১৩ অধ্যায় – গুপ্তচর নিয়োগ

১৩ অধ্যায় – গুপ্তর নিয়োগ

সানজু বলেন:

যখন এক লক্ষ্য সৈন্য তৈরি যুদ্ধের জন্য এবং তাদেরকে ক্যাম্প করার জন্য দূরে কোথাও পাঠানো হয় তখন জনগণের সাথে মিলিত রাজ কোষাগার থেকে বিতরণকৃত ধন-সম্পত্তির যে সমাবেশ ঘটে তা একদিনে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার পরিমাণ সম্পত্তি জমা করা হয়। ঘরে ও বাইরে এই কার্যক্রম চলতে থাকলে জনগণ পরিবহন করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়ে এবং এর পাশাপাশি কমপক্ষে সাত হাজার ঘরোয়া জিনিসপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সাও সাও এর ভাষ্যমতে, আদিকালো কমপক্ষে আট পরিবার মিলে একটা সম্প্রদায় গঠন করতো। যখন সেখান থেকে কোন একটা পরিবার একজনকে সৈন্যবাহিনীতে পাঠাতো, বাকি সাত পরিবার তার খরচের জন্য সহায়তা করতো। এভাবে এক লক্ষ সৈন্য তৈরি হলে বাকি সাত লক্ষ পরিবার তাদের সহায়তা করতো।

.

সানজুর মতে, যিনি বহু বছর ধরে শত্রুর মোকাবেলা করছেন, জয়ের জন্য প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন, যিনি শত্রুর বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন, তিনি সম্পূর্ণ অমানবিক কাজ করছেন। এমন মানুষ কিছুতেই সেনানায়ক হতে পারেন না; দেশের সার্বভৌম রক্ষায় তার কোন অবদান আছে বলে মনে হয় না; জয়ের সেনানী বলা যায় না তাকে।

বিজ্ঞ সেনানায়ক যখনই আক্রমণ করেন, তখনই শত্রুকে পরাজিত করতে পারেন এবং তাদের অর্জন সাধারন একজন দুরদর্শি মানুষের চিন্তাভাবনাকেও ছাড়িয়ে যায়। এই দুরদর্শিতা আধ্যাত্মিক সাধনা থেকেও আসেনা, অভিজ্ঞতা থেকেও না, এমনকি নির্ভুল কোন হিসাব কষেও পাওয়া যায় না। এটা অর্জন করা যায় শুধুমাত্র শত্রুর সংখ্যা, সামথ, মোতায়েন আর পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য খুঁজে বের করার মাধ্যমে। এই তথ্য সংগ্রহের জন্য চাই উপযুক্ত গুপ্তচর। সানজুর মতে, পাঁচ ধরনের গুপ্তচর নিয়োগ করা যায়। এগুলো হল নেটিভ, ইনছাইড, ডাবল, এক্সপেনডেবল, আর লিভিং।

যখন এই পাঁচ প্রকারের এজেন্ট এক সাথে তাদের কাজ শুরু করে দেয় এবং কেউই তাদের সেনানায়কের যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে কিছু জানতে পারে না, তখন তাদেরকে বলা হয় ‘দ্যা ডিভাইন স্কেইন’। আর তারা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের সম্পদ।

এক. নেটিভ এজেন্টরা হল যে এলাকায় আপনি যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন সেখানকার স্থানীয় লোক। যুদ্ধের কারনে জনজীবন এমনিতেই অতিষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয়রা যদি এমনিতেই আপনার শত্রুর ওপর ক্ষিপ্ত থাকে, তাহলে যে কোন কাজ খুব সোজা। অন্যথায় খাবার আর পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে তাদের কাজে লাগানো যায়। আবার একেবারে বেকায়দায় মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েও এদের দিয়ে কাজ করানো যায়।

দুই. ইনছাইড বা ইনওয়ার্ড এজেন্ট হল শত্রুর সামরিক অথবা সরকারি কর্মকতা-কর্মচারি। এদের বিপুল পরিমানে উৎকোচ দিয়ে অথবা অন্য উপায়ে কিনে ফেলা যায়। এদের অনেকেই নানা কারনে নিজ দেশের সরকার বা প্রশাসনের ওপর নাখোশ থাকে, তাই চেনা সহজ।

তিন. ডাবল এজেন্ট হল শত্রুর গুপ্তচর যে আপনার হয়েও কাজ করে। নিজ স্বার্থেই এরা দুই দিকেই তথ্য বিক্রি করে। তাই নিজেদের তথ্য যতটা সম্ভব এদের কাছ থেকে গোপন রাখতে হয়। এদেরকে কখনও পুর্ণ বিশ্বাস করতে নেই।

চার. এক্সপেনডেবল হল সেই সব গুপ্তচর যারা শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে আপনার দেয়া ভুল তথ্য নিয়ে ইচ্ছে করে শক্রর হাতে ধরা দেয়। শত্রু আপনার ভুল তথ্যের উপর কাজ করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়, আর আপনি তাকে পরাস্থ করতে পারেন।

পাঁচ. সারভাইভিং বা জীবন্ত গুপ্তচরেরা আপনার নিয়োগ দেয় গুপ্তচর যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুর তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে আসে। সেরা গুপ্তচরেরা সহজে আর লাভজনক যুদ্ধজেতার মত তথ্য এনে দিতে সক্ষম।

যখন এই পাঁচ গুপ্তচরেরা একত্রে কাজ করে, তখন এদেরকে বলা হয় “মহান রেশমের গুটি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকেরাই শুধু এদের ব্যাপারে জানে। এমন সংস্থা আর তাদের কাজ রাষ্ট্রের সবচেয়ে স্পর্শকাতর আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

যিনি মহাজ্ঞানী এবং বিজ্ঞ পন্ডিত, মানবিক গুন সম্পন্ন ব্যক্তি নন তিনি কিছুতেই গুপ্তচর নিয়োগ দিতে পারেন না। আর যিনি দুর্বল মনমাসকিতার অধিকারি তিনি গুপ্তচর থেকে সত্যতা বের করে আনতে অক্ষম হন।

তু-মু এর ভাষ্যমতে, যুদ্ধের প্রথমে যে বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করে নিতে হয় তা হল, যাকে গুপ্তচর নিয়োগ করছেন তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যেমন সে কি আপনার প্রতি অনুগত কিনা, বিশ্বাসযোগ্য এবং সত্যিকারের বুদ্ধিমান কিনা! তারপর তাকে নিয়োগ দেয়া যায়। গুপ্তচরদের মাঝে এমন অনেকে আছে যারা শত্রুর বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক পর্যবেক্ষন না করেই শুধু ধন-সম্পদের লোভে এ পেশায় আত্মনিয়োগ করে, এবং শেষ পর্যন্ত কোন সংবাদই তারা দিতে পারে না। এই ধরনের পরিস্থিতিতে তার প্রতি অত্যন্ত কঠোর ও গম্ভীর হতে হবে। তারপরই বুঝা যায় তার কথার মধ্যে কতটুকু সত্যতা রয়েছে এবং তখনই সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তার বক্তব্যের কতটুকু নেয়া যাবে আর কোন কথায় কান দেয়া যাবে না।

আসলেই কি দুর্বলচিত্তের! এমন কোন যুদ্ধ নেই যেখানে গুপ্তচরবৃত্তি হয় নি।

.

সানজু বলেন, গোপন কোন আক্রমণের খবর যদি কোন বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচরের মাধ্যমে অন্য কেউ জেনে যায় তবে সে যার যার সাথে কথা বলেছে তাদের সকলকে হত্যা করুন।

চেন হাও এর ভাষ্যমতে, তাদেরকে হত্যা করা যেতে পারে যাতে করে শক্রর কেউ আপনার গোপন খবর জানতে না পারে।

যে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত আপনি করতে চাচ্ছেন, যে শহর দখল করতে চাচ্ছেন, যাদেরকে হত্যা করতে চাচ্ছেন, তাদের কমান্ডার, অফিসার, গেট রক্ষক, দেহরক্ষী সকলের সম্পর্কে আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে। আপনার গুপ্তচর থেকে তাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিচয় যাতে পান তার নির্দেশ প্রদান করুন।

তু-মু এর ভাষ্যমতে, আক্রমণাত্নক কোন যুদ্ধ পরিচালনা করতে চাইলে শত্রু সৈন্যদের সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি। তারা কি মুখ নাকি জ্ঞানি, চালাক নাকি বোকা? তাদের সম্পর্কে জানতে পারলে তাদের জন্য আপনি যথাযথ পরিকল্পনা তৈরি করতে পারবেন।

শক্রর কোন গুপ্তচর আপনার বিরুদ্ধে আপনারই সৈন্যদের সাথে মিশে আছে কিনা তার খুঁজে বার করা অত্যাবশ্যকীয় কাজ এবং তাদেরকে ধন-সম্পদের লোভ দেখিয়ে আপনার পক্ষে কাজ করান। শত্রুর সঠিক খবরাখবর পাওয়ার জন্য তাদের উপর নজরদারি রাখুন। এভাবে ডাবল গুপ্তচরবৃত্তির সুযোগ নিতে হয়। এর মানে নিজেদের গুপ্তচর আর শত্রুর গুপ্তচর উভয় গুপ্তচরকে নিজের কাজে লাগানো।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, দুই দিক থেকে গুপ্তচর নিয়োগ করলে শত্রুর গুপ্তচর তার নিজের দেশের সৈন্য সম্পর্কে অনেক বেশি অভিজ্ঞ।

আর এর দ্বারা শত্রুর গুপ্তচরকে নিজের কাজে লাগিয়ে তাকে দিয়ে শত্রুর কাছে ভুল তথ্য পাঠিয়ে শত্রুকে বিভ্রান্ত করা সহজ হবে। তাছাড়া তা দ্বারা লিভিং গুপ্তচরকে যথাযথ সময়ে ব্যবহার করা সহজ হবে। সার্বভৌম কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এই পাঁচ ধরনের গুপ্তচর সম্পর্কে জানতে হবে। শত্রুর এই গুপ্তচরের মাধ্যমেই পাঁচ ধরনের গুপ্তচর সম্পর্কে জানা যাবে এবং তাই তাদেরকে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিতে হবে।

আর তাই আপনার সবচেয়ে প্রতিভাবান লোকদেরকে কোন কাজে নিয়োগ দেবেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি কি তাদেরকে সম্মুখ সমরে পাঠাবেন, নাকি অন্যদের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন, নাকি গুপ্তচর হিসেবে পাঠাবেন তা নির্ধারন করার সময় ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করবেন। তবে যেকোন সামরিক অভিযানে গুপ্তচরবৃত্তির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ আপনার পরিকল্পনায় রহস্যময় সব অপারেশন এর উপরই নির্ভরশীল।

চি-লিন এর ভাষ্যমতে, গুপ্তচর বিহীন সৈন্য পরিচালনা আর চোখ কান বিহীন মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

সমাপ্ত

1 Comment
Collapse Comments
Samir Kumar Debnath March 28, 2024 at 2:02 pm

Awesome work….well done Mr. Interpreter❤️❤️❤️

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *