ডাইনিং টেবিলে বসে মেরিনা প্রথমেই বলল, আমাদের পরিবারে যুদ্ধের আরেকটি ফ্রন্ট ওপেন হয়েছে, আব্বা।
ফ্রন্ট!
শব্দটি দুজনে একসঙ্গে উচ্চারণ করেন।
হ্যাঁ, আমি বলব যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট।
দুজনে আবারও একসঙ্গে বলেন, ফ্রন্ট।
মেরিনা এক গ্রাস ভাত মুখে পুরে বলে, আপনারা ভাত খান। তার পরে শোবার ঘরে গিয়ে বলব। আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমি দুপুরের পর থেকে আর কোনো কিছু খাইনি।
আমরাও খাইনি। চা-ও না।
তাহলে তো পেটপুরে খেতে হবে এখন। আরেকটি নতুন ফ্রন্টে যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হতে হবে না।
মেরিনা, ফিক করে হেসে বাবা-মায়ের দিকে তাকায়। দুজনেই চমকে ওঠেন। ওর বিষণ্ণ মুখের হাসি দেখে দুজনেই ভাবলেন, যেন মর্গের ভেতরে শায়িত কেউ। দুজনের ভাত খাওয়া মাথায় উঠল।
তাঁরা ভাত নাড়াচাড়া করলেন। মাছের টুকরো বোন-প্লেটে উঠিয়ে রাখলেন।
মেরিনা তাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে, এভাবে খেলে আজ রাতে আমার না ঘুমিয়ে কাটাতে হবে। আমার গলা দিয়ে ভাত নামবে না।
আকমল হোসেন প্লেটের ওপর মাথা নামিয়ে গবগবিয়ে কয়েক গ্রাস মুখে পোরেন। আয়শা ভাতে ডাল মাখালেন। ডাল দিয়ে প্লেটের ভাত শেষ করেন।
মেরিনা নিজে ধীরেসুস্থে ভাত খায়। ভাত-মাংস শেষ করে। দুটুকরো ভাজা মাছও খায়। এক বাটি ডাল খায় স্যুপের মতো করে।
ওর দিকে তাকিয়ে আয়শার মনে হয়, মেয়েটি নিজেকে সুস্থির করার চেষ্টা করেছে। ওর ভেতরে কোথাও কোনো ফাটল হয়েছে কিংবা কোথাও আগুন লেগেছে। ও নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় আছে। দুজনের কেউই ওর দিকে না তাকিয়ে ঘরের এপাশে-ওপাশে তাকান। ভাবেন, আজ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ঠিকমতো শুনতে হবে।
মেরিনা যখন বাবা-মায়ের মুখোমুখি বসে, তখন বেশ রাত হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা বারোটার প্রান্ত ছাড়িয়েছে। ও সরাসরি বলে, আজ আমাকে নওশীন ফোন করেছে।
নওশীন? দু
জন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন।
নুসরাতের ভাই। সে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। মনে হলো, এখন প্রবল দাপটে আছে।
কিছু বলেছে তোকে?
হ্যাঁ। আপনারা তো জানেন, ও একটা দুষ্টু ছেলে। চান্স পেলেই নিজের বোনকে বলত, আর্মির ক্যাম্পে দিয়ে আসব।
ওর বাড়াবাড়ির কারণে ওর বাবা-মা অন্যদের নিয়ে গ্রামে চলে গেছে। ও আমাকে দুটো কথা বলেছে। প্রথমে বলেছে মাজিয়ার কথা।
তোর বান্ধবী মাজিয়া?
হ্যাঁ, আম্মা। আমরা একসঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা বানিয়ে আকাশে উড়িয়েছিলাম।
কী হয়েছে ওর?
নিউ মার্কেটের সামনে ওকে রিকশায় উঠতে দেখে নওশীন গিয়ে ওকে আটকায়। তারপর জোর করে টহলদার আর্মির গাড়িতে তুলে দেয়।
ওহ, গড!
আকমল হোসেন দুহাত চুলের মধ্যে ঢোকান। আয়শা খাতুন বোকার মতো তাকিয়ে থাকেন। যেন নিজের মেয়ের চেহারা মনে পড়ছে না। ওকে চেনা যাচ্ছে না।
নওশীন বিকট হাসিতে ভরে দিয়েছিল টেলিফোন। বলেছিল, পতাকা বানানোর মজা বুঝিয়ে দিলাম ওকে। বুঝুক ঠেলা। পাকিস্তানের গায়ে হাত দেওয়া সহজ কথা না।
তুই এত কথা শুনলি, মা?
অনেক ধৈর্য ধরে, কষ্ট করে শুনেছি, আম্মা। আমার পুরো বিষয়টা বোঝার দরকার ছিল। ও কত দূর এগোতে চায়, তা দেখতে চাই।
রাগারাগি করিসনি তো?
প্রথমে করিনি। কৌশল হিসেবে রাগব না বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু পরে আর ধৈর্য রাখতে পারিনি।
কী বলেছে?
একটা গুন্ডার মতো কণ্ঠস্বর বানিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছে, এইবার তুমি তৈরি হও, মেরিনা জাহান। তোমাকেও স্বাধীনতার স্বপ্ন বুঝিয়ে ছাড়ব। টের পাবে কত ধানে কত চাল।
কী বললি? আয়শা ছিটকে ওঠেন। এত বড় কথা বলেছে?
নওশীন নুসরাতের ছোট ভাই। ওদের বাড়িতে গেলে, দেখা হলে ও আমাকে আপা ডাকত। আজকে তুমি করে বলেছে, নাম ধরে বলেছে।
তুই কিছু বলেছিস?
আমিও চিৎকার করে বলেছি, তোকেও আমি দেখে নেব, শুয়োরের বাচ্চা। তারপর আমি ফোন রেখে দিয়েছি। ফোনটা পরে আবার বেজেছিল। আমি ধরিনি।
ওর কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে থাকেন আয়শা। আকমল হোসেন উঠে পায়চারি করেন।
আমি ভয় পাইনি, আম্মা। ও আমার সঙ্গে বদমাশি করতে এলে আমিও ছাড়ব না।
আয়শা খাতুন কথা না বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। মেয়ের দৃষ্টি পড়তে থাকেন। মেরিনা মাকে শান্ত করার জন্য বলে, আমি বিকালবেলা নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম। তিনটে ছোট-বড় ছুরি কিনে এনেছি। সব সময় আমার সঙ্গে রাখব। প্রয়োজনে সুযোগ বুঝে ব্যবহার করব। হয় পেট ফুটো হবে, নয়তো বুক।
ওর কথা শুনে আকমল হোসেন ফিরে দাঁড়ালেন।
কী বললি, মা?
আমি তো নওশীনকে ছাড়ব না, আব্বা। ওর পাকিস্তানের অখণ্ডতার স্বপ্ন আমার হাতে দুটুকরো হবে।
আমি ভাবছি, এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাব। এখানে থাকা আমাদের উচিত হবে না।
আয়শা চোখ গোল করে আকমল হোসেনের দিকে তাকান। সমর্থন প্রত্যাশা করেন।
আকমল হোসেন ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলেন, না, সবাই ছাড়ব না। আমি একা থাকব আলতাফকে নিয়ে। তুমি আর মেরিনা যাবে।
তুমি থাকলে আমিও থাকব। আমিও বাড়ি ছাড়তে চাই না। এখনো এই বাড়িতে গোলাবারুদ-অস্ত্র আছে। এখনো এই বাড়িতে যখন-তখন ছেলেরা আসবে। খাবেদাবে, ঘুমাবে, অস্ত্র নিয়ে সরে পড়বে। মারুফ এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলবে, মা, আমি এসেছি। তুমি দেখো, গেরিলারা কেউ যদি মেলাঘরে যায়, তার সঙ্গে মেরিনাকে পাঠিয়ে দাও। ওরা ওকে বিশ্রামগঞ্জ ফিল্ড হাসপাতালে নার্সিংয়ের কাজে লাগিয়ে দেবে।
মেরিনা বাবা-মাকে সাহস দিয়ে বলে, আমি কাউকে পেলে মেলাঘরে যাওয়ার চিন্তা করব। তার আগে নওশীনকে মারব। তাহলে আমি শান্ত হব। বিশ্রামগঞ্জে হাসপাতালে আহতদের শুশ্রুষার কাজ করতে পারলে আমিও শান্তি পাব। আপনাদের এই বাড়ি ছাড়া ঠিক হবে না।
দুজনে একসঙ্গে বলেন, মেরিনা ঠিকই বলেছে। আমাদের সিদ্ধান্ত এটাই হোক।
রাতে ঘুমোলেও যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট সকাল থেকে আকমল হোসেনকে ভাবিত করে। মেরিনাকে তার বোনের বাড়িতে দিয়ে আসবেন, নাকি ওর নানার বাড়িতে পাঠাবেন। বাবার প্রস্তাব শুনে মেরিনা কোথাও যেতে রাজি হয় না। ওর এক কথা, হয় মেলাঘরে যাব, নয়তো এই বাড়িতে থাকব। আমাকে ধরতে এলে একটাকে মেরে মরব। কাউকে না মেরে আমি এই দুনিয়া ছাড়ব না।
আকমল হোসেনের মনে হয়, মেয়ের জেদের সঙ্গে তিনি পারবেন না। দুদিন পর চেনা আস্তানা খোঁজ করেন। কোথাও কেউ নাই। যারা পেরেছে নদী পার হয়ে চলে গেছে। যারা ঢাকায় আছে, তারা সবাই আস্তানা বদল করেছে। কেউ কারও খবর বলতে পারছে না। আশরাফ বলে, একসঙ্গে কয়েকজন গেরিলা ধরা পড়ল, এত বড় একটা বিপর্যয়ের পর শহর নীরব হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমার বিশ্বাস এ নীরবতা কয়েক দিনের জন্য মাত্র। আবার ফুটবে বোমা, পুড়বে পেট্রল পাম্প-পাওয়ার স্টেশন, গুলিবিদ্ধ হবে শত্রুসেনারা কিংবা তাদের দোসররা।
আকমল হোসেনও তা-ই মনে করেন।
খবরের কাগজ খুলে বসলে দেখতে পান, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা দিবস পালনের তোড়জোড় চলছে।
শির দেগা, নাহি দেগা আমামা—এই স্লোগান দিয়ে দিবস উদযাপন করা হবে। প্রতিরক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে শুরু হবে সভা-সমাবেশ। মিছিল। আকমল হোসেন কাগজ ভাঁজ করে রেখে উঠে পড়েন। ফার্মগেটের বাড়ির ভাড়া দিতে হবে। ছেলেদের খোঁজ নিতে যাবেন। ড্রয়িংরুমে আসতেই ফোন বাজে।
অপর প্রান্তে নওশীন।
হ্যালো, আমাকে মেরিনাকে দেবেন।
তুমি কে, বাবা?
আমি নওশীন। মেরিনাকে দিন।
মেরিনাকে কেন চাইছ? ওর সঙ্গে কী দরকার?
ওর সঙ্গে আমার দরকার আছে। আমি ওকে চাই। আপনি ফোন দেন।
ও বাড়িতে নেই। ও ওর খালার বাসায় আছে।
মিথ্যা কথা বলবেন না। আমি জানি, ও বাড়িতে আছে। আজ বের হয়নি। আমাদের লোক আপনার বাড়ির ওপর নজরদারি রাখে।
ওহ্, মাই গড।
ঘাবড়াচ্ছেন কেন? আপনি না সাহসী বীরযোদ্ধা। দেশকে স্বাধীন করবেন বলে জানপ্রাণ দিয়ে খাটছেন। আপনার পরিবারকে ধরে…
আকমল হোসেন ফোন রেখে দেন। আয়শা এসে ওটা ক্রেডলে না রেখে পাশে রাখেন। মেরিনাও বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আকমল হোসেন বলেন, তোমাকে অন্য জায়গায় যেতেই হবে, মা। বুঝতে পারছি, ও মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর্মির কাছে নিজের বাহাদুরি দেখাবে।
আয়শা বলেন, যাও মা, ছোট একটা ব্যাগ রেডি করে নাও।
মেরিনা কথা না বলে বের হয়ে যায়। থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে জানালার পাশে। একসঙ্গে এত মুক্তিযোদ্ধা দেখার পর এমন একজন রাজাকার দেখতে হবে—এটা ও ভাবতেই পারে না। ক্রোধ ওকে উত্তেজিত করে। যে ছুরিটা কিনেছে, সেটা ওর বুকে বেঁধানো উচিত। হোক ও বান্ধবীর ভাই, তাতে কিছু যায়-আসে না।
সেদিন বিকেলে কেঁদেকেটে বাড়ি তোলপাড় করে আলতাফ। ওর সঙ্গে কাঁদে মন্টুর মা। খবরটা প্রথমে মন্টুর মা-ই দেয় সবাইকে।
কাঁদতে কাঁদতে বলে, আলতাফের বাড়ি থেকে টেলিগ্রাম এসেছে।
কী খবর এসেছে? ওর বাবা ভালো আছে তো? বাড়ির অন্যসব খবর ভালো?
অত কিছু জানি না। শুনেছি ওর ভাই মারা গেছে।
ওর তো পাঁচ ভাই। কোন ভাই মারা গেল? যে
ভাইটা রাজাকার হয়েছিল।
মন্টুর মা চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়।
আয়শা বলে, বোধ হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে মারা গেছে। পাকিস্তানি আর্মি তো আর ওকে মারবে না।
হতে পারে। ঠিকই বলেছ। অথবা কোনো অসুখেও মারা যেতে পারে।
জওয়ান ছেলের আবার অসুখ কী!
আয়শা বিরক্তির সঙ্গেই বলেন। আকমল হোসেন নিজের মনে হাসেন। ভাবেন, সময়টাই এমন। এখন কোনো লোক অসুখে মরবে না। সবাই মরবে গুলিবিদ্ধ হয়ে কিংবা বিস্ফোরণে। হয় শত্রুপক্ষের, নয়তো মুক্তিবাহিনীর হাতে। মৃত্যুর উত্তর বড় সহজ হয়ে গেছে।
সন্ধ্যায় পুরো খবরটা আলতাফ জানাল।
মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প আক্রমণ করেছিল। আমার ভাই পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধে ছিল। মুক্তিসেনার গুলি খেয়েছে। ছয়জন পাকিস্তানি সেনা মরেছে। মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে দুজন।
তোমার বাবার খবর কী?
বাবা ভালোই আছেন।
আলতাফ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, একদিন দেশ স্বাধীন হবে। গাঁয়ের লোকে ওর নামে ধিক্কার দেবে। কেউ বলবে না যে, ও শহীদ হয়েছে। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার ভাগ্য ওর ছিল না।
একসময় হাউমাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলে, এই মরণ ওকে মরতে বলেছে কে? ওহ, আল্লারে, এর চেয়ে ও যদি নদীতে ড়ুবে মরত, তাও সান্ত্বনা পেতাম। আল্লায় আমারে এমন কষ্ট দিল ক্যান? ও আল্লারে।
মেরিনা এসে সামনে দাঁড়ায়।
থামেন তো। ও কি একটা মানুষ, তার জন্য আবার কান্নাকাটি!
আলতাফ চোখ মুছতে মুছতে বলে, ছোটবেলায় একসঙ্গে বড় হয়েছি না। ও আমার পাঁচ বছরের ছোট ছিল। কত কোলে নিয়েছি। এক থালায় ভাত ভাগ করে খেয়েছি। নিজের কথা নিজে ভুলব কেমন করে?
থামেন, বললাম। থামেন। এমন ছোটবেলা সব্বার আছে। এই ছোটবেলা নিয়ে কথা বলার কিছু নাই।
আলতাফ হা করে তাকায়। তারপর উঠে চলে যায়। বুঝতে পারে, মেরিনার মেজাজ খারাপ। মেরিনা ওর সঙ্গে এমন করে কথা বলে না। আজ তার অন্য কিছু হয়েছে।
ওর সঙ্গে মেজাজ করছিস কেন, মা? বাস্তব অবস্থা মানতে হবে।
আমার মেজাজ খারাপ, কারণ আমাকে ছোট একটা ব্যাগ গোছাতে হয়েছে। আমাকে বেশি প্রশ্ন করবেন না আপনারা।
আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন ওকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করতে পারেন না।
ও নিজেই আবার গলা উঁচিয়ে বলে, একজন রাজাকারের হুমকি-ধমকিতে আমার ব্যাগ গোছাতে হয়েছে। আমি এই দুর্গবাড়ি ছেড়ে সাধারণ বাড়িতে যেতে চাই না। তাহলে আমি যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে থাকব।
মা, কিছুদিন থাক। তারপর আবার আসবে।
না, আমি এক দিনও অন্য কোথাও থাকতে চাই না। ঠিক আছে, আমি আপনাদের কথামতো ব্যাগ গুছিয়েছি। তবে ছুরি দুটো ব্যাগে দিইনি।
কোথায় রেখেছ?
এই যে, দেখো।
ও কোমরে গুঁজে রাখা ছুরি দুটো দেখায়। চমকে ওঠেন আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন।
এখনই কোমরে গুঁজেছ কেন? বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে খুঁজলেই হতো।
প্র্যাকটিস করছি। হঠাৎ করে খুঁজলে অসুবিধা ফিল করতে পারি। কোমরে খুঁজে হাঁটছি, বসছি এবং শুয়েও দেখেছি। তেমন অসুবিধা দেখছি না। তবে বেকায়দা হলে আমার পেটেও ঢুকে যেতে পারে।
খিলখিল করে হাসে মেরিনা। ওকে হাসতে দেখে আবার চমকে ওঠেন দুজনে। হাসতে হাসতে মেরিনা বারান্দায় যায়। সেখান থেকে সামনে নামে। গাছ থেকে একটি জবা ফুল ছিঁড়ে চুলের ক্লিপে গেঁথে রাখে। দু-এক লাইন গান গাইবার চেষ্টা করে। মন ভালো থাকলে ও গান গায়। আয়শা খাতুনের আফসোস যে, মেয়েটা ঠিকমতো গান শিখল না। শিখলে ভালো গাইতে পারত। ওর গানের গলা দারুণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দু-একবার গেয়েছিল। দর্শকের প্রশংসা পেয়েছিল। তার পরও ঠিকমতো শেখা হলো না ওর। আজ ও নিজের বাড়ির প্রাঙ্গণে ঘুরতে ঘুরতে গাইল
হৃদয় আমার প্রকাশ হলো অনন্ত আকাশে।
বেদন বাশি উঠল বেজে বাতাসে বাতাসে।।
কিছুক্ষণ গাইলে আলতাফের কান্না বন্ধ হয়ে যায়। ও ঘরের বাইরে এসে চৌকাঠের ওপর বসে থাকে। একমনে গানটি শোনে। ও জানে, মেরিনা সব সময় গান গায় না। আজ তার মেজাজ খারাপ। তার পরও গাইছে।
ঘরে আয়শা খাতুন সোয়েটার বুনছিলেন। হাত থেমে যায়। উল আর কাঁটা এক হয় না। আকমল হোসেন নিজের টেবিলে বসে পত্রিকার পাতা উল্টান। বিভিন্ন নিউজে চোখ আটকে যায়। তার পরও নিউজের ভেতরে ঢুকতে পারেন না। হেড লাইন পড়ে ছেড়ে দেন।
সবশেষে চোখ পড়ে একটি খবরে—কোম্পানীগঞ্জের বামনিবাজারে আর্মি ও রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করে। চৌদ্দ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। আহত হয় বেশ কয়েকজন। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে আর্মি ও রাজাকাররা।
তিনি কাগজ রেখে বাইরে আসেন। দেখলেন, মেরিনা নেই। ও ঘরে চলে গেছে। ওর ঘরের দরজার সামনে ছোট ব্যাগটি রাখা আছে। তিনি ভাবলেন, কাল সূর্য ওঠার আগেই তিনি মেরিনাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। ওর নানার বাড়িতে রেখে আসবেন। ওখান থেকে কারও সঙ্গে মেলাঘরে চলে যাবে।
রাত দশটার দিকে তিনটি মিলিটারির গাড়ি আসে বাড়ির সামনে। দূর থেকে আর্মির গাড়ি গেটের সামনে থামতে দেখে আলতাফ হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে ঢোকে।
ভয়ে-আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে বলে, স্যার, গাড়ি। গাড়ি।
কার গাড়ি?
আর্মির।
ততক্ষণে বুটের পদাঘাতে থরথর করে কাঁপে লোহার গেট।
আকমল হোসেন আলতাফের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, যাও, গেট খুলে দাও।
আলতাফ চলে যায়। ওকে পাশ কাটিয়ে বাবা-মায়ের ঘরে ঢোকে মেরিনা।
তাহলে ওরা এসে গেছে? নওশীনও এসেছে কি?
আলতাফ গেটের তালা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুজন। কিল-ঘুষি-লাথি দিয়ে ফেলে দেয় ওকে। ও পড়ে থাকে গেটের পাশে।
আকমল হোসেন বারান্দার দিকে এগিয়ে যান। ক্যাপ্টেনসহ সেপাইরা ততক্ষণে বারান্দায় এসে উঠেছে। পেছনে নওশীন। ওরা আকমল হোসেনকে প্রথমে রাইফেলের বাট দিয়ে পিঠে আঘাত করে। তারপর জিজ্ঞেস করে, মুকুত কিধার? আর্মস-অ্যামুনিশন কিধার?
আকমল হোসেন চুপ করে থাকেন।
ওরা একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে আবার বলে, বাত কিউ নেহি বোলতা?
আবার রাইফেলের বাটের বাড়ি পড়ে। আকমল হোসেন মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। উঠতে পারেন না।
একজন ক্যাপ্টেন সেপাইদের দিকে তাকিয়ে বলে, গো, সার্চ।
দুপদাপ করে এগিয়ে যায় ওরা।
ততক্ষণে মেরিনাকে রেডি করে ফেলেছেন আয়শা খাতুন। আলমারির ভেতর থেকে একটি টাইম বোমা বের করে মেরিনার ব্লাউজের ভেতর ঢুকিয়ে দেন। একই সঙ্গে টাইম ফিক্স করে দেন।
ওরা যতজন এসেছে, শুধু ছুরি দিয়ে হবে না। বড় অস্ত্র লাগবে।
বুঝেছি। মেরিনা শক্তই থাকে। নওশীনের ফোন পাওয়ার পর থেকে অনেক বোঝাপড়া হয়েছে নিজের সঙ্গে। এখন ও আর ভীত নয়। শক্তভাবেই মনে করে, ওরা শরীরে হাত দেওয়ার আগেই সুইসাইড স্কোয়াড হওয়া জরুরি। গাড়িতে যতগুলো থাকবে তার সবগুলো মরবে। হাহ, প্রিয় স্বাধীনতার জন্য নিজেকে তৈরি করে, মেয়ে। ও বুকের ওপর সুতির শাড়ি ভাঁজ করে বোমাটা খানিকটা আড়াল করার চেষ্টা করে। আয়শা খাতুন নিজের পছন্দের একটা কাশ্মীরি শাল মেয়ের গায়ে জড়িয়ে দেন।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলেন, পারবি না, মা?
পারব। আমি পারবই। আমার জন্য ভাববেন না।
আমি জানি, তুই পারবি।
বোমার ওপর হাত রাখেন আয়শা খাতুন। বিদায়, আম্মা।
বিদায়! বিদায়! বিদায়!
আয়শা খাতুন চমকে মেয়ের দিকে তাকান।
বিদায়ই তো, আম্মা। আর দেখা হবে না। কোনো দিনই না।
ঘরে এসে দাঁড়ায় সেপাইরা। পেছনে নওশীন। ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা মা-মেয়ে একসঙ্গে বলেন, স্টপ। থাম।
পেছন থেকে নওশীন এগিয়ে এসে বলে, খুব সাহস দেখাচ্ছ। ছ্যাঁচা খেয়ে ঠিক হয়ে যাবে।
তুমি বেশি কথা বলবে না, নওশীন। তুমি একটা বেইমান। বিশ্বাসঘাতক।
তবে রে। বড় বড় বুলি আওড়াতে শিখেছ। স্বাধীনতার পাছায় লাথি মারি।
নওশীন সেপাইদের ইঙ্গিত করলে ওরা এগিয়ে আসার আগেই আয়শা খাতুন মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে বলেন, ভদ্র ব্যবহার কর, নওশীন। কী করতে হবে, বল।
ওকে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে।
ঠিক আছে, যাবে। যাও, মা।
সেপাইদের দিকে আঙুল তুলে বলেন, ডোন্ট টাচ হার।
মেরিনা দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
এতক্ষণ ধরে বাড়িঘর তছনছ করেছে সেপাইরা। জিনিসপত্র চারদিকে ছুড়ে মেরেছে। তোশক-বালিশ-সোফার কভার, কুশন ছিন্নভিন্ন করে বাড়িতে তুলো উড়িয়েছে। আসবাবপত্র উল্টে ফেলেছে। সবই দেখে মেরিনা। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে, যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট। নিজের অজান্তেই নিজের হাত টাইম বোমার ওপর চলে যায়। মারুফ ওকে যুদ্ধের শুরুতেই গ্রেনেডের পিন খোলা শিখিয়েছে। আজ ওর সেই চরম পরীক্ষা। তবে গ্রেনেড নয়, টাইম বোমা।
ও ড্রয়িংরুমে আসতেই ক্যাপ্টেন দন্ত বিকশিত করে বলে, আইয়ে। বহুত যুব সুরত।
সেপাইগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। পা দাপায় না বা রাইফেল তাক করে না। ক্যাপ্টেন মেরিনার পাশাপাশি হাঁটে, যেন এই মুহূর্তে মেরিনা সম্রাজ্ঞী। ওরা তার আজ্ঞাবহ দাস। এমন এক ভঙ্গি ওদের আচরণে। কারণ, সে ধরে নিয়েছে যে আর অল্পক্ষণ পরই এই সম্রাজ্ঞী তার হাতের মুঠোয় আসবে। কিছুক্ষণ সময়ের ব্যবধান মাত্র। তার উত্তেজনা অনেক কষ্টে দমন করে রাখে।
ঘর পেরিয়ে বারান্দায় এলে মেরিনা দেখতে পায় আকমল হোসেনকে। বারান্দার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর শরীরে রক্ত। মারের চোটে নাক-ঠোঁট-ঘাড়সহ বিভিন্ন জায়গা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। ও ছুটে বাবার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ক্যাপ্টেন হাত দিয়ে বলে, নো। ইধার নেহি, উধার।
ক্যাপ্টেন সিঁড়ি দেখিয়ে দেয়।
মেরিনা যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়েই আর্তচিৎকার করে, আব্বা। আকমল হোসেন সাড়া দেন না।
আপ চলিয়ে।
আব্বা, আব্বা। বাবার সাড়া নেই। বোধ হয় জ্ঞান হারিয়েছেন।
আবার পা বাড়াতে গেলে ক্যাপ্টেন বাধা দেয়।
নেহি। ইধার।
ক্যাপ্টেন মেরিনার হাত ধরে টেনে আনে। ওকে আর কোনো সুযোগ দেয় না। একজন পিঠের ওপর রাইফেলের নল লাগিয়ে রাখে। পেছন ফিরে তাকানোরও সুযোগ নেই। ওর মনে হয়, এখন সোজা হেঁটে গাড়িতে ওঠাঁই উচিত। টানাহেঁচড়া করলে বোমাটা পড়ে যেতে পারে। ও মুহূর্তে সতর্ক হয়।
গাড়ি সরে যায় গেটের সামনে থেকে। আড়ালে লুকিয়ে থাকা মন্টুর মা ছুটে এসে গেট আটকায়। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন আয়শা খাতুন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন জিনিসের পাশ কাটিয়ে আকমল হোসেনের কাছে আসেন। মাথা তুলে ধরতেই বুঝতে পারেন জ্ঞান হারিয়েছেন।
চিৎকার করে ডাকেন, আলতাফ, মন্টুর মা।
আলতাফ ততক্ষণে নিজে নিজে উঠেছে। মার খেয়ে জ্ঞান হারায়নি ও। ঘাপটি মেরে পড়ে ছিল। তার পরও যাবার সময় একজন পিঠে লাথি দিয়েছিল।
বলেছিল, শালা গাদ্দার।
আয়শা খাতুনের চিৎকার শুনে আলতাফ বারান্দায় উঠে আসে। আকমল হোসেনকে পড়ে থাকতে দেখে নিজের শরীরের অসহ্য যন্ত্রণার কথা ভুলে যায়। মন্টুর মা গ্লাসে করে পানি নিয়ে আসে।
আয়শা খাতুন পানি দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেন। ঠোঁটে পানি দিলে সে পানি গড়িয়ে পড়ে যায়। তিনি বলেন, ঘরে নিয়ে চলো।
তাঁকে ধরে ওঠানোর চেষ্টা করার সময় তিনি নড়ে ওঠেন। চোখ খোলেন। বলেন, পানি খাব।
পানি খেয়ে তিনি চারদিকে তাকান। তারপর উঠে বসার চেষ্টা করেন। সবাই মিলে তাকে সাহায্য করে। তিনি উঠে বসেন। বলেন, ওরা আমার ঘাড়ে মেরেছিল। আরও অনেক জায়গায়। আমার কিছু মনে নেই।
চলো, তোমাকে ঘরে নিয়ে যাই।
তোমাকে ওরা মারেনি তো, আশা?
না, আমাকে মারেনি।
আমার মা কোথায়? আমার মেরিনা?
যুদ্ধের নতুন ফ্রন্টে গেছে।
ফ্রন্টে? ও বাড়িতে নেই তাহলে?
জানো, ও খুব সাহসী ছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আব্বা, আব্বা করে খুব ডেকেছিল।
ডাকবেই তো। ও তো আমারই অংশ।
তখন প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে।
সবাই চমকে পরস্পরের দিকে তাকায়। রাস্তায় মানুষের হইচই শোনা যায়। আকমল হোসেনের মনে হয়, তার গায়ে পুরো শক্তি ফিরে এসেছে। তিনি আয়শা খাতুনের দিকে তাকান।
মেয়েটাকে টাইম বোমা দিয়েছিলে?
দিয়েছিলাম।
তাহলে যুদ্ধের নতুন ফ্রন্টে ও জয়ী হয়েছে।
মুহূর্ত সময় মাত্র। তারপর চিৎকার করে কাঁদতে থাকে পুরো পরিবার।
রাতের মধ্যপ্রহর শেষ হয়েছে।
শেষ রাতে আকমল হোসেন বিছানায় উঠে বসেন। দেখতে পান, ঘরে আয়শা খাতুন নেই। বিছানা থেকে নামলেন। দেখলেন, বাথরুমে নেই। বিছানায় শোয়ানোর সময় আয়শা তাকে পেইন কিলার দিয়েছিলেন। শরীরের ব্যথা খানিকটা কমেছে। মাথা টলছে। তার পরও পা বাড়ালেন। আয়শা কোথায় দেখতে হবে। মেরিনার ঘরে কি? ঠিকই ধরেছেন। একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছেন আয়শা। পুরো ঘর তছনছ করা। কাপড়চোপড়-বইপত্র মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। তিনি পাশ কাটিয়ে আয়শা খাতুনের পাশে গিয়ে বসলেন।
উঠলে কেন? শরীর ঠিক আছে?
তোমার কাছে এসেছি, আশা।
বসো। এসো। আমার হাত ধরো।
আকমল হোসেন স্ত্রীর পাশে বসেন। বুঝতে পারেন, বুক ভেঙে যাচ্ছে। বুঝতে পারেন, মাথা সোজা করে রাখা কঠিন হচ্ছে। চোখের জল সামলানো দুঃসাধ্য ব্যাপার।
আয়শা মৃদু স্বরে বলেন, শহীদের জন্য আমরা শোক করব না।
ওর জন্য গৌরব বোধ করব।
আকমল হোসেন দুহাতে বুক চাপড়ান।
আয়শা হাত টেনে ধরেন।
এখন মাতমের সময় নয়।
আমি জানি, শোককে শক্তি করার সময়। সামনে আমাদের অনেক কাজ।
ওর জন্য আমরা কুলখানি করব। মিলাদ হবে। ফকির খাওয়াব। কোরআন খতম হবে।
হ্যাঁ, সবই হবে।
শহীদের স্মরণে তোমার একটি গুনগুন ধ্বনি হবে না, আশা?
আমি এতক্ষণ সেই শক্তি পাচ্ছিলাম না। তোমাকে পেয়ে আমার মধ্যে শক্তি ফিরে এসেছে।
আকমল হোসেন দুহাতে আয়শাকে বুকে টানেন। তাঁর মাথার ওপর নিজের থুতনি রেখে বলেন, আয়শা, তুমি আমার মধ্যে শক্তি ভরে দাও। আমি যেন শহীদ মেয়েটির স্মৃতি বুকে নিয়ে কিছুকাল বেঁচে থাকি। আয়শা খাতুন সুর করেন–
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে৷।
তবু প্রাণ নিত্যধারা,
হাসে সূর্য চন্দ্র তারা, বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ ওঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফোটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ,
নাহি নাহি দৈন্যলেশ—সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে৷৷
শেষের লাইনটি আকমল হোসেন নিজেও গুনগুন স্বরে গাইতে থাকেন। আবার প্রথম লাইন গান দুজনে—আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
আকমল হোসেন নিজেকে সামলাতে পারেন না। আয়শা খাতুন তাকে শান্ত করার জন্য দ্বিতীয় পঙক্তিতে যান—তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগো কিন্তু দ্বিতীয় পঙক্তি গাওয়ার পর আয়শা খাতুন নিজেও কাঁদতে শুরু করেন।
এই প্রথম তার গুনগুন ধ্বনি কান্নার শব্দে মিশে যায়। দুজনের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হয়—
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ
নাহি নাহি দৈন্যলেশ…।
স্বাধীনতাযুদ্ধের ক্ষয় নেই, শেষ নেই। স্বাধীনতার অনন্ত বাণী ছড়াতে থাকে আকাশে। দুজন মানুষ দেয়ালে পিঠ ঠেকান, মাথা ঠেকান। রাত শেষ হয়। দিনের প্রথম আলো ছড়ায় চারদিকে।
ঘরের দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে আলতাফ। পেইন কিলার খাওয়ার পরও শরীরের ব্যথা কমেনি। তার পরও উঠে কোথাও যেতে পারে না। গত রাতে বাড়িটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়েছে। নতুন এই যুদ্ধক্ষেত্র তার জন্য চ্যালেঞ্জ।
রান্নাঘরে বসে থাকে মন্টুর মা। পুরো রান্নাঘর তছনছ হয়ে আছে। কেরোসিনের চুলা ভেঙে দিয়েছে। রান্না করতে হলে নতুন চুলা আনতে হবে। কাচের প্লেট-গ্লাস টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে। গত রাতে এই বাড়িতে যুদ্ধ হয়েছে।
একটি মেয়ে শহীদ হয়েছে।
ও মা গো, ও আল্লাহরে—
হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে মন্টুর মা। মাঝেমধ্যে সুর করে বিলাপ করে। কপাল আছড়ায়। ওর বিলাপের নানা কথা ছড়াতে থাকে বাড়িতে। আকমল হোসেন আর আয়শা খাতুন সোজা হয়ে বসেন। বিলাপের নানা কথা তাঁদের কাছে পৌঁছে যায়। দুজন আবার স্তব্ধ হয়ে পড়েন। স্মৃতিভরা এমন অজস্র কথা তো তাঁদেরও আছে। আমৃত্যু তারা এই সব কথা স্মরণ করবেন। এখন যুদ্ধ।
দুজনে উঠে মন্টুর মায়ের কাছে আসেন। আয়শা খাতুন তার পাশে বসে বলেন, থামো, মন্টুর মা। আমাদের এখন অনেক কাজ আছে।
বাড়ি তো যুদ্ধের ময়দান হয়েছে।
হবেই। আমাদের চারদিকে যুদ্ধের সময়। যুদ্ধের ময়লা এখন আবার সরাব।
অ, তাই তো। রান্নাঘরের ময়লা আমি একাই সরাতে পারব। এইটা কি আমার যুদ্ধ?
হ্যাঁ, তোমার যুদ্ধ।
ততক্ষণে আলতাফও বাড়ি পরিষ্কার করার কাজে লেগেছে। মাঝেমধ্যে বসে দম নিচ্ছে। চারদিকে তাকাচ্ছে। মাথা চাপড়াচ্ছে। আকমল হোসেন কাছে এলে আলতাফ বলে, আপনি কোথাও যাবেন, স্যার?
কোথায়? সেই রাস্তার ধারে। যেখানে জিপটা উল্টে গেছে।
না, শুধু উল্টে যায়নি। পুড়েছে। টুকরো টুকরো হয়েছে।
আলতাফ গভীর আগ্রহ নিয়ে বলে, সেখানে যাবেন, স্যার?
হ্যাঁ, যাব। শুধু তুমি আর আমি।
আকমল হোসেন পেছন ফিরে দেখলেন আয়শা রান্নাঘরে। তিনি আলতাফকে ইশারা করলেন। দুজনে গেট খুলে দ্রুত বের হলেন।
মাথার ওপর সূর্য। চারদিকে ঝকমকে রোদ।
তাঁরা ঘটনার জায়গায় পৌঁছাতে পারলেন না। অনেক দূর জুড়ে রাস্তা ঘিরে রেখেছে মিলিটারি পুলিশ।
দুজনে শিরীষগাছের নিচে দাঁড়ালেন। আকমল হোসেন পরক্ষণে আলতাফের দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো, ফিরে যাই। আমাদের যুদ্ধ তো শেষ হয়নি।
দুজনে দ্রুত পায়ে বাড়িতে ফিরে আসে।
গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আলতাফ বলে, স্যার, আপনি তো বললেন আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি।
বলেছি। ঠিকই তো বলেছি।
ওরা এই বাড়িতে আবার আসতে পারে। তাহলে আপনি এই বাড়ি থেকে চলে যান।
না। এটা দুর্গবাড়ি। এখানে এখনো অস্ত্র আছে। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা আসবে।
ওরা যদি এসে আপনাদেরকে ধরে নিয়ে যায়? তখন কী করবেন? আমরা চাই না এমন কিছু ঘটুক। আপনারা চলে যান। বাড়ি আমি একা পাহারা দেব।
না, তা হবে না। ধরে নিয়ে গেলেও আমি বাড়ি ছাড়ব না। এই বাড়ি থেকে আমার মেয়ে বেরিয়ে গেছে। এই বাড়িতে এখনো আমার ছেলে ফেরেনি। আমি বাড়িতে থেকেই শেষ দেখতে চাই রে, আলতাফ।
দুজনে গেটের ভেতরে ঢুকলে দেখতে পায় আয়শা খাতুন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। সিঁড়িতে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করেন, কোথায় গিয়েছিলে?
সেই জায়গায়। মেয়েটার হাড়গোড় খুঁজতে গিয়েছিলাম।
বুঝেছি। চলো, ঘরে চলো। আমাকে না বলে চলে গেলে কেন?
আকমল হোসেনের হাত ধরে আয়শা বলেন, তোমার গায়ে জ্বর দেখছি।
কখন জ্বর এল, টের পাইনি তো।
পেয়েছ ঠিকই। আমায় লুকাচ্ছ। ডাইনিং টেবিলে এসো। তোমাকে একটা নোভালজিন দিচ্ছি।
না, নোভালজিন লাগবে না। আমি ঘরে যাচ্ছি। আমি ঠিক আছি, আশা।
আকমল হোসেন দ্রুত পায়ে শোবার ঘরে যান। আয়শা পিছু পিছু যেতে পারেন না। তাঁর মনে হয়, মানুষটা নিজেকে সারানোর সময় চাচ্ছে। তাকে ডিসটার্ব না করাই উচিত।
আয়শা খাতুন চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকেন। জানেন, যেকোনো সময় আর্মির গাড়ি এ বাড়িতে আবার আসবে। আসুক, তিনি নিজেকে বলেন—আছে মৃত্যু, আছে দুঃখ।