এগার
উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ রাজত্ব স্থায়ীত্ব লাভ করার মধ্য দিয়ে বাঙালি সমাজে একটা বড়োরকম ভাঙচুর চলতে থাকে। মুসলিম অভিজাত শ্ৰেণী, যাঁরা ছিলেন শাসক নেতৃশ্রেণীর অংশ, তাঁদের অবস্থা ভীষণ রকম শোচনীয় হয়ে পড়ে। নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার তাঁদের না ছিলো মানসিকতা, না ছিলো যোগ্যতা। সিপাহী যুদ্ধের অবসানের পর যে মুষ্টিমেয় অভিজাত কোনো প্রকারে বৃটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করে নতুন পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদের অবস্থান নির্মাণের চেষ্টা করে আসছিলেন, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সঙ্গে তাঁদের কোনো সামাজিক সম্পর্ক ছিলো না। পশ্চিমা শিক্ষা লাভ করে ইংরেজ সরকারের আমলাতন্ত্রে স্থান করে নেয়া হয়তো তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়নি। কিন্তু তাঁরা সযত্নে সাধারণ জনগণের সম্পর্ক পরিহার করে চলতেন। তাঁরা বাংলা ভাষায় কথাও বলতেন না। উর্দু ভাষার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। মুসলিম সমাজের এই অংশ থেকেই সৈয়দ আমির আলি, নওয়াব আব্দুল লতিফ এই সকল ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়। সৈয়দ আমির আলি ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে গ্রন্থাদি রচনা করে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তাঁর মনীষা সাধারণ অশিক্ষিত মুসলমান সমাজে কোনো রকম অনুপ্রেরণা, কোনো রকম প্রণোদনা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। তারপরেও একথা সত্যি যে সৈয়দ আমির আলির মতো এরকম প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ তকালীন হিন্দু সমাজেও অধিক ছিলেন না। নওয়াব আব্দুল লতিফ মুসলিম সমাজের প্রয়োজন এবং দাবি দাওয়ার প্রশ্নে সজাগ ছিলেন, কিন্তু তিনি মনে করতেন বাঙালি মুসলমানের মুখের ভাষা উর্দু হওয়া উচিত।
.
উইলিয়াম হান্টার তাঁর গ্রন্থে যাঁদেরকে কাঠ কাটা এবং পানি বইবার ভারবাহী জীব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তারাই ছিলেন বাংলার মুসলমান সমাজের যথার্থ প্রতিনিধি। বাঙালি মুসলমানের সামগ্রিক চিত্র আরো করুণ। শহর কোলকাতার বাঙালি হিন্দুচিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে যে সকল নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিলেন, বলতে গেলে মুসলমান সমাজকে তা শৰ্শই করেনি। বঙ্কিমচন্দ্র যখন তাঁর যুগান্তকারী উপন্যাসসমূহ রচনা করেছিলেন, রাষ্ট্র সমাজ ইত্যাকার বিষয় নিয়ে চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেই সময়ে কোলকাতায় মুসলমানেরা বড়োজোর চিৎপুর রোডের সোনাউল্লার মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা গুলে বাকাগলির কিসসা কিংবা আমির হামজার পুথি শোনায় মশগুল। অথবা মিলাদ শুনে পীরের দরবারে ধরনা দিয়ে পূণ্য সঞ্চয়ে রত। মিলাদ, উরস, পুথিপাঠ, ঘটা করে খানা, মেজবানীর এন্তেজাম এই সবের মধ্যেই বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতিচর্চা সীমাবদ্ধ। সামর্থ্যের সীমাহীন দীনতা এবং আচার সংস্কারের সহস্র রকম বেড়াজাল মুসলমান সমাজকে কপাট জানালাহীন অচলায়তনে পরিণত করেছে। মুসলান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ জীবন জীবিকার তাড়নায় লাঙ্গলের ওপর বুকে রয়েছে। ওপরের দিকে তাকানোর কোনো সাহস তার নেই। এই রকমের একটা পরিস্থিতিতে মীর মোশাররফ হোসেনের মতো একজন শক্তিধর লেখক যে মুসলমান সমাজ থেকে বেরিয়ে এলেন, তাও কম বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। মীর মোশাররফ হোসেনের মানস জগত, সাধারণ মুসলমানদের মানস জগতের চাইতে খুব বেশি আলাদা নয়। কিন্তু তাঁর অনুভব করার মন ছিল, প্রকাশ করার ভাষা তিনি রপ্ত করেছিলেন। আর ইন্দ্রিয়গুলো ছিলো অতি মাত্রায় সজাগ এবং জ্ঞান শক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। মীরের প্রধান রচনা বিষাদসিন্ধু প্রকৃত প্রস্তাবে শহীদে কারবালা পুথিরই আধুনিক রূপায়ণ। সেখানে জীবন জগতের নতুন জিগাসা মীর চারিয়ে তুলতে পারেননি। তাঁর অন্যান্য রচনাসমূহে মীর সহজাত প্ৰকাশ ক্ষমতা বলে সমাজ বাস্তবতার চিত্র গাঢ় রঙে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। মীরের রচনায় সর্বপ্রধান গুণ প্রকাশভঙ্গির স্বতঃস্ফূর্ততা। এই কারণেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মীর মোশাররফ হোসেনের রচনা পাঠ করে মন্তব্য করেছিলেন এই লেখকের রচনায় পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ বেশি পাওয়া যায় না। একজন। মুসলমান লেখকের একজন হিন্দু লেখকের কাছ থেকে পাওয়া এটাই হলো শ্রেষ্ঠ শিরোপা।
উনবিংশ শতাব্দীতে শহর কোলকাতায় যে একটি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উথ নি, যে শ্রেণী আকাশের নক্ষত্রের মতো অনেক উজ্জ্বল দীপ্তিমান মনীষী পুরুষের জন্য সম্ভাবিত করেছে, তার মধ্যে মুসলমান সমাজের অংশগ্রহণ একেবারেই নেই বললেই চলে। উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তের সমগ্র জাগরণ ক্ষেত্রটাই ছিলো হিন্দু ধর্ম এবং সমাজ কেন্দ্রিক। যদিও বাঙালি মুসলমানেরা সারা বাংলা প্রদেশে সংখ্যার দিক দিয়ে হিন্দুদের চাইতে বেশি না হলেও অন্ততঃ সংখ্যায় অর্ধেক। হিন্দু সমাজের তরুণরা পশ্চিমা সভ্যতা সংস্কৃতির সংস্পর্শে পিতৃপুরুষের ধর্মবিশ্বাস ছুঁড়ে ফেলছেন। প্রতিভাবলে তরুণেরা খ্রীস্টধর্মের প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন করছেন। তাঁরাই প্রাচীন হিন্দুধর্ম নতুন করে গঠন করেছেন, হিন্দু ধর্মের সংস্কারে লাগছেন। তারাই নতুন বিত্তের মালিক হচ্ছেন, তাঁরাই বড়ো বড়ো চাকুরিগুলো করতলগত করছেন, তারাই নিলামে জমিদারী খরিদ করছেন। এই ফুটন্ত জাগ্রত হিন্দু সমাজের পাশে মুসলমান সমাজের উপস্থিতি একান্তই দীন, মলিন এবং করুণ। নতুন ভাবাদর্শে বলীয়ান হিন্দু সমাজের প্রতিভাবান মানুষেরা নতুনতরো সমাজের কথা চিন্তা করছেন, কেউ কেউ নাস্তিকতার প্রচার করছেন, কেউ আবার মাতৃভূমির ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সুন্দর চিত্রপট নির্মাণ করছেন। কিন্তু সবকিছু ঘটছে হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের পাটাতনে, কোনো কিছু মুসলমান সমাজকে স্পর্শই করছে। এমনকি তাঁরা যখন সনাতন হিন্দু ধর্মের বিরোধিতাও করছেন, তাও তাদেরকে পার্শ্ববর্তী সমাজের জনগোষ্ঠীর মাঝে টেনে আনছে না।
উনবিংশ শতাব্দীতেই আধুনিক ধ্যান ধারণা, চিন্তা চেতনা জন্ম নিয়েছে। কিন্তু তার বীজতলাটি ছিলো সম্পূর্ণরূপে হিন্দু মধ্যবিত্তের মধ্যে সংস্থাপিত। বৃহত্তররা হিন্দু সমাজের ভেতরে তাঁদের পরিচয় আস্তিক, নাস্তিক, গোঁড়া কিংবা নব্য হিন্দু, ব্রাহ্ম অথবা নবদীক্ষিত খ্রীষ্টান যাই হোক না কেনো, এই অংশের বাইরে তাঁদের কর্মকাণ্ডের এবং চিন্তা চেতনায় পরিধি বিস্তারিত হতে পারেনি। ব্যক্তিগত বিশ্বাসে তাঁরা যতোই সংস্কারমুক্ত এবং উদার হোন না কেনো সামগ্রিক বাঙালি সমাজের প্রেক্ষিতে তাঁদের ভূমিকা অবশ্যই গৌণ একথা স্বীকার করতে হবে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশব সেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনকি বিবেকানন্দ এই সকল মহীরূহ পুরুষ সকলের উথান ঘটেছে হিন্দু বীজতলাটি থেকে। তাঁদের সকলের ক্ষেত্র এক নয়। একজনের সঙ্গে আরেক জনের মিলও খুঁজে পাওয়া যাবে না, তথাপি তাঁদের চিন্তা চেতনা আবর্তিত হচ্ছে হিন্দু সমাজকে ঘিরেই। এমনকি যখন তাঁরা বিশ্বজনীন মতবাদ প্রচার করেছেন, তখনো তার ভারকেন্দ্রটি ধারণ করে আছে হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ পাটাতন। উনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চরিত্রের লক্ষণ বিচার এইভাবে যদি করা হয় আশা করি অন্যায় হবে না। রামমোহন রায় ছিলেন নতুন পুরাতনের সঙ্গে সেতুবন্ধ, সবচাইতে পরমত সহিষ্ণু উদার এবং নিবেদিত প্রাণ, আধুনিক চিন্তা ধারার প্রবক্তা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সর্বপ্রধান চারিত্র্যলক্ষণ মানবকল্যাণে সংস্কারক এবং বাংলা ভাষা বিকাশের প্রতি অঙ্গীকার শিক্ষা বিস্তার এসবের মধ্যেই সন্ধান করতে হবে। পরম পুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংস ছিলেন সনাতন হিন্দু ধর্ম চিন্তার সার্থক প্রতিনিধি। মধুসূদন দত্ত সর্বঅর্থে ছিলেন বিদ্রোহী এবং ডিরোজিয়োর যথার্থ উত্তর সাধক। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নব জাগ্রত ব্রাহ্ম ধর্মকে হিন্দুখাতে বইয়ে দিতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। কেশব সেন ব্রাহ্ম ধর্মমতের সঙ্গে খ্রীস্টিয় মতের সংশ্লেষ ঘটাতে চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাস শিল্পের সার্থক স্থপতি এবং আধুনিক হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশ্বদৃষ্টিসম্পন্ন কবি এবং মনীষী। তাঁর একক সাধনা বলেই বাংলা ভাষা রাতারতি প্রাদেশিকতার স্তর অতিক্রম করে বিশ্ব পরিসরে প্রতিষ্ঠা। অর্জন করেছে। বিবেকানন্দ হিন্দু সভ্যতা এবং সাংস্কৃতির মর্মবাণী ইউরোপ আমেরিকায় প্রচার করেছেন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করতে প্রয়াসী হয়ে উঠেছিলেন। আরো অনেক ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ করা যেতো, কিন্তু আমাদের একই উপসংহারে ফিরে আসতে হবে।
উনবিংশ শতাব্দীর এই যে হিন্দু মধ্যবিত্তের উথান তার দুটি প্রান্ত। এক প্রান্ত স্পর্শ করেছে হিন্দু ধর্ম এবং সমাজ। আরেক প্রান্ত বিকশিত করে তুলছে আধুনিক সমাজচিন্তা, রাষ্ট্রচিন্তা, সংস্কৃতিচিন্তা, সাহিত্যচিন্তা। এ দু’য়ের মধ্যবর্তী কোনো জল অচল কক্ষ না থাকলেও একথা নির্দিধায় বলা যায় উনবিংশ শতাব্দীতেই বাংলার প্রথম আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিলো। বৃটিশের উপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যেই এই আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটেছিলো বলেই তার বিকাশ বিকলাঙ্গ এবং একপেশে হয়েছিলো। মুসলমান সমাজ এই আধুনিকতার প্রতি যেমন মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেনি, তেমনি তা হিন্দুদের মতো করে গ্রহণও করতে পারেনি।
বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দু রাষ্ট্রচিন্তায় অভিঘাতে আরেকটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস মুসলিম সমাজের ভেতর থেকে স্কুরিত হয়ে উঠেছিলো। তার ফল এই হয়েছে যে বাংলদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। বাংলা তথা দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট দু’প্রান্তের দু’টো অঞ্চল মিলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। সিকি শতাব্দীর অবসান না হতেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী ভাষাভিত্তিক একটি স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক স্বতন্ত্র স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের জন্ম সম্ভাবিত করে তোলে। জন্মের পর থেকেই এই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের এক দোলাচল মানসিকতার মধ্য দিয়েই সময় অতিবাহিত করতে হচ্ছে। অনেক সময় তার প্রকোপ এমন মারাত্মক আকার ধারণ করে যে রাষ্ট্রের চরিত্রের ওপর তা অনিবার্য প্রভাব বিস্তার করে। ধর্ম এবং সাংস্কৃতিক প্রশ্নে জাতির মধ্যে দ্বিধা বিভক্তির লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠে। আইডেন্টিটি ক্লাইসিস তথা আত্মপরিচয়ের সঙ্কট তার রাষ্ট্রসত্তার ভবিষ্যত অন্ধকারে আবৃত্ত করে রাখে। বর্তমান বাংলাদেশ এক সময় অবিভক্ত বাংলাদেশের অংশ ছিলো। আবার পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলো। ব্যক্তির মতো জনগোষ্ঠীও অতীতের টান অগ্রাহ্য করতে পারে না। ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সর্বপ্রধান সংকটসমূহের একটা হলো ধর্ম এবং সংস্কৃতির মধ্যে একটা মেলবন্ধন রচনা করা। অদ্যাবধি বাংলাদেশের কৃত্যবিদ্য শ্রেণীর লোকেরা সে পথে বেশিদূর এগিয়েছেন সে কথা কিছুতেই বলা যাবে না।
ঘোষণা দিলেই একটা রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায় না। একটি দরিদ্র কৃষিপ্রধান দেশ কিছুতেই এক লাফে সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করতে পারে না। সে একটা সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আমি, ‘শুরু করতে হবে’, এই বাক্যটি জোর দিয়ে উচ্চারণ করছি। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রগণ্য প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবীদের বিরাট একটি অংশ বাঙালিয়ানার নামে সে সব চিন্তা চেতনা প্রচার করে আসছেন, তার বেশিরভাগই পশ্চিম বাংলা কোলকাতা কেন্দ্রিক চিন্তাচর্চার চর্বিত চর্বন। মুসলিম প্রধান একটি সমাজে বাঙালিয়ানার প্রচার ঘটাতে হলে বাঙালিয়ানার একটা নতুন সংজ্ঞা নির্মাণ করতে হবে। এই সংজ্ঞা নির্মাণ পদ্ধতিতে দু’টো বিষয় অবশ্যই সমান গুরুত্বে বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে। প্রথমতঃ ধর্মশাসিত বাঙালি মুসলমান সমাজে ধর্মতান্ত্রিক সামন্ত চিন্তার একচ্ছত্র প্রতাপের অবসান ঘটাতে হবে। যে জাড্যতা, যে বদ্ধমত, যে কুর্মবৃত্তি এই সমাজমানসকে সঙ্কুচিত, অসহিষ্ণুতার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার একটি সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া করা না হলে, বাঙালি মুসলমান সমাজ আধুনিক বিশ্বের সামনে নির্ভয় চিত্তে কখনো দাঁড়াতে পারবে না। বাংলাদেশে মুসলমান ছাড়া আরো নানা সম্প্রদায় রয়েছে। তথাপি মুসলমান সমাজের কথা বললাম একারণে যে তারা সংখ্যাগরিষ্ট সম্প্রদায়। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ বেস্থায় যদি নিজেদের মানস পরিবর্তনের পথটি অনুসরণ না করে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর পক্ষে বেশি কিছু করা সম্ভব হয়ে উঠে না। বাঙালি মুসলমানের মানস ভূবনের প্রায় সমস্ত অঞ্চলে মধ্যযুগ এখনো। রাজ্যপাট বিস্তার করে আছে। মধ্যযুগীয় মানস পরিমণ্ডলে আধুনিক যুগের আলো বিকিরণ করা সহজ কাজ নয়। বাঙালি মুসলমান নিজের ভারেই নুইয়ে আছে।
সাম্প্রতিক কালের বাঙালিত্বের নতুন সংজ্ঞা নির্মাণের দ্বিতীয় শর্তটি হলো উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির যে পাটাতনটি সৃষ্টি করেছে সম্পূর্ণরূপে নতুনভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে একটি গ্রহণযোগ্য মাণদণ্ড আবিষ্কার করা। বাঙালি সমাজের নানামুখী জাগরণের এই স্তরটি অবহেলা করা যেমন আমাদের সম্ভব হবে না, তেমনি নির্বিচারে গ্রহণ করাও উচিত হবে না। উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মধ্যবিত্তের জাগরণের সমস্ত বীজতলাটাই ছিলো হিন্দু সমাজের অধিকারে। বাঙালি সাংস্কৃতিতে এই শ্ৰেণীটি অনেক উৎকৃষ্ট কিছু সংযোজন করেছেন, কিন্তু পাশাপাশি তাঁদের সম্প্রদায়গত প্রবণতাসমূহও চারিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশে মধ্যশ্রেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উনবিংশ শতাব্দীর প্রতি এমন এক ধরনের মোহমুগ্ধতা ক্রিয়াশীল, সেটাকে অনেকটা অন্ধত্বের পর্যায়ে ফেলা যায়। এই অসঙ্গত অতীতমুখীতা তাঁদেরকে বর্তমানের প্রতি সম্পূর্ণরূপে কর্তব্য বিমুখ করে। রেখেছে। মুসলমান সমাজের ভেতর থেকে অনেকগুলো সংস্কার এবং সামাজিক আন্দোলনের উত্থিত হওয়া প্রয়োজন। পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে, সমাজ সংগঠনের মধ্যে মানব সম্পর্কের ক্ষেত্র পুরোনো মূল্যচিন্তার স্তরে একগুচ্ছ নতুন মূল্যচিন্তা সমাজে প্রতিষ্ঠা দিতে না পারলে বাঙালিত্বের নতুন সংজ্ঞা নির্মাণ করা কখনো সম্ভব হবে না। উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তের প্রেক্ষিতটা ভেঙ্গে ফেলে বাঙালিত্বের সম্পূর্ণ একটা নতুন প্রেক্ষিত নির্মাণ করা প্রয়োজন। ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষদের হাতে বাঙালিত্বের নতুন সংজ্ঞা নির্মাণের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে। এই প্রস্তাবিত নতুন সাংস্কৃতিক পাটাতন সমস্ত বাঙালি জনগণের মধ্যে বোঝাপড়া, এবং সুস্থ বিনিময়ের পথ অনেকখানিই সম্প্রসারিত করবে।