চতুর্দশ পর্ব – অধ্যায়-১
বরদিনোর যুদ্ধ, তার পরেই মস্কো দখল এবং বিনা যুদ্ধে ফরাসিদের পলায়ন–এটা ইতিহাসের একটি পরম শিক্ষণীয় ঘটনা।
সব ইতিহাসকারই একমত যে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জাতির পারস্পরিক সংর্ঘষের বহিরঙ্গ কার্যকলাপই যুদ্ধের ভিতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে এবং সে যুদ্ধের অল্প-বিস্তর সাফল্যের ফল অনুসারেই রাষ্ট্রের ও জাতির শক্তির হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে। : কোনও রাজা বা সম্রাট অন্য একরাজা বা ম্রাটের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে একটা সেনাবাহিনী গড়ে তোলে, শত্রুর সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে, তিন, পাঁচ, অথবা দশ হাজার মানুষকে মেরে জয়লাভ করে, এবং একটা রাজ্য ও কয়েক লক্ষ লোকের একটা জাতিকে পদানত করে–এ ধরনের ঐতিহাসিক বিবরণ খুব বিস্ময়কর মনে হলেও ইতিহাসের ঘটনাবলী (আমরা যতদূর জানি) এই বক্তব্যের সত্যতাকেই সমর্থন করে যে এক সেনাদলের বিরুদ্ধে অপর সেনাদলের সাফল্যের তারতম্যই সেই জাতির শক্তির হ্রাস-বৃদ্ধির কারণ, অন্ততপক্ষে একটি মৌলিক নির্দেশক-যদিও এটা খুবই দুর্বোধ্য যে একটা জাতির একশো ভাগের এক ভাগ মাত্র হয়েও একটা সেনাদলের পরাজয় ঘটলে একটা গোটা জাতি কেন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যেই একটি সেনাদল জয়লাভ করল অমনি সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ী জাতির অধিকার বিজিতের সর্ব রকম স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে বৃদ্ধিলাভ করে। একটা সেনাদল পরাজিত হল, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা জাতি তার সব অধিকার হারিয়ে ফেলল, আর সেই সেনাদল যদি সম্পূর্ণরূপে পর্যদস্ত হল তো গোটা জাতি হল সম্পূর্ণ পদানত।
ইতিহাস অনুসারে প্রাচীকাল থেকেই এই চলে আসছে, এবং আমাদের কালেও তাই চলেছে। নেপোলিয়নের সব যুদ্ধ এই নীতিকেই সমর্থন করে। অস্ট্রিয় বাহিনী যতটা পরাজয় বরণ করেছে সে অনুপাতে অস্ট্রিয়া তার অধিকার হারিয়েছে, আর সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পেয়েছে ফ্রান্সের অধিকার ও শক্তি। জেনা ও অয়েরস্তাদে ফরাসিদের জয়লাভ প্রুশিয়ার স্বাধীন সত্তাকে ধ্বংস করেছে।
কিন্তু তারপরে ১৮১২-তে ফরাসিরা মস্কোর কাছে একটা জয়লাভ করল। মস্কো দখল করা হল, আর তারপরে আর কোনো যুদ্ধ হল না, কিন্তু রাশিয়ার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হল না, বিলুপ্ত হয়ে গেল ছয় লক্ষ সৈন্যসমন্বিত ফরাসি বাহিনী এবং তারপরে নেপোলিয়ন-শাসিত ফ্রান্স দেশটা পর্যন্ত। ইতিহাসের বিধানের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ঘটনাকে বিকৃত করে একথা বলাও অসম্ভব যে বরদিনোর রণক্ষেত্র রুশদের হাতেই থেকে গিয়েছিল, অথবা মস্কোর পরে আর যেসব যুদ্ধ হয়েছিল তাতেই নেপোলিয়নের সেনাদল বিধ্বস্ত হয়েছিল।
বরদিনোতে ফরাসিদের জয়লাভের পরে সাধারণভাবে আর কোনো যুদ্ধ হয়নি, গুরুতর কোনো সংঘর্ষও ঘটেনি, তথাপি ফরাসি বাহিনীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেল। এর অর্থ কি? এটা যদি চীনের ইতিহাস থেকে নেওয়া কোনো দৃষ্টান্ত হত তাহলে আমরা বলতে পারতাম যে এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনাই নয় (কোনো কিছু যখন তাদের হিসেবের সঙ্গে খাপ খায় না, ইতিহাসকাররা তখন সুবিধামতো এই কথাই বলে থাকে), এটা যদি কোনো ছোটখাট সংঘর্ষ হত, তাহলে এটাকে ব্যতিক্রম বলে ধরে নিতে পারতাম, কিন্তু এই ঘটনাটি ঘটেছে আমাদের পিতৃপুরুষের চোখের সামনে, তাদের কাছে এটা ছিল তাদের পিতৃভূমির জীবন-মরণের প্রশ্ন, আর আমাদের জ্ঞানমতে এটা ঘটেছিল বৃহত্তম একটি যুদ্ধে।
১৮১২-র অভিযানে বরদিনোর যুদ্ধ ফরাসি বিতাড়ন পর্যন্ত এই অধ্যায়টিই প্রমাণ করেছে যে একটা যুদ্ধে জয়লাভ করলেই একটা দেশকে জয় করা যায় না, এবং দেশ জয়ের কোনো অনিবার্য সংকেতও সেটা নয়, এতে আরো প্রমাণ হয়েছে, যে-শক্তি একটা জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে সে-শক্তি কোনো বিজয়ীর হাতে থাকেনা, সেনাদল ও যুদ্ধের মধ্যেও থাকে না, থাকে অন্য কোথাও।
মস্কো ছেড়ে আসার আগে ফরাসি বাহিনীর অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ফরাসি ইতিহাসকাররা বলেছে যে অশ্বারোহী বাহিনী, গোলন্দাজ বাহিনী ও যানবাহন ব্যবস্থা ছাড়া আর সবদিক থেকেই গ্র্যান্ড আর্মির অবস্থা বেশ ভালোই ছিল–আর পশুদের কোনো রকম খাদ্যই ছিল না। সে দুর্ভাগ্যের কোনো প্রতিকার কারো হাতে ছিল না, কারণ সে জেলার চাষীরা সব খড় পুড়িয়ে দিয়েছিল যাতে সেগুলি ফরাসিদের হাতে না পড়ে।
জয়লাভকরেও ঈলিত ফল পাওয়া গেল না, কারণ চাষী কার্প ও ভাস এবং অনুরূপ অসংখ্য চাষী চড়া দাম পেয়েও তাদের খড় নিয়ে মস্কোতে যায়নি, সব পুড়িয়ে দিয়েছে।
এমন দুটি লোককে কল্পনা করা যাক যারা দ্বৈতযুদ্ধের সব রকম নিয়মকানুন মেনে তরবারি নিয়ে যুদ্ধে করতে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে যুদ্ধ চলল, হঠাৎ একজন যোদ্ধা যখন বুঝতে পারল যে সে আহত হয়েছে। আর ব্যাপারটা ঠাট্টা-ইয়ার্কি নয়, তখন সে তরবারি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাতের কাছে যে মুগুরটা পেল তাই ঘোরাতে শুরু করল। তারপর কল্পনা করা যাক, যে-যোদ্ধাটি কার্যোদ্ধারের শ্রেষ্ঠ এবং সহজতম পথটি বেছে নিল সেই কিন্তু আবার বীরত্বের চিরাচরিত ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আসল কথা গোপন সাহায্যেই সে জয়লাভ করেছে। সেই দ্বৈতযুদ্ধের এ হেন বিবরণ থেকে কত রকম গোলমাল ও অস্পষ্টতার সৃষ্টি যে হতে পারে তা তত সহজেই কল্পনা করা যায়।
এক্ষেত্রে দ্ধৈতযুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে ফরাসি বাহিনী, তার যে প্রতিপক্ষ তরবারি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মুগুর তুলে নিয়েছে সে হল রুশ জনগণ, যারা দ্বৈতযুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছে তারা হল এই ঘটনার বর্ণনাকারী ইতিহাসকাররা।
সমালেনস্কের অগ্নিকাণ্ডের পরে যে যুদ্ধ শুরু হল তাতে যুদ্ধের সাবেকি ঐতিহ্যের কিছুই পালন করা হল না। শহর ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, যুদ্ধের পরে পশ্চাদপসরণ করা, বরদিনোতে প্রচণ্ড আঘাত হানার পরে নতুন করে পশ্চাদপসরণ করা, মস্কোকে জ্বালিয়ে দেওয়া, লুটেরাদের গ্রেপ্তার করা, যানবাহন বাজেয়াপ্ত করা, আর গেরিলা যুদ্ধ-এ সবেতেই তো নিয়মকে লংঘন করা হয়েছে।
নেপালিয়ন এটা বুঝতে পেরেছিল, সময় সময় সে মস্কোতে দ্বৈতযুদ্ধের সঠিক মনোভাবও গ্রহণ করেছে এবং প্রতিপক্ষের তরবারির বদলে মাথার উপরে একটা মুগুরকে উদ্যত হতে দেখে সে কুতুজভ ও সম্রাট আলেক্সান্দারের কাছে এই মর্মে অভিযোগ করতেও ছাড়ে নি যে সব রকম নিয়ম-কানুন লংঘন করে যুদ্ধটা চালানো হচ্ছে যেন মানুষ মারার ব্যাপারেও কোনো নিয়ম-কানুন থাকে পারে। এ প্রসঙ্গে ফরাসিদের প্রতিবাদ জ্ঞাপন এবং কিছু উচ্চপদস্থ রুশ কর্মচারী কর্তৃক মুগুর-যুদ্ধটা লজ্জাজনক বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও জনযুদ্ধের মুগুরটাকে যথা সম্ভব ক্ষতিকর ভাবেও প্রচণ্ড শক্তিতে উদ্যত করা হল, এবং কারো পরামর্শ, রুচি বা অন্য কিছুর পরোয়ানা করে অর্থহীন সরলতার সঙ্গে সেটাকে বার বার তুলতে ও নামাতে লাগল, এবং ফরাসিদের মারতে মারতে একসময় গোটা অভিযানকেই বিধ্বস্ত করে দিল।
১৮১৩ সালে ফরাসিরা যা করেছিল তরবারির হাতলটা উদার বিজয়ীর দিকে এগিয়ে না ধরে সংকট-মুহূর্তে কোনো রকম নিয়মের তোয়াক্কা না করে হাতের কাছে যে মুগুরটা পেয়েছে সেটাকেই তুলে নিয়ে অনবরত আঘাত করেছে যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের অন্তরের বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার বদলে জেগে উঠেছে অবহেলা ও সহানুভূতি–একটা জাতির পক্ষে সেটা ভালোই হয়েছে।
.
অধ্যায়-২
যুদ্ধের তথাকথিত নিয়মের অন্যতম স্পষ্ট ও সুবিধাজনক ব্যতিক্রম হচ্ছে একত্র সম্মিলিত বহুজনের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট দলে আক্রমণ চালানো। জাতীয় স্তরের যুদ্ধেই এ ধরনের আক্রমণ চালানো হয়ে থাকে। এধরনের আক্রমণের ক্ষেত্রে দুটো জনতা পরস্পরের মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে দুদলেই সরে যায়, একক ভাবে আক্রমণ করে, অধিকতর শক্তিশালী প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখে পালিয়ে যায়, কিন্তু সুযোগ পেলেই আবার আক্রমণ করে। এই যুদ্ধই করেছিল স্পেনের গেরিলারা, ককেসাসের পার্বত্য জাতিরা এবং ১৮২২-তে রুশরা।
এধরনের যুদ্ধকে লোকে গেরিলা যুদ্ধ বলে, তারা ধরে নেয় যে নামেই এর তাৎপর্য পরিষ্কার হয়ে ওঠে। কিন্তু এধরনের যুদ্ধ কোনো নিয়মের আওতায় আসে না এবং অব্যর্থ বলে স্বীকৃত একটি সুপরিচিত রণ-নীতির এটা সম্পূর্ণ বিরোধী। সে নীতিটা হল–সংঘর্ষের সময় প্রতিপক্ষের চাইতে অধিকতর শক্তিশালী হতে হলে আক্রমণকারীকে সর্বশক্তি একত্রীভূত করতে হবে।
গেরিলা যুদ্ধ (ইতিহাসই সাক্ষী যে সেটা সর্বদাই সফল) এই নীতিকে সরাসরি লংঘন করে চলে।
এই স্ববিরোধিতার কারণ হল-সমর-বিজ্ঞানে ধরেই নেওয়া হয় যে একটি বাহিনীর শক্তিও তার সৈন্যসংখ্যা সমার্থবাচক। সমর-বিজ্ঞান বলে, সৈন্য যত বেশি শক্তিও তত বেশি।
সমর-বিজ্ঞানের পক্ষে এ-কথা বলা আর বলবিদ্যার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ভড়ের উল্লেখ করে বলবেগের সংজ্ঞা নিরুপণ করা একই কথা।
বলবেগ ভড় ও গতির ফলস্বরূপ।
সামরিক ব্যাপারে একটি বাহিনীর শক্তি ভড় এবং একটি অজ্ঞাত কিছুর ফলস্বরূপ।
একটি বাহিনীর শক্তিযে তার আকারের অনুরূ প হয় না, ছোট ছোট দল যে বড় দলকেপ্রান্ত করে, তার অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় দেখতে পেয়ে সমর-বিজ্ঞান অস্পষ্টভাবে একটি অজ্ঞাত শক্তির অস্তিত্বকে স্বীকার করে এবং সেটাকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে।
একটি বাহিনীর মনোবল হচ্ছে সেই অজ্ঞাত শক্তি, তাকে জড় দিয়ে গুণ করলেই আসল শক্তিটাকে পাওয়া যায়। এই অজ্ঞাত কিছুর-একটা বাহিনীর মনোবলের-সংজ্ঞা নিরুপণ করা এবং তার তাৎপর্যকে প্রকাশ করা বিজ্ঞানের একটা সমস্যা।
দশটি সৈনিক, দশটি ব্যাটেলিয়ন, বা দশটি ডিভিশন পনেরোটি সৈনিক, ব্যাটেলিয়ন, বাডিভিশনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়লাভ করে–অর্থাৎ অপর পক্ষকে মেরে ফেলে বা বন্দি করে, অথচ নিজপক্ষের মারা যায় চারজন, তার অর্থ, একপক্ষে যায় চারজন, আর অপরপক্ষে যায় পনেরো জন। ফলে চার হয়ে যায় পনেরোর সমান, আর তাই ৪-ক=১৫-খ। ফলে ক/খ=১৫/৪। এই সমীকরণ থেকে আমরা সেই অজ্ঞাত বস্তুরমূল্যমানটা পাই না, পাই দুটো অজ্ঞাত বস্তুর আনুপাতিক হার। বিভিন্ন নির্বাচিত ঐতিহাসিক ঘটনাকে (যুদ্ধ, অভিযান, যুদ্ধের সময়কাল) এই সমীকরণের অন্তর্ভুক্ত করলে এমন একটা সংখ্যা-শ্রেণী পাওয়া যেতে পারে যার মধ্যে নিহিত আছে কতকগুলি বিধি আর সেগুলিই অবশ্যই আবিষ্কারযোগ্য।
একটি বাহিনী আক্রমণ চালাবে একযোগে আর পশ্চাদপসরণ করবে ছোট ছোট দলে-রণ-কৌশলের এই নিয়মই অজান্তে স্বীকার করে যে একটি বাহিনীর শক্তি নির্ভর করে তার মনোবলের উপর। আক্রমণ প্রতিহত করতে যে শৃঙ্খলার দরকার, একটা সেনাদলকে গোলাগুলির মুখে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে তার চাইতে অনেক বেশি শৃঙ্খলা প্রয়োজন। কিন্তু এই নিয়মের মধ্যে সেনাদলের মনোবলকে ধরা হয়নি, তাই বারবার এটা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে।
রণকৌশল অনুসারে আত্মরক্ষার জন্য ছোট ছোট দলে বিভক্ত হওয়া উচিত হলেও ফরাসি বাহিনী ১৮১২ তে পশ্চাদপসরণের সময় একটি দলেই সংঘবদ্ধ হয়েছিল, কারণ তখন সেনাদলের মনোবল এতদূর ভেঙে পড়েছিল যে একমাত্র ভড়ই তাদের একত্র রাখতে পেরেছিল। অপরদিকে, নিয়ম অনুসারে রুশদের উচিত ছিল একযোগে সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ করা, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তারা ভাগ হয়ে গিয়েছিল ঘোট ঘোট দলে, কারণ তাদের মনোবল তখন এতই উঁচুপর্দায় উঠেছিল যে কোনো একটি সৈনিক বিনা হুকুমে ফরাসিদের উপর আঘাত হানতে লাগল, অথচ বাধ্যতামূলকভাবে নিজেদের কোনো রকম দুঃখ-দুর্দশা ও বিপদের মুখে ঠেলে দিতে হল না।
.
অধ্যায়-৩
ফরাসিদের সম্মালেনঙ্কে প্রবেশের পর থেকেই তথাকথিত দলীয় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
দলীয় যুদ্ধবিগ্রহ সরকারিভাবে স্বীকৃত হবার আগেই কসাকও চাষীদের হাতে হাজার হাজার দলছাড়া শত্রুসৈন্য, লুটেরা ও ঘোড়ার খাদ্য-চোর নিহত হয়েছে, একটা দলছাড়া পাগলা কুকুরকে অন্য কুকুরেরা যেভাবে মেরে ফেলে, তারাও এইসব ফরাসিদের সেইভাবেই মেরেছে। দেনিসম দাভিদভই প্রথম এধরনের লড়াইয়ের মূল্য বুঝেছিল।
২৪ আগস্ট দাভিদভের প্রথম দলীয় সেনাদল গঠিত হল, তারপর আরো অনেককে স্বীকৃতি দেওয়া হল। অভিযান যত অগ্রসর হয়ে চলল ততই এধরনের অসংখ্য সেনাদল গড়ে উঠতে লাগল।
এই বেসরকারি সেনাদলগুলি বিরাট বাহিনীকে একটু একটু করে ভাগে-ভাগে ধ্বংস করতে লাগল। ফরাসি বাহিনীরূপী শুকনো গাছ থেকে যে-সব পাতা আপনা থেকেই জরে পড়ছিল তারা কেবল সেগুলিকে সংগ্রহ করতে লাগল, কখনো বা গাছটাকে ঝাঁকিও দিল। অক্টোবর নাগাদ ফরাসিরা যখন ঘোলেনস্ক-এর দিকে পালাতে শুরু করেছে ততদিনে ছোট-বড় নানা আকারের ও চরিত্রের শত শত এই ধরনের সেনাদল গড়ে উঠেছে। কতকগুলি গড়ে উঠল পুরোপুরি সামরিক কায়দায়, তাদের মধ্যে পদাতিক, অশ্বারোহী, কর্মচারী এবং জীবনযাত্রার আয়াস-আরাম সবই ছিল। কতকগুলি গড়ে উঠল কেবলমাত্র কসাক অশ্বারোহী নিয়ে। পদাতিক, অশ্বারোহী, চাষী ও জোতদারদের নিয়েও অনেকদল এখানে-ওখানে গড়ে উঠল, তাদের পরিচয় কেউ জানল না। জনৈক গির্জা-কর্মী একটা দল গড়ে এক মাসে কয়েকশো শত্রুকে বন্দি করল, আর জনৈক গ্রাম-প্রধানের স্ত্রী ভাসিলিসা কয়েকশো ফরাসিকে হত্যা করল।
দলীয় যুদ্ধের আগুন তীব্রতর হয়ে জ্বলে উঠল অক্টোবরের শেষের দিকে। প্রথম অধ্যায় সবে শেষ হয়েছে, নিজেদের সাহস দেখে যোদ্ধারা নিজেরাই অবাক, প্রতি মিনিট তাদের শংকা এই বুঝি ফরাসিরা তাদের ঘিরে ফেলে প্রেপ্তার করে, ঘোড়ার পিঠ থেকে না নেমেই তারা জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, নামবার সাহস হয়না, সর্বদাই ভয় ফরাসিরা বুঝি পিছু নিয়েছে। অক্টোবরের শেষ নাগাদ এধরনের যুদ্ধ একটা নির্দিষ্ট আকার লাভ করল, সকলেই পরিষ্কার বুঝতে পারল ফরাসিদের বিরুদ্ধে কতটা এগুনো যেতে পারে এবং কতটা পারে না। যে ছোট দলগুলি অনেক আগে থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছে এবং খুব কাছে থেকে ফরাসিদের দেখেছে, তারা যেসব কাজকে সম্ভব বলে মনে করে বড় দলের অধিনায়করা তা কল্পনাও করতে পারে না। যেসব কসাক ও চাষীরা ফরাসিদের মধ্যে লুকিয়ে ঢুকে পড়েছে তারা সবকিছুই সম্ভব বলে মনে করে।
২২ অক্টোবর বেসরকারি দলের অন্যতম নেতা দেনিসভ তার দলবল নিয়ে গেরিলা উদ্দীপনার একেবারে চরমে উঠল। ভোর থেকে সে সদলবলে এগিয়ে চলেছে। যে জঙ্গলটা বড় রাস্তাটাকে ঘিরে রেখেছে সারাদিন সেই জঙ্গলের ভিতর থেকে সে দেখেছে, অশ্বারোহী বাহিনীর মালপত্র ও রুশ বন্দিদের নিয়ে একটা বড় ফরাসি দল কড়া পাহারায় গেঁলেনঙ্কের দিকে এগিয়ে চলেছে। দেনিসভ এবং দলখভ (সেও একটা ছোট দল নিয়ে দেনিসভের কাছাকাছিই ঘোরাফেরা করছিল) ছাড়া কয়েকটা ডিভিশনের কমান্ডারও এই দলটির কথা জানতে পেরে দাঁতে শান দিতে শুরু করল। এইসব বড় দলের দুজন কমান্ডার-একজন পোল ও অপরজন জার্মান-সঙ্গে সঙ্গে দেনিসভকে আমন্ত্রণ জানাল, এক সঙ্গে দলটিকে আক্রমণ করতে তাদের দলের সঙ্গে যোগ দিতে।
তাদের দলিলপত্র পড়ে দেনিসভ বলল, না ভাই, আমার নিজেরই যথেষ্ট গোঁফ গজিয়েছে, জার্মানটিকে লিখে জানাল, এরকম একজন সাহসী ও বিখ্যাত জেনারেলের অধীনে কাজ করবার আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাকে সে সুখ থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে, কারণ সে ইতিমধ্যেই একজন জেনারেলের অধীনে কাজ করছে। পুলিশ জেনারেলকেও সেই একই মর্মে চিঠি লিখে জানাল, সে ইতিমধ্যেই একজন জার্মান জেনারেলের অধীনে কাজ করছে।
এই ভাবে সব বন্দোবস্ত করে দেনিসভ ও দলখভ স্থির করল, উপরওয়ালাদের কিছু না জানিয়ে নিজেদের ছোট দল নিয়েই তারা ঐ যাত্রীদলটিকে আক্রমণ করে দখল করে নেবে। ২২ অক্টোবর দলটা মিকুলিনো গ্রাম থেকে শামশেভো গ্রামের দিকে যাচ্ছিল। মিকুলিনো ও শামশেভোর মাঝখানে রাস্তার বাঁ দিকে মস্ত বড় সব জঙ্গল কোথাও একেবারে রাস্তা পর্যন্ত প্রসারিত, আবার কোথাও বা রাস্তা থেকে এক ভা বা তার কিছু দূরে অবস্থিত। দেনিসভ ও তার দল সারাদিন সেই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে গেল, কখনো জঙ্গলের বেশ ভিতর দিয়ে, কখনো বা জঙ্গলের একেবারে কিনারা ধরে, কিন্তু কোনো সময়ই আগুয়ান ফরাসি দলটিকে দৃষ্টির বাইরে যেতে দিল না। সকালেই দেনিসভের দলের কসাকরা ঘোড়ার জিনভর্তি দুটো মালগাড়িকে আক্রমণ করে নিয়ে এল, জঙ্গল যেখানে রাস্তার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সেখানে গাড়ি দুটো কাদায় আটকে গিয়েছিল। তারপর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দলটা ফরাসিদের উপর সারাক্ষণ নজর রেখেছে, কিন্তু আক্রমণ করেনি। ফরাসি দলটাকে নির্ভয়ে চুপচাপ শামশেভোতে পৌঁছতে দেওয়া দরকার, কারণ পূর্ব ব্যবস্থা মতো সেখানে একটি পাহারাওয়ালার কুটিরে দলখভের আসার কথা আছে, তারপরেই ভোরবেলা তারা অতর্কিতে দুদিক থেকে দলটার মাথার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে তুষারপিণ্ডের মতো, এক আঘাতেই তাদের ছত্র ভঙ্গ করে দিয়ে দখল করে নেবে।
তাদের পিছনে মিকুলিনো থেকে দুই ভার্স্ট দূরে জঙ্গলটা যেখানে রাস্তা পর্যন্ত প্রসারিত সেখানে ছয় জন কসাককে মোতায়েন করা হয়েছে, কোনো নতুন ফরাসি দলকে দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের খবর দিতে হবে।
শামশেভো ছাড়িয়ে রাস্তার উপর অনুরূপভাবে নজর রাখবে দলখভ, অন্য ফরাসি সৈন্যরা কতদূরে আছে সেদিকে খেয়াল রাখবে সে। তাদের হিসেবমতো এই দলটাতে পনেরোশো লোক আছে। দেনিসভের আছে দুশো, আর দলখভের লোকের সংখ্যাও ঐরকমই। কিন্তু সংখ্যার এই তারতম্য দেনিসভকে দমাতে পারল না। তার এখন একমাত্র জানা দরকার এরা সব কোন সৈন্য এবং শত্রুপক্ষের ভিতর থেকে একটা জিভ–অর্থাৎ একটা লোককে গ্রেপ্তার করা যায় কি না। সকালবেলাকার মালগাড়ির উপর আক্রমণটা এত দ্রুত সারা হয়েছিল যে মালগাড়ির সঙ্গে যে ফরাসি সৈন্য ছিল তাদের সকলকেই মেরে ফেলা হয়েছে, কেবল একটা ঢাক বাজিয়ে ছেলেকে জীবন্ত ধরা হয়েছে, কিন্তু যেহেতু সেও দলছাড়া তাই সেনাদল সম্পর্কে বিশেষ কোনো খবরই সে বলতে পারল না।
গোটা সেনাদল পাছে সতর্ক হয়ে যায় এই ভয়ে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করাটা দেনিসভ বিপজ্জনক বলেই মনে করছে। তাই সে তার দলের চাষী তিখন শচেরবাতিকে শামশেভোতে পাঠিয়েছে, যাতে সে অনন্তত এমন একজন ফরাসি ভাণ্ডারিকেও ধরে আনতে পারে যাকে আগে আগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
.
অধ্যায়-৪
হেমন্তের একটি আতপ্ত বর্ষার দিন। আকাশে ও দিগন্তে ঘোলা জলের রং। মাঝে মাঝে একটা কুয়াশা নেমে আসছে, আর তারপরেই হঠাৎ বৃষ্টি তির্যক ফোঁটা পড়তে শুরু করছে।
গায়ে জোব্বা ও মাথায় ভেড়ার চামড়ার টুপি ছড়িয়ে দেনিসভ একটা শুটকো ঘোড়ায় চেপে চলেছে। পোশাক বেয়ে বৃষ্টির ধারা গড়িয়ে পড়ছে। ঘোড়াটা মাথা ঘুরিয়ে কান হেলিয়ে চলেছে। ঘোড়ার মতোই বৃষ্টি ছাঁট এড়াবার জন্য সেও মুখ ঘুরিয়ে সাবধানে সামনের দিকে তাকাচ্ছে। ছোট ঘন কালো দাড়িওয়ালা সরু মুখটাকে রাগী দেখাচ্ছে।
দেনিসভের পাশেই যথারীতি রয়েছে তার এক সহকর্মী, জোব্বা ও ভেড়ার চামড়ার টুপি পরে সেও চলেছে একটা বড় চকচকে ডন ঘোড়ায় চেপে।
তৃতীয় এসাউল লভয়েস্কি লোকটি দীর্ঘকায়, একটা তীরের মতো খাড়া, মুখ বিবর্ণ, চুল ভালো, কুতকুতে হাল্কা চোখ, মুখে ও চালচালনে শান্ত আত্মতুষ্টির প্রকাশ। তাদের আগে আগে হেঁটে চলেছে একটি চাষী পথ প্রদর্শক। পরনে ধূরস চাষী কোট, মাথায় শাদা বোনা টুপি।
কিছুটা পিছনে মস্তলেজ ও লোমশ একটা ছোট, শুটকো কিরঘিজ ঘোড়ায় চেপে চলেছে নীল রঙের ফরাসি ওভারকোট পরা একটি তরুণ অফিসার। ঘোড়াটার মুখ থেকে রক্ত ঝরছে।
তার পিছনে ঘোড়ায় চেপে চলেছে একজন হুজার। তার পিছনে ঘোড়ার পাছার উপর বসে চলেছে ছেঁড়া ফরাসি ইউনিফর্ম ও নীল টুপি পরা একটা ছেলে। ঠাণ্ডা লাল হাত দিয়ে ছেলেটা হুজারকে ধরে আছে, ভুরু তুলে অবাক হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। এটিই সেই ফরাসি ঢাক-বাজিয়ে ছেলে যাকে সকালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তাদের পিছন-পিছন জঙ্গল-কাটা বনপথ ধরে চলেছে তিন-চার সারি হুজার, তারপর কাক, তাদের কারো পরনে পশমি জোব্বা, কারো ফরাসি ওভারকোট, কারো বা মাথায় ঘোড়ার কাপড় ছড়ানো। ঘোড়াগুলো আসলে বাদামি বা ফুটফুট রঙের যাই হোকনা কেন, বৃষ্টিতে ভিজে এখন সবগুলোকেই কালো দেখাচ্ছে। লোমগুলো ভিজে জট পাকিয়ে যাওয়ায় ঘাড়গুলোকে খুব সরু মনে হচ্ছে। গা থেকে ধোয়া উঠছে। জামা, জিন, লাগাম, সবকিছুই রাস্তায় জমে-থাকা পচা পাতার মতো জলে ভিজে পিছল ও স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছে। বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত কসাকদের সারির মধ্যে ফরাসি ও কসাকদের ঘোড়ায় টানা দুটো মালগাড়ি গাছের কাটা ডালপালা ও গর্তের জলের ভিতর দিয়ে কোনো রকমে এগিয়ে চলেছে।
রাস্তার মধ্যে একটা জলের গর্তকে এড়িয়ে চলতে গিয়ে দেনিসভের ঘোড়াটা একপাশে কিছুটা সরে যেতেই চালকের হাঁটুটা একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেল।
আঃ, মহাশয়তান! দেনিসভ রেগে চেঁচিয়ে উঠল, দাঁত বের করে তিন চাবুক কসাল ঘোড়াটার পিঠে, নিজের ও সঙ্গীদের গায়ে ছিটকে এসে কাদা লাগল।
একে বৃষ্টি তায় ক্ষুধা (সকাল থেকে কারো কিছু খাওয়া হয়নি), দেনিসভের মন-মেজাজ এমনিতেই ভালো নেই, তার উপর এখনো পর্যন্ত দলখভের কোনো পাত্তা নেই, এবং একটা জিভকে আটক করতে যে লোকটাকে পাঠানো হয়েছে সেও এখনো ফেরেনি।
একটা যানবাহনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আজকের মতো সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। একা একা ওদের আক্রমণ করার অনেক ঝুঁকি, আর আক্রমণটা যদি একদিন পিছিয়ে দেই তাহলে বড় কোনো গেরিলা দল আমাদের নাকের উপর দিয়ে শিকারটা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতেই দেনিসভ অনবরত সামনের দিকে তাকাচ্ছে, মনে আশা, যদি দলখভের কোনো লোককে দেখতে পায়।
জঙ্গলের মধ্যে এমন একটা পথে তারা পৌঁছে গেল যেখান থেকে ডানদিকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। দেনিসভ থামল।
বলল, কে যেন আসছে।
এসাউলও সেইদিকে তাকাল। বলল, দুজন আসছে, একজন অফিসার ও একজন কসাক। কিন্তু লেফটেনান্ট-কর্নেল স্বয়ং আসছেন বলে তো মনে হচ্ছে না।
একটা উৎরাই ধরে নেমে যাওয়ার ফলে আশ্বারোহী দুজনকে আর দেখা গেল না, কিন্তু কয়েক মিনিট পরে আবার তারা দেখা দিল। সামনে একজন অফিসার, চুল ও পোশাক জলে ভিজে গেছে, হাতের চামড়ার চাবুকটা চালাচ্ছে, ট্রাউজার উঠে গেছে হাঁটুর উপরে। পিছনে রেকাবে পা রেখে দাঁড়িয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে একটি কসাক। অফিসারটির বয়স খুবই অল্প, চওড়া গোলাপি মুখ, তীক্ষ্ম ফুর্তিবাজ চোখ, ঘোড়া ছুটিয়ে দেনিসভের কাছে পৌঁছে তার হাতে একটা ভেজা খাম দিল।
বলল, জেনারেলের কাছ থেকে। খামটা শুকনো নেই বলে ক্ষমা করবেন।
ভুরু কুঁচকে দেনিসভ খামটা নিয়ে খুলে ফেলল।
লভায়েস্কিকে লক্ষ্য করে অফিসারটি বলল, সেখানে সকলেই অনবরত বলেছে: এটা বিপজ্জনক, এটা বিপজ্জনক। কিন্তু কমারভ ও আমি কসাকটিকে দেখাল প্রস্তুত ছিলাম। আমাদের প্রত্যেকের একটা করে পিস্তল আছে।…কিন্তু এ কে? ঢাক-বাজিয়ে ছোকরাকে দেখে সে প্রশ্ন করল। কোনো বন্দি কি? আপনারা এরই মধ্যে লড়াই শুরু করে দিয়েছেন? ওর সঙ্গে কথা বলতে পারি কি?
চিঠিটা পড়ে দেনিসভ চেঁচিয়ে বলল, রস্তভ! পেতয়া! কেন বলনি তুমি কে? সে হেসে তরুণের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল।
অফিসারটি পেতয়া রস্তভ।
সারাটা পথ পেতয়া নিজেকে তালিম দিতে দিতে এসেছে-পূর্ব পরিচয়ের কথা না জানিয়ে দেনিসভের সঙ্গে একজন বয়স্ক লোকের মতোই ব্যবহার করবে। কিন্তু দেনিসভ হেসে উঠতেই পেতয়ার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, খুশিতে তাতে লালে ছোপ লাগল, এতক্ষণ পর্যন্ত যে সরকারি আদব-কায়দার তালিম নিচ্ছিল সেটা ভুলে গিয়ে দেনিসভকে বলতে লাগল, ইতিমধ্যেই ভিয়াজমার কাছে একটা যুদ্ধে সে অংশ নিয়েছে, এবং হুজার হিসেবে সেখানে বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।
দেনিসভ তাকে বাধা দিয়ে বলল, তোমাকে দেখে খুশি হলাম। তার মুখে আবার উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে উঠল।
সঙ্গীকে বলল, মাইকের ফিয়কলিতিফ, জান আবার সেই জার্মানের চিঠি। পেতয়াকে দেখিয়ে বলল, ও তো তার অধীনেই আছে।
দেনিসভ সঙ্গীকে জানাল, চিঠিতে জার্মান জেনারেলটি আবারও সেই দাবিই জানিয়েছে যে যানবাহনের উপর আক্রমণ চালাতে সে যেন তার সঙ্গে হাত মেলায়।
তারপর বলল, আমরা যদি এ সুযোগ না নেই, তাহলে কাল সেই আমাদের নাকের উপর দিয়ে সুযোগটা ছিনিয়ে নেবে।
নতুন করে অ্যাডজুটান্ট ও জেনারেলের খেলা শুরু করে পেতয়া অভিবাদনের ভঙ্গিতে হাত তুলে বলল, কোনো হুকুম দেবেন কি ইয়োর অনার? না কি আমি আপনার সঙ্গেই থাকব?
হুকুম? দেনিসভ চিন্তিত ভাবে বলল। তুমি কি কাল পর্যন্ত থাকতে পারবে?
আহা, তাই করুন…আমি আপনার সঙ্গে থাকতে পারি কি? পেতয়া চেঁচিয়ে বলল।
দেনিসভ শুধাল, কিন্তু জেনারেল তোমাকে ঠিক কি বলে দিয়েছে। এখনি ফিরতে বলেছে কি?
পেতয়ার মুখ লাল হয়ে উঠল।
তিনি কিছুই বলেননি। আমার তো মনে হয় থাকতে পারি।
দেনিসভ বলল, বেশ, ঠিক আছে।
নিজের লোকদের দিকে ফিরে একটা দলকে বিশ্রামস্থলে যেতে বলল, জায়গাটা জঙ্গলের মধ্যে পাহারাদারের কুটিরের কাছে, কিরঘিজ ঘোড় সওয়ার অফিসারটিকে বলল দলখভের খোঁজ করতে এবং সে সন্ধ্যায় আসবে কি না সেটা জানতে। দেনিসভের নিজের ইচ্ছা, সঙ্গী ও পেতয়াকে নিয়ে জঙ্গলের সেই প্রান্তে চলে যাবে যেখানে সেটা শামমেশভো পর্যন্ত বিস্তৃত, ফরাসিদের যে সাময়িক আশ্রয় স্থলটাকে পরদিন আক্রমণ করা হবে সেখান থেকে তার কিছু অংশের উপর নজর রাখা যাবে।
চাষী পথ-প্রদর্শককে বলল, আচ্ছা বুড়ো, আমাদের শাম শেভোতে নিয়ে চল।
দেনিসভ, পেতয়া, ও সঙ্গীটি কসাক ও হুজারদের সঙ্গে নিয়ে একটা খাড়ি পেরিয়ে বাঁ দিক থেকে জঙ্গলের শেষ প্রান্তের দিকে ঘোড়া চালিয়ে দিল।
.
অধ্যায়-৫
বৃষ্টি থেমে গেছে। শুধু কুয়াশা নামছে, আর গাছ থেকে জলের ফোঁটা পড়ছে। দেনিসভ, তার সঙ্গী ও পেতয়া নীরবে চলেছে। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বোনা টুপি মাথায় চাষীটি। বাকলের জুতো পায়ে গাছের শিকড় ও ভেজা পাতার উপর দিয়েসে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে জঙ্গলের শেষ প্রান্তের দিকে।
একটা উঁচু জায়গায় উঠে সে থামল, চারদিকে তাকাল, তারপর যেখানে গাছগুলো ফাঁকাফকা সেই দিকে এগিয়ে চলল। একটা বড় ওক গাছের পাতাগুলি এখনো ঝরে পড়েনি। সেখানে পৌঁছে হাত বাড়িয়ে সে রহস্যজনক ভাবে ইঙ্গিতে কি যেন দেখাল।
দেনিসভ ও পেতয়া ঘোড়া ছুটিয়ে তার কাছে এগিয়ে গেল। চাষীটি যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে তারা ফরাসিদের দেখতে পেল। বনের ঠিক ওপারে একটা উৎরাইয়ের বুকে বসন্তকালীন গমের একটা ক্ষেত দেখা গেল। ডান দিকে একটা গভীর খাড়ির ওপারে একটা ছোট গ্রাম ও ভাঙা ছাদওয়ালা একটা বাড়িও আছে। গ্রামের মধ্যে, বাড়িটাতে, বাগানে, কুয়োর পাশে, পুকুরের ধারে,সবটা উঁচু জায়গায়, সেতুটা থেকে রাস্তা বরাবর পাঁচশো গজ দূর পর্যন্ত আগাগোড়া মানুষের পর মানুষের জমায়েত চোখে পড়ল কাঁপা কাঁপা কুয়াশার ভিতর দিয়ে। অ-রুশ ভাষায় ঘোড়াগুলোকে ডাকাডাকি এবং পরস্পরের কথাবার্তা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে।
ফরাসিদের উপর থেকে চোখ না সরিয়েই দেনিসভ নিচু গলায় বলল, বন্দিকে এখানে নিয়ে এস।
একটি কসাক ঘোড়া থেকে নেমে ছেলেটিকে তুলে দেনিসভের কাছে নিয়ে গেল। ফরাসি সৈন্যদের দেখিয়ে দেনিসভ তাকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে-ওখানে যারা রয়েছে তারা কারা। ঠাণ্ডা হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে ভুরু দুটো তুলে ছেলেটি সভয়ে দেনিসভের দিকে তাকাল, কিন্তু যা কিছু সে জানে সবকথা বলার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে এলোমেলো জবাব দিতে লাগল, দেনিসভ যা জিজ্ঞাসা করল তাতেই সায় দিয়ে চলল। ভুরু কুঁচকে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দেনিসভ তার সঙ্গীর অনুমান জানতে চাইল।
পেতয়া দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে একবার ঢাক-বাজিয়ে ছেলেটির দিকে, একবার দেনিসভের দিকে, একবার তার সঙ্গীর দিকে, এবং একবার গ্রাম ও পথ বরাবর অবস্থিত ফরাসিদের দেখতে লাগল। তার একমাত্র চেষ্টা, কোনো কিছুই যেন দৃষ্টি না এড়ায়।
চোখ মিটমিট করতে করতে দেনিসভ বলল, দলখভ আসুক আর না আসুক, আমরা ওদের দখল করবই।
সঙ্গী বলল, জায়গাটা খুবই উপযুক্ত।
দেনিসভ বলল, ঠিক আছে, জলাভূমির পাশ দিয়ে পদাতিক সেনাদের পাঠাও।
তারা বাগানটা পর্যন্ত ধেয়ে যাবে। তুমি কত্সকদের নিয়ে ওখানে গিয়ে ঘিরে ফেলবে-সে গ্রামের ওপারে জঙ্গলের মধ্যে একটা জায়গা দেখাল-আর হুজারদের নিয়ে আমি যাব এখান থেকে। আর সংকেত করা মাত্রই গুলি…
সঙ্গী বলল, গহ্বরটা অনতিক্ৰমণীয়-ওখানেও একটা জলাভূমি আছে। ঘোড়াগুলো ডুবে যাবে। আমাদের ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে হবে আরো বদিক দিয়ে…
তারা যখন নিচু গলায় কথা বলছে সেই সময় পুকুরের পাশের নিচু জমিটা থেকে একটা গুলির শব্দ হল, একটা শাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গেল, তারপর আর একটা, আর সঙ্গে সঙ্গে নিচের ঢালু জায়গাটা থেকে শত শত ফরাসির খুশির হৈ-হল্লা শোনা গেল। মুহূর্তের জন্য দেনিসভ ও তার সঙ্গী সরে গেল। তারা এত কাছে চলে গিয়েছিল যে তারা ভাবল যে তারাই এই গুলি ও হৈ-হল্লার কারণ। কিন্তু তাদের জন্য সেসব হয়নি। আরো নিচে একটা লোক লাল পোশাক পরে জলাভূমির ভিতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল। ফরাসিরা তাকে লক্ষ্য করেই গুলি ছুঁড়েছে, চেঁচামেচি করেছে।
সঙ্গীটি বলল, সে কি, ও যে আমাদের তিখন।
তাই তো! তাই তো!
রাঙ্কেল। দেনিসভ বলল।
ও ঠিক চলে যাবে, চোখ কুঁচকে সঙ্গী বলল।
যাকে ওরা তিখন বলল সে দৌড়ে নদীর কাছে গিয়ে জলে ঝাঁপ দিল, জল ছিটকে উঠল, মুহূর্তের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেল, তারপর হাত-পা ছুঁড়ে জল থেকে উঠেই ছুট লাগাল। ফরাসিরা তার পিছু নিয়ে শেষটা থেমে গেল।
লোকটা চালাক আছে, সঙ্গীটি বলল।
বিরক্ত মুখে দেনিসভ বলল, কি জানোয়ার রে বাবা। এতক্ষণ ও কি করছিল?
লোকটা কে? পেতয়া শুধাল।
আমাদের প্লাস্তুন (পদাতিক বন্দুকবাজ)। একটা জিভকে ধরে আনতে ওকে পাঠিয়ে ছিলাম।
ওঃ, তাই, পেতয়া এমন ভাবে মাথা নেড়ে কথাটা বলল যেন সে সবকিছু বুঝতে পেরেছে, আসলে কিন্তু সে কিছুই বোঝেনি।
তিখন শচেরবাতি তাদের দলের অপরিহার্য লোকদের অন্যতম। সে গঝাত নদীর কাছাকাছি পক্ৰোভস্কের একজন চাষী। কাজের ভার নিয়ে দেনিসভ যখন প্রথম পক্রোস্কে এসেছিল এবং গ্রাম-প্রাধানকে ডেকে ফরাসিদের খোঁজ-খবর জানতে চেয়েছিল তখন অন্যসব গ্রাম-প্রধানদের মতোই নিজেকে বাঁচাবার জন্য সে বলেছিল, কোনো ফরাসিকে সে দেখেনি, বা তাদের সম্পর্কে কিছু শোনেও নি। কিন্তু দেনিসভ যখন বুঝিয়ে বলল যে ফরাসিদের মেরে ফেলাই তার উদ্দেশ্য, আর তাই সে জানতে চাইছে সে অঞ্চলে কোনো ফরাসি এসেছে কি না, তখন গ্রাম-প্রধান জবাবদিল যে কিছু লুটেরা তাদের গ্রামে এসেছিল, কিন্তু একমাত্র তিখন শচেরবাতিই তাদের খোঁজ খবর রাখে। দেনিসভ তিখনকে ডাকিয়ে এনে তার কাজকর্মের অনেক প্রশংসা করে গ্রাম-প্রধানের সামনেই জার ও দেশের প্রতি আনুগত্য এবং পিতৃভূমির সব সন্তানেরই যে ফরাসিদের ঘৃণা করা উচিত সে বিষয়ে কিছুকথা বলেছিল।
দেনিসভের কথায় ভয় পেয়ে তিখন বলেছিল, আমরা তো ফরাসিদের কোনো ক্ষতি করিনি। কি জানেন, তাদের নিয়ে একটু মজা করেছি আর কি। জনবিশেকের মতো লুটেরাদের মেরে ফেলেছি বটে, কিন্তু আর কারো কোনো ক্ষতিতো করিনি…।
পরদিন চাষীটির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে দেনিসভ যখন পক্রোভঙ্ক ছেড়ে চলে গেল তখন তাকে জানানো হল যে তিখন তাদের দলে যোগ দিয়েছে এবং তাদের সঙ্গে থাকার অনুমতি চাইছে। দেনিসভ অনুমতি দিয়েছে।
প্রথম দিকে তিখন আজেবাজে কাজগুলি করত, আগুন জ্বালাত, জল আনত, মরা ঘোড়ার চামড়া ছাড়া, ইত্যাদি, কিন্তু অচিরেই দলীয় লড়াইয়ের প্রতি তার আকর্ষণ ও মোগ্যতার পরিচয় পাওয়া গেল। রাতের বেলা লুঠতরাজ করতে বেরিয়ে ফরাসিদের পোশাক ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসত, বলে দিলে কিছু বন্দিও ধরে আনত। তখন দেনিসভ তাকে আজেবাজে কাজ থেকে মুক্তি দিয়ে অভিযানে বের হবার সময় তাকে সঙ্গে নিত এবং তাকে কসাকদের সঙ্গে ভর্তি করে নিল।
তিখন ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসে না, সব সময় পায়ে হেঁটে চলে, কিন্তু কখনো অশ্বারোহীদের থেকে পিছনে পড়ে থাকে না। তার সঙ্গে থাকে একটা ছোট বন্দুক, একশো বর্শা ও একটু কুড় ল। তিখন খুব ভাললাভাবে কাঠ চিড়তে পারে, কুড়ল দিয়ে ছোট ছোট কাঠের পেরেক ও চামচে বানাতে পারে। দেনিসভের দলে তার একটা বিশিষ্ট আসন তৈরি হয়েছে। যখনই বিশেষ কষ্টকর ও বাজে কোনো কাজ করার দরকার হয়-একটা গাড়িকে কাদার ভিতর থেকে ঠেলে তোলা, লেজ ধরে টেনে একটা ঘোড়াকে জলাভূমির ভিতর থেকে বের করে আনা, তার ছাল ছাড়ানো, ফরাসিদের মধ্যে ঢুকে পড়া, অথবা একদিনে ত্রিশ মাইলের বেশি হাঁটা-তখন সকলেই হাসতে হাসতে তিখনকে দেখিয়ে দেয়।
সকলেই বলে, এতে শয়তানটার কিছু হবে না-ও তো ঘোড়ার মতো শক্তি রাখে।
একবার তিখন একটি ফরাসিকে গ্রেপ্তার করবার চেষ্টা করলে ফরাসিটি পিস্তল ছুঁড়ে তার পিঠের মাংসল জায়গাটাতে গুলি করেছিল। ভদকা খেয়ে ও তার প্রলেপ লাগিয়েই তিখন সে ঘাটা সারিয়ে তুলেছিল। সেই থেকে দলের সকলেই ঘটনাটা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে, আর তিখনও হাসিমুখে তাতে যোগ দেয়।
কসাকরা তাকে ক্ষেপাবার জন্য বলে, হ্যালো সাঙাৎ! আর কখনো যাবে? কেমন একখানা দিয়েছে? তিখন রাগের ভান করে ইচ্ছা করেই চোখ-মুখ পাকিয়ে ফরাসিদের সম্পর্কে নানারকম হাসির কথা বলে। এই ঘটনায় তিখনের আচরণে একটাই পরিবর্তন দেখা গেল–আহত হবার পর থেকে সে আর কাউকে বন্দি করে আনে না।
দলের মধ্যে সেই সবচাইতে সাহসী ও দরকারি লোক। আক্রমণের অধিকতর সুযোগ আর কেউ পায়নি, আর কেউই তার চাইতে বেশি ফরাসিদের গ্রেপ্তার করতে বা মারতে পারেনি, ফলে সব কসাক ও হুজাররাই তাকে ভাঁড় বানিয়ে তুলেছে, আর সেও স্বেচ্ছায় সে ভূমিকাটিকে মেনে নিয়েছে। গত রাতে দেনিসভ তাকে আমশেতভা পাঠিয়েছে একটি জিভকে গ্রেপ্তার করে আনতে। কিন্তু হয় মাত্র একটি ফরাসিকে নিয়ে আসতে তার মন চায়নি, অথবা সারা রাত ঘুমিয়ে কাটিয়েছে, কারণ যাই হোক এখন দিনের বেলায় ঝোঁপ-ঝাড়ের ভিতর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে একেবারে ফরাসিদের আওতার মধ্যে ঢুকে পড়েছে এবং–উপর থেকে দেনিসভ যে-রকমটা দেখতে পেয়েছে-ফরাসিরাও তাকে ঠিক দেখতে পেয়েছিল।
.
অধ্যায়-৬
পরদিনের আক্রমণ সম্পর্কে সঙ্গীর সঙ্গে কিছু কথা বলে দেনিসভ ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফিরে চলল।
পেতয়াকে বলল, চল হে ছেলে, এবার গিয়ে শরীরটাকে শুকিয়ে নেওয়া যাক।
পাহারা-ঘরে পৌঁছে দেনিসভ থেমে জঙ্গলের দিকে ভালো করে তাকাল। গাছপালার ভিতর দিয়ে একটি লোক লম্বা হাল্কা পায়ে এগিয়ে আসছে। তার পা দুটি লম্বা, লম্বা হাত দুটি দুপাশে ঝুলছে, পরনে খাটো কুর্তা, বাকলের জুতা ও কাজান টুপি। তার কাঁধে একটা ছোট বন্দুক, আর কোমরবন্ধে একটা কুড়ল গোঁজা। দেনিসভকে দেখেই সে তাড়াতাড়ি কি একটা যেন ঝোঁপের মধ্যে ছুঁড়ে দিল, মাথার ভিজে টুপিটা খুলল। তারপর কমান্ডারের দিকে এগিয়ে গেল। লোকটি তিখন। বলিরেখা ও ছোট ছোট গর্তেভরা মুখ ও ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ দুটি আত্মতৃপ্তির খুশিতে ঝিলমিল করছে। মাথাটা তুলে যেন একটা হাসিকে চেপে রেখে দেনিসভের দিকে তাকাল।
আচ্ছা, তুমি কোথায় উধাও হয়েছিলে? দেনিসভ শুধাল।
ফ্যাঁসফেঁসে অথচ সুরেলা মোটা গলায় তিখন সাহসের সঙ্গে তাড়াতাড়ি জবাব দিল, কোথায় উধাও হয়েছিলাম? আমি তো গিয়েছিলাম ফরাসিদের ধরে আনতে।
দিনের আলোয় ওখানে ঢু মেরেছিলে কেন? গাধা কোথাকার! আচ্ছা, একটাকেও আননি কেন?
আহা, একটাকে তো ঠিকই এনেছিলাম, তিখন বলল।
সে কোথায়?
দেখুন, খুব ভোরেই তাকে ধরেছিলাম, তিখন বলতে লাগল। তাকে জঙ্গলে নিয়ে এলাম। পরে বুঝলাম তাকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না। তাই ভাবলাম আবার গিয়ে একটু ভালো কাউকে আনব।
দেনিসভ সঙ্গীকে বলল, দেখলে তো?…কী শয়তান–ঠিক যা ভেবেছিলাম। তাকেই নিয়ে এলে না কেন?
তিখন সঙ্গে সঙ্গে সক্রোধে বলে উঠল, তাকে এনে কি লাভ হত? তাকে দিয়ে আপনার কাজ হত না। আপনার কি রকম লোক চাই তা যেন আমি জানি না!
তুমি একটা জানোয়ার!…তারপর?
তিখন বলতে লাগল, আর একজনের খোঁজে গেলাম। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এইভাবে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে শুয়ে পড়লাম। (হঠাৎ সে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।) একজন এসে হাজির হল, অমনি তাকে জাপটে ধরলাম, এইভাবে। (সে লাফিয়ে উঠল। বললাম, চল কর্নেলের কাছে। সে চেঁচাতে শুরু করে দিল, আর হঠাৎ তারা চারজন হয়ে গেল। ছোট ছোট তলোয়ার নিয়ে তারা আমার দিকে ধেয়ে এল। আমিও কুড় ল নিয়ে রুখে দাঁড়ালাম, এইভাবে : বললাম, তোমরা কি করতে চাও? খ্রিস্ট তোমাদের সহায় হোন! বুকটা চিতিয়ে ক্রুদ্ধ গলায় চিৎকার করে হাত নেড়ে চোখ মিটমিটি করে তাকিয়ে সঙ্গীটি বলল, যা, তুমি যে জলের ভিতর দিয়ে কীভাবে পালাচ্ছিলে সেটা আমরা পাহাড়ের উপর থেকে দেখেছি।
পেতয়ার ভীষণ হাসি পেল, কিন্তু তারা কেউই হাসল না। এসবের অর্থ কি বুঝতে না পেরে সে একবার তিখনের মুখের দিকে, একবার সঙ্গীটির এবং একবার দেনিসভের মুখের দিকে তাকাতে লাগল।
রাগে কাশতে কাশতে দেনিসভ বলল, ওসব ভাঁড়ামি রাখ! প্রথমটিকেই কেন ধরে আনলে না?
তিখন এক হাতে পিঠ ও অন্য হাতে মাথা চুলকোতে লাগল, তারপর হঠাৎ বোকার মতো দন্তপাটি বিকশিত করল, ফলে একটা পড়া দাঁতের ফোকলা জায়গাটা বেরিয়ে পড়ল। (এই জন্যই তাকে শচেরবাতি–অর্থাৎ ফোকলা-দাতি বলে ডাকে)। দেনিসভ মুচকি হাসল, পেতয়া খুশিতে হো-হো করে হেসে উঠল। তিখনো সে হাসিতে যোগ দিল।
তিখন বলল, আহা, সে যে একেবারেই অকর্মার ধাড়ি। তার পোশাক-তাও বাজে! তাকে আনি কেমন করে? আর কী অভদ্র ইয়োর অনার। বলে কি না, আমি নিজেই তো একজন জেনারেলের ছেলে, আমি যাব না!
দেনিসভ বলল, তুমি একটা জানোয়ার। আমি চেয়েছিলাম তাকে প্রশ্ন করে…
তিখন বলল, কিন্তু আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম। সে বলল বিশেষ কিছু জানে না। আরো বলল, আমরা তো অনেকে রয়েছি, কিন্তু সকলেই এলেবেলে-নামেই সৈনিক। জোর গলায় একটা হাঁক দাও, দেখবে সবগুলো ধরা দেবে। দেনিসভের চোখে চোখ রেখে তিখন হেসে ফেলল।
তোমাকে একশো চাবুক লাগাব-ভঁড়ামি করার মজা দেখিয়ে দেব! দেনিসভ রুক্ষকণ্ঠে বলল।
তিখন সক্ষোভে বলল, কিন্তু আপনি রাগ করছেন কেন? এমন ভাবে দেখাচ্ছেন যেন আপনার ফরাসিদের আমি চোখেই দেখিনি। অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত সবুর করুন, আপনার যে কজন চাই এনে দেব–চান তো তিন জনকে এনে দেব।
ঠিক আছে, এবার চলা যাক, বলে দেনিসভ ঘোড় চালিয়ে দিল, পাহারা-ঘর পর্যন্ত রাগে ভুরু কুঁচকে চুপচাপ চলতে লাগল।
তিখন কিছুটা পিছিয়ে পড়ল। পেতয়া শুনতে পেল, তিখন যে বুটজোড়া ঝোঁপের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল তা নিয়ে কসাকরা তিখনের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করছে।
তিখনের কথা শুনে ও হাসি দেখে পেতয়া যেরকম হাসির দমকে ফেটে পড়েছিল সেটা কেটে যেতে এবং তিখন একটা মানুষকে মেরে ফেলেছে সেকথা বুঝবার পরে পেতয়া খুব অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। সে ঢাক বাজিয়ে ছেলেটার দিকে তাকাল, বুকের মধ্যে একটা ব্যথা অনুভব করল। কিন্তু এ অস্বস্তি শুধু মুহূর্তের জন্য। তার মনে হল, তাকে মাথা উঁচু করে চলতে হবে, সাহস দেখাতে হবে, আগামীকালের অভিযান সম্পর্কে সঙ্গীটির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, যে দলে সে এসে পড়েছে তার উপযুক্ত তাকে হতেই হবে।
যে অফিসারটিকে খবর নিতে পাঠানো হয়েছিল তার সঙ্গে পথেই দেখা হয়ে গেল। সে খবর দিল, দলখভ অচিরেই এসে পড়বে এবং সে বহাল তবিয়তেই আছে।
সঙ্গে সঙ্গে দেনিসভ খুশি হয়ে উঠল। পেতয়াকে কাছে ডেকে বলল : আরে, এবার তোমার কথা বল।
.
অধ্যায়-৭
পরিবারের লোকজনরা মস্কো ত্যাগ করার পরেই পেতয়া তাদের ছেড়ে নিজের রেজিমেন্টে যোগ দেয় এবং অচিরেই একটা বড় গেরিলা দলের অধিনায়ক জেনারেল তাকে আর্দালি হিসেবে নিয়ে নেয়। কমিশন পাবার পর থেকে, বিশেষ করে যবে থেকে সে সক্রিয় সেনাদলে যোগ দিয়েছে এবং ভিয়াজমার যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তখন থেকে বড় হয়ে ওঠার একটা সানন্দ উত্তেজনা তাকে পেয়ে বসেছে, সত্যিকারের বীরত্বপূর্ণ কিছু করবার কোনো সুযোগ যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায় তার জন্য সে সদাসর্বদাই একান্ত তৎপর। সেনাবাহিনীতে এসে সে যা কিছু দেখেছে ও জেনেছে তাতে তার মন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার এও মনে হয়েছে যে সে যেখানে যেখানে থাকছে না আসল বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধটা সেখানেই ঘটে যাচ্ছে। তাই যেখানে সে নেই সেখানেই ছুটে যেতে তার এত তাড়া।
২১ অক্টোবর তার জেনারেল জানাল যে একজন কাউকে দেনিসভের দলের কাছে পাঠাতে হবে, তখন পেতয়া এমন করুণাভাবে সেখানে যাবার অনুমতি চাইল যে জেনারেল আপত্তি করতে পারল না। কিন্তু পাঠাবার সময় জেনারেলের মনে পড়ে গেল ভিয়াজমার যুদ্ধে পেতয়ার পাগলের মতো কাণ্ড-কারখানা, তাকে যেখানে পাঠানো হয়েছিল, সোজা রাস্তা ধরে সেদিকে না গিয়ে সে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছিল ফরাসি অগ্রবর্তী বাহিনীর একেবারে গোলাগুলির মুখে এবং সেখানে দু দুবার নিজের পিস্তল থেকে গুলি ছুঁড়েছিল। তাই জেনারেল এখন স্পষ্ট করে তাকে বলে দিয়েছে, দেনিসভের কোনো অভিযানে সে অংশ নিতে পারবে না। তাই তো দেনিসভ যখন জিজ্ঞাসা করেছিল সে থেকে যেতে পারবে কি না তখন পেতয়া জবাব দিতে ইতস্তত করেছিল, তার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। বনের প্রান্তে উপস্থিত হবার আগে পর্যন্ত পেতয়া ভেবেছিল যে জেনারেলের নির্দেশ সে কঠোরভাবে মেনে চলবে এবং অবিলম্বে ফিরে যাবে। কিন্তু ফরাসিদের দেখতে পেয়ে এবং তিখনকে দেখার পরে যখন সে জানতে পারল যে ফরাসিদের দেখতে পেয়ে এবং তিখনকে দেখার পরে যখন সে জানতে পারল যে সে রাতে নিশ্চয় একটা আক্রমণ চালানো হবে তখন সে হঠাৎ মতটা পাল্টে ফেলে স্থির করে বসল, যে জেনারেলকে সে এতদিন পর্যন্ত শ্রদ্ধা করে এসেছে সে একটি বদখত জার্মান, আর দেনিসভ একজন বীর, সঙ্গীটিও বীর, এমন কি তিখনও বীর, তাই এই সংকটকালে তাদের ছেড়ে যাওয়া তার পক্ষে খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার হবে।
দেনিসভ, পেতয়া ও সঙ্গীটি যখন পাহারা-ঘরে পৌঁছল তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গোধূলির আলোয় ঘোড়াগুলোকে দেখা যাচ্ছে, কসাক ও হুজাররা জঙ্গলের এমন জায়গায় আগুন জ্বালিয়েছে যেখান থেকে ফরাসিরা ধোয়া দেখতে পাবে না। ছোট পাহারা-ঘরের বারান্দায় জনৈক কসাক আস্তিন গুটিয়ে মাংস কাটছে। ঘরের মধ্যে দেনিসভের দলের তিনটি অফিসার একটা দরজাকে টেবিলের উপরকার কাঠে রূপান্তরিত করছে। পেতয়া ভেজা পোশাক ছেড়ে সেগুলো শুঁকতে পাঠিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খাবার টেবিল পাতার কাজে অফিসারকে সাহায্য করতে লেগে গেল।
দশ মিনিটের মধ্যে টেবিল তৈরি হয়ে গেল, একটা তোয়ালেও বিছিয়ে দেওয়া হল। টেবিলের পরিবেশন করা হল ভদকা, এক ফ্লাস্ক রাম, শাদা রুটি, ঝলসানো মাংস ও নুন।
অফিসারদের সঙ্গে টেবিলে বসে দুই হাতে চর্বিওয়ালা সুস্বাদু মাংস ছিঁড়তে ছিঁড়তে পেতয়ার মনে সকলের জন্য একটা শিশুসুলভ রোমাঞ্চকর ভালোবাসা জেগে উঠল, ফলে তার মনেও বিশষাস জন্মাল যে অন্যরাও তাকে সেইভাবেই ভালোবাসে।
সে দেনিসভকে বলল, আচ্ছা ভাসিলি দিমিত্রিচ, আপনি কি মনে করেন, আমার এখানে এই কটা দিন থাকা কি ঠিক হবে? জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে সে নিজেই জবাবটা দিল : দেখুন, আমাকে বলা হয়েছিল খুঁজে বের করতে–তা আমি তো খুঁজছি…শুধু আমাকে একেবারে ভিতরে…মানে আসল ঘটনার মধ্যে যেতে দেবেন…আমি কোনো পুরস্কার চাই না…কিন্তু আমি চাই…
পিছনে হেলান দিয়ে হাত নেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে পেতয়া চারদিকে তাকাতে লাগল।
দেনিসভ হেসে বলল, একেবারে প্রধান ঘটনার মধ্যে…
পেতয়া বলতে লাগল, শুধু দয়া করে আমাকে একটু পরিচালনার দায়িত্ব দিন, যাতে আমি সত্যি পরিচালনার সুযোগটা পাই। তাতে আপনার কি আসে-যায়?…ও হো, আপনার একটা ছুরি চাই। জনৈক অফিসারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে পেতয়া বলল।
একটা ভাঁজ-করা ছুরি তার দিকে এগিয়ে দিল। অফিসার ছুরিটার প্রশংসা করল।
মুখ লাল করে পেতয়া বলল, দয়া করে ওটা রেখে দিন। আমার ওরকম আরো আছে। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে বলল, হা ঈশ্বর! আমি তো একেবারেই ভুলে গেছি। আমার কাছে কিছু কিসমিস আছে, খুব ভালো জিনিস, একেবারে বিচি নেই। আমাদের সঙ্গে একজন নতুন দোকানি এসেছে, সে খুব ভালো ভালো জিনিস রাখে। আমি দশ পাউন্ড কিনে নিয়েছি। মিষ্টি কিছু খাওয়াটা আমার অভ্যাস। আপনাদেরও চাই তো?…পেতয়া ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে গেল এবং কয়েকটা থলে ভর্তি প্রায় পাঁচ পাউন্ড কিসমিস নিয়ে ফিরে এল। আপনারা কিছু নিন, কিছু, নিন!
সঙ্গীটিকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার একটি কফি-পাত্র চাই, তাই না? দোকানির কাছ থেকে আমি একটা চমৎকার কফি-পাত্র কিনেছি। তার জিনিসপত্রগুলোই চমৎকার। আর লোকটি খুব সৎ, সেটাই বড় কথা। আপনাকে একটা পাঠিয়ে দেব। আর আপনার চকমকি পাথরগুলো বোধ হয় অকেজো হয়ে গেছে, বা ক্ষয় হয়ে গেছে–মাঝে মাঝে ওরকম হয়। আমার সঙ্গেই কিছু পাথর আছে, এই দেখুন না-একটা থলে দেখাল-একশো পাথর আছে। খুব সস্তায় কিনেছি। যতগুলি চান নিয়ে নিন, দরকার হলে সবগুলিও…।
পরক্ষণেই বড় বেশি কথা বলে ফেলছে ভেবে সে হঠাৎ চুপ করে গেল। মনে করতে চেষ্টা করল, এই রকম বোকামির কাজ আর কিছু করেছে কি না। সারাদিনের ঘটনার কথা ভাবতে গিয়ে ঢাক-বাজিয়ে ছোকরাটার কথা মনে পড়ে গেল। এখানে আমরা তো তোফা আছি, কিন্তু তার কি হল? এরা তাকে কোথায় রেখেছে? তাকে খেতে দিয়েছে তো? তার মনে আঘাত দেয়নি তো? চকমকি পাথর নিয়ে অনেক কথা বলে ফেলায় এখন আর তার কথা বলতে সাহস হল না।
ভাবল, তার কথা যদি জিজ্ঞাসা করি তো বলবে : ও নিজে ছেলেমানুষ, তাই ছোট ছেলের প্রতি করুণা দেখাচ্ছে। কাল দেখিয়ে দেব আমি ছেলেমানুষ কি না। আহা, ছেলেটার কথা জিজ্ঞাসা করলে কি খারাপ শোনাবে? ঠিক আছে, যা হয় হবে।
সে শুধাল, যে ছেলেটিকে বন্দি করা হয়েছে তাকে ডেকে এনে কিছু খেতে দিতে পারি কি?…হয় তো…
দেনিসভ বলল, সত্যি, ছেলেটা বেচারি। তাকে ডেকে আন। তার নাম ভিনসেন্ট বোসে। তাকে ডেকে পাঠাও।
আমিই ডেকে আনছি, পেতয়া বলল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ডাকো। বেচারি, দেনিসভ কথাটা আর একবার বলল।
পেতয়া তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। অফিসারদের ফাঁক দিয়ে গলে সে দেনিসভের কাছে এসে বলল, আপনাকে একবার চুমো খেতে দিন। আঃ, আপনি কত ভালো, কত চমৎকার!
দেনিসভকে চুমো খেয়ে সে দৌড়ে কুটির থেকে বেরিয়ে গেল।
দরজার বাইরে থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, বোসে! ভিনসেন্ট।
অন্ধকারে কে যেন শুধাল, কাকে চান স্যার?
পেতয়া জবাব দিল, যে ফরাসি ছেলেটিকে সেদিনই গ্রেপ্তার করা হয়েছে সে তাকেই খুঁজছে।
ওঃ, ভেসেন্নি? একজন কসাক বলল।
ছেলেটির নাম ভিনসেন্ট। ইতিমধ্যেই কসাকরা তাকে ভেসেন্নি এবং চাষী ও সৈনিকরা ভেসনিয়া বানিয়ে ফেলেছে। দুটো নামকরণেই বসন্ত (ভেসনা) কথাটার ইঙ্গিত রয়েছে, ছেলেটি সকলের মনে বসন্তের আমেজই এনে দিয়েছে।
ওখানে আগুনের পাশে বসে শরীরটা গরম করছে। হো, ভেসেনিয়া! ভেসেনিয়া!–ভেসেন্নি! অন্ধকারেই তারা হাসাহাসি করে ডাকতে লাগল।
পাশে দাঁড়ানো একটি হুজার বলল, ছেলেটা বেশ চটপটে। কিছুক্ষণ আগেই আমরা তাকে কিছু খেতে দিয়েছি। তার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছিল।
অন্ধকারে কাদার ভিতর দিয়ে ছুটে আসা খালি পায়ের শব্দ শোনা গেল। ঢাক-বাজিয়ে ছেলেটি দরজায় হাজির।
পেতয়া ফরাসিতে বলল, আরে, এই যে তুমি! কিছু খাবে কি? কোনো ভয় নেই, ওরা তোমাকে মারবে না। এস, ভিতরে এস।
প্রায় শিশুর মতো কাঁপা গলায় ছেলেটি বলল, ধন্যবাদ মঁসিয়। নোংরা পা দুটো চৌকাঠে ঘষতে লাগল।
ছেলেটিকে অনেক কথা বলার ইচ্ছা পেতয়ার ছিল, কিন্তু বলবার সাহস হল না। একটু দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেটির হাত ধরে চাপ দিল। ভিতরে এস, ভিতরে এস!শান্ত মৃদুস্বরে আর একবার কথাটা বলল। দরজাটা খুলে তাকেই আগে ঢুকতে দিল।
ছেলেটিকে ঢুকিয়ে দিয়ে পেতয়া কিছুটা দূরে গিয়ে বসল। তার প্রতি মনোযোগ দেওয়াটা তার পক্ষে মর্যাদাহানিকর বলে মনে হল। পকেটে হাত দিয়ে টাকাগুলি নাড়াচাড়া করতে লাগল। কিছু টাকা ঢাক-বাজিয়ে ছেলেটিকে দিলে কি সেটা হাস্যকর মনে হবে!
.
অধ্যায়-৮
দলখভ এসে পড়ায় পেতয়ার মনোযোগ ঢাক-বাজিয়ে ছেলেটির উপর থেকে সরে গেছে। ইতিমধ্যেই দেনিসভ তাকে দিয়েছে মাংস ও ভদকা, তাকে পরিয়ে দিয়েছে একটা রুশ কোট যাতে অন্য বন্দিদের সঙ্গে পাঠিয়ে না দিয়ে তার দলেই রেখে দেওয়া হয়। সেনাদলে এসে দলখভের অসাধারণ সাহসিকতা ও ফরাসিদের প্রতি নিষ্ঠুরতার অনেক গল্প পেতয়া শুনেছে। তাই সে কুটিরে ঢোকার পর থেকে পেতয়া তার উপর থেকে চোখ সরায়নি, নিজের মনে সাহস এনে মাথা উঁচু করে রেখেছে। যাতে সে এই মহৎ সঙ্গের অনুপযুক্ত না হয়ে পড়ে।
দলখভের চেহারার সরলতায় পেতয়া অবাক হয়ে গেল।
দেনিসভের পরনে কসাক কোট, মুখে দাড়ি, অঘটন-ঘটনকারি নিকলাসের মূর্তি তার বুকে, তার কথা বলার ধরন ও কাজকর্মই বলে দেয় তার অসাধারণ মর্যাদার কথা। কিন্তু যে দলখভ মস্কোতে পরত একটা পারসিক পোশাক, এখন তাকে দেখলে রক্ষীবাহিনীর একজন ঠিক-ঠিক অফিসার বলেই মনে হয়। তার মুখ পরিষ্কার করে কামানো, পরনে রক্ষীবাহিনীর মোটা কোট, বোতামের ঘরে একটা সেন্ট জর্জের স্মরণ ঝোলানো, মাথায় একটা লুট-করা টুপি খাড়া করে বসানো। ভেজা পশমি জোব্বাটা ঘরের এক কোণে খুলে রেখে কারো সঙ্গে কুশল বিনিময় না করে সোজা দেনিসভের কাছে গিয়ে কাজকর্ম সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। দেনিসভ সব কথাই খুলে বলল।
এই অবস্থা। কিন্তু তারা কি ধরনের সৈন্য আর তাদের সংখ্যাই বা কত সেসবই আমাদের অবশ্য জানতে হবে। সেখানে যাবার দরকার হবে। তারা সংখ্যায় কতজন আছে সেটা সঠিক না জেনে আমরা কাজ শুরু করতে পারি না। সুনির্দিষ্ট ও সঠিকভাবে কাজ করতে আমি ভালোবাসি। এখানে–এই দ্রমশায়দের কেউ একজন কি আমার সঙ্গে ফরাসি শিবিরে যেতে পারবেন? আমি একটা বাড়তি ইউনিফর্ম এনেছি।
আমি, আমি…আমি যাব আপনার সঙ্গে, পেতয়া বলল।
দলখভকে লক্ষ্য করে দেনিসভ বলল, আপনার সেখানে যাবার কোনোই দরকার নেই, আর ওকে তো আমি কিছুতেই যেতে দেব না…
এটা আমার পছন্দ! পেতয়া বলে উঠল। কেন আমি যেতে পাব না?
কারণ যাওয়াটা বৃথা।
দেখুন, মাফ করবেন, কারণ…কারণ…আমি যাব, বাস। আপনি আমাকে সঙ্গে নেবেন তো? দলখভের দিকে ফিরে সে বলল।
ফরাসি ঢাক-বাজিয়ে ছেলেটিকে ভালো করে লক্ষ্য করতে করতে দলখভ অন্যমনস্কভাবে বলল, কেন নেব না? দেনিসভকে শুধাল, এই বাচ্চাটা কি অনেকদিন আপনার সঙ্গে আছে?
ওকে আজই ধরা হয়েছে, কিন্তু কিছুই জানে না। ওকে আমার সঙ্গেই রেখে দিচ্ছি।
বেশ, আর অন্যদের কোথায় রেখেছেন? দলখভ জানতে চাইল।
কোথায়? তাদের পাঠিয়ে দিয়েছি, আর একটা রসিদ নিয়েছি, দেনিসভ মুখ লাল করে চেঁচিয়ে বলল। আর আমি সাহস করেই বলছি যে বিবেকের বিরুদ্ধে আমি একটা লোকেরও জীবন নেই। খোলাখুলিই বলছি, একজন সৈনিকের সম্মানকে কলংকিত করার পরিবর্তে ত্রিশ অথবা তিনশো লোককে কড়া পাহারায় শহরে পাঠিয়ে দেওয়া কি আপনার পক্ষে কঠিন কাজ হত।
নিরাসক্ত ব্যঙ্গের সুরে দলখভ বলল, এই মোল বছরের কাউন্টের মুখে এসব অমায়িক কথা মানায়, কিন্তু আপনি এসব কথা বন্ধ করুন।
পেতয়া সলজ্জ ভঙ্গিতে বলল, সে কি? আমি তো কিছু বলিনি! শুধু বলেছি, আপনার সঙ্গে অবশ্যই যাব।
দলখভ বলতে লাগল, দেখুন, আপনার আর আমার পক্ষে এ ধরনের কথা এখন বন্ধ করাই ভালো। আচ্ছা, এই ছেলেটাকে আপনার কাছে রেখেছেন কেন? ওর জন্য দুঃখ হচ্ছে বলে তো! আপনার এই রসিদের ব্যাপারটা কি আমরা জানি না? আপনি পাঠালেন একশো আর সেখানে পৌঁছল ত্রিশ। বাকিরা হয় না খেয়ে মরে, নয় তো তাদের মেরে ফেলা হয়। সুতরাং তাদের না পাঠানোটাও কি আসলে একই ব্যাপার নয়?
সঙ্গীটি তার হাল্কা রঙের চোখ দুটি কুঁচকে সমর্থনসূচক ঘাড় নাড়ল।
সেটা কথা নয়। ব্যাপারটা নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই না। আমি শুধু এটাকে আমার বিবেকের উপর চাপিয়ে দিতে চাই না। আপনি বলছেন তারা তো মরবেই। ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো মারছি না!
দলখভ হাসতে লাগল।
বিশবার তো পার হয়ে গেল, কে তাদের বলেছিল আমাকে গ্রেপ্তার না করতে আমাকে ধরতে পারলে তো একটা অস্পেন গাছেই ঝুলিয়ে দিত, আর যত উদারতাই দেখান আপনারও সেই একই হাল হত। সে থামল। যাই হোক, আমাদের কাজ তো চালাতেই হবে। কসাককে আমার কিটটা আনতে বলুন। তাতে দুটো ফরাসি ইউনিফর্ম আছে। দেখ হে, তুমি আমার সঙ্গে যাচ্ছ তো? সে পেতয়াকে শুধাল।
আমি? হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়, প্রায় অশ্রুসজল চোখে দেনিসভের দিকে তাকিয়ে পেতয়া বলল।
দেনিসভের সব আপত্তির জবাবে পেতয়া শুধু বলল, যেন তেন প্রকারের বদলে সঠিকভাবে সব কাজ করতে সেও অভ্যস্ত, আর ব্যক্তিগত বিপদের কথা সে কখনো ভাবে না।
কারণ আপনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে ওখানে তারা কতজন আছে সেটা যদি আমরা না জানতে পারি…তার উপর নির্ভর করছে শত শত জীবন, আর এদিকে আমরা মাত্র দুজন। তাছাড়া, আমার যাবার একান্ত ইচ্ছা, আমি যাবই, কাজেই আমাকে বাধা দেবেন না, সে বলল। তার ফল আরো বেশি খারাপ হবে…
.
অধ্যায়-৯
ফরাসি গ্রেটকোট ও শাকো গায়ে চড়িয়ে পেতয়া আর দলখভ ঘোড়ায় চেপে সেই ভোলা জায়গাটায় গেল যেখান থেকে দেনিসভ ফরাসি শিবিরটা দেখতে পেয়েছিল। তারপর গাঢ় অন্ধকারে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে খড়ি বেয়ে নামতে লাগল। নিচে পোঁছে দলখভ সঙ্গী কসাকদের সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে রাস্তাটা ধরে সেতুর দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। উত্তেজনায় অধীর হয়ে পেতয়া চলল তার পাশে পাশে।
ফিসফিস করে বলল, যদি ধরা পড়ি আমাকে ওরা জীবন্ত গ্রেপ্তার করতে পারবে না। আমার সঙ্গে পিস্তল আছে।
অতি দ্রুত ফিসফিস করে দলখভ বলল, রুশ ভাষায় কথা বলল না, আর ঠিক সেইমুহূর্তে অন্ধকারের ভিতর থেকে তাদের কানে এল, Qui vive (কে যায়?) আর একটা বন্দুকের ধাতব শব্দ।
পেতয়ার মুখে রক্ত উঠে এল, পিস্তলটা চেপে ধরল।
দলখভ ফরাসিতে জবাব দিল, বর্শাধারী ষষ্ঠ রেজিমেন্ট। ঘোড়ার গতি সে কমালও না, বাড়ালও না।
সেতুর উপর শান্ত্রীর কালো মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।
সংকেতবাক্য?
ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে দলখভ পায়ে হাঁটা গতিতে এগিয়ে চলল। প্রশ্ন করল, কর্নেল জেরার্দ এখানে আছে কি না বল?
কোনও জবাব না দিয়ে তার পথ আটকে শান্ত্রী আবার বলল, সংকেতবাক্য?
একজন অফিসার যখন রোদে বের হয় তখন শান্ত্রীরা তার কাছে সংকেতবাক্য শুনতে চায় না, দলখভ সহসা গর্জে শান্ত্রীকে লক্ষ্য করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। আমি জানতে চাইছি, কর্নেল এখানে আছে কি না?
শান্ত্রী একপাশে সরে দাঁড়াল, তার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে দলখভ ধীর গতিতে ঘোড় চালিয়ে দিল।
একটি অস্পষ্ট মনুষ্য মূর্তিকে রাস্তা পার হতে দেখে দলখভ তাকে থামিয়ে কমান্ডার ও অফিসাররা কোথায় আছে জানতে চাইল। বস্তা কাঁধে সেই সৈনিকটি থামল, দলখভের ঘোড়র কাছে এগিয়ে গেল, ঘোড়র গায়ে হাত দিয়ে দেখল, তারপর সহজভাবে বন্ধুর মতো বুঝিয়ে বলল যে কমান্ডার ও অফিসাররা পাহাড়ের আরো উঁচুতে ডান দিকের একটা গোলাবাড়ির উঠোন রয়েছে।
রাস্তার দুই পাশে শিবির-আগুনকে ঘিরে ফরাসিদের কথাবার্তা কানে এল। তার ভিতর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে দলখভ-সেই উঠোনের দিকে এগিয়ে গেল। ভিতরে ঢুকে ঘোড়া থেকে নেমে সে একটা বড় জ্বলজ্বলে শিবির আগুনের দিকে এগিয়ে গেল। আগুনটা ঘিরে কয়েকজন জোর গলায় কথা-বার্তা বলছে। আগুনের এক কোণে একটা ছোট গামলায় কি যেন সিদ্ধ হচ্ছে। খাড়া টুপি ও নীল ওভারকোট পরা একটি সৈনিক পাশে হাঁটু গেড়ে বসে একটা কাঠি দিয়ে তার ভিতরকার বস্তুটাকে নাড়ছে।
আগুনের অপর দিকে ছায়ায় উপবিষ্ট একজন অফিসার বলল, আর, সে লোকটা বড় কঠিন ঠাঁই!
আর একজন হেসে বলল, লোকগুলোকে সে বিপদে ফেলবে।
দলখভ ও পেয়ার ঘোড়ার শব্দ কানে আসতে তারা অন্ধকারে তাকিয়ে চুপ করে গেল।
দলখভ সানন্দে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, বজু, মঁসিয়!
অন্ধকারে উপবিষ্ট অফিসারদের মধ্যে একটা আলোড়ন দেখা দিল, দীর্ঘস্কন্ধ দীর্ঘকায় একটি অফিসার আগুনটা ঘুরে দলখভের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
বলল, আরে, ক্লিমেন্ট না কি? কোথায় হাওয়া হয়ে… নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে থেমে গেল, বুরু কুঁচকে অপরিচিত জনের মতো দলখভকে স্বাগত জানিয়ে তার জন্যে কি করতে পারে তা জানতে চাইল।
দলখভ বলল, সে ও তার সঙ্গী অনেকক্ষণ থেকেই তাদের রেজিমেন্টটাকে ধরতে চেষ্টা করছে, তারপর সাধারণভাবে সকলকে উদ্দেশ করেই জানতে চাইল, তারা ষষ্ঠ রেজিমেন্টের কোনো খবর রাখে কি না। তারা কেউ কিছু জানে না, পেতয়ার মনে হল তার ও দলখভের দিকে তারা শত্রুতাপূর্ণ সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করেছে। কয়েক সেকেন্ড সকলেই চুপচাপ।
পিছন থেকে একজন চাপা হাসির সঙ্গে বলে উঠল, সন্ধ্যাবেলাকার ঝোলের আশা করে যদি এসে থাক তাহলে বড়ই দেরি করে ফেলেছ।
দলখভ জবাব দিল, তারা ক্ষুধার্ত নয়, আর সেই রাতেই তাদের আরো এগিয়ে যেতেই হবে।
যে সৈনিকটি পাত্রটাকে নাড়ছিল তার হাতে ঘোড়া দুটোকে ছেড়ে দিয়ে সে দীর্ঘস্কন্ধ অফিসারটির পাশে বসে পড়ল। সে অফিসারটি কিন্তু দলখভের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে পুনরায় জানতে চাই, সে কোন রেজিমেন্টের লোক। প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি এমনি ভাব দেখিয়ে দলখভ কোনো জবাব দিল না, পকেট থেকে একটা বেঁটে ফরাসি পাইপ বের করে আগুন ধরাল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, তাদের সামনের রাস্তাটা কতদূর পর্যন্ত কসাকদের হাত থেকে নিরাপদ।
আগুনের পিছন থেকে একজন অফিসার জবাব দিল, সে দস্যুরা তো সর্বত্র রয়েছে।
দলখভ বলল, তার সঙ্গী ও তার মতো দলছাড়াদের পক্ষেই কসাকরা বিপজ্জনক, কিন্তু তারা হয়তো বড় কোনো দলকে আক্রমণ করতে সাহস করবে না, কি বলেন? কেউ কোনো জবাব দিল না।
শিবির-আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে পেতয়া ভাবছে, এবার উনি চলে আসবেন।
কিন্তু দলখভ আবার সেই আলোচনাই নতুন করে শুরু করল এবং সরাসরি প্রশ্ন করতে লাগল, প্রতিটি ব্যাটেলিয়নে কত সৈন্য আছে, কতগুলি ব্যাটেলিয়ন আছে, আর বন্দিই বা কতজন আছে। সেই দলের সঙ্গের রুশ বন্দিদের কথা জানতে গিয়ে দলখভ বলল :
এই মরা মানুষগুলোকে টেনে নিয়ে চলা একটা ভয়ংকর কাজ! এসব ছোটলোককে গুলি করে মেরে ফেলাই ভালো। বলেই সে এমন অদ্ভুতভাবে হো-হো করে হেসে উঠল যে পেতয়ার মনে হল ফরাসিরা অবিলম্বেই তাদের ছদ্মবেশ ধরে ফেলবে। নিজের অজ্ঞাতেই সে আগুনের কাছ থেকে এক পা পিছিয়ে গেল।
দলখভের হাসির জবাবেও কেউ কিছু বলল না। জনৈক ফরাসি অফিসার গ্রেটকোটটা মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল বলে তারা তাকে দেখতে পায়নি। এবার সে উঠে একজন সঙ্গীর কানে কানে কি যেন বলল। দলখভ উঠে পড়ল! যে সৈনিকটি ঘোড়া দুটিকে ধরে রেখেছিল তাকে ডাকল।
আপনা থেকেই দলখভের আরো কাছে সরে গিয়ে পেতয়া ভাবল, ওরা কি ঘোড়া দুটো এনে দেবে?
ঘোড়া দুটো আনা হল। শুভ সন্ধ্যা মশায়রা, দলখভ বলল।
পেতয়ারও ইচ্ছা হল বলে শুভ রাত্রি, কিন্তু একটা কথাও তার মুখে এল না। অফিসাররা তখন পরস্পর ফিসফিস করছে। দলখভের ঘোড়ায় চাপতে বেশ দেরি হল, কারণ ঘোড়াটা কিছুতেই স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছিল না। তারপর সে হাঁটা-গতিতে উঠোনটা পেরিয়ে গেল। পেতয়াও চলতে লাগল তার পাশে পাশে, মুখ ফিরিয়ে দেখার সাধ হল ফরাসিরা তাদের পিছনে ছুটে আসছে কি না, কিন্তু সাহসে কুলোল না।
রাস্তায় পড়ে দলখভ আর ভোলা মাঠ পেরিয়ে ঘোড়া ছোটাল না, চলল গ্রামের ভিতর দিয়ে। একটা জায়গায় থেমে সে কান পাতল। শুধাল, শুনতে পাচ্ছ? পেতয়া রুশ গলার শব্দ চিনতে পারল, দেখল শিবির আগুনকে ঘিরে বসে আছে রুশ বন্দিদের কালো কালো মূর্তি। সেতুর কাছে নেমে এসে পেতয়া ও দলখভ শান্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে বেচারি একটিও কথা না বলে বিষণ্ণ মনে পায়চারি করে চলেছে। তারপর তারা সেই খাড়িতে নেমে গেল যেখানে কসাকরা তাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে।
আচ্ছা, এবার বিদায়। দেনিসভকে বলে দিও দিনের আলো ফুটতেই প্রথম গুলি সঙ্গে সঙ্গে, এই কথা বলেই দলখভ ঘোড়া ছুটিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু পেতয়া তাকে জড়িয়ে ধরল।
চেঁচিয়ে বলল, সত্যি! আপনি কত বড় বীর। আঃ, কী সুন্দর, কী চমৎকার! আপনাকে আমি কত ভালোবাসি!
ঠিক আছে, ঠিক আছে! দলখভ বলল। কিন্তু পেতয়া তাকে ছেড়ে দিল না। সেই অস্পষ্ট আলোয় দলখভ দেখল, পেতয়া তার উপর নুয়ে পড়েছে, তাকে চুমো খেতে চাইছে। দলখভ তাকে চুমো খেল, হাসল, তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
.
অধ্যায়-১০
পাহারাদারের কুটিরে পৌঁছে পেতয়া বারান্দাতেই দেনিসভের দেখা পেল। পেতয়াকে যেতে দিয়ে দেনিসভ তার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় উত্তেজনা, উদ্বেগ ও আত্ম-তিরস্কারের ভিতর দিয়ে সময় কাটাচ্ছিল।
সে বলে উঠল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! হ্যাঁ, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! কিন্তু তুমি কি জান, তোমার জন্য আমি ঘুমতে পারিনি! যাহোক, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এখন শুয়ে পড়। সকাল হবার আগে এখনো একটু চোখ বুজে নিতে পারব।
পেতয়া বলল, কিন্তু…না, আমি এখনই ঘুমতে চাই না। তাছাড়া, আমি জানি ঘুমিয়ে পড়লেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। তাই যুদ্ধের আগে না ঘুমনোটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।
কুটিরের ভিতরে বসে খুশি মনে সে অভিযানের খুঁটিনাটি বিষয়গুলির কথা ভাবতে লাগল, পরদিন যা ঘটবে তাও কল্পনা করতে লাগল। যখন দেখল দেনিসভ ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বাইরে তখনো বেশ অন্ধকার। বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু গাছ থেকে তখনো ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। কুটিরের কাছেই কসাকদের ঝুপড়ি ও ঘোড়াগুলোর কালো কালো চেহারা চোখে পড়ছে। কুটিরের পিছনে দুটো মালগাড়ি ও ঘোড়র কালো কালো ছায়া এবং খাড়ির মধ্যে নিভে-আসা আগুনের লাল আভা দেখা যাচ্ছে। সব কসাক ও হুজাররা ঘুমিয়ে পড়েনি, এখানে-ওখানে জল পড়া ও ঘোড়ার চিবনোর শব্দের ফাঁকে ফকে নিচু গলার ফিসফিস শব্দ কানে আসছে।
বাইরে এসে পেতয়া অন্ধকারের দিকে তাকাল, মালগাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। গাড়ির নিচে একজনের নাক ডাকছে, চারদিকে ঘোড়াগুলো যই চিবচ্ছে। অন্ধকারে নিজের ঘোড়াটাকে চিনতে পেরে পেতয়া সেই দিকে এগিয়ে গেল। ইউক্রেনিয় জাতের ঘোড়া হলেও পেতয়া ঘোড়াটাকে করবাখ বলে ডাকে।
ঘোড়াকে চুমো খেয়ে পেতয়া বলল, দেখ করবাখ! কাল কিছু কাজের কাজ হবে।
যে কসাকটি গাড়ির নিচে বসেছিল সে বলল, আপনি এখনো ঘুমোননি স্যার?
না, আরে…লিখাচিভ-এটাই তো তোমার না? তুমি কি জান এইমাত্র আমি ফিরেছি। আমরা ফরাসি শিবিরে ঢুকেছিলাম।
পেতয়া সমুদয় বিবরণ তাকে জানাল।
কসাক বলল, এখন আপনার একটু ঘুমিয়ে নেওয়া উচিত।
এ আমার অভ্যাস আছে, পেতয়া বলল। বলি কি, তোমাদের পিস্তলের পাথরগুলো কি ক্ষয়ে গেছে? আমার সঙ্গে কিছু পাথর আছে। তোমার কি দরকার আছে? কয়েকটা নিতে পার।
কসাকটি গাড়ির নিচ থেকেই মুখ বাড়িয়ে পেতয়াকে ভালো করে দেখল।
পেতয়া বলল, সবকিছু সঠিকভাবে করাই আমার অভ্যাস। অনেকেই কোনোরকমে কাজ সারে, আর পরে সেজন্য পস্তায়। সেটা আমি পছন্দ করি না।
ঠিক কথা, কসাক বলল।
হ্যাঁ, আর একটা কথা! দেখ ভাই, দয়া করে আমার তরবারিটা একটু শান দিয়ে দিতে পার? পারবে কি?
নিশ্চয় পারব।
লিখাচিভ উঠে এল। থলিটা হাতড়ে কি সব বের করল, অচিরেই শান-পাথরে ইস্পাত ঘষার একটা যুদ্ধের মতো শব্দ পেতয়ার কানে এল। গাড়ির উপর উঠে সে এক কোণে বসল। কসাকটি মালগাড়ির নিচে বসেই তরবারিতে শান দিতে লাগল।
বলছি কি! বাছারা সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে? পেতয়া শুধাল।
কতক ঘুমিয়েছে, কতক ঘুমোয়নি-যেমন আমরা।
আচ্ছা, সেই ছেলেটা?
ভেসেন্নি? আরে, সে তো ওখানে বারান্দাতেই শুয়ে পড়েছে। ভয় পাবার পরে এখন ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেছে।
পেতয়া অনেকক্ষণ চুপ করে নানান শব্দ শুনতে লাগল। অন্ধকারে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। একটা কালো মূর্তি এগিয়ে এল।
গাড়ির কাছে এসে শুধাল, কি ধার দিচ্ছ?
কেন, এই ভদ্রলোকের তরবারি।
ঠিক আছে, লোকটি বলল, পেতয়ার ধারণা সে একজন হুজার। কাপটা কি এখানে ফেলে গেছি।
ওখানে, চাকাটার পাশে।
হুজার কাপটা তুলে নিল।
শীঘ্রই ভোর হবে, হাই তুলে কথাটা বলে সে চলে গেল।
পেতয়া অবশ্যই জানে যে রাস্তা থেকে এক ভা দূরে জঙ্গলের মধ্যে দেনিসভের গেরিলাদের দলে সে আছে, ফরাসিদের কাছ থেকে আটক-করা একটা মালগাড়ির উপর সে বসে আছে, পাশে ঘোড়াগুলো এক দিগড়িতে বাঁধা রয়েছে, মালগাড়ির নিচে বসে লিমাচিভ তারই তরবারিতে শান দিচ্ছে, ডান দিকের বড় কালো ছায়াটা পাহারাদারের ঘর, বাঁ দিকে নিচে লাল আলোটা শিবিরের নিভে-আসা আগুন, যে লোকটা কাপ নিতে এসেছিল সে একটা হুজার। এসবই তার জানবার কথা, কিন্তু এই মুহূর্তে এসবকিছুই সে জানে না, জানতে চায়ও না। সে এখন রূপকথার রাজ্যে বাস করছে, সেখানে কোনো কিছুই বাস্তবের অনুরূপ নয়। বড় কালো ছায়াটা আসলে পাহারাদারের কুটির হলেও সেটা পৃথিবীর নিচে একেবারে অতলে যাবার একটা গহ্বরও হতে পারে। লাল আলোটা হয় তো একটা আগুন, আবার ওটা তো একটা প্রকাণ্ড দানবের চোখও হতে পারে। হয় তো সত্যি সত্যি সে বসে আছে একটা মালগাড়ির উপর, কিন্তু এও তো হতে পারে যে মালগাড়ি না হয়ে ওটা একটা ভয়ংকর উঁচু মিনার যেখান থেকে পড়ে গেলে সে হয় তো সারাদিন, বা সারা মাস ধরেই পড়তে থাকবে, অথবা শুধু পড়তেই থাকবে, কোনোদিন আর নিচে পৌঁছবে না। হয় তো কসাক লিখাচিভই মালগাড়ির নিচে বসে আছে, কিন্তু সে তো এমন একটি পরম দয়ালু, পরম সাহসী, পরম আশ্চর্য ও পরম চমৎকার মানুষ হতে পারে যার কথা পৃথিবীর কেউ জানে না। হয় তো একটি হুজারই জল নিতে এসে ফিরে গেছে, কিন্তু আসলে হয় তো সে উধাও হয়েছে–একেবারে অদৃশ্য হয়ে মহাশূন্যে মিলিয়ে গেছে।
এখন পেতয়া যাই দেখুক কিছুতেই বিস্মিত হবে না। সে এখন রূপকথার রাজ্যে বাস করছে, সেখানে সবই সম্ভব।
আকাশের দিকে তাকাল। আকাশটাও যেন পৃথিবীর মতোই রূপকথার দেশ। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে, গাছের উপর দিয়ে মেঘেরা ভেসে যাচ্ছে, যেন তারাদের মুখের ঘোমটা খুলে দিচ্ছে। অনেক সময় মনে হচ্ছে যেন মেঘেরা সরে যাচ্ছে আর পরিষ্কার কালো আকাশ বেরিয়ে আসছে। কখনো মনে হচ্ছে আকাশটা উপরে উঠে যাচ্ছে, একেবারে মাথার উপরে অনেক উঁচুতে, আমার মনে হচ্ছে সেটা এত নিচে নেমে এসেছে যেন হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে।
পেতয়ার চোখ দুটি বুজে এল, সে একটু ঢুলতে লাগল।
গাছ থেকে জল পড়ছে। চুপি-চুপি কথা শোনা যাচ্ছে। ঘোড়াগুলো হেষারব করে পরস্পর ঠেলাঠেলি করছে। একজন নাক ডাকাচ্ছে।
ও ঝেগ-ঝেগ, ও ঝেগ-ঝেগ… শান-পাথরে তরবারি ঘষার শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ পেতয়া শুনতে পেল, সম্মিলিত অর্কেস্ট্রায় একটা অজানা, মধুর, গম্ভীর মন্ত্র বাজছে। পেতয়ার সুর-জ্ঞান নাতাশার মতোই, যদিও নিকলাসের চাইতে বেশি, কিন্তু সে কখনো গান শেখেনি বা তা নিয়ে ভাবেওনি। তাই অপ্রত্যাশিতভাবে যে সুর তার কানে এল তাই তার কাছে তাজা ও আকর্ষণীয় বলে মনে হল। সুরটা ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে, এক যন্ত্র থেকে অপর যন্ত্রে সঞ্চারিত হচ্ছে। যে সুরটা বাজানো হচ্ছে সেটা ফুগ (পর্যায়ক্রমিক সঙ্গীত)-যদিও ফুগ কাকেবলে পেতয়া তা জানে না। যন্ত্রগুলিকে কখনো মনে হচ্ছে বেহালা, কখনো বা শিঙা, কিন্তু ঐ দুটোর চাইতেই অনেক ভালো ও অনেক স্পষ্ট। সেগুলি পর্যায়ক্রমে বাজতে বাজতে একসঙ্গে মিশে গেল, আবার আলাদা হয়ে গেল, আবার মিশে গেল। কখনো বেজে উঠল গির্জার গম্ভীর সঙ্গীত, কখনো বা আশ্চর্য এক জয়গান।
সামনে তাকিয়ে পেতয়া ভাবল, আরে–আমি কি স্বপ্ন দেখেছি! কানের মধ্যে বাজছে। হয় তো এ সঙ্গীত আমারই নিজস্ব। ঠিক আছে, বাজো আমার সঙ্গীত! এবার!…
সে চোখ বুজল, আর অমনি চারদিক থেকে ভেসে এল সুর, মিশে গেল, আলাদা হল, মিশে গেল, তারপর সব সুর মিলে মিশে একটি মধুর গম্ভীর যন্ত্র হয়ে উঠল। পেতয়া নিজের মনেই বলল, আহা, কী আনন্দময়! ঠিক আমার মনের মতন! প্রকাণ্ড অর্কেস্ট্রাটাকে পরিচালিত করার ইচ্ছা জাগল তার মনে।
এবার ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাও! শব্দগুলি তার কথা শুনল। এবার পূর্ণতর, আরো আনন্দময়। আরো–আরো আনন্দময়! অমনি কোনো অজ্ঞাত গভীরতা থেকে উঠল বর্ধিত শব্দরাশি। এবার সব স্বর এক হয়ে যাও! পেতয়া হুকুম দিল। আর অনেকদূর থেকে সে শুনতে পেল প্রথমে পুরুষের কণ্ঠস্বর, তারপর নারীদের। সে শব্দ সম্মিলিত বিজয়-গর্বে ক্রমেই বেড়ে চলল, আর পেতয়া ভয়ে ও আনন্দে কান পেতে তাদের অপার সৌন্দর্য শুনতে লাগল।
একটা গম্ভীর জয়যাত্রার সঙ্গীত, গাছের জলপড়ার শব্দ ও তরবারির হিসহিস একত্রে মিশে ধ্বনি উঠল ও ঝেগ-ঝেগ-ঝেগ…।
সে ধ্বনি কতক্ষণ ছিল পেতয়া জানে না : সে আনন্দে মজে গেল, নিজের আনন্দে নিজেই অবাক হল, আর মনে মনে দুঃখ পেল যে এ আনন্দের কেউ অংশীদার নেই। লিখাচিভের ডাকে তার স্বপ্ন ভেঙে গেল।
এটা হয়ে গেছে ইয়োর অনার, এটা দিয়ে একটা ফরাসিকে কেটে দুটুকরো করতে পারবেন।
পেতয়া জেগে উঠল।
আলো ফুটেছে, সত্যি আলো ফুটেছে, সে চেঁচিয়ে উঠল।
যে ঘোড়াগুলোকে আগে দেখা যাচ্ছিল না এখন সেগুলির লেজ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, পাতাঝরা ডালের ফাঁকে ফকে বৃষ্টি-ভেজা আলো দেখা যাচ্ছে। শরীরটাকে নাড়া দিয়ে পেতয়া লাফ দিয়ে উঠল, পকেট থেকে একটা রুবল বের করে লিখাচিভকে দিল, তারপর তরবারিটা ঘুরিয়ে ধার পরীক্ষা করে, খাপে ভরে নিল। কত্সকরা ঘোড়া খুলে দিয়ে কসে জিন আঁটতে লাগল।
লিখাচিভ বলল, এই তো কমান্ডার এসে গেছেন। দেনিসভ পাহারাদারের ঘর থেকে বেরিয়ে এল, পেতয়াকে ডেকে নিয়ে সকলকে তৈরি হবার হুকুম দিল।
.
অধ্যায়-১১
আধো অন্ধকারে লোজনরা ঘোড়া খুঁজে নিয়ে, জিন পরিয়ে, একত্র হল। দেনিসভ পাহারাদারের কুটিরের পাশে দাঁড়িয়ে শেষ নির্দেশাদি দিতে লাগল। দলের পদাতিক বাহিনী পথে নামল। শত শত পায়ে কাদা ছিটিয়ে প্রথম উষার কুয়াশার ভিতর দিয়ে তারা জঙ্গলের মধ্যে অতি দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল। সঙ্গীটিও তার দলের লোকদের কিছু হুকুম দিল। ঘোড়ার রাশ হাতে নিয়ে সওয়ার হবার হুকুমের অপেক্ষায় পেতয়া অধৈর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাণ্ডা জলে স্নান করায় তার মুখটা জ্বলজ্বল করছে, চোখ দুটো খুব ঝকঝকে দেখাচ্ছে। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নামছে, সারা শরীরের ধমনিগুলো তালে তালে চলছে।
দেনিসভ শুধাল, সবকিছু তৈরি? এবার ঘোড়া আন।
ঘোড়া আনা হল। জিনটা ঢিলে থাকায় দেনিসভ কসাকটির উপর রাগ করল, তাকে বকুনি দিল, তারপর সওয়ার হয়ে বসল। পেতয়া রেকাবে পা দিল। পিছন ফিরে একবার হুজারদের দেখে নিয়ে দেনিসভের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
বলল, ভাসিলি দিমিত্রিচ, আমাকে একটা কাজের ভার দিন। দয়া করে..ঈশ্বরের দোহাই…!
দেনিসভ বোধ হয় পেতয়ার অস্তিত্বই ভুলে গিয়েছিল। মুখটা ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল।
কঠোর কণ্ঠে বলল, তোমার কাছে আমার একটাই কথা। আমাকে মেনে চলবে, কোথাও নিজের থেকে নাক গলাবে না।
পেতয়াকে সে আর একটি কথাও বলল না, সারা পথ নিঃশব্দে ঘোড়া চালাল। যখন বনের প্রান্তে পৌঁছল তখন মাঠের উপর পরিষ্কার আলো ছড়িয়ে পড়েছে। দেনিসভ ফিসফিস করে সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলছে, কসাকরা পেতয়া ও দেনিসভকে পাশ কাটিয় চলে গেল। সকলে চলে গেলে দেনিসভ ঘোড়ার পিঠে হাত রেখে পাহাড়ের উৎরাই বেয়ে নামতে শুরু করল। ঘোড়াগুলো আরোহীসমেত খাড়িতে নেমে গেল। পেতয়া দেনিসভের পাশেই আছে, তার নাড়ির গতি ক্রমাগত বাড়ছে। ক্রমেই আলো বাড়ছে, কিন্তু দূরের জিনিস তখনো কুয়াশায় ঢাকা। উপত্যকায় পৌঁছে দেনিসভ পিছনে তাকাল, ইশারায় একটি কসাককে কাছে ডাকল।
বলল, সংকেত!
কসাকটি হাত তুলল, একটা গুলি সশব্দে ছুটে গেল। মুহূর্তের মধ্যে ঘোড়ার জোর কদমে ছোটার শব্দ শোনা গেল, বিভিন্ন দিক থেকে চিৎকার উঠল, আরো গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ হল।
ঘোড়র ক্ষুরের ও চিৎকারের প্রথম শব্দ শুনেই পেতয়া ঘোড়ার পিঠে চাবুক কসাল, রাশ আলগা করে দিয়ে সামনে ছুটে গেল, দেনিসভের কোনো কথা কানেই নিল না। পেতয়ার মনে হল, প্রথম গুলিটা ছোঁড়ার মুহূর্তেই সহসা যেন দুপুরের আলো দেখা দিল। ঘোড়া ছুটিয়ে সে সেতুর দিকে চলল। কাকরা চলেছে তার আগে আগে। সেতুর উপর জনৈক কসাকের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগল, সে পিছিয়ে পড়েছিল, জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল। তার সামনে সৈন্যরা সম্ভবত ফরাসি সৈন্যরা রাস্তা পার হবার জন্য ডান থেকে বাঁ দিকে ছুটছে। তাদের একজন পেতয়ার ঘোড়র পায়ের নিচে কাদার মধ্যে পড়ে গেল।
একটা কুটিরে চারপাশে কসাকরা ভিড় করেছে, তারা একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত। ভিড়ের ভিতর থেকে ভয়ংকর আর্তনাদ শোনা গেল। ঘোড়া ছুটিয়ে এসে হাজির হল পেতয়া। প্রথমেই তার চোখে পড়ল, একটি ফরাসি সৈনিক তাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়বার জন্য বর্শার হাতলটা ধরে আছে, তার মুখ বিবর্ণ, চোয়াল কাঁপছে।
হুররা।…বাছারা!…আমাদের! পেতয়া চেঁচিয়ে বলল। তারপর উত্তেজিত ঘোড়ার রাশ ঢিল দিয়ে গ্রাম্য পথ ধরে ছুটে গেল।
সামনের দিকে গুলির শব্দ শোনা গেল। কাকরা, হুজাররা, ছেঁড়া পোশাকপরা রুশ বন্দিরা রাস্তার দুপাশ থেকে ছুটে এসে জোর গলায় অসংলগ্নভাবে চিৎকার করে কি যেন বলছে। বেশ সাহসী দেখতে একজন ফরাসি হুজারদের দিকে হাতের ব্যেয়নেট উদ্যত করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। তার পরনে নীল ওভারকোট, মাথায় টুপি নেই, লাল মুখটা ভ্রুকুটিকুটিল। পেতয়া যখন ঘোড়া ছুটিয়ে সেখানে গেল ততক্ষণে লোকটি ধরাশায়ী হয়েছে। আবার বড় বেশি দেরি হয়ে গেল! কথাটা বিদ্যুৎগতিতে পেতয়ার মনে উদয় হল, ঘোড়া ছুটিয়ে সে আবার সেইদিক পানে গেল যেখান থেকে বারবার গুলির শব্দ আসছে। আগের দিন রাতে দলখভের সঙ্গে সে যে বাড়ির উঠোনে গিয়েছিল সেখান থেকেই গুলি আসছে। ঘন ঝোঁপঝাড়ের ভিতরকার বাঁশের বেড়ার আড়ালে ঘাঁটি গেড়ে ফরাসিরা ফটকে সমবেত কসাকদের উপর গুলি চালাচ্ছে। ফটকের কাছে এগিয়ে পেতয়া ধোয়ার ভিতর দিয়ে দলখভকে দেখতে পেল, বিবর্ণ মুখে সে লোকজনদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলছে, ঘুরে যাও! পদাতিক বাহিনীর জন্য অপেক্ষা কর! ততক্ষণে পেতয়া তার কাছে পৌঁছে গেল।
অপেক্ষা?…হুররা–আ-আ! পেতয়া চিৎকার করে উঠল। এক মুহূর্তও না থেমে যেখান থেকে গুলির শব্দ আসছে, যেখানে ধোয়া সব চাইতে ঘন সেইদিকে ছুটে গেল।
গুলিবর্ষণের শব্দ হল, কিছু বুলেট হিস-হিস করে পাশ দিয়ে চলে গেল, কিছুটা গিয়ে ছিটকে পড়ল কোনো কিছুর উপর। কসাকরা ও দলখভ পেতয়াকে অনুসরণ করে ফটকের দিকে ঘোড়া চালিয়ে দিল। ঘন ধোয়ার মধ্যে কিছু ফরাসি অস্ত্র ফেলে দিয়ে ঝোঁপ থেকে ছুটে বেরিয়ে এল কসাকদের সামনে, অন্যরা পাহাড় বেয়ে পুকুরের দিকে নেমে গেল। ওদিকে পেতয়া উঠোনের পাশ দিয়ে ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে রাশটা হাতে না ধরে দুই হাতই অদ্ভুতভাবে ঘোরাতে লাগল, আর ক্রমেই জিন থেকে সরে যেতে লাগল। জোর কদমে ছুটতে ছুটতে একটা নিভন্ত আগুনের কাছে পৌঁছে ঘোড়াটা হঠাৎ থেমে গেল, আর পেতয়া ধপাস করে ভেজা মাটিতে পড়ে গেল। কসাকরা দেখল, তার মাথাটা নিশ্চল থাকলেও হাত-পাগুলো খুব তাড়াতাড়ি নড়ছে। একটা বুলেট তার খুলির মধ্যে ঢুকে গেছে।
এদিকে ঊর্ধ্বতন ফরাসি অফিসারটি তরবারির মাথায় শাদা রুমাল বেঁধে বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা করল যে তারা আত্মসমর্পণ করছে। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে দলখভ ঘোড়া থেকে নেমে পেতয়ার কাছে গেল। সে তখন হাত ছড়িয়ে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে।
শেষ! ভুরু কুঁচকে কথাটা বলে দলখভ ফটকের দিকে এগিয়ে গেল। দেনিসভ ঘোড়া ছুটিয়ে তার দিকেই আসছে।
মৃত্যুর অভ্রান্ত লক্ষণ তার কাছে খুবই পরিচিত। দূর থেকে পেতয়ার দেহটাকে সেইভাবে পড়ে থাকতে দেখে দেনিসভ চিৎকার করে বলল, মেরে ফেলেছে।
সব শেষ। দলখভ পুনরায় কথাটা বলল, বলে যেন খুশি হল। তারপর তাড়াতাড়ি বন্দিদের দিকে এগিয়ে গেল। কসাকরা এসে তাদের ঘিরে ফেলেছে। সে দেনিসভকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমরা ওদের নিয়ে যাব না!
দেনিসভ জবাব দিল না, পেতয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে ঘোড়া থেকে নামল, তারপর কম্পিত হাতে পেতয়া রক্তমাখা কর্দমাক্ত মুখখানাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ধরল। মুখটা এর মধ্যেই শাদা হয়ে গেছে।
পেতয়ার কথাগুলি তার মনে পড়ে গেল : মিষ্টি কিছু খাওয়া আমার অত্যাস। কিসমিসগুলি খুব ভাললা…সব নিন! কুকুরের মতো আর্তনাদ করে দেনিসভ ঘুরে দাঁড়াল। সে শব্দ শুনে কত্সকরা সবিস্ময়ে তার দিকে তাকাল। দেনিসভ হাঁটতে হাঁটতে বাঁশের বেড়াটার কাছে গিয়ে সেটাকে চেপে ধরল।
দেনিসভ ও দলখভ যে রুশ বন্দিদের উদ্ধার করল তাদের মধ্যেই ছিল পিয়ের বেজুখভ।
.
অধ্যায়-১২
মস্কো থেকে পথ চলার পুরো সময়-কালের মধ্যে বন্দিদের সম্পর্কে ফরাসি কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কোনো নতুন আদেশ জারি করা হয়নি। সেই বন্দিদের দলে পিয়েরও ছিল। মস্কো ছাড়বার সময় বন্দিরা যে সেনাদল ও মালবাহী গাড়ির সঙ্গে ছিল, ২২শে অক্টোবর তারা আর সে দলের সঙ্গে ছিল না। যাত্রার প্রথম দিকে গজাল ভর্তি যে গাড়িগুলো তাদের সঙ্গে চলছিল তাদের অর্ধেক দখল করে নিয়েছে কসাকরা, আর বাকি অর্ধেক সামনে এগিয়ে গেছে। অশ্বহীন যে অশ্বারোহী সৈন্যরা বন্দিদের আগে আগে চলছিল তাদের একজনও নেই, সকলেই উধাও হয়ে গেছে। প্রথম দিকে বন্দিরা তাদের যে কামান-শ্রেণী দেখতে পেয়েছিল, এখন তার জায়গায় এসেছে মার্শাল জুনোৎ-এর মস্তবড় মালবাহী গাড়ি, ওয়েস্টফেলিয় সৈন্যরা সেটাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছে। বন্দিদের পিছন পিছন আসছে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা মালবাহী গাড়ি।
যে ফরাসি বাহিনী এতদিন তিন সারিতে অগ্রসর হচ্ছিল, ভিয়াজমা থেকে তারা চলেছে এক সারিতে। মস্কো ছেড়ে আসার পরে প্রথম বিশ্রামঘাঁটিতে পিয়ের বিশৃঙ্খলার যে লক্ষণগুলি দেখতে পেয়েছিল তা এখন চরমে উঠেছে।
যে রাস্তা ধরে তারা চলেছে তার দুই পাশে পড়ে আছে যত মরা ঘোড়া, ছেঁড়া পোশাক পরা যেসব সৈনিক বিভিন্ন রেজিমেন্ট থেকে পিছিয়ে পড়েছিল তারা অনবরত দল বদল করে চলেছে, কখনো একটা চলতি দলে যোগ দিচ্ছে, আবার পিছিয়ে পড়ছে।
চলতে চলতে বারকয়েক ভুল করে বিপদ-সংকেত দেওয়ার ফলে পাহারাদার সৈন্যরা বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়ে ছুটে পালাতে শুরু করে, ফলে নিজেরাই ধাক্কাধাক্কি করে মরে, আর পরে আবার একত্র হলে অকারণ ত্রাসের জন্য একে-অন্যকে গালাগালি করতে থাকে।
অশ্বারোহী বাহিনীর ভাণ্ডার, বন্দিদের পাহারা-দল ও জুনোতের মালবাহী গাড়ি–তিনটে দল একসঙ্গে চললেও তারা যেন একই সঙ্গে আলাদা ও এক, যদিও প্রতিটি দলের লোকজনই অতি দ্রুত কমে যাচ্ছে।
গোলন্দাজ বাহিনীর মালপত্রবাহী গাড়ির সংখ্যা একশো কুড়ি, এখন অবশিষ্ট আছে ষাটের মতো, বাকিগুলো হয় বেদখল হয়েছে, নয়তো পিছিয়ে পড়েছে। জুনোতের মালগাড়িরও কতকগুলি বেদখল হয়েছে অথবা পরিত্যক্ত হয়েছে। তিনটে মালগাড়ি আক্রমণ করে লুট করেছে দাভুতের সেনাদলের দলছাড়া সৈন্যরা। জার্মানদের কথাবার্তা থেকে পিয়ের জানতে পেরেছে যে বন্দিদের তুলনায় মালবাহী গাড়িগুলোর জন্য একটা বড় রকমের রক্ষীবাহিনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে, মার্শালের নিজের হুকুমেই তাদেরই সহকর্মী একজন জার্মানকে গুলি করে মারা হয়েছে, কারণ মার্শালের নিজস্ব একটা রুপোর চামচ তার কাছে পাওয়া গিয়েছিল।
বন্দিদের দলগুলি প্রায় সবই বরফে জমাট বেঁধে গেছে। যে একশো ত্রিশ জন মস্কো থেকে যাত্রা করেছিল তাদের মধ্যে এখনো অবশিষ্ট আছে একশো জনেরও কম। অশ্বারোহী বাহিনীর জিন অথবা জুনোতের মালপত্রের চাইতেও পাহারাদারদের কাছে বন্দিরাই বড় বোঝ। তারা জানে, জিনগুলো এবং জুনোৎ-এর চামচগুলো তবু কিছু কাজে লাগতে পারে, কিন্তু একদল শীতার্ত ক্ষুধিত সৈন্য সমপরিমাণে শীতার্ত ও ক্ষুধিত রুশদের পাহারা দিতেই থাকবে (তাদের অনেকেই ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে পিছিয়ে পড়েছে এবং এ অবস্থায় তাদের গুলি করে মারার হুকুম আছে)-এটা শুধু দুর্বোধ্যই নয়, একান্ত আপত্তিকরও বটে। নিজেদের কষ্টকর অবস্থায় বন্দিদের প্রতি কোনোরূপ করুণা দেখাতেও যেন তারা ভয় পেল এবং তাদের প্রতি রূঢ় ও কঠোর ব্যবহার করতে লাগল।
দরগবুঝে পাহারাদার সৈন্যরা বন্দিদের একটা আস্তাবলে তালাবন্ধ করে রেখে নিজেদের ভাড়ারই নিজেরা লুট করতে চলে গেলে কয়েকজন সৈনিক-বন্দি দেয়ালের নিচ দিয়ে সুরঙ্গ কেটে পালিয়ে গেল। কিন্তু ফরাসিরা আবার তাদের গ্রেপ্তার করে গুলি করে মেরে ফেলল।
যাত্রার মুখে অফিসার-বন্দিদের অন্য বন্দিদের থেকে আলাদা করে রাখার যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেটা অনেকদিন উঠে গেছে। যারা হাঁটতে পারল তারাই একসঙ্গে চলতে লাগল, তৃতীয় ঘাটির পরেই পিয়ের কারাতায়েভ ও তার নীল-ধূসর বাকা-ঠ্যাং কুকুরটার দলে যোগ দিল।
মস্কো ছেড়ে আসার পরে তৃতীয় দিনে কারাতায়েভ আবার সেই জ্বরে পড়ল মস্কোর হাসপাতালে থাকতে যে জ্বরে সে ভুগেছিল। সে ক্রমে যতই দুর্বল হয়ে পড়ল পিয়ের ততই তার কাছ থেকে সরে যেতে লাগল। কেন তা পিয়ের জানে না, কিন্তু যেদিন থেকে কারাতায়েভ দুর্বল হতে লাগল সেদিন থেকেই পিয়ের যেন কিছুটা অনিচ্ছাতেই তার কাছে যেত। কাছে গেলেই করাতায়েভের চাপা গোঙানি কানে আসে, তার শরীরের দুর্গন্ধ ক্রমেই বেশি করে নাকে আসে, আর পিয়ের ততই তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়, তার কথা ভাবেও না।
চালাঘরে বন্দি থাকার সময় পিয়ের জেনেছিল–বুদ্ধি দিয়ে নয়, সমস্ত সত্তা দিয়ে, জীবন দিয়ে জেনেছিল যে, মানুষের সৃষ্টি হয়েছে সুখের জন্য, সুখ আছে তার অন্তরে, আছে মানুষের সহজ, সরল প্রয়োজনের পরিপূর্তিতে, দুঃখের উদ্ভব হয় অভাব থেকে নয়, প্রয়োজনাতিরিক্ত জিনিসের প্রতি আসক্তি থেকে। আর এখন এই তিন সপ্তাহের ভ্রমণ-কালে আর একটি সান্তনাদায়ক নতুন সত্যকে সে জেনেছে–এই পৃথিবীতে ভয়ংকর বলে কিছু নেই। জেনেছে, যন্ত্রণা ও মুক্তিরও সীমা আছে, আর সে সীমা পরস্পরের খুব কাছাকাছি, গোলাপের বিছানায় শুয়ে একটি কুঁচকানো পাপড়ির জন্য মানুষ ঠিক ততখানি কষ্টই পায় যেটা সে ভোগ করছে সঁতসেঁতে খালি মেঝের উপর ঘুমিয়ে, যখন শরীরের একদিক গরম হতে না হতেই অপর দিকটা ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে, আঁটো নাচের জুতো পরলে যতখানি কষ্ট পেত, এখন ঘা-ভর্তি খালি পায়ে হাঁটতেও সেইরকম কষ্টই পাচ্ছে। নতুন করে আবিষ্কার করেছে, রাতের বেলা আস্তাবলে তালাবন্ধ অবস্থায় সে যতটা স্বাধীন আছে, স্ত্রীকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করার সময় তার চাইতে বেশি স্বাধীন ছিল না। এখন তার কাছে সবচাইতে যন্ত্রণাদায়ক তার ঘা-ভর্তি খালি পা দুটো। (ঘোড়ার মাংস ক্ষুধাবর্ধক ও পুষ্টিকর, নুনের বদলে যে বারুদ তারা ব্যবহার করে তার যবক্ষার-স্বাদও এখনো ভালোই লাগে, ঠাণ্ডাও খুব বেশি নয়, দিনের বেলা হাঁটতে বেশ গরমই লাগে, আর রাতের জন্য আছে শিবির-আগুন, যেসব উকুন শরীরটাকে কুরে কুরে খায় তারাই এখন শরীরটাকে গরম রাখে।) প্রথমেই যে জিনিসটা অসহ্য মনে হল সেটা তার পা দুটো।
দ্বিতীয় দিন পথ চলার পরে শিবির-আগুনে পা দুটো পরীক্ষা করে পিয়ের ভাবল, সে পা নিয়ে হাঁটা অসম্ভব। কিন্তু যখন সকলে উঠে পড়ল তখন সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে হাঁটতে লাগল, শরীর একটু গরম হলে হাঁটতে আর কোন কষ্ট হল না, কিন্তু রাতে পা দুটো আগের চাইতে ভয়ংকর দেখানো। কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে সে অন্য কথা ভাবতে লাগল।
এতদিনে পিয়ের মানব জীবনের পরিপূর্ণ শক্তিকে উপলব্ধি করতে পেরেছে, উপলব্ধি করেছে মানুষের সেই আত্মরক্ষাকারী শক্তিকে যার সাহায্যে মনকে এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে নিবিষ্ট করা যায়, এ যেন বয়লারের সেই সেফটি-ভালভটি যার সাহায্যে তাপ একটা নির্দিষ্ট সীমাকে ছাড়িয়ে ফেলেই বাড়তি তাপটাকে বের করে দেওয়া হয়।
যে বন্দিরা পিছিয়ে পড়েছিল তাদের ওরা কীভাবে গুলি করে মেরেছিল তা পিয়ের চোখে দেখেনি, কানেও শোনেনি, যদিও একশোর বেশি বন্দি সেই পথেই মৃত্যুবরণ করেছে। কারায়েভের কথা সে ভাবে না, সেও প্রতিদিন আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে, অচিরেই তারও সেই দশা হবে। পিয়ের নিজের কথা আরো কম ভাবে। অবস্থা যতই কঠিনতর হয়ে উঠছে, ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে আরো ভয়ংকর, ততই সান্ত্বনাদায়ক আনন্দময় চিন্তা, স্মৃতি ও কল্পনারা তার বর্তমান অবস্থাকে ছাড়িয়ে উঠতে লাগল।
.
অধ্যায়-১৩
২২ অক্টোবর দুপুরে কর্দমাক্ত পিছল পথে চড়াই বেয়ে উঠতে উঠতে পিয়ের একবার তার পায়ের দিকে একবার উঁচু-নিচু রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে চারদিকে পরিচিত ভিড়ের দিকে তাকিয়ে আবার তার পায়ের দিকে দৃষ্টি ফেরাচ্ছে। দুইই তার কাছে সমান পরিচিত, সমান নিজস্ব। নীল-ধূসর খোঁড়া কুকুরটা মনের খুশিতে রাস্তার পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে। কখনো পিছনের একটা পা তুলে তিন পায়ে লাফাচ্ছে। আবার ছুটছে চার পায়ে, মরা জন্তুর উপর বসে-থাকা কাকগুলোর দিকে ছুটে যাচ্ছে ঘেউ-ঘেউ করে। মস্কোর চাইতে এখন কুকুরটা আরো খুশি ও চকচকে হয়েছে। চারদিকে মানুষ থেকে ঘোড়া পর্যন্ত নানা জন্তুর পচা মাংস পড়ে আছে, লোকজনের যাতায়াতের ফলে নেকড়েগুলো আসতে পারছে না, ফলে কুকুরটা যথেচ্ছভাবে মাংস খেতে পারছে।
সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হয়েছিল যেকোন সময় বৃষ্টিটা থামতে পারে, এবং আকাশ পরিষ্কার হতে পারে, কিন্তু একটু থেমেই আবার জোর বৃষ্টি নামল। জলে-ভেজা রাস্তাটা আর জল শুষে নিতে পারল না, ফলে গাড়ির চাকার দাগ বেয়ে জলের স্রোত বয়ে চলল।
দুই দিকে তাকাতে তাকাতে পিয়ের হাঁটছে। তিনটে করে পা আঙুলে গুণছে। বৃষ্টিকে উদ্দেশ করে সে বলে উঠল, এইবার, আবার, চালিয়ে যাও! জোরসে ঢালো!
মনে হল সে কিছুই ভাবছে না, কিন্তু অন্তরের গভীরতম তলে একটা গুরুত্বপূর্ণ, সান্ত্বনাদায়ক বিষয় নিয়ে তার মন মেতে আছে। আগের দিন কারায়েভের সঙ্গে তার যে কথা হয়েছে তা থেকে অনুমিত একটি সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক সিদ্ধান্তই সেই বিষয়।
গতকালের বিশ্রাম-ঘাঁটিতে শিবির-আগুনটা নিভে যাওয়ায় পিয়ের উঠে পার্শ্ববর্তী জ্বলন্ত আগুনটার দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে একটা গ্রেটকোটে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে বসে প্লাতন কারাতায়েভ সৈন্যদের একটা গল্প বলছে। মাঝ রাত পার হয়ে গেছে। এসময় সাধারণত কারায়েভের জ্বরটা ছেড়ে যায়, সে বেশ সুস্থ বোধ করে। তবু কারায়েভের রোগজীর্ণ কণ্ঠস্বর শুনে এবং আগুনের আভায় উজ্জ্বল করুণ মুখটা দেখে পিয়েরের বুকটা ব্যথায় টনটন করে উঠল। লোকটির প্রতি এই করুণার উদ্রেক হওয়ায় পিয়ের ভয় পেয়ে গেল, সেখান থেকে চলে যেতে চাইল, কিন্তু আর কোনো আগুন না থাকায় প্লাতনের দিকে না তাকিয়ে চেষ্টা করে সেখানেই বসে পড়ল।
আরে, কেমন আছ? শুধাল।
কেমন আছি? রোগ নিয়ে গজগজ করলে তো ঈশ্বর মৃত্যুই দেবেন, এই জবাব দিয়ে প্লাতন আবার গল্পটা বলতে শুরু করল।
বিবর্ণ শীর্ণ মুখে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে আর দুই চোখে খুশির ঝিলিক তুলে বলতে লাগল, তারপর, শোন রে ভাই…
পিয়ের গল্পটা অনেকদিন শুনেছে। কারাতায়েভ খুশিতে ডগমগ হয়ে তাকেই অন্তত ছয়বার গল্পটা শুনিয়েছে। কিন্তু ভালোভাবে জানা হলেও পিয়ের এমনভাবে গল্পটা শুনতে লাগল যেন এই নতুন শুনেছে, শুনতে শুনতে কারায়েভের শান্ত উচ্ছ্বাস যেন তার মধ্যেও সঞ্চারিত হল। জনৈক বুড়ো বণিককে নিয়েই গল্প। সপরিবারে সে সৎ ও ধর্মভীরু জীবন যাপন করত। একদা একজন ধনী বণিকের সঙ্গে সে গিয়েছিল নিঝনি মেলায়।
একটা সরাইখানায় উঠে রাতে দুইজনই শুতে গেল, সকালে দেখা গেল সঙ্গীটির সর্বস্ব লুঠ হয়েছে, আর গলাকাটা আস্থায় পড়ে আছে। একটা রক্তমাখা ছোরা পাওয়া গেল বণিকের বালিশের তলায়। তার বিচার হল, তাকে চাবুক মারা হল, তারপর দুই নাক ফুটো করে কঠোর শাস্তিভোগের জন্য সাইবেরিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হল।
তারপর, ভাইরে, এইভাবে দশটা বছর বা তারও বেশি সময় কেটে গেল। বুড়ো মানুষটা অনুগতভাবে কয়েদির জীবন যাপন করতে লাগল। কখনো কোনো অন্যায় করে না। শুধু মৃত্যুর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। একদিন আমাদের মতোই বুড়ো মানুষটাকে নিয়ে কয়েদিরা জমা হল। সকলেই যার যার শাস্তির কারণ ও ঈশ্বরের প্রতি পাপের কথা বলতে লাগল। একজন বলল সে একটি লোককে খুন করে এসেছে, আর একজন বলল দুটি, তৃতীয় জন ঘরে আগুন জ্বালিয়ে এসেছে, অপর একজন ছিল নেহাৎই ভবঘুরে। কোনো অন্যায় কাজ করেনি। এইভাবে তারা বুড়োকে শুধাল, তোমার কি জন্য শাস্তি হয়েছে বাবা?–সে বলল, আমি ভোগ করছি নিজের ও অপরের পাপের শাস্তি। কিন্তু আমি কাউকে খুন করিনি, যা আমার নয় তাতে কখনো হাত দেইনি, শুধু যারা আমার চাইতেও গরীব তাদের সাহায্য করেছি। প্রিয় ভাইসব, আমি ছিলাম একজন বণিক, বিষয়-সম্পত্তিও প্রচুর ছিল। তারপর সে পরপর সব কথা খুলে বলল। নিজের জন্য আমি দুঃখ করি না। মনে হয় ঈশ্বর আমাকে শুদ্ধ করেছেন। শুধু দুঃখ হয় আমার বুড়ি বৌটা আর ছেলেমেয়েদের জন্য। এই বলে বুড়ো কাঁদতে লাগল। ঘটনাচক্রে যে লোকটা অপর বণিকটিকে খুন করেছিল সেও ছিল সেই কয়েদিদের দলে। সে বলল, ঘটনাটা কোথায় ঘটেছিল বাবা? কখন, কোন মাসে সব কথা শুনবার পরে তার বুকটা টনটন করে উঠল। তখন সে বুড়ো লোকটির কাছে এইভাবে এসে তার পায়ের উপর পড়ল। বলল, আমার জন্যই তুমি মরতে চলেছ বাবা। সত্যি বলছি বাছারা, অকারণেই এই নির্দোষ লোকটি কষ্ট ভোগ কছে। সেকাজটা করেছিলাম আমি, আর আমিই তোমার ঘুমের মধ্যে তোমার মাথার নিচে ছুরিটা রেখে দিয়েছিলাম। খ্রিস্টের দোহাই, তুমি আমাকে ক্ষমা কর বাবা!
কারাতায়েভ থামল, স্মিত হেসে আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল, দুটো পা জুড়ে নিল।
আর বুড়ো মানুষটা বলল, ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করবেন, তার চোখে আমরা সকলেই পাপী। আমার নিজের পাপের ফলই আমি ভোগ করছি, এইবলে সে খুব কাঁদতে লাগল। আচ্ছা, তোমার কি মনে কর বন্ধুরা? কারাতায়েভ প্রশ্ন করল, উচ্ছ্বসিত হাসিতে তার মুখটা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন এখন সে যা বলল তার মধ্যেই রয়েছে এই গল্পের প্রধান আকর্ষণ ও পুরো অর্থ। তোমরা কি মনে কর প্রিয় বন্ধুরা? সেই খুনী কর্তৃপক্ষের কাছে দোষ স্বীকার করল। বলল, আমি ছজনের প্রাণ নিয়েছি, (লোকটা মহাপাপী) কিন্তু আমি সব চাইতে বেশি দুঃখিত এই বুড়ো মানুষটির জন্য। তাকে আর কষ্ট দেবেন না। এইভাবে সে নিজের দোষ স্বীকার করল, সব লিখে দেওয়া হল, যথাসময়ে কাগজপত্র পাঠানো হল। জায়গাটা অনেক দূরে, নানা প্রশ্ন নিয়ে বিচার-বিবেচনা চলতে লাগল, যথারীতি কাগজ ভরে গেল, এদিকে সময় পার হতে লাগল। সমস্ত ব্যাপারটা জারের কাছে গেল। কিছুদিন পরে জারের নির্দেশ এল : বণিককে মুক্তি দেওয়া হোক এবং ঘোষণানুযায়ী ক্ষতিপূরণও দেওয়া হোক। কাগজপত্র এলে তারা বুড়ো মানুষটিকে খুঁজতে লাগল। যে নির্দোষ বুড়ো মানুষটি অকারণে কষ্টভোগ করছিল সে কোথায়? জারের কাছ থেকে একখানা কাগজ এসেছে। তারা লোকটিকে খুঁজতে লাগল। এইখানে কারায়েভের নিচের চোয়ালটা কাঁপতে লাগল। কিন্তু ইতিমধ্যেই সে ঈশ্বরের ক্ষমা পেয়ে গেছে–লোকটি মারা গেছে। এই হল ব্যাপার! কথা শেষ করে কারাতায়েভ স্মিত হেসে নীরবে বহুক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে রইল।
আর পিয়েরের অন্তর অস্পষ্টভাবে কিন্ত আনন্দের সঙ্গে ভরে উঠল গল্পের জন্য নয়, তার রহস্যময় তাৎপর্যের জন্য : বলতে বলতে কারায়েভের মুখখানি যে উচ্ছ্বসিত আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এবং সেই আনন্দের যে অতীন্দ্রিয় তাৎপর্য আছে তাতেই ভরে উঠল তার অন্তর।
.
অধ্যায়–১৪
যার যার জায়গায়! হঠাৎ একটা উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
পাহারাদার সেনাদল ও বন্দিদের মধ্যে উত্তেজনার একটা মধুর অনুভূতি এবং আনন্দময় গম্ভীর কোনো কিছুর প্রত্যাশা দেখা দিল। চারদিক থেকে ভেসে এল সামরিক নির্দেশ, সুবেশধারী একদল অশ্বারোহী ভালো ঘোড়ায় চেপে বাঁ দিক থেকে এসে বন্দিদের পাশ দিয়ে চলে গেল। কর্তৃপক্ষ স্থানীয় লোকের আবির্ভাব আসন্ন হলে যে উৎকণ্ঠা জাগে তারই স্পষ্ট প্রকাশ সকলের মুখে। বন্দিরা এক জায়গায় ভিড় করল, তাদের রাস্তা থেকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হল। পাহারাদাররা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সম্রাট! সম্রাট! মার্শাল! ডিউক! ঝকঝকে অশ্বারোহী দলটি চলে যেতে না যেতেই ছটি ধূসর ঘোড়ায় টানা একটা গাড়ি সশব্দে চলে গেল। পিয়ের মুহূর্তের জন্য তিনকোণা টুপি মাথায় একটি লোককে দেখতে পেল, তার ফোলা ফোলা সুদর্শন শাদা মুখে প্রসন্ন দৃষ্টি। পিয়েরের দশাসই দর্শনীয় চেহারার উপর তার চোখ পড়ল, যেরকম ভ্রুকুটি করে লোকটি পিয়েরের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল তা দেখে তার মনে হল, লোকটির মনে তার প্রতি সহানুভূতি জাগলেও সে সহানুভূতিকে চেপে রাখতেই সে চায়।
ভাণ্ডারের ভারপ্রাপ্ত জেনারেল ভীত রক্তিম মুখে চর্মসার ঘোড়াটার পিঠে চাবুক কমতে কমতে গাড়ির পিছনে ছুটে গেল। সৈন্যরা কয়েকজন অফিসারের একটা দলকে ঘিরে দাঁড়াল। সকলের মুখেই উত্তেজনা ও দুশ্চিন্তার আভাস।
পিয়ের শুনতে পেল সকলেই জিজ্ঞাসা করছে, তিনি কি বললেন? তিনি কি বললেন?
মার্শাল যখন চলে গেল, আর বন্দিরা একত্রে ভিড় করল, তখন পিয়ের কারাতায়েভকে দেখতে পেল। সকাল থেকে তার দেখা মেলেনি। ছোট ওভারকোটটা পরে সে একটা বার্চ গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। গতকাল গল্প বলার সময় যে সানন্দ অনুভূতি ফুটে উঠেছিল তার মুখে, তা ছাড়াও একটা শান্ত গাম্ভীর্যের আভাস এখন সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে।
অশ্রুভরা সদয় গোল গোল দুটি চোখ মেলে কারাতায়েভ পিয়েরের দিকে তাকাল, সে যেন চাইছে পিয়ের তার কাছে যাক যাতে সে কিছু বলতে পারে। কিন্তু পিয়ের তখনো মনস্থির করতে পারেনি। সে এমন ভাব। দেখাল যেন কারায়েভের দৃষ্টি তার নজরে পড়েনি। তাড়াতাড়ি সে সেখান থেকে সরে গেল।
বন্দিরা এগিয়ে গেলে পিয়ের আবার ঘুরে তাকাল। কারাতায়েভ তখনো রাস্তার পাশে বার্চ গাছের নিচে বসে আছে, তার মাথার উপর ঝুঁকে দুটি ফরাসি সৈনিক কি যেন বলছে। পিয়ের আবার ফিরে তাকাল। খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল।
কারাতায়েভ যেখানে বসেছিল তার পিছন থেকে একটা গুলির শব্দ এল। পিয়ের সেটা পরিষ্কার শুনতে পেল, কিন্তু সেইমুহূর্তে তার মনে হল স্মোলেন পোঁছতে আর কয়টা ঘাটি বাকি আছে সে হিসেবটা এখনো শেষ করা হয়নি। আবার সে হিসাব করতে শুরু করল। দুটি ফরাসি সৈনিক তার পাশ দিয়ে চলে গেল, একজনের হাতে একটা ধূমায়মান বন্দুক নিচু করে ধরা। দুজনেরই মুখ বিবর্ণ। একজন ভীরু চোখে পিয়েরকে দেখছে। তাদের চোখে-মুখে ঠিক সেই ভাব যা পিয়ের দেখছিল মৃত্যুদণ্ড পাবার মুহূর্তে সেই তরুণ সৈনিকটির মুখে। তার দিকে তাকিয়ে পিয়েরের মনে পড়ে গেল যে দুদিন আগে এই লোকটিই আগুনে শুকোতে গিয়ে তার শার্টটা পুড়িয়ে ফেলেছিল এবং তার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল।
কারাতায়েভ যেখানে বসেছিল তার পিছনে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করছে। পিয়ের ভাবল, জানোয়ারটা কী বোকা! এরকম ঘেউ ঘেউ করছে কেন?
যেখানে গুলিটা ছোঁড়া হয়েছে এবং ককুরটা ডাকছে, পিয়েরের বন্ধু কয়েদি-সৈনিকরা কিন্তু পিয়েরের মতো সেদিকে মোটেই তাকাল না, কিন্তু তাদের সকলের দৃষ্টিই তখন কঠিন হয়ে উঠেছে।
.
অধ্যায়-১৫
ভাণ্ডার, বন্দি ও মার্শালের মালপত্রবাহী গাড়ি সবই শামশোভা গ্রামে থামল। সকলেই শিবির-আগুন ঘিরে বসে পড়ল। পিয়ের আগুনের কাছে গিয়ে খানিকটা ঝলসানো শূকর মাংস খেল, তারপর আগুনের দিকে পিঠ দিয়ে শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়ল। বরদিনোর যুদ্ধের পরে মোঝায়েস্কের মতোই এখানেও সে আবার ঘুম দিল।
আবারও সত্য ও কল্পনা একাকার হয়ে গেল, আবারও সে অন্য কেউ তার চিন্তাকে ভাষা দিল, হয় তো বা সেই একই চিন্তা যা ভাষা পেয়েছিল মোঝয়েকে তার স্বপ্নের ভিতর দিয়ে।
জীবনই সব। জীবনই ঈশ্বর। সবকিছু বদলায়, এগিয়ে চলে আর সেই এগিয়ে চলাই ঈশ্বর। যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণই আনন্দ আছে ঈশ্বর-চেতনার মধ্যে। জীবনকে ভালোবাসাই ঈশ্বরকে ভালোবাসা। যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে, নির্দোষ যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে এই জীবনকে ভালোবাসাই তো অন্য সবকিছু অপেক্ষা কঠিন ও পবিত্র।
কারাতায়েভ! পিয়েরের মনে পড়ে গেল।
হঠাৎ সে যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেল সেই দীর্ঘবিস্মৃত সদয় বৃদ্ধটিকে যে তাকে সুইজারল্যান্ডে ভূগোল শিখিয়েছিল। একটু সবুর কর, বলে বুড়ো মানুষটি তাকে একটা ভূ-গোলক দেখাল। এই ভূ গোলকটি জীবন্ত–কোনো নির্দিষ্ট আয়তনবিহীন একটি স্পন্দনশীল গোলক। অনেকগুলি বিন্দুকে পর পর চেপে তার পরিধি গড়ে তোলা হয়েছে, সেই বিন্দুগুলি পরিবর্তিত হয় ও স্থান পরিবর্তন করে, কখনো কয়েকটি মিলে একটি হয়ে যায়, আবার কখনো একটি ভেঙে অনেকগুলি হয়ে যায়। প্রতিটি বিন্দু ছড়িয়ে পড়ে যত বেশি সম্ভব স্থান দখল করতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঐ একই কাজ করতে গিয়ে অন্য বিন্দুগুলি সেটাকে চেপে ধরে, অনেক সময় সেটাকে ধ্বংস করে ফেলে, আবার অনেক সময় সেটার সঙ্গে মিশে যায়।
এই তো জীবন, বুড়ো শিক্ষক বলল।
পিয়ের ভাবল, কথাটা কত সরল ও পরিষ্কার। আগে কেন যে এটা বুঝিনি?
ঈশ্বর আছেন কেন্দ্রে, প্রতিটি বিন্দু এমনভাবে প্রসারিত হতে চায় যাতে তাঁকে যথাসম্ভব বেশি করে প্রতিবিম্বিত করা যায়। প্রতিটি বিন্দু বড় হয়, মিশে যায়, উপর থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়, অতলে তলিয়ে যায়, আবার ভেসে ওঠে। ঐ তো ওখানে, কারাতায়েত নিজেকে প্রসারিত করে অদৃশ্য হয়ে গেছে। বুঝতে পারছ বাবা? শিক্ষক বলল।
বুঝতে পারছ হে গাড়োল? কে যেন চিৎকার করে উঠল, পিয়েরের ঘুম ভেঙে গেল।
সে উঠে বসল। একটি ফরাসি এইমাত্র একজন রুশ সৈন্যকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আগুনের পাশে বসে পড়ে একটা শিকের সাহায্যে একটুকরো মাংস ঝলসাচ্ছে। তার আস্তিন গোটানো, পেশীবহুল লোমশ লাল হাতের বেঁটে আঙুল দিয়ে বেশ সুকৌশলে শিকটাকে ঘোরাচ্ছে। পোড়া কয়লার আভায় তার বাদামি বিষণ্ণ মুখ ও ভ্রুকুটিকুটিল ভুরু দুটো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
যে সৈন্যটি তার পিছনে দাঁড়িয়েছিল তার দিকে ফিরে বিড়বিড় করে বলল, ওর পক্ষে সবই সমান। ডাকাত কোথাকার! পালাও!
শিকটা ঘোরাতে ঘোরাতে সে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে পিয়েরের দিকে তাকাল। পিয়েরর মুখ ঘুরিয়ে অন্ধকারের দিকে চোখ ফেলল। ফরাসিটি যে রুশ সৈন্যটিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে সে আগুনের কাছে বসে হাত দিয়ে যেন কার গায়ে চাপড় মারছে। আরো ভালো করে পিয়ের নীল-ধূসর কুকুরটাকে চিনতে পারল, সৈন্যটির পাশে বসে সে লেজ নাড়ছে।
আহা, ও কি এসে গেছে। কিন্তু প্লাতন– বলতে গিয়েও সে কথাটা শেষ করতে পারল না।
সহসা একযোগে অনেক স্মৃতি কল্পনায় তার মনের মধ্যে ভিড় করে এলগাছের নিচে বসে প্লাতন যেভাবে তার দিকে তাকিয়েছিল, সেখান থেকে আসা যে গুলির শব্দ সে শুনেছিল, কুকুরটার ঘেউ-ঘেউ, তাকে পাশ কাটিয়ে ছুটে যাওয়া দুটি ফরাসি সৈনিকের অপরাধী মুখ, নিচে নামানো ধূমায়মান বন্দুক, এখানে কারায়েভের অনুপস্থিতিসে যেন প্রায় বুঝে ফেলেছে যে কারাতায়েভকে মেরে ফেরেছে, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, কেন তা সে জানে না, পিয়েরের মনে পড়ে গেল আর একটি গ্রীষ্ম-সন্ধ্যার স্মৃতি যেদিনটা সে তার কিয়েভের বাড়ির বারান্দায় একটি সুন্দরী পুলিশ মহিলার সঙ্গে কাটিয়েছিল। দিনের ঘটনাগুলিকে একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা না করে, অথবা তার থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না টেনে পিয়ের চোখ বুঝল, গ্রীষ্মকালীন পল্লীর একটা দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, তার সঙ্গে মিশল জলে নেমে স্নানের স্মৃতি, একটি স্পন্দনশীল ভূ গোলকের স্মৃতি, আর সঙ্গে সঙ্গে সে এমনভাবে ডুবে গেল যেন জলস্রোত এসে তার মাথার উপর দিয়ে বয়ে গেল।
সূর্যোদয়ের আগেই চিৎকার-চেঁচামেচি ও ঘন ঘন বন্দুকের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। ফরাসি সৈন্যরা ছুটে পালাচ্ছে।
তাদের একজন চেঁচিয়ে বলল, কসাকরা এসেছে! মুহূর্তকাল পরে একদল রুশ পিয়েরকে ঘিরে দাঁড়াল।
কি যে ঘটে যাচ্ছে অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে তা বুঝতেই পারল না। শুধু শুনতে পেল, চারদিকে তার বন্ধুরা আনন্দে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
কসাক ও হুজারদের জড়িয়ে ধরে বুড়ো সৈন্যরা কেবলই কাঁদছে আর বলছে, ভাইরা আমার প্রিয়জন আমার! আদরের মানিক আমার!
হুজার ও কসাকরা বন্দিদের চারপাশে ভিড় করে দাঁড়াল। কেউ তাদের পোশাক দিল, কেউ বুট দিল, কেউ বা দিল রুটি। তাদের মাঝখানে বসে পিয়েরও ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, একটা কথাও বলতে পারল না। প্রথম যে সৈনিকটি তার কাছে এগিয়ে এল তাকেই বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে চুমো খেতে লাগল।
বিধ্বস্ত বাড়িটার ফটকে দাঁড়িয়ে আছে দলখভ। নিরস্ত্র ফরাসিরা ভিড় করে চলে যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে। উত্তেজিত ফরাসিরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু দলখভের চোখের দিকে তাকিয়ে তারা চুপ করে গেল। বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আছে তার কসাক, বন্দিদের গুণছে, আর প্রতি একশো জন গোণা হয়ে গেলে খড়ি দিয়ে ফটকে একটা করে দাগ দিচ্ছে।
দলখভ কসাককে শুধাল, কতজন হল?
দ্বিতীয় শত হল, কসাক জবাব দিল।
দলখভ অনবরত বলছে, ফাইলেজ, ফাইলেজ! (এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও!) কথাটা সে ফরাসিদের কাছ থেকে শিখেছে। বন্দিদের চোখে চোখ পড়তেই তার দুচোখ একটা নিষ্ঠুর আলো ঝিলিক দিয়ে উঠছে।
বাগানে একটা গর্ত খোঁড়া হয়েছে। কসাকরা পেতয়া রশুভের মৃতদেহটা সেখানে বয়ে নিয়ে চলেছে। খালি মাথায়, বিষণ্ণ মুখে দেনিসভ চলেছে তাদের পিছনে পিছনে।
.
অধ্যায়-১৬
২৮ অক্টোবরের পরে প্রথম বরফ পড়তে আরম্ভ হলে ফরাসিদের পলায়ন আরো শোচনীয় আকার ধারণ করল। লোকগুলো বরফে জমে যেতে লাগল, অনেকে শিবির-আগুনে ঝলসেই মারা পড়ল। ওদিকে লোমের পোশাক পরা লোকদের নিয়ে গাড়ির পর গাড়ি চলতে লাগল। সম্রাট, রাজন্যবর্গ, ডিউকবৃন্দ যে যা চুরি করেছিল সব গেল সেইসব গাড়িতে, কিন্তু ফরাসি বাহিনীর পলায়ন ও ভাঙন আগের মতোই চলতে লাগল।
রক্ষীবাহিনীকে না ধরেই (গোটা যুদ্ধের সময় তারা লুটতরাজ ছাড়া আর কিছুই করেনি) ফরাসি বাহিনীর মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল তিয়াত্তর হাজার। মস্কো থেকে ভিয়াজমা যেতেই সে সৈন্যসংখ্যা কমে দাঁড়াল ছত্রিশ হাজার, যদিও যুদ্ধে মারা পড়েছে অনধিক পাঁচ হাজার মাত্র। এইভাবে শুরু করে পরবর্তীকালে সৈন্যসংখ্যা হ্রাসের হারটা গণিতিক নিয়মেই নির্ধারণ করা যেতে পারে। শীতের তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধি, পশ্চাদঅনুসরণ, পথের প্রতিবন্ধকতা, বা অন্য বিশেষ কারণগুলি ছাড়াই মস্কো থেকে ভিয়াজমা, ভিয়াজমা থেকে ঘোলেন, স্মোলেনস্ক থেকে বেরিজিনা এবং বেরিজিনা থেকে ভিলনা-সর্বস্তরে ফরাসি বাহিনী একই হারে মরে গেল, ধ্বংস হয়ে গেল। ভিয়াজমার পর থেকে ফরাসি বাহিনী তিন সারির পরিবর্তে এক সারিতে ভিড় করতে লাগল এবং শেষপর্যন্ত সেইভাবেই চলল। বের্থিয়ের তার অবস্থা বর্ণনা করতে সম্রাটকে এই রকম লিখল (এখন আমরা জেনেছি একটি সেনাবাহিনীর অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে একজন অধিনায়ক অফিসার সত্য থেকে কতদূরে সরে যেতে পারে) :
গত দু-তিন দিনের যাত্রাপথের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন সেনাদলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তাদের অবস্থা সম্পর্কে সম্রাটের কাছে একটা প্রতিবেদন পাঠানো আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করি। তারা প্রায় দলছুট হয়ে পড়েছে। সৈন্যদের এক-চতুর্থাংশও তাদের রেজিমেন্টের পতাকাতলে সমবেত আছে কি না সন্দেহ, বাকিরা যার যেদিকে খুশি চলেছে, নিয়ম-শৃঙ্খলার হাত এড়িয়ে খাদ্য-সম্প্রহের আশাতেই তারা ছুটছে। সাধারণভাবে তারা মনে করে যে স্নোলেনই একমাত্র স্থান যেখানে তাদের অবস্থার উন্নতি হবার আশা আছে। গত কয়েক দিনে দেখা গেছে, অনেক সৈন্য তাদের কার্তুজ ও অস্ত্রশস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, আপনার চূড়ান্ত পরিকল্পনা যাই হোক না কেন, ইয়োর ম্যাজেস্ট্রির সেবার স্বার্থেই এটা জরুরি যে গোটা বাহিনীকে মোলেনকে সমবেত করা হোক, এবং যেসব অশ্ববিহীন অশ্বারোহী সৈন্য, অপ্রয়োজনীয় মালপত্র ও গোলন্দাজ বাহিনীর মালপত্র এখন আর সৈন্যসংখ্যার সমানুপাতিক নয় সেইসব অকার্যকর বোঝার হাত থেকে সেনাবাহিনীকে মুক্ত করা হোক। সৈন্যরা ক্ষুধায় ও ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। নতুন করে খাদ্য সরবরাহ ও কয়েক দিনের বিশ্রাম তাদের দরকার। এই কয়দিনে রাস্তায় অথবা সাময়িক আস্তানায় অনেকে মারা গেছে। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে, ভয় হয় জরুরি প্রতিকারের ব্যবস্থা না হলে নতুন করে যুদ্ধ বাধলে সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না।
৯ নভেম্বর : স্মোলেনস্ক থেকে ত্রিশ ভার্স্ট দূরে।
স্খলিত পায়ে কোনোরকমে স্মোলেনস্কের স্বর্গরাজ্যে পৌঁছে খাদ্যের সন্ধানে বিফলমনোরথ হয়ে ফরাসিরা পরস্পরকে খুন করল, নিজেদের খাদ্য লুট করল, এবং সবকিছু লুট করা শেষ হবার পরে আরো দূরে পালিয়ে গেল।
কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কিছুই জানে না। প্রতিভাধর নেপোলিয়ন জানত আরো কম, কারণ তার কাছে কেউ কোনো নির্দেশ পাঠায়নি। তথাপি সে নিজে এবং তার আশপাশের লোকরা তাদের পুরনো অভ্যাসমতোই চলতে লাগল : হুকুম জারি করল, চিঠি লিখল, প্রতিবেদন পাঠাল, দৈনিক নির্দেশও ঘোষণা করল, একে অন্যকে Sire, mon, prince d Eckmul, roi de Naples ইত্যাদি বলে সম্বোধনও করল। কিন্তু এইসব হুকুম ও প্রতিবেদন শুধু কাগজেই রইল, তার কিছুই কার্যে পরিণত করা হল না, কারণ কার্যে পরিণত করা সম্ভব ছিল না। যদিও একে অন্যকে ম্যাজেস্ট্রি, হাইনেস, বা কাজিন বলে ডাকত, তবু তারা সকলেই জানত যে তারা অতি শোচনীয় জীব, অনেক অন্যায় তারা করেছে, আর এখন তার জন্য মাশুল গুণতে হচ্ছে। সেনাবাহিনীর প্রতি দরদ দেখাবার ভান করলেও আসলে প্রত্যেকেই ভাবছে শুধু নিজের কথা, ভাবছে কত শীঘ্র এখান থেকে পালিয়ে নিজেকে বাঁচাবে।
.
অধ্যায়-১৭
মস্কো থেকে নিয়েমেন ফিরবার পথে রুশ ও ফরাসি বাহিনীর গতিবিধি ছিল অনেকটা কানা রুশোর কানামাছি খেলারই মতো। সেই খেলায় দুজন খেলুড়ের চোখ বেঁধে দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে একজন মাঝে মাঝে একটা ছোট ঘন্টা বাজিয়ে নিজের অবস্থান জানিয়ে নেয়। প্রথমে সে ঘণ্টা বাজায় নির্ভয়ে, কিন্তু কোনো শক্ত কোণে আটকা পড়লে যথাসম্ভব নিঃশব্দে সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করে, আর প্রায়ই পালাতে গিয়ে সোজা প্রতিপক্ষের হাতের মধ্যে ধরা পড়ে যায়।
প্রথমে কালুগা রোড ধরে যাবার সময় নেপোলিয়নের সৈন্যরা সকলকে তাদের উপস্থিতি জানিয়েই চলতে লাগল, কিন্তু পরে মোলেনস্ক রোডে পৌঁছে তারা ঘণ্টার ঘুন্টিটা চেপে ধরে ছুটতে লাগল এবং পালাতে গিয়ে সোজা রুশদের খপ্পরে ধরা পড়ল।
একটা সেনাদল পালাচ্ছে, অপর সেনাদল তাদের পিছু নিয়েছে। স্মোলেনস্ক ছাড়িয়ে ফরাসিদের সামনে কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন পথ খোলা ছিল। সহজেই মনে করা যেতে পারে যে সেখানে চারদিন অবস্থানের সময় ফরাসি বাহিনী নিশ্চয় শত্রুপক্ষের উপস্থিতি জানতে পারত, আরো সুবিধাজনক কোনো ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে পারত, এবং নতুন কোনো পথের কথা ভাবতে পারত। কিন্তু চারদিন বিশ্রামের পরে কোনোরকম পরিকল্পনা বা কৌশল ছাড়াই তারা চিরাচরিত পথ ধরে ছুটতে আরম্ভ করল, বায়েও গেল না, ডাইনেও গেল না, সোজা এগিয়ে গেল ক্রাসনু ও ওর্শার ভিতর দিয়ে সব চাইতে খারাপ পুরোনো রাস্তাটা ধরে।
শত্রু সম্মুখ দিক থেকে আসবে না, আসবে পিছন থেকে–এই আশায় ফরাসিরা পালাবার পথে এত দূরে ছড়িয়ে পড়ল যে অনেক জায়গায় তাদের পরস্পরের দূরত্ব চব্বিশ ঘণ্টাকেও ছাড়িয়ে গেল। প্রথমে সম্রাট, পরে রাজন্যবর্গ, তারপরে ডিউকরা–তাদের সামনে সকলেই পালাচ্ছে। নীপার পেরিয়ে নেপোলিয়ন ডান দিকের রাস্তা ধরবে-সেটাই তার পক্ষে যুক্তিসঙ্গত কাজ হত–এই আশায় রুশ বাহিনী ডাইনে মোড় নিয়ে ক্রাসনুতে গিয়ে বড় রাস্তায় পড়ল। আর কানামাছি খেলার মতোই ফরাসিরা এসে আমাদের অগ্রবর্তী বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে পড়ল। অপ্রত্যাশিতভাবে শত্রুকে দেখতে পেয়ে ফরাসিরা হতভম্ব হয়ে গেল, আকস্মিক ভয়ে থমকে দাঁড়াল, কিন্তু তার পরেই পিছনের বন্ধুদের ফেলে রেখে নতুন করে পালাতে শুরু করল। তারপর তিনদিন ধরে ফরাসি বাহিনীর ভিন্ন ভিন্ন শাখা-প্রথমে মুরাতের দল, তারপর দাভুতের দল, এবং তারপর নে-র দল-সকলেই রুশ বাহিনীর মুঠোর মধ্যে পড়ে গেল। তারা পরস্পরকে ছেড়ে গেল, ভারি মালপত্র, কামান বন্দুক এবং অর্ধেক সৈন্য ফেলে রেখে ডান দিকে অর্ধবৃত্তাকারে রাতের অন্ধকারে রুশ বাহিনীর পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
সকলের শেষে এল নে, কারো পথে না পড়লেও সে স্মোলেনস্কের দেয়ালগুলো উড়িয়ে দিতে লাগল, কারণ ঐ দেয়ালের গায়ে ধাক্কা খেয়ে সে দেয়ালকেই শাস্তি দিতে চাইল। দশ হাজার সৈন্য ছিল নে-র অধীনে, কিন্তু ওর্শাতে সে নেপোলিয়নের কাছে পৌঁছল মাত্র এক হাজার সৈন্য নিয়ে, বাকি সব সৈন্য ও কামান-বন্দুক সে ফেলে এসেছে, একটা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাতের অন্ধকারে আত্মগোপন করে সে নিপার নদী পার হয়ে এসেছে।
ওর্শা থেকে ভিলনা রোড ধরে তারা আরো দূরে পালাতে লাগল, পশ্চাদ্ধাবনকারী সৈন্যদের সঙ্গে তখনো চলল তাদের কানামাছি খেলা। বেরিজিনাতে তারা আবার দলছুট হয়ে পড়ল, অনেকে নদীতে ডুবে মরল, অনেকে আত্মসমর্পণ করল, আর যারা নদী পার হতে পারল তারা পালিয়ে গেল আরো দূরে। তাদের সর্বাধিনায়ক লোমের কোট পরে স্নেজে চেপে একাই ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল, পিছনে রেখে গেল সঙ্গীসাথীদের। আরো যারা পারল তারাও চলে গেল, আর যারা পারল না তারা হয় আত্মসমর্পণ করল, নয় তো মরল।
.
অধ্যায়-১৮
এ অভিযান যেন ফরাসিদের পলায়নেরই বৃত্তান্ত, এতে তারা যেন যথাশক্তি আত্মহননেই মেতে উঠল। যেদিন তারা কালুগা রোড ধরল সেদিন থেকে তাদের নেতার সেনাবাহিনী থেকে পলায়নের দিন পর্যন্ত তাদের গতিবিধি ছিল একেবারেই অর্থহীন। সুতরাং লোকে একথা ভাবতে পারত, যে ইতিহাসকাররা মনে করে যে একটি মানুষের ইচ্ছাই জনতার কর্মধারাকে নিয়ন্ত্রিত করে তাদের পক্ষে এই সময়কার পশ্চাদপসরণের বাহিনীকে তাদের মতবাদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। কিন্তু না! এই অভিযান সম্পর্কে ইতিহাসকাররা পাহাড়প্রমাণ বই লিখেছে, আর সর্বত্রই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে নেপোলিয়নের সুব্যবস্থা, তার সমর-কৌশল, সৈন্যপরিচালনার সুষ্ঠু পরিকল্পনা, এবং তার মার্শালদের সামরিক প্রতিভার কথা।
একটি রসদ-সমৃদ্ধ অঞ্চলে যাবার রাস্তা খোলা ছিল, পরবর্তীকালে কুতুজভ যে রাস্তা বরাবর তার পশ্চাদ্ধাবন করেছিল সেই সমান্তরাল রাস্তাটাও ভোলা ছিল, তবু নেপোলিয়ন যে মালো-ইয়ারোস্লাভেৎস থেকে পশ্চাদপসরণের সময় অপ্রয়োজনে একটা বিধ্বস্ত রাস্তা ধরে পশ্চাদপসরণ করেছিল তার ব্যাখ্যাস্বরূপ আমাদের বলা হয়েছে যে গভীর বিচার-বিবেচনাই নাকি তার কারণ। তার সম্মালেনস্ক থেকে ওশা পর্যন্ত পশ্চাদপসরণের পক্ষেও সেই একই গভীর বিচার-বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। তারপর বর্ণনা করা হয়েছে ক্রাসনুতে তার বীরত্বের। বলা হয়েছে, সেখানে সে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত ছিল, ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেও রাজি ছিল, আর একটা বার্চের ডাল হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল :
সম্রাট হিসেবে আমি দীর্ঘকাল কাজ করেছি, এবার সেনাপতি হিসেবে কাজ করার সময় এসেছে।তথাপি অবশিষ্ট বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত সৈন্যদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে পরক্ষণেই আবার সে পালিয়ে গিয়েছিল।
তারপর আমাদের বলা হয়েছে মার্শালদের অন্তরের মহত্ত্বের কথা–বিশেষ করে নে-র কথা–আ সে মহত্ত্বের তো এই স্বরূপ, বাহিনী-পতাকা, কামান-বন্দুক ও নয়-দশমাংশ সৈন্যকে ফেলে রেখে রাতের অন্ধকারে বনের আড়াল দিয়ে নিপার নদী পার হয়ে সে ওর্শাতে পালিয়ে গিয়েছিল।
এবং সবশেষে, বীরত্বপূর্ণ সেনাদলের কাছ থেকে মহান সম্রাটের চূড়ান্ত যাত্রাকে ইতিহাসকাররা বর্ণনা করেছে একটি মহৎ ও প্রতিভার স্মারক রূপে। এমন কি যে চূড়ান্ত পলায়নকে সাধারণ ভাষায় নিচতার সর্বনিম্ন ধাপ বলে বর্ণনা করা হয়, যা নিয়ে প্রতিটি শিশুকেও লজ্জা পেতে শেখানো হয়, তাকেও ইতিহাসকারদের ভাষায় সমর্থন জানানো হয়েছে।
ঐতিহাসিক যুক্তির সুতোকে যখন আর টানা যায় না, কোনো কাজ যখন মানুষ যাকে সঠিক, এমন কি ন্যায় বলে মনে করে তার সম্পূর্ণ বিরোধী হয়, তখনই ইতিহাসকাররা মহত্ত্ব নামক একটি আত্মরক্ষাকারী ধারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে। মনে হয়, মহত্ত্ব বুঝি ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠির অতীত। মহাপুরুষের পক্ষে কিছুই অন্যায় নয়, এমন কোনো নৃশংসতা নেই যার জন্য একজন মহাপুরুষকে দোষী করা যায়।
গরম লোমের পোশাকে শরীর ঢেকে নেপোলিয়ন স্বদেশে পালিয়ে গেল, মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে গেল তাদের যারা শুধু তার সহকর্মী নয়, যাদের সে এখানে নিয়ে এসেছিল। সে ভাবল খুব ভালো কাজই করেছে, আর তাই ভেবে তার মনও শান্ত হল।
নেপোলিয়ন বলল, মহান থেকে হাস্যকরের ব্যবধান মাত্র একটি ধাপের। আর সারা বিশ্ব পঞ্চাশ বছর ধরে তারই পুনরাবৃত্তি করে গেল : মহান! মহিমময়! নেপোলিয়ন মহিমময়! মহান থেকে হাস্যকরের ব্যবধান মাত্র একটি ধাপের।
একথা কারো মনে হল না যে, ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডের বিচারে যে মহত্ত্ব তুল্যমূল্য নয় তাকে স্বীকার করার অর্থই নিজের অন্তঃসারশূন্যতা ও অপরিমেয় নিচতাকে স্বীকার করা।
আমার কাছে, যেহেতু খৃস্টের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি ভালো ও মন্দের মানদণ্ড, মানুষের কোনো কাজই বিচারের ঊর্ধ্বে নয়। যেখানে সরলতা, সাধুতা ও সত্য অনুপস্থিত, সেখানে কোনো মহত্ত্ব থাকতে পারে না।
.
অধ্যায়-১৯
১৮১২ সালের অভিযানের শেষাংশের বিবরণ পড়ে কোন রুশ অধিবাসীর মনে দুঃখ, অসন্তোষ ও বিহ্বলতার একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি জাগেনি? আমাদের তিন তিনটি বাহিনী যখন যথেষ্ট সংখ্যাধিক্য নিয়ে ফরাসিদের ঘিরে ধরেছিল, ক্ষুধার্ত ও শীতার্ত বিশৃঙ্খল ফরাসিরা যখন দলে দলে আত্মসমর্পণ করছিল, যখন (ইতিহাসকারদের বিবরণ মতে) রুশদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ফরাসিদের প্রতিরোধ করা, তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং সব্বাইকে গ্রেপ্তার করা,-তখন সব ফরাসিদের কেন গ্রেপ্তার বা ধ্বংস করা হয়নি, এ প্রশ্ন নিজের কাছে কে না করেছে।
এটা কি করে ঘটল যে, রুশ বাহিনী যখন সংখ্যায় ফরাসিদের তুলনায় দুর্বলতর ছিল তখন তারা বরদিনোতো লড়তে পারল, আর যখন তারা তিন দিক থেকে ফরাসিদের ঘিরে ফেলল, যখন তাদের গ্রেপ্তার করাই ছিল তাদের লক্ষ্য, তখন তারা সে উদ্দশ্যে সিদ্ধ করতে পারল না? ফরাসিরা কি আমাদের চাইতে এত বেশি উঁচুদরের যোদ্ধা যে অধিক সংখ্যক সৈন্য নিয়ে ঘিরে ফেলেও আমরা তাদের মারতে পারিনি? সেটা ঘটল কেমন করে?
এই সব প্রশ্নের উত্তরে ইতিহাস (অথবা ঐ নামে যাকে ডাকা হয়) বলে, এটা ঘটেছিল কারণ কুতুজভ এবং তর্মাস এবং চিচাগভ এবং অমুক লোক ও তমুক তোক অমুক-তমুক রণ-কৌশলকে কার্যে পরিণত করেনি…
কিন্তু কেন তারা তা করেনি? আর পূর্ব-ব্যবস্থা অনুযায়ী কোনো লক্ষ্যকে কার্যে পরিণত না করার অপরাধে যদি তারা অপরাধী হয়ে থাকে, তাহলে কেন তাদের বিচার হল না, শাস্তি হল না? কিন্তু একথা যদি স্বীকার করেও নেওয়া যায় যে কুতুজভ, চিচাগভ ও অন্যরাই রুশ ব্যর্থতার কারণ তাহলেও তো এটা দুর্বোধ্যই থেকে যায় যে ক্রাসনু ও বেরিজিনাতে (দু জায়গাতেই আমাদের সৈন্যসংখ্যা বেশি ছিল) রুশ বাহিনী সুবিধাজনক অবস্থাতে থেকেও কেন রুশদের লক্ষ্য অনুযায়ী মার্শালগণ, রাজন্যবর্গ ও সম্রাটসহ গোটা ফরাসি বাহিনীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
কুতুজভ আক্রমণের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল এই কথা বলে রুশ সামরিক ইতিহাসকাররা এই অদ্ভুত ঘটনার যে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে সেটাও ভিত্তিহীন, কারণ আমরা জানি ভিয়াজমায় এবং তারুতিনোতে কুতুজভ সেনাদলকে আক্রমণ থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
যে রুশ বাহিনী অনেক কম শক্তি নিয়ে বরদিনোতে পূর্ণ শক্তিতে শক্তিমান শত্রুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে পারল, কেন তারা ক্রাস ও বেরিজিনাতে অধিকতর শক্তিশালী পক্ষ হওয়া সত্ত্বেও বিশৃঙখল ফরাসিদের হাতে মার খেল?
শত্রুপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করে নেপোলিয়ন ও তার মার্শালদের গ্রেপ্তার করাই যদি রুশদের লক্ষ্য ছিল-সে লক্ষ্য যে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, সে উদ্দেশ্য সাধনের প্রতিটি চেষ্টা অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে প্রতিহত হয়েছে–তাহলে তো অভিযানের এই শেষ পর্যায়কে ফরাসিরা যে তাদের জয়ের পর জয় বলে মনে করে সেটাই ঠিক, আর রুশ ইতিহাসকাররা যে সেটাকে আমাদের জয় বলে মনে করে সেটাই সম্পূর্ণ ভুল।
রুশ সামরিক ইতিহাসকাররা যদি যুক্তির দাবি মেনে চলে তাহলে তাদের স্বীকার করতেই হবে যে রুশ বাহিনীর শৌর্য, দেশসেবা প্রভৃতি সম্পর্কে যত উচ্ছ্বসিত কাব্য তারা রচনা করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে মস্কো থেকে ফরাসিদের পশ্চাদপসরণ নেপোলিয়নের জয়ের পর জয় এবং কুতুজভের পরাজয়ের পর পরাজয়েরই স্বাক্ষর বহন করে।
কিন্তু জাতীয় গর্ববোধের ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রেখেও যে কোনো মানুষেরই মনে হবে যে এধরনের সিদ্ধান্ত স্ববিরোধী, কারণ ফরাসিদের উপর্যুপরি জয় তাদের এনে দিয়েছিল পরিপূর্ণ ধ্বংস, আর রুশদের উপযুপরি পরাজয়ের ফল হল শত্রুপক্ষের সার্বিক বিনষ্টি এবং তাদের দেশের মুক্তি।
এই স্ববিরোধের উৎস খুঁজতে হবে একটিমাত্র ঘটনার মধ্যে : ইতিহাসকাররা সম্রাট ও জেনারেলদের চিঠিপত্র, স্মৃতিকথা, প্রতিবেদন, প্রকল্প ইত্যাদি থেকে তাদের রচনার উপাদান সংগ্রহ করতে গিয়ে ১৮১২ সালের অভিযানের শেষ পর্যায়ে এমন একটি লক্ষ্যের কথা বলেছে–অর্থাৎ মার্শালবর্গ ও সেনাবাহিনীসহ নেপোলিয়নকে ছিন্নভিন্ন করে গ্রেপ্তার করা–কোনোকালেই যার কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
এরকম কোনো লক্ষ্য কখনো ছিল না বা থাকতে পারে না, কারণ সেটা একান্তই অর্থহীন এবং তাকে কার্যে পরিণত করা একেবারেই অসম্ভব।
সেটা যে অর্থহীন তার প্রথম কারণ, নেপোলিয়নের ছত্রভঙ্গ বাহিনী তখন যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে রাশিয়া থেকে পালাচ্ছিল, আর প্রতিটি রুশ তখন সেটাই চাইছিল। কাজেই ফরাসিরা যখন প্রাণপণ শক্তিতে পালিয়েই যাচ্ছে তখন অকারণ যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রয়োজনটা কোথায়?
দ্বিতীয়, যে সৈন্যরা পালিয়ে যেতেই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে তাদের পথ আটকে দেবার তো কোনোই অর্থ হয় না।
তৃতীয়, যে ফরাসি বাহিনী বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজেকে নিজেই এমনভাবে ধ্বংস করে চলছিল যেপথে কোনোরকম বাধার সম্মুখীন না হয়েও মূল বাহিনীর একশো ভাগের এক ভাগের বেশি সৈন্য নিয়েও সীমান্ত পার হতে পারেনি, তাকে ধ্বংস করার জন্য নিজেদের সৈন্য নষ্ট করা হত একান্তই অর্থহীন।
চতুর্থ, সম্রাট, রাজন্যবর্গ এবং ডিউকবৃন্দকে গ্রেপ্তারের বাসনাটাই অর্থহীন হত,তাদের গ্রেপ্তার করা হলে সেটা যে রুশদের পক্ষে খুবই বেশিরকমের হতবুদ্ধিকর হত সেকথা তো সেসময়কার সবচাইতে নিপুণ কূটনীতিবিদরাই (জোসেফ দ্য মেইস্তার প্রভৃতিরা) স্বীকার করেছে। ফরাসি সৈন্যদের গ্রেপ্তার করার বাসনা আরো বেশি অর্থহীন হত, কারণ ক্ৰাসনুতে পৌঁছবার আগেই আমাদের সৈন্যসংখ্যা কমতে কমতে অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছিল, যখন আমাদের নিজেদের সৈন্যরাই পুরো রেশন পাচ্ছিল না, আর যাদের ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারাই ক্ষুধায় মরতে বসেছে, সেই পরিস্থিতিতে একটা গোটা সৈন্যদলকে বন্দি করে পাহারা দিয়ে নিতে যেতে একটা গোটা ডিভিশন সৈন্যেরই দরকার হয়ে পড়ত।
নেপোলিয়ন ও তার বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে গ্রেপ্তার করার গুরুগম্ভীর পরিকল্পনাগুলি সেই বাজার-মালির পরিকল্পনারই মতো যে বাগানে ঢুকে গাছের চারা মাড়িয়ে দেওয়ার জন্য গরুটাকে তাড়িয়ে দিতে ফটক পর্যন্ত ছুটে গিয়ে তার মাথায়ই মারল লাঠির ঘা। তার স্বপক্ষে একটিমাত্র কথাই বলা যায় যে সে খুব রেগে গিয়েছিল। কিন্তু এইসব প্রকল্প যারা রচনা করেছিল তাদের স্বপক্ষে একথাও বলা যাবে না, কারণ ফুলের কেয়ারি মাড়িয়ে দেবার ফলে তাদের অন্তত কোনো ক্ষতি হয়নি।
নেপোলিয়নকে তার সেনাদল থেকে বিচ্ছিন্ন করা যে অর্থহীন তাই শুধু নয়, সেটা অসম্ভবও বটে।
সেটা যে অসম্ভব তার প্রথম কারণ, অভিজ্ঞতা থেকেই জানা যায় যে রণক্ষেত্রে তিন মাইল দীর্ঘ সেনা সমাবেশ কখনো পরিকল্পনামাফিক চলতে পারে না, চিচাগভ, কুতুজভ ও উইগেনস্তিন যথাসময়ে একটা নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হবে–তার সম্ভাবনা এতই সুদূর যে সেটা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়েই পড়ে। বস্তুত, পরিকল্পনাটা হাতে পেয়ে কুতুজভ তো বলেইছিল যে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত কোনো পরিকল্পনা বাঞ্ছিত ফল এনে দিতে পারে না।
দ্বিতীয়, সেটা অসম্ভব এই কারণে যে, যে দুর্বার গতিতে নেপোলিয়নের সৈন্যরা পালাচ্ছিল তাকে স্তব্ধ করে দিতে হলে রুশদের তৎকালীন সৈন্যশক্তি অপেক্ষা আরো বহুগুণ সৈন্যের প্রয়োজন হত।
তৃতীয়, সেটা অসম্ভব এই কারণে যে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া এই সামরিক কথাটাই অর্থহীন। একটুকরো রুটিকে কেটে বিচ্ছিন্ন করা যায়, কিন্তু একটা সেনাদলকে তা করা যায় না। একটা সেনাদলকে বিচ্ছিন্ন করা-তার পথ আটকে দেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব, কারণ গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলবার প্রচুর পথ সব সময়ই ভোলা থাকে, তাছাড়া আছে রাতে যখন কিছুই চোখে দেখা যায় না, সমর-বিজ্ঞানীরা তো ক্ৰাসনু ও বেরিজিনার দৃষ্টান্ত থেকেই সেটা ভালোভাবে বুঝতে পারে। যারা বন্দি হতে চায় একমাত্র তাদেরই বন্দি করা যায়, যেমন যে পাখি হাতে এসে বসে তাকেই শুধু ধরা সম্ভব। সৈন্যরা যখন জার্মানদের মতো রণ-কৌশল হিসেবে আত্মসমর্পণ করে একমাত্র তখনই তাদের বন্দি করা যায়। কিন্তু ফরাসি সৈন্যরা সে কৌশলকে গ্রহণীয় বলে মনে করেনি, কারণ কি পলায়নে কি বন্দি জীবনে ক্ষুধায় এবং শীতে মৃত্যু তাদের অনিবার্য নিয়তি।
চতুর্থ এবং প্রধান কথা, সেটা অসম্ভব এই কারণে যে, জগতের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ১৮১২ সালের মতো ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে কখনো কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি, ফরাসিদের পশ্চাদ্ধাবন করতে রুশ বাহিনীকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হয়েছে, তার বেশি কিছু করতে গেলে সে নিজের ধ্বংসকেই ডেকে আনত।
তারুতিনো থেকে ক্রাসনু যাবার পথে রুশ বাহিনী রুগ্ন অথবা দলছুট হিসেবে পঞ্চাশ হাজার সৈন্যকে হারাল, অর্থাৎ সংখ্যাটা যে কোনো একটা বড় প্রাদেশিক শহরের জনসংখ্যার সমান। অর্ধেক সৈন্য মারা পড়ল বিনা যুদ্ধে।
অভিযানের এইরকম একটা পর্যায়ে–যখন সৈন্যদের ছিল না বুট, ছিল না ভেড়ার চামড়ার কোট, ছিল যথেষ্ট খাদ্য, ভদকা তো একেবারেই ছিল না, পনেরো ডিগ্রি তুষারপাতের মধ্যে মাসের পর মাস রাত কাটিয়েছে বাইরে তাঁবু খাঁটিয়ে, যখন দিনের আলো থাকত মাত্র সাত কি আট ঘণ্টা, আর বাকি রাতটাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা ছিল অসম্ভব, যখন কেবলমাত্র যুদ্ধের কয়েক ঘন্টা নয়, মাসের পর মাস সৈন্যদের এমন একটা মৃত্যুপুরীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যেখানে শৃঙখলা ভেঙে পড়তে বাধ্য, যখন প্রতিটি মুহূর্তে তারা যুদ্ধ করেছে ক্ষুধা ও শীতের আক্রমণে মৃত্যুর বিরুদ্ধে, যখন মাত্র একটি মাসে অর্ধেক সৈন্য ধ্বংস হয়ে গেল–অভিযানের সেই পর্যায় সম্পর্কে ইতিহাসকাররা আমাদের শোনালেন মিলোরদভিচের কোন পথে কোথায় সৈন্য পরিচালনা করা উচিত ছিল, তর্মাসভের কোন নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়া উচিত ছিল, হাঁটু পর্যন্ত বরফের ভিতর নিয়ে নদী পেরিয়ে চিচাগভের যাওয়া উচিত ছিল অন্য কোনখানে, এবং যেন তেন প্রকারেণ ফরাসি বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করা ও পরাস্ত করা উচিত ছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি।
অর্ধেক সৈন্য মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেও জাতির যোগ্য লক্ষ্য পূরণে যা কিছু করা সম্ভব এবং যা কিছু করা উচিত রুশ সৈন্যরা সেসবই করেছে, রাশিয়ার অন্য একদল মানুষ বৈঠকখানায় আরামে বসে তাদের অসম্ভব কিছু করতে বলেছে বলেই রুশ সৈন্যদের কোনোরকম দোষ দেওয়া উচিত নয়।
প্রকৃত সত্য ও ঐতিহাসিক বিবরণের মধ্যে বিচিত্র স্ববিরোধকে আজ বোঝা শক্ত তার কারণই হল, ইতিহাসকাররা লিখেছে সুন্দর সুন্দর কথা দিয়ে বিভিন্ন জেনারেলের মনোভাবের ইতিহাস, প্রকৃত ঘটনার ইতিহাস নয়।
তাদের আগ্রহ মিলোরাদভিচের কথায়, আর অমুক বা তমুক জেনারেল যেসব পুরস্কার পেয়েছে, তার প্রতি, কিন্তু যে পঞ্চাশ হাজার মানুষ হাসপাতালে অথবা কবরের নিচে পড়ে রইল তাদের কথা সেই ইতিহাসকারদের মনকে টানেনি, কারণ সেটা তাদের অনুসন্ধানের আওতার মধ্যে পড়ে না।
অথচ কেউ যদি প্রতিবেদন ও সাধারণ পরিকল্পনাগুলি বাতিল করে দিয়ে যে লাখ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে সেইসব ঘটনায় অংশ নিয়েছিল তাদের কথা আলোচনা করে তাহলেই যেসব সমস্যাকে সমাধানের অতীত বলে মনে হয়েছে সে সবকিছুরই অত্যন্ত সহজ ও সরল সমাধানের সূত্র সে সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে যাবে।
নেপোলিয়ন ও তার সেনাদলকে বিচ্ছিন্ন করার চিন্তা এক ডজন মানুষের কল্পনায় ছাড়া আর কোথাও কোনোকালে ছিল না। থাকতে পারে না, কারণ সে চিন্তাই অর্থহীন ও অবাস্তব।
জনসাধারণের মনে ছিল একটি লক্ষ্য : দেশকে আক্রমণের হাত থেকে মুক্ত করা। প্রথমত, ফরাসিরা যখন নিজে থেকেই পালাতে শুরু করল তখনই সে লক্ষ্য সিদ্ধ হয়ে গেল, কাজেই তাদের পলায়ন না থামানোটাই তখন একমাত্র কাজ। দ্বিতীয়ত, যে গেরিলাযুদ্ধে ফরাসিরা ধ্বংস হচ্ছিল তাতেই সে লক্ষ্য সিদ্ধ হয়েছে, তৃতীয়ত, রুশ বাহিনীর একটা বড় অংশ তখন ফরাসিদের পিছনে ধাওয়া করে চলেছে, তারা থামলেই সবশক্তি নিয়ে ফরাসিদের আক্রমণ করতে তারা প্রস্তুতই ছিল।
রুশ বাহিনীকে তখন কাজ করতে হয়েছিল ধাবমান জন্তুর পিঠে চাবুকের মতো। আর অভিজ্ঞ কোয়ানমাত্রই জানে যে ধাবমান জন্তুটার মাথায় চাবুকের ঘা বসানোর চাইতে ভয়-দেখানো ভঙ্গিতে চাবুকটাকে উদ্যত রাখাটাই শ্রেয়তর।