১৩. মানুষের মন

ত্রয়োদশ পর্ব অধ্যায়-১

মানুষের মন কখনো কোনো ঘটনার কারণসমূহের পুরোপুরি জানতে পারে না, অথচ জানবার বাসনা নিহিত আছে মানুষের মনের গভীরে। বহু কারণাংশের যেকোন একটিকেই যেখানে আলাদা করে দেখলে মনে হতে পারে তাদের জটিলতাকে বিচার করে না দেখে মানুষ কারণের কাছকাছি যেকোন একটি কারণাংশকেও মূল কারণ বলে ধরে নিয়ে বলে ওঠে: এটাই কারণ। ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম এবং সবচাইতে প্রাচীন অভিমত ছিল নানা দেবদেবীর ইচ্ছাকেই কারণ বলে গ্রহণ করা, আর তার পরে সে জায়গা নিয়েছিল তাদের ইচ্ছা যারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত-অর্থাৎ ইতিহাসের মহানায়ক যারা। কিন্তু যে-কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাই তাতে অংশগ্রহণকারী জনসাধারণের কার্যাবলির ফল, সেই ঘটনার মূলে প্রবেশের চেষ্টা করলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে যে ইতিহাসের মহানায়কদের ইচ্ছা জনসাধারণের কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং তার দ্বারাই বারবার নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক ঘটনার তাৎপর্যকে আমরা যেভাবেই বুঝি না কেন তাতে কিছু যায়-আসে না, তথাপি যে মানুষ বলে যে নেপোলিয়নের ইচ্ছানুসারেই পশ্চিমের মানুষগুলি পুব দিকে গিয়েছিল এবং যে মানুষ বলে যে এ ঘটনা ঘটবে বলেই ঘটেছিল, তাদের মধ্যে সেই একই পার্থক্য দেখা যায় যেমনটি দেখা যেত সেই দুটি দলের মধ্যে যাদের একদল বলত যে পৃথিবীটা স্থির আর অন্য সব গ্রহ তার চারদিকে ঘুরছে এবং অন্য দল বলত যে পৃথিবীকে কে ধরে আছে তা তারা জানে না, তবে একথা জানে যে নিদিষ্ট নিয়ম অনুসারেই পৃথিবী ও অন্যসব গ্রহের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। সব কারণের সেরা কারণটি ছাড়া কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার আর কোনো কারণ নেই, থাকতে পারে না। কিন্তু ওইসব ঘটনাকে নিয়ন্ত্রিণ করবার মতো নিয়ম-কানুন আছে, আর তার, কিছু কিছু আমাদের জানাও বটে। কিন্তু সেই সব নিয়ম কানুনকে আবিষ্কার করা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন কোনো একটি মানুষের ইচ্ছার মধ্যে সেই কারণকে খুঁজবার চেষ্টাকে আমরা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করি, ঠিক যেভাবে মানুষ যখন পৃথিবীর স্থিরত্বের ধারণাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করল একমাত্র তখনই গ্রহনিচয়ের গতিবিধির নিয়ম আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছিল।

ইতিহাকাররা মনে করে, বরদিনোর যুদ্ধ এবং শত্রু-কর্তৃক মস্কো দখল ও অগ্নিদগ্ধ করে তার ধ্বংসসাধনের পরেই ১৮১২ সালের যুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে রিয়াজান হতে কালুগা রোড এবং তারুতিনো শিবির পর্যন্ত রুশ বাহিনীর অভিযান-ক্রাসনয়া পখরা নদী বরাবর সৈন্যদের তথাকথিত পার্শ্বযাত্রা। সেই প্রতিভাদীপ্ত জয়ের গৌরব তারা দিয়ে থাকে বিভিন্ন মানুষকে, আর সে গৌরব কার প্রাপ্য তা নিয়ে বিতর্কও আছে। এমন কি ফরাসি ইতিহাসকাররা সমেত বিদেশী ইতিহাসকাররাও সেই পার্শ্বযাত্রার কথা বলতে গিয়ে রুশ সেনায়কদের প্রতিভাকে স্বীকৃতি জানিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধবিষয়ক লেখকরা, এবং তাদের দেখাদেখি অন্যরাও, কেমন করে মনে করে যে এই অভিযানটি একটি মাত্র মানুষের গভীর ধ্যান-ধারণারই ফল যে রাশিয়াকে রক্ষা করেছে এবং নেপোলিয়নকে ধ্বংস করেছে সেটা বোঝা খুব শক্ত। প্রথমত, এই পার্শ্বযাত্রার মধ্যে গভীর জ্ঞান ও প্রতিভার পরিচয় কোথায় আছে সেটাই বোঝা শক্ত, কারণ যখন আক্রান্ত হবার কোনো ভয় নেই তখন একটি সেনাদলের পক্ষে সেই জায়গায় অবস্থান করাই যে সর্বাপেক্ষা সুবিধাজনক যেখানে যথেষ্ট খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যাবে সেটা বুঝতে তো খুব বেশি মানসিক প্রচেষ্টায় প্রয়োজন হয় না, ১৮১২ সালে মস্কো থেকে পশ্বাদপসরণের পরে সেনাদলের পক্ষে সবচাইতে ভালো ঘাঁটি যে কালুগা লোগ সেটা তো যে কোনো একটা তেরো বছরের স্বল্পবুদ্ধি ছেলেও অনুমান করতে পারত। সুতরাং কোনো যুক্তিবলে ইতিহাসকাররা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে এই রণ-কৌশল গভীর জ্ঞানের পরিচায়ক সেটা বোঝা অসম্ভব। তাছাড়া, এটা বোঝা আরো শক্ত যে তারা কেন মনে করে বসল যে রাশিয়াকে রক্ষা করার এবং ফরাসিদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই রণ-কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল, কারণ এই রণ-কৌশলের আগে, সমকালে, বা পরবর্তীকালে যদি অন্য কোনোরকম পরিস্থিতি দেখা দিত তাহলে সেটা রুশদের পক্ষে ধ্বংসাত্মক এবং ফরাসিদের পক্ষে সুবিধাজনক হয়ে উঠতে পারত। সেই সেনাযাত্রার সময় থেকেও যদি রুশদের অবস্থার উন্নতি ঘটতে আরম্ভ করে থাকে তাহলেও তো একথা বলা যায় না যে ওই যাত্রাই তার কারণ।

মস্কো যদি ভস্মীভূত না হত তাহলে কি হত? মুরাৎ যদি রুশদের দৃষ্টির আড়ালে যেতে না দিত? নেপোলিয়ন যদি নিষ্ক্রিয় না হত? বেনিংসেন ও বার্কলের পরমর্শমতো রুশ বাহিনী যদি ক্রাসনয়া পখরাতে যুদ্ধ করত? রুশরা যখন পখরা নদী পেরিয়ে এগোচ্ছিল তখন ফরাসিরা তাদের আক্রমণ করত? নেপোলিয়ন যে উৎসাহ-উদ্যমের সঙ্গে আলেনস্কে রুশদের আক্রমণ করেছিল তার দশ ভাগের এক ভাগ উৎসাহ-উদ্যম নিয়েও সে যদি তারুতিনোর পথে তাদের আক্রমণ করত তাহলে কি হত? ফরাসিরা যদি পিটার্সবুর্গের দিকে এগিয়ে যেতে তাহলেই বা কি হত? এইসব ঘটনার যে-কোনো একটা ঘটলেই পাশ্বযাত্রা মুক্তির বদলে ধ্বংস বয়ে আনতে পারত।

তৃতীয় কথা এবং সবচাইতে দুর্বোধ্য কথা এই যে ইতিহাস নিয়ে যারা আলোচনা করে তারাও ইচ্ছা করেই বুঝতে চায় না যে এই পাশ্বযাত্রা কোনো একটি মানুষের ব্যাপার নয়, কেউই আগে থেকে এটা ভাবে নি, আর বাস্তব ক্ষেত্রে, ফিলি (রুশ বাহিনীর পশ্চাদপসরণের পথে সর্বশেষ গ্রাম) থেকে পশ্চাদপসরণের মতোই, এই পার্শ্বর্যাত্রাটা পুরোপুরিভাবে কোনো সময়ই কারো মাথা ছিল না, একটু-একটু করে, ধাপে-ধাপে, ঘটনার পর ঘটনার ভিতর দিয়ে অসংখ্য বিচিত্র পরিস্থিতির পরিণতিতে এটা ঘটেছে, ব্যাপারটা পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে দেখা দিল একমাত্র তখন যখন ঘটে যাবার পরে সেটা অতীতের বিষয় হল।

ফিলির বৈঠকে রুশ কমান্ডারদের মাথায় স্বাভাবিকভাবেই একটি মাত্র পথের কথাই এসেছিল-সোজা নিঝনি রোড ধরে পিছু হটে যাওয়া। কিন্তু কমিসারিয়েট বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ল্যানসকয় প্রধান সেনাপতিকে জানাল, সেনাবাহিনীর রসদের মোটা অংশই মজুত করা আছে তুলা ও রিয়াজন প্রদেশের ওকা নদীর তীর বরবার, কাজেই নিঝনি রোড ধরে গেলে সেনাদল প্রশস্ত ওকা নদীর দ্বারা রসদ-ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, আর প্রথম শীতে ওকা নদী পার হওয়া যাবে না। নিঝনি-নভগরদের পথ ধরে সোজা পিছিয়ে যাবার পরিবর্তে কেন অন্য পথ ধরতে হয়েছিল এখানেই তার হদিস পাওয়া যায়। সেনাদল রিয়াজন রোড ধরে আরো দক্ষিণে এগিয়ে চলল রসদের দিকে। পরবর্তীকালে ফরাসিদের নিষ্ক্রিয়তা, তুলার অস্ত্রাগারের নিরাপত্তার চিন্তা এবং রসদের কাছাকাছি যাবার সুবিধা-এই তিনটি পরিস্থিতির ফলেই সেনাদল আরো দক্ষিণে বেঁকে তুলা রোড ধরল। পখরা নদীর ওপরে তুলা রোডে পৌঁছে রুশ কমান্ডাররা স্থির করল পদোলঙ্কা-এই থেকে যাবে, তখনো তারা তরুতিনো ঘাঁটির কথা চিন্তাই করে নি, কিন্তু অসংখ্য ঘটনা ফরাসি সৈন্যদের পুনরাবির্ভাব, প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের সম্ভাবনা, এবং সর্বোপরি কালুগা প্রদেশে রসদের প্রাচুর্য–সবকিছু মিলে আমাদের সৈন্যদের বাধ্য করল আরো দিক্ষণে অগ্রসর হয়ে এবং তুলা থেকে কালুগা রোড ধরে তারুতিনোর দিকে এগিয়ে যেতে, যেসব রাস্তায় রসদ মজুদ করা ছিল তার মধ্যস্থলেই তারুতিনোর অবস্থান। মস্কো পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত কখন নেয়া হয়েছিল সেটা বলা যেমন অসম্ভব, ঠিক তেমনই তারুতিনো যাবার সিদ্ধান্ত কখন নেয়া হয়েছিল বা কে নিয়েছিল সেটা সঠিকভাবে বলাও অসম্ভব। অসংখ্য বিচিত্র ধরনের ঘটনার ফলে সেনাবাহিনী যখন সেখানে পৌঁছে গেল একমাত্র তখনই সকলে নিশ্চিত হয়ে ভাবল যে এই যাত্রাই ছিল তাদের অভিপ্রেত এবং বহুকাল আগেই তারা এর ফলটা দেখতে পেয়েছিল।

.

অধ্যায়

বিখ্যাত পার্শ্বযাত্রা ব্যাপারটা মোটামুটি এই : ফরাসিদের অগ্রগতি বন্ধ হবার পরে আক্রমণকারীদের কাছ থেকে অবিরাম পশ্চাদপসরণকারী রুশ বাহিনী নিজেদের গতিপথ পরিবর্তন করল এবং যখন দেখল যে শত্রু তার পিছনে ধাওয়া করছে তখন স্বভাবতই তারা সেইদিকে এগোতে লাগল যেখানে প্রচুর রসদ মজুত ছিল।

রুশ বাহিনীর প্রতিভাধর কমান্ডারদের কথা না ভেবে আমরা যদি সে বাহিনীটাকে পরিচালকহীন রূপে কল্পনা করি তাহলে সে বাহিনীর পক্ষে যেসব অঞ্চলে অধিকাংশ রসদ পাওয়া যাবে এবং যেটা দেশের সবচাইতে সমৃদ্ধ অঞ্চল সেখান দিয়ে অর্ধবৃত্তাকার পথে আবার মস্কো ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করা সম্ভব হত না।

নিঝনি থেকে রিয়াজান, তুলা ও কালুগা রোড ধরে চলাটা এতই অস্বাভাবিক যে রুশ লুটেরারাও ওই পথেই চলাচল করে থাকে, আর পিটার্সবুর্গ থেকে কুতুজভকেও ওই পথেই সৈন্য চালিয়ে নিতে বারবার বলা হচ্ছিল। রিয়াজান রোড ধরে সৈন্য চালানোর জন্য তারুতিনোতে কুতুজভকে সম্রাটের কাছ থেকে তীব্র ভর্ৎসনাই শুনতে হল, অথচ কালুগার কাছে যেখানে সে ইতিমধ্যেই ঘাঁটি পেতেছে ম্রাটের চিঠিতে তাকে সেখানে যাবার নির্দেশই দেয়া হল।

একটা বলের মতো গড়াতে গড়াতে রুশ বাহিনী স্বাভাবিকভাবে যেখানে যাবার কথা সেখানেই পৌঁছে গেল। কুতুজভের কৃতিত্ব তথাকথিত সমর-কৌশলগত প্রতিভার নয়, তার কৃতিত্ব যে একমাত্র সেই ঘটনার তাৎপর্যকে বুঝতে পেরেছিল। ফরাসি বাহিনীর তৎকালীন নিষ্ক্রিয়তার অর্থ একমাত্র সেই বুঝতে পেরেছিল, একমাত্র সেই বারবার বলেছে যে বরদিনোর যুদ্ধে তাদের জয় হয়েছে, প্রধান সেনপতি হিসেবে শত্রুকে আক্রমণ করতে চাওয়াটাই তার কাছে প্রত্যাশিত হলেও রুশ বাহিনীকে অকারণ সংঘর্ষ থেকে নিবৃত্ত করতে সেই সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছিল।

বরদিনোতে আহত জন্তুটিকে পলায়নমান শিকারী যেখানে রেখে গিয়েছিল সে সেখানেই পড়ে রইল, কিন্তু সে তখনো বেঁচে আছে কি না, শক্তিশালী হয়েও নেহাৎ পড়ে আছে কিনা, সেকথা শিকারি জানত না। হঠাৎ জন্তুটার আর্তনাদ শোনা গেল।

সেই আহত পশুর (ফরাসি বাহিনী) যে আর্তনাদ তার শোচনীয় অবস্থাটাকে প্রকাশ করে দিল সেটা হল শান্তির প্রস্তাব দিয়ে লরিস্টনকে কুতুজভের শিবিরে প্রেরণ।

নেপোলিয়ন সবসময়ই বিশ্বাস করত যে তার মাথায় যা আসে সেটাই ঠিক, যতই অর্থহীন হোক সে কথাগুলি প্রথম তার মনে এল তাই সে কুতুজভকে লিখে পাঠাল।

লিখল : মঁসিয় লি প্রিন্স কুতুজভ, কয়েকটি বিশেষ প্রশ্ন নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য আমার একজন অ্যাডজুটান্ট-জেনারেলকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। ইয়োর হাইনেসের কাছে আমার মিনতি, সে আপনাকে যা বলবে, বিশেষ করে দীর্ঘকাল ধরেই আপনার ব্যক্তিত্বের প্রতি যে সম্মান ও বিশেষ শ্রদ্ধা আমি পোষণ করে আসছি সেই মনোভাবকে সে যখন প্রকাশ করবে, তখন আপনি যেন তার কথায় বিশ্বাস করেন। এ চিঠির আর কোনো উদ্দেশ্য নেই, মঁসিয় লি প্রিন্স কুতুজভ, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তার পবিত্র ও সদয় আশ্রয়ে তিনি আপনাকে রক্ষা করুন!
—-মস্কো, ৩০শে অক্টোবর, ১৮১২ নেপেলিয়ন।

কুতুজভ জবাব দিল : আমাকে কোনোরকম মিটমাটের উদ্যোক্তা বলে মনে করলে উত্তরপুরুষ আমাকে অভিশাপ দেবে। আজ এই আমার জাতির মনোভাব। কিন্তু সেনাদল যাতে আক্রমণ না করে সেজন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করতে লাগল।

যে একটা মাস ধরে ফরাসি সৈন্যরা মস্কোতে লুঠতরাজ করে ফিরছিল আর রুশ সৈন্যরা তারুতিনোতে তবু ফেলে চুপচাপ বসেছিল, সেই সময়কালে দুই সেনাদলের মধ্যে কি মনোবলে কি সংখ্যায় একটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে–তার ফলে এখন রুশ পক্ষের দিকেই পাল্লাটা ভারি হয়েছে। যদিও ফরাসি বাহিনীর অবস্থা ও সংখ্যার কথা রুশরা জানত না, তবু এই পরিবর্তন ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই আক্রমণ করার প্রয়োজনটা অসংখ্য লক্ষণের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পেতে লাগল। সে লক্ষণগুলি হল : লরিস্টনের দৌত্য, তারুনিনোতে রসদের প্রাচুর্য, চতুর্দিক থেকে ফরাসিদের নিষ্ক্রিয়তা ও বিশৃঙ্খলার সংবাদ, চমৎকার আবহাওয়া, আমাদের রেজিমেন্টে নতুন সৈনিকের অবিরাম যোগদান, রুশ সৈন্যদের লম্বা বিশ্রাম ও কাজ করার জন্য অধৈর্য হয়ে ওঠা, যে ফরাসি বাহিনী এতকাল ছিল দৃষ্টির আড়ালে তাদের গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত হবার জন্য তারুতিনোতে অবস্থিত ফরাসিদের সম্পর্কে খুব নিকটবর্তী রুশ ঘাঁটির সৈন্যদের কৌতূহল, ফরাসিদের বিরুদ্ধে চাষী ও গেরিলা সৈনদের সহজ জয়লাভের সংবাদ ও তজ্জনিত উৎসাহ বৃদ্ধি, ফরাসিরা যতদিন মস্কোতে থাকবে ততদিন রাশিয়ার প্রতিটি মানুষের মনে প্রতিশোধের তীব্র স্পৃহা, এবং সর্বোপরি প্রতিটি রুশসৈনিকের মনের অস্পষ্ট ধারণা যে তুলনামূলকভাবে উভয়দলের সৈন্যসংখ্যার পরিবর্তন ঘটেছে, আর সেটা ঘটেছে আমাদেরই স্বপক্ষে। তুলনামূলক শক্তির যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটার ফলে সৈন্যদের অগ্রাভিযান অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ির মিনিটের কাঁটাটা একটা বৃত্ত পূর্ণ করামাত্রই যেমন ঘড়িটা বাজতে শুরু করে তেমনই উচ্চতর মহলের ফিসফিস, ফুসফুস এবং বর্ধিত কর্মপ্রচেষ্টার ভিতর দিয়ে এই পরিবর্তনই ঘোষিত হচ্ছে।

.

অধ্যায়-৩

রুশ বাহিনী পরিচালিত হচ্ছে সপার্ষদ কুতুজভের হাতে এবং পিটার্সবুর্গ থেকে সম্রাটের হাতে। মস্কো পরিত্যাগের সংবাদ পিটার্সবুর্গে পৌঁছবার আগেই গোটা অভিযানের একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা রচনা করে কুতুজভকে পাঠানো হয়েছিল সেই মতো কাজ করতে।

যদিও মস্কো আমাদের হাতে আছে এটা ধরে নিয়েই পরিকল্পনাটা রচিত হয়েছিল তবু কর্ম-পরিষদ কর্তৃক সেটা অনুমোদিত ও গৃহীত হয়েছিল। কুতুজভ উত্তরে শুধু জানাল যে এতটা দূর থেকে পাঠানো ব্যবস্থা অনুসারে কাজ করার অনেকরকম অসুবিধা আছে। কাজেই সম্ভাবিত অসুবিধা দূর করার জন্য নতুন নির্দেশাদি পাঠানো হল, সেই সঙ্গে কুতুজভের কাজকর্মের উপর নজর রাখতে এবং সে সম্পর্কে প্রতিবেদন পাঠাতে নতুন লোকও পাঠানো হল।

এছাড়া, রুশ বাহিনীর গোটা কর্ম-পরিষদও নতুন করে গঠিত হয়েছে। ব্যাগ্রেশন নিহত হওয়ায় এবং বার্কলে আক্রোশবশত চলে যাওয়া সেই দুটি শূন্যপদেও লোক নেয়া দরকার। তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও চলতে লাগল।

কুতুজভ ও তার কর্ম-পরিষদের প্রধান বেনিংসেনের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ, সম্রাটের ব্যক্তিগত প্রতিনিধির উপস্থিতি, এবং এইসব-রদ-বদলের ফলে সেনাবাহিনীর কর্মচারীদের মধ্যে নানারকম দলাদলি চলতে লাগল। যুদ্ধ কিন্তু এসব সত্ত্বেও নিজস্ব গতিতেই চলতে থাকল।

সম্রাটের ২রা অক্টোবরে লেখা যে চিঠিটা কুতুজভের হাতে পৌঁছল তারুতিনো যুদ্ধের পরে তাতে লেখা হয়েছিল : প্রিন্স মাইকেল ইলারিয়নভিচ! ২রা সেপ্টেম্বর থেকে মস্কো শত্রুপক্ষের হাতে রয়েছে। আপনার সর্বশেষ প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছে ২০শে তারিখে, এই সময়কালের মধ্যে আপনি শত্রুর বিরুদ্ধে অথবা প্রাচীন রাজধানীর উদ্ধারে কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি, কিন্তু আপনার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে আপনি আরো পিছিয়ে গিয়েছেন। শত্রুপক্ষের একটা ছোট দল ইতিমধ্যেই সেরপুখভ দখল করেছে, এবং সেনাবাহিনীর পক্ষে অপরিহার্য বিখ্যাত অস্ত্রাগারসহ তুলা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। জেনারেল উইতিনগরদের প্রতিবেদন থেকে আমি জানতে পেরেছি যে দশ হাজার সৈন্যের একটি শত্রুপক্ষীয় দল পিটার্সবুর্গ রোড ধরে এগিয়ে চলেছে। কয়েক হাজার সৈন্যের আর একটি দল দিমিত্রভের দিকে এগিয়ে আসছে। একটা তৃতীয় সেনাদল ভ্রাদিমির রোড ধরে এগোচ্ছে এবং একটা চতুর্থ বড় দল রুজা ও মোঝায়েঙ্কের মধ্যে ঘাঁটি করেছে। নেপোলিয়ন স্বয়ং ২৫শে তারিখ পর্যন্ত মস্কোতেই ছিলেন। এইসব সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে শত্রুপক্ষ যখন তার বড় বড় সেনাদলকে নানা দিকে ছড়িয়ে রেখেছে এবং নেপোলিয়ন ও তার রক্ষীবাহিনী মস্কোতেই রয়েছে তখনো কি আপনার সম্মুখস্থ শত্রুপক্ষ এতদূর শক্তিশালী হতে পারে যে আপনি তাদের আক্রমণ করতে পারছেন না? বরং আপনার অধীনস্থ সৈন্যদের চাইতে দুর্বলতর সেনাদল নিয়ে সেই হয়তো আপনার পশ্চাদ্ধাবন করছে। আমার তো মনে হয় এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একটি দুর্বলতর শত্রুকে আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, অন্ততপক্ষে তাকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করাই আপনার পক্ষে সুবিধাজনক, তাতে যে সমস্ত অঞ্চল এখন ফরাসিদের দখলে আছে তার কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ পুনর্দখল করে তুলা এবং ভিতরকার অন্য শহরগুলিকে বিপদমুক্ত করা যাবে। এদিকে বর্তমান অবস্থায় পিটার্সবুর্গে বেশি সৈন্য রাখা সম্ভব হয় নি, ফলে যে-কোনো রকমের একটা সেনাদল নিয়ে এসে শত্রু যদিএ রাজধানীটিকেও বিপন্ন করে তোল তার সব দায়-দায়িত্ব আপনাকেই বহন করতে হবে, কারণ আপনার যে বাহিনীকে রাখা হয়েছে তাতে যথেস্ট দৃঢ়তা ও উদ্যমের সঙ্গে চললে এই নতুন বিপদকে এড়িয়ে চলা খুবই সম্ভবপর। স্মরণে রাখবেন, মস্কো ছেড়ে আসার জন্য শুধু দেশবাসীর কাছে আপনার জবাবদিহি করাটা এখনো বাকি আছে। আপনি জানেন, আপনাকে পুরস্কৃত করতে আমি সর্বদাই প্রস্তুত আছি। সে দুর্বলতা আমাকে দুর্বল করবে না, কিন্তু আপনার কাছ থেকে সেই উত্সাহ, দৃঢ়তা ও সাফল্য আশা করার অধিকার আমার এবং গোটা রাশিয়ার অবশ্যই আছে, আপনার বুদ্ধি, সামরিক প্রতিভা এবং আপনার অধীনস্থ সৈন্যদের সাহসের গুণে সে প্রত্যাশা আমরা নিশ্চয়ই করতে পারি।

এই চিঠি যখন পাঠানো হল ততদিনে কুতুজভ আর তার সৈন্যদের ঠেকিয়ে রাখতে পারল না, একটা সংঘর্ষ এর মধ্যেই ঘটে গেছে।

২রা অক্টোবর সীমান্ত ঘাঁটির শাপোভালভা নামক একটি কসাক টহল দেবার সময় একটি খরগোসকে মেরে ফেলে এবং আর একটিকে আহত করে। আহত খরগোসটির পিছনে ধাওয়া করে জঙ্গলের একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়ে সেখানে অবস্থিত মুরাতের সেনাবাহিনীর বাম ব্যূহের কাছে পৌঁছে যায়। সে যে ফরাসিদের হাতে প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল, ফিরে এসে হাসতে হাসতে সেকথা সহকর্মীদের কাছে গল্প করল। আর সে গল্প শুনে জনৈক কর্নেল তার কমান্ডারকে খবরটা জানিয়ে দিল।

কসাকটিকে ডেকে পাঠিয়ে নানারকম প্রশ্ন করা হল। কসাক অফিসাররা এই সুযোগে কয়েকটা ঘোড়া হাতিয়ে নিতে চাইল, কিন্তু একজন ঊর্ধ্বতন অফিসার ব্যাপারটা আরো উপরে জানিয়ে দিল। উপর মহলে তখন খুবই রেশারেশি চলছে। কয়েকদিন আগেই এরমোলভ বেনিংসেনের সঙ্গে দেখা করে তাকে বলে এসেছে, আক্রমণ শুরু করার জন্য প্রধান সেনাপতির উপর যেন চাপ সৃষ্টি করা হয়।

বেনিংসেন উত্তরে তাকে বলেছে, আমি যদি আপনাকে না জানতাম তা হলে ভাবতাম যে আপনি মুখে যা বলছেন আসলে তা চাইছেন না। আমি যে পরামর্শই দেই না কেন, হিজ হাইসেন অবশ্যই করবেন ঠিক তার উল্টোটি।

কসাকটির প্রতিবেদন এবং অশ্বারোহী টহলদার পাঠানোতেই প্রমাণ পাওয়া গেল সে সন্ধিক্ষণ সমাগত। কসে পাক-দেওয়া স্পিংটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে শুরু করেছে, ঘণ্টা বাজছে। নিজের সব শক্তি, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা এবং মানব-চরিত্রের জ্ঞান সত্ত্বেও কাকটির প্রতিবেদন, বেনিয়সেনের চিঠি, তার মতে সম্রাটের অভিপ্রায়, এবং সব জেনারেলের ঐকমত্যের কথা চিন্তা করে কুতুজভ আর সেনাদলের অনিবার্য অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারল না, নিষ্ফল এবং ক্ষতিকর জেনেও সেই কাজটি করার হুকুমই দিল–অর্থাৎ যা ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে তাতে নিজের সম্মতি জানাল।

.

অধ্যায়-৪

 কসাকটি খবর দিল যে ফরাসি বাহিনীর বাঁ দিকটা অরক্ষিত, তার সঙ্গে বেনিংসেনের চিঠি এসে এটাই বুঝিয়ে দিল যে এখনই আক্রমণের নির্দেশ দেওয়া দরকার, দিন স্থির হল ৫ই অক্টোবর।

৪ঠা অক্টোবর সকালে কুতুজভ হুকুম-নামায় সই করল। তল সেটা এরমোলভকে পড়ে শোনাল, তাকে বাকি ব্যবস্থার উপর নজর রাখতে বলল।

ঠিক আছে–ঠিক আছে। এখন আমার হাতে সময় নেই, বলে এরশোলভ কুটির থেকে বেরিয়ে গেল।

তল যে হুকুমনামাটা রচনা করল সেটা খুবই ভালো হয়েছে। অস্তারলিজের হুকুমনামার মতোই এটাও লেখা হল–তবে এবার আর জার্মান ভাষায় নয়।

প্রথম সেনাদল এখানে-এখানে যাবে, দ্বিতীয় সেনাদল ওখানে-ওখানে যাবে, ইত্যাদি। কাগজে-কলমে সেনাদলগুলি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গেল এবং শত্রু বিধ্বস্ত হল। সব হুকুমনামার বেলায়ই যা হয়ে থাকে, আশ্চর্য নৈপুণ্যের সঙ্গে সবকিছুই ভাবা হল, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যেরকম ঘটে থাকে, একটি সেনাদলও যথানির্দিষ্ট সময়ে এসে পৌঁছল না।

হুকুমনামার প্রয়োজনীয় সংখ্যক কপি তৈরি হবার পরে একজন অফিসারকে ডেকে সেগুলো এরমমালভের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হল। অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনীর যে তরুণ অফিসাটির উপর এই কাজের ভার দেয়া হল সে কুতুজভের একজন আর্দালি। এত বড় কাজের ভার পেয়ে খুশি মনে সে এরমমালভের বাসায় গেল।

চলে গেছেন, এরমোলভের আর্দালি জানাল।

অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনীর অফিসারটি তখন আর এক জেনারেলের কাছে গেল, এরমোলভকে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা যায়।

না, জেনারেলও বেরিয়ে গেছেন।

 ঘোড়ায় চেপে অফিসার অন্য একজনের কাছে গেল।

না, তিনিও বেরিয়ে গেছেন।

এই বিলম্বের জন্য তারা আবার আমাকে না দায়ী করেন। যত সব বাজে ব্যাপার! ভাবতে ভাবতে অফিসারটি গোটা শিবিরটা চক্কর দিল। একজন বলল, অন্য কয়েকজন জেনারেলের সঙ্গে এরমোলভকে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে দেখেছে, অন্যরা বলল সে নিশ্চয় বাড়ি ফিরে গেছে। অফিসারটি সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করল, খাবার সময় পর্যন্ত পেল না। কিন্তু এরমোলভকে কোথাও পাওয়া গেল না, সে যে কোথায় গেছে তা কেউ জানে না। একজন সহকর্মীর কাছ থেকে কোনোরকমে কিছু খেয়ে সে আবার সামনের দিকে ছুটল মিলরাদভিচের খোঝে। সেও বেরিয়ে গেছে, তবে সেখান থেকে বলে দেওয়া হল যে জেনারেল কিকিন-এর বলনাচের আসরে তাকে পাওয়া যেতে পারে।

 কিন্তু সেটা কোথায়?

অনেক দূরে একটা বাড়ি দেখিয়ে কসাক অফিসারটি বলল, কেন, ওই তো, ওই এচকিনোতে।

 সে কি? আমাদের সীমানার বাইরে?

দুটো রেজিমেন্টকে ঘাঁটিতে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, আর তারা ওখানে মজা করছে। জঘন্য। দুটো ব্যান্ড আর তিন দল গায়িকা!

অফিসারটি আমাদের সীমানার ওপারে এচকিনোর দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। অনেকদূর থেকেই বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসা নৃত্য-সঙ্গীতের সুর তার কানে এল।

অবিরাম শিস ও তরবানের (একরকম তারের যন্ত্র) বাজনার সঙ্গে শুনতে পেল গান ওই প্রান্তরে.. ওই প্রান্তরে! মাঝে মাঝেই উল্লাস-ধ্বনিতে তাও চাপা পড়ে যাচ্ছে। আটটা বেজে গেছে। গোড়া থেকে নেমে একটা বড় বাড়ির বারান্দায় গিয়ে সে দাঁড়াল। একদিকে রুশ সৈন্য আর অন্যদিকে ফরাসি সৈন্য থাকা সত্ত্বেও বাড়িটা অক্ষতই আছে। ভিতরে ঢুকে দেখল, সব প্রধান জেনারেলরাই সেখানে হাজির, এরমোলভের দশাসই মূর্তিটাও আছে। সকলেরই কোটের বোতাম খোলা, লাল মুখে অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে তারা হো-হো করে হাসছে। ঘরের মাঝখানে একটি সুর্দশন বেঁটে জেনারেল মহা উৎসাহে পোক নাচছে।

হা, হা, হা! সাবাস নিকলাস আইভানিচ! হা, হা, হা!

অফিসারটির মনে হল একটা গুরুতর নির্দেশসহ এরকম সময়ে এখানে আসায় তার দ্বিগুণ অপরাধ হয়েছে, তার অপেক্ষা করাই উচিত ছিল, কিন্তু একজন জেনারেল তাকে দেখে ও তার মুখে সব শুনে এরমোলভকে খবর দিল।

ভ্রূকুটিত মুখে এগিয়ে এসে এরমোলভ অফিসারটির বক্তব্য শুনল, কোনো কথা না বলে কাগজগুলি তার হাত থেকে নিয়ে নিল।

কর্তব্যরত একজন সহকর্মী এরমোলভ প্রসঙ্গে অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনীর অফিসারটিকে বলল, তুমি কি মনে কর তিনি হঠাত্র বেরিয়ে গিয়েছিলেন? এটা একটা চাল। কনভনিৎসিনকে বিপদে ফেলবার জন্য ইচ্ছা করেই এটা করা হয়েছে। দেখো, কাল কী কেচ্ছাটাই না হবে!

.

অধ্যায়-৫

 কুতুজভ বলেই রেখেছিল পরদিন তাকে যেন বেশ সকালেই ঘুম থেকে ডেকে দেয়া হয়। শীর্ণদেহ বৃদ্ধ মানুষটি তাড়াতাড়ি প্রার্থনা করল, পোশাক পরল, এবং যে যুদ্ধে তার সম্মতি নেই তাতেই সৈন্য পরিচালনা করতে হবে মনের মধ্যে এই খুঁতখুতি নিয়েই কালিচে গাড়িতে চেপে লেশোভকা (তারুতিনো থেকে সাড়ে তিন মাইল দূরের একটা গ্রাম) থেকে নির্দিষ্ট জায়গার দিকে গাড়ি চালিয়ে দিল। কালিচেতে বসে সে একবার ঝিমুচ্ছে, আবার জেগে উঠছে, আর তখনই কান পেতে শুনতে চেষ্টা করছে যুদ্ধ শুরু হবার ইঙ্গিতস্বরূপ কোনো কামানের শব্দ ডান দিকে থেকে আসছে কি না। স্যাঁতসেঁতে, একঘেয়ে হেমন্তের সকাল, সবে ভোর হচ্ছে। তারুতিনোর কাছাকাছি পৌঁছে কুতুজভ দেখতে পেল, অশ্বারোহী সৈন্যরা তার যাবার পথটা পেরিয়েই ঘোড়াগুলোকে জল খাওয়াতে নিয়ে চলেছে। কুতুজভ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকাল, গাড়িটা থামাল, জিজ্ঞাসা করল তারা কোন রেজিমেন্টের লোক। যে সেনাদলের নাম তারা বলল তাদের তো এখন অনেক দূর এগিয়ে এক জায়গায় ওঁৎ পেতে থাকার কথা। হয় তো একটা ভুল হয়ে গেছে, বৃদ্ধ সেনাপতি ভাবল। কিন্তু আরো কিছুটা এগিয়ে দেখল, পদাতিক রেজিমেন্টের সৈন্যরা অস্ত্রশস্ত্র এক জায়গায় জড় করে রেখে আধা পোশাক পরে যই–পরিজ খাচ্ছে আর জ্বালানি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে একজন অফিসারকে ডেকে পাঠাল। অফিসার এসে জানাল, যুদ্ধযাত্রার কোনো হুকুম তারা পায় নি।

সে কি! পাওয়া যায় নি… বলতে গিয়েও কুতুজভ সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংযত করল, একজন ঊর্ধ্বতন অফিসারকে ডেকে পাঠাল। কালিচে থেকে নেমে মাথাটা নিচু করে নিঃশব্দে পায়চারি করতে লাগল, নিঃশ্বাস খুব দ্রুত পড়ছে। যাকে ডাকা হয়েছিল সেই অফিসার এইখানে আসতেই কুতুজভের মুখটা রাঙা হয়ে উঠল, এই ভুলের জন্য অফিসারটিই দায়ী বলে নয়, সে রাগ দেখাবার মতো যথেষ্ট উপযুক্ত একজন তোক বলে। কাঁপতে কাঁপতে, হাঁপাতে হাঁপাতে বুড়ো মানুষটি একেবারে ক্ষেপে গেল, এইখানে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত তুলে তাকে শাসাল, চিৎকার করল, গালাগালি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিল। ক্যাপ্টেন ব্রোজিন নামক আর একটি লোক ঘটনাক্রমে সেখানে এসে হাজির হয়েছিল, কোনো দোষে সে দোষী নয়, তবু তার কপালেও সেই একই লাঞ্ছনা জুটল।

কী রকম বদমাস লোক হে তোমরা? সব্বাইকে গুলি করব। পাজির দল! হাত ঘোরাতে ঘোরাতে নিজেও কাঁপতে কাঁপতে কুতুজভ কর্কশ গলায় চিৎকার করে বলল।

তার দৈহিক যন্ত্রণা দেখা দিল। সে একজন প্রধান সেনাপতি, প্রশান্ত মহামহিম, সকলেই বলে তার মতো শক্তিধর মানুষ রাশিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই : অথচ এই অবস্থায় সে যেন গোটা সেনাবাহিনীর কাছে হাসির খোরাক হয়ে উঠেছে। সে তখন নিজের মনেই ভাবছে : আজ তো এত তাড়াহুড়া করে প্রার্থনা করার কোনো দরকার আমার ছিল না, বা সারা রাত জেগে চিন্তা করারও দরকার ছিল না। আমি যদি জোচ্চোর অফিসার হতাম তাহলে তো কেউ আমাকে এভাবে ঠাট্টা করতে সাহস পেত না…আর এখন! তাকে যেন দৈহিক শাস্তি দেওয়া হয়েছে সেইরকম যন্ত্রণাই সে ভোগ করছে, তাই তো রাগে, দুঃখে সে চিৎকার করছে। কিন্তু বেশিক্ষণ তার শক্তিতে কুলোল না, চারদিকে তাকিয়ে যখন বুঝতে পারল যে সে অনেক আজেবাজে বকেছে, তখনই আবার গাড়িতে চেপে নিঃশব্দে গাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেল।

তার রাগ একবার ফুরিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না। চোখ মিটমিট করে সকলেন কৈফিয়ৎ ও যুক্তির ফিরিস্তি শুনল (এরমোলভ অবশ্য পরদিনের আগে তার সঙ্গে দেখা করতেই এল না), আর যে সেনাসমাবেশ ও যুদ্ধযাত্রা আজ করা গেল না সেটা পরদিন করা হোক এই মর্মে বেনিংসেন, কনভনিৎসিন ও তোলের পীড়াপীড়িতে কুতুজভকে আর একবার সে প্রস্তাবে সম্মতি দিতেই হল।

.

অধ্যায়-৬

পরদিন সন্ধ্যায় সৈন্যরা নির্দিষ্ট জায়গায় সমবেত হল এবং রাতেই যাত্রা শুরু করল। হেমন্তের রাতের আকাশে গাঢ় লাল মেঘ জমেছে, কিন্তু বৃষ্টি নেই। মাটি ভিজে, কিন্তু কর্দমাক্ত নয়, সৈন্যরা নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে, শুধু মাঝে মাঝে গোলন্দাজ বাহিনীর ঝন ঝন শব্দ ঈষৎ কানে আসছে। সৈন্যদের জোরে কথা বলতে পাইপ টানতে, বা আগুন জ্বালাতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে, তারাও ঘোড়ার ডাক বন্ধ করার চেষ্টা করছে। অভিযানের এই গোপনীয়তা তাদের বেশি করে মুগ্ধ করেছে, মনের সুখে তারা এগিয়ে চলেছে। লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে গেছে মনে করে কিছু দল থেমে গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র স্কুপ করে রেখে ঠাণ্ডা মাটিতেই বসে পড়ল, কিন্তু বেশির ভাগ সৈন্যই সারারাত ধরে এগিয়ে চলল এবং সব জায়গায় গিয়ে পৌঁছল যেখানে যাওয়া তাদের উচিত ছিল না।

একমাত্র কাউন্ট অর্লভ-দেনিসভ তার কসাকদের নিয়ে যথাসময়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গেল। স্ত্রমিলভা গ্রাম থেকে দিমিত্রভঙ্ক যাবার পথের ধারে একটা বনের প্রান্তে পৌঁছে এই সেনাদলটি থামল।

ভোরের দিকে কাউন্ট অর্লভ-দেনিসভ ঝিমুচ্ছিল, এমন সময় ফরাসি বাহিনী ছেড়ে আসা একটি সৈনিককে এনে হাজির করায় তার ঘুম ভেঙে গেল। লোকটি পনিয়াতোস্কি সেনাদলের একজন পোলিশ সার্জেন্ট, পোলিশ ভাষাতেই সে বলল যে, তাকে অনেক আগেই অফিসার করা উচিত ছিল, তাদের যে-কোনো লোকের চাইতে সে বেশি সাহসী, অথচ তাকে খুবই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয় বলেই সে তাদের ছেড়ে এসেছে, আর তাদের ভালোভাবে শিক্ষা দিতে চায়। আরো বলল, সেখান থেকে মাত্র এক ভাস্ট দূরে মুরাৎ রাতটা কাটাচ্ছে, আর মাত্র একশো সৈন্যের একটা দল যদি তার সঙ্গে দেয়া হয় তাহলে সে তাকে জীবিত গ্রেপ্তার করতে পারবে। কাউন্ট অর্লভ-দেনিসভসহ-অফিসারদের সঙ্গে পরামর্শ করল। প্রস্তাবটা এতই লোভনীয় যে প্রত্যাখ্যান করা যায় না। সকলেই স্বেচ্ছায় যেতে রাজি হল এবং একবার চেষ্টা করে দেখার পরামর্শ দিল। অনেক যুক্তি-তর্ক ও বাদানুবাদের পরে স্থির হল, মেজর-জেনারেল গ্রেকভ দুটি কসাক রেজিমেন্ট নিয়ে পোলিশ সার্জেন্টের সঙ্গে যাবে।

যাত্রার আগে কাউন্ট অর্লভ-দেনিসভ সার্জেন্টকে বলল, মনে রেখো, যদি মিথ্যা বলে থাক তো তোমাকে কুকুরের মতো ফাঁসিতে ঝোলানো হবে, কিন্তু যদি সত্যি হয় তাহলে পাবে একশো স্বর্ণমুদ্রা!

কোনো জবাব না দিয়ে সার্জেন্ট গম্ভীরভাবে ঘোড়ায় চেপে গ্রেকভের সঙ্গে চলে গেল। তারা জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয় গেলে কাউন্ট অর্লভ-দেনিসভ প্রথম ভোরের বাসাতে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এল। নিজের দায়িত্বে যে কাজ সে করেছে সেজন্য বেশ উত্তেজনাও বোধ করছে। ভোরের অস্পষ্ট আলোয় ও নিভে-আসা শিবির আগুনের আলোয় সে শত্রু-শিবিরের দিকে তাকাল। ডানদিকে খোলা জায়গায় এখন আমাদের সেনাদলকে দেখতে পাবার কথা। সেইদিকে ভালো করে তাকিয়েও তাদের দেখতে পেল না। কাউন্টের মনে হল, ফরাসি শিবির কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে, তার ক্ষীণদৃষ্টি অ্যাডজুটান্টটিও সেকথা সমর্থন করল।

শিবিরের দিকে তাকিয়ে কাউন্ট অলভ বলল, আঃ, সত্যি খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ তার মনে হল যে এই সার্জেন্ট একটি প্রতারক, সে মিথ্যা কথা বলেছে, এই দুটি রেজিমেন্টের অনুপস্থিতির জন্য রুশ আক্রমণটিই ব্যর্থ হয়ে যাবে, তাদের সে যে কোথায় নিয়ে যাবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। এত সৈন্যের মধ্যে থেকে একজন প্রধান সেনাপতিকে কেমন করে গ্রেপ্তার করা যাবে।

কাউন্ট বলল, আমি নিশ্চিত বলছি ওই রাস্কেলটা মিথ্যা বলেছে।

 একজন বলল, তাদের তো এখনো ফিরিয়ে আনা যায়।

 অ্যাঁ? সত্যি…তুমি কি মনে কর? তাদের এগিয়ে যেতে দেব, না দেব না?

 আপনি কি তাদের ফিরিয়ে আনতে চান?

ফিরিয়ে আন, ওদের ফিরিয়ে আন! হঠাৎ দৃঢ়সংকল্পে অর্লভ বলে উঠল। নইলে বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে। এখনই আলো ফুটেছে।

অ্যাডজুটান্ট জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

গ্রেকভ ফিরে এলে কাউন্ট অর্লভ-দেনিসভ উত্তেজনাবশে আক্রমণ করাই স্থির করল। সঙ্গের লোকজনদের মনেও সেই একই উত্তেজনা।

ঘোড়ায় চাপো! সে চাপা গলায় হুকুম দিল। সৈন্যরা জায়গামতো দাঁড়িয়ে ক্রুশ-চিহ্ন আঁকল।…আগে বাঢ়, ঈশ্বর তোমাদের সহায় হোন!

 হুররা–আআ! সারা বন প্রতিধ্বনিতে হল। কসাক দলটি বর্শা বাগিয়ে নালাটা পেরিয়ে শিবিরের দিকে ছুটে চলল।

প্রথম যে ফরাসি সৈনিকটি কসকদের দেখতে পেল সে সভয়ে চিৎকার করে উঠল–আর শিবিরে যে যেখানে ছিল–কেউ পোশাক পরে নি, সবে ঘুম থেকে উঠেছে–সকলেই যে যেদিকে পারল ছুট দিল, রইল কামান, বন্দুক আর ঘোড়া।

পিছনে ও চারদিকে নজর না দিয়ে কাকরা যদি ফরাসিদের পিছু নিত তাহলে তারা সেখানকার সবকিছু সহ স্বয়ং মুরাকেও গ্রেপ্তার করতে পারত। অফিসাররাও তাই চেয়েছিল। কিন্তু লুটের মাল ও বন্দিদের হাতের মুঠোয় পাওয়া কসাকদের এক পাও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তখন অসম্ভব। কেউ কোনো হুকুমের পরোয়াই করল না। এক জায়গাতেই পনেরোশো কয়েদি ও আটত্রিশটি বন্দুক পাওয়া গেল, তাছাড়া পতাকা, ঘোড়া, গদী, গোড়ার সাজ ও অন্য টুকিটাকি জিনিস তো আছেই। সবকিছুর বন্দোবস্ত করতে হবে, বন্দি ও বন্দুকগুলোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, লুটের মাল ভাগ করতে হবে–তার জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি ও নিজেদের মধ্যে ছোটখাট লড়াইও হল-এইসব নিয়েই কসাকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

পিছন থেকে তাড়া না খাওয়ায় ফরাসিরা ক্রমে ধাতস্থ হল : নানা দলে ভাগ হয়ে গুলি চালাতে শুরু করল। অর্লভ-দেনিসভ অন্য সেনাদলের আসার প্রতীক্ষায় থেকে আর অগ্রসর হল না।

এদিকে বেনিংসেন ও তোল-এর নেতৃত্বাধীন পদাতিক সেনাদলগুলি হুকুমনামা অনুসারেই যথারীতি যাত্রা করলে নির্দিষ্ট স্থানে না পৌঁছে, পৌঁছে গেল অন্য কোনো স্থানে। অবশ্য কিছু সেনাদল শেষপর্যন্ত নির্দিষ্ট স্থানেই গিয়ে হাজির হল, কিন্তু তখন এত দেরি হয়ে গেছে যে তারা কোনো কাজে লাগার পরিবর্তে শত্রুপক্ষের গোলাগুলির শিকারে পরিণত হল। তোল ঘোড়া ছুটিয়ে মহাউৎসাহে সর্বত্র ছুটে বেড়াল, কিন্তু দেখল সর্বত্র সবকিছুই বিপর্যস্ত, এলোমেলো। যখন একটা জঙ্গলের মধ্যে বাগভুত-এর সেনাদলের সঙ্গে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে, অনেক আগেই তাদের অলভ-দেনিসভের সঙ্গে যোগ দেবার কথা। উত্তেজিত ও বিরক্ত হয়ে একজন কাউকে এজন্য দায়ী করতে গিয়ে তোল সেই সেনাদলের কমান্ডারের কাছে হাজির হয়ে তাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করে শেষপর্যন্ত বলল যে তাকে গুলি করা উচিত। জেনারেল বাগভুত একজন শান্ত প্রকৃতির বৃদ্ধ যোদ্ধা, এইভাবে দেরি হওয়াতে এবং সর্বত্র গোলমাল ও ভুল-বোঝাবুঝির ফলে বিচলিত হওয়ায় সেও হঠাৎ ভীষণ রেগে গেল, সকলকে অবাক করে দিয়ে নিজের স্বভাববিরুদ্ধভাবে তোল-এর প্রতি অনেক অশোভন উক্তি করে বসল।

অন্যের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়াটা আমি পছন্দ করি না, কিন্তু অন্য যে-কোনো লোকের মতোই আমার লোকজনদের নিয়ে মরতে পারি, এই কথা বলে একটিমাত্র সেনাদল নিয়ে সে এগিয়ে গেল।

শত্রুপক্ষের গুলিবর্ষণের মুখে একটা মাঠে নেমে এই সাহসী জেনারেলটি সৈন্যদের নিয়ে সোজা এগিয়ে গেল, গভীর উত্তেজনায় একবার ভেবেও দেখল না এই অবস্থায় একটিমাত্র সেনাদল নিয়ে যুদ্ধের মধ্যে এগিয়ে যাওয়ায় কোনো ফল হবে কি না। রাগে সে তখন দিশেহারা, বিপদ, কামানের গোলা, বুলেট-যা হোক একটা কিছু তার চাই। প্রথম আসা একটি বুলেটের তার মৃত্যু হল, অন্য বুলেটে মরল তার অনেক সৈন্য। নেহাৎ অকারণেই তার সেনাদল আরো কিছুক্ষণ সেই গুলিবর্ষণের মুখে টিকে রইল।

.

অধ্যায়-৭

এদিকে আর একটা সেনাদল সম্মুখ থেকে ফরাসিদের আক্রমণ করবে এ-রকম কথা ছিল, কিন্তু সে দলের সঙ্গে ছিল কুতুজভ। সে ভালো করেই জানত যে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিচালিত এই যুদ্ধের ফলে গোলমাল সৃষ্টি ছাড়া আর কোনো লাভই হবে না, তাই সৈন্যদের টেনে রাখতে সে সাধ্যমতো চেষ্টা করে চলল। মোটেই এগিয়ে গেল না।

ঘোট ধূসর ঘোড়াটায় চেপে সে নীরবে পথ চলতে লাগল, আর কেউ যুদ্ধের কথা বললে ধীরে সুস্থে তার কথার জবাব দিতে লাগল।

মিলরাদভিচ অগ্রসর হবার অনুমতি চাইলে তাকে বলল, আক্রমণ কথাটা তো তোমাদের সকলের জিভেই লেগে আছে, কিন্তু কোনো রকম জটিল সেনাসমাবেশ করতে যে আমরা অক্ষম সেকথাটা তোমরা কেউ বুঝতে পারছ না।

অন্য একজনকে বলল, আজ সকালে আমরা মুরাকে বন্দি করতে পারি নি, ঠিক সময়ে সেখানে পৌঁছতেও পারি নি, এখন আর কিছু করার নেই!

কুতুজভকে খবর দেয়া হল, ফরাসিদের পিছন দিয়ে যেখানে আগে কোনো সৈন্য ছিল না এখন সেখানে দুই ব্যাটেলিয়ন পোলিশ সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। একথা শুনে পশ্চাদ্বর্তী এরমোলভের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে সে বলল, দেখলে তো! এরা আক্রমণ করতে বলছে, সব রকম ফন্দি-ফিকির করতে বলছে, কিন্তু কাজের বেলায় কেউ কিছু করছে না, আর ওদিকে শত্রুপক্ষ আগে থেকে কভর পেয়ে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করে ফেলছে।

একথা শুনে এরমোল চোখ কুঁচকে একটু হাসল। বুঝতে পারল, তার উপরকার ঝড়টা উড়ে গেছে, একটু খোঁচা দিয়েই কুতুজভ এখন খুশি থাকবে।

পার্শ্ববতী রায়েভস্কিকে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে বলল, আমাকে নিয়ে বেশ একটু মস্করা করে নিলেন।

একটু পরেই এরমোলভ কুতুজভের কাছে গিয়ে সশ্রদ্ধভাবে নিবেদন করল :

ইয়োর হাইসেন, আক্রমণের হুকুম যদি দিতে চান তো এখনো সময় আছে-শত্রুরা এখনো সরে পড়ে নি। আর তা যদি না করে তো রক্ষীবাহিনী এক ফোঁটা ধোয়াও দেখতে পাবে না।

কুতুজভ জবাব দিল না, কিন্তু তাকে যখন জানানো হল যে মুরাতের সৈন্যরা পিছু হটছে তখন সে সৈন্যদের অগ্রসর হবার হুকুম দিল, যদিও প্রতি একশো পা অন্তর সে একবার করে পৌনে এক ঘণ্টার মতো থামতে লাগল।

যুদ্ধ যা করার তা অলভ-দেনিসভের কাকরাই করল, বাকি সৈন্যদের মধ্যে শত শত লোক অকারণেই প্রাণ হারাল।

এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ কুতুজভ পেল হীরক-পদক, বেনিংসেন পেল হীরক ও এক লাখ রুবল, অন্যরাও পদমর্যাদা অনুসারে মনমতো পুরস্কার পেয়ে খুশি হল, আর কর্মচারীদের মধ্যে নতুন করে রদ-বদল করা হল।

তারুতিনো যুদ্ধের পরে রুশ অফিসার ও জেনারেলরা বলল, আমাদের নিয়ে এইরকমই করা হয়, মাথা মুণ্ডু কিছুই ঠিক থাকে না। তারা বলতে চাইল, কতকগুলো বোকা মিলে সব তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে, আমরা হলে এরকম করতাম না। একথা সব সময়ই বলা হয়। কিন্তু একথা যারা বলে তারা হয় কি বলছে তাই জানে না, আর না হয় তো ইচ্ছা করেই নিজেদের ঠকায়। তারুতিনো, বরদিনো, বা অস্তারলিজ-কোনো যুদ্ধই পরিকল্পনামাফিক হয় না। এটা একেবারে মূল সত্য।

সংখ্যা স্বাধীন শক্তি একটা যুদ্ধের গতিকে প্রভাবিত করে, সে গতি-পথ আগে থেকে জানা যায় না, এবং কোনো একটি শক্তির দ্বারা নির্দেশিত পথের সঙ্গে মেলেও না।– যদি ইতিহাসকারদের, বিশেষ করে ফরাসি ইতিহাসকারদের বিবরণে দেখা যায়। যে তাদের যুদ্ধ বিগ্রহগুলি পূর্বরচিত পরিকল্পনা অনুসারেই পরিচালিত হয়েছে তাহলে একমাত্র এই সিদ্ধান্তই করা যায় যে সেসব বিবরণই মিথ্যা।

স্পষ্টতই তারুতিনোর যুদ্ধ তেলের লক্ষ্যে পৌঁছেনি, কাউন্ট অর্লভ-দেনিসভ যুদ্ধে গিয়েছিল মুরাকে বন্দি করতে, সে উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হয় নি, গোটা সেনাদলকে সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস করবার যে উদ্দেশ্য বেনিংসেন ও অন্য অনেকের ছিল তাও পূর্ণ হয় নি, নিজেকে খ্যাতিমান করার উদ্দেশ্য নিয়ে যে অফিসার যুদ্ধে গিয়েছিল তার মনস্কামনা পূর্ণ হয় নি, বা যে কসাকরা আরো বেশি লুটের মালের আশায় ছিল তাও তারা পায় নি, ইত্যাদি। কিন্তু যুদ্ধের সত্যিকারের ফল যা হল, সেদিন গোটা রাশিয়া সে ফলকে কামনা করেছিল-ফরাসিদের রাশিয়া থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করা–সেটাই যদি এ যুদ্ধের লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে তো ওই পরিস্থিতিতে যা ঘটা উচিত ছিল তারুতিনোর যুদ্ধে ঠিক তাই ঘটেছে। সে যুদ্ধের যা সত্যিকারের ফলাফল তার চাইতে সুবিধাজক আর কোনো ফলের কথা তো কল্পনাও করা যায় না। ন্যূনতম প্রচেষ্টা ও তুচ্ছ ক্ষয় ক্ষতির ভিতর দিয়ে প্রচণ্ড গোলযোগ সত্ত্বেও সারা অভিযানের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ফলটিই অর্জিত হল : পশ্চাদপসরণের স্থলে অগ্রগমন, ফরাসিদের দুর্বলতাকে উদ্মাটন, আর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নের জন্য নেপোলিয়নের বাহিনী যে আঘাতের জন্য অপেক্ষা করেছিল তারই ব্যবস্থা গ্রহণ।

.

অধ্যায়-৮

 মস্কোয়ার গৌরবময় জয়লাভের পরে নেপোলিয়ন মস্কোতে প্রবেশ করল। জয়লাভ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না কারণ যুদ্ধক্ষেত্রটি তখন ফরাসিদের দখলে। প্রাচীন রাজধানীকে পিছনে ফেলে রুশরা পশ্চাদপসরণ করে চলেছে। খাদ্য, অস্ত্র, বারুদ ও অপরিমেয় সম্পদে ভরা মস্কো এসেছে নেপোলিয়নের হাতে। ফরাসিদের তুলনায় অর্ধেক সৈন্য-শক্তি নিয়ে রুশ বাহিনী একটা মাসের মধ্যে একবারও আক্রমণের চেষ্টা পর্যন্ত করল না। নেপোলিয়নের অবস্থা তখন খুবই সুবিধাজনক। দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে সে তখন রুশ বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ধ্বংস করতে পারে, সুবিধাজনক শর্তে সন্ধির আলোচনা করতে পারে, অথবা তাতে ব্যর্থকাম হলে পিটার্সবুর্গকে ধ্বংস করতে অগ্রসর হতে পারে, এমন কি বেগতিক বুঝলে স্মোলেনস্ক বা ভিলনাতে ফিরে যেতে পারে, অথবা মস্কোতেই থেকে যেতে পারে : সংক্ষেপে, ফরাসিরা যে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে সেটাকে বজায় রাখতে কোনো বিশেষ প্রতিভারই দরকার হয় না। সেজন্য দরকার শুধু কতকগুলি অত্যন্ত সরল ও সহজ পদক্ষেপ : সৈন্যদের লুঠতরাজ করতে না দেওয়া, শীতের পোশাকের ব্যবস্থা করা–একটা গোটা বাহিনীর পক্ষে যথেষ্ট শীতবস্ত্র তখন মস্কোতে ছিল, এবং সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে রসদ সংগ্রহ করা-ফরাসি ইতিহাসকারদের মত অনুসারেই গোটা বাহিনীর ছয় মাসের মতো রসদ তখন মস্কোতে ছিল। তথাপি সব প্রতিভার সেরা প্রতিভা যে নেপোলিয়ন, ইতিহাসকারদের মতে সৈন্যদের উপর যার নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ণ ছিল, সে এর কোনো পন্থাই অবলম্বন করল না।

সেরকম কিছু তো করলই না, উপরন্তু যতগুলি পথ তার সামনে খোলা ছিল তার মধ্যে সবচাইতে বুদ্ধিহীন ও ক্ষতিকর পথটাই সে বেছে নিল। নেপোলিয়ন তো কত কিছুই করতে পারত : শীতকালটা মস্কোতে থাকতে পারত, পিটার্সবুর্গের পথে অথবা নিঝনি-নভগরদের পথ ধরে অগ্রসর হতে পারত, অথবা আরো উত্তরের অথবা আরো দক্ষিণের কোনো পথে (যেমন পরবর্তীকালে কুতুজভ যে পথ ধরেছিল) ফিরে যেতে পারত, কিন্তু সে বাস্তব ক্ষেত্রে যা করল তার চাইতে বোকামি বা বিপজ্জনক আর কিছু কল্পনাও করা যায় না। অক্টোবর পর্যন্ত সে মস্কোতেই কাটাল, সৈন্যদের যথেচ্ছ লুটতরাজের সুযোগ দিল, তারপর একটা সেনাদলকে রেখে যাবে কি না সে বিষয়ে ইতস্তত করে মস্কো পরিত্যাগ করল, যুদ্ধে যোগদান না করে কুতুজভের সঙ্গে যোগাযোগ করল, ডাইনে মোড় নিয়ে মালো-ইয়াবোশ্লাভেৎসে পৌঁছল, আবারও সোজাসুজি এগিয়ে কুতুজভের পথটা না ধরে তার পরিবর্তে বিধ্বস্ত স্মোলেনস্ক রোড ধরে মোঝায়েঙ্কে ফিরে গেল। পরবর্তী ঘটনাতেই প্রমাণ হয়েছে যে এর চাইতে নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক এবং সেনাবাহিনীর পক্ষে অধিকতর ক্ষতিকর আর কিছুই ভাবা যেত না। নিজের বাহিনীকে ধ্বংস করাই যুদি নেপোলিয়নের লক্ষ্য ছিল তাহলেও তো রুশ বাহিনী যা করুক বা না করুক, অত্যন্ত নিপুণ কোনো রণকুশলীও তো সে উদ্দেশ্যকে পুরোপুরি কার্যে পরিণত করার জন্য এর চাইতে সফল কোনো কর্মপন্থা উদ্ভাবন করতে পারত না।

প্রতিভাধর বীর নেপোলিয়ন কিন্তু এই কাজটিই করল। কিন্তু নেপোলিয়ন ইচ্ছা করেই তার বাহিনীকে ধ্বংস করেছে, অথবা অত্যন্ত বোকার মতোই সে এ কাজ করেছে, এ কথা বলা নিশ্চয়ই ঠিক হবে না, যেমন ঠিক হবে না যদি বলা হয় যে সে খুব কুশলী ও প্রতিভাধর বলেই নিজের ইচ্ছা অনুসারেই তার বাহিনীকে মস্কোতে নিয়ে গিয়েছিল।

উভয় ক্ষেত্রেই যে সব নিয়ম যুদ্ধের গতিকে পরিচালিত করেছে তার সঙ্গে নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত ক্রিয়া কলাপ আকস্মিকভাবেই মিলে গিয়েছে মাত্র, নইলে যে-কোনো সৈনিকের ব্যক্তিগত কার্যকলাপের চাইতে তার নিজের কার্যকলাপের কোনো বিশেষ গুরুত্ব নেই।

ইতিহাসকাররা ভুল করেই বলে থাকে যে মস্কোতে এসে নেপোলিয়নের বিদ্যাবুদ্ধি দুর্বলতার হয়ে গিয়েছিল, আর তারা একথা বলে কারণ ফলাফলগুলি তার কার্যাবলিকে সমর্থন করে নি। আগেও যেমন করেছে, এবং ১৮১৩ সালের পরেও যেমন করেছে, তেমনই নিজের সব ক্ষমতা ও শক্তিকে নিয়োগ করেই সে নিজের ও সেনাবাহিনীর ভালো করতেই চেয়েছে। এক্ষেত্রেও তার কার্যাবলি মিশরে, ইতালিতে, অস্ট্রিয়ায় এবং প্রুশিয়াতে তার কার্যাবলির তুলনায় কিছু কম বিস্ময়কর ছিল না। মিশরে তার প্রতিভা কতখানি খাঁটি ছিল সেকথা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না, কারণ তার বড় বড় জয়ের বর্ণনা আমরা শুনেছি ফরাসিদেরই মুখে। অস্ট্রিয়া বা প্রুশিয়াতে তার প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন আমরা করতে পারি না, কারণ সেখানেও আমাদের সব তথ্যের উৎস হয় ফরাসি, না হয় জার্মান। কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, নিজেদের লজ্জাকে ঢাকবার জন্য তার প্রতিভাকে স্বীকার করার কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই। সমস্ত ব্যাপারটাকে সহজ, সরল চোখে দেখবার অধিকার অর্জন করতে অনেক মূল্য আমরা দিয়েছি, আর তাই সে অধিকার আমরা ছাড়ব না।

অন্য সব জায়গার মতোই মস্কোতেও তার ক্রিয়াকলাপ সমান বিস্ময়কর ও প্রতিভার পরিচায়ক। মস্কোতে ঢোকার মুহূর্ত থেকে তাকে ছেড়ে যাবার ক্ষণটি পর্যন্ত সে হুকুমের পর হুকুম জারি করেছে, পরিকল্পনা পর পরিকল্পনা রচনা করেছে। কোনো নাগরিক নেই, প্রতিনিধিদল নেই, মস্কো পুড়ছে, কিন্তু তাতে সে বিচলিত হয় নি। নিজের সৈন্যদের কল্যাণ, শত্রুর কার্যকলাপ, রাশিয়ার সাধারণ মানুষের কল্যাণ, প্যারিসের ঘটনাবলির গতিবিধি, অথবা প্রত্যাশিত সন্ধির শর্তাবলী নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনা–কোনো কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায় নি।

.

অধ্যায়-৯

সামরিক ব্যাপারের দিক থেকে মস্কোতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই নেপোলিয়ন জেনারেল সাবাস্তিয়ানিকে কড়া হুকুম দিল রুশ বাহিনীর গতিবিধির উপর নজর রাখতে, বিভিন্ন পথে সেনাদল পাঠাবার ব্যবস্থা করল, আর কুতুজভকে খুঁজে বের করার ভার দিল মুরাতের উপর। তারপর ক্রেমলিনকে সুরক্ষিত করার ব্যাপারে নানারকম নির্দেশ দিল, আর রাশিয়ার গোটা মানচিত্রের বুকে ভবিষ্যতে অভিযান চালাবার একটা চমৎকার পরিকল্পনাও তৈরি করে ফেলল।

কূটনৈতিক প্রশ্নের প্রসঙ্গে নেপোলিয়ন ক্যাপ্টেন ইয়াকভলেভকে ডেকে পাঠাল। তার সর্বস্ব লুঠ করে এমনভাবে ছেঁড়া পোশাক পরিয়ে ছেড়েছে যে সে বেচারি মস্কো ছেড়ে যাবার পথ পায় নি। তাকে ডেকে এনে নেপোলিয়ন নিজের নীতি ও উদারতার কথা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝিয়ে বলল এবং সম্রাট আলেক্সান্দারের বরাবরে একটা চিঠি লিখে তাকে পিটার্সবুর্গে পাঠিয়ে দিল। চিঠিতে লিখল, তার বন্ধু এবং ভাইকে একথা জানানো সে কর্তব্য বলে মনে করে সে মস্কোতে রস্তপচিনের কার্যকলাপ খুবই শোচনীয়।

সেই একইভাবে নিজের মতামত ও উদারতার কথা তুতোলমিনকে বুঝিয়ে বলে সেই বুড়ো মানুষটিকেও পিটার্সবুর্গে পাঠাল আলোচনা চালাতে।

আইনঘটিত ব্যাপারে অগ্নিকাণ্ডের ঠিক পরেই সে হুকুম দিল, যারা আগুন লাগিয়েছে তাদের খুঁজে এনে ফাঁসি দেওয়া হোক। তার বাড়িটাকে আগুনে পুড়িয়ে দিবার হুকুম দিয়ে শয়তান রস্তপচিনকে শাস্তি দিল।

শাসনকার্যসংক্রান্ত ব্যাপারে মস্কোর জন্য একটা গঠনতন্ত্র মঞ্জুর করা হল। একটা পৌরসভা স্থাপন করে নিম্নলিখিত ঘোষণা জারি করা হল : মস্কোর অধিবাসীগণ!

 আমাদের দুর্ভাগ্য বড়ই নিষ্ঠুর, কিন্তু আপনাদের সম্রাট ও নৃপতি হিজ ম্যাজেস্ট্রি সে দুর্ভাগ্যের গতিকে রোধ করতে চান। অবাধ্যতা ও অপরাধের শাস্তি তিনি কীভাবে দিয়ে থাকেন অনেক ভয়ংকর দৃষ্টান্তের ভিতর দিয়ে সে শিক্ষা আপনারা পেয়েছেন। বিশৃঙ্খলার অবসান করে জনগণের নিরাপত্তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে কঠোর ব্যবস্থার নেয়া হয়েছে। আপনাদের ভিতর থেকেই মনোনীত একটি পিতৃতুল্য শাসক-কর্তৃপক্ষ আপনাদের পৌরসভা ও নগরসরকার গড়ে তুলবে। তারাই আপনাদের দেখাশোনা করবেন, আপনাদের প্রয়োজন ও কল্যাণের ব্যবস্থা করবেন। এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা কাঁধের উপর দিয়ে কোনোকুনিভাবে একটা লাল ফিতে পরবেন, আর পৌরপিতা তাছাড়াও একটি সাদা কোমরবন্ধ পরবে। কিন্তু তারা যখন কর্তব্যরত অবস্থায় থাকবেন না তখন শুধু বাম বাহুতে একটা লাল ফিতে জড়িয়ে রাখবেন।

নগর-পুলিশকে পুরনো ব্যবস্থামতোই গড়ে তোলা হয়েছে, তাদের কার্যকলাপে ইতিমধ্যেই ভালো ফলও পাওয়া গেছে। সরকার দুজন কমিসারি-জেনারেল বা পুলিশ-প্রধান নিয়োগ করেছেন, নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডের জন্য ওয়ার্ড-ক্যাপ্টেনও নিয়োগ করা হয়েছে। বাম বাহুতে সাদা ফিতে দেখেই আপনারা তাদের চিনতে পারবেন। ছোট-বড় মিলিয়ে বেশ কয়েকটি গির্জা খোলা হয়েছে, সেখানে নির্বিঘ্নে ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছে। আপনাদের প্রতিবেশী নাগরিকরা প্রতিদিনই নিজ নিজ গৃহে ফিরে আসছে, দুর্ভাগ্যের দরুন যে সাহায্য ও আশ্রয় তাদের প্রয়োজন তা যাতে তারা পান তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং আপনাদের অবস্থার উন্নতি করতে এইসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য এটাও প্রয়োজন যে আপনারাও এ ব্যাপারে সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন, যে দুর্ভাগ্যের শিকার আপনারা হয়েছেন যথাসম্ভব তাকে ভুলে যাবেন, এই আশা পোষণ করবেন যে আপনাদের ভাগ্য এত বেশি নিষ্ঠুর নয়, একটা বিষয়ে নিশ্চিত থাকুন যে আপনাদের শরীরের উপর এবং অবশিষ্ট সম্পত্তির উপর যারা হাত দিতে চেষ্টা করবে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে অনিবার্য ও লজ্জাকর মৃত্যু এবং আপনাদের সর্বপ্রকার নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনোরকম সন্দেহ পোষণ করবেন না, কারণ যিনি সব নৃপতির সেরা এবং সর্বাপেক্ষা ন্যায়বান এটাই তার ইচ্ছা। সৈনিকগণ ও নাগরিকগণ, আপনারা যে জাতির মানুষই হোন না কেন, জনগণের মনে আস্থা, পুনঃপ্রতিষ্ঠা করুন, পরস্পর ভাইয়ের মতো বাস করুন, পরস্পরকে সাহায্য করুন, আশ্রয় দিন, যারা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাদের অভিপ্রায়কে ব্যর্থ করতে ঐক্যবদ্ধ হোন, সামরিক ও অসামরিক কর্তৃপক্ষকে মান্য করে চলুন, তাহলেই আপনাদের চোখের জলের ধারা বন্ধ হবে।

সেনাবাহিনীর রসদের ব্যাপারে নেপোলিয়ন নির্দেশ দিল, সেনাদল পর্যায়ক্রমে মস্কো প্রবেশ করবে a la maraude (লুঠেরা হিসেবে), এমনভাবে নিজেদের রসদ সংগ্রহ করবে যাতে সেনাবাহিনীর ভবিষ্যতের ব্যবস্থা হয়ে যায়।

ধর্মের ব্যাপারে নেপোলিয়ন নির্দেশ দিল, পুরোহিতদের ফিরিয়ে আনা হোক এবং গির্জায় গির্জায় আবার ধর্মীয় অনুষ্ঠান চালু হোক।

ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেনাবাহিনীর রসদের ব্যাপারে নিম্নলিখিত ইস্তাহার সর্বত্র প্রচার করা হল : ঘোষণা শুনুন! মস্কোর যে সব শান্তিকামী অধিবাসী, শিল্পকর্মী ও মজুর দুর্ভাগ্যের দরুন নগর থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, অকারণ ভয়ে যে সব চাষীরা এখনো মাঠ থেকে দূরে সরে আছেন, তারা সকলেই শুনুন! এই রাজধানীতে শান্তি ফিরে আসছে, শৃঙখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আপনাদের দেশবাসীরা সাহসের সঙ্গে তাদের গুপ্ত ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে আসছে। তাদের প্রতি এবং তাদের সম্পত্তির প্রতি যে কোনোরকম হিংসাত্মক ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি হচ্ছে। হিজ ম্যাজেস্ট্রি সম্রাট ও নৃপতি তাদের সকলকে আশা দিয়েছেন, একমাত্র যারা তাঁর আদেশ অমান্য করছে তারা ভিন্ন আর কাউকেই তিনি শত্রু বলে মনে করেন না। আপনাদের সব দুর্ভাগ্যের অবসান করে আবার আপনাদের নিজ নিজ গৃহে ও পরিবারের মধ্যে ফিরিয়ে দিতেই তিনি চান। সুতরাং তার এই মহৎ অভিপ্রায়ে আপনারা সাড়া দিন, নির্ভয়ে আমাদের কাছে আসুন। অধিবাসীবৃন্দ, পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে আপনাদের আবাসে ফিরে আসুন। আপনাদের যা কিছু প্রয়োজন অচিরেই সব পাবেন। কারিগর ও শিল্পশ্রমিকগণ, আপনাদের কাজে, আপনাদের ঘরে, আপনাদের দোকানে ফিরে আসুন, সর্বত্রই রক্ষীরা আপনাদের সাহায্যার্থে অপেক্ষা করে আছে। আপনাদের কাজের উপযুক্ত মজুরি আপনারা পাবেন। তার শেষ কথা, যেসব চাষীরা ভয়ে বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে আছেন তারাও নির্ভয়ে ফিরে আসুন, বিশ্বাস করুন আপনাদের জন্য সব রকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। নগরে যে সব বাজার বসানো হয়েছে সেখানে চাষীরা তাদের উদ্বৃত্ত রসদ এবং জমির ফসল নিয়ে আসতে পারবেন। তারা যাতে স্বাধীনভাবে সেসব বিক্রি করতে পারেন তার জন্য সরকার নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলি নিয়েছেন : (১) আজ থেকে চাষী, কৃষিজীবী এবং মস্কোর উপকণ্ঠের অধিবাসীরা নির্বিঘ্নে তাদের সবরকম জিনসপত্র দুটি নির্দিষ্ট বাজারে নিয়ে যেতে পারবেন-তাদের একটি মখভায়া স্ট্রিটে এবং অন্যটি রসদ বাজারে অবস্থিত। (২) ক্রেতা ও বিক্রেতা যে দর সাব্যস্ত করবে সেই দরেই সব জিনিসপত্র তাদের কাছ থেকে কেনা হবে, কোনো বিক্রেতা যদি তার জিনিসের ন্যায্য দাম না পান তাহলে তিনি ইচ্ছা করলেই তার জিনিস গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন, কোনো অজুহাতেই কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না। (৩) প্রতি সপ্তাহের রবিবার ও বুধবার প্রধান কেনা-বেচার দিন স্থির করা হয়েছে, এবং তদুদ্দেশ্যে মঙ্গলবার ও শনিবার মালগাড়িগুলি পাহারা দেবার জন্য বড় রাস্তা বরাবর অনেক দূর পর্যন্ত সৈন্য মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। (৪) চাষীরা যাতে তাদের মালগাড়ি ও ঘোড়া নিয়ে নির্বিঘ্নে ফিরে যেতে পারে তদনুরূপ ব্যবস্থাও করা হয়েছে। (৫) স্বাভাবিক বেচা-কেনা চালু করার জন্য অবিলম্বে সবরকম ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নগর ও গ্রামের অধিবাসীবৃন্দ, আর মজুর ও শিল্পকর্মীরা, জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে আপনাদের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে, হিজ ম্যাজেস্ট্রি সম্রাট ও নৃপতির এই পিতৃসুলভ মনোবাঞ্ছকে আপনারা পূর্ণ করুন, জন কল্যাণের কাজে তার সঙ্গে সহযোগিতা করুন। তার পদপ্রান্তে রাখুন আপনাদের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, আমাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে বিলম্ব করবেন না!

সেনাদল ও জনসাধারণের মনোবলকে বাড়িয়ে তুলবার জন্য মাঝে মাঝেই অবস্থার পর্যালোচনা করে পুরস্কার বিতরণ করা হতে লাগল। অধিবাসীদের সান্ত্বনা দেবার জন্য সম্রাট স্বয়ং অশ্বারোহণে রাজপথ পরিক্রমা করতে লাগল এবং প্রচুর রাজকার্য থাকা সত্ত্বেও তার হুকুমে প্রতিষ্ঠিত থিয়েটারগুলিতে পদার্পণ করতে লাগল।

মুকুটধারীদের শ্রেষ্ঠ ধর্ম মানবপ্রীতির ক্ষেত্রেও নেপোলিয়ন সাধ্যায়ত্ত সবকিছুই করল। সমস্ত দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানের মাথায় Maisonde ma mere শব্দগুলি খোদাই করিয়ে গভীর পুত্রস্নেহের সঙ্গে রাজকীয় মহানুভবতাকে মিশিয়ে প্রকাশ করল। অনাথ হাসপাতালটি পরিদর্শন করে অনাথ শিশুদের দিকে নিজের হাতে বাড়িয়ে দিত চুম্বনের জন্য, তুলেমিনের সঙ্গে সদয়ভাবে কথাবার্তাও বলত। তারপর, থিয়ের্সের বর্ণনা অনুসারে নিজের তৈরি জাল রুশ টাকায় সৈন্যদের বেতন দেবার হুকুম করল : নিজের এবং ফরাসি বাহিনীর যোগ্য উপায়ে এইভাবে টাকার ব্যবস্থা করে যাদের সর্বস্ব পুড়ে গেছে তাদেরও সাহায্য দেবার বন্দোবস্ত করল। কিন্তু যেহেতু তখন খাদ্য এতই দুর্মূল্য যে তা বিদেশীদের দেওয়া চলে না, আর বিদেশীরা তো অধিকাংশই শত্রু, তাই বাইরে থেকে খাদ্য কেনবার জন্য তাদের টাকা দেওয়াটাই নেপোলিয়ন বাঞ্ছনীয় মনে করল এবং তাদের মধ্যে কাগজের রুবল বিতরণের ব্যবস্থা করল।

সেনাদলের মধ্যে কঠোর শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অনবরত হুকুম জারি করা হতে লাগল যে যারা সামরিক কর্তব্য পালন না করবে তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে এবং কঠোর হাতে ডাকাতি বন্ধ করতে হবে।

.

অধ্যায়-১০

 কিন্তু আশ্চর্যের কথা, এইসব বিধান, প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনা অনুরূপ পরিস্থিতিতে প্রচারিত অন্য সব বিধি ব্যবস্থার চাইতে কোনো অংশে খারাপ না হলেও সমস্যার একেবারে মূলে পৌঁছতে পারল না, মূল মন্ত্র থেকে বিচ্যুত ঘড়ির কাঁটার মতো উদ্দেশ্যবিহীন এলোমেলোভাবে দুলতে লাগল যেন।

সামরিক দিক থেকে বলা যায়, অভিযানের যে পরিকল্পনা সম্পর্কে থিয়ের্স মন্তব্য করেছে এর চাইতে গভীরতর, কুশলতর, বা আশ্চর্যতর কোনো পরিকল্পনা তার (নেপোলিয়নের) প্রতিভার পক্ষেও সম্ভব হয়নি, সেটাকে কিন্তু মোটেই কার্যকর করা যায় নি, বা কখনো যেতও না, কারণ সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলির সঙ্গে সে পরিকল্পনার কোনো যোগই ছিল না। ক্রেমলিনের যে সুরক্ষা-ব্যবস্থার জন্য লা মঞ্জু (স্বর্গীয় আশীর্বাদধন্য বাসিল গির্জাকে নেপোলিয়ন এই নামেই উল্লেখ করত) গির্জাকে ধূলিসাৎ করতে হত সেটা একেবারেই বৃথা প্রমাণিত হল। ক্রেমলিনে সুরঙ্গ খোঁড়ার ফলে নেপোলিয়নের এই মনোবাসনা পূর্ণ করারই সহায়ক হল যে সে মস্কো ছেড়ে চলে যাবার পরেই যেন ক্রেমলিনকে উড়িয়ে দেওয়া হয়–যেমন ছোট ছেলে চায় যে মেঝের যে জায়গাটাতে সে আঘাত পেয়েছে, কেউ এসে সেই জায়গাটাতে আঘাত করুক। রুশ বাহিনীর পিছু নেবার ব্যাপারে নেপোলিয়নের খুবই উৎসাহ ছিল, আর তার ফলও হল অশ্রুতপূর্ব। ষাট হাজার সৈন্যের রুশ বাহিনী ফরাসি সেনাপতিদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, আর-থিয়ের্সের মতে-যেভাবে একটা হারানো পিন খুঁজে পাওয়া যায় সেইভাবে ঘটনাক্রমেই তাদের দেখা মিলল মুরাতের কৌশল ও প্রতিভার দৌলতে।

কূটনীতির ব্যাপারে, তুতোলমিন ও ইয়াকভলেভের কাছে নিজের মহানুভবতা ও ন্যায়পরায়ণতার যেসব বুলি নেপোলিয়ন আউড়েছিল সেসবই বৃথা হয়ে গেল : নেপোলিয়ন এই দূতদের সঙ্গে দেখা করল না এবং তাদের দৌত্যের কোনো জবাবও দিল না।

আইনঘটিত ব্যাপারে, তথাকথিত অগ্নিপ্রদানকারীদের মৃত্যুদণ্ডের পরেও মস্কোর বাকি অংশটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

শাসন-পরিচালনার ব্যাপারে, পৌরসভা প্রতিষ্ঠার ফলে লুটতরাজ বন্ধ হল না, শুধু যাদের নিয়ে পৌরসভা গঠিত হল তারাই শৃঙ্খলা রক্ষার নামে মস্কোতে লুটতরাজ চালাল, আর না হয় তো লুটতরাজের হাত থেকে কেবলমাত্র নিজেদের ধন-সম্পত্তি বাঁচাবার চেষ্টা করল।

ধর্মের ব্যাপারেও বিশেষ কোনো সুফল দেখা গেল না। মস্কোতে যে দু-তিনজন পুরোহিতকে পাওয়া গেল তারা নেপোলিয়নের ইচ্ছা পালন করতে চেষ্টা করল, কিন্তু প্রার্থনা-অনুষ্ঠান চালাবার সময় জনৈক ফরাসি সৈনিক তাদের একজনের মুখে চড় মেরে বসল, এবং অপরজনের সম্পর্কে জনৈক ফরাসি অফিসার মন্তব্য করল : আমি যে পুরোহিতটিকে খুঁজে এনে ধর্মানুষ্ঠানের কাজ করতে বললাম সে গির্জাটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তালা লাগিয়ে দিল। কিন্তু সেই রাতেই আবার দরজা ভাঙা হল, তালাগুলো চূর্ণবিচূর্ণ করা হল, পুঁথিগুলো নষ্ট করা হল এবং অন্য সবরকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করা হল।

ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে শিল্প-শ্রমিক ও চাষীদের প্রতি যে ঘোষণা প্রচার করা হল তাতে কোনোরকম সাড়া মিলল না। শিল্প-শ্রমিকদের পাত্তাই পাওয়া গেল না, আর যেসব কমিসাররা ঘোষণাপত্র নিয়ে শহর ছেড়ে অনেক বেশি দূরে গেল, চাষীরা তাদের ধরে ধরে খুন করল।

জনসাধারণ ও সৈন্যদের মনোরঞ্জনের জন্য যেসব থিয়েটারের ব্যবস্থা করা হল তাতেও কোনো সুফল পাওয়া গেল না। খাঁটি এবং মেজি কাগজের টাকায় তখন মস্কো ছেয়ে গেছে, তার দামও পড়ে গেছে। লুণ্ঠনকারী ফরাসিদের একমাত্র লক্ষ্য সোনার দিকে। শুধু যে নেপোলিয়নের দেয়া কাগজের টাকাই মূল্যহীন হয়ে পড়ল তাই নয়, সোনার তুলনায় রুপোর দামও পড়ে গেল।

কিন্তু সেসময়ে কর্তৃপক্ষ যেসব হুকুম জারি করেছিল তার মধ্যে বিফলতার সবচাইতে বিস্ময়কর উদাহরণ হল লুটতরাজ বন্ধ করতেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নেপোলিয়নের প্রচেষ্টা।

সামরিক কর্তৃপক্ষকের কাছ থেকে এই সব প্রতিবেদনই পাওয়া গেল : নির্দেশনামা সত্ত্বেও শহরে লুটতরাজ অবাধে চলেছে। এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসে নি এবং একটি ব্যবসায়ীও বিধিসম্মতভাবে ব্যবসাপত্র চালাচ্ছে না। সেনাদলের সঙ্গের ব্যবসায়ীরাই শুধু ব্যবসাপত্র চালাতে সাহস করছে, আর তারা তো বেচছে শুধু চোরাই মাল।

আমার ওয়ার্ডের আশেপাশে তৃতীয় কোরের সেনাদল লুটতরাজ চালাচ্ছে, যেসব হতভাগ্য অধিবাসী যৎসামান্য যা কিছু এখনো হাতে আছে তাই নিয়ে মাটির নিচে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিয়েও সন্তুষ্ট না হয়ে সৈনিকরা নিষ্ঠুরভাবে তাদের তরবারি দিয়ে আঘাত করছে, এরকম ঘটনা বারবার আমার চোখে পড়েছে।

সৈন্যরা ডাকাতি করছে, লুট করছে, এছাড়া নতুন কিছু নেই–৯ই অক্টোবর।

ডাকাতি ও লুট সমানে চলেছে। আমাদের অঞ্চলে একটা চোরের দল গড়ে উঠেছে, শক্তিশালী সেনাদল পাঠিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা উচিত-১১ই অক্টোবর।

সম্রাট অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছেন এই কারণে যে লুটতরাজ বন্ধ করার কড়া নির্দেশ সত্ত্বেও লুটেরা রক্ষীবাহিনীদের দলে দলে ক্রেমলিনে ফিরতে দেখা যাচ্ছে। পুরনো রক্ষীদলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও লুটতরাজ তীব্র আকারে নতুন করে দেখা দিয়েছে গতকাল সন্ধ্যায়, রাতে ও আজ। সম্রাট অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন, তার দেহরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত যেসব বাছাই সৈনিকদের উচিত শৃঙ্খলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা তারাই এতদূর অবাধ্য হয়ে উঠেছে যে সামরিক রসদের ঘাঁটি ও গুদামে পর্যন্ত তারা হানা দিয়েছে। অন্যরা আবার শান্ত্রী ও অফিসারদের অমান্য করে, এমন কি তাদের গালাগালি ও মারধোর করে নিজেদেরই অসম্মান ডেকে এনেছে।

শাসনকর্তা লিখেছে, রাজপ্রাসাদের গ্র্যান্ড মার্শাল তিক্ত ভাষায় অভিযোগ করেছে, বারবার হুকুম দেওয়া সত্ত্বেও সৈন্যরা সারা উঠানে, এমন কি সম্রাটের জানালার নিচেও মলমূত্র ত্যাগ করছে।

লাগামছাড়া গরু-ঘোড়ার মতো বেপরোয়াভাবে ইতস্তত ছুটাছুটি করে যে ফসল তাদের অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারত তাকেই পায়ের নিচে মাড়িয়ে সৈন্যরা মস্কোতে থেকে দিনের পর দিন মরতে লাগল। কিন্তু তবু তারা মস্কো ছেড়ে গেল না।

তবু সেইদিন থেকে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালাতে শুরু করল যেদিন স্মোলেনস্ক রোডে মালবাহী ট্রেনটা আটক করা হল এবং তারুতিনোতে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। একটা সেনাদল পরিদর্শনের সময় অপ্রত্যাশিতভাবে তারুতিনো যুদ্ধের সংবাদ পেয়েই রুশদের শাস্তি দেবার ইচ্ছা জাগল নেপোলিয়নের মনে (থিয়ের্স তাই লিখছে), আর সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর দাবি মেনে নিয়ে তাদের প্রত্যাবর্তনের আদেশ দিল।

মস্কো থেকে পালাবার সময় সৈন্যরা যে যা চুরি করেছিল সব সঙ্গে নিয়ে চলল। নেপোলিয়নও তার ব্যক্তিগত সব সম্পত্তি সঙ্গে নিয়েই চলল, কিন্তু একটা মাল-ট্রেন সেনাবাহিনীর গতিরোধ করায় খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল (থিয়ের্সের কথা)! তবু যুদ্ধের অভিজ্ঞতার দরুন বাড়তি যানবাহনগুলো পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দিল না। সৈন্যরা যেসব কালিচে-গাড়ি ও অন্য বড় বড় গাড়িতে করে যাচ্ছিল সেদিকে তাকিয়ে থেকে নেপোলিয়ন বলল, এ তো ভালোই হয়েছে, রসদ এবং রুগ্ন ও আহতদের বয়ে নেবার জন্য এই গাড়িগুলি ব্যবহার করা যাবে।

গোটা সেনাবাহিনীর অবস্থা দাঁড়াল সেই আহত জন্তুটির মতো যে বুঝতে পারছে যে একটু একটু করে সে মরতে চলেছে অথচ কি করছে তা নিজেই জানে না। মস্কোতে প্রবেশের মুহূর্ত থেকে তার ধ্বংস পর্যন্ত নেপোলিয়ন ও তার সেনাবাহিনীর সমর-কৌশল ও লক্ষ্যকে পর্যালোচনা করা আর একটি মারাত্মকভাবে আহত জন্তুর মৃত্যুকালীন লাফঝাঁপ ও থরো থরো কাঁপন লক্ষ্য করা একই কথা। প্রায়ই দেখা যায় আহত জন্তুটি খসখস শব্দ শুনলেই সোজা শিকারির বন্দুকের দিকে ছুটে যায়, একবার এগিয়ে যায় আবার পিছিয়ে আসে এবং নিজের মৃত্যুকেই ত্বরান্বিত করে। তারুতিনো যুদ্ধের খসখসানি জন্তুটিকে ভয় পাইয়ে দিল, সে ধেয়ে গেল শিকারির বন্দুকের দিকে, তার কাছে পৌঁছে গেল, ফিরে এল এবং শেষপর্যন্ত-যে-কোনো বন্য পশুর মতোই–সেই একান্ত অসুবিধাজনক ও বিপজ্জনক পথ ধরেই পিছন দিকে ছুটতে লাগল যেখানকার গন্ধ তার পরিচিত।

একটি অসভ্য মানুষ যেমন ভাবে যে, জাহাজের সম্মুখস্থ প্রতিমূর্তিটাই বুঝি জাহাজটাকে চালায়, তেমনই আমরাও মনে করি যে নেপোলিয়নই এত সব গতিবিধির নেতা, কিন্তু এই সময়টাতে নেপোলিয়ন যেন সেই ছোট ছেলেটির মতোই আচরণ করতে লাগল যে গাড়ির ভিতরে বসে একজোড়া দড়ি হাতে নিয়ে ভাবে যে গাড়িটাকে সেই চালাচ্ছে।

.

অধ্যায়১১

৬ই অক্টোবর খুব সকালে পিয়ের চালাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, ফিরে এসে দরজার পাশে থেমে বাঁকা-পা, নীল-ধূসর ছোট কুকুরটার সঙ্গে খেলা করতে শুরু করল। কুকুরটা তার চারপাশে লাফাতে লাফাতে লাগল। ছোট কুকুরটা তাদের চালাতেই থাকে, রাত্তিরে কারায়েভের পাশে ঘুমোয়, মাঝে মাঝে শহরে চলে যায়, কিন্তু ঠিক ফিরে আসে। হয় তো কোনোদিনই কুকুরটার কোনো মালিক ছিল না, এখনো নেই, তাই ওর কোনো নামও নেই। ফরাসিরা ওকে ডাকত আজোর বলে, গল্প-বলিয়ে সৈনিকটি ওকে ডাকে ফেমগালকা, কারাতায়েভ ও অন্যরা ডাকে গ্রে, কখনো বা ফ্ল্যাবি। কোনো মনিব নেই, নাম নেই, জাতি-বর্ণ নেই, কিন্তু তাতে নীল-ধূসর কুকুরটার কোনো সুখ-দুঃখ নেই। লোমশ লেজটাকে পালকের মতো উচ্চে তুলে নাচায়, প্রায়ই পিছনের একটা পা তুলে তিন পায়ে এমন সুন্দর দৌড়ায় যেন চারটে পা ব্যবহার করাটাই অতি বাজে কাজ। সবকিছুতেই ও খুশি। কখনো গড়াগড়ি দিতে দিতে আনন্দে ঘেউ-ঘেউ করে, কখনো গম্ভীর মুখে রোদ পোয়ায়, আবার কখনো একটুকরো কাঠ বা খড় নিয়েই মনের সুখে খেলা করে।

এতদিনে পিয়েরের পোশাক বলতে দাঁড়িয়েছে একটা ময়লা ছেঁড়া শার্ট, একজোড়া সৈনিকদের ট্রাউজার-কারায়েভের পরামর্শে শরীরটা গরম রাখবার জন্যে সেটাকে সে গোড়ালির কাছে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়েছে–আর চাষীদের কোট ও টুপি। এই সময়ের মধ্যে তার শরীরের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আর তাকে শক্ত-সমর্থ বলা যায় না, তবে তাকে দেখলে তার বংশানুক্রমিক শক্তি-সামর্থ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। গোঁফ-দাড়িতে মুখের নিচটা ঢেকে গেছে, উকুন-ভরা জট-পাকানো চুল মাথাটাকে ঢেকে রেখেছে টুপির মতো। চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে একটা দৃঢ়, শান্ত ও সোসাহ সতর্কতার ভাব। তার চোখে আগে যে অলস গতি দেখা যেত তার জায়গায় এখন দেখা দিয়েছে একটা সোৎসাহ বিরোধিতা ও কাজের মনোভাব।

পিয়ের প্রথমে মাঠের উপর দিয়ে তাকিয়ে গাড়ি-ঘোড়া ও অশ্বারোহীদের দেখল, তারপর দৃষ্টি ফেরাল নদীর ওপারে, তারপর কুকুরটার দিকে, এবং শেষে নিজের পায়ের নোংরা, মোটা, বড় বড় আঙুলগুলোকে নানা ভঙ্গিতে নেড়েচেড়ে সেইদিকেই তাকাল। যতবার খোলা পা দুটোর দিকে তাকাচ্ছে ততবারই আত্মতুষ্টিভরা হাসিতে মুখটা ভরে উঠছে। পা দুটোর দিকে তাকালেই তার মনে পড়ে যায় এই কয়েক সপ্তাহের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার কথা, আর সে স্মৃতি তার কাছে মধুর।

কয়েকদিন ধরেই আবহাওয়া বেশ শান্ত ও পরিষ্কার, সকালবেলা কিছুটা নীহার পড়ে–একেই বলে বুড়িবৌদের গ্রীষ্মকাল।

বাতাস রৌদ্রতপ্ত, সকালবেলাকার নীহারের সতেজ স্পর্শে সেই আতপ্ত বাতাস আরো মনোরম লাগছে।

দূরে ও নিকটে সবকিছুর উপরেই লেগেছে সেই হঠাৎ আলোর ঝলকানি যা শুধু হেমন্তের এই সময়টাতেই দেখা যায়। দূরে দেখা যাচ্ছে চাতক পাহাড়, তার গ্রাম, গির্জা ও সাদা বড় বাড়িটা সমেত। পাতা-জরা গাছগুলি, বালি, ইট ও বাড়িগুলির ছাদ, গির্জার সবুজ চূড়া, আর দূরের সাদা বাড়ির কোণগুলি-স্বচ্ছ বাতাসে সবকিছুই ফুটে উঠেছে সূক্ষ্ম রেখায় ও অস্বাভাবিক স্পষ্টতায়। কাছেই দেখা যাচ্ছে ফরাসিদের দ্বারা দখল-করা অর্ধদগ্ধ প্রাসাদটার ধ্বংসাবশেষ, বেড়ার ধারে গাঢ় সবুজ রঙের লিলাক ফুলের ঝোঁপগুলোও চোখে পড়ছে। যে ধসে-পড়া বাড়িটাকে খারাপ আবহাওয়ায় অত্যন্ত কুৎসিত দেখায়, এখনকার নিশ্চল পরিষ্কার উজ্জ্বলতায় তাকেও কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে।

জনৈক ফরাসি কর্পোরাল ঘরোয়াভাবে কোটের বোম খুলে মাথায় একটা খুলি-টুপি পরে এবং মুখে একটা ছোট পাইপ গুঁজে চালার কোণ থেকে বেরিয়ে এসে বন্ধুর মতো চোখ টিপে পিয়েরের দিকে এগিয়ে গেল।

কী একখানা রোদ মঁসিয় কিরিল! (পিয়েরকে তারা ওই নামেই ডাকে।) কি বলেন? ঠিক যেন বসন্তকাল।

দরজায় হেলান দিয়ে কর্পোরাল পাইপটা পিয়েরের দিকে এগিয়ে দিল, যদিও সে যতবার পাইপটা এগিয়ে দিয়েছে ততবারই পিয়ের সেটা ফিরিয়ে দিয়েছে।

এই আবহাওয়ায় পথে বের হওয়া… লোকটি বলতে শুরু করল। পথে বের হবার কথায় পিয়ের ব্যাপারটা জানতে চাইলে কর্পোরাল বলল যে প্রায় সব সৈন্যই তো চলে যাচ্ছে, আর ওইদিনই বন্দিদের সম্পর্কে একটা আদেশ প্রচার করা হবে। সকলভ নামক এই চালারই পিয়েরের একজন সঙ্গীর মুমূর্ষ অবস্থা, পিয়ের কর্পোরালকে জানাল যে তার সম্পর্কে একটা কিছু করা দরকার। জবাবে কর্পোরাল পিয়েরকে বলল, পিয়েরের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, তাদের একটা অ্যাম্বুলেন্স ও একটা স্থায়ী হাসপাতাল আছে, রোগীদের যথাযথ ব্যবস্থা অবশ্যই করা হবে, আর কর্তৃপক্ষ সম্ভাবিত সব ঘটনার কথা আগে থেকেই জানেন।

তাছাড়া, আপনি তো জানেন মঁসিয় কিরিল, আপনি শুধু ক্যাপ্টেনকে মুখের কথাটি বললেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তিনি কখনই কোনো কিছু ভুলে যান না। তিনি রোদে বের হলে তাঁর সঙ্গে কথা বলুন, আপনার জন্য তিনি সবকিছু করবেন।

 (কর্পোরাল যে ক্যাপ্টেনটির কথা বলল তার সঙ্গে পিয়েরের প্রায়ই দীর্ঘ গাল-গল্প হয়, সে লোকটি তাকে অনেক সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছে।)

এই তো সেদিন তিনি আমাকে বললেন, কি জান সেন্ট মাস, সিয় কিরিল একজন লেখাপড়া-জানা লোক, ফরাসি বলতে পারেন। তিনি একজন দুর্দশাগ্রস্ত সিনর, কিন্তু একজন মানুষের মতো মানুষ। তিনি সব জানেন, বোঝেন…তিনি যদি আমার কাছে কিছু চান, আমি তাকে ফিরিয়ে দেব না। কি জান, লেখাপড়া শিখলেই মানুষ শিক্ষার কদর ও ভদ্রলোকের দাম বোঝে। আপনার সুবিধার জন্যই কথাটা বললাম মঁসিয় কিরিল। সেদিন যদি আপনি না থাকতেন তাহলে তো অবস্থা বেশ খারাপই হত।

আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কর্পোরাল চলে গেল। (যে ঘটনার কথা সে উল্লেখ করল সেটা কয়েকদিন আগে ঘটেছে-বন্দি ও ফরাসি সৈন্যদের মধ্যে একটা লড়াই বেধে গেলে পিয়ের তার বন্ধুদের শান্ত করেছিল।) পিয়রকে কর্পোরালের সঙ্গে কথা বলতে শুনে কয়েকজন বন্দি ব্যাপারটা জানতে চাইল। পিয়ের যখন ফরাসি সৈন্যদের মস্কো ছেড়ে চলে যাবার কথা বলছিল, তখন ছিন্নবস্ত্র পরিহিত একটি ফরাসি সৈন্য বিবর্ণ মুখে চালাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। অভিবাদনের ভঙ্গিতে তাড়াতাড়ি কপালে আঙুল ঠেকিয়ে সে পিয়েরকে জিজ্ঞাসা করল, প্রাতোচ নামক যে সৈন্যটিকে সে একটি শার্ট দিয়ে গেছে সেলাই করতে সে চালাঘরে আছে কি না।

এক সপ্তাহ আগে ফরাসি সৈন্যদের জুতোর চামড়া ও কাপড় দেয়া হয়েছে, তারা আবার সেগুলো বন্দিদের দিয়েছে বুট ও শার্ট তৈরি করে দেয়ার জন্য।

পরিষ্কার ভাঁজ-করা একটি শার্ট নিয়ে এসে কারাতায়েভ বলল, তৈরি, একেবারে তৈরি ভাই!

গরম আবহাওয়ায় কাজের সুবিধার জন্য কারাতায়েভ পরেছে শুধু ট্রাউজার আর ঝুল-কালির মতো কালো একটা ঘেঁড়া শার্ট। লেবুগাছের বাকল দিয়ে তৈরি একটা টুকরো দিয়ে চুলটাকে গোল করে বেঁধেছে, ফলে তার গোল মুখটাকে আরো গোল এবং আরো সুন্দর দেখাচ্ছে।

নিজের হাতে সেলাই করা শার্টটাকে মেলে ধরে প্লান হেসে বলল, কথা যখন দিয়েছি তখন কাজ হাসিল হবেই। বলেছিলাম শুক্রবার, এই নাও শার্ট তৈরি।

ফরাসি সৈনিকটি অস্বস্তির সঙ্গে চারদিকে তাকাল, তারপর ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে তাড়াতাড়ি ইউনিফর্মটা খুলে ফেলে শার্টটা পরে ফেলল। তার শুকনো, বিবর্ণ শরীরে শুধু একটা তেল-চিটচিটে লম্বা সিল্কের ওয়েস্টকোট পরা ছিল, শার্ট ছিল না। নিশ্চয়ই তার মনে ভয় ছিল যে বন্দিরা তাকে দেখে হাসবে, তাই সে খুব তাড়াতাড়ি শার্টের মধ্যে মাথাটা গলিয়ে দিল। কিন্তু বন্দিরা একটা কথাও বলল না।

শার্টটাকে টেনে দিয়ে প্লাতন বারবার বলতে লাগল, দেখ, কী সুন্দর মাপমতো হয়েছে।

 চোখ না তুলেই মাথা ও হাত শার্টের মধ্যে গলিয়ে দিয়ে ফরাসিটি শার্টের সেলাইটার পরীক্ষা করতে লাগল।

নিজের কাজে নিজেই খুশি হয়ে একগাল হেসে প্লাতন বলল, কথা যখন দিয়েছি তখন কাজ হাসিল হবেই। বলেছিলাম শুক্রবার, এই নাও শার্ট তৈরি।

ফরাসি সৈনিকটি অস্বস্তির সঙ্গে চারদিকে তাকাল, তারপর ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে তাড়াতাড়ি ইউনিফর্মটা খুলে ফেলে শার্টটা পরে ফেলল। তার শুকনো বিবর্ণ শরীরে শুধু একটা তেল-চিটচিটে লম্বা সিল্কের ওয়েস্টকোট পরা ছিল, শার্ট ছিল না। নিশ্চয়ই তার মনে ভয় ছিল যে বন্দিরা তাকে দেখে হাসবে, তাই সে খুব তাড়াতাড়ি শার্টের মধ্যে মাথাটা গলিয়ে দিল। কিন্তু বন্দিরা একটা কথাও বলল না।

শার্টটাকে টেনে দিয়ে প্লাতন বারবার বলতে লাগল, দেখ, কী সুন্দর মাপমতো হয়েছে।

 চোখ না তুলেই মাথা ও হাত শার্টের মধ্যে গলিয়ে দিয়ে ফরাসিটি শার্টের সেলাইটাই পরীক্ষা করতে লাগল।

নিজের কাজে নিজেই খুশি হয়ে একগাল হেসে প্লাতন বলল, দেখ ভাই, এটা তো সেলাইয়ের দোকান নয়, আর ঠিকমতো যন্ত্রপাতিও আমার কাছে নেই, কথায় বলে, একটা উকুন মারতেও যন্ত্র থাকা চাই।

সৈনিকটি ফরাসিতে বলল, ভালো হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে, তোমাকে ধন্যবাদ। কিন্তু কিছুটা কাপড় তো বাড়তি হবার কথা।

কারাতায়েভ তবু নিজের কাজের প্রশংসা করেই বলতে লাগল, শরীরের সঙ্গে বসে গেলে মাপে আরো ঠিক হবে। পরতে খুব ভালো লাগবে, আরাম পাবে…

ফরাসিটি পুনরায় হেসে বলল, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ বুড়ো।…কিন্তু বাড়তি কাপড়টা? এক রুবলের নোটটা বের করে কারাতায়েভকে দিল। কিন্তু বাড়তি কাপড়টা আমাকে দিয়ে দাও।

পিয়ের বুঝল, প্লন ফরাসিটির কথাগুলো বুঝতে পারছে না, কিন্তু কিছু বলল না। টাকাটা পেয়ে কারাতায়েভ ফরাসি সৈনিকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে আবার নিজের কাজের প্রশংসায় মেতে উঠল। কিন্তু ফরাসিটির বাড়তি কাপড়টুকু চাই-ই, তাই সে পিয়েরকে বলল তার কথাগুলি ভাষান্তরিত করে দিতে।

কারাতায়েভ তখন বলল, ওটুকু কাপড় কিসের জন্য চাইছ? ও দিয়ে আমাদের জন্য পায়ের পট্টি হত। ঠিক আছে, কিছু মনে করো না। হঠাৎ কারায়েভের মুখের ভাবটা বদলে গেল, বিষণ্ণ মুখে নিজের শার্টের ভিতর দিয়ে এক বান্ডিল কাটা কাপড় বের করে ফরাসিটিকে দিল। ভাইরে! বলেই কারাতায়েভ তার দিকে না তাকিয়েই চলে গেল। ফরাসিটি কাপড়ের দিকে তাকাল, একমুহূর্ত কি যেন ভাবল, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পিয়েরের দিকে তাকাল, আর তারপরেই যেন পিয়েরের চাউনিই তাকে কিছু বলে দিয়েছে এমনিভাবে হঠাৎ সে মুখটা লাল করে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে বলল, পাতোচ! হেই প্লাতোচ! এগুলো তুমিই রেখে দাও! টুকরো কাপড়গুলো ফিরিয়ে দিয়েই মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।

মাথাটা নেড়ে নেড়ে কারাতায়েভ বলল, এই তো, চেয়ে দেখ। সকলে বলে, ওরা খৃস্টান নয়, ওদেরও মন আছে। তাই তো বুড়োরা বলে : যে হাত ঘামে সেই হাতই খোলা, আর শুকনো হাতই মুঠো করা। লোকটির পোশাক নেই, তবু সে এগুলো ফিরিয়ে দিয়ে গেল।

কারাতায়েভ চিন্তিতভাবে হেসে কাপড়ের টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।

কিন্তু এ দিয়ে চমৎকার পায়ের পট্টি তৈরি হবে, এই কথা বলে সে চালাঘরে ঢুকে গেল।

.

অধ্যায়-১২

পিয়েরকে বন্দি করার পরে চার সপ্তাহ কেটে গেছে, ফরাসিরা তাকে সাধারণ কয়েদিদের কাছ থেকে সরিয়ে অফিসারদের চালায় নিয়ে যেতে চেয়েছে, কিন্তু যে চালায় তাকে প্রথম রাখা হয়েছিল পিয়ের সেখানেই রয়ে গেছে।

একটি মানুষের পক্ষে যত রকম দুঃখকষ্ট সহ্য করা সম্ভব, দগ্ধ ও বিধ্বস্ত মস্কোতে তারই অভিজ্ঞতা পিয়েরের হয়েছে, কিন্তু তার শরীরিক শক্তি ও স্বাস্থ্যকে ধন্যবাদ, বিশেষ করে ধন্যবাদ এই সত্যকে যে এত সব দুঃখকষ্ট এমন ধীরে ধীরে এসেছে যে কবে তার শুরু হয়েছে তাই সে বলতে পারে না, এই পরিস্থিতিকে সে যে শুধু হেলায় সহ্য করেছে তাই নয়, সহ্য করেছে আনন্দের সঙ্গে। আর ঠিক এই সময়েই মনের সেই শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য সে পেয়েছে যার জন্য এতদিন সে বৃথাই চেষ্টা করে এসেছে। এতকাল নানাভাবে মনের এই শান্তির সন্ধানে সে ফিরেছে। শান্তি খুঁজেছে বিশ্ব-মানব-প্রীতির মধ্যে, ভ্রাতৃসংঘের কর্মধারার মধ্যে, শহর-জীবনের ভোগ সুখের মধ্যে, মদ্যপানে, আত্মত্যাগের বীরত্বপূর্ণ কাজকর্মের মধ্যে এবং নাতাশার প্রতি রোম্যান্টিক ভালোবাসার মধ্যে। কিন্তু হায়, সেসব সন্ধান ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আজ কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা না করেই সেই শান্তি ও অন্তরের মিল সে খুঁজে পেয়েছে মৃত্যুর ভয়াবহতা, দুঃখকষ্ট ও কারায়েভের অন্তর-সম্পদের মধ্যে।

রাশিয়া, যুদ্ধ, রাজনীতি, বা নেপোলিয়নের চিন্তা এখন আর তার মনে আসে না। সে এখন পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে, এগুলো তার কাজ নয়, এসব ব্যাপারে তার মতামত কেউ চায় না, আর তাই তার দিক থেকে মতামত দেবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। রাশিয়া আর গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া একসূত্রে গাঁথা নয়, কারায়েভের এই কথাগুলি সে মনে মনে আওড়াল। কথাগুলি তাকে আশ্চর্য রকমের সান্ত্বনা এনে দেয়। নেপোলিয়নকে হত্যা করার বাসনা এখন তার কাছে অর্থহীন, এমন কি হাস্যকর মনে হয়। স্ত্রীর প্রতি ক্রোধ এবং তার সঙ্গে জড়িত হয়ে নিজের নামকে কলংকিত করার দুশ্চিন্তা এখন তার কাছে শুধু তুচ্ছ নয়, একটা মজার ব্যাপার বলে মনে হয়। সেই নারী কোথায় কি রকম জীবন যাপন করছে, তাতে তার কি যায় আসে? তাদের বন্দির নাম যে কাউন্ট বেজুখভ এ-কথা তারা জানুক বা না জানুক তাতে কার কি, আর তার নিজেরই বা কি?

এখন পিয়েরের দিনমানের একমাত্র স্বপ্ন, কবে সে মুক্তি পাবে। অথচ পরবর্তীকালে সারা জীবন ভর মহা উৎসাহের সঙ্গে সে চিন্তা করেছে ও কথা বলেছে এই একটি মাসের বন্দি-জীবনের কথা, সেই আনন্দঘন অনুভূতির কথা এবং মনের সেই পরিপূর্ণ শান্তি ও অন্তর-মুক্তির কথা যার অভিজ্ঞতা সে পেয়েছিল শুধু সেই কয়টি সপ্তাহে।

প্রথম দিনটিতেই খুব ভোরে উঠে চালাঘর থেকে বেরিয়ে সে যখন প্রথম দেখেছিল আধো অন্ধকারে ঢাকা কুমারী মাতার নব কনভেন্টের গম্বুজ ও ক্রুশ, ধুলিমলিন ঘাসের উপর সাদা শিশিরকণাগুলি, চাতক পাহাড়, বহুদূরে বিলীয়মান আঁকাবাঁকা নদীটির তরুছায়া-ঢাকা তীর, প্রথম যখন শ্বাস নিয়েছিল তাজা বাতাসে আর মস্কো থেকে উড়ে আসা কাকদের ডাক শুনেছিল মাঠের উপরে, একটু পরে যখন পূর্বদিকটা আলোয় ভরে গেল, মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সূর্যের রশ্মি, আর সঙ্গে সঙ্গে গম্বুজ ও ক্রুশ, সাদা শিশিরকণা, দূরবর্তী নদী, সবকিছু সেই আলোয় ঝলমল করে উঠল–তখন এক অজ্ঞাতপূর্ব নতুন আনন্দ ও জীবনীশক্তির স্বাদ পেয়েছিল পিয়ের। সেই আনন্দ ও শক্তি গোটা বন্দিজীবনে তাকে ঘিরে রইল, শুধু তাই নয়, জীবনের দুঃখকষ্ট যত বাড়তে লাগল সেই আনন্দ ও শক্তিও তত বেড়ে চলল।

তাছাড়া, এই চালাঘরে আসার পর থেকে সহ-বন্দিরা তার সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা পোষণ করছে তাতেও তার এই অনুভূতি আরো তীব্র হয়েছে। তার বহু ভাষার জ্ঞান, তার প্রতি ফরাসিদের শ্রদ্ধা, তার সরলতা, তার দানশীলতা, তার শক্তিমত্তা, সঙ্গীদের প্রতি সদয় ব্যবহার, কোনো কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা ও চিন্তা করার ক্ষমতা (অন্য সকলের কাছে ব্যাপারটা দুর্বোধ্য)-সবকিছু মিলিয়ে সকলের চোখে সে হয়ে উঠেছে একটি রহস্যময় উচ্চ কোটির মানুষ। শক্তিমত্তা, জীবন-সম্ভোগের প্রতি বিতৃষ্ণা, অন্যমনস্কতা ও সরলতা–এই যেসব গুণ এতকাল তার নিজস্ব জগতে চলার পথে ছিল প্রতিবন্ধকস্বরূপ, সেইসব গুণই এই মানুষদের চোখে তাকে এনে দিয়েছে নায়কের মর্যাদা। পিয়ের বোঝে, তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিই তার উপর চাপিয়েছে নতুন দায়িত্বভার।

.

অধ্যায়-১৩

৬ই ও ৭ই অক্টোবর রাত থেকেই ফরাসিদের ফিরতি যাত্রা শুরু হল, রান্নাঘর ও চালাগুলো ভেঙে দেয়া হল, গাড়ি বোঝাই হল, সৈন্যদল ও মালগাড়ি যাত্রা শুরু করল।

সকাল সাতটায় অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে একটি ফরাসি রক্ষীদল চালাগুলির সামনে এসে দাঁড়াল। পরনে শাকো, হাতে বন্দুক, পিঠে ভ্রমণ-গাঠরি ও বড় বড় বস্তা। সকলের মুখে ফরাসি ভাষায় উত্তেজিত আলোচনা ও খিস্তি-খেউড়ের খই ফুটতে লাগল।

চালার মধ্যে সকলেই পোশাক পরে, কোমরবন্ধ এঁটে তৈরি, শুধু আদেশের অপেক্ষা। কেবল রুগ্ন সৈনিক সকল খালি পায়ে আসনে বসে আছে, পোশাক পরেনি, তার বিবর্ণ মুখে চোখের চারদিকে কালি পড়েছে। মুখটা শুকিয়ে যাওয়ার ফলে চোখ দুটো আরো বড় দেখাচ্ছে, সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু কেউ তার দিকে নজর দিচ্ছে না দেখে সে নিজের মনেই গোঙাচ্ছে।

পিয়ের কোমরে একটা দড়ি জড়িয়েছে, জনৈক ফরাসি সৈন্যের দেওয়া চামড়া থেকে কারাতায়েভ তাকে যে জুতো জোড়া বানিয়ে দিয়েছে সেটাই পরেছে। রুগ্ন লোকটির কাছে গিয়ে পিয়ের তার পাশেই বসে পড়ল।

বলল, জান সকলভ, ওরা সকলে যাচ্ছে না। এখানে ওদের একটা হাসপাতাল আছে। আমাদের চাইতে তুমি হয় তো ভালোই থাকবে।

লোকটি জোরগলায় আর্তনাদ করে উঠল, হে প্রভু! আঃ, এবার আমি মরব! হে প্রভু!

উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে পিয়ের বলল, আমি আবার গিয়ে সরাসরি ওদের বলব।

 পিয়ের দরজার কাছে পৌঁছতেই আগের দিনের সেই পাইপওয়ালা কর্পোরাল দুজন সৈন্য সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির হল। কর্পোরাল ও সৈন্যদের পরিধানে পথযাত্রার পোশাক, ভ্রমণ-গাঠরি ও শাকো, তাতে ধাতুর পাত আঁটা। সেই পোশাকে পরিচিত মুখগুলোই যেন বদলে গেছে। হুকুমমতো কর্পোরাল এসেছে দরজা বন্ধ করতে। বাইরে বের হবার আগে বন্দিদের গুণতি করা হবে। পিয়ের বলল, কর্পোরাল, এই রুগ্ন লোকটিকে নিয়ে কি করা যাবে…

কিন্তু সেইমুহূর্তে কর্পোরালের হাব-ভাব দেখে পিয়েরের মনে সন্দেহ জাগল, এই লোকটি তার পরিচিত সেই কর্পোরাল, না অপরিচিত কেউ। তার উপর, পিয়ের কথা বলতে শুরু করতেই হঠাৎ দুপাশ থেকে দমাদম ঢাক বেজে উঠল। পিয়েরের কথা শুনে কর্পোরাল ভুরু কুঁচকে অর্থহীন কিছু কথা বলে সশন্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল। চালাটা আধা অন্ধকার হয়ে গেল, আর দু-দিকে ঢাকের শব্দের মধ্যে রুগ্ন লোকটির আর্তনাদ ডুবে গেল।

সেই একই জিনিস!…আবারও!… পিয়ের আপন মনেই বলে উঠল, তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিহরণ নেমে গেল। কর্পোরোলের পরিবর্তিত মুখ, তার কণ্ঠস্বর, ঢাকের কাঠ-ফাটানো আওয়াজ–সবকিছুর ভিতর দিয়ে সেই রহস্যময় নির্বিকার শক্তিকেই যেন সে নতুন করে চিনতে পারল যা মানুষকে বাধ্য করেছে পরস্পরকে হত্যা করতে-যে শক্তির ফলকেই সে দেখেছে নানা প্রাণদণ্ডের মধ্যে। সে শক্তিকে ভয় করা অথবা তার কাছ থেকে পালাবার চেষ্টা করা, সে শক্তির যন্ত্র হিসেবে যা কাজ করে তাদের কাছে কাকুতি-মিনতি জানানো-সব বৃথা। এসবই পিয়ের জানে। শুধু অপেক্ষা করা এবং সহ্য করা ছাড়া অন্য গতি নেই। পিয়ের রুগ্ন লোকটির কাছে আর ফিরে গেল না, তার দিকে ফিরেও তাকাল না, ভুরু কুঁচকে কুটিরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।

দরজা খোলা হল। বন্দিরা ভেড়ার পালের মতো গাদাগাদি করে দরজার কাছে ভিড় করল। পিয়ের তাদের : ঠেলে জোর করে পথ করে নিয়ে সেই ক্যাপ্টেনটির দিকেই এগিয়ে গেল যে কর্পোরাল হিসেবে তাকে কথা দিয়েছিল সে তার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত। ক্যাপ্টেনের পরিধানেও অভিযানের পোশাক, তার নিস্পৃহ মুখে সেই একই জিনিস দেখা গেল যা পিয়ের দেখেছে কর্পোরালের কথায় আর ঢাকের বাজনায়।

ভিড়-করা বন্দিদের দিকে তাকিয়ে কঠোরভাবে ভঙ্গি করে ক্যাপ্টেন বারবার বলতে লাগল, এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও!

সব চেষ্টা বিফল হবে জেনেও পিয়ের তার দিকে এগিয়ে গেল।

যেন পিয়েরকে চিনতেই পারে নি এমনি নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয় অফিসার শুধাল, কি চাই?

 পিয়ের রুগ্ন লোকটির কথা বলল।

যেমন করেই হোক সে হেঁটেই যাবে! শয়তান ভরসা! বলেই ক্যাপ্টেন আর একবার তাড়া লাগাল, এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও!

কিন্তু লোকটি যে মরতে বসেছে, পিয়ের তবু বলল।

সক্রোধে ভুরু কুঁচকে ক্যাপ্টেন চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে তো ভালোই হয়…

দ্রাম–দাদা-দাম, দাম-দাম… ঢাক বেজে উঠল। পিয়ের বুঝল, সেই রহস্যময় শক্তি লোকগুলিকে পুরোপুরি কজা করে ফেলেছে, এখন এদের কোনো কথা বলা,বৃথা।

অফিসার-বন্দিদের সৈনিক-বন্দিদের থেকে আলাদা করে তাদের সামনে যেতে বলা হল। পিয়েরকে নিয়ে অফিসারের সংখ্যা ত্রিশ, আর সৈনিক শো তিনেক।

অন্য চালা থেকে আগত অফিসাররা সকলেই পিয়েরের অপরিচিত, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও তার চাইতে ভালো। তারা পিয়েরের দিকে, তার জুতোর দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল, যেন সে একজন বিদেশী। তার অনতিদূরেই একজন মোটাসোটা মেজর হেঁটে চলেছে, তার ফ্যাকাসে মুখটা ফোলা ফোলা, রাগী-রাগী দেখতে, পরনের কাজান ড্রেসিং-গাউনটাকে একটা তোয়ালে দিয়ে বেঁধেছে, স্পষ্টতই অন্য বন্দিরা তাকে বেশ সমীহ করে চলছে। তার এক হাতে তামাকের থলে, সে হাতটা সে ঢুকিয়ে রেখেছে ড্রেসিং গাউনের ভিতরে, অন্য হাতে ধরে আছে পাইপের গোড়াটা। হাঁফাতে হাঁফাতে আর জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে সকলের সঙ্গেই ঝগড়া করছে, তার ধারণা সকলেই তাকে ধাক্কা মারছে, অথচ ধাক্কাধাক্তি করে এগোবার কোনো কারণই তো নেই। অপর একজন ছোটখাট অফিসার সকলের সঙ্গেই কথা বলছে, তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সারাদিনে কতটা পথ পাওয়া যাবে-এই নিয়ে আলোচনা করছে, ফেল্ট বুট ও কমিসারিয়েট ইউনিফর্ম পরা আর একজন অফিসার এদিক-ওদিক ছুটে যাচ্ছে, মস্কোর ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকাচ্ছে, আর যা দেখছে তার বিবরণ শোনাচ্ছে উচ্চকণ্ঠে। একজন তৃতীয় অফিসার কমিসারিয়েট অফিসারের কথার প্রতিবাদ করল। কথা শুনলেই বোঝা যায় লোকটি পোল। সে বারবার বলতে লাগল যে কমিসারিয়েট-অফিসার স্থানগুলির ভুল বিবরণ শোনাচ্ছে।

মেজর রেগে বলল, আপনার আপত্তিটা কোথায়? এটা সেন্ট নিকলাস না সেন্ট ব্লসিয়াস তাতে কি যায় আসে? দেখছেন তো সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, বাস। খতম…আহা, তোমরা ঠেলছ কেন? রাস্তাটা কি যথেষ্ট চাওড়া নয়? বলেই সে পিছনের লোকটির দিকে তাকাল। সে কিন্তু মোটেই ঠেলছিল না।

আগুনে-পোড়া ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে বন্দিরা অনেকেই বলতে লাগল, ওঃ, ওঃ, ওঃ! ওরা কী করেছে? নদীর ওপারে সবকিছু, আর জুবভা ও ক্রেমলিন…তাকিয়ে দেখ! অর্ধেকটাও নেই। হ্যাঁ, আমি তো বলেছিলাম-নদীর ওপার পর্যন্ত সবকিছু গেছে, আর সেই কথাই ঠিক।

মেজর বলে উঠল, আচ্ছা, জানই তো সব পুড়ে গেছে, তাহলে সেকথা বলে আর লাভটা কি?

খামভনিকির (এ অঞ্চলটা পোড়ে নি) একটা গির্জার কাছ দিয়ে যাবার সময় বন্দিরা সকলেই সহসা একপাশে সরে গেল, সকলের কণ্ঠে ফুটে উঠল ত্রাস ও বিরক্তির চিৎকার।

আঃ, শয়তানের দল! নাস্তিকের দল! হ্যাঁ, মৃত, মৃত, লোকটা নির্ঘাৎ মৃত…সারা গায়ে কি যেন মাখানো!

যে বস্তুটি দেখে সকলে চিৎকার করছে। পিয়ের গির্জার সেই দিকটাতে এগিয়ে গেল। অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল, কে যেন গির্জার বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে রয়েছে। একটা মানুষের মৃতদেহ, বেড়ার গায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, মুখে ঝুল-কালি মাখিয়ে দিয়েছে।

এগিয়ে চল! কী শয়তান…এগিয়ে চল! ত্রিশ হাজার শয়তান!…

রক্ষীবাহিনীর লোকরা শাপ-শাপান্ত করতে লাগল, আর ফরাসি সৈন্যরা নতুন উদ্যমে সেই সব বন্দিদের তলোয়ারের খোঁচায় এগিয়ে নিয়ে চলল যারা দাঁড়িয়ে মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে ছিল।

.

অধ্যায়-১৪

খামনিকি অঞ্চলের এড়ো পথ ধরে বন্দিরা এগিয়ে চলেছে। তাদের পিছনে চলেছে শুধু রক্ষীবাহিনীর লোক এবং তাদের যানবাহন ও মালগাড়ি। কিন্তু সরবরাহ-ভাণ্ডারের কাছে পৌঁছেই তারা মিশে গেল প্রকাণ্ড একসারি বারুদবাহী গাড়ি ও বেসরকারী যানবাহনের জটলার মধ্যে। যারা সামনে রয়েছে তাদের রাস্তা পার হবার অপেক্ষায় বন্দিরা সেতুর মুখে থেমে গেল। সেতুর উপর থেকে তারা দেখল, সামনে ও পিছনে মালগাড়ির সীমাহীন ভিড়। ডানদিকে যেখানে কালুগা রোড নেসকুচনির কাছে মোড় নিয়েছে সেখানে সেনাদল ও গাড়ির সীমাহীন সারি বহুদূর পর্যন্ত চোখে পড়ছে। এইসব সৈন্যই বিউহারনায়েস-এর দলের, তারাই যাত্রা করেছে অন্য সকলের আগে। পিছনে নদীর তীরবরাবর এবং পাথর সেতুর উপরে রয়েছে নে-র সেনাদল ও যানবাহন।

বন্দিরা আছে দাভুত-এর সেনাদলের হেপাজতে। তারা ক্রিমিয় সেতু পার হচ্ছে, অনেকে ইতিমধ্যেই ভিড় থেকে বেরিয়ে কালুগা রোডে পড়েছে।

ক্রিমিয় সেতু পার হয়ে বন্দিরা কয়েক পা এগিয়ে থামল, তারপর আবার এগিয়ে চলল। চারদিক থেকে যানবাহান ও সৈন্যরা এসে ক্রমেই ভিড় বাড়াতে লাগল। কালুগা রোড থেকে সেতু পর্যন্ত কয়েকশো পা এগোতেই তাদের একঘণ্টার বেশি সময় লাগল। কালুগা রোড ও ট্র্যান্সমকভার সংযোগে পৌঁছে ভিড়ের চাপে বন্দিদের কয়েক ঘন্টা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হল। সমুদ্রগর্জনের মতো চারদিক থেকে শোনা যেতে লাগল চাকার ঘর্ঘর, পায়ের শব্দ, আর রাগারাগি ও গালাগালির অবিশ্রাম চিৎকার। একটা পোড়া বাড়িতে হেলান দিয়ে পিয়ের সেই শব্দ শুনছে, তার কল্পনায় সেই শব্দের সঙ্গে এসে মিশেছে ঢাকের শব্দ।

পিয়ের যে আধ-পোড়া বাড়িটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কয়েকজন অফিসার-বন্দি পরিস্থিতিটা ভালো করে দেখবার জন্য সেই বাড়িরই প্রাচীরের উপর উঠে গেল।

তারা চেঁচিয়ে বলতে লাগল, কী ভিড়! ভিড়ের দিকে তাকাও!…কামানের উপরে পর্যন্ত মালপত্র বোঝাই করেছে। দেখ, দেখ, বদমাসরা কত জিনিস লুট করেছে…ওই দেখ। গাড়িতে লোকটার পিছনে কি রয়েছে।…আরে, হা ঈশ্বর, ওগুলো দেবমূর্তির ফ্রেম!…ওঃ, রাস্কেলের দল!…দেখ, ওই লোকটা কত জিনিস কাঁধে নিয়েছে, হাঁটতে পারছে না। হায় প্রভু, ওরা যে গাড়ির চাকাগুলো পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে।…আর ট্রাংকের উপর বসে-থাকা ওই লোকগুলোকে দেখ…হায় ভগবান! ওরা যে লড়াই করছে…।

ঠিক হয়েছে, লাগাও নাকের উপর এক ঘুষি-ঠিক নাকের উপর। এভাবে চললে আমরা তো সন্ধ্যার আগে বের হতেই পারব না। দেখ, ওদিকে দেখ…আরে, ওটা নিশ্চয় নেপোলিয়নের নিজের। কী সব ঘোড়া! আর মুকুটসহ যুক্তাক্ষর-চিত্রগুলি। সবটাই যেন একটা চলমান বাড়ির মতো।…ওই একটা লোকের বস্তাটা পড়ে গেল, আর সেটা খুঁজে পাচ্ছে না। আবার লড়াই…শিশু-কোলে একটা মেয়েমানুষ, দেখতে মন্দ নয়! হ্যাঁ, এভাবে ছাড়া এগোবার পথ পাবে না…তাকিয়ে দেখ, ভিড়ের যেন শেষ নেই। রুশ কুমারীরা…হা ঈশ্বর, তারাও এসেছে! গাড়ির মধ্যে-দেখ, কেমন আরাম করে তারা বসেছে।

খামভনিকির গির্জার কাছে যেমন ঘটেছিল তেমনই কৌতূহলের ঢেউয়ের টানে বন্দিরা আবারও সামনের দিকে এগিয়ে গেল, চেহারাটা উঁচু-লম্বা হওয়ায় পিয়ের সকলের মাথার উপর দিয়েই তাদের এই কৌতূহলের কারণটা লক্ষ্য করতে পারল। বারুদের গাড়িগুলো মাঝখানের তিনটে গাড়িতে গাদাগাদি করে বসে আছে কতকগুলি মেয়ে। চোয়াড়ে মুখ, পরনে জ্বলজ্বলে রঙের পোশাক। কর্কশ স্বরে চিৎকার করে তারা কি যেন বলছে।

সেই রহস্যময় শক্তিকে চিনবার মুহূর্ত থেকেই পিয়েরের কাছে কোনো কিছুই আর বিচিত্র বা ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে না : কৌতুকভরে মুখে ঝুল-কালি মাখানো একটা মৃতদেহ নয়, এই চলমান মেয়েগুলো নয়, বা মস্কোর ধ্বংসাবশেষও নয়। এখন যা কিছু চোখে পড়ছে কিছুই তার মনের উপর দাগ কাটতে পারছে না–যেন একটা কঠোর সগ্রামের প্রস্তুতির দরুন তার মনকে দুর্বল করে দিতে পারে এমন কোনো কিছুকেই সে আমল দিচ্ছে না।

মেয়েদের গাড়িটা চলে গেল। তার পিছন পিছন এল আরো গাড়ি, আরো সৈন্য, আরো মালগাড়ি, আরো সৈন্য, কামানের গাড়ি, সৈন্য, বারুদের গাড়ি, আরো সৈন্য, আর মাঝে মাঝেই মেয়ের দল।

পিয়ের কোনো ব্যক্তিবিশেষকেই দেখছে না, দেখছে শুধু তাদের গতিবিধি।

মনে হচ্ছে, কোনো অদৃশ্য শক্তি বুঝি এই সব লোকজন ও ঘোড়াকে টেনে নিয়ে চলেছে। পিয়েরের চোখের সামেন যারা নানা পথ ধরে ধেয়ে আসছে তাদের সকলেরই একই লক্ষ্য তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাওয়া : সকলেই ধাক্কাধাক্কি করছে, রাগ করছে, মারামারি করছে, তাদের সাদা দাঁতগুলি ঝিকমিক করছে, ভুরু কুঁচকে উঠছে, চারদিক থেকে একই ধরনের গালাগালি ভেসে আসছে, আর সকলের মুখেই ফুটে উঠেছে সেই একই কঠোর, নিষ্ঠুর ভাব যা সকালেই পিয়ের দেখেছে ঢাকের শব্দের সঙ্গে কর্পোরালের মুখে।

সন্ধ্যা নাগাদ রক্ষীদলের অধিনায়কের চিৎকার, হাঁকডাক ও আপ্রাণ চেষ্টায় চারদিক থেকে চিড়ে-চ্যাপ্টা হওয়া বন্দিরা কোনো রকমে কালুগা রোডে উঠে হাঁফ ছাড়ল।

বিশ্রাম না নিয়েই তারা দ্রুত হাঁটতে লাগল, থামল একেবারে সূর্যাস্তের মুখে। মালপত্রের গাড়িগুলোও পৌঁছে গেল, সকলে রাতের বিশ্রামের আয়োজন করতে লাগল। সকলেই ক্রুদ্ধ, অসন্তুষ্ট। অনেকক্ষণ পর্যন্ত চারদিক থেকে শোনা যেতে লাগল ঈশ্বরের দোহাই, ক্রুদ্ধ চিৎকার ও মারামারির শব্দ।

এই বিশ্রামের কালে রক্ষীদলের লোকরা বন্দিদের প্রতি আগের চাইতে অনেক বেশি খারাপ ব্যবহার করতে লাগল। এখানেই প্রথম বন্দিদের খাদ্য-রেশন হিসেবে দেয়া হল ঘোড়ার মাংস।

অফিসার থেকে শুরু করে নিম্নতম সৈনিক পর্যন্ত সকলেই প্রতিটি বন্দির উপর যেন ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে লাগল, অথচ আগে তাদের ব্যবহার ছিল কত বন্ধুত্বপূর্ণ।

এই আক্রোশ আরো বেড়ে গেল যখন বন্দিদের নাম ডাকার পরে দেখা গেল, যে রুশ সৈনিকটি, শূলবেদনার ভান করছিল, মস্কো ছাড়বার গোলমালের সুযোগে সে পালিয়েছে। পিয়ের দেখল, রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে সরে যাওয়ার জন্য জনৈক ফরাসি একটি রুশ সৈনিককে নির্মমভাবে প্রহার করছে, আর রুশ সৈনিকটির পলায়নের জন্য একজন নন-কমিশনড অফিসারকে দায়ী করে তার বন্ধু সেই ক্যাপ্টেনটি তাকে কোর্ট-মার্শাল করবে বলে শাসাচ্ছে। নন-কমিশনড অফিসারটি যখন যুক্তি দেখাল সে সেই বন্ধুটি অসুস্থ থাকায় হাঁটতে পারছিল না, তখন অফিসারটি জবাবে বলল, যারা পিছিয়ে পড়বে তাদের গুলি করে মারববার হুকুম তো দেয়াই ছিল। পিয়েরের মনে হল, যে মারাত্মক শক্তি প্রাণদণ্ড বিধানের সময় তাকে একেবারে বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল, কিন্তু বন্দি অবস্থায় থাকার সময় যার কথা সে ভুলেই গিয়েছিল, সেই শক্তি আবার তার অস্তিত্বের উপর চেপে বসেছে। সে শক্তি ভয়ংকর, কিন্তু পিয়ের অন্তরে অন্তরে অনুভব করল, সেই মারাত্মক শক্তি তাকে ধ্বংস করতে যত চেষ্টাই করুক, তার অন্তরের মধ্যে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে, শক্তিশালী হয়ে উঠছে জীবনের এক নতুন শক্তি।

ঘোড়ার মাংস ও যবের ঝোল সহযোগ নৈশাহার সেরে সে বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে লাগল।

তারা মস্কোতে যা দেখেছে, অথবা ফরাসিদের কাছ থেকে যে রূঢ় ব্যবহার তারা পাচ্ছে, অথবা তাদের গুলি করে মারবার সে হুকুম জারি করা হয়েছে, পিয়ের বা অন্য কেউই সে সম্পর্কে কোনো কথাই বলল না। যেন তাদের অবস্থার অবনতির প্রতিক্রিয়া হিসেবেই তারা বিশেষভাবে উজ্জীবিত ও আনন্দিত হয়ে উঠেছে। অভিযানকালে যেসব মজার দৃশ্য তারা দেখেছে তারই স্মৃতিচারণায় তারা সময় কাটাতে লাগল, বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কোনো কথাই বলল না।

সূর্য অনেকক্ষণ অস্ত গেছে। আকাশে অনেক তারা জ্বলজ্বল করছে। পূর্ণ চাঁদের উদয়ে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে অগ্নিকাণ্ডের মতো একটা লাল আভা। প্রকাণ্ড লাল গোলকটি ধূসর পরিবেশের মধ্যে বিচিত্র ভঙ্গিতে দুলছে। ক্রমে তার রং হাল্কা হয়ে এল। সন্ধ্যার অবসান হয়েছে, কিন্তু এখনো রাত আসেনি। পিয়ের উঠে পড়ল, নতুন সঙ্গীদের ছেড়ে শিবির-আগুনগুলো পার হয়ে রাস্তার অপর পাশে চলে গেল, সে শুনেছে, সাধারণ সৈনিকদের সেখানেই রাখা হয়েছে। সে তাদের সঙ্গে কতা বলবে। পথে একটি ফরাসি শান্ত্রী তাকে থামাল, ফিরে যেতে হুকুম করল।

পিয়ের ফিরে গেল, শিবির-আগুনের পাশে সঙ্গীদের কাছে নয়, ফিরে গেল একটা গাড়ির কাছে, সেখানে কেউ নেই। গাড়ির চাকার পাশে দুই পা ভেঙে মাথাটা নুইয়ে ভিজে মাটির উপর বসে অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিজের চিন্তায় ডুবে রইল। হঠাৎ সে উচ্চকণ্ঠে হো-হো করে এমনভাবে হেসে উঠল সে আশপাশের সকলেই সবিস্ময়ে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল, এই বিচিত্র, একক হাসির অর্থ কি।

হা-হা-হা! পিয়ের হাসছে। তারপর উচ্চকণ্ঠে নিজেকেই বলল, সৈনিকটি আমাকে যেতে দিল না। তারা আমাকে ধরে আটক করেছে। আমাকে বন্দি করেছে। কি, আমাকে? আমাকে? আমার অমর আত্মাকে হা হা-হা! হা-হা-হা!… হাসতে হাসতে তার চোখে জল এসে গেল।

একজন উঠে দেখতে এল, এই বিচিত্র মানুষটি নিজে-নিজেই হাসছে কেন? হাসি থামিয়ে পিয়ের উঠে পড়ল, কৌতূহলী লোকটার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে চারদিকে তাকাল।

সীমাহীন প্রকাণ্ড অস্থায়ী আস্তানাটা এতক্ষণ শিবির-আগুনের ফট-ফট শব্দে ও নানা জনের কণ্ঠস্বরে মুখরিত ছিল, এখন সব নিস্তব্ধ, আগুনের লাল আভা ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসছে। মাথার উপরে আকাশের গায়ে ভরা চাঁদটা ঝুলে আছে। আগে চোখে না পড়লেও দূরের বন ও প্রান্তর এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আরো দূরে, সব বন ও প্রান্তর পেরিয়ে, উজ্জ্বল দোদুল্যমান অসীম দূরত্ব যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পিয়ের বহুদূরবর্তী আকাশ ও ঝিকিমিকি তারাদের দিকে তাকাল। ভাবল, আর এসবই তো আমি, এসবই তো আছে আমার অন্তরের মধ্যে, এই সবকিছুকে নিয়েই তো আমি। অথচ এই সবকিছুকে ধরে এনে ওরা কাঠের বেড়া দেওয়া চালাঘরের মধ্যে বন্দি করেছে। সে হাসল, তারপর উঠে গিয়ে সঙ্গীদের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

অধ্যায়-১৫

অক্টোবরের গোড়ায় নেপোলিয়নের কাছ থেকে শান্তির প্রস্তাবের চিঠি নিয়ে আর একজন দূত এল কুতুজভের কাছে। যদিও নেপোলিয়ন তখন কুতুজভের কাছ থেকে অনতিদূরে কালুগা রোডেই ছিল, তবু সে চিঠিতে মস্কোর তারিখ দেয়া। লরিস্তন আগে যে চিঠি এনেছিল তার যে জবাব কুতুজভ দিয়েছিল, এবারেও সেই একই জবাব দিয়ে সে জানিয়ে দিল, শান্তি স্থাপনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

দরখভের যে গেরিলা বাহিনী তারুতিনোর বাঁ দিকে কর্মরত ছিল সেখান থেকে অচিরেই খবর এল যে ব্রুসিয়েরের এক ডিভিশন সৈন্যকে ফরমিনস্কে দেখা গেছে, আর যেহেতু তারা মূল ফরাসিবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, তাই অনায়াসেই তাদের ধ্বংস করা যাবে। সৈনিক ও অফিসাররা পুনরায় যুদ্ধের দাবি জানাল। তারুতিনোর অনায়াস জয়লাভের স্মৃতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে জেনারেলরাও দরখভের প্রস্তাব মতো কাজ করতে কুতুজভের উপর চাপসৃষ্টি করল। কোনোরকম আক্রমণের দরকার আছে বলে কুতুজভ মনে করল না। ফলে অনিবার্য ভাবেই একটা সমঝোতা হল :ব্রুসিয়েরকে আক্রমণ করতে একটা ছোটখাট সেনাদলকে ফরমিনস্কে পাঠানো হল।

পরবর্তীকালে এই ছোট কাজটাই অত্যন্ত কষ্টকর ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছিল, আর একটা বিচিত্র যোগাযোগের ফলে এই কাজের ভার পড়ল দখতুরভের উপর-এ লোকটি সেই বিনীত ছোটখাট দখতুরভ যার সম্পর্কে কেউ কখনো লেখেনি যে সে যুদ্ধের পরিকল্পনা রচনা করেছে, রেজিমেন্টের আগে আগে ছুটে গিয়েছে, কামানশ্রেণীর উপর কুশ ছুঁড়ে দিয়েছে, ইত্যাদি, আর যার সম্পর্কে এই কথাই ভাবা হয়েছে ও বলা হয়েছে যে সে অস্থিরমতি ও স্বল্পবুদ্ধি-অথচ অস্তারলিজ থেকে শুরু করে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত গোটা রুশ ফরাসি যুদ্ধে আমরা তাকেই দেখেছি যে কোনো সংকট-কালে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে। অস্তারলিজে সকলেই যখন পালাচ্ছিল আর মরছিল, পশ্চাৎ-রক্ষীদলের একজন জেনারেলও যখন উপস্থিত ছিল না, তখন একমাত্র সেই শেষপর্যন্ত অগেজদ বাধে ছিল, রেজিমেন্ট পরিচালনা করছিল এবং সাধ্যমতো সবকিছু রক্ষা করছিল। জ্বরে আক্রান্ত হয়েও নেপোলিয়নের গোটা বাহিনীর আক্রমণ থেকে স্মোলেনস্ক শহরকে রক্ষা করতে মাত্র বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে সে সেখানে গিয়েছিল। স্মোলেনকের মলাখভ ফটকে জ্বরের ঘোরে সবে একটু তন্দ্রা এসেছিল এমন সময় শহরের উপর বোমাবর্ষণের শব্দে জেগে উঠে সে সারাটা দিন স্মোলেনস্ক শহরকে রক্ষা করেছিল। বরদিনোর যুদ্ধে যখন ব্রাগ্রেশনের মৃত্যু হল, বাম ব্যূহের দশ ভাগের নয় ভাগ সৈন্য নিহত হল, এবং ফরাসি গোলন্দাজ বাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন এই অস্থিরমতি, স্বল্পবুদ্ধি দখতুরভকেই সেখানে পাঠানো হয়েছিল-প্রথমে অন্য কাউকে সেখানে পাঠিয়ে কুতুজভ যে ভুলটা করেছিল তাড়াতাড়ি সে ভুলের সংশোধন করা হয়েছিল। শান্তশিষ্ট, হোটখাট দখতুরভ সেখানেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিল, আর রুশ বাহিনীর শ্রেষ্ঠ গৌরবের প্রতিভূ হয়ে দেখাদিল বরদিনো। কাব্যে ও গদ্যে অনেক মহাবীরের বর্ণনাই আমাদের শোনানো হয়েছে, কিন্তু দখতুরভ সম্পর্কে একটি কথাও কেউ বলেনি।

আবার এই দখতুরভকেই পাঠানো হল ফরমিনস্কে, আর সেখান থেকে মালো-ইয়ারোস্লাভেসে, সেখানেই হল ফরাসিদের সঙ্গে শেষ যুদ্ধ, আর সেখান থেকেই ফরাসি বাহিনীতে ভাঙনের সূত্রপাত ঘটল। অথচ অভিযানের সেই সময়কার অনেক প্রতিভাধর ও বীরের কথা আমাদের শোনানো হলেও দখতুরভ সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হল না, অথবা যৎকিঞ্চিৎ বলা হলেও সেটা যেন নেহাৎই একটা দায়সারা কাজের মতো করা হল। আর দুখতুরভ স্মপর্কে এই নীরবতাই তার কৃতিত্বের সব চাইতে বড় প্রমাণ।

১০ই অক্টোবর তারিখে দখতুরভ ফরমিনস্ক-এর অর্ধেক পথ পার হয়ে অরিস্তভ গ্রামে থামল এবং প্রাপ্ত আদেশমতো আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। ঠিক সেই সময় গোটা ফরাসি বাহিনী যুদ্ধ করবার অভিপ্রায় নিয়ে মুরাত-এর ঘাঁটিতে পৌঁছেই হঠাৎ বিনা কারণে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে নব কালুগা রোডে পড়ে ফরমিনস্কে ঢুকতে লাগল, সেখানে তখন ছিল শুধুমাত্র ব্রুসিয়ের। সেই সময় দখতুরভের অধীনে ছিল দরখভের সেনাদল ছাড়াও ফিনার ও সেসলাভি-এর দুটি ছোট গেরিলা বাহিনী।

১১ই অক্টোবর সন্ধ্যায় সে সলাভিন একজন ফরাসি রক্ষী সৈন্যকে গ্রেপ্তার করে অরিস্তভ প্রধান ঘাঁটিতে এসে হাজির হল। বন্দিটি বলল, ফরাসি বাহিনীর অগ্রবর্তী অংশটাই সেদিন ফরমিনস্কে ঢুকেছে, নেপোলিয়ন তাদের সঙ্গেই আছে, আর চারদিন আগেই গোটা বাহিনী মস্কো ছেড়ে চলে এসেছে। সেইদিন সন্ধ্যায়ই জনৈক পারিবারিক ভূমিদাস বরভঙ্ক থেকে এসে জানাল, একটা প্রকাণ্ড বাহিনীকে সে শহরে ঢুকতে দেখেছে। দখতুরভের দলের কয়েকজন কসাকও জানাল, ফরাসি রক্ষী বাহিনীকে তারা বরভস্কের পথে যেতে দেখেছে। এই সব সংবাদ থেকে স্পষ্টই বোঝা গেল, যেখানে তারা আশা করেছিল যে মাত্র একটি ডিভিশনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে, সেখানে এখন গোটা ফরাসি বাহিনীই একটা অপ্রত্যাশিত পথে মস্কো থেকে এগিয়ে আসছে–অর্থাৎ তারা আসছে কালুগা রোড ধরে। এ অবস্থায় কি করা উচিত সেটা। ঠিক বুঝতে না পারার জন্য তখনই সংঘর্ষে লিপ্ত হবার ইচ্ছা দখতুরভের ছিল না। তাকে হুকুম দেওয়া হয়েছে ফরমিনস্ক আক্রমণ করতে হবে। কিন্তু তখন তো সেখানে ছিল শুধুমাত্র ব্রসিয়ের, কিন্তু এখন যে গোটা ফরাসি বাহিনী সেখানে হাজির। এমলভ নিজের বিচার-বুদ্ধি অনুসারে কাজ করতে চাইল, কিন্তু দখতুরভ জানাল, তার আগে কুতুজভের নির্দেশ অবশ্যই পেতে হবে। সুতরাং স্থির হল, তার কাছে একটা চিঠি পাঠানো হবে।

সেকাজের জন্য বলখভিতিনভ নামক একজন দক্ষ অফিসারকে বেছে নেওয়া হল, একটা লিখিত প্রতিবেদন পেশ করা ছাড়াও সে মুখে মুখে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে। মধ্যরাতে চিঠি ও মৌখিক নির্দেশ নিয়ে বলখভিতিনভ বাড়তি ঘোড়াসহ একজন কসাককে সঙ্গে নিয়ে প্রধান ঘাঁটির উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

.

অধ্যায়-১৬

হেমন্তের আতপ্ত অন্ধকার রাত। চারদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। দুবার ঘোড়া বদল করে আঠালো কর্দমাক্ত পথে দেড় ঘণ্টায় বিশ মাইল ঘোড়া ছুটিয়ে রাত একটায় বলখভিতিনভ লিশোভকায় পৌঁছল। একটা কুটিরের কঞ্চির বেড়ার গায়ে জেনারেল স্টাফ সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখে সেখানেই ঘোড়া থেকে নেমে হাতের লাগামটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে অন্ধকার পথে পা বাড়াল।

একটি লোক জেগে উঠে অন্ধকার পথেই সশব্দে নাক ঝাড়ছিল, তাকে দেখেই বলল, কর্তব্যরত জেনারেলের কাছে আমাকে নিয়ে চল, তুড়ন্ত! খুব জরুরি।

আর্দালিটি ফিসফিস করে বলল, সন্ধ্যা থেকে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আজ তিন রাত তিনি ঘুমোননি। আপনি আগে ক্যাপ্টেনকে ডেকে তুলুন।

কিন্তু ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আমি জেনারেল দখতুরভের কাছ থেকে আসছি, অন্ধকারেই খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলখভিতিনভ বলল।

আর্দালি আগেই ঘরে ঢুকে কাকে যেন ডাকতে লাগল।

ইয়োর অনার, ইয়োর অনার! একজন সংবাদবাহক।

 কি? ব্যাপার কি? কার কাছ থেকে এসেছে? একটা ঘুমজড়িত কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

অন্ধকারে বক্তাকে দেখতে না পেলেও কথাশুনেই সে যে কনভনিৎসিন নয় সেটা অনুমানকরে বলখভিতিনভ বলল, দখতুরভ এবং আলেক্সি পেত্রভিচের কাছ থেকে।

যে লোকটিকে ডেকে তোলা হল সে হাই তুলে শরীরটা টান-টান করল।

কি যেন খুঁজতে খুঁজতে বলল, তাকে এখন জাগাতে চাই না। তিনি খুব অসুস্থ। হয় তো খবরটা গুজবমাত্র।

এই দেখুন চিঠি, বলখভিতিনভ বলল। আমার উপর হুকুম আছে, চিঠিটা এক্ষুনি দিতে হবে কর্তব্যরত জেনারেলের হাতে।

এক মিনিট অপেক্ষা করুন। মোমবাতিটা জ্বালাই। ব্যাটা রাস্কেল কোথাকার জিনিসপত্র সব কোথায় যে লুকিয়ে রাখে? শরীর টান-টান করে লোকটি আর্দালিকে বলল। (লোকটি কনভনিৎসি-এর অ্যাডজুটান্ট শচেরবিনিনি) পেয়েছি, পেয়েছি।

আর্দালি একটা দেশলাই ঠুকতে লাগল, শচেরবিনিন মোমবাতিদানের উপর কি যেন হাতড়াতে লাগল।

 আঃ, যত সব জানোয়ার! লোকটি বিরক্ত গলায় বলল।

শচেরবিনিনের হাতের মোমবাতির আলোয় বলখভিতিনভ তার যৌবনদীপ্ত মুখটা দেখতে পেল। আর একটি ঘুমন্ত মানুষের মুখও তার চোখে পড়ল। সে কনভনিৎসিন।

মোমবাতির আলোয় শচেরবিনিন পত্রবাহককে দেখতে পেল। তার সর্বাঙ্গ কাদায় মাখামাখি, সেই আস্তিন দিয়ে মুখ মোছার ফলে মুখভর্তিও কাদা লেগেছে।

গ্রেট-কোটে শরীর ঢেকে নৈশ টুপি মাথায় যে লোকটি শুয়েছিল তার কাছে যেতে যেতে শচেরবিনিন বলল, কিছু করার নেই, তাকে ঘুম থেকে জাগাতেই হবে। পিতর পেত্রভিচ! (কনভনিৎসিন কিন্তু নড়ল না)। জেনারেল স্টাফ-এর চিঠি! সে জানে এই কথা কয়টি নিশ্চয় তার ঘুম ভাঙিয়ে দেবে।

বস্তুত সঙ্গে সঙ্গেই নৈশ টুপি পরা মাথাটা জেগে উঠল। কনভনিৎসিনের মুখটা সুন্দর ও কঠিন, গাল দুটো জ্বরে লাল হয়ে উঠেছে। মুহূর্তের জন্য বর্তমান থেকে বহুদূরের একটি স্বপ্নময় ভাব সে মুখে দেখা গেল, কিন্তু পরক্ষণেই সে চমকে উঠল, মুখের উপর নেমে এল তার স্বাভাবিক শান্ত, কটিন ভাব।

আলোর দিকে মিটমিট করে তাকিয়ে সে ধীরে সুস্থে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা। ব্যাপারটা কি?

অফিসারের বক্তব্য শুনতে শুনতেই কনভনিৎসিন সিল ভেঙে চিঠিটা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে পশমি মোজা-পরা পা দুটো মাটির মেঝেতে নামিয়ে সে বুটজোড়া পরতে শুরু করল। মাথার টুপিটা খুলে চুলটাকে কপালের উপর আঁচড়ে আবার টুপিটা পরে নিল।

আপনি খুব দ্রুত এসেছেন তো? চলুন, হিজ হাইনেসের কাছে যাওয়া যাক।

কনভনিৎসিন সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছে যে আনীত সংবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং মোটেই সময় নষ্ট করা চলবে না। সংবাদ ভালো কি মন্দ তা সে ভাবল না। সেকথা জিজ্ঞাসাও করল না। সে ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। যুদ্ধের ব্যাপারটাকে সে বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে বিচার করে না, বিচার করে অন্য কিছু দিয়ে। তার মানে একটা গভীর অব্যক্ত দৃঢ় ধারণা আছে যে শেষপর্যন্ত সবই ভালোয় ভালোয় শেষ হবে, কিন্তু প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্তব্য করে যেতে হবে। আর তাই সে করে, সর্বশক্তি নিয়োগ করে কর্তব্য পালন করে। বার্কলে, রায়েভস্কি, এর্মলভ, প্রাতভ ও মিলোরাদভিচদের মতো ১৮১২ সালের তথাকথিত মহাবীরদের তালিকায় দখতুরভের মতো পিতর পেত্রভিচ কনভনিৎসিনের নামটাও মনে হয় সৌজন্যের খাতিরেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দখতুরভের মতোই সীমিত ক্ষমতা ও তথ্যের মানুষ বলেই তারও খ্যতি ছিল, দখতুরভের মতোই সেও কখনো যুদ্ধের পরিকল্পনা রচনা করেনি, কিন্তু যেখানেই সংকট সেখানেই তাকে সবসময় দেখা গেছে। কর্তব্যরত জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হবার পর থেকে সে সর্বদাই দরজা খুলে ঘুমোয়, তার হুকুম রয়েছে প্রতিটি সংবাদবাহককে যেন তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবার অনুমতি দেওয়া হয়। যুদ্ধের সময় সে সর্বদাই গোলাগুলির মধ্যে ছুটে যেত, তাই কুতুজভ সেজন্য তাকে তিরস্কার করেছে, তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতে ভয় পেয়েছে। দখতুরভের মতোই সেও তেমনি একটা কাঁটাওয়ালা চাকা যে কোনো শব্দ করে না বা যার প্রতিকারও নজর পড়ে না, অথচ যে চাকাটা গোটা যন্ত্রের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

কুটির থেকে বেরিয়ে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার রাতের মধ্যে এসে কনভনিৎসিন ভুরুটা কুঁচকাল-তার একটা কারণ মাথার যন্ত্রণাটা বেড়ে গেছে, আর অপর কারণ একটা অপ্রীতিকর চিন্তা ঢুকেছে তার মাথায় : এই সংবাদটা পাবার পরে এখানকার সব প্রভাবশালী লোকদের, এবং বিশেষ করে বেনিংসেনের বাসাটা কীভাবে নড়ে উঠবে, তারুতিনোর পর থেকে কুতুজভের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা তো একেবারে আদায়-কাঁচকলায়। এই চিন্তাটাই তার কাছে অপ্রীতিকর, যদিও সে জানে যে এ ব্যাপারে কিছুই করার নেই।

বাস্তবক্ষেত্রেও সে গিয়ে তোলকে সংবাদটা জানাতেই সে তার সঙ্গে একই ঘরে বসবাসকারী জেনারেলটি যুদ্ধ সম্পর্কে তার পরিকল্পনার কথা বোঝাতে লাগল। ক্লান্ত নীরবতার সঙ্গে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার কথাবর্তা শুনবার পরে কনভনিৎসিন তাকে স্মরণ করিয়ে দিল যে অবিলম্বে তাদের হিজ হাইনেসের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

.

অধ্যায়-১৭

 সব বুড়ো মানুষের মতোই কুতুজভও রাতে বেশিক্ষণ ঘুমতে পারে না। দিনের বেলায় প্রায়ই অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু রাতে পোশাক না ছেড়ে বিছানায় শুয়ে সাধারণত জেগে থেকে নানা কথা ভাবে।

এখনো ফোলা-ফোলা হাতের উপর ক্ষতচিহ্নিত ভারি মাথাটা রেখে সে বিছানায় শুয়ে আছে, গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে এক চোখে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে।

সম্রাটের সঙ্গে অধিক যোগাযোগের ফলে তার উপর বেনিংসেনের প্রভাবটাই অন্য সকলের চাইতে বেশি হওয়ায় বেনিংসেন ইদানীং কুতুজভকে এড়িয়েই চলে, ফলে তার এবং তার সেনাদলের পক্ষে অকারণ আক্রমণাত্মক কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাটা কম হওয়ায় কুতুজভ বেশ স্বস্তি অনুভব করছে। তারুতিনোর যুদ্ধ ও তার আগের দিনের শিক্ষার কথা কুতুজভ বেশ বেদনার সঙ্গেই স্মরণ করে থাকে, তার ধারণা সে শিক্ষার প্রভাব অন্যদের উপরেও পড়েছে।

কুতুজভ ভাবেঃ তাদের বোঝা দরকার যে আক্রমণ করলে আমাদের শুধু ক্ষতিই হবে। দৈর্য আর সময়ই হচ্ছে আমার যোদ্ধা, আমার বিজয়ী বীর। সে জানে, কাঁচা থাকতে আপেল তোলা উচিত নয়। যখন পাকবে তখন ওটা আপনি পড়বে, কাঁচা অবস্থায় পাড়লে আপেলটা নষ্ট হবে, গাছের ক্ষতি হবে, আর তোমার দাঁত টকে যাবে। অভিজ্ঞ শিকারীর মতো সে জানে যে জন্তুটা আহত হয়েছে, পুরো শক্তি নিয়ে রাশিয়ার পক্ষে যতখানি আঘাত করা সম্ভব ততখানি আহত হয়েছে। কিন্তু সে আঘাত মারাত্মক কিনা সেটা এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু এখন লরিস্তন ও বার্থিলেমিকে পাঠানোর ফলে এবং গেরিলাদের বিবরণ অনুসারে কুতুজভ প্রায় নিশ্চিত যে আঘাতটা মারাত্মকই হয়েছে। কিন্তু আরো প্রমাণ তার চাই, আর সেজন্য অপেক্ষা করা দরকার।

ওকে কতখানি আহত করা গেছে সেটা দেখতেওরা চাইছে দৌড়ে যেতে। অপেক্ষা কর, তাহলেই দেখতে পাবে। অবিরাম চলা মানেই অবিরাম অগ্রগতি! কিসের জন্য নিজেদের বিশিষ্ট করে তুলতে! যুদ্ধ যেন একটা মজার ব্যাপার। তারা সব ছেলে মানুষের মতো–সকলেই দেখাতে চায় তারা কত ভালো যুদ্ধ করতে পারে, ফলে তাদের কাছ থেকে ঘটনার কোনো অর্থপূর্ণ বিবরণই পাওয়া যায় না। কিন্তু এখন তো তার কোনো প্রয়োজন নেই।

বরদিনোর আঘাতটা মারাত্মক হয়েছে কি না এই অনিশ্চিত প্রশ্নটা একটা পুরো মাস ধরে কুতুজভের মাথার মধ্যে ঘুরছে। একদিকে ফরাসিরা মস্কো দখল করেছে। অন্যদিকে কুতুজভ সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে যে সে নিজে এবং সব রুশরা মিলে সর্বশক্তি দিয়ে যে ভয়ংকর আঘাত হেনেছে সেটা মারাত্মক হতে বাধ্য। কিন্তু সে যাই হোক প্রমাণ তো দরকার, প্রমাণের জন্য সে একটা মাস অপেক্ষা করেছে, যত অপেক্ষা করেছে ততই বেশি অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সিয়েরের ডিভিশন সম্পর্কে দরখভের প্রতিবেদন, নেপোলিয়নের সেনাদলের দুর্দশা সম্পর্কে গেরিলাদের সংবাদ, মস্কো ছেড়ে যাবার প্রস্তুতির গুজব-সবকিছু এই ধারণাকেই সমর্থন করছে যে ফরাসি বাহিনী মার খেয়ে পালাবার তাল করছে। কিন্তু এসবই তো ধারণামাত্র, যুবকদের কাছে এগুলি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও কুতুজভের কাছে তা নয়। ষাট বছরের অভিজ্ঞতায় সে জানে গুজবকে কতটা মূল্য দেওয়া যায়, এতে আত্মতুষ্টির অবকাশ মেলে, কিন্তু বিরূপ পরিস্থিতির কোনো মূল্যায়ন হয় না। তাই তার মনে স্বস্তি নেই। রুটিনমাফিক সবকাজই সে করে-সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করে, চিঠিপত্র লেখে, পিটার্সবুর্গের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, ইত্যাদি। কিন্তু একমাত্র সেই দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পায় ফরাসিদের ধ্বংস, আর সেটাই তার অন্তরের একমাত্র কামনা।

১১ অক্টোবর রাতে হাতের উপর ভর দিয়ে শুয়ে শুয়ে সেই কথাই সে ভাবছিল। পাশের ঘরে কারা যেন এসেছে, তোল, কনভনিৎসিন ও বলখভিতিনভের পায়ের শব্দ কানে এল।

আরে, ওখানে কারা? বহিরে আসুন, ভিতরে আসুন! খবর কি? ফিল্ডমার্শাল তাদের ডাকল।

একটি পরিচারক মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল। তোল সংক্ষেপে খবরটা জানাল।

সংবাদ এনেছে কে? এমন ভাবে তাকিয়ে কুতুজভ প্রশ্নটা করল যে মোমবাতির আলোয় তার কঠোরতা তোল-এর দৃষ্টি এড়াল না।

এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই ইয়োর হাইনেস।

তাকে ভিতরে ডাকুন, এখানে ডেকে আনুন।

কুতুজভ একটা পা ঝুলিয়ে বিছানায় উঠে বসল, অপর ভাঁজ-করা পায়ের উপর রইল তার ভুড়িটা। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সে সাংবাদবাহকের দিকে তাকাল, যেন নিজের মনের কথাটাই তার মুখের উপর দেখতে চাইল।

বুকের উপর খোলা শার্টটা টেনে মিলিয়ে দিয়ে বার্ধক্য জনিত নিচু গলায় বলখভিতিনভকে বলল, আমাকে বল, আমাকে বল বন্ধু। কাছে এস-আরো কাছে। আমার জন্য কি খবর তুমি এনেছ? অ্যাঁ? নেপোলিয়ন মস্কো পরিত্যাগ করেছে এই তো? তুমি ঠিক জান? অ্যাঁ?

তাকে যা কিছু বলে দেওয়া হয়েছিল বলখভিতিনভ গোড়া থেকে সব কথা সবিস্তারে বলল।

 আরো তাড়াতাড়ি বল, আরো তাড়াতাড়ি! আমাকে কষ্ট দিও না! কুতুজভ তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল।

বলখভিতিনভ সব কথা বলে নির্দেশের অপেক্ষায় চুপ করে রইল। তোল কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কুতুজভ তাকে থামিয়ে দিল। নিজে কিছু বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু হটাৎ তার মুখটা কুঁচকে ভাঁজ হয়ে গেল। তোলের দিকে হাতটা নেড়ে ঘরের বিপরীত দিকে ঝোলানো দেবমূর্তিগুলির ছায়ায় যে কোণটা অন্ধাকার হয়ে আছে সেই দিকে চলে গেল।

দুই হাত জোড় করে কাঁপা-গলায় বলতে লাগল, হে প্রভু, হে আমার সৃষ্টিকর্তা, আমাদের প্রার্থনা তুমি শুনেছ…রাশিয়া বাঁচল। হে প্রভু, তোমাকে ধন্যবাদ।

কুতুজভ কাঁদতে লাগল।

.

অধ্যায়-১৮

 এই সংবাদ পাবার পর থেকে অভিযানের শেষ দিন পর্যন্ত কুতুজভের সমস্ত কাজকর্মের একমাত্র লক্ষ্য হল ছলে, বলে কৌশলে ও অনুরোধে তার সৈন্যদের ধ্বংসের মুখ শত্রুর বিরুদ্ধে অনর্থক আক্রমণ, রণ-কৌশল ও সংঘর্ষ থেকে বিরত রাখা। দখতুরভ মালো-ইয়ারোস্লাভেসে চলে গেল, কিন্তু কুতুজভ মূল বাহিনীর সঙ্গেই রয়ে গেল,আর কালুগা থেকে সকলকে চলে যেতে হুকুম দিল, সে শহর থেকে আরো পিছনে সরে যাওয়া তার কাছে খুবই সহজ বলে মনে হল।

কুতুজভ সর্বত্রই পশ্চাদপসরণ করে চলল, কিন্তু শত্রুপক্ষ তার পশ্চাদপসরণের জন্য অপেক্ষা না করেই বিপরীত মুখে পালাতে লাগল।

নেপোলিয়নের ইতিহাসকাররা তারুতিনো এবং মালো-ইয়াররা স্লাভেস-এ তার সুকৌশল সৈন্য পরিচালনার কথা আমাদের শুনিয়েছে, আর নেপোলিয়ন যদি সময়মতো দক্ষিণের সমৃদ্ধ অঞ্চল গুলিতে প্রবেশ করতে পারত তাহলে কি ঘটতে পারত তা নিয়েও অনেক জল্পনা-কল্পনাও করেছে।

কিন্তু নেপোলিয়নের দক্ষিণ অঞ্চলের দিকে এগিয়ে যাবার পথেযে কোনো বাধাই ছিল না (কারণ রুশ বাহিনী কোথাও তাকে বাধা দেয়নি) সেকথা না হয় নাই বলা হল, তবু ইতিহাসকাররা ভুলে গেছে যে কোনো কিছুই তখন আর নেপোলিয়নের বাহিনীকে রক্ষা করতে পারত না, কারণ ততক্ষণে তার মধ্যে অনিবার্য ধ্বংসের বীজটি বপন করা হয়ে গেছে। যে বাহিনী মস্কোতে প্রচুর রসদের সরবরাহ পেয়েও তাকে মজুত না করে পায়ের নিচে পিবে নষ্ট করেছে এবং যোলেনস্কে পৌঁছে খাদ্যসম্ভার গুদামজাত না করে কেবল লুটই করেছে, সেই বাহিনী কালুগা প্রদেশে গিয়ে কেমন করে সুবুদ্ধি ফিরে পাবে যখন সেখানেও বাস করত মস্কোর মতোই সব রুশ অধিবাসীরা এবং সেখানেও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দেবার মতো সবকিছুই ছিল?

সে বাহিনী কোথাও গিয়ে বাঁচতে পারত না। বরদিনোর যুদ্ধ এবং মস্কো ধ্বংসের পরে তার ভিতরে ভিতরে যেন ধ্বংসের বীজ আপনা থেকেই রোপিত হয়ে গিয়েছিল।

স্বয়ং নেপোলিয়ন ও তার সৈন্যসহ যারা একদিন ছিল একটা বাহিনীর সদস্য তারাই পালাতে লাগল কোথায় পালাচ্ছে তা না জেনে, যে অসহায় অবস্থার সম্পর্কে তখন তারা সকলেই অল্প-বিস্তর সচেতন তার হাত থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালিয়ে বাঁচাটাই তখন প্রত্যেকেরই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।

তাই তো দেখতে পাই, জেনারেলরা সকলে একত্রে আলোচনার ভান করে মালো-ইয়ারোস্লাভেৎসের বৈঠকে সমবেত হয়ে নানা রকম অভিমত প্রকাশ করলেও একেবারে সকলের শেষে কথা বলতে উঠে সরল হৃদয় সৈনিক মুতো যখন বলল যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালিয়ে যাওয়াই এখন একমাত্র দরকারি কাজ, তখন সকলের মুখই বন্ধ হয়ে গেল, এমনকি এই সর্বজনস্বীকৃত সত্যের বিরুদ্ধে নেপোলিয়নও কিছুই বলতে পারত না।

পালিয়ে যাওয়াই যে দরকার সেকথাটা সকলে বুঝলেও তাকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে একটা লজ্জাবোধ তবু থেকেই গেল। সেই লজ্জাকে জয় করার জন্য একটা বাইরের আঘাতের খুবই দরকার ছিল, আর যথা সময়েই সে আঘাতটাও এল। তাকেই ফরাসিরা বলত le hourra de IEmpereur।

মালো-ইয়ারোস্লাভেৎস-এর বৈঠকের পরদিন খুব সকালে একদল মার্শাল ও একজন পরিদর্শককে সঙ্গে নিয়ে নেপোলিয়ন নিজের এলাকার মধ্যেই অশ্বারোহণে বেরিয়েছিল, পূর্বেকার ও আসন্ন যুদ্ধের ঘটনাস্থল এবং সেনা বাহিনী পরিদর্শনের জন্যই নাকি তার এই পরিক্রমণ। যাই হোক, কয়েকজন কসাক লুটের মালের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে নেপোলিয়নের দেখা পেয়ে যায় এবং তাকে প্রায় গ্রেপ্তার করবার উপক্রম করে। কসাকরা যে তখন নেপোলিয়নকে গ্রেপ্তার করেনি, নেপোলিয়ন যে তখনকার মতো বেঁচে গিয়েছিল, তার কারণ কসাকদের মন ছিল তখন লুটের মালের দিকে। সৈন্যদের ছেড়ে তারা লুটতরাজের দিকেই মন দিল। নেপোলিয়নকে ফেলে তারা ছুটল লুটের সন্ধানে, নেপোলিয়ন কোনো ক্রমে পালিয়ে বাঁচল।

সৈন্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় স্বয়ং সম্রাটই যখন এত সহজে শত্রুপক্ষের হাতে পড়তে পারত সে অবস্থায় নিকটবর্তী পরিচিত পথ ধরে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া ও কোনো গত্যন্তর ছিল না। চল্লিশ বছরের পুরোনো পাকস্থলী নিয়ে নেপোলিয়ন সৈনিকটির কথার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল, তার পূর্বেকার গতিশীলতা ও সাহস এখন আর নেই, তাছাড়া কসাকরাও তাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছে, তাই মুতোর সঙ্গে একমত হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে হুকুম দিল,-ইতিহাসকাররা তাই বলেস্মোলেনস্ক রোড ধরে পশ্চাদপসরণ করা হোক।

নেপোলিয়ন যে মুতোর সঙ্গে একমত হল এবং সৈন্যবাহিনী পশ্চাদপসরণ করল, তাতে কিন্তু একথা প্রমাণ হয় না যে নেপোলিয়ানই তার বাহিনীর পশ্চাদপসরণ ঘটিয়েছিল, বরং বলা যায়, যে শক্তিসমূহ গোটা বাহিনীকে প্রভাবিত করে তাকে মোঝায়েস্ক (অর্থাৎ স্মোলেনস্ক) রোড ধরে পরিচালিত করেছিল সেই শক্তিই একই সঙ্গে নেপোলিয়নকেও প্রভাবিত করেছিল।

.

অধ্যায়-১৯

একজন গতিশীল মানুষ সবসময়ই তার চলার স্বপক্ষে একটা লক্ষ্য খুঁজে নেয়। এক হাজার ভার্স্ট পথ অতিক্রম করতে হলে তাকে কল্পনা করে নিতেই হবে যে সেই হাজার ভাস্টের শেষে তার জন্য একটা ভালো কিছু অপেক্ষা করে আছে। চলার শক্তি অর্জন করতে হলে একটা প্রতিশ্রুত দেশের সম্ভাবনা সম্মুখে রাখতেই হবে।

ফরাসিদের অগ্রগতির সম্মুখে সেই প্রতিশ্রুত দেশটি ছিল মস্কো, আর তাদের পশ্চাদপসরণের সময় সেটি হয়েছে তাদের স্বদেশ। কিন্তু সে স্বদেশ তো বহুদূরে, যে মানুষকে এক হাজার ভার্স্ট যেতে হবে তার পক্ষে একান্তভাবে প্রয়োজন শেষ লক্ষ্যকে সরিয়ে রেখে নিজেকে এই কথা বলা : আজ আমি চল্লিশ ভার্স্ট দূরের এমন একটা স্থানে পৌঁছব যেখানে পাব বিশ্রাম, যেখানে রাতটা কাটাতে পারব। প্রথম দিনের যাত্রা পথে সেই বিশ্রামস্থলটিই তার শেষ লক্ষ্যকে ঢেকে দিয়ে তার সব আশা-আকাঙ্ক্ষাকে আকর্ষণ করে। আর ব্যক্তিবিশেষের এই মনোভাব সমষ্টির ক্ষেত্রে আরো বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

পুরনো স্মোলেনস্ক রোড ধরে আগুয়ান ফরাসি বাহিনীর শেষ লক্ষ্য তাদের স্বদেশভূমি তখন অনেক দূরে, তাদের প্রত্যক্ষ লক্ষ্য হচ্ছে স্মোলেনস্ক, তাই সমগ্র সেনাবাহিনীর মনের মধ্যে বহুগুণে বর্ধিত হয়ে তাদের সব আশা ও আকাঙ্ক্ষা সেই পথেই তাদের টেনে নিয়ে চলল। স্মোলেনদ্ধে তাদের জন্য প্রচুর খাদ্য ও নতুন সেনাদল অপেক্ষা করছে এ-কথা যে তারা জানত তা নয়, সেরকম কোনো কথা তাদের বলাও হয়নি (বরং ঊর্ধ্বতন অফিসাররা এবং স্বয়ং নেপোলিয়ানও জানত যে সেখানে রসদের একান্ত অভাব আছে)। কিন্তু একমাত্র এই আশা ও আকাঙ্ক্ষাই তাদের দিয়েছে এগিয়ে চলার এবং বর্তমান দুঃখ-দুর্দশা সহ্য করবার শক্তি। কাজেই একথা যারা জানত এবং যারা জানত না দুই দলই নিজেদের প্রতারিত করে আশ্বাসের স্থল হিসেবে আলেঙ্কের দিকেই ছুটে চলল।

বড় রাস্তায় পড়ে ফরাসিরা বিস্ময়কর উদ্যম ও অশ্রুতপূর্ব দ্রুতগতিতে পালাতে লাগল নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে! একই প্রেরণা ফরাসি সৈন্যদের একসূত্রে বেঁধে দিল, উৎসাহ যোগাল, তাছাড়া আরো একটি কারণ তাদের এক সঙ্গে বেঁধেছিল-সেটা তাদের প্রবল সংখ্যা। মাধ্যাকর্ষণ নিয়মের মতোই তাদের সমষ্টিগত প্রবলতা প্রতিটি মানব-অণুকে নিজের দিকে টেনে নিল। তারা হাজারে হাজারে এক জাতি, এক প্রাণ হয়ে ছুটতে লাগল।

এই সন্ত্রাস ও দুর্দশার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য প্রত্যেকেই তখন চাইছে নিজেকে বন্দি হিসেবে শক্রর হাতে সঁপে দিতে, কিন্তু একদিকে যাত্রার লক্ষ্যস্থল সমালেনস্ক-এর প্রতি সম-আকর্ষণের শক্তি সকলকে একই পথে টেনে নিয়ে চলল, আবার অন্যদিকে একটা আর্মি কার তো কোনো কোম্পানির কাছে আত্মসমর্পণ করতে, পারে না, যদিও ফরাসিরা নিজেদের আলাদা করে নিয়ে যে কোনো উপযুক্ত অজুহাতে আত্মসমর্পণের সুযোগ খুঁজতে লাগল, সে সুযোগ কিন্তু তাদের সামনে এল না। তাদের সংখ্যাধিক্য এবং সমবেত দ্রুতগতির জন্যই তারা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল, সর্বশক্তিনিয়োগ করে ফরাসিরা যেভাবে ছুটতে লাগল তাতে রুশদের পক্ষে তাদের গতিরোধ করা শুধু কষ্টকর নয়, অসম্ভব হয়ে পড়ল। একটা বিশেষ সময়সীমার পরে কোনো যান্ত্রিক বিচ্ছেদই জীবদেহের পচনকে ত্বরান্বিত করতে পারে না।

একতাল বরফ একমুহূর্তেই গলে যেতে পারে না। এমন একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে যার কমে তাপের কোনো মাত্রা প্রয়োগ করেই বরফকে গলানো যায় না। পরন্তু, তাপ যত বেশি হয়, অবশিষ্ট বরফটা ততবেশি জমাট বেঁধে যায়।

রুশ কমান্ডারদের মধ্যে একমাত্র কুতুজভই এটা বুঝত। মোলেনস্ক রোড ধরে ফরাসিদের পলায়ন যখনস্পষ্ট হয়ে উঠল, তখন ১১ অক্টোবর রাতে কনভনিৎসিন যেটা আগে থেকেই দেখতে পেয়েছিল তাই ঘটতে লাগল। ঊর্ধ্বতন অফিসাররা সকলেই চাইল নাম করতে, শত্রুকে মারতে, অবরোধ করতে, বন্দি করতে, ফরাসিদের পরাভূত করতে। সকলেই যুদ্ধের জন্য হৈ-হৈ করে উঠল।

একমাত্র কুতুজভই আক্রমণ প্রতিহত করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করল (যে কোনো প্রধান সেনাপতির পক্ষেই সে সাধ্য খুবই সীমিত)।

আজ আমরা যা বলছি সেদিন কুতুজভ তা বলতে পারেনিঃ আমাদের সৈন্যদের মৃত্যু ডেকে এনে আর ভাগ্যহীন লোকগুলোকে অমানুষিক ভাবে হত্যা করে কেন এই যুদ্ধ, কেন এই পথ-অবরোধ? যখন বিনা যুদ্ধেই তাদের সেনাদলের এক-তৃতীয়াংশ মস্কো থেকে ভিয়াজমা রোডের উপর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তখন এ যুদ্ধের কী দরকার? কিন্তু পরিণত বুদ্ধির উপর নির্ভর করে সে তাদের বলল স্বর্ণ-সেতুর কথা, সঙ্গে সঙ্গে তারা হেসে উঠল, কটুক্তি করল, মরণোম্মুখ জন্তুটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে, উল্লাসে ফেটে পড়ল।

এর্মলভ, মিলরাদভিচ, প্লাভ এবং অন্যরা ভিয়াজমার কাছে ফরাসিদের মুঠোর মধ্যে পেয়ে দুটো ফরাসি কোরকে বিচ্ছিন্ন করে ভেঙে চুরমার করে দেবার ইচ্ছাকে সংযত করতে পারল না, তাদের এই অভিপ্রায় কুতুজভকে জানাবার উদ্দেশ্যে খামে ভরে তাকে পাঠিয়ে দিল এক তাড়া শাদা কাগজ।

সৈন্যদের বাধা দিতে কুতুজভ সাধ্যমতো চেষ্টা করল, কিন্তু রাস্তা বন্ধ করে দেবার চেষ্টায় সৈন্যরা আক্রমণ করে বসল। শুনেছি, পদাতিক রেজিমেন্টগুলি বাজনা বাজিয়ে ঢাক পিটিয়ে আক্রমণ করতে এগিয়ে গেল এবং হাজার হাজার মানুষ খুন হল।

কিন্তু তারা না পারল পথ আটকাতে, আর না পারল কাউকে পরাজিত করতে, বিপদের মুখেপড়ে ফরাসি বাহিনী আরো সুসংহত হয়ে ধীরে ধীরে সংখ্যায় কমতে কমতেও সমালেনঙ্কের মারাত্মক পথ ধরে এগিয়ে চলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *