০৪ অধ্যায় – রণকৌশলগত বিন্যাস
১.
সানজু বলেন:
আদিকালের সুদক্ষ যোদ্ধারা প্রথমে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে তারপর শত্রুর দুর্বল কোন জায়গায় আঘাত হানার জন্য সুযোগ খুঁজতে। অপরাজেয়তা একজনের উপরই নির্ভর করে; শত্রুর দুর্বলতাকে যিনি নিজের কাজে লাগাতে পারেন। বলা হয়ে থাকে, যাদের যুদ্ধ সম্পর্কে সুনিপুন জ্ঞান আছে তারাই অপরাজেয়। এমনটা নয় যে তারা শত্রুর দুর্বলতার কারনে সবসময় অপরাজেয় হয়েছে।
মেই ইয়াও চেন এর ভাষ্যমতে, নিজের সৈন্য সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা থাকলে সেটা আমি পুষিয়ে নিতে পারবো; কিন্তু শত্রুর সৈন্য সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকলে সেখানে জয় পরাজয় অনিশ্চিত।
আর তাই বলা হয়ে থাকে যে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী জানে কিভাবে জিততে হবে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সব কিছু করা সবসময় করা যায় না। অপরাজেয়তা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করে; আর জয় নির্ভর করে আক্রমণের উপর। পর্যাপ্ত শক্তি না থাকলে তখনই কেউ প্রতিরোধ করে; আর যখন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সামর্থ্য থাকে তখনই আক্রমণ করে। দক্ষ প্রতিরোধকারীরা নিজেদেরকে গোপন করে রাখে, পারলে পৃথিবীর সাত স্তরের নীচে; যারা আক্রমণে দক্ষ তারা সাত স্বর্গ থেকেও চলে আসেবে আক্রমণ করার জন্য। এভাবে তারা নিজেদেরকে আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় আর জিতেও যায়।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, যারা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজাতে দক্ষ তারা মাথায় রাখে পাহাড়, নদী, আর চলার পথে উঁচু ঢিবিগুলোকে শত্রু থেকে প্রতিরক্ষা পেতে কাজে লাগায়। কোথায় আক্রমণ করতে হবে সেটা শত্রুদের জানার অসম্ভব করে তোলে। তারা নিজেদেরকে মাটির সাথে লুকিয়ে রাখে।
যারা আক্রমণে দক্ষ তারা মাথায় রাখে যে বর্তমানের ঋতুগত পরিবেশ এবং ভূমির সুবিধাটা গ্রহণ করে; পরিবেশ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে আগুন জ্বালায়। তারা এমনভাবে আক্রমণ করে যেন আকাশ থেকে অগ্নিগোলা বিক্ষিপ্ত হচ্ছে।
.
২.
সানজুর মতে, শুধুমাত্র জয়ী হওয়াই দক্ষতার সর্বোচ্চ পরিচয় নয়।
লি চুয়ান এর ভাষ্যমতে, হান সিং চাও রাজ্য দখল করে সকালের নাস্তা না সেরই ওয়েল এর দিকে রওয়ানা দেন। তিনি বলেন: ‘চাও সৈন্যদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে তারপরেই খাবার গ্রহন করব।’ জেনারেল সকলে তার সাথে একমত হওয়ার ভান করল। তর্জন গর্জন ছড়িয়ে তার সৈন্যরা নদীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। চাও সৈন্যরা নদীর অন্যপাড়ে থেকে কোন প্রস্তুতি না নিয়ে হান সিং সৈন্যদের কার্যক্রম দেখে হাসতে থাকল। তাদের দিকে তিরস্কারও করল: ‘হান সিংয়ের সেনানায়করা জানে না কিভাবে সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করতে হয়!’ তারপরই হান সিং সৈন্যরা চাও রাজ্য আক্রমণ করে লর্ড চেংএন কে হত্যা করে রাজ্য দখল নেয়।
যুদ্ধে সফল হওয়া এবং সার্বজনীনভাবে একজন সুদক্ষের খেতাব পাওয়া কিন্তু দক্ষতার সর্বোচ্চ শিখর নয়; চাঁদ আর সূর্যের মধ্যে পার্থক্য করতে পারাটা কিন্তু ভালো দেখতে পাওয়ার পরিচয় নয়; বর্জ বিদ্যুতের শব্দ শুনতে পারাটাও শোনার ক্ষমতা বেশি বলা যায় না। আদিকালে যাদেরকে যুদ্ধে পারদর্শি বলা হতো তারা কিন্তু আসলেই খুব সহজেই শত্রু বিনাশ করতে পারতো। আর তাই বিজিতরা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে, তার বুদ্ধিমত্তার খ্যাতির জন্য নয়।
তু-মু এর ভাষ্যমতে, কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আগেই যুদ্ধ জয় করা হয় এমন একটা ব্যাপার যা সাধারনেরা কখনও কল্পনাও করে নি। এভাবে বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারকারীরা কখনও খ্যাতি পাওয়ার প্রতি দৃষ্টিও রাখে না। এমন কোন কৌশল অবলম্বন করে যেখানে সে অস্ত্র রক্তাক্ত করার আগেই শত্রুর রাজ্য দখল হয়ে যায়।
হো ইয়েন সি এর ভাষ্যমতে, যখন আপনি শত্রুকে কোন প্রকার সম্মুখ যুদ্ধ না করেই দমন করেন কেউ আপনার সাহসিকতার প্রশংসা করবে?
তিনি বলেন, কোন ভুল না করলে যুদ্ধ জয় সহজ হয়ে যায়। ‘কোন ভুল না করা’ বলতে সেনানায়ক যা যা করেছে তার সবগুলো কৌশলই যুদ্ধের সামান্য হলেও সুফল এনে দিয়েছে এমনটা বোঝানো হচ্ছে; আর ইতোমধ্যে সে শত্রুকে দমন করে ফেলেছে।
চিয়েন হাউ এর ভাষ্যমতে, পরিকল্পনা ছাড়া অপ্রয়োজনে একটা পা ও ফেলবেন না; কৌশল ছাড়া একটা পদক্ষেপও নেয়া যাবে না।
আর তাই দক্ষ কমান্ডার এমন ভাবে সৈন্য সাজাবেন যেখানে তার পরাজয়ের কোন সম্ভাবনা থাকে না আর সুযোগ পেলে সেটা শক্রর বিরুদ্ধে যথাযথ কাজে লাগাবে। এভাবে একটা সৈন্যদল যুদ্ধের আগেই বিজয় লাভ করে;
তু-মু এর ভাষ্যমতে, ওইয়ের ডিউক লি চিং বলেন: ‘এখনকার দিনে, সেনানায়ক হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো একেবারে পরিস্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে, তার মিত্রদের সাথে একতা বজায় রাখা, একটা অত্যন্ত বুদ্ধিসম্পন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয়া সামনের অনেকগুলো পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে, ঋতু বৈচিত্রের পরিস্থিতি বুঝতে পারা এবং মানবিক ব্যাপারগুলো বুঝতে পারার সক্ষমতা, এই সবকিছুই থাকতে হবে তার। একজন সেনানায়ক তার সৈন্যদের সক্ষমতা অনুমাণ করতে না পারা অথবা উপযুক্ত সুযোগ গ্রহণ করতে না পেরে ভুল সময়ে আক্রমণ করে বসা অথবা আক্রমণ করতে দ্বিধা করা, মনোযোগ দিয়ে বায়ের কথা ভুলে যাওয়া অথবা তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা সাজাতে ব্যর্থ হওয়া যাবে না। হাস্যকর হলেও সত্য, সে অবিশ্বাস্য খবরের বিশ্বাস করে বিচলিত হয়ে পড়ে। পরে তার দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবে নাকি বিরতি দেবে এমন বিচলিত হয়ে পড়ে। এমন কাজ করা আর কিছু নিষ্পাপ লোককে আগুনে নিক্ষেপ করার মধ্যে কি পার্থক্য আছে? এটা কি ঠিক এমন নয় যে গরু আর ভেড়াগুলোকে হায়েনা বা বাঘের খাবার হওয়ার জন্য সেদিকে তাড়িয়ে দেয়া?’
যারা যুদ্ধ সম্পর্কে সুনিপুন তারা যুদ্ধের সকল নিয়মগুলো মান্য করেন। আর এর কারনেই তারা যুদ্ধের পরিকল্পনাগুলো কার্যকর করতে সক্ষম হন।
.
৩.
সানজুর মতে, আর্ট অব ওয়ারের উপাদানগুলো হল: প্রথমত, যুদ্ধক্ষেত্রের পরিমাপ; দ্বিতীয়ত, সৈন্যের পরিমানের অনুমান; তৃতীয়ত, হিসাব করে প্রতিটা পদক্ষেপ নেয়া; চুতর্থত, শত্রুর সাথে শক্তির তুলনা; পঞ্চমত, যুদ্ধে জয়ের সুযোগ।
জায়গার পরিমাপ যথাযথ যুদ্ধক্ষেত্রের ভূমি পরিমাপ থেকে উদ্ভূত। সৈন্যের পরিমাপ কথাটি এসেছে সৈন্য সাজানোর গঠন প্রণালি থেকে, তুলনা এসেছে। গঠন প্রণালি থেকে আর জয় এসেছে শক্তির তুলনার মাধ্যমে।
হো ইয়েন সি এর ভাষ্যমতে, ‘ভূমি’ শব্দটার মধ্যে দুরত্ব এবং টিরেনের অবস্থার উভয় বিষয়ই জড়িত; ‘পরিমাপ’ হল হিসাব করে পদক্ষেপ নেয়া; সৈন্যদের আক্রমণে পাঠানোর আগে, শত্রুর এলাকায় জায়গাটার মধ্যে কি কি অসুবিধা হতে পারে তার হিসাব করে ফেলা; রাস্তার দিকগুলোর হিসাব নিকাশ করা; সৈন্যদের পরিমান গুনে ফেলা; যুদ্ধ সরঞ্জামাদির পরিমান জানা এবং তার বর্তমান নৈতিক অবস্থার সম্পর্কে জ্ঞান রাখা ইত্যাদির পরিকল্পনা করা।
এভাবে বিজিত সৈন্যবাহিনী শত ঝামেলার সমাধান করতে পারে; আর পরাজিত বাহিনী শত ঝামেলার সৃষ্টি করে। এমনটা হয়ে থাকে কারণ বিজিত সেনানায়ক তার সৈন্যদেরকে হাটু সমান পানিতেও যুদ্ধ করতে প্রস্তুত করে ফেলে যেখানে তারা হঠাৎ উদ্ভুত সমস্যার সমাধান করতে পারে।
চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, পানির ধর্মই হল নীচু জমিগুলো ডুবিয়ে দেয়া, যখন কোন বাধ ভেঙে যায়, পানি অসম্ভব গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। আর এখন সৈন্যগুলোকে পানির জায়গায় প্রতিস্থাপন করুন; তাদের বিশৃঙ্খলার কার্যগুলোকে সুবিধা হিসেবে গ্রহণ করুন; এমন সময় আক্রমণ করুন যখন সে আক্রমণের প্রত্যাশা করে নি; তার সামথ্য সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করুন এবং তার দুর্বল জায়গায় আঘাত করুন এবং পানির মত কেউ আপনার প্রতিবাদও করার সুযোগ পাবে না।