালতের বিচারে অপরাধ প্রমাণ ও অপরাধীর শাস্তি দেওয়া প্রায় অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু কলিকাতায় পৌঁছিয়া রাজনীতিক গোলমাল ও সন্ত্রাসবাদের যে পরিচয় পাইলাম তাহার ধারণাও করিতে পারি নাই। বিশেষতঃ রাজদ্রোহের এত অভিযোগ আদালতে বিচারাধীন আছে যে, এক বৎসরের মধ্যেও বিচার শেষ হইবার সম্ভাবনা নাই। অধিকাংশ অভিযোগই এরূপ যে, তাহা প্রমাণ করিয়া
অভিযুক্তকে শাস্তি দিবার কোন সম্ভাবনা নাই। এগুলি সবই ছোটলাট স্যার এডওয়ার্ড বেকার (Sir Edward Baker) ও তাঁহার আইনজ্ঞ পরামর্শদাতাদের অবিমৃশ্যকারিতার (short sightedness) ফল। ইহার ফলে গভর্নমেন্টের প্রতিপত্তি কমিয়াছে এবং অরাজকতা (lawlessness) বৃদ্ধি পাইয়াছে। সমস্ত অবস্থা উপলব্ধি করিয়া আমি বেকারকে বলিলাম, অযথা এইরূপ অভিযোগ আনা পছন্দ করি না, বিশেষতঃ যখন সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী এক বৎসরের মধ্যেই ভারতে আসিবেন। তাহার পূর্বেই দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা ফিরাইয়া আনা নিতান্ত প্রয়োজন। আমি বেকারকে আরও বলিলাম যে, ভবিষ্যতে রাজনীতিক অপরাধের কোন অভিযোগ আনিবার পূর্বে আমার ব্যক্তিগত অনুমোদন লইতে হইবে, এবং যেসব অভিযোগে অপরাধ প্রমাণিত হইবার সম্ভাবনা নাই সেসব তুলিয়া লইতে হইবে।”
ভারত-সচিব লর্ড ক্রু-ও বঙ্গদেশের বিচারকার্য যেভাবে চলিতেছে তাহাতে গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করিলেন। ইহার ফলে সম্রাট আসিবার পূর্বেই সমস্ত মামলার নিষ্পত্তি হইয়া গেল।
লর্ড ক্রু কিন্তু বুঝিয়াছিলেন যে, এই বিদ্রোহ ও গোলমালের মূল হইতেছে বঙ্গবিভাগ, এবং ইহা রহিত করিয়া সমগ্র বঙ্গদেশকে বম্বে ও মাদ্রাজের ন্যায় একটি গভর্নরশাসিত প্রদেশে পরিণত করিবার প্রস্তাব পাঠাইলেন। হার্ডিং তখন মাত্র দুইমাস হইল ভারতে আসিয়াছেন; সুতরাং তিনি এ-বিষয়ে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে পরামর্শ করিলেন, এবং তাঁহারা সকলেই বিরোধী হওয়ায় লর্ড ক্রু-কে লিখিয়া পাঠাইলেন যে, এই প্রস্তাব গ্রহণ করা অসম্ভব।
কিন্তু কয়েকমাস এদেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিয়া হার্ডিং বুঝিলেন, সমগ্র বঙ্গদেশবাসী বঙ্গভঙ্গের ন্যায় একটি অন্যায় ও অসঙ্গত ব্যাপারের জন্য বিশেষ ক্ষুব্ধ; ইহার প্রতীকার না হইলে অবস্থা উত্তরোত্তর আরও খারাপ হইবে। বিশেষতঃ, কলিকাতা ভারতের রাজধানী হওয়ায় সমগ্র ভারতের রাজনীতিক চিন্তার উপর বাঙ্গালীর প্রভাব খুব বেশি এবং ষড়যন্ত্রে (intrigue) পটু বাঙ্গালীরা সমগ্র ভারতের মন বিষাক্ত করিবার প্রভূত সুযোগ পায়। এই সময় বড়লাটের কাউন্সিলের সদস্য (Home Member) স্যার জন জেঙ্কিন্স (Sir John Jenkins) ১৯১১ সনের ১৭ই জুন তারিখে একটি প্রস্তাব পাঠাইলেন যে, বঙ্গভঙ্গ রহিত করা হউক এবং ভারতের রাজধানী কলিকাতা হইতে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করা হউক। আনুষঙ্গিক পরিবর্তনসহ এই দুইটি বৃহৎ পরিবর্তনের কথাও দিল্লীর দরবারে সম্রাটের মুখে ঘোষণা করা হউক।
এই প্রস্তাব লর্ড হার্ডিং-এর মনঃপূত হইল। তিনি উহা নিম্নলিখিত প্রস্তাবাকারে তাহার গোপনীয় স্মারকলিপির অন্তর্ভুক্ত করিলেন :
(১) ভারতের রাজধানী কলিকাতা হইতে দিল্লীতে স্থানান্তরিতকরণ।
(২) একটি গভর্নরের অধীনে এক নূতন প্রদেশরূপে সমগ্র বঙ্গদেশের পুনর্গঠন।
(৩) বিহার ও উড়িষ্যাকে যুক্ত করিয়া লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে একটি নূতন প্রদেশ গঠন।
(৪) পূর্বের ন্যায় আসামকে পুনরায় চীফ কমিশনারের অধীনে আনয়ন। আশ্চর্যের বিষয়, বড়লাটের কার্যকরী মন্ত্রণাসভার (Executive Council) যেসব সদস্য লর্ড ক্রু-র প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন তাঁহারা সকলেই আবার এই চারিটি প্রস্তাব গ্রহণ করিলেন। স্থির হইল যে, সম্রাট দিল্লী-দরবারে স্বয়ং এই প্রস্ত বিগুলি ঘোষণা করিবেন।
১৯১১ সনের ১৯শে জুলাই লর্ড হাডিং এক সুদীর্ঘ চিঠিতে এই প্রস্তাবসমূহ অনুমোদনের জন্য বিলাতে পাঠাইয়া দিলেন। কয়েকদিন পরই ভারত-সচিব ক্রু-ও টেলিগ্রামে এই সমুদয় প্রস্তাব সমর্থন করিলেন (৭ই অগষ্ট, ১৯১১)। ঐ বৎসরেই ১০ই নভেম্বর তারিখে ব্রিটিশ মন্ত্রীপরিষদ এই প্রস্তাবগুলি গ্রহণ করিলেন।
১৯১১ সনের ১২ই ডিসেম্বর দিল্লীর দরবারের সমাপ্তিকালে ভারতসম্রাট এই পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করিয়া সমগ্র জনতাকে বিস্মিত করিলেন। মুসলমানসম্প্রদায় ও পূর্ববঙ্গের ইংরেজ কর্মচারীরা ইহাতে বিষম ক্ষুব্ধ হইলেন। সমগ্র হিন্দুসম্প্রদায় উল্লসিত হইল। বাঙ্গালীরা কলিকাতা হইতে রাজধানী স্থানান্তরিত করায় অসন্তুষ্ট হইলেন; কিন্তু, ভাঙ্গা বাংলা জোড়া লাগার আনন্দে সে অসন্তোষ চাপা পড়িল। বিলাতে পার্সিয়ামেণ্ট মহাসভায় এক নূতন আইনে (২৫শে জুন, ১৯১২) এই পরিবর্তনগুলি বিধিবদ্ধ হইল। বম্বে এবং মাদ্রাজের ন্যায় বঙ্গদেশকে একজন গভর্নরের ও শাসন পরিষদের অধীন করা হইল। লর্ড কার্জন বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া মন্তব্য করিলেন, এতবড় একটা ব্যাপার পার্লিয়ামেন্টের অজ্ঞাতসারে করা হইল–ইহা অত্যন্ত অন্যায় ও অসঙ্গত। লর্ড ক্রু উত্তর দিলেন, লর্ড কার্জনও পার্লিয়ামেন্টকে না-জানাইয়া বঙ্গব্যবচ্ছেদ করিয়াছিলেন।
খ। ১৯১২-১৯১৭
মহামান্য সম্রাট দিল্লী-দরবারে যে-ঘোষণা করিয়াছিলেন তদনুসারে ১৯১২ সনের ২৫শে জুন বিলাতের পার্সিয়ামেন্টে এক নূতন আইন (Government of India Act, 1912) পাশ হইল। বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া মিলিত পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ বম্বে ও মাদ্রাজের ন্যায় সপারিষদ গভর্নরের অধীনে এক নূতন প্রদেশ (Presidency) হইল। লর্ড কারমাইকেল ইহার প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হইলেন। ভারতের নূতন রাজধানী দিল্লী ও তাহার চতুস্পার্শ্বস্থ স্থান লইয়া একটি নূতন প্রদেশ গঠিত হইল।
লর্ড হার্ডিং-এর মনে-মনে আশা ছিল যে, বঙ্গভঙ্গ রহিত করিয়া বঙ্গদেশ হইতে সন্ত্রাসবাদ দূর করিবেন। কিন্তু কার্যত তাহা হইল না। সন্ত্রাসবাদ বঙ্গদেশে বাড়িয়াই চলিল এবং ক্রমে ক্রমে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়াইয়া পড়িল। ইহার বিস্তৃত বিবরণ পরবর্তী অধ্যায়ে দেওয়া হইবে। কেবল তাহাই নহে, হার্ডিং সাহেব নিজেই বাংলার সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্যস্থল হইলেন।
১৯১২ সনের ২৩শে ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লীকে ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী বলিয়া ঘোষণা করা হইবে এই উদ্দেশ্যে সিমলা হইতে বড়লাট হার্ডিং ট্রেনে দিল্লী আগমন করিলেন। ভারতের রাজন্যবর্গ, প্রধান রাজকর্মচারীবৃন্দ ও বহু বিশিষ্ট নাগরিক সস্ত্রীক বড়লাটকে অভ্যর্থনা করিলেন ও এক বিরাট মিছিল ধীরে ধীরে অগ্রসর হইল। পঞ্চাশটি হাতী ছিল এই মিছিলে এবং পথের দুইধারে ও আশেপাশের বাড়ীতে ও ছাদে ছিল অসংখ্য নরনারী। অপূর্ব সাজে সজ্জিত এক বিশালকায় হস্তীর উপর এক বিরাট হাওদায় সস্ত্রীক লাটসাহেব উপবেশন করিলেন। তিনশত গজ চলার পর বড়লাটের হাতী যখন চাঁদনীচকে ঘড়িঘরের নিকট উপস্থিত হইয়াছে তখন এক কর্ণবিদারী বিরাট শব্দ হইল। ধোয়া সরিয়া গেলে বুঝা গেল, শব্দটি বোমা-বিস্ফোরণের। দেখা গেল, রূপার চাদরে মোড়া হাওদার খানিকটা উড়িয়া গিয়াছে, হাওদার পশ্চাতে ছত্রধারী মৃত এবং লাটসাহেব গুরুতরভাবে আহত। লাটপত্নী হুমড়ি খাইয়া সম্মুখের দিকে পড়িয়া গিয়াছিলেন, কিন্তু আহত হন নাই। কিছুক্ষণ পরেই তিনি সোজা হইয়া বসিলেন। আরও দুইটি লোক বোমার টুকরার আঘাতে প্রাণ হারাইল।
হাতীটি থমকিয়া দাঁড়াইল। লাটসাহেব স্ত্রীকে বলিলেন, “বোধ হয় বোমা।” চলিবার আদেশ দিয়াই তিনি সংজ্ঞাহীন হইলেন। লাটপত্নী হাতী ও মিছিল থামাইয়া উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন লাটসাহেবকে মোটরে করিয়া লইয়া অবিলম্বে চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে। লাটসাহেবের প্রাণরক্ষা হইল, কিছুদিন পর তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হইলেন।
লাটসাহেবকে স্থানান্তর করিয়াই চারিদিকে আততায়ীর সন্ধান লওয়া হইল, কিন্তু লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা ও পুলিশের যথেষ্ট তৎপরতা সত্ত্বেও তাহার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না।
পরবর্তীকালে যেসব প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে তাহাতে বাংলার সন্ত্রাসবাদীদের নেতা রাসবিহারী বসুই যে এই হত্যা-ষড়যন্ত্রের প্রধান নেতা সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু কোথা হইতে কে বোমা ছুঁড়িয়াছিল তাহার নিশ্চিত কোন প্রমাণ অদ্যাবধি পাওয়া যায় নাই। ঘটনার কিছুদিন পরে সিঙ্গাপুর অঞ্চলে রাসবিহারী বসু এক বক্তৃতায় বলেন যে, তিনি স্বহস্তে এই বোমা নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। কিন্তু প্রচলিত ধারণা এই যে, বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী বসন্তকুমার বিশ্বাসই এই বোমাটি নিক্ষেপ করেন। তকালে গুজব ছিল যে, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের দোতলার বারান্দায় বহু স্ত্রীলোক মিছিল দেখিবার জন্য সমবেত হইয়াছিলেন, তাঁহাদেরই একজন এই বোমা নিক্ষেপ করেন, এবং তিনিই স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশধারী বসন্ত কুমার। এই সম্বন্ধে সর্বাপেক্ষা আধুনিক মত এই যে “রাসবিহারী বসু এই ব্যাপারের প্রধান উদ্যোগী ছিলেন, কিন্তু বসন্তকুমার বিশ্বাস রাস্তায় দাঁড়াইয়াই বোমাটি নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, স্ত্রীলোকের বেশে দোতলার বারান্দা হইতে নহে”।[৩] ১৯১৪ সনে দিল্লী-ষড়যন্ত্র মামলায় বসন্তকুমার, অবোধবিহারী, আমিরাদ ও বালমুকুন্দ–এই চারিজনের ফাঁসি হয় (১লা মার্চ, ১৯১৫)। রাসবিহারী ফেরারী আসামীরূপে বাঁচিয়া যান। রাসবিহারী বসুর বিচিত্র বৈপ্লবিক জীবন সম্বন্ধে অন্যত্র আলোচনা করা যাইবে।
লর্ড হার্ডিং আহত অবস্থায় পথেই সংজ্ঞালাভ করিয়া আদেশ দিয়াছিলেন যে, আয়োজিত অনুষ্ঠান যেন কাৰ্যসূচী-অনুসারে নিষ্পন্ন হয়। তদনুসারে দরবারের কার্য যথারীতি সম্পাদিত হইয়াছিল।
লর্ড হার্ডিংকে লক্ষ্য করিয়া বোমানিক্ষেপের ফলে সমগ্র ভারতবর্ষে বিষম ক্রোধ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া হার্ডিং ঘোষণা করিলেন যে, তাঁহার হত্যার এ প্রচেষ্টার ফলে তাঁহার শাসননীতির বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন ঘটিবে না। তিনি মাত্র কয়েকজন দুষ্কৃতকারীকেই এই বোমানিক্ষেপের জন্য দায়ী মনে করেন এবং আশা করেন যে, ক্রমে ভারতবাসীরা তাঁহার শাসনকালে বিশ্বস্ত রাজভক্তের ন্যায় ব্যবহার করিবে এবং শান্তি ও শৃঙ্খলার কোন ব্যাঘাত ঘটাইবে না। গোখেল তাঁহাকে আশ্বাস দিলেন যে, তাঁহার নরমপন্থীদল হার্ডিং-এর কোন কার্যে বাধা দিবে না। ইহাতে বড়লাটের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হইল।
লর্ড হার্ডিং এবং তখনকার অনেকেই বুঝিতে পারেন নাই যে, লর্ড হার্ডিং বোমার প্রথম লক্ষ্যস্থল হইলেও, তাহা কেবল কয়েকজন দুষ্কৃতকারীর কার্য নহে; ইহা নূতন এক জাতীয় আন্দোলনের অভিব্যক্তি এবং এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য স্বাধীনতালাভ, যাহা অচিরেই স্বায়ত্তশাসন (Home Rule) আন্দোলনে আত্মপ্রকাশ করিয়া বিপ্লব ও সন্ত্রাসবাদে আত্মগোপন করিয়াছিল।
গোথেলের আশ্বাসের কোন মূল্যই ছিল না এই কারণে যে, রাজনীতিক্ষেত্রে নরম দলের প্রভাব তখন লোপ পাইয়াছে। এই নিদারুণ সত্যও বড়লাট এবং তাঁহার পারিষদ-দল বুঝিতে পারেন নাই।
লর্ড হার্ডিংকে বোমা মারার ফলে যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছিল তাহা সম্পূর্ণ দূর না হইতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হইল। এই যুদ্ধের বিবরণ বর্তমান গ্রন্থে অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু ইহার ফলে ভারতবর্ষ ও ব্রিটিশ রাজশক্তির সম্বন্ধ কিরূপে প্রভাবান্বিত হইয়াছিল তাহার কিছু আভাস দেওয়া আবশ্যক।
১৯১৪ সনের ৪ঠা অগষ্ট ব্রিটেন জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিল। জার্মানীর মিত্র অষ্ট্রিয়া এবং ইংলণ্ডের মিত্র ফ্রান্স ও রাশিয়া–এই দুইদলের মধ্যে জলে ও স্থলে এবং ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন রণক্ষেত্রে যে ভীষণ যুদ্ধ হয় জগতের ইতিহাসে ইহার পূর্বে সেরূপ আর ঘটে নাই।
১৯১৪ সন : জার্মানী বেলজিয়ামের মধ্যদিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী পাঠাইলে ইংলণ্ড ও ফ্রান্স বেলজিয়ামের স্বাধীনতা রক্ষার্থে অগ্রসর হয়। কিন্তু জার্মানী বেলজিয়াম, ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের সম্মিলিত সৈন্যদলকে পরাজিত করিয়া সমগ্র বেলজিয়াম অধিকার করে এবং ফ্রান্সের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া মান নদীর তীরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ২০ মাইল দূরে পৌঁছে। বেলজিয়ামে ইংরেজদের প্রায় পঞ্চাশ হাজার সৈন্য হত হয়। জার্মানরা রাশিয়াকেও যুদ্ধে পরাজিত করে এবং রাশিয়ার একলক্ষ কুড়ি হাজার সৈন্য জার্মানীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। অক্টোবর মাসের শেষে তুরস্ক জার্মানী ও অষ্ট্রিয়ার সঙ্গে যোগ দিলে একদল ভারতীয় সৈন্য পশ্চিম এশিয়ায় মেসোপটেমিয়া ও প্যালষ্টাইনে তুর্কীসৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য প্রেরিত হয়। নৌবলে বলীয়ান ব্রিটিশ নৌবহর জার্মানীতে যাইবার সমুদ্রপথ অবরোধ করে এবং দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে এক নৌযুদ্ধে জার্মানীকে পরাজিত করে।
১৯১৫ সন : জার্মান সৈন্য পোল্যাণ্ড দখল করে এবং ব্রিটিশ সৈন্য দার্দানেলিসে তুর্কীদের হস্তে পরাজিত হয়। ইতালি, ইংলণ্ড ও ফ্রান্স, রাশিয়ার সঙ্গে যোগ দেয়। অপরপক্ষে বুলগেরিয়া জার্মানীর পক্ষে যোগ দিয়া সার্বিয়া দেশটি অধিকার করে। জার্মানী ডুবোজাহাজের (submarine) সাহায্যে ব্রিটিশের বহু বাণিজ্যতরী এবং লুসিটানিয়া’ নামক ইংরেজদের একখানি যাত্রীজাহাজ ১২০০ যাত্রীসহ ডুবাইয়া দেয়।
১৯১৬ সন : দুই দলে ভীষণ যুদ্ধ চলিতে থাকিলেও এবং বহু লোকক্ষয় হইলেও ইংরেজরা ফ্রান্সে জার্মান সৈন্য হটাইতে পারিল না এবং জার্মানরাও ফরাসি সৈন্যকে দুর্ভেদ্য ভার্জুন সীমান্তে হটাইতে পারিল না। রুমানিয়া ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের সহিত যোগ দিল, কিন্তু জার্মান সৈন্য ঐ দেশ অধিকার করিল। পশ্চিম এশিয়ার একটি বৃহৎ ভারতীয় সৈন্যদল কুট-নামক স্থানে তুর্কীর নিকট আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হইল।
১৯১৭ সন : বাণিজ্যতরী বিনষ্ট হওয়ার ফলে ইংলণ্ডে বিষম খাদ্যসঙ্কট উপস্থিত হইল এই কারণে যে, এই দেশে খাদ্যদ্রব্য বেশীর ভাগই বাহির হইতে সমুদ্রপথে আমদানি হইত। আমেরিকার যুক্তরাজ্যে কয়েকখানি বাণিজ্যতরী জার্মানীর ডুবোজাহাজের আক্রমণে ধ্বংস হয় ও ইহার ফলে যুক্তরাজ্য জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অপরপক্ষে, অন্তর্বিদ্রোহের ফলে রাশিয়া যুদ্ধ চালাইতে অসমর্থ হয়। ফ্রান্সের এক রণক্ষেত্রে (Passchendaele) এই বছরের জুলাই হইতে নভেম্বরের মধ্যে প্রায় তিন লক্ষ ইংরেজ সৈন্য হতাহত হয়। ইতালিও বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মিশর ও আরব দেশ তুর্কীর অধীনতা হইতে মুক্ত হয়। ব্রিটিশ সৈন্যরা পুনরায় কুট দখল করে এবং বাগদাদ অধিকার করে।
১৯১৮ সন : রাশিয়া খুব অপমানজনক শর্তে জার্মানীর সঙ্গে সন্ধি করিতে বাধ্য হয়। রুমানিয়াও জার্মানীর সহিত সন্ধি করে। জার্মান সৈন্য ফ্রান্সে জয়লাভ করিয়া পুনরায় প্যারিসের দিকে অগ্রসর হয়, এবং ইংলিশ চ্যানেল পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছে; অর্থাৎ, এই অপ্রশস্ত জলপথ পার হইলেই জার্মান সৈন্য ইংলণ্ড আক্রমণ করিতে পারে। এই বিপদের সময় আমেরিকা হইতে সৈন্যদল আসিয়া ইংলণ্ড ও ফ্রান্সকে রক্ষা করে এবং জার্মানরা ফ্রান্স ত্যাগ করিয়া পশ্চাদপসরণ করিতে বাধ্য হয়। অতঃপর ফ্রান্স ও ইংরেজের সৈন্যদল জার্মান সৈন্যকে সর্বত্রই হটাইয়া দেয়।
বুলগেরিয়া, তুরস্ক ও অষ্ট্রিয়া সন্ধি করিতে বাধ্য হয়। অবশেষে ১১ই নভেম্বর জার্মানী আত্মসমর্পণ করায় এই যুদ্ধের অবসান হয়। তুরস্কের সুলতান ছিলেন সমস্ত মুসলমান জগতের খলিফা। আরব দেশ (ইসলামের জন্মভূমি) ও অন্যান্য অনেক মুসলিম দেশের উপর তাহার কর্তৃত্ব এই যুদ্ধের ফলে লোপ পাইল। ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ইহার ফলে প্রচণ্ড বিক্ষোভের সৃষ্টি হইল।
বিশ্বযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশরূপে ভারতও এই যুদ্ধে লিপ্ত হইল। ভারতবাসীদের এ বিষয়ে কোন মতামত দিবার প্রয়োজন বা অধিকার ছিল না। দেশীয় রাজন্যবর্গ স্বেচ্ছায় (!) ইংরেজ সরকারকে সাহায্য করিয়াছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যেও একদল যুদ্ধের প্রতি সহানুভূতি দেখাইয়াছিলেন। একদল বাঙ্গালী স্বেচ্ছায় একটি সৈন্যদল গঠন করিয়া রণক্ষেত্রে সাধারণ সৈন্যের সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করিয়াছিল।
কিন্তু ইংরেজ সরকারের ভারতীয় সৈন্যবাহিনী এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বহু রণাঙ্গনে যুদ্ধ করিয়াছে এবং জার্মান সৈন্য যখন দ্রুতবেগে প্যারিসের দিকে অগ্রসর হইতেছিল তখন ভারতের গুর্খা সৈন্যদলের রণকৌশল ও বিক্রমই যে তাহাদের অগ্রগতি রোধের প্রধান কারণ তাহা অনেকেই স্বীকার করিয়াছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভারত হইতে কিরূপ সাহায্য পাইয়াছিল কয়েকটি তুলনামূলক সংখ্যাদ্বারা সে-সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা করা যাইতে পারে। বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ভারতীয় সৈন্যদলে প্রতি বৎসর ১৫,০০০ নূতন সৈন্য ভর্তি করা হইত। ১৯১৬-১৭ সনে ইহার সংখ্যা হয় ১২১,০০০ এবং পরবর্তী বৎসরে ৩০০,০০০ অর্থাৎ তিন লক্ষ। যুদ্ধের সময়ে সামরিক ও বেসামরিক মোট পঞ্চাশ লক্ষ ভারতীয় যুদ্ধের জন্য সংগৃহীত হইয়াছিল। ভারত-সচিব মন্টেগু বলিয়াছেন, “সমগ্র যুদ্ধে ১১,৬১,৭৮৯ জন নূতন ভারতীয় সৈন্য নিযুক্ত হইয়াছিল, ১২,১৫,৩২৮ জন ভারতীয় সৈন্য বিদেশে যুদ্ধ করিয়াছিল, এবং ইহার মধ্যে ১,০১,৪৩৯ জনের মৃত্যু হইয়াছিল।” কেবল এই বিরাট সৈন্যের বেতন নহে, তাহাদের যাতায়াতের খরচও ভারত-সরকারকে বহন করিতে হইয়াছিল। ইহা ছাড়া ভারতবাসীরা নগদে দশ কোটি পাউণ্ড ব্রিটিশ সরকারকে ‘দান’ (?) করে। ইহা ভারত-সরকারের বার্ষিক আয়ের অপেক্ষাও বেশী এবং ইহার ফলে ভারতের জাতীয় ঋণের পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পায়। সমগ্র যুদ্ধের খরচ বাবদ প্রায় তের কোটি পাউণ্ড ভারতের রাজস্ব বহন করে। ইহা ছাড়া কোটি কোটি টাকার মাল সরবরাহ করা হয়। ১,৮৭৪ মাইল রেলওয়ে লাইন, ৬,০০০ গাড়ী, ২৩৭টি রেলওয়ে এন্জিন, ৮৮৩টি ষ্টীমার ও বড় নৌকা, এককোটি কিউবিক ফুট উৎকৃষ্ট কাষ্ঠ এবং আরও অনেক জিনিস সরবরাহ করা হয়।
ইহা সত্ত্বেও ব্রিটিশ যুদ্ধমন্ত্রী লয়েড জর্জ বলিয়াছেন যে, প্রথম প্রথম ভারত সরকার বিশেষ কোন সাহায্য করেন নাই, আমরা চাপ দেওয়ায় বেশকিছু সৈন্য ও মাল-মসলা সরবরাহ করিয়াছিলেন। কিন্তু ভারতের তৎকালীন বড়লাট লর্ড হার্ডিং ভারতের বিরাট পরিমাণ সাহায্যের উল্লেখ করিয়া বলিয়াছিলেন যে, যতদূর সম্ভব আমরা ভারতকে শোষণ করিয়াছিলাম। ভারতে মাত্র ১৫,০০০ সৈন্য রাখিয়া অবশিষ্ট সৈন্য ভারতের বাহিরে পাঠান হইয়াছিল।
যুদ্ধের সময় কংগ্রেসের নরমপন্থী দল রাজভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছিলেন। এ বিষয়ে ১৯১৪ ও ১৯১৫ সনের দুই বাঙ্গালী কংগ্রেস সভাপতির বক্তৃতা ‘হাস্যাস্পদ’ বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি করা হইবে না। ভূপেন্দ্রনাথ বসু বলিলেন, “সাম্রাজ্যের অন্য সকলের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এই চরম সঙ্কটের সময় ভারতের সকল প্রদেশের ও সকল সম্প্রদায়ের লোকের কেবল একমাত্র চিন্তা–আমরা যুদ্ধ করিয়া আমাদের সাম্রাজ্য রক্ষা করিব।” এই প্রসঙ্গে বলা যাইতে পারে যে, যে পঞ্জাব প্রদেশ হইতে সাধারণতঃ ভারত-সরকার সৈন্য সংগ্রহ করেন, সেই প্রদেশ হইতে লোকেরা যুদ্ধে যাইতে অনিচ্ছুক হওয়ায় অকথ্য অত্যাচার করিয়া তাহাদিগকে সৈন্যদলে ভর্তি করা হইত।
মহাত্মা গান্ধী নিজে নূতন সৈন্য সংগ্রহের জন্য ঘুরিয়া বেড়াইতেন; তিনি নিজেই বলিয়াছেন যে, সাধারণ লোকদের সৈন্যদলে ভর্তি হইবার খুবই অনিচ্ছা ছিল এবং তাঁহার বন্ধু ও সহকর্মীরা তাঁহার এই সংগ্রহ-কার্যে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করিত। একদল শিক্ষিত ব্যক্তি সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে যে আগ্রহ দেখাইয়াছিল তাহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, এই সুযোগে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার সুবিধা হইবে।
১৯১৫ সনের সভাপতি সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ (পরবর্তী লর্ড সিংহ) বলিলেন, আজ ভারতের সর্বত্র, উচ্চ নীচ সকল শ্রেণীর মধ্যে, রাজভক্তির প্রবল বন্যা বহিতেছে–শিখ পাঠানের ন্যায় বাঙ্গালীও আজ ম্রাটের পতাকাতলে যুদ্ধ করিবার জন্য ব্যগ্র।
কিন্তু এই সময়ে বাংলা, পঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে–যে তিনটি প্রদেশের উল্লেখ করা হইয়াছে–সন্ত্রাসবাদ ও ইংরেজের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা সেই তিনটি (ও অন্যান্য) প্রদেশে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল।
সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের আর একটি উক্তিও সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি বলিলেন, “আমরা পুনঃ পুনঃ বলিয়াছি, আবার বলিতেছি, এই নিদারুণ সঙ্কটের সময় আমরা গভর্নমেন্টকে কোনরূপে বিব্রত করিতে চাই না। আমার দেশবাসীরা যেভাবে বিনা দ্বিধায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সরকারকে যুদ্ধে সর্বপ্রকার সাহায্য করিয়াছে তাহার জন্য আমরা কোন অনুগ্রহ বা সুবিধার দাবি করিব না।”
এই উক্তি যে কেবল অসত্য নহে, পরন্তু হাস্যাস্পদ, পূর্ব বৎসরের কংগ্রেসে গৃহীত নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি হইতেই তাহা প্রমাণিত হয় : “এই কংগ্রেস আবেদন করিতেছে যে, যেহেতু ভারতের অধিবাসীরা এই বিপদের সময় রাজভক্তির পরিচয় দিয়াছে, অতএব তাহা চিরস্থায়ী ও সুদৃঢ় করিবার জন্য গভর্নমেন্ট কর্তৃক নিম্নলিখিত শাসন-সংস্কারগুলি করা হউক।” এখানে স্পষ্টতঃ রাজভক্তির দোহাই দিয়াই সংস্কারগুলির জন্য আবেদন করা হইয়াছে, “In view of the profound and avowed loyalty”, এই শব্দ কয়টি দিয়া প্রস্তাবটি আরম্ভ করাতেও এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না। পরবর্তী বৎসর (১৯১৫) যখন যুদ্ধে ইংলণ্ডের অবস্থা অতিশয় সঙ্কটাপন্ন, তখনও কংগ্রেস শাসনসংস্কার সম্বন্ধে সুদীর্ঘ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে এবং তাহাদের দাবির লম্বা তালিকা দিয়াছে। সুতরাং সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের উক্তি রাজভক্ত নরমপন্থী দলের নেতাগণকেও হার মানাইয়াছে।
বলা বাহুল্য, অধিকাংশ ভারতবাসীই এই যুদ্ধে ব্রিটিশজাতির সঙ্কটের সুযোগ লইয়া শাসনাধিকার লাভের চেষ্টা করার উদ্দেশ্য সমর্থন করিত। আইরিশ বিদ্রোহীরা বলিত, ইংলণ্ডের বিপদই আয়ার্ল্যাণ্ডের সুযোগ (England’s necessity is Ireland’s opportunity)। খুব অল্পসংখ্যক কয়েকজনকে বাদ দিলে বলা যাইতে পারে যে, ভারতের অধিবাসীরা মনে করিত, ইংলণ্ডের বিপদই ভারতের সুযোগ। নরমপন্থী নেতাদেরও প্রকৃত মনোভাব মোটামুটি এইরূপই ছিল; তাহার প্রমাণ-যুদ্ধের মধ্যেও প্রতিবছর তাহাদের শাসন-সংস্কারের দাবি ক্রমশঃ বাড়িয়াই চলিয়াছিল।
অধিকাংশ ভারতীয়দের মনের ভাব ছিল, যুদ্ধের সুযোগে ব্রিটিশদের নিকট হইতে কিছু সুযোগসুবিধা আদায় করিতে হইবে। মহাত্মা গান্ধী যুদ্ধের সময় গভর্নমেন্টের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি দেখাইয়াছিলেন এবং নূতন সৈন্য সংগ্রহ করিতে ব্যক্তিগতভাবে গভর্নমেন্টের সহিত পূর্ণ সহযোগিতা করিয়াছিলেন। কারণস্বরূপ গান্ধীজি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, তিনি দক্ষিণআফ্রিকায় বুয়ার যুদ্ধের সময় ইংরেজের সাহায্যে আগাইয়া আসেন এবং বিশ্বযুদ্ধের সময় লণ্ডনে ও ভারতের নিজের ভগ্ন স্বাস্থ্য লইয়া সৈন্যসংগ্রহের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাহার কারণ, তাঁহার বিশ্বাস ছিল যে, ইহার ফলে ভারতও অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির ন্যায় স্বায়ত্তশাসন পাইবে। যুদ্ধের সময়ও সন্ত্রাসবাদীদের কার্যপদ্ধতির কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় নাই, বরং যুদ্ধের সুযোগ ভারতে ব্যাপক বিদ্রোহ করার কল্পনায় তাহারা মাতিয়া উঠিয়াছিল। ইহার বিস্তৃত বিবরণ পরবর্তী অধ্যায়ে দেওয়া হইবে। বলা বাহুল্য, গভর্নমেন্টের দমননীতি অব্যাহত ছিল এবং যুদ্ধের সময় ইহা চরমে পৌঁছিল।
১৯১৩ সনে গভর্নমেন্টের নূতন এক আইন দ্বারা ফৌজদারি দণ্ডবিধির গুরুতর পরিবর্তন হইল। ষড়যন্ত্র (conspiracy) এই শব্দের সংজ্ঞা এমন বিস্তৃত করা হইল যে, সরকারের বিরুদ্ধে যে-কোন কার্য বা মতামত ‘ষড়যন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হইতে পারিবে। এই আইনে ইহার শাস্তির পরিমাণও বর্ধিত করা হইল। এই নূতন আইন অনুসারে লর্ড হার্ডিংয়ের উপর বোমা-নিক্ষেপকারীদের বিচার হইল। চারিজনের ফাঁসি ও আর দুইজনের সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হইল।
বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভেই ‘ভারতরক্ষা আইন পাশ করা হইল। এই আইনের খসড়া প্রকাশিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ভারতবর্ষে ইহার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উত্থিত হইল। নরমপন্থী দল কিন্তু ইহা সমর্থন করিল। কারণ, গোখেল হার্ডিংকে (তাহার দেহে বোমানিক্ষেপের পর) প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন যে, অতঃপর বড়লাট যে-কোন আইন পাশ করিতে চাহিলে তাহার দল তাহা সমর্থন করিবে। যদিও এই নূতন আইনের বলে ভারতীয় নাগরিকদের সর্বপ্রকার ব্যক্তিগত ক্রিয়াকলাপ ও চলাফেরার স্বাধীনতা লোপ পাইল, তথাপি নূতন বিধানসভার অধিবেশনে মৃদুস্বরে দুই-একটি আপত্তি করিয়া নরমপন্থী দল এই আইন সমর্থন করিল। সকলে জানিল, ভারতীয়দের সম্মতিক্রমেই এই আইন পাশ হইল। আইনটির সংক্ষিপ্ত মর্ম দিতেছি।
সৈন্য ও নৌবহরের সর্বপ্রকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হইল। সরকার ইচ্ছা করিলে যে-কোন অপরাধীকে সাধারণ বিচারালয়ের পরিবর্তে স্থানীয় সরকারের মনোনীত তিনজনের কমিটির নিকট অভিযুক্ত করিতে পারিবে। এই কমিটি (Special Tribunal) ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের পদ্ধতি অনুসরণ না করিয়া নিজেদের ইচ্ছামত সরাসরি বিচার করিয়া ভারতরক্ষা আইন লঙ্ন করার অপরাধে যে-কোন ব্যক্তিকে ফাঁসি, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর অথবা দশ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিতে পারিবে এবং এই আদেশের বিরুদ্ধে কোন আপিল করা যাইবে না। ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে সাক্ষ্য গ্রহণ ও তাহার সত্যাসত্য নির্ণয়ের যেসব বিধিনিষেধ আছে, এই বিশেষ বিচার কমিটি (Special Tribunal) তাহা মানিতে বাধ্য থাকিবে না।
ভারতরক্ষা আইনের বলে ভারত সরকার যে-সমস্ত বিধিনিষেধ ঘোষণা করিবেন তাহা লঙ্ঘন করিলেই পূর্বোক্ত পদ্ধতিতে ইহার বিচার হইবে। অর্থাৎ সরকার যাহা আদেশ করিবে তাহাই আইন, এবং তাহা লঙ্ন করিলে উক্ত বিশেষ কমিটির দ্বারা বিচাররূপ প্রহসনের বলে যে-কোন ভারতীয় নাগরিক ফাঁসি, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর ও দশ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইতে পারিবে।
এইরূপ সরকারী আদেশের কয়েকটি নমুনা দিতেছি :
(১) সরকারের যদি সন্দেহ হয় যে, কোন ব্যক্তি সাধারণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হইতে পারে এমন কোন কার্য করিয়াছে বা করিতেছে–এমনকি, করিবার সংকল্প করিয়াছে, তবে তাহাকে এইরূপ নির্দেশ দেওয়া হইতে পারে যে :
(ক) সে কোন নির্দিষ্ট স্থানে যাইতে বা থাকিতে পারিবে না;
(খ) কোন নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই বাস করিতে হইবে;
(গ) ব্যক্তিগত সম্পত্তি সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা করিতে পারিবে বা পারিবে না, এ নির্দেশও সরকার দিতে পারিবে।
(২) সন্দেহের উদ্রেক হইলেই সরকারের আদেশে যে-কোন সামরিক বা বেসামরিক কর্মচারী যে-কোন বাড়ীতে প্রবেশ ও খানাতল্লাসী করিতে পারিবে এবং সেই বাড়ীতে সন্দেহজনক কোন দ্রব্যাদি, যাহা জনসাধারণের শান্তিভঙ্গ বা দেশরক্ষার বিঘ্নকারী বলিয়া মনে হইবে তাহা বাজেয়াপ্ত করিতে পারিবে।
(৩) কোন ব্যক্তি এই আইন অথবা ইহার অনুযায়ী কোন সরকারী বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করিয়াছে, এরূপ প্রমাণ পাইলে বা সন্দেহ হইলে সেই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করিবে। ( মোটের উপর যে-কেহ দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হইবার কারণ হইয়াছে বা হইতে পারে, এরূপ সন্দেহ মাত্রেই যে-কোন সরকারী কর্মচারী তাহার সম্বন্ধে যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে। এক কথায় আইন-কানুন দেশ হইতে লুপ্ত হইল এবং সরকারের আদেশই তাহার স্থান অধিকার করিল।
এই আইনের বলে বিশেষ বিচার কমিটির কাছে নয়টি রাজনীতিক দলের বিচার হয়। এই দলগুলির সদস্য সংখ্যা ১৭৫। ইহাদের মধ্যে ৩৮ জনের ফাঁসি, ৫৮ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর এবং ৫৮ জনের নির্দিষ্টকালের জন্য দ্বীপান্তর বা সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
এই বিশেষ বিচার কমিটির বিচারের নমুনা বড়লাট লর্ড হার্ডিং স্বয়ং বিবৃত করিয়াছেন। লাহোরের একটি মামলায় এই কমিটি ২৪ জনের প্রাণদণ্ড দেন। লর্ড হার্ডিং বিচলিত হইয়া পঞ্জাবের ছোটলাট সার মাইকেল ও’ডায়ারকে (Sir Michael O’Dyer) বলেন, হত্যা ও ডাকাতির অপরাধ মাত্র ছয়জনের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হইয়াছে। সুতরাং আমি এই ব্যাপক প্রাণদণ্ডের আদেশ অনুমোদন করি না। ইহার ফলে ছোটলাট ইহাদের মধ্যে মাত্র ছয়জনের প্রাণদণ্ড রহিত করিলেন। বড়লাট তখন বাকী কয়জনের সম্বন্ধে তাঁহার শাসন-পরিষদের আইনসদস্যের মতামত চাহিলেন। তিনি বলিলেন, অপরাধীদের মধ্যে ছয়জন ছাড়া বাকী ১৮ জনের বিরুদ্ধে যে অপরাধের অভিযোগ তাহাতে প্রাণদণ্ড হইতেই পারে না। বড়লাটের শাসন পরিষদও এই মত গ্রহণ করিলেন। কিন্তু বিশেষ কমিটির বিচারের বিরুদ্ধে আপীল করার ব্যবস্থা নাই। সুতরাং বড়লাট নিজের দায়িত্বে এই ১৮ জনের প্রাণদণ্ড রহিত করিলেন।
পূর্বোক্ত ভারতরক্ষা আইনের ১ (খ) নিয়মানুযায়ী সরকারী আদেশ অনুসারে বঙ্গদেশের সরকার প্রায় আটশত লোককে কোন নির্দিষ্ট স্থানে, সাধারণতঃ অস্বাস্থ্যকর জিলায়, শাসনকেন্দ্র হইতে দূরবর্তী কোন গণ্ডগ্রামে আটক রাখার ব্যবস্থা করিয়া অন্তরীণ করিয়া রাখে। ইহাদের কোন কোন স্থানে সাপের ভয় যথেষ্ট ছিল। বঙ্গদেশের ছোটলাট স্বীকার করিয়াছেন, ইহাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তাহা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় নাই। আমরা বিনা প্রমাণে কাহাকেও আটক করি নাই, তবে একথা স্বীকার করি যে, প্রমাণ যাহা পাইয়াছি তাহার বলে অনেক স্থলেই সাধারণ বিচারালয় কাহাকেও দোষী সাব্যস্ত করিবে না।’
বঙ্গদেশের পূর্বোক্ত লাট কারমাইকেল ও পরবর্তী লাট রোনাল্ডশে দুইজনই বলিয়াছেন, অন্তরীণে আবদ্ধ অধিকাংশ ব্যক্তিই নিজের অপরাধ স্বীকার করিয়াছে। এই স্বীকারোক্তি যে উপরওয়ালার নিকট কৃতিত্ব দেখাইবার জন্য পুলিশ অসহায় কয়েদীর মুখ হইতে অধিকাংশ স্থলেই জোর করিয়া বা ভয় দেখাইয়া অথবা অত্যাচার করিয়া আদায় করিত সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। একাধিক হাইকোর্টের জজ স্পষ্টভাষায় পুলিশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনিয়াছেন এবং ইহার প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করিয়াছেন যে অনেক স্থলেই অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করিয়াছে এবং বলিয়াছে যে ভয় দেখাইয়া এবং অত্যাচার করিয়া পুলিশ স্বীকারোক্তি আদায় করিয়াছে।
অন্তরীণে আবদ্ধ অনেক ব্যক্তি মুক্তিলাভের পর অভিযোগ করিয়াছে, পুলিশের অকথ্য অত্যাচারের ভয়ে বা যাতনা এড়াইবার জন্য তাহারা মিথ্যা স্বীকারোক্তি করিয়াছে। কী প্রকার যন্ত্রণা দিয়া বা অত্যাচার করিয়া স্বীকারোক্তি আদায় করা হইত তন্মধ্যে কয়েকটির উল্লেখও তাহারা করিয়াছে : (১) দিনের পর দিন হাতকড়ি দিয়া ঝুলাইয়া রাখা; (২) দেহের বিভিন্ন অংশে জোর করিয়া আলপিন দিয়া বিদ্ধ করা; (৩) মুখের মধ্যে জোর করিয়া বিষ্ঠা প্রদান।
অন্তরীণে আবদ্ধ এইসকল বন্দীদের দুর্দশা বর্ণনা করিয়া বাংলার অন্যতম নেতা শ্রীঅখিলচন্দ্র দত্ত বঙ্গীয় প্রভিন্সিয়াল কনফারেন্সের অধিবেশনে (১৯১৮, ৩০শে ও ৩১শে মার্চ) বলিয়াছেন :
“তাহাদের অনেকের নির্জনবাসের একমাত্র সঙ্গী সর্পকুল। অনেকে পীড়িত হইয়াও নির্জন গৃহে একাকী বাস করিতে বাধ্য হয়। অনেককে এমন ছোট চালাঘরে বাস করিতে হয় যাহার মধ্যে বায়ু ও রৌদ্র প্রবেশ করিতে পারে না। অনেকে বহু আবেদন-নিবেদন করিয়া পুস্তক বা সংবাদপত্র পায় না। এইসব দুঃখ দুর্দশায় তাহারা অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে। সুতরাং আমি এসবের বিস্তৃত বিবরণ দিতে চাহি না। কিন্তু আপনাদিগকে একবার স্মরণ করিতে বলি, কী নির্মম অত্যাচারের ফলেই অধ্যাপক শেঠ এবং চণ্ডীচরণ নাগের অকালমৃত্যু ঘটিয়াছে–ডুলাণ্ডা হাউসের ক্ষুদ্র কক্ষে নির্জনবাসের ফলে! কয়জন যুবক আত্মহত্যা করিয়া ভবযন্ত্রণা হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছে। আপনারা একবার অনুসন্ধান করুন, কী নির্মম অত্যাচারের ফলে তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ উন্মাদ হইয়াছে অথবা অনশন্ত্রত গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে।”
শ্রীঅখিলচন্দ্র দত্ত যাহা বলিয়াছিলেন তাহার কয়েকটি সুপরিচিত দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিতেছি : খুলনা জিলার অন্তর্গত দৌলতপুর কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ শ্ৰীমনীন্দ্রনাথ শেঠ এম.এস.সি. ১৯১৭ সনের ২৮শে অগষ্ট গ্রেপ্তার হন এবং তাঁহাকে একটি নির্জন ক্ষুদ্র কক্ষে রাখা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে তাঁহার উন্মাদের লক্ষণ দেখা দেয়, নভেম্বর মাসে তাঁহার যক্ষ্মারোগ হয় এবং ১৯১৮ সনের ১৬ই জানুআরি তাঁহার মৃত্যু হয়। হুগলী কলেজের অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের কাহিনী আরও শোচনীয়। ১৯১৭ সনের ৩রা জানুআরি তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিয়া একটি ক্ষুদ্র নির্জন কক্ষে আটক রাখা হয়। প্রথমে তাঁহার মধ্যে উন্মাদের লক্ষণ দেখা যায়, ক্রমে ক্রমে ‘কোমা’র (coma) ভাব হয়। নাক দিয়া আহার্য প্রবেশ করাইয়া তাঁহাকে বাঁচাইয়া রাখা হয়। কিন্তু তিনি মূক, উদ্ভ্রান্তদৃষ্টি, অসাড়, পক্ষাঘাতগ্রস্ত অচেতন পদার্থে পরিণত হন। তাঁহার শোকাতুরা জননী ছোট বড় অনেক সরকারী কর্মচারী, এমনকি বড়লাটের কাছেও প্রার্থনা জানান যাহাতে তাঁহার মৃতকল্প পুত্রকে তাহার ক্রোড়েই জীবনলীলার অবসান করিতে দেওয়া হয়। কিন্তু কোন ফলই হইল না।
বন্দীদের এইপ্রকার পরিণতি যে কারাগারের অভ্যন্তরে পুলিশের অমানুষিক অত্যাচারেরই ফল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। স্বাধীনতালাভের পর মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েকজন বন্দীর এইসব নির্মম অত্যাচার ভোগের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান কর্তৃক গ্যাসের কামরায় বিষাক্ত বাস্পের সাহায্যে শত শত বন্দীর এককালীন হত্যার কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়। প্রভেদ এই যে, জার্মান সরকার বহু বন্দীকে একসঙ্গে হত্যা করিয়াছিল, আর ইংরেজ গভর্নমেন্ট পৃথক্ পৃথক ভাবে নির্মম অত্যাচারে তিলে তিলে এক-একজনকে মৃত্যুমুখে প্রেরণ করিয়াছে। প্রসিদ্ধ ইংরেজ দার্শনিক বাট্রাণ্ড রাসেল যথার্থভাবেই এইসব ভারতীয় বন্দীদের প্রতি নির্মম অত্যাচারের সহিত নাৎসী গভর্নমেন্টের গ্যাস-প্রয়োগে ইহুদী হত্যার তুলনা করিয়াছেন। নাৎসী যুদ্ধাপরাধীর যেরূপ বিচার হইয়াছিল, ভারতীয় পুলিশ ও কারাগারের কর্মচারীদেরও সেরূপ বিচার হইলে মনুষ্যজাতির ইতিহাসে আর-একটি অমানুষিক নিষ্ঠুরতার কাহিনী যুক্ত হইত।
অদৃষ্টের পরিহাস এই যে, এইসকল বন্দীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তাহার সমর্থক প্রধান প্রমাণ ছিল একদল গুপ্তচরের মনগড়া কাহিনী। এইসব কাহিনী বন্দীদের গোচরীভূত করিয়া তাহার অসত্যতা প্রমাণের কোন সুযোগই দেওয়া হয় নাই; ফলে অর্থলোভে এইসব পৈশাচিক গুপ্তচরের কল্পিত কাহিনীই গভর্নমেন্ট ও তাহাদের নিযুক্ত তদন্ত কমিটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ বলিয়াই গ্রহণ করিত।
নির্জন কারাগারে বিনাবিচারে আবদ্ধ বন্দীদের প্রতি এই নির্মম ও অমানুষিক অত্যাচার ভারতে ইংরেজরাজত্বের চরম দুর্নীতি, অমার্জনীয় অত্যাচার এবং দুরপনেয় কলঙ্ক বলিয়া চিরদিন ইতিহাসে ঘোষিত হইবে।
৩. ভারতীয় রাজনীতি ও শাসন-সংস্কার (১৯১৭-১৯২০)
বিংশ শতাব্দীতে ইংরেজের শাসননীতির একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, হিন্দুদের কল্পিত দেবদেবীর ন্যায় তাহাদের একহাতে ছিল খড়গ, অপর হাতে বরাভয়। ১৯০৮ সনের দমননীতির সঙ্গে ১৯০৯ সনের শাসন-সংস্কারও অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার দমননীতি ও অত্যাচারের যে কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে, যুদ্ধশেষে তাহার পরিপূরক হিসাবে শাসন-সংস্কারেরও সম্ভাবনা দেখা দিল। ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রেও একদিকে যেমন ছিল সন্ত্রাসবাদ, অপরদিকেও তেমনি ছিল শান্তি পূর্ণ উপায়ে স্বায়ত্তশাসন অধিকারের জন্য কংগ্রেসী রাজনীতিকদের প্রয়াস। ১৯১২ সনে বঙ্গভঙ্গের অবসানে এই বৈশিষ্ট্যগুলির ফলেই ভারতের রাজনৈতিক বিবর্তন ঘটিয়াছে। পূর্ববর্তী দুই অধ্যায়ে দমননীতি ও সন্ত্রাসবাদের বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। অতঃপর আমরা শাসন-সংস্কারের বিষয় আলোচনা করিব।
জার্মানী নিরপরাধ বেলজিয়মকে আক্রমণ ও অধিকার করিয়া যে বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে এবং ইংলণ্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকার যুক্তরাজ্য-এই তিনটি মিত্রশক্তি এই অন্যায়ের প্রতীকারে জার্মানীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। বস্তুতঃ এই বিশ্বযুদ্ধ যে কেবলমাত্র নৈতিক কারণেই ঘটিয়াছিল, তাহা নহে। সাম্রাজ্যবাদী নববলে বলীয়ান জার্মানীর শক্তি খর্ব করাই ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে স্বার্থসিদ্ধিমূলক অনেক কার্যই বড় বড় আদর্শের মুখোস পরিয়া সাধারণতঃ আত্মপ্রকাশ করে। এইজন্যই মিত্রশক্তি প্রথম হইতেই ঘোষণা করিল যে, জগতে স্বৈরতন্ত্র হইতে গণতন্ত্র রক্ষা করিবার জন্যই তাহারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়াছে। তাহাদের পুনঃপুনঃ প্রচারিত ঘোষণার মর্ম এই যে, মিত্রশক্তির মুখ্য উদ্দেশ্য, জগতে ছোট বড় সকল জাতিই যাহাতে স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া নিজেদের ইচ্ছামত দেশশাসন করিতে পারে এবং কোন দেশ অন্য দেশের উপর কোনপ্রকার প্রভুত্ব স্থাপন করিতে না পারে–ইহার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করাই তাহাদের লক্ষ্য। অন্তরের ভাব যাহাই হোক, তাহাদের মুখের কথা ভারতীয় দাবির সম্পূর্ণ অনুকূল হইল। ইংলণ্ডের প্রধানমন্ত্রী অ্যাসকুইথ (Asquith) তাঁহার দেশবাসীর নিকট আবেগময় ভাষায় বলিলেন, জার্মানী ইংলণ্ড জয় করিয়া এই দেশ শাসন করিতেছে, কর আদায় করিতেছে, সমস্ত উচ্চ রাজপদে জার্মানরাই অধিষ্ঠিত এবং তাহারাই ইংলণ্ডের আইন প্রণয়ন করিতেছে, বৈদেশিক নীতি গঠন করিতেছে–বিদেশীর অধীনতার এইপ্রকার চরম দুর্গতির কথা কল্পনা করাও অসম্ভব। এই বক্তৃতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবাসীদের মনে এই কথাই জাগিত যে, আমাদের দেশে ইংরেজজাতি তো ঠিক এইরকমই প্রভুত্ব করিতেছে! ইংলণ্ডের প্রধান মন্ত্রী যে-পরাধীনতা অসহ্য বলিয়া মনে করেন, আমরাও ইংরেজজাতির প্রভুত্ব তেমনি অসহ্য বলিয়া মনে করি এবং স্বায়ত্তশাসন (Home-Rule) দাবি করি। সুতরাং ভারতবাসীর এই চিন্তা ও মনোভাব সমগ্র দেশে সোচ্চার হইয়া উঠিল। এই মহান আদর্শের স্বীকৃতি এবং যুদ্ধে ভারতের সৈন্য, অর্থ ও যুদ্ধোপকরণের সরবরাহ–এই দুই দাবিতে ভারতবাসীরা স্বায়ত্তশাসনের ন্যায্য দাবি প্রচার করিতে লাগিল। ১৯১৬ সনের কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে এই দাবি সমর্থন করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হইল। এ বিষয়ে হিন্দু, মুসলমান-নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে মতের কোন অনৈক্য ছিল না। এই ঐক্যের ফলে ১৯০৭ সনে সুরাট কংগ্রেসের পর চরমপন্থী ও নরমপন্থী দলের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটিয়াছিল, তাহাও মিটিয়া গেল এবং হিন্দু মুসলমানের মধ্যেও রাজনীতিক দাবি সম্বন্ধে একটা বোঝাপড়া হইল। কিন্তু, যুদ্ধ শেষ না হইলে যে ইংলণ্ড ভারতকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিবে এরূপ সম্ভাবনা দেখা গেল না। সুতরাং অ্যানি বেসান্ট (Mrs. Annie Besant) ও বালগঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসন (Home Rule) আন্দোলন সমগ্র দেশে বিষম উত্তেজনার সৃষ্টি করিল। বঙ্গদেশেও এই আন্দোলন দেখা দিয়াছিল, কিন্তু উপযুক্ত নেতার অভাবে তাহা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই।
হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে রাজনীতিক ঐক্যের ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশন ১৯১৫ ও ১৯১৬ সনের একই স্থানে এবং একই সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হইল। ১৯১৬ সনে লখনৌতে এই দুইটি সংগঠন একই শাসন-সংস্কারের দাবি করিল। প্রস্তাবিত এই সংস্কারের মধ্যে একটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সমগ্র ভারতের ও প্রতিটি প্রদেশের বিধানসভার সদস্যের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হইল, এবং এই মুসলমান সদস্যগণের নির্বাচনে কেবল মুসলমানেরাই ভোট দিবে এইরূপ নির্দেশ দেওয়া হইল। কংগ্রেস এই প্রস্তাবে সম্মত হওয়ায় প্রকারান্তরে স্বীকার করিল যে, হিন্দু ও মুসলমান–দুইটি ভিন্ন জাতি এবং ইহাদের স্বার্থ, লক্ষ্য ও কার্যপ্রণালী স্বতন্ত্র। উনিশ শতকের শেষে সৈয়দ আহমদ আলিগড়ে সর্বপ্রথম এই দাবি উত্থাপিত করেন, এই ভিত্তিতেই তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে হিন্দুর প্রতিষ্ঠান বলিয়া ঘোষণা করেন এবং মুসলমানদের কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদান করিতে নিষেধ করেন। কংগ্রেসের নেতারা এই দাবি পূর্বে কখনও স্বীকার করেন নাই বরং বরাবরই এই দাবির বিরোধিতা করিয়াছেন। কিন্তু লখনৌতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের শাসন-সংস্কারের দাবিতে উপরোক্ত দ্বিজাতিতত্ত্ব ও উভয়ের স্বার্থ ও লক্ষ্যের বিভিন্নতা পরোক্ষভাবে স্বীকার করা হইল। ত্রিশ বৎসর পরে স্বাধীন ভারতের এক অংশ পৃথক করিয়া মুসলমানদের জন্য যে পাকিস্তানের সৃষ্টি করা হইল–তাহার ভিত্তি যে হিন্দু মুসলমানের সম্মতিতে লখনৌতেই ১৯১৬ সনে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, এই সত্য অস্বীকার করা কঠিন।
বঙ্গদেশের আধুনিক যুগের ইতিহাসে ১৯১৬ সন একটি স্মরণীয় বৎসর। ১৯০৫ সনে কার্জন যাহা করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন, কিন্তু বঙ্গদেশের তীব্র আন্দোলনের ফলে উহাতে ব্যর্থ হইয়াছিলেন, কংগ্রেসের হিন্দুনেতারা রাজনীতিক কারণে মুসলমান তোষণের মূল্যস্বরূপ তাহাই স্বেচ্ছায় স্বীকার করিয়া লইলেন এবং ইংরেজশাসনের শ্রেষ্ঠ দান ভারতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মূলে প্রথম কুঠারাঘাত করিলেন। ইহার প্রথম ফল অচিরেই দেখা গেল। যুদ্ধের শেষভাগে ভারত-সচিব মন্টেগু ১৯১৭ সনের ২০শে অগষ্ট পার্লিয়মেন্ট মহাসভায় ঘোষণা করিলেন, ভারতে সম্পূর্ণ দায়িত্বভারসম্পন্ন শাসনাধিকার (Responsible Goverment) প্রতিষ্ঠাই ভারত গভর্নমেন্টের লক্ষ্য ও নীতি এবং ইহা সাধনের জন্য ভারত শাসনের সর্ববিভাগে তাহাদিগকে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়া ক্রমে ক্রমে স্বায়ত্তশাসনের উপযুক্ত করিয়া গড়িয়া তোলার ব্যবস্থা করা হইবে। এই উদ্দেশ্যে যত শীঘ্র সম্ভব বর্তমান শাসনপদ্ধতির তদনুযায়ী পরিবর্তন আরম্ভ করা হইবে।
এই ঘোষণায় নরমপন্থী দল খুব উল্লসিত হইলেও চরমপন্থী দল বিশেষ সন্তুষ্ট হইল না। কেননা, পুরাপুরি স্বায়ত্তশাসন কবে দেওয়া হইবে তাহার কোন আভাস মন্টের ঘোষণায় ছিল না। কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশন উপলক্ষে ইহার প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হইয়া উঠিল। চরমপন্থীদল অ্যানি বেসান্টকে সভাপতি করার প্রস্তাব করিলে নরমপন্থী দল ইহাতে আপত্তি করিল। অনেক বাদানুবাদের পর অ্যানি বেসান্টই সভাপতি নির্বাচিত হইলেন। ১৯১৭ সনে কলিকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে মন্টের ঘোষণা সম্বন্ধে আলোচনা হইবে, এইজন্য ৪,৯৬৭ জন প্রতিনিধি এবং প্রায় পাঁচ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন। অনেক বাদানুবাদের পর একটি আপোষ রফা হইল। নরম দলের তুষ্টির জন্য মন্টেগুর ঘোষণায় সন্তোষ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হইল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইহাও যোগ করা হইল যে, যে নূতন বিধান দ্বারা মন্টের ঘোষণা কার্যকরী হইবে তাহাতে উল্লেখ থাকিবে যে একটি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হইবে।
প্রস্তাবিত সংস্কার সম্বন্ধে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ও ভারত-সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য মন্টেগু ভারতবর্ষে আসিলেন (১০ই নভেম্বর, ১৯১৭)। এই অভূতপূর্ব ঘটনায় সমগ্র ভারতবর্ষে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি হইল, আসন্ন শাসন সংস্কারই একমাত্র আলোচনা ও আন্দোলনের বিষয় হইল, এবং দলনির্বিশেষে সকলেই মন্টেগুকে স্বাগত অভিনন্দন জানাইলেন। মন্টেগু বম্বে পৌঁছিলে এক বিরাট জনতার পুরোভাগে তিলক স্বয়ং মন্টেগুকে অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহার স্বায়ত্তশাসন সমিতির (Home Rule League) পক্ষ হইতে মন্টেগুর গলায় মালা পরাইয়া দিলেন।
মন্টেগু দিল্লীতে পৌঁছিয়া বহু রাজনীতিক দলের নেতা ও প্রতিনিধির সঙ্গে শাসন-সংস্কার বিষয়ে আলোচনা করিলেন। তারপর ভারত-সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সঙ্গেও পরামর্শ করিলেন। রিপোর্ট লেখা শেষ হইলে ১৯১৮ সনের ২২শে এপ্রিল মন্টেগু ও বড়লাট চেমসফোর্ড ইহাতে সহি করিলেন। এইজন্য এই রিপোর্ট ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্ট’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। তাঁহাদের পরামর্শদাতারূপে চারিজনের একটি ছোট কমিটি গঠিত হইয়াছিল। কমিটির সভ্যরাও ইহাতে সহি করিলেন। ইঁহাদের মধ্যে ভারতবাসী মাত্র একজনই ছিলেন –তিনি শ্রীভূপেন্দ্রনাথ বসু। ১৯১৮ সনের ৮ই জুলাই এই রিপোর্ট প্রকাশিত হইল।
বলা বাহুল্য, রিপোর্ট প্রকাশিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিক দলের ও নেতাদের মধ্যে আলোচনা ও বাদবিতণ্ডা আরম্ভ হইল। নরমপন্থী দল ইহাকে প্রগতিশীল ও মোটামুটি সন্তোষজনক বলিয়া স্বাগত জানাইল। কিন্তু ইহার যে আরও কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন প্রয়োজন, তাহাও দাবি করিল। চরমপন্থীর একদল ইহা একেবারেই অকিঞ্চিকর ও গ্রহণের অযোগ্য বলিয়া ঘোষণা করিল। এই দুইয়ের মধ্যবর্তী একদল মন্তব্য করিল যে, রিপোর্টটি সন্তোষজনক নহে। বিশেষ পরিবর্তন না হইলে উহা খুব কার্যকরী হইবে না। তবে বর্জন না করিয়া তাহা সংশোধনের চেষ্টা করাই উচিত। সম্ভবতঃ এই তৃতীয় দলই সংখ্যায় বেশি ছিল এবং নরমপন্থীদের সহিত ইহাদের মতভেদ খুব গুরুতর ছিল না। কিন্তু, নরমপন্থী দল কংগ্রেসের সাম্প্রতিক লখনৌ ও কলিকাতা অধিবেশনের অভিজ্ঞতা হইতেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, দেশে তাহাদের প্রভাব খুবই কমিয়া গিয়াছে। রিপোর্ট সম্বন্ধে আলোচনা হইতে নেতারা এই সিদ্ধান্ত করিলেন যে, দেশের অধিকাংশ লোকই মন্টেগু রিপোর্টের বিরোধী হইবে। তাই তাহাদের পুরাপুরি সমর্থন ও সাহায্য না পাইলে হয়ত এই রিপোর্ট-অনুযায়ী শাসন-সংস্কার হইবে না। সুতরাং এই রিপোর্ট আলোচনা করিবার জন্য কংগ্রেসের একটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইবে স্থির হইলে তাহাদের এই আশঙ্কা হইল যে, বিরোধীদলের প্রভাবে রিপোর্ট পুরাপরি বর্জন করার সিদ্ধান্তই হয়ত কংগ্রেস গ্রহণ করিবে এবং তাহাদের জীবনব্যাপী সাধনায় যে ফল প্রায় হাতের মুঠায় আসিয়া গিয়াছে তাহা হস্তচ্যুত হইবে; ফলে তাহাদের শ্রম ও অধ্যবসায় ব্যর্থ হইয়া যাইবে। এইসব চিন্তা করিয়া নরমপন্থীগণ স্থির করিল তাহারা কংগ্রেসের এই বিশেষ অধিবেশনে যোগদান করিবে না।
১৯০৭ সনে সুরাট কংগ্রেসে যে তাণ্ডবলীলা অনুষ্ঠিত হইয়াছিল তাহার ফলে কংগ্রেসে প্রথম ভাঙ্গন ধরে এবং চরমপন্থী দল কংগ্রেস হইতে বহিষ্কৃত হয়। কিন্তু ১৯১৬ সনে লখনৌ কংগ্রেসে আবার দুইদলের মিলন হইয়াছিল। কিন্তু ১৯১৮ সনের ২৯শে অগষ্ট বম্বেতে কংগ্রেসের যে অধিবেশন হয় তাহাতে যোগদান না করায় নরমপন্থী দল চিরদিনের মত কংগ্রেস হইতে বিদায় লইল। নরমপন্থী দল যে ইহা বুঝিয়াছিল তাহার প্রমাণ এই যে, মন্টেগু রিপোর্ট প্রকাশিত হইবার পূর্বেই তাহারা বাংলার নরমপন্থী দল (National Liberal League) নামে একটি পৃথক রাজনীতিক দল গঠন করিল। কিন্তু ইতিহাসের পৃষ্ঠা ছাড়া এই দলের নাম শীঘ্রই বিস্মৃতির অতলে ডুবিয়া গেল এবং সর্বত্রই পুরাতন নরমপন্থী দলের নেতাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি লোপ পাইল। এই সময় অনেকে অনুমান করিয়াছিলেন যে, মন্টেগুর কূটনীতির ফলেই এবং তাঁহার নির্দেশ অনুসারেই নরমপন্থী দল কংগ্রেস ছাড়িয়া নূতন একটি দল গঠন করেন। পরবর্তীকালে প্রকাশিত মন্টেগুর ডায়েরি (Diary) বা রোজনামচায় ইহার সমর্থক প্রমাণ পাওয়া যায়।
বম্বে শহরে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে (১৯১৮, ২৯শে অগষ্ট) বঙ্গদেশের নরমপন্থী নেতারা-সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, অম্বিকাঁচরণ মজুমদার যযাগদান করেন নাই। তিলক, মিসেস বেসান্ট, পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য প্রভৃতি সর্বভারতীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ৩,৮৪৫। নরমপন্থী দলের আশঙ্কা অমূলক প্রতিপন্ন হইল। মন্টেগু-রিপোর্টে শাসন-সংস্কারের যে অগ্রগতির পরিচয় আছে, কংগ্রেস তাহা স্বীকার করিল এবং ইহার উৎকর্ষবিধানের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করিল। তিলক মূল প্রস্তাবটি উপস্থাপিত করিবার ভূমিকাস্বরূপ বলিলেন যে, ইহাতে নরমপন্থী, চরমপন্থী ও মধ্যপন্থী-মন্টেগু-রিপোর্ট সম্পর্কে এই তিন শ্রেণীর মতের সমন্বয় করিয়াই তিনি প্রস্তাবটির খসড়া করিয়াছেন। তাঁহার এই দাবি অযৌক্তিক নহে।
কংগ্রেস অধিবেশনের দুইমাস পরেই নরমপন্থী দল বম্বে শহরে একটি পৃথক কনফারেন্সে মিলিত হইলেন (১৯১৮, ১লা নভেম্বর)। সুতরাং প্রকাশ্যেই এই দল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস বর্জন করিল। সুরেন্দ্রনাথ তাঁহার আত্মজীবনীতে ইহার সমর্থনে যাহা লিখিয়াছেন তাহার যৌক্তিকতা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। কারণ, মন্টেগু-রিপোর্ট প্রকাশিত হইবার পূর্বেই নরমপন্থীরা যে এক নূতন রাজনীতিক দল গঠন করিয়াছিল তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হইবার দুইদিন পরেই ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েসন’ ভবনে নরমপন্থী দল সমবেত হইয়া মন্টেগু রিপোর্ট পুরাপুরি সমর্থন করেন। সুতরাং চরমপন্থী দল এই রিপোর্ট সম্বন্ধে মন্তব্য প্রকাশের পূর্বেই নরমপন্থী দল তাহাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিল। তাহাদের আশঙ্কা ও চরমপন্থীদের মন্টেগু-রিপোর্ট সম্বন্ধে মতামতের ধারণা যে অমূলক, কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে তাহা প্রমাণিত হইল। ১৯০৯ সনের সংস্কারের পূর্বে মর্লি সাহেব নরমপন্থী দলের নেতা গোভেলের সাহায্যে যেমন তাহাদিগকে বশে আনিয়াছিলেন, মন্টেগুও ঠিক সেইরকম নীতি অবলম্বন করিয়াই সম্পূর্ণ সফল হইয়াছিলেন।
এই প্রসঙ্গে ইহাও বিশেষ প্রণিধানযোগ্য যে, বম্বে কনফারেন্সে মন্টেগু-রিপোর্ট সম্বন্ধে নরমপন্থী দল কর্তৃক যে-প্রস্তাব গৃহীত হয় তাহার সহিত ঐ শহরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবগুলির প্রভেদ এত গুরুতর নহে যে, যাহারা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ও এতকাল ইহার কর্ণধার ছিলেন তাঁহাদের এই জাতীয় সংস্থা বর্জন করার যথেষ্ট ও সঙ্গত কারণ ছিল, এরূপ মনে করা যাইতে পারে। চরমপন্থীরা কংগ্রেস হইতে বিতাড়িত হইবার পর দেশে তাহাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কমে নাই বরং বাড়িয়াই চলিয়াছিল। কিন্তু, নরমপন্থী দল যেদিন স্বেচ্ছায় কংগ্রেস হইতে বিদায় লইল, সেইদিন হইতে ভারতের রাজনীতিক্ষেত্র হইতেও তাহাদের চিরবিদায় লইতে হইল। ১৯১৮ সনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের রাজনীতিক ক্ষেত্রে নরমপন্থী দলের উপরও যবনিকা নামিয়া আসিল।
১৯১৯ সনের প্রারম্ভ হইতেই ভারতের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা হইল। কিন্তু ইহা বর্ণনা করিবার পূর্বে বিগত দশবৎসরে বঙ্গদেশের তথা ভারতের ইতিহাসে সন্ত্রাসবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করা প্রয়োজন। কারণ, এই নবযুগের উপর ইহার সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্বন্ধে স্পষ্ট ও পর্যাপ্ত ধারণা ইতিহাসে এখনও স্থান পায় নাই।
১৯১৯ সন : যে চারিটি ঘটনা ভারতবর্ষের ইতিহাসে ১৯১৯ সনকে চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছে এবং বঙ্গদেশেও অল্প-বিস্তর ইহার প্রভাব পরিলক্ষিত হইয়াছিল তাহার বিবরণ নিম্নে দিতেছি :
(১) রাউল্যাট বিল ও পঞ্জাবে অমানুষিক অত্যাচার;
(২) ভারতের রাজনীতিক ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধীর আবির্ভাব;
(৩) ভারতে বিশ্বজনীন ইসলাম শক্তি ও সভ্যতার প্রভাব; (৪) ভারতে নূতন শাসনবিধির প্রবর্তন।
(১) রাউল্যাট আইন
বিংশ শতকে ভারতে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে শাসন-সংস্কার ও দমননীতি এই দুইয়ের সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য। মিন্টোর ও হার্ডিংয়ের শাসনকালে যাহা হইয়াছিল, লর্ড চেমসফোর্ডের আমলেও তাহাই হইল। মন্টেগুর শাসন সংস্কার কার্যে পরিণত হইবার পূর্বেই একটি কমিটি গঠিত হইল ভারতে সন্ত্রাসবাদের তদন্ত করিবার জন্য এবং ইহার দমনকল্পে নূতন কোন আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা সে-সম্বন্ধে পরামর্শ দিতে। লণ্ডনের বিচারপতি রাউল্যাট এই কমিটির সভাপতি এবং দুইজন ইংরেজ ও দুইজন ভারতীয়-মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি কুমারস্বামী শাস্ত্রী এবং কলিকাতা হাইকোর্টের ব্যারিষ্টার প্রভাসচন্দ্র মিত্র-ইহার সদস্য নিযুক্ত হইলেন। সভাপতির নামানুসারে এই কুখ্যাত কমিটি ভারতবাসীর নিকট রাউল্যাট কমিটি’ নামেই পরিচিত। যুদ্ধের সময় যেসব আইনদ্বারা ভারতের নাগরিকদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার পথ রুদ্ধ হইয়াছিল তাহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। যুদ্ধের পর এইসব আইন বলবৎ থাকিবে না, সুতরাং তাহার পরিবর্তে অনুরূপ আইন বিধিবদ্ধ করাই এই কমিটি স্থাপনের উদ্দেশ্য। গভর্নমেন্টের দলিলপত্র ও মতামত ছাড়াও পুলিশের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করিয়া এই কমিটি সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে এক সুদীর্ঘ বিবরণ দিলেন এবং সন্ত্রাসবাদীদের দমন করিবার জন্য দুইটি নূতন আইনের খসড়া প্রস্তুত করিলেন। ইহার বিস্তারিত বিবরণের প্রয়োজন নাই। হার্ডিংয়ের আমলে যুদ্ধকালীন সঙ্কটের দোহাই দিয়া যে আইন পাশ করা হইয়াছিল তাহার কথা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। ঐসব আইনে যেমন নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্পূর্ণ লোপ পাইয়াছিল, যুদ্ধবিরতির পরও নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনের উপর গভর্নমেন্টের সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যবস্থা এই আইনেও করা হইল। আইন-আদালতের বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করিয়া যাহা ইচ্ছা তাহা করিবার এবং যে-কোন লোককে যে-অবস্থায় ইচ্ছা সেই অবস্থায় রাখার অধিকার গভর্নমেন্টের হাতে দেওয়া হইল। প্রকৃতপক্ষে এই একটি আইন দ্বারাই আর সব আইন বাতিল করা হইল।
সমস্ত দেশে এই আইনের বিরুদ্ধে তুমূল আন্দোলন শুরু হইল। বড়লাটের বিধান সভায় বেসরকারী সকল ভারতীয় সদস্য একযোগে ইহার প্রতিবাদ করিলেন এবং তাঁহাদের মধ্যে চারিজন প্রতিবাদস্বরূপ সদস্যপদ ত্যাগ করিলেন। বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনের পরে এরূপ দেশব্যাপী আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে আর হয় নাই। কিন্তু, এইসব প্রতিবাদসত্ত্বেও রাউল্যাট আইন বিধান পরিষদে কেবলমাত্র সরকারী কর্মচারীদের ভোটে পাশ হইল (১৮ই মার্চ, ১৯১৯)।
(২) মহাত্মা গান্ধী
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৮৬৯ সনের ২রা অক্টোবর গুজরাতের অন্তর্গত পোরবন্দরে এক মোদ বাণিয়া জাতীয় সঙ্গতিপন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইংলণ্ড হইতে ব্যারিষ্টার হইয়া আসিয়া তিনি আইনজীবীরূপে প্রতিপত্তি লাভ করিতে না পারিয়া ১৮৯৩ সনের এপ্রিল মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থিত একটি ভারতীয় কোম্পানির মামলা-সংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব লইয়া দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। এই সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী ভারতীয়গণ ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের রাজত্বে বর্ণবৈষম্যের জন্য নাগরিক অধিকারের অধিকাংশ হইতে বঞ্চিত ছিল। এই অন্যায়ের প্রতীকারের জন্য গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস করেন এবং স্থানীয় রাজশক্তির সহিত তাঁহার সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষের প্রতিরোধকল্পে গান্ধীজি যে এক নূতন কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেন তাহাই ‘সত্যাগ্রহ’ নামে পরিচিত হয় এবং সমস্ত জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সত্যাগ্রহ একপ্রকার নিরস্ত্র বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ, কিন্তু গান্ধীজি ইহাকে সৎ+আগ্রহ = সদাগ্রহ বা সত্যাগ্রহ নামে অভিহিত করেন। ইহার মূলনীতি ব্যাখ্যা করা এবং কার্যক্রম স্পষ্টভাবে নির্দেশ করা একপ্রকার অসম্ভব-কারণ গান্ধীর ভক্তগণ এ-বিষয়ে নানাপ্রকার অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, তিনিও বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্ন সময়ে ইহার বিভিন্ন কার্যসূচী নির্দেশ করিয়াছেন। তবে ইহার আদর্শ হিসাবে মোটামুটিভাবে বলা যাইতে পারে যে, কোন অন্যায় বা অত্যাচারের প্রতিকারকল্পে দৈহিক শক্তি অর্থাৎ হিংসাত্মক কর্ম, বলপ্রয়োগ প্রভৃতির পরিবর্তে আত্মিক শক্তির সাহায্য লওয়াই শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। ইহার প্রয়োগের নানা প্রণালী তিনি নিজের জীবনে দেখাইয়াছেন–যেমন, অসহযোগ আন্দোলন, অনশন-ব্রত প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিষয়টির গুরুত্ববোধ গান্ধীজির অনুরক্ত ও ভক্ত সহচরবৃন্দের অন্যতম নির্মলকুমার বসুর মত উদ্ধৃত করিতেছি : “সত্যাগ্রহের মূলনীতি এইভাবে স্থিরীকৃত হয় : সমাজে কোনও অন্যায়ের প্রতিকারকল্পে একদিকে আদর্শ জীবনযাপনের চেষ্টা, অপরদিকে অন্যায়ের সহিত অসহযোগ করিতে হইবে। অন্যায়কারীকে আঘাতের প্রয়োজন নাই, বরং নিজে সত্যপথে থাকিয়া অপরের প্রদত্ত আঘাত বীর্য এবং তিতিক্ষার সহিত সহ্য করা প্রয়োজন। ইহাতে বিরুদ্ধপক্ষের চিত্তে বিস্ময় এবং সম্ভম জাগরিত হইতে পারে। তখন উভয়পক্ষ মিলিয়া সত্যে প্রতিষ্ঠিত সন্তোষজনক মীমাংসায় উপনীত হওয়া সম্ভব। এই পদ্ধতিকে গান্ধীজি সত্যাগ্রহ আখ্যা দেন।”
ইহার পরিপূরক হিসাবে সত্যাগ্রহের আর-একটি সংজ্ঞা বা বিশ্লেষণ হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি। সত্যাগ্রহ “গান্ধীজি প্রবর্তিত অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নৈতিক ও আত্মিক প্রতিরোধ-পদ্ধতি। অত্যাচারীর ভিতরও বিবেক আছে; সাময়িকভাবে তাহা লোভ বা মোহের দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়া তাহাকে দুষ্কৃতিতে প্ররোচিত করে, কিন্তু এই প্রথায় ত্যাগ ও নিগ্রহের মাধ্যমে তাহার বিবেককে জাগ্রত করাইয়া তাহার হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটাইয়া তাহাকে এই দুষ্কৃতি হইতে নিবৃত্ত করার প্রয়াস করা হয়। অন্যায়কারীর সহিত অসহযোগ ছাড়াও প্রয়োজন হইলে ইহা পিকেটিং, বয়কট, অনশন, এমনকি আমৃত্যু অনশনের রূপও লইতে পারে।”
পূর্বেই বলিয়াছি, দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ভারতবাসীদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ ইংরেজদের বর্ণবৈষম্যমূলক অবিচার ও অত্যাচার দূর করিবার জন্যই গান্ধীজি সর্বপ্রথম এই সত্যাগ্রহের পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। তাঁহার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় বহু নরনারী আট বৎসর কাল এই সত্যাগ্রহ চালাইয়া বহু কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করিবার পর অনেক পরিমাণে তাহাদের নাগরিক ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিতে সমর্থ হয় (১৯১৪ সন)। ১৯১৭ সনে বিহার প্রদেশের অন্তর্গত চম্পারণে নীলচাষীদের উপর নীলকরদিগের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ করিয়া অন্যায়ের প্রতিকার করিতে সমর্থ হন। ১৯১৭ ও ১৯১৮ সনে যথাক্রমে আমেদাবাদ ও গুজরাতের খেড়া জেলায় সত্যাগ্রহ আন্দোলন আংশিকভাবে জয়যুক্ত হয়।
অতঃপর রাউল্যাট আইনের বিরুদ্ধে গান্ধীজি সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করেন। যখন গান্ধীজির আবেদনে কর্ণপাত না করিয়া বড়লাট রাউল্যাট কমিটির প্রস্তাব-অনুযায়ী পূর্বোক্ত দমননীতিমূলক আইনের বিল বিধানসভায় উপস্থাপিত করিলেন (৬ই ফেব্রুআরি, ১৯১৯) গান্ধী তখনই সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূত্রপাত করিলেন। তিনি ঘোষণা করিলেন, যদি এই বিল বিধানসভায় গৃহীত হয় তবে “আমরা এই আইন এবং অন্যান্য কোন কোন আইন (যাহা পরে স্থির করা হইবে)। অমান্য করিব, কিন্তু আমরা কোনপ্রকার বলপ্রকাশ বা হিংসামূলক কর্ম করিব না।” ইহার পূর্বাভাসস্বরূপ স্থির হইল যে, সমগ্র ভারতে ৬ই এপ্রিল হরতাল পালিত হইবে। হরতাল সম্পূর্ণভাবে পালিত হইয়াছিল, কিন্তু গান্ধীর অহিংস নীতি বহু স্থানে অনুসৃত হয় নাই। বাড়ীঘর পোড়ানো, অর্থলুণ্ঠন, দোকান-লুঠ, জোর করিয়া ট্রেন থামান, টেলিগ্রাফের তার কাটা এবং নিরপরাধ বহু লোকের হত্যা প্রভৃতি ঘটনায় তিনি বিচলিত হইয়া পড়িলেন। প্রকাশ্যে ঘোষণা করিলেন যে, তাঁহার সত্যাগ্রহ আন্দোলন একটি বিরাট ভুলের পরিচয় (Himalayan miscalculation)। ইহার প্রায়শ্চিতস্বরূপ তিনি তিনদিন উপবাস করিলেন এবং আইন অমান্য আন্দোলন করার যে-ব্যবস্থা তিনি করিয়াছিলেন তাহাও বাতিল করিয়া দিলেন (১৮ই এপ্রিল, ১৯১৯)।
অপরদিকে এই হরতাল উপলক্ষে নানাস্থানে সরকারী অত্যাচার ও সৈন্যকর্তৃক জনসাধারণের নির্যাতন অনুষ্ঠিত হইল। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগের জনহত্যার নিষ্ঠুর কাণ্ডে ইহা চরমে পৌঁছিল। এইসব অত্যাচারের বিস্তৃত বর্ণনা বঙ্গদেশের ইতিহাসের পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক।
(৩) খিলাফৎ আন্দোলন
তুল্যরূপে অপ্রাসঙ্গিক হইলেও গান্ধীজির পরবর্তী আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গদেশের ইতিহাসের সম্বন্ধ থাকায় ইহার একটু বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন। ইসলাম সম্প্রদায়ের খলিফা বলিয়া তুরস্কের সুলতান সমগ্র মুসলমানজগতে স্বীকৃত ও সম্মানিত এবং তাহার অধীনস্থ ইসলামের ধর্মরাজ্য খিলাফৎ-সর্বদেশেই, বিশেষতঃ ভারতে, মুসলমানদের দৃষ্টিতে পরম পবিত্র। ইসলামধর্মের নেতা বা খলিফা তুরস্কের অধিপতির প্রতি ইংরেজ ও তাহার মিত্রশক্তির দুর্ব্যবহার, এই দ্বিতীয় আন্দোলনের কারণ। তুরস্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষে যোগ দিয়াছিল, তাই পরাজয়ের পর যে সন্ধি হয় তাহাতে তাহার রাজ্যসীমা ও শক্তি অনেক হ্রাস পাইল। যুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকার ভারতীয় মুসলমানদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য আশ্বাস দিয়াছিল যে, তুরস্কের কোন অনিষ্ট করা হইবে না! সুতরাং সেই আশ্বাস রক্ষা না-করায় ভারতীয় মুসলমানগণও বিশেষ ক্ষুব্ধ হইল।
তুরস্ক-সাম্রাজ্য বা খিলাফতের সহিত হিন্দুদের কোন সম্বন্ধ ছিল না। গান্ধী মনে করিলেন যে, হিন্দু-মুসলমানের মিলনের এক অপূর্ব সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে। “খিলাফতের দাবিকে যদি ভারতের জাতীয় দাবি হিসাবে গ্রাহ্য করা যায় তাহা হইলে ভারতের মুসলমানগণ অ-মুসলমান সমাজের সহিত একযোগে চলিতে পারিবে”–এই আশায় প্রলুব্ধ হইয়া গান্ধীজি রাউল্যাট আইনের প্রতি ভারতের ন্যায্য বিক্ষোভ ও মুসলমানদের বিক্ষোভ-এই দুইটিকে একপর্যায়ে ফেলিয়া ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে অহিংস সত্যাগ্রহ যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। গান্ধীর আশা সফল হয় নাই এবং ভারতের অতীত ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে দেখিলে এইরূপ আশার কোনই সঙ্গত বা যুক্তিযুক্ত ভিত্তি ছিল না। কিন্তু গান্ধীর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের ফলে এই মুসলমান-তোষণ নীতি ভারতের জাতীয় জীবনে এমনভাবে শিকড় গাড়িয়া বসিল যে, দ্রুতবেগে বাড়িতে বাড়িতে এই শিকড় ভারতের জাতীয় জীবনের বিরাট প্রাসাদকে ভাঙ্গিয়া ধূলিসাৎ করিল। ইহারই ফলে ২৫ বৎসরের মধ্যে বঙ্গদেশের বিভাগ ঘটিল। লর্ড কার্জন যাহা করিতে ব্যর্থ হইয়াছিলেন, গান্ধীজির অযৌক্তিক মুসলমান-তোষণের নীতি তাহা সার্থক করিয়া তুলিল।
এই ঘটনা ঘটিবার মধ্যে ১৯২০ সনে (১লা অগষ্ট) তিলকের মৃত্যু হওয়ায় গান্ধী ভারতের মুক্তিসংগ্রামে অবিসংবাদিত নেতা হইলেন এবং ঠিক ঐ দিবসই তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় খিলাফৎ কমিটির দ্বারা অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত হরতালের নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন। অর্থাৎ এই সময় ভারতের মুক্তি অপেক্ষা মুসলিম খিলাফতের পূর্বগৌরব উদ্ধারকেই তিনি ভারতের রাজনীতিক আন্দোলনে প্রাধান্য দিলেন।
ইংরেজের উপর চাপ দিয়া যাহাতে তুরস্কের সুলতানের হৃত গৌরব, শক্তি ও সাম্রাজ্য ফিরাইয়া আনা যায় এই উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুসলমানেরা একটি কমিটি গঠিত করে। তাহাদের এই আন্দোলন খিলাফৎ আন্দোলন’ নামে পরিচিত। গান্ধীর সাহায্য ও সমর্থনে এই আন্দোলন প্রবল হইয়া উঠিল। গান্ধীজি এই আন্দোলনকে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একপর্যায়ে ফেলিলেন এবং ১৯২০ সনের প্রথমে খিলাফৎ আন্দোলনই তাঁহার কাছে গুরুতর বলিয়া মনে হইল। তাঁহার নেতৃত্বে অনেক হিন্দুও ইহাতে যোগ দিলেন। গান্ধীজি যুক্তি দেখাইলেন যে, “বিপদে সহায়তাই বন্ধুত্বের পরিচায়ক। যদি মুসলমানদের বিপদে আমরা সাহায্য না করি, তাহা হইলে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য অসম্ভব।”
এই যুক্তি খুব উদারতার পরিচায়ক সন্দেহ নাই, কিন্তু গান্ধীজি জাতীয়তাবাদের মূলসূত্রটি ভুলিয়া গিয়াছিলেন। কোন দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ঐক্যে একটি জাতি গঠন করিতে হইলে তাহার সর্বপ্রথম উপাদান এই যে, এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটির সহিত অপরের যে-সম্বন্ধ, দেশের বহির্ভূত অপর কোন গোষ্ঠীর সহিত একটিরও তদনুরূপ বা অধিকতর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের বন্ধন থাকিবে না। যদি থাকে, তবে তাহারা এক জাতির অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে না। ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায় যদি ভারতীয় হিন্দু অপেক্ষা তুরস্কের বা অন্য দেশের মুসলমান সম্প্রদায়কে অধিকতর ঘনিষ্ঠ মনে করে তবে হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া ভারতে এক জাতির গঠন অসম্ভব।
(৪) ভারত শাসনবিষয়ক নূতন আইন (১৯১৯)
পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, মন্টেগু ও চেমসফোর্ড রিপোর্ট ১৯১৮ সনের ৮ই জুলাই প্রকাশিত হয়, কিন্তু তদনুযায়ী নূতন সংবিধান প্রস্তুত করিতে অনেক বিলম্ব ঘটে। কারণ ইহার বিভিন্ন অংশের খসড়া প্রস্তুত করিতে বিভিন্ন কমিটি নিযুক্ত হয় এবং বহু ভারতীয় ও ইংরেজের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। অবশেষে এই সংবিধানটি ১৯১৯ সনের ২৩শে ডিসেম্বর আইনে পরিণত হয় এবং এই আইন অনুযায়ী শাসনতন্ত্র কার্যকরী হয় ১৯২১ সনের ৩রা জানুআরি হইতে।
এই সংবিধানে প্রাদেশিক শাসনের আমূল পরিবর্তন করা হয়। বঙ্গদেশ ও অন্য আটটি প্রদেশে দ্বৈতশাসন প্রবর্তিত হয় অর্থাৎ প্রাদেশিক শাসনের বিষয়গুলি দুই ভাগে বিভক্ত হয়–সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত। সংরক্ষিত বিষয়গুলির ব্যাপারে প্রাদেশিক গভর্নর পূর্বের ন্যায় একটি কার্যকরী নির্বাহক পরিষদের সহিত পরামর্শ করিয়া শাসন করিবেন। হস্তান্তরিত বিষয়গুলির ব্যাপারে গভর্নর মন্ত্রীদের সহিত . পরামর্শ করিবেন। গভর্নর কার্যকরী পরিষদের সভ্য মনোনীত করিবেন, কিন্তু মন্ত্রীগণকে তিনি মনোনীত করিবেন বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য হইতে। বিষয়গুলি মোটামুটি এইভাবে বিভক্ত হইল-হস্তান্তরিত : (১) স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন, (২) চিকিৎসা বিভাগ, (৩) শিক্ষা, (৪) কৃষি, (৫) পশুপালন, (৬) সমবায় সমিতি, (৭) আবগারী, (৮) রেজিষ্ট্রীকরণ, (৯) ধর্মীয় ও দাঁতব্য সম্পত্তি, (১০) শিল্পোন্নয়ন।
এগুলি ব্যতীত অবশিষ্ট বিভাগগুলি, যেমন পুলিশ (আইন ও শৃঙ্খলা), জেল ইত্যাদি সংরক্ষিত বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হইল।
বঙ্গদেশ, বম্বে ও মাদ্রাজের গভর্নরের কার্যনির্বাহক সভায় (Executive Council) চারিজন সদস্য থাকিবেন। ইহার মধ্যে দুইজন হইবেন ভারতীয় নাগরিক। সাধারণতঃ অধিকাংশের মতই গ্রাহ্য হইবে, কিন্তু রাজ্যের নিরাপত্তা সম্বন্ধীয় কোন বিষয়ে গর্ভনর ইচ্ছা করিলে অধিকাংশের মত অগ্রাহ্য করিতে পারিবেন।
গভর্নর সাধারণতঃ হস্তান্তরিত বিষয়গুলি সম্বন্ধে মন্ত্রীর মতামত অনুসারেই চলিবেন। কিন্তু কোন গুরুতর কারণ থাকিলে তিনি মন্ত্রীর মতের বিরুদ্ধেও কার্য করিতে পারিবেন। মন্ত্রীগণের সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিল না, তবে সাধারণতঃ দুই বা তিনজন মন্ত্রী থাকিতেন। যদিও আইনতঃ গভর্নর নিজের ইচ্ছামত বিধানসভার যে-কোন সদস্যকে মন্ত্রী নিযুক্ত করিতে পারিতেন, কিন্তু কার্যতঃ এই ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ আইনসভা মন্ত্রীদের বেতন কমাইতে বা বন্ধ করিতে পারিত এবং শাসনবিভাগের কার্যের জন্য মন্ত্রীর যে অর্থের প্রয়োজন হইত, আইনসভার হাতেই তাহা মঞ্জুর করিবার ক্ষমতা ছিল। সুতরাং আইনসভার অধিকাংশ সদস্য মন্ত্রীর সপক্ষে না থাকিলে তাহার মন্ত্রীত্ব করা সম্ভবপর হইত না।
প্রাদেশিক আইন (ব্যবস্থাপক) সভার (Legislative Council) সদস্যসংখ্যা অনেক বাড়ান হইল। ইহাদের মধ্যে শতকরা ৭০ জন জনগণের ভোট দ্বারা নির্বাচিত ও অবশিষ্ট ৩০ জন গভর্নর কর্তৃক মনোনীত হইতেন। এই মনোনীত ৩০ জনের মধ্যে কতক ছিলেন সরকারী কর্মচারী। আইনসভা সাধারণতঃ তিন বৎসরের জন্য নির্বাচিত হইত, কিন্তু গভর্নর ইচ্ছা করিলে ইহার মেয়াদ অর্থাৎ কার্যকাল বাড়াইতে বা কমাইতে পারিতেন। বাংলাদেশের আইনসভার সভ্যসংখ্যা ছিল ১৪৪। ইহার মধ্যে শতকরা ২০ জনের বেশী সরকারী কর্মচারী থাকিবার বিধান ছিল না।
আইনসভার সদস্যগণ যে-কোন বিষয়ে একাধিক প্রশ্ন করিতে পারিতেন। প্রাদেশিক আইনসভায় কোন বিল (Bill) গৃহীত হইলেও গভর্নর ও গভর্নর জেনারেলের সম্মতি না-পাওয়া পর্যন্ত ইহা আইনে পরিণত অথবা কার্যকরী হইত না। সংরক্ষিত শাসনবিভাগ সংক্রান্ত কোন ‘বিল’ বিধানসভা অনুমোন না করিলেও গভর্নর ইহা রাজ্যশাসনের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় মনে করিলে তাহার অনুমোদনেই ইহা গৃহীত হইত। রাজ্যশাসনের সংরক্ষিত বিভাগের প্রয়োজনীয় অর্থ আইনসভায় অনুমোদিত না হইলেও গভর্নর অনুমোদন করিতে পারিতেন। হস্তান্ত রিত বিভাগের বেলায় তিনি কেবল রাজ্য চালাইবার বা রক্ষার জন্য যে-পরিমাণ অর্থ একান্ত আবশ্যক তাহাই খরচ করিবার অনুমতি দিতে পারিতেন।
কেন্দ্রীয় শাসনের জন্য একটি ব্যবস্থা পরিষদ (Legislative Assembly) ও একটি রাষ্ট্র পরিষদ (Council of State) এবং প্রতি প্রদেশের জন্য একটি আইনসভা (Legislative Council) ছিল।
প্রাদেশিক আইনসভা গঠিত হইত তিন বৎসরের জন্য। আইনসভায় হিন্দু, মুসলমান, ভারতীয় খৃষ্টান, অ্যাংগ্লো-ভারতীয় ও ইউরোপীয়ান সদস্যেরা সকলেই প্রত্যেক সম্প্রদায়ের পৃথক ভোট দ্বারা নির্বাচিত হইতেন। কংগ্রেসের লখনৌ অধিবেশনে (১৯১৬) হিন্দু-মুসলমান সদস্যসংখ্যার যে ব্যবস্থা হয়, ১৯১৯ সনের সংবিধানে তাহাই গৃহীত হইয়াছিল। ভোট দিবার অধিকারের জন্য কতকগুলি নির্দিষ্ট নিয়ম করা হইয়াছিল। নিম্ন (তপশীলভুক্ত) জাতির অনেকেরই এই নিয়মানুসারে ভোট দিবার অধিকার ছিল না। এইজন্য তাহাদিগের মধ্যহইতে কয়েকজন সদস্য মনোনীত করার ব্যবস্থা ছিল। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্টার্ড গ্রাজুয়েটরা একজন সদস্য নির্বাচিত করিতে পারিতেন। ইহা ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের সহিত যুক্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেরও ভোট দিবার অধিকার ছিল। ১৯১৯ সনের ২৭শে ডিসেম্বর ভারত-শাসনবিষয়ক নূতন বিধান সম্বন্ধে অমৃতসরের কংগ্রেসে তুমুল বাদবিতণ্ডার সৃষ্টি হইল। শ্ৰীচিত্তরঞ্জন দাশ যে প্রস্তাব করিলেন তাহার মর্ম এই যে, এই নূতন সংবিধানে কোন কোন বিষয়ে একটু অগ্রগতির আভাস থাকিলেও ইহা অসন্তোষজনক এবং নৈরাশ্যব্যঞ্জক। ভারতবর্ষ সম্পূর্ণ দায়িত্বশীল শাসনের উপযুক্ত এবং এই কংগ্রেস ভারতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য পার্লিয়ামেন্টকে অনুরোধ করিতেছে। কংগ্রেসে বিতর্কের প্রধান বিষয় হইল, নূতন শাসন-সংস্কার মানিয়া লওয়া ও এই সংস্কারের জন্য মন্টেগুকে ধন্যবাদ দেওয়া হইবে কিনা। চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন এই নূতন সংস্কার একেবারে বর্জন করার পক্ষে। গান্ধীজি কংগ্রেসের আলোচনায় এই উপলক্ষেই সর্বপ্রথম সক্রিয় এবং বিশিষ্ট অংশগ্রহণ করিলেন। তাঁহার মতে এই নূতন সংস্কার হইতে বোঝা যায় যে, ইংরেজ ভারতের প্রতি সুবিচার ও ন্যায্য ব্যবহার করিতে প্রস্তুত-সুতরাং ইহার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্বন্ধে আলোচনা না করিয়া শান্তশিষ্ট হইয়া এই নূতন সংস্কারকে সাফল্যমণ্ডিত করাই আমাদের কর্তব্য। কোন নরমপন্থী নেতাই বোধ হয় ইহার অধিক আর কিছু বলিতে পারিতেন না। সদ্য সদ্য জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর এবং পর পর বম্বে এবং দিল্লীতে কংগ্রেস এই সংস্কারের বিরুদ্ধেই মত প্রকাশ করিয়াছে; ইহা সত্ত্বেও গান্ধীর ভাষণ যে সকলে ধৈর্যের সহিত শুনিল এবং একদল তাহার সমর্থন করিল, ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে গান্ধীর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও সাধুপ্রকৃতির খ্যাতি কেবল জনসাধারণের উপর নহে, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উপরও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। বহু বিচার, বিতর্ক ও আলোচনার পর কংগ্রেস চিত্তরঞ্জন দাশের বর্জননীতি ও গান্ধীর গ্রহণনীতি-ইহার কোনটিই গ্রহণ করিল না; তিলক যে আপোষের প্রস্তাব করিয়াছিলেন তাহাই গৃহীত হইল। চিত্তরঞ্জন যে প্রস্তাব করিয়াছিলেন তাহা অবিকৃত রাখিয়া তাহার সঙ্গে যোগ করা হইল :
“তবে যতদিন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠা না হয় ততদিন কংগ্রেসের মতে এই সংস্কার স্বীকার এবং তদনুসারে কাজকর্ম করিয়া যাহাতে শীঘ্রই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন লাভ করিতে পারা যায় তাহার চেষ্টা করা হউক এবং এই কংগ্রেস এই সংস্কারের জন্য মন্টেগুকে ধন্যবাদ দিতেছে।”
ইহার তিনদিন পর (১৯১৯, ৩০শে ডিসেম্বর) নরমপন্থী দল কলিকাতায় এক কনফারেন্সে পূর্ণ দায়িত্বশীল শাসনক্ষমতার প্রথম পদক্ষেপস্বরূপ নূতন শাসন সংস্কার সাদরে গ্রহণ করিলেন এবং সকলকে একত্র হইয়া ইহাকে সফল করিবার জন্য আমন্ত্রণ জানাইলেন। কংগ্রেস হইতে বিচ্ছিন্ন হইবার পর এই নরমপন্থী দল লিবারেল পার্টি (উদারপন্থী দল) এই নাম গ্রহণ করিয়াছিল।
(৫) অসহযোগ আন্দোলন
খিলাফৎ আন্দোলনের প্রতি গান্ধীর সহানুভূতির এবং সক্রিয় সাহায্যের কথা পূর্বেই বলিয়াছি। ১০ই মার্চ (১৯২০) তারিখে যখন মিত্রশক্তি (ইংলণ্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র) পরাজিত তুরস্কের সম্বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিবেন, এইরূপ আভাস পাওয়া গেল, তখনই গান্ধী এক ঘোষণাপত্রে বলিলেন, তুরস্কের প্রতি মিত্রপক্ষের আচরণ সন্তোষজনক না হইলে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ব্যবস্থা করিবেন। এই উপলক্ষেই গান্ধী সর্বপ্রথম তাহার এই ব্রহ্মাস্ত্রের উল্লেখ করেন। ১৯২০ সনের ১৫ই মে তারিখে তুরস্কের সহিত মিত্রপক্ষের সন্ধির শর্ত প্রকাশিত হইল এবং মুসলমানদের আশঙ্কা সত্যে পরিণত হইল। দুইদিন পরে গান্ধী এক ঘোষণাপত্রে মুসলমানদিগকে ইহার প্রতীকারের একমাত্র উপায়স্বরূপ অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করিতে পরামর্শ দিলেন। কেন্দ্রীয় খিলাফৎ সমিতি এই পরামর্শ গ্রহণ করা স্থির করিল (২৮শে মে)।
ঠিক ঐ তারিখেই (২৮শে মে, ১৯২০) পঞ্জাবে ব্রিটিশ কর্মচারীদের অকথ্য অত্যাচারের অভিযোগ সম্বন্ধে তদন্ত করিবার জন্য হান্টার (Hunter) সাহেবের সভাপতিত্বে যে কমিটি নিযুক্ত হইয়াছিল তাহার রিপোর্টও প্রকাশিত হইল। দেখা গেল, এই কমিটির পাঁচজন ইংরেজ সভ্যই কর্মচারীদের দোষক্ষালনের চেষ্টা করিয়াছেন এবং অপরাধের গুরুত্বহিসাবে খুব সামান্য শাস্তিবিধানের নির্দেশ দিয়াছেন। কিন্তু অবশিষ্ট তিনজন ভারতীয় সভ্য অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করিয়া ইহার জন্য দায়ী কর্মচারীদের উপযুক্ত শাস্তি দিবার প্রস্তাব করিয়াছেন। ইহাতে সমগ্র ভারত বিক্ষুব্ধ হইল এবং নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি’ এই রিপোর্টের তীব্র নিন্দা করিয়া ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে অনুরোধ করিল যে, বড়লাটকে বরখাস্ত করা হউক এবং পঞ্জাবের গভর্নর ও’ডায়ার (Sir Michael O’Dwyer), জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যার নায়ক সেনাপতি ডায়ার এবং অত্যাচারকারী অন্যান্য সামরিক কর্মচারীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হউক। ‘নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি’ তুরস্কের প্রতি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের আচরণের তীব্র নিন্দা করিল এবং অসহযোগ আন্দোলনের বিষয় বিবেচনার জন্য কংগ্রেসের একটি বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল।
অতঃপর কেন্দ্রীয় খিলাফৎ কমিটির আহ্বানে হিন্দু-মুসলমানের এক কনফারেন্স হইল (১লা ও ২রা জুন)। কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দুনেতা ইহাতে যোগ দিলেন। মুসলমানেরা হিন্দুদিগকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিতে অনুরোধ করিলেন। মুসলমানদের প্রতি কয়েকজন সহানুভূতি জানাইলেও অসহযোগ আন্দোলন সমর্থন করিলেন না। কিন্তু গান্ধী তাঁহার পূর্ণ সমর্থন জানাইয়া এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন।
কেন্দ্রীয় খিলাফৎ কমিটি গান্ধীর নেতৃত্বে ১লা অগষ্ট সমগ্র ভারতে ‘হরতাল (বর্তমান যুগের ‘বন্ধু’) ঘোষণা করিল। যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের নিকট হইতে গান্ধী যে-সকল পদক পাইয়াছিলেন তাহা ফেরৎ দিয়া বড়লাটকে লিখিলেন, “আমার মুসলমান ভাইগণের ধর্মবিশ্বাসে যে আঘাত লাগিয়াছে তাহা দূর না হওয়া পর্যন্ত এইসব ‘মেডেল’ ব্যবহার করিতে আমার বিবেকে বাধে। সুতরাং আজ হইতে খিলাফৎ আন্দোলনের অঙ্গহিসাবে যে অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ হইল তাহার নির্দেশে আমি মেডেলগুলি ফেরৎ পাঠাইলাম।” পরিশেষে গান্ধী লিখিলেন, “বিলাতের গভর্নমেন্ট ও আপনার গভর্নমেন্ট পঞ্জাবের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিয়াছেন তাহাও আমার গভীর অসন্তোষের আর একটি কারণ।”
গান্ধীজির চিঠি হইতে স্পষ্ট বোঝা যায়, তুরস্কের প্রতি মিত্রপক্ষের আচরণই ভারতে গান্ধীর নেতৃত্বে যে অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ হয় তাহার প্রকৃত ও মুখ্য কারণ। পঞ্জাবের অত্যাচার অন্যতম কারণ হইলেও (যদিও তাহার স্পষ্ট প্রমাণ নাই) তাহা গৌণ। ইহার কিছুদিন পরে ভারতের দুইজন নেতা বিজয়রাঘবাচারী ও মতিলাল নেহেরুর অভিপ্রায় অনুসারে ভারতের স্বাধীনতা লাভ’-অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম কারণ বলিয়া গান্ধী নির্দেশ করেন। প্রকৃত গান্ধীকে বুঝিতে হইলে এবং ভারতের মুক্তিসংগ্রামে গান্ধীর অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন করিতে হইলে এই সময়ের ক্রমটি স্মরণ রাখা আবশ্যক।
(৬) কংগ্রেস ও অসহযোগ আন্দোলন
পূর্বোক্ত নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে কলিকাতায় কংগ্রেসের এক বিশেষ অধিবেশন হইল (৪ঠা সেপ্টেম্বর, ১৯২০)। লাজপৎ রায় বহুদিন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনের পরে স্বদেশে ফিরিবার অনুমতি পাইয়াছিলেন তিনিই সভাপতি নির্বাচিত হইলেন। কিন্তু ১লা অগষ্ট দেশবরেণ্য নেতা বালগঙ্গাধর তিলকের মৃত্যুতে সমগ্র অধিবেশনের উপর একটি গভীর শোকের ছায়া পড়িল।
তুরস্কের প্রতি অবিচার, পঞ্জাবে অনুষ্ঠিত অত্যাচার এবং অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি বিধান না-করার উল্লেখ করিয়া মূল প্রস্তাবে বলা হইল যে, কংগ্রেসের মতে এই সমুদয়ের প্রতিকার না হইলে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইবে না এবং যাহাতে এইসকল পুনরায় না ঘটে এবং দেশের সম্মান বজায় থাকে তাহার একমাত্র উপায় স্বরাজ প্রতিষ্ঠা। এই কংগ্রেসের মতে এইসকল অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিবিধান এবং স্বরাজ প্রতিষ্ঠা না-হওয়া পর্যন্ত গান্ধী যে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছেন তাহার সমর্থন ভিন্ন ভারতবাসীর আর কোন পথ নাই।
অতএব এই কংগ্রেস নিম্নলিখিত নির্দেশ দিতেছে : (ক) সরকারপ্রদত্ত উপাধি, অনারারি চাকুরী এবং স্থানীয় বোর্ডগুলির সদস্যপদ–এইসকল বর্জন। (খ) সরকারী কর্মচারী কর্তৃক অথবা তাহাদের সম্মানে আয়োজিত দরবার প্রভৃতি অনুষ্ঠান বর্জন। (গ) সরকারী, সরকারের সাহায্যপ্রাপ্ত অথবা সরকারের শাসনাধীনে স্কুল কলেজ বর্জন এবং তাহাদের স্থানে জাতীয় স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা। (ঘ) উকীল ও মক্কেল কর্তৃক ক্রমে ক্রমে সরকারী আদালত বর্জন এবং মোকদ্দমার বা। অভিযোগের বিচারের জন্য বেসরকারী সালিশী আদালতের প্রতিষ্ঠা। (ঙ) সৈন্য, কেরানী এবং শ্রমিকদের মেসপটেমিয়ার চাকুরী করিতে অস্বীকার। (চ) নূতন ভারত শাসন আইন অনুসারে গঠিত বিধান-পরিষদের সদস্যপদের প্রার্থীগণ কর্তৃক উক্ত পদে নির্বাচনের আবেদনপত্রের প্রত্যাহার এবং যাহারা কংগ্রেসের মতের বিরুদ্ধে প্রার্থী হইবে তাহাদিগকে ভোট দিতে ভোটদাতাগণের অস্বীকার। (ছ) বিদেশী দ্রব্য বর্জন।
“এবং যেহেতু স্বদেশজাত ধুতি শাড়ী প্রভৃতির বহুল পরিমাণে ব্যবহার নিয়মানুবর্তিতা এবং আত্মত্যাগ শিক্ষার পক্ষে আবশ্যক–কিন্তু এ সকল দ্রব্যের সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম, সেইজন্য কংগ্রেস চরকায় সূতা-কাটা এবং লক্ষ লক্ষ তাঁতীদের তাঁতে কাপড় বুনিবার জন্য অবিলম্বে উৎসাহ প্রদান। করার পরামর্শ দিতেছে।”
কংগ্রেসের সাধারণ সভার অধিবেশনের পূর্বে বিষয়-নির্ধারণ সমিতিতে অভ্যর্থনা সমিতি প্রথমে এই বিষয়ে যে-প্রস্তাবের খসড়া উপস্থিত করেন, গান্ধী তাহার সংশোধন (amendment)-রূপে উপরোক্ত প্রস্তাবটি আনয়ন করেন। এইরূপ আরও ত্রিশটি সংশোধক-প্রস্তাব ছিল। গান্ধীর প্রস্তাবের সপক্ষে ছিলেন মুসলমান। ভ্রাতাদ্বয়-মহম্মদ আলি ও শওকৎ আলি এবং প্রায় সমস্ত মুসলমান প্রতিনিধিবর্গ। কিন্তু তথাপি ইহার বিরুদ্ধে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়। তিনদিন ব্যাপী আলোচনার পর গান্ধীর সংশোধক প্রস্তাব গৃহীত হইল এবং অন্যান্য প্রস্তাবগুলি বাতিল হইল।
কংগ্রেসের সাধারণ অধিবেশনে (৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯২০) চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিনচন্দ্র পাল, অ্যানি বেসান্ট, মদনমোহন মালব্য, মহম্মদ আলি জিন্না এবং আরও অনেক বিশিষ্ট রাজনীতিক নেতা গান্ধীর প্রস্তাবের বিরোধিতা করিলেও ইহা গৃহীত হয়। ইহার সপক্ষে ছিল ১৮৮৩৬ ভোট এবং বিপক্ষে মাত্র ৮৮৪ ভোট।
কংগ্রেসের নিয়মানুসারে ইহার বিশেষ অধিবেশনে কোন প্রস্তাব গৃহীত হইলে পরবর্তী সাধারণ অধিবেশনে ইহার সমর্থন প্রয়োজন। তদনুসারে কলিকাতা অধিবেশনে গৃহীত গান্ধীর পূর্বোক্ত প্রস্তাবটি নাগপুরের বার্ষিক অধিবেশনে আলোচিত হইল (ডিসেম্বর, ১৯২০)। এই অধিবেশনে প্রায় চৌদ্দ হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন এবং অভূতপূর্ব উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কারণ অনেকেই মনে করিয়াছিলেন যে, অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব লইয়া একটি খুব বড়রকমের লড়াই হইবে। কিন্তু এই আশা বা আকাঙ্ক্ষা মিথ্যা প্রমাণিত করিয়া প্রায় বিনাবাধায় প্রস্তাবটি সমর্থিত হইল। বাঙালী প্রতিনিধিদলের নেতা চিত্তরঞ্জন দাশ কলিকাতায় ইহার বিরোধিতা করেন এবং নাগপুরে এই প্রস্তাব নাকচ করিবার উদ্দেশ্যে এক বিরাট প্রতিনিধি দল লইয়া নাগপুর গমন করিয়াছিলেন। অথচ সময়কালে তিনি গান্ধীর প্রস্তাব সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করিলেন। ইহাতে প্রথমে বাঙ্গালী প্রতিনিধিরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হইয়া গেলেন। এই রহস্যের সম্বন্ধে অনেক জল্পনাকল্পনা হইয়াছে। সম্প্রতি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক যে কাহিনী বিবৃত করিয়াছেন তাহা আমার নিকট খুবই সম্ভবপর মনে হয়, যদিও ইহার সমর্থক অন্য কোন প্রমাণ আমার জানা নাই।
এই অধ্যাপক অমূল্যভূষণ সেনের পিতার কনিষ্ঠভ্রাতা কলিকাতা হাইকোর্টের প্রসিদ্ধ উকিল গুণদাচরণ সেন ছিলেন চিত্তরঞ্জনের পরম আস্থাভাজন অনুরাগী সুহৃৎ। গুণদাবাবুর পুত্র (এখনও জীবিত) অমূল্যভূষণকে যাহা বলেন তাহার সারমর্ম এই : “১৯২০ সনের ডিসেম্বর মাসে নাগপুর কংগ্রেস অধিবেশনের অল্প কয়েকদিন পূর্বে রাত্রিতে একটি ট্রাঙ্ক সঙ্গে লইয়া চিত্তরঞ্জন গুণদাবাবুর বাড়ী যাইয়া তাহাকে বলেন-”এই বাক্সে জনসাধারণের নিকট হইতে সংগৃহীত অনেক টাকা আছে। এটি আপনার কাছে রাখিয়া দিন।” তাহার নির্দেশমত ইহা বিতরণের দায়িত্ব গুণদাবাবুকে দেন। তারপর তাঁহাকে সঙ্গে নিয়া নাগপুর যান। “অধিবেশনের পূর্বরাত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গান্ধী ও চিত্তরঞ্জন একান্তে, তৃতীয় কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে, গভীর রাত্রি পর্যন্ত আলাপ করেছিলেন। দুইজনের মধ্যে ঠিক কী কথাবার্তা হয়েছিল জানা যায় না, তবে গান্ধী চিত্তরঞ্জনকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন যাতে তিনি ও বাংলার প্রতিনিধিরা অসহযোগ প্রস্তাব সমর্থন করেন।”
অমূল্যভূষণ লিখিয়াছিলেন, “চিত্তরঞ্জন আরও মুগ্ধ হয়েছিলেন বাংলার উপর গান্ধীজির অখণ্ড বিশ্বাস ও অসীম নির্ভরতা দেখে। বাংলা বিপ্লবপন্থী, গান্ধীনীতির বিরোধী। গান্ধী তা সম্যক জানেন, আরও জানেন ত্যাগে, চরিত্রের বলিষ্ঠতায় এবং আত্মবিসর্জনের উন্মাদনায় বাংলা সমগ্র ভারতের দিশারি। গান্ধী শুধু চান একটিমাত্র সুযোগ বাংলার কাছে–তাঁর অহিংস অসহযোগ নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন সার্থক করার সুযোগ। তিনি শুধু চান বাংলার বিপ্লবী তারুণ্য-শক্তি সংহত হোল্ক তাঁর প্রাণের মানুষ চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে, ঝাঁপিয়ে পড়ুক এ আন্দোলনে সমান নিষ্ঠায়। বাঙালী চিত্তরঞ্জনকে এই মর্মস্পর্শী আবেদনই গান্ধী-অনুরাগী করে তুলেছিল। ভাবপ্রবণ চিত্তরঞ্জন গান্ধীর ত্রিমুখী বয়কটের (সরকারী আদালত, কাউন্সিল ও বিদ্যায়তন) এবং বিদেশী বর্জনের আবেদনে সাড়া দিতে এতটুকু দ্বিধা করলেন না।”
এই কাহিনী বিশ্বাস করার সপক্ষে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর উক্তি মনে পড়ে। তিনি গান্ধীর যুক্তি অগ্রাহ্য করিলেও তাঁহার আবেদন অগ্রাহ্য করিতে পারিতেন না। গান্ধীজির এই অপূর্ব মোহিনীশক্তির নিকট ভারতের অনেক নেতাই আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন। সম্ভবতঃ নেতাজী সুভাষচন্দ্রই ইহার একমাত্র ব্যতিক্রম।
পরিশিষ্ট
চিত্তরঞ্জন দাশের কন্যা ঁ অপর্ণা দেবী মানুষ চিত্তরঞ্জন নামক গ্রন্থে লিখিয়াছেন : “অনেকের ধারণা ছিল মহাত্মার অসহযোগ-নীতিকে পরাজিত করবার জন্যই তিনি অনেক প্রতিনিধি নিয়ে (নাগপুরে) এসেছেন। কিন্তু কংগ্রেসের মণ্ডপে যখন তিনি দাঁড়ালেন, সকলে বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে দেখলো যে অসহযোগের প্রস্তাব পিতৃদেব নিজেই উত্থাপন করেছেন। ভিতরের খবর যারা জানেন না তারা এতে বিস্মিত হয়েছিলেন নিশ্চয়ই।
“বস্তুতঃ কলিকাতার কংগ্রেসে যে-সব আপত্তির জন্য পিতৃদেব মহাত্মাকে সমর্থন করেননি, নাগপুরে সে-সব আপত্তি অপসারণ করা হয়েছিল তার সমর্থনের জন্য। তিনি বললেন, ‘স্বরাজলাভই মুখ্য উদ্দেশ্য, খিলাফৎ ও পঞ্জাব গৌণ উদ্দেশ্য। কলিকাতা কংগ্রেসে মহাত্মা একথা স্বীকার করে নেননি। তাই পিতৃদেব এখানে স্পষ্টই বললেন, ‘মহাত্মা একথা যদি স্বীকার করে নেন, তবে আমি তাকে পূর্ণ সমর্থন করব। মহাত্মা তখন তাঁর একথায় সম্মত হয়ে মূল প্রস্তাবটি মুসাবিদার ভার পিতৃদেবের হাতেই ছেড়ে দেন। পিতৃদেব নিজের ইচ্ছানুযায়ী প্রস্তাবটি মুসাবিদা করে অসহযোগের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। এতে কলিকাতা কংগ্রেস হতে পিতৃদেবের মত পরিবর্তনের প্রশ্নই ওঠে না। একথা যারা বলেন বা লেখেন তাঁরা ভুল করেন, বরং বলতে হয় প্রকৃতপক্ষে মহাত্মাই স্বমতের কিছুটা পরিবর্তন করলেন। পিতৃদেবের এই প্রস্তাবে কাউন্সিল-বর্জনের কথা একেবারেই ছিল না।”
এই সুদীর্ঘ মন্তব্যটি একেবারেই বিচারসহ নহে। বস্তুতঃ কলিকাতার প্রস্তাবের কোন অংশেরই পরিবর্তন নাগপুরে হয় নাই।
প্রথমতঃ, কাউন্সিল বর্জনের কথা। কলিকাতা কংগ্রেসের সময় কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচন হয় নাই–তাই বলা হয়েছিল যে, সদস্যপদের প্রার্থীরা যেন তাঁহাদের পদনির্বাচনের আবেদনপত্র ফিরাইয়া নেন, অর্থাৎ পদপ্রার্থী না হন। (Withdrawal by candidates of their candidature for election).
নাগপুরে কংগ্রেসের সময় নির্বাচনপর্ব শেষ হইয়াছে। সুতরাং এবারকার প্রস্তাবে বলা হইয়াছে যে, যাহারা নির্বাচিত হইয়াছেন তাহারা যেন সদস্যপদ ত্যাগ করেন। সুতরাং অপর্ণা দেবীর উক্তি “পিতৃদেবের এই প্রস্তাবে কাউন্সিল বর্জনের কথা একেবারেই ছিল না” –সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
অপর্ণা দেবী বলেন, চিত্তরঞ্জনের মতে স্বরাজলাভই মুখ্য এবং খিলাফৎ ও পঞ্জাব গৌণ উদ্দেশ্য–গান্ধী কলিকাতায় একথা স্বীকার করেন নাই, কিন্তু নাগপুরে একথা স্বীকার করায় চিত্তরঞ্জন গান্ধীর প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ইহাও সত্য নহে। কারণ, প্রথমতঃ নাগপুর প্রস্তাবে বলা হইয়াছে যে, কলিকাতার প্রস্ত বি পুনরায় গৃহীত হইল (Reaffirming the resolution on Non-violent Non-co-operation passed at the special session of the Congress at Calcutta)। দ্বিতীয়তঃ, কলিকাতা কংগ্রেসের প্রস্তাবে বলা হইয়াছিল :
“That there can be no contentment in India without redress of the two aforementioned wrongs and that the only effectual means to vindicate national honour and to prevent repetition of similar wrongs in future is the establishment of Swarajya.
নাগপুরের প্রস্তাবে বলা আছে :
“ Whereas the people of India are now determined to establish Swaraj and
Whereas all methods….have failed to secure due recognition of their rights and liberties and redress of their many and grievous wrongs, more specially in reference to the Khilafat and the Punjab.”
এই দুইটি প্রস্তাব তুলনা করিলে একথা মনে করিবার কোন সঙ্গত কারণ নাই যে গান্ধীর মতের এমন কোন পরিবর্তন হইয়াছিল যাহাতে কলিকাতা কংগ্রেসে অহিংস অসহযোগ প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করিয়া চিত্তরঞ্জন নাগপুর কংগ্রেসে গান্ধীর সমর্থন করিতে পারেন। বস্তুতঃ মত পরিবর্তন হইয়াছিল চিত্তরঞ্জনের। আমরা দেখিব অতঃপর আরও দুইবার চিত্তরঞ্জন মত পরিবর্তন করিয়াছিলেন। ১৯২২ সনের শেষে গয়া কংগ্রেসের এবং ১৯২৫ সনে ফরিদপুর প্রাদেশিক কংগ্রেস সভার সভাপতির ভাষণে তাহা প্রমাণিত হয়।