০৭ অধ্যায় – রণকৌশল
সানজু বলেন:
১
সৈন্য নিয়োগ দেয়ার সময় সেনানায়ক প্রথমে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ পান। তিনি সৈন্য জড়ো করেন এবং দেশের জনগণের কাছ থেকে সমর্থন আদায় করেন। তিনিই সৈন্যদেরকে প্রশিক্ষিত এবং উজ্জীবিত করে একত্রিত করেন এবং তাদেরকে শিবির অনুযায়ী ভাগ করে দেন।
লি চুয়ান এর ভাষ্যমতে, সেনানায়ক সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের হুকুম পেলে টেম্পল কাউন্সিলের আর্শিবাদ বার্তাসহ সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বর্গীয় আদেশ কার্যকরের উদ্দেশ্যে শত্রুকে শাস্তি দিতে যাত্রা শুরু করেন।
যুদ্ধে রণকৌশলের মত কঠিন দ্বিতীয় কোন কাজ নেই। রণকৌশলের যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি কঠিন তাহল শত্রুর কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ রাস্তা খুঁজে বের করা এবং দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্যে পরিণত করা। সেজন্য পথে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে শত্রুকে আপনার পেছনে আসার সুযোগ করে দিন। তারপর কিছুদূর গিয়ে হঠাৎই ফিরে আসুন শত্রুকে চমকে দিয়ে আক্রমণ করুন। সৈন্যরা এই কৌশলটা সহজেই বুঝতে পারবে।
সাও সাও এর ভাষ্যমতে, শত্রুকে বুঝান আপনি অনেক দূরে। তার যাত্রা করার পরে আপনি যাত্রা করুন এবং তার পরিকল্পনা মাফিক নির্দিষ্ট জায়গায় তার আগেই আবির্ভূত হোন কারণ দূরত্ব কতটুকু তা অনুমান এবং হিসেব করে আপনি আগে থেকেই বলতে পারেন।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, যিনি এই কৌশলের সুযোগটাকে নিজের অনুকূলে করতে চান তিনি কঠিন কোন রাস্তা বেছে নেন এবং সেখানে যাওয়ার জন্য সহজ কোন উপায় খুঁজে বের করে নেন। দূর্ভাগ্যকে তিনি সৌভাগ্যে রুপান্তরিত করেন। তিনি শত্রুকে দেখাবেন যেন তিনি দেরি করছেন কিন্তু হঠাৎই দ্রুতগতিতে শত্রুর দিকে ধাবিত হবেন।
.
২
সুযোগ এবং বিপদ উভয় বিষয়ই রণকৌশলের উপর নির্ভর করে।
সাও সাও এর ভাষ্যমতে, দক্ষ যোদ্ধা এই কৌশলের সুবিধাটা পাবেন; আর যদি তা না পারেন তবে তিনি বিপদে পড়বেন।
যিনি পুরো সৈন্যবাহিনী একটা সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে ধাবিত করেন তবে তিনি যেন হেরে গেলেন। যদি তিনি সুযোগটা নেয়ার জন্য শিবির ছেড়ে বেড়িয়ে যান তবে আগে যা জমা করেছিলেন তার সবটাই লুট হয়ে যাবে।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, কেউ যদি জমাকৃত সম্পদ নিয়ে বের হন তবে তার এগুনোর গতি নিশ্চিতভাবে কমে যাবে আর এর কারণে তিনি সুযোগটা হারাবেন। যদি তিনি ভারি জিনিসপত্র রেখে যান এবং সেগুলো পাহাড়ায় অল্প কিছু সৈন্য রেখে যান তবে তার মনে আতঙ্ক থাকবে হয়তো সেগুলো তিনি হারাতে পারেন।
যদি এমনটা হয়ে থাকে যে কেউ দ্রুত অস্ত্র তৈরি করে দিন রাত একহাজার লি যাওয়ার জন্য যাত্রা করল তবে সেখানে যদি তিনজন কমান্ডারও থাকে তবুও তার ধরা পড়বে। সবচেয়ে তেজস্বী সৈন্যরা আগে পৌঁছুবে আর দুর্বলরা সেখানে পৌঁছার জন্য রাস্তায় খাটা খাটুনি করেই যাবে, এই পদ্ধতি অবলম্বনের কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে মাত্র দশভাগের একভাগ সৈন্যই এসে পৌঁছুতে পারবে।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত একজন সৈন্য দিনে ত্রিশ লি পর্যন্ত যেতে পারে। দ্রুত গেলে ত্রিশলি এর দ্বিগুণ যেতে পারে যেটা হল দ্বিতীয় পর্যায়। আপনি যদি দিন-রাত যেতে থাকেন তবে একশ লি পর্যন্ত যেতে পারবেন। আর যদি এই উপায়ে যেতে থাকেন তবে সৈন্যরা অবশ্যই আটক হতে বাধ্য। সানজু যখন এমনটা বলেছেন, তখন এর মানে দাঁড়ায়, যদি এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তবে দশজনে মাত্র একজনই গন্তব্যে পৌঁছুতে পারবে। তিনি বলতে চেয়েছেন, যখন আর কোন উপায় থাকবে না এবং আপনাকে অবশ্যই সুযোগটা পাওয়ার জন্য এগিয়ে যেতে হবে, আপনার সৈন্যদের মধ্যে সবচেয়ে তেজস্বী দশজন সৈন্যকে খুঁজে বার করুন যারা প্রথমে যাবে আর বাকিদেরকে নির্দেশ দেবেন তাদেরকে অনুসরণ করতে। আর এভাবে আপনি দশহাজার সৈন্যের মধ্যে এক হাজার সৈন্যকে বেছে নিলেন যারা খুব ভোরে পৌঁছুবে এবং বাকিরা একের পর এক পৌঁছুতে থাকবে, কেউ সকালের শেষের দিকে, কেউ কেউ দুপুরে, যাতে করে কেউই বিরক্ত না হয় এবং সময়মত সকলে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে যাবে। তাদের চলার গতি কোনভাবেই থেমে যাবে না। সুযোগটা পাওয়ার জন্য অবশ্যই কৌশলগতভাবে কঠিন একটা কাজ হতে যাচ্ছে। তবুও তেজস্বী ঐ এক হাজার সৈন্য সেখানে শত্রুকে প্রতিরোধ করতে যথেষ্ট। আর ততক্ষণে বাকি সৈন্যরা সেখানে এসে পৌঁছে যাবে।
পঞ্চাশ লি এগিয়ে যাওয়ার জন্য মার্চ করলে, সৈন্য কমান্ডারই পেছনে পড়ে যাবেন, আর এই পদ্ধতিতে মাত্র অর্ধেক সৈন্যই যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছুবে। ত্রিশ লি এগিয়ে যাওয়ার জন্য মার্চ করলে, দুই-তৃতীয়াংশ সৈন্য পৌঁছুতে পারবে। এই পদ্ধতি অনুসরণে সৈন্যরা ভারী অস্ত্র-সস্ত্র, শিবিরের সরঞ্জামাদি, খাবার এবং গচ্ছিত ধন-সম্পত্তি হারাবে।
লি চুয়ানের ভাষ্যমতে, যুদ্ধে শস্যকনা এবং খাদ্য লোহার তৈরি সুরক্ষা দেয়ালের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী।
যারা চলার পথের পাহাড়, বন, ঝুঁকিপূর্ণ গিরিখাত, জলাভুমি এসব পেরিয়ে যাবার কৌশলগুলি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকবেন তাদের এগিয়ে যাওয়ার গতি এমনিতেই বহুলাংশে কমে যাবে। যারা যুক্তিযুক্ত উপায় খুঁজে বের করতে পারবেন না তারা এই রকম জায়গাতে সেখান থেকে সুবিধা আদায় করে নিতে পারবেন না।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, কান’জু বলেন: ‘সাধারণত, মার্চ করার আগে কমান্ডারের হাতে অব্যশই একটা মানচিত্র থাকবে যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার বিপদগুলি সম্পর্কে অবহিত হবেন। আর এর মাধ্যমে রথ এবং ঘোড়া সওয়ারেরা চলার পথের পানির গভীরতা এবং রাস্তার খানা-খন্দ জেনে নিরাপদে এগিয়ে যেতে পারে। সৈন্যরা যাতে ওয়াগনগুলো যাওয়ার সময় পাহাড়ের ঢাল, নদীর গভীরতা, পাহাড়ি জমি, বন-জঙ্গল, রাস্তার দুরত্ব, পথিমধ্যে শহরগুলোর আয়তন ইত্যাদি সহজেই পেরিয়ে যেতে পারে। এই সব কিছুই তাকে জানতে হবে। সেনানায়কের মাথায় এই সব কিছুর স্বচ্ছ ধারনা থাকতে হবে; আর এসব করতে পারলেই সেনানায়ক এই সব জায়গার সুবিধাগুলি ব্যবহার করতে পারবেন।
লি চিং বলেন: ‘…আমাদেরকে সবচেয়ে সাহসি অফিসার নির্বাচন করতে হয়েছে এবং যিনি বুদ্ধিসম্পন্ন এবং স্থানীয় পথ পরিচালকদের সাহায্য নিতে হয়েছে যাদের মাধ্যমে গোপনে পাহাড়ে এবং বনের ভেতরে নিঃশ্বব্দে এগিয়ে গেছি, নিজেদের কোন পদচিহ্ন পর্যন্ত রাখিনি।
.
৩
এখনকার যুদ্ধের ভিত্তি হলো প্রতারণা। তাই সুযোগ বুঝে এগিয়ে যান এবং পরিস্থিতি বুঝে পরিকল্পনা পরিবর্তন করুন এবং শুধুমাত্র সৈন্যদের প্রতি মনোযোগ দিন। যখন এগিয়ে যাচ্ছেন তখন বাতাসের ক্ষিপ্রতায় আগান; ঘন বনের সাথে মিশে যান; যখন শত্রুর উপর আঘাত হানবেন তখন আগুনের মত তেজ্বদ্বীপ্ত হোন; যখন প্রতিরোধ করবেন তখন পাহাড়ের মত অটল থাকুন। আপনার পরিকল্পনা হবে আকাশের কালো মেঘের মত রহস্যময় আর যখন এগুবেন তখন বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে যান।
লুটের সময় আপনার সৈন্যদেরকে ভাগ করে দিন যাতে সব লুট কম সময়ে নিয়ে আসতে পারে আর যা লুট হবে সেগুলো তাদের মধ্যে বিলি করে দিন। আগে ভালো করে পরিস্থিতির অবলোকন করুন, তারপর এগিয়ে যান।
.
৪
যিনি ডিরেক্ট এবং ইনডিরেক্ট অ্যাপ্রোচের কৌশলগুলি ভালো করে রপ্ত করেন, তিনিই জয়ী হন। এগুলিই হল যুদ্ধের রণকৌশল।
দ্য বুক অব মিলিটারি অ্যাডমিনিস্ট্রিশন বলছে: ‘যুদ্ধের ময়দানে যেহেতু কারও কথা শোনা যায় না তাই ড্রাম ও ঘন্টা ধ্বনির ব্যবহার করা হয়। আবার একই দলের সৈন্যরা যেহেতু একজন আরেকজনকে দেখতে পায় না তাই পতাকা ও ব্যানার ব্যবহার করা হয়। এখন জোর ধ্বনি এবং ড্রামের শব্দ, ব্যানার আর পতাকা এসব ব্যবহার করে সৈন্যদের মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে হয়। কোন সাহসি সৈন্য একাকি এগিয়ে যাবে না, আবার ভীতুরাও একাকি পালানোর চেষ্টা করবে না, সবাই একত্রে আগাবে বা পেছাবে। এটাই হল বড় সৈন্যদের পরিচালনা কৌশল।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, সামরিক আইন আছে: যখন এগিয়ে যেতে হবে তখন যদি থেমে যান এবং থেমে যাওয়ার সময় তখন যদি এগিয়ে যান তবে তাদের শিরোচ্ছেদ নিশ্চিত।
অউ চি একবার চিন রাজ্যের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে, সেখানে তার একজন একগুয়ে অফিসার ছিলেন। তিনি এতটাই অস্থির হয়ে পড়েছিলেন যে আক্রমনের জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। নির্দেশের অপেক্ষা না করে তিনি আক্রমণে গিয়ে দুজন শত্রু সৈন্য হত্যা করে ফিরে এলেন। অউ চি ফরমান জারি করে তাকেই হত্যা করে ফেললেন।
আর্মি কমিশনার তাকে সতর্ক করে বললেন: সে তো প্রতিভাবান একজন অফিসার ছিল; তাকে হত্যা করাটা ঠিক হয়নি। অউ চি জবাবে বললেন: “আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সে অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন অফিসার আমি নিশ্চিত কিন্তু এর পাশাপাশি সে অবাধ্যও ছিল।
একারনেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
সানজুর মতে, রাতের যুদ্ধে যতবেশি সম্ভব মশাল এবং যুদ্ধের ড্রামাডোল ব্যবহার করুন, দিনের বেলায় যুদ্ধ হলে ব্যানার আর পতাকা ব্যবহার করে নিজেদের সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করুন।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, বিশাল সৈন্যবাহিনী গুলো ছোট ছোট দলেরই সমষ্টি, আর তাই সামনে, পিছনে, ডানে, বায়ে, সৈন্যদের আলাদা-আলাদা শিবির থাকে। আর এগুলো এমনভাবে বসানো হয় যে কমান্ডার ইন-চিফের শিবির থাকে একেবারে মাঝখানে। আর সৈন্যদের শিবিরগুলো চারিদিক থেকে বৃত্তের মত ঘুরে বসানো হয়। কয়েকটা কোনায় এত শক্ত শিবির গড়ে তোলা হয় যেন প্রত্যেকটা পি লেই এর মত একটা সমাবেশ।
একটা শিবির থেকে আরেকটার দূরত্ব পঞ্চাশ থেকে একশ পা এর বেশি নয়। মাঝের রাস্তাটা এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে করে সৈন্যরা সেখানে মার্চ বা প্যারেড করতে পারে। শিবিরগুলোর প্রবেশমুখ এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে করে এক শিবির অন্য শিবিরকে তীর ধনুক এবং বল্লম ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করতে পারে।
চারটা শিবিরের দুটো রাস্তা যেখানে ক্রস করে সেখানে একটা ছোট দুর্গ গড়ে তুলে তার মাথায় একটা মশাল জ্বালানো হয়। দুর্গের ভেতরে গোপন সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়। দুর্গের মাথায় মই দিয়ে উঠতে হয় যেখানে আবার সৈন্যদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার ব্যবস্থা থাকে। অন্ধকারে যদি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে কেউ যুদ্ধের ডামাডোল শুনে তবে সে ঐ চার শিবিরের মধ্যকার মশালটি জ্বালিয়ে জাগিয়ে তুলে। আর রাতে আক্রমণ করতে হলে শত্রুদেরকে কোন না কোন প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকতে হবে যেখানে ছোট ছোট শিবির থাকে যাদের নিজস্ব শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকে এবং উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম কোন দিক থেকে আক্রমণ করবে শত্ৰু সেটা বুঝতেই অনেকটা সময় লেগে যাবে।
কমান্ডার ইন-চিফ অথবা কোন সৈন্য শিবির আক্রমণের খবর যেই পাবে শত্রুকে ভেতরে ঢুকতে দেবে; সৈন্যরা তারপর ড্রামের শব্দ করলে সব শিবির থেকে শব্দের প্রতিত্তের দেবে। সব দূর্গগুলোর মশাল জ্বালিয়ে দিনের মত আলো সৃষ্টি করা হয়। পাশাপাশি সৈন্য-অফিসাররা প্রবেশ দরজা বন্ধ করে দেয় এবং একদল সৈন্য চারিদিক থেকে পাল্টা আক্রমনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। চারিদিক থেকে তীর-ধনুক এবং বল্লম ছোঁড়া হয় শত্রুদের টার্গেট করে।
তবে আমাদের সবচেয়ে ভাববার বিষয় হল শত্রুরা কখনও রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করে না, যদি সে জানে যে আক্রমণ করলে পরাজয় নিশ্চিত।
কমান্ডার যদি সৈন্যের সাহসিকতার প্রশংসা না করেন, তবে একজন সৈন্যের তেজস্বীতা মন্থর হয়ে যেতে পারে।
হো ইয়েন-সি এর ভাষ্যমতে, অউ চি বলেন: ‘লক্ষ সৈন্যের সামরিক তেজস্বীতা নির্ভর করে শুধুমাত্র একজন মানুষের উপর। তিনিই হলেন তাদের তেজদ্বীপ্তির একমাত্র চাবিকাঠি।
মেই ইয়াও চেন এর ভাষ্যমতে, যদি একজন সৈন্য তার সাহসিকতার পুরস্কার না পায়, তাহলে যেন কমান্ডার ঐ সেনার হৃদয়ের মালিকানাও হারালেন।
চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, হৃদয় হল সৈন্যের এমন একটা জিনিস যার দ্বারা কমান্ডার তার উপর আধিপত্য করতে পারে। আর তাই আদেশ পালন করবে নাকি সন্দেহ পোষণ করবে, সাহসিকতা প্রদর্শন করবে নাকি কাপুরুষের মত পালাবে এই সবকিছুই একজন সৈন্যের মনোবলের উপর নির্ভর করে। এ কারনেই বিচক্ষণ সেনানায়ক সৈন্যদের হৃদয় জয় করে শত্রুর বিরুদ্ধে তাকে যেতে উৎসাহিত করেন। সে যুদ্ধক্ষেত্রে এমন ভাব করবে যেন শত্রু তার সম্পর্কে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে এবং শত্রুকে ভাবতে শুরু করায় যেন তার প্রতিপক্ষ অত্যন্ত ভয়ানক। এভাবেই সে তার শত্রুর মন চুরি করে এবং পাশাপাশি তার সমস্ত শক্তিও।
সকালের দিকে সৈন্যদের তেজস্বতা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ থাকে, দুপুরের দিকে ঝিমিয়ে পড়ে এবং সন্ধার দিকে তাবুতে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আর তাই যারা বিচক্ষণ যোদ্ধা তারা শত্রুর তীক্ষ্ণ তেজস্বীতার সময় তাকে এড়িয়ে যান, যখন শত্রুর মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে তখন তাকে আক্রমণ করে এবং তারপরই তার সৈন্যরা ঘরে ফিরে যেতে চায়। এটাই হল সৈন্যের মনোবল নিয়ন্ত্রণ করা।
প্রবল আক্রমণাত্নক সময়ে দক্ষ যোদ্ধারা বিশৃঙ্খল শত্রুর জন্য অপেক্ষা করে; বিশ্রামের সময় শত্রুদের নিজেদের মধ্যে গোলযোগের সুযোগ খুঁজে। এটাই হল সৈন্যদের মানষিকতার সক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, দৃঢ় মনোবলের সময় সৈন্যরা শত্রুর বিশৃঙ্খলা দেখে ঘাবড়ে যায় না।
যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি শত্রুর আসার জন্য অপেক্ষা করুন; সেক্ষেত্রে আপনার জিরিয়ে নেয়া সৈন্যরা ক্লান্ত শত্রুর সাথে ভালোভাবে খাবার সেরে নেয়া সৈন্যরা ক্ষুধার্ত শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবে। এটাকে বলা হয় সৈন্যদের শারীরিক সক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ।
সুদক্ষরা কখনই গোছানো শত্রুর আগে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না, তাদের যত ভালো প্রস্তুতি থাকুক না কেন। এটাই হল পরিস্থিতির প্রয়োজনে পরিকল্পনার পরিবর্তনের সক্ষমতা।
.
৫
সৈন্য সাজানোর উপায় হল, যখন শত্রু উঁচু পাহাড়ে আছে তখন তার সামনাসামনি যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়া; শত্রুর পেছন দিক থেকে সরে যাওয়ার সময় তার প্রতিরোধ না করে বরং আক্রমণ করতে হবে। শত্রু যখন পেছনে সরে যাওয়ার ভান করে, তখন তার পিছু নেয়া যাবে না। শত্রুর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ বাহিনীকে আক্রমণ করা যাবে না। সবগুলো টোপ একসাথে দেয়া যাবে না।
মেই ইয়াও-চেন এর ভাষ্যমতে, যে মাছ টোপ একসাথে গিলে নেয় সেই ধরা পড়ে; টোপ হিসেবে সব সৈন্যকে একসাথে পাঠালে পরাজয় নিশ্চিত।
চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, ‘তৃমাত্রিক কৌশল’ বলছে: প্রয়োজনের অপ্রতুল টোপ খেয়ে ফেললে সেই মাছই ধরা পড়বে।
তাবুতে ফিরে যাওয়ার সময় শত্রুকে বাধা না দেয়াই ভালো। চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলা শত্রুকে পালিয়ে যাবার জন্য একটা পথ খোলা রাখতে হবে।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, তাকে বুঝতে দিন যেন একটা রাস্তা তার সামনে রয়েছে, এবং তার মধ্যে এই ভাবনার সৃষ্টি হতে দিন যেন মৃত্যু ভিন্ন অন্য একটা পথ তার সামনে খোলা আছে। তার এই ভাবনার ফলে তার মধ্যে যে রিল্যাক্স তৈরি হবে সেই সময়ই আক্রমণ করুন।
শত্রু যাতে কোন উপায়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
তু-ইউ এর ভাষ্যমতে, প্রিন্স ফুঁ চিয়া বলেন: বন্য পশু যখন সামনে নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে পায়, তখন সে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আর এটা একজন মানুষের বেলায়ও সত্য! যদি তারা বুঝতে পারে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল যুদ্ধ করা, তবে তারা প্রবল আক্রমণ করবে।
হান সমাট সুয়ার এর আমলে, চাও চুয়াং-কু বিদ্রোহি গোষ্ঠী চিয়াংদের দমন করতে গেলে চিয়াং উপজাতিরা দেখল তাদেরকে দমনে বিশাল সৈন্যবাহিনী আসছে। তারা তাদের ভারি সব জিনিসপত্র ফেলে গিয়ে ইয়েলো নদীর কিনারায় দুর্গ গড়ে তুলল। সৈন্যদের এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে রাস্তাগুলো ছিল খুবই ক্ষীণ। আর তাই চুয়াং কার্ডিনাল তার সৈন্যদেরকে ধীরে সুস্থে ক্ষীণ রাস্তা দিয়ে পাঠাতে লাগলেন।
কেউ একজন বলে উঠল: আমাদের প্রচুর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমাদের এগুনোর গতি অত্যন্ত ধীর।
চুয়াং-কু জবাবে বললেন: ‘বিদ্রোহিরা এখন উন্মত্ত হয়ে আছে। আমি তাদেরকে আর নাড়াতে চাই না। যদি তাদেরকে এমনটা বুঝতে দেই যে তাদের যুদ্ধ ছাড়া আর কোন উপায় নেই তবে তারা কোন দিক তাকাবে না। মৃত্যু পর্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে তারা যুদ্ধে লিপ্ত হবে।
সব জেনারেলরাই একসাথে বলে উঠলেন: ‘অসাধারণ কৌশল! এগুলোই হল সৈন্য পরিচালনার বিচক্ষণ কৌশল।