০৫.২ জমিদারি পরিদর্শন

অধ্যায়-১১

খুশি মনে দক্ষিণ রাশিয়া হয়ে জমিদারি পরিদর্শন শেষ করে বাড়ি ফিরেই পিয়ের স্থির করল বন্ধু বলকনস্কির সঙ্গে দেখা করতে যাবে। দু-বছর তার সঙ্গে দেখা হয়নি।

একটা সমতল একঘেয়ে গ্রামাঞ্চলে বোচারোভো অবস্থিত। চারদিকে মাঠ এবং ফার ও বার্চ গাছের জঙ্গল, তার কিছু অংশ কেটে ফেলা হয়েছে। নতুন-কাটা জল-ভর্তি একটা পুকুরের পিছনে বাড়িটা অবস্থিত। পুকুরপাড়ে এখনো ঘাস গজায়নি। বড় রাস্তা বরাবর এগিয়ে গেলে গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে কয়েকটা ছোট ফার গাছের ঝোঁপের মধ্যে বাড়িটা চোখে পড়ে।

বাস্তুভিটেতে আছে একটা ঝাড়াই-উঠোন, বহির্বাটি, আস্তাবল, মান-ঘর, আর একটা বড় পাকা বাড়ি–তার অর্ধবৃত্তাকার সম্মুখভাগটা এখনো তৈরি হচ্ছে। বাড়ির চারদিকে একটা নতুন বানানো বাগান। বেড়া ও গেট নতুন ও মজবুত। চালাঘরে রয়েছে সবুজ রং করা দুটো আগুন-পাম্প ও একটা জলের গাড়ি। রাস্তাগুলো সোজা, আর সেগুলো শক্ত ও রেলিং-বসানো। সবকিছুতেই একটা ছিমছাম সুব্যবস্থার আভাস। আন্তন নামে একটি লোক ছেলেবেলায় প্রিন্স আন্দ্রুর দেখাশুনা করত, সেই পিয়েরকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করল এবং একটা পরিচ্ছন্ন ছোট ঘরে নিয়ে বসাল।

পিটার্সবুর্গে যে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে বন্ধুর সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়েছিল তারপরে এই পরিচ্ছন্ন অথচ ছোটখাট বাড়ি দেখে পিয়ের অবাক হলে গেল।

সে দ্রুতপদে অভ্যর্থনা-ঘরে ঢুকে গেল। ঘরটার কাঠের দেয়ালে এখনো পলস্তরা পড়েনি। আন্তন তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিল।

আরে, কি হল? একটা তীক্ষ্ণ, অসন্তুষ্ট গলা শোনা গেল।

 একজন দর্শনার্থী, আন্তন জবাব দিল।

তাকে অপেক্ষা করতে বল, একটা চেয়ার পিছনে ঠেলে দেবার শব্দ হল।

 পিয়ের দ্রুতপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই প্রিন্স আন্দ্রুর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে গেল, তার চোখে ভ্রুকুটি, বেশ বয়স্ক দেখাচ্ছে। পিয়ের তাকে জড়িয়ে ধরল, চশমা তুলে বন্ধুর গালে চুমো খেয়ে ভালোভাবে তাকে দেখতে লাগল।

আচ্ছা, আমি তো তোমাকে আশাই করিনি, খুব খুশি হয়েছি, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

পিয়ের কিছুই বলল না, অবাক হয়ে একদৃষ্টিতে বন্ধুকে দেখতে লাগল। তার পরিবর্তনটাই তার চোখে পড়ছে। তার কথাগুলি সহৃদয়, ঠোঁটে ও মুখে হাসিটি লেগে আছে, কিন্তু চোখ দুটি একঘেয়ে ও প্রাণহীন। প্রিন্স আন্দ্রুলু অনেকটা শুকিয়ে গেছে, মলিন হয়ে গেছে, আরো বেশি বয়স্ক দেখাচ্ছে, কিন্তু পিয়ের সবচাইতে অবাক হল তার নিষ্ক্রিয়তা ও ভুরুর উপরকার ভাঁজটা দেখে, দেখলেই মনে হয় একটা চিন্তার মধ্যে সে যেন বড় বেশি ডুবে আছে।

দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরে দেখা হলে যেমনটি হয়ে থাকে, আলোচনা একটা সঠিক রূপ নিতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। এ-কথা সে-কথার পরে পিয়েরের মনে একটা দুর্নিবার ইচ্ছা জাগল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে বন্ধুকে জানিয়ে দিতে চায় যে পিটার্সবুর্গে সে যা ছিল এখন সে তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা পিয়ের হয়ে উঠেছে।

তখন থেকে আমি যে কত পথ পেরিয়ে এসেছি তা তোমাকে বলতে পারব না। এখন নিজেই নিজেকে চিনতে পারি না।

ঠিক কথা, আমরা অনেক বদলে গেছি, অনেক বেশি বদলে গেছি, প্রিন্স আন্দ্রু বল।

আচ্ছা, তুমিও? তোমার পরিকল্পনাটা কি?

পরিকল্পনা? প্রিন্স আন্দ্রু ব্যঙ্গের সুরে কথাটার পুনরাবৃত্তি করল। আমার পরিকল্পনা? দেখতেই তো পাচ্ছ, বাড়ি তৈরি করছি। আগামী বছরেই এখানে পুরোপুরি বাসা বাঁধব…

পিয়ের নীরবে সন্ধানী চোখে প্রিন্স আন্দ্রুর মুখের দিকে তাকাল।

না, আমি বলতে চাইছি… পিয়ের কথা শুরু করতেই প্রিন্স আন্দ্রু তাকে বাধা দিল।

কিন্তু আমার কথা কেন?…আমাকে বল, হ্যাঁ, আমাকে বল তোমার ভ্রমণের কথা, জমিদারিতে গিয়ে কি করেছ সেইসব কথা।

পিয়ের জমিদারিতে গিয়ে যেসব কাজ করেছে তা বলতে শুরু করল, অবশ্য সেইসব উন্নতির ব্যাপারে নিজের ভূমিকার কথা যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখতেই চেষ্টা করল। প্রিন্স আন্দ্রু কোনোরকম আগ্রহ না দেখালেও তার কথা শুনতে লাগল। কীরকম যেন অস্বস্তি বোধ করায় একসময় পিয়ের চুপ করে গেল।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, আমি আর কি বলব ভাই। এখানে কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছি, আর সবে চারদিকে তাকাবার অবসর পেয়েছি। আজই আমার বোনের কাছে ফিরে যাব। তার সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব। অবশ্য তুমি তো তাকে চেনই। ডিনারের পরেই আমরা যাব। আমাদের জায়গাটা ঘুরে দেখবে নাকি?

দুইজন বেরিয়ে গেল, ডিনারের সময় পর্যন্ত নানা রাজনৈতিক খবর ও পরিচিত লোকদের নিয়ে আলোচনা করল। নিজের বাড়ি তৈরির কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু বলল :

এসব কথা মোটেই ভালো লাগবার মতো নয়। চল, ডিনার শেষ করেই যাত্ৰা করি গে।

খেতে বসে পিয়েরের বিয়ের কথা উঠল।

সেকথা শুনে আমি তো খুবই অবাক হয়েছিলাম, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

পিয়েরের মুখ যথারীতি লাল হয়ে উঠল, তাড়াতাড়ি বলল :

কি করে কি হল সব তোমাকে একসময় বলব। কিন্তু তুমি তো জান সেসব চুকে গেছে, চিরদিনের মতো চুকে গেছে।

চিরদিনের মতো প্রিন্স আন্দ্রু বলল। কোনো কিছুই চিরন্তন নয়।

কিন্তু কীভাবে সব শেষ হল তা তো তুমি জান, তাই না? দ্বৈত যুদ্ধের কথা তো শুনেছ?

তাহলে সে-পথেও হেঁটেছ?

 লোকটাকে যে মেরে ফেলিনি সেজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই, পিয়ের বলল।

 তা কেন? প্রিন্স আন্দ্রু শুধাল। একটা পাপাশয় কুকুরকে মারা তো সত্যিকারের ভালো কাজ।

না, একটা মানুষকে মারা খারাপ-অন্যায়।

প্রিন্স আন্দ্রু তবু বলল, অন্যায় হবে কেন? কি ন্যায় আর কি অন্যায় সেটা জানা মানুষের কর্ম নয়। মানুষ চিরকাল ভুল করে এসেছে, চিরকাল ভুল করবে–বিশেষ করে ন্যায়-অন্যায়ের বিচারের বেলায়।

পিয়ের বলল, যা অন্যের ক্ষতি করে তাই খারাপ।

অন্যের পক্ষে কি খারাপ সেটা তোমাকে কে বলে দিয়েছে?

পিয়ের সোচ্চারে বলে উঠল, খারাপ! খারাপ! কি যে খারাপ তা আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি।

হ্যাঁ, তা বুঝতে পারি, কিন্তু যে ক্ষতি সম্পর্কে আমি নিজে সচেতন সেটাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারি না, পিয়েরের কাছে নিজের নতুন দৃষ্টিভঙ্গিটাকে প্রকাশ করবার ইচ্ছায় আরো বেশি উৎসাহের সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রু বলল। বলল ফরাসিতে। জীবনে সত্যিকারের দুটি পাপের কথা আমি জানিঃ অনুতাপ ও অসুস্থতা। এই দুইয়ের অনুপস্থিতিই একমাত্র কল্যাণ। এই দুই পাপকে পরিহার করে নিজের জন্য বাঁচাই এখন আমার জীবনদর্শন।

পিয়ের বলে উঠল, আর প্রতিবেশীকে ভালোবাসা, আত্মত্যাগ? না, তোমার সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না। পাপ করব না, অনুতাপ করব না–শুধু তেমন করে বাঁচাটাই যথেষ্ট নয়। আমি সেইভাবেই বেঁচে ছিলাম, নিজের জন্য বেঁচেছিলাম, আর তাতেই জীবনটাকে নষ্ট করেছি। আর এখন জীবনটাকে চালাচ্ছি, অন্তত চালাবার চেষ্টা করছি অপরের জন্য, আর তাই এখন পেয়েছি জীবনের সব সুখের আস্বাদ। না, তোমার সঙ্গে আমি একমত হব না, আর তুমিও মুখে যা বলছ আসলে তা বিশ্বাস কর না।

ব্যঙ্গের হাসি হেসে প্রিন্স আন্দ্রু নীরবে পিয়েরের দিকে তাকাল।

বলল, আমার বোন প্রিন্সেস মারির সঙ্গে দেখা হলে বুঝবে তার সঙ্গে তোমার মিলবে ভালো। হয়তো তোমার দিক থেকে তুমি ঠিকই বলেছ, কিন্তু প্রত্যেকেই তো নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। তুমি নিজের জন্য বাঁচতে চেয়েছ, আর বলছ যে জীবনটাকে প্রায় নষ্ট করে ফেলেছি, এবং অন্যের জন্য বাঁচতে শুরু করে তবেই সুখের স্বাদ পেয়েছ। আমার অভিজ্ঞতা ঠিক উল্টো। আমি বেঁচেছি গৌরবের জন্য। আর শেষপর্যন্ত গৌরব কাকে বলে? সেই একই-অন্যকে ভালোবাসা, তাদের জন্য কিছু করার বাসনা, তাদের সমর্থন লাভের বাসনা। সুতরাং আমিও পরের জন্যই বেঁচেছি, আর সম্পূর্ণ না হলেও জীবনটাকে প্রায় নষ্ট করে ফেলেছি। আর যখন থেকে কেবলমাত্র নিজের জন্যই বাঁচতে শুরু করেছি তখনই পেয়েছি কিছুটা শান্তি।

উত্তেজিত হয়ে পিয়ের শুধাল, কিন্তু নিজের জন্য বাঁচা বলতে তুমি কি বোঝাতে চাও? তোমার ছেলে, তোমার বোন, তোমার বাবা–তাদের কি হবে?

কিন্তু তারা তো আমারই লোক-অন্য নোক নয়, প্রিন্স আন্দ্রু বুঝিয়ে বলল। অন্য লোক, প্রতিবেশীর দল, তারাই তো যত নষ্টের গুরু। ওই যে তোমার কিয়েভ চাষীরা যাদের তুমি ভালো করতে চাও।

ঠাট্টার ভঙ্গিতে সে পিয়েরের দিকে তাকাল।

আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পিয়ের জবাব দিল, তুমি ঠাট্টা করছ। আমি যদি কারো ভালো করতে চাই, এমন কি কিছু ভালো করেও থাকি, তাতে দোষের বা অন্যায়ের কি থাকতে পারে? আমাদের ভূমিদাসদের মতো, আমাদের নিজেদের মতো যেসব হতভাগ্য মানুষ এতকাল আচার-অনুষ্ঠান ও অর্থহীন প্রার্থনার বাইরে ঈশ্বর ও সত্য সম্পর্কে কিছু না জেনেই জন্মেছে ও আজ যদি তাদের আমরা ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতি, নৈতিক উজ্জীবনের প্রতি, সান্ত্বনার প্রতি বিশ্বাসের দীক্ষা দিয়ে থাকি তাতে দোষের কি থাকতে পারে? যেসব মানুষ বিনা সাহায্যে অসুখে মারা যাচ্ছিল অথচ যাদের অনায়াসেই কিছু বাস্তব সাহায্য দেওয়া যেত, তাদের যদি আমি আজ ডাক্তার ও পাসপাতাল দিয়ে, বৃদ্ধদের আশ্রয়-শিবির দিয়ে সাহায্য করে থাকি, তাতে দোষের বা ভুলের কি থাকতে পারে?…আর খুব খারাপভাবে ও ছোট করে হলেও সে কাজই আমি করেছি। আসল কথা হল, আমি জেনেছি, নিশ্চিতভাবেই জেনেছি যে এই সব ভালো কাজ থেকেই আসে জীবনের একমাত্র নিশ্চিত সুখ।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, হ্যাঁ, এভাবে যদি কথাটা বল তো সেটা আলাদা ব্যাপার। আমি বাড়ি তৈরি করছি, বাগান করছি, আর তুমি হাসপাতাল তৈরি করছ। এ দুটো পথেই অবসর বিনোদন করা যায়। কিন্তু কোনটা ঠিক আর কোনটা ভালো সে বিচার সেই করতে পারে যে সবকিছু জানে, আমরা নই। বেশ তো, তর্ক করতে চাও তো চলে এস।

টেবিল থেকে উঠে দুজন গিয়ে বারান্দায় বসল। তারপর দুজনের মধ্য তর্কের ঝড় উঠল, আর একসময় উঠল যুদ্ধের প্রসঙ্গ।

পিয়ের প্রশ্ন করল, তুমি যুদ্ধে যোগ দিলে না কেন?

প্রিন্স আন্দ্রু বিষণ্ণ স্বরে বলল, অস্তারলিজের পরেও! না, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। প্রতিজ্ঞা করেছি, আর কোনোদিন সক্রিয়ভাবে রুশ বাহিনীতে ঢুকব না। না কখনো না–এমন কি বোনাপার্ত যদি এই স্নোলেনস্কে এসে বন্ড হিলসকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়-তবু আমি রুশ বাহিনীতে চাকরি করব না! এখন তো সৈন্য সংগ্রহের পালা চলছে। তিন নম্বর জেলার প্রধান কর্তা আমার বাবা, আর আমার পক্ষে যুদ্ধে যাওয়া থেকে রেহাই পাবার একমাত্র পথ তার অধীনে কাজ করা।

তাহলে তাই করছ?

করছি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

সে কাজই বা করছ কেন?

কেন, কারণটা তো বললাম। আমার বাবা সেকালের একজন বিখ্যাত লোক। কিন্তু তাঁর বয়স বাড়ছে, আর ঠিক নিষ্ঠুর না হলেও তিনি খুবই উদ্যমশীল। অসংযত ক্ষমতায় তিনি এতই অভ্যস্ত যে অনেক সময় তিনি ভয়ংকর হয়ে ওঠেন। এখন তো সম্রাট তাঁকে দিয়েছেন সৈন্য-সংগ্রহের প্রধান সেনাপতির ক্ষমতা। পক্ষকাল আগে আমি যদি পৌঁছতে দুই ঘণ্টা দেরি করতাম তাহলে ইয়ুখনভাতে একজন করণিককে তিনি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতেন। প্রিন্স আন্দ্রু হাসল। তাই আমি তার সঙ্গে কাজ করছি, কারণ একমাত্র আমার কথাই তিনি শোনেন, তাই মাঝে মাঝে এমন সব কাজ করা থেকে তাঁকে বিরত করতে পারি যার জন্য পরে তাকে কষ্ট পেতে হত।

তবেই বুঝতে পারছ।

বুঝতে ঠিকই পারছি, তবে তুমি যা ভাবছ তা নয়। ওই পাজি করণিকটা নতুন সৈন্যদের বুট চুরি করেছিল, তার জন্য আমার মোটেই মাথা ব্যথা ছিল না, এখনো নেই। সে ফাঁসিতে ঝুললেই আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমার দুঃখ আমার বাবার জন্য-আর সেটা তো আমার নিজের জন্যই হল।

প্রিন্স আন্দ্রু ক্রমেই উজ্জীবিত হতে লাগল। তার কাজকর্মের মধ্যে প্রতিবেশীর ভালো করার বাসনা যে তার ছিল না এটা প্রমাণ করতে গিয়ে তার চোখ দুটি যেন তীব্র আবেগে জ্বলতে লাগল।

সে বলতে লাগল, এই যে তুমি তোমার ভূমিদাসদের মুক্তি দিতে চাইছ, এটা খুব ভালো কাজ, কিন্তু তোমার পক্ষে নয়–তুমি যে কখনো কাউকে চাবুক মেরেছ বা সাইবেরিয়ায় পাঠিয়েছ তা আমি মনে করি না–তোমার ভূমিদাসদের পক্ষে তো মোটেই নয়। তাদের যদি মারা হয়ে থাকে, কশাঘাত করা হয়ে থাকে, সাইবেরিয়ায় পাঠানো হয়ে থাকে, তাতে তাদের অবস্থা কিছু বেশি খারাপ হয়েছে বলে আমি মনে করি না। সাইবেরিয়াতে গিয়ে তারা সেই একই পশুর জীবন যাপন করে, শরীরের আঘাতের দাগ শুকিয়ে যায়, তারা আগের মতোই সুখে দিন কাটায়। কিন্তু মালিকদের পক্ষে এটা ভালো কাজ, কারণ ন্যায়ভাবেই হোক অন্যায়ভাবেই হোক, অন্যকে শাস্তি দিতে পারার জন্য তাদের উপর নেমে আসে নৈতিক বিনষ্টি, তারা অনুতাপে দগ্ধ হয়, আর সে অনুতাপকে চেপে রেখে ক্রমে নির্বিকার হয়ে ওঠে। সেই মানুষগুলোর জন্যই আমার করুণা হয়, আর তাদের ভালোর জন্যই আমি ভূমিদাসদের মুক্তি দিতে চাই। তুমি হয়তো দেখনি, কিন্তু আমি দেখেছি, কেমন করে সীমাহীন ক্ষমতার ঐতিহ্যে লালিত-পালিত এইসব ভালো মানুষরা ক্রমেই আরো বেশি খিটখিটে হয়ে ওঠে, নির্মম ও কঠোর হয়ে ওঠে, সে সম্পর্কে সচেতন হয়েও নিজেদের সংযত করতে না পেরে ক্রমে আরো বেশি শোচনীয় অবস্থায় পড়ে।

প্রিন্স আন্দ্রু এমন আন্তরিকভাবে কথাগুলি বলল যে পিয়ের কিছুতেই না ভেবে পারল না যে তার বাবাকে দেখেই কথাগুলি তার মনে এসেছে।

সে কোনো জবাব দিল না।

অতএব আমার দুঃখের কারণ-মানবিক মর্যাদা, মনের শান্তি, পবিত্রতা, ভূমিদাসদের পিঠ ও কপাল নয়, যতই মার, যতই কামিয়ে দাও, সে-পিঠ, সে-কপাল সেই একই থাকে।

না, না! হাজারবার না! তোমার সঙ্গে আমি কোনোদিন একমত হব না, পিয়ের বলল।

.

অধ্যায়-১২

সন্ধ্যায় দিকে আন্দ্রু ও পিয়ের একটা ভোলা গাড়িতে চেপে বল্ড হিলসে চলে গেল। প্রিন্স আন্দ্রু মাঝে মাঝেই পিয়েরের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে কথা বলতে লাগল যাতে বোঝা গেল যে তার মেজাজ বেশ ভালো আছে।

মাঠের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে চাষবাসের ব্যাপারে যে সব উন্নতি করেছে তা বলতে লাগল।

পিয়ের চুপচাপ বসে রইল, হু-হাঁ করে জবাব সেরে নিজের চিন্তার মধ্যেই ডুবে রইল।

সে ভাবছে, প্রিন্স আন্দ্রু খুব দুঃখী, সে ভুল পথে চলেছে, সত্যিকারের আলো দেখতে পাচ্ছে না, আর তাই পিয়েরের উচিত তাকে সাহায্য করা, আলো দেখানো এবং তুলে ধরা। কিন্তু কি বলা উচিত সে-কথা ভাবতেই তার মনে হল যে প্রিন্স আন্দ্রু তো এককথায়, একটি যুক্তিতে তার সব বক্তব্য নস্যাৎ করে দেবে, কাজেই সে কোনো কথা বলতে সাহস পেল না।

তারপরই হঠাৎ একসময় মাথাটা নিচু করে আক্রমণোদ্যত ষাঁড়ের মতো বলে উঠল, না, কিন্তু তুমি এ কথা ভাবছ কেন? এরকম ভাবা তোমার উচিত নয়।

ভাবছি? কি ভাবছিঃ প্রিন্স আন্দ্রু সবিস্ময়ে শুধাল।

জীবনের কথা, মানুষের ভাগ্যের কথা। এরকম তো হতে পারে না। নিজের সম্পর্কেও আমি এইরকম ভাবতাম, কিন্তু কে আমাকে বাঁচিয়েছে জান? ভ্রাতৃসংঘ! না, হেসো না। আমি যা ভাবতাম ভ্রাতৃসংঘ সেরকম কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয় : ভ্রাতৃসংঘ মানবতার শ্রেষ্ঠ, শাশ্বত স্বরূপের এক শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।

সে ভ্রাতৃসংঘের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে শুরু করল। ভ্রাতৃসংঘ শেখায় রাষ্ট্র ও গির্জার বন্ধন থেকে মুক্ত খৃস্টধর্মের বাণী, শেখায় সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও প্রেম।

পিয়ের বলতে লাগল, আমাদের পবিত্র ভ্রাতৃত্বই জীবনের একমাত্র প্রকৃত তত্ত্ব, আর সবই স্বপ্ন। কি জান ভাই, এই সংঘের বাইরে যা কিছু সবই প্রতারণা ও মিথ্যায় ভরা, আমি তোমাদের সঙ্গে একমত যে, অপরের কোনো ক্ষতি না করে তোমার মতো শুধু নিজের জন্য বাঁচবার চেষ্টা করা ছাড়া একটি বুদ্ধিমান সৎ লোকের জীবনে আর কিছুই করার নেই। কিন্তু আমাদের মূল বিশ্বাসকে গ্রহণ কর, আমাদের ভ্রাতৃসংঘে যোগ দাও, আমাদের পথে চল, সঙ্গে সঙ্গে তুমি বুঝতে পারবে, যেমন আমি নিজে বুঝেছি, যে অদৃশ্য শৃঙ্খলের আদি লুকিয়ে আছে স্বর্গে তুমিও তারই একটা অংশ।

প্রিন্স আন্দ্রু সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে নীরবে পিয়েরের কথা শুনতে লাগল। যখনই গাড়ির চাকার শব্দে পিয়েরের কথাগুলি শোনা যাচ্ছে না তখনই সে কথাগুলি আর একবার বলতে বলছে, আর তার চোখের দীপ্তি ও নীরবতা দেখে পিয়ের বুঝতে পারছে যে তার কথাগুলি বৃথা যায়নি, প্রিন্স আন্দ্রু আর তার কথায় বাধা দেবে না বা শুনে হাসবে না।

দুই কূল ভাসানো একটা নদীর তীরে পৌঁছে তারা ফেরিতে নদীটা পার হল। গাড়ি ও ঘোড়াকে ফেরিতে তোলা হলে তারাও উঠে পড়ল।

প্রিন্স আন্দ্রু ফেরির রেলিংয়ে ভর দিয়ে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করা জলরাশির দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল।

পিয়ের শুধাল, আচ্ছা, এ বিষয়ে কি ভাবছ তুমি? এত চুপচাপ আছ কেন?

আমি কি ভাবছি? আমি তো তোমার কথা শুনছি। সবই ভাললা…তুমি বলছ : আমাদের ভ্রাতৃসংঘে যোগ দাও, জীবনের লক্ষ্য, মানুষের ভাগ্য, যে সব বিধান পৃথিবীকে শাসন করে-সে সব আমরা তোমাকে দেখিয়ে দেব। কিন্তু এই আমরা কারা? মানুষ। তোমরাই বা সবকিছু জানলে কেমন করে? তোমরা যা দেখেছ একমাত্র আমিই বা তা দেখতে পাই না কেন? তোমরা পৃথিবীতে দেখছ সৎ ও সত্যের শাসন, কিন্তু আমি তা দেখতে পাই না।

পিয়ের তাকে বাধা দিল।

তুমি কি পরলোকে বিশ্বাস কর? সে শুধাল।

পরলোক? প্রিন্স আন্দ্রু কথাটা পুনরায় উচ্চারণ করল, কিন্তু এ পুনরাবৃত্তিকে অস্বীকৃতি বলে ধরে নিয়ে তাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই পিয়ের বলে উঠল, তুমি বলছ, পৃথিবীতে সৎ ও সত্যের শাসন তুমি দেখতে পাও না। আমিও পেতাম না, আমাদের এই জীবনকেই যতক্ষণ পর্যন্ত সবকিছুর পরিণতিরূপে দেখা হবে ততক্ষণ কেউই তা দেখতে পাবে না। এই পৃথিবীতে, এখানে এই পৃথিবীতে (চারদিকের মাঠ দেখিয়ে) সত্য বলে কিছু নেই, সবই মিথ্যা ও অসৎ, কিন্তু এই বিশ্বে, সমগ্র বিশ্বে রয়েছে সত্যের রাজত্ব, আর আমরা যারা এই পৃথিবীর সন্তান, আমরাই তো অনন্তকাল ধরে এই বিশ্বেরও সন্তান। অন্তরে অন্তরে আমিও কি অনুভব করি না যে আমি সেই বিরাট একেরই একটি অংশ? আমি অনুভব করি যে আমি মুছে যাব না, কারণ পৃথিবীতে কিছুই মুছে যায় না, আমি চিরদিন আছি, চিরদিন থাকব। আমি অনুভব করি, আমাকে ছাড়িয়ে আমার উপরে আছে আত্মা, আর এই জগতে আছে সত্য।

প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল না। গাড়ি ও ঘোড়াকে অনেকক্ষণ ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দিগন্তে সূর্য অর্ধেক ডুবে গেছে, একটা সান্ধ্য কুয়াশা ফেরিটাকে ঘিরে আছে। কিন্তু পিয়ের ও আন্দ্রু তখনো ফেরিতে দাঁড়িয়ে কথা বলছে দেখে পরিচারক, কোচয়ান ওঁ ফেরিচালক সকলেই অবাক হয়ে গেছে।

যদি ঈশ্বর থাকেন পরকাল তাকে, তাহলে সত্য ও সও আছে, আর তাকে লাভ করার সাধনাতেই আছে মানুষের সর্বোচ্চ সুখ। আমাদের বাঁচতে হবে, ভালোবাসতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে যে একটুকরো পৃথিবীতে শুধু আজকের জন্যই আমরা বেঁচে নেই, আমরা বেঁচে আছি, চিরকাল বেঁচে থাকব ওখানে ওই ভূমার মধ্যে, আকাশের দিকে আঙুল বাড়িয়ে পিয়ের বলল।

রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রিন্স আন্দ্রু মন দিয়ে পিয়েরের কথাগুলি শুনল। নীল জলরাশির উপর সূর্যের রক্তিম ঝিলমিলের দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। চারদিকে পরম প্রশান্তি। পিয়েরও চুপ করল। ফেরিটা থেমে আছে, ঢেউ এসে ধীরে ধীরে তার গায়ে পড়ছে। ঢেউগুলি যেন তার কানে কানে বলছে :

এ কথাই সত্য, বিশ্বাস কর।

একটা নিঃশ্বাস ফেলে সে পিয়েরের মুখের দিকে তাকাল।

বলল, ঠিক বলেছ, আহা, তাই যেন হয়! যাই হোক, এবার নামতে হবে।

ফেরি থেকে নেমে এসে প্রিন্স আন্দ্রু আকাশের দিকে তাকাল। অস্তারলিজের রণক্ষেত্রে শুয়ে যে শাশ্বত আকাশকে দেখেছিল, অনেক দিন পরে এই প্রথম আর একবার সেই আকাশকে দেখতে পেল। একটা কিছু যা এতদিন তার মধ্যে ঘুমিয়েছিল, যা তার অন্তরের সেরা সম্পদ, তাই যেন সহসা জেগে উঠল তার যৌবনদীপ্ত আনন্দময় অন্তরের মধ্যে। চিরাচরিত জীবনযাত্রায় ফিরে আসা মাত্রই সে ভাব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, কিন্তু সে একটা বুঝতে পারল যে ভাবটা তার মধ্যে আছে। পিয়েরের সঙ্গে এই দেখা তার জীবনের একটা যুগান্তকারী ঘটনা। যদিও বাইরে সে একই পুরনো জীবনের পথেই চলতে লাগল, তবু তার অন্তরে শুরু হল এক নতুন জীবন।

.

অধ্যায়-১৩

প্রিন্স আন্দ্রু ও পিয়েরর যখন বল্ড হিলসের সামনের ফটকে পোঁছল তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাড়ির কাছাকাছি হতে প্রিন্স আন্দ্রু মৃদু হেসে পিছনের বারান্দায় একটা গোলমালের প্রতি পিয়েরের মনোযোগ আকর্ষণ করল। বয়সের ভারে নুয়েপড়া ঝোলা পিঠে একটি স্ত্রীলোক এবং কালো পোশাকপরা একটি লম্বা চুল বেঁটে যুবক গাড়িটাকে দেখেই ফটকে ছুটে এল। তাদের পিছনে আরো দুটি স্ত্রীলোক ছুটে এল। গাড়িটার চারদিক দেখে নিয়ে চারজনই বিষণ্ণ মনে পিছনের বারান্দার সিঁড়ির দিকে দৌড়ে চলে গেল।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, এরা সব মারির ভালো মানুষ। ওরা আমাকে বাবা বলে ভুল করেছে। এই একটা ব্যাপারে মারি বাবাকে অমান্য করে চলে। বাবার হুকুম, এই তীর্থযাত্রীদের তাড়িয়ে দিতে হবে, কিন্তু মারি তাদের সাদরে ডেকে আনে।

কিন্তু ভালো মানুষ মানে কী? পিয়ের শুধাল।

প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দেয়ার সময় পেল না। চাকররা বেরিয়ে এল, আর সে তাদের কাছে জানতে চাইল, বুড়ো প্রিন্স কোথায় গেছে এবং শিগগির ফিরে আসবে কি না।

বুড়ো প্রিন্স শহরে গেছে, যে-কোনো সময় ফিরতে পারে। প্রিন্স আন্দ্রু পিয়েরকে নিয়ে নিজের ঘরে গেল, তার জন্য ঘরটা সবসময়ই সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা হয়। তারপরেই সে নিজে চলে গেল নার্সারিতে।

ফিরে এসে পিয়েরকে বলল, চলো আমার বোনের সঙ্গে দেখা করে আসি। এখনো তাকে দেখতে পাইনি, হয়তো কোথাও লুকিয়ে তার ভালো মানুষদের সঙ্গে বসে আছে। কাজেই তার ভালো মানুষদেরও দেখতে পাবে। সত্যি আজব ব্যাপার।

ভালো মানুষ ব্যাপারটা কী? পিয়ের শুধাল।

 এসো, নিজেই দেখতে পাবে।

তারা ঘরে ঢুকলে প্রিন্সেস মারি সত্যি বিব্রত হয়ে পড়ল, তার গালে লালের ছোপ পড়ল। আরামদায়ক ঘরটিতে দেবমূর্তির সামনে বাতি জ্বলছে। লম্বা নাক ও লম্বা চুলওয়ালা একটি যুবক সন্ন্যাসীদের জোব্বা পরে তার পাশেই সোফায় বসে আছে, তাদের কাছেই হাতল চেয়ারে বসে আছে পাকানো শুকনো শরীরের একটি বুড়ি, তার মুখে শিশুর সরলতা মাখা।

ছানাদের সামনে মুরগির মতো তীর্থযাত্রীর সামনে উঠে দাঁড়িয়ে প্রিন্সেস মারি মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বলল, আন্দ্রু, তুমি আমাকে আগেই সতর্ক করে দাওনি কেন?

পিয়ের তার হাতে চুমো খেলে সে ফরাসিতে বলল, তোমাকে দেখে আনন্দিত হলাম। তোমাকে দেখে খুব খুশি হলাম। প্রিন্সেস শিশুকালে তাকে চিনত, এখন আর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব, স্ত্রীর ব্যাপারে তার দুর্ভাগ্য, আর বিশেষ করে তার সহজ সরল মুখখানির জন্য পিয়েরকে তার খুব ভালো লাগল। উজ্জ্বল চোখ মেলে তার দিকে তাকাল, যেন বলতে চাইল, তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি, কিন্তু দয়া করে আমার লোকদের দেখে হেসো না।

তরুণ তীর্থযাত্রীটির দিকে তাকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু বলে উঠল, আহা, ইভানুশকাও এখানে আছে দেখছি!

 প্রিন্সেস মারি অনুনয়ের সুরে বলল, আন্দ্রু!

প্রিন্স আন্দ্রু পিয়েরকে বলল, তোমার জানা দরকার যে ইনি একজন নারী।

আন্দ্রু ঈশ্বরের দোহাই! প্রিন্সেস মারি বলল।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, দেখ বন আমি, এই যুবকটির সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতার কথাটা বুঝিয়ে বলেছি বলে তোমার তো বরং আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।

সকৌতুক গাম্ভীর্যের সঙ্গে ইভানুশকার মুখের দিকে তাকিয়ে পিয়ের বলল, সত্যি? আর নারীটিও চপল চোখ মেলে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

নিজের লোকদের জন্য প্রিন্সেস মারি বিব্রত হবার কোনো কারণই ছিল না। তারা কিন্তু মোটেই লজ্জা পায়নি।

প্রিন্স আন্দ্রু বুড়িকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলে গো? কিয়েভে

বুড়ি অমনি গড়গড় করে বলতে শুরু করল, তাই তো গিয়েছিলাম জনাব। ক্রিসমাসের সময়ে সন্তের থানে যে পবিত্র ও স্বর্গীয় অনুষ্ঠান হয়ে গেল, আমাকেই তো তাতে যোগদানের উপযুক্ত মানুষ বলে গ্রাহ্য করা হয়েছিল। তবে মনিব, এখন আমি আসছি কোলিয়াজিন থেকে, সেখানে একটি মহৎ ও আশ্চর্য করুণা প্রকাশ পেয়েছে।

আর ইভানুশকা তোমার সঙ্গেই ছিল?

ভারী গলায় কথা বলার চেষ্টা করে ইভানুশকা বলল, আমি একাই যাই কর্তা। শুধু ইয়ুকনভোতে পেলাগেয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল…

পেলাগেয়া সঙ্গীকে বাধা দিয়ে বলল, মনিব, কোলিয়াজিনে এক আশ্চর্য করুণা প্রকাশ পেয়েছে।

সেটা কী? কোনো নতুন স্মারক? প্রিন্স আন্দ্রু জিজ্ঞেস করল।

প্রিন্সেস মারি বলল, আন্দ্রু, এখান থেকে যাও তো। পেলাগেয়া, ওকে কিছু বলো না।

না… কেন বলব না, কেন? ওঁকে আমি ভালোবাসি। উনি দয়ালু, ঈশ্বরপ্রেরিত লোক, উনি উপকারী, একসময় আমাকে দশ রুবল দিয়েছিলেন আমি তা ভুলিনি। যখন কিয়েভে ছিলাম তখন পাগল সিরিল (তিনিও ঈশ্বরের আপনজন, শীগ্রীষ্মে খালি পায়ে চলেন) আমাকে বলেছিলেন, তুমি কেন জায়গামতো যাচ্ছ না? কোলিয়াজিনে চলে যাও, সেখানে পবিত্র ঈশ্বর-জননীর একটি অদ্ভুতকর্মা মূর্তি আত্মপ্রকাশ করেছে। এই কথা শুনে ধর্মাত্মাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চল এসেছি।

সকলেই চুপ, শুধু তীর্থযাত্রিনী শ্বাস টেনে আবার বলতে শুরু করল।

তাই তো আমি এলাম মনিব, আর লোকে আমাকে বলল : একটি মহৎ করুণা প্রকাশ পেয়েছে, পবিত্র জননীর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পবিত্র তৈলধারা…

প্রিন্সেস মারি বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, সে-সব কথা তো পরেও বলতে পারবে।

পিয়ের বলল, আমাকে প্রশ্ন করতে দাও। তুমি নিজের চোখে দেখেছ?

অবশ্য দেখেছি মনিব। কী সৌভাগ্য আমার। মুখের উপর স্বর্গীয় আলো ঝলমল করছে আর পবিত্র জননীর দুই গাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে…

পিয়ের সরাসরি বলে উঠল, কিন্তু বাবু, সেটা তো ফাঁকিবাজিও হতে পারে!

ওঃ মনিব, এ আপনি কী বলছেন? আতঙ্কিত পেলাগেয়া কথাগুলি বলে সমর্থনের আশায় প্রিন্সেস মারির দিকে তাকাল।

পিয়ের আবার বলল, ওরা লোককে ধোঁকা দেয়।

ক্রুশচিহ্ন এঁকে স্ত্রীলোকটি চেঁচিয়ে বলল, হা প্রভু যিশুখৃস্ট! ওকথা বলবেন না মালিক। একজন অবিশ্বাসী সেনাপতি একবার বলেছিল, সন্ন্যাসীরা ধোকা দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে সে অন্ধ হয়ে গেল। সে স্বপ্নে দেখল, কিয়েব সমাধিক্ষেত্রের পবিত্র কুমারী মাতা তাকে বলছেন, আমার উপর বিশ্বাস রাখ, আমি তোমাকে ভালো করে দেব। তখন সেনাপতি সকলকে অনুরোধ করল, আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে চলো, তাঁর কাছে নিয়ে চলো। আপনাকে সত্যি কথাই বলছি, আমার নিজের চোখে দেখা। একেবারে অন্ধ অবস্থায় তাকে মাতার কাছে নিয়ে যাওয়া হল, তার কাছে উপুড় হয়ে পড়ে সে বলল, আমাকে ভালো করে দাও, জার আমাকে যা দিয়েছেন তাই আমি তোমাকে দেব। আমি নিজের চোখে দেখেছি মালিক, একটা তারা মূর্তির গায়ে আটকে গেল। তারপর কী হল বলুন তো? সে তার দৃষ্টি ফিরে পেল! ওসব বলাও পাপ। ঈশ্বর আপনাকে শাস্তি দেবেন, পিয়েরের দিকে ফিরে সে বলল।

তারাটা ঘরের মধ্যে এল কেমন করে? পিয়ের শুধাল।

আর পবিত্র জননী কি সেনাপতির পদটি পেয়েছিলেন? প্রিন্স আন্দ্রু হেসে বলল।

সহসা পেলাগেয়া মুখটা কালো করে নিজের হাত দুটো এক খরে চেপে ধরল।

হায় মালিক, মালিক, এ কী পাপ! অথচ আপনার ছেলে আছে! হঠাৎ মুখটা লাল করে সে বলতে শুরু করল। এ আপনি কি বললেন মালিক? ঈশ্বর আপনাকে ক্ষমা করুন! সে কুশ-চিহ্ন আঁকল। প্রভু ওকে ক্ষমা করুন! এ সবের অর্থ কি? সে প্রিন্সেস মারিকে শুধাল। প্রায় কাঁদতে কাঁদতে সে ঝোলাঝুলি গোছাতে শুরু করল। বোঝা গেল সে ভয় পেয়েছে, আবার বাড়ি ছেড়ে যেতেও কষ্ট হচ্ছে।

প্রিন্সেস মারি বলল, কেন এমন কাজ করলে? কেন তুমি আমার কাছে এলে?…

পিয়ের বলল, শোন পেলাগেয়া, আমি ঠাট্টা করছিলাম। তুমি বিশ্বাস কর প্রিন্সেস, ওকে আঘাত দিতে আমি চাইনি। কিছু মনে করে কথাটা বলিনি। একটু ঠাট্টা করেছি মাত্র। সবই আমার দোষ, আন্দুও ঠাট্টাই করেছে।

সন্দিহান চিবত্তে পেলাগেয়া থামল, কিন্তু পিয়েরের মুখে এমন আন্তরিক অনুতাপের ভাব ফুটে উঠল এবং প্রিন্স আন্দ্রু এমন ভীরু চোখে একবার তার দিকে একবার পিয়েরের দিকে তাকাতে লাগল যে পেলাগেয়া ধীরে ধীরে তাদের কথায় আশ্বস্ত হল।

.

অধ্যায়-১৪

 তীর্থযাত্রিনীটি শান্ত হল, নতুন করে কথা বলার উৎসাহ পেয়ে সে এফিলোকাস বাবার একটা দীর্ঘ বিবরণ দিতে লাগল। এফিলোকাস বাবা এত পবিত্র জীবন যাপন করে যে তার হাত দিয়ে ধুনোর গন্ধ বেরোয়, কিয়েভ ভ্রমণের সময় কয়েকজন পরিচিত সন্ন্যাসী তাকে ভূগর্ভস্থ সমাধিগুলোর চাবি দিয়েছিল, আর সেও কিছু শুকনো রুটি সঙ্গে নিয়ে দুটো দিন সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সেই সব সমাধিতে কাটিয়েছে। একস্থানে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করে অন্যস্থানে বসে ভেবেছি, তারপর আর একস্থানে গিয়েছি। একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার গিয়েছি, পুরাবস্তুগুলিতে চুমো খেয়েছি। চারদিকে সে কী শান্তি, কী আনন্দ! সেখান থেকে স্বর্গের আলোতেও বেরিয়ে আসতে ইচ্ছা করে না।

পিয়ের গম্ভীর মুখে সব শুনল। প্রিন্স আন্দ্রু বেরিয়ে গেল। ঈশ্বরের লোকদের চায়ের পাট শেষ করতে দেখে প্রিন্সেস মারি পিয়েরকে নিয়ে বসবার ঘরে গেল।

বলল, তোমার খুব দয়া।

সত্যি, ওদের প্রাণে আঘাত দিতে আমি চাইনি। ওদের আমি খুব ভালো করেই জানি, আর খুবই শ্রদ্ধা করি।

নীরবে তার দিকে তাকিয়ে প্রিন্সেস মারি সানুরাগ হাসি হাসল।

তুমি তো জান অনেকদিন থেকে আমি তোমাকে চিনি, দাদার মতোই তোমাকে ভালোবাসি। আন্দ্রুকে কেমন দেখছ? ওর জন্য বড়ই চিন্তায় আছি। শীতকালে ওর স্বাস্থ্যটা ভালো ছিল, কিন্তু গত বসন্তকালে ঘাটা আবার দেখা দিয়েছে, ডাক্তার বলছে আরোগ্যের জন্য কোথাও চলে যেতে। তান মানসিক অবস্থার কথা ভেবেও আমার বড় ভয় করছে। ও তো মেয়েদের মতো নয়, কষ্ট পেলে আমরা কেঁদে সে কষ্ট ভুলতে চেষ্টা করি, কিন্তু ও তো সব মনের মধ্যে চেপে রাখে। আজ সে বেশ হাসিখুশি ও খোশ মেজাজে আছে, কিন্তু সে তো তুমি এসেছ বলে–সচরাচর সে এমন থাকে না। দেখ তো, তুমি ওকে বিদেশে যেতে রাজি করাতে পার কি না! ওর দরকার কাজে ডুবে থাকা, এই শান্ত নিয়মিত জীবন ওর পক্ষে খুব খারাপ। অন্যরা সেটা বুঝতে পারে না, কিন্তু আমি পারি।

দশটা নাগাদ বুড়ো প্রিন্সের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে চাকরবাকররা ফটকের দিকে ছুটে গেল। প্রিন্স আন্দ্রু ও পিয়েরও বারান্দায় গেল।

গাড়ি থেকে নামতে নামতেই পিয়েরকে দেখতে পেয়ে বুড়ো প্রিন্স শুধাল, ও কে?

 তার পরিচয় শুনে বলল, আঃ! খুব খুশি হলাম! আমাকে চুমো খাও।

বুড়ো প্রিন্সেস মেজাজ ভালো ছিল, পিয়েরের প্রতিও খুবই সদয়।

নৈশ ভোজনের আগে বাবার পড়ার ঘরে ঢুকে প্রিন্স আন্দ্রু দেখল গৃহস্বামী ও অতিথির মধ্যে তুমুল তর্ক চলেছে। পিয়ের বলছে, এমন একদিন আসবে যখন যুদ্ধ বলে কিছু থাকবে না, আর বুড়ো প্রিন্স কোনোরকম রাগ না দেখিয়েই তার তীব্র প্রতিবাদ করছে।

মানুষের শিরা থেকে সব রক্ত বের করে নিয়ে সেখানে জল ঢেলে দাও, তবে যুদ্ধ বন্ধ হবে! যতসব বুড়িদের অর্থহীন কথা! বুড়ো প্রিন্স মুখে প্রতিবাদ করলেও সস্নেহে পিয়েরের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রুর টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলে তখন শহর থেকে আনা বাবার কাগজপত্রগুলো দেখছিল। বুড়ো প্রিন্স তার কাছে গিয়ে কাজের কথা শুরু করল।

কাউন্ট রস্তভ একজন মার্শাল হয়েও তার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যার অর্ধেক লোকও পাঠাননি। শহরে এসে তিনি আমাকে ডিনারে নেমন্তন্ন করতে চেয়েছিলেন–আমি তাকে আচ্ছা ডিনার খাইয়েছি!…যাক সে কথা। তোমার এই বন্ধুটি খুব ভালো ছেলে–আমার ভালো লেগেছে। সে আমাকে নাড়া দিতে পেরেছে। অন্যরা ভালো ভালো কথা বলে, কিন্তু কান পেতে কোনো কথা শোনে না, কিন্তু এ বাজে কথা বললেও মনকে নাড়া দিতে পারে। আচ্ছা, এখন এস। হয়তো নৈশভোজনের সময় আমিও তোমাদের সঙ্গে বসে যাব। তখন আর একগ্রস্থ তর্ক হবে। যেতে যেতে সে পিয়েরকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার বোকা মেয়েটার সঙ্গে বন্ধুত্ব করো হে।

প্রিন্স আন্দ্রুর সঙ্গে বন্ধুত্বের যে কত শক্তি ও আকর্ষণ পিয়ের সেটা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে এবার বল্ড হিলসে বেড়াতে এসে। সে আকর্ষণ বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কের বেলায় যত প্রকাশ পেয়েছে তার চাইতে বেশি প্রকাশ পেয়েছে তার পরিবার ও বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। কঠোর চরিত্র বুড়ো প্রিন্স এবং মৃদু ও ভীরু প্রিন্সেস মারিকে তার মনে হচ্ছে পুরোনো বন্ধুর মতো। তারাও ইতিমধ্যেই তার প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠেছে। শুধু প্রিন্সেস মারিই নয়, এক বছরের প্রিন্স নিকলাস এবং মাইকেল আইভানভিচ ও মাদময়জেল বুরিয়েও স্মিত হাসি হেসে তার দিকে তাকায়।

বুড়ো প্রিন্স নৈশ ভোজে যোগ দিতে এল, আর সেটা স্পষ্টতই পিয়েরের জন্য। মাত্র দুই দিন হল সে এখানে এসেছে, এরই মধ্যে সে বুড়ো প্রিন্সের প্রিয় হয়ে উঠেছে, সে তাকে আবার আসবার আমন্ত্রণও জানিয়েছে।

পিয়ের চলে যাবার পরে বাড়ির লোকরা যখনই একত্র হয় তখনই পিয়ের সম্পর্কে যার যার মতামত প্রকাশ করে। কোনো নতুন লোক বাড়িতে এসে চলে গেলে এটা হামেশাই ঘটে থাকে, কিন্তু এক্ষেত্রে এটাই ব্যতিক্রম যে কেউই তার সম্পর্কে ভালো ছাড়া মন্দ কিছু বলে না।

.

 অধ্যায়-১৫

ছুটি থেকে ফিরে আসার সময় রস্তভ এই প্রথম অনুভব করল, দেনিসভ ও গোটা রেজিমেন্টের সঙ্গে তার বন্ধন কত ঘনিষ্ঠ।

মস্কোতে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছবার সময় তার যে মনোভাব হত, রেজিমেন্টের কাছাকাছি পৌঁছে সেই একই ভাব জাগল তার মনে। তার রেজিমেন্টের বোতামখোলা ইউনিফর্ম পরা প্রথম হুজারটিকে যখন সে দেখতে পেল, যখন চিনতে পারল লাল-চুল দেমেন্তিয়েভকে, যখন লাভ্রুশকা সানন্দে তার মনিবকে ডেকে বলল, কাউন্ট এসে গেছেন! আর দিনসভ হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠে অগোছালো অবস্থায় মাটির ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল এবং অফিসাররা সকলেই তাকে অভ্যর্থনা করতে এসে জড় হল, তখন রস্তভের বুকের মধ্যে সেই অনুভূতিই জাগল যা জেগেছিল তখন যখন তার মা, বাবা ও বোন তাকে আলিঙ্গন করেছিল, আনন্দের অশ্রুতে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল, একটা কথাও বলতে পারল না। রেজিমেন্টও তো একটা বাড়ি, তার বাপ-মায়ের বাড়ির মতোই প্রিয় ও দামি।

আর একবার সৈনিক জীবনের সুনির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করে স্তব বিশ্রামরত ক্লান্ত মানুষের মতোই আনন্দ ও স্বস্তি অনুভব করতে লাগল। এবারকার অভিযানকালে সৈনিক-জীবন তার কাছে অধিকতর প্রীতিপদ মনে হল এই কারণে যে দলখভের কাছে হারবার পরে সে মনস্থির করেছে, আগেকার মতো না চলে সে তার দোষের প্রায়শ্চিত্ত করবে, একজন সত্যিকারের প্রথম শ্রেণীর কমরেড ও অফিসারের মতো আচরণ করবে-এ কথায় সে হয়ে উঠবে একটি পরিপূর্ণ চমৎকার মানুষ, যা হওয়া বাইরের জগতে খুবই শক্ত মনে হলেও রেজিমেন্টে খুবই সম্ভব।

অনেক টাকা হারবার পরে সে প্রতিজ্ঞা করেছে, পাঁচ বছরের মধ্যে বাবার সব দেনা শোধ করে দেবে। বছরে সে দশ হাজার রুবল পায়, কিন্তু স্থির করেছে এখন থেকে শুধু দুই হাজার নেবে আর বাকিটা রেখে দেবে বাবার ঋণ শোধ করার জন্য।

উপযুপরি পশ্চাদপসরণ ও অগ্রগমন এবং পুলতস্ত ও প্রশিক্ষ-আইলোর যুদ্ধের পরে আমাদের বাহিনী বার্তেনস্তিনের কাছে একত্র হয়েছে। সম্রাটের আগমন ও নতুন অভিযান শুরুর জন্য সকলেই অপেক্ষা করে আছে।

সেনাবাহিনীর যে অংশটা ১৮০৫-এর অভিযানের সঙ্গে যুক্ত ছিল তার অন্তর্ভুক্ত পাভলোগ্রাদ রেজিমেন্ট রাশিয়াতে পুরোদমে নতুন সৈন্য সংগ্রহ করে এত দেরিতে এসে হাজির হল যে অভিযানের প্রথম দিককার যুদ্ধে তারা কোনো অংশই নিতে পারল না। তারা না ছিল পুলতঙ্কে, না ছিল প্রশিঙ্ক-আইলোতে, অভিযানের দ্বিতীয়ার্ধে এসে তারা যখন সেনাবাহিনীতে যোগ দিল তখন তাদের প্রাতভের ডিভিশনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল।

প্লাতভের ডিভিশন মূল বাহিনী থেকে আলাদ হয়ে স্বাধীনভাবে যুদ্ধ করছিল। পাভলোগ্রাদ রেজিমেন্টের একটা অংশ কয়েকবার শত্রুদের সঙ্গে গুলি বিনিময় করেছে, শত্রুসৈন্যদের বন্দি করেছে, এমন কি একবার মার্শাল ওদিমোর গাড়িগুলোকে পর্যন্ত আটক করেছে। এপ্রিল মাসে একটা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও পরিত্যক্ত জার্মান গ্রামের কাছে প্রাভলোগ্রাদদের কয়েক সপ্তাহ ধরে চুপচাপ বসিয়ে রাখা হয়েছে।

বরফ গলতে শুরু করেছে, যেমন কাদা তেমনই ঠাণ্ডা, নদীতে বরফের চাই ভাঙতে শুরু করেছে, রাস্তাঘাট চলাচলের অযোগ্য। দিনের পর দিন না আসছে সৈন্যদের খাবার, না আসছে ঘোড়ার খাবার। গাড়ি-ঘোড়া কিছুই আসতে পারছে না দেখে সৈন্যরা নির্জন পরিত্যক্ত গ্রামে গ্রামে ঢুকে আলুর খোঁজ করতে লাগল, কিন্তু তাও জোটে না।

সবকিছু খেয়ে শেষ করে ফেলেছে, গ্রামবাসীরা সকলেই পালিয়েছে–যারা এখনো আছে তারা ভিখারীরও অধম, তাদের কাছ থেকে নেবার কিছুই নেই, এমনকি যে সৈন্যরা সাধারণত নির্মমই হয়ে থাকে তারাও তাদের কাছ থেকে নেবার পরিবর্তে প্রায়ই নিজেদের শেষ রেশনটুকুও তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে।

পাভলোগ্রাদ রেজিমেন্টের মাত্র দুটি সৈন্য যুদ্ধে আহত হয়েছে, কিন্তু ক্ষুধায় ও রোগে মারা গেছে প্রায় অর্ধেক সৈন্য। হাসপাতালে মৃত্যু এতই অবধারিত হয়ে উঠল যে যে-সব সৈন্য জ্বরে বুগছে অথবা অখাদ্য খেয়ে রোগে ভুগছে তারাও কর্তব্যরত থাকাটাই বেছে নিত এবং হাসপাতালে যাওয়ার বদলে পা টেনে টেনে রণক্ষেত্রে যাওয়াটাই পছন্দ করত। বসন্তকাল এলে সৈন্যরা দেখতে পেল যে শতমূলীর মতো দেখতে কোনো গাছ–যাকে তারা যে কারণেই হোক মাশকার মিষ্টি মূল বলত, মাটির ভিতর থেকে একটুখানি মাথা তুলেছে। সে গাছের স্বাদ খুব তেতো, কিন্তু তারই খোঁজে তারা মাঠে মাঠে গুরে বেড়াত, এবং অনিষ্টকর গাছড়া হিসাবে সেগুলি খাওয়া নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তারা তলোয়ার দিয়ে মাটি থেকে তুলে সেই গাছড়া খেত। সেই বসন্তকালেই সৈন্যদের মধ্যে একটা নতুন রোগ দেখা দিল, হাত, পা, মুখ সব ফুলতে আরম্ভ করল, আর ডাক্তাররা বলল যে এ রোগ ওই গাছড়া খাওয়ারই ফল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দেনিসভের সেনাদল প্রধানত মাশকার মিষ্টি মূল খেয়েই দিন কাটাতে লাগল, কারণ জনপ্রতি আধ পাউন্ড করে বিস্কুট শেষবারের মতো বরাদ্দ করার পরে দ্বিতীয় সপ্তাহ কেটে গেছে এবং সর্বশেষ যে আলু এসেছিল তাতে অঙ্কুর গজিয়েছে এবং জমে গেছে।

একপক্ষকাল ধরে ঘোড়াগুলো চালের খড় খেয়ে বেঁচে আছে, ভয়ঙ্করভাবে শুকিয়ে গেছে।

এই অভাবের মধ্যেও সৈনিক ও অফিসাররা স্বাভাবিক কাজকর্ম করে চলেছে। ফোলা মুখ আর ছোঁড়া ইউনিফর্ম নিয়ে হুজাররা নাম ডাকার সময় সারি দিয়ে দাঁড়াচ্ছে, জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছে, ঘোড়াগুলোর তদারক করছে, অস্ত্রশস্ত্র মেজে-ঘষে পরিষ্কার রাখছে, চাল থেকে কড় এনে ঘোড়াকে খাওয়াচ্ছে, এবং ফুটন্ত কড়াইয়ের পাশে গোল হয়ে খেতে বসে ক্ষিধে নিয়ে উঠে পড়ছে আর বাজে খাবার ও ক্ষিধে নিয়ে নানারকম ঠাট্টা-তামাশা করছে। যথারীতি অবসর সময়ে তারা আগুন জ্বালাচ্ছে, জামা খুলে শরীর গরম করছে, ধূমপান করছে, পচা আলু খুঁড়ে বের করে পুড়িয়ে খাচ্ছে, এবং পোটেমকিন, সুভরভ-এর অভিযান, চতুর আলেশার কাহিনী অথবা পুরোহিতের মজুর মিকলকার গল্প বলছে ও শুনছে।

অফিসাররা যথারীতি আধ-ভাঙা ছাদহীন ঘরে দুজন তিনজন করে বাস করছে। প্রধানরা খড় ও আলু এবং সৈনিকদের জন্য খাবারের যোগাড় করছে। তরুণরা আগের মতোই তাস খেলছে (খাদ্য না থাক, টাকার তো অভাব নেই), কেউ-বা অন্য ধরনের নির্দোষ খেলা খেলছে। অভিযানের কথা কেউ বড় একটা বলে না, কারণ স্পষ্ট করে কিছু জানাও যাচ্ছে না, আর সকলেরই ধারণা যে গতিক বড় ভালো নয়।

রস্তভ আগের মতোই দেনিসভের সঙ্গে বাস করছে, ছুটি কাটিয়ে আসার পর থেকে তাদের বন্ধুত্ব আরো প্রগাঢ় হয়েছে। দেনিসভ কখনো রস্ত পরিবারের কথা বলে না, কিন্তু অধিনায়কটি তার প্রতি যেরকম বন্ধুত্ব দেখাচ্ছে তাতেই রস্তভ বুঝতে পেরেছে যে নাতাশার প্রতি ব্যর্থ প্রবীণ হুজারের ব্যর্থ প্রেমই তাদের বন্ধুত্বের বন্ধনকে দৃঢ়তর করেছে। দেনিসভ সবসময়ই চেষ্টা করে স্তবকে যতদূর সম্ভব বিপদ থেকে দূরে রাখতে, একটা যুদ্ধের পরে সে নিরাপদে ফিরে এলে দেনিসভ তাকে সানন্দে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। আর একবার একটি অসহায় পোলিশ মেয়ে সম্পর্কে অশোভন উক্তি করায় রস্তভ বন্ধুদের উপর ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিল। দেনিসভ মাঝখানে পড়ে কোনোরকমে জগড়া থামায়। পরে এই নিয়ে রস্তভকে তিরস্কার করলে রস্তভ জবাব দিল : আপনার যা খুশি বলতে পারেন…সে আমার বোনের মতো, তাই আমি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছি…কারণ…দেখুন, সেই জন্যই…।

দেনিসভ তার পিঠটা চাপড়ে দিয়ে রস্তভের দিকে তাকিয়ে অতি দ্রুত ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। গভীর আবেগের মুহূর্তে এইরকম করাই তার স্বভাব।

সে তো-তো করে বলল, আঃ, তোমরা রস্তভরা একেবারে পাগল! রস্তভ লক্ষ্য করল, তার চোখের নিচে জল চিকচিক করছে।

.

অধ্যায়-১৬

এপ্রিল মাসে সম্রাটের আগমনের সংবাদে সৈন্যরা উৎসাহিত হয়ে উঠল, কিন্তু বার্তেনস্তিনে অনুষ্ঠিত সেনা সমাবেশে উপস্থিত থাকবার সুযোগ রস্তভের হল না, কারণ সেইসময় পাভলোগ্রাদরা ছিল সেখান থেকে অনেক দূরের একটা ঘাঁটিতে।

তারা তখন খোলা জায়গায় দিন কাটাচ্ছে। দেনিসভ ও রস্তভ বাস করছে মাটির ঘরে, সৈন্যরাই সে ঘর মাটি কেটে তৈরি করে দিয়েছে, ছাদ বানিয়েছে গাছের ডাল ও মাটির চাপড়া দিয়ে। তকালে প্রচলিত ব্যবস্থামতোই ঘরটা এইভাবে তৈরি করা হয়েছে। সাড়ে তিন ফুট চওড়া, চার ফুট আট ইঞ্চি গভীর ও আট ফুট লম্বা একটা ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছে। ট্রেঞ্চের এক প্রান্তে সিঁড়ি বানানো হয়েছে, সেটাই ঘরের প্রবেশদ্বার ও বারান্দা। ট্রেঞ্চটাই হল ঘর, স্কোয়াড্রন-কম্যান্ডারের মতো ভাগ্যবানদের জন্য সেখানে একটা পাটাতন পেতে টেবিল বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্রেঞ্চের দুই পাশে আড়াই ফুট চওড়া করে মাটি কেটে তাই দিয়ে খাট ও কোচের কাজ চালানো হচ্ছে। ছাদটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে ট্রেঞ্চের মাঝখানে একজন মানুষ দাঁড়াতে পারে, এমন কি বিছানার উপর বসতেও পারে। স্কোয়াড্রনের সৈনিকরা দেনিসভকে ভালোবাসে, তাই সে তো রাজার হালে আছে, ছাদের কোণে ভাঙা কাঁচ জুড়ে তার জন্য একটা জানালা পর্যন্ত বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এপ্রিল মাসে রস্তভ আর্দালির কাজে নিযুক্ত ছিল। একদিন বিদ্রি রাত কাটিয়ে সকাল সাতটা থেকে আটটা নাগাদ ফিরে এসে সে কাঠ আনবার জন্য লোক পাঠাল, বৃষ্টিভেজা জামাকাপড় পাল্টে নিল, প্রার্থনা করল, চা খেয়ে শরীর গরম করে নিল, এবং টেবিলের জিনিসপত্র গুছিয়ে তার নিজের কোণটিতে গিয়ে মাথার নিচে দুই হাত রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল, পরনে শুধু একটা শার্ট, ঠাণ্ডা বাতাস লেগে মুখটা চকচক করছে। খুশি মনে অচিরেই একটা পদোন্নতির কথা ভাবতে ভাবতে সে দেনিসভের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

হঠাৎ তার কানে এল, ঘরের পিছন দিকে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে দেনিসভ কাঁপা গলায় চিৎকার করছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি ল্যাচারচুক ওগুলো মাঠ থেকে তুলে এনেছে। কিন্তু আমি তো হুকুম দিয়েছি কেউ যেন মাশকা মূল না খায়।

আমিও তো বারবার হুকুম জারি করেছি ইয়োর অনার, কিন্তু ওরা কথা শোনে না, কোয়ার্টারমাস্টার জবাব দিল।

রস্তভ আবার শুয়ে পড়ল, নিজের মনে বলল : ওরা হুল্লোড় করতে থাকুক, আমার কাজ শেষ করে শুয়ে পড়েছি–চমৎকার!

দূর থেকে দূরে দেনিসভের গলা শোনা গেল। ঘোড়ার পিঠে জিন লাগাও! দ্বিতীয় প্লাটুন!

ওরা কোথায় যাচ্ছে? রস্তভ ভাবল।

পাঁচ মিনিট পরে দেনিসভ ঘরে ঢুকল, কাদামাখা বুট পরেই বিছানায় উঠল, পাইপটা ধরাল, জিনিসপত্র এখানে-ওখানে ছুঁড়ে ফেলে দিল, সিসেভরা চাবুকটা হাতে নিল, তরবারিসহ পেটিটা কোমরে বাঁধল, তারপর বেরিয়ে গেল। সে কোথায় যাচ্ছে রস্তভের এই প্রশ্নের জবাবে বিরক্ত হয়ে জানাল, তার কাজ আছে।

যেতে যেতেই দেনিসভ বলল, ঈশ্বর ও আমাদের মহান সম্রাট পরে যেন আমার বিচার করেন। কাদার ভিতর দিয়ে ছুটন্ত কয়েকটা ঘোড়র ক্ষুরের শব্দ শুভের কানে এল। দেনিসভ কোথায় গেল তা নিয়ে সে মোটেই মাথা ঘামাল না। ঘরের গরমে সে অচিরেই ঘুমিয়ে পড়ল, ঘুম ভাঙল সন্ধ্যা নাগাদ। দেনিসভ তখনো ফেরেনি। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, পাশের ঘরের কাছে দুজন অফিসার ও একটি শিক্ষার্থী শ্বেকা খেলতে খেলতে হাসাহাসি করছে। রস্তভ তাদের সঙ্গে যোগ দিল। খেলার মাঝখানে অফিসাররা দেখল, কয়েকটা মালগাড়ি আসছে, তার পিছনে হাড়-জিরজিরে ঘোড়ায় চেপে আসছে জনা পনেরো হুজার। হুজারদের পাহারায় গাড়িগুলো পিকেট-দড়ির কাছে পৌঁছতেই একদল হুজার তাদের ঘিরে ধরল।

রস্তভ বলল, এই তো, দেনিসভের কী দুশ্চিন্তা, এই তো খাবার এসে গেছে।

 অফিসাররাও বলল, তাই তো! সৈনিকরা এবার খুশি হবে।

 হুজারদের একটু পরে এল দেনিসভ, সঙ্গে দুজন পদাতিক অফিসার।

রস্তভ তাদের সঙ্গে দেখা করতে এগিয়ে গেল।

একটি বেঁটে সরু অফিসার অত্যন্ত রাগের সঙ্গে বলল, আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি ক্যাপ্টেন।

 আমি কি আপনাকে বলিনি যে ওগুলো ছেড়ে দেব না? দেনিসভ জবাব দিল।

এর জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে ক্যাপ্টেন। এ তো বিদ্রোহ–নিজের সেনাবাহিনীর যানবাহন আটক করা। দুদিন আমাদের সৈন্যরা কিছু খেতে পায়নি।

আর আমার সৈন্যরা না খেয়ে আছে দুসপ্তাহ ধরে, দেনিসভ বলল।

পদাতিক অফিসারটি গলা চড়িয়ে বলল, এ তো ডাকাতি! এর জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে স্যার!

দেনিসভ হঠাৎ মেজাজ গরম করে চেঁচিয়ে বলল, কেন আমাকে বিরক্ত করছেন? জবাবদিহি করতে হয় করব, কিন্তু আপনার কাছে নয়। এখানে মেলা বকবক করবেন না, তাতে ফল ভালো হবে না। দূর হোন! চলে যান!

ক্ষুদে অফিসারটি ভয় পেল না, চলেও গেল না। চিৎকার করে বলল, খুব ভালো কথা! আপনি যখন ডাকাতি করতে কৃতসংকল্প তাহলে আমিও…

আপনি জাহান্নামে যান! নিরাপদ ও সুস্থ থাকতে থাকতে পালান! দেনিসভ তার দিকে ঘোড়ার মুখ ফেরাল।

ঠিক আছে, ঠিক আছে! ধমকের সুরে কথা বলে অফিসারটি ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ছুটে চলে গেল।

দেনিসভ হো-হো করে হাসতে হাসতে রস্তভের কাছে গিয়ে বলল, পদাতিক বাহিনীর কাছ থেকে জোর করে গাড়িগুলো ধরে নিয়ে এসেছি। যাই হোক না কেন, আমার লোকগুলোকে তো না খেয়ে মরতে দিতে পারি না।

পরদিন রেজিমেন্ট-কমান্ডার দেনিসভকে ডেকে পাঠাল, তার চোখের সামনে আঙুলগুলো মেলে ধরে বলল, আমি ব্যাপারটাকে এইভাবে দেখছি : এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, আর এ নিয়ে বিচার-বিতর্কও করতে চাই না, কিন্তু আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি, ওদের কাছে গিয়ে কমিসারিয়েট বিভাগ থেকে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলুন, আর সম্ভব হলে অমুক-অমুক জিনিস পেয়েছি বলে একটা রসিদ সই করে দিন। অন্যথায় যেহেতু জিনিসপত্রগুলো পদাতিক রেজিমেন্টের নামে বুক করা ছিল সেইহেতু একটা হৈচৈ হবে এবং তাতে ফল খারাপও হতে পারে।

রেজিমেন্ট-কমান্ডারের পরামর্শমতো কাজ করার আন্তরিক ইচ্ছা নিয়েই দেনিসভ পদাতিক বিভাগের উদ্দেশে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। সন্ধ্যাবেলায় যে অবস্থায় যে ভূগর্ভস্থ ঘরে ফিরে এল রস্তভ আগে কখনো তাকে সে অবস্থায় দেখেনি। দেনিসভ তখন কথা বলতে পারছে না, হাঁসফাস করছে। রস্তভ যখন জানতে চাইল ব্যাপার কি তখন সে শুধু দুর্বল কর্কশ গলায় কতকগুলি অসংলগ দিব্যি করল আর কাকে যেন শাপান্ত করতে লাগল।

ডাকাতির দায়ে আমার বিচার করবে…ওঃ! জল দাও…করুক বিচার, কিন্তু আমি শয়তানদের শায়েস্তা করবই…সম্রাটকে বলব…বরফ… সে তো তো কেরে বলতে লাগল।

রেজিমেন্টের ডাক্তার এসে বলল, দেনিসভের রক্তমোক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। তার লোমশ বাহু থেকে একপাত্র ভর্তি রক্ত নেওয়া হল, আর তবেই সে সব কথা খুলে বলতে পারল।

সেখানে তো গেলাম। তারপর, তোমাদের বড়কর্তার বাসাটা কোথায়? দেখিয়ে দিল। দয়া করে অপেক্ষা করুন। আমি বিশ মাইল ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছি, বিস্তর কাজ পড়ে আছে, অপেক্ষা করার সময় নেই। আমার কথা বল গে। খুব ভালো, বড় চোর বেরিয়ে এলেন, আর এসেই বক্তৃতা শুরু করে দিলেন : এ তো ডাকাতি!–আমি বললাম, যে মানুষ তার সৈন্যদের খাবার যোগাতে খাদ্যদ্রব্য আটক করে, ডাকাতি সে করে না, ডাকাতি করে সে যে তার নিজের পকেট ভর্তি করে। আপনি কি দয়া করে চুপ করবেন?

খুব ভাল কথা। তখন তিনি বললেন। তাহলে যান, কমিশনারের হাতে একটা রসিদ দিন, কিন্তু আপনার এই ব্যাপার প্রধান ঘটিতে পাঠানো হবে। গেলাম কমিশনারের কাছে। চুকলাম, আর দেখি টেবিলে…কি ব্যাপার বল তো? না। একটু অপেক্ষা কর!… আমাদের না খাইয়ে রেখেছে কে সেই লোক? দেনিসভ চিৎকার করে বলল, আর সদ্য রক্ত-নেওয়া হাতের মুঠি দিয়ে এত জোরে টেবিলের উপর আঘাত করল যে টেবিলটা প্রায় ভাঙবার উপক্রম হল আর তার উপরকার গ্লাসগুলো উল্টে পড়ল। তেলিয়ানন! সে কি? তাহলে তুমিই আমাদের না খাইয়ে মারতে চাও? তাই নাকি? তাহলে এই নাও, এই নাও! তার নাকে-মুখে ঘুষি চালালাম…আঃ, সে যে কি…সে যে কি…মানে, খুব মজা হল আর কি! সকলে তাকে সরিয়ে না নিয়ে গেলে হয় তো খুন করেই ফেলতাম!

রস্তভ বলল, কিন্তু আপনি চেঁচাচ্ছেন কেন? শান্ত হোন। আপনার বাহু থেকে নতুন করে রক্ত বেরুচ্ছে। দাঁড়ান, আবার বেঁধে দিই।

নতুন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে দেনিসভকে শুইয়ে দেওয়া হল। শান্ত ও খুশি মেজাজ নিয়েই পরদিন তার ঘুম ভাঙল।

কিন্তু দুপুরবেলা রেজিমেন্টের অ্যাডজুটান্ট গম্ভীর মুখে তাদের ভূগর্ভস্থ ঘরে ঢুকে দুঃখের সঙ্গে মেজর দেনিসভকে লেখা রেজিমেন্ট-কমান্ডারের একটা চিঠি দেখাল, তাতে গত দিনের ঘটনা সম্পর্কে সবকিছু জানতে চাওয়া হয়েছে। সে আরো বলল যে ব্যাপারটা খুব খারাপ মোড় নিতে পারে, একটা সামরিক আদালত নিযুক্ত করা হয়েছে, আর এখন এসব ব্যাপারে যেরকম কড়াকড়ি চলছে তাতে পদাবনতির চাইতে ভালো কিছু আশাই করা যায় না। ফরিয়াদি পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যানবাহন আটক করার পরে মেজর দেনিসভ মাতাল অবস্থায় কোয়ার্টারমাস্টারের কাছে গিয়ে বিনা প্ররোচনায় তাকে চোর বলে, আঘাত করবে বলে শাসায় এবং সেখান থেকে বের করে দিল আপিসে ঢুকে দুইজন কর্মচারীকে ধোলাই দেয় এবং একজনের হাত ভেঙে দেয়।

রুস্তম্ভের প্রশ্নের জবাবে দেনিসভ হেসে বলল, যতসব বাজে কথা, যে কোনো বিচারকে সে মোটেই ভয় করে না, আর সেই শয়তানগুলো যদি তাকে আক্রমণ করতে আসে তো সে তাদের এমন জবাব দেবে যে সহজে তারা তা ভুলতে পারবে না।

দেনিসভ গোটা ব্যাপারটাকে তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিতে চাইলেও রস্তভ বুঝতে পারল যে মনে মনে সে সামরিক আদালতকে ভয় করে এবং তা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন আদালত থেকে নানারকম চিঠি ও মোটিশ আসতে লাগল, এবং পয়লা মে তারিখে হুকুম হল, পরবর্তী প্রধান অফিসারের হাতে স্কোয়াড্রনের বার দিয়ে দেনিসভকে তার ডিভিশনের সামনে হাজির হয়ে কমিসারিয়েট আপিসে মারধোর করার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। আগের দিন দুটো কাক রেজিমেন্ট ও দুই স্কোয়াড্রন হুজারকে সঙ্গে নিয়ে প্রাতভ প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে বেরিয়েছিল। তার যেমন স্বভাব, সেনিসভ সাহস দেখাবার জন্য ঘাঁটিগুলির সম্মুখ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। একজন ফরাসি বন্দুকধারীর গুলি এসে লাগল তার পায়ের মাংসল জায়গায়। অন্য সময় হলে দেনিসভ হয়তো এই সামান্য ক্ষতের জন্য রেজিমেন্ট ছাড়ত না, কিন্তু এই অজুহাতে সকলের সামনে হাজির হওয়া থেকে রেহাই পাবার সুযোগ পেয়ে সে হাসপাতালে চলে গেল।

.

 অধ্যায়-১৭

 ফ্রিডল্যান্ডের যুদ্ধ হল জুন মাসে, পাভলোগ্রাদরা তাতে কোনো অংশ নেয়নি, তারপরেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হল। রস্তভ বন্ধুর অনুপস্থিতিটা খুবই অনুভব করছিল, চলে যাওয়ার পর থেকে তার কোনো সংবাদ না পেয়ে এবং তার ক্ষত সম্পর্কে ও বিচার সম্পর্কে উদ্বেগ বোধ করায় যুদ্ধবিরতির সুযোগে সে ছুটি নিয়ে হাসপাতালে দেনিসভের সঙ্গে দেখা করতে গেল।

প্রাশিয়ার একটা ছোট শহরে হাসপাতালটা অবস্থিত, রুশ ও ফরাসি সৈন্যরা দু দুবার শহরকে ধ্বংস করে রেখে গেছে। তখন গ্রীষ্মকাল, বাইরের মাঠঘাটের দৃশ্য কত সুন্দর, কিন্তু এই ছোট শহরটার কী বিষণ্ণ চেহারা : ছাদ ও বেড়াগুলো ভাঙা, রাস্তাঘাট দুর্গন্ধে ভরা, অধিবাসীদের পরনে জীর্ণ পোশাক, রুগ্ন ও মাতাল সৈন্যরা এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

একটা পাকা বাড়িতে হাসপাতাল করা হয়েছে, তার কিছু কিছু জানালার ফ্রেম ও কাঁচ ভেঙে গেছে, উঠোনের কাঠের বেড়াটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কিছু ব্যান্ডেজ-বাঁধা সৈন্যরা উঠোনের রোদে বসে আছে, কেউ বা হেঁটে বেড়াচ্ছে।

দরজা দিয়ে ঢুকতেই একটা পচা গন্ধ ও হাসপাতালের বাতাস রভের নাকে লাগল। সিঁড়িতে একজন রুশ সামরিক ডাক্তারের সঙ্গে দেকা হল, তার মুখে একটা চুরুট, সঙ্গে একজন সহকারী।

ডাক্তার বলছে, আমি তো নিজেকে টুকরো টুকরো করে বাগ করতে পারি না। সন্ধ্যায় মাকার আলেক্সিভিচের কাছে এস। আমি সেখানে থাকব।

সহকারী আরো কিছু প্রশ্ন করল।

আঃ, যা পার তাই কর! সবই তো এক। উঠে-আসা রশুভের দিকে ডাক্তারের চোখ পড়ল।

বলল, আপনি কি চান স্যার? বুলেট তো লাগেনি দেখছি, তাহলে কি সান্নিপাতিক জ্বরের চিকিৎসা করাবেন? এটাই মহামারী-ভবন স্যার।

তার মানে? রস্তভ শুধাল।

সান্নিপাতিক জ্বরবিকার স্যার। এখানে ঢুকলেই মৃত্যু। শুধু আমরা দুজন, মাকিভ ও আমি (সহকারীকে দেখিয়ে) চালিয়ে যাচ্ছি। এখানেই আমাদের পাঁচটি ডাক্তার মারা গেছে। নতুন কেউ এলে এক সপ্তাহের মধ্যেই সাবাড়। প্রুশিয় ডাক্তারদের এখানে ডাকা হয়েছে, কিন্তু বন্ধুদের এটা মোটেই পছন্দ নয়।

রস্তভ জানাল, সে আহত হুজার দেনিসভের সঙ্গে দেখা করতে চায়।

আমি চিনি না। আপনাকে বলতে পারব না স্যার। শুধু একবার ভাবুন! চারশোর বেশি রোগী ও তিনটে হাসপাতালের দায় আমার একার ঘাড়ে। দানশীলা প্রুশিয় মহিলারা প্রতিমাসে দুই পাউন্ড কফি ও লিন্ট পাঠান তাই রক্ষা, নইলে আমাদের হয়ে যেত! সে হেসে উঠল। চারশো স্যার, তার উপর আবার নতুন রোগী, আসছে তো আসছেই। চারশোই তো আছে, কি বল? সে সহকারীকে শুধাল।

সহকারীটির মাথা ধরে গেছে। ডাক্তারের বকবকানি শুনে শুনে সে বিরক্ত ও অধৈর্য হয়ে পড়েছে।

রস্তভ আবার বলল, মেজর দেনিসভ। মোলিতেনে আহত হয়েছেন।

 সহকারীটি অবশ্য ডাক্তারের কথায় সায় দিল না।

 তিনি কি লম্বা? মাথার চুল লাল? ডাক্তার শুধাল।

রস্তভ দেনিসভের চেহারার বর্ণনা দিল।

খুশি-খুশি ভাব দেখিয়ে ডাক্তার বলল, ওরকম একজন ছিলেন বটে। মনে হচ্ছে তিনি মারা গেছেন। যাই হোক, একবার তালিকাটা দেখে নেব। আমাদের একটা তালিকা ছিল। তুমি সেটা পেয়েছ কি মাকিভ?

সহকারী জবাব দিল, সেটা মাকার আলেক্সিভিচের কাছে আছে। রশুভের দিকে ফিরে বলল, কিন্তু আপনি যদি অফিসার্স ওয়ার্ডে যান তাহলে তো নিজেই দেখে আসতে পারেন।

ডাক্তার বলে উঠল, আপনার না যাওয়াই ভালো স্যার, গেলে হয় তো আপনাকেই এখানে থেকে যেতে হবে।

ডাক্তারকে অভিবাদন জানিয়ে সহকারীকে পথটা দেখিয়ে দিতে বলল।

ডাক্তার পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, আমাকে কিন্তু দোষ দেবেন না।

রস্তভ ও সহকারী অন্ধকার বারান্দায় গেল। সেখানে গন্ধটা এত কড়া যে রস্তভ নাক চেপে ধরে একটু থেমে শক্তি সঞ্চয় করে তবে আবার এগোতে লাগল। ডান দিকে একটা খোলা দরজা। খালি পা ও শুধু তলবাস পরা একটি উটকো লোক ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে বেরিয়ে এল, দরজায় হেলান দিয়ে ঈর্ষাকাতর ঝকঝকে চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। দরজায় উঁকি মেরে রস্তভ দেখল, রুগ্ন ও আহত মানুষগুলো খড় ও ওভারকোটের উপর শুয়ে আছে।

আমি কি ভিতরে ঢুকে দেখতে পারি?

দেখার কি আছে? সহকারী বলল।

কিন্তু যেহেতু সহকারীটির ইচ্ছা নয় যে সে ভিতরে ঢোকে তাই রস্তভ সৈনিকদের ওয়ার্ডে ঢুকে পড়ল। বাতাসে দুর্গন্ধ এখানে আরো বেশি।

বড় বড় জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ায় লম্বা ঘরটা বেশ আলোকিত। দেয়ালের দিকে মাথা রেখে রুগ্ন ও আহতরা দুই সারিতে শুয়ে আছে, মাঝখানে যাতায়াতের পথ। তাদের মধ্যে অনেকেই অচেতন, নবাগতদের দিকে ফিরেও তাকাল না। যাদের চেতনা রয়েছে তারা উঠে বসল, না হয় শুকনো হলদে মুখ তুলে একাগ্র দৃষ্টিতে রশুভের দিকে তাকাল, সকলের মুখেই আশা, স্বস্তি, তিরস্কার ও অপরের স্বাস্থ্যের প্রতি ঈর্ষার সেই একই ভাব। ঘরের মাঝখানে গিয়ে পাশের আরো দুটি ঘরের দিকে তাকিয়েও রস্তভ সেই একই দৃশ্য দেখতে পেল। এরকম দৃশ্য যে দেখতে হবে তা সে আশা করেনি। তার ঠিক সামনে একটি রুগ্ন লোক শুয়ে আছে। চুল কাটার ধরন দেখে মনে হয় লোকটি কসাক। বড় বড় হাত-পা ছড়িয়ে লোকটি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। মুখটা রক্তবর্ণ, চোখ দুটো এমনভাবে পাকিয়ে আছে যে কেবল সাদা অংশটাই দেখা যাচ্ছে, লাল হাতপায়ের শিরাগুলো দড়ির মতো ফুলে উঠেছে। মাথাটা মেঝের উপর ঠুকতে ঠুকতে কর্কশ গলায় সে বারবার কী যেন বলছে। ভালো করে কান পেতে রস্ত কথাগুলো ধরতে পারল। সে বলছে, পানি, পানি, একটু পানি! চারদিকে তাকিয়ে রস্তভ এমন একটি লোককে খুঁজতে লাগল যে এই মানুষটিকে জায়গামতো শুইয়ে একটু পানি এনে দেবে।

সহকারীটিকে জিজ্ঞেস করল, এখানে রোগীদের দেখাশুনা করে কে?

ঠিক সেইসময় হাসপাতালের আর্দালি জনৈক কমিসারিয়েট-সৈনিক পাশের ঘর থেকে সেখানে এল।

রশুভের দিকে তাকিয়ে তাকে হাসপাতালের কর্তৃপক্ষদের একজন বলে ভুল করে বলল, শুভদিন ইয়োর অনার!

কসাকটিকে দেখিয়ে রস্তভ বলল, ওকে ঠিকমতো শুইয়ে দিয়ে একটু পানি এনে দাও।

ঠিক আছে ইয়োর অনার, শান্তভাবে জবাব দিয়ে সৈনিকটি চোখ দুটোকে পাকিয়ে আরো খাড়া হয়ে দাঁড়াল, কিন্তু সেখান থেকে নড়ল না।

না, এখানে কিছু করা অসম্ভব! চোখ নিচু করে এই কথা ভেবে রস্তভ বেরিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ডান দিকে একটি লোক একাগ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে সে ঘুরে দাঁড়াল। একেবারে কোণের দিকে পাকা দাড়িওয়ালা কঙ্কালসার একটি বুড়ো সৈনিক ওভারকোটের উপর বসে একদৃষ্টিতে রশুভের দিকে তাকিয়ে আছে। রস্তভের মনে হল বুড়োটি তাকে কিছু বলতে চাইছে। আরো কাছে গিয়ে সে দেখল, বুড়োর একটা পা ভাজ করা রয়েছে। আর অন্য পাটা হাঁটুর উপর থেকে কেটে বাদ দেয়া হয়েছে। তার পার্শ্ববর্তী যে লোকটি মাথাটা চিৎ করে চুপচাপ পড়ে আছে সে একটি যুবক সৈনিক। মোমের মতো বিবর্ণমুখে ফুটফুট দাগ, চোখ দুটো ওল্টানো। যুবক সৈনিকটির দিকে তাকাতেই রস্তভে শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল।

সহকারীটির দিকে ফিরে বলল, এ কি, মনে হচ্ছে এ তো…

চোয়াল কাঁপতে কাঁপতে বুড়ো সৈনিকটি বলল, আমরা কত করে মিনতি করছি ইয়োর অনার। সকাল থেকে লোকটা মরে পড়ে আছে। কিন্তু আমরা তো মানুষ, কুকুর নই।

সহকারী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, এখনই কাউকে পাঠাচ্ছি। ওকে নিয়ে যাবে।এক্ষুনি নিয়ে যাবে। আসুন ইয়োর অনার।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলুন–রস্তভ দ্রুত কথাটা বলল, চোখ নামিয়ে অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে দুই সারি ভর্ৎসনাপূর্ণ দৃষ্টির অগোচরে সে সেখান থেকে চলে যেতে চেষ্টা করল, একসময় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

.

অধ্যায়-১৮

বারান্দা বরাবর এগিয়ে সহকারীটি রস্তভকে নিয়ে অফিসার্স ওয়ার্ডে ঢুকল। মোট তিনটি ঘর, সব দরজা খোলা। ঘরে বিছানা আছে, রুগ্ন ও আহাত অফিসাররা কেউ শুয়ে আছে, কেউ বসে আছে। হাতপাতালের ড্রেসিং গাউন পরে কেউ কেউ ঘরের মধ্যেই হেঁটে বেড়াচ্ছে। অফিসার্স ওয়ার্ডে রশুভের প্রথম দেখা হল একহাত কাটা একটি ছোটখাট শীর্ণ লোকের সঙ্গে। নৈশ-টুপি মাথায় দিয়ে হাসপাতালের ড্রেসিং-গাউন পরে দাঁতের ফাঁকে একটা পাইপ ধরে সে এক নম্বর ঘরের মধ্যেই হাঁটছে। তাকে দেখেই রস্তভ স্মরণ করতে চেষ্টা করল, কোথায় যেন আগে তাকে দেখেছে!

ছোট লোকটি বলল, আরে, দেখ কোথায় এসে আবার দেখা হয়ে গেল! তুশিন, তুশিন, তোমার মনে নেই শোন গ্রেবার্নে তোমাকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিলাম? দেখতেই তো পাচ্ছ, আমার উপর একটু কাটা-ছেঁড়া হয়েছে, ড্রেসিং-গাউনের খালি আস্তিনটা দেখিয়ে সে হেসে বলল। তারপর রস্তভের প্রশ্নের জবাবে বলল, ভাসিলি দিমিত্রি দেনিসভকে খুঁজছ? আমার প্রতিবেশী। এদিকে, এদিকে, তুশিন তাকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। সেখান থেকে বেশ কয়েকজনের উচ্চহাসির শব্দ ভেসে এল।

আগের দৃশ্যগুলোর ও পচা মাংসের গন্ধের কথা মনে পড়ায় রস্তভ ভাবল, কেমন করে এখানে ওরা হাসতে পারে, এমনকি বেঁচে থাকতে পারে?

এখন প্রায় দুপুর, তবু দেনিসভ তার বিছানায় কম্বলে মাথা ঢেকে ঘুমিয়ে ছিল।

আরে, রস্তভ! কেমন আছ, কেমন আছ? রেজিমেন্টে থাকার সময়ের মতোই জোর গলায় দেনিসভ বলে উঠল, কিন্তু রস্তভ অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করল, তার এই স্বভাবসিদ্ধ স্বাচ্ছন্দ্য ও উৎসাহের অন্তরালে রয়েছে এমন একটি নতুন, অশুভ গোপন অনুভূতি যা দেনিসভের মুখের ভঙ্গিতে ও গলার স্বরে ফুটে উঠেছে।

তার ক্ষত খুবই সামান্য, কিন্তু ছয় সপ্তাহ পরে এখনো সেটা সারেনি। হাসপাতালের অন্য রোগীদের মতোই তার মুখেও সেই একই ফোলা-ফোলা হলদে ভাব। কিন্তু তাতে রস্তভ অবাক হয়নি। দেনিসভ যে তাকে দেখে খুশি হয়নি, সে যে তার দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিকভাবে হাসছে-এটা দেখেই সে অবাক হয়েছে। সে নিজে থেকে তাকে কোনো কথাই জিজ্ঞাসা করল না, এমন কি রস্তভ নিজে যখন কথা বলতে লাগল তখনো তাতে ভালো করে কান দিল না।

এমন কি রস্তভ লক্ষ্য করল, রেজিমেন্টের কথা এবং হাসপাতালের মুক্ত জীবনের কথা কেউ তাকে স্মরণ করিয়ে দিক সেটাও দেনিসভ চায় না। পুরোনো জীবনকে ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র কমিসারিয়েট-অফিসারদের ব্যাপার নিয়েই সে মেতে থাকতে চায়। রস্তভ যখন সেই ব্যাপারটার কথা জানতে চাইল সঙ্গে সঙ্গে সে বালিশের তলা থেকে বের করল কমিশনের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি এবং তার জবাবের যে খসড়া সে করেছে সেটা। সেটা পড়তে পড়তে সে উত্তেজিত হয়ে পড়ল, বিশেষ করে তার জবাবে শত্রুপক্ষের প্রতি যেসব কড়া কড়া কথা সে লিখেছে সেগুলির প্রতি সে রস্তভের মনোযোগ আকর্ষণ করল। তার যে সব হাসপাতালের সঙ্গী নবাগত রস্তবকে ঘিরে সেখানে জমায়েত হয়েছিল, এবার তারা একে একে সরে পড়তে লাগল। তাদের মুখ দেখেই রস্তভ বুঝতে পারল, এইসব ভদ্রলোকরা দেনিসভের চিঠির গল্প বারবার শুনে বিরক্ত হয়ে উঠেছে। শুধু তার পাশের বিছানার শক্তসমর্থ উহলানটি বুরু কুঁচকে পাইপ টানতে টানতে বিছানায়ই বসে রইল, আর একহাতওয়ালা তুশিন তখনো তার পড়া শুনতে শুনতে আপত্তিসূচক ঘাড় নাড়তে লাগল। পড়ার মাঝখানে দেনিসভকে বাধা দিয়ে উহলানটি কথা বলতে শুরু করল।

রস্তভের দিকে ঘুরে সে বলল, আমি বলি কি, ক্ষমা প্রার্থনা করে সম্রাটের কাছে দরখাস্ত পাঠানোই সবচাইতে ভালো।

আমি দরখাস্ত পাঠাব সম্রাটকে! দেনিসভ চেঁচিয়ে বলল, পুরোনো শক্তি ও তেজের সঙ্গে কথাটা বলতে চাইলেও সেটা শোনালো অক্ষরের বিরক্তিসূচক উক্তির মতো। কেন? কিসের জন্য? আমি যদি ডাকাত হতাম তো করুণা চাইতাম, কিন্তু আমাকে কোর্ট-মার্শাল করা হচ্ছে ডাকাতদের ধরিয়ে দেবার জন্য। তারা আমার বিচারই করুক, আমি কাউকে ভয় করি না। সম্মানের সঙ্গে আমি আমার জারের, আমার দেশের সেবা করেছি, চুরি তো করিনি! আর আমাকেই নিচে নামিয়ে দেবে?…শোন, আমি তাদের সোজা লিখে দিচ্ছি। লিখেছি : আমি যদি রাজকোষে লুঠ করতাম…

তুশিন বলল, লেখাটা নিশ্চয়ই খুব ভালো হয়েছে, কিন্তু সেটা তো কথা নয় ভাসিলি দিমিত্রিচ।রস্তভকে বলল, মেনে চলাই উচিত, কিন্তু ভাসিলি দিমিত্রিচ তা চান না। তুমি তো জান, অডিটার বলেছে যে ব্যাপার ভালো নয়।

বেশ তো, খারাপই হোক, দেনিসভ বলল।

তুশিন বলতে লাগল, আপনার জন্য অডিটর একটা আবেদনপত্র লিখে দিয়েছে, সেটাতে স্বাক্ষর করে এই ভদ্রলোককে সেটা নিয়ে যেতে বলা আপনার উচিত। (রস্তভকে দেখিয়ে) ওর নিশ্চয়ই উপর মহলে জানাশুনা আছে। এর চাইতে ভালো সুযোগ আর পাবেন না।

আমি তো বলেছি, কারো সামনে বুকে হাঁটতে পারব না, কথাটা বলে দেনিসভ আবার তার কাগজটা পড়তে লাগল।

রস্তভ বুঝতে পারল যে তুশিন ও অন্য অফিসাররা যে উপায় বাৎলেছে সেটাই সবচাইতে নিরাপদ, আর দেনিসভের কোনো কাজে লাগতে পারলে সেও খুশি হবে, কিন্তু দেনিসভকে বোঝাবার সাহস তার হল না। তার কঠিন ইচ্ছাশক্তি ও কড়া মেজাজের কথা সে জানে।

এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে দেনিসভের তীব্র জবাটা পড়া শেষ হলে রস্তভ কিছুই বলল না, বিষণ্ণ চিত্তে দেনিসভের হাসপাতালের বন্ধুদের সঙ্গেই দিনের বাকি সময়টা কাটিয়ে দিল। সারাটা সন্ধ্যা দেনিসভ চুপচাপ থাকল।

 একটু রাত হলে বিদায় নেবার আগে রস্তভ দেনিসভকে জিজ্ঞাসা করল, তার কিছু করণীয় আছে কি না।

আছে, একটু অপেক্ষা কর, অফিসারদের সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেনিসভ বালিশের তলা থেকে কাগজপত্র বের করে নিয়ে জানালার কাছে চলে গেল। সেখানে একটা দোয়াত ছিল, সে বসে লিখতে শুরু করল।

জানালার কাছ থেকে এসে বড় একটা খাম রস্তভকে দিয়ে বলল, আমার মনে হয়, দেয়ালে মাথা ঠুকে কোনো লাভ নেই। সেই খামে অডিটর কর্তৃক খসড়া-করা সম্রাটকে লেখা দরখাস্তটা ছিল, তাতে কমিসারিয়েট অফিসারদের দোষের কথা উল্লেক না করে দেনিসভ সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা করেছে।

এটা হাতে হাতে দিও। মনে হচ্ছে..

দেনিসভ কথাটা শেষ করল না, একটা বেদনাদায়ক অস্বাভাবিক হাসি তার মুখে দেখা দিল।

.

অধ্যায়-১৯

রেজিমেন্টে ফিরে গিয়ে কমান্ডারকে দেনিসভের ব্যাপারটা জানিয়ে রস্তভ ঘোড়ায় চেপে তিলজিত চলে গেল সম্রাটকে চিঠিটা দিতে।

১৩ই জুন ফরাসি ও রুশ সম্রাটদ্বয় তিলজিতে এল। বরিস বেস্কয় তার উপরওয়ালাকে বলল, তিলজিতে যারা থাকবে তাদের তালিকায় যেন তার নামটাও রাখা হয়।

এই মহাপুরুষটিকে দেখার খুব ইচ্ছে আমার, নেপোলিয়নের প্রসঙ্গে সে কথাটা বলল, যদিও অন্য সকলের মতোই এতকাল সেও তাকে বোনাপার্ত বলেই ডাকত।

সেনাপতি হেসে শুধাল, তুমি কি বোনাপার্তের কথা বলছ?

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সেনাপতির দিতে তাকিয়েই বরিস বুঝতে পারল যে তাকে পরীক্ষা করা হচ্ছে।

সে জবাব দিল, আমি সম্রাট নেপোলিয়ানের কথা বলছি প্রিন্স। সেনাপতি ঈষৎ হেসে তার কাঁধ চাপড়ে দিল।

তুমি অনেকদূর যাবে, সেনাপতি বলল, তাকে সঙ্গে নিয়েই তিলজিত গেল।

 দুই সম্রাটের মধ্যে যেদিন সাক্ষাৎ হল সেদিন নিয়েমেনে যে কজন উপস্থিত ছিল বরিসও তাদের একজন।

নামফলকে সজ্জিত ভেলাটা সে দেখল, নদীর অপর পারে ফরাসি রক্ষীবাহিনীর সামনে দিয়ে নেপোলিয়নকে যেতে দেখল, নিয়েমেন নদীর তীরে একটা হোটেলে নেপোলিয়নের আগমনের জন্য প্রতীক্ষারত সম্রাট আলেক্সান্দারের নীরব বিপ্ন মুখখানি দেখল, দুই সম্রাটকে নৌকায় উঠতে দেখল, আরো দেখল দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে আলেক্সান্দারের সঙ্গে দেখা করল, তার দিকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল, এবং দুজনই তাঁবুর ভিতর চলে গেল।

ইতিমধ্যেই বরিস উঁচু মহলে চলাফেরা করতে শুরু করেছে, সবকিছু মনোযোগ দিয়ে দেখার ও লিখে রাখা অভ্যাসও গড়ে তুলেছে। তিলজিতের সেই সাক্ষাৎকারের সময় নেপোলিয়নের সঙ্গে যারা এসেছিল তাদের নাম, তাদের ইউনিফর্মের বিবরণ সবকিছু সে জেনে নিল, এবং বড় বড় লোকেরা যা-কিছু বলতে লাগল সব মন দিয়ে শুনল। সম্রাটরা যেই তাঁবুতে ঢুকল অমনি সে ঘড়ি দেখল, আর অ্যালেক্সান্দার ফিরে এলেও সে ঘড়ি দেখতে ভুলল না। সাক্ষাৎকারটা চলেছে এক ঘণ্টা তিপ্পান্ন মিনিট। এই সময়টার একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে মনে করে অন্য সব ঘটনার সঙ্গে এটাকেও সে টুকে রেখে দিল।

অপর এক অ্যাডজুটান্ট পোলিশ কাউন্ট ঝিলিনস্কির সঙ্গে বরিস এক ঘরেই থাকে। ঝিলিনস্কি জাতিতে পোল, ধনী, ফরাসিদের খুব ভক্ত। তিলজিতে থাকার সময় প্রায় প্রতিদিনই রক্ষীবাহিনী ও ফরাসি প্রধান ঘাঁটির অফিসাররা তার সঙ্গে ও বরিসের সঙ্গে দিনে ও রাতে সর্বদাই খানা-পিনা করত।

২৪ জুন সন্ধ্যায় কাউন্ট ঝিলিনস্কি ফরাসি বন্ধুদের একটি নৈশভোজ সভায় আমন্ত্রণ করল। সেখানে সম্মানিত অতিথি হল নেপোলিয়নের একজন এড-ডি-কং, আর ছিল রক্ষীবাহিনীর কয়েকজন ফরাসি অফিসার ও নেপোলিয়নের একটি বালক-ভৃত্য, প্রাচীন অভিজাত এক ফরাসি পরিবারের ছেলে। রাতের অন্ধকারে অসামরিক পোশাকে কেউ তাকে চিনতে পারবে না এই ভরসায় সেইদিনই রস্তভ তিলজিত পৌঁছে বরিস ও ঝিলিনস্কির বাসস্থানে এসে হাজির হল।

দরোজা দিয়ে জনৈক অফিসারকে মুখ বাড়াতে দেখেই শত্রুপক্ষকে দেখে রুশ ভাষায় জিজ্ঞাসা করল দ্রবেষ্কয় সেখানে থাকে কিনা। বাইরের ঘরে অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে বরিস বেরিয়ে এল। রস্তভকে চেনামাত্রই তার মুখের উপর মুহূর্তের জন্য একটা বিরক্তির ছায়া পড়ল।

অবশ্য হাসি মুখে তার দিকে এগিয়ে বরিস বলল, আরে, তুমি? তোমাকে দেখে খুব, খুব খুশি হলাম। কিন্তু তার প্রথম প্রতিক্রিয়াটা রস্তভ লক্ষ্য করেছিল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, মনে হচ্ছে বড় অসময়ে এসে পড়েছি। আসা উচিত ছিল না কিন্তু দরকারে পড়েই এসেছি।

তা নয়। আমি শুধু অবাক হচ্ছি, তোমার রেজিমেন্ট ছেড়ে এলে কেমন করে? এক মিনিট, এখনই আসছি। কে যেন তাকে ডাকল, তাই বরিস শেষের কথাগুলি বলল।

মনে হচ্ছে তোমাদের কাজে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল, রস্তভ আবার বলল।

বরিসের মুখের উপর থেকে বিরক্তির ভাবটা এর মধ্যেই মিলিয়ে গেছে, নিঃশব্দে রশুভের হাত ধরে তাকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল।

আরে এসো, তুমি আসবে তার আবার সময়-অসময় কি! বলতে বলতে বরিস তাকে যে ঘরটাকে নিয়ে গেল সেখানে নৈশভোজনের টেবিল সাজানো হয়েছে, অতিথিদের সঙ্গে রস্তভের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, সে অসামরিক লোক নয়, একজন হুজার অফিসার, তার পুরনো বন্ধু।

অতিথিদের নাম করে করে বলল, কাউন্ট ঝিলিনস্তি-লে কোঁত এন.এন.-লে কাপ্তান এসো, এসো.রস্তভ ভুরু কুঁচকে ফরাসি ভদ্রলোকদের দিকে তাকাল, অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাথা নোয়াল, তারপর চুপচাপ বসে রইল।

স্পষ্টতই ঝিলিনস্কি এই নবাগত রুশ লোকটিকে খুশি মনে নিজেদের দলে অভ্যর্থনা করে নিল না, তার সঙ্গে কথাও বলল না। ফরাসিদের সহজাত ভদ্রতার সঙ্গে অপর একজন ফরাসি রভের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলল, সম্ভবত সে সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতেই তিলজিতে এসেছে।

রস্তভ সংক্ষেপে জবাব দিল, না, আমি একটা কাজে এসেছি।

বরিসের মুখে অসন্তোষের ভাবটা লক্ষ করা থেকেই রস্তভের মেজাজটা খিঁচড়ে গেছে। সে উঠে বরিসের কাছে নিচু গলায় বলল, যাই বল, আমি এসে তোমাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়েছি। কাজের কথাটা সেরে নিয়েই আমি চলে যাব।

বরিস বলল, না, না, তা হয় না। বরং তুমি যদি পরিশ্রান্ত হয়ে থাক তো আমার ঘরে চল, কিছুক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম নাও।

হ্যাঁ, সত্যি…

যে ছোট ঘরটাতে বরিস ঘুমোয় তারা সেখানে গেল। রস্তভ কিন্তু বসল না, তখনই দেনিসভের ব্যাপারটা খুলে জানতে চাইল, তার সেনাপতির মারফত সম্রাটের কাছে দরবার করে দেনিসভের আবেদনপত্রটা সম্রাটের হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা সে করতে পারবে কি না। বরিস পায়ের উপর পা তুলে ডান হাতের আঙুল দিয়ে বাঁ-হাতের উপর টোকা মারতে মারতে সেনাপতি যেবাবে অধস্তন কর্মচারীর প্রতিবেদন শোনে ঠিক সেইভাবে একবার এপাশে, একবার সোজা রস্তভের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলি শুনতে লাগল। আর প্রতিবারই রস্তভ অস্বস্তি বোধ করায় মুখটা নামিয়ে নিল।

এ রকম ঘটনার কথা আমি আগেও শুনেছি, আমি জানি মহামান্য সম্রাট এসব ব্যাপারে খুবই কড়া। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারটা সম্রাটের কাছে না নিয়ে সেনাদলের অধিনায়কের কাছে আবেদন করাই ভালো।… তবে সাধারণভাবে আমি মনে করি…

তার মানে তুমি কিছু করতে চাও না? বেশ তো, তাই বলে দাও! বরিসের মুখের দিকে না তাকিয়েই রস্তভ চেঁচিয়ে বলে উঠল। বরিস হাসল।

তা নয়। বরং আমি যতটা পারি তা করব। শুধু আমার মনে হল…

ঠিক সেই সময় ঝিলিনস্কি বরিসকে ডাকল।

ওই তো, যাও, যাও, যাও…রস্তভ বলল। সে খাবার টেবিলেও গেল না, ছোট ঘরটাতে একাই রইল, পাশের ঘরের ফরাসি ভাষায় হালকা কথা-বার্তা শুনতে শুনতে অনেকক্ষণ ধরে সে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল।

.

অধ্যায়-২০

 রস্তভ এমন একটা দিনে তিলজিত এসেছিল যেটা দেনিসভের আবেদনপত্র পেশ করার পক্ষে মোটেই উপযুক্ত ছিল না। সেনাপতির কাছে সে নিজে যেতে পারল না কারণ সে এসেছে সাদা পোশাকে আর তাও এসেছে কোনোরকম অনুমতি না নিয়ে, আবার ইচ্ছা থাকলেও বরিস পরের দিন তার সঙ্গে দেখা করতে পারত না। পরের দিন অর্থাৎ ২৭ জুলাই সন্ধির প্রাথমিক কাগজপত্রে সাক্ষর করা হল। সম্রাটদ্বয় পদক বিনিময় করল : আলেক্সান্দার গ্রহণ করল, লিজিয়ন অব অনার ক্রুশ আর নেপোলিয়ন পেল প্রথম ডিগ্রির সেন্ট আলু অর্ডার, সন্ধ্যায় একটা ভোজসভার আয়োজন করা হল, উভয় সম্রাটই তাতে যোগ দিল।

বরিসের সঙ্গ রস্তভের কাছে এতই অস্বস্তিকর মনে হল যে ভোজন সেরে সে যখন ফিরে এল রস্তভ তখন ঘুমের ভান করে পড়ে রইল এবং পরদিন সকালে বরিসের সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেল। বেসামরিক পোশাকে গেলে টুপি মাথায় দিয়ে সে শহরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল, রাজপথে ইউনিফর্মপরা ফরাসিকে দেখল, যে-সব বাড়িতে রুশ ও ফরাসি সম্রাটরা আছে তা দেখল। একটা স্কোয়ারে দেখল ভোজসভার জন্য টেবিল পাতা হয়েছে, রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশ রুশ ও ফরাসি পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে, তাতে বড় বড় হরফে এ. ও এন. লেখা। বাড়ির দরজায়-দরজায়ও নিশান টাঙানো হয়েছে।

নিকলাস ভাবতে লাগল, বরিস আমাকে সাহায্য করতে চায় না, আমিও তাকে সাহায্যের কথা বলতে চাই না। আমাদের মধ্যে সব চুকেবুকে গেছে, কিন্তু দেনিসভের জন্য যা করা সম্ভব তা না করে, বিশেষ করে তার চিঠিটা ম্রাটের কাছে পৌঁছে না দিয়ে আমি এখান থেকে যাচ্ছি না। সম্রাট!… তিনি তো এখানেই আছেন! আলেক্সান্দারের বাসভবনের সামনে এসে পড়ায় কথাটা রশুভের মনে হল।

সুসজ্জিত ঘোড়াগুলি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন হাজির হয়েছে। সম্রাটের বের হবার সময় হয়েছে।

রস্তভ ভাবতে লাগল, যে-কোনো মুহূর্তে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। চিঠিটা সরাসরি তার হাতে দিয়ে যদি বলি… অসামরিক পোশাকের জন্য তারা কি সত্যি আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে? নিশ্চয়ই না! ন্যায়ের পাল্লা কার দিকে সেটা তিনি বুঝতে পারবেন। তার মতো ন্যায়বান, উদারচিত্ত আর কে হতে পারে? আর এখানে এসেছি বলে তারা যদি আমাকে গ্রেপ্তারই করে, তাতেই বা কী?… লোকজন তো ভিতরে যাচ্ছেই… যতসব বাজে কথা! ভিতরে গিয়ে নিজের হাতেই চিঠিটা ম্রাটের হাতে তুলে দেব। সঙ্গে সঙ্গে একটা অপ্রত্যাশিত দৃঢ়তা রস্তভকে পেয়ে বসল, পকেটের চিঠিটাকে চেপে ধরে সে সোজা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল।

সে ভাবল, অস্তারলিজে যে সুযোগ হারিয়েছি সে সুযোগ আজ আর হারাব না। তার পায়ের উপর পড়ে মিনতি করব। তিনি আমাকে তুলে ধরবেন, আমার কথা শুনবেন, এমনকি আমাকে ধন্যবাদ দেবেন। কারো ভালো করতে পারলে আমি খুশি হই, আর অন্যায়ের প্রতিকারই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সুখ, বস্তভ কল্পনায় যেন সম্রাটের কথাগুলি শুনতে পেল। অনেক লোকজনকে কাটিয়ে সে সম্রাটের ভবনের বারান্দায় পৌঁছে গেল।

একজন জিজ্ঞেস করল, কী চাই?

কাঁপা গলায় নিকলাস বলল, একটা চিঠি, একটা আবেদনপত্র ম্রাটের হাতে দিতে চাই।

আবেদনপত্র? এইদিকে, ভারপ্রাপ্ত অফিসারের কাছে চলে যান (নিচে যাবার সিঁড়িটা দেখিয়ে দিল), তবে ওটা কেউ নেবে না।

তার নির্বিকার কণ্ঠস্বরে রস্তভ ভয় পেয়ে গেল, ভাবল সেখান থেকে চলে যাবে, কিন্তু ততক্ষণে লোকটি দরজাটা খুলে ধরেছে, আর রস্তভও ভিতরে ঢুকে গেল।

সাদা ব্রিচেস, উঁচু বুট ও সুতির শার্টপরা বছর তিরিশ বয়সের একটি হ্রস্বকায় জোয়ান লোক ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার খানসামা ব্ৰিচেসের বোম এঁটে দিচ্ছে।

এটা কী? আবেদনপত্র?

আবার আবেদনপত্র?

ওকে পরে আসতে বলে দাও। তিনি এখুনি বেরিয়ে আসবেন, আমাদের যেতে হবে।

পরে… পরে। কাল। অনেক দেরি হয়ে গেছে…

রস্তভ মুখ ফিরিয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ব্রিচেসপরা লোকটি তাকে থামাল।

 আপনি কার কাছ থেকে এসেছেন? আপনি কে?

 আমি এসেছি মেজর দেনিসভের কাছ থেকে, রস্তভ জবাব দিল।

আপনি কি একজন অফিসার?

 লেফটেন্যান্ট কাউন্ট রস্তভ।

কী ঔদ্ধত্য! ওটা আপনার কম্যান্ডারের মারফৎ পাঠাবেন। এবার চলে যান… চলে যান, খানসামার হাত থেকে ইউনিফর্মটি নিয়ে সে পড়তে লাগল।

রস্তভ হলঘরে ফিরে গেল। প্যারেড ইউনিফর্মে সজ্জিত অনেক অফিসার ও সেনাপতি সেখানে ভিড় করেছে। চোখ নিচু করে তাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতেই একটি পরিচিত কণ্ঠ তার নাম ধরে ডাকল, একটি হাত তার পথ আটকে দিল।

অসামরিক পোশাকে আপনি এখানে কী করছেন স্যার?

লোকটি অশ্বারোহী বাহিনীর একজন সেনাপতি, এই অভিযানের সম্রাটের বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেছে, আগে রস্তভের সঙ্গে একই সেনাদলে ছিল।

তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে রস্তভ সব কথা খুলে বলল, দেনিসভের ব্যাপারে তার সাহায্য চাইল। সব কথা শুনে সেনাপতিটি গম্ভীরভাবে মাথা নাড়তে লাগল।

ভালো মানুষটির জন্য আমি দুঃখিত, খুবই দুঃখিত। চিঠিটা দিন।

রস্তভ সবে চিঠিটা তার হাতে দিয়ে দেনিসভের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছে এমন সময় সিঁড়িতে দ্রুত পায়ের শব্দ শোনা গেল, সেনাপতিটি তাকে রেখে বারান্দায় এগিয়ে গেল। ম্রাটের পর্ষদরা সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে এসে যার যার ঘোড়র কাছে চলে গেল। সম্রাটের ঘোড়ার পরিচিত পদশব্দ রস্তভের কানে এল। ধরা পড়ে যাওয়ার বিপদকে ভুলে গিয়ে কয়েকজন কৌতূহলী নাগরিকের সঙ্গে রস্তভও বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল, দুই বছর পরে আর একবার দেখতে পেল তার সেই প্রিয় মূর্তি, সেই একই মুখ, একই দৃষ্টি, একই পদক্ষেপ, মহিমা ও নম্রতার সেই একই সহাবস্থান… সম্রাটের প্রতি আকর্ষণ ও অনুরাগের সেই পুরনো অনুভূতি নতুন করে জাগল রস্তভের অন্তরে। প্রিয়োব্রাজেনস্ক রেজিমেন্টের ইউনিফর্ম-সাদা শ্যাময় চামড়ার ব্রিচেস ও উঁচু বুট পরে বুকে একটা স্টার লাগিয়ে সম্রাট বারান্দায় নেমে এল, হাতে দস্তানা পরা, বগলের নিচে টুপি। থেমে একবার চারদিকে তাকাল, তার দৃষ্টিপাতে সবকিছু যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কয়েকজন সেনাপতির সঙ্গে কিছু কথা বলে রস্তভের সেনাদলের প্রাক্তন কম্যান্ডারকে চিনতে পেরে সম্রাট হেসে ইশারায় তাকে কাছে ডাকল।

দলের অন্য সকলে সরে গেল, রস্তভ দেখল, সেনাপতিটি কিছু সময় সম্রাটের সঙ্গে কথাবার্তা বলল।

তার সঙ্গে কথা শেষ করে সম্রাট ঘোড়ার দিকে এক পা এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার পার্ষদবর্গ ও পথের। দর্শনার্থীরা ম্রাটের দিকে এগিয়ে গেল। ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে জিনটা ধরে সম্রাট অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতির দিকে মুখ ফেরাল, যাতে সকলে শুনতে পায় সেভাবে উচ্চকণ্ঠে বলল, এ-কাজ আমি করতে পারি না সেনাপতি। আমি পারি না, তাছাড়া আইন আমার চাইতেও বেশি শক্তিমান। সম্রাট পাদানিতে পা দিল।

সেনাপতি সম্মানে মাথা নোয়াল, সম্রাট ঘোড়ার পিঠে চেপে জোরকদমে রাজপথে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। উৎসাহে আত্মহারা হয়ে জনতার সঙ্গে সঙ্গে রস্তভও তার পিছন পিছন ছুটতে লাগল।

.

অধ্যায়-২১

ঘোড়ায় চেপে সম্রাট স্কোয়ারে গিয়ে হাজির হল। সেখানে দুই দল সৈন্য মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, প্রিয়োব্রাঝেনস্ক রেজিমেন্টের দলটি ডাইনে, আর টুপিপরা ফরাসি রক্ষীবাহিনীর সেনাদলটি বাঁ দিকে।

জার কাছে আসতেই সেনাদল তাকে অভিবাদন জানাল, সে-সময়ই আর একদল অশ্বারোহী এগিয়ে এল, রস্তভ চিনল তাদের সকলের আগে নেপোলিয়ন। আর কেউ হতে পারে না। সে এগিয়ে এল দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে, মাথায় ছোট টুপি, পরনে সাদা কুর্তার উপর নীল ইউনিফর্ম, কাঁধের উপর সেন্ট এন্ডরুজ ফিতেটি ঝোলানো। জরির কাজকরা লাল রঙের জিনে সাজানো একটা ভালো জাতের আরবি ঘোড়ায় চেপে সে এসেছে। আলেক্সান্দারের কাছে গিয়ে নেপোলিয়ন মাথার টুপিটা তুলল। সৈন্যরা চিৎকার করে উঠল হুররা!-ভিতা লা এম্পোরিয়র! দুইজনে কোনো কথা হল না, দুই সম্রাট গোড়া থেকে নেমে পরস্পরের হাত ধরল। নেপোলিয়নের মুখে অপ্রীতিকর কৃত্রিম হাসি, আলেক্সান্দারের মুখে শিষ্টাচারের বাণী।

রস্তভ যখন দেখল আলেক্সান্দার বোনাপার্তের সঙ্গে সমকক্ষের মতো ব্যবহার করছে, আর নেপোলিয়নও এমন সহজভাবে জারের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে যেন সম্রাটের সঙ্গে এ ধরনের মেলামেশাটা তার কাছে প্রাত্যহিক ঘটনারই মতো, তখন তার বিস্ময়ের সীমা রইল না।

আলেক্সান্দার ও নেপোলিয়ন ভিড়ের একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল। সমবেত জনতা তখন অপ্রত্যাশিতভাবে দুই সম্রাটের এত কাছাকাছি এসে পড়েছে যে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে রস্তভের ভয় হল যে তার পরিচয় হয়তো প্রকাশ পেয়ে যাবে।

জনাব, আপনার সৈন্যদের মধ্যে যে সবচাইতে সাহসী তাকে সম্মানপদকে ভূষিত করার অনুমতি দিন, প্রতিটি শব্দকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে একটি তীক্ষ্ণকণ্ঠে কথাগুলি বলা হল।

আলেক্সান্দারের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে কথাগুলি বলল হ্রস্বকায় নেপোলিয়ন। কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনে আলেক্সান্দার মাথা নিচু করে মদুর হাসি হাসল।

সম্মুখে দণ্ডায়মান রুশ সেনিকদের দিকে তাকিয়ে প্রতিটি শব্দকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে নেপোলিয়ন আরো বলল, বিগত যুদ্ধে যে সবচাইতে অধিক সাহসের পরিচয় দিয়েছে তাকে…

ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি কি কর্নেলের সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে দেবেন? এই কথা বলে আলেক্সান্দার অতি দ্রুত পা ফেলে ভারপ্রাপ্ত কম্যান্ডার প্রিন্স জলভস্কির দিকে এগিয়ে গেল।

ইতিমধ্যে বোনাপার্ট হাতের দস্তানা খুলতে গিয়ে সেটা ছিঁড়ে ফেলে দিল। জনৈক এড-ডি-কং পিছন থেকে ছুটে এসে সেটা তুলে নিল।

সম্রাট আলেক্সান্দার নিচু গলায় কজলভস্কিকে জিজ্ঞাসা করল, ওটা কাকে দেওয়া যায়?

ইয়োর ম্যাজেস্ট্রি যাকে দিকে বলবেন।

অসন্তোষের সঙ্গে দুটো ভুরুকে এক করে পিছনে তাকিয়ে সম্রাট বলল, কিন্তু ওকে তো একটা জবাব দিতে হবে।

কজলভস্কি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সৈন্যদের বিচার করতে লাগল, রস্তভও সে বিচারের মধ্যে পড়ল।

আমাকে কী? রস্তভ ভাবল।

ভুরু কুঁচকে কর্নেল হাঁকল, লাজারেভ! সারির প্রথম সৈনিকটি দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল।

কোথায় চললে? এখানেই দাঁড়াও! কয়েকজন ফিসফিস করে লাজারেভকে বলল। কোথায় যেতে হবে বুঝতে না পেরে লাজারেভ থেমে গেল, সভয়ে তাকাল, কর্নেলের দিকে। তার মুখটা কুঁচকে উঠছে।

নেপোলিয়ন মাথাটা একটু সরাল, যেন কোনো কিছু নেয়ার জন্য ভোলা ছোট হাতটা পিছন দিকে বাড়িয়ে দিল। সে কী চাইছে বুঝতে পেরে পার্ষদরা হাতে হাতে একটা জিনিস এগিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে পরস্পরকে কী যেন বলল, আর শেষপর্যন্ত বালকভৃত্যটি গতকাল সন্ধ্যায় রস্তভ যাকে বরিসের বাসায় দেখেছিল–দৌড়ে এগিয়ে গেল এবং বাড়ানো হাতটাকে সসম্মানে অভিবাদন জানিয়ে মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা না করে লাল ফিতেয় বাঁধা সম্মানচিহ্নটি হাতের উপর রেখে দিল। নেপোলিয়ন না তাকিয়েই দুই আঙুলের ফাঁকে সেটাকে ধরে নিল। তারপর সে লাজারেভের দিকে এগিয়ে গেল, সম্রাট আলেক্সান্দারের দিকে একবার তাকাল এবং সম্মানচিহ্নসহ ছোট হাতখানি লাজারেভের একটি বোমকে স্পর্শ করল। নেপোলিয়ন কুশটিকে লাজারেভের বুকের উপর শুধু রেখে দিল, তারপর হাতটা নামিয়ে আলেক্সান্দারের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, যেন সে নিশ্চিত জানে যে কুশটা সেখানেই আটকে থাকবে। আর সত্যি সত্যি তাই থাকল।

রুশ ও ফরাসি কর্মচারীরা সঙ্গে সঙ্গে কুশটিকে ধরে তার ইউনিফর্মে আটকে দিল। লাজারেভ বিষণ্ণ চোখে ছোট মানুষটিকে একবার দেখে নিয়ে আলেক্সান্দারের চোখে চোখ রাখল, যেন জানতে চাইল, সে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, না চলে যাবে, না অন্যকিছু করবে। কিন্তু কোনো হুকুম না পেয়ে সেখানেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

সম্রাটদ্বয় পুনরায় ঘোড়ায় চেপে চলে গেল। প্রিয়োব্রাঝেন সৈন্যরা দল ভেঙে ফরাসি রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে মিশে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে পড়ল।

লাজারেভ বসল সম্মানের আসনে। রুশ ও ফরাসি অফিসাররা তাকে আলিঙ্গন করল, অভিনন্দন জানাল, তার হাত চেপে ধরল। দলে দলে অফিসার ও নাগরিকরা শুধু তাকে দেখার জন্য ভিড় করল। হাসি ও গল্পে টেবিল জমে উঠল। দুজন খুশি-খুশি অফিসার রস্তভের পাশ দিয়ে চলে গেল।

একজন বলল, জিনিস কী রকম বলে মনে হয়? সবটাই রুপোর পাতের উপর। লাজারেভকে দেখেছ?

দেখেছি।

শুনলাম প্রিয়োব্রাঝেনস্কিরা কাল তাকে ডিনার দেবে।

হ্যাঁ, কিন্তু লাজারেভের কী কপাল! আজীবন বারোশ ফ্রা পেনশন।

জনৈক প্রিয়োব্রাঝেনস্কি সৈনিক একটা ফরাসি টুপি মাথায় দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ছেলেরা, এই একটা টুপি!

খুব ভালো জিনিস! একেবারে সেরা!

রক্ষীবাহিনীর জনৈক অফিসার আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করল, সাংকেতিক শব্দটা শুনেছ কি? গত পরশু ছিল নেপোলিয়ন, ফ্রান্স, ব্রেভুরে, গতকাল ছিল আরেক্সান্দ্র, রুশি, গ্রাদিয়র। একদিন আমাদের সম্রাট ওটা দেন, পরের দিন দেন নেপোলিয়ন। কাল আমাদের সম্রাট একটি সেন্ট জর্জ ক্রুশ পাঠাবেন ফরাসি রক্ষীবাহিনীর সবচাইতে সাহসী বীরের জন্য। তা তো করতেই হবে। দানের প্রতিদান তো দিতেই হবে।

বন্ধু ঝিলিনস্কিকে নিয়ে বরিসও এসেছিল প্রিয়োব্রাঝেনস্কিদের ভোজসভা দেখতে। ফেরার পথে দেখল, একটা বাড়ির কোণে রস্তভ দাঁড়িয়ে আছে।

রস্তভ! কেমন আছ? আর তো আমাদের দেখাই হয়নি, সে বলল। রস্তভের মুখটা এতই বিষণ্ণ ও চিন্তাগ্রস্ত ছিল যে বরিস তার কারণ জিজ্ঞাসা না করে পারল না।

কিছু না, কিছু না, রস্তভ জবাব দিল।

আবার আমাদের দেখা হবে তো?

হ্যাঁ, হবে।

 সেই কোণটাতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রস্তভ দূর থেকে ভোজসভাটা দেখতে লাগল। তার মনের মধ্যে একটা ব্যথার ধারা বয়ে চলেছে। তার শেষ নেই। ভয়ঙ্কর সব সন্দেহ জেগেছে তার অন্তরে। তার মনে পড়ল দেনিসভের পরিবর্তন, তার কথা, গোটা হাসপাতাল, দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হাত-পা, আবর্জনা ও রোগ। হাসপাতালের পচা মাংসের দুর্গন্ধ এত তীব্র হয়ে তার মনে পড়ল যে সে-দুর্গন্ধ কোথা থেকে আসছে জানার জন্য সে চারদিকে তাকাতে লাগল। তারপরেই মনে এল আত্মতুষ্ট বোনাপার্তের কথা, যে আজ সম্রাট হয়েছে, আলেক্সান্দারও যাকে পছন্দ করে, শ্রদ্ধা করে। তাহলে কেন এইসব বিচ্ছিন্ন হাত-পা, আর মৃত মানুষের ভিড়?… আবার মনে এল পুরস্কৃত লাজারেভ এবং দেনিসভের কথা–যে শাস্তি পেল, ক্ষমা পেল না। এমন সব চিন্তা তার মাথায় ঢুকতে লাগল যে সে ভয় পেয়ে গেল।

প্রিয়োব্রাঝেনস্কিদের খাদ্যের গন্ধে তারও ক্ষিধে পেয়ে গেল, এখান থেকে যাবার আগে কিছু খাওয়া দরকার। একটা হোটেলে গেল। সেখানে আরো অনেক লোক খেতে এসেছে। নিকলাস নিঃশব্দে পান-ভোজন (বিশেষ করে প্রথমটা) শেষ করল। একই দুবোতল মদ সাবাড় করল। মনের মধ্যেকার সেই চিন্তাগুলো এখনো তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। না পারছে তাকে প্রকাশ করতে, না পারছে তাকে মন থেকে তাড়াতে। হঠাৎ একজন অফিসার যেই বলে উঠল যে ফরাসিদের দিকে তাকানোটাই অসম্মানকর অমনি রস্তভ এমন অপ্রত্যাশিতভাবে চেঁচিয়ে উঠল যে অন্য অফিসাররা অবাক বনে গেল।

চোখ মুখ লাল করে সে চেঁচিয়ে বলল, কী ভালো তার আপনারা কী বোঝেন? সম্রাটের কাজের সমালোচনা করবার আপনারা কে? কী অধিকার আপনাদের? সম্রাটের লক্ষ্য বা তার কাজকর্মকে বুঝবার ক্ষমতা আমাদের নেই!

আমি তো সম্রাটের সম্পর্কে একটা কথাও বলিনি! অফিসারটি বলল। রস্তভের এই রাগের কারণ বুঝতে না পেরে সে ধরে নিল যে রস্তভ মাতলামি শুরু করেছে।

 কিন্তু রস্তভ তার কথায় কান দিল না।

বলতে লাগল, আমরা তো কূটনীতিক কর্মচারী নই, আমরা সৈনিক, তার বেশি কিছু নই। আমাদের যদি মরতে হুকুম দেয়া হয় তো আমাদের মরতেই হবে। যদি শাস্তি দেয়া হয় তো বুঝতে হবে যে শাস্তি আমাদের প্রাপ্য, বিচারের ভার আমাদের হাতে নয়। সম্রাট যদি বোনাপার্তকে সম্রাট বলে মেনে নেন, তার সঙ্গে যদি সন্ধি করে থাকেন, তো বুঝতে হবে যে সেটাই সঠিক কাজ। একবার যদি আমরা সবকিছু নিয়ে বিচার করতে, তর্ক করতে শুরু করি, তাহলে পবিত্র বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না! সে-পথে গেলে আমরা বলতে শুরু করব যে ঈশ্বর নেই–কিছুই নেই, টেবিলে ঘুষি মেরে নিকলাস চিৎকার করে বলতে লাগল।

আমাদের কাজ কর্তব্য পালন করা, যুদ্ধ করা, চিন্তা-ভাবনা করা নয়! বাস, তাহলেই হল… সে বলল।

 জনৈক অফিসার আপোসে বলল, আর মদ খাওয়া।

 হ্যাঁ, মদ খাওয়া, নিকলাস কথাটা মেনে নিল। এই, কে আছিস! আর এক বোতল! সে হাঁক দিয়ে বলল।

.

অধ্যায়-২২

১৮০৮ সালে সম্রাট নেপোলিয়নের সঙ্গে নতুন করে সাক্ষাৎ করতে সম্রাট আলেক্সান্দার এরফুর্তে গেল। পিটার্সবুর্গের উপর মহলে এই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারের অনেক জাঁকজমকের কথা শোনা গেল।

১৮০৯ সালে পৃথিবীর দুই সালিস-নেপোলিয়ন ও আলেক্সান্দারকে এইভাবেই উল্লেখ করা হত-এর মধ্যে এতই ঘনিষ্ঠতা জন্মাল যে নেপোলিয়ন যখন অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল তখন আমাদের প্রাক্তন মিত্র অস্ট্রিয়ার সম্রাটের বিরুদ্ধে আমাদের প্রাক্তন শক্ত বোনাপার্তের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য একটি রুশ সৈন্যদল সীমান্ত পার হয়ে গেল, এবং দরবারমহলে নেপোলিয়নের সঙ্গে আলেক্সান্দারের এক বোনোর বিয়ের সম্ভাবনার কথাও আলোচিত হতে লাগল। কিন্তু বৈদেশিক নীতির কথা ছাড়াও সেই সময় সরকারের বিভিন্ন বিভাগে যে সব অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন করা হচ্ছিল তার প্রতিও রুশ সমাজের সকলেরই তীক্ষ্ণ মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছিল।

ইতিমধ্যে জীবনের ধারা সত্যিকারের জীবন, তার স্বাস্থ্য ও রোগ, পরিশ্রম ও বিশ্রাম, চিন্তায়, বিজ্ঞানে, কাব্যে, সঙ্গীতে, ভালোবাসায়, বন্ধুত্বে, বিদ্বেষে ও আবেগে তার যে বৌদ্ধিক আগ্রহ–সবকিছুকে নিয়ে যে জীবনের ধারা তা স্বাভাবিক গতিতেই বয়ে চলতে লাগল, নেপোলিয়নের রাজনৈতিক বন্ধুত্ব বা শত্রুতা এবং পুনর্গঠনের সবরকম পরিকল্পনার স্পর্শ থেকে দূরে থেকে স্বাধীনভাবেই বয়ে চলল। [প্রথম খণ্ড সমাপ্ত]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *