অধ্যায়-১৬
রস্তভদের জামাই বের্গ এর মধ্যেই কর্নেল হয়েছে; ভলাদিমির ও আন্না সম্মান-পদক ঝুলিয়েছে; এখনো দ্বিতীয় বাহিনীর প্রথম ডিভিশনের সহকারী কমান্ডারের প্রধান কর্মচারীর সহকারীর নির্ঝঞ্ঝাট ও সুখের চাকরিতেই কাজ করে চলেছে।
১লা সেপ্টেম্বর সে সেনাদল থেকে মস্কো এসেছে।
মস্কোতে তার কোনো কাজ ছিল না; কিন্তু যখন দেখল যে সকলেই ছুটি নিয়ে কোনো না কোনো কাজে মস্কো যাচ্ছে, তখন সেও পারিবারিক ও গৃহস্থালির কারণে ছুটি চাওয়াটা দরকার বোধ করল।
কোনো রাজপুত্রের মতো সুদৃশ্য দুটো ঘোড়ায় টানা নিজের ফিটফাট ছোট গাড়িটা হাঁকিয়ে বের্গ শ্বশুরবাড়ি এসে হাজির হল। উঠোনের গাড়িগুলোকে ভালো করে দেখতে দেখতে বারান্দায় পৌঁছে একখানা পরিস্কার রুমাল পকেট থেকে বের করে তাতে একটা গিট দিল।
বাইরের ঘর থেকে অধৈর্য হয়ে পা ফেলে বৈঠকখানায় ঢুকে সে কাউন্টকে আলিঙ্গন করল, নাতাশা ও সোনিয়ার হাতে চুমো খেল এবং তাড়াতাড়ি মামণির স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞাসা করল।
কাউন্ট বলল, যা দিনকাল পড়েছে তার মধ্যে আবার স্বাস্থ্য? এবার তোমার খবর বল। সেনাদল কি পশ্চাদপসরণ করবে, না কি আর একটা যুদ্ধ হবে?
বের্গ বলল, আমাদের পিতৃভূমির কপালে যে কি আছে তা একমাত্র সর্বশক্তিমান ঈশ্বরই জানেন বাপি। সেনাদল তো বীরত্বে টগবগ করছে, আর নেতারা সমর-পরিষদের বৈঠকে বসেছেন। কি যে হবে তা কেউ জানে না। কিন্তু মোটামুটিভাবে আপনাকে বলতে পারি বাপি, রুশ বাহিনী যে বীরত্বের মনোভাব, যে প্রাচীনকালের শৌর্যবীর্যের স্বাক্ষর রেখেছে ২৬ তারিখের যুদ্ধে কোনো ভাষায় তার বর্ণনা করা যায় না। আপনাকে বলছি বাপি (একজন জেনারেলের নকল করে বের্গ নিজের বুকে করাঘাত করল, যদিও সেটা করা উচিত ছিল রুশ বাহিনী কথাটা বলার সময়), খোলাখুলিই বলছি যে আমরা সেনাপতিরা প্রায় কিছুই করিনি, বরং তাদের প্রাচীনকালের শৌর্য প্রদর্শনের বেলায় বাধা দিতে পর্যন্ত পারিনি। আপনাকে নিশ্চয় করে বলতে পারি, সেনাদলের সম্মুখে থেকে জেনারেল বার্কলে দ্য তলি সর্বত্রই নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছেন। আমাদের সেনাদলের ঘাটি ছিল একটা পাহাড়ের পাশে। ভাবতে পারেন!
সেই দিনগুলিতে শোনা যেসব কাহিনী তার মনে ছিল বের্গ সে সবগুলিই একে একে বলে গেল। নাতাশা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সে একটু বিচলিত বোধ করল।
একটু হেসে বলতে লাগল, সবকিছু মিলিয়ে রুশ যযাদ্ধারা যে বীরত্ব দেখিয়েছে তা যেমন কল্পনাতীত, তেমনই বর্ণনাতীত! রাশিয়া আজ মস্কোতে নেই, তার আসন পাতা রয়েছে তার বীর পুত্রদের অন্তরে! তাই নয় কি বাপি?
ঠিক সেইসময় কাউন্টেস ঘরে ঢুকল; তার চোখে-মুখে ক্লান্তি ও বিরক্তির ছাপ। বের্গ লাফিয়ে উঠে কাউন্টেসের হাতে চুমো খেল, তার স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নিল, মাথা নেড়ে সহানুভূতি প্রকাশ করে তার পাশেই দাঁড়িয়ে রইল।
সত্যি বলছি মামণি, রাশিয়ার প্রতিটি মানুষের পক্ষে আজ বড়ই দুর্দিন, বড়ই কষ্টের দিন। কিন্তু আপনি এত উৎকণ্ঠিত হচ্ছেন কেন? এখান থেকে যাবার মতো অনেক সময় হাতে পাবেন…
স্বামীর দিকে ঘুরে কাউন্টেস বলল, চাকরবাকরগুলো যে কি করছে বুঝি না। এইমাত্র বলল, এখনো কিছু তৈরি হয়নি। দেখাশুনা করবার মতো একজন লোক তো চাই। এ সময় মিতেংকা থাকলে কত ভালো হত। কাজ যেন আর শেষ হতে চাইছে না।
কাউন্ট কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল। চেয়ার ছেড়ে দরোজার দিকে এগিয়ে গেল।
ঠিক সেইমুহূর্তে সম্ভবত নাকটা ঝাড়বার জন্যই বের্গ রুমালটা বের করল। গিটটা চোখে পড়তেই অর্থপূর্ণভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে কি যেন ভাবল।
বলল, আপনার কাছে একটা অনুগ্রহ ভিক্ষা করছি বাপি।
হুম… বলে কাউন্ট থেমে গেল।
বের্গ হেসে বলল, এইমাত্র ইউসুপভ-এর বাড়ির পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম, এমন সময় আমার পরিচিত একটি নায়েব ছুটে এসে জানতে চাইল, আমি কিছু জিনিস কিনব কি না। কৌতূহলবশত ভিতরে ঢুকে দেখলাম একটা ছোট সুন্দর কাবার্ড ও একটা ড্রেসিং-টেবিল। আপনি তো জানেন ভেরার ওরকম একটা কাবার্ডের খুব শখ, আর এই নিয়ে আমরা কত ঝগড়া পর্যন্ত করেছি। আর জিনিসটা কী সুন্দর। একটা চোরা ইংলিশ টানা পর্যন্ত আছে! ভেরা অনেক দিন থেকে এরকম একটা জিনিস চাইছে। কি জানেন, আমি ওকে বেশ অবাক করে দিতে চাই। আপনার উঠোনে তো অনেক গাড়ি দেখলাম। ওর একটা আমাকে দিন, লোকটিকে ভালো টাকাই দেব, আর…
কাউন্ট ভুরু কুঁচকে কাশল।
কাউন্টেসকে বল, আমি কোনো হুকুম দেই না।
বের্গ বলল, অসুবিধা হলে থাক; শুধু ভেরার জন্যই জিনিসটা নিতে চেয়েছিলাম।
আঃ, উচ্ছন্নে যাও, তোমরা সবাই উচ্ছন্নে যাও!… বুড়ো কাউন্ট চেঁচিয়ে উঠল। আমার মাথার ভিতরটা ঘুরছে।
কাউন্ট ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কাউন্টেস কাঁদতে শুরু করল।
সত্যি মামণি! বড়ই দুর্দিন। বের্গ বলল।
বাবার সঙ্গে সঙ্গে নাতাশাও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল; তারপর কি করবে বুঝতে না পেরে প্রথমে তাকে অনুসরণ করে পরে ছুটে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।
পেতয়া ছিল বারান্দায়; যেসব চাকর মস্কো ছেড়ে চলে যাচ্ছে সে তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দিচ্ছে। বোঝাই গাড়িগুলো তখনো উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। একটার দড়িগুলো খুলে ফেলা হয়েছে, আর আর্দালির সহায়তায় একজন অফিসার সেই গাড়িটা বেয়ে উঠছে।
পেতয়া নাতাশাকে শুধাল, ব্যাপার কি বল তো?
নাতাশা বুঝল, বাবা-মা কি নিয়ে ঝগড়া করছে সেটাই সে জানতে চাইছে। কোনো কথা বলল না।
পেতয়াই বলল, বাপি সবগুলো গাড়িই আহতদের জন্য দিতে চাইছে। আর তাই নিয়েই ঝগড়া। ভাসিলিচ আমাকে বলেছে। আমি মনে করি…।
নাতাশা হঠাৎ রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, আমি মনে করি এটা এত ভয়ংকর, এত ঘৃণ্য, এত…কি বলব জানি না। আমরা কি জঘন্য জার্মান?
চাপা কান্নার আবেগে তার গলা আটকে গেল; পাছে রাগটা ধরা পড়ে যায় তাই সে মুখ ঘুরিয়ে ছুটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল।
কাউন্টেসের পাশে বসে বের্গ তাকে পরমাত্মীয়ের মতো সান্ত্বনা দিচ্ছে। কাউন্ট পাইপ হাতে নিয়ে ঘরময় পায়চারি করছে। এমন সময় ক্রোধে মুখটা বিকৃত করে নাতাশা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে দ্রুতপায়ে মার দিকে এগিয়ে গেল।
আর্তকণ্ঠে বলল, এ তো ভয়ংকর! এ তো ঘৃণ্য! এরকম হুকুম তুমি দিতে পার না।
ভীত, বিব্রত চোখে বের্গ ও কাউন্টেস তার দিকে তাকাল। জানালায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাউন্ট কান পাতল।
নাতাশা চেঁচিয়ে বলল, মামণি, এ অসম্ভব; উঠোনে কী হচ্ছে নিজে গিয়ে দেখে এস! তাদের ফেলে রেখে যাওয়া হবে!…
তোমার হল কি? কাদের কথা বলছ? কী চাও তুমি?
কেন, আহত লোকগুলো! এ তো অসম্ভব মামণি! এ তো দানবীয় কাজ।…না, লক্ষ্মী মামণি, এ হতে পারে না। আমাকে ক্ষমা কর লক্ষ্মী মামণি…কিছু বাড়তি জিনিস সঙ্গে গেল কিনা তাতে কি যায় আসে?…একবার শুধু দেখে এস উঠোনে কি হচ্ছে…মামণি!…এ অসম্ভব!…
মুখ না ফিরিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়েই কাউন্ট সব শুনছে। হঠাৎ নাক ঝেড়ে সে মুখটা জানালার আরো কাছে সরিয়ে নিল। কাউন্টেস মেয়ের দিকে তাকাল, মুখটা মায়ের জন্য লজ্জায় আনত, ক্রোধে উচ্ছ্বসিত; স্বামী কেন যে মুখ না ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাও বুঝতে পারল; বিব্রত চোখে চারদিকে তাকাল।
কিন্তু হাল না ছেড়েই বলল, আঃ তোমাদের যা খুশি কর! আমি কি কাউকে বাধা দিচ্ছি?
মামণি, লক্ষ্মীটি, আমাকে ক্ষমা কর।
কিন্তু কাউন্টেস মেয়েকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে স্বামীর দিকে এগিয়ে গেল।
ওগো, যা ভালো মনে কর তাই বলে দাও…তুমি তো জান এসব আমি ঠিক বুঝি না, চোখ নিচু করে কাউন্টেস বলল।
ডিমরা…ডিমরা এখন মুরগিদের শেখাচ্ছে…কাউন্ট বিড়বিড় করে বলল; খুশিতে তার চোখে জল এসে গেছে; সে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল। আর স্ত্রীও সলজ্জ দৃষ্টি লুকোবার জন্য তার বুকে মাথা রাখল।
বাপি! মামণি! আমি কি ওদিকটা দেখব? কি বল? নাতাশা শুধাল, এখনো দরকারি জিনিসপত্র প্রায় সবই আমরা সঙ্গে নিতে পারব।
কাউন্ট সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল, আর নাতাশা হরিণীর মতো চকিত চরণে নাচঘর ও বাইরের ঘর পেরিয়ে সোজা উঠোনে নেমে গেল।
চাকরবাকররা নাতাশাকে ঘিরে ধরল, কিন্তু তার অদ্ভুত হুকুম বিশ্বাসই করতে পারল না। শেষপর্যন্ত কাউন্ট নিজে এসে স্ত্রীর নামে ঘোষণা করে দিল যে সবগুলি গাড়ি আহতদের জন্য ছেড়ে দিতে হবে, আর ট্রাংকগুলোকে ভাড়ার ঘরে ফিরিয়ে নিতে হবে।
যেন এই কাজটি আরো আগে না করার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবেই বাড়ির সবগুলো মানুষই একযোগে আহতদের গাড়িতে তুলে দেবার নতুন কর্তব্যটি পালন করতে সাগ্রহে এগিয়ে গেল। আহতরা নিজেদের টানতে টানতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিবর্ণ অথচ খুশিমুখে গাড়ির চারদিকে জড় হতে লাগল। গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে এই খবর ছড়িয়ে পড়ায় আশপাশের বাড়ি থেকেও আহতরা বেরিয়ে এসে রস্তভদের উঠোনে জমা হতে লাগল। অনেকে বলল, মালপত্র নামাবার দরকার নেই, তারা সেগুলির উপরে বসেই যেতে পারবে। কিন্তু মাল নামাবার কাজ একবার শুরু হয়ে যাওয়ায় আর থামানো গেল না।
নায়েব বলল, আমরা আরো চারজনকে নিতে পারি। তারা আমার গাড়িতেই যাবে, নইলে তাদের দশা কি হবে?
কাউন্টেস বলল, আমার পোশাকের গাড়িটা ওদের দিয়ে দাও। দুনিয়াশা আমার সঙ্গে বড় গাড়িতেই যেতে পারবে।
পোশাকের গাড়িটাকে খালি করে দুই দরোজা পরের বাড়ির সামনে সেটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল সেখানকার আহতদের তুলে নিতে। চাকরসমেত গোটা বাড়িটাই খুশিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। নাতাশার মন এত বেশি খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে যে তেমনটি অনেকদিন হয়নি।
একটা ট্রাংককে গাড়ির পিছনের পাদানিতে বসিয়ে দেবার চেষ্টায় চাকররা বলল, এটাকে কিসের সঙ্গে বাঁধব? অন্তত একটা গাড়ি রেখে দিতেই হবে।
এতে কি আছে? নাতাশা শুধাল।
কাউন্টের বইপত্র।
ছেড়ে দাও, ভাসিলিচ ওটা তুলে রাখবে। ওটার দরকার নেই।
ফিটনটা যাত্রীতে ভর্তি হয়ে গেছে; কাউন্ট পিতর বসবার জায়গা পাবে কিনা সন্দেহ।
নাতাশা চেঁচিয়ে বলল, বক্সের উপরে। তুমি বক্সের উপর বসবে পেতয়া, পারবে না?
সোনিয়াও সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত, কিন্তু তার কাজের লক্ষ্য নাতাশার চাইতে আলাদা। যেসব জিনিস ফেলে যাওয়া হচ্ছে সেগুলি গুছিয়ে রেখে কাউন্টেসের নির্দেশমতো সে তার একটা ফর্দ তৈরি করেছে; যথাসম্ভব বেশি জিনিস সঙ্গে নিতেই সে চেষ্টা করছে।
.
অধ্যায়-১৭
বিকেল দুটোর আগেই রস্তভদের চারখানা গাড়ি পুরো ভর্তি হয়ে সামনের দরোজায় এসে দাঁড়াল। একটার পর একটা গাড়ি আহতদের নিয়ে উঠোন থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল।
যে কালেচ-গাড়িতে প্রিন্স আন্দ্রুকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা সামনের বারান্দার পাশ দিয়ে যাবার সময় সোনিয়ার নজর সেদিকে গেল। ফটকে দাঁড়ানো মস্ত বড় উঁচু গাড়িটাতে সোনিয়া তখন একটি দাসীকে নিয়ে কাউন্টেসের জন্য একটা আসন পাতার আয়োজন করছিল।
গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে সে জিজ্ঞাসা করল, ওটা কার কালে?
দাসী জবাব দিল, সে কি, আপনি জানেন না মিস? উনিই তো আহত প্রিন্স; আমাদের বাড়িতেই রাত কাটিয়েছেন, আর আমাদের সঙ্গেই যাচ্ছেন।
কিন্তু তিনি কে? তার নাম কি?
তিনিই তো আমাদের প্রিন্স বলকনস্কি স্বয়ং। একটা নিঃশ্বাস ফেলে দাসী বলল, সকলে বলছে তিনি মারা যাবেন।
গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে সোনিয়া ছুটে কাউন্টেসের কাছে গেল। শাল ও ওড়না পরে যাত্রার জন্য তৈরি হয়ে ক্লান্ত দেহে কাউন্টেস ঘরের মধ্যেই পায়চারি করছে। যাত্রার আগে সকলে বন্ধ ঘরের মধ্যে সমবেত হয়ে নীরবে একবার প্রার্থনা করবে–এটাই রীতি। কাউন্টেস সেইজন্যই অপেক্ষা করছে। নাতাশা ঘরে নেই।
সোনিয়া বলল, মামণি, মারাত্মক আহত হয়ে প্রিন্স আন্দ্রু এখানেই আছেন। তিনি আমাদের সঙ্গেই যাচ্ছেন।
কাউন্টেস হতাশ ভঙ্গিতে তাকাল; সোনিয়ার হাতটা চেপে ধরে চারদিক দেখল।
নাতাশা? সে অস্ফুট স্বরে বলল।
এইমুহূর্তে তাদের কাছে এই সংবাদের একটিই মাত্র তাৎপর্য। নাতাশাকে তারা চেনে; এ খবর তার কানে গেলে যে কি ঘটবে সেই ভয়েই এই লোকটির প্রতি তাদের দুজনের সহানুভূতিতেই ভাটা পড়ল।
সোনিয়া বলল, নাতাশা এখনো জানে না, কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গেই যাচ্ছেন।
তুমি বলছ সে মরতে বসেছে?
সোনিয়া মাথা নাড়ল।
সোনিয়াকে জড়িয়ে ধরে কাউন্টেস কেঁদে উঠল।
ভাবল, ঈশ্বর যে কখন কি করেন তা আমাদের বুদ্ধির অগোচর। সর্বশক্তিমানের অদৃশ্য হাত ক্রমেই যেন ঘটনাবলীর ভিতর দিয়ে প্রত্যক্ষগোচর হয়ে উঠছে।
উত্তেজিত মুখে ঘরে ঢুকে নাতাশা শুধাল, আচ্ছা মামণি, সবই তো প্রস্তুত। ব্যাপার কি?
কাউন্টেস বলল, কিছু না তো। সব প্রস্তুত হয়ে থাকলে এবার আমরা যাত্রা করি।
নিজের মুখের উত্তেজনা লুকোবার জন্য কাউন্টেস ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে দিল। সোনিয়া নাতাশাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল।
নাতাশা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।
ব্যাপার কি? কি হয়েছে?
কিছু না…না…
সহজ বুদ্ধিতে একটা কিছু আঁচ করে নাতাশা বলল, আমার পক্ষে খুব খারাপ কিছু কি? সেটা কি?
সোনিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, কোনো জবাব দিল না। কাউন্ট, পেতয়া, মাদাম শোস, মাভা কুজমিনিচনা ও ভাসিলিচ বৈঠকখানায় ঢুকে দরোজাগুলো বন্ধ করে দিল। তারপর সকলে বসে পড়ে কিছুক্ষণ নীরবে কাটাল; কেউ কারো দিকে তাকাল না।
প্রথমে উঠে দাঁড়াল কাউন্ট; দেবমূর্তির সামনে শ-চিহ্ন এঁকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অন্য সকলেও তাই করল। তারপর কাউন্ট মাভ্রা কুজমিনিচনা ও ভাসিলিচকে আলিঙ্গন করল; তারা দুজন মস্কোতেই থেকে যাচ্ছে। তারা যখন তার হাত ধরে কাঁধে চুমো খেল কাউন্ট তখন আলতোভাবে তাদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে কিছু সান্ত্বনা। ও স্নেহের বাণী শোনাল। ভজনালয়ে ঢুকে কাউন্টেস দেখল দেয়ালে ঝোলানো একটি দেবমূর্তির সামনে সোনিয়া নতজানু হয়ে বসে আছে।
পেতয়া যেসব লোকদের তরবারি ও ছুরি দিয়েছিল তারা উঁচু বুটের মধ্যে ট্রাউজার খুঁজে দিয়ে, কোমরবন্ধগুলো শক্ত করে এঁটে যারা এখানেই থেকে যাচ্ছে তাদের কাছ থেকে একে একে বিদায় নিতে শুরু করেছে।
কোথাও যাবার আগে যেমন হয়ে থাকে, অনেককিছুই ভুল হয়েছে বা ভুল জায়গায় রাখা হয়েছে; কাউন্টেসকে গাড়িতে তুলে দেবার জন্য দুটি চাকর গাড়ির পাদানির দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে; আর দাসীরা ছুটাছুটি করে টুকিটাকি জিনিস নিয়ে একবার গাড়ি, কালেচ ও ফিটনের দিকে ছুটে আসছে, আবার বাড়ির ভিতরে যাচ্ছে।
কাউন্টেস বলল, ওরা সবসময় সবকিছু ভুলে যাবে। তুমি কি জান না যে এভাবে আমি বসতে পারি না?
দুনিয়াশা কোনো কথা না বলে দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষুব্ধ মুখে গাড়ির মধ্যে ঢুকে আসনটাকে নতুন করে পাততে লাগল।
মাথা নেড়ে কাউন্ট বলল, আঃ, চাকরগুলোও হয়েছে বটে!
বুড়ো কোচয়ান এফিম বক্সে সোজা হয়ে বসে আছে; চারদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে একবার তাকিয়েও দেখছে না। কাউন্টেস একমাত্র তাকেই ভরসা করে নিজের গাড়িটা চালাতে দেয়। ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতায় সে জানে যে ঈশ্বরের নাম নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দাও! এ হুকুম আসতে এখনো দেরি আছে; সে জানে, হুকুম হবার পরেও আরো দু একবার গাড়ি থামাতে হবে, ভুল করে ফেলে-আসা কিছু জিনিসপত্র আনতে আবার তারা বাড়ির ভিতর ঢুকবে এবং তারপরেও আবার তাকে থামিয়ে কাউন্টেস জানালা দিয়ে মুখ বের করে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে পাহাড় থেকে নামবার সময় তাকে খুব সতর্কভাবে গাড়ি চালাতে বলবে। এসবই তার জানা; তাই ঘোড়াগুলোর চাইতেও বেশি ধৈর্যের সঙ্গে সে অপেক্ষা করতে লাগল। শেষপর্যন্ত সকলে উঠে বসল, গাড়ির সিঁড়িগুলো ভাজ করে তুলে দেওয়া হল, দরোজা বন্ধ করা হল, একজনকে পাঠানো হল একটা বক্স আনতে, আর কাউন্টেস মাথা বের করে যা বলার ছিল তাই বলল। এফিম ইচ্ছা করেই টুপিটা তুলে কুশ চিহ্ন আঁকতে লাগল। সহিস ও অন্য চাকররাও তাই করল। টুপিটা মাথায় বসিয়ে এফিম বলল, ঈশ্বরের নাম নিয়ে যাত্রা কর। শুরু কর! ঘোড়াগুলো নড়ে উঠল, গাড়ির চাকায় শব্দ হল, গাড়িটা দুলে উঠল। সহিস চলতি গাড়িতে লাফিয়ে উঠল; একটা ঝাঁকুনি খেয়ে উঠোন পেরিয়ে গাড়িটা অসমান রাস্তায় পড়ল; অন্য গাড়িগুলো দুলতে দুলতে পিছু নিল; গাড়ির একটা শোভাযাত্রা পথ ধরে এগিয়ে চলল। বাড়ির উল্টো দিকের গির্জার পাশ দিয়ে যাবার সময় গাড়ি, কালেচ ও ফিটনের সব যাত্রীরাই ক্রুশ-চিহ্ন আঁকল। যারা মস্কোতেই থেকে গেল। তারা যাত্রীদের বিদায় জানাতে গাড়িগুলোর দুই পাশে হাঁটতে লাগল।
কাউন্টেসের পাশে বসে পরিত্যক্ত, বিক্ষুব্ধ মস্কোর অপসৃয়মান দেয়ালগুলির দিকে তাকিয়ে নাতাশার মনে আনন্দের যে অনুভূতি জাগল এর আগে সেরকম অনুভূতি তার জীবনে কদাচিৎ এসেছে। মাঝে মাঝে গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একবার পিছনে তাকাচ্ছে, একবার সামনে সারিবদ্ধ আহতদের দিকে তাকাচ্ছে। সেই সারির একেবারে সামনে আছে প্রিন্স আন্দ্রুর দুই-তালা কালেচ-গাড়িটা। সে গাড়ির মধ্যে কে আছে তা সে জানে না, কিন্তু যতবার সারির দিকে তাকাচ্ছে ততবারই ওই কালেচটা তার চোখে পড়ছে। সে জানে যে গাড়িটা তার সামনেই আছে।
কুদ্রিনোতে অনুরূপ আরো কয়েকটি গাড়ির শোভযাত্রা এল নিকিৎস্কি, প্রেমিয়া ও পদনভিনস্ক স্ট্রিট থেকে। সদভায়া স্ট্রিট ধরে এগোবার সময় সবগুলো যাত্রী-গাড়ি ও মালগাড়ি দুটো সারি বেঁধে পাশাপাশি এগিয়ে চলল।
সুখারেভ জলের গম্বুজটা ঘুরে যাবার সময় নাতাশা হঠাৎ সানন্দ বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল : আরে! মামনি, সোনিয়া, দেখ, তিনি যাচ্ছেন!
কে? কে?
দেখ! হ্যাঁ, সত্যি বলছি, ঐ তো বেজুখভ! কোচয়ানের লম্বা কোট পরিহিত একটি দীর্ঘকায় লোককে দেখিয়ে নাতাশা বলল। লোকটির চালচলন দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ছদ্মবেশে চলেছে। সঙ্গে ফ্রীজ-কোট পরা একটি ফ্যাকাসে-মুখ, দাড়িবিহীন বুড়ো লোক।
নাতাশা বলল, হ্যাঁ, ঠিক বেজুখভ; কোচয়ানের কোট গায়ে, সঙ্গে একটি অদ্ভুত-দর্শন বুড়ো। সত্যি, তাকিয়ে দেখ!
না, সে নয়। কী বাজে বকছ?
নাতাশা চেঁচিয়ে বলল, মামণি, আমার মাথাটা বাজি, নির্ঘাত! সে! আমি নিশ্চিত বলতে পারি। থাম, থাম! সে কোচয়ানকে লক্ষ্য করে বলল।
কিন্তু কোচয়ান থামতে পারল না, কারণ মেশচানস্কি স্ট্রিট থেকে আরো অনেক গাড়ি এসে পড়ল, আর তারা সকলেই রস্তভদের রাস্তা আটকে না থেকে এগিয়ে যেতে বলল।
যদিও এখন লোকটি আরো দূরে চলে গেছে তবু রস্তভরা সকলেই পিয়েরকে-বা হুবহু তার মতো দেখতে একটি লোককে-দেখতে পেল; একটা কোচয়ানের কোট গায়ে চড়িয়ে মাথাটা নিচু করে গম্ভীর মুখে হেঁটে চলেছে; পাশে একটি ছোটখাট দাড়িহীন বুড়ো মানুষ; দেখে মনে হয় পরিচারক। বুড়ো লোকটি খেয়াল করল যে গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে কে যেন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে; সশ্রদ্ধভাবে পিয়েরের কনুই ছুঁয়ে তাকে কি যেন বলে গাড়িটা দেখাল। পিয়ের চিন্তায় ডুবে ছিল, প্রথমে তার কথা বুঝতে পারল না। পরে বুড়োর নির্দেশমতো গাড়িটার দিকে তাকিয়ে নাতাশাকে চিনকে পারল এবং প্রথম আবেগের টানেই দ্রুতপায়ে গাড়িটার দিকে এগিয়ে এল। কিন্তু ডজনখানেক পা ফেলার পরেই কিছু মনে পড়ায় থেমে গেল।
নাতাশার মুখটা রহস্যময় মমতায় জ্বলজ্বল করতে লাগল।
পিয়েরের দিকে হাত বাড়িয়ে সে চেঁচিয়ে বলল, পিতর কিরিলভিচ, এখানে আসুন! আমরা তাকে চিনতে পেরেছি! কী আশ্চর্য!…আপনি এখানে কি করছেন? আপনার এরকম চেহারা হয়েছে কেন?
চলমান গাড়ি থেকেই নাতাশা হাত বাড়িয়ে দিল। গাড়ির পাশে হাঁটতে হাঁটতেই সে হাতটায় চুমো খেল।
বিস্মিত ও সহানুভূতিপূর্ণ সুরে কাউন্টেস বলল, ব্যাপার কি কাউন্ট?
কি? কি? কেন? এসব প্রশ্ন করবেন না, বলে পিয়ের নাতাশার দিকে মুখ ফেরাল; তার আনন্দে রক্তিম মুখখানি দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেল।
আপনি তাহলে মস্কোতেই আছেন?
পিয়ের ইতস্তত করল।
মস্কোতে? হ্যাঁ, মস্কোতে। বিদায়!
নাতাশা বলে উঠল, হায়, আমি যদি পুরুষমানুষ হতাম! তাহলে ঠিক ওঁর সঙ্গে থেকে যেতাম। কী চমৎকার! মামণি, যদি রাজি হও তো আমি থেকে যাই।
নাতাশার দিকে তাকিয়ে পিয়ের কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কাউন্টেস তাকে বাধা দিল।
শুনেছি, আপনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, গিয়েছিলাম, পিয়ের জবাব দিল। কাল আর একটা যুদ্ধ হবে… নাতাশা তাকে বাধা দিল।
কিন্তু আপনার কি হয়েছে কাউন্ট? আপনি যে একেবারেই বদলে গেছেন।…
আঃ, কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না, কিচ্ছু না! আমি নিজেই জানি না। কাল…কিন্তু না! বিদায়, বিদায়!…বড়ই খারাপ সময় চলেছে! সে ফুটপাতে পা বাড়িয়ে দিল।
নাতাশা অনেকক্ষণ জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রইল; একটা রহস্যময় খুশির হাসিতে তার মুখটা ঝলমলিয়ে উঠল।
.
অধ্যায়-১৮
বাড়ি ছেড়ে আসার পর থেকে শেষের দুটো দিন পিয়ের তার উপকারী মৃত বাজদিভের খালি বাড়িতেই বাস করছে। ব্যাপারটা এইভাবে ঘটেছে।
মস্কোতে ফিরে আসার পরে এবং কাউন্ট রস্তপচিনের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন কিছুক্ষণ সে বুঝতেই পারল না সে কোথায় আছে এবং তাকে কি করতে হবে। যখন তাকে জানানো হল যে অভ্যর্থনা-ঘরে যারা তার জন্য অপেক্ষা করছে তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে একটি ফরাসি ভদ্রলোক, আর সে তার স্ত্রী কাউন্টেস হেলেনের কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে এসেছে, তখন সহসা একটা বিশৃঙ্খলা ও হতাশার ভাব তাকে একেবারে পেয়ে বসল। তার মনে হল, সব শেষ হয়ে গেছে, সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, কেউ ঠিক নয় বা কেউ ভুল নয়, ভবিষ্যতের কোনো আশা নেই, আর এ পরিস্থিতির হাত থেকেও পরিত্রাণ নেই। অস্বাভাবিকভাবে হেসে বিড়বিড় করে কি যেন বলল, প্রথমে হতাশ হয়ে একটা সোফায় বসে পড়ল, তারপর উঠে অভ্যর্থনা-ঘরের দরোজার কাছে গিয়ে একটা ফোকড়ের ভিতর দিয়ে উঁকি দিল, এবং দুই হাত ঘোরাতে ঘোরাতে এসে একটা বই তুলে নিল। বড় নায়েব দ্বিতীয়বার ঘরে ঢুকে বলল, যে ফরাসি লোকটি কাউন্টেসের চিঠি নিয়ে এসেছে সে একমিনিটের জন্য হলেও একবার দেখা করতে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, আর বাজদিতের বিধবা পত্নীর কাছ থেকে আগত একজন জানাচ্ছে, যেহেতু বিধবাটি গ্রামে ফিরে যাচ্ছে তাই পিয়ের যেন তার স্বামীর বইগুলোর ভার বুঝে নেয়।
পিয়ের বলল, ও, হ্যাঁ, একমিনিট সবুর কর…না, থাক।…গিয়ে বল, আমি এখনই যাচ্ছি।
কিন্তু লোকটি বেরিয়ে যেতেই পিয়ের টেবিল থেকে টুপিটা নিয়ে অন্য দরোজা দিয়ে পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দায় কেউ ছিল না। গোটা বারান্দাটা পেরিয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত চলে গেল এবং ভুরু কুঁচকে দুই হাতে কপালটা ঘষে প্রথম চাতাল পর্যন্ত নেমে গেল। হলের দারোয়ান সামনের দরোজাতেই দাঁড়িয়েছিল। পিয়ের যে চাতালে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে একটা দ্বিতীয় সিঁড়ি নেমে গেছে পিছনের ফটকে। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে সে উঠোনে চলে গেল। কেউ তাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু সেখানে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল; পিয়ের ফটকের বাইরে পা দিতেই কোচয়ান ও দারোয়ান তাকে দেখে টুপি তুলল। পিয়ের যখন বুঝতে পারল যে সে ধরা পড়ে গেছে তখন সে উটপাখির মতো ব্যবহার করে বসল : উটপাখি যেমন অন্যের নজর এড়াতে ঝোঁপের মধ্যে মাথা গুঁজে দেয়, পিয়েরও তেমনি মাথাটা নুইয়ে দ্রুত পা ফেলে রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল।
সেদিন যেসব কাজ পিয়েরের হাতে ছিল তার মধ্যে জোসেফ বাজদিভের বই ও কাগজপত্রের সুরাহা করাটাই তার কাছে সবচাইতে দরকারি বলে মনে হল।
একটা গাড়ি ভাড়া করে চালককে বলল প্যাট্রিয়ার্কস পন্তে যেতে; বাজদিভের বিধবা পত্নী সেখানেই থাকে।
বোঝাই গাড়িগুলো সারি বেঁধে চারদিক থেকে অনবরত মস্কো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে দৃশ্য দেখতে দেখতে আর জোড়াতালি-মারা পুরনো গাড়ি থেকে তার মোটা শরীরটা যাতে ছিটকে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রেখে পিয়ের স্কুল-পালানো ছেলের মতো খুশির মেজাজে চালকের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।
লোকটি বলল, ক্রেমলিনে আজ সব্বাইকে অস্ত্র দেওয়া হচ্ছে, কাল প্রত্যেককে পাঠিয়ে দেওয়া হবে তিনপাহাড় ফটকের ওপারে, সেখানে একটা প্রচণ্ড লড়াই হবে।
প্যাট্রিয়াকর্স পন্তে পৌঁছে পিয়ের বাজদিভের বাড়িটা খুঁজে নিল। অনেকদিন এখানে আসা হয়নি। ফটকের দিকে এগিয়ে গেল। ঢোকার শব্দে গেরাসিম বেরিয়ে এল। পাঁচ বছর আগে তঝকে এক ফ্যাকাসে দাড়িহীন বুড়ো লোকটাকেই সে জোসেফ বাজদিভের সঙ্গে দেখেছিল।
বাড়ি আছেন? পিয়ের শুধাল।
যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তার ফলে সোফিয়া দানিলভনা বাচ্চাদের নিয়ে তঝক জমিদারিতে চলে গেছেন ইয়োর এক্সেলেন্সি।
আমাকে ভিতরে যেতেই হবে, বইগুলো একবার দেখতে চাই, পিয়ের বলল।
দয়া করে ভিতরে আসুন। আমার স্বর্গত মনিবের ভাই মকার আলেক্সিভিচ এখানেই আছেন, কিন্তু আপনি তো জানেন তার অবস্থাও খুব দুর্বল, বুড়ো চাকরটি বলল।
পিয়ের জানে জোসেফ বাজদিভের আধাপাগল ভাই মকার আলেক্সিভিচ একটি পাঁড় মাতাল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি। ভিতরে চল… বলে পিয়ের বাড়ির ভিতরে ঢুকল।
একটি লাল নাক, টাক মাথা, লম্বা বুড়ো লোক বাইরে ঘরে দাঁড়িয়েছিল। তার পরনে ড্রেসিং-গাউন, পায়ে উঁচু রবারের জুতো। পিয়েরকে দেখে রাগে বিড়বিড় করতে করতে সে বারান্দা ধরে চলে গেল।
গেরাসিম বলল, একসময় খুব চালাক-চতুর লোক ছিলেন, কিন্তু ইয়োর অনার তো দেখতেই পাচ্ছেন যে এখন বড়ই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আপনি কি পড়ার ঘরে যাবেন? পিয়ের মাথা নাড়ল। ঘরটা যেমন সিল মারা ছিল তেমনই আছে। সোফিয়া দানিলভনা বলে গেছেন, আপনার কাছ থেকে কেউ এলে তাকে যেন বইগুলো দিয়ে দেই।
উপকারীর জীবদ্দশায় এই বিষণ্ণ পড়ার ঘরটাতে দুরুদুরু বুকে পিয়ের অনেকবার ঢুকেছে। জোসেফ বাজদিভের মৃত্যুর পরে কারো হাত না পড়ায় ধুলোময়লাতে ঘরটা আরো বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।
একটা জানালা খুলে দিয়ে গেরাসিম পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিয়ের চারদিক ঘুরে দেখল, যে কাবার্ডে হাতে-লেখা পুঁথিগুলি থাকে সেদিকে গেল এবং যে গ্রন্থগুলি একদিন ছিল সংঘের পবিত্রতম বস্তু সেগুলি বের করে নিল। ধূলি-মলিন লেখার টেবিলে বসে পাণ্ডুলিপিগুলি সামনে মেলে ধরল, আবার বন্ধ করল, একপাশে সরিয়ে রাখল, তারপর দুই হাতের মধ্যে মাথাটা রেখে ধ্যানে ডুবে গেল।
গেরাসিম বারকয়েক সতর্কভাবে ঘরে এল; প্রত্যেকবারই পিয়েরকে সেই একই ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখল।
দু ঘণ্টার বেশি পার হয়ে গেল। পিয়েরের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য গেরাসিম সাহস করে দরোজার কাছে একটু শব্দ করল; কিন্তু পিয়ের তা শুনতে পেল না।
কোয়ানকে কি ছেড়ে দেব ইয়োর অনার?
ওঃ, হ্যাঁ! ধ্যান ভেঙে তৃরিতে উঠে পিয়ের বলল। তারপর গেরাসিমের কোটের একটা বোম ধরে অশ্রুভেজা, রহস্যময় চোখে বুড়ো লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বলছি কি, কাল যে একটা যুদ্ধ হবে তা কি তুমি জান?
সেইরকমই শুনেছি, লোকটি জবাব দিল।
আমার অনুরোধ, আমি কে সেকথা কাউকে বল না, আর আমি যা বলছি তাই কর।
গেরাসিম বলল, ঠিক আছে ইয়োর এক্সেলেন্সি। আপনি কিছু খাবেন কি?
না, কিন্তু একটা জিনিস আমি চাই। পরিষ্কার জামা-কাপড় আর একটা পিস্তল, অপ্রত্যাশিতভাবেই মুখটা লাল করে পিয়ের বলল।
একমুহূর্ত ভেবে গেরাসিম বলল, তাই হবে ইয়োর এক্সেলেন্সি।
সারাটাদিন পিয়ের একাকি সেই পড়ার ঘরেই কাটাল। গেরাসিম শুনতে পেল সে অস্থিরভাবে ঘরময় পায়চারি করছে আর আপন মনেই কথা বলছে।
সেই ঘরের বিছানাতেই রাতটাও কাটাল।
এ বাড়িতে অনেক বিচিত্র ঘটনা ঘটতে গেরাসিম দেখেছে; তাই পিয়ের এ বাড়িতে থাকাতেও সে বিস্মিত হল না, বরং একজন লোক পেয়ে খুশিই হল। সেদিন সন্ধ্যায়ই বিনা প্রশ্নে সে পিয়েরের জন্য একটা কোচয়ানের কোট ও টুপি এনে দিল এবং কথা দিল যে পিস্তলটা পরের দিন যোগাড় করে দেবে। সন্ধ্যাবেলা মকার আলেক্সিভিচ তার উঁচু রবারের জুতো পরে দরোজা পর্যন্ত এসে করুণ চোখে পিয়েরের দিকে তাকাল। কিন্তু পিয়ের তার দিকে চোখ ফেরাতেই ড্রেসিং-গাউনে শরীরটা ঢেকে লাজুক অথচ ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। গেরাসিমের এনে দেওয়া কোটটাকে উত্তাপের সাহায্যে জীবাণুমুক্ত করে সেটাকে গায়ে চাপিয়ে পিয়ের যখন বুড়োকে সঙ্গে নিয়ে সুখারেভ মার্কেটে যাচ্ছিল পিস্তল কিনতে তখনই তার সঙ্গে রস্তভদের দেখা হয়ে যায়।
.
অধ্যায়-১৯
মস্কোর ভিতর দিয়ে রিয়াজান রোডে পশ্চাদপসরণের কুতুজভের হুকুমনামাটা জারি করা হল ১লা সেপ্টেম্বর রাতে।
প্রথম সেনাদল সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রা করল; সারারাত কোনোরকম তাড়াহুড়া না করে তারা ধীরেসুস্থে পিছিয়ে চলল। অবশ্য ভোরবেলা দরগমিলভ সেতুর নিকটবর্তী শহরের কাছে পৌঁছে তারা দেখতে পেল, তাদের সামনে দলে দলে সৈন্য ভিড় করে সেতু পার হচ্ছে, বিপরীত দিক থেকে উঠে রাজপথ ও গলি আটকে দিচ্ছে, আবার পিছন দিক থেকে অসংখ্য সৈন্য অকারণ তাড়াহুড়ায় ও আতঙ্কে তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। তারা সেতুর দিকে, সেতুর উপরে এবং নানা খড়ি ও নৌকোর দিকে ছুটে যাচ্ছে। স্বয়ং কুতুজভ ঘুরপথে গাড়ি হকিয়ে মস্কোর অপরদিকে পৌঁছে গেছে।
২রা সেপ্টেম্বর সকাল নাগাদ বাহিনীর একমাত্র পিছনের অংশটাই রয়ে গেল দরগমিলভের উপকণ্ঠস্থ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। মূল বাহিনী তখন মস্কোর অপর দিকে অথবা মস্কো ছাড়িয়ে চলে গেছে।
ঠিক সেইসময় ২রা সেপ্টেম্বর সকাল দশটায় পকলোনি পাহাড়ের উপর সৈন্যপরিবৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে সম্মুখে প্রসারিত প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছে। ২৬শে আগস্ট থেকে ২রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, অর্থাৎ বরদিনোর যুদ্ধ থেকে ফরাসি বাহিনীর মস্কোতে প্রবেশ পর্যন্ত একটা উত্তেজনাপূর্ণ স্মরণীয় সপ্তাহ ধরে দেখা দিয়েছে সেই অপ্রত্যাশিত হেমন্তের আবহাওয়া যা হঠাৎ এসে সকলকে অবাক করে দেয়, যখন সূর্য নেমে এসে বসন্তকালের চাইতে বেশি উত্তাপ ছড়ায়, যখন বিরল পরিষ্কার আবহাওয়ায় সবকিছু ঝলমল করে চোখকে ধাধিয়ে দেয়, যখন হেমন্তের সুরভিত বাতাস শ্বাস টেনে হৃৎপিণ্ড শক্তিশালী ও তাজা হয়ে ওঠে, যখন রাতগুলি পর্যন্ত আতপ্ত হয়ে ওঠে, যখন সেই অন্ধকারে আতপ্ত রাতে সোনালি তারারা অনবরত আকাশ থেকে খসে পড়ে আমাদের চকিত ও আনন্দিত করে তোলে।
২রা সেপ্টেম্বর সকাল দশটাতেও সেই একই আবহাওয়া চলেছে।
সকালের উজ্জ্বলতায় যাদুর স্পর্শ। পকলোনি পাহাড় থেকে দেখা যাচ্ছে, মস্কো তার নদী, বাগান ও গির্জা নিয়ে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত; তার বুকে যেন বয়ে চলেছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা; সূর্যের আলোয় তার গম্বুজগুলো তারার মতো ঝলমল করছে।
বিশিষ্ট স্থাপত্যকীর্তিসমন্বিত এই বিচিত্র শহরটির দিকে তাকিয়ে নেপোলিয়নের মন সেই ঈর্ষাতুর অস্বস্তিকর কৌতূহলে ভরে উঠল যা মানুষ বোধ করে একটা অজ্ঞাতপূর্ব বিপরীত জীবনধারার স্বাদ পেলে। শহরটি যেন তার নিজস্ব জীবনযাত্রার তাগিদে বেঁচে আছে। অনেক দূর থেকেও যে অস্পষ্ট লক্ষণ দেখে মৃত ও জীবিতের পার্থক্য বোঝা যায়, তা দেখেই পকলোনি পাহাড়ে দাঁড়িয়ে নেপোলিয়ন এই শহরটির প্রাণ স্পন্দনকে অনুভব করতে পারল; একটি সুন্দর মহান দেশের শ্বাস-প্রশ্বাস যেন তার নাড়িতে স্পন্দিত হতে লাগল।
মস্কোর দিকে তাকিয়ে প্রতিটি রুশই তাকে মা বলে মনে করে; নগরজননী হিসেবে তার তাৎপর্য ধরতে না পারলেও মস্কোর এই নারী-চরিত্র প্রতিটি বিদেশীর চোখেও ধরা পড়ে; নেপোলিয়নের চোখেও পড়ল।
ঐ তো সেই অসংখ্য গির্জাশোভিত এশিয়ার শহর মস্কো! শেষপর্যন্ত তাহলে এলাম সেই বিখ্যাত শহরে! সময় হয়েছে নিকট এবার। ফরাসিতে কথাগুলি বলে নেপোলিয়ন ঘোড়া থেকে নামল; মস্কোর একখানা মানচিত্র সামনে খুলে ধরবার হুকুম দিয়ে দোভাষী লেরশ্নে দ্য ইদেভিলকে ডেকে পাঠাল।
যে শহরকে শত্রু দখল করেছে সে তো মানহারা কুমারীর মতো, সে ভাবল (মালেনস্ক-এ কথাটা সে তুচকভকে বলেছিল)। সেই দৃষ্টিতেই সে এই অদৃষ্টপূর্ব প্রাচ্য সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে রইল। তার দীর্ঘদিনের অপ্রাপ্যনীয় বাসনা যে শেষপর্যন্ত পূর্ণ হয়েছে সেকথা ভেবে তার অবাক লাগছে। সকালের পরিক্ষার আলোয় একবার শহরকে দেখছে, একবার মানচিত্রের দিকে তাকাচ্ছে, তার খুঁটিনাটি বিচার করছে, আর তাকে পাবার নিশ্চিত আশ্বাসে মনটা উত্তেজনায় ও ভয়ে দুলে উঠছে।
সে ভাবতে লাগল : এর কি অন্যথা হতে পারত? এই তো রাজধানী আমার পায়ের তলে পড়ে আছে। কোথায় এখন আলেক্সান্দার, আর কিই বা তিনি ভাবছেন? একটা আশ্চর্য সুন্দর মহান নগরী, আর একটা আশ্চর্য ও মহান মুহূর্ত! কোন আলোয় আমি তাদের কাছে দেখা দেব! নিজের সৈন্যদের কথা মনে করে সে ভাবল, এই তো সেই নারী, এইসব দুর্বল-হৃদয় মানুষদের পুরস্কার। আমার মুখের একটি কথা, আমার হাতের একটি ইশারা, সঙ্গে সঙ্গে জারদের এই প্রাচীন শহর ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ক্ষমা তো বিজিতের মাথায় নেমে আসবার জন্য সদাই প্রস্তুত। আমাকে উদার হতে হবে, সত্যিকারের মহৎ হতে হবে। কিন্তু না, আমি মস্কোতে এসে গেছি এটা সত্য হতে পারে না, হঠাৎ তার মনে হল কথাটা। কিন্তু ওই তো সে আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে, তার সোনালি গম্বুজ ও কুশগুলি সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে। কিন্তু আমি তাকে মুক্তি দেব। বর্বরতা ও স্বেচ্ছাচারের প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে আমি উৎকীর্ণ করে যাব ন্যায় ও করুণার মহান বাণী। এটাই আলেক্সান্দারকে সবচাইতে বেশি ব্যথা দেবে, তাকে আমি চিনি। (নেপোলিয়নের ধারণা যা কিছু ঘটছে নিজের এবং আলেক্সান্দারের মধ্যে ব্যক্তিগত সংঘর্ষই তার প্রধান তাৎপর্য) ক্রেমলিনের মাথায় দাঁড়িয়ে-হ্যাঁ। ঐ তো ক্রেমলিন–আমি তাদের দেব সঠিক বিধান, তাদের শিখিয়ে দেব সভ্যতার প্রকৃত অর্থ, এমন ব্যবস্থা করব যাতে বয়াররা (জারের প্রধান সহকারীর দল) বংশ বংশ ধরে তাদের বিজেতাকে ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করে। প্রতিনিধিদলকে বলব, যুদ্ধ আমি চাইনি, কোনোদিনই চাই না; আমি যুদ্ধ করেছি শুধু তাদের রাজদরবারের ভ্রান্ত নীতির বিরুদ্ধে; আলেক্সান্দারকে আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি; মস্কোতে আমার নিজের এবং আমার জনগণের উপযুক্ত শর্তে সন্ধির প্রস্তাব আমি মেনে নেব। যুদ্ধের সৌভাগ্যকে একজন সম্মানিত নৃপতিকে অসম্মান দেখাবার কাজে লাগাতে আমি চাই না। তাদের ডেকে বলব, বয়ারগণ, আমি যুদ্ধ চাই না, চাই আমার প্রজাবৃন্দের শান্তি ও কল্যাণ। যাই হোক, আমি জানি তাদের উপস্থিতি আমাকে অনুপ্রাণিত করবে, যেমন সব সময়ই করে থাকি তাদের সঙ্গেও সেইভাবেই কথা বলব : স্পষ্টভাবে, প্রভাব বিস্তার করে, মহত্ত্বের সঙ্গে। কিন্তু আমি মস্কোতে পৌঁছেছি–এ কি সত্য হতে পারে? হ্যাঁ, ওই তো সে পড়ে আছে।
বয়ারদের আমার সামনে হাজির কর, দলের লোকদের বলল।
ঝকঝকে পোশাক পরা একজন জেনারেল সঙ্গে সঙ্গে বয়ারদের আনতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
দুঘণ্টা কেটে গেল। নেপোলিয়ন খাওয়া শেষ করে পকলোনি পাহাড়ের উপর সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রতিনিধিদলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। বয়ারদের কাছে যে ভাষণটি দেবে কল্পনায়ও সেটা স্পষ্ট রূপ পেয়ে গেছে। নেপোলিয়নের ধারণামতে সে ভাষণ মর্যাদা ও মহত্ত্বে পরিপূর্ণ।
মস্কোর প্রতি যে উদারতা দেখাবে বলে সে স্থির করেছে তার দ্বারা সে নিজেই অভিভূত হয়ে পড়েছে। জারদের প্রাসাদে অনুষ্ঠিত যে সমাবেশে রাশিয়ার এবং তার বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ একত্র মিলিত হবে, কল্পনায় তার দিন-ক্ষণ পর্যন্ত সে স্থির করে ফেলেছে। মনে মনে এমন একজন শাসনকর্তা নিয়োগ করেছে যে জনগণের হৃদয় জয় করবে। মস্কোতে অনেক দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান আছে জেনে সে মনে মনে স্থির করেছে যে সে সবগুলিতেই সে করুণা বিতরণ করবে। আফ্রিকাতে সে যেমন আরবদের মতো মস্তকাবরণ পরে মসজিদে গিয়ে বসেছিল, তেমনই মস্কোতেও সে জারদের মতোই সকলের উপকার করবে এবং শেষপর্যন্ত রুশদের অন্তরকে স্পর্শ করার উদ্দেশ্যে সে স্থির করল যে এইসব প্রতিষ্ঠানের গায়ে সে বড় বড় অক্ষরে খোদাই করে দেবে : এই প্রতিষ্ঠানকে আমার আদরের মায়ের নামে উৎসর্গ করা হইল। অথবা শুধু লেখা হবে : Maison de la Mere (মাতৃসদন)। কিন্তু আমি কি সত্যি মস্কোতে এসেছি? হ্যাঁ, ওই তো সে আমার সামনে পড়ে আছে। কিন্তু শহর থেকে প্রতিনিধিদল আসতে এত বিলম্ব হচ্ছে কেন? সে অবাক হল।
ইতিমধ্যে তার দলবলের পিছন দিকে জেনারেল ও মার্শালদের মধ্যে ফিসফিস করে একটা উত্তেজিত আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। প্রতিনিধিদলকে নিয়ে আসতে যারা গিয়েছিল তারা এই সংবাদ নিয়ে ফিরে এসেছে যে মস্কো এখন জনশূন্য, প্রত্যেকেই মস্কো ছেড়ে চলে গেছে। যারা আলোচনা করছে তাদের মুখ বিবর্ণ ও বিচলিত অধিবাসীরা মস্কো ত্যাগ করে চলে গেছে এ সংবাদে তারা শঙ্কিত নয়, তাদের শঙ্কা হচ্ছে ম্রাটের মর্যাদাকে হাস্যকর করে না তুলে কেমন করে তাকে বলা হবে যে বৃথাই সে এতক্ষণ বয়ারদের জন্য অপেক্ষা করে আছে : মস্কোতে এখন পাঁড় মাতাল ছাড়া আর কেউ নেই। কেউ বলল, কোনোরকম একটা প্রতিনিধিদল খাড়া করা হোক; আবার অন্যরা তাতে আপত্তি করে বলল, আগে সাবধানে সুকৌশলে সম্রাটকে তৈরি করে নিয়ে তারপর সত্য কথাই বলা হোক।
তাকে বলতে তো হবেই। কিন্তু ভদ্ৰজনরা…
অবস্থাটা আরো ঘোরালো হয়ে উঠেছে কারণ বড় বড় পরিকল্পনার কথা ভাবতে ভাবতে সম্রাট প্রসারিত মানচিত্রের পাশে ধৈর্যের সঙ্গে পায়চারি করছে এবং উজ্জ্বল গর্বের হাসি হেসে কপালের উপর হাত তুলে বারবার মস্কোর রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে।
কিন্তু এ যে অসম্ভব, দলের লোকরা কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে উঠল; কিন্তু এটা হাস্যকর এই আসল কথাটা সাহস করে বলতে পারল না।
শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ প্রতীক্ষায় ক্লান্ত হয়ে সম্রাট তার অভিনেতাসুলভ স্বাভাবিক প্রবৃত্তিবশেই বুঝতে পারল যে অত্যন্ত বেশিক্ষণ বিলম্বিত হওয়ার ফলে সেই মহান মুহূর্তটি তার মহত্ত্বকে হারিয়ে ফেলেছে; সঙ্গে সঙ্গে সে হাত তুলে একটা ইঙ্গিত করল। তারপরেই শোনা গেল কামানের একটা সংকেত-ধ্বনি, আর মস্কোর বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে থাকা সৈন্যরা তিভের, কালুগা ও দরগমিলভ ফটক দিয়ে শহরে ঢুকতে শুরু করল। পরস্পরের সঙ্গে রেষারেষি করে দ্রুত, আরো দ্রুত তারা জোর কদমে বা দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল, অশ্বক্ষুর থেকে উথিত ধোয়ায় নিজেরাই ঢেকে গেল, সকলের কান-ফাটানো সম্মিলিত কোলাহলে বাতাস ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
সৈন্যদের গতির টানে নেপোলিয়নও তাদের সঙ্গে দরগমিলভ ফটক পর্যন্ত গিয়ে থামল, ঘোড়া থেকে নেমে কামের-কোলেজস্কি প্রাচীরের পাশে অনেকক্ষণ পায়চারি করল প্রতিনিধিদলের প্রতীক্ষায়।
.
অধ্যায়-২০
ইতিমধ্যে মস্কো ফাঁকা হয়ে গেছে। কিছু লোক তখনো আছে, হয়তো আগেকার জনসংখ্যার পঞ্চাশ ভাগের একভাগ; তবু ফাঁকা। রানী-মৌমাছিহীন একটা মুমূর্ষ মৌচাক যে অর্থে ফাঁকা।
ভাসা-ভাসা চোখে অন্য যেকোনো মৌচাকের মতো জীবন্ত দেখালেও রানী-মৌমাছিহীন মৌচাকে কোনো জীবন থাকে না।
জীবন্ত মৌচাকের মতোই রানীহীন মৌচাক ঘিরেও মৌমাছিরা চক্রাকারে ঘোরে মধ্যাহ্ন সূর্যের উত্তপ্ত রোদ গায়ে মেখে; অন্য মৌচাকের মতোই দূর থেকে মধুর গন্ধ পাওয়া যায়, মৌমাছিরা ভিতরে-বাইরে একইভাবে উড়তে থাকে। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে চাকে তখন আর জীবন নেই। মৌমাছিরা ঠিক আগের মতো ওড়ে না, মৌমাছি-পালকের নাকেও আগের মতো গন্ধ আসে না। মৌমাছি-পালক যখন রুগ্ন, মৌচাকের দেয়ালে টোকা দেয় তখন আগে যেমন মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার মৌমাছি তলপেটকে ভয়ংকরভাবে সংকুচিত করে এক সুরে গুঞ্জন করে উঠত, পাখনার দ্রুত ঝটপটানিতে একটা বায়বীয় জীবন্ত শব্দ তুলত, তার পরিবর্তে পরিত্যক্ত মৌচাক থেকে শোনা যায় শুধু বিভিন্ন অংশ থেকে আসা একটা অসংলগ্ন ভোঁ-ভোঁ শব্দ। শান্ত্রী-মৌমাছিরা যেভাবে তলপেটটা তুলে বিপদ-সংকেত জানাত এবং মৌচাকটিকে রক্ষায় জীবন দিতে প্রস্তুত হত এখন আর সেটা দেখা যাবে না। ফুটন্ত জলের মতো স্পন্দিত কর্মব্যস্ততার পরিমিত শান্ত শব্দের পরিবর্তে এখন শোনা যাবে নানা বিশৃঙ্খল বেসুরো শব্দ। মৌচাকের ভিতরে ও বাইরে লম্বা কালো দস্যু-মৌমাছিগুলি মধুতে মাখামাখি হয়ে ভীরু ধীর গতিতে উড়ে বেড়ায়। তারা হুল ফোঁটায় না, ভয়ে কুঁকড়ে সরে যায়। আগে একমাত্র মধুবাহী মৌমাছিরাই চাকের ভিতরে ঢুকত, বেরিয়ে আসত শূন্য দেহে, আর এখন তারা বেরিয়ে আসছে মধুর বোঝাই হয়ে। আগে থাকত একটা পরিষ্কার চটচটে মেঝে, সেখানে বইত মৌমাছিদের পাখার হাওয়া, আর এখন মেঝেতে ছড়িয়ে আছে মোমের টুকরো, বিষ্ঠা, মুমূর্ষ মৌমাছিরা কোনোরকমে পা নাড়ছে, আর মরা মৌমাছিগুলোকেও সরিয়ে দেওয়া হয়নি।
মৌমছি-পালক চাকের উপরের অংশটা খুলে ভিতরটা পরীক্ষা করে দেখে। মধুচক্রের প্রতিটি খোপ মোম দিয়ে ভর্তি করার কাজে ব্যস্ত থাকা মৌমাছির পরিবর্তে এখন সে দেখতে পায় শুধু মধুচক্রের একটা জটিল সুকৌশল গঠন, কিন্তু আগেকার পবিত্রতার স্পর্শ তাতে নেই। সবই উপেক্ষিত, পচা। কালো কালো দস্যু মৌমাছিগুলি দ্রুতপায়ে চোরের মতো মধুচক্রের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে, আর ছোট ছাট গৃহিণী মৌমাছিগুলি নিরুৎসাহভাবে বিকৃত দেহ নিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দস্যুগুলোকে তাড়াবার কোনো চেষ্টাই করছে না; যেন জীবনের সব বোধ, সব বাসনাই হারিয়ে ফেলেছে। মৌমাছি-পালক মধ্যেকার দুটো বেড়া ফাঁক করে জীবকোষগুলোকে পরীক্ষা করে। আগে যেখানে পিঠে পিঠ লাগিয়ে হাজার হাজার মৌমাছি কালো বৃত্ত রচনা করে রাখত যেন জন্মের গভীর রহস্যকে ঢেকে রাখবার জন্যই, এখন সেখানে সে দেখে শুধু কয়েক শ নিস্তেজ, নিরুৎসাহ মৌমাছির ঘুমন্ত খোলস। নিজেদের অজ্ঞাতেই তারা প্রায় মরতে বসেছে; যে আশ্রয়কে তারা এতদিন রক্ষা করেছে, এখন আর যার কোনো অস্তিত্বই নেই, তারই উপরে তারা বসে আছে। তাদের গায়ে ধ্বংস ও মৃত্যুর গন্ধ। শুধু কয়েকটা মৌমাছি এখনো নড়ছে, উঠছে, শত্রুর হাতের উপর বসবার জন্য কোনোক্রমে উড়ছে, শেষবারের মতো হুল ফুটিয়ে মরবার ইচ্ছাটা পর্যন্ত হারিয়ে গেছে; বাকিগুলো সব মরে গেছে, মাছের আঁশের মতো ঝরে পড়ছে। মৌমাছি-পালক চাকটা বন্ধ করে, তার উপর একটা খড়ির দাগ কাটে, তারপর সময়মতো ভিতর থেকে সবকিছু বের করে এনে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে।
মস্কো যখন ঠিক সেইরকম ফাঁকা তখনই ক্লান্ত বিষণ্ণ নেপোলিয়ন কামের-কোলেজস্কি প্রাচীরের সামনে পায়চারি করতে করতে প্রতিনিধিদলের জন্য অপেক্ষা করছে; নেহাৎই আনুষ্ঠানিক ব্যাপার হলেও তার বিবেচনায় এই সৌজন্য রক্ষা করে চলা প্রয়োজন।
মস্কোর কোণে কোণে তখনো কিছু লোক উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে; তারা যে কি করছে সেটা না বুঝেই পুরনো অভ্যাসবশত ঘোরাফেরা করছে।
অনেক বিচার-বিবেচনার পরে নেপোলিয়নকে যখন জানানো হল যে মস্কো জনশূন্য, তখন সে সংবাদদাতার দিকে একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই সরে গেল এবং নীরবে পায়চারি করতে লাগল।
আমার গাড়ি! হাঁক দিল।
কর্তব্যরত এড-ডি-কংয়ের পাশে বসে নেপোলিয়ন শহরতলীর দিকে গাড়ি চালিয়ে দিল। নিজের মনেই বলল, মস্কো পরিত্যক্ত! কী অবিশ্বাস্য ঘটনা!
শহরে না ঢুকে সে দরগমিলভ শহরতলীর একটা সরাইখানায় উঠল।
নাটকীয় ঘটনাটি আর ঘটল না।
.
অধ্যায়–২১
রাত দুটো থেকে বিকেল পর্যন্ত রুশ সৈন্যরা মস্কোর উপর দিয়ে পিছিয়ে যেতে লাগল; আহত সৈন্য ও অবশিষ্ট অধিবাসীদের সঙ্গে নিয়ে গেল।
সৈন্যদের চলাচলের সবচাইতে বেশি চাপ পড়ল স্টোন, মস্ক ও ইয়াউজা সেতুর উপর।
সৈন্যরা যখন দুদলে ভাগ হয়ে ক্রেমলিনকে ঘুরে যাচ্ছিল, মস্ক ও স্টোন সেতুর উপর ভিড় করছিল, তখন বহুসংখ্যক সৈন্য সেই ভিড় ও যানজটের সুযোগ নিয়ে সেইসব সেতুর উপর থেকে পিছিয়ে এসে নিঃশব্দে চুপি চুপি সরে পড়ল এবং সুন্দরী ভাসিলি গির্জার পাশ দিয়ে ও বরভিৎস্কি ফটকের নিচ দিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠে রেড স্কোয়ারে ফিরে গেল; সহজাত প্রবৃত্তিই যেন তাদের বলে দিল, সেখানে গেলে তারা সহজেই এমন সব জিনিস হাতাতে পারবে যা তাদের নয়। সস্তা নিলামে যেসব লোক ভিড় করে তারা এসে বাজারের অলিগলি সব ভরে ফেলেছে; কিন্তু কোনো নিলামওয়ালা গলা ছেড়ে খদ্দেরদের সাদর আহ্বান জানাচ্ছে না; কোনো ফেরিওয়ালা সেখানে নেই, নেই ক্রয়েচ্ছ মেয়েদের ভিড়; শুধু ইউনিফর্ম ও ওভারকোট পরা সৈন্যরাই ভিড় করেছে; তাদের হাতে কিন্তু বন্দুক নেই; খালি হাতে তারা নীরবে বাজারে ঢুকছে আর নানারকম বান্ডিল হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী ও তাদের সহকারীরা বিমূঢ়ভাবে ইতস্তত চলাফেরা করছে। একবার দোকানের তালা খুলছে, আবার লাগাচ্ছে, আর সহকারীদের সহায়তায় যতটা পারছে মালপত্র সরিয়ে নিচ্ছে। বাজারের সামনে স্কোয়ারের মধ্যে ভেরীবাদকরা জমায়েতের বাজনা বাজাচ্ছে, কিন্তু তা শুনে সৈন্যরা তাদের দিকে এগিয়ে না গিয়ে বরং আরো দূরে সরে যাচ্ছে। দোকানে ও গলিতে সৈন্যদের মধ্যে এমন কিছু লোক দেখা যাচ্ছে যাদের পরনে ধূসর কোট, মাথা কামানো (জেল থেকে ছাড়া পাওয়া বন্দির দল)। দুজন অফিসার ইলিংকা স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। একজনের ইউনিফর্মের উপর চাদর জড়ানো, একটা শুটকো গাঢ় ধূসর রঙের ঘোড়ায় আসীন; অপরজনের গায়ে ওভারকোট, রাস্তায় দণ্ডায়মান। তৃতীয় একজন অফিসার ঘোড়া ছুটিয়ে সেখানে এল।
জেনারেল হুকুম দিয়েছেন, এই মুহূর্তে সব্বাইকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ যে অসহ্য! অর্ধেক সৈন্য সরে পড়েছে।
বন্দুকবিহীন তিনজন পদাতিক সৈন্য ওভারকোটের তলাটা উঁচু করে তুলে বাজারের গলিতে কেটে পড়ছিল; তাদের দেখে অফিসারটি চেঁচিয়ে বলল, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?…কোথায়?…থামো, রাস্কেলের দল!
অপর অফিসার বলল, কিন্তু ওদের আপনি থামাবেন কেমন করে? ওদের তো একত্রে পাওয়াই যাচ্ছে না। অন্যরা পথ আটকাবার আগেই সেনাবাহিনীকে এগিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু এগিয়ে যাবে কেমন করে? ওরা তো ওখানে আটকে গেছে, সেতুর উপর যেন খোটা, গেড়েছে, মোটেই নড়ছে না। বাকিরা যাতে পালাতে না পারে সেজন্য তাদের ঘেরাও করা দরকার নয় কি?
সিনিয়র অফিসার চেঁচিয়ে বলল, চলে আসুন, ওখানে যান, ওদের তাড়িয়ে দিন!
চাদর জড়ানো অফিসারটি ঘোড়া থেকে নেমে একজন ভেরিবাদককে ডেকে তাকে নিয়ে ঢাকা বারান্দায় চলে গেল। কয়েকটি সৈনিক দল বেঁধে ছুট দিল। নাকের কাছে গালের উপর লাল তিলওয়ালা একটি দোকানি হাত দোলাতে দোলাতে তার দিকে এগিয়ে এল।
বলল, ইয়োর অনার! দয়া করে আমাদের বাঁচান! ছোটখাট জিনিস খোয়া গেলে আমরা কিছু মনে করি না, আপনারা যা খুশি নিতে পারেন–তাতে আমরা খুশিই হব!…এমন একজন সম্মানিত ভদ্রলোকের জন্য একটুকরো কাপড় আমি এক্ষুণি এনে দিচ্ছি, দরকার হলে দুটো টুকরোও খুশি হয়েই দেব। অবস্থাটা তো বুঝতেই পারছি : কিন্তু এসব কী হচ্ছে-এ যে স্রেফ ডাকাতি; আপনি কি দয়া করে কিছু পাহারা বসাতে পারেন না যাতে আমরা অন্তত দোকানগুলো বন্ধ করতে পারি…
কয়েকজন দোকানি অফিসারকে ঘিরে দাঁড়াল।
কড়া চেহারার একজন রেগে বলল, আঃ, কী বোকার মতো বক! মাথাটাই যখন কাটা যাচ্ছে তখন কি কেউ চুলের লাগি কাঁদে! দয়া করে ভিতরে আসুন ইয়োর অনার!
শুটকো লোকটি চেঁচিয়ে বলল, বকবকই বটে! এখানে আমার তিনটে দোকানে এক লাখ রুবল দামের মালপত্র আছে। সৈন্যরা চলে গেলে কি সেসব বাঁচানো যাবে? আর মানুষগুলোও হয়েছে বটে! ঈশ্বরের মার দুনিয়ার বার।
প্রথম দোকানি অভিনন্দন জানিয়ে বলল, ভিতরে আসুন ইয়োর অনার!
অফিসারটি বিব্রত বোধ করতে লাগল; তার মুখে ইতস্তত ভাব।
এটা আমার কাজ নয়, বলেই সে তাড়াতাড়ি গলিতে পা বাড়াল।
একটা খোলা দোকানের ভিতর থেকে ঘুষোঘুষি ও গালাগালির শব্দ শোনা গেল। অফিসারটি সেখানে আসা মাত্রই মাথা কামানো ধূসর কোট পরা একটি লোককে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলে দেওয়া হল।
লোকটি ডিগবাজি খেয়ে ব্যবসায়ী ও অফিসারটির মাঝখান দিয়ে ছুটে চলে গেল। দোকানের মধ্যে যেসব সৈন্য ছিল অফিসারটি তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠিক সেইমুহূর্তে মস্ক সেতুর উপরকার প্রচণ্ড ভিড়ের ভিতর থেকে একটা ভয়ংকর আর্তনাদ ভেসে এল আর অফিসারটি ছুটে স্কোয়ারের ভিতর ঢুকল।
কি হল? কি হল? সে শুধাল, কিন্তু তার সহকর্মীটি ততক্ষণে সুন্দরী ভাসিলির পাশ কাটিয়ে আর্তনাদ লক্ষ্য করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছে।
অফিসারটিও ঘোড়াও চেপে তার পিছু নিল। সেতুর উপর পৌঁছে দেখতে পেল দুটো কামান দাঁড়িয়ে আছে, পদাতিক সৈন্যরা সেতু পার হচ্ছে, কয়েকটা গাড়ি উল্টে গেছে, আর কতক সৈন্যরা ভয় পেয়েছে, কতক হাসছে। কামানের পাশে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে; তাতে ঘোড়া জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। গলায় কলার পরানো চারটে কুকুর চাকা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা উঁচু করে বোঝাই করা হয়েছে, আর উল্টো করে বসানো একটা বাচ্চাদের চেয়ারের পাশে বসে একটি চাষা স্ত্রীলোক মর্মভেদী চিৎকার করছে। সহকর্মী-অফিসাররা জানাল, জেনারেল এর্মালভ এখানে পৌঁছে যখন জানতে পারল যে সৈন্যরা দোকানে দোকানে ঢুকে পড়েছে, আর নাগরিকরা সেতুর উপরে জট পাকিয়ে ফেলেছে, তখন সে হুকুম দেয় যে সেতুকে লক্ষ্য করে গুলি চালাবার ভান করে কামান দুটোকে সেইদিকে তাক করে বসানো হোক, আর তার ফলেই ভিড়ের লোকজন ও স্ত্রীলোকটি আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছে। ভিড়ের লোকরা ধাক্কাধাক্কি করে, গাড়ি উল্টে ফেলে বেপরোয়াভাবে চিৎকার করতে করতে সেতুর মুখটা ফাঁকা করে দিয়েছে, আর তাই সৈন্যরা এখন সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
.
অধ্যায়–২২
ইতিমধ্যে শহর জনশূন্য হয়ে গেছে। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। সব ফটক ও দোকানপাটই বন্ধ; শুধু শুড়িখানাগুলো ঘিরে এখানে-ওখানে কিছু চেঁচামেচি ও মাতলামির গান শোনা যাচ্ছে। পথে কোনো গাড়ি নেই। পায়ের শব্দও কদাচিৎ কানে আসে। পোভাস্কায়া নিস্তব্ধ ও জনহীন। রস্তভদের বাড়ির প্রকাণ্ড উঠোনে পড়ে আছে শুধু খড়ের স্তূপ আর ঘোড়ার গোবর; একটা মানুষও চোখে পড়ছে না। বাড়ির মস্তবড় বৈঠকখানায় জিনিসপত্র সবই আছে, কিন্তু মানুষ আছে মাত্র দুটি। উঠোনের দারোয়ান ইগনাৎ আর ভাসিলিচের নাতি ছোকরা-চাকর মিশকা; ঠাকুর্দার সঙ্গে সেও মস্কোতে থেকে গেছে। মিশকা ক্ল্যাভিকর্ডটা খুলে এক আঙুল দিয়ে সেটাকে ঠুকছে। ইগনাৎ দুই হাত আড়াআড়িভাবে বুকের উপর রেখে বড় আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে খুশিতে হাসছে।
হঠাৎ দুই হাতে কিবোর্ডে ঠেকা দিতে দিতে ছেলেটা বলে উঠল, খুব চমৎকার, কি বল ইগনাৎ খুড়ো?
আয়নায় নিজের দন্তবিকাশ দেখে বিস্মিত ইগনাৎ বলল, কী আশ্চর্য!
মাভ্রা কুজমিনিচনা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে বলে উঠল, বেয়াদপি! বেয়াদপি! মোটা জালাটা কী রকম দাঁত বের করেছে দেখ! তুমি কি এই জন্যই এখানে আছ? ওদিকে কিছু পরিষ্কার করা হয়নি, আর ভাসিলিচ খেটে খেটে মারা গেল। একটু সবুর কর!
বেল্টটা ঠিক করতে করতে চোখ নিচু করে ইগনাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ছেলেটি বলল, আমি খুব আস্তে আস্তেই বাজাচ্ছিলাম মাসি।
হাত তুলে মারের ভয় দেখিয়ে মাভ্রা কুজমিনিচনা বলল, তোমাকেও আস্তে আস্তেই কিছু দেব, বাঁদর কোথাকার! যাও, ঠাকুর্দার জন্য সামোভারটা গরম কর গে।
মাভ্রা কুজমিনিচনা ক্ল্যাভিকর্ডের ধুলো ঝেড়ে সেটা বন্ধ করল; দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে প্রধান দরোজায় তালা লাগিয়ে দিল।
উঠোনে নেমে একটু থেমে ভাবতে লাগল এখন কোথায় যাবে-চাকরদের ঘরে গিয়ে ভাসিলিচের সঙ্গে চা খাবে, না কি ভাড়ার ঘরে গিয়ে সেটাকে একটু গোছগাছ করবে।
শান্ত রাজপথে দ্রুত পায়ের শব্দ শোনা গেল। কে যেন ফটকে এসে থামল। ছিটকিনির শব্দ হল, কে যেন সেটা খুলবার চেষ্টা করছে।
মাভ্রা কুজমিনিচনা ফটকের দিকে এগিয়ে গেল।
কি চাই?
কাউন্ট–কাউন্ট ইলিয়া অন্দ্রিভিচ রস্তভ।
কিন্তু আপনি কে?
একজন অফিসার, তার সঙ্গে দেখা করতে চাই, নম্র, মার্জিত রুশ গলায় জবাব এল।
মাভ্রা কুজমিনিচনা ফটক খুলে দিল। আঠারো বছর বয়সের একটি অফিসার উঠোনে ঢুকল; রস্তভদের মতোই গোল তার মুখের আদল।
মাভ্রা কুজমিনিচনা সাদরে বলল, তারা তো চলে গেছেন স্যার। কাল সন্ধ্যাবেলায় চলে গেছেন।
তরুণ অফিসারটি ঢুকবে কি ঢুকবে না ইতস্তত করে জিভ দিয়ে চুক-চুক শব্দ করল।
বলল, আঃ, বড়ই মুস্কিল হল! আমার গতকালই আসা উচিত ছিল। কী দুঃখের কথা!
এদিকে মাভ্রা কুজমিনিচনা ছেলেটির মুখের রস্ত পরিবারের আদল, তারা ছেঁড়া কোট ও ছেঁড়া বুটের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল।
বলল, কাউন্টের সঙ্গে কি জন্য দেখা করতে চাইছেন?
দেখুন, মানে…কোনো লাভ নেই! বিরক্ত স্বরে কথাটা বলে চলে যাবার জন্যই সে ফটকে হাত দিল।
ইতস্তত করে আবার থামল।
তারপর হঠাৎ বলে উঠল, দেখুন, আমি কাউন্টের একজন আত্মীয়; তিনি আমার প্রতি খুব সদয়। দেখতেই তো পাচ্ছেন আমার জামা-জুতো সবই শতচ্ছিন্ন, হাতেও টাকা নেই, তাই কাউন্টের কাছে এসেছিলাম কিছু…
মাভ্রা কুজমিনিচনা তাকে কথা শেষ করতে দিল না।
একমিনিট অপেক্ষা করুন স্যার! ক্ষণিকমাত্র, সে বলল।
অফিসারটি ফটকের হাতল থেকে হাতটা সরিয়ে নিতেই সে পিছনের উঠোন দিয়ে চাকরদের ঘরের দিকে চলে গেল।
উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে অফিসারটি নিজের ছেঁড়া বুটজোড়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ঈষৎ হাসল। ভাবল, কী দুঃখ যে খুড়োমশায়ের সঙ্গে দেখা হল না! এই বৃদ্ধাটিও কী ভালো। উনি ছুটে গেলেন কোথায়? আমার রেজিমেন্ট তো এতক্ষণে রঘোঝস্কি ফটকের কাছে পৌঁছে গেছে; রেজিমেন্টকে ধরবার সোজা পথটাই বা কেমন করে খুঁজে পাব? ঠিক সেইসময় একখানা পাকানো ডোরাকাটা রুমাল হাতে নিয়ে মাদ্রা কুজমিনিচনা এসে হাজির হল। কয়েক পা দূরে থাকতেই রুমালের পাক খুলে একখানা পঁচিশ রুবলের শাদা নোট বের করে তাড়াতাড়ি সেটা তার হাতে গুঁজে দিল।
হিজ এক্সেলেন্সি বাড়ি থাকলে অবশ্য আত্মীয় হিসেবে তিনি…কিন্তু এ অবস্থায়…
মাভ্রা কুজমিনিচনার মুখ লাল হয়ে উঠল। অফিসারটি আপত্তি না করে নীরবে নোটটা নিয়ে তাকে ধন্যবাদ দিল।
মাভ্রা কুজমিনিচনা ত্রুটিস্বীকারের ভঙ্গিতে আবার বলল, কাউন্ট যদি বাড়ি থাকতেন…খৃস্ট আপনার সহায় হোন স্যার! ঈশ্বর আপনাকে রক্ষা করুন! সে মাথাটা নোয়াল; অফিসারটি বেরিয়ে গেল।
মাথা দুলিয়ে খুশিতে হাসতে হাসতে অফিসারটি পরিত্যক্ত পথ বেয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল যাতে ইয়াউজা সেতুতেই তার রেজিমেন্টকে ধরতে পারে।
কিন্তু মাভ্রা কুজমিনিচনা অশ্রুভেজা চোখে বেশ কিছুক্ষণ ফটকেই দাঁড়িয়ে রইল; অজ্ঞাত তরুণ অফিসারটির প্রতি মাতৃস্নেহ ও করুণার অপ্রত্যাশিত প্রবাহে তার বুকটা ভরে উঠেছে; বিষণ্ণ অন্তরে সে মাথাটা দোলাতে লাগল।
.
অধ্যায়-২৩
বরবাৰ্কার উপরে অবস্থিত একটা অসমাপ্ত বাড়ির একতলার মদের দোকান থেকে মাতালদের হৈ-হল্লা ও গান ভেসে আসছে। একটা ছোট নোংরা ঘরের টেবিলের চারপাশে বেঞ্চিতে বসে আছে জনাদশেক কারখানার মজুর। আবছা দৃষ্টি ও হাঁ-করা মুখে ঘর্মাক্ত অবস্থায় তারা বেশ কষ্ট করে একটা না একটা গান করে চলেছে। সে গানে কোনো তাল-লয় নেই, গাইতে বেশ কষ্টও হচ্ছে, গান গাওয়ার জন্যই যে গাইছে তাও নয়, তারা যে মাতাল হয়ে বেশ মৌজে আছে সেটা দেখাতেই গান করছে। পরিষ্কার নীল কোটপরা একটি লম্বা সুকেশ ছেলে অন্য সকলের উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁট দুটো পাতলা, চাপা ও বাঁকা না হলে এবং চোখ দুটো স্থির ও বিষণ্ণ না হলে সুন্দর খাড়া নাকের জন্য তার মুখটা বেশ ভালোই দেখাত। একটা কিছু বলার জন্যই সে উঠে দাঁড়িয়েছে; কনুই পর্যন্ত আস্তিন গুটিয়ে সকলের মাথার উপর দিয়ে শাদা হাতটা ঘোরাচ্ছে নোংরা আঙুলগুলোকে অস্বাভাবিকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে। কোটের আস্তিনটা বারবার নেমে যাচ্ছে, আর সেও বাঁ হাত দিয়ে সেটাকে বারবার গুটিয়ে নিচ্ছে, যেন যে পেশীবহুল হাতটা সে ঘোরাচ্ছে সেটা খোলা থাকা খুবই দরকারি। গানের ফাঁকে ফাঁকেই বারান্দায় ও ফটকে চিৎকার, লড়াই ও ঘুমোঘুষির শব্দ শোনা যাচ্ছে। লম্বা ছেলেটি হাত নাড়তে লাগল।
হঠাৎ সে বলে উঠল, এসব থামাও! ওখানে লড়াই চলেছে বাছাধনরা! তারপর আস্তিন গোটাতে গোটাতেই বাইরের ফটকে চলে গেল।
কারখানার মজুররা তার পিছু নিল; লম্বা ছেলেটার নেতৃত্বে এই লোকগুলি সকালেই মদের দোকানে ঢুকে মদ খাচ্ছিল; কারখানা থেকে কিছু চামড়া নিয়ে এসেছিল, আর তার বদলেই তাদের সকলকে মদ দেওয়া হচ্ছিল। এদিকে নিকটবর্তী কামারশালা থেকে একদল কামার শুড়িখানায় হৈ-হট্টগোল শুনে ওরা দোকানের দরোজা ভেঙে ঢুকেছে ভেবে তারাও জোর করে ঢুকতে চাইল, আর তাই নিয়ে ফটকে দুই দলের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেছে।
দোকানের মালিক দরোজার কাছেই একটা কামারকে মারছিল; মজুররা এসে পড়তে কামারটা মালিকের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সপাটে পথের উপর পড়ে গেল।
আর একটি কামার বুক দিয়ে মালিককে ঠেলে দরজা দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করল।
আস্তিন-গুটানো ছেলেটা কামারের মুখে এক ঘুষি মেরে চিৎকার করে বলল, ওরা আমাদের সঙ্গে লড়তে এসেছে হে!
সেইসময় প্রথম কামারটি উঠে নিজের ছড়ে-যাওয়া মুখটাকে আঙুল দিয়ে আঁচড়ে রক্ত বের করে কান্নাভরা গলায় চিৎকার করে বলল :
পুলিশ! খুন!!…একটা লোককে ওরা খুন করেছে!
কাছাকাছি আর একটা ফটক দিয়ে বেরিয়ে এসে একটি স্ত্রীলোক চেঁচাতে শুরু করল, হায় কপাল!…একটা লোককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে–খুন করেছে!…
রক্তাক্ত কামারটিকে ঘিরে ভিড় জমে গেল।
দোকানের মালিককে ডেকে একজন বলল, মানুষের অনেক কিছু তো লুঠ করেছ-তাদের শেষ শার্টটা পর্যন্ত নিয়েছ। ওরে চোর, একটা মানুষকে কেন খুন করেছিস?
লম্বা ছেলেটা একবার দোকানির দিকে, একবার কামারের দিকে তাকিয়ে যেন ভাবতে লাগল এবার কার সঙ্গে লড়বে।
হঠাৎ দোকানির দিকে ফিরে বলল, এই খুনী! ওকে বেঁধে ফেল বাছারা।
যে লোকটি এগিয়ে এসেছিল তাদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এবং মাথার টুপিটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দোকানের মালিক চেঁচিয়ে বলল, আমাকে তো বাঁধতে চাইবেই!
যেন তার এই কাজের একটা রহস্যময় ক্ষতিকর তাৎপর্য আছে এই কথা ভেবে মজুররা ইতস্তত করে থেমে গেল।
আইনের খবর আমি ভালোই জানি স্যাঙাত্রা! ব্যাপারটাকে পুলিশের ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে যাব। তার কাছে আমি যেতে পারব না ভেবেছ? আজকালকার দিনে ডাকাতি করার অধিকার কারো নেই! টুপিটা তুলে নিয়ে দোকানি বলল।
তাহলে চলে এস। তাহলে চলে এস! মদের দোকানি ও লম্বা ছেলেটা পরপর কথাটা বলল। দুইজন একসঙ্গে পথে নামল।
রক্তমাখা কামারটিও চলল তাদের পাশে। চেঁচিয়ে কথা বলতে বলতে কারখানার মজুররাও তাদের পিছু পিছু চলল।
মরসিকার মোড়ে জুতো তৈরির সাইনবোর্ড ঝোলানো বন্ধ-জানালা একটা বড় বাড়ির বিপরীত দিকে জনা বিশেক শুকনো, ক্লান্ত, বিষণ্ণ-মুখ মুচি ওভারল ও ছেঁড়া লম্বা কোট পরে দাঁড়িয়েছিল।
একটি শুটকো মজুর ভুরু কুঁচকে পাতলা দাড়ি দুলিয়ে বলছে, তার তো উচিত লোকদের প্রাপ্য ঠিকমতো দেওয়া। কিন্তু সে আমাদের রক্ত চুষে খেয়েছে, আর এখন ভাবছে আমাদের তাড়াতে পারলেই বাঁচে। সপ্তাহ ভরে আমাদের ভুল বুঝিয়েছে, আর আজ আমাদের এই সংকটের মধ্যে ফেলে সটকে পড়েছে।
রক্তমাখা লোকটিসহ ভিড়কে দেখে মুচিরা কথা থামিয়ে সাগ্রহ কৌতূহলে চলমান ভিড়ের সঙ্গে মিশে গেল।
এরা সব কোথায় চলেছে?
কেন, নিশ্চয় পুলিশের কাছে!
আমি বলছি, আমাদের যে মেরেছে সেটা কি সত্যি
তোমার কি মনে হয়? ওরা কি বলছে তাই শোন।
অনেক প্রশ্ন ও উত্তর শোনা গেল। বর্ধিত ভিড়ের সুযোগ নিয়ে খুঁড়িখানার মালিক পিছনে কেটে পড়ে দোকানে ফিরে গেল।
শত্রু যে সরে পড়েছে সেটা লক্ষ্য না করে লম্বা যুবকটি খোলা হাতটা ঘোরাতে ঘোরাতে অনবরত বকতে লাগল। তাকে ঘিরেই সকলে ভিড় করে চলল।
সরকারকে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে, আইন চালাতে হবে, সরকার তো আছেই সেইজন্যে। ভালোমানুষ খৃস্টানরা, আমি ঠিক বলিনি? প্রায় অদৃশ্য হাসি হেসে যুবকটি বলল। সে ভেবেছে সরকার বলে কিছু নেই! সরকার ছাড়া কখনো চলে? সরকার না থাকলে তো সকলেই আমাদের লুঠ করত।
ভিড়ের ভিতর থেকে অনেকে বলে উঠল, কি বাজে কথা বলছ? তারা কি এইভাবে মস্কো ছেড়ে দেবে? তারা ঠাট্টা করে কি বলল, আর তাই তুমি বিশ্বাস করলে! প্রচুর সৈন্য কি যাচ্ছে না? সত্যি কি তাকে (নেপোলিয়নকে) আসতে দেবে! সরকার কি এইজন্যেই আছে! বরং জনসাধারণ কি বলছে তাই শোন।
চীনা-টাউনের প্রাচীরের পাশে একটা ছোট দল পশমি কোট-পরা একটি লোককে ঘিরে ভিড় করেছে। লোকটির হাতে একটা কাগজ।
সম্রাটের আদেশ-পত্র, সম্রাটের আদেশ-পত্র পড়া হচ্ছে! ভিড়ের ভিতর থেকে অনেকের গলা শোনা গেল। সকলে পাঠকের দিকে ছুটতে শুরু করল।
পশমি কোট-পরা লোকটি ৩১শে আগস্ট তারিখের ইস্তাহার পড়ছে। চারদিকে থেকে লোককে ভিড় করে আসতে দেখে লোকটি কিছুটা বিচলিত বোধ করল, কিন্তু লম্বা ছেলেটি ভিড় ঠেলে তার কাছে হাজির হয়ে পড়ার দাবি জানাতে সে কাঁপা গলায় ইস্তাহারটা গোড়া থেকে পড়তে লাগল।
কাল ভোরেই আমি প্রশান্ত মহামহিমের কাছে যাব, (বিজয়ীর হাসি হেসে ভুরু কুঁচকে লম্বা ছেলেটা বলল, প্রশান্ত মহামহিম) এই শয়তানদের সমূলে বিনাশ করতে তার সঙ্গে পরামর্শ করব, কাজ করব, সেনাবাহিনীকে সাহায্য করব। তাদের ধ্বংস করার কাজে আমরাও অংশগ্রহণ করব, এইসব অতিথিদের জাহান্নামে পাঠাব। ডিনারের সময় ফিরে এসেই কাজ শুরু করব। এই শয়তানদের একেবারে তচনচ করে ছাড়ব।
শেষের কথাগুলি যখন পড়া হল তখন চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। লম্বা ছেলেটি বিষণ্ণভাবে মাথাটা নুইয়ে রেখেছে। স্পষ্ট বোঝা গেল যে শেষের অংশটা কেউই বুঝতে পারেনি। বিশেষ করে ডিনারের সময় ফিরে এসে কথাটায় পাঠক ও শ্রোতা সকলেই অসন্তুষ্ট হয়েছে। এসব সাধারণ কথা তো যে কেউ বলতে পারে, একজন উচ্চতম কর্তৃপক্ষের ইস্তাহারে একথা থাকা উচিত হয়নি।
সকলেই নিরাশ হয়ে চুপ করে রইল। লম্বা যুবকটি ঠোঁট নাড়তে নাড়তে এ-পাশে ও-পাশে দুলতে লাগল।
ওকে জিজ্ঞাসা করা উচিত…ওই তো তিনি স্বয়ং!…ঠিক, ওকেই জিজ্ঞাসা করা হোক! কেন করব না? উনি সব বুঝিয়ে বলবেন…হঠাৎ ভিড়ের পিছন দিক দেখে এই ধরনের নানা কথা কানে এল। দুই দল অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে পুলিশ-সুপারিন্টেডেন্ট স্কোয়ারের দিকে যাচ্ছিল; সকলেরই দৃষ্টি গেল তার গাড়ির উপর।
কাউন্ট রস্তপচিনের হুকুমে পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্ট সকালেই গিয়েছিল বজরা পুড়িয়ে দিতে; সেই ব্যাপারে বহু টাকা পকেটস্থ করেই সে ফিরছে। একদল লোককে এগিয়ে আসতে দেখে সে কোয়ানকে গাড়ি থামাতে। বলল।
লোকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, এরা সব কারা?
কোনো জবাব না পেয়ে আবার চিৎকার করে বলল, এরা সব কারা?
পশমি কোট-পরা দোকানি জবাব দিল, ইয়োর অনার, হাইয়েস্ট এক্সেলেন্সি কাউন্টের ঘোষণা মতে এরা জীবন পণ করে দেশের সেবা করতে চায়; এটা কোনোরকম দাঙ্গাহাঙ্গামা নয়,কিন্তু যেহেতু হাইয়েস্ট এক্সেলেন্সি বলেছেন…
পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্ট বলল, কাউন্ট তো চলে যাননি, এখানেই আছেন; তোমাদের সম্পর্কেও একটা ঘোষণা প্রচার করা হবে।…চালাও! কোচয়ানকে হুকুম দিল।
সুপারিন্টেন্ডেন্টের কথাগুলি যারা শুনতে পেল, লোকজন এসে তাদের চারদিকে ভিড় করল; চলমান গাড়িটার দিকে তাকাল।
সেইমুহূর্তে পুলিশ-সুপারিন্ডেন্ডেন্টও শংকিত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে কোয়ানকে কি যেন বলল। ঘোড়াগুলো গতি বাড়িয়ে দিল।
লম্বা যুবকটি চেঁচিয়ে বলল, সব ফাঁকিবাজি হে! ওর পিছু নাও! ওকে যেতে দিও না হে বাছারা! আমাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে তবে চলে যাক। ওকে ধর! চিৎকার করতে করতে সকলে গাড়িটার পিছনে ছুটতে লাগল।
উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে বলতে ভিড়ের লোকজন পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্টকে অনুসরণ করে লুবিয়াংকা স্ট্রিটের দিকে চলল।
ভিড়ের মধ্যে নানা কণ্ঠস্বরে বারবারই উচ্চারিত হতে লাগল, ঐ দেখ, ভদ্রলোক আর ব্যবসায়ীরা ভেগেছে, আর আমাদের রেখে গেছে মরতে। ওরা কি মনে করে আমরা কুকুরের দল?
.
অধ্যায়-২৪
১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কুতুজভের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে কাউন্ট রন্তপচিন মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হয়ে মস্কোতে ফিরে গেল; তার কারণ সমর পরিষদে তাকে আমন্ত্রণ করা হয়নি এবং শহর রক্ষার যে প্রস্তাব সে দিয়েছিল কুতুজত তাকেও আমল দেয়নি। তাছাড়া, শিবিরে এসে সে যখন বুঝল যে শহরের শান্ত ভাব ও দেশপ্রেমের উত্তেজনাকে শুধু যে গৌণ ব্যাপার বলে মনে করা হচ্ছে তাই নয়, মনে করা হচ্ছে সম্পূর্ণ অবান্তর ও গুরুত্বহীন ব্যাপার বলে, তখন তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এইসব দেখেশুনে বিচলিত, আহত ও বিস্মিত হয়ে রক্তপচিন মস্কো ফিরে এল। নৈশাহারের পরে পোশাক না ছেড়েই সে একটা সোফায় শুয়ে পড়ল; মাঝরাতের ঠিক পরেই জনৈক সংবাদবাহক কুতুজভের একটা চিঠি নিয়ে এসে তার ঘুম ভাঙাল। চিঠিতে কাউন্টকে অনুরোধ করা হয়েছে, যেহেতু সেনাবাহিনী মস্কো ছাড়িয়ে রিয়াজান রোডের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছে সেইজন্য পুলিশ অফিসারদের সেখানে পাঠিয়ে দেয়। রস্তপচিনের কাছে এটা কোনো খবরই নয়। মস্কো পরিত্যক্ত হবে সেকথা সে যে আগের দিন পকলোনি পাহাড়ের উপর কুতুজভের সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই জানতে পেরেছে তাই শুধু নয়, কথাটা সে জেনেছে বরদিনো যুদ্ধের পর থেকেই, কারণ সে যুদ্ধের পর থেকে সেনাপতিরা যে যখন মস্কো এসেছে সকলেই একবাক্যে বলেছে যে আর একটা যুদ্ধ করা একেবারেই অসম্ভব; তাছাড়া তখন থেকেই প্রতি রাত্রে সব সরকারি সম্পত্তি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং রস্তপচিনের নিজের অনুমতিক্রমেই অর্ধেক বাসিন্দা মস্কো ছেড়ে চলে গেছে। তথাপি রাতের বেলা সুখন্দ্রিাটুকু ভেঙে দিয়ে সে খবরটা একটা সাধারণ চিঠির আকারে কুতুজভের হুকুমসহ আসায় সে বিস্মিত ও বিরক্ত হয়েছে।
পরবর্তীকালে নিজের স্মৃতিকথায় এই সময়কার কার্যাবলি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সে বারবার বলেছে যে দুটি মাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বারা সে তখন পরিচালিত হয়েছে : মস্কোতে শান্তি বজায় রাখা এবং অধিবাসীদের চলে যাওয়া ত্বরান্বিত করা। এই দুটি উদ্দেশ্যকে স্বীকার করে নিলে রস্তপচিনের তৎকালীন সব কাজকর্মই নিন্দার
অতীত বলে মনে হবে। পবিত্র স্মৃতিচিহ্নসমূহ, অস্ত্রশস্ত্র, কামান-বন্দুক, গোলা-বারুদ ও শস্য-ভাণ্ডার কেন– সরিয়ে ফেলা হয়নি? কেন হাজার হাজার অধিবাসীকে ঠকিয়ে বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে মস্কোকে শত্রুর হাতে তুলে দেওয়া হবে না-তাদের সর্বনাশ করা হবে না। কাউন্ট রস্তপচিনের কৈফিয়ৎ, শহরের শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে। … সরকারি অফিসগুলো থেকে বস্তা-বস্তা অকেজো কাগজপত্র, আর লেপপিসের বেলুন ও অন্যান্য জিনিসপত্র কেন সরানো হয়েছিল? রস্তপচিনের কৈফিয়ৎ, শহরকে ফাঁকা করে রেখে যেতে। জন শান্তি বিপন্ন–একথা মেনে নিলে যে কোনো কাজেরই সমর্থন মেলে।
ত্রাসের রাজত্বের সব ভয়াবহতার একমাত্র ভিত্তি জনগণের শান্তি বিধানের কামনা।
তাহলে ১৮১২ সালে মস্কোর শান্তি বিঘ্নিত হবার ভয় কাউন্ট রস্তপচিনের মনে এসেছিল কেন? শহরে একটা বিদ্রোহ দেখা দেবার সম্ভাবনার কথা ভাববার কি কারণ ছিল? অধিবাসীরা মস্কো ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, আর পশ্চাদপসরণকারী সৈন্যরা এসে সে স্থান পূর্ণ করছিল। তার ফলে সাধারণ মানুষ দাঙ্গা বাধাবে কেন?
শত্রু যখন একটা শহরে ঢোকে তখন মস্কোতে অথবা রাশিয়ার অন্য কোনো জায়গায় কখনো গণ অভ্যুত্থানের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। ১লা ও ২রা সেপ্টেম্বর তারিখেও দশ হাজারের বেশি মানুষ মস্কোতে ছিল, কিন্তু শাসনকর্তার নির্দেশে তার বাড়ির সামনে সমবেত কিছু লোকের উজ্জ্বলতা ছাড়া আর কোথাও কিছু ঘটেনি। একথা তো খুবই পরিষ্কার যে বরদিনের যুদ্ধের পর মস্কো পরিত্যাগ করা যখন নিশ্চিত হয়ে উঠেছিল, অন্ততপক্ষে তার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তখন অস্ত্রশস্ত্র বিলিয়ে এবং ইস্তাহার বিলি করে জনসাধারণকে উত্তেজিত না করে রস্তপচিন যদি পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন, গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র ও টাকাপয়সা সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করত এবং লোকজনদের খোলাখুলি বলে দিত যে শহরটাকে পরিত্যাগ করা হবে, তাহলে জনসাধারণের মধ্যে একটা গোলযোগের আশংকা করার কারণ অনেক কমে যেত।
দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হলেও রস্তপচিন ছিল আশাবাদী ও আবেগপ্রবণ; সবসময় ঊর্ধ্বতম শাসকমহলেই সে চলাফেরা করত; যাদের পরিচালক বলে সে নিজেকে ভাবত সেই জনসাধারণের সঙ্গে তার সম্যক পরিচয় ছিল না। যদিও সে জানত যে দুর্দিন আসছে, তবু একেবারে শেষমুহূর্ত পর্যন্তও সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত না যে মঙ্কোকে ছেড়ে যেতে হবে, আর তাই সেজন্য সে প্রস্তুতও ছিল না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই অধিবাসীরা মস্কো ছেড়ে গেল। সরকারি আপিসগুলো সরিয়ে দেওয়া হল কর্মচারীদের দাবিতে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাউন্টকে সে দাবি মেনে নিতে হয়েছিল। তীব্র কল্পনাবিলাসী মানুষের বেলায় যেমনটি হয়ে থাকে, মস্কো ছেড়ে চলে যেতে হবে এ-কথাটা অনেকদিন আগে থেকেই জানলেও রন্তপচিন সেটা জানত বুদ্ধি দিয়ে, কিন্তু অন্তরে তা বিশ্বাস করত না, আর তাই এই নতুন পরিস্থিতির জন্য কোনো মানসিক প্রস্তুতিও সে নেয়নি।
তার যতকিছু কাজকর্ম (কার্যক্ষেত্রে তা কতদূর ফলপ্রসূ হয়েছিল সেটা অন্য প্রশ্ন) সব কিছুরই লক্ষ্য ছিল জনগণের মনে দেশাত্মবোধক ফরাসি-বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলা।
কিন্তু ঘটনাবলী যখন প্রকৃত ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করল, যখন ফরাসি-বিদ্বেষের বুলিতে আর কুললো না, এমন একটা যুদ্ধের ভিতর দিয়ে সে বিদ্বেষকে প্রকাশ করাও সম্ভব হল না, মস্কোর একমাত্র প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে আত্মবিশ্বাসের যখন আর কোনো দামই রইল না, যখন সব মানুষ এককাট্টা হয়ে সবকিছু ছেড়ে স্রোতের মতো মস্কো ছেড়ে যেতে লাগল এবং সেই নেতিবাচক কাজের ভিতর দিয়েই তাদের জাতীয়তাবোধের প্রমাণ রাখল, তখন জননেতার যে ভূমিকা রস্তপচিন বেছে নিয়েছিল অকস্মাৎ সেটা একেবারেই অর্থহীন হয়ে দেখা দিল। অপ্রত্যাশিতভাবে নিজেকে বড়ই হাস্যকর, দুর্বল ও নিঃসঙ্গ মনে হল; পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল যেন।
ঘুম থেকে জেগে উঠে কুতুজভের সেই অনুতাপ, অবশ্যপালনীয় চিঠি পেয়ে সে আরো বেশি বিরক্ত হয়ে উঠল। যেসব সরকারি সম্পত্তি বিশেষভাবে তার হেফাজতে রাখা আছে সেসবই এখনো মস্কোতেই রয়েছে; সে সবকিছু সরিয়ে নিয়ে যাওয়া এখন আর সম্ভব নয়।
এরজন্য কে দায়ী? কে এই সংকট ডেকে এনেছে? রস্তপচিন স্মৃতিমন্থন শুরু করল। নিশ্চয় আমি নই। আমি তো তৈরি হয়েই ছিলাম। মস্কো ছিল আমার হাতের মুঠোয়। আর তারা কি না তার এই হাল করে ছাড়ল! যত সব পাষণ্ড! বিশ্বাসঘাতক! কাদের যে সে পাষণ্ড ও বিশ্বাসঘাতক বলল তা সে নিজেই ভালো করে জানে না।
মস্কোর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেসব লোক তার কাছে এসেছিল, রস্তপচিন সারারাত তাদের জন্য হুকুম জারি করল। যারা তার কাছাকাছি থাকে তারা কোনোদিন কাউন্টকে এত বিষণ্ণ ও বিরক্ত দেখেনি।
ইয়োর এক্সেলেন্সি, রেজিস্ট্রার বিভাগের ডিরেক্টর খবর পাঠিয়েছেন…পরিষদ থেকে, সেনেট থেকে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ফাউন্ডলিং হাসপাতাল থেকে, সহযোগী বিশপের কাছ থেকে লোক এসেছে…খবরের জন্য…ফায়ার ব্রিগেড সম্পর্কে আপনার কি নির্দেশ? কারা-শাসনকর্তার কাছ থেকে…পাগলা গারদের সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছ থেকে…সারারাত এই ধরনের ঘোষণা কাউন্টের কাছে অনবরত আসতে লাগল।
এই সবরকম প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত ও ক্রুদ্ধ জবাবে সে শুধু জানাল, এখন আর তার হুকুমের কোনো দরকার নেই, তার সব সযত্বরচিত পরিকল্পনা এবার অন্য কেউ নষ্ট করে ফেলেছে। এখন যা কিছু ঘটবে তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব সেই একজনকেই বহন করতে হবে।
রেজিস্ট্রার বিভাগের প্রশ্নের জবাবে সে বলল আঃ, সেই মাথা-মোটা লোকটাকে বলে দাও, তার সব দলিলপত্র রক্ষা করতে তাকেই এখানে থাকতে হবে। ফায়ার ব্রিগেড সম্পর্কে বোকার মতো প্রশ্ন করছ কেন? তাদের সঙ্গে তো ঘোড়া আছে, তারা ভলালাদিমির চলে যাক; ঘোড়াগুলো যেন ফরাসিদের হাতে না পড়ে।
ইয়োর এক্সেলেন্সি, পাগলা গারদের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এসেছেন : তাঁকে কি হুকুম দেবেন?
আমার হুকুম? তারা চলে যাক। বাস।…আর পাগলদের শহরে ছেড়ে দেওয়া হোক। যখন পাগলরাই আমাদের সৈন্যদের চালাচ্ছে, তখন নিশ্চয় ঈশ্বরের এই ইচ্ছা যে অন্য পাগলদের মুক্তি দেওয়া হোক।
কারাগারের দণ্ডিত বন্দিদের সম্পর্কে একটা প্রশ্নের উত্তরে রস্তপচিন রেগে শাসনকর্তাকে বলল : আপনি কি আশা করেন তাদের পাহারা দেবার জন্য আপনাকে আমি দুই ব্যাটেলিয়ন সৈন্য দেব? সৈন্য পাব কোথায়? তাদের ছেড়ে দিন, বাস, মিটে গেল!
ইয়োর এক্সেলেন্সি, কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দি আছেন, মেশকভ, ভেরেশচাগিন…।
ভেরেশচাগিন! তাকে এখনো ফাঁসি দেওয়া হয়নি? রস্তপচিন চেঁচিয়ে উঠল। তাকে আমার কাছে নিয়ে এস!
.
অধ্যায়-২৫
সকাল নটা নাগাদ মস্কোর ভিতর দিয়ে সৈন্যদের চলাচল শুরু হয়ে গেল। তখন থেকে আর কেউ নির্দেশের জন্য কাউন্টের কাছে এল না। যারা যেতে পারল নিজের থেকেই চলে গেল, আর যারা থেকে গেল তারাও নিজেরাই কর্তব্য স্থির করল।
সকোলনিকি যাবার জন্য গাড়ি আনতে বলে কাউন্ট পড়ার ঘরে গিয়ে দুইহাত জোড় করে বিষণ্ণ, বিবর্ণ মুখে চুপচাপ বসে রইল।
দেশ যখন শান্ত ও গোলযোগহীন থাকে তখন প্রত্যেক শাসকই ভাবে যে একমাত্র তার চেষ্টাতেই তার শাসনাধীন লোকগুলি চলাফেরা করে, আর এই অপরিহার্যতার চেতনার মধ্যেই সব শাসক তার সব চেষ্টা ও শ্রমের প্রধান পুরস্কার খুঁজে পায়। ইতিহাসের সমুদ্র যখন শান্ত থাকে তখন শাসক-কর্তৃপক্ষ তার তার ভঙ্গুর নৌকোখানিকে একটা আঁকড়ার সাহায্যে জল-জাহাজের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে নিজে চলতে থাকে আর স্বাভাবিকভাবেই কল্পনা করে যে তার চেষ্টাতেই জাহাজখানা চলছে। কিন্তু যেই ঝড় ওঠে, সমুদ্র বিক্ষুব্ধ হয়, জাহাজ চলতে থাকে, তখন আর সে ভ্রান্ত ধারণা থাকা সম্ভব নয়। জাহাজ তখন নিজের প্রচণ্ড গতিতেই এগিয়ে চলে, নৌকোর আঁকড়াটা আর সেই চলমান জাহাজ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না, আর সঙ্গে সঙ্গে সেই শাসক আর শাসক থাকে না। শক্তির উৎস থাকে না, সে হয়ে যায় একটি তুচ্ছ, অকর্মণ্য, দুর্বল মানুষ।
রস্তপচিনেরও তাই মনে হচ্ছে, আর সেইজন্যেই সে আরো চটে গেছে।
যে পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্টকে জনতা থামিয়েছিল সে যখন রস্তপচিনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল ঠিক তখনই একজন অ্যাডজুটান্ট এসে খবর দিল যে ঘোড়ার সাজ পরানো হয়েছে। দুজনের মুখই বিবর্ণ; তার নির্দেশ মতোই কাজ করা হয়েছে এ-সংবাদ জানিয়ে সুপারিন্টেন্ডেন্ট কাউন্টকে খবর দিল যে অনেক লোক তার উঠোনে ভিড় করেছে; তারা দেখা করতে চায়।
একটি কথাও না বলে রস্তপচিন উঠে তাড়াতাড়ি পা ফেলে তার বিলাসবহুল বৈঠকখানায় ঢুকে ব্যালকনির দরোজার কাছে গেল, হাতলে হাত রাখল, আবার ছেড়ে দিল, তারপর জানালার ধারে গেল; সেখান থেকে বাইরের জনতাকে আরো ভালোভাবে দেখা যায়। লম্বা ছেলেটি সকলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ঘোরাচ্ছে, আর কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন বলছে। রক্তমাখা কামারটি বিষণ্ণ মুখে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধ জানালার ভিতর দিয়ে বহুকণ্ঠের গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেল।
জানালার কাছ থেকে ফিরে এসে রস্তপচিন বলল, আমার ঘোড়া কি হাজির?
হাজির ইয়োর এক্সেলেন্সি, অ্যাডজুটান্ট বলল।
রস্তপচিন আবার ব্যালকনির দরোজায় গেল।
কিন্তু ওরা কি চায়? পুলিশ-সুপারিন্টেন্ডেন্টকে জিজ্ঞাসা করল।
ইয়োর এক্সেলেন্সি, ওরা বলছে যে আপনার হুকুমমতো ওরা ফরাসিদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য তৈরি হয়েছে, আর তাই ওরা বিশ্বাসঘাতকতার কথা কি যেন বলছে। জনতা খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ইয়োর এক্সেলেন্সি–আমি কোনোরকমে ওদের হাত এড়িয়ে চলে এসেছি। ইয়োর এক্সেলেন্সি, আমার পরামর্শ যদি, শোনেন তো বলি…
আপনি যেতে পারেন। কি করতে হবে সেকথা বলার জন্য আপনাকে দরকার হবে না! রস্তপচিন সক্রোধে বলল।
জনতার দিকে চোখ রেখে সে ব্যালকনির দরোজায় দাঁড়িয়ে রইল।
এসব কিছুর জন্য যে লোকটি দায়ী তার বিরুদ্ধে অবরুদ্ধ ক্রোধে সে ভাবতে লাগল, তারাই তো রাশিয়ার এই হাল করেছে। আমার এই হাল করেছে। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে ভাবল, ওই এক উচ্ছল জনতা, সমাজের আবর্জনা : তাদের বোকামির জন্যই ওরা মাথা তুলতে পেরেছে! ওরা একটা শিকার খুঁজছে। একথাটা তার মনে হল কারণ সে নিজেই এমন একটি শিকার খুঁজছে যার উপর মনের ঝালটা মেটানো যায়।
গাড়ি কি হাজির? সে আবার শুধাল।
হ্যাঁ ইয়োর এক্সেলেন্সি। ভেরেশচাগিন সম্পর্কে আপনার কি হুকুম? সে তো বারান্দায় অপেক্ষা করছে, অ্যাডজুটান্ট বলল।
যেন এক অপ্রত্যাশিত স্মৃতির আঘাতে রস্তপচিন বলে উঠল, আঃ!
তাড়াতাড়ি দরোজা খুলে দৃঢ় পদক্ষেপে সে বাইরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সব কথা থেমে গেল, মাথার সব টুপি নেমে গেল, সব চোখ পড়ল কাউন্টের উপর।
কাউন্ট হঠাই উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, শুভ সকাল বাছারা! তোমরা এখানে এসেছ বলে ধন্যবাদ। একমুহূর্তের মধ্যেই আমি তোমাদের কাছে যাচ্ছি, কিন্তু আগে শয়তানদের সঙ্গে ফয়সালা করতে হবে। যে শয়তানরা মস্কোর সর্বনাশ করেছে তাদের শাস্তি দিতেই হবে। আমার জন্য অপেক্ষা করে থাক।
তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে সরে গিয়ে কাউন্ট সশব্দে পাল্লাটা বন্ধ করে দিল।
ভিড়ের মধ্যে সমর্থন ও সন্তোষের একটা গুঞ্জন বয়ে গেল। তিনি শয়তানদের সঙ্গে একটা ফয়সালা করবেনই, তোমরা দেখে নিও। আর তোমরা বলছ যে ফরাসিরা…আইন কাকে বলে সেটা তিনিই তোমাদের দেখিয়ে দেবেন। তারা এমনভাবে কথা বলতে লাগল যেন এই লোকটির উপর ভরসা না রাখার জন্য একে অন্যকে তিরস্কার করছে।
কয়েক মিনিট পরে একজন অফিসার দ্রুতপায়ে সামনের দরোজা দিয়ে বেরিয়ে এসে কি যেন হুকুম করল, আর অশ্বারোহীর দল সারি দিয়ে দাঁড়াল। জনতা সাগ্রহে ব্যালকনি থেকে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। ক্রুদ্ধ, দ্রুত পা ফেলে রস্তপচিন সেখানে বেরিয়ে এসে এমনভাবে চারদিকে তাকাতে লাগল যেন কাউকে খুঁজছে।
কোথায় সে? সে খোঁজ করল। বলতে বলতেই সে দেখতে পেল একটি যুবক বাড়িটার মোড় ঘুরে দুই দল অশ্বারোহীর মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসছে। তার ঘাড়টা সরু ও লম্বা, অর্ধেক কামানো মাথায় আবার ছোট ছোট চুল গজিয়েছে। যুবকটির পরনে শেয়ারের লোমের পাড়বসানো নীল কাপড়ের ছেঁড়া জামা, একদিন হয়তো সেটা সৌখিন ছিল, শনপাটের নোংরা কয়েদির ট্রাউজার, আর পাতলা, নোংরা ছেঁড়া বুট। দুটি দুর্বল পায়ে ভারি শেকল বাঁধা, যার ফলে তার চলতে কষ্ট হচ্ছে।
আঃ! বলে রস্তপচিন, তাড়াতাড়ি যুবকটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বারান্দার একেবারে নিচের সিঁড়িটা দেখিয়ে বলল, ওকে এখানে নিয়ে এস।
শিকলের ঝন ঝন শব্দ তুলে যুবকটি নির্দেশিত জায়গার দিকে এগিয়ে গেল। কোটের কলারটা গলায় চেপে বসায় একটা আঙুল দিয়ে সেটাকে ঠেলে ধরে ঘাড়টাকে দুইবার এদিক-ওদিকে ঘোরাল, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কাজে অনভ্যস্ত হাত দুটি জোড় করে বিনীতভাবে দাঁড়াল।
কয়েক সেকেন্ড সব চুপ। শুধু পিছনের সারির যে লোকগুলো সেই একটি জায়গার দিকে এগিয়ে আসতে চাপ দিচ্ছে, তাদের দীর্ঘশ্বাস, আর্তনাদ ও পা ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
যুবকটি যতক্ষণ সিঁড়িতে তার নির্দিষ্ট জায়গায় এল ততক্ষণ পর্যন্ত রস্তপচিন ভুরু কুঁচকে এক হাতে মুখটা মুছতে মুছতে দাঁড়িয়ে রইল।
কণ্ঠস্বরে একটা ধাতব শব্দ তুলে বলল, বাছারা! এই লোকটি, এই ভেরেশচাগিনই সেই শয়তান যার কৃতকর্মের ফলে মস্কো আজ ধ্বংস হতে বসেছে।
লোমের পট্টি দেওয়া কোট পরা যুবকটি একটু ঝুঁকে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে; আঙুলগুলো সামনের দিকে একত্র করা। মাথাটা অর্ধেক কামানোর ফলে বিকৃতদর্শন শীর্ণ তরুণ মুখখানি অসহায়ভাবে ঝুলে পড়েছে। কাউন্টের প্রথম কথাগুলি শুনেই সে ধীরে ধীরে মাথা তুলে তার দিকে তাকাল; যেন কিছু বলতে চাইল, অথবা অন্তত তার চোখে চোখ রাখতে চাইল। যুবকটির লম্বা সরু গলার একটা শিরা দড়ির মতো ফুলে উঠে কানের কাছে নীল হয়ে গেল; হঠাৎ তার মুখটা লাল হয়ে উঠল।
সকলের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ। সেও জনতার দিকে তাকাল; তাদের মুখের ভাব দেখে কিছুটা আশান্বিত হয়ে একটুকরো ভীরু, বিষণ্ণ হাসি ফুটল তার মুখে মাথাটা নিচু করে সিঁড়িতে পা দিল।
সে জারের প্রতি, তার দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, বোনাপার্তের দলে ভিড়েছে। একমাত্র সেই রাশিয়ার নামে কলংক লেপন করেছে, মস্কোকে ধ্বংস করেছে, কর্কশ, জোরালো গলায় কথাগুলি বলে রস্তপচিন হঠাৎ ভেরেশচাগিনের দিকে তাকাল; তখনো সে একই বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সে দৃশ্য দেখে জ্বলে উঠে রস্তপচিন হাত তুলে জনতাকে সম্বোধন করে চিৎকার করে বলে উঠল :
ওকে নিয়ে তোমরা যা ভালো মনে কর তাই কর! ওকে তোমাদের হাতেই তুলে দিলাম!
জনতা নিপ; ক্রমেই একে অন্যের আরো কাছে ঘেঁষে দাঁড়াল। এইভাবে পরস্পর ঠেলাঠেলি করা, এই রুদ্ধ বাতাসে শ্বাস টানা, একটুও নড়াচড়া করবার জায়গা না পেয়ে একটা অজ্ঞাত, দুর্বোধ্য ও ভয়ংকর কিছুর জন্য অপেক্ষা করা ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছে। যারা সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যারা সবকিছু দেখেছে ও শুনেছে, তারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চোখ ও মুখ বিস্ফারিত করে দাঁড়িয়ে আছে, আর যারা পিছন থেকে এগিয়ে আসতে চেষ্টা করছে তাদের ঠেলে রাখছে।
রস্তপচিন চিৎকার করে বলল, ওকে মার!…বিশ্বাসঘাতকের মৃত্যু হোক, রাশিয়ার নামে সে যেন আর কলঙ্ক লেপন করতে পারে না পারে! ওকে কেটে ফেল। আমি হুকুম দিচ্ছি।
যত না মুখের কথায় তার চাইতে বেশি রস্তপচিনের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনে জনতা আর্তনাদ করে ঢেউয়ের মতো এগিয়ে গিয়েও আবার থেমে গেল।
সেই ক্ষণিক নিস্তব্ধতার মাঝখানে ভেরেশচাগিন ভীরু অথচ নাটকীয় স্বরে বলে উঠল, কাউন্ট! আমাদের দুইজনের মাথার উপরে একই আকাশ… মাথাটা তুলল; সরু গলার মোটা শিরাটা আবারও রক্তে ভরে উঠল; মুখের উপর অঙ্ক্ষিত রঙের ছোপ পড়ে আবার মিলিয়ে গেল।
যা বলতে চেয়েছিল তা বলা হল না।
ভেরেশচাগিনের মতোই বিবর্ণ মুখে রস্তপচিন চিৎকার করে বলল, ওকে কেটে ফেল! আমি হুকুম দিচ্ছি।
নিজের তরবারি কোষমুক্ত করে অশ্বারোহী অফিসার চেঁচিয়ে বলল, তরবারি খোল!
জনতার মধ্যে আবার একটা ঢেউ উঠল; সে ঢেউ প্রথম সারিতে পৌঁছে তাকে বারান্দার প্রথম ধাপে পৌঁছে দিল। লম্বা যুবকটি মুখে প্রস্তরকঠিন ভাব ফুটিয়ে হাত তুলে ভেরেশচাগিনের পাশে দাঁড়াল।
অশ্বারোহী অফিসার ফিসফিসিয়ে বলল, ওকে তরবারির আঘাত হান!
ক্রোধে বিকৃত মুখ একটি সৈন্য তার তরবারির ভোতা দিক দিয়ে ভেরেশচাগিনের মাথায় আঘাত করল।
কেন যে তাকে এভাবে আঘাত করা হল সেটা বুঝতে না পেরে ভীরু বিস্ময়ে ভীত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে ভেরেশচাগিন আঃ! বলে চিৎকার করে উঠল। ভিড়ের মধ্যেও অনুরূপ সবিস্ময়ে আর্তনাদ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। বিষণ্ণ গলায় কে যে বলে উঠল হায় প্রভু!
বিস্ময়সূচক শব্দটা মুখ থেকে বেরিয়ে যাবার পরেই ভেরেশচাগিন যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আর্তনাদ করে উঠল, আর সেই আর্তনাদ হল মারাত্মক। মানুষের অনুভূতির যে প্রাচীর এতক্ষণ জনতাকে সংযত রেখেছিল এবার চরম সীমায় পৌঁছে সেটা ভেঙে পড়ল। অপরাধ শুরু হয়েছিল, এবার তাকে সম্পূর্ণ করতে হবে। তিরস্কারের যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ জনতার ভয়ংকর ক্রুদ্ধ গর্জনের তলে ডুবে গেল। সপ্তম ও সর্বশেষ আঘাত যেভাবে একটা জাহাজকে চুরমার করে দেয়, তেমনই অপ্রতিহত শেষ ঢেউটি পিছন থেকে ধেয়ে এসে প্রথম সারির উপর আছড়ে পড়ল, তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল, ডুবিয়ে দিল। অশ্বারোহী সৈনিকটি আবার আঘাত হানতে উদ্যত হল। ভেরেশচাগিন আতঙ্কে আর্তনাদ করে দুই হাতে মাথাটা ঢেকে ভিড়ের দিকে ছুটে গেল। লম্বা যুবকটির সঙ্গে ধাক্কা খেতেই সেও দুই হাতে তার সরু গলাটা চেপে ধরে বেপরোয়া ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠে তাকে নিয়েই অগ্রসরমান জনতার পায়ের নিচে পড়ে গেল।
কেউ ভেরেশচাগিনকে আঘাত করল, তার পোশাক ছিঁড়ে ফেলল, কেউ বা ঝাঁপিয়ে পড়ল লম্বা যুবকটির উপর। যারা পায়ের নিচে চাপা পড়ল আর যারা লম্বা ছেলেটাকে রক্ষা করতে চেষ্টা করল তাদের মিলিত আর্তনাদে জনতার রোষবহ্নি আরো প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। রক্তাপুত যুবকটিকে তাদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেবার আগেই ক্রুদ্ধ জনতা মারতে মারতে তাকে প্রায় মেরে ফেলবার উপক্রম করে ফেলেছে। আর কাজটাকে অদ্রুিত শেষ করার চেষ্টা সত্ত্বেও যারা ভেরেশচাগিনকে আঘাত করছে, গলা টিপে ধরছে, টানা-হেঁচড়া করছে তারা তাকে একেবারে শেষ করতে পারল না, কারণ ভিড়ের লোকজন চারদিক থেকে চাপ সৃষ্টি করে মাঝখানে এমনভাবে জমাট বেঁধে গেছে যে তারা না পারছে তাকে মেরে ফেলতে, না পারছে তাকে ছেড়ে দিতে।
আরে, একটা কুড় ল দিয়ে মার!…বিশ্বাসঘাতক, খৃষ্টকে বেচে দিয়েছে…এখনো প্রাণে বেঁচে আছে…নাছোড়বান্দা…ঠিক দাওয়াই দেওয়া হয়েছে। কষ্ট না দিলে চোর শায়েস্তা হয় না। টাঙ্গি চালাও!…সে কি–তবু বেঁচে আছে?
আক্রান্ত যুবকটি যখন লড়াইতে ক্ষান্ত দিল, তার চিৎকার যখন একটা একটানা লম্বা মৃত্যু-গোঙানিতে পরিণত হল, তখনই ধরাশায়ী রক্তাক্ত দেহটার চারপাশ থেকে ভিড় সরে যেতে লাগল। প্রত্যেকেই একবার এগিয়ে এসে নিজেদের কৃতকর্মের ফল দেখে ভয়ে, বিস্ময়ে ও ধিক্কারে পিছিয়ে যেতে লাগল।
হে প্রভু! মানুষ কি আজ বন্যপণ্ড হয়ে গেছে! কেমন করে এ এখনো বেঁচে আছে? ভিড়ের মধ্যে নানা কণ্ঠস্বর শোনা যেতে লাগল। আর একেবারেই ছেলেমানুষ…নিশ্চয় কোনো ব্যবসায়ীর ছেলে। কী মানুষ সব!…আর তারা বলছে ও সঠিক লোক নয়…কেমন করে নয়?…হে প্রভু! ঐ তো আরো একজনকে মেরেছে–সকলেই বলছে তার প্রায় হয়ে এসেছে…হায়রে মানুষ…তাদের কি পাপের ভয় নেই?…সেই একই জনতা এখন যন্ত্রণাদীর্ণ ক্ষোভের সঙ্গে মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে বলছে; লোকটির সরু গলাটা অর্ধেক কেটে ফেলা হয়েছে; কালসিটে-পড়া মুখটা রক্তে ও ধুলোয় মাখামাখি।
একজন কষ্টসহিষ্ণু পুলিশ অফিসার হিজ এক্সেলেন্সি বাড়ির উঠোনে একটা মৃতদেহ পড়ে থাকা ভালো দেখায় না বিবেচনা করে অশ্বারোহী সৈনিকদের সেটাকে সরিয়ে ফেলতে বলল। দুইজন অশ্বারোহী সৈনিক বিকৃত ঠ্যাং ধরে মাটির উপর দিয়ে টানতে টানতে মৃতদেহটাকে নিয়ে গেল। রক্তাক্ত, ধূলি-কলংকিত, আধা কামানো মাথা ও লম্বা গলাটা মাটির উপর দিয়ে একেবেঁকে এগিয়ে গেল। জনতা আতঙ্কে চোখ ফিরিয়ে নিল।
যেমুহূর্তে ভেরেশচাগিন মাটিতে পড়ে গেল এবং জনতা বর্বর উল্লাসে তাকে ঘিরে ধরল তখন সহসা রস্তপচিনের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল; পিছনের ফটকে যেখানে তার জন্য গাড়ি দাঁড়িয়েছিল সেদিকে না গিয়ে কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে সেসব না বুঝেই মাথা নিচু করে দ্রুত পা ফেলে সে বারান্দা ধরে একতলার ঘরগুলোর দিকে যেতে লাগল। কাউন্টের মুখ শাদা হয়ে গেছে, নিচের চোয়ালের তীব্র কাঁপুনিকে কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না।
এই পথে ইয়োর ইক্সেলেন্সি….ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?…দয়া করে এই দিকে… পিছন থেকে একটা ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
কাউন্ট রস্তপচিন কোনো জবাব দিতে পারল না, বাধ্য ছেলের মতো মুখ ঘুরিয়ে নির্দেশিত পথে এগিয়ে গেল। পিছনের ফটকে দাঁড়িয়েছিল তার কালিচে-গাড়ি। ভিড়ের লোকদের উন্মাদ কণ্ঠস্বর তখনো শোনা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসনে বসে কোয়ানকে বলল, সকোলনিকিতে তার পল্লীভবনের দিকে গাড়ি চালাতে।
মিয়াসনিৎস্কি স্ট্রিটে পৌঁছে যখন উন্মত্ত জনতার চিৎকার আর শোনা গেল না তখন কাউন্টের অনুশোচনা শুরু হল। অধীনস্থ কর্মচারীদের সামনে যে উত্তেজনা ও ভীতি সে প্রকাশ করেছে সেকথা মনে করে সে দুঃখিত হল। ফরাসিতে নিজেকেই বলতে লাগল, হাঙ্গামাকারী জনতা কী ভয়ংকর বিরক্তিকর। তারা যেন নেকড়ে বাঘ, মাংস না খেলে তাদের তৃপ্তি হয় না। কাউন্ট! আমাদের দুজনেরই মাথার উপরে আছেন একই ঈশ্বর!-ভেরেশচাগিনের কথাগুলি হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, আর একটা অসন্তুষ্টির স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে লাগল। কিন্তু এটা তার ক্ষণিকের অনুভূতিমাত্র; কাউন্ট রস্তপচিনের মুখে দেখা দিল আত্ম-নিন্দার হাসি। ভাবল, আমার তো অন্য কর্তব্যও ছিল। জনগণকে তো শান্ত করতে হবে। জনকল্যাণের জন্য আরো অনেকে প্রাণ দিয়েছে-এখনো দিচ্ছে।…আমি যদি শুধুমাত্র থিয়োডোর ভাসিলিয়েভিচ হতাম তাহলে আমার কর্মধারা হত সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, কিন্তু প্রধান সেনাপতি হিসেবে আমার জীবন ও মর্যাদা রক্ষা করা কর্তব্য।
গাড়ির নরম গদিতে বসে ঈষৎ দুলতে দুলতে এবং জনতার সেই ভয়ঙ্কর হল্লা আর কানে না আসাতে রস্তপচিনের শরীরটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল, আর সেইসঙ্গে মনটাকেও শান্ত করে তুলবার উপযুক্ত করার কাজে ব্যাপৃত হল।
সে যা করেছে তার জন্য নিজের বিচার-বুদ্ধি তাকে দোষী তো করলই না, বরং একটি অপরাধীকে শাস্তি দেবার এবং সেইসঙ্গে উন্মত্ত জনতাকে শান্ত করবার এমন একটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছে বলে আত্মতুষ্টিতে তার মন ভরে উঠল।
ভেরেশচাগিনকে বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, রস্তপচিন ভাবতে লাগল (যদিও সেনেট তাকে কঠোর সশ্রম দণ্ডমান দিয়েছিল) সে তো একটি বিশ্বাসঘাতক, গুপ্তচর। আমি তো তাকে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দিতে পারি না, তাই এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছি : ক্ষিপ্ত জনতাকে শান্ত করতে তাদের হাতে একটি শিকার তুলে দিয়েছি, আর সেইসঙ্গে একজন দুষ্কৃতকারীকে শাস্তি দিয়েছি।
দেশের বাড়িতে পৌঁছে গৃহস্থালীর ব্যাপারে নানান নির্দেশাদি দিতে শুরু করে কাউন্ট সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে গেল।
আধঘণ্টা পরেই দ্রুতগামী অশ্বচালিত গাড়িতে চেপে সকোলনিকির মাঠের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে তার মনে অতীতকে নিয়ে কোনো চিন্তাই এল না, এখন তার চিন্তা শুধু যা ঘটবে তাকে নিয়ে। সে শুনেছে কুতুজভ এখন ইয়াউজা সেতুতে আছে; তাই সেখানেই সে চলেছে। কুতুজভের ধোঁকাবাজির জন্য তাকে যে ক্রুদ্ধ, হুল ফোঁটানো কথাগুলি শোনাবে সেটাই মনে মনে আওড়াচ্ছে। সেই বুড়ো শেয়ালকে সে বুঝিয়ে দেবে, শহর পরিত্যাগ করে যে দুর্গতিকে সে ডেকে এনেছে, যেভাবে রাশিয়ার সর্বনাশ ঘটিয়েছে তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পড়বে তারই বাহাতুরে বুড়োর মাথার উপর। কুতুজভ যা যা বলবে মনে মনে সেগুলি ভাবতেই রস্তপচিন রাগে গাড়ির মধ্যেই মুখ ফিরিয়ে কঠোর দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।
সকোলনিকির মাঠও পরিত্যক্ত। শুধু একেবারে শেষপ্রান্তে অতিথিশালা ও পাগলাগারদের সামনে শাদা পোশাকপরা কিছু লোক দেখা যাচ্ছে, আর তাদের মতোই আরো কিছু লোক মাঠে হাঁটতে হাঁটতে যার যার মতো চিৎকার করছে, হাত-পা নাড়ছে। তাদের মধ্যে একজন কাউন্ট রন্তপচিনের গাড়িচলার পথটা পার হবার জন্য সেইদিকেই ছুটে আসছে। এইসব ছাড়া-পাওয়া পাগলগুলোকে বিশেষ করে যে পাগলটা তাদের দিকে দৌড়ে আসছে তাকে দেখে স্বয়ং কাউন্ট, তার কোচয়ান ও অশ্বারোহী সৈনিকরা আতঙ্কে ও কৌতূহলে সেইদিকে ড্রেসিং-গাউন পরে লম্বা কম গলায় চিৎকার কর দাড়ি,
ঝোলা ড্রেসিং-গাউন পরে লম্বা সরু পা ফেলে এপাশ-ওপাশ দুলতে দুলতে পাগলটা সবেগে ছুটছে, তার দৃষ্টি রস্তপচিনের উপর নিবদ্ধ, কর্কশ গলায় চিৎকার করতে করতে সে ইশারায় তাকে থামতে বলছে। পাগলটার গম্ভীর, বিষণ্ণ মুখটা শুকনো ও হলদে, মুখে অসমান দাড়ি, চোখের জাফরান-হুঁদ শাদা অংশের মধে উজ্জ্বল কালো মণি দুটো নিচের পাতার কাছে অস্থিরভাবে ঘুরছে।
থাম! ঘোড়া থামাও, আমি বলছি, তীক্ষ্ণ স্বরে সে চিৎকার করে উঠল; হাত-পা নেড়ে প্রতিটি কথার উপর অতিরিক্ত জোর দিয়ে সে অনবরত চেঁচাতে লাগল।
কালিচে-গাড়িটাকে ধরে ফেলে সে তার পাশে পাশে দৌড়তে লাগল।
তিনবার তারা আমাকে খুন করেছে, তিনবার আমি মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে উঠেছি। তারা আমাকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে, ক্রুশে বিদ্ধ করেছে…আমি আবির্ভূত হবই…হবই…হবই। তারা আমার দেহটাকে ছিঁড়েছে। ঈশ্বরের রাজ্যের পতন ঘটানো হবে। তিনবার আমি তার পতন ঘটাব, আবার তিনবার তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করব! ক্রমেই গলা চড়াতে চড়াতে সে চেঁচাতে লাগল।
জনতা যখন ভেরেশচাগিনকে ঘিরে ধরেছিল তখনকার মতোই কাউন্ট রস্তপচিনের মুখটা হঠাৎ শাদা হয়ে গেল। মুখ ঘুরিয়ে নিল। কাঁপা গলায় কোচয়ানকে বলল, চালাও..আরো জোর! কালিচে-গাড়িটা যত দ্রুত সম্ভব উড়ে চলল, কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত পাগলটার হতাশ আর্তকণ্ঠ তার কানে বাজতে লাগল, ক্রমেই দূর। হতে দূরে অস্পষ্টতর হয়ে এল; তার চোখের সামনে আর কিছু নেই, শুধু ভাসতে লাগল লোমের পটি বসানো কোট পরা সেই বিশ্বাসঘাতকের বিস্মিত, ভয়ার্ত, রক্তাক্ত মুখটা।
এই মানসিক ছবিটা এত টাটকা যে রস্তপচিনের মনে হল সেটা বুঝি তার বুকের মধ্যে কেটে বসেছে, সেখানে রক্ত ঝরাচ্ছে। এইমুহূর্তে তার স্পষ্ট মনে হল, সেই স্মৃতির রক্তাক্ত চিহ্ন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যাবে না, বরং সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তীব্রতর নিষ্ঠুরতায় ও বেদনায় তার বুকের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকবে। নিজের কথাগুলি এখনো তার কানে বাজছে : ওকে কেটে ফেল। আমি হুকুম দিচ্ছি!…
সে ভাবল, এ কথাগুলি কেন বলেছিলাম? হঠাৎই বলে ফেলেছি…বলার কোনো দরকার ছিল না। তাহলে তো কিছুই ঘটত না। যে অশ্বারোহী সৈনিকটি আঘাত করেছিল তার ভীত, ক্রুদ্ধ মুখটা সে যেন দেখতে পেল; লোমের পটি দেওয়া কোট-পরা ছেলেটির সেই নীরব, ভীরু তিরস্কারের দৃষ্টিটা যেন তার দিকেই পড়ে আছে। কিন্তু আমি তো নিজের জন্য একাজ করিনি। একাজ করতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম…ক্ষিপ্ত জনতা, বিশ্বাসঘাতক, জনকল্যাণ, সে ভাবতে লাগল।
সৈন্যরা তখনো ইয়াউজা সেতুতে ভিড় করে আছে। দিনটা গরম। সেতুর পাশে একটা বেঞ্চিতে বসে কুতুজভ হাতের চাবুকটা দিয়ে বালির উপর আঁকিবুকি টানছে, এমন সময় একটা কালিচে সশব্দে এসে হাজির হল। টুপিতে পালক লাগানো, জেনারেলের ইউনিফর্মধারী একটি লোক কুতুজভের সামনে হাজির হয়ে ফরাসিতে কি যেন বলল। লোকটি কাউন্ট রস্তপচিন। কুতুজভকে বলল, সে এসেছে কারণ রাজধানী মস্কো আর নেই, সেখানে আছে শুধু সৈন্যরা।
প্রশান্ত মহামহিম যদি আমাকে না বলতেন যে আর একটা যুদ্ধ না করে তিনি মস্কো পরিত্যাগ করবেন না, তাহলে সমস্ত ব্যাপারটাই অন্যরকম হত; এসব ঘটতই না, সে বলল।
সে যা বলছে তার অর্থ বুঝতে না পেরে কুতুজভ এমনভাবে রস্তপচিনের দিকে তাকাল যেন এইমুহূর্তে লোকটির মুখে কি লেখা আছে সেটা পড়বার চেষ্টাই সে করছে। রস্তপচিন বিচলিত হয়ে চুপ করল। ঈষৎ মাথা নেড়ে স্থিরনিবদ্ধ দৃষ্টি রস্তপচিনের মুখের উপর থেকে না সরিয়েই কুতুজভ ধীরে ধীরে নিচু গলায় বলতে লাগল :
না! একটা যুদ্ধ ছাড়া আমি মস্কো পরিত্যাগ করব না!
এই কথাগুলি বলার সময় কুতুজভ মনে মনে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কিছু ভাবছিল অথবা ইচ্ছা করেই সে কথাগুলি বলল; রস্তপচিন কিন্তু আর কোনো কথা না বলেই দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। আর কী আশ্চর্যের কথা, মস্কোর শাসনকর্তা গর্বোদ্ধত কাউন্ট রস্তপচিন একটা কসাক চাবুক হাতে নিয়ে সেতুর কাছে গিয়ে হাজির হল এবং পথ-অবরোধকারী গাড়িগুলোকে হটিয়ে দিতে সমানে চিৎকার করতে লাগল।