দ্বিতীয় অধ্যায় – বঙ্গভঙ্গ
১৯০৫ সন ভারতের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় তারিখ। এই তারিখে ব্রিটিশ শাসিত বঙ্গপ্রদেশ দুইভাগে বিভক্ত হয় এবং ইহার বিরুদ্ধে যে তীব্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তাহাই ক্রমে ক্রমে ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে পর্যবসিত হয়।
ব্রিটিশ-শাসনের প্রারম্ভে উত্তরভারতের ব্রিটিশ-অধিকৃত অঞ্চল বাংলা দেশের গভর্নর জেনারেলের প্রত্যক্ষ শাসনের অধীনে ছিল, অবশিষ্ট বিজিত বা অন্য কারণে অধিকৃত দেশগুলি মাদ্রাজ ও বোম্বের গভর্নরের অধীনে ছিল। ১৮৫৩ সনে অযোধ্যা ব্রিটিশ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর একটি স্বতন্ত্র ব্রিটিশ প্রদেশে পরিণত হয়। উত্তরভারতের অবশিষ্ট ইংরেজ-অধিকৃত প্রদেশগুলি অর্থাৎ বঙ্গ, বিহার, আসাম, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর একজন লেপ্টেন্যান্ট গভর্নর বা ছোটলাট শাসন করিতেন।
১৮৭৪ সনে আসাম এবং বঙ্গভাষাভাষী গোয়ালপাড়া, কাছাড় ও শ্রীহট্ট লইয়া একটি ভিন্ন প্রদেশ গঠিত হয় এবং একজন চীফ কমিশনারের হস্তে ইহার শাসনভার ন্যস্ত হয়।
বঙ্গদেশের অবশিষ্ট অংশের পরিমাণ ছিল ১৮৯,৯০০ বর্গমাইল; ইহার লোকসংখ্যা ছিল সাত কোটি পঁচাশী লক্ষ এবং ইহার রাজস্বের পরিমাণ ছিল এগারো কোটি টাকারও বেশী। এই বিস্তৃত প্রদেশ একজন ব্যক্তির পক্ষে শাসন করা দুঃসাধ্য বিবেচিত হওয়ায় ইহার প্রতীকার কিভাবে করা যায় তাহা লইয়া অনেক আলোচনা ও বিতর্ক হয় এবং বিভিন্ন সময়ে এই উদ্দেশ্যে নানারকম প্রস্তাব হয়।
লর্ড কার্জন বড়লাট হইয়া আসিবার পর তিনি এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেন। ১৯০৩ সনের শেষভাগে তিনি প্রস্তাব করেন যে চট্টগ্রাম বিভাগ, এবং ঢাকা ও মৈমনসিংহ জিলা আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হউক। ইহার ফলে বাংলা যাহাদের মাতৃভাষা তাহারা দুইটি পৃথক দেশের অধিবাসী হইবে–এই কারণে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন হয়। রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ, জমিদারশ্রেণী এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাংলার জনসাধারণ সকলেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। সমগ্র দেশে নগরে ও গ্রামে সভা সমিতিতে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ও প্রস্তাব গৃহীত হয়। দুইমাসের মধ্যে কেবলমাত্র পূর্ববঙ্গে পাঁচশত সভায় এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করা হয় এবং এই প্রস্তাব কার্যে পরিণত হইলে বাঙ্গালীর পক্ষে কিরূপ অশুভ হইবে তাহার বিশদ আলোচনা শত শত পুস্তিকাকারে সমগ্র দেশের মধ্যে প্রচারিত হয়। কেবল বাংলা নহে-ইংরেজী সংবাদপত্রে, এমনকি গোঁড়া ইংরেজদের মুখপত্র ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকায় এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করা হয়। ইউরোপীয় বণিকগণের মুখ্য প্রতিষ্ঠান Bengal Chamber of Commerce-ও (বেঙ্গল চেম্বার অব্ কমার্স) এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেন।
বাঙ্গালীর এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে তাহাদের জাতীয় সংহতির গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়া লর্ড কার্জনের মনে আশঙ্কা হইল যে ইহা ভবিষ্যতে ইংরেজশাসনের একটি গুরুতর বিপদের কারণ হইয়া উঠিবার সম্ভাবনা। সুতরাং তিনি অঙ্কুরেই এই বিপদের মূল উচ্ছেদ করিবার জন্য আরও ব্যাপক একটি পন্থা উদ্ভাবন করিলেন। তিনি স্থির করিলেন যে, সমগ্র উত্তর ও পূর্ববঙ্গ আসামের সহিত যুক্ত করিয়া একটি, এবং পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা লইয়া আর একটি–মোট দুইটি ছোটলাট শাসিত প্রদেশ গঠিত করিবেন। ইহার ফলে জাতীয়তাবাদী এবং শিক্ষাদীক্ষায় অধিকতর উন্নত হিন্দু বাঙ্গালীরা এই উভয় প্রদেশেই সংখ্যালঘু হইবে। ওদিকে মুসলমানরা পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় তাহাদের ক্ষমতা বাড়িবে, এই সম্ভাবনা দেখাইয়া তিনি মুসলমানদিগকে এই প্রস্তাবের পক্ষপাতী করিয়া তুলিলেন। এ বিষয়ে ঢাকার নবাবকে অল্প সুদে বহু টাকা কর্জ দিয়া এবং নূতন প্রদেশে তাঁহার গৌরব ও ক্ষমতাবৃদ্ধির লোভ দেখাইয়া তাঁহাকে প্রস্তাবিত বঙ্গ-বিভাগের প্রধান সমর্থনকারীরূপে খাড়া করিলেন। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে প্রভেদের এই-যে নীতি কার্জন প্রথম প্রবর্তিত করিলেন, ক্রমে ক্রমে তাহাই ইংরেজ রাজনীতির একটি প্রধান ও চিরন্তন অঙ্গস্বরূপ হইল এবং ইহার সুদূরপ্রসারী ফলস্বরূপ পাকিস্থানের সৃষ্টি হয়–ইহা বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি করা হইবে না।
জাতীয়তাবোধে সচেতন বাঙ্গালীর শক্তিহাসের এই ব্যবস্থা খুব গোপন রাখা হইল। পূর্বের প্রস্তাব অর্থাৎ চট্টগ্রাম বিভাগ এবং ঢাকা মৈমনসিংহ জিলা আসামের অন্তর্ভুক্ত করা লইয়া যখন ঘোর আন্দোলন চলিতেছিল এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ১৯০৩ ও ১৯০৪ সনের বার্ষিক অধিবেশনে ইহার বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত হইল তখন গভর্নমেন্ট ঘোষণা করিলেন যে, এখনও এ-বিষয়ে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত করা হয় নাই। অতঃপর ১৯০৫ সনের ১১ই জানুআরি তারিখে বাংলা দেশের বিভিন্ন জিলার প্রায় তিনশত প্রতিনিধি একটি কনফারেন্সে সমবেত হইলেন। এই কনফারেন্সের সভাপতি ছিলেন বিগত কংগ্রেস অধিবেশনের সভাপতি আসামের অবসরপ্রাপ্ত চীফ কমিশনার স্যার হেনরী কটন। তিনি তাঁহার ভাষণে বলিলেন যে “শাসনসৌকর্যের জন্য আবশ্যক বোধ করিলে বিহার ও ছোটনাগপুরকে বঙ্গদেশ হইতে বিচ্ছিন্ন এবং শ্রীহট্ট ও কাছার এই দুই বঙ্গভাষাভাষী জিলা বঙ্গদেশের সহিত যুক্ত করিয়া একটি নূতন গভর্নরশাসিত প্রদেশ (Presidency) গঠিত করা হউক।” উক্ত কনফারেন্সে নিম্নলিখিত প্রস্তাব গৃহীত হইল :
“বঙ্গবিভাগ সম্বন্ধে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় নাই শুনিয়া এই কনফারেন্স আশ্বস্ত হইয়াছে। ইংরেজী সংবাদপত্রগুলিতে এই বঙ্গদেশ বিভক্ত হওয়া সম্বন্ধে যে নূতন প্রস্তাবগুলির আভাস দেওয়া হইয়াছে তাহা সত্য হইলে এই কনফারেন্স গভর্নমেন্টকে এই প্রার্থনা জানাইতেছে, যে কোন পরিবর্তিত প্রস্তাব গ্রহণ করার পূর্বে তাহা সর্বাধারণের গোচরে আনা হউক-যাহাতে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে গভর্নমেন্ট জনসাধারণের মতামত জানিবার সুযোগ পান।”
১৯০৫ সনের মে মাসে লণ্ডনের ষ্ট্যাণ্ডার্ড’ (Standard) নামক পত্রিকায় সংবাদ বাহির হইল যে বিলাতের কর্তৃপক্ষ ভারত গভর্নমেন্টের বঙ্গ-ভঙ্গ প্রস্তাব অনুমোদন করিয়াছেন। তৎক্ষণাৎ বিলাতে টেলিগ্রাম করা হইল যে এ-বিষয়ে একটি আবেদন বা স্মারকলিপিতে (Memorial) বাঙ্গালীদের যে মতামত ব্যক্ত হইয়াছে তাহা বিবেচনা না করিয়া যেন কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা না হয়। ষাট হাজার লোকের স্বাক্ষরিত এই আবেদনপত্র প্রস্তুত হইলে বিলাতে পালিয়ামেন্টের একজন সভ্য বিলাতে ভারতবিষয়ক মন্ত্রী (Secretary of State for India) মি. ব্রডরিককে জিজ্ঞাসা করেন যে তিনি এ বিষয়টি জানেন কিনা এবং এই স্মারকলিপি পাওয়ার পূর্বে এ-বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্থগিত রাখিবেন কিনা। ১৯০৫ সনের ৪ঠা জুলাই এই প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী ব্রডরিক বলিলেন, বিগত ১৮ ফেব্রুআরি তারিখে তিনি এ-বিষয়ে ভারত গভর্নমেন্টের প্রস্তাব পাইয়াছেন এবং ইহা অনুমোদন করিয়া ভারত গভর্নমেন্টকে জানাইয়াছেন। তিন দিন পরে, অর্থাৎ ১৯০৫ সনের ৭ই জুলাই সিমলা হইতে ভারত সরকার ইহা ঘোষণা করিলেন। ১৯শে জুলাই গভর্নমেন্ট এই প্রস্তাব একটি সরকারী সিদ্ধান্ত (Resolution) রূপে গ্রহণ করিলেন এবং পরদিন ইহা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইল।
এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুসারে স্থির হইল যে, আসাম ও বাংলা দেশের অন্তর্গত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজসাহী বিভাগ লইয়া ছোটলাটশাসিত একটি নূতন প্রদেশ গঠিত হইবে। বাংলা দেশের প্রেসিডেন্সী বিভাগ এবং বিহার ও উড়িষ্যা ঐরূপ আর-একটি প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হইবে।
লর্ড কার্জনের প্রথম প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দেশময় যে আন্দোলন হইয়াছিল তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। বলা বাহুল্য, এই নূতন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও ব্যাপক ও তীব্র আকার ধারণ করিল। এরূপ দেশময় আন্দোলন ইহার পূর্বে আর কখনও দেখা যায় নাই। ইহার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়াও সম্ভব নহে। কয়েকটি বিশিষ্ট ঘটনার উল্লেখ করিতেছি।
ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দেশীয় সংবাদপত্রে অতি তীব্রভাবে প্রস্তাবটির নিন্দা করা হয়। ইংরেজী ‘বেঙ্গলী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেন যে, এই বঙ্গভঙ্গ আমরা কিছুতেই মানিয়া লইব না। যতদিন ইহা রহিত না হয় ততদিন আইনসঙ্গত উপায়ে আমরা যে আন্দোলন চালাইব, ব্যাপকতা ও তীব্রতায় তাহার সমতুল্য কোন আন্দোলন ইহার পূর্বে এদেশে আর কখনও হয় নাই। ভারতীয় সমস্ত সংবাদপত্র এবং ইংরেজচালিত কয়েকটি পত্রিকায়ও ইহার তীব্র প্রতিবাদ হয়।
১৯০৩ সনের ডিসেম্বর মাস হইতে ১৯০৫ সনের অক্টোবর মাসের মধ্যে অন্ত তঃ ৩০০০ প্রকাশ্য সভায় জনসাধারণ ইহার প্রতিবাদ করে। বাংলার সর্বত্র এইরূপ সভার অধিবেশন হয়। হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই এই সমুদয় সভায় যোগদান করে এবং এই সকল সভায় ৫০০ হইতে ৫০,০০০ শ্রোতা উপস্থিত থাকিতেন।
সরকারী বিবরণ অনুসারেও সাধারণ লোকের অন্ততঃ ৫০০ প্রতিবাদসভা হইয়াছিল এবং ৭৫,০০০ লোকের স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবাদপত্র পাঠান হয়।
কলিকাতার টাউন হলে পাঁচটি বিশাল সভার অধিবেশন হয়। এই সকল সভায় রাজা-মহারাজা-জমিদার, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, জাতি-বর্ণ-ধর্মনির্বিশেষ হাজার হাজার লোক সমবেত হইয়াছিলেন। বিলাতে কর্তৃপক্ষের নিকট সত্তর হাজার লোকের স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়। বাঙ্গালী নেতারা বাংলার সংবিধানসভায় (Legislative Assembly) ইহার তীব্র প্রতিবাদ করেন। অম্বিকাঁচরণ মজুমদার বলেন যে, খুনী আসামীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়–কিন্তু তিন কোটি বাঙ্গালীকে কোন কথা বলিবার সুযোগ না দিয়াই তাহাদিগের চরম দুর্ভাগ্যের ব্যবস্থা করা হইল। ভূপেন্দ্রনাথ বসু বলেন, বাঙ্গালীর জাতীয় একতার ধ্বংসমূলক যে ব্যবস্থা হইয়াছে, মুঘল ও পাঠান রাজাদের আমলেও এরূপ জাতীয় দুর্ঘটনা ঘটে নাই। এই দুঃখের ভার ও ধ্বংসের হাত হইতে মুক্তির জন্য আমাদের সমগ্র শক্তি ও সম্বল নিয়োগ করিতে হইবে।
কলিকাতা ও মফঃস্বলের বাংলা সংবাদপত্র ‘হিতবাদী’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘সন্ধ্যা’, চারুমিহির’ প্রভৃতি সহজ ভাষায় এই বঙ্গভঙ্গের ফলে বাঙ্গালীর ভবিষ্যৎ অবস্থা সাধারণের নিকট তুলিয়া ধরিত। প্রস্তাবিত বঙ্গদেশে বাঙ্গালীর সংখ্যা হইবে এক কোটি সত্তর লক্ষ, কিন্তু বিহারীদের সংখ্যা হইবে দুই কোটি। তাহা ছাড়া উড়িয়া ভাষাভাষী আছে। সুতরাং নিজ বাসভূমে বাঙ্গালীকে সংখ্যালঘিষ্ঠ হইয়াই থাকিতে হইবে। লর্ড কার্জনের সমর্থনকারীরা বলিত যে, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন কলিকাতার স্বার্থান্বেষী লোকেরাই কৃত্রিম উপায়ে জীয়াইয়া রাখিয়াছে। ইহা যে সম্পূর্ণ অসত্য তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। নেতৃস্থানীয় কয়েকজন মহানুভব ইংরেজও বঙ্গভঙ্গের তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছেন। কলিকাতা হাইকোর্ট, ইংরেজ বণিকদের প্রতিষ্ঠান চেম্বার অব্ কমার্স, ইংরেজ আই. সি. এস, কর্মচারী এবং এদেশের ও বিলাতের কয়েকটি ইংরেজ-পরিচালিত পত্রিকাও বঙ্গভঙ্গের তীব্র প্রতিবাদ করেন। এমনকি, ১৯০৬ সনে বিলাতে যিনি ইংরেজ সরকারের মন্ত্রীসভায় ভারতের সেক্রেটারী অব স্টেট পদ গ্রহণ করিয়াছিলেন সেই সুপ্রসিদ্ধ ইংরেজ লেখক ও চিন্তাশীল নেতা জন (পরে লর্ড) মর্লিও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন যে, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন কয়েকজন নেতা স্বার্থপ্রণোদিত হইয়া কৃত্রিম উপায়ে চালু রাখিয়াছেন ইহা সত্য নহে–ইহা বাঙ্গালী জনসাধারণের প্রকৃত মনোভাবের অভিব্যক্তি মাত্র।
তবে লর্ড কার্জন ও ইংরেজ সরকার যে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহকে ও তাঁহার সহায়তায় মুসলমান সম্প্রদায়কে এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন হইতে নিবৃত্ত করিয়া ক্রমে ক্রমে তাহাদিগকে ইহার বিরোধী করিয়া তুলিতে সমর্থ হইয়াছিলেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। শীঘই যে বঙ্গভঙ্গ-আন্দোলন সমগ্র বাঙ্গালীর নহে, প্রধানতঃ বাঙ্গালী হিন্দুদের আন্দোলনে পর্যবসিত হইয়াছিল ইহা কোনমতেই অস্বীকার করা যায় না। অবশ্য মুসলমানদের মধ্যেও কেহ কেহ শেষপর্যন্ত এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন।
মৌলবী লিয়াকৎ হোসেন ইহার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এরূপ আরও কয়েকজনের নাম করা যাইতে পারে। কিন্তু তাঁহাদের সংখ্যা বেশী নহে। বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ও বিরোধ সৃষ্টি করা যে লর্ড কার্জনকর্তৃক বঙ্গভঙ্গের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তাহাতেও যেমন কোন সন্দেহ নাই–তাহার এই উদ্দেশ্য যে সম্পূর্ণ সফল হইয়াছিল তাহাও সেইরূপ অনস্বীকার্য। এইদিক দিয়াও ১৯০৫ সনের বঙ্গভঙ্গ ভারতের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা।
কিন্তু, লর্ড কার্জনের একটি উদ্দেশ্য সাধিত হইলেও বঙ্গভঙ্গের মুখ্য উদ্দেশ্য সফল হয় নাই। যদিও কার্জন প্রচার করিতেন যে শাসনকার্যের অসুবিধা দূর করার জন্যই বঙ্গভঙ্গের ব্যবস্থা করা হইয়াছে, বাঙ্গালী হিন্দুরা ইহা কোনদিনই বিশ্বাস করে নাই। কারণ তাহা হইলে পূর্বোক্ত কটন সাহেবের প্রস্তাব অনুযায়ী বাঙ্গালীদের এক প্রদেশে রাখিয়াও, বিহার, উড়িষ্যা প্রভৃতি বাদ দিয়া এই প্রদেশের আয়তন ও লোকসংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস করা যাইত। বঙ্গদেশের নেতাগণ এবং দুইজন উচ্চপদস্থ ইংরেজও এই প্রস্তাব সমর্থন করিয়াছিলেন। অনেকেই তখন বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে শিক্ষাদীক্ষা ও জাতীয়তার অনুপ্রেরণায় অধিকতর অগ্রসর বাঙ্গালী জাতি ইংরেজ-রাজ্যের বিপদের কারণ হইয়া উঠিতে পারে–এই আশঙ্কা দূর করিবার জন্যই কার্জন বঙ্গভঙ্গ দ্বারা বাঙ্গালীর সংহতি ও প্রভাব নষ্ট করা এবং হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করার প্রয়াস পাইয়াছিলেন।
তদানীন্তন গভর্নমেন্ট ইহা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করিলেও ইহাই যে বঙ্গভঙ্গের মূল উদ্দেশ্য ছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। পরবর্তীকালে সরকারী কাগজপত্রের সাহায্যেই এই সত্য নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হইয়াছে।
১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার মি. ওল্ডহ্যাম প্রস্তাব করিয়াছিলেন যে মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গ একটি পৃথক প্রদেশ হইলে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘিষ্ঠ বাঙ্গালী হিন্দুসম্প্রদায়ের রাজনীতিক হিসাবে বর্তমান আশঙ্কাজনক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি (threatening position of the Hindu minority) অনেক হাস পাইবে। ইহার কয়েক বৎসর পরে সার এণ্ড ফ্রেজার মন্তব্য করেন যে, বাঙ্গালী হিন্দুদের রাজনীতিক ক্ষমতা অসম্ভব বৃদ্ধি পাইয়াছে; সুতরাং বঙ্গদেশের এক অংশ পৃথক করিয়া এই বিপদ দূর করা উচিত। লর্ড কার্জন এই মন্তব্য সম্পূর্ণ সমর্থন করেন; কিন্তু এই উদ্দেশ্যের কথা যাহাতে সরকারী দলিলপত্রে না থাকে তাহার নির্দেশ দেন। যখন প্রস্তাব করা হইল যে, বিহার বঙ্গদেশ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া স্বতন্ত্র প্রদেশ করা হউক তখন ইহার বিরুদ্ধে যুক্তি দেখান হইল, ইহাতে কলিকাতার বাঙ্গালী রাজনীতিক নেতাদের ক্ষমতা আরও বাড়িয়া যাইবে। বঙ্গভঙ্গ হইলে তাহাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অনেক কমিয়া যাইবে বলিয়া কংগ্রেস নেতারা যে আশঙ্কা প্রকাশ করিতেছেন ইহা সম্পূর্ণ সত্য, কিন্তু ইহাই আমাদের মতে বঙ্গবিভাগের প্রকৃত সার্থকতা। কিন্তু ইহা সরকারী দলিলে প্রকাশ্যভাবে উল্লেখ করা সঙ্গত নয়।’ লর্ড কার্জন ১৭ই জানুআরি (১৯০৪) ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট ব্রডরিককে এক চিঠিতে লেখেন : “বাঙ্গালীরা মনে করে তাহারা একটি জাতি এবং স্বপ্ন দেখে যে ইংরেজদিগকে তাড়াইয়া একজন বাঙ্গালী বাবুই বড়লাট লইয়া কলিকাতা রাজভবনে বাস করিবেন। বঙ্গভঙ্গ হইলে তাহাদের রাজনীতিক প্রাধান্য নষ্ট হইবে এবং এই স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া যাইবে-এইজন্যই ইহার বিরুদ্ধে এত প্রবল আন্দোলন চালাইতেছে। আজ যদি আমরা তাহাদের চীকারে বঙ্গভঙ্গ রহিত করি, তবে আর কোনদিন বাঙ্গালীর শক্তি খর্ব করা যাইবে না।” এই চিঠি পাওয়া সত্ত্বেও শেষমুহূর্তে আন্দোলনের প্রবলতায় শঙ্কিত হইয়া সেক্রেটারি অব স্টেট টেলিগ্রাম করিলেন (২০শে মে, ১৯০৫) যে, বঙ্গদেশ বিভক্ত না করিয়া ছোটনাগপুর ও উড়িষ্যাকে পৃথক করা হউক। তখন কার্জন ক্রোধে গর্জন করিয়া লিখিলেন, “এই ব্যবস্থা অবলম্বন করিলে বাঙ্গালীদের ঐক্য ও ক্ষমতা আরও বাড়িবে এবং যে অনিষ্ট বন্ধ করার জন্য আমরা বঙ্গভঙ্গ করিতে চাই তাহা আরও বৃদ্ধি পাইবে।” এইরূপ সম্প্রতি প্রকাশিত আরও অনেক গোপনীয় সরকারী চিঠিপত্র ও দলিলে রাজনীতিক্ষেত্রে বাঙ্গালীর প্রভাব খর্ব করাই যে বঙ্গভঙ্গের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাহা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হইয়াছে।
ওল্ডহ্যাম, ফ্রেজার ও লর্ড কার্জনের এই গূঢ় উদ্দেশ্য ও নীতি ক্রমে ক্রমে সরকারী মহলের বাহিরে অন্যান্য ইংরেজদেরও হৃদয়ঙ্গম হইল এবং মুসলমানের ন্যায় ভারতের ইংরেজ সম্প্রদায়ও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন হইতে বিরত হইলেন। কিন্তু বাঙ্গালী হিন্দুদের বিরোধিতা ক্রমশই বাড়িয়া চলিল এবং উগ্রতর আকার ধারণ করিল। গভর্নমেন্টের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হইলেও হিন্দুরা কিছুমাত্র দমিল না। তাহারা দৃঢ় সংকল্প করিল যে, এই অন্যায় ও অত্যাচার কখনই স্বীকার করিয়া লইব না–ইহার প্রতিবিধানের জন্য লড়াই চালাইয়া যাইতে হইবে। শ্রীসুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রতিরোধের অবিসংবাদিত নেতা বলিয়া স্বীকৃতি লাভ করিলেন। তিনি দসহকারে ঘোষণা করিয়াছিলেন, যদিও সরকার বঙ্গভঙ্গ একটি অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত (Settled Fact) বলিয়া প্রচার করিতেছেন, আমরা ইহার পরিবর্তন ঘটাইবই। তিনি এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিয়াছিলেন। কিভাবে আপাতদৃষ্টিতে এই অসম্ভব সম্ভব হইয়াছিল অতঃপর তাহাই বিবৃত করিব।
সমগ্র দেশবাসীর সমবেত প্রতিবাদসত্ত্বেও যখন বঙ্গদেশ বিভক্ত করা হইল তখন বাঙ্গালী হিন্দুরা নিঃসংশয়ে বুঝিল, কেবলমাত্র সভা-সমিতি ও আবেদন নিবেদন করিয়া কোন ফল লাভ হইবে না। যেভাবেই হউক গভর্নমেন্টের উপর চাপ সৃষ্টি করিতে হইবে। সশস্ত্র বিদ্রোহ করা সম্ভব নহে, সুতরাং অন্য উপায় অবলম্বন করা প্রয়োজন।
গভর্নমেন্টের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাজানি হইবার কয়েকদিন পরে কৃষ্ণকুমার মিত্র ১৩ই জুলাই (১৯০৫) তাঁহার সম্পাদিত সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় লিখিলেন, সরকারী প্রস্তাবের প্রতিবাদে বিলাতী দ্রব্য ও সরকারী কর্মচারীদের সংস্পর্শ বর্জন করা হউক এবং সমগ্র দেশ শোকচিহ্ন ধারণ করুক। ১৩ই জুলাই (১৯০৫) খুলনা জিলার বাগেরহাট গ্রামে একটি জনসভায় এই মর্মে দুইটি প্রস্তাব গৃহীত হইল যে, বঙ্গভঙ্গ রহিত না-হওয়া পর্যন্ত বিলাতী ও অন্যান্য বিদেশীয় দ্রব্য বর্জন করা হউক এবং ছয়মাস পর্যন্ত প্রকাশ্যভাবে জনসাধারণের আমোদ-উৎসব নিষিদ্ধ হউক।
১৯০৫ সনের ১৭ই জুলাই ‘অমৃতবাজার পত্রিকায় একখানি পত্রে প্রস্তাব করা হয় যে, ইংরেজ জাতিকে ভারতের অসন্তোষ দূর করিতে বাধ্য করার জন্য বিলাতী দ্রব্য, বিশেষতঃ মাঞ্চেস্টারের কাপড় বর্জন করা হউক। অনেকে মনে করেন, প্রসিদ্ধ ব্যারিষ্টার লালমোহন ঘোষই এই পত্রের লেখক।
১৯০৫ সনের ২১শে জুলাই : দিনাজপুরের মহারাজার সভাপতিত্বে এক জনসভা আহূত হয়। ইহাতে লালমোহন ঘোষ বলেন, ইংরেজ জাতির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিম্নলিখিত উপায়গুলি অবলম্বন করা হউক।
১। সমস্ত অনাররি ম্যাজিস্ট্রেটের পদত্যাগ।
২। জিলা বোর্ড, মিউনিসিপ্যালিটি এবং পঞ্চায়েতের সদস্যগণের একযোগে পদত্যাগ।
৩। এক বৎসর জাতীয় শোক-চিহ্নস্বরূপ সর্বপ্রকার প্রকাশ্য অমোদ-উৎসবে যোগদান না করা।
২৪শে জুলাই ‘হিতবন্ধু’ পত্রিকা লিখিল, “বিলাতের বণিকগণ যখন বুঝিতে পারিবে যে মাঞ্চেষ্টারের কাপড় বর্জনের ফলে তাহাদের বহু আর্থিক ক্ষতি হইবে তখন তাহাদের চাপে সরকার বঙ্গভঙ্গ রহিত করিতে বাধ্য হইবে”। বাগেরহাট ও দিনাজপুরের অনুকরণে পাবনা, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, মাগুরা, মৈমনসিংহ, যশোহর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, বীরভূম, রামপুরহাট, এমনকি সুদূর আসামের অন্তর্গত নওগাঁ ও প্রভৃতি নানা স্থানে বিরাট জনসভায় বিলাতীবর্জন ও স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারের প্রস্তাব গৃহীত হইল। পাবনার সভায় তাঁতিবন্দের জমিদার জ্ঞানদাগোবিন্দ চৌধুরী সভাপতি ছিলেন।
২৬শে জুলাই বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের প্রাঙ্গণে বিরাট সভায় স্থানীয় উকীলগণের নেতা দীনবন্ধু সেন সভাপতিত্ব করেন এবং বরিশালের প্রসিদ্ধ জনপ্রিয় নেতা অশ্বিনীকুমার দত্ত ভাষণ দেন। বর্তমান লেখক তখন ব্রজমোহন কলেজের ছাত্র-এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় উদ্দীপনাময় বক্তৃতা, শ্রোতাগণের অপূর্ব উন্মাদনা ও নগ্নপদে কালো পতাকা হস্তে দলবদ্ধ মিছিলের শহরের রাস্তায় পরিভ্রমণের স্মৃতি এখনও তাঁহার মন হইতে মুছিয়া যায় নাই।
এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে, পূর্বোক্ত আন্দোলনগুলির বহুপূর্বে টহলরাম গঙ্গারাম নামে ডেরা ইসমাইল খার একজন ক্ষুদ্র জমিদার লর্ড কার্জনের কুশাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। তিনি গোলদীঘির ধারে বক্তৃতায় সর্বপ্রথম বিলাতী দ্রব্য বর্জনের প্রস্তাব করেন।
কলিকাতাতেও ছাত্রদের ও জনসাধারণের নানা সভায় বিলাতী দ্রব্য বর্জনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ৩১শে জুলাই সমস্ত কলেজের ছাত্রদের মিলিত সভায় প্রতি কলেজে এই সম্বন্ধে একটি সমিতি গঠনের প্রস্তাব হয়। কলিকাতায় নেতৃবৃন্দ প্রায় প্রতিদিনই হয় ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনে, নাহয় মৈমনসিংহের জমিদার সূর্যকান্ত চৌধুরীর বাড়ীতে মিলিত হইতেন এবং বিলাতী দ্রব্য বর্জনের প্রস্তাব গ্রহণ করিতেন।
অবশেষে ১৯০৫ সনের ৭ই আগস্ট কলিকাতা টাউন হলে এক বিরাট সভার অধিবেশন হইল। বড় বড় নেতৃবৃন্দ এবং বঙ্গদেশের প্রতি জিলার প্রতিনিধি, ছাত্রবৃন্দ এবং অগণিত জনসমাগমের ফলে এই সভা এক অপূর্ব রূপ ধারণ করিল। পাঁচটার সময় সভা আরম্ভের কথা, কিন্তু বেলা দুইটা হইতে ছাত্রদলের মিছিলের যাত্রা আরম্ভ হইল। দুই-দুইজন করিয়া এক পংক্তিতে কালো পতাকা হস্তে ছাত্রেরা দলে দলে কলিকাতার বিভিন্ন রাস্তা দিয়া গোলদীঘির তীরে সমবেত হইল। সেখান হইতে ভিন্ন ভিন্ন কলেজের প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্র শিক্ষকদের নেতৃত্বাধীনে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হইয়া ধীর পদক্ষেপে একযোগে টাউন হলের দিকে অগ্রসর হইল। তাহাদের হাতে কালো পতাকায় লেখা ‘সংযুক্ত বঙ্গ’, ‘একতাই শক্তি’, ‘বন্দে মাতরম্’, ‘বঙ্গভঙ্গ চাই না’, ইত্যাদি বাক্য এবং মুখে শোকের চিহ্ন। এরূপ বিশাল ও শ্রেণীবদ্ধ শোকযাত্রা কলিকাতায় পূর্বে কেহ কখনও দেখে নাই। টাউন হলেও অভূতপূর্ব ও অপরূপ দৃশ্য-রাজা, জমিদার, উকীল, শিক্ষক ও অগণিত লোকের এত ভীড় হইল যে টাউন হলের ভিতরে সকলের স্থান সঙ্কুলান না-হওয়ায় বাহিরের প্রাঙ্গণদুইটিতে অতিরিক্ত সভার ব্যবস্থা করিতে হইল। প্রধান সভার সভাপতি ছিলেন কাশিমবাজারের মহারাজ শ্ৰীমণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। সভায় চারিটি প্রস্তাব গৃহীত হইল। প্রথম প্রস্তাবে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ করিয়া বলা হইল যে, ইহা অন্যায়, অনাবশ্যক ও স্বেচ্ছাচারিতার পরিচায়ক এবং ইহা বাঙ্গালীর সামাজিক, নৈতিক ও আর্থিক অগ্রগতির পরিপন্থী, এবং ইহা বাঙ্গালীর জ্ঞান বৃদ্ধির পক্ষে বিশেষ অনিষ্টের সম্ভাবনা। জনমত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব কার্যে পরিণত করায় ইংরেজশাসনের প্রতি লোক আস্থাহীন হইয়াছে–সুতরাং সেক্রেটারী অব স্টেটকে অনুরোধ করা হইল যে বঙ্গভঙ্গ সম্পূর্ণ রদ করা বা পরিবর্তিত করা হউক।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে যে-পদ্ধতিতে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব কার্যে পরিণত করা হইয়াছে তাহার তীব্র নিন্দা করা হইল।
নিম্নলিখিত তৃতীয় এবং সর্বাপেক্ষা গুরুতর প্রস্তাবটি উত্থাপন করিলেন শ্রীনরেন্দ্রনাথ সেন। “বাংলার সর্বত্র অসংখ্য সভায় বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদস্বরূপ যে বিলাতী দ্রব্য বর্জনের প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে এই সভা তাহার সম্পূর্ণ অনুমোদন করিতেছে–এবং যতদিন বঙ্গভঙ্গ রহিত না হয় ততদিন বিলাতের লোকের ভারতবর্ষ সম্বন্ধে ঔদাসীন্যের প্রতিবাদস্বরূপ এই বর্জননীতির প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতি ও সমর্থন জানাইতেছে।”
চতুর্থ প্রস্তাবে বলা হইল যে, বঙ্গভঙ্গ রহিত না-হওয়া পর্যন্ত ইহার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চালাইতে হইবে।
বিলাতীবর্জনের প্রস্তাব নানা সভা-সমিতির মাধ্যমে সারাদেশে নানাভাবে প্রবল উদ্দীপনার সৃষ্টি করিল। সরকারী রিপোর্টে বলা হইয়াছে যে প্রতিদিন নগরে ও বড় বড় গ্রামে অনুষ্ঠিত জনসভায় বিলাতী দ্রব্য বর্জনের প্রস্তাব গৃহীত হইত। বরিশালে এক সভায় লর্ড কার্জনের কুশপুত্তলি দাহ এবং শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠান করা হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’ দেশোদ্ধারব্ৰতী সন্তান বা একদল সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর যে অপূর্ব কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে তাহা বাঙ্গালীর আদর্শ হইল এবং তাহাদের সেই বিখ্যাত দেশাত্মবোধক বন্দে মাতরম্’ গানটি প্রথমে বঙ্গদেশে ও পরে ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হইল। এই গানটি দিয়াই সভা আরম্ভ হইত। ফরাসি বিদ্রোহের সময় বিখ্যাত ‘লা মার্সেলিস’ সঙ্গীত ছাড়া বিশ্বের ইতিহাসে আর কোনও সঙ্গীত একটি জাতির মনে এরূপ উন্মাদনার সৃষ্টি করে নাই। ইহার প্রথম দুইটি শব্দ “বন্দে মাতরম্” ১৯০৫ সনে বঙ্গদেশের জাতীয় আন্দোলন ও নবজাগরণের মন্ত্ররূপে গৃহীত ও লোকমুখে উচ্চারিত হইত। আজ পর্যন্তও ইহা সমগ্র ভারতে সেই স্থান অধিকার করিয়া আছে। আনন্দমঠে’ এই সঙ্গীতের যে মর্ম ব্যাখ্যাত হইয়াছে এই অধ্যায়ের পরিশিষ্টে তাহা উদ্ধৃত করা হইল।
ছাত্রদের মধ্যে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করিল। সভা-সমিতি ও মিছিলযোগে বিলাতী দ্রব্যের বর্জন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইল। কোন কোন স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যেও অনেকে শোকের চিহ্নস্বরূপ খালিপায়ে স্কুলে আসিত।
গভর্নমেন্টের এক স্কুলের ২৭৫ জন ছাত্রকে ক্লাস হইতে বহিষ্কৃত করা হইল এবং ভয় দেখানো হইল যে জুতা পায়ে দিয়া না আসিলে তাহাদের নাম কাটা যাইবে। ছাত্রেরা বিলাতী লবণ ও চিনি কিনিয়া সর্বসমক্ষে পোড়াইত। তারপর পিকেটিং আরম্ভ হইল। বিলাতী দ্রব্যের দোকানের সম্মুখে কয়েকজন ছাত্র দাঁড়াইয়া থাকিত। ক্রেতা আসিলে করজোড়ে তাহাদিগকে বিলাতী দ্রব্য না কিনিতে অনুরোধ করিত। অনেকে নিবৃত্ত হইত; কিন্তু কেহ কেহ বাধা না মানিয়া বিলাতী দ্রব্য কিনিলে অনেক সময় ছাত্রদের সহিত বচসা এমনকি সংঘর্ষও হইত। এই উপলক্ষে এবং কোন কোন সময় এরূপ উপলক্ষ না থাকিলেও, পুলিশ মোটা পাকা বাঁশের লাঠি দিয়া ছাত্রদিগকে গুরুতররূপে প্রহার করিত। হাটে বাজারে এইরূপ ঘটনা প্রায়ই ঘটিত। গভর্নমেন্ট বলিত যে জমিদারদের উস্কানিতেই ছাত্রেরা এরূপ পিকেটিং করে। ইহার মধ্যে কিছু সত্য থাকিলেও মোটের উপর যে বিলাতী দ্রব্য বর্জনের উৎসাহ ও আবেদন অনেক পরিমাণেই স্বতঃপ্রবৃত্ত ছিল ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। কারণ এই বিলাতী দ্রব্য বর্জনের মনোবৃত্তি হিন্দুসমাজের সর্বশ্রেণীর মধ্যে এমনভাবে বিস্তার লাভ করিয়াছিল যে তাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। মৈমনসিংহ জিলার মুচীরা একত্র হইয়া ঘোষণা করিল যে অতঃপর তাহারা বিলাতী জুতা মেরামত করিবে না। বরিশাল জিলার ঠাকুর-চাকরেরা সভা ডাকিয়া স্থির করিল যে যাহারা বিলাতী দ্রব্য কিনিবে তাহাদের বাড়ীতে কাজ করিবে না। কালীঘাটের পোপারা সভায় মিলিত হইয়া স্থির করিল যে তাহারা বিলাতী কাপড় কাচিবে না। ফরিদপুরের ধোপা ও মুচীরাও অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল। ছয় বছরের একটি বালিকা গুরুতর অসুখের সময়ও বিলাতী ঔষধ খাইতে অস্বীকার করিল। ব্রাহ্মণেরা স্থির করিলেন, বিলাতী কাপড় ব্যবহার করিলে বিবাহে পৌরোহিত্য করিবেন না। পরীক্ষায় উত্তর লিখিবার খাতা বিলাতী কাগজের বলিয়া ছাত্রেরা পরীক্ষা দিতে অস্বীকার করিল। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা ব্যবস্থা দিলেন যে বিলাতী লবণ ও চিনি ব্যবহার করা হিন্দুধর্মশাস্ত্রের বিরোধী। সমগ্র বাঙ্গালী জাতির মনে বিলাতী দ্রব্য বর্জনের প্রতিজ্ঞা যে কিরূপ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল পূর্বোক্ত দৃষ্টান্তগুলি হইতেই তাহা বুঝা যাইবে।
ইহার আর একটি প্রমাণ ইংরেজ সম্প্রদায়ের উপর এই মনোভাবের প্রতিক্রিয়া। অল্পসংখ্যক যে কয়জন ইংরেজ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন সমর্থন করিয়াছিলেন তাঁহারা ক্রুদ্ধ হইয়া বিলাতী দ্রব্য বর্জনের আন্দোলন কঠোরহস্তে সমূলে ধ্বংস করিবার জন্য অনুরোধ করিতে লাগিলেন। কলিকাতার ইউরোপীয় সদাগরেরা বাঙ্গালী কেরানীগণকে বরখাস্ত করিবেন বলিয়া ভয় দেখাইলেন। ফিরিঙ্গী সাহেবেরা ভয় দেখাইলেন, পঞ্চাশ বৎসর পরে আবার তাঁহারা খাপ হইতে তরবারি খুলিবেন।
মোটের উপর অসন্তোষের ও বিদ্বেষের আগুন সারা বঙ্গদেশে জ্বলিয়া উঠিল। যে জমিদারশ্রেণী সাধারণতঃ রাজনীতিক আন্দোলনে যোগদান করেন না, তাঁহাদের অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে ইহার ইন্ধন যোগাইলেন। গভর্নমেন্টের চেষ্টাসত্ত্বেও মুসলমানেরা কতক পরিমাণে এই আন্দোলনে যোগ দিয়াছিলেন। এই শ্রেণীর নেতাদের মধ্যে আব্দুল রসুল, আবদুল হালিম গজনভি, য়ুসুফখান বাহাদুর, মহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী, লিয়াকৎ হোসেন খান প্রভৃতির নাম করা যাইতে পারে।
যে সমুদয় উপায়ে সমগ্র বঙ্গদেশে আপামর জনসাধারণের মধ্যে বিলাতী দ্রব্য বর্জন এবং স্বদেশীয় দ্রব্য ব্যবহারের জন্য তীব্র উন্মাদনার সৃষ্টি হয় তাহার মধ্যে কয়েকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমতঃ, বাংলা সংবাদপত্র। ইহার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানের সংবাদ প্রচারিত হইত। গ্রাম্য ডাকঘরে একজন পড়িত এবং বহুলোক আগ্রহসহকারে তাহা শুনিত। অমুক স্থানে লোকেরা কত কিছু করিতেছে আর আমরা পিছাইয়া থাকিব-ইহা লজ্জার কথা–এই মনোভাব সকলের মধ্যে নূতন উদ্দীপনা ও উদ্যমের সৃষ্টি করিত।
দ্বিতীয়তঃ সমিতি স্থাপন ও জনসভায় বক্তৃতা–এ বিষয়ে কলিকাতার দৃষ্টান্ত সকলকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করিত। কলিকাতার Anti Circular Society ও অন্য কয়েকটি সমিতি, বিশেষতঃ সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ‘ডন সোসাইটি ছিল এ বিষয়ে অগ্রণী। সতীশচন্দ্রের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত শিক্ষিত যুবকের দল তাহাদের মুখপত্র ডন পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখিয়া এবং নানা স্থানে বক্তৃতার সাহায্যে ছাত্রদলকে মাতাইয়া তুলিয়াছিল। বাগীশ্রেষ্ঠ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ইংরেজীতে এবং বিপিনচন্দ্র পাল বাংলাতে যেসব বক্তৃতা করিতেন তাহাতে অপূর্ব উন্মাদনার সৃষ্টি হইত।
তৃতীয়তঃ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীতে দেশে যে স্বদেশপ্রেমের বন্যা বহিতে লাগিল এবং জনসাধারণের মধ্যে যে উন্মাদনার সৃষ্টি হইল, ভারতবর্ষের ইতিহাসে ইহার পূর্বে বা পরে সেরূপ কখনও দেখা যায় নাই। এমনকি, পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধির অহিংস অসহযোগ আন্দোলন সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়াইয়া পড়িলেও–কোথাও জনসাধারণের মধ্যে সাহিত্য ও সঙ্গীতের মাধ্যমে এরূপ ভাব-প্লাবনতা সৃষ্টির নিদর্শন পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্তের সেই সময়কার কবিতা ও সঙ্গীত এখনও বঙ্গসাহিত্যের অমূল্য নিধি হইয়া বিরাজ করিতেছে এবং যতদিন বাংলাভাষা জীবিত থাকিবে ততদিন এইসব রচনা, বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক সঙ্গীত ও কবিতা, কখনই বিলুপ্ত হইবে না, ইহা নিশ্চিত বলা যাইতে পারে। “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”, “বঙ্গ আমার জননী আমার ধন্য আমার আমার দেশ”, “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই”
প্রভৃতি গানগুলি আমাদের ছাত্রজীবনে যে উন্মাদনা সৃষ্টি করিত তাহার স্মৃতি সত্তর বৎসর পরে আজও আমার মনে গভীরভাবে অঙ্কিত রহিয়াছে।
চতুর্থতঃ, বিদেশী দ্রব্য বর্জনকে হিন্দুধর্মের অঙ্গীভূত করা এবং মন্দিরে দেবমূর্তির সম্মুখে প্রতিজ্ঞা করা–আমরা যথাসাধ্য বিদেশী দ্রব্য বর্জন আন্দোলনকে সার্থক করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিব।
এই উন্মাদনার প্রকৃত স্বরূপ, গভীরতা ও আন্তরিকতা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। কেবলমাত্র দুইটি ঘটনার উল্লেখ করিব। প্রথম, ১৯০৫ সনের ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে মহালয়ার দিনে কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে সর্বজনীন পূজা; দ্বিতীয়, বঙ্গভঙ্গের নির্দিষ্ট তারিখ বাংলা ৩০শে আশ্বিন, ইংরেজী ১৬ অক্টোবর (১৯০৫) মহালয়ার দিন প্রাতঃকালে প্রবল ঝড়-বৃষ্টিসত্ত্বেও শত শত নরনারী নগ্নপদে কলিকাতার বিভিন্ন রাস্তা দিয়া কালীঘাটের মন্দিরে সমবেত হইল। নাটমন্দির ও প্রাঙ্গণে বিশাল জনসমুদ্র-তিল ধারণের স্থান ছিল না।
সহর ও সহরতলীর বিভিন্ন স্থান হইতে সমাগত বহুসংখ্যক, প্রায় একশত, দল সারাদিন ধরিয়া সংকীর্তন করিল এবং জাতীয় সঙ্গীত গাহিল। ধনী, দরিদ্র, বালক, বৃদ্ধ, পুরুষ, স্ত্রী মিলিয়া অন্ততঃ পঞ্চাশ হাজার লোক মায়ের মন্দিরে মিলিত হইয়া প্রার্থনা করিল, যেন বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়, শপথ করিল-বিলাতী বস্ত্র বর্জন করিবে। বেলা এগারটায় পূজা আরম্ভ হইল। নাটমন্দিরের মধ্যস্থলে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে ধূপ, ধূনা, চন্দনকাঠ, ঘৃত প্রভৃতি নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে সহস্র সহস্র কণ্ঠে মন্ত্র ও স্তবস্তুতির ধ্বনি গগন বিদীর্ণ করিল। মন্দিরের অভ্যন্তরে ব্রাহ্মণদের কণ্ঠে সংস্কৃতে নিম্নলিখিত মর্মে আবেদন ধ্বনিত হইল : “অন্য সকল দেব-দেবীর পূর্বে জননী জন্মভূমিকে পূজা করিবে; সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মভেদ, বৈরিতা, স্বার্থপরতা বিস্মৃত হও; সকলে শপথ কর–মাতৃভূমির সেবা করিবে এবং তাহার দুঃখ-দুর্দশা দূর করিবার জন্য প্রাণপণ আত্মনিয়োগ করিবে।”
তারপর দলে দলে নাটমন্দিরে প্রবেশ করিয়া সকলে ভক্তিভরে এইসকল ব্রত পালন করিবার প্রতিজ্ঞা করিল-”মাতঃ, আমি এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিতেছি, আমি যথাসাধ্য বিদেশী দ্রব্য ব্যবহার করিব না, দেশীয় দোকানে যেসব দ্রব্য পাওয়া যায় তাহা বিদেশী দোকান হইতে কিনিব না। এবং দেশীয় লোক যে কার্য করিতে পারে তাহার জন্য কোন বিদেশীকে নিযুক্ত করিব না।”
১৯০৫, ১৬ই অক্টোবর (১৩১২ সন, ৩০শে আশ্বিন) বঙ্গ-ব্যবচ্ছেদের ব্যবস্থা আইন অনুসারে কার্যে পরিণত হইল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার কবিত্বপূর্ণ ভাষায় এই দিনটিতে উভয় বঙ্গের মিলনের চিহ্নস্বরূপ রাখিবন্ধনের প্রস্তাব করিয়া লিখিলেন, আগামী ৩০শে আশ্বিন বাংলাদেশ আইনের দ্বারা বিভক্ত হইবে। কিন্তু ঈশ্বর যে বাঙ্গালীকে বিচ্ছিন্ন করেন নাই তাহাই বিশেষরূপে স্মরণ ও প্রচার করিবার জন্য সেই দিনকে আমরা বাঙ্গালীর রাখিবন্ধনের দিন করিয়া পরস্পরের হাতে হরিদ্রাবণের সূত্র বাঁধিয়া দিব। রাখিবন্ধনের মন্ত্রটি এই, “ভাই ভাই এক ঠাই”। রামেন্দ্রসন্দর ত্রিবেদী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য “অরন্ধন” পালন করিবার প্রস্তাব করিলেন। উভয় প্রস্তাবই কার্যে পরিণত হইল। নিম্নলিখিত কার্যপদ্ধতি গৃহীত ও সমগ্র বঙ্গদেশে ৩০শে আশ্বিন ইহা প্রতিপালিত হইল।
ঐদিন শোকপ্রকাশের চিহ্নস্বরূপ শিশু ও রোগী ব্যতীত সকলেই উপবাস করিবেন এবং কাহারও পাকশালায় রন্ধনক্রিয়া অনুষ্ঠিত হইবে না। সকলেই নগ্নপদে থাকিবে। দোকানপাট বন্ধ থাকিবে। ঘোড়ার গাড়ী বা গরুর গাড়ী চলিবে না। যুবকগণ সূর্যোদয়ের পূর্বে উঠিয়া “বন্দে মাতরম্” সঙ্গীত গাহিতে গাহিতে গঙ্গাস্নান করিবে এবং দলবদ্ধ হইয়া বিডন স্কোয়ার (বর্তমান রবীন্দ্র কানন) কর্ণওয়ালিস স্ত্রীটে (ও অন্যত্র নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হইবে। সেখানে সকলে পরস্পরের হাতে রাখি বাঁধিয়া বঙ্গ-ব্যবচ্ছেদের জন্য শোক প্রকাশ করিবে। বৈকালে আপার সার্কুলার রোডে এক বিরাট জনসভার অধিবেশন হইবে। গভর্নমেন্টের আইনসত্ত্বেও যে দুই বাঙলার ঐক্য ও মিলন পূর্ববৎ অক্ষুণ্ণ আছে ও থাকিবে তাহার প্রতীকস্বরূপ একটি অখণ্ড বঙ্গভবন নির্মাণের ব্যবস্থা করিবে। এই সভা শেষ হইলে সকলে পদব্রজে বাগবাজারে পশুপতিনাথ বসুর ভবনে যাত্রা করিবে এবং সেখানে আর একটি সভা এবং স্বদেশী বস্ত্র উৎপাদনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হইবে।
৩০শে আশ্বিন প্রভাতে রবীন্দ্রনাথকে পুরোভাগে রাখিয়া বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আপামর জনসাধারণ এক বিরাট শোভাযাত্রা করিয়া গঙ্গাতীরে সমবেত হইল। গঙ্গাস্নান করিয়া পরস্পরের হস্তে রাখি বন্ধন করিল। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের রচিত নিম্নলিখিত প্রার্থনা সেদিন সহস্র সহস্র কণ্ঠে কলিকাতার ও বঙ্গদেশের সর্বত্র গীত হইল :
বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার হাওয়া বাংলার ফল
পুণ্য হউক পুণ্য হউক
পুণ্য হউক হে ভগবান।
বাংলার ঘর বাংলার হাট
বাংলার বন বাংলার মাঠ
পূর্ণ হউক পূর্ণ হউক
পূর্ণ হউক হে ভগবান।
বাঙ্গালীর পণ বাঙ্গালীর আশা
বাঙ্গালীর কাজ বাঙ্গালীর ভাষা
সত্য হউক সত্য হউক
সত্য হউক হে ভগবান।
বাঙ্গালীর প্রাণ বাঙ্গালীর মন
বাঙ্গালীর ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক এক হউক
এক হউক হে ভগবান।
৩০শে আশ্বিন সকালে গঙ্গানদীতে স্নানের পর এই সঙ্গীত গাহিয়া বীডন উদ্যানে, সেন্ট্রাল কলেজে ও অন্যত্র বহুস্থানে রাখিবন্ধন হইল। অপরাহে অখণ্ড বঙ্গ-ভবন’ স্থাপনের উদ্দেশ্যে কলিকাতায় পার্শিবাগানের মাঠে (এখন যেখানে ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়) ফেডারেশন হল’ বা ‘মিলন মন্দিরের ভিত্তি স্থাপিত হইল। রোগশয্যাগত আনন্দমোহন বসু সভাপতিত্ব করিলেন। আরামকেদারায় করিয়া তাহাকে সভাস্থলে আনা হইল। প্রায় পঞ্চাশ হাজার কণ্ঠে উচ্চারিত বন্দে মাতরম্’ ধ্বনির মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় উঠিয়া সভাপতির অভিভাষণ পাঠ করিলেন। অতঃপর সভাপতির স্বাক্ষরিত একটি ঘোষণাপত্র পঠিত হইল। ইংরেজীতে আশুতোষ চৌধুরী ও বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইহা পাঠ করিলেন। ঘোষণাটি এই : “যেহেতু বাঙ্গালী জাতির সর্বজনীন প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করিয়া পার্লামেন্ট বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ করিয়াছেন, সেহেতু আমরা এই প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের কুফল নাশ করিতে এবং বাঙ্গালী জাতির একতা সংরক্ষণ করিতে আমরা সমস্ত বাঙ্গালী জাতি আমাদের শক্তিতে যাহা কিছু সম্ভব তাহার সকলই প্রয়োগ করিব। বিধাতা আমাদের সহায় হউন।”
সভাভঙ্গের পর বিপুল জনতা পশুপতি বসুর বাটীর দিকে যাত্রা করিল। রবীন্দ্রনাথও তাহাদের মধ্যে ছিলেন এবং সহস্রকণ্ঠে তাঁহার নব-রচিত গীত আরম্ভ হইল :
ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে,
মোদের ততই বাঁধন টুটবে।
ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে,
ততই মোদের আঁখি ফুটবে।
এই গীতটি গাহিতে গাহিতে জনতা সুদীর্ঘ পথ পদব্রজে চলিল। গানটি শেষ হইলে রবীন্দ্রনাথের নব-রচিত আর একটি সঙ্গীত আরম্ভ হইল :
বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান….
আমাদের ভাঙ্গা গড়া তোমার হাতে এমন অভিমান।
সন্ধ্যাকালে পশুপতি বসুর গৃহপ্রাঙ্গণে বিরাট জনসভা হইল। কেহ কেহ অনুমান করিয়াছেন যে, উপস্থিত লোকসংখ্যা প্রায় এক লক্ষ হইবে। স্বদেশী বস্ত্র প্রস্তুত করিবার জন্য একটি ধনভাণ্ডার খোলার প্রকল্প এবং তাহার জন্য অর্থ ভিক্ষা করিলে চতুর্দিক হইতে যে মুদ্রাবৃষ্টি হয় তাহার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার টাকা। পরে আরও কুড়ি হাজার টাকা আদায় হয়। এই অর্থের দ্বারা একটি বস্ত্রবয়ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইল, কিন্তু ইহা কিছুদিন পরেই বন্ধ হইয়া যায়।
পার্শিবাগানের মাঠে যে মিলন-মন্দিরের ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছিল উহা নির্মাণের জন্যও একটি জাতীয় ধনভাণ্ডার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। কিন্তু এই গৃহ আর নির্মিত হয় নাই। অনেকে মনে করেন, নেতাদের মধ্যে তীব্র মতভেদই ইহার কারণ। পরবর্তীকালে “মহাজাতি সদন”-এর প্রতিষ্ঠা এই প্রস্তাব কার্যে পরিণত করিয়াছে।
তিন সপ্তাহ পরে পশুপতি বসুর ভবনে বিজয়া দশমীর পরদিন (২১শে কার্তিক) বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠিত হইল। মৈমনসিংহের মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত ও গণ্যমান্য বহু লোক ইহাতে যোগ দেন। এই সভায় রবীন্দ্রনাথ যে বক্তৃতা করেন তাহার উপসংহার উদ্ধৃত করিতেছি :
“হে বন্ধুগণ, আজ আমাদের বিজয়া সম্মিলনের দিনে হৃদয়কে একবার আমাদের এই বাংলা দেশের সর্বত্র প্রেরণ কর। উত্তরে হিমাচলের পাদমূল হইতে দক্ষিণে তরঙ্গমুখর সমুদ্রকূল পর্যন্ত নদীজালজড়িত পূর্ব সীমান্ত হইতে শৈলমালাবন্ধুর পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত চিত্তকে প্রসারিত কর। যে চাষী চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর–যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে এতক্ষণে ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর। শঙ্খমুখরিত দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর। অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর। আজ সায়াহ্নে গঙ্গার শাখা-প্রশাখা বাহিয়া ব্রহ্মপুত্রের কূল-উপকূল দিয়া একবার বাংলা দেশের পূর্বে পশ্চিমে আপন অন্তরের আলিঙ্গন বিস্তার করিয়া দাও-আজ বাংলা দেশের সমস্ত ছায়াতরুনিবিড় গ্রামগুলির উপরে এতক্ষণে যে শারদ আকাশে একাদশীর চন্দ্রমা জ্যোত্সধারা অজস্র ঢালিয়া দিয়াছে, সেই নিস্তব্ধ শুচিরুচির সন্ধ্যাকাশে তোমাদের সম্মিলিত হৃদয়ের ,বন্দে মাতরম্ গীতধ্বনি এক প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্তে পরিব্যাপ্ত হইয়া যাক্–একবার করজোড় করিয়া নতশিরে বিশ্বভুবনেশ্বরের কাছে প্রার্থনা কর–
‘বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল।
পুণ্য হউক পুণ্য হউক পুণ্য হউক, হে ভগবান’।
লর্ড কার্জন যে অস্ত্র দ্বারা বাংলাকে দ্বিখণ্ড করিয়া বাঙ্গালীর জাতীয় ঐক্য বিনাশ করিতে তৎপর হইয়াছিলেন, বিধির অমোঘ বিধানে তাহাই ভারতের ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনা উন্মেষের বীজ বপন করিল।
পরিশিষ্ট
[ধনী মহেন্দ্র ও সন্ন্যাসী ভবানন্দ]
মহেন্দ্ৰ কথা কহিল না। তখন ভবানন্দ নিরুপায় হইয়া আপন মনে গীত আরম্ভ করিলেন–
“বন্দে মাতরম্
সুজলাং সুফলাং মলয়জ-শীতলাং শস্যশ্যামলাং মাতরম্।”
মহেন্দ্র গীত শুনিয়া কিছু বিস্মিত হইল, কিছু বুঝিতে পারিল না–সুজলা সুফলা মলয়জ শীতলা মাতা কে জিজ্ঞাসা করিল, “মাতা কে?”
উত্তর না করিয়া ভবানন্দ গাহিতে লাগিলেন–
“শুভ্রজ্যোস্না পুলকিত যামিনীম
ফুল্ল কুসুমিত মদল শোভিনীম্
সুহাসিনীং সুমধুর ভাষিণীম্
সুখদাং বরদাং মাতরম্।”
মহেন্দ্র বলিল, “এত দেশ, এ ত মা নয়।”
ভবানন্দ বলিলেন, “আমরা অন্য মা মানি না–জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। আমরা বলি, জন্মভূমি জননী, আমাদের মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই, বন্ধু নাই–স্ত্রী নাই, পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ী নাই, আমাদের আছে কেবল সেই সুজলা, সুফলা, মলয়জ সমীরণ শীতলা, শস্য শ্যামলা।”
তখন বুঝিয়া মহেন্দ্র বলিলেন, “তবে আবার গাও।” ভবানন্দ আবার গাহিলেন…(সমগ্র গীতটি)। মহেন্দ্র দেখিল, দস্যু গায়িতে গায়িতে কাঁদিতে লাগিল।
মহেন্দ্র তখন সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা কারা?
ভবানন্দ বলিল, “আমরা সন্তান।”
মহেন্দ্র। সন্তান কি? কার সন্তান?
ভবানন্দ। মায়ের সন্তান।
মহেন্দ্র। ভাল, সন্তানে কি চুরি ডাকাতি করিয়া মায়ের পূজা করে? সে কেমন মাতৃভক্তি?
ভবানন্দ। আমরা চুরি-ডাকাতি করি না।
মহেন্দ্র। এই ত গাড়ী লুঠিলে।
ভবানন্দ। সে কি চুরি ডাকাতি? কার টাকা লুঠিলাম?
মহেন্দ্র। কেন, রাজার?
ভবানন্দ। রাজার? এই যে টাকাগুলি সে লইবে, এ টাকায় তার কি অধিকার?
মহেন্দ্র। রাজার রাজভাগ।
ভবানন্দ। যে রাজা রাজ্য পালন করে না, সে আবার রাজা কি?
মহেন্দ্র। তোমরা সিপাহীর তোপের মুখে কোন্ দিন উড়িয়া যাইবে দেখিতেছি।
ভবানন্দ। অনেক শালা সিপাহী দেখিয়াছি–আজিও দেখিলাম।
মহেন্দ্র। ভাল করে দেখ নি, একদিন দেখিবে।
ভবানন্দ। না হয় দেখলাম, একবার বই ত দুবার মরব না।
[আনন্দমঠ, বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদ সংস্করণ, ২২-২৪ পৃষ্ঠা]
এই কথোপকথন পুরাপুরি পড়িলে বুঝা যাইবে-বাঙ্গলার বিপ্লববাদীদের উপর আনন্দমঠের প্রভাব কতটা ছিল। ইহা পড়িতে পড়িতে মনে হয়, যেন বিংশ শতকের কোন বিপ্লবীর সহিত সাক্ষাতের বিবরণ পড়িতেছি। কিন্তু স্মরণ রাখিতে হইবে যে, বঙ্কিমচন্দ্র ৯৪ বত্সর পূর্বে এই গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন (১২৮৭ বঙ্গাব্দ)। ইহা ইংরেজী, হিন্দী, মারাঠি, তামিল, তেলুগু ও কানাড়ী ভাষায় অনূদিত হইয়াছে।