১২. অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকলেন

অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকলেন আকমল হোসেন।

টেবিলের ওপর ডায়েরি খোলা। কখনো লিখছেন, কখনো চুপচাপ বসে থাকছেন। বুঝতে পারছেন, নিজের চিন্তাশক্তি বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে বারবার বোঝালেন যে, যুদ্ধ কোনো সুখের সময় নয়। বিশেষ করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ।

স্বাধীনতাযুদ্ধের কঠিন সময়ে দিনরাতের কোনো আলাদা প্রহর হয় না। এর রং দুটি—হয় কালো, না হয় সাদা। হয় আনন্দ, না হয় কষ্ট হয় জীবন, না হয় মৃত্যু। এমন ভেবে ডায়েরির পাতা ভরালেন তিনি। সময়ের স্মৃতিচারণা করলেন। গতকাল মেলাঘর থেকে তিনজন গেরিলাযোদ্ধা ঢাকায় ঢুকেছে। তাদের কথা লিখলেন। ওরা বলেছে, একটি সিটি টেরোরাইজিং অপারেশন করতে হবে। প্রতি মুহূর্তে শত্রুপক্ষকে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়া গেরিলাযুদ্ধের কৌশল।

ওদের দীপ্ত চেহারায় যুদ্ধ ও শান্তির ছবি প্রতিফলিত হচ্ছিল। ওদের স্নিগ্ধতার সঙ্গে বারুদের গন্ধের মাখামাখি ছিল। তিনি আঁকিবুকি রেখায় ওদের নাম লিখলেন। ডিজাইন করলেন নামের রেখার সঙ্গে ফুলপাতা এঁকে। মনে হলো, এইটুকুতে তার খানিকটুকু স্বস্তি ফিরে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে নামের সঙ্গে পতাকার ছবি আঁকলেন। ডায়েরির বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা এভাবে ভরালেন। মনে করলেন, এটিও যুদ্ধের স্মৃতি।

রাত বাড়ছে।

তিনি ঘড়ি দেখলেন। কিন্তু ঘুমোবার কথা তার মনে এল না। চেয়ারে মাথা হেলিয়ে রাখলেন। আয়শা ঘুমোচ্ছ। ভাবলেন, ও ঘুমাক। এই মুহূর্তে ঘুমই ওর যুদ্ধ।

এই রাতে ঢাকা শহরের গেরিলাদের আশ্রয়-বাড়ি আক্রমণ করেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। আক্রমণের সময় ছিল সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত। বেশ অনেকজন গেরিলা ধরা পড়েছে। এই খবরে মর্মাহত আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন।

সারা দিন গাড়ি চালিয়ে প্রতিটি আক্রান্ত বাড়িতে গেরিলাদের খবরাখবর নিয়ে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরলেন দুজন।

মেরিনার খোঁজ করলেন। বাড়িতে নেই ও। কোথায় গিয়েছে, তা কাউকে বলে যায়নি। আয়শা খাতুন শোবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন। আকমল হোসেন নিজের পড়ার টেবিলের ওপর কনুই রেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন।

গতকাল রাব্বি, বাকের আর শরীফ অস্ত্রসহ ঢাকায় ঢুকেছিল। অপারেশনের নতুন পরিকল্পনা ছিল ওদের। দুই ট্রাঙ্ক অস্ত্র নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। সেই ট্রাঙ্ক বাড়ির পেছন দিকে মাটি খুঁড়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

ওই বাড়ির কারও কাছ থেকে এসব কথা শুনেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছিল পাকিস্তানি কয়েকজন সেনা, পেছন দিকের গেটের দরজা ভেঙে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে আরও বলেছিলেন, আমাদের যোদ্ধা মানুষটি সৈনিকদের জিজ্ঞাসার সামনে নির্ভীক ছিলেন। নিজে একাই কথা বলেছিলেন। কাউকে কোনো কথা বলতে দেননি। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে নিয়েই তিনি বন্দী হয়েছিলেন।

আকমল হোসেন চারদিকে তাকিয়ে বাড়িটি দেখছিলেন। আয়শা ছিলেন তাঁর পাশে। দেখেছিলেন খোঁড়া মাটির স্তুপ। জানতেন, ঘরের কোথাও তার প্রিয় হারমোনিয়াম আছে। এই হারমোনিয়ামে তিনি অসাধারণ সুর তুলেছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পরে। এই বছরেও সেই গান গেয়ে শহীদ মিনারে গিয়েছিল শহরের মানুষ।

সুরের মানুষের দাঁত ভেঙে যায় রাইফেলের বাঁটের প্রচণ্ড আঘাতে।

বেয়নেটের খোঁচায় কপালের চামড়া উঠে যায়। চামড়ার একাংশ ঝুলতে থাকে কানের পাশে।

সেই অবস্থায় সুরের মানুষ মাটি খুঁড়তে থাকেন। টেনে তোলেন লুকিয়ে রাখা অস্ত্র। তুলে দেন শত্রুর হাতে। যাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য লড়াই, তাদের হাতে। তিনি তখন জানতেন না স্বাধীনতা দোরগোড়ায়। মাত্র সাড়ে তিন মাস বাকি।

একজন বললেন, তিনি সুর আর অস্ত্রের সঙ্গে জীবন বাজি রেখেছিলেন।

আকমল হোসেন শুনতে পেলেন কান্নার শব্দ।

শুনতে পেলেন শিশুর চিৎকার।

তিনি জানতেন, তাঁর মেয়েটির নাম শাওন। বয়স চার বছর মাত্র।

তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজনকে যখন বন্দী করে গাড়িতে তোলা হলো, তিনি বুঝলেন, অতি যত্নে সংরক্ষিত অস্ত্র আর গেরিলাযুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না। এই ভাবনায় তার ভেতরে যন্ত্রণা দগ্ধীভূত হলো।

আকমল হোসেন দেখলেন, বাড়ির ছাদে রোদ লুটোচ্ছে। উঠোনের কাঁঠালগাছে কাকেঁদের কা কা শব্দ নিস্তব্ধতার বুক চিরে দিচ্ছে।

বাড়িটির খুব কাছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন। পঁচিশের রাতে পুলিশ লাইনে ভয়াবহ তাণ্ডব সংঘটিত হয়েছে। এখন পুলিশ লাইনের ব্যারাকে বন্দী আছে মেয়েরা। নির্যাতনে জর্জরিত মেয়েদের কণ্ঠে আছে প্রতিশোধের শপথ। তিনি দূরের দিকে তাকিয়ে রাবেয়ার কথা ভাবলেন। সুইপার রাবেয়া। সুইপার পরদেশীর কথাও ভাবলেন। তাঁর মনে হলো, যুদ্ধক্ষেত্রের পুরোটাই এখন তার সামনে।

তিনি আয়শা খাতুনকে নিয়ে মগবাজারে এলেন। এই প্রথম তিনি গাড়ি চালাতে ক্লান্তি বোধ করলেন। তাঁর মনে হচ্ছে, পথ ফুরোচ্ছে না। সামনে আরও দীর্ঘ পথ। যেতে হবে, যেতেই হতে থাকবে।

মগবাজারের ৩০ নম্বর দুর্গবাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামতে নামতে মনে হয়, এই বাড়ি থেকে যদি মারুফ গ্রেপ্তার হয়ে থাকে, তাহলে কোথায় খুঁজবেন ওকে? না, তিনি ওকে খুঁজতে নামেননি। ক্র্যাক প্লাটুনের সব সদস্যের খোঁজখবর নিচ্ছেন, যারা তাঁর বাড়িতে সব সময় যোগাযোগ রেখেছে। কখনো থেকেছে, কখনো থাকেনি। কখনো তার বাড়ি থেকে অস্ত্র নিয়ে অপারেশনে বেরিয়ে গেছে।

হঠাৎ করে আয়শা খাতুন তার দিকে তাকিয়ে বলেন, মারুফ!

আমাদের একটিমাত্র ছেলেই গেরিলাযোদ্ধা নয়, আয়শা।

তা নয়। ওর সঙ্গে সব নামই থাকে। কখনো একটা নামই উচ্চারিত হয় নিজের অজান্তে। পেটে ধরেছি। লালন-পালন করেছি। এইটুকু মায়া ও আমার কাছ থেকে বেশিই পাবে।

আয়শা আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। তাঁর মনে হচ্ছে, আজ তিনি একটু বেশি ঘামছেন। বারবার মুছেও ঘাম কমাতে পারছেন না। কেমন করে যাবেন মুক্তিযোদ্ধা রাশেদের মায়ের সামনে? কেমন করে জিজ্ঞেস করবেন, যারা ধরা পড়েছে তাদের নাম কী? জিজ্ঞেস না করেও রাজারবাগ আউটার সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে জানতে পেরেছিলেন সুরের মানুষটির সঙ্গে আর কারা ধরা পড়েছিল। এখন কী করবেন? বুকের ভেতরে প্রবল আতঙ্ক!

গাড়ি লক করে আকমল হোসেন বললেন, এসো।

নিস্তব্ধ এলাকা। তিন মাস আগে রেললাইনের কাছাকাছি জায়গায় নামিয়েছিলেন মাহমুদাকে। এখন যাবেন রেললাইন থেকে শিল্প এলাকার দিকে খানিকটুকু এগিয়ে হাতের ডান দিকের একটি গলিতে। একতলা বাড়ি। দেখলেন আশপাশের বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ। এই একতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেন, সামনের দরজা খোলা। দু-চারজন মানুষ চুপচাপ বসে আছেন। বাড়িতে পরিচিত কেউ আছে কি না, বোঝা যাচ্ছে না।

একজন বললেন, আসুন। বসুন। আপনাকে আমি চিনি। ভাগনের মুখে আপনার কথা শুনেছি। আপনার ছেলে কোথায়?

আয়শা বুঝলেন, তার ছেলে রাতে এই হাইডে ছিল না। আকমল হোসেনও উত্তর পেয়ে গেছেন। তারপর ঘাড় নেড়ে বললেন, মারুফ যে কোথায়, তা তো আমি জানি না।

জানারই কথা। এ কয় দিনে ঢাকায় না থাকলে হয়তো রূপগঞ্জে আছে, নয়তো মেলাঘরে।

হ্যাঁ, সেরকমই হবে।

কাল এ বাড়িতে গোলাগুলি হয়েছে। কাজী গুলি করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যকে। তারপর পালিয়ে যেতে পেরেছে। ধরা পড়েছে বাকি ছয়জন। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন রেকি করতে গিয়ে জুয়েলের আঙুলে গুলি লেগেছিল। ও দিলু রোডের বাড়িতে ছিল।

আকমল হোসেন ভুরু কুঁচকে বলেন, আমি শুনেছিলাম, ও অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার কথা বলে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু মাকে ওর দেখতে যাওয়া হয়নি। মানে, ও যায়নি। ও এসেছিল এই বাড়িতে। ওদের পরিকল্পনা ছিল অপারেশনের। আজাদের সঙ্গে ও ধরা পড়েছে।

আকমল হোসেন বিবর্ণ মুখে কথাগুলো শোনেন। মনে মনে উচ্চারণ করেন, সেই ছেলেটি…। আয়শা খাতুন ভেজা চোখ নিয়ে অন্যদিকে তাকান। একদিন ও বলেছিল, আমি গাজরের হালুয়া পছন্দ করি। আমি আরও এক বাটি হালুয়া খাব।

আয়শা বিব্রতবোধ করে চুপ করে ছিলেন। সেদিন বাটিতে আর হালুয়া ছিল না।

ও মৃদু হেসে বলেছিল, জয় বাংলা মামণি, যেভাবে বসে আছেন, আমার মায়ের হাতেও খাবার না থাকলে এমন গোমড়া মুখে বসে থাকতেন। দিতে না পারার কষ্ট আমি মায়েদের মুখ দেখে বুঝতে শিখেছি।

আয়শা খুঁজে দেখার দৃষ্টিতে বাড়িটি দেখেন। গলির রাস্তাটির এমাথাওমাথায় তাকান। রিকশাগুলো খোঁজেন। ভাবেন, যদি কোনো পরিচিত মুখ দেখতে পাওয়া যায়। যদি কেউ কাছে দাঁড়িয়ে বলে, জয় বাংলা মামণি, ঠান্ডা পানি চাই। ফ্রিজে কি পুডিং আছে? আজ কি মুগের ডাল রান্না হয়েছে? পুঁইশাক-চিংড়ি মাছের তরকারি? আমি বিরিয়ানি খাব। কাচ্চি বিরিয়ানি।

আয়শা নিজের ভেতর আচ্ছন্ন হয়ে যান। তার চোখের সামনে থেকে একতলা বাড়িটি উধাও হয়ে যায়। জেগে থাকে অপার প্রান্তর। যেখানে শত শত ছেলেমেয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিন একজন এক বস্তা গুলি এনে বলছে, এগুলো রাখেন। দরকারমতো নিতে থাকব। তিনি তো রেখেছেন। গ্যারেজের মেঝে খুঁড়ে। সেদিন সব ব্যবস্থা শেষ করতে রাত ফুরিয়ে গিয়েছিল। একবারও মনে হয়নি, আজ না কাল করব। এখন না তখন। ছেলেদের যা হুকুম, সেটা তো নিমেষে করতেই হয়।

আকমল হোসেন বলেন, চলো, যাই।

আয়শা খাতুন বিড়বিড় করে বলেন, বিদায়, যোদ্ধারা। তোমরা ধরা পড়েছ। যদি ছাড়া পাও, আবার দেখা হবে।

আকমল হোসেন আবার বলেন, চলো যাই। যুদ্ধক্ষেত্র দেখার শেষ থাকে, আয়শা। যত দিন বাঁচব, এই সব যুদ্ধক্ষেত্র দেখতে হবে। স্মরণের দীপশিখায় আমাদের জ্ঞানের আলোয় দেখতে হবে। ইতিহাসের পাতায় গেঁথে রাখতে হবে পরবর্তী মানুষদের জন্য।

গাড়ি আবার ছুটছে।

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

এলিফ্যান্ট রোডে।

কণিকা বাড়িতে?

হ্যাঁ। মাত্র কিছুদিন আগে ঘুরে এলাম ওখান থেকে।

যুদ্ধের সময় মুহূর্তে মুহূর্তে অন্য রকম হয়ে যায় সবকিছু। আনন্দ-কষ্ট পাশাপাশি থাকে।

জানি। বুঝতে পারি। আমরা প্রতি মুহূর্তে এর ভেতরে দিন কাটাচ্ছি।

গাড়ি যাচ্ছে। দুজন চুপ। তারা বুঝতে পারেন, আজ তাদের কথা বুকের ভেতরে বেশি। যেটুকু বলছেন, সেটুকু জোর করে। অনেক বেশি কথা ভেতরে স্তব্ধ হয়ে আছে।

গাড়ি গেটের কাছে থামলে তারা দেখলেন, দু-তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একজন বলল, খালাম্মা বাড়িতে নাই।

একজন বলল, পাঁচজনকে ধরে নিয়ে গেছে। রুমীর বাবাকেও।

আয়শা স্খলিত কণ্ঠে বললেন, ইমাম ভাইকেও?

কেউ কোনো উত্তর দিল না। আকমল হোসেনের মনে হলো, তিনি একজন অসহায় মানুষ। যুদ্ধের সময় মানুষ কখনো কখনো এমন পরিস্থিতির শিকার হয়। মানুষের অসহায়ত্ব নির্ণয় করা কঠিন।

কেউ একজন বললেন, সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত মোট ছয়টি বাড়ি আক্রমণ করেছে সৈন্যরা। প্রথম আক্রমণ হয়েছে মগবাজারের ৪১৫ নম্বর বাড়ি। ধরে নিয়ে গেছে আবদুস সামাদকে।

আমরা তো ওই দিক থেকেই এলাম। জানতাম না বলে ঢোকা হয়নি। এমন সর্বনাশ কী করে হলো? ওরা কেমন করে জানল?

কেউ কোনো কথা বলে না। কোন অন্তরালে কোথায় কী ঘটেছে, তা তো কেউ জানে না। দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো কাঁদতে শুরু করে।

আরেকজন বলে, ওই বাড়ির পেছন থেকে ধরা পড়েছেন সরকার আবদুল হাফিজ। নির্যাতনে তার একটি চোখ বের হয়ে গিয়েছিল। একটি রগের সঙ্গে তাঁর চোখটি আটকেছিল।

উহ, মা! আয়শা খাতুন অস্ফুট শব্দ করেন। তিনি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেখছিলেন অন্য বাড়িগুলো। মেইন রোড থেকে যে গলিতে বাড়িটা, সেটা একটা ব্লাইন্ড গলি। কণিকা বাড়ির পরে আর একটি মাত্র বাড়ি আছে। হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ারও রাস্তা নেই। সব বাড়িতে অজস্র গাছ। বৃষ্টিস্নাত গাছের পাতা চকচক করছে। ফুল আছে অনেক গাছে। গেরিলাযোদ্ধাদের তৎপরতা এবং গোলাবারুদের আনা-নেওয়ার মধ্যে আশ্চর্য স্নিগ্ধ প্রকৃতি। আয়শা খাতুনের মনে হয়, সংগীতের মতো এই প্রকৃতি, যা মানুষের চিত্তকে মোহিত করে। শান্তির মগ্নতায় মানুষ স্থির হয়। আজকের প্রকৃতি ধরা পড়া গেরিলাদের জন্য প্রার্থনা করছে। আয়শা খাতুন এতক্ষণে বুকের ভেতর স্বস্তি অনুভব করেন।

আকমল হোসেন তাঁর দিকে তাকালে তিনি বলেন, ধানমন্ডি আটাশে চলো যাই।

আকমল হোসেন পা বাড়াতেই একজন বলে, ওই বাড়ি থেকে কেউ ধরা পড়েনি। গেরিলারা কেউ ছিল না। আমি বাড়িতে ঢুকেছিল। এই ঘটনার দুদিন আগে দুজন যোদ্ধা মেলাঘরে চলে গিয়েছিল। ওরা একজন দারোয়ানকে ধরে। অন্যজন পালিয়ে যায়।

চলো, আমরা দিলু রোডে যাই।

হ্যাঁ, চলো।

গলি ছেড়ে বের হয়ে গাড়ি মেইন রোডে ওঠে।

ছুটতে শুরু করে গাড়ি। পৌঁছে যায় দিলু রোডে। মেইন রোড থেকে বেশ অনেকটা ভেতরে ছিল বাড়িটা। আকমল হোসেন যখনই এসেছেন, মাঠে এক চক্কর ঘুরেছেন। বাড়ির পাশের বড় মাঠটি তিনি খুব পছন্দ করেন। আলমকে বলেন, মাঠটি হলো শান্তির জায়গা। আলো-বাতাসের মুক্তি। পতাকা ওড়ানোর মুক্তি।

হা হা করে হাসত আলম। বলত, তোমার ভাবনাই অন্য রকম। কোথাকার জিনিস কোথায় যে নিতে পারো। ভাবতেও পারো, বাপু।

আলমের হাসি বুকে নিলে যুদ্ধের ছবি অন্য রকম হয়ে যায়। যুদ্ধ আর প্রতিদিন এক হয়ে থাকে।

গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

একজন বলল, বিশ-পঁচিশ জন সেনা এসেছিল। প্রবল মারমুখী হয়ে। সে রাতে বাড়িতে এসেছিলেন কাজী। আজাদের বাড়িতে আর্মি ঢুকলে কাজী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ক্যাপ্টেনের ওপর। বেশ ধস্তাধস্তি হয়েছিল। সেপাইরা এলোপাতাড়ি গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয় দুজন যোদ্ধা। আহতদের ফেলে রেখে অন্যদের ধরে নিয়ে যায় সৈন্যরা। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাওয়া কাজী এই বাড়িতে এসেছিল।

আকমল হোসেন দাঁড়িয়ে রইলেন।

আয়শা ভেতরে ঢুকেছেন। যোদ্ধারা কেউ নেই বাড়িতে। বাড়ির মেয়েরাও সবাই নেই। শুধু একজন আছে। মাত্র কয়েক দিন আগে সে করাচি থেকে এসেছে। এই বাড়ির বড় মেয়ে সে।

সে বলল, বাবা আর্মির উপস্থিতি টের পেয়ে পেছনের দেয়াল টপকে পাশের বাসায় চলে গিয়েছিলেন।

আয়শা জানেন, এ বাড়ির ছেলে একদম প্রথম দিককার গেরিলাযোদ্ধা। নিজের বিছানায় কোলবালিশ চাদর দিয়ে ঢেকে রেখে কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিল যুদ্ধে। তবে বাবার কাছে একটা চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিল।

আয়শা তার বোনের দিকে তাকালে সে বলে, আমি খুব ভালো উর্দু জানি। ওদেরকে করাচি থেকে এসেছি, সে কথা বললাম। বিমানের টিকিট দেখালাম। কিছুটা দমল ওরা। কিন্তু ওদের আক্রমণটা এল অন্য দিক থেকে। মনে হলো, ওরা যেন জেনেশুনেই এসেছে যে বাড়ির কোথায় কী আছে। ওদের হাঁটাচলার ভঙ্গি দেখে আমার মনে হয়েছিল, বাড়ির ম্যাপটা ওদের মুখস্থ। দেড় তলা বাড়িটা ওদের নখদর্পণে। ওরা সরাসরি রান্নাঘরে যায়। রান্নাঘরে ওদের কী আছে, তা ওরা যেন জেনেশুনেই এসেছে। সেপাইরা আগেই শাবল এনে রেখেছিল। ওরা রেডি ছিল। ক্যাপ্টেনের ইশারা পেয়েই শাবল দিয়ে রান্নাঘরের মেঝে খুঁড়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ বের করল। ক্যাপ্টেনসহ অন্যরা হা হা করে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, বহুত আচ্ছা। বহুত আচ্ছা।

আরও কী কী সব বলেছিল, তা আমি মনে করতে পারছি না। আমার মধ্যে তখন একটাই চিন্তা ছিল, ওরা রান্নাঘরে অস্ত্রের খোঁজ পেল কোথা থেকে! আমার আব্বা মেঝে খুঁড়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ রেখেছিলেন। তার ওপরে স্ল্যাব দিলেন। স্ল্যাবের ওপর রাখা হলো কেরোসিনের চুলা। পাশে শুকনো লাকড়ি। বোঝার কোনো উপায় ছিল না। অথচ ওরা ঠিকই শাবল দিয়ে মেঝে খুঁড়ে ফেলল।

যোদ্ধার বোন দুহাতে মুখ ঢাকলে আয়শা তার মাথায় হাত রাখেন। গুনগুনিয়ে বলেন, আমার সকল দুঃখের প্রদীপ…। মেয়েটি তার দুহাত জড়িয়ে ধরে। আয়শার সামনে দেড় তলা বাড়িটি যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে যায়। যে বাড়িতে অস্ত্র রাখা হয়, যোদ্ধারা থাকে, শত্রুপক্ষ আক্রমণ করতে আসা সে বাড়ি তো একটি যুদ্ধক্ষেত্রই হবে। এমন দুর্গবাড়িগুলো এখন এই শহরের প্রাণ।

ওদের গাড়ি আবার ছুটছে। যাচ্ছে নাসিরাবাদ। এখানকার বাড়িটিও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের ও অস্ত্র রাখার জায়গা। দূর থেকেই দেখলেন, বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছাই ও কয়লার স্কুপের পাশে পড়ে আছে একটি রক্তাক্ত লাশ। চিত হয়ে পড়ে থাকা লাশে অজস্র বুলেটের চিহ্ন।

তাঁরা গাড়ি থেকে নামলেন না। গেলেন এলিফ্যান্ট রোডে। একটি সরকারি বাড়ি এটি। বড় ভাই সরকারি চাকুরে। ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা। এ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। যখন-তখন যেকোনো প্রয়োজনে চলে আসত ওরা। এমন অনায়াস যাতায়াতের জন্য ভীত ছিলেন গৃহকর্তা। তিনি সরকারি বাড়িতে বসবাস করতেন চাকরিসূত্রে। অন্যদিকে বাড়িতে অস্ত্র-গোলাবারুদ ছিল। আলমারিতে স্যুটের আড়ালে রাইফেল লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। গ্রেনেড ছিল অনেকগুলো। চুল্লু বুঝতে পেরেছিল যে একটা কিছু ঘটবে। প্ল্যান ছিল সকালের আগেই এসব অস্ত্রসহ সরে পড়বে। কিন্তু হয়নি। ভোর হওয়ার আগেই আর্মির গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামে। দরজায় বুটের লাথি পড়লে ঘুম ভেঙে যায় সাদেকের।

বাড়িতে অতিথি এলে এভাবে দরজায় ধাক্কা দেয় না। এত রাতে কারও আসার কথাও নয়। তাহলে কি মুক্তিযোদ্ধাদের আসা-যাওয়া আর্মির নজরদারিতে পড়েছে? শুনতে পায়, দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে বলে গালাগালি করছে সেপাইরা।

সাদেকের মুখের দিকে তাকিয়ে আকমল হোসেন বলতে চান, এখন মধ্যরাতে সেপাইরা নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের জীবন। লাথি দিয়ে, তো দিয়ে, বুলেটের আঘাতে, বেয়নেটের খোঁচায় তারা যা খুশি তা করতে পারে।

সাদেক বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, এই বাড়িতে আমি ওকে প্রশ্রয় না দিলে ওকে হয়তো আর্মির হাতে ধরা পড়তে হতো না। অন্তত আমার সামনে থেকে ওকে ধরে নিয়ে যেতে দেখতাম না।

আপনি এভাবে বলতে পারেন না। যিনি যোদ্ধা, তিনি বিপদের ভেতর দিয়েই হেঁটে যান। মৃত্যুভয় নিয়ে কেউ যুদ্ধে যায় না। আপনি ভাইকে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন। আজাদের মা যে ছেলেকে ধরে নিয়ে যেতে দেখলেন। আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী যে স্বামীকে ধরে নিয়ে যেতে দেখলেন। মিসেস ইমাম যে স্বামী ও দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে যেতে দেখলেন!

আয়শা কান্নাভেজা স্বরে অস্ফুট আর্তনাদ করে বললেন, উহ, থাম!

সাদেক আকমল হোসেনের দুহাত জড়িয়ে ধরে বললেন, ঠিকই বলেছেন। ওর জন্য কষ্ট হচ্ছে বলেই নিজের ওপর এমন দায় টেনেছি। দুঃখ কখনোনা খুবই ব্যক্তিগত, কখনো সামষ্টিক।

আকমল হোসেন মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, আমাদের সকলের বুকবোঝাই কষ্ট আছে। আমরা কেউই কষ্ট থেকে বের হতে পারছি না। একের কষ্ট অপরের কষ্টের সঙ্গে যোগ হচ্ছে অনবরত।

পাশাপাশি স্বপ্নও আছে।

হ্যাঁ, তা আছে। স্বপ্ন ছাড়া আমরা দিন গুজরান করি না।

আবার সবাই চুপ হয়ে যান। এই মুহূর্তে এসব কথার কোনো অর্থ আছে বলে মনে হয় না আয়শা খাতুনের। মনে হয়, যা কিছু বলা হচ্ছে; তা অর্থহীন। শুধু রিয়ালিটি সত্য। এই বাস্তব নিয়ে বুকে অনেক কিছু জমবে। তাকে ঘাটাঘাটি করার দরকার কী! যা জমছে জমুক। ইসমাত তাকে হাত ধরে ভেতরের ঘরে নিয়ে যায়।

মুখোমুখি চেয়ারে বসলে ভিজে ওঠে দুজনের চোখ।

ভাবি, কী হলো আমাদের?

যাত্রাপথে এমন অঘটন ঘটেই থাকে। আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।

ওরা কি ফিরে আসবে?

আয়শা খাতুন চুপ করে থেকে বলেন, জানি না তো। ওদের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

আমরা কি ওদের খোঁজটুকুও পাব না।

এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? আমাদের চারপাশে উত্তর দেওয়ার লোক নেই।

আয়শা খাতুন জানেন, এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না। উত্তর দেওয়ার সাধ্য তার নিজের নেই। শুরুর সময়ে ওরা একদিন বলেছিল, আপনার কাছ থেকে সেই গুনগুন ধ্বনি শুনতে চাই—

লাজুক হেসে থেমেছিল চুন্নু। কোন গানটা শুনতে চায়, তা বলতে দ্বিধা করছিল।

মারুফ ধমকে উঠেছিল, তুই আমার মায়ের সামনে লজ্জা পাচ্ছিস রে?

মারুফের পিঠে চাপড় দিয়ে আয়শা বলেছিলেন, আহ্, এভাবে বলিস না। তুই কোন গানটা শুনতে চাস, বল চুল্লু।

চল্ চল্ চল্ উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল…

সেদিন গুনগুন ধ্বনি শোনার পর ওরা পাঁচজন মার্চপাস্টের ভঙ্গিতে ঘরের ভেতর ঘুরেছিল। বলেছিল, আমরা পারব। যিনি এই গানের কবি, তিনি একজন সৈনিক ছিলেন। আমরাও জীবন-জয়ের সৈনিক হব।

আয়শা খাতুন ইসমাতের দিকে তাকিয়ে বলেন, ওরা জীবন-জয়ের সৈনিক। ওদের হাতে লাল-সূর্যের পতাকা। তাদের মাথায় তুলে রাখার সাধ্য আমাদের নাই। ভারি তো এক কাপ চা আর দুই মুঠো ভাত খাইয়েছি—

আয়শা চোখে আঁচল চাপা দেন। ইসমাত বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকে। মধ্যরাতে হিংস্র সেনাদের হাতে ধরা পড়া কতিপয় যোদ্ধার সঙ্গে পরিচয় ওদের বাকি জীবনের সঞ্চয়। এই সঞ্চয় ইতিহাসের। স্বাধীনতার গৌরবের। যদি বেঁচে থাকেন, তারা এই সঞ্চয়ের সাক্ষী হবেন। আয়শা ইসমাতকে জড়িয়ে ধরলে দুজনের নিঃশ্বাস দুজনের শরীরে বয়ে যায়। পরস্পর পরস্পরের স্পর্শ অনুভব করেন। এবং দুজনেই বলেন, আমরা রাত জেগে ওদের জন্য অপেক্ষা করব। পাকিস্তানি সৈন্যদের শত নির্যাতন আমাদের পিছিয়ে রাখতে পারবে না। বাড়ি আক্রান্ত হলেও আমরা ভীত নই।

আয়শা ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে বলেন, আমরা ওদের জন্য জেগে থাকব। আমাদের কেউ মেরে শেষ করতে পারবে না।

ওরা যতই খুঁজে খুঁজে আমাদের দুর্গগুলো ভেঙে চুরমার করুক, আমরা নতুন দুর্গ গড়ব।

আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা আবার শহরকে কাঁপাবে।

কথা বলতে বলতে নেমে যান আয়শা। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আকমল হোসেন। দাঁড়িয়ে ছিলেন আরও কেউ কেউ। আয়শা বাড়িটা দেখেন। একতলা বাড়িটার সামনে যোদ্ধারা বাচ্চাদের সঙ্গে খেলত। দুর্গবাড়িটির একটি স্বাভাবিক ইমেজ রাখার জন্য। আয়শা দৃষ্টি ঘুরিয়ে আকমল হোসেনের দিকে তাকান।

চলো।

আপনারাও সাবধানে থাকবেন।

সাবধান! আকমল হোসেন সবার দিকে তাকান।

আমরা একটা ধাক্কা খেলাম না।

আমরা যা করছি তার থেকে তো পিছিয়ে যেতে পারব না। সাবধান শব্দটি আমরা সঙ্গেই রাখি। তার পরও দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

আপনারা না থাকলে ওরা সাপোর্ট পাবে কোথায়? অপারেশন চালানোর জন্য ওদের আশ্রয় দরকার। খোলা মাঠ থেকে গেরিলাযুদ্ধ পরিচালিত হয় না।

আমরা আপনার কথা বুঝেছি। আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমরা যাই।

গাড়ি ছুটছে।

ছুটছে ঘরবাড়ি। মানুষ। গাছপালা।

ছুটছে চিন্তা এবং পরিকল্পনা।

আয়শা বলেন, আমরা বাড়ি যাচ্ছি।

আমরা তো বাড়িতেই ছিলাম। এতক্ষণ আমরা যা দেখেছি, তার খতিয়ান করেছি।

আমরা কি বাড়িতে আছি?

এখনো আছি।

এবং থাকব।

ওরা যদি এই বাড়ি আক্রমণ করতে আসে?

আসবে।

ওরা যদি উঠিয়ে নিয়ে যেতে চায়?

যেতে হলে যাব।

আমি খুশিমনে যাব।

যদি বন্দিশালায় ওদের দেখা পাই, মনে করব, ঠিক জায়গায় এসেছি। যদি ওদের সঙ্গে কথা হয়, বুঝব, ভুল ঠিকানায় যাইনি। যদি ওদের সঙ্গে মৃত্যু হয়, মনে করব, স্বাধীনতা পেয়েছি।

বিষাদ এবং কষ্ট নিয়ে দুজনে শোবার ঘর ছাড়েন। কতক্ষণ আগে বাড়িতে ফিরেছেন, তা ভুলে যান। দুপুরের ভাত খাওয়া হয়নি, তা মনে থাকে না। ঘুম কী জিনিস, তা-ও ভুলে যান। রেস্ট শব্দটি তাদের জীবনপাতার কোথাও লেখা নেই। দুজনে মৃদু পায়ে বারান্দায় আসেন। দেখতে পান, আলতাফ গেট খুলে দিচ্ছে। মেরিনা রিকশা থেকে নামছে। ও বারান্দায় বাবা-মাকে দেখে বলে, আপনারা কখন ফিরলেন?

বেশ কিছুক্ষণ হলো।

আপনাদের সঙ্গে কথা আছে। আমি আসছি।

কোথায় গিয়েছিলি, মা?

আমি আসছি, আব্বা।

আকমল হোসেনের মনে হয়, ওকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।

পাশাপাশি জেদি এবং একরোখা ভঙ্গি ওর ভেতরে কাজ করছে। আকমল হোসেন আর আয়শা খাতুন ড্রয়িংরুমে এসে বসেন। টেলিভিশন ছাড়েন।

খবরে দেখতে পান, নতুন গভর্নর হিসেবে শপথ নিচ্ছেন ডা. মালিক। তল্কালীন প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী তাকে শপথ পাঠ করান। দুদিন আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ডা. মালিককে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে গেছেন গতকাল। জামায়াতে ইসলামীর এক প্রেস রিলিজে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী সর্বশক্তি দিয়ে দেশের শত্রুদের দমনের ব্যাপারে নতুন গভর্নরকে সহায়তা করবে।

আকমল হোসেন খবরের এতটুকু দেখে নিজের পড়ার টেবিলে আসেন। সকালে খবরের কাগজ পড়া হয়নি। কয়েকটি সংখ্যা টেবিলের ওপর জমা করে রেখেছেন।

পত্রিকার পাতা উল্টাতেই দেখতে পেলেন, নতুন গভর্নর ডা, মালিকের ছবি ছাপা হয়েছে। নতুন সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। তিনি পত্রিকা মুড়ে পাশে রাখলেন। খুললেন দৈনিক পাকিস্তান। একটি খবরের জন্য কয়েক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন; কিন্তু পত্রিকায় তেমন করে আসেনি। আজ সেই খবরের ওপরে চোখ আটকে গেল। লেখা হয়েছে—মরতে যখন হবেই, তখন দেশের জন্যই মরি। বিশ বছর বয়স্ক পাইলট রশিদ মিনহাজ গত ২০ আগস্ট পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি বিমানকে জোর করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস ব্যর্থ করতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়েছেন।

তিনি মুখে মুখে শোনা খবরটির আরও বিস্তারিত জানার জন্য যে কাগজগুলো পড়া হয়নি, তার পাতা উল্টাতে লাগলেন। দেখলেন, কয়েক দিন ধরে কেবল রশিদ মিনহাজের বীরত্বের খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। তাকে সামরিক মর্যাদায় দাফন করার কথা আছে। কিন্তু কে বিমান হাইজ্যাক করলেন, তাঁর নাম নেই।

শেষ পর্যন্ত নাম পাওয়া গেল। তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এ কে এম মতিউর রহমান। তিনি বিমান হাইজ্যাক করে ভারতে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রশিদ মিনহাজের সাহসিকতার কারণে তিনি সে কাজটি করতে পারেননি। ভারতের সীমানায় পৌঁছানোর কয়েক মাইল আগে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। সরকার রশিদকে দিয়েছে সর্বোচ্চ বীরের খেতাব। আর মতিউরকে বলা হয়েছে বিশ্বাসঘাতক, গাদ্দার। তিনি পত্রিকা ভাঁজ করে পাশে রাখলেন। খুললেন দৈনিক পূর্বদেশ। পত্রিকায় বড় করে ছাপা হয়েছে বিশ্বাসঘাতকের নাম মতিউর রহমান।

আকমল হোসেন পত্রিকার পৃষ্ঠায় বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। একজন বীর বাঙালিকে একটি বাংলা ভাষার দৈনিক পত্রিকা এভাবে লিখতে পারে? পরমুহূর্তে তিনি নিজের ভাবনার সংশোধন করলেন। বাংলা ভাষার অসংখ্য মানুষই তো যুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি হয়েছে। তাহলে শুধু একটি পত্রিকার ক্ষতের মতো শিরোনাম তাকে এমন পীড়িত করছে কেন? তিনি নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। সব পত্রিকা ভাঁজ করে ফাইলে রাখেন ইতিহাস লেখার জন্য। ইতিহাসের উপকরণ রাখতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। তিনি জানেন না, ইতিহাস তিনি লিখতে পারবেন কি না, কিন্তু উপকরণ সংরক্ষণ করে যেতে তো পারবেন। যুদ্ধের পাশাপাশি এই পারাটাও নৈতিক কাজ। তিনি মতিউরকে সর্বোচ্চ বীরের খেতাব দিয়ে, বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করে ডায়েরির পাতায় বড় করে লিখে রাখেন।

আয়শা এসে পাশে দাঁড়ালেন।

খাবে, চলো।

আকমল হোসেন ডায়েরি বন্ধ করলেন। কলমের মুখ আটকালেন।

ডায়েরিতে কী লিখেছ?

মতিউরের কথা। লিখেছি, বল বীর চির উন্নত মম শির। তোমার একটি গুনগুন ধ্বনি না হলে আমি আজ রাতে খেতেও পারব না, ঘুমোতেও পারব না।

চলো, একসঙ্গে গাইব।

আকমল হোসেন আয়শার ঘাড়ে হাত রাখেন। আয়শা টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে শুরু করেন গুনগুন ধ্বনি–

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য করা দহন-দানো।।
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে।।

মেরিনা কান খাড়া করে গুনগুন ধ্বনি শোনে। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে বাবা-মায়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। ছড়াতে থাকে সুর। আজ ওর মন ভালো নেই। প্রবল দুশ্চিন্তায় ওর প্রতিটি মুহূর্ত আক্রান্ত। তার পরও গানের শক্তিতে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। আয়শার কণ্ঠ একা নয়, যুক্ত হয়েছে আকমল হোসেনের কণ্ঠও—

আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোঁটাক তারা নব নব
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্বপানো।।

মেরিনা মায়ের সুরের ধ্বনি শেষ হওয়ার আগে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে আসে। কোথাও না রেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাতে ধরে রাখে।

আকমল হোসেন কাছে এসে মোমবাতি ওর হাত থেকে নিজে নিয়ে বলেন, আয় মা। তোর কথা শুনব এখন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *