আজ স্টেট ব্যাংকে অপারেশন। ক্র্যাক প্লাটুনের পাঁচজন সদস্য তৈরি। ব্যাংকের একজন পিয়নের সাহায্যে বেলা বারোটার দিকে রেকির কাজ শেষ করা হয়েছে। অপারেশনের সময় ছয়টা।
এদের কাছে আছে স্টেনগান ও হ্যান্ড-গ্রেনেড। বিস্ফোরণের জন্য তৈরি করা হয়েছে প্লেটার চার্জ। ওর ভেতরে আছে কুড়ি পাউন্ড পিকে এবং সাত সের স্প্লিন্টার।
প্লেটারটি বানানোর খরচ দিয়েছেন আকমল হোসেন। এখন ঘড়ি ধরে বসে আছেন। তিনি জানেন, তার সামনে এখন একেকটি মুহূর্ত অনন্তকাল। ড্রয়িংরুমে মৃদু আলো জ্বলছে। মেরিনা ওর নিজের ঘরে। পতাকা বানানোতে ব্যস্ত। আয়শা খাতুন সোয়েটার বোনা বাদ দিয়ে পতাকা সেলাইয়ে হাত লাগিয়েছেন।
আকমল হোসেনের সামনে পরিকল্পনার কাগজ। তিনি খুঁটিয়ে দেখছেন। বিস্ফোরক প্লেটারটি ব্যাংকের উত্তর দিকের গেটে পুলিশদের বাংকারের পাশে বসানো হবে। হাতের আড়ালে স্টেনগান লুকিয়ে মনিরুল কাভার দেবে। গ্লাক্সো ভবনের কাছে গ্রেনেড নিয়ে তৈরি থাকবে মাসুদ ও জিনাত। ওরা রিকশায় করে স্টেট ব্যাংক ভবনের গেটের কাছে আসবে।
আকমল হোসেন ম্যাপের ওপর মাথা নামিয়ে রাখেন। চোখ সরাতে পারছেন না। মাথাও তুলতে পারছেন না। তাঁর মনে হয়, তিনি ফিক্সড হয়ে গেছেন অপারেশন ম্যাপের ওপর। বুঝতে চাচ্ছেন, এখন ওরা কোথায়। ঘড়ি দেখে সময় মেলালেন। ধরে নিলেন, ওরা এখন প্লেটার চার্জ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানেন প্লেটারটি ওজনে ভারী এবং দেখতে খানিকটা অন্য রকম। প্রচলিত আকারের নয়। যে কেউ বলবে, অদ্ভুত এই জিনিসটা কী।
সন্ধ্যা বলে রাস্তা বেশ ফাঁকা। লোক চলাচল কম। রিকশা আছে। যারা হাঁটছে তারা বেশ দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছে। শাহজাহান আর জলিল বাক্সটি নিয়ে দ্রুত পায়ে যায়। পাহারারত পুলিশের সন্দেহ হয়। এগিয়ে আসতে থাকে ওদের দিকে। ওরা বুঝতে পারে যে এটা নিয়ে কথা-কাটাকাটি হলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় আছে। ওরা বাক্সটি এক জায়গায় রেখে খানিকটা দূরে সরে যায়।
পুলিশ কিছু অনুমান করতে না পেরে পিছু হটে নিজের জায়গায় যায়। ওদেরকে একটু বিভ্রান্ত মনে হয়। বোঝা না-বোঝার দোলাচলে ওরা নিজের অবস্থান নেয়। চারদিকে তাকায়।
মুহূর্ত সময় মাত্র। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় মনিরুল। বুঝতে পারে যে দেরি করলে সময় নষ্ট হবে। ও একটি সিগারেট জ্বালিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়। কয়েকজন পথচারী অদ্ভুত বাক্সটি দেখে দাঁড়িয়েছে। নানাজনে নানা কথা বলছে। মনিরুল সিগারেটে টান দিয়ে এগিয়ে যায়। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে প্লেটারের চার্জকে ইগনাইট করে। তারপর নিমেষে সরে পড়ে। ওর এই কাজটুকু দেখে পথচারীসহ এগিয়ে আসা পুলিশের মনে হয় কিছু একটা ঘটবে। ওরা ঝটিতি পিছু হটে যায়। অল্পক্ষণেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে হ্যান্ড-গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়।
চোখের পলকে জনশূন্য হয়ে যায় এলাকা।
গেরিলারা নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে ফোন দেয় আকমল হোসেনকে। উজ্জ্বল মুখে তিনি বলেন, কনগ্রাচুলেশনস। ফোন কেটে দেন।
আয়শা হেসে বলেন, খবর পেয়ে গেছি। তোমাকেও অভিনন্দন। যাই, পতাকা বানানোর কাজটা শেষ করি।
হ্যাঁ, দ্রুত করা। সময় বেশি নেই।
বলতে বলতে তিনি নিজের পড়ার টেবিলে এসে কাগজ খুলে বসেন। প্রতিদিনের কাগজ না পড়লে তিনি একটুও স্বস্তি পান না।
প্রথম যে খবরে চোখ যায়, তা টিক্কা খানের নির্দেশ। সামরিক দপ্তরের এক নোটিশে যোলোজন নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সামরিক কর্তৃপক্ষের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাউকে কাউকে নাটোরের ২ নম্বর সেক্টরের উপসামরিক আইন প্রশাসকের সামনে হাজির হতে বলা হয়েছে। কাউকে কাউকে যশোরের ৩ নম্বর সেক্টরের উপসামরিক প্রশাসকের সামনে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আকমল হোসেন নামগুলো লিখে রাখেন। কেউই দেশে নেই। সবাই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রবাসী সরকারকে সহযোগিতা দিচ্ছে। সরকার শক্ত হাতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। এখন তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার হবে। ইন্ডিয়া বসে কেউ যদি এমন খবর পায়, তাহলে তারা বুড়ো আঙুল দেখাবে।
আকমল হোসেন কাউন্সিল মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আবুল কাসেমের বিবৃতি ডায়েরিতে তুলে রাখেন—৫৪ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে। মার্চ থেকে এই সমাজবিরোধীরা চূড়ান্ত আঘাত হানে। সম্মিলিতভাবে এসব দুষ্কৃতিকারীকে প্রতিহত করে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ডায়েরির পাতা বন্ধ করলেন তিনি।
খুললেন আরেকটি পত্রিকা। পড়লেন খবর—নিয়াজি রংপুর ও বগুড়া সফরে গিয়েছে। রংপুরের শান্তি কমিটি, রাজাকার ও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় বলেন, আবার তিনি ডায়েরির পাতা উল্টালেন, লিখলেন নিয়াজির বক্তৃতার অংশ-ভারত কোনো দিনই পাকিস্তানের বন্ধু নয়। বাঙালির প্রতি লোক দেখানো সহানুভূতির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই অঞ্চল কুক্ষিগত করা। তাই তারা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সমাজবিরোধীদের সাহায্য করছে। কিন্তু আমাদের বীর সেনাবাহিনী এই অপপ্রয়াসকে কোনো দিন সফল হতে দেবে না।
চোখ গেল আরেকটি খবরের ওপর। ৮৮ নম্বর সামরিক আদেশ জারি হয়েছে। এই আদেশবলে আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসক এক বা একাধিক ফৌজদারি আদালত গঠনের ক্ষমতা লাভ করে।
আকমল হোসেন সব কাগজ ভাঁজ করে সরিয়ে রাখলেন। ভাবেন, পাকিস্তানের তেইশ বছরে এ দেশের মানুষ কেন্দ্রীয় সরকারের নানা নিপীড়ন সহ্য করেছে। এসব দমন-পীড়নে মানুষের আর কিছু যায় আসে না। মানুষ এখন যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চলেছে। পেছন ফিরে তাকাবে না। মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের বিচার করবে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে স্বাধীন দেশেও তোমাদের বিচার হবে। তৈরি হও।
আকমল হোসেন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন।
কয়দিন পরই প্রতিটি বাড়ি থেকে তৈরি করা পতাকাগুলো চলে যায় ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোডের বাড়িতে। সেখানে বসে পরিকল্পনা করা হয়। ঢাকার বেশ কয়েকটি বাড়ি থেকে পতাকা ওড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। চুনু ধোলাইখাল এলাকা থেকে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে আসে ধানমন্ডির বাড়িতে। কারও চোখে ঘুম নেই। সবাই ব্যস্ত থাকে বেলুনে গ্যাস ভরার জন্য। রাত কেটে যায় নানা গল্পে। একজন একটা বলে তো আরেকজন আরেকটা। রাত ওদের কাছে রাত মনে হয় না। দিনরাত সমান।
হেলাল চুটকি কেটে বলে, কাল ওরা উদ্যাপন করবে আজাদি দিবস।
আর আমরা করব আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দিবস। আমাদের লাল-সবুজ পতাকা ঢাকার আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বলব, দেখো আমাদের। আমরা তোমাদের মাথার ওপর উড়ছি। বাতাসের বেগে ছুটছি। আমাদের পথ আটকাবে কে?
হা হা করে হাসে সবাই।
ওরা আমাদের কাজ দেখেও দেখতে পায় না রে।
ওদের কি দেখার চোখ আছে নাকি? ওরা তো অন্ধ। যেটুকু দেখে ওটুকু ওদের ক্ষমতার জমিন। বাকিটা সাফা। অন্ধের না দেখা।
রাজাকারগুলোও এমন হয়েছে। সব জাউরা। পা চাটাই শিখেছে। স্বাধীনতার মূল্য বোঝেনি।
চীন আর আমেরিকার মতো বড় দেশ দুটোও যা করছে, তাতে মনে হয়, ওরা কখনো স্বাধীনতার জন্য জীবন দেয়নি।
ওরা তো ঘরে বসে পেয়েছে। ভাবখানা এমন।
কাজ করতে করতে ওরা হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে, বিগ পাওয়ার। বিগ পাওয়ার হলে মাথাটা বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে হয়। এটা যে ওরা কোথায় থেকে শিখল কে জানে! আমরা বিগ পাওয়ার হলে আমাদের এমন ভীমরতি হবে না।
ঠিক বলেছিস। হা হা হাসিতে অন্ধকার তাড়ায় ওরা।
শেষ রাতে ওদের ঘুম পায়। পরদিন সারা দিনের অপেক্ষা। চৌদ্দ তারিখে রাতের আকাশে উড়ে যায় বাংলাদেশের পতাকা। গ্যাস বেলুনের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া পতাকায় চাঁদের আলো ছড়ায়।
আকমল হোসেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছাদে ওঠেন। সন্ধ্যার আঁধার ঘন হলে তাঁর বাড়ির ছাদ থেকে পতাকা নিয়ে উড়ে যায় পাঁচটি গ্যাস বেলুন। মেরিনা হাততালি দিতে চেয়েছিল। আয়শা খাতুন ওর হাত চেপে ধরে বলেন, এখন উচ্ছ্বাসের সময় না। উচ্ছ্বাসের দিন সামনে।
মেরিনা নিজেকে সামলায়। ভাবে, এত পতাকা সেলাই করে মরে গেলে ও কি শহীদ হবে? শহীদের সংজ্ঞা কী? মেরিনার ভাবনায় শব্দটি তোলপাড় করে। এই মুহূর্তে মাকে এই সব কথা জিজ্ঞেস করা যাবে না। বাবাকেও না। আকাশে উড়ে যাওয়া পতাকার দিকে তাকিয়ে ওর ভীষণ মন খারাপ হয়। গতকাল নুসরাত বলেছে, নওশীন খুবই বাড়াবাড়ি করছে। রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না। তাই আমরা চলে যাচ্ছি। তোর সঙ্গে কবে আবার দেখা হবে, জানি না। জয় বাংলা, মেরিনা।
জয় বাংলা।
মেরিনা টেলিফোনে চেঁচিয়ে জয় বাংলা বলেছিল। এখন খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে পারছে না। বাড়িটা নিয়ে চিন্তিত সবাই। এই মুহূর্তে কেউ কোনো কথা বলছে না। মন্টুর মা একটি পাটি এনে বিছিয়ে দিয়েছে। সবাই বসে আছে। নিচে বাড়ির সব বাতি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ঘরেও তালা, গেটেও। কেউ এসে খোঁজ করলে বুঝবে বাড়িতে কেউ নেই। আর মুক্তিযোদ্ধারা খুঁজতে এলে ভাববে দুর্গবাড়ি। পরিবারের সবাই আজ ছাদে। আকাশে পতাকা-বেলুন ওড়াচ্ছে। ওরা কেউ এলে অপেক্ষা করবে। নইলে ঘুরেফিরে আবার আসবে। বলবে, জয় বাংলা মামণি, মিষ্টি খাব। আজ উৎসবের দিন।
পরদিন লালবাগের শান্তি কমিটির নেতা ওবায়দুল্লাহর পিছু নেয় ক্র্যাক প্লাটুনের দুজন। সোহেল আর শিহাব। দুজনই মোটরসাইকেলের আরোহী। ওবায়দুল্লাহও মোটরসাইকেলে যাচ্ছে। বকশীবাজারের কাছে রিভলবারের গুলিতে বিদ্ধ করা হয় তাকে। মোটরসাইকেল সামলাতে না পারলে সেটা গিয়ে আছড়ে পড়ে রাস্তার পাশের একটি বাড়ির দেয়ালের ওপর। ওরা দুজন মোটরসাইকেল নিয়ে উধাও হয়ে যায়। কেউ কিছু বোঝার আগেই ওরা চলে যায় নিরাপদ দূরত্বে।
সেই সন্ধ্যায় ফার্মগেট এলাকার দুর্গবাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় একজন। যাবে বনানী। একসময়কার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের বাড়ি সেখানে। ক্ষমতার সুতা ধরে বনানীতে বড় একটি বাড়ির মালিক হয়েছিলেন তিনি। প্লটটা অনেক বড়। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের দখলে নেওয়া। শাসনকালের পুরো সময় নিজের দেশের মানুষকে পীড়িত করেছেন অনবরত। আর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পা চেটেছেন প্রভুদের। লজ্জা-শরমের ধার ধারেননি লোকটি। মানুষ কী করে এমন নির্লজ্জভাবে নিজের স্বার্থ পূরণের জায়গাটি ভরাতে পারে? লোকটি আত্মসম্মান শব্দের মানেই জানেন না।
দুর্গবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা একজন বনানীর বাড়ির ড্রয়িংরুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। পেছনের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকেছে মুক্তিযোদ্ধা। দরজার দিকেই মুখ করে বসে আছেন মোনায়েম খান। চারপাশে বেশ কয়েকজন লোক। চামচা গোছের হবে। যারা তার কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে পেট ফুলিয়েছে। এখন স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করছে।
লুঙ্গি এবং হাওয়াই শার্ট পরা গেরিলা স্টেনগান তাক করে ফায়ার করে। গুলি তার তলপেট ভেদ করে সোফা ভেদ করে দেয়ালে গিয়ে লাগে। অন্যদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে বেরিয়ে যায় একজন গেরিলা। মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। প্রধান সড়কে তখনো গাড়ি ও মানুষ। ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষের ভিড়ে মিলেমিশে এক হয়ে গেলে একজন পথচারী জিজ্ঞেস করে, একটুক্ষণ আগে গুলির শব্দ পেলাম। কারা হতে পারে? কোথায় হতে পারে?
আমি কী করে জানব! আমি তো আর কাউকে দেখিনি।
আপনি গুলির শব্দ পাননি?
পেয়েছি। আপনারা সবাই পেলে আমি পাব না কেন?
কিছু ভাবেননি? কারা এটা করতে পারে?
ভাবব কী, পালাতে পারলে বাঁচি। মুক্তিযোদ্ধাদের দাপট যে কত বেড়েছে, তা কি আর বলে শেষ করা যায়। ছোটখাটো গুলির শব্দ ওদের কাছ থেকেই আসবে। আর্মি হলে তো চারদিক ফাটাবে।
ওরা আছে বলে তো ধড়ে প্রাণ ফিরে পাই। নইলে আর্মি আর রাজাকারদের অত্যাচারে দেশটা ছারখার হয়ে যেত। ওরা আছে বলেই তো স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাই না। স্বাধীনতার অপেক্ষায় থাকি।
ঠিক বলেছেন। আমিও আপনার মতোই ভাবি।
গেরিলাযোদ্ধা পথচারীর সঙ্গে হাত মেলায়।
তারপর দ্রুত পায়ে হেঁটে মিশে যায় অন্ধকারে। রাস্তার মিটমিটে বাতি সে শরীর স্পর্শ করে না। যেন মানুষটাকে আড়ালে রাখতে চায়। ফুটপাতে হেঁটে যাওয়া লোকজনের পাশ কাটিয়ে এগোতে এগোতে যোদ্ধা ভাবে, দুর্গবাড়িতে অন্যরা অপেক্ষা করে আছে খবরের জন্য। ওদের কেউ উঠোনে পায়চারি করছে। কেউ হয়তো রাস্তার মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে। উৎকণ্ঠিত অপেক্ষা এখন। যোদ্ধা একটি রিকশা নিয়ে মহাখালী পার হয়ে ফার্মগেটের রাস্তায় ওঠে। ইচ্ছে হয় গলা ছেড়ে গান গাইতে। সেটা আর হয়ে ওঠে না। তার পরও দেশের জন্য একটি সাফল্য ওর জীবনের সবটুকু ছাপিয়ে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে। অল্পক্ষণে ও পৌঁছে যায় ফার্মগেটের দুর্গবাড়িতে।
আকমল হোসেন নিজের টেবিলে বসে পত্রিকার পাতা উল্টান। প্রথম খবর পড়েন, আজাদি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সিম্পোজিয়ামের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সভাটি হয়েছে। সভাপতিত্ব করেছেন পিডিপির নেতা নুরুল আমিন। জামায়াত নেতা গোলাম আযম আজাদির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, কখনো দেশ তার নিজের দেশের মানুষ দ্বারা শাসিত হলেই আজাদ হবে, আজাদির এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।
আগা সাদেক লেনে আবদুল মালেক গেটের উদ্বোধন করেন মতিউর রহমান নিজামী। খুলনার খালিশপুরের সভায় বক্তৃতা করেন সবুর খান। রাজশাহীতে আয়োজিত সেমিনারে বক্তৃতা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এম এ বারী—আজাদি দিবসের খবরাখবর নোট করে ডায়েরির পাতা বন্ধ করেন আকমল হোসেন।
তখন ফোন আসে ক্র্যাক প্লাটুনের হাসানের কাছ থেকে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বরে বলে, আঙ্কেল, আমাদের অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।
লাইন কেটে যায়।
আজ ওরা আইয়ুব গেটের কাছে একটি আর্মি কনভয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। মোহাম্মদপুর থেকে ওরা গাড়ি নিয়ে বের হয়। দেখতে পায়, মিরপুরের দিক থেকে আর্মি কনভয় আসছে। আইয়ুব গেটের কাছে পেট্রল পাম্পে ওরা পেট্রল নেওয়ার জন্য ঢোকে। পুরোটাই ছিল ছল করে ঢোকা এবং সময় কাটানো। গাড়ি থেকে নেমে জুয়েল রাস্তায় কয়েকটি মাইন পেতে দিয়ে আসে। কনভয়ের প্রথম দুটি গাড়ি মাইন চাপা না দিয়ে বেরিয়ে যায়। তৃতীয় গাড়ির চাকা মাইন চাপা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে গাড়ির চাকা বা হয়।
চারদিকে হইচই দৌড়াদৌড়ির মাঝে ওরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। ওদের লক্ষ্য, সুযোগ বুঝে আরও দু-চার জায়গায় অপারেশন চালানো। এভাবে ওরা শহরকে সন্ত্রস্ত রাখছে। পাকিস্তানিরা বলে, মুকুত। কেউ ধরা পড়লে চেঁচিয়ে বলে, মুকুত মিল গিয়া। মুকুতের ভয়ে পাকিস্তানি আর্মি যেন তটস্থ থাকে—এই ইচ্ছা নিয়ে ওরা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো আক্রমণ চালাচ্ছে।
পরদিন ফোন আসে। ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন আকমল হোসেন।
আঙ্কেল, আমরা বের হচ্ছি। দোয়া করবেন।
ওরা পাঁচজন বের হয়। লক্ষ্য দাউদ পেট্রলিয়াম লিমিটেডের পেট্রল পাম্প। টয়েনবি সার্কুলার রোড। বঙ্গভবনের পাশেই পেট্রল পাম্পটি।
ওরা কালো মুখোশ পরে ছিল। বের করে রাখা চোখজোড়া জ্বলছিল জ্বলজ্বল করে। ওরা একটি ফোক্স ওয়াগনে করে এসেছে। নেমেই ঝটপট ঘিরে ফেলে পাম্প অফিস। অফিসের পাহারায় থাকে একজন। কালো মুখোশ পরা গেরিলাদের দেখে পাম্পের অবাঙালি কর্মচারী দুজন ভয়ে চিৎকার করে উঠে বলে, ফ্যাক্টোমাস আ গিয়া। ছুটে পালিয়ে যায় ওরা।
নীলু হাসতে হাসতে বলে, দেখো দেখো, এই ব্যাটারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করবে।
আরেকজন বলে, চুনোপুঁটিদের কথা ছাড়।
ওরা তিনজন স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরক চার্জ বসায় মারুফ। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বসে আছে সামাদ। কাজ শেষে গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে দাউদাউ জ্বলে ওঠে পেট্রল পাম্প।
গাড়ি ছুটে যায় হাটখোলার দিকে।
ওরা জানে, আরেকদল গেরিলা পীরজঙ্গী মাজার পাওয়ার স্টেশন অপারেশনে যাবে। কমলাপুর রেলস্টেশনের উল্টো দিকে পাওয়ার স্টেশনটি। ওয়াপদার তৈরি। এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় মতিঝিল কমার্শিয়াল এলাকা, মতিঝিল আবাসিক কলোনি, শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি এবং কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে।
আকমল হোসেন ঘড়ি দেখেন এবং নিজের আঁকা ম্যাপের ওপর ঝুঁকে থাকেন। লাল কালি দিয়ে রাস্তা আঁকা আছে। গাড়ি যাচ্ছে এমন করে ছবি এঁকেছেন, যেন তিনি বুঝতে পারেন গাড়ি কোন রাস্তা দিয়ে ছুটছে। তাকিয়ে থাকেন একদৃষ্টে। ভাবেন, মনোযোগ ছুটে যেতে দেওয়া যাবে না।
পাশে বসে আছে আয়শা ও মেরিনা। তারাও খুব উদ্বিগ্ন। এমন পরিস্থিতিতে আয়শা সব সময় আঙুল মটকান। আর মেরিনা দাঁতে নখ কাটে। আকমল হোসেন নিজে একদম নিশ্চুপ হয়ে যান, যেন তাঁর সামনে কথা বলার মতো পরিস্থিতি থাকে না। মনে করেন, গুটিয়ে থাকাই এ সময়ের কথা। নানাভাবে তার প্রকাশ ঘটে। ঘরে দিনের আলোর আলো-আঁধারি। জানালায় মোটা কাপড়ের পর্দা টানা। দুপাশের দরজা মুখে মুখে লাগানো। ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ছোটোছুটি করে একটা টিকটিকি।
পাওয়ার স্টেশন অপারেশনের জন্য দশ পাউন্ড পিকে দিয়ে তৈরি করা হয় দুটো ইমপ্রোভাইজড গ্রেনেড। সঙ্গে দেওয়া হয় দুটো নন-ইলেকট্রিক ডেটোনেটর-২৭ এবং প্রতিটিতে দেড় মিনিটের ফিউজওয়্যার। সঙ্গে আছে স্টেনগান ও গ্রেনেড-৩৬।
আকমল হোসেন ওদের পরিকল্পনার কথা জানেন। ওরা লুঙ্গি আর শার্ট পরে যাবে। পাওয়ার স্টেশনের পাহারায় থাকা দুজন পুলিশকে হ্যান্ডস আপ করাবে নজরুল ও মীজান। অসীম জুডো জানে। ও কায়দা করে প্রহরীদের ফেলে দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলবে। তারপর ইমপ্রোভাইজড গ্রেনেড ফিট করে বিস্ফোরণ ঘটাবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী অ্যাকশন শুরু হয়।
পুলিশদের পাশ কাটিয়ে স্টেনগান হাতে ভেতরে ঢুকে পড়ে নজরুল ও মীজান।
ধমক দিয়ে বলে, হ্যান্ডস আপ।
গোঁ গোঁ করতে থাকে দুজনে। নিজেদের রাইফেল নামিয়ে রেখে হাত তুলে দাঁড়ায়।
চুপ, শালারা। শব্দ করবি না।
ওরা আতঙ্কে মূর্তিবৎ দাঁড়িয়ে থাকে। অসীম কারাতের আঘাতে কাত করে ফেলেছে প্রহরীদের। জসীম আর শিবলি ইমপ্রোভাইজড গ্রেনেড ফিট করে ফেলেছে।
মাত্র কয়েক মিনিট।
প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। নিহত হয় একজন প্রহরী।
ওরা ততক্ষণে হাওয়া।
ফেরার পথ করে নেয় শাজাহানপুরের ভেতর দিয়ে। আকস্মিকভাবে লোকোশেডের কাছে স্থাপিত রাজাকারদের চেকপোস্টের সামনে পড়ে যায়। রাজাকাররা ওদের চ্যালেঞ্জ করে।
কোথা থেকে আসছ তোমরা? দাঁড়াও। দেখে তো এলাকার ছেলে মনে হয় না।
আমরা যেখান থেকে আসি না কেন, তোমাদের কী?
আবার বড় গলায় কথা বলা হচ্ছে। আমাদের পাড়ায় ঢুকেছ কেন? ঠিক করে বলো?
ওরে আমার কে রে। এদের কাছে আবার কৈফিয়ত দিতে হবে। যত্তসব।
আমরা তোমাদের সার্চ করব।
করেই দেখো। তোমাদেরও আমরা সার্চ করব।
কী, এত বড় কথা! ব্যাগে কী আছে, দেখা।
রাজাকাররা নজমুলকে জাপটে ধরলে শিবলি ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয়। নজরুল ইচ্ছে করে জোর খাঁটিয়ে জাপটাজাপটি করার ফাঁকে শিবলি ব্যাগ থেকে গ্রেনেড বের করে ছুড়ে মারে। গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলে রাজাকাররা হকচকিত বিমূঢ় হয়ে যায়। এই ফাঁকে ওরা নিজেদের মুক্ত করে। সঙ্গে সঙ্গে স্টেনগান বের করে গুলি করে। লুটিয়ে পড়ে দুজন রাজাকার। নিহত হয় কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন রিকশাওয়ালা।
ওরা আর একমুহূর্ত দাঁড়ায় না।
যে যে দিকে পারে সুযোগ বুঝে নিরাপদ জায়গায় চলে যায়। ওদের আর একসঙ্গে থাকা হয় না।
কয়েক ঘণ্টা পর তরিকুল আলমের বাড়িতে ফোন করে আকমল হোসেন জানতে পারেন যে অপারেশন সাকসেসফুল এবং ওরা নিরাপদে নিজ নিজ হাইডে চলে যেতে পেরেছে।
তিন দিন পর বাড়িতে আসে মারুফ।
আগস্টের এক বিকেল। ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ঝট গায়ে মাখে মেরিনা। আজ বাড়িতে ও একা। আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন জরুরি মিটিংয়ে আরেক দুর্গবাড়িতে গিয়েছেন। এলিফ্যান্ট রোডে। বলেছেন, সন্ধ্যার আগে ফিরবেন। নুসরাত ঢাকায় না থাকায় মেরিনা একা হয়ে গেছে। এখন এই নিশ্চুপ বাড়িটি ওর কাছে ভুতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে।
মারুফ ওর দরজায় এসে দাঁড়ালে চমকে ওঠে মেরিনা।
ভাইয়া, তুই। কবে এসেছিস? কী যে খুশি লাগছে। এবার বাড়িতে থাকবি?
তাই ভাবছি। বাবা-মা-বোনের আদর চাই।
অপারেশন নাই?
আছে। পাঁচ দিন থাকতে পারব বাড়িতে।
পাঁচ দিন। অনেক সময়। আমার কাছে এখন প্রতি সেকেন্ড এক দিন হয়ে যায়। উহ্, কী যে খুশি লাগছে!
তোর খুশি দেখে আমিও খুশি। আমারও ভীষণ ভালো লাগছে। কী করছিস একা একা?
বৃষ্টি দেখছি। তুই কাপড় চেঞ্জ করে নে, ভাইয়া। আমি তোর জন্য চানাশতার ব্যবস্থা করছি। তারপর দুজনে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখব।
তা-ই সই। আমি আসছি।
মারুফ নিজের ঘরে চলে গেলে মেরিনা বিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। জেবুন্নেসার কথা কি আজ ওকে বলবে? বুঝতে পারে না। বাবা-মাকে জিজ্ঞেস না করে বলা ঠিক হবে কি না, সেটাও চিন্তা করতে হবে। জেবুন্নেসার মৃত্যুর আঘাতে ও যদি দমে যায়? যদি মন খারাপ করে বসে থাকে? যদি…মেরিনা আর ভাবতে পারে না।
ও উঠে রান্নাঘরে যায়। চুলোয় চায়ের পানি বসায়। ফ্রিজ থেকে পাটিসাপটা পিঠা বের করে। মারুফ এই পিঠা খুব পছন্দ করে। ওর ভাগ্য, মায়ের হাতে বানানো পিঠা খাবে বলে ও আজ বাড়িতে এসেছে। মেরিনা এটুকু ভেবে খুশি হয়। দুঃখের খবর দেওয়ার আগে ওকে আনন্দ পেতে হবে। কতটা ও সইতে পারবে কে জানে! মেরিনা ট্রে-ভর্তি খাবার নিয়ে বারান্দার ছোট টেবিল গোছায়। চেয়ার আনে। হাসনাহেনা ফুলের ছোট একটি ডাল ভেঙে ছোট ফ্লাওয়ার ভাসে দিয়ে টেবিলে রাখে। ভাবে, আর কী করতে পারবে একজন যোদ্ধা ভাইয়ের জন্য। যার সামনে ও আজই এক দুঃখের কথা বলবে। বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। দুঃখের রূপকথা এখনই বলতে হবে। মেরিনা নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে জেবুন্নেসার চিঠিটা ড্রয়ার থেকে বের করে নিজের পড়ার টেবিলে চাপা দিয়ে রাখে।
বারান্দায় এসে ছোট টিপয়ের দিকে তাকিয়ে মারুফ বলে, বাহ্, সুন্দর আয়োজন তো। শান্ত এবং স্নিগ্ধ। একদম মনের মতো। পাটিসাপটা পিঠাও আছে দেখছি।
খাও। তুমি মায়ের ভাগ্যবান ছেলে। কত দিন পর বাড়ি এসে মায়ের বানানো পিঠে পেলে।
তুই কি আমাকে হিংসা করছিস?
মোটেই না। মায়ের ভালোবাসার আবার ভাগাভাগি কী! তুমি তো জানো, মা তোমার জন্য ফ্রিজে নানা খাবার রেডি রাখেন। বলেন, ও কোথায় কী খায় তার তো ঠিক নাই। বাড়িতে এসে যদি ঠিকমতো কিছু না পায়, তাহলে মন খারাপ করবে। আমাকে কিছু বলবে না, নিজে নিজে দুঃখ পাবে। থাকগে। তোমার কথা বলো। যুদ্ধের কথা।
ঢাকাকে ঘিরে গেরিলা তৎপরতা বেড়েছে। টের পাচ্ছিস না?
আমরা তো টের পাচ্ছি। আব্বা খুবই খুশি।
বলা যায়, পুরো রূপগঞ্জ থানা গেরিলা ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ধরে যে মিলগুলো আছে, সেখানে শুরুর দিকে আর্মির বাংকার ছিল। গেরিলা আক্রমণের কারণে তারা বেশ নাজেহাল হয়ে পড়েছে। বাংকার গুটিয়ে পিছু হটেছে। মনে হয়, আস্তে আস্তে কেটে পড়বে। স্থানীয় পাঠশালায়, আমরা যেখানে থাকি, ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা, আমরা তো সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছি। এই পতাকাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণের চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুই করতে পারেনি। এমনকি হেলিকপ্টারে করে কমান্ডাে নামানোর চেষ্টা করেছিল। নামাতে পারেনি। আমরা বুঝে গেছি যে আমরা ওদের মুখোমুখি হওয়ার সমান হয়েছি। আমরা গুল টেক্সটাইল মিলের বাংকার আক্রমণ করেছিলাম। বড় একটি এলাকা নিয়ে যুদ্ধ হয়। শেষ পর্যন্ত ওরা সাতাশটি লাশ ফেলে রেখে পিছু হটে যায়। গেরিলারা বড় আকারের প্রতিরোধব্যুহ রচনা করে। আমরা ভাবছি, স্বাধীনতার জন্য আমাদের আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
এটুকু বলে মারুফ থামে।
মেরিনা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ও বলে, কয়টা পিঠা খাব রে?
পিরিচে যা আছে, তার সবগুলো। একটাও বাদ দিতে পারবে না।
হা হা করে হাসে মারুফ।
ছুটে আসে আলতাফ আর মন্টুর মা।
কী হয়েছে? কোনো খুশির খবর আছে?
হ্যাঁ, আছে। যুদ্ধের খুশির খবর আছে বলেই তো হাসতে পারছি।
কী, কী খবর?
দুজনে কাছে এসে দাঁড়ায়।
আমাদের যুদ্ধের দিন ফুরিয়ে আসছে। আর বেশি দিন যুদ্ধ করতে হবে। আমরা জয়ী হবই।
সত্যি?
একদম সত্যি। আপনারা নিজেদের কাছে পতাকা রাখবেন। স্বাধীনতার খবর পেলেই পতাকা ওড়াবেন।
মন্টুর মা মারুফের মুখোমুখি বসে পড়ে। আলতাফ সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে বলে, ওরা যত হারবে তত হিংস্র হবে। মরণকামড় দিতে পারে। আলতাফ দুপা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বলে, দেবেই। ওরা তো খালি হাতে এখানে মরতে আসেনি।
ঠিক বলেছেন, আলতাফ ভাই।
মেরিনাও সায় দিয়ে বলে, একদম ঠিক।
তখন বাইরে থেকে ফিরে আসেন আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন। মারুফকে দেখে দুজনে খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে যান। আকমল হোসেন ওকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তুই কেমন আছিস, বাবা? আয়শা খাতুন ওকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোর শরীরে বারুদের গন্ধ পাচ্ছি, বাবা।
সব অপারেশনে জিতেছি বলে বারুদের গন্ধ আমাদের শরীরের গন্ধ, আম্মা। আমরা সময়কেও গায়ে মেখে রেখেছি।
চল, ঘরে চল।
রাতের খাবারের পরে ড্রয়িংরুমে এলে আকমল হোসেন মেরিনাকে বলেন, মা, মারুফের একটা চিঠি আছে তোমার কাছে। নিয়ে এসো।
মেরিনা উঠে যায়। নিজের ঘরের দরজার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। তারপর পড়ার টেবিলের ওপর থেকে চিঠিটা নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে আসার সময় শুনতে পায় মারুফের কণ্ঠস্বর। নিজের ঘরে যাওয়ার সময়ও একবার মারুফের কণ্ঠস্বর শুনেছে। তখন ওর জিজ্ঞাসার উত্তর কেউ দেয়নি। মেরিনা ড্রয়িংরুমে এলে শুনতে পায় মারুফ আবার একই কথা বলছে।
চিঠি? আমার? কে লিখেছে? আপনারা তো জানেন কে লিখেছে। তাহলে বলছেন না কেন?
আয়শা খাতুন মৃদুস্বরে বলেন, জেবুন্নেসা।
জেবুন্নেসা! মারুফ সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মেরিনার দিকে যাওয়ার জন্য দুপা এগিয়ে আবার ফিরে দাঁড়ায়। কাউকে সরাসরি উদ্দেশ না করেই বলে, ও কেন এ বাড়িতে চিঠি লিখবে? ও কোথায় আছে, জানি না। শুনেছি ওরা বাবামায়ের সঙ্গে গ্রামে কোথাও চলে গেছে। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আকমল হোসেন বলেন, বস, বাবা। আগে চিঠিটা পড়।
আপনাদের সঙ্গে ওর কোথায় দেখা হলো?
আমাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। পাকিস্তানি সেনারা ওকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ওদের নির্যাতনে ও মারা যায়। তার আগে একটি চিঠি লিখে পুলিশ লাইনের সুইপার রাবেয়াকে দিয়ে বলেছিল এই বাড়িতে পৌঁছে দিতে। মনে হয়, এই বাড়ির ঠিকানা ওর কাছে ছিল। আমরা চিঠিটা যত্ন করে রেখেছি।
মেরিনা চিঠিটা মারুফের হাতে দেয়। চিঠির খামে ও আতর মাখিয়ে রেখেছিল। মারুফ চিঠি খোলার সময় আতরের গন্ধ সবার নাকে লাগে।
চিঠি পড়ে মারুফ প্রবল যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়। দুহাতে মুখ ঢাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি জেবুন্নেসাকে দেখেছি, ভাইয়া। তেমন আলাপ ছিল। এখন মনে হচ্ছে, কেন যে আমার সঙ্গে আলাপ হলো না!
মারুফ শূন্যদৃষ্টিতে মেরিনার দিকে তাকায়। বুঝতে পারে, ওর ভেতরে বোধ কাজ করছে না। ও মেরিনাকে চিনতে পারছে না। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে একজন অচেনা মানুষ তার সামনে বসে আছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, তাকে কখনো কোথাও দেখেনি ও। ঘরটা রূপগঞ্জের একটা ক্যাম্প-মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। ওখানে দাঁড়িয়ে জেবুন্নেসা ওকে বলছে, একটি মিলিটারি কনভয় উড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি সুইসাইডাল অ্যাটাক করতে চাই। বোমাটা আমার শরীরের কোথায় বাধলে ঠিক হবে?
আমাকে ভাবতে দাও, জেবুন্নেসা। দুজনে মিলে ঠিক করব যে, কীভাবে কী করা যায়। তবে শরীরে বোমা বেঁধে তুমি ঝাঁপিয়ে পড়বে কেন? আমিও পড়তে পারি।
না, তুমি যুদ্ধ করবে। ফ্রন্টে যাবে। যদি তোমাকে যুদ্ধের শেষ মানুষটি হতে হয়, তুমি তা-ই হবে। আমি কাজ ভাগ করে নিতে চাই। ওহ্, জেবুন্নেসা! ও পাগলের মতো মাথা ঝাঁকায়।
আকমল হোসেন ওর পাশে এসে বসেন। ঘাড়ে হাত রাখেন। মেরিনা একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে এনে বলে, চলো, তোমার ঘরে দিয়ে আসি।
ফ্লাওয়ার ভাস দেখেছিলাম বাইরে। ওটাও দিস।আলো এবং গন্ধ চাই আমি।
আকমল হোসেন ওকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিলে ও চিৎকার করে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে যায়। পেছনে যায় মেরিনা। ফুলের সৌরভ আর আলোর শিখা নিয়ে। গুনগুন ধ্বনি ওঠে আয়শা খাতুনের কণ্ঠে। ধ্বনি ছড়াতে থাকে ঘরে–
এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে–
কী উৎসবের লগনে…।
মায়ের কণ্ঠের ধ্বনি শুনে নিজের ঘরে দাঁড়ায় মারুফ। বুঝতে পারে, ধ্বনি ওকে বেদনার অতলে নিয়ে যাচ্ছে–
সব আলোটি তেমন করে ফেললা আমার মুখের পরে…
তুমি আপনি থাকো আলোর পেছনে…।
মারুফ দুহাতে মুখ মোছে। ভাবে, ওর মতো কত শতজন বুঝতে পারছে যে যুদ্ধ মানে প্রেম এবং মৃত্যু। যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে জীবনের নতুন পথ তৈরি হয়। প্রেম ও মৃত্যু পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটে। বোঝার সময় থাকে না কীভাবে মৃত্যু প্রেমকে ঢেকে দেয়। প্রেম কীভাবে মৃত্যুকে ভালোবাসাময় করে দেয়। ওহ্, জেবুন্নেসা। ভেসে আসে গুনগুন ধ্বনি–
প্রেমটি যেদিন জ্বালি হৃদয় গগনে–
কী উৎসবের লগনে–
সব আলো তার কেমন করে–
পড়ে তোমার মুখের পরে–
আমি আপনি পড়ি আলোর পিছনে—
মায়ের গুনগুন ধ্বনি তো ও কত দিন শুনেছে, সেই বুঝে ওঠার বয়স থেকে; কিন্তু মায়ের কণ্ঠস্বর ওর কাছে আজকের মতো এমন তোলপাড় করা মনে হয়নি, এমন শান্তির স্নিগ্ধতায় ভরপুর মনে হয়নি। জীবনকে বিলিয়ে দেওয়ার মগ্নতায় এমন ঐশ্বরিক মনে হয়নি।
বুকভাঙা কান্নায় মারুফ নিজেকে উজাড় করে দিতে থাকে। কখনো পুরো ঘরে হাঁটতে হাঁটতে, কখনো বালিশে মুখ গুঁজে। কখনো দুহাতে চুলের মুঠি ধরে। কখনো জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে, আকাশের কোন তারাটি তুমি হয়েছ, জেবুন্নেসা? কথা ছিল, তুমি-আমি একসঙ্গে যুদ্ধে যাব, কথা ছিল যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে বলব, ফুল ফুটুক না-ফুটুক আজ বসন্ত…
একসময় স্তব্ধ হয়ে যায় মারুফ।
ঘরময় শুধু মৌমাছির গুঞ্জনের মতো মুখরিত হয় গানের ধ্বনি–
এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে।
কী উৎসবের লগনে।।
এখন স্বাধীনতার সময়। জেবুন্নেসা, তোমাকে বলি, তুমি জীবন দিয়ে আমার সামনে মৃত্যুর উৎসব সাজিয়েছ। আমরা মৃত্যুর উৎসব পালন করব। তোমাকে বলি জেবুন্নেসা–
প্রেমটি যেদিন জ্বালি হৃদয় গগনে
কী উৎসবের লগনে
সব আলো তার কেমন করে
পড়ে তোমার মুখের পরে
আমি আপনি পড়ি আলোর পিছনে।।
মোমবাতিটি হাতে তুলে মারুফ ঘরে ঘুরতে ঘুরতে বলে, তুমি আমার আলোর শিখা, জেবুন্নেসা। শহীদের চেতনায় জ্বলে থাকবে আমৃত্যু।