০৮ অধ্যায় – রণকৌশলের ব্যতিক্রমী নয় ভাবনা
সানজু বলেন:
১
সাধারণত একটা সামরিক অভিযানে সৈন্য নিয়োগের পদ্ধতি হল: কমান্ডার প্রথমে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের থেকে নির্দেশ পেলে নিয়মিত সৈন্য সমাবেশের মাধ্যমে সেখান থেকে সৈন্য জোগাড় করেন। সৈন্য শিবির কোথায় স্থাপন করলে সর্বোচ্চ সুযোগ পাবেন ও কিভাবে যুদ্ধ শুরু করবেন তা সম্পর্কে সানজুর মত,
এক. মার্চ করে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি নিচু কোন এলাকায় সৈন্য শিবির স্থাপন করা যাবে না।
দুই. মিত্র রাজ্যের সাথে আলোচনার আয়োজন করে মিত্রবাহিনী গঠন করতে হবে।
তিন. জনশূন্য এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় গড়িমসি করা একেবারেই উচিত নয়।
চার. চারিদিকে জনাকীর্ণ স্থান থেকে যুদ্ধ সরঞ্জামাদি এবং খাবার পর্যাপ্ত পরিমানে জোগাড় করে নিন।
পাঁচ. রুক্ষ-শুকনো জমিতে যুদ্ধ করুন।
ছয়. কিছু রাস্তা আছে যেগুলো দিয়ে কখনও যাতায়াত করবেন না; কিছু সৈন্য আছে যাদেরকে ঘাটাবেন না; কিছু শহর আছে যেখানে হামলা করবেন না; এবং কিছু জমি আছে যেখানে ভুলেও যুদ্ধ করতে যাবেন না।
ওয়াং সি এর ভাষ্যমতে, সানজু এর দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন যেন শক্রর কিছু চালাকি থাকতে পারে যেখানে উঁচু দেয়াল এবং গভীর খাদ দ্বারা মূল্যবান সম্পদ বেষ্টিত করে রেখেছেন। সেখানে আক্রমণ করা যাবে না। যদি আপনি সেই শহরে আক্রমণ করেন এবং সেখানে পৌঁছুনো এতটাই খরচ হবে যে সৈন্য পাঠিয়ে সেখান থেকে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে যাবে। আর তাই সেটা আক্রমণ করা ঠিক হবে না।
সাত. এমন কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে যেখানে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকেও মান্য করা যাবে না।
সাও সাও এর ভাষ্যমতে, যুদ্ধের একেবারে টানটান উত্তেজনায় সেনানায়ককে কিছুতেই সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের দ্বারা আটকানো উচিত হবে না।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, ওয়েই লিয়াজু বলেন: ‘অস্ত্র হল দুর্ভাগ্যপূর্ণ একটা যন্ত্র; দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ হল উত্তৰ্ষতার সম্পূর্ণ বিপরীত; মৃত্যুদূত স্বর্গ এবং মর্তের মধ্যে যেমন পার্থক্য সৃষ্টিকারী নন; এবং যুদ্ধে দুত দু-পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টির জন্য দায়ি নন।’
চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, কং-ফু চি বলেন: ‘যখন যথাযথ কার্য সম্পাদনের উপায় দেখবে; সেটা সম্পাদনের জন্য আদেশ দিতে দেরি করবে না।’
.
২
একজন সুবিবেচক সেনানায়ককে যুদ্ধে সাফল্য অর্জনে নয়টি ব্যতিক্রমী চিরায়ত কৌশল খুব ভালো ভাবে রপ্ত করে নিতে হয়।
চি-লিন এর ভাষ্যমতে, সেনানায়ককে অবশ্যই তার সামর্থ্যের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে যাতে করে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেন। তিনি কিছু নিয়মকানুনের মধ্যে ধরাবাধা থাকতে পারবেন না।
সেনানায়ক যদি নয়টি ব্যতিক্রমী চিরায়ত কৌশল খুব ভালো ভাবে রপ্ত করতে না পারেন তবে যতই পরিচিত আর সুবিধাজনক জায়গায় তিনি ঘাটি তৈরি করুন না কেন যুদ্ধক্ষেত্র এবং টেরেইনের সুবিধাগুলি তিনি নিজের অনুকুলে করতে পারেবেন না।
চি-লিন এর ভাষ্যমতে, যুদ্ধের পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে একজন সেনানায়কের ভাগ্য পাল্টে যেতে পারে।
সামরিক অভিযানের দিক নির্দেশনার সময় কেউ যদি এই চিরায়ত নয়টি রণকৌশলগুলো কাজে লাগানোর সময় সামরিক কৌশলগুলির সন্নিবেশ ঘটাতে
পারেন তবে তার যদি যুদ্ধ ক্ষেত্র এবং টেরেইনের সেই ‘পাঁচটি সুবিধা জানাও থাকে তবুও তিনি তার সৈন্যদেরকে যথাযথ উপায়ে কাজে লাগাতে পারবেন না।
চি-লিন এর ভাষ্যমতে, এখানে পাঁচটি চিরায়ত ব্যতিক্রমধর্মী কৌশল হল:
এক. একটা রাস্তা, সেটা অল্প দূরত্বেরও হতে পারে; সেটা অনুসরণ করা যাবে না যদি সেখানে কোন বিপদ আছে বলে সন্দেহ হয়।
দুই, একজন সৈন্য, যদি আক্রমণিত হয়েও থাকে তবুও শত্রুকে পাল্টা আক্রমণ করা যাবে না যখন সে জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে থাকে।
তিন. একটা শহর, জনশূন্য এবং আক্রমণিত হওয়ার আশংকা থাকলেও, সেখানে আক্রমণ করা যাবে না সেখানে মূল্যবান সম্পদ থাকলেও সেখানে অনিয়মিত সৈন্য বাহিনী দ্বারা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা করলেও আক্রমণ করা যাবে না। এর মানে হল সেনারা তাদের নেতার প্রতি অনুগত এবং বিজ্ঞ নেতাদের পরিকল্পনাগুলো সবসময় অসংঙ্গায়িত হয়ে থাকে।
চার. একটা ভূমি, অনেক ছোট হতে পারে, সেখানে যুদ্ধে জড়ানো যাবে না যদি তারা সেটা দখলও করে ফেলে; কারণ সেখানে প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে, অথবা হতেও পারে সেটা দখল করে তার কোন লাভ হল না। কিন্তু সেখানে যুদ্ধে জড়ানো মানে পাল্টা আক্রমণের তোপে পড়তে পারেন এবং পরে ভুগতে হবে।
পাঁচ. সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ, সেটা মান্য করা বলে উচিত মনে হলেও মান্য করা যাবে না, যদি সেনানায়ক বুঝতে পারেন যে এটার মধ্যে রাজধানী থেকে কোন ভুল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এই পাঁচটি শর্ত অবশ্যই মেনে চলতে হবে যেহেতু এগুলো দৃষ্টিগোচর হবেই এবং পরিস্থিতির কারণে সেগুলো সামনে আসবেই, এবং সেগুলো আগে থেকে নিশ্চিত করা যাবে না। আর এই কারণেই, বুদ্ধিমান সেনানায়ক তার কর্ম সম্পাদনের সময় অবশ্যই অনুকূলে এবং প্রতিকূলে থাকা বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবেন।
সাও সাও এর ভাষ্যমতে, তিনি সুবিধাগুলির মধ্যে থাকা বিপদগুলোকে এবং বিপদের মধ্যে কোন সুযোগ থাকলে সেগুলোকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন।
অনুকূলে থাকা সুযোগগুলো নেয়ার মাধ্যমে তিনি পরিকল্পনাটাকে কার্যকরের আরও সহজ করে তুলবেন; প্রতিকুলে থাকা সুবিধাগুলো নিজের করে নেয়ার মাধ্যমে তিনি বিপত্তিগুলোকে সহজ করে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসবেন।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুর থেকে যদি কোন সৌভাগ্য পেতে চান তবে আপনাকে সৌভাগ্যটাকে শুধু সুযোগ ভাবলেই হবে না; সৌভাগ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে এটাও মনে রাখতে হবে যে শত্রুর দ্বারা আপনারও ক্ষতি হতে পারে।
হো ইয়েন-সি এর ভাষ্যমতে, সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য উভয়ই পাশাপাশি সহাবস্থান করে। একটা অপরটার পরিপূরক।
যিনি দু-প্রতিবেশির মাঝে ঝগড়া বিবাদের সমাধান করতে যান তিনিও সেখানে আহত হতে পারেন।
চি-লিন এর ভাষ্যমতে, শত্রুর কোন ক্ষতি করার পরিকল্পনা শুধুমাত্র একটা পদ্ধতিতেও কার্যকর নাও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে তার পারদর্শী এবং প্রতিভাবান সঙ্গীরা তার পরিকল্পনার বিরোধীতা করতে পারে। এর কারণ হল তিনি ভালোভাবে পরিকল্পনাটা প্রণয়নে যোগ্য উপদেষ্টা নিয়োগ দেননি। অথবা তিনি কোন বিশ্বাসঘাতককে পাঠিয়েছেন। অনেক সময় ধূর্ত লোক পাঠালে সে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের থেকে আপনাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। অথবা এমন অনেক দুত আছে যারা রাজ্যের জনগণকে তাদের সম্পদ পাঠানো বন্ধ করে দিতে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। অথবা আপনাকে দিয়ে সুন্দরী কোন রমনি হরন করাবে যাতে আপনার সম্মানহানী ঘটে।
.
৩
শত্রু আপনাকে একাধারে বিজিত হতে সুযোগ দিতে থাকবে এবং আপনাকে একের পর এক সুযোগ সামনে এনে দেবে। সকল যুদ্ধের একটা নিজস্ব মতবাদ আছে, কখনও মনে করা যাবে না যে শত্রু আপনার পেছনে আসছে না, বরং সচেতন থাকতে হবে যেকোন সময় শত্রুর সাথে সংঘর্ষ হতে পারে। সে জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, এমনটা মনে করা যাবে না যে, তারা আর আক্রমণ করবে না, বরং সবসময় যাতে বিজিত হতে পারেন সেজন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
হো ইয়েন-সি এর ভাষ্যমতে, রাজা অউ এর যুদ্ধ কৌশল’ বলছে: ‘পুরো পৃথিবীর মানুষ যখন শান্ত, নিশ্চয়ই কেউ একজন তার বগলের নিচে একটা তরবারি প্রস্তুত রেখেছে।’
.
৪
সানজুর মতে, পাঁচটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো একজন সেনানায়কের চরিত্রে থাকাটা খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
এক, তিনি যদি একগুয়ে স্বভাবের হন, তবে তিনি মারা পড়বেন; দুই. যদি ভীতু হন, তবে ধরা পড়বেন; তিন. যদি বদমেজাজি হন, তবে নিজেই নিজের বোকামির ফাঁদে পড়বেন;
চার. যদি সম্মানের প্রশ্নে বেশি দুর্বল হোন, তবে সম্মানের প্রশ্নে তিনি চূড়ান্ত পরিণতি বরণ করে নিতেও দ্বিধাবোধ করবেন না;
পাঁচ. যদি অসহিষ্ণু হোন, তবে নিজের ভুলের জন্য নিজেই অপদস্থ হবেন। এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্য একজন সেনানায়কের চরিত্রের অত্যন্ত খারাপ দিক এবং সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিপজ্জনক। একটা সৈন্যদলের সর্বনাশ এবং সেনানায়কের মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে একজন সেনানায়কের এই সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এগুলো নিয়ে তাকে গভীর চিন্তা ভাবনা করতে হবে।