০৮. বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা
একবার একদল স্ত্রী পুরুষ ভয়ঙ্কর এক ঝড়ের তাণ্ডবের সামনে পড়েছিলেন। অবশ্য সত্যিকার ঝড় নয়, তবে তার চেয়েও বোধ হয় বেশি। আসলে তারা মরিস গোল্ডস্ল্যাট নামে একজন মানুষ ঝড়ের মুখে পড়ে যান। ওই দলের একজন এইভাবে ঘটনাটি বর্ণনা দিয়েছিলেন :
‘আমরা শিকাগোয় এক মধ্যাহ্নভোজের টেবিলের চারপাশে বসেছিলাম। যে ভদ্রলোকের কথা বলছি তাকে আমরা বিখ্যাত একজন বক্তা বলেই জানতাম। কথা বলার জন্য উঠে দাঁড়াতেই আমরা তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালাম।
‘তিনি বেশ শান্তভাবেই আরম্ভ করলেন–মধ্যবয়স্ক লোকটি, আচার আচরণ চমৎকার। তিনি তাঁকে আমন্ত্রণ করার জন্য ধন্যবাদ জানালেন। তিনি জানালেন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি কথা বলতে চান আর আমরা বিরক্ত বোধ করলে যেন তাকে মার্জনা করি।
‘তারপরেই এক ঝড়ের মতই তিনি আক্রমণ করলেন। সামনে ঝুঁকে তিনি শান্ত কণ্ঠেই যখন কথাটা বললেন মনে হল যেন একটা কামানের গোলা ফাটল।
‘চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখুন, তিনি বললেন। পরস্পরের দিকে তাকান। আপনাদের কি জানা আছে আপনাদের মধ্যে কতজন ক্যান্সারে মারা যাবেন? আপনাদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজন, যাদের বয়স পঁয়তাল্লিশের উপর। মনে রাখবেন প্রতি চারজনে একজন।
‘একটু থামলেন তিনি আর তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর তিনি বললেন, এটা নিছক নিষ্ঠুর সত্য, তবে বেশিদিন এমন থাকবে না এবং এসম্পর্কে কিছু করা যাবে। এই ধরণের কিছু ব্যাপারটা হল ক্যান্সারের চিকিৎসায় অগ্রগতি আর এর কারণ অনুসন্ধান।
তিনি টেবিলের চারদিকে আমাদের দিকে তাকলেন। আপনারা কি এই প্রচেষ্টায় সাহায্য করতে চান? তিনি প্রশ্ন করলেন।
‘হ্যাঁ’ ছাড়া আর কি কোন উত্তর হয়? আমি আর বাকি সবাই একসঙ্গে বলে উঠলাম, হ্যাঁ!
এক মিনিটের অবকাশেই মরিস গোল্ডস্ল্যাট আমাদের জয় করে ফেললেন। তিনি তাঁর নিজের বিষয়ে আমাদের টেনে নিলেন। তিনি সমাজ সেবার জন্য যা করতে চাইছিলেন তাতে তাঁর পাশে আমাদেরও দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করলেন।
সর্বত্রই শ্রোতাদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া আশা করা যে কোন বক্তারই মহৎ উদ্দেশ্য থাকে। যেমন মিঃ গোল্ডব্ল্যাটও নাটকীয়ভাবে সুন্দর কারণ দেখিয়ে আমাদের মন জয় করলেন। তিনি এবং তার ভাই নাথান প্রায় কিছু হাতে না নিয়েই একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোরের শৃঙখল খুলে বছরে প্রায় ১০০,০০০,০০০ ডলারের ব্যবসা করে চলেছেন। কল্পনাতীত সাফল্যই তাঁরা পান কিন্তু নাথান অসুস্থ থাকায় অল্পদিন পরেই ক্যান্সারে মারা যায়। তারপর মরিস গোল্ডস্ল্যাট, গোল্ডস্ল্যাট ফাউণ্ডেশানের পক্ষে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্সার গবেষণার জন্য দশলক্ষ ডলার দান করার ব্যবস্থা করেন। এরপর থেকে মরিস গোল্ডব্ল্যাট ব্যবসা থেকে অবসর গ্রহণ করে জনসাধারণের সুবিধার্থে ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য তার সারা জীবন উৎসর্গ করেন।
এইসব ঘটনা মরিস গোল্ডব্ল্যাটের ব্যক্তিত্বই আমাদের জয় করল। ঐকান্তিকতা, আগ্রহ, উৎসাহ-এই তিনটির সমন্বয়ে তিনি মুহূর্তেই আমাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন, তাঁর বন্ধুত্বলাভ করে আমরাও ধন্য। এসবই তাঁকে মধুরতম করেছিল একজন ভাল বক্তা হওয়ার গুণে।
১. যোগ্যতা দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করুন
কুইন্টিলিয়ান একজন বক্তাকে আখ্যা দেন এইভাবে কথা বলায় দক্ষ একজন ভালো মানুষ। একাগ্রতা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা সম্বন্ধে তিনি এটা বলেছিলেন। এ বইয়ে যাই বলা হোক বা নাই বলা হোক এর চেয়ে ভালো বিশ্লেষণ, বক্তা সম্পর্কে আর হয় না। পিয়েরপন্ট মর্গ্যান বলেছেন প্রশংসা আদায় করার শ্রেষ্ঠ উপায় হল চরিত্র। আর শ্রোতাদের বিশ্বাস অর্জন করার ব্যাপারেও এ কার্যকরী হয়।
আলেকজাণ্ডার উলকট বলেছিলেন, কোন মানুষ যখন আন্তরিকভাবে কথা বলেন তখন তার কথায় যে রঙ ফোটে তা কোন যাদুকর ও দেখাতে পারে না।
আসলে আমাদের বক্তব্যের যখন উদ্দেশ্য হয় বিশ্বাস জন্মানো, তখন দরকার হয় আমাদের অন্তর নিঃসৃত বিশ্বাসকে কথার মধ্য দিয়ে আন্তরিকতায় মেলে ধরা। অপরকে বিশ্বাস অর্জন করাতে হলে নিজেদের প্রথমেই নিশ্চিত হতে হয়।
২. শ্রোতাদের ‘হ্যাঁ’ বলতে চেষ্টা করুন
নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওয়াল্টার ডিল স্কট বলেছেন যে, ‘মনের মধ্যে যে প্রতিটি ধারণা ও আদর্শ বা উপসংহারের অস্তিত্ব থাকে তা সত্য, আর তা বাধাপ্রাপ্ত হয় শুধুমাত্র কোন বিরোধী ধারণা জেগে উঠলে তবেই।’
এরকম করতে সক্ষম হলে শ্রোতাদের ‘হ্যাঁ’ বলানো বেশ সহজও হয়ে ওঠে। নিউ ইয়র্কের এক স্কুলে এ ব্যাপারে মনস্তত্বের দিক থেকে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেন আমার বিশেষ বন্ধু হ্যাঁরী ওভারস্ট্রিট। তিনি বলেন :
‘একজন দক্ষ বক্তা যদি কোন ভাবে শ্রোতাদের হ্যাঁ এই ভাবটুকু আদায় করতে পারেন তাহলে তিনি শ্রোতাদের মনস্তাত্ত্বিক অগ্রসর হওয়ার মধ্যে সাড়া জাগাতে পারেন। এ অনেকটা কোন বিলিয়ার্ড খেলার বলের নড়াচড়ার মতোই। এই বিলিয়ার্ড বলকে ঠেলে দিন দেখবেন এটাকে ঠেলতে বেশ শক্তি লাগছে। উল্টো পথে পাঠানোর জন্য দরকার বেশি শক্তি।
এ ব্যাপারে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটি বেশ পরিষ্কারই বলা যায়। যখন শ্রোতাদের মধ্যে একজন বলে না আর বেশি জোরের সঙ্গেই তা বলে, তখন মাত্র ওই একটা কথাই সে বলে না। তার সমস্ত দেহতন্তু, স্নায়ু, পেশী একসঙ্গে মিলেই যেন প্রতিবাদে মুখর হতে চায়। অন্যদিকে যখন ‘হ্যাঁ’ জবাব আসে তখন প্রতিরোধ বা প্রতিবাদের অবকাশ না থাকায় দেহের সমস্ত সত্তাই এগিয়ে আসে এবং তা সবকিছু তৎপর হতে চায়। এই জন্যই বলতে চাই আমরা যতখানি বেশি করে ‘হ্যাঁ’ ভাবটি জাগিয়ে তুলতে পারব ততই সহজে শ্রোতাদের মন জয় করে নিতেও পারব।
এই শ্রোতাদের দিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলানো কাজটি অতি সহজেই বলা যায়। অথচ আশ্চর্যের কথা এই ব্যাপারটি কিভাবে সকলে অবহেলা করতে চান। প্রায়ই দেখা যায় বক্তা শ্রোতাদের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে যেয়ে প্রথমেই তাদের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এতে কি ভালো ধরনের প্রতিক্রিয়া আশা করতে পারব? বক্তা যদি একটু আনন্দের উদ্দেশ্য নিয়ে এরকম করতে চান, তাহলে তাকে ক্ষমা করা চলতে পারে। কিন্তু যদি দেখা যায় বিশেষ কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তিনি সেটা করেছেন, তাহলে তাকে মনস্তাত্বিক দিক থেকে মূর্খই বলতে হয়।
কোন ছাত্রকে গোড়াতেই একবার কোন বিষয়ে ‘না’ বলতে দিয়ে দেখুন-শুধু ছাত্র নয়, কোন ক্রেতা, শিশু, স্বামী বা স্ত্রীকেও না বলতে দিন; এবার দেখবেন তাদের কাউকেই ‘হ্যাঁ’ বলাতে গেলে কি ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। আপনার সমস্ত প্রাণপাত চেষ্টাই বিফল হবে।
তাহলে গোড়াতেই এই ‘হ্যাঁ’ সাড়া পাওয়ার পথ কিভাবে পাওয়া যাবে? খুব সহজে। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন একবার এ সম্বন্ধে বলেন, কোন বিতর্কে জয়ী হওয়ার জন্যে প্রথমেই আমার চেষ্টা থাকতো উভয়ের মধ্যে কোথায় মিল আছে খুঁজে বের করতে। লিঙ্কন এই কৌশল খাঁটিয়েছিরেন সবচেয়ে স্পর্শকাতর সেই বিষয় সম্বন্ধেও-অর্থাৎ দাসপ্রথার অবলোপ। দি মিরর নামে নিরপেক্ষ এক সংবাদপত্র তাঁর কোন এক বক্তৃতার উল্লেখ করতে গিয়ে বলে, তার বিরোধীরা প্রথম আধ ঘন্টায় তিনি যা বলেছেন তার সঙ্গে একমত হন। সেই অবস্থা থেকেই তিনি তাদের একটু একটু করে বিপরীত পথে নিয়ে যেতে আরম্ভ করেন যতক্ষণ না মনে হয় তিনি সব বিরোধীদের একেবারেই বিপরীত বিন্দুতে এনে ফেলেছেন।’
এতে কি বুঝতে পারছেন না যে বক্তা তার শ্রোতাদের সঙ্গে গোড়া থেকেই তর্কে নেমে পড়েন, আসলে তিনি এতে তাদের জেদ আর বিরোধীতাই জাগিয়ে তোলার কাজটি করে ফেলেন। তারা সাবধান হয়ে যায়-আর তখন তাদের মন ঘোরানোর কোন কাজই সমাধা হতে পারে না। সে সময় একথা বলে লাভ হবে, আমি অমুক অমুক প্রমান করে দেব?’ তাতে কি আপনার শ্রোতারা মুচকি হেসে মনে মনে বলবেন না; দেখা যাক করুন তো একবার, দেখি?
তাহলে কি আপনি যদি শ্রোতা আর বক্তা দুপক্ষই যা বিশ্বাস করেন সেরকম কিছু বলে শুরু করলে ভাল করবেন না? তারপর এমন কিছু যোগ্য প্রশ্ন রাখবেন যা শ্রোতারা উত্তর দিতে তৈরি? এবার শ্রোতাদের এমনভাবে আগ্রহী করে তোলা চাই যাতে তারা আপনার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলতে তৈরি হয়। মনে রাখবেন সবচেয়ে ভালো বিতর্ক হল যাকে সরল কোন ব্যাখ্যা বলে মনে হয়।
.
একথা মনে রাখলে ভাল করবেন, প্রত্যেক বিতর্কিত বিষয়ে, তা সে যতই বিরাট আর তিক্ত মনে হোক, বক্তার সঙ্গে শ্রোতাদের কোথাও খানিকটা মিল থাকবেই। একটা উদাহরণ দিচ্ছি : ১৯৬০ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের সংসদের উভয় সভায় কিছু বক্তৃতা দেন। তিনি সে সময় গ্রেট ব্রিটেনের বর্ণ বৈষম্য সংক্রান্ত নীতি ব্যাখ্য করেন। ওই সময় আবার দক্ষিণ-আফ্রিকায় ওই বর্ণ বৈষম্য নীতি পুরোপুরি বজায় ছিল। তিনি কি গোড়াতেই তার বিপরীত মত দিয়ে বক্তব্য আরম্ভ করেছিলেন? না। তিনি আরম্ভ করেন দক্ষিণ-আফ্রিকার চমৎকার অর্থনেতিক উন্নতি আর দুনিয়ার প্রতি সে দেশের দান সম্বন্ধে আলোচনা করে। তারপর বেশ কৌশল আর দক্ষতায় তিনি মত পার্থক্যের বিষয়ে অবতারণা করেন। এক্ষেত্রেও তিনি জানান তিনি জানেন এই মত পার্থক্যের যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য কারণ আছে। তাঁর সমস্ত বক্তৃতাই বেশ বিদগ্ধ অথচ দৃঢ়তাব্যঞ্জক ছিল। এতে মিশে ছিল লিঙ্কনের মতই দৃঢ়তাময় বক্তব্য। কমনওয়েলথের সদস্য এক রাষ্ট্র হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটাই আমাদের ইচ্ছা ও আগ্রহ যে তাদের সবরকম সহায়তা দান করা হোক, কিন্তু আমার আশা আমার এ কথায় আপনারা ত্রুটি ধরবেন না যে আপনাদের নীতির সঙ্গে, যে নীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি তার একটি মূলগত প্রভেদ গড়ে উঠেছে। আমার মনে হয় বন্ধুর মতই আমরা খোলাখুলি আলোচনা করতে পারব যে আজ আমাদের মাঝখানে এমন নীতি পড়ে রয়েছে যা সারা বিশ্ব মেনে নিতে অনিচ্ছুক।
এতেই বোঝা যাচ্ছে শ্রোতারা গ্রহণ করতে যতই অনিচ্ছুক থাকুক এমন বক্তব্য রাখলে তাদের তা না মেনে গত্যন্তর থাকে না। একবার ভাবুন, হ্যারল্ড ম্যাকমিলান গোড়াতেই মত পার্থক্য নিয়ে বলতে শুরু করলে তার পরিণতি কি হতে পারত?
প্রফেসার জেমস্ হার্ভে রবিনসন তার মাইও ইন দি মেকিং’ গ্রন্থে বলেছেন, মাঝে মাঝে কোন বাধা ছাড়াই আমাদের মন পরিবর্তন করি বা আবেগ বদলাই। কিন্তু কেউ যদি জানায় কোথাও আমরা ভুল করেছি আমরা সঙ্গে সঙ্গেই তা অগ্রাহ্য করতে তৈরি হই আর আমাদের মন কঠিন হয়ে ওঠে। আমাদের মনে কোন বিশ্বাস গড়ে ওঠার ব্যাপারে আমরা অবিশ্বাস্য রকম খেয়ালশূন্য, অথচ মনে গড়ে ওঠা কোন বিশ্বাসের কেউ সমালোচনা করলে আমাদের তা আঁকড়ে থাকার অদ্ভুত রকম বাসনা জেগে ওঠে। আমাদের বিশ্বাস আমাদের প্রিয়ময় আদৌ যা প্রিয় তা হল আত্মগর্ব …। আমরা যা বিশ্বাস করে আসি তাই মেনে চলতে চাই। এর ফল হল আমাদের যুক্তি কেবল সেটাই আঁকড়ে থাকতে প্রেরণা যোগায়।
৩. শ্রোতাদের উৎসাহিত করুন
কোন বক্তা যখন আবেগ আর উৎসাহ নিয়ে কোন বক্তব্য রাখার ভাবটি প্রকাশ করেন তখন মতপার্থক্য থাকলেও শ্রোতাদের মধ্যে প্রতিরোধ করার আকাঙ্ক্ষা জাগে না। এক্ষেত্রে ‘ছোঁয়াচে’ কথাটা ব্যবহার করছি–তার মানে হল এমনভাবে বক্তব্য রাখতে হবে যাতে শ্রোতারা তাৎক্ষণিক ভাবেই উৎসাহিত হতে পারে। আর এই উৎসাহ সৃষ্টি করতে হলে চাই সত্যিকার আন্তরিকতা। এক্ষেত্রে বক্তা যেভাবেই শুরু করুন না কেন। তার বাগবিন্যাস যেমনই হোক, তাতে অলঙ্কার বা অনুপ্রাস থাকুক চাই না থাকুক–প্রথম যা থাকা দরকার তা হল আবেগ আর বিশ্বাস। আপনার দৃষ্টি, অঙ্গ-ভঙ্গী, কণ্ঠস্বর সবকিছুর মধ্যেই প্রকাশ পাবে ওই আন্তরিকতা আর উৎসাহের আবেগ। শ্রোতারা এতে মুগ্ধ হবেই।
আপনি যখনই কোন জনসংযোগের কাজে নামবেন, বিশেষ করে শ্রোতাদের বিশ্বাস জন্মানোই যখন আপনার কাজ; তখন শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য রাখতেই হবে। আপনি যদি সাধারণ হন, শ্রোতারাও তাই হবে।
আমাকে একবার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পদক বিতরণ উৎসবে তিনজনের বিচারক মণ্ডলীর একজন হিসেবে ডাকা হয়। গ্রহীতাদের মধ্যে ছিল প্রায় আধ ডজন আণ্ডার গ্র্যাজুয়েট। সকলেই শিক্ষিত আর পদকটি পাওয়ার জন্য আগ্রহী। কিন্তু তবু তাদের মধ্যে একটা জিনিসের অভাব ছিল–তারা বিশ্বাস জন্মানোর জন্য আগ্রহী ছিল না, তাদের একটাই আগ্রহ–যে কোন ভাবে পদকটি লাভ করা।
ছাত্ররা বক্তৃতার বিষয় ঠিক করেও রেখেছিল। অথচ বিষয় সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস জন্মানো নিয়ে কোন আগ্রহ ছিল না। নিজেদের যুক্তিকে দৃঢ় করতে তাদের আকাঙক্ষারও অভাব ছিল। তাদের বক্তৃতাটা নিছক বক্তৃতাই হয়ে উঠেছিল।
একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল একজন জুলু রাজপুত্র। সে তার বক্তব্যের বিষয় ঠিক করে আধুনিক সভ্যতায় আফ্রিকার দান’। কথা বলার সময় আন্তরিকতার সঙ্গেই সে বক্তব্য রাখতে থাকে। তার প্রতিটি কথার পিছনে ছিল জ্বালাময়ী আবেগের স্পর্শ। শুধু শেখা কোন বক্তৃতা নয়-তার কথাগুলো হয়ে ওঠে সজীবতায় ভরা, আবেগ আর আন্তরিকা নিজের দৃঢ় বিশ্বাস মতই সে শ্রোতাদের নিজের কথা শোনাতে চায়–তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে চায়।
আমরা তাকেই পদকটি দিই, যদিও বক্তা হিসেবে সে হয়তো অন্যদের সমকক্ষ ছিল না। আমরা বিচারকরা তবুও তাকে পদকটি দিলাম এই কারণেই যে তার মধ্যে ছিল সত্যিকার আন্তরিকতা, সদিচ্ছা–তার প্রতিটি কথাই ছিল সত্যদর্শী। সেখানে বাকিদের বক্তব্য ছিল সাদামাটা।
রাজপুত্রটি অনেক দূরের এক দেশে শিখেছে যে একমাত্র ব্যক্তিত্বের জোরে কোন বক্তব্য গ্রহণীয় হয়, হয় না যুক্তি দিয়েও। আপনাকে বোঝাতে হবে নিজের বক্তব্যকে কতখানি বিশ্বাস করেন।
৪. শ্রোতাদের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধা দেখান
‘মানুষের ব্যক্তিসত্তা চায় ভালবাসা আর তাছাড়াও সম্মান’, বলেছিলেন ড. নরম্যান ভিনসেন্ট পীল। প্রত্যেকটি মানুষেরই নিজের সম্পর্কে ধারণা, আত্মসম্মান আর গুরুত্ববোধ থাকে। সেই মানুষটির ওই ধারণায় একবার আঘাত করুন, দেখবেন চিরকালের মতই তাকে হারিয়েছেন। তাই যখনই কোন লোককে ভালবেসে শ্রদ্ধা জানাবেন, মনে রাখবেন সেও আপনাকে ততখানি ভালবাসবে আর শ্রদ্ধা জানাতে চাইবে।
‘আমি একবার কোন অনুষ্ঠানে একজন কমেডিয়ানের সঙ্গে ছিলাম। লোকটিকে তেমন ভাল করে জানতাম না। সেই সাক্ষাৎকারের সময় যখন জানতে পারলাম তিনি তার কাজে বেশ অসুবিধা বোধ করছেন, তখনই বুঝলাম কেন।
‘আমি তার পাশে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”আপনি ভয় পাচ্ছেন না? তিনি জানতে চাইলেন।
‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন, আমি জবাবে বললাম। শ্রোতাদের সামনে কথা বলতে আমি সব সময় একটু নার্ভাস বোধ করি। শ্রোতাদের সম্পর্কে আমার গভীর শ্রদ্ধা, তাই দায়িত্বের কথাটা ভাবলেই একটু ভয় লাগে। আপনি নার্ভাস হন না?’
‘না’, তিনি বললেন, ‘ভয় পাব কেন? শ্রোতাদের কাছে ভয় কি? তাদের সহজেই বাগানো যায়।
‘আপনার সঙ্গে আমি একমত নই, আমি বললাম। শ্রোতারাই আপনার আসল বিচারক। তাদের প্রতি আমার অপার শ্রদ্ধা আছে।
ডঃ পীল যখন ওই ভদ্রলোকের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমে আসার কথা শুনলেন তিনি বুঝলেন এর কারণ রয়ে গেছিল ভদ্রলোকের শ্রোতাদের প্রতি ব্যবহারের মধ্যে। তিনি এতে অপরের অশ্রদ্ধাই জাগিয়ে তুলেছিলেন তাদের জয় করতে না চেয়ে। আমাদের মত যারা অন্যকে কিছু দিতে চায় তাদের কাছে এটা একটা মস্ত শিক্ষার বিষয়।
৫. বন্ধুত্বপূর্ণভাবে শুরু করুন
একবার এক নাস্তিক উইলিয়াম পেলীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন ভগবান বলে কিছু নেই সে কথা অপ্রমাণ করতে। খুব শান্তভাবেই পেলী তার ঘড়িটা বের করলেন : আপনাদের যদি বলি ঘড়ির এই সব লিভার আর স্প্রিং নিজেরাই নিজেদের তৈরী করে চলতে আরম্ভ করেছে, তাহলে কি আপনি আমার বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না? অবশ্যই তা করবেন। একবার আকাশের তারাদের লক্ষ্য করুন। এদের প্রতিটিরই নিখুঁত গতিপথ আর গতিবেগ আছে-সূর্যের চারপাশের গ্রহমণ্ডল আর পৃথিবীর-এরা লক্ষ লক্ষ মাইল গতিতে যথানিয়মে পরিকল্পনা করে চলেছে। প্রত্যেক তারাই এক একটি সূর্য, আর তাদের নিজস্ব উপগ্রহও আছে, ঠিক আমাদের সৌরজগতের মত। অথচ কোন সংঘর্ষ নেই। কোন গণ্ডগোল নেই, কোন ভুল নেই। সবই শান্ত, নিখুঁত আর নিয়ন্ত্রিত। তাই এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে এসবই আপনা থেকেই হয় না কি অন্য কেউ তা নিয়ন্ত্রণ করে?
ধরুন উনি এভাবে কথা না বলে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রথমেই বলে উঠতেন : ভগবান নেই? বোকার মত কথা বলবেন না কি বলছেন তা জানেন না।’ একথা বললে কি ঘটত? সন্দেহ নেই বেশ তর্কাতর্কি লেগে যেত-যেরকম কথা কাটাকাটি হত তাতে শেষ পর্যন্ত ফল কিছুই হত না। নাস্তিক ভদ্রলোক নিশ্চয়ই গরম হয়ে বুনো বিড়ালের মত ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কেন? কারণ তাঁর সযতে গড়ে তোলা মতটা যে চুরমার হয়ে যেতে বসেছে, তার অহঙ্কার নষ্ট হতে চলেছে।
মানুষের চরিত্রে এই অহমিকা একেবারে মৌলিক এক বৈশিষ্ট্য। তাহলে ওই বৈশিষ্ট্যকে আমাদের মতের বিরুদ্ধে গড়ে উঠতে না দিয়ে তাকে আমাদের সপক্ষে লাগাই না কেন? কিন্তু তা করব কিভাবে? ঠিক পেলী যা করেছিলেন সেইভাবে কথা বলে-অর্থাৎ আমাদের প্রতিপক্ষ যা বিশ্বাস করে তাই বলে। এর ফলে সে আপনার কথা বাতিল না করে বরং গ্রহণ করবে। এতে সংঘর্ষের পথ এড়ানো যায়।
পেলী দেখাতে চেয়েছিলেন মানুষের মন কীভাবে কাজ করে আর প্রশংসা কিভাবে গ্রহণ করে। বেশির ভাগ মানুষই কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারটা মেনে চলেন না। তাদের ধারণা আক্রমণ করেই বোধ হয় অপরকে চট করে আয়ত্তে আনা যায়। এর ফলে কি ঘটে? খুবই সহজ ব্যাপার-যেই মাত্র মতবিরোধের সূত্রপাত ঘটে, মনের সমস্ত দরজা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় আর কথার লড়াই এবং মতপার্থক্য জন্ম নেয়। দুপক্ষের কেউই আর পরাজয় মানতে চায় না।
আমি এখানে যে মানার মত নিয়মের কথা বলতে চাই তা কিন্তু মোটেই নতুন নয়। বহুঁকাল আগেই এটি সেন্ট পল কাজে লাগিয়ে ছিলেন। তিনি এটা কাজে লাগান মার্শ হিলে এথেন্সবাসীদের কাছে তাঁর বিখ্যাত ভাষণে–তাঁর সেই ভাষণ এমন চমৎকার আর পরচিত্তজয়ী ছিল যে আজও প্রায় উনিশ শতক পরেও আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়ি। তাঁর শিক্ষা ছিল পুর্ণতাময়, খ্রীষ্টানধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর কৃতিত্বই তাঁর প্রধান সহায় হয়ে ওঠে। একদিন তিনি এথেন্সে উপস্থিত হলেন–পেরিক্লিসের পরবর্তীকালের এথেন্স, যে এথেন্স একদিন গৌরবের শিখরে উঠেছিল কিন্তু ধীরে ধীরে তার পতন ঘটে চলেছিল। ওই সময় সম্বন্ধে বাইবেলে বলা হয়েছে : সমস্ত এথেন্সবাসী আর বিদেশীরা, যারা ওখানেই থাকতেন প্রতিদিনই নতুন কিছু বলতেন বা শুনতেন।
সে সময় এথেন্সে রেডিও, টেলিগ্রাফ বা ডাক ব্যবস্থা ছিল না অথচ এথেন্সবাসীরা প্রত্যেকদিন বিকেলেই নতুন খবরাখবর সংগ্রহ করতে পারত। তারপরেই সেন্ট পল হাজির হলেন। এটাও নতুন ঘটনা। তারা সবাই বেশ খুশী মনে, আনন্দেই তাঁকে আগ্রহ নিয়ে ঘিরে ধরল। তাকে এরোপাগানে নিয়ে গিয়ে তারা বলল : আপনার ওই নতুন চিন্তাধারা জিনিসটি একবার শুনতে পারি কি, যার কথা বলছেন? কারণ আমাদের কানে আপনি নতুন কথা ঢুকিয়েছেন, তাই আমরা এর অর্থ জানতে চাই।
অর্থাৎ বলতে পারা যায় তারা একটা বক্তৃতাই শুনতে চেয়েছিল। আসলে সেন্ট পলও তাই ওখানে যান। খুব সম্ভব তিনি একটা পাথরের খণ্ডের দাঁড়িয়ে গোড়ায় একটু নার্ভাস হয়েই হাত কচলিয়ে, গলা সাফ করে বলতে আরম্ভ করেন। সবাই যা করে থাকে।
অবশ্য তিনি তাদের আমন্ত্রণের পদ্ধতিটা মোটেই জানতে পারেন নি। সেটা এই : নতুন মতবাদ … অদ্ভুত জিনিস মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে একেবারে বিষাক্ত বস্তু। প্রথমে তাকে এই মনোভাব তাদের মন থেকে দূর করতেই হবে। এটা থেকে গেলে পরস্পরবিরোধী ভাব বাড়তেই থাকবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। তিনি কিছুতেই সেরকম হতে দিতে পারবেন না। অতএব বেশ কৌশলে তাঁর শ্রোতারা যা ইতিমধ্যেই বিশ্বাস করে সে কথা দিয়েই শুরু করতে হবে। এতে মতবিরোধ কমতে থাকবে। কিন্তু আরম্ভ করা যায় কিভাবে? এক মুহূর্ত ভাবলেন সেন্ট পল, তারপরেই তাঁর মাথায় চমৎকার একটা মতলব জেগে উঠতেই তিনি তাঁর অমর বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলেন “হে এথেন্সবাসীগণ, আমার মনে হয় আপনারা কুসংস্কারপ্রিয়।”
কোন কোন অনুবাদে আছে, আপনারা অত্যন্ত ধার্মিক। আমার মনে হয় এই কথাটাই ঠিক। তারা বহু দেবতার পূজা করত, অত্যন্ত ধার্মিকও ছিল। এটা করে তারা বেশ গর্বও করত। সেন্টপল তাদের প্রশংসা করায় তারা খুবই খুশি হল। তারা একটু একটু করে তার উপর খুশি হতে আরম্ভ করল। জনসংযোগের কাজে একটা নীতি হল কোন উদাহরণ দিয়ে নিজের বক্তব্য প্রমাণ করা। তিনি ঠিক তাই করলেন :
‘এখানে আসার সময় আপনাদের ভক্তির প্রমাণ পেয়েছি, একটা দেবীও দেখেছি, তাতে আছে : ‘অপরিচিত ঈশ্বরকে।
এতেই প্রমাণ হয় তারা সত্যিই অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তারা কোন একজন দেবতাকে পাছে অসম্মান জানানো হয় ভেবে একটা বেদী বানিয়ে সকলের প্রতিই সম্মান জানাতে চেয়েছিল। সেন্টপল তাই ওই দেবীর উল্লেখ করে জানান তিনি তাদের তোষামোদ করছেন না, তিনি যা বলছেন তা সত্যিকার দৃষ্টিতে দেখে নেওয়া প্রশংসার বাণী।
এবার সেন্টপলের ওই চমৎকার ভাবে শুরু করার কারণটাই বলছি : ‘অজ্ঞাতসারে আপনারা যাকে পূজা করছেন তাকেই আপনাদের কাছে উন্মুক্ত করছি।’
‘নতুন ধারণা … অদ্ভুত কিছু?’ কণামাত্রও না। সেন্ট পল সেখানে হাজির হয়ে শুধু ব্যাখ্য করতে চেয়েছিলেন তারা না জেনে যে ঈশ্বরের উপাসনা করছে তারই সম্পর্কে কিছু।
এরপর সেন্ট পল তাঁর যুক্তির নীতি আর ধারণা নিয়ে অনেক কথা বলে এথেন্সবাসীদের নিজস্ব গ্রীক কবিদের কিছু কবিতা ও আবৃত্তি করলেন-এতেই বাজীমাত করলেন। অনেকেই তাকে ব্যঙ্গ করলেও বাকিরা বলল, “আমরা আবার আপনার কথা শুনব।
অপরের মনে কিছু ঢোকাতে বা তাদের বিশ্বাস অর্জনে আমাদের সমস্যা হল এই; আমাদের ধারণাকে তাদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যাতে কোনো রকমেই বিরোধী না জাগে। এমন ক্ষমতা যার থাকে তিনিই কথা বলায় দক্ষতা অর্জন করেন আর অপরকে প্রভাবিতও করতে পারেন।
আপনার জীবনের প্রায় প্রতিটি দিনেই আপনি নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলে থাকেন যাদের সঙ্গে আপনার মতের মিল থাকে না। আপনি কি প্রায় সব সময়েই অন্যদের নিজের মতাবলম্বী করার প্রচেষ্টা চালাতে চান না? সে চেষ্টা নিশ্চয়ই আপনি চালান। বাড়িতে, অফিসে, সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে ইত্যাদি নানা জায়গায় চালান। এসব ক্ষেত্রে আপনার কৌশলকে কি বেশ খানিকটা উন্নত করা যায় না? কিভাবে তাহলে শুরু করবেন? লিঙ্কনের দক্ষতা আর ম্যাকমিলানের মত কৌশলে? তাই যদি হয় তাহলে আপনি সত্যই বেশ বড় কুটনীতিক আর দূরদর্শী। এক্ষেত্রে উড্রো উইলসনের কথাগুলো মনে রাখা দরকার। সেকথাগুলো এই : আপনি যদি আমার কাছে এসে বলেন, “আসুন, আমরা একসঙ্গে বসে পরামর্শ করি–যদি আমাদের মতের অমিল থাকে, তাহলে, আসুন ভাবতে চেষ্টা করি এ অমিল কেন; এরকম হলে আমরা দেখব আমাদের মত বিরোধের সীমানা খুবই ছোট। আমাদের যদি একটু ধৈর্য থাকে আর সমাধানের ইচ্ছা থাকে তাহলে আমরা অনায়াসেই একসঙ্গে চলতে পারব।