০৭. পরদিন উলনের দল বেরিয়ে যায়

পরদিন উলনের দল বেরিয়ে যায় গাজীর নেতৃত্বে। ওরা যখন বেরিয়ে যায় তখন শুনতে পায়, আয়শা খাতুন ডাইনিং স্পেসে দাঁড়িয়ে গুনগুন করছেন, যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে। মুক্ত করো হে ভয়…।

ছেলেরা সেই ধ্বনি বুকে নিয়ে বের হয়। কেউ পেছন ফেরে না। ওরা কোথাও থেকে গাড়ি জোগাড় করেছে। আকমল হোসেনের তা আর জিজ্ঞেস করা হয় না। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন। মেরিনা নিজের ঘরে। আলতাফ গেট খুলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার বন্ধ করে দেয়।

আজ ওরা ট্রান্সফরমার ওড়াবে। সঙ্গে নিয়েছে কুড়ি পাউন্ড পিকে ও পনেরো ফুট প্রাইমা কর্ড, প্রায় তিন মিনিট-মেয়াদি সেফটি ফিউজওয়্যার আর ডেটোনেটর।

গাজী যেতে যেতে বলে, আমাদের পরিকল্পনার কথা সবার তো মনে আছে?

অন্যরা সাড়া দেয়, আছে।

গাজী তার পরও পুনরাবৃত্তি করার জন্য বলে, আমরা ঠিক করেছি, ১০ পাউন্ড করে পিকের দুটি চার্জ প্রাইমা কর্ড দিয়ে লাগিয়ে ট্রান্সফরমারের দুই পাশে ফিট করা হবে। ঠিক?

হ্যাঁ, ঠিক। সবকিছু আমাদের মনে আছে। তার পরও তোমার কথা শুনতে আমাদের ভালো লাগছে। কারণ, কথাগুলো খালাম্মার গুনগুন স্বরের গানের মতো। ওই গানের বাকিটুকু আমাদের কানে আসবে অপারেশন শেষ করে ফেরার পথে।

কথাগুলো হাফিজ একটানে বলে। সবাই কান পেতে শোনে। সবারই শুনতে ভালো লাগছিল।

ও থামলে গাজী নিজের নাম উচ্চারণ করে বলে, অপারেশনের অগ্রগামী দলে থাকবে গাজী আর মারুফ। ওদের কাছে থাকবে স্টেনগান।

ঠিক। আমরা মনে রেখেছি!

হাফিজ ট্রান্সফরমারের গায়ে চার্জ বসাবে।

জিন্নাহ একটি রিভলবার নিয়ে গেটের পাহারায় থাকবে।

মতিন টেলিফোন লাইন কেটে দেবে।

গাজী থামলে মারুফ জোরের সঙ্গেই বলে, স্টেনগানের সঙ্গে আমরা গ্রেনেড ৩৬ নিয়েছি।

গাড়ির ভেতরে শব্দ গমগম করে, অপারেশনের সময় রাত সাড়ে আটটা থেকে পৌনে নয়টা।

সময়টা আমাদের জীবনমরণ।

সময়টা আমাদের স্বাধীনতার জন্য।

তখন সবাই একসঙ্গে উচ্চারণ করে, জয় বাংলা। জোরে চেঁচাতে পারে। গাড়ির ভেতরে মৃদু শব্দে ধ্বনিত হয় জয় বাংলা।

একই রকমের কথা বলে গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত যোদ্ধারা। ওরা ক্র্যাক প্লাটুনের আটজন। ছোটখাটো একটা দল। পুলু বলে, আমরা নিয়েছিলাম ৪০ পাউন্ড পিকে।

কুড়ি পাউন্ড পিকে দিয়ে চার্জ বানানোনা হয়েছে ট্রান্সফরমারের গায়ে লাগানোর জন্য।

তোমরা সবাই আমাকে দায়িত্ব দিয়েছ ট্রান্সফরমারের গায়ে চার্জ বাধার জন্য। আমার কাছে ২৪ ফুট প্রাইমা কর্ড আছে। এই বিস্ফোরক কর্ড এক্স দিয়ে আমি চার্জ বাঁধব, প্রয়োজনে…

পুলু কথা বাড়ায় না। ভাবে, অন্যরা বলুক প্রয়োজনে কী করতে হবে। ওর থেমে যাওয়ার পর একমুহূর্ত সময় মাত্র। সবাই একসঙ্গে বলে, প্রয়োজনে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

দ্রুত সিদ্ধান্ত।

সাকসেসফুল হওয়ার জন্য অপেক্ষার সময় নেই।

আমাদের সময় রাত সাড়ে আটটা থেকে পৌনে নয়টা। একমুহূর্ত এদিকওদিকে হওয়া চলবে না।

আমরা সময়ের সন্তান। সময়কে জয় করে বীরের মতো ঘরে ফিরব। আমরা প্রস্তুত।

ওরা আটজন এগিয়ে যায় গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনের দিকে। ততক্ষণে ক্র্যাক প্লাটুনের ছয়জন সদস্য উলন পাওয়ার স্টেশনের কাঁটাতারের বেড়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

হ্যান্ডস আপ।

ওদের হুকুমে কেঁপে ওঠে পুলিশ ও দারোয়ান। তিনজন ওদের রিভলবারের মুখে দাঁড় করিয়ে রাখে। অন্যরা ট্রান্সফরমারের গায়ে চার্জ বসায়।

সময় স্তব্ধ হয়ে থাকে ওদের সামনে। সময় এখন ওদের সহযোগী সঙ্গী। বন্ধু। ওদের মতো সাহসী যোদ্ধা। ওদের জীবনে এমন সময় তো আগে আসেনি। ওরা সবাই সময়ের সন্তান। সময়ের সেই সন্তানেরা গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনে চার্জ বাধে ২৪ ফুট প্রাইমা কর্ড দিয়ে। কর্ডের মাঝখানে বসানো হয় ডেটোনেটর ২৭। দেওয়া হয় এক মিনিট ফিউজওয়্যার। চার্জ লাগানোর পর পুলু খেয়াল করে, যেভাবে চার্জ লাগানো হয়েছে, তাতে ট্রান্সফরমার ধ্বংস হবে, কিন্তু বেস-বার ওড়ানো যাবে না।

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বাশার ফিসফিসিয়ে বলে, যা ভেবেছিস, সেটাই ঠিক। একমুহূর্ত দেরি না। পুলু দ্রুত নতুন পজিশনে চার্জ লাগায়। মুহূর্ত সময় মাত্র। ওদের সামনে সময় দাঁড়ায় না। সময় উড়ে যায়। নতুন পজিশনে চার্জ লাগানো শেষ। ৮টা ৪৪ মিনিটে পুলু ইগনাইট করে। বেরিয়ে আসে সবাই। দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। ৮টা ৪৭ মিনিটে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ট্রান্সফরমারের মাথা উড়ে গিয়ে পড়ে পাশের বাড়ির টিনের চালের ওপর। অন্ধকারে ড়ুবে যায় এলাকা।

এই বিস্ফোরণের কয়েক মিনিট পর বিস্ফোরিত হয় উলন পাওয়ার স্টেশন।

প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে আশপাশের এলাকা। অন্ধকার নেমে আসে। শব্দ বুকে নিয়ে ওরা নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যেতে থাকে। গুলবাগ এলাকা থেকে সরে পড়তে অসুবিধা হয় না। আটজনের দল এক এক করে আলাদা হয়ে যায়। উলন থেকে সরে যাওয়ার সময় ক্র্যাক প্লাটুনের ছয়জন দেখতে পায়, টেলিভিশন সেন্টারে পাহারারত আর্মি সেপাইরা রাস্তার ওপর পজিশন নিয়েছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ। মুহূর্তমাত্র দেরি না করে ওরা বিলের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাঁতার দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। মাথার ওপর তারাভরা আকাশ। বর্ষার আকাশ হলেও ঘন কালো মেঘ নেই আকাশে। চিতসাঁতার দিয়ে যেতে যেতে একজন বলে, ভালোই তো লাগছে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের পরে এমন বিলের জলে সাঁতার কাটতে। আগুন-বারুদমৃত্যু-রক্ত-পানি এবং আমাদের জীবন এখন একই সমান্তরালে। এ বড় গভীর আনন্দ।

সে জন্য আকমল আঙ্কেল বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান।

সে জন্য তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় তোমাদের শরীর তোমাদের না।

এই খেসারত সবচেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে আমাদের বোনদের। ওদের প্রতিরোধও কঠিন। আমরা ওদের স্যালুট করি।

হাফিজের কণ্ঠস্বর জলে ভেজা স্বরের মতো গাঢ় বিষণ্ণতায় দমে থাকে। কেউ আর কথা বলে না। দূর থেকে শোনা যায় পুলিশের বাঁশির শব্দ। হইচই। মানুষের কণ্ঠস্বর উচ্চকিত। এলাকার রাজাকাররা হয়তো জড়ো হয়েছে। ওরা তোলপাড় করবে চারদিক। ওরা অস্ত্র ও ক্ষমতা পেয়েছে। দুর্ভাগ্য এই দেশের। দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার। এ দেশের দামাল ছেলেদের পাশাপাশি ওদের মনে হয় ভুইফোড় কেউ। নইলে জলদস্যুদের অবৈধ সন্তান, যারা এ দেশে শুধুই লুটপাট করতে এসেছে। এ দেশের মাটি, বৃষ্টি, গাছপালাকে নিজেদের মনে করে না। এমন কুসন্তানদের নিয়ে কী করবে স্বাধীন দেশ! ওরা মন খারাপ করে বিলের ধারে পৌঁছে যায়। ওদের মনে হয়, ওরা শুনতে পাচ্ছে আয়শা খাতুনের গুনগুন ধ্বনি।

আকমল হোসেন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকেন। বুঝতে পারেন, ওরা এখন আর অপারেশনে নেই। সময়ের হিসাব তা-ই বলে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে ওদের অপারেশনের সময় শেষ হয়েছে। ওরা এতক্ষণে নিজ নিজ হাইডে পৌঁছে গেছে। গুলবাগের ছেলেরা তো পৌঁছে গিয়েছে। আর উলনের ছেলেদের বিল সাঁতরাতে হলে ওদের সময় লাগবে। তবে নিশ্চিত যে ওরা নিরাপদে আছে। ওদের মাথার ওপরে সাদা শাপলা লেগে আছে। আকমল হোসেন মনে মনে স্বস্তি বোধ করেন।

আয়শা এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে বলেন, খাও। তোমার পিপাসা পেয়েছে।

দাও। আকমল হোসেন এক চুমুকে গ্লাস শেষ করেন। হাত দিয়ে মুখ মুছে বলেন, বুঝতে পারছি, খুব পিপাসা পেয়েছিল। কিন্তু টের পাইনি যে পিপাসা পেয়েছে।

তোমার উৎকণ্ঠার কারণে পিপাসার কথা মনে করতে পারোনি। তোমার মুখ দেখে আমি বুঝেছি যে তোমার পানি খেতে হবে।

তাই তো মনে হচ্ছে। তুমি এভাবে বুঝতে পারো বলেই তো আমার এমন সহজ বেঁচে থাকা। এ জন্য তোমার আগে আমি মরতে চাই, আশা।

দেখো, বাজে কথা বলবে না।

আকমল হোসেন সরল হাসি হাসেন। আয়শার বিবেচনার কাছে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি জেগে থাকে তার হাসিতে। তিনি বিষয়টি উপভোগ করেন। আয়শা ভালোবাসার হাসিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।

ফোন বেজে ওঠে।

তিনি দ্রুত পায়ে ফোন ধরতে যান। ফোনের অপর পাশে মারুফ।

আব্বা, আমরা হাইডে পৌঁছে গেছি। অপারেশন সাকসেসফুল।

লাইন ছেড়ে দেয়। তিনি কথা বলার সুযোগ পান না। রিসিভার হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন।

আয়শা কাছে এসে দাঁড়ান।

কী হয়েছে? রিসিভারটা রাখো। এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম না। ওর সঙ্গে আরও একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম।

ও হয়তো ক্লান্ত। কে জানে, বিল সাঁতরে ওদের যেতে হয়েছে কি না! এখন কি আমাদের মন খারাপ করার সময়? ওরা সাকসেসফুল হয়েছে এই আনন্দ এখন আমাদের সবচেয়ে বড়। বাকি, ওরা ওদের মতো থাকুক।

ঠিকই বলেছ। বারবার আমিই ভুল করছি।

এটা কোনো ভুল নয়। আসলে তোমার উদ্বেগ কাটেনি।

ফোন আবার বেজে ওঠে। অপর প্রান্তে পুলু।

আঙ্কেল, সবকিছু ঠিকঠাকমতো শেষ হয়েছে। আমরা হাইডে পৌঁছে গেছি।

ফোন কেটে যায়। এবারও কথা বলার সুযোগ পেলেন না। কিন্তু মন খারাপ করলেন না। ভাবলেন, সময়কে বোঝার দায় এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়।

নিজের ঘরের টেবিলে এসে নানা কাগজপত্র খুলে বসলেন। ডায়েরির পৃষ্ঠায় লেখা নানা তথ্যের ওপর নজর পড়ে। চীন নগ্নভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করছে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠানো বাণীতে পাকিস্তানের পাশে থাকার কথা বলেছেন। পাকিস্তান সরকারকে আশ্বস্ত করেছেন। আকমল হোসেন নানা কিছু মাঝেমধ্যে নোট করেন। লন্ডন টাইমস পত্রিকার প্রতিনিধি মাইকেল হনসবে তার রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যাবিষয়ক খবরকে ভারতের কাল্পনিক প্রচারণা বলে লিখেছেন। মরক্কোর সংবাদপত্র পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিক পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, তাঁর সরকার বাংলাদেশকে কখনোই স্বীকৃতি দেবে না। ইরান ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও একই সুরে কথা বলছেন। তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে মুসলিম বিশ্বকে এক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

এসব নোট করে আকমল হোসেন লাল কালি দিয়ে বড় বড় করে নিচে লিখলেন, বাস্টার্ড। মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে সাপোর্ট দিতে শেখেনি।

আবার ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টান।

শান্তি কমিটির খবরের ওপর ঝুঁকে পড়েন। বেশ কিছুদিন আগে শহরের বিভিন্ন ইউনিট ও মহল্লায় শান্তি কমিটি গঠনের কথা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেসব কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে লিয়াজো অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ শুরু করেছে।

গতকালই আকমল হোসেন মারুফকে বলেছিলেন, স্বাধীনতার পক্ষের বাঙালিদের চিহ্নিত করে ক্যান্টনমেন্টে আর্মির কাছে তাদের নামের তালিকা পৌঁছে দেওয়াই হচ্ছে লিয়াজোঁ অফিসগুলোর মূল কাজ। লিয়াজো অফিসগুলোকে রাজাকার-দালালেরা নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করবে। বিষয়টি আমাদের খুব ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে।

এ নিয়ে আমাদের ভাবনার বড় জায়গা রয়েছে, আব্বা। ওরা এখন যা খুশি তা-ই করবে।

হ্যাঁ, তা করবে। যারা নিরীহ বাঙালি, তাদের ওপরও নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাবে।

আকমল হোসেন ডায়েরি বন্ধ করেন।

খবরের কাগজের পৃষ্ঠা উল্টান।

দৃষ্টি আটকে যায় একটি খবরে-কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী গভর্নর হাউসে টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি সেনাবাহিনীর পাশে থেকে কাজ করবেন বলে তাকে আশ্বাস দেন।

এমন আরও খুঁটিনাটি তিনি নোট করেন। কিন্তু ঘুরেফিরে শান্তি কমিটির কাজের বিস্তার তাকে ভাবিয়ে তোলে। এসব দালাল দেশজুড়ে ছড়াতে থাকবে। সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারের সীমা-পরিসীমা বাড়বে।

প্রচণ্ড অবসন্ন বোধ করেন তিনি। নিজেদের মানুষগুলো নিজেদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। যুদ্ধের আরেকটি ফ্রন্ট ওপেন হয়েছে। দেখা যাক কত দূর যেতে পারে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী দালালেরা।

আয়শা কাছে এসে দাঁড়ান। ঘাড়ের ওপর হাত রাখেন। বাম হাত দিয়ে চুল এলোমেলো করেন।

খাবে চলো। টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। অবশ্য তেমন কিছু রান্না হয়নি।

আজ রাতে খেতে চাচ্ছি না। কিছু ভালো লাগছে না। খিদে নেই বলে মনে হচ্ছে।

খাওয়া নিয়ে তালগোল পাকানো চলবে না। ওঠো। দুমুঠো খেয়ে শুয়ে পড়ো। এটাও তুমি জানো যে আমি তোমাকে না খেয়ে শুতে দেব না। এসো।

আয়শা খাতুন হাত ধরে টানেন। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে বলেন, নিজে নিজে এসো। তোমার আগে আমি চলে গেলে কে তোমাকে এভাবে খেতে ডাকবে!

আহ, আশা, এভাবে বলবে না।

আয়শা খাতুন সামনে এগিয়ে যান। পেছন ফিরে আর তাকান না। যেন আকমল হোসেনের দীর্ঘশ্বাস এবং বেদনাভরা কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পাননি।

খেতে বসলে আলতাফ-প্রসঙ্গ ওঠে।

আয়শা বলেন, আলতাফ কাল বাড়ি যেতে চাচ্ছে। তোমার সঙ্গে নাকি কথা হয়েছে?

হ্যাঁ, হয়েছে। আমি ওকে যেতে দিতে চাই। ওরা বাবা গভীর পারিবারিক সমস্যায় আছে।

ওকে ছেড়ে দিতে আমার মন চায় না। কখন কী খবর হবে কে জানে! তুমি একা একা কতটা সামলাতে পারবে, কে জানে! ও যখন যাওয়ার কথা বলল তখন আমার বুক ধক করে উঠল। বুঝলাম, আমাদের কাছে ও কত বড় একটা ভরসার মানুষ।

ওর ভাই রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে, আশা। ও ঢাকায় বসে ভাইকে কতটা শাসন করতে পারবে? ওকে আমাদের যেতে দেওয়া উচিত। ঘুরে আসুক বাড়ি থেকে। বাবা-মাকেও দেখে আসুক।

আয়শা চুপ করে থাকেন। মেরিনা বলে, আলতাফ ভাই যে কয়দিন থাকবে, সে কয়দিন আমরা না হয় আরেকজনকে বাড়িতে রাখতে পারি, আব্বা।

আয়শা নিজেই বাধা দিয়ে বলেন, না, এ বাড়িতে চট করে কাউকে আনা যাবে না। কারণ, এটা কোনো সাধারণ বাড়ি নয়। এটা একটা দুর্গবাড়ি।

আকমল হোসেন এক লোকমা ভাত মুখে পুরে বলেন, ঠিক। আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। শান্তি কমিটি পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার জন্য বড় একটা জাল ছড়িয়েছে। ওরা প্রতিটি জেলা-মহকুমা-গ্রাম পর্যন্ত কমিটি গঠন করে নির্যাতনমূলক কাজের প্রচার চালাচ্ছে। কয়দিন আগে সেন্ট্রাল শান্তি কমিটির আহ্বায়ক খাজা খয়েরউদ্দিন প্রেস রিলিজ দিয়েছেন। তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে জঙ্গিদের উসকানি দিচ্ছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা করতে পারবে না, এরা তার দ্বিগুণ করবে। এরা মানুষের ঘরে ঘরে ঢুকবে। সেনাবাহিনীকে পথ দেখাবে।

মেরিনা মাথা চেপে বলে, উহ্, মাগো।

আয়শা মাথা নেড়ে বলেন, তোমার কথার সূত্র ধরে বলতে হয় যে সেনাবাহিনীকে সরাসরি চেনা যাবে। এদের চেনা যাবে না। এরা হলো গুপ্ত ঘাতক।

একদম ঠিক। এদের সব ধরনের লেবাস থাকবে।

অকস্মাৎ সবাই নীরব হয়ে যায়। তিনজনে নিঃশব্দে ভাত খায়। যেভাবে খেলে মানুষের মনের তৃপ্তি হয়, এ খাওয়া সে খাওয়া নয়। এটি রুটিন খাওয়া। কোনো রকমে খাদ্যকে পেটের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেওয়া মাত্র। যে খাদ্য বেঁচে থাকার একটি শর্ত। এই শর্ত না মানলে একটু আগে চলে যাওয়ার কথা যে আয়শা বলেছে, তা-ই ঘটবে।

তিনজনের কেউই রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারল না।

মেরিনা অনেক রাত পর্যন্ত ঘরে বাতি জ্বালিয়ে রাখল। বই পড়ার চেষ্টা করল। পুরো খাতা আঁকিবুকি-হিজিবিজিতে ভরিয়ে ফেলল। পায়চারি করল। পানি খেল। অস্বস্তি ওকে জাপটে ধরে রাখল।

ও দুদিন ধরে বিভিন্ন বাড়িতে গেরিলা পত্রিকা পৌঁছে দিয়েছে। যুদ্ধের নানা খবর শুনেছে। প্রবাসী সরকারের খবর, চরমপত্র ইত্যাদি সবকিছু আলোচনায় আসে। চরমপত্র প্রচারের প্রশংসা করে সবাই। অবরুদ্ধ শহরে চরমপত্র শোনার অপেক্ষায় থাকে সবাই। কখনো আলোচনা জমে যায়। তখন আর দ্রুত উঠে পড়তে পারে না ও। যুদ্ধের হিসাব-নিকাশে ড়ুবে যায় পরিবারের সবাই। কোথাও দুপুরের ভাত খেতে হয়। যুদ্ধের পরিবেশ সবখানে আছে। কাছের কাউকে পেলে অন্যরা মন খুলে কথা বলে। বাড়িতে যা আছে, তা উজাড় করে। শুধু নুসরাতের বাসায় গিয়ে মন খারাপ করে ফিরল ও। গুম হয়ে থাকল। বাবা-মায়ের সঙ্গেও কথা বলল না। বাবার কথায় মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। ভাবল, যুদ্ধের ফ্রন্ট বাড়ছে। এসব ছদ্মবেশী কাছের মানুষের সঙ্গে প্রতিদিনের দেখা-সাক্ষাৎ কিংবা মাঝেমধ্যে দেখাশোনার জায়গা নষ্ট হলো। নিজের মর্যাদাকে উপেক্ষা করে ওরা নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। কখনো বুঝে, কখনো না বুঝে। কখনো লোভে, কখনো ব্যক্তির স্বার্থপরতায়। নইলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পরিবারের ছেলে কী করে নিজে নিজে গিয়ে রাজাকারবাহিনীতে নাম লেখায়?

নুসরাতের কলেজপড়ুয়া ভাই নওশীন রাজাকার হয়েছে। ট্রেনিংও নিয়েছে। ওদের বাড়িতে এখন চরম অশান্তি চলছে। বাবা ওকে বলেছেন, বাড়ি ছাড়ো। আমি একমুহূর্তের জন্য তোমার মুখ দেখতে চাই না।

নওশীন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে বলেছে, পাকিস্তানি সেনারা নুসরাতকে তুলে নিতে এলে তখন আমাকেই খুঁজবে তোমরা। এখন যেতে বলছ, যাচ্ছি। আর আসব না।

বাবা রেগে গিয়ে বলেছেন, আসিস না। তুই আমার একা সন্তান না।

এখন বাড়িতে সবাই চুপ। কষ্ট ওর মায়ের মনে বেশি। ঠিকমতো কাঁদতে পারছে না। নুসরাত বলে, মায়ের কষ্ট দুই ধরনের। ছেলেটা ঢাকা শহরে থেকেও বাড়িতে নেই। আবার স্বাধীনতাযুদ্ধে উল্টো পথে চলে গেল ছেলেটা। মা কারও সঙ্গেই মুখ খুলে কথা বলছে না। একদম নিজের ভেতর গুটিয়ে গেছেন।

তুই কী মনে করছিস?

নষ্টকে সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়াই উচিত। গেছে, ভালো হয়েছে। আমিও ওর মুখ দেখতে চাই না। এমন একটি পরিবারে থেকে ও কী করে একা একা রাজাকার হলো? ও তো যুদ্ধ করার জন্য চলে যেতে পারত।

মেরিনা ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, আস্তে বল। খালাম্মা শুনবে।

আম্মা আমার মনোভাব জানে। আমি রেখেঢেকে কথা বলি না। নওশীন আরও বেশি জানে। সে জন্য আমাকে পাকিস্তানি আর্মির ভয় দেখায়।

আমার সঙ্গে যাবি?

কোথায়?

আমাদের বাড়িতে। দুদিন থেকে আসবি।

না। আমার কিছু ভালো লাগে না। নওশীনের আচরণে আমার পৃথিবী ভেঙে পড়েছে। আমি ঠিক করেছি, সোয়েটার বুনব। কামাল ভাই ফোন করে সোয়েটার বানাতে বলেছেন। সামনের শীতে মুক্তিযোদ্ধাদের এক শ টা সোয়েটার দেওয়ার ভাবনা মাথায় নিয়েছি।

আমিও বানাব। মাকে বললে আমাকে উল কিনে দেবেন। মারুফ ভাইয়া সোয়েটার নিয়ে যাবে ক্যাম্পে।

হ্যাঁ, বানাবি। আমরা দুজনে মিলে অনেক বানাব। এটাও একটা বড় কাজ।

উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল নুসরাতের দৃষ্টি। ও মেরিনাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমাদের যুদ্ধে জিততে হবে, মেরিনা। আমরা পরাজিত হব না।

মেরিনা রিকশায় উঠলে বলেছিল, নওশীনের কথা বাড়িতে কাউকে বলিস না। ও আমাদের বাড়ির একটা কুলাঙ্গার। সেদিন ওর দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল আত্মহত্যা করি।

মেরিনা ওর হাত চেপে ধরে বলেছিল, শান্ত হ। আমাদের আবার দেখা হবে।

এখন মনে হচ্ছে একজনকে শান্ত হতে বলা সহজ। কিন্তু কাজটি কি অত সহজ! ওর নিজেরই তো ঘুম আসছে না। ওকে কথা দিয়েছে বলে বাবামাকেও বলতে পারছে না।

শেষরাতে ঘুম এলে গভীর স্বপ্নে তলিয়ে যায় মেরিনা। স্বপ্ন দেখল, ও আর নুসরাত যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। চারদিকে প্রবল গোলাগুলি। ওদের ওপরে বৃষ্টির মতো গুলি পড়ছে। ওরা হেঁটেই যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা যে দ্বীপে পৌঁছায়, সেখানে অজস্র শহীদের সমাধি। কোথাও এক ইঞ্চি জমি খালি নেই।

ও নুসরাতের হাত চেপে ধরে বলে, আমরা কীভাবে এই দ্বীপে হাঁটব। পা রাখার জায়গা নেই।

পেছন থেকে কে যেন এসে হাত ধরে।

ওর হাত ধরে বলে, এসো আমার সঙ্গে।

তুমি কে? তোমাকে কোথায় যেন আমি দেখেছি।

আমার নাম জেবুন্নেসা।

ঘুম ভেঙে যায়। আশ্চর্য হয় মেরিনা। বিড়বিড় করে বলে, জেবুন্নেসা। তোমার শহীদ হওয়ার খবরটি আমি মারুফকে দিতে পারিনি। তোমার চিঠিও না। আমি যদি শহীদ হতাম এবং তোমার হাতে এমন একটি কঠিন দায়িত্ব থাকত, তাহলে তুমি কী করতে, জেবুন্নেসা? আমার আরেকটি গভীর স্বপ্নে তুমি আমাকে এই পরামর্শটি দিয়ে কিন্তু। মনে থাকবে তো, জেবুন্নেসা!

মেরিনা দুই হাতে চোখের পানি মোছে। দেখতে পায়, পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে ভোরের আলো আসছে ঘরে। বোঝা যায়, দিনের প্রথম আলো নয়। রোদ উঠেছে। আলোয় ভেসে যাচ্ছে শহর। মেরিনা আড়িমুড়ি ভাঙে।

 

পরদিন আলতাফ চলে যায় গ্রামের বাড়িতে। সবাইকে আশ্বস্ত করে বলে, দুই দিন আসা-যাওয়া, দুই দিন বাড়িতে থাকা। চার দিনের বেশি থাকব না, স্যার। পথে যদি কোনো ঝামেলা না হয়, বাড়িতে যদি সবকিছু ঠিক থাকে, তাহলে দেরি হওয়ার কোনো কারণই হবে না। সবার জন্য তালের রসের গুড় নিয়ে আসব। আপনারা বোধ হয় তালের রসের গুড় খাননি।

হেসে ফেলেন আয়শা।

ঠিক বলেছ, আমরা তালের রসের গুড় খাইনি। তবে ভেবে অবাক হচ্ছি, এত কিছুর মধ্যে তোমার একটা কিছু আনার তাগিদ থেকেই গেছে। নাকি আলতাফ?

ও মাথা চুলকে হাসে। বলে, একটা কিছু আনতে তো হবেই। খালি হাতে আসলে আমার মা বেশি রাগ করবে। আমি তো জানি, মা পারলে পিঠে-পুলি বানিয়ে দেবে। বাড়ির অবস্থা কেমন আছে কে জানে।

আকমল হোসেন হাসতে হাসতে বলেন, যুদ্ধ কি ওর আতিথেয়তার জায়গাও বন্ধ করে দেবে, আয়শা! বাঙালির প্রাণের টানই এমন। এটা আমাদের কালচারের অংশ। আমরা এর বাইরে যেতেই পারব না।

বিকেলে আলতাফ চলে যায়।

আলতাফ চলে যাওয়ার পরপরই ক্র্যাক প্লাটুনের ছয়জন সদস্য আসে। আকমল হোসেনের সঙ্গে কথা বলবে ওরা।

নেহাল বলে, ফার্মগেট একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ওখান থেকে বিভিন্ন অপারেশন চালাতে হবে। এলাকাটি জঙ্গলে প্রায় ভরা। ওখানে আমাদের একটি ঘাঁটি দরকার।

আমাদের কোনো বন্ধুর বাড়ি যদি না থাকে, তাহলে একটি বাড়ি ভাড়া করা যায়। সে জন্য আমাদের খোঁজ নিতে হবে।

আমরা খোঁজ নিয়েছি, আঙ্কেল। আপনাকে নিয়ে যাব। ওই গাছগাছালির মধ্যে গেলে আপনার ভালো লাগবে। যে বাড়িটা পছন্দ করেছি, সেটিও চমৎকার। একতলা বাড়ি। দেয়াল পাকা, ওপরে টিন। মেঝে খুঁড়ে অস্ত্র লুকিয়ে রাখা যাবে।

তাহলে চলল, কাল সকালে গিয়ে দেখে আসি। যার বাড়ি তার সঙ্গে কথা বলব। ভাড়ার টাকা আমি দেব।

যে বাড়িটি আমরা ঠিক করেছি, তার অবস্থানও খুব ভালো, আঙ্কেল। ফার্মগেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যেখানে আর্মি নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে, সেখানে আমাদের অপারেশন হতেই হবে। নইলে নিজেরাই নিজেদের কাছে জবাব দিতে পারব না।

আকমল হোসেন হাঁ করে নেহালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ছেলেটি কত দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলছে। পরক্ষণে নিজেকে নিজেই উত্তর দেন, ওরা তো এই সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান। ওরা তো এমনই হবে। ওদের নিয়ে এভাবে ভাবাই উচিত নয়। ভাবলে, নিজের কাছে নিজেকে ছোট হতে হবে।

নেহাল আবার বলে, তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা মিলন ভাইয়ের বাড়ি আছে ফার্মগেট এলাকায়। চারদিকের ঘন গাছপালার কারণে বাড়িটা বেশ নিরাপদ। তিনি বলেছেন, দরকার হলে তিনি তার নিজের বাড়িটা দেবেন।

বাহ, বেশ তো। তবে বেশ সাবধানে কাজ করতে হবে। রাজাকারদালালেরা শহরে বাড়ছে। কোনো কিছু ঠিক করার আগে ভালো করে দেখেশুনে নেবে। তোমরা কোন বাড়িতে আগে অবস্থান নেবে, ঠিক করেছ?

যে বাড়িটি ভাড়া করতে চাই, সেটি আগে নিই। মিলন ভাইয়ের বাড়িটি আরও দু-এক মাস পরে নেব।

গুড। তোমরা যা ভালো মনে করবে, সেটাই আমি তোমাদের সিদ্ধান্ত হিসেবে নেব। দ্বিতীয় চিন্তা করার সুযোগ রাখব না। কাল সকালে আমি তোমাদের সঙ্গে ফার্মগেটে যাব।

ছেলেরা খুশি হয়ে মাথা নাড়ে। ওরা জানে, এই পথে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আর্মির গাড়ি চলাচল করে। এই পথের উত্তর দিকে তেজগাঁও এয়ারপোর্ট। ফার্মগেট জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা হলে কী হবে, গুরুত্ব অনেক। কারণ, এখানকার মিলিটারি চেকপোস্ট অনেক বড়। নানা দিক থেকে জায়গাটির গুরুত্ব বুঝে এর পাহারা জোরদার করা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্ট, অপারেশন হেডকোয়ার্টার, এমপি হোস্টেল, সর্বোপরি দ্বিতীয় রাজধানীর সংযোগস্থল মিলিয়ে জায়গাটির যে গুরুত্ব, সেখানে আঘাত করতে পারলে যুদ্ধকৌশলের বড় সাফল্য আসবে। ট্রাফিক আইল্যান্ডের মধ্যে তাঁবু খাঁটিয়ে মিলিটারি, পুলিশ আর তাদের সহযোগীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রিন রোডের মুখের বাঁ দিকে তৈরি হচ্ছে একটি সিনেমা হল। এই অর্ধেক নির্মিত দালানের মাথায় লাইট মেশিনগান হাতে পাহারা দেয় সেনাসদস্যরা। ট্রাফিক আইল্যান্ডের ফুটপাতে ও চেকপোস্টের প্রহরীরা রাইফেল ও লাইট মেশিনগান হাতে রাত-দিন পাহারা দেয়।

পরদিন চান কুটির ভাড়া করতে এসে পুরো এলাকা দেখে নেন আকমল হোসেন। দেখেশুনে খুশি হন। হাইডের জন্য বাড়িটি চমৎকার। একদম সেনাদের নাকের ডগায়, কিন্তু আপাত সরলভাবে নিরাপদ। প্রাঙ্গণজুড়ে আছে বেশ বড় বড় গাছ। এর মধ্যে ডালপালা মেলে দেওয়া পেয়ারাগাছ আছে সবচেয়ে বেশি।

বাড়িতে ছিল একটি পরিবার। পরিবারের ছয়জন সদস্য যুদ্ধের সঙ্গে জড়ানোর জন্য উদগ্রীব ছিলেন। আকমল হোসেনের হাত জড়িয়ে ধরে আবদুল জব্বার বললেন, যুদ্ধের সঙ্গে যদি নিজেদের যুক্ত করতে না পারি, তাহলে সারা জীবন অপরাধী হয়ে থাকব। স্বাধীনতা কি সহজ কথা!

আকমল হোসেন তাকে জড়িয়ে ধরেন। তারা বাড়ির চারদিকে হাঁটেন। দেখতে পান, বৃষ্টিতে ঝরা পাতা মাটির সঙ্গে মিশে আছে। তাদের পায়ের চাপে দেবে যায়। শুকনো পাতার খসখস শব্দ হয় না। আচমকা আতঙ্কিত হতে হয় না। নিরাপদ থাকার জন্য সুন্দর বাড়ি বলে মনে হয় তার। আকমল হোসেন বলেন, এসব গাছের গোড়া খুঁড়ে অস্ত্র রাখা যাবে। ছেলেরা সহজেই কাজটি করতে পারবে।

নেহাল বলে, শুধু গাছের গোড়ায় না, গাছের মাথায়ও অস্ত্র বেঁধে রাখব। এই ঘন ডালপালা আমাদের সহায়ক শক্তি। নিচে দাঁড়িয়ে চট করে বোঝা কঠিন যে ওখানে অস্ত্র আছে।

আকমল হোসেন হেসে বলেন, এই যুদ্ধে বৃষ্টি আমাদের সহায়তা দিচ্ছে। এখন দেখি গাছও দিচ্ছে। রাস্তার অপর পারে ধানখেত আছে। বর্ষায় এলাকাটা পানিতে ড়ুবে থাকে। আমাদের যোদ্ধাদের পক্ষেও এসব থাকবে। প্রকৃতি আমাদের সহায়ক যোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনারা এসবের ভালো দিক বুঝবে না। ওরা ঘাবড়াবে। বর্ষা দেখে, ঘন গাছের মাথা দেখে, ধানখেত দেখে ওরা ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে।

সবাই মিলে চারদিকে তাকায়। সবাই মিলে অপারেশনের পরিকল্পনায় অংশীদার হয়। শুধু তারা একটি কথাই ভাবতে পারে না যে এই বাড়ির প্রাঙ্গণে শহীদদের কবর হবে।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আকমল হোসেনের মনে হলো, স্যান্ডেলে কোনো লতা জড়িয়ে গেছে। কোথাও কেউ তাকে বলছে, দাঁড়াও। আমাকে রেখে তুমি চলে যাচ্ছ কেন? তিনি দাঁড়ালেন। স্যান্ডেল খুললেন। দেখলেন, শুকনো ঘাসের কুচি জমে আছে পায়ের তলায়। স্যান্ডেল ঝেড়ে আবার পা ঢোকালেন। তার পরও স্বস্তি নেই। পায়ের নিচে চুলকাচ্ছে। তিনি স্যান্ডেল খুলে ঘাসে পা মুছলেন। বুঝলেন, ঘাসের গায়ে ভীষণ মমতা। তার পা-জোড়া আদরে ভরে দিয়েছে। তিনি মনে মনে বললেন, বেশ তো করলে। এমন মায়া কেন তোমাদের? আমি তো আবার আসব তোমাদের কাছে। তখন পা-ভরে ভালোবাসা দিয়ো, ঘাসেরা। যাচ্ছি। তোমাদের বিদায় বলব না। তোমরা আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আর আমার ছেলেগুলোকে দেখেশুনে রাখবে। আহ, এসব ভাবতে কী যে ভালো লাগে!

এমন জঙ্গলাকীর্ণ একটি বাড়ির ছায়া তাঁকে আচ্ছন্ন করে। বুকের ভেতর কোনো অনুভব খচ করে উঠলেও তিনি স্বস্তি বোধ করেন। কোথাও কোনো বড় আয়োজন তার জন্য বুঝি অপেক্ষা করছে। তিনি সবার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, যাই, বাবারা।

আবার আসবেন, চাচা।

হ্যাঁ, আসব। আমাকে তো বারবার আসতেই হবে। এই দুর্গবাড়ি ইতিহাসের বাড়ি হবে না!

গেরিলারা হা হা করে হাসতে পারে না। কেউ ভি দেখায়। কেউ ওপরে লাফ দিয়ে দুম করে নিচে পা ফেলে। কেউ এক পাক ঘোরে। তিনি ওদের আনন্দ দেখে নিজেও খুশি হয়ে ভি দেখান।

গাড়ি ছুটে যায় ফার্মগেট কারওয়ান বাজারের রাস্তায়। অনেক দিন পর তাঁর ভেতরে অফুরান শক্তির জোয়ার অনুভব করেন। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে আকাশ দেখেন। পাশ দিয়ে চলে যায় আর্মির কনভয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *