অষ্টম অধ্যায় – অসহযোগ আন্দোলন
অসহযোগ আন্দোলনের দুইটি দিক ছিল–গঠন ও বর্জন। গঠনাত্মক কর্মের মধ্যে প্রধান ছিল দেশী সূতায় বস্ত্রবয়ন–অর্থাৎ চরকা ও তাঁত, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, মদ্যপান-নিবারণ, হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও তিলক-স্মৃতি তহবিলের জন্য এক কোটি টাকা চাঁদা আদায়।
বর্জননীতির প্রধান লক্ষ্য হইল আইনসভা, আদালত, সরকারী স্কুল-কলেজ এবং সরকারদত্ত উপাধি ও অবৈতনিক সরকারি কর্ম প্রভৃতি পরিত্যাগ করা। এগুলির সফলতার জন্য কিছু গঠনমূলক কার্যেরও প্রয়োজন ছিল–যেমন সালিশী আদালত, জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বদেশী দ্রব্য উৎপাদন ইত্যাদি।
এইসব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নাগপুর কংগ্রেস অধিবেশনের পরেই নেতৃবর্গ দেশের নানা অঞ্চলে ভ্রমণ করিয়া আসিলেন। ইহার ফলে :
(ক) তিলক-স্মৃতি তহবিলের জন্য এক কোটি পনেরো লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় হইল।
(খ) কংগ্রেসের নূতন সদস্যসংখ্যা পঞ্চাশ লক্ষ ছাড়াইয়া গেল, এবং (গ) ঘরে ঘরে প্রায় কুড়ি লক্ষ চরকায় সূতা কাটা চলিতে লাগিল।
নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি নির্দেশ দিল, যেন পরবর্তী ৩০শে সেপ্টেম্বরের পূর্বে স্বদেশী বস্ত্র সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা হয়। ইহার ফলে অধিক পরিমাণে খদ্দর প্রস্তুত হইলেও তাহা আশানুরূপ পরিমাণে পৌঁছিল না, লক্ষ্যের অনেক কম হইল। পিকেটিং করায় মদের বিক্রয় অনেক কমিয়া গেলেও পিকেটিং বন্ধ হইবামাত্র মদের দোকানে পূর্ববৎ মদ বিক্রয় আরম্ভ হইল।
নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির নির্দেশ ছিল যে, বিদেশী বস্ত্র সংগ্রহ করিয়া হয় তাহা পোড়াইয়া ফেলিবে, নাহয় বিদেশে পাঠাইয়া দিবে–যেমন তুর্কী সৈন্যের ব্যবহারের জন্য স্মার্ণায় (পশ্চিম এশিয়ায়) কাপড় পাঠাইবার প্রস্তাব করা হইল। ইহার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরও অনেকে আপত্তি করিয়া বলিয়াছিলেন, দেশের লোকের প্রচুর বস্ত্রাভাব, সুতরাং একশত কোটি টাকার কাপড় নষ্ট করা সঙ্গত নহে। কিন্তু এ-বিষয়ে গান্ধী জেদ করায় রাশি রাশি বিদেশী বস্ত্র ভস্মীভূত হইল, কিন্তু তাহাতেও বিদেশী বস্তুবর্জন-আন্দোলন সফল হইল না। স্বদেশী যুগে বঙ্গদেশে এই আন্দোলন যেরূপ তীব্র ও ব্যাপক হইয়াছিল, সমগ্র ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে এবার সেরূপ কিছুই হইল না। কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতি বম্বের অধিবেশনে (১৯২১, ৫ই অক্টোবর) এই অপ্রিয় সত্য স্বীকার করিতে বাধ্য হইল। গঠনমূলক অন্য কয়েকটি আন্দোলনও-অস্পৃশ্যতাবর্জন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রীতির বন্ধন-বিশেষ সফলতা লাভ করে নাই।
পিকেটিং-এর ফলে স্কুল-কলেজ বর্জন কিছুদিন কয়েক স্থানে সাফল্য লাভ করিলেও মোটের উপর ব্যর্থ হইয়াছিল। আইনসভা বর্জন আন্দোলনও সফল হইল
। কংগ্রেস সদস্যেরা নির্বাচন প্রার্থী না হইলেও ভোটদাতাদের অন্ততঃ এক চতুর্থাংশ ভোট দিয়াছিল এবং সমস্ত আসনই অন্য দলের প্রার্থীরা দখল করিয়াছিল। কংগ্রেস তামাসার জন্য বঙ্গদেশে একজন মুচীকে ভোট দিয়া আইনসভার সদস্য নির্বাচিত করিয়াছিল।
ওকালতী বন্ধ করিয়া আদালতবর্জন আন্দোলন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়াছিল। চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরু দুইজনেই ব্যারিষ্টারী ও ওকালতী করিয়া মাসে ১৫। ২০ হাজার টাকা অর্জন করিতেন। তাঁহারা উভয়েই কংগ্রেসের নির্দেশে, আইন-ব্যবসা বর্জন করিয়া অপূর্ব স্বার্থত্যাগের যে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছিলেন তাহা এই আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে। কিন্তু তাহাদের দৃষ্টান্তে প্রথমদিকে বেশী হইলেও শেষপর্যন্ত খুব কম লোকই আইন-ব্যবসা ত্যাগ করিয়াছিল। ইংরেজ আদালতের কাজকর্মও পূর্ববৎ চলিয়াছিল। সালিশী আদালতও প্রথম প্রথম কয়েকস্থানে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, কিন্তু কিছুদিন পরেই তাহা লোপ পাইল। কংগ্রেসের নির্দেশে যাহারা সরকারপ্রদত্ত সম্মান ও উপাধি ত্যাগ করিয়াছিল তাহাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম, এবং সরকারী চাকুরী পরিত্যাগকারীদের সংখ্যাও হাতের আঙ্গুলে গোনা যায়।
কেবল একটি বিষয়ে বর্জননীতি (Boycott) অনেকটা সফল হইয়াছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যুবরাজ ভারত-পরিভ্রমণে আসিবেন, এই বার্তা প্রচারিত হইলে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি নির্দেশ দিল (২৮শে জুলাই, ১৯২১) যুবরাজ বোম্বে পৌঁছিবার দিন (১৭ই নভেম্বর) ভারতের সর্বত্র হরতাল পালিত হইবে। কলিকাতায়, সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে এই হরতাল সম্পূর্ণ সফল হইয়াছিল। অন্যত্রও ইহা ভালভাবেই পালিত হয়।
বম্বে শহরে কিন্তু এই উপলক্ষে আন্দোলনের ‘অসহযোগ’-অংশ সফল হইলেও, অহিংস’-এই অংশ সফল হয় নাই। এই উপলক্ষে সমস্ত শহরে বিষম দাঙ্গাহাঙ্গামা হইল। এইদিন সমুদ্রতীরে বিরাট এক জনসভায় গান্ধী ভাষণ দিলেন এবং রাশি রাশি বিদেশী কাপড় পোড়ান হইল। যাহারা যুবরাজের শোভাযাত্রা দেখিতে চাহিয়াছিল, উন্মত্ত জনতা তাহাদের মাথার পাগড়ী ও টুপি জোর করিয়া ফেলিয়া দিল, ট্রামগাড়ী পোড়াইল, সাহেবদের গায়ে ঢিল ছুঁড়িল, মোটরগাড়ী ও মদের দোকান জ্বালাইয়া দিল। অনেক ব্যক্তি প্রহৃত হইল, অনেক পার্শী মহিলার শাড়ী বিক্ষোভকারীরা কাড়িয়া লইল। অনতিবিলম্বে পুলিশ গুলি করিতে আরম্ভ করিল। শহরের পার্শী ও ফিরিঙ্গীপাড়ায় প্রতিশোধস্বরূপ খদ্দরধারী কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদল গুরুতররূপে প্রহৃত ও আহত হইল। পাঁচদিন ধরিয়া এই তাণ্ডবলীলা চলিল। সরকারী রিপোর্ট অনুসারে ৫৩ জন নিহত ও প্রায় ৪০০ জন আহত হইয়াছিল। গান্ধী ইহার তীব্র নিন্দা করিয়া বলিলেন, এই হিংসাত্মক কার্যকলাপ মজুর বা নিম্নজাতীয় গুণ্ডাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয় নাই–নিহতদের মধ্যে অন্ততঃ ৪৫ জন এবং আহতদের মধ্যে অন্ততঃ ৩৫০ জন অসহযোগ আন্দোলনের কর্মী ও তাহাদের দলের লোক। তিনি দুঃখ করিয়া বলিলেন, “আমরা মুখে অহিংসার বুলি আওড়াই কিন্তু কাজের বেলায় হিংসায় উন্মত্ত হই। গত দুইদিন যে স্বরাজের দৃশ্য দেখিয়াছি তাহার গন্ধে অস্থির হইয়াছি (Stank in my nostrils)।” প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ তিনি অনশন আরম্ভ করিলেন এবং বারদৌলি নামক স্থানে প্রস্তাবিত আইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত রাখিলেন।
বম্বে শহর ছাড়া অন্যান্য স্থানে যুবরাজ-বর্জনকল্পে হরতাল শান্তিতে ও সুষ্ঠুভাবেই পালিত হইয়াছিল। কলিকাতায় ইহার পূর্ণ সার্থকতায় সাহেবমহল বিশেষ বিচলিত হইল। দুইটি ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা Statesman এবং Englishman মন্তব্য করিল, ঘটনা দেখিয়া মনে হয় ইংরেজরাজত্ব শেষ হইয়াছে এবং কংগ্রেসী শাসন আরম্ভ হইয়াছে। ইংরেজদের এই তীব্র ও ভর্ৎসনামূলক সমালোচনায় ফল ফলিল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সরকারের দমননীতি প্রচণ্ড রূপ ধারণ করিল-কংগ্রেস ও খিলাফৎ স্বেচ্ছাসেবক সঙ্ অবৈধ বলিয়া ঘোষিত হইল।
এক সপ্তাহ পরে বঙ্গদেশের ছোটলাট রোনাল্ডশে (Ronaldshay) তিনমাসের জন্য কলিকাতায় ও অন্যান্য কয়েকটি বড় শহরে জনসভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ বলিয়া ঘোষণা করিলেন। প্রকৃতপক্ষে প্রায় এগারো মাস চুপচাপ থাকিয়া অবশেষে গভর্নমেন্ট অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করিলেন।
কলিকাতায় ২৭শে নভেম্বর (১৯২১) বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সমিতির গোপনীয় বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হইল যে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করা হইবে। সুভাষচন্দ্র বসু ও বিপ্লবীদের কর্মধারা বাদ দিলে ভারতের মুক্তিসংগ্রামে ইহাই বঙ্গদেশের সর্বশেষ অবদান। এই আন্দোলনের ‘নায়ক’ ও ‘নিয়ামক’ চিত্তরঞ্জন দাশের কন্যা অপর্ণা দেবী প্রত্যক্ষদর্শী। ইহার বিস্তৃত কাহিনী যথাসম্ভব তাহার ভাষাতেই বর্ণনা করিব। কেবল ‘পিতৃদেব’ শব্দের পরিবর্তে ‘চিত্তরঞ্জন ব্যবহার করিব।
“চিত্তরঞ্জন বাংলার কংগ্রেস ও খিলাফৎ কমিটির আহ্বানে নিয়ামক পদে সমাসীন হয়ে দশলক্ষ স্বেচ্ছাসেবকের জন্য এবং এই সঙ্কট সময়ে দেশকর্মীদের কর্তব্য নির্দেশ করে উপযুপরি কয়েকটি আহ্বানবাণী ঘোষণা করেন। কিন্তু গভর্নমেন্ট এগুলিকে বেআইনী বলে ঘোষণা করে-কংগ্রেস ও খিলাফৎ-কর্মীদের গ্রেপ্তার করতে লাগলো। দেশবরেণ্য নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত তিনমাসের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। ১৯০৮ সনের সভা সমিতি ও প্রকাশ্য আন্দোলন প্রভৃতি নিষেধসূচক পুরানো আইন অনুযায়ী দমননীতি আরম্ভ হওয়া সত্ত্বেও দলে দলে কিশোর ও যুবকেরা সমবেত হলেন। চিত্তরঞ্জনের অদ্ভুত কর্মপ্রেরণায় ও আদর্শে সমগ্র বাংলা দেশে এক নূতন ভাবের বন্যা বয়ে গেল। এক নূতন উৎসাহ ও কর্মোদ্যমে বাংলা জেগে উঠলো।
“১লা ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দেশবাসীদের উদ্দেশ্যে এক বাণী প্রচার করেন (My Message to my Countrymen)। তিনি বললেন, বুরোক্রেসী এবার অসহযোগ আন্দোলন ধ্বংস করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছে।..ধৈর্যের সহিত আপনারা সর্বপ্রকার অত্যাচার সহ্য করিবেন। হিংসানীতির কখনও আশ্রয় লইবেন না, কংগ্রেসের নির্দিষ্ট কার্য করিতে কখনও বিতৃষ্ণ হইবেন না। মনে রাখিবেন, স্বরাজলাভই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।…আজ হইতে সমস্ত নরনারী যেন ভলান্টিয়ার হইয়া এই অসঙ্গত আইন অমান্য করিতে সঙ্কুচিত না হন। আজ হইতে আমি নিজে ভলান্টিয়ার শ্রেণীভুক্ত হইলাম।
“৩রা ডিসেম্বর (১৯২১) সুভাষচন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে প্রথম স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী প্রতি দলে পাঁচ-পাঁচজন করে পাঁচটি দলে খদ্দর বিক্রয় ও হরতাল ঘোষণার জন্য প্রেরিত হল। পরদিন দশটি দল প্রেরিত হল। পুলিশ কাহাকেও গ্রেপ্তার করল না।
“ডিসেম্বরের তিন তারিখে লাহোরে লাজপৎ রায় ও আর কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেন। চিত্তরঞ্জন ক্ষোভে গর্জন করে ছাত্রদের সমরে আহ্বান করে বল্লেন :
‘লাজপৎ রায় আজ কারাগৃহে। আমি এখন প্রকাশ্য আক্রমণ চাই। বাংলার তরুণ যুবকেরা, তোমরা কি দাঁড়িয়ে কংগ্রেসের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া দেখবে? তোমরা কি মায়ের আহ্বানে সাড়া দেবে না? এখন কি তোমাদের পড়বার সময়?…কলকাতার ছাত্রবৃন্দ! এত বড় নগরীতে কি মাত্র পাঁচ হাজার সন্তান! তোমরা আর নিষ্ক্রিয় হয়ে থেকো না’।
“অতঃপর চিত্তরঞ্জনের পুত্র ডোম্বল ২১ জন সঙ্গীসহ গ্রেপ্তার হন। পরদিনই চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে বড়বাজারে গেলেন, সঙ্গে গেলেন চিত্তরঞ্জনের দুই ভগিনী এবং আর একজন কর্মী। বড়বাজারে তাঁরা গ্রেপ্তার হলেন। এতে কলিকাতায় হুলস্থুল পড়ে গেল, জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল, বাংলার অগণিত যুবক গ্রেপ্তার হল।
“বাসন্তী দেবী যখন গ্রেপ্তার হন তখন বড়লাট লর্ড রেডিং কলিকাতায় ছিলেন। নরমপন্থী কংগ্রেস-নেতারা ঐ রাত্রে তাঁর সম্মানে এক নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন। ভোজসভায় বাসন্তী দেবীর গ্রেপ্তারের সংবাদ শুনে সুরেন্দ্রনাথ মল্লিক তীব্র প্রতিবাদ করে ভোজসভা থেকে বের হয়ে গেলেন। বাসন্তী দেবীর ভ্রাতা বিজয় চট্টোপাধ্যায় নিজ দায়িত্বে লর্ড রোনাল্ডশের কাছে গিয়ে বাসন্তী দেবী ও তাঁর সঙ্গিনীদের মুক্তির ব্যবস্থা করে এলেন। ফিরে এসে চিত্তরঞ্জনকে যখন এই সুসংবাদটি দিলেন তখন চিত্তরঞ্জন ব্যাঘের মতন গর্জন করে বল্লেন, তুমি কার অনুমতিতে এ কাজ করেছ? তুমি কি বুঝবে যে আমাদের সমস্ত শ্রম তুমি কিভাবে পণ্ড করে দিলে’? ওদিকে রাত্রি এগারটার পর জেলার গিয়ে বাসন্তী দেবীকে জানালেন তাঁরা মুক্ত, এবং বাড়ী যেতে পারেন। বিজয় চট্টোপাধ্যায়কে দেখে সব ব্যাপার শুনে বাসন্তী দেবী ভয়ানক রেগে গেলেন এবং জেল থেকে বেরুতে অস্বীকার করলেন। কিন্তু জেলার বললেন যে, বন্দী মুক্তি পেলে তাঁকে জেলে রাখতে তাঁরা অপারগ। বাসন্তী দেবী ক্ষোভে পীড়িত হয়ে রাত বারোটার সময় বাড়ী ফিরে এলেন। কিন্তু তার পরদিনই বাসন্তী দেবী আবার খদ্দর বিক্রয় করতে গেলেন, কিন্তু আর তাদের গ্রেপ্তার করা হলো না।”
১৯২১ সনের ১০ই ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন গ্রেপ্তার হইলেন। সেইদিনই সুভাষচন্দ্র বসু, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, আবুল কালাম আজাদ এবং আরও কয়েকজন গ্রেপ্তার হইলেন। চিত্তরঞ্জনের স্থানে শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী নিয়ামক এবং শাসমলের স্থানে সাতকড়িপতি রায় সম্পাদক হইলেন। চিত্তরঞ্জন নিজের পক্ষ সমর্থন করিলেন না। তাঁহার ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হইল।
১৯২১ সনের ১৯শে ডিসেম্বর পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য বড়লাটের দূতরূপে জেলে চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া অনুরোধ করিলেন, যুবরাজের আগমন উপলক্ষে হরতাল বন্ধ করা হউক, তাহা হইলে সরকার অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ ব্যক্তিগণকে মুক্ত এবং দমননীতি প্রত্যাহার করিয়া সকল দলের প্রতিনিধি লইয়া একটি গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করিতে প্রস্তুত আছেন। চিত্তরঞ্জন ও আবুল কালাম আজাদ এই প্রস্তাব সমর্থন করিয়া গান্ধীকে তারবার্তা পাঠাইলেন। কিন্তু গান্ধী দাবি করিলেন, অসহযোগ আন্দোলনের পূর্বে আদালতের বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত মহম্মদ আলি, শওকত আলি ও তাঁহাদের সঙ্গীগণকে মুক্তি দিতে হইবে এবং সভার ফল সন্তোষজনক বিবেচিত না-হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ বন্ধ করা সম্ভব হইবে। ফলে মহাত্মার সম্মতি না-পাওয়ায় গভর্নমেন্টের সঙ্গে কোন আপোষ হইল। চিত্তরঞ্জন গান্ধীর “এই মারাত্মক ভুলের জন্য কারাগৃহে রোষে, ক্ষোভে ও অন্ত বেদনায় অস্থির হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং বলিয়াছিলেন “জীবনের এই এক সুবর্ণ সুযোগ আমরা হারালাম”।
এই ঘটনার অল্প কয়েকদিন পরেই আহমদাবাদে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইল। প্রায় ৪০ হাজার কংগ্রেসকর্মী কারাগারে থাকায় এবারকার অধিবেশনে নাগপুরের তুলনায় অনেক কমসংখ্যক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন (নাগপুরে ১৪,৫৮৩ ও আহমদাবাদে ৪,৭২৬)। শ্ৰীচিত্তরঞ্জন দাশ সভাপতি নির্বাচিত হইয়াছিলেন, কিন্তু তিনি জেলে থাকায় হাকিম আজমল খাঁ সভাপতিত্ব করেন। এই অধিবেশনে বোম্বে শহরে দাঙ্গা-হাঙ্গামার নিন্দা করা হয়, কিন্তু বলা হয় যে, যেহেতু অসহযোগ আন্দোলনের ফলে আমরা স্বরাজের পথে অনেকদূর অগ্রসর হইয়াছি এবং গভর্নমেন্টের প্রতিপত্তি অনেক কমিয়াছে, অতএব ইহা আরও জোরের সহিত চালাইতে হইবে। আর একটি প্রস্তাবে বলা হয়, কেবল ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগতভাবেও অসহযোগ আন্দোলন চালাইতে হইবে (individual civil disobedience and mass civil disobedience)। প্রয়োজন হইলে কংগ্রেসের অন্যান্য কর্মসূচী স্থগিত রাখিতে হইবে।
এই প্রস্তাব-অনুসারে গান্ধী বড়লাটের নিকট পত্র লিখিলেন, সুরাট জিলার বারদৌলী গ্রামে (লোকসংখ্যা ৮৭০০০) সমষ্টিগত আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ করা হইবে। অসহযোগ আন্দোলনে সরকারী অত্যাচার ও উৎপীড়নের এক সুদীর্ঘ তালিকা দিয়া গান্ধী আবেদন করিলেন, সরকারী দমনমূলক নীতি পরিবর্তন করিয়া অহিংস কর্মের জন্য যাহাদের জেল হইয়াছে, তাহাদিগকে মুক্তি দেওয়া হউক, সংবাদপত্রের উপর বহুপ্রকারের নিয়ন্ত্রণমূলক নির্দেশ তুলিয়া দেওয়া হউক এবং অহিংস কর্মের উপর কোনপ্রকার হস্তক্ষেপ করিতে সরকার বিরত হউক–এইগুলি পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করা হউক। এই ঘোষণা যদি এক সপ্তাহের মধ্যে করা হয় তবে বারদৌলীতে আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ করিতে আমি পরামর্শ দিব। বলা বাহুল্য, সরকার ইহাতে ভ্রূক্ষেপও করিল না। গান্ধী যখন নিজে এই আইন অমান্য আন্দোলনের নেতৃত্ব করিবার জন্য বারদৌলী গেলেন তখন সমগ্র ভারতবর্ষ রুদ্ধশ্বাসে এই অসমসাহসিক সংগ্রামের গতি ও ফলাফলের জন্য উন্মুখ হইয়া রহিল। কিন্তু যুদ্ধ আরম্ভ হইবার আগেই গান্ধী পশ্চাতে হটিবার আদেশ দিলেন।
গোরক্ষপুরের নিকট চৌরীচৌরা গ্রামে পুলিশ এক শোভাযাত্রার উপর গুলি চালায়, কিন্তু তাহাদের গুলিবারুদ ফুরাইয়া গেলে তাহারা এক ঘরের মধ্যে আশ্রয় লয়। ক্ষিপ্ত জনতা তখন ঐ ঘরে আগুন লাগাইয়া দিলে পুলিশদল বাহিরে আসিবামাত্র জনতা তাহাদিগকে আক্রমণ করে। ইহাতে বাইশজন পুলিশের মৃত্যু হয় (৫ই ফেব্রুআরি, ১৯২২)। এই সংবাদে মর্মাহত হইয়া গান্ধী বারদৌলীতে কংগ্রেসের কার্যকরী সভার এক অধিবেশনে প্রস্তাব করেন (১১ই ফেব্রুআরি, ১৯২২) যে, অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করা হউক এবং দেশবাসী শুধু চরকায় সূতাকাটা ও অস্পৃশ্যতা-দূরীকরণ ইত্যাদি কাজে আত্মনিয়োগ করুক। অনেকে ইহা অযৌক্তিক মনে করিলেও গান্ধীর মতেই মত দিলেন ও নিখিল ভারতীয় কংগ্রেস কমিটি ২৫শে ফেব্রুআরি অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করিয়া দিলেন। চিত্তরঞ্জন কারাগারে এই সংবাদ পাইয়া অতিশয় ক্ষুব্ধ হইলেন এবং বলিলেন, “এতবড় বৃহৎ দেশে চৌরীচৌরা ঘটবেই। তার জন্য সমস্ত প্রদেশে আন্দোলন বন্ধ করবার কোন মানে হয় না।”
অকস্মাৎ তুচ্ছ কারণে এইভাবে অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করিয়া দেওয়ায় ভারতের জাতীয়তাবাদী দল বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হইল এবং গান্ধীর অনেক অনুরক্ত ভক্তও ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিল। গান্ধীর জনপ্রিয়তা হ্রাসে গভর্নমেন্ট তাহাদের এই শত্রুকে দূর করিবার অপূর্ব সুযোগ পাইল। গান্ধীকে গ্রেপ্তার করা হইল এবং ১৯২২ সনের ৮ই মার্চ আহমদাবাদ আদালতে বিচারে তাহার ছয় বৎসর বিনাশ্রম কারাদণ্ড হইল। এইভাবে অসহযোগ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটিল। এই ব্যর্থতায় ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে অবসাদ দেখা দিল। অনেকে মনে করেন, পরবর্তী কয় বৎসর যে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা ঘটিয়াছিল তাহা এই অবসাদেরই অবাঞ্ছিত ফল। অসহযোগ আন্দোলনের জন্য জনশক্তির ভিতরে যে অপূর্ব জাগরণ দেখা দিয়াছিল, গান্ধীর ব্যক্তিত্বই যে তাহার প্রধান কারণ সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। ইহাতে যেমন একদিকে ভারতের মুক্তিসংগ্রামে গান্ধীর অবদান সম্বন্ধে আমাদের সুউচ্চ ধারণা জন্মে, অপরদিকে মাত্র একজন ব্যক্তির উপর যে আন্দোলন নির্ভর করে তাহার প্রকৃত মূল্য যে খুব বেশী নহে তাহাও স্পষ্ট হইয়া উঠে।
মালব্যের প্রস্তাব অগ্রাহ্র করায় এবং সহস্র সহস্র লোক যে আন্দোলন উপলক্ষে কারাবরণ ও বহু ক্ষতি ও অত্যাচার সহ্য করিয়াছিল তাহা অকস্মাৎ বন্ধ করায় গান্ধীর প্রতি চিত্তরঞ্জনের অচলা ভক্তি অনেকটা হ্রাস পায় এবং আইনসভা বর্জন বিষয়ে জেলে থাকিতেই তাঁহার মত পরিবর্তন হয়। তাঁহার বিশ্বাস হইয়াছিল যে “কাউন্সিলে প্রবেশ করিয়া গভর্নমেন্টের সমস্ত কার্যে সক্রিয় বাধা দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। এই সময় ১৯২২ সনের ১৫ই ও ১৬ই এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলন হয়। বাসন্তী দেবী ছিলেন ইহার সভানেত্রী। চিত্তরঞ্জন কারাগারে। সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করিয়া বাসন্তী দেবীকে এই অভিমত জানাইয়াছিলেন এবং বাসন্তী দেবী সভানেত্রীর ভাষণে বলিলেন, “কাউন্সিলে প্রবেশ করে আমরা অসহযোগিতা করব। যে পর্যন্ত না আমরা নিজ অধিকার লাভে সক্ষম হই, সে পর্যন্ত আমরা কাউন্সিলের ভালমন্দ প্রত্যেক কাজে বাধা দিব।” ১৯২২, ৯ই অগষ্ট, জেল হইতে বাহির হইয়াই চিত্তরঞ্জন এই কাউন্সিল প্রবেশ আন্দোলন আরম্ভ করিলেন। ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে গয়া কংগ্রেসে সভাপতি চিত্তরঞ্জন তাঁহার অভিভাষণে এই মতের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করিয়া বলিলেন, “কাউন্সিলে প্রবেশ করিয়া গভর্নমেন্টের সব কাজে বাধা দিয়া কাউন্সিল ধ্বংস করিব।” গয়া কংগ্রেসে কাউন্সিল-প্রবেশ প্রস্তাব গৃহীত হইল না। কিন্তু চিত্তরঞ্জন হতাশ হইলেন না। “কংগ্রেসের সভাপতিরূপে দাঁড়িয়ে উঠে তিনি বললেন, “আজ আমি পরাজিত হয়েছি সত্য, কিন্তু একদিন–এক বৎসরের মধ্যেই-কংগ্রেসকে আমার মতে আনয়ন করব।”
৩১শে ডিসেম্বর (১৯২২) গয়াতেই মতিলাল নেহেরুর সঙ্গে একযোগে তিনি এক নূতন রাজনীতিক দল গঠন করিলেন। বাংলা দেশের প্রায় সকল কংগ্রেসনেতাই এই দলে যোগ দিলেন। পরে ভিন্ন প্রদেশেরও অনেক নেতা যোগ দেওয়ায় ‘স্বরাজ্য পার্টি’ নামে এই দল বেশ প্রবল হইয়া উঠিল। প্রথমে কংগ্রেস এই দলের বিরোধী ছিল, কিন্তু শেষে দুইদলের মধ্যে একটা রফা হয়। ২৭ মে (১৯২২) নিখিল ভারত-কংগ্রেস কমিটির বোম্বে অধিবেশনে স্থির হয় যে স্বরাজ্য পার্টি’ যে উদ্দেশ্যে কাউন্সিলে প্রবেশ সমর্থন করে সেভাবে কেহ নির্বাচনপ্রার্থী হইলে কংগ্রেস তাহাদের কোন বাধা প্রদান করিবে না।
জেলে থাকিতেই চিত্তরঞ্জনের স্বাস্থ্য ভঙ্গ হয়। বিশ্রাম লইবার জন্য উত্তরভারতে বহু স্থানে ঘুরিয়া কিছুটা সুস্থ হইলেন। কিন্তু ফিরিবার পথে ‘কাউন্সিল প্রবেশ নীতি প্রচার করিবার জন্য নানা স্থানে থামিয়া বক্তৃতা দিতেন। স্বরাজ্য পার্টি গঠিত ও কংগ্রেসকর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর তিনি দক্ষিণভারতের বিভিন্ন স্থানে তাঁহার কন্যার ভাষায় “বিষ্ণুর চক্রের মতই ভারতের সর্বত্র ঘুরে স্বরাজ্য বার্তা প্রচার দ্বারা লোকমত গঠন করতে লাগলেন”। তামিলনাড় ও অন্ধ্রপ্রদেশের বহু শহরে চিদম্বরম, ত্রিচিনোপল্লী, তাঞ্জোর, মাদুরা, তুতিকর্ণ (Toticorin), চিতুর, সালেম, নেলোর প্রভৃতি স্থানে অসহযোগ, কাউন্সিলের ভিতরে ও বাহিরের কর্মধারা, আইনভঙ্গ ইত্যাদি বিশদৃভাবে দেশবাসীকে বুঝাইয়াছিলেন। তাঁহার মূল বক্তব্য ছিল : “কাউন্সিলে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে আমাদের জাতীয় দাবিসকল পেশ করব। যদি গভর্নমেন্ট তা পূরণ না করে, তবে আমরা কাউন্সিলে প্রত্যেক প্রস্তাবে আপত্তি করব–প্রত্যেক বিষয়ে বাধা দেব-যাতে গভর্নমেন্ট কাউন্সিলের মাধ্যমে এদেশ শাসন করতে না পারে। গভর্নমেন্ট যে মুখোস পরে রাজ্যশাসন করছে আমি সেই মুখোস ছিঁড়ে ফেলতে চাই। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ হতে আমাদের কাউন্সিল প্রবেশদ্বারা সর্ববিষয়ে বাধা দেওয়া আরও উৎকৃষ্টতর অসহযোগ।”
কারাগার হইতে মুক্তি পাইয়া অসুস্থ শরীর ও ভগ্নস্বাস্থ্য সত্ত্বেও এই কাউন্সিল প্রবেশের জন্য চিত্তরঞ্জন যে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়াছিলেন এবং রাজনীতিজ্ঞান ও বাগ্মিতার পরিচয় দিয়াছিলেন সত্যই তাহা তাঁহার এক অবিনশ্বর কীর্তি। এই সময় হইতে তিনি সর্বত্রই দেশবন্ধু’ নমে অভিহিত হইতে লাগিলেন। কে বা কাহারা সর্বপ্রথম তাহার প্রতি এই দেশবন্ধু’ সম্বোধনটি ব্যবহার করিয়াছিল আজ তাহা জানিবার উপায় নাই। কিন্তু চিত্তরঞ্জনের স্বরূপ ও দেশবাসীর মনে তাঁহার প্রতি যে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা স্বতঃই ফুটিয়া উঠিয়াছিল তাহা যে এই একটিমাত্র শব্দে প্রকাশ করিবার ভাষা খুঁজিয়া পাইয়াছিল তাহাতে কোন সন্দেহই নাই। অতঃপর আমরা তাহাকে ‘দেশবন্ধু’ বলিয়াই সাধারণত অভিহিত করিব।
১৯২৩ সনের এই নির্বাচনের ফল ও ব্যবস্থাপকসভায় স্বরাজ্য দলের কার্যপ্রণালী পরে আলোচিত হইবে।