১২. দীর্ঘ বক্তৃতা তৈরি

১২. দীর্ঘ বক্তৃতা তৈরি

কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কোন পরিকল্পনা ছাড়া বাড়ি তৈরি করেন না, সেক্ষেত্রে কোন রকম তৈরি না হয়ে বক্তৃতাই বা দেবেন কেন?

কোন বক্তৃতার ব্যাপার হল সমুদ্রে ভ্রমণের মত। তাই যিনি কোথা থেকে শুরু করতে হবে জানেন না, তিনি কোথায় পৌঁছবেন তারও ঠিক থাকে না।

নেপোলিয়ন যে কথা একবার বলেছিলেন মনে হয় তা সোনার অক্ষরে বাঁধিয়ে রাখা দরকার। কথাগুলো এই : যুদ্ধ হল এক ধরণের শিল্পবিজ্ঞান, তাই আগে হতে পরিকল্পনা না নিলে সফলতা হবে অসম্ভব।

বক্তৃতা দেবার ব্যাপারটাও অনেকটা তাই। আশ্চর্যের কথা হল বহুক্ষেত্রেই বক্তারা মনে রাখেন না–বা মনে রাখলেও তা কি কাজে লাগান? না, তা লাগান না। এ বিষয়ে অবশ্য নির্ভুল কোন নিয়ম সামনে রাখা সম্ভব নয়, তবে কিছু এমন বিষয় আছে যা আলোচনা করে মনে গেঁথে রাখা যেতে পারে।

১. গোড়াতেই দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করুন

আমি একবার নর্থ ওয়েষ্টার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. লিন হ্যারল্ড হাউকে প্রশ্ন করেছিলাম, বক্তা হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা কি রকম বলে। একটু ভেবে তিনি বলেন : প্রথমেই দরকার আকর্ষণীয় প্রস্তাবনা যাতে শ্রোতাদের চট করে মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। ডঃ লিন একজন বিখ্যাত বক্তা। তিনি যেভাবে সুরু করতেন সেটা একটু দেখা যাক।

কোন ঘটনার উদাহরণ দিয়ে শুরু করবেন

লাওয়েল টমাস ছিলেন একজন খ্যাতনামা সংবাদ বিশ্লেষক, বক্তা, চলচ্চিত্র প্রোডিউসার। তিনি লরেন্স অব অ্যারাবিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে এইভাবে আরম্ভ করতেন :

একদিন আমি জেরুজালেমের ক্রিশ্চিয়ান স্ট্রীটে হেঁটে চলার সময় ঝলমলে প্রাচ্যদেশীয় পোশাক পরিহিত একজন মানুষের দেখা পাই…. তার পোশাকের একদিকে ঝুলছিল বিশাল একখানা তরবারী….।

এরপরেই তিনি ঘটনাটি বর্ণনা করে যান। এভাবে শুরু করলে ব্যর্থতার আশঙ্কা থাকে না। শ্রোতাদের আগ্রহী করে তোলা যায় সহজেই।

যে বক্তা কোন কাহিনীর মধ্য দিয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন, যে কাহিনী তার অভিজ্ঞতা লব্ধ তিনি কখনই ব্যর্থ হন না। যে কোন দীর্ঘ বক্তৃতা করার ক্ষেত্রে এই ধরণের কাহিনী দিয়ে শুরু করলে সহজে সপ্রতিভভাবে এগিয়ে চলা সম্ভবপর হয়। তবে মনে রাখবেন অতি নাটকীয়তা কখনই আনতে চাইবেন না। প্রতিটি শব্দ আর কথা বলার সময় পরস্পর সম্বন্ধ রেখে চলা চাই। কোনভাবেই শ্রোতাদের বিরক্তি উৎপাদন করতে চাইবেন না।

তাৎক্ষণিক বক্তৃতা আর সেই তুলনায় দীর্ঘ বক্তৃতা করার সময় কিছু বিভিন্নতা থাকবেই।

শ্রোতাদের আগ্রহ জাগিয়ে তুলুন

যে কোন ছোট ভাষণের ক্ষেত্রে যেমন করা হয়ে থাকে, কোন দীর্ঘ বক্তৃতা আরম্ভ করার সময়ও সেই একই নীতি কার্যকর। অর্থাৎ শ্রোতাদের মানসিক ব্যাপারটা একই রকম থাকায় তাদের আগ্রহ জাগানোই বক্তার প্রথম কর্তব্য হবে। এই আগ্রহ জাগিয়ে তোলার সময় এমনভাবে সুরু করা চাই যাতে শ্রোতারা আরও জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

শ্রোতাদের চাহিদা পূর্ণ করার মতো বক্তব্য রাখুন

নিশ্চিতভাবে শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার উপায় হল তারা যা চায় সেটি পাওয়ার পথ ও প্রতিশ্রুতি। যেমন এইভাবে শুরু করা চমৎকার :

‘আমি আপনাদের ক্লান্তি দূর করার উপায় সম্পর্কে বলতে চাই।’

‘আমি আপনাদের আয় কি করে বাড়ানো সম্ভব সেই সম্বন্ধে বলব।

‘আমি কথা দিতে পারি, আমি যা বলব সে কথা যদি দশ মিনিট ধৈর্য ধরে শোনেন তাহলে কিভাবে জনপ্রিয় হওয়া যায় নিশ্চিতভাবেই জানতে পারবেন।’

এই রকম শপথ করার উদ্ধৃতিসহ বক্তব্য শুরু করলে চট করে শ্রোতাদের আগ্রহী করে তোলা যায়। কারণ এখানে শ্রোতাদের ব্যক্তিগত আকাক্ষা যুক্ত থাকে। সকলেই কিছু না কিছু জানার জন্য উদগ্রীব তাই দৈনন্দিন জীবনের নানা সমস্যা সমাধানে কোন উপায় বা পথ নির্দেশ থাকা শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়।

অভিজ্ঞদের নাম উল্লেখ করুন

বক্তৃতা করার সময় প্রায়শঃই কোন বিশেষ অভিজ্ঞ মানুষের উদাহরণ দিতে পারেন। অবশ্য সেই

অভিজ্ঞতার উদাহরণ রাখার সময় নিচের কথাগুলি মনে রাখতে হবে :

১। যে উদ্ধৃতি রাখতে চাই সেটি কি নির্ভুল?

২। এটি কি কোন ব্যক্তির নিজস্ব অভিজ্ঞতা লব্ধ অর্থনীতির সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কখনই জো লুইয়ের উদাহরণ রাখা প্রাসঙ্গিক হবে না।

৩। যার উদাহরণ রাখছি শ্রোতাদের তার প্রতি শ্রদ্ধার ভাব আছে তো?

৪। যে অভিজ্ঞতার উদাহরণ রাখবো তা কি শুধু ব্যক্তিগত সুবিধা লব্ধ না অন্যেরও কাজে লাগবে?

আমাদের পাঠক্রমের একজন সদস্য একবার ব্রুকলীনের চেম্বার্স অব কমার্সে বক্তৃতা করার সময় অ্যান্ড্রু কার্নেগীর উদ্ধৃতি দিয়ে ছিলেন। কাজটা কি তিনি ঠিক করেন? হ্যাঁ, ঠিক, কারণ যার কথা তিনি বলেন শ্রোতাদের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র। ব্যবসায় সাফল্যের ব্যাপারে তার চেয়ে যোগ্য কেউ আর নেই। সেই উদ্ধৃতিটি এই রকম :

‘আমার বিশ্বাস যে কোন বিষয়ে প্রকৃত সাফল্য লাভের প্রকৃষ্ট পথ একমাত্র সে বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করা। কারও সম্পদ নানা ভাবে ছড়িয়ে ফেলায় আমি বিশ্বাস করি না। আমার জীবনে এমন কাউকেই দেখিনি–বিশেষভাবে উৎপাদনের কাজে–যিনি নানা বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে অর্থ উপার্জন করেছেন। যে সব মানুষ সফল হয়েছেন তারা একটা লাইন বেছে নিয়ে তাতেই লেগে থেকেছেন।‘

সারাংশ প্রকাশ করুন

দীর্ঘ বক্তৃতার ক্ষেত্রে অনেকটা সময় ধরেই নানা কথা বলা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে উপসংহার টানার সময় কিছু বিশেষ পথ গ্রহণ কর্তব্য। দীর্ঘ বক্তৃতায় বক্তা সাধারণতঃ জানা বিষয় উল্লেখ করার ফলে শ্রোতারা অনেক সময় বিহ্বল হয়ে পড়ে, মূল বক্তব্য তাদের কাছে অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। খুব কম বক্তাই ব্যাপারটা উপলব্ধি করে থাকেন। তাঁরা ধরে নেন বিষয়টা তাঁদের কাছে যেহেতু বেশ স্বচ্ছ আর সহজ শ্রোতাদের কাছেও বুঝি তাই। তার কিন্তু কখনই হয় না। শেক্সপীয়ার যেমন বলেছিলেন, ‘শ্রোতারা অনেক কথাই শোনে কিন্তু মনে রাখে কম।’

একজন বিখ্যাত আইরিশ রাজনৈতিক নেতা বলেছিলেন কিভাবে বক্তৃতা দিতে হয়। কথাটা এই রকম : ‘শ্রোতাদের প্রথমে বলুন কি বলতে চলেছেন। তারপর সেটা বলুন, তারপর আবার তাদের বলুন কি বললেন। এই কারণেই তাদের কি বললেন তার সারাংশ আবার বলা চাই। সারাংশের উপকারিতা এই জন্যই অপরিসীম।

এবার ভাল বক্তা হওয়ার জন্য বক্তৃতা দেবার নানা সূক্ষ্ম কারুকার্য আর নিয়ম ছাড়াও দরকার হয় আরও অনেক কিছু। এ হল বক্তার নিজস্ব ব্যক্তিগত বিষয় যা শ্রোতাদের সঙ্গে অনেকখানিই জড়িত। সেগুলো হল এই :

মঞ্চে উপস্থিতি ও ব্যক্তিত্ব

এ সম্পর্কে আগে আলোকপাত করা হলেও বিষয়টি এতই জরুরি যে আরও বিশদ করে জানা দরকার।

ব্যক্তিত্ব অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বংশানুক্রমিক হয়ে থাকে। একে চট করে বদল করা যায় না। যে কোন জনসংযোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ব অনেকখানি কাজ করে। তাহলে কি ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলা সম্ভবপর হয় না? হ্যাঁ, অবশ্যই হয়। এর জন্য অভ্যাস প্রয়োজন। শ্রোতাদের সামনে কথা বলার সময় এজন্য প্রথমেই তাদের মনোযোগ আকর্ষণ প্রয়োজন। এই মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে ক্লান্ত ভঙ্গী হয় মারাত্মক। বক্তাকে তাই মঞ্চে ওঠার সময় বা শ্রোতাদের মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হবে তিনি যেন ক্লান্ত না থাকেন। ধরুন কোন ব্যবসা সংক্রান্ত সভায় আপনি বক্তব্য রাখতে চলেছেন–সেক্ষেত্রে কখনই মধ্যাহ্ন ভোজের পর অফিসে কাজে যোগ দেবেন না। এজন্য আপনার যা চাই তা হল বিশ্রাম।

কোন জরুরী বক্তৃতা করার আগে খাদ্য সম্পর্কেও সতর্কতা নেওয়া দরকার। বিখ্যাত গায়িকা মাদাম সেলবা বলেছিলেন, ‘কোন অপেরা বা কনসার্ট থাকলে আমি অত্যন্ত অল্পই খেতে অভ্যস্ত। অনুষ্ঠান শেষ হলে বাড়ি ফিরে পুরো আহার করতে চাই।’

পোশাক কতটা প্রতিক্রিয়া আনে?

একজন মনস্তত্ত্ববিদ বেশ কিছু মানুষকে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিলেন পোশাক তাদের মনে কতখানি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্রায় প্রত্যেকেই স্বীকার করেন যে নিখুঁত পরিপাটি পোশাক পরলে, তার অনুভূতি সকলের মনেই অদ্ভুত একটা ভাবনার জন্ম দেয়। এই ভাব কোন রকমে প্রকাশ করা যায় না। এই নিখুঁত। পোশাক পরা থাকলে তাদের মনে আত্মবিশ্বাস দারুণভাবেই বেড়ে যায় তারা টের পেয়েছে। এতে তাদের আত্মসম্মান বোধও ঢের বেড়ে যায়। তারা লক্ষ্য করে দেখেছেন, তারা সাফল্যের কথা ভাবলে সাফল্য লাভ করাও যেন এতে সহজ হয়ে যায়। যিনি ভাল, নিখুঁত পোশাক পরেন তার উপর এর প্রতিক্রিয়া হয় এই রকমই।

কিন্তু শ্রোতাদের উপর পোশাকের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়? বারবার রক্ষ্য করে দেখেছি কোন জনসংযোগের ক্ষেত্রে বক্তার দেহে যদি ঢোলা ট্রাউজার, ইস্ত্রি ছাড়া কোট আর নোঙরা জুতো থাকে, আর। পকেট থেকে পেন বা তামাকের পাইপ উঁকি মারতে থাকে তাহলে শ্রোতাদের মনে সঙ্গে সঙ্গেই বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে নিখুঁত, ভদ্র, আড়ম্বর বর্জিত পোশাক প্রথম আবির্ভাবেই শ্রোতাদের মনে ভাল ধারণা জাগিয়ে তোলে। এতে একটা শ্রদ্ধার ভাবও শ্রোতাদের মনে জেগে উঠতে শুরু করে।

শুধু পোশাকই নয়। সেই সঙ্গে নিখুঁতভাবে আঁচড়ানো চুল, ফিটফাট মুখভঙ্গী পোশাকের মতই শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই কারণেই প্রত্যেক বক্তাকে বাইরের এ বিষয়েও তীক্ষ্ণ নজর দেওয়া দরকার।

আমেরিকার সেকালের বিখ্যাত সেনাপতি জেনারেল গ্র্যান্ট এই পোশাকের ব্যাপারে একবার তীব্র অনুশোচনা করেছিলেন। গৃহযুদ্ধ শেষে শত্রুপক্ষের সেনাপতি জেনারেল লী যখন অ্যাপোম্যাটক্স কোর্ট হাউসে গ্ল্যান্টের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য আসেন, তার দেহে ছিল নতুন সামরিক পোশাক। তাঁর কোমরের একপাশে ঝুলছিল বহু মূল্যবান একখানা তরবারী। অন্যদিকে গ্ল্যান্টের দেহে কোন কোট ছিল না, তরবারীও ছিল না। তার দেহে ছিল একটা শার্ট আর ট্রাউজার। নিজের আত্মজীবনীতে গ্র্যান্ট লেখেন, তুলনায় আমাকে অতি দরিদ্র আর তুচ্ছ দেখাচ্ছিল আমার পাশেই দাঁড়ান ছিল ছ’ ফিট দীর্ঘ এক সুপুরুষ, চমৎকার নিখুঁত তার পোশাক। ওই ঐতিহাসিক দিনটিকে নিখুঁত পোশাক না পরে থাকার জন্য সারাজীবন অনুতাপ করেছিলেন জেনারেল এ্যান্ট।

ব্যাপারটি এই রকমই হয়। বক্তাও সব সময়েই শ্রোতাদের তীক্ষ্ম দৃষ্টির মধ্যে থাকেন–তাকে আতস কাঁচের নিচে রেখেই যেন যাচাই করা হতে থাকে, তার সামান্যতম ক্রটিও অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে।

কথা শুরু করার আগেই আমরা গৃহীত বা বাতিল হই

বেশ কয়েক বছর আগে আমি একজন নামী সফল ব্যাঙ্কার সম্পর্কে আমেরিকান ম্যাগাজিনে লিখছিলাম। তার এক বন্ধুকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম ভদ্রলোকের সাফল্যের কারণ কি? সেই বন্ধুটি উত্তরে বলেছিলেন সাফল্যের কারণ হল তার বিজয়ী হাসি। প্রথমে ভেবেছিলাম কথাটায় বাড়াবাড়ি আছে, পরে জেনেছিলাম কথাটা নিছক সত্যি। সত্যিই এই ধরনের বিজয়ী হাসি শ্রোতার মন জয় করতে সক্ষম।

এক চীনা প্রবাদ আছে, ‘যে হাসতে পারে না, তার কোন দোকান করা উচিত নয়। হাসি অনেক ক্ষেত্রেই ছোঁয়াচে হতে পারে। আমাদের ব্যবহারই শ্রোতাদের মধ্যে অনুকুল ধারণা জাগাতে চায়। তাই আমাদের উপস্থিতির মধ্যে যদি গ্রহণযোগ্য ভাব না থাকে তাহলে শ্রোতাদের মধ্যে প্রথম দর্শনেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া জাগতে পারে। তাই জেনে রাখা চাই আমরা কথা শুরু করার আগেই গৃহীত বা বর্জিত হয়ে যাই শ্রোতাদের কাছে। এই কারণেই আমাদের ভাবভঙ্গী এমন হতে হবে যাতে সকলের কাছ থেকে উত্তাপ ভরা আগ্রহ পেতে পারি।

শ্রোতাদের এক জায়গায় কাছাকাছি আনবেন

একজন জনসংযোগকারী বক্তা হিসেবে আমি একটা বিচিত্র জিনিস লক্ষ্য করেছি। যখন কোন বড় হলঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শ্রোতাদের সামনে কিছু বলেছি, তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া খুবই কম হয়েছে। অন্যদিকে কোন দর্শক বা শ্রোতায় ঠাসা ছোট্ট ঘরে যখন কিছু বলেছি শ্রোতাদের মধ্যে তার অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

এর কারণ অনুসন্ধান করে বুঝেছি যে, যত ভাল বিষয়বস্তুই হোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শ্রোতাদের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া মোটেই হয় না। খালি আসন বা চেয়ার আগ্রহে জল ঢেলে দেয়।

হেনরি ওয়ার্ড বিচার করে বলেছেন, সামান্য বারো জন শ্রোতার সামনে কথা বলেও আনন্দ পাওয়া যায় যদি তারা আমার চারপাশে ঘিরে থাকে। আর এক হাজার শ্রোতাও যদি চার ফিট করে পরস্পরের তফাতে থাকে তাহলে ফাঁকা ঘরে কথা বলছি বলেই মনে হয়।

বিশাল শ্রোতাদের সামনে যে কোন বক্তাই তার বক্তিসত্ত্বা হারিয়ে ফেলেন। তিনি দর্শকদেরই একজন হয়ে যান–এক্ষেত্রে তিনি অনেক সহজভাবে কাজ করতে পারেন কারণ অল্প শ্রোতার সামনে তাঁকে ঢের সতর্ক থাকতে হয়। অতএব সবচেয়ে ভাল হয় শ্রোতার সংখ্যা বেশি হলে।

অল্প শ্রোতাদের সামনে কোন মঞ্চ থেকে না বলাই ভাল। এক্ষেত্রে একই উচ্চতায় তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েই কথা বলা ভাল।

মঞ্চে কোন অতিথি রাখবেন না

আমি একবার অন্টারিওতে কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে বক্তৃতা করতে দেখেছিলাম। একটু পরে একজন কর্মচারি ঘরের জানালাগুলো খুলে দিতে আরম্ভ করে। এতে কি হয়? হলের প্রায় সমস্ত শ্রোতাই বক্তাকে আমল না দিয়ে ওই কর্মচারীকে লক্ষ করতে থাকে।

এর কারণ শ্রোতারা কিছুতেই কোন চলমান বস্তু না লক্ষ করে পারে না। প্রত্যেক বক্তাকেই কথাটা মনে রাখতে হবে। এছাড়াও বক্তা নিজেও শ্রোতাদের অমনোযোগী করে তুলতে পারেন। আর সেটা করা হয় অকারণে হাত নাড়তে চেয়ে, জামায় হাত দিয়ে, মাথার চুল স্পর্শ করে ইত্যাদি। এ ধরনের মারাত্মক অভ্যাস বর্জন করা চাই।

বিখ্যাত বক্তা ডেভিড বেলাসকো কোন মঞ্চের টেবিলে লাল গোলাপ রাখতে দিতেন না কারণ তা শ্রোদাঁতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

এই কারণেই মঞ্চে কোন বাড়তি কাউকে রাখতে দেবেন না। না, কোন অতিথি নয়।

.

১৪. যা শিখলেন তা কাজে লাগানো

আমার পাঠক্রমের চৌদ্দতম অধ্যায় শেষ হওয়ার পর আমি প্রায়ই শুনেছি আমার ছাত্ররা কিভাবে এই বইয়ের কৌশলগুলো প্রাত্যহিক জীবনে কাজে লাগিয়েছে। আমার আনন্দ এতে বাধ মানেনি। আমি বলেছি এই পাটক্রম থেকে বিক্রয় প্রতিনিধিরা তাঁদের বিক্রি বাড়াতে পেরেছেন, উচ্চপদস্থ কর্মীরা প্রোমোশান লাভ করেছেন–আর এর সবই তাদের দক্ষতা বেড়ে গিয়েছে বলেই। আর তা এসেছে তাদের সমস্যা সমাধানে পাঠ্যক্রম কাজে লাগিয়ে।

এন. রিচার্ড ডিলার তাঁর ‘টুডে’জ স্পীচ-এ লিখেছেন : বক্তব্য, কোন বিশেষ ধরনের বক্তব্য, বক্তব্যের ওজন, আর এই বক্তব্যের আবহাওয়া…শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রাণদায়ী রক্ত প্রবাহের ভূমিকা নিতে পারে।’ জেনারেল মোটর কোম্পানির ডেল কার্নেগি পাঠক্রমের অধিকর্তা আর, ফেড. কানোডে লিখেছেন : আমাদের জেনারেল মোটর প্রতিষ্ঠানে আমরা যে বক্তৃতার পাঠক্রম অনুরাগী হয়েছি তার কারণ আমাদের প্রত্যেক সুপারভাইজারই এক একজন শিক্ষক। প্রতিটি নতুন কর্মীকেই তারা গোড়া থেকেই শিক্ষা অনুরাগী করে তোলেন।

বক্তব্যের সিঁড়ি বেয়ে আমরা জনসংযোগের ক্ষেত্রে যতই অগ্রসর হতে থাকি-জনগণের সামনে বক্তৃতা যেসব ক্ষেত্রে একান্ত দরকার–ততই আমরা দেখতে পাই আলোচনা, কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা মেটানো, নীতি-নির্ধারণ, ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই এই জনসংযোগকারী বক্তৃতা কি অসাধারণ কার্যকরী। এ বইয়ের উপদেশ আর পরামর্শ তাই চমঙ্কার ভাবেই কাজে লাগানো সম্ভব। বিক্রয় সংক্রান্ত ক্ষেত্রে এটা অভাবনীয় সাফল্য আনতে সক্ষম তার প্রমাণ বহুবারই পাওয়া গেছে।

আপনি হয়তো অবাক হয়ে ভাবছেন আগে তেরোটা পরিচ্ছেদ থেকে যা শিখেছেন সেগুলো কিভাবে কোথা থেকে কবে কাজে লাগাতে শুরু করবেন। আমার উত্তর শুনে হয়তো অবাক হবেন : এখনই।

আপনি এখনই, এই মুহূর্তেই হয়তো কোন জনসংযোগকারী বক্তৃতা দিচ্ছেন না, তা সত্ত্বেও বলতে চাই আপনার দৈনন্দিন জীবনেও আপনি এটা কাজে লাগাতে পারবেন। এখনই কথাটা বলতে গিয়ে আমি বলতে চাই পরক্ষণেই যে মানুষের সঙ্গে আপনার কথা বলার দরকার হবে তাকে দিয়েই আপনি আরম্ভ করুন।

আপনি যদি পুরো বিষয়টা একবার বিশ্লেষণ করে দেখেন তাহলে আশ্চর্য হয়ে দেখবেন যে আপনার দৈনন্দিন কাজে কর্মে, চিরাচরিত কথাবার্তায় কেমন ফল পেতে সুরু করেছেন।

সাত নম্বর পরিচ্ছেদে আপনাদের জানানো হয়েছে কোন দলের সামনে কথা বলার সময় কোন্ চারটি নিয়ম মেনে চলতে হবে : আপনি হয়তো শ্রোতাদের জানাতে চান তাদের উৎসাহিত করতে চান, তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে চান বা কোন কাজে উদ্বুদ্ধ করতে চান। জনসংযোগের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলি আমাদের মনে রাখা দরকার।

প্রাত্যহিক কথাবার্তায় ও সব বিষয়গুলোই স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়ে থাকে আর সারাদিনে নানাভাবে কার্যকর হতে থাকে। কখনও আমরা হয়তো কোন হালকা ধরণের আলাপ আলোচনায় মেতে থাকি আবার পরক্ষণেই কোন প্রয়োজন দেখা দিলে কোন পণ্য সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই। এই বইয়ে লেখা নিয়মগুলো কাজে লাগাতে পারলে সব রকম অবস্থাতেই তাকে কাজে লাগানো যাবে। এ থেকে আমরা

যে কোন ভাবেই নানা ধারণা লাভ করে অপরকে কোন কাজে লাগাতেও পারি।

১. প্রাত্যহিক কথাবার্তায় নির্দিষ্ট বর্ণনা রাখুন

মাত্র একটা নিয়ম নিয়ে দেখা যাক এবার। মনে রাখবেন, প্রথম পরিচ্ছেদে বলেছি আপনার বক্তব্য রাখার সময় তাকে বর্ণনাময় করা চাই। এটা করলে আপনার বক্তব্য বেশ সহজ আর সজীব হয়ে উঠবে। অবশ্য কোন একদল শ্রোতার সামনেই এটা করার কথা বলেছি। তবুও রোজকার কথাবার্তায় এর কি কোন দাম নেই? অবশ্যই তা আছে। প্রাত্যহিক মেলামেশা আর আলাপ আলোচনাতেও এর মূল্য অনেক।

তবে একটা বিষয় জেনে রাখা দরকার। কথাবার্তায় এই দক্ষতা অর্জন করতে হলে নিজের উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখা অবশ্যই চাই। অল্প কিছু লোকজনের কাছে কথা বলতে গেলেও আপনার ধারণাকে : স্পষ্ট রূপ দেওয়ার চেষ্টা করবেন। নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয় নিয়েই বক্তব্য রাখা চাই-কথা শুরু করার পর দেখবেন কেমন তরতর করে এগিয়ে চলেছেন।

গৃহকর্ত্রীরা এ ব্যাপার থেকে যথেষ্ট সুফল পেতে পারেন। সিনসিনাটির মিসেস আর. ডি. হার্ট লিখেছিলেন, ‘দেখতে পেলাম আমার নতুন অভিজ্ঞমতা কতখানি আনন্দের হয়ে উঠেছে। সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে কথা বলার সময় ঘটমান বিষয় আমার যথেষ্ট অবহিত করে তোলে। আমি কথা বলতে পেরে দারুণ খুশি হই।’

কোন শিক্ষিকার কাছে ব্যাপারটা নতুন নয়। আমরা অনেকে কিন্তু শিক্ষকের কাজ না করলেও প্রাত্যহিক জীবন যাপনের সময় অনেক সময়েই কাউকে না কাউকে কিছু শেখানোর জন্য বলে থাকি। বাবা মা তার সন্তানদের শেখানোর জন্য বলেন, পড়শীরা অনেক বিষয়ে উপদেশ বা পরামর্শ দিয়ে থাকেন, ভ্রমণবিলাসীরা সহজে সস্তায় কোন্ পথে ভ্রমণ করলে ভাল হয় বলেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই এসব করা হয়।

২. কর্মক্ষেত্রে জনসংযোগ কৌশল কাজে লাগান

এবার আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কর্মক্ষেত্রে এই জনসংযোগ কৌশল কিভাবে কাজে লাগাতে পারি সেটাই দেখব। মনে রাখবেন বিক্রয় প্রতিনিধি, ম্যানেজার, করণিক-গ্রুপ নেতৃত্বের অধিকারী, ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক–আমরা এর যে কোন পদেই কাজ করি না কেন, আমাদের দায়িত্ব থাকে নিজেদের বিশেষ এলাকা সম্বন্ধে অপরকে শেখানো। এটা অনেক সময়েই পেশাদারী হতে পারে। এই সব কাজে নিজেদের দক্ষতা প্রকাশ বহু ক্ষেত্রেই আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির সহায়ক হয়ে ওঠে। কিছু জানানোর সময় দ্রুত চিন্তা করা আর সেই জ্ঞান চমৎকারভাবে পরিবেশন করাই দক্ষতার লক্ষণ। এই কারণেই দক্ষতা অর্জন তখনই আরও ভাল হতে পারে যদি আমরা জনসংযোগের সহজ নিয়মকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। ক্রেতার কাছে বিক্রয় প্রতিনিধি, ছাত্রের কাছে শিক্ষক, অধস্তন কর্মীর কাছে ম্যানেজার সকলেই তাদের লব্ধ জ্ঞান সুষ্ঠুভাবে পরিবেশন করতে পারেন।

৩. জনসংযোগের সুযোগ অন্বেষণ করুন

এই বইয়ে জানানো প্রতিদিনের বক্তব্য রাখার বিষয় কাজে লাগানো সুযোগ আপনাকে তৈরি করে নিতে হবে। আপনাকে অনবরত জনসংযোগের সুযোগ খুঁজে নিতে হবে। এটা কিভাবে করবেন? যে সব ক্লাবে জনসংযোগকারী বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ আছে সেখানে সদস্য হতে পারেন। তার নিছক সদস্য হলেই হবে না, আপনাকে কার্যকর ভূমিকাও নিতে হবে। সদস্যদের সামনে কথা বলার অভ্যাসটি গড়ে তুলতেও হবে।

যখনই সুযোগ আসবে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট বক্তৃতা দেবার চেষ্টা করবেন। সুযোগ পেলে নামী কোন বক্তার বক্তৃতা শোনার চেষ্টাও করতে হবে। অর্থাৎ আপনাকে নিজেকেই কথা বলার, জনসংযোগের সুযোগটি খুঁজে নিতে হবে।

৪. লেগে থাকা চাই

আমরা যখনই কোন নতুন কিছু শিখিযেমন ধরা যাক ফরাসী ভাষা শেখা বা গলফ খেলা বা ধরুন জনগণের সামনে বক্তৃতা করা, সব বিষয়েই আমরা সমান তালে এগুতে পারি না। তাই ধীরে ধীরে আমাদের উন্নতি লাভও সম্ভব হয় না। ঢেউ যেভাবে আসে আমরা সেইভাবেই থেমে থেমে একটু একটু করে শিখি। তারপর বেশ কিছুদিন এক জায়গায় আটকে থাকি–আগেকার শেখা অনেকটা ভুলেও যাই। মনস্তাত্ত্বিকরা এই অবস্থাকে বলেন শিক্ষার বক্তৃতায় অধিত্যকা। জনসংযোগের ছাত্ররা প্রায়ই হয়তো এই রকম অধিত্যকায় আটকে যায়। শত কঠিন পরিশ্রমেও যেন তারা লড়তে পারেন। দুর্বল যারা তারা এ অবস্থায় হতাশায় হাল ছেড়েও দেয়। যারা কঠিন প্রত্যয় নিয়ে লেগে থাকতে সক্ষম তারা একদিন অবাক হয়ে দেখে আচমকা তারা যেন বাধার প্রাচীর পার হয়ে চমৎকার উন্নতি করেছে। অধিত্যকা পার হয়ে তারা যেন প্লেনে উঠতে সুরু করেছে। ব্যাপারটা যেন রাতারাতি ঘটে যায়। তাদের মধ্যে জেগে ওঠে স্বাভাবিকতা, আত্মবিশ্বাস আর শক্তি।

এ বইয়ে আগে যেমন বলা হয়েছে, জনসংযোগ শুরু করে কথা বলতে গিয়ে আপনি হয়তো গোড়ায় নিদারুণ ভয়, ধাক্কা বা স্নায়বিক দুর্বলতা বোধ করতে পারেন। শ্রোতাদের মখোমুখি হলেই এই ভাব দেখা দেওয়া সম্ভব। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞরাও শ্রোতাদের সামনে এমন বোধ করেন। পেড্রেভস্কি পিয়ানোর সামনে বসলেই নার্ভাস হয়ে পড়তেন। কিন্তু পিয়ানো বাজাতে আরম্ভ করার পর ধীরে ধীরে তিনি স্বাভাবিক হয়ে উঠতেন। পেড্রেভস্কির অভিজ্ঞতা আপনারও হতে পারে। শুধু যদি একাগ্রতা বজায় রাখতে পারেন, তাহলেই প্রথম দিকের ভীতি কাটানো সে রকম অসম্ভব হবে না। প্রাথমিক ভয় কাটাতে পারা মানেই অর্ধেকটা জয় করা। কথা বলার মুখে হয়তো কিছুটা ভয় লাগা স্বাভাবিক–কথা বলতে শুরু করুন দেখবেন একটু একটু করে সে ভয় কেটে গেছে। আনন্দের সঙ্গেই এরপর কথা বলে যেতে পারবেন।

একসময় এক তরুণ, আইন পাঠ করার জন্য ইচ্ছুক হয়ে আব্রাহাম লিঙ্কনের কাছে উপদেশ চেয়ে চিঠি লিখেছিল। লিঙ্কন তাকে জবাবে লেখেন : ‘তুমি যদি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আইনবিদ হওয়ার মনস্থ করে থাকো তাহলে অর্ধেক কাজ ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে…সব সময় মনে রাখবে সাফল্য লাভ করার জন্য তোমার একান্ত বাসনাই অন্য সব কিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

লিঙ্কন একথা জানতেন। সারা জীবনে সেটাই ছিল তাঁর অভিজ্ঞতা। অথচ সারা জীবনে একবছরের বেশি তিনি স্কুলে শিক্ষালাভ করতে পারেন নি। আর বই? লিঙ্কন একবার বলেছিলেন তাঁর বাড়ির পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে যেখানে যত বই ছিল সবই তিনি ধার করে পড়ে ফেলেছিলেন। তাঁর কেবিনে সারা রাত ধরে কাঠের আগুন জ্বলত। মাঝে মাঝে হাতের কাছে রাখা ছড়িতে আগুন উসকে দিতেন তিনি এবং সেই জ্বলন্ত কাঠের আগুনের আলোয় পড়ে যেতেন লিঙ্কন। ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় পাশ ফিরে চোখে জল নিয়ে লিঙ্কন পাশে রাখা কোন বই নিয়ে আবার পড়ে চলতেন।

তিনি কখনও কখনও ত্রিশ মাইল পায়ে হেঁটে কোন বক্তার বক্তৃতা শুনতে যেতেন। সব রকম পথে হাঁটার অভ্যাস করতেন লিঙ্কন–অনেকক্ষেত্রে বনজঙ্গলে। যে কোন জায়গায় তিনি বক্তৃতা শোনার জন্য ছুটে যেতেন। তিনি বক্তৃতার নেশায় যোগ দিয়েছিলেন নিউ সালেমের বিতর্ক ক্লাবে–আর দিনরাত বক্তৃতা দান অনুশীলনী করে চলতেন। সে বক্তৃতা হত সাধারণত সমসাময়িক সমস্যা। মেয়েদের সামনে একটু লজ্জা পেতেন লিঙ্কন। মেরি টডের সঙ্গে প্রেমে পড়লে লিঙ্কন লজ্জায় বেশি কথা বলতে পারতেন না, পার্লারে বসে মেরীর কথাই শুনে যেতেন। অথচ আশ্চর্য কথা সেই মানুষই অনুশীলন আর প্রাণপাত চেষ্টায় হয়ে ওঠেন সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক বক্তা আর সেকালের শ্রেষ্ঠ বক্তা সেনেটর ডগলাসের সমকক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী। এই মানুষটিই গেটিসবার্গে যে ভাষণদান করেন মানুষের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরেই লেখা থাকবে চিরকাল।

তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই, নিজের প্রচণ্ড অসুবিধা আর জীবন সংগ্রাম সত্ত্বেও লিঙ্কন লিখেছেন অদম্য বাসনা থাকলে সে কাজের অর্ধেকই হয়ে যায়…।’

ওয়াশিংটনের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, হোয়াইট হলেন মধ্যে লিঙ্কনের বিশাল এক তৈলচিত্র টাঙানো আছে। প্রেসিডেন্ট থিয়োডোর রুজভেল্ট লিখেছেন : ‘যখন কোন ব্যাপারে সমস্যায় পড়ি, বা মেটানো বেশ কঠিন মনে হয়–আমি লিঙ্কনের দিকে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করি আমার জায়গায় থাকলে লিঙ্কন কি করতেন। আপনারা হয়তো ব্যাপারটা আশ্চর্য মনে করবেন। তবুও আমি দেখেছি আমার সমস্যা এতে অনেক হালকা হয়ে যায়।’

তাহলে আপনিও রুজভেল্টের মতো করুন না কেন? যখন কোন বক্তৃতা দেওয়ার সময় সমস্যায় আকীর্ণ হবেন লিঙ্কনের কথাই ভাবুন না কেন? তিনি ওই সময় কি করতেন? আপনি অবশ্যই জানেন তিনি কি করতেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটের নির্বাচনে তিনি স্টিফেন এ ডগলাসের কাছে পরাজিত হওয়ার পর বলেন : ‘একবার কেন একশবার পরাজিত হলেও হাল ছাড়া উচিত নয়।

৫. পুরস্কারের অবশ্যম্ভাবিতা সামনে রাখুন

আমার একান্ত বাসনা আপনারা আপনাদের প্রাতরাশের টেবিলে প্রফেসর উইলিয়াম জেমসের এই লেখাটি রেখে মুখস্থ করে ফেলবেন :

‘কোন তরুণ তার লাইন যে রকমই হোক, সে যেন তার শিক্ষা নিয়ে কোনরকম উদ্বেগ বোধ না করে। দৈনিক জীবনে সে যদি নিয়মিত প্রতিটি ঘন্টা বিশ্বস্তভাবে কাটায় তাহলে সফলতা আসবেই। একদিন সে দেখতে পাবে সফলতা তার হাতের মুঠোয়।’

প্রফেসর জেমসের মত আমিও বলতে চাই বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অনুশীলন করে চললে একদিন আপনার পক্ষেও সুযোগ্য বক্তা হয়ে ওঠা মোটেই কঠিন হবে না।

মনে রাখবেন কথাগুলো যতই অসম্ভব বলে মনে হোক সাধারণভাবে এটা সত্য। অবশ্যই একথা ঠিক এর ব্যতিক্রম আছে। নিকৃষ্ট মানসিক অবস্থার বা ব্যক্তিত্বহীন কোন মানুষের যার বলার মত কিছুই থাকে না, তার পক্ষে কোনো ড্যানিয়েল ওয়েবার হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। তবে কিছুটা তার পক্ষেও নিজেকে তৈরি করা সম্ভব।

একটা উদাহরণ দিচ্ছি : নিউ জার্সির প্রাক্তন গভর্নর স্টোকম ট্রেনটনে একদিন আমার পাঠক্রমের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেন ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি সদস্যদের যে বক্তৃতা করতে শুনেছেন তা ওয়াশিংটনের শোনা বক্তৃতার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। এই বক্তৃতা দেন কিছু ব্যবসায়ী আর বিক্রয় প্রতিনিধিরা যারা পাঠক্রমের ক্লাসে যোগদান করার আগে শ্রোতাদের সামনে দাঁড়াতেই ভয় পেতেন। অথচ তারাই একদিন সকালে জেগে উঠে যেন নিজেদের সফলতায় মণ্ডিত দেখতে পান।

অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আমি বহু বক্তাকে লক্ষ্য করেছি। আমি দেখেছি তাঁদের অনেকেই শ্রোতাদের সামনে কথা বলার ক্ষমতা অর্জনের জন্য কি প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিভাবান কয়েকজনই মাত্র অল্প আয়াসে দক্ষতালাভ করেছে–বাকি সকলে কখনও হতাশায় ভেঙে পড়েনি। তাঁরাও পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে শিখরে উঠতে পেরেছেন।

এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। ব্যবসা জগতে অহরহ এমনই ঘটে থাকে। জন ডি রকফেলার (বড়) বলেছিলেন ব্যবসাজগতে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ধৈর্য আর জ্ঞান। সাফল্য এতে আসবেই। বক্তৃতা আর জনসংযোগের ক্ষেত্রেও তাই।

কয়েক বছর আগে বিখ্যাত বেডেকার অস্ট্রিয়ার দিক থেকে আল্পস পর্বতের শিখরের উচ্চতা মাপার চেষ্টা করেন। এর নাম ওয়াইল্ডার কাইজার। বেডেকার বলেন ওদিক দিয়ে ওঠা বেশ কঠিন ছিল। বিশেষ করে অপেশাদারদের একজন গাইড থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। বেডেকার আর জনৈক বন্ধু গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কোন গাইড ছিল না। একজন তাই জানতে চান তারা সফল হবেন কিনা। অবশ্যই হব’,

বেডেকার জবাব দেন।

‘এরকম ভাববার কারণ?’ ভদ্রলোক জানতে চান।

‘অনেকেই গাইড ছাড়া পেরেছেন, বেডেকার বলেন, অতএব আমাদের যুক্তি আমরা কেন পারব। পরাজয়ের কথা ভেবে আমি কোন কাজ হাতে নিই না।’

যে কোন কাজে, এমন কি মাউন্ট এভারেষ্ট বিজয় সম্পর্কেও মনস্তত্ব তাই বলে।

বক্তৃতাদানে বা জনসংযোগের কাজেও কথাটা একই রকম। আপনি কতখানি সফল হবেন তার চিন্তাধারাই আপনাকে অনেকটা প্রভাবিত করে : আপনি যদি মনে মনে ভাবেন সফল হবেন আর সেইভাবেই মনে সাহসের জোগান দেন তাহলে নিশ্চয়ই সফল হতে পারবেন। প্রয়োজন হল দৃঢ় আত্মবিশ্বাস।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় অ্যাডমিরাল ডুপো অন্ততঃ ছ’টি কারণ দেখিয়ে বলেছিলেন চার্লস্টন বন্দরে কেন তিনি তাঁর বন্দুকবাহী জাহাজ নিয়ে যান নি। অ্যাডমিরাল ফ্যরাগট বেশ মন দিয়ে সব কথা শোনার পর বলেন, আর একটা কারণের কথা আপনি বলেন নি।

‘সেটা কি?’ অ্যাডমিরাল ডুঁপো প্রশ্ন করেন।

এবার জবাব এলো : ‘কাজটা আপনি করতে পারবেন বলে আদৌ ভাবেন নি।‘

রাফল ওয়ালডো এমার্সন একবার বলেছিলেন : উৎসাহ ছাড়া কোন বড় কিছু করা কখনই সম্ভব হয় নি। সাফল্যের চাবিকাঠিও তাই।

উইলিয়াম লিয়ন ফেলপস ছিলেন সম্ভবতঃ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ আর জনপ্রিয়তম একজন শিক্ষক। তাঁর ‘একসাইটমেন্ট অব টিচিং’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘আমার কাছে শিক্ষাদানের কাজ এক শিল্পকলার মত। এ আমার ভালবাসা। আমি শিক্ষা দিতে ভালবাসি, যেমন শিল্পী শিল্প সৃষ্টি করতে ভালবাসেন। গায়ক সঙ্গীত ভালবাসেন, কবি তেমন কবিতা রচনা করতে ভালবাসেন। সকালে শয্যা ছেড়ে ওঠার পরেই আমি আমার ছাত্রদের কথাই আনন্দে স্মরণ করি।‘

কোন শিক্ষক যে তার কাজে এমন আন্তরিক আনন্দ পান তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে? বিলি ফেলপস তাঁর ছাত্রদের উপর প্রচণ্ড প্রভাব রেখেছিলেন, আর তা তিনি পেরেছিলেন ভালবাসা, আগ্রহ এবং আন্তরিকতার স্পর্শে।

আপনার শেখার বিষয়েও আপনি যদি এ ধরনের আন্তরিকতা দিয়ে অগ্রসর হতে পারেন সমস্ত বাধাই তাহলে দূর করতে পারবেন সন্দেহ নেই। আপনার ক্ষমতা আগ্রহের সামনে এ একটা চ্যালেঞ্জ, তার বিশ্বাস রাখতে শুরু করুন নিজের উপর। চেষ্টা করুন ছোট ছোট কোন দলের আস্থা অর্জন করতে। দেখবেন একটু একটু করে বড় মাপের কিছু কারও আর কঠিন বলে থাকবে না। জনসংযোগে এ ধরনের প্রচেষ্টা ফলবতী হবেই।

ডেল কার্নেগি পাঠক্রমের শিক্ষকদের গাইড বইয়ে এই কথাগুলি লেখা থাকে : ক্লাসের সদস্যরা যখন আবিষ্কার করেন তারা শ্রোতাদের মনোযোগ আর শিক্ষকদের দৃষ্টি অকার্ষণে সমান–তখনই তারা অন্তরে একটা ক্ষমতার অধিকারী হন। তাঁদের সাহস আর আত্মবিশ্বাসে কোন ত্রুটি থাকে না। এর ফলাফল কি হয়? তাঁরা স্বপ্নেও যা ভাবতে পারেন নি সেই কাজই তারা করতে সক্ষম হন। তাঁরা শ্রোতাদের সামনে কথা বলার সুযোগই খুঁজতে থাকেন। তারা ক্রমেই অনেক বেশি করে ব্যবসা সংক্রান্ত আর পেশাদারী, সামাজিক কাজকর্মে যোগদান করে নেতৃত্বের অধিকারী হয়ে ওঠেন।

‘নেতৃত্ব’ কথাটি এই বইয়ে অনেকবার ব্যবহার করা হয়েছে। সমাজে নেতৃত্বের চিহ্ন হল দৃঢ়তাব্যঞ্জক ভঙ্গি, নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা। এ ধরনের গুণাগুণ যার মধ্যে প্রকাশ পায় সমাজে, তিনিই সকল নেতৃত্বের অধিকারী হন। আপনিও সে ক্ষমতা অর্জনে সচেষ্ট হবেন না কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *