দুদিন পর এক সন্ধ্যায় স্কুটার নিয়ে এ বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ায় নাজমুল। ওকে দেখে গেট খুলে দেয় আলতাফ। ও উদ্বিগ্ন স্বরে বলে, আঙ্কেল কই?
ড্রয়িংরুমে।
জয় বাংলা মামণি কেমন আছে? কথা বলছ না যে? তোমারই বা কী হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ?
আলতাফ উত্তর দেয় না। নাজমুল দুই লাফে সিঁড়ি পার হয়ে ড্রয়িংরুমে ঢোকে। আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন টেলিভিশন দেখছিলেন। ওকে দেখে সুইস অফ করেন।
এসো, বাবা।
আমি বসব না। স্কুটার দাঁড় করিয়ে রেখেছি। মারুফ ভাই পাঠিয়েছে আমাকে।
মারুফ? মারুফ কোথায়?
ঢাকায় নেই। মেলাঘরে। আমাকে বলেছে মেরিনা আপাকে নিয়ে মেলাঘরে যেতে।
তুমি বসবে? বসো না একটু।
ফ্যাসফ্যাস করে আয়শা খাতুনের কণ্ঠস্বর। কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।
জয় বাংলা মামণি, আমার বসার সময় নেই। সবাই অপেক্ষা করছে। মেরিনা আপাই কেবল বাকি। আমরা গেলেই…
দুজনকে মুখ ঢাকতে দেখে চারদিকে তাকায় নাজমুল। ঘরের লন্ডভন্ড অবস্থা দেখে কিছু আঁচ করে। বাইরে এসে আলতাফের ঘাড়ে হাত রেখে ঝাকুনি দেয়।
কী হয়েছে? খুব তাড়াতাড়ি বলেন। আমার সময় নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।
আলতাফ দ্রুত কণ্ঠে সব কথা বলে দেয়। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নাজমুলের চোখ। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে বলে, শাবাশ! মেরিনা আপা এত বড় যুদ্ধ করেছে। শাবাশ। খবরটা সবাইকে পৌঁছাতে হবে। গেলাম।
স্কুটার ছাড়ার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকে আলতাফ। তারপর গেট বন্ধ করে। গেটে পিঠ ঠেকিয়ে দম নেয়। আগামীকাল এ বাড়িতে মিলাদ। ফকির খাওয়ানো হবে।
তিন দিন পর সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে মারুফ।
ছেলেকে দেখে দুজনই চমকে ওঠেন।
মারুফ, তুই? আয়শা খাতুন আতঙ্কিত কণ্ঠে বলেন। মারুফ মাকে ব্যাকুল শোকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আকমল হোসেন ছেলের ঘাড়ে মুখ রেখে নিজের চোখের জল সামলান। মারুফ বাবার ঘাড়ে মাথা ঘষে, আবার মায়ের বুকে আশ্রয় নেয়।
এই মুহূর্তে এই বাড়িতে সময় স্তব্ধ হয়ে থাকে। এক-একটি মুহূর্ত অনন্তকাল হয়ে যায়।
বাবা-মা দুজনে ছেলেকে নিয়ে মেরিনার ঘরে আসেন। মারুফ বলেছে, এই বাড়িটা এখন একটা বিপজ্জনক জায়গা জেনেও আমি এসেছি, আব্বা-আম্মা। ওর ঘরে একটি মোমবাতি জ্বালাতে এসেছি।
তুই মেলাঘর থেকে কবে এলি?
আজই দুপুরে এসে পৌঁছেছি।
কবে যাবি? কা
লকে যাব। নাজমুলের কাছ থেকে খবরটা শোনার পরে অনেকে আমাকে এই বাড়িতে আসতে না করেছে। আমি অনেকক্ষণ এই বাড়িকে নজরে রেখে তার পরে ঢুকেছি। সতর্কতার সঙ্গে এসেছি, আব্বা।
মেরিনার ঘরে আলো জ্বলছিল। সারা রাত এই ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখেন আয়শা খাতুন। রান্নাঘর থেকে একটি মোম জ্বালিয়ে নিয়ে আসেন তিনি। মারুফের হাতে দেন। মারুফ খাটের ওপর মেরিনার মাথার কাছে কতগুলো বই রেখে তার ওপর মোম রাখে। নিচে বসে কাঠের ওপর মাথা ঠেকিয়ে রাখে ও।
আয়শা খাতুন নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকেন। ঘরের ভেতরে গুনগুন ধ্বনি ছড়ায়—আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে। তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে…।
আকমল হোসেন নিচু হয়ে ছেলেকে টেনে তোলেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। আয়শা খাতুন আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মোছেন, ছেলের চোখ মোছেন। পুরো পরিবার একটি মোমের শিখার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবেন, তাদের মেয়েটি মরে যায়নি। ও এখন একটি প্রজ্বলিত আগুনের শিখা।
সময় ফুরোয়।
মারুফ বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি এখন যাই।
আয়শা খাতুন ওর হাত ধরে বলেন, আমাদের সঙ্গে খেয়ে যা। তোকে বেশিক্ষণ আটকাব না।
ডাইনিং টেবিলে আবার নিস্তব্ধতা।
ঠিকমতো খেতে পারে না কেউ। খাবার মুখে ওঠানো কত যে কঠিন কাজ, এ কাকে বলে বোঝাবে কে। তবু মারুফ প্লেটের ভাত শেষ করে। ডাল উঁাড়শ ভাজি আর ডিমের তরকারি দিয়ে। মায়ের রান্নার আগের টেস্টও নেই। ডাইনিং টেবিলের আয়োজনও নেই।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার পেট ভরে গেছে, আম্মা। আপনাদের খাওয়া শেষ হলে আমি হাত ধোব।
আমাদের খাওয়া!
শেষ করবেন না?
করব তো। অনেক সময় লাগবে।
আমার তো বেশি রাত করা উচিত না। পথেঘাটে কত বিপদ।
ও, তাইতো।
দুজনে দ্রুত খেয়ে শেষ করেন। ডাল আর ভাজি ঠিকমতো খাওয়া হয় না। ডিমের তরকারি তো প্লেটেই ওঠে না।
মন্টুর মা টেবিলের কাছে এসে বলে, এরকম করে খেলে তাদের শরীর কি ঠিক থাকবে!
আব্বা-আম্মাকে আপনারা দেখবেন, বুয়া।
আমরা তো চেষ্টা করি। সব সময় পেরে উঠি না।
দুজনে উঠে বেসিনে গিয়ে হাত ধোন। মারুফও উঠে এসে বাবা-মায়ের কাছে দাঁড়ায়।
তুই এখন কোথায় যাবি, বাবা?
ফার্মগেটের দুর্গবাড়িতে। সকালে উঠে মেলাঘরে চলে যাব।
কয় দিন থাকবি মেলাঘরে?
বেশি দিন না। কমান্ডার আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। নতুন তেজে গেরিলাদের আবার ঢুকতে হবে ঢাকায়। গোলাবারুদ-অস্ত্র নিয়ে। আগস্ট মাসে গেরিলাদের ধরা পড়ার পরে ঢাকা শহরে গেরিলা তৎপরতা যে কমেছে, এই অবস্থা বেশি দিন থাকবে না। আমরা আরও দ্বিগুণ প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকায় ঢুকব।
মারুফ তোয়ালেতে হাত-মুখ মুছে বলে, যাই, আম্মা।
যাবি?
যেতে তো হবেই, আম্মা।
আয়শা খাতুন ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।
এখন কান্নার সময় নয়, আশা। এখন বুকে পাথর বাধার সময়। আমরা তো এই প্রতিজ্ঞা নিয়েছি।
যাই, আব্বা।
কবে আসবি?
সাত দিনের মধ্যে ঢাকায় ঢুকব।
বাড়িতে আসবি তো?
এবার আমার হাইড হবে ফার্মগেটের বাড়িতে। ওখানে থেকেই অপারেশনে যাব। দোয়া করবেন আমার জন্য। কবে বাড়িতে আসতে পারব, তা বলতে পারছি না।
মারুফ দুজনকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
আলতাফকে বলে, সাবধানে থাকবেন। আসি।
বেরিয়ে যাওয়ার সময় পেছন দিকে তাকায় না। দ্রুত রিকশায় ওঠে।
সাত দিনের মাথায় বৃষ্টি মাথায় করে দুজন যোদ্ধা আসে আকমল হোসেনের বাড়িতে। আয়শা খাতুন ওদের তোয়ালে দেন ভেজা শরীর মোছর জন্য। ওরা শিহাব আর কামরুল। বয়স কম। মাত্র স্কুলের গণ্ডি পার হয়েছে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে, আমরা আবার ঢাকা শহরে ঢুকেছি। আগামীকাল থেকে এই শহর চাঙা করে তুলব।
আকমল হোসেন মৃদু হেসে বলেন, আমরা আবার জয়ী হব, বাবারা।
আয়শা ওদের দুহাত নিজের কপালে ঠেকিয়ে বলেন, তোমরা আমার প্রাণ।
ছেলেরা তাঁর দিকে তাকিয়ে বলে, আমরা এই বাড়িটা গুছিয়ে দেব? যারা তছনছ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এটাও একটা প্রতিশোধ।
না। এভাবেই থাকুক কিছুদিন। এভাবে থাকলে মেরিনা নেই এ সত্য আমরা তীব্রভাবে বুঝতে পারি।
কত দিন এভাবে থাকবে?
আমি জানি না।
স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত কি?
হতে পারে। তোমাদের জন্য চা নিয়ে আসি।
আয়শা খাতুন উঠে যান। যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে আকমল হোসেন বলেন, তোমরা ঢাকায় কত দিন থাকবে?
আপাতত যাচ্ছি না। পরশু আমাদের অপারেশন আছে। সিরিজ অপারেশনের চিন্তা আছে।
কোন পথে ঢুকেছ তোমরা?
আমরা গোপীবাগের পেছন দিয়ে ঢাকায় ঢুকেছি। ওখানে একটা গ্রামে ক্যাম্প করা হয়েছে। আস্তে আস্তে গোলাবারুদ-অস্ত্র ঢাকায় আনা হবে। সাভারের দিক থেকেও গেরিলারা ঢাকায় ঢুকছে। দলে দলে গেরিলারা ঢাকায় ঢুকবে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, পাকিস্তানি আর্মিকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা হবে। যেন ওরা দম ফেলার সময় না পায়। আকমল হোসেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বিষণ্ণতার মধ্যে এ এক অলৌকিক আনন্দ। ছেলেরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বস্তি পায়। আয়শা খাতুন ওদের জন্য পুডিং আর চা নিয়ে আসেন। ছোট প্লেটে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা দেন।
চটপট খেয়ে নাও।
এত খাবার?
তোমাদের জন্য মোটেই বেশি না। একটু খাবার তো খেতেই হবে। খিচুড়িটা আগে খাও। তারপর পুডিং। পরে চা।
ছেলেরা বেসিন থেকে হাত ধুয়ে আসে। দ্রুত খেয়ে শেষ করে। যাবার সময় বলে, প্রতিদিন কোথাও-না-কোথাও কিছু ঘটবে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনলে ভাববেন, আমরা আপনাদের কাছে আছি। আমরা যাচ্ছি, জয় বাংলা মামণি।
দুজনে চুপ করে বসে থাকেন। তারা বুঝতে পারেন, তাঁদের জীবন থেকে সময় কমে যাচ্ছে। আয়শা খাতুনের মনে হয়, কত দিন ধরে তিনি যেন সোয়েটার বুনছেন না। উল-কাঁটা হাত দিয়ে ধরলে পুড়ে যায় হাত–প্রবল যন্ত্রণা তাকে উথালপাতাল করে। আগুনবিহীন পুড়ে যাওয়ার স্মৃতি তাঁর শরীর অবশ করে দেয়। তিনি সোফার ওপর পা উঠিয়ে বসেন। পেছনে মাথা হেলিয়ে দেন। দৃষ্টি ছড়িয়ে থাকে উল্টে-পাল্টে থাকা ঘরের ভেতর। কিন্তু তিনি কিছুই দেখতে পান না। এই বোধ তাকে ভীষণ ক্লান্ত করে। ভাবেন, শরীরের সবটুকু শক্তি নিঃশেষ। এমন কাউকে যদি পেতেন যে, তাঁর পুরো সময়টুকু গানে গানে ভরিয়ে রাখত!
আকমল হোসেন সোফা ছেড়ে উঠতে চান। পারেন না। শরীর ভারী লাগছে। পিঠের ব্যথা চড়চড়িয়ে উঠছে। পা ফেলতেও কষ্ট। মনে হয় কত কাল ধরে যেন নিজের টেবিলে বসা হচ্ছে না। ডায়েরির পৃষ্ঠা খোলা হচ্ছে না। পত্রিকার খবর পড়া হচ্ছে না। ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহে ভাটা পড়েছে। স্মৃতির পৃষ্ঠা ভরে থাকছে শুধু। তাঁর পাশে যদি কেউ থাকত, যদি লিখে রাখত প্রতিদিনের ঘটনা-বলত, দেখুন, কত কিছু লিখে রেখেছি আপনার জন্য। ভয় নেই, ইতিহাসের একটি তথ্যও হারাবে না। এই শহরের সবটুকু আপনার জন্য রক্ষিত আছে। আকমল হোসেন সোফায় মাথা হেলালেন। দেখলেন, তছনছ করা ঘরে দুজন মানুষ মুমূর্ষ অবস্থায় বসে আছেন। কারণ, এই বাড়ির একটি মেয়ে শহীদ হয়েছে। বাড়িটিকে যুদ্ধক্ষেত্র ভেবে তারা এই বসবাসকে নিজেদের ভেতরের সবটুকুর সঙ্গে আটকে রেখেছেন। তারা স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের বাইরের মানুষ নন। সোফায় মাথা হেলালে দুচোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। আর কত দিন পারবেন নিজেকে সামলাতে! সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবতে চাইলেন। পরে মনে হলো, না, ভাবাটি ভালো।
দুদিন পরই মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে গ্রেনেড ছোড়া হলো। ফোন পেলেন নাহিদের কাছ থেকে।
আমরা এভাবে শহরজুড়ে থাকব।
কেটে যায় লাইন। তিনি বসে পড়েন। বুকের ভেতর ধস। ব্যথায় কষ্ট লাগছে।
দুই দিন পর আবার খবর পেলেন, খান এ সবুর খানের ধানমন্ডির বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে।
আবার খবর পেলেন, প্রাদেশিক নির্বাচন কমিশন অফিসে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। একজন মারা গেছেন, দুজন আহত হয়েছেন, ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, বোমার আগুনে কাগজপত্র পুড়েছে। ঘরের ছাদ ধসে পড়েছে।
খবর জানতে পারেন তুহিনের কাছ থেকে। ওর হাসিতে ঝড় ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, আমরা গেরিলা পত্রিকা সাইক্লোস্টাইল করে ছেপেছি। দু-এক দিনের মধ্যে বিলি করতে হবে। আমি আর শমসের পত্রিকার কপি নিয়ে আসব।
ফোন রেখে দেয় ওরা। মেরিনা গেরিলা পত্রিকা বিতরণ করত। বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসত। এখন এই বাড়িতে তাকে কপি দেবে ওরা। কে বিতরণ করবে? চোখ ভিজে যায় আকমল হোসেনের। এত চোখ ভিজে গেলে তো অন্ধ হয়ে যাবেন, এই যুদ্ধের সময় কি কারও নিজে নিজে অন্ধ হয়ে যাওয়া সাজে? একদম না। নিজেকে ধমক দিয়ে নিজেকেই উত্তর দেন তিনি। আয়শা কাছে এসে বলেন, চা খাবে?
হ্যাঁ। কড়া করে চা দিতে বলল।
ডাইনিং টেবিলে এসো। নাকি বারান্দায় বসবে?
বারান্দায়। আকমল হোসেন জোর দিয়ে বলেন।
আয়শা খাতুন ভুরু কুঁচকে বলেন, বারান্দার ছোট টেবিলটা সেপাইরা ভেঙে ফেলেছে।
ড্রয়িংরুমের একটা টিপয় নিয়ে আসছি। তুমি যাও।
আয়শা খাতুন যেতে যেতে স্বস্তি পান। অনেক দিন পর ভালোবাসার মানুষটির স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর টের পেলেন আজ। যেন নিজের জায়গায় ফিরে এসেছেন, যেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে যুদ্ধ-সময়ের মানুষ ভাবতেন। বলতেন, আমার বয়স হয়নি। এখনো তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর। প্রতিদিনের যুদ্ধক্ষেত্রে হেঁটে যেতে পারি।
চা খেতে খেতে আয়শাকে বললেন, দু-এক দিনের মধ্যে ছেলেরা গেরিলা পত্রিকা বিলি করার জন্য নিয়ে আসবে। ফোনে তা-ই বলল।
আসুক। যত খুশি কপি পারে নিয়ে আসুক।
কে বিলি করবে?
কেন, আমি। তুমিও করবে। আলতাফ করবে।
আয়শা খাতুন চায়ের কাঁপে চুমুক দেন। আকমল হোসেনের দিকে তাকান না। আয়শা খাতুনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করলেন আকমল হোসেন। তিনি নিজেও শেষ করে কাপটা ঠেলে দিলেন। দেখলেন, আয়শা খাতুন চামচ দিয়ে পিরিচে টুংটুং শব্দ করছেন। একপর্যায়ে বলেন, বল, কী বলবি? ভাবছিস, কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকলেই আমি তোর কথা বুঝব? পেটে ধরেছি বলে এমন করে ভাবতে হবে?
আমার গানটি আপনার কাছ থেকে শুনব, আম্মা। মনে হচ্ছে, এখনই আমার গান শোনার সময়।
তোর প্রিয় গানটি, মা? আমার ময়না পাখি।
তুমি কি কিছু ভাবছ, আশা?
ভাবছি। তোলপাড় করা দুনিয়ায় আমার ভাবনার শেষ নেই।
কী ভাবছ, বলবে? আমি তোমার ভাবনার অংশী হতে চাই।
মেরিনার প্রিয় গানের কথা ভাবছি। ও আমাকে এই গানটি গাইতে বলছে।
আকমল হোসেন গান শোনার অপেক্ষা করেন। একটু আগেই তিনি বুঝে গেছেন যে, আয়শার নিজের ভেতরে ফিরে আসার প্রস্তুতি শেষ। এখন তিনি মেরিনার সঙ্গে কথা বলছেন। নিজের সঙ্গে কথাও। আকমল হোসেন প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে দূরে তাকালেন। ভেসে ওঠে গুনগুন ধ্বনি—
আমার যাবার বেলাতে সবাই জয়ধ্বনি কর।
ভোরের আকাশ রাঙা হলো রে,
আমার পথ হলো সুন্দর।।
আয়শা একমুহূর্ত থেমে বলেন, তুমি কি গাইবে আমার সঙ্গে?
আকমল হোসেন চমকে আয়শার দিকে তাকান। বলেন, হ্যাঁ, গাইব। মেরিনার প্রিয় গানটি আমিও গাইতে চাই, আশা।
তুমিও ওর কথা শুনতে পাও?
আকমল হোসেন চুপ করে থাকেন।
আমি শুনতে পাই। প্রতিদিন আমি ওর সঙ্গে কথা বলি।
তিনি আবার শুরু করেন গানের ধ্বনি–
কী নিয়ে বা যাব সেথা ওগো তোরা ভাবিস নে তা,
শূন্য হাতেই চলব বাহিরে
আমার ব্যাকুল অন্তর।।
মালা পরে যাব মিলনবেশে, আমার পথিকসজ্জা নয়
বাধা বিপদ আছে সঁঝের দেশে,
মনে রাখি নে সেই ভয়।
যাত্রা যখন হবে সারা
উঠবে জ্বলে সন্ধ্যাতারা, পূরবীতে করুণ বাঁশরি
দ্বারে বাজবে মধুর স্বর।
আকমল হোসেনের মনে হয়, আয়শার গুনগুন ধ্বনি আজ বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
আয়শা গুনগুন ধ্বনি থামিয়ে বলেন, মেয়েটির যাত্রা তো শেষ হয়েছে। সন্ধ্যাতারা কি জ্বলে উঠেছে? তুমি কি দেখেছ? খুঁজেছ নাকি সন্ধ্যাতারা?
আকমল হোসেন দুহাতে মুখ ঢাকেন।
আয়শা খাতুন প্রাঙ্গণে দৃষ্টি ফেলে বলেন, মানুষের দ্বারে কি মধুর স্বর বাজছে? শহীদের জন্য ঘরে ঘরে প্রার্থনার মতো বলা হচ্ছে কি, তোমরা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছ, আমরা তোমাদের জয়গান গাইছি। আহ্, ওরা তো নির্ভীক পায়ে যাত্রা শেষ করেছে। ওদের শেষ যাত্রায় জয়ধ্বনি করতে বলেছে।
তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না?
না, না। আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।
আকমল হোসেন দেখলেন, আয়শা জ্ঞান হারিয়েছেন। সবাই মিলে তাকে শোবার ঘরে নিয়ে যায়।
দিন সাতেক পর আবার বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে শহর। দুদিন আগে এসেছিল ছেলে দুটো। স্কুলের ছাত্র, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে। পাঁচ পাউন্ড পিকে নিয়ে গেছে তাঁর কাছ থেকে।
এই দুজনের লক্ষ্য ছিল ডিআইটি টাওয়ারের ওপরে টেলিভিশনের যে অ্যান্টেনা টাওয়ার আছে, সেটিকে কাটিং চার্জ করে ফেলে দেওয়া। নানা বাধায় সুযোগ করতে পারেনি। এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, ডিআইটির একজন কর্মচারী মাহবুব। তিনি নাটক করেন। জন আর ফেরদৌসকে সহযোগিতা দিচ্ছেন। ভেতরে ঢোকার পাস জোগাড় করে দিয়েছেন।
টেলিভিশন স্টুডিও থাকার কারণে ডিআইটি ভবনের সিকিউরিটিতে খুবই কড়াকড়ি। চেকিংয়ের শেষ নেই। প্রধান দুটো গেটের একটি খোলা থাকে ভেতরে ঢোকার জন্য। তা-ও আবার প্রতি ফ্লোরে আছে চেকিংয়ের ব্যবস্থা। মূল ভবনে ঢোকার মুখে আছে চেকপোস্ট। প্রতিটি তলার সিঁড়ির মুখে আছে চেকপোষ্ট। প্রতি তলার চেকপোস্ট পার হয়ে সাততলায় উঠতে হয়।
কথাগুলো বলে মিষ্টি করে হাসে জন। আকমল হোসেন সেই হাসি দেখে জেগে ওঠেন। ওরা আছে বলে শক্তি ফুরোয় না। এক রাতে কতজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে গেল, ওরা ভয় পায়নি। ওদের জায়গা পূরণ করে রুখে দাঁড়িয়েছে। এখানেই মৃত্যুর শান্তি।
আগামীকাল আমরা রেকি করতে সাততলায় যাব। ভয় পাচ্ছি, এত চেকিং কাটাতে পারব কি না ভেবে।
সব অপারেশনেই রিস্ক থাকে, ছেলেরা। ভয় পেলে চলবে না, রিস্ক কাটাতেও হবে।
আমরা সেই সাহস নিয়েই তো এগোই, আঙ্কেল।
জানি। তোমাদের পিকে নেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে?
মাহবুব ভাই বারো পাউন্ড পিকে নিতে পেরেছেন। আমাদের মোলো পাউন্ড লাগবে।
মাহবুব দারুণ কাজ করেছে।
প্রথম দিন মাহবুব ভাই অফিসে যাওয়ার আগে আমি তার পায়ের কাছে ফার্স্ট এইড ব্যান্ডেজ বেঁধে আট আউন্স পিকে বেঁধে দিই। জুতোর ভেতরে পায়ের পাতার নিচে আরও আট আউন্স পিকে দেওয়া হয়। মাহবুব ভাই বারো দিনে বারো পাউন্ড পিকে বিল্ডিংয়ের ভেতরে নিয়ে গেছেন। সাততলার একটি ঘরের পুরোনো ফাইলপত্রের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
জন আবার মিষ্টি করে হাসে। একমুখ হাসি নিয়ে ফেরদৌসও আকমল হোসেনের দিকে তাকায়। তার মনে হয়, এই হাসিই এখন সম্বল।
তোমাদের কি আরও পিকে দেব?
না, লাগবে না। যোলো পাউন্ড পিকে আমাদের হাতে আছে। রেকির কাজ শেষ হলে দু-এক দিনের মধ্যে অপারেশনের সময় ঠিক করব।
এসো।
আকমল হোসেন হাত বাড়িয়ে ওদের ডাকেন।
ওরা কাছে এলে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাখেন। পরস্পরের বুকের উষ্ণতায় নির্ভরতা বাড়ে। আকমল হোসেন ওদের মাথার ওপর মুখ রেখে চোখ বন্ধ করেন।
তারপর ছেলেরা বলে, আমরা যাই, আঙ্কেল।
এসো। দোয়া করি, সফল হও।
যোলো পাউন্ড পিকে বহন করার আগেই সমস্যা দেখা দেয়। মাহবুব ওদের খবর দেয় যে, সাততলার যে ঘরে পিকে রাখা হয়েছে, সে ঘরের ফাইলপত্র গোছানোর তোড়জোড় চলছে। দুই কিশোর যোদ্ধা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। যোলো পাউন্ড পিকে বহন করার আগেই কাজটি করে ফেলতে হবে।
মাহবুবের পায়ের নকল ব্যান্ডেজের নিচে বেঁধে দেওয়া হয় ছয় গজ ফিউজওয়্যার। একটি কলমের ভেতরের অংশ ফেলে দিয়ে খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় একটি ডেটোনেটর। মাহবুব সেগুলো পায়ে বেঁধে ঢুকে যান অফিসে।
জন আর ফেরদৌসের জন্য দুটো পাস জোগাড় করা হয়েছিল। অডিশন দেওয়ার অজুহাত ছিল। ওরা নির্দিষ্ট সময়ে ডিআইটি ভবনে ঢুকে যায়। ছয়তলার চেকপোেস্ট পর্যন্ত নির্বিঘ্নে ওঠে। সাততলার গেটে পুলিশ ওদের আটকায়। কী জন্য যাবে, জিজ্ঞেস করতেই ওরা বলে, ওরা সরকারের অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছে বুড়িগঙ্গায় কতটা পানি বেড়েছে, তা দেখার জন্য। এবারে বর্ষা খুব বেশি। বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ওদের কথার মাঝখানে অন্য লোকজন এসে পড়ায় পুলিশ ওদের ছেড়ে দেয়।
ওরা দ্রুত উঠে যায় নির্দিষ্ট ঘরে। পিকে বের করে একত্র করে। জন চার্জ সেট করে। ফিউজওয়্যারে ইগনিশন পয়েন্ট ও ডেটোনেটর ফিট করে ফেরদৌস।
ওদের সামনে সময় অনন্তকাল। অথচ মুহূর্ত মাত্র সময়। বেলা একটা বারো মিনিটে ফিউজওয়্যারে আগুন দেয় ওরা।
হাতে মাত্র তিন মিনিট সময়। তিন মিনিট পর বিস্ফোরণ ঘটবে। সরে যেতে হবে এই ভবনের এলাকা থেকে। ওরা যখন ভবন ছেড়ে রাস্তায় নামে, তখন বিস্ফোরণ ঘটে।
গাড়ি নিয়ে স্টেডিয়াম এলাকায় অপেক্ষা করছিলেন আকমল হোসেন। বিভিন্ন দোকানে ঘুরে নানা জিনিস দেখছিলেন। টুকটাক কেনাকাটাও করেছেন। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে গাড়ির কাছে আসেন। ওদের দূর থেকে দেখে গাড়িতে স্টার্ট দেন। ওরা এসে গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চলতে শুরু করে।
কনগ্রাচুলেশনস, ফ্রিডম ফাইটার্স।
আকমল হোসেন রাস্তার দিকে তাকিয়ে কথা বলেন।
আমার বুক এবং পিঠ দুটোই তোমাদের জন্য আছে। আমার পিঠ দেখে ভেবো না যে, আমি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করছি।
হা হা করে হাসে দুই ছেলে।
আমরা তো সবই জানি, আপনি আমাদের অভিভাবক, আঙ্কেল।
তোমাদের কোথায় নামাব?
মগবাজারের কোথাও।
ঠিক আছে। এই সময় আমি বাইরে থাকতে চাই না। বাড়িতে খোঁজ নিতে আসতে পারে বিস্ফোরণের ঘটনায়। ওরা দেখুক যে আমি বাড়িতেই আছি। ওদের কোনো প্রশ্নের সুযোগ দেব না। যা করবে, আমার ওপর দিয়ে করবে। গাড়ি থামে মগবাজারের মোড়ে। দুজনে নেমে যায়।
বাড়ি পৌঁছে আমাকে একটা ফোন দিয়ো তোমরা।
জি, আঙ্কেল।
ওরা দ্রুত পায়ে গলির ভেতর ঢুকে পড়ে।
আকমল হোসেন বাড়ি ফিরলে দেখতে পান, আয়শা খাতুন বারান্দায় বসে আছেন। এক পলক তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। হঠাৎ করে বয়স বেড়ে গেছে মনে হয়। মাথার সামনের দিকের অনেক চুল সাদা হয়েছে। আকমল হোসেন গ্যারেজে গাড়ি ঢোকাতে গেলে পেছনের বারান্দায় আসেন আয়শা খাতুন। তিনি বারান্দায় উঠলে বলেন, সাকসেসফুল অপারেশন?
হ্যাঁ।
ওদের বাড়িতে দিয়ে এসেছ?
না। মগবাজারের মোড়ে ছেড়ে এসেছি। ভাবলাম, আমার বাড়িতে থাকা দরকার। যদি আর্মি খুঁজতে আসে।
যদিও সেদিনের পর আর্মি এ বাড়িতে আসেনি। তারপর বলা তো যায় না।
ঠিক বলেছ, আশা।
তোমার জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে রেখেছি।
লেবুর শরবত! চমকে ওঠেন আকমল হোসেন। হঠাৎ করে মনে হয়, কথাটি তাকে মেরিনা বলল। ঠিক যেমন করে মেরিনা বলত, ঠিক তেমন ভঙ্গিতেই আয়শা বলেছে। তিনি আয়শার পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়েও ফিরে দাঁড়ান। ঘাড়ে হাত রেখে বলেন, এসো। লেবুর শরবত খাবে। যা গরম পড়েছে। ভীষণ ভাপসা গরম।
আয়শা ফ্রিজ থেকে লেবুর শরবত বের করেন। নিজের জন্যও এক গ্লাস। দুহাতে দু-গ্লাস নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসেন। গ্লাস নিতে নিতে আকমল হোসেন জিজ্ঞেস করেন, কী রান্না হয়েছে?
পাবদা মাছের ঝোল। করল্লা ভাজি আর ডাল। আর কিছু চাও?
না, না, এতেই হবে।
ভাত তো খেতেই পারো না। ভাতের থালা সামনে নিয়ে বসে থাকো। মনে হয়, ভাত খেতে তোমার বুঝি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এভাবে কেউ ভাত খায় না।
ঠিকই বলেছ। তবে ঠিক বলেনি যে, এভাবে কেউ ভাত খায় না।
ঠিক বলিনি? আমি ঠিকই বলেছি।
আমি তো জানি, আরও একজন এভাবেই ভাত খায়। আমারই সামনে বসে খায়।
আয়শা খাতুন লেবুর শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে উঠে পড়েন।
বসো, আশা। তুমি শরবত না খেলে আমিও খেতে পারব না।
আয়শা খাতুন সোফায় এসে বসেন। দুজনে একসঙ্গে একটু একটু করে শরবত খান। যেন একেকটি চুমুকে শেষ হয়ে যেতে পারে জীবনের বাকি সময়টুকু।
মন্টুর মা দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, টেবিলে খাবার দিয়েছি।
দুজনে ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকান। যেন বলতে চান, তুমি আমাদের নীরবতা কেন ভাঙতে এসেছ। কিন্তু বলা হয় না।
ঘুমোতে যাবার আগে ফোন আসে জনের কাছ থেকে।
আঙ্কেল, মাহবুব ভাই জানিয়েছেন, বিস্ফোরণে টাওয়ারের একটি অংশে ফোকর হয়েছে। সাততলার মেঝেতে গর্ত হয়েছে। আগুন সাততলা থেকে ছয়তলায় ছড়িয়ে পড়েছে। অফিসের অনেক কাগজপত্র পুড়ে গেছে।
আবারও তোমাদের কনগ্রাচুলেশনস। ওরা বুঝেছে যে আমাদের দমাতে পারেনি।
আঙ্কেল, দোয়া করবেন।
সেদিন তিনি নিজের টেবিলে এসে বসলেন। ডায়েরির পাতা খুললেন। আয়শা উল-কাটা নিয়ে সোয়েটার বুননের বাকি কাজ নিয়ে বসেন। পেছনের বারান্দার দিক থেকে ঝিঁঝিটের ডাক ভেসে আসে। দুজনেরই মারুফের কথা মনে হয়। শব্দের ভেতরে স্মৃতির বিকাশ ঘটে। শব্দ স্মৃতিকে পথে ডাকে। দুজনেই ভাবলেন, পথের ডাকে স্মৃতির রেশ বড় নিষ্ঠুর। দুজনে ঘুমোত গেলে পরস্পরের দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে থাকলেন। বুঝলেন, জীবনের জলরঙে স্মৃতির ক্যানভাস ভরে না। কোথায় পালাবেন তারা? তাদের সামনে কোনো ঠিকানা নাই। যন্ত্রণার দাবদাহে পুড়বেন। আবার ফিনিক্স হয়ে জাগবেন। জাগতেই তো হয় মানুষকে। তারা পরস্পরের দিকে মুখ ফেরালেন। হাত ধরলেন। আয়শা খাতুন বিড়বিড় করলেন, মারুফ যে এখন কোথায় আছে? শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে? নাকি সীমান্তের ওপারে? আকমল হোসেন বিড়বিড় করলেন, আমরা কেন ওর কথা ভাবছি। ওকে তো ওর মতো থাকতে দিতে হবে। আয়শা বললেন, তাহলে কি অপেক্ষা করব? হ্যাঁ, অপেক্ষাই করতে হবে আমাদের। ওর বিজয়ী হয়ে ফিরে আসার অপেক্ষা।
দুজনেরই মনে হয়, চারদিক তোলপাড় হচ্ছে। ঝিঁঝিটের ডাক নেই। পোকাগুলোকে বুটের নিচে পিষে মারছে সৈনিকেরা। ওরাও এখন ওদের শত্রু। ওই শব্দ যেন কারও স্বাধীনতার স্বপ্ন বাড়িয়ে না দেয়, সে জন্য ওদের এমন নিধন। দুজনে বিছানার ওপর উঠে বসেন।
তুমি কি কোনো স্বপ্ন দেখেছ, আশা?
আমার মনে হচ্ছিল, মারুফ বুঝি ডাকছে। ও পাগলের মতো আমাদের খুঁজছে। আমরা সামনে দাঁড়িয়ে আছি, ও আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। তুমি কিছু স্বপ্ন দেখেছ?
আমার মনে হলো, মারুফ আমাদের দেখে হেঁটে আসছে। কিন্তু ভীষণ কুয়াশা ওর চারদিকে। কুয়াশা কখনো নীল, কখনো সাদা। কখনো গোলাপি, কখনো সবুজ। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আমি ওকে এভাবেই দেখব অনন্তকাল।
আমাদের মাথা কি খারাপ হয়ে যাচ্ছে?
নাকি আমরা ওকে দেখার জন্য ব্যাকুলতা বোধ করছি?
দুজনের প্রবল নিঃশ্বাস বাতাসে উড়ে যায়। দুজন পেছনের বারান্দায় এসে বসেন। সুনসান রাত। কুকুরও কোথাও ডাকছে না। পাখিও না। জোনাকি নেই। অন্ধকার সামনে রেখে বসে থাকার যন্ত্রণা দুজনকে কুঁকড়ে রাখে।
পরদিন মারুফের ফোন আসে। ফোন ধরেন আয়শা।
আম্মা, আমি ঢাকায় এসেছি।
কোথায় আছিস, বাবা?
ফার্মগেটের দুর্গবাড়িতে।
বাড়িতে আসবি একবার?
অপারেশনের পরে আসব। আব্বা কই?
তিনি তো বাইরে গেছেন। ডা. আশরাফের সঙ্গে একজন আহত গেরিলাকে দেখতে যাবেন।
কে আহত হয়েছে, আম্মা?
নাম তো আমার মনে নাই রে।
আব্বার সঙ্গে আর কথা হবে না। আব্বাকে আমার সালাম দেবেন।
ছেলের সঙ্গে কথা বলে আয়শার মন খুশিতে ভরে যায়। ভাবেন, আলতাফকে বাজারে পাঠাবেন। মারুফের পছন্দের খাবার ফ্রিজে রাখতে হবে। তিনি রান্নাঘরে আসেন।
মন্টুর মা, মারুফ ঢাকায় এসেছে।
মেলা অস্ত্রশস্ত্র এনেছে?
এনেছে বোধ হয়।
কোথায় যুদ্ধ করবে?
এটা তো আমাকে বলেনি। এসব কথা ফোনে বলা ঠিক নয়।
হ্যাঁ, তাইতো। কী রাঁধব আজ?
ওর পছন্দের সবকিছু। আলতাফ যা আনবে, সব দেখেশুনে রান্না করবে। ফ্রিজে রাখা হবে। ও কখন আসে বলা তো যায় না।
মন্টুর মা ঘাড় নেড়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়। আয়শা খাতুন মারুফের তছনছ করে যাওয়া ঘরটা গোছাতে শুরু করেন। জোরে জোরে সেনাসদস্যদের গাল দেন, বকা দেন। মানুষের ঘরদুয়োর নষ্ট করার জন্য অভিশাপ দেন। আয়শা খাতুনের মনে হয়, তিনি জীবনের বাকি সময়ে এই ঘর আর ঠিক করতে পারবেন না। এ বড় কঠিন কাজ।
আকমল হোসেন বাড়ি ফিরে দেখতে পান, আয়শা খাতুন ঘর পরিষ্কার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে খাটের পাশে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। তিনি জেনেছেন মারুফের টেলিফোনের কথা। তার সঙ্গে ছেলের কথা হলো না! এই বিষাদে তিনি খানিকটা মনমরা হয়ে গেলেও ছেলের ঘর দেখে স্বস্তি পেলেন। এত দিন কোনো ঘরই গোছানো হয়নি। আজ মারুফের ঘর গোছানো হচ্ছে। বুকের ভেতরে খানিকটা স্বস্তি ফিরিয়ে এনে ভাবলেন, আয়শা ঘুমাক। ওর ঘুম খুব দরকার। ও নিজের সঙ্গে লড়াই করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তার আর নিজের ঘরে যাওয়া হলো না। মারুফের ঘরে ঢুকে খালি একটা চেয়ারে বসে পড়েন।
পরদিন সকালে ফার্মগেটের দুর্গবাড়ি আক্রমণ করে আর্মি। বেশ কিছুদিন ধরে এলাকার চারদিকে নজর রাখছিল ওরা। নতুন লোকজনের আসা-যাওয়া খেয়াল করছিল। কে কোন দিক থেকে আসছে, কোন দিকে ঢুকছে এই সব। নতুন লোক দেখলে মাঝেমধ্যে আইল্যান্ডে অবস্থানকারী মিলিটারি পুলিশ জিজ্ঞেস করত, তুমহারা নাম কেয়া? কিধার যায়েগা? উত্তর না দিলে বেতের লাঠির খোঁচা দিয়ে বলত, বাতাইয়ে।
এই উৎপাতের কারণে এলাকায় পায়ে হাঁটা লোকজনের চলাচল কমে গিয়েছিল। তারপর গোয়েন্দারা গেরিলাদের আশ্রয়কেন্দ্রটি খুঁজে পায়। তখন সকাল আটটা বাজে। ওরা পাঁচজন ছিল বাড়িতে। কেউ ঘুম থেকে জেগেছে, কেউ বিছানা ছাড়েনি। এমন সময় যমদূতের মতো এসে দাঁড়ায় ওরা। ওদের আগমনের খবর প্রথমে টের পায় মারুফ। ঘরে ঢুকে অন্যদের খবর দেয়, আমাদের দুর্গ আক্রান্ত হয়েছে। ওরা বাড়ির উঠোনে এসেছে। ওরা ছয়জন। রাইফেল, স্টেনগান আছে হাতে। গাছপালাঘেরা বাড়ি তো, তাই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সতর্কতার সঙ্গে আসছে।
তুই বাইরে গিয়ে দাঁড়া। দেখ, কী বলে।
বাকিরা চৌকি ছেড়ে উঠে পড়ে।
মারুফ বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওর চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান দেয়। একজন সৈনিক।
আর্মস-অ্যামুনিশন কিধার?
নেহি জানতা।
নেহি জানতা! গাদ্দার। বাতাইয়ে।
বাকিরা ঘরে ঢুকেছে। বিভিন্ন ঘর থেকে বের করে আনে সবাইকে। ওদের গেঞ্জি ও শার্ট খুলে হাত এবং চোখ বাঁধে। পাঁচ-ছয়বার বাড়ির চারদিকে ঘোরায়। ওরা কেউ কোনো কথা বলে না। রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাড়ি দিলে ওরা পাঁচজন শুধু বলে, নেহি জানতা। প্রশ্ন ছাড়া উত্তরটা অনবরত আওড়াতে থাকে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা।
ওদের কাছ থেকে অস্ত্রের খবর বের করা কি সহজ! ওরা তো মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে। ওদের হারানোর কিছু নেই।
যমদূতের মতো ছয়জন পাকিস্তানি সেনা ওদেরকে বাড়ির পেছনে নিয়ে যায়। গাছ, বুনো ঝোপ এবং ঘাস ও শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি চারদিকে কম্পন তোলে।
বাতায়ে মুকুত কিধার? বাতায়ে আর্মস কিধার?
ওরা বুক টান করে দাঁড়ালে গুলি বিদ্ধ হয় ওদের শরীরে।
মারুফের গুলি লাগে বুকে। বুক ফুটো করে বেরিয়ে যায়।
ময়েজের চোখে গুলি লেগে মাথার একাংশ উড়ে যায়।
স্বপনের পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসে।
মিজারুল আর ওমর আহত হয়। একজনের কানের পাশ দিয়ে গুলি চলে যায়। উড়ে যায় কান। অন্যজনের পায়ে লাগে।
লুটিয়ে পড়ে সবাই।
দুদিন পর ফার্মগেটের বাড়ির খবর নিতে আসেন আকমল হোসেন। সঙ্গে আলতাফ। দূর থেকে বাড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন অবস্থা খারাপ। আলতাফ পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে, স্যার, আপনি যাবেন না। আমি গিয়ে আগে দেখে আসি।
আকমল হোসেন মাথা নেড়ে সায় দেন।
বিধ্বস্ত বাড়িটির কাছে এসে আলতাফের বুক মুচড়ে ওঠে। বুঝতে পারে, এই বাড়িতে যুদ্ধ হয়েছে। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মনে হয়, বাড়িতে কেউ নাই। পাকিস্তানিরা বোধ হয় বাড়ি তছনছ করে চলে গেছে। বাড়ির ভেতরে ঢোকে না ও। একরকম ছুটে গিয়ে খবর দেয় আকমল হোসেনকে।
স্যার, যুদ্ধ। হাঁপাতে থাকে, যেন দম আটকে আসছে ওর। স্যার, চলেন।
তুমি কি ছেলেদের দেখেছ?
কাউকে দেখিনি, স্যার। আমি তো বাড়িতে ঢুকতে পারিনি। সব তছনছ হয়ে আছে। স্যার, অনেক বড় যুদ্ধ হয়েছে।
তুমি শান্ত হও, আলতাফ। তোমাকে উত্তেজিত দেখলে মিলিটারি পুলিশ সন্দেহ করবে। তুমি গাড়িতে ওঠো। গাড়িটা অন্যদিকে কোথাও রেখে আসি।
আকমল হোসেন বিপন্ন বোধ করেন। আলতাফকে তা বুঝতে দেন না। গাড়ি গ্রিন রোড ধরে অনেকখানি চালিয়ে ফিরে আসতে থাকেন। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। দেখতে পান, আলতাফ দুহাতে চোখ মুছছে। নিজেরও একটু খটকা আছে। অপারেশনের পর মারুফ বাড়িতে ফোন করেনি। তাহলে কি ও রূপগঞ্জে চলে গেছে। না মেলাঘরে? বুক চেপে আসে। তার পরও মাথা ঠিক রেখে বাড়ির কাছাকাছি এক জায়গায় গাড়ি পার্ক করেন।
তুমি গাড়িতে থাকো, আলতাফ।
না, স্যার, আমিও আপনার সঙ্গে যাব। গাড়ি এখানে থাকুক। যা হয় হবে। তিনি এক পলক দীর্ঘদিনের পারিবারিকভাবে যুক্ত লোকটির দিকে তাকান। শুকনো, ছোটখাটো মানুষটি। বছর দশেক ধরে তাঁর কাছে আছে। পরিবারের সুখ-দুঃখের সঙ্গে এক হয়ে আছে। আজও তার ভূমিকা পরিবারের একজনের মতোই। তিনি আলতাফের হাত ধরে বলেন, আমার পা টলছে। ঠিকমতো হাঁটতে পারছি না।
সে জন্যই আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি। আমি তো জানি, এই দুর্গবাড়িটি আপনি খুব যত্ন করতেন। এখানে এলে আপনি যুদ্ধ আর শান্তি দেখতেন। আপনি আমাকে এ কথা বলেছেন।
দুজনে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান। আকমল হোসেন আলতাফের হাত চেপে ধরে বলেন, একি! আশ্চর্য! এতটা ঘটেছে। কেউ আমাকে কোনো খবর দিল না। হায় আল্লাহ, ওরা কোথায়?
বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণ, প্রতিটি ঘর তছনছ, লন্ডভন্ড। আক্রোশ মেটানো যে হয়েছে তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। কোথায় গেল ছেলেরা? সরে পড়তে পেরেছিল কি?
আর কোথায় খুঁজব? তার চেয়ে বাড়িতে গিয়ে অন্য দুর্গবাড়িতে ফোনে যোগাযোগ করে দেখি কোনো খবর পাওয়া যায় কি না।
স্যার, বাড়ির পেছন দিকটা দেখে আসি।
পেছনে তো সব বুনোনা ঝোপঝাড়। ও ব্যাটারা এরকম জায়গায় যেতে ভয় পায়।
স্যার, আমাদের এখানে আসা আর না-ও হতে পারে। দেখে আসি। খোঁজ নিতে তো অসুবিধা নাই।
ঠিক আছে, চলো, আমিও যাই। তুমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ, আলতাফ।
আকমল হোসেন বাড়ির পশ্চিম দিক ঘোরেন প্রথমে। ওখানে ঝোপঝাড় পায়ের নিচে দোমড়ানো। মনে হয় অনেকগুলো বুটের নিচে থেঁতলে গেছে ঘাস। তার শরীর শিউরে ওঠে। তাহলে যুদ্ধ কি বাড়ির পেছনে হয়েছে? তিনি পশ্চিম থেকে দক্ষিণে আসেন। দূর থেকেই দেখলেন, পাঁচটি রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। ছুটে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই চক্ষু স্থির হয়ে যায় আকমল হোসেনের। ওদের চোখ এবং হাত বাঁধা। মারুফ চিত হয়ে পড়ে আছে। বুকজুড়ে ফোকর তৈরি হয়েছে। ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে চারদিক। আকমল হোসেন হাঁটু গেড়ে বসলেন। বুকের ফুটোর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দুহাত বাড়িয়ে মিজারুলের বাম পায়ের পাতা পেলেন। আর স্বপনের ডান হাত। মাথা ঝুঁকে গেল তার বুকের ওপর।
কতক্ষণ সময় গেল দুজনের কেউই বুঝতে পারেন না। আকমল হোসেন অনুভব করেন, তার মাথা ক্রমাগত শহীদের শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়ছে। তিনি মাথা কাত করে আলতাফকে বলেন, বাসায় যাও।
আলতাফ আঁতকে উঠে বলে, বাসায়!
হ্যাঁ, বাসায়। তোমার খালাম্মা আর মন্টুর মাকে নিয়ে এসো।
আলতাফ দুহাত দিয়ে বুক চেপে ধরে।
আর শোনো, তোমার খালাম্মাকে বলবে, বিছানার পাঁচটা সাদা চাদর আনতে।
আমি কেমন করে বলব? ও আল্লাহ রে—
শোনো, দুটো কোদাল এনো। তোমার জন্য একটা, আমার জন্য একটা। আমি জানি, দুটো কোদাল বাসায় নেই। তুমি কোদাল কিনে বাসায় যাবে। আমার পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে নাও। তাড়াতাড়ি যাও। তাড়াতাড়ি আসবে।
আপনি কী করবেন, স্যার?
আমি এখানে থাকব।
না, স্যার, আপনাকে একা রেখে আমি যাব না।
তোমাকে তো যেতেই হবে, আলতাফ।
আলতাফ কাঁদতে শুরু করে। দশ বছর ধরে মানুষটিকে দেখছে, কিন্তু এমন কণ্ঠস্বরে কোনো দিন কথা বলতে শোনেনি।
আলতাফ, তুমি যাও। আর কেঁদো না।
আপনি, স্যার?
আমি ওদের সঙ্গে শুয়ে থাকব। তুমি যাও। সময় নষ্ট করছ কেন?
আলতাফ কথা না বাড়িয়ে এগোয়। বিল্ডিংয়ের কোনায় গিয়ে পেছন ফিরে তাকায়।
দেখতে পায়, আকমল হোসেন শহীদদের পাশে শুয়ে পড়েছেন। গেটের কাছে যাওয়ার আগেই ভেসে আসে তার কণ্ঠস্বর—ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা…।