তৃতীয় পর্ব – অধ্যায়-১
ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা করে সেই মতো কাজ করার লোক প্রিন্স ভাসিলি নয়। নিজের সুবিধার জন্য অন্যের ক্ষতি করার কথাও সে ভাবতে পারে না। সে একজন সাধারণ সংসারী লোক, এগিয়ে চলতে চলতে এগিয়ে চলাটাই তার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। নিজে থেকে কোনো পরিকল্পনা সে করে না, কোনো কৌশলও উদ্ভাবন করে না, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও মানুষজনের ভিতর থেকেই তার পরিকল্পনা ও কৌশল গড়ে ওঠে। এই ধরনের পরিকল্পনা শুধু একটি-দুটি নয়, ডজন ডজন তার মাথায় ঘোরে, কতকগুলি সবে গড়ে উঠছে, কতকগুলি বাস্তবে রূপায়িত হবার পথে। আবার কতকগুলি নষ্ট হবার পথে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সে কখনো নিজের মনে বলে না! এই লোকটির প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, তার বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব আমাকে অর্জন করতে হবে, এবং তাকে দিয়ে একটা বিশেষ কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। অথবা এ কথাও সে বলে না, পিয়ের ধনী লোক, তাকে ভুলিয়ে আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে, এবং তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় চল্লিশ হাজার রুবল ধার নিতে হবে। কিন্তু কোনো পদস্থ লোকের সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রই তার মা তাকে বলে দেয় যে এই লোকটি কাজে লাগতে পারে, আর অমনি আগে থেকে কিছু না ভেবেচিন্তেই প্রিন্স ভাসিলি প্রথম সুযোগেই তার বিশ্বাস অর্জন করে, তাকে খোসামোদ করে, তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয় এবং শেষপর্যন্ত একটা অনুরোধ পেশ করে।
মস্কোতে পিয়েরকে হাতের কাছে পেয়ে সে তাকে শয়নকক্ষের দ্ৰজন পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করে দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলের মর্যাদা পাইয়ে দিল এবং যুবকটিকে ধরে বসল, তার সঙ্গে পিটাসবুর্গে গিয়ে তার বাড়িতেই বাস করতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে আপন-ভোলা হলেও সে যে ঠিক কাজটি করছে সে বিষয়ে একান্ত নিশ্চিত হয়েই প্রিন্স ভাসিলি সাধ্যমতো চেষ্টা করতে লাগল যাতে পিয়ের তার মেয়েকে বিয়ে করে। আগে থেকে পরিকল্পনা করে নিলে ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন মর্যাদার লোকদের সঙ্গে মেলামেশার ব্যাপারে সে কখনো এত বেশি সহজ, স্বাভাবিক ও অবিচলিত হতে পারত না। এমন একটা কিছু আছে যা তাকে সর্বদাই অধিকতর ধনী ও প্রতিপত্তিশালী লোকদের দিকে টানে, আর সেই সব লোকদের দিয়ে কাজ গুছিয়ে নেবার শুভক্ষণটিকে আঁকড়ে ধরবার একটা বিরল দক্ষতাও তার অধিগত।
কিছুদিন আগেও পিয়ের ছিল নিঃসঙ্গ মানুষ, কোনো চিন্তা-ভাবনা তার ছিল না, কিন্তু এখন অপ্রত্যাশিতভাবে কাউন্ট বেজুখভও মস্তবড় ধনী মানুষ হয়ে যাওয়ায় তার ঝুট-ঝামেলা ও কাজকর্ম এত বেড়ে গেছে যে রাতে শোবার আগে সে আর নিজেকে খুঁজে পায় না। অনেক কাগজপত্রে সই করতে হয়, উদ্দেশ্য না জেনেই সরকারি অফিসে হাজিরা দিতে হয়, প্রধান নায়েবের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হয়, মস্কোর নিকটবর্তী জমিদারি দেখতে যেতে হয়, আর এমন সব লোককে স্বাগত জানাতে হয় যারা আগে তার অস্তিত্বের খবরটাও রাখত না, অথচ এখন তাদের সঙ্গে দেখা না করলে তারা অসন্তুষ্ট হবে, ক্ষুব্ধ হবে। এই সমস্ত লোকজন ব্যবসায়ী, আত্মীয় ও পরিচিত জন-সকলেই এই তরুণ উত্তরাধিকারীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব কামনা করে তার স্তাবকতা করে, সকলেরই দৃঢ় ধারণা যে পিয়ের বহু সদগুণের অধিকারী। এমন কি যে সব লোক আগে তার প্রতি বিরূপ ছিল, তার সঙ্গে অমিত্রসুলভ আচরণ করত, তারাও এখন তার প্রতি অনুরক্ত ও স্নেহশীল হয়ে উঠেছে। এমন কি সেই কোপনস্বভাবা বড় রাজকুমারীও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরে পিয়েরের ঘরে এসেছিল। চোখ নামিয়ে বারবার মুখটা লাল করে সে তাকে বলেছে : অতীতের ভুল-বোঝাবুঝির জন্য সে খুবই দুঃখিত, সে জানে যে পিয়েরে কাছে। কোনো কিছু চাইবার অধিকার তার নেই, তবু যে বাড়িকে সে এত ভালোবাসে, যে বাড়িতে সে অনেক কিছু ত্যাগ করেছে, সেই বাড়িতে আরো কয়েক সপ্তাহ থাকবার অনুমতি সে চাইছে। বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলল। প্রস্তর-মূর্তিটির মতো অবিচল এই রাজকুমারীর এতাদৃশ পরিবর্তন দেখে পিয়ের তার হাতটি ধরে তার কাছে ক্ষমা চাইল, অথচ কিসের জন্য ক্ষমা তা সে জানে না। সেদিন থেকেই পিয়েরের প্রতি বড় রাজকুমারীর মনোভাব সম্পূর্ণ বদলে গেল, সে পিয়েবের জন্য একটা ডোবা-কাটা স্কার্ফ বুনতে শুরু করল।
রাজকুমারীর উপকারের জন্য একটা দলিল সই করাতে সেটাই পিয়েরের হাতে দিয়ে প্রিন্স ভাসিলি বলল, আমার জন্য তুমি এটা কর বাবা, আর যাই হোক, মৃত ব্যক্তিটির জন্য সে অনেককিছু সহ্য করেছে।
কারুকার্যখচিত পোর্টফোলিওতে যা রয়েছে তাকে নিজের অংশ সম্পর্কে রাজকুমারী যাতে কোনো প্রশ্ন না তোলে সেজন্য এই হাড়ের টুকরো-তিরিশ হাজার রুবলের একটা বিল–তাকে দেওয়াই সমীচীন-অনেক ভেবে প্রিন্স ভাসিলি এই সিদ্ধান্তেই এসেছে। পিয়ের দলিলে সই করে গিদল, আর তার পর থেকে রাজকুমারী তার প্রতি আরো সদয় হয়ে উঠল। ছোট রাজকুমারীরাও তার প্রতি সদয় হয়ে উঠল, বিশেষ করে গালে তিলওয়ালী একেবারে ছোট সুন্দরীটির হাসি তো প্রায়ই তাকে বিব্রত করে তোলে, আবার পিয়েরের সঙ্গে দেখা হলেই সে নিজেও বিব্রত হয়ে পড়ে।
সকলে যে তাকে ভালোবাসে সেটা পিয়েরের কাছে এতই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হয়েছে যে চারদিককার লোকজনের আন্তরিকতায় বিশ্বাস না করে সে পারে নি। আসলে এই লোকগুলি আন্তরিক কি না সে প্রশ্ন করবার সময়ই তার ছিল না। সে সদাই ব্যস্ত, সর্বদাই তার সময় কাটছে একটা মধুর নেশার মধ্যে।
প্রথম দিকে অন্য সকলের তুলনায় প্রিন্স ভাসিলিই পিয়েরের বিধিব্যবস্থা এবং স্বয়ং পিয়েরকে বেশি করে নিজেরকর হাতে তুলে নিয়েছে। কাউন্ট বেজুখভের মৃত্যুর পর থেকে কখনো এই ছেলেটিকে হাতছাড়া হাতে দেয় নি, সে এমন ভাব দেখাতে লাগল যেন কাজকর্মের চাপে অত্যন্ত শ্রান্ত ও বিপর্যস্ত হলেও পুরোনো বন্ধুর ছেলে ও প্রভূত অর্থের অধিকারী এই অসহায় যুবকটির সে ভাগ্যের খেয়ালখুশি ও দুষ্ট লোকের চক্রান্তের হাতে ছেড়ে দিতে পারে না। কাউন্ট বেজুখভের মৃত্যুর পরে যে কটা দিন সে মস্কোতে ছিল তখন সে হয় পিয়েরকে ডেকে পাঠাত, আর না হয়তো নিজেই তার কাছে যেত এবং ক্লান্ত গলায় কর্তব্য সম্পর্কে তাকে নানা রকম নির্দেশ দিত, প্রতিবারই সে যেন বলত : তুমি তো জান কাজকর্ম নিয়ে আমি একেবারে ডুবে আছি, আর শুধু তোমার ভালোর জন্যই তোমার কথা ভাবছি, তুমি তো ভালো করেই জান যে আমি যা বলছি একমাত্র সেটাই হওয়া সম্ভব।
দেখ বাপু, কাল তাহলে আমরা রওনা হচ্ছি, একদিন প্রিন্স ভাসিলি চোখ বুজে পিয়েরের কনুইতে হাত বুলোতে বুলোতে এমন সুরে কথা বলতে লাগর যেন এ ব্যাপারটা অনেক আগেই স্থির হয়ে আছে এবং এখন আর তার কোনো পরিবর্তন ঘটতে পারে না। কাল আমরা রওনা হচ্ছি আর আমার গাড়িতে তোমার জন্য একটা জায়গাও রেখেছি। আমি খুব খুশি হয়েছি। এখানে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির ব্যবস্থা হয়ে গেছে, অনেক আগেই আমার এখান থেকে যাওয়া উচিত ছিল। এটা পেয়েছি চ্যান্সেলরের কাছ থেকে। তোমার জন্য তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তোমাকে কূটনৈতিক বিভাগে নিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং শয্যা-কক্ষের দ্রজনের পদ দেওয়া হয়েছে।
পিয়ের কি যেন বলতে চাইল, কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে প্রিন্স ভাসিলি আবার বলল, না হে বাপু, যা করেছি নিজের জন্যই করেছি, আমার বিবেককে পরিতুষ্ট করতেই করেছি, সেজন্য ধন্যবাদ জানাবার কিছু নেই। ভালোবাসার বাড়াবাড়ির কোনো অভিযোগ আজ পর্যন্ত কেউ করেনি, তাছাড়া, তুমি ইচ্ছা করলেই কাল সব ছুঁড়ে ফেলে দিতে পার। কিন্তু পিটার্সবুর্গে গেলে সবকিছুই তো নিজের চোখে দেখতে পারবে। এখানকার ভয়ংকর স্মৃতির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য তোমার এখান থেকে চলে যাবার সময় হয়ে গেছে। প্রিন্স ভাসিলি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হ্যাঁ, হ্যাঁ বাবা। আমার খানসামা তোমার গাড়িতে যেতে পারবে। আরে, আমি তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি তো জানো বাবা, তোমার বাবার সঙ্গে আমার কিছু দেনা পাওনার ব্যাপর ছিল, আর তাই রিয়াজান জমিদারি থেকে পাওনাটা আমি নিয়ে নিয়েছি, ওটা আমার কাছেই থাকবে, তোমার ওটা দরকার হবে না। হিসাব-নিকাশটা পরে করা হবে।
রিয়াজান জমিদারি থেকে পাওনা বলতে প্রিন্স ভাসিলি চাষীদের কাছ থেকে পাওয়া কয়েক হাজার রুবল খাজনার কথাই বলতে চাইল, টাকাটা সে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে।
যেমন মস্কোতে তেমনি পিটার্সবুর্গেও পিয়ের সেই একই ভদ্রতা ও স্নেহের পরিবেশই পেল। প্রিন্স ভাসিলি তার জন্য যে চাকরি, বরং বলা যায় পদমর্যাদার (কারণ তাকে কিছুই করতে হয় না) ব্যবস্থা করে দিয়েছে সেটাকে সে অস্বীকার করতে পারেনি, ফলে নানাবিধ আমন্ত্রণ ও সামাজিক বাধ্যবাধকতা এত বেশি বেড়ে গেছে যে অবিরাম হৈ-হল্লায় সে বড়ই বিব্রত বোধ করতে লাগল।
তার আগেকার পরিচিত বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই এখন পিটার্সবুর্গে নেই। রক্ষীবাহিনী রণক্ষেত্রে চলে গেছে, দলখভের পদাবনতি ঘটেছে, আনাতোল যুদ্ধে যোগ দিয়ে মফস্বলে কোথাও চলে গেছে, প্রিন্স আন্দ্রু বিদেশ, কাজেই পিয়ের ইচ্ছামতো রাত কাটার সুযোগ পাচ্ছে না, বা কোনো শ্রদ্ধাভাজন বন্ধুর কাছে মন খুলে কথা বলতেও পারছে না। ডিনারে আর বলনাচেই তার সবটা সময় চলে যাচ্ছে, তার দিন কাটছে প্রধানত প্রিন্স ভাসিলির বাড়িতে তার স্ত্রী, সুন্দরী কন্যা হেলেন ও রাজকুমারীর সাহচর্যে।
সমাজে অন্য সকলের মতোই পিয়েরের প্রতি আন্না পাভলভনা শেরেরের মনোভাবের ও পরিবর্তন ঘটেছে।
আগেকার দিন আন্না পাভলভনার সামনে গেলেই পিয়েরের মনে হত সে যা কিছু বলছে সেটাই অবান্তর, বুদ্ধিহীন ও বেমানান, অথচ পিহোলিতের অত্যন্ত বোকা বোকা কথাগুলিও কত চতুর ও মানানসই। এখন তো পিয়ের যা কিছু বলে তাই সুন্দর।
১৮০৫-৬-এর শীতকালের গোড়ার দিকে পিয়ের আন্না পাভলভনার একখানা গোলাপি চিঠি পেল, তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সে লিখেছে : যাকে দেখলেই মন ভরে সেই সুন্দরী হেলেনকে এখানে পাবে।
চিঠি পড়ে পিয়ের এই প্রথম অনুভব করল যে তার ও হেলেনের মধ্যে একটা যোগসূত্র গড়ে উঠেছে, এই চিন্তা একদিন তাকে ভীত করে তুলল, কারণ এমন একটা দায় যেন তার উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে যা সে পূর্ণ করতে পারবে না, আর এতে সে খুশিও হল, কারণ প্রস্তাবটা সুখকর বটে।
আন্না পাভলভনার এবারকার স্বাগত অনুষ্ঠানটিও ঠিক আগেকার অনুষ্ঠানেরই অনুরূপ, শুধু অতিথিদের সামনে এবার যে নতুন ব্যক্তিটিকে সে উপস্থিত করেছে সে মর্তেৰ্মার্ত নয়, বার্লিন থেকে সদ্য আগত একজন কূটনীতিবিদ, সম্রাট আলেকজান্দারের পসদাম পরিভ্রমণ এবং মানবজাতির মহাশত্রুর বিরদ্ধে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকল্পে দুই সম্মানিত বন্ধুর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য মৈত্রীর প্রতিশ্রুতির বিবরণ সংগ্রহ করে নিয়েই সে এখানে এসেছে। কাউন্ট বেজুখভের মৃত্যুতে সম্প্রতি পিয়েরের যে ক্ষতি হয়েছে সেটা স্মরণ করেই আন্না পাভলভনা ঈষৎ বিষণ্ণতার সঙ্গে পিয়েরকে স্বাগত জানাল। এতে পিয়েরের মন বেশ খুশিই হল। স্বাভাবিক কুশলতার সঙ্গেই আন্না পাভলভনা বিভিন্ন দলকে তার বসার ঘরে আলাদা আলাদাভাবে বসিয়েছে। বড় দলটাতে বসেছে প্রিন্স ভাসিলি, সেনপতিরা এবং নবাগত কূটনীতিবিদ। আর একটা দল বসেছে চায়ের টেবিলে। পিয়েরের ইচ্ছা ছিল বড় দলটাতেই যোগ দেয়, কিন্তু আন্না পাভলভনা তাকে দেখতে পেয়েই আঙুল দিয়ে তার আস্তিনটা চেপে ধরে বলল, একটু সবুর করো, আজ সন্ধ্যায় তোমাকে একটা জিনিস দেখাব। (হেলেনের দিকে চোখ ফিরিয়ে সে হাসল।) প্রিয় হেলেন, আমার বেচারি মাসির প্রতি একটু সদয় হও, সে তোমাকে ভালোবাসে। দশ মিনিট তার কাছে গিয়ে বসো। আর সেখানে যাতে তোমার একঘেয়ে না লাগে সেজন্য আমাদের প্রিয় কাউন্ট তোমাকে সঙ্গ দিতে আপত্তি করবে না।
সুন্দরী হেলেন মাসির কাছে চলে গেল, কিন্তু আন্না পাভলভনা পিয়রকে আটকে রাখল, মনে হল তাকে কিছু চূড়ান্ত ও প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়ার আছে।
অপসৃয়মাণ সুন্দরীকে দেখিয়ে সে পিয়েরকে বলল, খুব সুন্দরী নয় কি? আর কি আচার-আচরণ! এত অল্প বয়সে আচরণের কী মহৎ পরিপূর্ণতা! সবই যেন অন্তর থেকে উৎসারিত হচ্ছে। এ মেয়েকে যে জয় করবে সে সুখী হবে! তাকে সঙ্গিনী পেলে সংসারের অতি সাধারণ মানুষও সমাজে উজ্জ্বল আসনের অধিকারী হবে। তোমারও কি তাই মনে হয় না? আমি শুধু চেয়েছিলাম তোমার অভিমতটা জানতে, এই কথা বলে আন্না পাভলভনা পিয়রকে ছেড়ে দিল।
পিয়েরও জবাবে হেলেনের আচরণের পূর্ণতা সম্পর্কে তার সঙ্গে ঐকমত্যই প্রকাশ করল। অবশ্য হেলেনের কথা ভাবতে গিয়ে তার রূপ ও নিঃশব্দ মর্যাদা প্রকাশের উল্লেখ্যযোগ্য নৈপুণ্যের কথাই তার মনে পড়েছে।
বৃদ্ধা খালা দুটি যুবক-যুবতাঁকে তার ঘরে স্বাগত জানালেও মনে হল সে যেন হেলেনের প্রশংসা করার বদলে আন্না পাভলভনর প্রতি ভীতিকে প্রকাশ করতেই অধিক ইচ্ছুক। বোনঝির দিকে তাকিয়ে সে যেন জানতে চাইল, এদের নিয়ে সে কি করবে। যাবার আগে আর একবার পিয়েরের আস্তিন ধরে আন্না পাভলভনা বলল, আশা করি তুমি বলবে না যে আমার বাড়িটা বড় একঘেয়ে লাগে। সে আর একবার হেলেনের দিকে তাকাল।
হেলেন হাসল, তার চোখের দৃষ্টি যেন বলতে চাইল, তাকে যে দেখবে সেই মজবে-একটা সম্ভব বলে সে মনে করে না। মাসি কাশল, ঢোক গিলল, ফরাসিতে বলল যে হেলেনকে দেখে সে খুব খুশি হয়েছে, তারপর পিয়েরের দিকে ঘুরে সেই একইভাবে তাকিয়ে একই অভ্যর্থনা জানাল। কথাবার্তার মাঝখানে হেলেন উজ্জ্বল সুন্দর হাসি হেসে পিয়েরের দিকে তাকাল। পিয়ের এ ধরনের হাসিতে অভ্যস্ত, তার কাছে এ হাসি অর্থহীন, তাই সেদিকে সে নজরই দিল না। মাসি পিয়েরের বাবা কাউন্ট বেজুখভের নস্যি-দানির সংগ্রসের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে নিজের নস্যি-দানিটা তাদের দেখাল। প্রিন্সেস হেলেন নস্যি-দানির ঢাকনাতে মাসির স্বামীর প্রতিকৃতিটা দেখাতে বলল।
অন্য টেবিলের আলোচনায় কান রেখেই টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে নস্যদানিটা নেবার জন্য হাত বাড়িয়ে পিয়ের একজন বিখ্যাত ক্ষুদ্রচিত্রশিল্পীর নাম উল্লেখ করে বলল, এটা বোধ হয় ভিনেসের হাতের কাজ।
চলে যাবার জন্য কিছুটা উঠে দাঁড়াতেই মাসি হেলেনের পিঠের পিছন দিয়ে নস্য-দানিটা পিয়েরের দিকে বাড়িয়ে দিল। জায়গা করে দেবার জন্য একটু ঝুঁকে হেলেন ছোট্ট করে হাসল। সান্ধ্য মজলিসে যাবার মতো সামনে পিছনে খুবই নিচু-কাটের পোশাক হেলেন পরেছে। তার শরীরটা পিয়েরের কাছে সবসময়ই মর্মরমূর্তি বলে মনে হয়, এখন সে পিয়েরের এত কাছে এসেছে যে তার স্বল্প দৃষ্টি চোখ দুটিতেও ধরা পড়েছে হেলেনের গলা ও কাঁধের জীবন্ত আকর্ষণ, সেগুলো তার ঠোঁটের এত কাছে যে মাথাটা একটু নোয়ালেই তাদের ছোঁয়া যায়। তার দেহের উত্তাপ, নির্যাসের গন্ধ ও পোশাকের খসখস শব্দ সম্পর্কে সে এখন সম্পূর্ণ সচেতন।
হেলেন যেন বলতে চাইছে, তাহলে কি তুমি আগে খেয়াল করনি যে আমি কত সুন্দরী? হ্যাঁ, আমিই এক নারী যে যে-কোনো পুরুষের হতে পারে–তোমারও, তার চোখের দৃষ্টি যেন এই কথাই বলছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পিয়ের বুঝতে পারল, হেলেন যে তার স্ত্রী হতে পারে তাই শুধু নয়, হেলেনকে তার স্ত্রী হতেই হবে, এর অন্যথা হতে পারে না।
এই মুহূর্তে তার নিশ্চিতরূপে মনে হল, তারা দুজন যেন পবিত্র বেদীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আসলে সেটা কীভাবে ঘটবে তা সে জানে না, সেটা যে ভালো কাজ হবে তাও সে জানে না (এমন কি বিনা কারণেই তার মনে হয় সে সেটা খারাপ কাজই হবে, কিন্তু এটা সে জানে যে এ-ঘটনা ঘটবেই)।
পিয়ের চোখ নামাল আবার চোখ তুলল, তার ইচ্ছা করছে নিজের থেকে অনেক দূরে এক দূরবর্তী সুন্দরী হিসেবে সে হেলেনকে দেখবে, এই মুহূর্তের আগে পর্যন্ত সেইভাবেই তো দেখেছে, কিন্তু এখন আর সেভাবে দেখতে পারছে না। হেলেন যে তার বড় বেশি কাছে এসে গেছে। সে তাকে অভিভূত করেছে, তাদের দুজনের মধ্যে নিজের বাসনার প্রাচীর ছাড়া আর কোনো প্রাচীর এখন নেই।
বেশ তো, তোমাদের এখানেই রেখে যাচ্ছি, আন্না পাভলভনার গলা শোনা গেল। এখন তো তোমরা ভালোই আছ দেখতে পাচ্ছি।
সে নিন্দনীয় কিছু করে বসেছে কি না বুঝবার জন্য পিয়ের সলজ্জ ভঙ্গিতে চারদিকে তাকাল। তার মনে হল, তার যা ঘটেছে সেটা যেমন সে নিজে জেনেছে তেমনই অন্য সকলকেও জেনেছে।
একটু পরে সে যখন বড় হলটার কাছে গেল তখন আন্না পাভলভনা বলল, শুনছি তুমি নাকি তোমাদের পিটার্সবুর্গের বাড়িটাকে নতুন করে সাজিয়ে তুলছ?
কথাটা সত্য। স্থপতি জানিয়েছে সেটা করা দরকার, আর কেন দরকার সেটা না জেনেই পিয়ের তাদের পিটার্সবুর্গের মস্ত বড় বাড়িটার মেরামতের কাজে হাত দিয়েছে।
খুব ভালো কথা, কিন্তু পিন্স ভাসিলির কাছ থেকে চলে যেয়ো না। প্রিন্সের মতো বন্ধু থাকা ভালো, প্রিন্স ভাসিলির দিকে তাকিয়ে মহিলাটি বলল। আমি সে ব্যাপারে কিছু কিছু জানি। কি বল? আর তুমি এখনো যুবক। তোমার পরামর্শের প্রয়োজন। বুড়িদের ক্ষমতা খাটাচ্ছি বলে আমার উপর রাগ করো না।
আন্না পাভলভনা থামল, বয়সের উল্লেখ করে সব নারীই একটা কিছু শোনার আশায় চুপ করে যায়। একদৃষ্টিতে দুজনকে দেখে নিয়ে সে আবার বলল, যদি বিয়ে করো সেটা আলাদা ব্যাপার। পিয়ের হেলেনের দিকে তাকাল না, হেলেনও তাকাল না তার দিকে। কিন্তু সে তখন পিয়েরের মারাত্মক কাছে এসে পড়েছে। পিয়ের অস্পষ্টভাবে কী যেন বলে লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
যা ঘটে গেল সে কথা ভেবে বাড়িতে ফিরেও পিয়ের অনেকক্ষণ ঘুমতে পারল না। কী ঘটে গেল? কিছুই । সে শুধু এইটুকু বুঝেছে যে এই নারী তার হতে পারে। । কিন্তু সে তো বোকা। আমি নিজেই বলেছি সে বোকা। পিয়ের ভাবতে লাগল। সে আমার মনে যে অনুভূতি জাগিয়েছে সেটা তো কদর্য, সেটা তো অন্যায়। আমি শুনেছি যে তার ভাই আনাতোল তার প্রেমে পড়েছিল, তাই নিয়ে একটা কেলেংকারি হয়েছিল, আর সেইজন্যই আনাতোলকে দূরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। হিপোলিৎ তার ভাই… প্রিন্স ভাসিলি তার বাবা…এটা খারাপ… সে ভাবল। কিন্তু এই চিন্তার পাশাপাশি আর একটা চিন্তা মনে আসায় তার মুখে হাসি দেখা দিল। হেলেনের অযোগ্যতার কথা ভাবতে গিয়ে সে আবার এ স্বপ্নও দেখতে লাগল যে সে হবে তার স্ত্রী, সে তাকে ভালোবাসবে, সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ হয়ে উঠবে, এবং তার সম্পর্কে সে যা কিছু শুনেছে সব হয়তো মিথ্যা হয়ে যাবে। সে আবার হেলেনের দিকে তাকাল, প্রিন্স ভাসিলির মেয়ে হিসেবে নয়, একটি ধূসর পোশাকে ঢাকা একটা গোটা মানুষের দিকে। কিন্তু না! এ চিন্তা কেন আগে আমার মাথায় আসে নি? পুনরায় সে নিজেকে বলল যে এটা অসম্ভব, এ বিয়ে একটা অস্বাভাবিক, এমন কি অসম্মানজনক ব্যাপারই হবে। কিন্তু হেলেনের সম্পর্কে যত কিছুই সে ভাবুক, সেই সঙ্গেই তার মনের আর এক কোণে হেলেনের মূর্তি নারী-সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে দেখা দিল।
*
অধ্যায়-২
১৮০৫-এর নভেম্বর মাসে ভাসিলিকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে যেতে হল পরিদর্শন উপলক্ষে। এই পরিদর্শনের ব্যবস্থাটা সে নিজেই করে নিয়েছিল যাতে সেইসঙ্গে তার উপেক্ষিত জমিদারিগুলোকে একবার দেখে আসতে পারে এবং সেখানে রেজিমেন্টে কর্মরত ছেলে আনাতোলকে সঙ্গে নিয়ে প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কির সঙ্গে দেখা করে সেই ধনী বৃদ্ধের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়েটাকেও পাকা করতে পারে। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে এবং সেইসব ব্যবস্থায় হাত দেবার আগে প্রিন্স ভাসিলিকে পিয়েরের ব্যাপারটাও পাকা করতে হবে। একথা ঠিক যে ইদানীং সে বাড়িতে, অর্থাৎ প্রিন্স ভাসিলির বাড়িতেই সারাটা দিন কাটায়, হেলেনের সামনে এলেই কেমন যেন কিন্তু, উত্তেজিত ও বোকা বোকা হয়ে ওঠে (প্রেমিকরা যে রকম হয়ে থাকে), কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করেনি।
একদা সকালে দুঃখের সঙ্গে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে প্রিন্স ভাসিলি মনে মনে বলল, এসবই তো ভালো লক্ষণ, কিন্তু ব্যাপারটা তো পাকাপাকি করে ফেলা দরকার তার মনে হল, তার কাছে অনেকরকম বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে পিয়েরের আচরণ ঠিক হচ্ছে না। যৌবন, হাল্কা মেজাজ… বেশ তো, ঈশ্বর তার সহায় হোন, কিন্তু একটা হেস্তনেস্ত তো করা চাই। আগামী পরশু লেলিয়ার (হেলেনের আদরের নাম) নামকরণ দিবস। সেদিন দুতিনজনকে নিমন্ত্রণ করব, তখনো যদি পিয়ের তার করণীয় না করে, তখন সে দায় আমিই নেবহ্যাঁ, তাই নেব, আমি তার বাবা।
আন্না পাভলভনা স্বাগত অনুষ্ঠানের এবং যে বিচিত্র রজনীতে পিয়ের স্থির করেছিল যে হেলেনকে বিয়ে করাটা একটা দুর্ঘটনার ব্যাপর হবে আর তাই তাকে এড়িয়ে তার এখান থেকে চলে যাওয়াই উচিত, তারপরে ছয় সপ্তাহ কেটে গেলেও সে এখনো প্রিন্স ভাসিলির বাড়ি ছেড়ে যায়নি, বরং সে সভয়ে লক্ষ্য করছে যে যত দিন যাচ্ছে ততই লোকের চোখে সে হেলেনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, হেলেনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, আর যত ভয়ংকরই হোক হেলেনের ভাগ্যের সঙ্গেই নিজেকে ভাগ্যকে জড়াতেই হবে। হয়তো সে নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারত, কিন্তু আজকাল এমন একটা দিনও যায় না যেদিন একটা সান্ধ্য মজলিসের ব্যবস্থা করে প্রিন্স ভাসিলি পিয়েরকে সেখানে ডেকে না পাঠায়। আর দেখা হলেই কোনো বিশেষ মুহূর্তে প্রিন্স ভাসিলি পিয়েরের হাতখানি ধরে নিচের দিকে নামিয়ে নেয়, অথবা অন্যমনস্কভাবে নিজের বলিরেখাঙ্কিত পরিষ্কার কামানো মুখখানা এগিয়ে ধরে পিয়েরের চুম্বনলাভেল জন্য, আর সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে : কাল আবার দেকা হবে, অথবা ডিনারে এস কিন্তু, নইলে তোমার মুখদর্শন করব না, অথবা তোমার জন্যই তো এখানে। রয়ে গেছি, ইত্যাদি। যদিও দেখা হলে প্রিন্স ভাসিলি কদাচিৎ তার সঙ্গে দু-একটা কথা বলে, তবু তাকে হতাশ করবার শক্তি পিয়েরের নেই। প্রতিদিন সে নিজেকে একই প্রশ্ন করে : হেলেনকে বুঝবার, তার স্বরূপ সম্পর্কে মনস্থির করবার সময় এসেছে। আমি কি আগেই ভুল করেছিলাম, না কি এখন ভুল করছি? না, সে তো নির্বোধ নয়, সে চমৎকার মেয়ে, সে কখনো ভুল করে না, বোকার মতো কথা বলে না। সে কথা কম বলে, কিন্তু যেটুকু বলে তা সহজ, সরল, কাজেই সে নির্বোধ নয়। সে তো কখনো লজ্জা পেত না, এখনো লজ্জা পায় না, কাজেই। সে খারাপ মেয়েমানুষ হতে পারে না! যখনই সে কথা বলে তখনই তার মুখে ফুটে ওঠে উজ্জ্বল হাসি। পিয়ের জানে, সকলেই অপেক্ষা করে আছে কবে সে সুখ খুলবে, কবে একট বিশেষ সীমারেখা সে পার হবে, সে আরো জানে, আগে হোক পরে হোক সীমারেখা তাকে পার হতেই হবে, আর সেকথা ভাবলেই একটা দুর্বোধ্য আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসে। এই দেড় মাস যাবত হাজারবার তার মনে হয়েছে যে সে ক্রমাগত একটা ভয়ংকর গহ্বরের। দিকে এগিয়ে চলেছে, আর ভেবেছে : এ আমি কী করছি? আমার চাই স্থিরসংকল্প। তা কি আমার নেই?
হেলেনের নামরকণ দিবসে নিজেদের লোকজনের একটা ছোট দল প্রিন্স ভাসিলির বাড়িতে নৈশভোজে মিলিত হল। সব বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে সেই সন্ধ্যায়ই একটি তরুণীর ভাগ্য নির্ধারিত হবে। অতিথিরা সকলেই নৈশভোজে বসেছে। সুন্দরী প্রিন্সেস কুরাগিনা বসেছে প্রধানার আসনে, তার দুই পাশে বসেছে অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন অতিথিরাজনৈক বৃদ্ধ সেনাপতি ও তার স্ত্রী এবং আন্না পাভলভনা শেরার। টেবিলের অপর প্রান্তে বসেছে অন্য সব অতিথি, তরুণ-তরুণীরা এবং পরিবারের লোজন, পিয়ের ও হেলেন বসেছে পাশাপাশি। প্রিন্স ভাসালি নিজে নৈশভোজনে যোগ দেয়নিঃ খুশি মনে সে টেবিলের চারধারে ঘুরছে, কখনো এর পাশে কখনো ওর পাশে একটু বসছে। গোটা টেবিলকে সে জমিয়ে রেখেছে। মোমবাতিগুলো জ্বলছে, লাল উর্দিপরা চাকররা ঘুরছে, আর চিনেমাটির পাত্র, ছুরি-কাঁটা ও গ্লাসের টুং-টাং-এর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে নানা আলোচনার প্রাণবন্ত গুঞ্জন ধ্বনি।…
এই পরিবেশের মধ্যে বসে শিয়ের পরিষ্কার বুঝতে পারছে যে এসব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু সে নিজে, আর তাতেই সে যুগবৎ তুষ্ট ও বিব্রত বোধ করছে। সে যেন একটা কাজের মধ্যে সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। কোনো কিছুই সে দেখছে না, শুনছে না, বা স্পষ্ট করে বুঝছে না।
সে ভাবল, এবার সব শেষ। আর কেমন করে এটা ঘটল? এত দ্রুত! এখন বুঝতে পারছি, শুধু তার জন্য । নয়, শুধু আমার জন্যও নয়, কিন্তু এখানকার প্রত্যেকের জন্যই সেটা অনিবার্যভাবেই ঘটবে। তারা সকলেই এটা আশা করছে, এটা যে ঘটবেই সে সম্পর্কে তারা এতই সুনিশ্চিত যে আমি তাদের হতাশ করতে পারি না, পারি না। কিন্তু কেমন করে ঘটবে? আমি জানি না, কিন্তু অবশ্যই ঘটবে!
অথবা হঠাই সে যেন লজ্জিত হয়ে উঠল, অথচ সে লজ্জার কারণ সে জানে না। এই যে সকলেরই মনোযোগ তার দিকেই আকৃষ্ট হয়েছে, সকলেই তাকে ভাগ্যবান ভাবছে, এবং তার মুখের দিকে তাকাচ্ছে হেলেনবিজয়ী প্যারিসের মতো–এটাই তার কাছে অদ্ভুত লগছে। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই যে এইরকমই হয়ে থাকে, আর অবশ্যই হবে! এই বলে সে নিজেকে সান্ত্বনা দিল। তাছাড়া এটা ঘটাতে আমি আর কী করছি? কোথায় এর সূচনা? প্রিন্স ভাসালির সঙ্গে আমি মস্কো থেকে এখানে এসেছি। তখন তো কিছুই ছিল না। কাজেই তার বাড়িতে আমি থাকব কেন? তারপর হেলেনের সঙ্গে তাস খেলেছি, তার থলিটা হাতে নিয়ে তার সঙ্গে গাড়িতে চেপে বেড়াতে গেছি। কিন্তু এ ব্যাপারটা শুরু হলো কখন, আর কেমন করেই বা ঘটল? আর আজ সে তার পাশেই বসে আছে তার বাকদত্ত স্বামীরূপে, তাকে দেখছে, তার কথা শুনছে, তার সান্নিধ্য, তার নিঃশ্বাস, তার চলন, তার রূপ উপভোগ করছে। হঠাৎ সে শুনতে পেল একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর দ্বিতীয়বার তাকে কি যেন বলল। কিন্তু পিয়ের এতই আত্মমগ্ন হয়ে পড়েছিল যে সে কথার কোনো অর্থই তার কাছে বোধগম্য হলো না।
প্রিন্স ভাসালি তৃতীয়বার বলল, আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছিলাম বলকনস্কির কাছ থেকে শেষ চিঠি তুমি কবে পেয়েছ? তুমি কেমন করে যেন অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছে।
প্রিন্স ভাসালি হাসল, পিয়ের লক্ষ্য করল, তাকে ও হেলেনকে দেখে সকলেই হাসছে। সে মনে মনে বলল, বেশ তো, আপনারা যদি সব জেনেই থাকেন, তাতে হলোটা কী? কথাটা তো সত্যি! শিশুর মতো সরল হাসি ফুটল তার মুখে, হেলেনও হাসল।
তুমি কবে চিঠি পেয়েছ? চিঠিটা কি ওলমুজ থেকে লেখা একটা বিতর্কের মীমাংসা করার জন্যই যেন প্রিন্স ভাসালি কথাটা জানতে চাইল।
পিয়ের ভাবল, এই সব তুচ্ছ কথা মানুষ বলেই বা কেমন করে আর ভাবেই বা কেমন করে? একটা নিঃশ্বাস ফেলে জবাব দিল, হ্যাঁ, ওলমুজ থেকে।
নৈশ ভোজনের পরে সঙ্গিনীকে নিয়ে পিয়ের অন্য সকলের সঙ্গে বসবার ঘরে গেল। অতিথিরা চলে যেতে
শুরু করল, কেউ কেউ হেলেনের কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই চলে গেল, কেউ-বা মুহূর্তের জন্য তার সঙ্গে দেখা করেই তাড়াতাড়ি বিদায় নিল। বিষণ্ণ নিঃশব্দের মধ্যে কুটনীতিবিদ বসার ঘরে ছেড়ে গেল। তার মনে হলো, পিয়েরের সুখের তুলনায় তার কুটনৈতিক সাফল্যের গর্ব কত অর্থহীন। বৃদ্ধ সেনাপতির স্ত্রী যখন জানতে চাইল তার পা কেমন আছে তখন সে খেঁকিয়ে উঠল।
মনে মনে বলল, হায় নির্বোধ বুড়ি! পঞ্চাশ বছর বয়সেও প্রিন্সেস হেলেন এমনি সুন্দরীই থাকবে।
বৃদ্ধা প্রিন্সেসকে চুমো খেয়ে আন্না পাভলভনা.তার কানে কানে বলল, মনে হচ্ছে আপনাকে অভিনন্দন জানাতে পারি। মাথার যন্ত্রণাটা না দেখে দিলে আরো কিছুক্ষণ থেকে যেতে পারতম।
বৃদ্ধ পিন্সেস জবাব দিল না, নিজের মেয়ের সুখের প্রতি ঈর্ষায় তার অন্তর জ্বলছে।
অতিথিরা একে একে বিদায় নিয়ে চলে গেল। হেলেনকে সঙ্গে নিয়ে পিয়ের সারাক্ষণ ঘোট বসবার ঘরটাতেই কাটিয়ে দিল। গত ছয় সপ্তাহ ধরে অনেক সময়ই সে হেলেনের সঙ্গে একা কাটিয়েছে, কিন্তু কোনো সময়ই তাকে ভালবাসার কথা বলেনি। এখন সে জেনেসে যে সেটা অনিবার্য, তবু চুড়ান্ত পদক্ষেপ করবার জন্য সে মনস্থির করতে পারছে না। সে লজ্জা পেল, তার মনে হলো, হেলেনের কাছে অন্য কারো আসন সে দখল করতে চলেছে। একটা অন্তর্নিহিত কণ্ঠস্বর যেন তাকে চুপি চুপি বলছে, এ সুখ তোমার জন্য নয়। তোমার মধ্যে যা রয়েছে তা যাদের মধ্যে নেই এ সুখ তাদের জন্যই।
কিন্তু কিছু তো বলতেই হবে, তাই হেলেনকে সে জিজ্ঞেস করল, আজকের ভোজসভায় সে খুশি হয়েছে কি না। হেলেন জবাবে জানাল যে নামকরণ দিবসের অনুষ্ঠান তার খুবই ভালো লাগে।
কিছু কিছু নিকট আত্মীয় এখনো চলে যায়নি। সকলেই বড় বসার ঘরটায় বসে আছে। অবসন্ন পায়ে প্রিন্স ভাসালি পিয়েরের কাছে এগিয়ে এল। পিয়ের উঠে দাঁড়াল। প্রিন্স ভাসালি কঠোর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। কিন্তু তার পরেই মুখের ভাব বদলে পিয়েরের হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিয়ে সস্নেহে হাসল।
সঙ্গে সঙ্গেই মেয়ের দিকে ফিরে আদর করে বলল, এই যে লেলিয়া? পরমুহূর্তেই পুনরায় পিয়েরের দিকে ফিরে অস্ফুট স্বরে কী যেন বলে হঠাৎ সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিয়েরের মনে হলো, প্রিন্স ভাসালি খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে, তাতে সেও দুঃখিত হল, হেলেনের দিকে তাকিয়ে মনে হলো সেও মনে কষ্ট পেয়েছে, তার চোখ যেন বলতে চাইছে, দেখ, এটা তোমার দোষ!
পিয়ের ভাবল, চূড়ান্তভাবে পা ফেলতেই হবে, কিন্তু আমি পারছি না, পারছি না।
বসার ঘরে ফিরে গিয়ে প্রিন্স ভাসালির কানে এলো তার স্ত্রী জনৈকা বর্ষিয়সী মহিলাকে পিয়েরের কথাই বলছে।
অবশ্য এটা একেবারে রাজযোটক, কিন্তু সুখের কথা কেউ…
মহিলাটি বলল, বিয়ে তো বিধাতার হাতে।
না শোনার ভান করে তাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে প্রিন্স ভাসালি ঘরের একেবারে এককোণে একটা সোফায় গিয়ে বসল। দুই চোখ বুজে যেন ঝিমুতে লাগল। মাথাটা সামনে ঝুঁকে পড়তেই আবার সজাগ হয়ে উঠল।
স্ত্রীকে বলল, এলিন, যাও তো দেখে এসো ওরা কী করছে।
প্রিন্সেস দরজাটা পার হয়ে ছোট ঘরটার দিকে তাকাল। পিয়ের ও হেলেন আগের মতোই কথা বলছে।
সে স্বামীকে বলল, সেই একই অবস্থা।
প্রিন্স ভাসালির চোখে ভুকুটি ফুটে উঠল, মুখটা বেঁকে গেল, গাল টুটো কাঁপতে লাগল, মুখে দেখা দিল একটা কর্কশ অসন্তোষের ভাব। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে মাথাটাকে পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে মহিলাদের পাশ কাটিয়ে সে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দ্রুত পায়ে সানন্দে সে পিয়েরের কাছে গেল। তার মুখের অস্বাভাবিক জয়োল্লাসের দীপ্তি লক্ষ করে পিয়ের সভয়ে উঠে দাঁড়াল।
প্রিন্স ভাসিলি বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! আমার স্ত্রী আমাকে সব কথাই বলেছে!-(এক হাত দিয়ে সে পিয়েরকে জড়িয়ে ধরল, অন্য হাতে জড়িয়ে ধরল মেয়েকে।) বাবা… লেলিয়া… আমি খুব খুশি হয়েছি। (তার গলার স্বর কাঁপছে।) তোমার বাবাকে আমি ভালোবাসতাম… স্ত্রী হিসেবে ওকে তোমার ভালোই লাগবে… ঈশ্বর তোমাদের আশীর্বাদ করুন!…
সে মেয়েকে আলিঙ্গন করল তারপর পিয়েরকেও-দুর্গন্ধ মুখে তাকে চুম্বন করল। সত্যিকারের চোখের জলেই তার দুই গাল ভিজে গেল।
চিৎকার করে ডাকল, প্রিন্সেস, এখানে এসো!
বৃদ্ধা প্রিন্সেস এল, সেও কেঁদে ফেলল। বর্ষিয়সী মহিলাটিও চোখে রুমাল চাপা দিল। পিয়েরকে চুমো খাওয়া হল, সেও বারকয়েক সুন্দরী হেলেনের হাতে চুমো খেল। কিছুক্ষণ পরে আবার তাদের একা রেখে সকলেই চলে গেল। পিয়ের ভাবল, এ সবই ভবিতব্য, এর অন্যথা হতে পারত না, কাজেই এটা ভালো কি মন্দ সে প্রশ্ন বৃথা। এটা ভালোই, কারণ এটা স্পষ্ট, আর এর ফলে একটা যন্ত্রণাদায়ক সন্দেহের অবসান ঘটল। নিঃশব্দে বাকদত্তার হাতখানি ধরে পিয়ের তার সুন্দর বুকের ওঠা নামা দেখতে লাগল।
হেলেন! একবার ডেকেই সে থেমে গেল।
তার মনে হল, এসব ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বলতে হয়, কিন্তু লোকে কী বলে তা স্মরণ করতে পারল না। হেলেনের মুখের দিকে তাকাল। হেলেন আরো কাছে সরে এল। তার মুখ লজ্জায় রাঙা।
পিয়েরের চশমা জোড়া দেখিয়ে হেলেন বলে উঠল, আঃ, ওটা খুলে ফেল… ওটা…।
পিয়ের চশমা খুলে ফেলল। হেলেনের হাতের উপর ঝুঁকে পড়ে তাকে চুমো খেতে উদ্যত হল, কিন্তু একটা দ্রুত, জান্তব গতিতে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে হেলেন তার ঠোঁট দুটিকে থামিয়ে দিয়ে নিজের ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরল। তার মুখের পরিবর্তিত, উত্তেজিত ভাব দেখে পিয়ের অবাক হয়ে গেল।
এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, কাজ শেষ, তাছাড়া, আমি ওকে ভালোবাসি, পিয়ের ভাবল।
এইসব মুহূর্তে কী বলতে হয় সেটা তার মনে পড়ে গেল, সে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি! কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বরের দুর্বলতায় সে নিজেই লজ্জা পেল।
ছয় সপ্তাহ পরে তার বিয়ে হয়ে গেল, কাউন্ট বেজুখবের আসবাবপত্রে সাজানো পিটার্সবুর্গের মস্ত বড় বাড়িতে বিখ্যাত সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে এবং লক্ষ টাকার মালিক হয়ে সে সুখের সংসার পাতল।
*
অধ্যায়-৩
১৮০৫-এর নভেম্বর মাসে বৃদ্ধ প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কি প্রিন্স ভাসিলির একটা চিঠি পেল, সে জানিয়েছে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করতে আসছে। লিখেছে, আমি পরিদর্শনের কাজে যাচ্ছি, কাজেই আমার সম্মানিত হিতসাধকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বাড়তি সত্তর মাইল পথ পরিক্রমা করতে আমার কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। সেনাবাহিনীতে যোগদানের পথে আমার ছেলে আনাতোলও আমার সঙ্গে যাবে তাই আমি আশা করি, বাবার দেখাদেখি সেও আপনার প্রতি যে গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে সেটা যাতে সে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকে আপনাকে জানাতে পারে সে অনুমতি আপনি দেবেন।
খবরটা শুনে হোট প্রিন্সেস হঠাই বলে ফেলল, মনে হচ্ছে মেরিকে আর বাইরে বের করতে হবে না? পাণিপ্রার্থীরা নিজেদের তাগিদেই আমাদের কাছে আসছে।
প্রিন্স নিকলাসের চোখে ভ্রুকুটি দেখা দিল, মুখে কিছু বলল না।
চিঠি পাবার পক্ষকাল পরে একদিন সন্ধ্যায় প্রিন্স ভাসিলির চাকর বাকররা আগাম এসে হাজির হলো, সে আর তার ছেলে এল পরদিন।
প্রিন্স ভাসিলির চরিত্র সম্পর্কে বুড়ো বলকনস্কির ধারণা কোনোদিনই ভালো নয়, সম্প্রতি সেটা আরো খারাপ হয়েছে কারণ পল এবং আলেক্সারের নতুন রাজত্বে প্রিন্স ভাসিলি উচ্চপদে ও সম্মানে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এখন চিঠি থেকে এবং ছোট প্রিন্সিসের উক্তি থেকে সে বুঝতে পারল হাওয়া কোনদিকে বইছে, আর তার খারাপ ধারণার পরিবর্তে দেখা দিল একটা ঘৃণার মনোভাব। প্রিন্স ভাসিলির কথা মনে হতেই সে যেন খেঁকিয়ে উঠতে লাগল। যেদিন প্রিন্স ভাসিলির আসার কথা সেদিন প্রিন্স বলকনস্কির মন মেজাজ বিশেষরকম খিঁচড়ে রইল। প্রিন্স ভাসিলি আসছে বলে তার মন খারাপ হোক, আর তার মন খারাপ বলেই প্রিন্স ভাসিলির আগমনে তার মেজাজ তিরিক্ষি হোক, এটা ঠিক সে তার মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে আছে, আর সকালেই তিখোন স্থপতিকে সাবধান করে দিল সে যেন প্রিন্সের কাছে না যায়।
প্রিন্সের পায়ের শব্দের দিকে স্থপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিখোন বলল, ওঁর হাঁটার ধরনটা শুনতে পাচ্ছেন? গোড়ালির উপর ভর দিয়ে পা ফেলছেন–ওর অর্থ আমরা ভালোই জানি…
যাই হোক, সকাল নটায় ভেলভেট কোট ও কালো কলার ও টুপি চাপিয়ে প্রিন্স যথারীতি বেড়াতে বেরিয়ে গেল। আগেরদিন বরফ পড়েছে, বাগানের যে কাঁচের ঘরটার পাশ দিয়ে প্রিন্সের বেড়ানো অভ্যাস তার উপর দিয়ে বরফের স্রোত বয়ে গেছে : বরফের মধ্যে গাছ-গাছড়াগুলো দেখা যাচ্ছে, পথের দুপাশের উঁচু বরফের এক পাশে একটা বেলচা আটকে রয়েছে। অগত্যা ভুরু কুঁচকে প্রিন্স নিঃশব্দে সবজিঘর, ভূমিদাসের বাসস্থান ও বহির্বাটির ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেল।
বাড়ি ফিরবার সময় ওভারসিয়ার তার সঙ্গী হল, লোকটি আচার আচরণে তার মনিবের মতোই শ্রদ্ধাস্পদ। প্রিন্স তাকে জিজ্ঞেস করল, একটা স্লেজ যেতে পারবে কি?
ইয়োর অনার, বরফ বেশ পুরু হয়ে পড়েছে। পথটা আঁটা দেওয়াবার ব্যবস্থা করছি।
মাথাটা নুইয়ে প্রিন্স ফটক পর্যন্ত এগিয়ে গেল। ওভারসিয়ার ভাবল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে ঝড়টা থেমে গেছে!
মুখে বলল, গাড়ি চালিয়ে যাওয়া খুব শক্ত হত ইয়োর অনার। শুনলাম, একজন মন্ত্রী আপনার সঙ্গে দেকা করতে আসছেন।
প্রিন্স ওভারসিয়ারের দিকে ঘুড়ে দাঁড়াল, ভুরু কুঁচকে একদৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে।
কি? মন্ত্রী? কোন মন্ত্রী? কে হুকুম দিল? কর্কশ গলায় প্রিন্স বলল। রাস্তাটা আমার মেয়ের জন্য ঝাটা না দিয়ে দেয়া হল একজন মন্ত্রীর জন্য! আমার কাছে মন্ত্রী বলে কেউ নেই!
ইয়োর অনার, আমি ভেবেছিলাম…
তুমি ভেবেছিলে! প্রিন্স চেঁচিয়ে উঠল। যতসব রাস্কেল! বদমাস!… ভাবনা কাকে বলে তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি! লাঠিটা তুলে এমনভাবে ঘোরাল যে ওভারসিয়ার আলপাতিচ হঠাৎ সরে না গেলে তার গায়েই লাগত। ভেবেছিলাম… বদমাসের দল… প্রিন্স সমানে চেঁচাতে লাগল।
কিন্তু আঘাতকে এড়িয়ে যাওয়ার দুঃসাহসের জন্য ভয় পেলেও আলপাতিচ মাথা নিচু করে প্রিন্সের কাছেই গেল, আর হয়তো সেই কারণেই মুখে বদমাস!… রাস্তার উপর আবার বরফ ছড়িয়ে দাও বলে চেঁচালেও প্রিন্স দ্বিতীয়বার লাঠিটা না তুলে দ্রুত পায়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল।
ডিনারের আগে প্রিন্সেস মারি ও মাদময়জেল বুরিয়ে প্রিন্সের বদমেজাজের খবর পেয়ে তার আসার অপেক্ষায়ই আগে থেকে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, মাদময়জেল বুরিয়ের উজ্জ্বল মুখ যেন বলছে : আমি কিছুই জানি না, আমি আগের মতোই আছি, আর প্রিন্সেস মারির মুখখানি বিষণ্ণ, ভীত, চোখ দুটি আনত।
মেয়ের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স বলল, বোকা…নাকি পুতুল!
আর অপরটি এখানে আসেইনি, কত রকম কথাই যে এরা রটাচ্ছে, খাবার ঘরে হোট প্রিন্সেসকে না দেখে সে ভাবল।
প্রশ্ন করল, প্রিন্সেস কোথায়? গা-ঢাকা দিয়েছে?
উজ্জ্বল হাসি হেসে মাদময়জেল বুরিয়ে বলল, আর শরীরটা ভালো নেই। সে আসতে পারবে না। এ অবস্থায় সেটাই স্বাভাবিক।
হুম। হুম! বসতে বসতে প্রিন্স বিড় বিড় করে বলল।
প্লেটটা যথেষ্ট পরিষ্কার মনে না হওয়ায় একটা দাগ দেখিয়ে প্রিন্স সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। তিখোন সেটা ধরে নিয়ে একজন পরিচারকের হাতে দিল। ছোট প্রিন্সেস অসুস্থ হয়নি, কিন্তু প্রিন্সের বদমেজাজের খবর পেয়ে এতই ভয় পেয়েছে যে এখানে আসবে না বলেই স্থির করেছে। ১ মাদময়জের বুরিয়েকে বলেছে, বাচ্চার জন্যই আমি ভয় পাচ্ছি, ভয় থেকে যে কী হতে পারে তা ঈশ্বরই জানেন।
বন্ড হিলসে ছোট প্রিন্সেস সবসময়ই ভয়ে ভয়ে থাকে, সেই সঙ্গে বুড়ো প্রিন্সের প্রতি তার মনে একটা বিরূপতার ভাবও আছে। আবার তার প্রতিও এই বিরূপতার ভাব আছে বুড়ো প্রিন্সেরও মনে, যদিও বিরূপতার চাইতে ঘৃণার ভাবই তার মনে বেশি। বন্ড হিলের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হবার পর থেকেই মাদময়জেল বুরিয়েকে ছোট প্রিন্সেসের খুব ভালো লেগেছে। তার সঙ্গেই সারাটা দিন কাটায়, নিজের ঘরে তাকে শুতে বলেছে, প্রায়ই বুড়ো প্রিন্স সম্পর্কে তার সঙ্গে কথা বলে, সমালোচনা করে।
গোলাপি আঙুল দিয়ে সাদা তোয়ালের ভাজ খুলতে খুলতে মাদময়জেল বুরিয়ে বলল, তাহলে কিছু : অতিথি আসছেন, তাই না প্রিয় প্রিন্স? শুনলাম হিজ এক্সেলেন্সি প্রিন্স ভাসিলি কুরাগিন ও তার ছেলে আসছেন?
সপ্রশ্ন সুরে সে বলল।– হুম! হিজ এক্সেলেন্সি খুব দেমাকি অথচ আমিই তার চাকরি করে দিয়েছিলাম। প্রিন্স ঘৃণার সঙ্গে বলল।
তার ছেলে যে কেন আসছে বুঝতে পারছি না। হয়তো প্রিন্সেস এলিজাবেথ ও প্রিন্সেস মারি জানে। কেন যেন যে সে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসছে তা তো জানি না। তাকে আমি চাই না। (লজ্জিত মেয়ের দিকে তাকাল) আজ কি তোমার শরীর খারাপ! অ্যাঁ? আলপাতিচ আজ সকালে যাকে মন্ত্রী বলে উল্লেখ করেছে তার জন্য ভয় পেয়েছ নাকি?
না বাপি। ডিনার শেষ করে প্রিন্স পুত্রবধূকে দেখতে গেল। হোট প্রিন্সেস একটা ছোট টেবিলের পাশে বসে দাসী মাশার সঙ্গে গল্প করছিল। শ্বশুরকে দেখে তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল।
সে অনেক বদলে গেছে। সুন্দরী হওয়ার পরিবর্তে তার চেহারা এমন সাদাসিদে হয়ে গেছে। গাল বসে গেছে, ঠোঁট ঠেলে উঠেছে, আর চোখ নেমে এসেছে।
প্রিন্স তখন জানতে চাইল তার শরীর কেমন আছে তখন সে বলল, হ্যাঁ, একটা কষ্ট হচ্ছে।
তোমার কি কিছু দরকার আছে?
না তো।
ঠিক আছে, ঠিক আছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে প্রিন্স বিশ্রাম-ঘরে গেল, সেখানে আলপাতিচ মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়েছিল।
বেলচা মেরে সব বরফ আবার পথে ছড়ানো হয়েছে কি?
হ্যাঁ ইয়োর এক্সেলেন্সি। ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে ক্ষমা করুন… ওটা আমারই বোকামি।
বাধা দিয়ে প্রিন্স বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তারপর অস্বাভাবিক উচ্চ হাসি হেসে হাতটা আলপাতিচের দিকে বাড়িয়ে দিল চুমো খাবার জন্য, তারপর পড়ার ঘরের দিকে চলে গেল।
সেই সন্ধ্যায়ই প্রিন্স ভাসিলি এল। পথেই কোচয়ান ও পরিচারক তার সঙ্গে দেখা সরল এবং ইচ্ছা করে ছড়িয়ে রাকা বরফের উপর দিয়ে হৈহৈ করতে করতে তার স্লেজটাকে টেনে নিয়ে গেল।
প্রিন্স ভাসিলি ও আনাতোলের জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা হল।
ওভারকোটটা খুলে রেখে আনাতোল কোণের একটা টেবিলে দুই হাত মুড়ে বসে হাসিমুখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার মনে হল, সারা জীবনটাই একটা অবিরাম আনন্দের ব্যাপার, যে কারণেই হোক কেউ না কেউ তার জন্য সে আনন্দের যোগান দিয়েই যাবে। একজন রুক্ষপ্রকৃতির বৃদ্ধ আর একটি ধনবতী কুৎসিত উত্তরাধিকারিণীর সঙ্গে দেখা করতে আসাটাকেও সে সেই দৃষ্টিতে দেখছে। সবকিছুই হয়তো একটা মজার ব্যাপার হয়ে উঠবে। সে ভাবল, মেয়েটি যখন এত টাকার মালিক তখন তাকে বিয়ে করতে আপত্তি কিসের? ক্ষতি তো কিছু হবে না।
সে দাড়ি কামাল, অভ্যাস মতোই সযত্নে ও সুচারুরূপে গন্ধ মাখল এবং সুন্দর মাথাটা উঁচু করে স্বাভাবিক বিজয়ীর ভঙ্গিতে বাবার ঘরে ঢুকল। প্রিন্স ভাসিলির দুটি খানসামা তার সাজসজ্জা নিয়ে ব্যস্ত, ছেলেকে দেখে
সে খুশি মনে ঘাড় নাড়ল, যেন বলতে চাইল, হা, তোমাকে এইরকম দেখতেই আমি চাই।
যেন পূর্ব আলোচনার জের টেনেই আনাতোল প্রশ্ন করল, ঠাট্টা নয় বাবা, সত্যি আমি জানতে চাইছি, মেয়েটি কি কদাকার?
খুব হয়েছে! কী বাজে কথা বলছ! যাই কর, বুড়ো প্রিন্সের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় সাবধান থেকো, শ্রদ্ধাশালী হয়য়া।
প্রিন্স আনাতোল বলল, হৈচৈ বাধালে আমি কিন্তু কেটে পড়ব। ঐ সব বুড়োদের আমি সইতে পারি না, হ্যাঁ।
মনে রেখো, এর উপরেই তোমার সবকিছু নির্ভর করছে।
এদিকে দাসীমহলে সকলেই জেনে গেছে যে মন্ত্রী ও ছেলে পৌঁছে গেছে, তাদের চেহারার ছবি নিয়ে খুঁটিনাটি বর্ণনাও চলেছে। প্রিন্সেস মারি নিজের ঘরে একলা বসে বৃথাই মনের উত্তেজনা চাপবার চেষ্টা করছে।
আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ওরা কেন চিঠি লিখল, লিজাই বা এ-কথা আমাকে বলল কেন? এখন আমি বসবার ঘরে ঢুকব কেমন করে? তাকে যদি পছন্দও হয় তবু তো তার সামনে আমি সহজ হতে পারব না। বাবার চাউনির কথা মনে হতেই সে ভয়ে সারা হল। ছোট প্রিন্সেস ও মাদময়জেল বুরিয়ে ইতিমধ্যেই দাসী মাশার কাছ থেকে মন্ত্রীপুত্রের সব খবরই পেয়ে গেছে-সে কি সুন্দর, গোলাপি গাল, ঘন ভুরু, বাবা যখন পা টেনে টেনে দোতলায় উঠছিল, ছেলে তখন তার পিছন পিছন ঈগল পাখির মতো এক এক করে তিনটে করে ধাপ পেরিয়ে যাচ্ছিল। এই খবর শুনেই তারা দুজন খলবল করতে করতে প্রিন্সেস মারিয়ার ঘরে ঢুকল।
ঢুকেই একটা হাতল-চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ে ছোট প্রিন্সেস বলল, তারা এসেছে সে-খবর শুনেছ কি মারি?
সকালে সাধারণত যে ঢিলে গাউনটা সে পরে তার বদলে এখন পরেছে একটা খুব ভালো পোশাক। চুল সযত্নে পাট করা, মুখখানি উজ্জ্বল। তবু তার শাদাসিদে পোশাক দেখে মাদময়জেল বুরিয়ে বলে উঠল, একি! প্রিয় সখি, তুমি কি এইরকমই থাকবে নাকি? এখনই তো ভদ্রলোকদের বসবার ঘরে ঢোকার কতা ঘোষণা করা হবে, আর আমাদেরও নিচে নামতে হবে, অথচ তুমি মোটেই সাজগোজ করনি।
ছোট প্রিন্সেস উঠে দাসীকে ডাকবার জন্য ঘণ্টা বাজাল, আর প্রিন্সেস মারিকে কীভাবে সাজানো হবে তাড়াতাড়ি তার একটা পরিকল্পনা করে ফেলল। একজন পাণিপ্রার্থীর আগমনে সে যে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে এতে প্রিন্সেস মারির আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে। সে যদি এখন বলে যে নিজের ও তাদের দুজনের ব্যবহারে সে লজ্জা বোধ করছে তাহলে তার নিজের উত্তেজনাটাই ধরা পড়বে, আবার তাদের সাজপোশাকের ব্যাপারে বাধা দিলেও তারা সামনে ঠাট্টা-তামাশা করতে থাকবে। সে লজ্জা পেল, সুন্দর চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এল, মুখে লালের ছোপ লাগল, মাদময়জেল বুরিয়ে ও হোট প্রিন্সেসের হাতে পড়লেই তার মুখে এই রকম আকর্ষণীয় শহিদসুলভ ভাব ফুটে ওঠে। দুই সখী কিন্তু আন্তরিকভাবেই তাকে সুন্দরী করে তুলতে চেষ্টা করতে লাগল। ভালো সাজসজ্জা যে কোনো মুখকে সুন্দর করে তুলতে পারে–মেয়েদের এই দৃঢ় ধারণার বশেই তারা আন্তরিকতার সঙ্গেই প্রিন্সেস মারিকে সাজাতে বসল।
একটু দূর থেকে প্রিন্সেস মারিকে নজর করে লিজা বলল, সত্যি ভাই, তোমার এ পোশাকটা মোটেই ভালো নয়। তোমার যে লাল রঙের পোশাকটা আছে সেটা আনাও। সত্যি! তুমি তো বোঝ তোমার গোটা ভাগ্যই এর উপর নির্ভর করছে। কিন্তু এ পোশাকটা বড় বেশি হাল্কা, তোমাকে ঠিক মানাচ্ছে না।
কিন্তু লাল পোশাকটা পরিয়ে চুল বাঁধার ঢং বেশ খানিকটা পাল্টে দেবার পরেও ব্যবস্থাটা তার ঠিক মনঃপুত হল না। দুই হাত এক করে সে বলল, না, এটাও চলবে না। না মারি, এ পোশাকটাও তোমাকে মানাচ্ছে না। তোমার সেই রোজকার পরার ছোট ধূসর পোশাকটাই ভালো মনে হচ্ছে। দয়া করে সেটাই পর। কাতি, যাও তো প্রিন্সেসের ধূসর পোশাকটা নিয়ে এস। তুমি দেখো মাদময়জেল বুরিয়ে, কী রকম একখানা সাজিয়ে দি।
কিন্তু কাতি যখন নির্দিষ্ট পোশাকটা এনে দিল প্রিন্সেস মারি তখনো আয়নার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইল, আয়নার মধ্যেই সে দেখতে পেল, তার চোখ দুটি জলে ভরে উঠেছে, মুখটা কাঁপছে, যে কোনো সময় সে কান্নায় ভেঙে পড়বে।
মাদময়জেল বুরিয়ে বলল, এদিকে এস তো প্রিন্সেস মারির কাছে গিয়ে বলল, দেখে নিও, এবার একটা মানানসই অথচ সহজ সরল সাজেই তোমাকে সাজিয়ে দেব।
প্রিন্সেস মারি বলল, না, আমাকে রেহাই দাও।
তার কণ্ঠস্বরে এতখানি গাম্ভীর্য ও বিষণ্ণতা ফুটে উঠল যে অন্যদের তরল কণ্ঠের কলকাকলি তৎক্ষণাৎ থেমে গেল। বড় বড়, চিন্তাৰিত ও অপূর্ণ সুন্দর চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে তারা বুঝতে পারল যে এ নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করা নিরর্থক, নিষ্ঠুরতাও বটে।
ছোট প্রিন্সেস বলল, অন্তত কেশ-বিন্যাসটি পাল্টে নাও! মাদময়জেল বুরিয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আগেই বলিনি, এ ধরনের চুলবাঁধা মারির মুখে মানায় না। মোটেই মানায় না! দয়া করে ওটা বদলে দাও।
চোখের জল না ফেলবার আপ্রাণ চেষ্টা করে জবাব এল, আমাকে ছেড়ে দাও, দয়া করে আমাকে ছেড়ে দাও। আমার কাছে সবই সমান।
মাদময়জেল বুরিয়ে ও ছোট প্রিন্সেস দুজনই নিজেদের কাছে স্বীকার করল যে এ সাজে প্রিন্সেস মারিকে স্বাভাবিক অবস্থার চাইতেও খারাপ দেখাচ্ছে, কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। চিন্তাৰিত, বিষণ্ণ যে-দৃষ্টিতে সে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে তাকে তারা চেনে। প্রিন্সেস মারির মুখের এই ভাব দেখে তারা ভয় পেল না, কিন্তু তারা জানে যে এ ভাব যখন তার মুখে ফুটে ওঠে তখন সে মূক হয়ে যায়, তাকে কোনোমতেই সংকল্পচ্যুত করা যায় না।
লিজা বলল, তুমি কি এটা পাল্টাবে না? প্রিন্সেস মারি কোনো জবাব না দেওয়াতে সে ঘর থেকে চলে গেল।
প্রিন্সেস মারি ঘরে একা রইল। অসহায়ভাবে হাত দুটো ঝুলিয়ে চোখ নিচু করে বসে সে ভাবতে লাগল। তার কল্পনায় ভেসে উঠল একটি শক্তিমান, প্রভাবশালী, আশ্চর্য সুন্দর পুরুষের ছবি যে হবে তার স্বামী, তার সঙ্গে সে যেন চলে গেল এক খুশির জগতে। একটি শিশুর ছবি ফুটে উঠল তার কল্পনায়, তার নিজের সন্তান–আগেরদিন যেমনটি সে দেখেছিল তার নার্সের মেয়ের কোলে রয়েছে তার কোলে, আর পাশে দাঁড়িয়ে স্বামী তাদের দুজনকে দেখছে। অমনি তার মনে হল, না, এ অসম্ভব, আমি যে বড় বেশি কুৎসিত।
দরজায় দাসীর গলা শোনা গেল, দয়া করে চা খেতে আসুন। প্রিন্স এখনই তার ঘর থেকে বের হবেন।
সে উঠে দাঁড়াল। নিজের চিন্তায় নিজেই শংকিত হল। নিচে নামবার আগে সে পাশের ঘর গেল। সেখানে সব দেবমূর্তি ঝোলানো রয়েছে। ত্রাণকর্তার একটি বড় মূর্তির কালো মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুই হাত জোড় করে সে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। একটা বেদনার্ত সন্দেহে তার মন ভরে উঠল। ভালোবাসার আনন্দ কি তার ভাগ্যে আছে? বিয়ের কথা ভাবতে গেলেই প্রিন্সেস মারি সুখের স্বপ্ন দেখে, সন্তানের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু অন্তরের গভীরে যে প্রবল বাসনাকে সে লুকিয়ে রেখেছে তার লক্ষ্য পার্থিব ভালোবাসা। নিজের কাছ থেকে, অন্যের কাছ থেকে এই বাসনাকে সে যতই লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে ততই সেটা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সে বলল, হে ঈশ্বর, অন্তরের এই শয়তানী লোভকে আমি কেমন করে চেপে মারব? শান্তির পথে তোমার ইচ্ছাকে পূর্ণ করবার জন্য এই নিচ কল্পনাকে আমি কেমন করে চিরতরে পরিত্যাগ করতে পারব? প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই ঈশ্বর তার মনের মধ্যেই একটা উত্তরও দিয়ে দিল। নিজের জন্য কিছুই কামনা করো না, কিছুই খুঁজো না, উদ্বেগ বা ঈর্ষাকে মনে স্থান দিও না। মানুষের ভবিষ্যৎ আর তোমার ভাগ্য তোমার কাছে লুকানোই থাকবে, কিন্তু সব সময় সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থেকো। বিবাহের কর্তব্য পালনের ভিতর দিয়ে তোমাকে পরীক্ষা করাই যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়, তো তাঁর সেই ইচ্ছা পূর্ণ করতে প্রস্তুত থেকো। মনের মধ্যে এই সান্ত্বনার বাণী শুনে প্রিন্সেস মারি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্রুশ-চিহ্ন এঁকে নিচে নেমে গেল, নিজের গাউন বা চুল-বাধার কথা, অথবা কেমন করে সে চলবে ও কি কথা বলবে সে-কথাও সে একবারও ভাবল না। আর যে ঈশ্বরের চেষ্টায় ভিন্ন মানুষের মাথার একটা চুলও পড়তে পারে না, তার ইচ্ছার তুলনায় এ সবের মূল্যই বা কতটুকু?
*
অধ্যায়-৪
প্রিন্সেস মারি নিচে নেমে দেখল বসবার ঘরে প্রিন্স ভাসিলি ও তার ছেলে ছোট প্রিন্সেস ও মাদময়জেল বুরির্টের সঙ্গে কথা বলছে। ভারী পা ফেলে সে ঘরে ঢুকতেই ভদ্রলোক দুটি ও মাদময়জেল বুরিয়ে উঠে দাঁড়াল, আর ছোট প্রিন্সেস তাকে দেখিয়ে ভদ্রলোকদের বলল : এই হল মারি। প্রিন্সেস মারি সকলকেই বেশ ভালোভাবেই দেখল। দেখল প্রিন্স ভাসিলির মুখ, প্রথমে গম্ভীর, কিন্তু একটু পরেই মুখে হাসি, মারি অতিথিদের মনের উপর কতটা দাগ কাটতে পেরেছে সেইদিকেই ছোট প্রিন্সেসের কড়া নজর। সে দেখল, মাদময়জেল বুরির্টের ফিতে বাঁধা মুখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল দৃষ্টি যুবকটির উপর নিবদ্ধ, কিন্তু সে নিজে তাকে দেখতে পাচ্ছে না, সে শুধু দেখল একটা মস্তবড়, উজ্জ্বল ও সুন্দর কিছু তার দিকে এগিয়ে আসছে। প্রথমে এগিয়ে এল প্রিন্স ভাসিলি, প্রিন্সেস মারি তার ঝুঁকে-পড়া টাকওয়ালা কপালে চুমো খেল, আর তার প্রশ্নের উত্তরে জানাল যে তাকে তার ভালোভাবেই মনে আছে। তারপর এগিয়ে এল আনাতোল। এখনো সে তাকে দেখতে পেল না। শুধু অনুভব করল একটা নরম হাত তার হাতটাকে চেপে ধরল আর সে একটি শাদা কপালে তার ঠোঁট দুটি ছোঁয়াল, সে কপালের উপরকার হাল্কা বাদামি রঙের চুলে পমেডের গন্ধ। তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে প্রিন্সেস মারি তার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। ইউনিফর্মের একটা বোতামের নিচে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি রেখে সে দাঁড়িয়ে আছে, প্রশস্ত বুক, পিঠটা একটু বাঁকানো, একটা পা ঈষৎ দোলাতে দোলাতে মাথাটাকে একটু নুইয়ে উজ্জ্বল মুখে সে প্রিন্সেসের দিকে তাকাল, কিন্তু কোনো কথা বলল না, বরং মনে হল তার কথা সে ভাবছেই না। আনাতোল খুব তাড়াতাড়ি কিছু বুঝতে পারে না, আলাপ-পরিচয়ের ব্যাপারেও সে পটু নয়। প্রিন্সেস সেটা বুঝতে পেরে তার বাবার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু আসর জমিয়ে তুলল ছোট প্রিন্সেস লিজা। প্রিন্সে ভাসিলির কাছে গিয়ে সে চপলতার সঙ্গে এমন সব পুরোনো ঠাট্টা ও মজার স্মৃতির উল্লেখ করতে লাগল যা কোনোদিন ঘটেনি। আনাতোলকেও সে এই আলোচনায় ডেকে আনল। মাদময়জেল বুরিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। এমন কি প্রিন্সেস মারিও এবার পিছিয়ে রইল না।
হোট প্রিন্সেস ফরাসিতে প্রিন্স ভাসিলিকে বলল, প্রিয় প্রিন্স, এখানে অন্তত আপনাকে একান্তভাবে আমাদের মধ্যে পেয়েছি। আনেতের প্রীতিভোজ থেকে কিন্তু আপনি সর্বদাই পালিয়ে বেড়াতেন। প্রিয় আনেৎকে নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে?
ওঃ, কিন্তু আনেতের মতো তুমিও আবার রাজনীতির কথা শুরু করবে না তো!
আর আমাদের সেই ছোট্ট চায়ের আসর!
ওঃ, হ্যাঁ।
হোট প্রিন্সেস আনাতোলকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কেন কখনো আনেতের বাড়ি যেতেন না? একটা চতুর কটাক্ষে হেসে সে বলল, আহা আমি জানি, আমি জানি। আপনার ভাই হিপোলিৎ আমাকে সব বলেছে। আহা, এমন কি প্যারিসে আপনার কাণ্ড-কারখানার কথাও আমি শুনেছি।
প্যারিসের কথা শুনেই মাদময়জেল বুরিয়ে সুযোগ মতো আলোচনায় যোগ দিল। সে জানতে চাইল, আনাতোল কি অনেক দিন হল প্যারিস ছেড়ে এসেছে, আর সে শহরটাই বা তার কেমন লেগেছে। আনাতোল সঙ্গে সঙ্গে এই ফরাসিনীর কথার জবাব দিল এবং সহাস্যে তার দিকে তাকিয়ে তার স্বদেশ সম্পর্কে নানা কথা বলতে লাগল। সুন্দরী বুরিয়েকে দেখে আনাতেলের মনে হল, বন্ড হিলস তাহলে খুব একঘেয়ে লাগবে না। তাকে ভালো করে দেখে নিয়ে ভাবল, মোটেই খারাপ নয়! এই ছোট্ট সঙ্গিনীটি মোটেই খারাপ নয়। আশা করি আমাদের বিয়ের পরে প্রিন্সেস একেও সঙ্গে নিয়ে যাবে, এই ছোট্ট সুন্দরীটি মনোহারিণী বটে!
বুড়ো প্রিন্স তার পড়ার ঘরে ধীরে সুস্থে সাজগোজ করতে লাগল, চোখ কুঁচকে ভাবতে লাগল, সে কি করবে। এই দুটি অতিথির আগমনে সে বিরক্তি হয়েছে। প্রিন্স ভাসিলি ও তার ছেলে আমার কে প্রিন্স ভাসিলি একটা বাজে দাম্ভিক লোক, অবশ্য তার ছেলেটি ভালো। যে অমীমাংসিত প্রশ্নটাকে সে সব সময় চেপে রাখতে চেয়েছে, নিজেকে সব সময় ঠকিয়েছে, এদের দুজনের আগমনে সেই প্রশ্নটা নতুন করে তার মনে জেগেছে বলেই তার এত রাগ। প্রশ্নটা হল, সে কি কোনোদিন মেয়েকে বিদায় দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠাতে পারবে। প্রিন্স কখনো প্রশ্নটাকে সরাসরি নিজের কাছে করেনি, কারণ সে জানে তাকে উচিত জবাবই দিতে হবে, আর সে উচিত জবাব যে শুধু তার মনকেই আঘাত করবে তাই নয়, আঘাত করবে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনার মূলে। তার কাছে প্রিন্সেস মারির মূল্য যত অল্পই হোক, তবু তাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথা সে যে ভাবতেই পারে না। সে ভাবতে লাগল, আর সে বিয়ে করবে কেন? অসুখী যে হবে সেটা তো নিশ্চিত। এই তো লিজার বিয়ে হয়েছে আন্দ্রুর সঙ্গে-আজকের দিনে তারচাইতে একটি ভালো স্বামীর কথা ভাবাই যায় না–কিন্তু নিজের ভাগ্য নিয়ে সে কি খুশি? আর ভালোবেসে মারিকে বিয়ে করবে কে? কথাটা তো যেমন সরল তেমনি অদ্ভুত! তার উচ্চ বংশ ও সম্পত্তির কথা ভেবেই তারা তাকে গ্রহণ করবে। পৃথিবীতে কি অবিবাহিতা নারী কেউ নেই, আর তারা কি সুখী নয়? পোশাক পরতে পরতে প্রিন্স বলকনস্কি এই কথাগুলি ভাবছিল, অথচ যে প্রশ্নটিকে সে এতদিন চাপা দিয়ে রেখেছিল আজ তার জবাব দেবার সময় এসেছে। বিয়ের প্রস্তাব করতেই প্রিন্স ভাসিলি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে, আজ হোক কাল হোক, সে তো একটা জবাব চাইবেই। তার জন্ম তার সামাজিক মর্যাদা তো খারাপ নয়। এর বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই, প্রিন্স নিজের মনেই বলল, কিন্তু আমার মেয়ের যোগ্য হতে হবে। আর সেটাই আমাদের ভালো করে দেখতে হবে।
সেটাই আমাদের দেখতে হবে। সেটাই আমাদের দেখতে হবে! সে উচ্চকণ্ঠে বারবার বলতে লাগল।
যথারীতি সতর্ক পদক্ষেপে দ্রুত চারদিকে তাকাতে তাকাতে সে বসবার ঘরে ঢুকল। ছোট প্রিন্সেসের পোশাকের পরিবর্তন, মাদময়জেল বুরিয়ের ফিতে, প্রিন্সেস মারির বেমানান কেশ-বিন্যাস, মাদময়জেল বুরিয়ে ও আনাতোলের হাসি, আর চারপাশের কলগুঞ্জনের মধ্যে তার মেয়ের নিঃসঙ্গতা-এ সবকিছুই তার দৃষ্টি এড়াল না। বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে সে ভাবল, কেমন বোকার মতো সেজেছে! ওর লজ্জা নেই, আর ছেলেটিকেও উপেক্ষা করেছে!
সে সোজা প্রিন্স ভাসিলির দিকে এগিয়ে গেল।
আরে! কেমন আছেন? কেমন আছেন? আপনাকে দেখে খুশি হলাম!
প্রিন্স ভাসিলি তার স্বভাবসিদ্ধ দ্রুত, আত্মবিশ্বাসে ভরা সুরে বলল, বন্ধুত্বের টান দূরত্বকে উপহাস করে। এই আমার দ্বিতীয় পুত্র, দয়া করে তাকে ভালোবাসবেন, তার বন্ধু হবেন।
প্রিন্স বলকনস্কি আনাতোলকে ভালো করে দেখতে লাগল।
বলল, বড় ভালো ছেলে! বড় ভালো ছেলে! এসেছ, আমাকে চুমো খাও। সে গালটা বাড়িয়ে দিল।
আনাতোল বৃদ্ধকে চুমো খেল, কৌতূহল ও পরিপূর্ণ ধৈর্যের সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, বাবার মুখে তার যেসব খামখেয়ালের কথা শুনেছে না জানি কতক্ষণে সেগুলো প্রকাশ পাবে।
প্রিন্স বলকনস্কি সোফার এককোণে তার নির্দিষ্ট জায়গায় বসে একটা হাতল-চেয়ার টেনে নিয়ে প্রিন্স ভাসিলিকে ইঙ্গিতে বসতে বলে নানা রাজনৈতিক ব্যাপার ও সংবাদ সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করতে লাগল। প্রিন্স ভাসিলির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও সে বারবার প্রিন্সেস মারির দিকে তাকাতে লাগল।
প্রিন্স ভাসিলির শেষের কথাগুলির পুনরাবৃত্তি করে সে বলল, তাহলে তারা ইতিমধ্যেই পটসডাম থেকে লিখতে শুরু করেছে? তারপরই হঠাৎ সে মেয়ের কাছে চলে গেল।
বলল, তুমি কি অতিথিদের জন্যই এরকম সেজেছ, অ্যাঁ? ভালো, খুব ভালো! অতিথিদের জন্য তুমি নতুন কেতায় চুল বেঁধেছ, তাই তাদের সামনেই বলছি, ভবিষ্যতে আমার অনুমতি ছাড়া তুমি কখনো তোমার সাজগোজের পরিবর্তন করতে পারবে না।
ছোট প্রিন্সেস সলজ্জভাবে বাধা দিয়ে বলল, দোষটা আমার।
পুত্রবধূর সামনে মাথাটা নুইয়ে প্রিন্স বলকনস্কি বলল, তুমি যা খুশি তাই করতে পার, কিন্তু ও তো নিজেকে তোমার হাতের পুতুল বানাতে পারে না, এমনিতেই তো ও শাদাসিদে মানুষ।
মেয়ের দিকে আর না তাকিয়ে সে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল, মেয়েটির চোখে জল এসেছে।
প্রিন্স ভাসিলি বলল, বরং আমি তো দেখছি এই চুল বাঁধাটা প্রিন্সেসকে খুব ভালো মানিয়েছে।
প্রিন্স বলকনস্কি আনাতোলের দিকে ঘুরে বলল, এই যে তরুণ প্রিন্স, তোমার নামটা কি? এদিকে এস, তোমার সঙ্গে কথা বলি, পরিচয় করি।
হেসে বুড়ো প্রিন্সের পাশে বসে আনাতোল ভাবল, এই খেল শুরু হল।
দেখ বাপু, শুনেছি তুমি বিদেশে শিক্ষা পেয়েছ, তোমার বাবা ও আমার মতো ডিয়েনের কাছে লিখতে ও পড়তে শেখনি। এখন বল তো বাপু, তুমি কি অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনীতে কাজ করছ?
কোনোরকমে হাসি চেপে আনাতোল বলল, না, আমাকে শিবিরে বদলি করা হয়েছে।
আঃ! খুব ভালো কথা। তাহলে বাবা, জারকে ও দেশকেই তো তুমি সেবা করতে চাও? এখনো যুদ্ধের সময়। আচ্ছা, তুমি কি সীমান্তে যাচ্ছ?
না প্রিন্স, আমাদের রেজিমেন্ট সীমান্তে চলে গেছে, কিন্তু আমি যুক্ত রয়েছি…কিসের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি বাপি? হেসে বাবার দিকে ফিরে আনাতোল বলল।
চমৎকার সৈনিক, চমৎকার! আমি কিসের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি! হা হা, হা! প্রিন্স বলকনস্কি হেসে উঠল। আরো জোরে হেসে উঠল আনাতোল। হঠাৎ প্রিন্স বলকনস্কির চোখে ভ্রুকুটি দেখা দিল।
তুমি যেতে পার, সে আনাতোলকে বলল।
আনাতোল হেসে মহিলাদের মধ্যে চলে গেল।
আপনি তো ওকে বিদেশে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, তাই না প্রিন্স ভাসিলি? বুড়ো প্রিন্স প্রশ্নটা করল।
আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, আর আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি যে সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের চাইতে অনেক ভালো।
হ্যাঁ, আজকাল সবকিছুই অন্যরকম হয়ে গেছে, সবকিছুই বদলে গেছে। ছেলেটি খুব সুন্দর। খুব সুন্দর, এখন আমার সঙ্গে আসুন। প্রিন্স ভাসিলির হাত ধরে বুড়ো প্রিন্স নিজের পড়ার ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে যখন শুধু তারাই দুজন তখনই প্রিন্স ভাসিলি তার আশা ও বাসনার কথা জানাল।
বুড়ো প্রিন্স সক্রোধে বলল, আপনি কি মনে করেন আমি মেয়েকে বাধা দেব, তাকে ছাড়া থাকতে পারব না? কী যে ধারণা সব! বিয়ের জন্য আমি কালই প্রস্তুত! শুধু বলতে চাই, আমার জামাকে আমি ভালো করে জানতে চাই। আমার নীতি তো আপনি জানেন–সবকিছুই খোলাখুলি! আপনার সামনেই কাল মেয়েকে জিজ্ঞেস করব, মেয়ে যদি রাজি থাকে তো আপনার ছেলে এখানে থাকুক। সে থাকুক, আমিও সবকিছু দেখি। নাক ঝাড়ার শব্দ করে বুড়ো প্রিন্স আরো বলল সে বিয়ে করুক না, আমার কাছে সবই সমান! নিজের ছেলের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় যে মর্মভেদী স্বর ফুটেছিল তার গলায় সেইরকম আর্তস্বরেই সে কথাটা বলল।
এরকম একজন তীক্ষ্ণদৃষ্টির মানুষের কাছে চালাকি করে কোনো ফল হবে না বুঝতে পেরে প্রিন্স ভাসিলি বলল, সব কথাই খোলাখুলিভাবে আপনাকে বলব। আপনি তো সবই বোঝেন, মানুষের ভিতরটা পর্যন্ত আপনি দেখতে পান। আনাতোল প্রতিভাধর নয়, কিন্তু সে সৎ ও উদার অন্তঃকরণের ছেলে, পুত্র হিসেবে, আত্মীয় হিসেবে সে চমৎকার।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, দেখাই যাক।
যেসব নারী দীর্ঘদিন পুরুষসমাজ থেকে দূরে থাকে তাদের বেলায় সাধারণত যা ঘটে থাকে এক্ষেত্রেও তাই ঘটল, আনাতেলের আবির্ভাবে প্রিন্স বলকনস্কির পরিবারের তিনটি নারীরই মনে হল, এতদিন তারা সত্যিকারের জীবনের স্বাদ পায়নি। তাদের চিন্তার, অনুভূতির ও পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা সঙ্গে সঙ্গে দশগুণ বেড়ে গেল, তাদের যে জীবন এতদিন কেটেছে অন্ধকারে, সহসা তা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে পরিপূর্ণ তাৎপর্যের উজ্জ্বল আলোয়।
নিজের মুখ ও চুল বাঁধার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেল প্রিন্সেস মারি। যে লোকটি তার স্বামী হতে পারে তার সুন্দর চিন্তায় সে বিভোর হয়ে রইল। তার মনে হল, এই মানুষটি দয়ালু, সাহসী, স্থিরসংকল্প, পুরুষোচিত ও উদার। সে বিষয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। তার কল্পনায় ভেসে বেড়াতে লাগল অনাগত পারিবারিক জীবনের হাজার স্বপ্ন। সে তাদের মন থেকে তাড়িয়ে দিল, লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করল।
প্রিন্সেস ভাবল, কিন্তু আমি কি তার প্রতি বড় বেশি উদাসীন হইনি? আমি গম্ভীর হতে চেষ্টা করছি, কারণ অন্তরের গভীরে ইতিমধ্যেই আমি তার বড় বেশি কাছে এসে পড়েছি, কিন্তু আমার মনের কথা তো সে জানতে পারবে না, হয়তো ভাববে আমি তাকে পছন্দ করি না।
প্রিন্সেস মারি নতুন অতিথিটির প্রতি সদয় হতে চেষ্টা করল, কিন্তু পেরে উঠল না। আনাতোল ভাবল, বেচারি, মেয়েটি জঘন্য রকমের কুৎসিত!
মাদময়জেল বুরিয়ের চিন্তা অন্যরকমের। প্রিন্স বলকনস্কির বাড়িতে সারাজীবন কাটাবার ইচ্ছা তার মোটেই নেই। অনেকদিন ধরে সে অপেক্ষা করে আছে কবে একটি রুশ প্রিন্স এসে তাকে একনজর দেখেই এই শাদাসিদে, বিশ্রী সাজসজ্জার রুশ প্রিন্সেসটির তুলনায় তার শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করতে পারবে, তার প্রেমে পড়বে এবং তাকে নিয়ে চলে যাবে, আর অবশেষে এই তো এসেছে সেই রুশ প্রিন্স-এসেছে গল্পের রাজপুত্র। সে তাকে নিয়ে যাবে, তাকে বিয়ে করবে। আনাতোলের সঙ্গে প্যারিস শহর নিয়ে আলোচনার মুহূর্ত থেকেই এই ভবিষ্যৎ জীবনের ছবি তার মাথায় ঢুকেছে। তার মনেও বাসনা জাগল আনাতোলকে খুশি করবে, আর যথাসম্ভব সেই চেষ্টাই সে করতে লাগল।
বুড়ো যুদ্ধের ঘোড়া যেমন ভেরির বাজনা শুনলেই টগবগিয়ে ওঠে, ছোট প্রিন্সেসও নিজের অবস্থা ভুলে সম্পূর্ণ অচেতনভাবেই পরিচিত পূর্বরাগের জোর কদমের তালিম দিতে শুরু করল। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য বা আত্মদ্বন্দ্বের প্রেরণায় নয়, সরল ও হাল্কা আমোদের ছলেই সে ছলাকলায় মন দিল।
আনাতোল যদিও নারীসমাজে বহু-আকাক্ষিত ক্লান্ত পুরুষের ভূমিকাই গ্রহণ করে থাকে, তবু তিনটি নারীর উপর তার প্রভাব লক্ষ্য করে সে গর্বে ডগমগ হয়ে উঠল। তাছাড়া, সুন্দরী ও উত্তেজনাময়ী মাদময়জেল বুরিয়ের প্রতি তার মনে জাগতে শুরু করেছে সেই দুর্বার পাশবিক কামনা যা তাকে সহসা গ্রাস করে বসবে এবং অত্যন্ত রূঢ় বেপরোয়া কাজের পথে তাকে টেনে নিয়ে যাবে।
চায়ের পরে সকলে বসবার ঘরে গেল, আর সেখানে প্রিন্সেস মারিকে ক্লাভিকউ (বাদ্যযন্ত্র) বাজাতে বলা হল। আনাতোল খোশ মেজাজে হাসতে হাসতে এগিয়ে গিয়ে তার মুখোমুখি এবং মাদময়জেল বুরিয়ের পাশে কনুইতে ভর দিয়ে দাঁড়াল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রিন্সেস মারির মনে জাগল বেদনাময় আনন্দের অনুভূতি। তার প্রিয় সোনাতা তাকে নিয়ে গেল এক অতিপরিচিত কাব্যের জগতে, আনাতোলের চোখের দৃষ্টি সে জগৎকে করে তুলল আরো কাব্যময়। কিন্তু আনাতোলের চোখ তার উপরে থাকলেও তার মন ছিল মাদময়জেল বুরিয়ের ছোট্ট পা-খানির গতিবিধির উপর, ক্লাভিকর্ডের নিচ দিয়ে সে তখন নিজের পা দিয়ে মাদময়জেল বুরিয়ের পা-খানি ছুঁয়েছিল। মাদময়জেল বুরিয়েও তাকিয়ে আছে প্রিন্সেস মারির দিকে, কিন্তু তার মধুর দুটি চোখে তখন ফুটে উঠেছে যে বেদনাময় আনন্দ ও আশা সেটা প্রিন্সেসের কাছে একান্তই নতুন।
প্রিন্সেস মারি ভাবল, সে আমাকে কত ভালোবাসে। এখন আমি কত সুখী, আর এরকম একটি বন্ধুকে নিয়ে, স্বামীকে নিয়ে আমি কত সুখীই না হতে পারব! স্বামী? তা কি সম্ভব হবে?
নৈশভোজনের পরে সকলের যখন শুতে যাবার সময় হল তখন আনাতোল প্রিন্সেস মারির হাতে চুমা খেল। প্রিন্সেস মারি জানে না এ-সাহস সে কোথায় পেল, কিন্তু একখানি সুন্দর মুখ যখন তার স্বপ্ন-দৃষ্টি চোখ দুটির কাছে এগিয়ে এল তখন সে সোজাসুজি সেই মুখের দিকে তাকাল। প্রিন্সেস মারির কাছ থেকে সরে গিয়ে আনাতোল মাদময়জেল বুরিতেঁর হাতে চুমা খেল। (এটা শিষ্টাচারসম্মান নয়, কিন্তু সব কাজই সে করে সরলভাবে, নিশ্চয়তার সঙ্গে। মাদময়জেল বুরিয়ে লাজারক্ত হয়ে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে প্রিন্সেসের দিকে তাকাল।
প্রিন্সেস ভাবল, কী বিনয়! আমার প্রতি এমেলির (মাদময়জেল বুরিয়ে) অকৃত্রিম স্নেহ ও অনুরাগের কোনো মূল্য না দিয়ে আমি তাকে ঈর্ষা করব, একথা তার পক্ষে ভাবাও কি সম্ভব? তার কাছে এগিয়ে গিয়ে গভীর আবেগে তাকে চুমো খেল। হোট প্রিন্সেসকে চুমো খাবার জন্য আনাতোল তার দিকে এগিয়ে গেল।
না! না! না! তোমার বাবা যখন আমাকে চিঠি লিখে জানাবেন যে তোমার স্বভাব ভালো হয়েছে তখনই তোমাকে আমার হাতে চুমো খেতে দেব। তার আগে নয়! ছোট প্রিন্সেস বলে উঠল। হেসে আনাতোলকে লক্ষ্য করে একটা আঙুল তুলে সে ঘর থেকে চলে গেল।
*
অধ্যায়-৫
সকলে যার যার মতো চলে গেল। বিছানায় শোয়ামাত্রই আনাতোল ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু বাকি সকলেই সে রাতটা অনেকক্ষণ জেগে কাটাল।
এই যে লোকটি অপরিচিত হয়েও এত সদয়-হা, সদয় হওয়াটাই বড় কথা-সে কি সত্যি আমার স্বামী হবে-এই কথাটা ভাবতেই প্রিন্সেস মারির মনে ভয় দেখা দিল। চারদিকে তাকাতেও তার ভয়–তার মনে হল যেন ঘরের অন্ধকার কোণে পর্দার আড়ালে একজন কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সেই একজন সে-শয়তান–আবার শাদা কপাল, কালো ভুরু ও লাল ঠোঁটের এই মানুষটিও সে।
ঘন্টা বাজিয়ে দাসীকে ডাকল, তাকে বলল তার ঘরে এসে ঘুমোতে। সেই রাতে মাদময়জেল বুরিয়ে বৃথাই একজনের প্রত্যাশায় দীর্ঘ সময় সবজি-ঘরে পায়চারি করে বেড়াল। ছোট প্রিন্সেস দাসীকে বকুনি দিল, বিছানাটা ঠিকমতো করা হয় নি। না উপুড় হয়ে না এক পাশে কোনোভাবেই সে শুতে পারছে না। যেভাবে পোবার চেষ্টা করছে তাতেই অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। ড্রেসিং-গাউন ও রাত-টুপি পরে সে একটা হাতল-চেয়ারে বসে রইল, আর ঘুম-ঘুম চোখে গজগজ করতে করতে কাতি তৃতীয়বার তার পালকের বিছানাটা ঠিকঠাক করে দিল।
ছোট প্রিন্সেস আরো একবার বলল, তোমাকে তো বলেছি, বিছানার কোথাও ফুলে উঠেছে, কোথাও নিচু হয়েছে। আমি তো ঘুমতে পারলেই খুশি হই, কাজেই দোষটা আমার নয়। ক্রন্দনমুখী। শিশুর মতো তার গলাটা কাঁপছে।
বুড়ো প্রিন্সও ঘুমতে পারল না। আধা ঘুমের মধ্যে তিখোন শুনতে পেল, সে সক্রোধে ঘরময় পায়চারি করছে আর গড় গড় করছে। তার মনে হচ্ছে, মেয়ের জন্য সে অপমানিত হয়েছে। সে অপমান তাকে আরো বেশি বেজেছে কারণ অপমানটা তার নয়, তার মেয়ের, আর সেই মেয়েকে সে নিজের অধিক ভালোবাসে। সে বারবার নিজেকে বলতে লাগল, সমস্ত ব্যাপারটা ভেবে দেখতে হবে, কোনটা ঠিক আর তার কি করা উচিত তাও স্থির করতে হবে, কিন্তু তার বদলে সে ক্রমাগত উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগল।
প্রথম একটা পুরুষ মানুষকে দেখল-অমনি বাবাকে ভুলে গেল, সবকিছু ভুলে গেল, ছুটে উপরে গিয়ে চুল বেঁধে ল্যাজ নাড়তে লাগল, আর একেবারেই বদলে গেল! বাবাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েই খুশি! আর সে জানে যে সবই আমার নজরে পড়ে! ফ্র..ফ্র..ফ্র…! আমি কি দেখতে পাচ্ছি না যে সে বোকাটার নজর পড়েছে। বুরিতেঁর উপরতাকে এবার তাড়াতে হবে। আর এটা বুঝবার মতো আত্মমর্যাদাও কি তার নেই? নিজের মর্যাদাবোধ যদি নাও থাকে, আমার মর্যাদাটাও তো রাখতে হবে। তাকে চোখ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে যে ওই মুখখুটা তার কথা মোটেই ভাবছে না, সে আছে বুরিয়ের তালে। না, তার কোনো মর্যাদাবোধই নেই…কিন্তু আমি তাকে দেখিয়ে দেব…
বুড়ো প্রিন্স জানে, সে যদি মেয়েকে বলে দেয় যে সে ভুল করছে, আনাতোল চাইছে মাদময়জেল বুরিয়ের সঙ্গে পূর্বরাগ জমাতে, তাহলেই প্রিন্সেস মারির আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগবে আর তারও কার্যোদ্ধার হবে। এই কথা ভেবে মনকে শান্ত করে সে তিখোনকে ডেকে পোশাক খুলতে লাগল।
তিখোন যখন তার শুকনো বুড়ো শরীর আর পাকা চুলে ভর্তি বুকটাতে নাইট-শার্ট পরাতে ব্যস্ত তখন সে ভাবতে লাগল, কেন যে মরতে ওরা এখানে এসেছে। আমি তো নেমন্তন্ন করে আনিনি। তারা এসে আমার জীবনটাকে বিরক্তিতে ভরে তুলেছে–আর সে জীবনের কয়দিনই বা বাকি আছে।
ওরা উচ্ছন্নে যাক! শার্টে মাথাটা ঢাকা অবস্থায়ই সে বলে উঠল।
মনিবের এই সোচ্চার চিন্তার ব্যাপারটা তিখোনের জানা আছে, তাই সহজভাবেই সে মনিবের ক্রুদ্ধ মুখের দিকে তাকাল।
শুতে গেছে কি? প্রিন্স জিজ্ঞেস করল।
সব ভালো খানসামার মতোই তিখোনও মনিবের চিন্তার হদিস রাখে। সে ধরেই নিল যে মনিব প্রিন্স ভাসিলি ও তার ছেলের কথাই বলছে।
তারা দুজনই শুতে গেছেন, আর ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়েছেন ইয়োর অনার।
বাজে…বাজে… দ্রুত লয়ে কথা বলতে বলতে প্রিন্স চটিতে পা গলিয়ে দিল এবং ড্রেসিং-গাউনের আস্তিনে হাত ঢুকিয়ে ঘুমোবার কোচটির দিকে এগিয়ে গেল।
মুখে কোনো কথা না হলেও আনাতোল ও মাদময়জেল বুরিয়ে নিজেদের পূর্বরাগের প্রথম অংশের কথা ভালোই বুঝেছে, তারা বুঝতে পেরেছে, দুজনের মধ্যে একান্তে আরো অনেক কথা হওয়া দরকার। তাই তারা সকাল থেকেই দুজন একত্র হবার সুযোগ খুঁজছে। যথাসময়ে প্রিন্সেস মারি যখন তার বাবার ঘরে ঢুকল তখন মাদময়জেল বুরিয়ে ও আনাতোল সবজি-ঘরে গিয়ে মিলিত হল।
সেদিন সকালে বুড়ো প্রিন্সে মেয়ের সঙ্গে খুবই সস্নেহ ও সদয় ব্যবহার করল। কিন্তু বাবার মুখের এই কষ্টের ভাব প্রিন্সেস মারি ভালোই জানে। তার মুখের এই ভাব সে অনেক দেখেছে-সে যখন গণিতের কোনো অংক বুঝতে পারত না তখন এমনি মুখ করে বাবা শুকনো হাত দিয়ে তার হাতটা চেপে ধরত, একই কথা বারবার বলতে বলতে চেয়ার থেকে উঠে হাঁটতে থাকত।
সে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অস্বাভাবিক হাসি হেসে বুড়ো প্রিন্স বলল, তোমার ব্যাপারে একটা প্রস্তাব এসেছে। আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছে যে আমার সুন্দর চোখের জন্য প্রিন্স ভাসিলি তার ছাত্র আনাতোলকে (যে কারণেই হোক প্রিন্স বলকনস্কি আনাতোলকে ছাত্র বলে উল্লেখ করল) সঙ্গে নিয়ে এখানে আসেননি। গত রাতে তিনি তোমার বিয়ের প্রস্তাব করেছেন, আর আমার রীতিনীতি তো তুমি জানই, তাই সে প্রস্তাব আমি তোমার কাছে রাখছি।
প্রথমে বিবর্ণ ও পরে লাজারক্ত হয়ে প্রিন্সেস বলল, তোমার ইচ্ছা কি বাপি?
আমার ইচ্ছা কি! বাবা রেগে বলল। পুত্রবধূ হিসেবে প্রিন্স ভাসিলির তোমাকে পছন্দ হয়েছে, তাই তার ছাত্রের পক্ষ থেকে তোমার কাছে প্রস্তাব করেছেন। ব্যাপার তো এই! আমার ইচ্ছা কি!…সেটাই তো আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি!
প্রিন্সেস অস্ফুটে বলল, তুমি কি ভাবছ তা তো আমি জানি না বাবা।
আমি? আমি? আমার কথা কেন? আমাকে ছেড়ে দাও। বিয়েটা তো আমার হচ্ছে না। তোমার কথা কি? সেটাই আমি জানতে চাই।
প্রিন্সেস বুঝল এ ব্যাপারে তার বাবার সায় নেই, কিন্তু সেইমুহূর্তেই তার মনে হল যে এখনই যদি তার ভাগ্য নির্ধারিত না হয়তো আর কখনো হবে না।
আপনার ইচ্ছামতো কাজ করতেই আমি চাই, তবে যদি আমার ইচ্ছাই ব্যক্ত করতে হয়… সে কথা শেষ করতে পারল না। বুড়ো প্রিন্স বাধা দিল।
চমৎকার। সে চেঁচিয়ে উঠল। সে তোমাকে নেবে যৌতুকসহ, আর মাদময়জেল বুরিয়েকে নেবে ফাউ হিসেবে। সেই হবে স্ত্রী, আর তুমি…।
প্রিন্স থামল। মেয়ের উপর এই কথাগুলির ফল সে দেখতে পেল। মেয়ে মাথা নিচু করল। এখনই তার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়বে।
প্রিন্স বলল, আরে, আরে, আমি তো ঠাট্টা করছিলাম। একটা কথা মনে রেখো প্রিন্সেস, স্বামী নির্বাচনের পরিপূর্ণ অধিকার মেয়ের আছে–এই নীতিই আমি সমর্থন করি। আমি তোমাকে স্বাধীনতা দিলাম। শুধু মনে রেখো, তোমার সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করছে তোমার জীবনের সুখ। আমার কথা ভেবো না।
কিন্তু আমি তো বুঝতে পারছি না বাবা!
আমার বলার তো কিছু নেই। সে হুকুম পেয়েছে, তোমাকে হোক যাকে হোক বিয়ে করবে, কিন্তু পছন্দ করে নেবার স্বাধীনতা তোমার আছে।…তোমার ঘরে যাও, ভালো করে ভেবে দেখ, আর এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এসে তার সামনেই আমাকে বলে দাও :্যা কি না। আমি জানি এ নিয়ে তুমি প্রার্থনা করতে বসবে। ইচ্ছা হয় প্রার্থনা করো, কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখো। যাও! হ্যাঁ কি না, হ্যাঁ কি না, হ্যাঁ কি না! কুয়াশার মধ্যে পথ হারাবার মতো অনিশ্চিত পা ফেলে প্রিন্সেস পড়ার ঘর থেকে চলে গেল।
তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে, ভালোই হয়েছে। কিন্তু মাদময়জেল বুরিয়ে সম্পর্কে তার বাবা যা বলল সেটা যে ভয়ংকর। কথাটা অবশ্যই মিথ্যা, তবু বড় ভয়ংকর, সে চিন্তাটাকে সে মন থেকে সরাতে পারল না। কোনোদিকে না তাকিয়ে কোনো কিছুতে কান না দিয়ে সে সোজা চলে যাচ্ছিল সবজিঘরের ভিতর দিয়ে, এমন সময় হঠাৎ মাদময়জেল বুরিয়ের পরিচিত ফিস ফিস গলা শুনে সে সজাগ হয়ে উঠল। চোখ তুলে দুপা দূরেই দেখতে পেল, আনাতোল ফরাসিনীকে জড়িয়ে ধরে তার কানে কানে কি যেন বলছে। আতংকিত মুখে আনাতোল প্রিন্সেস মারির দিকে তাকাল, কিন্তু মাদময়জেল বুরিয়ে এখনো তাকে দেখতে পায়নি, সেও সঙ্গে সঙ্গেই তার কোমর থেকে হাত তুলে নিল না।
আনাতোলের মুখের ভাব দেখে মনে হল সে যেন বলতে চায় : কে ওখানে? কিসের জন্য? একমুহূর্ত অপেক্ষা কর! প্রিন্সেস মারি নিঃশব্দে তাদের দিকে তাকাল। সে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। অবশেষে মাদময়জেল বুরিয়ে আর্তনাদ করে দৌড়ে পালিয়ে গেল। প্রিন্সেস মারির দিকে তাকিয়ে আনাতোল মৃদু হেসে মাথা নোয়াল, যেন এই অদ্ভুত ঘটনা দেখে তাকেও হাসতে বলল, তারপর কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
একঘন্টা পরে তিখোন এল প্রিন্সেস মারিকে ডাকতে, সে আরো জানাল যে প্রিন্স ভাসিলিও সেখানে আছে। তিখোন ঘরে ঢুকে দেখল, প্রিন্সেস মারি তার সোফায় বসে ক্রন্দনরতা মাদময়জেল বুরিয়েকে জড়িয়ে ধরে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। গভীর মমতা ও করুণাময় বিগলিত উজ্জ্বল দুটি সুন্দর চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
না প্রিন্সেস, তোমার স্নেহ আমি চিরদিনের মতো হারিয়েছি, মাদময়জেল বুরিয়ে বলল।
প্রিন্সেস মারি বলল, তা কেন? আমি তোমাকে আগের চাইতেও বেশি ভালোবাসি, আর তোমার সুখের জন্য সবকিছুই করতে চেষ্টা করব।
কিন্তু তুমি আমাকে ঘৃণা কর। তোমার হৃদয় পবিত্র, তাই কামনার টানে মানুষ যে কতদূর যেতে পারে। তা তুমি বুঝতে পারবে না।
বিষণ্ণ হাসি হেসে প্রিন্সেস মারি বলল, আমি খুব বুঝতে পারি। তুমি শান্ত হও। আমি বাবার কাছে যাচ্ছি। সে বেরিয়ে গেল।
প্রিন্স ভাসিলি পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে একটা নস্য-দানি হাতে নিয়ে বসেছিল। তার মুখে গভীর আবেগের হাসি। এমন সময় প্রিন্সেস মারি ঢুকল। সেও তাড়াতাড়ি একটিপ নস্য নিল।
উঠে দাঁড়িয়ে প্রিন্সেস মারির হাত দুটি ধরে বলে উঠল, এই যে সোনা আমার, এস। তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার ছেলের ভাগ্য এখন তোমার হাতে। তোমাকে তো চিরদিন মেয়ের মতোই দেখে এসেছি, এবার তুমি মনস্থির করে ফেল।
সে ফিরে দাঁড়াল, তার চোখে সত্যিকারের অশ্রুবিন্দু।
ফ্র…ফ্র…, প্রিন্স বলকনস্কির নাকের শব্দ হলে। প্রিন্স তোমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করছেন তার ছাত্রের মানে তার ছেলের নামে। তুমি কি প্রিন্স আনাতোল কুরাগিনের স্ত্রী হতে চাও, না চাও না? জবাব দাও, হ্যাঁ কি না, তবেই আমার নিজের মতামত আমি জানাব। প্রিন্স ভাসিলির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার অনুরোধভরা দৃষ্টির জবাবে সে আবার বলল, হ্যাঁ। আমার মতামত, একমাত্র আমার মতামত। বল, হ্যাঁ কি না?
বাবা, আমার ইচ্ছা কোনোদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না, তোমার জীবন থেকে আমার জীবনকে আলাদা করব না। আমি বিয়ে করতে চাই না, সুন্দর চোখ দুটি মেলে প্রিন্স ভাসিলি ও বাবার দিকে তাকিয়ে সে স্পষ্ট জবাব দিল।
ফাঁকি! অর্থহীন! ফাঁকি, ফাঁকি ফাঁকি! প্রিন্স বলকনস্কি চেঁচিয়ে উঠল। মেয়ের হাত দুটি চেপে ধরল, কিন্তু তাকে চুমো খেল না, শুধু নিজের কপালটাকে তার কপালের কাছে নিয়ে আস্তে চুঁইয়ে দিল, আর হাতটাকে এত জোরে চাপ দিল যে মেয়ে আর্তনাদ করে উঠল।
প্রিন্স ভাসিলি উঠে পড়ল।
সোনা আমার, আমাকে বলতেই হবে যে এই মুহূর্তটিকে আমি ভুলব না, কোনোদিন ভুলব না। কিন্তু সোনা, কিছু আশাও কি তুমি আমাকে দেবে না? অন্তত বল হয়তো…ভবিষ্যৎ তো অনেক দীর্ঘ। বল, হয়তো।
প্রিন্স, যা আমার অন্তরের কথা তাই আপনাকে বলেছি। আপনার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ কিন্তু আমি কোনোদিই আপনার পুত্রবধূ হব না।
বুড়ো প্রিন্স বলল, তাহলে তো ও পাট শেষই হয়ে গেল। আপনার দেখা পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। খুব খুশি! প্রিন্সেস, তোমার ঘরে যাও। যাও! প্রিন্স ভাসিলিকে আলিঙ্গন করে সে পুনরায় বলল, আপনার দেখা পেয়ে খুব খুশি হয়েছি।
প্রিন্সেস মারি ভাবতে লাগল, আমার কর্তব্য সম্পূর্ণ পৃথক। অন্য এক ধরনের সুখ, ভালোবাসা ও আহোসর্গের যে সুখ তার ভিতর দিয়ে সুখী হওয়াই আমার আদর্শ। যে মূল্যই দিতে হোক, বেচারি এমেলির সুখের ব্যবস্থা আমি করব। আমাকে সে কত ভালোবাসে, আজ তার অনুতাপের অন্ত নেই। তাদের দুজনের বিয়ের জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। যুবকটি যদি ধনী না হয়, আমি তাকে অর্থ দেব, বাবাকে বলব, আন্দ্রুকে বলব। সে যখন এই যুবকের স্ত্রী হবে তখন আমি খুব খুশি হব। সে বড় ভাগ্যহীনা, অপরিচিতা, একলা, অসহায়! যে ঈশ্বর, আজকের কথা ভুলতে পারলে সে আমাকে কত না ভালোবাসবে! হয়তো আমিও এই করতাম!… প্রিন্সেস মারি ভাবতে লাগল।
*
অধ্যায়-৬
অনেকদিন হয়ে গেল রস্ত পরিবারের কাছে নিকলাসের কোনো খবর আসেনি। অবশেষে শীতের মাঝামাঝি সময়ে কাউন্টের হাতে এল একটা চিঠি, ছেলের নিজের হাতে তার ঠিকানা লেখা। চিঠিটা পেয়েই সকলের নজর এড়াবার জন্য সভয়ে অতিদ্রুত পা টিপেটিপে সে তার পড়ার ঘরে ঢুকল, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করল।
আন্না মিখায়লভনা এ বাড়ির সব খবরই জানতে পারে। চিঠি এসেছে শুনেই সে মৃদু পায়ে ঘরে ঢুকে দেখল, চিঠি হাতে নিয়ে কাউন্ট যুগপত কাঁদছে ও হাসছে।
নিজের অবস্থার উন্নতি হলেও আন্না মিখায়লভনা এখনো রস্তভদের বাড়িতেই আছে।
সহানুভূতি জানাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে সে বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বন্ধু?
কাউন্ট আরো বেশি করে কেঁদে উঠল।
নিকোলেংকা (নিকলাসের আদরের নাম)… একটা চিঠি…আ…হ…ত…হয়েছে…আদরের খোকা… কাউন্টেস অফিসার পদে উন্নতী হয়েছে.. ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ছোট কাউন্টেসকে কেমন করে বলব!
আন্না মিখায়লভনা তার পাশে বসল, নিজের রুমাল দিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিল, চিঠির উপর যে চোখের জল পড়েছিল তাও মুছিয়ে দিল, তারপর নিজের চোখ মুছে কাউন্টকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। স্থির হল, ডিনারের সময় থেকে চায়ের সময় পর্যন্ত সে কাউন্টেসের মনকে ঠিক করে তারপর চায়ের পরে ঈশ্বরকে সহায় করে তাকে খবরটা জানাবে।
ডিনারে বসে আন্না মিখায়লভনা সারাক্ষণ যুদ্ধের খবর ও নিকোলেংকার খবরের কথাই বলতে লাগল, দুবার জিজ্ঞাসা করল তার শেষ চিঠি কবে এসেছে, আর সঙ্গে সঙ্গে বলল যে আজ হয়তো তার একটা চিঠি আসতে পারে। এসব শুনে কাউন্টেস যেই মাত্ৰ উৎকণ্ঠিতভাবে কাউন্ট ও আন্না মিখায়লভনার দিকে তাকাতে থাকে তখনই সে সুকৌশলে আজেবাজে কথা পেড়ে বসে। নাতাশা কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। এদের কথাবার্তার ভাবভঙ্গি থেকে তার নিশ্চিত ধারণা হল যে তার বাবা ও আন্না মিখায়লভনা একটা কিছু গোপন করতে চাইছে। আর সেটা নিশ্চয় তার দাদার প্রসঙ্গে। ডিনার শেষ হতে না হতেই সে আন্না মিখায়লভনার পিছু পিছু ছুট দিল এবং ছোট বসবার ঘরটায় তাকে ধরে ফেলে একেবারে তার কাঁধের উপর ঝুলে পড়ল।
মিষ্টি খালা, আমাকে বল কি হয়েছে?
কিছু তো হয়নি মামণি।
না, না, মিষ্টি খালা, মধু খালা, আমি তোমাকে ছাড়ছি না–আমি জানি তুমি কিছু জান।
আন্না মিখায়লভনা মাথা নাড়তে লাগল।
তুমি দেখছি খুব চালাক, সে বলল।
আন্না মিখায়লভনার মুখের দিকে তাকিয়েই নাতাশা চেঁচিয়ে বলল, নিকোলেংকার চিঠি এসেছে। আমি জোর করে বলতে পারি।
ঈশ্বরের দোহাই, খুব সাবধান, তুমি তো বোঝ একথা শুনলে তোমার মার অবস্থা কি হবে।
আমি জানি, তবু আমাকে বল! বলবে না? বেশ, তাহলে আমি এখনই গিয়ে বলে দিচ্ছি।
নাতাশা কাউকে বলবে না এই শর্তে আন্না মিখায়লভ অল্প কথায় চিঠির মর্ম তাকে বলে দিল।
কথা দিচ্ছি কাউকে বলব না, ক্রুশ-চিহ্ন এঁকে নাতাশা বলল। কাউকে বলব না। সঙ্গে সঙ্গে সে এক দৌড়ে সোনিয়ার কাছে চলে গেল।
বিজয়গর্বে সে ঘোষণা করে দিল, নিকোলেংকা…আহত হয়েছে…একটা চিঠি।
নিকলাস! বলেই সোনিয়া সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
দাদার আহত হবার সংবাদ শুনে সোনিয়ার এই অবস্থা দেখে সংবাদের দুঃখের দিকটা এই প্রথম সে অনুভব করল।
সোনিয়ার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে সে নিজেও কাঁদতে শুরু করল।
আঘাত সামান্য, কিন্তু তাকে অফিসার করা হয়েছে, এখন সে ভালো আছে, নিজেই চিঠি লিখেছে, চোখের জল ফেলতে ফেলতে সে বলল।
বড় বড় পা ফেলে ঘরময় পায়চারি করতে করতে পেতয়া বলে উঠল, এই দেখ! দেখছি তোমরা মেয়েরা সব্বাই কাঁদুনে খুকি। আমি কিন্তু খুব খুশি হয়েছি, দাদার এই উন্নতির কথা শুনে সত্যি খুশি হয়েছি। তোমরা শুধু কাঁদতেই জান, কিছু বোঝ না।
নাতাশা চোখের জলের মধ্যেও হেসে ফেলল।
তুমি তো চিঠিটা পড়নি? সোনিয়া জিজ্ঞেস করল।
না, কিন্তু খালা বলেছে সব ঠিক হয়ে গেছে, আর এখন সে একজন অফিসার।
কুশ-চিহ্ন এঁকে সোনিয়া বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! কিন্তু খালা হয়তো তোমাকে ধোকা দিয়েছে। চল মামণির কাছে যাই।
পেতয়া কিছুক্ষণ নিঃশব্দে পায়চারি করে একসময় বলে উঠল, নিকোলেংকার জায়গায় যদি আমি হতাম তাহলে আরো অনেক বেশি ফরাসিকে মেরে ফেলতাম। তারা তো সব ঘৃণ্য জানোয়ার! আমি তাদের এত বেশি মারতাম যে মৃতদেহের স্কুপ হয়ে যেত।
চুপ কর পেতুয়া, কি হাঁসের মতো প্যাঁক-প্যাঁক করছ!
পেতয়া বলল, হাঁস আমি নই, যারা তুচ্ছ ব্যাপারে কাঁদে তারাই হাঁস।
একমুহূর্ত চুপ করে থেকে নাতাশা হঠাৎ প্রশ্ন করল, তার কথা তোমার মনে আছে? সোনিয়া হাসল।
নিকলাসকে মনে আছে কি না?
তা নয় সোনিয়া, কিন্তু তার সবকিছু ঠিক ঠিক মনে আছে কি না? একটা বিশেষ ভঙ্গি করে নাতাশা বলল। নিকোলেংকাকে আমারও মনে আছে, ভালোভাবেই মনে আছে। কিন্তু বরিসের কথা মনে নেই। তাকে একটুও মনে পড়ে না।
সে কি! বরিসকে তোমার মনে পড়ে না? সোনিয়া সবিস্ময়ে বলল।
মনে পড়ে না তা ঠিক নয়–তার চেহারাটা মনে আছে, কিন্তু নিকোলেংকাকে যেভাবে মনে আছে ঠিক তেমনটি নয়। তাকে–চোখ বুজলেই দেখতে পাই, কিন্তু বরিস…না! (সে চোখ বন্ধ করল) না! কিছু নেই।
আঃ, নাতাশা! উম্মসভরে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সোনিয়া বলে উঠল।
দুটি বিস্মিত চোখ তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নাতাশা সোনিয়ার দিকে তাকাল, মুখে কিছুই বলল না। সোনিয়ার মনের কথা সে জানে, সে তার দাদাকে ভালোবাসে। এ ভালোবাসার অভিজ্ঞতা আজও নাতাশার হয়নি। সে বিশ্বাস করে ভালোবাসা আছে, কিন্তু বুঝতে পারে না।
তুমি কি তাকে চিঠি লিখবে? নাতাশা জিজ্ঞেস করল।
সোনিয়াকে চিন্তিত দেখাল। নিকলাসকে কি লিখবে, লেখা উচিত কি না, এইসব প্রশ্ন তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। আজ সে অফিসার হয়েছে, আহত নায়ক হয়েছে, তাকে এখন নিজের কথা বলা, স্বেচ্ছায় স্বীকৃত দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?
সলজ্জভাবে জবাব দিল, আমি জানি না। মনে করি, সে যদি লেখে তো আমিও লিখব।
তাকে চিঠি লিখতে তোমার লজ্জা করবে না?
সোনিয়া হাসল।
না।
আর আমার কিন্তু বরিসকে চিঠি লিখতে লজ্জা করবে। আমি লিখছি না।
লজ্জা করবে কেন?
তা জানি না। ব্যাপারটা যেন কেমন, আমার লজ্জা করবে।
নাতাশার আগের মন্তব্যে অসন্তুষ্ট হয়ে পেতয়া বলল, আমি জানি ও কেন লজ্জা পাবে। কারণ সেই চশমা-পরা মোটকার সঙ্গে ও প্রেমে পড়েছিল (নতুন কাউন্ট বেজুখভকে পেতয়া এইভাবেই বর্ণনা করে), আর এখন প্রেম করছে সেই গায়কের (নাতাশার ইতালিয় সঙ্গীত-শিক্ষক) সঙ্গে, তাই ওর এত লজ্জা!
পেতয়া, তুমি ভারি দুষ্ট! নাতাশা বলল।
একজন প্রধান ব্রিগেডিয়ারের ভঙ্গিতে নয় বছরের পেতয়া বলল, তোমার চাইতে বেশি দুষ্ট নই মাদাম। ডিনারের সময় আন্না মিখায়লভনার ইঙ্গিত থেকেই কাউন্টেস নিজের মনকে তৈরি করে নিয়েছে। নিজের ঘরে ফিরে একটা হাতল-চেয়ারে বসে নস্যদানির ঢাকনার উপর আঁকা ছেলের ছোট প্রতিকৃতিটির দিকে সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, দুই চোখ জলে ভরে উঠছে। চিঠিখানা হাতে নিয়ে আন্না মিখায়লভনা পা টিপে টিপে কাউন্টের দরজার কাছে এসে থামল।
বুড়ো কাউন্টও তার পিছনেই আসছিল, তাকে বাধা দিয়ে বলল, এখন নয়, পরে আসবেন। সে ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
কাউন্ট চাবির গর্তে চোখ রেখে কান পাতল।
প্রথমে অসংলগ্ন কিছু শব্দ, তারপর আন্না মিখায়লভনার দীর্ঘ একক বক্তৃতা, তারপর কান্না, নীরবতা, তারপর খুশি গলায় দুজনের কথা, তারপর পায়ের শব্দ। আন্না মিখায়লভনা দরজা খুলে দিল। একটা শক্ত অস্ত্রোপচার শেষ করে আসা সার্জনের গর্বিত ভঙ্গি তার মুখে।
বিজয়গর্বে কাউন্টেসকে দেখিয়ে সে কাউন্টকে বলল, কাজ শেষ! এক হাতে প্রতিকৃতিসহ নস্যদানি এবং অন্য হাতে চিঠিটা ধরে সে বসে আছে, একবার এটাকে আর একবার ওটাকে ঠোঁটে ছোঁয়াচ্ছে।
কাউন্টকে দেখে সে দুহাত বাড়িয়ে তার টাক মাথাটাকে জড়িয়ে ধরল, মাথার উপর দিয়ে আর একবার চিঠি ও ছবির দিকে তাকাল এবং পুনরায় সে দুটোকে ঠোঁটের উপর চেপে ধরবার জন্য টাক মাথাটাকে একটু ঠেলে সরিয়ে দিল। এবার ভেরা, নাতাশা, সোনিয়া ও পেতয়া ঘরে ঢুকল এবং চিঠি পড়া শুরু হল। যে অভিযানে ও দুটি যুদ্ধে সে অংশগ্রহণ করেছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে এবং তার পদোন্নতির উল্লেখ করে নিকলাস বাবা ও মার হাতে চুমো খাবার কথা জানিয়ে তাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছে এবং ভেরা, নাতাশা ও পেতয়াকেও চুমো খেয়েছে। তাছাড়া মঁসিয় শেলিং, মাদাম শোস ও বুড়ি নার্সকে শুভকামনা জানিয়ে তাদের বলেছে তার হয়ে প্রিয় সোনিয়াকে চুমো খেতে, তাকে সে আগের মতোই ভালোবাসে, তার কথা ভাবে। একথা শুনে লজ্জায় সোনিয়ার চোখে জল এসে গেল, চারদিক থেকে সকলের দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে সে ছুটে নাচ-ঘরে চলে গেল, পূর্ণ গতিতে এমনভাবে ঘুরতে লাগল যে তার পোশাকটা বেলুনের মতো উড়তে লাগল, তারপর হাসতে হাসতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। কাউন্টেস তখনো কাঁদছে।
ভেরা জিজ্ঞেস করল, তুমি কাঁদছ কেন মামণি? সে যা লিখেছে তাতে তো খুশি হওয়া উচিত, কাঁদার কথা তো নয়।
কথাটা সত্যি, কিন্তু কাউন্ট, কাউন্টেস ও নাতাশা তিরস্কারের ভঙ্গিতে তার দিকে তাকাল। কাউন্টেস ভাবল, ও আবার কার পিছনে ঘুরছে?
নিকলাসের চিঠিটা একশোবারের বেশি পড়া হল, চিঠি শোনার উপযুক্ত বলে যাদের বিবেচনা করা হল তারা সকলেই কাউন্টেসের কাছে এসে শুনে গেল কারণ চিঠিটা হাত ছাড়া করতে সে নারাজ। শিক্ষকরা এল, নার্সরা এল, দিমিত্রি এল, এল আরো অনেক পরিচিত জন, কাউন্টেস প্রতিবারই নতুন আনন্দে চিঠি পড়ে শোনাল, আর প্রতিবারই চিঠিতে নিকোলেংকার নতুন নতুন গুণ আবিষ্কার করতে লাগল।
চিঠি পড়তে পড়তে সে বলে ওঠে, লেখার কী ভঙ্গি! বিবরণ কত আকর্ষণীয়! আর কী তার মন! নিজের সম্পর্কে একটা কথাও বলেনি… একটা কথাও না! এক দেনিসভ ও অন্য অনেকের কথা লিখেছে, কিন্তু আমি জোর গলায় বলতে পারি তাদের চাইতে সে অনেক বেশি সাহসী। নিজের দুঃখকষ্টের কথা কিছুই লেখেনি। কী অন্তঃকরণ! এ তো তারই উপযুক্ত! আর কী সুন্দর সকলকেই মনে রেখেছে। কাউকে ভোলনি। তার এতটুকু বয়স থেকে আমি এসেছি–সব সময় বলে এসেছি…
এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি চলল, নিকলাসকে লেখা বাড়ির সকলের চিঠির খসড়া তৈরি করা হল, সেগুলি নকল করা হল, এবং কাউন্টেসের তত্ত্বাবধানে ও কাউন্টের উদারতায় নতুন পদোন্নত অফিসারের ইউনিফর্ম ও অন্যান্য জিনিসের জন্য টাকা তোলা হল। আন্না মিখায়লভনার চেষ্টার স্থির হল, চিঠি ও টাকা গ্র্যান্ড ডিউকের পত্রবাহক মারফৎ পাঠানো হবে বরিসকে, আর বরিস সেগুলি পাঠাবে নিকলাসকে। চিঠি লিখল বুড়ো কাউন্ট, কাউন্টেস, পেতয়া, ভেরা, নাতাশা ও সোনিয়া, আর শেষপর্যন্ত বুড়ো কাউন্ট ছেলেকে পাঠাল পোশাকের জন্য ছহাজার রুবল ও টুকিটাকি নানা জিনিস।
*
অধ্যায়-৭
১২ অক্টোবর তারিখে ওলমুজের সামনে শিবির ফেলে অবস্থানরত কুতুজভের সেনাবাহিনী পরিদর্শনের প্রস্তুতি, নিয়ে ব্যস্ত ছিল, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার দুসম্রাট পরদিন বাহিনী পরিদর্শনে আসবে। রাশিয়া থেকে আগত রক্ষীবাহিনী ওলমুজ থেকে দশ মাইল দূরে রাত কাটিয়ে পরদিন সকাল দশটায় সোজা চলে আসবে ওলমুজ প্রান্তরে।
নিকলাস রস্তভ সেইদিনই বরিসের একটা চিঠি পেল, সে লিখেছে, ইসমালভ রেজিমেন্ট ওলমুজ থেকে দশ মাইল দূরে রাতের মতো ঘাটি পেতেছে, তার ইচ্ছা নিকলাস তার সঙ্গে দেখা করে, কারণ তার চিঠি ও টাকা এসেছে বরিসের কাছে। রশুভেরও তখনো টাকার খুবই দরকার, যুদ্ধক্ষেত্রে কিছুদিন কাটাবার পরে সৈন্যরা এখন ওলমুজে ঘাটি করেছে, অনেক রকম জিনিসপত্র নিয়ে ভাণ্ডারীরা শিবিরে এসে ভিড় জমিয়েছে, অস্ট্রিয় ইহুদিরা এসেছে নানারকম মনোহরী মালপত্র নিয়ে। অভিযানে নানারকম পুরস্কার পাওয়ায় পাভলোগ্রাদরা ভোজসভার পর ভোজসভা দিচ্ছে মাঝে মাঝেই, তারা ওলমুজে গিয়ে ক্যারোলিন নামক জনেক হাঙ্গেরিয়র সম্প্রতি ভোলা রেস্তোরাঁতে ভিড় করছে! মেয়েরাই সেখান খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করে। রস্তভও কর্নেলপদে উন্নীত হওয়া উপলক্ষে একটা ভোজসভার আয়োজন করেছে, দেনিসভের ঘোড়া বেদুইনকে কিনেছে এবং তার ফলে বন্ধুবান্ধব ও ভাণ্ডারীদের কাছে অনেকটা টাকা ধার করে বসেছে। বরিসের চিঠি পেয়েই একজন সহকর্মী অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে সে ওলমুজ-এর পথে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল, সেখানে আহারাদি সেরে, এক বোতল মদ গলায় ঢেলে পুরোনো খেলার সাথীর সঙ্গে দেখা করতে একাকি রক্ষী-শিবিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
বরিস ও বের্গ তখন শিবিরে বসে দাবা খেলছিল।
বরিস বলল, এই নাও, দেখি এবার কেমন করে পার পাও?
চেষ্টা তো করতে হবে, একটা খুঁটিতে হাত রেখে কথাটা বলেই বের্গ হাতটা সরিয়ে নিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরোজাটা খুলে গেল।
রস্তভ চিৎকার করে বলল, শেষপর্যন্ত দেখা পেলাম! আর বের্গও আছে! আরে, ছোট ছেলেরা, শুতে যাও, ঘুমিয়ে পড়? ছোটবেলায় তার রুশ নার্স ফরাসিতে এই কথাগুলি বলত। আর তা শুনে সে ও বরিস হো-হো করে হাসত।
আরে বাস, তুমি কত বদলে গেছ!
বরিস খেলা রেখে রস্তভের দিকে এগিয়ে গেল, নিকলাস এড়িয়ে যেতে চাইলেও বরিস বন্ধুর মতো শান্তভাবে তাকে আলিঙ্গন করল, তিনবার চুমো খেল।
প্রায় ছমাস তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ নেই, যে বয়সে মানুষ জীবনের পথে প্রথম পদক্ষেপ করে সেই বয়সে পৌঁছে দুজনই দুজনের মধ্যে যথেষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করল, যে সমাজে তারা পা রেখেছে তারই প্রভাব পড়েছে তাদের উপর।
নিজের কাদামাখা ব্রিচেস দেখিয়ে রস্তভ বলল, আরে, তোমরা তো ফুলবাবুর দল! এত তাজা যে দেখে মনে হয় কোনো উৎসব থেকে ফিরছে, সম্মুখ সমরে রত আমাদের মতো পাপীদের মতো মোটেই নয়। রস্তভের চড়াগলা শুনে জার্মান বাড়িউলিটি দরজায় মুখ বাড়াল।
আরে, বেশ সুন্দরী, কি বল? চোখ টিপে সে বলল।
বরিস বলল, অত চেঁচাচ্ছ কেন? ওদের ভয় পাইয়ে দেবে যে। তুমি আজই আসবে আশা করিনি। কুতুজভের অ্যাডজুটান্ট বলকনস্কি আমার বন্ধু, তার হাত দিয়ে মাত্র গত কালই তো তোমাকে চিঠিটা পাঠিয়েছি। সে যে এত তাড়াতাড়ি তোমাকে চিঠিটা পৌঁছে দেবে তা ভাবিনি।…তারপর, কেমন আছ? এর মধ্যেই গোলাগুলির মুখে পড়েছ?
কোনো জবাব না দিয়ে ইউনিফর্মের সঙ্গে আটকানো সৈনিকদের সেন্ট জর্জ ক্রুশটা নেড়ে ব্যান্ডেজ-বাঁধা হাতটা দেখিয়ে রস্তভ একটু হেসে বের্গের দিকে তাকাল।
দেখতেই তো পাচ্ছ, মুখে বলল।
বটে? হা! হা! বরিসও হেসে বলল। আর আমরাও একটা চমৎকার যাত্রার ভিতর দিয়ে এসেছি। তুমি নিশ্চয়ই জান, হিজ ইম্পিরিয়াল হাইনেস সারাক্ষণই আমাদের রেজিমেন্টের সঙ্গে অশ্বারোহণে এসেছেন, কাজেই সবরকম আরাম ও সুবিধা আমরা পেয়েছি। পোল্যান্ডে সে কী অভ্যর্থনার ঘটা! কী সব ডিনার ও বল নাচ! তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। আর জারেভিচও আমাদের অফিসারদের উপর খুবই সদয় ছিলেন।
দুই বন্ধুই নিজের নিজের কাজের ফিরিস্তি দিতে লাগল, একজন বলল হুজার জীবনের হৈ-হল্লা ও রণক্ষেত্রের জীবনযাত্রার কথা, আর অপরজন শোনাল রাজপরিবারের সদস্যদের অধীনে চাকরি করার সুখ সুবিধার কথা।
রস্তভ বলল, আরে, রক্ষীবাহিনীর কথাই আলাদা! এখন কিছু মদ আনাও দেখি।
বরিস মুখটা বাঁকাল।
বলল, তুমি যদি সত্যি চাও।
বরিস বিছানার কাছে গিয়ে পরিষ্কার বালিশটার নিচ থেকে টাকার থলি বের করে মদ আনতে পাঠাল।
তারপর বলল, ও হ্যাঁ, তোমাকে দেবার জন্য আমার কাছে কিছু টাকা ও চিঠি আছে।
রস্তভ চিঠিটা নিল, টাকাটা সোফার উপর ছুঁড়ে দিয়ে দুই হাত টেবিলে রেখে পড়তে লাগল। কয়েক লাইন পড়তেই রাগত দৃষ্টিতে বের্গের দিকে তাকাল, তারপর তার চোখে চোখ পড়তেই চিঠির আড়ালে মুখ লুকাল।
ভারি থলেটার দিকে তাকিয়ে বের্গ বলল, আরে, ওরা বেশ মোটা টাকাই পাঠিয়েছে। আমাদের কথা যদি বল কাউন্ট, আমাদের বেতনের টাকাতেই চালাতে হয়। নিজের কথা তোমাকে বলতে পারি…
রস্তভ বলে উঠল, আমি বলছি বের্গ, বাড়ি থেকে যখন তোমার কোনো চিঠি আসে এখন নিজের এমন কোনো লোক আসে যার সঙ্গে তোমার অনেক কথা বলার থাকে, তখন আমি সেখানে হাজির থাকলে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে সরে যাই।…যে কোনো জায়গায় যেখানে খুশি চলে যাও…উচ্ছন্নে যাও! চেঁচিয়ে কথাগুলি বলেই তৎক্ষণাৎ তার ঘাড়ে হাত রেখে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের রুক্ষ স্বরকে নরম করার চেষ্টায় সে বলল, কষ্ট পেয়ো না ভাই, তুমি তো জান পুরোনো বন্ধুর কাছে আমি প্রাণ খুলেই কথা বলি।
ও কথা বল না কাউন্ট! আমি সব জানি, বের্গ বলল।
বরিস তাকে বলল, বাড়ির কর্তাদের কাছে যাও, তারা তোমাকে নেমন্তন্ন করেছে।
বের্গ সবচাইতে পরিষ্কার একটা কোট গায়ে চড়াল, কোটে একটা দাগ নেই, একবিন্দু ধুলো নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সম্রাট আলেক্সান্দারের মতো চুলগুলোকে কপাল থেকে উপরের দিকে ব্রাশ করে নিল, এবং কোটটা যে রস্তভের নজরে পড়েছে তার চাউনি থেকে সেটা বুঝতে পেরে স্মিত হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চিঠি পড়তে পড়তে রস্তভ অস্ফুটে বলল, আহারে, আমি একটা জানোয়ার।
কেন?
আমি একটা শুয়োর, নইলে এতদিনে তাদের একটা চিঠি লিখিনি, তাদের এত ভয় পাইয়ে দিয়েছি। আঃ, আমি একটা শুয়োর! মুখ লাল করে সে আর একবার কথাটা বলল। ভালো, কথা, গেব্রিয়েলকে মদের জন্য পাঠিয়েছ তো? ঠিক আছে, একটু মদ খাওয়া যাক!
বাবা-মার চিঠির সঙ্গে ব্যাগ্রেশনের বরাবর একখানা প্রশংসাপত্র জুড়ে দেওয়া ছিল, আন্না মিখায়লভনার পরামর্শক্রমে কোনো পরিচিত লোক মারফৎ সেটা যোগাড় করে কাউন্টেস ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছে, সে যেন প্রশংসাপত্রখানি যথাস্থানে পৌঁছে দেয় ও তার সদ্ব্যবহার করে।
যত সব বাজে! এ সবের আমার ঘোরাই দরকার! বলে রস্তভ কাগজটা টেবিলের নিচে ফেলে দিল।
ওটা ফেলে দিলে কেন? বরিস জিজ্ঞেস করল।
একখানা প্রশংসাপত্র…ওটা আমার কোন কাজে লাগবে!
চিঠিটা তুলে ঠিকানাটা পড়ে বরিস বলল, ও কথা কেন বলছ? চিঠিটা তোমার অনেক কাজে লাগতে পারে।
আমার কিছুই চাই না, আমি কারো অ্যাডজুটান্টও হব না।
কেন হবে না? বরিস জিজ্ঞেস করল।
ওটা তো খানসামার চাকরি!
মাথা নেড়ে বরিস বলল, তুমি দেখছি সেই একই স্বপ্নদর্শীই রয়ে গেছ।
আর তুমি সেই একই কূটনীতিবিদ। কিন্তু সেটা কথা নয়।…তারপর, বল কেমন আছ? রস্তভ জিজ্ঞেস করল।
তা যেমন দেখছ। এখনো পর্যন্ত সবই ঠিক আছে, কিন্তু আমি স্বীকার করছি, আমি অ্যাডজুটান্ট হতেই চাই, রণক্ষেত্রে থাকতে চাই না।
কেন?
কারণ একবার যদি কেউ সামরিক চাকরিতে ঢোকে তাহলে জীবনে যথাসম্ভব সাফল্যলাভের চেষ্টা করাই তার পক্ষে উচিত।
ওঃ, এই কথা! রস্তভ বলল, তার মনে তখন অন্য চিন্তা। বুড়ো গ্রেবিয়েল মদ নিয়ে এল।
বরিস জিজ্ঞেস করল, এখন কি বের্গকে ডেকে পাঠাতে পারি? সে তোমার সঙ্গে মদ খেতে পারবে। আমি খাই না।
বেশ, ডেকে পাঠাও।…তারপর এই জার্মানটির সঙ্গে কেমন চলছে? তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রস্তভ বলল।
সে খুব, খুব ভালো, সৎ ও মনের মতো লোক, বরিস জবাব দিল।
রস্তভ আর একবার একদৃষ্টিতে বরিসের চোখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
বের্গ ফিরে এলে এক বোতল মদ নিয়ে বসে তিন অফিসারের মধ্যে প্রাণবন্ত আলোচনা শুরু হল। রক্ষীবাহিনীর দুই অফিসার শোনাল তাদের অভিযানের কথা, রাশিয়া, পোল্যান্ড ও অন্যত্র তাদের প্রশংসার কথা। তাদের সেনাপতি এ্যান্ড ডিউকের নানা উক্তি ও কাজের ফিরিস্তি দিল, তার দয়া-দাক্ষিণ্য ও খিটখিটে মেজাজের নানা গল্প বলল। তারপর এল রশুভের পালা। কথা বলতে বলতে সেও ক্রমেই উৎসাহিত হয়ে উঠল। স্তভ সত্যবাদী যুবক, সে কখনো ইচ্ছা করে মিথ্যা বলে না। সেইভাবে প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা দিয়েই সে তার কাহিনী শুরু করল, কিন্তু নিজের অজ্ঞাতেই আপনা থেকে কখন যে মিথ্যা এসে তার কথার মধ্যে জুড়ে বসল তা সে বুঝতেই পারল না। আসলে সে যদি আগাগোড়া সত্য কথাই বলে যেত তাহলে হয় শ্রোতারা তাকে বিশ্বাস করত না, আর না হয়তো এ ধরনের খেলো বিবরণের জন্য রস্তভকেই দোষী সাব্যস্ত করত।
যাই হোক, তার গল্পের মাঝখানেই প্রিন্স আন্দ্রু ঘরে ঢুকল, বরিস তাকে আশাও করছিল। প্রিন্স আলু যুবকদের সাহায্য করতে ভালোবাসে, বরিস যেচে তার সহায়তা প্রার্থনা করায় সে খুব খুশি হয়েই এখানে এসেছে। জারেভিচের জন্য কিছু কাগজপত্র দিয়ে কুতুজভ তাকে পাঠিয়েছে। সে আশা করেছিল বরিসকে একলা পাবে। কিন্তু এখানে এসে যখন দেখল যুদ্ধক্ষেত্রের জনৈক হুজার তার সামরিক কার্যকলাপের বিবরণ শোনাচ্ছে (এ ধরনের মানুষকে প্রিন্স আন্দ্রু সহ্য করতে পারে না), তখন স্মিত হাসির সঙ্গে বরিসের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে আধ-বোজা চোখে তাকাল রশুভের দিকে, ক্লান্তভাবে মাথাটা ঈষৎ নোয়াল, তারপর আলস্যবশত সোফায় গিয়ে বসল। এ ধরনের বাজে দলের মধ্যে এসে পড়ায় তার মেজাজ বিগড়ে গেল। সেটা লক্ষ্য করে রস্তভ উত্তেজিত হল, কিন্তু তাকে আমল দিল না, লোকটি নেহাই অপরিচিত। বরিসের দিকে তাকিয়ে দেখল, যুদ্ধক্ষেত্রের একজন হুজারকে নিয়ে সেও যেন লজ্জায় পড়েছে।
বরিস পরিচিত সকলের খবর জানতে চাইল এবং সুবিবেচকের মতো যুদ্ধের কথা যতটা জানতে চাওয়া উচিত সে সম্পর্কে কিছু প্রশ্নও করল।
হয়তো আমরা আরো এগিয়ে যাব, একজন অপরিচিত লোকের সামনে এর চাইতে বেশি কিছু বলতে বলকনস্কি স্বভাবতই অনিচ্ছুক।
এই সুযোগে একান্ত বিনয়ের সঙ্গে বের্গ জানতে চাইল, অফিসারদের ঘোড়ার খাদ্য বাবদ ভাতা দ্বিগুণ হবে বলে যে গুজব রটেছে সেটা সত্য কি না। তাতে প্রিন্স আন্দ্রু হেসে জানাল, এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নির্দেশ সম্পর্কে কোনো মতামত সে দিতে পারে না। তা শুনে বের্গ খুশিতে হেসে উঠল।
বরিসকে উদ্দেশ্য করে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, আপনার কাজের ব্যাপারে আমরা পরে কথা বলব (মুখ ঘুরিয়ে সে রস্তভের দিকে তাকাল)। পরে আমার সঙ্গে দেখা করবেন, যা সম্ভব তা আমি অবশ্যই করব।
ঘরের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু রশুভের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, মনে হল আপনি শান গ্রেবার্নের কথা বলছিলেন? আপনি কি সেখানে ছিলেন?
যেন এড-ডি-কংকে অপমান করবার জন্যই রস্তভ রাগের সঙ্গে বলল, আমি সেখানে ছিলাম।
হুজারটির মনের অবস্থা লক্ষ্য করে বলকনস্কির মজা লাগল। ঈষৎ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, হ্যাঁ, সেখানকার ব্যাপার নিয়ে এখন অনেক গল্পই বলা হচ্ছে!
হ্যাঁ, অনেক গল্প, জোর গলায় রস্তভ কথাটার পুনরাবৃত্তি করল। তার চোখ দুটো হঠাৎ জ্বলে উঠল, সে একবার বরিসের দিকে একবার বলকনস্কির দিকে তাকাল। হ্যাঁ, অনেক গল্প। কিন্তু আমাদের গল্প সেই সব মানুষের গল্প যারা শত্রুপক্ষের গোলাগুলির সামনে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের গল্পগুলি ওজনে ভারি, যেসব কর্মচারী কিছু না করেই পুরস্কার পায় তাদের গল্পের মতো নয়!
শান্ত, উদার হাসি হেসে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, যাদের দলের আমি একজন বলে আপনি মনে করেন?
সেই মুহূর্তে একটা অদ্ভুত ক্রোধ এবং এই লোকটির আত্মসংযমের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব মিলে-মিশে রশুভের মনে একাকার হয়ে গেল।
সে বলল, আপনার কথা আমি বলছি না। আপনাকে আমি চিনি না, আর সত্যি কথা বলতে কি, চিনতে চাইও না। আমি সাধারণভাবে বেসামরিক কর্মচারীদের কথাই বলছি।
তাকে বাধা দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু শান্ত কর্তৃত্বের সুরে বলল, আর আমি আপনাকে বলতে চাই, আপনি আমাকে অপমান করতে চাইছেন, আর এবিষয়ে আপনার সঙ্গেই একমত হতে আমি রাজি যে আপনার যথেষ্ট আত্মমর্যাদাবোধ না থাকলে সে কাজটা করা খুবই সহজ হতো, কিন্তু এটা জেনে রাখুন যে আপনি স্থান ও কালটা বড়ই খারাপ বেছে নিয়েছেন। দুই একদিনের মধ্যেই আমাদের আরো অনেক বড় ও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটা লড়াইতে অংশ নিতে হবে, তাছাড়া, দুর্ভাগ্যবশত আমার মুখটা দেখেই যে আপনি অখুশি হয়েছেন সেজন্য আপনার পুরনো বন্ধু বেস্কয় মোটেই দোষী নয়। যাইহোক, সে উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলতে লাগল, আমার নাম আপনি জানেন, আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে তাও জানেন, কিন্তু একটা কথা ভুলে যাবেন না যে আমাকে বা আপনাকে এতটুকু অপমান করা হয়েছে বলে আমি মনে করি না, আর আপনার চাইতে বয়সে বড় বলেই আমার পরামর্শ শুনুন, এ ব্যাপারটার উপর এখানেই ইতি টেনে দিন। আচ্ছা, তাহলে শুক্রবার পরিদর্শনের পরে আমি আপনাকে আশা করব বেস্কয়। অ রিভোয়া! সোচ্চারে কথাটা বলে দুজনকেই অভিবাদন জানিয়ে সে বেরিয়ে গেল।
প্রিন্স আন্দ্রু চলে যাবার পরে রস্তভ বুঝতে পারল তার কি কথা বলা উচিত ছিল। আর সেকথা বলতে না পারায় এখনো তার রাগ গেল না। তক্ষুনি ঘোড়া আনবার হুকুম দিয়ে কোনোরকমে বরিসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। সে কি পরের দিন হেডকোয়ার্টারে গিয়ে এই দাম্ভিক অ্যাডজুটান্টের মোকাবিলা করবে, নাকি এখানেই ব্যাপারটাকে শেষ হতে দেবে, সারাটা পথ এই প্রশ্নই তাকে বিব্রত করে তুলল। রাগের মাথায় একবার মনে হল, তার পিস্তলের পাল্লার মধ্যে পড়ে এই ছোটখাট ভঙ্গুর লোকটির ভীত অবস্থা দেখলে সে কত না খুশি হবে, কিন্তু পরক্ষণেই সে সবিস্ময়ে অনুভব করল, সে অ্যাডজুটান্টটিকে সে এত ঘৃণা করে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে তার যত সাধ, পরিচিত লোকজনদের অন্য কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার ততখানি সাধ তার মনে নেই।
*
অধ্যায়-৮
রস্তভ যেদিন বরিসের সঙ্গে দেখা করতে যায় তার পরদিনই অস্ট্রিয় এবং রুশ সৈন্যদের একটি অভিপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল। যেসব সৈন্য রাশিয়া থেকে নতুন এসেছে এবং যারা কুতুজভের অধীনে অনেকদিন থেকে অভিযান চালিয়েছে–এই দুদলই সে অনুষ্ঠানে ছিল। রুশ সম্রাট তার উত্তরাধিকারী জারেভিচকে সঙ্গে নিয়ে এবং অস্ট্রিয় সম্রাট আর্চডিউককে সঙ্গে নিয়ে মিত্রপক্ষের আশি হাজার সৈন্যের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করে।
খুব সকাল থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চটপটে সৈনিকদের চলাফেরা শুরু হয়ে যায়, দুর্গের সম্মুখস্থ মাঠে তারা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ে। বেলা দশটা নাগাদ সব ব্যবস্থা সুসম্পন্ন হয়ে যায়। প্রকাণ্ড মাঠে সৈন্যরা সমবেত হয়েছে। গোটা বাহিনীতে তিনটি সারিতে সাজানো হয়েছে : সকলের আগে অশ্বারোহী বাহিনী, তার পিছনে গোলন্দাজ বাহিনী এবং তারও পরে পদাতিক বাহিনী।
প্রতি দুই সারি সৈন্যের মাঝখানে রাস্তার মতো চওড়া একটা জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনীর তিনটি অংশকে পরিষ্কার আলাদাভাবে চেনা যাচ্ছে : কুতুজভের যুদ্ধরত সেনাদল (পাভলোগ্রাদরা রয়েছে সামনের সারির ডান দিকে), রক্ষীবাহিনী ও সেনাবারিকের রেজিমেন্টসহ যেসব সৈন্য সম্প্রতি রাশিয়া থেকে এসেছে তারা এবং
অস্ট্রিয় সেনাদল। কিন্তু সকলেই দাঁড়িয়েছে একই সারিতে, একই সেনাপতির অধীনে এবং একই পর্যায়ক্রমে।
গাছের পাতার উপর বাতাসের মতো একটা উত্তেজিত গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল : তারা আসছেন। তারা আসছেন! শোনা গেল অনেক আতংকিত কণ্ঠস্বর, গোটা বাহিনী চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে দুলে উঠল।
তাদের সম্মুখে ওলমুজের দিক থেকে একটা দলকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা দমকা হাওয়া সেনাবাহিনীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় তাদের বর্শার ফলাগুলি ঝিলমিল করে উঠল, খোলা পতাকাগুলি দণ্ডের গায়ে লেগে পৎ পৎ করতে লাগল। মনে হল যেন গোটা বাহিনীটি নড়েচড়ে দুই সম্রাটের আগমনে আনন্দ প্রকাশ করছে। শোনা গেল একটি উচ্চ কণ্ঠস্বর : সামনে তাকাও! তারপর সূর্যোদয়ের কালে মোরগের ডাকের মতো নানাদিক থেকে সেই একই কথার প্রতিধ্বনি করা হল। আবার সব চুপচাপ।
সেই মৃত্যু-স্তব্ধতার মধ্যে শোনা যেতে লাগল শুধু অশ্বক্ষুরের ধ্বনি। সম্রাটদ্বয়ের দল এগিয়ে আসছে। দুই সম্রাট অশ্বারোহণে এগিয়ে এল, প্রথম অশ্বারোহী রেজিমেন্টের ভেরি বেজে উঠল। মনে হল, এ যেন ভেরির বাদ্য সে নয়, সম্রাটদ্বয়ের আগমনে উৎফুল্ল গোট-বাহিনীই বুঝি সঙ্গীতে মেতে উঠেছে। তারই মধ্যে শোনা গেল সম্রাট আলেক্সন্দারের যৌবনদীপ্ত কণ্ঠস্বর। সকলকে সে জানাল সাদর সম্ভাষণ, আর প্রথম রেজিমেন্ট গর্জে উঠল হুররা! সে গর্জন কানে তালা লাগিয়ে একটানা চলতে লাগল, আর তা শুনে বুঝি সৈনিকরাও ভয় পেয়ে গেল।
রস্তভ দাঁড়িয়েছিল কুতুজভের বাহিনীর সামনের সারিতে। জার সেই দিকেই প্রথম এগিয়ে এল। সেনাদলের অন্য প্রতিটি লোকের মতোই একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল রস্তভের : আত্মবিস্মৃতির অনুভূতি, শক্তির গর্বিত চেতনা, আর এই জয়-গৌরবের মূলাধার মানুষটির প্রতি সানুরাগ আকর্ষণ।
তার মনে হল, এই লোকটির একটিমাত্র কথায় এই বিরাট জনতা ছুটে যাবে আগুন ও জলের পথে, অপরাধ করবে, মরবে, না হয় চরম বীরত্ব প্রদর্শন করবে। তাই তার শরীর কেঁপে উঠল, সেই কথাটি শুনবার প্রত্যাশায় তার অন্তর স্তব্ধ হয়ে রইল।
চারদিক থেকে ব্রজের গর্জন উঠল হুররা! হুররা! হুররা! রেজিমেন্টের পর রেজিমেন্ট সম্রাটকে সম্ভাষণ জানিয়ে বলতে লাগল হুররা। আবার এগিয়ে চলল সকরে, আবার হুররা! হুররা! সে শব্দ ক্রমাগতই আরো জোরদার, আরো পরিপূর্ণ, আরো কান-ফাটানো।
অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনীর ইউনিফর্ম পরিহিত টুপি মাথায় সুদর্শন যুবক সম্রাট আলেক্সান্দার সকলেরই আকর্ষণ করল।
রস্তভ ছিল ভেরিবাদকদের কাছাকাছি। জারকে চিনতে পেরে সে তার আগমনের উপর নজর রাখল। জার যখন তার থেকে বিশ পায়ের মধ্যে এসে গেল তখন নিকলাস তার সুদর্শন, খুশিভরা মুখের প্রতিটি রেখা পরিষ্কার দেখতে পেল, সঙ্গে সঙ্গে এক অজ্ঞাতপূর্ব মমতায় ও উম্মসে তার মন ভরে গেল। জারের প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি চলন তাকে মুগ্ধ করল।
পাভলোগ্রাদদের সামনে থেমে জার ফরাসিতে অস্ট্রিয় সম্রাটকে একটা কিছু বলে ঈষৎ হাসল।
সে হাসি দেখে রস্তভও আপনা থেকেই হেসে ফেলল, সম্রাটের জন্য একটা প্রবল ভালোবাসার স্রোত বয়ে গেল তার অন্তরে। তার ইচ্ছা হল, সে ভালোবাসকে বাইরে প্রকাশ করে। কিন্তু সেটা একেবারেই অসম্ভব জেনে তার কাঁদতে ইচ্ছা করল। রেজিমেন্টের কর্নেলকে ডেকে জার তার সঙ্গে কিছু কথা বলল।
রস্তভ ভাবল, হা ঈশ্বর, সম্রাট আমার সঙ্গে কথা বললে না জানি কি হতো! আমি বুঝি সুখে মরেই যেতাম!
অফিসারদের উদ্দেশ্যে জার বলল : ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের সকলকেই আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি, সমস্ত অন্তর দিয়ে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।রস্তভের মনে হল, প্রতিটি কথা যেন স্বর্গ থেকে ভেসে এল। এই মুহূর্তে জারের জন্য সে সানন্দে মরতেও প্রস্তুত!
আপনারা সেন্ট জর্জের পতাকা লাভ করেছেন, আশা করি তার উপযুক্ত হবেন।
আহা, তার জন্য মরণেও সুখ! রস্তভ ভাবল।
জার আরো কি যেন বলল, সেটা রস্তভ শুনতে পেল না, সৈন্যরা চিৎকার করে উঠল হুররা!
জিনের উপর উপুড় হয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে রস্তভও চিৎকার করে বলল হুররা!
জার কয়েক মিনিট হুজারদের সামনে দাঁড়াল, যেন কি করবে বুঝতে পারছে না।
রস্তভ ভাবল, সম্রাট কি করে ইতস্তত করতে পারেন?
সে ইতস্ততভাব মাত্র মুহূর্তের জন্য। উঁচলো-মুখ বুট পরিহিত জারের পা তার ঘোড়র পেটে খোঁচা মারল, তার শাদা দস্তানা-ঢাকা হাতে তুলে নিল রাশ, আর এড-ডি-কং বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে জার ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। অন্যসব রেজিমেন্টের সামনে থামতে থামতে সে দূর থেকে দূরে চলে গেল, শেষপর্যন্ত রস্তভের চোখের সামনে ভাসতে লাগল শুধু তার টুপির শাদা পালকগুলো।
সে দলে রস্তভ দেখতে পেল বলকনস্কিকেও। গতকালের ঝগড়ার কথাটা রস্তভের মনে পড়ে গেল, বলকনস্কিকে দ্বৈতযুদ্ধে আহ্বান করা উচিত কি না সে প্রশ্নও মনে জাগল। এখন ভাবল, নিশ্চয়ই না। এই কি এ কথা ভাবার বা বলার উপযুক্ত সময়? এমন ভালোবাসা, এমন উন্মাদনা, এমন আত্মত্যাগের মধ্যে আমাদের ঝগড়া-বিবাদের কি দাম আছে। এখন আমি সকলকেই ভালোবেসেছি, ক্ষমা করেছি।
সম্রাট যখন প্রায় সবগুলি রেজিমেন্টকে পার হয়ে গেল তখন সৈন্যরা তার সামনে শুরু করল আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ। বেদুইনের পিঠে চেপে রস্তভও তাতে যোগ দিল।
সম্রাট বলল, পাভলোগ্রাদগণ! আপনারা খুব ভালো!
হা ঈশ্বর, এই মুহূর্তে তিনি যদি আমাকে আগুনে ঝাঁপ দিতে বলতেন তাহলে আমি ক সুখী হতাম! রস্তভ ভাবল।
কুচকাওয়াজ শেষ হবার পরে নবাগত অফিসার ও কুতুজভের অফিসাররা দলে দলে ভাগ হয়ে নানা পুরস্কারের কথা, অস্ট্রিয় সেনাদল ও তাদের ইউনিফর্মের কথা, বোনাপার্তের কথা, এখন যদি এসেন বাহিনী এসে পড়ে আর প্রাশিয়া আমাদের পক্ষে যোগ দেয় তাহলে বোনাপার্তের অবস্থা যে কাহিল হয়ে পড়বে–এইসব নানা কথা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল।
কিন্তু প্রতিটি দলের আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল সম্রাট আলেক্সান্দার। একান্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি চলনের বিবরণ চলতে লাগল। সকলের মুখে মুখে।
সকলেরই মনে একটিমাত্র বাসনা : সম্রাটের আদেশ যত শীঘ্র সম্ভব শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। সম্রাট স্বয়ং নেতৃত্ব দিলে তারা কাউকে পরাজিত করতে পশ্চাৎপদ হবে না, তা সে যেই হোক না কেন : এই কথাই ভাবতে লাগল রস্তভ, ভাবতে লাগল অধিকাংশ অফিসার।
দুটো যুদ্ধে জয়লাভ করলেও যতটা না হত এখন তারা যুদ্ধজয় সম্পর্কে তার চাইতে নিশ্চিত বোধ করছে।
*
অধ্যায়-৯
কুচকাওয়াজের পরদিন সেরা ইউনিফর্মটি গায়ে চাপিয়ে বন্ধু বের্গের শুভেচ্ছা নিয়ে ঘোড়ায় চেপে বরিস গেল ওলমুজে বলকনস্কির সঙ্গে দেখা করতে। ইচ্ছা, তার বন্ধুত্বকে কাজে লাগিয়ে একটা চাকরি বাগিয়ে নেবে–কোনো বিখ্যাত লোকের অ্যাডজুটান্ট হতে পারলেই ভালো হয়, কারণ সেনাবাহিনীতে ঐ চাকরিটাই তার বেশি পছন্দ। রশুভের বাবা একসময় দশ হাজার রুল পাঠাতে পারে, তাই তার পক্ষে কারো খানসামা না হওয়ার কথা বলা শোভা পায়, কিন্তু আমার তো মাথার ঘিলু ছাড়া আর কিছু নেই, আমাকে তো জীবনে উন্নতি করতেই হবে, কাজেই আমি কোনো সুযোগই হারাতে পারি না, সুযোগের সদ্ব্যবহার আমাকে করতেই হবে!
সেদিন সে ওলমুজে প্রিন্স আন্দ্রুর দেখা পেল না, কিন্তু যে শহরে তাদের প্রধান ঘাঁটি ও কূটনৈতিক দপ্তর অবস্থিত, দুই সম্রাট যেখানে সদলে বাস করছে, রয়েছে নানা বাড়িঘর ও আদালত, সেখানকার চেহারা দেখে সেই জগতের বাসিন্দা হবার বাসনা তার মনে প্রবলতর হল।
কাউকে সে চেনে না, তার রক্ষীবাহিনীর শোভন ইউনিফর্ম সত্ত্বেও রাজকীয় সভাসদ ও সামরিক কর্মচারীসহ যেসব পদস্থ ব্যক্তি পালক, ফিতে ও পদকে সজ্জিত হয়ে সুন্দর সুন্দর গাড়িতে চেপে পথ দিয়ে চলেছে, তারা সকলেই তার মতো একজন তুচ্ছ অফিসারের তুলনায় এত বেশি উঁচু মহলের লোক যে তারা যে তাকে দেখে শুভকামনাও জানাল না তাই নয়, তার অস্তিত্বকেই বুঝি স্বীকার করল না। প্রধান সেনাপতি কুতুজভের আপিসে বলকনস্কির খোঁজ করতে গেলে সেখানকার অ্যাডজুটান্টরা, এমন কি আর্দালিরা পর্যন্ত, এমনভাবে তার দিকে তাকাতে লাগল যেন তারা বলতে চাইছে, আরে বাপু, তোমার মতো কত অফিসার এখানে হামেশাই আসা-যাওয়া করছে, তাদের নিয়ে আমাদের এতটুকু মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এসব সত্ত্বেও, অথবা হয়তো এই কারণেই, পরদিন ১৫ নভেম্বর ডিনারের পরেই সে আবার ওলমুজে গেল এবং যে বাড়িটা কুতুজভ দখল করেছিল সেখানে পৌঁছে বলকনস্কির খোঁজ করল। প্রিন্স আন্দ্রু ভিতরেই ছিল, বরিসকে একটা বড় হলে নিয়ে যাওয়া হল। হলটা আগে বোধহয় নাচের জন্য ব্যবহার করা হতো, কিন্তু এখন সেখানে পাঁচটা বিচানা পাতা রয়েছে, আর আছে রকমারি আসবাব : একটা টেবিল, চেয়ার ও একটা ক্ল্যাভিকর্ড। একজন অ্যাডজুটান্ট পারসিক ড্রেসিং-গাউন পরে দরজার কাছে বসে লিখছে। আর একজন লাল নেসভিৎস্কি হাতের উপর মাথা রেখে বিছানায় শুয়ে পাশে বসা জনৈক অফিসারের সঙ্গে হাসাহাসি করছে। তৃতীয়জন ক্লাভিকর্ডে ভিয়েনিজ ওয়ালজ বাজাচ্ছে, আর চতুর্থজন ক্ল্যাভিকর্ডের উপর শুয়ে গান গাইছে। বলকনস্কি সেখানে ছিল না। বরিসকে দেখে ভদ্রলোকরা কেউই নড়েচড়ে বসল না। যে লিখছিল সে বরিসের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়ে দিল, বলকনস্কি এখন কাজে ব্যস্ত আছে, তার সঙ্গে দেখা করতে হলে দরজা পেরিয়ে অভ্যর্থনা-ঘরে যেতে হবে। অভ্যর্থনা-ঘরে গিয়ে বরিস জনাদশেক অফিসার ও অধিনায়ককে দেখতে পেল।
প্রিন্স আন্দ্রু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চোখ নামিয়ে পদকসজ্জিত একজন বুড়ো রুশ সেনাপতির কথা শুনছিল। প্রায় আঙুলের উপর খাড়া দাঁড়িয়ে বুড়ো সেনাপতিটি রক্তিম মুখে একজন সাধারণ সৈনিকের তোষামোদী ভঙ্গি ফুটিয়ে কি যেন বলছে।
কথায় তাচ্ছিল্য প্রকাশ করতে হলেই প্রিন্স আন্দ্রু ফরাসি উচ্চারণে কথা বলে, এখনো সেইভাবেই বলল, খুব ভালো কথা, তাহলে অপেক্ষাই করুন, আর তখনই বরিসকে দেখতে পেয়ে সে মাথা নেড়ে স্মিত হাসির সঙ্গে তার দিকে এগিয়ে গেল। বুড়ো রুশ সেনাপতিটি তবু আরো কিছু কথা শোনাবার জন্য মিনতি জানাতে জানাতে তার পিছনে চলতে লাগল।
প্রিন্স আন্দ্রু বরিসকে বলল, কাল তোমার সঙ্গে দেখা না হওয়ায় আমি খুবই দুঃখিত। সারাদিন জার্মানদের সঙ্গে হৈচৈ করেই কেটেছে। যাই হোক, তুমি কি এখনো অ্যাডজুটান্ট হতে চাও? তোমার কথাই ভাবছিলাম।
হ্যাঁ, প্রধান সেনাপতির কাছে কথাটা তুলব বলে ভাবছিলাম। আমার ব্যাপারে তিনি প্রিন্স কুরাগিনের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছেন।
প্রিন্স আন্দ্রু বলল, বেশ তো, বেশ তো। পরে এ নিয়ে কথা হবে। আগে এই ভদ্রলোকের কাজের কথাটা শুনে আসি, তারপর তোমার সঙ্গে কথা বলব। লাল-মুখ ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা শেষ করে দুজনে বড় হল ঘরটাতে গেলে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, দেখ ভাই, তোমার কথা আমি ভেবেছি। তোমার প্রধান সেনাপতির কাছে যাবার কোনো দরকার নেই। তিনি অনেক ভালো ভালো কথা বলবেন, তোমাকে ডিনারে নেমন্তন্ন করবেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। শীঘ্রই আমাদের মতো এড-ডি-কং ও অ্যাডজুটান্টদের নিয়ে একটা সেনাদল গড়ে তোলা হবে। কিন্তু আমরা যা করব তা হল : আমার একটি ভালো বন্ধু আছে–অ্যাডজুটান্ট-জেনারেল প্রিন্স দলগরুক, আর তুমি না জানলেও আসল সত্য হল, এখন সপারিষদ কুতুজভ ও আমাদের কোনো প্রভাবই নেই। সবকিছুই হচ্ছে সম্রাটকে কেন্দ্র করে। কাজেই আমরা দলগরুকভের কাছেই যাব, এমনিতেই তার কাছে আমাকে যেতে হতো, আর তোমার কথা তাকে বলেও রেখেছি। দেখা যাক সে তোমাকে তার দলে নিয়ে নিতে পারে কি না, অথবা সূর্যের কাছাকাছি কোনো স্থানে তোমাকে বসাতে পারে কি না।
কোনো যুবককে জাগতিক সাফল্য লাভের ব্যাপারে সাহায্য করতে প্রিন্স সর্বদাই প্রস্তুত। অহংকারবশত যে কাজ সে নিজের জন্য করতে কখনো রাজি নয়, অপরের জন্য সেই জাগতিক সাফল্য লাভের চেষ্টা করতে গিয়ে সে উপর মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে, কারণ সেইসব মহলের লোকজন তাকেও আকর্ষণ করে। সে খুব সহজেই বরিসের দায়টা মাথায় নিল এবং তাকে নিয়ে দলগরুকভের কাছে গেল।
ওলমুজের যে প্রাসাদে দুই সম্রাট ও তার দলবল বাস করছিল সেখানে তারা যখন ঢুকল তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। সেইদিনই সমর-পরিষদের একটা বৈঠক হয়ে গেছে, হফক্রিগসরাথের সমস্ত সদস্য এবং দুই সম্রাট তাতে অংশগ্রহণ করেছে। সেই বৈঠকে বৃদ্ধ সেনাপতি কুতুজভ ও প্রিন্স শোয়ার্তজেনবের্গের আপত্তি সত্ত্বেও স্থির হয়েছে যে অবিলম্বে অগ্রসর হয়ে বোনাপার্টের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে হবে। সমর-পরিষদের বৈঠক সবে শেষ হয়েছে এমন সময় দলগরুকভের সঙ্গে দেখা করতে প্রিন্স আন্দ্রু বরিসকে সঙ্গে নিয়ে প্রাসাদে ঢুকল। বৈঠকের প্রভাবে তখনো সকলেই আচ্ছন্ন, সেখানে তরুণদের দলই জয়লাভ করেছে। যারা বিলম্ব করার পরামর্শ দিয়েছিল, যারা বলেছিল এখনই অগ্রসর না হয়ে অন্যকিছুর জন্য অপেক্ষা করা হোক, তাদের এমনভাবে সম্পূর্ণ চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের সব যুক্তিকে এমন অকাট্যভাবে খণ্ডন করা হয়েছে যে আসন্ন যুদ্ধ এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে জয়লাব করাটাকে এখন আর কেউ ভবিষ্যতের ব্যাপার বলে মনে করছে না–সেটা যেন অতীতের ঘটনা। সব রকম সুবিদাই তো আমাদের পক্ষে। নেপোলিয়নের সৈন্যদের তুলনায় নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতর আমাদের সৈন্যরা সংখ্যায় প্রচুর, তারা সকলে এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে, আর ম্রাটের উপস্থিতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা যুদ্ধ শুরু করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। যেখানে যুদ্ধটা। হবে তার সমরকৌশলগত অবস্থানের প্রতিটি বিবরণ অস্ট্রিয় সেনাপড়ি ওয়েরদারের পরিচিত : সৌভাগ্যক্রমে ..
যে প্রান্তরে এবার ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধ হবে ঠিক সেখানেই আগের বছর অস্ট্রিয় বাহিনীকে পরিচালিত করা হয়েছিল, কাছাকাছি এলাকাগুলিও পরিচিত এবং মানচিত্রে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখানো হয়েছে। ওদিকে বোনাপার্ত এখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল, আর নতুন কোনো উদ্যোগও সে নিচ্ছে না।
আক্রমণ-প্রস্তাবের অন্যতম প্রধান সমর্থক দলগরুকভ সবেমাত্র পরিষদের বৈঠক থেকে ফিরেছে, শ্রান্ত, ক্লান্ত হলেও জয়ের আনন্দে তার গর্বের অন্ত নেই। প্রিন্স আন্দ্রু তার সঙ্গে বরিসের পরিচয় করিয়ে দিল, কিন্তু প্রিন্স দলগরুকভ তাকে কিছুই বলল না, শুধু বিনীত অথচ দৃঢ়ভাব প্রিন্স আর হাতটা চেপে ধরে নিজের মনের কথাটা চেপে না রাখতে পেরে ফরাসিতে বলল :
আহা, কী যুদ্ধই না আমরা জয় করেছি! ঈশ্বর করুন, এর ফলে সত্যিকারের যে যুদ্ধ হবে তাতেও যেন আমরা বিজয়ী হতে পারি! আজকের মতো আমাদের অনুকূল পরিস্থিতি কোনোদিন হবে না। অস্ট্রিয়দের সূক্ষ্ম ও সঠিক জ্ঞানের সঙ্গে রুশদের সাহসের সমন্বয়ের বেশি আর কি চাওয়া যায়?
তাহলে আক্রমণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত? বলকনস্কি জিজ্ঞেস করল।
আপনি জানেন কি না জানি না, কিন্তু আমার তো মনে হয় বোনাপার্তের সাহসে ভাটা পড়েছে, সম্রাটের কাছে লেখা তার একটা চিঠিও আজ পাওয়া গেছে, অর্থপূর্ণ হাসি হেসে দলগরুকভ বলল।
তাই নাকি? তিনি কি লিখেছেন? বলকনস্কি জানতে চাইল।
কি আর লিখবেন? ব্রা-দি-রি-দি-রা আর কি…কোনোরকমে সময় কাটানো। কিন্তু সবচাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের চিঠিতে পাঠ কি লেখা হবে সেটাই আমরা বুঝতে পারছি না! যদি কন্সল না লেখা হয়, সম্রাট তো মোটেই না, আমার মনে হয় সেনাপতি বোনাপার্ত, হওয়াই উচিত।
কিন্তু তাকে সম্রাট বলে স্বীকার না করে সেনাপতি বোনাপার্ত বলা–এ দুইয়ের মধ্যে তো তফাৎ আছে।
দলগরুকভ হেসে উঠে তাড়াতাড়ি বলল, ঠিক কথা! আপনি তো বিলিবিনকে চেনেন–ভারী চতুর মানুষ। সে প্রস্তাব করেছে পাঠ লেখা হোক রাজ্যহারক ও মানবতার শত্রু।
দলগরুকভ নিজের খুশিতেই হেসে উঠল।
শুধুই এই? বলকনস্কি বলল।
যাই হোক, বিলিবিনই একটা উপযুক্ত পাঠ খুঁজে বের করেছে। সে যেমন জ্ঞানী তেমনই চতুর।
সেটা কী?
ফরাসি সরকারের প্রধান সমীপেষু… Au chif du governement francais. গভীর আত্মতুষ্টির সঙ্গে দলগরুকভ বলল। ভালো, তাই না?
বলকনস্কি বলল, হ্যাঁ, কিন্তু তিনি তো এটা খুবই অপছন্দ করবেন?
হ্যাঁ, কিন্তু তিনি তো এটা খুবই অপছন্দ করবেন? বলকনস্কি বলল।
তা তো বটেই, খুবই অপছন্দ হবে! আমার দাদা তাকে চেনে, সে তো বর্তমান সম্রাটের সঙ্গে খানাও খেয়েছে, দাদাই আমাকে বলেছে, তার মতো ধূর্ত ও সূক্ষ্মবুদ্ধি কূটনীতিক সে আর দেখেনি–জানেন তো, লোকটি ফরাসি নিপুণতা ও ইতালিয় অভিনয়-দক্ষতার এক অপূর্ব সমন্বয়! তার ও কাউন্ট মার্কভের গল্পটা জানেন তো? কাউন্ট মার্কভই একমাত্র তোক যে তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে পারত! রুমালের গল্পটা জানেন তো? ভারি মজার!
একবার বরিসের দিকে একবার প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে ফিরে ফিরে বাঁচাল দলগরুকভ বলতে লাগল, আমাদের রাষ্ট্রদূত মার্কভকে পরীক্ষা করবার জন্য বোনাপার্ত ইচ্ছা করে তার সামনে নিজের রুমালটা ফেলে দিয়ে মার্কভের দিকে তাকাল, হয়তো সে আশা করেছিল যে মার্কভ তার রুমালটা তুলে দেবে, কিন্তু মার্কভ সঙ্গে সঙ্গে নিজের রুমালটাকে তার রুমালের পাশে ফেলে দিয়ে নিজেরটা তুলে নিল, কিন্তু বোনাপার্তের রুমালটা স্পর্শও করল না।
বলকনস্কি বলল, খুব মজার গল্প! কিন্তু প্রিন্স, আমি আপনার কাছে এসেছি এই যুবকের হয়ে একটা আবেদন নিয়ে। দেখুন… প্রিন্স আন্দ্রু কথা শেষ করার আগেই সম্রাটের কাছ থেকে একজন এড-ডি-কং এল দলগরুকভকে ডাকতে।
আঃ, কত যে ঝামেলা, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে প্রিন্স আন্দ্রু ও বরিসের হাতে চাপ দিয়ে দলগরুকভ বলল। জানেন তো আপনার জন্য ও এই যুবকটির জন্য আমার সাধ্যমতো কিছু করতে পারলে আমি খুব খুশি হব। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছেন… অন্য সময় হবে!
উচ্চ ক্ষমতাশালী লোকদের এত কাছাকাছি আসার চিন্তায় বরিস তখন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। প্রিন্স দলগরুকভের পিছন পিছন তারা দুইজনও বারান্দায় বেরিয়ে এল। ম্রাটের ঘরের যে দরজা দিয়ে প্রিন্স দলগরুকভ ঢুকল, সেই দরজা দিয়েই বেরিয়ে এল বেসরকারি পোশাকপরা একটি ছোটখাট মানুষ, তার চতুর মুখ ও বেরিয়ে-আসা চোয়ালে ফুটে উঠেছে একটা সজীব ও চটপটে ভাব। দলগরুকভকে দেখে লোকটি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো মাথাটা নাড়ল, তারপর ঠাণ্ডা, নিরাসক্ত দৃষ্টিতে প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকিয়ে সোজা এগিয়ে এল, স্পষ্টতই সে আশা করেছিল যে প্রিন্স আন্দু তাকে অভিবাদন করবে, আর না হয়তো তার পথের সামনে থেকে সরে যাবে। প্রিন্স আন্দ্রু কোনোটাই করল না : তার মুখে দেখা দিল শত্রুতার ভাব, ছোট লোকটিও মুখ ঘুরিয়ে বারান্দার অন্য দিকে সরে গেল।
লোকটি কে বরিস জিজ্ঞেস করল।
ইনি হচ্ছেন অত্যন্ত বিখ্যাত, কিন্তু আমার কাছে অত্যন্ত অপ্রীতিকর-পররাষ্ট্র মন্ত্রী আদম জারতরিস্কি, এদের মতো লোকরাই জাতির ভাগ্যবিধাতা, প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলকনস্কি বলল।
পরদিন শুরু হল সেনাবাহিনীর অভিযান, সেই থেকে একেবারে অস্তারলিজ যুদ্ধ পর্যন্ত বরিস কি প্রিন্স আন্দ্রুর সঙ্গে, কি দলগরুকভের সঙ্গে আর একটিবারও দেখা করতে পারল না, ততদিন সে এসমেলভ রেজিমেন্টেই থেকে গেল।
*
অধ্যায়-১০
১৬ নভেম্বর ভোরে প্রিন্স ব্যাগ্রেশনের অধীনস্থ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত দেনিসভের অশ্বারোহী সেনাদল (এই সেনাদলে আছে নিকলাস রস্তভ) রাতটা কাটিয়ে পূর্বব্যবস্থামতো যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চলল। প্রায় এক ভার্ল্ড পথ অন্য সেনাদলের পিছন পিছন চলবার পরে বড় রাস্তায় দেনিসভের সেনাদলকে থামিয়ে দেওয়া হল। রস্তভ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, কাকরা, ও পরে প্রথম ও দ্বিতীয় হুজারবাহিনী, পদাতিক বাহিনী ও গোলন্দাজ বাহিনী একে একে তাদের ফেলে এগিয়ে গেল, তারপর সেনাপতি ব্যাগ্রেশন ও সেনাপতি দলগরুকভও তাদের অ্যাডজুটান্টদের সঙ্গে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল। যুদ্ধ শুরু হবার আগেকার আতংক, সে আতংককে জয় করবার মানসিক দ্বন্দ্ব, যুদ্ধে একজন প্রকৃত হুজার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন–সবই বৃথা হয়ে গেল। তাদের সেনাদলকে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হল, আর রশুভকে পুরো দিনটা কাটাতে হল শোচনীয় একঘেয়েমির মধ্যে। সকাল নয়টায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে এল, শোনা গেল হুররা ধ্বনি, কিছু কিছু আহত সৈন্যকে বয়ে আনা হল, এবং শেষপর্যন্ত কসাকদের পাহারায় একটা পুরো ফরাসি অশ্বারোহী সেনাদলকে নিয়ে আসা হল। বোঝা গেল, যুদ্ধ শেষ হয়েছে, এবং বড় মাপের যুদ্ধ না হলেও যুদ্ধে তাদেরই জয় হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে সৈনিক ও অফিসাররা বলতে শুরু করল উজ্জ্বল সাফল্যের কথা, উইশাউ শহর দখলের কথা, এবং একটা পুরো ফরাসি অশ্বারোহী সেনাদলকে বন্দি করার কথা। রাতের তীব্র বরফপাতের পরে সারাদিনটা বেশ উজ্জ্বল ও রৌদ্রস্নাত, হেমন্তের দিন যেন খুশিতে ঝলমল, তারই সঙ্গে সুর মিলিয়ে জয়লাভের কাহিনী ফিরছে সকলের মুখে মুখে, রশুভের পাশ দিয়ে আসতে-যেতে সাধারণ সৈনিক থেকে আরম্ভ করে অফিসার, সেনাপতি ও অ্যাডজুটান্ট সকলেই বলছে যুদ্ধজয়ের কথা। আর সে যুদ্ধের আগেকার সব আতঙ্ক সহ্য করেও এই শুভদিনটিকে কাটিয়েছে নিষ্ককর্মার মতো, আর তার ফলে তার মন মেজাজ আরো খারাপ হয়ে উঠেছে।
একটা ফ্লাস্ক ও কিছু খাবার নিয়ে রাস্তার পাশে বসেছিল দেনিসভ। সে চেঁচিয়ে ডাকল, এদিকে এস হে রস্তভ। এস আমাদের সব দুঃখ গলায় ঢেলে দি!
অফিসাররা দেনিসভকে ঘিরে পান-ভোজনে মেতে উঠল।
দুটি কসাক জনৈক বন্দি ফরাসি অশ্বারোহীকে হটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তাকে দেখিয়ে একজন অফিসার বলে উঠল, ঐ দেখ! ওরা আর একজনকে ধরে আনছে!
বন্দির কাছ থেকে কেড়ে-নেওয়া একটা সুন্দর বড় ঘোড়ার লাগাম ছিল একজন কসাকের হাতে।
দেনিসভ কসাকদের বলল, ও ঘোড়াটা আমাদের কাছে বেচে দাও।
হুজুরদের পছন্দ হলে নিয়ে নিন!
কসাকরা দুটি স্বর্ণমুদ্রার বদলে ঘোড়াটা দিয়ে দিল আর সেটা কিনে নিল রস্তভ, কারণ এখন তার হাতে অনেক টাকা।
তার হাতে ঘোড়াটা তুলে দেওয়া হলে ফরাসি অশ্বারোহীটি বলল, আমার ঘোড়াটিকে কষ্ট দেবেন না যেন!
রস্তভ হেসে তাকে আশ্বাস দিয়ে দামটা দিয়ে দিল।
বন্দির হাত ধরে কসাকটি বলল, চল হে, চল।
হঠাৎ হুজারদের মধ্যে সোরগোল উঠল, সম্রাট! সম্রাট!
সকলেই হৈ-চৈ ছুটাছুটি শুরু করে দিল, রস্তভ দেখল, শাদা পালক গোঁজা টুপি মাথায় কয়েকজন অশ্বারোহী পিছন দিক থেকে এগিয়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে প্রত্যেকেই যার যার জায়গা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
কখন সে যে ছুটে গিয়ে ঘোড়ায় চেপে বসেছে রস্তভ তা জানে না, মনে করতেও পারে না। যুদ্ধে যোগ দিতে না পারার দুঃখ ও অপ্রসন্ন মেজাজ, এমন কি নিজেকে নিয়ে সব ভাবনাচিন্তা মুহূর্তের মধ্যে দূর হয়ে গেল। সম্রাটের কাছাকাছি আসতে পারার আনন্দেই মন ভরে উঠল। মনে হল, এই কাছে আসতে পারাতেই তার সারাদিনের দুঃখ মিটে গেল। মিলনেরা বহুবাঞ্ছিত মুহূর্তটি সমাগত হলে প্রেমিকের মনে যে সুখের সঞ্চার হয় সেই সুখ জেগেছে তার মনে। চারদিকে তাকাবার সাহস পর্যন্ত নেই : তার মনে শুধু একটি আনন্দের উচ্ছ্বাস–তিনি আসছেন! রস্তভের কাছে, আরো কাছে এগিয়ে আসছে সেই সূর্য, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে তার নরম মহনীয় অথচ সরল আলোকরশ্মি! চারদিকের মৃত্যু-স্তব্ধতার মধ্যে শোনা গেল সম্রাটের কণ্ঠস্বর।
পাভলোগ্রাদ অশ্বারোহীদল কি? সম্রাট জিজ্ঞেস করল।
রিজার্ভ সেনাদল স্যার! উত্তর এল পূর্ব কণ্ঠস্বরের তুলনায় একটি সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরে।
সম্রাট এসে থামল রস্তভের পাশে। তিন দিন আগেকার কুচকাওয়াজ দেখা মুখের চাইতেও আজ আলেক্সান্দারের মুখ অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। সে মূর্তি যেন একটি ফুটফুটে চোদ্দ বছরের বালকের, অথচ সে মুখ মহামান্য সম্রাটের। অশ্বারোহী দলটিকে পর্যবেক্ষণের সময় ঘটনাক্রমেই সম্রাটের চোখ পড়ল রস্তভের চোখে, দুই সেকেন্ডের জন্য সেখানেই স্থির হয়ে রইল। রশুভের মনের মধ্যে তখন কি হচ্ছে সম্রাট তা বুঝল কি না কে জানে (রস্তভের মনে হল সম্রাট সব বুঝতে পেরেছে), তার দুটি নীল চোখ দুই সেকেন্ড সময় রস্তভের মুখের দিকেই তাকিয়ে রইল। সে দৃষ্টিতে ঝরে পড়ল একটি শান্ত, মৃদু আলো। তারপর হঠাৎই ভুরু তুলে পা দিয়ে ঘোড়র পেটে খোঁচা মেরে সে জোর কদমে ছুটে চলে গেল।
পাঁচ মিনিট পরেই পাভলোগ্রাদ সেনাদলকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেওয়া হল। ছোট জার্মান শহর উইশাউতে রস্তভ আর একবার সম্রাটকে দেখল। সম্রাট আসার ঠিক আগেই বাজার অঞ্চলে বেশ কিছুটা গোলাগুলি চলেছিল, কিছু নিহত ও আহত সৈনিক তখনো সেখানে পড়েছিল, সরিয়ে নেবার মতো সময় পাওয়া যায়নি। অফিসার ও সভাসদ পরিবৃত হয়ে একটা লেজকাটা বাদামি ঘোটকির পিঠে চড়ে চলেছে সম্রাট। একদিকে ঝুঁকে সোনা-বাঁধানো কাঁচটাকে আস্তে চোখের সামনে ধরে সে দেখল, একটি সৈনিক উপুড় হয়ে পড়ে আছে, তার ভোলা মাথাটা রক্তে মাখামাখি। আহত সৈনিকটি এত নোংরা, তাকে দেখলে এমনভাবে গা ঘিনঘিন করে করে যে সম্রাটকে তার এত কাছাকাছি দেখে রস্তভ মনে কষ্ট পেল। রস্তভ দেখল, সম্রাটের কাঁধ দুটি এমনভাবে কাঁপছে যেন তার শীত করছে, বাঁ পায়ের পাদানি দিয়ে সে ঘোড়ার পেটটা আস্তে আস্তে ঠুকতে লাগল, আর সুশিক্ষিত ঘোড়াটাও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটা স্ট্রেচার আনা হল। একজন অ্যাডজুটান্ট ঘোড়া থেকে নেমে দুই হাতে সৈনিকটিকে তুলে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিল। সৈনিকটি আর্তনাদ করে উঠল।
আস্তে, আস্তে, আর একটু আস্তে তুলে ধরতে পার না? এমনভাবে সম্রাট কথাটা বলল যে মুমূর্ষ সৈনিকটির চাইতে তারই বেশি কষ্ট হচ্ছে। তারপরই সম্রাট ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
রস্তভ দেখল, সম্রাটের চোখ জলে ভরে উঠেছে। যেতে যেতেই সে জারতরিস্কিকে বলছে : এই যুদ্ধ কী ভয়ংকর : কত ভয়ংকর!
অগ্রবর্তী সৈনিকদের প্রতি ম্রাটের কৃতজ্ঞতা ঘোষণা করা হল, নানারকম পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল, সৈনিকদের দেওয়া হল ভদকার দ্বিগুণ রেশন। সশব্দে জ্বলল শিবির-আগুন, সৈনিকদের গান ধ্বনিত হল আগের রাতের চাইতে অধিকতর আনন্দের সুরে। মেজর পদে উন্নত হওয়ায় দেনিসভ একটা অনুষ্ঠান করল, আর সেখানেই প্রচুর মদ খেয়ে রস্তভ ম্রাটের স্বাস্থ্য কামনা করতে উঠে বলল, আমি বলব না আমাদের সার্বভৌম সম্রাট যা বলা হয়ে থাকে সরকারি ভোজসভায়, আমি স্বাস্থ্য পান করব আমাদের সার্বভৌম, সৎ, মোহময়, মহান পুরুষের! আসুন আমরা পান করি তার স্বাস্থ্য এবং ফরাসিদের নিশ্চিত পরাজয় কামনা করি!
সে আরো বলল, যদি ফরাসিদের অগ্রসর হতে না দিয়ে শোন গ্রেবার্নের মতো আমরা আগেই তাদের সঙ্গে যুদ্ধে নামতাম তাহলে এখন তিনি যখন রণক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে হাজির হয়েছেন তখন আমরা কী না করতাম? তাঁর জন্য আমরা খুশি হয়ে মৃত্যু বরণ করতাম। তাই নয় কি ভদ্রজনরা? হয়তো আমি কথাটা ঠিক মতো বলতে পারছি না, বড় বেশি মদ গিলেছি–কিন্তু এটাই আমার মনের কথা, আর আপনাদেরও! প্রথম আলেক্সান্দারের স্বাস্থ্য কামনায়! হুররা!
অফিসাররাও সোৎসাহে চিৎকার করে উঠল, হুররা!
বাইশ বছর বয়সের রস্তভের মতোই সমান উৎসাহে ও আন্তরিকতায় চেঁচিয়ে উঠল অশ্বারোহী বাহিনীর বৃদ্ধ ক্যাপ্টেন কিসতেন।
অফিসাররা যখন নিজ নিজ গ্লাস খালি করে আছড়ে ভেঙে ফেলল, কিসতেন তখন অন্য গ্লাস ভর্তি করে নিয়ে শার্ট ও ব্রিচেস পরেই সৈনিকদের শিবির-আগুনের কাছে এগিয়ে গেল, এবং দীর্ঘ পাকা গোঁফ ও বুকখোলা শার্টের নিচে শাদা বুক ফুলিয়ে উদ্যত হাত দোলাতে দোলাতে মহনীয় ভঙ্গিতে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ওজে ছোকরারা! আমাদের সার্বভৌম সম্রাট ও শত্রুর উপর জয়লাভের উদ্দেশে এই গ্লাস! হুররা!
হুজাররা চারদিকে ভিড় করে উচ্চ চিল্কারে তাকে সমর্থন করল।
সেদিন অনেক রাতে সকলে চলে গেলে দেনিসভ তার প্রিয় রস্তভের ঘাড়ে আস্তে আস্তে চাপড় দিতে লাগল।
বলল, যেহেতু সমরাভিযানের সময় প্রেমে পড়বার মতো কাউকে পাওয়া যায় না, তাই সে জারের প্রেমেই পড়েছে।
রস্তভ চেঁচিয়ে বলল, দেনিসভ, এ নিয়ে ঠাট্টা করো না। এ অনুভূতি বড় মহৎ, বড় সুন্দর, এমন একটা…।
আমি তা বিশ্বাস করি বন্ধু, বিশ্বাস করি, আমিও তো এর অংশীদার, সমর্থক…
না, তুমি কিছু বোঝ না!
রস্তভ উঠে শিবির-আগুনের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল, তার চোখের একই স্বপ্ন-সম্রাটের জীবন রক্ষার জন্য নয় (সেকথা সে ভাবতেও পারে না), শুধু তার চোখের সামনে মরতে পারলেই কত না সুখ সে পেত! সত্যি, জারের প্রতি, রুশ বাহিনীর গৌরবের প্রতি, ভবিষ্যৎ বিজয়ের আশার প্রতি সে প্রেমে পড়েছে। আর অস্তারলিজ যুদ্ধের আগেকার সেই স্মরণীয় দিনগুলিতে এ অভিজ্ঞতা শুধু তার একার হয় নি, রুশ বাহিনীর দশ ভাগের নয় ভাগ লোক তখন জারের এবং রুশ বাহিনীর গৌরবের প্রেমে পড়েছিল।