০৬. প্রিন্স আন্দ্রু

দ্বিতীয় খণ্ড – ষষ্ঠ পর্ব – অধ্যায়-১

প্রিন্স আন্দ্রু একটানা দুটো বছর গ্রামে কাটাল। পিয়ের তার জমিদারিতে যে-সব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল এবং অনবরত একটা ছেড়ে অন্যটায় হাত দেয়ার ফলে কোনোটাই সমাধা করতে পারেনি প্রিন্স আন্দ্রু কোনোরকম আড়ম্বর না করে কোনোরকম আপাত অসুবিধা ছাড়াই সেগুলিকে কার্যে রূপায়িত করে তুলতে লাগল।

তার মধ্যে বাস্তব কর্ম-তৎপরতা এত বেশি পরিমাণে ছিলসেটা পিয়েরের মধ্যে একেবারেই ছিল না–যে-কোনোরকম হৈ-হট্টগোল ছাড়াই কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে চলতে লাগল।

তার একটা জমিদারিতে তিনশো ভূমিদাসকে মুক্তি দেয়া হয়েছে, এখন তারা স্বাধীন ক্ষেতমজুর হয়ে কাজ করছে রাশিয়াতে এ ধরনের প্রথম দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। অন্য সব জমিদারিতেও কিছু অর্থের বিনিময়ে ভূমিদাসদের বাধ্যতামূলক শ্রমদান মকুব করা হয়েছে। তার নিজের খরচে বোণ্ডচারোতভারের জন্য একজন শিক্ষাপ্রাপ্ত ধাত্রীকে নিয়োগ করা হয়েছে, আর চাষী ও পারিবারিক ভূমিদাসদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য একজন পুরোহিতকে মাইনে দেয়া হচ্ছে।

প্রিন্স আন্দ্রু অর্ধেক সময় কাটায় বল্ড হিলসে তার বাবা ও ছেলের সঙ্গে। ছেলেটি এখনো ধাত্রীর হাতেই মানুষ হচ্ছে। বাকি সময়টা কাটায় বোচারোভো আশ্রমে, প্রিন্স আন্দ্রুর জমিদারিকে তার বাবা ওই নামেই ডাকে। পিয়েরের কাছে জাগতিক ব্যাপার সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীনতা প্রকাশ করলেও সে কিন্তু বেশ পরিশ্রমসহকারেই সাম্প্রতিক ঘটনাবলির উপর নজর রাখে, তার কাছে অনেক বইপত্রও আসে, আর জীবনের ঘূর্ণাবর্তরূপ পিটার্সবুর্গ থেকে তার কাছে বা তার বাবার কাছে যে-সব অতিথি আসে, দেশের এবং বিদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে তাদের জ্ঞান তার চাইতে এত কম যে তা দেখে প্রিন্স আন্দ্রুর বিস্ময়ের অবধি থাকে না, অথচ সে তো গ্রাম ছেড়ে কোথাও যায় না।

জমিদারির কাজে ব্যস্ত থাকা এবং নানা ধরনের বইপড়া ছাড়াও এই সময়ে আমাদের দুটি দুর্ভাগ্যজনক বিগত অভিযান সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণাত্মক জরিপের কাজ নিয়েও প্রিন্স আন্দ্রু খুবই ব্যস্ত রয়েছে, সামরিক বিধি-বিধান সংস্কারের একটা খসড়াও সে তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছে।

১৮০৯-এর বসন্তকালে সে ছেলের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রিয়াজান জমিদারি দেখতে সেখানে গেল।

বসন্তের আতপ্ত রোদে বসে চোখ মেলে সে দেখছিল নতুন ঘাস, বাচগাছের ডালে ডালে নতুন পাতা, আর পরিষ্কার নীল আকাশে ভেসে-চলা বসন্তের সাদা মেঘের দল। কোনো কিছু নিয়েই সে ভাবছে না, অন্যমনস্কভাবে আনন্দিত মনে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সবকিছু দেখছে।

আগের বছর যেখানে দাঁড়িয়ে পিয়েরের সঙ্গে তার কথা হয়েছিল সেখানেই তারা ফেরিটা পার হল। কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে ঝাড়াই উঠোন ও শীতকালীন গমের সবুজ ক্ষেত পেরিয়ে, কখনো সেতুর কাছে বরফজমা পাহাড়ের উত্রাই বেয়ে, কখনো-বা বৃষ্টিতে গলে যাওয়া কাদার চড়াই ভেঙে, ফসল কাটা মাঠ পেরিয়ে, সবুজের ছোপ-লাগা ঝোঁপঝাড় ডিঙিয়ে রাস্তার দুপাশে গজিয়েওঠা বার্চের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে তারা এগিয়ে চলল। বনের মধ্যে বেশ গরম, বাতাসের ছোঁয়াও লাগছে না। কাঠির মতো সবুজ পাতাওয়ালা বাচগাছগুলি নিশ্চল, লিলাক-রঙের ফুল আর সবুজ ঘাসের প্রথম শিসগুলি মাথা তুলেছে। বাচগাছের ফাঁকে ফাঁকে এখানে ওখানে ছড়ানো ছোট ছোট চিরসবুজ ফারগাছগুলি শীতের অপ্রীতিকর স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। জঙ্গলে ঢুকে ঘোড়াগুলি নাক ডাকাতে লাগল, তাদের শরীরও ঘেমে উঠেছে।

পরিচারক পিতর কোচয়ানকে কী যেন বলল, সেও তাতে সায় দিল। কিন্তু বোঝা গেল যে কোচয়ানের সহানুভূতিকে যথেষ্ট মনে না করে পিতর বক্সের উপর থেকেই মনিবের দিকে ফিরে সশ্রদ্ধ হাসির সঙ্গে বলল, কী চমৎকার ইয়োর এক্সেলেন্সি!

কী?

বড় চমৎকার ইয়োর এক্সেলেন্সি!

প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, ওক কিসের কথা বলছে? মনে হচ্ছে, বসন্তের কথা। সত্যি, এর মধ্যেই সবকিছু কেমন সবুজ হয়ে উঠেছে।… এত আগে থেকেই! বার্চ, চেরি ও অ্যান্ডার গাছের পাতা বেরিয়েছে… কিন্তু ওকগাছের এখনো দেখা নেই। আরে, এই তো একটা ওক!।

পথের প্রান্তেই একটা ওকগাছ দাঁড়িয়েছিল। সম্ভবত এই বার্চের জঙ্গলের চাইতে বয়সে দশগুণ বড় এই ওকগাছটা ওগুলোর চাইতে দশগুণ মোটা এবং দুগুণ উঁচু। গাছটা প্রকাণ্ড, একটা লোক যতটা জড়িয়ে ধরতে পারে তার দ্বিগুণ এর বেড়টা, অনেকদিন আগেই ডালপালা অনেক ভেঙে গেছে, অনেক বাকল কেটে তুলে নেয়া হয়েছে। মস্ত বড় বড় বিশ্রী ডালপালাগুলো এলোমেলোভাবে বেড়ে উঠেছে। কেমন গিট-পাকানো হাত ও আঙুল, দেখে মনে হয়, হাসি-হাসি বার্চগাছগুলি মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কঠোর ও ঘৃণ্য এক বুড়ো দানব। কেবল জঙ্গলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু মড়ার মতো দেখতে ফারগাছ এবং ওকগাছটাই যেন বসন্তের মাধুর্যের কছে হার মানতে চাইছে না, চাইছে না বসন্ত ও তার রোদকে চোখ মেলে দেখতে।

ওকটা যেন বলতে চাইছে, বসন্ত, ভালোবাসা, সুখ! এইসব অর্থহীন, ফাঁকা বুলি অনবরত শুনতে কি তোমাদের ক্লান্তি আসে না? সব সময়ই সেই এক কথা, সর্বদাই ফাঁকি! এখানে বসন্ত নেই, সূর্য নেই, সুখ নেই! এই কুঁকড়ে-যাওয়া মরা ফারগুলোকে দেখ, চিরদিন একই আছে, আমাকে দেখ, কখনো পিঠ থেকে কখনো পাশ থেকে যেমন খুশি গজিয়ে ওঠা আমার এই ভাঙা, বাকল-ঢাকা আঙুলগুলো বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি : এগুলো যেমন গাজিয়েছে আমিও তেমনি দাঁড়িয়ে আছি, তোমাদের আশা, তোমাদের মিথ্যাকে আমি বিশ্বাস করি না।

জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে প্রিন্স আন্দ্রু বার বার ফিরে ফিরে ওক গাছটার দিকে তাকাতে লাগল, যেন তার কাছ থেকে কিছু আশা করছে। ওক গাছটার নিচেও ফুল ও ঘাস রয়েছে, কিন্তু তাদের মাঝখানেই গাছটা দাঁড়িয়ে আছে সেই একই কঠিন, বিকৃত, রূঢ় আকৃতি নিয়ে।

প্রিন্স আন্দ্রু মনে মনে বলল, হ্যাঁ, ওকের কথাই ঠিক, হাজারবার ঠিক! অন্যরা–যুবকরা–এই ফকির কাছে নতুন করে মাথা নোয়াক, কিন্তু আমরা তো জীবনকে চিনেছি, আমাদের জীবন তো শেষ হয়ে গেছে।

এই গাছটাকে ঘিরে তার মনের মধ্যে আশাহীন কিন্তু শোচনীয়ভাবে প্রীতিপ্রদ নতুন চিন্তার স্রোত বইতে লাগল। এই যাত্রাকালে সে যেন নতুন করে জীবনকে দেখতে শিখল, আশাহীনতার মধ্যেও সেই পুরনো শান্তিময় সিদ্ধান্তে উপনীত হল, তার দিক থেকে নতুন করে শুরু করার কিছু নেই–কিন্তু তাকে বেঁচে থাকতে হবে, কারো কোনো ক্ষতি না করে, নিজেকে বিব্রত না করে, বা কোনো কিছু কামনা না করেই খুশি থাকতে হবে।

.

অধ্যায়

 যে রিয়াজান জমিদারির সে একজন অছি তার ব্যাপারেই এ জেলার মার্শাল অব দি নবিলিস্টের সঙ্গে দেখা করতেই প্রিন্স আন্দ্রু এসেছে। কাউন্ট ইলিয়া রস্তভই সেই মার্শাল। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রিন্স আন্দ্রু তার সঙ্গে দেখা করতে গেল।

বসন্তকালের গরম আবহাওয়া। গোটা জঙ্গলটা এর মধ্যেই সবুজে ঢেকে গেছে। ধুলো উড়ছে, আর এত গরম পড়েছে যে পথের পাশে পানি দেখলেই ডুব দিতে ইচ্ছা করছে।

মার্শালের সঙ্গে কী কথা বলবে সে-কথা ভাবতে ভাবতে বিষণ্ণ মনে প্রিন্স আন্দ্রু অত্রাদণুতে অবস্থিত রস্তভদের বাড়ির সামনে দিয়েই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল। ডান দিকে গাছের ওপারে কিছু মেয়েলি গলায় খুশির কথাবার্তা কানে এল, সে দেখতে পেল একদল মেয়ে তার গাড়ির সামনে দিয়ে পথটা পার হবার জন্য ছুটে আসছে। সকলের আগে আগে আসছে একটি সুন্দরী মেয়ে, কালো চুল, ছিপছিপে চেহারা, হলুদ ছিটকাপড়ের পোশাক, মাথায় জড়ানো সাদা রুমালের নিচে ঝুলে পড়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ চুল। মেয়েটির চিৎকার করে কী যেন বলছে, কিন্তু যখন বুঝল যে সে অপরিচিত লোক তখন তার দিকে না তাকিয়েই হাসতে হাসতে ছুটে গেল।

হঠাৎ কী জানি কেন সে একটা যন্ত্রণা বোধ করল। দিনটা সুন্দর, সূর্য ঝলমল করছে, চারদিকে খুশির আমেজ, কিন্তু ওই ছিপছিপে সুন্দর মেয়েটি, তার অস্তিত্বের কথাটাই জানল না, জানতে চাইল না, নিজের উজ্জ্বল ও সুখী-হয়তো-বা নির্বোধ-জীবনটা নিয়েই সে পরিতুষ্ট, খুশি। কী নিয়ে সে এত খুশি? সে কী ভাবছে? নিশ্চয়ই সামরিক আইন-কানুন অথচ রিয়াজানের ভূমিদাসদের ব্যবস্থার কথা নয়। তাহলে সে কী ভাবছে? কেন সে এত সুখী? সহজাত কৌতূহলবশেই প্রিন্স আন্দ্রু নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল।

কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ এবারেও আগেকার বছরগুলোর মতোই অত্রাদণুতে বাস করছিল, অর্থাৎ আগের মতোই গোটা প্রদেশকে শিকারে, থিয়েটারে, ডিনারে ও গান বাজনায় একেবারেই মাতিয়ে তুলেছে। কোনো নতুন অতিথি এলেই সে খুশি হয়, প্রিন্স আন্দ্রুকে পেয়েও খুশি হল, রাতটা থেকে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। আসন্ন নাম দিবস উপলক্ষে বুড়ো কাউন্টের বাড়িটা তখন লোকভর্তি। সারাটাদিন বাড়ির বয়স্ক লোকজন ও গণ্যমান্য অতিথিদের নিয়ে কাটালেও প্রিন্স আন্দ্রু বারবার নাতাশার দিকে তাকাতে লাগল। মেয়েটি তার দলবল নিয়ে হাসিঠাট্টা করছে, খুশিতে ফেটে পড়ছে। প্রতিবারই প্রিন্স আন্দ্রু ভাবছে, সে কি ভাবছে? ও এত খুশি কেন?

রাতের বেলা নতুন পরিবেশে একেবারে একলা হওয়ায় অনেকক্ষণ তার ঘুম এল না। কিছুক্ষণ পড়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল, আবার জ্বালাল। ঘরের ভিতরকার খড়খড়িগুলো বন্ধ থাকায় গরটা বেশ গরম। বোকা বুড়োটার (রস্তভকে সে ওই বলেই ডাকত) উপর সে বিরক্ত হয়ে উঠল, শহর থেকে কিছু দরকারি কাগজপত্র না আসায় সেই তাকে রাতটা এখানে থেকে যেতে বলেছে। এখানে থেকে যাবার জন্য সে নিজের উপরেও বিরক্ত হল।

বিছানা থেকে উঠে জানালাটা খুলে দিতে গেল। খড়খড়ি কোলামাত্রই চাঁদের আলো হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল যেন এইজন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করে ছিল। পাল্লাও খুলে দিল। বাইরে উজ্জ্বল, শান্ত রাত। জানালার ঠিক সামনেই একসারি পোর্লাড গাছ, তার একদিকে অন্ধকার, অপর দিকে রুপোলি আলোর ঝিলিক। গাছগুলোর ঠিক নিচে একধরনের ভিজে ভিজে ঘন ঝোঁপঝাড়, সেগুলির পাতায় ও বোটায় রুপোলি আলো পড়ে ঝিলমিল করছে। কালো গাছগুলোর পিছনে একটা ছাদের উপর শিশিরের কণাগুলি ঝিকমিক করছে, ডানদিকে উজ্জ্বল সাদা কাণ্ড ও ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা পাতাভরা গাছ। আর প্রায় তারকাবিহীন পাণ্ডুর বসন্তের আকাশে পূর্ণ চাঁদের আলো এসে পড়েছে গাছটার মাথায়। জানালার গোবরাটে কনুই রেখে প্রিন্স আন্দ্রু সেই আকামের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল।

তার ঘরটা দোতলায়। উপরের ঘরের সব লোকজনও জেগে আছে। মাথার উপরে অনেক মেয়েলি গলার স্বর তার কানে এল।

ঠিক আর একবার, একটি মেয়েলি গলা শুনেই প্রিন্স আন্দ্রু চিনতে পারল।

 কিন্তু তুমি কখন ঘুমতে যাবে? অন্য কণ্ঠস্বর বলল।

আমি ঘুমব না, ঘুমতে পারছি না, কী হবে ঘুমিয়ে? শেষবারের মতো এসো।

দুটি মেয়েলি গলায় গানের কলি ফুটল-কোনো গানের শেষ অংশ।

আঃ কী সুন্দর! এবার ঘুমতে যাও। এখানেই শেষ হোক।

জানালার আরো কাছে এসে প্রথম কণ্ঠস্বর বলল, তুমি ঘুমতে যাও, আমি ঘুমতে পারব না। মেয়েটি নিশ্চয় বাইরে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে, কারণ তার পোশাকের খসখস শব্দ, এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে। সবকিছুই পাথরের মতো স্তব্ধ, ঠিক ওই চাঁদ, তার আলো ও ছায়াগুলির মতো। পাছে তার অনিচ্ছাকৃত উপস্থিতি ধরা পড়ে সেই ভয়ে প্রিন্স আন্দ্রুও সরে যেতে সাহস করল না।

সোনিয়া! সোনিয়া! আবার সেই কণ্ঠস্বর। আঃ, তুমি যে কী করে ঘুমচ্ছ? শুধু একবার চেয়ে দেখ কী অপরূপ! আঃ, কী অপরূপ! উঠে পড় সোনিয়া! তার গলা থেকে যেন কান্না ঝরে পড়ল। এমন মধুর রাত আগে তো কখনো আসেনি, কোনোদিন না।

সোনিয়া একান্তু অনিচ্ছায় কী যেন জবাব দিল।

একবার বাইরে এসে দেখ কী একখানা চাঁদ!… আঃ, কী মধুর! এখানে এস।… লক্ষ্মী, সোনামণি, এখানে এসো! মনে হচ্ছে এইভাবে দুহাত দিয়ে হাঁটু দুটোকে যথাসম্ভব জোরে চেপে ধরে গোড়ালির উপর ভর দিয়ে বসি, আর তারপরেই উড়ে চলে যাই! ঠিক এইভাবে…

আরে সাবধান, বাইরে পড়ে যাবে যে।

একটা ধস্তাধস্তির শব্দ কানে এল, কানে এল সোনিয়ার আপত্তিভরা গলা, একটা বেজে গেছে।

আঃ, তুমি শুধু বরবাদ করতেই জান। ঠিক আছে, যাও, চলে যাও।

আবার সব চুপচাপ, কিন্তু আন্দ্রু জানে মেয়েটি তখনো সেখানেই বসে আছে। মাঝে মাঝে একটা মৃদু খসখস, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ সে শুনতে পেল।

হঠাৎ মেয়েটি চেঁচিয়ে বলল, হে ঈশ্বর! এর অর্থ কী? বেশ, তাহলে শুতেই যাই, যেতেই যখন হবে! সশব্দে জানালাটা বন্ধ হয়ে গেল।

তার গলা শুনতে শুনতেই প্রিন্স আন্দ্রু বলল, তার কাছে তো আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। যে কারণেই হোক সে আশা করছে যে মেয়েটি তার সম্পর্কে কিছু বলুক, আবার তাতে ভয়ও পাচ্ছে। ওই তো সে আবার এসেছে! কোনো মতলব নিয়েই এসেছে!

সহসা তার মনের মধ্যে যৌবনসুলভ ভাবনা ও প্রত্যাশার এমন এক অপ্রত্যাশিত বিভ্রাট দেখা দিল যা তার সমস্ত জীবনযাত্রার পরিপন্থী, নিজের কাছেই নিজের এই অবস্থার কোনো ব্যাখ্যা দিতে না পেরে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

 অধ্যায়-৩

পরদিন সকালে একমাত্র কাউন্ট ছাড়া আর কারো সঙ্গে দেখা না করে এবং মহিলাদের কারো জন্য অপেক্ষা না করেই প্রিন্স আন্দ্রু বাড়ির পথে পা বাড়াল।

জুন মাস আরম্ভ হয়ে গেছে। ফেরার পথে সেই বার্চগাছের জঙ্গলে সে পৌঁছে গেল যেখানে বুড়ো ওকগাছটা তার মনে একটা অদ্ভুত স্মরণীয় দাগ কেটেছিল। জঙ্গলে ঢোকার পরে জোয়ালের ঘণ্টাগুলো ছয় সপ্তাহ আগের তুলনায় আরো অনেক বেশি অস্পষ্ট সুরে বাজতে লাগল, কারণ জঙ্গলটা এখন আরো বেশি ঘন ও ছায়াচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে, আর ইতস্তত ছড়ানো নতুন ফার গাছগুলো এখানকার সৌন্দর্যের কোনোরকম হানি না ঘটিয়ে বরং তাদের সতেজ সবুজ ডালপালা মেলে দিয়ে পরিবেশের সঙ্গে আরো বেশি করে মিলেমিশে গেছে।

সারাদিনটাই খুব গরম ছিল। কোথায় একটা ঝড় জমে উঠেছে, কিন্তু এখানে মুধু একটুকরো মেঘ থেকে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে রাস্তাটাকে ও নতুন পাতাগুলোকে ভিজিয়ে দিয়েছে। জঙ্গলের বাঁ দিকটা ছায়ায় অন্ধকার, ডান দিকটাতে রোদ ঝিলমিল করছে, ভেজা পাতাগুলো চিকচিক করছে, বাতাসে একটুও নড়ছে না। গাছে গাছে ফুল ফুটেছে, নাইটিঙ্গেল পাখিরা ডাকছে, তাদের স্বর দূরে ও কাছে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, হ্যাঁ, যে ওক গাছটার সঙ্গে আমি একান্ত হয়েছিলাম সেটা এখানেই ছিল। সেটা গেল কোথায়? রাস্তার বাঁদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল, আর চিনতে না পেরে যে ওক গাছটাকে সে খুঁজছিল সেটার দিকেই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। বুড়ো ওক গাছটা বদলে গেছে, গাঢ় সবুজ নতুন পাতার চাঁদোয়া ছড়িয়ে একমনে দাঁড়িয়ে আছে, আর অস্তসূর্যের আলোয় ঈষৎ কাঁপছে। সেই গাঁটওয়ালা আঙুলও নেই, বাকলে সেই পুরনো ক্ষতও নেই, পুরনো সন্দেহ ও দুঃখকষ্টের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। শতাব্দীকালের প্রাচীন বাকল থেকে একটা ডালও গজায়নি, অথচ তাতেই এত পাতা গজিয়েছে যে এই বুড়ো গাছটাই যে সেগুলির জনক সেটা বিশ্বাস করাই শক্ত।

হ্যাঁ, এই তো সেই ওক গাছটা, একথা ভাবতেই একটা অকারণ বসন্তকালীন আনন্দ ও পুনরুজ্জীবনের অনুভূতি প্রিন্স আন্দ্রুকে একেবারে পেয়ে বসল। সহসা স্মৃতির পথ ধরে ভেসে এল জীবনের সবগুলি শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। অস্তারলিজের উঁচু আকাশটা, তার স্ত্রীর অনুযোগভরা মৃত মুখখানি, ফেরিঘাটে পিয়েরের উপস্থিতি, রাতের সৌন্দর্য দেখে বিহ্বল মেয়েটি, সেই রাতটি ও তার চাঁদটি, আর… সহসা সে-সব কিছু তার মনের মধ্যে এসে ভিড় করল।

হঠাৎ প্রিন্স আন্দ্রু একটা চিরদিনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করে বসল, না, একত্রিশ বছর বয়সে জীবন শেষ হতে পারে না! আমাদের মধ্যে কী আছে সেটা জানাই যথেষ্ট নয়–সকলকেই সেটা জানাতে হবে : পিয়ের, আর সেই যে মেয়েটি আকাশে উড়তে চেয়েছিল, তারা সকলেই আমাকে জানুক, যাতে আমার জীবনটা শুধু আমার জীবন হয়েই অন্য সকলের থেকে দূরে না থাকে, যাতে তাদের সকলের মধ্যে আমার জীবনটা প্রতিফলিত হতে পারে, যাতে তারা এবং আমি এক হয়ে বাঁচতে পারি।

বাড়িতে পৌঁছে প্রিন্স আন্দ্রু স্থির করল হেমন্তকালেই সে পিটার্সবুর্গে যাবে, আর এই সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে সবরকম যুক্তি বের করতে লাগল। একগাদা অর্থপূর্ণ ও যুক্তিসঙ্গত কারণ তাকে বলে দিল যে পিটার্সবুর্গে যাওয়া তার পক্ষে একান্তভাবে প্রয়োজন, এমনকি আবার চাকরিতে ঢোকার কথাও তার মনটাকে দোলা দিতে লাগল। এখন সে বুঝতেই পারল না কেমন করে জীবনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তাকে সে একদিন সন্দেহ করেছিল, ঠিক যেমন একমাস আগেও সে বুঝতে পারত না যে শান্ত গ্রাম্যজীবনকে ছেড়ে আসার কথা কেমন করে তার মাথায় আসতে পারে। এখন সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে যে কোনোরকম কাজে নিজেকে নিয়োজিত না করলে এবং আবার জীবনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ না করলে তার জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতাই অর্থহীনভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। রিয়াজান পরিভ্রমণের পরে গ্রাম্যজীবনটাই তার কাছে একঘেয়ে মনে হতে লাগল, আগেকার কাজকর্মে সে আর তেমন আগ্রহ বোধ করে না, অনেক সময়ই নিজের পড়ার ঘরে একলা বসে থাকতে থাকতে সে উঠে দাঁড়ায়, আয়নার কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিজের মুখের দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেইসব মুহূর্তে কেউ তার ঘরে ঢুকলে সে অতি কঠোর ও কঠিন হয়ে ওঠে, এমনকি অপ্রীতিকর রকমের যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে।

হয়তো সেইরকম কোনো মুহূর্তে ঘরে ঢুকে প্রিন্সেস মারি বলল, দেখ দাদা, ছোট্ট নিকলাস আজ বাইরে যাবে না, দিনটা বড় ঠাণ্ডা।

তখন প্রিন্স আন্দ্রু হয়তো রুক্ষ গলায় বোনকে বলে বসল, যদি গরম হত তাহলে সে বাইরে বের হত ঢিলে জামা পরে, কিন্তু আজ যেহেতু ঠাণ্ডা তাই তাকে গরম পোশাক পরতে হবে, সেজন্যই তো ওগুলো বানানো হয়েছে। আজ ঠাণ্ডা পড়েছে বলে ছেলে ঘরের মধ্যে থাকবে এটা তো কোনো যুক্তি হতে পারে না।

সেসব মুহূর্তে প্রিন্সেস মারি হয়তো ভাবত, বুদ্ধিগত কাজকর্মের ফলে মানুষ কত নীরসই না হয়ে যেতে পারে।

.

অধ্যায়-৪

১৮০৯-এর অগস্ট মাসে প্রিন্স আন্দ্রু পিটার্সবুর্গে পৌঁছল। সে-সময়ে যৌবনদীপ্ত স্পেরানস্কি খ্যাতির একেবারে শিখরে অধিষ্ঠিত, প্রচণ্ড উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে চলেছে তার সংস্কার-কার্য। সেই অগস্ট মাসেই সম্রাট তার গাড়ি থেকে পড়ে যায়, তার পায়ে চোট লাগে, তিন সপ্তাহ তাকে পিতরহপে থাকতে হয়, প্রতিদিন একমাত্র স্পেনস্কি ছাড়া আর কারো সঙ্গে সম্রাট দেখা করত না। সেই সময় এমন দুটি বিখ্যাত বিধান তৈরি করা হচ্ছিল যা সমাজকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিল আদালতের বিভিন্ন মর্যাদার স্তরভেদ রহিত করা এবং কলেজিয়েট এসেসর ও স্টেট কাউন্সিলর পদের জন্য পরীক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করা, শুধু এই দুটোই নয়, রাশিয়ার তকালীন শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য গোটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোটাকেই পাল্টে দেয়া : রাষ্ট্রীয় পরিষদ থেকে জেলা বিচার পদ্ধতি পর্যন্ত আইন, শাসন ও অর্থনৈতিক স্তরে পরিবর্তন সাধন করা। যে-সব অস্পষ্ট উদারনৈতিক স্বপ্ন নিয়ে সম্রাট আলেক্সান্দার সিংহাসনে আরোহণ করেছিল এবং সহযোগী জারতোরিস্কি, নভসিলৎসেভ, কোচুবে ও স্লোগানভের সাহায্যে তাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে চেষ্টা করছিল সেগুলি ক্রমে স্পষ্ট আকার নিয়ে বাস্তবায়িত হতে চলছিল।

এখন অসামরিক দিক থেকে এসব লোকের স্থান দখল করেছিল স্পেরানস্কি, আর সামরিক দিক থেকে আরাকচিভ। পৌঁছার কিছুক্ষণ পরেই প্রিন্স আন্দ্রু ম্রাটের দরবারে হাজির হল। আগে দুবার দেখা হওয়া সত্ত্বেও সম্রাট অনুগ্রহ করে তাকে একটি কথাও বলল না। প্রিন্স আন্দ্রুর আগাগোড়াই মনে হয়েছে যে সম্রাটের প্রতি তার সহানুভূতি নেই, পরবর্তীকালে তার মুখ এবং ব্যক্তিত্ব কোনোটাই সে পছন্দ করত না, আর আজ ম্রাটের এই নিরুত্তাপ, প্রতিরোধী দৃষ্টিপাতের ফলে তার সে ধারণা আরো দৃঢ় হল। তার প্রতি সম্রাটের এই তাচ্ছিল্যকে সভাসদরা এই বলে ব্যাখ্যা করল যে ১৮০৫ সাল থেকে বলকনস্কি সেনাদলের চাকরি ছেড়ে দেয়ায় হিজ ম্যাজেস্টির অসন্তুষ্টিই এর আসল কারণ।

প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, কারো ভালো লাগা মন্দ লাগার উপর যে মানুষের হাত থাকে না সেকথা আমি নিজেও জানি, কাজেই সামরিক বিধিবিধান সংস্কারের জন্য আমি যে প্রস্তাব তৈরি করেছি সেটা ব্যক্তিগতভাবে সম্রাটের হাতে দিলেই কোনো কাজ হবে না, কিন্তু আমার প্রকল্পের গুণই তাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।

সে যা লিখে এনেছে তার কথা বাবার বন্ধু জনৈক বৃদ্ধ ফিল্ড-মার্শালকে বলল। ফিল্ড-মার্শাল তার সঙ্গে দেখা করার একটা সময় স্থির করে দিল, তাকে সাদরে অভ্যর্থনা করল এবং কথা দিল যে সম্রাটকে জানাবে। কয়েক দিন পরেই প্রিন্স আন্দ্রু একটা চিঠি পেল, যুদ্ধমন্ত্রী কাউন্ট আরাকচিভের সঙ্গে তাকে দেখা করতে হবে।

নির্দিষ্ট দিনে সকাল নয়টায় প্রিন্স আন্দ্রু কাউন্ট আরাকচিভের প্রতীক্ষাকক্ষে ঢুকল।

সে ব্যক্তিগতভাবে আরাকচিভকে চেনে না, আগে কখনো তাকে দেখেনি, কিন্তু তার সম্পর্কে যেসব কথা শুনেছে তাতে লোকটির প্রতি তার মনে কোনো শ্রদ্ধাই জাগেনি।

তিনি যুদ্ধমন্ত্রী, সম্রাটের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি, তার ব্যক্তিগত গুণাগুণ বিচার করার কোনো দরকার আমার নেই, আমার প্রকল্পটি বিচার করে দেখার ভার তার উপর পড়েছে, কাজেই একমাত্র তিনিই এটাকে গ্রহণ করতে পারেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাউন্ট আরাকচিভের প্রতীক্ষা-কক্ষে বসে প্রিন্স আন্দ্রু এই কথাগুলিই ভাবতে লাগল।

যে মুহূর্তে দরজাটা খুলে গেল তখনই উপস্থিত ছোট-বড় সকলের মুখে একটিমাত্র অনুভূতিই প্রকাশ পেল-ভয়ের অনুভূতি। প্রিন্স আন্দ্রু কর্তব্যরত অ্যাডজুট্যান্টকে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করল তার নামটা এগিয়ে দেবার জন্য, কিন্তু একটা ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টি হেনে অ্যাডজুট্যান্ট জানিয়ে দিল যথাসময়েই তার পালা আসবে। কর্তব্যরত অ্যাডজুট্যান্ট আরো কয়েকজনকে মন্ত্রীর ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া ও বের করে আনার পরে সেই ভয়ংকর দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হল এমন একটি অফিসারকে যার মর্যাদাহীন ভীত ভাবভঙ্গি দেখে প্রিন্স আন্দ্রু অবাক হয়ে গেল। অফিসারটির সাক্ষাঙ্কার দীর্ঘ সময় ধরে চলল। তারপর হঠাৎ দরজার ওপাশে একটা কর্কশ কণ্ঠের কঠোর শব্দ শোনা গেল এবং পাণ্ডুর মুখ ও কাঁপা ঠোঁট নিয়ে অফিসারটি ঘর থেকে বেরিয়ে এল-দুই হাতে মাথাটা চেপে ধরে প্রতীক্ষা-কক্ষের ভিতর দিয়ে বাইরে চলে গেল।

তারপরেই কর্তব্যরত অফিসারটি প্রিন্স আন্দ্রুকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ডান দিকে, জানালার কাছে।

একটা পরিচ্ছন্ন সাদামাঠা ঘরে ঢুকে প্রিন্স আন্দ্রু দেখল বছর চল্লিশের একটি লোক টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তার কোমর লম্বা, মাথায় বড় বড় চুল, কপালে অনেকগুলি ভজ, সবুজ-বাদামি চোখের উপর ভ্রুকুটি কুটিল ভুরু, ঝোলানো রক্তিম নাক। না তাকিয়েই আরাকচিভ মাথাটা তার দিকে ঘোরাল।

আপনার কিসের আবেদন? আরাকচিভ প্রশ্ন করল।

আমি কোনো আবেদন রাখছি না ইয়োর এক্সেলেন্সি, প্রিন্স আন্দ্রু শান্তভাবে জবাব দিল।

আরাকচিভের চোখ দুটি তার দিকে ঘুরল।

 বলল, বসুন। প্রিন্স বলকনস্কি?

কোনো ব্যাপারে আবেদন জানাতে আমি আসিনি। আমার একটা প্রকল্প মহামান্য সম্রাট আপনার কাছে পাঠিয়েছেন…

দেখুন সাহেব, আপনার প্রকল্পটা আমি পড়েছি, প্রথম কথাগুলি বেশ ভদ্রভাবে উচ্চারণ করেই আরাকচিত পুনরায় প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে না তাকিয়েই একটা বিরক্তিপূর্ণ ঘৃণার সুরে ফিরে গেল। আপনি নতুন সামরিক আইনের প্রস্তাব করেছেন? আইন তো অনেক রয়েছে, কিন্তু পুরনো আইনকে কাজে লাগাবার মতো লোকেরই তো অভাব। আজকাল তো সকলেই আইন তৈরি করেন, কাজ করার চাইতে লেখাটা অনেক সহজ।

প্রিন্স আন্দ্রু বিনীতভাবে বলল, আমি যে স্মারকলিপিটা পাঠিয়েছি সে সম্পর্কে আপনার অভিমত জানবার জন্য মহামান্য সম্রাটের ইচ্ছানুসারেই আমি ইয়োর এক্সেলেন্সির কাছে এসেছি।

আপনার স্মারকলিপির উপর একটা প্রস্তাব অনুমোদন করে সেটা কমিটিতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি এটা সমর্থন করি না, উঠে দাঁড়িয়ে লেখার টেবিল থেকে একখানা কাগজ তুলে আরাকচিভ বলল, এই নিন! কাগজটা সে প্রিন্স আন্দ্রুর হাতে দিল।

বড় হাতের অক্ষর ব্যবহার না করে, ভুল বানানে, যতিচিহ্ন ছাড়াই আড়াআড়িভাবে কাগজটার উপর লেখা হয়েছে, রচনা সুষ্ঠু হয়নি কারণ ফরাসি সামরিক বিধির নকল বলে মনে হয় আর সমর-বিধি থেকে অপ্রয়োজনে সরে যাওয়া হয়েছে।

কোন কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে? প্রিন্স আন্দ্রু জানতে চাইল।

সেনাবাহিনী-সংক্রান্ত কমিটির কাছে, আমি সুপারিশ করেছি, মহাশয়কে একজন সদস্য মনোনীত করা উচিত, কিন্তু বিনা বেতনে।

প্রিন্স আন্দ্রু হাসল।

 আমি চাই না।

বিনা বেতনে সদস্য আরাকচিভ পুনরায় কথাটা বলল। আমি বলছি…এই! পরবর্তী লোককে ডাক! আর কে আছে? প্রিন্স আন্দ্রুকে অভিবাদন জানিয়ে সে চিৎকার করে বলল।

.

অধ্যায়-৫

কমিটিতে নিজের মনোনয়নের ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করে থাকার ফাঁকে প্রিন্স আন্দ্রু পূর্বপরিচিত লোকজনদের খোঁজ করতে লাগল, বিশেষ করে যারা এখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে এবং যাদের সহায়তা তার কাছে লাগবে।

কাউন্ট আরাকচিভের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পরদিন প্রিন্স আন্দ্রুন্দ্ৰ সন্ধ্যাটা কাটাল কাউন্ট কোচুবের বাড়িতে। কাউন্ট আরাকচিভের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কথাও তাকে বলল।

দেখুন মশায়, এক্ষেত্রেও মাইকেল মিখায়লভিচ স্পেরানস্কিকে ছাড়া আপনার চলবে না। সবকিছুই তো তার হাতে। আমি তার সঙ্গে কথা বলব। আজ সন্ধ্যায়ই তার আসার কথা আছে।

সামরিক বিধি-বিধানের সঙ্গে স্পেরানস্কির কি সম্পর্ক থাকতে পারে? প্রিন্স আন্দ্রু শুধাল।

কোচুবে হেসে মাথা নাড়তে লাগল, যেন বলকনস্কির সরলতা দেখে সে অবাক হয়েছে।

সে বলতে লাগল, কয়েকদিন আগেই আপনার সম্পর্কে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে, আপনার স্বাধীন চাষীর ব্যাপারটা নিয়েও কি হয়েছে।

ক্যাথারিনের সময়কার একজন বুড়ো মানুষ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলকনস্কির দিকে ঘুরে বলে উঠল, ও, তাহলে আপনিই ভূমিদাসদের মুক্তি দিয়েছেন প্রিন্স?

বুড়ো মানুষটি যাতে অকারণে বিরক্ত না হয় সেজন্য নিজের কাজটাকে ছোট করে দেখাতে প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল, জমিদারিটা ছিল খুব ছোট, বিশেষ কোনো লাভ হতো না।

কোচুবের দিকে তাকিয়ে বুড়ো বলল, আমার হয়তো দেরি হয়ে যাচ্ছে… আরো বলল, একটা কথা আমি বুঝতে পারি না। তাদের যদি মুক্তি দেওয়া হয় তাহলে জমি চাষ করবে কারা? আইন লেখা সহজ, কিন্তু শাসন করা বড় শক্ত…ঠিক যেরকম এখন–আপনাকেই শুধাই কাউন্ট–সকলকেই যদি পরীক্ষা পাশ করতে হয় তাহলে বিভাগীয় প্রধান হবে কারা?

পায়ের উপর পা রেখে চারদিকে তাকিয়ে কোচুবে জবাব দিল, মনে হয় যারা পরীক্ষা পাশ করবে তারাই।

দেখুন, প্রিয়ানিচনিকভ আমার অধীনে কাজ করে, চমৎকার লোক, দামি লোক, কিন্তু বয়স ষাট। সে কি এখন পরীক্ষা দিতে যাবে? ..

হ্যাঁ, সেটা একটা অসুবিধা বটে, শিক্ষাটা তো সাধারণ ব্যাপার নয়, কিন্তু কাউন্ট কোচুবে কথা শেষ না করেই আসন ছেড়ে উঠে প্রিন্স আন্দ্রুর হাতে চাপ দিয়ে লম্বা টাক-মাথা একটি লোকের সঙ্গে দেখা করতে এগিয়ে গেল। এইমাত্র সে ঘরে ঢুকেছে। তার বয়স প্রায় চল্লিশ বছর, মস্তবড় খোলা কপাল, অস্বাভাবিক সাদা লম্বাটে মুখ। নবাগতের পরনে চাতক পাখির লেজওয়ালা নীল রঙের কোট, গলা থেকে একটা কুশ ঝুলছে, বাঁ দিকের বুকে একটা তারকা। লোকটি স্পেরানস্কি। প্রিন্স আন্দ্রু সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনতে পারল, তার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল, জীবনের সংকট-মুহূর্তে এইরকমই হয়ে থাকে। এর কারণ কি শ্রদ্ধা, ঈর্ষা, না প্রত্যাশা তা সে জানে না। স্পেরানস্কির চেহারায় এমন একটা বৈশিষ্ট্য আছে যে তাকে সহজেই চেনা যায়। প্রিন্স আন্দ্রু যে সমাজে বাস করে সেখানে সে এমন কাউকে কখনো দেখেনি যে একাধারে কিম্ভুত ও বিশ্রী অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে এমন প্রশান্তি ও আত্মপ্রত্যয়ের অধিকারী, ঐ দুটি আধ-বোজা সজল চোখের মতো দৃঢ় অথচ শান্ত ভাব অথবা এমন ভাবলেশহীন কঠিন হাসি সে কখনো দেখেনি, এমন সরল, নরম, সুচারু কণ্ঠস্বরও কখনো শোনেনি, সর্বোপরি প্রশস্ত, অতি স্কুল ও নরম মুখের ও হাতের এমন সূক্ষ্ম সাদা রংও সে কখনো দেখেনি। দীর্ঘদিন হাসপাতালে-থাকা সৈনিকদের মুখেই শুধু এরকম সাদা রং ও নরম ভাব প্রিন্স আন্দ্রু দেখেছে। এই হল স্পেরানস্কি, স্বরাষ্ট্রসচিব, সম্রাটের প্রতিবেদক এবং এরফুর্ত-এ সম্রাটের সঙ্গী, সেখানে একাধিকবার সম্রাটের সঙ্গে দেখা করেছে, নেপোলিয়নের সঙ্গে কথা বুলেছে।

অনেক লোকের মধ্যে ঢুকে লোকে সাদারণত যা করে থাকে স্পেরানস্কি সেইভাবে এক মুখ থেকে অন্য মুখের উপর দৃষ্টি ফেরাতে লাগল না। কথা শুরু করার ব্যাপারেও তাড়াহুড়া করল না। কথা বলল ধীরে ধীরে, সকলেই যে তার কথা শুনবে সে বিশ্বাস তার আছে, আর যখন যার সঙ্গে কথা বলছে একমাত্র তার দিকেই তাকাচ্ছে।

প্রিন্স আন্দ্রু বিশেষ মনোযোগসহকারে রোনস্কির প্রতিটি কথা ও প্রতিটি চলাকে অনুসরণ করতে লাগল। কোনো নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা হলেই বিশেষ করে স্পেরানস্কির মতো লোক যার সুখ্যাতি সে শুনেছে–সে সব সময় তার ভিতরকার মানবিক গুণগুলোকে পুরোপুরি আবিষ্কার করতে চেষ্টা করে।

স্পেরানস্কি কোচুবেকে বলল, আরো আগে আসতে না পারার জন্য সে দুঃখিত, কারণ সে রাজপ্রসাদে আটকা পড়েছিল। সম্রাট যে তাকে আটকে রেখেছিল সেকথা সে বলল, প্রিন্স আন্দ্রু তার এই অতিবিনয়টুকু লক্ষ্য করল। কোচুবে যখন প্রিন্স আন্দ্রুর পরিচয় দিল তখন স্বভাবসিদ্ধ হাসির সঙ্গে স্পেরানস্কি ধীরে ধীরে বলকনস্কির দিকে চোখ দুটো ফেরাল, নীরবে তার দিকে তাকাল।

আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম। সকলের মতো আমিও আপনার কথা শুনেছি, একটু থেমে সে বলল।

আরাকচিভ যেভাবে বলকনস্কিকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে অল্প কয়েকটি কথায় কোচুবে তার উল্লেখ করল। স্পেরানস্কি আরো স্পষ্ট করে হাসল।

প্রতিটি শব্দ ও শব্দাংশের উপর জোর দিয়ে সে বলল, সেনাবাহিনীর বিধিসংক্রান্ত কমিটির সভাপতি সঁসিয় মাগনিস্কি আমার বিশিষ্ট বন্ধু। আপনি চান তো তাঁর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি। একটু থেমে বলল, আশা করি তিনি আপনাকে সহানুভূতি দেখাবেন এবং যুক্তিসঙ্গত যেকোন ব্যবস্থায় আপনার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন।

অচিরেই স্পেরানস্কিকে ঘিরে একটা চক্র গড়ে উঠল, যে বুড়োমানুষটি তার অধীনস্থ প্রিয়ানিচনিকভের কথা বলছিল সে স্পেরানস্কিকে একটা প্রশ্ন করল।

আলোচনায় যোগ না দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু স্পেরানস্কির প্রতিটি গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগল : কিছুদিন আগেও এই লোকটি ছিল ধর্মশাস্ত্রের একজন নগণ্য ছাত্র, আর আজ তার হাতের মুঠোয়–ঐ দুটো স্কুল, সাদা হাতে-রাশিয়ার ভাগ্য বিধৃত। যেরকম অসাধারণ ঘৃণার সঙ্গে স্পেরানস্কি বুড়ো লোকটির প্রশ্নের জবাব দিল তা শুনে প্রিন্স আন্দ্রু অবাক হয়ে গেল। বুড়ো লোকটি যখন উঁচু গলায় কথা বলতে শুরু করল, স্পেনস্কি তখন হেসে বলল, সম্রাট কিসে খুশি হবেন তার সুবিধা-অসুবিধার কথা বিচার করবার অধিকার তার নেই।

সকলের সঙ্গে সাধারণভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পরে স্পেরানস্কি প্রিন্স আন্দ্রুর কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের এককোণে চলে গেল। পরিষ্কার বোঝা গেল, বলকনস্কির প্রতি সে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

ঈষৎ বিদ্রুপের হাসি হেসে সে বলল, ঐ সম্মানিত ভদ্রলোকটি যে উত্তেজিত আলোচনার মধ্যে আমাকে জড়িয়ে রেখেছিল তাতে আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি প্রিন্স। এই স্তুতি-বচনে প্রিন্স আন্দ্রু খুশি হয়ে উঠল। আপনার কথা আমি অনেক আগেই শুনেছি, প্রথমতো ভূমিদাসদের ব্যাপারে আপনার কাজের কথা শুনেছি, এই প্রথম দৃষ্টান্তটির আরো অনেক অনুকরণকারী থাকা বাঞ্ছনীয়, আর দ্বিতীয়ত, আপনি সেই সব ভদ্রলোকদের একজন যারা সভাসদদের পদমর্যাদাসংক্রান্ত নতুন বিধানে আঘাত পাননি, অথচ তা নিয়ে গল্প-গুজব ও হৈ-চৈর অন্ত নেই।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, না, আমার বাবা চাননি যে সেসব সুবিধার সুযোগ আমি নেই। একেবারে নিচু পদ থেকেই আমি চাকরি শুরু করেছিলাম।

আপনার বাবা বিগত শতাব্দীর মানুষ, যে ব্যবস্থা স্বাভাবিক ন্যায়ের পুনঃ প্রতিষ্ঠামাত্র তার বিরুদ্ধাচরণ করছে যেসব সম্প্রতিকালের মানুষ তিনি স্বভাবতই তাদের অনেক উর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত।

স্পেরানস্কির প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হয়ে থাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টায় প্রিন্স আন্দ্রু পাল্টা জবাব দিল, অবশ্য আমি মনে করি যে এই বিরুদ্ধাচরণের স্বপক্ষেও কিছু যুক্তি আছে। স্পেরানস্কির সব কথার সঙ্গে একমত হতে সে চায় না, প্রতিবাদ করার একটা ইচ্ছা জাগল তার মনে। সাধারণত সে সহজে ও ভালোভাবেই কথা বলতে পারে, কিন্তু এখন স্পেরানস্কির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিজের মনোভাব প্রকাশ করতে সে কিছুটা অসুবিধা বোধ করতে লাগল। এই বিখ্যাত লোকটির ব্যক্তিত্বকে পর্যবেক্ষণ করার কাজে সে বড় বেশি ডুবে গিয়েছিল।

ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা কারণ হতে পারে, স্পেরানস্কি শান্তভাবে বলল।

 আর কতকটা রাষ্ট্রের স্বার্থও বটে, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

চোখ নামিয়ে স্পেরানস্কি শান্তভাবে শুধাল, আপনি কি বলতে চান?

প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল, মতেঙ্কুকে আমি শ্রদ্ধা করি, আর তার ধারণা যে অভিজাত শ্রেণীর কতকগুলি অধিকার ও সুযোগ-সুবিধাকে আমি তর্কাতীত বলে মনে করি তাকেও আমি সমর্থন করি।

স্পেরানস্কির সাদা মুখের উপর থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। সম্ভবত প্রিন্স আন্দ্রুর চিন্তাধারা তার ভালো লেগেছে।

প্রশ্নটাকে আপনি যদি সেদিক থেকে বিচার করেন, ফরাসিতে কথাগুলি বলতে স্পেরানস্কির যথেষ্ট অসুবিধা হলেও সে বেশ শান্তভাবে কথাগুলি বলল। তার যুক্তিগুলি সংক্ষিপ্ত, সরল ও স্পষ্ট। কিন্তু আলোচনাটা তার সঙ্গীকে বিব্রত করে তুলেছে দেখে তার উপর ইতি টেনে স্পেনস্কি বলল, আপনি যদি দয়া করে বুধবারে আমার সঙ্গে দেখা করেন, তাহলে ইতিমধ্যে মাগনিস্কির সঙ্গে কথা বলে নিয়ে আপনাকে সব কথা জানিয়ে দেব এবং আরো খোলাখুলিভাবে আপনার সঙ্গে আলোচনা করে আনন্দ লাভ করব।

চোখ দুটি বন্ধ করে সে ফরাসি কায়দায় অভিবাদন জানাল, এবং বিদায় না নিয়ে যথাসম্ভব অল্প মনোযোগ আকর্ষণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

.

অধ্যায়-৬

পিটার্সবুর্গে অবস্থিতির প্রথম কয়েক সপ্তাহেই প্রিন্স আন্দ্রু বুঝতে পারল, নিভৃত জীবন-যাপনের দিনগুলিতে যে চিন্তাধারা তার মনে গড়ে উঠেছিল, এই শহরের ছোট ছোট চিন্তাভাবনাগুলি তাকে একেবারেই চাপা দিয়ে ফেলেছে।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে নিজের নোট-বইতে চার-পাঁচটি দরকারি দেখা-সাক্ষাতের বিষয় ও নির্দিষ্ট সময় সে টুকে রাখে। জীবনের যান্ত্রিক গতি, সর্বত্র যথাসময়ে উপস্থিত হবার দৈনন্দিন ব্যবস্থা–এতেই তার কর্মশক্তির বেশির ভাগ্য ব্যয় হতে লাগল। সে কিছুই করে না, চিন্তা পর্যন্ত করে না, অথবা চিন্তা করার সময়ই পায় না, কিন্তু গ্রামে থাকতে যা কিছু ভেবেছে ৪ধু তাই নিয়ে কথা বলে, সাফল্যের সঙ্গে কথা বলে।

সে যে বিভিন্ন মহলে একই দিকে একই মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে সেটা বুঝতে পেরে মাঝে মাঝেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু দিনের পর দিন সে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় সে যে কোনো কিছু ভাবতে পর্যন্ত পারছে না–এ কথাটা বুঝবার মতো সময়ও তার নেই।

কোচুবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাঙ্কারে যেমন ঘটেছিল তেমনই বুধবারেও স্পেরানস্কি যখন নিজের বাড়িতে প্রিন্স আন্দ্রুর মুখোমুখি বসে তার সঙ্গে একান্তে দীর্ঘ সময় ধরে কথাবার্তা বলল তখনো প্রিন্স আন্দ্রুর উপর তার প্রভাব বেশ বড় হয়েই দেখা দিল।

বলকনস্কির কাছে বেশির ভাগ লোককেই এক বেশি ঘৃণাহ ও তুচ্ছ বলে মনে হয়, আর যে পূর্ণতার আদর্শের জন্য সে সগ্রাম করছে একটি মানুষের মধ্যে সেই পূর্ণতার জীবন্ত আদর্শকে দেখবার বাসনা তার মনে এতই প্রবল হয়ে উঠেছে যে সে সহজেই বিশ্বাস করে বসল যে স্পেরানস্কির মধ্যেই সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী ও ধার্মিক মানুষের সেই আদর্শকে সে খুঁজে পেয়েছে। স্পেনস্কি যদি তার নিজের সমাজ থেকেই উঠে আসত এবং সেই একই পরিবেশে মানুষ হতো তাহলে হয়তো বলকস্কি অচিরেই তার দুর্বলতা, মানবিকতার। দিকগুলিকে আবিষ্কার করে ফেলত, কিন্তু আসলে অবস্থা যা দাঁড়াল তাতে স্পেরানস্কির বিচিত্র যুক্তিবাদী মনটাই তার মনে আরো বেশি করে শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে তুলল, কারণ সে তাকে ঠিকমতো বুঝতেই পারত না। তার উপর সঙ্গীটির ক্ষমতার জন্যই হোক আর তাকে নিজের দলে টানবার জন্যই হোক, স্পেরানস্কি বেশ সূক্ষ্মভাবে প্রিন্স আন্দ্রুর স্তুতিগানও করত।

বুধবার সন্ধ্যায় দুইজনের দীর্ঘ আলোচনা প্রসঙ্গে রোনস্কি একাধিকবার মন্তব্য করল : চিরাচরিত প্রথার সাধারণ স্তরের ঊর্ধ্বে যা কিছু আছে তাকেই আমরা শ্রদ্ধা করি…, অথবা একটু হেসে : কিন্তু আমরা চাই নেকড়েও তার খাদ্য পাক আবার মেষটাও নিরাপদ থাকুক…আবার : তারা এটা বুঝতে পারে না…আর এ সবই এমনভাবে বলে যেন সে বলতে চায় : তারাই বা কি আর আমরাই বা কি-এ কথা তো বুঝি শুধু আমরা-আপনি এবং আমি।

স্পেরানস্কির সঙ্গে এই প্রথম দীর্ঘ আলোচনার ফলে প্রথম সাক্ষাৎকারে প্রিন্স আন্দ্রুর মনে যে ভাবের উদয় হয়েছিল সেটাই দৃঢ়তর হল। তার মধ্যে সে এমনি একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্পষ্ট চিন্তার মানুষকে দেখতে পেল যার প্রচণ্ড ধীশক্তি, কর্মশক্তি ও অধ্যবসায় তাকে ক্ষমতার শিখরে প্রতিষ্ঠিত করেছে, আর সেই ক্ষমতাকে সে ব্যবহার করছে কেবলমাত্র রাশিয়ার কল্যাণে। প্রিন্স আন্দ্রুর চোখে স্পেরানস্কিই সেই মানুষ যা সে নিজে হতে চেয়েছে–জীবনের সব ঘটনাকে সে বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে জানে। সবই ঠিক আছে, সব কিছুই যেমনটি হওয়া উচিৎ তেমনটিই হয়েছে : শুধু একটা জিনিস প্রিন্স আন্দ্রুকে অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে ফেলেছে। সেটা স্পেরানস্কির নিরাসক্ত, মুকুরসদৃশ দৃষ্টি যার ভিতর দিয়ে দৃষ্টি চলে, আর তার সাদা সুচারু হাত দুখানি, যে হাতের দিকে প্রিন্স আন্দ্রু নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও এমনভাবে তাকায় যেভাবে লোকে তাকায় ক্ষমতাসীন লোকের হাতের দিকে। এই মুকুরসদৃশ দৃষ্টি আর ঐ দুটি সুচারু হাত প্রিন্স আন্দ্রুকে বিব্রত করে, কেন করে তা সে জানে না।

সাধারণভাবে বুদ্ধিবৃত্তির শক্তি ও কর্তৃত্বের উপর একান্ত ও অনড় বিশ্বাস-স্পেরানস্কির মানসিকতার এই বৈশিষ্ট্যই প্রিন্স আন্দ্রুকে সবচাইতে বেশি প্রভাবিত করেছে। তার সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম পর্বে বলকনস্কি তার প্রতি সেই আবেগাপ্লুত শ্রদ্ধা অনুভব করেছিল যা সে একসময় বোনাপার্তের জন্য অনুভব করত। স্পেরানস্কি যে একজন গ্রাম্য পুরোহিতের ছেলে আর নিচ কুলে জন্ম বলে বোকা লোকগুলি যে তাকে ঘৃণা করতে পারত (আসলে অনেকেই তা করে) এই বোধই প্রিন্স আন্দ্রুর মনে তার প্রতি বড় বেশি আবেগের সৃষ্টি করেছে এবং তার নিজের অজ্ঞাতেই সেটা বেড়ে চলেছে।

বলকনস্কির সঙ্গে কাটানো সেই প্রথম সন্ধ্যায়ই আইন পুনর্বিন্যাস কমিটির কথা উল্লেখ করে স্পেরানস্কি বিদ্রূপ করে বলল যে এই দেড়শ বছরের জীবনে কমিশন লাখ লাখ খরচ করেছে, অথচ বিভিন্ন আইন বিষয়ক পরিচ্ছেদগুলিতে রোজেনকামসের হাতে কতকগুলি লেবেল আঁটা ছাড়া আর কিছুই করেনি।

সে বলল, লাখ লাখ খরচ করে সরকার শুধু এইটুকুই করেছে। তাই আমরা সিনেটের হাতে আইনানুগ ক্ষমতা দিতে চাই, কিন্তু সেরকম কোনো আইন আমাদের নেই। আর সেই কারণেই এসময়ে আপনার মতো লোকের কাজ না করাও একটা পাপ।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, সে কাজের জন্য যে আইনের শিক্ষা প্রয়োজন সেটা তার নেই।

সে শিক্ষা তো কারো নেই, কাজেই আপনি বা পাবেন কোথায়? কিন্তু এই পাপ-চক্র থেকে আমাদের তো বেরিয়ে আসতেই হবে।

এক সপ্তাহ পরে প্রিন্স আন্দ্রু সামরিক-বিধি কমিটির একজন সদস্য হয়ে গেল, এবং–যেটা সে মোটেই আশা করেনি–তাকে আইন পুনর্বিন্যাস কমিটির একটা শাখার সভাপতিও করা হল। স্পেরানস্কির অনুরোধে অসামরিক বিধির খসড়ার প্রথম অংশটা সে নিজের হাতে নিল, এবং কোড নেপলিয়ন ও জস্টিনিয় ইসুটিট্যুটের সাহায্যে ব্যক্তিগত অধিকার সংক্রান্ত ধারা রচনার কাজ শুরু করে দিল।

.

অধ্যায়-৭

এর ঠিক দুবছর আগে ১৮০৮ সালে জমিদারি পরিদর্শন করে ফিরবার পরে পিয়ের আপনা থেকেই পিটার্সবুর্গ ভ্রাতৃসংঘের প্রথম সারিতে নিজের আসনে পেয়ে গিয়েছিল। তখন সে ভোজন ও অন্ত্যেষ্টিসভার আয়োজন করল, নতুন সদস্য সংগ্রহ করল, এবং বিভিন্ন আশ্রমকে একত্র করে নির্ভরযোগ্য বিধান তৈরির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করল। মন্দির নির্মাণের জন্য টাকা দিল, এবং অধিকাংশ সদস্যের অনিয়মিত প্রচেষ্টায় যে ভিক্ষা সংগৃহীত হয় তাতে সাধ্যমতো নিজের দান যোগ করে দিল। সংঘ পিটার্সবুর্গে যে দরিদ্রাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিল, একক প্রচেষ্টায়ই সেটাকে সে চালাতে লাগল।

ইতিমধ্যে তার জীবনযাত্রা আগের মতো সেই একই মোহ ও আমোদ-প্রমোদের ভিতর দিয়ে কাটাতে লাগল। ভালো খেতে ও পান করতে সে ভালোবাসত, নীতি-বিরুদ্ধ ও অসম্মানকর মনে করলেও যে অবিবাহিতদের মহলে সে চলাফেরা করত তার প্রলোভন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারত না।

অবশ্য এই সব কাজকর্ম ও আমোদ-প্রমোদের মধ্যেই বছরখানেক পরে পিয়রের মনে হল, ভ্রাতৃসংঘের মাটির উপর যতই ভরসা করতে চেষ্টা করছে ততই সে মাটি তার পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে সে এটাও অনুভব করতে লাগল যে তার পায়ের তলা থেকে যত বেশি মাটি সরে যাচ্ছে ততই সে ভ্রাতৃসংঘের হাতে বেশি করে বাঁধা পড়ছে। ভ্রাতৃসংঘে যোগদান করার সময় তার মনে হয়েছিল, গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সে একটা জলাভূমির মসৃণ বুকের উপর পা রাখতে চলেছে। কিন্তু সেখানে পা রাখামাত্রই পা যে ডুবে যাচ্ছে। মাটিটা যে সত্যি শক্ত সেবিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য সে আর একটা পাও তার উপর রাখল, আরো গভীরে ডুবে গেল, এবং নিজের অজ্ঞাতেই জলাভূমির হাঁটু-জলে চলতে লাগল।

যেকাজ সে করছে তা নিয়ে ক্রমেই তার মনে অসন্তোষ জমতে লাগল। ভ্রাতৃসংঘের কাজকর্ম যতটা সে দেখেছে তাতে তার মনে হয়েছে এর সবটাই বাহ্যিক আড়ম্বরের উপর প্রতিষ্ঠিত। আসলে ভ্রাতৃসংঘের কাজকর্মে সন্দেহ করার কথা তার মনে আসেনি, তবে তার মনে হচ্ছে যে রুশ ভ্রাতৃসংঘ ভুল পথে চলেছে এবং মূল নীতিগুলি থেকে দূরে সরে গেছে। আর তাই বছরের শেষ দিকে সংঘের উচ্চতর মন্ত্রগুপ্তির সন্ধানে সে বিদেশে যাত্রা করল।

.

 ১৮০৯ সালের গ্রীষ্মকালে পিয়ের পিটার্সবুর্গে ফিরে এল। আমাদের ভ্রাতৃসংঘের লোকরা পত্র মারফৎ জানতে পারল যে বিদেশে গিয়ে বেজুখভ অনেক উচ্চপদস্থ লোকের বিশ্বাস অর্জন করেছে, তার পদোন্নতি হয়েছে, এবং এমন কিছু সে সঙ্গে নিয়ে আসছে যাতে রাশিয়াতে ভ্রাতৃসংঘের কাজকর্মের অনেক সুবিধা হবে। পিটার্সবুর্গের ধর্ম-ভাইরা সকলেই তার সঙ্গে দেখা করতে এল, তার সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করল, তাদের মনে হল সে তাদের জন্য একটা কিছু তৈরি করছে আর সেটা লুকিয়ে রেখেছে।

দ্বিতীয় শ্রেণীর আশ্রমবাসীদের একটা গুরুগম্ভীর সভা ডাকা হল, সংঘের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে পিয়ের তাদের জন্য যা নিয়ে এসেছে সেই সভাতেই পিটার্সবুর্গের ভাইদের তা জানিয়ে দেওয়া হবে। সভা লোকে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। যথারীতি সব আচার-অনুষ্ঠান হয়ে গেলে পিয়ের উঠে দাঁড়িয়ে ভাষণ শুরু করল।

লজ্জায় আরক্ত হয়ে তো-তো করে লিখিত ভাষণটি হাতে নিয়ে সে বলতে শুরু করল।

প্রিয় ভাইসব, আশ্রমের নির্জন ঘরের মধ্যে আমাদের রহস্যময় কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করাটাই যথেষ্ট নয়-আমাদের কাজ করতে হবে-কাজ! আমরা ঘুমে ঢুলছি, কিন্তু আমাদের কাজ করতে হবে। নোট-বইটা তুলে ধরে পিয়ের পড়তে শুরু করল।

নিষ্কলুষ সত্যের প্রচার এবং ধর্মের জয় প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের মন থেকে ভুল ধারণাকে মুছে ফেলতে হবে, সময়ের সঙ্গে তাল রেখে ঐক্যের নীতিকে ছড়িয়ে দিতে হবে, যুবকদের শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে, বিজ্ঞতম মানুষদের সঙ্গে নিজেদের বাধতে হবে ঐক্যের অচ্ছেদ্য বন্ধনে, সাহসের সঙ্গে, সুবিবেচনার সঙ্গে কুসংস্কার, অবিশ্বাস ও নির্বুদ্ধিতাকে জয় করতে হবে, এবং আমাদের প্রতি যারা অনুরক্ত তাদের নিয়ে একই উদ্দেশ্যের সূত্রে গথিত একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পাপের উপর পুণ্যের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, এমন প্রচেষ্টা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে যাতে সৎ লোকেরা তাদের পুণ্যকর্মের জন্য এই জগতেই স্থায়ী পুরস্কার লাভ করতে পারে। কিন্তু এই মহৎ প্রচেষ্টার পথে আমাদের সবচাইতে বড় বাধা আজকের দিনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি। এ অবস্থায় কি করতে হবে? বিপ্লবকে সমর্থন করা, সবকিছু উৎখাত করা, শক্তি দিয়ে শক্তির প্রতিরোধ করা?…না! আমরা থাকব সে পথ থেকে অনেক দূরে। প্রতিটি সশস্ত্র সংস্কার অবশ্যই নিন্দনীয়, কারণ তাতে পাপের প্রতিকার হয় না, মানুষ যা ছিল তাই থাকে, তাছাড়া, জ্ঞানের কখনো হিংসার দরকার হয় না।

একই প্রত্যয়ের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ দৃঢ়চিত্ত পুণ্যবান মানুষ তৈরি করা, পাপ ও নির্বুদ্ধিতার শাস্তি বিধান করা, প্রতিভা ও ধর্মের পোষকতা করা, উপযুক্ত লোকদের পথের ধুলো থেকে তুলে এনে আমাদের ভ্রাতৃসংঘের সঙ্গে যুক্ত করা–এই ধারণার উপরেই গড়ে উঠেছে আমাদের সংঘের গোটা পরিকল্পনা। একমাত্র তখনই আমাদের সংঘ সেই অপ্রতিহত শক্তির অধিকারী হবে যার দ্বারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের হাত বেঁধে ফেলে তাদের অজ্ঞাতেই তাদের বশ করা যাবে। এককথায়, এমন একটি সার্বভৌম সরকার আমাদের গঠন করতে হবে যার কর্তৃত্ব ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে। এই একই লক্ষ্য ছিল খৃষ্টধর্মের। এই ধর্ম মানুষকে শিখিয়েছে জ্ঞানী হতে,  সৎ হতে, নিজেদের কল্যাণের জন্যই শ্রেষ্ঠ ও বিজ্ঞতম মানুষদের দৃষ্টান্ত ও উপদেশকে অনুসরণ করতে।

যে মুহূর্তে প্রতিটি রাজ্যে আমরা নির্দিষ্ট সংখ্যক সমর্থ লোক পাব, আবার তারা প্রত্যেকে দুইজনকে শিক্ষিত করে তুলবে, এবং সকলে ঐক্যবদ্ধ হবে, তখনই আমাদের সংঘের পক্ষে সবকিছু সম্ভব হবে। মানবজাতির কল্যাণের জন্য সেকাজ ইতিমধ্যেই গুপ্তভাবে সুসম্পন্ন হয়েছে।

বক্তৃতাটি সকলকে যথেষ্ট প্রভাবিত তো করলই, উপরন্তু আশ্রমে যথেষ্ট উত্তেজনার সৃষ্টি হল। অধিকাংশ গুরুভাইরা এর মধ্যে অলৌকিকতার বিপদ দেখতে পেয়ে যেরকম নিরাসক্তভাবে কথাগুলি শুনল তাতে পিয়ের অবাক হয়ে গেল। মহাপ্রভু তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করল, আর সেও অধিকতর উৎসাহের সঙ্গে তার মতবাদকে গড়ে তুলতে লাগল। এরকম বিক্ষুব্ধ সভা অনেককাল হয়নি। একদল পিয়েরের বিরুদ্ধে অলৌকিকতার অভিযোগ তুলল, আর একদল তাকে সমর্থন করল। সেই সভায় মানুষের মনের সীমাহীন বৈচিত্র্য লক্ষ্য করে পিয়েরের মনে এই প্রথম খুব আঘাত পেল, সে বুঝল, যেকোন দুইজন মানুষের কাছে সত্য একই স্বরূপে উপস্থিত হতে পারে না।

সভার শেষে প্রচণ্ড আবেগের জন্য মহাপ্রভু বেজুখভকে ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় তিরস্কার করে বলল যে শুধুমাত্র ধর্মের প্রতি ভালোবাসার জন্য নয়, সগ্রামের প্রতি ভালোবাসাই তাকে এই বিতর্কের মধ্যে টেনে নামিয়েছে। পিয়ের তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে সংক্ষেপে জানতে চাইল, তার প্রস্তাবটি গৃহীত হবে কি না। তাকে যখন বলা হল যে হবে না, তখন প্রথাগত অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা না করেই সে আশ্রম ছেড়ে বাড়ি চলে গেল।

.

অধ্যায়-৮

যে মানসিক অবসাদকে পিয়ের এত ভয় করে সেটাই তাকে আবার পেয়ে বসল। আশ্রমে বক্তৃতা দেবার পর তিন-তিনটে দিন বাড়িতে সোফায় শুয়ে কাটাল, কারো সঙ্গে দেখা করল না, বাইরে কোথাও গেল না।

ঠিক সেইসময় সে স্ত্রীর কাছ থেকে একটা চিঠি পেল, তার সঙ্গে দেখা করতে সে পিয়েরকে অনুরোধ করেছে, তার জন্য সে যে কত কষ্ট পাচ্ছে এবং সারা জীবন তার সেবা করবার তার যে কত ইচ্ছা সে-কথাও জানিয়েছেন সাত হাজার

চিঠির শেষে সে পিয়েরকে আরো জানিয়েছে, কয়েক দিনের মধ্যেই সে বিদেশ থেকে পিটার্সবুর্গে ফিরবে।

এই চিঠির পরে পরেই একজন গুরুভাই জোর করে তার সঙ্গে দেখা করতে এল। এই গুরুভাইটিকে সে মোটই ভক্তি-শ্রদ্ধা করত না। গুরুভাইটি পিয়েরের বৈবাহিক ব্যাপার নিয়ে আলোচনা শুরু করে ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের পরামর্শ প্রসঙ্গে বলল যে স্ত্রীর প্রতি এরূপ কঠোর আচরণ করে সে অন্যায় করেছে এবং অনুতপ্তা স্ত্রীকে ক্ষমা না করে সে ভ্রাতৃসংঘের অন্যতম প্রধান নির্দেশকেই লঙ্ঘন করেছে।

সেইসময়ে তার শাশুড়ি প্রিন্স ভাসিলির স্ত্রীও তাকে অনুরোধ করে পাঠাল। একটা অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপারে আলোচনার জন্য সে যেন কয়েক মিনিটের জন্য হলেও একবার তার কাছে যায়। পিয়ের বুঝতে পারল, তার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র চলেছে, তারা চাইছে স্ত্রীর সঙ্গে তার পুনর্মিলন ঘটাতে, আর তখন তার যা মনের অবস্থা তাতে এটা তার কাছে খুব অপ্রীতিকরও নয়। তার তো কিছুতেই কিছু যায়-আসে না। এ জীবনে তার কাছে কোনো কিছুই খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, আর মানসিক অবসাদের প্রভাবে স্ত্রীকে শাস্তি দেবার জন্য সে তার স্বাধীনতা অথবা সংকল্প কোনোটাকেই খুব মূল্য দিল না।

ভাবল, কেউ সঠিক নয়, আর কারো দোষ নেই, কাজেই তার স্ত্রীকেও দোষ দেওয়া চলে না।

স্ত্রীর সঙ্গে পুনর্মিলনের স্বপক্ষে যে সে তখনই মত দিল না তার একমাত্র কারণ তার তখনকার অবসাদগ্রস্থ মানসিক অবস্থায় কোনো পদক্ষেপের শক্তিই তার ছিল না। স্ত্রী যদি তার কাছে এসে হাজির হতো তাহলে সে তাকে ফিরিয়ে দিত না। তখন তার মনের যা অবস্থা তাতে সে স্ত্রীর সঙ্গে বাস করছে কি করছে না সেটা কি খুবই তুচ্ছ ব্যাপার নয়? স্ত্রীর বা শাশুড়ির চিঠির কোনো জবাব না দিয়ে একদিন গভীর রাতে পিয়ের যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল এবং জোসেফ আলেক্সিভিচের সঙ্গে দেখা করতে মস্কো রওনা হল। দিনপঞ্জির পাতায় লিখলঃ

মস্কো, ১৭ই নভেম্বর।

এইমাত্র আমার হিতকারীর কাছ থেকে ফিরেছি, সঙ্গে সঙ্গেই লিখতে বসেছি আমার অভিজ্ঞতার কথা। জোসেফ আলেক্সিভিচ দরিদ্রের মতো বাস করছেন, তিন বছর যাবৎ মূত্রাশয়ের একটা যন্ত্রণাদায়ক রোগে ভুগছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ তার মুখে একটা আর্তনাদ বা অভিযোগের বাণী শোনেনি। একমাত্র অতি সাধারণ খাদ্যটুকু গ্রহণ করার সময় ছাড়া সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি বিজ্ঞানের কাজে ব্যস্ত থাকেন। তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন এবং যে বিছানায় শুয়েছিলেন তার উপরেই আমাকে বসালেন। প্রাচ্য দেশের ও জেরুজালেমের মহাবীরদের মতো ইঙ্গিত আমি করলাম, আর তিনিও সেইভাবেই জবাব দিলেন, মৃদু হেসে জানতে চাইলেন, প্রুশিয় ও স্কটিশ আশ্রমগুলিতে আমি কি শিখেছি, কি পেয়েছি। যথাসাধ্য সব তাঁকে বললাম, পিটার্সবুর্গের আশ্রমে কি প্রস্তাব রেখেছি, তাদের কাছ থেকে যে খারাপ ব্যবহার পেয়েছি এবং গুরুভাইদের সঙ্গে আমার মতবিরোধ–সবই তাঁকে জানালাম। বেশ কিছুক্ষণ নীরব ও চিন্তাবিত অবস্থায় থেকে জোসেফ আলেক্সিভিচ এ ব্যাপারে তার অভিমত আমাকে বললেন, আর তার ফলে আমার সমস্ত অতীত এবং ভবিষ্যতে যেপথে আমি চলব সব আমার সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন সংঘের ত্রিবিধ আদর্শ : (১) রহস্যের সংরক্ষণ ও অনুশীলন, (২) তাকে গ্রহণ করবার জন্য নিজের পরিশুদ্ধি ও সংস্কারসাধান এবং (৩) সেই পরিশুদ্ধির প্রচেষ্টার ভিতর দিয়ে মানবজাতির উন্নতি বিধান-এই আদর্শের কথা আমার মনে আছে কিনা, তখন আমি অবাক হয়ে গেলাম। এই তিনটির মধ্যে কোনটি প্রধান? অবশ্যই আত্ম সংস্কার ও আত্মশুদ্ধি। কেবলমাত্র সেই আদর্শের লক্ষ্যেই আমরা পরিস্থিতির নিরপেক্ষভাবে অগ্রসর হবার চেষ্টা করতে পারি। এদিক থেকে বিচার করে জোসেফ আলেক্সিভিচ আমার ভাষণ ও কাজকর্মের নিন্দা করলেন, আর অন্তরের গভীরে তার সঙ্গে আমি একমত হলাম। আমার পারিবারিক কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, তোমাকে তো আগেই বলেছি, নিজেকে পূর্ণ করে তোলাই একজন খাঁটি সংঘ-সদস্যের প্রধান কর্তব্য। আমরা প্রায়ই মনে করি যে জীবনের সব বাধা-বিঘ্নকে দূর করলেই আমরা দ্রুত সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব, কিন্তু প্রিয় মহাশয়, একমাত্র জাগতিক জ্বালা-যন্ত্রণার ভিতর দিয়েই তিনটি প্রধান লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি : (১) আত্মজ্ঞান-কারণ শুধুমাত্র তুলনার দ্বারাই মানুষ নিজেকে জানতে পারে। (২) আত্ম-পূর্ণতা-শুধুমাত্র সংগ্রামের ভিতর দিয়েই তা অর্জন করা যায়, এবং (৩) প্রধান গুণ মৃত্যুকে ভালোবাসাকে অর্জন করা। একমাত্র জীবনের উত্থান-পতনের ভিতর দিয়েই তার অসারতা আমরা উপলব্ধি করতে পারি এবং তার ফলে জন্ম নেয় মৃত্যুকে ভালোবাসা অথবা নবজন্ম পরিগ্রহণের প্রতি ভালোবাসা। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন, আমি যেন পিটার্সবুর্গ গুরুভাইদের যোগাযোগ এড়িয়ে না যাই, কিন্তু আশ্রমে শুধুমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে অধিষ্ঠিত থেকে গুরুভাইদের অহংকারের পথ থেকে সরিয়ে আত্ম-জ্ঞান ও আত্ম-পূর্ণতার সঠিক পথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করি। এছাড়া তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে পরামর্শ দিলেন, আমি যেন নিজের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখি, এবং সেই উদ্দেশ্যে আমাকে একটা নোট-বই দিলেন, সেই নোট-বইতে আমি এখন লিখছি এবং ভবিষ্যতে আমার সব কাজের কথা লিখব।

পিটার্সবুর্গ, ২৩শে নভেম্বর।

আবার আমি স্ত্রীর সঙ্গে বাস করছি। শাশুড়ি আমার কাছে এসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললেন হেলেন এখানে এসেছে, সে মিনতি জানিয়েছে আমি যেন তার কথাগুলি শুনি, সে নির্দোষ, সে দুঃখী, আরো অনেক কথা। আমি জানতাম একবার যদি তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দেই তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেবার শক্তি আমার হবে না। এই বিপদে কার কাছে সাহায্য চাইব, পরামর্শ চাইব তাও বুঝতে পারিনি। আমার হিতকারী যদি এখানে থাকতেন তাহলে তিনিই আমাকে বলে দিতেন কি করতে হবে। আমার ঘরে ঢুকে জোসেফ আলেক্সিতীচের চিঠিগুলি আর একবার পড়লাম, তার সঙ্গে যা কথা হয়েছিল সেগুলি স্মরণ করলাম, আর তা থেকে এই সিদ্ধান্ত করলাম, যে মানুষ সবিনয়ে প্রার্থনা জানাচ্ছে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত হবে না, প্রত্যেকের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করাই আমার কর্তব্য-বিশেষ করে যে আমার সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ বাঁধনে বাঁধা–আমার কুশ আমাকে বহন করতেই হবে। কিন্তু ঠিক কাজ করার খাতিরে তাকে যদি ক্ষমাই করি, তাহলে আত্মিক উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে মিলনও হোক। এই সিদ্ধান্ত করে জোসেফ আলেক্সিভিচকেও তাই জানিয়ে দিলাম। স্ত্রীকে বললাম, সে যেন অতীতকে ভুলে যায়, তার প্রতি যদি কোনো অন্যায় করে থাকি তাহলে সে যেন আমাকে ক্ষমা করে, আর আমার ক্ষমা করার কিছুই নেই। তাকে একথা বলতে পেরে আনন্দ পেলাম। তার সঙ্গে আবার দেখা করা যে আমার পক্ষে কত কঠিন সেটা আর তার জানার দরকার নেই। এই বড় বাড়িটার দোতলাতেই আমি বাসা নিয়েছি, লাভ করেছি নবজন্মের এক সুখের অনুভূতি।

.

অধ্যায়-৯

যেমন সর্বদাই ঘটে থাকে, সেই সময়ই দরবারে সমবেত সর্বোচ্চ মহলে এবং বড় বড় বল নাচের আসরে সকলেই যার যার নিজস্ব মেজাজে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বসতে লাগল। তার মধ্যে আবার সবচাইতে বড় দলটি ছিল নেপোলিয়ন-অনুরাগী ফরাসি দলটি, অর্থাৎ কাউন্ট রুমিয়ান্তসেভ ও কলাইকুর্তের দল। স্বামীকে নিয়ে পিটার্সবুর্গে বসবাস শুরু করেই হেলেনও এই দলের একজন চাই হয়ে উঠল। ফরাসি দূতাবাসের সদস্যবর্গ এবং বুদ্ধি ও পরিচ্ছন্ন আচার-আচরণের জন্য সুপ্রসিদ্ধ ঐ মহলের অনেকেই সবসময় তার কাছে আসা-যাওয়া শুরু করে দিল।

দুই সম্রাটের বিখ্যাত সাক্ষাৎকারের সময় হেলেন এরফুর্তেই ছিল, এবং নেপোলিয়ন-অনুরাগী বিশিষ্ট লোকদের সঙ্গে সেখানেই তার যোগাযোগ ঘটেছিল। এরফুর্তে সে খুবই সাফল্য লাভ করেছিল। থিয়েটারে স্বয়ং নেপোলিয়নের নজরে সে পড়েছিল, তার সম্পর্কে নেপোলিয়ন বলেছিল : Cest un superbe ani mal. (ঐ একটি অপূর্ব জীব)। সুন্দরী রুচিসম্পন্না নারী হিসেবে তার এই সাফল্যে পিয়ের অবাক হয়নি, কারণ সে এখন আগের চাইতেও বেশি সুন্দরী হয়েছে। সে অবাক হয়েছে এটা লক্ষ্য করে যে এই বিগত দুই বছরে তার স্ত্রী যেমন বুদ্ধিমতী তেমনই সুন্দরী একটি মনোরমা নারী হবার সুখ্যাতি অর্জন করতে পেরেছে। বিশিষ্ট প্রিন্স দ্য লিগনে তাকে আট-পাতা চিঠি লিখেছে। বিলিবিন তার সরস কবিতাগুলি জমিয়ে রেখেছে কাউন্টেস বেজুখভের সামনে উপস্থিত করবে বলে। কাউন্টেস বেজুখভের দরবারে উপস্থিত হতে পারাটাকেই বুদ্ধির তকমা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। তার দরবারে যাতে কিছু বলা যায় সেই উদ্দেশ্যে হেলেনের সান্ধ্য বাসরে যোগ দেবার আগে যুবকরা পুঁথিপত্র পড়ে নেয়। দূতাবাসের সচিবরা, এমন কি রাষ্ট্রদূতরা পর্যন্ত কূটনৈতিক গোপন কথা হেলেনকে বিশ্বাস করে বলে দেয়। কাজেই হেলেন একটা শক্তি-কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। স্ত্রীর বোকামির কথা পিয়ের জানে, তাই স্ত্রীর সান্ধ্য বাসরে এবং ডিনার-পার্টিতে যখন রাজনীতি, কাব্য ও দর্শনের আলোচনা চলে তখন পিয়ের ভয় ও সংশয়ের একটা বিচিত্র মিশ্র অনুভূতি নিয়ে কখনো কখনো সেখানে উপস্থিত থাকে। একজন যাদুকর যখন আশংকা করে যে তার কলা-কৌশল যেকোন মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারে তখন তার যেরকম মনের অবস্থা হয় ঠিক সেই মনের অবস্থা নিয়েই পিয়ের ঐ সব পার্টিতে যোগ দেয়। কিন্তু যে কারণেই হোক হেলেন ধরা পড়ে না, বরং মনোরমা এক চতুর নারী হিসেবে হেলেন বেজুখভের সুখ্যাতি এতই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ল যে তার অত্যন্ত ফাঁকা ও বোকা-বোকা বুলি শুনেও তার প্রতিটি কথায়ই সকলে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে এবং সেগুলির এমন সব গভীর তাৎপর্য খুঁজতে থাকে যার তিলমাত্র ধারণাও তার নিজের মনে কখনো ছিল না।

পিয়ের এখন উঁচু মহলের একটি মহিলার পক্ষে প্রয়োজনীয় স্বামীমাত্র। সে একজন উদাসীন খেয়ালি মানুষ, এমন একটি পরম মহাশয় স্বামী যে কারো সাতে-পাঁচে থাকে না, বসবার ঘরের উচ্চগ্রামের ভাবস্রোতকে ক্ষুণ্ণ করে না, সুন্দরী ও কুশলী স্ত্রীর সুবিধাজনক পশ্চাৎপট হয়ে থাকাই তার একমাত্র কাজ। লোকে যেভাবে থিয়েটারে ঢোকে, সেও সেইভাবেই খ্রীর বসবার ঘরে ঢোকে, সকলের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করে, সকলকে দেখেই সমান খুশি হয়, আর সকলের প্রতিই সমান উদাসীন। পিটার্সবুর্গের অত্যন্ত বিশিষ্ট এই মহিলাটির বিচিত্র স্বামী হিসেবে তার পরিচয় এতদূর প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে তার এই খামখেয়ালিপনা কেউই বিশেষ গুরুত্ব দেয় না।

যেসব যুবক প্রায়ই হেলেনের বাড়িতে হানা দেয় তাদের মধ্যে সামরিক চাকরিতে সুপ্রতিষ্ঠিত বরিস বেস্কয়ই এখন বেজুখভ-পরিবারের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছে। হেলেন তাকে বলে প্রিয় সেবক, তাকে দেখে শিশুর মতো। সকলের জন্যই সে একই হাসি হাসে, তবু হেলেন যখন বরিসকে দেখে হাসে তখন পিয়ের অস্বস্তি বোধ করে। বরিসও পিয়েরকে একটা বিশেষ মর্যাদা ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এই শ্রদ্ধার ভাবটাও পিয়েরকে বিরক্ত করে। তিন বছর আগে স্ত্রীর কাছ থেকে সে এত যন্ত্রণা ভোগ করেছে যে এখন সে যন্ত্রণার পুনরাবৃত্তি থেকে সে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে চায়, আর সেজন্য প্রথমত সে স্ত্রীর উপর স্বামীত্বের দাবি খাটায় না, দ্বিতীয়ত নিজের মনে কোনো সন্দেহকে বাসা বাঁধতে দেয় না।

পিয়ের নিজেকে বোঝায়, না, সে এখন বিদূষী হয়ে উঠেছে, কাজেই আগেকার সব মোহই সে কাটিয়ে উঠেছে। বিদূষী মহিলারা হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে গা ভাসিয়েছে এরকম কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। অথচ কী আশ্চর্য, বরিস তার স্ত্রীর বসবার ঘরে হাজির হলেই (এবং সে হাজিরা প্রায় সব সময়ই চলে) পিয়েরের শরীরটাই যেন কেমন হয়ে যায়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি কেমন সংকুচিত হয়ে ওঠে, তার চলাফেরার অচেতন স্বাধীনতা নষ্ট হয়ে যায়।

পিয়ের ভাবে, কী আশ্চর্য বিরূপতা, অথচ একসময় বরিসকে কত ভালোবাসতাম।

পৃথিবীর চোখে পিয়ের একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক, এক বিশিষ্ট স্ত্রীর অন্ধ ও অবুঝ স্বামী, এমন একটি খেয়ালি মানুষ যে কিছুই করে না, কারো ক্ষতিও করে না, প্রথম শ্রেণীর একজন ভালোমানুষ। কিন্তু পিয়েরের মনের মধ্যে সারাক্ষণই আভ্যন্তরীণ অগ্রগতির এমন একটা জটিল ও কঠিন কাজ চলতে লাগল যাতে অনেককিছুই তার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল, আর তার ফলে অনেক আত্মিক সংশয় ও আনন্দ তার মধ্যে দেখা দিল।

.

 অধ্যায়-১০

পিয়েরের দিনপঞ্জি লেখা চলতেই থাকল, এই সময়ে সে লিখল :

২৪শে নভেম্বর।

আটটায় ঘুম থেকে উঠলাম, ধর্ম-পুস্তক পড়লাম, তারপর কাজে গেলাম। জোসেফ আলেক্সিভিচের পরামর্শক্রমে পিয়ের সরকারি চাকরিতে ঢুকেছে এবং একটা কমিটিতে কাজ করছে।) খাওয়ার জন্য বাড়ি ফিরে একাই খেলাম-কাউন্টেসের এমন সব অতিথি ছিল যাদের আমি পছন্দ করি না। নিয়মমতো পান ভোজন সেরে গুরুভাইদের জন্য কয়েকটি অনুচ্ছেদ লিখলাম। সন্ধ্যায় কাউন্টেসের কাছে গিয়ে বি. সম্পর্কে একটা মজার গল্প বললাম, আর তা শুনে সকলেই যখন হো-হো করে হেসে উঠল একমাত্র তখনই মনে পড়ল যে কাজটা করা উচিত হয়নি।

শান্ত সুখী মন নিয়ে শুতে চলেছি। মহান ঈশ্বর, তোমার পথে চলতে আমাকে সাহায্য কর, (১) প্রশান্তি ও সুবিবেচনার দ্বারা ক্রোধকে জয় করতে, (২) আত্মসংযম ও প্রতিরোধের দ্বারা কামনাকে পরাভূত করতে, (৩) সংসার থেকে দূরে সরে থাকতে, কিন্তু (ক) রাষ্ট্রের সেবা, (খ) পারিবারিক কর্তব্য, (গ) বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক, এবং (ঘ) নিজের কাজকর্মের ব্যবস্থাকে পরিহার না করতে।

২৭শে নভেম্বর।

অনেক দেরিতে উঠেছি। ঘুম থেকে জেগেও আলস্যবশত অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়েছিলাম। হে ঈশ্বর, তোমার পথে চলতে আমাকে সাহায্য কর, শক্তি দাও। ধর্ম-পুস্তক পড়লাম, কিন্তু মনে ভাব জাগল না। ভাই উরুসভ এসে পার্থিব বিষয়ের কথা বলতে লাগল। ম্রাটের নতুন প্রকল্পের কথা বলল। আমি সেগুলির সমালোচনা করতে লাগলাম। আমার জিবাই আমার শক্র। ভাই জি. ভি. এবং ও, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। একটি নতুন ভাইকে স্বাগত জানাবার ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা হল। আমার উপর তারা দীক্ষার কাজটা চাপিয়ে দিল। নিজেকে বড়ই দুর্বল ও অক্ষম মনে হয়। তারপরেই শুরু হল মন্দিরের সাতটি স্তম্ভ ও সাতটি সিঁড়ির ধাপ, সাত বিজ্ঞান, সাত সদগুণ, সাত পাপ, এবং পবিত্র আত্মার সাত দানের ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা। ভাইও খুব ভালো বলতে পারেন। সন্ধ্যায় স্বাগত-অনুষ্ঠানটি হল। বরিস বেক্ষয়কে সংঘে নেওয়া হল। আমি তাকে মনোনীত করে দীক্ষা দিলাম। একটা অন্ধকার ঘরে যখন তাকে নিয়ে আমি একা ছিলাম তখন একটা অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে তোলপাড় করে তুলল। তার প্রতি একটা ঘৃণার ভাব আমার মনের মধ্যে জমে আছে বুঝতে পেরে সেটাকে দূর করতে সচেষ্ট হলাম। আমার মনে হল, আশ্রমের সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার এবং তাদের করুণা পাবার জন্যই বরিস সংঘে প্রবেশ করতে এসেছে। কিন্তু মুখ ফুটে সেকথা তাকেও বলতে পারলাম না, গুরুভাইদের এবং মহাপ্রভুকেও বলতে পারলাম না। প্রকৃতির মহান রূপকার, মিথ্যার গোলকধাঁধা থেকে বের হবার সত্য পথ আবিষ্কার করতে সাহায্য কর!

৩রা ডিসেম্বর।

দেরিতে ঘুম ভেঙেছে, ধর্মগ্রন্থ পড়েছি, কিন্তু সেদিকে মন যায়নি। তারপর বড় হলটায় গিয়ে পায়চারি করেছি। ইচ্ছা হল ধ্যানে বসি, কিন্তু তার পরিবর্তে কল্পনায় ভেসে উঠল চার বছর আগেকার একটি ঘটনার ছবি : দ্বৈরথের পরে মস্কোতে আমার সঙ্গে দেখা করে দলখভ বলেছিল, আমার স্ত্রীর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও আমি বেশ খোশমেজাজে আছি বলেই সে আশা করছে। তখন তাকে কোনো জবাব দেইনি। এখন সেই সাক্ষাৎকারের প্রতিটি বিবরণ আমার মনে পড়ল-মনে মনে অনেক বিদ্বেষপূর্ণ তিক্ত জবাব তাকে দিয়েছিলাম। যখন দেখলাম আমার ভিতরটা রাগে জ্বলছে তখনই নিজেকে সংযত করে সে চিন্তাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিলাম। তারপর বরিস দ্রবেষ্কয় এসে নানা অভিযানের কথা বলতে লাগল। গোড়া থেকেই তার আসায় আমি বিরক্তিবোধ করছিলাম, কিছু অপ্রীতিকর কথাও তাকে বললাম। সে জবাব দিল। আমিও জ্বলে উঠলাম, এমনকিছু বললাম যা তার পক্ষে অপ্রীতিকর, এমন কি রূঢ়। সে চুপ করে রইল, আমিও নিজেকে সংযত করলাম। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। হে ঈশ্বর, আমি তার সঙ্গে চলতেই পারছি না। এর কারণ আমার অহংবোধ। নিজেকে তার উপরে বসাই বলেই তার চাইতে এত ছোট হয়ে যাই, কারণ আমার রূঢ়তার প্রতি সে উদার, আর তার প্রতি আমি পোষণ করি ঘৃণা। হে ঈশ্বর, তার সামনে আমি যাতে আমার নিচতাকে বুঝতে পারি, যাতে আমার আচরণে তারও কল্যাণ হয় সেই ব্যবস্থাই কর। আহারের পরে ঘুমিয়ে পড়লাম, আর ঘুমের মধ্যেই স্পষ্ট শুনতে পেলাম কে যেন আমার বাঁ কানে বলছে, তোমার দিন!

স্বপ্নে দেখলাম আমি অন্ধকারে হাঁটছি, হঠাৎ একদল কুকুর আমাকে ঘিরে ধরল, কিন্তু কোনোরকম ভয় না পেয়ে আমি চলতে লাগলাম। হঠাৎ একটা ছোটখাট কুকুর দাঁত দিয়ে আমার বাঁ উরুটা কামড়ে ধরল, কিছুতেই ছাড়ল না। দুই হাতে সেটার গলা টিপে ধরলাম। সেটাকে ছাড়িয়ে দিতে না দিতেই বড় গোছের আর একটা কুকুর আমাকে কামড়াতে শুরু করল। সেটাকে তুলে ধরলাম, কিন্তু যত উপরে তুলি সেটা ততই বড় আর ভারি হয়ে উঠতে লাগল। হঠাৎ ভাই এ. এসে আমার হাত ধরে একটা পাকা বাড়িতে নিয়ে চলল। সে বাড়িতে ঢুকবার মুখে আমাদের একটা সরু তক্তার উপর দিয়ে যেতে হল। সেটার উপর পা দিতেই তক্তাটা বেঁকে ভেঙে গেল, আমি একটা বেড়া বেয়ে উঠতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু হাত বাড়িয়ে কিছুতেই যেন তার নাগাল পেলাম না। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে টেনে তুললাম, আমার পা দুটো ঝুলে রইল একদিকে আর শরীরটা রইল অন্যদিকে। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ভাই এ. বেড়াটার উপর দাঁড়িয়ে আছে, আর আঙুল দিয়ে বাইরে একটা চওড়া রাজপথ ও বাগান দেখাচ্ছে, সেই বাগানে রয়েছে একটা সুন্দর বড় বাড়ি। ঘুম ভেঙে গেল। হে প্রভু, হে প্রকৃতির মহান রূপকার, এই কুকুরগুলোর-এই সব কামনা-বাসনার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে আমাকে সাহায্য কর, বিশেষ করে এই শেষ কুকুরটির হাত থেকে যার মধ্যে আগেকার অন্য সবগুলির শক্তি একত্রিত হয়েছে, স্বপ্নের মধ্যে যে ধর্ম-মন্দিরের ছবি আমি দেখেছি সেখানে ঢুকতে আমাকে সাহায্য কর।

 ৭ ডিসেম্বর।

স্বপ্ন দেখলাম জোসেফ আলেক্সিভিচ আমার বাড়িতে বসে আছেন, আর আমি খুশি হয়ে তাঁকে আপ্যায়িত করতে চাইছি। মনে হল, আমি যেন অন্য সকলের সঙ্গে অবিশ্রাম বকে চলেছি আর হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে এতে উনি খুশি হবেন না, আমার ইচ্ছা হল তার আরো কাছে যাই, তাঁকে আলিঙ্গন করি। কিন্তু কাছে যেতেই দেখলাম তার মুখটা বদলে গিয়ে যুবকের মতো হয়ে গেল, আমাদের সংঘের শিক্ষা সম্পর্কে তিনি শান্তভাবে কিছু বলতে লাগলেন, কিন্তু এত আস্তে বললেন যে আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। তারপরেই মনে হল যেন আমরা সকলেই ঘর থেকে চলে গেলাম এবং একটা আশ্চর্য কিছু ঘটল। আমরা মেঝেতে শুয়ে বা বসে আছি। তিনি যেন আমাকে কিছু বলছেন, আর আমি চাইছি আমার বোধশক্তি তাকে দেখাতে, তাঁর কথায় কান না দিয়ে আমার ভিতরকার মানুষটার কথা এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদে, তাঁর পুতঃ হবার কথাই আমি ভাবতে লাগলাম। আমার চোখে জল এল, আর সেটা তার নজরে পড়ায় আমি খুশি হলাম। কিন্তু বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে তিনি লাফ দিলেন, তার কথায় ছেদ পড়ল। আমি লজ্জা পেয়ে জানতে চাইলাম তিনি আমার ব্যাপারে কিছু বলছিলেন কি না। কিন্তু তিনি জবাব দিলেন না, সদয় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, তারপরেই হঠাৎ দেখলাম আমরা রয়েছি আমার শোবার ঘরে, আর সেখানে একটি দুইজনের মতো বিছানা পাতা আছে। তিনি বিছানার এক প্রান্তে শুয়ে পড়লেন, আর তাকে আদর করবার জ্বলন্ত বাসনায় আমিও শুয়ে পড়লাম। আর তিনি বললেন, আমাকে খোলাখুলি বল তো কি তোমার প্রধান প্রলোভন? তা কি তুমি জান? আমি মনে করি তুমি তা জান। এ প্রশ্নে লজ্জা পেয়ে বললাম, আলস্যই আমার প্রধান প্রলোভন। তিনি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন, আরো লজ্জা পেয়ে বললাম, তার পরামর্শমতো আমার স্ত্রীর সঙ্গে বাস করলেও আমি তার সঙ্গে স্বামীর মতো বাস করছি না। এতে তিনি বললেন, স্ত্রীকে আলিঙ্গন থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়, তিনি আমাকে বোঝালেন যে সেটাই আমার কর্তব্য। কিন্তু আমি জবাব দিলাম যে সেকাজ করতে আমার লজ্জা হওয়া উচিত, আর সহসা সব কিছু অদৃশ্য হয়ে গেল। আমারও ঘুম ভেঙে গেল, মনে পড়ল। সুসমাচারের পাঠ : জীবনই মানুষের আলোকস্বরূপ। সে আলো অন্ধকারে কিরণ দেয়, অন্ধকার তাকে ঢেকে দিতে পারে না। জোসেফ আলেক্সিভিচের মুখখানা আরো যুবকের মতো উজ্জ্বল দেখাতে লাগল। সেইদিনই আমার হিতকারির কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম, তাতে তিনি দাম্পত্য কর্তব্যের কথা লিখেছেন।

৯ ডিসেম্বর।

একটা স্বপ্ন দেখে যখন ঘুম ভেঙে গেল তখন বুকটা টিপটিপ করছিল। দেখলাম, আমি রয়েছি মস্কোতে নিজের বাড়িতে, বড় বসবার ঘরটাতে, আর জোসেফ আলেক্সিভিচ বেরিয়ে এলেন বৈঠকখানার ঘর থেকে। মনে হল, আমি যেন সেইমুহূর্তে জেনে ফেলেছি যে তার মধ্যে পুনর্জন্মের কাজ শুরু হয়ে গেছে, তার দিকে ছুটে গেলাম। তাকে আলিঙ্গন করলাম, হাত দুটিতে চুমো খেলাম, তিনি বললেন, তুমি কি লক্ষ্য করেছ যে আমার মুখটা বদলে গেছে? তখনো তাকে জড়িয়ে ধরেই ছিলাম, মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাঁর মুখটা একজন যুবকের, কিন্তু তার মাথায় চুল নেই, আর মুখটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমি বললাম, হঠাৎ দেখা হয়ে গেলেও আপনাকে আমি চিনতে পারতাম, নিজের মনে ভাবলাম, আমি কি সত্য কথা বলছি আর সহসা দেখলাম তিনি একজন মরা মানুষের মতো শুয়ে আছেন, তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে আমার সঙ্গে আমার পড়ার ঘরে গেলেন, আঁকার কাগজের একটা বড় বই তাঁর হাতে। বললাম, ওগুলো আমি একেছি, মাথাটা নুইয়ে তিনি জবাব দিলেন। বইটা খুললাম, সবগুলো পাতায়ই চমৎকার সব আঁকা।

আমার স্বপ্ন থেকেই জেনেছিলাম, প্রিয়তমার সঙ্গে আত্মার ভালোবাসার অভিযান নিয়েই ছবিগুলি আঁকা। পাতায় পাতায় দেখতে পেলাম, স্বচ্ছ দেহকে স্বচ্ছ পোশাকে আবৃত করে আকাশে উড়ে-চলা একটি নারীর সুন্দর প্রতিকৃতি। আর আমার যেন মনে হল এটা পরমা সঙ্গীতের প্রতিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। সেই ছবিগুলির দিকে তাকিয়ে স্বপ্নের মধ্যেও আমার মনে হল যে আমি অন্যায় করছি, কিন্তু সেগুলির উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না। প্রভু, আমার সহায় হও! ঈশ্বর আমার, আমাকে পরিত্যাগ করাই যদি তোমার কাজ হয় তো তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক, কিন্তু আমি নিজে যদি এর কারণ হই তাহলে আমাকে বলে দাও করবে!

.

 অধ্যায়-১১

 দুটো বছর গ্রামে কাটিয়েও রস্তভদের আর্থিক অবস্থার কোনোরকম উন্নতি হল না।

যদিও নিকলাস রস্তভ তার সংকল্পে অটল থেকে অপেক্ষাকৃত অল্প খরচে একটা নগণ্য রেজিমেন্টে খুব সাদাসিধেভাবে দিন কাটাচ্ছে, ওদিকে অত্রাদ-র জীবনযাত্রা বিশেষ করে মিতিংকার গৃহস্থালি-এমনভাবে চলছে যাতে প্রতিবছরই ঋণের পরিমাণ অনিবার্যভাবেই বেড়ে চলেছে। একটা সরকারি পদের জন্য আবেদন করাই তখন বুড়ো কাউন্টের সামনে একমাত্র পথ আর তার খোঁজেই সে পিটার্সবুর্গে এসেছে, আর এই ফাঁকে মেয়েরাও শেষবারের মতো একটু আমোদ-আহ্লাদ করে নিতে পারবে।

পিটার্সবুর্গে আসার কিছুদিন পরেই বের্গ ভেরাকে বিয়ের প্রস্তাব করে এবং তা গৃহীত হয়।

মস্কোর মতো পিটার্সবুর্গেও রস্ত পরিবার সেই একই আতিথেয়তার রীতি বজায় রেখেই চলেছে, তাদের নৈশভোজনে নানা ধরনের লোক এসে মিলিত হয়। অত্রানুর পল্লী অঞ্চলের প্রতিবেশীরা, দুস্থ অবস্থার প্রাচীন জমিদার ও তাদের কন্যারা, সম্ভ্রান্ত মহিলা পেরোনায়া, পিয়ের বেজুখব, আর তাদের জেলা পোস্টমাস্টারের পিটার্সবুর্গে চাকরিরত ছেলেটি। পুরুষদের মধ্যে যারা অচিরেই রস্তভদের পিটার্সবুর্গের বাড়ির নিয়মিত অতিথি হয়ে উঠল তাদের মধ্যে রয়েছে বরিস, পিয়েরকে তো কাউন্ট রাস্তায় দেখতে পেয়ে জোর করেই বাড়িতে টেনে এনেছে, আর বের্গ সারাটাদিন রস্তভদের বাড়িতেই কাটায় এবং বড় মেয়ে কাউন্টেস ভেরার প্রতি সেইরকম মনোযোগ দিয়ে চলে, একটি যুবক বিয়ের প্রস্তাব করার আগে ভাবী কনের প্রতি যতটা মনোযোগ দিয়ে থাকে।

বের্গ যে অস্তারলিজে আহত ডান হাতটা সকলকেই দেখিয়ে বেড়ায় এবং একটা সম্পূর্ণ অদরকারী তলোয়ার বাঁ হাতে নিয়ে চলে সেটাও বৃথা যায়নি। সেই ঘটনাকে সে এতবার বলেছে আর এমন গুরুত্বের সঙ্গে বলেছে যে সকলেই তার সেই কাজটির গুণ ও প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাস করেছে। অস্তারলিজের জন্য সে দুটো সম্মান-চিহ্নও পেয়েছে।

কিছু কিছু নিন্দুক বের্গের গুণাবলীর কথা শুনে হাসলেও একথা অস্বীকার করা যায় না যে সে একজন পরিশ্রমী ও সাহসী অফিসার, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার সম্পর্ক চমৎকার, আর একজন সচ্চরিত্র যুবক হিসেবে তার সামনে আছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও সমাজে একটি সুনিশ্চিত আসন।

চার বছর আগে মস্কোর একটি থিয়েটারের স্টলে জনৈক জার্মান সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হলে বে ভেরা রন্তভাকে দেখিয়ে তাকে জার্মান ভাষায় বলেছিল, ঐ মেয়েটি আমার ভাবীবধূ, আর সেই মুহূর্ত থেকেই সে স্থির করেছে যে ভেরাকেই বিয়ে করবে। এবার পিটার্সবুর্গে এসে রস্তভদের অবস্থা ও নিজের অবস্থা বিবেচনা করে সে স্থির করল যে এবার বিয়ের প্রস্তাব করার সময় এসেছে।

প্রথমে বিয়ের প্রস্তাব শুনে কিছুটা বিব্রত বোধ করলেও নিজেদের আর্থিক অবস্থা ও ভেরার চব্বিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে রস্তভরা শেষপর্যন্ত এ-প্রস্তাবে সম্মতি দিল।

প্রায় একমাস হয়ে গেল বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে, বিয়ের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি, কিন্তু যৌতুকের ব্যাপারে কাউন্ট এখনো মনস্থির করতে পারেনি, বা স্ত্রীকে এ সম্পর্কে কিছু বলেনি। একসময়ে কাউন্ট ভেবেছিল, রিয়াজান জমিদারিটা মেয়েকে দিয়ে দেবে, বা একটা জঙ্গল বিক্রি করে দেবে, আবার কখনো ভেবেছে হ্যান্ড-নোটে টাকা ধার করবে। বিয়ের দিনকয়েক আগে একদিন সকালে বের্গ কাউন্টের পড়ার ঘরে ঢুকে স্মিত হাসির সঙ্গে সশ্রদ্ধভাবে ভাবী শ্বশুরের কাছে জানতে চাইল ভেরাকে কিরকম যৌতুক দেওয়া হবে। এই দীর্ঘ-প্রতীক্ষিত প্রশ্নে কাউন্ট এতই বিব্রত হয়ে পড়ল যে কোনো কিছু না ভেবেই প্রথম যে জবাবটা মাথায় এল সেটাই বলে ফেলল। এ ব্যাপারে তুমি যে পাকা ব্যবসায়ীর মতো কথা বলেছ তাতে আমি খুশি হয়েছি…এটাই আমি পছন্দ করি। তুমি যাতে সন্তুষ্ট হও তাই…

আলোচনায় ইতি টানবার ইচ্ছায় বের্গের পিঠটা চাপড়ে দিয়ে কাউন্ট উঠে পড়ল। বের্গ কিন্তু স্মিত হাসির সঙ্গে বলল, ভেরা কতটা কি পাবে সেটা নিশ্চিত করে না জানতে পারলে এবং যৌতুকের একটা অংশ আগাম না পেলে আমাকে হয়তো সমস্ত ব্যবস্থাটাই ভেঙে দিতে হবে। কারণ, ভেবে দেখুন কাউন্ট, স্ত্রীর ভরণপোষণের যথেষ্ট ব্যবস্থা ছাড়াই আমি যদি এখন বিয়ে করে বসি তাহলে কাজটা খুবই খারাপ হবে

কাউন্ট আর কথা না বাড়িয়ে জানিয়ে দিল যে আশি হাজার রুবলের একটা হ্যান্ড-নোট সে দেবে। বের্গ বিনীতভাবে হেসে কাউন্টের কাঁধে চুমো খেয়ে জানাল যে সে খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করছে, কিন্তু তিরিশ হাজার নগদে না পেলে তার পক্ষে নতুন জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করা অসম্ভব। তারপর বলল, অন্তত বিশ হাজার কাউন্ট, আর পরে মাত্র ষাট হাজারের হ্যান্ড-নোট।

কাউন্ট তাড়াতাড়ি বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে। শুধু আমাকে ক্ষমা কর বাবা, আমি তোমাকে বিশ হাজারও দেব, আবার আশি হাজারের হ্যান্ড-নোটও দেব। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাকে চুমো খাও!

.

অধ্যায়-১২

নাতাশার বয়স এখন ষোল, আর এটা সেই ১৮০৯ সাল, চার বছর আগে পরস্পরকে চুমো খাবার পর থেকে যে বছরটার জন্য বরিসের সঙ্গে সেও আঙুল গুনে চলেছে। সেই থেকে সে একদিনের জন্যও বরিসকে দেখেনি। সোনিয়াও তার মার সামনে কথাপ্রসঙ্গে বরিসের নাম উঠলে সে এমন সহভাবে সে সম্পর্কে কথা বলে যেন সেটা একটা অনেকদিন আগে ভুলে-যাওয়া ছেলেমানুষী ব্যাপার, সেটাকে মনে করে রাখার কোনো মানেই হয় না। কিন্তু বরিসের সেই বিয়ের প্রস্তাব একটা ঠাট্টামাত্র, না কি একটা গুরুতর প্রতিশ্রুতি এই প্রশ্ন মনের গভীর গহনে তাকে অনবরত যন্ত্রণা দিয়ে চলেছে।

১৮০৫ সালে বরিস যখন সেনাদলে যোগ দিতে মস্কো থেকে চলে গিয়েছিল তারপরে রস্তদের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। বারকয়েক সে মস্কো এসেছে, অস্ত্রাদ-র কাছ দিয়েও গেছে, কিন্তু কখনো তাদের সঙ্গে দেখা করতে যায়নি।

কখনো কখনো নাতাশার মনে হয়েছে যে বরিস আর তার সঙ্গে দেখা করতে চায় না, বড়রাও তার সম্পর্কে যে সুরে কথা বলে তাতেও তার এই অনুমানই সমর্থিত হয়।

বরিসের কথা উঠলেই কাউন্টেস বলে, আজকাল পুরনো বন্ধুদের কেউ মনে রাখে না।

আন্না মিখায়লভনাও আজকাল আগের তুলনায় অনেক কম আসে, সবসময় একটা গাম্ভীর্য বজায় রেখে চলে, এবং ছেলের গুণপনা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা নিয়েই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। রস্তভরা পিটার্সবুর্গে এলে বরিস তাদের সঙ্গে দেখা করতে এল।

বেশ উত্তেজনা নিয়েই সে তাদের বাড়ি গেল। নাতাশার স্মৃতি তার কাছে খুবই কাব্যময়। কিন্তু এই দৃঢ় সংকল্প নিয়েই সে গেল যে নাতাশাকে ও তার বাবা-মাকে বুঝিয়ে দেবে, নাতাশার সঙ্গে তার ছেলেমানুষী সম্পর্কটা দুইজনের কারো পক্ষেই বাধ্যতামূলক হতে পারে না। কাউন্টেস বেজুখভের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার দৌলতে সমাজে সে সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত, একজন পদস্থ ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতার দৌলতে চাকরিক্ষেত্রেও তার সম্ভাবনা সুউজ্জ্বল, এবং পিটার্সবুর্গের জনৈকা অন্যতম ধনী উত্তরাধিকারিণীকে বিয়ে করার ব্যবস্থাও সে শুরু করে দিয়েছে, আর সে ব্যবস্থা সহজেই বাস্তবে রূপায়িত হতে পারবে। সে যখন রস্তভদের বসবার ঘরে ঢুকল তখন নাতাশা ছিল তার নিজের ঘরে। বরিসের আসার সংবাদ পেয়ে সে লজ্জায় লাল হয়ে মধুর হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে দৌড়ে সেখানে এসে হাজির হল।

বরিস চার বছর আগে নাতাশাকে যেমনটি দেখেছিল, সেই খাটো পোশাক পরা, কোঁকড়া চুলের নিচে উজ্জ্বল দুটি কালো চোখ, সেই ছেলেমানুষী উচ্ছল হাসি, নাতাশার সেই চেহারাটাই এখনো তার মনে আছে। কাজেই যখন সম্পূর্ণ আলাদা এক নাতাশা এসে ঘরে ঢুকল তখন সে যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, একটা উচ্ছ্বসিত বিস্ময় ফুটে উটল তার মুখে।

কাউন্টেস শুধাল, আচ্ছা, তোমার সেই ছোট পাগলি খেলার সাথীটিকে চিনতে পারছ কি?

 নাতাশার হাতে চুমো খেয়ে বরিস বলল তার এই পরিবর্তন দেখে সে অবাক হয়ে গেছে।

 তুমি কত সুন্দর হয়েছ?

তাই তো মনে হয়! নাতাশার হাসিভরা চোখ দুটি জবাব দিল।

বলল, পাপা কি খুব বড় হয়েছে?

নাতাশা বসল, কাউন্টেসের সঙ্গে বরিসের কথাবার্তায় যোগ না দিয়ে সে নীরবে তার ছেলেবেলাকার প্রণয়ীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। বরিসও সেটা বুঝতে পেরে বার বার নাতাশার দিকে তাকাতে লাগল।

বরিসের ইউনিফর্ম, কাঁটা-মারা জুতো, টাই, চুল ব্রাশ করার ভঙ্গি, সবই একেবারে হাল-ফ্যাশনের। সবই নাতাশার নজরে পড়ল। কাউন্টেসের পাশের হাতল চেয়ারটায় সে আরাম করে বসেছে, ডান হাত দিয়ে পরিষ্কার দুটি দস্তানাকে এমনভাবে পরল যেন সে দুটি হাতের চামড়াই হয়ে গেল, ঠোঁট দুটিকে সুন্দরভাবে চেপে পিটার্সবুর্গের উঁচু মহলের আমোদ-প্রমোদের কথা বলছে, আর মৃদু বিদ্রুপের সঙ্গে মস্কোর পুরনো দিনের কথা ও পরিচিত লোকজনদের কথাও উল্লেখ করছে।

বরিস দশ মিনিটের বেশি সেখানে থাকল না, আসন থেকে উঠে বিদায় নিল। দুটি সপ্রশ্ন, ঠাট্টাভরা, দৃষ্টি তখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম সাক্ষাতের পরে বরিস নিজেকে বোঝাল, নাতাশা তাকে আগের মতোই আকর্ষণ করেছে, কিন্তু এই আকর্ষণের কাছে ধরা দিলে চলবে না, কারণ সম্পত্তিহীন এই মেয়েটিকে বিয়ে করা মানেই তার ভবিষ্যৎ উন্নতির সর্বনাশ করা আবার তাকে বিয়ে করার ইচ্ছা না থাকলেও তার সঙ্গে নতুন করে ভাব জমানোটা অসম্মানজনক। বরিস স্থির করল নাতাশার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করবে না, কিন্তু সে সংকল্প সত্ত্বেও কয়েকদিন পরেই আবার দেখা করতে গেল এবং প্রায়ই দেখা করতে লাগল এবং রস্তভদের বাড়িতে সারাটাদিন কাটাতে লাগল। তার মনে হল, নাতাশার সঙ্গে তার একটা বোঝাঁপড়া হওয়া দরকার, তাকে জানানো দরকার যে পুরনো দিনের কথা ভুলে যেতে হবে, যত যাই হোক…সে তার স্ত্রী হতে পারে না, তার কোনো সামর্থ্য নেই, আর নাতাশার বাবা-মাও তার সঙ্গে নাতাশার বিয়ে দেবে না। দিনের পর দিন সে ক্রমেই জড়িয়ে পড়তে লাগল। তার মার ও সোনিয়ার মনে হল, নাতাশা আগের মতোই বরিসকে ভালোবাসে। সে বরিসকে তার প্রিয় গানগুলি গেয়ে শোনায়, নিজের ছবির অ্যালবাম তাকে দেখায়, বরিসকে দিয়ে তাতে কিছু লিখিয়ে নেয়, পুরনো কথা তুলতেই দেয় না, বর্তমান যে কত সুখের শুধু সেই কথাই বলে, প্রতিদিনই সেই একই কুয়াশার মধ্যে সে বিদায় নেয়, যা বলতে চায় তা বলা হয় না, কি করছে, কেন এখানে আসছে, কোথায় এর শেষ–তাও সে জানে না। হেলেনের সঙ্গে দেখা করা ছেড়ে দিল, প্রতিদিনই তার কাছ থেকে তিরস্কারপূর্ণ চিঠি পেতে লাগল, তবু তার দিনগুলি কাটতে লাগল রস্তভদের বাড়িতেই।

.

অধ্যায়-১৩

একদিন রাতে বুড়ি কাউন্টেস যখন রাত-টুপি ও ড্রেসিং-জ্যাকেট পরে কম্বলের উপর হাঁটু ভেঙে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আর্তনাদ করছিল আর মেঝেতে উপুড় হয়ে প্রার্থনা করছিল, তখন তার ঘরের দরজাটা কাঁচ ক্যাচ শব্দ করে উঠল এবং ড্রেসিং-জ্যাকেট গায়ে ও খালি পায়ে চটি পরে নাতাশা দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল। কাউন্টেসের প্রার্থনার মেজাজ চলে গেল, ভুরু কুঁচকে চারদিকে তাকাল। এও কি হতে পারে যে এই কোচটিই হবে আমার সমাধি?–এই শেষ প্রার্থনাটিই কাউন্টেস শেষ করতে যাচ্ছিল। মাকে প্রার্থনা করতে দেখে নাতাশা হঠাৎ ছোটা বন্ধ করে অর্ধেক বসার ভঙ্গিতে নিজের অজ্ঞাতেই জিভটা বের করল, যেন নিজেকেই তিরস্কার করতে চাইল। যখন দেখল প্রার্থনা করেই চলেছে তখন সে পা টিপে টিপে বিছানায় গেল এবং তাড়াতাড়ি এক পা দিয়ে অন্য পায়ের চটি খুলে ফেলে দিয়ে একলাফে বিছানায় উঠে গেল–একটু আগেই কাউন্টেস আশংকা করেছিল যে এই বিছানাটাই বুঝি তার সমাধি হবে। কোচটা উঁচু, পালকের গদি ও পাঁচটা বালিশ, প্রত্যেকটা নিচেরটার চাইতে কিছু ছোট। লাফ দিয়ে উঠেই নাতাশা পালকের গদিতে ডুব দিল পাক খেয়ে দেয়ালের দিকে সরে গেল, বিছানার চাদর নিয়ে খেলতে শুরু করে দিল, একবার আপাদমস্তক ঢেকে ফেলল, আবার মুখ বের করে মার দিকে তাকাল। প্রার্থনা শেষ করে কাউন্টেস কঠিন মুখে বিছানার কাছে এগিয়ে গেল, কিন্তু নাতাশার মাথাটা ঢাকা দেওয়া থাকায় তার মুখে দেখা দিল সদয়, দুর্বল হাসি।

বলল, এই–এই!

 নাতাশা বলল, মামণি, একটু কথা বলতে পারি? পারি তো? এবার তাহলে তোমার গলায় একটা, আর…এতেই হবে! মার গলা জড়িয়ে ধরে চুমো খেল।

বালিশগুলো ঠিকঠাক করে দিয়ে দুইজনে লেপ মুড়ি দিয়ে শোবার পরে মা বলল, আরে, আজ রাতে এসব কি হচ্ছে?

কাউন্ট ক্লাব থেকে ফিরে আসার আগে রাতে নাতাশার একবার করে মার কাছে আসাটা মা ও মেয়ে দুইজনের কাছেই একটা বড় আনন্দের ব্যাপার।

আজ রাতে এসব কি?-কিন্তু আমি তোমাকে বলতে চাই…

নাতাশা মার মুখের উপর হাতটা রাখল।

গম্ভীর গলায় বলল, বরিসের কথা তো…আমি জানি। সেইজন্যই তো এসেছি। কিছু বল না–আমি জানি। না, আমাকে বল! নাতাশা হাতটা সরিয়ে নিল। বল মামণি! সে খুব ভালো, নয়?

নাতাশা, তোমার বয়স ষোল। তোমার বয়সে আমার বিয়ে হয়েছিল। তুমি বলছ বরিস ভালো। সে খুব ভালো, আমি তাকে ছেলের মতো ভালোবাসি। কিন্তু তাতে কি? তুমি কি ভেবেছ? তার মুণ্ডুটা যে একেবারেই ঘুরিয়ে দিয়েছ তা তো দেখতেই পাচ্ছি…

বলতে বলতে কাউন্টেস মেয়ের দিকে তাকাল। খাটের এক কোণে মেহগনি কাঠের উপর খোদাই-করা ফিনস্কের মূর্তিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে নাতাশা শুয়ে ছিল। কাজেই কাউন্টেস মেয়ের মুখের রেখাচিত্রটাই শুধু দেখতে পেল। সে মুখের কঠিন গম্ভীর ভাব দেখে সে অবাক হল।

নাতাশা কি যেন ভাবছে।

বলল, বেশ, তারপর?

তার মুণ্ডুটা তো একেবারে ঘুরিয়ে দিয়েছ, কিন্তু কেন? তাকে নিয়ে কি করতে চাও? তুমি তো জান তাকে বিয়ে করতে পারবে না।

কেন নয়? একভাবে শুয়ে থেকেই নাতাশা বলল।

কারণ তার বয়স অল্প, কারণ সে গরীব, কারণ সে আত্মীয়…এবং কারণ তুমি নিজেও তাকে ভালোবাস না।

কি করে জানলে?

আমি জানি। এটা ঠিক নয় বাছা!

কিন্তু আমি যদি চাই… নাতাশা বলল।

 বাজে কথা রাখ, কাউন্টেস বলল।

 কিন্তু আমি যদি চাই…

নাতাশা, আমি কিন্তু আন্তরিকভাবেই…

নাতাশা তাকে কথাটা শেষ করতে দিল না। কাউন্টেসের হাতটা টেনে নিয়ে তার পিঠে চুমো খেল, তারপর তালুতে চুমো খেল, আবার হাতটাকে উল্টে নিয়ে প্রথমে একটা গাঁটে চুমো খেল, তারপর দুই গাঁটের মাঝখানের জায়গাটাতে, তারপর পরের গাঁটে, আর ফিসফিস করে বলতে লাগল, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে। বল মামণি, তুমি কিছু বলছ না কেন? কথা বল!

এ চলবে না বাছা! ছেলেবেলাকার এই বন্ধুত্বকে সকলে বুঝবে না। তার সঙ্গে তোমার এই ঘনিষ্ঠতা দেখলে অন্য যেসব যুবক আমাদের বাড়িতে আসে তাদের মনে আঘাত লাগতে পারে। সবচাইতে বড় কথা, অকারণেই সেও কষ্ট পাবে। হয়তো ইতিমধ্যেই তার একটা ভালো অর্থকরী বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে, আর এখন সে তো আধা পাগল হয়ে উঠেছে।

পাগল? নাতাশা কথাটা আবার বলল।

আমার নিজের কথা কিছুটা তোমাকে বলছি। আমার একটি জ্ঞাতিভাই ছিল…

আমি জানি! সিরিল মাভিচ…তিনি তো বুড়ো।

চিরদিন সে বুড়ো ছিল না। কিন্তু আমি এই করব নাতাশা, বরিসের সঙ্গে একবার কথা বলব। এত ঘন ঘন তার আসার দরকার নেই…

কিন্তু কেন, সে যদি আসতে চায়…

কারণ আমি জানি যে শেষপর্যন্ত এতে কিছুই লাভ হবে না…

তুমি কি করে জান? না মামণি, তার সঙ্গে কথা বল না! যত সব বাজে কথা! নাতাশা এমনভাবে কথা বলল যেন একটা সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বেশ তো, আমি তাকে বিয়ে করব না, কিন্তু আসতে যদি তার ভালো লাগে, আমারও ভালো লাগে, তাহলে তাকে আসতে দাও। নাতাশা হেসে মার দিকে তাকাল। বিয়ে নয়, কিন্তু ঠিক বিয়ের মতো, সে যোগ করল।

বিয়ের মতো, সেটা কি বাছা?

 বিয়ের মতো। তাকে বিয়ে করার কোনো দরকার নেই। কিন্তু…বিয়ের মতো।

বিয়ের মতো, বিয়ের মতো, কথাটা বারকয়েক আউড়ে কাউন্টেস হঠাৎ খোশ মেজাজে, অপ্রত্যাশিতভাবে, বুড়োদের মতো করে হেসে উঠল।

হেসো না, থাম! নাতাশা চেঁচিয়ে বলল। গোটা বিছানাটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছ! তুমি একেবারে আমার মতো, ঠিক আমার মতোই আর এক হাসির হররা।…দাঁড়াও…কাউন্টেসের দুই হাত ধরে সে কড়ে আঙুলের গাঁটে চুমো খেয়ে বলল, জুন, তারপর অন্য হাতে চুমো খেতে খেতে বলল, জুলাই, আগস্ট…কিন্তু মামণি, সে কি খুবই প্রেমে পড়েছে। তোমার কি মনে হয়? কেউ কি কোনোদিন তোমার এতখানি প্রেমে পড়েছিল সে তো খুব ভালো, খুব, খুব ভালো। শুধু ঠিক আমার মনের মতো নয়–তার মনটা এত সংকীর্ণ, ঠিক খাবার ঘরের ঘড়িটার মতো…বুঝতে পারলে না? সংকীর্ণ, জান তো-ধূসর, হাল্কা ধূসর…

কী বাজে কথা বলছ! কাউন্টেস বলল।

 নাতাশা বলেই চলল :

তুমি সত্যি বুঝতে পারছ না? নিকলাস হলে বুঝত…বেজুখভ এখন নীল, গাঢ় নীল ও লাল (শরীরতত্ত্ববিদরা জানেন, শব্দ মানুষের কাছে রঙের তাৎপর্য বহন করে থাকে), আর সে তো সরল মানুষ।

কাউন্টে হেসে বলল, তুমি তো তার সঙ্গেও ঢলাঢলি কর।

না, সে যে ভ্রাতৃসংঘের সদস্য সেটা আমি জেনে ফেলেছি। সে ভালো মানুষ, গাঢ় নীল ও লাল…তোমাকে কেমন করে যে বোঝাব?

দরজার ওপাশ থেকে কাউন্টের গলা শোনা গেল, ছোট কাউন্টেস! ঘুমিয়ে পড়নি তো? নাতাশা লাফ দিয়ে উঠে চটি হাতে নিয়ে একদৌড়ে খালি পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার ঘুম এল না। সে ভাবতে লাগল, সে যা বোঝে, তার মধ্যে যা কিছু আছে তা কেউ বুঝতে পারে না।

চেরুবিনির লেখা তার প্রিয় অপেরার একটুকরো গুন গুন করতে করতে সে বিছানায় এলিয়ে পড়ল, অচিরেই ঘুম আসবে এই মধুর চিন্তায় হাসতে লাগল। দাসী দুনিয়াশাকে ডেকে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিতে বলল, আর দুনিয়াশা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগেই সে নিজে চলে গেল আর এক সুখের স্বপ্ন-জগতে যেখানে সবকিছুই হাল্কা আর সুন্দর, হয়তো আলাদা বলেই আরো বেশি সুন্দর।

.

পরদিন বরিসকে একান্তে ডেকে কাউন্টেস তার সঙ্গে কথা বলল। তারপর থেকেই সে রস্তভদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিল।

.

অধ্যায়-১৪

১৮১০ সালের নববর্ষের পূর্ব সায়াহ্ন ৩১শে ডিসেম্বরে ক্যাথারিনের সময়কার এক বুড়ো জমিদার একটি বল নাচ ও মধ্যরাত্রিক ভোজনের আয়োজন করল। কূটনৈতিক মহলের ব্যক্তিরা এবং সম্রাট স্বয়ং সেখানে হাজির হবে।

ইংলিশ জাহাজঘাটার উপর অবস্থিত জমিদারের বিখ্যাত প্রাসাদটি অসংখ্য আলোয় ঝলমল করছে। উজ্জ্বলরূপে আলোকিত ফটকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, সেখানে পাতা হয়েছে লাল কার্পেট, আর শুধু সৈনিকরা নয়, ডজন-ডজন পুলিশ-অফিসার এমন কি স্বয়ং পুলিশ-মাস্টার পর্যন্ত ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে নামছে ইউনিফর্ম, তারকা ও ফিতেয় সজ্জিত পুরুষের দল, আর মহিলারা সাটিন ও সাদা লোমের পোশাক পরে গাড়ি থেকে সাবধানে নেমেই দ্রুত অথচ নিঃশব্দ পায়ে কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

যতবার একটা নতুন গাড়ি আসছে প্রায় ততবারই ভিড়ের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠছে, আর সকলেই টুপি খুলছে।

সম্রাট কি?…না, একজন মন্ত্রী…প্রিন্স…রাষ্ট্রদূত। পালক দেখছ না?

…জনতার কণ্ঠে ফিসফিস কথা।

অন্য সকলের চাইতে বেশি সুসজ্জিত একজন অতিথি তো উচ্চপদস্থ অনেকেরই নাম ধরে ডাকতে লাগল, মনে হল সে প্রায় সকলকেই চেনে।

অতিথিদের এক-তৃতীয়াংশ এর মধ্যেই এসে গেছে, কিন্তু রস্তভরা এখনো সাজগোজ নিয়েই ব্যস্ত।

এই বল-নাচকে কেন্দ্র করে রস্তভ পরিবারে অনেক আলোচনা ও প্রস্তুতি চলেছে। হয়তো আমন্ত্রণই আসবে না, পোশাক-পরিচ্ছদই হয় তো তৈরি হবে না, অথবা যেমনটি হওয়া উচিত তেমন ব্যস্থাটি করা যাবে না।

নাতাশা এই প্রথম বড় মাপের বল-নাচে যাচ্ছে। সকাল আটটায় সে ঘুম থেকে উঠেছে, সারাটা দিন প্রবল উত্তেজনা ও কাজকর্মের মধ্যে কেটেছে। সকাল থেকে একটা ব্যাপারেই তার সকল শক্তি নিয়োগ করেছে, তারা সকলেই সে নিজে, ও মামণি তো তার হাতেই নিজেদের সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছে। সোনিয়া সাজগোজ করে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। একটা পিন আটকাতে গিয়ে তার সুন্দর আঙুলে লাগতেই সে চেঁচিয়ে উঠল ।

ওভাবে নয় সোনিয়া, ওভাবে নয়! মাথাটা ঘুরিয়ে নাতাশা চেঁচিয়ে বলল। বো-টা ঠিক হয়নি। এখানে এস!

সোনিয়া বসে পড়ল, নাতাশা অন্যভাবে পিন দিয়ে ফিতেটা আটকে দিল।

 দাসী নাতাশার চুল বেঁদে দিচ্ছিল। সে বলল, আমাকে দেখিয়ে দাও মিস! আমি ওভাবে করতে পারি না।

আহা বাপু! তাহলে অপেক্ষা কর। ঠিক আছে সোনিয়া।

তোমরা এখনো তৈরি হওনি? প্রায় দশটা বাজে, কাউন্টেসের গলা শোনা গেল।

এই হয়ে গেল! এই হয়ে গেল। আর তুমি মামণি?

আমার শুধু টুপিটা আটকানো বাকি।

নাতাশা বলল, ওটা আমাকে ছাড়া করো না। তুমি ঠিকমতো পারবে না।

 কিন্তু দশটা যে বাজে।

তোমরা কখন তৈরি হবে? দরজার কাছে এসে কাউন্ট শুধাল। এই যে আতরটা নাও। পেরোনস্কায়া নিশ্চয় বসে বসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কাউন্টেসের বান্ধবী পেরোনস্কায়াকে পথে তুলে নিয়ে যাবার কথা আছে।

নাতাশা পোশাক পরতে শুরু করল।

কাউন্ট দরজাটা খুলতেই সে চেঁচিয়ে উঠল, এক মিনিট! এক মিনিট! বাপি, ভিতরে এস না!

 সোনিয়া সশব্দে দরজাটা ঠেলে দিল। এক মিনিট পরে কাউন্টকে ঢুকতে দিল।

তার পরনে নীল রংয়ের চাতক পাখির লেজওয়ালা কোট, জুতো, মোজা, গায়ে আতর মেখেছে, আর চুলে পমেড।

জামার ভাঁজ পালিশ করতে করতে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নাতাশা বলে উঠল, আঃ, বাপি! তোমাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! চমৎকার!

ঠিক সেইমুহূর্তে আস্তে পা ফেলে সলজ্জ ভঙ্গিতে কাউন্টেস ঘরে ঢুকল, মাথায় টুপি, পরনে ভেলভেট গাউন।

উ-উ, সুন্দরী আমার! কাউন্ট উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠল, ওকে তো তোমাদের সকলের চাইতে ভালো দেখাচ্ছে।

কাউন্ট হয় তো তাকে জড়িয়ে ধরত, কিন্তু পাছে পোশাক কুঁচকে যায় এই ভয়ে কাউন্টেস লজ্জায় সরে গেল।

সাজপোশাক সেরে শেষপর্যন্ত সোয়া দশটার সময় তারা গাড়িতে চেপে রওনা হল। এখনো তরিদা বাগান থেকে পেরোনস্কায়াকে তুলে নেওয়া বাকি আছে।

পেরোনস্কায়া তৈরি হয়েই ছিল। বয়স হলেও সেও রস্তভদের মতো এই প্রথায় সাজগোজ করেছে। কুশ্রী বুড়ো শরীরটাকে ধধায়ামোছা করেছে, আতর মেখেছে, পাউডার ঘষেছে। বান্ধবী তার সাজপোশাকের প্রশংসা করল। সেও রস্তভদের সাজগোজের প্রশংসা করল। সকলের চুলের বিনুনি ও পোশাক আর একবার ঠিকঠাক করে নিয়ে এগারোটার সময় তারা গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি ছেড়ে দিল।

.

অধ্যায়-১৫

ভোর থেকে নাতাশার একমুহূর্ত সময় হাতে ছিল না, আর তার সামনে কি অপেক্ষা করে আছে সে একবারও ভাববার সময় পায়নি।

বাইরে ঠাণ্ডা ভিজে হাওয়ায় এবং ভিতরে লোকে-ঠাসা গাড়ির দুলুনিতে এই সে প্রথম পরিষ্কার করে ভাববার সময় পেল সেখানে বল-নাচের আসরে-গান, ফুল, নাচ, সম্রাট এবং পিটার্সবুর্গের সব ঝকঝকে যুবকদের মধ্যে সেই সব আলোকিত উজ্জ্বল ঘরের মধ্যে তার ভাগ্যেও কি ঘটতে পারে। সেখানে যেসব ভালো ঘটনা ঘটতে পারে তা এই ঠাণ্ডা অন্ধকার আর গাড়ির ভিড়ের সঙ্গে বেমানান যে বিশ্বাস করাই শক্ত। ফটকের লাল কার্পেটের উপর পা ফেলে সে যখন হল-ঘরে ঢুকল, লোমের জোব্বাটা খুলে ফেলল, এবং সোনিয়াকে পাশে নিয়ে মার আগে আগে উজ্জ্বল আলোকিত সিঁড়ির ফুলেঢাকা ধাপগুলিতে পা দিতেই সে যেন বুঝতে পারল বল-নাচে তাকে কীভাবে চলতে হবে, আর সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবেশে যে গাম্ভীর্যপূর্ণ ভঙ্গিমা একটি মেয়ের পক্ষে অপরিহার্য বলে মনে হল, নিজের আচরণে সেই ভঙ্গিমাটি ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হল।

নাতাশা আয়নায় নিজেকে দেখতে পেল, কিন্তু অন্যের প্রতিচ্ছবি থেকে নিজেকে আলাদা করে চিনতেই পারল না। সব যেন মিলেমিশে একটা মিছিলের সামিল হয়ে গেছে। নাচঘরে ঢুকে লোকের কলগুঞ্জন, পায়ের শব্দ, আর আপ্যায়নে তার কানে তালা লেগে গেল, আলো ঝলমলানি তার চোখকে আরো বেশি করে ধাধিয়ে দিল। গৃহকর্তা ও গৃহকত্রী আধঘণ্টা ধরে দরজায় দাঁড়িয়ে একই কথা আপনাকে দেখে খুশি হলাম বলে সকলকেই অভ্যর্থনা করছে, সেই একইভাবে রস্তভদের ও পেরোনস্কায়াকেও অভ্যর্থনা জানাল।

নাচঘরে অতিথিরা ম্রাটের প্রতীক্ষায় দরজার কাছে ভিড় জমিয়েছে। কাউন্টেস নিজের জন্য ভিড়ের একেবারে সামনের সারিতে একটা জায়গা করে নিয়েছে। সব দেখেশুনে নাতাশা বুঝতে পারল, বেশ কয়েকজন তার কথা জিজ্ঞাসা করছে, তাকে দেখছে। সে আরো বুঝল, যারা তাকে দেখছে তারাই তাকে পছন্দ করছে, এতে তার মন বেশ শান্ত হল।

ভাবল, কেউ কেউ আমাদেরই মতো, আবার কেউ বা খারাপ।

 পেয়োনায়া নাচের আসরে সমবেত বড় বড় লোকদের দিকে আঙুল বাড়িয়ে কাউন্টেসকে দেখাচ্ছে।

দেখতে পাচ্ছ? উনি হচ্ছেন হল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত! ঐ যে পাকাচুল মাথায় লোকটি।

হেলেনকে দেখিয়ে বলল, এই তো এসে পড়েছে পিটার্সবুর্গের রানী কাউন্টেস বেজুখভা। কী সুন্দর! একেবারে মারিয়া আন্তনভনার সমক্ষক। দেখ, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই তাকে সম্মান দেখাচ্ছে। যেমন সুন্দরী, তেমনি চটপটে…লোকে বলে প্রিন্স–তার জন্য একেবারে পাগল। আর ঐ দুটিকে দেখ, দেখতে সুশ্রী না হলেও অনেকেই ওদের পিছনে ছোটে।

সাদাসিধে পোশাকের মেয়েকে নিয়ে একটি মহিলা ঘরটা পার হয়ে গেল, তাদের দেখিয়েই পেরোনস্কায়া শেষের কথাগুলি বলল।

কলাইকুর্তকে দেখিয়ে কাউন্টেস তার পরিচয় জানতে চাইলে পেরোনস্কায়া বলল, আরে, উনি তো স্বয়ং ফরাসি রাষ্ট্রদূত! দেখ না, ঠিক যেন রাজা। যাই বল, ফরাসিরা মনোরম, খুব মনোরম। আর-এই তো তিনি-সকলের সেরা সুন্দরী আমাদের মারিয়া আন্তনভনা! কী সাদাসিধে পোশাক! চমৎকার! আর চশমা-পরা ঐ শক্তসমর্থ মানুষটি, পিয়েরকে দেখিয়ে সে বলতে লাগল, উনি হলেন ভ্রাতৃসংঘের সদস্য। স্ত্রীর পাশে ওকে দাঁড় করিয়ে দেখ, মনে হবে যেন একটি ভাঁড়।

নাতাশা সানন্দে পিয়েরের পরিচিত মুখের দিকে তাকাল। সে জানে, পিয়ের তাদেরই খোঁজ করছে, বিশেষ করে তার। সে কথা দিয়েছে, বল-নাচে উপস্থিত থেকে তার নাচের জুটি ঠিক করে দেবে।

কিন্তু তাদের কাছে আসবার আগেই পিয়ের একটি সুদর্শন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। লোকটির উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রং গাঢ়, পরনে সাদা ইউনিফর্ম, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে তারকা ও ফিতেয় সজ্জিত একটি লোকের সঙ্গে কথা বলছে। সাদা ইউনিফর্মের বেঁটে যুবকটিকে দেখেই নাতাশা চিনতে পারল : সে বলকনস্কি, নাতাশার মনে হল সে আগের চাইতে আরো কমবয়সী, আরো সুখী এবং আরো সুদর্শন হয়ে উঠেছে।

প্রিন্স আন্দ্রুকে দেখিয়ে নাতাশা বলল, দেখতে পাচ্ছ মামণি, আরো একজনকে আমরা চিনি-বলকনস্কি তোমার মনে আছে অত্রাদণুতে একটা রাত সে আমাদের বাড়িতে কাটিয়েছিল?

পেরোনস্কায়া বলল, আরে, তোমরা ওকে চেন? আমি ওকে সহ্য করতে পারি না। এখন তো ভালো-মন্দ আবহাওয়া সবই ওর উপর নির্ভর করে। লোকটি বড়ই অহংকারী। ঠিক বাবার মতো। স্পেরোনস্কির সঙ্গে খুব দহরম মহরম, কোনোনা কোনো প্রকল্প লেখার কাজ নিয়েই আছে। দেখ না, মহিলাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছে। যে কেউ কথা বলতে যাচ্ছে অমনি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমার সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করলে ঢিট করে দিতাম।

.

অধ্যায়-১৬

হঠাৎ সকলে নড়েচড়ে উঠল, কথা বলতে শুরু করল, একবার এগিয়ে গেল, আবার পিছিয়ে এল, এবং এইভাবে সমবেত সকলে দুই দিকে সরে যাওয়ায় তার ভিতর দিয়ে সম্রাট প্রবেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে বাজনা শুরু হয়ে গেল। তার পিছনেই প্রবেশ করল গৃহকর্তা ও গৃহকত্রী। একবার ডাইনে, একবার বয়ে মাথা নোয়াতে নোয়াতে সম্রাট দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগল, যেন অভ্যর্থনার প্রাথমিক মুহূর্তগুলিকে তাড়াতাড়ি শেষ করাই তার ইচ্ছা। আলেক্সান্দার, এলিসাবেতা, আমাদের সকলের হৃদয় আপনি হরণ করেছেন-এই কথার তালে তালে তৎক্কালে প্রচলিত পলোনেসের ব্যান্ড বাজতে লাগল। সম্রাট বসবার ঘরে চলে গেল, একদল লোক উত্তেজিত মুখে সেখানে ঢুকেই আবার পিছিয়ে এল। সাজপোশাকের ক্ষতি হবে জেনেও কিছু মহিলা ভদ্রতার সীমা ভুলে গিয়ে সেইদিকে এগিয়ে গেল। এদিকে পুরুষরা যার যার জুটি বেছে নিয়ে পলোনেস নাচের জন্য জায়গা বেছে নিতে শুরু করে দিল।

সকলে সরে দাঁড়াল, গৃহকত্রীর হাত ধরে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল সম্রাট, তার পা তখন আর বাজনার তালে তালে পড়ছে না। তাদের পিছনে গৃহকর্তা ঢুকল মারিয়া আন্তনভনা নারিস্কিনাকে সঙ্গে নিয়ে, তারপর একে একে ঢুকল যত রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রী ও সেনাপতির দল, পেরোনস্কায়া অনেক কষ্টে তাদের প্রত্যেকের নাম বলে যেতে লাগল। বেশির ভাগ মহিলা ইতিমধ্যে তাদের জুটি বেছে নিয়ে পলোনেস-নাচের জন্য তৈরি হয়ে গেছে। নাতাশার মনে হল, কেউ তাকে নাচে ডাকবে না, যে অল্পকিছু মহিলা দেয়ালের কাছে ভিড় করে আছে, মা ও সোনিয়াকে নিয়ে তাকেও সেখানেই পড়ে থাকতে হবে। দুর্বল হাত দুটি নামিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল, তার অনুন্নত বুকটা নিয়মিত উঠছে-নামছে। রুদ্ধশ্বাসে ভীত, চকিতদৃষ্টি সম্মুখে প্রসারিত করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যেন চূড়ান্ত সুখ বা দুঃখের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। সম্রাটকে নিয়ে, অথবা যেসব মহারথীদের নাম পেরোনস্কায়া ঘোষণা করছে তাদের নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই-তার মনে একটিমাত্র চিন্তা : এও কি সম্ভব যে কেউ আমাকে ডাকবে না, প্রথম যারা নাচবে তাদের একজন আমি হতে পারব না? এও কি সম্ভব যে এত লোকের মধ্যে একজনও আমার দিকে নজর ফেরাবে না? মনে হচ্ছে, তারা যেন আমাকে দেখতেই পাচ্ছে না, অথবা দেখতে পেলেও তারা এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন বলতে চাইছে: আহা, আমি যাদের খুঁজছি এ তো তাদের কেউ নয়, কাজেই তার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই! না, এ অসম্ভব। নাচবার যে আমার কত ইচ্ছা, আমি যে কী চমৎকার নাচতে পারি, আমার সঙ্গে নাচলে তাদের যে কত ভালো লাগবে, এসব তাদের জানাতেই হবে।

পলোনেসের যে সুর অনেকক্ষণ ধরে বাজছে এবার যেন সেটা নাতাশার কানে দুঃখের স্মৃতি হয়ে বাজতে শুরু করেছে। তার কান্না পেল। পেরোনস্কায়া তাদের রেখে অন্যত্র গেছে। কাউন্ট গেছে ঘরের অপর কোণে। সে, কাউন্টেস ও সোনিয়া যেন একলা দাঁড়িয়ে আছে একটা গভীর জঙ্গলের মধ্যে, চারদিকে অপরিচিত মানুষের ভিড়, তাদের প্রতি কারো কোনো আগ্রহ নেই, কেউ তাদের চাইছে না। একটি মহিলাকে নিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু পাশ দিয়ে চলে গেল, তাদের চিনতেই পারল না। সুদর্শন আনাতোল সঙ্গিনীকে বাহুবন্ধনে ধরে তার সঙ্গে কথা বলছে, আর এমনভাবে নাতাশার দিকে তাকাচ্ছে যেন সে একটা দেয়ালমাত্র। বরিস দুইবার তাদের পাশ দিয়ে গেল, প্রতিবারই মুখটা ঘুরিয়ে নিল। বের্গ ও তার স্ত্রী তাদের দিকে এগিলে এল।

এই পারিবারিক জমায়েতটা নাতাশার কাছে অসম্মানকর মনে হতে লাগল-যেন কথা বলবার জন্য তাদের এখানে আসা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ভেরা নিজের সবুজ পোশাকটা সম্পর্কে কি যেন বলছিল, নাতাশা তাতে কানই দিল না।

অবশেষে সম্রাট তার শেষ জুটির পাশে থেমে গেল (তিনজনের সঙ্গে তার নাচ হয়ে গেছে), সঙ্গে সঙ্গে বাজনাও থেমে গেল। একজন বিব্রত এড-ডি-কং রস্তভদের কাছে ছুটে এসে তাদের আরো পিছনে সরে যেতে বলল, অথচ তারা তখন প্রায় দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। গ্যালারি থেকে ভালসের মধুর সুর ভেসে এল। সম্রাট হাসিমুখে নাচঘরের দিকে তাকাল। এক মিনিট পার হয়ে গেল, কিন্তু কেউ নাচ শুরু করল না। একজন এড় ডি-কং কাউন্টেস বেজুখভার কাছে গিয়ে তাকে নাচতে বলল। সেও হেসে তার কাঁধে হাত রাখল, একবার ফিরেও দেখল না সে কে। এড-ডি-কংটি নাচের ব্যাপারে খুব ওস্তাদ, সঙ্গিনীটির কোমরটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রথমে ধীরে ধীরে বৃত্তের প্রান্ত ঘেঁষে একপাক ঘুরে নিয়ে ঘরের একটা কোণে গিয়ে হেলেনের বাঁ হাতটা ধরে তাকে ঘুরিয়ে দিল, দ্রুততালের বাজনার শব্দ ছাড়া একমাত্র শব্দ শোনা যেতে লাগল তার কাটা-মারা জুতোর অনায়াস সহজ গতির সুরেলা ঠুকঠুক আওয়াজ, আর প্রতি তৃতীয় তালটির সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গিনীটি ঘুরে যেতে লাগল এবং তার ভেলভেটের পোশাক বাতাসে উড়তে লাগল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নাতাশার কান্না পেয়ে গেল, কারণ ভালস-নাচের প্রথম নাচটাও তার কপালে জুটল না।

অশ্বারোহী কর্নেলের সাদা ইউনিফর্ম, মোজা ও নাচের জুতো পরে প্রিন্স আন্দ্রু রস্তভদের থেকে অনেক দূরে দীপ্ত মুখে একেবারে সামনের সারিতেই দাঁড়িয়েছিল। পরের দিন রাষ্ট্রীয় পরিষদের যে প্রথম অধিবেশন বসবে সে সম্পর্কে ব্যারন ফিরহপ তার সঙ্গে কথা বলছিল। প্রিন্স আন্দ্রু কিন্তু ফিরহপের কথায় কান না দিয়ে একবার সম্রাটকে, আর একবার নাচে অংশগ্রহণেচ্ছু লোকদেরই দেখছিল।

পিয়ের এগিয়ে এসে তার হাত ধরল।

তুমি তো সর্বত্রই নাচ। এখানে আমার একটি পরিচিতা আছে-তরুণী রস্তভা। তাকে ডেকে নাও, সে বলল।

কোথায় তিনি? বলকনস্কি শুধাল, তারপর ব্যারনের দিকে ঘুরে বলল, মাফ করবেন–ও আলোচনাটা অন্য সময় শেষ করা যাবে–বলনাচে এসে নাচটাই আগে। পিয়েরের ইঙ্গিতে সে এগিয়ে গেল। নাতাশার মুখের হতাশ, বিষণ্ণ ভাবটা তার চোখে পড়ল। সে নাতাশাকে চিনতে পারল, তার মনের কথাটা অনুমানে বুঝে নিল, বুঝল যে এ ধরনের আসরে এই তার প্রথম আবির্ভাব, জানালার পাশে তার কথাগুলি মনে পড়ল, মুখে একটা খুশির ভাব ফুটিয়ে সে কাউন্টেস রস্তভার দিকে এগিয়ে গেল।

কাউন্টেস বলল, আমার মেয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।

তার কঠোর ব্যবহার সম্পর্কে পেরোনস্কায়ার মন্তব্যকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু অত্যন্ত ভদ্রভাবে মাথাটা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে বলল, কাউন্টেসের যদি স্মরণ থেকে থাকে তো বলি, পরিচয়ের সৌভাগ্য আমার আগেই হয়েছে। নাতাশার দিকে এগিয়ে গিয়ে নাচের আমন্ত্রণ জানানোর কাজটা শেষ না করেই সে নাতাশার কোমর জড়িয়ে ধরবার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল। ভালস নাচের আমন্ত্রণ। নাতাশার মুখের কাঁপা ভাবটা সরে গিয়ে হঠাৎ সেখানে ফুটে উঠল সকৃতজ্ঞ খুশির শিশুর মতো হাসি।

প্রিন্স আন্দ্রুর কাঁধে হাতটা রাখতে গিয়ে শংকার চোখের জলের পরিবর্তে যে হাসি সে হাসল তা যেন বলতে চাইল, তোমার জন্য আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আছি। নাচের আসরে প্রবেশকারী তারাই দ্বিতীয় জুটি। প্রিন্স আন্দ্রু সেসময়কার শ্রেষ্ঠ নাচিয়েদের একজন, আর নাতাশাও চমৎকার নাচে। সাটিনের নাচের জুতো পরা তার ছোট পা দুইখানি দ্রুত লয়ে, হাল্কা চালে নাচতে লাগল, আর তার মুখটা উচ্ছ্বসিত আনন্দে ঝলমল করতে লাগল। প্রিন্স আন্দ্রুন্দ্ৰ নাচতে ভালোবাসে, রাজনৈতিক ও চটুল আলোচনায় সকলে তাকে যেভাবে ঘিরে ধরেছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার হাত থেকে পালাবার জন্যই সে নাচতে শুরু করেছে, আর পিয়ের নাতাশাকে দেখিয়ে দিয়েছে বলেই সে তাকে বেছে নিয়েছে, তাছাড়া, এই সুন্দরী মেয়েটিই প্রথম তার চো খেও পড়েছে, কিন্তু তার সেই নরম, ক্ষীণ তনুটিকে জড়িয়ে ধরে, তার দেহের নৈকট্য অনুভব করে ও এত কাছে থেকে তাকে হাসতে দেখে নাতাশার আকর্ষণের সুরা যেন একেবারে তার মাথায় উঠে গেল, এবং নাচের শেষে তাকে ছেড়ে দিয়ে সে যখন জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে অন্যদের নাচ দেখতে লাগল তখন তার মনে হল সে বুঝি নতুন জন্ম, নবীন যৌবন লাভ করেছে।

.

অধ্যায়-১৭

প্রিন্স আন্দ্রুর পরে বরিস এসে নাতাশাকে তার সঙ্গে নাচতে বলল, তারপর এল সেই এড-ডি-কং যে আসরের উদ্বোধন করেছিল, আর তারপরে আরো কয়েকটি যুবক, ফলে বাড়তি জুটিদের সোনিয়াকে দিয়ে রক্তিম মুখে, খুশিভরা মনে নাতাশা সারাটা সন্ধ্যা একটানা নেচে গেল। অন্য কে কি করল না করল সে-দিকে সে চোখ কান কিছুই দিল না। আহারের আগে একটা মজার সমবেত নাচে প্রিন্স আন্দ্রু আবার তার জুটি হল। সেইসময় প্রিন্স আন্দ্রু নাতাশাকে স্মরণ করিয়ে দিল, অত্রানুর পথে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, সেই জ্যোৎস্না রাতে নাতাশা একটুও ঘুমতে পারেনি, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সব কথা সে লুকিয়ে শুনে ফেলেছিল। সেসব কথা মনে পড়ায় নাতাশার মুখ লাল হয়ে উঠল, যেন এর মধ্যে লজ্জা পাবার মতো কিছু আছে।

যেসব পুরুষ মানুষ সমাজের উঁচু মহলের মধ্যে বড় হয়ে ওঠে তাদের সকলের মতোই প্রিন্স আন্দ্রুও এমন কাউকেই পছন্দ করে যার উপর তথাকথিত সমাজের ছাপ পড়েনি। ঠিক তেমনি মেয়ে নাতাশা, তার বিস্ময়, তার খুশি, তার লজ্জা, এমন কি তার ভুল করে ফরাসি বলাটাও আর পছন্দ। বিশেষ যত্ন ও আদরের সঙ্গে সে নাতাশার সঙ্গে ব্যবহার করল, তার পাশে বসে খুব সরল ও সাধারণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করল, তা চোখের দৃষ্টি ও মুখের হাসির সানন্দ উজ্জ্বলতার প্রশংসা করল। অপর একজন নাচিয়ে যখন তাকে বেছে নিয়ে ঘরময় নাচতে লাগল তখনো প্রিন্স আন্দ্রু তার সলজ্জ মাধুর্যের প্রশংসা করতে লাগল। মজলিসের মাঝামাঝি সময়ে নাতাশা যখন হাঁপিয়ে উঠে তার আসনে ফিরে যাচ্ছিল তখন আর একটি নাচিয়ে এসে তাকে নাচতে ডাকল। নাতাশা তখন ক্লান্ত, হাঁপাচ্ছে, একবার ভাবল লোকটিকে ফিরিয়ে দেবে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হেসে লোকটির কাঁধে হাত রাখল।

আপনার পাশে বসে একটু বিশ্রাম নিতে পারলে খুশি হতাম : আমি ক্লান্ত, কিন্তু দেখছেন তো সকলেই আমাকে নাচতে ডাকছে, আর সেটা আমার ভালোই লাগছে। আমি খুশি, সকলকেই ভালোবাসি, আপনি আর আমিই তো একথা জানি। মুখের কথার চাইতে তার হাসিটা অনেক বেশি কথা বলল। সঙ্গীটি চলে গেলে সে দুটি মহিলাকে বেছে নিতে ছুটে গেল।

সে যদি প্রথমে তার জ্ঞাতি দিদির কাছে যায় এবং তারপরে যায় অন্য মহিলাটির কাছে তাহলে সে আমার স্ত্রী হবে, মনে মনে কথাটা বলেই প্রিন্স আন্দ্রু অবাক হয়ে গেল। নাতাশা কিন্তু প্রথমে দিদির কাছে গেল না।

এক এক সময় কী যে আজেবাজে কথা মাথার মধ্যে ঢোকে! প্রিন্স আন্দ্রু ভাবল, কিন্তু একটা কথা ঠিক যে মেয়েটি এতই মনোরমা, এতই কচি যে একমাস নাচবার আগেই তার বিয়ে হয়ে যাবে…ওর মতো মেয়ে এখানে বিরল। বডিসের উপর থেকে খসেপড়া গোলাপটাকে ঠিক জায়গায় আটকাতে আটকাতে নাতাশা তার পাশেই এসে বসল।

মজলিস শেষ হয়ে গেলে বুড়ো কাউন্ট তার নীল কোট পরে নাচিয়েদের কাছে এল। প্রিন্স আন্দ্রুকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাল, আর মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল তার বেশ ভালো লেগেছে কি না। নাতাশা সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিল না, শুধু মুখ তুলে হাসল, সে হাসি যেন তিরস্কার করে বলল : এরকম প্রশ্ন তুমি করলে কেমন করে?

মুখে বলল, এত ভালো আগে আর কখনো লাগেনি! প্রিন্স আন্দ্রু দেখল, তার সরু হাত দুটি বাবাকে আলিঙ্গন করতে উঠেই আবার তৎক্ষণাৎ নেমে গেল। আজ নাতাশা যত সুখী হয়েছে এমনটা জীবনে আর কখনো হয়নি। সেই সুখের স্বর্গে সে উঠে গেছে যেখানে গেলে মানুষ সম্পূর্ণরূপে সদয় ও সৎ হয়ে ওঠে, পাপ, সুখের অভাব অথবা দুঃখের সম্ভাবনাকে পর্যন্ত বিশ্বাস করে না।

.

দরবার মহলে তার স্ত্রীর যে স্থান তা দেখে এই বল-নাচেই পিয়ের সর্বপ্রথম খুব অপমানিত বোধ করল। সে যেন কেমন বিষণ্ণ ও উদাসীন হয়ে পড়ল। তার কপাল জুড়ে একটা গভীর খাঁজ দেখা দিল, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে চশমার ফাঁক দিয়ে দূরে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কারো দিকে নজর দিল না।

খেতে যাবার পথে নাতাশা তার পাশ দিয়ে যাবার সময় পিয়েরের বিষণ্ণ, দুঃখী দৃষ্টি দেখে থমকে দাঁড়াল। পিয়েরকে সাহায্য করবার, নিজের সুখের প্রাচুর্য দিয়ে তাকে ঢেকে রাখবার বাসনা জাগল মনে।

বলল, কী সুখের ব্যাপার! তাই না কাউন্ট?

তার কথার অর্থ না বুঝেই পিয়ের অন্যমনস্কভাবে হাসল।

হ্যাঁ, আমি খুব খুশি, সে বলল।

নাতাশা ভাবল, কোনোকিছু নিয়ে মানুষ অখুশি হয় কেমন করে? বিশেষ করে বেজুখভের মতো এমন একজন বড়দরের মানুষ! নাতাশার চোখে নাচের আসরের সব মানুষই সমান ভালো, দয়ালু ও সহৃদয়, সকলেই পরস্পরকে ভালোবাসে, কেউ কারো ক্ষতি করতেই পারে না–আর তাই সকলেরই সুখী হওয়া উচিত।

.

 অধ্যায়-১৮

পরদিন প্রিন্স আন্দ্রু বল-নাচের কথা চিন্তা করতে লাগল, কিন্তু সে চিন্তা বেশিক্ষণ তার মনে থাকল না। যা, নাচের আসরটা চমৎকার হয়েছিল, আর তার পরেই…যা, ছোট্ট রস্তভা খুবই মনোরমা। তার মধ্যে এমন কিছু তাজা, কচি ও পিটার্সবুর্গ-অসুলভ ভাব আছে যেটা একান্তভাবে তারই বৈশিষ্ট্য। গতকালের নাচের ব্যাপারে তার ভাবনা-চিন্তা ওই পর্যন্তই, তার পরেই সকালের চা খেয়ে সে কাজে মন দিল।

কিন্তু ক্লান্তির জন্যই হোক আর অন্দ্রিার জন্যই হোক, কাজে মন বসল না, ফলে কোনো কাজই হল না। সে বসে বসে নিজের কাজের সমালোচনা শুরু করল, আর ঠিক তখনই কারো আসার শব্দ শুনে খুশি হয়ে উঠল।

আগন্তুক বিৎস্কি, লোকটি নানা কমিটিতে কাজ করে, পিটার্সবুর্গের সবরকম মহলে চলাফেরা করে, নতুন ধ্যান-ধারণা ও স্পেরানস্কির একজন অনুরাগী ভক্ত, এবং পিটার্সবুর্গের পরিশ্রমী সংবাদসগ্রাহকদের একজন। কোনোরকমে টুপিটা রেখেই সে ছুটে গেল প্রিন্স আন্দ্রুর ঘরে, সঙ্গে সঙ্গে বকবক করতে শুরু করল। রাষ্ট্রীয় পরিষদের প্রাতঃকালীন অধিবেশন ও সম্রাট কর্তৃক উদ্বোধনের কথা সে এইমাত্র শুনে এসেছে, সেই কথাই সে সবিস্তারে বলতে লাগল। সম্রাট একটি অসাধারণ ভাষণ দিয়েছে। এ রকম ভাষণ একমাত্র নিয়মতান্ত্রিক সম্রাটরাই দিতে পারে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আজকের ঘটনা একটি যুগান্তের সূচনা করেছে, এটি আমাদের ইতিহাসের সবচাইতে যুগান্তকারী ঘটনা, এই বলে সে শেষ করল।

প্রিন্স আন্দ্রু মন দিয়ে সব কথা শুনল। একটা খুব সহজ চিন্তা তার মনে এল : রাষ্ট্ৰীয় পরিষদে সম্রাট দয়া করে কি বললেন তাতে আমার বা বিৎস্কির কি যায়-আসে? এতে কি আমার সুখ বাড়বে, না ভালো কিছু হবে?

এই সহজ চিন্তাটি সহসা আসন্ন সংস্কার-প্রচেষ্টাগুলি সম্পর্কে প্রিন্স আন্দ্রুর সব আগ্রহকে নষ্ট করে দিল। সেদিন সন্ধ্যায় অল্প কয়েকজন বন্ধুসহ তার স্পেরানস্কির বাড়িতে খাবার কথা আছে। যে মানুষটিকে সে এত শ্রদ্ধা করে তার গৃহ-পরিবেশে এই ভোজনের ব্যবস্থার প্রতি প্রিন্স আন্দ্রুর অপরিসীম আগ্রহ ছিল, বিশেষত আজ পর্যন্ত সে স্পেরানস্কিকে তার পারিবারিক পরিবেশে কখনো দেখেনি, কিন্তু এখন তার মনে সেখানে যাবার ব্যাপারে একটা অনিচ্ছা দেখা দিল।

যাই হোক, নির্দিষ্ট সময়ে সে স্পেরানস্কির তারিদা গার্ডেন্সের সাধারণ বাড়িটাতে হাজির হল। বাড়িটা ছোট হলেও খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন (একটা মঠের কথা মনে করিয়ে দেয়)। প্রিন্স আন্দ্রুর একটু দেরি হয়ে গেছে, সে যখন ঢুকল ততক্ষণে পাঁচটা নাগাদ পরিচিত বন্ধুজনরা এসে গেছে। স্পেরানস্কির ছোট মেয়ে ও তার শিক্ষয়িত্রী ছাড়া অন্য কোনো মহিলা সেখানে ছিল না। বাইরের ঘরে থাকতেই উঁচু গলার কথাবার্তা এবং একটা উচ্চগ্রামের হাসি-যে ধরনের হাসি রঙ্গমঞ্চেই শোনা যায়–প্রিন্স আন্দ্রুর কানে এল। কে যেন-গলাটা স্পেরানস্কির বলেই মনে হল-হো-হো করে হাসছে। স্পেরানস্কির বিখ্যাত হাসি প্রিন্স আন্দ্রু আগে কখনো শোনেনি, একজন কূটনীতিকের গলার এমন কলকণ্ঠ, জোরালো হাসি তার মনে একটা অদ্ভুত ভাবের সৃষ্টি করল।

সে খাবার ঘরে ঢুকল। দুটো জানালার মাঝখানে ছোট টেবিলেটাকে ঘিরে সকলেই দাঁড়িয়ে আছে। হাসতে হাসতেই স্পেরানস্কি তার নরম সাদা হাতটা প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে বাড়িয়ে দিল।

বলল, আপনাকে দেখে খুশি হলাম প্রিন্স। এক মিনিট… অন্যদের দিকে আমোদ-প্রমোদের জন্য, কাজকর্মের একটা কথাও এখানে বলা হবে না। এই বলে সে আবার হাসতে লাগল।

প্রিন্স আন্দ্রু বিস্ময়, বিষাদ ও মোহভঙ্গের সঙ্গে হাস্যমুখর স্পেরানস্কিকে দেখতে লাগল। তার মনে হল এ যেন স্পেরানস্কি নয়, অন্য কেউ। এর আগে স্পেরানস্কির যা কিছু তার কাছে মনে হতো রহস্যময় ও আকর্ষনীয়, হঠাৎ সে সবকিছুই অতি সাধারণ হয়ে উঠল, তার কোনো আকর্ষণই রইল না।

খাবার সময় মুহূর্তের জন্যও কথার বিরাম ঘটল না, মনে হল কোনো হাসি-তামাশার বইয়ের পাতা থেকে বুঝি সকলেই কথা বলছে। প্রিন্স আন্দ্রুও বারকয়েক আলোচনায় যোগ দিতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার কথাগুলিকে প্রতিবারই একপাশে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হল। তাদের মতো করে তামাশা করতে সে জানে না।

ডিনারের পরে স্পেরানস্কির মেয়ে ও তার শিক্ষয়িত্ৰী উঠে পড়ল। সাদা হাতে মেয়ের পিঠ চাপড়ে দিয়ে সে তাকে চুমো খেল। ভঙ্গিটাও প্রিন্স আন্দ্রুর কাছে অস্বাভাবিক ঠেকল।

অন্য সকলে টেবিলেই বসে থাকল সামনে পোর্টের বোতল নিয়ে–এটাই ইংরেজি কেতা। নেপোলিয়নের স্পেনসংক্রান্ত ব্যাপারের আলোচনায় সকলেই তাকে সমর্থন করলেও প্রিন্স আন্দ্রু ভিন্ন মত প্রকাশ করল। স্পেরানস্কি একটু হাসল, আর আলোচনাটা যাতে অপ্রীতিকর হয়ে না উঠতে পারে সেজন্য এমন একটা গল্প বলতে শুরু করল যার সঙ্গে পূর্বের আলোচনার কোনো সম্পর্কই ছিল না। কয়েক মিনিট সকলেই চুপচাপ রইল।

আরো কিছুক্ষণ টেবিলে বসে থেকে কথা বলতে বলতে বসবার ঘরে গেল। জনৈক পত্রবাহক দুটো চিঠি দিল স্পেরানস্কির হাতে। চিঠি নিয়ে সে পড়ার ঘরে চলে গেল। অতিথিরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল।

ফিরে এসে স্পেরানস্কি বলল, এবার আবৃত্তি হোক! সঙ্গে সঙ্গে ম্যাগনিৎস্কি নামক অতিথিটি পিটার্সবুর্গের নানা খ্যাতনামা লোকদের নিয়ে ফরাসিতে তার নিজের লেখা হাসির কবিতাগুলো পর পর আবৃত্তি করতে লাগল। প্রশংসা-ধ্বনিতে বার বার তার আবৃত্তিতে বাধা পড়ল। আবৃত্তি শেষ হলে প্রিন্স আন্দ্রু স্পেরানস্কির কাছে গিয়ে চলে যাবার অনুমতি চাইল।

আপনি এত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন কেন? স্পেরানস্কি শুধাল।

 একটা অভ্যর্থনা-সভায় যাব বলে কথা দিয়েছি।

কেউ কিছু বলল না। সেই আয়নার মতো স্বচ্ছ অথবা দুর্ভেদ্য চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রুর মনে হল স্পেরানস্কির কাছ থেকে বড় কিছুর প্রত্যাশা করাই তার ভুল হয়েছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত সেই নিরানন্দ উচ্চহাসি তার কানে বাজতে লাগল।

বাড়ি পৌঁছে প্রিন্স আন্দ্রু গত চার মাসের পিটার্সবুর্গের জীবনের কথা ভাবতে বসল, যেন এটা তার কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা। নিজের নানাবিধ সংস্কার প্রচেষ্টা ও গণ্যমান্য লোকদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের কথা মনে পড়ল। তারপর স্পষ্টরূপে মনে করতে চেষ্টা করল বোচারোভোর কথা, গ্রামে গিয়ে তার কাজকর্মের কথা, রিয়াজান যাত্রার কথা, সেখানকার চাষী ও গ্রাম-প্রধান দ্রোনের কথা। আর সঙ্গে সঙ্গে এখানে এইসব অদরকারী কাজে এত সময় কাটিয়েছে ভেসে সে অবাক হয়ে গেল।

.

অধ্যায়-১৯

পরদিন প্রিন্স আন্দ্রু এমন কয়েকটা বাড়িতে দেখা করতে গেল যেখানে আগে যাওয়া হয়নি। রস্তভদের বাড়িতেও গেল, বল-নাচের আসরে তাদের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় হয়েছে। ভদ্রতার খাতিরেও একবার যাওয়া দরকার, তাছাড়াও যে কচি মেয়েটি তার মনে একটা মধুর প্রভাব ছড়িয়েছে, তার নিজের বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করার একটা ইচ্ছাও তার হল।

নাতাশার সঙ্গেই প্রথম দেখা হল। তার পরনে ছিল গাঢ় নীল রঙের ঘরোয়া পোশাক, তাতে এখন তাকে বল-নাচের পোশাক থেকেও ভালো লাগছে। সে ও রস্ত পরিবারের অন্য সকলেই তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল। যে পরিবারটিকে আগে সে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিল এখন তাদের সকলকেই চমৎকার, সরল, সদয় মানুষ বলে মনে হল। বুড়ো কাউন্টের আতিথেয়তা ও সুন্দর স্বভাব প্রিন্স আন্দ্রুর এতই ভালো লাগল যে ডিনারে যোগদানের প্রস্তাবকে সে প্রত্যাখ্যান করতে পারল না। মনে মনে বলল, এরা চমৎকার লোক, কিন্তু নাতাশা যে কী রত্ন সে বিষয়ে ধারণাই এদের নেই। জীবন-রসে টইটম্বুর এই কাব্যময়ী মনোরমা মেয়েটির উপযুক্ত পরিবেশই তারা রচনা করে আছে!

ডিনারের পরে প্রিন্স আন্দ্রুর অনুরোধে নাতাশা ক্ল্যাভিকর্ডে গিয়ে গান গাইতে শুরু করল। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রিন্স আন্দ্রু গান শুনতে লাগল। একটা কথার মাঝখানে সে হঠাৎ থেমে গেল, হঠাৎ তার মনে হয় কান্নায় গলা আটকে আসছে, অথচ সে জানত যে তার পক্ষে এটা অসম্ভব। সে তাকিয়ে নাতাশাকে গান গাইতে দেখছে, আর একটা নতুন, আনন্দময় কি যেন তার বুকের মধ্যে উত্তাল হয়ে উঠছে। যুগপৎ হর্ষ ও বিষাদ তাকে আচ্ছন্ন করে দিল। কাঁদবার কোনো কারণই ছিল না, অথচ কাঁদতেই সে চায়। কিসের জন্য? প্রাক্তন প্রিয়ার জন? ছোট প্রিন্সেসের জন্য নিজের স্বপ্নভঙ্গের জন্য?…ভবিষ্যতের জন্য?…হা এবং না। এ অবস্থার প্রধান কারণ নিজের অন্তরের অসীম ও অন্তহীন মহত্ত্বের সঙ্গে তার, এমন কি নাতাশারও সীমিত ও বাস্তব সত্তার মধ্যে এক প্রচণ্ড বিরোধ। এই বিরোধই তার মনের উপর চেপে বসেছে, আবার গান শুনতে শুনতে তাকে উৎফুল্ল করে তুলেছে।

গান শেষ করে নাতাশা তার কাছে গিয়ে শুধাল, গলাটা তার কেমন লাগল। প্রশ্নটা করেই কেমন যেন বিব্রত বোধ করল, মনে হল প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। প্রিন্স আন্দ্রু তার দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল, গান খুব ভালো লেগেছে, তার সবকিছুই তার ভালো লাগছে।

রস্তভদের বাড়ি থেকে বেশ দেরি করেই প্রিন্স আন্দ্রু বাড়ি ফিরল। অভ্যাসবশতই শুতে গেল, কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারল যে ঘুম আসবে না। মোমবাতি জ্বালিয়ে বিছানায় উঠে বসল, তারপর উঠল, আবার শুয়ে পড়ল : ঘুম আসছে না বলে মনে কোনো কষ্টই নেই : তার মনটা এতই তাজা ও আনন্দে ভরপুর যেন একটা দমবন্ধ করা ঘর থেকে ঈশ্বরের খোলা হাওয়ায় সে পা ফেলেছে। সে যে নাতাশার প্রেমে পড়েছে সেকথা তার মাথায়ই ঢোকেনি, নাতাশার কথাই সে ভাবছে না, নিজের মনে শুধু তার ছবি আঁকছে, আর তাতেই তার সারা জীবন নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। নিজের মনেই বলল, একটা জীবন, একটা গোটা জীবন যখন এত আনন্দ নিয়ে আমার সামনে অবারিত রয়েছে, তখন এই সংকীর্ণ, বদ্ধ দেহের খাঁচার মধ্যে কেন আমি পরিশ্রম করছি, সংগ্রাম করছি আর দীর্ঘকালের মধ্যে এই প্রথম সে ভবিষ্যতের মধুর পরিকল্পনা রচনায় মেতে উঠল। স্থির করল, একজন শিক্ষক জোগাড় করে ছেলের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করবে, তারপর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বিদেশে যাত্রা করবে, দেখবে ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও ইতালি। মনে মনে বলল, এত শক্তি ও যৌবন যখন আমার মধ্যে রয়েছে তখন আমি স্বাধীনভাবেই চলব। পিয়ের যথার্থই বলে যে সুখী হতে হলে সুখের সম্ভাবনায় বিশ্বাস রাখতেই হবে, এখন তার সেকথা আমি বিশ্বাস করি। যা কিছু মৃত তা কবরে যাক, যার জীবন এখনো আছে সে বাঁচুক, সুখী হোক!

.

অধ্যায়-২০

পিয়েরের পরিচিত কর্নেল অ্যাডলফ বের্গ একদিন সকালে তার সঙ্গে দেখা করতে এল। তার পরনে আনকোরা নতুন ইউনিফর্ম, পমেড মাখানো চুল সম্রাট আলেক্সান্দারের কেতায় পিছন দিকে বুরুশ করা।

একটু হেসে বলল, এইমাত্র আপনার স্ত্রী কাউন্টেসের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দুঃখের বিষয় তিনি আমার অনুরোধ রাখলেন না, কিন্তু আমি আশা করি আপনার বেলায় আমার ভাগ্য প্রসন্নই হবে।

আপনি কি চান কর্নেল? আপনার সেবায় আমি প্রস্তুত।

দেখুন কাউন্ট, সবেমাত্র আমার নতুন বাসায় স্থিতি হয়ে বসেছি, তাই আমার ইচ্ছা আমার নিজের ও আমার স্ত্রীর বন্ধুদের নিয়ে একটা ছোট পার্টির আয়োজন করি। কাউন্টেসকে অনুরোধ করেছিলাম, তিনি যেন চায়ে ও নৈশভোজে যোগ দিয়ে আমাদের সম্মানিত করেন।

বেৰ্গদের মতো লোকদের নিচু জগতের লোক মনে করে তাদের আমন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করার মতো নিষ্ঠুরতা একমাত্র কাউন্টেস হেলেনের পক্ষেই সম্ভব। বের্গের সব কথা শুনে পিয়ের আপত্তি করতে পারল না, যাবে বলে কথা দিল।

কিন্তু দেরি করবেন না কাউন্ট, যদি অভয় দেন তো বলি : দয়া করে আটটা বাজবার দশ মিনিট আগেই আসুন। এক রাবার খেলা হতে পারবে। আমাদের সেনাপতিও আসছেন। তিনি আমার প্রতি খুব সদয়। রাতের খাবার ব্যবস্থাও থাকবে। কাজেই এটুকু অনুগ্রহ আমাকে করবেন।

কোথাও যেতে পিয়ের সাধারণতই দেরি করে থাকে, কিন্তু সেদিন সে বেৰ্গদের বাড়িতে পৌঁছল আটটার দশ মিনিট নয় পনেরো মিনিট আগে।

পার্টির সব উদ্যোগ-আয়োজন শেষ করে বের্গ-দম্পতি অতিথিদের আগমনের জন্যই অপেক্ষা করছিল। ছোট ঘোট আবক্ষ মূর্তি, ছবি ও আসবাবে সুসজ্জিত নতুন ও পরিচ্ছন্ন পড়ার ঘরে বের্গ ও তার স্ত্রী বসেছিল। বোম আটকানো নতুন ইউনিফর্ম পরে স্ত্রীর পাশে বসে বের্গ তাকে বোঝাচ্ছিল, মাথার উপরকার লোকদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করাই উচিত, কারণ একমাত্র তাতেই আলাপ-পরিচয়ে মজাটা ভোগ করা যায়।

সেখানে তুমি কিছু জানতে পার, কিছু চাইতে পার। এই দেখ না, আমার প্রথম পদোন্নতিটা কীভাবে বাগিয়েছি (বেৰ্গ জীবনটাকে মাপে পদোন্নতি দিয়ে, বছর দিয়ে নয়)। আমরা সহকর্মীরা এখনো কিছুই হতে পারেনি,অথচ একটা রেজিমেন্টের কমান্ডার হবার জন্য আমি শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছি, আর তোমার স্বামী হবার সুখলাভ করেছি। এসব কি করে পেলাম? প্রধানত কাদের সঙ্গে পরিচয় করব সেটা জানি বলেই। অবশ্য উপরে উঠতে হলে যে বিবেকবান ও শৃঙ্খলাপরায়ণ হতে তবে সেকথা তো বলাই বাহুল্য।

সে যে এই দুর্বল নারীটির অনেক উপরের মানুষ একথা ভেবে বের্গ একটু হাসল, ভাবল, তার এই দুর্বল স্ত্রীটি জানেই না মানুষের মর্যাদা কাকে বলে, কাকে বলে মানুষ হওয়া। ওদিকে বিবেকবান স্বামীর তুলনায় সে যে অনেক উপরের মানুষ একথা ভেবে ভেরাও হাসতে লাগল, ভাবল, সব পুরুষ মানুষের মতোই সেও জীবনটাকে ভুলই বুঝেছে। স্ত্রীকে দিয়ে বিচার করে বের্গ মনে করে যে সব নারীই দুর্বল ও নির্বোধ। স্বামীকে দিয়ে বিচার করে ভেরাও মনে করে যে যদিও পুরুষরা কিছুই বোঝে না, যদিও তারা দাম্ভিক ও স্বার্থপর, তবু ভাবে যে একমাত্র তারাই সাধারণ বুদ্ধির অধিকারী।

বের্গ উঠে সযত্নে স্ত্রীকে আলিঙ্গন করল, তার ঠোঁটে চুমো খেল।

অবচেতন মনের একটা চিন্তার জের টেনে বলল, একমাত্র কথা হল অচিরেই আমাদের সন্তানলাভ করা চাই।

ভেরা জবাব দিল, আমি সেটা মোটেই চাই না। আমাদের বাঁচতে হবে সমাজের জন্য।

স্ত্রীর ত্রিকোণ গলবন্ধটা দেখিয়ে খুশির হাসি হেসে বের্গ বলল, প্রিন্সেস ইউসুপোভাও ঠিক এইরকম একটা পরেছিল।

ঠিক তখন কাউন্ট বেজুখভের আগমন ঘোষণা করা হল। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের দিকে তাকাল, আত্মসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে দুইজনই হাসল, প্রত্যেকেই মনে মনে এই আগমনের সম্মানটা দাবি করল।

তারা নতুন ছোট বসার গরে বেজুখভকে স্বাগত জানাল। অনতিবিলম্বেই এসে হাজির হল বের্গের পুরনো সহকর্মী বরিস। বের্গ ও ভেরার প্রতি তার আচরণে কিছুটা করুণা প্রকাশ পেল। বরিসের পরেই কর্নেলকে সঙ্গে নিয়ে একটি মহিলা এল, তারপর স্বয়ং সেনাপতি এবং তারও পরে এল রস্তভরা। আর সব মিলিয়ে এ মজলিসটা হয়ে উঠল অন্য যেকোন সান্ধ্যমজলিসেরই মতো। সেনাপতি বসল কাউন্ট ইলিয়া রশুভের পাশে। বুড়োরা বসল বুড়োদের দলে, যুবকরা যুবকদের দলে, আর গৃহকত্রী বসল চায়ের টেবিলে, সে টেবিলেও অন্য সব মজলিসের মতোই রুপোর ঝুড়িতে সেই একইরকম কেক। অন্য সর্বত্র যেমনটি হয়ে থাকে এখানেও সবকিছু ঠিক সেইরকম।

.

অধ্যায়-২১

অন্যতম প্রধান অতিথি হিসেবে কাউন্ট রস্তভ, সেনাপতি ও কর্নেলের সঙ্গে পিয়েরকেই বস্টনের (একধরনের তাসখেলা, অনেকটা ব্রিজ খেলার মতো) টেবিলে বসতে হল। তাসের টেবিলে ঘটনাক্রমে তাকে বসতে হল নাতাশার একেবারে মুখোমুখি। সেদিনের বল-নাচের পরে আজ তার পরিবর্তন লক্ষ্য করে পিয়ের অবাক হয়ে গেল। সে চুপচাপ বসে আছে, চেহারায়ও সে জৌলুস নেই, আর সবকিছুতেই কেমন যেন উদাসীন।

তার দিকে তাকিয়ে পিয়ের ভাবল, ওর হয়েছে কি? চায়ের টেবিলে সে দিদির পাশে বসেছে, পাশেই বসেছে বরিস, তার প্রশ্নের জবাবে তার দিকে না তাকিয়েই একান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে নাতাশা কি যেন একটা জবাব দিল। খেলার মাঝখানে পিয়ের আর একবার নাতাশার দিকে তাকাল।

আরো অবাক হয়ে পিয়ের ভাবল, ওর হয়েছে কি?

প্রিন্স আন্দ্রুর তার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন বলছে। নাতাশাও মুখ তুলে তার দিকে তাকাল, তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হল। ভিতরের একটা চাপা আগুন যেন নতুন করে জ্বলে উঠল। নাতাশা সম্পূর্ণ বদলে গেল, একটা সাধারণ মেয়ের পরিবর্তে আবার সেই নাচের আসরের মেয়েটি হয়ে উঠল।

প্রিন্স আন্দ্রু পিয়েরের কাছে এগিয়ে গেল, পিয়ের দেখল বন্ধুর মুখে নতুন যৌবনের দীপ্তি উঠেছে।

খেলতে খেলতে পিয়ের বার বার আসন বদল করল, একবার বসল নাতাশার দিকে পিঠ দিয়ে, তারপর তার মুখোমুখি, কিন্তু পুরো ছটা রাবার খেলার সময় সে নাতাশা ও বন্ধুর উপর নজর রাখল।

সে ভাবল, ওদের দুইজনের মধ্যে একটা গুরুতর কিছু ঘটছে, সঙ্গে সঙ্গে একাধারে খুশির ও বেদনার একটা অনুভূতি দেখা দিল তার মনে, খেলার দিকে তার মনে রইল না।

ছটা রাবার খেলার পরে সেনাপতি খেলা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, এভাবে খেলে কোনো লাভ নেই, পিয়েরও মুক্তি পেল। একদিকে নাতাশা কথা বলছিল সোনিয়া ও বরিসের সঙ্গে, আর সূক্ষ্ম হাসি হেসে ভেরা কি যেন বলছিল প্রিন্স আন্দ্রুকে। পিয়ের বন্ধুর দিকে এগিয়ে গেল এবং তারা কোনো গোপন কথা বলছে কিনা জানতে চেয়ে তাদের পাশেই বসে পড়ল। সে লক্ষ্য করল ভেরা তার নিজের কথা নিয়েই মশগুল হয়ে আছে, আর প্রিন্স আন্দ্রুকে কেমন যেন বিব্রত মনে হচ্ছে, অথচ তার বেলায় এরকমটা বড় একটা ঘটে না।

বাঁকা হাসি হেসে ভেলা বলল, আপনি কি মনে করেন প্রিন্স? একবার দেখেই তো আপনি মানুষের চরিত্র এত ভালো বুঝতে পারেন। নাতালির ব্যাপারে আপনি কি মনে করেন? তার অনুরাগ কি স্থায়ী হবে? অন্য নারীর মতো (সে যেন নিজেকেই বোঝাতে চাইছিল) সে কি কোনো পুরুষকে চিরদিনের মতো ভালোবাসতে পারে, চিরকাল তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারে? আমি তো সেটাকেই সত্যিকারের ভালোবাসা বলে মনে করি। আপনি কি বলেন প্রিন্স?

ঈষৎ ব্যঙ্গের হাসি হেসে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, আপনার বোনকে আমি এত অল্প জানি যে এধরনের কোনো সূক্ষ্ম প্রশ্নের মীমাংসা করা সম্ভব নয়, তাছাড়া আমি দেখেছি একটি নারী যত কম আকর্ষণীয়া হয় সে তত বেশি বিশ্বস্ত হয়ে থাকে। এই কথা বলে সে পিয়েরের দিকে মুখ তুলে তাকাল।

ভেরা বলতে লাগল, হ্যাঁ, সেকথা ঠিক প্রিন্স। আমাদের একালে মেয়েরা এত স্বাধীনতা ভোগ করে যে পূর্বরাগের আনন্দ অনেক সময়ই তাদের অনুভূতিকে ভের্তা করে দেয়। আর একথা তো স্বীকার করতেই হবে যে নাতালি খুবই স্পর্শকাতর। নাতালির প্রসঙ্গ ওঠায় প্রিন্স আন্দ্রুর ভুরু দুটি অস্বস্তিতে জুড়ে গেল, সে উঠতেই যাচ্ছিল, কিন্তু ভেরা আবার কথা বলতে শুরু করল।

আমি তো মনে করি তার সঙ্গে যত মানুষ ভাব জমাতে আসে তেমন আর কারো বেলায় ঘটেনি, তবু ইদানীংকাল পর্যন্ত কারো দিকে তার মন সেভাবে ঢলেনি। তারপর পিয়েরকে বলল, কি জানেন কাউন্ট, নিজেদের মধ্যে বলেই বলছি, এই যে আমাদের আদরের ভাই বরিস এতদূর এগিয়ে গেছে…

প্রিন্স আন্দ্রু ভুরু কুঁচকে চুপ করে রইল।

তার সঙ্গে তো আপনার খুব বন্ধুত্ব, তাই না? ভেরা শুধাল।

হ্যাঁ, আমি তাকে চিনি… ।

আশা করি নাতাশার প্রতি ছেলেমানুষী ভালোবাসার কথা সে আপনাকে বলেছে?

অপ্রত্যাশিতভাবে লজ্জায় লাল হয়ে প্রিন্স আন্দ্রু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ওহো, ওটা তাহলে একটা ছেলেমানুষী ভালোবাসা?

হ্যাঁ, আপনি তো জানেন জ্ঞাতি বাই-বোনের ঘনিষ্ঠতা অনেকসময় ভালোবাসা হয়ে দেখা দেয়। জ্ঞাতি ভাই-বোনের কাছাকাছি থাকাটা বড়ই বিপজ্জনক।

প্রিন্স আন্দ্রু বলে উঠল, হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে! তারপরেই হঠাৎ অস্বাভাবিক তৎপরতার সঙ্গে মস্কোর পঞ্চাশ বছর বয়সের জ্ঞাতি বোনদের সম্পর্কে সতর্ক হবার জন্য পিয়েরকে ঠাট্টা করতে শুরু করল এবং সেইসব ঠাট্টার কথা বলতে বলতেই পিয়েরের হাত ধরে তাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেল।

বন্ধুর মুখ-চোখের উদ্দীপনাপূর্ণ ভাব দেখে এবং সে যে বারবার নাতাশার দিকে তাকাচ্ছে সেটা লক্ষ্য করে পিয়ের শুধাল, ব্যাপার কি?

তোমাকে…তোমাকে একটা কথা বলা দরকার, প্রিন্স আন্দ্রু বলল। আমি…কিন্তু না, পরে বলব। তার চোখে একটা বিচিত্র আলো ফুটে উঠল, চালচলনে কেমন যেন একটা অস্থিরতা। প্রিন্স আন্দ্রু নাতাশার কাছে গিয়ে তার পাশে বসল। পিয়ের দেখল, প্রিন্স আন্দ্রু নাতাশাকে কি যেন বলল, আর জবাব দিতে গিয়ে তার চোখমুখ লাল হয়ে উঠল।

ঠিক সেইমুহূর্তে বের্গ এসে পিয়েরকে বলল, স্পেনের ব্যাপার নিয়ে সেনাপতি ও কর্নেলের মধ্যে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তাতে তাকে অবশ্যই যোগ দিতে হবে।

বের্গ যেমন খুশি, তেমনই সুখী। তার মুখের উপর থেকে খুশির হাসিটুকু কখনই মিলিয়ে যাচ্ছে না। তার মজলিসটা অন্য সব মজলিসের মতোই খুব সফল হয়েছে। আর সবই যেমনটি হয়ে থাকে ঠিক তেমনটি হয়েছে। শুধু পুরুষদের মধ্যে জোর গলায় আলোচনা এবং একটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিতর্কেরই অভাব ছিল এতক্ষণ। এবার সেনাপতি সেই বিতর্কের সূত্রপাত করেছে, আর তাই বের্গ এসে পিয়েরকে সেখানে টেনে নিয়ে গেল।

.

অধ্যায়-২২

 পরদিন কাউন্টের আমন্ত্রণে প্রিন্স আন্দ্রু রস্তভদের সঙ্গে আহার করল এবং সারাটা দিন সেখানেই কাটাল।

প্রিন্স আন্দ্রু কার জন্য এসেছে বাড়ির সকলেই সেটা বুঝতে পেরেছে, আর সেও সেটা না লুকিয়ে সারাদিন নাতাশার সঙ্গে সঙ্গেই থাকতে চেষ্টা করল। ভীত অথচ সুখী ও উচ্ছ্বসিত নাতাশার অন্তরেই শুধু নয়, সারা বাড়িটাতেই এমন একটা ভীতির অনুভূতি দেখা দিল যে একটা গুরুতর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। প্রিন্স আন্দ্রু যখনই নাতাশার সঙ্গে কথা বলছে তখনই কাউন্টেস বিষণ্ণ, রূঢ় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে এবং তার চোখে চোখ পড়লেই যেকোন একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করছে। সোনিয়ায় ভয়-নাতাশা তাকে ছেড়ে যাবে। মুহূর্তের জন্য প্রিন্স আন্দ্রুর সঙ্গে একলা হলেই প্রত্যাশার আতংকে নাতাশার মুখ সাদা হয়ে যাচ্ছে। প্রিন্স আন্দ্রুর ভীরুতা তাকে বিস্মিত করছে। সে বুঝতে পারছে, প্রিন্স আন্দ্রু তাকে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না।

সন্ধ্যায় প্রিন্স আন্দ্রু চলে গেলে কাউন্টেস নাতাশার কাছে গিয়ে চুপিচুপি বলল : তারপর, কি হল?

মামণি! ঈশ্বরের দোহাই, এখন আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করো না। সেকথা কেউ মুখে বলতে পারে না, নাতাশা বলল।

তা সত্ত্বেও সেদিন রাতে কখনো উত্তেজিত, কখনো ভীত মনে অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে মায়ের বিছানায় শুয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রিন্স আন্দ্রু যে তার প্রশংসা করেছে, নিজের বিদেশে যাবার কথা বলেছে, গ্রীষ্মকালটা তারা কোথায় কাটাতে যাবে সেকথা জানতে চেয়েছে, এবং বরিস সম্পর্কেও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করেছে–এ সবই সে একে একে মাকে বলল।

আর বলল, কিন্তু এরকম…এরকম…কখনো আমার হয়নি। সে কাছে এলেই আমার কেমন ভয় করে। তার কাছে থাকলেই ভয় করে। তার অর্থ কি? তার কি এই অর্থ যে এটাই আসল জিনিস? কি বল? ঘুমিয়ে পড়লে মামণি?

না বাছা, আমি নিজেও ভয় পাচ্ছি, মা জবাব দিল। এবার যাও!

যাই বল, আমি ঘুমতে পারব না। ঘুমিয়ে পড়াটা কী বোকামি! মামণি! মামণি! আগে কখনো তো আমার এরকম হয়নি। আমরা কি কখনো ভাবতে পারতাম!…

নাতাশার মনে হতে লাগল, অত্রাদণু-তে প্রথম যখন প্রিন্স আন্দ্রুকে দেখেছিল তখনই তাকে ভালোবেসেছিল। যাকে সে সেদিনই পছন্দ করেছিল তার সঙ্গেই আবার দেখা হওয়ার এবং সেই মানুষটিকে তার প্রতি অনুরক্ত দেখার এই অপ্রত্যাশিত বিচিত্র সুখটাকেই যেন তার যত ভয়।

আমরা যখন এখানে এলাম তখনই যে সেও বিশেষ করে পিটার্সবুর্গেই আসবে এটাই ঘটতে বাধ্য। বল নাচে তার সঙ্গে আমাদের যে দেখা হবে সেটাও ঘটতে বাধ্য। এটাই নিয়তি। স্পষ্টত এটাই নিয়তি, সবকিছুর এখানেই পরিণতি! যখনই তাকে দেখলাম তখনই একটা অদ্ভুত অনুভূতি জাগল আমার মনে।

সে তোমাকে আর কি বলেছে? কবিতাগুলোই বা কিসের? সেগুলি পড় তো… প্রিন্স আন্দ্রু নাতাশার এ্যালবামে যে কবিতাগুলি লিখে দিয়েছে তার কথাই মা বলল।

মামণি, সে যে বিপত্নীক তা নিয়ে কি লজ্জা পাবার কিছু আছে?

লজ্জা পাবে কেন নাতাশা! ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কর। বিয়ের ব্যবস্থা স্বর্গে বসে তিনিই করেন। মা বলল।

লক্ষ্মী মামণি, তোমাকে আমি কত ভালোবাসি! আমি কত সুখী! নাতাশা চেঁচিয়ে বলল, তারপর আনন্দে ও উত্তেজনায় চোখের জল ফেলতে ফেলতে মাকে জড়িয়ে ধরল।

ঠিক সেই সময়েই প্রিন্স আন্দ্রু পিয়েরের সঙ্গে বসে তাকে বলতে লাগল, নাতাশাকে সে ভালোবাসে, তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে সে দৃঢ়সংকল্প।

.

সেদিনই কাউন্টেস হেলেনের বাড়িতে একটা মজলিসের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিল ফরাসি রাষ্ট্রদূত, জনৈক বিদেশী প্রিন্স এবং অনেক উঁচুমহলের ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক। পিয়ের নিচের তলায় এসে এ-ঘরে ও-ঘরে বেড়াতে লাগল, তার উদাসীন, মনমরা ভাব সকলেরই চোখে পড়ল।

বল-নাচের পর থেকেই তার মধ্যে একটা স্নায়বিক অবসন্নতা দেখা দিয়েছে, সেটাকে প্রতিরোধ করতে সেও আপ্রাণ চেষ্টা করছে। রাজবংশের প্রিন্সের সঙ্গে স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতার পর থেকেই পিয়েরের মনে এই বিষণ্ণতা দেখা দিয়েছে, মানবজীবনের সবকিছুই বৃথা-এই অশুভ চিন্তা প্রায়ই তাকে পেয়ে বসে। সঙ্গে সঙ্গে নাতাশা ও প্রিন্স আন্দ্রুর পারস্পরিক সম্পর্কের কথা ভেবে এবং তার ও বন্ধুর অবস্থার পার্থক্যের কথা ভেবে তার এই বিষণ্ণতা যেন আরো বেড়ে ওঠে। স্ত্রীর চিন্তা এবং নাআশা ও প্রিন্স আন্দ্রুর চিন্তা এড়িয়ে চলতেই সে চেষ্টা করে, তখনই অনন্তকালের তুলনায় সব কিছুই তুচ্ছ মনে হয়, সেই একই প্রশ্ন : তাহলে কিসের জন্য? আবারও মনের সামনে ভেসে ওঠে, আর তখনই সে বেশি করে ভ্রাতৃসংঘের কাজের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করে, সেই অশুভ শক্তিটাকে তাড়িয়ে দিতে চায়। মধ্যরাতে কাউন্টেসের বাসা থেকে বেরিয়ে এসে তার তামাকের ধোয়ায় আচ্ছন্ন নিচু ঘরের টেবিলে বসে একটা নোংরা ড্রেসিং-গাউন পরে সে যখন স্কটিশ আশ্রমের মূল কাগজপত্র নকল করার কাজ শুরু করল তখন কে যেন ঘরে ঢুকল। প্রিন্স আন্দ্রু।

আরে, তুমি! অসন্তুষ্ট গলায় পিয়ের বলল। আর দেখতেই তো পাচ্ছ, আমি বড়ই ব্যস্ত, পাণ্ডুলিপির খাতাটা দেখিয়ে বলল।

প্রিন্স আন্দ্রুর চোখ-মুখ নতুন জীবনের উচ্ছ্বাসে ঝলমল করছে। পিয়েরের সামনে দাঁড়িয়ে তার বিষণ্ণ দৃষ্টিটা লক্ষ্য না করে নিজের আনন্দেই সে হাসতে লাগল।

বলল, দেখ প্রাণের বন্ধু, কালই তোমাকে ব্যাপারটা বলতে চেয়েছিলাম, আজ বলতেই এসেছি। আগে কখনো এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। আমি প্রেমে পড়েছি বন্ধু!

হঠাৎ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে পিয়ের তার ভারি দেহটা সোফায় এলিয়ে দিল।

বলল, নাতাশা রস্তভার সঙ্গে, কি বল?

ঠিক, ঠিক! সে ছাড়া আর কে হবে? একথা আমি বিশ্বাস করতেই পারতাম না, কিন্তু প্রেম যে আমার চাইতে বেশি শক্তিশালী। কাল যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি, কিন্তু পৃথিবীর কোনো কিছুর সঙ্গেই সে যন্ত্রণাকে আমি বদল করতে চাই না। এতদিন যেন আমি বেঁচেই ছিলাম না, অবশেষে বেঁচে উঠেছি, কিন্তু তাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না! কিন্তু সে কি আমাকে ভালোবাসবে?…তার কাছে আমি যেন বড় বেশি বুড়ো…তুমি কথা বলছ না কেন?

আমি? আমি? আমি তোমাকে কি বলেছি? হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পিয়ের বলল, আর তারপরেই ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। একথা আমি আগেই ভেবেছি…মেয়েটি একটি রত্ন…এরকম মেয়ে দেখা যায় না…প্রিয় বন্ধু, তোমাকে মিনতি করছি, কোনোরকম চিন্তা করো না, সংশয় করো না, বিয়ে কর, বিয়ে কর, বিয়ে কর…নিশ্চিত করে বলছি, তোমার চাইতে সুখী কেউ হবে না।

কিন্তু তার কথা?

 সে তোমাকে ভালোবাসে।

 হেসে পিয়েরের চোখে চোখ রেখে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, বাজে কথা বল না…

পিয়ের হিংস্র গলায় বলে উঠল, সে ভালোবাসে, আমি জানি।

পিয়েরের হাত চেপে ধরে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, কিন্তু মন দিয়ে শোন। আমি কি অবস্থায় আছি তা কি তুমি জান? তা নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতেই হবে।

বলে যাও, বলে যাও। আমি খুব খুশি, পিয়ের বলল। এবার সত্যি তার মুখটা বদলে গেল, ভুরু সমান হয়ে গেল, খুশি মনে সে প্রিন্স আন্দ্রুর কথা শুনতে লাগল। দেখে মনে হল, প্রিন্স আন্দ্রু সম্পূর্ণ আলাদা, সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষ হয়ে গেছে, আসলেও তাই হয়েছে। কোথায় গেল তার ঈর্ষা, তার জীবনের প্রতি ঘৃণা, তার মোহভঙ্গ? পিয়েরই একমাত্র লোক যার কাছে সে খোলাখুলি সব কথা বলবে বলে স্থির করল, আর মনের সব কথাই তাকে বলল। এবার সে বহুদূর প্রসারিত ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে ফেলল, জানাল যে বাবার খেয়ালের জন্য সে নিজের সুখকে বিসর্জন দিতে পারবে না, হয় সে এ বিয়েতে বাবার সম্মতি আদায় করে নাতাশাকে ভালোবাসবে, অথবা তার সম্মতি ছাড়াই যা করবার তা করবে।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, আমি যে এভাবে ভালোবাসতে পারি একথা অন্য কেউ বললে আমি বিশ্বাস করতাম না। অতীতে যা আমি জানতাম এটা মোটেই সেরকম অনুভূতি নয়। আমার কাছে গোটা জগৎটাই এখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে : তার একভাগ নাতাশা, সেখানে শুধুই আনন্দ, আশা ও আলো : আর অন্য ভাগে আছে। সবকিছু যেখানে সে নেই, সেখানে শুধু দুঃখ ও অন্ধকার…।

অন্ধকার ও দুঃখ, পিয়ের কথাটা আর একবার উচ্চারণ করল, ঠিক, ঠিক, আমি সব বুঝতে পারি।

আলোকে ভালো না বেসে আমি পারি না। সেটা তো আমার দোষ নয়। আর আমি কত সুখী! আমার কথা বুঝতে পারছ? আমি জানি, আমার জন্য তুমিও খুশি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বন্ধুর দিকে ব্যথিত, বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে পিয়ের কথাটা মেনে নিল। তার চোখে প্রিন্স আন্দ্রুর কপাল যত উজ্জ্বল হতে লাগল, তার নিজের কপাল হয়ে উঠল ততই বিষণ্ণতর।

.

অধ্যায়-২৩

বিয়েতে বাবার সম্মতি প্রয়োজন, তাই সম্মতি পাবার জন্য প্রিন্স আন্দ্রু পরদিনই দেশের উদ্দেশে যাত্রা করল।

তার বাবা ভিতরে রাগ ও বাইরে শান্ত ভাব নিয়ে ছেলের সব কথা শুনল। সে বুঝতে পারল না, নিজের জীবনই যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন সে কেমন করে সে জীবনের পরিবর্তন ঘটাতে অথবা কোনো নতুন কিছু সেখানে প্রবর্তন করতে ইচ্ছুক হতে পারে। বুড়ো মানুষটি ভাবল, শুধু তারা যদি আমার ইচ্ছামতো আমার দিনগুলোকে কাটাতে দেয় তাহলে তারা যা খুশি তাই করুক। অবশ্য ছেলের সঙ্গে সে সেই চালটি দিল যা সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য তুলে রাখে, শান্ত গলায় সব ব্যাপারটা নিয়ে সে আলোচনা করল।

প্রথমত জন্ম, সম্পত্তি ও পদমর্যাদার বিচারে বিয়েটা খুব একটা ভালোকিছু নয়। দ্বিতীয়ত, এখন আর সে আগের মতো যুবকটি নয়, তার স্বাস্থ্যও খারাপ, আর মেয়েটি তরুণী। তৃতীয়ত, তার একটি ছেলে আছে যাকে ঐ প্রতারক মেয়েটির হাতে তুলে দিলে সেটা খুবই দুঃখের ব্যাপার হবে। চতুর্থত এবং শেষ কথা, বিয়েটা তুমি এক বছর বন্ধ রাখ : বিদেশে যাও, আরোগ্য লাভ কর, এবং যেমনটি চেয়েছিলে প্রিন্স নিকলাসের জন্য একজন জার্মান শিক্ষক সংগ্রহ কর। তোমার ভালোবাসা, বা কামনা, বা একগুয়েমি যা খুশি বলতে পার-যদি তখনো আজকের মতোই জোরদার থাকে তো বিয়ে করো! আর এ ব্যাপারে এটাই আমার শেষ কথা। মনে রেখো, শেষ কথা! কাউন্ট এমন গলায় কথাটা শেষ করল যাতে বোঝা গেল যেকোন অবস্থাতেই তার এই সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটবে না।

প্রিন্স আন্দ্রু পরিষ্কার বুঝতে পারল, বুড়ো আশা করছে যে তার মনোভাব অথবা তার বাকদত্তার মনোভাব এক বছরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে না, অথবা তার আগেই সে (বুড়ো প্রিন্স স্বয়ং) নিজেই মারা যাবে, কাজেই বাবার ইচ্ছাটাকে মেনে নেয়াই সে স্থির করল–বিয়ের প্রস্তাব করে এক বছরের জন্য বিয়েটাকে স্থগিত রাখবে।

রস্তভদের সঙ্গে শেষ সন্ধ্যাটা কাটাবার তিন সপ্তাহ পরে প্রিন্স আন্দ্রু পিটার্সবুর্গে ফিরে গেল।

মার সঙ্গে সে রাতের কথাবার্তার পরের দিন নাতাশা সারাটা দিন বলকনস্কির জন্য অপেক্ষা করে রইল, কিন্তু সে এল না। দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিনেও সেই একই অবস্থা। পিয়েরও আর আসেনি, প্রিন্স আন্দ্রুন্ডু যে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেছে সেকথা জানত না বলে তার অনুপস্থিতির কারণ নাতাশা কিছুই বুঝতে পারল না।

এইভাবে তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেল। নাতাশা বাইরে কোথাও যায় না, ছায়ার মতো এ-ঘর থেকে ও ঘরে ঘুরে বেড়ায়, রাতে গোপন চোখের জল ফেলে, সন্ধ্যায় মার কাছেও যায় না। অনবরত চোখ-মুখ লাল করে থাকে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তার মনে হয়, সকলেই তার এই হতাশার কথা জানে, তাকে দেখে হাসে, করুণা করে। একে মনোকষ্টের অন্ত নেই, তার উপর এভাবে অহংকারে আঘাত লাগায় তার কষ্ট আরো বেড়ে গেছে।

একসময় মার কাছে গেল, কিছু বলতে চেষ্টা করল, তারপর হঠাৎ কেঁদে ফেলল।

কাউন্টেস নাতাশাকে সান্ত্বনা দিল, কিছুক্ষণ মার কথা কান পেতে শুনে হঠাৎ সে বাধা দিয়ে বলল, ওকথা থাক মামণি। ও নিয়ে আমি ভাবি না, ভাবতে চাই না। সে এসেছিল, চলে গেছে, চলে গেছে…

তার গলা কাঁপতে লাগল, প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম, কিন্তু কোনোরকমে নিজেকে সংযত করে বলল :

আমি মোটেই বিয়ে করতে চাই না। তাকে আমি ভয় করি : এবার আমি শান্ত হয়েছি, একেবারে শান্ত হয়েছি।

পরদিন নাতাশা সেই পুরনো পোশাকটা পরল যেটা পরলে, তার বিশ্বাস, সকাল বেলায় মন প্রফুল্ল থাকে, আর সেদিন থেকেই আবার সে পুরনো জীবনযাত্রায় ফিরে গেল যেটা সে বল-নাচের দিন থেকে ছেড়ে দিয়েছিল। সকালের চা খাওয়া শেষ করে সে তার নাচের ঘরে চলে গেল এবং গান গাইতে শুরু করল।

হলের ফটকটা খুলে গেল, কে যেন জিজ্ঞাসা করল, বাড়ি আছে। তারপরেই পায়ের শব্দ শোনা গেল। নাতাশা তখন আয়নার দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু নিজেকে দেখছিল না। তার কান ছিল হলের শব্দের দিকে। যখন নিজেকে দেখতে পেল, তার মুখটা ম্লান হয়ে গেছে। সে এসেছে। বন্ধ দরজার ভিতর দিয়ে কণ্ঠস্বরের সামান্য আঁচ পেলেও সে ঠিক বুঝতে পেরেছে।

উত্তেজিত, বিবর্ণ মুখে নাতাশা বসবার ঘরে ছুটে গেল।

বলল, মামণি! বলকনস্কি এসেছে! মামণি, এ যে ভয়ংকর, এ যে অসহ্য! আমি আর…যন্ত্রণা ভোগ করতে চাই না। আমি কি করব?…

কাউন্টেস জবাব দেবার আগেই প্রিন্স আন্দ্রু উত্তেজিত, গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকল। নাতাশাকে দেখামাত্রই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে কাউন্টেসের ও নাতাশার হাতে চুমো খেল, সোফার পাশে বসল।

অনেকদিন হল তোমার দেখা…কাউন্টেস বলতে শুরু করামাত্রই প্রিন্স আন্দ্রু তাকে বাধা দিয়ে তাড়াতাড়ি তার প্রশ্নের জবাবটাই দিয়ে দিল।

এতদিন আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারিনি, কারণ আমি বাবার কাছে গিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ছিল। সবে গতকাল রাতেই ফিরেছি। একটু থেমে আবার বলল, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই কাউন্টেস।

কাউন্টেস চোখ নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

 অস্পষ্ট গলায় বলল, বল, আমি শুনছি।

নাতাশা বুঝতে পারল যে তার চলে যাওয়া উচিত, কিন্তু যেতে পারল না, কিসে যেন তার গলা চেপে ধরল, তারপর আচরণের নিয়মকানুন না মেনেই বড় বড় চোখ মেলে সোজা প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকাল।

এখনই? এই মুহূর্তে!…না, তা হতে পারে না! সে ভাবল।

প্রিন্স আন্দ্রু আবার নাতাশার দিকে তাকাল, সেই দৃষ্টি থেকেই নাতাশার ধারণা দৃঢ়তর হল যে সে ভুল বোঝেনি। হ্যাঁ, এখনই, এই মুহূর্তেই তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাক।

কাউন্টেস চুপি চুপি বলল, যাও নাতাশা! আমি তোমাকে ডাকব।

 প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে ও মায়ের দিকে ভীত, অনুনয়ভরা চোখে তাকিয়ে নাতাশা বেরিয়ে গেল।

আমি এসেছি কাউন্টেস, আপনার মেয়ের পাণি প্রার্থনা করতে, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

কাউন্টেসের মুখ গরম হয়ে উঠল, কিন্তু মুখে কিছুই বলল না।

অবশেষে গম্ভীর গলায় বলতে শুরু করল, তোমার প্রস্তাবে… প্রিন্স আন্দ্রু নীরব। তোমার প্রস্তাব আমাদের কাছে গ্রহণীয় এবং…আমি তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করছি। আমি খুশি হয়েছি। আর আমার স্বামীও…আশা করি…কিন্তু সবকিছু নির্ভর করছে নাতাশার উপর…

আপনার সম্মতি পেলেই আমি তার সঙ্গে কথা বলব।…আপনি সম্মতি দিলেন তো? প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

হ্যাঁ, কাউন্টেস জবাব দিল। সে প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল, আর প্রিন্স যখন সেই হাতে চুমো খাবার খাবার জন্য নিচু হল তখন বিরোধ ও মমতার মিশ্র অনুভূতির সঙ্গে তার কপালে ঠোঁট দুটি স্পর্শ করল। ইচ্ছা হল, ছেলের মতো তাকে ভালোবাসে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হল যে তার কাছে প্রিন্স একটি অপরিচিত ও ভয়ংকর লোক। আমি নিশ্চিত যে আমার স্বামী সম্মতি দেবেন, কিন্তু তোমার বাবা…।

বাবাকে সব কথা বলেছি, তিনি এই সুস্পষ্ট শর্তে সম্মতি দিয়েছেন যে বিয়েটা হবে এক বছর পরে। আর সে কথাই আপনাকে বলতে এসেছি, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

একথা ঠিক যে নাতাশা এখনো ছেলেমানুষ, কিন্তু-তাই বলে এত দেরি?…

এটা অনিবার্য, দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

মেয়েকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি, এই কথা বলে কাউন্টেস ঘর থেকে চলে গেল।

মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে বার বার বলল, প্রভু আমাদের করুণা করুন!

সোনিয়া বলল, নাতাশা তার শোবার ঘরেই আছে। ম্লান মুখে শুকনো চোখে বিছানার উপর বসে নাতাশা একদৃষ্টিতে দেবমূর্তির দিকে তাকিয়ে আছে এবং অতি ক্রুশ-চিহ্ন আঁকতে আঁকতে ফিসফিস করে কি যেন বলছে। মাকে দেখেই সে লাফ দিয়ে যেন উড়ে তার কাছে চলে এল। ।

এই যে মামণি?…তারপর?…

যাও, তার কাছে যাও। সে তোমার পাণি প্রার্থনা করেছে, কাউন্টেসের কথাগুলি নাতাশার কানে কেমন যেন উদাসীন শোনাল। বিন্ন সুরে, কিছুটা তিরস্কারের ভঙ্গিতেই মা আবার বলল, যাও…যাও, মেয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল।

কেমন করে সে যে বসবার ঘরে ঢুকেছিল নাতাশা তা মনেও করতে পারে না। ভিতরে ঢুকে প্রিন্স আন্দ্রুকে দেখেই সে থমকে দাঁড়াল। এও কি সম্ভব যে এই অপরিচিত লোকটিই এখন আমার সর্বস্ব হয়ে উঠেছে? নিজেকে প্রশ্ন করে সঙ্গে সঙ্গেই সে জবাব দিল, হা, সর্ব! জগতের সবকিছু অপেক্ষা সেই এখন আমার প্রিয়তর। চোখ দুটি নত করে প্রিন্স আন্দ্রু তার দিকে এগিয়ে গেল।

প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকেই তোমাকে আমি ভালোবেসেছি। আমি কি আশা করতে পারি?

নাতাশার দিকে তাকিয়ে তার মুখের গম্ভীর আবেগহীন ভাব দেখে প্রিন্স আন্দ্রু অবাক হয়ে গেল। তার মুখ । বলছে : কেন জিজ্ঞাসা করছ? যা তুমি জেনেছ তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছ কেন? মনের কথা যখন কথায় প্রকাশ করা যায় না, তখন কথা বলছ কেন?

তার কাছে এগিয়ে নাতাশা থেমে গেল। প্রিন্স আন্দ্রু তার হাতখানা ধরে তাতে চুমো খেল।

তুমি আমাকে ভালোবাস?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, যেন বিরক্ত হয়েই অনুচ্চ কণ্ঠে নাতাশা বলল। তারপর সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত শ্বাস টানতে টানতে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

একি হল? ব্যাপার কি?

 ওঃ, আমি কত সুখী! নাতাশা জবাব দিল, চোখের জলের ভিতর দিয়ে হাসি ফুটিয়ে তার আরো কাছে এগিয়ে গেল, একমুহূর্ত থেমে যেন জানতে চাইল সে কাজটা করতে পারে কি না, তারপরই তাকে চুমা খেল।

প্রিন্স আন্দ্রু তার হাত দুটি ধরল, চোখে চোখ রাখল, কিন্তু নিজের অন্তরে নাতাশার প্রতি আগেকার ভালোবাসাকে খুঁজে পেল না। তার মধ্যে কি যেন হঠাৎ বদলে গেছে, আগেকার সেই কাব্যময় ও রহস্যময় বাসনার মোহ যেন আর নেই, শুধু আছে নাতাশার নারীসুলভ, শিশুসুলভ দুর্বলতার প্রতি করুণা, তার অনুরাগ ও বিশ্বস্ততার জন্য ভয়, আর আছে একটি আনন্দময় কর্তব্যবোধ যা তাকে চিরকালের মতো এই মেয়েটির সঙ্গে একসূত্রে বেঁধে দিয়েছে। এখনকার এই অনুভূতি আগেকার মতো উজ্জ্বল ও কাব্যময় না হলেও তার চাইতে অধিক শক্তিশালী ও গুরুতর।

তখনো নাতাশার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, তোমার মা কি বলেছেন যে বিয়েটা এক বছরের মধ্যে হতে পারছে না?

নাতাশা ভাবল, এও কি সম্ভব যে এখন আমি এই অপরিচিত, প্রিয়, চৌকোস লোকটির স্ত্রী ও সমকক্ষ হব, অথচ আমার বাবা পর্যন্ত একে উঁচু নজরে দেখে? একি সত্যি হতে পারে? একি সত্যি হতে পারে যে এখন থেকে আর জীবন নিয়ে খেলা করা চলবে না, আমি এখন বড় হয়েছি, আমার প্রতিটি কথা ও কাজের দায়িত্ব এখন আমার নিজের? হ্যাঁ, কিন্তু সে আমাকে কি বলল?

প্রিন্স আন্দ্রুর প্রশ্নটা বুঝতে না পেরেই সে জবাব দিল, না।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, আমাকে ক্ষমা কর। কিন্তু তুমি এখনো এত ছোট, আর আমি জীবনের কত পথ পার হয়ে এসেছি। তোমার জন্য আমার ভয় হয়, এখনো তুমি নিজেকেই চেনো না।

গভীর মনোযোগের সঙ্গে নাতাশা কথাগুলি শুনল, কিন্তু চেষ্টা করেও তার অর্থ বুঝতে পারল না।

প্রিন্স আন্দ্রু বলতে লাগল, এই যে একটা বছর আমার সুখকে বিলম্বিত করে দিল সেটা খুবই কঠোর, তবু এই এক বছর তুমি নিজে নিশ্চিত হবার সময় পাবে। আমি অনুরোধ করছি, এক বছর পরে তুমি আমাকে সুখী করবে, কিন্তু তুমি থাকবে মুক্ত : আমাদের বাকদান গোপন থাকবে, আর তুমি যদি বোঝ যে আমাকে ভালোবাস না, অথবা যদি ভালোবাস… অস্বাভাবিক হাসির সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

নাতাশা তাকে বাধা দিল, ও কথা কেন বলছ? তুমি তো জান, প্রথম যেদিন অত্রাদতে এসেছিলে সেদিন থেকেই তোমাকে ভালোবেসেছি।

এক বছরের মধ্যে তুমি নিজেকে জানতে শিখবে…

একটা পুরো বছর! নাতাশা হঠাৎ কথাটা বলল, যেন এইমাত্র সে বুঝতে পেরেছে যে বিয়েটা এক বছর পিছিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এক বছর কেন? এক বছর কেন?…

প্রিন্স আন্দ্রু বিলম্বের কারণটা বুঝিয়ে বলতে লাগল, কিন্তু নাতাশা কিছুই শুনল না।

সে শুধু জিজ্ঞেস করল এটাকে কি বদলানো যায় না? প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল না, কিন্তু তার মুখই বলে দিল যে এ সিদ্ধান্ত বদলানো অসম্ভব।

এ যে ভয়ংকর! ওঃ, এ যে ভয়ংকর! ভয়ংকর! নাতাশা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। এক বছর অপেক্ষা করতে হলে আমি মরে যাব : এ অসম্ভব, এ ভয়ংকর! প্রেমিকের মুখের দিকে তাকিয়ে সেখানে দেখতে পেল সহানুভূতি ও বিচলিত ভাবের মিশ্র দৃষ্টি।

হঠাৎ চোখের পানি সংবরণ করে সে বলে উঠল, না, না, আমি সব করব! আমি আজ কত সুখী!

 বাবা ও মা ঘরে ঢুকে বাগদত্তা দম্পতিকে আশীর্বাদ করল।

 সেদিন থেকে প্রিন্স আন্দ্রু নাতাশার বাগদত্তা প্রেমিকরূপেই রস্ত পরিবারে আসা-যাওয়া শুরু করল।

.

অধ্যায়-২৪

কোনওরকম বাগদান অনুষ্ঠান হল না, বলকনস্কির সঙ্গে নাতাশার বিয়ের কথা ঘোষণা করাও হল না, প্রিন্স আন্দ্রুন্তু এটাই চেয়েছিল। সে বলল, যেহেতু বিলম্বের জন্য সেই দায়ী, সেইহেতু সবটা বোঝা তাকেই বইতে হবে, সে কথা দিয়েছে, চিরজীবনের মতো নিজেকে বেঁধেছে, কিন্তু নাতাশাকে সে বাঁধতে চায় না, সে তাকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। ছমাস পরে সে যদি বোঝে যে আমাকে ভালোবাসে না, তাহলে তাকে প্রত্যাখ্যান করবার পূর্ণ অধিকার নাতাশার থাকবে। স্বভাবতই নাতাশা বা তার বাবা-মা এ কথা শুনতে চাইল না, কিন্তু প্রিন্স আন্দ্রু সংকল্পে অটল। সে রোজ রস্তভদের বাড়িতে আসে, কিন্তু নাতাশার সঙ্গে বাগদত্তা প্রেমিকের মতো আচরণ করে না, তাকে ঘনিষ্ঠ নামে ডাকে না, চুমো খায় শুধু তার হাতে। তাদের দেখে মনে হয় যেন এর আগে তাদের মধ্যে কোনো পরিচয়ই ছিল না। যখন তারা কেউ কারো বিশেষ কিছু ছিল না তখন তারা পরস্পরকে যে চোখে দেখতে সেকথা স্মরণ করতে দুজনই ভালোবাসে, এখন তারা নিজেদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মানুষ বলে মনে করে : তখন তারা ছিল কৃত্রিম, এখন তারা স্বাভাবিক ও আন্তরিক। প্রথম দিকে প্রিন্স আন্দ্রুর সঙ্গে চলাফেরা করতে রস্ত পরিবার বেশ অসুবিধা বোধ করত। ধীরে ধীরে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠল এবং তার উপস্থিতিতেই অসংকোচে নিজেদের জীবনযাত্রা অব্যাহত রেখে চলতে লাগল, আর প্রিন্স আন্দ্রুও তাতে অংশ নিতে লাগল।

একটি বাগদত্তা দম্পতির উপস্থিতিতে বাড়িতে যে ধরনের কাব্যিক একঘেয়েমি ও প্রশান্তি বিরাজ করে, এ বাড়িতেও সেই আবহাওয়া চলতে লাগল। অনেক সময়ই সকলে একসঙ্গে বসেও প্রত্যেকেই চুপচাপ থাকে। কখনো বা সকলে সেখান থেকে চলে যায়, ওরা দুজন একলা থাকে, কিন্তু তবু চুপচাপ বসে থাকে। ভবিষ্যৎ জীবনের কথা তারা কদাচিৎ বলে। সেসব কথা বলতে প্রিন্স আন্দ্রুর ভয় করে, সে লজ্জা পায়। অন্য সবকিছুর মতোই নাতাশা প্রিন্স আন্দ্রুর এই মনোভাবেরও অংশীদার হয়। একবার নাতাশা প্রিন্স আন্দ্রুকে তার ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করলে যে যথারীতি লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, তার এই ভাবটা নাতাশার খুব পছন্দ-বলল যে ছেলে তাদের সঙ্গে থাকবে না।

কেন থাকবে না? নাতাশা সভয়ে জানতে চাইল।

তার ঠাকুরদার কাছ থেকে তাকে সরিয়ে নিতে আমি পারব না, আর তাছাড়া…

তার মনের কথা বুঝে নিয়ে নাতাশা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আমি তাকে কত ভালোবাসতাম! কিন্তু আমি জানি আমাদের দোষ ধরার যে-কোনো কারণকে তুমি এড়িয়ে চলতে চাও।

কখনো বা বুড়ো কাউন্ট নিজে এসে প্রিন্স আন্দ্রুকে চুমো খায়, পেতয়ার লেখাপড়া বা নিকলাসের সম্পর্কে তার পরামর্শ চায়। তাদের দিকে তাকিয়ে বুড়ি কাউন্টেস দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সোনিয়ার মনে সবসময়ই ভয় পাছে সে দুজনের মিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আর তাই যেকোন ছুতোনাতায় সে তাদের একলা রেখে সরে পড়ে। প্রিন্স আন্দ্রু যখন কথা বলে (সে খুব ভালো গল্প বলতে পারে) নাতাশা তখন গর্বের সঙ্গে তা শোনে; আর নাতাশা লক্ষ্য করে যে যখনই সে কথা বলে তখনই প্রিন্স আন্দ্রু গভীর মনোযোগর সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিব্রত হয়ে সে নিজেকেই প্রশ্ন করে : আমার মধ্যে সে কী খোঁজে? আমার দিকে তাকিয়ে কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করছে কী! যা খুঁজছে যদি না পায়? প্রিন্স আন্দ্রু কদাচিৎ হাসে, কিন্তু যখন হাসে তখন মন-প্রাণ ঢেলে দিয়ে হাসে, আর সেই হাসির পরেই নাতাশার মনে হয় সে যেন তার আরো অনেক কাছে এসে গেছে। নাতাশার এই সুখ ষোলকলায় পূর্ণ হত যদি না তাদের আসন্ন বিচ্ছেদের চিন্তা তাতে শংকিত করে তুলত, সেই একই চিন্তায় প্রিন্স আন্দ্রুর মুখটাও বিবর্ণ ও কঠিন হয়ে ওঠে।

 পিটার্সবুর্গ থেকে চলে যাবার প্রাক্কালে প্রিন্স আন্দ্রু একদিন পিয়েরকে সঙ্গে নিয়ে এল, বল-নাচের পরে পিয়ের একদিনও রস্তভদের বাড়ি আসেনি। তাকে খুবই বিষণ্ণ ও বিব্রত মনে হল। সে কাউন্টেসের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। নাতাশা ও সোনিয়া একটা ছোট দাবার ছক নিয়ে বসেছিল। তাদের ডাক শুনে প্রিন্স আন্দ্রুও সেখানে গেল।

বলল, বেজুখভকে তো তুমি অনেকদিন ধরেই চেন? তাকে কেমন লাগে?

হ্যাঁ, সে ভালো, তবে খুবই খেয়ালি।

পিয়েরের কথা বলতে গিয়ে তার অন্যমনস্কতার অনেক কাহিনী সে বলে গেল, এমনকি কিছু বানিয়েও বলল।

প্রিন্স আন্দ্রু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি কি জান আমাদের গোপন কথা সবই তাকে বিশ্বাস করে বলেছি। ছেলেবেলা থেকেই তাকে আমি চিনি। তার মনটা সোনা দিয়ে গড়া। তোমাকে মিনতি করছি নাতালি…আমি তো চলে যাচ্ছি, কী যে ঘটবে তা ঈশ্বরই জানেন। হয়তো তোমার ভালোবাসা… ঠিক আছে, আমি জানি সেটা আমার বলার কথা নয়। শুধু এইটুকু : আমি যখন এখানে থাকব না তখন তোমার যাই ঘটুক না কেন…।

কী ঘটতে পারে?

প্রিন্স আন্দ্রু বলতে লাগল, যত বিপদই আসুক, তোমাকে মিনতি করছি মাদময়জেল সোফি, যাই ঘটুক না কেন, পরামর্শ ও সাহায্যের জন্য একমাত্র তার দিকেই হাত বাড়িয়ে! সে খুবই অন্যমনস্ক ও খেয়ালি মানুষ, কিন্তু তার অন্তরটা সোনা দিয়ে গড়া।

প্রেমিকের কাছ থেকে এই বিচ্ছেদ নাতাশার উপর কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে সেটা কেউ বুঝতে পারেনি–তার বাবা নয়, মা নয়, সোনিয়া নয়, এমন কি প্রিন্স আন্দ্রুন্তু নিজেও নয়। মুখ লাল করে উত্তেজিতভাবে সে সারাদিন বাড়িময় ঘুরে বেড়াতে লাগল, তুচ্ছ জিনিস নিয়ে সময় কাটাতে লাগল। বিদায় নিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু যখন তার হাতে চুমো খেল তখন সে কাঁদল না পর্যন্ত। শুধু এমন স্বরে বলল যেও না! যে প্রিন্স আন্দ্রু সবিস্ময়ে ভাবল তার এখান থেকে যাওয়াটা উচিত কি না; অনেকদিন পর্যন্ত সে স্বর তার মনে পড়ত। সে চলে যাবার পরেও নাতাশা কাঁদল না; কিন্তু কয়েকদিন ধরেই শুকনো চোখে নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকে, কোনো কিছুতেই মন দেয় না, শুধু মাঝে মাঝেই বলে ওঠে, আঃ, কেন সে চলে গেল?

কিন্তু প্রিন্স আন্দ্রু চলে যাবার পক্ষকাল পরে আশপাশের সকলকে অবাক করে দিয়ে অত্যন্ত আকস্মিকভাবেই সেই মানসিক বিষণ্ণতাকে কাটিয়ে উঠে নাতাশা আবার তার আগেকার অবস্থায় ফিরে গেল, কিন্তু তার মধ্যে একটা নৈতিক পরিবর্তন দেখা দিল ঠিক যেরকমভাবে দীর্ঘ রোগভোগের পরে কোনো শিশুর মুখের ভাবের পরিবর্তন ঘটে।

.

অধ্যায়-২৫

ছেলে চলে যাবার পর থেকেই প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কির স্বাস্থ্য ও মেজাজ আরো খারাপ হয়ে পড়ল। সে আরো খিটখিটে হয়ে উঠল, আর প্রায়ই তার অকারণ ক্রোধের ঝাঁপটা এসে পড়ত প্রিন্সেস মারির উপরেই। বেছে বেছে প্রিন্সেস মারির মনের নরম জায়গাগুলির উপরেই সে কঠোরভাবে আঘাত করত। প্রিন্সেস মারির জীবনে দুটোই আকর্ষণ আর দুটোই আনন্দ-ভাইপো ছোট নিকলাস, আর ধর্ম–আর এই দুটিই হয়ে উঠল প্রিন্সেস আক্রমণ ও ঠাট্টার প্রিয় বিষয়বস্তু। যে কথাই উঠুক সে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বয়স্কা কুমারিদের কুসংস্কার এবং ছেলেমেয়েদের আদর দিয়ে নষ্ট করার প্রসঙ্গে চলে যেত। বলত, তুমি তো ওকে-ছোট নিকলাসকে-তোমার মতোই বুড়ি বানাতে চাইছ! কী দুঃখের কথা! প্রিন্স আন্দ্রুন্তু চাইছে একটি ছেলে, আর তুমি ওকে বানাচ্ছে একটা বুড়ি! অথবা মাদময়জেল বুরিয়ের দিকে ফিরে প্রিন্সেস মারির সামনেই তাকে জিজ্ঞাসা করত গ্রাম্য পুরোহিত ও দেবমূর্তিগুলিকে তার পছন্দ কি না, তাদের নিয়ে অনেকরকম ঠাট্টা রসিকতাও করত।

সে অনবরতই প্রিন্সেস মারির মনে আঘাত দেয়, তাকে যন্ত্রণা দেয়, সে কিন্তু সহজভাবেই প্রিন্সকে ক্ষমা করে। তার বাবা তাকে ভালোবাসে, সে কি তাকে কষ্ট দিতে পারে, তার প্রতি অবিচার করতে পারে? ন্যায়বিচার কি? ন্যায়বিচার এই গর্বিত শব্দটার কথা প্রিন্সেস কখনো ভাবেনি। তার কাছে মানুষের সব জটিল আইনকানুনই একটিমাত্র স্পষ্ট ও সরল আইনে কেন্দ্রায়িত-ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের আইন : নিজে ঈশ্বর হয়েও যিনি মানুষকে ভালোবেসে তার জন্য নির্যাতন ভোগ করেছেন এ আইন তিনিই শিখিয়েছেন। অন্য মানুষের ন্যায়-অন্যায় দিয়ে সে কি করবে? তার কাজ সহ্য করা, ভালোবাসা, আর তাই সে করে চলেছে।

শীতকালে প্রিন্স আন্দ্রু বল্ড হিলসে ফিরে গেল; এবার সে অনেক বেশি হাসিখুশি, শান্ত ও স্নেহশীল হয়েছে; প্রিন্সেস মারি অনেকদিন তাকে এরকমটা দেখেনি। সে বুঝল যে একটা কিছু ঘটেছে, কিন্তু প্রিন্স আন্দ্রুন্তু নিজে কিছুই বলল না। বাড়ি থেকে যাবার আগে কি নিয়ে যেন সে বাবার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করল, প্রিন্সেস মারি লক্ষ্য করল, যাবার আগে দুজনই পরস্পরের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছে।

প্রিন্স আন্দ্রু চলে যাবার পরেই প্রিন্সেস মারি পিটার্সবুর্গে বন্ধু জুলি কুরাগিনকে চিঠি লিখল। তাকে সে স্বপ্নে দেখেছে (সব মেয়েরাই এরকম স্বপ্ন দেখে) তুরস্কে দাদার মৃত্যু হওয়ায় বেচারি এখন শোকে দিন কাটাচ্ছে। চিঠিতে দাদার সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাবের কথাই সে লিখল।

প্রিয় মিষ্টি বন্ধু জুলি, মনে হয় দুঃখ আমাদের সকলেরই ললাট-লিখন।

তোমার এ ক্ষতি এতই ভীষণ যে নিজের কাছে আমি এর শুধু একটা ব্যাখ্যাই খুঁজে পাইতোমাকে ও তোমার মাকে ভালোবেসে তোমাদের পরীক্ষা করবার জন্যই ঈশ্বর এই বিশেষ ব্যবস্থাটি করেছেন। হায় বন্ধু! ধর্ম, একমাত্র ধর্মই পারে–আমাদের সান্ত্বনা দিতে পারে বলব না-হতাশা থেকে আমাদের রক্ষা করতে। মানুষ যা বুঝতে পারে না একমাত্র ধর্মই তা বুঝিয়ে দিতে পারে : কেন, কি কারণে, যেসব দয়ালু মহৎ লোক জীবনে সুখলাভে সক্ষম-যারা শুধু যে অন্যের ক্ষতি করে না তাই নয়, অনেক সুখের পক্ষে একান্ত দরকারি–তাদেরই ডাক আসে ঈশ্বরের কাছ থেকে, অথচ যে সব নিষ্ঠুর, অদরকারি, ক্ষতিকর মানুষ শুধু নিজেদেরই নয় অন্যের পক্ষেও বোঝাস্বরূপ তাদেরই বাঁচতে দেওয়া হয়। জীবনে প্রথম যে মৃত্যু আমি প্রত্যক্ষ করেছি, যা আমি কোনোদিন ভুলব না–আমার আদরের বৌদির মৃত্যু–সেই মৃত্যুই আমাকে একথা শিখিয়েছে। তুমি যেমন নিয়তিকে প্রশ্ন করছ, কেন তোমার এমন চমৎকার দাদাকে মরতে হল, তেমনই আমিও প্রশ্ন করেছিলাম, দেবদূতের মতো যে লিজা কখনো কারো প্রতি অন্যায় করেনি, কোনো অশুভ চিন্তা কখনো যার মনে আসেনি, তাকে কেন মরতে হল। প্রিয় বন্ধু, তোমার কি মনে হয়? তারপরে পাঁচটি বছর কেটে গেছে, এর মধ্যেই আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি কেন তাকে মরতে হয়েছিল, কীভাবে সেই মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার অসীম কল্যাণময় তারই প্রকাশমাত্র, আমাদের কাছে দুর্বোধ্য হলেও যার প্রতিটি কাজ জীবের প্রতি তার অসীম ভালোবাসারই প্রকাশ। প্রায় ভাবি, তার দেবদূতের মতো নির্দোষ স্বভাবের পক্ষে মায়ের সব কর্তব্য পালনের মতো শক্তিই তার ছিল না। তরুণী বধূ হিসেবে সে নিন্দার অতীত, হয়তো বা মা হিসেবে সে তা নাও হতে পারত। যাই হোক, সে আমাদের ছেড়ে গেছে, বিশেষ করে ছেড়ে গেছে প্রিন্স আন্দ্রু, রেখে গেছে শুধু দুঃখ আর স্মৃতি, কিন্তু সম্ভবত সেখানে সে এমন একটি আসন পাবে যেটা পাবার আশা আমি নিজে করতে পারি না। কিন্তু শুধু তার কথাই বা বলি কেন, যত দুঃখই পেয়ে থাকি তবু সেই ভয়ংকর অকাল মৃত্যু আমার ও দাদার জীবনে অতীব কল্যাণময় প্রভাব বিস্তার করেছে। তখন সেই ক্ষতির মুহূর্তে এসব চিন্তা আমার মনে আসেনিঃ তখন হয় তো এসব চিন্তাকে সভয়ে দূরে ঠেলে দিতাম, কিন্তু সে চিন্তা এখন আমার কাছে স্পষ্ট ও নিশ্চিত। প্রিয় বন্ধু, সুসমাচারের যে সত্যবাণী আমার জীবনের মন্ত্র হয়ে দেখা দিয়েছে তার সত্যতায় তোমাকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই তোমাকে এত কথা লিখলাম : তার ইচ্ছা ভিন্ন আমাদের মাথার একগাছি চুলও পড়তে পারে না। আর তার ইচ্ছা তো পরিচালিত হয় একমাত্র আমাদের প্রতি অসীম ভালোবাসার দ্বারা, আর তাই আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটে আমাদের ভালোর জন্যই ঘটে।

তুমি জানতে চেয়েছ আগামী শীতকালটা আমরা মস্কোতে কাটাব কি না। তোমাকে দেখার অনেক ইচ্ছা সত্ত্বেও তা হবে বলে মনে করি না, আর আমি তা চাইও না। শুনে অবাক হবে যে বোনাপার্টই এর কারণ! ব্যাপারটা এই : বাবার স্বাস্থ্য খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে, আমার কোনো প্রতিবাদই তিনি সহ্য করতে পারেন না, ক্রমেই খিটখিটে হয়ে উঠছেন। তুমি তো জান, রাজনৈতিক সমস্যাই এর কারণ। ইউরোপের সব রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে, বিশেষ করে মহান ক্যাথারিনের পৌত্র আমাদের সম্রাটের সঙ্গে বোনাপার্ট যে সমমর্যাদায় সন্ধির আলোচনা করছে–এটা বাবা কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। তুমি জান, রাজনীতির দিকে আমার কোনো আগ্রহ নেই কিন্তু বাবার কথাবার্তা এবং মাইকেল আইভানভিচের সঙ্গে তার আলোচনা থেকে পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে সবই আমি জানতে পারি–বিশেষ করে বোনাপার্টের উপর যেসব সম্মান বর্ষিত হয়েছে সেকথা তো বটেই। আমার তো মনে হয়, সারা পৃথিবীতে একমাত্র বল্ড হিলসেই তাকে মহাপুরুষ তো দূরের কথা, ফ্রান্সের সম্রাট বলেও স্বীকার করা হয় না। বাবা এসব সহ্যই করতে পারেন না। আমার তো মনে হয়, রাজনৈতিক মতামতের জন্যই বাবা মস্কো যাবার কথা বলতে অনিচ্ছুক; কারণ তিনি জানেন যে কারো তোয়াক্কা না করে নিজের মতামত প্রকাশ করলেই সেখানে সংঘর্ষ বেধে যাবে। বোনাপার্টকে নিয়ে বিতর্ক তো অনিবার্য, আর তার ফলে চিকিৎসায় যেটুকু ভালো ফল হবে তাও বিফলে যাবে। যাই হোক, শীঘ্রই এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আমার দাদা আন্দ্রুর অনুপস্থিতি ছাড়া আমাদের পারিবারিক জীবন আগেকার মতোই চলছে। তোমাকে আগের চিঠিতেও লিখেছি, ইদানীং সে খুব বদলে গেছে। সেই দুঃখের পরে এবছরই তাকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে দেখলাম। ছেলেবেলায় তাকে যেমন দেখেছি : দয়ালু, স্নেহশীল, সোনায় মোড়া অদ্বিতীয় অন্তরের অধিকারী, আবার সে ঠিক সেই রকমটি হয়েছে। মনে হচ্ছে, সে বুঝতে পেরেছে যে তার জীবন শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দৈহিক দিক থেকে সে আরো অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেক শুকিয়ে গেছে, স্নায়ু দুর্বল হয়েছে। তাকে নিয়ে উদ্বেগে আছি, তবে সুখের বিষয় অনেক আগেই ডাক্তাররা তাকে বিদেশে যাবার যে পরামর্শ দিয়েছিল এতদিনে সে কাজটা সে করছে। আশা করছি, এবার সে ভালো হয়ে উঠবে। তুমি লিখেছ, পিটার্সবুর্গে সকলেই বলে সে একজন সক্রিয়, সংস্কৃতিসম্পন্ন, সক্ষম যুবক। আত্মীয় হিসেবে আমার অহংকার ক্ষমা করো, কিন্তু এবিষয়ে কোনোদিনই আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। এখানকার চাষী থেকে দ্ৰজন পর্যন্ত সকলের যে উপকার সে করেছে তা অপরিমেয়। পিটার্সবুর্গে পৌঁছে সে তার প্রাপ্যটুকুই পেয়েছে। আমি অবাক হয়ে ভাবি গুজব কত তাড়াতাড়ি পিটার্সবুর্গ থেকে মস্কোতে ছড়াতে পারে, বিশেষ করে যে মিথ্যা গুজবের কথা তুমি লিখেছ-ছোট্ট রস্তভার সঙ্গে দাদার বাগদানের কথাই আমি বলছি। আমার তো মনে হয় না দাদা আর কখনো বিয়ে করবে, সে মেয়েকে তো কিছুতেই নয়, আর তার কারণ : প্রথম, আমি জানি যদিও সে হারানো স্ত্রীর কথা কদাচিৎ বলে থাকে, তবু সেই হারানোর ব্যথা তার অন্তরের এত গভীরে প্রবেশ করেছে যে তার জায়গায় অন্য কাউকে বসানো এবং আমাদের ছোট্ট দেবদূতের জন্য একজন সৎ-মা এনে দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। দুই, আমি যতদূর জানি, তাকে খুশি করার মতো মেয়ে সে নয়। তাই আমি মনে করি না যে তাকে সে স্ত্রীরুপে বেছে নেবে, আর সত্যি কথা বলতে কি আমিও সেটা চাই না। কিন্তু চিঠিটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে, দ্বিতীয় পাতার শেষে পৌঁছে গেছি। বিদায় বন্ধু। ঈশ্বর তার পবিত্র ও সরল মেহে তোমাকে রক্ষা করুন। প্রিয় বন্ধু, মাদময়জেল বুরিয়েও তোমাকে চুম্বন পাঠাচ্ছে। —মারি

.

অধ্যায়-২৬

 গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি প্রিন্সেস মারি সুইজারল্যান্ড থেকে প্রিন্স আন্দ্রুর একটা অপ্রত্যাশিত চিঠি পেল। সে চিঠিতে একটা বিচিত্র ও বিস্ময়কর সংবাদ সে জানিয়েছে। নাতাশা রস্তভার সঙ্গে তার বিয়ের সংবাদ দিয়েছে। সারা চিঠিতে বাগদত্তার প্রতি প্রেমের উচ্ছ্বাস এবং বোনের প্রতি মমতা ছড়িয়ে আছে। লিখেছে, এমন ভালো সে কাউকে কোনোদিন বাসেনি, জীবন যে কি সে শুধু এখনই বুঝেছে ও জেনেছে। শেষবারের মতো বল্ড হিলসে গিয়ে তাকে এই সংকল্পের কথা জানায়নি বলে সে বোনের কাছে ক্ষমা চেয়েছে, যদিও একথা সে বাবাকে তখনই জানিয়েছে। বোনকে এই ভয়ে বলেনি যে প্রিন্সেস মারি তাহলে বাবার সম্মতি চাইত, তাকে বিরক্ত করে তুলত, তার অসন্তুষ্টির ধাক্কা সইত, অথচ ভালো কিছুই হত না। লিখেছে, তাছাড়া, তখন ব্যাপারটা এখনকার মতো পাকা হয়নি। বাবা তখন একবছর অপেক্ষা করার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন; এখন তার অর্ধেক সময় ছমাস পার হয়ে গেছে, কিন্তু আমার সংকল্প আগের চাইতে দৃঢ়তর হয়েছে। ডাক্তাররা যদি আমাকে আর এখানে আটকে না রাখে তাহলেই আমার রাশিয়াতে ফিরে যাওয়ার কথা, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আরো তিন মাস আমাকে এখানে থাকতে হবে। আমাকে তুমি চেন, বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তুমি জান। তার কাছ থেকে আমি কিছুই চাই না। চিরদিন স্বাধীন ছিলাম, আর তাই থাকব, কিন্তু হয়তো আর বেশিদিন তিনি আমাদের মাঝে থাকবেন না, তাই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তার বিরাগভাজন হলে আমার সুখের অর্ধেকটাই নষ্ট হয়ে যাবে। সেইকথা নিয়ে তাকেও একটা চিঠি লিখছি; আমার মিনতি, একটা ভালো সময় বুঝে চিঠিটা তার হাতে দিও, এবং আমাকে জানিও সমস্ত ব্যাপারটাকে তিনি কিভাবে নিয়েছেন এবং সময়টা চার মাস কমিয়ে আনতে তিনি সম্মতি দিতে পারেন এরকম কোনো আশা আছে কি না।

অনেক ইতস্তত, সন্দেহ ও প্রার্থনার পরে প্রিন্সেস মারি চিঠিটা বাবার হাতে দিল। পরদিন বুড়ো প্রিন্স তাকে শান্তভাবে বলল :

তোমার দাদাকে লিখে জানিয়ে দিও যেন আমার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করে…বেশি দিন লাগবে না–অচিরেই আমি তাকে মুক্তি দেব।

প্রিন্সেস জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাবা তাকে কথাই বলতে দিল না, উত্তরোত্তর গলা চড়িয়ে চিৎকার করে বলল : বিয়ে কর, বিয়ে কর বাপু।…ভালো পরিবার…চমৎকার লোক, অ্যাঁ? ধনী, অ্যাঁ? হ্যাঁ, ছোট্ট নিকলাস সুন্দর একটি সৎ-মা পাবে। চিঠি লিখে তাকে জানিয়ে দাও, ইচ্ছা করলে সে কালই বিয়ে করতে পারে। সে হবে ছোট্ট নিকলাসের সৎ-মা, আর আমি বিয়ে করব বুরিয়েকে!…হা, হা, হা! তারও তো একজন সৎ-মা থাকা চাই। শুধু একটা কথা, আমার বাড়িতে আর মেয়েমানুষের দরকার নেই–বিয়ে করে সে যেন নিজের মতো বাস করে। তুমি হয়তো তার কাছে গিয়েই থাকবে? প্রিন্সেস মারির দিকে ফিরে বলল। ঈশ্বরের দোহাই, তাই যাও! বেরিয়ে যাও তুষার-ঝড়ের মধ্যে…তুষার-ঝড়…তুষার-ঝড়!

এই চেঁচামেচির পরে প্রিন্স এ নিয়ে আর একটি কথাও বলেনি। কিন্তু ছেলের এই আচরণের দরুন চাপা বিরক্তি প্রকাশ পেতে লাগল মেনের প্রতি ব্যবহারে। আগেকার ঠাট্টা-বিদ্রুপের সঙ্গে একটা নতুন বিষয় যুক্ত হল-সৎ-মার কথা এবং মাদময়জেল বুরিয়ের নম্র স্বভাবের কথা।

মেয়েকে শুধায়, আমি কেন তাকে বিয়ে করব না? সে তো একটি চমৎকার প্রিন্সেস হবে!

বিস্ময়বিমূঢ় ভাবে প্রিন্সেস মারি লক্ষ্য করতে লাগল যে ইদানীং তার বাবা সেই ফরাসি মেয়েটির সঙ্গে খুবই দহরম-মহরম শুরু করে দিয়েছে। চিঠিটার ভাগ্যে যা ঘটেছে সে-কথা প্রিন্স আন্দ্রুকে সে চিঠি লিখে জানিয়ে দিল, তবে তাকে এই আশা দিয়ে সান্ত্বনা জানাল যে বাবা মত করে দিতে পারবে।

ছোট্ট নিকলাস ও তার লেখাপড়া, দাদা আন্দু এবং ধর্ম-এই হল প্রিন্সেস মারির আনন্দ ও সান্ত্বনা; কিন্তু এছাড়াও প্রত্যেক মানুষেরই যেমন কতকগুলি ব্যক্তিগত আশা থাকে তেমনই প্রিন্সেস মারিও তার অন্তরের গভীরতম কোণে এমন একটি গোপন স্বপ্ন ও আশাকে লালন করে যা তার জীবনের প্রধান সান্ত্বনা। এই সান্ত্বনাভরা স্বপ্ন ও আশা তাকে এনে দেয় ঈশ্বরের আপনজনরা–সেইসব আধ-পাগলা ও অন্য তীর্থযাত্রীর দল যারা প্রিন্সের অজ্ঞাতসারে তার সঙ্গে দেখা করে। যত বেশিদিন সে বাঁচছে, জীবনের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ যত বাড়ছে, ততই সেইসব স্বল্পদৃষ্টি মানুষকে দেখে সে বেশি অবাক হচ্ছে যারা এই পৃথিবীতেই আনন্দ ও সুখের খোঁজ করছে : সেই অসম্ভব, অবাস্তব, পাপপূর্ণ সুখকে পাবার জন্য পরিশ্রম করছে, যন্ত্রণা ভোগ করছে, সংগ্রাম করছে এবং পরস্পরের ক্ষতি করছে। প্রিন্স আন্দ্রুন্তু স্ত্রীকে ভালোবাসল, সে মারা গেল, কিন্তু তাও যথেষ্ট হল না, আর একটি মেয়েমানুষের সঙ্গে সে নিজের সুখকে বাধতে চাইল। বাবা এতে আপত্তি করলেন, কারণ আন্দ্রুর জন্য তিনি চান আরো খ্যাতি ও অর্থসম্পন্ন একটি কনে। আর এমন কিছুকে পাবার জন্যে তারা সকলেই লড়াই করল, কষ্ট পেল, একে অন্যকে যন্ত্রণা দিল, তাদের আত্মাকে, শাশ্বত আত্মাকে ক্ষত-বিক্ষত করল, যা একান্তই ক্ষণস্থায়ী। একথা যে আমরা নিজেরাও জানি তাই শুধু নয়, ঈশ্বর-পুত্র খৃস্টও পৃথিবীতে নেমে এসে আমাদের বললেন যে এই জীবন মুহূর্তের খেলাঘর মাত্র; তথাপি আমরা একেই আঁকড়ে ধরে থাকি, এই জীবনেই সুখের খোঁজ করি। প্রিন্সেস মারি ভাবল, একথা কেউ বোঝে না কেন? বোঝে শুধু ঈশ্বরের সেইসব ঘৃণিত আপনজনরা, ঝোলা পিঠে নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে যারা আমার কাছে আসে পাছে প্রিন্স তাদের দেখে ফেলেন এই ভয়ে; তার কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার পাবার ভয়ে নয়, পাছে তার পাপ হয় সেই ভয়ে। পরিবার, বাড়িঘর ও পার্থিব সুখের সব চিন্তা ছেড়ে, কোনো কিছুকে আঁকড়ে না ধরে শনের কম্বলে শরীর ঢেকে একটা নতুন নাম নিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, কারো কোনো ক্ষতি না করে যারা তাড়িয়ে দেয় আর যারা আশ্রয় দেয় তাদের সকলের জন্যই প্রার্থনা করা : এই জীবন ও সত্যের চাইতে মহত্তর কোনো জীবন বা সত্য নেই!

একটি তীর্থযাত্রী প্রিন্সেস মারির বড়ই প্রিয়; নাম থিয়োদসিয়া, বয়স পঞ্চাশ বছর, ছোটখাট শান্ত মানুষটি, মুখভর্তি দাগ; খালি পায়ে ভারি শিকল পরে তিরিশ বছরের অধিককাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদা একটা ঘরে দেবমূর্তির সামনে জ্বালানো স্বল্পালোকিত বাতির নিচে বসে থিয়োদসিয়া যখন তার জীবনের কথা বলছিল তখন একমাত্র থিয়োদসিয়াই যে জীবনের সত্য পথের সন্ধান চেয়েছে সহসা এই চিন্তা এত তীব্রভাবে প্রিন্সেস মারির মনে জেগে উঠল যে সে স্থির করল নিজেও তীর্থযাত্রী হয়ে যাবে। থিয়োদসিয়া ঘুমতে চলে গেলে প্রিন্সেস মারি অনেকক্ষণ এ নিয়ে ভাবল, এবং শেষপর্যন্ত মনস্থির করে ফেলল যে যত অদ্ভুতই মনে হোক সে তীর্থযাত্রায় বের হবেই। কেবলমাত্র তার দীক্ষাগুরু সন্ন্যাসী আকিনফি বাবার কাছেই এই সিদ্ধান্তের কথা জানাল আর সেও তার অভিপ্রায়কে সমর্থন করল। তীর্থযাত্রীদের উপহার দেবার অছিলা করে সে নিজের জন্য একপ্রস্থ তীর্থযাত্রীর পোশাক তৈরি করাল; মোটা কাপড়ের একটা আলখাল্লা, কাঠের জুতো, মোটা কাপড়ের কোট ও কালো রুমাল। যে সিন্ধুকটাতে তার নিজস্ব গোপন অর্থাদি আছে বারকয়েক সেটার কাছে গিয়েও প্রিন্সেস মারি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল; পরিকল্পনা মতো কাজ করবার সময় হয়েছে কি না তা নিয়ে ইতস্তত করতে লাগল।

যাত্রীদের কাহিনী শুনতে বসে তাদের সরল কথাবার্তায় প্রায়ই সে এত বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে অনেকবারই সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছে। কল্পনায় সে যেন দেখতে পায়, মোটা কম্বলে দেহ জড়িয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে পিঠে বোঁচকা ফেলে থিয়োদসিয়ার পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে সে এক সন্তের স্থান থেকে অন্য সন্তের স্থানে এগিয়ে চলেছে; মন থেকে বিদায় নিয়েছে যত ঈর্ষা দ্বেষ, জাগতিক ভালোবাসা ও কামনা এবং অবশেষে পৌঁছে গেছে সেই স্থানে যেখানে দুঃখ নেই, দীর্ঘশ্বাস নেই, আছে শুধু শাশ্বত সুখ ও পরমানন্দ।

প্রিন্সেস মারি ভাবে : এক জায়গায় গিয়ে সেখানে প্রার্থনা করব; সেখানে থাকতে অভ্যস্ত হবার বা সে জায়গাটাতে ভালোবাসার আগেই আরো এগিয়ে যাব। যতদিন পা চলে ততদিনই এগিয়ে চলবো, তারপর কোনো এক জায়গায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে মরে যাব এবং শেষপর্যন্ত পৌঁছে যাব সেই শাশ্বত, শান্ত আবাসে যেখানে কোনো দুঃখ নেই, দীর্ঘশ্বাস নেই…।

কিন্তু পরক্ষণেই বাবাকে দেখল, বিশেষ করে ছোট্ট কোকোকে (নিকলাস) দেখলেই তার মন দুর্বল হয়ে পড়ে। সে নীরবে চোখের জল ফেলে, আর ভাবে সে তো পাপী, সে যে বাবাকে আর ছোট ভাইপোটিকে ঈশ্বরের চাইতেও বেশি ভালোবাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *