০৩. শহরে গেরিলা অপারেশনের খবর

শহরে গেরিলা অপারেশনের খবর পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সুইপার রাবেয়া। ড্রেন পরিষ্কার করার কাজ রেখে ওকে কাঁদতে দেখে সুইপার পরদেশী জিজ্ঞেস করে, রাবেয়া, কী হয়েছে তোর? হঠাৎ এমন কাঁদতে শুরু করলি কেন?

বুকে ব্যথা হচ্ছে। ব্যথায় মাথাও জানি কেমন করছে?

বুকে ব্যথা নিয়ে এত জোরে কাঁদতে পারে মানুষ? তুই তো দেখছি একটা উল্লুক। এমন উল্লুক আমি একটাও দেখিনি। তুই আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছিস। বল, তোর কী হয়েছে?

রাবেয়া কথা না বলে কাঁদতে থাকে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকে। কান্নায় ওর শরীরে প্রবল ঝাকুনি। কান্নার দমকে মাঝেমধ্যে হেঁচকি উঠছে। দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। মাঝেমধ্যে কাশছে। পরদেশী রেগে ওর দিকে তাকায়। একসময় নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে, থাম বলছি। রাবেয়া থামে না। থামার জন্য প্রস্তুতিও নেয় না। কান্না যেন তাকে পেয়ে বসেছে।

পরদেশী ভুরু কুঁচকে বলে, কী হলো, কান্না থামা। নইলে তোকে ঘুষি মেরে ড্রেনের মধ্যে ফেলে দেব।

রাবেয়া ভেজা চোখে পরদেশীর দিকে তাকায়। চোখভরা পানি দেখে পরদেশী বিপন্ন বোধ করে। রাবেয়া চোখ মুছে আস্তে করে বলে, রাগিস না। এখন আমাদের রাগের সময় না। নিজেদের নিজেদের রাগারাগি আমাদের সর্বনাশ করবে।

উপদেশ দিস না, রাবেয়া। উপদেশ শুনে মেজাজ গরম লাগছে। কী হয়েছে, বল?

আমি কি কাঁদি সাধে? দেখিস না সেই কাল রাতের পর থেকে ওরা কত কত মেয়ে ধরে নিয়ে এসে পুলিশ লাইনের ব্যারাকে ভরে ফেলেছে। ওদের গু-মুত সাফ করতে আমি যাই। তোকে যেতে হয় না, পরদেশী। তুই তো শুনতে পাস না যে কত যন্ত্রণায় ওরা চিল্লায়।

চুপ কর, চুপ কর, রাবেয়া। আমি সইতে পারি না। আমাকে তোর বলে বোঝাতে হবে না।

তাহলে শোন, তুই তো আমাকে কতবারই কাঁদতে দেখেছিস। সেই কান্না ছিল কষ্টের, রাগের। তখন কেঁদেছি দুঃখে, যন্ত্রণায়। নিজের হাত কামড়ে নিজের রক্ত নিজে চুষেছি। আজ আমি কাঁদছি আনন্দে। আজ আমার আনন্দের শেষ নাই।

আনন্দ? কিসের আনন্দ তোর? তোর আজকে কী হয়েছে, বল তো?

হোটেল ইন্টারে গেরিলারা গ্রেনেড ফাটিয়েছে। কেউ ধরা পড়েনি। বোমা ফাটিয়ে ঠিকঠাকমতো চলে যেতে পেরেছে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনেছি। তুই চুপ করে থাক, রাবেয়া। এসব শুনলে ওরা তোকেআমাকে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখবে। ন্যাংটো করে ঝোলাবে। তারপর চাবুক দিয়ে পেটাবে।

হ্যাঁ, জানি। এমনই করবে ওরা। সে জন্য হাসছি না, কাঁদছি। হাসির বদলে কেঁদে নিজের খুশি ফোঁটাচ্ছি। যেন ওরা বুঝতে না পারে যে আমার কী হয়েছে।

পঁচিশের প্রথম রাতে তোকে যখন নির্যাতন করল, তখন তো তুই কাঁদিসনি, রাবেয়া।

যে দুঃখ সারা জীবন বইতে হবে, তার জন্য কেঁদে কী লাভ, পরদেশী? কিন্তু কচি কচি মেয়েদের ধরে নিয়ে আসছে, এটা আমি সইতে পারছি না। আমার মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ছে। মনে হচ্ছে, মাটি ফাঁক হয়ে গেলে আমি জ্যান্ত কবরে চলে যাব। আর যদি ব্যারাকে আগুন জ্বালায়, তাহলে আমি ওই আগুনকে চিতা মনে করে ঢুকে যাব। মরেই নিজের জনম সার্থক করব।

আহ্, থাম, রাবেয়া। এত কথা কেন বলছিস। চল, এই ড্রেনের পাশে একটুক্ষণ বসি। তোর একটু দম নেওয়া দরকার। কেঁদেকেটে হয়রান হয়ে গেছিস।

দুজন সুইপার ড্রেনের ভেতর পা ঝুলিয়ে বসে। খুব অল্পক্ষণের জন্য। এটুকু সময়ই ওদের জীবনে এক বিশাল সময়। সময় প্রাণ খুলে কথা বলার এবং শেখের বেটা যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে, সেই স্বাধীনতার মর্ম বোেঝার। ওরা দুজনেই দুহাতে ঝাড়ু ধরে রাখে, যেন কোনো দিক থেকে ডান্ডা হাতে মিলিশিয়া জওয়ান এলে বলতে পারে আমরা তো কাজ করছি। পরদেশী হাসতে হাসতে বলে, কেউ এলে আমি লাফ দিয়ে ড্রেনে নেমে যাব। পানি ঝাড়ু দিতে দিতে বলব, দেখো, কাজ করছি।

আর আমি কী করব? আমার জন্য তোর পরামর্শ কী, শুনি?

তুই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবি। মাথা নড়বে না। কোনো দিকে তাকানো চলবে না।

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব কেন?

 

আকাশের তারা গুনবি।

দিনের বেলা কি তারা দেখা যায়?

কষ্ট সইতে হলে দিনের বেলা তারা খুঁজতে হবে, রাবেয়া। দেখবি বুকের ভেতরের কষ্ট তারার মতো লুকিয়ে আছে। কষ্টের কাছে তোর কোনো হার হবে না।

রাবেয়া অবাক হয়ে পরদেশীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিস্মিত দৃষ্টি ওর মুখের ওপর স্থির রেখে বলে, তুই এত কিছু বুঝিস, পরদেশী? আগে তো কখনো টের পাইনি।

মাঝে মাঝে বুঝি। সব সময় বুঝি না। শুধু এইটুকু বুঝি, আমাদের জীবনে স্বাধীনতা হলো পেট পুরে ভাত, নয়তো রুটি খাওয়া। লাল জামা কেনা। নীল লুঙ্গি পরা। মদ খাওয়া। গা ছেড়ে ভুঁড়ি ফুলিয়ে ঘুমানো। বেঁচে থাকার যা কিছু দরকার, স্বাধীন দেশে তার সবটুকু চাই। মাথার ওপর কেউ ছড়ি ঘোরাবে না। বানচোত, শুয়োরের বাচ্চা বলে গাল দেবে না।

আর কিছু না?

হয়তো আরও অনেক কিছু, কিন্তু আমি জানি না। মুখসুখ মানুষ, এত কিছু বুঝব কী করে!

আমিও জানি না। শেখের বেটা যেদিন সাতই মার্চের ভাষণ দিল রেসকোর্সে, সেদিন আমি সেটা শুনতে আসছিলাম। সুইপার কলোনির অনেকে এসেছিল। আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে। এটুকু বলে রাবেয়া বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, তার পরও আমরা স্বাধীনতার কথা বেশি জানি না।

রাবেয়ার কণ্ঠস্বর এবং চেহারার বিষণ্ণতায় মন খারাপ হয় পরদেশীর। ও অন্যদিকে তাকায়। ঝাড়ুটা পা দিয়ে নাড়ায়। ভাবে, এটা যদি একটা রাইফেল হতো, নয়তো মেশিনগান। ওর বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

দুজনে আকস্মিকভাবে শুনতে পায় নারীকণ্ঠের আর্তনাদ। একটি-দুটির নয়, অনেকগুলোর একসঙ্গে। রাবেয়া পরদেশীর হাত চেপে ধরে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, কী হলো রে মেয়েগুলোর? কখনো তো একসঙ্গে এমন জোরালো চিৎকার শুনিনি।

পরদেশী রাবেয়াকে হাত টেনে বসিয়ে দিয়ে বলে, আর কী হবে। রোজ যা হয়, তা-ই হচ্ছে। ভোগ করার পরে হয়তো চাবুক দিয়ে পেটাচ্ছে।

আজ বেশি চেঁচাচ্ছে ওরা। ছেড়ে দে আমাকে, আমি ব্যারাকের দিকে যাই। দেখি, কতটা নরক বানিয়েছে। তুই ড্রেন সাফ কর।

ঠিক আছে, যা। তোর ওদের কাছে যাওয়াই দরকার।

তখন সুইপার লালু অন্যদিক থেকে ওদের কাছে এসে দাঁড়ায়। ক্রোধে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, সইতে পারি না। দু-একটা অস্ত্র পেলে দিতাম সবগুলোকে সাবাড় করে।

রাবেয়া রুখে দাঁড়িয়ে বলে, আমারও তা-ই মনে হয়। পঁচিশ তারিখে রাজারবাগের পুলিশরা যেমন কিছুক্ষণের জন্য ওদেরকে রুখে দিয়েছিল, ঠিক তেমন। চল না, আমরা অস্ত্র জোগাড়ের চেষ্টা করি।

কথা খালি মনে করাস না, রাবেয়া। মনে করব, কিন্তু কিছু করতে পারব। না, তাহলে তো একটা নেংটি ইদুর হয়ে যাব।

রাবেয়া কথা আরও এক ধাপ বাড়িয়ে বলে, সেদিন পুলিশরা অস্ত্র পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্রের ঘর ওদেরকে খুলে দেওয়া হয়েছিল।

পরদেশী উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তুই থাম, রাবেয়া। বাকি কথা আমি মনে করি। সেনারা যখন উত্তর দিকের টিনশেড ব্যারাকে বোমা আর পেট্রল ধরিয়ে দিয়েছিল, তখন কয়েকজন পুলিশ আগুনে পুড়ে যায়। আহা রে, এক দিন পরে সেই সব লাশ দেখে আমার বুকের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিল রাগে-দুঃখে। সেদিন আমি ভয় পাইনি। কিন্তু অত মৃত্যু দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। আমি লাশ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। নিজেকে বলেছিলাম, প্রতিশোধ নেব। কতটুকু পারব তা আমার মাথায় ছিল না। জেনেছিলাম, এই মুহূর্তে আমাকে লাশ সরাতে হবে। আমি কাঁদতে কাঁদতে লাশ টেনেছিলাম। আমার চোখের জল বুকের আগুন নেভাতে পারেনি। নেভাতে কেউ পারবে না। বুড়িগঙ্গা নদীও না। জন্মেছি ডোম হয়ে। এ জীবনের সাধ আর মিটল না।

দুঃখ করিস না, পরদেশী। দুঃখ করলে হেরে যাব। মনে জোর রাখ।

লালু ওর হাত চেপে ধরে।

ফুহ, দুঃখ করব কেন? দেশের স্বাধীনতা দেখতে পেলে এই জীবনের আয়ু গোনার দিন শেষ হবে। আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।

কথা শেষ করে আর দাঁড়ায় না পরদেশী। ঝাড়টা বগলের নিচে চেপে ধরে অন্যদিকে চলে যায়। লালু আর রাবেয়া তাকিয়ে থাকে। মাস ছয়েক আগে পরদেশীর বউ মরে গেছে। ঘরে তিনটে বাচ্চা আছে। বাচ্চাগুলোকে ওর মা দেখে। ওর মা বুড়ো হয়েছে। এখন মায়ের বিশ্রামের সময়। সারা জীবন ঝাড় দিয়ে দিয়ে কুঁজো হয়ে গেছে। মায়ের কষ্ট পরদেশীর সহ্য হয় না; কিন্তু উপায় নেই। বাচ্চাগুলো অবশ্য বেশি ছোট নয়। দু-এক বছরে ঝাড়া হাত-পা হবে। মায়ের জন্য ভীষণ মায়া হয় পরদেশীর। বুড়িটা আর কত দিন বাঁচবে? স্বাধীনতা দেখতে পাবে তো! পরদেশী শিরীষগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝাড়ুটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে নিজেকে নিষ্পেষণ করে।

তখন প্রবল গোঙানির শব্দ ভেসে আসে। রাবেয়া দ্রুত পায়ে সামনে এগোয়। ও জানে, ব্যারাকে গিয়ে লাভ নেই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে, এইটুকুই। তার পরও সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি ঝাড়ু দিতে চায় না। হাত ওঠে না। বারান্দা ঝাড়ু দিতে চায়, পারে না। ঝাড়ুটা দূরে ফেলে দিয়ে ঠা ঠা রোদে বসে থাকে। যে হারামিগুলো ভেতরে আছে, ওগুলো বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওকে অপেক্ষা করতে হবে।

ও পুড়ে যাওয়া ব্যারাকের দিকে তাকায়। ঘরগুলো এখনো ঠিক করা হয়নি। পোড়া অবস্থায় আছে। ওই ঘরে কয়েকজন পুলিশের লাশ ছিল। ওই পোড়া লাশ সরানোর সময় পরদেশী, লালু, যাদব, সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। এখন ওরা মাঝেমধ্যে ওই পোড়া ব্যারাকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, আমাদেরও সুযোগ আসবে। তোমরা যেখানেই থাকো, স্বাধীনতার বাতাস বুকে টেনে বলবে, ডোমেরাও আমাদের পাশে ছিল। রাবেয়ার মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে, ওই ঘরের ভেতরে আটকে রেখে দুজন পুলিশের গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া যায় না? তাহলেই প্রতিশোধ নেওয়া জুতসই হয়।

ও নিজের দুহাত মুঠি করে ধরে রাখে। দূরের দিকে তাকায়। আশপাশে দৃষ্টি ঘোরায়। চাকরিজীবনের শেষ বেলায় এতসব মেয়ের এমন দুর্দশা দেখতে হলো। ভেবে ওর মাথার পোকা কিলবিল করে। জীবনভর ভালো কিছু জোটেনি। সে জন্য আফসোস নেই রাবেয়ার। বাবা-মা একটি বয়সী লোকের সঙ্গে বিয়ে দিল। বছর তিনেক সংসার করতে না-করতেই মরে গেল। একদিন ভরদুপুরে কাশতে কাশতে চোখ স্থির হয়ে গেল লোকটার। ছেলেটার বয়স তখন দুই শেষ হয়েছে মাত্র। সেই ছেলে বড় হলো। বিয়ে করল। মদের নেশায় বুদ হয়ে থাকতে শিখল। মাকে বলতে শিখল, পেটে ধরেছিস বলে মনে করিস না যে তোর গর্ভের ঋণ আমাকে শোধ করতে হবে। আমি তোকে ভাত দিতে পারব না। ওষুধও না। কিছু না। ও যে এসব মদের নেশায় বলে, তা নয়। জেনেশুনেই বলে। ব্যস, হয়ে গেল বুড়ির পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ। সব বুঝে চাকরিটাকে আঁকড়ে ধরল। সুইপারের চাকরি। ভালোই তো কেটেছিল দিন। কিন্তু শেষ বেলায় এসে এসব কী দেখতে হচ্ছে? নরক দেখার চেয়েও বেশি দেখা? রাবেয়া ঝাড়টা উঠিয়ে এনে নিজের পাশে রাখে। জীবনভর যা কিছু দেখা হয়নি, তার সবটুকু কত অল্প সময়ে দেখতে হলো। ও দেয়ালের গায়ে মাথা ঠেকালে ওর চোখ জলে ভরে ওঠে। একসময় দুগাল বেয়ে গড়াতে থাকে।

পঁচিশের রাতে ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এসএফ ক্যানটিনে ছিল। পাঞ্জাবি সেনারা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেয়েদের এনে ব্যারাকে জমা করতে থাকে। অনেক মেয়েকে হেডকোয়ার্টার বিল্ডিংয়ের ওপর তলায় রাখা হয়। যাদের ব্যারাকে রাখা যায়নি, তাদের বারান্দায় রাখা হয়। কখনো জিপে করে ওদের কোথায় নিয়ে গেছে ও জানে না। এক দলকে পাঁচ-সাত দিন রেখে অন্য কোথাও ছেড়ে দিয়েছে। আবার জিপ ভর্তি করে এনেছে নতুন মেয়েদের।

রাবেয়া ঝাড়টা নিজের সামনে রাখে। পা দিয়ে নাড়াচাড়া করে। ও বুঝতে পারে, ওর ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সেনাগুলোকে যদি এই ঝাড়ু দিয়ে পেটানো যেত? পিটিয়ে ড্রেনে ফেলা যেত? যদি ওদের বলতে পারত যে তোরা বেজন্মা। মানুষের বাচ্চা না। তাহলে পৃথিবীর সবটুকু শান্তি ওর সামনে এসে পাহাড় হতো। ওই মেয়েটিকে একটা ছুরি দিলে কি হয় যে ওদের আঁচড়েকামড়ে ব্যতিব্যস্ত করে? রাবেয়ার চোখ জ্বলে ওঠে। ও ঠিক করে, মেয়েটিকে একটি ছুরি দেবে। ছোট একটি ছুরি। ওদের হাতে নির্যাতিত হয়ে মরে যেতে মেয়েটির খুব লজ্জা হচ্ছে। এমন কথা ও রাবেয়াকে বলেছে। বলেছে, মরে যেতে আমার ভয় নাই। কিন্তু কিছু না ঘটিয়ে মরতে চাই না। একটাকেও যদি জবাই দিতে পারি, তাহলে বুঝব স্বাধীনতার জন্য কিছু করেছি।

রাবেয়া আঁতকে উঠে বলেছিল, এই যে শরীর দিচ্ছ, এটা কিছু করা নয়? এটাও তো স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। যুদ্ধ না বাধলে তোমাকে এখানে আটকাত কোন শালা।

যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েছিল মেয়েটির মুখ। নিজেকেই বলেছিল, দেশের মানুষ কি যন্ত্রণাকে যুদ্ধ বলবে?

ঝাড়ু নাড়াচাড়া করতে করতে রাবেয়া ভাবে, একটি ঘটনা ঘটিয়ে মরুক মেয়েটি। ওকে ধরে নিয়ে আসার পর থেকে মেয়েটি তো ফাইট করছে। একটুও না দমে ফাইট করতে যা বোঝায়, তা-ই করছে। একটি ঘটনা ঘটাতে পারলে ওর আত্মা শান্তি পাবে। হঠাৎ নিজের ভাবনায় চমকে ওঠে রাবেয়া। ভাবে, যুদ্ধের সময় কারও আত্মা কি শান্তি পায়? স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নাই।

ও দেখতে পায়, তিনজন সেনা হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। ওদের বুটের শব্দে স্তব্ধ হয়ে যেতে চায় রাবেয়ার হস্পন্দন। তার পরও শব্দ ওকে আড়ষ্ট করে রাখে। ওর দুচোখে বিদ্যুতের আলো চমকায়। ওরা এসব মেয়ের কাছে যখন-তখন আসে। যখন খুশি তখন। যেন উল্লাস করবে বলে ওদের যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছে। যুদ্ধ মানে মেয়েদের শরীর ছিঁড়ে-খুবলে খাওয়া। রাবেয়া দাঁড়িয়ে থেকে তিনজন সেনাকে চলে যেতে দেখে। ও জানে, একটু পর আবার কেউ আসবে।

ও সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। দুপা ফেলার পর মনে হয় উঠতে পারছে না। শব্দ ওকে পিছু টেনে ধরে, বিকট শব্দ। ঝমঝম করছে শব্দের তাণ্ডব। কাঁপছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এসএফ ক্যানটিনে লুকিয়ে ছিল রাবেয়া। একদিকে হামলা, অন্যদিকে পুলিশদের বাধা দেওয়া। সারা দিন ব্যারাক ঝাড়ু দিয়ে সেদিন আর বাড়ি ফিরতে পারেনি। দিনভর উত্তেজনা ছিল। রক্ত গরম ছিল সবার। পুলিশ ভাইদের অস্ত্রের ঘর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ওর বারবার মনে হচ্ছিল, এত কিছু ছেড়ে বাড়ি যাবে কেন? যুদ্ধ তো ওকেও করতে হবে। যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ওরা এসেছিল কামান, গোলা, বোমা, ট্যাংক নিয়ে। কানফাটা গর্জনে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল চারদিক। ও ধরে নিয়েছিল, শেখের বেটার ভাষণের পর এত দিনে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ও এখন একটা পরিপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে আছে।

ও আবার দুপা ফেলে দুটো সিঁড়ি পার হয়। শরীর ভারী হয়ে গেছে। শরীরজুড়ে কাঁটা। কাঁটার খোঁচায় প্রতি মুহূর্তে টুপটুপ করে রক্ত ঝরে। এ এক ভিন্ন ধরনের যন্ত্রণা। অনুভব করা যায়, কিন্তু দেখা যায় না। রক্ত ঝরার দৃশ্যটি বারান্দার শিকে ঝুলিয়ে রাখা মেয়েদের শরীর। রাবেয়ার হাত থেকে ঝাড়ু পড়ে যায়। ও ধপ করে বসে পড়ে দুহাতে মুখ ঢাকে।

সেদিন থেকে কত কিছু দেখা হলো।

এক জীবনে অনেক কিছু দেখার প্রেরণায় রাবেয়া দু-তিন ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে মাথায় ওঠে। লম্বা বারান্দা পার হলে পাবে ঘর। সব ঘরে বন্দী আছে মেয়েরা। তখন ওর বুক ধড়ফড় করে। বুঝতে পারে, ওর দেখার সত্য যুদ্ধের স্মৃতি। এসব মেয়ের বীরত্বের সাক্ষী হয়ে ও নিজের স্মৃতির কথা বলবে সবাইকে। বলবে সবার আগে। যারা ওদের নষ্ট মেয়ে বলবে, তাদের মুখের ওপর।

তখন আর্তচিৎকার ভেসে আসে বারান্দার শেষ মাথার ঘর থেকে। ওকে কঠিন শাস্তি দিয়েছে ওরা। মেয়েটি ওকে যেন কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু বলতে পারেনি। কথা বলার আগেই ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ও কি আর বলতে পারবে? রাবেয়া দ্রুত পায়ে হেঁটে শেষ ঘরটিতে যায়। মেয়েটি পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় ঝুলে আছে। পা বেঁধে ঝোলানো হয়েছে ওকে। ওর মাথা নিচের দিকে। ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে। ও একজন সেনাকে আঁচড়ে-খামচে দিয়েছে বলে এই নির্যাতন। ঝুলিয়ে রেখে চাবুক দিয়ে পিটিয়েছে মেয়েটিকে। এভাবে ও আর কয় দিন বাঁচবে? ওর মুখ থেকে গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে যে চিৎকার-তোলপাড় করেছিল চারদিক, তা এখন স্তিমিত। রাবেয়া ওর মাথার কাছে দাঁড়ায়। উল্টে থাকা চুল জড়ো করে মাথার ওপর খোঁপার মতো বেঁধে দেয়। ওর হাতের মুঠি বন্ধ। ও হয়তো একটা কিছু খামচে ধরতে চেয়েছিল। পায়নি বলে শূন্য মুঠি স্থির হয়ে আছে। ওর ন্যাংটা, বিবস্ত্র, উলঙ্গ শরীর দুলছে। রাবেয়া ওর মাথা বুকে চেপে ধরে বলে, চোখ খোলা মেয়ে। দেখো আমাকে।

মেয়েটি চোখ খুলতে পারে না। ওর চোখের পাতা ফুলে আছে। মাথা উল্টো হয়ে আছে বলে রাবেয়াকে ক্ষণিকের জন্য দেখারও সুযোগ নেই।

তুমি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলে, বলবে?

আমার মায়ের বাড়ির ঠিকানা দিতে চেয়েছিলাম তোমাকে। আমার মৃত্যুর খবরটা তাকে দিতে বলতে চেয়েছিলাম। এখন তো আর দিতে পারব না।

মুখে মুখে ঠিকানা বলল, আমি ঠিকই মনে রাখতে পারব। আমি তোমার খবর তোমার মাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারব। তুমি আমার মানিক, তুমি আমার সোনা।

কিন্তু মেয়েটি আর কথা বলে না। নিথর হয়ে যায় ওর দেহ। রাবেয়ার বুকে মাথা রেখে ঝুলন্ত অবস্থায় মরে যায় মেয়েটি। রাবেয়া কতক্ষণ ওকে বুকে রেখেছিল, ও জানে না। ওর নিথর শরীর ক্রমাগত শীতল হয়ে যাওয়ার অনুভবও ও টের পায়নি। ও শুধু বুঝেছিল, স্বাধীনতার কথা ওর বুকের ভেতরে তড়পাচ্ছে। ও চিৎকার করে বলছে, স্বাধীনতার জন্য জীবন দিলে তুমি। তোমার মাকে এ খবর কেমন করে পৌঁছাব? আমি কোথায় খুঁজব তোমার মাকে? তোমার লাশ ওরা কোথায় নিয়ে ফেলে দেবে, তা-ও আমি জানি না। আমি আর তোমাকে খুঁজে পাব না, মেয়ে।

হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে রাবেয়া। ঝুলন্ত মেয়েটির মাথার কাছে বসে পা ছড়িয়ে দেয় ও। যেন ওর দুপায়ের ওপর বালিশ রেখে মেয়েটিকে শোয়ানো হবে। আর ঘুমপাড়ানি গান গাইবে রাবেয়া। সেই গানে দাগ পড়তে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। হায় রাবেয়া, তুমি যা দেখছ, সে দেখার শেষ নেই।

 

একদিন জেবুন্নেসা যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলে, তুমি আমাকে একটা ছুরি দাও, খালা। আমি এভাবে মরতে পারব না। একটাকে মেরে মরতে চাই। এটাই হবে আমার যুদ্ধ।

 

যুদ্ধ? মাগো, তুমি যুদ্ধ করতে চাও?

হ্যাঁ, চাই তো। যুদ্ধ করে শহীদ হতে চাই। আমাকে একটা ছুরি দিলেই হবে, খালা। এদের নির্যাতনে মরে গেলে কেউ আমাকে শহীদ বলবে না, খালা।

হ্যাঁ, তা বলবে না। এত কিছু দেখে আমিও যদি মরে যাই, আমিও শহীদ হব না।

জেবুন্নেসার কাতরানো শব্দ উঁচু হয়ে ওঠে। গায়ের জোর ঢেলে চেঁচিয়ে বলে, তুমি না বলেছ যে, খালা, আমার শরীর আমার না। এই শরীর এখন স্বাধীনতার। তাহলে আমি মরে গেলে শহীদ হব না কেন? আর বেঁচে গেলেই বা আমার কী হবে? সমাজের মানুষ কি আমাকে বুকে তুলে নেবে? আমার সব ক্ষতি পুষিয়ে দেবে?

জেবুরে, তোমার কি পিপাসা পেয়েছে? পানি দেব?

না, আমার পিপাসা পায়নি। পানি দিতে হবে না। আমাকে ছুরি দাও। কাত হয়ে পড়ে যায় জেবুন্নেসা। রাবেয়া ওকে ধরতে পারে না। শুনতে পায় বাইরে বুটের শব্দ। তোলপাড় করে সেই শব্দ এগিয়ে আসছে। তারপর আর্তচিঙ্কারে ভরে যায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের প্রাঙ্গণ। রাবেয়া ঝাড়বালতি নিয়ে ব্যারাক পরিষ্কারের কাজে লাগে। দুকান ভরে শুনতে থাকে অনেক মেয়ের আর্তচিৎকার। ঘরের ভেতর গর্জন। গোঙানি। ধমক। গালি। সব মিলিয়ে যুদ্ধ রাবেয়া খাতুনের শোনার ইন্দ্রিয়কে তীক্ষ্ণ করে। ও একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। জেবুন্নেসা মরে গেলে কি শহীদ হবে? রাবেয়া আকাশপাতাল হাতড়ায়। না, এ প্রশ্নের উত্তর ওর কাছে নেই। ও মুখসুস্থ মানুষ, এত প্রশ্নের উত্তর ও কেমন করে বুঝবে। রাবেয়া ঝাড়-বালতি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামে। একবার মাথা টলে ওঠে। ও রেলিং ধরে সামলায়। দেখতে পায় পরদেশী ড্রেন পরিষ্কার করছে। এই মুহূর্তে পরদেশী ওর কাছে ছায়া। দুচারটে কথা বললেও নিঃশ্বাস ফেলা সহজ হয়, নইলে চারদিকের দম আটকানো ভয়াবহতা রাবেয়ার বেঁচে থাকার জীবনটুকু মুড়ে ফেলে। ও দ্রুত পায়ে পরদেশীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

আর তো সইতে পারি না, পরদেশী।

পরদেশী নিজের কাজ করতে করতে এবং মাথা তুলে না-তুলে কঠিন গলায় বলে, পারতে হবে। যুদ্ধ কী, আমি জানি না। শুধু বুঝি, শত্রুরা এমন করে।

তাহলে যে মেয়েটা মরে গেছে, সে কি শহীদ?

কী বললি? আরেকবার বল।

ও কি শহীদ? ওকে কি শহীদ বলবে স্বাধীন দেশের মানুষ?

শহীদ! শহীদ! কী যে যা তা ভাবিস না। এখন এসব কি ভাবা ঠিক। আমি জানি না। ওদের শহীদ বলা হবে কি না।

পরদেশী হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। রাবেয়াকে অন্য রকম লাগছে। রাবেয়াও হয়তো একদিন শহীদ হয়ে যাবে। পরদেশী চারদিকে ঝড়ের তোলপাড় অনুভব করে।

রাবেয়া অসহায়ের মতো বলে, কে আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেবে। তাহলে কাকে জিজ্ঞেস করব?

কাউকে না। কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে না। চুপ করে থাক। মুখ আটকে রাখ।

পরদেশীকে বিভ্রান্ত দেখায়। এই মুহূর্তে ওকে চিনতে পারছে না রাবেয়া। ও তখন দুহাত ওপরে তুলে হাতের ঝাড় শূন্যে ঘোরায়। বলে, ঝড় তুলব। একটা বড় ঝড়।

পরদেশী ধমক দিয়ে বলে, থাম, রাবেয়া। এমন করলে তোর দিকে একটা গুলি ছুটে আসবে। তুই মরবি। তখন মেয়েগুলোকে দেখবে কে? এই যে গুমুত সাফ করছিস, এটাও তোর যুদ্ধ।

যুদ্ধ? মিথ্যে কথা। ওই শয়তানগুলোর দিকে কামান দাগতে না পারলে আমার আর যুদ্ধ কী!

রাবেয়া সোজা রাস্তা ধরে দৌড়াতে থাকে। ও কোথায় যাবে? যেখানে খুশি সেখানে যাক, পরদেশী ভাবে। ওর ড্রেন পরিষ্কার করতে সময় লাগবে। ও কাজে মন দেয়। বুকের ভেতরে কষ্ট। পঁচিশের রাতে লাইনের পুলিশদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলে যুদ্ধ করা যেত। এখন ও কী করবে? ওর ভাবনা ফুরোয় না। পরমুহূর্তে ভাবে, ওর যাওয়া উচিত নয়। ও গেলে মেয়েগুলোকে দেখবে কে? মেয়েগুলোর যদি ওকে কোনো কারণে দরকার হয়? যদি কোনো কাজের কথা বলতে চায়? সেই জরুরি কাজটি করতে পারলে ওর এই পুলিশ লাইনে থাকা সার্থক হবে। এটিও যুদ্ধের কাজ। ওর দিনগুলো এখন ওর নিজের নয়। দিনগুলো স্বাধীনতার। দেশের স্বাধীনতার। সেদিন যদি ওর জীবনে আসে, তখন ও দেশের মানুষকে বলবে, আমাকে পুরো দেশ পরিষ্কার করার কাজ দাও। আমি দেশের সব রাস্তা ঝাড় দেব।

বাতাসের শনশন কান পেতে শোনে পরদেশী। কবে বাবা-মার হাত ধরে এ দেশে এসেছিল, কবে কতগুলো দিন ঝোড়ো বাতাসের মতো উড়ে গেল। কোনো কিছুর তো হিসাব করেনি। বেঁচে থাকা নিয়েই খুশি ছিল। বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার, তার সবকিছুই করেছিল। শুধু যুদ্ধ দেখা হয়নি। একদিন রেসকোর্স ময়দানে শেখের বেটার বক্তৃতা শুনতে গিয়ে তার কথায় যুদ্ধ টের পেয়েছিল। তার মুখে যুদ্ধ দেখেছিল। এখন যুদ্ধ দেখছে ওই মেয়েগুলোর শরীরে। পরদেশী ড্রেনের ভেতর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বোজে। শুনতে পায় আর্তনাদ। চেঁচাচ্ছে রাবেয়া। সেনাদের কেউ ওর পিঠে রাইফেলের বাট দিয়ে মেরে বলছে, এধার কিউ আয় হ্যায়? কাম মে যাও। রাবেয়া মাটিতে পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। পরদেশী ড্রেন থেকে উঠে রাবেয়ার দিকে যেতে চাইলে একজন ওর দিকে বন্দুক তাক করে চেঁচিয়ে বলে, খবরদার। খামোশ! পরদেশী থমকে দাঁড়ায়। দু-চার পা পিছিয়ে ফিরে আসে ড্রেনের কাছে। সারা দিন রাবেয়ার সঙ্গে ওর আর দেখা হয় না। ভাবে, রাবেয়া কি একদিন শহীদ হবে!

এর কয়েক দিন পর রাবেয়া ওকে জেবুন্নেসার গল্প বলে। বলে, জেবুন্নেসার জন্য ছুরি কিনতে হবে। বেশি বড় নয়, কিন্তু শক্তপোক্ত এবং খুবই ধারালো। যেন অনায়াসে পেটের ভেতর ঢুকে যায়। কিনতে হবে আজই। দেরি করার সময় নেই। আজই।

আজই কেন? আজ কি বিশেষ দিন যে আজই কিনতে হবে।

বিশেষ দিনটিন বলে কিছু নেই। ও ওর যুদ্ধ শেষ করতে চায়। ও আর দিন গড়াতে চায় না। বুঝলি?

পরদেশী একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলে, তাহলে আমাদের উচিত ওকে অস্ত্র দেওয়া। ওরা যত মরবে, যুদ্ধ তত বাড়বে।

হ্যাঁ, আমাদের উচিত। আজই কিনতে হবে। আমিও চাই না এমন যন্ত্রণা সহ্য করে ওরা বেঁচে থাকুক। যুদ্ধ যখন করতেই হবে হয়ে যাক এসপারওসপার।

আমি কাজ থেকে ফিরেই দোকানে যাব। কোনো সময় নষ্ট করবে না। রাবেয়া আঙুল উঁচিয়ে বলে, ও আরও দুটো জিনিস চেয়েছে। বলেছে, ওর খুব দরকার।

কী? পরদেশী ভুরু কুঁচকে তাকায়। কী চেয়েছে?

এক টুকরো কাগজ আর পেনসিল।

কী করবে?

চিঠি লিখবে।

কাকে? এমন নরককুণ্ড থেকে কাকে চিঠি লিখবে ও?

তা আমাকে বলেনি। আমিও জানতে চাইনি। কেন জানতে চাইব। ওর যাকে খুশি তাকে লিখবে।

লিখতে পারবে? কেমন করে লিখবে? ওদের শরীর তো আর শরীর নেই।

মাটিতে উপুড় হয়ে লিখবে বলেছে। লিখতে পারবে ও। ওর মনের জোর আছে। সাহস আছে। খুব জেদি মেয়ে। একরোখা। মুখ বুজে যন্ত্রণা সহ্য করে। টু শব্দ করে না। বলে, শুধু প্রতিশোধ নিতে পারলে ওর যন্ত্রণা শেষ হবে। সেদিন ও প্রাণফাটা চিৎকারে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দেবে।

ভালোই তো, আমরা ওকে কাগজ দেব। পেনসিল দেব। যা চাইবে, তা-ই দেব।

আমি কাগজ আনতে গিয়েই মার খেয়েছি।

পেরেছিস আনতে?

পেরেছি। আমার এই রাউজের ভেতরে কাগজ আর পেনসিল আছে। ওকে এখনো দিইনি। ছুরির সঙ্গে একসঙ্গে দেব।

কাগজ-পেনসিল দিয়ে দে। ওর লিখতে সময় লাগবে। লুকিয়ে লুকিয়ে লিখতে হবে তো।

ও পারবে। তুই ওকে তো কাছ থেকে দেখিসনি। ওর সঙ্গে কথা বললে আমারও সাহস বাড়ে।

চা খাবি, রাবেয়া?

হ্যাঁ, চা চাই। শরীর চাঙা করতে হবে।

তুই এখানে থাক। আমি ক্যানটিন থেকে চা নিয়ে আসছি।

পরদেশী চলে গেলে রাবেয়ার মনে হয়, ও ভয় পেয়েছে। পরদেশী বেশি কিছু ভাবতে পারছে না। জেবুন্নেসা একটি চিঠিই তো লিখবে। ওর যাকে খুশি তাকে, তাতে কী এসে-যায়। ওর দুঃখ আছে, কষ্ট আছে, অপমানের জ্বালা আছে। স্বাধীনতার জন্য প্রতিজ্ঞা আছে। এত কিছু বুকে নিয়ে ও এখানে কেন বন্দী থাকবে। রাবেয়া আঁচল নেড়ে বাতাস লাগানোর চেষ্টা করে। বৈশাখের শেষ। দারুণ গরম পড়েছে।

চা আর একটা করে ডালপুরি নিয়ে ফিরে আসে পরদেশী। ডালপুরি দেখে খুশি হয় রাবেয়া।

ডালপুরি এনেছিস? কী যে মজা! ডালপুরি দেখেই বুঝেছি যে খিদে পেয়েছে। সে জন্য পেটটা মোচড়াচ্ছে।

ও ডালপুরিতে কামড় বসায়। পরদেশী আড়চোখে ওর খুশি মুখ দেখে। কিছু বলে না। নিজের ডালপুরি আর চা খেয়ে শেষ করে। তারপর আস্তে করে বলে, ক্যানটিনের মিলিশিয়া সেপাইটা তোকে উদ্দেশ করে বলেছে, ওই মেয়েলোকটার সঙ্গে তোকে যদি বেশি কথা বলতে দেখি, তাহলে অফিসে নালিশ দেব। তখন দেখবি গুলি খেয়ে মরবি। এখন থেকে সাবধান হয়ে যা।

তুই বললি?

তুই তো জানিস, ওদের সঙ্গে কথা বলতে আমার ঘেন্না হয়। আমি কিছুই বলিনি। চা নিয়ে সোজা তোর কাছেই তো চলে এলাম। দেখুক কথা বলি কি বলি না।

ঠিক আছে, যা খুশি করুক। অত ভয় পাই না। তবে এখন থেকে আমরা ব্যারাকের পেছনে বসে কথা বলব।

জায়গা খোঁজার দরকার নেই। যেখানে কাজ সেখানেই কথা হবে। আমাদের তো কথা বলতে হবে। আমাদের মেয়েগুলো স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিচ্ছে আর আমরা কথাও বলব না?

ঠিক বলেছিস। যাই।

রাবেয়া আর পরদেশীর দিকে ফিরে তাকায় না। আঁচল দিয়ে নিজের মুখহাত মুছে নেয়। ঝাড় নেয়, সেটা বগলের নিচে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। সিঁড়ির মুখে সূর্যমণির মুখোমুখি হয় রাবেয়া। ওকে দেখে থমকে দাঁড়ায় সূর্যমণি। চোখ মুছতে মুছতে বলে, আর চাকরি করব না ঠিক করেছি। এত নির্যাতন সহ্য হয় না। আমি ভাত খেতে পারি না। রাতে ঘুমোত পারি না।

চুপ কর, সূর্য। কী করছে ওরা?

পরিষ্কার করে দেওয়ার পর একটু স্বস্তিতে আছে।

ঘুমোতে পারছে?

কেউ কেউ চোখ বুজেছে।

তাহলে এখানে একটু বসি। ওরা একটু ঘুমিয়ে নিক।

জেবুন্নেসা তোমাকে খুঁজছিল।

রাবেয়া চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস টানে। সূর্যমণিকে জেবুন্নেসার কথা বলা হয় না। যেটুকু পরদেশীকে বলেছে, সেটুকু আর কাউকে বলবে না। দুজনে পাশাপাশি সিঁড়িতে বসে। রাবেয়ার কানে ভেসে আসে জেবুন্নেসার কণ্ঠ—আমি আব্বা-আম্মা-ভাইবোনের সঙ্গে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পারে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। আব্বা বলেছিলেন, এই গণহত্যার পরে আমরা আর ঢাকায় থাকব না। গ্রামে চলে যাব। তারপর কী করব দেখা যাবে। যুদ্ধে যাওয়ার পথে যাব। কিন্তু সদরঘাটে ওরা আমাকে ধরে। আব্বাকে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়। আম্মা ছোট ভাইবোনদের নিয়ে কোথায় আছে, আমি জানি না। আম্মাও জানে না আমি কোথায়। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জেবুন্নেসা আবার বলে, মারুফও জানে না আমি কোথায়। মারুফের সঙ্গে কি আমার আর দেখা হবে? মারুফ কোথায়, তা আমি জানি। ও কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে আছে। ও আমাকে বলেছিল, যুদ্ধ শুরু হলে ও দেশে থাকবে না।

রাবেয়া মৃদু হেসে বলেছিল, মারুফের সঙ্গে তোমার পেরেম না?

ও ঘাড় নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ। ছয় মাস আগে ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় ও আমাকে বলেছিল, আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করব, জেবু। আমি বলেছিলাম, যুদ্ধ হবে তুমি তা কী করে জানলে? ও শপথের মতো করে বলেছিল, এই ভাষণের পরে যুদ্ধ না হয়ে পারে না। যুদ্ধ হবে। দেশও স্বাধীন হবে। রাবেয়া খালা, মারুফ তো আমাকে আর খুঁজে পাবে না, না?

রাবেয়া চুপ করে ছিল। রাবেয়া নিজেও বোঝে, এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না। জেবুন্নেসাও বোঝে যে উত্তর হয় না। পুরো সময়টাই অনিশ্চয়তায় ভরা। কোথায় কাকে কখন পাওয়া যাবে, এ কথা কেউ জানে না।

জেবুন্নেসা ওর হাত ধরে বলেছিল, তুমি আমার একটা চিঠি মারুফকে পৌঁছে দেবে, রাবেয়া খালা?

চিঠি? কোথায় পৌঁছাব? মারুফকে তো আমি চিনি না।

মারুফের বাড়িতে পৌঁছাবে। ওকে তোমার চিনতে হবে না। ওর বাড়িতে ওর বাবা-মা, বোন থাকে। ওনাদের কারও হাতে চিঠিটা দিয়ে আসবে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে মারুফ জানতে পারবে যে আমি নেই। আমি শহীদ হয়েছি।

ঠিকানা আছে?

সব দেব। তুমি আমাকে কাগজ-পেনসিল জোগাড় করে দিয়ো। দেবে তো, খালা? তোমার পায়ে ধরি, খালা। মরার আগে তুমি আমার এই ইচ্ছাটা পূরণ করো।

এখনো জেবুন্নেসার অনুরোধ দুকান ভরে বাজে রাবেয়ার কানে। ব্লাউজের ভেতরে এক টুকরো কাগজ আর পেনসিল রাখা আছে। ওরা দেখতে পায়, ওদের খেতে দিতে তিন-চার বালতি ভরে ভাত-ডাল-তরকারি আনা হচ্ছে। এখন ওদের খাওয়ার সময় হয়েছে। রাবেয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আবার জেবুন্নেসার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, খালা, আমি মরে গেলে তুমি আমার কথা মারুফকে বলবে। নাকি বলা ঠিক হবে না? আমার এই দুর্দশার কথা শুনতে বোধ হয় ওর ভালো লাগবে না, খালা। থাক, তোমাকে কোনো কথা বলতে হবে না। আমি জানি, ও ওর স্মৃতি থেকে আমাকে সরাতে পারবে না। ও বলেছে, আমার সঙ্গেই ওর প্রথম প্রেম। আমিও মারুফ ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসার কথা বলিনি। ওর সঙ্গে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় হয়। আর্টস বিল্ডিংয়ের দোতলায় প্রথম কথা হয়।

রাবেয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, তুমি ঘুমাও, মেয়ে।

এত কথা বললে তোমার শক্তি কমে যাবে। তোমাকে আমি ছুরি দেব। তোমার সামনে যুদ্ধ আছে।

হ্যাঁ, আমি যুদ্ধ করব। তার পরও তোমাকে মারুফের কথা বলতে আমার ভালো লাগছে। মারুফের বাড়িতে কেউ আমাকে চেনে না। ওর বোন মেরিনাকে আমি দূর থেকে দেখেছি। মারুফকে না পেলে আমার চিঠিটা মেরিনার কাছে দিয়ে। মেরিনাকে যতটুকু দেখেছি, ভালো মেয়ে মনে হয়েছে। ও আমার ওপর রাগ করবে না।

তুমি আর কথা বোলো না, জেবুন্নেসা।

আমার তো কথা বলতে ভালো লাগছে। আমি তো ভাবতে পারছি যে আমি মারুফের সঙ্গে কথা বলছি। অসহযোগ আন্দোলনের পুরো সময় আমরা অনেক কথা বলেছি। আমরা দুজনেই যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়েছিলাম। আমরা ট্রেনিং নিয়েছিলাম। মিছিল করেছিলাম। যেদিন আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল, সেদিন ও বলেছিল, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত। আমি হেসে বলেছিলাম, ইয়াহিয়া খান দেশে অস্ত্র আর সৈন্য এনে ভরে ফেলেছে, তুমি বসন্তের কথা বলছ? ও বলেছিল, অস্ত্রের ফাঁক গলিয়ে যে ফুলটি ফুটবে, সেই ফুলটি আমি তোমাকে দেব, জেবু। বলব, তোমার খোঁপায় স্বাধীনতা খুঁজে দিলাম। ওর সঙ্গে কথা বলে খুব আনন্দ পেতাম, খালা। আমার যুদ্ধের কথা তুমি ওকে বোলো, খালা।

বলব, বলব। আমি সব বলব ওকে। তুমি থামো।

সেদিন জেবুন্নেসা আর কথা বলেনি। ওর চোখ বুজে এসেছিল। ও নেতিয়ে পড়েছিল। জ্ঞান হারিয়েছিল। আমি ওর চোখমুখে পানি ছিটিয়ে বলেছিলাম, জেবু, ওঠো। জেবুন্নেসা ওঠেনি। আমি ডাক্তারকে খবর দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, স্যার, মেয়েটাকে দেখেন। ও বোধ হয় বাঁচবে না।

ডাক্তার বিরক্তির সঙ্গে আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, এদের মরাই উচিত। এগুলো বাঁচবে কোন সাধে? ভাগাড়ের শকুন সব।

ডাক্তার জেবুন্নেসাকে দেখতে আসেনি। পুলিশ লাইনের বাঙালি ডাক্তার। সেদিন রাবেয়া মনের সুখে গাল দিয়েছিল, জাউরা একটা। হারামি। যুদ্ধ বোঝে না। স্বাধীনতা বোঝে না। হারামি নিজের জীবন বোঝে শুধু। হারামি, তুইও বাঁচবি কোন সাধে?

তারপর একদিন ভরদুপুরে, যখন হালকা মেঘের আড়ালে রোদ ঝিমিয়ে পড়েছে পুলিশ লাইনের ওপর, কোনো জরুরি অপারেশনে বেরিয়েছিল বেশির ভাগ মিলিটারি গাড়ি, সেদিন এক শ টা কমলা নিয়ে এসেছিল ডাক্তার আহমদ। বলেছিল, ওদের দেখার মতো মনের জোর আমার নাই, রাবেয়া। ওদের জন্য ওষুধ বরাদ্দ নাই। চিকিৎসাব্যবস্থার কিছু নাই। ওদের জন্য আমি কিছু করতে পারব না বলে আমি আসি না। তুমি আমার কথায় কিছু মনে করবে না।

স্যার, আপনি কী যে বলেন।

রাবেয়া বিব্রত এবং লজ্জিত হয়েছিল।

এই কমলাগুলো রাখো। লুকিয়ে রাখবে। ওদের খেতে দিয়ো। আর বলবে, লাইনের ডাক্তার ওদের জন্য কিছু করতে পারেনি বলে তার মরে যেতে ইচ্ছা করে।

যুদ্ধে যেতে ইচ্ছা করে না, স্যার?

হ্যাঁ, করে। কিন্তু বিছানায় পড়ে যাওয়া বাবাকে ফেলে আমার যুদ্ধে যেতে ভয় করে। মানুষটা আমার দুহাত জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদে। বলে, আমাকে বিষ দে, খোকা। আমি মরে যাই। তুই যুদ্ধে যা। আমি এসব কথা শুনলে বোকা হয়ে যাই। আমার চারদিকে অন্ধকার।

সেদিন ডাক্তার আহমদকে একজন অসহায় মানুষ মনে হয়েছিল রাবেয়ার। মনে হয়েছিল, ওর নিজের যে মনের জোর আছে, সেটুকু এই ডাক্তারের নেই। ও হাত উল্টে মাফ করে দিয়েছিল তাকে। নিজেকে বলেছিল, কোনো কোনো মানুষ এমন। গর্তে লুকিয়ে থেকে ভাবে, দিনটা আজ বড্ড ঠান্ডা। কোথা থেকে এত শীত পড়ল। কুয়াশা এমন ঘন কেন? দৃষ্টি বেশি দূরে ছড়ানো যায় না। ওদের মাথা কোনো দিনই আকাশসমান হয় না।

জেবুন্নেসা আরও বলেছিল, মরার আগে ভালোবাসা বুঝেছি। আরেক জীবনে ঠিকই মারুফের সঙ্গে দেখা হবে আমার। আবার প্রেমের কথা শুনব ওর কাছ থেকে। বলব, স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছিলাম। এবার প্রেমের জন্য জীবন দেব। ও ঠিকই হাসতে হাসতে বলবে, আর জীবন দিতে হবে না। এখন আমাদের শান্তির জীবন কাটবে। আমাদের সংসারের বাগানে ফুল ফুটবে। রাবেয়া খালা, ওর নাম মারুফুল হক। ওদের বাড়ি হাটখোলায়। তোমাকে আমি ঠিকানা লিখে দেব।

রাবেয়া উঠে দাঁড়ায়। সূর্যমণিকে বলে, আমার সঙ্গে আয়। এদের খেতে দেব।

আমি যাব না। ঝুলিয়ে রাখা মেয়েটাকে কী করে খাওয়াব?

পরদেশীকে ডেকে নিয়ে আয়। সবাই মিলে ধরে ওকে নামাব।

গুলি খেতে চাও? এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুলি করবে তোমাকে। মরার পথ খুঁজে বের করেছ, ভালোই।

মারলে মারবে। ওরা কিছু বললে বলব, আমরা তো তোমাদের জন্য ওকে সুস্থ রাখতে চাই। সে জন্য ওকে খেতে দিয়েছি।

ওরা বলবে, আমাদের লাশ দরকার নাই। দশটা যাবে, আমরা আবার নতুন দশটা আনব।

রাবেয়া ওকে ধমক দিয়ে বলে, তোর কাছে এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না, সূর্যমুখী। লাথি মেরে তোকে দোতলা থেকে ফেলে দেব।

যা খুশি কর। কিন্তু আমি পরদেশীকে এখানে ডেকে আনতে পারব না।

তাহলে তুই আর আমি কাজটা করব।

, সেটাও আমি পারব না। তোমাকেও করতে দেব না।

কেন? রাবেয়া দুহাত কোমরে দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে।

এরা আমাদের কাউকে বাঁচতে দেবে না। এই মেয়েগুলোকেও না। তুমি বলেছ ওদের একজন একজন করে ছেড়ে দিতে পারলে দেবে। ওরা যুদ্ধ করতে যাবে। বলোনি?

বলেছি তো। সুযোগমতো ছেড়েও দেব।

তাহলে চিন্তাভাবনা করে এগোনো ভালো না?

রাবেয়া চুপ। তারপর মাথা নাড়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জেবুন্নেসার কাছে গিয়ে বলে, কেমন আছ?

এমন কথা জিজ্ঞেস কোরো না। আমার কাগজ-পেনসিল এনেছ?

হ্যাঁ, এনেছি। এখন দেব না। তুমি তো লিখতে পারবে না।

এভাবে পারব না। পাশের ঘরে নীলু আছে। ওকে ডাকো। ও লিখবে। তোমাকে ভাত খাইয়ে দিই?

না। আমি আর কথা বলতে পারব না, খালা।

রাবেয়া বুঝতে পারে, কথা বলতে মেয়েটির কষ্ট হচ্ছে। ও হয়তো আর বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবে না। ওর সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফুরিয়ে যাওয়া সময়ের আগে ওকে ওর নিজের মতো থাকতে দিতে হবে। শৈশব থেকে গড়ে ওঠা এক আশ্চর্য পৃথিবী এখন ওর সামনে। সেই পৃথিবীর দেখা-না-দেখার আকাঙ্ক্ষায় ওর বুকের জমিন তোলপাড়। ও আর কথা বলবেই বা কেন? ও দেখুক নিজের জীবনের কাটিয়ে আসা সময়টুকু। ফাঁকফোকর-গলিঘুপচি সবটুকু হাতড়ে দেখুক-পায়ে হেঁটে দেখুক-একছুট দিয়েও দেখে আসতে পারে। এটা মানতে হবে যে যুদ্ধের সময় অনেক অনেক মেয়ে কেবলই ক্ষতবিক্ষত হয়। রক্তাক্ত হয়। তারপর টুপটাপ রক্ত ঝরে। ঝরতেই থাকে। মেঝেতে রক্ত ছড়ায়। আর মেয়েরা শ্বাস নিতে ভুলে গিয়ে ঝুলে থাকা দৃষ্টি দিয়ে রক্তমাখা মেঝে দেখে। জেবুন্নেসা ধরে নেয়, এভাবে দেখতে শেখা যুদ্ধের সময়ের নিয়ম। মেঠো মাটি নয় যে রক্ত শুষবে। পিচ্ছিল মেঝেতে রক্ত কালো দাগ হয়ে দু-চার শ নদীর মতো শুকিয়ে থাকা। গড়িয়ে যাওয়া রক্তের আঁকাবাঁকা রেখা জেবুন্নেসার দৃষ্টিতে এক মানচিত্র, যেখানে জনপদ আছে, মানুষের বসবাস আছে। এসব জায়গা এখন দুর্গ, মিলিটারি কনভয় এবং যুদ্ধের তাণ্ডব। রক্ত, মৃত্যু, জীবন এক সুতায় সমান্তরাল গাঁথা। এই মানচিত্রে শত শত মাইল শস্যক্ষেত্র আছে, পতিত জমি ও সীমান্তরেখা মানচিত্রের পৃষ্ঠার রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্র। সারা দেশের শহরগুলো গেরিলাযুদ্ধে আক্রান্ত। লড়ছে শহরবাসী—নানা কৌশলে, নানা সূত্রে-পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ রেখে অথবা না রেখে। সত্য শুধু লড়াই। জেবুন্নেসা তাকিয়ে থাকলে নিজের পরিবারের হারিয়ে যাওয়া ছবি দেখতে পায়। ভাবে, ওরা কোথাও না কোথাও আছে গ্রামে অথবা শহরে, নানা অথবা দাদার বাড়িতে। নয়তো চাচা-মামা কারও সঙ্গে ওর মা সব ভাইবোনকে নিয়ে চলে গেছে। হয়তো ওদের সঙ্গে মারুফের দেখা হতে পারে। মারুফকে ওর মা চেনে না, মারুফও ওর মাকে দেখেনি। তার পরও দেখা গেল, কাকতালীয়ভাবে পরিচয় হয় মারুফের সঙ্গে। পথের ধারে একজন নারীকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসে থাকতে দেখে মারুফ এগিয়ে যায়। বলে, মাগো, আমার সঙ্গে আসুন। আমি আপনাকে শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছে দেব। কোনো ভয় করবেন না। আমি আপনার দেখাশোনা করব। তখন মা বলবেন, আমার জেবুন্নেসাকে আর্মি তুলে নিয়ে গেছে। ওকে আমি কোথায় খুঁজব, বাবা?

জেবুন্নেসা! মারুফের ভুরু কুঁচকে যাবে। তারপর বলবে, ঠিক আছে, আপনার জেবুন্নেসাকে আমি খুঁজে দেখব। শরণার্থী শিবিরের সব মেয়ের নাম আমি জিজ্ঞেস করব। ওকে খুঁজে পেলে আপনার কাছে নিয়ে আসব।

ওকে তো আর্মি নিয়ে গেছে, বাবা।

মাগো, আমি সাধ্যমতো খুঁজব।

ভালোবাসার মানুষটিকে মনে করে জেবুন্নেসা চোখ বুজে বড় করে শ্বাস টানে। ভাবে, যুদ্ধের সময় প্রিয়জনকে তো এভাবেই মনে করতে হয়। যুদ্ধের পরিস্থিতির বাইরে তো কাউকে স্মরণ করা যায় না। যুদ্ধের সবটুকু সেই স্মরণে থাকে।

একসঙ্গে শহরের আনন্দে ফুটে ওঠে দৌড়ে যাওয়া গেরিলাদের সন্তর্পণ বিচরণক্ষেত্র। যেখানে অস্ত্র এবং সাহস এক সুতায় গাঁথা হয়। যেখানে জীবনের পক্ষে নানা উপচার সজ্জিত গৃহগুলো সাহসীদের হাত ধরে বলে, আবার এসো, আমরা তোমাদের অপেক্ষায় আছি।

আর গোলাবারুদ-ট্যাংক-মর্টার-মেশিনগান আশ্চর্য দ্যুতিময় ঝলকানিতে স্বাধীনতার জন্য লড়াকু মানুষের চকচকে দৃষ্টি হয়ে বলে, ডর নেই। আমরা জয়ী হবই। যত রক্ত এবং জীবন দিতে হোক না কেন, দেবই। স্বাধীনতার সোনালি শস্যক্ষেত্রে দেখো অলৌকিক ফুল ফুটেছে। যে ফুলের নাম জীবন।

জেবুন্নেসার চোখ বুজে আসে।

জেবুন্নেসা মুখ দিয়ে শ্বাস টানে।

জেবুন্নেসার শরীর রক্তে ভাসিয়ে দিচ্ছে মেঝে। ওর জীবনপ্রদীপের শিখায় প্রবল বাতাসের ধাক্কা—ওটা নিবুনিবু প্রায়।

তখন নীলুকে নিয়ে ফিরে আসে রাবেয়া। নীলু স্কুলের ছাত্রী। ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। ওর কৈশোরের চোখজোড়া আশ্চর্য শাণিত। বলছে, জেবু আপা, আমি আপনার কী কাজে লাগব?

তুমি আমার জন্য একটি চিঠি লিখবে।

চিঠি? এত সামান্য কাজ দিচ্ছেন?

সামান্য নয়, নীলু। এটি অনেক বড় কাজ। আমি এক সত্য কথা বলতে চাইব এখন।

আপনি বলুন, আমি লিখছি।

জেবুন্নেসা অস্ফুট ধ্বনিতে বলে, প্রিয় মারুফ, আমি তোমার ভালোবাসায় একটি সুখী মেয়ে ছিলাম। তোমার ভালোবাসা স্বাধীনতার জন্য আমার প্রিয় দেশ এখন। আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। ওরা আমার লাশ শিয়ালশকুনকে খেতে দিলেও আমি বলব, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত। যুদ্ধের বসন্ত। তুমি সবাইকে বলবে, যুদ্ধের বসন্তে জেবুন্নেসা শহীদ নারী। ও স্বাধীনতার জন্য নিজের সবটুকু দিয়েছে। এই নিবেদনে ওর ত্যাগ ছিল, কিন্তু ভয় ছিল না।

জেবুন্নেসার কথা ফুরিয়ে যায়। ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মেধাবী ছাত্রী। ও অস্ফুট ধ্বনিতে বলে, এই চিঠি মারুফের কাছে পৌঁছে দিয়ো, খালা। ওকে পেলে ওর বোনকে দিয়ে। ওকেও না পেলে ওর মাকে দিয়ে। নইলে ওর বাবাকে। কেউ না কেউ যেন জানতে পারে জেবুন্নেসা যুদ্ধের আর একটি ক্ষেত্রে শহীদ হয়েছে। ওকে জয়ের তিলক পরানো হবে, কলঙ্কের নয়।

সেই রাতে মৃত্যু হয় জেবুন্নেসার। ডডামেরা এসে সরিয়ে নিয়ে যায় জেবুন্নেসার লাশ। কোথায় নিয়ে যাবে, তা জানতে পারে না রাবেয়া। ও শুধু অনুভব করে ব্লাউজের ভেতর রাখা আছে জেবুন্নেসার চিঠি আর বাড়ির। ঠিকানা। শীতল হয়ে থাকে রাবেয়া। মুখে কথা নেই। নীলু ওকে ডাকে, খালা। আপনার কী হয়েছে?

রাবেয়া ওর দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে।

নীলু রাগতস্বরে বলে, নিঃশ্বাস ফেললা না, খালা। নিঃশ্বাসের শব্দ পেলে আমার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। তুমি যদি আমাকে একটা ছুরি না দাও, তাহলে তোমাকে আমি গলা টিপে মেরে ফেলব।

চুপ কর, নীলু। গলা নামিয়ে কথা বল।

আমার গলা আর নামবে না। তোমাকে বলে রাখলাম, একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব।

করিস। আমি নিচে যাচ্ছি।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রাবেয়া শুনতে পায় নীলু চিৎকার করে কাঁদছে। ওর মনে হয়, ও নামছে তো নামছেই। সিঁড়ি আর শেষ হয় না। কতকাল লাগবে এই সিঁড়ি শেষ হতে? পরক্ষণে নিজে সিঁড়ির ওপর বসে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ওর ক্রন্দনধ্বনি পৌঁছে যায় পুলিশ লাইনের সুইপারদের কাছে।

 

পরদিন দুপুর।

হালকা মেঘের আড়ালে রোদ ঝিমিয়ে পড়েছে পুলিশ লাইনের প্রাঙ্গণে। শত শত মৌমাছি কোথা থেকে উড়ে আসছে কেউ বলতে পারে না। তাদের গুঞ্জনে মুখরিত প্রাঙ্গণ। প্রত্যেকে মুখ তুলে চারদিকে তাকায়। ভাবে, আজ এত মৌমাছি কেন? কোথা থেকে এল? পুলিশ লাইনের ব্যারাক-অফিস-প্রাঙ্গণ তো সরষেখেত নয় যে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করতে এসেছে? প্রতিটি ব্যক্তির কপাল কুঁচকে থাকে। তারা ফিসফিস করে বলে, হলো কী আজ? বেলুচিস্তানের সৈনিক বুখারি পাঞ্জাবি সেনা গিলানিকে বলে, কেয়া হুয়া ভাইয়া? বুখারি দেখতে পায়, ওর রাইফেলের বাটে মৌমাছি এসে বসেছে। ভরে গেছে পুরো রাইফেল। দোতলার ঘরে যন্ত্রণায় তড়পাতে তড়পাতে নীলু ভাবে, জেবু আপার চিঠিটা নিতে এসেছে মৌমাছির ঝাঁক। একজন শহীদ নারীর কথা ওরাও ছড়াবে তো! ও ব্যারাকের সব জায়গায় দৌড়ে দৌড়ে বলে, আমরা শহীদ নারী হব। আমাদের কথা পৌঁছে যাবে দেশের মানুষের কাছে। আজ আমাদের এখানে কোনো সেনা নেই। আজ এই ব্যারাক আমাদের আর শত শত মৌমাছির। দেখো, বারান্দায় ঘরের দেয়ালে ফুলের মতো বসে আছে ওরা। ওরা জেবু আপার চিঠি বয়ে নিয়ে যাবে, হ্যাঁ, এ জন্যই এসেছে।

পরদেশী যাদবকে বলে, মৌমাছিরা আমাদের বন্ধু। ওরা কোন ফুলের ঘ্রাণে এখানে এসেছে রে?

গতকাল যে ফুল ফুটেছে তার ঘ্রাণে এসেছে ওরা।

ঠিক বলেছিস, একজন শহীদ নারী স্বাধীনতার সৌরভ।

এই সৌরভ পেয়েই উড়ে এসেছে মৌমাছি। আমার ইচ্ছা হচ্ছে কিছু মৌমাছি ধরে বাড়ি নিয়ে যাই। আজ ওরা আমাদের হুল ফোঁটাবে না।

না থাক, ওদেরকে ওদের মতো করেই থাকতে দে। বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

তখন ড্রেনের পাশে এসে দাঁড়ায় রাবেয়া। পরদেশীকে বলে, এই শহীদ মেয়েদের জন্য তোর কাছে কাজ এসেছে পরদেশী। কাজটা আজই করতে হবে। এক দিনও দেরি নয়।

কাজ? কী করব ওদের জন্য? দুহাতে নিজের বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, ওদের জন্য কাজ করে ধন্য হতে চাই আমি।

এই চিঠিটা পৌঁছাতে হবে হাটখোলার একটি বাড়িতে। এই যে ঠিকানা।

দে, দে। আমি আমার বুকপকেটে রাখব?

হ্যাঁ, বুকপকেটেই রাখ।

সিকিউরিটির লোকেরা যদি আমার শরীর হাতড়ায়? যদি চিঠিটা কেড়ে নেয়?

তাহলে পকেটে রাখিস না। জামার ভেতরে রাখ। চিঠিটা যেন তোর বুকের সঙ্গে মিশে থাকে।

পরদেশী খুব যত্ন করে চিঠিটা বুকের সঙ্গে লাগিয়ে নেয়। তারপর শার্টের সব বোম লাগায়।

আমার মুক্তিসেনা বোনটা আমাকে একটা কাজ দিয়েছে। আমার সারা জীবন মনে থাকবে। আমি গেলাম। আয় যাদব। তুইও আমার সঙ্গে যাবি।

রাবেয়া বাধা দেয়। দুহাত বাড়িয়ে বলে, না, দুজন একসঙ্গে যাবে না। বিপদ হলে একজনেরই হবে। যাদবকে থাকতে হবে আর একজন শহীদ মেয়ের জন্য।

হ্যাঁ, ঠিক। আমি একাই যাই।

পরদেশী চলে যায়। যাদবও অন্যদিকে যায়। রাবেয়া একা দাঁড়িয়ে থাকে। দুহাতে চোখের জল মোছে।

 

পরদেশী যখন হাটখোলার বাড়িতে আসে চিঠির ঠিকানা ধরে, তখন শেষ বিকেল। পশ্চিম আকাশটা অদ্ভুত লাল রং ধরে আছে। অথচ এক স্লান আলোয় ভরে আছে শহর। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার রাস্তায় চোখ রেখে, পরদেশীর এমনই মনে হয়। মনে হয়, শহর খুব বিষণ্ণ হয়ে আছে। ও বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে টুকটুক শব্দ করে। গেটের কাছে আলতাফ ছিল। কাছে এগিয়ে আসে। গেটের অল্প ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা যে কে এসেছে, কিন্তু পরদেশীর পুরো শরীর দেখা যায় না। মুখ তো নয়ই। কারণ ও ঘাড়টা রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। লোকজনের চলাচল খেয়াল করছে। বাড়ির ভেতরে আকমল হোসেন সামনের ছোট পরিসরে পায়চারি করছিলেন। কখনো আকাশ দেখেন, কখনো কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকেন-কী শুনতে চান তিনি নিজেও তা বুঝতে পারেন না। বোমার শব্দ, আর্মি কনভয়ের চলাচল, আয়শার গুনগুন ধ্বনি, কিংবা উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ—বুঝতে পারেন সবকিছু একসঙ্গে চলছে বলে তিনি কোনো কিছু আলাদা করার কথা ভাবেন না। কিন্তু তার পরও তার মনে হয়, কারও পায়ের শব্দ এ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কেউ কোনো বার্তা নিয়ে এসেছে কি? মারুফ কেমন আছে? ও এখন কোথায়, তা তার জানা নেই। তিনি নিজের সঙ্গে নিজের চিন্তা যোগ করতে পারেন না। মনে হয়, চিন্তার পরিসর বেড়ে যাচ্ছে, তারও বড় জমিন। তৈরি হয়েছে তার জন্য। এখন তার অপেক্ষার সময়। তিনি আকাশের দিকে তাকান—অদ্ভুত রংটা আরও বেশ অনেকখানি ব্যাপ্তি নিয়ে ছড়িয়েছে।

পরদেশী আবার গেটে শব্দ করে। এবার বেশ জোরে। বোঝাতে চায় যে ও এই বাড়িতেই এসেছে। ও ঠিকানা ভুল করেনি বলেই নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে। পরদেশীকে গেটের কাছে এসে দাঁড়াতে দেখে আলতাফ দুপা এগিয়ে বলে, কাকে চান?

এ বাড়ির কাউকে। এটা তো জনাব আকমল হোসেনের বাড়ি?

হ্যাঁ, তার বাড়ি। কোথা থেকে এসেছেন?

রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে।

ফিসফিস করে বলে পরদেশী। চারদিকে তাকায়। আলতাফ বুঝে যায় যে ও কোনো খবর নিয়ে এসেছে।

পরদেশী অস্থির হয়ে ওঠে। যেন ধৈর্য ধরার সময় নয় এখন। যা কিছু করার তা করতে হবে বিদ্যুৎ-গতিতে। বুকের ভেতর উত্তেজনা থরথর করে কাঁপে পরদেশীর।

কে আছেন বাড়িতে? তাঁকে ডাকেন।

আপনি ভেতরে আসেন। বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হবে না।

আলতাফ গেট খুলে দেয়। ও বুঝতে পারে যে লোকটি হয়তো গেরিলাদের খবর নিয়ে এসেছে। ওকে দেখে আকমল হোসেন এগিয়ে আসেন। পরদেশী কাঁপা গলায় তাকে বলে, আমি একটা চিঠি নিয়ে এসেছি।

চিঠি? কার চিঠি?

একজন শহীদের।

শহীদ? মারুফের বন্ধু নাকি?

শুনেছি বন্ধু। মারুফ কই?

ও তো যুদ্ধে গেছে। গেরিলা হয়েছে।

যখন বাড়িতে আসবে, তাকে এই চিঠিটা দেবেন।

ও চারদিকে তাকিয়ে জামার বোম খুলে চিঠি বের করে আকমল হোসেনের হাতে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমি জল খাব। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।

আকমল হোসেন চিঠিটা নিয়ে বলেন, আলতাফ, পানি। তুমি আমার সঙ্গে এসো। বসো।

আলতাফ পানি আনতে যায়। রান্নাঘরে গিয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে গেলে গ্লাস উপচে পানি পড়ে মেঝেতে। মন্টুর মা রাগতস্বরে বলে, কী হয়েছে? হাত কাঁপে কেন?

আলতাফ উত্তর দেয় না।

আকমল হোসেন পরদেশীর হাত ধরেন। বারান্দায় যে চেয়ার ছিল, সেটা টেনে বসতে দেন। বুঝতে পারেন, ওর ভেতরে একধরনের অস্থিরতা কিংবা প্রবল আবেগ কাজ করছে। ও খুব স্বাভাবিক নয়। তিনি খুব শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করেন, কোথা থেকে এসেছ?

রাজারবাগ পুলিশ লাইন। ওখানে সুইপারের কাজ করি।

বুঝেছি। আকমল হোসেন মাথা নাড়েন। হেঁটে এসেছ বোধ হয়, তোমাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে।

হ্যাঁ, হেঁটেই এসেছি। তবে টায়ার্ড না। আমি অনেক কাজ করতে পারি। আমি যুদ্ধ করতেও পারব।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আয়শা খাতুন আর মেরিনা। আকমল হোসেন চিঠিটা আয়শা খাতুনের হাতে দিয়ে বলেন, ও এই চিঠিটা এনেছে। তুমি আগে পড়ে দেখো।

পরদেশী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি পরদেশী। সুইপার।

তুমি এখানে বসো। মেরিনা, ওকে হালুয়া আর চা দে।

না, মাইজি, হালুয়া খাব না। শুধু জল।

তা হবে না। যুদ্ধের সময় এখন। সব যোদ্ধাকে একটু কিছু খেতে হবে এই বাড়িতে। এটা হলো যোদ্ধাদের জন্য দুর্গবাড়ি।

ও ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে বলে, বহুত আচ্ছা, মাইজি, বহুত আচ্ছা। আমি চেয়ারে বসব না। এখানে বসি।

পরদেশী সিঁড়ির ওপর পা গুটিয়ে বসে। সুজির হালুয়া খায়। প্রাণভরে কয়েক গ্লাস জল খায়। বুঝতে পারে না এই বাড়িতে বসে আজ ওর এত তেষ্টা পাচ্ছে কেন? কোথাও কিছু কি ভেঙেচুরে পড়ে যাচ্ছে? পরদেশী যাওয়ার জন্য দাঁড়ালে আকমল হোসেন বলেন, পুলিশ লাইন তো আমাদের আরেকটা যুদ্ধক্ষেত্র, না?

হ্যাঁ, স্যার। ওখানে এই শহরের অনেক মেয়ে যুদ্ধ করছে।

বুঝেছি। আমার ছেলে এলে বলব তোমাকে মেলাঘরে নিয়ে যেতে। তোমার বাড়ির ঠিকানা আমাকে দিয়ে রেখো।

না, স্যার, আমি অন্য কোথাও যাব না। আমি আমাদের মেয়েদের বাঁচাতেই যুদ্ধ করব। আমি যাই, স্যার। আকমল হোসেন পরদেশীর সঙ্গে হেঁটে গেটের কাছে যান। ও বেরিয়ে গেলে গেট বন্ধ করে আলতাফ। তিনি আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। দিনের আলো শেষ হয়েছে। আকাশের লাল রং আর নেই। ওখানে ছাই রঙের ফ্যাকাশে বিবর্ণ ভাব ছড়িয়ে আছে। অন্ধকার পুরো নামেনি। অল্পক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামবে। তিনি দাঁড়িয়েই থাকেন। ভাবেন, পরদেশী তার চোখ খুলে দিয়েছে। যুদ্ধের সময় যে অনেক রকম যুদ্ধক্ষেত্র হয়, সেই কথা বলে গেছে ও। এর চেয়ে বড় সত্য আর কী হতে পারে? তিনি নড়তে পারেন না। পঁড়িয়েই থাকেন। মনে হয়, তার কী যেন হয়েছে। তিনি তা বুঝতে পারছেন না। পেছন ফিরে দেখেন, আয়শা খাতুন আর মেরিনা ঘরে চলে গেছে। একসময় মেরিনা চিৎকার করে ডাকে, আব্বা-আ-ব-বা—।

তিনি ধীরপায়ে ঘরে ঢোকেন। সোফায় বসেন। দেখতে পান, মা-মেয়ে কাঁদছে। কান্না থামিয়ে একসময় আয়শা খাতুন বলেন, এটি জেবুন্নেসা নামের একটি মেয়ের চিঠি। মারুফের সঙ্গে ওর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। পঁচিশের রাতে আর্মি ওকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নিয়ে আটক করে।

 

মেরিনা চোখ মুছে বলে, ভাইয়া আমাকেও জেবুন্নেসার কথা বলেনি। সম্পর্ক বোধ হয় বেশি দিনের না। তাহলে আমি জানতে পারতাম। আমি ইউনিভার্সিটিতে জেবুন্নেসাকে দেখেছি। ফিজিকস পড়ত। কার্জন হলের বারান্দায় হেঁটে যেতে দেখেছি। তবে তেমন পরিচয় ছিল না।

চিঠিটা তুমিই যত্ন করে রেখে দাও, মা। আমাদের কাছে থাকা ঠিক হবে না।

আকমল হোসেন সোফা থেকে উঠে দাঁড়ান। মেরিনাও উঠে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ভাইয়া বাড়িতে এলে দেব? নাকি অনেক পরে দেব?

না, ও বাড়িতে এলেই দিয়ো। ওকে একা দিয়ো আগে। আমাদের সামনে দিয়ো না। ও যদি আমাদের কিছু বলে তা আমরা শুনব।

তিনি কয়েক পা এগিয়ে আবার ফিরে আসেন। আয়শা খাতুনের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, মেয়েটি আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম শহীদ। কয়েকজনকে ডেকে ঘরোয়া মিলাদের আয়োজন করো। আর ফকির খাওয়াও। ওর কুলখানি হবে এই বাড়িতে।

আয়শা খাতুন চুপচাপ বসে থাকেন। আকমল হোসেনের কথায় মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানান। মেরিনা চলে গেছে নিজের ঘরে। বিছানায় শুয়ে কপালে হাত দিয়ে রাখে। আকমল হোসেন পেছনের বারান্দায় গিয়ে বসে থাকেন। বুক ভীষণ ভার হয়ে আছে। এই প্রথম একটি ঘটনা তাঁকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে ফেলে। ভাবেন, কত দিন লাগবে এই সামলে উঠতে!

তখন গুনগুন ধ্বনি ছড়াতে থাকে ঘরে। আয়শা খাতুন সোফায় মাথা হেলিয়ে দিয়েছেন। ঘরে বাতি নেই। অন্ধকার গুমরে ওঠে সুরের ছায়ায় :

কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না
শুকনো ধুলো যত।
কে জানিত আসবে তুমি গো
অনাহূতের মতো॥…

মেরিনা শূন্য দৃষ্টিতে ঘরের ছাদ দেখে। ইলেকট্রিক বাতির চারপাশে পোকা জমেছে। কোথা থেকে এল এরা? দুচোখ ববাজে মেরিনা। ভালো লাগে না। আবার উঠে দাঁড়ায়। ভাবে, বাতি বন্ধ করলে পোকাগুলো বেরিয়ে যাবে। পরক্ষণে সিদ্ধান্ত পাল্টায় ও। বাতি বন্ধ করলে পোকাগুলো সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়বে। তার চেয়ে ওগুলো যেখানে আছে সেখানেই থাকুক। মেরিনা টেবিলের ড্রয়ারে যত্ন করে রাখা জেবুন্নেসার চিঠিটা আবার বের করে। টেবিলের ওপর মেলে রেখে পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেয়। তাকিয়ে থাকে পেনসিলে লেখা অক্ষরগুলোর দিকে। এটা জেবুন্নেসার হাতের লেখা নয়। পরদেশী বলেছে, জেবুন্নেসা বলেছে আর একজন মেয়ে লিখে দিয়েছে। হঠাৎ মেরিনার মনে হয়, পেনসিলের লেখা যদি ঝাপসা হয়ে যায়, তাহলে মারুফ কীভাবে পড়বে? তখন ও কাগজ-কলম বের করে কালো কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে পুরো লেখাটা লিখে ফেলে। ভাবে, মারুফ ইচ্ছা করলে এই চিঠিটা অনেক দিন সংগ্রহে রাখতে পারবে। হায় ভাইয়া, তোমার প্রথম প্রেম। দেশ স্বাধীন হলে যদি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জাদুঘর হয়, তখন জেবুন্নেসার ছবি আর এই চিঠিটা সেখানে রাখা যাবে। দেশের ইতিহাসে যুক্ত হবে জেবুন্নেসার নাম। মেরিনা চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারে না। দুহাতে চোখের পানি মোছে আর ফোঁপায়।

আয়শা খাতুন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। অন্ধকারে পা ফেলেন। জানালার পর্দার ফাঁকে রাস্তার বাতির আলো আসছে। তিনি ক্ষুদ্র একটি আলোর বৃত্তের পাশে দাঁড়ান—সুরের ধারা আলোকিত করে ঘর :

পার হয়ে এসেছ মরু, নাই যে সেথায় ছায়াতরু–
পথের দুঃখ দিলেম তোমায় গো এমন ভাগ্যহত॥
আলসেতে বসে ছিলেম আমি আপন ঘরের ছায়ে,
জানি নাই যে তোমায় কত ব্যথা বাজবে পায়ে পায়ে।
ওই বেদনা আমার বুকে বেজেছিল গোপন দুখে—
দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো গভীর হৃদয়ক্ষত।।

আকমল হোসেন কান খাড়া করে গুনগুন ধ্বনি শুনছেন। একসময় দুহাতে নিজের চুলের মুঠি ধরে বুক ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। এমন বুক উজাড় করা কান্না আরও একবার কেঁদেছিলেন মায়ের মৃত্যুতে। বাবার মৃত্যুতেও এমন করে কাঁদেননি। ছেলেটির প্রথম প্রেম ভেবে এমন কান্না তাঁকে ভাসিয়ে দেয়।

তখন আয়শা খাতুন নিজের ঘরে আসেন—সুর থামে নাস্তিমিত হয়–হাহাকারের ধ্বনি তোলে ঘরের ভেতর—দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো গভীর হৃদয়ক্ষত॥–দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো—আয়শা খাতুন কাঁদতে থাকেন। বুঝতে পারেন, এই মুহূর্তে কান্না ছাড়া তিনি আর কিছুই করতে পারছেন না।

তাঁর কান্নার ধ্বনি ছড়ালে দরজায় এসে দাঁড়ান আকমল হোসেন। তাঁর পেছনে মেরিনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *