০৪. স্বদেশী আন্দোলন ও নিখিল ভারতীয় রাজনীতি

চতুর্থ অধ্যায় – স্বদেশী আন্দোলন ও নিখিল ভারতীয় রাজনীতি

স্বদেশী গ্রহণ ও বিদেশী বর্জন (বয়কট) এই দুইটি আন্দোলন পরস্পরের সহিত অঙ্গাঙ্গীভাবে সংযুক্ত। বিদেশীবর্জন আন্দোলন সফল করিতে হইলে যে-সকল নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য বর্জন করা হয়, স্বদেশে তাহা প্রস্তুত করা দরকার। আবার স্বদেশী আন্দোলন সফল করিতে হইলে ভারতে শিল্পের অনুন্নত অবস্থায় বয়কট বা বর্জননীতি অবলম্বন না করিলে প্রতিযোগিতায় স্বদেশী দ্রব্য বিদেশী দ্রব্যকে হঠাইতে পারিবে না, সুতরাং তাহা ক্রমে লোপ পাইতে থাকিবে। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদস্বরূপ বিলাতী দ্রব্য বর্জন অর্থাৎ বয়কটই প্রথম অবলম্বন করা হয় এবং তাহা অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্যই স্বদেশী অর্থাৎ দেশীয় শিল্পজাত দ্রব্য ক্রয় করিবার আগ্রহ জাগাইবার চেষ্টা হয়।

১. বয়কটের বিরোধিতা ও ইহার ব্যাপক অর্থ

বাংলার বাহিরে নানা প্রদেশে যে স্বদেশী আন্দোলন প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। রাজনীতিক দল অর্থাৎ কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দও ইহাকে পূর্ণ সমর্থন করিতেন। কিন্তু বয়কট বা বিলাতীবর্জন অনেকের মনঃপূত হয় নাই। এমনকি, মহামতি গোখেলও বলিয়াছিলেন, “যাহারা বয়কট প্রচার করে তাহারা অনেকেই ইহার এই অর্থ করে যে, যতদূর সম্ভব বিদেশী দ্রব্যের পরিবর্তে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার করিবে।” অনেকটা ইহার সমর্থনে তিনি এই যুক্তির অবতারণা করেন যে। ‘বয়কট’ বলিলে অপরপক্ষের প্রতি হিংসাত্মক প্রতিশোধের মনোভাব ও তাহার অনিষ্ট করিবার প্রবৃত্তি বোঝায়। সুতরাং তিনি উপদেশ দিলেন, “আমরা বর্তমান আন্দোলনকে কেবল ‘স্বদেশী আন্দোলন বলিব-বয়কট’ শব্দটি বর্জন করিব, কারণ ইহাতে অনর্থক অপর পক্ষকে আমাদের প্রতি বিরূপ করিয়া তোলা হয়।” বাংলার বাহিরে কংগ্রেস দলের অনেক নেতাই গোখেলের মতেই সায় দিতেন। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ বাংলার নেতৃবৃন্দ এই মত গ্রহণ করেন নাই। তাহাদের যুক্তি এই যে, সরকারী নীতির প্রতিবাদে এবং বঙ্গভঙ্গের অবসান ঘটাইবার জন্য নিরস্ত্র সংগ্রামের অস্ত্রস্বরূপই বিদেশীবর্জন নীতি গৃহীত হইয়াছে। ইহার পশ্চাতে কোন দুর্নীতি বা হিংসাত্মক মনোভাব নাই। আমেরিকা, আয়ার্ল্যাণ্ড ও চীন দেশের লোকেরা অনুরূপ অবস্থায় অবিচারের ও অত্যাচারের প্রতীকার স্বরূপ এই নীতি অবলম্বন করিয়াছিল।

গোখেলের আর একটি যুক্তি ছিল, “বর্তমান অবস্থায় শিল্পবিষয়ে অনুন্নত ভারতবর্ষের লোকের পক্ষে বিদেশী দ্রব্য সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা অসম্ভব। সুতরাং বয়কট’ সফল হইবার কোন সম্ভাবনা নাই এবং এই প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া আমরা অনর্থক জগতের কাছে হাস্যাস্পদ হইব।” আশ্চর্যের বিষয়, গোভেলের ন্যায় বিচক্ষণ ব্যক্তি ভুলিয়া গেলেন যে তৎকালীন কংগ্রেসের নীতি, অর্থাৎ আবেদন নিবেদনের প্রস্তাব সম্বন্ধেও ঠিক ঐরূপ আপত্তি করা যায়। কারণ, কুড়ি বৎসর পর্যন্ত বৃটিশশাসনের অনেক ত্রুটি ও তাহার সংশোধনের জন্য অনেক প্রস্তাব করা হইয়াছে–তাহার খুব সামান্য অংশই ফলপ্রদ হইয়াছে। সুতরাং বিদেশীবর্জন। আন্দোলনের দ্বারা আমরা সম্পূর্ণ সফল না হইলেও যেটুকু সুবিধা আদায় করিতে পারি তাহা দোষের নহে।

২. নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ

কিন্তু ইহার অপেক্ষাও বয়কট-নীতির সমর্থনে যে আরও প্রবল যুক্তি ছিল অচিরেই তাহার পরিচয় পাওয়া গেল। বর্জননীতির লক্ষ্য বিদেশীদ্রব্য ছাড়াইয়া সবরকমে সরকারের সহযোগবর্জন রূপ গ্রহণ করিল। ১৯২০ সনে মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে যে আন্দোলন আরম্ভ হয়, যাহা ‘নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ’ (Passive Resistance) এবং অহিংস অসহযোগ আন্দোলন (Non-violent non-co-operation) নামে সুপরিচিত, বঙ্গদেশের ‘বয়কট আন্দোলনকেই তাহার সূচনা ও পথনির্দেশক বলা যাইতে পারে। এ-বিষয়ে তিনজন বাঙ্গালী নেতার উক্তি উদ্ধৃত করিলেই যথেষ্ট হইবে। ‘বন্দে মাতরম্’ নামক ইংরেজী দৈনিক পত্রিকায় ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই সেপ্টেম্বর বিপিনচন্দ্র পাল এ বিষয়ে যে সুদীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“প্রবল ইংরেজ গভর্নমেন্টের বিরদ্ধে বিদ্রোহ করা আমাদের সাধ্যের অতীত। পাগলা-গারদের বাহিরে কেহই এইরূপ সম্ভাবনার কথা মনে আনিতে পারে না যে, বেআইনী হিংসাত্মক কার্য দ্বারা আমরা স্বাধীনতা অর্জন করিতে পারি।

“কিন্তু তাই বলিয়া আমরা এ-বিষয়ে একেবারে সহায় ও সম্বলহীন তাহা বলা যায় না। দৈহিক শক্তি দ্বারা দৈহিক শক্তিকে পরাজয় করা অসম্ভব হইলেও আমরা যদি সরকারকে কোনরূপে সাহায্য করিতে অস্বীকৃত হই তাহা হইলে একদিনেই ইংরেজের শাসনযন্ত্র অচল হইয়া পড়িবে। আমরা গভর্নমেন্টের আইন অমান্য করিব না, কিন্তু নিছক আইনের নির্দেশের অতিরিক্ত আর কোনরকমে শাসনকার্যে স্বেচ্ছায় কোনরূপ সহায়তা না করিলে গভর্নমেন্ট নতি স্বীকার করিতে বাধ্য হইবে। …আমাদের নীতি ‘Passive Resistance’–অর্থাৎ দলবদ্ধভাবে গভর্নমেন্টের সঙ্গে সর্বপ্রকার অসহযোগিতা”।…(পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)।

বিপিন পাল শুধু সংবাদপত্রেই লেখেন নাই, এ সম্বন্ধে অনেক বক্তৃতাও করিয়াছেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তাঁহার সম্পাদিত দৈনিক ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় (১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে নভেম্বর) লিখিলেন, “যদি চৌকিদার কনষ্টেবল হইতে আরম্ভ করিয়া মুন্সেফ ও ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট পর্যন্ত সমস্ত সরকারী কর্মচারী (সিপাহীরা যোগ দিলে আরো ভালো হয়) একযোগে কর্মত্যাগ করে তবে একটি বন্দুকের গুলি না ছুঁড়িয়াও ফিরিঙ্গী শাসনের অবসান ঘটানো যায়।”

অতঃপর ‘Bande Mataram’ পত্রিকায় শ্রীঅরবিন্দ ধারাবাহিক কয়েকটি প্রবন্ধ লিখিয়া এই নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ-নীতির বিশদ ব্যাখ্যা করেন এবং কী পদ্ধতিতে ইহার বাস্তবরূপ দেওয়া হইবে দৃষ্টান্তদ্বারা তাহা বুঝাইয়া দেন। ইহা পরে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হইবে। সুতরাং ১৯০৫-০৬ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গদেশে যে বয়কটের বীজ রোপিত হইয়াছিল তাহাই চোদ্দবৎসর পরে বিশাল মহীরুহে পরিণত হইয়াছিল।

৩. জাতীয়তার উন্মেষ

বিদেশীবর্জন উপলক্ষে গভর্নমেন্টের সহিত জনসাধারণের যে সংঘর্ষ হয় তাহার ফলে প্রথমতঃ সমগ্র ভারতে জাতীয়তার চেতনার উন্মেষ হয়। নিদ্রিত বিশালকায় দৈত্য যেমন ঘটনাচক্রে সহসা জাগরিত হইয়া উঠে, বিশাল ভারতের যে জাতীয়তাবোধ ও স্বাধীনতাস্পৃহা অবচেতন মনে সুপ্ত ছিল, তাহা অকস্মাৎ এক অতর্কিত আঘাতে প্রথমে বাংলাদেশে, পরে সমগ্র ভারতে সোচ্চার হইয়া উঠিল। দ্বিতীয়তঃ গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে সগর্বে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবার সাহস দেশবাসীর মনে সঞ্চারিত হইল। চলতি গ্রাম্যভাষায় সন্ধ্যা’ পত্রিকার লেখক ইহা এইরূপে ব্যক্ত করিয়াছিলেন : যেমন জুজুবুড়ীর ভয় দেখাইয়া শিশুদের নিরস্ত করা যায়–কিন্তু একটু বড় হইলেই সে ভয় যে মিছামিছি, প্রতারণামাত্র, একবার ইহা বুঝিতে পারিলেই শিশুকে আর ঘরে আটক করিয়া রাখা যায় না। গোদা পায়ের লাথি-শীর্ষক প্রবন্ধে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় লিখিয়াছিলেন, “স্ফীতকায় হাতীর পায়ের ন্যায় গোদা পায়ের লাথি মারিবার ভয় দেখাইয়া এক ব্যক্তি সকলকে দাবাইয়া রাখিয়াছিল। একদিন হঠাৎ রাগের মাথায় সে একজনকে সত্য সত্যই লাথি মারিল। প্রহৃত ব্যক্তি দেখিল, হাতীর মত মোটা পায়ের যে লাথিকে তাহারা এতদিন ভীষণ ভয় করিত, তাহাতে মোটেই ব্যথা লাগে না। বরং তুলার বালিশের মত সে লাথি স্বচ্ছন্দে সহ্য করা যায়, বিশেষ কোন ক্লেশ হয় না। সেই অবধি গোদা পায়ের লাথির ভীতি দূর হইল।”

স্বদেশী আন্দোলনে পুলিশের লাঠি ও কারাবাস লোকের এমন গা-সহা হইয়া গেল যে, এই দুই মারণাস্ত্রই গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়াইবার যে ভয় ছিল তাহা দূর করিল। হাসিতে হাসিতে যাহারা ফাঁসীর রঞ্জু গলায় পরিয়াছিল এবং ফাসীর মঞ্চে দাঁড়াইয়া যাহারা জীবনের জয়গান গাহিতে গাহিতে জীবন বিসর্জন দিয়াছিল–তাহাদের দৃষ্টান্ত ও প্রেরণাই ইংরেজের কঠোর শাসনদণ্ডকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ করিয়া দিয়াছিল।

স্বদেশী আন্দোলন ও বিদেশী বর্জনের এই নিগূঢ় অর্থ ও ভাবসম্পদ যে বাংলার বাহিরে সমগ্র ভারতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল নিম্নলিখিত তিনজন সর্বভারতীয় নেতার উক্তি হইতে তাহা প্রমাণিত হয়।

গোখেল বলিয়াছেন, “আমি অনেকবার বলিয়াছি–কিন্তু তবু পুনরুক্তি করিতেছি যে, স্বদেশী আন্দোলন কেবল শিল্পের উন্নতি নহে–আমাদের জাতীয় জীবনের সামগ্রিক উন্নতির জন্য উদাত্ত আহ্বান–সর্বতোভাবে মাতৃভূমির প্রতি ভক্তি ও ভালবাসা এবং জাতীয় জীবনের সর্ববিভাগে এক উচ্চতর মহান আদর্শের প্রতিষ্ঠাই ইহার লক্ষ্য-মানুষের সমগ্র জীবনের সর্ববিধ উন্নতিই ইহার একমাত্র কাম্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এই আন্দোলনের মাধ্যমেই ভারতের প্রকৃত মুক্তির সন্ধান পাওয়া যাইবে।”

মাদ্রাজের সুপ্রসিদ্ধ নেতা জি. সুব্রাহ্মনিয়া আইয়ার একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধে গোভেলের উক্তির পূর্ণ সমর্থন করিয়া ইহার বিশ ও বিস্তৃত বিশ্লেষণ করিয়াছেন। এখানে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“স্বদেশী আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে শিল্পের উন্নতিসাধন এবং এ বিষয়ে পরনির্ভরতা হইতে মুক্তিলাভের চেষ্টা হইলেও ইহার মাধ্যমে সমগ্র জাতীয় জীবনের সর্ববিধ বন্ধনমোচন ও সংস্কার দ্বারা পুনর্গঠনই ইহার মুখ্য উদ্দেশ্য। এই আন্দোলনের ফলে জাতীয় জীবনে যে নূতন আদর্শ জাগিয়া উঠিয়াছে তাহা আজ আর কেবল বাংলায় বা অন্য কোন প্রদেশে সীমাবদ্ধ নহে–সমগ্র ভারতে তাহা যে নব জীবনের এবং নবীন আকাঙ্ক্ষা, উদ্দেশ্য ও উন্নতির সূচনা করিয়াছে, তাহা সত্যই অভাবিত ও অপ্রত্যাশিত। এই নূতন ভাবস্রোতের যে জোয়ার উঠিয়াছে তাহার গতিবেগ সর্বত্র সমান নহে, কিন্তু ইহা যে সকল প্রদেশে সকল শ্রেণীর মধ্যে প্রবাহিত হইতেছে তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

“কংগ্রেস শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনে জাতীয়তা ও স্বদেশী প্রীতির ভাব জাগাইয়াছিল। স্বদেশী আন্দোলন উচ্চ মধ্য নিম্ন শ্রেণীর সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই সেই ভাব জাগাইয়া জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকলকে এক-জাতীয়তার ভাবে প্রণোদিত করিয়াছে”।

মহাত্মা গান্ধি ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দে লিখিয়াছিলেন, “বঙ্গভঙ্গের পরেই ভারতের প্রকৃত নবজাগরণ ঘটিয়াছে–এই বঙ্গ-বিভাগই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভাগের কারণ হইবে।” তিনি আরও লিখিয়াছিলেন, “বঙ্গভঙ্গ রদ-এর দাবি-প্রকৃতপক্ষে স্বায়ত্ত শাসনের (Home Rule) দাবি। এ পর্যন্ত আমাদের ধারণা ছিল যে, আমাদের অসন্তোষ বা ক্ষোভের কোন কারণ ঘটিলে রাজার দরবারে প্রতিকারের প্রার্থনা করিব, প্রতিকার না পাইলে আমরা চুপ করিয়া বসিয়া থাকিব, অথবা আবার আবেদন করিব। বঙ্গভঙ্গের পর লোকে বুঝিয়াছে যে, আবেদন সফল করিতে হইলে তাহার পশ্চাতে শক্তির, বলপ্রয়োগের এবং কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতার নিদর্শন থাকা চাই।”

এই যে নূতন ভাবের ও মনোবৃত্তির উদ্ভব হইয়াছিল, গান্ধিজীর মতে তাহার বৈশিষ্ট্য ছিল, ইংরেজের কারাদণ্ড-ভয়ের বিলোপ এবং স্বদেশী আন্দোলন। “এই নূতন মনোবলের (spirit) পরিচয় পাওয়া গিয়াছিল সংবাদপত্রে নির্ভীক মতামত প্রকাশে। পূর্বে যাহা ভয়ে ভয়ে গোপনে বলা হইত, তাহা এখন প্রকাশ্যে বলা এবং লেখা হইতেছে। আগে যুবা বৃদ্ধ সকলেই সাহেব দেখিলে পলায়ন করিত–এখন আর কেহ সাহেব দেখিলে তোয়াক্কা রাখে না। এখন লোকে গোলযোগের সৃষ্টি করিতে বা জেলে যাইতে কিছুমাত্র ভয় পায় না। আবেদন নিবেদন, আর এই নূতন মনোবৃত্তির মধ্যে প্রভেদ বেশ গুরুতর। এই মনোবৃত্তি বঙ্গদেশে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে, কিন্তু এখন পঞ্জাব হইতে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত তাহা ছড়াইয়া পড়িয়াছে।”

উপরে বঙ্গদেশের আন্দোলনের সম্বন্ধে তিনজন প্রসিদ্ধ অবাঙ্গালী নেতার মতামত যে মোটামুটিভাবে শিক্ষিত ভারতীয়দের মনোভাবের পরিচয় দেয় ইহা অনুমান করা অসঙ্গত হইবে না। অনেক বিদেশীয়গণও যে এইরূপ অভিমত পোষণ করিতেন তাহা ভ্যালেন্টাইন চিরল নামক প্রসিদ্ধ ইংরেজ লেখকের নিম্নলিখিত উক্তি হইতে বুঝা যাইবে :

“বঙ্গভঙ্গের প্রসঙ্গ এখন গৌণ হইয়া পড়িয়াছে। মূল প্রশ্ন যাহা এতদিন আকারে ইঙ্গিতে ব্যক্ত হইত কিন্তু এখন খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত হইতেছে, তাহা ইংরেজের অধীনে বাংলাদেশ একটি না দুইটি প্রদেশ হইবে ইহা নহে-ইংরেজ শাসন আদৌ বঙ্গদেশে তথা ভারতে থাকিবে কিনা ইহাই এখন মূল প্রশ্ন।”

স্বদেশী আন্দোলনের আর একটি বৈশিষ্ট্য, ভারতের রাজনীতিক ক্ষেত্রে এক গুরুতর পরিবর্তন আনয়ন। যে শ্রেণীর লোক সাধারণতঃ রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিতেন না-তাঁহারাও এই আন্দোলনে মাতিয়া উঠিলেন। ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে বারানসী কংগ্রেসে গোখেল তাঁহার সভাপতির ভাষণে এদিকে গভর্নমেন্টের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন। সমগ্র বাঙ্গালী জাতির প্রতিবাদ, আবেদন-নিবেদন অগ্রাহ্য করিয়া বঙ্গভঙ্গ আইনে পরিণত করা বৃটিশ আমলাতন্ত্র-শাসনের চরম কলঙ্ক এবং এই শাসনতন্ত্রের নিকট ন্যায়বিচারের দাবি যে প্রহসনমাত্র ইহা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করিয়া গোখেল প্রতিবাদকারীদের মধ্যে স্যার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, স্যার গুরুদাস ব্যানার্জী, রাজা প্যারীমোহন মুখার্জী, রাসবিহারী ঘোষ এবং ময়মনসিংহ ও কাশিমবাজারের মহারাজার নাম উল্লেখপূর্বক মন্তব্য করেন, “এই সমুদয় লোক এতদিন রাজনীতিতে কোন অংশগ্রহণ বা ইংরেজ গভর্নমেন্টের আপত্তি বা বিরক্তি জনক কোন উক্তি করেন নাই, তাঁহারাও গুরুতর কর্তব্যবোধে এবং একটি বিষম বিপদ হইতে দেশকে রক্ষার নিমিত্ত বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ করিতে অগ্রসর হইয়াছেন।

“যদি এই সব লোকের মতামতও তাচ্ছিল্যের সহিত উপেক্ষা করা হয়, যদি ইঁহাদিগকেও মূক তাড়িত পশু (dumb driven cattle) অপেক্ষা উচ্চতর জীবের ন্যায় গণ্য করা না হয়–যেসব লোক অন্য দেশে বিশিষ্ট সম্মানের অধিকারী বলিয়া বিবেচিত হন তাঁহাদের অবস্থাও যে প্রকৃতপক্ষে নিজেদের দেশে কতদূর হেয় ও অসম্মানজনক ইহা তাঁহাদের চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখান হয়, তবে আমি এইমাত্র বলিতে পারি যে, আমলাতন্ত্রের সহিত সহযোগিতা, চিরকালের জন্য বিদায়। শতবর্ষ এই রাজ্যশাসনের পরও যদি এরূপ ঘটনা ঘটে, তবে বৃটিশ-শাসনের ইহা অপেক্ষা গুরুতর কোন কলঙ্ক আমি কল্পনা করিতে পারি না।”

এই প্রসঙ্গের উপসংহারে গোখেল বলেন, স্বদেশী আন্দোলন যেভাবে সমগ্র ভারতীয় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করিয়াছে বৃটিশরাজত্বে ইহার পূর্বে সেরকম আর কখনও দেখা যায় নাই…এবং ভারতের জাতীয় চেতনার অগ্রগতিতে ইহা একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বলিয়া চিরদিন বিবেচিত হইবে। স্বদেশী আন্দোলন নিখিল ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে যে বিষম আলোড়ন তুলিল তাহার ফলে ক্রমশঃ একটি নূতন রাজনীতিক দলের উদ্ভব হইল। এই দলের নেতা ছিলেন তিলক, অরবিন্দ, বিপিনচন্দ্র পাল ও লালা লাজপৎ রায়। অরবিন্দ ঘোষের পূর্ব জীবনী ও কর্ম সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত বিবরণ পূর্বেই দেওয়া হইয়াছে। ১৯০৭ সালে তিনি ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করিয়া বিপিনচন্দ্র পাল প্রতিষ্ঠিত ‘বন্দে মাতরম্’ নামক দৈনিক পত্রিকার পরিচালন-ভার গ্রহণ করেন। এই কাগজের মাধ্যমে অরবিন্দ বহু প্রবন্ধ রচনা করিয়া রাজনীতিক্ষেত্রে প্রচলিত মত ও পথ ত্যাগ করিয়া এক নূতন পদ্ধতিতে দেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান করেন। তিনিই সর্বপ্রথম দেশপ্রেমকে ধর্মের পর্যায়ে উন্নীত করেন এবং জন্মভূমিকে কেবল জননী নহে, একমাত্র উপাস্য দেবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়া তাঁহার সেবাই মোক্ষলাভের উপায় বলিয়া প্রচার করেন। তাঁহার রাজনীতির মূলকথা তিনটি : আমাদের লক্ষ্য

পূর্ণ স্বাধীনতা, পন্থা-অহিংস প্রতিরোধ ও অসহযোগ (Passive Resistance), নেতা–স্বয়ং ভগবান। তবে তিনি যে হিংসাত্মক কর্মপদ্ধতি বর্জন করেন নাই তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। এ সম্বন্ধে তাহার নিম্নলিখিত উক্তিটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য : “রাজনীতি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম এবং ক্ষাত্রধর্মের অনুসরণই প্রকৃত রাজনীতিক পন্থা। এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণোচিত পন্থা অর্থাৎ ঋষিজনোচিত বৈরাগ্য ও সহিষ্ণুতা আশ্রয় করিলে বর্ণসংকরতা দোষে দুষ্ট হইতে হয়। রাজনীতিতে প্রেম ও ভালবাসার স্থান আছে কিন্তু ইহার একমাত্র লক্ষ্য দেশের মুক্তি। অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুরবস্থা ও ভবিষ্যতে মুক্তির আগ্রহ–এই প্রেমবৃক্ষের মূল, কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখা। দেশসেবা, দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ, স্বার্থবিসর্জন ও দুঃখবরণ ইহাই এই বৃক্ষের ফল। জননী জন্মভূমিকে দেবীরূপে সাধনাই এই বৃক্ষের মূলে জীবনীশক্তিরূপে রসের সঞ্চার।”

যেমন ঋষি অরবিন্দ ছিলেন দেবীরূপিণী দেশমাতৃকার সাধক, তেমনি কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমাদের প্রত্যক্ষ নয়নগোচর জননী জন্মভূমির প্রধান চারণগায়ক। তাঁহার দেশবন্দনার কয়েকটি দৃষ্টান্ত পূর্বে উদ্ধৃত করিয়াছি। ইহার মধ্যে দ্বিতীয় সঙ্গীতটি–’আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি যাহার আরম্ভ, তাহাতে অপূর্ব কবিতৃময় ভাষায় অরবিন্দের কল্পনা রূপায়িত হইয়া উঠিয়াছে।

এই প্রকার মতবাদের ও অন্য নানাবিধ ঘটনার আলোচনা করিলে কোন সন্দেহ থাকে না যে অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ ও স্বদেশী আন্দোলনের অন্য নেতাদের, এমনকি সুরেন্দ্রনাথের রাজনীতির উপরও হিন্দুধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। রাজনীতির উপর ধর্মের প্রভাব থাকা বাঞ্ছনীয় ও পরিণামে মঙ্গলকর কিনা, বর্তমান প্রসঙ্গে ইহার আলোচনা অনাবশ্যক। তবে ইহাও স্মরণ রাখিতে হইবে যে, মুসলমান সম্প্রদায়ের রাজনীতিতেও যে কেবল ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ছিল তাহা নহে, এই সম্প্রদায়ের রাজনীতি ধর্মের একটি অঙ্গস্বরূপ ইহা বলিলেও অত্যুক্তি করা হইবে না।

কেহ কেহ মনে করেন, রাজনীতিক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদের একটি কারণ। ইহা কতদূর সত্য তাহা বলা কঠিন। এইরূপ হিন্দুর অতীত ইতিহাসও স্বদেশী আন্দোলনকে গভীর প্রেরণা দিয়াছিল কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর তাহার ফল হইয়াছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। দৃষ্টান্ত স্বরূপ শিবাজী-উৎসবের উল্লেখ করা যাইতে পারে। শিবাজী হিন্দুপদ-পাদশাহী প্রতিষ্ঠার জন্য মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজীবের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন এবং তাহার শিক্ষা ও দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত মারাঠা জাতিই মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসের প্রধান কারণ। সুতরাং শিবাজীকে হিন্দুরা যে-পরিমাণ ভক্তি করিত, মুসলমানেরা ঠিক সেই পরিমাণেই তাহার প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করিত। তিলক মারাঠা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে মহারাষ্ট্রে বার্ষিক শিবাজী-উৎসবের প্রবর্তন করেন। সমগ্র মহারাষ্ট্রে এই উৎসব স্বাধীনতার অপূর্ব প্রেরণার সৃষ্টি করিয়া জাতীয় চেতনা উদ্বুদ্ধ করে। ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দ হইতে প্রতি বৎসর কলিকাতায় এবং বরিশাল প্রভৃতি বাংলার শহরগুলিতে এই উৎসবের অনুষ্ঠান হয়। ১৯০৪ সনে বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হইয়া এই উৎসব বিপুল উন্মাদনা ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার যে বিখ্যাত ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতাটি রচনা করেন, যতদিন বঙ্গভাষা জীবিত থাকিবে ততদিন ইহা হিন্দুজাতিকে স্বাধীনতার প্রেরণা জোগাইবে। ঐ বৎসর এই উৎসব উপলক্ষে যে বিরাট জনসভা হয় তাহাতে অশ্বিনীকুমার দত্ত তাঁহার ভাষণে বলেন, “এরূপ বিপুল জনসমাগম বরিশালে পূর্বে কেহ দেখে নাই এবং সমগ্র দেশে এই উৎসব এক নবীন জাতীয় চেতনার সঞ্চার করিয়াছে।”

কিন্তু ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের পর যখন স্বদেশী আন্দোলনের স্রোত পূর্ণবেগে প্রবাহিত তখন কলিকাতায় এই উৎসব এক অভূতপূর্ব সফলতা লাভ করে। পাঁচদিনব্যাপী এই উৎসবে সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে তিলক, খাপার্দে, লাজপৎ রায়, মুঞ্জে প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। ইহাতে স্বদেশী দ্রব্যের এক প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা করা হয়। ৫ই জুন আশ্বিনীকুমার দত্তের সভাপতিত্বে যে বিরাট সভা হয় তাহাতে সহস্র সহস্র লোক সমবেত হয়, অনেকেই স্থানাভাবে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হয়। সভাপতি বলেন, আধুনিক যুগে যদি আমাদের জাতীয় নেতা কেহ জন্মিয়া থাকেন তবে তিনি মারাঠা জাতির প্রতিষ্ঠাতা শিবাজী। দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত-প্রাণ সেই মহান শিবাজীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং মারাঠা জাতির সহিত প্রীতিসম্বন্ধ স্থাপনই এই সভার উদ্দেশ্য। তিলকও তাঁহার ভাষণে জাতীয়তার দিক হইতে এইপ্রকার বার্ষিক উৎসবের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন।

এই উৎসব-সভার একটি বৈশিষ্ট্য বর্তমান স্বাধীন ভারতের রাজনীতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষভাবে স্মরণীয়। যে-সময় এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তখন লর্ড কার্জনের কূটনীতিতে বঙ্গদেশের মুসলমানগণ যে ঢাকার নবাবের নেতৃত্বে হিন্দুগণের রাজনীতির ঘোরতর বিরোধী হইয়া উঠিয়াছিল এবং বঙ্গভঙ্গের পূর্ণ সমর্থন করিত তাহা অন্যত্র বলিয়াছি। এইজন্য হিন্দু রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ মুসলমানদিগকে তুষ্ট রাখিতে খুবই সচেষ্ট ছিলেন। জাতীয়তার দিক হইতে ইহা খুবই স্বাভাবিক সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহার জন্য তাঁহারা যে ভারতের অতীত ইতিহাসকে বিকৃত করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই তাহার প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় এই শিবাজী-উৎসবে। হিন্দুদের প্রতি ধর্মান্ধ ঔরঙ্গজেব যে অকথ্য অত্যাচার করেন তাহার জন্যই এই মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে শিবাজীর অভিযান আর তাহার জীবনের ব্রত ছিল হিন্দুপদ-পাদশাহী, হিন্দুর ধর্মরাজ্য স্থাপন। কিন্তু যে-কারণে হিন্দুরা শিবাজীকে মহাপুরুষজ্ঞানে পূজা করে, মুসলমানেরা ঠিক সেই কারণেই মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংসকারী মারাঠা জাতির জনক শিবাজীর প্রতি বীতস্পৃহ হইবে, এমনকি তাঁহার স্মৃতি-উৎসবের প্রতি বিরূপ ভাব পোষণ করিবে, ইহা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু হিন্দুরা তখন ইংরেজের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মুসলমানদের সাহায্যপ্রার্থী, সুতরাং শিবাজীর সম্বন্ধে যাহা সর্বাপেক্ষা বড় সত্য তাহা গোপন করিয়া তিনি-যে মুসলমানদের বিরোধী ছিলেন না, ইহা প্রতিপন্ন করিবার জন্য তাঁহারা ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন। এমনকি, সভাপতি অশ্বিনীকুমার দত্ত-যিনি জীবনে সম্ভবতঃ কখনও মিথ্যা কথা বলেন নাই–তিনি বলিলেন, “শিবাজীর সময় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সমস্য ছিল না, তখন মুসলমান না হিন্দু ভারতের সম্রাট হইবেন, কোন সম্প্রদায়ই ইহা লইয়া মাথা ঘামাইত না। স্মরণ রাখিতে হইবে, শিবাজীর সময় ঘোরতর হিন্দুবিদ্বেষী ঔরংজীব ছিলেন দিল্লীর সম্রাট। তিনি কাশীর বিশ্বনাথমন্দির ও ভারতের বহু স্থানে হিন্দুমন্দির ধ্বংস করিয়াছিলেন, হিন্দুর উপর জিজিয়া কর পুনরায় প্রচলিত করিয়াছিলেন এবং হিন্দুকর্মচারীদের বরখাস্ত করিয়াছিলেন। তাঁহার হিন্দুবিদ্বেষের জন্যই রাজপুত রাণা রাজসিংহ ও মারাঠা শিবাজী তাহার বিরুদ্ধে বহুদিন সংগ্রাম করিয়াছেন।

আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, শিবাজী-উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা মারাঠী বালগঙ্গাধর তিলক মুসলমান-তোষণের জন্য বলিলেন যে, শিবাজী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন নাই, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। তিনি কি বিস্মৃত হইয়াছিলেন যে, শিবাজীর মূলমন্ত্র ছিল “হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা এবং তিনি (তিলক) যে চিৎপাবন কুলোদ্ভূত ব্রাহ্মণ, সেই চিৎপাবনবংশীয় পেশোয়াগণের রাজনীতির প্রধান লক্ষ্যই ছিল মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংস করিয়া হিন্দু মারাঠা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা?” গরজ যে কত বড় বালাই ইহা তাহার একটি চরম দৃষ্টান্ত। আজ ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়, মাত্র দুই বৎসর পূর্বে ঐ কলিকাতা শহরেই শিবাজী-উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ যে বিখ্যাত কবিতাটি রচনা করেন তাহাতে তিনি লিখিয়াছেন :

হে রাজা শিবাজী
তব ভাল উদ্ভাসিয়া এ ভাবনা তড়িৎ প্রভাবৎ
এসেছিল নামি–
এক ধর্মরাজ্য পাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত
বেঁধে দিব আমি।
তার পরে একদিন মারাঠার প্রান্তর হইতে
তব বজ্রশিখা
আঁকি দিল দিগ্‌দিগন্তে যুগান্তের বিদ্যুদ্বহ্নিতে
মহা মন্ত্রলিখা।
মোগল উষ্ণীষশীর্ষ প্রস্ফুরিল প্রলয় প্রদোষে
পক্বপত্র যথা
সে দিনও শোনেনি বঙ্গ মারাঠার সে বজ্রনির্ঘোষে
কী ছিল বারতা।

১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে শিবাজীর রাজধানী রায়গড়ে ‘শিবাজী-উৎসব’ প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে শিবাজীর মুসলমান-ধ্বংসকারীর রূপই তিলক এবং অন্যান্য বক্তারা সর্বোপরি তুলিয়া ধরিয়াছিলেন। শিবাজীকর্তৃক আফজল খাঁর হত্যা সমর্থন করিয়া তিলক (ও অন্যান্য বক্তারা বলেন যে, শিবাজীর এই হত্যাকাণ্ড ভারতীয় দণ্ডবিধির দ্বারা বিচার করা যায় না। সমস্ত দণ্ডবিধির উপর জাতীয় উন্নতির যে দাবি তাহার দ্বারাই ইহা বিচার্য। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য আফজল খাঁকে হত্যা করা শিবাজীর পক্ষে সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত।

১৮৯৫ হইতে ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত আসমুদ্রহিমাচল ভারতের অধিবাসী হিন্দুরা শিবাজীকে মুসলমানরাজ্য ধ্বংস করিয়া হিন্দুরাজ্য স্থাপনের প্রবর্তক মারাঠা জাতির জনক বলিয়া গৌরববোধ করিতে দ্বিধা করিত না। কবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ এই অনুভূতিকে অপূর্ব ভাষায় রূপ দিয়াছেন, কিন্তু ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে মুসলমানদের তোষণ করিবার উদ্দেশ্যে এই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ নিষিদ্ধ হইল। তখনকার দিনে ইহার হয়ত কিছু সমর্থন বা সার্থকতা ছিল, কিন্তু অসত্যকে একবার প্রশ্রয় দিলে সে অভ্যাস দূর করা যে কত কঠিন তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারি যখন দেখি সত্তর বছর পরে আজও ‘স্বাধীন ভারতে সেই মুসলমান-তোষণনীতির প্রভাবে ভারতের অতীত ইতিহাসকে বিকৃত করা হইতেছে।

এ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত কবিতা হইতে কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করিতেছি। ইংরেজ ও মুসলমান ঐতিহাসিকদের উদ্দেশ করিয়া কবি লিখিয়াছেন :

বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যু বলি করে পরিহাস
অট্টহাস্যরবে–
তব পুণ্য চেষ্টা যত তস্করের নিষ্ফল প্রয়াস
এই জানে সবে।
অয়ি ইতিবৃত্তকথা, ক্ষান্ত করো মুখর ভাষণ।
ওগো মিথ্যাময়ী,
তোমার লিখন-’পরে বিধাতার অব্যর্থ লিখন
হরে আজি জয়ী।
যাহা মরিবার নহে তাহারে কেমনে চাপা দিবে
তব ব্যঙ্গবাণী
যে তপস্যা সত্য তারে কেহ বাধা দিবে না ত্রিদিবে
নিশ্চয় সে জানি।

ইতিহাসের সত্য মিথ্যার-ব্যুহ ভেদ করিয়া একদিন আত্মপ্রকাশ করিবেই। শিবাজীর সম্বন্ধে যে মিথ্যা বাণী রাজনীতির অনুরোধে প্রচলিত করা হইয়াছিল আজ তাহার প্রভাব নাই, কিন্তু ইতিহাসকে বিকৃত করা রাজনীতির অঙ্গস্বরূপ চিরস্থায়ী হইয়াছে।

৪. নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের উৎপত্তি

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে রাজনীতি ক্ষেত্রে যে মতভেদের উল্লেখ করিয়াছি তাহার ফলে অচিরেই কংগ্রেসের মধ্যে দুইটি স্বতন্ত্র দলের উদ্ভব হইল। ইহাদিগের সাধারণ সংজ্ঞা হইল-মডারেট (Moderate) ও একস্ট্রিমিস্ট (Extremist)-বাংলায় ইহাদিগকে প্রথমে প্রাচীনপন্থী ও নূতনপন্থী, পরে নরমপন্থী ও চরমপন্থী বলা হইত। আমরা এই সংজ্ঞাই ব্যবহার করিব।

১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়। কুড়ি বৎসর পর্যন্ত একটি দলেই ইহার উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল। ইহার নেতা ছিলেন পার্শী ফিরোজ শাহ মেটা, মারাঠী গোপালকৃষ্ণ গোখেল, এবং বাঙ্গালী সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। নূতন দলের নেতা হইলেন মারাঠী বালগঙ্গাধর তিলক ও বাঙ্গালী অরবিন্দ ঘোষ। বিপিনচন্দ্র পালেরও এই দলে যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল এবং তাহাকে অন্যতম নেতা বলা যায়।

এই দুইটি রাজনীতিক দলের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস বিংশ শতকের ভারতের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু বঙ্গদেশের ইতিহাসে ইহার বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন নাই। সুতরাং সংক্ষেপে কেবলমাত্র এই দুই দলের বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করিব। এই বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে প্রকট হইল প্রথমতঃ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য এবং দ্বিতীয়তঃ এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পৌঁছিবার উপায় বা পদ্ধতি লইয়া। ১৯০৫ সনেও নরমপন্থী বা মডারেট দলের উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতির ন্যায় বৃটিশ সম্রাটের অধীনে স্বায়ত্তশাসন লাভ করা। চরমপন্থীদের লক্ষ্য হইল পূর্ণ স্বাধীনতালাভ। নরমপন্থীরা বিশ্বাস করিতেন, শাসনযন্ত্রের সংস্কারসাধন দ্বারাই ক্রমশঃ ভারতীয়দের সম্পূর্ণ ক্ষমতালাভের সম্ভাবনা আছে–চরমপন্থীদের একমাত্র দাবি স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন, ছোটখাট শাসন-সংস্কারের দাবিতে তাঁহাদের আস্থা বা সহানুভূতি ছিল না।

নরমপন্থীরা চিরাচরিত প্রথানুসারে বিশ্বাস করিতেন যে, কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে দেশের অভাব-অভিযোগ উপস্থাপিত করিয়া তাহার প্রতিকারের জন্য বৃটিশরাজের নিকট বিভিন্ন প্রস্তাব নিবেদন করিলেই কার্যসিদ্ধি হইবে। তাঁহাদের অটুট বিশ্বাস ছিল, ন্যায়পরায়ণ বৃটিশ জাতি ও ইহার সরকারকে আমাদের দাবি যে সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত যদি ইহা বুঝাইতে পারি, তাহা হইলেই আমাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে। ইহা ছাড়া যে আমাদের অধিকতর শাসনক্ষমতা লাভ করিবার অন্য কোন পন্থা বা উপায় আছে এমন ধারণা তাহাদের ছিল না।

নূতন দলই প্রথমে ঘোষণা করেন, গভর্নমেন্টের কাছে আবেদন-নিবেদনে কোন ফল হইবে না, কেবলমাত্র ন্যায়ের খাতিরে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়া বৃটিশজাতি ভারতের শাসনক্ষমতা ভারতীয়দের হস্তে ছাড়িয়া দিবে, ইহা তাহারা বিশ্বাস করেন না। তিলক বলিতেন, “আমরা আবেদন করিব, কিন্তু এই আবেদন যাহাতে গভর্নমেন্ট পূরণ করে তাহার জন্যও ব্যবস্থা করিব।” এই ব্যবস্থাই পরে ‘অহিংস প্রতিরোধ বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিল। বিপিনচন্দ্র পাল (অথবা শ্রীঅরবিন্দ) এই সম্বন্ধে বন্দে মাতরম্’ পত্রিকায় যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। ১৯০৭ সনে এই নীতির স্বরূপ ব্যাখ্যা করিয়া শ্রীঅরবিন্দ যে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন (৯ই হইতে ৩০শে এপ্রিল) তাহার সারমর্ম নিম্নে বিবৃত করিতেছি :

“সরকারের সহিত বিরোধ দুই প্রকার–অহিংস ও হিংসাত্মক। বলপূর্বক অনিষ্ট বা ক্ষতিসাধন দ্বারা সরকারের নিকট হইতে প্রার্থিত দাবি আদায় করার নাম সহিংস প্রতিরোধ। গভর্নমেন্টকে সর্বপ্রকার সাহায্য হইতে বিরত থাকার নাম অহিংস প্রতিরোধ। শেষোক্ত উপায় (Passive Resistance) অবলম্বন করিয়া শাসনকার্য অচল করা–ইহাই ছিল চরমপন্থীদের কর্মপদ্ধতি। গভর্নমেন্টের অর্থনীতি দেশকে শোষণ করিয়া ভারতবাসীকে নিঃস্ব ও দরিদ্র করিতেছে, সুতরাং বিদেশী দ্রব্য বর্জন করিতে হইবে; সরকারের শিক্ষানীতি আমাদের পক্ষে অনিষ্টকর, সুতরাং সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন করিতে হইবে–এইরূপে সরকারী আদালত ও অন্যান্য শাসনবিভাগ বর্জন করিতে হইবে এবং ইহাতে বাঞ্ছিত ফল না পাইলে সরকারী খাজনা দেওয়া বন্ধ করিতে হইবে। অবশ্য ইহার ফলে আমাদের নিজস্ব কল-কারখানা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, আদালত ও শাসনবিভাগ গড়িয়া তুলিতে হইবে।”

শ্রীঅরবিন্দ তাঁহার সম্পাদিত ‘কর্মযোগিন্‌’ পত্রিকায় (১৯০৯, ৩১শে জুলাই) “আমার দেশবাসীর নিকট খোলা চিঠি” নামক প্রবন্ধে লেখেন :

“অহিংস প্রতিরোধের উদ্দেশ্য দুইটি–আত্মনির্ভরতা শিক্ষা এবং গভর্নমেন্টের উপর চাপ দেওয়া। এই নীতির সারমর্ম এই যে, যতদিন পর্যন্ত দেশের আইন প্রণয়ন, আয়-ব্যয় এবং শাসনকার্যে দেশবাসীকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া না হইবে ততদিন পর্যন্ত আমরা গভর্নমেন্টকে কোন প্রকারে সাহায্য করিব না। আমেরিকার লোকেরা যখন বৃটেনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করিয়াছিল তখন তাহাদের মন্ত্র ছিল, হয় শাসনকার্যে সহযোগিতা, নচেৎ ট্যাক্স বন্ধ। সেইরূপ আমরাও বলিব, হয় শাসনক্ষমতা, নচেৎ অসহযোগ। বয়কট বা বর্জন,–অর্থাৎ, আমাদের দেশের অর্থ শোষণ, শিক্ষাদান, বিচার ও শাসনসংক্রান্ত সকল ব্যাপারে অসহযোগ।”

এককথায় বলিতে গেলে দশবছর পরে মহাত্মা গান্ধির যে অসহযোগ আন্দোলনে সমগ্র দেশ মাতিয়া উঠিয়াছিল, বাংলার বিপিনচন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষই যে সর্বপ্রথম বঙ্গদেশে সেই নীতির ঘোষণা করেন সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

বিংশ শতকের প্রথম দশকে ভারতের রাজনীতির বিবর্তনের ধারা বিপিনচন্দ্র পালের জীবনে বিশেষভাবে পরিস্ফুট হইয়াছিল। এই শতকের প্রারম্ভে তিনি কংগ্রেসের নরমপন্থীদের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত ছিলেন। ১৯০২ সনেও, ভারতে বৃটিশপ্রভুত্ব ভারতের কল্যাণসাধনের জন্য ভগবানের দান বলিয়াই তিনি গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি মনে করিতেন : “বৃটিশের অধীন থাকিয়াই আমরা জাতীয়তার সমস্ত আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করিব। আমাদের রাজভক্তি স্বতঃপ্রণোদিত ও স্বাভাবিক, সুতরাং ইহার জন্য গভর্নমেন্টের উদ্বেগের কোন কারণ নাই।” কিন্তু বঙ্গভঙ্গের সমর্থনে লর্ড কার্জনের অনমনীয় দৃঢ়তার ফলে তাহার মনের পরিবর্তন হইল। ১৯০৪ সনে তিনি লিখিলেন, “ইংলণ্ড স্বেচ্ছায় তাহার চিরাচরিত আদর্শ অনুসারে ভারতের দাসত্বশৃঙ্খল মোচন করিবে, এই আশাই আমরা এতকাল পোষণ করিয়াছিলাম। কিন্তু, সে আশা আর নাই।” তাহার পর ১৯০৬ সনে তিনি Passive Resistance বা দলবদ্ধ অসহযোগিতার সমর্থন করিয়া চরমপন্থী দলে যোগ দিলেন। গোখেল বলিয়াছিলেন, পাগলাগারদের বাহিরে কেহ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করিবে না। বিপিনচন্দ্র চরমপন্থীদের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি গ্রহণ করিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গোখেলের ভাষার অনুকরণে লিখিলেন, “পাগলা গারদের বাহিরে কেহ মনে করিতে পারে না যে বে-আইনী হিংসাত্মক কার্যদ্বারা আমরা স্বাধীনতা অর্জন করিতে পারিব।” কিন্তু, চরমপন্থী দলের দুইজন বিশিষ্ট নেতা শ্রীঅরবিন্দ ও তিলক যে হিংসাত্মক বিপ্লবের সমর্থন করিতেন এবং ইহা মুক্তিসংগ্রামের সহায়ক বলিয়া মনে করিতেন, সে-সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। ক্রম বিবর্তনের এই শেষ ধাপেও যে বিপিনচন্দ্র সম্ভবতঃ পৌঁছাইয়াছিলেন তাহার একটি প্রমাণ তাহার ‘Cult of the Bomb’ নামক প্রবন্ধ। তবে এ-বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। পরবর্তী অধ্যায়ে স্বদেশী আন্দোলনের ফলে বিপ্লববাদ কতদূর অগ্রসর হইয়াছিল তাহার আলোচনা করিব।

বিপ্লববাদ সমর্থন করিলেও শ্রীঅরবিন্দ তিলক কেহই প্রকাশ্যে ইহা তাঁহাদের নূতন রাজনীতিক দলীয় মতের অন্তর্ভুক্ত করেন নাই। সুতরাং নরমপন্থী বিপিনচন্দ্র পাল যেভাবে চরমপন্থী দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে পরিগণিত হইলেন, সেইরূপ ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক নেতা-লাজপৎ রায়, খাপার্দে, প্রভৃতি চরমপন্থী দলে যোগ দিলেন। ইহার প্রমাণস্বরূপ দুইটি ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারে। ১৯০৬ সনের ‘শিবাজী উৎসবে’ তিলক ও লাজপৎ রায় নিমন্ত্রিত হইয়া আসিলেন, কিন্তু নরমপন্থীরা ইহা বর্জন করিলেন। এমনকি, বঙ্গদেশের নরমপন্থী দলের নেতা সুরেন্দ্রনাথ ও আরও অনেকেই ইহাতে যোগদান করেন নাই।

দ্বিতীয়তঃ পূর্বোক্ত অহিংস অসহযোগের, অর্থাৎ Passive Resistance নীতি গ্রহণ তো দূরের কথা, বিদেশী দ্রব্য বর্জন, যাহা বাংলার নরমপন্থী দল গ্রহণ করিয়াছিলেন, অন্যান্য প্রদেশের নরমপন্থীরা তাহা অনুমোদন করিতেন না। এমনকি, গোখেলও যে ইহাকে হিংসাত্মক বলিয়া পরিহার করিতে উপদেশ দিয়াছিলেন তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। তিনি ও অন্যান্য নরমপন্থীরা স্বদেশী আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানাইলেও ইহার পরিপূরক বিদেশী বর্জননীতি গ্রহণ করিতে প্রস্তুত ছিলেন না। সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জনেরও তাঁহারা ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। বলা বাহুল্য, যুবরাজ ভারতভ্রমণে আসিবেন এই প্রস্তাব শুনিয়া যখন চরমপন্থীরা তাঁহার সাদর অভ্যর্থনা ও সমারোহ প্রভৃতি বর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলেন, তখন গোখেল বড়লাট লর্ড মিন্টোকে আশ্বাস দিলেন যে, তিনি এই সিদ্ধান্ত নাকচ করিয়া দিবেন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদস্বরূপ যে স্বদেশী আন্দোলনের আরম্ভ হয়, এইরূপে ক্রমে ক্রমে তাহা নিখিল ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে একটি গুরুতর পরিবর্তন ঘটাইল। কুড়ি বৎসর যাবৎ ভারতের যে জাতীয় কংগ্রেস ভারতের রাজনীতির একমাত্র কেন্দ্র, নিয়ামক ও পরিচালক বলিয়া সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হইত, তাহার অভেদ্য দুর্গপ্রাচীরে ফাটল ধরিল এবং ইহার উপর নরমপন্থীদের অবিসংবাদিত প্রভুত্ব ঘুচিয়া গেল। বারানসীতে ১৯০৫ সনে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনেই ইহার সূচনা দেখা দিল।

৫. জাতীয় কংগ্রেসের আভ্যন্তরিক দ্বন্দ্ব

(ক) বারানসী কংগ্রেস

চরমপন্থী দলের প্রভাববৃদ্ধিতে শঙ্কিত হইয়া নরমপন্থী দল গোখেল ও লাজপৎ রায়কে বিলাতে পাঠাইলেন। তাঁহাদের উদ্দেশ্য ছিল, এই নূতন পরিপ্রেক্ষিতে ইংলণ্ডের কর্তৃপক্ষের মত পরিবর্তন করাইয়া বঙ্গভঙ্গ রহিত করা। কিন্তু তাহাদের দৌত্য নিষ্ফল হইল, তাঁহারা নিরাশ হইয়া ফিরিয়া আসিলেন। ইহার ফলে শ্মশান বৈরাগ্যের ন্যায় সাময়িকভাবে গোখেলের মতেরও কিছু পরিবর্তন হইল। বারানসীতে কংগ্রেসের অধিবেশনে (ডিসেম্বর, ১৯০৫) সভাপতির ভাষণে গোখেল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের খুব প্রশংসা করিলেন এবং বলিলেন, চরম সঙ্কট উপস্থিত হইলে বয়কট বা বিদেশী বর্জননীতিও গ্রহণ করা যাইতে পারে। চরমপন্থী লাজপৎ রায় স্পষ্ট ভাষায় বলিলেন, বিলাতের লোকেরা ভারতবর্ষ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন এবং সেখানকার সংবাদপত্রও ভারতীয়দের রাজনীতিক দাবী বা জনমতের সমর্থন করে না। সুতরাং স্বাধীনতা লাভ করিতে হইলে ভারতকে নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হইবে।

নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে বিভেদ আরও পরিস্ফুট হইয়া উঠিল যখন বিদেশী দ্রব্য বর্জনের প্রস্তাব কংগ্রেসে উত্থাপিত হইল। বাঙ্গালী প্রতিনিধিরা ইহা সমর্থন করিলেও অবাঙ্গালী প্রতিনিধিরা ইহার বিরোধিতা করিলেন। ইঁহাদের সংখ্যাধিক্য থাকায় প্রস্তাবটি অনুমোদিত হইবে না, এই আশঙ্কায় বাঙ্গালীরা ভয় দেখাইলেন যে, বয়কট প্রস্তাব গ্রহণ না করিলে তাহারা যুবরাজকে অভ্যর্থনা করা বা অভিনন্দন দেওয়ার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিবেন। নরমপন্থীরা প্রমাদ গণিলেন, কারণ এইরূপ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত না হইলে যুবরাজের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অসম্মান দেখান হইবে। বিশেষতঃ, এই বিষয়ে যে গোখেল বড়লাটকে আশ্বাস দিয়া আসিয়াছিলেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। সুতরাং দুইপক্ষের মধ্যে অনেক তর্কাতর্কির পর উভয়পক্ষই কিছু নরম হইলেন এবং ইহার একটা মীমাংসা হিসাবে স্থির হইল যে, যুবরাজকে অভিনন্দন দিবার প্রস্তাব উপস্থিত করার পূর্বেই বাঙ্গালী প্রতিনিধিরা সভামণ্ডপ ত্যাগ করিয়া বাহিরে যাইবেন, অর্থাৎ সমর্থন বা আপত্তি কিছুই করিবেন না, ফলে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হইবে। অপরপক্ষে, নিম্নলিখিত প্রস্তাবটিও নরমপন্থীরা সমর্থন করিবেন এবং ইহাও সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হইবে :

“ভারত সরকার জনমত এবং সমগ্র জাতির নিবেদন ও আবেদন অগ্রাহ্য করিয়া বঙ্গ বিভাগ করার ফলে বাঙ্গালীরা আর কোনও উপায়ে ইহা রহিত করিতে অসমর্থ হইয়া অবশেষে এ বিষয়ে বৃটিশজাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার জন্য বিদেশী দ্রব্য বর্জনরূপ শেষ ও একমাত্র বিধিসঙ্গত পন্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছে। কিন্তু ইহা দমনের জন্য গভর্নমেন্ট যে কঠোর উৎপীড়ন ও অত্যাচারমূলক নীতি অবলম্বন করিয়াছে এই কংগ্রেস তাহার তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে।”

প্রসঙ্গক্রমে বলা যাইতে পারে, এই প্রস্তাবের সমর্থনে কোন কোন বক্তা দৃষ্টান্ত–স্বরূপ চীনদেশ ও আয়ার্ল্যাণ্ডে বয়কটের কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন।

আপাততঃ কংগ্রেসের দুই দলের মধ্যে একটা আপোস-রফা হইল; কিন্তু, দুই দলের মধ্যে মৌলিক প্রভেদ আরও পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। সুতরাং কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হইলে ঐ সভামণ্ডপেই চরমপন্থী দলেরও একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হইল। স্থির হইল যে, ঐ দল কংগ্রেসের মধ্যে থাকিয়াও একটি নূতন ‘জাতীয় দল গঠন করিবেন এবং Passive Resistance বা অহিংস প্রতিরোধের ভিত্তিতে একটি নূতন কর্মসূচী গ্রহণ করিবেন।

এই নীতি অবশ্য আবেদন-নিবেদনের পরিবর্তে সামগ্রিকভাবে অহিংস অসহযোগ। এই দলগঠনের পরেই তিলক ও বিপিন পাল দলের নীতি প্রচার করিবার জন্য ভারতের নানা স্থানে সভা সমিতি করিয়া নূতন নীতি দেশময় প্রচার করিতে লাগিলেন।

বিপিনচন্দ্র মাদ্রাজের একটি সভায় বলিলেন, “ভারতীয়েরা উচ্চপদে নিযুক্ত হইতে পারেন, হাইকোর্টের বিচারপতি, বিধান সভা ও লাটসাহেবের শাসন পরিষদের সভ্যপদ পাইতে পারেন, এমনকি, সিভিল সার্ভিসে কেবলমাত্র ভারতীয়ই নিযুক্ত হইতে পারেন, কিন্তু সকলকেই বৃটিশকর্তৃপক্ষের হুকুম মানিয়া চলিতে হইবে। কর্মচারী ভারতীয় হইলেও শাসনের কর্তৃত্ব ইংরেজদের হাতেই থাকিবে–আমরা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পাইব না।”

“বয়কটনীতি অবলম্বনের বিরুদ্ধে অনেকে এই আপত্তি তোলেন, তোমরা কি সকল সরকারী চাকুরীই বর্জন করিতে পারিবে’? ইহা সত্য যে, আমরা তাহা পারিব না। কিন্তু, দেশের শাসককার্য অচল ও অসম্ভব করার নানা উপায় আমাদের হাতেই আছে।” দৃষ্টান্তস্বরূপ বিপিনচন্দ্র বলেন, আমরা সরকারী কর্মচারীদের ‘একঘরে’ অর্থাৎ সমাজচ্যুত করিতে পারি।

এই ধরনের বক্তৃতা জনমতের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করিয়া নূতন ‘জাতীয় দলের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধিতে বিশেষ সাহায্য করিয়াছিল।

(খ) কলিকাতা কংগ্রেস (১৯০৬)

বারানসী কংগ্রেসে কোন পক্ষেরই পুরোপুরি জয় হয় নাই, সুতরাং পরবর্তী বৎসর (১৯০৬) দুই দলই কংগ্রেসের আগামী অধিবেশনের জন্য নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করিতেছিল। ইংলণ্ডে নূতন নির্বাচনের ফলে লিবারেল পার্টির জয় হইল এবং জন মর্লি ভারতের সেক্রেটারী অব স্টেট নিযুক্ত হইলেন। ইহাতে নরমপন্থী দল উফুল্ল হইয়া উঠিল। কারণ, উদারমতাবলম্বী বিখ্যাত বার্ক ও মিল–এই দুইজনের শিষ্য এবং গ্লাডস্টোনের সুহৃদ ও জীবনীলেখক মর্লি ভারতবর্ষের ন্যায্য দাবি নিশ্চয়ই মঞ্জুর করিবেন, এই আশায় তাহারা বিশেষ উৎসাহিত বোধ করিল। চরমপন্থী দলের ইংরেজবিরোধী নীতি যাহাতে এই পরম সুযোগ নষ্ট করিতে না পারে এইজন্য নিজেদের দল শক্তিশালী করিতে বদ্ধপরিকর হইল। ওদিকে চরমপন্থী দলও জাপান কর্তৃক রাশিয়ার শোচনীয় পরাজয়ে এশিয়াখণ্ডের সমূহ শক্তি বৃদ্ধির আশায় উফুল্ল হইয়া উঠিল এবং আত্মশক্তির উপর অধিকতর নির্ভরশীল হইবার নীতি প্রচার করিতে লাগিল। আবার, ঠিক এই সময়ে শ্রীঅরবিন্দ রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় চরমপন্থী দলের শক্তি ও প্রতিপত্তি অনেক বৃদ্ধি পাইল। বন্দে মাতরম্’ পত্রিকার মাধ্যমে অরবিন্দ ও বিপিনচন্দ্র পাল চরমপন্থীদের যে আদর্শ ও নীতি এবং কর্মপদ্ধতি প্রচার করিতে লাগিলেন তাহা পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। লালা লাজপৎ রায়, বালগঙ্গাধর তিলক ও বিপিনচন্দ্র পাল এই ত্রয়ী-লাল বাল পাল–এবং তাঁহাদের মধ্যমণি শ্রীঅরবিন্দের নেতৃত্বে ও ব্যক্তিত্বে চরমপন্থী দল নব বলে বলীয়ান হইয়া যুদ্ধং দেহি রবে অগ্রসর হইল।

যুদ্ধের উদ্যোগপর্ব আরম্ভ হইল কলিকাতায়, ১৯০৬ সনের কংগ্রেস অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচন লইয়া। চরমপন্থী দলের ইচ্ছা ছিল, তিলককে এই পদের জন্য নির্বাচিত করা। নরমপন্থী দল এই বিপদ হইতে উদ্ধারের জন্য ৮২ বৎসরের বৃদ্ধ প্রবীণ ও প্রসিদ্ধ দেশবরেণ্য নেতা দাদাভাই নওরোজীকে সভাপতির পদ গ্রহণ করিতে সম্মত করাইলেন। দাদাভাই-এর বিরুদ্ধে আর কোন ব্যক্তিকে সভাপতির পদের জন্য প্রস্তাব করা অসঙ্গত ও অশোভন হইবে, এই ভরসাতেই নরমপন্থীরা এই কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। সর্বসম্মতিক্রমে দাদাভাই নওরোজী সভাপতি নির্বাচিত হইলেন।

প্রবল উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনার মধ্যে ২৬শে ডিসেম্বর (১৯০৬) কলিকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন আরম্ভ হইল। ১৬৬৩ জন প্রতিনিধি এই অধিবেশনে যোগ দিলেন। দর্শকের সংখ্যা ছিল প্রায় বিশ হাজার। ইহার পূর্বে কংগ্রেসের অধিবেশনে এত অধিকসংখ্যক প্রতিনিধি বা দর্শক যোগদান করেন নাই।

সভাপতির অভিভাষণে দাদাভাই কংগ্রেসের চিরাচরিত বুলিরই প্রতিধ্বনি করিলেন-আন্দোলন কর, আন্দোলন কর-কারণ, ইহাই তাঁহার মতে ভারতের শাসনসংস্কার লাভ করিবার একমাত্র পন্থা। গত দুই বৎসরে গঙ্গানদীর মধ্যদিয়া কত জলধারা বহিয়া গিয়াছে এবং পুরাতনের পরিবর্তে নবীনের আবির্ভাব হইয়াছে, অশীতিপর বৃদ্ধ সে-বিষয়ে যে বিশেষ কিছু অবগত আছেন তাঁহার ভাষণ হইতে তাহা মনে হইল না। কেবল একটিমাত্র উক্তির জন্য তাঁহার এই ভাষণ চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। তিনি ঘোষণা করিলেন, আমাদের রাজনীতির লক্ষ্য ‘স্বরাজ’-লাভ। অবশ্য এই ‘স্বরাজ’ বলিতে কী বুঝায় তিনি তাহার ব্যাখ্যা করেন নাই। সুতরাং চরমপন্থীরা ইহার অর্থ করিল ‘পূর্ণ স্বাধীনতা এবং নরমপন্থীরা বলিল, ইহা ইংরেজ উপনিবেশে প্রচলিত স্বায়ত্তশাসনমাত্র। ইহার কোটি সত্য বা প্রকৃত তাহা লইয়া বহুদিন পর্যন্ত বাদানুবাদ চলিয়াছিল এবং দুই দলই ইহা নিজেদের নীতির সমর্থক বলিয়া দাবি করিত।

কংগ্রেসের নিয়মানুসারে ইহার অধিবেশনে যে-প্রস্তাবগুলি উত্থাপিত করা হইবে পূর্বে তাহা একটি ক্ষুদ্র বিষয় সমিতি’ (Subjects Committee) আলোচনা দ্বারা স্থির করে। বঙ্গভঙ্গ, বয়কট প্রভৃতি প্রস্তাবের খসড়া লইয়া তুমুল দ্বন্দ্ব হয় এবং চরমপন্থীদের এক দল উত্তেজিত হইয়া সভা ত্যাগ করে। অবশেষে দুইদলের মধ্যে একটি আপোসরফা হইয়া অধিবেশনের প্রস্তাবগুলি স্থির হয়।

এই সমিতির নির্দেশানুসারে প্রকাশ্য অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গ রহিত করার প্রস্তাব উপস্থিত করা হইল। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বলিলেন, মর্লির মত উদারপন্থী মন্ত্রী বলিয়াছেন যে বঙ্গভঙ্গ’-বিষয়ে আর কোন পরিবর্তন হইবে না। ইহাতে আমরা নিরাশ হইয়াছি। কিন্তু, সঙ্গে সঙ্গে যোগ করিলেন যে, আমরা এখনও মর্লির প্রতি বিশ্বাস হারাই নাই।

বয়কট সম্বন্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করা হইল, “যেহেতু দেশের শাসনসংক্রান্ত ব্যাপারে এদেশীয় লোকের কোন ক্ষমতা নাই এবং গভর্নমেন্টের নিকট কোন দাবি করিলে তাহার যথাযথ বিচার হয় না, কংগ্রেসের মতে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদস্বরূপ বয়কট আন্দোলন যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত ছিল এবং এখনও আছে।”

বিপিনচন্দ্র পাল এই প্রস্তাব সমর্থন করিয়া বলিলেন, ‘বয়কট’ বলিতে কেবল বিদেশী দ্রব্য বর্জন নহে, গভর্নমেন্টের সহিত সর্বপ্রকার সহযোগিতা বর্জন বুঝিতে হইবে। এই ব্যাখ্যায় আপত্তি করিয়া নরমপন্থীরা বলিলেন, ‘বিষয় সমিতি’ যে-প্রস্ত বি করিয়াছেন আমরা তাহাই গ্রহণ করিব-বিপিনচন্দ্র ইহার যে ব্যাখ্যা বা ভাষ্য যোগ করিয়াছেন তাহা গ্রহণ করিব না। তদনুসারে প্রস্তাবটি গৃহীত হইল।

স্বদেশী সম্বন্ধে প্রস্তাবটি ছিল এই : “এই কংগ্রেস স্বদেশী আন্দোলনের পূর্ণ সমর্থন করে, এবং দেশবাসীকে অনুরোধ করে যে, তাহারা যেন দেশীয় শ্রমশিল্পের উন্নতিকল্পে যথাসাধ্য চেষ্টা ও যত্ন করিয়া ইহাকে সার্থক করিয়া তোলে এবং মূল্য বেশী হইলেও বিদেশী দ্রব্যের পরিবর্তে দেশীয় শিল্পজাত দ্রব্য ক্রয় করিয়া দেশীয় দ্রব্যের অধিকতর উৎপাদনে সহায়তা করে।” উক্ত প্রস্তাবের অধধারেখ শব্দ কয়টি নরমপন্থী দলের মনঃপূত ছিল না, কিন্তু অপর দল ইহার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করায় ইহা গৃহীত হয়।

জাতীয় শিক্ষা সম্বন্ধে এই প্রস্তাবটি গৃহীত হয় : “এই কংগ্রেসের মতে, জাতীয় ভাবে প্রণোদিত ও জাতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এবং ছাত্র ও ছাত্রীদিগের যুগোপযোগী সর্বপ্রকার সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরী শিক্ষার ব্যবস্থা কিভাবে করা যায় তাহা বিবেচনা করিবার সময় আসিয়াছে।”

স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধে গৃহীত প্রস্তাবটি এইরূপ : “এই কংগ্রেসের মতে, বৃটিশ উপনিবেশগুলিতে যেরূপ স্বায়ত্তশাসন প্রচলিত আছে, ভারতেও তাহার প্রবর্তন করা হউক এবং ইহার সূচনাস্বরূপ অবিলম্বে নিম্নলিখিত সংস্কারগুলি সাধন করা হউক।”

বয়কটের ন্যায় এই প্রস্তাবটিও আপোসমূলক। ইহার প্রথম অংশটি নূতন দলের প্রভাব সূচিত করে, কিন্তু প্রাচীন নরমপন্থী দল শেষের অংশটুকু যোগ করিয়া ইহার মূল উদ্দেশ্য অনেক পরিমাণে খর্ব করিয়াছে। কারণ প্রস্তাবটির অর্থ এই যে, ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন আমাদের চরম লক্ষ্য। কিন্তু, আপাততঃ শাসন-সংস্কারই আমাদের কাম্য। সভাপতির ভাষণে ‘স্বরাজ আমাদের লক্ষ্য এই উক্তিটি থাকিলেও স্বরাজ বলিতে কী বুঝায় তাহার নির্দেশ নাই। অথচ এই প্রস্তাবে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের উল্লেখ ‘স্বরাজে’র প্রকৃত অর্থ সূচিত করে। মোটের উপর এই দুইটি শব্দ আমাদের রাজনীতিক আদর্শ বলিয়া গ্রহণ এই কংগ্রেস অধিবেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলিয়া বিবেচনা করা যাইতে পারে।

কলিকাতা কংগ্রেসে চরমপন্থীদের পুরাপুরি না হইলেও যে আংশিক জয় হইয়াছিল, সে-বিষয়ে প্রাচীন নরমপন্থীরাও অবহিত ছিল। বারানসীর অধিবেশনে যে-প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয় নাই কলিকাতায় তাহা গৃহীত হয় এবং স্বদেশী আন্দোলনের মূল দাবিগুলি কংগ্রেসের স্বীকৃতি লাভ করে। স্বদেশী, বয়কট ও জাতীয় শিক্ষা, যাহা এতদিন বাংলার আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল তাহাও সর্বভারতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়।

কলিকাতার কংগ্রেস-অধিবেশনের আরও দুইটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়: প্রথমতঃ, রাজনীতিক্ষেত্রে প্রাচীন নরমপন্থী দলের অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব যে অনেকটা হ্রাস পাইয়াছে সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ রহিল না। অরবিন্দ এই বিষয়ে মন্তব্য করিয়াছেন, “শ্রদ্ধা-ভক্তি এখন ব্যক্তির বদলে জাতীয় আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছে, দাদাভাই নওরোজী ও ফিরোজশাহ মেটার নির্দেশের পরিবর্তে দেশের প্রতি কর্তব্যই কংগ্রেস প্রতিনিধিদের পরিচালিত করে। স্বরাজ’ই এখন আমাদের আদর্শ। দাদাভাই ইহা লাভ করিতে যুবকগণকে আহ্বান করিয়াছেন। এই আদর্শের জন্য দেশকে প্রস্তুত করিয়া প্রবীণ নেতাগণ তাঁহাদের কর্তব্য শেষ করিয়াছেন। এই নূতন আদর্শ আমরা সানন্দে গ্রহণ করিলাম এবং প্রয়োজন হইলে প্রাণপাত করিয়াও আমরা এই নির্দেশ পালন করিব।”

(গ) সুরাট কংগ্রেস

কলিকাতা কংগ্রেসে যেসব প্রস্তাব অনুমোদিত হইয়াছিল, তাহা নরমপন্থী ও চরমপন্থীর মধ্যে আপোসের ফল, অতএব কোন পক্ষই তাহাতে পুরাপুরি খুসী হয় নাই। সুতরাং ১৯০৭ সনে প্রায় সারা বছর ধরিয়াই দুইদলের মধ্যে সভায় ও সংবাদপত্রে তর্কযুদ্ধ চলিল। উল্লিখিত যে-প্রস্তাবগুলি অনুমোদিত হইয়াছিল তাহা যে নরমপন্থীদের মনঃপূত হয় নাই এবং কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশনে যে তাহারা এগুলি বর্জন বা পরিবর্তন করিবার চেষ্টা করিবে, চরমপন্থীদের মনে এরূপ আশঙ্কা দেখা দিল। এই আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নহে তাহা শীঘ্রই প্রমাণিত হইল। ১৯০৭ সনের এপ্রিল মাসে সুরাটে বোম্বাই প্রাদেশিক কনফারেন্সের অধিবেশনে ‘বয়কট’ ও ‘জাতীয় শিক্ষা সম্বন্ধে কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাবের কোন উল্লেখই করা হইল না। মেদিনীপুর জিলা কংগ্রেসে দুইদলের মতভেদের জন্য মারামারি আরম্ভ হয় এবং পুলিশ ডাকিয়া শান্তিরক্ষা করিতে হয়।

কলিকাতা কংগ্রেসে স্থির হইয়াছিল, কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশন নাগপুরে হইবে। কিন্তু, কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন লইয়া অভ্যর্থনা সমিতির সভায় দুইদলের মধ্যে মতের ঐক্য না-হওয়ায় গোলমালে সভা ভঙ্গ হয় এবং স্থির হয় যে, কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশন নাগপুরের পরিবর্তে সুরাটে হইবে। নাগপুরে চরমপন্থীরা এবং সুরাটে ফিরোজশাহ মেটার দল সংখ্যায় বেশি ছিল। ইহাতে সকলেই বুঝিল, নরমপন্থীদের চক্রান্তেই তাহাদের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য এই স্থান পরিবর্তন হইল।

সভাপতি নির্বাচন লইয়াও মতভেদ হইল। লালা লাজপৎ রায় বহুদিন ‘অন্তরীণে’ আবদ্ধ থাকিয়া সদ্য মুক্তিলাভ করিয়াছেন; বিশেষ করিয়া এই কারণেই, গভর্মেন্টের কার্যের প্রতিবাদস্বরূপ চরমপন্থীরা তাঁহাকেই সভাপতি পদে বরণ করার অভিপ্রায় প্রকাশ করিল। কিন্তু, নরমপন্থীদের ইহা মনঃপূত হইল না। তাহারা রাসবিহারী ঘোষকে সভাপতি নির্বাচিত করিল। নরমপন্থীদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আরও একটি কারণে চরমপন্থীদের সন্দেহ ঘনীভূত হইল। কংগ্রেস অধিবেশনের দশদিন পূর্বে আলোচ্য বিষয়ের যে-তালিকা প্রচারিত হইল তাহার মধ্যে স্বায়ত্তশাসন, বয়কট ও জাতীয় শিক্ষা–এই তিনটির কোন উল্লেখ ছিল না। তিলক কংগ্রেস অধিবেশনের তিনদিন পূর্বে (২৩শে ডিসেম্বর, ১৯০৭) সুরাটে আসিয়া স্থির করিলেন যে, কলিকাতা কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাব বাদ দেওয়ার মতলব যে-কোন উপায়েই ব্যর্থ করিতে হইবে। ইহার পর দুইদলের মধ্যে যে কথাবার্তা চলিয়াছিল তাহার কোন সঠিক বিবরণ নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। কারণ, এ সম্বন্ধে দুইদলের বিবৃতি বিভিন্ন রকমের। তবে দুইটি বিষয় সম্বন্ধে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। প্রথমতঃ, তিলক অপরপক্ষকে স্পষ্ট জানাইয়াছিলেন, কলিকাতা অধিবেশনে স্বায়ত্তশাসন, বয়কট ও জাতীয় শিক্ষা সম্বন্ধে যে তিনটি প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল, সুরাট অধিবেশনে তাহার কোন পরিবর্তন হইবে না, এরূপ আশ্বাস পাইলে তাঁহারা সভাপতি নির্বাচনে কোন বাধা দিবেন না। দ্বিতীয়তঃ, ইহা সত্ত্বেও এবং অন্যথা বিষম গোলমালের সৃষ্টি হইবার সম্ভাবনা আছে জানিয়াও নরমপন্থীদের এরূপ কোন আশ্বাস দেন নাই।

কংগ্রেস অধিবেশনের পূর্বদিন সন্ধ্যাকালে চরমপন্থী দল স্থির করিলেন যে, যদি পূর্বোক্ত তিনটি প্রস্তাবের কোনরূপ পরিবর্তন করা হয় তবে তাঁহারা সভাপতি নির্বাচনের প্রস্তাবে বিধিসঙ্গত উপায়ে আপত্তি করিবেন, অর্থাৎ তাঁহারা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে একযোগে নিঃশব্দে ভোট দিবেন।

২৬শে ডিসেম্বর (১৯০৭) কংগ্রেসের অধিবেশন আরম্ভ হইল এবং ঐদিন অপরাহে কংগ্রেসে যেসব প্রস্তাব আলোচনা করা হইবে তাহার খসড়া সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হইল। দেখা গেল পূর্বোক্ত তিনটি প্রস্তাবেই গুরুতর পরিবর্তন করিয়া নরমপন্থীদের মতে আপত্তিকর কথাগুলি বর্জন বা পরিবর্তন করা হইয়াছে।

২৬শে ডিসেম্বর কংগ্রেসের অধিবেশনে শ্রীরাসবিহারী ঘোষের নাম সভাপতির পদের জন্য প্রস্তাব করা মাত্র চারিদিক হইতে ‘না, না’ শব্দ উঠিল। সুরেন্দ্রনাথ প্রস্তাবটি সমর্থন করিতে উঠিলে চারিদিক হইতে এত কলরব আরম্ভ হইল যে অধিবেশন স্থগিত করা হইল। সেইদিন রাত্রে তিলক, গোখেল ও ফিরোজশাহ মেটার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া একটি মীমাংসায় উপনীত হইবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কাহারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ মিলিল না। পরদিন বেলা সাড়ে বারোটার সময় তিলক অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতিকে লিখিলেন, সভাপতি নির্বাচনের প্রস্তাব উত্থাপন ও সমর্থন হওয়ার পরই তিনি প্রতিনিধিদের নিকট সভা মুলতুবি রাখার জন্য আবেদন করিবেন এবং একটি মীমাংসায় পৌঁছান যায় এমন একটি প্রস্তাব উপস্থিত করিবেন,-তাহাকে যেন বলিবার সুযোগ দেওয়া হয়।

২৭শে ডিসেম্বর (১৯০৭) বেলা একটার সময় কংগ্রেসের স্থগিত অধিবেশন আরম্ভ হইল। সুরেন্দ্রনাথ ও মতিলাল নেহরু রাসবিহারী ঘোষকে সভাপতি নির্বাচন করার প্রস্তাব সমর্থন করিলে অনেকে ‘হ, হ’ এবং অল্প কয়েকজন না, না’ ধ্বনি করিলেন। সভাপতি ঘোষণা করিলেন যে, নির্বাচন প্রস্তাব অনুমোদিত হইয়াছে। রাসবিহারী ঘোষ সভাপতির ভাষণ দেওয়ার জন্য দাঁড়াইবামাত্র তিলক সভামঞ্চে উঠিয়া বলিলেন, অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতিকে তিনি পূর্বেই জানাইয়াছেন যে, তিনি সভায় একটি প্রস্তাব উপস্থিত করিবেন। কমিটির সভাপতি উঠিয়া বলিলেন, তিলকের প্রস্তাব নিয়মবিরুদ্ধ। কিন্তু, তিলক তাঁহার নির্দেশ মানিতে অস্বীকার করিয়া প্রতিনিধিবর্গের নিকট আবেদন করিতে চাহিলেন। তখন সভায় তুমুল গোলমাল আরম্ভ হইল। রাসবিহারী ঘোষ তাঁহার ভাষণ দিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু তিলক চীৎকার করিয়া বলিতে লাগিলেন, তাঁহার প্রস্তাব তিনি উত্থাপন করিবেনই, নচেৎ সভার কার্য চালাইতে দিবেন না। ইতিমধ্যে কলরব ও গোলমাল চরমে পৌঁছিলে উভয়পক্ষের সদস্যরাই সপ্তমে গলা চড়াইয়া পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতে লাগিলেন। ইহার পর যাহা ঘটিল সে-সম্বন্ধে দুই দলের বিবরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। চরমপন্থীরা বলেন যে, একদল জোর করিয়া তিলককে মঞ্চ হইতে সরাইয়া নিবার চেষ্টা করেন; অপরপক্ষ বলেন, তিলকের অনুচরেরা লাঠি হাতে মঞ্চের প্রতি ধাবমান হন। সম্ভবতঃ দুইটিই সত্য এবং প্রথমটিই দ্বিতীয়টির কারণ। মোটের উপর যেটুকু সত্য বলিয়া নিঃসংশয়ে গ্রহণ করা যায় তাহা এই : সভায় তাণ্ডবলীলার আবির্ভাব হইল, অন্য অস্ত্রের অভাবে পরস্পর পরস্পরের দিকে। চেয়ার ছুঁড়িতে আরম্ভ করিল, ইতিমধ্যে সভামণ্ডপের মধ্য হইতে একপাটি জুতা মঞ্চের দিকে নিক্ষিপ্ত হয়, এই জুতা সুরেন্দ্রনাথ ও ফিরোজশাহ মেটার গায়ে লাগে। অবশ্য কে কাহাকে লক্ষ্য করিয়া জুতা ছুঁড়িয়াছিল তাহা নির্ণয় করিবার উপায় নাই এই কারণে যে, দূর হইতে নিক্ষিপ্ত জুতা ঠিক উদ্দিষ্ট ব্যক্তির গায়েই পড়িবে, অন্য কাহারও অঙ্গ স্পর্শ করিবে না, এরূপ অব্যর্থ লক্ষ্যসন্ধানের পরিচয় সচরাচর পাওয়া যায় না–উত্তেজিত জনতার পক্ষে ইহা অসম্ভব বলিয়াই মনে হয়। ইহার পর সভার যে অবস্থা হইল তাহা যথাযথ বর্ণনা করার ভাষা নাই। গোলমাল ও মারামারি-লাঠি ও চেয়ারের সহযোগে–ক্রমশঃ বাড়িতে লাগিল, কংগ্রেসমণ্ডপ মেছোবাজারে পরিণত হইল এবং সভাপতি উপায়ান্তর না দেখিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা স্থগিত রাখিলেন।

এই দক্ষযজ্ঞের পর যাহা ঘটিল তাহার বিশ্বস্ত ও বিস্তারিত বিবরণ ভারতবর্ষের ইতিহাসে সহজেই পাওয়া যাইবে। মোটের উপর বলা যাইতে পারে, নরমপন্থীরা পৃথক সভা করিয়া কংগ্রেসের নিয়মাবলী পরিবর্তনের ব্যবস্থা করিলেন। এই নূতন নিয়মের ফলে কংগ্রেসে চরমপন্থীদের যোগ দিবার অধিকার রহিল না। পরবর্তী সাত বৎসর ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রকৃতপক্ষে নরমপন্থীদের মিলনক্ষেত্র হইল–”জাতীয় কংগ্রেস’ এই নামের কোন সার্থকতা থাকিল না–অনেকে ইহাকে বলিত ‘মেটা মজলিস’।

পরিশিষ্ট

On 18 September, 1905, B. C. Pal wrote an article under the caption of “That Sinful Desire” of which a few passages are quoted below:

“The expression of our desire for autonomy, absolutely free from British control, has driven the Anglo-Indian Press into quite a chorus of hysterics…. It is not in human nature to rest eternally contented with a state of subordination or serfdom…Governments might punish a man for being hungry and feeling athirst, with as much reason and justification as they may punish their subjects for desiring to be free. Yet wisdom counsels the pursuit of freedom, so far as it may be with peaceful methods. … The foreign despotism that holds political sway over us now, is strong…the people are as absolutely disarmed… What chance is there for any organised and active opposition to this Government by a people such as curs? No one outside a lunatic asylum will ever think of or counsel any violent and unlawful methods in India in her present helplessness, for the attainment of her civic freedom.

“But still we are not so helpless in other directions. If we may not oppose physical force by physical force we may yet make the administration in India absolutely impossible any day…Our ideal is Freedom which means absence of all foreign control. Our method is Passive Resistance. which means an organised determination to refuse to render any voluntary and honorary service to the Government….”

Referring to speeches of this kind in Madras by B. C. Pal, Srinivas Sastri observed : “Bipin Chandra Pal burst out into full fame in Madras as preacher of the new political creed. For several days on the sands of the beach he spoke words hot with emotion and subty logical which were wafted by the soft evening breeze to tens of thousands of listeners, invading their whole souls and setting them aflame with the fever of a wild consuming desire. Oratory had never dreamt of such triumphs in India; the power of the spoken word was never demonstrated on such a scale.”

Bipin Chandra Pal, Memoirs of my Life and Times, Second Revised Edition, 1973, pp. 638-41 (underlining is ours).

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *